মােঙ্গল জাতি, তৈমুরীয় বংশ ও তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের পতনােত্তর যুগে মােঙ্গলদের ইতিহাস

Table of Contents

মােঙ্গলদের ইতিহাস

ভূমিকা

১৩শ শতাব্দীর প্রারম্ভে মধ্য-এশিয়ার দুর্ধর্ষ মােঙ্গল জাতির অভ্যুত্থান ঘটে। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মােঙ্গলদের এই উথান সাধারণভাবে পৃথিবীর এবং বিশেষভাবে মুসলিম ইতিহাসের এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ৭ম শতকে আরব মুসলমানদের অভ্যুথান ও তাদের বিস্ময়কর সাফল্যের সঙ্গে কেবলমাত্র এর তুলনা করা যায়। চেঙ্গিস খানের আবির্ভাবের পূর্বে মােঙ্গল জাতি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তেমন কোন উল্লেখযােগ্য অধ্যায়ের সংযােজন করতে পারেনি। মােঙ্গল ইতিহাসে চেঙ্গিস খানের আবির্ভাব তাই নিঃসন্দেহে এক পরম সৌভাগ্যের বিষয়। চেঙ্গিস খান তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা ও সাংগঠনিক শক্তিবলে বহু গােত্রে বিভক্ত এবং সর্বদা আত্মকলহে লিপ্ত এই উচ্ছল জাতিকে সুসংহত করে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করেন। পৃথিবীর মধ্যযুগের ইতিহাসে এটি একটি বিস্ময়কর ও অনন্যসাধারণ ঘটনা। মোঙ্গলরা চেঙ্গিস খান এবং তার সুযােগ্য উত্তরাধিকারীদের আমলে চীন থেকে শুরু করে মধ্য-এশিয়া, পারস্য ও রাশিয়াতে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া মিশর, ভারত, জাপান, কোরিয়া, বার্মা ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত মােঙ্গল অভিযানের তরঙ্গ প্রচণ্ডভাবে আঘাত হেনেছিল। মােঙ্গলদের এই বিজয় অভিযানগুলো অবশ্য নিষ্ঠুরতা, লুণ্ঠন, নরহত্যা ও অগ্নিসংযােগের লােমহর্ষক কাহিনীতে ভরপুর। এর ফলে কত লােক প্রাণ হারিয়েছে, কত জনপদ শ্মশানে পরিণত হয়েছে আর কত সুপ্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এই কারণে সমালােচক ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ কেউ মােঙ্গলদেরকে ‘বিধাতার অভিশাপ’ ও ‘বিশ্বের ত্রাস’ প্রভৃতি বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এটি ঘটনার কেবল একটি দিক মাত্র। মােঙ্গল ইতিহাসে ধ্বংসের উন্মত্ত উল্লাসের সঙ্গে সৃষ্টির নব চেতনাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চেঙ্গিস খানের পরবর্তী বংশধরগণ ইসলামের তথা বিশ্বের ইতিহাসে যে সকল কল্যাণমুখী ও গঠনধর্মী অবদান রেখে গিয়েছেন তাও প্রণিধানযােগ্য। 

মোঙ্গল জাতির উৎপত্তি

প্ৰাক-ঐতিহাসিক যুগ থেকে মধ্য-এশিয়ায় বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চল ও পার্বত্য চারণভূমিতে বিভিন্ন যাযাবর জাতির বসবাস। মােঙ্গলগণও এদের মধ্যে অন্যতম একটি জাতি। মোঙ্গলদের আদি বাসস্থান ছিল গােবি মরুভূমির উত্তরে এবং বৈকাল হ্রদের দক্ষিণে অবস্থিত। মােঙ্গলদের উৎপত্তি সম্বন্ধে ঐতিহাসিক ও নৃতত্ত্ববিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে মঙ্গোলিয়া এদের আদি বাসস্থান বলে এদেরকে মােঙ্গল বলা হয়। এছাড়া চীনা ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, মোঙ্গল নাম চীনা ভাষার ‘মঙ্গ’ (অর্থাৎ সাহসী) শব্দের পরিবর্তিত রূপ। মােঙ্গলদেরকে অনেক সময় তাতার নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। বস্তুত মােঙ্গলদের প্রাচীন নাম তাতার নামেও অপর একটি পৃথক গােত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই তাতার-গােত্র দীর্ঘদিন ধরে মােঙ্গলদের সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিল। কিন্তু কালক্রমে মােঙ্গল ও তাতারগণ একটি অভিন্ন জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। মােঙ্গল জাতিকে বিভিন্ন গােত্রে বিভক্ত করা যায়, যথা : ‘নাইমান’, ‘কেরাইট’, ‘মেরকাইট’, এবং ‘ঐরাইট’। সভ্যতার তারতম্য হিসেবে চীনা ঐতিহাসিকগণ অবশ্য মােঙ্গলদেরকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন, যথা : ‘শ্বেত তাতার’ ‘কৃষ্ণ তাতার’ ও ‘বন্য তাতার’। (বি. স্পুলার : The Muslim World. (মােঙ্গল যুগ), ইংরেজি অনুবাদ : এফ. আর. সি. বাগলে, দ্বিতীয় খণ্ড, নেদারল্যান্ডস, ১৯৬০, পৃ: ২) মােঙ্গলদের জীবনযাত্রা প্রণালী ছিল অত্যন্ত সহজ ও সরল। তারা অন্যান্য যাযাবর জাতির মতো তাবুতে বসবাস করত এবং পশুর চামড়া ছিল তাদের অন্যতম প্রধান পরিধেয়। মেষ চারণ, পশু শিকার ও লুটতরাজ করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করত। দুধ ও মাংস ছিল তাদের অন্যতম প্রধান খাদ্য। এরা টেংরীবাদ ধর্ম অনুসরণ করত, কিন্তু অনেকে খ্রিস্টধর্মের নেস্টোরীয় সহ অন্যান্য শাখার অনুসারী ছিল। মােঙ্গলদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আহার্য দ্রব্যাদি প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনুল আসির বলেন, “প্রাতঃকালীন উদীয়মান সূর্যের পূজা করা ছিল তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। বৈধ অবৈধের কোন ধারই তারা ধারত না। নির্বিচারে তারা সকল প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করত; এমনকি কুকুর, শূকর ও অনুরূপ প্রাণীও বাদ দিত না।” (ইবনুল আসির : পি. সাইকস কর্তৃক উদ্ধৃত : A History of Persia. লণ্ডন, ১৯২১, পৃ: ৭২)। অসভ্য যাযাবর জীবনের প্রায় সকল দোষ-গুণই মােঙ্গলদের চরিত্রে পরিলক্ষিত হয়। সাহসিকতা, কষ্টসহিষ্ণুতা ও দলপতির প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য ছিল তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এছাড়া দুর্ধর্ষ যােদ্ধা, সুপটু অশ্বারােহী ও তীরন্দাজ হিসেবেও তাদের বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। বলা বাহুল্য যে, ভৌগােলিক পরিবেশই তাদের চরিত্রের এই সকল দোষ-গুণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল। মােঙ্গলদের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ১২শ শতকের প্রারম্ভে মোঙ্গলরা উত্তর চীনের জিন সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে পড়ে। চেঙ্গিস খানের প্রপিতামহ কাবুল খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা ১১৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে জিন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে এবং জিন সেনাপতি কুসাকু তাদের নিকট পরাজিত হন। কাবুল খান এই সময় বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং ‘খাকান’ উপাধি ধারণ করেন। (জি. হ্যাম্বলি : Central Asia. নিউইয়ক, ১৯৬৯, পৃ: ৮৯)। কাবুল খানের নেতৃত্বে পরাধীনতার বিরুদ্ধে এই প্রথম সাফল্যজনক বিদ্রোহ অদূর ভবিষ্যতে মােঙ্গলদের মধ্যে বিশেষ জাতীয় চেতনাবােধের উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। অতঃপর ১৩শ শতকের প্রথম দিকে বিভিন্ন গােত্রে বিভক্ত ও সদা আত্মকলহে লিপ্ত মোঙ্গলজাতি চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী মহাজাতিতে পরিণত হয়।

চেঙ্গিস খান (১১৬২-১২২৭ খ্রি.)

চেঙ্গিস খানের জন্ম তারিখ নিয়ে মতবিরােধ আছে। পারস্যের ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ১১৫৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু চীনা ঐতিহাসিকগণ এই তারিখ ১১৬২ খ্রিস্টাব্দ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি যে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই বিষয়ে প্রায় সকলেই এক মত। সুতরাং শেষােক্ত, অর্থাৎ ১১২৬ খ্রিস্টাব্দেই চেঙ্গিসের জন্ম তারিখ হওয়ার বেশি সম্ভাবনা। তার জন্ম হয় মঙ্গোলিয়ার ওনােন নদী তীরবর্তী ডাইলিউন বুলদাঘা নামক স্থানে। তার পিতার নাম ছিল ইসুজাই এবং মাতার নাম হেলুন। ইসুজাই মোঙ্গলদের তেরটি গােত্রের নেতা ছিলেন এবং নিজ ক্ষমতার দ্বারা পার্শ্ববর্তী গােত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চেঙ্গিস খানের বাল্য নাম ছিল তেমুচিন। (Encyclopaedia of Islam, দ্বিতীয় খণ্ড , ১৯৫৮, পৃ: ৪১) তেমুচিনের জন্মের বছর তার পিতা ইসুজাই তাতার গােত্র আক্রমণ করেন এবং তার দলপতি তেমুজদিন উজিকে পরাজিত ও নিহত করেন। বিজিত এই শত্রুর নামানুসারে ইসুজাই তার পুত্রের নাম রাখেন তেমুচিন। (অর্থাৎ কঠিন ইস্পাত) মােঙ্গলদের মধ্যে বাল্যবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে ইসুজাইও তার পুত্র তেমুচিনকে উনগির গােত্রের দেসাইচান নামক জনৈক ব্যক্তির দশ বছর বয়স্কা কন্যার সাথে বিবাহ দেন। তেমুচিনের স্ত্রীর নাম ছিল বােরতাই। এরপর ইসুজাই প্রচলিত প্রথা অনুসারে তার পুত্রকে শ্বশুরালয়ে রেখে দেশে ফিরছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে তাতার গােত্রের লােকেরা তাকে আমন্ত্রণ জানায় এবং তার খাদ্যে বিষ প্রয়ােগের মাধ্যমে তাকে হত্যা করে। এভাবে তাতারগণ ইসুজাইকে হত্যা করে তাদের পরাজয় ও দলপতি তেমুজদিন উজিকে হত্যার প্রতিশােধ গ্রহণ করল। (পূর্বোক্ত : পৃ. ৪১)। পিতার মৃত্যুকালে তেমুচিনের বয়স ছিল তের বছর এবং এই অল্প বয়সেই তিনি গােত্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। বালক তেমুচিনের জন্য অবশ্য তার পিতৃ আসন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। কারণ দুর্ধর্ষ মােঙ্গলরা এই কিশাের বালকের নেতৃত্ব সহজে মেনে নিল না। ফলে তেমুচিনকে বাধ্য হয়ে গােত্রকলহে লিপ্ত হতে হল। কিন্তু কেবল নিজ প্রতিভা ও মাতা হেলুনের সুযােগ্য অভিভাবকত্বের ফলে তেমুচিন তার এই প্রাথমিক ঝুঁকি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেন। পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক নরপতিকেই এরকম প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু বিপদে হতাশ না হয়ে তেমুচিন ধৈর্য ও বীরত্বের সঙ্গে অবস্থার মােকাবেলা করতে লাগলেন। এই সময় মেরকাইট গােত্রের লােকেরা তেমুচিনের স্ত্রী বােরতাইকে জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে গেলে তার সামনে এক নতুন বিপদ এসে উপস্থিত হয়। হাতে তেমুচিন ভীষণ ক্ষুদ্ধ ও অপমানিত বােধ করতে লাগলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই সময় তিনি কেরাইট গােত্রের অধিপতি তুঘরিলের বন্ধুত্ব লাভে সক্ষম হলেন।

তুঘরিল ইতিহাসে ‘ওয়াং খান’ নামেও পরিচিত। চীনের জিন সাম্রাজ্যের পক্ষ অবলম্বন করে তিনি তাতারদেরকে দমন করেছিলেন বলে জিন সম্রাট তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন। ওয়াং খান শব্দের অর্থ ‘যুবরাজ খান’। যাই হোক, চেঙ্গিস খান তুঘরিলের সহযােগিতায় মেরকাইট গােত্রকে এক যুদ্ধে পরাজিত করে তেমুচিন তার স্ত্রী বােরতাইকে উদ্ধার করতে সক্ষম হলেন। স্ত্রী-উদ্ধারপর্ব তেমুচিনের প্রাথমিক জীবনের একটি বিশেষ স্মরণীয় ঘটনা। কারণ এর মাধ্যমে তিনি অদূর ভবিষ্যতে বৃহত্তর সামরিক সংঘর্ষের জন্য বিরাট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। এরপর তেমুচিন তুঘরিলের সহযােগিতায় তার অপর প্রধান শত্রু তাতারদেরকে পরাজিত করেন এবং উত্তর-চীনের জিন সাম্রাজ্যের রাজার বন্ধুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হন। তেমুচিনের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি এভাবে উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে ‘নাইমান’, মেরকাইট’ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গােত্র তার বিরুদ্ধে জামুকা নামক জনৈক শক্তিশালী নেতার অধীনে এক ঐক্যজোট গড়ে তুলল। কিন্তু ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তেমুচিন এই সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। জোট-নেতা জামুকা যুদ্ধক্ষেত্রে বলি হন এবং পরে তাকে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে মােঙ্গল জাতির মধ্যে তেমুচিনের বিরােধিতা করার মতাে আর তেমন কোন শক্তিই রইল না। ফলে তেমুচিন মােঙ্গল জাতির একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেন। কিন্তু উচ্চাভিলাষী তেমুচিন এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন না। তিনি তার ক্ষমতার পেছনে সকল গােত্রের স্বীকৃতি লাভের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। এরপর এই উদ্দেশ্যে তিনি ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী কারাকোরামে ‘কুরিলতাই’-এর এক মহাসম্মেলন আহ্বান করলেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে চেঙ্গিস খান উপাধি ধারণ করলেন। কুরিলতাই হলো বিভিন্ন গােত্রপতি, অভিজাত শ্রেণী ও উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের উপস্থিতিতে মােঙ্গলদের জাতীয় মহাসম্মেলন। এই সম্মেলনে নতুন খান নির্বাচিত ও তার অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হত। পরিশেষে মহােৎসব ও ভোজের মাধ্যমে এই সম্মেলন শেষ হত। পরবর্তীকালে ইতিহাসে তিনি চেঙ্গিস খান নামেই পরিচিত।   

চেঙ্গিস খানের রাজ্য বিজয়

মােঙ্গলদের ওপর নিজ কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর চেঙ্গিস খান দিগ্বিজয়ে বের হবার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। ফলে অচিরেই তিনি চীন, খাওয়ারিজম, রাশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম পারস্যের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। এই সকল যুদ্ধে চেঙ্গিস খান যে সাফল্য ও রণ-কৌশলের পরিচয় দেন পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসে তার তুলনা বিরল।  দিগ্বিজয়ে বের হয়ে চেঙ্গিস খান সর্বপ্রথম চীনের প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। চীন এই সময় দুইটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল, যথা জিন রাজবংশ ও সং রাজবংশ। ১২১১ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খান সং বংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। উপর্যপরি কয়েকটি সফল অভিযানের পর এই রাজ্যের অধিকাংশ স্থান মোঙ্গল বাহিনীর অধিকারে এলো। এরপর চেঙ্গিস খান জিন বংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন এবং ১২১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী পিকিং অবরােধ করে বসলেন। কিন রাজা চেঙ্গিস খানের আগমনে ভীত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করলেন এবং তাকে বহু নগদ অর্থ ও মূল্যবান পাথর উপঢৌকন হিসেবে প্রেরণ করলেন। এছাড়া জনৈকা চীনা রাজকুমারীকেও চেঙ্গিস খানের স্ত্রী রূপে তার নিকট অপর্ণ করা হল। (জি. হ্যাম্বলি : Central Asia : নিউইয়র্ক, ১৯৬৯, পৃ: ১৪)। ফলে সেই বছর নানা কারণে চেঙ্গিস খান পিকিং অধিকার না করে রাজধানী কারাকোরামে ফিরে গেলেন। কিন্তু পরবর্তী বছর তিনি পুনরায় চীন প্রবেশ করলেন এবং ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে তার পিকিং বিজয় সম্পন্ন করলেন।  চেঙ্গিস খানের চীন অভিযানে ব্যস্ত থাকিবার সুযােগে কারাখিতাই-এর তাতার অধিপতি গুর খান বিদ্রোহী হলেন। চেঙ্গিস খান এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য তার অন্যতম সুযােগ্য সেনাপতি জেবিকে প্রেরণ করেন। ১২১৮ খ্রিস্টাব্দে কারাখিতাই-এর বিদ্রোহী নেতা গুর খান জেবির হতে পরাজিত ও নিহত হলেন এবং এই অঞ্চল চেঙ্গিস খানের অধিকারে এলো।  কারাখিতাই-এর তাতার শক্তিকে পদানত করার ফলে চেঙ্গিস খানের রাজ্যসীমা তৎকালীন শ্রেষ্ঠ মুসলিম শক্তি খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের সীমান্তের সাথে এক হয়ে দাঁড়ালো। এই সময় আলাউদ্দিন মুহম্মদ শাহ (১২০০-১২২০ খ্রি.) খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন। তার রাজ্যসীমা পূর্বে সির-দরিয়া থেকে পশ্চিমে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এছাড়া মুহম্মদ শাহ মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মােঙ্গল শক্তির অভ্যুত্থানের ফলে তার বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হল। পক্ষান্তরে চেঙ্গিস খানও তার এই শক্তিশালী প্রতিবেশি মুহম্মদ শাহকে ভীতির চোখে দেখতেন। তবে তা সত্ত্বেও উভয় নরপতির মধ্যে প্রথমত সৎপ্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু এই সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হল না এবং অচিরেই উভয়ের মধ্যে প্রবল শত্রুতার সৃষ্টি হল। যেহেতু উভয় নরপতিই উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং উভয়ের রাজ্য পাশাপাশি অবস্থিত ছিল, ফলে তাদের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে সংঘর্ষের সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এই সংঘর্ষ ত্বরান্বিত হওয়ার জন্য খাওয়ারিজম শাহ কর্তৃক অনুসৃত আপোষহীন নীতিই বিশেষভাবে দায়ী ছিল। কারণ প্রথমত তিনি চেঙ্গিস খান কর্তৃক প্রেরিত উপঢৌকন প্রত্যাখান করেন এবং তার দূতকে হত্যা করেন। মুহম্মদ শাহের নিকট লিখিত পত্রে চেঙ্গিস খান তাকে ‘পুত্র’ বলে সম্বােধন করেছিলেন, যা তৎকালীন প্রচলিত প্রথা অনুসারে মুহম্মদ শাহের পক্ষে চরম অপমানকর ব্যাপার ছিল। কারণ এর মাধ্যমে চেঙ্গিস বস্তুত মুহম্মদ শাহকে তার বশ্যতা স্বীকারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত এই সময় খিবা ও বােখারা হতে চারশত পঞ্চাশ জনের একটি মুসলমান বণিক দলকে তিনি চেঙ্গিস খানের গুপ্তচর সন্দেহে বন্দি করলেন এবং তার নির্দেশক্রমে ওতরারের গভর্নর তাদেরকে হত্যা করেন। এর প্রতিকার এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করে চেঙ্গিস খান মুহম্মদ শাহের কাছে দ্বিতীয়বার দূত প্রেরণ করলেন। কিন্তু এবারও তিনি চেঙ্গিস খানের এই দূতকে হত্যা করলেন। ফলে উভয় নরপতির মধ্যে অবশেষে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দেখা দিল।

১২১৯ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খান এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে মুহম্মদ শাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। খাওয়ারিজম অধিপতি মুহম্মদ শাহ্ও‌ দমবার পাত্র ছিলেন না। নিজ সাফল্য সম্বন্ধে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আশাবাদী এবং তার সৈন্য সংখ্যা ছিল মােঙ্গল বাহিনী অপেক্ষা বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি নানা কারণে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন। উসের নিকটবর্তী স্থানে অনুষ্ঠিত এক প্রচণ্ড যুদ্ধে মুহম্মদ শাহ মােঙ্গল বাহিনীর হাতে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। চেঙ্গিস খান দ্রুতগতিতে ওতরার, সমরখন্দ ও বােখারা অধিকার করলেন। এরপর তিনি আমু দরিয়া অভিমুখে অগ্রসর হলেন এবং ১২২১ খ্রিস্টাব্দে বাল্‌খ, খােরাসান, হিরাত ও মার্ভ একের পর এক তার পদানত হল। মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে মুহম্মদ শাহ নিশাপুর পলায়ন করলেন। মোঙ্গল সৈন্যরা পলায়মান শাহের পশ্চাদ্ধাবন করে নিশাপুর অধিকার করল। ফলে তিনি বাধ্য হয়ে কাম্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী কোন এক অজ্ঞাতনামা স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করলেন এবং এখানেই কিছুদিন পর ভগ্নহৃদয় মুহম্মদ শাহের মৃত্যু হয়। খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এই বিজয় গৌরব অর্জন করতে চেঙ্গিস খানের মাত্র তিন বছর (১২১৯-১২২১ খ্রি.) সময় লাগিয়াছিল। কিন্তু এর ফলে এই সকল বিজিত অঞ্চলের যে অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক বি. স্পুলার বলেন, “এই বিপর্যয়ের ফলে উক্ত অঞ্চলের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মধ্য-এশিয়ার ইসলামী সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এই শহরগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে যে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তা এখনও অপূরণীয় রয়ে গিয়েছে।” (বি স্পুলার : The Muslim World (মােঙ্গল যুগ) দ্বিতীয় খণ্ড, নেদারল্যাণ্ড; ১৯৬০, পৃ: ৯)। মুহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তার সুযােগ্য পুত্র জালালউদ্দিন মঙ্গাবারানী পিত সিংহাসনের অধিকারী হলেন। মধ্যযুগীয় একজন প্রথম শ্রেণীর নরপতির যে সকল গুণাবলি থাকা প্রয়ােজন জালালউদ্দিনের তার কোনটারই অভাব ছিল না। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন জালালউদ্দিনের বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জালালউদ্দিন নিজ বংশের গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হলেন এবং গজনির নিকট অনুষ্ঠিত একটি খণ্ড যুদ্ধে মােঙ্গল বাহিনীকে পরাজিত করলেন। খুব সম্ভবত মােঙ্গল বাহিনীর পক্ষে এটিই ছিল প্রথম পরাজয়। কিন্তু জালালউদ্দিনকে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এক দুর্জেয় শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। ফলে সিন্ধু নদীর তীরে ১২২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি চেঙ্গিস খানের সাথে অপর এক যুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও অবশেষে পরাজিত হলেন। চতুর্দিক হতে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লে জালালউদ্দিন নিরুপায় হয়ে ত্রিশ ফুট উঁচু পর্বত-গাত্র থেকে সিন্ধু নদীবক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অসীম বীরত্বের সাথে এই নদী অতিক্রম করেন। (এডওয়ার্ড গিবন: The Decline and fall of the Roman Empire. লণ্ডন, ১৮১৬)। সন্তরণয়ত অবস্থায়ও জালালউদ্দিন তার অশ্বপৃষ্ঠ হতে অবিচ্ছিন্ন থাকেন এবং ঐ অবস্থার মধ্যেও পশ্চাত শত্রুদের লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করা অব্যাহত রাখেন। এরপর পলায়মান শাহ তৎকালীন দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশের দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করে বিফল হলেন। কারণ জালালউদ্দিনকে আশ্রয় দিয়ে দূরদর্শী ইলতুৎমিশ চেঙ্গিস খানের মতাে প্রবল শত্রুর বিরাগভাজন হতে চাইলেন না। পরে পলায়নকৃত জালালউদ্দিন ১২৩১ খ্রিস্টাব্দে এক আততায়ীর হতে নিহত হন। তার মৃত্যুতে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। 

চেঙ্গিস খান যখন মধ্য-এশিয়ার খাওয়ারিজম শাহদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলেন, তখন সুবাত-ই ও জেবি নামক তার দুইজন সেনাপতিকে তিনি দক্ষিণ-রাশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম পারস্যে বিজয়ের জন্য প্রেরণ করেন। কালকা নদীর তীরে অনুষ্ঠিত এক প্রচণ্ড যুদ্ধে মােঙ্গল বাহিনীর কাছে রুশ-বাহিনী পরাজিত হয় এবং খিবা মোঙ্গলদের হস্তগত হয়। এছাড়া উত্তর-পশ্চিম পারস্যের রাই, রুম, হামাদান ও সাবাহ প্রভৃতি প্রধান শহরগুলো সহ অধিকাংশ স্থানই মোঙ্গলদের অধিকারে আসে।  জালালউদ্দিনের সঙ্গে যুদ্ধই ছিল চেঙ্গিস খানের ব্যক্তিগত জীবনের শেষ যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মােঙ্গল বাহিনীর মূল শাখা সিন্ধু প্রদেশের মুলতান পর্যন্ত অগ্রসর হল এবং এটিই ছিল ভারতে মােঙ্গলদের অগ্রাভিযানের শেষ সীমা। এরপর তিনি রাজধানী কারাকোরামে প্রত্যাবর্তন করেন। পথিমধ্যে ১২২৩ খ্রিস্টাব্দে মােঙ্গল বাহিনীর হতে পেশােয়ার সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। প্রতিকূল আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার জন্য চেঙ্গিস খানের পক্ষে সিন্ধু নদী অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। ফলে মোঙ্গল আক্রমণের বহ্নিশিখা থেকে ভারত রক্ষা পেল। এভাবে প্রায় সমগ্র মধ্য-এশিয়া পদানত করার পর চেঙ্গিস খান ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী কারাকোরামে প্রত্যাবর্তন করলেন। কিন্তু তিনি বেশি দিন তার এই বিজয়লব্ধ ফল ভােগ করতে পারলেন না। এই সময় দক্ষিণ-চীনের সং সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি তা দমন করার জন্য পুনরায় চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে মঙ্গোলিয়ার ছালি নামক নদীর তীরে ১১৭ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খান মৃত্যুমুখে পতিত হন। মৃত্যুকালে চেঙ্গিস খান সাফল্য ও শৌরবের শীর্ষ শিখরে সমাসীন ছিলেন। তার সাম্রাজ্য পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর এবং উত্তরে তুর্কিস্তান থেকে দক্ষিণে সিন্ধু নদী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। 

চেঙ্গিস খানের কৃতিত্ব ও চরিত্র বিচার

পৃথিবীর যে সকল নরপতি ইতিহাসের ধারায় বিরাট বিবর্তন এনেছেন চেঙ্গিস খান নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন মােঙ্গল জাতির জনক এবং মােঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। চেঙ্গিস খানের আবির্ভাবের পূর্বে মােঙ্গল জাতি ইতিহাসের পাতায় তেমন কোন উল্লেখযােগ্য অধ্যায়ের সংযােজন করতে পারেনি। মােঙ্গলগণ বহু গােত্রে বিভক্ত ছিল এবং তারা সর্বদা আত্মকলহে লিপ্ত থাকত। কিন্তু চেঙ্গিস খান তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা ও সাংগঠনিক শক্তিবলে এই অসভ্য ও বর্বর জাতিকে সুসংহত করে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।  মাত্র তের বছর বয়সে চেঙ্গিস খান পিতৃ-আসনে অধিষ্ঠিত হন এবং নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে অবশেষে গােটা মোঙ্গল জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। পৃথিবীতে খুব কমসংখ্যক নরপতিকেই এরূপ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু উচ্চাভিলাষী চেঙ্গিস খান এতে আত্মতৃপ্তি লাভ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন না। মোঙ্গলদের ওপর নিজ প্রাধান্য সুদৃঢ় করে তিনি রাজ্য বিজয়ে মনােনিবেশ করলেন। সর্বপ্রথম তিনি চীনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে (১২১১-১২১৫ খ্রি.) সং ও জিন বংশকে পরাজিত করে সমগ্র চীন পদানত করেন। এরপর তিনি খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য অধিকার করেন। এই বিশাল সাম্রাজ্য জয় করতে তার মাত্র তিন বছর (১২১৯-১২২১ খ্রি.) সময় লেগেছিল। এছাড়া দক্ষিণ-রাশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম পারস্যও চেঙ্গিস খানের অধিকারভুক্ত হয়। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তার রাজ্যসীমা পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। রাজ্য বিজয়ে চেঙ্গিস খানের এই বিরাট সাফল্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে ঐতিহাসিক লেইন পুল যথার্থই তাকে ‘এশিয়ার আলেকজান্ডার’ বলে অভিহিত করেছেন। (এস. লেইনপুল : The Mohammadan Dynasties.-বৈরুতে, ১৯৬৬, পৃ: ২০২)।  চেঙ্গিস খান কর্তৃক বিজিত এই বিশাল সাম্রাজ্য তার মৃত্যুর পর শুধু যে উত্তরােত্তর শক্তিশালী হয়েছিল তাই নয়, তা দীর্ঘস্থায়ীও হয়েছিল। একজন অসাধারণ সমরবিদ ও সংগঠক না হলে এত অল্প সময়ে এত বড় বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করা তার পক্ষে সম্ভব হত না। ঐতিহাসিক জে. কার্টিন চেঙ্গিস খানের এই সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, “সামান্য কয়েকটি তাবু ও কুঁড়েঘর থেকে আরম্ভ করে গােত্রের পর গােত্র এবং দেশের পর দেশ জয় করে অবশেষে মৃত্যুকালে চেঙ্গিস খান পৃথিবীর যে কোন নরপতির চেয়ে বেশি ভূ-ভাগের অধিপতি হতে পেরেছিলেন।” (জে. কার্টিন : ‘The Mongols, বােস্টন, ১৯০৮, পৃ: ১৪১)। চেঙ্গিস খান ছিলেন একজন সুযােগ্য প্রশাসক ও ন্যায়বিচারক। ঘােড়ার পিঠে চড়ে তিনি রাজ্য জয় করেছিলেন বটে, কিন্তু ঘােড়ার লাগাম ধরে রাজ্য শাসনের প্রচেষ্টা তিনি করেননি। শাসন কার্যে তিনি জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শ শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করতেন। সামরিক ও বেসামরিক শাসন ব্যবস্থায় চেঙ্গিস খানের ওপর প্রবল চীনা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তার শাসন ব্যবস্থায় সুদক্ষ চীনা প্রশাসক ইয়েলু চ্যুৎশাই তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। চেঙ্গিস খান একটি সুদক্ষ গােয়েন্দা বিভাগের দ্বারা রাজ্যের বিভিন্ন গােপন খবরাখবর সংগ্রহ করতেন। তার আমলে চোর ও দুষ্কৃতকারীদেরকে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হত। বিশেষ করে কেউ ঘােড়া চুরি করলে তার দণ্ড স্বরূপ তাকে বিশটি ঘােড়া দিতে হত। অন্যথায় তার পুত্রদেরকে রাজ দরবারে জামিন হিসেবে রাখতে হত অথবা মৃত্যুদণ্ড ভােগ করতে হত। চেঙ্গিস খানের আমলে রাজ্যে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করত। রাজ্যের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য ডাক বিভাগের প্রচলন করা হয়। পথিক ও ব্যবসায়ীগণ নিরাপদে যাতায়াত করতে পারত এবং বিশেষ প্রহরার মাধ্যমে সকলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হত। এশিয়ার ইতিহাসে খুব সম্ভবত এই প্রথমবারের মতাে তুর্কিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দিয়ে পথিকরা সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সঙ্গে চলাচল করতে পারত। (হেনরি হােয়ার্থ : History of the Mongols.-প্রথম খণ্ড, লন্ডন, ১৯২৮, পৃ: ১১১)। 

চেঙ্গিস খান সেনা বিভাগের আমূল সংস্কার সাধন করেন। তার সেনাবাহিনীর দশ, একশত, এক হাজার ও দশ হাজার সৈন্যের বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত ছিল এবং তিনি প্রতিটি ইউনিটকে সুযােগ্য সেনানায়কের অধীনে ন্যস্ত করেন। (জি. হ্যাম্ললি : Central Asia.- নিউইয়র্ক, ১৯৬৯, পৃ: ৯২)। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল তার সামরিক সংস্কারের মূল চাবিকাঠি।(A History Of persia.- লণ্ডন, ১৯২১, পৃ: ৮৫)। সৈন্যদের সামান্যতম অবাধ্যতা, অবহেলা অথবা ভীরুতা তিনি সহ্য করতে না এবং তার শাস্তি ছিল বেত্রাঘাত, চাকরি থেকে বরখাস্ত অথবা মৃত্যুদণ্ড। সৈন্যরা যুদ্ধবিরতি দিনগুলো পর্যন্ত অলসভাবে কাটাতে পারত না। বিপুল আয়ােজনে চেঙ্গিস খান শিকারে বের হতেন এবং তার সৈন্যদেরকেও তার সাথে যােগ দিতে হত। এর মাধ্যমে সৈন্যদের একদিকে যেমন চিত্তবিনােদন হত অপরদিকে তাদের শরীরচর্চাও হত। ব্যক্তিগতভাবে চেঙ্গিস খান অতুলনীয় রণনৈপূণ্যের অধিকারী ছিলেন। এছাড়া তিনি একদল বিশ্বস্ত ও সুনিপুণ সেনাপতির সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তাদের সহযােগিতা ও প্রচেষ্টা চেঙ্গিস খানের সামরিক সাফল্যের মূলে বিশেষ অবদান রেখেছিল। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মােঙ্গলদের বিজয় কখনও সংখ্যাধিক্যের বিজয় ছিল না। বরং মােঙ্গল বাহিনীর শৃঙ্খলা, সংগঠন ও উন্নতমানের প্রশিক্ষণই ছিল তাদের বিজয়ের অসাধারণ প্রতিভার জাদুস্পর্শ। চেঙ্গিস খানের কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে জওহরলাল নেহেরু লিখিয়াছেন, “চেঙ্গিস নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক প্রতিভা ও নেতা। আলেকজান্ডার এবং সিজারকেও তার সম্মুখে নিষ্প্রভ বলে মনে হয়। (জওহরলাল নেহেরু : Glimpses of the Wrold History-নয়াদিল্লি, ১৯৬৪, পৃ: ২২৩) চেঙ্গিস খানের কৃতিত্ব কেবল তার চমকপ্রদ সামরিক বিজয় ও প্রশাসন ব্যবস্থার মধ্যেই খুঁজলে চলবে না। একজন আইন প্রণেতা হিসেবেও তার বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনি একটি আইন কাঠামাে প্রণয়ন করেন। এই আইন ‘উলাঙ্গ ইয়াছা’ নামে পরিচিত। (‘উলাঙ্গ ইয়াছা’ এর পূর্ণাক্ত পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত হয়নি। অংশবিশেষ পাঠের জন্য দ্রষ্টব্য : ভি. এ. রাইসনভস্কি Fundamental Principles of Mongol law, দি হেগ, ১৯৬৫)। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন বিভাগের জন্য বিভিন্ন ধরনের আইন এতে লিপিবদ্ধ ছিল। মোঙ্গল যুবকদেরকে বিদ্যালয়ে এই আইন বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানাে হত। চেঙ্গিস খান সাম্রাজ্যের অর্থনীতির ক্ষেত্রেও কতকগুলো মৌলিক সকোর সাধন করেন। তার নির্দেশে কেবল চাষােপযােগী জমির ওপর খাজনা ধার্য করা হত এবং জমির উর্বরতা ও ফলনের ওপর এই খাজনার তারতম্য ঘটত। ব্যবসায়ীদেরকেও তাদের বাণিজ্যিক পণ্যদ্রব্যের ওপর খাজনা দিতে হত। এর ফলে রাজ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়। চেঙ্গিস খানের গঠনধর্মী ও সৃজনশীল প্রতিভার প্রতি লক্ষ্য রেখে ঐতিহাসিক হেনরি হােয়ার্থ তাই সত্যই বলেছেন, “সমাজনীতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপারে চেঙ্গিস খান ছিলেন স্রষ্টা এবং তার আইন ও শাসনবিধি ইতিহাসের পাঠক মাত্রেরই প্রশংসার উদ্রেক করে।” (হেনরি হোয়ার্থ : History of the Mongols. প্রথম খণ্ড, লণ্ডন, ১৯২৮)।

চেঙ্গিস খানের রাজ্য বিজয় কোন উদ্দেশ্যে বিবর্জিত অথবা নিরর্থক বিজয় ছিল না। কারণ তা হলে তার মৃত্যর সঙ্গে সঙ্গেই তার বিজিত এই বিশাল সাম্রাজ্য লণ্ডভণ্ড হয়ে যেত। বস্তুত ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষের সাথে মােঙ্গল জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তা চেঙ্গিস খানকে সর্বদা বিচলিত করত। মোঙ্গল জাতিকে ইতিহাসের পাতায় সম্মানজনক আসনে উপবিষ্ট দেখার জন্য তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিরলস চেষ্টা করে গিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে চেঙ্গিস খানের এই স্বপ্ন ও প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। তার বংশধর এবং উত্তরাধিকারীদের আমলে মােঙ্গল জাতির গৌরব উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। মােঙ্গল অভিযানের প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের নিকট বিজিত দেশগুলোর যে ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়েছিল পরবর্তীকালে তার যথাযােগ্য ক্ষতিপূরণে মােঙ্গল নরপতিগণ সক্ষম হয়েছিলেন। চেঙ্গিস খান নিজে নিরক্ষর হলেও শিক্ষা ও শিক্ষিতের প্রতি তিনি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি যুদ্ধবন্দিদের মধ্য হতে পণ্ডিত, শিল্পী ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের বেছে বের করতেন এবং তাদেরকে মুক্তি দিয়ে যথােপযুক্ত পেশায় নিয়ােগ করতেন। সকল ধর্মের পুরােহিতগণ ও গরিব সম্প্রদায়ের ওপর থেকে তিনি কর মওকুফ করে দেন। এছাড়া জ্যোতিষিগণ ও চিকিৎসকগণ তার দরবারে বিশেষ সমাদর লাভ করতেন। চেঙ্গিস খান টেংরীবাদ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। এই ধর্মাবলম্বীরা ‘চিরন্তন নীল আকাশের’ উপাসনা করত। বিপদের সময় চেঙ্গিস খানকে তাই অনেক সময় উন্মুক্ত আকাশের পানে তাকিয়ে করজোড়ে শক্তি ও সাহায্য প্রার্থনা করতে দেখা যেত। (জওহরলাল নেহেরু : পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ: ২২৬) ধর্ম সম্বন্ধে চেঙ্গিস খানের সম্যক কোন ধারণা অথবা ঔৎসুক্য না থাকলেও তিনি পরধর্মের প্রতি উদার মনােভাব পােষণ করতেন। তার দরবারে খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও মুসলমান সকলেই সমান ব্যবহার পেতেন। ঐতিহাসিক এওয়ার্ড গিবন চেঙ্গিস খানের পরধর্ম সহিষ্ণুতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। (এডওয়ার্ড গিবন : পূর্বোক্ত গ্রস্থ, লন্ডন, ১৮৯৬)।

ওগােদাই খান (১২২৯-১২৪১ খ্রি.)

চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার সুযােগ্য উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বে মােঙ্গল বিজয় অভিযান অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। চেঙ্গিস খানের ইচ্ছানুসারে বিশাল মােজাল সাম্রাজ্যে তার চার পুত্র ওগােদাই, জুচি, চাগতাই ও তুলির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। এভাবে প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হবার পর ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘কুরিলতাই’-এর অনুষ্ঠানে ওগােদাই সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান খান নির্বাচিত হলেন। এই সময় মােঙ্গলগণ বিশেষ একতা ও শৃঙ্খলাবােধের পরিচয় দিয়েছিল। অন্যথায় তারা যদি ক্ষমতা দখলের আত্মঘাতী কোন্দলে লিপ্ত হয়ে পড়িত তা হলে চেঙ্গিস খানের স্বপ্ন ও সাধনা-তথা মােঙ্গল জাতির ভবিষ্যৎ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা দেখা দিত।  ১২২১ খ্রিস্টাব্দে ওগােদাই সর্বসম্মতিক্রমে মােঙ্গলদের প্রধান খান নির্বাচিত হলেন। ওগােদাই ছিলেন পিতার সুযোগ্য পুত্র। তিনি রাজ্য জয়ের ক্ষেত্রে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেন। তার আমলে মােঙ্গল ইতিহাসে আর একটি গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়ের সংযোজন ঘটে। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে ওগােদাই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে একটি খাওয়ারিজম শাহ জালালউদ্দিনের বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়টি পূর্ব-ইউরােপ ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং অপরটি চীন সাম্রাজ্যের বিশ্বে। চেঙ্গিস খানের সময়ই মােঙ্গলদের নিকট চীনের পতন ঘটে। কিন্তু মধ্য এশিয়ায় চেঙ্গিস খানের ব্যস্ততার সুযােগ নিয়ে জিন সাম্রাজ্যের বিদ্রোহ দেখা দেয়। ফলে ওগােদাইকে এই বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হতে হয়। কিন সম্রাটের প্রবল প্রতিরােধ সত্ত্বেও অবশেষে ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেখানে মােঙ্গল কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। অতঃপর তিনি সং সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আর একটি অভিযান প্রেরণ করেন। ওগােদাই-এর এই অভিযান মােটামুটিভাবে সাফল্যমণ্ডিত হলেও সং সাম্রাজ্য তার সুযােগ্য উত্তরাধিকারী কুলবাই খানের আমলেই কার্যকরভাবে মােঙ্গলদের পদানত হয়। এরপর ওগােদাই কোরিয়া আক্রমণ করেন এবং কোরিয়ার রাজা তার নিকট পরাজিত হয়ে মােঙ্গল প্রাধান্য স্বীকার করে কর প্রদানে রাজি হন।  খাওয়ারিজমের শাহ জালালউদ্দিন চেঙ্গিস খানের হতে পরাজিত হয়ে ভারতে পলায়ন করেন এবং সাময়িকভাবে সুলতানের ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। পরে সেখান থেকে তিনি নিজ রাজ্যে ফিরে যান এবং আজারবাইজান ও জর্জিয়া দখল করেন। এমনকি বাগদাদের খলিফাও তার হতে পরাজিত হন। জালালউদ্দিনের এই ক্রমবর্ধমান শক্তি বিনষ্ট করার জন্য ওগোদাই তার বিরুদ্ধে একটি মােঙ্গল বাহিনী প্রেরণ করেন। জালালউদ্দিন বীরের মতো যুদ্ধ করেও অবশেষে পরাজিত হন এবং পলায়নরত অবস্থায় ১২৩১ খ্রিস্টাব্দে জনৈক কুর্দি আততায়ীর হতে নিহত হন। জালালউদ্দিনের মৃত্যুর সঙ্গেই খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের চির অবসান ঘটে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে মােঙ্গল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ওগােদাই- এর কৃতিত্বের মধ্যে রাশিয়া ও অন্যান্য ইউরােপীয় রাজ্য জয় বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। হুন জাতির নেতা আট্টিলার আক্রমণে সমগ্র পূর্ব ইউরােপ যেমন মহাবিপদের সম্মুখীন হয়েছিল সেরকম তাদের উত্তরপুরুষ মোঙ্গলদের নিকটও পূর্ব-ইউরােপ ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ওগােদাই-এর ভ্রাতুষ্পুত্র মহাবীর বাতুর নেতৃত্বে মােঙ্গল বাহিনী পূর্ব ইউরােপ আক্রমণ করে। ১২৩৭ খ্রিস্টাব্দে উরাল পর্বতমালা অতিক্রম করে বাতু সমগ্র রাশিয়া পদানত করেন। মস্কো, ব্লাডিমির, কিয়েভ ও ক্রিমিয়া তার প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়। এরপর ১২৪১ খ্রিস্টাব্দে পোলান্ড ও জার্মানের সম্মিলিত-বাহিনী বাতুর নেতৃত্বে মােঙ্গলদের নিকট লেবনিজ নামক স্থানে অনুষ্ঠিত এক যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। ফলে হাঙ্গেরি বাতুর পদানত হয়। হাঙ্গেরির পলাতক রাজা বেলার পশ্চাদ্ধাবন করে বাতু সুদূর ডালমাটিয়ার উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হন। ফলে প্রায় সমগ্র ইউরােপ মহাদেশ মােঙ্গল আক্রমণের মুখে অনিবার্য পতনের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। কিন্তু এই সময় ১২৪১ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ ওগােদাই-এর মৃত্যু হলে বাতুকে রাজধানী কারাকোরামে ফিরে আসতে হয়। ফলে একান্ত সৌভাগ্যক্রমে পশ্চিম-ইউরােপ মােঙ্গল আক্রমণের বহ্নিশিখা হতে রক্ষা পায়।    ওগােদাই কেবল একজন রাজ্য-বিজেতাই ছিলেন না। এই সঙ্গে তিনি রাজ্যের সুশাসনেরও ব্যবস্থা করেন। তিনি রাজধানী কারাকোরামে অনেকগুলো সুরম্য ইমারত গড়ে তােলেন। এছাড়া সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নানা প্রকার ফল ও ফুলের চাষের বাবস্থা করেন। তিনি প্রজাদের দেয় খাজনার হার নির্দিষ্ট করে দেন এবং তাদের সুবিধার্থে বিভিন্ন স্থানে শস্যাগার নির্মাণ করেন। এছাড়া ওগােদাই ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তােলেন। 

ইয়েলু চ্যুৎসাই

পৃথিবীর ইতিহাসে মােঙ্গল জাতি দুর্ধর্ষ যােদ্ধা ও রাজ্য-বিজেতা হিসেবেই সমধিক পরিচিত। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা এই বিজিত রাজ্য সুশাসনের ব্যবস্থাও করেছিলেন। কারণ তা না হলে এই বিজয় কিছুতেই দীর্ঘস্থায়ী হত না। মােঙ্গল শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বিশিষ্ট চীনা মনীষী ও প্রশাসন-বিশারদ ইয়েলু চ্যুৎসাই-এর নাম ওতপ্রােতভাবে জড়িত। ইয়েলু ১১৯০ খ্রিস্টাব্দে ইয়ানের খিতান-বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভূগােল, গণিত ও জ্যোতির্শাত্রেও সুপণ্ডিত ছিলেন। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মােঙ্গলরা যখন ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে কিন সাম্রাজ্যের রাজধানী পিকিং দখল করে তখন ইয়েলু চ্যুৎসাই পিকিং-এর গভর্নর ছিলেন। চেঙ্গিস খান তাকে সঙ্গে করে কারাকোরামে নিয়ে আসেন এবং একজন জোতির্বিদ হিসেবে চ্যুৎসাই মোঙ্গল দরবারে স্থান লাভ করেন। মোঙ্গল বাহিনীর নিকট অচিরেই খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পতন ঘটবে বলে ইয়েলু চ্যুৎসাই এই সময় ভবিষ্যদ্বাণী করেন। অচিরেই তার এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হওয়ায় চেঙ্গিস খানের নিকট তার মর্যাদা বেড়ে যায়। জ্যোতির্বিদ্যা ছাড়া ইয়েলু চ্যুৎসাই চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বিশেষ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ছিলেন। কথিত আছে যে, এক মহামারীর কবল হতে তিনি নিজের প্রস্তুতকৃত এক প্রকার ঔষধ দ্বারা দশ হাজার লােকের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। মােঙ্গলগণ সামরিক শক্তিবলে চীনদেশ জয় করেছিল বটে কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক হতে উন্নততর চীনা সভ্যতার কাছে তারা অচিরেই পরাভূত হল। ইয়েলু চ্যুৎসাই এর মারফত মােঙ্গলরা চীনা সমরকৌশল ও সামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিল। ফলে অচিরেই চীনা রীতিনীতি ও শিষ্টাচার মােঙ্গল দরবারে নির্ভেজালভাবে প্রবেশ করল। ঘােড়ার পৃষ্ঠে চড়ে রাজ্য বিজয় সম্ভব হলেও ঘােড়ার লাগাম ধরে যে রাজ্য শাসন করা যায় না এই সত্যটি চেঙ্গিস খান ও তার উত্তরাধিকারী ওগােদাইকে সাফল্যের সঙ্গে অনুধাবন করাইতে সক্ষম হয়েছিলেন।  চেঙ্গিস ও ওগােদাই-এর আমালে ইয়েলু চ্যুৎসাই মােঙ্গল সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যে নানাবিধ অর্থনৈতিক সংস্কার আনয়ন করেন। ইয়েলু চ্যুৎসাই এর সৌভাগ্যের প্রতি মােঙ্গল রাজদরবারের অনেকেই হিংসান্বিত ছিল। তারা ইয়েলুর বিরুদ্ধে শত্রুতা করে ওগােদাই-এর কান ভারি করতে লাগিল। ফলে ওগােদাই একান্ত সন্দেহবশে চুৎসাইকে অর্থমন্ত্রীর পদ হতে বহিষ্কার করলেন এবং আবদুর রহমান নামক জনৈক আরব মুসলানকে উক্ত পদে বহাল করলেন। ইয়েলুর প্রতি ওগােদাই – এর এই বাবহারে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং খুব সম্ভবত এই শােকেই তিনি ১২৪৪ মেটাব্দে প্রাণত্যাগ করেন। দীর্ঘকাল ধরে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী থাকায় অবশ্যই তিনি বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে থাকবেন এই সন্দেহে তার বাড়ি তল্লাশি করা হয়। কিন্তু কিছু পুস্তক, মানচিত্র, বাদ্যযন্ত্র এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ব্যতীত তার ঘরে আর কিছুই পাওয়া গেল না। ওগােদাই নিজের ভুল বুঝতে পেরে প্রবল অনুশােচনায় ভাঙ্গিয়া পড়লেন। কিন্তু ইয়েলুর প্রতি তার দুর্ব্যবহারের প্রতিকার করার আর সময় ছিল না। ইয়েলু চ্যুৎসাই ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান সাধু পুরুষ। ওগােদাই খানের একজন উত্তরাধিকারী তাকে বিশেষ সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। পিকিং শহরের অদূরে আজও ইয়েলু চুৎসাই-এর সমাধিসৌধ ও প্রস্তর স্মৃতি বিরাজ করছে। 

কুয়ুক খান (১২৪১-১২৪৮ খ্রি.)

