বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতা, ১৪৫৩-তে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন এবং রেনেসাঁ, ভৌগলিক আবিষ্কার ও ইউরোপের ক্ষমতা-ভারসাম্যে এর প্রভাব

Table of Contents

পতনের পূর্বে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবস্থা ও কনস্ট্যান্টিনোপল পতনের কারণ

ভূমিকা

৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে বর্বর জার্মান আক্রমণে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। রােমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ভাঙ্গন ও বৈদেশিক আক্রমণ তার পতনের জন্য দায়ী ছিল। শেষ পশ্চিম রােমান সম্রাট রােমিউলাস অগাস্টিউলাস সিংহাসনচ্যুত হন। পশ্চিম ইউরােপে ‘অন্ধকার যুগ’ নেমে আসে, তবে পূর্ব ইউরােপে কনস্ট্যান্টিনােপলকে কেন্দ্র করে বাইজানসিয়াম (Byzantium) সাম্রাজ্য বা পূর্ব গ্রিক সাম্রাজ্য টিকে থাকে। এক হাজার বছর ধরে কনস্ট্যান্টিনোপল ছিল প্রাচ্যের রাজধানী, সভ্যতার কেন্দ্র এবং ঐশ্বর্যের জন্য বিখ্যাত। ল্যাটিন, স্লাভ, তাতার, তুর্কি সকলে এই শহরটি অধিকার করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। এই শহরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল প্রাচীন ঐতিহ্য, ঐশ্বর্য, নিরাপত্তা এবং খ্যাতি। নিজের অধীনে স্থাপন করে পাশ্ববর্তী উদীয়মান জাতিগুলি এসবের অধিকারী হতে চেয়েছিল। ১০ম শতক থেকে ল্যাটিন ও স্লাভরা এই নগরের প্রান্তসীমায় হানা দিতে শুরু করেছিল। ১১শ শতক থেকে পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা ও বাইরে বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ শুরু হয়। তুর্কিদের সঙ্গে লড়াইয়ে গ্রিক রাজারা পরাজয়ের সম্মুখীন হন। পূর্বদিকে এশিয়ার উপজাতিদের সঙ্গে সাম্রাজ্যের সংঘাত শুরু হয়েছিল, তাতাররা পশ্চিমে অভিপ্রয়াণ শুরু করেছিল। সাম্রাজ্যের উত্তরদিকে সম্রাটকে স্লাভ জাতির অন্তর্ভুক্ত বুলগার, সার্ব, কোমান ও অন্যান্য গােষ্ঠির লোকদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হতে হয়। ১২০৪ সালে ল্যাতিনরা বা ক্রুসেডাররা কনস্টান্টিনোপল দখল করে ব্যাপক লুণ্ঠনকার্য চালায় ও বাইজান্সিয়ামের পতন ঘটিয়ে ল্যাতিন সাম্রাজ্য গঠন করে। পরবর্তীতে পুনরায় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি পূর্বের শক্তি আর ফিরে পায়নি। ১৪শ শতকের প্লেগে এর আরো ক্ষতি হয়। সব মিলে কনস্ট্যান্টিনোপলের জনসংখ্যা ও শক্তি অনেক কমে যায়। পূর্ব রােমান সাম্রাজ্যের ওপর তুর্কিদের নানা গােষ্ঠি আক্রমণ হেনেছিল। এই তুর্কিরা মধ্য এশিয়া থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে অভিপ্রয়াণ শুরু করেছিল। এই তুর্কিদের একটি গােষ্ঠি অটোমান তুর্কিরা ১৪শ শতকে তুর্কিরা ধীরে ধীরে বলকান ও গ্রিক অঞ্চলগুলো দখল করে নিয়ে বাইজানসিয়ামকে দুর্বল করে দেয়। ১৪৫৩ সালে সম্রাট ১১শ কনস্ট্যান্টাইনকে পরাস্ত করে কনস্ট্যান্টিনােপল অধিকার করেছিল। এদের নেতৃত্ব দেন অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ (১৪৫১-৮১ খ্রি.)।

৪র্থ ক্রুসেড ও পশ্চিম ইউরোপের সাথে বাইজানসিয়ামের শত্রুতা

পশ্চিমী দেশগুলো ক্রুসেডের মাধ্যমে পুণ্যভূমি জেরুজালেম উদ্ধারের কথা ভেবেছিল। তারা বাইজানসিয়ামের শত্রু তুর্কিদেরও প্রতিহত করেছিল। ধর্মীয় আবেগ ছিল প্রথম তিনটি ক্রুসেডে। কিন্তু এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসে। এতদিন যাবৎ কনস্টান্টিনোপলের ওপর সমগ্র খ্রিস্টান জগতের একটা প্রগাঢ় ধর্মীয় আনুগত্য ও মমত্ববোধ ছিল, ফলে প্রতিবারই খ্রিস্টান জগৎ তুর্কি বাহিনীর হাত থেকে নগরীকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতো। কিন্তু বহুবার এভাবে কনস্টান্টিনোপলের সাহায্যে অগ্রসর হয়ে অপরাপর ইউরোপীয় খ্রিস্টান রাজন্যবর্গ ও জনসাধারণ দৈর্যহারা হয়ে পড়েছিল। চতুর্থ ক্রুসেডের সময় (১২০২ – ১২০৪ খ্রি.) অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চিন্তা-ভাবনা প্রাধান্য পেয়েছিল। ফলে পূর্বাপেক্ষা কনস্টান্টিনোপলের প্রতি তাদের আন্তরিক আকর্ষণও ক্রমাগত শিথিল হয়ে আসছিল। ভেনিসের সঙ্গে বাইজানসিয়ামের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, কনস্ট্যান্টিনােপলে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব চলেছিল। ভেনিস তার সুযােগ নিয়ে ক্রুসেডারদেরকে কনস্ট্যান্টিনােপল আক্রমণের পরামর্শ দিয়েছিল। কনস্ট্যান্টিনােপল লুষ্ঠিত হয়, এই ধাক্কা পূর্বে সাম্রাজ্য সামলাতে পারেনি, তার দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের ক্রুসেডাররা কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন ঘটায় ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে দিয়ে আধুনিক গ্রিস, বলকান ও কনস্ট্যান্টিনোপল সহ আধুনিক তুরস্কের কিছু অংশ নিয়ে ল্যাতিন সাম্রাজ্য (১২০৪ – ১২৬১ খ্রি.) নামে একটি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। তবে সেই সময় লাস্কারিস পরিবার নামে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের একটি অভিজাত পরিবার বর্তমান তুরস্কের একটি অংশ নিয়ে নাইকিয়া সাম্রাজ্য (Empire of Nicaea) (১২০৪ – ১২৬১ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করে, সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম থিওডোর লাস্কারিস (শাসনকাল – ১২০৪ – ১২২২ খ্রি.)। আধুনিক তুরস্কের বাকি অংশ সেলজুক তুর্কিদের অধীনে ছিল। নাইকিয়ান সাম্রাজ্যকে উপর্যুপরি বুলগেরিয়া, সেলজুক ও ল্যাতিন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। থিওডোর লাস্কারিসের পর সম্রাট হন তার জামাতা তৃতীয় জন ডোউকাস ভাটাৎজেস ( শাসনকাল – ১২২২ – ১২৫৪ খ্রি.)। তিনিই এই সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সফল সম্রাট ছিলেন। তিনি বুলগেরিয়াকে পরাজিত করেন ও ল্যাতিন সাম্রাজ্যের অনেক অঞ্চল দখল করেন। তার পুত্র ২য় থিওডোর লাসকারিস ১২৫৮ সাল পর্যন্ত শাসক ছিলেন, কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার শিশুপুত্র ৩য় জন লাস্কারিস সম্রাট হন। শিশু ছিলেন বলে তিনি সেনাধ্যক্ষ ৮ম মাইকেল প্যালিওলোগাসের রিজেন্সিতে থাকেন, প্রকৃত ক্ষমতা ছিল মাইকেলের হাতেই। ১২৫৯ সালে তিনি নিজেকে “সহ-সম্রাট” ঘোষণা করেন। রবার্ট অফ কোউর্টনির শাসনকাল অবধি ১২২৮ সাল পর্যন্ত ল্যাতিন সাম্রাজ্যের অবস্থা ভালই ছিল, কিন্তু তার মৃত্যুর পর ল্যাতিন সাম্রাজ্যের পতন হতে থাকে, উপর্যুপরি বুলগেরিয়া ও নাইকিয়া সাম্রাজ্যের আক্রমণে ল্যাতিন সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে। ১২৬০ সালে মাইকেল জেনোয়ার সাথে মিলে কনস্ট্যান্টিনোপলে আক্রমণ করেন। ল্যাতিনদের মিত্র ভেনিস ছিল জেনোয়ার শত্রু। এরপর ১২৬১ সালে ৮ম মাইকেল প্যালিওলোগাসের অধীনে পুনরায় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি ১২৮২ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত এই প্যালিওলোগাস রাজবংশই বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের শাসক ছিল। ১৪৫৩ সালে যে বাইজান্টাইন সম্রাটের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন হয়েছিল সেই একাদশ কনস্ট্যান্টাইন (শাসনকাল ১৪৪৮ – ১৪৫৩) ছিলেন এই রাজবংশের ১২শ সম্রাট। চতুর্থ ক্রুসেডের ক্রুসেডারগণ ও তৎপরবর্তি ল্যাটিন এম্পায়ার ও এর সাথে অন্য শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের মাধ্যমে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের যে ক্ষতি হয় তা পরবর্তীতে প্যালিওলোগাস রাজবংশের দ্বারা গঠিত নতুন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য কখনই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পিয়ার্স লিখেছেন যে ১২০৪ খ্রি. ঘটনাটি ছিল এর পতনের পূর্বাভাস। ১২০৪ সালের এই ঘটনার পর কনস্ট্যান্টিনােপলের দুর্বলতা বিদেশীদের কাছে ধরা পড়ে যায়। রান্সিম্যান, এডউইন আর্নল্ড ও এডউইন পিয়ার্স জানিয়েছেন যে ১৪৫৩ সালে তুর্কিদের আক্রমণে কনস্ট্যান্টিনােপলের পতনের সময় কনস্টান্টিনােপলের জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল এক লক্ষে (অনেকের মতে ৫০ হাজারে), এর মধ্যে মাত্র ছয় থেকে আট হাজার লােক তুর্কিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। চতুর্থ ক্রুসেডের ভয়াবহতা ছাড়াও ১৪শ শতকের প্লেগেরও নগরের দুর্বলতা ও জনসংখ্যা হ্রাসের সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। এই প্লেগ ও ক্রুসেডই এই শহরের ওপর ধর্মযােদ্ধাদের আক্রমণ এর পতনের সূচনা করেছিল। বাইজান্টাইন সম্রাটদের মধ্যকার গৃহবিবাদও ছিল এই সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির দুর্বলতার অন্যতম কারণ।

