তুর্কি শক্তির অভ্যুত্থান, সেলজুক সাম্রাজ্য, রুমের সালতানাত ও এশিয়া মাইনোরের স্বাধীন গাজী রাষ্ট্রসমূহ

(সংশোধন ও সম্প্রসারণযোগ্য)

Table of Contents

তুর্কি শক্তির অভ্যুত্থান

আরব মুসলমানদের নেতৃত্বে মুসলিম-শক্তির অভ্যুদয় পৃথিবীর ইতিহাসে এক চমকপ্রদ ঘটনা। ইসলামের প্রচলিত ইতিহাস অনুসারে, মুহম্মদের মৃত্যুর পর তার অনুসারীদের প্রচেষ্টায় অর্ধশতাব্দীর মধ্যে ইসলাম বিজয়ী বেশে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা-এই তিনটি মহাদেশে বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আরব মুসলমানদের এই নেতৃত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বস্তুত ৮ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে দামেস্কের উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম বিশ্বের কার্যকরী ক্ষমতা আরবদের হাতছাড়া হতে থাকে। উমাইয়াদের পর আব্বাসীয় বংশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আব্বাসীয় বংশ জাতিগতভাবে আরবীয় হলেও এই আমলে পারস্যদের হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল এবং খলিফা আল-মামুনের আমল থেকে এই ক্ষমতার হস্তান্তরে আর কোন গোপনীয়তা রইলো না। তবে পারস্য বেশি দিন বিশ্ব-মুসলিম সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হয়নি। অচিরেই তৃতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব বদলের পালা এলো। আর পালা বদলের এই অমোঘ চক্রে এবার ইসলামের নেতৃত্বের ভার পড়ে তুর্কিদের কাঁধে। ইসলামের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে এবার তুর্কিজাতি নামক এক নতুন মানবগোষ্ঠীর চাঞ্চল্যকর অভ্যুদয় ঘটলো। তুর্কিরা দীর্ঘকালব্যাপী সাফল্যের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ প্রদান করতে সক্ষম হয়েছিল। তুর্কিশক্তির অভ্যুথান তাই মুসলিম ইতিহাসে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। স্মরণাতীত কাল থেকে মধ্য-এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী যাযাবর জাতির বসবাস। জাতিতেই এরা ছিল প্রধানত তুর্কি ও মোঙ্গল। তুর্কিদের নিজেদের ইউরেশীয় স্তেপ অঞ্চল ত্যাগ করে এশিয়া মাইনোর থেকে ভারত পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত হবার পেছনে অর্থনৈতিক কারণই ছিল প্রধান। তবে তাদের চিরশত্রু মোঙ্গলদের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষই অবশেষে তাদেরকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছিল।

তুর্কিদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু দরিদ্র হলেও তারা অসম সাহসী, কষ্টসহিষ্ণু এবং দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে সুপরিচিত ছিল। এছাড়া সুপটু অশ্বারোহী হিসেবেও তৎকালে এদের তুলনা ছিল না। তুর্কিদের এসব চারিত্রিক গুণাবলীর জন্যে অবশ্য দেশের প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থাই বিশেষভাবে দায়ী ছিল। তুর্কিদের আদি বাসস্থান মধ্য-এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা উমাইয়া খিলাফতের আমলে আরবদের অধীনে আসে এবং তখন থেকেই তারা ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসতে থাকে। পরবর্তী সময়ে আব্বাসীয় খিলাফতের আমলে তারা সাধারণ সৈন্য হিসেবে আবার কখনওবা খলিফার দেহরক্ষী হিসেবে চাকরিতে প্রবেশ করে। কারণ প্রতিভাবান এই তুর্কিরা সর্বোচ্চ মূল্য প্রদানকারীর কাছেই সর্বদা তাদের প্রতিভা বিক্রয় করতে প্রস্তুত থাকতো।

আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাসিম (৮৩৩-৮৪২খ্রি:) তার একান্ত অজান্তে ইসলামের ইতিহাসে তুর্কি শক্তির অভ্যুত্থানের বীজ বপন করেছিলেন। কারণ আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে তুর্কি ক্রীতদাসদের সমন্বয়ে দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করেন। খোরাসানি ও আরব দেহরক্ষীদের ঐদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে তার পাল্টা ব্যবস্থা স্বরূপ তিনি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই অদূরদর্শী খলিফার দ্বারা গৃহীত এই পদক্ষেপ অবশেষে আব্বাসীয় বংশের পক্ষে চরম হুমকি স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। তুর্কিরা আব্বাসীয় সেনাবাহিনীর প্রধান থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো অধিকার করে বসে। ফলে ক্ষমতার লড়াইয়ে আরবরা এবার আরও এক স্তর পেছনে চলে যেতে বাধ্য হলো। রাজধানী বাগদাদ তুর্কিদের এই অত্যাচার এবং অসৌজন্যমূলক ব্যবহারে উত্যক্ত হয়ে উঠলো। একবার খলিফা আল মুতাসিম তুর্কি দেহরক্ষীসহ বাগদাদের রাজপথে বের হলে জনৈক আরব শেখ তার প্রতি বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করেন। মনে করা হয় যে, এই ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ ও মর্মাহত হয়ে খলিফা বাগদাদ থেকে ৬০ মাইল দূরবর্তী তাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত সামাররায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। প্রায় অর্ধশতাব্দীব্যাপী (৮৩৬-৮৯৪ খ্রি:) অন্ততপক্ষে সাতজন আব্বাসীয় খলিফা সামাররা থেকে খিলাফত পরিচালনা করেন। খলিফা আল-মুতাজিদ (৮৯২-৯০২ খ্রি:) কর্তৃক আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী বাগদাদে পুন:প্রতিষ্ঠিত হলেও তার ফলে বিদ্যমান ঘটনা প্রবাহে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয়নি। দুর্বল আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে অবস্থা আরও শোচনীয় আকার ধারণ করল। তুর্কিরা রক্ষকের ভূমিকা পরিত্যাগ করে ভক্ষক হয়ে বসলো এবং স্বয়ং প্রভুকেই ভৃত্যের মন যুগিয়ে চলতে হলো। কোন ব্যাপারে আব্বাসীয় খলিফা তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনী ও সাধারণ সৈন্যদের খামখেয়ালি মনোবৃত্তি চরিতার্থ করতে ব্যর্থ হলে তাকে হত্যা কিংবা সিংহাসনচ্যুত করে তুর্কিগণ তাদের পছন্দনীয় এবং বাধ্যগত অন্য কাহাকেও খলিফা নির্বাচন করতো। জনৈক ঐতিহাসিক সত্যই মন্তব্য করেছেন যে, “অদৃষ্টের পরিহাসে এভাবে ক্রেতা অবশেষে বিক্রয়ের পণ্যে পরিণত হলো।” আব্বাসীয় খলিফাদের অনুকরণে মিশরের আইয়ুবী বংশের নরপতিগণও তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করেছিলেন এবং বলাবাহুল্য যে, তার পরিণতিও ঠিক একই রকম হয়েছিল।

তবে তুর্কিদের এই প্রারম্ভিক ও সাময়িক উচ্ছলতা উপেক্ষা করলে তাদের এভাবে একচেটিয়া ক্ষমতা দখল পরবর্তীকালেই ইসলাম তথা মুসলিম বিশ্বের পক্ষে আশীর্বাদ স্বরূপ হয়েছিল। কারণ তুর্কিরা প্রকৃত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনা, রাজ্য বিজয় ও সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদর্শনে অভূতপূর্ব সাফল্য ও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিল। ১১শ শতাব্দীতে ইসলামের শক্তি যখন ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল ঠিক সেই মুহূর্তে তুর্কিরা ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে আবির্ভূত হয় এবং মুসলিম জাতিকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। তুর্কিরা ইউরোপের ভিয়েনা থেকে সমগ্র পশ্চিম-এশিয়া, মধ্য এশিয়া, ভারতবর্ষ ও আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাঞ্চল অধিকার করে নিয়েছিল। ৯ম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করে ২০শ শতাব্দীর প্রথম এক চতুর্থাংশ পর্যন্ত নানা অবস্থায় তুর্কিদের এই নেতৃত্ব অক্ষুন্ন ছিল। এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশে যে কয়টি তুর্কি বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের মধ্যে মিশরের তুলুনীদ বংশ (৮৬৮-৯০৫ খ্রি:), আফগানিস্তানের গজনভী বংশ (৯৯৭-১০৪০ খ্রি:), বাগদাদ ও এশিয়া মাইনরের সেলজুক বংশ (১০৫৫-১৩০২ খ্রি:), আফগানিস্তানের ঘোরী বংশ (১১৭৩-১২০৬ খ্রি:), সিরিয়া ও মসুলের জেঙ্গী বংশ (১১২৭-১১৬৯ খ্রি:), মিশর ও সিরিয়ার আইয়ুবী বংশ (১১৬৯-১২৫০ খ্রি:), মামলুক বংশ (১২৫০-১৫১৭ খ্রি:), ভারতের দাস বা মামলুক বংশ (১২০৬-১২৯০ খ্রি:), খলজি বংশ (১২৯০-১৩২০ খ্রি:), তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১৩ খ্রি:,) সাইয়েদ বংশ (১৪১৪১৪৫১ খ্রি:), লোদী বংশ (১৪৫১ -১৫২৬ খ্রি:), তুরস্কের অটোমান বংশ (১৩০২-১৯২৪ খ্রি:) প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সেলজুক তুর্কি সাম্রাজ্য (১০৩৭-১১৯৪) ও রুম সালতানাত (১০৭৭-১৩০৮)

ভূমিকা

১১শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেলজুক তুর্কি শক্তির অভ্যুথান ঘটে। মুসলিম বিশ্ব এসময়ে নানান রকম আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যায় জর্জরিত ছিল। বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফত তখন যেন তেন প্রকারে নিজ অস্তিত্ব বজায় রেখে চলছে। মুসলিম বিশ্ব এসময়ে ক্ষুদ্র-খণ্ড স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে একমাত্র মিশরের ফাতেমি সাম্রাজ্য ছাড়া অন্য কোন উল্লেখযোগ্য শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু ফাতেমিগণ ইসলামের শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল বলে সুন্নীদের সাথে তাদের শত্রুতারও অন্ত নেই। স্পেইন ও উত্তর-আফ্রিকা ইতোপূর্বেই বাগদাদের খলিফাদের হাতছাড়া হয়ে পড়েছে। তাছাড়া সিরিয়া, ইরাক ও পারস্যের অবস্থাও বলতে গেলে একইরকম। তাই এ অবস্থায় সেলজুক শক্তির বিকাশ নিঃসন্দেহে বিশ্বের মুসলিমদের ভাগ্যের দরজা খুলে দেয়। তাদের প্রচেষ্টায় আব্বাসীয় সুন্নী খিলাফতের লুপ্ত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তারা রাজ্য বিস্তার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতায় এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। আফগানিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত থেকে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত সেলজুক শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেলজুক তুর্কিরা বাইজান্টাইনদের থেকে অনেক অঞ্চল অধিকার করেছিল আর ক্রুসেডারদেরকেও তারা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিহত করেছিল। এদের এই অবদানের কারণেই পরবর্তীতে আরেক তুর্কি বংশ অটোমানরা ইউরোপ ও এশিয়া মাইনোরে সাফল্যের সাথে অদূর ভবিষ্যতেই তাদের সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিল। (পি. কে. হিট্টি : “The Near East in History”- প্রিন্সটন, ১৯৬০ পৃ: ২৯৫)। সেলজুক তুর্কিগণ সুদূর আনাতোলিয়া পর্যন্ত তাদের অধীনে আনয়ন করতে সক্ষম হয়। আনাতোলিয়া ছিল বহু প্রাচীন জাতি ও সভ্যতার আদিভূমি এবং তিনটি মহাদেশের মিলনক্ষেত্র। তাই এই অঞ্চলে ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি নতুন ধর্ম ও ভাষাভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষ নিঃসন্দেহে ইতিহাসের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা (The Cambridge History of Islam-ক্যাঘরিজ, ১৯৭০, প্রথম খণ্ড, পৃ: ২৩১)।

মধ্য-এশিয়ার তুর্কিরা নয়টি প্রধান গোত্রে বিভক্ত ছিল। এদের মধ্যে সেলজুকরা ছিল ওঘুজ তুর্কিদের একটি অন্যতম শাখা। ওঘুজ দলপতিকে ‘ইয়াবঘু’ বলা হতো। এরা ছিল মূলত তুর্কিস্তানের অধিবাসী। ওঘুজ তুর্কিরা তাদের দলপতি সেলজুক ইবন্ ইয়াকুবের নেতৃত্বে জন্মভূমি পরিত্যাগ করে বোখারা প্রদেশের জাল নামক স্থানে আগমন করে (সাইক্‌স্ তার “A History of Persia” নামক পুস্তকে সেলজুকের পিতার নাম তুকাক বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু লেনপুলের বর্ণনায় এই নাম দেখানো হয়েছে ইয়াকুব।)। কথিত আছে যে, ওঘুজ দলপতি সেলজুক সর্বপ্রথম সদলবলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন (এস. লেনপুল : “The Mohammadan Dynasties”-বৈরুত, ১৯৬৬, পৃ: ১৫০-৫১)। দলপতি সেলজুকের নাম অনুসারে এই গোত্র ইতিহাসে সেলজুক বংশ বলে পরিচিত হয়। সেলজুকগণ অতঃপর গজনভি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবু মনসুর শবুক্তগিনের (Abu Mansur Sabuktigin, রা. ৯৭৭-৯৯৭ খ্রি.) অধীনে চাকরি গ্রহণ করে এবং অবিলম্বে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গজনীর পরবর্তী শাসনকর্তা সুলতান মাহমুদ (Mahmud of Ghazni, রা. ৯৯৯-১০৩০ খ্রি.) সেলজুকদের এই শক্তি বৃদ্ধিতে ভীত হয়ে তাদের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতেন। অবশেষে সেলজুক তুর্কিদের একটি দলকে তাদের দলপতি সেলজুকের (মৃ. ১০০৯ খ্রি.) অধীনে খোরাসানে বহিষ্কার করে দেন। সুলতান মাহমুদ কর্তৃক সেলজুকদেরকে খোরাসানে বহিষ্কার প্রকৃতপক্ষে তাদের জন্য শাপে বর স্বরূপ হয়েছিল, কেননা অদূরভবিষ্যতে খোরাসানকে কেন্দ্র করেই সেলজুকদের শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেলজুকের পর দলপতির ভার নেন তার পুত্র মিকাইল ইবনে সেলজুক বেগ বা মিকাইল অফ কিনিক ট্রাইব (Mikail of Kınık tribe)। তিনিও প্রথম দিকে তার পিতার মতো অমুসলিম ছিলেন। তিনি ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

তুঘ্রিল বেগ

মিকাইলের মৃত্যুর পর ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র তুঘ্রিল বেগ (Tughril Bey, রা. ১০৩৭-১০৬৩ খ্রি.) তার স্থলাভিষিক্ত হন। বস্তুত তুঘ্রিলের যোগ্য নেতৃত্ব ও সমর প্রতিভার ফলেই সেলজুকরা একটি রাজশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর তার দুর্বল উত্তরাধিকারীদের অধীনে গজনভি সাম্রাজ্যের দ্রুত পতন সূচিত হয়। এই সুযোগে তুঘ্রিলের নেতৃত্বে সেলজুকরা প্রথমে মার্ভ ও পরে নিশাপুর দখল করে নিতে সক্ষম হয় এবং তাদের কাছে হেরাতের পতনও অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দেয়। এসময়ে গজনভির সম্রাট ছিলেন সুলতান মাসুদ (Masʽud I of Ghazni, রা. ১০৩০-৪০ খ্রি.)। তিনি চূড়ান্তভাবে সেলজুকদের মোকাবেলা করার জন্য নিজেই সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রা করলেন। ফলে ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে দান্দানাকানের রিবাত নামক স্থানে এই দুই বাহিনীর মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় (Battle of Dandanaqan)। যুদ্ধে সেলজুক নেতা তুঘ্রিল বেগের কাছে গজনির সুলতান মাসুদ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। খোরাসানের ইতিহাসে এই যুদ্ধকে এক ভাগ্যনির্ধারণকারী যুদ্ধ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে কারণ এই যুদ্ধে গজনি সাম্রাজ্যের পতন সুনিশ্চিত হয়ে দেখা দিয়েছিল, এদিকে এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে খোরাসান সেলজুকদের অধিকারভুক্ত হয়ে পড়ে। এর পর থেকে সেলজুকগণ আর যাযাবর দল হয়ে রইলো না, বরং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করল। তুঘ্রিল বেগ এরপর বল্‌খ, তাবারিস্তান, খাওয়ারিজম, হামাদান, আল্ রাই ও ইস্পাহান প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো একের পর এক দখল করে নেন। এভাবে গজনভি সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর সেলজুক তুর্কি শক্তির অভ্যুদয় হলো।