ওগােদাই খানের মুত্যুর পর তার পুত্র কুয়ুক খান ১২৪১ খ্রিস্টাব্দে মােঙ্গল সিংহাসনে উপবেশন করেন। সিংহাসনে আরােহণ করেই তিনি রাজ্যের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রদবদল আনয়ন করেন। কিন্তু নিজ হস্তে রাজ্য পরিচালনার কোন ইচ্ছাই তার ছিল না। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান ও উচ্ছল জীবন যাপনে অভ্যস্ত কুয়ুক রাজকার্য পরিচালনার দায়িত্ব কাইদাক ও চিনকাই নামক তার দুই মন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত করলেন। ঘটনাক্রমে এই মন্ত্রীদ্বয় উভয়ইে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ছিলেন। ফলে তার রাজত্বকালে জন কার্পিনিসহ আরও অনেক খ্রিস্টধর্মপ্রচারক কুয়ুক খানকে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। কারণ ধর্মীয় ব্যাপারে কুয়ুক ছিলেন একেবারেই উদাসীন। কুয়ুকের রাজত্বকালে তেমন উল্লেখযােগ্য কোন ঘটনা ঘটেনি। ১২৪৭ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়ার রাজা তাকে কর প্রদানে অস্বীকার করলে তিনি তার বিরুদ্ধে এক শাস্তিমূলক সমর অভিযান প্রেরণ করেন। অনুরূপভাবে চীনের সং সাম্রাজ্য ও পারস্যের বিরুদ্ধেও তিনি একটি মােঙ্গল-বাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু ১২৪৮ খ্রিস্টাব্দে অকস্মাৎ তার মৃত্যু হলে এই অভিযান স্থগিত হয়ে যায়। 

কুয়ুক খানের সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মোঙ্গল কমান্ডার বাইজু নোয়ানের কাছে সেলজুক রুমের পরাজয়, যার মধ্য দিয়ে সেলজুক রুম মোঙ্গলদের পদানত হয়েছিল। ওগোদাই খান ১২৪১ সালে বাইজু নোয়ানকে নিকট প্রাচ্যের ভাইসরয় পদে নিয়োগ করেছিলেন, যিনি ১২৪৭ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। তিনি এশিয়া মাইনোর, জর্জিয়া ও পারস্য অঞ্চলের মোঙ্গল সেনা কমান্ডার ছিলেন। ত্রিশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে বাইজু নোয়ান এরজুরেম অধিকার করলেন। অতপর ১২৪৩ খ্রিস্টাব্দে কোজাদাগ নামক স্থানে মোঙ্গল বাহিনীর সঙ্গে সেলজুক বাহিনীর এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সুলতান কায়খসরু স্বয়ং আশি হাজার সৈন্যের এক বিশাল সেলজুক বাহিনী পরিচালনা করেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। কোজাদাগের এই ভাগ্যনির্ধারণকারী যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে এশিয়া মাইনরে সেলজুক শাসনের মৃত্যুসংকেত ধ্বনিত হলো। মোঙ্গলগণ সিভাস ও কায়সারিয়া অধিকার করে এবং এই শহরগুলোর হাজার হাজার নিরপরাধ অধিবাসী তাদের কাছে চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়। পরে মেঙ্গু খানের শাসনামলে ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় কায়খসরুর মৃত্যু হলে চতুর্থ কিলিজ আরসলান সেলজুক সিংহাসনে উপবেশন করেন। তিনি মোঙ্গলদের অধীনতা স্বীকার করলেন এবং স্বয়ং মোঙ্গল রাজধানী কারাকোরামে গমন করে মোঙ্গল খানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হন। পরে উভয় শক্তির মধ্যে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হলো এবং মোঙ্গল খান এশিয়া মাইনরের সেলজুক তুর্কি বংশের রাজত্ব অনুমোদন করলেন। বিনিময়ে সেলজুকগণ মোঙ্গলদেরকে বাৎসরিক নির্দিষ্ট হারে কর প্রদানে রাজি হয়। ১২৪৩ থেকে ১৩০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এশিয়া মাইনরের সেলজুকগণ বাহ্যত স্বাধীন হলেও তা প্রকৃতপক্ষে মোঙ্গল খানদের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে বিরাজমান ছিল।

মেঙ্গু খান (১২৪৮-১২৫৯ খ্রি.)

কুয়ুকের মৃত্যুর পর তুলির পুত্র মেনু খান মােঙ্গল সিংহাসনে উপবেশন করেন। মেঙ্গুর শাসনকালকে মােটামুটিভাবে শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ বলে অভিহিত করা যায়। তার আমলে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি দেখা দেয়। ফলে রাজ্যের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ডাক বিভাগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল সুগম করেন। ফলে রাজধানী কারাকোরাম সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলােকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং সেখানে দেশবিদেশ হতে বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটে। তার আমলে মােঙ্গল সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের প্রচারকগণ অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের সুযােগ লাভ করেন। এমনকি মুসলমান ছাত্রদের শিক্ষার সুবিধার্থে তিনি বােখারায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানী কারাকোরামের বিভিন্ন স্থানে সুরম্য মন্দির, মসজিদ ও গির্জা গড়ে ওঠে। জার্মান পরিব্রাজক রুবরুকের উইলিয়াম মেঙ্গু খানের রাজত্বের সর্বাত্মক উন্নতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।  মেঙ্গু খান তার সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ প্রশাসন-ব্যবস্থা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে এরপর রাজ্য বিজয়ে মনােনিবেশ করেন। তার আমলে মােঙ্গল সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে আরও বিস্তার লাভ করে। সৌভাগ্যবশত এই ব্যাপারে তিনি তার সুযােগ্য ভ্রাতা হালাকু খান ও কুবলাই খানের সাহায্য পেয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে হালাকু খানকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে প্রেরণ করা হয়। তিনি ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে হাসান-বিন-সাবাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে’ চূড়ান্তভাবে দমন করেন। এরপর হালাকু খান আব্বাসীয় বংশের রাজধানী ও তৎকালীন মুসলিম সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ নগরী আক্রমণ করেন। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খানের নিকট বাগদাদ নগরীর পতন ঘটে এবং আব্বাসীয় বংশের শেষ খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহ নিহত হন। এরপর তিনি সিরিয়া ও আলেপ্পো দখল করেন। এই সময় হঠাৎ মেঙ্গু খানের মৃত্যু সংবাদে তিনি সৈন্য পরিচালনার ভার তার সেনাপতি কেৎবুঘার ওপর অর্পণ করে রাজধানী কারাকোরামে ফিরে আসেন।  এদিকে মেঙ্গু খানের অপর ভ্রাতা কুবলাই খান চীনের সং বংশের বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি সং সম্রাটকে পরাজিত করে তার সাম্রাজ্যের অধিকাংশ স্থান পুনরাধিকার করতে সক্ষম হন। নীতিগতভাবে কুবলাই খান অযথা রক্তপাতের বিরােধী ছিলেন। তার ন্যায়বিচার ও সদয় ব্যবহারের জন্য তিনি চীনে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই কারণে মেঙ্গু খান কুবলাইকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন এবং ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাকে অপসারিত করে আলেমদারকে নতুন সেনাপতি হিসেবে নিয়ােগ করলেন। পরবর্তী বছর মেঙ্গু খান অবশ্য নিজেই চীনের বাকি অংশ বিজয়ে বের হন। কিন্তু পথিমধ্যে একটি দুর্গ অবরােধকালে ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে সহসা তার মৃত্যু হয়।

পিকিং-কেন্দ্রিক ইউয়ান বংশ (১২৫৭-১৩৭০ খ্রি.) ও কুবলাই খান (১২৫৯-১২৯৪ খ্রি.)

মে খানের আকস্মিক মৃত্যুর পর তার ভাই কুবলাই খান ১২৫৯ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। চেঙ্গিস খান ছিলেন মােঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, কিন্তু কুবলাই খান ছিলেন নিঃসন্দেহে এই সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি। তার সুদীর্ঘ ৩৫ বছর রাজত্বকালকে মোঙ্গল শাসনের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা যায়। কুবলাই খান সম্মন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক হেনরি হােয়ার্থ বলেছেন : “মােঙ্গলদের ইতিহাসে তার রাজত্বকাল সর্বাপেক্ষা গৌরবােজ্জ্বল যুগ। মােঙ্গল খানদের মধ্যে তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী, সাহসী, বিদ্যোৎসাহী ও ঐশ্বর্যশালী।” (হেনরি হােয়ার্থ : History of the Mongols. লন্ডন, ১৮৮৮, পৃ: ২৫২)। তার সাম্রাজ্য পূর্বে কোরিয়া হতে পশ্চিমে পারস্য উপসাগর এবং উত্তরে তুর্কিস্তান হতে দক্ষিণে বার্মা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ডি. ওহাসনের ভাষায় : “তিনি প্রায় গােটা এশিয়া মহাদেশের অধিপতি ছিলেন। পৃথিবীতে কোন কালে কোন নরপতি এত বড় সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন না।” (ডি. ওহাসন : History of the Mongols, এ্যামসটারডাম, ১৪৫২; দ্রষ্টব্য : হেনরি হােয়ার্থ, পূর্বোক্ত গ্রন্থ : লন্ডন, ১৮৮৮)।  কুবলাই খানের রাজত্বের প্রারম্ভে মােঙ্গল যুবরাজদের মধ্যে সিংহাসন অধিকারের প্রশ্নে প্রবল গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। তার ভাই আরিকবুকা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। কিন্তু কুবলাই খানের অপর ভাই হালাকু খান পারস্যের শাসনকর্তা হিসেবে সন্তুষ্ট থেকে তার প্রাধান্য স্বীকার করে নিলেন। ফলে হালাকুর সমর্থনপুষ্ট হয়ে অচিরেই তিনি আরিকবুকার বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হন। কিন্তু এই সময় ওগােদাই খানের পৌত্র কাইদু খান কুবলাই-এর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ালেন। কাইদু কাশগর থেকে কুবলাই খানের প্রতিনিধিকে বিতাড়িত করলেন এবং ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে কারাকোরাম তার হস্তগত হল। কিন্তু কুবলাই খানের বিখ্যাত সেনাপতি বায়ান কর্তৃক কাইদু অচিরেই পরাজিত হলেন এবং কারাকোরাম পুনরায় কুবলাই খানের অধিকারে এলো। তবে কুবলাই খানের পক্ষে কাইদুকে সম্পূর্ণরূপে দমন করা সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতে কাইদু তার পক্ষে আর তেমন হুমকির কারণ রইলেন না। সিংহাসনে আরােহণ করে কুবলাই খান কারাকোরাম থেকে রাজধানী পিকিং-এ স্থানান্তরিত করেন এবং পিকিং-কেন্দ্রিক এই নতুন মােঙ্গল সাম্রাজ্যের নাম দেন ‘ইউয়ান বংশ’। কুবলাই খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইউয়ান বংশের শাসন প্রায় এক শতাব্দীকাল স্থায়ী হয়েছিল।

কুবলাই খান একজন বিশিষ্ট রাজ্য-বিজেতা ছিলেন। চীন সাম্রাজ্য স্থায়ীভাবে পদানত করার জন্য মােঙ্গলরা চেঙ্গিস খানের আমল থেকে ক্রমাগত চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু কুবলাই খানই অবশেষে এই গৌরবের অধিকারী হলেন। একাধিক্রমে কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করার পর দীর্ঘ তিন শত বছরের পুরনো সং বংশের (৯৬০-১২৮০ খ্রিস্টাব্দ) পতন ঘটে এবং সমগ্র চীন কুবলাই খানের পদানত হয়। বিশাল চীন সাম্রাজ্য পদানত করার পর তিনি কোরিয়া, তিব্বত, বার্মা ও আসাম দখল করেন। কিন্তু ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে জাপান ও ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে জাভার বিরুদ্ধে পরিচালিত তার দুটি অভিযানই শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। জাপানের বিরুদ্ধে প্রেরিত এক লক্ষ সৈন্যের এক বিরাট মােঙ্গল বাহিনী সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। কেবল তিনজন সৈন্য এই পরাজয়ের মর্মান্তিক দুসংবাদ বহন করে রাজধানী পিকিং-এ ফিরতে পেরেছিল। মার্কো পােলাের মতে রাজধানী থেকে অতি দূরত্ব, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং নৌপথের নানাবিধ অসুবিধাই কুবলাই খানের এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল। (মার্কো পােলাে : The Travels of Marco Polo, (ইংরেজি অনুবাদ : মার্সডেন) নিউইয়র্ক, ১৯২৬. পৃ: ২৬৮)। কুবলাই খান শুধু মােঙ্গলদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজ্য-বিজেতা ছিলেন না, একজন সুযােগ্য শাসক হিসেবেও তিনি বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে গঠিত এই বিরাট সাম্রাজ্যের শাসন-ব্যবস্থা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। স্থানীয় চীনা আইন ও সমাজ ব্যবস্থার সাথে তিনি আপােষমূলক উদার নীতি অবলম্বন করেন। ফলে তার সময় হতে মােঙ্গলদের ওপর প্রবল চীনা প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কুবলাই খানের রাজত্বকালে বিখ্যাত ভেনেশীয় পর্যটক মার্কো পােলাে তার বিশেষ পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেন। তিনি ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দে মােঙ্গল দরবারে আগমন করেন এবং দীর্ঘ সতর বছর কুবলাই খানের সাথে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে জড়িত থাকেন। এই বিশিষ্ট পর্যটকের ভ্রমণ বৃত্তান্ত হতে কুবলাই খানের শাসন-ব্যবস্থা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য কুবলাই খান তার সাম্রাজ্যকে বারটি প্রদেশে বিভক্ত করেন এবং এই প্রদেশগুলোর শাসনভার বারজন সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রশাসন সংস্থার ওপর ন্যস্ত করেন। চীনা ভাষায় এই সংস্থাকে ‘সিঙ্গ’ বলা হত। (হেনরি হোয়ার্থ : পুর্বোক্ত গ্রন্থ, লন্ডন ১৮১৬)। কুবলাই খান সেনাবাহিনীর সংস্কার ও ডাক বিভাগের উন্নতি সাধন করেন। তার আমলে ডাক বিভাগের সুব্যবস্থা ও কর্মতৎপরতা সম্মন্ধে মার্কো পােলাে লিখেছেন, “কুবলাই খানের সাম্রাজ্যের প্রত্যেকটি প্রধান রাজপথে পঁচিশ থেকে ত্রিশ মাইল অন্তর পথিকদের জন্য বিশ্রামাগার থাকত। প্রত্যেকটি ফাঁড়িতে চারশত উৎকৃষ্ট ঘােড়া সর্বদা প্রস্তুত থাকত। মহান খানের অধীনে কর্তব্যরত এই বার্তাবাহকগণ ও রাজকীয় দূতগণকে তাদের পরিশ্রান্ত ঘােড়ার বিনিময়ে সুস্থ ও সবল ঘােড়া সরবরাহ করা হত। এভাবে তার রাজ্যের অন্ততপক্ষে দুই লক্ষ ঘােড়া এবং দশ হাজার ফাঁড়ি ডাক বিভাগের কাজে নিয়ােজিত থাকত। বস্তুত এই ব্যবস্থা এমন সুন্দর ও সুষ্ঠু ছিল যে তা বর্ণনাতীত।” (মার্কো পোলো : ওয়ালব্যাংক ও টেইলর কর্তৃক উদ্ধৃত ; Civilization Past and Present, নিউইয়র্ক, ১৯৬০, প্রথম খণ্ড, পৃ: ২৮৮)।

কুবলাই খানের রাজত্বকালে ভারত ও ইউরােপ মহাদেশের সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় এবং রাজধানী পিকিং একটি কর্মব্যস্ত বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতিকল্পে তিনি মুদ্রা ব্যবস্থা সংস্কার করেন এবং ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতীক কাগজের মুদ্রা প্রচলন করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে খুব সম্ভবত তিনিই সর্বপ্রথম এই জাতীয় মুদ্রার ব্যবহার প্রবর্তন করেন। কুবলাই খান একজন প্রজাহিতৈষী নরপতি ছিলেন। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শস্যাগার নির্মাণ করেন এবং তাতে কয়েক বছরের জন্য খাদ্যশস্য মজুদ রাখার ব্যবস্থা করেন। দেশে খাদ্যভাব এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে গরিব প্রজাদের মধ্যে এই শস্য তিনি বিনামূল্যে বিতরণ করতেন। দুস্থ, অনাথ ও পথিকদের জন্য তিনি বহু হাসপাতাল, অনাথ আশ্রম ও পান্থশালা নির্মাণ করেন। প্রজাদের সুবিধার্থে তিনি রাজ্যে বহু খাল খনন করেন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। ফলে রাজধানী পিকিং-এর সাথে সম্রাজ্যের বিভিন্ন শহর ও বন্দরের যােগাযােগ ব্যবস্থা সহজতর হয়। এর ফলে কৃষিকার্য ও আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেরও বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়। কুবলাই খানের নির্দেশে রাজধানী পিকিং শহরের ঠিক মধ্যস্থানে একটি বিরাট কাসার ঘণ্টা ও একটি জলঘড়ি স্থাপন করা হয়। এটি একদিকে যেমন শহরের গৌরব বৃদ্ধি করে অন্যদিকে তেমনি শহরবাসীও বিশেষভাবে উপকৃত হয়। (হেনরি হােয়ার্থ : পূর্বোক্ত গ্রন্থ; লন্ডন, ১৮৯৬)। কুবলাই খান শিল্প , ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশেষ পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তিনি নিজে একজন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান লােক ছিলেন। তার দরবারে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ ভিড় জমাতেন। চৈনিক সভ্যতা ও ধর্ম কুবলাই খানের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং চীনা ধর্মীয় প্রথা অনুসারে পূর্ব পুরষদের অর্চনার প্রবর্তন করেন। এজন্য তিনি ১২৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘তাই-মিয়াও’ নামে পিকিং-এ একটি উপাসনালয় স্থাপন করেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় মোঙ্গলীয় বর্ণমালা প্রবর্তনের মাধ্যমে মােঙ্গলদের একটি নতুন জাতীয় ভাষার প্রচলন করা হয়। এছাড়া জামালউদ্দিন নামক জনৈক পারস্যবাসী মুসলমান বৈজ্ঞানিকের সাহায্যে তিনি একটি পঞ্জিকাও প্রকাশ করেন। স্থাপত্য শিল্পের প্রতি কুবলাই খানের বিশেষ অনুরাগ ছিল। তার আমলে রাজধানী পিকিং একটি আন্তর্জাতিক ও সার্বজনীন সভ্যতার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। পিকিংসহ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মন্দির, মসজিদ, গির্জা ও বহু সুরম্য অট্টালিকা গড়ে ওঠে। বস্তুত সমগ্ৰ মােঙ্গল নরপতিদের মধ্যে কুবলাই খানই ছিলেন সর্বাপেক্ষা সুরুচিসম্পন্ন ও সংস্কৃতিবান ব্যক্তি। কুবলাই খানের রাজত্বকাল ছিল মােঙ্গল ইতিহাসে শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ। তিনি কেবল মােঙ্গল বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতিই ছিলেন না, চীনা ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নরপতিদের মধ্যে অন্যতম এবং এই কারণে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐতিহাসিকদের কাছে তিনি যথার্থই ‘মহামতি’ বলে আখ্যায়িত হয়েছেন। কুবলাই খানের রাজদরবারের জাঁকজমকতা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি ও প্রাচুর্যের কথা মার্কো পােলাের ভ্রমণ বৃত্তান্ত হতে অবগত হওয়া যায়। এছাড়া বিশিষ্ট ইংরেজ কবি কোলরিজের বিখ্যাত কবিতার মাধ্যমেও কুবলাই খান পৃথিবীর সকলের নিকট সুপরিচত। (কোলরিজ : Kubla Khan, (দ্রষ্টব্য : Thc Poems of Samuel Coleridge, সম্পাদক, ই. এইচ. সিরিজ), লন্ডন, ১৯১২, পৃ: ২৯৫-২১৮)। দীর্ঘ ৩৫ বছর রাজত্ব করার পর ১২৯৪ খ্রিস্টাব্দে বুবলাই খান মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল আশি বছর। কুবলাই খানের মৃত্যুতে মােঙ্গল ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরবােজ্জ্বল যুগের অবসান ঘটে। 

পিকিং কেন্দ্রিক মােঙ্গল সাম্রাজ্যের পতন

কুবলাই খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পিকিং-কেন্দ্রিক ইউয়ান সাম্রাজ্য প্রায় এক শতাব্দীকাল স্থায়ী হয়েছিল। তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে উলজাইতু (১২৯৪-১৩০৭ খ্রি.), কুলুক (১৩০৭-১৩১১ খ্রি.), বায়ানতু (১৩১১-১৩২০ খ্রি.), গিজেন (১৩২০-১৩২৩ খ্রি.) ও ইসুন তিমুর (১৩২৩-১৩২৮ খ্রি.) প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য। কিন্তু এদের মধ্যে কেউই তেমন যােগ্যতার অধিকারী ছিলেন না। এদের আমলে মােঙ্গল সাম্রাজ্যের দ্রুত পতন শুরু হয়। বস্তুত কুবলাই খানই তার ইউয়ান সাম্রাজ্যের পতনের বীজ নিজ থেকে বপন করে গিয়েছিলেন। মােঙ্গলদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা অনুসারে কুরিলতাই এর পরিষদই প্রধান খান নির্বাচন করত। কিন্তু এই নির্বাচন পদ্ধতি তুলে দিয়ে কুবলাই খান বংশানুক্রমিক (অর্থাৎ প্রধান খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র পিতার স্থলাভিষিক্ত হবেন) প্রথার প্রচলন করেন। ফলে ইউয়ান বংশের অন্যান্য যুবরাজদের মধ্যে অসন্তোষ এবং সিংহাসন লাভের জন্য আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।  কুবলাই খানের উচ্চাভিলাষী বৈদেশিক অভিযান ও ব্যয়বহুল আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রায় রাজ্যের কোষাগার শূন্য হয়ে পড়ে। ফলে প্রজাদের ওপর করভার পূর্বাপেক্ষা বহুগুণে বেড়ে যায় এবং অনেক কৃষক তাদের কর অনাদায়ের অভিযােগে জমির মালিকানা স্বত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে কুবলাই খান তার অতিরিক্ত অর্থের প্রয়ােজন মেটাতে গিয়ে কাগজের মুদ্রার প্রচলন করেন। কিন্তু এই মুদ্রা জাল হওয়ার ফলে মুদ্রামান ভীষণভাবে হ্রাস পায় ও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। ফলে এই অবস্থার মােকাবেলা করতে গিয়ে কুবলাই খানকে বাধ্য হয়ে তার রাজত্বের শেষ দিকে কাগজের মুদ্রার প্রচলন বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু এই মুদ্রা-সংকটের ফলে সাম্রাজ্যে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দিল তা থেকে মােঙ্গলগণ পরে আর কখনও মুক্তি পায়নি।  কুবলাই খানের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কেউ তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না। ফলে এই বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এছাড়া উন্নততর চীনা সভ্যতার সংস্পর্শে এসে মােঙ্গলরা প্রকৃতির অতি সাধারণ নিয়মেই তাদের পূর্বেকার সামরিক শৌর্য-বীর্য হারিয়ে আরামপ্রিয় এবং ভােগ-বিলাসী হয়ে উঠল। কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার এই দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে মোঙ্গলদের বিভিন্ন গােত্রপতি ও যুবরাজগণ স্বাধীণতা ঘােষণা করলেন। ফলে পারস্যে ইল-খানি সাম্রাজ্য, রাশিয়ায় কিপচাক সাম্রাজ্য এবং ট্রান্সঅক্সিয়ানায় চাগতাই সাম্রাজ্য গড়ে উঠল। মােঙ্গলদের রাজত্বকালে চীনের অধিবাসীগণ সামরিক ও বেসামরিক বিভাগের চাকরিতে বিশেষ সুযােগ-সুবিধা ভােগ করত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মােঙ্গলরা ভিন্ন জাতি ও বহিরাগত বিধায় চীনারা তাদেরকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখত এবং মনে-প্রাণে সর্বদা তাদের উচ্ছেদ কামনা করত। কুবলাই খান বিশেষ আইন জারি করে মোঙ্গলদের অধিকার অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু মােঙ্গলরা শাসক হিসেবে ছিল নিতান্তই সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতি। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ ও উন্নততর সভ্যতার অধিকারী চৈনিক জাতি মোঙ্গলদের বশ্যতা ততদিন পর্যন্ত স্বীকার করল যতদিন মােঙ্গলদের সামরিক শক্তি অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই ভােগ-বিলাসে মত্ত হয়ে কুবলাই খানের উত্তরাধিকারীগণ হীনবল হয়ে পড়ল। ফলে ১৪শ শতাব্দীর মাঝামাঝি চৌ-এন-চাঙ্গ নামক জনৈক প্রাক্তন বৌদ্ধ পুরােহিতের নেতৃত্বে চীনারা মােঙ্গলদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘােষণা করল। চৌ-এন-চাঙ্গ অবিলম্বে পিকিং দখল করলেন এবং ১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দে শতাধিক বছরের পুরনো এবং ঐতিহাসিক ইউয়ান মােঙ্গল সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে ‘মিং’ বংশের গােড়াপত্তন করলেন। এভাবে মােঙ্গলদের মূল শাখার নেতৃত্বে গড়ে উঠা পিকিং-কেন্দ্রিক ইউয়ান সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটল। (বিস্তারিত পাঠের জন্য দ্রষ্টব্য : জে. কার্টিন The Mongols.-বােস্টন, ১৯০৮)। 

বিশ্বসভ্যতায় মোঙ্গলদের অবদান

আপাতদৃষ্টিতে মােঙ্গল জাতির ইতিহাস এক ভয়াবহ ধ্বংসলীলা ও হত্যাকাণ্ডের ইতিবৃত্ত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এই ধারণা একান্তই মােঙ্গল ইতিহাসের একতরফা অধ্যয়নপ্রসূত ফল। মোঙ্গল ইতিহাসে ধ্বংসের উন্মত্ত উল্লাসের সাথে সৃষ্টির নব চেতনাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বস্তুত বিশ্ব সভ্যতায় মােঙ্গলদের অবদান অপরিসীম এবং তার অবমূল্যায়ন করার কোন অবকাশই নেই। এটি অবশ্য সত্য যে মােঙ্গল আক্রমণের ত্বরিত গতির সম্মুখে এশিয়া ও ইউরােপ মহাদেশের বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। কিন্তু এদের মধ্যে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই সাম্রাজ্যগুলো জরাজীর্ণ ও মৃতপ্রায় আবর্জনার মত বিরাজ করছিল। সুতরাং বহু ক্ষয়-ক্ষতির বিনিময়ে হলেও মােঙ্গলদের অধিকার আসার পর এই সকল রাজ্যে এক বলিষ্ঠতর নবজীবনের সূচনা হয়। পিকিং, সমরখন্দ, তাশখন্দ, হেরাত ও তাবরিজকে কেন্দ্র করে এশিয়া, ইউরােপ ও আফ্রিকার মধ্যে এক আন্তঃমহাদেশীয় যােগসূত্র সৃষ্টি হয়। মধ্য এশিয়ার এই শহরগুলো ছিল তৎকালীন বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। মোঙ্গল আমলে তাশখন্দ এশিয়ার রণসম্ভার সরবরাহের কেন্দ্রস্থল বলে বিবেচিত হত। তীর, তলােয়ার, তাবু ও বল্লমের প্রধান বাজার ছিল এই শহর। সির-দরিয়া ও আমু-দরিয়ার নদীপথে সুদূর ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে লােক আসত তাশখন্দের বাজারে এই সমরাস্ত্র বেচাকেনার জন্য।  কুবলাই খানের অধীনে মােঙ্গলদের মূল শাখা চীনে ইউয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এই সাম্রাজ্য প্রায় শতাধিক বছর স্থায়ী হয়েছিল। চীনে মােঙ্গলরা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপােষকতা করে। কুবলাই খানের প্রচেষ্টায় অচিরেই পিকিং সভ্যতার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। ধাতু নির্মিত মুদ্রার পরিবর্তে কুবলাই খান কর্তৃক কাগজের নােট প্রচলন আন্তর্জাতিক মুদ্ৰাজগতে মোঙ্গলদের একটি বিশেষ অবদান। এর ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা হয়। মধ্য এশিয়া ও চীনে মোঙ্গল শাসনের অবসান ঘটলে সেখানকার অবস্থা বর্ণনা করে বিখ্যাত ঐতিহাসিক এইচ. এ. এল. ফিসার বলেন, “একশো বছরব্যাপী তাতার (মোঙ্গল) শাসনের অবসান ঘটলে মধ্য-এশিয়া পুনরায় বিশৃঙ্খলার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয় এবং চীন দুর্ভেদ্য অন্ধকারের যুগে ফিরে যায়।” (এইচ. এ. এল. ফিসার : History of Europe from Earliest Time to 1713, লন্ডন, ১৯৩৫)  পারস্যের ইল-খানি শাসন আমলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়। ইতিহাস ও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বিশ্ব-সভ্যতার ভাণ্ডারে মোঙ্গলদের অমর অবদান রয়েছে। এই সময় বিখ্যাত কবি সেখ সাদী ও জালালউদ্দিন রুমীর আবির্ভাব ঘটে। এছাড়া প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাশিদুদ্দিন ও আতা মালিক জুয়াইনির নামও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন বিশ্বের অতুলনীয় প্রতিভা। তৈমুরীয় আমলেও এই সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে এবং বিশেষ করে স্থাপত্য শিল্প ও চিত্র-শিল্প বিশ্ব-সভ্যতার এক সােনালি অধ্যায়ের সংযােজন ঘটে। ‘প্রতীচ্যের রাফায়েল’ বলে আখ্যায়িত চিত্রশিল্পী কামাল উদ্দিন বিহ্‌জাদ ও মহাকবি হাফিজ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর গৌরব। মোঙ্গল নরপতিগণ জ্যোতির্বিদ্যার বিশেষ পৃষ্ঠপােষকতা করেন এবং এই ক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযােগ্য অবদান রয়েছে। হালাকু খানের পৃষ্ঠপােষকতায় নাসিরুদ্দিন তুসি আজারবাইজানের মারাঘা নামক স্থানে একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন। নাসিরুদ্দিন ছিলেন পৃথিবীর মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ এবং তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মানমন্দিরটির গুরুত্ব ও প্রাধান্য পরবর্তী কয়েক শতাব্দীব্যাপী অম্লান থাকে। (বি. স্পুলার : ‘The Cambridge listory of Islam, প্রথম খণ্ড, ক্যাম্ব্রিজ, ১৯৭০, পৃ: ১৬৪)।

১৪২০ খ্রিস্টাব্দে উলুঘ বেগ সমরখন্দে একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন। এছাড়া ‘জিজে গুরকানি’-নামক একটি নক্ষত্র সূচিও তার অবদানের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইংরেজ জ্যোতির্বিদ রয়েল ও পরে ইউরােপীয়গণ ব্যাপকভাবে এটি ব্যবহার করেন। (ভি. ভি. পার্টহোল : Ulugh-Beg, লণ্ডন, ১৯৫৮)। খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দী থেকে ইউরােপের সাথে মধ্য-এশিয়া, চীন ও ভারতের যােগাযােগ স্থাপিত হয়। প্রধানত মশলা ও সিল্ক কাপড়ের ব্যবসায়ের মাধ্যমে উভয় অঞ্চলের মধ্যে এই সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে নানা কারণে অবশ্য এই যােগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু মােঙ্গল শক্তির আবির্ভাবের পর প্রাচীন সিল্ক রুটের মাধ্যমে এই যােগসূত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ব-সভ্যতা বিবর্তনের ক্ষেত্রে এই বাণিজ্যিক আদান-প্রদানে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আরব মুসলমানদের মাধ্যমে চীনে আবিষ্কৃত ও প্রস্তুতকৃত বিস্ফোরক পদার্থ, কাগজ প্রস্তুত প্রণালী, মুদ্রণযন্ত্র ও দিগদর্শন যন্ত্র ইউরােপ মহাদেশে প্রচলিত হয়। (ওয়ালব্যাক ও টেইলর : Civilization Past and Present, নিউইয়র্ক, ১৯৬০, প্রথম খণ্ড, পৃ: ২৮)। পক্ষান্তরে ইউরােপ থেকেও বহু নব নব আবিষ্কার ও জ্ঞান-বিদ্যার দ্বারা মোঙ্গলরা তথা প্রাচ্যের দেশসমূহ বিশেষভাবে উপকৃত হয়। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের রাজ্য বিজয়ের ফলশ্রুতি হিসেবে ‘হেলেনিস্টিক’ সভ্যতার পর কেবল মােঙ্গলদের অধীনেই প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের এই যােগসূত্র সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে এটিও লক্ষণীয় যে এই যােগসূত্রের পেছনে কোন ধর্মীয় বন্ধন অথবা অপার্থিব শক্তি কাজ করেনি এবং একান্তভাবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণেই এই যােগসূত্র গড়ে উঠেছিল। মোঙ্গল নরপতিগণ পরধর্মের প্রতি উদার ও সহনশীল মনােভাব পােষণ করতেন। ফলে মোঙ্গল রাজদরবারে বহু ইউরােপীয় পর্যটক ও ধর্ম প্রচারকের আগমন ঘটে। এদের মধ্যে মার্কো পেলাে, কার্পিনি ও উইলিয়াম প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই সমস্ত পর্যটক প্রতীচ্যের এবং বিশেষ করে মােঙ্গল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিষয়ক উন্নতি ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রার ওপর বিশদ ভ্রমণবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন। এই ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠে ইউরােপীয়দের মনে বিশেষ কৌতূহল ও আলােড়নের সৃষ্টি হয়। ইউরােপীয় নাবিকদের ভৌগােলিক আবিস্কারের পেছনে এই ভ্রমণবৃত্তান্ত বিশেষ অনুপ্রেরণা যােগায়। সুতরাং খুব ন্যায়সঙ্গতভাবেই এই কথা বলা যায় যে, বিশ্ব-সভ্যতায় মােঙ্গলদের অবদান প্রথমে ইতালিতে ও পরে সমগ্র ইউরােপে ‘রেনেসাঁ’ বা নব-জাগরণ আনয়নেও পরােক্ষভাবে সাহায্য করেছিল। বিশ্ব-সভ্যতায় মােঙ্গলদের এই সুদূরপ্রসারী অবদানের প্রতি দৃষ্টি রেখেই একে ‘প্যাক্স মােঙ্গলিকা’ অর্থাৎ মােঙ্গলদের শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। (জি. হ্যাম্বলি: Central Asia, লন্ডন, ১৯৬৯, পৃ: ১০৯)।

পারস্যের ইল-খানি বংশ (১২৫৬-১৩৫ খ্রি.) ও হালাকু খান (১২৫৬-১২৬৫ খ্রি.)

পারস্যের ইতিহাসে ইল-খানি বংশের গুরুত্ব অপরিসীম। ইল-খানি বংশ মােঙ্গল জাতির একটি অন্যতম প্রধান শাখা। চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খান ছিলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। (হালাকু খানের নাম উচ্চারণভেদে ‘হালাগু’, ‘দুলাগু,’ ‘হালাকু,’ ও ‘হুলাকু’ প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়।)। মেঙ্গু খানের মৃত্যুর পর তার ভাই কুবলাই খান মােঙ্গল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং তিনি তার অপর ভাই হালাকু খানের ওপর পারস্যের শাসন ক্ষমতা অর্পণ করেন। হালাকু খান ভাইয়ের অধীনতা স্বীকার করে নিলেন এবং ‘ইল-খান’ উপাধি ধারণ করে পারস্য শাসন করতে থাকেন। ইল-খান শব্দের অর্থ ‘গােত্রপতি’। কিন্তু বিশেষ অর্থে এটি ‘প্রধান খানের অধীনস্ত শাসক’ বলে ব্যবহৃত হতে থাকে। (‘ইল -খান’ উপাধির পরিবর্তে গাজান খান কেবল ‘খান’ শব্দের ব্যবহার করেন। দ্রষ্টব্য: হেনরি হােয়ার্থ-History of the Mongols, তৃতীয় খণ্ড, লন্ডন ১৯২৮, পৃ: ৪৮৬)। গাজান খান নামক এই বংশের একজন বিশিষ্ট নরপতির সময় থেকে অবশ্য ইল-খান উপাধি প্রকৃতপক্ষে নিরর্থক হয়ে দাড়ায়। কারণ তিনি পিকিং-কেন্দ্রিক মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রধান খানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে পারস্যকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। তার মুদ্রা থেকে মহান খানের নাম তুলে দেয়া হয় এবং পিকিং-এর সাথে সকল প্রকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। যাই হােক হালাকু খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পারস্যের এই মোঙ্গল বংশ ইতিহাসে ইল-খানি বংশ এবং তার বংশধরগণ ইল-খান বলে পরিচিত। হালাকু খান ১২১৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। চেঙ্গিস খানের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র তুলি ছিলেন তার পিতা। মেঙ্গু খান মোঙ্গল সিংহাসনে আরােহন করলে তিনি সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে দ্বিতীয়বারের মত নতুন বিজয় অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং হালাকু খানের ওপর এই অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। পারস্যের গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় ও বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফার বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করাই ছিল এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। 

গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান : সেলজুক সুলতান মালিক শাহের আমলে (১০৭২-১০৯২ খ্রি.) হাসান-বিন-সাবাহ কর্তৃক এই গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরা ছিল ইসলাম ধর্মের শিয়া মতাবলম্বী একটি উগ্রপন্থী দল। এই সম্প্রদায়ের লােকেরা সুন্নি মুসলমানদের প্রতি বিশেষ ঘৃণা ও হিংসাত্মক মানােভাব পােষণ করত। এমনকি দলীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা শক্তি প্রয়ােগ ও গুপ্তহত্যার আশ্রয় পর্যন্ত গ্রহণ করত। ১৩শ শতাব্দীর প্রারম্ভে আব্বাসীয় খলিফাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা পারস্যের পূর্বাঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং পার্শ্ববর্তী মােঙ্গল সাম্রাজ্যেও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সন্ত্রাসবাদী ও অনিষ্ঠকারী এই গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে সমুচিত শাস্তি দেয়ার জন্য হালাকু খান ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে পারস্য অভিমুখে অগ্রসর হন। হালাকু খানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফার্সের আতাবেক সা’দ এবং আইজুদ্দিন ও রুনুদ্দিন নামক সেলজুক রুমের প্রতিদ্বন্দ্বী সুলতানদ্বয়ও এই অভিযানে তার দলে যােগদান করেন। ফলে হালাকু খানের প্রবল আক্রমণের সম্মুখে একের পর এক গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের চল্লিশটি দুর্গের পতন ঘটে। এরপর তিনি তাদের প্রধান দুটি ঘাটি আলামুথ ও লানবাসার অবরােধ করেন। অচিরেই দুর্ধর্ষ মােঙ্গল বাহিনীর কাছে এই ঘাটি দুটির পতন ঘটে এবং অসংখ্য নর নারী ও শিশু মােঙ্গলদের হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হয়। সৌভাগ্যবশত এই ধ্বংসের হাত থেকে ঐতিহাসিক আতা মালিক জুয়াইনি গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের মূল্যবান গ্রন্থাগারটি রক্ষা করতে পেরেছিলেন। এই সম্প্রদায়ের তৎকালীন নেতা ছিলেন রুকনুদ্দিন। ‘পর্ততের বৃদ্ধ লােকটি’ বলে অভিহিত এই নেতা ও মােঙ্গল বাহিনীর দ্বারা নিহত হন। ফলে এই গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের শক্তি চিরতরে বিলুপ্ত হয়। 

বাগদাদ আক্ৰমণ (১২৫৮ খ্রি.) : মোঙ্গলদের কাছে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হলে সুন্নি মুসলমানগণ স্বস্তির নিশ্বাশ ফেলল। বােধ হয়, এতে তাদের যথেষ্ট উল্লাসেরও কারণ ছিল। কিন্তু অচিরেই এই উল্লাস মহাশােকের কালাে ছায়া ডেকে আনল। কারণ হালাকু খান গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে শায়েস্তা করার পর আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ আক্রমণের জন্য অগ্রসর হলেন। এই সময় বাগদাদের খলিফা ছিলেন আল-মুসতাসিম বিল্লাহ্ (১২৪২-৫৮ খ্রি.)। বাগদাদ আক্রমণের জন্য হালাকু খানকে অজুহাত খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে দমন করার জন্য হালাকু খান ইতােপূর্বে বাগগাদের খলিফার সহযােগিতা কামনা করেছিলেন। কিন্তু খলিফা হালাকু খানের এই আহ্বানে কর্ণপাত করেননি। এতে ক্রোধান্বিত হয়ে হালাকু খান বাগদাদ অভিমুখে ধাবিত হলেন এবং অবিলম্বে তার কাছে খলিফাকে আত্মসমর্পণ করার দাবি জানালেন। খলিফার কাছে লিখিত একটি পত্রে হালাকু খান তাকে এই মর্মে অভিযুক্ত করলেন যে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাকে সহযােগিতা না করায় তিনি নিজ কর্তব্যের প্রতি অবহেলা দেখিয়েছেন এবং সেই কারণে সুন্নি মুসলমানদের খলিফা পদের অযােগ্য বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন। খলিফা হালাকু খানের এই দাবিকে ঘৃণাভরে উড়িয়ে দিলেন এবং পরিষদবর্গের পরামর্শক্রমে হালাকু খানের এই পত্রের এক কড়া উত্তর পাঠাইলেন। ফলে হালাকু খানের সাথে খলিফার সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালো। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হালাকু খান বাগদাদ নগরী অবরােধ করলেন। খলিফা বাগদাদ রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। মােঙ্গল বাহিনী নগরে প্রবেশ করে এক সপ্তাব্যাপী লুণ্ঠন, নরহত্যা ও পাশবিক অত্যাচারের তাণ্ডবলীলা চালালো। ইবনে খলদুনের মতে প্রায় ষােল লক্ষ লােক এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছিল। (ইবনে খলদুন : আল-মুকাদ্দিমা; জন ম্যালকোম কর্তৃক উদ্ধৃত : History of Persia লন্ডন, ১৮২৯)। ঐতিহাসিক আমীর আলী এই ধ্বংসলীলার এক লােমহর্ষক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। (আমীর আলী : A sliort History of the Saracens. লন্ডন, ১৯৫৩, পৃ: ৩৯৮)। খলিফা আল-মুসতাসিম জীবন রক্ষার্থে তার সঞ্চিত সকল ধনরত্ন নিয়ে হালাকু খানের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু এতেও তার প্রাণ রক্ষা পেল না। খলিফা হত্যা করার ভয়াবহ পরিণতি সম্বন্ধে হালাকু খানকে সতর্ক করে দেয়া হল যে, “যদি খলিফাকে হত্যা করা হয় তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হবেই, সূর্য উদিত হবে না, অনাবৃষ্টি দেখা দেবে এবং মাটিতে আর ফসল ফলবে না।” (আল-ফাখত্মি : অধ্যাপক পি. কে. হিট্টি কর্তৃক উদ্ধৃত : History of the Arabs, নিউইয়র্ক, ১৯৬৮, পৃ: ৪৮৫)। কিন্তু হালাকু খান এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। খলিফা এবং তার পরিবারবর্গের প্রায় সকলকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হল। কেবল কিছুসংখ্যক চাটুকার, শিল্পী ও অমুসলমান নাগরিক ব্যতীত বাকি সকলেই মােঙ্গলদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ হারালো। আর সেই সঙ্গে ইসলামী শিক্ষা ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এবং ‘প্রতীচ্যের রােম’ বলে আখ্যায়িত বাগদাদ নগরী মোঙ্গলদের হাতে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হল। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খানের থেকে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন একটি প্রতীক ঘটনা হিসেবে ধরা হলে বস্তুত এই পতন সূচিত হয়েছিল দীর্ঘ তিনশত বছর পূর্বেই। খলিফা আল-মুসতাকফি কর্তৃক ৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বুয়াহিদদেরকে এবং পরে ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-কাইম কর্তৃক সেলজুকদেরকে আমন্ত্রণের মাধ্যমে আব্বাসীয় খিলাফতের করুণ চিত্রই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। কারণ অচিরেই আব্বাসীয় খলিফাগণ এই সকল তথাকথিত ত্রাণকর্তাদের হাতের ক্রীড়ানকে পরিণত হয়ে পড়লেন। পক্ষান্তরে খলিফাদের এই দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে ৯ম শতকের শুরু থেকেই একের পর এক প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ স্বাধীনতা ঘােষণা করতে থাকেন। অধ্যাপক হিট্টির ভাষায়, “রােগী ইতােপূর্বের মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিল, এমন সময় সিঁদেল চোরের দল দরজা ভেঙ্গে জোরপূর্বক ঘরে প্রবেশ করল এবং রাজকীয় সম্পদ থেকে স্ব স্ব অংশ ছিনিয়ে নিল।” (পি. কে. হিট্টি : পূর্বোক্ত গ্রন্থ, নিউইয়র্ক, ১৯৬৮, পৃ: ৪৮৪)।

বলাবাহুল্য যে আব্বাসীয় খলীফাদের করুণ অবস্থার প্রতি দৃষ্টি রেখেই এরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। মােঙ্গল আক্রমণের প্রাক্কালে বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফার অবস্থা ছিল বর্ণনাতীতভাবে শােচনীয়। এককালে যে বাগদাদ খলিফার নামে রােমান ও বাইজান্টাইন সম্রাটদের আতঙ্কের সৃষ্টি হত সেই খলিফা এই সময় ভােগ ও বিলাসিতায় প্রমত্ত হয়ে কেবল রাজপ্রাসাদ ও হারেমের শােভা বর্ধন করছিলেন। আত্মনির্ভশীলতা, সৎসাহস ও কর্মক্ষমতা হারিয়ে বাগাদের মুসলমানরাও এই সময় হতােদ্দম ও অদৃষ্টবাদী একপ্রকার সামাজিক জীবে পরিণত হয়েছিল। বাগদাদে এই সময় একজন শক্তিশালী খলিফা থাকলে আব্বাসীয়-মােঙ্গল সংঘর্ষের ফলাফল কি হত তা বলা মুশকিল। (পি. সাইকস : A History of Persia, লন্ডন, ১৯২১, পৃ: ১৯)। কারণ মােঙ্গলরা যে একেবারে দুর্ভেদ্য বা দুর্জেয় শক্তি নয় তা মিশরের মামলুকগণ মাত্র দুই বছর পরেই আইনজালুতের যুদ্ধে প্রমাণ করেছিল। কিন্তু অযােগ্য খলিফা ও নিজীর্ব বাগদাদবাসী সাহসিকতার সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতির মােকাবেলা করতে পারল না। সুতরাং নবশক্তিকে বলীয়ান দুর্ধর্ষ মােঙ্গল নেতা হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতন প্রকৃতির অতি সাধারণ নিয়মেই সংঘটত হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ নগরী ধ্বংসের ঘটনা যেমন মর্মান্তিক তার ফলাফলও তেমনি সুদূরপ্রসারী। আব্বাসীয় বংশের শেষ খলিফা আল-মুস্‌তাসিম বিল্লাহকে হত্যা করার ফলে মুসলিমবিশ্ব সাময়িকভাবে খলিফাশূন্য হয়ে পড়ল। সৌভাগ্যক্রমে মিশরের মামলুক সুলতান বাইবার্স খিলাফতের এই পবিত্র ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না করলে হয়তাে এটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেত। হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ অধিকারের ফলে পাঁচশো বছরের পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী আব্বাসীয় বংশের পতন ঘটল এবং বাগদাদ পারস্যের ইল-খানি সাম্রাজ্যের অধীনস্ত একটি প্রাদেশিক শহরে পরিণত হল। সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাগদাদের পতন আরও বেদনাদায়ক, কারণ বাগদাদ ছিল তৎকালীন মুসলিমবিশ্বের শিক্ষা ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। এই ধ্বংসলীলায় অসংখ্য গ্রন্থাগার ভস্মীভূত হয় এবং বহু প্রখ্যাত মনীষী ও বৈজ্ঞানিক প্রাণ হারান। বাগদাদ নগরী স্থাপত্যশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু মোঙ্গল আক্রমণের ফলে এই নগরীর বহু মসজিদ, রাজপ্রাসাদ ও সুরম্য অট্টালিকা বিধ্বস্ত হয় এবং নগরীটি এক মহাশ্মশানে পরিণত হয়। এই ধ্বংসের ফলে শুধু যে মুসলিমবিশ্বের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তাই নয় বরং গােটা বিশ্ব সভ্যতার সামগ্রিক অগ্রগতিও বিশেষভাবে ব্যাহত হয়েছিল। (পূর্বোক্ত : পৃ: ১৮)।

হালাকু খানের অন্যান্য অভিযান, সেলজুক রুম ও মামলুক মিশরের সাথে সম্পর্ক : ১২৪৩ থেকে ১৩০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এশিয়া মাইনরের সেলজুকগণ বাহ্যত স্বাধীন হলেও তা প্রকৃতপক্ষে মোঙ্গল খানদের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে বিরাজমান ছিল। সুলতান দ্বিতীয় কায়খসরুর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এদিকে পারস্যের ইল-খানি বংশের (Ilkhanate) প্রতিষ্ঠাতা হালাগু খান (Hulagu Khan. রা. ১২৫৬-৬৫ খ্রি.) ১২৫৮ সালে বাগদাদ আক্রমণ, লুণ্ঠন, ধ্বংস ও দখল করেন। বাগদাদ পদানত করার পর হালাকু খান সিরিয়া আক্রমণ করেন এবং হামাদান, নিসিবন ও আলেপ্পো প্রভৃতি শহরগুলো একের পর এক তার হস্তগত হয়। এশিয়া মাইনরের সেলজুক রুম ও গােল্ডেন হাের্ডের সঙ্গেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে মােকাবেলা করেন। সেলজুকদের আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে তিনি এশিয়া মাইনরকে দুটো অংশে বিভক্ত করেন। তিনি কিলিজ ইরমাক নদীর পূর্বাঞ্চল চতুর্থ কিলিজ আরসলানের (Kilij Arslan IV, রা. ১২৪৮-৬৬) ওপর এবং পশ্চিমাঞ্চল তার ভ্রাতা দ্বিতীয় কায়কাউসের (Kaykaus II, রা. ১২৪৬-৬২ খ্রি.) ওপর ন্যস্ত করেন। কিন্তু সেলজুক রুমের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা মুঈন আল-দীন সুলাইমান নামক জনৈক ব্যক্তির হাতেই অর্পিত হলো। তিনি পারওয়ানা উপাধি ধারণ করেন এবং মোঙ্গলদের প্রতিনিধি হিসেবে সেলজুক রুমের সর্বময় কর্তা হয়ে বসেন। তার অধীনে সাময়িকভাবে এশিয়া মাইনরে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এরপর হালাকু খান মিশরের মামলুকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু হঠাৎ এই সময় তার ভাই মেঙ্গু খানের মৃত্যু হলে তিনি রাজধানী কারাকোরামে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন। হালাকু খানের অনুপস্থিতিতে তার সেনাপতি কেৎবুঘা ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে মিশর আক্রমণ করেন। কিন্তু ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে আইনজালুতের প্রান্তরে মোঙ্গলগণ সর্বপ্রথম মামলুক সুলতান কুতুজের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। মোঙ্গল সেনাপতি কেৎবুঘা যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হলেন। আইনজালুতের যুদ্ধ যুগপৎ মােঙ্গল ও মামলুক ইতিহাসের একটি ভাগ্যনির্ধারণকারী ঘটনা। কারণ এর ফলে মােঙ্গলদের মিশর বিজয়ের বাসনা চিরতরে ব্যর্থ হয়ে যায় এবং প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র কায়রাে মােঙ্গলদের ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পায়। 