প্যালিওলোগাস রাজবংশের শাসনের সময় খ্রিস্টীয় প্রতিবেশী ও চার্চের সাথে দ্বন্দ্ব

নতুন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। উপর্যুপরি বৈদেশিক আক্রমণ তো আছেই, সেই সাথে ছিল গৃহযুদ্ধ ও বিদ্রোহ। ৮ম মাইকেলের সময় (রা. ১২৫৯-১২৮২ খ্রি.) মঙ্গোল আক্রমণে সেলজুক তুর্কিরা বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই মুসলিমরা তার থ্রেট ছিল না, থ্রেট ছিল খ্রিস্টানরাই। ফ্র্যাংক ও ভেনিশীয়রা পুনরায় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ওপর আক্রমণ হানতে পারেন। ফ্রান্সের প্রোভেন্স (বা প্রভাঁস) এর কাউন্ট ১ম চার্লস সিসিলি অধিকার করে নিলে ভয় আরও বেড়ে যায়। এদিকে পোপ ৪র্থ ক্লিমেন্ট ঘোষণা করেছিলেন চার্লস কনস্ট্যান্টিনোপলে অভিযান চালালে তাকে ভূমিদান করা হবে। তবে চার্লস অভিযানে দেরি করলে মাইকেল ১২৭৪ সালে রোমান চার্চের সাথে সন্ধি করে ফেলেন। কিন্তু এরপর চতুর্থ মার্টিন পোপ হলে পুনরায় আগের হুমকি ফিরে আসে। এইসময় আরাগনের ৩য় পিটার সিসিলিতে চার্লসের বিরুদ্ধে অবরোধ করতে চাইলে মাইকেল তাতে আর্থিক সহায়তা দান করেন। ফলে ১২৮১ সালে সিসিলি থেকে চার্লস ক্ষমতাচ্যূত হন ও আরাগনের রাজা ৩য় পিটার সিসিলির ক্ষমতায় আসেন, সেবারের মত বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বেঁচে যায়। এছাড়া মাইকেল গ্রিস ও বলকান অঞ্চলে ল্যাতিন ও বুলগেরিয়ার সাথে যুদ্ধ করে সাফল্য লাভ করেছিলেন। তবে গ্রিক ও বলকান অঞ্চলের স্লাভ ও বুলগার শাসকগণ বরাবরই বাইজানসিয়ামের জন্য হুমকি ছিল, এরা খ্রিস্টীয় অঞ্চলই ছিল। ৪র্থ ক্রুসেডের পূর্বেও বাইজানসিয়ামকে এদের সাথে যুদ্ধবিগ্রহে জড়িত থাকতে হয়। এছাড়া তাতার-মোঙ্গলরাও বাইজানসিয়ামের জন্য হুমকি হয়ে এসেছিল। এদিকে পশ্চিমের রােমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে পূর্বের গ্রিক চার্চের সম্পর্ক ভালাে ছিল না। এর কারণ হল দুই চার্চের মধ্যে নীতিগত বিরােধ ছিল। গ্রিক চার্চের মরমিয়াবাদ পশ্চিমের চার্চ নেতারা সমর্থন করেননি। ১২০৪ খ্রি. পশ্চিমের প্ররােচনায় ক্রুসেডাররা কনস্টান্টিনােপল আক্রমণ করলে পশ্চিমের প্রতি গ্রিক চার্চের শত্রুতা আরও বেড়েছিল। গ্রিক চার্চের মধ্যেও বিভেদ ছিল। ১৪৩৯ সালে দুই চার্চের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়। সম্রাট অষ্টম জন সমন্বয় ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারেননি। গ্রিক চার্চের কাছে মনে হয়েছিল ঐক্যের অর্থ হল পশ্চিমের কাছে আত্মসমর্পণ, গ্রিক যাজকেরা তাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের লােকেরা আত্মসমর্পণের চেয়ে বিধর্মীদের অধীনস্থ হওয়াকে বাঞ্ছনীয় মনে করেছিল। পশ্চিমের কর্তৃত্ব তাদের কাছে একেবারেই গ্রহণযােগ্য ছিলনা। গ্রিক চার্চের এই নীতি অনেকে মনে করেন বাইজানসিয়ামের পতনের একটি কারণ। এসব কারণে তুর্কিরা কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ করলে পশ্চিম থেকে সাহায্য আসেনি। খ্রিস্টানদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও অসহিষ্ণুতার ফলে কনস্টান্টিনোপলের এই মহাবিপদে একে অপরের সাহায্যে অগ্ররস হতে ইতস্তত করছিল।

অটোমানদের এগিয়ে আসা এবং গ্রিক ও বলকান অঞ্চল দখল

এই পরিস্থিতিতে একাধিক কারণে অটোমানরা কনস্টান্টিনোপল দখলের সুযোগ লাভ করে। নিকট প্রাচ্যে আনাতােলিয়া অঞ্চলে তুর্কিরা রাজপাট স্থাপন করেছিল। দলে দলে তুর্কিরা আনাতােলিয়ায় প্রবেশ করে পূর্ব রােমক সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছিল। এই অঞ্চলে প্রথম সামরিক অভিযান চালিয়েছিল সেলজুক তুর্কিরা। ১০৭১ সালের মাঞ্জিকার্টের যুদ্ধে বাইজানসিয়ামকে পরাস্ত করে সেলজুকরা এখানে রাজ্য স্থাপন করেছিল। সেলুজকরা শাসনকার্যে দক্ষ ছিল না। এখানকার উপজাতিদের নিয়ে তারা শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। মােঙ্গল আক্রমণে এই রাজ্যটি দুর্বল হয়ে পড়েছিল, অধীনস্থ জাতিগুলি সেলজুকদের মানত না। এই অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে অটোমান তুর্কিরা আনাতােলিয়ায় ক্ষমতা দখল করেছিল। প্রথম অটোমান সুলতান ওসমান (১২৯০-১৩২৬ খ্রি.) অটোমান সুলতানির প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরােপের বলকান অঞ্চলে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। অটোমান সুলতানরা নাইকিয়া ও নিকোমিডিয়া অধিকার করে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল। ১৪শ শতকে অটোমান তুর্কিরা গ্রিসের রুমেলিয়া প্রদেশটি আক্রমণ করেছিল, এতে সাম্রাজ্য আরও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তুর্কিরা আনাতােলিয়া (এশিয়া মাইনর) অধিকার করে নিলে পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য আরও সংকটের মধ্যে পড়েছিল। বাইজান্টাইন সৈন্যবাহিনীর বেশিরভাগ সৈন্য এই অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হত। সাম্রাজ্য এর পর থেকে ভাড়াটে, ভাগ্যান্বেষী সৈনিকদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়, এতে রাজকোষের ওপর চাপ পড়েছিল। সম্রাট তার দুর্গগুলি সুসজ্জিত রাখতে পারেননি। তুর্কিরা যখন কনস্ট্যান্টিনােপল আক্রমণ করেছিল, দুর্গগুলির অনেকাংশ এবং শহরের দেওয়ালগুলি ভগ্নদশায় ছিল। ১৫শ শতকের গােড়াতে মােঙ্গলরা আবার এই অঞ্চলে হানা দিয়েছিল, তাতে অটোমান সুলতানির বিশেষ ক্ষতি হয়নি। অটোমান সুলতানরা মােঙ্গল আক্রমণের পর দ্রুত তাদের শক্তিকে সংহত করেন, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরােপে সম্প্রসারণের সুযােগ খুঁজতে থাকেন। বলকান অঞ্চলে সার্বিয়া ও বুলগেরিয়া নতুন রাজ্য স্থাপন করেছিল, কিন্তু এই রাজ্য দুটি ছিল দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন। তুর্কি আক্রমণের সম্ভাবনা তারা অনুমান করতে পারেনি। সার্বিয়াকে শাস্তিদানের জন্য বাইজান্টাইন সম্রাট জন কান্টাকুজিন (John Cantacuzene) অটোমান সৈন্যবাহিনীর সাহায্য চান। এই পদক্ষেপটি ছিল সম্রাটের পক্ষে এক মারাত্মক ভুল। ভুল বুঝতে পেরে সম্রাট তুর্কিবাহিনীকে বিতাড়নের জন্য সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ার সাহায্য চেয়েছিলেন। সার্বিয়া ও বুলগেরিয়া তাকে সাহায্য পাঠায়নি। অটোমান সুলতান আরাে সৈন্য বলকান অঞ্চলে পাঠালেন। বাইজান্টাইন সম্রাট ও বলকান রাজ্যগুলো যৌথভাবে তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। একশাে বছর ধরে লড়াই চলেছিল। তুর্কি বাহিনী সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ার বাহিনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল। এরপর অটোমানরা সার্বিয়া ও বুলগেরিয়াকে দখল করে নেয়। এরফলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের আশেপাশের সকল অঞ্চল অটোমানদের হস্তগত হয়ে যায় ও সাম্রাজ্য আরও বেশি হুমকির মুখে পড়ে। এদিকে মধ্য ইউরোপের তৎকালীন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্য হাঙ্গেরিকে সুলতান প্রথম বায়েজীদ নিকোপলিসের যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের মনে অটোমান শক্তি সম্বন্ধে ভীতির সৃষ্টি করেছিলেন। হাঙ্গেরির বীর সেনাপতি জন হুনিয়াদির নেতৃত্বে তারা অটোমানদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েকটি সংঘর্ষে জয়লাভ করলেও অচিরেই ঐতিহাসিক ভার্নার যুদ্ধে দ্বিতীয় মুরাদ হুনিয়াদির নেতৃত্বে সম্মিলিত খ্রিস্টান শক্তিকে পরাজিত করেন। ফলে তুর্কি শক্তির বিরুদ্ধে তাদের সর্বশেষ অভিযান চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। বস্তুত সুলতান বায়েজীদমুরাদের হাতেই ইতোপূর্বে কনস্টান্টিনোপলের পতন হতো, যদি না এসময়ে অটোমানদের বিরুদ্ধে এশিয়া মাইনরে তৈমুরের আক্রমণ, জ্যানিসারি বাহিনীর বিক্ষোভ এবং অপরাপর সেলজুক তুর্কি আমীরদের বিদ্রোহ দেখা না দিত। এইসব ঘটনা অটোমানদের কনস্ট্যান্টিনোপল জয় বিলম্বিত করলেও বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। দ্বিতীয় মুহম্মদের সময় তিনি এশিয়া মাইনরে ও মধ্য-ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন এবং সর্বশক্তি নিয়োগ করে কনস্টান্টিনোপল আক্রমণ করেন। প্রকৃতপক্ষে বাইজান্টাইন সম্রাটের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি এসময়ে কেবলমাত্র কনস্টান্টিনোপলের সুরক্ষিত প্রাচীরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তাই বলা যায়, দ্বিতীয় মুহম্মদের জন্য কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ক্ষেত্র আগে থেকেই মোটামুটিভাবে প্রস্তুত হয়েছিল। এদিকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে অন্যান্য খ্রিস্টীয় শক্তি ও রোমান ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে বৈরিতা থাকায় তাদের থেকেও আর সাহায্য আসেনি। সব মিলে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন অনিবার্য হয়ে যায়।

দ্বিতীয় মহম্মদের নেতৃত্ব ও সামরিক কৌশল

উল্লিখিত কারণগুলোর জন্য এটা মনে করলে ভুল হবে যে কনস্টান্টিনোপল দখলের কাজ দ্বিতীয় মুহম্মদের পক্ষে একেবারেই সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল। কারণ কনস্টান্টিনোপলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মুহম্মদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ও যুদ্ধের ঘটনাবলিই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কাজেই কনস্টান্টিনোপল বিজয়ে তুর্কি সৈন্যদের বীরত্ব এবং ব্যক্তিগতভাবে সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদের সামরিক প্রতিভা কোনক্রমেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। উপরের ফ্যাক্টরগুলো ছাড়াও অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদের নেতৃত্ব, সামরিক কৌশল এবং সৈন্যবাহিনী তুর্কিদের বিজয় সম্ভব করেছিল। মহম্মদ মনে করেন কনস্ট্যান্টিনােপল জয় করলে তিনি শুধু ঐশ্বর্যের অধিকারী হবেন তা নয়, তিনি সীমাহীন খ্যাতি ও গৌরব লাভ করবেন। রােমান রাজধানী অধিকার করলে তার সাম্রাজ্য নিরাপদ হবে, সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটানাে সহজ হবে। কনস্ট্যান্টিনােপল এসব সম্ভাবনার পথ রােধ করে দাঁড়িয়ে আছে। সমকালীন লেখকেরা জানাচ্ছেন যে তিনি মনে করেছিলেন, রাজধানী অধিকার করে তিনি রােমানদের বিশ্বজনীন সাম্রাজ্যিক ঐতিহ্যের অধিকারী হবেন। হয়তাে তিনি খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের ওপর কর্তৃত্বের কথাও ভেবেছিলেন। কনস্ট্যান্টিনােপলের ওপর আক্রমণ চালানাের আগে তিনি বসফোরাসের পশ্চিম দিকে দুর্গ বানিয়েছিলেন। এই স্থানটি ছিল সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুর্গ নির্মাণের ফলে প্রণালীর উভয় তীরে তুর্কি বাহিনী মােতায়েন করা সম্ভব হয়, প্রণালীর ওপর মহম্মদের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। কনস্ট্যান্টিনােপলের চতুর্দিকে যে দুর্গ প্রকার ছিল মহম্মদের শক্তিশালী গােলন্দাজ বাহিনী তা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি বাজধানীর অবরােধ দীর্ঘস্থায়ী হতে দেননি, মাত্র পঞ্চাশ দিন অবরােধের পর ১৪৫৩ সালের ২৯ মে তিনি প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে রাজধানী অধিকার করেন। কনস্ট্যান্টিনােপল বাইরে থেকে সাহায্য পায়নি, শুধু জেনােয়া থেকে চারটি স্যালিতে করে কিছু সৈন্য এসেছিল। মহম্মদের দৃঢ়তা, বীরত্ব ও নেতৃত্ব এই জয়ের জন্য দায়ী ছিল। বাইজান্টাইন সম্রাটের পক্ষে মাত্র ছয় থেকে আট হাজার সৈন্য যুদ্ধ করেছিল। অপরদিকে মহম্মদের সঙ্গে ছিল মােট দেড়লক্ষ লােক, এর মধ্যে পঞ্চাশ হাজার ছিল নিয়মিত সৈন্য। যুদ্ধ জয়ের পর তিনি তার সৈন্যদের তিনদিন ধরে শহর লুট করতে দেন, তারপর শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। শহরের সবচেয়ে বড়াে চার্চ আয়া সােফিয়া (Hagia Sophia)-তে গিয়ে তিনি প্রার্থনা করেন, এটি মসজিদে পরিণত হয়। রাজধানীর নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন ইস্তামবুল। তুর্কিরা ইউরােপে এসে হাজির হয়, ইউরােপের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর এর প্রভাব পড়েছিল। গ্রিকরা শহর ছেড়ে পালিয়েছিল। ইউরােপীয় রাজনীতির ওপর তুরস্কের প্রভাব অব্যাহত ছিল।

কনস্টান্টিনোপল বিজয় (১৪৫৩ খ্রি.)

