ফ্রিডরিক নীটশে (১৮৪৪-১৯০০)

ভূমিকা ও জীবন

নিটশে (Friedrich Nietzsche, ১৮৪৪-১৯০০ খ্রি., আসল উচ্চারণ ফ্রেদরিখ নিচা) সঠিকভাবেই নিজেকে শােপেনহাওয়ারের উত্তরাধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অবশ্য অনেক দিক থেকেই, বিশেষ করে তার মতবাদের সামঞ্জস্যতা এবং সংগতির দিক থেকে তিনি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। শােপেনহাওয়ারের ত্যাগ সম্পর্কিত প্রাচ্য নৈতিকতা তার ইচ্ছার সর্বব্যাপী অধিবিদ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নিটশের দর্শনে নৈতিকতার যেমন প্রাধান্য রয়েছে, তেমনি অধিবিদ্যারও প্রাধান্য রয়েছে। নিটশে ছিলেন একজন অধ্যাপক। তবে তিনি একজন একাডেমিক দার্শনিকের চেয়ে সাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সত্তাতত্ত্বে বা অধিবিদ্যায় তিনি কোনাে নতুন টেকনিক্যাল মতবাদ আবিষ্কার করতে পারেন নি। তার গুরুত্ব প্রথমত নীতিবিদ্যায় এবং দ্বিতীয়ত একজন ধীশক্তিসম্পন্ন ইতিহাসের সমালােচক হিসেবে।

স্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীটশে তার অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন, প্রাচীন গ্রিক বিষয়ে তার দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর (সেই সময়ে যা খুবই কাঙ্ক্ষিত একটি বিষয় ছিল)। ধারাবাহিকভাবে তাকে বেশ কয়েকজন নারী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, বিষয়টি তাকে বেশ দুঃখ দিয়েছিল (তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার সুবিশাল পরিমাণে আত্মবিশ্বাসের অভাব’)। তার পরিবারের কারাে সাথেই তিনি মানিয়ে চলতে পারেননি (‘আমি আমার মাকে পছন্দ করিনা আর আমার বােনের কণ্ঠস্বর শােনা আমার জন্য রীতিমতাে যন্ত্রণাদায়ক।’) এবং তার এই একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার প্রত্যুত্তরে তিনি তার বিখ্যাত গোঁফটি রেখেছিলেন এবং প্রায়শই পাহাড়ি গ্রামের পথে তিনি দীর্ঘসময় ধরে হাঁটতে বের হতেন। বহুবছর ধরেই তার বইগুলাে আদৌ বিক্রি হয়নি। যখন তার বয়স ৪৪, মানসিকভাবে তিনি পুরােপুরি ভেঙে পড়েছিলেন, এর থেকে তিনি আর নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে পারেননি, এর ১১ বছর পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই তিনি সুইজারল্যান্ডে বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে নিয়ােগ পান, কিন্তু খ্যাপাটে এবং খুবই মৌলিক একজন দার্শনিক হিসাবে প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জগতে তিনি নিজেকে বেমানান হিসাবে আবিষ্কার করেছিলেন খুব শীঘ্রই, কোনাে ধরাবাধা নিয়ম মেনে চিন্তা করা তার পক্ষে কখনােই সম্ভব ছিলনা, সুতরাং মনে হতেই পারে নিজের জীবনকে যতটা কঠিন করা সম্ভব এমন একটা নেশা তার মধ্যে ছিল। ১৮৭৯ সালে তিনি অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করেন, আংশিকভাবে এর কারণ অবশ্য ছিল তার ক্রমশ দূর্বল হতে থাকা স্বাস্থ্য। এরপর তিনি প্রথমে ইতালি, এরপর ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন, এই ভ্রমণের সময় তিনি বেশকিছু বই লিখেছিলেন, যে বইগুলাে সেই সময় খুব কম মানুষই পড়েছিল, অথচ এখন তার প্রতিটি বই শুধুমাত্র দর্শন নয়, সাহিত্যেরও অনন্য নিদর্শন এবং সুবিখ্যাত। তার মানসিক অবস্থার অবনতি হলে জীবনের শেষ সময়টুকু তাকে আশ্রয়কেন্দ্রেই কাটাতে হয়।

খ্রিস্টধর্মের সমালােচক এবং বিশেষ করে নাস্তিক হিসেবে আধুনিক ইউরােপীয় দর্শনের ইতিহাসে তথা অস্তিত্ববাদী দর্শনে নীৎসের একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। কিয়ের্কেগার্ড যেখানে খ্রিস্টধর্মকে চেয়েছিলেন পুনরুজ্জীবিত করতে, নীৎশে সেখানে চেয়েছিলেন তা সম্পূর্ণরূপে বিলােপ করতে। খ্রিস্টধর্মের প্রতি তার এ বিরূপ মনােভাব এবং বিশেষ করে তার নাস্তিক চিন্তাধারা পরবর্তীকালে আধুনিক অস্তিত্ববাদের প্রধান প্রবক্তা সার্তকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। নীৎসেই বস্তুতপক্ষে নাস্তিক অস্তিত্ববাদের জনক। নীৎসের নাস্তিক্যবাদ নাস্তিধর্মী (negative) বা ধ্বংসাত্মক মনে হতে পারে; আসলে কিন্তু এর ছিল একটা গভীর লক্ষ্য। তিনি চেয়েছিলেন তৎকালীন ইউরােপীয় সভ্যতায় যে শূন্যতা বিরাজ করছিল – যে শূন্যতা কিয়ের্কেগার্ড নিজে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং খ্রিস্টধর্মের সমালােচনার মাধ্যমে ব্যক্ত করেছিলেন – সে শূন্যতায় পরিপূর্ণতা নিয়ে আসা, একটা সমাধান প্রদান করা।

নীৎসের মতে প্রকৃত দার্শনিক হবেন অধিনায়ক, আইন-প্রণয়নকারী এবং যুগের বিরুদ্ধে সংগ্রামী। সে অর্থে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত দার্শনিক। ভাষাতত্ত্বে ছিল তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য এবং তিনি ছিলেন একজন বড় শিল্পী, একজন বড় কবি-দার্শনিক। তার লেখা ছিল সারগর্ভ-সংক্ষিপ্ত উক্তিতে (aphorism) পূর্ণ; তার রচনায় যে সৌন্দর্য ও রচনাশৈলী দেখা যায়, এবং শব্দচয়নে যে নৈপুণ্য তিনি দেখিয়েছেন, তার জন্য হলেও তিনি দর্শনের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। নীটশে মনে করতেন সার্বিকভাবে এ জগতের কোনাে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই। এ কারণে মানব জাতিরও কোনাে লক্ষ্য নেই – মানুষ নিজেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে এবং সে লক্ষ্যের একটা শৈল্পিক মূল্য আছে যা মানুষের শক্তি বৃদ্ধি করে। সে ধরনের লক্ষ্য মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রেষ্ঠ মানবের দ্বারা, মানুষের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ তার দ্বারা । শ্রেষ্ঠ মানব হলাে জীবন বৃদ্ধির একটি ধারণা, মানুষের ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ। যে কোনাে ধর্ম, নৈতিকতা বা রাজনীতি যা জীবন-বিরােধী বা যা শ্রেষ্ঠ মানবের আগমনের পথে বাধা সৃষ্টি করে, তা অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে। একমাত্র বীর্যশালী ও প্রভুত্বপরায়ণ ব্যক্তির নৈতিক নিয়ম জীবনের প্রকৃত লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দাসত্ব নৈতিকতার দ্বারা উদ্বুদ্ধ খ্রিস্টধর্মই জীবনের চরমতম শত্রু।

এ খ্রিস্টধর্মকে বিলােপ করতে হবে, যুক্ত ইউরােপ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যুবকদের দিতে হবে ফলপ্রসূ শিক্ষা এবং প্রচলিত বৈবাহিক নিয়মের করতে হবে পরিবর্তন সাধন। উদ্দেশ্য হচ্ছে উন্নততর মানব শ্রেণীর জন্ম দেওয়া – যারা পরিচালিত হবে শ্রেষ্ঠ মানবের দ্বারা। এ শ্রেষ্ঠ মানবই অধিকার করবে ঈশ্বরের স্থান। নীৎসের চিন্তাধারা ছিল একদিকে উদ্দীপক এবং অন্যদিকে বিরােধমূলক উদ্দীপক, যেহেতু তিনি প্রচলিত সব ধারণা, বিশ্বাস ও মূল্যবােধের বিরােধী ছিলেন; বিরােধমূলক, এ কারণে যে, তার দার্শনিক চিন্তাধারা বিপথগামী মনে হওয়া সত্ত্বেও ছিল গভীরভাবে উদ্দীপক। এমনকি, তার নিজের ভাগ্যও ছিল বিরােধমূলক, কেননা তার সমগ্র সৃজনশীল জীবনে বিশেষভাবে অবহেলিত থাকার পর হঠাৎ করে তার। নামটি সমগ্র ইউরােপে যেন এক ধরনের আদর্শমূলক রণধ্বনিতে পরিণত হয়। তার নিন্দুকরা এবং সম্ভবত অনুগতরাও যতই তাকে ভুল বুঝে থাকুক না কেন, তার দার্শনিক চিন্তা যে অনুভূতি ও ভাবাবেগ জাগ্রত করেছিল, তা আমাদের এ আধুনিক সভ্যতাকে, যান্ত্রিকযুগের মানসিক ও নৈতিক পরিস্থিতিকে বুঝতে যে বিশেষভাবে সাহায্য করছে, এতে কোনাে সন্দেহ নেই।

নীটশের জীবনযাপন ছিল সরল। তার পিতা ছিলেন একজন প্রটেস্টান্ট ধর্মযাজক, এবং তিনি ধর্মীয় পরিবেশেই বড় হয়ে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চিরায়ত সাহিত্য এবং ভাষাতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে মেধার পরিচয় দেন। এই মেধার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিলাভের পূর্বেই ১৮৬৯ সালে তাকে বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ গ্রহণের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। এবং তিনি তা গ্রহণ করেন। তার শারীরিক অবস্থা কখনােই ভাল ছিল না, এবং কয়েকবার পীড়াজনিত ছুটি গ্রহণের পর অবশেষে তিনি ১৮৭৯ সালে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন। অবসর গ্রহণের পর তিনি সুইজারল্যান্ড এবং ইতালিতে বসবাস করেন। ১৮৮৮ সালে তিনি মানসিক রােগে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই রােগাক্রান্ত অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করেন। ওয়াগনারের (Wagner) প্রতি তার এক ধরনের আবেগপূর্ণ প্রশংসা ছিল। ওয়াগনার রচিত পার্সিল (Parsifal) নৃত্য-নাটক নিয়ে তাদের মধ্যে সামান্য ঝগড়া হয়। এই নাটককে তিনি অতিরিক্ত খ্রিস্টধর্ম ঘেঁষা এবং পূর্ণত্যাগের কাহিনী হিসেবে উল্লেখ করেন। এই বিবাদের পর তিনি ওয়াগনারকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ভাষায় আক্রমণ করেন, এবং তাকে একজন ইহুদি হিসেবে আখ্যায়িত করতেও তিনি দ্বিধা করেন নি। রিং (Ring) নাটকের বক্তব্যের সঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গির খুবই সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। নিটশের অতিমানব অনেকটা সিগফ্রেইডের (Siegfried) মতােই, শুধু ব্যতিক্রম হচ্ছে তিনি গ্রিক ভাষা জানেন।

নিটশে সচেতনভাবে একজন রােমান্টিক ছিলেন না, অবশ্য তিনি প্রায়ই রােমান্টিকদের কঠোরভাবে সমালােচনা করতেন। সচেতনভাবে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল হেলেনিক (Hellenic), কিন্তু এ থেকে তিনি অর্ফিক (Orphic) উপাদান বা পিথাগােরাস (Phythagoras) ব্যতীত তিনি সক্রেটিসপূর্ব সকল দার্শনিকের প্রশংসা করেন। হিরাক্লিটাসের দর্শনের সঙ্গে তার দর্শনের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। এরিস্টোটলের মহানুভব ব্যক্তির সঙ্গে নিটশের ‘মহৎ মানুষ’-এর অনেক মিল রয়েছে, কিন্তু প্রধানত তিনি সক্রেটিস পরবর্তী গ্রিক দার্শনিকদেরকে তাদের পূর্বসূরিদের চেয়ে হীন মনে করতেন। সক্রেটিসের বিনয়ী স্বভাবের জন্য তিনি তাকে ক্ষমা করতে পারেন নি, তিন তাকে ‘নীচব্যক্তি’ (roturier) নামে অভিহিত করেন, এবং তাকে মহৎ এথেনিয় যুবকদের গণতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা নীতিবর্জিত অসৎ করার অভিযােগে অভিযুক্ত করেন। মানসিক ও নৈতিক উন্নতি উপলব্ধির ক্ষমতা থাকার কারণে তিনি বিশেষ করে প্লেটোকে নিন্দা করেন। অবশ্য নিটশে তাকে সত্যি সত্যি নিন্দা করতে চান নি এবং তাকে এ কারণে ক্ষমা করার প্রস্তাব করেন যে, তিনি সম্ভবত অনান্তরিক ছিলেন এবং নীচু শ্ৰেণীর মানুষকে সুশৃঙ্খল করার জন্যই সদগুণ প্রচার করেন। একবার তিনি তাকে বলেন ‘একজন বড় ক্যাগলিওসট্রো (Cagliostro) (অর্থাৎ ইতালিয় অভিযাত্রিক ও ভণ্ড তাপস)। তিনি ডেমােক্রিটাস (Democritus) এবং এপিকিউরিয়াসকে পছন্দ করতেন। কিন্তু এপিকিউরিয়াসের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল কিছুটা অযৌক্তক, যদি না বিষয়টিকে লিউক্রিটিয়াসের প্রতি তার প্রকৃত সম্মান হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। এটি অবশ্য প্রত্যাশিত যে, কান্টের প্রতি তার নিচু ধারণা ছিল। তিনি কান্টকে ‘রুশাের মতােই নৈতিক গোঁড়া ব্যক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেন।

রােমান্টিকদের সমালােচনা সত্ত্বেও নিটশের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাদের কাছে তিনি অনেকটাই ঋণী। তিনি বায়রনের অভিজাততান্ত্রিক নৈরাশ্যবাদ পছন্দ করতেন এবং এ কারণে তিনি যখন বায়রনকে প্রশংসা করেন তখন অনেকেই আশ্চর্য হন না। তিনি দুই ধরনের মূল্যবােধকে সমন্বিত করার চেষ্টা করেন যা সহজে সমন্বিত হয় না – একদিকে তিনি নির্মমতা, যুদ্ধ, এবং অভিজাততান্ত্রিক গর্ব পছন্দ করতেন; অন্যদিকে তিনি দর্শন এবং সাহিত্য এবং কলা, বিশেষ করে সঙ্গীত পছন্দ করতেন। ঐতিহাসিকভাবে এসব মূল্যবােধ রেনেসাঁ সময়কালে সহাবস্থান করেছিল; দ্বিতীয় পােপ জুলিয়াস (Pope Julius) বােলােগনার (Bologna) জন্য যুদ্ধ করেছিলেন এবং মাইকেলেঞ্জেলােকে (Michelangelo) একাজে নিযুক্ত করেছিলেন। নিটশে মাইকেলেঞ্জেলাের মতাে একজন ব্যক্তিকে সরকার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিযুক্ত দেখতে আশাপােষণ করেছিলেন। নিটশে এবং মেকিয়াভেলির (Machiavelli) মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই দুইজনের মধ্যে তুলনা করা স্বাভাবিক। এই পার্থক্যসমূহের মধ্যে রয়েছে – মেকিয়াভেলি বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন, তার অভিমত ছিল সাধারণ মানুষের কাজকর্মের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত বিষয় দিয়ে গঠিত, আর এসব কিছুই ছিল তার যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি পণ্ডিতি মনােভাবসুলভ বা সুশৃঙ্খল ছিলেন না, এবং বলতে গেলে তার রাজনৈতিক দর্শন সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। বিপরীতক্রমে নিটশে একজন অধ্যাপক ছিলেন, ছিলেন একজন বই পড়ুয়া ব্যক্তি। তিনি ছিলেন একজন সচেতন দার্শনিক এবং তার সময়কার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নৈতিক ধারার বিরােধী। অবশ্য সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়সমূহ আরো গভীরতর। ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স (The Prince) গ্রন্থের রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে নিটশের রাজনৈতিক দর্শনের সাদৃশ্য রয়েছে (অবশ্য মেকিয়াভেলির ডিসকোর্সেস (Discourses) গ্রন্থের বক্তব্যের সঙ্গে নয়)। অবশ্য দ্য প্রিন্স গ্রন্থটি ব্যাপক আকারে এবং ব্যাপক ক্ষেত্রে প্রয়ােগের উদ্দেশ্যে রচিত। নিটশে এবং মেকিয়াভেলি উভয়েরই একটি নৈতিক আদর্শ ছিল। এই আদর্শটি ছিল ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং সুচিন্তিত ও উদ্দেশ্য প্রণােদিতভাবেই খ্রিষ্টবিরােধী। অবশ্য এ ব্যাপারে বক্তব্য প্রদানে নিটশে বেশি উদার ছিলেন। মেকিয়াভেলির নিকট সিজার বোরজিয়া (Caesar Borgia) যেমন ছিলেন, ঠিক তেমনি নিটশের নিকট নেপােলিয়ানও (Napoleon) তেমনি ছিলেন।