আইনজালুতের যুদ্ধের কাহিনী : বাহ্‌রি মামলুক বংশের তৃতীয় সুলতান মুজাফফর সাইফুদ্দিন কুতুজ ছিলেন একজন বিখ্যাত সমরবিদ। মােঙ্গলদের সাথে যুদ্ধ তার সংক্ষিপ্ত রাজত্বকালের বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খানের (১২৫৬-৬৫ খ্রি.) নেতৃত্বে মোঙ্গলরা মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রভূমি বাগদাদ নগরী বিধ্বস্ত করে দেয় এবং মিশর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই সময় সহসা মােঙ্গল অধিপতি মেঙ্গু খানের (১২৪৮-৫৯ খ্রি.) মৃত্যু হলে হালাকু খান রাজধানী কারাকোরাম ফিরে যান। ফলে মামলুকদের বিরুদ্ধে প্রেরিত মােঙ্গল-বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে সেনাপতি কেৎবুঘা নয়ােন ও তার সহকারী বায়দারের উপর। ইতােপূর্বে বিশেষ দূত মারফত মােঙ্গলরা মামলুক সুলতান কুতুজকে তাদের বশ্যতা স্বীকারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কুতুজ মোঙ্গল প্রস্তাবকে ঘৃণাভরে উড়িয়ে দেন এবং প্রকাশ্যে মােঙ্গল দূতকে হত্যা করেন। ফলে মােঙ্গল-মামলুক সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। মোঙ্গলদের সাথে যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে পরাজিত হলে তার সম্ভাব্য পরিণতি সম্বন্ধে কুতুজ সম্পূর্ণরূপে সজাগ ছিলেন। কাজেই বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত ও পূর্ণ আস্থা সহকারে তিনি এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মােঙ্গলদের মােকাবেলার জন্য অগ্রসর হলেন। (Encyclopaedia of Islam. প্রথম খণ্ড, লন্ডন, ১৯৬০, অনুসারে উভয় বাহিনীতে এই উল্লিখিত সংখ্যা দেখানাে হয়েছে। কিন্তু ড. ফাতেমা সাদেক তার Baybars 1 of Egyps. ঢাকা, ১৯৫৬ শীর্ষক গ্রন্থে মামলুক সৈন্য সংখ্যা অনুরূপ এবং মোঙ্গল সৈন্য সংখ্যা ত্রিশ হাজার হতে ষাট হাজার বলে উল্লেখ করেছেন।) পক্ষান্তরে কেৎবুঘা মাত্র দশ হাজার সৈন্য নিয়ে মিশর আক্রমণের জন্য গাজায় তার শিবির সন্নিবেশ করলেন। উভয় পক্ষের পূর্ণ প্রস্তুতির পর অবশেষে ১২৬০ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর প্যালেস্টাইনের বায়সান ও নাবুলুসের মধ্যবর্তী আইনজালুত নামক প্রান্তরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হলো। কিন্তু এই যুদ্ধে মােঙ্গলদের ভাগ্য বিপর্যয় দেখা দিল এবং তুমুল যুদ্ধের পর মােঙ্গলরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হলো। বহু মােঙ্গল সৈন্য মামলুক বাহিনীর হতে হতাহত হলো এবং সেনাপতি কেৎবুঘা অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও অবশেষে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। তার ছিন্ন মস্তক প্রদর্শনীর জন্য কায়রোতে পাঠানাে হলো। মামলুক বাহিনীর অনতম সেনাপতি বাইবার্সের নেতৃত্বে একটি সেনাদল মোঙ্গলদের পশ্চাদ্ধাবন করে ইউফ্রেটিস পর্যন্ত অগ্রসর হলো। এছাড়া আলেপ্পো ও হামাদান হতেও মোঙ্গলগণ বিতাড়িত হলো। আইনজালুতের যুদ্ধে মামলুক-বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি বাইবার্সের নেতৃত্বে একটি সেনাদল মােঙ্গলদের পশ্চাদ্ধাবন করে ইউফোটিস নদী পর্যন্ত অসের হলো। এছাড়া আলেপ্পো ও হামাদান থেকেও মোঙ্গলগণ বিতাড়িত হলো। আইনজালুতের যুদ্ধে মামলুক-বাহিনীর অনুসৃত যুদ্ধ কৌশল তাদের জয়লাভের বিশেষ সহায়তা করেছিল। বাহ্‌রি মামলুকগণ ছিল কিপচাকের অধিবাসী। মোঙ্গলদের যুদ্ধকৌশল তাদের কাছে অজানা ছিল না। ফলে কৌশলগত দিক হতে মোঙ্গলরা এতদিন অন্যান্য বিজিত শক্তিসমূহের উপর যে সুবিধা গ্রহণ করে আসছিল মামলুকদের বেলায় তা সম্ভব হয়নি। এছাড়া মামলুক-বাহিনীর বিরাট সংখ্যাধিক্য এবং সেনাপতি কুতুজ ও বাইবার্সের অসাধারণ সমরনৈপুণ্য তাদের বিজয়ের কারণ ছিল।

আইনজালুতের যুদ্ধকে যথার্থই মিশরের ইতিহাসে এক চূড়ান্ত ও ভাগ্য নির্ধারণকারী যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই যুদ্ধে মামলুক শক্তি পরাজিত হলে অনান্য প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সভ্যতার কেন্দ্রভূমির মতো মিশরের কায়রাে ও মােঙ্গলদের দ্বারা বিধ্বস্ত হতো। এই যুদ্ধে মামলুকগণ প্রথমবারের মতাে আপাতদৃষ্টিতে দুর্জেয় ও দুর্ভেদ্য বলে বিবেচিত মোঙ্গল শক্তিকে পরাভূত করতে সক্ষম হলো। দুর্ধর্ষ হান জাতির নেতা আটিলা এবং সম্মিলিত জার্মান ও রােমান-বাহিনীর মধ্যে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কলােনসের যুদ্ধের সঙ্গে আইনজালুতের তুলনা করা যেতে পারে। হানদের পরাজয়ের ফলে যেমন রােম ও খ্রিস্টান জগৎ অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা পেয়েছিল তদ্রুপ আইনাজালুতের যুদ্ধে মোঙ্গলদের পরাজয়ের ফলেও কায়রাে এবং ইসলাম জগৎ রক্ষা পায়। আইনজালুতের যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে পশ্চিম সীমান্তে মােঙ্গাল বাহিনীর অগ্রযাত্রা চিরতরে প্রতিহত হলো। আইনজালুতের যুদ্ধের তাৎপর্য নিরূপণ করতে গিয়ে মিশরীয় ঐতিহাসিক মুহম্মদ আবদুল্লাহ ইনান বলেন, “আইনজালুতের যুদ্ধ কেবলমাত্র মিশর ও ইসলামের ইতিহাসে নয় বরং সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। এই যুদ্ধে ধ্বংসাত্মক তাতার শক্তি প্রাচ্য ও প্রতীচ্যকে সমানভাবে বিপদগ্রস্ত করেছিল। যদি তাতাররা মিশর জয় করতে সক্ষম হতো, তবে উত্তর আফ্রিকা, স্পেইন এবং সম্ভবত ইউরােপের অভ্যন্তরেও তারা প্রবেশ করত এবং যুগপৎ প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ইসলামী ও খ্রিস্টীয় সভ্যতা ধ্বংস করে দিত। আইনজালুতের যুদ্ধে মিশর একই সঙ্গে ইসলাম ও বিশ্বসভ্যতাকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।” (মুহম্মদ আবদুল্লাহ ইনান : Decisive Moments in the History of Islam. C ১৯৯৪, পৃ: ১৬৩)। অধ্যাপক ইনানের এই বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা অতিশয়ােক্তি থাকলেও আইনজালুতের যুদ্ধের গুরুত্ব নির্ণয় করতে হলে মন্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য।

হালাকু খানের কৃতিত্ব ও চরিত্র : হালাকু খান মধ্যযুগীয় মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রভূমি বাগদাদ নগরীর ধ্বংসকারী হিসেবে ইতিহাসে কুখ্যাত ও ধিকৃত হয়ে রয়েছেন। কিন্তু একটি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও একজন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপােষক হিসেবে তার কৃতিত্বের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। পারস্যের ইল-খানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি ইতিহাসে অক্ষয় আসনের অধিকারী হয়ে রয়েছেন। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় ও আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটিয়ে তিনি মােঙ্গলদের বিজয় পতাকা ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত প্রশস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হালাকু খানের রাজ্যসীমা আমু-দরিয়া থেকে সিরিয়া এবং ককেসাস থেকে হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার প্রতিষ্ঠিত ইল-খানি সাম্রাজ্য প্রায় এক শতাব্দীকাল স্থায়ী হয় এবং তার উত্তরাধিকারীগণ ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়ের সংযােজন করতে সক্ষম হন। হালাকু খানের কৃতিত্ব নিরূপণ করতে গিয়ে অধ্যাপক জে. এ. বয়েল বলেন, “তিনি (হালাকু খান) এবং তার উত্তরাধিকারিগণ পারস্যে একটি জাতীয় রাষ্ট্র সৃষ্টির পটভূমি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।….. একান্ত অজ্ঞাতসারে হলেও হালাকু খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশই পরে সাফাভিদের দ্বারা অনুসৃত কেন্দ্রমুখী ও জাতীয়তাবাদী নীতির পথ সুগম করে দিয়েছিল।” (জে. এ. বায়েল : The Cambridge History of Iran. পঞ্চম খণ্ড, ক্যাম্ব্রিজ, ১১৬৮, পৃ: ৫৫)। হালাকু খান একজন অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর নরপতি ছিলেন এবং সে বিষয়ে দ্বিমত পােষণ করার কোন অবকাশই নেই। কিন্তু তাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি তার প্রগাঢ় অনুরাগ ও পৃষ্ঠপােষকতার অবমূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। নাসিরুদ্দিন তুসি ও বিখ্যাত ঐতিহাসিক আতামালিক জোয়াইনি তার দরবার অলঙ্কৃত করেছিলেন। নাসিরুদ্দিন তুসি মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ ছিলেন। (বি. স্পুলার : The Cambridge Fistory of Islam. প্রথম খণ্ড, ক্যারিজ, ১৯৭০, পৃ: ১৬৪)। জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার জন্য হালাকু খানের পৃষ্ঠপােষকতায় তিনি আজারবাইজানের মারাঘা শহরে একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীব্যাপী এই মানমন্দিরটির গুরুত্ব একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীব্যাপী এই মানমন্দিরটির গুরুত্ব এতটুকুও ম্লান হয়নি। সমসাময়িক মােঙ্গল ইতিহাস রচনাকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক রাশিদুদ্দিন হালাকু খানের দর্শন শাস্ত্র, স্থাপত্য শিল্প ও রসায়ন বিদ্যার প্রতি বিশেষ অনুরাগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। (রাশিদুদ্দিন : “Jami-ut-Tawarikh” হেনরী হোয়ার্থ কর্তৃক উদ্ধৃত- History of the Mongols লন্ডন, ১৮৮৮, পৃ: ২১২)। হালাকু খান ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের প্রতি উদাসীন হলেও তার রাজ্যে সকল সম্প্রদায়ের লোকই ধর্মীয় স্বাধীনতা ভােগ করত। এদের মধ্যে খ্রিস্টানদের প্রতি তিনি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন। খুব সম্ভবত এটি হালাকু খানের ওপর তার খ্রিস্টান স্ত্রী ডােকুজ খাতুনের বিশেষ প্রভাবের ফল। ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে ৪৯ বছর বয়সে হালাকু খান মৃত্যুমুখে পতিত হন। 

আবাগা খান (১২৬৫-১২৮২ খ্রি.)

হালাকু খানের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আবাগা খান ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের ইল-খানি সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি পিতার সুযােগ্য পুত্র ছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তাকে সাহসী ও বিচক্ষণ নরপতি বলে বর্ণনা করেছেন। সিংহাসনে উপবেশন করার পর আবাগা খান আভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়ােগ করেন। তিনি সাম্রাজ্যের রাজধানী মারাঘা থেকে তাবরিজে স্থানান্তরিত করেন। আবাগা খানকে নানা প্রকার বহিঃশত্রুর মােকাবেলা করতে হয়। তার রাজত্বকালে কিপচাক সাম্রাজ্যের মােঙ্গলরা বা গোল্ডেন হোর্ড তার রাজ্য আক্রমণ করলে তিনি উপর্যুপরি দুবার তাদেরকে পরাজিত করেন। হালাকু খানের সময় গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে চরম আঘাত হানা হলেও তাদের শক্তি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়নি। ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে এই গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের সর্বশেষ ঘাটি গির্‌দ্‌-কুহ্ আবাগা খানের কাছে আত্মসমর্পণ করে। দীর্ঘ আঠার বছর অবরােধের পর মােঙ্গল বাহিনীর হাতে এই ঘাঁটির পতন হয় এবং এর পর থেকে এই সম্প্রদায় চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আবাগা খান গ্রিসসহ পূর্ব-ইউরােপীয় শক্তিগুলোর সাথে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। কিন্তু মিশর ও সিরিয়া অভিযানে তিনি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। 

হালাকু খান সেলজুক রুমের কী অবস্থা করেছিলেন তা বলা হয়েছে। এরপর হঠাৎ এশিয়া মাইনরের মোঙ্গল বিরোধী গণঅসন্তোষ দেখা দেয় এবং কয়েকজন প্রভাবশালী সেলজুক বেগ মিশরের মামলুক সালতানাতের (Mamluk Sultanate) বাইবার্সকে (Baibars, রা. ১২৬০-৭৭ খ্রি.) সেলজুক রুম আক্রমণে আমন্ত্রণ জানায়। আইনজালুতের যুদ্ধের পর থেকে মিশরের মামলুকগণ মোঙ্গলদের সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু ছিল। ফলে এই দুই শক্তির মধ্যে তিক্ততার শেষ ছিল না। সুলতান বাইবার্স তাই বিনা দ্বিধায় সেলজুক বেগদের আমন্ত্রণে সাড়া দেন এবং ১২৭৬ খ্রিস্টাব্দে এশিয়া মাইনর আক্রমণ করলেন। তখন ইল-খানি সাম্রাজ্যের খান ছিলেন হালাকু খানের জেষ্ঠ্যপুত্র আবাগা খান। বাইবার্স আলবিস্তান নামক স্থানে অবস্থানরত একটি ক্ষুদ্র মোঙ্গাল বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং কায়সারিয়া পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু মোঙ্গলদের বিরুদ্ধাচরণ করে মামলুক সুলতান বাইবার্সের সহযোগিতা করার ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করে পারওয়ানা অথবা সেলজুক সুলতান তার প্রতি সক্রিয় সমর্থন প্রদানে বিরত থাকলেন। বাইবার্স বিচক্ষণ নরপতি ছিলেন। তিনি স্থানীয় শাসন কর্তৃপক্ষের সমর্থন লাভে বঞ্চিত হয়ে কায়সারিয়ায় অবস্থান করা অথবা তার অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখা নিরাপদ মনে করলেন না। কারণ মোঙ্গল খানের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বাহিনীর আগমনে তার যাত্রাপথ পশ্চাৎদিক থেকে রুদ্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে তিনি ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে দ্রুতগতিতে মিশর প্রত্যাবর্তন করলেন।

বাইবার্স কর্তৃক এশিয়া মাইনর আক্রমণ ও মোঙ্গল বাহিনীর পরাজয়ে আবাগা খানের ক্ষোভের সীমা রইলো না। তিনি সসৈন্যে এশিয়া মাইনর আক্রমণ করলেন এবং সেলজুক তুর্কিদের বিদ্রোহ ও মামলুক সুলতানের প্রতি তাদের সমর্থনের শাস্তি স্বরূপ তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালালেন। এমনকি মোঙ্গলদের এককালীন বিশ্বস্ত ও অনুগত প্রতিনিধি পারওয়ানা নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেও এই হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেলেন না। সীমান্ত নিয়ে বিরােধ দেখা দিলে ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে মােঙ্গলদের সাথে মামলুক বাহিনীর এক প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে আবাগা খান পরাজিত হন এবং এই পরাজয়ের প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য তিনি পরবর্তী বছর আবার সিরিয়া আক্রমণ করেন। কিন্তু এবারও তিনি শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। সম্ভবত বারবার এই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আবাগা খান ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়েন এবং ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন। 

মোঙ্গল আক্রমণের ফলে এশিয়া মাইনোরের পরিণতি : আবাগা কর্তৃক সেলজুক রুমের ওপর আক্রমণের ঘটনার পর থেকে ১৩০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এশিয়া মাইনরে সেলজুক তুর্কি সুলতান তৃতীয় কায়খসরু (Kaykhusraw III, রা. ১২৬৫-১২৮৪ খ্রি.), দ্বিতীয় মাসুদ (Mesud II, রা. ১২৮৪-৯৬, ১৩০৩-৭ খ্রি.) এবং তৃতীয় কায়কোবাদ (Kayqubad III, রা. ১২৯৮-১৩০২ খ্রি.) একের পর এক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কোনরকম শাসন ক্ষমতার অধিকারীই ছিলেন না। মোঙ্গলদের অত্যাচার এবং বিশেষ করে কর সংগ্রহের ব্যাপারে তাদের কড়াকড়ি পূর্বাপেক্ষা বহুগুণে বেড়ে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এসময়ে পারস্যের ইলখানাত মোঙ্গল শক্তি হীনবল হয়ে পড়ায় এশিয়া মাইনরের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল। মোঙ্গলদের উপর্যুপরি আক্রমণের ফলে এশিয়া মাইনরে সেলজুক তুর্কি শক্তি হীনবল হয়ে পড়ে। কিন্তু এশিয়া মাইনরের মোঙ্গল শক্তির প্রাধান্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোঙ্গলগণ ইতোমধ্যেই মূল ভূখণ্ডে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পক্ষান্তরে বাইজান্টাইনগণও এশিয়া মাইনরের তৎকালীন রাজনৈতিক দুরবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। কারণ বাইজান্টাইন সম্রাটকে এসময়ে বলকান অঞ্চলে আভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়তে হয়। ফলে সম্রাটের পক্ষেও তার এশীয় রাজ্যাংশের প্রতি মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়নি। তাই এই সুযোগে এশিয়া মাইনরের পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে টার্কোম্যান গাজী আমীরগণ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং সেখানে বহু সংখ্যক স্বাধীন গাজী রাজ্য গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তুরস্কের অটোম্যান তুর্কি বংশও ছিল এই গাজী রাজ্যসমূহেরই অন্যতম একটি (The Cambridge History of Islam. প্রথম খণ্ড, ক্যামব্রিজ, ১৯৭০ পৃ: ২৬৩। আরও দ্রষ্টব্য : পি. উইটেক, The rise of the Ottoman Empire. লন্ডন, ১৯৩৮, পৃ: ৩৪)। ১৩দশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব এশিয়া মাইনরের প্রতিষ্ঠিত এসব গাজী রাজ্যসমূহের মধ্যে- (১) তেকেলি, (২) রামাজান, (৩) আদানা, (৪) জুলকাদার, (৫) মালাটিয়া, (৬) এলবিস্তান, (৭) মেন্টেসি, (৮) সারুখান, (৯) আইদিন, (১০) কারাসি, (১১) কারামানিয়া, (১২) কাস্তমুনি , (১৩) হামিদ, (১৪) জার্মিয়ান, (১৫) সিনোপ, (১৬) সেলেরি, (১৭) জান্দার, (১৮) টেক্কি , প্রভৃতির নাম উলেখ করা যেতে পারে। এই রাজ্যগুলোর নামকরণ বহু ক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে আবার কখনও বা স্থানের নামানুসারে হয়েছে। এসব গাজী রাজ্যসমূহের মধ্যে মেন্টেসি, আইদিন, কারামানিয়া ও জামিয়ান ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, অটোমানদের উত্থানের সাথে তাই মোঙ্গল আক্রমণের একটি পরোক্ষ সম্পর্ক আছে, কারণ সেলজুক রুম সালতানাতের পতনের ফলস্বরূপ অটোমানদের উত্থানের, আর মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলস্বরূপ সেলজুক রুম সালতানাতের পতন।

তাগুদার (আহমদ) (১২৮২-১২৮৪ খ্রি.)

আবাগা খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র তাগুদার সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আহমদ নাম ধারণ করেন এবং মিশরের মামলুক সুলতানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। তাগুদারের এই ধর্মান্তর ও বৈদেশিক নীতির পরিবর্তন মােঙ্গলরা সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে তার বিরুদ্ধে আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং ১২৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আততায়ীর থেকে নিহত হন। তাগুদারের পর অরঘুন (১২৮৪-৯১ খ্রি.), ঘাইকাতু (১২৯১-৯৫ খ্রি.) ও বাইদু (১২৯৫-৯৫ খ্রি.) নামক তিনজন নরপতি পারস্যের ইল-খানি সিংহাসনে উপবেশন করেন। কিন্তু এদের কেউই তেমন যােগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। অবশেষে ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে গাজান খানের সিংহাসন লাভের ফলে এই বংশের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা হয়।   

গাজান খান (১২৯৫-১৩০৪ খ্রি.)

১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে গাজান খান পারস্যের সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার শাসনকাল পারস্যের ইল-খানি বংশের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে গাজান খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণ যুগপৎ মােঙ্গল ও ইসলামের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ঐতিহাসিক ই. জি. ব্রাউন সত্যিই বলেছেন যে, “হালাকু খানের প্রপৌত্র গাজান খানের সিংহাসন লাভের ফলে মোঙ্গল পৌত্তলিকতার ওপর ইসলামের নিশ্চিত বিজয় ঘটে এবং এটি পারস্যের স্বাধীনতা পুনর্গঠনের শুভ সূচনা করে।” (ই. জি ব্রাউন : A Literary History of Persia. ক্যাম্ব্রিজ, ১৯৫৬, পৃ: ৪০) গাজান খানের পরবর্তী ইল-খানি বংশের নরপতিগণ সকলেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। গাজান খান পিকিং-কেন্দ্রিক মােঙ্গল সাম্রাজ্যের মহান খানের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন এবং ‘ইল-খান’ উপাধির পরিবর্তে কেবল খান শব্দের প্রচলন করেন। পারস্যের রাজধানী তাবরিজের সাথে পিকিং এর রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের সম্পর্কের অবসান ঘটে। এছাড়া তার মুদ্রা থেকেও তিনি মহান খানের নাম তুলে দেন এবং তার পরিবর্তে পবিত্র আল্লাহ ও তার রসূলের নাম স্থান লাভ করে। 

গাজান খানের আমলে যুদ্ধ-বিগ্রহ : গাজান খান মাত্র নয় বছর রাজত্ব করেন। এই সংক্ষিপ্ত শাসন আমলের প্রথম দিকে তাকে নানা আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন থেকে হয়। কিন্তু তিনি কঠোর থেকে এই বিশৃঙ্খলা দমন করে রাজ্য বিজয়ে মনােনিবেশ করেন। গাজান খান একজন বিখ্যাত সমরবিদ ছিলেন। কিন্তু রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি অপরাপর খানদের মতো নিষ্ঠুর নীতি অনুসরণ করেননি। মিশরের মামলুকগণ প্রথম থেকেই পারস্যের ইল-খানদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। মিশরের মামলুক সুলতান আল-নাসিরের  (১২৯৩-৯৪, ১২৯৮-১৩০৮ এবং ১৩-৯-১৩৪১) আমলে মিশরের আভ্যন্তরীণ গােলযােগের সৃষ্টি হয়। এর সুযােগ নিয়ে গাজান খানের নেতৃত্বে মােঙ্গলরা মিশর আক্রমণ করে। গাজান খান মামলুকদের বিরুদ্ধে ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে লক্ষাধিক সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে সিরিয়া আক্রমণ করেন। মােঙ্গল-বাহিনীর সাথে তাদের মিত্রশক্তি আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার সৈন্যগণও যােগদান করল। ফলে ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে হিমস এর কাছে যাম্‌মা-উল-সুরুজ নামক স্থানে উভয় বাহিনীর মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হলো। এই যুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মােঙ্গল বাহিনীর কাছে মামলুকগণ পরাজয় বরণ করে এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক সহ এর একটি বিশাল অংশ গাজান খানের অধীনে চলে আসে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই মামলুকগণ সিরিয়া পুনরুদ্ধার করেন। ফলে মোঙ্গলরা সিরিয়া পরিত্যাগ করে যেতে বাধ্য হয় এবং সমগ্র সিরিয়ায় আবার মামলুক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মােঙ্গলরা পুনরায় কুৎলুগ শাহের নেতৃত্বে সিরিয়া আক্রমণ করে। কিন্তু মােঙ্গলরা এবার মারজ-উস-সাফারের যুদ্ধে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হলো এবং গাজান খান ভগ্নোৎসাহ হয়ে তাবরিজ ফিরে গেলেন। মোঙ্গল-মামলুক সংঘর্ষের ইতিহাসে একে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। কারণ এরপর তৈমুরের আবির্ভাব পর্যন্ত প্রায় একশত বছরের মধ্যে মােঙ্গলরা আর মিশর আক্রমণ করার সাহস পায়নি। এভাবে উপর্যুপরি দুবার গাজান খানের সিরিয়া দখলের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তিনি তৃতীয়বারের জন্য সিরিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ এই সময় তার মৃত্যু হওয়ায় তার এই আশা অপূর্ণ থেকে যায়।   

মোঙ্গলদের পরবর্তী নরপতি গাজান খান তদকালীন অটোমান শাসক ওসমানের সমসাময়িক ছিলেন। বাইজান্টাইন সম্রাট ওসমানের কাছে পরাজিত হয়ে তুর্কিদের চিরশত্রু মোঙ্গলদের সাথে মিত্রতা স্থাপনের চেষ্টা করেন। সাম্রাজ্যের পূর্ব-সীমান্ত থেকে তুর্কিদেরকে আক্রমণ করার জন্য তিনি গাজান খানকে প্ররোচিত করেন। কিন্তু প্রথমত তুর্কিদের শক্তি ও দ্বিতীয়ত তারা স্বধর্মী বিধায় গাজান খান তুর্কিদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক নীতি বর্জন করেন। ফলে তুর্কি বিরোধী এই সন্ধি কার্যকর হয়নি।

গাজান খানের প্রশাসনিক সংস্কার : গাজান খান রাজ্যবিজয়ের চেয়ে স্বীয় রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি ছিলেন। সামরিক তৎপরতার চেয়ে প্রশাসন সংস্কারেই তিনি বেশি সময় ও শক্তি নিয়ােগ করতেন। ফলে বিজেতা হিসেবে তিনি তেমন সাফল্যের পরিচয় দিতে না পারলেও একজন প্রথম শ্রেণীর প্রশাসক হিসেবে তিনি পারস্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন। গাজান খানের পূর্বে রাজ্যের প্রকৃত শাসন-ক্ষমতা আমীরদের ওপর ন্যস্ত থাকত এবং তারা নিজেদের খেয়াল-খুশিমত শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। পক্ষান্তরে ইলখানি নরপতিগণ শিকার ও নানা প্রকার আমােদ-প্রামােদে ডুবে থাকতেন। ফলে শাসন ব্যবস্থায় এক শােচনীয় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এই সময় রাজস্ব বিভাগ অত্যন্ত দুর্নীতিপূর্ণ ছিল। এতদিন ধরে মােঙ্গল রাজকীয় কোষাগারের মােট আয় ও ব্যয় সম্বন্ধে নিয়মিত কোন তালিকা পর্যন্ত রক্ষা করা হত না। ফলে কেন্দ্রীয় কোষাগারে যেমন সকল রাজস্ব ঠিকমত পৌঁছতো না, অন্যদিকে এর তেমন অপচয় হত। রাজস্বখাতে এরকম ঘাটতির ফলে সৈন্যবাহিনী ও রাজকর্মচারীরা পর্যন্ত নিয়মিত বেতন পেত না। অথচ অতিরিক্ত করভারে কৃষক সম্প্রদায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়তো। এছাড়া খাজনা আদায়কারী রাজকর্মচারীদের অকথ্য অত্যাচার ও উৎপীড়নের ভয়ে অনেক সময় কৃষকরা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হত। গাজান খানের প্রধানমন্ত্রী ও বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রাশিদুদ্দিনের একটি বক্তব্যেরই প্রসঙ্গে সকলের করুণা ও হাসির উদ্রেক না করে পারে না। তিনি লিখেছেন : “কৃষকগণ অনেক সময় তাদের ঘরের ছাদ থেকে রাজস্ব আদায়কারীকে আসতে দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো। ফলে অনেকে উক্ত ছাদ থেকে সােজাসুজি রাস্তায় লাফ দিয়ে পলায়নের চেষ্টা করতে গেলে বহু ক্ষেত্রে নিজেদের পা পর্যন্ত ভেঙ্গে যেত।” (রাশিদুদ্দিন : “Juni-ut-Tiwarikh” হেনরি হােয়ার্থ কর্তৃক তার Flistory of the Mongols. শীর্ষক গ্রন্থে উদ্ধৃত, পন্ডন, ১৮৮৮, পৃ: ৪৯৭)।  গাজান খান এই অবস্থার প্রতিকারকল্পে কিছু সুষ্ঠু ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। প্রথমত, তিনি রাজ্যের সমস্ত চাষােপযােগী জমি জরিপ করিয়ে তার খাজনা নির্ধারণ করে দেন। দ্বিতীয়ত, সকল প্রকার অবৈধ কর খুলে দিয়ে তিনি প্রজাগণকে দুই কিস্তিতে খাজনা পরিশােধ করার সুযােগ প্রদান করেন। তৃতীয়ত, খাজনা আদায়কারী সরকারি কর্মচারীগণ যাতে প্রজাদের ওপর কোন প্রকার উৎপীড়ন অথবা বেআইনি খাজনা আদায় করতে না পারে তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। তার ফলে রাজস্ব বিভাগে স্থিতিশীলতা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সৃষ্টি হয়। গাজান খান ডাক বিভাগের সংস্কার ও উন্নতি সাধন করেন। ইতােপূর্বে সরকারি কর্মচারীগণ ডাকবাহী ঘোড়া ব্যক্তিগত প্রয়ােজনে ব্যবহার করত। ফলে একদিকে ডাক-বাহকের যেমন বিশেষ অসুবিধা হত, অন্যদিকে এই বিভাগের কর্মক্ষমতাও অনেকাংশে ব্যাহত হত। গাজান খান ডাক বিভাগের এই দুর্নীতি দূর করে এক বিশেষ আদেশ জারি করেন। ফলে ডাক বিভাগের উল্লেখযােগ্য উন্নতি হয়। ঠিক অনুরূপভাবে গাজান খান বিচার বিভাগকেও কলুষমুক্ত করেন। বিচারকগণ যাতে উৎকোচ গ্রহণ করে বিচারে পক্ষপাতিত্বের পরিচয় দিতে না পারেন তার ব্যবস্থা করেন। দলিল লেখক ও বিচারকমণ্ডলীর জন্য বেতনের হার নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। উৎকোচ গ্রহণের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শ্মশ্রু মুণ্ডিত করে দেয়া হত এবং গাধার পিঠে চড়িয়ে শহর প্রদক্ষিণ করানাে হত। এছাড়া গুরুতর অপরাধের জন্য এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া হত। এরকম ব্যবস্থা অবলম্বন করার ফলে গাজান খানের আমলে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে কলুষমুক্ত হয়। (হেনরি হােয়ার্থ : History of the Mongols. তৃতীয় খণ্ড, লন্ডন ১৮৮৮, পৃ: ৫২৪-২৫)।

গাজান খানের আমলে কৃষি ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। কৃষি ক্ষেত্রে তিনি বিপ্লবাত্মক সংস্কার আনয়ন করেন। মােঙ্গল অভিযানের ফলে বহু গ্রাম ও জনপদ উজাড় হয়ে যায় এবং ব্যাপক গণহত্যার ফলে ভূমিচাষীদের বিশেষ অভাব দেখা দেয়। ফলে বেশির ভাগ জমিই অকর্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে এবং কৃষি উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়। এই অবস্থার মােকাবেলা করে কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির জন্য গাজান খান তার সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন। ব্যাপক ভিত্তিতে জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করা হয় এবং কৃষকদের ওপর থেকে করের বােঝা লাঘব করে দিয়ে তাদেরকে পুনরায় কৃষিকাজে উৎসাহী করে তােলা হয়। ফলে দেশের আভ্যন্তরিণ চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য ও ফলমূল বিদেশে পর্যন্ত রপ্তানি করা সম্ভব হয়। এছাড়া রাজস্ব খাতে আয় বেড়ে পূর্বের এক কোটি সত্তর লক্ষ দিনারের পরিবর্তে গাজান খানের সময় দুই কোটি দশ লক্ষ দিনারে উন্নতী হয়। (পূর্বোক্ত: পৃ: ৫১০-১১)। গাজান খান সামরিক বিভাগেরও উন্নতি সাধন করেন। ইতােপূর্বে সৈন্যদেরকে বিভিন্ন প্রজাদের বাড়িতে বাধ্যতামূলকভাবে আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হত। এর ফলে প্রজাদের নানা প্রকার হয়রানি ও অত্যাচারের শিকার থেকে হত। সেনাবিভাগের এই কুপ্রথা তুলে দিয়ে গাজান খান তার পরিবর্তে জায়গীয় প্রথার প্রবর্তন করেন। এছাড়া ওজন ও পরিমাপের মান উন্নয়ন, মুদ্রা সকার করে খাটি ইসলামী রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ও নতুন ইল-খানি সন প্রবর্তন প্রভৃতি গাজান খানের শাসন সংস্কারের আরও বিশেষ কয়েকটি উল্লেখযােগ্য দিক। (ঐ: পৃ: ৫৩০ গাজান খান কর্তৃক প্রবর্তিত সনকে ‘ইল-খানি সন’ বলা হয়। এই সন আরম্ভ হয় হিজরি সন ১৩ ই রজব, ৭০১ এবং ইংরেজি সন ১৪ ই মার্চ, ১৩০২ থেকে।)

গাজান খানের কৃতিত্ব ও চরিত্র

১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে গাজান খান পারস্যের ইল-খানি সিংহাসনে উপবেশন করেন। তিনি ছিলেন এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। ইল-খানি বংশের দ্বিতীয় নরপতি আবাগা খানের মৃত্যুর পর এই বংশ ভীষণ সংকটের মধ্যে পতিত হয়। দুর্বল ও অযােগ্য শাসকদের অধীনে এই সাম্রাজ্য কোন প্রকার অস্তিত্ব বজায় রেখে চলছিল মাত্র। এই অবস্থায় গাজান খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং নিজ প্রতিভা ও সাংগঠনকি শক্তিবলে পারস্যের ইল-খানি সাম্রাজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করে তােলেন। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক হেনরি হােয়ার্থ তার সম্বন্ধে বলেন, “গাজান খানের সিংহাসনে আরােহণ এই সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। তিনি কেবল ইল-খানি বংশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন না, প্রতীচ্যের ইতিহাসে তিনি ছিলেন এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তি পুরুষ।” (হেনরি হােয়ার্থ : History of the Mongols. তৃতীয় খণ্ড , লন্ডন, ১৮৮৮, পৃ: ৩৯৩)। গাজান খান মাত্র নয় বছর রাজত্ব করেন। এই সংক্ষিপ্ত শাসন আমলের প্রথম দিকে তাকে নানা বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন থেকে হয়। কিন্তু তিনি কঠোর হস্তে এই বিশৃঙ্খলা দমন করেন এবং রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। গাজান খান ব্যক্তিগতভাবে একজন বিখ্যাত সমরবিদ ছিলেন। ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে মাজমা উল্-মুরুয এর যুদ্ধে মামলুক শক্তিকে পরাজিত করে তিনি তার প্রমাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা প্রতিকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার পরবর্তী অভিযানগুলো সফল হয়নি। গাজান খান রাজ্য বিজয়ের চেয়ে নিজ রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। বিজেতা হিসেবে গাজান খান তাই ব্যর্থ হলেও প্রশাসক হিসেবে তিনি পারস্যের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন। গাজান খানের পূর্বে রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার প্রতি ইল-খান নরপতিগণ বিশেষ নজর দিতেন না। ফলে শাসন ব্যবস্থার ভয়ানক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এই সময় রাজস্ব ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্নীতিপূর্ণ ছিল। এমনকি রাজকীয় কোষাগারের মােট আয় ও ব্যয় সম্বন্ধে কোন নিয়মিত হিসাব-তালিকা পর্যন্ত রাখা হত না। ফলে কেন্দ্রীয় কোষাগারে যেমন সকল রাজস্ব ঠিকমত পৌঁছতো না, অন্যদিকে এর তেমনি অপচয় হত। এভাবে রাজস্ব ঘাটতির ফলে সেনাবাহিনী ও রাজকর্মচারীগণ পর্যন্ত নিয়মিত বেতন পেত না। অথচ অতিরিক্ত কর-ভারে কৃষক সম্প্রদায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়তো। এছাড়া খাজনা আদায়কারী রাজকর্মচারীদের অকথ্য অত্যাচার ও উৎপীড়নের ভয়ে কৃষকগণ অনেক সময় গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হত। গাজান খান এই অবস্থার প্রতিকারকল্পে কিছু সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথমত তিনি রাজ্যের সমস্ত চাষােপযােগী জমি জরিপ করিয়ে তার কর নির্ধারণ করে দেন। দ্বিতীয়ত, সমস্ত প্রকার অবৈধ কর তুলে দিয়ে প্রজাগণকে দুই কিস্তিতে খাজনা পরিশােধ করার সুবিধা দেয়া হয়। তৃতীয়ত, কর আদায়কারী সরকারি কর্মচারীগণ যাতে প্রজাদের ওপর কোন প্রকার উৎপীড়ন অথবা বেআইনি কর আদায় করতে না পারে তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। এর ফলে রাজস্বখাতে স্থিতিশীলতা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সৃষ্টি হয়। গাজান খান ডাক বিভাগের সংস্কার ও উন্নতি সাধন করেন। তিনি বিচার বিভাগকে কলুষমুক্ত করেন এবং সকলেই যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ ন্যায় বিচার লাভ করতে পারে তার প্রতি লক্ষ্য রাখেন।

গাজান খানের আমলে কৃষি ব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়, ব্যাপক ভিত্তিতে কৃষিক্ষেত্রে জলসেচ ব্যবস্থার প্রর্বতন করা হয়। এর ফলে খাদ্যশয্যের প্রাচুর্য ও রাজস্ব তহবিলের আয় বহুগুণে বেড়ে যায়। গাজান খান সামরিক বিভাগেরও ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন এবং জায়গির প্রথার প্রবর্তন করেন। এছাড়া ওজন ও পরিমাপের মান উন্নয়ন, মুদ্রা সংস্কার করে খাটি ইসলামী রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ও নতুন ‘ইল-খানি সনের’ প্রবর্তন ইত্যাদি ছিল গাজান খানের প্রশাসনিক কৃতিত্বের অপর কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য দিক। গাজান খান ইসলামের একজন একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। তার প্রচেষ্টায় মােঙ্গলদের মধ্যে ইসলাম দুত প্রসার লাভ করে। কেবল গাজান খানের সঙ্গেই তার এক লক্ষ মােঙ্গল অনুসারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। (জে. ম্যালকোম : History of Persia, প্রথম খণ্ড, লন্ডন, ১৮২১, পৃ. ২৭৬। ই, জি, ব্রাউন এই সংখ্যা দশ হাজার-বলে উল্লেখ করেছেন, পূর্বোক্ত গ্রন্থ পৃ: ৪০)। তিনি ইসলামের বহু বিধান কার্যক্ষেত্রে প্রয়ােগ করেন। বস্তুত গাজান খানের ইসলাম রাজ-ধর্মের মর্যাদা লাভ করে। ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পাগড়ির ব্যবহার প্রচলন করেন। ইল খানি মুদ্রায় আল্লাহ্ ও তার রসূলের নাম স্থান লাভ করে। অতঃপর ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশেষ এক আদেশ জারি করে সুদ গ্রহণ, মদ্যপান ও বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করে দেন। সুদ প্রথা বন্ধ করে দিলে ব্যবসায়-বাণিজ্যের রাজ কোষাগারের ক্ষতি হতে পারে বলে যুক্তি দেখানাে হলে গাজান খান উত্তরে বলেন যে, তিনি অবৈধ উপায়ে টাকার আদান-প্রদান বন্ধ করতে চান। যেহেতু এটি আল্লাহ্ ও তার রসূলের নির্দেশ বহির্ভূত সুতরাং তার স্বপক্ষে কোন যুক্তিই তিনি শুনতে প্রস্তুত নন। (হেনরি হােয়ার্থ : পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃ: ৫০৩)। ইসলামের প্রতি গাজান খানের অবদানের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক হিট্টি বলেন : “ইসলামের সংস্কৃতি ধ্বংস সাধনকল্পে হালাকু খানের নৃশংস অভিযানের মাত্র পঞ্চাশ বছর পরেই তার প্রপৌত্র গাজান খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং এই বিধ্বস্ত সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন”। (পি. কে. হিট্টি : History of the Arabs-নিউইয়র্ক, ১৯৬৮, পৃ: ৪৮৮))।

গাজান খানের আমলে ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি হয়। চীন ও পশ্চিম-এশিয়ার সাথে পারস্যের বাণিজ্যিক যােগসূত্র সৃষ্টি হয়। সুদূর জেনেভা ও ভেনিস থেকে তার রাজধানী তাবরিজে বাণিজ্য উপলক্ষে বিশেষ প্রতিনিধিদল আগমন করেন। ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতিকল্পে রাস্তা ঘাট নির্মাণ করা হয় এবং পথিক ও ব্যবসায়ীগণের যাতায়াতের পথে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। গাজান খানের রাজ্যসীমা আমু দরিয়া থেকে সিরিয়া এবং ককেসাস পর্বতমালা থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং এই বিশাল সাম্রাজ্যে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করত। শাসক হিসেবে গাজান খানের সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সুদূর চীন, ভারত, মিশর, পেন ও ইংল্যান্ড থেকে তার দরবারে রাজদূত আসে। গাজান খান বিজ্ঞান-সাহিত্য ও স্থাপত্য শিল্পের একজন মস্ত বড় পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তার মতাে একজন ভাষাবিদ ও বহু শত্রে অভিজ্ঞ শাসক মধ্যযুগের বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। তিনি ইতিহাস, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র প্রভৃতিতে সুপণ্ডিত ছিলেন। এছাড়া আরবি, ফার্সি, হিন্দি, কাশ্মিরি , চীনা, তিব্বতি ও ফরাসি প্রভৃতি ভাষায় তার মােটামুটি অধিকার ছিল। (রাশিদুদ্দিন ; Jami ut-Tawarikh; হেনরি হােয়ার্থ কর্তৃক বর্ণিত। আরও দ্রষ্টব্য: ই, জি, ব্রাউন : A literary History of Persia, – তৃতীয় খণ্ড, ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৬৪ , পৃ: ৪৩)। সমসাময়িক বিখ্যাত ঐতিহাসিক রাশিদুদ্দিন বলেন যে, একজন নরপতি হয়েও গাজান খান স্বর্ণকার, কর্মকার, সুতাের-চিত্রকর প্রভৃতি কাজ সুনিপুণভাবে করতে পারতেন। এছাড়া ঘােড়ার লাগাম, জিন ও চাবুক তৈরির নৈপুণ্যে গােটা সাম্রাজ্যে তার জুটি ছিল না। গাজান খান শ্রমের মর্যাদা দিতে জানিতেন এবং অবসর অথবা যুদ্ধবিরতির সময় চিত্তবিনােদনের জন্য এই সকল কাজ করতেন। মধ্যযুগীয় একজন নরপতি হিসেবে গাজান খানের বহুমুখী প্রতিভার কথা ভাবলে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। গাজান খান একজন বিদ্যোৎসাহী নরপতি ছিলেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে তিনি বহু হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, মানমন্দির ও শিক্ষানিকেতন স্থাপন করেন। এই সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য তিনি উপযুক্ত বেতন দিয়ে সে যুগের শ্রেষ্ঠ অধ্যাপক ও বৈজ্ঞানিকদের নিযুক্ত করতেন। দেশ-বিদেশ থেকে বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি তার দরবারে আশ্রয় লাভ করেন। গাজান খানের দরবারে উপস্থিত বিদেশী রাষ্ট্রদূতগণ ও পণ্ডিত সভাসদগণ তার অপূর্ব বাচনভঙ্গি, বিভিন্ন দেশের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও পাণ্ডিত্বপূর্ণ আলােচনা শ্রবণ করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতেন। তার প্রধানমন্ত্রী রাশিদুদ্দিন তার দরবারের গৌরব বর্ধন করেছিলেন। তার লিখিত ‘জামি-উত-তাওয়ারিখ’ সমসাময়িক মােঙ্গল ইতিহাসের ওপর একখানি বিশিষ্ট গ্রন্থ। এছাড়া গাজান খানের আমলে অপর একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ছিলেন আতা মালিক জুয়াইনি। তার লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘তারিখ-ই-জাহান গুশা’ সার্বজনীন সমাদর লাভ করেছে।  গাজান খান অত্যন্ত খর্ভকায় ও কুদর্শন ছিলেন। ঐতিহাসিক ইউলির ভাষায় : “বস্তুত তার দুই লক্ষ মােঙ্গল সৈন্যদের মধ্যে এই যুবরাজের মতাে (গাজান খান) খর্বকায়, কুশ্রী ও ক্ষুদ্র দেহধারী আর কেউই ছিল না।”(এইচ. ইউলি, Cathay and the way Thither- লন্ডন – ১৮৬৬)। কিন্তু বহুমুখী প্রতিভার এমন অপরূপ সমাবেশ মধ্যযুগের আর কোন নরপতির মধ্যে কদাচিৎ পরিলক্ষিত হয়। এই ব্যাপারে তাকে ভারতের মুহাম্মদ বিন-তুঘলকের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।  ব্যক্তিগত চরিত্রের দিক থেকেও গজান খান ছিলেন সমপূর্ণরূপে কলুষমুক্ত। যে সকল অপরাধ অপরাপর মোঙ্গল খানদের বেলায় অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল তা গাজান খানকে স্পর্শও করতে পারেনি। তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী একজন আদর্শস্থানীয় শাসক। ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে গাজান খান মৃত্যুবরণ করেন। প্রজাসাধারণের কাছে তিনি এতই প্রিয় ছিলেন যে তার এই আকস্মিক ও অকাল মৃত্যুতে তারা গভীর শােকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে। গাজান খানের রাজত্বকাল সংক্ষিপ্ত হলেও বিভিন্ন দিক বিচার করে তার আমলকে পারস্যের মােঙ্গল ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরবােজ্জ্বল যুগ বলে আখায়িত করা যায়। 

উলজাইতু খান (১৩০৪-১৩১৬ খ্রি.)

গাজান খানের মৃত্যুর পর তার ভাই উলজাইতু সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি প্রথমে খ্রিস্টধর্মে ও পরে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। কিন্তু সিংহাসনে আরােহণের পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মুহম্মদ খুদাবান্দা (সৌভাগ্যবান) নাম ধারণ করেন। গিলান বিজয় ও চাগতাই মােঙ্গলদের খােরাসান অভিযান ব্যর্থ করে দেয়া উলজাইতুর কৃতিত্বের অন্যতম উল্লেখযােগ্য ঘটনা। উলজাইতু মিশরের মামলুকদের সাথে মােঙ্গলদের মধ্যকার পূর্ব শত্রুতা পুনরুজ্জীবিত করে তােলেন। তিনি মামলুকদের বিরুদ্ধে পশ্চিম ইউরােপীয় শক্তিবর্গের সাথে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবে তিনি উল্লেখ করেন যে, খ্রিস্টান শক্তিবর্গ মামলুকদের বিরুদ্ধে তাকে সক্রিয় সাহায্য করলে তার বিনিময়ে তিনি তাদেরকে প্যালেস্টাইন ছেড়ে দেবেন। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে পশ্চিম-ইউরােপীয় শক্তিবর্গ উলজাইতুর এই সামরিক চুক্তির প্রস্তাবে সাড়া দিতে সক্ষম হয়নি। ফলে উলজাইতু নিজেই মামলুকদের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নিলেন। ১৩১২ খ্রিস্টাব্দে কারাসজুর আল আফরানের নেতৃত্বে কয়েকজন মামলুক বিদ্রোহী আমীর মােঙ্গল দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এই দুইজন মামলুক বিদ্রোহী নেতা যথাক্রমে দামেস্ক ও ত্রিপলির গভর্নর ছিলেন। উলজাইতু খান এদেরকে আশ্রয় প্রদান করেন এবং তাদেরকে যথাক্রমে মারাঘা ও হামাদানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। এই বিদ্রোহী আমীরদ্বয়ের প্ররােচনা ও উৎসাহের ফলে উলজাইতু অবশেষে ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার রাবাত-আল শাম দুর্গটি অবরােধ করেন। কিন্তু মামলুক সৈন্যগণ বীরত্বের সঙ্গে মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করে দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে উলজাইতু তার এই অবরােধ তুলে লইতে বাধ্য হন। এভাবে অর্ধ-শতাব্দীব্যাপী মোঙ্গলদের সিরিয়া বিজয়ের প্রচেষ্টা উলজাইতুর সময়ে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল। উলজাইতুর পরে আর কোন মােঙ্গল নরপতি সিরিয়া বিজয়ের চেষ্টা করেননি।  উলজাইতুর মধ্যে তার ভাই গাজান খানের যােগ্যতা ও চারিত্রিক গুণাবলী না থাকলেও তিনি শিল্পকলার একজন উদার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তার ইচ্ছানুসারে তার প্রধানমন্ত্রী ও ঐতিহাসিক রাশিদুদ্দিন তারিখ-ই-গজনির দ্বিতীয় খণ্ড রচনা আরম্ভ করেন। তবে একজন নির্মাতা হিসেবেই উলজাইতু বেশি কৃতিত্বের দাবিদার। তিনি সুলতানিয়া নগরসহ বিসিতুন পর্বতের পাদদেশে ‘সুলতানাবাদ চামচিমল’ নামক সাম্রাজ্যের একটি দ্বিতীয় রাজধানী নির্মাণ করেন। উলজাইতু খানের আমলে রাস্তার প্রতি এক মাইল অন্তর স্তম্ভ বসানাে হয়। তিনি ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। 

আবু সাঈদ (১৩১৬-১৩৩৫ খ্রি.)

উলজাইতুর পর তার কিশাের পুত্র আবু সাইদ মাত্র বার বছর বয়সে পারস্যের সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি ছিলেন ইল খানি বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি এবং মােঙ্গলদের মধ্যে একমাত্র খাটি ইসলামী নামধারী শাসক। তার রাজত্বের প্রথম দশ বছরকে মােটামুটিভাবে সাফল্যের যুগ বলে বর্ণনা করা যায়। এর জন্যে তিনি অবশ্য তার মন্ত্রী সেবানের কাছে বিশেষভাবে ঋণী ছিলেন। তার সক্রিয় সহযােগিতায় আবু সাঈদ দক্ষিণ রাশিয়ার গােল্ডেন হাের্ড ও মধ্য-এশিয়ার চাগতাই মােঙ্গলদের পারস্য আক্রমণ সাফল্যের সাথে প্রতিহত করেন। এছাড়া ১২২৩ খ্রিস্টাব্দে আবু সাঈদ মিশরের মামলুক সুলতানদের সাথে বিদ্যমান দীর্ঘকালীন শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে শান্তি স্থাপন করেন।  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আবু সাঈদের শাসন আমলের শেষার্ধে আমীরদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দেয়। দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী রাশিদুদ্দিন ও অপর মন্ত্রী আলী শাহের মধ্যে নানা কারণে মনােমালিন্যের সৃষ্টি হয়। বস্তুত উভয়ের মধ্যকার এই কলহ উলজাইতুর আমলেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই কলহ এক পর্যায়ে এতই তীব্র আকার ধারণ করে যে উলজাইতু বাধ্য হয়ে সাম্রাজ্যকে দুই অংশে বিভক্ত করে তার কলহমান দুই মন্ত্রীকে দুই অংশের গভর্নর নিযুক্ত করেন। কিন্তু এর ফলে সাময়িকভাবে এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটলেও আবু সাঈদের আমলে এটি তীব্রতর হয়ে দেখা দেয়। ফলে মন্ত্রী আলী শাহের প্ররােচনায় আবু সাঈদ তার সুযােগ্য মন্ত্রী রাশিদুদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। রাশিদুদ্দিন দীর্ঘকাল যাবৎ যে যােগ্যতা ও বিশ্বস্ততার সাথে ইল-খানি বংশের সেবা করে আসছিলেন তার তুলনা হয় না। কিন্তু হঠাৎ আবু সাঈদের বিরাগভাজন হয়ে তার মৃত্যু হওয়ায় এই সাম্রাজ্যের শান্তি ও সংহতি বিশেষভাবে বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। এছাড়া এই সময় নানা কারণে আমীর সেবানও আবু সাঈদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন এবং অবশেষে বাধ্য হয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। কিন্তু আবু সাঈদের কাছে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। আবু সাঈদের সিংহাসন লাভের পেছনেও তার প্রাথমিক সাফল্যের জন্য আমীর সেবানের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। সাম্রাজ্যে অভ্যন্তরীণ শান্তি ফিরিয়ে আনতে এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে আমীর সেবান বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু আবু সাঈদ ক্রোধান্ধ হয়ে তার সমস্ত অবদানের কথা ভুলে গেলেন এবং তাকে হত্যা করলেন। আমীর সেবান ও রাশিদুদ্দিনের মৃত্যুতে পারস্যের ইল-খানি সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়ে। ইবনে তাঘ্‌রি বিরদি আবু সাঈদের গুণাবলীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, “তিনি (আবু সাঈদ) সাহসী প্রতিভাশালী, সুদর্শন, দানশীল ও বিচক্ষণ যুবরাজ ছিলেন।” (ইবনে তাবরি বিরদি : History of Egypt. (ইংরেজি অনুবাদ : ডব্লিউ, পপার) লস্ এঞ্জেলস্‌, ১৯৫৪)। মােঙ্গলীয়, আরবি ও চীনা ভাষায় তার হস্তলিপি অত্যন্ত সুন্দর ছিল। এছাড়া আবু সাঈদ একজন উন্নত মানের কবি ও সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। তিনি পরধর্মের প্রতি উদার ও সহনশীল মনােভাব পােষণ করতেন। খ্রিস্টধর্মাবলখীরা তার আমলে বিশেষ সুযােগ-সুবিধা ভােগ করত। কিন্তু তা সত্ত্বেও একমাত্র গাজান খান ছাড়া অপরাপর মোঙ্গল খানদের মতো তার চরিত্রও দোষমুক্ত ছিল না। শঠতা, নিষ্ঠুরতা ও নারীর প্রতি আসক্তি তার চরিত্রকে কলুষিত করেছিল এবং অবশেষে এই নারীঘটত ব্যাপারই তার জীবদ্দশাতে সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে দিয়েছিল। আবু সাঈদ তার প্রধানমন্ত্রী চুপানের অন্যত্র বিবাহিতা কন্যাকে নিজে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব করেন এবং জোরপূর্বক তাকে অপমান করেন। মন্ত্রী চুপান এতে অস্বীকৃতি জানালে আবু সাঈদের সাথে তার মনােমালিন্যের সৃষ্টি হয় এবং তার পরে চুপানের মৃত্যুও ইল-খানি বংশের পতনের কারণ হয়ে পাড়ায়।  ১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে আবু সাঈদ নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে পারস্যের ইল-খানি বংশের গৌরব-রবি অস্তমিত হয়। তার উত্তরাধিকারীগণ সকলেই দুর্বল ও অযােগ্য ছিলেন এবং তাদের আমলে সাম্রাজ্য দ্রুত ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হয়। ১৪শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্থে পারস্যের ইল-খানি সাম্রাজ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং এই সকল রাজ্যের মধ্যে প্রবল আত্মকলহের সৃষ্টি হয়। অবশেষে এই সময় তৈমুরের আবির্ভাব ঘটে এবং তিনি পারস্যের ইল-খানি সামাজ্যের ধ্বংসস্তুপের ওপর নতুন তৈমুরীয় বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

ইল-খানি বংশের পতনােত্তর যুগে পারস্যের ইতিহাস

ভূমিকা

পারস্যের ইল-খানি বংশের পতনের ফলে উচ্চাভিলাষী ও সুযােগ-সন্ধানী টার্কো-মােঙ্গল যুবরাজদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য প্রবল গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। ফলে পারস্য ও মধ্য এশিয়ার ওপর অনেকগুলো স্বাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে জালায়েরি বংশ (১৩৩৬-১৪১১ খ্রি.), মুজাফফারীয় বংশ (১৩১৩-১৩৯৩ খ্রি.), কুর্ত বংশ (১২৪৫-১৩৮৯ খ্রি.), সারবাদারি বংশ (১৩৩৭-১৩৮১ খ্রি.), কারা কুয়ুনলু বংশ (১৩৬৯-১৩৭৮ খ্রি.) এবং আক্‌ কুয়ুনলু বংশ (১৩৭৮-১৫০২ খ্রি.) প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

জালায়েরী বংশ (১৩৩৬-১৪১১ খ্রি.)