এসময়ে আব্বাসীয় খলিফা আল্ কাইম (Al-Qa’im, রা. ১০৩১-৭৫ খ্রি.) বুয়িদ (Buyid dynasty) আমীরদের দৌরাত্মের ফলে ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। তুঘ্রিল বেগ খলিফার সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন। এমনকি দান্দানাকানের যুদ্ধে জয়লাভ করার পর বাগদাদের খলিফার কাছে তিনি তার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে একটি পত্রও লিখিয়াছিলেন। ফলে খলিফা আল কাইম বুয়ায়হিদ বা বুয়িদদের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করার জন্যে সেলজুক অধিপতি তুঘ্রিল বেগকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি বিনা দ্বিধায় তাতে রাজি হয়ে বাগদাদ অভিমুখে অগ্রসর হলেন। ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ডিসেম্বর সেলজুকদের জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। কারণ এই দিনে তুঘ্রিল বেগ সসৈন্যে বাগদাদে প্রবেশ করে বুয়ায়হিদ বা বুয়িদ সাম্রাজ্যের ইরাকের সর্বশেষ আমীর মালিক রহিমকে (Al-Malik al-Rahim, রা. ১০৪৮-৫৫ খ্রি.) পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। এই ঘটনায় খলিফা আল-কাইমের আনন্দের সীমা রইলো না এবং তিনি তুঘ্রিল বেগকে বাগদাদে সাদর সম্ভাষণ জানান। কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ খলিফা তুঘ্রিলকে “সুলতান আল মুয়াজ্জম” উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সাম্রাজ্যের সকল কর্তৃত্ব তার থেকে অর্পণ করেন। এভাবে তুঘ্রিলের নেতৃত্বে বাগদাদের সেলজুক বংশের প্রতিষ্ঠা হয়।

তুঘ্রিল বেগ এসময়ে বাগদাদে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত থাকার সুযোগে বাইজান্টাইনরা মুসলিম শাসিত অঞ্চলে অতর্কিতে হানা দিয়ে লুটতরাজ করতে থাকে। ফলে ১০৬০ খ্রিস্টাব্দে তুঘ্রিল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন এবং কাপাডোসিয়া ও ফ্রিজিয়া থেকে খ্রিস্টানদেরকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু এদিকে তুঘ্রিলের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তুর্কিদের শিয়া সম্প্রদায়ের দলপতি আল বাসাসিরি (al-Basasiri) বাগদাদ দখল করেন। এরা আগে শিয়া সাম্রাজ্য বুয়িদদের অধীনে মামলিক বা দাস সৈন্য হিসেবে কাজ করতো, বুয়িদদের পতনের পর এরা মিশরের ফাতেমী খিলাফতের অধীনে কাজ করা শুরু করে। বাসাসিরি খলিফা আল-কাইমকে সিংহাসনচ্যুত করে মিশরের ফাতেমি রাজবংশের শিয়া খলিফা আল-মুসতানসির বিল্লাহর (Al-Mustansir Billah, ১০৩৬-৯৪ খ্রি.) প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তার নামে খুৎবা পাঠ করেন। এই সংবাদ পেয়ে তুঘ্রিল বেগ দুত বাগদাদে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বিদ্রোহী নেতা বাসাসিরিকে পরাজিত ও নিহত করে খলিফা আল-কাইমকে পুনরায় খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত করেন।

সেলজুকের নামানুসারে এই বংশের নামকরণ হলেও তুঘ্রিল বেগ ছিলেন নিঃসন্দেহে সেলজুক বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। খিলাফত নামক মুসলিমদের নিকট পবিত্র প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। একজন জ্ঞানী, উদার ও বিদ্যোৎসাহী নরপতি হিসেবে সেলজুক ঐতিহাসিক ইমাম আল-দীন তুঘ্রিল বেগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। দীর্ঘ ২৩ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পর ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে তুঘ্রিল বেগ মৃত্যুবরণ করেন।

আলপ আরসলান, কেরমান (১০৪১-১১৮৬ খ্রি.) ও এশিয়া মাইনোরে (১০৭৭-১৩০৮) সেলজুক সালতানাতের সূচনা

তুঘ্রিল বেগের ভাই চাঘরি বেগের (Chaghri Beg) জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন কারা আরসালান কার্ভুট। তিনি বর্তমান ইরানের কেরমানে সেলজুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ১০৪১ খ্রিস্টাব্দে কেরমান গমন করেন এবং ১০৪৯ খ্রিস্টাব্দে বারদাশির অধিকার করেন। পরে তিনি কুফিদের পরাজিত করে ওমান দখল করতে সমর্থ হন। এদিকে তুঘ্রিল বেগের মৃত্যুর পর সেলজুক সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন চাঘরি বেগের আরেক পুত্র আবু সুজা আলপ আরসলান মোহাম্মদ (Alp Arslan, ১০৬৩-৭২ খ্রি.)। আলপ আরসলান সিংহাসনে বসলে কাভুর্ট বিদ্রোহী হয়ে ১০৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এছাড়া আলপ আরসলানের পিতৃব্য কুলুমিশ সিংহাসনের দাবি করে সাবেহ নামক অঞ্চলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এজন্য আলপ আরসালানের শাসনকালের প্রথম দিকটি গৃহযুদ্ধময় ছিল। বাধ্য হয়ে সুলতান আলপ আরসলানকে এই দুই বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে হয়। তিনি তার সুযোগ্য মন্ত্রী নিজাম-উল-মুলকের সহযোগিতায় অচিরেই এই প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে পরাজিত করে নিজ আসন কণ্টকমুক্ত করতে সক্ষম হন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কাভুর্টের বিরুদ্ধে তিনি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি সসৈন্য কিরমান উপস্থিত হলে কাভুর্ট তার বশ্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। কাভুর্ট পরাজিত ও বিতাড়িত হয়ে পারস্য উপসাগর অতিক্রম করে ওমানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে তিনি বুয়িদ অধীনতা থেকে ওমানকে মুক্ত করে সেখানে সেলজুক তুর্কি শাসন প্রবর্তন করেছিলেন।

এছাড়া আলপ আরসলান বেলুচিস্তানের মাকরান অঞ্চলে কুফিচি নামক পার্বত্য দস্যুদের বিরুদ্ধেও একটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন এবং দীর্ঘ দিন পর এই অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। সুলতান আলপ আরসলান একজন বিখ্যাত সমরবিদ ও রাজ্য বিজেতা ছিলেন। অসাধারণ সাহস ও রণনৈপুণ্যের জন্য তার বিশেষ সুখ্যাতি ছিল। সিংহাসনে উপবেশন করার পরবর্তী বছরই তিনি আর্মেনিয়া প্রদেশের রাজধানী আনী অধিকার করেন। কার্সের শাসনকর্তা গাজিক আব্বাসও তার বশ্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। এরপর আলপ আরসলান জর্জিয়া আক্রমণ করেন। জর্জিয়ার সম্রাট চতুর্থ বাগরাত আলপ আরসলানের সাথে তার ভ্রাতুষ্পুত্রী বা ভাই এর মেয়ের সাথে বিবাহ দিয়ে ও বাৎসরিক নিয়মিত কর প্রদানে স্বীকৃত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেন।

সুলতান আলপ আরসলান এসময়ে দক্ষিণ-সিরিয়ায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে তিনি হঠাৎ সংবাদ পেলেন যে, বাইজান্টাইন সম্রাট ৪র্থ রোমানাস ডায়োজেনাস (Romanos IV Diogenes, রা. ১০৬৮-৭১ খ্রি.) এরজুরেমে সেলজুকদের বিরুদ্ধে ৪০-৫০,০০০ সৈন্যের এক সেনাবাহিনীকে সমাবেশ করেন। আর্মেনিয়া অতিক্রম করে বাগদাদ আক্রমণ করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। বাইজান্টাইন সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য ২০-৩০,০০০ সৈন্যের এক সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন, নেতৃত্বে আল্প আরসালান নিজেই ছিলেন। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে মাঞ্জিকার্ট বা মালাজকিরদ নামক প্রান্তরে উভয় বাহিনীর মধ্যে এক তুমল যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় যা মাঞ্জিকার্টের যুদ্ধ (Battle of Manzikert) নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে সেলজুক বাহিনীর থেকে বাইজান্টাইনদের শোচনীয় পরাজয় হয় এবং সম্রাট ৪র্থ রোমানাস ডায়োজেনাস আল্প আরসলানের থেকে আহত অবস্থায় বন্দি হলেন। বিজয়ী সুলতান পরাজিত ও বন্দি সম্রাটের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেন। ঐতিহাসিক গিবন মনে করেন যে, বাইজান্টাইন সম্রাটের প্রতি সেলজুক সুলতানের এই ব্যবহার থেকে “আধুনিক সভ্য জগৎ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।” (এডওয়ার্ড গিবন ; Decline and fall of the Roman Empire-লন্ডন, ১৮৯৬)। যুদ্ধ শেষে বাইজান্টাইন সম্রাট বাধ্য হয়ে সুলতানের সাথে সন্ধি করতে রাজি হলেন। সন্ধির শর্তানুসারে বাইজান্টাইন সম্রাট সেলজুক সুলতানকে মাঞ্জিকার্ট, এডেসা, এ্যান্টিক এবং মানবিজ ছেড়ে দিতে রাজি হলেন। দ্বিতীয়ত নগদ এককালীন দশলক্ষ এবং বাৎসরিক তিন লক্ষ ষাট হাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করতে বাধ্য থাকবেন বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। তৃতীয়ত, সম্রাট সমস্ত মুসলমান বন্দিকে স্বহাতে মুক্তি প্রদান করতে এবং তার কন্যার সাথে আলপ আরসলনের পুত্রের বিবাহ দিতে সম্মত হলেন। যথারীতি সন্ধি স্বাক্ষরিত হবার পর সম্রাট ডায়োনেসাস স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। কিন্তু তার এই ব্যর্থতা ও গ্লানিকর সন্ধি স্বাক্ষরের জন্য তিনি বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত ও পরে নিহত হলেন। মাঞ্জিকার্টের যুদ্ধ সুলতান আলপ আরসলানের কৃতিত্ত্বের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই যুদ্ধকে নিঃসন্দেহে একটি ভাগ্যনির্ধারণকারী চূড়ান্ত যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। এই যুদ্ধে সেলজুক তুর্কিগণ মূলত উমাইয়া খলিফা তুয়াবিয়ার আমল থেকে মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষিত স্থান এশিয়া মাইনর জয় করতে সক্ষম হয়।

এশিয়া মাইনরের সেলজুক তুর্কি বংশের প্রতিষ্ঠা বিশ্বমুসলিম ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায় (এশিয়া মাইনরের সেলজুক তুর্কিদের সম্বন্ধে বিস্তারিত পাঠের জন্য দ্রষ্টব্য : The Seljuks in Asia Minor-টি. টি. রাইস, নিউইয়র্ক, ১৯৬১)। এর মাধ্যমে মূলত উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়ার আমল থেকে মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল। এশিয়া মাইনরের সেলজুক তুর্কিদেররা বাইজান্টাইন শক্তিক্রুসেডারদের প্রতিহত করেছিল। ফলে বাইজান্টাইন অধিকার থেকে এশিয়া মাইননের অনেক অঞ্চল চিরতরে তুর্কিদের হাতে চলে এসেছিল। এছাড়া এর ফলে পরবর্তী পর্যায়ে তুরস্ককে কেন্দ্র করে তাদের স্বজাতিভুক্ত বিখ্যাত অটোমান তুর্কি শক্তি বিকাশের পথও সুপ্রশস্ত হয়। এশিয়া মাইনর ছিল বহু প্রাচীন জাতি ও সভ্যতার আদিভূমি এবং তিনটি মহাদেশের সঙ্গমস্থল। ফলে এই অঞ্চলে সেলজুক তুর্কিদের দ্বারা ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি নতুন ধর্ম ও ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতির বিকাশ নিঃসন্দেহে মুসলিম ইতিহাসের এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

১০৭১ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক মাঞ্জিকার্টের যুদ্ধে সুলতান আলপ আরসলানের হাতে বাইজান্টাইন শক্তির পরাজয়ের ফলে এই বংশের প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। কারণ এর ফলে এশিয়া মাইনর ভাগ্যান্বেষী তুর্কিদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং বহু সংখ্যক তুর্কি মুসলমান সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করে। একটি মতানুসারে সুলতান আলপ আরসলান তার জনৈক দূর সম্পর্কে পিতৃব্য ভ্রাতা সুলাইমানকে এই নববিজিত অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। আবার আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওসমান তুরান এই প্রচলিত ধারণার সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন যে, সেলজুক সুলতান আলপ আরসলান কর্তৃক সুলাইমানকে এশিয়া মাইনরের শাসকর্তা হিসেবে নিয়োগ করার প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। তার মতে সুলাইমানের পিতা কতুলমিশ কর্তৃক আলপ আরসলানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শাস্তি স্বরূপ তিনি সুলাইমানকে এশিয়া মাইনরে নির্বাসিত করেন। (দ্রষ্টব্য : The Cambridge History of Islam. প্রথম খণ্ড, ক্যামব্রিজ, ১৯৭০, পৃ: ২৩৬)। এই দুই মতের যেটাই সত্য হোক না কেন, সুলাইমান ইবনে কুতুলমিশই (Suleiman ibn Qutulmish, রা. ১০৭৭-৮৬ খ্রি.) ছিলেন এশিয়া মাইনরের সেলজুক তুর্কি বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ পারস্যে সেলজুক বংশের মূল শাখার প্রতিষ্ঠার প্রায় ৩৫ বছর পরে এশিয়া মানইরের এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা করতে সক্ষম হন। সুলাইমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই রাজবংশ ‘সেলজুক রুম’ এবং এর শাসকগণ ‘রুমের সুলতান’ বলে ইতিহাসে প্ররিচিত। ‘রুম’ শব্দের ‘রোমান’ শব্দের বিকৃত রূপ (সেলজুকদের পূর্বে বাইজান্টাইন রোমানরা এতঞ্চলে রাজত্ব করতো বলে এইরূপ নামকরণ হয়েছে।)। এছাড়া রাজধানী কোনিয়ার (বা আইকনিয়াম) নামানুসারে এশিয়া মাইনরের সেলজুকগণ ‘কোনিয়ার সেলজুক’ বলেও আখ্যায়িত।

সুলতান আলপ আরসলান দশ বছর সগৌরবে রাজত্ব করার পর ১০৭২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পরাক্রমশালী এই সেলজুক সুলতানের মৃত্যুর কাহিনী বড়ই মর্মান্তিক। খাওয়ারিজম প্রদেশের বিদ্রোহী শাসনকর্তা ইউসুফকে বন্দি অবস্থায় সুলতান আলপ আরসলানের সম্মুখে উপস্থিত করা হলে তিনি তাকে ভর্ৎসনা করেন। এটিতে ক্রোধান্বিত হয়ে ইউসুফ ছুরিকাঘাতে সুলতানকে হত্যা করে। সুলতান আলপ আরসলান একজন সুশাসক, জ্ঞানী ও বিচক্ষণ নরপতি ছিলেন। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বিখ্যাত প্রশাসক নিজাম-উল-মুলক তার রাজদরবার অলঙ্কৃত করেছিলেন। তার আমলে রাজধানী ইস্পাহান মধ্য এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরীতে পরিণত হয়।