ইমানুয়েল কান্টের ধারণাগুলাের সুশৃঙ্খল উপস্থাপনার পুরাে বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা নীটশের দর্শন খুব সহজেই সবদিক থেকে আমাদের আক্রমণ করে। বেশিরভাগ লেখাই তার সংক্ষিপ্ত, খণ্ড খণ্ড অনুচ্ছেদ আর খুবই গােছানাে এক বাক্যের মন্তব্য, যাদের কোনােটি তির্যক, শ্লেষাত্মক, কিছু আন্তরিক,বেশিরভাগই উদ্ধত এবং প্ররােচিত করার ক্ষমতায় দক্ষ। কখনাে মনে হতে পারে যেন নীটশে আমাদের উদ্দেশ্যেই চিৎকার করছেন, কখনাে ফিসফিস করে আমাদের কানে গভীর কোনাে জ্ঞানের কথা উচ্চারণ করছেন। প্রায়শই তিনি চেয়েছেন যে তার পাঠকরা তার সাথে ষড়যন্ত্রে অংশ নিক, যেমন তিনি বলছেন, তিনি ও আপনি একমাত্র জানেন পরিস্থিতিটা আসলে কেমন, কিন্তু ঐযে সব নির্বোধ মানুষরা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, তারা সবাই বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত। একটি বিষয় তিনি বারবার আলােচনা করেছিলেন, সেটি হচ্ছে নৈতিকতার ভবিষ্যৎ। যদি ঈশ্বর মৃত হয়ে থাকেন, তাহলে এর পরের পদক্ষেপ কী? এই প্রশ্নটি নিচাহ নিজেকেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তার উত্তর ছিল ঈশ্বরের মত্যর কারণে নৈতিকতার কোনাে ভিত্তি ছাড়া আমরা এখন পরিত্যক্ত। ভালো মন্দ বা শুভ আর অশুভ সংক্রান্ত আমাদের ধারণাগুলাে অর্থবহ হয় এমন পৃথিবীতে যেখানে ঈশ্বর আছেন। ঈশ্বরহীন কোনাে পৃথিবীতে এর কোন নেই। ঈশ্বরকে আপনি সরিয়ে ফেলে ভাবুন কীভাবে আমাদের বাঁচা উচিত। তাহলেই জিনিসগুলােকে আমরা মূল্য দেব, তাহলেই বিভিন্ন বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালাও তৈরি করব। এটি ছিল বেশ শক্তিশালী একটি বার্তা এটি, কিন্তু তার সমসাময়িকরা এমন কিছু শুনতে চাননি। তিনি নিজেকে বর্ণনা করেছিলেন immoralist হিসাবে, অর্থাৎ নিজেকে তিনি নৈতিকতা বিবর্জিত বলে পরিচয় দিতেন, তবে এমন কেউ নেই যিনি ইচ্ছা করে অশুভ কর্মে লিপ্ত, বরং তিনি বিশ্বাস করতেন, আমাদের সব নৈতিকতাকে অতিক্রম করে যেতে হবে। তার একটি বিখ্যাত বইয়ের শিরােনাম, beyond good and evil; নীৎশে মনে করতেন, ঈশ্বরের মৃত্যু মানবতার জন্যে নতুন সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত করেছে, একই সাথে এটি উত্তেজনাপূর্ণ ও ভীতিকর। এর নেতিবাচক দিকটি হচ্ছে কোনাে ধরনের নিরাপত্তা চাদর আর নেই, কোনাে নিয়ম নেই কীভাবে মানুষ বাঁচবে অথবা থাকবে। একসময় নৈতিক আচরণের অর্থ, উদ্দেশ্য আর সীমা বেঁধে দিয়েছিল ধর্ম, কিন্তু বর্তমানে ঈশ্বরের অনুপস্থিতি সবকিছুই সম্ভাব্য করে তুলেছে, সব সীমারেখা সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এর ভালো দিকও আছে। নীটশের দৃষ্টিভঙ্গিতে এর ভালাে দিকটি হচ্ছে, প্রতিটি মানুষই এখন তার নিজের জন্যে মূল্যবােধ সৃষ্টি করতে পারবে, শিল্পকর্মের সমতুল্য বেঁচে থাকার নিজস্ব কোনাে শৈলী উদ্ভাবন করে তারা তাদের জীবনকে রূপান্তর করতে পারবে।

নীটশে বলেন, একবার যখন আপনি মেনে নেবেন ঈশ্বর নেই, আপনি যেখানে-সেখানে আর ভালাে-মন্দের সঠিক সংজ্ঞা খুঁজতে খ্রিস্টীয় চিন্তায় আর আবদ্ধ থাকবেন না, কারণ সেটি হবে আত্মপ্রবঞ্চনা। যে মূল্যবােধগুলাে আমরা সংস্কৃতির উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, যেমন সহমর্মিতা, দয়া, অন্য মানুষের প্রতি বিবেচনা, সবকিছুকেই চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। আর সেটি করার জন্য তার উপায় হচ্ছে কীভাবে এইসব মূল্যবােধগুলাে প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল তার অনুসন্ধান করা। তিনি বলেন, দয়াকে প্রশংসা আর স্বার্থপরতাকে ঘৃণা করার শিক্ষা পেয়ে আমরা সহমর্মিতা আর দয়াকে অবশ্যই ভালাে মনে করার শিক্ষা পাই। কিন্তু নীটশে এইসব নৈতিকতা-আচরণের বিরুদ্ধে যান। প্রথমেই তিনি বলেন, আমাদের চিন্তার রূপ আর অনুভূতি যা আমরা ঘটনাচক্রে ধারণ করি তার ইতিহাস আছে। একবার এর ইতিহাস বা উৎপত্তি বা ‘জিনিয়ালজি’ জানা গেলে এই আচার-আচরণগুলো সবসময়ই অপরিবর্তনশীল ছিল – তা ভাবাটা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

নীটশে তার Genealogy of Morality বইটিতে প্রাচীন গ্রিসের একটি পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছিলেন, ক্ষমতাবান অভিজাতশ্রেণির বীরােচিত চরিত্ররা তাদের জীবন গড়ে তুলেছিলেন সম্মান, মর্যাদা, লজ্জা ও যুদ্ধে বীরত্বের ধারণার উপর ভিত্তি করে; দয়াশীলতা, উদারতা এবং খারাপ কাজ করার অপরাধবােধ দিয়ে নয়। এটাই সেই জগৎ যা ব্যাখ্যা করেছিলেন হােমার, তার ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্যে। বীরদের এই জগতে যাদের ক্ষমতা নেই, ক্রীতদাস ও দুর্বলরা হিংসা করত শক্তিশালীদের। ক্রীতদাসরা শক্তিশালীদের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ আর হিংসা পরিচালিত করত। এইসব নেতিবাচক অনুভূতিগুলাের মধ্যে থেকে তারা সুষ্টি করেছিল নতুন একগুচ্ছ মূল্যবােধ। তারা অভিজাতশ্রেণির বীরােচিত মূল্যবােধকে পুরােপুরি উল্টে দিয়েছিল। অভিজাতশ্রেণির মতাে শক্তি আর ক্ষমতার গুণগান করার বদলে, ক্রীতদাসরা উদারতা আর দুর্বলদের সাহায্য করাটিকে রূপান্তর করে সদগুণ হিসাবে। নীটশে বলেন, এই ক্রীতদাসের নৈতিকতাই ক্ষমতাবানদের কাজকে অশুভ আর তাদের নিজেদের সৌহার্দ্যপূর্ণ অনুভূতিকে ভালাে হিসেবে চিহ্নিত করে। নীটশের মতে তাই এই খ্রিস্টীয় দয়াশীলতার নৈতিকতার জন্ম দুর্বলদের ঈর্ষার অনুভূতি থেকেই। 

নিচাহ নিজেই অভিজাতদের নৈতিকতার, দুর্বলদের প্রতি সহমর্মিতার চেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধপ্রিয় বীরদের খ্রিস্টীয় নৈতিকতার প্রতি নিজের পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি খ্রিস্টীয় ধর্ম ও নৈতিকতাকে ঘৃণা করেছেন, কারণ এটি দাবি করে যে, প্রতিটি মানুষের মূল্য একই। নীটশের দৃষ্টিতে এটাই খুব গুরুতর একটি ভ্রান্তি। তার শৈল্পিক বীর, যেমন বিটহােভেন ও শেক্সপিয়ার সাধারণ মানুষের চেয়ে বহু অগ্রসরবর্তী। তার দৃষ্টিতে দুর্বলদের ঈর্ষা থেকে উদ্ভূত এই খ্রিস্টীয় মূল্যবােধ মানবতাকে পেছনের দিকে টেনে ধরেছে। এই মূল্যবোধের পরিসমাপ্তি টানতে হবে, এতে দুর্বলরা নিষ্পেষিত হবে, কিন্তু নীটশের মতে এটাই দরকার, এটাই যুক্তিযুক্ত, এটাই শক্তিশালীদের জন্য এটি গৌরব আর অর্জনের পথ উন্মুক্ত করে দেবে। Thus Spake Zaruthustra বইটিতে তিনি Ubermensch বা সুপারম্যান সম্বন্ধে লিখেছিলেন। এখানে ভবিষ্যতের কাল্পনিক মানুষদের বর্ণনা রয়েছে যারা প্রথাগত কোনাে নৈতিকতার নিয়মে আবদ্ধ নয়, বরং তারা সেটি অতিক্রম করে নতুন মূল্যবােধ সৃষ্টি করে। হয়তাে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব সম্বন্ধে তার বােধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি দেখেছিলেন এই Ubermensch হচ্ছে মানবজাতির উন্নয়নের পরবর্তী ধাপ। নাৎসিরা নীটশের এই ধারণাটি তাদের মাস্টার রেইস সংক্রান্ত বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গিটির সমর্থনে ব্যবহার করেছিল। তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই মনে করেন নীৎশে যা লিখেছিলেন নাৎসিরা তার বিকৃত করেছিল।

নীৎশের দুর্ভাগ্য ছিল যে তিনি তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। মূলত তার বােন এলিজাবেথ পরবর্তী সময়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, তার সব কাজগুলাে নিয়ে কী হবে তা ছিল এলিজাবেথেরই হাতে। নীৎশের মৃত্যুর পর আরাে পঁয়ত্রিশ বছর তার সব লেখাই ছিল এলিজাবেথেরই দখলে। এলিজাবেথ ছিলেন জার্মান জাতীয়তাবাদী ও খুবই বাজে ধরনের ইহুদিবিদ্বেষী। তিনি তার ভাইয়ের নােটবুক ঘেঁটে, সেই লাইনগুলাে বের করেছিলেন যার সাথে তিনি একমত ছিলেন, বাদবাকি সব বাদ দিয়েছিলেন। নীটশের করা জার্মানির সমালোচনা বা তার বর্ণবাদবিদ্বেষী কথাগুলো সবই বাদ দেয়া হয়। নিৎশের এই কাট এন্ড পেস্ট লেখাগুলো প্রকাশ করা হয় The Will to Power নামে একটি গ্রন্থে। এই গ্রন্থটিই নীটশেকে নাৎসিদের প্রচারণার মুখপাত্রে রূপান্তরিত করে, তিনি স্থান করে নেন হিটলারের তৃতীয় রাইখে একজন স্বীকৃত লেখকের জায়গায়। তিনি আরও কিছুকাল বেঁচে থাকলে এই জিনিসটা ঘটত না। তবে এটাও ঠিক যে তার লেখা বহু পঙক্তি শক্তিশালীদের দুর্বলদের ধ্বংস করার অধিকারকে সমর্থন করেছে। তিনিই লিখেছিলেন, বাচ্চা ভেড়া বাজপাখিকে ঘৃণা করে, কিন্তু এর মানে এইনা যে নিজেদের খাদ্যের সন্ধানের জন্য বাজপাখির ছােট ভেড়ার বাচ্চাদের ছোঁ মেরে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়াকে আমরাও ঘৃণা করব। কীভাবে আবেগ আর অযৌক্তিক শক্তি মানবমূল্যবােধকে রূপ দেবার জন্য তাদের প্রভাব আরােপ করে এটা দেখানোর ক্ষেত্রেই নীটশে সবসময়েই জোর দিয়েছেন। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি বহু মানুষকে প্রভাবিত করেছিল, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড, যিনি অবচেতন মনে শক্তি আর কামনার অনুসন্ধান করেছিলেন।

আমাদের উদ্দেশ্যে নীটশের দেয়া চারটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা

ভূমিকা

নীটশে মনে করতেন দর্শনের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব হচ্ছে, আমরা সত্যিকার অর্থে যা তা কিকরে হয়ে উঠতে পারব (become we we are) তা শেখানো। অর্থাৎ এটা শেখানো যে কীভাবে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে আবিষ্কার ও তার প্রতি অনুগত থাকতে পারি। এই উদ্দেশ্যে তিনি চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ আমাদের উপহার দিয়েছিলেন – 

১. নিজের ঈর্ষাকে স্বীকার করুন

সাধারণত আমাদেরকে ঈর্ষার অনুভূতিগুলাে নিয়ে লজ্জা পেতে শেখানো হয়, আমরা এটি নিজেদের ও অন্যদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখি, কিন্তু নীৎশে ঈর্ষাকে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে শনাক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ঈর্ষাকে লুকিয়ে রাখা অসম্ভব, বিশেষ করে ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী এই আধুনিক বিশ্বে তো এটি অবশ্যই অসম্ভব। নীৎশের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র, প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক অভিজাতশ্রেণীর পরিসমাপ্তি সৃষ্টি করেছিল পরশ্রীকাতরতা, এটিই ঈর্ষার অনুভূতির অত্যন্ত উর্বর প্রজনন ক্ষেত্রটির, কারণ এখন যে-কেউই তারা অন্য সবারই মতাে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সমান – এই চিন্তায় প্ররােচিত হতে পারেন। সামন্তপ্রথার যুগে, কোনাে একজন প্রজার কখনােই রাজপুত্রকে ঈর্ষা করার কথা মনে পড়ত না, কিন্তু এখন প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের বাকি সবার সাথে তুলনা করেন এবং ফলে তারা উন্মুক্ত হন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর নিজস্ব অপ্রতুলতার একটি বিস্ফোরক মিশ্রণের সম্মুখে। তবে তার মতে, ঈর্ষার অনুভূতি নিয়ে কোনাে অপরাধবােধ থাকার দরকার নেই, এর কোনােটাই অস্বাভাবিক নয়। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে, কীভাবে আমরা সেই ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করব। আমাদের ঈর্ষার কারণে সৃষ্ট সমস্যা থেকে, সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে আমরা কতটুকু শিখতে পেরেছি,তার উপর নির্ভর করেই মহত্ত্ব আসে। নিৎশে ঈর্ষাকে ভাবতেন সংশয়পূর্ণ, তবে গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হিসাবে, যা আসে আমাদের নিজেদের গভীরতম সত্তা থেকে, যা আমাদের জানায় আসলেই আমরা কী চাইছি। যা কিছু আমাদের ঈর্ষাকাতর করে তােলে তা আমাদের সত্যিকারের সম্ভাবনার খণ্ডিত অংশ, যাকে অস্বীকার করলে আমাদের নিজেদেরই ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের শেখা উচিত কীভাবে নিজেদের ঈর্ষার ময়নাতদন্ত করতে হয়, ঈর্ষাকাতর মুহূর্তগুলাের একটি ডায়রি রেখে এবং এরপর এইসব পর্বগুলাে যাচাই করে দেখার মাধ্যমে ভবিষ্যতের আমাদের উত্তম সত্তার রূপটি নির্ণয় করে। যে ঈর্ষা আমরা নিজেদের বলে স্বীকার করব না, নিৎশের মতে সেগুলাে বেরিয়ে আসবে দুর্গন্ধ হিসাবে, নিৎশের ভাষায় যে ঈর্ষাকে বোঝা হয়না, স্বীকার করা হয়না সেই ঈর্ষা হচ্ছে গন্ধকের দুর্গন্ধ (sulfurous odours), তিক্ততা। এমন নয় যে নিৎশে বিশ্বাস করতেন, আমরা যা চাই তা আমরা সবসময়ই পাই (তার নিজের জীবনেই এই শিক্ষাটি তিনি যথেষ্ট পরিমানে পেয়েছিলেন)। তিনি শুধুমাত্র দাবি করেছিলেন যে, আমাদের সত্যিকারের সম্ভাবনার ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন হয়ে উঠতে হবে, এবং সেটিকে সম্মান করার জন্য বীরের মতাে যুদ্ধ করতে হবে, শুধুমাত্র তারপরই আমাদের ভাবগম্ভীর অকপটতা আর মর্যাদাপূর্ণ সততার সাথে ব্যর্থতার জন্য শোক করার অধিকার তৈরি হবে।

২. খ্রিস্টান হবেন না

নিৎশে খ্রিস্টধর্ম নিয়ে বেশকিছু কঠোর মত করেছিলেন, যেমন, ‘আমি খ্রিস্টধর্মকে বলব একটি বিশাল অভিশাপ, নৈতিক বিকৃতি ছড়িয়ে আছে পুরাে নিউ টেস্টামেন্টে, সেই গ্রন্থের একটিমাত্র চরিত্রই শ্রদ্ধা পাবার যােগ্য, তিনি হচ্ছেন, পিলাটে, তদকালীন রােমান…’। এই বক্তব্যটি বেশ শক্তিশালী ছিল, তবে তার সত্যিকারের নিশানা ছিল আরাে সহজ এবং আরাে বেশি কৌতূহলােদ্দীপক। তিনি খ্রিস্টধর্মকে অপছন্দ করতেন মানুষকে তাদের ঈর্ষা থেকে রক্ষা করার কারণে। নিৎশের বর্ণনায় খ্রিস্টধর্ম আবির্ভূত হয়েছিল রােম সাম্রাজ্যের শেষাংশে ভীরু ক্রীতদাসদের মধ্য দিয়ে, তারা যা সত্যিকারভাবে চাইছে সেটি অর্জন করার জন্য সাহস তাদের সেই ছিল না, আবার ব্যর্থ হবার পর সেটি তারা স্বীকারও করত না। তাই তারা আঁকড়ে ধরেছিল একটি দর্শনকে যা তাদের ভীরুতা আর কাপুরুষতাকে ভার্চু বা সদ্‌গুণে রূপান্তরিত করেছিল একটি। এই ধর্মাবলম্বীরা পরিপূর্ণতার সত্যিকার স্বাদ পেতে চাইতেন, যা ছিল এই পৃথিবীতে একটি সম্মানজনক অবস্থান, যাতে ছিল যৌনতা, বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা, সৃজনশীলতা। কিন্তু তারা সেটি অর্জন করার জন্য যথেষ্ট দক্ষ ছিলনা। সেকারণেই তারা সৃষ্টি করে একটি ভণ্ডামিপূর্ণ মতবাদ যা নিন্দা করেছিল সেই সবকিছু যা তারা চাইতেন, তবে তারা সেটি অর্জন করার জন্য যুদ্ধ করার যোগ্য ছিলনা। আবার অন্যদিকে এমন সবকিছুরই প্রশংসা করে যার কিছুই তারা চায়না কিন্তু ঘটনাচক্রে তাদের আছে। তাই খ্রিস্টীয় মূলবােধের এই সিস্টেমে, যৌনতাহীনতা রূপান্তরিত হয় বিশুদ্ধতা বা purity-তে, দুর্বলতা রূপান্তরিত হয় ভালােত্ব বা গুডনেসে, ঘৃণ্য কারাে কাছে নতি স্বীকার করা হয়েছে আনুগত্য, নিৎশের ভাষায় not-being-able-to-take-revenge বা প্রতিশােধ নিতে না পারার অক্ষমতা রূপান্তরিত হয় ক্ষমাশীলতায়। খ্রিস্টধর্ম রূপান্তরিত হয় নিষ্ক্রিয়তার একটি সুবিশাল যুক্তিযুক্ততা এবং জীবন থেকে এর সম্ভাবনা শুষে নেবার একটি পদ্ধতিতে।

