আধুনিকতাবাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতার ক্রিটিকাল প্রতিক্রিয়া

(সম্প্রসারিত হবে)

Table of Contents

আধুনিকতাবাদ

এনলাইটেনমেন্টের বিকাশ

রেনেসাঁর মাধ্যমে ইউরােপীয়রা নতুন করে জেগে ওঠে যা সূচিত হয় প্রাচীন গ্রিসের শিল্প, সাহিত্য ও দর্শন পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। ১৫শ শতাব্দীতে মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার সুগম করে দিয়েছিল নতুন নতুন ধ্যান ধারণা দ্রুত ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে। রােমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি হয় নতুন নতুন সংস্কারবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়, যারা সামগ্রিকভাবে প্রটেস্টান্ট নামে পরিচিত। এসব পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ১৮শ শতাব্দীর শেষার্ধে সংগঠিত হয় দুটি বড় ধরনের বিপ্লব যা ছিল প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক বিপ্লব। একটি হল ফরাসি বিপ্লব, অপরটি আমেরিকান বিপ্লব যা সংঘটিত হয়েছিল ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে এবং সেখানকার রাজতন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে বা ভেঙে দিয়েছিল। ততদিনে শিল্প বিপ্লবও ছড়িয়ে পড়েছে গােটা ইউরােপ জুড়ে। সামন্ত শ্রেণীর জায়গায় ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে নগরভিত্তিক একটি বুর্জোয়া পুঁজিপতি শ্রেণী, যারা ব্যাংক, শিল্পকলকারখানার মালিক। ১৮শ শতকেই ঘটে যায় চিন্তা জগতে আরেক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব যা আমাদের কাছে আলােকময়তা (এনলাইটেন্টমেন্ট) নামে পরিচিত। এর মাঝেই যুক্তি, বিজ্ঞান ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতাবাদের ভিত্তি রচিত হয়। আর এই বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমেই আধুনিকতা ধারণাটির সূত্রপাত হয়।

ইউরােপের চিন্তার জগতে ১৮শ শতক বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এ সময় বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়ােগের মাধ্যমে প্রাযুক্তিক নতুন নতুন আবিষ্কারের জোয়ার এনেছিলেন। খ্রিস্টধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাস নতুন চিন্তার আলােতে পরীক্ষিত হতে থাকে। সাধারণভাবে চিন্তার জগতে যে প্রবল আলােড়নের সৃষ্ট হয়েছিল তা থেকে তৈরি হয় নতুন প্রজন্মের দর্শন। প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়ে যুক্তি ও তথ্যের নিরিখে সমস্ত ধারণাকে যাচাই করার দর্শনের উদ্ভব হয়। নতুন জ্ঞান তথ্য আহরণ, যুক্তির প্রয়ােগ ও তথ্যকে প্রমাণের মাধ্যমে তা সত্য হিসেবে ধরা হয়।

আলােকময়তা আমাদের যে মানদণ্ড দেয় তার পরিমাপক হল বিজ্ঞান। এই সময়ে বস্তুবাদী দর্শনের উদ্ভব হয়। তথ্যকে যুক্তি প্রয়ােগ এবং বাস্তবতার নিতি বিশ্লেষণ করতে হত। আলােকময়তার এই সময়কে বলা হত বিজ্ঞানের নিয়ন্ত্ৰণবাদ। জার্মান তাত্ত্বিক য়ুর্গেন হেবারমাস বলেন যে, আধুনিক যুগের সকল হয় আলােকময়তার শুরু থেকে। তিনি বলেন যে, আলােকময়তার প্রকল্প অন্ধবিশ্বাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয়-বিশ্বাস ও অনুশাসনকে প্রত্যাখ্যান করে। আধুনিকতাবাদ বিষয়টি আলােচনা করতে গেলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে ‘আধুনিক’ বা মডার্ন কি এবং কাকে চিহ্নিত করবাে।

‘আধুনিক’ ও ‘আধুনিকতা’ এর চিহ্নিতকরণ

একটি পদ হিসেবে মডার্ন’ শব্দটি আবির্ভূত হয় ১৬শ শতকের শেষ দিকে. মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক রেমন্ড উইলিয়াম তার কি ওয়ার্ডস গ্রন্থে বলেছেন, মডার্ন শব্দটি যখন উদ্ভূত হয় তথন এটি বােঝাত বর্তমানকে। তার মানে আধুনিক শব্দের সাথে ইতিহাসের ধারণা যুক্ত। আধুনিক শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল অতীত থেকে বর্তমানের একটি সীমারেখা স্পষ্ট করে তােলার জন্য। অর্থাৎ অতীত থেকে বর্তমানের দূরত্ব বা পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য আধুনিক শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। অর্থাৎ আধুনিক শব্দের সাথে ইতিহাস, সময়, কাল সম্পূক্ত।

আধুনিকতা শব্দটি আধুনিকতাবাদ থেকে পৃথক যা ভিন্ন প্রেক্ষিতে ১৬৩০-১৯৪০ সালের সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক গতিবিধিকে নির্দেশ করে। আধুনিকতা টার্মটি বিভিন্ন বিষয়কে নির্দেশ করতে পারে। সাধারণভাবে ‘আধুনিকতা’ ২০ শতকের একটি ধারাকে নির্দেশ করে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে মােটামুটিভাবে ১৫০০-১৮০০ সালের মধ্যে। অনেকের মতে আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে ১৮০০ শতক হতে। এই মতানুসারে ১৯ শতকের শিল্পায়ন আধুনিকতার প্রথম পর্ব হিসেবে ধরা হয়, যেমন ২০ শতককে ধরা হয় দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে। ইউরােপীয়দের ইতিহাসকে তিনটি বৃহৎ পর্বে বা যুগে বিভক্ত করা হয়েছে। তা হল, ১. প্রাচীন যুগ; ২. মধ্যযুগ এবং ৩. আধুনিক যুগ।

আধুনিক যুগ বলা যেতে পারে পােস্ট-মেডিয়াভেল ইউরােপীয়দের ইতিহাসের সময় থেকে। সমসাময়িক ইতিহাস রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ের প্রেক্ষিতে বলা হয় আধুনিক যুগের সূচনা হিসেবে কোথাও ১৮৭০-১৯১০ ধরা হয় যা বর্তমানেও চলমান। আরাে নির্দিষ্ট করে বললে বলা হয় যে ২০শ শতাব্দীতে এর বিকাশকাল শুরু হয়। যদিও পরবর্তীতে আধুনিক সময়কাল ধরা হয় ১৮ শতক হতে। মডার্নিটি শব্দটি মডার্নিজম থেকে পাওয়া। এটা শিল্পের ক্ষেত্রে একটি গতিবিধি যা নতুন কিছুকে প্রকাশ করে এবং পুরাতনকে প্রশ্নের মুখে ছেড়ে দেয়। কিছু সাধারণ টার্ম মধ্য ১৪ শতকের পশ্চিমা ইতিহাসকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো হল, পুঁজিবাদের উত্থান (Rise of capitalism), সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের উদ্ভব (Emergence of Socialist Countries), প্রতিনিধিত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান (Institution of representative democracy), ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Individualism), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ভূমিকা (Icreasing role of science and technology), সামাজিক আন্দোলনের বিস্তার (Spread of social movements), নগরায়ন (Urbanization), গণ স্বাক্ষরতা ও গণ্যমাধ্যমের বিস্তার (Mass literacy and proliferation of mass-media), এবং শিল্পায়ন (Industrialization)। এই প্রেক্ষিতে আধুনিক সমাজ বিভিন্ন সময়ের মধ্য দিয়ে উন্নতি লাভ করেছে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে । মাধনিকতা সুনির্দিষ্ট পথ ধরে আমাদের কাছে এসেছে। এগুলো হলো – (১) ভৌগলিক আবিষ্কারের যুগ (The Age of Discovery), (২) রেনেসাঁ (The Renaissance), (৩) ধর্মসংস্কার আন্দোলন ও প্রতিসংস্কার আন্দোলন (The Reformation and the Reform), (৪) আলোকায়নের যুগ (The Age of Reason বা The Age of Enlightenment), (৫) রোমান্টিক যুগ (The Romantiic era), (৬) ভিক্টোরীয় যুগ (The Victorian era), (৭) আধুনিক যুগ (The Modern Era)। আধুনিকতার বিকাশে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংযুক্ত রয়েছে। এগুলো হল – ১. মুদ্রন যন্ত্রের আবির্ভাব (The arrival of the Printing Press), ২. ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ (The English Civil War), ৩. আমেরিকান বিপ্লব (The American Revolution), ৪. ফরাসি বিপ্লব (The French Revolution), ৫. ১৮৪৮ সালের বিপ্লব (The Revolution of 1848), ৬. রুশ বিপ্লব (The Russian Revolution), এবং ৭. প্রথম বিশ্বযুদ্ধদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (The First World War and the Second World War)। সাধারণভাবে ধারণা পাওয়া যায় যে এসব ঘটনাগুলাের মাধ্যমে ইউরােপের আধনিক সমাজ পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে। 

বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধুনিকতার দ্বারা পরিবর্তনের বিপ্লব ঘটে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১. সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারা (Sociological Thought), ২. রাজনৈতিক চিন্তাধারা (Political Thought), ৩. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (Science and Technology), 8. আবিষ্কার (Inventions), ৫. শিল্প (Industry), ৬. কল্যাণ (Welfare), ৭. সংস্কৃতি (Culture), ৮. শিল্প (The arts) এবং ৯. বিশ্ববিদ্যালয় (University)।

সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদ বিভিন্ন বিষয়াবলিকে সংঘবদ্ধ করে, যেমন –
১. কিছু নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশ্বের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয় এবং তা সকলের জন্য প্রযােজ্য, 
২. একটি জটিল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিল্পজাত দ্রব্য এবং বাজার অর্থনীতি এর ক্ষেত্রে, 
৩. একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা সংযুক্ত করে জাতি-রাষ্ট্র এবং ম্যাস ডেমােক্রেসি কে।এই সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে আধুনিকতা পূর্বের যেকোনাে সামাজিক শ্রেণী এর চেয়ে অধিক প্রাণবন্ত ও গতিশীল হয়। 

বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ব্যবহার আধুনিকতার অন্যতম মাপকাঠি। রাজনৈতিক বিপ্লবের চেয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপ্লবও আধুনিক পৃথিবীকে পাল্টে দিতে কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নি। বৈজ্ঞানিক বিপ্লব শুরু হয় কেপলার ও গ্যালিলিওর আবিষ্কারের মাধ্যমে এবং পরিপূর্ণতা লাভ করে নিউটনের ফিলােসফি ন্যাচারালিস প্রিনসিপিয়া ম্যাথমেটিকার মাধ্যমে। এরই মাধ্যমে প্রাকৃতিক বিশ্বকে অবলােকন করার পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়। প্রযুক্তির কারণে মানুষ নতুন নতুন আবিষ্কারে আগ্রহ দেখায়। বৈজ্ঞানিক এবং যান্ত্রিক আবিষ্কারসমূহ মানুষের স্বার্থ এবং মানব সমাজের সকল ক্ষেত্রে, যেমন, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক এবং বর্ণনামূলক সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, বৃটেনের আধুনিক যন্ত্রের কাপড় ও লৌহজাত পণ্য তৈরির কথা। পরিবহনের ক্ষেত্রে ঘােড়া এবং ষাঁড়ের ব্যবহারের গুরুত্ব কমে যায় পাওয়ার ইঞ্জিন, ট্রেন, জাহাজ এবং উড়ােজাহাজ আবিষ্কারের মাধ্যমে। শিল্পের কারণে পণ্য অতি দ্রুত উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে এবং তা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ব বাজারে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রগতির যাত্রা চলমান। টেলিফোন, রেডিও, এবারে, মাইক্রোসকোপ, বিদ্যুৎ এসব আবিষ্কার চিকিৎসা ক্ষেত্রে বড় ধরনের উন্নতি সাধন করে। আধুনিকতার মানে যুদ্ধকালীন অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে অর্থাৎ নতুন রাইফেল, পিস্তল, ট্যাঙ্ক, জেট প্লেন এবং মিসাইল আবিষ্কারের মাধ্যমে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আধুনিকতার ছােঁয়া দেখা যায়। ধর্মের ক্ষেত্রে আধুনিকতা নতুন মনােভঙ্গি নিয়ে আসে। এ সময়ে মানুষ চার্চের অধীনতা থেকে বেরিয়ে আসে, ব্যক্তি স্বাধীনতার তৈরি হয় এবং এর সাথে আরাে যুক্ত হয় যৌন স্বাধীনতা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে লিঙ্গের সমতা, নারী স্বাধীনতা আধুনিকতার কারণেই তা লাভ করা সম্ভব হয়েছে।

মানব ইতিহাসের এক পর্বকে ইতিহাসবিদরা আখ্যা দিয়েছেন আধুনিক কাল। হিসেবে। কখন এই আধুনিক পর্বের সূচনা হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। গত পাঁচশ বছর যদি আধুনিক কাল হিসেবে ধরা হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, এ সময়ে যে সব প্রবণতা দেখা যায় তার বৈশিষ্ট্য ঠিক এক রকম ছিল না। আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য হল –
১. সেকুলারিজম এবং যুক্তিবাদ;
২. এক ধরনের রাজনৈতিক অবস্থাকে আধুনিক বলা হয়েছে;
৩. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারকেও আধুনিকতার মাপকাঠি হিসেবে দেখা যায় এবং
৪. কারাে কারাে মতে, কম উন্নত দেশগুলাে সামাজিক পরিবর্তনের চেয়ে প্রক্রিয়ায় উন্নত দেশগুলাের ধরন-ধারণ অর্জন করে তাই আধুনিকতা।