পারস্যের ইল-খানি বংশের সর্বশেষ নরপতি আবু সাঈদের মৃত্যুর পর আমীর হুসেন জালায়েরের নেতৃত্বে এই জালায়েরি বংশের উন্মেষ ঘটে। শেখ হাসান বুজর্গ ছিলেন এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইরাক দখল করেন এবং বাগদাদ তার রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। তিনি ইল-খানি বংশের তিনজন নামসর্বস্ব খানকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রেখে রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা নিজেই হস্তগত করেন। বর্তমান ইরাক, আজারবাইজান, ইরানের উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং সিরিয়ার কিছু অংশ নিয়ে ১৩৩৫-১৪৩২ সাল পর্যন্ত জালায়রিদ রাজ্য টিকে ছিল। এর রাজধানী ছিল ১৩৩৫-১৩৫৮ সালে বাগদাদ, ১৩৫৮-১৩৮৮ সালে তাবরিজ (বর্তমান ইরানে), ১৩৮৮-১৪১১ সালে পুনরায় বাগদাদ (বর্তমান ইরাকে), এবং ১৪১১-১৪৩২ সালে বসরা (বর্তমান সিরিয়ায়)। মুহম্মদ, তুঘা-তিমুর ও জাহান-তিমুর এই তিনজন ছিলেন শেখ হাসান বুজর্গ কর্তৃক বাগদাদের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত নামসর্ব ইল-খান নরপতি। তিনি দীর্ঘ ত্রিশ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার আমলে চুবানি আমীরদের সাথে তার সংঘর্ষ বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা। শেখ হাসান বুজর্গের মৃর্তর পর তার পুত্র ওয়ারেস খান ১৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের জালায়েরি সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি একজন বিশিষ্ট সমরবিদ ছিলেন। তার আমলে গােল্ডেন হাের্ডের খানদের অধিকার থেকে তিনি আজারবাইজান ও তাবরিজ পুনরুদ্ধার করেন। অতঃপর ১৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মসুল ও দিয়েরবেকির অধিকার করতে সক্ষম হন এবং তার রাজ্য-সীমা বহুগুণে সম্প্রসারিত হয়। ওয়ারেস খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র হুসাইন ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। তিনি মুজাফফরীয় এবং ‘কৃষ্ণ মেষ বংশের’ সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং এক পর্যায়ে কৃষ্ণ মেষ বংশকে তার বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। দীর্ঘ সতের বছর রাজত্ব করার পর ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে ওয়ারেস খান তার দুই পুত্র সুলতান আহমদ ও বায়েজীদের ওপর রাজ্যভার অর্পণ করেন। সুলতান আহমদ ইরাজ ও আজারবাইজানের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন এবং বায়েজীদের ওপর অর্পিত হয় কুর্দিস্তানের শাসনভার। ভাই শেইখ হুসেইন জালায়িরের ষড়যন্ত্র নস্যাত করার মাধ্যমে সুলতান আহমাদ (রা. ১৩৮২-১৪১০ খ্রি.) ক্ষমতায় আসেন। তাকে আরদাবিলের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। ১৩৮২ সালে তিনি আরদাবিল থেকে প্রস্থান করে তাবরিজ দখল করেন, এবং হুসাইনকে বন্দী করে হত্যা করেন। শেইখ আলী ও বায়জীদ তার বিরুদ্ধে যান। হুসাইনের প্রাক্তন আমির আদিল আকার কথায় বায়জীদ নিজেক সোলতানিয়ার সুলতান দাবি ঘোষণা করেন, এবং শেইখ আলী বাগদাদ ত্যাগ করে তাবরিজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। নিজেকে স্বজনদের বিরুদ্ধ্বে রক্ষা করার জন্য সুলতান আহমাদ কারা কুনলুর তুর্কমেনদের সাহায্য নেন। তুর্কমেনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শাইখ আলী পরাজিত হন, দুই বছরের মধ্যে সুলতান আহমাদ বায়জিদকেও নিউট্রালাইজ করেন।

১৩৮৪ সালে তৈমুর জালায়রিদদের আক্রমণ করেন। এতে তদকালীন জালায়রিদ শাসক সুলতান আহমাদকে বন্দী করা সম্ভব হয়নি, তিনি পালিয়ে যান। তার অধীনস্তরা সোলতানিয়া প্রতিরক্ষা করতে ব্যর্থ হন এবং তৈমুর প্রায় বিনা বাধাতেই নগরটি দখল করে। এরপর তৈমুর আদিল আকাকে নগরের দায়িত্বে রেখে অভিযান থেকে ফিরে আসেন। এদিকে তৈমুরের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১৩৮৫ সালে গোল্ডেন হোর্ডের খান তোখতামিশ জালায়রিদ রাজ্যে আক্রমণ করেন। ইরানের উত্তর পশ্চিম দিকে আজারবাইজান ও তাবরিজে আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। সুলতান আহমেদ এর ফলে বাগদাদে পালিয়ে যান। এই আক্রমণের ফলে সুলতান আহমাদ দুর্বল হয়ে যান। আর-রাই ও সুলতানিয়া দখল করে তৈমুর সমরখন্দে প্রত্যাবর্তন করেন। এরফলে ১৩৮৬ সালে তৈমুর লং পুনরায় জালায়রিদ আক্রমণ করলে তিনি তা প্রতিহত করতে পারেননি। তৈমুর এর ফলে তাবরিজ নিয়ে নেন এবং তাবরিজের নাগরিকদেরকে ভারি নজরানা দিতে হয়। আদিল আকা এই নজরানা গ্রহণ করেন, কিন্তু তৈমুর তাকে দুর্নীতিবাজ সন্দেহে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এভাবে ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর আজারবাইজান ও জর্জিয়া অধিকার করেন এবং গিলান ও শিরওয়ানের যুবরাজদ্বয়ও তার বশ্যতা স্বীকার করেন। এরপর থেকে আজারবাইজান তৈমুরের নিয়ন্ত্রণেই ছিল, কারণ আহমাদ আর এটি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। ১৩৯৩ সালে পুনরায় তৈমুর জালায়রিদ রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এর মধ্যে তৈমুর একে একে সমস্ত দক্ষিণ-পারস্য, আর্মেনিয়া, বাগদাদ, মেসােপটেমিয়া ও দিয়েরবেকির পদানত করে ফেলেছেন। ঐ সময় আহমাদ বাগদাদে ছিলেন। আগস্টের শেষের দিকে তৈমুর বাগদাদে পৌঁছেন, যেখানে সুলতান আহমদ অবস্থান করছিলেন। তৈমুরের হাত থেকে বাগদাদকে বাঁচানো অসম্ভব বিবেচনা করে তিনি মিশরের মামলুক অধীনস্ত সিরিয়ায় পালিয়ে যান এবং তদকালীন মামলুক শাসক সুলতান বারকুকের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদিকে তৈমুর বাগদাদকে ভারি প্রায়শ্চিত্ত দিতে বাধ্য করা হয় ও অনেক বন্দিকে সাথে নিয়ে যাওয়া হয়, যার মধ্যে আহমাদের পুত্র আলা আল দৌলাও ছিলেন। তবে বাগদাদ নগরের বেশিরভাগ অংশেরই কোন ক্ষতি করা হয়নি। খাজা মাসুদ সাবজাভারি নামে একজন সারবাদারকে নগর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে তৈমুর সমরখন্দ প্রত্যাবর্তন করলে ১৩৯৪ সালে সুলতান আহমাদ বাগদাদে ফিরে আসেন। মামলুক সুলতানের সাহায্য ও সহযােগিতায় সুলতান আহমদ বাগদাদ অধিকার করতে সমর্থ হন, খাজা মাসুদ যুদ্ধের বদলে পশ্চাদপসরণ করেছিলেন। ফলে পরবর্তী ছয় বছরের জন্য আহমাদ বাগদাদের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। সাময়িকভাবে হলেও ইরাকের জালায়েরি বংশের পূর্বগৌরব ফিরে আসে। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। ১৩৯৭ ও ১৩৯৮ সালে তার বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ ষড়যন্ত্র পরিচালনা করা হয়। এরফলে বাগদাদে থাকাকে অনিরাপদ মনে করে তিনি নগর থেকে পালিয়ে যান এবং কারা কুনলু বা কৃষ্ণ মেষের কারা ইউসুফের সহায়তা কামনা করেন। কারা কুনলুর তুর্কমেনরা নগরে আসে, কিন্তু তারা লুণ্ঠনকার্য চালায়, ফলে সুলতান আহমেদ তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। এর মধ্যে তৈমুর তার জালায়রিদদের থেকে তার অধিকৃত আজারবাইজানের গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন তার পুত্র মিরান শাহকে। ১৩৯৮ সালে মিরান শাহ বাগদাদ দখল করার চেষ্টা করলে সুলতান আহমাদ তাকে প্রতিহত করেন। ১৩৯৯ সালে একজন জর্জিয়ান আলেনজাক নগর অবরোধ করেন, এই নগরটিকে প্রায় এক দশক ধরে তিমুরিদরা দখল করার চেষ্টা করে আসছিল। এই জর্জিয়ান সেনাবাহিনীর নেতা ছিলেন আহমেদেরই এক পুত্র। তিনি বাগদাদে এসে বিদ্রোহ করেন, কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়।

যাই হোক, ১৩৯৮ সাল থেকে তৈমুর তার দিল্লী অভিযানে ছিলেন। ১৪০০ সালে তিনি ফিরে আসেন। এবার সুলতান আহমাদ তৈমুরের পুনরায় বাগদাদ আক্রমণের কথা ভেবে ভীত হয়ে ওঠেন, এবং বাগদাদ থেকে পালিয়ে যান। কিছুকালের জন্য তিনি ফিরে আসেন, কিন্তু আবার অটোমানদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৪০১ সালের মে মাসে তৈমুর বাগদাদ দখলের উদ্দেশ্যে সৈন্য পাঠান। কিন্তু তাদেরকে প্রতিহত করা হয়। এরপর তৈমুর সেখানে আরও সৈন্য পাঠান। কিন্তু তাও বাগদাদ দখল করা যায়নি। এরফলে তৈমুর নিজে বাগদাদে এসে আক্রমণ করেনে এবং আরও ৪০ দিন ধরে বাগদাদ অবরোধ করার পর বাগদাদ দখল করা সম্ভব হয়। বাগদাদ দখল করার পর এর প্রায় সকল পুরুষ,নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয় ও বেশিরভাগ পাবলিক বিল্ডিংকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এই ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ এতই বিপুল ছিল যে তৈমুর বাগদাদে পুনরায় নতুন গভর্নর নিযুক্ত করার প্রয়োজনই বোধ করেননি। এর কিছুদিন পর সুলতান আহমাদ আবার বাগদাদে ফিরে আসেন এবং নগরের পুনর্গঠনে হাত দেন। তৈমুরের সৈন্যদের একটা অংশ তাকে বন্দী করে, কিন্তু ১৪০২ সালে কয়েক মাস পর কারা কুনলুর শাসক কারা ইউসুফের সাথে তিনি ফিরে আসেন, যিনি নিজেও অটোমানদের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তবে তাদের বন্ধুত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, এবং কারা ইউসুফ তাকে বাগদাদ থেকে বহিষ্কার করেন। এরপর দ্বিতীয়বারের মতো সুলতান আহমাদ মামলুকদের মিশরে পলায়ন করেন। তৈমুরের ভয়ে তিনি নিজেকে বন্দী করে রাখেন। ১৪০৩ সালে তৈমুরের সৈন্যরা বাগদাদে আক্রমণ করে কারা সেখানকার তদকালীন শাসক কারা ইউসুফকে বিতাড়িত করে। তিনিও মামলুক মিশরে পালিয়ে যান, ও সুলতান আহমাদের সাথে নিজেকে বন্দী করে রাখেন। দুই বন্দীতে মিলে নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব পুনরায় নবায়ন করেন। তারা চুক্তিবদ্ধ হন যে সুলতান আহমাদ ইরাক গ্রহণ করবেন ও কারা ইউসুফ গ্রহণ করবেন আজারবাইজান। এছাড়া তাদের চুক্তি অনুসারে সুলতান আহমদ কারা ইউসুফের শিশুপুত্র পীরবুদাগকে দত্তক গ্রহণ করেন। ১৪০৫ সালে তৈমুরের মৃত্যুর পর তদকালীন মামলুক সুলতান নাসির আদ-দিন ফারাজ সুলতান আহমাদ ও কারা ইউসুফকে মুক্ত করে দেন। এরপর সুলতান আহমাদ বাগদাদ ও কারা ইউসুফ তাবরিজে ফিরে যান। তবে কারা ইউসুফ ও সুলতান আহমাদের মধ্যকার চুক্তি বেশিদিন টেকেনি। সুলতান আহমাদ মনে মনে জালায়রিদ রাজ্যের পুরনো অংশ আজারবাইজান পুনর্দখল করতে চাইতেন। তাই তিনি কারা কুনলুতে আক্রমণ করলেন। অল্প সময়ের জন্য তিনি তাবরিজ অধিকার করতে সক্ষম হন। কিন্তু ১৪১০ সালের ৩০শে আগস্ট কারা ইউসুফ তাকে পরাজিত করেন। তাকে বন্দি করা হয়, এবং তার দত্তক গ্রহণ করা কারা ইউসুফের ৭ বছরের বায়োলজিকাল সন পীরবুদাগকে পরিত্যাগ করতে ও কারা ইউসুফের আরেক পুত্র শাহ মুহম্মদকে বাগদাদের শাসনকর্তা নিয়োগ করতে বাধ্য করা হয়। পরের দিন বিস্তাম বেগের প্ররোচনায় কারা ইউসুফ তাকে হত্যা করেন। এদিকে তিমুরিদরা সুলতান আহমের পুত্র আলা-উদ-দৌলাকে ছেড়ে দেয়, তাকেও হত্যা করা হয়। সুলতান আহমাদের ভ্রাতুস্পুত্র শাহ ওয়ালাদ জালায়ির কিছুকালের জন্য বাগদাদ শাসন করেন, কিন্তু পরের বছর ১৪১১ সালে কারা কুনলু বাগদাদও দখল করে নেয়, ফলে জালায়রিদরা ইরাকের আরও দক্ষিণে সংকুচিত হয়ে যায় যেখানে তান্ডু নাম্নী শাহ ওয়ালাদের বিধবা পত্নী হিল্লাহ, ওয়াসিত ও বসরা নগর শাসন করতেন। তিনি তৈমুরের পুত্র ও উত্তরাধিকারী শাহরুখের অধীনতা স্বীকার করে নিজ ক্ষমতা সুদৃঢ় করেন। তাণ্ডু অপুত্রক ছিলেন। ফলে তার মৃত্যুর পর তার সৎপুত্র দ্বিতীয় ওয়ারেস ও মুহম্মদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। এরপর ১৪২৮-৩২ সালে কারা কুনলু বা কৃষ্ণ মেষ বংশের হাতে তাদের পরাজয় ও মৃত্যুর ফলে জালায়েরি শাসনের শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত মুছে যায়। (হেনরি হোয়ার্থ : History of the Mongols, লন্ডন, ১৮৮৮, তৃতীয় খণ্ড, পৃ: ৫৪, এবং উইকিপিডিয়া এর “Ahmad Jalayir” নিবন্ধ)।

মুজাফফরীয় বংশ – ফার্স, কিরমান ও কুর্দিস্তান (১৩১৩-১৩৯৩ খ্রি.)

মুজাফফরীয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আর শরাফুদ্দিন মুজাফফার। তার পিতার নাম জালালুদ্দিন মনসুর এবং পিতামহের নাম গিয়াসুদ্দিন আলহাজী। মুজাফফারের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন আরবের অধিবাসী। পরে তারা খােরাসানে এসে বসতি স্থাপন করে। শরাফুদ্দিন মুজাফকারের নামানুসারে এই বংশ মুজাফফারী বংশ বলে ইতিহাসে পরিচিত। মুজাফফার ইল-খান মোঙ্গলদের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন এবং নিজ প্রতিভাবলে ইস্পাহানের দূরবর্তী মায়বুদ প্ৰদশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। মুজাফফারের মৃত্যুর পর তার সুযােগ্য পুত্র মুবারিজুদ্দিন ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে পিতৃপদে বহাল হন। বস্তুত তিনিই ছিলেন এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা এবং তার আমলেই এই বংশের প্রতিপত্তি ও গৌরব বৃদ্ধি পায়। তিনি সর্বশেষে ইল-খান নরপতি আবু সাঈদের কাছ থেকে ১৩১৯ খ্রিস্টাব্দে ইয়াজ্দ‌ এর শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে সুদীর্ঘ সংগ্রামের পর তিনি আবু ইসহাক ইনজুকে পরাজিত করে কিরমান দখল করতে সক্ষম হন। অতঃপর ১৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিরাজসহ সমগ্র ফার্স প্রদেশ দখল করেন এবং ১৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইস্পাহানও তার পদানত হয়। কিন্তু তিনি পরবর্তী বছর তাবরিজ আক্ৰমণ করতে অগ্রসর হলে তার পুত্রগণ বিদ্রোহী হয়ে তাকে বন্দি করে এবং ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাদের হাতে নিহত হন। এভাবে দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল তিনি মুজাফফারীয় বংশের শাসনদণ্ড পরিচালনা করেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি। মুবারিজুদ্দিনের মৃত্যুর পর জালালুদ্দিন শাহ শুজা ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে উপবেশন করেন। তার আমলে তাবরিজ ও বাগদাদ মুজাফফারীয়দের হস্তগত হয়। জালালুদ্দিন শিক্ষা ও সংস্কৃতির একজন বড় পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। পারস্যের মহাকবি হাফিজ তার দরবার অলঙ্কৃত করেন। বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ “দিওয়ানের” রচয়িতা হিসেবে হাফিজ বিশ্ববরেণ্য হয়ে রয়েছেন। শাহ সুজা তাবরিজে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং এই প্রতিষ্ঠানটি তৎকালীন মধ্য-এশিয়ার অন্যতম প্রধান শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়। এছাড়া ‘পা মিনার’ নামক একটি চমৎকার মসজিদ তৈরির জন্যও তার রাজত্বকাল বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে রয়েছে। শাহ সুজা আরবি ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং তিনি স্বয়ং কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেও বিশেষ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। দীর্ঘ সাতাশ বছর রাজত্ব করার পর ১৩৮৪ খ্রিস্টাব্দে শাহ সুজা মৃত্যুমুখে পতিত হন। শাহ সুজার মৃত্যুর পর তার পুত্র জয়নুল আবেদিন সিংহাসনে উপবেশন করেন। তিনি মাত্র তিন বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার পিতা শাহ সুজা তৈমুরের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বয়সে নবীন হলেও জয়নুল আবেদিন তেজস্বী নরপতি ছিলেন। তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন না। তিনি তৈমুরের বশ্যতা অস্বীকার করে তার প্রেরিত দূতকে বন্দি করে রাখলেন। ফলে তৈমুরের প্রবল আক্রমণের মুখে তাবরিজ ও ইস্পাহান ধ্বংসস্থূপে পরিণত হল। জয়নুল আবেদিন ১৩৮৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর শাহ ইয়াহিয়া, সুলতান আহমদ ও শাহ মনসুর যথাক্রমে ইয়াজ্দ‌, কিরমান ও ইসপাহানের শাসনভার নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিলেন। তারা ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত মুজাফফারীয় বংশ শাসন করেন। এই সময় তৈমুর পুনরায় সসৈন্যে সিরাজে উপস্থিত হলে মনসুর বীরবিক্রমে তার গতিপথ রুদ্ধ করে দাড়ান। এমনকি অল্পের জন্য মনসুরের অতর্কিত আক্রমণের হাত থেকে তৈমুর প্রাণে রক্ষা পান। (পি, সাইকস : A History of Persia. লন্ডন ১৯২১, পৃ: ১১৭)। কিন্তু অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও মনসুর অবশেষে পরাজিত ও নিহত হন এবং এই সঙ্গেই মুজাফফারীয় বংশের চির অবসান ঘটে। 

কুর্ত বংশ (১২৪৫-১৩৮৯ খ্রি.)

ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কুর্ত জাতির আফগানিস্তানের ঘুর অঞ্চলের অধিবাসী। এই বংশের জনৈক রুক্নু‌দ্দিন মােহাম্মদ ঘুরীর জামাতা ছিলেন। রুনুদ্দিনের পুত্র সামসুদ্দিন ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দে হেরাতের কুর্ত বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১২৪৫ থেকে ১২৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবৎ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। পারস্যের ইল-খান নরপতিদের অনুগ্রহভাজন হয়ে তিনি হেরাত, মার্ভ, কাবুল ও সিস্তানের শাসনকর্তা পদ লাভ করেন। এরপর ফখরুদ্দিন হেরাতের কুর্ত বংশীয় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন (১২৮৫ ১৩০৮ খ্রি.)। তিনি ইল-খান অধিপতি গাজান খানের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। বিদ্রোহী নেতা নওরােজকে তার হস্তগত করে ফখরুদ্দিন গাজান খানের অনুগ্রহ লাভে সক্ষম হন। ফখরুদ্দিনের পর এই বংশের গিয়াসুদ্দিন (১৩০৮-১৩২৮ খ্রি.), – দ্বিতীয় সামসুদ্দিন (১৩২৮-১৩২৯ খ্রি.), হাফিজ (১৩২৯-১৩৩১ খ্রি.), মুইজুদ্দিন (১৩৩১-১৩৭০ খ্রি.) এবং গিয়াসুদ্দিন পীর আলী (১৩৭০-১৩৮৯ খ্রি.) পর্যায়ক্রমে হেরাত শাসন করেন। পারস্যের মোঙ্গল শক্তি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ার সুযােগে কুর্ত বংশের নরপতিগণ তাদের ক্ষমতা দীর্ঘ দেড়শো বছর স্থায়ী করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর পারস্য আক্রমণ করেন। খােরাসান অধিকার করাই তার প্রধান লক্ষ্য ছিল। খােরাসানের কুর্ত বংশীয় শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিন পীর আলী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তৈমুরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। খােরাসান তৈমুরের হস্তগত হলে ধীরে ধীরে ১৩৮১ সালের মধ্যে কাবুল, কান্দাহার ও হেরাত তৈমুরের অধীনে চলে আসে। এরপর তৈমুর কালাত-ই-নাদিরি ও তুরশিস দুর্গ দুটি অবরােধ করেন। প্রবল প্রতিরােধের পর অবশেষে এই দুর্গ দুটি তৈমুরের হস্তগত হয় এবং সিস্তানও তৈমুরের রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ আট বছর তৈমুরের অধীনে করদ রাজ্য হিসেবে থাকার পর ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে কুর্ত রাজ্য তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। প্রধান কুর্ত নরপতিগণের বীরত্ব, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং বিশেষ করে তাদের ক্ষমতার উৎস হেরাতের দুর্গটি দুর্গম স্থানে অবস্থিত হওয়ার ফলেই কুর্ত বংশের রাজত্ব এত দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল।

সারবাদারি বংশ (১৩৩৭-১৩৮১ খ্রি.)

সারবাদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুর রাজ্জাক বিন-ফজল। তিনি খােরাসানের অন্তর্গত বাশতিন গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। আবদুর রাজ্জাক পারস্যের সর্বশেষ ইল-খানি নরপতি আবু সাঈদের অধীনে চাকরি করতেন। তিনি ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে খােরাসানের ইল-খানি প্রাদেশিক শাসনকর্তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে পরিচালিত এই বিদ্রোহীগণ ‘সার-বাদার’ (অর্থাৎ মস্তক অথবা কিছুই নয়) নাম ধারণ করেন এবং এটি থেকেই সারবাদার বংশের নামের উৎপত্তি। এই বিদ্রোহীগণ সাবজাওয়ার এবং সেই সঙ্গে খােরাসানের আরও কয়েকটি জেলা অধিকার করতে সমর্থ হয়। এছাড়া সাময়িকভাবে হেরাত ও নিশাপুর তাদের পদানত হয়। সারবাদার নরপতিগণ প্রায় অর্ধশতাব্দীব্যাপী রাজত্ব করেন। এই বংশের মােট বারজন নরপতি পর্যায়ক্রমে রাজ্য শাসন করেন এবং তার মধ্যে প্রায় নয়জনই অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। সারবাদার বংশের সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন আলী মুয়াইদ (১৩৬৪-১৩৮১ খ্রি.)। তিনি দীর্ঘ সতের বছর রাজত্ব করেন। অবশেষে অন্যান্য ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর মতো সারবাদার তৈমুরের সর্বগ্রাসী আক্রমণের মুখে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কুর্তদের অঞ্চল দখলের পরই তৈমুর সারবাদারিদের অঞ্চল দখল করেছিলেন। খােরাসান ও সিস্তানে নিজ ক্ষমতা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে তৈমুর প্রথমবারের মতাে দূরবর্তী অঞ্চলে অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি ওক্সাস নদী পার হয়ে শক্তিশালী একটি সেনাদলসহ অগ্রসর হন এবং এ্যাস্ট্রাবাদের কাছে শিবির সন্নিবেশ করেন। দীর্ঘ এক মাস অবরােধের পর তৈমুরের কাছে এ্যাস্ট্রাবাদের পতন ঘটে, যা সারবাদারিদের ছিল।

কারা-কুয়ুনলু বংশ (কৃষ্ণ মেষ বংশ: ১৩৭৮-১৪৬৯ খ্রি.)

১৪শ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে জালায়েরি বংশের অধীনে টার্কোম্যান গােত্রের লােকেরা কারা মুহম্মদের নেতৃত্বে মসূল শাসন করত। ইতিহাসে এরা কারা-কুয়ুনলু (অর্থাৎ কৃষ্ণ মেষ) বংশ বলে পরিচিত। এই টার্কোম্যানগণ তাদের পতাকায় কৃষ্ণ মেষের প্রতীক ছবি ব্যবহার করত বলে তাদের এরকম নামকরণ হয়েছে। এই টার্কোম্যানগণ ইসলামের শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল। এই বংশের সুলতান হুসাইনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের ওপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

এই বংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন মোহাম্মদ বারানি বা কারা ইউসুফ (রা. ১৩৮৮-১৪২০)। পির হাসানের বিদ্রোহে তার পিতা কারা মোহাম্মদ তোরেমিশের মৃত্যুর পর তিনি শাসক মনোনিত হন, এরপর তিনি কারা ওসমানের সাথে মিলে পির হাসানকে পরাজিত করেন। শাসনের শুরুতে তিনি আক কুনলু বা শ্বেত মেষদের বিরুদ্ধে বাগদাদ ও তাবরিজের জালায়রিদদের সন্ধি স্থাপন করেন। তবে খুব দ্রুত তিনি সিভাসের সুসেহরি নগরে বন্দি হন। তার আন্ট তাতার হাতুন আক কুনলুর শাসক কারা ইউলুককে (রা. ১৩৭৮-১৪৩৫ খ্রি.) প্রায়শ্চিত্ত-অর্থ দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। যাই হোক, শীঘ্রই কারা ইউসুফ ও জালায়রিদ উভয়ই পূর্ব দিক থেকে তৈমুরের হুমকির মুখে পড়েন। ১৩৯৩ সালে তৈমুর বাগদাদ দখল করেন এবং তিন বছর পর তিনি আজারবাইজানে তার পুত্র মিরান শাহকে গভর্নর ভাইসরয় নিযুক্ত করেন। ১৩৯৪ সালে তৈমুর খাজা মিসরকে বন্দি করে তাকে সমরখন্দে পাঠান। সুলতান আহমেদের সাথে মিলে তিনি তিমুরিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, এবং কারা ইউসুফ সফলভাবে কারা কুনলুকে স্বাধীন করেন। ১৪০০ সালে তিমুরিদরা পুনরায় অভিযান পরিচালনা করেন এবং কারা কুনলু ও জালায়রিদ উভয়কেই পরাজিত করেন। কারা ইউসুফ ও সুলতান আহমদ উভয়ই প্রথমে মামলুকদের কাছে ও পরে অটোমান সুলতান প্রথম বায়েজীদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বায়েজীদ তার দরবারে কারা ইউসুফকে আশ্রয় প্রদান করে তৈমুরের বিরাগভাজন হন এবং এটি উভয়ের মধ্যে ১৪০২ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত আঙ্গোরার বা আঙ্কারার যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অঙ্গোরার যুদ্ধের পর তৈমুর সমরখন্দে ফিরে গেলে ১৪০২ সালে কারা ইউসুফ ও সুলতান আহমেদ সেনাবাহিনী সমেত ফিরে আসেন। কিন্তু বাগদাদ নিয়ন্ত্রণে নেবার পর তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা ঘটে, এবং কারা ইউসুফ বাগদাদ থেকে সুলতান আহমেদ জালায়িরকে বিতাড়িত করেন। এরফলে সুলতান আহমেদ মামলুক শাসক নাসির আদ দিন ফারাজের কাছে আশয় নেন, কিন্তু তিমুরের ভয়ে তিনি নিজেকে বন্দী করে রাখেন। ১৪০৩ সালে তিমুরিদরা আলগামি ক্যানালের যুদ্ধে তাকে পরাজিত করে তাকে আবার বাগদাদ ত্যাগ করতে বাধ্য করে এবং তার ভাই ইয়ার আলিকে হত্যা করে। এর ফলে তিনিও মামলুকদের অধীন দামেস্কে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শীঘ্রই নাসির আদ দিন ফারাজের নির্দেশে উভয়কেই বন্দী করা হয়। বন্দী অবস্থায় সুলতান আহমদ ও কারা ইউসুফ তাদের বন্ধুত্বকে নবায়ন করেন, তাদের মধ্যে চুক্তি হয় যে, সুলতান আহমদ বাগদাদ গ্রহণ করবেন ও কারা ইউসুফ আজারবাইজান গ্রহণ করবেন। সুলতান আহমেদ কারা ইউসুফের পুত্র পীরবুদাগকে দত্তকও গ্রহণ করেন। ১৪০৫ সালে তৈমুরের মৃত্যুর পর নাসির আদ দিন ফারাজ উভয়কেই মুক্ত করে দেন। কিন্তু ফারুক সুমেরের মতে, দামেস্কের বিদ্রোহী ওয়ালী শেইখ মাহমুদের নির্দেশেই তাদের মুক্ত করা হয়।

মিশর থেকে মুক্ত হয়ে কারা ইউসুফ আনাতোলিয়ায় ফিরে যান। সেখানে তিনি ভ্যান অঞ্চলে তৈমুরের গভর্নর ইজ্জাদ্দিন শিরকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করেন। তৈমুর আলতামিস দখলের পর এই ভাইসরয়কে এই অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, এবং এর ফলেই কারা ইউসুফকে মামলুক সুলতান বারকুকের কাছে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। যাই হোক, এরপর কারা ইউসুফ আজারবাইজানে যান। সেখানে তিনি ১৪০৬ সালের ১৪ অক্টোবর নাখচিভানের যুদ্ধে তিমুরিদ আবু বকরকে পরাজিত করেন, এবং তাবরিজ পুনর্দখল করেন। এই আবু বকর ছিলেন আজারবাইজানে গভর্নর পদে নিয়োগপ্রাপ্ত তৈমুরের পুত্র মিরান শাহ এর পুত্র, অর্থাৎ তৈমুরের নাতি। আবু বকর ও তার পিতা মিরান শাহ এরপর আজারবাইজান পুনর্দখলের চেষ্টা করেন, কিন্তু ১৪০৮ সালের ২০ এপ্রিলে সারদ্রুদের যুদ্ধে কারা ইউসুফ এদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত জয়লাভ করেন, যেখানে মিরান শাহ নিহত হন। এই যুদ্ধটি ছিল প্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ, এর মধ্য দিয়েই পশ্চিম প্রাচ্যে তিমুরিদ শক্তি চূড়ান্তভাবে নির্মূল হয়। ১৪০৯ সালের শরতে তিনি তাবরিজে প্রবেশ করে শিরভান, বিশেষ করে শাকিতে একটি রেইডিং পার্টি প্রেরণ করেন যা বিফল হয়। সুলতানিয়া ও কাজভিন দখলের জন্যও তিনি বিস্তাম বেগের অধীনে তিনি অভিযান পাঠান। একই বছর তিনি আনাতোলিয়ায় অভিযান পাঠিয়ে সালিহ শিহাবেদ্দিন আহমেদকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরতুকিদদের মারদিন শাখার পরিসমাপ্তি ঘটান, তাকে কারার এক মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে মসুল শাসনের জন্য পাঠানো হয়। উল্লেখ্য, তৈমুরের মৃত্যুর পর তিমুরিদ সাম্রাজ্য থেকে যে তিনটি অঞ্চল স্বাধীন হয়ে যায় সেগুলো ছিল কারা কুনলু, আক কুনলু ও আরতুকিদ অঞ্চল। তিনটি অঞ্চলই মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। কারা ইউসুফ দীর্ঘ তিনশত বছরের প্রাচীন আর্তুকিদ বংশের পতন ঘটিয়ে ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে এই রাজ্যটিও তার পদানত করেন।

তাবরিজে রাজধানী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আজারবাইজানে ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর কারা ইউসুফ তার পূর্ববর্তী মিত্র সুলতান আহমদ জালায়িরের সাথেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সুলতান আহমদ আজারবাইজান আক্রমণ করে কিছুকাল দখল করেছিলেন। কিন্তু তাবরিজের কাছে ১৪১০ সালের ৩০শে আগস্ট তাকে কারা ইউসুফ পরাজিত করেন। তাকে বন্দি করা হয়, এবং তার দত্তক গ্রহণ করা কারা ইউসুফের ৭ বছরের বায়োলজিকাল সন পীরবুদাগকে পরিত্যাগ করতে ও কারা ইউসুফের আরেক পুত্র শাহ মুহম্মদকে বাগদাদের শাসনকর্তা নিয়োগ করতে বাধ্য করা হয়। পরের দিন বিস্তাম বেগের প্ররোচনায় কারা ইউসুফ তাকে হত্যা করেন। সুলতান আহমেদের মৃত্যুর মাধ্যমে প্রথমবারের মতাে ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’-এর পূর্বাংশ তুর্কি শাসনের আওতাভুক্ত হয়। (The Cambridge History of Islam.-ক্যাম্ব্রিজ, প্রথম খণ্ড, পৃ: ১৭২)। কারা ইউসুফ তার পুত্রকে ১৪১১ সালে সুলতান ঘোষণা করেন, তবে তিনি রিজেন্ট হিসেবে তখনও দায়িত্বে ছিলেন। ক্ষমতা আরও দৃঢ় করে তিনি শিরভানের দিকে অভিযান পরিচালনা করেন যেখানে শিরভানশাহ ইব্রাহিম তিমুরিদদের অনুগত সামন্ত হিসেবে শাসন করতেন। জর্জিয়ার প্রথম কনস্টান্টিন, ইব্রাহিম ও সৈয়দ আহমেদ ওরলাত (শাকির লর্ড) এর মিলিত শক্তির সাথে ১৪১২ সালে কারা ইউসুফের যুদ্ধ হয় যা চালাগানের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে মিলিত শক্তি কারা ইউসুফের কাছে পরাজিত হয়। এরপর তিনি ১৪১৫ সালে সুলতানিয়ার গভর্নরশিপ থেকে বিস্তাম বেগকে সরিয়ে জাহান শাহকে বসান। ১৪১৭ সালে আর ১৪১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে আক কুনলুর শাসক কারা ওসমানকে পরাজিত করেন। মামলুকরা কারা ওসমানকে আশ্রয় দিলে তিনি মামলুকদের অধীনস্ত আইনতাবে রেইড পার্টি পাঠিয়েছিলেন। ১৪১৮ সালে তার পুত্র ও নমিনাল সুলতান পিরবুদাগ মারা যায়, ফলে কিছু দিনের জন্য তিনি শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৪২০ সালে তিনি ১ম মাহমুদের সাথে একটি এন্টাই-তিমুরিদ ঐক্যজোট তৈরি করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

তৈমুরের পুত্র শাহরুখ কারা ইউসুফের আনুগত্য দাবি করেন, তাতে কারা ইউসুফ রাজি না হলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে ১৭ই নভেম্বর ১৪২০ সালে কারা ইউসুফ মারা যান। কারা ইউসুফের মৃত্যুর পর শাহরুখ মির্জা ডিসেম্বরে কারা ইউসুফের পুত্র কারা ইস্কান্দারের (রা. ১৪২০-১৪৩৭ খ্রি.) কাছ থেকে আজারবাইজান অধিকার করার চেষ্টা করেন। তিনি ইস্কান্দারকে ১৪২০-২১ ও ১৪২৯ সালে দুবার পরাজিত করেন, কিন্তু তবুও আজারবাইজান তিনি দখল করতে পারেননি। জাহান শাহ ছিলেন কারা কুনলুর ক্ষমতায় কারা ইস্কান্দারের প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৪২০ সালে তার সাথে ত্রিবিজন্দের শাসক ৪র্থ আলেক্সিয়সের কন্যা থিওডোরা কান্দাকুজেনের বিবাহ হয়, আর চুক্তি হয় যে ত্রিবিজন্দ এরপর থেকে তিমুরিদদের বদলে কারা কুনলুকে নজরানা দান করবে। যাই হোক, জাহান শাহকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করায় তিনি কারা ইস্কান্দারের দ্বারা জীবন ঝুঁকিতে পড়েন। তাই তিনি তার আরেক ভাই বাগদাদের শাসক ভাই ইসপেন্দের কাছে আশ্রয় নেন। এরপর ১৪৩৬ সালে তিমুরিদ শাসক শাহরুখের সাথে তিনি জোটবদ্ধ হন, এবারে শাহরুখ জাহান শাহ এর সহায়তা নিয়ে কারা ইস্কান্দারকে পরাজিত করে আজারবাইজান দখল করতে সক্ষম হলেন। জাহান শাহ শাহরুখের সামন্ত হিসেবে আজারবাইজান শাসন করা শুরু করেন। শাহরুখের প্রধান সঙ্গী গহরশাদ বেগম জাহান শাহকে দত্তক নিয়েহিলেন, এবং তিনিই ১৯শ এপ্রিল ১৪৩৮ সালে তাকে “মুহাফফার আল দীন” উপাধি দিয়ে রাজমুকুট দান করেন।

১৪৪০ সালে জর্জিয়ার রাজা ১ম আলেকজান্ডার জাহান শাহকে নজরানা প্রদান না করলে তিনি ২০,০০০ সৈন্য নিয়ে জর্জিয়া আক্রমণ করেন এবং সামশভিল্ড ও তিবলিসি ধ্বংস করেন। পরবর্তিতে গঠিত হওয়া সাফাভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ১ম শাহ ইসমাইলের পিতামহ শেইখ ইব্রাহিমও এই অভিযানে তার সাথে ছিল। ১৪৪৪ সালে তিনি জর্জিয়ার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আরেকটি অভিযান পরিচালনা করেন, যেখানে ১ম আলেকজান্ডারের উত্তরাধিকারী ৪র্থ ভাখতাং এর সাথে আখালশিখতেতে তার যুদ্ধ হয়, কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত ছিল, এবং তাকে রাজধানী তাবরিজে ফিরে আসতে হয়। বাগদাদ ও তার আশপাশের অঞ্চলে জাহান শাহ এর ভাই ইসপেন্দ ক্ষমতায় ছিলেন, তিনি ১৪৪৫ সালে মারা গেলে ক্ষমতা চলে যায় তার ভ্রাতুষ্পুত্র আলভান্দ মির্জার কাছে, কারণ ইসপেন্দের পুত্র ফুলাদ মির্জা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন না। জাহান শাহ তার আশ্রয়ে থাকা বাগদাদের কতিপয় আমিরের সহায়তায় বাগদাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেন, এবং সাত মাস যাবৎ তিনি বাগদাদ অবরোধ করেন। অবশেষে ১৪৪৬ সালের ৯ জুনে তিনি বাগদাদ দখল করেন। তিনিও ভ্রাতুষ্পুত্র আলভান্দ মির্জা, রুস্তম, তারখান ও মাহমুদকে একত্রে মসুল শাসন করার জন্য পাঠান এবং তার পুত্র মিরজা মুহাম্মদকে তার অধীনে বাগদাদ শাসন করার জন্য নিয়োগ করেন। ১৪৪৭ সালে শাহরুখের মৃত্যুর পর জাহান শাহ কারা কুনলুর স্বাধীন শাসকে পরিণত হন, এবংতিনি সুলতান ও খান উপাধি গ্রহণ করেন। একই সময় তিমুরিদ সাম্রাজ্য টার্কোমেন রাজকুমারদের মধ্যকার সংঘর্ষের সুযোগ নেয় এবং সুলতানিয়া ও কাজভিন দখল করে (ওঘুজ তুর্কিদেরকে টার্কোমেন বলা হতো, কারা কুনলু, আক কুনলু ও অটোমানরা ওঘুজ তুর্কি বা টার্কোমেন ছিল)। শাহরুখের নাতি ও বেশংকুরের পুত্র পারস্য ও ফার্স এর তিমুরিদ শাসক সুলতান মুহম্মদ বিন বেসংকর জাহান শাহ এর জাহান শাহ এর কন্যার বিবাহের মাধ্যমে শান্তি স্থাপিত হয়, জাহান শাহ বেশংকুরের আরেক পুত্র মির্জা বাবুরের কাছে হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন ও ১৪৫২ সালে পুত্র পিরবুদাগকে ইসফাহানের শাসক নিযুক্ত করেন। ২৮ জুন, ১৪৫৮ সালে তিনি হেরাত অবরোধ করেন, কিন্তু আজারবাইজানে পুত্র হাসান আলীর বিদ্রোহের কারণে তকে তার পূর্বদিকের অভিযান পরিত্যাগ করতে হয়। জাহান শাহ এর পুত্র হাসান আলীকে তার বিদ্রোহী প্রকৃতির জন্য মাকুর কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ১৪৫৮ সালের শীতে তাকে পরাজিত করা হয়। এই সময়ে তার পুত্র পিরবুদাগও বিদ্রোহ করেন, যিনি ফার্স এর হাসান আলীর সাথে বিদ্রোহে যোগ দেন। বিদ্রোহ দমনের পর তার মায়ের অনুরোধে তাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং জাহান শাহ তার আরেক পুত্র মির্জা ইউসুফকে তার স্থলে নিয়োদ দেন। এদিকে পিরবুদাগকে বাগদাদ শাসনের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। জাহান শাহ এর আরেক পুত্র কাসিম বেগকে কেরমানে নিয়োগ দেয়া হয় ও হাসান আলীকে আবার বন্দী করা হয়। যাই হোক, পিরবুদাগ আবার বিদ্রোহ করে বাগদাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। ১৪৬৪ সালে তাকে পরাজিত করা হয় ও মির্জা মুহাম্মদ তাকে হত্যা করেন। জাহান শাহ একজন বিখ্যাত সমরবিদ ছিলেন। তৈমুরীয় বংশের শেষ নরপতি আবু সাঈদের কাছ থেকে তিনি জর্জিয়া, জেবাল, কিরমান, ফার্স ও খােরাসান অধিকার করতে সমর্থ হন এবং মহাসমারােহে তাকে হেরাতে অভিষিক্ত করা হয়। তবে তার এই রাজ্য জয়ের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কেবল জেবাল ও কিরামানই স্থায়ী হয়েছিল। জাহান শাহ দীর্ঘ ত্রিশ বছর রাজত্ব করেন। তিনি তাবরিজের বিখ্যাত ‘ব্লু মসজিদের’ নির্মাণকাজ শুরু করেন। কিন্তু জাহান শাহের শেষ জীবন শান্তিতে কাটেনি। তার পুত্রগণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে দাঁড়ায়।

১৪৪৭ সাল থেকে জাহান শাহ আক কুনলু বা শ্বেত মেষের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে যান, যারা সর্বদাই কারা কুনলু বা কৃষ্ণ মেষ বংশের শত্রু ছিল। এদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয় যখন আলভান্দ মির্জা বিদ্রোহ করে আক কুনলুর প্রধান জাহাঙ্গির বেগের কাছে পালিয়ে যান। জাহান শাহ জাহাঙ্গির বেগকে তার বিদ্রোহী ভ্রাতুষ্পুত্রকে ফিরিয়ে দিতে বলেন, কিন্ত জাহাঙ্গির বেগ তাতে অস্বীকৃতি জানান। এর ফলে জাহান শাহ এরজিকানে আক্রমণ করেন এবং জাহাঙ্গিরকে পরাজিত করার জন্য রুস্তম বেগে অধীনে সেনাভিযান পাঠান। শেষ পর্যন্ত আক কুনলু কারা কুনলুর অধীনস্ততা মেনে নেয় এবং জাহাঙ্গির তার মেয়ের সাথে জাহান শাহ এর পুত্র মির্জা মুহাম্মদের বিবাহ দেন। এদিকে উজুন হাসান তার বড় ভাই এর অধীনস্ততা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি বড় ভাই জাহাঙ্গির বেগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। ১৪৫৭ সালে তিনি আমিদ দখল করেন, ফলে জাহাঙ্গির জাহান শাহ এর কাছে পালিয়ে যান।এদিকে সাফাভিদরা উজুন হাসানকে সমর্থন দেন। সাফাবিদদের নেতা শেইখ জুনাইদ ছিলেন উজুন হাসানের শ্যালক। ১৪৬৬ এর ১৬ই মে-তে জাহান শাহ একটি বিশাল সেনাবাহিন নিয়ে তাবরিজ থেকে অভিযান শুরু করেন, এবং লেক ভ্যানে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন যে উজুন হাসান তার অঞ্চলে ১২,০০০ অশ্বারোহী নিয়ে আক্রমণ করছেন। এই সময়ে উজুন হাসানও সন্দেহ করেছিলেন যে জাহান শাহ তাকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছেন। তিনি যত্নের সাথে গিরিপথগুলোতে প্রহরী বসিয়েছিলেন। জাহান শাহ ও উজুন হাসানের মধ্যে দূত আসা যাওয়া করতে থাকে, কিন্তু জাহান শাহ এর অনেক চাহিদার কারণে কোন চুক্তি হয়নি। মুস পর্যন্ত পৌঁছবার পর জাহান শাহ শীতকালের আগমনের ফলে তার আক্রমণে বিরতি দেন। তার সেনারা অভিযোগ করা শুরু করলে তিনি শীতকালীন আশ্রয়ে নিজের সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেন। এই সময়ে হঠাৎ করে উজুন হাসান তার সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে তাদেরকে পরাজিত করেন। ১৪৬৭ সালের ১১ই নভেম্বরে চাপাকচুরের যুদ্ধে মির্জা ইউসুফ ও মির্জা মুহাম্মদকে বন্দী করা হয়। যুদ্ধের সময় পলায়ন করার সময় জাহান শাহকে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুর পর হাসান আলী কারা-কুয়ুনলু বংশের সিংহাসনে উপবেশন করেন। কিন্তু মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি উজুন হাসানের কাছে পরাজিত হন এবং ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে কারা কুয়ুনলু বংশের পতন ঘটে। 

আক-কুয়ুনলু বংশ (শ্বেত মেষ বংশ ১৩৭৮-১৫০২ খ্রি.)