মালিক শাহ, রুমের সুলায়মানের সাথে দ্বন্দ্ব, সিরিয়ার সেলজুক বংশ (১০৭৮-১১১৭ খ্রি.) ও নিজাম উল মুলক

আলপ আরসলানের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ১ম মালিক শাহ (Malik-Shah I, রা. ১০৭২-৯২ খ্রি.) ১০৭২ খ্রিস্টাব্দে জালালউদ-দৌলা মুইজুদ্দীন আবুল ফাতেহ উপাধি ধারণ করে সেলজুক সিংহাসনে আরোহণ করেন। মালিক শাহ ছিলেন নিঃসন্দেহে সেলজুক বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান। সাম্রাজ্য বিস্তার, প্রশাসনিক সংস্কার, জনহিতকর কার্যাবলী ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতায় মালিক শাহের রাজত্বকালকে সেলজুক বংশের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা চলে। তার সাম্রাজ্য পূর্বে কাশগর থেকে পশ্চিমে জেরুজালেম এবং উত্তরে-কনস্টান্টিনোপল থেকে দক্ষিণে ইয়েমান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।

মালিক শাহের রাজত্বকালের রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাবলীকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথমত গৃহযুদ্ধ, দ্বিতীয়ত সাম্রাজ্য বিস্তার এবং তৃতীয়ত বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফার সাথে তার সম্পর্ক। মালিক শাহ সিংহাসনে আরোহণ করলে তার সহোদর আয়াজ সিংহাসনের দাবি নিয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করেন। এছাড়া তার পিতা আলপ আরসালানের কাছে পরাজিত তার পিতৃব্য কেরমানের সেলজুক সুলতান কারা আরসলান কাভুর্টও তিনি ক্ষমতায় এলে নতুন করে বিদ্রোহ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মালিক শাহ কার্ভুটকে হামাদানের কাছে এক যুদ্ধে পরাজিত করেন ও ১০৭৪ খ্রিস্টাব্দে বন্দি অবস্থায় তাকে হত্যা করা হয়। এছাড়া এসময়ে তার অপর প্রতিদ্বন্দ্বী আয়াজের হঠাৎ মৃত্যু হলে মালিক শাহ আভ্যন্তরীণ বিপদমুক্ত হন। মালিক শাহ অবশ্য দয়াপরবশ হয়ে কার্ভুটের পুত্র সুলতান শাহকে তার পিতার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। এই সুলতান শাহ্‌ই ১০৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কেরমানের শাসনকর্তা ছিলেন।

বাইজান্টাইন সীমান্তে অবস্থিত রুমের সালতানাতের শাসনভার সুলাইমানের কাছে তেমন লোভনীয় ছিল না। কিন্তু পরে নানা কারণে এটি তার পক্ষে বিরাট আশীর্বাদস্বরূপই হয়েছিল। কারণ তিনি এশিয়া মাইনরের অবস্থানরত তুর্কিদেরকে তার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ করতে সক্ষম হন এবং কোনিয়াকে কেন্দ্র করে উত্তরোত্তর তার শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসময়ে বাইজান্টাইন সম্রাট ১ম আলেক্সিয়স কমনেনোস (Alexios I Komnenos, রা. ১০৮১-১১১৮ খ্রি.) তার অপরাপর প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে কোনিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা সুলাইমানের সাহায্য কামনা করেন। সুলাইমান ছিলেন সুযোগসন্ধানী এবং অতিশয় উচ্চাভিলাষী। তিনি বিনাদ্বিধায় বাইজান্টাইন সম্রাটের এই আহ্বানে সাড়া দিলেন। ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সসৈন্যে মারমরা সাগর পর্যন্ত অগ্রসর হলেন এবং বিনা প্রতিরোধে নাইকিয়া অধিকার করে বসলেন। অতপর নাইকিয়া সুলাইমানের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে, যা তুর্কিদের কাছে ইজনিক নামে পরিচিত ছিল।

সুলাইমানের এই সাফল্য মালিক শাহ শুভদৃস্টিতে দেখতে পারলেন না। কারণ এশিয়া মাইনরে সুলাইমানের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তার যথেষ্ট ভীতির অবকাশ ছিল। ফলে ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দে আমীর বারকুকের নেতৃত্বে মালিক শাহ সুলাইমানের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করলেন এবং এক প্রচণ্ড যুদ্ধে সুলাইমানের পুত্র মনসুর পরাজিত ও নিহত হলেন। কিন্তু এশিয়া মাইনরে সুলাইমানের সমর্থন ও কর্তৃত্ব আগের মতোই অক্ষুন্ন রয়ে গেল। এসময়ে কনস্টান্টিনোপলের সিংহাসন নিয়ে বাইজান্টাইনদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ দেখা দিলে সুলাইমান তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করলেন। ১০৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি ক্ষুদ্র বাইজান্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করে তিনি বসফোরাস পর্যন্ত অগ্রসর হন। অতপর ১০৮২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আদানা, তারসুস ও মেসিসা দখল করে সমগ্র সিলিসিয়ার ওপর তার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এটি। ছাড়া এন্টিওক শহরের খ্রিস্টান অধিবাসীগণও সুলাইমানের কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে এবং তিনি আলেপ্পো অবরোধ করে বসেন। সুলাইমানের এই বিরাট সাফল্যে ভীত হয়ে মালিক শাহ তার ভ্রাতা তুতুশকে সুলাইমানের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তুতুশ এসময়ে দামেস্কের প্রাদেশিক শাসন কর্তা ছিলেন। ১০৮৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এক যুদ্ধে সুলাইমান সেলজুক সেনাপতি তুতুশের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।

সুলাইমানের এই আকস্মিক মৃত্যুতে এশিয়া মাইনরের সেলজুক বংশ অকালে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার উপক্রম হয়, কারণ সুলাইমানের পুত্র কিলিজ আরসলান তখন বাগদাদে কারারুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। ফলে ১০৮৬ থেকে ১০৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাইকিয়ার সিংহাসনে সুলাইমানের কোন উত্তরাধিকারীই ছিলেন না। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সুলাইমানের প্রতি অনুগত দানিশমান্দ গোত্রপতি আহমদ গাজী ও তার প্রতিনিধি আবুল কাশেম তার মৃত্যুর পর বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেলজুক সিংহাসন রক্ষণাবেক্ষণ করেন। তারা মালিক শাহ কর্তৃক প্রেরিত সেলজুক-বাহিনীকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করেন এবং এশিয়া মাইনরে সুলাইমানের বংশের প্রতি জনসমর্থন অক্ষুন্ন রাখেন।

মালিক শাহের আমলে সেলজুক শক্তি আরবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১০৬৭ খ্রিস্টাব্দে আর্তুর্কের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সেলজুক বাহিনী আল-আহসা হয়ে পূর্ব আরবে প্রবেশ করে এবং স্থানীয় শিয়া কারামাতিয়ান শক্তিকে পরাজিত করে বাহরাইন পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এর ফলে হিজাজ, ইয়েমান ও এডেন প্রদেশ মালিক শাহের অধিকারভুক্ত হয়। মালিক শাহ মক্কা থেকে পবিত্র খুৎবা বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুকতাদির কাছে প্রেরণ করেন। এছাড়া মক্কা শরীফকেও তিনি তার আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করেন। এর ফলে মিশরের ফাতেমি শিয়া খলিফাদের ওপর পরোক্ষভাবে সুন্নী মুসলমানদের এক নিশ্চিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিজয় সূচিত হয়।

বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা আল-মুকতাদির (Al-Muqtadi, রা. ১০৭৫-৯৪ খ্রি.) সাথে সেলজুক সুলতান মালিক শাহের সম্পর্ক তার রাজত্বকালের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মালিক শাহের আমলে বাগদাদের খলিফার ওপর সেলজুকদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ পূর্বাপেক্ষা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কেবল ধর্মীয় ক্ষমতা ছাড়া প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সব রকম ক্ষমতা থেকে খলিফাকে বঞ্চিত করা হয়। মালিক শাহের হাতে বাগদাদের খলিফা আল-মুকতাদি প্রকৃতপক্ষে পুতুল খলিফায় পরিণত হন। বাগদাদকে মালিক শাহ তার শীতকালীন রাজধানী মনোনীত করেন এবং গওহার আইন নামক জনৈক ব্যক্তিকে বাগদাদের সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। খলিফা আল মুকতাদি এর ফলে মালিক শাহের প্রতি বিশেষ অসুন্তষ্ট হন। মালিক শাহ খলিফাকে খুশি করে তার সাথে সম্পর্কের উন্নতি করার জন্য তার বাৎসরিক ভাতা বৃদ্ধি করেন এবং মহাসমারোহে তিনি তার এক কন্যাকে খলিফার সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ করেন। কিন্তু মালিক শাহ কর্তৃক খলিফার কাছ থেকে রাজ্য শাসনের প্রকৃত ক্ষমতা হরণ করে তাকে বাহ্যিক প্রলেপ দ্বারা সন্তুষ্ট করার এই প্রচেষ্টা তেমন সফল হয়াছিল বলে মনে হয় না।

মালিক শাহ একজন প্রজারঞ্জক নরপতি ছিলেন। বস্তুত রাজ্য বিজয় অপেক্ষা প্রশাসন ও জনিহতকর কার্যেই তিনি অধিক সুনাম অর্জন করেছিলেন। আভ্যন্তরীণ সংস্কার, জনহিতকর কার্যাবলী ও ন্যায়বিচারের জন্য তিনি মুসলিম জগতের অপরাপর বিখ্যাত নরপতিদের সমকক্ষ ছিলেন। তার বিশাল সাম্রাজ্য নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করতো। তিনি সাম্রাজ্যের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল হওয়ার জন্য অন্ততপক্ষে ১২ বার সাম্রাজ্যের এই সীমান্ত থেকে অপর সীমান্ত পরিদর্শন করেন। মালিক শাহ বহু রাস্তা-ঘাট, মসজিদ, হাসপাতাল ও বিদ্যানিকেতন নির্মাণ করেন। জনসাধারণের সুবিধার্থে রাজ্যের নানা স্থানে তিনি বহু খাল খনন করেন এবং হজযাত্রীদের জন্য পথিমধ্যে বহু সরাইখানা নির্মাণ করেন। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি কাজের উন্নতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার আমলে পথিক ও ব্যবসায়িকগণ নিরাপদে পথ চলাচল করতে পারতো। ইরাকে জনসাধারণের ওপর থেকে তিনি বেআইনি কর, পণ্যসামগ্রীর ওপর আরোপিত শুল্ক এবং হজযাত্রীদের ওপর ধার্যকৃত যাতায়াত কর রহিত করে দেন। তার আমলে বাগদাদ নতুন রাজধানীর মর্যাদা লাভ করলে তিনি সেখানে নানান রকম সুরম্য অট্টালিকা গড়ে তোলেন। বাগদাদ নগরীতে তিনি স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ক বহুবিধ সংস্কার করেন। এদের মধ্যে শহরের নর্দমা। থেকে ময়লা ও জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মালিক শাহের কৃতিত্ব ও গৌরব কেবলমাত্র তার একক প্রচেষ্টার ফলে সম্ভব হয়নি। বস্তুত এর পেছনে ছিল তার প্রধানমন্ত্রী ও অভিভাবক নিজাম-উল-মুলকের অপরিসীম অবদান। নিজাম-উল-মুলকের প্রকৃত নাম ছিল খাজা আবু আলী আল হাসান। তিনি ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের তুস নগরীর অদূরবর্তী বাদকান নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল আলী। তিনি গজনভিদ সুলতান মাহমুদের অধীনে রাজস্ব বিভাগে চাকরি করতেন। পিতার ন্যায় নিজাম-উল-মুলকও প্রথমে গজনি সুলতানের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। পরে ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে দান্দাকানের যুদ্ধে গজনি সুলতান মামুদ তুঘ্রিল বেগের কাছে পরাজিত হলে সেলজুকরা তাকে খোরাসানে নিয়ে আসে। নিজ প্রতিভাবলে নিজাম-উল-মুলক তুঘ্রিল বেগের পুত্র আলপ আরসলানের আমলে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন এবং আলপ আরসলানের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী মালিক শাহের আমলেও তিনি উক্ত পদে বহাল থাকেন। বস্তুত বিশ বছরব্যাপী মালিক শাহের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতাই নিজাম-উলমুলকের হাতে ন্যস্ত ছিল (Encyclopeadia of Islam: লন্ডন, ১৯৩৬, তৃতীয় খণ্ড, পৃ: ৯৩৪)। মালিক শাহ নিজাম-উল-মুলককে “আতাবেক” উপাধিতে ভূষিত করেন (‘আতাবেক’ একটি তুর্কি শব্দ। এটি দুটো অংশে বিভক্ত, যথা: আতা (অর্থাৎ পিতা) এবং বেক (অর্থাৎ যুবরাজ)। সেলজুক সুলতান মালিক শাহ সর্বপ্রথম তার প্রধানমন্ত্রী নিজাম-উল-মুলককে এই উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তী সময়ে আতাবেক উপাধিটি ‘অভিভাবক প্রধান সেনাপতি এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তা’ প্রভৃতি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।)। অষ্টাদশ বর্ষীয় যুবক মালিক শাহ পিতৃ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে প্রবীণ ও বিজ্ঞ নিজাম-উল-মুলককে অভিভাবক হিসেবেই দেখতেন এবং তাকে পিতা বলে সম্বোধন করতেন।

মালিক শাহ্‌ এর ভাই তুতুশ ছিলেন সিরিয়া সেলজুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা। আলপ আরসলানের রাজত্বকালে আতসিজ-ইবন-আবাক নামক জনৈক টার্কোম্যান নেতা প্যালেস্টাইন আক্রমণ করেন এবং রামলা ও জেরুজালেম তার হস্তগত হয়। অতপর ১১৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি দামেস্ক অধিকার করেন। কিন্তু পরবর্তী বছর তিনি মিশর আক্রমণ করলে ফাতেমি সেনাপতি বদর আল-জামালির হাতে তার শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এই ঘটনার পর এমনকি দামেস্ক রক্ষা করাও তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ে এবং তিনি বাধ্য হয়ে তুতুশ-ইবনে-আলপ আরসলানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তুতুশ এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দামেস্ক আক্রমণ করেন এবং পরে গোপনে অতসিজকে হত্যা করে ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কের শাসন ক্ষমতা হস্তগত করেন। এসময়ে আলেপ্পোর শাসনকর্তা ছিলেন মুসলিম-ইবন কুরাইশ। তিনি ১০৮২ খ্রিস্টাব্দে তুতুশকে পরাজিত করে দামেস্ক অধিকার করেন। কিন্তু পরবর্তী বছর তিনি এশিয়া মাইনরের সেলজুক সুলতান সুলাইমান ইবন-কুতমিশের হাতে পরাজিত ও নিহত হন। এই ঘটনার পর সেলজুক সুলতান মালিক শাহ স্বয়ং আলেপ্পোর বিরুদ্ধে সমর অভিযান প্রেরণ করেন এবং জেঙ্গি বংশের আকসুংকুরকে সেখানকার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। কিন্তু মালিক শাহ এবং আলেপ্পোতে তার প্রতিনিধি আকসুংকুরের মৃত্যুর পর তুতুশ পুনরায় সিরিয়ার সর্বময় কর্তা হয়ে বসেন।