মার্শাল বারমেন বলেন যে, আধুনিকতা হল এক ধরনের অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতা বাস্তবের কাজেই আধুনিকতা ও বাস্তবতা অভিন্ন। আধুনিক হওয়া মানে এমন একটা পরিবেশে নিজেকে আবিষ্কার করা যেখানে রয়েছে অনেকগুলাে অঙ্গীকার – অভিযাত্রার, ক্ষমতার, আনন্দের, উত্থানের, অন্ত জগত ও বহিবিশ্ব পরিবর্তনের। আবার একই সাথে রয়েছে আমাদের সমস্ত অর্জন, সাফল্য ও প্রগতির বিনাশের বার্তা। ‘আধুনিকতা’ কোনাে ধ্রুব বিষয় না, এটি চলমান। অর্থাৎ আজকে যাকে আমরা আধুনিক বলছি ২০ বা ৫০ বছর পর তাকে আমরা আধুনিক নাও বলতে পারি । ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানের মত সংস্কৃতির ইতিহাস তাত্ত্বিকরা এক ধরনের আধুনিকতার কথা বলেন। আগে মনে করা হত রেনেসাস উত্তর ইউরােপীয় শিল্প সাহিত্যে এই আধুনিকতার লক্ষণ দেখা যায়। এরপর বলা হলো ফরাসি বিপ্লব উত্তর কালের শিল্প সাহিত্য আধুনিকতার বাহক। এরপর ধরা হল উনিশ শতকের শেষ দিকে এর শুরু। তবে এভাবে কালানুক্রমিক ক্ৰম করা যায় যে, ১৮৯০-১৯৪০ এর মধ্যে ফ্রান্সে, ১৮৯০-১৯২০ এর মধ্যে জার্মানিতে, ১৯০০-১৯২০ এর মধ্যে রাশিয়াতে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে থেকে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল।

আধুনিকতাবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ

আধুনিকতাবাদ হল সেই আন্দোলন যা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে শিল্প সংস্কৃতিতে আধিপত্য বিস্তার করে। কিছু চিন্তক বলেছেন আধুনিকতাবাদ হল একটি একক সাংস্কৃতিক মনোভঙ্গি। বারমেনের মতে, আধুনিকতা হল একটি অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতা আধুনিকায়নের মাধ্যমে প্রবাহমান এবং যার মাধ্যমে উদ্ভব হয় আধুনিকতাবাদের। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে অভিজ্ঞতা কী? বারমেনের মতে তা হল, ব্যক্তির অসীম আত্মউন্নয়ন, আত্মবিকাশ, আত্মবিস্তার। আরভিং হাে আধুনিকতাবাদকে দেখেছেন প্রাক্তন শৈলীর বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ হিসেবে। আধুনিকতাবাদ কাজ করে দুই ভাবে, প্রথমত, বিষয়গত, এ ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদ মানবসত্তার মহিমা ও তার অফুরন্ত সৃষ্টিশীলতায় অঙ্গীকারবদ্ধ; এবং দ্বিতীয়ত, শৈলীগত, এ ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদ ঘােচাতে চায় দূরত্বকে, এই দূরত্ব হল মনােজগতে সমাজ সম্পর্কিত দূরত্ব। বিষয় বা শৈলী বা উভয়ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদের যে প্রত্যয় প্রতিফলিত হয় তার মূলে রয়েছে ১৯শ শতাব্দীর সমাজ জীবন। উভয় ক্ষেত্রেই আছে প্রতিক্রিয়া এবং সে প্রতিক্রিয়া শিল্পকলার ধ্রুপদী বােধ ও উপলব্ধির বিরুদ্ধে।

আধুনিকতার কেন্দ্র পশ্চিম হলেও তার বিস্তার ঘটেছে পৃথিবীর সকল প্রান্তে। আধুনিকতার বিকাশ হল প্রাতিষ্ঠানিক এবং প্রভাবের দিক থেকেও আধুনিকতা বিশ্বজনীন। আধুনিকতা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে বিয়ােজন করে বলা হয়। আধুনিকতাবাদ হল একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা মনােভঙ্গি। এই আধুনিক মনােভঙ্গি বলতে বােঝানাে হয়েছে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যাবলিকে যেগুলো হলো –

  • ১. নতুনত্ব, অর্থাৎ যা কিছু নতুন, যা প্রাক-আধুনিকতা তা থেকে ভিন্ন কিছু। আধুনিকতাবাদী আন্দোলন পুরাতনকে বর্জন করে আধুনিক ও প্রগতিশীল করতে চায়। 
  • ২. আধুনিকতাবাদী শিল্পীরা রাজনীতিতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাদের মতে রাজনৈতিক পরিবর্তন তখনই সম্ভব যখন পুরাতনকে ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়। 
  • ৩. জনসংস্কৃতি হতে দূরত্ব আধুনিকতাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আধুনিকতাবাদ হল একটি বিশেষ মনােভঙ্গি। আর এই বিশেষ মনােভঙ্গির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল সংস্কৃতির বিভাজন। সাধারণ মানুষের সংস্কৃতির সাথে আলােকিত বা আধুনিক মানুষের সংস্কৃতির বিভাজন। তাদের সংস্কৃতি ভাল ও উঁচু। ভাল সাহিত্য বলতে আমরা বুঝি এমন সাহিত্য যা সকলের জন্য। ভালর মানে হচ্ছে সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন ধরনের নিয়ম কানুন আছে তা অনুসরণ করবে। ভাল বা আধুনিক সাহিত্য অনেক বেশি নিয়মকেন্দ্রিক হবে। আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিকোণ মাত্রই গণসংস্কৃতিকে ‘নিম্ন সংস্কৃতি’ হিসেবে বিবেচনা করে এবং এগুলাে হতে দূরত্ব রচনা করে। আধুনিকতাবাদী আন্দোলন হচ্ছে যা অন্তর্নিহিত, যা গভীর সেটিকে ঘিরে, সারফেসকে ঘিরে নয়। অর্থাৎ আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিতে যা কিছু আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই এবং যা কিনা অন্তর্নিহিত বা বস্তুর আকার ও উপাদান এ দুটো বিষয় মিলে সত্য ও বাস্তবতা গঠিত হয়। আর সারফেস পুরাে সত্য না। সরফেস হল পারিবেশন মাত্র, অর্থাৎ সারফেস হল কোনাে ঘটনা বা বিষয়বস্তুকে আমি কীভাবে উপস্থিত করবে। কিন্তু আধুনিকতাবাদ সারফেসকে প্রাধান্য দেয় না। 
  • ৫. আধুনিকতাবাদের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হল, এটি নারীবাদীবর্ণবাদবিরোধীদের দ্বারা সমালােচিত। আধুনিকতাবাদ সকলকে অন্তর্ভুক্তকারী একটি মানব সত্তার কথা বলে। এর মতে পৃথিবীর সকল মানুষ এক এবং তাদের সম অধিকার রয়েছে। কিন্তু নারীবাদী এবং বর্ণবাদ বিরােধীদের সমালােচনা হল, আধুনিকতাবাদ সকলকে অন্তর্ভুক্তকারী মনুষ্য সত্তার কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে এটি যে সত্তাকে নির্মাণ করেছে তা হল নারীবাদীদের মতে পুরুষ এবং বর্ণবাদীবিরোধীদের মতে শ্বেতাঙ্গ পুরুষ এবং সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণীর প্রশ্নকে সামনে রেখে এই সত্তা হলো বুর্জোয়া শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। 
  • ৬. চিন্তকরা বলেছেন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ২০শ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন আধুনিকতাবাদী আন্দোলন যা ২০শ শতাব্দীর শিল্প, সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের যে বৈশিষ্ট্য এটিকে বিশিষ্টতা দান করে সেটি হল রােমন্টিকতাবাদের বিরােধিতা করা। রােমান্টিকতাবাদের উৎপত্তি হয় নতুন আধুনিক শিল্পভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠার সাথে সাথে। এই দৃষ্টিমতে শিল্প ভিত্তিক সমাজের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে দূরত্ব রচিত হচ্ছে এবং ঐতিহ্যের পতন ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে অবিশ্বাস, আনুগত্যহীনতা, প্রেম-ভালােবাসা, মায়া-মমতাহীনতার নতুন মূল্যবােধ জন্ম লাভ করছে। অপরপক্ষে পুরাতন ও ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন সেটিই হল রােমান্টিকতাবাদ। ১৯শ শতকের আন্দোলন হল রােমন্টিকতাবাদ এবং ২০শ শতাব্দীতে আধুনিকতাবাদ রােমান্টিকতাকে বর্জন করে একটি নতুন আন্দোলন হিসেবে শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়। 

আধুনিকতাবাদের সাথে উত্তর আধুনিকতাবাদ পদটি সম্পর্কিত। এই দুটি ক্রমান্বয়িক পর্ব নয়। অর্থাৎ আধুনিক যুগের পরবর্তী যুগ উত্তর আধুনিক নয়, কিছু লেখক মনে করেন যে এই শব্দ দুটির মধ্যে বিপরীতধর্মিতার চেয়ে ধারাবাহিকতা অনেক বেশি। ১৯৫০-৬০ সালের মধ্যে আমেরিকায় উত্তর আধুনিক শব্দটি চালু হয়। তখন উত্তর আধুনিকতা বলতে বােঝানাে হত প্রথম দিকের আধুনিকতা হতে বর্তমান আধুনিকতার দূরত্বকে । কিন্তু ৭০ দশক হতে উত্তর আধুনিকতা শব্দটি ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়। নব্য রক্ষণশীলরা দেখা দিলেন যারা ‘বিপর্যস্ত’ সংস্কৃতির বিপরীতে অতীত ও ঐতিহ্যের প্রবক্তা, অন্যদিকে আবির্ভূত হয় নতুন স্থাপত্যবাদীরা যারা আধুনিকায়নের অনাসৃষ্টিতে সােচ্চার।

আধুনিকতাবাদের সাথে উত্তরাধুনিকতার বিতর্ক

আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর আধুনিকতাবাদ পদ দুটিই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে বােঝায়। দুটি পদই ২০শ শতকে শিল্প, সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে খণ্ডিতকরণকে দেখে, কিন্তু এই দেখার মেজাজ ভিন্ন। আধুনিকতাবাদী আন্দোলনে উঁচু-নিচু সংস্কৃতির বিভাজন স্পষ্ট কিন্তু উত্তরাধুিনিকতাবাদী আন্দোলনে উঁঁচু-নিচু সংস্কৃতির বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করে, এটি রকমারি মিশ্রণ, চকরা-বকরা এসবকে সমর্থন করে। আধুনিকতাবাদ যে সার্বজনীন সাবজেক্ট তৈরি করেছিল, সেটিকে ইতিহাসের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাহলাে, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী মানুষ এবং যা কিছু অনাধুনিক তাকে প্রত্যাখ্যানকারী মানুষ। উত্তরআধুনিকতাবাদ এই মানুষ, বিষয় ও ইতিহাসের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। সংক্ষেপে এভাবে বলা যায় যে, উত্তর আধুনিকতাবাদ হল আধুনিকতাবাদের প্রতি প্রবলভাবে সমালােচনামনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি।

আধুনিকতাবাদের তর্ক-বিতর্কে তিনজন তাত্ত্বিকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তাদের মধ্যে একজন হলেন জার্মান তাত্ত্বিক ইয়ুর্গেন হাবারমাস (Jürgen Habermas, ১৯২৯- এখনো জীবিত)। অপর দু’জনকে হাবারমাস উত্তর-আধুনিকতাবাদী বলেছেন। এরা দু’জনেই ফরাসি। এরা হলেন জ্যাঁ ফ্রাসােয়া লিওতার (Jean-François Lyotard, ১৯২৪-৯৮ খ্রি.) এবং জ্যাঁ বদরিয়া (Jean Baudrillard, ১৯২৯-২০০৭  খ্রি.), প্রথম জন হচ্ছেন দার্শনিক, এবং দ্বিতীয়জন হচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানী। হাবারমাস সম্ভবত ৮০ কিংবা ৮২ এর দিকে একটি প্রবন্ধ লেখেন যেটিতে তিনি ফরাসি চিন্তকদের বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপন করেন। তার মধ্যে অবশ্যই বদরিয়া, লিওতার, মিশেল ফুকো এবং জ্যাক দেরিদা ছিলেন। হাবারমাসের বক্তব্য হল আধুনিক কাল বিশেষ করে আলােকময়তার যে অবদান ঐতিহ্য, অন্ধবিশ্বাস এগুলাে পরিত্যাগ করলে এবং ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, সংকীর্ণ স্বার্থ হতে মুক্ত ব্যক্তি যুক্তিবিদ্যা, যুক্তিশীলতা প্রয়ােগের মাধ্যমে সমাজের সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারবে এবং সমস্যা মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে পারবে। তিনি বলেন যে আলােকময়তা বা এনলাইটেনমেন্টের কারণে আমরা নানাভাবে উপকৃত হয়েছি। নানা ধরনের যুদ্ধ, গণহত্যা ঘটে থাকলেও প্রগতির যাত্রা শেষ হয়ে যায়নি। তিনি বলেন, হতে পারে আলােকময়তার যাত্রা অসম্পূর্ণ, তবে এটা নিশ্চিত আমরা উপকৃত হয়েছি। তিনি বলেন, মানুষ মাত্রই যুক্তিবাদী। সে নিপীড়িত হলে অবশ্যই নিপীড়ন মুক্ত হতে চায়। বিজ্ঞানের সাহায্যে, উচ্চতর চিন্তা-ভাবনার সাহায্যে মানুষ নিপীড়ন মুক্ত হতে চায়, লিওতার, বদরিয়া, ফুকো, দেরিদাকে তিনি ইয়ং কনসারভেশন বলেছেন। হাবারমাসের লেখার উত্তরে লিওতার্দ দ্যা পােস্ট মর্ডান কন্ডিশন এ রিপাের্ট অন নলেজ নামক একটি বই লেখেন। লিওতার্দ হাবারমাসের প্রেক্ষিতে বলেন যে, আলােকময়তা কিছু মহাবয়ান বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। এই বয়ানগুলাে প্রচণ্ড শক্তিশালী। এই আন্দোলনে যুক্তিবাদী ধারণাগুলাে যেমন, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী ইত্যাদি ধারণাগুলাে শক্তিমত্তা অর্জন করে। তিনি বলেন যে, এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভগুলাে দাবি করে যে সমগ্র বিশ্বে যা কিছু ঘটছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সবকিছুর ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে, মূলত পারে না। লিওতারের বক্তব্য হল, বাস্তব আরাে জটিল আরাে বহুবিধ এবং সত্যও বহুবিধ। তিনি বলেন কোনাে বিশেষ সংঘাতের ক্ষেত্রে নানাবিধ যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে তা সামনে নিয়ে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মীমাংসিত উত্তরের বিপক্ষে লিওতারের কথা হল বিভিন্ন অবস্থান হতে সত্যাকে বুঝতে হবে, একটি বিষয়ে সত্য পরবর্তীতে সেটি সত্য নাও হতে পারে। লিওতারের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদ বিবিধতা মুছে ফেলে, এটি সমরূপতা ও অখণ্ডতা তৈরির চেষ্টা চালায়। লিওতার বারবার মেটা-ন্যারেটিভ বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহাবয়ানের ওপর গুরুত্বারােপ করেন। তিনি এটির প্রতি সন্দিহান। তিনি বলেছেন, এই মহাবয়ানসমূহ তাদের বিশ্বাসযােগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। উত্তর আধুনিকতাবাদীর দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই বিশ্বাসহীনতা এবং বিবিধতার ওপর গুরুত্বারােপ। সত্য বহুবিধ এবং সত্য উপলব্ধিতে অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বদরিয়ার প্রসঙ্গে আসা যাক। তিনি বলেন যে, আধুনিকতাবাদে বাস্তব এবং অবাস্তবের বিভাজন রেখা স্পষ্ট ছিল। এই দুটির মধ্যে পার্থক্য দাঁড় করানাের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। যেমন, ভূত দেখা, এটি বিজ্ঞান সম্মত নয় বিধায় এটা বাস্তব নয়। বদরিয়ার বক্তব্য হচ্ছে যে, বর্তমানের সমাজ জীবনে সিনেমা, টিভি, বিজ্ঞাপনের ইমেজসমূহের সর্বব্যাপী প্রভাবের কারণে বাস্তব এবং অবাস্তব, সত্যি-কল্পিত, আসল-নকল, সারফেস-গভীর এসবের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে গেছে। এর ফলে আমরা একটি হাইপার রিয়েল কালচার পাই। যেখানে দুইয়ের ভিন্নতা ক্ষয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা প্লাস্টিক সার্জারির কথা বলতে পারি। প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে আমরা আমাদের জন্মসূত্রে পাওয়া রূপের পরিবর্তন আনতে পারি। যেমন নাকটা পছন্দ হচ্ছে না, তা প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে ঠিক করে নিতে পারি। এই প্রেক্ষিতে বদরিয়া বলেন যে বাস্তব এবং পরিবেশন এই দুয়ের মধ্যে যে সুস্পষ্ট বিভাজন ছিল সেটি উত্তর-আধুনিকতা সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞাপন, সিনেমা এসবের প্রভাবে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। বদরিয়া খুব বিতর্কিত বুদ্ধিজীবী। তার সবচেয়ে বিতর্কিত কথা ছিল উপসাগরীয় যুদ্ধ সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন এ যুদ্ধ আসলে ঘটে নি সম্ভবত যা ঘটেছিল সেটি ছিল টেলিভিজুয়াল বাস্তবতা বা একটা টেলিভিশন যুদ্ধ।