৩. কখনােই মদ্যপান করবেন না

নীৎশে শুধুমাত্র বিশেষ উপলক্ষে দুধ বাদ দিয়ে জল ছাড়া আর কিছু পান করতেন না, এবং তিনি ভাবতেন আমাদেরও সেটাই করা উচিত। এখানে তিনি কিন্তু কোনাে খাদ্যসংক্রান্ত উপদেশ দেবার চেষ্টা করেননি। এই ধারণাটি তার দর্শনের কেন্দ্র থেকেই এসেছে, যেমন আমরা তার ঘােষণায় দেখতে পাই, ইউরােপীয় সভ্যতায় দুটি প্রধান মাদক হচ্ছে – খ্রিস্টধর্ম ও অ্যালকোহল। তিনি অ্যালকোহল ঘৃণা করতেন ঠিক একই কারণে, যে কারণে তিনি খ্রিস্টধর্মকে ঘৃণা করতেন। কারণ দুটোই কষ্টকে অবশ করে এবং দুটোই আমাদের আশ্বস্ত করে যে সবকিছু যেমন আছে ঠিকই আছে, আর এভাবেই আমাদের জীবনকে আরাে উন্নত করার ইচ্ছাটি এটি শুষে নেয়। মদ্যপান সন্তুষ্টির একটি সাময়িক অনুভূতির সৃষ্টি করে, সেটি ভয়ানকভাবে ব্যাহত করে আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেবার প্রচেষ্টাকে। এমন নয় যে নীৎশে দুঃখকষ্টকে তাদের খাতিরেই শুধু প্রশংসা করছেন। বরং তিনি শনাক্ত করেছিলেন দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে, তা হলো জীবনের উন্নতি আর অর্জনের জন্য দরকার অনিবার্যভাবে যন্ত্রণাময় বিষয়, “কী হতে পারে যদি আনন্দ আর দুঃখ এত নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকে, যে-কেউই এর একটি যতবেশি চাইবে তাকে অবশ্যই অন্যটাও যতটা সম্ভব বেশি গ্রহণ করতে হবে। জীবনে আপনার বেছে নেবার একটি সুযােগ আছে – হয় যতটা সম্ভব ততটা কম দুঃখ, সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কষ্টহীনতা অথবা যতটা সম্ভব দুঃখ অনেক পরিমাণ সূক্ষ্ম সুখ আর আনন্দের মূল্য হিসেবে।’ নীৎশের চিন্তা কষ্টবােধকে নতুনভাবে পরিমাপ করেছিল। আমাদের জন্যে কিছু কঠিন অনুভূত হয়, অবশ্যই সেটি পরাজয় বা ব্যর্থতার চিহ্ন নয়, হতে পারে যে কাজটি করার আমরা চেষ্টা করছি এটি শুধুমাত্র সেটির মহত্ত্ব আর কষ্টসাধ্যতার প্রমাণ।

৪. ঈশ্বর মৃত 

ঈশ্বরের মৃত্যু সম্বন্ধে নিৎশের নাটকীয় এই দাবি, সাধারণত যেভাবে ভাবা হয়, আদৌ কোনাে উচ্ছ্বাসময় মন্তব্য নয়। খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে তার বিরূপদৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও নিৎশে কিন্তু মনে করেননি এই ধর্মবিশ্বাসের পরিণতি নিয়ে উচ্ছ্বাস করা যেতে পারে। তিনি জানতেন যে ধর্মবিশ্বাস হচ্ছে মিথ্যা, কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেছিলেন একটি সমাজের স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস খুব উপকারী। ধর্মকে বাদ দেয়া মানে মানুষের নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে যা তাদের দিকনির্দেশনা, সান্ত্বনা, নৈতিকতার ধারণা আর আধ্যাত্মিক লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। বিষয়টি সহজ কোনাে কাজ হবে না বলেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। নিৎশে প্রস্তাব করেছিলেন যে ধর্মের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করা উচিত সংস্কৃতি দিয়ে (দর্শন, শিল্পকলা, সংগীত ও সাহিত্য); ধর্মগ্রন্থকে প্রতিস্থাপিত করা উচিত সংস্কৃতির। তবে নিৎশে তার সেই সময়ে সংস্কৃতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছিল সেই বিষয়ে সন্দেহ পােষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে মানবিক বিষয়গুলােকে হত্যা করছে, তাদেরকে রূপান্তরিত করছে শুষ্ক অ্যাকাডেমিক ও তাত্ত্বিক অনুশীলনে, আমরা ব্যর্থ হচ্ছি জীবনের পথনির্দেশক হিসেবে তাদের যেভাবে ব্যবহার করা উচিত সেভাবে ব্যবহার করতে। গ্রিকরা যেভাবে তাদের ট্রাজেডিগুলােকে বাস্তবমুখী, প্রয়ােগযােগ্য, চিকিৎসার একটি উপায় হিসাবে, বিশেষ করে ক্যাথারসিস কিংবা নৈতিক শিক্ষার বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছে, তিনি তা বিশেষভাবে প্রশংসা করেছিলেন। এবং তিনি তার সময়কে চেয়েছিলেন তুলনামূলকভাবে আরাে বেশি উচ্চাকাক্ষী হয়ে ওঠার জন্যে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় আর মিউজিয়াম-নির্ভর শিক্ষা-সংস্কৃতিকে অভিযুক্ত করেছেন জীবন-নির্দেশনাকারী, নৈতিকতার শিক্ষাদানকারী সংস্কৃতি থেকে সরে যাবার জন্য, বিশেষ করে ঠিক সেই সময় যখন ঈশ্বরের মৃত্যু এই বিষয়গুলােকে আরাে বেশি আবশ্যক করে তুলেছে। তিনি সংস্কারের জন্য ডাক দিয়েছিলেন, যেখানে মানুষ তার বিশ্বাসের অবসানে সৃষ্ট সংকটে নতুন সচেতনতা সহ, ধর্মের অপসৃয়মানতায় সৃষ্ট শূন্যস্থানগুলাে পূরণ করবে প্রজ্ঞা আর সংস্কৃতির নিরাময়ী সৌন্দর্য দিয়ে। প্রতিটি যুগই মুখােমুখি হয়েছে বিশেষ ধরনের মনােজাগতিক চ্যালেঞ্জের, নিৎশে ভাবতেন দার্শনিকদের কাজ হলাে সেটি শনাক্ত করা এবং এর সমাধানে সাহায্য করা। ১৯শ শতকের দুটি বিশেষ ঘটনা নিৎশেকে বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল, ব্যাপক গণতন্ত্রায়ন এবং নিরীশ্বরবাদিতা। প্রথমটি শঙ্কা জাগিয়েছিল অজীর্ণ ঈর্ষার এবং বিষাক্ত ক্ষোভের প্লাবন, দ্বিতীয়টি মানুষকে দাঁড় করিয়েছিল দিকনির্দেশনা অথবা নৈতিকতাবিহীন একটি শূন্যস্থানে। এই দুটি চ্যালেঞ্জ মােকাবেলায় নিৎশে বেশকিছু সমাধানও প্রস্তাব করেছিলেন, যেগুলাে থেকে আমাদের সময়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রায়ােগিক বিষয় শেখার সুযােগ আছে, যেমনটি তিনি সুস্পষ্টভাবে চেয়েছিলেন।

সত্য ও ইচ্ছাশক্তি (truth and will to power) 

সত্য সম্পর্কে দর্শনের ইতিহাসে, বিশেষ করে তাত্ত্বিক দার্শনিকদের চিন্তাধারায় যে ধারণা পাওয়া যায়, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পােষণ করেন অস্তিত্ববাদী দার্শনিকেরা। প্লেটো, হেগেল প্রমুখ তাত্ত্বিক দার্শনিকরা শুধু যে বস্তুগত সত্যে (objective truth) বিশ্বাস করেন তা নয়, তাদের মতে এ সত্যকে বস্তুগতভাবেও জানা যায়। কিয়ের্কেগার্ডই প্রথম কঠোরভাবে এ মতের বিরােধিতা করেন। তার মতে সত্যকে কখনাে বস্তুগতভাবে বা যুক্তি দিয়ে জানা যায় না; সত্যকে জানার একমাত্র উপায় বিশেষভাবে আত্মােপলব্ধি, আত্মিকতাতেই (subjectivity) সত্য নিহিত। কিয়ের্কেগার্ডের এই মত নিঃসন্দেহে সত্যের এক নতুন ব্যাখ্যা। তবে লক্ষণীয় যে, সত্য বলতে কিয়ের্কেগাের শুধু ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা খ্রিস্টধর্মকেই বুঝিয়েছেন। এ ধারণা ছাড়া অন্য কোনাে বস্তুগত সত্য, যেমন বহির্জগৎ সম্পর্কে, তিনি কিছু বলেননি, সম্ভবত বলার প্রয়ােজনও বােধ করেননি। কিয়ের্কেগার্ডের মতাে নীৎসেও বস্তুগত সত্যের বিরােধিতা করেছেন। তবে দু’জনের মধ্যে বিশেষ একটা পার্থক্য আছে। কিয়ের্কেগার্ড বস্তুগত সত্যকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেননি, বস্তুগতভাবে জানা সম্ভব না হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে তিনি বস্তুগত সত্য বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু নীৎসে বস্তুগত সত্যকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন। তার মতে বস্তুগত সত্যের ধারণা আমাদের বুদ্ধির আসল শক্র। এ জগতে কঠিন ও শনাক্ত করা যায় – এমন ঘটনা আছে যেগুলােকে বোঝানাের জন্য আমরা নির্দিষ্ট ভাষা ও বচন ব্যবহার করে থাকি – এ ধারণাকে নীৎসে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করেন, এ জগৎ বা জগতের ঘটনাবলী বর্ণনা করার জন্য এবং ভবিষ্যতে জগতের কি অবস্থা হবে তার পূর্বসংকেত দেওয়ার জন্য আমরা যেসব ধারণা বা মত পােষণ করি, তা সবই আমাদের দ্বারা আরােপিত। জগৎ সম্পর্কে আমাদের মতামত আমরা নিজেরাই নির্বাচন করি। 

আমরা জগৎকে আমাদের ধারণার অনুরূপ করি – কান্টের এই ধারণার কিছুটা আঁচ নীৎসের মতে থাকলেও নীৎসের মনােভাব আরও চরম বলে মনে হয়। নীৎসে মনে করেন, এ জগৎ সম্পর্কে বর্ণনা আমাদের মূল্যায়নের উপরেই নির্ভর করে। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা বস্তুগত ও বিজ্ঞানােচিত ঘটনা বর্ণনায়ও আমাদের নির্বাচনের প্রয়ােজন আছে, যেমন শ্রেণীবিন্যাসে, অগ্রাধিকার দেওয়ায় বা খণ্ডন করার ব্যাপারে। আমাদের ইন্দ্রিয়-জ্ঞানকে আমরা মূল্যায়ন করি। (যেমন, উপকারী না ক্ষতিকর, গ্রহণযােগ্য না অগ্রহণযােগ্য), বিশেষ রং আমাদের বিশেষ বিশেষ মূল্য প্রকাশ করে। কীট-পতঙ্গেরা পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন রং-এর প্রতি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়, কেউ পছন্দ করে একটা রং, কেউ বা অন্য একটা। অনেকে এ সত্যটুকু জানতে রাজি নন যে, সর্বকালের জন্য সত্য – এমন কোনাে বস্তুগত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নেই, বরং তারা তাদের কতকগুলাে মিথ্যা মত ও ধারণাকে প্রকাশ করেন এবং সেগুলােকে সত্য বলে আখ্যায়িত করেন। 

নীটশের মতে এ জগৎ সম্পর্কে বর্ণনা দেবার জন্য বা আমাদের মত ব্যক্ত করার জন্য আমরা যেসব ধারণা নির্বাচন করি, তা আমরা আমাদের উদ্দেশ্যাপযােগী করেই নির্বাচন করি। আমরা কি পছন্দ করি বা করি না, অথবা আমাদের জন্য কোনটা ক্ষতিকর বা মঙ্গলজনক – এর উপর ভিত্তি করেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন ঘটনাবলির মূল্যায়ন করি। মূলত মানুষ চায় জগতের উপর কর্তৃত্ব করতে, জগৎকে নিজের উদ্দেশের উপযােগী করতে, পরিবেশকে নিজের আয়ত্তাধীনে আনতে। মানুষের যদি কোনাে ইচ্ছা না থাকতাে, তাহলে সে মানুষই হতাে না; ইচ্ছাশক্তির বলেই মানুষ তার উদ্দেশ্যের উপযােগী করে এ জগৎকে পরিবর্তন করতে চায়। আমাদের জ্ঞান-ক্ষমতার লক্ষ্য জ্ঞানার্জন নয়, আধিপত্য ও দখল। এমনকি পরম বস্তুগত সত্যের জন্য মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তাও জগতের উপর আধিপত্য করা বা নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছাশক্তি থেকে উদ্ভূত। নীটশের মতে তাহলে পরম বস্তুগত সত্যের ধারণা ভ্রমমাত্র। মানুষ সম্বন্ধে দেকার্ত যে মতবাদ দিয়েছেন, নীৎসের মতে তা ভুল। দেকার্তের মতানুযায়ী দেহ ও মন – এ দুয়ের সমন্বয়েই মানুষ গঠিত, একটি অন্যটি থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও ভিন্ন। কিন্তু প্রশ্ন হলাে, দেহ ও মন কিভাবে একটি অন্যটির উপর ক্রিয়া করে। এ দুটোর সংযােগ হয় কিভাবে। দেকার্ত এই প্রশ্নের কোনাে সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। তিনি অবশ্য পিনিয়াল গ্লান্ডের মাধ্যমে দেহ ও মনের মধ্যে সম্পর্কের একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সে ব্যাখ্যার কোনাে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এবং এর ফলে দেকার্তের দেহ-মন সমস্যাটি অব্যাখ্যায়িত থেকে গেছে। নীৎসে দেকার্তের এ যন্ত্রেভূত (ghost in the machine’) ধারণাটি খণ্ডন করেছেন তার ইচ্ছাশক্তি ধারণার মাধ্যমে। দেকার্তের দ্বৈতবাদ নীৎসের দর্শনে এসে একত্ববাদে পরিণত হয়েছে। দেহ ও মন, কর্ম ও জ্ঞান আলাদা বস্তু নয়, এগুলাে ইচ্ছাশক্তির অংশমাত্র। 

কান্টই ইচ্ছাশক্তিকে প্রয়ােগ করতে চেয়েছিলেন শুধু নৈতিকতার ক্ষেত্রেই, কিন্তু নীৎসের মতে মানুষের যে কোনাে কাজের মূলেই রয়েছে এ ইচ্ছাশক্তি। তবে ইচ্ছাশক্তি কর্মের কারণ নয়, কেননা কার্য থেকে কারণকে যেভাবে আলাদা করা যায়, কর্ম থেকে ইচ্ছাশক্তিকে তেমনভাবে আলাদা করা সম্ভব নয়। আমরা বহির্জগৎকে যেভাবে দেখি বা মূল্যায়ন করি, আমাদের অন্তর্জগৎকেও ঠিক সেভাবে বিচার করি। আমাদের সমগ্র জীবন – জ্ঞান-বিষয়ক, নৈতিক, ব্যবহারিক বা সৃজনক্ষম – সবই আমাদের ইচ্ছাশক্তির ব্যাপার। এ ইচ্ছাশক্তি হলাে বস্তুকে পরিবর্তন করার একটা ক্ষমতা লাভ। এ ক্ষমতা লাভের ইচ্ছাশক্তি বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তি থেকে অভিন্ন। জগতের সব প্রাণীর প্রধান লক্ষ্য বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তি নয়, বরং ক্ষমতা বিস্তার করা, বৃদ্ধি করা, আয়ত্ত করা বা লাভ করার আকাঙ্ক্ষা, অর্থাৎ ক্ষমতা লাভের ইচ্ছাশক্তি। নীৎসে মনে করেন যেখানে প্রাণ আছে, সেখানে ক্ষমতা লাভের ইচ্ছাশক্তি আছে; এমনকি ভৃত্যের মধ্যেও আছে প্রভু হবার ইচ্ছাশক্তি। প্রয়ােজনীয়তা বা আকাঙ্ক্ষা নয়, ক্ষমতার প্রতি অনুরাগ বা ভালােবাসাই হলাে মানবজাতির প্রকৃত শক্তি। স্বাস্থ্য, খাদ্য, আশ্রয়, ভােগ-বিলাস – এসব পাওয়ার পরও মানুষ অসন্তুষ্ট ও অতৃপ্ত থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না তার সেই শক্তি পরিতুষ্ট হয়। ক্ষমতা লাভের ইচ্ছাশক্তি অত্যাবশ্যকভাবে বাস্তব ও ব্যবহারিক; এবং স্বাভাবিকভাবে এর থেকে শুধু যে জগৎকে ব্যাখ্যা করার এবং শ্রেণীবিভাগ করার সিদ্ধান্তগুলাে আসে তা নয়, আমাদের ব্যবহার এবং আচরণ সম্পৰ্কীয় সিদ্ধান্তগুলােও এর উপর নির্ভরশীল। যেহেতু নীৎসের মতানুসারে, পরম বস্তুগত সত্য বলতে কিছু নেই, সেহেতু নৈতিকতার ক্ষেত্রেও সে-রকম কোনাে সত্য নেই। মূল্যায়ন করা এবং বস্তুকে ভালাে বা মন্দ বলার সঙ্গে সত্যকে জানার কোনাে সম্পর্ক নেই – এটাও এক ধরনের কর্ম এবং সব কর্মেরই একটি অংশমাত্র।