কনস্টান্টিনোপলের পত্তন ও গুরুত্ব

অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল বিজয় এককভাবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা (বিস্তারিত পাঠের জন্য দ্রষ্টব্যঃ The Fall of Constantinople, 1453 : স্টিভেন রানকিনম্যান, ক্যাম্বরিজ, ১৯৬৫)। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত রোমান সম্রাট কন্সটান্টাইন বসফোরাস প্রণালীর উপকূলবর্তী প্রাচীন গ্রিক শহর বাইজান্টিয়ামের ওপর তার সাম্রাজ্যের জন্য একটি নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন। তিনি এই নবনির্মিত নগরীর নাম রাখেন নোভা রোমা—অর্থাৎ নতুন রোম। কিন্তু অচিরেই এই শহর সম্রাটের নাম অনুসারে কনস্টান্টিনোপল হিসেবে পরিচিত হয়। সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে বলকান প্রদেশগুলোর ওপর কার্যকরী শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কনস্টান্টিনোপলের গুরুত্ব তিনি বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট থিওডোসিয়াস রোমান সাম্রাজ্যকে তার দুই পুত্রের মধ্যে বিভক্ত করে দেবার পরবর্তী সময় থেকেই পৃথকভাবে পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। এই নতুন সাম্রাজ্যটি গ্রিক অথবা বাইজান্টাইন-এই উভয় নামেই পরিচিত ছিল। কালক্রমে এই নতুন সাম্রাজ্যই মূল রোমান সাম্রাজ্যের থেকে বেশি শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ালো এবং কনস্টান্টিনোপল এর রাজধানীর মর্যাদা লাভ করল। এছাড়া খ্রিস্টধর্মের পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিক চার্চের প্রাণকেন্দ্র হিসেবেও কনস্টান্টিনোপল বর্ধিত সম্মানের অধিকারী হলো। কনস্টান্টিনোপল ছিল মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং বহু শতাব্দী ধরে এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিল। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত বলে কনস্টান্টিনোপলের ভৌগোলিক ও অবস্থানিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এছাড়া কনস্টান্টিনোপলের নগর পরিকল্পনা এমনই ছিল যে, এশিয়া থেকে এর বিরুদ্ধে আক্রমণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই কনস্টান্টিনোপলকে ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করে বাইজান্টাইনগণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে আসছিল।

রাশেদুন, উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের ব্যর্থতা

মুসলমান খলিফাগণ কনস্টান্টিনোপলের সার্বিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে এটি জয় করার জন্য প্রথম থেকেই সচেষ্ট ছিলেন। ৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমানের খিলাফতের আমলে তার অধীনে সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম কন্সটান্টিপলের বিরুদ্ধে সমর অভিযান প্রেরণ করেন। এশিয়া মাইনর হয়ে এই বাহিনী বসফোরাস প্রণালী পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। ঠিক একই সময় বুস্‌র, বিন-আলতাহ্-এর নেতৃত্বে আরও একটি আরব মুসলিম সেনাবাহিনী ত্রিপলি থেকে সমুদ্রপথে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের প্রচেষ্টা চালায়। গ্রিক সম্রাট দ্বিতীয় কন্সটান্টাইনকে একটি নৌযুদ্ধে পরাজিত করে সেনাপতি বুস্‌র সামনের দিকে অগ্ররস হন (ইবন-উল-আসির, “আল-কামীল” তৃতীয় খণ্ড, পৃঃ ৫০। ঐতিহাসিক থিওফেন্সের এই মতামত ফিনলে তার ‘Greece under the Romans’ শীর্ষক পুস্তকে সমর্থন করেছেন। মুহম্মদ আবদুল্লাহ ইনান কর্তৃক তার ‘Decisive Moments in the History of Islam’ নামক পুস্তকেও উদ্ধৃত, লাহোর, ১৯৪৯, পৃঃ ৩১।)। কিন্তু তার নৌবাহিনীর বিশেষ ক্ষয়-ক্ষতির ফলে তিনি এই অভিযান বর্জন করতে বাধ্য হন। দামেস্কের উমাইয়া খলিফা হিসেবে মুয়াবিয়া তার পুত্র ইয়াজিদের নেতৃত্বে ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো প্রচেষ্টা চালান। উমাইয়া বংশের খলিফা সুলাইমানের আমলেও সেনাপতি মাসলামার নেতৃত্বে আরব মুসলিম বাহিনী ৭১৭ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু এই আক্রমণ চলাকালে হঠাৎ সুলাইমানের মৃত্যু হলে সেনাপতি মাসলামা খলিফার কাছ থেকে অতিরিক্ত সাহায্য পেতে ব্যর্থ হন। এছাড়া পরবর্তী উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওমর নীতিগতভাবে সমস্ত বৈদেশিক যুদ্ধ বর্জন করেন। ফলে বাধ্য হয়ে খলিফার নির্দেশ অনুসারে সেনাপতি মাসলামাকে কনস্টান্টিনোপল অবরোধ প্রত্যাহার করতে হয়। সুতরাং কনস্টান্টিনোপলের বিরুদ্ধে আরব মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত তিনটি অভিযানই পর পর এভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যায়। এই ব্যর্থতার পেছনে অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে দামেস্ক থেকে কনস্টান্টিনোপলের অতি- দূরত্ব ও নৌযুদ্ধে আরবদের অনভিজ্ঞতাই প্রধানতম বলে মনে হয়। উমাইয়াদের পর বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে হারুন-অর-রশীদও কনস্টান্টিনোপল অধিকারের চেষ্টা করেন। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের শত্রু ফ্রান্সিয়ার শ্যার্লিম্যানের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে তিনি তার উদ্দেশ্য অর্জনের প্রয়াস পান। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টাও সার্থক হয়নি।

অটোমান সুলতানদের ব্যর্থতা

১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খিলাফতের পতনের পর অবশেষে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের কাজ তুরস্কের অটোমান সুলতানদের ওপর ন্যস্ত হয়। অটোমান সুলতানগণও কনস্টান্টিনোপল অধিকারের প্রয়োজনীয়তা পূর্বাপেক্ষা আরও বেশি করে উপলদ্ধি করেছিলেন। কারণ মুসলমান সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে তুরস্কের অটোমানগণই সর্বপ্রথম প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয় শক্তি হবার স্বপ্ন দেখছিলেন। কাজেই তাদের এই স্বপ্ন সফল করার জন্য কনস্টান্টিনোপল অধিকার করা তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। কারণ এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের দুই অংশের ওপর অবস্থিত অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিরাপদ করার জন্য কনস্টান্টিনোপল তাদের অধিকারে আনয়ন করার প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হয়। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের জন্য অটোমান সুলতানদের মধ্যে সর্বপ্রথম বাস্তব ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সুলতান প্রথম বায়েজীদ। ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেন। কিন্তু এসময়ে হাঙ্গেরির রাজা সিগিসমান্তের নেতৃত্বে সম্মিলিত খ্রিস্টান শক্তি একত্র হয়ে বায়েজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি সাময়িকভাবে কনস্টান্টিনোপল অবরোধ মুলতবি রেখে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য অগ্রসর হন। নিকোপলিসের যুদ্ধে বায়েজীদ সম্মিলিত খ্রিস্টান শক্তিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে পুনরায় কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেন। এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর এই অবরোধ অব্যাহত থাকার পর বায়েজীদের কাছে কনস্টান্টিনোপল নগরীর পতন যখন অনিবার্য ও আসন্ন হয়ে দাঁড়ালো তখন হঠাৎ মধ্য-এশিয়ার দিগ্বিজয়ী তৈমুর এশিয়া মাইনরে তুর্কি সাম্রাজ্য আক্রমণ করলে ঘটনা সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। বাধ্য হয়ে বায়েজীদকে তৈমুরের অগ্রগতি রোধ করার জন্য এশিয়া মাইনরে চলে আসতে হয়। ফলে কনস্টান্টিনোপল অবরোধ তাকে প্রত্যাহার করতে হয়। সুলতান বায়েজীদ প্রতিটি অটোমান সৈন্যকে এশিয়া মাইনরে তৈমুরের বিরুদ্ধে সন্নিবেশিত হবার নির্দেশ দেন। কিন্তু ১৪০২ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক আঙ্গোরার যুদ্ধে বায়েজীদ তৈমুরের কাছে পরাজিত, বন্দি ও পরে বন্দি অবস্থায় তার মৃত্যু হলে অটোমান সাম্রাজ্যের অকাল মৃত্যুসংকেত ধ্বনিত হয়। এর ফলে নিতান্তই ঘটনাচক্রে তুর্কিদের হতে কনস্টান্টিনোপলের পতন অর্ধ শতাব্দীর জন্য বিলম্বিত হয়ে যায়। আর সৌভাগ্যবশত এই বংশের পরবর্তী সুলতান প্রথম মুহম্মদ নিজ প্রতিভাবলে তুর্কি সাম্রাজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হন। ফলে দ্বিতীয় মুরাদ ১৪২৩ খ্রিস্টাব্দে নতুন করে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ে মনোনিবেশ করেন। সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের এই কন্সটান্টিপোল অবরোধ তার পূর্ববর্তী সুলতানদের চেয়ে আরও জোরদার করা হয়। কিন্তু নানা কারণে এই বিজয় গৌরব তার পক্ষেও লাভ করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে দ্বিতীয় মুরাদের পুত্র দ্বিতীয় মুহম্মদই কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের গৌরবের অধিকারী হন।

দ্বিতীয় মুহম্মদের কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণের কারণসমূহ

সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল আক্রমণের কয়েকটি পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণ রয়েছে। সিংহাসনে উপবেশন করে সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদও কনস্টান্টিনোপলের গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন এবং পূর্বপুরুষদের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার জন্য বদ্ধপরিকর হন। একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী সুলতান হিসেবে দ্বিতীয় মুহম্মদ দেখলেন যে, তার পূর্বপুরুষগণ উপর্যুপরি কয়েকটি চূড়ান্ত যুদ্ধে সম্মিলিত ইউরোপীয় খ্রিস্টান শক্তিকে পরাজিত করেও তাদেরকে অটোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা থেকে বিরত রাখতে পারেননি। বলকান শক্তিগুলো বার বার পরাজিত হয়ে তুর্কিদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হলেও তারা কখনও এই সন্ধির মর্যাদা রক্ষা করেনি। তাই কনস্টান্টিনোপল অধিকার করে তাকে যুদ্ধের ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারলেই কেবল ইউরোপে অটোমান শক্তি সুদৃঢ় ও নিরাপদ হবে। এসময়ে কনস্টান্টিনোপলের সম্রাট ছিলেন ১১শ কন্সটান্টাইন। তিনি সাহসী ও দেশপ্রেমিক হলেও তার মধ্যে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অভাব ছিল। অটোমান সূত্র অনুসারে তিনি যুবক সুলতান মুহম্মদের শক্তি ও সামর্থ্যকে ভুল বুঝে তার বিরুদ্ধে এক হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। এবং এটিই ছিল সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ কর্তৃক কনস্টান্টিনোপল আক্রমণের সর্বশেষ প্রত্যক্ষ কারণ। বাইজান্টাইন সম্রাট কন্সটান্টাইন তুর্কি সুলতান মুহম্মদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করার একটি চমৎকার সূত্র আবিষ্কার করেন। তিনি একজন ভণ্ডকে সুলতান বায়েজীদের পুত্র হিসেবে পরিচয় দিয়ে সুলতান মুহম্মদের কাছে তার ভরণপোষণের জন্য অর্থ বরাদ্দের দাবি করে বসেন। এবং এই দাবি সুলতান কর্তৃক অগ্রাহ্য করা হলে তিনি উক্ত ভণ্ডকে তুর্কি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে সুলতানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তার পক্ষ অবলম্বন করবেন বলেও শাসিয়ে দেন। সুলতান মুহম্মদ বাইজান্টাইন সম্রাটের এই দাবি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাকে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন।