উত্তর আধুনিকতাবাদের সমালােচনা প্রসঙ্গে তালাল আসাদের বক্তব্য হল, কোনাে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ নেই, এর মাধ্যমে উত্তর আধুনিকতাবাদীরা পুঁজিবাদের ইতিহাসকে অস্বীকার করেন। তিনি আরাে বলেন, উত্তর আধুনিকতাবাদীরা বার বার খণ্ডিতকরণ, স্থানিকতা, একাধিক সত্য ও বহুবিধতার ওপর গুরুত্ব আরােপ করে। কিন্তু এ ধরনের বিশ্লেষণে উপেক্ষিত হয় কীভাবে বিশেষ সত্য বিশেষ সময়কালে সৃষ্ট। এটি সম্ভব হয় অসম ক্ষমতার দ্বারা। যেমন, একটি ধনী দেশের ওপর একটি গরিব দেশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারী করতে পারে না। বিষয়টি যতরকম দৃষ্টিকোণ হতেই দেখি না কেনাে সত্য বদলায় না।

উপমহাদেশে আধুনিকতাবাদ-উত্তরাধুনিকতাবাদ বিতর্ক

উপমহাদেশের উত্তরাধুনিকতাবাদীরা বলছেন, মডার্ন হল বিশ্ব আয়তনিক একটি নাটক যা ইউরােপ আমেরিকার মঞ্চে অভিনীত হয়েছে, এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হল আধুনিক মানুষ এবং আধুনিক শিল্প তার চালিকা শক্তি; আধুনিকতাবাদ হল প্রাচ্যের ওপর পশ্চিমের চাপিয়ে দেয়া একটা প্রকল্প, আধুনিকতার নামে তারা আমাদের মননে মগজে কিছু সরসরি উন্নতি করেছে, তারা আমাদের শিখিয়েছে উন্নত-অনুন্নত, সুন্দর-অসুন্দরের শ্রেণীবিন্যাস এবং তাদের মাধ্যমেই আমরা আধুনিক, প্রগতিশীল, বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ হয়ে উঠছে; আধুনিকায়নের নামে তারা আমাদের এমনভাবে হেজিমোনাইজড করে রেখেছে যে, আমরা মানে প্রাচ্য দিন দিন তার ভােক্তায় পরিণত হচ্ছি। এর উদাহরণস্বরূপ আমরা বলেত পারি, ইউনিলিভার এর একটি পণ্য ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ এর বিজ্ঞাপনে দেখা যায় যে, একটি মেয়ে কালো তাই তার চাকরি হয় না। কিন্তু যখনই সে ফেয়ার এন্ড লাভলি ব্যবহার করছে তখনই তার চাকরি হয়ে যায়। তার কোন কোন অংশকে আমরা আধুনিক হিসেবে চিহ্নিত করবো। আমাদের অতীতের কোনাে রেনেসাঁ, কিংবা আলােকময়তা চোখে পড়ে না। তারপরও আধুনিকতার নামে আমরা অন্ধ, যে আধুনিকতা পশ্চিম উৎপাদন করছে এবং আমরা পুনরুৎপাদন করছি। রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক কবি বলা হয়। তিনি তার সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে পুরােপুরি পশ্চিমা কাঠামােকে অনুসরণ করেন নি। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে তিনি পশ্চিমা কাঠামাে বা আধুনিক সাহিত্যের যে রীতিনীতি এবং স্থানীয় রীতিনীতির সংমিশ্রণে তার সাহিত্য রচনা করেছেন। ফলে তার সাহিত্যে স্থানীয় আধুনিকতার প্রকাশ দেখা যায়, স্থানীয় আধুনিকতার প্রকাশ দেখা যায়, স্থানীয় আধুনিকতা হল স্থানীয় কোনাে বিষয়কে পশ্চিমা ঢং-এ উপস্থাপন করা অর্থাৎ স্থানীয় সংস্কৃতি এর সাথে পশ্চিমা সংস্কৃতি এর সংমিশ্রণ যা ফিউশন নামেও পরিচিত। যেমন, কুচি কেটে শাড়ি পরা। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী লেখকরা আধুনিকতার প্রচার করেছেন। কিন্তু তারা অন্ধভাবে পশ্চিমা কাঠামােকে অনুসরণ করেছে।

এদিকে আধুনিকতাবাদীরা দেখান, আধুনিকতার দ্বারা আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি। এটি চিকিৎসা শাস্ত্রের অভূতপূর্ব উন্নতি জীবন যাপনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে, এর মাধ্যমে মানবতার বিষয়টি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এর মাধ্যমেই দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি, সেচ যন্ত্র ও পাওয়ার টিলার আবিষ্কারের মাধ্যমে ফলন বেড়ে প্রায় ১০ গুণ হয়েছে। বিদ্যুতের আবিষ্কারের কারণে আমরা অনেক আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করতে পারছি। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, ফ্যাক্স, প্লেন, উড়ােজাহাজ ইত্যাদি। আবিষ্কারের ফলে আমরা পৃথিবীর একস্থান হতে অন্য স্থানে অতি দ্রুত যােগাযােগ করতে পারি। প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কারের কারণে মানুষের লাইফ স্টাইল পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে উন্নতর জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্ব

আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্বের আলোচনায় সমস্যা ও আধুনিকতাবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য

নন্দনতত্ত্বে আধুনিকতাবাদের আলোচনায় মূলত দুরকমের সমস্যা দেখা যায় –
(১) চিত্রকলা, সাহিত্য, স্থাপত্য সব বিভিন্ন শিল্পকর্মে আধুনিকতাবাদের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
(২) একেক রকম শিল্পের ক্ষেত্রে একেক সময়কে আধুনিকতাবাদের সূত্রপাত হিসেবে ধরা হয়, যেমন সঙ্গীতে ধরা হয় আধুনিকতার উদ্ভব ১৯শ শতকের শেষ দিকে, ইংরেজি সাহিত্যে ২০শ শতকের প্রথম দুই দশকে, চিত্রকলায় ১৮৬০ এর দশকে ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট আন্দোলন থেকে ২০শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকার বিমূর্ত প্রকাশবাদের শীর্ষ সময় পর্যন্ত। কারও মতে, ১৮শ শতকের শেষ প্রান্তসীমায় আধুনিকতার শুরু।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে শিল্প সাহিত্যের সব শাখায় আধুনিকতাবাদের কি কোন সাধারণ বৈশিষ্ট্য নেই? থাকলে তা কী? এক্ষেত্রে তিনটি বৈশিষ্ট্যকে সামনে আনা যায় –
(১) ক্লাসিকাল শিল্পের ঐতিহ্যের অনুসরণে অনীহা প্রকাশ করে নতুন দৃষ্টিকোণ, আদর্শ, শৈলীর জন্ম দিতে চাওয়া,
(২) যা কিছু প্রাচীন ও প্রাসঙ্গিকতাহীন, সেসবের অস্বীকার, যেমন আধুনিক ইতিহাসে প্রাচীন গ্রিস ও রোমের ইতিহাস বাদ পড়ে যাওয়া, আধুনিক ভাষায় ল্যাতিন বাদ, কিন্তু যেসব প্রাচীন ভাষা রূপান্তর ও পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটের সঙ্গে খাপখাইয়ে ব্যবহারযোগ্য তাদের অন্তর্ভূক্তি,
(৩) কেবল বর্জন নয়, অতীতকে রূপান্তর ও পরিমার্জনের মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক করে তোলা।

এই সাধারণ ও বিস্তৃত সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে শিল্পতত্ত্বের কাঠামো বা নির্দেশক হিসেবে আধুনিকতাকে তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।

আধুনিকতাবাদের তিনটি দৃষ্টিকোণ

১. চার্লস বোদেলেয়ার এবং শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ হিসেবে আধুনিকতাবাদ

এই দৃষ্টিকোণে আধুনিকতাবাদকে ১৯শ শতকের মাঝামাঝি থেকে ২০শ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাশ্চাত্য সংস্কৃতি শনাক্তকরণের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়েছে। পাশ্চাত্যের এই সংস্কৃতি তৈরি হয় শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে, তাই এই ব্যাখ্যায় আধুনিকতা হল এইসময়কার নতুন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অবস্থার উদ্ভবের প্রেক্ষিতে কিছু প্রবণতা ও প্রভাব, এবং এগুলোর ফলে মানুষের প্রতিক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গি (পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ)। এক্ষেত্রে আধুনিকতা একটি বাস্তব অবস্থা বা অবজেক্টিভ কন্ডিশন, এখানে আধুনিকীকরণের উদ্দেশ্য হল মানুষের জীবনে এগুলোর প্রভাব বিস্তার। শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচন, ব্যবহার পদ্ধতি, শৈলি ও আঙ্গিকে এর প্রভাব দেখা যায়। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়ায় তার প্রতিফলন আসে, তাতে কিছু প্রতিষ্ঠানের, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, মিউজিয়াম, বাজারের রিতিনীতি ও অগ্রাধিকার পাল্টে যায়।

চার্লস বদেলেয়ার তার ‘পেইন্টার অফ মডার্ন লাইফ’ প্রবন্ধে আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যময় চরিত্রকে অনুধাবন ও আত্মস্থ করায় জোর দেন, যেখানে এই চরিত্রগুলো হল তার কাছে, ক্ষণস্থায়ী, পলাতক, আকস্মিক ও শিল্পের সেই অর্ধেক অংশ যার বাকি অংশ চিরায়ত ও অপরিবরতনশীল। অর্থাৎ তিনি সমসাময়িক কালের বিষয় ও ঘটনাবলির সাথে সাযুজ্য স্থাপন ও উপলব্ধির প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যেমন ম্যানের ১৮৬৩ সালে আঁকা ‘অলিম্পিয়া‘ যেখানে তিৎসিয়ানো বা জিওর্জিনো যেভাবে ক্লাসিকাল পদ্ধতিতে ভেনাসকে শায়িত অবস্থায় দেখাতেন তার বিপরীতে সমসময়ের প্রেক্ষিতে পরিমার্জন করে নতুন ভঙ্গিমায় ভেনাসকে দেখানো হয়েছে, এছাড়া নগ্নিকা হিসেবে দেখানো হয়েছে, অর্থ হল আধুনিকতার ফলে নারী যে আরও বেশি করে বাজারের পণ্যে পরিণত তা দেখানো। আধুনিক জগতে ভেনাস ভালোবাসার দেবি, কিন্তু বাজারের লেনদেনের মাধ্যমে সৃষ্ট চরিত্র হিসেবে ভালোবাসার পাত্র হিসেবে নয়। এই প্রদর্শনীর পরেই বদেলেয়ার ‘নারী ও বেশ্যা’ প্রবন্ধ যোগ করেন। উপরের ব্যাখ্যায় আধুনিকতাকে দেখা হয়েছে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেখানে এটি হল সমাজের নতুন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফল।

২. ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ এবং সাংস্কৃতিক জীবনের একটি প্রধান প্রবণতা হিসেবে আধুনিকতাবাদ