নীৎসের দর্শনের অন্যতম কাজ হলাে নীতিবাদী ও নীতিদার্শনিকদেরকে বিজ্ঞানীদের থেকে আলাদা করা। বিজ্ঞানীরা ভুল করেন যখন তারা মনে করেন যে, জগৎ সম্পর্কে তারা কঠিন বস্তুগত ঘটনা আবিষ্কার করেন; কিন্তু নীতিবাদীরা আরও বেশি ভুল করেন যখন তারা নিজেরাও ঐ রকম ধারণা পােষণ করেন। তাদের কাজ মানদণ্ড তৈরি করা, আবিষ্কার করা নয়। মূল্য এমন নয় যে বস্তুর মধ্যে লুকিয়ে থাকে, আর আমাদের কাজ সেগুলােকে খুঁজে বের করা। নীতিবাদীদের কাজ নৈতিক নিয়ম প্রণয়ন করা; কিন্তু তাদের সে নিয়ম পরম সত্য হতে পারে না বা সবার জন্য প্রযােজ্য হতে পারে না। সার্বিক মূল্য বলতে কিছু নেই। জগৎ ব্যাখ্যার জন্য উন্মুক্ত, মূল্য বস্তু সম্পর্কে আমাদের ব্যাখ্যাদান ছাড়া আর কিছুই নয় এবং বস্তুকে আমরা যেভাবে চাই ঠিক সেভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারি। তাহলে দেখা যায়, নীৎসের নৈতিক দর্শন নৈতিক প্রকৃতিবাদের (ethical naturalism) সম্পূর্ণ বিরােধী। নৈতিক প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের মতে জগতের বিশেষ কোনাে প্রত্যক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য থেকেই নৈতিক মূল্য এমনভাবে উদ্ভূত যে আমরা সবাই এগুলােকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতে বাধ্য হই। এ প্রকৃতিবাদের সবচেয়ে বলিষ্ঠ মত পােষণ করেন উপযােগবাদীরা (utilitarians), যাদের মতানুসারে মানুষ অপরিহার্যভাবেই সুখ চায় এবং দুঃখ বর্জন করে; একমাত্র সে জিনিসই ভালাে ও নৈতিক – যা সুখ উৎপন্ন করে এবং যা দুঃখ জন্ম দেয় – তা মন্দ। উপযােগবাদীরা মনে করেন যে, এ জগতের কতকগুলাে জিনিস সুখের, কতকগুলাে দুঃখের এবং এ সত্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরীক্ষা করা সম্ভব, এবং এর উপর ভিত্তি করেই তারা মনে করেন, ভালাে আচরণের জন্য নৈতিক নিয়ম প্রণয়ন করা সম্ভব। নীৎসে  শুধু যে এ ধরনের প্রকৃতিবাদী মত খণ্ড করেছেন তা নয়, তিনি বিরােধিতা করেছেন নৈতিক আনুষ্ঠানিকতাবাদের বা যে কোনাে মতবাদের, যে মতবাদ অনুসারে মূল্যকে মনে করা হয় নির্দিষ্ট, স্থায়ী এবং বস্তুগতভাবে অস্তিত্বশীল, যাকে শুধু বুদ্ধি, স্বজ্ঞা বা ঈশ্বরের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে আবিষ্কার করা যায়। নীৎসের মতে আসল সত্য হলাে, মানুষ নিজেই তার মূল্য নির্বাচন করে। জগতের বর্ণনা দিতে গিয়ে মানুষ যেমন সে ধরনের বর্ণনাকেই নির্বাচন করে – যা সবচেয়ে বেশি উপযােগী মনে হয়, বা আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, মানুষ যেমন তার পরিবেশকে আয়ত্ত করতে অথবা তার উপর প্রভুত্ব করতে তার ক্ষমতা লাভের ইচ্ছাশক্তিকে প্রয়ােগ করে, ঠিক তেমনি নিজের পছন্দ মতােই সে নিজের মূল্য নির্বাচন করে।

নৈতিকতা (Morality)

নীৎসে প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতার তীব্র সমালােচনা করেন। তার কোনাে কোনাে লেখা পড়লে মনে হয় তিনি যেন অনৈতিকতা, নিষ্ঠুরতা, উচ্ছলতা বা স্বার্থপরতার মতবাদ প্রচার করছেন। নৈতিকতা সম্পর্কে নীৎসের মতের দুটো দিক আছে মনে হয়। প্রথমত মানুষ ভিন্ন ধরনের নৈতিক মূল্য নির্বাচন করতে পারে। প্রচলিত নৈতিকতার দ্বারা সে অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়। দ্বিতীয়ত মানুষের ভিন্ন ধরনের নৈতিক মূল্য নির্বাচন করা উচিত। প্রথমটি ঠিক দ্বিতীয়টির মতােই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি জগৎকে পরিবর্তন করার জন্য মানুষের যে ইচ্ছাশক্তি আছে – সে ধারণা থেকে উদ্ভূত। 

নীটশের মতে নৈতিকতা হলাে কোনাে একটা সম্প্রদায় বা জাতিকে সংরক্ষণ করার একটা ঐতিহ্য। নীতিবান, আদর্শবান এবং পুণ্যবান হওয়ার অর্থই হলাে প্রাচীন বা প্রতিষ্ঠিত রীতি-নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যশীল হওয়া। ক্ষতির ভয় এবং প্রয়ােজনীয়তা ও সুযােগের আশাই হলাে এ ধরনের নৈতিকতার উদ্দেশ্য। নৈতিক নিয়ম মেনে চলার জন্য মানুষকে সব রকমের ভয় দেখানাে হয় এবং ঐতিহ্য যত পুরনাে হবে, ততই তাকে পবিত্র বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। যে কারণে, অনেকে একে সমালােচনা করা বা এর বিরুদ্ধে কিছু বলাকে অনৈতিক কাজ বলে মনে করেন। সব মূল্যায়নই হলাে কোনাে একটা সম্প্রদায় বা জনগােষ্ঠীর জন্য যা প্রয়ােজন বা যা উপকারে আসে, তারই প্রকাশ। যেহেতু একটা সম্প্রদায়ের সংরক্ষণ উপযােগী অবস্থা অন্য একটা সম্প্রদায়ের অবস্থা থেকে ভিন্ন, সেহেতু বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নৈতিক নিয়মের প্রচলন দেখা যায়।

নীটশের মতে নৈতিকতা হলাে ব্যক্তির মধ্যে সম্প্রদায়ের একটা সহজাত আবেগ বা প্রবৃত্তি। সম্প্রদায়ের জন্য সুখ ব্যক্তির জন্য সুখের চেয়ে পুরনাে এবং সম্প্রদায়ের জন্য বিবেক যেখানে বড়, সেখানে ব্যক্তির জন্য বিবেকের কোনাে স্থান নেই। মহৎ ও স্বাধীন চিন্তা-ধারা, স্বাবলম্বী হবার ইচ্ছা এবং এমনকি অকাট্য যুক্তিকে পর্যন্ত বিপজ্জনক বলে উড়িয়ে দেয়া হয়; যা ব্যক্তিকে সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে উন্নত করতে সহায়তা করে এবং প্রতিবেশীর কাছে যা ভীতির উৎস, তা মন্দ বলে বিবেচিত হয়; এবং সহনশীল, বিনীত, নম্র অবস্থার সঙ্গে খাপ-খাওয়ানাে ও সমতা রক্ষা করার গুণকেই সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হয়। নৈতিকতা আসে বাধ্যবাধকতা হিসেবে, যার প্রতি মানুষ আত্মসমর্পণ করে দুঃখকে পরিহার করার জন্য। সে নৈতিকতা পরে সংস্কারে পরিণত হয়, এর পরে তা হয় স্বাধীন আনুগত্য এবং সবশেষে তা হয় একটা সহজাত আবেগ বা প্রবৃত্তি এবং তখন থেকেই তা পুণ্য বলে বিবেচিত হয়। অনেক সময় আমরা কোনাে একটা বিশেষ কাজকে অনৈতিক বলে নিন্দা করে থাকি, যেহেতু কাজটি আমাদের বিবেকের কাছে মন্দ বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে আমাদের বিবেকের কাছে কাজটি মন্দ এ কারণে যে, দীর্ঘদিন ধরে সে কাজটি আমাদের সংস্কার দ্বারা নিন্দিত। আমাদের বিবেক যা করে তা হলাে অনুকরণ করা, সংস্কারকে অনুকরণ করা। পাপানুভূতি কোনাে বাস্তব ঘটনা নয়, বরং বিশেষ একটা ঘটনার ব্যাখ্যা এবং তা হলাে শারীরিক অস্বস্তি। নিজেকে স্বাস্থ্যবান মনে করলেই যেমন কেউ স্বাস্থ্যবান হয় না, ঠিক তেমনি কেউ যদি নিজকে পাপী মনে করে, সে যে পাপী তা প্রমাণিত হয় না। 

নীটশে কান্টের মতােই মনে করেন যে, নৈতিকতা নিয়মেরই ব্যাপার। নৈতিক নিয়মই মানুষকে একটি বিশেষ ধারায় কাজ করতে বাধ্য করে, যা অন্যথায় সে করতাে না। নৈতিক নিয়মগুলাে হলাে ইচ্ছাশক্তির মাধ্যম, যার দ্বারা এ পৃথিবীতে মানুষ তার নিজের উপর নিয়ম আরােপ করে। এবং বলা যায়, এ নিয়ম সৃষ্টি ও নিয়ম মেনে চলার জন্যই মানব-সভ্যতা এখনাে টিকে আছে এবং এগিয়ে চলেছে। নীটশে কান্টের মতাে নৈতিকতাকে নীতি প্রণয়নের ব্যাপার মনে করলেও দু’জনের মধ্যে কিন্তু একটি ক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। কান্টের মতে সার্বিক প্রয়ােগ ছাড়া কোনাে নৈতিক নিয়ম থাকতে পারে না। যদিও প্রত্যেক মানুষ স্বাধীনভাবে নিজের জন্য নিয়ম প্রণয়ন করে, তার ইচ্ছাশক্তি একমাত্র তখনই নৈতিক হবে, যখন তার নিজের উপর আরােপিত নিয়মটি অন্য যে-কোনাে বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির উপরও আরােপ করা যাবে। আমি যদি একটি বৈধ যুক্তি দেই, যুক্তিটি কার দেয়া এ প্রশ্নটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ যুক্তিটি সার্বিকভাবে বৈধ হবেই; ঠিক তেমনি নৈতিক নির্বাচন ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। আমি যদি স্বাধীনভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, কোনাে একটা বিশেষ কাজ নৈতিক, তাহলে আমার এ সিদ্ধান্তটি আমার মতাে একই অবস্থায় যে কোনাে লােকের জন্য প্রযােজ্য হবে। তাহলে আমি নিজের জন্য নির্বাচন করতে গিয়ে আসলে সমগ্র জগতের নিয়ম প্রণয়ন করি।

নৈতিক নিয়ম সম্পর্ক কান্টের এ সার্বিকতার মতবাদকে নীটশে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার মতে নিয়ম প্রণয়ন করা মানে নিজের জন্যই প্রণয়ন করা। কান্টের মতানুসারে আমরা যদি নির্বাচন করতে চাই বা কোনাে একটা কাজ করতে চাই, তাহলে আমরা নিজেরা কোনটাকে ন্যায্য মনে করি তার উপর ভিত্তি করে নয়, বরং প্রত্যেককে একই অবস্থায় একই ধরনের কাজ করা উচিত – এ নিয়মের উপর ভিত্তি করেই করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলাে, ‘একই অবস্থা’ বা ‘একই কাজ করা’ বুঝবার উপায় কী? নীটশে মনে করেন যে, আমরা নীতি প্রণয়ন করি সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিজেদের জন্যই, যেমন আমি যদি সত্য কথা বলার জন্য নিজেকে অঙ্গীকারাবদ্ধ করি, এ সত্য বলার নীতিটি তাহলে আমার ইচ্ছাশক্তি দ্বারা সৃষ্ট, শুধু আমার এবং আমার নিজের জন্যই।

দাসত্ব ও প্রভুত্ব নৈতিকতা (slave morality and master morality) 

নীটশে মনে করেন নৃতত্ত্বের দিক থেকে নৈতিকতাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়; দাসত্ব ও প্রভুত্ব। দাসত্ব-নৈতিকতায় সদয়তা, সহানুভূতি, দাক্ষিণ্য প্রভৃতি গুণকে প্রশংসিত করা হয় আর প্রভুর নৈতিকতায় মূল্য দেয়া হয় অহংকার, ক্ষমতা, সাহসিকতা প্রভৃতিকে। এই দু’প্রকারের নৈতিকতার যে-কোনাে একটাকে তারাই নির্বাচন করে যারা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য ঐ নৈতিকতাকে উপযােগী মনে করে। অবশ্য মানুষ ইচ্ছে করলে যে কোনাে সময়ই অন্য মূল্য নির্বাচন করতে পারে বা তাকে গুরুত্ব দিতে পারে, সমাজে মূল্যবােধের যে অবস্থাই হােক না কেন। এখানে অন্যান্য অস্তিত্ববাদীদের মতাে নীটশেও একটি মারাত্মক ভ্রান্ত ধারণা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছেন এবং তা হলাে অধিকাংশ লােকই নির্বিচারে সমাজে প্রচলিত নৈতিকতাকে মেনে চলে এবং মনে করে যে, তা মানতে তারা বাধ্য। মানুষ আসলে সমাজের নৈতিকতা দ্বারা বাধা নয়; সে ইচ্ছে করলে স্বাধীনভাবে নিজের মূল্য নির্বাচন করতে পারে; মানুষ হিসেবে তার যে ইচ্ছাশক্তি আছে তার দ্বারা সে তার নিজের জন্য অন্য ধরনের নৈতিকতা সৃষ্টি করতে পারে বা গ্রহণ করতে পারে।

নিটশের ধর্ম ও দর্শনের সমালােচনা সম্পূর্ণরূপে নৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তিনি কিছু কিছু গুণের প্রশংসা করেন এবং বিশ্বাস করেন (সম্ভবত সঠিকভাবেই) এসব গুণ অভিজাত সংখ্যালঘিষ্ট মানুষেরই থাকা সম্ভব। তার মতে, সংখ্যাগরিষ্ট হবে সংখ্যালঘিষ্টের শ্রেষ্ঠতার মাধ্যম, এবং সুখ ও কল্যাণের জন্য তাদের কোনাে স্বাধীন দাবি থাকবে না। তিনি তার স্বভাবসুলভভাবেই ইঙ্গিত করেন যে, সাধারণ মানুষ হচ্ছে আনাড়ি এবং বিশ্রী, এবং মহৎ মানুষ সৃষ্টির প্রয়ােজনে তিনি তাদের দুঃখকষ্ট ভােগের কোনাে প্রকার আপত্তি দেখেন না। এভাবে তিনি ১৭৮৯ সাল থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে নেপােলিয়ানের কার্যাবলির মধ্যে সারাংশ আকারে প্রকাশ করেন, “বিপ্লব নেপােলিয়ানের কার্যাবলি সম্ভব করে তােলে। এটিই তার কার্যের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে। যদি কাজের এরূপ পুরস্কারই পাওয়া যায় তাহলে আমাদের সমগ্র সভ্যতার এরূপ নৈরাজ্যকর পতনই কাম্য হওয়া উচিত। নেপােলিয়ান জাতীয়তাবাদকে সম্ভব করে তােলেন। এটি একটি সাম্প্রতিক কৈফিয়ত। তিনি বলেন, এই শতাব্দীর সর্ব প্রকার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেপােলিয়ানের কারণে সম্ভব হয়েছে।”

নীটশের মতে নৈতিক মূল্যের মধ্যে পার্থক্যের ধারণার উৎপত্তি হয়েছে, হয় শাসকগােষ্ঠী বা প্রভুশ্রেণীর মধ্যে যারা সচেতনভাবে শাসিতদের থেকে নিজেদেরকে স্বতন্ত্র মনে করে, নতুবা শাসিত বা দাসশ্রেণীর মধ্যে প্রভুশ্রেণীর কাছে ‘ভালাে’ ও মন্দের অর্থ হলাে ‘সম্রান্ত’ ও ‘নীচ’ এবং দাসশ্রেণীর কাছে ‘ভালাে’ অর্থ হলাে প্রয়ােজনীয়’ বা ‘উপযােগী’ আর ‘মন্দের’ অর্থ হলাে বিপজ্জনক। মানুষের মধ্যে সমান অধিকারের সম্পূর্ণ বিরােধী ছিলেন নীটশে। প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের জনগােষ্ঠীকে শাসক, যােদ্ধা ও শ্রমিক এ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করতে চেয়েছিলেন; আর নীটশে চেয়েছিলেন মাত্র প্রভু ও দাস – এ দুশ্রেণীতে ভাগ করতে। মানুষ কখনাে সমান হতে পারে না; আদর্শ সমাজে প্রভু ও দাস – একমাত্র এ দুটো শ্রেণীই থাকবে, তা না হলে কোনাে উন্নত সংস্কৃতি বা শ্রেষ্ঠ মানবের জন্ম সম্ভব নয়।

তিনি তার দার্শনিক চিন্তাধারাকে আত্মবিরােধী অথচ সত্য হিসেবে ব্যক্ত করতে পছন্দ করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল গতানুগতিক পাঠকদের মনে মর্মবেদনার সৃষ্টি করা। তিনি ‘শুভ’ এবং ‘অশুভ’ শব্দসমূহকে সাধারণ অর্থে ব্যবহার করে বলতেন যে, তিনি ‘শুভ’-এর চেয়ে ‘অশুভ’কে অগ্রাধিকার প্রদান করেন। আর এভাবেই তিনি পাঠকের মনে মনােবেদনার সৃষ্টি করেন। তার বিয়ন্ড গুড এ্যান্ড ইভিল (Beyond Good and Evil) গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে পাঠকের শুভ এবং অশুভ ধারণা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে লিখিত। কিন্তু কিছু স্থান ব্যতীত এই গ্রন্থে তিনি অশুভকে প্রশংসা করে শুভকে নিন্দনীয় বলে ঘােষণা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেন, শুভকে জয় করার লক্ষকে কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করা এবং অশুভকে বিলুপ্তসাধন করা ভুল। এই মতবাদ ইংরেজদের এবং বিশেষ করে ‘নির্বোধ’ জন স্টুয়ার্ট মিলের। এই ব্যক্তির প্রতি তার বিশেষ বিদ্বেষপূর্ণ ঘৃণা ছিল। তার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি লােকটির অশিষ্টতা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি যখন তিনি বলেন, “একজনের যা শুভ, অন্য জনের জন্য তাই শুভ”; অন্যের নিকট তুমি যে আচরণ প্রত্যাশা কর না, সেই একই আচরণ তুমি অন্যের প্রতি করাে না।” এ ধরনের নীতিসমূহ সমগ্র মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সেবাবৃত্তির মনোভাবকে উৎসাহিত করে তুলবে। কারণ আমাদের প্রতিটি কাজই হবে এক ধরনের নগদ অর্থ প্রদানের মতো। এ ধরনের প্রকল্প বা অনুমান চরম পর্যয়ের লজ্জাকর ব্যাপার : এখানে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, আমার এবং তোমার কাজের মধ্যে এক ধরনের মূল্যের সমমানতা রয়েছে।’