কনস্ট্যান্টিনোপল জয়ের জন্য প্রস্তুতি

সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ কনস্টান্টিনোপল জয় করার জন্য সম্ভাব্য সব রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগলেন। কিন্তু তার এই প্রস্তুতি ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে গোপন রাখা হলো। একবার কোন এক ব্যক্তি সুলতান মুহম্মদকে তার ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিল। প্রত্যুত্তরে মুহম্মদ বলেছিলেন, “যদি আমার একটি কেশ পর্যন্ত আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে আভাস পায় তবে তা আমি তখনই উপড়িয়ে ফেলি” (এস. লেনপুল : Turkey, নিউইয়র্ক, ১৮৮৮, তৃতীয় সংস্করণ, পৃঃ ১০২)। বস্তুত সুলতান মুহম্মদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে এই “সমপূর্ণ গোপনীয়তা ও দ্রুত কার্য সম্পাদনই তার সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করেছিল” (তদেব, পৃঃ ১০২)। সুলতান মুহম্মদ কনস্টান্টিনোপলের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করার আগে সাম্রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্ত থেকে বিদ্রোহের সম্ভাব্য সকল কারণ দূরীভূত করলেন। এসময়ে তিনি হাঙ্গেরির সেনাপতি হুনিয়াদির সাথে তিন বছর মেয়াদী একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং এই সঙ্গে এশিয়া মাইনরের পুর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। কনস্টান্টিনোপল থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে অবস্থিত রুমেলি হিসার নামে তিনি একটি শক্তিশালী ও সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করলেন। এক হাজার রাজমিস্ত্রি ও এক হাজার শ্রমিক দিন রাত কাজ করে মাত্র তিন মাসের মধ্যে এই দুর্গ নির্মাণের কাজ শেষ করে। ত্রিশ ফুট প্রশস্ত প্রাচীর বিশিষ্ট এই দুর্গের ওপর দূলপাল্লার ভারি কামান বসান হয়। বসফোরাস প্রণালীর জলপথ নিয়ন্ত্রণ করাই এই কামান-বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল। এছাড়া চারশো লোকের একটি দলকে সুলতান বসফোরাস প্রণালীর জলপথে চলাচলকারী নৌযানগুলো থেকে খাজনা আদায় করার জন্য নিয়োগ করলেন। প্রথম থেকেই অটোমান সুলতানগণ নৌবাহিনীর অপ্রতুলতার সম্মুখীন হয়ে আসছিলেন। বস্তুত তুর্কিদের নৌযুদ্ধের ব্যাপারে কোন ঐতিহ্যও ছিল না। ইতোপূর্বে সাধারণত ভাড়াকৃত যুদ্ধ-জাহাজ দিয়েই অটোমান নৌবাহিনী গঠন করা হতো। কিন্তু যুদ্ধের সময় প্রয়োজনীয় যুদ্ধ জাহাজ সরবরাহ না পাওয়া গেলে ভীষণ অসুবিধা হতে পারে এই চিন্তা করে সুলতান মুহম্মদ নৌবাহিনী সম্প্রসারণ করার দিকে দৃষ্টি দিলেন। সুলতানের নির্দেশ ও ব্যক্তিগত তদারকের ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় তিনশো রণতরী-বিশিষ্ট একটি বিশাল নৌবহর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। অতঃপর সব রকম প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন করে সুলতান মুহম্মদ প্রায় ১,৭০,০০০ জনের নানা ধরনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত একটি বিশাল-বাহিনী নিয়ে কনস্টান্টিনোপল অবেরাধ করলেন। সুলতানের সেনাবাহিনীর মধ্যে আরবান নামে হাঙ্গেরির একজন সমরাস্ত্র নির্মাণকার্যে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তার সাহায্যে সুলতান একটি প্রকাণ্ড কামান প্রস্তুত করলেন। এই কামানটি ব্রোঞ্জ দ্বারা নির্মিত ছিল এবং এটি একসঙ্গে ১২০০ পাউন্ড গোলা নিক্ষেপ করতে পারতো। সেই আমলে এটিই সর্বাপেক্ষা কার্যকর ও শক্তিশালী কামান ছিল বলে মনে করা হয়।

কনস্টান্টিনোপলের তদকালীন অবস্থা ও একে রক্ষার জন্য কনস্টান্টাইনের গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ

বাইজান্টাইন সম্রাট কন্সটান্টাইনও তার রাজধানী রক্ষার্থে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন খাটি দেশপ্রেমিক ও বীরপুরুষ ছিলেন। কিন্তু তার শক্তি ও সম্বল একান্তভাবেই সীমিত ছিল। পশ্চিম ইউরোপীয় খ্রিস্টান নরপতিদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তিনি আশানুরূপ সাড়া পেলেন না। স্পেন, ইতালি ও ভেনিসের সাথে কনস্টান্টিনোপলের বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত ছিল। তাই এসব রাজ্যগুলো ক্ষুদ্র একটি বাহিনী দিয়ে সাহায্য প্রেরণ করল। কেবলমাত্র জিওভানি গিয়াস্তিনিয়ানির নেতৃত্বে জেনোয়া থেকে ৭০০ পেশাদার সৈন্যের যে সাহায্য এসেছিল তাই সম্রাটের বিশেষ উপকারে এসেছিল। পশ্চিম-ইউরোপ থেকে আশানুরূপ সমর্থন ও সাহায্য না আসায় বাইজান্টাইন সম্রাট কন্সটান্টাইন বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। তিনি রোমান পোপের কাছ থেকে সাহায্য লাভের বিনিময়ে গ্রিক (ইস্টার্ন অর্থোডক্স) ও ল্যাটিন (রোমান ক্যাথোলিক) চার্চের একত্রীকরণের প্রচেষ্টা চালালেন (বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য সহ পূর্ব ইউরোপীয়রা খ্রিস্টধর্মের গ্রিক বা ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী ছিল, যেখানে পশ্চিম ইউরোপ ছিল ল্যাটিন বা রোমান ক্যাথোলিক চার্চের অনুসারী)। কিন্তু এর ফল হলো বিপরীত। সম্রাট কন্সটান্টাইনের নিজস্ব লোকজনের মধ্যেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। গ্রিক চার্চের ধর্মান্ধ পুরোহিতগণ সমাটকে ধর্মদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করল। শুধু তাই নয়, গ্রিক চার্চের গোড়া পুরোহিত গ্রান্ড ডিউক নোটারাস প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করলেন যে, “তিনি রোমান পোপের মুকুটের চেয়ে কনস্টান্টিনোপলের তুর্কি সুলতানের পাগড়ি দেখতে বেশি পছন্দ করবেন।” (জি. অস্ট্রোগরকি কর্তৃক তার ‘History of the Byzantine state’ শীর্ষক পুস্তকে উদ্ধৃত, নিউ বার্নসউইক, ১৯৫৭, পৃঃ ৫০৫)। এর ফল হলো এই যে, তুর্কি সুলতানের হাত থেকে কনস্টান্টিনোপল রক্ষা করতে গিয়ে বাইজান্টাইন সম্রাট যে সময়োপযোগী ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন তা ব্যর্থ হয়ে গেল এবং নিজেদের মধ্যেও বিরাট ভাঙ্গনের সৃষ্টি হলো। এমনিতে ১৩৪৬ থেকে ১৩৪৯ সালের মধ্যে সংঘটিত ব্ল্যাকডেথের কারণে কনস্টান্টিনোপলের জনসংখ্যা অনেক কমে যায়, তার উপর ১৫শ শতক পর্যন্ত সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ক্ষতি ও বিভিন্ন অঞ্চল হারানোর কারণে তার প্রভাব কনস্টান্টিনোপলের অর্থনীতিতে পড়ে, সেজন্যেও এখানকার জনসংখ্যা অনেক কমে আসে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের এই দুর্বলতার জন্য ক্রুসেডারদেরও একটা বড় হাত ছিল, ১২০৪ সালে তারা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য আক্রমণ করে ও কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করে সেখানে ব্যাপক লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সব মিলিয়ে যে কনস্টান্টিনোপলে ৪র্থ – ৫ম শতকে জনসংখ্যা ছিল আড়াই লক্ষ থেকে দশ লক্ষ, সেই শহরে ১৪৫৩ সালে পতনের সময়ে জনসংখ্যা নেমে আসে মাত্র ৫০,০০০-এ। তার উপর নগরের লোকেরা সম্রাটের উপর বিতৃষ্ণ হওয়ায় এই পঞ্চাশ হাজার জনগণের মধ্যে যুদ্ধে যোগদান করে মাত্র ছয় হাজার জন। আর বহিরাগত সাহায্যকারী সৈন্যদের সমন্বয়ে সম্রাটের মোট সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো মাত্র নয় হাজার। চৌদ্দ মাইল দীর্ঘ প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত কনস্টান্টিনোপল শহর রক্ষার্থে এই সৈন্য ছিল নিতান্তই অপ্রতুল ও নগণ্য। তবুও এই সীমিত শক্তি নিয়েই সম্রাট কন্সটান্টাইন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তুর্কিদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত হলেন। ব্যক্তিগতভাবে সম্রাট তার কর্তব্য পালনে কোন অবহেলা প্রদর্শন করেননি।

কনস্টান্টিনোপল অবরোধ ও যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণী

১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল সুলতান মুহম্মদ বার হাজার জ্যানিসারি সহ (তুর্কিদের বিশেষ সৈন্য) লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করলেন। কিন্তু সম্রাট কন্সটান্টাইনের তুলনায় সুলতান মুহম্মদের শক্তি ও সৈন্য সংখ্যা যতই হোক না কেন কনস্টান্টিনোপল দখল করা তার পক্ষে খুব সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। কারণ কনস্টান্টিনোপল নগরী বহিঃশত্রুদের আক্রমণ থেকে বিশেষভাবে সুরক্ষিত ছিল। তিনটি সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত এই নগরটি ছিল ত্রিকোণাকার। এর দুই দিকে ছিল সাগর এবং অন্যদিকে প্রাচীর ছাড়া প্রায় একশথ ফুট গভীর পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত। স্থলযুদ্ধে তুর্কিগণ তৎকালীন সেরা সৈন্য হলেও নৌযুদ্ধে বাইজান্টাইনদের পূর্ব ঐতিহ্য তখনও পর্যন্ত অনেকাংশে অক্ষুন্ন ছিল। কাজেই নৌপথে কনস্টান্টিনোপল অধিকার মুহম্মদের পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। দীর্ঘ চুয়ান্ন দিনব্যাপী একাধিক্রমে অটোমান-বাহিনী কনস্টান্টিনোপলের প্রাচীরের ওপর কামানের গোলা নিক্ষেপ করে চললো। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে ফাটলের সৃষ্টি হলো বটে কিন্তু গোল্ডেন হর্ন পথে কনস্টান্টিনোপল শহরে প্রবেশের কোন সম্ভাবনাই দেখা গেল না। অন্যদিকে জেনোয়া থেকে ইতোমধ্যে গিয়াস্তিনিয়ানির নেতৃত্বে চারটি যুদ্ধ-সম্ভারপূর্ণ রণতরী কনস্টান্টিনোপলের সাহায্যার্থে আগমন করল। বসফোরাস প্রণালীপথ প্রহরারত সুলতানের নৌবাহিনী শত্রুপক্ষের এই জাহাজগুলো আটক অথবা ধ্বংস করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। জেনোয়া থেকে আগত এই চারটি যুদ্ধ-জাহাজের নৌসেনাগণ শত্রু পরিবেষ্টিত বসফোরাস প্রণালী অতিক্রম করতে যে অপূর্ব সাহসিকতা ও কৌশল প্রদর্শন করেছিল তা সত্যই প্রশংসনীয়। জেনোয়া থেকে এই সাহায্য আগমনের সংবাদে হতোদ্যম কনস্টান্টিনোপলবাসীর মনে নতুন করে বিপুল সাহস ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হলো। ফলে বহু ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও তারা তুর্কিদের এই প্রচণ্ড আক্রমণ সাফল্যের সাথে প্রতিহত করে চললো।

