Table of Contents
এলিয়ার দার্শনিক সম্প্রদায়
আয়োনিয়া থেকে দক্ষিণ ইতালীতে গ্রিক জ্ঞানবিজ্ঞানের স্থানান্তর : মাইলেসীয় দর্শনের ধারার পর গ্রিক দর্শনের পরবর্তী ধাপটি দক্ষিণ ইতালির গ্রিক শহরসমূহের সঙ্গে সম্পর্কিত। আয়োনিয়া থেকে দুই ধারায় সেখানকার পণ্ডিতরা অন্যান্য গ্রিক অঞ্চলে অভিবাসন করে। এক. যখন পারসিকরা আয়োনীয় ও ঈজিয়ান অঞ্চল সব দখল করে নেয়, এই সময় পিথাগোরাস ঈজিয়ান দ্বিপ সামোস ছেড়ে ইতালির ক্রোটনে তার জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে চলে আসেন, সাথে আসে আয়োনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারাও। আর দুই. যখন পারস্যের বিরুদ্ধে আয়োনিয়া বিদ্রোহ করে পরাজিত হয় ও তার ফলস্বরূপ পারসিকরা মিলেটাস নগর ধ্বংস করে দেয়। মিলেটাসের এই ধ্বংসের পর আয়োনিয়া আর কখনই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেদের পুরনো সত্তা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার ঐতিহ্য চিরকালের মতো হারিয়ে যায়। মিলেটাসের ধ্বংসের পর দক্ষিণ ইতালি ও সিসিলির গ্রিক ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোই হয়ে উঠেছিল গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন ধারক ও বাহক। সেই সময় আয়োনিয়া তো বটেই মূলভূমির গ্রিসও পারস্যের আক্রমণের হুমকিতে ছিল। কিন্তু দক্ষিণ ইতালি ছিল অনেকটাই নিরাপদ। ফলে সেই স্থানেই যে জ্ঞান-বিদ্যা চর্চার নতুন সুযোগ গড়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। যাই হোক, প্রাচীন গ্রিক দর্শনের এই দ্বিতীয় ধারাটি অধিকতর ধর্মীয় ভাবাপন্ন এবং বিশেষ করে অর্ফিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিল। এই দার্শনিক চিন্তাধারা কোনাে কোনাে দিক থেকে অধিকতর আকর্ষণীয় এবং কৃতিত্বের দিক থেকে প্রশংসনীয়। কিন্তু মাইলেসিয় দার্শনিক চিন্তাধারায় যতখানি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় মাইলেসিয়-পরবর্তী এই দার্শনিক চিন্তাধারায় ততখানি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় না।
এশিয়া মাইনোরে পারসিক আক্রমণ, আয়োনীয় বিদ্রোহ ও মিলেটাস ধ্বংস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান
দর্শন আলােচনার কেন্দ্র এলিয়া নগর : দক্ষিণ ইতালির এলিয়া নগরে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে যে দার্শনিক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয় তারা এলিয়াটিক দার্শনিক বলে পরিচিত। গ্রীক দর্শনের সূচনা হয়েছিল এশিয়া মাইনরের মিলেটাস নগরে। থেলিস, অ্যানাক্সিমেন্ডার, অ্যানাক্সিমিনিস সবাই জন্মগ্রহণ করেছিলেন মিলেটাস নগরে। সেই কারণে তাদের দর্শন মাইলেসীয় দর্শন নামে পরিচিত। পিথাগােরাস সামস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তিনি দক্ষিণ ইটালির ক্রোটনে বসবাস করেন। সেখানে তিনি অনেক শিষ্য অনুসারী তৈরী করেন যাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ইতালিয়। ফলে ইতালিতে দর্শনচর্চার একটি ভালাে পরিবেশ তৈরী হয়। ক্রোটনের পর দক্ষিণ ইতালির অন্য একটি নগর এলিয়ায় দার্শনিক আলােচনা বিস্তার লাভ করে। সেখানে একটি দার্শনিক গােষ্ঠীর উদ্ভব হয়। এই দার্শনিক গােষ্ঠী এলিয়াটিক দার্শনিক বলে পরিচিতি লাভ করেন। জেনােফেনিস (Xenophanes) ছিলেন এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। তবে পারমিনাইডিস ও জেনাে এই সম্প্রদায়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। অ্যারিস্টোটলও তার মেটাফিজিক্সে জেনােফ্যানিসকে ‘এক’-এর ধারণার প্রথম প্রবর্তক বলে অভিহিত করেন এবং তাকে এলিয়াটিকদের প্রথম দার্শনিক বলে মনে করেন। তবে জেনােফেনিসকে এলিয়াটিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বা জনক বলায় কারাে কারাে আপত্তি আছে। কেউ কেউ মনে করেন দর্শন ছাড়া ধর্মতাত্ত্বিক আলােচনায়ই তার আগ্রহ বেশী ছিলাে। তাই এই সম্প্রদায়কে দার্শনিক সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তােলার ক্ষেত্রে তার অবদান প্রশ্নসাপেক্ষ। একারণে অনেকে পারমেনাইডিসকেই এলিয়াটিক সম্প্রদায়ের জনক বলে অভিহিত করেন। তাছাড়া জেনােফেনিস খাঁটি ইতালীয় বা এলিয়াবাসী ছিলেন না। তিনি গ্রিসের আয়োনিয়া দ্বীপ থেকে এসেছিলেন। অন্যদিকে পারমেনাইডিস ছিলেন খাঁটি ইতালিয়। এলিয়াতেই তার জন্ম হয়েছিল। যাই হােক, একথা সুবিদিত যে, পারমেনাইডিস জেনােফেনিসকে গুরু মেনেছেন। তার অনেক ভাবনাকে তিনি গ্রহণ ও সংস্কার করেছেন। মােট কথা এলিয়াটিক দর্শন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জেনােফেনিসের প্রত্যক্ষ এবং প্রাথমিক ভূমিকা ও প্রভাবকে অস্বীকার করা চলে না। তবে এটাও ঠিক যে, সত্যিকারের দর্শন বলতে যা বােঝায় তার চর্চা এলিয়াতে শুরু করেছিলেন পারমেনাইডিস। এবং জেনাে তার তাত্ত্বিক আলােচনাকে উচ্চমাত্রায় যুক্তিনিষ্ঠ করে তােলায় এলিয়াটিক দর্শনের মান বৃদ্ধি পায়।
এক থেকে বহুর উদ্ভবের সমস্যার উপর গুরুত্ব প্রদান : এলিয়াটিক দর্শনে স্বকীয়তা রয়েছে। পিথাগােরীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের দার্শনিক চিন্তাধারা ছিল দ্বৈতবাদী, কিন্তু মাইলেসীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা ছিল একত্ববাদী। মাইলেসীয়ার দার্শনিকবৃন্দ বিশ্বের মৌলিক দ্রব্যের স্বরূপ সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেছিলেন এবং সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যেও সচেষ্ট হয়েছিলেন। সেটি হল, যে এক সব কিছুর মূল ভিত্তি, যে এক বিশ্বের মূলতত্ত্ব, সেই এক থেকে বহুত্বের এবং বিশেষের যে বৈচিত্র্য দেখা যায় তার উদ্ভব কিভাবে হয়? এই সমস্যার সমাধানের জন্য খুব আন্তরিক প্রচেষ্টা এ যাবৎ দেখা যায়নি। এখন এই সমস্যার সমাধানের প্রয়ােজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হল। এক এবং বহু, সৎ (Being) এবং অসৎ (Becoming), স্থিরতা এবং গতি ইত্যাদি আলােচনায় কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়াল এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দ এবং হেরাক্লিটাস এই আলােচনায় বিশেষভাবে ব্ৰতী হলেন। অনেকেই মনে করেন যে, এলিয়ার দার্শনিকগণের আবির্ভাবের পূর্বে ঠিক দার্শনিক চিন্তা বলতে যা বােঝায় তার সূচনা ঘটেনি। এতদিন যাবৎ যাকে দার্শনিক চিন্তা বলে অভিহিত করা হয়েছে তা অপরিণত চিন্তার সমষ্টি মাত্র, যার মধ্যে দার্শনিক চিন্তার বীজ অস্পষ্টভাবে বিদ্যমান, কিন্তু তাকে যথার্থ দার্শনিক চিন্তা বলে অভিহিত করা চলে না। তাই অনেকে মনে করেন এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দের দার্শনিক চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই যথার্থ দর্শনের আবির্ভাব ঘটেছে। এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জেনোফ্যানিস। পারস্য সম্রাট সাইরাস (৫৫৮-৫২৯ খ্রিঃপূঃ) যখন এশিয়া মাইনর জয় করে সমস্ত গ্রীক অধিকার করেন তখন বহু সভ্ৰান্ত গ্রীক নাগরিক বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়। পিথাগােরাসের অনুসারী কতিপয় ব্যক্তি দক্ষিণ ইতালিতে গিয়ে বসবাস শুরু করে। পিথাগােরাস শুধু দার্শনিক শিক্ষা দেননি, গৌতম বুদ্ধের ন্যায় তিনি একটি সম্প্রদায়ের (Botherhood) প্রতিষ্ঠা করেন। পণ্ডিত রাসেল বলেন, বুদ্ধিবাদের উত্তরাধিকারীর মধ্যে জেনােফ্যানিস তার নিজস্ব স্থান দখল করে নিলেও তিনি একজন স্বাধীন চিন্তাবিদ ছিলেন, প্রথম সারির বুদ্ধিবাদী চিন্তাবিদ ছিলেন না। এলিয়াটিক দর্শনে স্বকীয়তা রয়েছে। এলিয়াটিক দার্শনিকদের ঝোঁক ছিলাে একত্ববাদ বা অদ্বৈতবাদের দিকে। জগতের কারণ হিসেবে তারা অনেকেই কোন একক সত্তার অনুসন্ধান করেছেন। তবে মতবাদ যাই হােক না কেন স্বকীয় ভাবনা এবং দার্শনিক তথা যৌক্তিক পদ্ধতি প্রয়ােগে এবং পদ্ধতিগত আলােচনার দিক থেকে এলিয়াটিক দর্শন ছিলাে সর্বপ্রথম সমৃদ্ধ দার্শনিক আন্দোলন। এ প্রসঙ্গে W. T. Stace বলেন : “… with the Eleatics we step out definitely for the first time upon the platform of philosophy. Eleaticism is the first true philosophy.” (W.T. Stace, A Critical History of Greek Philosophy, p. 41).
জেনােফ্যানিস (আনু. ৫৭০-৪৭৮ খ্রিঃপূঃ)
জীবনী
এলিয়াটিক সম্প্রদায়ের সাথে জেনােফেনিসের (Xenophanes, ৫৭০-৪৭৮ খ্রিঃপূঃ) নাম আবশ্যিকভাবে যুক্ত। তিনিই এই সম্প্রদায়ের সূচনা করেন। দার্শনিক চিন্তার উৎকর্ষতার বিচার না করেও প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে এলিয়াটিক সম্প্রদায়ের জনক বা প্রতিষ্ঠাতা বলা অসঙ্গত হবে না বলেই মনে হয়। এবং আজ অবধি এই সম্প্রদায়ের জনক হিসেবেই তিনি বেশী পরিচিত। তবে তিনি এলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেননি, প্রাচীন গ্রিসের আয়োনিয়া দ্বীপের কলােফন (Colophon) নামক নগরে আনু. ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলে মনে করা হয়। (W.T. Stace, A Critical History of Greek Philosophy, p. 41)। কাজেই অনেকে মনে করেন যে, জেনােফ্যানিস হলেন এলিয়ার দর্শন সম্প্রদায়ের একজন পৃষ্ঠপােষক, তবে এলিয়ার দর্শন সম্প্রদায়ের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন পারমিনাইডিস। কিন্তু পরে পারমিনাইডিস জেনােফ্যানিসের চিন্তার মধ্য থেকে কিছু কিছু চিন্তাকে দার্শনিক নীতিতে পরিণত করেছিলেন, সেই কারণে জেনােফ্যানিসের দার্শনিক চিন্তাকেও এলিয়াটিক সম্প্রদায়ের চিন্তাধারায় ধরা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৫ অব্দে জেনােফ্যানিসের মাতৃভূমি কলোফন পারসিকদের দ্বারা অধিকৃত হওয়ায় ফলে জেনেফ্যানিস সেখান থেকে পালিয়ে যান। যৌবনে তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান এবং দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব চর্চা করেন। তবে এসময় একজন চারন কবি হিসেবেও তিনি পরিচিতি লাভ করেন। এক পর্যায়ে তিনি ইতালি গমন করেন এবং দক্ষিণ ইতালির এলিয়াতে বসতি স্থাপন করেন। তবে সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিলেন কি না এ বিষয়ে ভাষ্যকারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
কিন্তু এটি অবিতর্কিত যে, তিনি এলিয়াতে একটি দার্শনিক সম্প্রদায়ের সূচনা করেছিলেন। এই দার্শনিক সম্প্রদায়ই এলিয়াটিক দার্শনিক সম্প্রদায় বলে খ্যাত। তিনি হেরাক্লিটাসের সমসাময়িক ছিলেন। দর্শন ছাড়া কবিতা ও ধর্মের প্রতি তার আকর্ষণ ছিলাে। তিনি ছিলেন একজন কবি, আর কাব্যচর্চাই ছিল তার জীবিকা নির্বাহের মূল অবলম্বন। পরে তিনি একজন প্রহসনকার ও ধর্মসংস্কারক হিসেবে প্রসিদ্ধিলাভ করেন। প্রহসন রচয়িতা হিসেবে তিনি তদানীন্তন সমাজের দুর্নীতি ও অসারপ্রিয়তার নিন্দা করেন এবং মানুষকে অনাড়ম্বর ও সরল জীবনযাপন ও জ্ঞানানুশীলনের উপদেশ দেন। ঐশ্বর্য ভােগবিলাস জাঁকালাে বেশভুষা উগ্র সুগন্ধি প্রভৃতিকে তিনি অপছন্দ করেন। শুধু তাই নয়, সেদিনের সমাজের আত্যন্তিক ক্রীড়াপ্রীতিরও তিনি নিন্দা করেন। তার মতে, নির্মল জ্ঞানচর্চার চেয়ে মাংসপেশী সঞ্চালনের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরােপ নিতান্তই দুঃখজনক। যুদ্ধবিগ্রহ, প্রচণ্ড বিপ্লব, দৈত্যদানবের রূপকথা, এদের কোনােটিই প্রশংসনীয় নয় বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। এসব পরিহার করে সত্য ও সুন্দরের অনুসন্ধান তথা যথার্থ জীবনযাপনের জন্য তিনি জনগণের কাছে আবেদন জানান। কথিত আছে যে, নব্বই বছর বয়সেও তিনি কবিতা রচনা করতেন। তার দার্শনিক চিন্তা তার কবিতাতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে তিনি দার্শনিক কবিতা লেখেননি, তিনি লিখেছেন নানা বিষয়ে শােকসঙ্গীত, তিনি রচনা করেছেন বিদ্রুপাত্মক সাহিত্য এবং প্রসঙ্গক্রমে এগুলোতে তার ধর্ম সম্পর্কীয় মতামত প্রকাশিত হয়েছে। এই সব কবিতার অংশবিশেষ পাওয়া গেছে।
ধর্মীয় আলোচনায় উৎসাহ, বহুঈশ্বরবিরোধিতা ও একেশ্বরবাদের প্রচার