১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে কারা ইয়ুলুক ওসমান আক-কয়ুনলু বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। আক কুয়ুনলু বংশের নরপতিগণ তাদের পতাকায় শ্বেত মেষের প্রতীক ছবি ব্যবহার করত বলে এরা ‘শ্বেত মেষ বংশ’ বলেও আখ্যায়িত। কারা ইয়ুলুক ওসমান (১৩৭৮ ১৪০৬ খ্রি.) তৈমুরকে কয়েকটি যুদ্ধে বিশেষভাবে সাহায্য করেন এবং তার প্রতিদানে তৈমুরের কাছ থেকে আর্মেনিয়া ও মেসােপটেমিয়ার শাসনভার প্রাপ্ত হন। আক কুয়ুনলু বংশের লােকেরা ইসলামের সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল। ওসমানের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী হামজা (১৪০৬-১৪৪৫ খ্রি.) ও জাহাঙ্গীর (১৪৪৫-১৪৬৬খ্রি.) দীর্ঘ ষাট বছর রাজত্ব করেন। আক-কুয়ুনলু অধিপতিগণ দিয়েরবেকিরকে তাদের রাজধানী হিসেবে মনােনীত করেন। এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন উজুন হাসান (১৪৬৬-১৪৭৮ খ্রি.)। কারা কুনলু রাজবংশ নিয়ে আলোচনার সময় তার দ্বারা কারা কুনলুর পতন সম্পর্কে ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে। তিনিই কারা কুয়ুনলু বংশের সর্বশেষ নরপতি হাসান আলীকে পরাজিত ও নিহত করে সেই বংশের পরিসমাপ্তি ঘটান। জাহান শাহ এর পরাজয়ের পর তিমুরিদ শাসক আবু সাইদ মির্জা জাহান শাহ এর পুত্রের অনুরোধে তাকে সাহায্য করতে আসেন এবং জাহান শাহ এর অঞ্চলের অনেক স্থান দখল করে নেন, ফলে আবু সাইদের সাথে উজুন হাসানের যুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় (এই আবু সাইদ ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের পিতামহ)। ১৪৬৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে তাবরিজের কাছে সংঘটিত কারাবাঘের যুদ্ধে উজুন হাসান আবু সাইদকে পরাজিত ও বন্দী করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারিতে আবু সাইদকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হেরাতের তিমুরিদ শাসক ইয়াদগার মুহাম্মদ মির্জা হত্যা করেন।  আবু সাঈদকে পরাজিত করার মাধ্যমে উজুন হাসান জেবাল, ইস্পাহান ফার্স ও কিরমান হস্তগত করেন। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম পারস্যে তৈমুরীয় বংশের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু এই সময় অটোমান তুর্কিদের দ্বারা ভীষণভাবে হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় তিনি পূর্ব-পারস্যের তৈমুরীয় রাজ্যের বিরুদ্ধে নতুন ভাবে অভিযান পরিচালনা করা থেকে বিরত থাকেন। অটোমান তুর্কিদের কাছে এই সময় এশিয়া মাইনরের কারামান ও কাস্তমুনি নামক গাজী রাজ্যদ্বয়ের পতন হওয়ায় উজুন হাসানের সঙ্গে তুর্কি সুলতানের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। উজুন হাসান ভেনেশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তুর্কি সুলতানের মােকাবেলা করতে চাইলেন। কিন্তু নানা কারণে এই চুক্তির কোন উল্লেখযােগ্য ফলাফল দাঁড়ায়নি। উজুন হাসান ১৪৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দে উপর্যুপরি কয়েকবার তুর্কি সুলতানের দ্বারা নাজেহাল হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তুর্কি সুলতান ও তৈমুরের উত্তরাধিকারীদের কাছে তিনি বিশেষ উদ্বিগ্নের কারণ ছিলেন। ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে এই বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী উজুন হাসান মৃত্যুবরণ করেন এবং আক-কুয়ুনলু রাজ্য তার পুত্রদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে এই বংশের রাজত্বকাল আরও পঁচিশ বছর স্থায়ী হলেও পূর্বেকার সেই ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি আর রইল না। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সাফাভি বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাহ ইসমাইল সর্বশেষ আক-কুয়ুনলু নরপতি মুরাদকে পরাজিত করে এই বংশের পতন সুনিশ্চিত করেন। 

কিপচাক সাম্রাজ্য অথবা গােল্ডেন হাের্ড

মােঙ্গলদের জাতীয় ইতিহাসে কিপচাক সাম্রাজ্যের (গােল্ডেন হাের্ড) অভ্যুদ্বয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ মােঙ্গল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে এটিই সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। এছাড়া ইউরােপের বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসায-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই সাম্রাজ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। চেঙ্গিস খানের পুত্র ও প্রধান উত্তরাধিকারী ওগােদাই-এর আমলে ১২৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে ভল্গা নদীর অববাহিকা অঞ্চল ও সাইবেরিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি এলাকাসহ রাশিয়া মােঙ্গলদের পদানত হয়। এই অভিযান জুচির পুত্র বাতুর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এবং তিনিই কিপচাক মােঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। বাতুর বংশধরেরা সাধারণত ‘গােল্ডেন হাের্ড’ নামে পরিচিত। (এস. লেন-পুল: the Mohammadan Dynasties. বৈরুত, ১৯৬৬ পৃ: ২২২)। খুব সম্ভবত বাতু কর্তৃক ব্যবহৃত ‘সি ওরদা’-অর্থাৎ সােনালি তাবু থেকে এই নামের উৎপত্তি হয়েছে। এছাড়া সােনালি রং ছিল মােঙ্গলদের জাতীয় রং। এই সাম্রাজ্য দক্ষিণে ককেশাস পর্বতমালা, পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর এবং উত্তরে পােল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর রাজধানী ছিল সারাই। ভল্গা-নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত এই রাজধানীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বয়ং বাতু। বাতু ছিলেন অসাধারণ সামরিক প্রতিভার অধিকারী। বাতু খানের পরিচালনায় তাতার-মােঙ্গলরা (রুশরা গোল্ডেন হোর্ডকে তাতার বলতো) বর্তমান রাশিয়ার রিয়াজান প্রিন্স রাজ্য আক্রমণ করে। প্রিন্সের দ্রুঝিন্নাক (প্রিন্সের পার্শ্বচর দলের সদস্য) আর শহরের সমস্ত মানুষ ভ্লাদিমিরের প্রিন্সের নিকট সাহায্যের আবেদন জানায় কিন্তু তাতে সাড়া না দেয়ায় রিজানের পতন হয়। এরপর তাতার-মােঙ্গলরা ভ্লাদিমির দখল করে। এরপর তারা নভগােরদ শহর দখলের জন্য অভিযান করে। নভগােরদের চারদিকের বন, জলাভূমি, হ্রদ অতিক্রম করা মােঙ্গলের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ১২৪০ সালে মােঙ্গলবাহিনী কিয়েভ দখল করে শহরটি জ্বালিয়ে দেয়। এভাবে ক্রমে মোঙ্গল আক্রমণে রুশ জনপদগুলাে বিধ্বস্ত হয়। মােঙ্গলরা ভলগা আর দন নদী বরাবর স্তেপভূমিতে বসতি স্থাপন করে নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, এবং তারা রুশদের কাছ থেকে নজরানা আদায় করে। প্রায় দুই শতাব্দীর বেশি-কাল তাতার-মোঙ্গল আধিপত্য রুশ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত করেছিল। ১২৩৭ থেকে ১২৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি সমগ্র রাশিয়া অধিকার করেন এবং বিজয়ীবেশে পােল্যান্ড ও হাঙ্গেরির অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। ফলে গােটা ইউরােপ বাতুর নেতত্বে পরিচালিত মােঙ্গল বাহিনীর ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনাক্রমে এসময় ওগােদাই খানের মৃত্যু হলে ইউরােপের বিরুদ্ধে সমর অভিযান স্থগিত রাখা হয়। সুচতুর বাতু কারাকোরামে অনুষ্ঠিত কুরিলতাই এর অনুষ্ঠানে যােগাদন করা থেকে বিরত থাকেন এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কিপচাক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন।

তদকালীন ও পরবর্তীকালের রাশিয়ার পরিস্থিতি জানতে রাশিয়ার ইতিহাস শীর্ষক নিবন্ধটি পড়ুন।

কিপচাক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাতু খান ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তার ভাই বার্কে (১২৫৬-১২৬৬ খ্রি.) তার স্থলাভিষিক্ত হন। মােঙ্গল খানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেন। বার্কে ছিলেন ১৩শ শতাব্দীর একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ মােঙ্গল নরপতি। তিনি ‘নতুন সারাই’ নামক একটি চমৎকার নগরী নির্মাণ করেন। বার্কের রাজত্বকালে ককেশাস অঞ্চল অধিকারের প্রশ্নে পারস্যের হালাকু খান ও আবাগা খানের সাথে তার তুমুল সংঘর্ষ বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এছাড়া বার্কের ইসলাম গ্রহণ ও বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতি তার অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবােধের জন্যও ইল-খান নরপতিদ্বয়ের সাথে তার তিক্ততার সৃষ্টি হয়। ১২৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইল-খান মোঙ্গলবাহিনীকে তেরেখ্‌ এর যুদ্ধে পরাজিত করেন। বার্কে বিশেষ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে পারস্যের মােঙ্গলদের প্রধানতম শত্রু মিশরের মামলুকদের সাথে এক অর্থনৈতিক ও সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে মিশরের সাথে কিপচাক অঞ্চলের তুর্কি ও মােঙ্গল ক্রীতদাস ব্যবসায়ে উভয়দেশ বিশেষভাবে লাভবান হয়। এছাড়া মিশর থেকে বহু শিল্পী, কারিগর ও ধর্ম প্রচারকদের কিপচাক সাম্রাজ্যে প্রেরণ করা হয় এবং উভয় দেশের মধ্যে বিশেষ সাংস্কৃতিক যােগসূত্র গড়ে ওঠে। ১২৬৭ খ্রিস্টাব্দে বার্কে মৃত্যুবরণ করেন।  বার্কের মৃত্যুর পর বাতু খানের সাক্ষাৎ বংশধরগণ পরবর্তী এক শতাব্দীব্যাপী গােল্ডেন হাের্ডের শাসনকর্তা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এদের মধ্যে মঙ্কে তিমুর (১২৬৭-৮০ খ্রি.), তুদা মঙ্কে (১২৮০-৮৭ খ্রি.) তুলাবুঘা (১২৮৭-৯০ খ্রি.) তুখতু (১২৯১-১৩১২ খ্রি.) পর্যায়ক্রমে রাজত্ব করেন। এরপর ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে উজবেক খান সারাই এর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং এই সঙ্গে কিপচাক সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা হয়। উজবেক খান ছিলেন এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি। তার আমলে কিপচাক সাম্রাজ্য উন্নতির শীর্ষ-শিখরে আরােহণ করে। তিনি সারাই এর পরিবর্তে নতুন সারাইতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। এই নতুন রাজধানীতে তিনি সুরম্য মসজিদ, বিদ্যানিকেতন, শিল্প-কারখানা ও আবাসিক এলাকা গড়ে তােলেন। এছাড়া এই আমলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিশেষ উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। ভূমধ্যসাগর ও বাল্টিক-সাগরীয় অঞ্চলের সাথে চীনের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান নিয়ন্ত্রণ করে কিপচাক মােঙ্গলগণ বিশেষ লাভবান হন। ১৩শ শতাব্দীর বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা এই নতুন রাজধানী পরিদর্শন করেন এবং উজবেক খানের রাজত্বকালের নানামুখী উন্নতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। (এইচ. এ. আর. গিব :The Travels of Ibn Batuta. (১৩২৫-১৫৪ খ্রি.) দ্বিতীয় খণ্ড, লন্ডন, ১৯৭১)। তার আমলে গােল্ডেন হাের্ড একটি পরিপূর্ণ ইসলামী রাজ্যে পরিণত হয় এবং চেঙ্গিস খানের ‘উলাঙ্গ ইয়াছার’ পরিবর্তে ইসলামী শরীয়তের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। (জি. হ্যাম্বলি: Central Asia. নিউইয়র্ক, ১৯৬৯, পৃ: ১১৯)।

কিপচাক সাম্রাজ্যে ইসলামী শাসন প্রবর্তন যুগপৎ মােঙ্গল ও রাশিয়ার ইতিহাসে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ এর ফলে উভয় জাতির মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রবােধের সৃষ্টি হয় এবং ভবিষ্যতে একজাতি হিসেবে এদের মিলন অথবা সমন্বয় সাধন সুদূরপরাহত হয়ে দাঁড়ায়। (পূর্বোক্ত : পৃ: ১২০)। তবে উজবেক খান নিষ্ঠাবান মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পরধর্মের প্রতি বিশেষ উদার ও সহনশীল মনােভাবের পরিচয় দেন। উজবেক খানকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য খ্রিস্টধর্ম প্রচারকগণ বিশেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। উজবেক খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করে যদি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতেন তবে তার ভবিষ্যৎ বংশধরগণ রাশিয়ার জারের স্থান দখল করতে পারতেন বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। (বি. স্পুলার : The Muslim World. (মোঙ্গল যুগ, দ্বিতীয় খণ্ড) লিডেন ,১৯৬০, পৃ: ৫৩)। কিন্তু সে ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে মােঙ্গলদের স্বতন্ত্র সত্তা অবশ্যই বিলুপ্ত হয়ে যেত। উজবেক খানের উত্তরাধিকারীগণ একাদিক্রমে সকলেই মুসলমান ছিলেন এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তাকে রাশিয়ার মুসলিম তাতার জাতির জনক ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। উজবেক খানের নামানুসারে আজও মধ্য-এশিয়ায় উজবেক জাতি এবং তাদের দেশ উজবেকিস্তান বিদ্যমান রয়েছে এবং এর রাজধানী তাসখন্দ।  উজবেক খানের পর জানি বেগ (১৩৪০-৫৭ খ্রি.) কিপচাক মােঙ্গল সিংহাসনে আরােহণ করেন। জানি বেগ একজন পরাক্রমশালী রাজ্য বিজেতা ছিলেন। এসময় পারস্যে চরম রাজনৈতিক অরাজকতা চলছিল। তিনি এর পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে তিন লক্ষ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে ককেশাস পর্বতমালা অতিক্রম করেন এবং প্রথমে তাবরিজ ও পরে আজারবাইজান দখল করেন। এছাড়া তাবরিজ অধিপতি মালিক আশরাফও তার হাতে নিহত হন কিন্তু এসময় পারস্যে ভয়াবহ মহামারী দেখা দেয় এত দ্রুতগতিতে এই মহামারী বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে কেবল ক্রিমিয়াতেই ৮৫ হাজার লােকের অকালমৃত্যু ঘটে। জানি বেগ এই মহামারীর তীব্রতায় ভীত হয়ে পড়েন এবং দ্রুত রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু খুব সম্ভবত এই প্লেগের জীবাণু তার দেহে প্রবেশ করায় তিনি অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। এলে তার পারস্য ও ককেশাস বিজয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যায়।  জানি বেগের পর বিরদি বেগ (১৩৫৭-৫৯ খ্রি.) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মাত্র দুই বছর রাজত্ব করার পর তিনি হঠাৎ আততায়ীর হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুতে কিপচাক সাম্রাজ্যে গৃহবিবাদ ও আভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে এই সাম্রাজ্য দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়। তার ওপর এসময় মােলদাভিয়া ও লিথুয়ানিয়া নামে দুটি মোঙ্গল বিরােধী নতুন রাজ্যের ও গ্র্যান্ড ডিউকের নেতৃত্বে মস্কোতে নতুন শক্তির অভ্যুদয় ঘটে। ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে উজবেক খান মস্কোর শাসনকর্তা প্রথম ইভানকে গ্র্যান্ড ডিউক উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দে লিথুয়ানিয়ার রাজ্য ব্লু ওয়াটার্স এর যুদ্ধে পোডোলিয়ার তাতার শক্তিকে পরাজিত করে কিয়েভ দখল করেন। এরপর মস্কোর গ্র্যান্ড ভিউক তাতার সেনাপতি মামাইকে ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে ডন নদীর তীরে কুলিকোভার যুদ্ধ নামে এক প্রচণ্ড যুদ্ধে পরাজিত করেন

এই যুদ্ধটি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলা যাক। ১৪শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মস্কোর প্রিন্সরা মােঙ্গলদের (সুবর্ণ ওর্দা বা গোল্ডেন হোর্ড) নজরানা দিতে অস্বীকার করে। মােঙ্গলরা কর আদায়ের জন্য মস্কোভিয়া আক্রমণ করে। ১৩৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মােঙ্গলরা নেপ্রিয়াদ্‌ভা নামক স্থানে রুশদের বাধার সম্মুখীন হয়। দুই পক্ষের সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অনেক লােক নিহত হয়। এই লড়াইয়ে প্রিন্স দ্‌মিত্রি প্রতিভাশালী এবং সাহসী নেতা প্রতিপন্ন হন এবং তার নাম হয়ে দাঁড়ায় দ্‌মিত্রি দন্‌স্কোই। কুলিকোভার যুদ্ধে মােঙ্গলদের পরাজয় রুশদের মনে সাহস সঞ্চার করে এবং মস্কোকে কেন্দ্র করে ১৫শ শতকে ঐক্যবদ্ধ রুশ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি হয়। রুশ ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। নভগােরদ আর তভেরের সওদাগররা মস্কোভিয়া মহারাজ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে থাকে। রুশ কারিগরদের খ্যাতি বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মস্কোভিয়া মহারাজা ক্রমে সমস্ত রুশ ভূমিকে একত্র করে অন্যান্য সমস্ত প্রিন্সকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। এভাবে গড়ে ওঠে রাশিয়া রাষ্ট্র এবং মস্কোভিয়া রাজধানীতে পরিণত হয়। রুশিদের সঙ্গে উত্তরের এবং ভলগা অববাহিকার জাতিগুলি – মারি, মােৰ্দভা, ইউগরা, কোমি, পেচোরা, কারেলীয় এবং অন্যান্য জাতি মিলিত হল রাশিয়া রাষ্ট্রে। ফলে রাষ্ট্রটি বহুজাতিক হয়ে ওঠে। যাই হোক, যুদ্ধে পরাজিত হলেও এর ফলে কিপচাক সাম্রাজ্যের ক্ষমতা চিরতরে নির্বাপিত হয়নি। সৌভাগ্যক্রমে এসময় তােখতামিশ নামক জনৈক শক্তিশালী নরপতি সারাই এর সিংহাসন অধিকার করেন। তােখতামিশ বাতুর ভাই ওরদার বংশধর এবং হোয়াইট হাের্ডের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়ার দিগ্বিজয়ী নরপতি তৈমুরের সাহায্যপুষ্ট হয়ে কিপচাক তাতার শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তােখতামিশ ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে সাফল্যের সঙ্গে মস্কো অবরােধ করেন এবং গ্র্যান্ড ডিউককে কর প্রদানে বাধ্য করেন। কিন্তু তােখতামিশের নেতৃত্বে গােল্ডেন হাের্ডের এই সৌভাগ্যকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তােখতামিশ তৈমুরের প্রতি অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে তার অনুপস্থিতিতে ট্রান্সঅক্সিয়ানা আক্রমণ করেন। এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে তৈমুর ১৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে স্বয়ং ককেশাস পর্বতমালা অতিক্রম করে তােখতামিশকে আক্রমণ করেন এবং তেরেখ্‌ এর যুদ্ধে তাকে পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। বস্তুত তেরেখ এর যুদ্ধে তােখতামিশের পরাজয়ের ফলে রাশিয়ার গােল্ডেন হাের্ড সাম্রাজ্যের মৃত্যুঘণ্টা ধ্বনিত হয়। তৈমুরের সেনাবাহিনী ত্বরিতগতিতে সমস্ত রাশিয়া তছনছ করে দেয়। কিন্তু রাশিয়ায় স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করার কোন ইচ্ছাই তৈমুরের ছিল না। ফলে রাশিয়া থেকে তৈমুরের প্রত্যাবর্তনের পর তােখতামিশ পুনরায় রাজধানী সারাই অধিকার করতে সক্ষম হলেন। কিন্তু তার পূর্বের সেই শক্তি আর ছিল না। তিনি অচিরেই তৈমুর কুলুঘ নামক জনৈক সেনাপতির কাছে পরাজিত হয়ে লিথুয়ানিয়ার যুবরাজ ভিটোল্ডের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং সেখানে ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।  তোখতামিশের পর সারাই এর ক্ষমতা দখলের জন্যে বিভিন্ন মােঙ্গল গােত্রের খানদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এই সংঘর্ষে অবশেষে এদিগু খান নামে জনৈক শক্তিশালী নােগাই অধিপতি ক্ষমতা দখল করেন। তিনিই ছিলেন গােল্ডেন হাের্ডের সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ নরপতি। এদিগু খান ১৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দে লিথুয়ানিয়ার যুবরাজ ভিটোল্ডকে পরাজিত করে কিপচাক সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এছাড়া তৈমুরের বংশধরদেরকে পরাজিত করে ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে খাওয়ারিজম অধিকার করেন এবং বােখারা পর্যন্ত অগ্রসর হন। এরপর ১৪০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মস্কো অবরােধ করে মস্কোর গ্র্যান্ড ডিউকের কাছ থেকে বহু পরিমাণ অর্থ ও উপঢৌকন আদায় করেন। কিন্তু ১৪১৯ খ্রিস্টাব্দে এদিগু খানের মৃত্যু হলে কিপচাক সাম্রাজ্য আবার হীনবল হয়ে পড়ে এবং এই অঞ্চলের ওপর কাজান (১৪৩৮-১৫৫২খ্রি.) অস্ত্রাখান (১৪৬৬-১৫৫৪ খ্রি.) এবং ক্রিমিয়া (১৪২০-১৭৮৩ খ্রি.) নামে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি রাজ্য গড়ে ওঠে। এই রাজ্যগুলোর অধিপতিগণ অবশ্যই সকলেই চেঙ্গিস খানের পুত্র জুচির সাক্ষাৎ বংশধর ছিলেন। যাই হোক, গােল্ডেন হাের্ডের এই আভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে মস্কো ও লিথুয়ানিয়ার ডিউকগণ উপর্যুপরি আক্রমণের মাধ্যমে তাতার শক্তিকে পর্যুদস্ত করে দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৬শ শতাব্দীব্যাপী গােল্ডেন হাের্ড কোনক্রমে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এসময় গােল্ডেন হাের্ডের ক্ষমতা ও শাসন রাজধানী সারাই এর চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং এটি তখন সাধারণত ‘গ্রেট হাের্ড’ নামেই অভিহিত হত। (Encyclopaedia of Islain. লন্ডন, ১৯৬০ প্রথম খণ্ড, পৃ: ১১০৮)। অবশেষে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রেট হাের্ড ও রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। 

কিপচাক সাম্রাজ্যের পতনােত্তর যুগে মােঙ্গলদের ইতিহাস

কিপচাক সাম্রাজ্যের পতনের পর সেই অঞ্চলের ওপর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে স্থানীয় তুর্কী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখার উচ্চাভিলাষী যুবকদের মধ্যে এক প্রবল প্রতিযােগিতা শুরু হয়। ফলে মধ্য-এশিয়া ও রাশিয়ায় (ভল্গা নদী ও কৃষ্ণসাগরীয় অববাহিকা অঞ্চল) কয়েকটি স্বাধীন তাতার রাজ্যের সৃষ্টি হয়। তাতাররা ছিল একটি তুর্কীভাষী জনগোষ্ঠী। এদের রাজ্যগুলোর মধ্যে কাজান (১৪৩৭-১৫৫৭ খ্রি.), অস্ত্রাখান (১৪৬৬-১৫৫৬ খ্রি.) ও ক্রিমিয়া (১৪২০-১৭৮৩ খ্রি.) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। 

কাজানের তাতার বংশ (১৪৩৭-১৫৫৭ খ্রি.) :  ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে উলুঘ মােহাম্মদ কাজানের তাতার বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাতু খানের বংশধর ছিলেন। কাজান রাজ্যটি ভরা নদী অববাহিকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। অতি প্রাচীনকাল থেকে এই অঞ্চল খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। মোঙ্গলদের হাতে এই অঞ্চল পতনের পূর্বে কাজান বুলগেরিয়ার অধীনে ছিল। কিপচাক সাম্রাজ্যের পতনের পর কাজানে এই নতুন তাতার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে মস্কোর গ্র্যান্ড ডিউকের কাছে এটি বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বংশের মধ্যে মুহম্মদ আমীন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তার আমলে কাজান উন্নতির শীর্ষ শিখরে আরােহণ করে। তিনি রাশিয়ার কাছ থেকে নিয়মিত কর আদায় করতে সক্ষম হন এবং সাফল্যের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী স্লাভ রাজ্যগুলো আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ আমীনের মৃত্যুতে এই বংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ অস্ত্রাখান ও ক্রিমিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এই প্রতিবেশী রাজ্য দুটির সাথে কাজানের শত্রুতা লেগেই থাকত। কিন্তু তবুও ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে সাহিব গিরাই খানের নেতৃত্বে কাজানের তাতারগণ সাফল্যের সঙ্গে মস্কো আক্রমণ করেন। এসময় বিশেষ রাজনৈতিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে তিনি ১৫২৩ খ্রিস্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদের সাথে মিত্ৰতা স্থাপন করেন। কিন্তু জার ইভানের আমলে রাশিয়া বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তিনি কাজানের ওপর নিজ প্রাধান্য বিস্তারে বদ্ধপরিকর হন। প্রথমত তিনি কাজানে একজন রাশিয়াপন্থী তাতার খানকে গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ কাজানের তাতার অধিবাসীগণ মুসলমান হওয়ায় তুরস্কের অটোমান সুলতানের প্রতিই তাদের আন্তরিক আনুগত্য ছিল। সুতরাং ইভান সরাসরি কাজান অধিকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ফলে কাজান শহরটি ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার অধীনস্ত হয়। এবং একজন রাশিয়াপন্থী খানকে কাজানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে কাজান দখল করতে রাশিয়ার প্রায় আরও পাঁচ বছর সময় লাগে এবং ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে কিপচাক সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী কাজানের তাতার রাজ্য স্থায়ীভাবে রাশিয়ার পদানত হয়। রাশিয়া কর্তৃক কাজানের তাতার রাজ্য অধিকারের পরবর্তী ইতিহাস বড়ই করুণ ও হৃদয়বিদারক। কারণ তখন থেকে পরবর্তী দুইশত বছরব্যাপী এই অঞ্চলের তাতার মুসলমানদের ওপর রাশিয়ার খ্রিস্টান শক্তি ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এক অকথ্য অত্যাচার চালায়। তাতারগণ অবশ্য রাশিয়ার জারদের এই অত্যাচার নীরবে সহ্য করেনি। ১৬শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তারা অন্তত দশবার প্রবল বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। সর্বস্তরের তাতার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যােগদান করে। কিন্তু প্রতিবারই এই বিদ্রোহ চরম নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহ রক্তপাতের মাধ্যমে দমন করা হয়। জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিনের আমলে অবশ্য কাজানের তাতারদের ওপর থেকে এই অত্যাচারের মাত্রা কিছুটা প্রশমিত হয়। তিনি তাতার মুসলমানদেরকে বিশেষ ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রদান করেন। ফলে রাশিয়ার জার শাসনের সাথে তাতার মুসলমানগণ বহু ক্ষেত্রে সহযােগিতার হাত সম্প্রসারণ করে। কিন্তু ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার সেনাবহিনী মধ্য এশিয়া জয় করলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুশ খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অসহিষ্ণুতা আবার প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে ১৯শ শতাব্দীব্যাপী প্রায় দুই লক্ষ তাতার মুসলমানকে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। (জি. হ্যাম্বলি : Central Asia. লন্ডন, ১১৬১-শীর্ষক গ্রন্থের “The Tatars of Kazan Under Russian Rule”-আলোচনাটি দ্রষ্টব্য: পৃ: ১৮৭-১৯২)। ২০শ শতাব্দীর শুরু থেকে কাজানের তাতার জাতির মধ্যে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। আবু নাসার খুসাভি ও আবুল কাইয়ুম নাসারি প্রমুখ ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারকদের প্রচেষ্টায় তাদের মধ্যে এক ব্যাপক গণচেতনার সৃষ্টি হয়। মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা বর্জন করে তাতারগণ আধুনিকতা ও প্রগতির পথে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে তাদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও গড়ে ওঠে। রাশিয়ার বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা অধিকার করলে কাজান ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের তাতার মুসলমানদেরকে বিশেষ অধিকার প্রদান করা হয়। কিন্তু রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বসবাসকারী এই তাতার মুসলমানগণ ক্রমাগতই তাদের পূর্বেকার জাতীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে প্রবল রুশিকরণ নীতির প্রভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে।

অস্ত্রাখানের তাতার বংশ (১৪৬৬-১৫৫৬ খ্রি.) : ১৪৬৬ খ্রিস্টাব্দে কাশিম খান অস্ত্রাখানের তাতার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন কাজান রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উলুঘ মুহম্মদের পুত্র। ১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দে উলুঘ মুহম্মদ আততায়ীর হাতে নিহত হলে তার পুত্র কাশিক খান পলাতক অবস্থায় রাশিয়ার জারের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং মস্কো সেনাবাহিনীতে চাকরি গ্রহণ করেন। পরে রাশিয়ার জার তাকে অস্ত্রাখান অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং নিজ প্রতিভাবলে তিনি স্বাধীন অস্ত্রাখান রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। অস্ত্রাখানের তাতার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কাশিম খানের নামানুসারে এদেরকে ‘কাজিমােদের খান বংশ’ বলেও অভিহিত করা হয়। অস্ত্রাখান ভল্গা নদীর মােহনায় অবস্থিত বিধায় এর অর্থনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অস্ত্রাখানের তাতারগণ দুর্ধর্ষ যােদ্ধা ছিল। অনেক সময় তারা রাশিয়া ও পােল্যান্ডের বেতনভােগী ভাড়াটিয়া সৈন্য হিসেবে কাজ করত। অস্ত্রাখানের তাতার খানদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবদুর রহমান খান (১৫৩৪-৩৮ খ্রি.) রাশিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বস্তুত তখন থেকেই অস্ত্রাখানের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়ে পড়ে। এছাড়া প্রতিবেশী রাজ্য ক্রিমিয়া ও কাজানের সাথে বিভিন্ন সময় যুদ্ধের ফলেও অস্ত্রাখান হীনবল হয়ে পড়ে। ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার জার জনৈক দরবেশ আলী খানকে অস্ত্রাখানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। কিন্তু দরবেশ আলী পরে ক্রিমিয়া ও অটোমান তুর্কিদের বশ্যতা স্বীকার করে তাদের সঙ্গে যােগদান করেন। ফলে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে জার দরবেশ আলীকে পদচ্যুত করে অস্ত্রাখান অধিকার করেন। অস্ত্রাখানের তাতার মুসলমান প্রাধান্য খর্ব করার জন্য রাশিয়ার জার হাজার হাজার কোসাক অধিবাসীকে অস্ত্রাখানে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনি অস্ত্রাখান শহরটির পুনঃনির্মাণ করেন এবং পরবর্তী দুই শতাব্দী যাবৎ এটি কাম্পিয়ান সাগরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। (১৯শ শতাব্দীর শেষ সময় থেকে বাকু কাস্পিয়ান সাগরের শ্রেষ্ঠ নৌবন্দরে পরিণত হয়।)। বর্তমানে অস্ত্রাখানের তাতার মুসলমানগণ সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতি হলেও তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়নি।

ক্রিমিয়ার তাতার বংশ (১৪২০-১৭৮৩ খ্রি.) গােল্ডেন হাের্ড সাম্রাজ্যের পতনের পর সেই অঞ্চলের ওপর গড়ে ওঠা তাতার রাজ্যসমূহের মধ্যে ক্রিমিয়াই ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী। ক্রিমিয়ার এই তাতার বংশের রাজত্বকাল দীর্ঘ সাড়ে তিনশত বছর স্থায়ী হয় এবং পর্যায়ক্রমে বাষট্টিজন তাতার খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ক্রিমিয়ার তাতারগণ ১৫শ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকেই রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্জন করতে থাকে। কাজান বংশের প্রতিষ্ঠাতা উলুঘ মুহম্মদের জনৈক ভাই তাশ-তিমুর তােখতামিশের সেনাপতি ছিলেন এবং তিনিই ক্রিমিয়ার তাতার বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। (তোখতানিশ হোয়াইট হোর্ডের অধিপতি ছিলেন। পরে তিনি ‘গােল্ডেন হাের্ড’ অধিকার করেন।)। তবে তার পুত্র হাজী গিরাইকেই সাধারণত এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। হাজী গিরাই-এর নামানুসারে ক্রিমিয়ার তাতার নরপতিগণ গিরাই খান বলেও পরিচিত। ক্রিমিয়ার গিরাই খানগণ প্রথমত পােল্যান্ডের ডিউকের সঙ্গে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলেন। কিন্তু ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ কর্তৃক কাফফা নামক গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি অধিকৃত হলে ক্রিমিয়ার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। কারণ তখন থেকে ক্রিমিয়ার খান মেঙ্গলি গিরাই মূলত তুর্কি সুলতানের অধীনত মিত্রশক্তিতে পরিণত হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্রিমিয়ার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব বাস্তব ক্ষেত্রে অক্ষুন্নই ছিল। মেঙ্গলি গিরাই এর আমলকে ক্রিমিয়ার তাতার রাজত্বের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা যায়। তিনি বাহ্যত তুর্কি সুলতানের অধীনতা স্বীকার করলেও মূলত এটি ক্রিমিয়ার পক্ষে ছিল বিরাট সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয়। কারণ তিনি সুশিক্ষিত তুর্কি সেনাবাহিনীকে নিজের প্রয়ােজনে রাশিয়া, পােল্যান্ড ও কোসাকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে সক্ষম হন। এছাড়া তিনি ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে এই তুর্কি বাহিনীর সাহায্যের কাফফা থেকে জেনােয়ার শত্রু-বাহিনীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করতে সক্ষম হন।  ক্রিমিয়ার রাজধানী ছিল বাগ্‌সে-সারাই, এর বর্তমান নাম সিঙ্কোরোপোল। ১৬শ শতাব্দীতে ক্রিমিয়ার বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়। ফলে এসময় তাতারদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুদ্ধ-বিগ্রহই ছিল তাদের অন্যতম প্রধান পেশা এবং এর ওপরই বহুলাংশে নির্ভর করত তাদের উন্নতি আর অবনতি। এসময় ক্রিমিয়ার তাতারগণ সাফল্যের সঙ্গে পােল্যান্ড, রাশিয়া ও কোসাকদের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি কয়েকটি সমর অভিযান পরিচালনা করে। এমনকি ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দৌলত গিরাই এর নেতৃত্বে তারা রাশিয়ার জার ইভানকে পরাজিত করে রাজধানী মস্কো নগরী বিধ্বস্ত করে দেয় এবং জারকে কর প্রদানে বাধ্য করে। গিরাই খানের নেতৃত্বে প্রায় দুই পক্ষের এক বিরাট তাতার বাহিনী ছিল। এছাড়া বহু তাতার সৈন্য অটোমান তুর্কি বাহিনীতে যােগদান করে এবং দক্ষিণ পূর্ব ইউরােপীয় যুদ্ধক্ষেত্রে খ্রিস্টান শত্রু-বাহিনীর মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করে। এসময় ক্রিমিয়ার গিরাই খানগণ ককেশাস, কারবারদান, দাগেস্তান ও রুমেলিয়ার ওপরও তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। তুর্কি সুলতানদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ক্রিমিয়ার তাতারগণ এভাবে রাশিয়ার অস্তিত্বের প্রতি বিরাট হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ালো। রাশিয়ার বিখ্যাত জারিনা ক্যাথারিন ক্রিমিয়ার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন।

তিনি সর্বপ্রথম কৃষ্ণসাগরের ওপর রাশিয়ার প্রাধান্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হন এবং এর মাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে অনুসৃত মহামতি পিটারের নীতিরই বাস্তবায়ন ঘটে। ফলে রাশিয়ার জারের হাতে যথাক্রমে ১৭৩৬ ও ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়া বিধ্বস্ত হয় এবং ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত রুশ ও কোসাক বাহিনী ক্রিমিয়ার রাজধানী বাগসে-সারাই অধিকার করে। বহুদিন পূর্ব থেকেই প্রাচ্য সমস্যার ক্ষেত্রে ক্রিমিয়া সর্বদাই একটি বিরাট সমস্যার কারণ ছিল। তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ক্রিমিয়া তাই উভয় শক্তির কাছেই বিশেষ উদ্বিগ্নের কারণ ছিল। এছাড়া কোসাকগণ যেমন রাশিয়ার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেছিল তেমনি ক্রিমিয়ার তাতারগণও মুসলমান হওয়ায় তুর্কি সুলতানের প্রবল সমর্থক ছিল। কিন্তু এসময় তুরস্ক ক্রমাগতই হীনবল হয়ে পড়তে থাকে এবং পক্ষান্তরে রাশিয়া উত্তরােত্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে তুর্কিগণ এসময় রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হয় এবং ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক কুচুককায়নারজির সন্ধিতে ক্রিমিয়া স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বিনিময়ে তুর্কি সুলতান রাশিয়ার জারের কাছ থেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করলেন। ফলে স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়েও যেমন একদিকে ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার পরােক্ষ প্রভাব অক্ষুন্ন রইল অন্যদিকে তেমন তুর্কি সুলতানের ওপর ক্রিমিয়ার তাতারদের ধর্মীয় আনুগত্যের বন্ধন অটুট রইল। কাজেই ক্রিমিয়া সমস্যার মূলত কোন সমাধান হল না। এসময় সর্বশেষ ক্রিমিয়ার খান শাহীন গিরাই এর সাথে তুর্কি সুলতানের মনােমালিন্যের সুযােগ নিয়ে রুশ-বাহিনীর কুচুকায়নারজির সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে পুনরায় ক্রিমিয়া অধিকার করল। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে এক আনুষ্ঠানিক ঘােষণার মাধ্যমে জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করলেন। প্রথমে তুরস্ক এই ঘােষণার বিরােধিতা করলেও ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে সাক্ষরিত জ্যাসির সন্ধিতে তুর্কি সুলতান ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে স্বীকার করে নিলেন।  রাশিয়ার অধীনে ক্রিমিয়ার তাতার জাতির পরবর্তী ইতিহাস বড়ই মর্মান্তিক। যদিও ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ই এপ্রিলের ঘােষণায় ক্রিমিয়ার তাতারদের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার অক্ষুন্ন থাকবে বলে আশ্বাস দেয়া হয় তবুও বাস্তবে তা হয়নি। রাশিয়ার জারের উস্কানিতে তাতার মুসলমানদেরকে জোরপূর্বক ধর্মান্তর ঘটানাের চেষ্টা চলল এবং তাদের ওপর নেমে এলো এক চরম অর্থনৈতিক ও সামাজিক নির্যাতন। ফলে বাধ্য হয়ে ক্রিমিয়ার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক তাতার মুসলমান স্বদেশ ত্যাগ করে তুরস্ক ও মধ্য-এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিল। এছাড়া ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হলে এই অঞ্চল সাময়িকভাবে ইংরেজ ও তুর্কিদের অধীনে চলে যায় এবং তার ফলে তাতার মুসলমানদের ওপর নতুন করে এক মহাবিপদ উপস্থিত হয়। কারণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে তাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়। ফলে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার পাঁচ লক্ষ তাতার মুসলমানের স্থানে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা মাত্র এক লক্ষে এসে দাড়ায়। (জি. হ্যাম্বলি: Central Asia, লন্ডন, ১৯৬৯ শীর্ষক গ্রন্থের ”The Crimea under Russian Rule”. আলােচনাটি দ্রষ্টব্য: পৃ: ১১২-১১৭)।

যাই হোক, সৌভাগ্যবশত নানা অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়েও ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানদের মধ্যে ২০শ শতাব্দীর প্রারম্ভে নবজাগরণ দেখা দেয়। ইসমাইল বে নামক জনৈক সুশিক্ষিত ও উদারপন্থী তাতার নেতার অবদান এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তিনি তাতার মুসলমানদের সনাতন শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয় সাধন করেন। তার সুযােগ্য নেতৃত্বে হতাশাগ্রস্ত, ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাতার মুসলমানগণ আধুনিকতা ও প্রগতির পথে পরিচালিত হয়। তিনি ‘তারজুমান’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং এর মাধ্যমে তার সংস্কারধর্ম আন্দোলন বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি সমসাময়িক মুসলিমবিশ্বের প্যান ইসলামী মতবাদ এবং সেই সঙ্গে তুরকের নব্য তুর্কি দলের জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। তার নেতৃত্বে ক্রিমিয়ার তাতার যুবশক্তি ‘মিল্লি ফিরকা’ (অর্থাৎ জাতীয় দল) নামে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। তবে নানা জাতির সংমিশ্রণে গঠিত ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানগণ একান্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়ায় বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার বলশেভিকগণ ক্রিমিয়া অধিকার করলে সেখানকার তাতার মুসলমানদের জীবনে এক নবদিগন্তের সূচনা হয়। কারণ বলশেভিকগণ ক্রিমিয়াকে সােভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রদান করে। রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তাতারদের ‘মিল্লি ফিরকা’ বা জাতীয় দলের কোয়ালিশন সরকার পর্যন্ত গঠন করা হয়। যদিও প্রকৃত ক্ষমতা রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির হাতেই ছিল তবুও তাতার মুসলমানগণ সীমিতভাবে স্বায়ত্তশাসন প্রাপ্ত হয় এবং তাদের ভাষাকে অন্যতম আঞ্চলিক রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। এছাড়া তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ দেয়া হয় এবং বিভিন্ন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরতে নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানদের এই সুদিন বেশিকাল স্থায়ী হল না। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে মস্কো সরকার তাতার জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্মূল করার জন্য তাদের ওপর পূর্বাপেক্ষা কঠিনতর আঘাত হানে। ফলে বহু তাতার নেতা এই অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়ে প্রাণ হারায় এবং নতুনভাবে আবার তাতারগণ দেশত্যাগ করতে শুরু করে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারীতে ক্রিমিয়ায় তাতার মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা মাত্র তেইশজনে এসে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্ব-মহাযুদ্ধের সময় ক্রিমিয়া জার্মানির পদানত হলেও ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে রুশ বাহিনী হিটলারকে পরাজিত করতে সক্ষম হলে ক্রিমিয়া শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু দেশদ্রোহিতার অপরাধে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানগণ পুনরায় মস্কো সরকারের কোপানলে পতিত হয়। ফলে বহু তাতার মুসলমানকে স্বদেশ থেকে উৎখাত করে সাইবেরিয়া অথবা মধ্য-এশিয়ায় দেশান্তরিত করা হয় এবং ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনীয় প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এভাবে বহু ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত ক্রিমিয়া এবং সেই সঙ্গে সেখানকার তাতার মুসলমান জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। 

ট্রান্সঅক্সিয়ানার চাঘতাই বংশ (১২২৭-১৩৬৯ খ্রি.)

চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার দ্বিতীয় পুত্র চাঘতাই মধ্য-এশিয়ায় ট্রান্সক্সিয়ানার ওপর নিজ আধিপত্য বিস্তার করেন। চেঙ্গিস খানের জীবদ্দশাতেই তিনি পুত্র চাঘতাই এর ওপর বিশাল মােঙ্গল সাম্রাজ্যের এই অংশের শাসনভার অর্পণ করেছিলেন। চাঘতাই অবশ্য স্বাধীন নরপতি ছিলেন না। মােঙ্গলদের মহান খানের অধীনে তিনি এই অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। চাঘতাই পিতার সুযােগ্য পুত্র ছিলেন। চীন ও মধ্য এশিয়া আক্রমণের সময় তিনি পিতার সাথে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। মােঙ্গলদের জাতীয় রীতি নীতি এবং বিশেষ করে চেঙ্গিস খান কর্তৃক প্রবর্তিত ‘উলাঙ্গ ইয়াসা’ নামক আইন সম্বন্ধে চাঘতাই বিশেষভাবে অভিজ্ঞ ছিলেন বলে মোঙ্গলদের কাছে তিনি সমাদৃত হতেন। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে চাঘতাই ট্রান্সঅক্সিয়ানার শাসনভার গ্রহণ করেন। কুতুবুদ্দিন হাবাস নামে চাঘতাই এর একজন মুসলমান মন্ত্রী ছিলেন। কুতুবুদ্দিন ওব্রারের অধিবাসী ছিলেন এবং তিনি চাঘতাইকে তার রাজ্য শাসন ব্যাপারে নানাভাবে সহযােগিতা করেন। চাঘতাই এর আমলে মুসলমানদের সুদিন ছিল না। মোঙ্গলদের উলাঙ্গ ইয়াসা আইন অনুসারে গলা কেটে প্রাণী হত্যা করা এবং বজ্রপাতের সময় প্রবাহিত জলে হাত-মুখ ধৌত করা বা স্নান করা নিষেধ ছিল। কিন্তু ইসলামী শরিয়তে জবাই করা এবং যে-কোন পরিষ্কার জলে ওজু বা গােসল করার নিয়ম মৌল আইন বিরােধী হওয়ায় অনেক সময় তাদেরকে শাস্তি ভােগ করতে হত। এই কারণে চাঘতাই মুসলমানদের কাছে মােটেই প্রিয় ছিলেন না। ১২৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে চাঘতাই মৃত্যুবরণ করেন। চাঘতাই-এর নামানুসারে ট্রান্সক্সিয়ানার মোঙ্গলরা ইতিহাসে চাঘতাই বংশ বলে পরিচিত। অবশ্য চাঘতাই-এর জীবদ্দশায় বা তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই বংশের এইরুপ নামকরণ হয়নি। এই বংশের অলঘু খানই সর্বপ্রথম মোঙ্গল মহান খানের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে মধ্য-এশিয়ায় একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং তখন থেকেই এরা চাঘতাই বংশ বলে পরিচিত হতে থাকে। চাঘতাই এর উত্তরাধিকারীগণ প্রায় দেড় শতাব্দী (১২২৭-১৩৬৯) ধরে ট্রান্সঅক্সিয়ানা শাসন করেন।  চাঘতাই-এর মৃত্যুর পর তার পৌত্র কারা হুলেগু ট্রান্সঅক্সিয়ানার সিংহাসনে বসেন। কিন্তু অনতিকাল পরেই তিনি মহান মােঙ্গল খান কুয়ুক (১২৪১-১২৪৮) কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন এবং চাঘতাই-এর পঞ্চম পুত্র ইসু মঙ্গকিকে ক্ষমতায় বসানাে হয়। ইসু মঙ্গকি বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা করেন। ১২৫১ খ্রিস্টাব্দে ইসু মঙ্গকি মােঙ্গলদের মহান খান মেঙ্গুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে তাকে হত্যা করা হয়। এবং কারা হুলেগু আবার ক্ষমতা লাভ করেন। কিন্তু সেই বছরই তিনি হঠাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হলে তার বিধবা স্ত্রী ওরঘানা স্বামীর প্রতিনিধি হিসেবে শাসন কাজ পরিচালনা করেন। ওরঘানার সময় মুসলমানগণ বিশেষ সুযােগ-সুবিধা লাভ করে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে ওরঘানা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ওরঘানার পর তার পুত্র মুবারক শাহ ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে চাঘতাই সিংহাসন লাভ করেন। চাঘতাই খানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং খাটি ইসলামী নাম ধারণ করেন। কিন্তু এই বছরই তিনি তার পিতৃব্যপুত্র বুরাক খান কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন।

বুরাক খান কাইদুর কাছে পরাজিত হন এবং তার বশ্যতা স্বীকার করেন। কাইদু ছিলেন মােঙ্গলদের মহান খান কুয়ুকের ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনি অসীম বীরত্বের সাথে মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের ওপর নিজ প্রাধান্য বিস্তার করেন। তিনি কুবলাই খানের সাথেও সাফল্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কারাকোরাম অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তন করার সময় ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে কাইদু মৃত্যুবরণ করেন। তার পুত্র এবং উত্তরাধিকারী কাপার চাঘতাই বংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে চাঘতাই অধিপতি কাবাক খানের কাছে পরাজিত হয়ে চীনের মােঙ্গল খানের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই সঙ্গেই মধ্য-এশিয়ার উলু বংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।  ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে বুরাক খানের মৃত্যু হলে কাইদু চাঘতাই এর পৌত্র নিকপাইকে ক্ষমতায় বসান। নিকপাই এর পর বুকা তিমুর নামে চাঘতাই এর অপর এক পৌত্র সিংহাসন লাভ করেন। বুকা তিমুরের মৃত্যুর পর ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে বুরাক খানের পুত্র দুয়া যান চাঘতাই সিংহাসনে উপবেশন করেন। দুয়া খান সুদক্ষ যােদ্ধা ছিলেন এবং কাইদুর অধীনে তার সহযােগিতায় বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দুয়া খান ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার পর থেকে চাঘতাই বংশের বাকি সকল নরপতিগণই তার বংশধর ছিলেন। দুয়া খানের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তার তিন পুত্র ইসেন বুকা (১৩০৯-১৩১৮), খান কাবাক (১৩১৮-১৩২৬) ও তারমাশিরিন (১৩২৬-১৩৩৪) পর্যায়ক্রমে চাঘতাই বংশের সিংহাসনে আরােহণ করেন। ইসেন বুকার আমলে মােঙ্গলদের মহান খান ট্রান্সঅক্সিয়ানা আক্রমণ করেন এবং চাঘতাইদের শীত ও গ্রীষ্মকালীন আবাস ইসিক্কুল ও তালাশ বিধ্বস্ত করে দেন। এই ঘটনার পর ইসেন বুকার ভাই ও উত্তরাধিকারী খান কাবাকের সময় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ‘মা-অরা-উন্নাহারে’ (নদীর ওপার) স্থানান্তরিত করা হয়। খান কাবাক মুসলমান ছিলেন না। ঐতিহাসিকগণ তাকে একজন ন্যায় বিচারক নরপতি বলে উল্লেখ করেছেন। চাঘতাই বংশের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে খাটি রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন করেন। এই মুদ্রাকে ‘কাবাকি’ বলা হত। খান কাবাক একজন বিখ্যাত নির্মাতা ছিলেন। তিনি কয়েকটি নগর ও ‘নাখশাব’ নামে একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে খান কাবাক মৃত্যুমুখে পতিত হন।  খান কাবাকের মৃত্যুর পর তারমাশিরিন সিংহাসন লাভ করেন। তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে আলাউদ্দিন নাম ধারণ করেন।

১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বিন তুঘলকের সময় তারমাশিরিন ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন। (আগা মাহদি হুসাইন এই প্রচলিত মতের বিরােধিতা করে বলেন যে, তারমাশিরিন কখনও ভারত আক্রমণ করেননি, বরং তিনি পলাতক অবস্থায় ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। দ্রষ্টব্য : The Rise and Fall of Muhammad bin Tughluq-লন্ডন, ১৯৩৮)। তার রাজত্বের শেষ দিকে চাঘতাই সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বুজান নামে তারমাশিরিনের এক ভ্রাতুষ্পুত্র তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। যুদ্ধে তারমাশিরিন পরাজিত ও মৃত্যুবরণ করেন। তারমাশিরিনের মৃত্যুর পর থেকে চাঘতাই বংশের দ্রুত পতন সূচিত হয়। ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একের পর এক সতেরজন নরপতি চাঘতাই সিংহাসনে আরােহণ করেন। এদের গড় রাজত্বকাল দুই বছরের অধিক ছিল না। এরা কেউই তেমন যােগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। এদের আমলে চাঘতাই বংশের মধ্যে আত্মকলহ এবং সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ লেগেই থাকত। ফলে এই দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলে চাঘতাই সাম্রাজ্য দ্রুত পতনের দিকে অগ্রসর হয়। ১৪শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ট্রান্সঅক্সিয়ানা ও পারস্যে বিরাজমান এই রাজনৈতিক অরাজকতার সুযােগ নিয়ে তৈমুর নামে এক অভূতপূর্ব সামরিক প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে। তৈমুর অচিরেই নিজ প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত করে ট্রান্সঅক্সিয়ানার সিংহাসন অধিকার করেন। ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর কর্তৃক ট্রান্সক্সিয়ানা দখলের মাধ্যমে সেখানে চাঘতাই বংশের চির সমাধি রচিত হয়। তবে বিশেষ কৌতূহলের ব্যাপার হল এই যে, তৈমুরের আমলেও তুরা বলে পরিচিত চাঘতাই বংশের নামেমাত্র একজন খান সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু মােটা মাসােহারা ও আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করা ছাড়া তার অবশ্য আর কোন ক্ষমতা ছিল না। 

তৈমুরীয় বংশের ইতিহাস (১৩৬৯-১৫০৬খ্রি.)

দিগ্বিজয়ী তৈমুর (১৩৬৯-১৪০৫ খ্রি.)