আজকের সারা বিশ্বের মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সােচ্চার। কিন্তু এ গণতন্ত্রের বিরােধিতা করেছেন বেশ কয়েকজন ইতিহাস-প্রসিদ্ধ দার্শনিক। এদের মধ্যে এরিস্টটল ও নীটশের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এরিস্টটলের মতে গণতন্ত্র একটি মিথ্যে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তা হলাে সমতার ধারণা। গণতন্ত্র এ ধারণা থেকে উদ্ভূত যে যারা একদিক দিয়ে সমান (যেমন, আইনের দিক থেকে) সর্বক্ষেত্রেই তারা সমান; কেননা তারা সবাই সমানভাবে স্বাধীন এবং এ কারণেই তারা দাবি করে যে তারা সম্পূর্ণরূপে সমান। এর ফলে ব্যক্তি-সামর্থ্য জনতার কাছে, জনগােষ্ঠীর চাপে বিনষ্ট হয়, এবং জনতাকে সুচতুর কৌশলে স্বার্থসিদ্ধির উপযােগী করে কাজে লাগানাে হয়।

এরিস্টটল যেভাবে গণতন্ত্রের বিরােধিতা করেছেন, মনে হয় তার চেয়েও বেশি বিরােধিতা করেছেন নীটশে। এরিস্টটল গণতন্ত্রকে একেবারে বাদ দিতে চাননি; তিনি অভিজাততন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের সংযুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু নীটশে ছিলেন গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিরােধী। তার মতে শ্রেষ্ঠ মানবের অনুশাসন সম্ভব একমাত্র অভিজাততন্ত্রের মাধ্যমেই, গণতন্ত্রের মাধ্যমে নয়। নীটশে গণতন্ত্রকে ‘নাক গােনার’ একটা গতিক’ বলে তুচ্ছ করে বলেছেন যে, খ্রিস্টধর্মের উদ্ভব থেকেই গণতন্ত্রের জন্ম, কেননা যিশুখ্রিস্ট বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদের বিরােধী ছিলেন এবং সমান অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। গণতন্ত্রের রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা হলাে, “তােমাদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ, তাকে তােমাদের ভৃত্য হতে দাও।” প্রাচীন অভিজাততন্ত্রের বিলােপের মূলে ছিল ইউরােপে খ্রিস্টধর্মের বিজয়। তাই নীটশের মতে অভিজাততন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম কাজ হলাে খ্রিস্টধর্মের বিলােপ সাধন।

এমনকি নীটশের বস্তুগত নৈতিকতা খণ্ডনের মূলেও রয়েছে ডারউইনের বিবর্তনবাদ। ডারউইনের মতানুসারে টিকে থাকার জন্য যদি আমাদেরকে নির্মমভাবে জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়, তাহলে সেখানে নৈতিকতার কোনাে গুরুত্ব নেই; এবং এ জগতে যদি উন্নতি ও বিকাশ স্বতঃস্ফুর্ত ও অপরিহার্য হয়, তাহলেও নৈতিকতার কোনাে মূল্য নেই। এভাবে নীটশে নৈতিকতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সার্বিক কোনাে নৈতিক নিয়ম নেই; আমরা নিজেরাই আমাদের উদ্দেশ্য-উপযােগী নৈতিক নিয়ম সৃষ্টি করি। নীটশে নৈতিকতা ও খ্রিস্টধর্মকে আক্রমণ করেছেন এবং দোষযুক্ত বলে অভিযুক্ত করেছেন, কারণ উভয়ই, তার মতে, শ্রেষ্ঠ মানবের প্রভুত্ব করার কাজকে অসম্ভব করে তােলে। ডারউইনের মতানুসারে শক্তিমানই যদি টিকে থাকে, তাহলে শক্তিমানই দুর্বলকে বশীভূত করবে এবং রাজত্ব করবে। কিন্তু নীটশে মনে করেন দুর্বলরা এ বশ্যতা থেকে রক্ষা পাবার জন্য উদ্ভাবন করেছে নৈতিকতা, খ্রিস্টান নৈতিকতা। শক্তিমানদের চেয়ে দুর্বলরাই বেশি এ নৈতিকতাকে মানে, এবং এটাকে যদি শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড বলে গণ্য করা হয়, তাহলে দুর্বলদেরকেই শ্রেষ্ঠ মানব বলে মনে হয়। এ ধরনের নৈতিকতা হলাে দাসত্বের নৈতিকতা, জনতার নৈতিকতা, যার উদ্দেশ্য হলাে শক্তিমানকে পরাজিত করা এবং দুর্বলের অধীনস্থ করা। নীটশের মতে ইউরােপীয়ানরা এ ধরনের নৈতিকতায় নিজেদেরকে লুকাতে চায়, যেহেতু তারা পীড়িত, রুগ্ন, খোঁড়া এবং যাদের বশীভূত হবার যথেষ্ট কারণ আছে, কেননা তারা অকালকুষ্মাণ্ড, অপরিপূর্ণ; দুর্বল, কদাকার এবং অপদার্থ। ধর্ম হলাে এক ধরনের স্নায়ুরােগ – যা এ ধরনের অসুস্থতার জন্ম দেয় এবং কাজে লাগায়। বিশেষভাবে খ্রিস্টধর্ম দিয়েই এ দাসত্ব নৈতিকতার শুরু এবং যারা বেমানান অন্যায়ভাবে অনুগৃহীত, মানবজাতির মধ্যে যারা অধম ও অপদার্থ, তাদেরকেই খ্রিস্টধর্ম সমর্থন জানিয়েছে এবং সপক্ষে এনেছে। খ্রিস্টান অর্থে উন্নতি হলাে প্রকৃত উন্নতির ঠিক বিপরীত, কারণ খ্রিস্টধর্ম মানুষকে মনে করে বশীভূত, দুর্বল, নিরুৎসাহী, কোমলমনা, দুর্বলচিত্ত ও পুরুষত্বহীন।

নিটশের মতে, প্রথাগত ধারার বাইরে যে সত্য সদগুণ রয়েছে তা সকলের জন্য নয়, কিন্তু সদগণকে অভিজাত সংখ্যালঘিষ্টের বৈশিষ্ট্য হিসেবে থাকতে হবে। সত্য সদগণ লাভ বা দূরদর্শী কিছু নয়। এই গুণের অধিকারী ব্যক্তি নিজেকে অন্যদের থেকে পৃথক করে। নিয়মশৃঙ্খলার প্রতি বৈরীভাবাপন্ন এবং অধস্তনদের ক্ষতি করে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে করা উন্নতশ্রেণীর জন্য প্রয়ােজনীয়, এবং যুগের গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিরােধ করাও প্রয়ােজন। কারণ সকল দিক থেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী একত্রিত হয়ে নিজেদের প্রভু বানাতে চাচ্ছে। ‘যেসব বিষয় অত্যধিক প্রশ্রয় দেয়, যেসব বিষয় মনকে কোমল বা দুর্বল করে, এবং যেসব বিষয় “জনগণ” বা “নারী”কে অগ্রণী ভূমিকা পালনে সহায়তা করে যেসব বিষয় সর্বজনীন ভােটাধিকারের পক্ষে কাজ করে – অর্থাৎ যেসব বিষয় নিকৃষ্ট মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়’ সেগুলোকে পরিহার করতে হবে। প্রতারক হচ্ছেন রুশাে যিনি নারীদের আকষর্ণীয় করে তােলেন; এরপর আসে হ্যারিট বিচার স্টোই (Harriet Beecher Stowe) এবং দাসগণ; পরবর্তীতে শ্রমিক শ্রেণী। এবং দরিদ্রের বিজয়ের বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে সমাজতান্ত্রিকদের। এদের সবার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে।

গণতন্ত্র বলতে নীটশে বােঝেন ঝোঁক, কোনাে দেহের প্রত্যেক অঙ্গের যা খুশি তা করার অনুমতি, সঙ্গতি ও পরস্পর নির্ভরশীলতার অবনতি, এবং স্বাধীনতা ও বিশৃঙ্খলার রাজত্ব। গণতন্ত্র হলাে মাঝারি গুণসম্পন্ন লােকের উপাসনা, শ্রেষ্ঠ গুণের বিদ্বেষ। গণতন্ত্র শ্রেষ্ঠ মানবকে অসম্ভব করে তােলে – শ্রেষ্ঠ মানবরা কিভাবে ভােটের অপমান ও অশিষ্টতার কাছে আত্মসমর্পণ করবে? কি সুযােগ তারা পাবে? এ ধরনের মাটিতে কি কখনাে শ্রেষ্ঠ মানব জেগে উঠতে পারে? এবং একটা জাতি কিভাবে বড় হতে পারে যদি তার শ্রেষ্ঠ মানবরা অকেজো, নিরুৎসাহী ও অজ্ঞাত থাকে? এ ধরনের সমাজ তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে, শ্রেষ্ঠ মানবের পরিবর্তে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়, প্রত্যেককেই প্রত্যেকের সমান হয়ে যায়, এমনকি স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে প্রভেদ লােপ পায় – পুরুষ মেয়ে হয় এবং মেয়ে পুরুষ হয়ে যায়।

নিটশের নৈতিকতা যেকোনাে সাধারণ অর্থে আত্মপ্রশ্রয়ের নৈতিকতা নয়; তিনি স্পার্টার শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করতেন এবং কোনাে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ অর্জনের জন্য দুঃখকষ্ট বরণ এবং তা ভােগের নীতিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে ইচ্ছার সার্বভৌমের প্রশংসা করতেন। তিনি বলেন, ক্ষমতার ইচ্ছাশক্তি কী পরিমাণ প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারে এবং কী পরিমাণ দুঃখবেদনা এবং অত্যাচার সহ্য করতে পারে তার উপর ভিত্তি করেই আমি এর পরীক্ষা করি এবং জানতে চাই কীভাবে এটি এর বিনিময়ে আমাদের সুযােগ-সুবিধা প্রদান করে। আমি অশুভ এবং অস্তিত্বের বেদনাকে ভর্ৎসনা ও নিন্দা দ্বারা নির্দেশ করি না, বরং এই আশাপােষণ করি যে জীবন একদিন বর্তমানের তুলনায় অধিকতর অশুভ, অধিকতর পরিপূর্ণ দুঃখে পূর্ণ হবে।’ তিনি করুণাকে সগ্রামের জন্য দুর্বলতা হিসেবে অভিহিত করেন। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই মহানব্যক্তির পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন করা যা ভবিষ্যতের মানুষকে শৃঙ্খলা এবং লক্ষ লক্ষ আনাড়ি এবং বিশ্রী মানুষের ধ্বংসসাধন দ্বারা আদর্শায়িত করতে পারে, এবং এর ফলে দৃশ্যমান সৃষ্ট দুঃখকষ্টের ধ্বংসকে এড়িয়ে যেতে পারে। এরকম দৃশ্য পূর্বে আর কখনাে দেখা যায় নি। তিনি উল্লাস ও আনন্দের সঙ্গে একটি বিশ্বযুদ্ধ যুগের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি বেঁচে থাকলে তার এই ভবিষ্যদ্বাণী পরিপূরণে তিনি সুখী হতেন কিনা তা দেখে যে কেউ বিস্মিত হতেন। 

তিনি অবশ্য রাষ্ট্রের পূজারী ছিলেন না, তিনি ছিলেন এর চেয়ে অনেক দূরে। তিনি একজন আবেগপ্রবণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী, একজন বীরের (hero) ধারণায় বিশ্বাসী। তিনি বলেন, একটি সমগ্র জাতির দুঃখ একজন মহৎ ব্যক্তির দুঃখের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ। পরাক্রমশক্তিশালী ব্যক্তির আবেগ-অনুভূতি হওয়া ব্যতীত এসব ছােট ছােট ব্যক্তির দুর্ভাগ্য একত্রে দুঃখের যােগফলের সমান হয় না।’
নিটশে জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, এবং তিনি জার্মানির জন্য অতিরিক্ত কোনো প্রশংসাও দেখান নি। তিনি একটি আন্তর্জাতিক শাসকজাতি আশা করেছিলেন, যারা হবেন এই পৃথিবীর প্রভু -. ‘সবচেয়ে কঠিন আত্মবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি নতুন বিশাল অভিজাত সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের থাকবে দার্শনিক মানুষের শক্তির ইচ্ছা এবং শিল্পীর স্বৈরশাসনের চাপ যা হাজার হাজার বছর ধরে বিদ্যমান থাকবে।’ তিনি নিঃসন্দেহে এন্টি-সেমেটিক ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, জার্মানি যত সংখ্যক সম্ভব ইহুদিদের আত্মীকৃত করতে পারবে, তবে ইহুদিদের অবিরাম আগমন অনুমােদন করবে না। তিনি নতুন বাইবেল (New Testament) অপছন্দ করলেও পুরাতন বাইবেল অপছন্দ করতেন না। এই বাইবেলকে তিনি সর্বোচ্চ প্রশংসায় ভূষিত করতেন। নিটশের দর্শনের বিচার করতে হলে আমাদের এ বিষয়টির উপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে যে, আধুনিক দর্শনের যে সব বিষয়ের বিকাশের সঙ্গে তার নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির যােগ রয়েছে তা তার সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত অভিমতের বিপরীতমুখী।

শ্রেষ্ঠ মানব (superman)

নীটশের ব্যক্তিগত জীবন যাই হােক না কেন, তার একটা নির্দিষ্ট দার্শনিক চিন্তাধারা ছিল – যা অন্যান্য অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের দর্শনের মতােই বৈপ্লবিক। নীটশে নৈতিকতা, ঈশ্বরের ধারণা ও বিশেষভাবে খ্রিস্টধর্মকে যেভাবে আক্রমণ করেছেন, তা দেখে তার চিন্তাধারাকে শুধু নাস্তিধর্মী বলেই মনে হয়, কিন্তু আসলে তার দর্শনের একটা আস্তিধর্মী দিকও আছে, যা তার ক্ষমতালাভের ইচ্ছাশক্তি ও শ্রেষ্ঠ মানবের ধারণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নীটশের মতানুসারে, আমাদের প্রত্যেককেই যদি অপরিহার্যভাবে জগৎ সম্পর্কে কিছু না কিছু মূল্যায়ন করতে হয় বা নৈতিক নিয়ম সৃষ্টি করতে হয়। তাহলে কার নৈতিকতা শ্রেষ্ঠ বা গ্রহণযােগ্য? নীটশে তার শ্রেষ্ঠ মানবের ধারণা দিয়েই এ প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। তার মতে শ্রেষ্ঠ মানবই নৈতিক মানবদণ্ড প্রণয়ন করবে এবং তার সৃষ্ট নীতিই সমাজের অন্য সবার উপর আরােপিত হবে। নীটশের এ শ্রেষ্ঠ মানবের ধারণার পেছনে রয়েছে ডারউইনের প্রভাব। এ জগতে প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার জন্য অবিরাম সংগ্রামের যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ডারউইন দিয়েছেন, তা ১৯শ শতাব্দীর চিন্তাধারাকে বিশেষভাবে আলােড়িত করেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে জীবন-মৃত্যুর নির্মম সংগ্রামের মতবাদ পরবর্তীকালে সর্বত্র এক নতুন নৈতিকতায় পরিণত হয়েছে, ধনতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী দেশগুলােতে শ্রেণী-সংগ্রামে ও উগ্র জাতীয়তাবাদের এর প্রকাশ ঘটেছে। জীবন-মৃত্যু সংগ্রামে তুলনামূলকভাবে যে শক্তিশালী সে টিকে থাকে, যে দুর্বল সে মারা যায়। ডারউইনের এ বিবর্তনবাদে (evolution) নীটশের শ্রেষ্ঠমানবের ধারণাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ডারউইনের শক্তিশালী মানুষ নীটশের শ্রেষ্ঠমানবে পরিণত হয়েছে।

নীটশে মনে করেছিলেন যে, খ্রিস্টধর্ম ইউরােপের অধিকাংশ লােকের উপর, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের উপর আধিপত্য হারিয়েছে এবং এটি তার মতে ১৯শ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যেহেতু ইউরােপীয় সভ্যতা খ্রিস্টধর্মের ঈশ্বরের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারানাের ফলে, নীটশের মতে, ইউরােপীয় সভ্যতায় এক বিরাট শূন্যতা এসেছে – ঈশ্বরের পরিবর্তে সেখানে বিরাজ করছে শূন্যতা। নীটশে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন যে, এ শূন্যতা অশুভ, বিপজ্জনক। এ শূন্যতার মুহূর্তে নানা বিশ্বাস, ধারণা ও নীতি জন্ম নিয়েছে। এবং নিচ্ছে, কিন্তু আমাদের অস্তিত্বের অন্তঃস্থল হিসেবে আমরা এর সম্মুখীন হয়েই আছি। শূন্যতার ধারণা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ইউরােপীয় সভ্যতার প্রত্যেকটি জিনিসকে গ্রাস করেই চলেছে। নীটশে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, আমাদের জীবন নির্মমতা, যুদ্ধ-বিগ্রহে বিঘ্নিত হবে। সে ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে হয়নি, দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ তারই প্রমাণ। এ শূন্যতাকে নীটশে মনে-প্রাণে উপলব্ধি করেছিলেন এবং ধারণা করেছিলেন যে, এর ফলাফল খুবই ভয়াবহ। অনেকের মতে এ উপলব্ধিই নীটশের ব্যক্তিগত জীবনে উন্মাদ হবার পিছনে অনেকটা দায়ী। সম্ভবত উন্মাদ হয়ে যাবার জন্য নীটশে তার দর্শনের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হননি। কিন্তু তবুও তার সময়কালীন ইউরােপের যে একটা করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ‘ঈশ্বর মৃত’, ‘ঈশ্বরকে আমরা হত্যা করেছি, খ্রিস্টধর্ম অচল, মহৎ সব নীতি মূল্যহীন’ – এ নৈরাশ্যবাদ তার দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি উন্মাদ ব্যক্তিটির মুখ দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, আমরা যে ঈশ্বরকে হত্যা করেছি, এ কাজটি কি আমাদের জন্য খুব বেশি হয়নি? আমাদের সম্ভাব্য সান্ত্বনা কি? নীটশে কোনাে সান্তনা খুঁজে পেয়েছিলেন কি না বলা যায় না, তবে তার নৈরাশ্যবাদ পরিণতি লাভ করেছে শ্রেষ্ঠমানব ও বীরত্ব-নৈতিকতার ধারণায়।