আধুনিকতাবাদকে বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে না দেখে সাংস্কৃতিক জীবনের একটা প্রধান প্রবণতা হিসেবেও দেখা হয়েছে। এর ফলে সংস্কৃতির কোন কোন বৈশিষ্ট্য জীবন্ত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ (বা বিশেষ) তার মূল্যায়নের প্রচেষ্টা হয়েছে। এসবের ভিত্তিতে ক্লাসিক্যাল, সংরক্ষণশীল শ্রেণী (ধর্মীয় শ্রেণী), জনপ্রিয় শিল্প (পপ কালচার) ও একাডেমিক শিল্পের থেকে পৃথক করে উচ্চমার্গীয় শিল্প বা হাই আর্টকে যাতে শনাক্ত করা যায়, আধুনিকতা সেই প্রবণতা ও আদর্শের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই পৃথকীকরণের মতবাদের প্রধাণ প্রবক্তা ছিলেন মার্কিন সমালোচক ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ। তিনি ১৯৩৯ সালে আভাঁ গার্দ (Avant-garde) ও জগাখিচুরি বা কিচ (Kitsch) শিল্পের মধ্যে পার্থক্য করেন। কিচ বলতে নগরকেন্দ্রিক সস্তা জনপ্রিয় শিল্পকে যেমন বুঝিয়েছেন, একাডেমিক আর্টকেও এখানে অন্তর্ভূক্ত করেন। তার বিশ্বাস ছিল, আভাঁ গার্দ শিল্পই অগ্রগতির ভরসা। শিল্পের ক্ষেত্রে আধুনিকতাকে এই দুই শ্রেণী – আভাঁ গার্দ ও কিচ ফেলে আধুনিকতা যেসব ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত নয় তার উপরে জোড় দিয়েছেন। এখানে আধুনিকতা বা মডার্নিজমের সাথে আধুনিকত্ব বা মডার্নিটির পার্থক্য চলে আসে। আধুনিকত্ব সমসাময়িক সংস্কৃতি থেকে নির্যাস গ্রহণ করে ও তার সঙ্গে অংশ ভাগ করে নেয়, এর মাধ্যে কিচও থাকে। অন্যদিকে আধুনিকতাবাদ বা মডার্নিজম তাই হবে যা সংশ্লিষ্ট শিল্প মাধ্যমের অন্তর্গত বা তার চর্চার সাথে সম্পর্কিত। এভাবে দেখলে আধুনিকতাবাদ আধুনিকত্বের বিস্তৃত ও বিশদ অভিজ্ঞতার বিষয়াদির প্রতিনিধিত্ব করে।

অতীতে শিল্প-সাহিত্যের যে নন্দনতাত্ত্বিক মানদণ্ড ছিল, সেগুলো ছিল কোন না কোন মানুষের কল্পনা ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক যোগ্যতার ফল। কোন নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মানুষের এই কল্পনাগত বা অভিজ্ঞতাগত যোগ্যতা অপরিবর্তনীয়, তাই তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নন্দনতাত্ত্বিক মানদণ্ডও কোন নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অপরিবর্তনীয়। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে মানদণ্ডটির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের যে শর্তগুলো থাকে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সেগুলোর পরিবর্তন হয়, যেহেতু ইতিহাস পরিবর্তনশীল। তাই কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে আগে যে শিল্প তৈরি সম্ভব ছিল, একই মানদণ্ডে সেই শিল্প তৈরি করা গেলেও সেই মানদণ্ডের পেছনে যে শর্তগুলো, তার মূল্যবোধ রয়েছে সেটার অভাবের কারণে প্রকৃতপক্ষে সেই শিল্পটির পুনর্নির্মাণ আর সম্ভব হয়না। তাই শিল্পসাহিত্যকে যদি আধুনিকতা ধারণ করতে হয় তবে সেজন্য তাকে (১) তার নিজের পরম্পরা বা ঐতিহ্যকে ধারণ করতে হবে (পূর্বের নন্দনতাত্ত্বিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে শিল্পের পুনর্নির্মাণের বদলে), (২) তাকে নিজের মৌলিকত্বকে প্রমাণ করতে হবে (যার মাধ্যমে এটি নিজেকে অন্যগুলোর থেকে আলাদা করতে পারবে)।

গ্রিনবার্গের মতে, শিল্পের কোন শাখার আধুনিকতা সমসাময়িক কালের চিন্তাভাবনাকে সেটি কিরকম বা কতটুকু ধারণ করছে (এংগেজমেন্ট) তার উপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে স্বয়ংক্রীয় ও স্বসমালোচিত (সেলফ ক্রিটিকাল) পদ্ধতির উপর (এর ফলে এটি উপরের দুটি শর্তকে পুরণ করতে পারবে)। আধুনিকত্বের প্রয়োগে শিল্পের অগ্রগতি হয়না, সেটি বরং একটি শর্ত হয়ে দেখা যায়। এই স্বসমালোচিত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিধ্বংস করার জন্য নয়, বরং শিল্পটির যোগ্যতাকে আরও দৃঢ় করার জন্য” কোন শিল্পের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য বা প্রচলিত পদ্ধতি দিয়ে তার সমালোচনা করাই আধুনিকতা। এভাবে দেখলে আধুনিকতা হল, আধুনিকের সর্বব্যাপী প্রভাবের মুখোমুখি হয়ে তাকে উপেক্ষা না করে শিল্প মাধ্যম বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি নন্দনতাত্ত্বিক মানদণ্ড অর্জনের প্রয়াস। গ্রীনবার্গের কিচ আধুনিক কিন্তু আধুনিকতাবাদ নয় কারণ এটি স্বসমালোচনাপ্রসূত নয় তাই মৌলিক নয়। আধুনিকতাবাদী হতে হলে কোন শিল্পকর্মের নিদর্শনকে এর উদ্দেশ্য ও সেই শিল্প মাধ্যমের চাহিদার ভিত্তিতে স্বসমালোচনায় ব্যাপৃতির ওপর জোর দেয়া হয়। সেই সাথে সেই সময়কার পূর্ববর্তী দৃষ্টান্ত ও চর্চার প্রেক্ষিতে আধুনিকতাবাদ মৌলিকত্বও প্রতিষ্ঠিত করে।

গ্রিনবার্গের কাছে ম্যানের অলিম্পিয়া আধুনিক তাতে আধুনিক জীবনের প্রতিফলনের জন্য নয়, বরং এর উপরিভাগ বা সারফেসে প্রকাশভঙ্গিমার সততা ও স্পষ্টবাদিতার জন্য। গ্রিনবার্গের মতে পেইন্টিং এর সমতলবিশিষ্টতা বা ফ্লাটনেস ও দ্বিমাত্রিকতার যে বৈশিষ্ট্য তার সাথে অন্য কোন মাধ্যমের মিল নেই, পেইন্টিং তা অন্যদের সাথে ভাগও করে না। ফ্লাটনেস পেইন্টিং এর অনন্য বৈশিষ্ট্য হওয়ায় উপরিভাগের গুরুত্বের সহজ স্বীকৃতি হয়ে দাঁড়ায় স্বসমালোচনাক্ষম পেইন্টিং এর লক্ষ্য। এক্ষেত্রে অলিম্পিয়ার তাৎপর্য সমাজতাত্ত্বিক বা মনস্তাত্ত্বিকভাবে সমসাময়িক বিষয় হিসেবে দর্শক বা খদ্দের ও বারবণিতার মুখোমুখি হওয়ায় নয়, বরং চিত্রকর্মের মায়া বা ইল্যুশন ও সারফেসের অলঙ্করণের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সমর্কে। অর্থাৎ চিত্রকর্মটির স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয় এর ভেতরের মায়া সৃষ্টি ও সারফেসের ফ্লাটনেসের মধ্যবর্তী সম্পর্কের নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বা দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। এটি যুগ চরিত্রের নীরব সাক্ষী কিনা এই প্রশ্ন তোলা সমিচীন নয়, বরং এই চিত্রকর্ম নন্দনতাত্ত্বিক বিষয় ও সমস্যা (আঙ্গিক, স্টাইল) মোকাবেলার পর শিল্পকর্ম হিসেবে কী দাঁড়ায় সেই বিষয়ে সাক্ষী দেয়। আধুনিকতাবাদ তাই নতুন বিষয়ের উপস্থাপনা নয়, তার জন্য ব্যবহৃত নতুন শৈলী বা স্টাইলও বটে।

৩. মরিস ডেনিস ও অন্যান্যদের সমালোচনার দৃষ্টিকোণ

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিকতার অন্তর্গত সমালোচনার ভঙ্গির উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক্ষেত্রে একজন আধুনিকতাবাদী শিল্পী বা সাহিত্যিক নয়, তিনি একজন সমালোচক যার মধ্যে তার বিচারবুদ্ধি ও শিল্প সম্বন্ধে গড়ে ওঠা তার বিশেষ শ্রেণীর ধারণা, বিশ্বাস ও মানদণ্ডের প্রতিফলন দেখা যায়। সমালোচনার এই দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে আধুনিকতাবাদ ফ্রান্সে ১৯শ শতকে শিল্প সমালোচনার একটি ধারার সৃষ্টি করেছিল যার পথিকৃৎ হলেন মরিস ডেনিস। পরে বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে ইংল্যান্ডে ক্লাইভ বেল, রজার ফ্রাই ও আর এ উইলেনস্কির লেখায় ও ১৯৩০ থেকে ১৯৬০ এর দশকে আমেরিকায় ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গ ও মাইকেল ফ্রায়েডের রচনায় এই ধারা উৎকর্ষ লাভ করে। গ্রিনবার্গ ও ফ্রায়েডের আধুনিকতাবাদ ছিল মূলত ভাষ্কর্য ও পেইন্টিং এর নতুন শিল্পরূপে প্রতিফলিত। এই শিল্পরূপ একইসাথে সচেতনভাবে আধুনিক ও গুণগতভাবে তাৎপর্যময়, যার সাথে তাদের প্রসঙ্গে সমালোচনাও জড়িত। তারা আধুনিকতাবাদী বলতে যা বুঝেছেন তা ছিল আধুনিক শিল্পকর্মের উপাদান, বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা, যা আধুনিক শিল্পীদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছিল। ম্যানে, সেজাঁ, পিকাসো, মাতিস, মিরো, পোলোক, নোলান্ড প্রমুখের চিত্রকর্মের মধ্যে সাধারণ সম্পর্ক ছিল এসব উপাদান বা প্রবণতার মাধ্যমে, যে সমালোচনাপদ্ধতির মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করা হয় সেখানে নয়। (মানে সমালোচনাপদ্ধতি বিভিন্ন রকমের হতে পারে, কিন্তু এগুলোর আধুনিকত্ব, উপাদান, বৈশিষ্ট্য, প্রবণতার মধ্যে সামঞ্জস্য ছিল যার ভিত্তিতে এগুলোকে বিভিন্নভাবে সমালোচনা করা হয়, যেখানে এই সমালোচনার ধারাই উত্তরাধুনিকতা)।

অন্য শিল্প মাধ্যমের কেউ কেউ আধুনিকতাবাদের উৎস্যে ১৮ শতকের সন্ধান করলেও চারুকলার ক্ষেত্রে সবাই একমত যে গ্রিনবার্গই এর সূচনা করেন। আধুনিকতাবাদকে শিল্প সাহিত্যের সৃজন প্রক্রিয়ায় একটি মোড় ফেরা নতুন প্রবণতা হিসেবে দেখা হয়, সেই সাথে এর পেছনে সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা ও তার ভিত্তিতে নতুন ধারা সৃষ্টির বিষয়টিও স্বীকৃত। আধুনিকতাবাদ ভিত্তিক সমালোচনার ঐতিহ্যে বাস্তবতার বৈষম্যের উল্লেখ দীর্ঘদিন ধরে বহুল প্রচলিত। আধুনিকতাবাদী তত্ত্ব প্রথম থেকেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এজাম্পশনের উপর প্রতিষ্ঠিত –

  • (১) শিল্পকর্মে তার নান্দনিক গুণ বা মূল্যের বাইরে আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। গ্রিনবার্গের ভাষায় – শিল্পকর্মে গুণগত উৎকর্ষ ছাড়া আর কিছু আশা করা উচিৎ নয়।
  • (২) শিল্পের ক্ষেত্রে সমালোচনার উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ সেটাই বিবেচিত হবে যা সর্বাধিক মূল্যমান যুক্তি শিল্পকর্মকে পরষ্পর যুক্ত করে। আধুনিকতাবাদীরা তাই ব্যতিক্রমী শিল্পকর্ম যাতে শনাক্ত কররা যায় তাই পটভূমি হিসেবে সার্বিকভাবে ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতির উপর আগ্রহ দেখায়।
  • (৩) যেখানে নন্দনতাত্ত্বিক বিচার আর নৈতিক বিচারের সাথে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা বা সামাজিক বিবেচনার দ্বন্দ্ব দেখা যায়, সেখানে নান্দনিক বিচারকে প্রথমে পরীক্ষা না করে নৈতিক বিচার, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বা সামাজিক বিবেচনার ভিত্তি যাচাই করা উচিৎ।

এসব এজাম্পশন নিয়ে প্রশ্ন দেখা যায়। যেমন – মডার্নিস্ট সমালোচকেরা যাকে নান্দনিক বলে মনে করে বা নান্দনিক গুণের প্রতিনিধিত্ব করে বলে মনে করে তা শিল্পকর্মের বস্তুগত বা অবজেক্টিভ ও পৃথক করার মত উপাদান বা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু নন্দনতাত্বিক গুণগুলো যদি সমালোচকের নিজের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা ও স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হয় তাহলে কী হবে? এখানে প্রশ্ন উঠছে, হাই আর্টকে সামাজিক দায়িত্ব ও ভূমিকার ঊর্ধ্বে রেখে কার স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে? আধুনিকতাবাদ অনেক দিন থেকেই এসব ও অন্যান্য সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। একে অভিজাত ও শাসকশ্রেণীর আদর্শ রক্ষাকারী ও সংরক্ষণশীলও বলা হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নতুন পথে মোড় নিয়েও বিপ্লবাত্মক আধুনিকতাবাদ যে সংরক্ষণশীলতার অপবাদগ্রস্ত হতে পারে তা সময়ের বিবর্তনের জন্যই। গতকাল যা আধুনিক তাকে আজ পুরনো মনে হবেই। কিন্তু আধুনিক সব সময়ের জন্য প্রচলিত প্রবণতা যা দেশ কালের সঙ্গে সামঞ্জস্যময় হতে চায়। দর্শন ও সংস্কৃতিতে আধুনিকের সঙ্গে নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনার সম্পর্ক তাই সন্দেহাতীত।

আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্বের বিভিন্ন ভাবনা

আধুনিকতাবাদের দুটি পৃথক কিন্তু সম্পর্কিত নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনা আছে –

  • (১) শিল্পকর্ম সংহত বা ইউনিফায়েড – আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের তত্ত্বে আই. এ. রিচার্ডস ও এফ আর লেফিস এর লেখায়, এবং ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ এর দশকে আমেরিকায় নিউ ক্রিটিসিজমে দেখা যায়। এক্ষেত্রে বলা হয়, শিল্পকর্মের মধ্যে পার্থক্যগত বিষয়ের নিরসন করা হলে ও জটিল অসংলগ্নতা বা ডিসকন্টিনুইটির মিলন ঘটলে তার শিল্পমূল্য বৃদ্ধি পায়।
  • (২) শিল্পকর্ম স্বশাসিত বা অটোনোমাস – গ্রিনবার্গ ও ফ্রায়েডের শিল্প সমালোচনায় পাওয়া যায়। এরা বলেছেন, বিশুদ্ধ শিল্পকর্মের দায়িত্ব হল প্রকাশের উদ্দেশ্যে তার নিজের মাধ্যমে অনুসন্ধান বা পরীক্ষা করা। ১৯৬৫ সালে গ্রিনবার্গ লেখেন, শিল্প ও সমালোচনার দায়িত্ব হল একটি শিল্পের ফলাফল থেকে অন্য সব শিল্পের বা তার মাধ্যমের সব প্রভাব মুছে ফেলা। এভাবে প্রতিটি শিল্প বিশুদ্ধ হবে। এই বিশুদ্ধতার মধ্যে থাকবে গুণের উৎকর্ষ ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা।

মাইকেল ফ্রায়েডের লেখায় সংহতি ও স্বাধীনতা দুটি বিষয়ই সমন্বিতভাবে উপস্থাপিত। তিনি শিল্পকর্মে (ছবি ও ভাষ্কর্যে) নাটকীয়তার গুণের বিরোধিতা করেন কেননা এসব অন্য শিল্পরূপের অনুকরণ যা শিল্পকর্ম থেকে মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্বে শিল্পকর্মের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হল তার বিশুদ্ধতা। এই নন্দনতত্ত্বের প্রধান উদ্দেশ্য হল আধুনিক সস্তা জনপ্রিয় সংস্কৃতির অবক্ষয়িত রূপ থেকে প্রকৃত নন্দনতাত্ত্বিক চর্চাকে পৃথক করা। নন্দনতত্ত্বের এই স্বাধীনতার সপক্ষে দাবির পেছনে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া থাকে। এর ফলে শিল্পে বিপ্লবাত্মক নতুন ধরণের প্রকাশভঙ্গি ও চেতনার আবির্ভাব হতে পারে। কিন্তু আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্ব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে এ ধরণের বৈপ্লবিক ও বিনষ্ট সাধনকারী শক্তি থেকে দূরেও থাকতে পারে।

আমেরিকায় রিচার্ডস, অগডেন, লেভিস ও এলিয়টের নিউ ক্রিটিসিজম (সাহিত্য সমালোচনা)

মডার্নিজমের অংশ হিসেবে সাহিত্য সমালোচনা অগ্রসর হয়, সাহিত্যের মূল্যায়নে এগুলোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। একটি শব্দ বা বাক্য দ্বারা আরেকটি অর্থ কিভাবে বোঝানো যায়, অর্থাৎ সঙ্কেতের ব্যবহার সম্পর্কে সবচেয়ে পুরনো কাজটি করেছিলেন আই এ রিচার্ডস ও সি কে অগডেন তাদের দ্য মিনিং অফ মিনিং গ্রন্থে, উপশিরোনাম ছিল চিন্তা ও প্রতীকের বিজ্ঞানে ভাষার প্রভাব। তাদের আগে কেউ এটা করেনি। ‘রেফারেন্স’ বলতে তারা যা উল্লেখ করেন তা উত্তরসুরিদের প্রভাবিত করে যারা এই ধারণার বিকাশ ঘটায়। রিচার্ডসন ও অগডেন ভাষার বিভিন্ন ক্রিয়া বা ভূমিকার মধ্যে যে পার্থক্য তাতে নজর দেয়, বিশেষ করে ভাষার সূত্র উল্লেখ করার ক্রিয়া বা ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করে। তারা রেফারেনশিয়াল ও ইমোটিভ এর মধ্যে পার্থক্য করেন। রেফারেনশিয়াল দ্বারা বোঝায় সেই কথা যেখানে কথা সম্পূর্ণ প্রতীকী চরিত্র ধারণ করে, আর ইমোটিভ ক্রিয়া যেখানে কথা বক্তার অনুভূতির বাহক হয়। ভাষার এই দুই বিভিন্ন ব্যবহার এস্থেটিক্সের ধারণাকে প্রভাবিত করে, ফলে দুটি উৎপন্ন ফল পাওয়া যায়।

এস্থেটিক্সে ভাষার এই দুরকম ব্যবহারে প্রথম ফল রিচার্ডসন ও অগডেন উল্লেখ করেন। কবিতা ও বৈজ্ঞানিক আলোচনাতে (গদ্য) যে পার্থক্য তার ব্যাখ্যায় এই ফল কার্যকর হয়। তাদের ভাষায় গদ্য ও পদ্যের মধ্যে বিরোধিতার পরিবর্তে ভাষার রেফারেনশিয়াল ও ইমোটিভ ব্যবহারের কথা বলা যায়। এই পার্থক্যের মৌলিক গুরুত্ব সাহিত্যের সব জায়গায় এমনকি বিজ্ঞান দর্শনেও কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। রিচার্ডস পরে তার প্র্যাক্টিকাল ক্রিটিসিজমে কবিতা সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দেয়ার সময় কবিতাকে ইমোটিভ পরিচিতির তুলনায় জ্ঞান বা অবধারনের উৎস্য বা মাধ্যম হিসেবে বলেছেন। এর আগে সায়েন্স এন্ড পোয়েট্রিতে তিনি কবিতার ভাষাকে আবেগ প্রকাশের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত বলেন, মানে ইমোতিভ ভূমিকা রেফারেনশিয়ালের চেয়ে প্রাধান্য পায়। লজিকাল পজিটিভিস্টরা এই অর্থেই কবিতায় ভাষার ও প্রকৃতির বিশ্লেষণ করে।

রিচার্ডস ও অগডেনের ভাষা ব্যবহারে বিভিন উদ্দেশ্য ও ফলাফলের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তার উত্তরসুরিদের দ্বারা ইমোটিভ মিনিং এর ধারণাকে আরও মার্জিত ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে। এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইমোটিভ মিনিং এর মাধ্যমে সমালোচনামূলক বিচারকে ঠিক-ভুল কিছুই বলা যায় না এই উপসংহারে পৌঁছাতে হয়। রিচার্ডস ও অগডেনের বক্তব্য হচ্ছে, সৌন্দর্যের প্রকৃতি সম্বন্ধে যে মতান্যৈক্য তার পেছনে আছে ভাষার ভূমিকা সম্বন্ধে সংশয় ও বিভ্রান্তি। তার ভাষায় সাধারণত সৌন্দর্যের মত কথা আলোচনায় ব্যবহার করা হয় তাদের ইমোটিভ অর্থের জন্য। শিল্পকর্মের ভেল্যুতে এই আবেগময়তার তত্ত্ব ২০শ শতকে বারবার ফিরে আসে। রিচার্ড ও অগডেনের দ্য মিনিং অফ মিনিং ভাষার সংকেতধর্মীতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে ভাষার অর্থ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে। কবিতা ও সাহিত্য কোন অর্থে বৈজ্ঞানিক রচনার চেয়ে পৃথক বা চিত্রকলা ও সঙ্গীত কোন অর্থে তাৎপর্যময় এই বিষয়গুলো নতুনভাবে দেখা ও তাদের বিবেচনার ভিত্তি তৈরি হয়। ব্যাখ্যার সাধারণ তত্ত্ব তৈরিতে যেসব সমস্যা সে সম্পর্কে আগের তুলনায় আরও বিশদ ও বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। প্রশ্ন আসে, আমরা যখন একতি অর্থ বুঝি তখন কি হয়, আর তার সঠিক অর্থ উপলব্ধির মানদণ্ড কী? রিচার্ডসের পর বেশ কিছু লেখায় এই প্রশ্ন সম্পর্কিত বিষয় আলোচিত হয়।

প্র্যাক্টিকাল ক্রিটিসিজমের ৩য় অংশে রিচার্ডস সমালোচনায় ৪ ধরণের উপকরণের কথা বলেন, ১মটি শ্রম্বণ, কথা যা ইন্দ্রিয়নির্ভর। ২য়টি অনুভূতি যা মনস্তাত্ত্বি, ৩য়টি টোন বা সুর, বা যে ভঙ্গিমা ব্যবহৃত হবে তা, ৪র্থ হচ্ছে উদ্দেশ্য যা স্বয়ংব্যাখ্যিক। তার মতে এদের উপর নির্ভর করে কবিতার ভেতর প্রবেশ করতে হবে। এসবের উদ্দেশ্য হল নির্ভর করে কবিতায় প্রবেশ করতে হবে। এদের উদ্দেশ্য হল নিবির বা অনুপুঙ্খ পাঠ। পাথের উৎকর্ষই ভাল সমালোচনা ও বিচারের গুঢ় রহস্য উদ্ঘাটন করে। এভাবে রিচার্ডস জোর দিয়ে বললেন সমালোচনা মূলত পাঠভিত্তিক। এই পাঠের সময় ভাষা ব্যবহারের পার্থক্যের কথা মনে রাখতে হবে, তার নন্দনতত্ত্ব ভাষার ব্যবহার না ইমোতিভ ও জ্ঞানগত প্রেক্ষিতকে ভিত্তি করে তৈরি। তিনি নান্দনিক অভিজ্ঞতার তাৎক্ষণিক অনুভূতি বা আলোড়নকে মূল্য দেননি, মূল্য দিয়েছেন কবিতা পাঠের ফলে মনের সংগঠনে যে স্থায়ী পরিবর্তন হয় তাকে। কবিতার ভাষায় ইমোটিভ ক্রিয়া কার্যকর বলে তিনি নিকৃষ্ট মনে করেন না, যদি কবিতার অভিজ্ঞতার আবেগসমূহের মধ্যে সঙ্গতি সুষমা এনে দেয়। তার মতে কবিতার সত্যরূপে কোন মূল্য নেই কিন্তু এর মূল্য আছে ছন্দোবদ্ধ জীবনের পরিপোষক প্রকাশ রূপে। ভাষার গুরুত্বে দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কবিতায় ভাষার কাজ ও নিহিতার্হ নিয়ে বক্তব্যের সারবত্তাই আধুনিক সমালোচনার ইতিহাসে তার নাম স্থায়ী করে রাখবে। চারুকলায় প্রতীকের ব্যবহার ও মূর্তির সূত্র উল্লেখ বা আইকনোলজিকাল রেফারেন্স, রিচার্ডস ও অগডেনের অর্থের এই তাত্ত্বিক আলোচনা অনুসরণে গড়ে ওঠে বলা যায়। শিল্পের দর্শন নিয়ে যারা লিখেছেন তাএর কাছেও অর্থের অর্হ তাৎপর্যময় মনে হয়েছে ও তাদের ধারণাকে প্রভাবিত করেছে।

এফ আর লেভিস ১৯৩২ সালে স্ক্রুটিনি নামে যে পত্রিকা প্রকাশ করেন সেখানে প্রচলিত সাহিত্যতত্ব ও দর্শনের বিপরীতে বক্তব্য। লেভিস ভলেন, প্রচলিত সাহিত্য সমালোচনার শৃঙ্খলা বা পদ্ধতিহীনভাবে অগ্রসর হবে যদি তার পেছনে কঠোর সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের কেন্দ্রিয় চরিত্র প্রতিষ্ঠা করা না যায়, আর বই এর পৃষ্ঠায় যে অক্ষর তার প্রতি মনোযোগ দেয়া না যায়। এর প্রয়োজন কেবল নান্দনিক বিবেচনায় নয়, আধুনিক সভ্যতা যে আত্মিক সংকটে নিপতিতি তার নিরসনের প্রচেশটার জন্যেও। খেয়াল কুশিমত রুচির ব্যবহার নয়, পরিশীলতা, শিক্ষিত, ও সুশৃঙ্খল বিশ্লেষণধর্মী মানসিকতা নিয়ে সাহিত্য বিচার করতে হবে। সাহিত্যে সৃজনশীলতার অমিয় শক্তি নিহিত, কিন্তু বাণিজ্যিকীকরণের উপর ভিত্তি করে যে সমাজ গড়ে উঠেছে সেখানে সাহিত্য তার ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বিশেষ করে ভাষার যে যথেষ্ট ও অমার্জিত ব্যবহার চালু হয়েছে তা রসংশোধন করে সাহিত্য ভাষার সৃজনশীল ব্যবহারের মানদণ্ডকে সমুন্নত রাষতে পারে। তার মতে একটি সমাজে ভাষার ব্যবহারে যে মান ও উৎকর্ষ তার দ্বারা সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনের গুণগত মাত্রা বিচার করা যায়। ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি নিষ্ঠা ও আগ্রহ দেখানোর মাধ্যমে শিল্পভিত্তিক সমাজের হৃদয়হীনতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা যেতে পারে। ইংরেজ ভাষা ও সাহিত্যকে কেবল একটি অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে না দেখে একটি আত্মিক অনুশ্লন মনে করেন যার সাথে সভ্যতার অগ্রগতির সম্পর্ক রয়েছে।