কিন্তু যেভাবেই হোক কনস্টান্টিনোপল অধিকারের সিদ্ধান্তে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ছিলেন অবিচল ও আপোষহীন। এমতাবস্থায় সুলতান মধ্যযুগের এক বিস্ময়কর ও অচিন্তনীয় যুদ্ধ কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, তার রণতরীগুলো যদি গোল্ডেন হর্নের পোতাশ্রয়ে নিয়ে না যাওয়া যায় তবে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের আশা নিতান্তই বৃথা। কারণ কনস্টান্টিনোপল প্রবেশের জলপথ শক্তিশালী নৌবাহিনী দ্বারা বিশেষভাবে সুরক্ষিত ছিল। ফলে সুলতানের নির্দেশে বসফোরাস প্রণালী থেকে গোল্ডেন হর্নের পোতাশ্রয় পর্যন্ত দীর্ঘ দশ মাইল স্থলপথের ওপর কাঠের তক্তা বিছানো হলো এবং মেষ ও গবাদি পশুর চর্বি দ্বারা তা মসৃণ করা হল। অতঃপর এক রাতের মধ্যেই এই চর্বিযুক্ত পিচ্ছিল পথে ৮৭ টি রণতরী কনস্টান্টিনোপল শহরের সম্মুখভাবে গোল্ডেন হর্নের পোতাশ্রয়ে টেনে আনা হলো। সুলতান মুরাদ নদীর ওপর একটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করে তার ওপর সাঁজোয়া বাহিনীসহ প্রাচীর বিধ্বংসী কামানগুলো স্থাপন করলেন। অপেক্ষাকৃত কাছেবর্তী অবস্থান থেকে অনবরত কামানের গোলা বর্ষণের ফলে অবশেষে প্রাচীর গাত্রে ফাটল ও ভাঙ্গনের সৃষ্টি হলো। বহু ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে হলেও নগর প্রতিরক্ষাবাহিনী সাফল্যের সঙ্গে তুর্কি বাহিনীর উপর্যুপরি দুটো প্রবল আক্রমণ প্রতিহত করল। কিন্তু ভারি কামান থেকে নিক্ষিপ্ত প্রচণ্ড গোলা ও বিপুলাকায় প্রস্তর খণ্ড একশো ফুট গভীর প্রতিরক্ষামূলক পরিখাটি পরিপূর্ণ করে ফেললো। এর ফলে স্থলবাহিনীর সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে নগর প্রবেশে সুবিধা হবে বলে সুলতান মনে করলেন। কিন্তু অসামান্য বীরত্ব ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বাইজান্টাইন সৈন্যগণ রাতের অন্ধকারে পরিখাটি পরিষ্কার করে ফেলল। কিন্তু সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ এতে বিন্দুমাত্র নিরুৎসাহিত না হয়ে ব্যক্তিগত পরিচালানাধীনে জ্যানিসারি বাহিনী নিয়ে কনস্টান্টিনোপলের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানলেন। নগর প্রতিরক্ষা কার্যে জেনোয়া বাহিনীর প্রধান জন গিয়াস্তিনিয়ান এযাবৎ অসীম বীরত্বের পরিচয় প্রদান করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তিনি অটোমান কামানের আঘাতে গুরুতররূপে আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলেন (কোন কোন সূত্র মতে ক্রসবো এর আঘাতে আহত হয়েছিল, দিনটি ছিল ২৯ মে, অর্থাৎ কনস্টান্টিনোপলের পতনের দিন)। তার অনুপস্থিতিতে বাইজান্টাইন বাহিনীর মনোবল একেবারে ভেঙ্গে পড়ল। তাকে একটি বন্ধ দরজা খুলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু দরজা খুলে দেয়া হলে অনেক ভীত সৈন্যই পালানো শুরু করে, এতে চারদিকে প্যানিক ছড়িয়ে যায় (গিয়াস্তিনিয়ানির সৈন্যরা ঠিক মত বেরিয়ে যেতে পারলেও গিয়াস্তিনিয়ানি ২ দিন পর ১ জুনে আঘাতের কারণে মৃত্যুবরণ করেন)।

গিয়াস্তিনিয়ানিকে পিছিয়ে যেতে দেখে দ্বিতীয় মুহম্মদ পুরোদমে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন, এদিকে সম্রাট একাদশ কন্টান্টাইনও গিয়াস্তিনিয়ানির আহত হবার কথা শুনে নিজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তিনি নিজে একজন বীর ছিলেন, তখন তার বয়স ছিল ৪৮। এই যুদ্ধে তার নিশ্চিত পরাজয়ের কথা জেনেও তিনি বললেন, “ইশ্বরের ইচ্ছায় এমন যেন না হয় যাতে সাম্রাজ্যহারা সম্রাট হিসেবে আমাকে জীবিত থাকতে হয়। আমার নগরীর (কনস্টান্টিনোপল) পতনের সঙ্গে সঙ্গে আমারও যেন মৃত্যু হয় (জে. এ. সি. ফুলারের ‘A Military History of the Western World’, প্রথম খণ্ড, নিউইয়র্ক ১৯৫৪, শীর্ষক গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃঃ ১৫০-১৫১)। সম্রাট কন্সটান্টাইন বিপুল বিক্রমে কিছুক্ষণ যাবৎ নগর রক্ষা করে চললেন। কিন্তু এক বা একাধিক ব্যক্তির বীরত্বের ফলে শক্তিশালী এবং কনস্টান্টিনোপল বিজয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তুর্কি-বাহিনীকে প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না। অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে সিজারের পঞ্চান্নতম উত্তরাধিকারী এবং ঐতিহ্যবাহী বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সম্রাট ১১শ কন্সটান্টাইন যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ বিসর্জন দিলেন। তার মৃত্যুতে অটোমান তুর্কিদের কাছে কনস্টান্টিনোপলের পতন হলো (গ্রিক ইতিহাস সূত্র সহ বেশিরভাগ সূত্র অনুসারেই ১১শ কনস্ট্যান্টাইন যুদ্ধ করেন ও শহীদ হন, তবে তিনটি সূত্র বলছে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন, এছাড়া কিছু সূত্র অনুসারে দ্বিতীয় মুহম্মদ তার শিরোশ্ছেদ করেছিলেন। তবে হতেই পারে যে দ্বিতীয় মুহম্মদ ১১শ কনস্ট্যান্টাইনের মৃতদেহেরই শিরোশ্ছেদ করেছিলেন)।

কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের পর সংঘটিত লুণ্ঠন ও ধর্ষণ

একাধিক্রমে ৫৪ দিন অবরোধের পর ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে কন্সটান্টিনোপাল অটোমান তুর্কিদের দখলে এলো। কনস্ট্যান্টিনোপল জয়ের পর দ্বিতীয় মেহমেদ তার সৈন্যদেরকে পূর্বে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নগরটি লুণ্ঠন করার জন্য তিনটি দিন সময় দিয়েছিলেন। সেসময় নগর অবরোধের পূর্বে সৈন্যদেরকে দীর্ঘকাল যুদ্ধের নগরের সম্পদ লুণ্ঠন ও নারী ধর্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সৈন্যদের মনোবল ও জেতার ইচ্ছা বৃদ্ধি করা এবং নগর জয়ের পর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদেরকে যেমন খুশি লুণ্ঠন ও যুদ্ধ-ধর্ষণের সুযোগ দেয়া বলতে গেলে একটি সাধারণ রীতি ছিল। অটোমান সৈন্যদের হাতে কনস্ট্যান্টিনোপলের নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়। বারবারোর মতে, “সারাদিন ধরে তুর্কিরা শহরের মধ্য দিয়ে খ্রিস্টানদের হত্যা করেছে”। ঐতিহাসিক ফিলিপ ম্যানসেল সহ অনেকেই উল্লেখ  করেন, শহরের বেসামরিক বাসিন্দাদের উপর ব্যাপক নির্যাতন সংঘটিত হয়, যার ফলে হাজার হাজার খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এবং ৩০,০০০ বেসামরিক নাগরিককে ক্রীতদাস বানানো হয় বা জোর পূর্বক বিতাড়িত করা হয়। উভয় লিঙ্গের লোকেদেরকেই আয়া সোফিয়ার অভ্যন্তরে ধর্ষণ করা হয়েছিল। জিম ব্র্যাডবিউরি তার দ্য মেডিয়েভাল সিজ গ্রন্থে লিখেছেন, দ্বিতীয় মুহম্মদ বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের গ্র্যান্ড ডিউক লোউকাস নোতারাসের (Loukas Notaras) পুত্র ১৪ বছর বয়সী জ্যাকব নোতারাসের (Jacob Notaras) প্রতি আকৃষ্ট হন ও লোউকাসের কাছে তাকে দাবি করেন। লোউকাস তাতে অসম্মত হলে তিনি লোউকাস, তার অন্যান্য পুত্র ও জামাতাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং জ্যাকবকে তার হারেম সেরাগ্লিওতে রাখেন, যেখানে জ্যাকব তার ক্যাটামাইট (“রক্ষিত”) হিসেবে ছিলেন। ৭ বছর পর ১৪৬০ সালে জ্যাকব পালিয়ে ইতালিতে তার বোনদের কাছে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

স্টিভেন রুনসিম্যানের মতে গির্জার ভেতরে শরণার্থী হিসেবে বেশীরভাগ বয়স্ক এবং অসুস্থ/আহত এবং অসুস্থ নিহত হয়, এবং অবশিষ্ট (প্রধানত কিশোর পুরুষ এবং তরুণ ছেলেদের) শিকল দিয়ে বেঁধে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা অনুসারে, দ্বিতীয় মুহম্মদ “প্রাথমিক পর্যায়ে লুণ্ঠন করার অনুমতি দেন এবং এর ফলে অনেক অর্থোডক্স চার্চকে ধ্বংস করা হয়”, কিন্তু তিনি নগরের পূর্ণাঙ্গ ধ্বংসকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। নগরের নির্দিষ্ট কিছু অংশে লুণ্ঠন সব থেকে বেশি হয়েছিল। ২রা জুনে সুলতান যখন নগরে এলেন তখন তিনি দেখলেন নগর প্রায় খালি, এবং এর অর্ধেকই ধ্বংসপ্রাপ্ত। চার্চগুলোকে ধ্বংস ও অপবিত্র করা হয়েছে, বাড়িঘরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে, দোকানপাট সব খালি হয়ে গেছে। যে নগর জয় করার জন্য কয়েক শতকের প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনা তার এই হাল দেখে তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, “What a city we have given over to plunder and destruction.”। সবচেয়ে বেশি লুটপাট চালিয়েছিল নাবিক এবং নৌসেনারা। ওরা সংখ্যায় কম ছিল, প্রধান ফটক দিয়ে নিয়মিত সৈন্যরা শহরে এসে গেলে এরা আর লুণ্ঠনের সুযোগ পেতো না। তাই নিয়মিত সৈন্যরা আসার আগেই এরা অন্যান্য দেয়াল দিয়ে শহরে প্রবেশ করে ও ব্যাপকভাবে লুটপাট করে। এর পূর্বে ১২০৪ সালে ক্রুসেডাররা কনস্ট্যান্টিনোপল নগর লুণ্ঠন করেছিল, তাতে দুই হাজার বেসামরিক গ্রিক নাগরিককে হত্যা করেছিল (বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা গ্রিক ভাষাভাষী ছিল)। ১৪৫৩ সালের কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণে সৈন্য ও বেসামরিক জনতা সব মিলে আনুমাণিক চার হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল।