দর্শন আলােচনার তুলনায় জেনােফ্যানিস ধর্মের আলােচনায় বিশেষ করে উৎসাহী ছিলেন। ধর্মতাত্ত্বিক আলােচনার ক্ষেত্রে প্রাচীন যুগে জেনােফেনিস সুনাম লাভ করেন। জেনােফ্যানিস তার সমসাময়িক বহুঈশ্বরবাদের, বিশেষ করে এর অবতারবাদী বিশ্বাসের তীব্র সমালােচনা করেন। প্রচলিত গ্রীক ধর্মমত বহুদেবদেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত এবং এইসব দেবদেবীর উপর মানব বৈশিষ্ট্য আরােপ করে এদের মানুষের মত কল্পনা করত। জেনােফ্যানিস এর অযৌক্তিকতা তুলে ধরেন এবং মনুষ্যরূপী এই সব দেবদেবীর তীব্র সমালােচনা করেন। তার মতে, ঈশ্বরের আকৃতি অকল্পনীয়। মানবাকৃতি হােক আর অন্য কোন আকৃতিতেই হােক ঈশ্বরকে কোন আকৃতি প্রদান করা ঈশ্বরের ধারণাকে বিকৃত করে। দেবতাদের নরমুর্তিধারী ও নরসুলভ গুণসম্পন্ন বলে কল্পনা করার সমালােচনায় তিনি বলেন, “যদি ষাঁড়, ঘােড়া বা সিংহের হাত থাকত এবং হাত দিয়ে চিত্র অঙ্কন করতে পারত বা মানুষের মত কলা (Art) সৃষ্টি করতে পারত তাহলে ঘােড়ারা দেবতাদের আকৃতি ঘােড়ার মত এবং ষাঁড়েরা ষাঁড়েদের মত আকৃতি চিত্রিত করত এবং নিজেদের বিভিন্ন ধরনের আকৃতির কল্পনায় তাদের দেহ আঁকত।” তাছাড়া দেখা যায় যে, “ইথিয়পীয় দেবমূর্তি কালাে এবং বোচা নাকওয়ালা, থ্রেসীয়দের দেবতা লাল চুলাে, নীল নয়নবিশিষ্ট।” জেনোফ্যানিস বলেন, মরণশীল জীবের সঙ্গে বুদ্ধি বা আকৃতির দিক থেকে এই ঈশ্বরের কোন তুলনা হয় না। তার সাথে কোন কিছুর তুলনা করা যায় না। তাই জাগতিক কোন কিছুর আদলে তাকে কল্পনা করা চলে না। এটা ঈশ্বরের জন্য শােভনীয়ও নয়। ঈশ্বরকে মানবীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহকারে প্রকাশ করা এক ধরনের অর্থহীন প্রচেষ্টা। কেননা ঈশ্বর আমাদের মতাে চোখধারী নন, তিনি হচ্ছেন সর্বদ্রষ্টা: ঈশ্বর আমাদের মতাে কর্ণধারী নন, তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রোতা। এভাবে ঈশ্বর হলেন সর্ব বিষয়ে পরমমান। তিনি মুর্তিপূজারও বিরােধিতা করেন। তার মতে, ঈশ্বরকে ভক্তি করা মনের ব্যাপার। এজন্য ঈশ্বরকে আকৃতি দিয়ে সামনে রাখার কোন দরকার নেই। যে আকৃতিই দেয়া হােক না কেন তা হবে আমাদের সসীম মনের সীমাবদ্ধ চিন্তার ফসল। কিন্তু ঈশ্বর অসীম। তার প্রকৃতিকে মানুষ অথবা অন্যকোন প্রাকৃতিক সত্তার সাথে তুলনীয় হতে পারে না। গ্রীক উপাখ্যানে বর্ণিত দেবদেবীর স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন তিনি অবিশ্বাস্য মনে করতেন। তার মতে তিনি সবসময় একই স্থানে বিরাজ করেন। তিনি গতিশীল নন; একবার এখানে, একবার ওখানে যাতায়াত করা তার মানায় না। তার মতে দেবদেবীর জন্মবৃত্তান্তও একান্ত অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
তিনি যথার্থই বুঝেছিলেন যে, আয়োনীয় বিজ্ঞান আর পরিমার্জিত সাংস্কৃতিক ভাবধারা – এদের কোনােটিরই প্রচলিত ধর্মের সাথে যােগাযােগ ছিল না। আর তিনি নিজেও চলতি ধর্মমত সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পােষণ করতে পারেন নি। প্রচলিত ধর্মমত ও বিশ্বাসে দেবদেবীদের সম্পর্কে যে চিত্র তিনি দেখতে পান তাতে তিনি ব্যথিত হন। এর নৈতিক নিম্নমান ও বৌদ্ধিক অসারতার কারণে তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। যেমন, হােমার, হেসিয়ড প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকরা ঈশ্বরকে নানারূপে চিত্রায়িত করেছেন, তারা চৌর্য, চরিত্রদোষ, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি যেসব দোষ দেবদেবীদের ওপর আরােপ করেছিলেন, সেগুলাে মানুষের বেলায় লজ্জাকর ও অসম্মানজনক। দেবতাদের অনৈতিক বলে চিত্রিত করে হােমার ও হেসিয়ড তাদের স্বভাব সম্পর্কে এক বিকৃত ধারণা দিয়েছিলেন। জেনােফেনিসের মতে, এতে করে ঈশ্বরের নির্মল প্রকৃতিকে বিকৃত করা হয়েছে। এগুলো এক দিক দিয়ে যেমন দেবদেবীদের মর্যাদার হানি ঘটায় অন্য দিক দিয়ে দেবদেবীদের অনৈতিক আচরণ অনুকরণে উৎসাহিত করতে পারে। একথা ভেবে জেনােফ্যানিস দেবদেবীদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ এক চিত্র একেছিলেন। তার মতে দেবদেবীরা আদর্শ স্বভাবের অধিকারী। তাদের আচরণ সম্পূর্ণ নৈতিক এবং মানুষের পক্ষে অনুকরণযােগ্য। তবে জেনোফ্যানিস নিজেও কবি ছিলেন। তাই কবিদের প্রতি তার কোন বিরাগ ছিলাে না। কিন্তু ধর্মের প্রতি দুর্বলতার জন্য তিনি কবিদের কিছু অহেতুক কর্মকান্ডের তীব্র সমালােচনা করেন। এসব কারণে বহুঈশ্বরবাদের বদলে জেনােফেনিস একেশ্বরবাদ গ্রহণ ও প্রচার করেন। তার মতে ঈশ্বর বহু হতে পারে না, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বর এক ছাড়া বহু হতে পারে না, যা সর্বোত্তম তা একই হতে পারে।
কিন্তু কেন মানুষ ঈশ্বরকে নিয়ে এরকম কল্পনা করেন? এক্ষেত্রে জেনােফ্যানিসের চিন্তায় একধরনের সতর্ক সংশয়বাদের ইংগিত পাওয়া যায়। তিনি বলেন ধর্ম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান অনিশ্চিত ও অসম্পূর্ণ। এজন্যই ধর্ম বিষয়ে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন মত পােষণ করে থাকে। দেবদেবী ও অন্যান্য যেসব ব্যাপারে আমরা আলােচনা করি তাদের সম্পর্কে কেউ কোনােদিন নিশ্চিত ছিল না, কোনােদিন হবেও না, কারণ যদিও কেউ দৈবক্রমে খাঁটি কথা বলে ফেলেন, তবু তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন না যে তার কথাটি খাঁটি। এ পরিস্থিতিতে অনুমান করার ব্যাপারে সবাই স্বাধীন। ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাপারে নিশ্চিত জ্ঞানলাভ অসম্ভব – জেনােফ্যানিসের এ মতে আধুনিক সংশয়বাদের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। বিশেষ করে প্রকৃতিবাদের সমর্থক হিসেবে তাকে নিঃসন্দেহে আধুনিক বলা চলে। এই প্রকৃতিবাদী মনােভাবই জেনােফ্যানিসের দার্শনিক প্রভাবের উৎস, এবং এটিই ছিল তার দার্শনিক খ্যাতি ও মর্যাদার কারণ। তিনি পিথাগােরাসের অতীন্দ্রিয়বাদেরও বিরােধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে যথার্থ সত্য আবিষ্কার করা সম্ভব নয়, যে কোনাে সিদ্ধান্ত অনুমানমূলক।
একেশ্বরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ ও অদ্বৈতবাদ
‘প্রকৃতি প্রসঙ্গে’ (‘On Nature’) নামক একটি কবিতায় তিনি প্রকৃতির স্বরূপ সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত অভিমতের কথা ব্যক্ত করেছেন। তার দর্শনের মূল কথা হল, সকল কিছুর ঐক্য অর্থাৎ ‘সবকিছুর এক’-এই বিষয়টি ঘােষণা করা। এই এক, যা হল সব কিছু, হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর জগতের অতিবর্তী নন, জগতের সঙ্গে আঙ্গিক সম্পর্কে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। এই ঈশ্বর, সাধারণ দেবতাদের কবিরা যেভাবে চিত্রিত করেছেন তার থেকে স্বতন্ত্র। তিনি হলেন সর্বচক্ষু, সর্বকর্ণ, সর্বচিন্তা। বিনা প্রচেষ্টায়, শুধুমাত্র মনের শক্তির দ্বারাই তিনি সকল কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তার মতে ঈশ্বর এক ও অপরিণামী নিত্যসত্তা। তিনি নিশ্চল, এক জায়গায় অবস্থান করেন। তবে তিনি সবকিছু দেখেন, সমগ্রকে অনুভব করেন, সবকিছু শােনেন। ঈশ্বর অনন্ত। তার শুরু কিংবা শেষ নেই। তার পাশে কিছুই নেই। এদিক থেকে তিনি অসীম। আবার অন্য এক অর্থে তাকে সসীম বলা চলে; কেননা তিনি পূর্ণ ও নিখুঁত আকারবিশেষ, নিরাকার অসীম নন। সামগ্রিক অর্থে তিনি অনড়, কেননা গতি তার একত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে সমগ্র হিসেবে গতিহীন হলেও অংশগুলােতে গতি ও পরিবর্তন রয়েছে। তার মতে, একক সত্তা হিসেবে ঈশ্বর অনাদি ও অবিনশ্বর। তার উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। একক’ হলাে এমন সত্তা যা অদ্বিতীয়। তাই অন্য কোন সত্তা তার সমসাময়িক থাকা সম্ভব নয়। সেকারণে অন্য কোন সত্তা দ্বারা একক ঈশ্বরের সৃষ্টি হওয়ার কোন সুযােগ নেই। আবার একের মধ্যে যা আছে বা ঈশ্বরের মধ্যে যা আছে তা দিয়ে ঈশ্বর সৃষ্টি হয় — এমন ধারণা হাস্যকর। তাই ঈশ্বর অনাদি। তার ধ্বংস কল্পনা করা চলে না। কেননা ধ্বংস করার মতাে তার থেকে কোন উচ্চতর সত্তা নেই।
জেনােফ্যানিস অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ প্রচার করেছেন এরূপ ধারণা করলে ভুল করা হবে। অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ অনুসারে, সেনাপতি যেমন তার সৈন্যদের শাসন করেন তেমনি ঈশ্বর জগতবহির্ভূত সত্তারূপে জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু জেনােফ্যানিসের একেশ্বরবাদকে এত সহজ প্রচলিত অর্থে নেয়া চলে না। সাধারণ অর্থে এক ঈশ্বর বলতে যা বোঝানো হয়, তিনি ঠিক তা বোঝাতে চান নি। বরং এমন কথাই বলা যুক্তিযুক্ত হবে যে, জেনােফ্যানিস ঈশ্বর ও জগতকে অভিন্ন গণ্য করতেন। তার মতে, জগতই ঈশ্বর, একটি ইন্দ্রিয়বিহীন চেতন সত্তা। জেনােফেনিস সবকিছুই ‘এক’ (all is one)’ এবং ‘এক’ ছাড়া অন্য কোন কিছুর বাস্তবতা নেই মনে করেছেন, তার মতে, সমগ্র জগৎ-সংসার এক ঈশ্বরেরই প্রকাশ। অর্থাৎ তিনি ঈশ্বর ও জগতকে অভিন্ন মনে করেছেন, বলেছেন জগৎ হলাে ইন্দ্রিয়হীন এক সচেতন সত্তা। অ্যারিস্টটল মেটাফিজিক্সে বলেন যে, জেনােফ্যানিস সমস্ত বিশ্বের দিকে তাকিয়ে বলতেন, একই ঈশ্বর। কাজেই জেনােফ্যানিসের অভিমতকে একেশ্বরবাদ (Monotheism) না বলে, যথাযথভাবে অভিহিত করতে গেলে সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism) নামে অভিহিত করা যেতে পারে। ঈশ্বর বলতে তিনি কোন আধ্যাত্মিক সত্তাকে বোঝেননি, বুঝেছেন প্রকৃতি জগতকে। ঈশ্বর ও জগতের তুলনায় তিনি ঈশ্বরের চেয়ে জগতের উপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করেছেন। জেনেফ্যানিসের মতে, একই ঈশ্বর। এই এক হল অপরিণামী, পরিবর্তনাতীত, অবিভাজ্য, স্থির, আবেগ বিযুক্ত এবং গতিহীন। এই এক হল সনাতন, কেননা এর উৎপত্তি বা বিনাশের কথা চিন্তা করা যায় না। যা চিরস্থায়ী, তার থেকেই এই একের উৎপত্তি এমন কথা বলা চলে না। কেননা যা এক এবং যা চিরস্থায়ী, দুই অভিন্ন। আবার যার স্থায়িত্ব নেই, যা নেই, তার থেকে একের উৎপত্তি সম্ভব নয়। যা অস্তিত্বহীন তা কখনও কোন কিছু উৎপাদন করতে পারে না। এই এক চিরস্থায়ী, নিত্য। অতীতে, বর্তমানে, ভবিষ্যতে সর্বকালেই তার অস্তিত্ব থাকবে।
জেনোফ্যানিস এক ঈশ্বর বলতে তিনি বুঝেছেন এক অনন্ত বিকারহীন প্রকৃতিজগৎকে। একথা অবশ্য ঠিক যে অতীতে প্রকৃতিতে এমন সব গুণ আরােপ করা হয়েছে পরবর্তীকালে যাদের অজড়ীয় আধ্যাত্মিক বলে ধরে নেয়া হয়েছে। এ থেকে বােঝা যায় যে, জড় ও অজড়ের মধ্যে আজকাল যে সুস্পষ্ট পার্থক্য করা হয়ে থাকে, গ্রিকরা তখনও তা করতে শেখেনি। প্লেটোর সময় পর্যন্ত গ্রিক দার্শনিকদের অনেকেই সত্তায় কিছু আধ্যাত্মিক গুণ আরােপ করেছেন। কিন্তু করতে গিয়ে তারা সত্তার ভৌত বা জড়ীয় বৈশিষ্ট্যকে মােটেও অস্বীকার করেন নি। মােটকথা, জেনােফ্যানিস ছিলেন সর্বেশ্বরবাদী। ঈশ্বর বলতে তিনি কোনাে আধ্যাত্মিক সত্তাকে বােঝেন নি, বুঝেছেন প্রকৃতিজগৎকে। ঈশ্বর ও জগৎ – এ দুটিকে এক বলে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বেশি গুরুত্ব আরােপ করেছেন জগতের ওপর, ঈশ্বরের ওপর নয়। তিনি চেয়েছেন ঈশ্বরকে প্রাকৃতিক শক্তিসমূহে রূপান্তরিত করতে, প্রকৃতিকে স্বর্গীয় স্তরে উন্নীত করতে নয়। তবে তিনি নিশ্চল একক ঈশ্বর এবং পরিবর্তনশীল ইন্দ্রিয়জগতের বিরােধ মীমাংসা করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে হয় না। তার উত্তরসূরিদের জন্য এই বিরােধ ছিল একটি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। প্রকৃতিকে প্রাণবিশিষ্ট ভেবে তিনি আদি গ্রিকদের সজীব জড়বাদ গ্রহণ করেছেন। তবে তিনি যদি কখনাে বহু ঈশ্বরবাদের দেবদেবীতে বিশ্বাস করে থাকেন, তা করেছেন দেবদেবীদের জগতের অংশ কিংবা প্রাকৃতিক সত্তা ভেবে।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অনেকে জেনােফ্যানিসকে একেশ্বরবাদী হিসেবে অভিহিত করলেও কপলস্টোন ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাকে একত্ববাদী ব অদ্বৈতবাদীরূপে গণ্য করার পক্ষপাতী। কপলস্টোন তাকে একেশ্বরবাদী হিসেবে গণ্য করতে নারাজ, কারণ তার মতে, জেনােফ্যানিসকে অদ্বৈতবাদীরূপে গণ্য করাই তার প্রতি এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দের মনােভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাছাড়া তার মতে, সেই সময় গ্রীসদেশে একেশ্বরবাদী ধর্মতত্ত্ব খুব একটা পরিচিত বিষয় ছিল এরূপ মনে করা যুক্তিযুক্ত হবে না। রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেন, ‘জেনােফ্যানিস রামানুজের চেয়েও স্পষ্টভাবে ঈশ্বর ও জগতের অভিন্নতাকে মেনে নিয়েছেন।’ যাই হোক, যেহেতু তিনিই ‘সব কিছু এক’ এই বচনের প্রথম প্রবক্তা, দর্শনে তিনি একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তার এই চিন্তার উপরই এলিয়ার দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেন পারমিনাইডিস। সত্তার স্বরূপ সম্পর্কে জেনােফ্যানিসের মতবাদে এলিয়াটিক দার্শনিক নীতির, বিশেষ করে পারমেনাইডিসের মতের পূর্বাভাস রয়েছে। নিত্য ও অপরিণামী ‘এক’-এর সঙ্গে অনিত্য, চঞ্চল ও পরিণামী বহুর সম্বন্ধ নিয়ে মাইলেসীয় কিংবা পিথাগােরীয়দের কেউ চিন্তা করেন নি। এলিয়াটিক দার্শনিকরাই প্রথম এ বিষয়ে আলােচনা শুরু করেছিলেন। আর এলিয়াটিকদের মধ্যে জেনেফ্যানিসই সর্বপ্রথম এ প্রশ্নটিকে মৌলিক বলে ঘােষণা করেছিলেন। এদিক থেকে তাকে সত্তাবিষয়ক আলােচনার প্রবর্তক ও পথিকৃৎ বলা যায়।
নৈতিক, পারলৌকিক ও বিশ্বতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
জেনােফেনিস আত্মা, পরকাল, পাপ-পুণ্য ইত্যাদির অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। (W.T. Stace, p. 42) তাই তিনি ধর্মীয়-নৈতিক জীবনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। সেজন্য তাকে অনেকেই ধর্মীয় সংস্কারক বলেও অভিহিত করেন। এইদিক থেকে জেনােফেনিসের গুরুত্ব নির্ণয় করতে গিয়ে জেলার বলেন: “তার সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব হলাে এই যে, তিনি নিজেকে নাস্তিকতার দিকে চালিত করেননি; বরং ঈশ্বরের ধারণাকে সর্বপ্রথম মানবােচিত ক্রটি থেকে মুক্ত করে ঈশ্বরের গভীরতর ধারণার পথকেই যে শুধু স্পষ্ট করে তুলেছেন তা নয়, বরং ধর্মানুরাগ তথা ঈশ্বর ভক্তিকে সর্বপ্রকার কুসংস্কার থেকে মুক্ত করেছেন। এর সার কথা হলাে নৈতিক চিন্তা বা নৈতিক আচরণ। জগতের ঐক্য, এবং ঈশ্বর ও প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্যতার ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই ধর্মতত্ত্বই হচ্ছে জেনােফেনিসের দার্শনিক চিন্তার সর্বোত্তম দিক।” (E. Zeller, Outlines of the History of Greek Philosophy.)। তিনি পরকালে বিশ্বাস করলেও পিথাগােরাসের মতো জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতেন না। তার মতে, যারা মরে গেছে তারা আর এই পার্থিব জগতে ফিরে আসবে না। তারা পরকালীন জীবনে ঈশ্বরের সামনে উপস্থিত হবে। ঈশ্বরের বিচার অনুযায়ী তারা স্বর্গ বা নরকপ্রাপ্ত হবে।