সাহিত্যিক সূত্রের চেয়ে সাহিত্যকর্ম ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে কি রায় দেয় সেটাই বেশি মূল্যবান মনে করেন লেভিস, সাহিত্যকর্মকে তার ভূমিকা দিয়ে বিচার করে হবে, বিশেষ করে জীবনমুখিতা দিয়ে। স্ক্রুটিনির মাধ্যমে লেভিস একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিযান শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে এমনভাবে জীবনের জন্য প্রস্তুত করা যেন তারা শিল্প সভ্যতার যান্ত্রিকতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ ও নিম্নরুচির সংস্কৃতি থেকে মোক্ষ লাভ করতে পারে। অর্থনৈতিক অকমিউনিজমের দিকে সাময়কভাবে ঝুঁকলেও সমাজ পরিবর্তন নয়, এসমাজের মোকাবেলার জন্যই সাহিত্য ব্যবহার করার কথা ভেবেছেন লেভিস। ম্যাথু আর্নোল্ডের মত কেবল শিক্ষার ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের কথা ভাবেন, যাতে মার্জিত রুচির ও প্রকৃত শিক্ষিত মানুশ তৈরি করা যাবে। এজন্য স্ক্রুটিনির পক্ষ থেকে কালচারাল স্টাডিজ গ্রুপ প্রতিষথা করা হয়। টেরি ইগলটনের মতে শিক্ষা অরথনৈতিক ব্যবশ্তার ঊর্ধ্বে নয়, আর মুনাফাই যদি সেই ব্যবস্থার লক্ষ্য হয় তাহলে শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে পৃথক্কভাবে দেখার চেশা বাতুলতা। তার কাছে স্ক্রুটিনি ও লেভিসের মতাদর্শকে মনে হয় হাস্যকর ও অবাস্তব। স্ক্রুটিনি পত্রিকা ও লেভিসকে অনেকেই তাই এলিটিস্ট ভাবেন।

টি এস এলিয়টও লেভিস ও তার পত্রিকা স্ক্রুটিনির মত পুঁজিবাদী শিল্পোন্নয়নে যে বন্ধ্যাত্ব তার দ্বারা হতাশাগ্রস্ত হয়েহচিলেন। তিনি নস্টালজিয়ার প্রভাবে যে কৃষিভিত্তিক সমাজ অপসৃয়মান তার মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনার কথা ভাবেন। জন্মগতভাবে আমেরিকান হলেও ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ডে আসার পর তিনি লেভেইসের মত সম সাময়িক বৈপ্লবিক অসহযোগিতার ঐতিহ্যতাকে গ্রহণ করেন। খুব শিঘ্রই এলিয়টকে মধ্যবিত্তের উদারনৈতিক যে মতাদর্শ শাসক গোষ্ঠির প্রিয় ছিল তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হল। তার বিবেচনায় সমস্যার সমাধান ছিল চরম ডানপন্থী কর্তৃত্ববাদ, যার অধীনে ব্যক্তিগত মতামত বিসর্জন দিতে হতে পারে। সাহিত্যে এই নৈর্ব্যক্তিক ও পরাক্রান্ত শক্তির প্রতিনিধিত্ব করেছে ঐতিহ্যে। এই ঐতিহ্য ছিল এলিয়টেরই নির্বাচিত যা তার সাহিত্য দৃষ্টির জন্য উপযোগী ও সহায়ক এবং সেজন্য সর্বজনীন নয়। তার মতে একটি সাহিত্য কর্ম তার মূল্য ও গুরুত্ব করতে করতে ঐতিহ্যের নিরিখেই।

এলিয়টের মতে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্ক যুক্ত ভাষার সুবিধা হল এর মাধ্যমে সাহিত্যিকদের পক্ষে যুক্তিবাদী চিন্তার মারাত্মক বিমূর্ততা এড়ানো যায় ও পাঠকের মস্তিষ্ক কোষ, স্নায়ুকেন্দ্র ও পরিপাকযন্ত্রের সাথে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়। কবিতা পাঠককে চিন্তা করতে বলে না, তার অর্থোদ্ধারের জন্য আহ্বান জানায় না। অর্থের কথা বলে পাঠিককে শান্ত করা হলেও কবিতা তার পায়ু ও দৈহিক যন্ত্রের উপর কৌশলে প্রভাব বিস্তার করে। তিনি মনে করেন, মধ্যবিত্ত উদারনৈতিক যুক্তিবাদীদের ভাষা জরাজীর্ণ হয়ে গেছে এই সময়ে প্রগতি ও যুক্তির কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কবিদের তাই এসব বস্তাপচা যুক্তির কথা ত্যাগ করে একটি স্পর্শকাতর ভাষা তৈরি করতে হবে যা সরাসরি স্নায়ুযন্ত্রের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। এই ভাষার অন্তরগত শব্দের গতিবিধি এমন হবে যে, তার সাভায্যে মানুষের মনের অন্তস্থানে সুপ্ত কামনাবাসনা, ভয়ভীতি ও অন্য সব আদিম অনুভূতির নৈকট্য পাওয়া সম্ভব। চেতনার এই আদিম স্তরেই সব নরনারীর অভিজ্ঞতা এক। যে জৈবিক সমাজ অপসৃত, তার অবশিষ্ট কিছু চিহ্ন বা অভ্যাস গোষ্ঠির সম্মিলিত অবচেতনে এখনও আছে। এই অবচেতনে গভীর কোন প্রতীক, মানসিক ছন্দ, অপরিবর্ত্তনীয় আর্কেটাইপ হয়ে রয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেছেন।

সমসাময়িক সমাজ ও যুদ্ধত্তোর ইউরোপে যে শ্রেণিসংঘাত ও অপরিণত পুজিবাদের সংকট সেসব থেকে ত্রাণ পাওয়ার জন্য তিনি ইতিহাসের দিকে পিঠ ফিরিয়ে অতিকথন বা মিথোলজির শরণাপন্ন হতে চেয়েছেন। যান্ত্রিক সভ্যতার ও বিজ্ঞানের যাত্রার আগে মানুষের ভাষায় সেই অতিকথন ও প্রতীকই প্রাহান্য পেয়েছে। এলিয়ত তাই দেখেছেন লগ্ন পুঁজির উপর প্রতিষ্ঠিত অরথনীতির অনেক নিচে হলেও রয়েছে কিং ফিসার, যে জন্ম মৃত্যুর ও পুনরুজ্জীবনের প্রতিক ও যার মাধ্যমে মানুষ তার সাধরণ পরিচিত লাভ করতে পারে। ১৯৩২ সালে দ্য ওয়েশট ল্যান্ড কবিতায় তিনি জানান উর্বরতাভিতিক বম্বাস বা ফার্টিলিটি কাল্ট পাশাচাত্যের আত্মিক সংকটি নিরসনে সাহায্য করতে পারে। মনস্তাত্ত্বিক এই বিশেলেষণে মিথের ব্যবহারের পাশাপাশি ভাষা ব্যবহারেও নতুনত্বের সূচনা করেন। শিল্পভিত্তিক সমাজে যে ভাষা পুরনো ও বাসি হয়ে গেছে তার ব্যবহার করে কবিতা লেখা যে সফল হবে না সে কথা তিনি আগেই বুঝেছিলেন। তার উপলব্ধির সাথে রাশিয়ান ফরমালিস্ট, এজরা পাউন্ড ও টি ই ইহউমের চিন্তাধারার মিলন হয়েছে। কবিতার ভাষা দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে অবিতাকে হাস্যাস্পিদ অরে তুউলেছিল। ভাষার সবলতা ও ঋজুতা প্রতিষ্ঠা ক্করে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থান করার প্রয়োজন সম্বন্ধে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছেন।

সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে এলিয়ট ছিলেন গতানুগতিক তত্ত্ব বিরোধী ও এম্পিরিসিজমে বিস্বসী। সাহিত্যের এথেতিক্স নিয়ে তার সন্দেহ ছিল। কবিতার সমালোচনাকে তিনি মনে করেছেন মূলত নিজের কবিতার সার্বক্ষণিক সমর্থনে কবিরই বক্তব্য রাখা। তিনি তিন ধরণের সমালোচনার উল্লেখ করেন –
(১) সৃজনশীল সমালোচনা, যা দুর্বলতা ও রক্তশয়ন্যতার নামান্তর ও যার দ্ররষ্টান্ত ওয়াল্টার প্যাটারের লেখায় পাওয়া যায়
(২) ঐতিহাসিক ও নৈতিক সমালোচুনা যার দৃষ্টান্ত ফরাসি লেখক সেন্ট বিউভের লেখায় আছে
(৩) প্রকৃত সমালোচনা, যা কবিরা লিখে থাকেন।

এই শ্রেণীবিভাগে এলিয়ট তত্বকে উপেক্ষা করেন। কেবল এরিস্টোটলের সাহিত্যতত্ত্বের প্রভাবকে তিনি মূল্য দন্ন। সমালোচনার জন্য তিনি খুব সীমিত ভূমিকা দেখেন। এই ভূমিকাকে কখনও তিনি শিল্পকর্মের বিশদীকরণ, আবার কখন এর রুচির পরিমার্জন হিসেবে দেখেন। প্রকৃত বিচারের সাধারণ অন্বেষা হসিসেব্বে তিনি কখনও সমালোচনার ভূমিয়াকে দেখতে পান। কিন্তু ব্যাখ্যা দেয়া বা মূল্য বিচারের উদ্দেশ্যে যে সমালোচনা তাকে তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। ব্যাখ্যা দেয়ার চেশটাকে তিনি অশুভ প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন যা কল্পকাহিনি রচনায় দরকার হতে পারে। মূল্য বিচারে র ক্ষমতা সমালোচককে দিতে নারাজ সমালোচক জোর কুরে কিছু বলতে পারেনা ও ভাল হোক মন্দ হোক সে রায়ই দিতে পারে না। সে বড় জোড় বিশদীক্রওন করতে পারেন, এর সাথে ব্যাখ্যার কী তফত তা বলেননি। পাঠুকে নিজের বিবেচনায় ও উপলব্ধি দিয়ে সাহিত্যের ম্ল্য সম্বন্ধে বিচার করার সুযোগ দিতে হবে। এলিয়ট নিজে তার সিলেক্টেড এসেজের প্রতি পৃষ্ঠায় বিচার করে রায় দিয়ে গেছেন। তিনি নিজের ভূমিকাকে দেখেছেন ওতিহ্যের ধারক, নাহক, রক্ষক হিসেবে ও মূল্যবোধের স্রষ্টার ভুমিকায়। তার সমালোচনাতত্ত্বে তাই অনেক স্ববিরোধিতা ও অহংবোধ আছে।

নিউক্রিটিসিজম নামে আমেরিকায় ১৯৩০ এর দশকে যে সমালোচনাতত্ত্বে প্রচলন তার উপর রিচার্ডসের লেখা ও চিন্তাভাবনার প্রভাব ছিল বলা যায় নিউ ক্রিটিসিজমের প্রবক্তারা তার উন্নয়ন করে। নিউ ক্রিটিকরা রিচার্ডসের মত বিশ্বাস করেছেন একটি সাহিত্যকর্মকে জৈবিক সমগ্র বা অরগানিক হোল হিসেবে দেখতে ও পিরতে হবে। এই অরগানিক হোল তার সব জটিলতা ও একতা নিয়ে স্বসম্পূর্ণ ও স্ব অস্তিত্বময়। কবিতা ইমোটিভ ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে বহু আবেগের মধ্যে সমীকরণ ও সুষমা আনে, রিচার্ডসের এই অভিমত নিউ ক্রিটিকরা গ্রহন করে। সাথে গদ্য ও পদ্যের বিচাজনকে মেনে নেয়। কিত্নু সামগ্রিকভাবে সাহিত্যের আবেগভিত্তিক তত্ত্ব এরা অনেক সময় বর্জন করেছেন, ডাব্লিউ কে উইমস্যাত তার দ্য ভার্বাল আইকন গ্রন্থে বলেন, আবেগগত প্রতিক্রিয়া বা প্রত্যুত্তরে সাহিত্য সমালোচনার বিষয়বস্তু বা লক্ষ্য নয়। অন্যদিকে কবিতার সঙ্গতি উৎপাদনের শক্তি সম্বন্ধে রিচার্শসের বক্তব্যের তিনি প্রশংসা করেন। কিন্তু উইমস্যাট রিচার্ডসের সৌকিন মনস্তত্ত্বকে বর্জন করে গ্রহণ ক্রএছেন এলিয়টের কবিতার নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্বক। এলিয়ট বলেন, একটি মহাকবিতা বা নাটক আবেগের বস্তুগত প্রাতিসাম্য বা অবিজেক্টিভ কোরিলেটিভ রচনা করে মাত্র। যে মানুষ বেদনা ভোগ করে আর যে মন সাহিত্য তৈরি করে তাদের এটা রয়েছে। অনেকেই রিচার্ডসের লেকাহ্য কবিতার অর্থবোধে যেসব বাধা তার ন্নিরণয় ও কবিতার ভাষার প্রতি যে মনোযোগ দেখা যায় তার প্রশংসা করেছেন যদিও তার মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তিনি যে কবিতাকে জ্ঞানের ভার থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন এটাও প্রশংসিত হয়। কবিতার অনুভূতি বাস্তব ও ব্যতকি অভিজ্ঞতাপ্রসূচ না হলেও চলবে, তার স্থানে কাল্পনিক নুভূতি ভাল, রিচার্ডের এই মতের সাথীলিয়টের বক্তব্যের মিল আছে। নিউ ক্রিটিসিজমের প্রবক্তারা রিচার্ডের কাছ থেকে ঋণ স্বীকার করলেও কবিতার প্রতি তাদের দৃশটিভঙ্গি অবজেক্টিভ ছিল। তাদের বিশ্লেশনের উদ্দেশ্য ছিল পাঠককে কী আছে তার আবিষাক্রে সাহায্য করা, অর্থ বলে দেয়া নয়। নি ক্রিটিকসের এই অবিজেটিভিস্ট প্রবণতা গেস্টল্ট মনস্তত্ব (সমগ্রতা অংশের চেয়ে বড়) এবং বাহিক রূপই সব অর্থাৎ প্রপঞ্চবাদ থেকে সমর্থন ও শক্তি পায়।