শ্রেষ্ঠমানবের ধারণা মেলে জরথুস্ত্রের কাছ থেকে। প্রাচীন পার্সি ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা জরথুস্ত্রকেই নীটশে যেন তার দর্শনের মুখপাত্র করেছিলেন। জরথুস্ত্র নির্ভয়ে ঘােষণা করেছে যে, ঈশ্বর মৃত। খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বরের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যেহেতু ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে, তাই সে শূন্যস্থান পূরণ করবে মানুষ। সে মানুষ কিন্তু সাধারণ মানুষ নয়, সে মানুষ হলাে শ্রেষ্ঠমানব, যার মধ্যে সংযুক্ত হবে অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে পশুর সৌন্দর্য ও শক্তি, যা তাকে সক্ষম করবে নিজকে, জনতাকে, জগৎকে এবং এমনকি অদৃষ্টকে জয় করতে। সে হবে এ পৃথিবীর প্রভু, যে এ পৃথিবীর উদ্দেশ্যকে পূরণ করবে এবং ইতিহাসকে করবে অর্থময়। জরথুস্ত্রের মতে এ শ্রেষ্ঠ মানবই ঈশ্বরের উত্তরাধিকারী। নীটশে তার শ্রেষ্ঠ মানবকে ইতিহাসের কোনাে বিশেষ মহাপুরুষের অনুসরণে কল্পনা করেছিলেন কি না বলা মুস্কিল, তবে তিনি নেপােলিয়ানের খুব বড় ভক্ত ছিলেন। সম্ভবত নেপােলিয়নকে তখন ফ্রান্স ছাড়াও জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া ও ইউরােপের অন্যান্য স্থানে যে পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতাে তার দ্বারা নীটশে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং নেপােলিয়নের মতাে করে তার শ্রেষ্ঠমানবকে কল্পনা করেছিলেন।

নীটশের মতে শ্রেষ্ঠমানব সর্বোপরি এক বড় যােদ্ধা এবং নির্মম বিজয়ীর প্রতীক। নীটশে যদিও নির্মমতা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, প্রথম দিকে তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছিলেন, কারণ তিনি চেয়েছিলেন তার শ্রেষ্ঠমানব এক বড় যােদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হােক এবং সমগ্র জগৎ তার সর্বক্ষমতা মেনে নিক। খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য বিলুপ্ত হবার পর যুদ্ধক্ষম বীরত্ব যে প্রশংসার চরমে পৌঁছেছিল, ইউরােপের সর্বত্র নেপােলিয়নের প্রতি পরম শ্রদ্ধা থেকে তা স্পষ্ট। এমনকি মধ্যযুগেও বীরত্ব যে পরম লক্ষ্য ছিল তা বােঝা যায় প্রাচীন ইউরােপীয় নাইট-বীরদের বীরধর্মের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মকে যুদ্ধের ভাবাদর্শে সংযুক্ত করার প্রবণতা থেকে। প্রাচীন গ্রিসেও বীরত্ব যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ছিল, স্পার্টায় দুর্বল শিশু ভূমিষ্ঠ হলেই মেরে ফেলার রীতি থেকে তা সহজেই অনুমেয়। নীটশেই সর্বপ্রথম বীরত্ব সম্পর্কে এ মনােভাবের একটি সচেতন ও প্রলুব্ধকারী আধুনিক ব্যাখ্যা দেন এবং তার ফলেই বীরপুরুষ জনতার প্রভু ও জগৎ বিজয়ী এ শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শ সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বিশেষভাবে এ কারণেই নীটশেকে নাৎসিদের সমর্থক এবং তাদের মতের প্রচারক বলে অভিযুক্ত করা হয়। এ অভিযােগ অমূলক নয়। নীটশে ছিলেন বীরের পূজারী এবং তিনি চেয়েছিলেন বীর বা শ্রেষ্ঠ মানবরাই সমগ্র পৃথিবী শাসন করুক। তার মতে মানবজাতি নয়, শ্রেষ্ঠমানবই আমাদের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি ছিলেন প্রজননের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠমানবের জন্য দেবার পক্ষপাতী। সােপেনহাওয়ারকে সমালােচনা করে নীটশে এ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বীরের সঙ্গে দাস, সম্প্রদায়ের মেয়েদের বা প্রতিভাশালী ব্যক্তির সঙ্গে দরজি মেয়ের প্রেমবন্ধন বিবাহ একটা অসম্ভব ব্যাপার। প্রেম শ্রেষ্ঠ মানবজাতি প্রজননের মাধ্যমে নয়; প্রেমকে বিবাহের আইনগত প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য করা উচিত। শ্রেষ্ঠ শুধু শ্রেষ্ঠকেই বিয়ে করবে; প্রেম নিম্নশ্রেণীর লােকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। বিবাহের উদ্দেশ্য শুধু সন্তান জন্ম দেয়া নয়, উন্নতি-সাধনও এবং ভালাে জন্ম ছাড়া আভিজাত্য সম্ভব নয়। নীটশে তাই প্রভু-শ্রেণীর প্রজননের দাবি করেছেন এবং সেই সঙ্গে দাবি করেছেন অতৃপ্ত, বিদ্বেষী ও হিংসুকদেরকে জন্ম না দিতে, অপরাধীদের বন্ধ্যা করতে এবং অপদার্থদেরকে বিনাশ করতে। নাৎসিদের গ্যাস চেম্বারে হাজার হাজার লােককে হত্যা করার জঘন্যতম ঘটনা নীটশের এ দাবিরই পরিপূরণ যেন। তবে এটা ঠিক যে, নাৎসিদের সর্বনাশী কার্যকলাপের জন্য নীটশের চিন্তাধারাকেই একমাত্র দায়ী করা যায় না; কিন্তু তবুও এটা নিঃসন্দেহে সত্য যে, নীটশের মতাে একজন প্রসিদ্ধ দার্শনিক তাদের কার্যকলাপ সমর্থন করায় সেগুলােকে বাস্তবে প্রয়ােগ করতে তাদের সুবিধে হয়েছিল।

নীটশে চেয়েছিলেন প্রাচীন বা প্রচলিত নৈতিকতাকে বিলােপ করে শ্রেষ্ঠমানবের নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে। শ্রেষ্ঠমানবের নৈতিকতাই শ্রেষ্ঠ; সাধারণ মানুষের নৈতিকতা নিকৃষ্ট। নীটশের মতে নৈতিকতা দয়া-মমতার মধ্যে নয়, শক্তি বা বীর্যের মধ্যেই নিহিত। নৈতিকতাকে বিচার করতে হবে দুর্বলতা দিয়ে নয়, বীর্য দিয়ে। সর্বপ্রকার নৈতিকতার মূলে রয়েছে ক্ষমতা লাভের ইচ্ছাশক্তি। ভালমন্দ নির্ভর করে ইচ্ছাশক্তির উপর। সে ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ ঘটে সাহসের মধ্য দিয়ে, বীর্যের মধ্য দিয়ে। শ্রেষ্ঠমানব হবে অসাধারণ সাহসী ও নির্ভিক – সে তার ইচ্ছাশক্তিকে প্রকাশ করবে তার সাহসিকতায়। ভালাে কি? সাহিসকতাই ভালাে। যা বীর্য বা ক্ষমতা লাভের ইচ্ছাশক্তিকে বৃদ্ধি করে তাই ভালাে। মন্দ কি? দুর্বলতাই মন্দ। দুর্বলতা থেকে যা অদ্ভুত তাই মন্দ। নীটশের মতে আমাদেরকে হয় শ্রেষ্ঠ হতে হবে, নয়তাে শ্রেষ্ঠমানবের দাস হতে হবে। একমাত্র এভাবেই আমরা সার্থকভাবে বাচতে পারি এবং আমাদের অস্তিত্ব কেবল তখনই অর্থপূর্ণ হবে।

নীটশে ছাড়া অস্তিত্ববাদীদের মধ্যে অনেকে পূর্ণতার আলেকে মানুষের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিয়ের্কেগার্ড পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছেন খ্রিস্টধর্মে। আদম নিষিদ্ধ ফল খেয়ে যে পাপ করেছেন, আমরাও সে পাপের অংশীদার, কারণ আমরা আদমেরই সন্তান। সে-পাপ, সে-অপূর্ণতা থেকে রক্ষা পেতে হলে মানুষকে ধর্মীয় জীবনযাপন করতে হবে, একজন আদর্শ খ্রিস্টান হতে হবে, শর্তহীনভাবে নিজকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করতে হবে। সার্তও মানুষকে অপূর্ণ বলে চিত্রিত করেছে। মানুষের স্বভাব স্থিতিশীল নয় – অবিরাম সে সামনের দিকে, এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। এ অস্থিতিশীলতা মানুষের অপূর্ণতারই প্রকাশ। এ অপূর্ণতা থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারে, যদি সে একটা অসম্ভব ও অবাস্তব বস্তুকে পরিণত হতে পারে। সে-বস্তুটি হলাে চেতন-অচেতনের মিলন, সার্ত যার নাম দিয়েছেন ঈশ্বর। চেতন-অচেতনের মিলন যৌক্তিকভাবে অসম্ভব, তাই ঈশ্বরের ধারণাও অসম্ভব, বিরােধপূর্ণ। মানুষ শুধু পূর্ণতা লাভের আকাঙক্ষা করে, কিন্তু কখনাে তা অর্জন করতে পারে না। একইভাবে শ্রেষ্ঠমানবও নীটশের একটি আদর্শ, একটি চরম লক্ষ্য – যার মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন মানবজীবনের সার্থকতা ও পূর্ণতা।

নীটশের নারী ও খ্রিস্টধর্ম বিদ্বেষ

নীটশের নৈতিকতার দুটি প্রায়ােগিক দিক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে – প্রথমত, নারীর প্রতি ঘৃণা, এবং দ্বিতীয়ত খ্রিস্টধর্মের কঠোর সমালােচনা। নীটশের মতে মেয়েরা কখনাে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে না। মেয়েদের সবকিছুই প্রহেলিকা; তাদের সম্বন্ধে একটিমাত্র উত্তর – সন্তান উৎপাদন। পুরুষ আমাদের জন্য একটি উদ্দেশ্য সাধনের উপায়; উদ্দেশ্য হলাে সন্তান। কিন্তু মেয়েরা পুরুষের জন্য একটি বিপজ্জনক খেলনা। পুরুষদেরকে শিক্ষিত করতে হবে। যুদ্ধের জন্য, আর মেয়েদেরকে যােদ্ধাদের মনােরঞ্জনের জন্য। এছাড়া সবই মূর্খতা। মেয়েদের সম্পর্কে নীটশের একটি বিখ্যাত উক্তি হলাে, “তুমি যদি কোনাে মেয়ের কাছে যেতে চাও, তাহলে চাবুক নিতে ভুলাে না।” একথা বলা সহজ, কিন্তু বাস্তবে প্রয়ােগ করা কঠিন, বিশেষ করে যদি যৌনাবেগ প্রবল হয়। চাবুকের পরিবর্তে তার সমস্ত অন্তর দিয়ে নীটশে ভালােবেসেছিলেন, বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, একাধিক মেয়েকে, কিন্তু প্রতিবারেই এসেছে শুধু ব্যর্থতা – জীবন হয়েছে তার দুঃখময়। নীটশের জীবনে প্রথম মহিলা হলেন সুবিখ্যাত সুরকার ভ্যাগনারের স্ত্রী, কোসিমা ভ্যাগনার। ভ্যাগনারের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুযােগেই নীটশের কোসিমার সঙ্গে গভীরভাবে মেশার সুযােগ হয়েছিল। তার বিভিন্ন পত্র থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোসিমার প্রতি নীটশের ছিল গভীর ভালােবাসা এবং এ ভালােবাসাই নীটশের মনে ভ্যাগনারের প্রতি জাগিয়েছে ঈর্ষা যার পরিণতি হলাে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব-বিচ্ছেদ। নীটশের প্রতি কোসিমার কোনাে দুর্বলতা ছিল কি বলা যায় না, তবে ভ্যাগনারের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে নীটশে আর কখনাে কোসিমার সঙ্গে দেখা করেননি। কিন্তু নীটশে কোসিমাকে ভুলতে পারেননি এক মুহূর্তের জন্যও, তার প্রমাণ কোসিমাকে লেখা তার চিঠিপত্র। ১৮৮৯ সালে তিনি যখন উন্মাদ হয়ে ভেঙে পড়েন, জেনা ক্লিনিকে তার অসংলগ্ন প্রলাপের মধ্যে একটি ছিল, “আমার স্ত্রী, কোসিমা ভ্যাগনার আমাকে এখানে এনেছে।” কোসিমাই নীটশের জীবনে একমাত্র ব্যর্থ-প্রেম নয়, লুই অট নামে এক বিবাহিতা মহিলার সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল ব্যর্থতা। এরপর নীটশে ম্যাথিল্ড ট্রামপেদ্যাক নামে এক মেয়ের প্রেমে পড়েন এবং লিখিতভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেন; কিন্তু দুঃখের বিষয়, তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। লাে সালােম নামে অন্য আরও এক মহিলার সঙ্গেও নীটশের গভীর সম্পর্ক ছিল; কিন্তু ঠিক একইভাবে এবারও তার বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।

কিয়ের্কেগার্ড ভালােবাসা পেয়েছিলেন, কিন্তু বিয়ে করেননি। নীটশে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভালােবাসা পাননি – বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিয়ে করার প্রবল ইচ্ছা অথচ চরম ব্যর্থতা – এ মানসিক দ্বন্দ্বে নীটশের জীবন ছিল জর্জরিত। তার এ মানসিক যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়, যখন তার একমাত্র মেয়ে-সঙ্গী, তার বােনের বিয়ে হয় এমন একজনের সঙ্গে যাকে নীটশে দুচোখে দেখতে পারতেন না। নীটশের যৌনাবেগ ছিল অত্যন্ত প্রবল। কিন্তু বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি সেই আবেগ প্রকাশ করেছিলেন নান ধরনের মেয়ের সঙ্গে সাময়িকভাবে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে, যার পরিণতিতে তিনি হয়েছিলেন যৌন-রােগে আক্রান্ত। অনেকের মতে যৌন-রােগ সংক্রমণই নীটশের অসুস্থতা এবং পরবর্তীকালে উন্মাদ হবার অন্যতম কারণ। নীটশের জীবনের এসব ঘটনা বিচার করলে মেয়েদের প্রতি তার বিষাদগারময় মনােভাবের কারণ খুব সহজেই অনুমেয়।

নারীদের বিরুদ্ধে নিন্দা করতে তিনি কখনাে ক্লান্ত ছিলেন না। তিনি তার কপট ভবিষ্যদ্বাণীমূলক গ্রন্থ দাজ স্পোক জরাথুস্ত্র (Thus Spake Zarathustra)-এ বলেন, নারীরা এখনাে বন্ধুত্বের যােগ্য সঙ্গিনী হওয়ার যােগ্যতা অর্জন করে নি; তারা এখনাে বিড়াল বা পাখি, বা বেশি হলে গরুর মতাে। পুরুষকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যুদ্ধের জন্য, আর নারীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে সেই যােদ্ধার চিত্তবিনােদনের জন্য। এ ছাড়া আর সব কিছু বােকামি। যােদ্ধাদের চিত্তবিনােদন বিশেষ এক ধরনের হবে যদি সে তার এ বিষয়ে সবচেয়ে জোরালাে প্রবচনে বিশ্বাস করতে পারে, ‘তুমি কি নারীদের কাছে যাও? তাহলে তােমার চাবুকটি সঙ্গে নিতে ভুল না।’ নারীদের সম্পর্কে সর্বদা তিনি এত হিংস্র মনােভাবাপন্ন না হলেও সর্বদা ঘৃণার মনােভাব পােষণ করতেন। তিনি তার উইল টু পাওয়ার (Will to Power) গ্রন্থে বলেন, ‘আমরা যেমন সুন্দর ও চমৎকার জিনিস দেখে আনন্দলাভ করি ঠিক তেমনি নারীদের দেখেও আনন্দলাভ করি, কারণ তারা কমনীয়, এবং তারা এক ধরনের অধিকতর বায়বীয় প্রাণী। যেসব প্রাণীর মধ্যে শুধু নৃত্য এবং নির্বুদ্ধিতা এবং সুন্দর ও শশাভনীয় বিষয় রয়েছে। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা কী মজারই না হবে। তাদের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্তের উত্তেজনার আনন্দ এবং পুরুষের আত্মার গভীরতা থাকে। অবশ্য এসব প্রশংসিত গুণ সেই সব নারীর মধ্যে পাওয়া যায় যতক্ষণ তারা পুরুষােচিত পুরুষ দ্বারা শাসিত থাকে; স্বাধীনতা পেলেই তারা অসহনীয় হয়ে ওঠে। নারীদের লজ্জার অনেক কারণ আছে; তাদের মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত ক্লান্তিকর ও অপ্রয়ােজনীয় পণ্ডিতিপণা, অগভীরতা, স্কুলশিক্ষকের মনােভাব, ক্ষুদ্র অনুমান, লাগামহীনতা, এবং গুপ্ত অশিষ্টাচার …পুরুষ মানুষের ভয়ে এগুলাে নিয়ন্ত্রিত এবং শাসিত হয়। সুতরাং, তিনি তার বিয়ন্ড গুড এন্ড ইভিল (Beyond Good and Evil) গ্রন্থে নারী প্রসঙ্গে এসব মন্তব্যের সঙ্গে আরাে যােগ করে বলেন যে, আমরা প্রাচ্যবাসীদের মতাে তাদের সম্পদ মনে করবাে। নারী প্রসঙ্গে এসব অমর্যাদাপূর্ণ উক্তি তিনি স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে প্রদান করেছেন; তিনি ইতিহাস থেকে বা নিজ জীবন থেকে কোনাে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এসব উক্তি করেন নি। সুতরাং, নারী প্রসঙ্গে এসব উক্তি তার বােনকে কেন্দ্র করেই সীমিত।