বিজয়ের পর সুলতানের দ্বারা গৃহীত পদক্ষেপসমূহ

যাই হোক, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞের সমাপ্তির পর বিজয়ীবেশে সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ পূর্বপুরুষদের বহু আকাঙ্ক্ষিত এই নগরীতে প্রবেশ করলেন এবং বিখ্যাত সেন্ট সোফিয়া (আয়া সোফিয়া বা Hagia Sophia) গির্জায় আনুষ্ঠানিকভাবে নামাজ আদায় করলেন। সুলতানের নির্দেশে অধিকৃত শহরের মধ্যে সাময়িক অরাজকতা ও লুটতরাজের অবসান ঘটলো এবং সামগ্রিকভাবে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে এলো। একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদের মতো সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ উপলব্ধি করলেন যে, বিজিত কনস্টান্টিনোপল নগরীতে তুর্কি সাম্রাজ্যের রাজধানী করতে হলে তুর্কিদের জন্য নগরবাসীর আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা অপরিহার্য। কাজেই তিনি খ্রিস্টানদের প্রতি বিশেষ সহনশীল ও উদার নীতি অবলম্বন করলেন। বিজয় গৌরবে উন্মত্ত তুর্কি বাহিনীর ভয়ে ভীত হয়ে ইতোমধ্যে অনেকেই নগর ত্যাগ করেছিল। সুলতান তাদেরকে অভয়দান করে স্বাভাবিক এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে নির্দেশ দিলেন। গ্রিক চার্চ সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রিস্টানগণ ধর্মীয় ব্যাপারে এতই গোঁড়া ছিল যে, স্বাধীনতার চেয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামিকেই তারা বেশি মূল্য দিত। এই কারণে সম্রাট কন্সটান্টাইন রোমান ও গ্রিক চার্চের সমন্বয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে জাতীয় এই মহাদুর্দিনেও তারা সম্রাটের আহ্বানে সক্রিয় সাড়া দেয়নি। সুলতান মুহম্মদ খ্রিস্টানদের এই ধর্মীয় দুর্বলতার কথা আগে থেকেই জানতেন এবং এখন তিনি তার পরিপূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করলেন। যথাযোগ্যমর্যাদার সঙ্গে তিনি গেন্নদিয়েস নামে একজন গ্রিক প্যাট্রিয়ার্ককে (প্রধান পুরোহিত) কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টানদের ধর্মীয় নেতা নির্বাচন করলেন এবং নিজেকে খ্রিস্টধর্মের প্রতিরক্ষক হিসেবে ঘোষণা করলেন। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সুলতান কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টান জনসাধারণকে একটি সনদও প্রদান করলেন। উক্ত সনদ অনুসারে খ্রিস্টানদের সম্পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয় এবং প্রধান পুরোহিতসহ অন্যান্য ধর্মযাজকদের সর্বপ্রকার কর মওকুফ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বহু পূর্ব থেকে এবং বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক যুদ্ধে হতাহত হওয়ার ফলে কনস্টান্টিনোপল নগরীতে জনবসতি বিরল হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থার প্রতিকারকল্পে সুলতান তার সাম্রাজ্যের নানা স্থান থেকে হাজার হাজার পরিবার ও তাদের পরিজনকে কনস্টান্টিনোপলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। ফলে অচিরেই নগরটি আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য ও জনকলরবে মুখরিত হয়ে উঠলো।

কনস্টানটিনােলের পতনের তাৎপর্য, পরবর্তি ঘটনা ও ফলাফল

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে তুর্কি কর্তৃত্বপ্রতিষ্ঠা সুগম হওয়া ও অটোমান সাম্রাজ্যের মর্যাদা বৃদ্ধি

অটোমান তুর্কিদের কাছে কনস্টান্টিনোপলের পতন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর ফলে ১১শ শতাব্দীর পুরাতন ও ঐতিহ্যবাহী বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের চিরকালের মতো অবসান ঘটে। কিন্তু এতে কনস্টান্টিনোপলের গুরুত্ব বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন হয়নি। কারণ এটি অচিরেই অটোমান তুর্কিদের নতুন রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তী পাঁচশো বছর ধরে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে কনস্টান্টিনোপলের এই গৌরব অক্ষুন্ন ছিল। কেবলমাত্র ২০শ শতাব্দীর প্রথম দিকে তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরক প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টি করলে কনস্টান্টিনোপলের পরিবর্তে রাজধানী আঙ্কারায় স্থানান্তরিত হয়। আর এই সঙ্গে সঙ্গে কনস্টান্টিনোপল আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন নাম ধারণ করে ইস্তাম্বুল বলে পরিচিত হয় (অবশ্য ইস্তাম্বুল শব্দটি ১৪৫৩ সালের আগে থেকেই আনঅফিশিয়ালি ব্যবহৃত হতো)। কনস্টান্টিনোপলের পতনের ফলে পূর্ববর্তী অটোমান সুলতানের স্বপ্ন ও প্রচেষ্টা বাস্তবে রপান্তরিত হয়। এর পর থেকে তুর্কিগণ অবিসংবাদিতভাবে ইউরোপীয় শক্তি – তথা ইউরোপীয় জাতিতে পরিণত হয়। কনস্টান্টিনোপলের পতনের ফলে বলকান প্রদেশগুলো দখলের পক্ষে অটোমান তুর্কিদের জন্য সর্বশেষ বড় প্রতিবন্ধকতা তিরোহিত হয় এবং সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে তুর্কিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভের পথ সুগম হয়।

সমগ্র ইউরোপবাসীর ওপর কনস্টান্টিনোপল পতনের ফলে যে মনস্তাত্ত্বিক ও মানবিক আবেগজনিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা ছোট করে দেখা চলে না। কারণ সমগ্র ইউরোপীয় খ্রিস্টান অধিবাসীদের হৃদয়ে কনস্টান্টিনোপলের একটি স্থায়ী আসন সৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই তার পতনের ফলে এই নগরীর সাথে তাদের হৃদয়ের সেই যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কনস্টান্টিনোপলের পতন তাই খ্রিস্টানদের কাছে প্রকারান্তরে সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন বলে প্রতীয়মান হলো। এছাড়া কনস্টান্টিনোপলের পতন সমগ্র খ্রিস্টান জগতের কাছে মস্ত বড় লজ্জা, ক্ষোভ ও ত্রাসের সঞ্চার করল। পক্ষান্তরে বিশ্বের মুসলমান জাতির কাছে তুর্কিদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের সংবাদ একটি সুখবর এবং গৌরবজনক ব্যাপার বলে প্রতীয়মান হলো। ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই খলিফাগণ এই নগরী দখলের চেষ্টা করেছিলেন। অবশেষে এই মহৎ ও বহু আকাঙ্ক্ষিত কাজ অটোমান তুর্কিদের হাতে সমাধান হওয়ায় সাধারণভাবে তুর্কি জাতির এবং বিশেষভাবে বিজেতা মুহম্মদের সম্মান ও মর্যাদা বিশ্বের মুসলমান জাতির দৃষ্টিতে বহু গুণে বৃদ্ধি পেলো।

অটোমান সেনাবাহিনীর বিকাশ, এদের অব্যাহত বিজয় ও ইউরোপের ক্ষমতা-ভারসাম্যে পরিবর্তন

তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্যতম ভিত্তি ছিল শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী, তুর্কি সুলতানরা সৈন্যবাহিনীকেই তাদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে দেখেছিলেন। প্রথম যুগে হালকা অস্ত্রসজ্জিত ও দ্রুতগামী অশ্বারােহীদের ওপর নির্ভরশীল হলেও পরবর্তীকালে তারা ইউরােপীয়দের ধাঁচেই সামন্ত ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল বৃহৎ সেনাবাহিনী গড়ে তােলে। অধীনস্থ সামন্তরাই সৈন্যের জোগান দিতেন। কিন্তু ইউরােপীয়দের তুলনায় এই বাহিনী ছিল বহুগুণ ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন ও সুশৃঙ্খল। প্রধানত এই বাহিনীর সাহায্যে তুর্কিরা পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরােপে প্রাধান বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল, সম্প্রসারিত হয়েছিল অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের সীমানা। জ্যানিসারি সৈন্যরা ছিল এই বাহিনীর অন্যতম স্তম্ভ, তুর্কি বাহিনীর সেরা অংশ ছিল এই জ্যানিসারি সৈন্যদল। নেপােলিয়নের গ্রান্ড আর্মির মতাে এই বাহিনী ছিল অত্যন্ত দক্ষ এবং সর্বাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত। এই বাহিনী অটোমান সামাজ্য গঠনে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। জ্যানিসারি বাহিনী সার্বিয়া ও হাঙ্গেরি দখল করেছিল, সম্রাট পঞ্চম চার্লসের রাজধানী ভিয়েনা আক্রমণ করেছিল। অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ইউরােপের সামরিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। ইউরােপের কূটনীতিতে তারা ছিল অপরিহার্য। তুর্কিদের সামরিকবাহিনীর সঙ্গে তুলনায় পশ্চিমের সৈন্যবাহিনী ছিল সশস্ত্র উচ্ছৃঙ্খল জনতা (armed rabble)। শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর সাহায্য নিয়ে অটোমান সুলতানরা দ্রুত তাদের সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন। তুর্কি সাম্রাজ্যের একটি দুর্বলতা হল অবিরাম যুদ্ধ ও সম্প্রসারণের ওপর এর স্থিতিশীলতা নির্ভরশীল ছিল। সুলতানদের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ছিল এর চালিকা শক্তি। ১৫৬৬ সালে সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের মৃত্যুর পর এই রাজ্যে নেতৃত্বের দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল। এই সময় থেকে কার্যত তুর্কি সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সূচনা হয়। সমকালীন পর্যবেক্ষকদের মতে এর মাধ্যমে স্রোত উল্টোদিকে বইতে শুরু করেছে (the tide was beginning to turn)। কনস্টানটিনােপল দখলের সঙ্গেই তুর্কি বিজয়রথের চাকা স্তব্ধ হয়ে যায়নি। তুর্কি বিজয় অভিযান পরিচালিত হয়েছিল দক্ষিণ ইউরােপের অন্যত্র। অটোমানরা একে একে বেলগ্রেড নগরী ও রােডস দ্বীপ জয় করতে সক্ষম হয়। উপর্যুপরি দুইবার অবরুদ্ধ হয় হ্যাপ্‌সবার্গ সাম্রাজ্যের রাজধানী ভিয়েনা। অটোমান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট (১৫২০-৬৬ খ্রি.) পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলির দুর্বলতার পূর্ণ সুযােগ নেন। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মােহকাসের (Mohacs) যুদ্ধে তিনি হাঙ্গেরিকে অটোমানদের পদানত করেন, আর এরপর তিনি ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে ওঠেন।  ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মােরিয়া থেকে ভেনিসীয়দের উচ্ছেদ করা হয়। ঈজিয়ান দ্বীপপুঞ্জও তাদের হস্তচ্যুত হয়। অতঃপর গ্রিস তুর্কি অধিকারে আসে। অটোমান সাম্রাজ্যের সীমানা দক্ষিণ ইউরােপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারিত হয়। বল্কান অঞ্চলে তুর্কি প্রভাব ইতিপূর্বেই বিস্তৃত হয়েছিল। সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বাধীন তুর্কি শক্তি প্রায় অপ্রতিরােধ্য হয়ে ওঠে। তুর্কিরা কনস্ট্যান্টিনােপল অধিকার করার ফলে ইউরােপের রাজনীতির পরিবর্তন ঘটে। খ্রিস্টান ইউরােপে অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্য ছিল একটি উদীয়মান শক্তি। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট পঞ্চম চার্লস পূর্ব ইউরােপের প্রতিরক্ষা নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েন। এইসময় থেকেই স্পেন ও অস্ট্রীয় পবিত্র রােমান সম্রাট পঞ্চম চার্লস সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভীতসন্ত্রস্ত বােধ করতে থাকেন। পঞ্চম চার্লস ও তার পরবর্তী সম্রাট প্রথম ফার্দিনান্দ হাঙ্গেরি ও মধ্য ইউরােপের প্রতিরক্ষার দিকে নজর দেন। কিন্তু এই সংকট মুহূর্তে ইউরােপ ঐক্যবদ্ধভাবে বহিঃশত্রুর মােকাবেলা করতে পারেনি। স্পেইন-অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের শত্রুতা চলছিল। ১৫৩৬ সালে ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস অস্ট্রিয়া-স্পেনের শত্রু তুর্কিদের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, ফ্রান্স তুর্কিদের সঙ্গে যােগ দিয়ে স্পেনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। ফ্রান্স খ্রিস্টান ইউরােপের স্বার্থের কথা ভাবেনি, ভালােয়া রাজবংশের স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছিল। এই সময় থেকে ইউরােপের রাজনীতি ও কূটনীতিতে অটোমান সাম্রাজ্য স্থায়ী আসন পেয়েছিল। ইউরােপের কূটনীতিতে এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে যায়। ইউরােপের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি তুর্কিদের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগ নিয়েছিল। ফ্রান্স তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে সামরিক অভিযানও চালিয়েছিল। ১৫৫৬ সালে সুলতান সুলেমানের মৃত্যুর পরেও সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের শাসনকালেও তুর্কি সম্প্রসারণ প্রায় অব্যাহত থাকে। এই পর্বে ভেনিস ও সাইপ্রাস অধিকৃত হয়। মাল্টা ও ক্রিট দ্বীপের ওপর অটোমান অধিকার অক্ষুন্ন থাকে। হাঙ্গেরির ওপর অধিকার আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপিত হয়। ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে সুলেমানের মৃত্যুর সময় মধ্য ইউরােপে ইসলামের সম্প্রসারণ প্রতিহত করা সম্ভব হয়, তুর্কিরা ভিয়েনায় প্রবেশ করতে পারেনি। অবশেষে পােপ পঞ্চম পায়াসের উদ্যোগে ১৫৭১ সালে ভেনিস ও স্পেনকে নিয়ে তুর্কি-বিরােধী লিগ গঠিত হলে তুর্কি অগ্রগতি, বিশেষত তাদের নৌবহরের অগ্রগতি স্তব্ধ হয়।