বিজ্ঞানের তুলনায় কবিতা ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতাকে মূল্য দেয় ও যুক্তিসঙ্গগত জ্ঞানের পরিবররে আবেগের মাধ্যমে প্রায় আধ্যাত্মিকতার তন্ময়তার বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বলে মনে করে নিউ ক্রিটিকরা। এভাবে যে পৃথিবী বিজ্ঞান ও শিল্পোন্নয়নের জন্য বিচ্ছিন্ন তাকে শিল্পের মাধ্যমে ফিরে পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন। ধ্যানাভিমুখিতার জন্য কবিতা বাইরের পৃথিবীকে বনয়ের সাথে উপলব্ধিতে ও সমীহ ক্রতে উদ্বুদ্ধ করবে। কবিতা নতুন ধর্মের মত যা হারিয়ে যাওয়া স্তৈর্যকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ঈশ্বরের মত কবিতা যুক্তিসঙ্গত যুক্তিসঙ্গত অনুসন্ধানের অতীত। কবিতা নিজেকে আবৃত করে রাখা বস্তু একে শব্দান্তরিত করা যায়না, নিজের ছাড়া অন্যের ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এর প্রতিটি অংশ অন্যগুলোর সাথে জটিল জৈবিক ঐক্যের সম্পর্কে জড়িত যা লঙ্ঘন করা অপরাধের সমান। সাহিত্যের টেক্সটকে রিচার্ডস যেমন তার ফাংশনালিস্ট ভূমিকা নিয়ে উপলব্ধি করেন, নি ক্রিতিকরাও তেমন দৃষ্টিতে দেখেন, যার ফলে কবিতা তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সামঞ্জস্যময় সহযোগিতায় কাঠামোর ভিতর থেকে সংঘাতমুক, অন্যম, স্ববিরোধিতার ঊর্ধ্বে উঠেছে। কিন্তু কবিতা পৃথিবীর প্রেক্ষতে একটি আদর্শের রূপে কাজ অরতে হলে পাঠকদের সেই আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ করতে হলে তার অন্তর্গত ঐক্যের পাশাপাশি বাস্তবের সঙ্গে কছুটা যুক্ত হতে হবে। তাই নিউ ক্রিতিসিজম এভাবে একাব্রে ফরমালিজম সর্বস্ব হয়নি, ব্যবহারিক দিকোও মনে রেখেছে।

রিচার্ডস, লেভিস, এলিয়ট, নিউ ক্রিটিকদের সবাই মূলত কবিতাকেই তাদের সমালোচনাতত্ত্বের আলোচনায় ব্যবহার করেন। এলিয়ট নাটকের প্রসঙ্গ এনেছেন, লেভিস নাট্য কবিতার। কিন্তু কবিতাই প্রধান। আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বে কবিতাকে এভাবে ব্যবহারের কারণ হিসেবে টেরি ইগলটন মনে করেন এর ইতিহাস নিরপেক্ষতা। উপন্যাস বা নাট স্থান ও কালে স্থাপ্ত একমাত্র কবিতাই এই দুই এর নিয়ন্ত্রণ থেকে মোটামুটি মুক্ত। সুতরাং সংবেদনশীলতাকে বিশুদ্ধতম ভাবে রেখে ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সম্পর্করহিতভাবে একমাত্র কবিতা রচনা করা যায়। তাছাড়া কবিতায় বক্তিব্যের চেয়ে কিভাবে বলা হল, কোন উপমা, উৎপ্রেক্ষার সাহায্য নেয়া হল সব শৈলিগত দিক প্রাধান্য পায়। তাই সাহিত্যতত্ত্ব বা সমালোচনাতত্ত্ব তৈরি করতে গিয়ে কবিতার উদাহরণবেশি দেয়া হয়। এরমানে এই নয় অন্যান্য শাখায় প্রযোজ্য বে না।

তথ্যসূত্র

  • ক্রিটিক্যাল তত্ত্বচিন্তা, সম্পাদক মাসউদ ইমরান, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১০, পৃ – ২৩৯-২৫০
  • আহমেদ, রে., ২০০৪, রেপ্রিজেন্টেশন ও (বাস্তবতা) কিছু পরিসর, কিছু প্রসঙ্গ, কাউন্টার ফটো, দৃক আলােকচিত্র গ্রন্থাগার লিমিটেড, ঢাকা এবং কাউন্টার ফটো-এ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন, ঢাকা
  • আহমেদ, রে ও মা. চৌধুরী ২০০৩, নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ: সমাজ ও সংস্কৃতি, একুশে পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ঢাকা
  • আহমেদ, রে., ২০০২, উত্তর-আধুনিকতাবাদ প্রসঙ্গে, ঢাকা: প্রতিরুদ্ধ প্রকাশনী।
  • সবার জন্য নন্দনতত্ত্ব, হাসনাত আবদুল হাই, সন্দেহ প্রকাশনী, ঢাকা, ফ্রেব্রুয়ারী ২০১৭, পৃ ২৯৮-৩০৩, ৩১৭-৩২৪

উত্তরাধুনিকতাবাদ

উত্তরাধুনিকতাবাদের জন্ম ও ইতিহাস

উত্তরাধুনিক বা Postmodern শব্দবন্ধটির উৎপত্তি নিয়ে নানা রকমের মতানৈক্য রয়েছে। তবে য়ুর্গেন হাবারমস তার এক লেখনিতে জানান যে, মডার্ন শব্দটি ল্যাটিন modernus রূপে সেই ১৫শ খ্রিস্টাব্দে প্যাগান অতীত থেকে বর্তমান খ্রিস্টানকে আলাদা করে দেখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। ফরাসি ইমপ্রেসনিস্ট চিত্র অপেক্ষা আরাে আধুনিক, আরাে আভাঁ-গার্দ (Avant-Grade) টাইপের চিত্রকে বোঝাতে গিয়ে জন ওয়াটকিনস নামক একজন পেইন্টার এবং চিত্র সমালােচক ১৯১৭ সালের দিকে পােস্টমডার্ন অভিধাটিকে ব্যবহার করেন। ১৯১৭ সালে রুডলফ প্যানউইজ একটি বইতে নিৎসে’র নায়ালিজম (Nihilism) এবং সে সময়কার ইউরােপের মূল্যবােধের ভাঙ্গন সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। নিৎসেকে অনুসরণ করে তিনি নতুন Postmodern মানুষের কথা বলেন, যার দেখা পাওয়া যায় ১৯৫০ এর দশকে। এতে পয়তাল্লিশােত্তর উত্তরাধুনিকতার বৈশিষ্ট্যাবলি স্পষ্ট হতে শুরু করে। ইতিমধ্যে দাদাবাদ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট মানুষের সমগ্র অর্জন এবং মূল্যবােধসমূহকে তাচ্ছিল্য করতে থাকে এবং সমকালীন চিত্রশিল্প, স্থাপত্য ও শিল্পকলায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে যা উস্কে দেয় উত্তর-আধুনিক চেতনার বীজ।

শব্দবন্ধটির সুনির্দিষ্ট ব্যবহার আরাে অনেক পরের ঘটনা। ১৯৩৫ সালে স্পেনের ফেদরিকো দে ওনলি ‘আধুনিক কবিতার প্রতি কাব্যিক প্রতিক্রিয়া’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাহিত্যে এর ব্যবহার ঘটান। ৫০ দশকের শেষের দিকে রাইট এবং মিলস্ এমন একটি কথা বলেন যে, আধুনিক কালের মার্ক্সবাদ, উদারনীতিবাদ, কিংবা পুঁজিবাদ কোনােটিই আর বিশ্ব প্রত্যয়টিকে উৎপাদন করতে পারছে না, কারণ এ তত্ত্বগুলি যুক্তি বা বুদ্ধি স্বাধীনতার মধ্যকার অন্তর্যোগে বিশ্বাস করত এবং মনে করত যে, বর্তমান যুক্তিবাদীরা বর্তমান স্বাধীনতার জন্ম দেয়। ষাটের দশকে ভাবনাটি আরাে শক্ত হয় এবং সত্তরের দশকে এসেই এখনকার উত্তরাধুনিক বলতে যা বোঝানাে হয়, তা স্পষ্ট হতে শুরু করে। লি কর্বোসিয়ার রচিত Villa Savoye আখ্যানটিতে আধুনিক ইশতেহারের একটি অংশে তিনি একটি নতুন স্থাপত্যের দিকে তাকিয়ে থাকার কথা বলেছিলেন।

উত্তরাধুনিকতা আন্দোলনটির শুরু হয়েছিল আধুনিক আন্দোলনের মধ্যে উপস্থিত হিংস্রতা আর শক্রতার বিপরীতে একটি প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন হিসেবে। ওয়াল্টার শ্রোপিয়াস এবং ফিলিপ জনসনের মত বিদ্বান আর মেধাবী লােকদের হাত ধরে আধুনিক স্থাপত্য প্রতিষ্ঠিত এবং বিকশিত হয়েছিল যার কেন্দ্রীয় লক্ষ ছিল একটি আদর্শ পারফেকশন, ফর্মের সংহতি ও ক্রিয়া, এবং ভারিক্কি অলংকরণের অগ্রাহ্যকরণ। আধুনিকতাবাদের সমালােচনা এই রকম যুক্তি-তর্ক উপস্থিত করে যে, উপযুক্ততা বা পারফেকশনের যে গুণারােপ করা হচ্ছে এবং তাদের যে সীমাবদ্ধকরণ নীতি তা নিজ থেকেই সাবজেক্টিভ। সমালােচনার ভাষ্যে বলা হতে থাকে যে, আধুনিক চিন্তা-চেতনার মধ্যে বিশৃঙ্খলবাদিতা সুস্পষ্ট এবং এর দার্শনিক উপকারিতাগুলাে সম্পর্কেও প্রশ্ন তােলা হয়। ডেফিনিটিভ উত্তরাধুনিক স্থাপত্য যেমন, মিশেল গ্রাভস-এর কাজ একটি পারফেক্ট আর্কিটেকটনিক ফর্মের ধারণাকে পরিত্যক্ত করে দেয়। এর বদলে বরং সব ধরনের পদ্ধতি থেকেই বিস্তর রকমের কাজ লুফে নেয়া হতে থাকে। স্থপতিদের কাছে সহজলভ্য উপাদান, ফর্ম এবং রঙকেও কাজে লাগানাে হতে থাকে। আধুনিক চিন্তা-চেতনার প্রায় সামগ্রিকতাবাদী গুণাবলির বিপরীতে একটি ব্যাপকতর প্রতিক্রিয়া হিসেবে উত্তরাধুনিক স্থাপত্য তার যাত্রা শুরু করে। এতে ব্যক্তিগত বিষয়াদীকে অগ্রাধিকার দেয়া হতে থাকে এবং নৈব্যক্তিক বিচিত্রতার দিকে ও সর্বোন্নত শর্তাবলি কিংবা নীতিসমূহের দিকে সুনজর দিতে থাকে। এটাই হচ্ছে সমালােচনা, সংশয়বাদিতা এবং সাবজেক্টিভিটির সেই আবহাওয়া (Atmosphere) যা উত্তরাধুনিক দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করে। ১৯৭২ সালে বিখ্যাত স্থাপত্য সমালােচক চার্লস জেঙ্কস্ একটি বক্তৃতায় বলেন যে, ‘আধুনিক স্থাপত্যের মৃত্যু ঘটেছে’ যদিও বাস্তবে তা কিন্তু কখনোই ঘটে নি। বরঞ্চ বক্তব্যটি ছিল পুরােপুরিই ফেইক যা আয়রনির মধ্য দিয়ে নির্মিত । ইহাব হাসান (Hassan 1985:2:123-4) তার দ্য পােস্টমডার্ন টার্ন প্রবন্ধে প্রথম সাহিত্যদর্শন ও শিল্পকলায় বিশেষভাবে পােস্টমডার্ন প্রবণতাকে শনাক্তকরণের চেষ্টা চালান। ১৯৭৫ সালে ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি ‘বহুত্ববাদ ও অ-পশ্চিমা সংস্কৃতিসমূহের উত্থান’ বর্ণনা করতে গিয়ে এর প্রয়ােগ করেন।

আধুনিকতাবাদ ও আধুনিকতার নিগ্রহ থেকে মুক্তির পথ হিসেবে উত্তরাধুনিকতাকে একটি সদর্থক বিকাশ ও একটি ডিসকোর্স হিসেবে দেখা শুরু হয়। কিন্তু কোনাে সংহত ধারণা গড়ে ওঠে না। নানাজনের কাছে উত্তরাধুনিকতা নানাভাবে আসে। কেউ আধুনিকের সঙ্গে এর ধারাবাহিকতা দেখেন, কেউ বা জোর দেন এদের মধ্যকার বিচ্ছেদ বা বিচ্যুতির ওপর। ফ্রেডরিক জেমসনের মতাে কারাে কারাে কাছে এটি নিতান্তই সাময়িক একটি ব্যাপার। লিওতার তার দ্যা পােস্টমডার্ন কন্ডিশন প্রবন্ধে দেখান যে, একজন উত্তর-আধুনিক আধুনিকের ঐক্য ও সংহতির অন্বেষণকে বাতিল করে যে বিচ্ছিন্নতা-দীর্ণতা অন্বেষণের কথা বলেন তারও উদ্দেশ্য হচ্ছে সংযােগ-সংহতি আর অন্বেষণকেই খুঁজে পাওয়া। তিনি আরাে দেখান যে, উত্তর-আধুনিক এসব মায়া-কুহক কিংবা ঐন্দ্রজাল থেকে মুক্ত। পেরি এন্ডারসন উত্তরাধুনিককে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশেষ পরিস্থিতিজাত বলেই মনে করেন। এ সময়ের পর থেকেই পশ্চিমা ধনতন্ত্র স্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণী তাতে অঙ্গীভূত হয়ে যায়, সমসাময়িক চিত্রশিল্পীদের কাছে জগৎ হয়ে ওঠে শূন্য, যেন এক বীভৎস উট (‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ যেন এরকমই একটি প্রতিক্রিয়া)। যুদ্ধত্তোরকালে অর্থাৎ ষাটের দশকে অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ সংকটে পড়ে যায় ধনতান্ত্রিক উদারনীতি। অথচ, শ্রেণী সংগ্রাম নেই, মন্দা প্রলম্বিত হয়, আর সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন হয়ে যায় উধাও। তখনই আসে পােস্টমডার্নের ডিসকোর্স, মুহূর্তের প্লুরালিজম বা বহুত্ববাদ – একই সঙ্গে র‍্যাডিক্যাল, ইতিহাস সম্পর্কে সংশয় আর ‘কাউন্টার-এনলাইটমেন্টের’ শেষ পর্যায় পােস্টমডার্নিজম।