মালিক শাহ্‌ এর মন্ত্রী নিজাম-উল-মুলক ছিলেন মধ্যযুগে এশিয়ার অন্যতম একজন খ্যাতনামা প্রশাসক। তিনি বিখ্যাত ‘দিওয়ান’-এর মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। কেন্দ্রীয় আমলাতান্ত্রিক এই শাসনযন্ত্র প্রধানত পাঁচটি বিভাগে বিভক্ত ছিল, যথা-অর্থ বিভাগ, হিসাবরক্ষণ বিভাগ, সামরিক বিভাগ, গোয়েন্দা ও তদন্ত বিভাগ এবং যোগাযোগ বিভাগ। নিজাম-উল-মুলক এই পঞ্চশাখা বিশিষ্ট দিওয়ানের সভাপতি ছিলেন। সেনাবাহিনীর ওপরও নিজাম-উল-মুলকের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। প্রাদেশিক শাসনকর্তা। নিয়োগ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে সেনাপতি নির্বাচন পর্যন্ত মালিক শাহ তার প্রধানমন্ত্রী নিজাম-উল-মুলকের পরামর্শ ছাড়া করতেন না। ব্যক্তিগতভাবে নিজামউল-মুলক কয়েকটি সমর অভিযানও পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে বার্ধক্যহেতু প্রশাসনিক কাজেই তিনি বেশি মনোযোগ দেন। নিজাম-উল-মুলকের পরামর্শক্রমে মালিক শাহ ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে নবনির্মিত মানমন্দিরে (নক্ষত্র-পর্যবেক্ষণিক) জ্যোতির্বিদদের এক মহাসম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে এ যাবত প্রচলিত পারসিক দিনপঞ্জির পরিবর্তে সৌরমাস অনুসারে দিনপঞ্জি প্রস্তুতির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিখ্যাত অঙ্কশাস্ত্রবিদ, কবি ও জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়াম বাগদাদে অনুষ্ঠিত এই মহতী বিজ্ঞান সম্মেলনে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। এই সম্মেলনে সমাগত বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলশ্রুতি হিসেবে নতুন দিনপঞ্জি প্রবর্তিত হয়। জালাল উদ্দিন মালিক শাহের নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘জালালী দিনপঞ্জি”। এটি গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জি থেকে বহুগুণে নির্ভুল ছিল বলে পাশ্চাত্যের জ্যোতির্বিদগণ মনে করেন।

নিজাম-উল-মুলক একজন প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ ছিলেন। ঐতিহাসিক পি. কে. হিটি যথার্থই তাকে “ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসের অলঙ্কার” বলে অভিহিত করেছেন (পি. কে. হিট্টি : History of the Arabs, নিউইয়র্ক, ১৯৬৮, পৃ: ৪৭৭)। স্যার সৈয়দ আমীর আলী তার সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন : “সম্ভবত ইয়াহিয়া বার্মেকীর পর নিজাম-উল-মুলকই ছিলেন এশিয়ার যোগ্যতাম মন্ত্রী ও প্রশাসক” (সৈয়দ আমীল আলী : A Short History of the Saracens : লন্ডন ১৯৫১, পৃ: ৩১৫)। নিজাম-উল-মুলকের অমর অবদান তার ‘সিয়াসাত নামা” শীর্ষক রাজনীতি বিষয়ক পুস্তকটি (সিয়াসাতনামা : সম্প্রতি এই মূল্যবান পুস্তকটি বাংলা একাডেমীর সৌজন্যে প্রকাশিত হয়েছে; অনুবাদ যাহিদ হোসেন, ঢাকা ১৯৬৯)। এই পুস্তকটি অধ্যয়ন করলে তৎকালীন মুসলিম শাসন-ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে এই পুস্তকে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলিরদি প্রিন্স নামক পুস্তকটির সাথে এর তুলনা করা যেতে পারে।

নিজাম-উল-মুলকের কার্যাবলী আলোচনা করলে তার মধ্যে একটি বিদগ্ধ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ১০৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাগদাদে বিখ্যাত ‘নিজামিয়া মাদ্রাসা’ স্থাপন করেন। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এটি তৎকালীন মিশরের ঐতিহ্যবাহী আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়কেও ম্লান করে দিয়েছিল। নিজামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা ছিল অবৈতনিক এবং শিক্ষার্থীদেরকে বিশেষ বৃত্তি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হতো। এই শিক্ষায়তনে প্রসিদ্ধ মনীষী ইমাম আল গাজ্জালী ও দার্শনিক আবু ইসহাক আল-সিরাজী শিক্ষকতা করতেন। নিজামিয়া মাদ্রাসা ছাড়া তিনি সাম্রাজ্যের প্রায় প্রতিটি বিখ্যাত শহরে অন্তত একটি করে মাদ্রাসা থাপন করেছিলেন। ইসলামী মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বিবর্তনের ইতিহাসে এই সময়কে উৎকর্সের যুগ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। মুসলিম বিশ্বে আজও ‘দারসে নিজামিয়া’ বা নিজামিয়া মাদ্রাসার অনুরুপ শিক্ষা চালু রয়েছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই মহান সাধক নিজাম-উল-মুলক ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে ফার্স প্রদেশের সিহনা নামক স্থানে এক অজ্ঞাতনামা আততায়ীর থেকে নিহত হন। নিজামউল-মুলকের হত্যাকারী হাসান-ই-সাবাহ (Hassan-i Sabbah বা ওল্ড ম্যান অফ দ্য মাউন্টেইন) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হাসানসিন (যেখান থেকে ইংরেজি Assasin শব্দটি এসেছে) নামক উগ্রপন্থী ইসমাইলি শিয়া গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের সদস্য ছিল বলে মনে করা হয়। সুন্নী মুলমান সম্প্রদায়ের প্রতি এই দলটি চরম হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করতো। নিজাম-উল-মুলকের মৃত্যুতে মুসলিমবিশ্বের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান ব্যক্তির জীবনের অবসান ঘটে। সেলজুক সুলতান মালিক শাহও তার সুযোগ্য ও প্রিয় মন্ত্রী নিজাম-উল-মুলকের মৃত্যুর মাত্র দুই মাসের মধ্যেই হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে মালিক শাহের বয়স ছিল মাত্র ৩৮ বছর। মালিক শাহ ও তার মন্ত্রী নিজাম-উল-মুলকের মৃত্যুর সঙ্গেই সেলজুক তুর্কি বংশের গৌরবরবি অস্তমিত থেকে আরম্ভ করে।

সেলজুক সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন, পরবর্তী সম্রাটগণ ও রুমের সুলতান কিলিজ আরসালানের মৃত্যু

১০৯২ সালে মালিক শাহের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীগণ সেলজুক সাম্রাজ্যকে দুত পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি। ১ম মালিক শাহ্‌ এর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী তেরকেন খাতুন তার চার বছরের শিশু পুত্র ১ম মাহমুদকে (Mahmud I, রা. ১০৯২-৯৪ খ্রি.) ক্ষমতায় বসান। কিন্তু ১ম মালিক শাহ্‌ এর জ্যেষ্ঠ পুত্র বার্কিয়ারুক (Berkyaruq, ১০৯২-১১০৫ খ্রি.) সিংহাসন দাবি করেন। দুই দাবিকর্তার মধ্যে হামাদানে যুদ্ধ হয়। বার্কিয়ারুক জয়লাভ করেন, নিজাম উল মুলকের পরিবার রাজা ১ম মাহমুদ ও রাজমাতাকে হত্যা করেন। বার্কিয়ারুক ইসফাহানকে রাজধানী করে সিংহাসন গ্রহণ করেন, কিন্তু সেলজুক সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে যায়। রুমের সুলতান সুলাইমানের পুত্র ১ম কিলিজ আরসালান (Kilij Arslan I, রা. ১০৯২-১১০৭ খ্রি.) ইসফাহানে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। মালিক শাহ্‌ এর মৃত্যুর সুযোগে তিনি সেখান থেকে পালিয়ে আনাতোলিয়ায় চলে যান। এছাড়া ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে মালিক শাহের মৃত্যু হলে এশিয়া মাইনরের ওপর সেলজুকদের চাপও প্রশমিত হয়। এসময়ে বাগদাদে সেলজুক বংশের মূল শাখার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সিংহাসন অধিকারের প্রশ্নে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। এই সুযোগে সুলাইমানের পুত্র ১ম কিলিজ আরসলান (Kilij Arslan I, রা. ১০৯২-১১০৭) কারামুক্ত হয়ে নাইকিয়া আগমন করতে সক্ষম হন এবং সেখানে তাকে মহাউল্লাসের সঙ্গে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। তখন থেকে এশিয়া মাইনোর রুমের সেলজুক সালতানাতের হাতে স্বাধীনভাবেই শাসিত হতে থাকে, অবশ্য এশিয়া মাইনর মালিক শাহ্‌ এর সময়েই সুলাইমানের হাতে স্বাধীন হয়ে গিয়াছিল।

সিরিয়া চলে যায় মালিক শাহ্‌ এর ভাই ১ম তুতুশের হাতে। তুতুশের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র রিজওয়ান ও দুকাক যথাক্রমে আলেপ্পো ও দামেস্কের শাসনভার গ্রহণ করেন। দুকাক ১১০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দামেস্ক শাসন করেন এবং তার মৃত্যুর পর দামেস্কের প্রকৃত শাসনক্ষমতা তুঘতাজিন নামক জনৈক আতাবেগের হস্তগত হয়। তিনি দুকাকের ভ্রাতা বেকতাশের নামে খুত্বা পাঠ করলেও এক প্রকার স্বাধীনভাবেই রাজ্য শাসন করেন এবং পরবর্তী সময়ে বুয়ীদ বংশের গোড়াপত্তন করেন। অন্যদিকে আলেপোর শাসনকর্তা রিজওয়ান-ইবন-তুতুশ ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তার পুত্র আলপ আরসলান সিংহাসনে উপবেশন করেন। কিন্তু তিনি অচিরেই তার গৃহভৃত্য লুলুর হাতে নিহত হন এবং সুলতান শাহইবন-রিজওয়ান তার স্থলাভিষিক্ত হন। ১১১৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শাহ মৃত্যুবরণ করেন এবং সেই সঙ্গেই সিরিয়ার সেলজুক বংশের রাজত্বের অবসান ঘটে।

এশিয়া মাইনোর ও সিরিয়া ছাড়াও আলেপ্পো ও দিয়ারবাকিরও স্বাধীনত ঘোষণা করে। মালিক শাহের মৃত্যুর পর এভাবে সিরিয়া, ইরাক এবং কেরমানও অচিরেই সেলজুকদের হাতছাড়া হয়ে গেল। তুর্কি প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ শক্তিশালী হয়ে উঠলো এবং পারস্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হলো। এই ভাঙ্গনের ফলে উপকৃত হয় ১ম ক্রুসেডের ক্রুসেডাররা যারা ১০৯৬ সালের প্রথম দিকে আক্রমণ শুরু করেছিল। কিলিজ আরসালান বিশেষ পারদর্শিতা ও সাফল্যের সঙ্গে এশিয়া মাইনরে সেলজুক শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং এশীয় ভুভাগে আক্রমণকারী খ্রিস্টান সৈন্যদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। কিন্তু এসময়ে ১০৯৭ খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত খ্রিস্টান শক্তির দ্বারা পরিচালিত ক্রুসেডার বাহিনীর আগমনে তিনি মহাবিপদের সম্মুখীন হন। তিনি দানিশমান্দ নেতা আহমদ গাজী ও কাপাদোশিয়ার হাসান বেগের সহযোগিতায় এই ক্রুসেডার বাহিনীর মোকাবেলা করেন, এবং এস্কি শহরের উপকণ্ঠে অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধে কিলিজ আরসলান পরাজিত হন। এর ফলে নাইকিয়া ক্রুসেডারদের হস্তগত হয়। তবে অচিরেই ১১০০ খ্রিস্টাব্দে মালাটিয়া ও আমাসিয়ায় অনুষ্ঠিত উপর্যুপরি দুটো যুদ্ধে তিনি ক্রুসেডারদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। এমনকি বোহেমন্ড সহ আরও বহু প্রখ্যাত খ্রিস্টান যুবরাজ তার হাতে বন্দি হন।

বার্কিয়ারুকের মৃত্যুর পর তার পুত্র ২য় মালিক শাহ (Malik-Shah II, রা. ১১০৫) সেলজুক সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। কিন্তু, তাত্ত্বিকভাবে তিনি সম্রাট হলেও খোরাসানের মালিক ও তার আংকল আহমাদ সানজারের হাতেই সম্ভবত তখন প্রকৃত ক্ষমতা ছিল, যিনি ১০৯৭ থেকে ১১১৮ সাল পর্যন্ত খোরাসানের মালিক ছিলেন। এই আহমাদ সানজার ছিলেন ১ম মালিক শাহ্‌ এর তৃতীয় পুত্র। যাই হোক, ২য় মালিক শাহ্‌কে তার আরেক আংকল মুহাম্মদ তাপার হত্যা করে ১১০৫ সালে ১ম মুহম্মদ তাপার (Muhammad I Tapar, রা. ১১০৫-১১১৮ খ্রি.) নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনিও ১ম মালিক শাহ্‌ এরই পুত্র ছিলেন।

প্রথম ক্রুসেডের ফলে নাইকিয়া চিরতরে রুমের সেলজুক সালতানাতের হাতছাড়া হয়ে গেলেও কিলিজ আরসালান তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। তিনি কোনিয়ায় তার নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। পরবর্তী দুই শতাব্দীব্যাপী কোনিয়াই এশিয়া মাইনরে সেলজুকদের রাজধানী হিসেবে কাজ করেছিল। রুম সুলতান কিলিজ আরসলান অতপর মালাটিয়া ও মসুলসহ পূর্ব আনাতোলিয়া অধিকার করতে সমর্থ হন। তার রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে তিনি এই সম্প্রসারণনীতি গ্রহণ করলে সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান ১ম মুহম্মদের সাথে নতুন করে তার সংঘর্ষের সৃস্টি হয়। দুর্ভাগ্যবশত ১১০৭ খ্রিস্টাব্দে খাবুর নদী তীরবর্তী অঞ্চলে অনুষ্ঠিত এক যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।

দেনিশমান্দের আমির গাজি, হামাদানের সেলজুক সালতানাত (১১১৮-১১৯৪), রুমের সালতানাতের ১ম মাসুদ ও সেলজুক সাম্রাজ্যের আহমাদ সানজার

১১০৭ সালে কিলিজ আরসলানের এই অকস্মাৎ মৃত্যুর ফলে তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে সংঘর্ষের সৃস্টি হয়, আর সেই সুযোগে বাইজান্টাইন সম্রাট ১ম আলেক্সিওস কমনেনোস উত্তর-পশ্চিম এশিয়া মাইনর থেকে সেলজুকদেরকে বহিষ্কার করতে সমর্থ হন। তবে সেই সময়ে দানিশমান্দ (Danishmend) নেতা আমীর গাজী তার জামাতা সুলতান মাসুদের (কিলিজের অন্যতম পুত্র) পক্ষ অবলম্বন করে সেলজুক রুমের রক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। আমীর গাজী (Emir Gazi, রা. ১১০৪-১১৩৪ খ্রি.) এসময়ে এতই শক্তিশালী ছিলেন যে ১১০৪ থেকে ১১৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনিই এশিয়া মাইনরের প্রকৃত শাসনকর্তা ছিলেন। এমনকি সেলজুক সুলতান সানজার ও আব্বাসীয় খলিফা তাকে এশিয়া মাইনরের শাসনকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং তাকে ‘মালিক’ উপাধিতে ভূষিত করে তার জন্য সম্মানসূচক পোশাক ও প্রতীক পতাকা প্রেরণ করেন।

১১১৮ সালে ১ম মুহম্মদের মৃত্যুর পর সেলজুক সাম্রাজ্য দুই ভাগ হয়ে যায়। ইরাক, কুর্দিস্তান ও পশ্চিম পারস্য পায় তার পুত্র ২য় মাহমুদ (Mahmud II, রা. ১১১৮-১১৩১ খ্রি.), যিনি বাগদাদের সেলজুক সুলতান হিসেবে ক্ষমতা লাভ করেন। অন্যদিকে খোরাসান ও ট্রান্সক্সিয়ানা যায় খোরাসানের মালিক আহমাদ সানজারের (Ahmad Sanjar রা. ১১১৮-৫৭ খ্রি.) হাতে, যিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে সিংহাসন লাভ করেন।