১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে ৯ই এপ্রিল তৈমুর সমরখন্দের অদূরবর্তী কেশ নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আমীর তুরঘাই এবং মাতার নাম তাকিনাহ খাতুন। তৈমুরের পিতা বারলাস নামক মোঙ্গল গােত্রের গুরখান শাখার একজন দলপতি ছিলেন, এই শাখাটি যথেষ্ট পরিমাণে তুর্কীকৃত হয়ে গিয়েছিল (Central Asia, history of Timur”, in Encyclopædia Britannica, Online Edition, 2007, জি আর গার্থহোয়াইট, The Persians, Malden, Blackwell Pub., 2007.)। দলপতি বলতে তৈমুরের পিতা বিত্তবান বা ক্ষমতাশালী ছিলেন না। ধর্ম চর্চায়ই তিনি অধিক আনন্দ পেতেন। তৈমুরকেও তিনি শৈশবে নানা ধর্মীয় উপদেশ দান করতেন। এছাড়া পূর্ব-পুরুষের কীর্তি ও গৌরবের কাহিনীও তিনি বালক তৈমুরকে শোনাতেন। এটি ভবিষ্যতে তৈমুরের জীবনে উদ্দীপনা ও উচ্চাভিলাষ সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল। তৈমুর শব্দের অর্থ লৌহ। প্রাথমিক জীবেন কোন এক দুর্ঘটানার ফলে তিনি ডান হাত ও ডান পায়ে গুরুতর আঘাত পান এবং চিরজীবনের জন্য খোড়া হয়ে যান। ফার্সি ভাষায় ‘ল্যাঙ্গা’ শব্দের অর্থ খোড়া এবং কেবলমাত্র নিন্দাচ্ছলেই তাকে তৈমুরলঙ্গ বলা হত। ইউরােপীয়দের কাছে তিনি অবশ্য তৈমুরল্যান নামেই সমধিক পরিচিত। কীভাবে তুৈমুর খোড়া হয়েছিলেন সে বিষয়ে পরস্পরবিরােধী ও বিভ্রান্তিকর নানা মত প্রচলিত রয়েছে। কিংবদন্তী আছে যে ভবিষ্যতে তৈমুর মানব জাতির ধ্বংসকারী হবেন এটি আধ্যাত্মিক শক্তিবলে অবগত হয়ে এক দরবেশ তার লাঠি দিয়ে আঘাত হেনে তৈমুরকে খােড়া করে দিয়েছিলেন। তৈমুরের জীবনীকার ইবনে আরাবশাহ লিখেছেন যে তৈমুর শৈশবে রাহাজানি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং একদা মেষ চুরি করতে গিয়ে তিনি হাতে এবং পায়ে গুরুতর আঘাত পান এবং তার ফলে খোড়া হয়ে যান। প্রফেসর পি. কে. হিট্টিও এই মতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ঐতিহাসিক পি. সাইক অবশ্য ভিন্নমত পােষণ করে স্পষ্ট লিখেছেন যে তৈমুরের খােড়া হবার করণ সিস্তানের শাসনকর্তা জালালুদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে তার আঘাত প্রাপ্তির ফল। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে সমরখন্দ্রে অবস্থিত তৈমুরের সমাধিসৌধ রাশিয়ার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেন এবং তৈমুরের কংকাল মস্কোতে প্রেরণ করা হয়। সেখানে পরীক্ষা করে তার ডান পা ও ডান হাত বিকলাক্ত দেখা গিয়েছে। অনুমান করা হয়েছে যে, সম্ভবত তিনি আজন্ম খোড়া ছিলেন অথবা এটি কোন গুরুতর আঘাত প্রাপ্তির ফল। তবে সিস্তানের যুদ্ধে আঘাত প্রাপ্তির ফলেই সে তৈমুর খোড়া হয়েছিলেন এই সত্য আধুনিক গবেষণা দ্বারা সন্দেহাতীভাবে প্রমাণিত হয়েছে। উচ্চারণ ও বানানভেদে ইতিহাসে তৈমুরের নানাবিধ নামের উল্লেখ দেখা যায়, যথা: তিমুর, তৈমুর , তাইমুর, তিমুরল্যান, তৈমুরল, তাম্বুরলেন, তামারলেন ইত্যাদি।  তৈমুরের সঠিক কুলনিৰ্ণয় একটি দুরূহ ব্যাপার। কারণ তৈমুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের বা বংশের কোন বিশেষ নাম ছিল না অথবা তিনি নিজেও কোন রাজকীয় উপাধি ধারণ করেননি। এশিয়ার ঐতিহাসিকগণ তাকে ‘আমীর তৈমুর গুরিগান’ বলে অভিহিত করেছেন। গুরিগান শব্দের অর্থ গৌরবময়। তৈমুর মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর বলে চাঘতাই মােঙ্গলদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক ছিল। এই কারণে তৈমুর ও তার উত্তরাধিকারীগণকে সাধারণত চাঘতাই বংশােদ্ভূত বলে মনে করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বংশগতভাবে তৈমুর মােঙ্গল ছিলেন এই ব্যাপারে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন। পি. সাইকের মতে তৈমুরের পিতা তুরঘাই ছিলেন নির্ভেজাল তুর্কি। সুতরাং পিতৃকুল থেকে তৈমুরেরও তাই তুর্কি হওয়ারই কথা। (পি. সাইকস : A History of Persia, লন্ডন, ১৯২১, পৃ. ১২০)। কিন্তু এই সমস্যার পরিসমাপ্তি এখানেই নয়। তৈমুরের জীবনীকার ও মধ্য-এশিয়া বিষয়ক সুপণ্ডিত হ্যারল্ড ল্যাম্ব তৈমুরকে তাতার অধিপতি বলে বর্ণনা করেছেন। (হ্যারল্ড ল্যাধ : Tamberlane, নিউয়র্ক, ১৯২৮, পৃ: ৮)।

মধ্য-এশিয়ার অপরাপর যাযাবর জাতিসমূহের মধ্যে মােঙ্গল ও তুর্কিদের মতো তাতাররাও একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিগণিত। অতএব দেখা যাচ্ছে যে হ্যারল্ড ল্যাম্ব বারলাস গােত্রকে পি. সাইকস্ এর অনুসরণে তুর্কি গােত্র না বলে তাতার গােত্র মনে করছেন। এদিকে গার্থহোয়াইটের মতো অনেকে তাকে মোঙ্গল মনে করেন। সুতরাং তৈমুর ও তার বংশধরগণকে সরাসরি তুর্কি, তাতার অথবা মোঙ্গল বলে আখ্যায়িত করা যেমন মুশকিল তেমনি অনেকের মত সকল মত রক্ষা করতে গিয়ে তৈমুরকে ‘চাঘতাই -তুর্কি’ বলে বর্ণনা করাও হাস্যকর। তবে ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দে বলখ এ অনুষ্ঠিত তৈমুরের অভিষেক উৎসবে তিনি নিজেকে মধ্য-এশিয়ার চাঘতাই বংশের ধারক, বাহক ও উত্তরাধিকারী বলে ঘােষণা করেছিলেন। (হিলদা দুহাম; Tamburlaine the Conqueror. লন্ডন, ১৯৬২ পৃ: ৮৬)। এই কারণেও অনেক ঐতিহাসিক তৈমুরকে চাঘতাই বলে বর্ণনা করেছেন।  চেঙ্গিস খানের মতো তৈমুরকে অতি অল্প বয়সে পিতৃ-আসনে উপবেশন করতে হয়। মাত্র বারাে বছর বয়স থেকেই তৈমুরের যুদ্ধবিদ্যায় হাতেখড়ি হয় এবং তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি বিশেষ চাতুর্য, সাহস ও প্রজ্ঞার পরিচয় প্রদান করেন। পৃথিবীর বহু বড় বড় নরপতির মতো তৈমুরের ক্ষমতা লাভের পথও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পিতৃ আসন লাভ করেই তিনি নানা বিপদের সম্মুখীন হলেন। কিন্তু কোন বিপদেই তিনি হতাশ বা বিচলিত হতেন না। তৈমুর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, একবার তিনি ভীষণ বিপদগ্রস্ত হয়ে এক ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সেখানে একটি পিপীলিকা তার চেয়ে দ্বিগুণ ভারি একটি খাদ্যবস্তু মুখে করে প্রাচীরের ওপর উঠতে চেষ্টা করলে আটষট্টিবার ব্যর্থ হয়। কিন্তু বার বার এই ব্যর্থতায় পিপীলিকা হতাশ না হয়ে প্রচেষ্টা চালাতে থাকলে পরবর্তীবার কৃতকার্য হয়। এই ঘটনা থেকে তৈমুর জীবনে অধ্যবসায় সম্বন্ধে বড় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। (তৈমুর : Mulfuzat-i-Timuri- ইংরেজি অনুবাদ: মেজর চার্লস স্টেওয়ার্ট , Memoirs of Timur, লন্ডন, ১৮৩০)। এসময় পতনমুখী চাঘতাই সাম্রাজ্যে ট্রান্সঅক্সিয়ানার সিংহাসন নিয়ে তুমুল সংঘাত চলছিল। এই সুযােগে মঙ্গোলিয়ার শাসনকর্তা তুঘলক তৈমুর খান ট্রান্সক্সিয়ানা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে হাজী বারলাস পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। হাজী বারলাস ছিলেন তৈমুরের পিতৃব্য। এতে তৈমুর ভীষণ বিপদে পড়েন এবং বাধ্য হয়ে তৈমুর খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তৈমুরের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তুঘলক তৈমুর খান তার ওপর ট্রান্সঅক্সিয়ানার শাসনভার অর্পণ করেন। কিন্তু তার ভাগ্য বেশি দিন সুপ্রসন্ন রইল না। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তৈমুর সমরখন্দ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। 

ভাগ্যান্বেষী তৈমুর

সমরখন্দ ত্যাগ করে তৈমুর সহায় ও সম্বলহীন অবস্থায় ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ভাগ্যবিপর্যয়ের এই চরম সন্ধিক্ষণে তিনি তৈমুর তুঘলক খান কর্তৃক বিতাড়িত আমীর হুসাইনের সাথে মিলিত হন। সম্পর্কে তৈমুর আমীর হুসাইনের ভগ্নিপতি ছিলেন। এই দুই ভাগ্যান্বেষী যখন এমনিভাবে দক্ষিণ-পারস্যে ভ্রমণ করছিলেন তখন সিস্তানের শাসনকর্তা জালালুদ্দিন মাহমুদ এক বিদ্রোহ দমন করার জন্য তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। বিনাদ্বিধায় তৈমুর ও আমীর হুসাইন জালালুদ্দিনের আহ্বানে সাড়া দিলেন এবং বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করলেন। কিন্তু ভবিষ্যতে তৈমুর ও আমীর হুসাইন তার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে মনে করে অকৃতজ্ঞ জালালউদ্দিন তাদেরকে আক্রমণ করলেন। এই যুদ্ধেই তৈমুর তার ডান হাত ও পায়ে তীরবিদ্ধ হয়ে চিরজীবনের জন্য খোড়া হয়ে যান। কিন্তু বিরাট ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে হলেও এই যুদ্ধই ভবিষ্যতে তৈমুরের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল। সিস্তানের যুদ্ধে জয়লাভ করার পর তৈমুর ও আমীর হুসাইন কুনদুজ দখল করেন এবং কেস পর্যন্ত তাদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে।  এসময়ে তুঘলক তৈমুর খানের মৃত্যু হলে তার পুত্র খােজা ইলিয়াস সিংহাসনে মারােহণ করেন। কিন্তু ইলিয়াস নিজের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না করতেই তৈমুর ও আমীর হুসাইন তাকে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে খােজা ইলিয়াস পরাজিত হওয়ায় সমরখন্দ তাদের অধিকারে আসে। ফলে ট্রান্সঅক্সিয়ানা, সিস্তান ও সমরখন্দ তাদের হস্তগত হল। প্রকৃতপক্ষে তৈমুর ও আমীর হুসাইন উভয়েই ছিলেন এই বিজয়ের সমঅংশীদার। কিন্তু প্রাক্তন শাসনকর্তার পুত্র বলে আমীর হুসাইনের ওপরই দেশ শাসনের ভার পড়ল। ঘটনাপ্রবাহে বাধ্য হয়ে তৈমুরকে হুসাইনের চেয়ে নিচ আসন গ্রহণ করতে হল। খাজনা আদায়, বিচার ও জমির বন্দোবস্ত দেয়ার ভার হুসাইন নিজ হাতে গ্রহণ করলেন। কিন্তু কেস নগরী থেকে আমুদরিয়া পর্যন্ত ভূ-ভাগের ওপর তৈমুরের প্রাধান্য স্বীকৃত হল। হুসাইন যখন বারলাস গােত্রের লােকজনদের ওপর বিপুল করভার চাপিয়ে দিলেন তখন তৈমুর এর প্রতিবাদ করলেন এবং বহু কষ্টে এই কর পরিশােধ করলেন। তৈমুরের উদারতা ও সহিষ্ণুতার ফলে উভয়ের মধ্যকার তিক্ততা প্রকাশ্যে বিবাদে পরিণত হল না। কিছুকাল উভয়ে মিলে-মিশে রাজ্য শাসন করলেন। কিন্তু রাজনীতির চিরাচরিত নিয়মানুসারে তৈমুর ও আমীর হুসাইনের মধ্যকার আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের বন্ধন বেশি দিন স্থায়ী হল না। উপরন্তু তৈমুরের স্ত্রী এবং হুসাইনের বোন আলজাই খাতুনের এসময় মৃত্যু হলে উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ক আরও শিথিল হয়ে পড়ল। কিন্তু তৈমুরের সৈন্যবল ও সমর্থন আমীর হুসাইনের চেয়ে কম থাকায় তিনি তখন তার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করলেন না। এসময় আমীর হুসাইন জাঠদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমনে লিপ্ত হয়ে পড়েন এবং এতে তার দীর্ঘ ছয় বছর নানাভাবে কর্মব্যস্ত থাকতে হয়। এই সুযােগে তৈমুর শক্তি ও সমর্থন যুগিয়ে আমির হুসাইনের সাথে প্রকাশ্য বিবাদে লিপ্ত হলেন। যুদ্ধে আমীর হুসাইন পরাজিত হয়ে বল্খে‌ আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর তৈমুর বল্খ আক্রমণ করেন এবং তা অধিকার করেন। হুসাইন তৈমুরের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করলে তাকে অভয় প্রদান করা হয়। কিন্তু হুসাইন তৈমুরের কাছে আত্মসমর্পণ না করে একটি মসজিদের মিনারে আত্মগােপন করেন। পরে তাকে বন্দি করা হয় এবং তিনি গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। এভাবে তৈমুর নিজেকে সম্পূর্ণরূপে কণ্টকমুক্ত করে ১৩৬১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। বল্খে‌ই তার অভিষেক অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয় এবং সমরখন্দ তৈমুরের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। 

তৈমুরের পারস্য বিজয়

মধ্যযুগের বিশ্ব ইতিহাসে সামরিক দক্ষতা ও সাফল্যের ক্ষেত্রে তৈমুর ছিলেন এক অতুলনীয় প্রতিভা। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের মতো তিনিও বিশ্ববিজয়ের আকাঙ্ক্ষা পােষণ করতেন। তাই সিংহাসনে উপবেশন করেই তৈমুর রাজ্যজয়ের নেশায় মেতে উঠলেন। এসময় মধ্য-এশিয়ায়, বিশেষ করে পারস্যে চরম রাজনৈতিক অরাজকতা বিরাজ করছিল। এটি একদিকে যেমন তৈমুরকে এই অঞ্চল আক্রমণে উৎসাহিত করেছিল অন্যদিকে তেমনি তার সামরিক সাফল্য এনে দিয়েছিল। পারস্য বিজয়ের মাধ্যমেই তৈমুরের ‘বিশ্বরাজ্য প্রতিষ্ঠার’ জয়যাত্রা শুরু হয়। ইল-খানি বংশের পতনের পর ওক্সাস নদী থেকে তাইগ্রিস নদী পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব হয়। এই সকল রাজ্যের আমীরগণ সর্বদা পরস্পর আত্মকলহে লিপ্ত থাকত। এই কলহে থাকা আমীরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জালায়েরি, মুজাফফরীয়, কুর্ত, সারবাদারি, কারা-কুয়ুনলু ও আক্‌কুয়ুনলু বংশ। এই গােলযােগ ও বিশৃঙ্খলার সুযােগ নিয়ে তৈমুর রাজ্য বিস্তারে মনােযােগী হলেন। আমীর হুসাইনকে সাফল্যের সাথে পরাভূত করে ট্রাসঅক্সিয়ানার ওপর তৈমুর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করলেন। পরবর্তী দশ বছর তৈমুর প্রতিবেশী জাটখাওয়ারিজম রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর পারস্য আক্রমণ করেন। খােরাসান অধিকার করাই তার প্রধান লক্ষ্য ছিল। খােরাসানের কুর্ত বংশীয় শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিন পীর আলী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তৈমুরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। খােরাসান তৈমুরের হস্তগত হলে ধীরে ধীরে কাবুল, কান্দাহার ও হেরাত তৈমুরের অধীনে চলে আসে। এরপর তৈমুর কালাত-ই-নাদিরি ও তুরশিস দুর্গ দুটি অবরােধ করেন। প্রবল প্রতিরােধের পর অবশেষে এই দুর্গ দুটি তৈমুরের হস্তগত হয় এবং সিস্তানও তৈমুরের রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ে।  খােরাসান ও সিস্তানে নিজ ক্ষমতা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে তৈমুর প্রথমবারের মতাে দূরবর্তী অঞ্চলে অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি ওক্সাস নদী পার হয়ে শক্তিশালী একটি সেনাদলসহ অগ্রসর হন এবং এ্যাস্ট্রাবাদের কাছে শিবির সন্নিবেশ করেন। দীর্ঘ এক মাস অবরােদের পর তৈমুরের কাছে এ্যাস্ট্রাবাদের পতন ঘটে।

১৩৮৪ সালে তৈমুর জালায়রিদদের আক্রমণ করেন। এতে তদকালীন জালায়রিদ শাসক সুলতান আহমাদকে বন্দী করা সম্ভব হয়নি, তিনি পালিয়ে যান। তার অধীনস্তরা সোলতানিয়া প্রতিরক্ষা করতে ব্যর্থ হন এবং তৈমুর প্রায় বিনা বাধাতেই নগরটি দখল করে। এরপর তৈমুর আদিল আকাকে নগরের দায়িত্বে রেখে অভিযান থেকে ফিরে আসেন। এদিকে তৈমুরের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১৩৮৫ সালে গোল্ডেন হোর্ডের খান তোখতামিশ জালায়রিদ রাজ্যে আক্রমণ করেন। ইরানের উত্তর পশ্চিম দিকে আজারবাইজান ও তাবরিজে আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। সুলতান আহমেদ এর ফলে বাগদাদে পালিয়ে যান। এই আক্রমণের ফলে সুলতান আহমাদ দুর্বল হয়ে যান। আর-রাই ও সুলতানিয়া দখল করে তৈমুর সমরখন্দে প্রত্যাবর্তন করেন। এরফলে ১৩৮৬ সালে তৈমুর লং পুনরায় জালায়রিদ আক্রমণ করলে তিনি তা প্রতিহত করতে পারেননি। তৈমুর এর ফলে তাবরিজ নিয়ে নেন এবং তাবরিজের নাগরিকদেরকে ভারি নজরানা দিতে হয়। আদিল আকা এই নজরানা গ্রহণ করেন, কিন্তু তৈমুর তাকে দুর্নীতিবাজ সন্দেহে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এভাবে ১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর আজারবাইজান ও জর্জিয়া অধিকার করেন এবং গিলান ও শিরওয়ানের যুবরাজদ্বয়ও তার বশ্যতা স্বীকার করেন। এরপর থেকে আজারবাইজান তৈমুরের নিয়ন্ত্রণেই ছিল, কারণ আহমাদ আর এটি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। ১৩৯৩ সালে পুনরায় তৈমুর জালায়রিদ রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এর মধ্যে তৈমুর একে একে সমস্ত দক্ষিণ-পারস্য, আর্মেনিয়া, বাগদাদ, মেসােপটেমিয়া ও দিয়েরবেকির পদানত করে ফেলেছেন। ঐ সময় আহমাদ বাগদাদে ছিলেন। আগস্টের শেষের দিকে তৈমুর বাগদাদে পৌঁছেন, যেখানে সুলতান আহমদ অবস্থান করছিলেন। তৈমুরের হাত থেকে বাগদাদকে বাঁচানো অসম্ভব বিবেচনা করে তিনি মিশরের মামলুক অধীনস্ত সিরিয়ায় পালিয়ে যান এবং তদকালীন মামলুক শাসক সুলতান বারকুকের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদিকে তৈমুর বাগদাদকে ভারি প্রায়শ্চিত্ত দিতে বাধ্য করা হয় ও অনেক বন্দিকে সাথে নিয়ে যাওয়া হয়, যার মধ্যে আহমাদের পুত্র আলা আল দৌলাও ছিলেন। তবে বাগদাদ নগরের বেশিরভাগ অংশেরই কোন ক্ষতি করা হয়নি। খাজা মাসুদ সাবজাভারি নামে একজন সারবাদারকে নগর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে তৈমুর সমরখন্দ প্রত্যাবর্তন করলে ১৩৯৪ সালে সুলতান আহমাদ বাগদাদে ফিরে আসেন ও পরবর্তী ছয় বছরের জন্য বাগদাদ শাসন করেন। কিন্তু ১৪০১ সালে পুনরায় তৈমুর বাগদাদ দখল করেন, ১৪০৫ সালে তৈমুরের মৃত্যুর পর তিনি অল্প কালের জন্য বাগদাদ, তথা ইরাক ফিরে পান, কিন্তু ১৪১০ সালে কারা কুনলু বা কৃষ্ণ মেষের কারা ইউসুফ তাকে পরাজিত ও হত্যা করে বাগদাদ, তথা ইরাক দখল করে নেন।

যাই হোক, ১৩৮৬ সালে আজারবাইজান দখলের পর তৈমুর নবপ্রতিষ্ঠিত কারা-কুয়ুনলু রাজ্যের রাজধানী ভ্যান দখল করেন। এই রাজ্যের যুবরাজ কারা ইউসুফ পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন এবং অটোমান তুর্কি সুলতান প্রথম বায়েজীদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে পলাতক কারা ইউসুফকে আশ্রয় দিয়ে বায়েজীদ তৈমুরের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। পরে এটিই উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষের অন্যতম একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শাহ সুজার পুত্র জয়নুল আবেদিন এসময় মোজাফফারীয় বংশের শাসনকর্তা ছিলেন। তার রাজধানী ছিল ফার্স। তৈমুর মোজাফফারীয় সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান শহর ইস্পাহান অধিকারের নির্দেশ দিলেন। একপ্রকার বিনাযুদ্ধেই ইস্পাহান তৈমুরের কাছে আত্মসমর্পণ করল। কিন্তু হঠাৎ এক ক্ষিপ্ত জনতা তৈমুরের সৈন্যদের ওপর চড়াও হয়ে তার তিন হাজার সৈন্যকে হত্যা করল। পরদিন যখন এই সংবাদ তৈমুরের গােচরীভূত হল, তখন তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। মৃতদের মধ্যে ছিল তৈমুরের এক প্রিয় আমীর। প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের আদেশ দিলেন তিনি। প্রতিটি সৈন্যকে এক একজন ইরানির ছিন্ন মস্তক আনতে নির্দেশ দেয়া হল। সমস্ত দিন ধরে এই হত্যা উৎসব চলল। তৈমুরের সৈন্যদের কাছে মানব জীবন এত তুচ্ছ বােধ হয় আর কখনও মনে হয়নি। তৈমুরের বহু সৈন্য এভাবে ঠাণ্ডা মস্তিকে হত্যার দ্বারা নিজেদের হাত কলুষিত করতে চাহিল না। কিন্তু তৈমুরের আদেশ অমান্য করার সাহস কারও ছিল না। ফলে তারা অপর সৈন্যদের কাছ থেকে ছিন্ন মস্তক ক্রয় করে আনল। প্রথমে প্রতিটি মস্তক কুড়ি দিনারে বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু পরে নির্দিষ্ট সংখ্যা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় অর্ধ-দিনার এমনকি বিনামূল্যেও একটি মস্তক পাওয়া যেতেছিল। তৈমুরের নির্দেশে ছিন্ন মস্তকগুলো স্তুপাকারে একস্থানে রেখে একটি উচু কেল্লা তৈরি করা হল। এভাবে ইপাহানে সত্তর হাজারেরও বেশি লােক প্রাণ হারালো। (হ্যারল্ড ল্যাম্ব : Taimberlane, নিউইয়র্ক, ১৯২৮)। তবে প্রথম থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের কোন পরিকল্পনাই তৈমুরের ছিল না। বাধ্য হয়েই তৈমুরকে তার সৈন্যদের হত্যার প্রতিশােধ নিতে হয়েছিল। কিন্তু এই প্রতিশোধে নিষ্ঠুরতা ছিল সীমাহীন। কেবলমাত্র মনসুর ছাড়া মোজাফফরীয় বংশের অন্যান্য যুবরাজগণ ভীত হয়ে তৈমুরের কাছে আত্মসমর্পণ করল। মনসুর পলায়ন করে আত্মগােপন করল। সমগ্র পারস্য তৈমুরের অধিকারের এলো এবং প্রতিটি মসজিদে শুক্রবারের খুৎবায় তৈমুরের নাম পাঠ করা হতে লাগল।  পারস্যের শিরাজ নগরীতে অবস্থানকালে তৈমুর বিখ্যাত ফার্সি কবি হাফিজকে এক সময় তার দরবারে ডেকে পাঠালেন। কবি নিতান্ত সাধারণ পােশাকে তৈমুরের কাছে উপস্থিত হলেন। তৈমুর মৃদু তিরস্কারের স্বরে কবিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি এইসব কি লিখেছেন?”  ‘আমার শিরাজ-বঁধূয়া যদি গাে দিল পরে মাের হাত বুলায়, পা’র তলে তার লুটিয়ে দেব গাে সমরখন্দ আর বােখারায়।” (হ্যারল্ড ল্যাম্ব : Taimberlane, নিউইয়র্ক, ১৯২৮, কবিতার অনুবাদটি গৃহীত হয়েছে আবুল কালাম শামসুদ্দিন কর্তৃক হ্যারল্ড ল্যাম্বের পুস্তকটির অনুবাদগ্রন্থ ‘দিগ্বিজয়ী তাইমুর’ থেকে, রায়হান পাবলিকেশনস, ঢাকা, ১৯৬৫, পৃ: ১৪৯) হাফিজ উত্তরে বললেন, “শাহানশাহ এটা আমার কবিতা মাত্র। তৈমুর বললেন, “বহু বছর সংগ্রাম করে তলােয়ার বলে আমি সমরখন্দ অধিকার করেছি এবং এই সমরখন্দের জন্যই আমাকে অন্যান্য শহর থেকে বহু মূল্যবান সামগ্রী সগ্রহ করতে হয়েছে। আর আপনি কিনা শিরাজের একটি মেয়ের জন্য তা বিলিয়ে দিতে চান?” কবি একটু ইতস্তত করে মৃদুহাস্যে বললেন, “জাহাঁপনা, দেখতেই পাচ্ছেন যে এই অমিতব্যয়িতার জন্যই তাে আমার আজ এই দুর্দশা।” এই ত্বরিত অথচ চমৎকার উত্তরে তৈমুর নিতান্ত সন্তুষ্ট হলেন এবং কবিকে বিশেষভাবে ধন-রত্ন দ্বারা পুরষ্কৃত করে সম্মানের সাথে বিদায় দিলেন। 

রাশিয়া অভিযান 

তৈমুরের বিজয় অভিযানগুলোর মধ্যে রাশিয়ায় অবস্থিত গােল্ডেন হাের্ড বা সােনালি বাহিনীর সাম্রাজ্য আক্রমণ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৮০ খিস্টাব্দ পর্যন্ত এই দশ বছরের মধ্যে প্রাক্তন মােঙ্গল সাম্রাজ্যের তিন -চতুর্থাংশই তৈমুরের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। বাকি যে অংশ রইল তা হল তৈমুরের সাম্রাজ্যের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত গােল্ডেন হাের্ড বা সােনালি বাহিনীর সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস খানের জ্যেষ্ঠপুত্র জুচির ছেলে বাতু ছিলেন এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এসময় গােল্ডেন হাের্ডের খান ছিলেন মামাই এবং এর পূর্বে অবস্থিত শ্বেতবাহিনী সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন উরুস খান। তোখতামিশ নামে ক্রিমিয়ার মোঙ্গল গােত্রের এক সামন্তরাজ গােল্ডেন হাের্ডের আওতা থেকে পালিয়ে তৈমুরের দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মূলত তৈমুর এটিই চেয়েছিলেন। কারণ গােল্ডেন হাের্ডের খানকে পরাজিত করে তার শক্তি ও গৌরবের প্রমাণ দেয়ার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। চেঙ্গিস খানের বংশধর একজন তার পক্ষে, এটি তৈমুরের কাছে সৌভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। এছাড়া তৎকালীন রীতি অনুসারে আশ্রয়প্রার্থীকে ত্যাগ করাও তৈমুরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তৈমুর তোখতামিশের সম্মানে ভােজের আয়ােজন করলেন এবং তাকে ‘পুত্র’ বলে সম্বােধণ করলেন। তৈমুরের সাহায্যপুষ্ট হয়ে তােখতামিশ উরুস খানের বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন। কিন্তু উপর্যুপরি দুবার তিনি ভীষণভাবে পরাজিত হলেন। সৌভাগ্যবশত উরুস খান এসময় মৃত্যুবরণ করলে তোখতামিশ গােল্ডেন হাের্ডের সিংহাসনে প্রকৃত দাবিদার হয়ে পড়লেন এবং মােঙ্গলদের সমর্থন লাভ করে যুদ্ধে জয়ী হতে লাগলেন। তোখতামিশ মামাইকে বিতাড়িত করে ভল্গা নদী তীরে অবস্থিত রাজধানী সরাই শহর দখলে আনলেন। তােখতামিশ ছিলেন একগুঁয়ে, নিষ্ঠুর এবং তার নীতির কোন বালাই ছিল না। তিনি রাশিয়ার সীমান্ত রাজাদের কাছে কর দাবি করলেন। কিন্তু মাত্র দুই বছর পূর্বে ডন নদী তীরে গােল্ডেন হাের্ড অধিপতি মামাইকে পরাজিত করার গৌরব স্মৃতি তখনও তারা ভুলে যায়নি। কাজেই তােখতামিশের দাবির প্রতি তারা কর্ণপাতও করল না। ফলে তােখতামিশ বাধ্য হয়ে মস্কো অবরােধ করলেন এবং মকো তার হাতে বিধ্বস্ত ও অগ্নিদগ্ধ হল। এতে মস্কোর গ্র্যান্ড প্রিন্সের দুর্দশার সীমা রইল না। এবং মকো বিজয়ী তােখতামিশ ধরাকে সরাজ্ঞান করতে লাগলেন, তৈমুরের আশ্রয় ও সাহায্যের কথা তিনি ভুলে গেলেন। কিন্তু হাের্ডের এই সৌভাগ্য বেশি দিন স্থায়ী হল না। তৈমুরের খােরাসান অভিযানের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে অপরিণামদর্শী তােখতামিশ তাবরিজ আক্রমণ করেন। দশদিন ব্যাপী লুণ্ঠন, ধ্বংস ও হত্যাকাণ্ডের পর তাবরিজ থেকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ নিয়ে তােখতামিশ নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সংবাদ তৈমুরের কাছে পৌঁছলে তিনি অকৃতজ্ঞ তােখতামিশের ওপর অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হলেন এবং ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে দুই লক্ষ সৈন্যসহ গােল্ডেন হাের্ড সাম্রাজ্য আক্রমণ করলেন। তৈমুর উপলদ্ধি করতে পারলেন যে, তােখতামিশ যতদিন উত্তরাঞ্চলের অধিপতি হয়ে থাকবেন ততদিন সমরখন্দের নিরাপত্তার কোন নিশ্চয়তা নাই। কাজেই তােখতামিশকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার জন্য তৈমুর সবরকম ঝুঁকি গ্রহণের সর্বাত্মক প্রস্তুতি হলেন। আসন্ন পরিণতির কথা চিন্তা করে তােখতামিশ তৈমুরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে সন্ধির প্রস্তাব করলেন। নয়টি সুন্দর ঘােড়া এবং মুক্তার কণ্ঠকবচ পরিহিত একটি বাজপাখি তৈমুরের কাছে দূত মারফত উপহার হিসেবে প্রেরণ করা হল। কিন্তু এতে কোন ফল হল না। কারণ এটি যে ধূর্ত তােখতামিশের পক্ষে একটি কূটনৈতিক চালমাত্র তৈমুরের তা উপলদ্ধি করতে বিলম্ব হল না।

তবে তােখতামিশের এই শান্তি প্রস্তাব একেবারে বাতিল করে না দিয়ে গােল্ডেন হাের্ডের প্রধান উজির আলী বেঁকে এই সম্পর্কে আলােচনা চালানাের জন্যে তৈমুরের কাছে উপস্থিত হতে বললেন। আসলে সন্ধির ব্যাপারে তােখতামিশের আন্তরিকতা পরীক্ষা করার জন্যই তৈমুর এই পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। কিন্তু আলী বেঁ যখন তৈমুরের কথামতাে তার দরবারে এলো না, তখন তােখতামিশের শান্তি প্রস্তাবের পেছনে অসৎ উদ্দেশ্যের কথা পরিষ্কার হয়ে গেল এবং উভয় বাহিনী মােকাবেলা করার জন্য অগ্রসর হল। ভরা নদীর পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত কুনদুজচা নামক স্থানে অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধে তােখতামিশ পরাজিত হলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পলায়ন করলেন। এই যুদ্ধে তােখতামিশের প্রায় এক লক্ষ সৈন্য হতাহত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। যুদ্ধশেষে তৈমুর এত অর্থ-সম্পদ ও সােনা রুপা পেলেন যে প্রতিটি সৈনিকের সারা জীবনের প্রয়ােজন মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল। ভরা নদীর তীরে সপ্তাহব্যাপী এক উৎসব শেষে তৈমুর সমরখন্দ প্রত্যাবর্তন করলেন। গােল্ডেন হাের্ডের সারাই শহরে একজন মােঙ্গল শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হল।  কিন্তু এই যুদ্ধে তােখতামিশের শক্তি ও সমর্থন নিশ্চিহ্ন হল না। মাত্র তিন বছর পরেই তােখতামিশ আবার কাস্পিয়ান সাগরের উত্তর দিকে তৈমুরের রাজ্যসীমায় এসে হানা দিলেন। এই সংবাদে তৈমুর এতই ক্ষুব্ধ হলেন যে, অনতিবিলম্বে তিনি তােখতামিশকে উচিত শিক্ষাদানের জন্য রাশিয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। কিন্তু তার প্রস্তুতি এবার তেমন ব্যাপক ছিল না বলে যুদ্ধে তিনি অল্পের জন্য পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা পেলেন। এমনকি যুদ্ধের এক পর্যায়ে তোকতামিশের হাতে তৈমুরের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে গােল্ডেন হাের্ড বাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হল এবং তােখতামিশ উত্তরাঞ্চলের গভীর জঙ্গলে পলায়ন করলেন। তার সৈন্যবাহিনীর কিছু সংখ্যক ক্রিমিয়ায়, কিছু আদ্রিওনােপল ও হাঙ্গেরিতে আশ্রয় নিল। বাকি অংশ তৈমুরের বশ্যতা স্বীকার করে তার দলে যােগদান করল। দীর্ঘ দেড়শত বছরের পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী গােল্ডেন হাের্ড সাম্রাজ্যের এভাবে চির অবসান ঘটল।   গােল্ডেন হাের্ডের রাজধানী সারাই দখল করার পর তৈমুর অস্ত্রাখান আক্রমণ করলেন। বিরাট ধ্বংস ও হত্যার মাধ্যমে অস্ত্রাখান তৈমুরের হস্তগত হল। তৈমুরের মস্কো পদানত করার ইচ্ছা ছিল এবং এটি তৈমুরের কাছে কোন কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু এসময় প্রচণ্ড শীত পড়ায় এবং মাত্র কয়েক বছর পূর্বে লুণ্ঠিত এবং বিধ্বস্ত মস্কো শহর আক্রমণ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তেমন লাভজনক ব্যাপার মনে না হওয়ায় তৈমুর এই পরিকল্পনা ত্যাগ করলেন। তৈমুরের ভয়ে মস্কোবাসী এতই ভীত হয়ে পড়েছিল যে, যুদ্ধ প্রস্তুতি না নিয়ে তারা মা মেরির কৃপার ওপরই মস্কো রক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল। তৈমুর ব্যক্তিগত কারণে মস্কো আক্রমণ না করায় মস্কো রক্ষা পেয়ে গেল। অস্ত্রাখান পদানত করার পর তৈমুর আরব সাগরের তীরবর্তী ইউরােপীয় উপনিবেশগুলো দখল করলেন। ভেনিস, জেনােয়া, বাস্ক ও কাটান নামক সাগর তীরবর্তী বন্দর-শহরগুলো একের পর এক তৈমুরের অধিকারে এলো। তৈমুর কাস্পিয়ান সাগরের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করে তার অভিযানের পরিসমাপ্তি টানলেন। সুদূর বিস্তারিত সাইবেরিয়ান তৃণভূমি অতিক্রম করে তৈমুর অবশেষে আলবুর্জ পর্বতমালার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন। পথিমধ্যে তিনি কালাত ও তাক্রিত নামে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ অধিকার করলেন। এই বিজয় অভিযানের ফলে তৈমুর তখন উত্তরাঞ্চল, আরাল, কাস্পিয়ান সাগর, পারস্য ও ককেশাস পার্বত্যভূমির একচ্ছত্র অধিপতি হলেন। 

ভারত আক্রমণ

তৈমুরের ভারত বিজয় তার কৃতিত্বের অন্যতম উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ভারতবর্ষের ধনরত্ন ও অতুল ঐশ্বর্য প্রথম থেকেই মােঙ্গলদের লােলুপ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চেঙ্গিস খান পাঞ্জাব ও মুলতান পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে নানা কারণে সিন্ধু নদী অতিক্রম করেননি। বােধ হয় ভারতের প্রতিকূল আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাই এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। কিন্তু তৈমুরের বেলায়ের ব্যতিক্রম হল। এসময় দিল্লির সুলতান ছিলেন তুঘলক বংশের মাহমুদ শাহ। তিনি দুর্বলচেতা সুলতান ছিলেন। ফলে সাম্রাজ্যের অরাজকতা ও আমীরদের মধ্যে অন্তঃকলহ দেখা দেয়। এই অবস্থার সুযােগ নিয়ে তৈমুর ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে তার পৌত্র পীর মােহাম্মদকে সসৈন্যে ভারত আক্রমণের নির্দেশ দেন। পীর মােহাম্মদ সিন্ধু নদী অতিক্রম করে পাঞ্জাবের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন এবং মুলতান অবরােধ করেন। মুলতানের শাসনকর্তা সারাং খান দীর্ঘ ছয় মাস সাহসিকতার সাথে মুলতানের পতন ঠেকিয়ে রাখেন। অবশেষে তিনি পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন এবং মুলতান তৈমুরের অধিকারে চলে যায়।  এরপর তৈমুর নিজে নব্বই হাজার সৈন্যসহ দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তৈমুর দিল্লির উপকণ্ঠে উপস্থিত হলেন। দিল্লির সুলতান ও তার সেনাপতি মাল্লু খান পঞ্চাশ হাজার সৈন্যসহ তৈমুরের গতিরােধ করতে গিয়ে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। বিজয়ীবেশে তৈমুর দিল্লির অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। প্রচুর অর্থদণ্ডের বিনিময়ে তিনি দিল্লির নাগরিকদেরকে জীবননাশ থেকে অব্যাহতি দিতে রাজি হলেন। কিন্তু তৈমুরের সৈন্যগণ লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে চেষ্টা করলে তাদের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে কিছু সংখ্যক হিন্দু নাগরিক বাধা প্রদান করে এবং তৈমুরের সৈন্যদের আক্রমণ করে। এতে তৈমুর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযােগের আদেশ দিলেন। ফলে দিল্লী এক রক্তাক্ত কসাইখানায় পরিণত হল। অনুমান করা হয় যে প্রায় লক্ষাধিক লােক এই হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল। ভারত যতবার বৈদেশিক শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তার মধ্যে তৈমুরের আক্রমণই সর্বাপেক্ষা মর্মস্পর্শী ঘটনা। (আর. সি. মজুমদার ও অন্যান্য : An Advanced History of India, লন্ডন, ১৯৬৩, পৃ: ৩৩৬-৩৭)। ভারতে অবস্থান করা অথবা দিল্লিকে স্থায়ীভাবে সাম্রাজ্যভুক্ত করার কোন ইচ্ছাই তৈমুরের ছিল না। পঁচিশ দিন পর্যন্ত লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডের পর অগণিত ধনরাশি ও অসংখ্য ক্রীতদাস নিয়ে তৈমুর দিল্লি ত্যাগ করে সমরখন্দ অভিমুখে যাত্রা করলেন। প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি মিরাট বিধ্বস্ত করেন, আগ্রা পদানত করেন এবং জম্মু লুণ্ঠিত হয়। তৈমুর খিজির খানকে মুলতান ও লাহােরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন, কিন্তু দিল্লি নিজের ভাগ্যের ওপরই পরিত্যক্ত হয়। এরপর “ভয় এবং ধ্বংস, দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীর এক বীভৎস কাহিনী পেছনে রেখে” তৈমুর ভারত ত্যাগ করেন। তৈমুরের ভারত আক্রমণের ফলে এদেশের যে ক্ষতি সাধিত হয় তা পূরণ করতে বহু যুগ সময় লেগেছিল। কত লােক যে প্রাণ হারিয়েছিল, কত শহর ও গ্রাম যে শ্মশানে পরিণত হয়েছিল এবং কত সম্পদ যে লুণ্ঠিত ও অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। তৈমুরের ভারত আক্রমণের ফলে তুঘলক বংশের যবনিকা পতন হয়। তৈমুর ভারত ত্যাগ করলে পলাতক সুলতান মাহমুদ শাহ দিল্লি ফিরে এসে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করলে তিনি তা বেশি দিন ভােগ করতে পারেননি। ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তৈমুরের প্রতিনিধি খিজির খান তুঘলক বংশের পতন ঘটিয়ে সৈয়দ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তৈমুরের ভারত আক্রমণে ভারতীয় শিল্পকলার বিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। কিন্তু এর ফলে মধ্য-এশিয়ায় ভারতীয় শিল্প বিস্তার লাভ করে। তৈমুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় ভারত থেকে বহু শিল্পী, স্থপতি ও কারিগর তার সঙ্গে নিয়ে যান। এই সকল শিল্পিবৃন্দ তৈমুরের নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুসারে সমরখন্দকে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। 

মামলুকদের বিরুদ্ধে অভিযান, সিরিয়া ও ইরাক আক্রমণ

ভারত অভিযানের পর তৈমুর সমরখন্দে প্রত্যাবর্তন করেন। তার পরবর্তী আক্রমণের শিকার হল মিশর ও সিরিয়ার মামলুক সাম্রাজ্য। এসময় মিশরের মামলুক সুলতান ছিলেন মালিক আলনাসির ফারাজ। সুলতান বারকুকের মৃত্যুর পর তার দশ বছর বয়স্ক পুত্র নাসিরুদ্দিন আল-ফারাজ ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে মিশরের বুরজি মামলুক সিংহাসনে উপবেশন করেন। তিনি দুর্বলচেতা শাসক ছিলেন এবং মামলুকদের পূর্ব গৌরব তার হাতে ক্ষুন্ন হয়। মিশর ও সিরিয়ায় এই সময় চরম অরাজকতা চলছিল। সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা আল-ফারাজের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে বিদ্রোহী হলে সুলতান দামেস্ক আক্রমণ করেন এবং বিদ্রোহীদের পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। ফলে সিরিয়ায় শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এই সময়ে তৈমুরের সিরিয়া আক্রমণ বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ভারত অভিযান শেষে ১৪০০ সালের দিকে তিনি ফিরে এসেছেন। এই দেখে তদকালীন মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরের শাসক ভীত হয়ে পড়েছেন। বাগদাদের জালায়েরি শাসক সুলতান আহমদ অটোমান শাসক বায়েজীদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। যাই হোক, তৈমুর সর্বপ্রথম সমরখন্দ থেকে আজারবাইজান গমন করেন এবং এশিয়া মাইনরে অবস্থিত অটোমান তুর্কিদের কাছ থেকে সিভাস দুর্গটি দখল করলেন। এরপর তৈমুর এশিয়া মাইনরে আর অগ্রসর না হয়ে সেনাবাহিনীর গতি পরিবর্তন করে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথিমধ্যে বাহাসনা দুর্গটি তৈমুরের হস্তগত হল। সিরিয়া সেই সময়ে মিশরের মামলুক শাসকদের নিয়ন্ত্রণে। বস্তুত বারকুকের সময় থেকেই মামলুকগণ তৈমুরের আক্রমণের আশঙ্কা করছিল। কিন্তু ফারাজের সময় এই মহাবিপদ অবশেষে সত্যিই উপস্থিত হলো। তৈমুর  তার বিদ্রোহী আমীর ইতিলমিশকে তার কাছে সমর্পণ করে তার অধীনতা স্বীকারের জন্য আল-ফারাজের কাছে পত্র লিখলেন। কিন্তু তৈমুরের এই পত্র আল-ফারাজ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তৈমুরের প্রেরিত দূতকে হত্যা করা হলো। এতে তৈমুরের ক্রোধের সীমা রইল না। তিনি আলেপ্পো অবরোধ করলেন। আলেপ্পোর গভর্নর দামরুদশাহ প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। আলেপ্পোয় এক মাস অবস্থানের পর সিরিয়ার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শহর দামেস্ক তৈমুরের সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হল।

এই সংবাদে মামলুক সুলতান ফারাজ মামলুক বাহিনীসহ তৈমুরকে প্রতিহত করার জন্য কায়রাে থেকে দামেস্ক অভিমুখে অগ্রসর হলেন। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত তৈমুরের সাথে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে সাহস করলেন না, তৈমুরের কাছে প্রেরিত এক পত্রে তিনি ইতিলমিশকে মুক্তি দিয়ে তার অধীনতা স্বীকার করলেন এবং নিয়মিত কর প্রদানে রাজি হলেন। অতপর আল-ফারাজ সিরিয়া পরিত্যাগ করে দ্রুত মিশর প্রত্যাবর্তন করলেন। এতে সিরিয়ার সৈন্যদের মধ্যে ভীষণ হতাশার সৃষ্টি হল। দামেস্কবাসী এভাবে তাদের সুলতান কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ল। কিন্তু বিনা যুদ্ধে তার তৈমুরের কাছে বশ্যতা স্বীকারে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু সাহস ও বীরত্বের সাথে তারা তৈমুরের সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করে চলল। দামেস্কবাসী বীরের মতো তৈমুর বাহিনীকে প্রতিরােধ করে চলল এবং বহু ক্ষয়-ক্ষতির বিনিময়ে প্রায় একমাস অবরােধের পর অবশেষে তৈমুর দামেস্ক দখল করতে সক্ষম হলেন। বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ না করার অপরাধে দামেস্কবাসীর ওপর নেমে এলো হত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসের এক মহা বিভীষিকা। তৈমুর বাহিনী প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দামেস্কবাসীর উপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালালো এবং এককালীন উমাইয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী দামেস্ক শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো। তৈমুর বললেন, এর মাধ্যমে তিনি দামেস্কের উমাইয়া শাসকদের দ্বারা হাসান ও হুসেইন হত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছেন। মিশর জয় করে তৈমুরের পক্ষে পিরামিড দেখা সম্ভব হলো না বলে তিনি দামেস্ক শহরের উপকণ্ঠে ত্রিশ হাজার যুদ্ধবন্দির ছিন্ন মস্তক দ্বারা একটি নকল পিরামিড তৈরির নির্দেশ দিলেন। প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে হালাকু খানের হাতে যেমন বাগদাদ ধ্বংস হয়েছিল তৈমুরের হাতেও দামেস্ক শহরের প্রায় একই পরিণতি হলো। সর্বোপরি তৈমুরের কাছে মামলুকদের এই পরাজয় এবং আল-ফারাজের বশ্যতা স্বীকার বিগত দেড় শতাব্দী যাবৎ মােঙ্গলদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয় গৌরবকে ধূলিসাৎ করে দিল। এসময় অটোমান তুর্কি সুলতান প্রথম বায়েজীদ তৈমুরের মােকাবেলা করার জন্য সসৈন্যে এশিয়া মাইনরে আগমন করলেন। ফলে তৈমুর পশ্চিম সীমান্তে তার বিজয় অভিযান অব্যাহত না রেখে এশিয়া মাইনরে ফিরে যান।     

এরমধ্যে তৈমুরের বাগদাদ ধ্বংসের ঘটাটিও উল্লেখ করা দরকার। ১৪০১ সালের মে মাসে তৈমুর বাগদাদ দখলের উদ্দেশ্যে সৈন্য পাঠান। কিন্তু তাদেরকে প্রতিহত করা হয়। এরপর তৈমুর সেখানে আরও সৈন্য পাঠান। কিন্তু তাও বাগদাদ দখল করা যায়নি। এরফলে তৈমুর নিজে বাগদাদে এসে আক্রমণ করেনে এবং আরও ৪০ দিন ধরে বাগদাদ অবরোধ করার পর বাগদাদ দখল করা সম্ভব হয়। বাগদাদ দখল করার পর এর প্রায় সকল পুরুষ,নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয় ও বেশিরভাগ পাবলিক বিল্ডিংকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এই ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ এতই বিপুল ছিল যে তৈমুর বাগদাদে পুনরায় নতুন গভর্নর নিযুক্ত করার প্রয়োজনই বোধ করেননি।

১৪০২ খ্রিস্টাব্দে আঙ্গোরার যুদ্ধে বায়েজীদকে পরাজিত করে তৈমুর ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিস নদীবিধৌত অঞ্চলের দিকে পুনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। এবার মিশরের মামলুকদের আক্রমণ করার কোন প্রতিবন্ধকতাই তৈমুরের পেছনে রইল না। বায়েজীদের পরাজয় এবং সসৈন্যে তৈমুরের মিশর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সংবাদে মামলুক সুলতান মালিক আল-নাসির ফারাজ অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়লেন। তৈমুরের সাথে যুদ্ধে অবধারিত পরাজয় এবং এই পরাজয়ের ফলাফল কি ফারাজ তা ভালভাবেই জানতেন। কাজেই তিনি তৈমুরের বশ্যতা স্বীকার করে তাকে বার্ষিক করদানে রাজি হয়ে তার কাছে দূত প্রেরণ করলেন। ফারাজের দরবারে পলাতক সুলতান আহমদকে তৈমুরের কাছে পাঠানো হল এবং তিনি কারাগারে আবদ্ধ হলেন। কারবালা ও বাগদাদসহ মামলুকদের এশিয়া মহাদেশের অংশটুকু তৈমুরের হস্তগত হল। ফারাজের আত্মসমর্পণের ফলে মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যে তৈমুরের নামে খুৎবা পাঠ করা হতে লাগল। চেঙ্গিস খানের বংশধর অথবা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তৈমুরই সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ সমরে না হলেও মামলুক সুলতানকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করলেন। আইনজালুতের যুদ্ধে মােঙ্গলদের পরাজয়ের গ্লানি এবার তৈমুরের হাতেই মােচন হল।

এশিয়া মাইনর ও তুরস্ক বিজয়

পূর্ব-ইউরোপ বিজয়ী অটোমান সুলতান বায়েজীদ ও এশিয়া বিজয়ী তৈমুরের মধ্যকার সংঘর্ষ পৃথিবীর সমকালীন যুদ্ধের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই যুদ্ধ অবশ্য কোন আকস্মিক বা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার নয়। মোঙ্গল অধিপতি চেঙ্গিস খানের উত্তরাধিকারী হিসেবে তৈমুর এশিয়া মাইনরে তার আধিপত্যের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন ছিলেন। পক্ষান্তরে সেলজুক তুর্কিদের উত্তরাধিকারী হিসেবে অটোমান সুলতান বায়েজীদও এশিয়া মাইনরে তার আধিপত্যের দাবিদার ছিলেন। কিন্তু অটোমানগণ এতদিন যাবৎ এশিয়া মাইনর পদানত করার পূর্বে ইউরোপের দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল। অনুরূপভাবে তৈমুর ও মধ্য এশিয়ায় নিজ কর্তৃত্ব বিস্তারে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষের কোন প্রশ্নই ওঠেনি। এছাড়া অটোমানদের দ্বারা ইউরোপের খ্রিস্টান শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় তৈমুরের কাছে ধর্মীয় কারণেও সুখকর সংবাদ ছিল। কিন্তু বায়েজীদ তুরস্কের সিংহাসনে আরোহণ করার পর অটোমানদের সাথে তৈমুরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হলো। কারণ অটোমান সুলতানদের মধ্যে বায়েজীদই সর্বপ্রথম নীতিগতভাবে এশিয়া মাইনরে অটোমান প্রভুত্ব বিস্তারে মনোযোগী হলেন। ফলে নানা কারণে অবশেষে সেই যুগের এই শ্রেষ্ঠ মুসলিম নরপতিদ্বয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দেখা দিল।