খ্রিস্টধর্মের প্রতি এরূপ বিরূপ মনােভাব নীটশের নাস্তিকতার বড় পরিচয়। তার নাস্তিকতার উল্লেখযােগ্য উক্তি হলাে, ঈশ্বর মৃত, আমরা ঈশ্বরকে হত্যা করেছি, ঈশ্বর মরে গেছে। স্পষ্টতই এটি সরাসরি একজন নাস্তিকের উক্তি নয়। একজন নাস্তিক সােজাসুজি দাবি করতেন যে, ঈশ্বর নেই, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস। একটি অর্থহীন কুসংস্কারমাত্র এবং এর কোনাে ভিত্তি নেই। কিন্তু ‘ঈশ্বর মৃত’ – এ উক্তিটি ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতাকে বােঝায় না, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারানােকেই বােঝায়। ১৮৮২ সালে নীটশে তার বিখ্যাত গ্রন্থ Joyful Wisdom-এ এটি রূপকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, “তােমরা কি সেই উন্মাদের কথা শােননি, যে এক উজ্জ্বল সকালে হারিকেন হাতে দৌড়ে হাটে গিয়েছিল চিৎকার করতে করতে যে, “আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি?” সে মুহর্তে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই ছিল নাস্তিক, কাজেই তার এ আচরণ সেখানে বিরাট হাসির উদ্রেক করেছিল। কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি কি তাহলে তাকে হারিয়েছ?” কেউ প্রশ্ন করেছিল – “সে কি শিশুর মতাে পথ হারিয়েছে? অথবা সে কি লুকিয়ে আছে? সে কি আমাদের ভয়ে ভীত? সে কি সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছে? নাকি সে স্বদেশত্যাগী?” এসব বলে চিৎকার করে হেসেছিল সবাই। উন্মাদ লােকটি চিৎকার করে বলেছিল, “ঈশ্বর কোথায়? আমি তােমাদেরকে বলবাে। আমরা তাকে হত্যা করেছি – তােমরা এবং আমি…। ঈশ্বর মৃত! ঈশ্বর মৃতই থাকবে। এবং আমরা তাকে মেরে ফেলেছি।”

খ্রিস্টধর্মের প্রতি নিটশের আপত্তির কারণ হচ্ছে এই ধর্ম ‘দাস নৈতিকতা’ সমর্থন করে। খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে নিটশের যুক্তি এবং ফরাসি বিপ্লবকে অথগামী করার জন্য যে সব ফরাসি দার্শনিক খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে যুক্তি প্রদান করেছিলেন তাদের বৈপরীত্যের বিষয়টি লক্ষ করা কৌতুহলজনক। তারা যুক্তি প্রদান করেছিলেন যে, খ্রিষ্টীয় ধর্মমত অসত্য; তারা বলেন যে, খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বরের ইচ্ছার নিকট বশ্যতা স্বীকার করতে শিক্ষা দেয়, অথচ আত্মমর্যাদাবােধসম্পন্ন কোনাে মানুষের উচ্চতর শক্তির নিকট মাথা নত করা উচিৎ নয়। এছাড়া খ্রিষ্টধর্ম স্বৈরশাসকদের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে, এবং গণতন্ত্রের শত্রুদের স্বাদ অস্বীকার করতে গরিবদের উৎপীড়ন করতে সাহায্য করছে। নিটশে খ্রিষ্ট বা অন্য কোনো ধর্মের অধিবিদ্যক সত্যে আগ্রহী নয়। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যেহেতু কোনাে ধর প্রকৃত অর্থে সত্য নয়, সেহেতু তিনি সকল ধর্মকে তাদের সামাজিক ফলাফল দ্বারা বিচার করেন। যেসব দার্শনিক তথাকথিত ঈশ্বরের ইচ্ছার বশ্যতা স্বীকারের বিরােধিতা করেন তিনি তাদের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেন, কিন্তু এর বিকল্প হিসেবে পার্থিব ‘শিল্পী স্বৈরশাসকের’ বশ্যতার কথা স্বীকার করেন। এসব অতিমানব ব্যতীত বশ্যতা স্বীকার যথার্থ, কিন্তু খ্রিষ্টীয় ঈশ্বরের নিকট বশ্যতা স্বীকার করা যথার্থ নয়। যেহেতু খ্রিস্টীয় চার্চসমূহ স্বৈরশাসকের বন্ধু  এবং গণতন্ত্রের শত্ৰু, সেহেতু তিনি বলেন এটি সত্যের একেবারেই বিপরীত। তার মতানুসারে, ফরাসি বিপ্লব এবং সমাজতন্ত্রের মর্মবস্তু মূলত খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ কারণে তিনি এদের বিরােধিতা করেন এবং বলেন, কোনােদিক থেকেই তিনি সকল মানুষকে সমান হিসেবে গণ্য করবেন না।

তিনি বলেন, বৌদ্ধধর্ম ও খ্রিস্টধর্ম উভয়ই ‘শূন্যতাবাদী’ ধর্ম। এ দুটি ধর্ম এ অর্থে শূন্যতাবাদী যে, তারা একজন মানুষের থেকে অন্য একজন মানুষের মধ্যে চরম মূল্যের পার্থক্য অস্বীকার করে, তবে এ দুটি ধর্মের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম কম আপত্তিযােগ্য। খ্রিস্টধর্ম হচ্ছে অধঃপতিত, পরিপূর্ণভাবে ক্ষয়শীল এবং পশুবিষ্ঠাবৎ; এর মূলচালিকাশক্তি হচ্ছে আনাড়ি ও বিশ্রী মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ইহুদিদের দ্বারা এবং ‘পবিত্র মৃগীরােগী’ সেন্ট পল এটিকে খ্রিস্টধর্মে স্থান দেন। সেন্ট পলের কোনাে সততা ছিল না। ‘নতুন বাইবেল’ হচ্ছে মানবজাতির সম্পূর্ণভাবে লজ্জাকর কাহিনী সংক্রান্ত গ্রন্থ। খ্রিস্টধর্ম হচ্ছে সবচেয়ে নিয়তিমূলক সর্বনাশা এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনােমুগ্ধকর মিথ্যায় পরিপূর্ণ ধর্ম। এ ধরনের ধর্মের অস্তিত্ব পূর্বে ছিল না। স্মরণীয় কোনাে ব্যক্তি খ্রিষ্ট আদর্শ অনুসরণ করেন নি; উদাহরণস্বরূপ আমরা প্লুটার্কের লাইভস (Lives) গ্রন্থের বীরদের কথা আলােচনা করতে পারি (লাইভস হচ্ছে প্লুটার্ক কর্তৃক সংগৃহীত গ্রিস ও রােমের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত জীবনী (১০৫-১৫ খ্রিস্টাব্দ))। গর্বের মূল্য, অদূরবর্তী করুণরস, মহৎ দায়িত্ব, প্রাণােচ্ছল উচ্ছ্বাস, অত্যন্ত তৃপ্তিকর পশুবৎ জীবন বা পাশবতা, যুদ্ধ এবং যুদ্ধ বিজয়ের সহজাত প্রবৃত্তি, প্রবল অনুরাগের উপর দেবত্বারােপ, প্রতিশােধ গ্রহণ, ক্রোধ, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, দুঃসাহসিক অভিযান, ‘জ্ঞান’কে অস্বীকার করার জন্য খ্রিস্টধর্মকে নিন্দা করতে হবে। সুতরাং, নিটশে মত প্রদান করেন যে, উপযুক্ত সব কিছুই ভাল, কিন্তু খ্রিস্টধর্ম এগুলাে মন্দ হিসেবে অভিহিত করে।

তিনি যুক্তি প্রদান করেন যে, খ্রিস্টধর্ম মানুষের আত্মাকে অনুগত করে, কিন্তু এ কাজটি করা ভুল। একটি বন্যপশুর উজ্জ্বলদীপ্তি থাকে কিন্তু পােষ মানালে এটি সেই উজ্জ্বল দীপ্তি হারিয়ে ফেলে। দস্তয়ভস্কি (Dostoevsky) যেসব অপরাধীর সঙ্গে মিশতেন তারা তার চেয়ে অধিকতর ভাল ছিলেন, কারণ তারা ছিলেন অধিকতর আত্মমর্যাদাবােধসম্পন্ন। অনুশােচনা এবং মুক্তিবােধের ধারণাগুলাে নিটশের নিকট এক ধরনের বিতৃষ্ণাবােধের সৃষ্টি করে যাকে তিনি উন্মাদ বৃত্তাকার (folic circulaire) বলে অভিহিত করতেন। মানুষের আচরণ সম্পর্কে এ ধরনের চিন্তা থেকে নিজেদের মুক্ত করা কঠিন। আমরা দুই হাজার বছরের বিবেকের তাড়না এবং আত্মহননের ধারণার উত্তরাধিকারী। প্যাসক্যাল (Pascal) সম্পর্কে খুবই অলঙ্কারপূর্ণ আলােচনা রয়েছে যা উদ্ধৃতিযােগ্য। কারণ এই আলােচনা খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে নিটশের আপত্তির কথা সুন্দরভাবে উল্লেখ করে – ‘খ্রিস্টধর্মে আমরা কিসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি? খ্রিস্টধর্মের লক্ষ হচ্ছে শক্তিমানকে ধ্বংস করা, তাদের জীবনীশক্তিকে ভেঙ্গে টুকরাে টুকরাে করা, তাদের ক্লান্তিকর এবং দুর্বল মুহূর্তকে বিনষ্ট করা, তাদের গর্বিত আত্মপ্রত্যয়কে উদ্বিগ্নতা করে বিবেকের দ্বন্দ্বে নিপতিত করা। এটি জানে কীভাবে মহত্তম প্রবৃত্তিকে বিষাক্ত করতে হয় এবং এদের রােগাক্রান্ত করতে হয়, যে পর্যন্ত তাদের শক্তি, তাদের ইচ্ছাশক্তি অন্তর্মুখী হয়, তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা – যে পর্যন্ত তাদের অতিরিক্ত আত্ম-ঘৃণাকে এবং আত্ম-উৎসর্গকে শক্তি দিয়ে ধ্বংস না করে : ধ্বংসের সেই বিভীষিকাময় অবস্থা বর্ণনার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছেন প্যাসক্যাল।’

খ্রিস্ট সাধু-সন্তের স্থলে নিটশে ‘মহৎ’ মানুষকে দেখার ইচ্ছাপােষণ করেন, কিন্তু এই ‘মহৎ মানুষ’ কোনাে অবস্থাতেই একজন সর্বজনীন প্রকৃতির মানুষ হবেন না। তিনি হবেন অভিজাত শাসক। এই মহৎ মানুষ নিষ্ঠুর কাজ করার যােগ্যতা সম্পন্ন হবেন এবং স্থূলভাবে যাকে আমরা অপরাধ বলে অভিহিত করি তিনি মাঝে মধ্যে সে রকম অপরাধজনক কাজও করবেন। তিনি শুধু তার সমযােগ্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কর্তব্য সম্পাদন স্বীকার করবেন। তিনি শিল্পী এবং কবি এবং দক্ষ ও পারদর্শী ব্যক্তিদের সুরক্ষা প্রদান করবেন, এবং তিনি এ কাজটি করবেন একজন উচ্চতর শ্রেণীর সদস্য হিসেবে। যােদ্ধাদের উদাহরণ থেকে মহৎ ব্যক্তি যে উদ্দেশ্যে লড়াই করছেন তার সঙ্গে মৃত্যুকে যুক্ত করে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করবেন। তিনি বিপুল সংখ্যায় প্রতিপক্ষীয়দের হত্যা করার ক্ষেত্রে প্রয়ােজনে অনমনীয় হবেন। তিনি কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলবেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতা এবং ধূর্তবুদ্ধি প্রয়ােগে পরান্মুখ হবেন না। তিনি অভিজাততান্ত্রিক উৎকর্ষের ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতার স্থান সম্বন্ধে পরিজ্ঞাত থাকবেন – ‘আমরা যেগুলােকে “উচ্চতর সংস্কৃতি” বলি সেগুলাে নিষ্ঠুরতার অধ্যাত্মকরণ ও তার গভীরায়নের উপরে স্থাপিত। মহৎ ব্যক্তি’ মূলত ইচ্ছাশক্তির প্রতিমূর্তি।’

নীটশের দর্শন নিয়ে বার্ট্রান্ড রাসেলের আলোচনা-সমালোচনা

রাসেল নীটশের দর্শনের আলোচনায় প্রথমেই বেশ কিছু প্রশ্ন তোলেন, যেমন – নিটশের মতবাদসমূহ সম্পর্কে আমাদের অভিমত কী? এসব মতবাদ কতটুকু সত্য? এসব মতবাদ কতটুকু প্রয়ােজনীয়? এসব মতবাদের মধ্যে কি কোনাে বস্তুনিষ্ঠতা আছে, অথবা এসব মতবাদ শুধুই নির্বল মানুষের শক্তির আকাশ-কুসুম কল্পনা? যাই হোক, তবে একথা অস্বীকার করা যায় না যে, নিটশের প্রভাব শুধু টেকনিক্যাল দার্শনিকদের উপরই ছিল না, সাহিত্যিক ও শৈল্পিক সংস্কৃতির মানুষের মধ্যেও প্রবলভাবেই ছিল। আমাদের অবশ্যই একথা স্বীকার করতে হবে যে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার উক্তিসমূহ উদারনৈতিক ও সমাজতান্ত্রিকদের চেয়ে প্রায় অধিকতর সঠিক ছিল। সে যদি শুধুই কোনাে রােগের লক্ষণ হয়, তাহলে আধুনিক জগতে সেই লক্ষণ খুব দ্রুত বিস্তারলাভ করবে। তবুও তার দর্শনে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যাকে একান্তই অতিআত্মম্নন্যতাগ্রস্ত ব্যক্তির চিন্তা বলে বাতিল করতে পারি। স্পিনােজার দর্শন সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একজন অসুস্থ সন্ন্যাস ছদ্মবেশধারী ব্যক্তির ব্যক্তিগত লজ্জা ও ভীরুতা কতখানি প্রতারণা করতে পারে তার উদাহরণ তিনি!’ ঠিক একই কথা তার সম্পর্কেও বলা যায়, তবে যেহেতু তিনি স্পিনােজা সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করতে দ্বিধাবোধ করেন তিনি তাই তার ক্ষেত্রে কথা কম অনিচ্ছাসহকারেই বলা যায়। একথা সত্য দিবাস্বপ্নে তিনি একজন যোদ্ধ, অধ্যাপক নন; আর তিনি যাদের প্রশংসা করেছেন তারা সকলেই সামরিক ব্যক্তি। অন্য সকল নারী সম্পর্কে তার অভিমত তার নিজস্ব আবেগেরই বাস্তব বহিঃপ্রকাশ। অবশ্য নারীদের সম্পর্কে এরূপ অভিমত ভয়েরই ব্যাপার। ‘তােমার চাবুকটি সঙ্গে নিতে ভলাে না’ – কিন্তু দশজনের মধ্যে নয়জন নারীই তার কাছ থেকে চাবুকটি ছিনিয়ে নেবে। একথা তিনি জানতেন বলেই নারীদের কাছ থেকে তিনি দূরে থাকতেন, এবং এ কারণে সত্য সত্যই তিনি নির্দয় ও নিষ্ঠুর মন্তব্য দ্বারা তার আহত অহমিকাকে শান্ত ও প্রশমিত করতেন।

তিনি খ্রিস্ট প্রেম-প্রীতি ভালােবাসাকে ঘৃণা করতেন, কারণ তিনি মনে করতেন এটি ভয় থেকে উদ্ভূত ; আমি ভীত যে আমার প্রতিবেশী আমাকে আঘাত করতে পারে, এবং সে কারণে আমি তাকে নিশ্চয়তা দেই যে, আমি তাকে ভালােবাসি। আমি যদি তার চেয়ে শক্তিশালী ও সাহসী হতাম, তাহলে আমি তাকে প্রকাশ্যে নিন্দা করতাম, আর আমি তাকে অবশ্যই নিন্দা করা অনুভব করি। নিটশের মনে একথা কখনাে উদয় হয় নি যে, একজন মানুষের প্রকৃত সর্বজনীন ভালােবাসা অনুভব করা উচিত, কারণ তিনি নিজে প্রায় সর্বদা সর্বজনীন ঘৃণা এবং ভয় অনুভব করতেন। তিনি এই ঘৃণা ও ভয়কে ঐশ্বরিক উদাসীনতার আনন্দের ছদ্মাবরণে প্রকাশ করতে চান। তার মহৎ ব্যক্তি নিজে একজন দিবাস্বপ্ন – তার নিজের মধ্যে কোনাে করুণা নেই, তিনি নির্মম-নির্দয়, তিনি ধূর্ত, নিষ্ঠুর। তিনি শুধু নিজের শক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন। উন্মাদপ্রায় অবস্থায় কিং লিয়ার (King Lear) বলেন, “প্রতিশােধ নেব আমি-/ কেমন কঠোর – এখনাে ভাবিনি।/ তবে অবশ্যই হবে রুদ্র ভয়ঙ্কর/ অদ্যাবধি যার রূপ জগৎ দেখেনি।” সংক্ষেপে এই হচ্ছে নিটশের দর্শন।