জেনােফেনিস ঈশ্বরতত্ত্ব ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে আলােচনা করেছেন। তিনি কিছু প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক মতবাদ দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন। পাথরে সামুদ্রিক দ্রব্যের নমুনা থেকে তিনি অনুমান করেন যে, মানুষসহ সকল প্রাণী মাটি ও জল থেকে উদ্ভূত। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, জগতের প্রাথমিক পর্যায় সমুদ্র, সমুদ্রাবস্থা থেকে ক্রমশ বিশ্ব এই অবস্থা ধারণ করেছে। অতীতের কোনাে একসময় পৃথিবী সমুদ্রের সাথে যুক্ত ছিল। কালক্রমে তা পৃথক হয়ে যায়। ভবিষ্যতের কোনাে একসময় জগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে ও পৃথিবী পুনরায় সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে কাদায় পরিণত হবে। কিন্তু আবারও সমুদ্র থেকে জগৎ জেগে উঠবে। সৃষ্টি হবে মানুষসহ সকল প্রকার জীব-জন্তু-উদ্ভিদ। আবার নতুন করে মনুষ্যজাতির সৃষ্টি হবে। জেনােফেনিস সৃষ্টিবাদী ছিলেন না কি বিবর্তনবাদী ছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। সমুদ্র থেকে ক্রমান্বয়ে বিশ্ব বিকশিত হয়েছে – এ তত্ত্ব বিবর্তনবাদের ইংগিত বহন করে। কিন্তু অন্যত্র তিনি বলেছেন যে, ঈশ্বরের ইচ্ছায় জগতের সবকিছু হয়। তিনি কেবল ইচ্ছা করলেই সবকিছু হয়ে যায়। কোন কিছুর সাহায্যে তাকে কোন কিছু সৃষ্টি করতে হয় এই বিশ্বাস নি:সন্দেহে সৃষ্টিবাদকে অনুমােদন করে।
জেনােফ্যানিস বহু সূর্য ও চন্দ্রের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সূর্য একটি জ্বলন্ত বাষ্পকুন্ডলী, বিভিন্ন আগ্নেয় কণিকার সমবায়ে রােজ রােজ সূর্য গঠিত হচ্ছে। এটা সরল রেখায় চলে। সারাদিন চলতে চলতে এটা সন্ধ্যাবেলা বায়ুতে মিশে নিঃশেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ বায়ু হয়ে যায়। পরের দিন আবার একটি নতুন সূর্য ওঠে। এভাবে সূর্যের সৃষ্টি ও বিনাস প্রক্রিয়া চলতে থাকে। অর্থাৎ একই সূর্য প্রতিদিনই প্রাতঃকালে উদিত হয় না। সমুদ্রের বাষ্প থেকে নিত্যই একটি করে নতুন সূর্য তৈরি হয়। তার এই ধারণা তার এক বিশেষ ধর্ম সম্পর্কীয় মনােভাবের সূচক। তার উদ্দেশ্য এই কথা ব্যক্ত করা যে সূর্য, নক্ষত্র প্রভৃতি ঐশ্বরিক বস্তু নয়। এগুলো নশ্বর বস্তু, ক্ষণস্থায়ী। এদিকে উত্তপ্ত মেঘ থেকে নক্ষত্রপুঞ্জের উৎপত্তি। দিনের বেলায় এরা নিভে যায় এবং রাতের বেলায় পুনরায় প্রজ্বলিত হয়। তাদের উদয় ও অস্ত বলতে এভাবে প্রজ্বলিত ও নির্বাপিত হওয়াকেই বোঝায়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সূর্য রয়েছে। কোনাে এক সময় সূর্যের সামনের দিক পৃথিবীর এমন এক স্থানে এসে পৌঁছায় যেখানে কোনাে জনবসতি নেই। স্বাভাবিক কারণেই তখন মানুষের কাছে মনে হয় সূর্য যেন একটি গর্তে প্রবেশ করেছে। সূর্যগ্রহণ বলতে সূর্যের এই অবস্থাকেই বুঝায়। সূর্য যে দূরত্ব পরিভ্রমণ করে থাকে তার কোনাে শেষ বা সীমানা নেই। তৎকালীন গ্রিসসহ অনেক দেশে চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্রের মধ্যে প্রাণ আছে, এমনকি এদেরকে ঐশ্বরিক বা দেবতা বলে মনে করা হতাে। জেনােফেনিস এই ধরনের ধারণার প্রত্যক্ষ বিরােধিতা করেন।
জেনােফ্যানিসের বিশ্বতাত্ত্বিক মতবাদ, বিশেষ করে নক্ষত্ররাজিকে রাতের বেলা প্রজ্জ্বলিত এবং দিনের বেলা নির্বাপিত মেঘ বলে মনে করার তার ধারণাকে আদিম বলে মনে হয়। একথাও ঠিক যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার চিন্তা ছিল অসংবদ্ধ। তার রচনায় যুক্তিবাদী দার্শনিকের চেয়ে আবেগবান কবির ছাপই বেশি লক্ষণীয়। এতকাল আমরা ইতিহাসদৰ্শন বলতে যা বুঝি, সে সম্পর্কেও তার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল। সে দিনের মানুষের ধারণা ছিল যে, দেবদেবীরাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসার ও অগ্রগতির মূলে। জেনােফ্যানিস এ মতের বিরােধিতা করেন। তার মতে দেবদেবীরা নয়, মানুষ নিজেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সংঘটক ও পরিচালক। এ যুক্তিতেই তিনি ঘােষণা করেন যে, আগুন কোনাে দেবতার দেয়া বস্তু নয়, মানুষেরই আবিষ্কার।
জেনােফ্যানিসের অবদান
জেনােফ্যানিস যে একজন প্রথম শ্রেণীর দার্শনিক ছিলেন না, এ বিষয়ে হয়ত কেউ দ্বিমত হবেন না। কিন্তু গ্রীক দর্শনে বিশিষ্ট লেখকবৃন্দ তার অভিমতের আলােচনা প্রসঙ্গে তার কিছু অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। জেলার (Zeller) বলেন, “তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল যে তিনি ঈশ্বরের ধারণাকে সকল রকম মানববাচিত ত্রুটি থেকে মুক্ত করে ঈশ্বরের গভীরতর ধারণার পথকেই যে শুধু সুস্পষ্ট করে তুলেছেন, সেই সাথে ধর্মানুরাগ বা ঈশ্বর ভক্তিকে তিনি সকল রকম কুসংস্কার থেকে মুক্ত করেছেন, যার সার কথা হল, নৈতিক চিন্তা ও নৈতিক আচরণ। এই ধর্মদর্শন, যা জগতের ঐক্য এবং ঈশ্বর ও প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্যতার ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, জেনােফ্যানিসের দার্শনিক চিন্তার সর্বপ্রধান গুণ। তিনি এককে নিত্য, অপরিণামী বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই নিত্য সনাতন এক, পরিণামী অনিত্য বহুর সঙ্গে কিভাবে সম্বন্ধযুক্ত হতে পারে, বহুর উদ্ভব এক থেকে কিভাবে সিদ্ধ হল, এই সব প্রশ্নের উত্তর জেনােফ্যানিস দেননি। এই অবভাসিক জগতের সঙ্গে এক ঈশ্বরের সম্বন্ধ তিনি কিভাবে চিন্তা করেছেন, তা আমরা জানতে পারি না। কিন্তু নিত্য ও অনিত্যের মধ্যে যে মৌলিক দ্বন্দ্ব বর্তমান তার আভাস তিনি দিয়েছেন, যা পরবর্তী দার্শনিকদের কাছে একটি বিরাট সমস্যারূপে দেখা দিয়েছে এবং যার সমাধানের জন্য তারা ব্রতী হয়েছেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ঈশ্বরকে জগতের অন্তর্বর্তী গণ্য করে তাকে এক অপরিণামী সৎ-এর সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছেন। তিনিই ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকে অনির্ভরযােগ্য গণ্য করে তার উপর চিন্তার প্রাধান্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এই সব কারণে জেলার মনে করেন যে, তিনি যে গ্রীক দর্শনে এক নতুন ধারার প্রতিষ্ঠাতা তা সুস্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হয়। বস্তুত তিনি উপনিষদের ঋষির মত বলেছেন, সব কিছুই একের মধ্যে নিমজ্জিত এবং সেই এক হলেন ঈশ্বর।
পারমিনাইডিস (৫১৪-? খ্রিঃপূঃ)
ভূমিকা ও জীবনী
পারমিনাইডিস (Parmenides, ৫১৪-? খ্রিঃপূঃ) এলিয়াটিক দর্শন সম্প্রদায়ের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও তাকে দক্ষিণ ইতালির এলিয়া নগরের দার্শনিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দার্শনিকরূপে গণ্য করা হয়। জেনোফ্যানিসকে কেউ কেউ এলিয়ার দর্শন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠারূপে গণ্য করতে চান। কিন্তু অনেকের মতে, তিনি হলেন এলিয়ার দর্শন সম্প্রদায়ের একজন পৃষ্ঠপােষক মাত্র। কেউ কেউ বলেন, দার্শনিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এলিয়ার দর্শন সম্প্রদায়ের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন পারমিনাইডিস। পারমিনাইডিস ছিলেন এলিয়ারই নাগরিক। তিনি ছিলেন একটি মহৎ ও ধনী পরিবারের সন্তান। খ্রিস্টপূর্ব ৫১৪ অব্দে এলিয়াতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। চন্দ্র সূর্যের দ্বারা আলোকিত হয়, সকালের এবং সন্ধ্যাবেলার তারা ভিন্ন তারা নয়, তারকা হিসেবে এগুলো অভিন্ন, পৃথিবীর আকার বর্তুলাকার-এই জাতীয় অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞানের তিনি অধিকারী ছিলেন এবং এই জ্ঞান তিনি পিথাগোরীয় দর্শনের ভক্ত হিসেবে প্রচার করেন, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি তার নিজের দর্শন প্রচার করেন। যৌবনে তিনি পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। রাসেলের মতে, এই প্রভাবিত হওয়ার মাত্রাটি অনুমানমূলক। তিনি পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের প্রমাণের গাণিতিক পদ্ধতি (Mathematical Method of Proof) দার্শনিক সমস্যার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আকারনিষ্ঠ তর্কবিজ্ঞান (Formal Logic) আবিষ্কার করেন। তার চিন্তাশক্তির গভীরতা এবং চরিত্রের মহত্ত্বের জন্য তিনি প্রাচীনকালে বিশেষভাবে সমাদর লাভ করেছিলেন। প্লেটো সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে তার কথা উল্লেখ করতেন। সাধারণত তাকে জেনোফ্যানিসের শিষ্য মনে করা হয়। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিদ্যা এবং অন্যান্য বিজ্ঞান সম্পর্কেও অনেক কিছু লিখেছেন।
জেনোফ্যানিসের মত পারমিনাইডিস স্বরচিত এক কাব্যে তার দর্শন বিবৃত করেছেন। কাব্যের শুরুতে দেখা যায় কবি অশ্বচালিত রথে দেবীর কাছে উপস্থিত হলেন যিনি কবির কাছে একাধারে সত্য এবং মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাসের কথা প্রকাশ করলেন। এই কাব্যের দুটি অংশ – প্রথম অংশে সত্যের বর্ণনা। দ্বিতীয় অংশে ভ্রান্ত বিশ্বাসের বর্ণনা। প্রথম অংশের নাম সত্যের পথ (The way of Truth), দ্বিতীয় অংশের নাম বিশ্বাস বা মতামতের পথ (The Way of Belief or Opinion)। প্রথম অংশে তিনি তার নিজ দার্শনিক মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। এই অংশে আছে শুদ্ধ সত্তার (Pure Being) ধারণার আলোচনা। দ্বিতীয় অংশে আছে ব্যবহারিক জগতে প্রচলিত বিভিন্ন ভ্রান্ত বিশ্বাস বা মতের আলোচনা (Belief or Opinion)। প্রথম অংশে তিনি তার নিজ দার্শনিক মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। এই অংশে আছে শুদ্ধ সত্তার (Pure Being) ধারণার আলোচনা। দ্বিতীয় অংশে আছে ব্যবহারিক জগতে প্রচলিত বিভিন্ন ভ্রান্ত বিশ্বাস বা মতের আলোচনা। পারমিনাইডিসের দার্শনিক মতবাদকে অতি সংক্ষেপে ব্যক্ত করা যায় এইভাবে ‘কেবলমাত্র সত্তা অস্তিত্বশীল , অ-সত্তা অস্তিত্বশীল নয় এবং তাকে চিন্তা করা যায় না’ (Only Being is, not being is not and cannot be thought)। এই মৌলিক ধারণা থেকেই তিনি সত্তার প্রকৃতি সম্পর্কে সকল রকম ধারণা গঠন করেছিলেন।
সত্তা নিয়ে পারমিনাইডিসের দর্শন
সত্তাই একমাত্র তত্ত্ব : পারমিনাইডিসের দর্শন অনুসারে কেবলমাত্র সত্তারই যথার্থ অস্তিত্ব আছে। থেলিস যেমন জলকে, অ্যানাক্সিমিনিস বায়ুকে, পিথাগোরীয় সম্প্রদায় সংখ্যাকেই একমাত্র তন্তুরুপে ঘােষণা করেছিলেন, তেমনি পারমিনাইডিস সত্তা (Being)-কেই একমাত্র তত্ত্ব, বস্তুর মৌলিক নীতিরূপে ব্যক্ত করলেন। অ-সত্তা সত্তার বিপরীত। এ হচ্ছে শূন্যতা, এ হচ্ছে কোন কিছু নয়। সত্তা হল এক, সত্তা অস্তিত্বশীল এবং অ-সত্তা বা পরিণাম হল অলীক বা মিথ্যা। সত্তার সম্পর্কে প্রথম কথাই হল ‘এটি আছে’ (It is)। তার প্রকৃতি যাই হােক না কেন, সত্তা আছে, সত্তা অস্তিত্বশীল, এর পক্ষে অস্তিত্বশীল না হওয়া অসম্ভব। সত্তার বক্তব্যের বিষয় আমাদের চিন্তার বিষয় হতে পারে। যা আমাদের আলোচনার বিষয় হতে পারে, যার সম্পর্কে আমরা চিন্তা করতে পারি, তা অস্তিত্বশীল হতে পারে। অস্তিত্বশীল হতে পারে, এর অর্থ হল, এটি অস্তিত্বশীল। কেননা অস্তিত্বশীল হতে পারে, অথচ নয়, তাহলে এটা হবে কিছুই না বা নিছক শূন্যতা। নিছক শূন্যতা কথার বা চিন্তার বিষয় হতে পারে না, কেননা শূন্যতা সম্পর্কে কিছু বলা বা চিন্তা করা, কিছু বলা বা কিছু চিন্তা না করার সামিল। এ সম্পর্কে পারমিনাইডিস-এর একটা যুক্তির কথা উল্লেখ করা যায় । পারমিনাইডিস বলেন, “যে বিষয়টি চিন্তা করা যায় এবং যার জন্য চিন্তার অস্তিত্ব এ দুটি একই বিষয়। কেননা কোন কিছু যার অস্তিত্ব রয়েছে, যার সম্পর্কে কিছু বলা হল তাকে বাদ দিয়ে চিন্তার দেখা মেলে না।” (you cannot find thought without something that is, as to which it is uttered)। বার্নেট-এর অর্থ করতে গিয়ে বলেছেন, কোন নাম যা বাস্তব কোন কিছুর নাম নয়, তার অনুরূপ কোন চিন্তার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। রাসেল পারমিনাইডিসের যুক্তির সারমর্ম নিরূপণ করতে গিয়ে বলেন যে, যখন তুমি চিন্তা কর তখন তুমি কোন কিছু সম্পর্কে চিন্তা কর, যখন তুমি কোন নামের ব্যবহার কর তখন এটি অবশ্যই কোন কিছুর নাম হবে। সুতরাং চিন্তা এবং ভাষা উভয়েরই চিন্তা ও ভাষা-বহির্ভূত বস্তুর প্রয়োজন আছে। এবং যেহেতু তুমি কোন বিষয় সম্পর্কে কোন এক সময়ে বা অন্য কোন সময়ে চিন্তা করতে পার বা কিছু বলতে পার, সেহেতু যা কিছু চিন্তা করা যায় বা বলা যায় তা সকল সময়েই অস্তিত্বশীল হবে। সুতরাং কোন পরিবর্তন সম্ভব নয়। কেননা, পরিবর্তন বস্তুর আবির্ভাব এবং তিরোভাব নির্দেশ করে। মন্তব্য করতে গিয়ে রাসেল বলেন, চিন্তা এবং ভাষা থেকে ব্যাপকভাবে জগতে উপনীত হবার ব্যাপারে কোন যুক্তি উপস্থাপনের এটিই হল দর্শনে প্রথম উদাহরণ, যদিও রাসেল বলেছেন যে, এটিকে বৈধ বলে গ্রহণ করা যেতে পারে না। (B. Russell : History of Western Philosophy: Page 68)