এই সংঘর্যের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায় যে প্রথমত তৈমুর ও বায়েজীদ উভয়েই শক্তিশালী এবং উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং একে অপরকে ভীতি ও সন্দেহের চোখে দেখতেন। দ্বিতীয়ত উভয় সাম্রাজ্যের অবস্থান পাশাপাশি হওয়ায় সীমান্ত নিয়ে কলহের সৃষ্টি খুবই স্বাভাবিক ছিল। তৃতীয়ত, মোঙ্গল ও তুর্কিদের মধ্যে মরণানীত কাল থেকে শত্রুতা চলে আসছিল। তৈমুর চাঘতাই মোঙ্গল ছিলেন এবং অটোমান তুর্কিগণ তৈমুরকে তাতার অধিপতি বলে মনে করতো। প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মোঙ্গলদের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই মধ্য এশিয়া থেকে স্বদেশত্যাগী তুর্কিগণ এশিয়া মাইনরে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং কালক্রমে অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তাই জাতীয় শত্রু হিসেবে তুর্কি ও মোঙ্গলদের মধ্যে আগে থেকেই যে বৈরীভাব বিরাজ করছিল তা এসময়ে আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। কিন্তু বায়েজীদ ও তৈমুরের মধ্যকার স্বাভাবিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটিয়ে অবশেষে উভয়কে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার পর্যায়ে ঠেলে দেবার পেছনে বোধ হয় উভয়ের পক্ষে রাজদ্রোহীদের আশ্রয় প্রদান ও তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীই প্রধান হিল। আজারবাইজানের বিদ্রোহী যুবরাজ কারা ইউসুফবাগদাদের সুলতান আহমদকে বায়েজীদ তার দরবারে আশ্রয় দিয়ে তৈমুরের বিরাগভাজন হলেন। পক্ষান্তরে অটোমানদের দ্বারা নববিজিত এশিয়া মাইনরের আইডিন ও কাস্তেমুনির পলাতক আমীর ও যুবরাজদেরকে তৈমুর তার দরবারে স্থান দিয়ে বায়েজীদের রোষানলে পড়লেন। তৈমুর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, প্রথমে তিনি বায়েজীদকে তার বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক নীতি বর্জন করে যুক্তি ও শুভবুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ এবং কারা ইউসুফকে ফিরিয়ে দেবার জন্য বায়েজীদের কাছে পত্র লিখেছিলেন। কিন্তু বায়েজীদ এতে কর্ণপাত করেননি। পক্ষান্তরে তিনি তৈমুরের আশ্রিত রাজ্য এরজিনদিয়ানের আমীর তাহেরতিনকে স্বয়ং তার রাজকোষাগারের সকল অর্থ-সম্পদ নিয়ে অটোমান রাজদরবারে হাজির হতে আদশে দিলেন। তৈমুর এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন এবং উভয়ের মধ্যকার সম্পর্কে আরও অবনতি ঘটলো। তৈমুর বায়েজীদের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ আনলেন যে, খ্রিস্টান রমণী ওলিভিয়া ডেসপিনার পাণি গ্রহণ করে তিনি ইসলামের অবমাননা করেছেন। প্রত্যুত্তরে বায়েজীদ তৈমুরের স্ত্রী ও হারেমে রক্ষিত রমণীদের প্রতি অপমানসূচক মন্তব্য করে তার কাছে এক পত্র লিখলেন। এই পত্রে তিনি তৈমুরকে সশরীরে অটোমান রাজদরবারে উপস্থিত থেকে নির্দেশ দিলেন। তৈমুরের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের উপায় হিসেবে এই পত্রের প্রথমে তিনি সোনালি অক্ষরে নিজের নাম এবং নিচে কালো অক্ষরে তৈমুরের নাম লিখলেন। এতে তৈমুরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। উভয়ের মধ্যকার এই মসির যুদ্ধ অবশেষে অসির যুদ্ধে পরিণত হলো।

১৪০০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস। এক বিরাট–বাহিনী নিয়ে তৈমূর এশিয়া মাইনরে অবস্থিত সিভাস দুর্গ আক্রমণ করলেন। প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত এই শহরটি বিশেষভাবে সুরক্ষিত ছিল এবং মাত্র কিছুদিন পূর্বেই এটি অটোমানদের হস্তগত হয়েছিল। তৈমুরের হাত থেকে সিভাস রক্ষা করার জন্য বায়েজীদের পুত্র তুঘরিল প্রাণপণে যুদ্ধ করেও পরাজিত হলেন ও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিলেন। দীর্ঘ আঠার দিন অবরোধের পর সিভাস তৈমূরের অধিকারে এলো। কিন্তু এশিয়া মাইনরের দিকে আর অগ্রসর না হয়ে তৈমুর ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিস নদী বিধৌত অঞ্চলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। পরবর্তী দেড় বছরকাল তৈমুর বাগদাদ ও দামেস্ক অধিকারে ব্যয় করেন। ১৪০২ খ্রিস্টাব্দে শীতকালে তৈমুর এশিয়া মাইনর অভিমুখে যাত্রা করলেন। অটোমান সুলতান বায়েজীদের সাথে মোকাবেলা করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। তৈমুরের সঙ্গে ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ সৈন্যের সুসজ্জিত এক বিশাল বাহিনী। মধ্য-এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই বাহিনী সংগ্রহ করা হয়েছিল। তৈমুরের পুত্র শাহজাদা মোহাম্মদের ওপর এই বিশাল বাহিনীর মধ্যভাগ পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পিত হলো। এতে ছিল সমরখন্দের খ্যাতিসম্পন্ন আশিটি সেনাদল ও তাদের দলপতিবৃন্দ। প্রধান সেনাপতি নূরুদ্দিন তৈমুরের সঙ্গে থাকলেন। এছাড়া নানা বিচিত্র সাজে সজ্জিত ও বর্মাবৃত একটি হস্তীবাহিনীও তৈমুরের সঙ্গে চললো। শত্রুদের ওপর অগ্নি-গোলক নিক্ষেপ ও তীরদৃষ্টি বর্ষণ করাই এই বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল। তৈমুরের হাতে সিভাস দুর্গের পতন এবং যুদ্ধে তার পুত্র তুঘরিলের মৃত্যু সংবাদ বায়েজিদের কাছে পৌঁছলে তিনি দুঃখে ও ক্ষোভে অধীর হয়ে পড়লেন। এসময় অটোমান সেনাবাহিনী কন্সটান্টিনােপল অবরােধে নিয়ােজিত ছিল। সুলতান বায়েজীদ এই অবরােধ মুলতবি রেখে তৈমুরের সঙ্গে মােকাবেলা করার জন্য এশিয়া মাইনরের দিকে অগ্রসর হলেন। ইউরােপে অবস্থিত প্রতিটি অটোমান তুর্কি সৈন্যকে যুদ্বার্থে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেয়া হল। অতি সম্প্রতিকালে কাসােভা ও নিকোপলিসের যুদ্ধে সম্মিলিত খ্রিস্টান শক্তির বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী দুর্ধর্ষ অটোমান তুর্কি বাহিনীকে প্রথমে ব্রুসায় ও পরে আঙ্গোরায় সন্নিবেশিত করা হল। এদের সাথে যােগ দিল শক্তিশালী আনাতােলিয়ার সেনাবাহিনী ও সার্বিয়ার সম্রাট স্টিফেনের নেতৃত্বে বিশ হাজার লৌহবর্মাবৃত সার্বিয়ান ও বলকান অশ্বারােহীদল। এছাড়া গ্রিস ও ওয়ালাসিয়া থেকে এলো সুলতান বায়েজীদের সাহায্যে বিপুল সংখ্যক পদাতিক বাহিনী। সব মিলে বায়েজীদের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় দুই লক্ষের ওপর। অটোমান সেনাবাহিনীর বাম ও ডান বাহু পরিচালনার দায়িত্ব পড়ল যথাক্রমে সুলতানের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলাইমান ও প্রধান সেনাপতি তিমুরতাশের ওপর। পশ্চাদভাগ পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন সুলতানের অপর পুত্র মুহম্মদ। আর মধ্যভাগ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন সুলতান বায়েজীদ নিজেই। তার সঙ্গে রইল বিশ হাজার অনুগত ও অটোমান সেনাবাহিনীর গৌরব জ্যানিসারি সৈন্যদল। বায়েজীদের সৈন্যবাহিনী সকল যুদ্ধে কেবল জয়ই দেখেছে। কাজেই বায়েজীদ ছিলেন নিজ জয় সম্পর্কে একেবারে সংশয়হীন। 

১৪০২ খ্রিস্টাব্দে ২৮শে জুলাই। তৈমুর ও বায়েজীদের মধ্যকার অনুষ্ঠিত যুদ্ধ ইতিহাসে আঙ্গোরার যুদ্ধ বলে খ্যাত। আঙ্গোরা শহরটি ছিল একটি বিশাল প্রান্তরের ঠিক মধ্যস্থানে অবস্থিত। এই প্রান্তরেই সংঘটিত হল সেই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই যুদ্ধ। সকাল দশটায় প্রখর রৌদ্রতাপের মধ্যে তুর্কি বাহিনীই প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করল। প্রচণ্ড যুদ্ধ চললো এবং যুদ্ধের গতি ও প্রকৃতি প্রথমত অনিশ্চিত বলে মনে হতে লাগল। কিন্তু হঠাৎ তুর্কি বাহিনীর সম্মুখভাগ থেকে বহু সংখ্যক তাতার সৈন্য দলত্যাগ করে স্বজাতি তৈমুরের বাহিনীতে যােগদান করল। এদের সংখ্যা ছিল বায়েজীদের সৈন্য সংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এর ফলে তুর্কি বাহিনীতে চরম বিশৃঙ্খলা ও হতাশা দেখা দিল। বলতে গেলে এক প্রকার যুদ্ধের শুরুতেই তুর্কিগণ হারতে বসলো। উপায়ান্তর না দেখে বায়েজীদ তার পুত্র সুলাইমানকে বাম বাহু থেকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তৈমুরের পক্ষ থেকে অবিরাম তীর ও তৈলসিক্ত অগ্নিগােলক নিক্ষেপের ফলে সুলাইমান তার আক্রমণ জোরদার করতে পারলেন না। ধূলি ও ধূম্র যবনিকার অন্তরালে হাজার হাজার তুর্কি সৈন্য হতাহত এবং অদৃশ্য হতে লাগল। তৈমুরের প্রধান সেনাপতি নুরুদ্দিন তুর্কি বাহিনীর এই বিশৃঙ্খল অবস্থার পূর্ণ সুযােগ নিয়ে বীর বিক্রমে তুর্কি সৈন্যব্যুহ বিধ্বস্ত করে দিলেন। যুদ্ধের অবস্থা বেগতিক দেখে সুলাইমান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করলেন। সুলতান বায়েজীদ অশ্বপৃষ্ঠ থেকে একটি প্রকাণ্ড কুঠার হাতে অসাধারণ বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে চললেন। দীর্ঘ পনের মাইলব্যাপী বিস্তৃত এলাকা নিয়ে তৈমুর ও বায়েজীদের সৈন্যরা মুখােমুখি যুদ্ধ করছিল। এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ঐতিহাসিক আরাবশাহ ও শেরিফুদ্দিন সুলতান বায়েজীদের বীরত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এতে কোন ফল হল না। ক্লান্ত ও হতাশাগ্রস্ত সুলতান বায়েজীদের অশ্ব এক পর্যায়ে তীরবিদ্ধ হয়ে ভূলুণ্ঠিত হল এবং সারা বিকাল যুদ্ধের পর ঠিক সন্ধ্যালগ্নে বায়েজীদ তৈমুরের সৈন্যদের কাছে বন্দি হলেন। বায়েজীদের সাথে আরও বন্দি হলেন তার এক পুত্র, সেনাপতি তিমুরতাশ ও প্রিয় পত্নী ওলিভিয়া ডেসপিনা।

বন্দি অবস্থায় বায়েজীদকে যখন তৈমুরের কাছে হাজীর করা হল তখন ছিল রাত্রি দ্বিপ্রহর। বর্ণিত আছে যে এসময় তৈমুর তার পুত্র শাহরুখের সাথে দাবা খেলায় মগ্ন ছিলেন। বন্দি বায়েজীদকে দেখে তৈমুর উঠে দাঁড়ালেন এবং মৃদুহাস্যে তার মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এমন ভাগ্যবিপর্যয়েও বায়েজীদের রাজোচিত গর্ব-গাম্ভীর্য অক্ষুন্ন ছিল। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বললেন, “খােদা যাকে মেরেছেন, তাকে উপহাস করা অশােভন”। (তৈমুর ও বায়েজীদের মধ্যকার কথােপকথন হ্যারল্ড ল্যাম্বের Tamberlane’ শীর্ষক পুস্তক থেকে গৃহীত হয়েছে; নিউইয়র্ক, ১৯২৮)। উত্তরে অত্যন্ত ধীর ও শান্তভাবে তৈমুর বললেন, “আমি এই কারণে হেসেছি যে খােদা আমার মতাে একজন খোঁড়া এবং তােমার মতাে একজন অন্ধ ব্যক্তিকে পৃথিবীর মালিকানা দিয়েছেন।” এর পর গভীরভাবে তিনি বললেন, “তুমি যদি জয়লাভ করতে, তা হলে আমার এবং আমার লােকজনের কি অবস্থা হত তা কারও অজানা নয়।” এর পর তৈমুরের নির্দেশক্রমে বায়েজীদকে বন্ধনমুক্ত করা হল এবং সম্মানের সাথে শামিয়ানার নিচে তৈমুরের পাশেই বায়েজীদকে বসতে দেয়া হল। ইউরােপে ত্রাস সঞ্চারকারী সুলতান বায়েজীদকে পরাজিত ও বন্দি করতে পেরে দিগ্বিজয়ী বৃদ্ধ তৈমুরের আনন্দের সীমা ছিল না। তৈমুর বন্দি বায়েজীদের সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছিলেন।১২ কিন্তু বায়েজীদ পলায়নের চেষ্টা করলে তাকে কড়া প্রহরাধীনে রাখা হয়। বন্দি হওয়ার আট মাস পরে তিনি হতাশ হৃদয়ে ১৪০৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে প্রাণত্যাগ করেন।

বায়েজীদের প্রতি তৈমুরের ব্যবহার এবং বায়েজীদের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরস্পরবিরােধী নানা মত রয়েছে। ইবনে আরাবশাহ লিখেছেন যে, “বায়েজীদকে প্রত্যহ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করার জন্য তৈমুরের দরবারে উপস্থিত করা হত এবং তাকে শিকল পরিহিত অবস্থায় পাখির মতাে লােহার খাঁচায় আবদ্ধ রাখা হত।” আরাবশাহর থেকে গৃহীত এরকম একটি গল্প কবি মার্লোর ‘Tamberlane the Great’ শীর্ষক গ্রন্থেও পাওয়া যায়। এই বক্তব্য সত্য বলে মনে হয় না। কারণ ইউরােপে পলায়মান বায়েজীদের পুত্র সুলাইমানকে দেশে ফিরতে বলা হলে তিনি তৈমুরের কাছে এক পত্রে বলেন, “যেহেতু আমাদের পিতার প্রতি আপনি সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছেন, তখন আপনার কাছ থেকে আমাদের আর কোন ভীতি নেই” (হিলদা হুকহাম : “Tamberlane the Conqueror’ লন্ডন ১৯৬২, পৃ: ১৫৬)। দ্বিতীয়ত, বায়েজীদ অসুস্থ হয়ে পড়লে তৈমুর তাকে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের চিকিৎসাধীনে রাখেন এবং তৈমুরের নির্দেশে বায়েজীদের মৃতদেহ যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে ব্রুসায় অবস্থিত অটোমান রাজকীয় সমাধিস্থানে সমাহিত করা হয়। অতএব, এই সকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সকলের প্রণিধানযােগ্য। প্রকৃতপক্ষে বন্দি বায়েজীদকে যথােপযুক্ত সম্মান ও সৌজন্য প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু তিনি পলায়নের চেষ্টা করলে তাকে আটক অবস্থায় কড়া প্রহরাধীনে রাখা হয়। পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে একটি শিবিকায় (litter) করে তাকে আনা-নেওয়া করা হত। অনেকে ভুল করে এই শিবিকা নামক বস্তুটিকে ‘Iron cage of bircls’ বলেছেন এবং শেখান থেকেই সব ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। বস্তুত ভােজে হাজির হতে বাধ্য করা ছাড়া তার প্রতি কোনরূপ অসদ্বব্যবহার করা হয়নি” (হ্যারল্ড ল্যাম্ব: Tamberlane, লন্ডন, ১৯২৮)। ভােজসভায় বায়েজীদের স্ত্রী ওলিভিয়াকে অর্ধোলঙ্গ অবস্থায় খাদ্য পরিবেশন করতে বাধ্য করা হয় বলে বর্ণিত ঘটনা সত্য মনে হয়। বােধ করি বায়েজীদের দাম্ভিক ও গর্বিত আচরণে বিরক্ত হয়ে তার দর্পচূর্ণ করার জন্যেই তৈমুর এমন ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া তৈমুরের স্ত্রীদের প্রতি অসম্মানসূচক মন্তব্য করে বায়েজীদ তৈমুরের কাছে যে পত্র লিখেছিলেন তার প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য ও হয়তবা বায়েজীদের স্ত্রীর প্রতি তৈমুর এরকম ব্যবহার করে থাকবেন। তবে প্রিয় স্ত্রীকে এভাবে লাঞ্ছিত হতে দেখে লজ্জায় ও অপমানে লৌহদণ্ডের সাথে বারংবার মস্তকে আঘাত হেনে বায়েজীদ আত্মহত্যা করেছিলেন বলে যে তথ্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে তা সত্য নয়। বায়েজীদ রােগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অটোমান ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, ওলিভিয়ার প্রতি এইরূপ অপমানসূচক ব্যবহারের পর থেকে অটোমান সুলতানগণ আর ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন না। ভবিষ্যতে অটোমান সুলতানের স্ত্রীর প্রতি এই ধরনের অসম্মানজনক আচরণের পুনরাবৃত্তি এড়ানাের জন্যই এরকম করা হত বলে বিশ্বাস। 

অঙ্গোরার যুদ্ধে বায়েজীদের পরাজয় ও তৈমুরের জয়লাভের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায় যে, তৈমুরের সৈন্যদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল অশ্বারোহী এবং বায়েজিদের সৈন্যদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল পদাতিক। তাই যে কোন যুদ্ধে অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনী যে পদাতিক বাহিনীর ওপর প্রধান্য বিস্তার করবে এটি সহজেই বোধগম্য এবং আঙ্গোরার যুদ্ধের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দ্বিতীয়ত অটোমান সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণগতভাবে যুদ্ধে আক্রমণ অপেক্ষা প্রতিরক্ষামূলক কৌশলেই বেশি অভিজ্ঞ ছিল। এই যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগের ফলে তারা ইউরোপ ভূ-খণ্ডে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু তৈমুরের সাথে যুদ্ধে বায়েজীদ শত্রু বাহিনীকে প্রথম আক্ৰমণ করে কৌশলগত দিক থেকে মস্ত বড় ভুল করে বসলেন। তৃতীয়ত বায়েজীদের সৈন্যদের মধ্যে তাতার গোত্রের এক বিরাট সংখ্যক সৈন্য যুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতকতা করে তৈমুরের পক্ষে যোগদান করে। এর ফলে তুর্কি বাহিনীতে বিশখলা ও হাতাশা দেখা দেয় এবং বায়েজীদ এক প্রকার শুরুতেই যুদ্ধে হারাতে বসেন। চতুর্থত স্থান নির্বাচন এবং যুদ্ধের সময় নির্বাচনেও বায়োজীদের ভুল হয়েছিল। তৈমুর-বাহিনীর সন্ধানে তার পশ্চাদ্ধাবন করে তুর্কি-বাহিনী অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এছাড়া বায়েজীদ যে স্থানে শিবির সন্নিবেশ করেছিলেন তার আশপাশের খাদ্যশস্য ও পানীয় জল তৈমুর পূর্বেই বিনষ্ট করে দিয়েছিলেন। ফলে বায়েজীদের অধিকাংশ সৈন্য তৃষ্ণা ও খাদ্যাভাবেই মৃত্যুবরণ করে। পঞ্চমত নানা জাতীয় লোক সংগ্রহ করা বায়েজীদের সৈন্যদের মধ্যে সমঝােতা, একতা ও একাগ্রতার অভাব ও তার পরাজয়ের জন্য দায়ী ছিল। শেষত নিকোপলিসের যুদ্ধে জয়লাভ করে বায়েজীদ এতই উন্মত্ত ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন যে, তখন থেকে তিনি প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান ও নারী সাহচর্য বায়েজীদকে নানা দিক থেকে অধগতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এমনকি সেনাবাহিনীর কাছেও এসময়ে তিনি আগের মতো শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন না। ঘটনা দৃষ্টে দেখা যায় যে, তৈমুর মধ্য-এশিয়া আক্রমণে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু বায়েজীদই তাকে তার হঠকারিতা ও দাম্ভিকতাপূর্ণ নীতির ফলে তৈমুরকে এই আক্রমণে বাধ্য করলেন। এছাড়া এশিয়া বিজয়ী তৈমুরের মতো একজন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তিনি নিজ জয় সম্বন্ধে একান্ত নিশ্চিত ছিলেন। এমনকি এসময়ে তিনি নিশ্চিত মনে বড় বড় ভোজ ও জলসার আয়োজন করতেও দ্বিধা করেননি। কাজেই আত্মবিশ্বাস থাকা যেমন ভাল তেমনি তা যদি অতি-আত্মবিশ্বাসের পর্যায়ে গিয়ে আত্মতুষ্টির সৃষ্টি করে তখন বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। বায়েজীদের বেলায়ও ঠিক তাই হয়েছিল।

অঙ্গোরার যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে বায়েজীদের সমস্ত গৌরব ও ব্যক্তিত্ব নিমেষে ধূলিষাৎ হয়ে গেল। ঐতিহাসিক এস. লেনপুল এই প্রসঙ্গে বলেন, “বায়েজীদের মতো ক্ষমতার শীর্ষ শিখর থেকে হঠাৎ শৃঙ্খল পরিহিত বন্দি অবস্থায় পতিত হওয়ার মতো লজ্জাকর ও ভয়াবহ ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।” (এস. লেনপুল : Turkey, লন্ডন, ১৮৮৮)। অটোমান তুর্কিদের জাতীয় ইতিহাসে বিগত একশো বছরের মধ্যে আঙ্গোরার যুদ্ধে তারা এই প্রথমবারের মতো পরাজয় বরণ করল। এছাড়া বায়েজীদই একমাত্র অটোমান সুলতান যিনি শত্রু সেনাদের থেকে বন্দি হন। কিন্তু ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে অঙ্গোরার যুদ্ধকে পৃথিবীর অপরাপর চূড়ান্ত ও ভাগ্যনির্ধারণকারী যুদ্ধের পর্যায়ে গণ্য করা চলে না। কারণ অন্যান্য বিজিত দেশের মতো এশিয়া মাইনরেও স্থায়ী সমাজ প্রতিষ্ঠার কোন ইচ্ছাই তৈমুরের ছিল না। বায়েজীদের পুত্র সুলাইমানকে তৈমূর তুরস্কের ইউরোপীয় অংশের গভর্নর নিযুক্ত করলেন। নিয়মিত কর প্রদান ও আনুগত্যের অঙ্গীকারে সুলাইমান এই পদে বহাল হলেন। অটোমানদের দখলকৃত এশিয়া মাইনরের রাজ্যগুলো তৈমুরের আশ্রিত ও করদরাজ্যে পরিণত হলো। কিন্তু তৈমুরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অটোমান তুর্কিদের এই অবস্থার অবসান ঘটলো এবং তারা সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন হয়ে গেল। কাজেই অঙ্গোরার যুদ্ধে বায়েজীদের পরাজয়ের ফলে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত না হয়ে বরং এটি তুর্কিদের পক্ষে একটা সাময়িক পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। অতএব, এই দিক দিয়ে বিচার করলে অঙ্গোরার যুদ্ধের তেমন কোন সুদূরপ্রসারী ফলাফল লক্ষ্য করা যায়না। কাজেই অঙ্গোরার যুদ্ধে ফলাফল ও আসল গুরুত্ব অন্যত্র খুঁজতে হবে। বায়েজীদের পরাজয়ের ফলে পরবর্তী অটোমান সুলতানদের ভবিষৎ কর্মপদ্ধতিতে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হলো। তখন থেকে এশিয়ায় শক্তি বিস্তার করা অপেক্ষা ইউরোপ বিজয়েই তারা বেশি মনোযোগী হলেন। তুরস্কের রাজধানী পরিবর্তিত হয়ে মূল ইউরোপ ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত করা হলো। কনস্টান্টিনোপল অবরোধ স্থগিত রেখে বায়েজীদ তৈমুরের সাথে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাই বায়েজীদের পরাজয়ের ফলে কনস্টান্টিনোপল অনিবার্য পতনের হাত থেকে অর্ধশতাব্দীর জন্য রক্ষা পেলো। কিন্তু সাময়িকভাবে তুর্কি আক্রমণের হাত থেকে ইউরোপ রক্ষা পেলেও তখন থেকে অটোমান তুর্কিরা পুরাপুরি ইউরোপীয় শক্তি হবার স্বপ্ন দেখতে লাগলো। বলাবহুল্য যে, অটোমানদের এই স্বপ্ন ব্যর্থ হয়নি এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষ করলে অঙ্গোরার যুদ্ধের সুদূরপ্রবাসী ফলাফল ও গুরুত্ব কারও দৃষ্টি এড়ায় না।

ঐতিহাসিক আঙ্গোরার যুদ্ধে তুর্কি সুলতান বায়েজীদের শোচনীয় পরাজয় এবং বন্দি অবস্থায় আট মাস পরে তার মৃত্যু হলে অটোমান সাম্রাজ্যে আপাতঃদৃষ্টিতে প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং কেউই এর পুনর্জাগরণ আশা করেনি। কারণ এই যুদ্ধে তুর্কিরা এমনভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল যে, দ্বিতীয়বারের জন্য তৈমুরের মোকাবেলা করার মতো কোন শক্তিই তাদের ছিল না। বসফোরাস প্রণালী থেকে আরম্ভ করে সমগ্র এশিয়া মাইনর মাত্র এক মাসের মধ্যেই তৈমুরের পদতলে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু এই নব বিজিত অঞ্চল স্থায়ীভাবে শাসনাধীনে রাখার কোন ইচ্ছাই তৈমুরের ছিল না। এবং প্রধানত তৈমুরের এই নীতি অটোমানদের পুনর্জাগরণের পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অটোমানদের দ্বারা উত্থাতকৃত আমীর ও যুবরাজবৃন্দের কাছ থেকে আনুগত্য ও বাৎসরিক করদানের অঙ্গীকারে তৈমুর এশিয়া মাইনরের রাজ্যগুলো তাদেরকে ফিরিয়ে দিলেন। অন্যদিকে বায়েজীদের পুত্র সুলাইমানের ওপর অটোমানদের ইউরোপ ভূখণ্ডের শাসনভার অর্পণ করা হলো। কিন্তু হঠাৎ তৈমুরের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে গৃহবিবাদের সূত্রপাত হয় এবং তারা তুরস্কের ওপর কোন পকার প্রাধান্য বজায় রাখার চেষ্টা ছেড়ে তৈমুর কর্তৃক বিজিত মধ্য-এশিয়া নিয়েই সন্তষ্ট থাকলেন। ফলে অটোমান সাম্রাজ্যে পুনর্জাগরণের বিরাট সুযোগের সৃষ্টি হলো। অঙ্গোরার যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের সাময়িক মৃত্যু হলেও বায়েজীদের সুযোগ্য পুত্রগণ জীবিত ছিলেন এবং অটোমান জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস তখন নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বরং দেখা গেল যে মাত্র এক যুগের মধ্যেই অটোমান জাতি এই চরম আঘাত ও বিপর্যয়ের হাত থেকে মুক্তিলাভ করাি অপেক্ষাকৃত বহুগুণ ক্ষমতা ও সঞ্জীবনী শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হলো।

বায়েজীদের কনিষ্ঠ পুত্র মুহম্মদের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও উদার শাসন নীতির ফলে অটোমন তুর্কিগণ আবার তাদের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হলো। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ফিনলে অটোমান সাম্রাজ্যের পুনর্জাগরণের কারণগুলো নির্ণয় করতে গিয়ে লিখেছেন, “প্রথমত, পৃথিবীর সমসাময়িক সকল জাতি অপেক্ষা অটোমানরা ধর্ম, কৃষ্টি, নৈতিকতা ও সামরিক দক্ষতায় অনেক উন্নত ছিল। দ্বিতীয়ত আড্রিয়াটিক সাগর থেকে কৃষ্ণ সাগর এবং দানিউব নদী থেকে ঈজিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে নানা জাতির বসবাস ছিল। তৃতীয়ত গ্রিক সাম্রাজ্যের জনশক্তি হ্রাস পাওয়ার ফলে বিচার ও প্রশাসন ব্যবস্থার অবনতি এবং হেলেনিক জাতির চরম নৈতিক অধঃপতন সূচিত হয়েছিল।” (ফিনলেঃ History of Greece, লন্ডন, ১৯৪৫, পৃঃ ৪৭৫, এস. লেনপুল কর্তৃক ‘Turkey’ শীর্ষক গ্রন্থে উদ্ধৃত পৃঃ ৭৬)। এসময়ে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগুলোর মধ্যে সর্বদাই আত্মকলহ লেগে থাকতো। ফলে অটোমানদের মহাদুর্দিনেও তারা সংঘবদ্ধ হয়ে অটোমানদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে অস্ত্রধারণ করতে পারেনি। 
অঙ্গোরার যুদ্ধের পর তুর্কিদেরকে সামরিক শক্তি পুনর্গঠনের সুযোগ না দিয়ে ইচ্ছা করলে তারা এদেরকে নির্মূল করতে পারতো। কিন্তু তা না করে বরং তৈমুর কর্তৃক বিতাড়িত তুর্কি আমীর, পাশা ও সৈন্যগণকে গ্রিস ও জেনোয়ার নৌবহরগুলো সযত্নে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ ভূখণ্ডে পৌঁছতে সাহায্য করেছিল। ইউরোপীয় রাজ্যের বহু রাজা অটোমানদের বিরুদ্ধে তৈমুরকে অর্থ ও জাহাজ দিয়ে সাহায্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়মত তৈমুরকে সাহায্য না করে কেন খ্রিস্টানগণ তাদের পূর্বের উৎপীড়ক অটোমানদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে গেল এর উত্তর পাওয়া মুশকিল। তবে হয়ত এই সাহায্যের জন্য তারা অটোমানদের কাছ থেকে প্রচুর নগদ অর্থ পেয়েছিল, অথবা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তাদের অনুগ্রহভাজন হওয়ার জন্য পূর্বেকার নীতি অনুসরণ করেছিল। আসল ঘটনা যাই হোক না কেন তৈমুর ও খ্রিস্টান শক্তিবর্গের অনুসৃত এই নীতি এবং অটোমান জাতির অন্তর্নিহিত শক্তিবলে তুর্কি সাম্রাজ্য এই ঘোর দুর্দিনেও টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। বায়েজীদের মৃত্যুর পর তৈমুর কর্তৃক পরিত্যক্ত অটোমান সাম্রাজ্যের ওপর নিজ নিজ দখল প্রতিষ্ঠার জন্য বায়েজীদের পুত্রদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী গৃহবিবাদ দেখা দেয়। এছাড়া অটোমান সাম্রাজ্যে একাধিক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। তাই এই যুদ্ধের পর অটোমান সুলতান প্রথম মুহম্মদকে (রা. ১২০২-১২২১ খ্রি.) একই সাথে যেমন সাম্রাজ্যের গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হয়, তেমনি ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজ ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, একই সাথে বিদ্রোহ দমন করে সাম্রাজ্যে শান্তি ও সংহতিও প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এসব নিয়েই ছিল প্রথম মুহাম্মদের যুদ্ধ পরবর্তী ২০ বছরের শাসন, এই সময়ে তারা সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের সুযোগ পায়নি।

তৈমুরের সমরখন্দ প্রত্যাবর্তন

আঙ্গোরার যুদ্ধে অটোমান তুর্কিশক্তি এমনিভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল যে তাদের সাথে তৈমুরের আর দ্বিতীয়বার যুদ্ধের প্রয়ােজন হল না। আঙ্গোরার সাথে সাথে ব্রুসা ও নাইকিয়া তৈমুরের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। আর বাকি সকলে হয়ত তৈমুরের দলে যােগ দিল অথবা ইউরােপে পলায়ন করল। এক মাসের মধ্যে এশিয়া ভূখণ্ডে আর একটি তুর্কি সৈন্যও রইল না। সাগর তীর থেকে তৈমুরের সৈন্যগণ হেলেসপন্টে অবস্থিত প্রাচীনকালের ইতিহাস প্রসিদ্ধ হেলেনের লীলাভূীম ট্রয়ের ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে ঘােড়া ছুটিয়ে স্মার্নার দ্বারদেশে এসে উপস্থিত হল। প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত এই স্মার্নাই অতি সম্প্রতিকালে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে অটোমান সুলতান বায়েজীদের অবরােধ সাফল্যের সাথে প্রতিহত করেছিল। যথারীতি আবেদনের পর আত্মসমর্পণে অস্বীকৃত হলে তৈমুর প্রচণ্ড আঘাতের বিনিময়ে স্মার্না অধিকারে আনলেন। স্মার্না পতনের ফলে গােটা এশিয়া মাইনর তৈমুরের পদানত হল। বায়েজীদ যে কাজ দীর্ঘ আট বছরে করতে পারেননি, তৈমুরের তা সম্পন্ন করতে সময় লাগল মাত্র এক মাস। এশিয়া মাইনরে বায়েজীদের দরবার থেকে কারা ইউসুফ ও সুলতান আহমদ গােপনে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। সুলতান আহমদ মিশরের মামলুক সুলতানের কাছে আশ্রয় নিলেন এবং কারা ইউসুফ আরবের বিশাল মরুভূমিতে আত্মগােপন করলেন। এখন তৈমুরের পক্ষে মিশরের মামলুক সাম্রাজ্য আক্রমণের পথ নিরাপদ হয়ে গেল। কিন্তু তৈমুরের সাথে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া আর পরাজিত হয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া একই কথা মনে করে মিশরের মামলুক সুলতান আত্মসমর্পণ, নিয়মিত করদানের অঙ্গীকার এবং তৈমুরের নামে খুৎবা পাঠের স্বীকৃতি জানিয়ে তার দরবারে দূত প্রেরণ করলেন।  তৈমুরের সাম্প্রতিক তুর্কি শক্তির জয়লাভের জন্য ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ হেনরি ও স্পেনের রাজা ষষ্ঠ চার্লস তৈমুরকে দূত মারফত অভিনন্দনবাণী পাঠালেন। বাইজান্টাইনদের ভ্রাম্যমান সম্রাট ম্যানুয়েল কন্সটান্টিনােপলে ফিরে এলোেন এবং তৈমুরকে বার্ষিক করদানের প্রতিশ্রুতি জানিয়ে তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেন। ইচ্ছা থাকলেও তৈমুর ইউরােপ ভূখণ্ডে প্রবেশের চেষ্টা করলেন না। কারণ তার সৈন্যগণ দীর্ঘ তিন বছর যাবৎ একটানা যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকার ফলে অত্যন্ত ক্লান্ত ও স্বদেশমুখী হয়ে পড়েছিল। এছাড়া অটোমানদের কাছ থেকে তৈমুর প্রচুর ধন-সম্পদ লাভ করেছিলেন। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে ছিল সেন্ট পল ও সেন্ট পিটারের মূর্তি-খােদিত ব্রুসার রৌপ্য নির্মিত সিংহদ্বার এবং বিখ্যাত বাইজান্টাইন লাইব্রেরি। এই সকল নিয়ে তৈমুর দীর্ঘ তিন বছর অনুপস্থিত থাকার পর রাজধানী সমরখন্দে প্রত্যাবর্তন করলেন। 

চীন অভিযান ও মৃত্যু

এশিয়া মাইনর পদানত করে তৈমুর বিজয়ীবেশে রাজধানী সমরখন্দে ফিরে আসেন। এসময় তিনি অতিশয় বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বার্ধক্য তৈমুরের মনােবল এবং বিজয়লিপ্সা বিন্দুমাত্র প্রশমিত করতে পারেনি। এবার তিনি চীনদেশ জয় করার এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। চীনের প্রাচীর ভেঙ্গে সুরক্ষিত ক্যাথে নগরীতে প্রবেশ করবেন এই ছিল তার স্বপ্ন এবং এই উদ্দেশ্যে বিরাট প্রস্তুতি চলল। ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে দুই লক্ষ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে তৈমুর চীন অভিমুখে যাত্রা করলেন। তখন ছিল নভেম্বর মাস, প্রচণ্ড শীত। নদীগুলো বরফাচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিল এবং রাস্তায় ও জমেছিল বরফ। কিছু লােক এই শীতে মারাও পড়ল। কিন্তু কিছুই তৈমুরের অগ্রাভিযান শুদ্ধ করতে পারল না। বরফের ওপর পশমী কাপড়ের আস্তরণ ফেলে তৈমুর সেনাবাহিনীকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিলেন। এ যেন সীমিত সাধ্যের অধিকারী এক মানবের পক্ষে অসাধ্য সাধন করার এক উন্মত্ত প্রচেষ্টা। সিরদরিয়া অতিক্রম করে সমরখন্দ থেকে আড়াইশত মাইল দূরে ওতরার নামক স্থানে এলে হঠাৎ তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ থেকে শরীর উষ্ণ রাখার জন্য তৈমুরকে প্রচুর মদ্যপান করতে হয়েছিল। চিকিৎসকগণ সুচিন্তিত মত প্ৰকাশ করলেন যে, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানই তৈমুরের এই পীড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। সাধ্যমত সকল চিকিৎসা করা হল। কিন্তু এতে কোন ফল হল না। তৈমুরের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে সমরখন্দ থেকে তার বেগম ও পুত্রবধূগণ এলেন। আমীর ও সেনাপতিগণ তৈমুরকে ঘিরে দাঁড়ালেন, পুত্রগণ পিতার শয্যাপাশে বসে অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলেন, রাজ্যের সেরা উলেমগণ কোরআন পাঠ করতে লাগলেন এবং সৈন্যদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল। কিন্তু আসলে তৈমুরের জীবন-পাত্র পূর্ণ হয়ে এসেছিল এবং কোন মানুষই তার ভাগ্যের এই চূড়ান্ত পরিণতিকে এড়াতে পারেনা, তৈমুরও পারলেন না। ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে সত্তর বছর বয়সে চীন বিজয়ের পথে দিগ্বিজয়ী তৈমুর মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। 

তৈমুরের কৃতিত্ব ও চরিত্র বিচার 

পৃথিবীর মধ্যযুগের ইতিহাসে সামরিক দক্ষতা ও সাফল্যের ক্ষেত্রে তৈমুর ছিলেন এক বিস্ময়কর ও অতুলনীয় প্রতিভা। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের মতো তিনি বিশ্বজয়ের আশা পােষণ করতেন। সামরিক সাফল্যের দিক দিয়ে বিচার করলে তৈমুরকে ‘এশিয়ার আলেকজান্ডার’ বলে আখ্যায়িত করলে অত্যুক্তি হবে না। তিনি গর্বভরে বলতেন, “আকাশে যেমন একজন খােদা, পৃথিবীতেও তেমনি একজন বাদশাহ থাকবেন।” (তৈমুর : Mulfuzat-I-Timuri,-(ইংরেজি অনুবাদ : মেজর স্টেওয়ার্ট চার্লস : Memoires of Tinur) লন্ডন, ১৮৩০)। আর বলাবাহুল্য যে তিনিই হবেন সেই বাদশাহ। বিশ্বরাজ্য প্রতিষ্ঠার এই স্বপ্নে তৈমুর ছিলেন বিভাের। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি সেই চেষ্টাই করে গিয়েছেন। প্রায় অর্ধশতাব্দীব্যাপী তিনি এশিয়া, ইউরােপ ও আফ্রিকা মহাদেশের ত্রাস স্বরূপ ছিলেন। সামান্য একজন গােত্রপতির পুত্র হয়ে তিনি যে সাহস, প্রজ্ঞা ও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তার তুলনা হয় না। এই সমস্ত গুণাবলীই তৈমুরকে তার লােকদের অবিসংবাদিত নেতা ও সর্বজন প্রশংসিত সমরনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তৈমুর সেনাবাহিনীর সংগঠন, প্রশিক্ষণ ও নিয়মানুবর্তিতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করতেন। সমগ্র সেনাবাহিনী তৈমুরের নেতৃত্বের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাশীল ছিল। একজন সেনানায়কের পক্ষে এই শ্রদ্ধা ও আনুগত্য অপরিহার্য এবং এটিই ছিল তৈমুরের বিরাট সাফল্যের প্রধান হাতিয়ার। মৃত্যুকালে তার সাম্রাজ্য যতদূর বিস্তার লাভ করেছিল এশিয়ার কোন নরপতির পক্ষে কোনকালে তা সম্ভব হয়নি। উত্তরে বসফোরাস প্রণালী থেকে দক্ষিণে গঙ্গা নদী এবং পূর্বে চীনের প্রাচীর থেকে পশ্চিমে নীলনদ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য তৈমুর পদানত করেছিলেন। রাজ্যবিজেতা হিসেবে তৈমুর অপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেও শাসক হিসেবে তিনি অনুরূপ প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেননি। তার বিরাট ক্ষমতার পেছনে কোন স্থায়ী ভিত্তি অথবা বৃহৎ উদ্দেশ্য ছিল না। কেবল নিজ ব্যক্তিত্ব ও শক্তির ওপরই তা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ফলে তৈমুরের মৃত্যুর সাথে সাথেই তার সমস্ত সাধনা ও পরিশ্রম তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ল। তৈমুরের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী গৃহবিবাদ দেখা দিল এবং তারা তৈমুরের বিজিত বিশাল সাম্রাজ্যের খণ্ডাংশ নিয়েই আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন। তৈমুর ক্ষমতা এবং অর্থ চেয়েছিলেন এবং তা পেতে গিয়ে পররাজ্য আক্রমণ, লুণ্ঠন, নরহত্যা এবং নির্যাতন করতে তিনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। তবে এটি ছিল মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য। তৈমুরকেও সেই যুগের আলােকে বিচার করতে হবে। তৈমুর কর্তৃক লুণ্ঠিত অর্থ-সম্পদ কল্যাণমুখী কাজে ব্যয়িত হয়েছিল। নগর নির্মাণ, জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা এবং সর্বোপরি জনকল্যাণে তিনি এই অর্থ অকৃপণ হাতে ব্যয় করেছিলেন।  শাসক হিসেবে তৈমুর বৈশিষ্ট্যের দাবিদার হলেও তিনি নিরপেক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ ছিলেন। ধনী-দরিদ্র এবং উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সকলের প্রতি তিনি ন্যায় বিচার করতেন। অপরাধী সে যেই হউক না কেন তাকে শাস্তি দিতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। দুশ্চরিত্রের অভিযােগে নিজের প্রিয় পুত্র খলিল সুলতানকেও তিনি কঠোর শাস্তি দিতে ও প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদ থেকে বরখাস্ত করতে ব্যর্থ হননি। তৈমুর মানুষের দুর্বলতা ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে পারতেন না। একবার সমরখন্দে বহু ভিখারীর ভিড় দেখে তিনি ব্যথিত ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন। এর প্রতিকারকল্পে তিনি ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ ঘােষণা করলেন এবং এই সকল ভিখারীদের জন্য প্রত্যহ কিছু খাদ্যের বরাদ্দ করে দিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভিখারীগণ তাদের ভিক্ষাবৃত্তি ত্যাগ করল না। কারণ এটি ছিল তাদের পেশা। এটি দেখে তৈমুর অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হলেন এবং ভিখারীদেরকে হত্যা করার জন্য সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন। (হ্যারল্ড ল্যাম্ব : Tanberlane- নিউইয়র্ক, ১৯২৮)। তৈমুরের কঠোর আইনের ফলে সাম্রাজ্যে সাধারণ অপরাধ ও চৌর্যবৃত্তি একেবারেই লােপ পেয়েছিল। তৈমুর নির্দেশ জারি করে দিলেন যে, কোন শহরে চুরি হলে সেই শহরের প্রশাসক ও পাহারাদারকে তার জন্য দায়ী থেকে হবে এবং চুরি যাওয়া দ্রব্যাদির ক্ষতিপূরণ তাদেরকেই করতে হবে। ফলে বহুদিন পর মধ্য-এশিয়ায় আবার শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে এলো। (আতা মালিক জুয়াইনি : “History of the World Conqueror” (অনুবাদক : জে. এ. বয়েল) ম্যানচেস্টার, ১৯৫৮ দ্রষ্টব্য: হিলদা হুকহাম : Tamburlaine the Conqueror. লন্ডন, ১৯৬২ পৃ: ৩)। 

তৈমুর একজন প্রজারঞ্জক নরপতি ছিলেন। প্রজাদের সুবিধার্থে তিনি বহু মসজিদ, হাসপাতাল, সরাইখানা ও বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তিনি কৃষিকার্য ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্যে বিশেষ নজর দেন। তার আমলে আমুদরিয়া ও সিন্ধু নদী দিয়ে আরব সাগর পর্যন্ত এবং ইউফ্রেটিস ও তাইগ্রিস নদী দুটি দিয়ে বিপুল বাণিজ্য-সম্ভার পরিচালিত হত। তৈমুরের প্রচেষ্টায় রাজধানী সমরখন্দ ও তাবরিজ এশিয়া মহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। তৈমুরের সময় সাম্রাজ্যের মধ্যে তাবরিজই ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল ও সর্বাপেক্ষা ঘণবসিতপূর্ণ নগরী। এই সময় তাবরিজে প্রায় দশ লক্ষাধিক লােক বসবাস করত। কেবল এই শহর থেকে তৈমুর যে রাজস পেতেন ফ্রান্সের রাজার বাৎসরিক রাজত্ব তার চাইতে কম ছিল। (হিলদা হুকহাম : Tamburlalne the Conqueror, লন্ডন, ১১৬২)। এই একটিমাত্র উদাহরণ থেকে তৈমুরের সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও তৎসহ আনুষঙ্গিক উন্নতি সম্পর্কে মােটামুটি একটা ধারণা করা যেতে পারে। তৈমুর নিজে সুপণ্ডিত না হলে ও শিক্ষা ও জ্ঞানী-গুণীর সমাদর করতেন। বিজিত রাজ্যের যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে থেকে আইনজীবী, চিকিৎসক, জ্যোতির্বিদ, থপতি ও নানা ধরনের শিল্পীদেরকে তৈমুর সমরখন্দে আনয়ন করেন। এরা প্রত্যেকেই তৈমুরের কাছে বিশেষ সমাদর ও পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করতেন। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক তাবরিজের মওলানা ফজল একজন বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ ছিলেন। তৈমুরের নির্দেশে ও আনুকূল্যে মওলানা নিজামউদ্দিন ‘জাফর নামা’ শীর্ষক বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। তৈমুরের রাজদরবারে অপর দুইজন ঐতিহাসিক ইবনে আরাবশাহ ও গিয়াসুদ্দিন আলীর নামও বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সিরিয়া অভিযানকালে তৈমুরের সঙ্গে দামেক নগরীতে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদ ইবনে খালদুনের সাক্ষাৎ হয়। তৈমুর এই মনীষীর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। (দ্রষ্টব্য : Ibn Khaldun and Tamerlan : Their historic meeting in Damascus in 1401. (ইবনে-খালদুনের আত্মজীবনী থেকে ডব্লিউ. আর. ফিসেল কর্তৃক অনূদিত) লস অ্যাঞ্জেলস ১৯৫২) তৈমুর একজন ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি চাঘতাই তুর্কি, ফার্সি ও মোঙ্গলীয় ভাষা লিখিতে ও পড়তোে পারতেন। চাঘতাই-তুর্কি ভাষায় লিখিত তৈমুরের আত্মজীবনী মুলফুজাত-ই-তিমুরি’ শীর্ষক গ্রন্থটি তার জ্ঞান পিপাসার স্বাক্ষর বহন করে। তৈমুর শিল্পকলা ও স্থাপত্য শিল্পের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রদর্শন করেন। ফলে রাজধানী সমরখন্দ মনােরম অট্টালিকা, রাজপ্রাসাদ ও স্মৃতিসৌধে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে। বস্তুত তৈমুর তার রাজধানী সমরখন্দকে ‘এশিয়ার রােম হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা সমরখন্দ সম্বন্ধে বলেছেন : “দুনিয়ার সবচাইতে বড়, সুন্দর ও মহান নগরীগুলোর অন্যতম হচ্ছে সমরখন্দ।” ( ‘The Travels of Ibn Batuta. অনুবাদক : এস. এইচ. গিব: ক্যাম্ব্রিজ, ১৯৫৮)।

তৈমুর তার স্ত্রীর নামানুসারে নির্মিত ‘বিবি খানুম মাদ্রাসা’ ও নিজের জন্য ‘গুর-ই-মির’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া সমরখন্দের ‘দিলকুশা’ রাজপ্রাসাদ ও জামী মসজিদ তার নির্মাণকার্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই শাহী মসজিদটি আকারে এত বিরাট ছিল যে তৈমুরের দরবারের সব লােকের তাতে পান সংকুলান হত। মসজিদের মধ্যে চারশত আশিটি পাথরের স্তম্ভ ছিল এবং এর দরজা ছিল পিতলের কাজ করা। এই সৌধগুলো তৈমুরের শিল্প-রুচির এবং তৈমুরীয় যুগের স্থাপত্যশৈলীর জ্বলন্ত নিদর্শন হিসেবে আজিও বিদ্যমান রয়েছে।  তৈমুরের চরিত্র ঐতিহাসিকদের কাছে একটি সমস্যা। তার চরিত্রে পরস্পরবিরােধী দোষ-গুণের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। তিনি একদিকে যেমন অসীম সাহসী, উদার ও প্রজাবৎসল ছিলেন অন্যদিকে তেমনি ছিলেন নিষ্ঠুর ও রক্তপিপাসু। পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক নরপতিই তৈমুরের মতো এমনিভাবে একাধারে ঘৃণিত ও অভিশপ্ত আবার অপরদিকে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছেন। তৈমুর গম্ভীর প্রকৃতির লােক ছিলেন এবং হাস্য-রসিকতা মােটেই পছন্দ করতেন না। তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস এবং আত্মজীবনীমূলক পুস্তক পাঠ করতে ও দাবা খেলতে বিশেষ পছন্দ করতেন। তৈমুর ছিলেন একজন চৌকস দাবা-খেলােয়াড়। এই খেলার কৌশল ভালভাবে আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি দ্বিগুণ সংখ্যক ছক ও খুঁটিযুক্ত এক নতুন বাের্ড তৈরি করেছিলেন। (হ্যারল্ড ল্যাম্ব : পূর্বোক্ত গ্রন্থ, (অনুবাদ : দিগ্বিজয়ী তাইমুর, আবুল কালাম শামসুদ্দিন) রায়হান পাবলিকেশন, ঢাকা, ১৯৬৫, পৃ: ৬৬-৬৭)। তৈমুর কবিদের খুব পছন্দ করতেন বলে মনে হয় না। বর্ণিত আছে যে, মহাকবি হাফিজের বিশেষ একটি কবিতা পাঠ করে তৈমুর কবিকে তিরস্কার করেছিলেন। কিন্তু পরে কবির উত্তরে মুগ্ধ হয়ে তৈমুর তাকে ধন-রত্ন দ্বারা বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন। ইবনে আরাবশাহ নামক তৈমুরের দরবারের জনৈক ঐতিহাসিক তৈমুর চরিত্রের যে চিত্র আঁকিয়াছেন তা হল : “এই দগ্বিজয়ী ছিলেন দীর্ঘদেহী। তার মাথা ছিল বড় ও কপাল প্রশস্ত। যেমনি ছিল তার দৈহিক শক্তি, তেমনি সাহস। প্রকৃতি তার চেহারায় কোন খুঁত রাখেননি। তার শরীরের চামড়া ছিল সাদা ও বর্ণ উজ্জ্বল। হাত-পাগুলো সবল, কাঁধ প্রশস্ত এবং আঙ্গুলগুলো লৌহকঠিন। তার দাড়ি ছিল লম্বা ও হাত শুকনো। ডান পায়ে তিনি খুড়িয়ে চলতেন। তার কণ্ঠস্বর ছিল গভীর। মধ্যবয়সেও যৌবনােচিত দৈহিক শক্তি ও মনােবল তার এতটুকু ক্ষুন্ন হয়নি। তিনি ছিলেন পাহাড়ের মতােই দৃঢ়। মিথ্যা বলা অথবা ঠাট্টাবিদ্রুপ তিনি মােটেই পছন্দ করতেন না। অপ্রিয় হলেও সত্য কথাই তিনি শুনতে চাহিতেন। দুঃসময়ে তিনি যেমন বিচলিত হতেন না, সুসময়ে তেমনি হতেন না আনন্দে আত্মহারা। তার সিলমােহরের ওপর দুটি ফার্সি শব্দ ছিল : ‘রাস্তি রাউস্তি’, অর্থাৎ শক্তিই ঠিক।” (ইবনে-আরাবশাহ : Timur the Great Amir, অনুবাদক : জে. এইচ. সাউডার, লন্ডন, ১৯৩৬)। তৈমুর নিষ্ঠাবান শিয়া মতাবলম্বী মুসলমান ছিলেন। তিনি নিয়মিত ধর্মব্রত পালন করতেন। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হত না। ধর্মীয় নেতাদের প্রতি তিনি বিশেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন এবং তাদের সাথে ধর্মীয় আলােচনা পছন্দ করতেন। মােঙ্গল শাসকদের মধ্যে গাজান খানের পর তিনিই প্রথম রাজ্যে ইসলামী আইন প্রবর্তন করেন। কিন্তু তাই বলে তিনি পরধর্ম উৎপীড়ক ছিলেন না। তৈমুরের চরিত্রে পরধর্ম সহিষ্ণুতার গুণ ছিল। খ্রিস্টধর্মযাজকরা তার সময় বিশেষ সম্মান ও সমাদর পেতেন। 

তৈমুরের উত্তরাধিকারীদের যুগ

তৈমুরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। তৈমুরের মৃত্যুকালে তার বহু সংখ্যক সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কেবল তার এক পৌত্র ও ভাগিনেয় ছাড়া আর কেউই তার কাছে উপস্থিত ছিলেন না। তৈমুরের মনােনীত প্রথম উত্তরাধিকারী সুলতান মুহম্মদ ১৪০২ খ্রিস্টাব্দে তার জীবদ্দশাতেই মৃত্যুবরণ করেন। পরে তৈমুর তার প্রথম পুত্র জাহাঙ্গীরের সন্তান পীর মােহাম্মদকে তার উত্তরাধিকারী মনােনীত করেন। পীর মােহাম্মদ তৈমুরের মৃত্যুকালে ভারতে ছিলেন। সেখানে মুলতান ও লাহােরের শাসনভার তার ওপরই ন্যস্ত ছিল। তৈমুরের চতুর্থ পুত্র শাহরুখ পিতার মৃত্যুকালে হেরাতে ছিলেন এবং প্রায় এক বছরব্যাপী বিভিন্ন যুদ্ধের পর তিনি হেরাত, খােরাসান ও ট্রান্সঅক্সিয়ানার ওপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। তৈমুরের তৃতীয় পুত্র মিরন শাহ তাবরিজ ও বাগদাদসহ পারস্যের পশ্চিমাঞ্চল দখল করেন। কিন্তু অচিরেই তিনি নিজ পুত্রদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এদিকে তৈমুরের নিযুক্ত উত্তরাধিকারী পীর মােহাম্মদের অনুপস্থিতির সুযােগ নিয়ে তার অপর এক পৌত্র খলিল সুলতান রাজধানী সমরখন্দ দখল করে বসেন। এই সংবাদে ভারত থেকে পীর মােহাম্মদ সিংহাসন অধিকারের জন্য সমরখন্দ অভিমুখে অগ্রসর হন। ফলে পীর মােহাম্মদ ও খলিল সুলতানের মধ্যে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পীর মােহাম্মদ পরাজিত ও নিহত হন এবং খলিল সুলতান সমরখন্দের সিংহাসনে উপবেশন করেন। 

খলিল সুলতান (১৪০৫-১৪০৯ খ্রি.)