পশ্চিম পারস্য ও কুর্দিস্তানের এই হামাদানের সেলজুক সালতানাত সম্রাট ১ম মুহাম্মদই তৈরি করে গিয়েছিলেন। আর তার মৃত্যুর পর তার পুত্র ২য় মাহমুদ মাত্র ১৩ বছর বয়সে এই সালতানাতের সুলতান হন। ইরাকের বাগদাদের আব্বাসিদ খিলাফতের উপর এই সালতানাতের প্রভাব ছিল। অবশ্য ২য় মাহমুদ সেখানকার তদকালীন আমীরদের হাতের ক্রীড়নক ছিলেন। সেখানে এলদিদুজিদ বংশের মত বিভিন্ন বংশের আমীরদের প্রভাব ছিল। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর রাজত্ব করার পর ১১৩১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর সেলজুক সাম্রাজ্যের সম্রাট আহমাদ সানজারই ছিলেন সেলজুক জগতের প্রধান শাসনকর্তা। যাই হোক, ২য় মাহমুদের মৃত্যুর পর হামাদানের সালতানাতে ১১৩১ থেকে ১১৩৪ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের চলে। ১১৩১ সালে গিয়াসউদ্দিন দাউদ (১১৩১-৩২ খ্রি:) সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন, কিন্তু তার রাজত্বকাল এক বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি। তুর্কিদের জাতীয় রীতি অনুসারে ১ম মুহম্মদের মৃত্যুর পর তার চার পুত্র মাহমুদ, ২য় তুঘ্রিল, মাসুদ ও সুলাইমান সকলেই ভিন্ন ভিন্ন আমীর বা আতাবেকদের অভিভাবকত্বে লালিত হতে থাকেন। এসব অভিভাবকগণ প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব প্রার্থীকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যস্ত থাকতেন। এজন্যই সেলজুক যুবরাজদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি হয়েছিল। এই গৃহযুদ্ধে দুজন আব্বাসিদ খলিফা জড়িয়ে পড়েছিলেন, এবং দুজনই নিহত হন। তারা হলেন আল-মুস্তরশিদ (Al-Mustarshid, রা. ১১১৮-১১৩৫ খ্রি.) এবং আল-রশিদ (Al-Rashid Billah, রা. ১১৩৫-৩৬ খ্রি.)। মূলত দাউদ, মাসুদ ও ২য় তুঘ্রিলের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলেছিল। ২য় তুঘ্রিল (Toghrul II, রা. ১১৩২-৩৪ খ্রি.) ১১৩২ থেকে ১১৩৪ সাল পর্যন্ত স্বল্পকালীন সুলতানের পদে বসেওছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত মাসুদই জয়লাভ করেন এবং ১১৩৪ সালে তিনি গিয়াসুদ্দিন মাসুদ (Ghiyath ad-Din Mas’ud, রা. ১১৩৪-১১৫২ খ্রি.) নাম নিয়ে সিংহাসন গ্রহণ করে ১১৫২ পর্যন্ত এই সালতানাতের সুলতান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু তার সময়ও সালতানাতের অবস্থা খারাপ ছিল। অনেক আমিরই কার্যতও স্বাধীন হয়ে যান। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইমাদ আল দীন জেঙ্গি (Imad al-Din Zengi, রা. ১১২৭-৪৬), যিনি ১১২৭ সালে এই সালতানাতের দুর্বলের সুযোগ নিয়ে মসুলে জেঙ্গিদ রাজবংশের সূচনা করেছিলেন। মাসুদের মৃত্যুর পর ২য় মাহমুদের আরেক পুত্র ৩য় মালিক শাহ্‌ (Malik-Shah III, রা. ১১৫২-৫৩ খ্রি.) ক্ষমতায় আসেন, কিন্তু ১ বছর পরেই তাকে তার ভাই ২য় মুহম্মদ (Muhammad II ibn Mahmud, রা. ১১৫৩-১১৫৯ খ্রি.) ক্ষমতাচ্যুত করেন। সেলজুক বংশের মূল শাখার সুলতান সানজারের হস্তক্ষেপের ফলে এই সালতানাতের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু ১১৫৭ খ্রিস্টাব্দে আহমাদ সানজারের মৃত্যুর পর এই সালতানাতের সেলজুকগণ বাগদাদ ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সাময়িকভাবে হামাদানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।

এদিকে এশিয়া মাইনোরের দানিশমান্দ বংশের মালিক আমীর গাজীর মৃত্যুর পর ১১৩৪ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র মালিক মুহম্মদ পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। তিনিও সুযোগ্য শাসক ছিলেন এবং পিতৃ গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হলে দানিশমান্দ গোত্রের মধ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা শুরু হয় এবং এই সুযোগে রুমের সেলজুক সালতানাতের সুলতান ১ম মাসুদ (Mesud I, রা. ১১১৬-৫৬ খ্রি.) সমগ্র এশিয়া মাইনরের ওপর সেলজুক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এসময়ে তাকে সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে মসুলের আতাবেক ও আর্তুকিদদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। সুলতান মাসুদের এই ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে বাইজান্টাইন সম্রাট ১ম ম্যানুয়েল কমনেনোস (Manuel I Komnenos, রা. ১১৪৩-৮০ খ্রি.) তার বিরাট বাহিনী নিয়ে এশিয়া মাইনর অভিমুখে যাত্রা করেন। অতঃপর আক-হিসারের প্রান্তরে একটি ক্ষুদ্র সেলজুক বাহিনীকে পরাজিত করে তিনি সেলজুক রাজধানী কোনিয়া অবরোধের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। সুলতান মাসুদ এই সংবাদে দ্রুত রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১১৪৭ খ্রিস্টাব্দে কোনিয়ার অদূরে অনুষ্ঠিত এক যুদ্ধে বাইজান্টাইন-বাহিনীকে পরাজিত করেন।

এসময়ে মসুলের আতাবেক ইমাদ উদ্দিন জেঙ্গি এডেসা অধিকার করলে দ্বিতীয় ক্রুসেডের সৃষ্টি হয়। এই ক্রুসেডে অংশগ্রহণের জন্য জার্মান-বাহিনী এশিয়া মাইনরের ওপর দিয়ে অগ্রসর হলে হঠাৎ রুমের সুলতান মাসুদ এই বাহিনীকে আক্রমণ করেন এবং তাদেরকে পরাজিত করেন। এভাবে যুগপৎ বাইজান্টাইন ও দ্বিতীয় ক্রুসেড-বাহিনীকে পরাজিত করায় সুলতান মাসুদের শক্তি ও মর্যাদা সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টিতে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। মাসুদের এই বিজয়ের মাধ্যমে রুমের সেলজুক বংশের প্রাথমিক বিপর্যয়ের অবসান ঘটে এবং শান্তি ও সমৃদ্ধির নবযুগ সূচিত হয়। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা সেলজুক সুলতান মাসুদকে এশিয়া মাইনরের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার জন্য বিশেষ সম্মানসূচক পোশাক ও প্রতীক পতাকা প্রেরণ করলেন। অতঃপর ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাসুদ সিরিয়া আক্রমণকারী ক্রুসেডার বাহিনীকে পরাজিত করেন। এছাড়া সিভাস ও মালাটিয়া সহ আরমেনিয়ার অংশবিশেষও তার অধিকারভুক্ত হয়। ১১৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাফল্য ও গৌরবের শীর্ষশিখরে অধিষ্ঠিত অবস্থায় সুলতান মাসুদ মৃত্যুবরণ করেন।

সেসময় সেলজুক সাম্রাজ্যের সম্রাট আহমাদ সানজার সেলজুক সাম্রাজ্যের একজন শক্তিশালী সম্রাট ছিলেন। ১১১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেলজুক সিংহাসনে আরোহণ করে দীর্ঘ ৩৫ বছর রাজত্ব করেন। তবে তার রাজত্বের শেষ দিকে সাম্রাজ্যে চরম আভ্যন্তরীণ অরাজকতা দেখা দেয় এবং সেলজুক সাম্রাজ্য বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়। ১১৪১ খ্রিস্টাব্দে চীনের কারাখিতাই গোত্রের মোঙ্গলরা সুলতান সানজারকে পরাজিত করে ট্রান্সঅক্সিয়ানা দখল করে। অতঃপর ১১৫৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওঘুজ তুর্কিদের একটি দলের হাতে পরাজিত ও বন্দি হন। ১১৫৬ সালে তিনি পালিয়ে আসেন ও ১১৫৭ সালে মারা যান। আহমাদ সানজারের মৃত্যুর পর হামদানের সেলজুক সুলতান ২য় মুহম্মদই সেলজুক সম্রাট ছিলেন। তার মৃত্যুর পর যথাক্রমে সুলাইমান শাহ্‌ (Suleiman-Shah, রা. ১১৫৯-৬০ খ্রি.) সাম্রাজ্যের অধিপতি হন।

এই ওঘুজ তুর্কি দলের হাতে কেরমানের সেলজুক সালতানাতেরও পতন হয়েছিল। পূর্বে সুলতান শাহ্‌ এর কথা বলা হয়েছে যাকে মালিক শাহ্‌ কেরমানের সিংহাসনে বসার সুযোগ দিয়েছিলেন। তারপর সেই সেলজুক বংশের অপরাপর নরপতিদের মধ্যে দ্বিতীয় তুরান শাহ (১০৮৪-৯৭ খ্রি:), আরসলান শাহ (১০৯৭-১১০০ খ্রি:), মুঘিত আল-দীন মুহম্মদ (১১০০-১১৪১ খ্রি:), তুঘ্রিল শাহ (১১৪১-১১৫৬ খ্রি), তুরকান শাহ (১১৫৬-৮৩খ্রি:) এবং দ্বিতীয় মুহম্মদ শাহের (১১৮৩-১১৮৬ খ্রি:) রাজত্বকাল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এদের মধ্যে কেউই তেমন বিশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যেতে সক্ষম হননি। অবশেষে ওঘুজ তুর্কিদের বর্বর আক্রমণের সম্মুখে কেরমানের সেলজুক তুর্কি বংশের পরিসমাপ্তি ঘটে। ওঘুজগণ তুরকান শাহকে ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত ও নিহত করেন। এছাড়া সমগ্র কিরমান রাজ্য ওঘুজদের লুটতরাজ ও অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়। তুরকান শাহের উত্তরাধিকারী মুহম্মদ শাহ ওঘুজদের ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করেন এবং ১১৮৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। তিনিই ছিলেন কেরমানের সেলজুক তুর্কি বংশের সর্বশেষ নরপতি। জনৈক ওঘুজ নেতা মালিক দিনার অতঃপর কিরমানে তার আধিপত্য বিস্তার করেন।

সেলজুক সাম্রাজ্যের শেষ অবস্থা, জেঙ্গিদ ও আইয়ুবিদ রাজবংশ, রুমের সুলতান ২য় কিলিজ আরসালান

১১৯৪ সাল পর্যন্ত সেলজুক সাম্রাজ্য টিকেছিল। ১১৫৭ থেকে ১১৯৪ সালের মধ্যে যেসব সম্রাট সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন তাদের মধ্যে মধ্যে কেউই তেমন যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি। আহমাদ সানজারের মৃত্যুর পর থেকেই সেলজুক সাম্রাজ্য বিভাজিত হতে শুরু করেছিল। এসময়ে সিরিয়ার ক্রুসেডারদের আক্রমণে সুলতানরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। সেলজুক সুলতানদের এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে বহু উচ্চাভিলাষী আমীর বিদ্রোহী হয়ে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি করেন। এরা যথেচ্ছভাবে আতাবেক, মালিক অথবা শাহ উপাধি ধারণ করেন। নামে সেলজুক সাম্রাজ্য টিকে থাকলেও আসলে তা সাম্রাজ্যের আতাবেগরা কার্যত স্বাধীন ছিলেন। এরা হলেন – খোরাসান ও ট্রান্সক্সিয়ানার খোরাসানি সেলজুক, কেরমানি সেলজুক, রুম সালতানাত, ইরানে সালঘুরিদ বংশ (আতাবেলিক), ইরাক ও আজারবাইজানের এলদিগুজিদ বংশ (আতাবেলিক), সিরিয়ার বুরিদ বংশ (আতাবেলিক), আল জাজিরা বা উত্তর মেসোপটেমিয়া বা আলেপ্পো ও মসুলের জেঙ্গিদ বংশ (আতাবেলিক), এশিয়া মাইনোরের বিভিন্ন টার্কোম্যান বেলিক, যথা দেনিশমেনিদ, আরতুকিদ, সালতুকিদ ও মেঙ্গুজেকিদ বংশ। এদের মধ্যে মসুলের জেঙ্গি বংশ ও ফার্সের সালঘারিদ বংশের আতাবেকদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাদ আল দীন তো আগেই জেঙ্গিদ রাজবংশ তৈরি করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। জেঙ্গি বংশের ইমাদ আল-দীন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন।

১১৪৬ সালে ইমাদ আল দীন জেঙ্গির মৃত্যুর পর মসুল লাভ করেন তার পুত্র ১ম সাঈফ আল দীন গাজি (Sayf al-Din Ghazi I, রা. ১১৪৬-১১৪৯ খ্রি.), এবং আলেপ্পো লাভ করেন তার পুত্র নুরুদ্দিন জেঙ্গি। জেঙ্গিদ বংশের নুরুদ্দিন জেঙ্গি (Nur ad-Din, আলেপ্পো-১১৪৬-৭৪, দামেস্ক ১১৫৬-৭৪) ১১৪৬ সালে আলেপ্পোর শাসক হন, ১১৫৬ সালে তিনি দামেস্ক লাভ করেন। দুজনই ২য় ক্রুসেডে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। ১১৭৪ সাল পর্যন্ত নুরুদ্দিন জেঙ্গি দামেস্ক ও আলেপ্পো শাসন করেন।

রুমের সুলতান মাসুদের মৃত্যুর পর ১১৫৬ সালে তার পুত্র দ্বিতীয় কিলিজ আরসলান (Kilij Arslan II, রা. ১১৫৬-১১৯২ খ্রি.) তার স্থলাভিষিক্ত হন, তিনি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এশিয়া মাইনরের সেলজুক সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার আমলে দানিশমান্দগণ বিদ্রোহী হলে তিনি তাদেরকে দমন করেন এবং তারা সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এছাড়া সিরিয়া আনাতোলিয়ার সীমান্ত নিয়ে সেলজুক সুলতানের সাথে জেঙ্গি বংশের আতাবেক নুরুদ্দীনের সঙ্গেও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।

সুলতান কিলিজ আরসলানের আমলে বাইজান্টাইন সম্রাট ১ম ম্যানুয়েল কমেনাসের সঙ্গে তার যুদ্ধ একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে কিলিজের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে বাইজান্টাইন সম্রাট কোনিয়া আক্রমণ করেন। কিন্তু ১১৭৬ খ্রিস্টাব্দে মাইবিত্তকেফালনে অনুষ্ঠিত এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে সেলজুক বাহিনীর হাতে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও বন্দি হন। সেলজুক সুলতান কিলিজ অবশ্য বাইজান্টাইন সম্রাটের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেন এবং উভয়ের মধ্যে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধির শর্তানুযায়ী বাইজান্টাইন সম্রাট ম্যানুয়েল সেলজুক সুলতান কিলিজকে এশিয়া মাইনরের একচ্ছত্র অধিপতি বলে স্বীকৃতি প্রদান করেন। বিনিময়ে সেলজুক বাহিনীর বিশেষ প্রহরাধীনে সম্রাটকে কনস্টান্টিনোপলে প্রেরণ করা হয়। মাঞ্জিকার্টের যুদ্ধের পর সেলজুক তুর্কিদের হাতে বাইজান্টাইন শক্তির এটিই ছিল দ্বিতীয়বারের মতো শোচনীয়। পরাজয়। এর ফলে এশিয়া মাইনরে বাইজান্টাইন শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। সুলতান দ্বিতীয় কিলিজ আরসলান একজন উদার ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তার আমলে কোনিয়ায় বিরাট অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধিত হয়। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু জ্ঞানী-গুণী, কবি সাহিত্যিক ও ধর্মবেত্তাগণ তার দরবার অলঙ্কৃত করেন। তার আমলের নির্মিত বহু মসজিদ, সরাইখানা, ও বিদ্যানিকেতনের নিদর্শন আজও কোনিয়া, সিভাস ও কায়সারিয়ায় দেখতে পাওয়া যায়। তিনি উদার বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করেন এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীগণ তার রাজত্বকালে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। বাইজাইন্টান সম্রাটের বিশেষ আমন্ত্রণ ও আতিথেয়তায় তিনি কনস্টান্টিনোপল সফর করেন। তার এই সহনশীল ও শান্তিপূর্ণ নীতির ফলে এশিয়া মাইনরে সেলজুক, টার্কোম্যান ও খ্রিস্টান সংস্কৃতির সমন্বয়ে এক নতুন ও বৈচিত্র্যময় জীবনব্যবস্থার উন্মেষ ঘটে। দীর্ঘ ৩৭ বছর রাজত্ব করার পর সুলতান দ্বিতীয় কিলিজ আরসলান ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