সত্তার প্রকৃতিস্বরূপ : এই সত্তা অ-সত্তার (not-being) সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্বন্ধ রহিত, সর্বপ্রকার অ-সত্তা বা পরিণাম বহির্ভূত। সত্তার প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি তার নেতিবাচক বর্ণনা দিয়েছেন। সত্তার কোন পরিণাম বা পরিবর্তন নেই। এটি অ-পরিণামী এবং অবিনাশী। এর কোন উৎপত্তি নেই, বিনাশও নেই। যদি বলা হয় যে এর উৎপত্তি আছে তাহলে সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, সত্তা হয় সত্তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে কিংবা অ-সত্তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু সত্তা যদি সত্তা থেকে উৎপন্ন হয় তাহলে সত্তা উৎপন্ন হয়েছে একথা বলা যাবে না, কেননা সত্তা থেকে সত্তা উৎপন্ন হলে সত্তা পূর্ব থেকেই অস্তিত্বশীল এই সিদ্ধান্ত করতে হবে। আর যদি বলা হয় সত্তা অসত্তা থেকে উদ্ভূত হয়েছে তাহলে অ-সত্তাকে অস্তিত্বশীল কিছু বলে স্বীকার করে নিতে হয়, যাতে সে সত্তাকে উৎপন্ন করতে পারে। কিন্তু এই জাতীয় উক্তি হবে স্ব-বিরোধ দোষে দুষ্ট। অসত্তা নিছক শূন্যতা ছাড়া কিছুই নয়, এবং নিছক শূন্য থেকে কোন কিছু উদ্ভূত হতে পারে না। অ-সত্তা হল অলীক বা মিথ্যা। কাজেই সত্তা কি সত্তা থেকে বা কি অ-সত্তা থেকে উদ্ভূত হতে পারে না। এটি কখনও অস্তিত্বশীল হয়েছে বলে এমন কথা বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। এটি হয়েছে না বলে, বলতে হবে এটি আছে, এটি অস্তিত্বশীল (It is)। কাজেই পরিবর্তন মানে কোন কিছু জন্মান, গতিশীল হওয়া এসব অসম্ভব। এটি আছে, তার অর্থ হল এটি অসৃষ্ট, অবিনাশী; এটি পরিপূর্ণ, অগতিশীল এবং সমাপ্তিবিহীন।
সত্তা এক ও অবিভাজ্য, এর সাথে কোন কিছু যোগ করা যায়না : সত্তা সম্পর্কে এটি ছিল, এটি আছে, এটি থাকবে, একথা বলা চলে না। সত্তার সম্পর্কে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা বলা চলে না। এ হল এক অনাদি কালহীন বর্তমান (Eternal Timeless Present)। পারমিনাইডিস বলেন, সত্তা হল পরিপূর্ণ অখণ্ড সত্তা, এটি হল এক। যদি এটি অখণ্ড বা এক নয় এটি এর থেকে পৃথক কোন কিছুর দ্বারা বিভাজ্য হবে। কিন্তু একমাত্র সত্তা ছাড়া আর কোন কিছুর অস্তিত্ব যদি না থাকে, তাহলে সত্তা, সত্তা ছাড়া অন্য কিছুর দ্বারা বিভাজ্য হতে পারে না। অসত্তা যেহেতু নিছক শূন্যতা, অসত্তা সত্তাকে বিভক্ত করছে একথা বলা হলে অসত্তাকে সত্তারূপে গণ্য করা হবে। কিন্তু অ-সত্তা তো সত্তা নয়। তা সত্ত্বেও যদি বলা হয় অ-সত্তা সত্তাকে বিভক্ত করছে তাহলে এই জাতীয় উক্তি হবে আত্মবিরোধীতা দোষে দুষ্ট। কেননা ‘যা কিছু নয়’ তার পক্ষে ভাববাচক বা সদর্থক কোন ক্রিয়া সম্পাদন করা সম্ভব নয়। সত্তার সঙ্গে কোন কিছুর যোগ করা যায় না। কারণ সত্তার সঙ্গে যা যোগ করা হবে তাকেও হতে হবে সত্তা।
সত্তা অচল, স্থির, নিরবচ্ছিন্ন : সত্তা হল অচল এবং স্থির। কারণ গতি এবং অস্থিরতা হল অ-সত্তার প্রকারভেদ এবং সব অ-সত্তাই সত্তা-বহির্ভূত। সত্তা সর্বোতভাবে নিজের সঙ্গে অভিন্ন। এটি নিজের থেকে ছাড়া, অন্য কিছু থেকে উৎপন্ন হয় না। এটি কোন কিছুতে চলে যায় না। এটি নিরবচ্ছিন্ন। এটি তার অস্তিত্বের বা বাস্তবতার জন্য অন্য কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। এর কোন ভাববাচক বৈশিষ্ট্য নেই। এর অস্তিত্বই এর একমাত্র ভাববাচক বৈশিষ্ট্য। এটি এই বা ঐ, এটির গুণ আছে, এটি এখানে বা ঐখানে, এটি এখন বা তারপর, এ জাতীয় কোন কথাই সত্তা সম্পর্কে বলা চলে না। সত্তা আছে, শুধু একথাই বলা যেতে পারে। থাকা বা অস্তিত্বশীল হওয়াই এর একমাত্র গুণ। সত্তা কম বা বেশি হতে পারে না। কাজেই সত্তা এক জায়গায় যতখানি আছে, অন্য জায়গায়ও ততখানি আছে। এটি নিরবচ্ছিন্ন এবং অবিভাজ্য, কেননা, সত্তা-বহির্ভূত এমন কিছু নেই যা সত্তার অংশগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে থাকার পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই এ হল পরিপূর্ণ, নিরবচ্ছিন্ন, অবিভাজ্য, অনাদি ও অপরিণামী। সত্তা সম্পর্কে এটিই হল চূড়ান্ত সত্য। এটি অচল বা গতিহীন কেননা সচল বা গতিশীল হলে একে শূন্য দেশে (Empty Space) চলাচল করতে হবে, কিন্তু শূন্য দেশ হল শূন্যতা এবং শূন্যতা বলে কিছু নেই।
সত্তা সসীম, বর্তুলাকার, জড়াত্মক : পারমিনাইডিস যে সত্তাকে জড়াত্মক গণ্য করেছেন, সত্তাকে সীমিত (Finite) বলে ব্যক্ত করা থেকেই তা সুস্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া যায়। অসীম বলতে পারমিনাইডিস বুঝেছেন নির্বিশেষ বা (Indeterminate) এবং অনির্দিষ্ট। কিন্তু সত্তা যেহেতু বাস্তব সেহেতু কখনই নির্বিশেষ বা অনির্দিষ্ট হতে পারে না। সত্তা অপরিণামী, একথা আগেই বলা হয়েছে। সত্তা শূন্য দেশে নিজেকে প্রসারিত করছে এরূপ ধারণা করা চলে না। সত্তা হল সুনির্দিষ্ট, সবিশেষ, পরিপূর্ণ। এটা অসীম এই অর্থে যে, এর আদি-অন্ত নেই। কিন্তু দৈশিক দিক থেকে এটি সীমিত। এটি সব দিকেই সমানভাবে অস্তিত্বশীল। কাজেই এটি আকারের দিক থেকে গোলাকার। কেন্দ্র থেকে এটি সকল দিকেই সমানভাবে অবস্থিত। কেননা এটি কোন স্থানে বেশি আবার কোন স্থানে কম এমন হতে পারে না। গোলকের সকল দিক একইরকম, তাই হয়ত সত্তার আকারের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে পারমিনাইডিস তাকে বর্তুলাকার বলে অভিহিত করেছেন। সুতরাং যা আছে তা হল একটি সীমিত, বর্তুলাকার , গতিহীন, নিরবচ্ছিন্ন অবরুদ্ধ দেশ। (Plenum), যার বাইরে আর কিছুই নেই।
সত্তা সম্পর্কিত মতবাদের উৎস : পারমিনাইডিস-এর সত্তা সম্পর্কীয় চিন্তার উৎস হল বস্তুর ক্ষণস্থায়ীত্ব এবং পরিণামী স্বভাব অর্থাৎ পরিবর্তনশীলতা। এই জগতের সব বস্তুই ক্ষণস্থায়ী ও পরিবর্তনশীল। কোন কিছুরই থায়িত্ব নেই। কোন কিছু এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু যা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীল তার সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। সেই কারণে পারমিনাইডিস যা পরিবর্তনশীল তার মাঝে যা স্থায়ী তাকে জানার জন্য প্রয়াসী হলেন এবং এরই ফলে সত্তা এবং অ-সত্তার দ্বন্দ্ব দেখা দিল। যা স্থায়ী এবং অপরিণামী তাই সত্তা, যা অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল তাই অ-সত্তা। সত্তাই হচ্ছে পরিপূর্ণভাবে সৎ, অ-সত্তা হচ্ছে অসৎ। প্রথমটি বাস্তব, দ্বিতীয়টি অবাস্তব। অ-সত্তার কোন অস্তিত্ব নেই। এই অ-সত্তাকেই তিনি পরিবর্তনের সঙ্গে, অপরিবর্তনশীল বস্তুর সঙ্গে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছেন। ইন্দ্রিয়ের জগৎ হল অবাস্তব, অলীক, নিছক অবভাস। এটি হল অ-সত্তা। কেবলমাত্র সত্তারই যথার্থ অস্তিত্ব আছে।
পারমিনাইডিসের দর্শনে ইন্দ্রিয় এবং বিচার-বুদ্ধির পার্থক্য
পারমিনাইডিস তার দর্শনে সর্বপ্রথম খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এই পার্থক্য হল ইন্দ্রিয় (Sense) এবং বিচারবুদ্ধির (Reason) পার্থক্য। পারমিনাইডিস মনে করেন যে, ইন্দ্রিয় আমাদের কাছে যে জগতকে উপস্থাপিত করে সেই জগৎ হল মিথ্যাত্বের এবং অবভাসের, পরিবর্তনের, অসত্তার। সত্য এবং যথার্থ সত্তাকে আমরা বিচার-বুদ্ধির বা চিন্তার মাধ্যমে জানতে পারি। পারমিনাইডিসের মতে মিথ্যা, ভ্রান্তি, অলীকতার উৎস হল ইন্দ্রিয়। বিচারবুদ্ধির মাধ্যমেই সত্যতাকে জানা যায়। পারমিনাইডিসের বিচারবুদ্ধির উপর এই গুরুত্ব আরোপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কেননা ইন্দ্রিয়ের জগতের মধ্যে সত্যতা নেই, সত্যতা আছে বিচারবুদ্ধিতে। এটাই হল ভাববাদীদের মৌলিক বক্তব্য। পারমিনাইডিস স্পষ্টই স্বীকার করলেন যে, মানুষের বিচারবুদ্ধির সত্তাকে জানার ক্ষমতা আছে। মানুষের সব বিচারবুদ্ধিই যে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত তা হল এই যে যা বৌদ্ধিক বা স্পষ্টত চিন্তার যোগ্য তা অবশ্যই সঙ্গতিপূর্ণ হবে। ‘ক’ হয় যুগ্ম এবং অযুগ্ম সংখ্যা – এই জাতীয় বচন অভ্যন্তরীণ দোষে দুষ্ট, এইরূপ কোন সংখ্যা সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় এবং আমরা সুনিশ্চিত যে, এরূপ আত্ম-বিরোধী কোন সংখ্যার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। কাজেই বিরোধের অভাব (Non-contradiction) যে অস্তিত্বের এবং চিন্তার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য এই কথা বলে পারমিনাইডিস একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির উল্লেখ করলেন। কেবলমাত্র সঙ্গতিপূর্ণ পদার্থই হল অস্তিত্বশীল। এটাকে স্বীকার করে নিলে সার্বিকীকরণের সত্যতাকে তাদের সংগতির দ্বারাই পরীক্ষা করে নেওয়া যাবে। দর্শন, পদার্থবিদ্যা, সর্বত্রই তাদের যুক্তিসিদ্ধ পরিণতি বিচার করেই বলা যায় যে, অনেক সার্বিকীকরণই সত্য নয়। কাজেই বৈধ অবরোহ যদি কোন বিরোধপূর্ণ পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যায় তাহলে আমরা সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারব যে, পূর্বস্বীকৃত অনুমান হল ভ্রান্ত। যা অভ্যন্তরীণ বিরোধিতাপূর্ণ, সত্তা তাকে গ্রাস করতে পারে না। পারমিনাইডিস দেখালেন যে, সত্তার সঙ্গে অমূর্ত যৌক্তিক আকারের (Abstract Logical Form) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
পারমিনাইডিসের কাব্যের বিভিন্ন অংশ
পারমিনাইডিস-এর কাব্যের প্রথম অংশেই রয়েছে সত্তা সম্পর্কে পারমিনাইডিসের মতবাদ। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে ভ্রান্ত বিশ্বাস বা মতামতের আলোচনা। কাব্যের দ্বিতীয় অংশে যে মতামতের পথ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে তা পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টিতত্ত্ব (Cosmology)। যেহেতু এই সৃষ্টিতত্ত্ব পরিবর্তন এবং গতিকে স্বীকার করে নেয় , সেহেতু পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের এই দর্শনকে পারমিনাইডিস বর্জন করেন। পারমিনাইডিস দ্বিতীয় অংশে দেখান যে, সাধারণ লোকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগতকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। প্রকৃতপক্ষে যা অস্তিত্বশীল তা হল সত্তা (Being)। মানুষের বিশ্বাস বা মত (Opinion), যা প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, সত্তার পাশাপাশি অ-সত্তাকে (Not-Being) উপস্থাপিত করে এবং সকল কিছুকে দুটি উপাদানের দ্বারা গঠিত মনে করে, যার একটি সত্তা এবং অপরটি হল অ-সত্তা; আলোক, অগ্নিময়, এবং রাত্রি, অন্ধকার, অলঘু এবং শীতল, যাকে পারমিনাইডিস পৃথিবী বলেও অভিহিত করেছেন। প্রথমটিকে তিনি সক্রিয় এবং শেষেরটিকে নিষ্ক্রিয় নীতিরূপে বর্ণনা করেছেন কিন্তু সম্পূরক হিসেবে দেবীর রহস্যময় আকারের কথা ব্যক্ত করেছেন, যিনি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন। পারমিনাইডিস দেখাবার চেষ্টা করেছেন, জগতের সৃষ্টি এবং বিন্যাস, এই সবের পূর্বস্বীকৃত অনুমানের উপর নির্ভর করতে হবে। জগতের সব বস্তুই দুটি বিপরীত উপাদানে গঠিত, উষ্ণ এবং শীতল, আলোক এবং অন্ধকার। যত উত্তাপ, ততই জীবন, যত শীতলতা ততই অবাস্তবতা এবং মৃত্যু। একটা প্রশ্ন দেখা দেয় সেটা হল এই যে, কাব্যের এই দ্বিতীয় অংশের প্রয়োজনীয়তা কি? এ সম্পর্কে পণ্ডিতরা বিভিন্ন অভিমত দিয়েছেন। কারও কারও মতে এই দ্বিতীয় অংশের আলোচনা প্রমাণ করে যে, অবভাসের জগৎ হল শুদ্ধ সত্তার অভিক্ষেপ। আবার কারও মতে, দ্বিতীয় অংশের উদ্দেশ্য হল তৎকালে প্রচলিত অশুদ্ধ বা ভ্রান্ত মতামতগুলো আলোচনা করা যাতে ছাত্ররা সেগুলোকে সহজে স্মরণ রাখতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন যে, পারমিনাইডিস অবভাসের জগৎ সম্পর্কে তার ধারণা পরিবর্তন করে দ্বিতীয় অংশে তাকে ব্যক্ত করেছেন বা পারমিনাইডিস একথা ব্যক্ত করতে চেয়েছেন যে, এই বিশ্বজগৎ এক অদ্ভূত জগৎ যেখানে বিচারবুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতার কোন সমন্বয় সাধন সম্ভব নয়। কাব্যের দ্বিতীয় অংশ সম্পর্কে সমালোচকের এ জাতীয় অনেক মন্তব্যই করেছেন। এই প্রসঙ্গে ব্রাম (Brumbaugh)-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তার মতে, কাব্যের দ্বিতীয় অংশ ‘মতামতের পথ’ (The Way of Opinions), পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের বিশ্বজগতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বিশ্বাসযোগ্যতার উপর আক্রমণের সামিল, যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পরস্পর বিরোধী নীতি, যেমন সীমা এবং নির্বিশেষ, সংখ্যা এবং শূন্যতা, আকার এবং ক্ষেত্র প্রভৃতির সাহায্যে জগতকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রয়াসী হয়েছে।
পারমিনাইডিসের দর্শন জড়বাদী না ভাববাদী?