শক্তিশালী ও কার্যকরী শাসনব্যবস্থা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা

কনস্টানটিনােল অধিকার করার সময় অটোমান তুর্কিরা হত্যা, ধ্বংস, লুঠতরাজ আর অগ্নিসংযােগের তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল। সামরিক বলে বলীয়ান অটোমানদের চাপের সামনে নতিস্বীকার করে রােমানরা সাত সপ্তাহের মধ্যে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এর আগে বসফরাসে অবস্থিত বাইজানটাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বা বাইজান্টিনাম অবরুদ্ধ হয়েছিল কিন্তু কখনােই তার চূড়ান্ত পতন ঘটেনি। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে বিজয়ী মুসলমান বাহিনী বীরদর্পে রাজধানীর বিশাল ও দুর্ভেদ্য প্রাচীর অতিক্রম করে নগরের প্রাণকেন্দ্রে প্রবেশ করে। তারা পূর্ব রােমান সম্রাটকে হত্যা করে ও অবাধে লুণ্ঠনলীলা চালায় (১৪৫৩ সালের ২৭ মে)। কনস্টানটিনােপলে তুর্কিরা তাদের বিজয়-ধ্বজা উড়িয়ে দেয়ার পরবর্তীকালে তারা সেখানে একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলে, বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দূর করে শান্তি স্থাপন করে। একই সাথে তারা সেখানে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রয়ােজনের বাস্তব তাগিদে পরধর্ম ও মতের প্রতি সহিষ্ণুতার বাতাবরণ সৃষ্টি করে। অটোমান সুলতানরা শাসিত জনগণের প্রতি সহিষ্ণুতার নীতি অনুসরণ করেছিলেন। তুর্কি নব বিজিত অঞ্চলে তাদের মিলেট (millet) ব্যবস্থায় অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণের অধিকার লাভ করেছিল। গ্রিক ও ইহুদিরা এখানে সুস্থ পরিবেশ পেয়েছিল। আর্মেনিয়ান, গ্রিক অন্যান্য খ্রিস্টানরা ও ইহুদিরা তাদের ধর্মগুরু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা লাভ করে, তুর্কি সুলতানরা এ ব্যাপারে তাদের সহায়তা দেন। পশ্চিমী দেশের সঙ্গে তুলনায় তারা এখানে অনেক ভালাে ছিল। ইহুদিরা স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে কনস্টানটিনােপলে আশ্রয় লাভ করে সেখানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, নানা শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনেও তারা প্রয়াসী হয়, তাদের অর্থ ও কারিগরি কুশলতা লাভ করে অটোমান সাম্রাজ্য লাভবান হয়েছিল। এদের কাছ থেকে বাণিজ্যিক মূলধন এবং কারিগরি কুশলতা (know-how) লাভ করে অটোমানরাও লাভবান হয়। অটোমান সুলতানরা অধীনস্থ অমুসলমান প্রজাদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার মেনে নিয়েছিলেন। সুলতানদের অনুসৃত এই নীতির ফলে পরবর্তীকালে দু ধরনের অসুবিধা দেখা দেয়। তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ ব্যাহত হয়। তুর্কি সাম্রাজ্যে অবক্ষয় শুরু হলে এই আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদে পরিণতি লাভ করেছিল।

কনস্টান্টিনোপলে গ্রিকো-রোমান ও ইসলামী সংস্কৃতির সমন্বয়

৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিক বর্বর সেনানায়ক ফ্লেভিয়াস ওডোয়েইসের (Flavius Odoacer) শেষ রােমান সম্রাট রােমুলাসকে পরাস্ত ও সিংহাসনচ্যুত করলে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটে। ৫ম শতাব্দী অবসানের পূর্বে একাধিক বর্বর জাতি ওই সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের ওপর প্রাধান্য বিস্তার এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। এরপর অস্ট্রোগথরা ইতালিতে ; ভিসিগথ, বার্গান্ডিয়ান এবং ফ্রাঙ্করা গলদেশে (বর্তমান ফ্রান্স) ; ভিসিগথদের একটি প্রশাখা আইবেরীয় উপদ্বীপে (স্পেন ও পাের্তুগাল) এবং জুট ও অ্যাঙ্গোলরা ব্রিটেনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটলেও পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য আরও প্রায় হাজার বছর যাবৎ অস্তিত্ব রক্ষায় সক্ষম হয়েছিল। শুধু রাজনৈতিক অস্তিত্ব নয়, বাইজানটিয়াম অচিরেই গ্রিকো-রােমান সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। একটি সমন্বয়কামী সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূত হয়েছিল সাহিত্যে, চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে এবং স্থাপত্যে। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ও রাজ্যসমূহে ততদিনে ইসলামের প্রসার ঘটেছে, তাই এই সংস্কৃতি ইসলামী সংস্কৃতির দ্বারাও প্রভাবিত হয়, আরবি ভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা (বিশেষত ভেষজ ও চিকিৎসাবিজ্ঞান) আত্মস্থ করতে বাইজানটাইন পণ্ডিতরা দ্বিধা বােধ করেননি। রাজনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য বহু কারণে ১৩শ শতক থেকে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠতে থাকে, অবশেষে ১৫শ শতকের মধ্যভাগে অটোমান তুর্কিরা এই একসময়ের সমৃদ্ধ নগর সভ্যতার ওপর চরম আঘাত হানতে সক্ষম হয়। তবে বিজিত অঞ্চলে সংস্কৃতি চর্চা পুরােপুরি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এটা মনে করার কোনাে কারণ নেই। তুর্কিরা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরােপের এক বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে নিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। রাজধানী কনস্ট্যান্টিনােপলকে ঘিরে সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলেছিল। এখানকার গ্রিকোরােমান সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামী সংস্কৃতির মিলন ঘটেছিল, সাহিত্য, শিল্প ও চিত্রকলায় এই মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছিল। শিল্প ও স্থাপত্যের নিদর্শনগুলি আজও ইস্তাম্বুলে (অতীতের কনস্টানটিনােপলে) আগত পর্যটকদের বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করে। আরবি ভাষা, আরবের বিজ্ঞান চর্চা, বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞান, ইউরােপীয়রা সাদরে গ্রহণ করেছিল। আরব পণ্ডিতকৃত গ্রিক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ইউরােপের গবেষকদের প্রভাবিত করেছিল, তাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান ইতিপূর্বেই ইউরােপে গৃহীত হয়েছিল। আরব পণ্ডিতদের কৃত গ্রিক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ইউরােপে পৌঁছেছিল। গ্রিক রােমান, খ্রিস্টান, ল্যাটিন ও ইসলামী সংস্কৃতির মিশ্রণে ইউরােপে নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। কনস্ট্যান্টিনােপল ছিল এই সংস্কৃতি সমন্বয়ের পীঠস্থান।

ইউরোপের নবজাগরণ বা রেনেসাঁ

কনস্টান্টিনোপল বহু যুগ ধরে তৎকালীন বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিল। কনস্টানটিনােল বিজয়ের মাধ্যমে তুর্কিরা এক হাজার বছরের প্রাচীন বাইজানটাইন সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতির অবসান ঘটায়। এসময় থেকে এই নগরী আর গ্রেকো-রােমান সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র ছিল না। এই নগরীর গ্রিক পণ্ডিতদেৱ একাংশ আত্মরক্ষার্থে তাদের পুথিপত্র নিয়ে ইতালির বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই পণ্ডিতগণ তাদের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির বহু বিলুপ্তপ্রায় পাণ্ডুলিপি, পুথি ও নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন। ইতালির লোকেরাও এদের পৃষ্ঠপােষকতা করেছিল এবং এদের অনেককেই ইতালিতে শিক্ষক হিসাবে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। ফলে তারা সমগ্র ল্যাটিন জগতের কাছে এই মূল্যবান তথ্যাদির পরিচয় করিয়ে দেন এবং ক্রমবর্ধমান আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে তা অধ্যয়ন ও চর্চা হতে থাকে। এদের উদ্যোগে নতুন করে প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প প্রভৃতির চর্চা শুরু হয়। এতদিন যাবৎ পাশ্চাত্য জগৎ মুসলমানদের কাছ থেকে কর্ডোভা ও সিসিলির মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিল। কিন্তু এখন কনস্টান্টিনোপল থেকে প্রত্যাগত শরণার্থি পণ্ডিতদের সংস্পর্শে এসে তাদের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার প্রতি অনুরাগ আরও বেড়ে গেল। এভাবে ইতালির মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপে নতুন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত হয়। এই চর্চার ফলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণের প্রসার ঘটে। এজন্য অনেকে মনে করেন যে কনস্ট্যান্টিনােপলের পতনের পর থেকে ইউরােপে রেনেসাঁর সূচনা হয়েছিল। ইংরেজ ঐতিহাসিক লর্ড অ্যাক্টন (Lord Acton) মনে করেন, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আধুনিক ইউরােপের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিনি মনে করেন যে ১৪৫৩ সাল থেকে আধুনিক ইউরােপের যাত্রা শুরু হয়েছিল, ইউরােপে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এই আধুনিক মহাদেশের অন্যতম স্তম্ভ ছিল একটি সুশিক্ষিত আমলাতন্ত্র, স্থায়ী সৈন্যবাহিনী, নিয়মিত ও সুষ্ঠু প্রশাসন ও করব্যবস্থা, কূটনীতি, সম্প্রসারিত বাণিজ্য, শিল্পোন্নয়ন ও কৃষির অগ্রগতি, অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটেছিল, ইউরােপ কৃষি-নির্ভর মধ্যযুগ থেকে শিল্প-বাণিজ্য নির্ভর আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছিল। তুর্কিদের কাছ থেকে ইউরােপ আধুনিক সমর বিজ্ঞানের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আয়ত্ত করেছিল।  শক্তিশালী ও দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করে শত্রুকে প্রতিহত করার কৌশল ইউরােপীয়রা তুর্কিদের কাছ থেকে আয়ত্ত করেছিল। আধুনিক কালে পণ্ডিতরা আর এই ধারণাকে তেমন গুরুত্ব দেন না। সাম্প্রতিককালের কয়েকজন ইতিহাসবিদ এই মতের বিরােধিতা করে বলেন, কনস্টানটিনােপলের পতনের পূর্বেই ইতালিতে রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছিল। ভেনিসে গ্রিক চর্চা ও ধ্রুপদি সাহিত্য পাঠ আগেই শুরু হয়েছিল। ১৪শ শতাব্দীতে বিশিষ্ট গ্রিক পণ্ডিত ক্রাইসােলােরাস (Chrysolorus) ভেনিসে গ্রিক চর্চার সূচনা করেছিলেন। যাই হােক, তবুও পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য ও তার ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজধানীর পতনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

কনস্টান্টিনোপলের সামরিক ও ভৌগলিক তাৎপর্য, অটোমানদের বাণিজ্যে আধিপত্য ও ভেনিসের পতন, এবং ইউরোপীয়দের নতুন বাণিজ্যপথের অনুসন্ধান