১১৪৭-১১৫০ সালের ২য় ক্রুসেডের পর নুরুদ্দিনের এক কুর্দিশ সেনাপতি শিরকুহ্‌ ফাতিমিদদের অঞ্চলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি আইয়ুবিদ বংশের লোক ছিলেন। তার মৃত্যুর তার স্থলাভিষিক্ত হন তার ভ্রাতুষ্পুত্র সালাউদ্দিন বা সালাদিন (Saladin, রা. ১১৭৪-৯৩ খ্রি.)। সালাউদ্দিন নুরুদ্দিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন ও নুরুদ্দিনের মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করে, সিরিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে নিয়ে আইয়ুবিদ রাজবংশের (১১৭৪-১২৬০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। এদিকে জর্জিয়া রাজ্য আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয় ও সেলজুক সাম্রাজ্যের কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়।

সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী আতাবেকদের মধ্যে মার্দিনের উরতুকিদ এবং খিলাফতের হিন-কাইফা ও আরমান শাহ্দে‌র নাম করা যেতে পারে। এসব আতাবেক ও শাহদের মধ্যে শামসুদ্দিন ইলদিঘিজ সুলতান ২য় তুঘ্রিলের এক বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করেন এবং ১১৬১ খ্রিস্টাব্দে সুলাইমান শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র আরসলান শাহ্‌কে (Arslan Shah, রা. ১১৬১-৭৪ খ্রি.) সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু আরসলানের কোন ক্ষমতাই ছিল না। রাজ্যের প্রকৃত শাসনভার ইলদিঘিজই হস্তগত করেছিলেন। কিন্তু ইলদিঘিজের পুত্র পহলোয়ান বড় হয়ে পিতাকে পদচ্যুত করেন এবং ১১৭৬ সালে ৩য় তুঘ্রিলকে (Toghrul III, রা. ১১৭৬-১১৯৪ খ্রি.) প্রকৃত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। ইনিই সেলজুক সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন।

১১৫৭ সালে আহমাদ সানজারের মৃত্যুর পর ইরাক ও পশ্চিম পারস্যের এই সেলজুক সালতানাতের সুলতানগণ বাগদাদ ছেড়ে পালিয়ে এসে হামাদানে তাদের রাজধানী স্থাপন করলে বাগদাদের আব্বাসিদ খলিফাদের ক্ষমতা পূর্বাপেক্ষা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময়ে আব্বাসিদ খলিফা আন-নাসির (Al-Nasir, রা. ১১৮০-১২২৫ খ্রি.) তার খিলাফতের কর্তৃত্ব পুনর্বহাল করেন এবং খোয়ারেজমীয় সাম্রাজ্যের (১০৭৭-১২৩১) শাহ্‌ তাকাশের (Ala ad-Din Tekish, রা. ১১৭২-১২০০ খ্রি.) সাথে মৈত্রী স্থাপন করেন। তখন সেলজুক সাম্রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছেন এর শেষ সম্রাট ৩য় তুঘ্রিল। ৩য় তুঘ্রিল কেবলমাত্র আনাতোলিয়ার রুম সালতানাতের সেলজুক বংশ ছাড়া সকল সেলজুক বংশেরই সুলতান ছিলেন। ১১৯৪ সালে ৩য় তুঘ্রিল খোয়ারেজমের সম্রাট তাকাশের হাতে পরাজিত ও নিহত হন। এরপর গোটা সেলজুক সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। পূর্ববর্তী সেলজুক সাম্রাজ্যের মধ্যে কেবল আনাতোলিয়ার রুম সালতানাতই টিকেছিল।

পতনোন্মুখ রুম সালতানাত ও মোঙ্গল পরাধীনতা

সুলতান দ্বিতীয় কিলিজ আরসলানের মৃত্যুর পূর্বে তিনি সেলজুক রুমকে তার এগার জন (মতান্তরে বার জন) পুত্রের মধ্যে বিভক্ত করে প্রত্যেকের ওপর এক একটি প্রদেশের শাসনভার অর্পণ করে যান। কিলিজের অনুসৃত এই নীতির অবশ্যম্ভাবী কুফল অবশ্য তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিয়েছিল। কারণ অচিরেই সেলজুক যুবরাজদের মধ্যে সিংহাসন দখলের লড়াই শুরু হলো। এই সংগ্রামে অবশেষে ১ম কায়খসরু (Kaykhusraw I, ১১৯২-৯৬, ১২০৫-১১ খ্রি.) ২য় সুলাইমান (Suleiman II, রা. ১১৯৬-১২০৪ খ্রি.) ও অপরাপর ভ্রাতাদের ওপর নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলেন। ১২১১ খ্রিস্টাব্দে কায়খসরুর মৃত্যুর পর তার পুত্র কায়কাউস (Kaykaus I, রা. ১২১১-২০ খ্রি.) সেলজুক সিংহাসনে উপবেশন করলেন। তার আমল থেকে সেলজুক রুমের দ্বিতীয় গৌরবোজ্জ্বল যুগের সূচনা হয়। তিনি ১২১৪ খ্রিস্টাব্দে সিনোপি অধিকার করেন। তার আমলে কৃষ্ণসাগরের শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে ওঠে। তিনি ত্রিবিজোন্দের রাজাকে এক যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি করতে সক্ষম হন। সুলতানের বশ্যতা স্বীকার ও কর প্রদানে রাজি হয়ে পরে তিনি মুক্তি লাভ করেন। এছাড়া সুলতান কায়কাউস সাইপ্রাসের রাজাকে পরাজিত করেন এবং আর্মেনিয়ার রাজাকে নিয়মিত কর প্রদানে বাধ্য করেন। এসময়ে আইয়ুবী বংশের গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে তিনি সিরিয়ার উত্তরাংশ অধিকার করেন। এছাড়া আর্তুকিদ বংশের আমীর মাহমুদ ও ইরবিলের শাসনকর্তা মুজাফফার উদ্দিনও তার বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। সুলতান কায়কাউস ১২২০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি রাজধানী কোনিয়ায় একটি বিখ্যাত হাসপাতাল নির্মাণ করেন। এই হাসপাতালের মধ্যবর্তী কোন এক স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

সেলজুক রুমের পরবর্তী সুলতান ছিলেন আলাউদ্দিন কায়কোবাদ (Kayqubad I, রা. ১২২০-৩৭ খ্রি.)। তার রাজত্বকালে এশিয়া চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ মোঙ্গল জাতির অভ্যুত্থান ঘটে। মোঙ্গল আক্রমণের এই প্রবল বহ্নিশিখা থেকে এশিয়া মাইনরকে রক্ষা করার জন্য সুলতান কায়কোবাদ কতকগুলো ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। তিনি বিভিন্ন দুর্গের সংস্কার সাধন করেন এবং রাজধানীসহ সিভাস ও কায়সারিয়া প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো মজবুত ও সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। সুলতান কায়কোবাদ ভূমধ্যসাগর উপকূলবর্তী কালুনোরস নামক দুর্গটি অধিকার করেন। এই দুর্গটিকে তিনি একটি নৌপোতাশ্রয় হিসেবে গড়ে তোলেন এবং তার নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘আলাইয়া’। তিনি মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে খাওয়ারিজম শাহ জালালউদ্দিনের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। এটি তার কূটনৈতিক বিচক্ষণতার প্রমাণ বহন করে। সুলতান কায়কোবাদ জর্জিয়া আক্রমণ করেন এবং জর্জিয়ার রানীকে তার বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। এছাড়া সিরিয়ার আইয়ুবী সুলতান ও দিয়েরবেকিরের আর্তুকিদগণও তার অধীনতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। সুলতান কায়কোবাদ একজন বিখ্যাত নির্মাতা ছিলেন। কুবাদাবাদ ও কায়কোবাদিয়া নামক দুটো নতুন শহর নির্মাণ তার প্রকৃত প্রমাণ। এছাড়া তিনি বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, সরাইখানা ও চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তার আমলকে নিঃসন্দেহে এই বংশের ‘সোনালি যুগ’ বলে অভিহিত করা চলে। তিনি ১২৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এশিয়া মাইনরের সেলজুক জাতীয় ইতিহাসে সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

সুলতান কায়কোবাদের মৃত্যুর পর থেকে এশিয়া মাইনরের সেলজুক রাজত্বের ক্রমপতন সূচিত হয়। তার উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় কায়খসরু (Kaykhusraw II, রা. ১২৩৭-৪৬ খ্রি.) একজন অযোগ্য দুর্নীতিপরায়ণ ও আরামপ্রিয় সুলতান ছিলেন। তার আমল থেকেই এশিয়া মাইনরের সেলজুক বংশের ভিত্তিমূল দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ১২৩৯ খ্রিস্টাব্দে বাবা ইসহাক নামক জনৈক শেখের নেতৃত্বে তুর্কি গাজী ও টাকোম্যানদের বিদ্রোহ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বাবা ইসহাক কায়খসরুর দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ব্যবস্থা ও রাজদরবারের বিলাসিতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। এটিকে একটি সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। সুলতান কায়খসরু নির্মম হাতে এই বিদ্রোহ দমন করেন এবং বিদ্রোহী নেতা বাবা ইসহাক তার হাতে নিহত হন। কিন্তু এর ফলে সেলজুক তুর্কিগণ চিরতরে গাজী ও টাকোম্যানদের সমর্থন ও সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়া এসময়ে সেলজুকদের ওপর মোঙ্গল আক্রমণের মহা-অভিশাপ পতিত হয়। বাইজু নোয়ান ছিলেন আনাতোলিয়া (এশিয়া মাইনোর), জর্জিয়া ও পারস্য অঞ্চলের মোঙ্গল কমান্ডার। তিনি ওগোদাই খানের (১২২৯-৪১ খ্রি.) নিয়োগে ১২৪১-১২৪৭ সালে ও মেঙ্গু খানের (১২৪৮-৫৯ খ্রি.) নিয়োগে ১২৫১-১২৫৫ সালে নিকট প্রাচ্যের ভাইসরয়ের পদে ছিলেন। যে সময়ের কথা হচ্ছে তখন তিনি মোঙ্গল সম্রাট কুয়ুক খানের (১২৪১-৪৮ খ্রি.) অধীনে নিকট প্রাচ্যের ভাইসরয়। ত্রিশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে বাইজু নোয়ান এরজুরেম অধিকার করলেন। অতপর ১২৪৩ খ্রিস্টাব্দে কোজাদাগ নামক স্থানে মোঙ্গল বাহিনীর সঙ্গে সেলজুক বাহিনীর এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সুলতান কায়খসরু স্বয়ং আশি হাজার সৈন্যের এক বিশাল সেলজুক বাহিনী পরিচালনা করেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। কোজাদাগের এই ভাগ্যনির্ধারণকারী যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে এশিয়া মাইনরে সেলজুক শাসনের মৃত্যুসংকেত ধ্বনিত হলো। মোঙ্গলগণ সিভাস ও কায়সারিয়া অধিকার করে এবং এই শহরগুলোর হাজার হাজার নিরপরাধ অধিবাসী তাদের কাছে চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়। ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান দ্বিতীয় কায়খসরুর মৃত্যু হলে চতুর্থ কিলিজ আরসলান সেলজুক সিংহাসনে উপবেশন করেন। তিনি মোঙ্গলদের অধীনতা স্বীকার করলেন এবং স্বয়ং মোঙ্গল রাজধানী কারাকোরামে গমন করে নতুন মোঙ্গল খান কুয়ুকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হলেন। পরে উভয় শক্তির মধ্যে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হলো এবং মোঙ্গল খান এশিয়া মাইনরের সেলজুক তুর্কি বংশের রাজত্ব অনুমোদন করলেন। বিনিময়ে সেলজুকগণ মোঙ্গলদেরকে বাৎসরিক নির্দিষ্ট হারে কর প্রদানে রাজি হলো।

১২৪৩ থেকে ১৩০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এশিয়া মাইনরের সেলজুকগণ বাহ্যত স্বাধীন হলেও তা প্রকৃতপক্ষে মোঙ্গল খানদের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে বিরাজমান ছিল। সুলতান দ্বিতীয় কায়খসরুর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এদিকে পারস্যের ইল-খানি বংশের (Ilkhanate) প্রতিষ্ঠাতা হালাগু খান (Hulagu Khan. রা. ১২৫৬-৬৫ খ্রি.) ১২৫৮ সালে বাগদাদ আক্রমণ, লুণ্ঠন, ধ্বংস ও দখল করেন। বাগদাদ পদানত করার পর হালাকু খান সিরিয়া আক্রমণ করেন এবং হামাদান, নিসিবন ও আলেপ্পো প্রভৃতি শহরগুলো একের পর এক তার হস্তগত হয়। এশিয়া মাইনরের সেলজুক রুম ও গােল্ডেন হাের্ডের সঙ্গেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে মােকাবেলা করেন। সেলজুকদের আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে তিনি এশিয়া মাইনরকে দুটো অংশে বিভক্ত করেন। তিনি কিলিজ ইরমাক নদীর পূর্বাঞ্চল চতুর্থ কিলিজ আরসলানের (Kilij Arslan IV, রা. ১২৪৮-৬৬) ওপর এবং পশ্চিমাঞ্চল তার ভ্রাতা দ্বিতীয় কায়কাউসের (Kaykaus II, রা. ১২৪৬-৬২ খ্রি.) ওপর ন্যস্ত করেন। কিন্তু সেলজুক রুমের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা মুঈন আল-দীন সুলাইমান নামক জনৈক ব্যক্তির হাতেই অর্পিত হলো। তিনি পারওয়ানা উপাধি ধারণ করেন এবং মোঙ্গলদের প্রতিনিধি হিসেবে সেলজুক রুমের সর্বময় কর্তা হয়ে বসেন। তার অধীনে সাময়িকভাবে এশিয়া মাইনরে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এরপর হালাকু খান মিশরের মামলুকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু হঠাৎ এই সময় তার ভাই মেঙ্গু খানের মৃত্যু হলে তিনি রাজধানী কারাকোরামে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন। হালাকু খানের অনুপস্থিতিতে তার সেনাপতি কেৎবুঘা ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে মিশর আক্রমণ করেন। কিন্তু ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে আইনজালুতের প্রান্তরে মোঙ্গলগণ সর্বপ্রথম মামলুক সুলতান কুতুজের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। মোঙ্গল সেনাপতি কেৎবুঘা যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হলেন। আইনজালুতের যুদ্ধ যুগপৎ মােঙ্গল ও মামলুক ইতিহাসের একটি ভাগ্যনির্ধারণকারী ঘটনা। কারণ এর ফলে মােঙ্গলদের মিশর বিজয়ের বাসনা চিরতরে ব্যর্থ হয়ে যায় এবং প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র কায়রাে মােঙ্গলদের ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পায়। 

এদিকে এসময়ে হঠাৎ এশিয়া মাইনরের মোঙ্গল বিরোধী গণঅসন্তোষ দেখা দেয় এবং কয়েকজন প্রভাবশালী সেলজুক বেগ মিশরের মামলুক সালতানাতের (Mamluk Sultanate) বাইবার্সকে (Baibars, রা. ১২৬০-৭৭ খ্রি.) সেলজুক রুম আক্রমণে আমন্ত্রণ জানায়। আইনজালুতের যুদ্ধের পর থেকে মিশরের মামলুকগণ মোঙ্গলদের সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু ছিল। ফলে এই দুই শক্তির মধ্যে তিক্ততার শেষ ছিল না। সুলতান বাইবার্স তাই বিনা দ্বিধায় সেলজুক বেগদের আমন্ত্রণে সাড়া দেন এবং ১২৭৬ খ্রিস্টাব্দে এশিয়া মাইনর আক্রমণ করলেন। তখন ইল-খানি সাম্রাজ্যের খান ছিলেন হালাকু খানের জেষ্ঠ্যপুত্র আবাগা খান (১২৬৫-১২৮২ খ্রি.) যিনি পিতার মৃত্যুর পর ১২৬৫ সালে পারস্যের ইল-খানি সিংহাসনে আরােহণ করেছেন। বাইবার্স আলবিস্তান নামক স্থানে অবস্থানরত একটি ক্ষুদ্র মোঙ্গাল বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং কায়সারিয়া পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু মোঙ্গলদের বিরুদ্ধাচরণ করে মামলুক সুলতান বাইবার্সের সহযোগিতা করার ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করে পারওয়ানা অথবা সেলজুক সুলতান তার প্রতি সক্রিয় সমর্থন প্রদানে বিরত থাকলেন। বাইবার্স বিচক্ষণ নরপতি ছিলেন। তিনি স্থানীয় শাসন কর্তৃপক্ষের সমর্থন লাভে বঞ্চিত হয়ে কায়সারিয়ায় অবস্থান করা অথবা তার অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখা নিরাপদ মনে করলেন না। কারণ মোঙ্গল খানের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বাহিনীর আগমনে তার যাত্রাপথ পশ্চাৎদিক থেকে রুদ্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে তিনি ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে দ্রুতগতিতে মিশর প্রত্যাবর্তন করলেন।