নিটশের মনে একথা কখনাে উদিত হয় নি যে, যে প্রবল ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার কথা তিনি বলেছেন তা ভয় থেকে সৃষ্টি। অথচ এই ক্ষমতা তিনি তার অতিমানবকে প্রদান করতে চান। যারা তাদের প্রতিবেশীকে ভয় করে না তারা তাদের অত্যাচার করারও প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন না। যে সব মানুষ ভয়কে জয় করেছেন তারা নিটশের ‘শিল্পীর স্বৈরাচার’ নিরাের (Nero) মতাে আত্মহারা ক্ষিপ্ত গুণ চান না। কারণ অনিবার্য প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে যখন জনগণের হৃদয় ভয় ও আতঙ্কে উৎকণ্ঠিত তখন এই নিরাে সঙ্গীত এবং ধ্বংসযজ্ঞ উপভােগ করেছিলেন। আমি একথা অস্বীকার করবাে না যে, অংশত তার শিক্ষার কারণে এই বাস্তব পৃথিবী তার দুঃস্বপ্নের মতাে পৃথিবীতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু তার দুঃস্বপ্ন আমাদের পৃথিবীকে কম ভয়াবহ করে তুলতে পারে নি।

একথা স্বীকার করতে হবে যে, এমন এক ধরনের খ্রিষ্ট নৈতিকতা রয়েছে যাতে অভিযােগ যুক্তিযুক্তভাবে প্রয়ােগ করা যেতে পারে। প্যাসক্যাল এবং দস্তয়ভস্কি – তার নিজস্ব দৃষ্টান্ত – তাদের সদগুণে এমন কিছু রয়েছে যা সেই সদগুণকে হীন করেছে। প্যাসক্যাল তার চমৎকার গাণিতিক বুদ্ধি তার ঈশ্বরকে উৎসর্গ করেন। এতে তিনি ঈশ্বরের উপর এক ধরনের বর্বর গুণই আরােপ করেছেন যা ছিল প্যাসক্যালের পীড়িত মানসিক অত্যাচারের মহাজাগতিক বিস্তৃতিকরণ, ‘উপযুক্ত’ গর্ববােধ দ্বারা দস্তয়ভস্কির কিছুই করণীয় ছিল না; অনুশােচনা করার জন্যই তিনি পাপকাজ করতেন এবং অপরাধ স্বীকারােক্তির বিলাসিতা উপভােগ করতেন। খ্রিস্টধর্মকে এ ধরনের বিপথগামিতা দ্বারা কতটুকু অভিযুক্ত করা যায় তা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে, কিন্তু সেদিকে না গিয়েও স্বীকার করা যায় দস্তয়ভস্কির চরম অবসন্নতার যে দিকটি নিটশে চিন্তা করেছেন তাকে বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো অনেকেই ঘৃণার যােগ্য বলে নিটশের সাথে ঐকমত্য পােষণ করেন। রাসেলও নিটশের সাথে তাল মিলিয়ে বলেন, উত্তম চরিত্রের উপাদানসমূহ হচ্ছে একধরনের ঋজুতা এবং গর্ববােধ এবং অহম্পূর্বিকা। তবে রাসেলের মতে নিটশের এরকম মতে পেছনে কাজ করেছে তার ভয়, এক্ষেত্রে তিনি বলেন, যেকোনাে সদগুণের মূলভিত্তি যদি ভয় হয়, তাহলে খুব একটা প্রশংসা করা যায় না। 

দুই ধরনের সাধু-সন্ত রয়েছে : প্রকৃতিগতভাবে সাধু-সন্ত এবং ভয় থেকে হওয়া সাধুসন্ত। প্রকৃতিগতভাবে সাধু-সন্তদের মানবজাতির প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত ভালােবাসা থাকে; তিনি জনগণের কল্যাণ করেন কারণ এ কাজ তাকে সুখ ও আনন্দ দেয়। অন্যদিকে ভয় থেকে হওয়া সাধু-সন্ত এমন মানুষের মতাে যারা শুধু পুলিশের ভয়ে চুরি করা থেকে বিরত থাকে, নরক-অগ্নির ভয়ে ভীত না করলে বা প্রতিবেশীর প্রতিশােধের ভয়ে ভীত না হলে অসৎ হবে। নিটশে শুধু মাত্র দ্বিতীয় ধরনের সাধু-সন্তের কথাই কল্পনা করেছেন। তিনি ভয় এবং ঘৃণা দ্বারা এমনভাবে আবদ্ধ যে মানবজাতির প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত ভালােবাসাকে তিনি অসম্ভব মনে করেন। ভয়হীন এবং অতিমানবের একগুঁয়ে গর্ববােধসহ তিনি এমন একজন মানুষের কথা চিন্তাও করতে পারেন নি যিনি কোনাে ইচ্ছা ছাড়াই দুঃখ বেদনা ভােগ করতে পারেন। আব্রাহাম লিংকন যা করেছিলেন তা তিনি নরকের ভয়ে করেছিলেন এমন কথা বলা যায়না, কিন্তু তবুও নিটশের নিকট লিংকন একজন কাপুরুষ, নেপােলিয়ান মহৎ ব্যক্তি। 

নিটশে নৈতিক দর্শন একটি প্রশ্নের জন্ম দেয় – “আমাদের নৈতিক আদর্শ কি অভিজাততান্ত্রিক হবে, নাকি সকল মানুষকে সমদৃষ্টিতে দেখবে?” এই প্রশ্নের খুব সুস্পষ্ট অর্থ নেই। তাই প্রথম পর্যায়ে আমাদের কাজ হবে বিষয়টিকে অধিকতর সুস্পষ্ট করা। প্রথমেই অভিজাততান্ত্রিক রাজনৈতিক মতবাদ থেকে অভিজাততান্ত্রিক নৈতিক আদর্শকে পৃথক করা যাক। বেনথামের (Bentham) সর্বাধিক সংখ্যক লােকের সর্বাধিক সুখের নীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তির একটি গণতান্ত্রিক নৈতিক আদর্শ আছে, কিন্তু তিনি মনে করতে পারেন একটি অভিজাততান্ত্রিক সরকার দ্বারাই সর্বোত্তমভাবে সর্বসাধারণের সুখ বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু নিটশের অবস্থানটি এ রকম নয়। তিনি মনে করেন, সর্বসাধারণের সুখের বিষয়টি অপরিহার্যভাবে শুভ-এর বিষয় নয়। যা কিছু স্বয়ং শুভ বা মন্দ তা শুধু স্বল্পসংখ্যক উচ্চশ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকে, অবশিষ্ট মানুষের ভাগ্যে কী ঘটে তার কোনাে মূল্য নেই। পরবর্তী প্রশ্নটি হচ্ছে – স্বল্পসংখ্যক উচ্চশ্রেণীর মানুষকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে? বাস্তবে তারা হচ্ছেন বিজয়ী জাতি বা উত্তরাধিকার সূত্রে অভিজাত সম্প্রদায়ের লােক, এবং অন্তত তাত্ত্বিক দিক থেকে হলেও অভিজাত সম্প্রদায়ের লােক বিজয়ী জাতির বংশধর। নিটশে সম্ভবত এই সংজ্ঞা গ্রহণ করবেন। তিনি আমাদের বলেন, ‘ভাল বংশে জন্মগ্রহণ ব্যতীত কোনাে নীতিপরায়ণতা সম্ভবপর নয়।’ তিনি বলেন যে, মহৎ জাতি সর্বদা প্রথমে বড় থাকে, কিন্তু অভিজাত সমাজের কারণে মানুষের প্রতিটি স্তরের উন্নতিসাধিত হয়। একথা সুস্পষ্ট নয় যে, নিটশে জন্মগতভাবেই অভিজাতদের শ্রেষ্ঠ হিসেবে অভি করেছেন, না-কি শিক্ষা এবং পরিবেশের কারণে শ্রেষ্ঠ হিসেবে অভিহিত করেছেন। যদি পরবর্তীটি সঠিক হয়, তাহলে একই সুবিধাপ্রাপ্ত সমযােগ্যতা অর্জনকারী ব্যক্তিদের বাদ দেওয়ার বিষয়টি সমর্থন করা কঠিন হবে এবং তার এরূপ অনুমান করাও সঠিক নয়। সুতরাং আমি অনুমান করবাে যে, গৃহপালিত মানবেতর প্রাণীদের তুলনায় আমরা যেমন মানুষদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি, ঠিক তেমনি বিজয়ী অভিজাত এবং তাদের বংশধরদেরকে তিনি জৈবিকভাবেই তাদের প্রজাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ হিসেবে গণ্য করেছেন। অবশ্য মানবেতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই শ্রেষ্ঠত্ব মাত্রাগতভাবে কম ‘জৈবিকভাবে শ্রেষ্ঠ’ বােঝাতে আমরা কী বােঝাবাে? নিটশের দর্শন ব্যাখ্যাকালে আমরা এর দ্বারা এ কথাই বােঝাবাে যে, অন্তত নিটশের অর্থে, শ্রেষ্ঠ জাতির ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের বংশধরগণ অন্যদের তুলনায় অধিকতর ‘মহৎ’, তাদের থাকবে অধিকতর ইচ্ছার শক্তি অধিকতর সাহস ও মনােবল, ক্ষমতার প্রতি অধিকতর প্রণােদনা বা প্রেরণা, কম করুণা ও সহানুভূতি, কম ভীতি এবং কম ভদ্রজনােচিত আচরণ। 

আমরা এখন নিটশের নৈতিকতা ব্যাখ্যা করতে পারি। যুদ্ধে বিজয়ী এবং তাদের উত্তরাধিকারিগণ সাধারণত পরাজিতদের চেয়ে জৈবিকভাবে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং এটি কাম্য যে, তারা সকল ক্ষমতার অধিকারী হবেন, এবং বিশেষ করে তাদের নিজস্ব স্বার্থে তারা সকল বিষয় দেখাশুনা করবে। এখানেও ‘কাম্য’ শব্দটি রয়েছে এবং এই শব্দটি আলােচনার অপেক্ষা রাখে। দার্শনিকের বাইরের মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে, নিটশে যা কামনা করেন তাকেই নিটশে ‘কাম্য’ বা ‘কামনার যােগ্য বলে অভিহিত করেন। এই ব্যাখ্যানুসারে নিটশের মতবাদকে এক বাক্যে অধিকতর সরলভাবে এবং সততার সঙ্গে ব্যাখ্যা করা যায় – ‘আমার ইচ্ছা আমি যদি পেরিক্লিসের এথেন্স বা মেডিচির ফ্লোরেন্সে বাস করতে পারতাম। কিন্তু এটি কোনাে দর্শন নয়; এটি কোনাে এক ব্যক্তির একটি জৈবিক ঘটনা। ‘কাম্য’ বা ‘কামনার যােগ্য’ শব্দটি ‘আমার দ্বারা কাম্য’ শব্দ সমষ্টির সমার্থক নয়। যতই অস্পষ্ট হােক না কেন এটির একটি দাবি রয়েছে, আর সেটি হচ্ছে সর্বজনীনভাবে আইনে প্রণয়ন করা। একজন ঈশ্বরবাদী বলতে পারেন যে, ঈশ্বর যা কামনা করেন তাই কামনার যােগ্য, কিন্তু নিটশে এরূপ বলতে পারেন না। তিনি বলতে পারেন যে, আমি জানি নৈতিক স্বজ্ঞা দ্বারা শুভ বলতে কী বােঝায়, কিন্তু তিনি এরূপ বলবেন না, কারণ, এটি অত্যন্ত কান্টিয় শক্তি বলে মনে হয়। ‘কাম্য’ বা ‘কামনার যােগ্য’ শব্দের সম্প্রসারণ অর্থ হিসেবে যা বােঝায় তারই আলােকে তিনি যা বলতে পারেন তা হচ্ছে, ‘মানুষ যদি আমার রচনাবলি পড়ে, তাহলে তাদের একটি অংশ সমাজ সংগঠন প্রসঙ্গে আমার কামনার অংশীদার হতে আগ্রহী হবে; আমার দর্শন এসব মানুষকে যে শক্তি এবং দৃঢ়সংকল্প করার ক্ষমতা দেবে তাতে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে। অভিজাত হিসেবে বা (আমার মতাে) অভিজাততন্ত্রের স্তাবক হিসেবে অভিজাততন্ত্রকে সংরক্ষণ বা পুনরুদ্ধার করবে। এভাবে তারা জনগণের সেবক হিসেবে যে ধরনের জীবনযাপন করবে। তার চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণ জীবনযাপনের ব্যবস্থা অর্জন করবে।’

নিটশের দর্শনে আরেকটি উপাদান রয়েছে, যা ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অমার্জিত ও রূঢ় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের দ্বারা উথাপিত অভিযােগের অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ। সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধে বিজয়ী ব্যক্তির এমন কিছু গুণাবলি থাকে যা নিটশে প্রশংসা করেছেন। এই গুণাবলি হচ্ছে সাহস, সম্পদের সম্ভাবনা সন্ধানে দক্ষতা, এবং ইচ্ছার শক্তি। কিন্তু এসব অভিজাত গুণের অধিকারী নয় (যারা সংখ্যায় অধিক্য) এমন মানুষ যদি সংঘবদ্ধ হয়, তাহলে ব্যক্তিগত হীনতা থাকা সত্ত্বেও তারা যুদ্ধে জয়ী হতে পারে। অভিজাতদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ উচ্ছল জনতার এই যুদ্ধে খ্রিষ্টধর্ম হচ্ছে ভাবাদর্শগত ফ্রন্ট, যেমন ছিল ফরাসি বিপ্লব ভাবাদর্শগত ফ্রন্ট। সুতরাং আমাদের উচিত হবে ব্যক্তিগতভাবে দুর্বলদের মধ্যে ঐক্যের বিরুদ্ধতা করা, এবং আমরা এর বিরােধিতা করবাে এই ভয়ে যে, তাদের সম্মিলিত শক্তি ব্যক্তিগতভাবে শক্তিমানদের পরাজিত করবে। অন্যদিকে আমাদের উচিত হবে জনসংখ্যার শক্তিশালী এবং পৌরুষদীপ্তদের মধ্যে ঐক্যের উন্নতিসাধন করা। এরূপ ঐক্যের প্রথম ধাপ সৃষ্টি হচ্ছে নিটশের দর্শন প্রচারের লক্ষ। ফলে দেখা যাবে যে, এতে নৈতিকতা এবং রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখা সহজ হবে না। নিটশের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বাস্তব যুক্তি রয়েছে। এই যুক্তিসমূহ থেকে দেখা যায় যে, তার উদ্দেশ্য অর্জনের চেষ্টা বাস্তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু অর্জন করবে। জন্মগতভাবে অভিজাত হওয়ার বিষয়টি আজকাল আর তেমন মর্যাদা প্রদান করে না। একমাত্র বাস্তবসম্মত অভিজাততন্ত্রের সংগঠন ফ্যাসিবাদী বা নাৎসি দলের মতাে সংগঠন এ ধরনের সংগঠন বিরােধিতাকে জাগিয়ে বা সক্রিয় করে তােলে, এবং এদের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ারই সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যদি এরা যুদ্ধে পরাজিত না হয়, তাহলে অবশ্যই পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এই পুলিশ রাষ্ট্রে শাসকগণ গুপ্তহত্যার ভয় নিয়ে জীবন অতিবাহিত করে, এবং বীরেরা বন্দীশিবিরে অবস্থান করে। এরূপ সম্প্রদায়ে বিশ্বাস এবং সম্মানের জীবনীশক্তির বিলােপন ঘটে, এবং ভাবী অতিমানবের অভিজাততত্ত্ব ভীরু কাপুরুষতায় শিউরে ওঠা স্বার্থান্ধ ক্ষুদ্র দলে পর্যবসিত হয়। অবশ্য এই যুক্তিসমূহ আমাদের বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রদান করা হয়েছে, অতীতে এসব যুক্তিকে ভাল বলে মনে করা হতাে না, কারণ তখন অভিজাততন্ত্র ছিল প্রশ্নাতীত। কয়েক সহস্রাব্দ যাবৎ মিশরিয় সরকার নিটশের নীতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছিল। আমেরিকান এবং ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের প্রায় সরকারই অভিজাততান্ত্রিক সরকার ছিল। সুতরাং আমাদের জিজ্ঞাসা করতে হবে, যে সরকারের এরকম একটি দীর্ঘ এবং সাফল্যের ইতিহাস রয়েছে তার পরিবর্তে গণতন্ত্রে অগ্রাধিকার প্রদানের কোনাে ভাল যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কি-না, অথবা আমরা যেহেতু রাজনীতি নয়, নৈতিকতা বিবেচনা করছি তাই যে নৈতিকতা দ্বারা নিটশে অভিজাততন্ত্রকে সমর্থন করেছেন তাকে বাতিল করার কোনাে বাস্তব কারণ আছে কিনা।

রাজনীতির বিপরীতে নৈতিকতার প্রশ্নটি সহানুভূতি-সমবেদনার প্রশ্ন। কেউ দুঃখকষ্ট পেয়ে অসুখী হলে আমরা সহানুভূতি প্রদর্শন করি। এই সহানুভূতি প্রদর্শন মানুষের সহজাত। কিন্তু বিভিন্ন মানুষের মধ্যে এই সহানুভূতির বিকাশে অত্যন্ত পার্থক্য রয়েছে। কিছু কিছু মানুষ অত্যাচার করে আনন্দ পায়; আবার অন্যেরা, যেমন, বুদ্ধ অনুভব করেন, যতদিন পর্যন্ত কোনাে জীবন্ত মানবেতর প্রাণীর মধ্যে দুঃখ থাকবে ততদিন তারা পূর্ণসুখ পেতে পারে না। অধিকাংশ মানুষ মানবজাতিকে আবেগের সঙ্গে বন্ধু এবং শক্র – এই দুই ভাগে ভাগ করে। তারা পূর্বোক্তদের জন্য সহানুভূতি প্রদর্শন করে, কিন্তু পরবর্তীদের জন্য করে না। যাই হোক, নিটশের দর্শন সহানুভূতির কোনাে প্রকার স্থান নেই, তিনি প্রায়ই সহানুভূতির বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছেন। এই জায়গাটিতেও রাসেল নীটশের সমালোচনা করেছেন। নীটশের বিপরীতে তিনি বুদ্ধকে দাঁড় করিয়ে বুদ্ধকেই সমর্থন করেছেন।

তথ্যসূত্র

  • অস্তিত্ববাদ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা : দর্শনে ও সাহিত্যে, নীরুকুমার চাকমা, অবসর প্রকাশ, ২০২০, ঢাকা, পৃ. ৭৩-৮৭
  • A History of Western Philosophy, Bertrand Russell, Routledge Classics 2004, ch. Nietzsche.
  • A Little History of Philosophy, Nigel Warburton, ch. The Death of God – Friedrich Nietzsche

1 Trackback / Pingback

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.