পারমিনাইডিস-এর দর্শন সম্পর্কে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রশ্নটি হল, তার দর্শনকে জড়বাদী (Materialistic), না ভাববাদী (Idealistic) কিভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে? এ সম্পর্কে লেখকদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ করা যায়। হেগেল, আর্ডম্যান, সােয়েগলার, কপলস্টোন প্রমুখ লেখকবৃন্দ পারমিনাইডিস-এর দর্শনকে ভাববাদী দর্শনরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু অধ্যাপক বার্নেট তার দর্শনকে জড়বাদী দর্শনরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। বার্নেট-এর নিজের কথা উদ্ধৃত করে বলা যেতে পারে, “পারমিনাইডিস, যেমন অনেকে বলেছেন, ভাববাদের জনক নন। বিপরীত পক্ষে, সব জড়বাদই তার অভিমতের উপর নির্ভর করে।” (Early Greek Philosophy, Chap. IV: 89.)।
জড়বাদের যুক্তি হিসেবে বলা যায়, পারমিনাইডিস যে সত্তা (Being)-কে মূল তত্ত্বরূপে আখ্যাত করেছেন সেটি সীমিত দেশ অধিকার করে থাকে এবং বর্তুলাকার। নিঃসন্দেহে সত্তার এই জাতীয় বর্ণনা প্রমাণ করে যে, পারমিনাইডিস সত্তাকে জড় বলে গণ্য করেছেন, কেননা যার অবস্থান আছে এবং যা দেশ অধিকার করে থাকে তাকে জড় বলেই গণ্য করতে হয়। তার ঠিক পরবর্তী দুজন দার্শনিক এমপিডক্লিজ (Empedocles) এবং ডিমােক্রিটাস (Democritus) তার চিন্তার জড়বাদী দিকটি গ্রহণ করে তাকেই বিকশিত করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিল। অন্যদিকে ভাববাদের সপক্ষে তিনটি যুক্তি দেয়া যায় –
- পারমিনাইডিস-এর মূলতত্ত্ব যা হল সত্তা, জড় নয়, কেননা জড়বস্তুর মত তার এখানে বা ওখানে কোন অস্তিত্ব নেই। সত্তা হল এক অমূর্ত চিন্তা, একটা প্রত্যয় (Concept)। পারমিনাইডিস নিজেই বলেছেন যে, সত্তা অবিভাজ্য, গতিহীন; সত্তা এখানে নেই, সেখানে নেই, এখন নয়, তখন নয়। সত্তা শুধুমাত্র অস্তিত্বশীল। কাজেই এর থেকে বোঝা যায় যে, সত্তা হল শুল্ক প্রত্যয়, একটা সার্বিক ধারণা (a general idea); এটি কোন বস্তু নয়, এটি চিন্তা। কাজেই পারমিনাইডিস সত্তাকে জড়াত্মক বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যরূপে ধারণা করলেও তাকে একটি ধারণা বা চিন্তা রূপেই উপস্থাপিত করেছেন। ভাববাদীদের মূল বক্তব্য হল, বিশ্বের মূলতত্ত্ব হল ধারণা বা প্রত্যয়, এই বিশ্ব তার প্রকাশ।
- পারমিনাইডিস সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, সত্তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বুদ্ধিগ্রাহ্য। ইন্দ্রিয় এবং বুদ্ধির মধ্যে পার্থক্যও ভাববাদীদের ভাববাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। জড়বাদীরা মনে করেন যে, তত্ত্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, ভাববাদীরা মনে করেন তত্ত্ব বুদ্ধিগ্রাহ্য। তাছাড়া পারমিনাইডিস বাহ্য জগৎ, বা ইন্দ্রিয়ের জগতকে অলীক বা মিথ্যা এবং অবভাসরূপে আখ্যাত করেছেন। জড়বাদীরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে যথার্থ মনে করেন আর ভাববাদীরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে অবভাস মনে করেন।
- দার্শনিক প্লেটো পারমিনাইডিস-এর সত্তাকে তার ধারণা’ (Idea)-র সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছিলেন। প্লেটো মনে করতেন যে, জগতের সত্তা নিহিত রয়েছে চিন্তা বা প্রত্যয় বা ধারণার মধ্যে।
প্রশ্ন হল , উভয় পক্ষের যুক্তির ভিত্তিতে পারমিনাইডিসকে জড়বাদী, না ভাববাদী কিভাবে আখ্যাত করা যায়? অনেকেই স্বীকার করেছেন যে, পারমিনাইডিস-এর দর্শনের মধ্যে জড়বাদ ও ভাববাদ পাশাপাশি রয়েছে। যাদের সমন্বয় সাধিত হয়নি। পারমিনাইডিস জড়বাদী হলেও তার দর্শনে ভাববাদের বীজ প্রচ্ছন্ন রয়েছে। কপলস্টোন এই প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য মনে হয়। পারমিনাইডিস সত্তাকে অপরিণামী বলে গণ্য করেছিলেন এবং অপরিণামী সত্তাকে অস্তিত্বশীল এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ ধারণার সঙ্গে অভিন্ন গণ্য করেছিলেন। কাজেই সেই দিক থেকে পারমিনাইডিসকে ভাববাদের জনক বলা যেতে পারে। প্লেটোর মত সুবিখ্যাত ভাববাদী দার্শনিক পারমিনাইডিসের একটি মূল বক্তব্যকে গ্রহণ করে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাছাড়া দার্শনিক প্লেটো পারমিনাইডিসের বুদ্ধির জগৎ এবং ইন্দ্রিয়ের জগতের পার্থক্যকে অনেক কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু কপলস্টোনের অভিমতানুসারে, ঐতিহাসিক অর্থে পারমিনাইডিসকে প্লেটোর উপর তার অসন্দিগ্ধ প্রভাবের জন্য ভাববাদের জনকরূপে আখ্যাত করা হলেও , একথা ভুললে চলবে না যে, পারমিনাইডিস নিজে জড়বাদী মতবাদ শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং ডিমােক্রিটাসের মত জড়বাদীরা ছিল তারই চিন্তার উত্তরাধিকারী।
পারমিনাইডিস-এর দর্শনের সমালোচনা ও পরবর্তীকালের গ্রীক দর্শনের উপর প্রভাব
পারমিনাইডিস-এর দর্শনের নানারকম সমালোচনা হয়েছে, পারমিনাইডিস শুধুমাত্র সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন, যেখানে ভেদ বা পরিবর্তন হল অবাস্তব। ভারতীয় দর্শনে শঙ্করাচার্য যে যুক্তির সাহায্যে একের ঐক্য এবং বিশেষের মিথ্যাত্ব প্রমাণ করেছেন পারমিনাইডিস এর দর্শনে তার একান্ত অভাব দেখা যায়। পারমিনাইডিস সত্তার যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে অবভাস বলে কিছু স্বীকারই করা চলে না। অবভাস অবভাসিত হয় না, কেননা অবভাস হল নিছক শূন্যতা। পারমিনাইডিসের মতবাদ আমাদের জানা এই জগতের অস্তিত্বকে মেনে নেয় না এবং এটাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে এটাকে ভ্ৰমপ্রত্যক্ষ বলেও গণ্য করা চলে না। কিন্তু জগতের এ জাতীয় ব্যাখ্যা দেওয়া জগতের কোন বোধগম্য ব্যাখ্যা দেওয়া নয়। বার্নেটের মতে, জগতের কোন বোধগম্য ব্যাখ্যা দিতে যেমন করেই হােক না কেন গতির পূর্ণপ্রবর্তন প্রয়োজন। তবে তাকে বিনা প্রমাণে স্বীকার করে নেওয়া চলবে না। একে কোন না কোন ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।
পারমিনাইডিসের মতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হল, বিরোধের অভাব (Non-contradiction) অস্তিত্বের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। পারমিনাইডিসের যুক্তি এবং অতীন্দ্রয়বাদের সংমিশ্রণ পরবর্তীকালের গ্রীক দর্শনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তার শুদ্ধ যুক্তিবিজ্ঞান সমাদৃত হয়েছিল এবং গৃহীত হয়েছিল। যা নয় তার থেকে কোন কিছু উদ্ভূত হতে পারে না। তার এই যুক্তি বহু দার্শনিককে পরিণাম বা পরিবর্তনের প্রকৃতিকে যথাযথ ব্যাখ্যার জন্য সচেষ্ট করে তুলেছিল। পারমিনাইডিসের দার্শনিক সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালের দার্শনিকদের ‘সত্তা’ এবং ‘অ-সত্তা’, এই উভয় প্রত্যয়ের প্রকৃতি নিরূপণের জন্য নতুন করে সচেষ্ট করে তুলেছিল। পরবর্তীকালের দার্শনিকবৃন্দ একটিমাত্র পদার্থের সঙ্গে সত্তাকে অভিন্ন গণ্য করতে স্বীকৃত হলেন না। পারমিনাইডিসের পরে সত্তা এবং পরিবর্তনের স্বরূপ অনুসন্ধানের কার্য অদ্বৈতবাদী থেকে বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গীর রূপ গ্রহণ করল। এক অপরিবর্তনীয় তত্ত্বের পরিবর্তে বহু উপাদানের সাহায্যে জগৎ ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হল।
জেনো (৪৯৫-৪৩০ খ্রি.পূ.)
ভূমিকা
এলিয়ার অধিবাসী জেনো (Zeno of Elea, ৪৯৫-৪৩০ খ্রি.পূ.) ছিলেন পারমিনাইডিসের অনুগামী। এলিয়া দর্শন সম্প্রদায়ের তিনি ছিলেন তৃতীয় উল্লেখযোগ্য দার্শনিক। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৯ অব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পারমিনাইডিসের অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য। প্লেটোর মতে, তিনি তার চেয়ে পঁচিশ বছরের ছােট ছিলেন। কথিত আছে এলিয়া নগরের শাসনকার্যে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
হেঁয়ালির রচয়িতা হওয়াই জেনোর একমাত্র পরিচয় নয়
জেনোর নাম অনেকেরই এক সপরিচিত এই হিসেবে যে, তিনি গতির অসম্ভাব্যতা প্রমাণ করার জন্য কয়েকটি যুক্তি দক্ষতার সঙ্গে রচনা করেছিলেন যেমন, একিলিস ও কচ্ছপের হেঁয়ালি , ধাবমান তীরের হেঁয়ালি ইত্যাদি। তার থেকে অনেকে হয়ত এমন ধারণাও করতে পারেন যে, আসলে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ হেঁয়ালি বা ধাঁধাঁর রচয়িতা, যিনি ধাঁধাঁর মাধ্যমে অপরের কাছে নিজের বুদ্ধির উৎকর্ষ প্রমাণ করতেন এবং ধাঁধাঁর মাধ্যমে অপরের মধ্যে হতবুদ্ধিতার সৃষ্টি করে মজা পেতেন। কিন্তু এভাবে জেনোকে বিচার করা হলে তার প্রতি সুবিচার করা হবে না। নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, তিনি খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন। কিন্তু অপরের কাছে নিজেকে তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরূপে জাহির করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি হেঁয়ালিগুলো রচনা করেননি। তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নতর।
পারমিনাইডিসের দার্শনিক মতবাদকে সমর্থন করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি তার যুক্তিগুলো গঠন করেছিলেন। সেই যুক্তিগুলো পরোক্ষভাবে পারমিনাইডিস-এর দার্শনিক সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানায়। এই দিক থেকে বিচার করলে এলিয়ার দর্শনের ক্ষেত্রে তার অবদান ইতিবাচক (Positive) নয়, নেতিবাচক, কেননা পারমিনাইডিসের দার্শনিক বক্তব্যের ক্ষেত্রে তিনি নতুন কিছু সংযোগ করতে পারেননি। তিনি পারমিনাইডিসের সত্তা (Being) সম্পর্কীয় মতবাদকে সমর্থন করেছেন।
দেশ ও কাল সম্পর্কে জেনোর ধারণার পরবর্তী কালে গুরুত্ব লাভ
পারমিনাইডিসের মতবাদকে সমর্থন করতে গিয়ে তিনি দেশ ও কালের মৌলিক প্রকৃতি সম্বন্ধে এমন কিছু ধারণা ব্যক্ত করেছেন যেগুলো পরবর্তী সময়ে দর্শনে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। পারমিনাইডিস ইন্দ্রিয়ময় জগতকে অলীক বা মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বহুত্ববাদের (Pluralism) বিরোধিতা করেছেন এবং পরিবর্তন ও গতিকে অলীক বা ভ্ৰম-প্রত্যক্ষ (Illusion) বলে বর্ণনা করেছেন। পারমিনাইডিস-এর মূলতত্ত্ব-সত্তা পরিপূর্ণভাবে স্থির এবং অপরিণামী। এই সত্তা অচল বা গতিহীন। বহুত্ব এবং পরিবর্তন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের দুটি প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য। তাদের অলীক বা মিথ্যা ঘােষণা করার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই পারমিনাইডিস হয়ে পড়েন উপহাসের পাত্র। পারমিনাইডিস-এর একনিষ্ঠ সমর্থন জেনো বহুত্ব এবং পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুক্তি এনে দেখাতে চাইলেন যে বহুত্ব এবং পরিবর্তনকে মিথ্যা বা অলীক ঘােষণা করে পারমিনাইডিস মােটেও নিজেকে উপহাসের পাত্র বা হাস্যস্পদ করে তোলেননি। তিনি বহুত্ব এবং পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপিত করে, বহুত্ব এবং গতিকে অসম্ভব প্রমাণ করে, পারমিনাইডিস-এর সিদ্ধান্তের প্রতি পরোক্ষভাবে সমর্থন জানালেন। এত নিখুঁতভাবে তিনি তার যুক্তিগুলো প্রয়োগ করেছেন যে অ্যারিস্টটল তাকে ডায়েলেটিক (Dialectic) বা দার্শনিক বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার’-এর আবিষ্কর্তা হিসেবে আখ্যাত করেছেন। জেনো দেখাতে চাইলেন যে বহুত্ব এবং পরিবর্তনকে যদি বাস্তব বলে স্বীকার করা হয় তাহলে পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তে আমাদের উপনীত হতে হয়। কিন্তু পরস্পর বিরুদ্ধ দুটি বক্তব্যকে বা বচনকে স্বীকার করে নেওয়া চলে না। কাজেই মেনে নিতে হয় যে, যাকে স্বীকার করার জন্য দুই পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তের উদ্ভব সেই স্বীকৃত বিষয়ই মিথ্যা বা ভ্রান্ত।
জেনোর আসল উদ্দেশ্য পারমিনাইডিসের মতবাদকে সমর্থন
পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের দার্শনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার ইচ্ছা থেকেই এলিয়ার দর্শন সম্প্রদায়ের উদ্ভব। জেনো পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের দর্শনের সমালোচনা করেছেন। জেনোর গ্রন্থের শিরোনাম ছিল ‘দার্শনিকদের অভিমতের জবাব’ (A reply to the Philosophers)। দার্শনিক বলতে (Zeno) পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত দার্শনিকদের বোঝাতে চেয়েছেন, সেই রকম ধারণা করার সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। জেনো দেখাতে চেয়েছেন যে, পিথাগোরীয় সম্প্রদায় প্রচারিত বহুত্ববাদ মেনে নিলে এমন সমস্যার সৃষ্টি হয় যার সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং তাদের স্বীকৃত বহুত্ববাদের পরিপ্রেক্ষিতেও পরিবর্তন এবং গতি অসম্ভব। আসলে জেনোর যুক্তিগুলোর মূল উদ্দেশ্য হল যে, যে পিথাগোরীয় সম্প্রদায় পারমিনাইডিস-এর দার্শনিক মতবাদের বিরোধিতা করেছে, সেই সম্প্রদায়ের অভিমত খন্ডন করা। প্লেটো তার ‘পারমিনাইডিস’ গ্রন্থে এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “আসল সত্য হল এই যে, এই রচনাগুলো (জেনোর রচনাগুলো) পারমিনাইডিসকে যারা আক্রমণ করেন এবং দেখাতে চান যে ‘এক’-কে স্বীকার করে। নিলে অনেক হাস্যকর এবং বিরোধী পরিণতির সৃষ্টি হয়, তাদের বিরুদ্ধে পারমিনাইডিস-এর যুক্তির পক্ষে নিরাপত্তা সৃষ্টি করা।”
একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, গতির বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি তার যুক্তিগুলো হেঁয়ালির আকারে উপস্থাপিত করলেন কেন? এর উত্তর হল, পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ভুক্ত দার্শনিকদের গতি সম্পৰ্কীয় অভিমত খণ্ডন করা যেমন তার উদ্দেশ্য ছিল তেমনি তার অপর একটি উদ্দেশ্য হল সাধারণ বুদ্ধি এবং ব্যবহারিক গাণিতিক অভিমত (Technical Mathematical Views), এই দুই-এর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান। জেনো দেখাতে চান যে হেঁয়ালিগুলোকে যদি বাস্তবভাবে গ্রহণ করা হয় তাহলে কিছু সমস্যার উৎপত্তি হয়। সাধারণ বুদ্ধিকে স্বীকার করে নিতে হয় যে, গতি সম্পর্কে তার অনেক ধারণাই যত যুক্তিযুক্ত বলে প্রতিভাত হােক না কেন, আসলে কিন্তু তা নয়। তেমনি অমূর্ত সমালোচনার (Abstract Criticism) বিশেষ উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা হলে হেঁয়ালিগুলো এই বিষয়ই প্রমাণ করতে চায় যে, বিন্দু এবং মুহূর্ত সম্পর্কে অনেক ব্যবহারিক অনুমান যৌক্তিক অসংগতির সৃষ্টি করে।
জেনো পারমিনাইডিসের চিন্তার উভয় দিক গ্রহণ এবং বহুত্ব, গতি ও স্থানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যুক্তিসমূহ
জেনো পারমিনাইডিসের চিন্তার উভয় দিকই গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম দিক হল, বহুত্ব এবং পরিবর্তন যে অলীক বা মিথ্যা, পারমিনাইডিসের এই দার্শনিক সিদ্ধান্ত জেনো গ্রহণ করেছিলেন এবং দ্বিতীয় দিক হল কোন মতবাদের সঙ্গতি পরীক্ষা করে সেই মতবাদ বিচার করার জন্য আকারগত যুক্তিবিজ্ঞানকে পদ্ধতিরূপে জেনো গ্রহণ করেছিলেন। পারমিনাইডিসের দার্শনিক মতবাদের যথার্থ প্রমাণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি তার বিরোধী মতের অর্থাৎ জগতে বহুত্ব এবং পরিবর্তন আছে, এই মতের অসম্ভাব্যতা প্রমাণে ব্রতী হলেন। এই প্রসঙ্গে তার সার্থক প্রচেষ্টা হল চারটি হেঁয়ালী রচনা করে প্রমাণ করা যে গতি অবাস্তব এবং মিথ্যা। তিনি দেখাতে চান যে সাধারণ বুদ্ধি বা পিথাগোরাস্ সম্প্রদায় গতিকে স্বীকার করতে গেলে অসঙ্গতি বা অসম্ভাব্যতাকে কোন মতেই এড়াতে পারবে না।
বহুত্বের (Multiplicity or Pluralism) বিরুদ্ধে জেনোর যুক্তি :
- (ক) পিথাগোরীয় সম্প্রদায় মনে করে সত্তা এক নয়, বহু। যদি বহুর অস্তিত্ব থাকে, তাহলে সেই বহু হবে এককের (Units) দ্বারা গঠিত, কেননা বহু বললে সেই কথাই বোঝায়। এই এককগুলোর হয় বিস্তার (Magnitude) থাকবে, না হয় থাকবে না। যদি বিস্তারযুক্ত হয়, তাহলে ধরা যাক্, কোন একটি রেখা, যা এককের দ্বারা গঠিত, বিস্তৃতির অধিকারী হওয়াতে অন্তহীনভাবে বিভাজ্য (Infinitely Divisible) হবে। সেক্ষেত্রে রেখাটি হবে অন্তহীন সংখ্যক এককের দ্বারা গঠিত, যার প্রতিটি একক হবে বিস্তারের অধিকারী। তাহলে রেখাটি হবে অন্তহীনভাবে বৃহৎ (Infinitely Great)। তাহলে এই জগতের প্রতিটি বস্তুই হবে অন্তহীনভাবে বৃহৎ এবং এই জগতও হবে অন্তহীনভাবে বৃহৎ। আবার বিপরীতপক্ষে যদি এককগুলো বিস্তৃতিবিহীন হয়, তাহলে সমগ্র বিশ্বও হবে বিস্তৃতিবিহীন। কেননা বিস্তৃতিবিহীন এককের সমষ্টিও বিস্তৃতিবিহীন হতে বাধ্য। আর এই বিশ্ব যদি বিস্তৃতিবিহীন হয় তাহলে এই বিশ্ব হবে অন্তহীনভাবে ক্ষুদ্র (Infinitely Small)। তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, এই বিশ্বের বস্তু হয় অন্তহীনভাবে বৃহৎ, বা প্রতিটি বস্তু হয় অন্তহীনভাবে ক্ষুদ্র। জেনোর বক্তব্য হল যে, এই পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্ত যে বিষয়টিকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য উদ্ভূত হয়েছে, সেটিকে স্বীকার করা চলে না। অর্থাৎ কিনা, ‘এক’-এরই শুধুমাত্র অস্তিত্ব আছে-পারমিনাইডিস-এর এই সিদ্ধান্ত যদি অসম্ভব এবং হাস্যকর হয়, তাহলে বিপরীত সিদ্ধান্ত এক নয়, বহুর অস্তিত্ব আছে অনুরূপভাবে অসম্ভব ও হাস্যকর মনে হবে।
- (খ) সংখ্যার দিক থেকে বহু হয় সীমিত (Finite) কিংবা অ-সীমিত (Infinite) হবে। বহু সীমিত, কারণ একে গণনা করা যায়; গণনা করা না গেলে একে অস্তিত্বশীল বলা চলে না। বহু সংখ্যায় যতগুলো রয়েছে তার বেশি হতে পারে না, কাজেই এটি একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা। এটি একটি সীমাবিশিষ্ট সংখ্যা। কিন্তু বহু আবার অসীম; কারণ এটি অন্তহীনভাবে বিভাজ্য এবং সেহেতু অন্তহীন এককের দ্বারা বা অংশের দ্বারা গঠিত। কিন্তু বহু একই সময়ে সীমিত এবং অসীম-এই জাতীয় সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে অসম্ভব।
২. দেশ (Space) সম্বন্ধীয় মতবাদের বিরুদ্ধে জেনোর যুক্তি : পারমিনাইডিস্ শূন্য দেশ বা স্থানের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। এই সিদ্ধান্তের বিরোধী সিদ্ধান্ত শূন্য দেশ বা স্থানের অস্তিত্ব আছে – এর বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপিত করে, জেনো পারমিনাইডিসের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। মনে করা যাক একটা দেশের অস্তিত্ব রয়েছে যেখানে বস্তু অবস্থিত। এখন হয় এই দেশ অস্তিত্বশীল, কিংবা অস্তিত্বশীল নয়। যদি অস্তিত্বশীল না হয়, বস্তু এতে থাকতে পারে না। আর যদি এটি অস্তিত্বশীল হয় তাহলে একেও কোন দেশে বা স্থানে অবস্থিত হতে হবে। আবার সেই দেশকে অন্য কোন দেশে অবস্থিত হতে হবে, এইভাবে চলতে থাকবে। কিন্তু তা হতে পারে না। কাজেই বস্তু কোন দেশে বা কোন শূন্যতায় অবস্থিত নেই। তার অর্থ হল, শূন্য দেশ বা স্থানের অস্তিত্ব নেই।
৩. গতির (Motion) বিরুদ্ধে জেনোর যুক্তি :
- (ক) কোন দূরত্ব অতিক্রম করতে হলে প্রথমে সেই দূরত্বের অর্ধেক অতিক্রম করতে হবে। অবশিষ্ট অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য বাকী থাকবে। তারপর অবশিষ্ট এই অর্ধেক দূরত্বের অর্ধেক অতিক্রম করতে হবে, আবার অর্ধেক অবশিষ্ট থাকবে। তার মানে সীমিত সময়ে অন্তহীন সংখ্যক দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, যা অসম্ভব। কাজেই সব রকম গতি অসম্ভব। এর অর্থ কোন ব্যক্তি যদি একটি ঘােড়দৌড়ের মাঠ অতিক্রম করতে চায় তার সেই মাঠ অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। জেনো দেখাবার চেষ্টা করলেন যে, যে গতিকে পারমিনাইডিস্ অস্বীকার করেছেন, পিথাগোরাস্ সম্প্রদায়ের বহুত্ববাদের প্রেক্ষিতে তাকে স্বীকার করে নেওয়া অসম্ভব।
- (খ) একিলিস এবং কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতা কচ্ছপকে যদি একিলিস কিছুটা দূরত্বে এগিয়ে দৌড় শুরু করতে দেয়, এবং তারপর যদি একিলিস দৌড়াতে শুরু করে তাহলে একিলিস কখনই কচ্ছপকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না। কারণ যেখান থেকে কচ্ছপ যাত্রা শুরু করছে সেই জায়গায় গিয়ে যখন একিলিস পৌছাবে, তখন কচ্ছপ আরও এগিয়ে গেছে অন্য একটি স্থানে, আবার সেখানে যখন একিলিস গিয়ে পৌছাবে। তখন কচ্ছপ অপর একটি স্থানে গিয়ে পৌছেছে, এইভাবে একিলিস ক্রমশ কচ্ছপের কাছাকাছি দূরত্বে এসে যাবে কিন্তু কখনও তাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না। আরও পারবে না এই কারণে যে, একটি রেখা অনন্ত সংখ্যক বিন্দুর দ্বারা গঠিত এবং একিলিসকে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, যা অসম্ভব। কাজেই দেখা যাচ্ছে, গতি অবাস্তব। কেননা ধীরগতিসম্পন্ন জীব ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন। ব্যক্তির মতোই ক্ষিপ্রগতিতে দৌড়ায় , কি করে সম্ভব হতে পারে?