খলিল সুলতান গৃহযুদ্ধে জয়যুক্ত হয়ে ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে সমরখন্দের সিংহাসনে উপবেশন করেন। একজন সার্থক নরপতি হবার অনেক গুণাবলি তার মধ্যে ছিল। তিনি তৈমুরের প্রধান আমীরগণ ও সেনাবাহিনীর সমর্থন লাভ করতেও সক্ষম হন। এমনকি ঐতিহাসিক ইবনে আরাবশাহ পর্যন্ত যুবরাজ খলিল সুলতানের সত্যবাদিতা ও অন্যান্য চারিত্রিক গুণাবলির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু সুলতান হিসেবে তিনি আশানুরূপ যােগ্যতা ও সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেননি। দুর্ভাগ্যবশত তৈমুরের জীবদ্দশাতেই তিনি শাদ-ই-মুলক নাম্নী জনৈকা নিম্নবংশজাত মহিলার প্রেমে পতিত হয়ে তাকে বিয়ে করেন। এই উপলক্ষে তৈমুরের কাছ থেকেও তিনি বহুবার তিরস্কার শুনেছেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ক এত গভীর ছিল যে, খলিল কিছুতেই এই আসক্তি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সিংহাসনে আরােহণ করার পর এই আসক্তির আতিশয্য বরং ক্রমাগত বেড়েই চলল এবং অচিরেই খলিল সুলতান তার স্ত্রী শাদ ই-মূলক-এর হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হলেন। তিনি রাজকার্য পরিচালনা ছেড়ে ভােগ বিলাসে মেতে উঠলেন এবং তৈমুর কর্তৃক জমাকৃত বিপুল ধনরাশি অল্পদিনের মধ্যেই অপচয় করে ফেললেন। ফলে শেষ পর্যন্ত খলিল সুলতানের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যে প্রবল বিদ্রোহ দেখা দিল এবং ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাশগড়ে নির্বাসিত হলেন।

শাহরুখ (১৪০৯-১৪৪৭ খ্রি.)

খলিল সুলতানের সিংহাসনচ্যুতির পর তৈমুরের চতুর্থ পুত্র শাহরুখ ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে সমরখন্দের সিংহাসন অধিকার করলেন। পিতার মৃত্যুর পর থেকে তিনি হেরাত, খােরাসান ও ট্রান্সঅক্সিয়ানার শাসনকর্তা ছিলেন। সিংহাসনে আরােহণ করে শাহরুখ সমরখন্দ থেকে হেরাতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। শাহরুখ তৈমুরীয় বংশের ইতিহাসে বিশেষ গৌরবােজ্জ্বল আসনের অধিকারী। তিনি পিতা তৈমুরের মতো উদ্দেশ্য বিবর্জিত রাজ্যজয়ে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সাম্রাজ্যের সীমারেখা প্রশস্ত করার চাইতে তার সংগঠনে অধিক মনােযােগ দেন। কিন্তু তাই বলে তিনি যুদ্ধবিদ্যায় অপারদর্শী ছিলেন না। প্রয়ােজনবােধে শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে তিনি কখনও দ্বিধা করেননি। শ্বেত মেষ বংশের’ কারা ইউসুফকে উপর্যুপরি তিনটি যুদ্ধে পরাজিত করে আজারবাইজান ও কিরমান বিজয় তার সামরিক কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে। শাহরুখের শাসনকালে চীনদেশের সাথে তার কয়েকবার দূত বিনিময় হয়। বাংলার সাথেও তৈমুরের একান্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। রাজা গণেশের পুত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালউদ্দিন মােহাম্মদ শাহ নাম ধারণ করেন। তিনি যখন বাংলার অধিপতি তখন জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহীম শর্কি ১৪২১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা আক্রমণ করেন। ফলে জালালউদ্দিন শাহরুখের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তার দরবারে দৃত প্রেরণ করেন। শাহরুখ ইব্রাহীম শর্কিকে বাংলা আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়ে তার কাছে এক কড়া পত্র লেখেন। ইব্রাহীম শর্কি শাহরুখের এই আদেশ অমান্য করতে সাহস করেননি। এই কারণে জালালউদ্দিন আজীবন শাহরুখের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ ছিলেন। (চার্লস স্টেওয়ার্ট : History of Bengal, কলকাতা, ১৯০৩, পৃ: ১১-১৩, মনতাজুর রহমান তরফদার : Husain Shahf Bengal-A Social-Political Study. ঢাকা, ১৯৬৫, পৃ: ৫)। পারস্য ও মধ্য-এশিয়ার ইতিহাসে শাহরুখ ছিলেন একজন অন্যতম সংস্কৃতিবান নরপতি। তার শাসনকালে সাম্রাজ্যে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজমান ছিল। এসময় হেরাত মধ্য-এশিয়ার সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। শিল্পকলা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপােষকতার জন্য শাহরুখের রাজত্বকাল বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে। বহু বিখ্যাত পণ্ডিত ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি তার দরবার অলঙ্কৃত করেন। এদের মধ্যে চিত্রশিল্পী মওলানা খলিল, সঙ্গিতবিদ আবদুল কাদির, ইঞ্জিনিয়ার কেয়ামুদ্দিন ও বাদ্যকার ইউসুফ আনদাকানির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। স্থাপত্য শিল্পের প্রতি শাহরুখের বিশেষ অনুরাগ ছিল। তার স্ত্রী গওহার-শাদ স্থাপত্য শিল্পের একজন বিশিষ্ট সমঝদার ছিলেন। সেই যুগের বিখ্যাত স্থপতি কেয়ামুদ্দিনের সাথে তার সক্রিয় সহযােগিতার ফলে সাম্রাজ্যে নানা ধরনের বহু অট্টালিকা, মসজিদ, শিক্ষায়তন ও স্মৃতিসৌধ গড়ে ওঠে। এর মধ্যে গওহার-শাদ মসজিদ’ ও ‘খারগিরদের মাদ্রাসা’ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। শাহরুখ একজন দয়ালু, উদার ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। শান্তিপ্রিয়তা ও সরলতা ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তিনি নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন এবং ধর্মালােচনা অনুষ্ঠানে যােগদান করতে পছন্দ করতেন। দীর্ঘ আটত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর একাত্তর বছর বয়সে শাহরুখ মৃত্যুবরণ করেন। 

উলুঘ বেগ (১৪৪৭-১৪৪৯ খ্রি.)

উলুঘ বেগ ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে সুলতানিয়া নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। উলুঘ বেগ নামের অর্থ ‘মহান যুবরাজ’। উলুঘ বেগের প্রাথমিক নাম ছিল মুহম্মদ তারাঘাই। পিতা শাহরুখের মৃত্যুর পর তিনি ১৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। এসময় তার বয়স ছিল একান্ন বছর। সিংহাসন লাভের পূর্বে তিনি দীর্ঘ আটত্রিশ বছর যাবৎ সমরখন্দের গভর্নর ছিলেন। উলুঘ বেগ শান্তিপ্রিয় লােক ছিলেন এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ মােটেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনায় তিনি কম কৃতিত্বের পরিচয় দেননি। সিংহাসনে আরােহণ করার অল্পকাল পরেই উলুঘ বেগ তার ভ্রাতুপুত্র ও খােরাসানের অধিপতি আলা-উদ-দৌলতের বিরুদ্ধে এক সফল অভিযান পরিচালনা করেন। মুরগার নদীর তীরে অনুষ্ঠিত এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আলা-উদ দৌলত তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বাবুর মীর্জার কাছে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। কিন্তু টার্কো উজবেক আক্রমণ থেকে হেরাত ও সমরখন্দ রক্ষা করা অবশ্য তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। উলুঘ বেগ মধ্য-এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী ও শিল্পানুরাগী নরপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন সেই যুগের একজন খ্যাতনামা পণ্ডিত ও বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক। দুর্ভাগ্যবশত উলুঘ বেগের রাজত্বকাল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও তার নাম মধ্য-এশিয়ার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হওয়ার যােগ্য। তিনি পারসিক সাহিত্য ও চিত্রশিল্পের বিশেষ পৃষ্ঠপােষকতা করেন। বিখ্যাত ফার্সি কবি নিজামি ছিলেন উলুঘ বেগের কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয়। তার সভা-কবিদের মধ্যে ইসমাতুল্লাহ বুখারি ও কামাল বাদাখশিরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এছাড়া উলুঘ বেগ নিজেও একজন প্রতিভাবান কবি ছিলেন। উলুঘ বেগের পিতৃব্য বায়ুসুঙ্কুর মীর্জা একজন প্রসিদ্ধ হস্তলিপিকার ছিলেন। এছাড়া একজন বাদ্যকার ও চিত্রশিল্পী হিসেবেও তার প্রসিদ্ধি কম ছিল না। উলুঘ বেগের বিশেষ পৃষ্ঠপােষকতায় রাজধানী হেরাতে বহুসংখ্যক হস্তলিপিকার, পুস্তক বাঁধাইকারক ও নকলনবিস সর্বদা কার্যরত থাকত। উলুঘ বেগ ইতিহাসের চর্চাও করতেন। তিনি ‘তারিখ-ই-উলুস-ই-আরবায়া’ নামক একটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি চেঙ্গিস খানের পূর্ব-পুরুষ ও তৈমুর পর্যন্ত তার উত্তর পুরুষের ধারাবাহিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। (ঐতিহাসিক মীরখাওয়ান্দ অবশ্য মনে করেন এই ইতিহাস-গ্রন্থটি উলুঘ বেগ কর্তৃক লিখিত হয়নি। তার মতে শাহরুখের রাজদরবারের জনৈক প্রখ্যাতনামা ঐতিহাসিক উলুঘ বেগের নামে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। দ্রষ্টব্য : ভি.ভি. বার্টহােল্ড, Four Studies on the History of Central Asia, লিডেন, ১৯৬৩, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ১৩৬))।

কিন্তু বিজ্ঞানের সাধনা, বিশেষ করে জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চাই ছিল উলুঘ বেগের জীবনের সর্বাপেক্ষা প্রিয় বিষয়। ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে সমরখন্দে তিনি একটি মানমন্দির (গ্রহ-নক্ষত্র-পর্যবেক্ষণিকা) ও একটি উচ্চতা মাপক যন্ত্র নির্মাণ করেন। বস্তুত উলুঘ বেগের পর জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা মধ্য-এশিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। (Encyclopedia of Islam, প্রথম খণ্ড, প্রথম সংস্করণ, নাল্লিনাে কর্তৃক লিখিত, ‘Astronomy’ শীর্ষক প্রবন্ধটি দ্রষ্টব্য)। এছাড়া তিনি ১৪২৮ সালে ‘জিজে-গুরকানি’ নামক একটি নক্ষত্র-সূচিও তৈরি করেন। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইংরেজ জ্যোতির্বিদ রয়েল ও পরে ইউরােপীয়গণ ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার করেছিলেন। (ভি. ভি. বার্টহােণ্ড : Ulugl-beg-লন্ডন, ১৯৫৮)। এটি অবস্থিত সমরকন্দের শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে চুপান-আতা সমভূমিতে, প্রাচীন আফ্রাসিয়াব শহরের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে। ১৯০৮ সালে রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক ভ্লাদিমির ভিয়াৎকিন এই গোলাকার ত্রিতল মানমন্দিরের ভিত এবং মর্মর পাথরের এক বৃহদাকার, ৩৬ মিটার, সেক্সট্যান্টের মাটিতে প্রোথিত অংশ খুঁড়ে বের করেন। “ইবন মাসুদ, আল রুমী, আল কুশচি এবং আরও কয়েকজন জ্যোতির্বিদ এইখানে গবেষণা করিয়া ‘জিজ উলুগ বেগ’ নামে যে জ্যোতিষীয় তালিকা প্রণয়ন করেন, তাহাই জ্যোতিষে মুসলমানদের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান।” (পৃষ্ঠা ১৫৩, বিজ্ঞানের ইতিহাস ২য় খণ্ড, সমরেন্দ্রনাথ সেন, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সায়েন্স) এটি আদতে ছিল একটি স্টার ক্যাটালগ, ১০১৮টি তারার কো-অর্ডিনেটের সূক্ষ্ণ হিসেব সমেত। বলা হয়, টলেমির থেকেও এই ক্যাটালগ আরও বিস্তৃত এবং নির্ভুল। বহুমুখী প্রতিভাশালী এই মানুষটি দক্ষ রসায়নবিদও ছিলেন। “According to the Russian medical book ‘Mashkovskiy’, Ulugh Beg discovered a mixture of alcohol with garlic, apparently preserving it to help treat conditions like diarrhea, headache, stomach ache and intestine illnesses.” (উইকিপিডিয়া) শুধু তাই নয়, “মধ্যযুগের এই মানুষটি চিন্তাভাবনায় ছিলেন আশ্চর্য রকমের এগিয়ে থাকা। তিনি বলতেন, ধর্মমত একদিন অসার প্রতিপন্ন হতে পারে কিন্তু বৈজ্ঞানিক সত্য ধ্রুব, অবিনশ্বর।” (পৃষ্ঠা ২৭, প্রমিথিউসের পথে, উৎস মানুষ সংকলন)। ভাবলে আশ্চর্য থেকে হয় যে, আজ থেকে পাঁচশত বছরেরও অধিককাল পূর্বে অজ্ঞানতা ও বর্বরতার মধ্যযুগে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন, “কালের কুটিল প্রভাবে সকল সাম্রাজ্যই খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাবে, ধর্ম হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, কিন্তু বিজ্ঞান সাধকের অবদান বেঁচে থাকবে অনন্তকাল”। (এস.এম. আলী কর্তৃক তার ‘তাশখন্দ ও উলুঘ বেগ” শীর্ষক প্রবন্ধ উদ্ধৃত, দ্রষ্টব্য : ইতিহাস, (ইতিহাস পরিষদ পত্রিকা) প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ঢাকা, ১৩৭৪, পৃ: ১০৯)। ১৪শ শতাব্দীর শেষে জন্মগ্রহণ করলেও তার মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিককালের উপযােগী। উলুঘ বেগের কার্যকলাপ আলােচনা করলে তার মধ্যে একটি উন্নত ও বিদগ্ধ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি অত্যন্ত পরিমার্জিত, দয়ালু ও শান্ত প্রকৃতির লােক ছিলেন। এই জ্ঞান সাধকের সৌজন্যপূর্ণ আচরণ মধ্যযুগের উপযােগী ছিল না। কারণ তার এই আচরণকে লােকে দুর্বলতা বলে মনে করত। ফলে তৎকালীন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে তিনি মােকাবেলা করতে পারেননি। মাত্র আড়াই বছর রাজত্ব করার পর তিনি বিদ্রোহী পুত্র আবদুল লতিফ কর্তৃক বন্দি হন। তাকে মক্কায় হজ্জ্বযাত্রা করার অনুমতি দেয়া হয়, যাত্রাপথে তার ভাই আব্দাল আজিজের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হয়ে তিনি নিহত হন।

আবদুল লতিফ, বাবর ও আবু সাঈদ (১৪৪৯-১৪৬৯ খ্রি.)

উলুঘ বেগের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে তৈমুরের বংশধরদের মধ্যে পুনরায় আত্মকলহ দেখা দেয়। পিতৃঘাতক আবদুল লতিফ বেশিদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারেননি। তার সিংহাসন লাভের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে সাম্রাজ্যে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং আবদুল লতিফ নিজের সেনাবাহিনীর হাতেই নিহত হন। আবদুল লতিফের মৃত্যুর পর শাহরুখের পৌত্র বাবর খােরাসান দখল করে তৈমুরীয় সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি সাম্রাজ্যে নানাবিধ সংস্কার আনয়ন করবেন বলে ইমাম রেজার পবিত্র মাজার পর্শ করে শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে প্রাণত্যাগ করায় তার এই ইচ্ছা অপূরণীয় থেকে যায়। তিনি মাত্র দুই বছর (১৪৫০-১৪৫২ খ্রি.) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাবরের আকস্মিক মৃত্যুর পর আবু সাঈদ ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি ছিলেন তৈমুরের প্রপৌত্র এবং মিরন শাহের পুত্র। শাহরুখের রাজত্বকালে আবু সাঈদ সিরাজ ও ফার্সের প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর আবুবকর মীর্জা নামক জনৈক জ্ঞাতি ভাই-এর সাথে তার সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। উজবেগদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে তিনি আবুবকরকে পরাজিত ও নিহত করেন। এভাবে দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি উত্তর পারস্য, ট্রান্সক্সিয়ানা ও আফগানিস্তানের ওপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। আবু সাঈদ অতিশয় ধর্মভীরু নরপতি ছিলেন। তার আমলে খােজা আহরার নামক জনৈক তাশখন্দের অধিভাসী তার দরবারে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করে। খােজা আহরার একজন সুফি দরবেশ সম্প্রদায়ের লােক ছিলেন। আবু সাঈদের আমলে খােজা আহরারের নেতৃত্বে মধ্য-এশিয়ায় পরবর্তী চল্লিশ বছরের জন্য এই দরবেশদের বিশেষ প্রাধান্যের যুগ সূচিত হয় এবং ফলে তাদের পূর্ববর্তী সাইখ-উল-ইসলামদের প্রাধান্য বিনষ্ট হয়। (ভি.ডি. বার্টহােল্ড : Four Studies on the History of Central Asia. নেদারল্যান্ড, ১৯৬৩, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ: ১৬৯)। কিন্তু বেশি দিন রাজত্ব করা আবু সাঈদের ভাগ্যে ছিল না। ১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘শ্বেত মেষ বংশের’ উজুন খানকে দমন করার জন্য আজারবাইজান আক্রমণ করেন। কিন্তু উভয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক প্রচণ্ড যুদ্ধে আবু সাঈদ পরাজিত ও বন্দি হন এবং পরে তাকে হত্যা করা হয়। আবু সাঈদের মৃত্যুর পর তার এগার পুত্রের মধ্যে ওমর শেখ মীর্জা ছাড়া আর কেউই তেমন যােগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। ওমর শেখ মীর্জা ফরগনায় নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। তিনিই ছিলেন ভারতের বিখ্যাত মােগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা স্বনামধন্য সম্রাট জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবরের পিতা। এছাড়া আবু সাঈদের অপর দুই পুত্র সুলতান আহমদ (১৪৬৭-৯৩ খ্রি.) ও সুলতান মাহমুদ (১৪৯৩ ১৪৯৪ খ্রি.) সমরখন্দে দীর্ঘ ত্রিশ বছরব্যাপী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। কিন্তু তাদের শাসনকাল কোন দিক থেকেই তেমন উল্লেখযােগ্য নয়। 

সুলতান হুসাইন বাইকারা (১৪৬৯-১৫০৬ খ্রি.)

আবু সাঈদের মৃত্যুর পর ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হুসাইন বাইকারা হেরাতের তৈমুরীয় সিংহাসনে উপবেশন করেন। তার রাজত্বকালে একান্ত অস্থায়ীভাবে হলেও এই বংশের হৃতগৌরব অনেকাংশে ফিরে আসে। সুলতান হুসাইন বাইকারা আফগানিস্তানের হেরাতে তার নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। তার শাসনামলে হেরাত উন্নতির চরম শিখরে আরােহণ করে। এই বংশের শাহরুখ ও উলুঘ বেগের মতো তিনিও ছিলেন একজন বিদগ্ধ ও সংস্কৃতিবান নরপতি। তার সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে তৈমুরীয় বংশের পূর্ব গৌরব পুনরুজ্জীবিত হয়। সেই যুগের শ্রেষ্ঠ কবি জামি, আলী মেরনেওয়াই, চিত্রশিল্পী কামাল উদ্দিন বিহজাদ, লিপিকার সুলতান আলী এবং ঐতিহাসিক মীরখাওয়ান্দ তার দরবার অলংকৃত করেছিলেন। ঐতিহাসিক মীরখাওয়ান্দের ‘রাউজাত-আল-সাফা’ এবং মহাকবি জামির ‘ইউসুফ জুলাইখা’ সার্বজনীন সমাদর লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া কামালউদ্দিন বিহজাদের অবদানের ফলে চিত্রকলার দিক থেকে এই আমলকে পারস্যের সােনালি যুগ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। কামাল উদ্দিন বিহজাদকে পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকগণ ‘প্রতীচ্যের রাফায়েল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। (এম. এ. ডিমান্ড : A Handbook of Mohammidan Decorative Arts. নিউইয়র্ক, ১৯৫৮)। সম্রাট বাবর তার আত্মজীবনীতে হুসাইন বাইকারার রাজত্বকালে তার রাজধানী হেরাতের সর্বাত্মক উন্নতি ও প্রাচুর্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, সুলতান হুসাইন বাইকারার অধীনে হেরাত বিশ্বের অতুলনীয় শহরে পরিণত হয় এবং এর জাকজমকতা দশ থেকে বিশগুণ বৃদ্ধি পায়। (বাবর : Babur-nama, এ. এস. ব্যাভারিজ কর্তৃক সম্পাদিত, লন্ডন, ১৯০৫)। দীর্ঘ সঁইত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হুসাইন বাইকারা মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মধ্য-এশিয়ার তৈমুরী বংশের গৌরব রবি চিরতরে অস্তমিত হয়। তার অযােগ্য উত্তরাধিকারীগণ এই বংশের পতন ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি এবং অচিরেই এই অঞ্চলের ওপর ইসমাইলের নেতৃত্বে পারস্যের বিখ্যাত সাফাভি সাম্রাজ্যের অভ্যুদয় ঘটে। 

তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের পতনােত্তর যুগে মােঙ্গল জাতির ইতিহাস

শাইবানি বংশ অথবা উজবেগ সাম্রাজ্য (১৫০০-১৫৯৯ খ্রি.)

ওগােদাই খানের আমলে (১২২৯-১২৪১ খ্রি.) চেঙ্গিস খানের পৌত্র শাইবান খান ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে মােঙ্গল সেনাপতি মহাবীর বাতুর সাথে হাঙ্গেরি বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন। বিনিময়ে সাইবান খান উরাল পর্বতমালা ও ইরঘিজ নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের শাসনভার প্রাপ্ত হন এবং সেখানে তার বংশধরগণ ক্রমাগত সংখ্যায় বর্ধিত হতে থাকে। ১৫শ শতকের শেষের দিকে আবুল খায়ের নামক শাইবান খানের জনৈক বংশধর খাওয়ারিজম ও তুর্কিস্তান অধিকার করেন। এছাড়া ‘হোয়াইট হাের্ড’-এর অধিপতি তােখতামিশ কিপচাক সাম্রাজ্য অধিকারে ব্যস্ত থাকার সুযােগে আবুল খায়ের হোয়াইট হাের্ড অঞ্চল তার পদানত করতে সক্ষম হন। আবুল খানের পুত্র মুহম্মদ শাইবানি খান পিতার মতো সুনিপুণ সমরবিদ ছিলেন। তিনি ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে ট্রান্সঅক্সিয়ানার তৈমুরীয় বংশের সর্বশেষ নরপতি মাহমুদের বিবদমান তিন পুত্রকে পরাজিত করে তার রাজ্যসীমা আফগানিস্তান ও খােরাসান পর্যন্ত বিস্তৃত করতে সক্ষম হন। মুহম্মদ শাইবানি খানই ছিলেন মােঙ্গল জাতির অন্যতম শাখা শাইবানি বংশের প্রতিষ্ঠাতা। (মুহম্মদ শাইবানি খানের অপর নাম ছিল শাহী বেগ খান।)। এই বংশ ইতিহাসে উজবেগ সাম্রাজ্য বলেও পরিচিত। (গোল্ডেন হোর্ডের বিখ্যাত উজবেগ খানের নামানুসারে শাইবানি বংশের নামকরণ হয়েছে।)। শাইবানি খান অবশ্য দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন না। তিনি ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সাফাভি বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাহ ইসমাইলের কাছে মার্ভে অনুষ্ঠিত এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। তবে তার এই হঠাৎ মৃত্যুতে উজবেগ সাম্রাজ্যের তেমন বিশেষ ক্ষতি হয়নি। কারণ তার মৃত্যুর পর তার পিতৃব্য কোকুনজি খান ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সমরখন্দের সিংহাসনে উপবেশন করেন। তিনি গাজদিনের যুদ্ধে জয়লাভ করে এই বংশের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন এবং তাশক, বালখ, বােখারা ও খিবা তার পদানত হয়। কোকুনজি খান দীর্ঘ বিশ বছর রাজত্ব করার পর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার পুত্র আবু সাঈদ তার মৃত্যুর পর ওবায়দুল্লাহ খান উজবেগ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ওবায়দুল্লাহ খান ছিলেন উজবেগ সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও নিঃসন্দেহে এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি। পারস্যের সাফাভি শাহদের প্রতি প্রবল যুদ্ধ-বিগ্রহ তার রাজত্বকালের বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ওবায়দুল্লাহ খানের নেতৃত্বে উজবেগগণ বহুবার হেরাত, খােরাসান ও মার্ভ বিধ্বস্ত করতে সমর্থ হয়। কিন্তু ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে ওবায়দুল্লাহ খান তার স্বজাতি খিবার মােঙ্গলদের হাতে শােচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল তেষট্টি বছর।

ওবায়দুল্লাহ খানের মৃত্যুর পর প্রথম আবদুল্লাহ খান (১৫৩৯ ৪০ খ্রি.), আবদুল লতিফ খান (১৫৪০-৫১ খ্রি), নওরােজ আহমদ (১৫৫১-৫৫ খ্রি.) প্রথম পীর মােহাম্মদ (১৫৫৫-৬০ খ্রি.) ও ইস্কান্দর খান (১৫৬০-৮৩ খ্রি) প্রমুখ নরপতিগণ পর্যায়ক্রমে শাইবানি বংশের উজবেগ শাসনদণ্ড পরিচালনা করেন। এদের রাজত্বকাল মােট তেতাল্লিশ বছর স্থায়ী হয়। এই সকল নরপতিদের মধ্যে কেউই তেমন বিশেষ যােগ্যতার পরিচয় না দিতে পারলেও এদের আমলে শাইবানিদের গৌরব মােটামুটিভাবে অক্ষুন্ন থাকে।  কিন্তু এসময় দ্বিতীয় আবদুল্লাহ খান (১৫৮৩-১৫ খ্রি.) উজবেগ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে শাইবানি বংশের ইতিহাসে আর এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সংযােজন ঘটে। তার আমলে উজবেগ রাজধানী সমরখন্দ পুনরায় শিক্ষা ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং দেশে সর্বাঙ্গীণ শান্তি ও সমৃদ্ধি বিরাজ করে। তার পূর্ব-পুরুষদের মতো দ্বিতীয় আবদুল্লাহ খানও একজন বিখ্যাত সমরবিদ ছিলেন। তিনি আমু-দরিয়া অতিক্রম করে কাজাখ অঞ্চল পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করেন এবং বাদাখশান ও তুখারিস্তান অধিকার করতে সক্ষম হন। ফলে তার রাজ্যসীমা পশ্চিমে অস্ত্রাখান থেকে পূর্বে আশগর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। আবদুল্লাহ খান পারস্যের সাফাভি নরপতি মহামতি শাহ আব্বাসের সমসাময়িক ছিলেন এবং যশ ও প্রতিপত্তির দিক থেকে তিনি প্রায় তার সমকক্ষ ছিলেন। আবদুল্লাহ খান গোড়া মুসলমান ছিলেন। তিনি সমরখন্দ ও বােখরা থেকে দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়নরত বহু বিদ্যার্থীকে বহিস্কার করেন এবং ভারতের মুঘল সম্রাট আকবর কর্তৃক ইসলাম ধর্ম বর্জনের গুজবে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে তার কাছে এক পত্র লেখেন। তবে তা সত্ত্বেও আবদুল্লাহ খান স্থাপত্য ও চিত্র শিল্পের একজন উদার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। আবদুল্লাহ খান ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেই সঙ্গেই শাইবানি বংশের গৌরবরবি অস্তমিত হয়। উজবেগ সাম্রাজ্যে প্রবল মহামারী ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়া এবং আবদুল্লাহ খানের পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন দখলের কোন্দল শুরু হয়। এই সুযােগে পারস্যের সাফাভি নরপতি শাহ আব্বাস মাশাদ, মার্ভ ও হেরাত অধকার করে আমু-দরিয়া পর্যন্ত অগ্রসর হন। শাইবানি বংশের পরবর্তী নরপতিদ্বয় আবদুল মমিন ও দ্বিতীয় পীর মুহম্মদ মাত্র কয়েক মাস রাজত্ব করেন এবং ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে শাইবানি বংশের মূল ও প্রধান শাখার এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে। চেঙ্গিস খানের বংশধরদের মধ্যে শাইবানি বংশই ছিল সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ যােদ্ধাবংশ। এই বংশের পতনের পর তার ধ্বংসাবশেষের ওপর জানিদ, মাঙ্গিত, খিবা ও খােকান্দ বংশের উৎপত্তি হয়। 

বােখারার জানি বংশ (১৫৯৯-১৭৮৫ খ্রি.)

১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার জার কর্তৃক অস্ত্রাখান অধিকৃত হলে সেখানে তাতার রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত জানি খান নামক অস্ত্রাখানের জনৈক তাতার যুবরাজ বোখারায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং শাইবানি বংশের বিখ্যাত নরপতি দ্বিতীয় আবদুল্লাহ খানের ভগ্নিকে বিবাহ করেন। শাইবানি বংশের সর্বশেষ নরপতি মীর মুহমদের মৃত্যুর পর এই বংশের কোন সাক্ষাৎ পুরুষ উত্তরাধিকারী জীবিত না থাকায় জানি খানের পুত্র বাকি মুহম্মদ ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে তার মামার স্থলাভিষিক্ত হন। বাকি মুহম্মদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বােখারার এই রাজবংশ তার পিতা জানি খানের নামানুসারে ‘জানি বংশ’ বলে ইতিহাসে পরিচিত। জানি বংশের বারজন নরপতি প্রায় দুইশত বছর পর্যন্ত (১৫৯৯-১৭৮৫ খ্রি.) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং বোখারা ছিল তাদের রাজধানী। জানি বংশের নরপতিগণ তাদের পূর্ববর্তী শাইবানি বংশের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সমগ্র মাওয়ারা উন-নাহার সহ বালুখ, সমরখন্দ, বােখারা, ফরগনা ও বাদাখশান-এই বিরাট ভূ-ভাগের অধিপতি হন। এই বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন ইমাম কুলী খান (১৬০৮-৪০ খ্রি)। তার আমলে বােখারা শান্তি ও সমৃদ্ধির শীর্ষ-শিখরে আরােহণ করে। ইমাম কুলী খান নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন এবং ‘সিরদার মাদ্রাসা’ নামে তিনি সমরখন্দে একটি শিক্ষা-নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজত্বের শেষ দিকে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে ধর্মীয় জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফে অবস্থান করেন। ইমাম কুলী খানের পদত্যাগের সুযােগে ভারতের মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র মুরাদ বক্স ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে বাদাখশান ও বাল্খ অধিকার করেন। জানি শাসনকর্তা নাদীর মুহম্মদ (১৬৪০-৪৭ খ্রি.) প্রথমে মাশাদ ও পরে সাফাভি রাজধানী ইস্পাহানে পালিয়ে যান। কিন্তু নানা কারণে মুরাদ বক্স বালখ পরিত্যাগ করলে শাহজাহান তাকে সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করেন এবং তার অপর পুত্র আওরঙ্গজেবকে সেই পদে বহাল করেন। কিন্তু নাদীর মুহম্মদের পুত্র আবদুল আজিজ ও শাবান কুলী খান মুঘল সেনাপতি আওরঙ্গজেবের এই আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করেন এবং বালখ ও বাদাখশানের ওপর পুনরায় জানি বংশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ভারতের মুঘল সম্রাটগণ কর্তৃক মধ্য-এশিয়ায় রাজ্য বিস্তারের সর্বশেষ প্রচেষ্টা এভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। মু

ঘলদের বোখারা আক্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে “শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, মারাঠা সাম্রাজ্য ও মুঘল সাম্রাজ্যের পতন” লেখাটির “শাহজাহানের মধ্য-এশিয়া নীতি” অংশটি পড়ুন। 

জানি বংশের আবদুল আজিজ (১৬৪৭-১৬৮০ খ্রি.) ও শাবান কুলী খান (১৬৮০ ১৭০২ খ্রি.) দীর্ঘ অর্ধ-শতাব্দীব্যাপী রাজত্ব করেন। শাবান কুলী খান পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর একটি পুস্তিকা রচনা করেন। তার আমলে রাজধানী বােখারায় ‘আবদুল আজিজ মাদ্রাসা’ ও সমরখন্দে ‘তালাকারি মাদ্রাসা’ নামে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। শাবান কুলীর পর ওবায়দুল্লাহ্ (১৭০২-১৭০৫ খ্রি.) ও আবুল ফায়েজ (১৭০৫-১৭৪৭ খ্রি.) বােখারার শাসনদণ্ড পরিচালনা করেন। আবুল ফায়েজের রাজত্বকালে নাদির শাহ জানি রাজ্য আক্রমণ করেন এবং সমরখন্দ, বােখারা ও বালখ তার হস্তগত হয়। কিন্তু আবুল ফায়েজ নাদিরের বশ্যতা স্বীকার করে তার সাথে সন্ধি করলে দিল্লির মতো বােখারা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। নাদিরের প্রত্যাবর্তনের পর জানি বংশ আরও প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু এসময় মাঙ্গি বংশের উৎপত্তি হলে জানি নরপতিগণ তাদের কাছে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে সর্বশেষ জানি নরপতি আবুল গাজী খানকে অপসারিত করে মাঙ্গি বংশের প্রতিষ্ঠাতা মীর মাসুম শাহ মুরাদ বােখারা অধিকার করেন। এভাবে দীর্ঘ দুইশত বছর পর জানি বংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।

বােখারার মাঙ্গি বংশ (১৭৮৫-১৮৬৮ খ্রি.)

মীর মাসুম শাহ মুরাদ ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে শাইবানি বংশের মাঙ্গি শাখার প্রতিষ্ঠা করেন। মাঙ্গি শব্দের অর্থ ‘চ্যাপ্টা নাক’। এরা কিপচাকের নোগাই তাতারদের বংশধর। ১৬শ শতাব্দীর প্রারম্ভে এরা মুহম্মদ শাইবানির নেতৃত্বে নিজেদের ভাগ্যান্বেষণে কিপচাক পরিত্যাগ করে। অস্ত্রাখানের তাতার শাসন আমলে তাদের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পায় এবং ১৮শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাদের দলপতি মীর মাসুম শাহ মুরাদ বােখারার জানি বংশের প্রধান উজির নিযুক্ত হন। পরে তিনি ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে জানি বংশের শেষ নরপতি আবুল গাজী খানকে অপসারিত করে মাঙ্গি বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। শাহ মুরাদের আমলে বােখারা (১৭৮৫-১৮০০ খ্রি.) সাময়িকভাবে অন্ধকার যুগে নিপতিত হলেও পুনরায় শান্তি ও সমৃদ্ধির সােপানে উন্নীত হয়। তিনি সুনিপুণ যােদ্ধা ছিলেন। তার আমলে খিবা ও খােকান্দ বােখারার অধিকারক্ত হয়। এছাড়া খােরাসান ও মার্ভের বিরদ্ধেও তিনি কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন। তবে আফগানিস্তানের দুররানি বংশের সাথে আপােষ নীতি গ্রহণ করে তিনি বালখ আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকেন। শাহ মুরাদ নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন এবং দরবেশের মতো অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। ইসলামী শরিয়ত ও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি তার প্রগাঢ় ভক্তি ছিল এবং সেই সঙ্গে সামরিক নৈপুণ্যের জন্য তিনি প্রজাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা অর্জন করেন। শাহ মুরাদের পুত্র ও উত্তরাধিকারী আমীর হায়দারও (১৮০০-১৮২৬ খ্রি.) পিতার মতো অনেক গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। কিন্তু ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন অধিকারের প্রশ্নে রক্তক্ষয়ী গৃহবিবাদ শুরু হয়। ফলে মাঙ্গি বংশের সুনাম ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে ব্যাহত হয়। ভাইদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই গৃহ বিবাদে অবশেষে নাসরুল্লাহ খান জয়লাভ করেন এবং তিনি পরবর্তী বত্রিশ বছর (১৮২৭-১৮৬০ খ্রি.) বােখারার মাঙ্গি বংশের শাসনদণ্ড পরিচালনা করেন। নাসরুল্লাহর মৃত্যর পর তার উত্তরাধিকারী মুজাফফার উদ্দিন (১৮৬০-১৮৬৮ খ্রি.) রাশিয়ার সাথে এক সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন এবং ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বােখারা রাশিয়ার করদ রাজ্যে পরিণত হয়। বােখারার মাঙ্গি বংশীয় আমীরগণ অবশ্য ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এভাবে রাশিয়ার জারের নেতৃত্বে আশ্রিত রাজ্যের মর্যাদা ভােগ করে। কিন্তু এসময় বলশেভিকগণ ক্ষমতা দখল করলে বােখারা স্থায়ীভাবে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

খিবার খান বংশ (১৫১৫-১৮৭২ খ্রি.)

চেঙ্গিস খানের আমলে খিবা (খাওয়ারিজম) মােঙ্গলদের পদানত হয়। এরপর ওগােদাই খানের মৃত্যুর পর থেকে বহুদিন যাবৎ খিবা গােল্ডেন হাের্ড-এর খানদের অধীনে ছিল। পরে ১৫শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এটি তৈমুরের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তৈমুরীয় বংশের পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অরাজকতার সুযােগ নিয়ে উজবেগ অধিপতি মুহম্মদ শাইবানী খান ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে খিবা অধিকার করেন এবং তার জনৈক বংশধর ইলবার্স খানের নেতৃত্বে খিবা একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। খিবা প্রায় সাড়ে তিন শতাব্দীব্যাপী স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হিসেবে স্থায়ী হয় এবং পর্যায়ক্রমে তেত্রিশজন নরপতি এই রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু খিবা রাজ্য দীর্ঘদিন স্থায়ী হলেও সমসাময়িক অপরাপর মোঙ্গল রাজ্যের তুলনায় সামরিক শক্তির দিক থেকে এটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছিল। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও খিবা তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেনি। এছাড়া অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও এই রাজ্যটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ছিল। সাফাভি নরপতি শাহ আব্বাসের আমলে খিবা পারস্যের বশ্যতা স্বীকার করে এবং ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে নাদির শাহ এই অঞ্চল অধিকার করেন। এছাড়া জানি বংশের নরপতি দ্বিতীয় আবদুল্লাহ খান ও মাঙ্গি বংশের প্রতিষ্ঠাতা মীর মাসুম শাহ মুরাদের সময়ও খিবা তাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ১৭শ শতাব্দীর শেষার্ধে পারস্যের সাফাভি ও সমরখন্দের জানি বংশ হীনবল হয়ে পড়লে এই সুযােগে খিবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি আবুল গাজী বাহাদুর খান (১৬৪৩-৬৩খ্রি.) ও তার পুত্র আনুশা খানের আমলে (১৬৬৩-৭৪ খ্রি.) তারা সাফল্যের সঙ্গে খােরাসান ও সমরখন্দ আক্রমণ করেন। আবুল গাজী বাহাদুর খান একজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ছিলেন। তার লিখিত ‘শাজারাত –আল আতরাক’ খিবার রাজবংশের ওপর একটি মূল্যবান গ্রন্থ। দীর্ঘ সাড়ে তিন শতাব্দীব্যাপী এভাবে নানা উত্থান ও পতনের মাধ্যমে খিবা কোন প্রকার তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এরপর ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রুশ সেনাপতি কাউফম্যান খিবা দখল করেন। তবে পাশ্ববর্তী রাজ্য বােখারার মতো খিবাও ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাশিয়ার আশ্রিত ও করদরাজ্য হিসেবে কোন রকমে টিকে ছিল। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার বলশেভিকগণ খিবাকে স্থায়ীভাবে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করলে তাতার মুসলমানদের অধীনস্ত খিবা রাজ্যের চির-অবসান ঘটে। 

খােকান্দের খান বংশ (১৭০০-১৮৭৫ খ্রি.)

১৭০০ খ্রিস্টাব্দে শাহরুখ বেগ নাম জনৈক তাতার যুবরাজ খােকান্দ রাজ্যের (ফরগনা) প্রতিষ্ঠা করেন। শাহরুখ বেগ চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। এই বংশ প্রায় পৌনে দুই শত বছর স্থায়ী হয় এবং বিশজন নরপতি পর্যায়ক্রমে খােকান্দের খান বংশের শাসনদণ্ড পরিচালনা করেন। এই বংশের মধ্যে আলিম খান সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে তাশখন্দ ও খােজান্দ অধিকার করতে সমর্থ হন। তার উত্তরাধিকারী মুহম্মদ ওমর শেখ (১৮০৯-২২ খ্রি.) একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন এবং তিনি সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের বিশেষ পৃষ্ঠপােষকতা করেন। তিনি রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাজাক রাজ্য আক্রমণ করেন এবং সির-দরিয়ার উত্তর তীরে ‘আক্ মেচেৎ’ নামে একটি শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করেন। অতঃপর তার পুত্র মুহম্মদ আলী ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে খােকান্দের শাসনকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তার রাজত্বকালকে (১৮২২-৪০ খ্রি.) এই বংশের চরম উন্নতি ও সমৃদ্ধির যুগ বলে অভিহিত করা যায়। কিন্তু এসময় তিনি বােখারার শক্তিশালী নরপতি নাসরুল্লাহ খানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন এবং তার মৃত্যুর পর এই বংশ বিশেষ দুর্বল হয়ে পড়ে। এছাড়া রাজ্যের অভ্যন্তরে উজবেগ ও তাজিকদের মধ্যে আত্মঘাতী গৃহবিবাদের ফলে খােকান্দ রাজ্যের প্রতিপত্তি আরও ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়ে। এই সুযােগে রাশিয়ার জার সর্বশেষ খােকান্দ অধিপতি নাসির উদ্দিনকে পরাজিত করে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে এই রাজ্যটি তার সাম্রাজ্যভুক্ত করেন

তথ্যসূত্র

  • বি. স্পুলার : The Muslim World. (মােঙ্গল যুগ), ইংরেজি অনুবাদ : এফ. আর. সি. বাগলে, দ্বিতীয় খণ্ড, নেদারল্যান্ডস, ১৯৬০)
  • জি. হ্যাম্বলি : Central Asia. নিউইয়ক, ১৯৬৯
  • Encyclopaedia of Islam, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড , ১৯৫৮
  • এডওয়ার্ড গিবন: The Decline and fall of the Roman Empire. লণ্ডন, ১৮১৬
  • এ. লেইনপুল : The Mohammadan Dynasties.-বৈরুত, ১৯৬৬
  • জে. কার্টিন : ‘The Mongols, বােস্টন, ১৯০৮
  • জওহরলাল নেহেরু : Glimpses of the Wrold History-নয়াদিল্লি, ১৯৬৪
  • হেনরি হোয়ার্থ : History of the Mongols. তিন খণ্ড, লণ্ডন, ১৯২৮
  • ডি. ওহাসন : History of the Mongols, এ্যামসটারডাম, ১৪৫২
  • মার্কো পােলাে : The Travels of Marco Polo, (ইংরেজি অনুবাদ : মার্সডেন) নিউইয়র্ক, ১৯২৬
  • ওয়ালব্যাংক ও টেইলর ; Civilization Past and Present, নিউইয়র্ক, ১৯৬০, প্রথম খণ্ড
  • এইচ. এ. এল. ফিসার : History of Europe from Earliest Time to 1713, লন্ডন, ১৯৩৫
  • জন ম্যালকোম : History of Persia, প্রথম খণ্ড, লন্ডন, ১৮২১
  • আমীর আলী : A sliort History of the Saracens. লন্ডন, ১৯৫৩
  • পি. সাইকস : A History of Persia, লন্ডন, ১৯২১
  • ভি. ভি. পার্টহোল : Ulugh-Beg, লণ্ডন, ১৯৫৮
  • পি. কে. হিট্টি : History of the Arabs, নিউইয়র্ক, ১৯৬৮
  • জে. এ. বায়েল : The Cambridge History of Iran. পঞ্চম খণ্ড, ক্যাম্ব্রিজ, ১১৬৮
  • ই. জি ব্রাউন : A Literary History of Persia. ক্যাম্ব্রিজ, ১৯৫৬
  • এইচ. ইউলি, Cathay and the way Thither- লন্ডন – ১৮৬৬
  • ডব্লিউ, পপার : History of Egypt, লস্ এঞ্জেলস্‌, ১৯৫৪
  • The Cambridge History of Islam.-ক্যাম্ব্রিজ, প্রথম খণ্ড
  • এইচ. এ. আর. গিব :The Travels of Ibn Batuta. (১৩২৫-১৫৪ খ্রি.) দ্বিতীয় খণ্ড, লন্ডন, ১৯৭১
  • আগা মাহদি হুসাইন : The Rise and Fall of Muhammad bin Tughluq-লন্ডন, ১৯৩৮
  • Encyclopædia Britannica, Online Edition, Central Asia, history of Timur”, ২০০৭ 
  • জি আর গার্থহোয়াইট, The Persians, Malden, Blackwell Pub., ২০০৭
  • হ্যারল্ড ল্যাধ : Tamberlane, নিউয়র্ক, ১৯২৮
  • হিলদা দুহাম; Tamburlaine the Conqueror. লন্ডন, ১৯৬২
  • তৈমুর : Mulfuzat-i-Timuri- ইংরেজি অনুবাদ: মেজর চার্লস স্টেওয়ার্ট , Memoirs of Timur, লন্ডন, ১৮৩০
  • আর. সি. মজুমদার ও অন্যান্য : An Advanced History of India, লন্ডন, ১৯৬৩
  • হিলদা হুকহাম : “Tamberlane the Conqueror’ লন্ডন ১৯৬২
  • আতা মালিক জুয়াইনি : “History of the World Conqueror” (অনুবাদক : জে. এ. বয়েল) ম্যানচেস্টার, ১৯৫৮
  • Ibn Khaldun and Tamerlan : Their historic meeting in Damascus in 1401. (ইবনে-খালদুনের আত্মজীবনী থেকে ডব্লিউ. আর. ফিসেল কর্তৃক অনূদিত) লস অ্যাঞ্জেলস ১৯৫২
  • ইবনে-আরাবশাহ : Timur the Great Amir, অনুবাদক : জে. এইচ. সাউডার, লন্ডন, ১৯৩৬
  • চার্লস স্টেওয়ার্ট : History of Bengal, কলকাতা, ১৯০৩
  • মনতাজুর রহমান তরফদার : Husain Shahf Bengal-A Social-Political Study. ঢাকা, ১৯৬৫
  • ভি.ভি. বার্টহােল্ড, Four Studies on the History of Central Asia, লিডেন, ১৯৬৩
  • Encyclopedia of Islam, নাল্লিনাে কর্তৃক লিখিত
  • এম. এ. ডিমান্ড : A Handbook of Mohammidan Decorative Arts. নিউইয়র্ক, ১৯৫৮
  • বাবর : Babur-nama, এ. এস. ব্যাভারিজ কর্তৃক সম্পাদিত, লন্ডন, ১৯০৫
  • মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাস (১২৫৮-১৮০০), আশরাফউদ্দিন আহমেদ, চয়নিকা, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ৩৬-১২২
  • ড. ফাতেমা সাদেক : Baybars 1 of Egyps. ঢাকা, ১৯৫৬
  • মুহম্মদ আবদুল্লাহ ইনান : Decisive Moments in the History of Islam. C ১৯৯৪
  • এস. লেনপুল : Turkey, লন্ডন, ১৮৮৮
  • উইকিপিডিয়া নিবন্ধ – Ahmad Jalayir, Qara Yusuf, Jahan Shah, Uzun Hasan, Abu Sa’id Mirza, Yadgar Muhammad Mirza, Sultan Husayn Bayqara, Badi’ al-Zaman Mirza, Ismail I, Sultan Ahmed Mirza, Sultan Mahmud Mirza, Umar Shaikh Mirza II, Ulugh Beg II, Babur

সম্পর্কিত মানচিত্রভিত্তিক ভিডিও

মোঙ্গল সাম্রাজ্য (১২০৬-১২৯৪ খ্রি.)

মোঙ্গলদের ইতিহাস

এশিয়ার ইতিহাস

এশিয়ার ইতিহাস (২)

ইউরেশিয়ার ইতিহাস

পৃথিবীর ইতিহাস

পূর্ব ইউরোপের ইতিহাস

ইউরোপের ইতিহাস

মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস

মধ্য এশিয়ার ইতিহাস

মধ্য এশিয়ার ইতিহাস (খ্রি.পূ. ২০৯-১২৪৪ খ্রি.)

উত্তর-পশ্চিম এশিয়ার খানাতসমূহ

গোল্ডেন হোর্ডের ইতিহাস

ইরানের ইতিহাস

তিমুরিদ সাম্রাজ্য

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.