বাইবার্স কর্তৃক এশিয়া মাইনর আক্রমণ ও মোঙ্গল বাহিনীর পরাজয় পারস্যের ইলখানি মোঙ্গল নরপতি আবাকা খানের (Abaqa Khan, রা. ১২৬৫-৮২ খ্রি.) ক্ষোভের সীমা রইলো না। তিনি সসৈন্যে এশিয়া মাইনর আক্রমণ করলেন এবং সেলজুক তুর্কিদের বিদ্রোহ ও মামলুক সুলতানের প্রতি তাদের সমর্থনের শাস্তি স্বরূপ তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালালেন। এমনকি মোঙ্গলদের এককালীন বিশ্বস্ত ও অনুগত প্রতিনিধি পারওয়ানা নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেও এই হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেলেন না। এই ঘটনার পর থেকে ১৩০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এশিয়া মাইনরে সেলজুক তুর্কি সুলতান তৃতীয় কায়খসরু (Kaykhusraw III, রা. ১২৬৫-১২৮৪ খ্রি.), দ্বিতীয় মাসুদ (Mesud II, রা. ১২৮৪-৯৬, ১৩০৩-৭ খ্রি.) এবং তৃতীয় কায়কোবাদ (Kayqubad III, রা. ১২৯৮-১৩০২ খ্রি.) একের পর এক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কোনরকম শাসন ক্ষমতার অধিকারীই ছিলেন না। মোঙ্গলদের অত্যাচার এবং বিশেষ করে কর সংগ্রহের ব্যাপারে তাদের কড়াকড়ি পূর্বাপেক্ষা বহুগুণে বেড়ে যায়। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এসময়ে পারস্যের ইলখানাত মোঙ্গল শক্তি হীনবল হয়ে পড়ায় এশিয়া মাইনরের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে।

এশিয়া মাইনরের স্বাধীন গাজী রাজ্যসমূহ

মধ্য-এশিয়ার চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ মোঙ্গল জাতির অভ্যুত্থানের ফলে পারস্য, আজারবাইজান ও তুর্কিসথান থেকে বহু সংখ্যক সুফি, দরবেশ ও ধরবেশ ও ধর্মবেত্তা এশিয়া মাইনরের উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে আশ্রয় গ্রহণ করেন। জাতিতে এরা ছিল প্রধানত টার্কোম্যান। তারা উক্ত অঞ্চলের সামানীয় সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রিস্টান ও যাযাবর লোকদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। এই সমস্ত টার্কোম্যান মুসলমানগণ তাদের ধর্মের জন্যে এমনকি প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকতেন। সীমান্তবর্তী খ্রিস্টান বিধর্মীয়দের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ এবং তার মাধ্যমে শত্রুদের কাছ থেকে অর্থসম্পদ লুণ্ঠন করা তাদের অন্যতম পেশা ছিল। এই কারণে তারা গাজী (অর্থাৎ ধর্মযোদ্ধা) বলে পরিচিত ছিলেন (টার্কোম্যান গাজিদের ন্যায় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের মুসলিম সীমান্তেও পাল্টা দল হিসেবে খ্রিস্টীয় ধর্মযোদ্ধারা ছিল। এদেরকে “আকরিতোই” বলা হতো।)। এই গাজীগণ তাদের পূর্বপুরুষ গাজী সৈয়দ বাতালের বংশধর বলে নিজদেরকে পরিচয় দেন (পি. উইটেক ; The Rise of the Ottoman Empire, খণ্ড ২৩, লণ্ডন, ১১৩৮ পৃ: ২০)। এশিয়া মাইনরে সেলজুক রাজত্বের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই গাজীগণ সেখানে বসবাস করে আসছিল এবং তদঞ্চলে সেলজুক শক্তি প্রতিষ্ঠার পেছনে তাদের অবদানও ছিল অপরিসীম। সেলজুক তুর্কিগণ এই কারণে গাজীদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিল এবং তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য নির্মূল করার জন্য কখনও শক্তি প্রয়োগ করেনি। কিন্তু ১২৩১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান কায়খসরুর দ্বারা বাবা ইসহাকের নেতৃত্বে গাজী বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করার ফলে সেলজুক তুর্কিগণ গাজী টাকোম্যানদের সমর্থন ও সহানুভূতি থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়।

মোঙ্গলদের উপর্যুপরি আক্রমণের ফলে এশিয়া মাইনরে সেলজুক তুর্কি শক্তি হীনবল হয়ে পড়ে। কিন্তু এশিয়া মাইনরের মোঙ্গল শক্তির প্রাধান্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মোঙ্গলগণ ইতোমধ্যেই মূল ভূখণ্ডে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পক্ষান্তরে বাইজান্টাইনগণও এশিয়া মাইনরের তৎকালীন রাজনৈতিক দুরবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। কারণ বাইজান্টাইন সম্রাটকে এসময়ে বলকান অঞ্চলে আভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়তে হয়। ফলে সম্রাটের পক্ষেও তার এশীয় রাজ্যাংশের প্রতি মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়নি। তাই এই সুযোগে এশিয়া মাইনরের পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে টার্কোম্যান গাজী আমীরগণ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং সেখানে বহু সংখ্যক স্বাধীন গাজী রাজ্য গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তুরস্কের অটোম্যান তুর্কি বংশও ছিল এই গাজী রাজ্যসমূহেরই অন্যতম একটি (The Cambridge History of Islam. প্রথম খণ্ড, ক্যামব্রিজ, ১৯৭০ পৃ: ২৬৩। আরও দ্রষ্টব্য : পি. উইটেক, The rise of the Ottoman Empire. লন্ডন, ১৯৩৮, পৃ: ৩৪)। ১৩দশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব এশিয়া মাইনরের প্রতিষ্ঠিত এসব গাজী রাজ্যসমূহের মধ্যে- (১) তেকেলি, (২) রামাজান, (৩) আদানা, (৪) জুলকাদার, (৫) মালাটিয়া, (৬) এলবিস্তান, (৭) মেন্টেসি, (৮) সারুখান, (৯) আইদিন, (১০) কারাসাই, (১১) কারামানিয়া, (১২) কাস্তমুনি , (১৩) হামিদ, (১৪) জার্মিয়ান, (১৫) সিনোপ, (১৬) সেলেরি, (১৭) জান্দার, (১৮) টেক্কি , প্রভৃতির নাম উলেখ করা যেতে পারে। এই রাজ্যগুলোর নামকরণ বহু ক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে আবার কখনও বা স্থানের নামানুসারে হয়েছে। এসব গাজী রাজ্যসমূহের মধ্যে মেন্টেসি, আইদিন, কারামানিয়া ও জামিয়ান ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।

মেন্টেসি এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত ছিল। গাজী রাজ্যগুলোর মধ্যে এটিই ছিল প্রাচীনতম। মেন্টেসির গাজীগণ দুর্ধর্ষ নৌযোদ্ধা ছিল। বাইজান্টাইন সম্রাট তার নৌবাহিনী বন্ধ করে দিলে উক্ত বাহিনীর বহু খ্রিস্টান নৌসেনাও মেন্টেসির সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়। মেন্টেসি ছিলেন এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এক পর্যায়ে রোডস দ্বীপটি দখল করতে সমর্থ হন এবং সাগর তীরবর্তী সকল অঞ্চল তার প্রতাপে অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু ১৩১০ খ্রিস্টাব্দে নাইট হসপিটালার্সগণ গাজীদেরকে রোড়স্ থেকে বহিষ্কার করতে সক্ষম হয়। মেন্টেসির প্রাধান্য বিনষ্ট হওয়ার পর আইদিন নামক গাজী রাজ্যটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মেন্টেসির বহু সুশিক্ষিত নৌসেনানী আইদিন বাহিনীতে যোগদান করে। ফলে জল ও স্থল এই উভয় ক্ষেত্রেই আইদিন সেনানীগণ শক্তিশালী ছিল। আইদিনের গাজীগণ স্মার্না অধিকার করতে সমর্থ হয় এবং পরবর্তী সময়ে আইদিন অধিপতি গাজী ওমর বেগের নেতৃত্বে তারা গ্রিস, মেসিডোনিয়া ও থ্রেস আক্রমণ করে এবং অগণিত ধনরাশি নিয়ে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়। গাজী ওমর বেগের সুনাম চতুর্দিকে বিশেষ প্রসার লাভ করে এবং বিভিন্ন স্থান থেকে উচ্চাভিলাষী ও ভাগ্যান্বেষী সৈন্যগণ তার সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে থাকে। এর ফলে আইদিন রাজ্যটি খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে পোপের আহ্বানে ভেনিস, রোডস্ সাইপ্রাস ও গ্রিস একটি সম্মিলিত সামরিক জোটের সৃষ্টি করে এবং আইদিনের গাজী শক্তিকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। ফলে স্মার্না গাজীদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দে গাজী ওমর বেগ উক্ত নগরী পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে যুদ্ধরত অবস্থায় প্রাণত্যাগ করেন। গাজী ওমর বেগের মৃত্যুর পর থেকে আইদিন রাজ্যটি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৪শ শতাব্দীর শেষের দিকে আইদিন অটোম্যান তুর্কিদের অধিকারভুক্ত হয়।

এশিয়া মাইনরের অপরাপর শক্তিশালী গাজী রাজ্যগুলোর মধ্যে কারামানিয়া ও জার্সিয়ান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারামানিয়ানগণ নিজেদেরকে কোনিয়ার সেলজুক তুর্কিদের উত্তরাধিকারী বলে দাবি করতে এবং সেলজুক জাতীয় বৈশিষ্ট্যই তাদের মধ্যে প্রাধান্য লাভ করে। কারামানিয়া তাউরুস পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত ছিল। কারামানিয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কারামান নামক জনৈক টার্কোম্যান সুফির পুত্র। বাবা ইসহাকের সমর্থক ও অনুসারীগণের সমন্বয়েই তিনি তার বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। সেলজুক তুর্কি বংশের পতনের পর করামানিয়ানরা কোনিয়ায় তাদের অটোম্যান তুর্কিদের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কারামানিয়ানগণ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ১৬শ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত অটোম্যানদের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কারামানিয়ার আমীরদের মধ্যে মুহম্মদ বেগের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনিই সর্বপ্রথম এশিয়া মাইনরের ইতিহাসে ফার্সি ভাষার পরিবর্তে তুর্কি ভাষাকে রাজভাষার মর্যাদা প্রদান করেন। কারামানিয়ার পর এশিয়া মাইনরের গাজী রাজ্যগুলোর মধ্যে জার্মিয়ানের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই রাজ্যটি ১২৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন পাইজিয়া অঞ্চলের ওপর গড়ে এঠ। এর রাজধানী ছিল কুতাইয়া। জার্মিয়ান রাজ্যটি পশ্চিম আনাতোলিয়ার আইদিন ও সারুখান প্রভৃতি রাজ্যগুলোর প্রাণকেন্দ্র ছিল। জার্মিয়ান আমীরগণ কখনও গাজী উপাধি ধারণ করেননি। পশ্চিম আনাতোলিয়ার গাজী আমীরগণও কখনও গাজী উপাধি ধারণ করেননি। পশ্চিম আনাতোলিয়ার গাজী রাজ্যগুলো জার্মিয়ানের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রদর্শন করতো। সেলজুক তুর্কি বংশের প্রতিষ্ঠার পেছনে জার্মিয়ানদেরও বিরাট অবদান ছিল। এই রাজ্যটি সুদীর্ঘকাল যাবত এর অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১৫শ শতকের শেষার্ধে তুরস্কের অটোম্যান তুর্কিদের কারণে জার্মিয়ানদের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়।

এশিয়া মাইনরের প্রতিষ্ঠিত এই অসংখ্য গাজী রাজ্যগুলো নানা কারণে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীব্যাপী এতদঞ্চলে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনব্যবস্থা তুর্কিদের ওপর যে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল তা ছিল এই রাজ্যগুলোরই প্রত্যক্ষ অবদান। তুরস্কের অটোম্যান তুর্কি সাম্রাজ্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা সৃষ্টি করতে হলে তাই তার পটভূমিকা হিসেবে গাজী রাজ্যগুলোর ইতিহাস জানা অপরিহার্য (১৪শ শতাব্দীর মরক্কোবাসী বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবন বতুতা এশিয়া মাইনর ভ্রমণ করেন এবং তার ভ্রমণবৃত্তান্ত এই গাজী রাজ্যগুলো সম্বন্ধে একটি চমৎকার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। দ্রষ্টব্য : The Travels of Ibn Batuta. (ইংরেজি অনুবাদ এস. এইচ. গিব) ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৫৮))।

অটোমানদের কাছে গাজী রাজ্যগুলোর পতন

১৩২৭ সালে অটোমান শাসক ওরখান (রা. ১৩২৬-৫৯ খ্রি.) যখন নাইকিয়া বিজয়ে ব্যস্ত ছিলেন তখন এই সুযোগে সাম্রাজ্যের দক্ষিণপূর্ব সীমান্তে তিনি মোঙ্গল ও সেলজুক তুর্কিদের হুমকির সম্মুখীন হলেন। ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক রুমের মোঙ্গল শাসনকর্তা তিমুরতাস এশিয়া মাইনরের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তিমুরতাস ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী অঞ্চলে গ্রিকদের সাথে কলহে লিপ্ত হলে ওরখান মোঙ্গলদের সাথে অনিবার্য সংঘর্ষের হাত থেকে রক্ষা পান। সেলজুক রুমের সর্বশেষ মোঙ্গল গভর্নর বাহাদুর খান ১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলে অটোমানগণ চিরতরে মোঙ্গল হুমকির হাত থেকে মুক্ত হয়। এশিয়া মাইনরে সেলজুক তুর্কিদের অধীনে অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য ছিল কারাসাই। ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে কারাসাই এর আমীরের মৃত্যু হলে তার পুত্রদ্বয়ের মধ্যে গৃহবিবাদ দেখা দেয়। কনিষ্ঠ ভ্রাতা তুরসুন ওরখানের শরণাপন্ন হয়ে তার সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি সসৈন্যে কারাসাই আক্রমণ করেন এবং আমীরকে পরাজিত ও নিহত করেন। ফলে ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে কারাসাই-এর রাজধানী পেরগামস ওরখানের হস্তগত হয়। 

ওরখানের মৃত্যুর পর ১৩৫৯ সালে তার পুত্র প্রথম মুরাদ (১৩৫৯-৮৯ খ্রি.) সিংহাসনে উপবেশন করে তার পিতৃরাজ্য বিস্তারে মনোনেবেশ করেন। বস্তুত এসময়ে অটোমান সৈন্যবাহিনী থ্রেস অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। রাজ্য বিজয়ের ক্ষেত্রে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুরাদ ইউরোপের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। বলকান উপদ্বীপে একটি স্থায়ী সমর ঘাঁটি পদানত করাই মুরাদের মনে অগ্রাধিকার লাভ করেছিল। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা বদলের এই সুযোগ নিয়ে মধ্য-এশিয়া মাইনরে অবস্থিত ক্ষুদ্র রাজ্য কারামানিয়ের যুবরাজ বিদ্রোহী হলে বাধ্য হয়ে মুরাদ তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক সমর অভিযান প্রেরণ করেন। ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দে পরিচালিত মুরাদের এই প্রথম অভিযান বিশেষ সাফল্য লাভ করে এবং কারামানিয়ের বিদ্রোহী যুবরাজ কর প্রদানে রাজি হয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হন।