- (গ) চলমান তীর সকল সময়ই স্থির, কখনও গতিশীল নয়, কাজেই গতির অস্তিত্ব নেই। কেননা কোন বস্তু একটি মুহূর্তে দুটি স্থানে অবস্থান করতে পারে না, কিন্তু কোন একটি স্থানে অবস্থান করার অর্থ স্থির থাকা। কাজেই নিক্ষিপ্ত তীর যে কোন মুহূর্তে নিজের দৈর্ঘ্যের সমান দেশে অবস্থান করবে এবং সে কারণে এটি স্থির, এটি গতিশীল নয়। অনন্ত সংখ্যক স্থিরতার অবস্থানের যোগফল কখনও গতি হতে পারে না। কাজেই চলার প্রতিটি মুহূর্তে তীরটি স্থির, গতিশীল নয়। কাজেই গতি অসম্ভব।
- (ঘ) সমানবেগে সমান দূরত্বকে সম সময়ে অতিক্রম করা যায়। দুটি রেখার মধ্যে একটি যদি স্থির থাকে এবং অপর রেখাটি যদি রেখাটিকে অতিক্রম করে যায় তাহলে স্থির রেখাটি অতিক্রম করতে তার কত সময় লাগবে? এটি অবশ্য নির্ভর করেছে গতিশীল রেখার বেগের উপর। কিন্তু যে বেগই কল্পনা করা যাক না কেন, সময়ের একক হবে ঐ রেখার দৈর্ঘ্য অতিক্রম করার সময়। কিন্তু যদি তৃতীয় একটি রেখা দ্বিতীয় গতিশীল রেখাটি যে দিক থেকে ধাবমান তার বিপরীত দিক থেকে ধাবমান হয়, তাহলে ঐ দুটি রেখা কখন স্থির রেখাটিকে অতিক্রম করবে? প্রত্যেকের স্থির রেখার দৈর্ঘ্য অতিক্রম করতে লাগবে মূল এককের অর্ধেক সময়। জেনো তার হেঁয়ালির সাহায্যে প্রমাণ করলেন যে, কোন সময়ের অর্ধেক তার সমগ্র অংশের সঙ্গে সমান বা সময়ের এককের অর্ধেক সমগ্র সময়ের এককের সমান (half the unit of time is equal to whole unit of time)। কিন্তু এই জাতীয় সিদ্ধান্ত অসম্ভব।
জেনোর যুক্তির স্ব-বিরোধ ও সমাধান
এই ধরনের যুক্তিকে আধুনিককালে বলা হয় স্ব-বিরোধ (Antiomy)। এটা এক ধরনের প্রমাণ। একটা বিষয়কে স্বীকার করে নিলে যদি তার থেকে একই ভাবে পরস্পর বিরুদ্ধ দুটি বচন নিঃসৃত হয় তাহলে যে বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হবে। জেনোকে ‘দার্শনিক বিরোধের সাহায্যে বিচার (Dialectic)’-এর আবিষ্কারক বলে অ্যারিস্টটল অভিহিত করেছেন। এ হল এক ধরনের যুক্তি যার উদ্দেশ্য হল দেখান যে, মিথ্যা নিজেকে নিজে খণ্ডন করে।
স্টেইসের অভিমত : স্টেইস (Stace)-এর মতানুসারে জেনো বহুত্ব এবং গতির বিরুদ্ধে যে-সব যুক্তি প্রয়োগ করেছেন সেগুলো একটি মাত্র যুক্তিরই প্রকারভেদ। যুক্তিটি দেশ ও কাল উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু যুক্তিটির দৈশিক তাৎপর্যই স্টেইস ব্যাখ্যা করেছেন। যে-কোন পরিমাণ দেশ, ধরা যাক্, একটি বৃত্তের দ্বারা পরিবেষ্টিত। যে দেশ, হয় তা অনন্তসংখ্যক ভাবে বিভাজ্য হবে কিংবা মৌলিক অবিভাজ্য এককের দ্বারা গঠিত হবে। যদি অবিভাজ্য এককের দ্বারা গঠিত হয়, তবে আমাদের এমন সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হতে হয় যে, এর বিস্তৃতি আছে কিন্তু তা অবিভাজ্য। যদি একে অনন্ত সংখ্যক ভাগে বিভক্ত করা যায় তাহলে আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, অনন্ত সংখ্যক অংশের যোগফল হল একটা সীমিত সমষ্টি। কাজেই জেনোর হেয়ালিগুলোকে একেবারে ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। জেনো তার হেঁয়ালির মাধ্যমে আমাদের দেশ ও কালের মধ্যে যে বিরোধিতা নিহিত রয়েছে তা প্রকাশ করে পরবর্তী কালের দর্শনের পক্ষে প্রয়োজনীয় সমস্যার উথাপন করেছেন।
অনন্ত সংখ্যক বিভাজ্যতার স্ব-বিরোধ : জেনোর উপরিউক্ত যুক্তিটিকে বলা হয়। অনন্তসংখ্যক বিভাজ্যতার স্ব-বিরোধ (Antinomy of Infinitely Divisibility)। জেনোর ধাবমান তীরের হেঁয়ালিও যে অভিমতের উপর প্রতিষ্ঠিত তা হল যে, কাল অনন্ত সংখ্যকভাবে বিভাজ্য। অনন্ত সংখ্যকভাবে বিভাজ্য একটি মুহূর্ত, যার কোন স্থিতিকাল নেই, সেই মুহুর্তে নিক্ষিপ্ত তীরটি হল স্থির। দেশ ও কালকে কেন্দ্র করে এই স্ব-বিরোধ ছাড়াও আমরা অনেক অ-বিরোধের কথা জানি। অসীম দেশের ধারণার মধ্যেই স্ব-বিরোধ রয়েছে।
নানাভাবে সমাধান : জেনোর অনন্তসংখ্যক বিভাজ্যতার স্ব-বিরোধের নানাভাবে সমাধান করা হয়েছে। জেনো নিজেও এর একটা সমাধান দেবার চেষ্টা করেছেন। জেনো পারমিনাইডিসের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করার জন্যই দেশের ধারণার এই বিরোধিতার কথা উল্লেখ করেছেন। জেনোর বক্তব্য হল যে, বহুত্ব এবং গতির মধ্যে যেহেতু এই সব বিরোধিতা রয়েছে সেহেতু বহুত্ব এবং গতি যথার্থ হতে পারে না, কাজেই পারমিনাইডিসের সত্তার, যা এক এবং বহুত্ব, গতি এবং ভবন (Becoming) বর্জিত অস্তিত্ব রয়েছে। পরবর্তীকালে জার্মান দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট ব্যক্ত করেছেন যে, এই সব বিরোধিতা দেশ ও কালের ধারণার মধ্যে নিহিত; যেহেতু দেশ ও কাল যথার্থ নয়, অবভাস মাত্র। দেশ ও কাল তার মতে প্রত্যক্ষের আকার (Forms of Perception)। আমাদের মনই বস্তুকে প্রত্যক্ষ করার সময় তাতে দেশ ও কালকে আরোপ করে, বস্তু আমাদের মনে দেশ এবং কালকে আরোপ করে না। কান্ট এই সব ‘বিরোধিতা থেকে এই সিদ্ধান্তও করেছিলেন যে, অসীমের ধারণা করা মানুষের বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয়। দেশ ও কাল অনন্ত সংখ্যকভাবে বিভাজ্য – হিউম এই বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন এবং ঘােষণা করেছিলেন যে, বিস্তারযুক্ত বিভাজ্যহীন এককের দ্বারা তারা গঠিত। কিন্তু হিউম বিষয়টিকে ভালভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি, কেন এককগুলোর বিস্তার থাকা সত্ত্বেও তারা অবিভাজ্য। প্রকৃত সমাধান তখনই সম্ভব যখন একটি ব্যাপকতর ধারণার মধ্যে দুই পরস্পর বিরোধী ধারণার সমন্বয় সাধিত হবে, যা দার্শনিক হেগেল প্রমাণ করার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন।
জেনোর হেয়ালিগুলোর আসল উদ্দেশ্য
জেনোর হেঁয়ালিগুলোর আসল উদ্দেশ্য হল দেখান যে, পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের গতি, দেশ এবং কালের ধারণাতে কিছু ভুল আছে। যদিও পরবর্তীকালের দার্শনিকবৃন্দ তার জন্য পারমিনাইডিসের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রণােদিত হননি, তবু জেনোর হেঁয়ালিগুলোর জন্য তারা আকারগত তর্কবিদ্যার (Formal Logic) প্রশংসা করেছেন এবং তার প্রয়োগের মধ্যে নতুন সম্ভাবনা দেখেছেন। এর আর একটি ফল হল পরবর্তীকালের দার্শনিকবৃন্দ পিথাগোরীয় সম্প্রদায়ের ধারণাগুলোকে অসংগতিমুক্ত করে উপস্থাপিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এটি পরবর্তীকালে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করেছে। অ্যানাক্সাগোরাস শুদ্ধ নিরবচ্ছিন্নতার ধারণা গ্রহণ করে পৃথক পৃথক বিন্দুর ধারণা বর্জন করেছেন। অ্যারিস্টটল পাটীগণিতকে জ্যামিতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক মনে করেছেন, পরমাণুবাদের ভিত্তি হিসেবে জাগতিক ও গাণিতিক বিভাজ্যতার (Physical and Mathematical Divisibility) মধ্যে পার্থক্য প্রবর্তন করেছেন।
হেরাক্লিটাস (৫৩৫-৪৭৫ খ্রী.পূ.)