পশ্চিম ইউরােপের সঙ্গে তুলনায় কনস্ট্যান্টিনােপল ছিল সমৃদ্ধ, ১৫শ শতকের শেষ অবধি তা চলেছিল। ইতালির নগর-রাষ্ট্রগুলি ছিল সমৃদ্ধ, পশ্চিম ইউরােপের অন্যান্য অঞ্চল ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর ও অনুন্নত। সেই সময়কার সভ্য পৃথিবীতে পশ্চিম ইউরােপের অবস্থান ছিল প্রান্তিক। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ও তার রাজধানী কনস্ট্যান্টিনােপল দক্ষিণ বল্কান, দক্ষিণ ইতালি ও গ্রিসের ওপর প্রাধান্য স্থাপন করেছিল। তার বাণিজ্য বেড়ে চলেছিল, শিল্প উৎপাদনেও এই সাম্রাজ্য পিছিয়ে ছিল না। পল বারােচ লিখেছেন যে সেই সময় বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্রে ছিল এশিয়া। কনস্ট্যান্টিনােপল সৌখিন পণ্য উৎপাদনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। ৯ম শতকে পশ্চিম ইউরােপের ওপর বর্বর আক্রমণ চললেও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কাজকর্ম বজায় রেখেছিল, ভেনিসের সঙ্গে তার বাণিজ্য অটুট ছিল। দক্ষিণ ইতালির ওপর আধিপত্য বজায় রেখে কনস্ট্যান্টিনােপল তার বাণিজ্যে সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিল। কনস্টান্টিনােপল থেকে অনেকগুলি রাস্তা ধরে এই বাণিজ্য পরিচালিত হত। স্লাভ অধ্যুষিত অঞ্চল, কোলন ও মেজ পর্যন্ত ভালাে বাণিজ্যিক পথ ছিল। কয়েকটি বাণিজ্য পথ রাশিয়ার মধ্য দিয়ে বাল্টিক সাগর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সামরিক ও ভৌগােলিক দিক থেকে কনস্টানটিনােপলের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কনস্ট্যান্টিনােপলের পাশে ছিল দুটি প্রণালী, দার্দানেলিস ও বসফোরাস, যেগুলোর মাধ্যমে কনস্টানটিনােপল ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরের সাথে যুক্ত ছিল, অর্থাৎ এই দুই প্রণালী দিয়ে কৃষ্ণসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে যাওয়া যেত, এই দুই প্রণালী দিয়ে রাশিয়ার জাহাজগুলো ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করত; স্পেন, জেনোয়া, ভেনিস প্রভৃতি দেশগুলো বসফোরাস প্রণালীপথে সুদূর কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো, এর মধ্যে কনস্টান্টিনোপলের সঙ্গেই তাদের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান বেশি হতো। তাই কনস্ট্যান্টিনােপল অধিকার করে তুর্কিরা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরােপে শুধু রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপন করেনি, এই অঞ্চলের অর্থনীতির ওপর তাদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছিল। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও নৌ-পরিবহণের ওপর অটোমানদের আধিপত্য স্থাপিত হয়। এই অঞ্চল খ্রিস্টানদের হাত থেকে তুর্কিদের হাতে চলে গিয়েছিল। এই অঞ্চলে স্বতন্ত্র ধারায় অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছিল। কনস্টানটিনােপল অধিকারের ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের ওপর অটোমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কনস্ট্যাণ্টিনােপল এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগােলিক অঞ্চলে অবস্থিত যে তুর্কিরা এশিয়ার স্থলপথগুলি নিয়ন্ত্রণের অধিকার পেয়েছিল। প্রাচ্যের নানাবিধ বাণিজ্যপণ্য এখান থেকে রপ্তানি হত, এসবের মধ্যে অন্যতম ছিল রেশম, সুতিবস্ত্র, মশলা ও নানাবিধ কাঁচামাল (raw materials)। অতঃপর এগুলি পশ্চিম ইউরােপে আবার রপ্তানি করা হত। তবে এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, পশ্চিম ইউরােপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকায় বলকান অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতি তেমন হয়নি, এই অঞ্চলে পশ্চিমের মতাে কারিগরি বা প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা অগ্রগতি প্রায় কিছুই হয়নি, ফলে এখানে কোনাে বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠেনি। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে ভেনিসের সঙ্গে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। পশ্চিম ইউরােপের এক প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হল ভেনিস। ভেনিস বাণিজ্য করত উত্তর ও পশ্চিম ইউরােপ, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সে ছিল বাণিজ্যিক যােগাযােগের প্রধান সূত্র। ভেনিস ছাড়া জেনােয়া ও ফ্লোরেন্স দক্ষিণ ইতালির সঙ্গে বাণিজ্য করত। সিসিলির পালার্মোতে এদের বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। ভেনিস, মিশর, আলেকজান্দ্রিয়া ও স্যালােনিকা থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করে সারা ইউরােপের দেশগুলিতে তা রপ্তানি করত। ভেনিস ছাড়া জেনােয়া ও রাগুসান এই সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। মধ্য ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের বন্দরগুলি এই সব আমদানি করা খাদ্যশস্য কিনে নিত। পূর্ব ইউরােপের সবচেয়ে জনবহুল শহর এই খাদ্য কিনত। উর্বর কৃষ্ণসাগর অববাহিকার উদ্বৃত্ত সব শস্য ভেনিস ও কনস্ট্যান্টিনােপল কিনে নিত। দক্ষিণ ইতালির আপুলিয়া ও সিসিলি, যাকে বলা হত ভূমধ্যসাগরের শস্য ভাণ্ডার, তাদের উদ্বৃত্ত শস্য রপ্তানি করত।

কৃষ্ণসাগর অঞ্চল এই বাণিজ্য বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ভেনিস বণিকদের ভূমধ্যসাগই বাণিজ্য বেড়ে গিয়েছিল। মধ্য ভূমধ্যসাগরের আড্রিয়াটিক, গ্রিস, মাল্টা ও সাইপ্রাসের সঙ্গে ভেনিস বাণিজ্য করত। এদের মাধ্যমে সে প্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গেও তার বাণিজ্য পরিচালনা করে চলেছিল। এসব ছাড়াও ভেনিস করফু দ্বীপটি দখল করলে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে তার বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। বাইজানন্টাইন সাম্রাজ্য ছিল ভেনিসের বাণিজ্যের একটি প্রধান অংশীদার। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিরা কনস্ট্যান্টিনােপল অধিকার করলে শুধু এই অঞ্চলের সঙ্গে নয়, সিরিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া ও আলেপ্পোর সঙ্গে তার যে বাণিজ্য চলত তা প্রভাবিত হয়। তুর্কি শাসকগােষ্ঠির অনুমােদন ছাড়া ভেনিস পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারত না। সাধারণত তুর্কিরা ভেনিসকে এই বাণিজ্য করার অনুমতি দিত না। ঠিক এই কারণে ১৬শ শতকের সত্তরের দশকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্য নিয়ে তুর্কিদের সঙ্গে ভেনিসের বিরােধ বেধেছিল। অটোমান নৌবহর পূর্ব ভূমধ্যসাগরের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল, ভেনিস এই অঞ্চলে বাণিজ্য করার কোনাে সুযােগ পায়নি। পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য করে তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এতে ভেনিসের বাণিজ্য অবশ্যই সীমিত হয়ে পড়েছিল। ১৪শ শতক থেকে ইউরােপের বাণিজ্য ছিল ভেনিসের হাতে। কনস্ট্যান্টিনােপলের পতনের পর এই বাণিজ্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলশ্রুতি হল ভেনিসের বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়, সমগ্র ইতালির ওপর এই মন্দার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

কনস্ট্যান্টিনােপলের পতনের সময় ইউরােপের অর্থনৈতিক জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। পর্তুগাল আফ্রিকার গিনি কোস্টে গিয়ে হাজির হয়। বলা হয় ঐ ঘটনা থেকে বিশ্ব ইতিহাসের এক নবযুগের সূচনা হল। কনস্ট্যান্টিনােপলের পতন থেকে প্রাচ্যের সঙ্গে পশ্চিমের বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়েছিল। পর্তুগালের অভিযানের ফলে এক নতুন সম্প্রসারণবাদী, বাণিজ্যিক এবং ঔপনিবেশিক যুগের সূচনা হয়। অটোমান তুর্কিদের সম্প্রসারণ, কনস্ট্যাণ্টিনােপলের পতন প্রভৃতি ঘটনা ইতালির অর্থনৈতিক প্রাধান্য অবশ্যই খর্ব করেছিল। ইতালি ভৌগােলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নিতে পারেনি। ইতালির বণিকদের অর্থ ছিল, জাহাজ ও নাবিক ছিল কিন্তু নতুন দেশ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তার কোনাে ভূমিকা দেখা যায় না। কয়েক শতাব্দী ধরে ইতালীয় বণিকরা ইউরােপের বাণিজ্য জগৎ গড়ে তুলেছিল, বহু বাণিজ্য পথ ধরে ইতালীয় বণিকদের বাণিজ্য চলত, অনেক ইউরােপীয় ও প্রাচ্য দেশীয় বন্দরের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক যােগাযােগ ছিল। মধ্য ১৫শ শতকে এসে আকস্মিকভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। ভেনিসের সঙ্গে অটোমান নৌবহরের সংঘর্ষ হয়, ভেনিস জয়ী হতে পারেনি। এর ফলে লেভান্টকেন্দ্রিক (সিরিয়া, লেবানন ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল) পূর্ব বাণিজ্য থেকে তারা সরে আসতে বাধ্য হয়। পর্তুগাল ও স্পেন আটলান্টিক পেরিয়ে নতুন পৃথিবীর সন্ধানে নেমে পড়েছিল, এই প্রচেষ্টার সঙ্গে ইতালি যুক্ত হতে পারেনি। কলম্বাস ১৪৯২ খ্রিস্টানে আমেরিকা পৌঁছে যান, ভাস্কো ডা গামা ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কালিকটে গিয়ে হাজির হন। এসবই হল কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পরােক্ষ ফল। প্রাচ্যের স্থল ও জলপথগুলি তুর্কিদের অধীনে চলে যাওয়ায় ইউরােপীয়রা নতুন করে বাণিজ্য পথ ও বাণিজ্য জগৎ গঠনের প্রয়াস চালিয়েছিল। পশ্চিমের জগতের কাছে আটলান্টিকের পারে ছিল অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। পুরনাে বাণিজ্য জগৎ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পুরনাে বাণিজ্য-নির্ভর দেশ ইতালি যবনিকার অন্তরালে চলে যায়, ভৌগােলিক আবিষ্কার ও বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিল পর্তুগাল ও স্পেন। নতুন সম্প্রসারণ ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া গেল আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায়। ভৌগোলিক আবিষ্কারের সাথে সাথে আবার তার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে প্রাচ্যের দেশসমূহে ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং এই সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের প্রচারও শুরু হয়ে যায়।

তুর্কি জাতির নৈতিক অবক্ষয়

কনস্টান্টিনোপলের যা কিছু ভাল তুর্কিগণ তা বিনা সংকোচে গ্রহণ করল, কিন্তু এই সঙ্গে বাইজান্টাইনদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রা ও বিলাসিতার অন্তরালে অতি সযত্নে লালিত দুর্নীতি, হীনমন্যতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের বিষফলও অটোমানগণ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হন। তুর্কিগণ মধ্য এশিয়ার ও এশিয়া মাইনরের যাযাবর পরিবেশে লালিত পালিত হয়েছিল। সুঠাম স্বাস্থ্য ও সহজ-সরল জীবনই ছিল তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ভদ্র, মার্জিত ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতে গিয়ে বাইজান্টাইনদের চরিত্রের দোষগুলো তুর্কিদের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে পড়ে। ফলে কালক্রমে তুর্কিগণ তাদের পূর্বেকার সেই জাতীয় গুণগুলো পরিত্যাগ করে ভদ্রবেশী, শৌর্য-বীর্যহীন ও দুর্নীতিপরায়ণ জাতিতে পরিণত হয়। তুর্কিদের এই নৈতিক অবক্ষয় ও অধোগতি তাদেরকে দ্রুত পতনের দিকে ঠেলে দেয়। এই প্রসঙ্গে লিউক বলেছেন, “তুর্কিগণ অবশ্যই এই মহানগরী (কনস্টান্টিনোপল) অধিকার করল, কিন্তু বিজেতাদের কাছ থেকে এর ওপর যতটুকু প্রভাব পড়ল তার চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রভাব সুলতান ও সাম্রাজ্যের ওপর পতিত হলো।” (হ্যারি লিউক : The Making of Modern Turkey, লন্ডন, ১৯৩৬)।

তথ্যঋণ

  • মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাস, আশরাফউদ্দিন আহমেদ, চয়নিকা প্রকাশনি, ঢাকা, ৩য় সংস্করণ, ২০১১, পৃষ্ঠা – ১৬৫ – ২৩৩
  • The Fall of Constantinople, 1453, steven runciman, Cambridge, 1965
  • জি. অস্ট্রোগরকি : ‘History of the Byzantine state’, নিউ বার্নসউইক, ১৯৫৭,
  • এস. লেনপুল : Turkey, নিউইয়র্ক, ১৮৮৮, তৃতীয় সংস্করণ
  • ইবন-উল-আসির, “আল-কামীল” তৃতীয় খণ্ড
  • মুহম্মদ আবদুল্লাহ ইনান কর্তৃক তার ‘Decisive Moments in the History of Islam’, লাহোর, ১৯৪৯
  • জে. এ. সি. ফুলার, ‘A Military History of the Western World’, প্রথম খণ্ড, নিউইয়র্ক ১৯৫৪
  • হ্যারি লিউক : The Making of Modern Turkey, লন্ডন, ১৯৩৬
  • আধুনিক ইউরোপের বিবর্তন : মধ্য পঞ্চদশ থেকে মধ্য অষ্টাদশ শতক, বাসবেন্দ্র বসু, মিত্রম, কলকাতা, পৃ. ১৭-২০
  • আধুনিক ইউরোপ আদিপর্বের রূপান্তর (১৪০০-১৭৮৯), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ১২-২১
  • উইকিপিডিয়া নিবন্ধ – “Fall of Constantinople”, “Giovanni Giustiniani”, “Mehmed the Conqueror”, “Jacob Notaras”

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.