ইউরোপে অটোমান শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর মুরাদ এশিয়া মাইনরের অপরাপর মুসলিম শক্তিবর্গের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেন। এশিয়া মাইনরে রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে মুরাদ ‘যুদ্ধ, বৈবাহিক সম্বন্ধ ও সরাসরি রাজ্যাংশ ক্রয়’-এই তিন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন (এস. লেইনপুল, Turkey, লন্ডন, ১৮৮৮)। এশিয়া মাইনরের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্য আনাতোলিয়ার আমীর আলাউদ্দিনকে তিনি নিজ কন্যা দান করেন এবং উভয়ের মধ্যে সাময়িক সম্প্রীতি থাপিত হয়। অন্যদিকে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়জীদের সাথে কারমিয়ার আমীরের কন্যার বিবাহ দেন। এই বিবাহের যৌতুক হিসেবে তিনি কুতিয়া নামক একটি দুর্গসহ কারমিয়ার কিংদংশ লাভ করেন। ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে বায়েজীদ কারামিয়ার গভর্নর নিযুক্ত হন। সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে এশিয়া মাইনরে অটোমান স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব প্রধানত বায়েজীদের ওপরই ন্যস্ত ছিল।

১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে হামিদ নামক অপর একটি রাজ্যের আমীর তার শক্তিশালী প্রতিবেশী সুলতান মুরাদের বন্ধুত্ব লাভের আশায় তার কাছে নিজ রাজ্যের কিয়দংশ বিক্রয় করেন। পরবর্তী বছর মুরাদ টেক্কির আমীরের সাথে এক সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং তার রাজ্যের একাংশ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। মুরাদ কর্তৃক পরিচালিত এশিয়া মাইনরের অভিযানগুলোর মধ্যে আনাতোলিয়ার আমীর আলাউদ্দিনের সাথে যুদ্ধই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুরাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও আলাউদ্দিন শ্বশুরের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। মুরাদের শক্তি বৃদ্ধিতে ভীত ও শঙ্কিত হয়ে আলাউদ্দিন বিদ্রোহী হলে মুরাদ তার বিরুদ্ধে সমর অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হন। মুরাদ তার দুই পুত্র বায়েজীদ ও ইয়াকুবের নেতৃত্বে অটোমান বাহিনী প্রেরণ করেন। কেবলমাত্র অটোমান সৈন্য ছাড়াও বলকান অঞ্চল থেকে আগত বহু খ্রিস্টান সৈন্য অটোমান বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৩৮৭ খ্রিস্টাব্দে কুনিয়ের বিশাল প্রান্তরে শ্বশুর ও জামাতার মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হলো। যুদ্ধে আলউদ্দিন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন। এবং বাধ্য হয়ে মুরাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। প্রথমত মুরাদ বিদ্রোহী আলাউদ্দিনের প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শন করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেও পরে নিজ কন্যা সজল নয়নে পিতার কাছে স্বামীর জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করলে মুরাদ তা অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। আলাউদ্দিন মুরাদের অনুকম্পা লাভ করে তার আনুগত্য স্বীকারপূর্বক তার হস্ত চুম্বন করলেন। মুরাদ সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলেন। মুরাদের পুত্র ও উত্তরাধিকারী প্রথম বায়জীদের সময় সমগ্র এশিয়া মাইনর অটোমানদের অধিকারে আসে।

উল্লেখ্য ১৩৮৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত কুনিয়ের যুদ্ধে বায়েজীদ সর্বপ্রথম একজন সুদক্ষ সেনাপতি হিসেবে নিজ প্রতিভার পরিচয় প্রদান করেন। এই যুদ্ধের পর থেকেই তিনি নতুন উপাধি ‘ইলদ্রিম’ (অর্থাৎ বিদ্যুৎ) নামে আখ্যায়িত হন (ত্বরিত গতিতে কার্য সম্পাদন এবং সসৈন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনাগমনের জন্য)। ১৩৮৯ সালে প্রথম মুরাদের মৃত্যুর পর তিনি প্রথম বায়েজীদ (১৩৮৯-১৪০৩ খ্রি.) নাম নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। ১৩৮৯ সালের কসোভার যুদ্ধের পর সুলতান বায়েজীদ বিজিত রাজ্যে নিজ আধিপত্য স্থাপনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে এশিয়া মাইনরের আনাতোলিয়ায় অটোমানদের করদ ও মিত্র রজ্যের আমীরগণসহ অনেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলো। বাধ্য হয়ে বায়জীদ আনাতোলিয়ার বিদ্রোহ দমনে অগ্রসর হলেন। বস্তুত বায়েজীদই প্রথম অটোমান সুলতান যিনি এশিয়া মাইনর স্থায়িভাবে অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত করার জন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য যে, এই নীতিই ভবিষ্যতে তার শোচনীয় পরাজয় ও ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আনাতোলিয়ায় বায়েজীদ সর্বপ্রথম আইদিনের আমীর ঈসা বেগের বিরুদ্ধে সমর অভিযান পরিচালনা করেন। বায়েজীদের বিরুদ্ধে এককভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মতো সাহস ও ক্ষমতা ঈসার ছিল না। তাই তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আত্মসমর্পণ করে বায়েজীদকে কর দানে স্বীকৃত হলেন। কিন্তু বায়েজীদ ঈসা বেগের সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করে তাকে বন্দি করেন এবং আইদিন সরাসরি অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে যায়। ঈসা বেগ পরে বন্দি অবস্থায় ব্রুসায় মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার দুই পুত্র ইসা ও ওমর গোপনে পলায়ন করে তৈমুরের দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মুরাদের সময় থেকেই টেক্কি অটোমানদের করদরাজ্যে পরিণত হয়। কিন্তু মুরাদের মৃত্যু এবং পরবর্তী অটোমান সুলতান বায়েজীদ ইউরোপে ব্যস্ত থাকার সুযোগ নিয়ে টেক্কির আমীর বিদ্রোহী হলে বায়েজীদ তাকে শাস্তি প্রদানের জন্য অগ্রসর হন। ১৩৯১ খ্রিস্টাব্দে আদালিয়া নামক একটি বিশিষ্ট বন্দরসহ সমগ্র টেক্কি রাজ্য বায়েজীদের পদানত হয়। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী নদীবন্দরগুলোর মধ্যে আদালিয়াই সর্বপ্রথম অটোমান তুর্কিদের অধিকারে আসে।

আইদিন ও টেক্কি অধিকারের পর ১৩৯১ খ্রিস্টাব্দে বায়েজীদ আনাতোলিয়ার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত খ্রিস্টান অধিকৃত স্মার্না (Smyrna) দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু বেশ কিছু কারণে সেখানে আক্রমণ না করে বায়েজীদ অভিযান পরিচালনা করেন আনাতোলিয়ার সারুখান, মেন্টেশি ও কাস্তেমুনির আমীরদের বিরুদ্ধে। সারুখান ও মেন্টেশির আমীরদ্বয় বায়েজীদের অভিযান প্রতিরোধ করতে সাহস করলেন না। নিজেদের রাজ্য পরিত্যাগ করে তারা কাস্তেমুনির আমীরের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। বিনা যুদ্ধে এভাবে সারুখান ও মেন্টেশি অটোমান সুলতান বায়েজীদের অধিকারে এলো। সারুখান ও মেন্টেশির পলাতক আমীরদ্বয়কে আশ্রয় প্রদান করে কাস্তেমুনির আমীর বায়েজীদের বিরাগভাজন হলেন। ফলে ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে বায়েজীদ কাস্তেমুনি রাজ্য আক্রমণ করলেন। কাস্তেমুনির আমীর স্বরাজ্য ত্যাগ করে তৈমুরের দরবারে আশ্রয় নিলেন। অটোমান সৈন্যগণ পরিত্যক্ত কাস্তেমুনি রাজ্য দ্রুতগতিতে অধিকারে আনল। এর ফলে অটোমানদের জন্য কৃষ্ণসাগরে প্রবেশের একটি দ্বার উন্মােচিত হলো।

আনোতোলিয়ায় বিদ্রোহী রাজ্যগুলোর মধ্যে কারামানিয়াই ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। কারমানিয়ের আমীর আলাউদ্দিন মুরাদের জামাতা হলেও তিনি অটোমানদের আশ্রিত হতে প্রস্তুত ছিলেন না। কসোভার যুদ্ধের পর বায়েজীদ যখন সার্বিয়ানদের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত ছিলেন তখন এই সুযোগে আলাউদ্দিন বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং বাইশেহরি দখল করে একেবারে এসকি-শহর পর্যন্ত অগ্রসর হলেন। আলাউদ্দিনকে শাস্তি দেবার জন্য বায়েজীদ কারামানিয়া আক্রমণ করলেন এবং কোনিয়া অটোমান সেনাবাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে আলাউদ্দিন তাউরুস পর্বতে আশ্রয় নিলেন। কোনিয়া শহরটি বিশেষভাবে সুরক্ষিত ছিল। বায়েজীদ দেখলেন যে খুব সহজে অবরুদ্ধ কোনিয়া শহর আত্মসমর্পণ করবে না। এছাড়া এসময়ে ইউরোপে বায়েজীদের উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে পড়ায় আলাউদ্দিনের সন্ধি প্রস্তাবে রাজি হলেন। বিনিময়ে আলাউদ্দিন আক্-শহর ও আক-সেরাই নামক দুটো নগরসহ তার রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ বায়েজীদকে ছেড়ে দিলেন। বায়েজীদ এই নব-দখলকৃত অঞ্চল সেনাপতি তিমুরতাশের অধীনে রেখে রাজধানী অ্যাড্রিনোপলে প্রত্যাবর্তন করলেন। কিন্তু ১৩৯২ খ্রিস্টাব্দে বায়েজীদ যখন হাঙ্গেরির রাজা সিগিসমান্তের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন সেই সুযোগে আলাউদ্দিন অটোমানদের সাহত স্বাক্ষরিত সন্ধি ভঙ্গ করে আবার বিদ্রোহী হলেন। এবার তিনি অটোমানদের এশিয়া মাইনর থেকে বিতাড়িত করে এতদঞ্চলে নিজ প্রভুত্ব বিস্তারে স্বপ্ন দেখলেন। এবং এই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য আলাউদ্দিন অতর্কিতে অটোমান-বাহিনীকে আক্রমণ করে নিজ রাজ্যাংশ উদ্ধার করে নিলেন। অটোমান সেনাপতি তিমুরতাশ আলাউদ্দিনের হাতে বন্দি হলেন এবং কারামানিয়ান সেনাবাহিনী ব্রুসা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হলো। এই সংবাদে বায়েজীদ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে বিদ্যুৎ গতিতে সসৈন্যে ব্রুসায় উপস্থিত হলেন। বায়েজীদের সঙ্গে ছিল হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে সদ্যবিজয়ী অটোমান সেনাবাহিনী ও ইউরোপের করদরাজ্যের বহু সৈন্য-সমান্ত। ফলে আলাউদ্দিন বায়েজীদের সাথে ক্ষমতা পরীক্ষায় অবতীর্ণ থেকে সাহসী হলেন না। তিনি বন্দি অটোমান সেনাপতি তিমুরতাশকে বিনাশর্তে মুক্তি দিলেন এবং যুদ্ধ পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে রাজি হয়ে পুনরায় বার্যেজীদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু বায়েজীদ এই ধূর্ত ও সুযোগসন্ধানী আলাউদ্দিনকে চরম শিক্ষা দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বাধ্য হয়ে অবশেষে আলাউদ্দিনকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হলো। কোনিয়ার অদূরে অবস্থিত আক্-চাই (অর্থাৎ শুভ্র নদী) নদী তীরে উভয় পক্ষের মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে কারামানিয়ার আমীর আলাউদ্দিন পরাজিত ও বন্দি হলেন। আলাউদ্দিনের দুই পুত্র আলী এবং মুহাম্মদও পিতার সাথে বন্দি হলো। বন্দি অবস্থায় আলাউদ্দিনকে তিমুরতাশের সম্মুখে উপস্থিত করা হলে তিনি আক্রোশে ফেটে পড়লেন। কারণ জীবনে তিনি একবারই যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি ভোগ করেছেন এবং বলাবাহুল্য যে, এই পরাজয় ঘটেছিল কারামানিয়ার আমীর আলাউদ্দিনের কাছেই। তাই তিনি ক্ষোভে ও ঈর্ষায় এমনই উন্মত্ত হয়ে পড়লেন যে, আলাউদ্দিন কর্তৃক তাকে মুক্তিদানের কৃপার কথা পর্যন্ত তিনি ভুলে গেলেন। অতএব, বায়েজীদের সম্মুখে আলাউদ্দিনকে উপস্থিত করার পূর্বেই তিনি তাকে হত্যার আদেশ কার্যকরী করলেন। বায়জীদের ভগ্নীপতি হিসেবে তিনি আলাউদ্দিনকে ক্ষমা করে দিতে পারেন এই ধারণার বশবর্তী হয়েই তিমুরতাশ দ্রুত আলাউদ্দিনের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে ফেললেন। অত্যন্ত নিকটতম আত্মীয় হলেও বায়েজীদের কাছে আলাউদ্দিন ছিলেন তার এশিয়া মাইনর পদানত করার একমাত্র শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই তিমুরতাশের থেকে আলাউদ্দিনের মৃত্যুতে তিনি বিন্দুমাত্র শোকাভিভূত হলেন না, বরং নিজ ভগ্নীপতি হত্যার এই অপ্রীতিকর কাজ ও তার দায়িত্ব নিজেকে বহন করতে হলো বলে বোধকরি তিনি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর ফলে সমগ্র কারামানিয়া রাজ্য অটোমানদের অধিকারভুক্ত হলো। কিন্তু আক্‌ চাইএর বিজয় কিছু দিনের মধ্যেই অটোমানদের কাছে সাময়িক বিজয় বলে প্রতিপন্ন হলো। কারণ এই যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে যদিও কারামানিয়ানরা এশিয়া মাইনরের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের প্রতিপত্তি হারালো তবুও আগোরার যুদ্ধে তৈমুরের কাছে বায়েজীদের পরাজয়ের ফলে কারামানিয়া তৈমুরের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে টিকে ছিল। আক–চাই-এর যুদ্ধের পর দীর্ঘ সত্তর বছর পর সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদের সময় কারামানিয়া স্থায়ীভাবে অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

কারামানিয়া পদানত করার পর এশিয়া মাইনরে একমাত্র আমীর বুরহানুদ্দিন অপরাজিত রয়ে গেল। কারামানিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত হাসিল নদীর তীরবর্তী কায়সারিয়া ও সিভারস বুরহানুদ্দিনের রাজ্যভুক্ত ছিল। কারা উলুক নামক অটোমান সেনাপতির অধীনে একদল অটোমান সৈন্য সিভাস আক্রমণ করলে বুরহানুদ্দিন আর্মেনিয়ের পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করেন। পরে তিনি কারা উলুকের কাছে ধৃত হন এবং তাকে হত্যা করা হয়। ফলে সিভাস, টোকাট ও কায়সারিয়া বায়েজীদের অধিকারে চলে আসে।

তথ্যঋণ

  • উইকিপিডিয়া নিবন্ধ Mahmud I of Great Seljuq, Malik-Shah II, Seljuk Empire, Seljuq dynasty
  • মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাস (১২৫৮-১৮০০), আশরাফউদ্দিন আহমেদ, চয়নিকা প্রকাশনী, ঢাকা, অক্টোবর ২০১১, পৃ. ৯-৩৫
  • The Cambridge History of Islam. প্রথম খণ্ড, ক্যামব্রিজ, ১৯৭০
  • The Travels of Ibn Batuta. (ইংরেজি অনুবাদ এস. এইচ. গিব) ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৫৮
  • পি. উইটেক ; The Rise of the Ottoman Empire, খণ্ড ২৩, লণ্ডন, ১১৩৮
  • এস. লেইনপুল : The Mohammadan Dynasties.-বৈরুতে, ১৯৬৬

1 Trackback / Pingback

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.