জীবনী
হেরাক্লিটাসের (Heraclitus, ৫৩৫-৪৭৫ খ্রীপূ) জন্মসময় সঠিকভাবে নিরূপণ করা কঠিন। সেই কারণে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস রচয়িতাগণ তার জন্মসময়ের উল্লেখ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ের কথা বলেছেন। ডায়ােজিনিসের (Diogenes) অভিমতের উপর ভিত্তি করে কেউ কেউ হেরাক্লিটাসের জন্মসময় খ্রীঃ পূর্বঃ ৫০৪ বা ৫০১ অব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন হেরাক্লিটাস ৫৩৫ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি ছিলেন জেনােফ্যানিসের পরবর্তী দার্শনিক এবং পারমিনাইডিসের সমসাময়িক, কিন্তু জেনাের থেকে বয়সে বড়। আবার কারও কারও মতে, তিনি পারমিনাইডিস এবং জেনাের পূর্বে জন্মগ্রহণ করলেও তার দার্শনিক জীবনের শেষভাগ ছিল উভয় দার্শনিকের সমকালবর্তী। ঐতিহাসিক দিক থেকে মন্তব্য করা যেতে পারে যে, তিনি এলিয়ার দার্শনিকদের সঙ্গে সমকালবর্তী ছিলেন।
এশিয়া মাইনরে এফিসাস নামে একটি নগরে হেরাক্লিটাসের জন্ম হয়। পারস্যবাসীরা মিলিটাস ধ্বংস করার পর এফিসাস এশিয়া মাইনরের অন্যতম শক্তিশালী নগরীতে পরিণত হয়। আর্টেমিসের জগতবিখ্যাত মন্দির এই নগরীতে অবস্থিত ছিল। এই মন্দির প্রাচ্য ও গ্রীক সংস্কৃতির মিশ্রণের এক অপূর্ব নিদর্শন ছিল। এক সম্ভ্রান্ত এফিসাস পরিবারে হেরাক্লিটাসের জন্ম হয়। বংশগতভাবে যে প্রধান পুরােহিতের মর্যাদাপূর্ণ পদ তার পরিবারের লাভ করার কথা, তিনি সেই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অধিককাল সেই পদে অধিষ্ঠিত না থেকে পদটি তার ছােট ভাইকে দিয়ে দেন। (The ancient dignity of Basileus (at this date no doubt a religious office) was hereditary in his family; for we are told that he resigned it in favour of his brother.”- Burnet; Greek Philosophy; page 58)।
অভিজাততন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন বলে এবং অভিজাত ঘরের লােক ছিলেন বলে তিনি গণতন্ত্রের মােটেও সমর্থক ছিলেন না এবং গণতন্ত্রের ক্রিয়াকলাপে তিনি এতই বিরক্ত বােধ করতেন যে, তিনি আর্টেমিসের মন্দিরের নিঃসঙ্গতার আশ্রয় গ্রহণ করতেন। বস্তুত তিনি ছিলেন খুবই রাশভারী বা গম্ভীর মেজাজের ব্যক্তি। মানুষের ক্রিয়াকলাপ ও মতামতের প্রতি ছিল তার একান্ত উপেক্ষার ভাব। এফিসাসের জনসাধারণের প্রতি যেমন, তেমনি অতীতের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের প্রতিও তার উপেক্ষার ভাব ছিল প্রবল। তার রাজনৈতিক মনােভাবের পরিচয় পাই যখন তিনি বলেন, এফিসাসের নাগরিকদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক তাদের উচিত শ্ৰশুবিহীন বালকদের উপর নগরের শাসনভার অর্পণ করে নিজেদের ফাঁসির বন্দোবস্ত করা, কারণ তারাই তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ সেই হারমােডােরসকে বিতাড়িত করেছে এই বলে যে, আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এমন কেউ যদি থাকে সে অন্যত্র চলে যাক, তাকে আমাদের প্রয়ােজন নেই। হেরাক্লিটাসের এই উক্তি থেকে বােঝা যায় যে, জনসাধারণের ক্ষত বৃদ্ধিতে তিনি অত্যন্ত রুষ্ট হয়েছিলেন। দেশের সাধারণ লােকের প্রতিই যে তার অবজ্ঞার ভাব ছিল কেবলমাত্র তা নয়, পূর্ববর্তী অন্যান্য খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সম্পর্কে তিনি একটা ভাল কথা বলে যাননি। তাদের সম্পর্কেও হেরাক্লিটাস অবজ্ঞাসূচক উনি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হােমারকে তালিকা থেকে বার করে দেওয়া উচিত এবং তাকে বেত্রাঘাত করা উচিত। আর কিলােকাসের প্রতি অনুরুপ ব্যবহার করা উচিত। অনেক বিষয় শিক্ষা করলে যে মানুষ চিন্তা করতে শেখে না, এই সত্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি হেসিয়ােড, পিথাগােরাস, জেনােফ্যানিস এবং হিকেটিয়াসের নাম উল্লেখ করেছেন। পিথাগােরাস সম্পর্কে তিনি বলতেন, পিথাগােরাস যে জ্ঞান লাভ করার জন্য নিজেকে জ্ঞানী বলে প্রচার করতেন তা আসলে একাধিক বিষয়ের অপরিপূর্ণ জ্ঞান এবং নিছক প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। পিথাগােরাসের গবেষণার কোন মূল্য তিনি দেননি, কারণ তার মতে বিজ্ঞতা (Wisdom) একাধিক বিষয়ের অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ জ্ঞান নয়, এ হল একটিমাত্র বিষয়ের সুস্পষ্ট জ্ঞান।
হেরাক্লিটাসের কোন কোন উক্তি একাধারে বিদ্রুপপূর্ণ এবং কৌতুককর। তিনি বলেন, চিকিৎসকরা রােগীর শরীরের উপর কাটা ছেঁড়া করে, তার দেহ পুড়িয়ে দেয়, দেহে ছুরি চালায় এবং দেহটাকে নিয়ে টানাহেচড়া করে, এবং তারপর তার জন্য পারিশ্রমিক দাবী করে, যা তারা কোন মতেই দাবী করতে পারে না। সাধারণ মানুষের প্রতি তার সীমাহীন অবজ্ঞার ভাব প্রকাশ পেয়েছে। যখন তিনি উক্তি করেছেন, গর্দভের দল সােনা ছেড়ে খড় বেছে নেয়। সাধারণ মানুষের প্রতি অবজ্ঞাবশত তিনি চিন্তা করতেন যে, কেবলমাত্র বল প্রয়ােগের দ্বারা তারা তাদের নিজের কল্যাণের জন্য কাজ করতে বাধ্য হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি পশুকে প্রহারের দ্বারাই পশুচারণ ভূমিতে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে হয়। হেরাক্লিটাস যে বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন বার্নেটের (Burnet) এক মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। হেরাক্লিটাস-এর দর্শন আলােচনার শুরুতেই তিনি মন্তব্য করেছেন যে, হেরাক্লিটাসকে নিয়ে আলােচনা করতে গেলেই আমরা অনুভব করতে পারি যে, দর্শনের সংহতির রূপ দেবার ব্যাপারে (in shaping systems of philosophy) ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব কতটুকু।
স্বাধীনচেতা হেরাক্লিটাস সত্য অনুসন্ধানের জন্য স্বাধীনভাবে নিজ পথ অনুসরণ করেছিলেন। হেরাক্লিটাস তার দার্শনিক চিন্তা গদ্য রচনার আকারে একটি গ্রন্থে প্রকাশ করেন। গ্রন্থটির নাম জানা যায়নি। সক্রেটিসের সময়ে এটি সুপরিচিত ছিল। কিন্তু সমগ্র গ্রন্থটি এখন আর পাওয়া যায় না, তার অংশবিশেষ কেবলমাত্র এখন আমাদের কাছে এসে পৌছেছে। তার রচনাশৈলীর দুর্বোধ্যতার জন্য তাকে অস্পষ্ট দার্শনিক বলে অভিহিত করা হতাে, এরকম প্রবাদ আছে। তার বক্তব্য বিষয়কে তিনি খুব সংক্ষিপ্ত, সারগর্ভ, অর্থপূর্ণ কথার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতেন।
পরিবর্তনই বিশ্বের ধর্ম
জেনােফ্যানিসের মত হেরাক্লিটাসের দার্শনিক চিন্তা শুরু হয়েছিল প্রকৃতির পর্যবেক্ষণকে ভিত্তি করে। প্রকৃতিকে তিনি অনুভব করেছিলেন এক সমগ্ররূপে। কাজেই এর আবির্ভাবও নেই, তিরােধানও নেই। কিন্তু বস্তুর নিরন্তর পরিবর্তন, বিশেষ বস্তুর অস্থায়িত্ব হেরাক্লিটাসের মনের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, তিনি তার মধ্যেই বিশ্বের সাধারণ নিয়মকে পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং এই বিশ্বজগতকে সদা পরিবর্তনশীল এবং নিত্যনতুন পরিণামের অধীন বলে গণ্য করতেন। গৌতমবুদ্ধের মত হেরাক্লিটাস পরিবর্তনবাদ ও ক্ষণিকবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তার মতে, সকল কিছুই নিরন্তর পরিবর্তিত হচ্ছে, পুরাতন রূপ এবং আকার পরিত্যাগ করে নতুন রূপ এবং আকার পরিগ্রহ করছে। কোন কিছুই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, কোন কিছুই যা, তাই থেকে যায় না। গতি ও পরিবর্তনই বিশ্বের ধর্ম, সকল কিছুই গতিশীল, স্রোতের মত প্রবাহমান এবং নিরন্তর পরিবর্তনশীল (All things are in a state of flux)। পরিবর্তনের অর্থ হল একটি অবস্থার পর আর একটি অবস্থার উদ্ভব। জগতের যাবতীয় বস্তু সদা পরিণামী। তিনি বলেন, “এক নদীতে কেউ দুবার অবগাহন করতে পারে না, কেননা প্রথমবার অবগাহন করার পর নদী পরিবর্তিত হয়ে গেছে, নতুন জলের স্রোত প্রবাহমান”। কোন মুহূর্তেই পূর্ববর্তী মুহুর্তের নদীর জলের সঙ্গে তার পরবর্তী মুহূর্তের জলের কোন সাদৃশ্য নেই। এ জগতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়।
হেরাক্লিটাস শুধুমাত্র যে সবরকম চরম স্থায়ীত্বই অস্বীকার করেছেন তা নয়, তিনি বস্তুর আপেক্ষিক স্থায়ীত্বের বিষয়টিকেও অলীক বলে ঘােষণা করেছেন। সব কিছুই মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে কোন কিছু এক মুহূর্ত থেকে অন্য মুহূর্তে অপরিবর্তিত থাকছে না। আমরা মনে করি, কোন একটি বস্তু অনেক মুহূর্ত ধরে অপরিবর্তিত থাকছে, কিন্তু বস্তুর এই ধরনের আপেক্ষিক স্থায়ীত্বের বিষয়টি ভ্রম প্রত্যক্ষ ছাড়া কিছুই নয়। স্টেইস ঐ প্রসঙ্গের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উদাহরণস্বরূপ জলের ঢেউ- এর উল্লেখ করেছেন। জলের উপরিভাগ দিয়ে যে ঢেউ বয়ে যায় আপাতদৃষ্টিতে তাকে এক ঢেউ বলেই মনে হয়। কিন্তু আসলে ঢেউটি এক নয়, কেননা যে জল দিয়ে ঢেউটি তৈরি সেটি মুহুর্তে মুহুর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে। বস্তুর মধ্যে সমপরিমাণ দ্রব্যের প্রবেশ ও নির্গমনই হেরাক্লিটাসের মতে, বস্তুর স্থায়ীত্বের ভাব মনে জাগিয়ে তােলে। সব কিছুই নিরন্তর পরিবর্তনশীল। হেরাক্লিটাস বলেন যে, এক সূর্য রােজ উদিত হচ্ছে বা অস্ত যাচ্ছে তা নয়, রােজই এক নতুন সূর্যের আবির্ভাব ঘটছে। কেননা সূর্যের অগ্নি নিজেকে দগ্ধ করে নিঃশেষিত করলেও সমুদ্রের বাষ্প থেকে তার ক্ষয়পূরণ হয়ে যাচ্ছে। বস্তু যে শুধু মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে তা নয়, এক মুহূর্তও তারা এক অভিন্ন বস্তু থাকছে না। একটি বস্তু প্রথম মুহূর্তে এক রয়েছে, তার পরের মুহূর্তে অন্য কিছুতে পরিবর্তিত হচ্ছে, তা নয়, একই সময়ে এটি আছে এবং নেই এই কথাই সত্য। ভবন (Becoming)-এর অর্থই হচ্ছে তাই একই সঙ্গে থাকা আর না থাকা।
হেরাক্লিটাসের দার্শনিক তত্ত্ব এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দের প্রচারিত দার্শনিক তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত। এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দ সব রকম পরিবর্তনকে অলীক মনে করে ভবনের (Becoming) অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে, সত্তারই (Being) শুধুমাত্র অস্তিত্ব আছে। কিন্তু হেরাক্লিটাসের মতে কেবলমাত্র ভবনের (Becoming) অস্তিত্ব আছে। সত্তা, স্থায়ীত্ব, অভেদত্ব, এসব কিছুই অলীক, কেননা শুধু ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্যই যে পরিবর্তিত হচ্ছে তা নয়, সমস্ত জগতই নিরন্তর গতিশীল ও পরিণামী। স্থিতিশীলতা, স্থিরতা – এ সবের কোন সত্যতা নেই। কাজেই সত্তা নয়, ভবনেরই একমাত্র সত্যতা রয়েছে।
জগতের মূল উপাদান অগ্নি
হেরাক্লিটাসের এই ভবন ও পরিবর্তনশীলতার দর্শনের পরিপূর্ণ তাৎপর্য বুঝতে হলে তার দর্শনে জগতের মূল উপাদান বা পদার্থ সম্পর্কীয় মতবাদ সম্পর্কে জানা দরকার। মাইলেসীয় দার্শনিকবৃন্দের মতই হেরাক্লিটাস মনে করেন যে, জগতের সব কিছুই এক মূল উপাদান বা পদার্থ থেকে উদ্ভূত। থেলিস্ এই মূল পদার্থকে জল, অ্যানাক্সিমেন্ডার তাকে বায়ু বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু হেরাক্লিটাসের মতে, এই মূল উপাদান হল জল বা বায়ু থেকে অনেক সূক্ষ্ম পদার্থ। তা হল অগ্নি (Fire)। জেলার (Zellar) বলেন, “তিনি অগ্নি বলতে শুধু শিখা বােঝেননি, সাধারণভাবে উষ্ণতাকে বুঝেছেন, সেই কারণেই তিনি তাকে উর্ধে ধাবমান বাষ্পশ্বাস বলে অভিহিত করেছেন।” (“Hence he understood by his fire not merely the flames, but warmth generally, Hence he called it a rising vapour or breath.” – Zeller : Outlines of the History of Greek Philosophy; Page 46)। তার মতে সবই অগ্নির দ্বারা গঠিত। এই জগৎ, যা সকলের কাছে এক, ঈশ্বর বা মানুষের দ্বারা নির্মিত নয়। এই জগৎ চিরকাল ধরেই এক আদি অন্তহীন প্রাণবন্ত অগ্নি। সব কিছুই অগ্নি থেকে উদ্ভূত হয়। অগ্নিতেই সব কিছুর লয়। অগ্নিই মূল উপাদান। বিশ্বের সব কিছুই অগ্নিরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ বা প্রকাশ। “সব কিছুই অগ্নির বদলে বিনিময় হয় এবং অগ্নি সব কিছুর বদলে বিনিময় হয়। যেমন, পণ্যদ্রব্য সােনার বদলে, সােনা হয় পণ্যদ্রব্যের বদলে।”
প্রশ্ন হল, হেরাক্লিটাস্ অগ্নিকেই জগতের মূল উপাদান বলে গণ্য করলেন কেন? তার কারণ তিনি দেখলেন যে, বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে অগ্নিই সবচেয়ে গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। অগ্নি চিরচঞ্চল, এক মুহূর্তও পরিবর্তিত না হয়ে থাকতে পারে না। এই অগ্নি কখনও শিখারূপে ঊর্ধ্বে ধাবমান, কখনও ভস্মে পরিণত, আবার কখনও সেই ভস্ম থেকে উত্থিত ধূমরূপে ঊর্ধ্বে বিলীয়মান। হেরাক্লিটাসের মতে, অগ্নি প্রথম বায়ুতে রূপান্তরিত হয়, তারপর বায়ু থেকে জলে এবং জল থেকে মৃত্তিকায় পরিণত হয়। এই পরিবর্তনকে হেরাক্লিটাস নিম্নগামী (Downward Path) রূপে অভিহিত করেছেন। আবার মৃত্তিকা পরিণত হয় জলে, জল বাতাসে এবং বাতাস অগ্নিতে। একে হেরাক্লিটাস ‘ঊর্ধ্বগামী পথ’ (Upward Path) বলে অভিহিত করেছেন। সব পরিবর্তন ঘটে একটা নিয়মিত শৃঙ্খলা অনুসারে। এবং হেরাক্লিটাসের মতে, উর্ধ্বগামী এবং নিম্নগামী উভয় পথই এক।
হেরাক্লিটাস যে অগ্নিকে মূল উপাদানরূপে গণ্য করেছেন, কপলস্টোন (Copleston) মনে করেন যে, তার একটা কারণ আছে। এবং সেটি তার দর্শনের মূল চিন্তাধারার সঙ্গে জড়িত। অগ্নি দহন করে এবং বিজাতীয় বস্তুকে নিজের মধ্যে রূপান্তরিত করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে এবং আর একাধিক বস্তু থেকে উদ্ভূত হয়ে তাদের নিজেতে পরিণত করে এবং এই উপাদানের সরবরাহ ব্যতিরেকে এর ঘটবে মৃত্যু, এ হয়ে পড়বে সত্তাহীন। এই বিরােধ (Strife) এবং টান (Tension)-এর উপরই নির্ভর করছে অগ্নির অস্তিত্ব। এই প্রসঙ্গে কপলস্টোন-এর মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেন যে, হেরাক্লিটাসের অগ্নিকে মূল উপাদানরূপে গণ্য করা তার খামখেয়ালির ব্যাপার নয়, নতুনত্ব সৃষ্টি করার ইচ্ছামাত্র নয় বা পূর্বসূরীদের থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা মাত্র নয়। এটা তার মূল দার্শনিক চিন্তার দ্বারাই সূচিত হয়েছে।
এই বিশ্ব অনবরতই পরিবর্তিত হলেও, কোনক্ষণেই তা স্থির না থাকলেও আমাদের মনে কেন এই জগতে বস্তুর স্থায়ীত্বের ভাব জাগে হেরাক্লিটাস এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন অগ্নির দ্বারাই। এই জগৎ এক সদা-জীবন্ত অগ্নি এর কিছু পরিমাণ প্রজ্বলিত হয় এবং কিছু পরিমাণ নির্বাপিত হয়। কাজেই অগ্নি যেমন বস্তু থেকে গ্রহণ করে, প্রজ্বলিত করে, তাদের নিজের মধ্যে রূপান্তরিত করে, তেমনি অগ্নি যতটুকু গ্রহণ করে ততটুকু দেয়। কাজেই যদিও প্রতি ধরনের জড়ের যে দ্রব্য (Substance), তার অনবরত পরিবর্তন ঘটলেও সেই জড়ের সমষ্টিগত পরিমাণ থেকে যাচ্ছে। অগ্নির বিভিন্ন পরিমাণে, কমবেশি সমান অনুপাতে, প্রজ্বলিত হওয়া এবং নির্বাপিত হওয়ার জন্যই বস্তুর আপেক্ষিক স্থায়ীত্ব রয়েছে। এই পরিমাণের বিষয়টি, বা ঘটনাটি উচ্চগামী এবং নিম্নগামী পথের ভারসাম্য – একেই হেরাক্লিটাস বিশ্বের লুক্কায়িত সমন্বয়বিধান (Hidden Attunement of the Universe) বলে অভিহিত করেছেন, এবং তিনি বলেন, যা প্রকাশিত তার তুলনায় এটা অনেক ভাল।
হেরাক্লিটাসের “বাণী” এবং সত্তা, অ-সত্তা, এক ও ঈশ্বরের ধারণা
হেরাক্লিটাস এর মতে, বিজ্ঞতা বহু বিষয়ের জ্ঞান নয়, কেবলমাত্র একটি বিষয়ের সুস্পষ্ট জ্ঞান এবং একেই হেরাক্লিটাস তার বাণী (Word) বলে বর্ণনা করেছেন। হেরাক্লিটাস বলতেন, তার বাণী চিরকালই সত্য, যদিও মানুষকে তা বলা হলে তারা তা বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু হেরাক্লিটাস মনে করতেন যে, তার এই বাণীর কথা তিনি প্রকাশ করবেন, অপরে শুনুক বা না শুনুক। তাহলে প্রশ্ন হলো হেরাক্লিটাস তার বাণী বলতে কি বােঝাতে চেয়েছেন। ‘অগ্নিই মূল পদার্থ’, এই মতবাদ কিংবা ‘পরিবর্তনই বিশ্বের ধর্ম’, বা ‘যাবতীয় পদার্থ নিরন্তর পরিবর্তনশীল’ এই মতবাদই কি তার বাণীর আসল তাৎপর্য? বার্নেট, কপলস্টোন প্রমুখ পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস প্রণেতাগণ মনে করেন না যে, উপরিউক্ত মতবাদই তার বাণীর সেই তাৎপর্য।
হেরাক্লিটাসের এই বাণীটি হলো সত্তা ‘এক’ এবং এই এক সত্তা বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, ভেদের মধ্যে অভেদ। বিষয়টা ভাল করে বুঝে নেওয়া যাক্-এলিয়ার দার্শনিকবৃন্দ দুটি প্রত্যয়ের সাহায্যে সব কিছু বর্ণনা করেছেন সত্তা এবং অ-সত্তা। তারা সত্তারই সত্যতা স্বীকার করেছেন এবং অ-সত্তাকে অলীক বা মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন। কিন্তু হেরাক্লিটাস সত্তা এবং অ-সত্তা উভয়কেই সত্য বলে স্বীকার করেছেন। কারণ আসলে উভয়ে এক পথ নয়। ভবন হল সত্তা এবং অ-সত্তার অভেদ। ভবন হল বস্তুর উৎপত্তি এবং তাদের তিরােধান, তাদের শুরু এবং তাদের শেষ, তাদের উৎপত্তি এবং তাদের ধ্বংস। উৎপতি হল অ-সত্তার সত্তায় পরিণতি, ধ্বংস হল সত্তার অ-সত্তায় পরিণতি। কাজেই ভবন হল সত্তা ও অসত্তা এই দুই উপাদানের একটির আর একটিতে পরিণতি। সত্তা এবং অসত্তা একই সময়ে সব কিছুতে বর্তমান। ‘সত্তাই অ-সত্তা’, সত্তাতেই অ-সত্তা রয়েছে। জীবনের মধ্যেই প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে মৃত্যু। এই কারণে হেরাক্লিটাস বলেছেন যে, বস্তু আছে আবার নেই।
জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে রয়েছে তার যা বিরােধী তার অস্তিত্ব ও শুধু সত্তার মধ্যেই যে অ-সত্তা রয়েছে তা নয়, জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই রয়েছে তার যা বিরােধী তার অস্তিত্ব। প্রতিটি অস্তিত্বশীল বস্তু হল বিরােধী টানের এক ভারসাম্য (Harmony of Opposite Tensions)। বিরােধী শক্তির সংঘাত বিশ্বের সর্বত্রই দ্রষ্টব্য। বস্তুত প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই নিহিত রয়েছে তার বিরােধী নীতি। এই পরস্পরবিরােধী নীতির সংঘাতের মধ্যেই রয়েছে বস্তুর অস্তিত্ব, বস্তুর সত্তা। প্রতিটি বস্তুর অন্তরে রয়েছে সংঘাত। বস্তুর মধ্যে যদি এই সংঘাত না থাকত, বস্তু ধ্বংস হয়ে যেত। বিরােধের সংঘাতের কথা নতুন কিছু নয়। মাইলেসীয় দার্শনিক অ্যানাক্সিমেন্ডার, এই বিরােধীরা পরস্পরের সীমা লঙ্ঘন করছে, এমন কথার উল্লেখ করেছেন। অ্যানাক্সিমেন্ডার বিরােধীর সংঘাতকে শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী, একের শুদ্ধতা ধ্বংসকারী বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু হেরাক্লিটাসের মতে, বিরােধীসংঘাত একের অস্তিত্বের জন্য অনিবার্যভাবে প্রয়ােজন। এই সংঘাতের বিষয়টিকে হেরাক্লিটাস নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘সংঘাতই সব কিছুর জনক’। “ঈশ্বর হলেন দিন এবং রাত্রি, গ্রীষ্ম এবং শীত, যুদ্ধ এবং শান্তি, ক্ষুধা এবং পরিতৃপ্তি।”
হেরাক্লিটাস সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, সত্তা হল এক এবং এই একের অস্তিত্বের জন্য বিরুদ্ধধর্মী পদার্থের সংঘাত অবশ্যই প্রয়ােজন। তার কয়েকটি উক্তি থেকেই এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে জানা যায়। যেমন, তিনি বলেছেন, আমরা অবশ্যই জানব যে যুদ্ধ সকল ক্ষেত্রেই বর্তমান এবং বিরােধ বা সংঘাতই ন্যায় সব বস্তুই সংঘাতের মাধ্যমেই সত্তাবান হয় এবং তিরােহিত হয়। হােমার দেবতা এবং মানুষের মধ্য থেকে সংঘাত তিরােহিত হবার জন্য যে প্রার্থনা জানিয়েছেন তার জন্য হেরাক্লিটাস তার নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, হােমারের এই প্রার্থনা যদি পূরণ করা হত তাহলে সমস্ত বিশ্বজগতই ধ্বংস হয়ে যেত। হেরাক্লিটাস স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, মানুষ জানে না যে, যা সংঘাতপূর্ণ তা নিজের সঙ্গে কিভাবে সংগতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এ হল বিপরীত টানের (Tension) সমন্বয়বিধান, যা দেখা যায়, যখন ছড়ের আঘাতে বীণার তারে টান পড়ে এবং তার থেকে সুরের উৎপত্তি ঘটে।
একের অস্তিত্বের পক্ষে বিরােধের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী ও ‘এক’ হচ্ছে তার নিজেরই পার্থক্য এবং এই পার্থক্যগুলো নিজেরাই হচ্ছে ‘এক’। তারা একেরই বিভিন্ন দিক। এই পার্থক্যগুলো কখনও বিলুপ্ত হতে পারে না, তাহলে একেরই কোন অস্তিত্ব থাকে না। কাজেই একের এই বিভিন্ন দিক, উচ্চগামী পথ আর নিম্নগামী পথ কোনটাই বিলুপ্ত হতে পারে না। সুতরাং একের অস্তিত্বের পক্ষে এই বিরােধের অবিচ্ছেদ্যতাকে স্বীকার করে নিতেই হয়। একের বিভিন্ন মুহূর্তের স্বীকৃতিকে কোন মতেই অগ্রাহ্য করা চলে না। নানা কথার মধ্য দিয়ে হেরাক্লিটাস এই বিষয়টিকে প্রকাশ করেছেন। উপরের পথ আর নীচের পথ একই। আত্মার পক্ষে জলে পরিণত হওয়া এবং জলের পক্ষে মৃত্তিকায় পরিণত হওয়া, মৃত্যুরই সামিল কিন্তু জল মৃত্তিকা থেকে এবং জল থেকেই আত্মা আসে। একেতেই সব বিভেদের ঐক্য, সব পার্থক্যের সুসংগতি ও সব টানের (Tension) সমন্বয়বিধান সাধিত হয়। ঈশ্বরের কাছে সব কিছুই ভাল এবং সুন্দর এবং যথার্থ। কিন্তু মানুষই কিছু জিনিসকে ঠিক-বেঠিক মনে করে। হেরাক্লিটাস এই এককেই অগ্নি, প্রজ্ঞা (Logos) বা ঈশ্বর (God) বলে অভিহিত করেছেন। হেরাক্লিটাসের মতে, এই তিনটিই মূলে এক। ঈশ্বর হল এক সার্বিক বিচারবুদ্ধি, এক সার্বিক নীতি যা সব জিনিসের মধ্যে অন্তর্নিহিত থেকে সব বস্তুকে ঐক্যবদ্ধ করছে এবং এক সার্বিক নিয়মানুসারে বিশ্বের অবিরত পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
হেরাক্লিটাসের বুদ্ধিবাদ ও স্টোয়িকদের উপর হেরাক্লিটাসের প্রভাব
এলিয়ার দার্শনিকদের মত হেরাক্লিটাস ইন্দ্রিয় এবং বিচারবুদ্ধির মধ্যে পার্থক্য করেছেন। হেরাক্লিটাসের মতে, ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে সত্যকে জানা যায় না। একমাত্র বুদ্ধির দ্বারাই সত্যকে জানা যায়। ভবনই (Beeoming) যে সত্য, বুদ্ধির দ্বারাই এই নীতি বােধগম্য হয়। হেরাক্লিটাসের মতে, মানুষের বিচারবুদ্ধি সার্বিক বিচারবুদ্ধিরই একটি মুহূর্ত মাত্র। কাজেই মানুষের উচিত বিচারবুদ্ধির সাহায্যে সত্যকে উপলদ্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া, বিচারবুদ্ধির সাহায্যে সবকিছুর ঐক্যকে বুঝে নিতে চেষ্টা করা। বিচারবুদ্ধি এবং চেতনা মানুষের মধ্যে অগ্নিময় উপাদান। তারা হল মূল্যবান উপাদান।
কপলস্টোন বলেন, সার্বিক নীতি এবং বিচারবুদ্ধিতে মানুষের অংশগ্রহণ এই দুই এর উপর গুরুত্ব আরােপ করে হেরাক্লিটাস স্টোয়িকদের সার্বজনীন আদর্শের পথ প্রশস্ত করতে সহায়তা করেছিলেন। এই সার্বজনীন সর্ব-শৃংখলা আনয়নকারী বিচারবুদ্ধির ধারণা স্টোয়িকদের দার্শনিক চিন্তায় দেখা যায়, যারা তাদের বিশ্বজগৎ সম্পর্কীয় ধারণা হেরাক্লিটাস থেকে গ্রহণ করেছিল। হেরাক্লিটাস ঈশ্বর, অগ্নি, প্রজ্ঞা সবকেই এক বলে মনে করেছেন। কিন্তু এই ‘এক’ ঈশ্বর হলেও তিনি কি কোন পুরুষরূপী ঈশ্বর? থেলিস্ বা অ্যানাক্সিমিনিসের মত হেরাক্লিটাস এই ‘এক’কে কোন পুরুষরূপী ঈশ্বররূপে গণ্য করেননি। স্টোয়িকদের মত হেরাক্লিটাসও ছিলেন একজন সর্বশ্বেরবাদী, যে মতবাদ অনুসারে ঈশ্বরই সবকিছু এবং সবকিছুই ঈশ্বর।
এক সার্বিক অগ্নিকাণ্ড থেকে সবকিছু সংঘটিত হচ্ছে – এই মতবাদে স্টোয়িকরা বিশ্বাসী ছিলেন। হেরাক্লিটাসের কাছ থেকেই এই ধারণা তারা পেয়েছেন, এই মনে করে হেরাক্লিটাসও এই মতবাদে বিশ্বাসী, এরূপ ধারণা করা হয়েছে। কিন্তু কপলস্টোন কতকগুলাে যুক্তি উপস্থাপিত করেন, হেরাক্লিটাস এই জাতীয় মতবাদে বিশ্বাসী নয় বলেই তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রথমত, বিরােধের সংঘাত যদি একের অস্তিত্বের পক্ষে অনিবার্য মনে করা হয়, তাহলে পর্যায়ক্রমে যদি সববস্তু শুদ্ধ অগ্নিতেই ফিরে যায় তাহলে যুক্তি দিয়ে বিচার করলে অগ্নিরই কোন অস্তিত্ব থাকবে সিদ্ধান্ত করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, হেরাক্লিটাস বলেছেন যে, এই জগৎ বরাবরই এক সদা জীবন্ত অগ্নি ছিল, আছে এবং থাকবে, যার কিছু পরিমাণ প্রজ্বলিত হচ্ছে এবং কিছু পরিমাণ নির্বাপিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, হেরাক্লিটাস বলেছেন, এক হল সব সময়ই বহু। এমপেডোক্লেসের মতে, এক হল পর্যায়ক্রমে বহু এবং এক। কাজেই হেরাক্লিটাস উপরিউক্ত মতবাদে বিশ্বাসী বলা চলে না এবং স্টোয়িকরা যখন বলে যে, হেরাক্লিটাস এই মতবাদে বিশ্বাসী তখন তাদের নিজেদের মধ্যেও মতভেদ দেখা যায়।
আত্মা সম্পর্কে হেরাক্লিটাসের মতবাদ
হেরাক্লিটাস তার সমকালবর্তী ধর্মবিষয়ক শিক্ষকদের সঙ্গে একমত যে, আত্মা কোন অশরীরী বস্তু বা ভুত বা ছায়া নয়। আত্মা সবচেয়ে বাস্তব বস্তু এবং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হল চিন্তন বা বিজ্ঞতা। আত্মার পরিমাপ এত গভীর যে এর সীমারেখা নিরূপণ করা যায় না। মানুষের আত্মা ঐশ্বরিক অগ্নির একটা অংশ। এই অগ্নি যত শুদ্ধ আত্মা তত উৎকৃষ্ট বা নিখুঁত। শুষ্ক আত্মাই বিজ্ঞতম এবং শ্রেষ্ঠ (The driest soul is the wisest and the best)। আর্দ্র হওয়াটা আত্মার পক্ষে আনন্দকর হতে পারে, কিন্তু আত্মার পক্ষে জল হওয়া তার মৃত্যুরই সামিল। আত্মা যখন জেগে থাকে, তখনই আত্মা পরিপূর্ণভাবে সজীব। নিদ্রা হল জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থা। আত্মার উচিত নিদ্রার জগৎ থেকে জাগ্রত অবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়া অর্থাৎ কিনা, চিন্তা এবং বিচার-বুদ্ধির জগতে উত্তীর্ণ হওয়া। এই চিন্তাই হেরাক্লিটাসের বাণী। আত্মা যখন দেহকে পরিত্যাগ করে, আত্মা নির্বাপিত হয় না, যে জগৎ-অগ্নি থেকে আত্মা এসেছিল, সে সেখানেই ফিরে যায়। আত্মা যেহেতু অগ্নি, অন্য অগ্নির মতই সে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে এবং তার পরিপূরণের প্রয়ােজন হয়। এটি সে ইন্দ্রিয় এবং শ্বাসের মাধ্যমে জগতের সাধারণ জীবন এবং বিচারবুদ্ধি থেকে প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ, চারপাশের পরিবেশ এবং সর্ব-ব্যাপক অগ্নি থেকে লাভ করে। এর মধ্যেই আমরা বাঁচি, নড়াচড়া করি এবং আমাদের অস্তিত্ব বজায় রাখি। কোন মানুষেরই নিজস্ব আত্মা নেই। এটি হল এক সার্বজনীন আত্ম-অগ্নির অংশমাত্র। কাজেই এর সঙ্গে সংস্পর্শ বিনষ্ট হলে মানুষ বিচারবুদ্ধিশূন্য হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুমুখে পতিত হয়। নিদ্রা হল জাগরণ ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী অবস্থা। নিদ্রার সময় ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় এবং বাইরের অগ্নি শুধুমাত্র নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়েই আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। কাজেই নিন্দ্রার সময়ে আমরা বিচারবুদ্ধি শূন্য এবং অচেতন হয়ে পড়ি, জগতের সাধারণ জীবন থেকে নিজেদের নিজস্ব একটা ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে আসি।
ধর্মের প্রতি হেরাক্লিটাসের সংশয়বাদ ও মানুষের জীবনের পরমার্থ
ধর্মের প্রতি হেরাক্লিটাসের মনােভাব সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, তিনি এ ব্যাপারে ছিলেন সংশয়বাদী। জেনোফ্যানিসের মত তিনি ধর্মের কেন্দ্রীয় ধারণা এবং ঈশ্বর সম্পর্কীয় মতবাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযােগ উত্থাপন করেননি। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানই ছিল তার সমালােচনার বিষয়বস্তু। তিনি বলতেন, সাধারণ মানুষেরা যেসব ধর্মীয় আচার পালন করে সেগুলো অপবিত্র। তিনি পৌত্তলিকতার বিরােধী ছিলেন এবং পশু উৎসর্গ বা বলির মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে রক্তপাত নিরর্থক মনে করতেন। হেরাক্লিটাস ছিলেন সর্বেশ্বরবাদী। জেনােফ্যানিসের তুলনায় তার সর্বেশ্বরবাদ ছিল সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট। জেনােফ্যানিস ঈশ্বরের সঙ্গে বিশ্বজগতের সম্পর্ককে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে পারেননি। কিন্তু হেরাক্লিটাসের ঈশ্বর জগতের অন্তর্বর্তী এক আত্মা যিনি নিজের থেকেই প্রকৃতি, ইতিহাস, ধর্ম, আইন এবং নৈতিকতা সৃষ্টি করেছেন। হেরাক্লিটাসের সর্বেশ্বরবাদের তিনটি মূল ধারণা হল – ঐক্য, আদি-অন্তহীন পরিবর্তন এবং জগৎ-শৃঙ্খলার নিয়মের অলঙ্ঘনীয়তা। জেলার বলেন, “তিনি হলেন প্রথম দার্শনিক যিনি ধর্মের সাংকেতিক প্রকৃতি স্বীকার করেন।”
মানুষের জীবনের পরমার্থ হলো নীতিবিদ্যার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়বস্তু। হেরাক্লিটাসের মতে বিশ্বের ঐশ্বরিক শৃঙ্খলায় বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত হয় সন্তোষ এবং এই সন্তোষকেই হেরাক্লিটাস জীবনের পরমকল্যাণ বলে গণ্য করেছেন। হেরাক্লিটাস মানবীয় জ্ঞানের সীমারেখা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। মানুষের ধারণাকে তিনি আপেক্ষিক মনে করতেন। তিনি নৈতিক মূল্যকেও বিশেষ গুরুত্ব দেননি। তিনি মনে করতেন মানুষের জগতেই এদের যথার্থ আছে এবং অন্যান্য বস্তুর মত এদের বিরােধিতারও সমন্বয় সাধিত হয় পর বিশ্বসঙ্গতিতে অর্থাৎ ঈশ্বরে।
দর্শনে হেরাক্লিটাসের অবদান
জেলার হেরাক্লিটাসকে প্রাক-সক্রেটিস দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রগাঢ় এবং সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দার্শনিকরূপে বর্ণনা করেছেন। ব্রাম্ব মনে করেন, হেরাক্লিটাস শুধু যে একটা নতুন মতবাদ প্রচার করেছিলেন তাই নয়, তিনি গ্রীক দর্শনে এক নতুন মাত্রা সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন। হেরাক্লিটাস দেখিয়েছিলেন যে, সত্তার গতিশীল দিকটিকে স্থির, অমূর্ত প্রত্যয়ের সাহায্যে বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করা যাবে না। বর্তমান শতাব্দীতে অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা (Existentialist Philosophers) এই বিষয়টির দিকেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সব মৌলিকতা সত্ত্বেও হেরাক্লিটাস একজন আয়ােনিয়ার দার্শনিকই থেকে গেছেন। হেরাক্লিটাস কোন দর্শন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেননি কিন্তু স্টোয়িকদের উপর এবং প্লেটো, অ্যারিস্টটল, ফিলাে এবং নব্য প্লেটোনিকদের উপর তার প্রভাব সুস্পষ্ট। আধুনিক দার্শনিকদের মধ্যে স্লায়ারমাকার (Schliermacher), লাসালস্ (Lasalles) এবং হেগেলের (Hegel) উপর তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। হেরাক্লিটাসের ভবনবাদের (Theory of Becoming) মধ্যে হেগেল সৎ ও অসতের মিলনের সন্ধান পেয়েছিলেন।
তথ্যঋণ
- পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস (প্রাচীন ও মধ্যযুগ), নূরনবী, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৪৮-৭৬
- A History of Western Philosophy, Bertrand Russell, Routledge Classics 2004
- W.T. Stace, A Critical History of Greek Philosophy
- E. Zeller, Outlines of the History of Greek Philosophy
- পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস : থেলিস থেকে হিউম, ১ম খণ্ড, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৫৬-৭২
- প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাশ্চাত্য দর্শনের কথা, ডঃ মোঃ শওকত হোসেন, তিথি পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ৪৬-৭৭
Leave a Reply