ঠিক ঐ সময়েই এটিকে সাহিত্যিক তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস লক্ষ করা যায় যুদ্ধবিরােধী চেতনা, দাদা এবং স্যুররিয়েলিজমের অনুপ্রেরণায়। ইউরােপে যে হিপ্পি আর আমেরিকায় যে বিট প্রজন্মের উদ্ভব হয়েছিল তা মূল জায়গাটি থেকে সরে এসে এক সময় পপ কালচারের রূপ নেয়। জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, রােলা বার্থ, জুলিয়া ক্রিস্টোভা, জাঁ বদ্রিয়ার, জাক লাকাঁ প্রমুখ এটিকে ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। উত্তর-কাঠামােবাদ থেকেই দর্শন আর সাহিত্যের একটি গভীরতর দর্শন হিসেবে উঠে আসে উত্তর-আধুনিকতাবাদ। ফলে এই ব্যাখ্যা এতদিনে একাডেমিক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছালাে, নজর কাড়লো বুদ্ধিজীবী ব্যাখ্যান সম্প্রদায়দের। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক আর উৎসাহীরা নড়েচড়ে বসলেন। যে সব তাত্ত্বিকরা ভাবনাটিকে রীতিমত কুলীন পর্যায়ে তুলে আনলেন, তাদেরকে এর সূচনা পর্বের ভুল ব্যাখ্যাকারী’ বলা বােধহয় ঠিক হবে না, যদিও তারা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে মতানৈক্য এতটাই প্রকট হয়ে পড়ল যে, এটি একটি সুনির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কাঠামাে থেকে বহুদূরে অবস্থান নিলাে। ফলে সমস্যাটি অতি তাত্ত্বিক আর দুর্ভেদ্য রকমের জটিল হয়ে পড়ে।

উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফ্রাঙ্ক কারমােডের বয়ানটি খেয়াল করুন, “অনেক ব্যাখ্যানের জন্যই ব্যাপারটা এমনই দাড়িয়েছে যে, আধুনিক দশাটি ফুরিয়ে গিয়েছে বলেই যেন তারা খালাস (একটা টাইম ফ্রেমের ভেতর তকমা লাগিয়ে দিলেই কি সব কিছু শেষ হয়ে যায়!)। এর বিপরীতে উপযুক্ত উপস্থাপন করতে হলে আমাদেরকেও একটি শক্তিশালী ভাষা চাই যেন রেনেসাঁর চেতনাটিকেও সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়। সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছু বদলায়, আবার অনেক কিছুই কিন্তু বদলায় না; কেবল বৈচিত্র্যকেই বরং সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। আধুনিকের একটি প্রতিবেদনমূলক ইতিহাস কুড়ি বছর আগে ঠিক যেমনটি থাকে, আরাে কুড়ি বছর পরেও নিশ্চয় ঠিক তেমনটি থাকবে না।”(Sarantakos 1998: 28)। কারমােডের এই বয়ানটির মধ্যে আমেরিকার যে ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘটেছিল তার উপাদানগুলােকেও চিহ্নিত করা যায়। আমেরিকা একটি মাস কালচারে রূপ নিচ্ছিল। ফলে এটিকে ব্যাখ্যা করতে একটি নতুন কাউন্টার আদিকল্প বা প্যারাডাইমের দরকার হয়ে পড়েছিল। ইদানিংকার সামাজিক গবেষণাগুলােতে উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আদিকল্প (Paradigm) আকারে দেখার চেষ্টা হচ্ছে (Sarantakos 1998: 28 দ্রষ্টব্য)।

উত্তরাধুনিক এবং উত্তরাধুনিকতাবাদ টার্মগুলাে চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকে হাল্কা-পাতলা ব্যবহৃত হতে দেখা গেলেও পরের দশক থেকেই এর ব্যবহার বেশ ভারিক্কি হয়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক মূল্যবােধ বা ভ্যালুর আন্তক্ষরণকে শনাক্ত করতে গিয়ে টার্মগুলাে ক্রিটিক্যাল লেখালেখিগুলােতেও স্থান করে নিতে থাকে। উত্তরাধুনিকতাবাদকে অনেকটা এভাবে দেখা যায় যে, ‘বিল্ডিং এন্ড আনবিল্ডিং অব অর্থডক্স’ (Broomer 1992: 4) অর্থাৎ ‘সনাতনের নির্মাণ এবং অনির্মাণ’। এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে ক্রমারের ভাষ্য হল, “There is no absolute single cultural entity or absolute historical break, therefore, and no absolute inside or outside part from the ideological constructions requiring them” (Broomer 1992: 4)। এ ক্ষেত্রে ফ্রেডরিক জেমসনের ভাষ্যটির কথা বলা যেতে পারে, “We can not view postmodernism as an historical situation and present a critique of it from a position on the outside, for how can we be outside history? It follows that we can not view modernism from outside postmodernism either”।

আধুনিকতা এবং উত্তরাধুনিকতার একটি কালানুক্রম টানতে গেলে তাতে নানা রকমের শিল্প আন্দোলন, ডিসকাশন মিটিং, ব্যক্তি পর্যায়ের কর্মকাণ্ড কিংবা ঘটনাবলিও চলে আসে যার মধ্য দিয়ে এই আজকের বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এসে আমরা বিশেষ করে ইউরােপে এসে দাঁড়িয়েছি যার রাজনীতির বাইরেও আমাদের অবস্থানটি শুধু নিষ্ক্রিয় নয়। এর যথােপযুক্ত বর্ণনা এভাবে হতে পারে যে, এটি প্রান্তিক আকারগুলােকে হেজিমনিগত কাঠামােগুলাের ভেতর থেকে বের করে আনে এবং এক ঝাঁক অভিঘাতমূলক প্রতিক্রিয়াশীল প্রশ্নের বাণ ছুড়ে দেয়। এবং একটি ভয়ংকর রকমের আন্দোলন হিসেবে প্রচলিত সাংস্কৃতিক স্কুলগুলাের সমালােচনার মধ্য দিয়ে যুক্তি-তর্কের রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হয়। অনেকে এটিকে সদর্থক ত্রাস বলতেও পিছপা হন না।

ইহাব হাসান একটি বিকল্প জ্ঞানভাষ্য এবং সমালােচনার মাধ্যম হিসেবে এটিকে মানতে চান। তিনি যে উত্তরাধুনিকতাবাদের কথা বলতে চান তাতে উইলিয়াম ব্লেক, ডি সাদ; একটা সময়ের পাউন্ড, জয়েস, দাদা, স্যুরিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ, নব্য ফরাসি উপন্যাসের ধারা, জেনেট, দি বিটস, জনপ্রিয় সাহিত্য এবং নব্য সাংবাদিকতা এমনকি একটি উত্তর কাঠামােবাদী চিন্তক দলের চিন্তাকল্পের আত্তীকরণ অনেকটা এ্যামিবার মত করে ঘটে । তিনি আধুনিকতাবাদ এবং উত্তর আধুনিকতাবাদের মধ্যে তুলনা দেখাতে গিয়ে দ্যা কালচার অব পােস্টমডার্ননিজম (১৯৮৫) প্রবন্ধেও কিছু বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। স্টুয়ার্ট হল এটিকে বলছেন ‘সেই স্বপ্নের আমেরিকা যেমনটি হতে পারত বা হওয়ার চেষ্টা ছিল’ (Bird et al.1980:46)। পল ব্রোমারের (১৯৯২) ভাষ্যে বিষয়টি এমনই দাঁড়ায় যে, এটি আমেরিকাকে প্রথম বিশ্বের পশ্চিমা আধিপত্যের একটি কেন্দ্র হিসেবে দেখে। একটি ঐতিহাসিক অবস্থা হিসেবে আমেরিকার ক্ষেত্রে এটিকে দেখলে ব্যাপারটা এমনই দাঁড়াবে যে, এটি অর্থনীতি, রাজনীতি, মিলিটারি ক্ষমতা তথা আমেরিকা ও পশ্চিমের সাংস্কৃতিক প্রভাবের বা আধিপত্যের যে নিয়ন্ত্রণমূলক মনস্তত্ত্ব, ‘সত্যের মিথের’ প্রতি আকর্ষণ তথা সাংস্কৃতিক-ভৌগােলিক যােগযােগ ব্যবস্থার ওপর পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের শেয়ালীপনার বিরুদ্ধে কথা বলে বা বলতে চায়। সে অর্থে এটি যখন WTO কনফারেন্স হয় তখনও এই কূ-কৌশলী বিশ্বায়নের বিরােধিতা করে তার অবস্থানটিকে প্রকাশ করতে চায়।

সংক্ষেপে উত্তরাধুনিকতার দার্শনিক এবং সাহিত্যিক তথা ভাষাতাত্ত্বিক বিকাশকে দেখানাে যায় –

  • ১৯১৬ – দাদা আন্দোলন – ডিসকোর্স এবং অবজেক্টের ফ্রেমিং এর ওপর এমনই গুরুত্ব পেয়েছে যে নিজের কাজের তীব্রতা দেখে নিজেই অস্থির…
  • ১৯৩০ – কার্ল বার্থ – ঈশ্বরতত্ত্বে সংশয় প্রকাশের মাধ্যমে সাব্জেক্টিভিটির উদ্ভাস ঘটায়…
  • ১৯৩০ – মার্টিন হাইডেগার – সাব্জেক্টিভিটি এবং অবজেক্টিভিটি উভয় ধারণাকেই দর্শনের ভিত্তি থেকে প্রত্যাখ্যান করেন।
  • ১৯৫০ – লুডভিদ ভিনগেনস্টাইন – নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে (On certainty) এন্টি-ফাউন্ডেশনালিজম ভাষার একটি দর্শন…
  • ১৯৬২ – থমাস স্যামুয়েল কুন – বিজ্ঞানীদের সাময়িক সচেতনতা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের র‍্যাপিড পরিবর্তন ঘটছে। এটাকে তিনি ‘প্যারাডাইম শিফট’ হিসেবে দেখেছেন…
  • ১৯৬২ – ডব্লিউ. ভি. ও. কুইন – অনুবাদ এবং তত্ত্ববিদ্যাগত আপেক্ষিকতার অনির্ধারণত্বের থিসিজ নির্মাণ করেন (the theses of indeterminacy of translation and ontological relativity)
  • ১৯৭০ – জ্যাক দেরিদা – লেখনীর (writing) দার্শনিক ভিত্তিগুলোকে পুননিরীক্ষা এবং পশ্চিমা অধিবিদ্যার ভাষাগত দুর্বলতা অনুসন্ধান করেন… জন্ম দেন ‘বিনির্মান তত্ত্বের’…
  • ১৯৭৫ – মিশেল ফুকো – শৃঙ্খলা এবং শাস্তির ক্ষেত্রে ডিসকার্সিভ ক্ষমতার নিরীক্ষা চালান এবং বলেন যে, ‘ভাষা হচ্ছে নির্যাতন’ (এই অর্থে যে, ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যে অপ্রেসিভ হতে চায় ন্না সে এক ধরণের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। যারা সে ভাষায় কথা বলবে না তারা দুর্বল হয়ে পড়বে)…
  • ১৯৭৯ – জাঁ-ফ্রাসোয়া লিওতার – সার্বজনীনতা, গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ এবং সাধারণীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন…
  • ১৯৭৯ – রিচার্ড রোর্টি – দর্শন ভুলক্রমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলোর অনুসরণ করছে এমন কথা বলে তিনি ট্রেডিশনাল দার্শনিক সমস্যাগুলোর (anti-foundationalism and anti-essentialism) সমাধানের ইঙ্গিত দেন…
  • ১৯৮১ – জ্যাঁ বদ্রিয়ার – বলেন্ম যে, প্রতিরূপায়ন (simulacram) ও অনুসরণ কিংবা ভান (simulation) হচ্ছে মাধ্যম বা মিডিয়া নির্মিত বাস্তবতা…

পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও ঔপনিবেশিকতা বনাম মার্ক্সবাদ

একটি সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন হিসেবে ইউরােপীয় রেনেসাঁ এবং ফরাসি আলােকময়তার যুগের ধারাবাহিকতায় আধুনিকতা বা আধুনিকতাবাদের সূত্রপাত ঘটেছিল ১৯শ শতকে আবারও সেই ইউরােপেই (পশ্চিম), যার মূলে ছিল দ্রুতগতির শিল্পায়ন ও নগরায়ন, যার সঙ্গে জড়িত ছিল প্রথাগত জীবনচর্চায় নানা রকমের পরিবর্তন বা রূপান্তর (Transaction); পুঁজির বিকাশ ও পরিকল্পিত শিক্ষার বিস্তার, নানা সামাজিক-বৈজ্ঞানিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তা ও মতবাদের প্রভাব (ডারউইন, কার্ল মার্ক্স কিংবা সিগমুন্ড ফ্রয়েড); উপনিবেশিক শাসনের বিস্তার, যান্ত্রিকায়ণ ও মানুষের জায়গা দখল করে নেয়া মিডিয়ার বিকাশ (পত্রিকা, বিজ্ঞাপন, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি), লিঙ্গ সংক্রান্ত বিষয়াবলির গুরুত্ব অর্জন, ভৌত ও পদার্থ বিজ্ঞানের কার্যকারণ বিশ্লেষণের স্থলে সম্ভাব্যতা, নিশ্চয়তার জায়গায় আপেক্ষিকতা, সম্ভাব্যতাময় কোয়ান্টাম জগৎ। আধুনিকতাবাদীরা জাতীয়তার বিপরীতে মানবতাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, প্রকৃতি ও পরিবেশকে একটি পঠনের ভেতরে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, বিশ্ব-দর্শনে বহুমাত্রিকতা এবং সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতার পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। ভিক্টোরিয়ান যুগের ঈশ্বরকেন্দ্রিকতা, প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাকেন্দ্রিকতাকে তারা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। এ যুগে বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের উপনিবেশিক শাসন বিশ্বের অনেক অঞ্চলকেই করায়ত্ত করে নিয়েছিল। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় যে ‘কেন্দ্র-পরিধি’, ‘আমরা-তারা’, ‘সভ্য-অসভ্য’, ‘সাদা-কালাে’ এ রকম দ্বৈততার সৃষ্টি হয়েছিল যা আধুনিকতার আলােকবার্তাকে বিপদজনক করে তােলে, নিয়ে যায় এমন একটি বৈপরীত্যমূলক অবস্থানে যেখানে আধুনিকতা হয়ে ওঠে মানুষের দাসত্বের বাণী। কেবলমাত্র ক্ষমতালােভী রাজনীতি আর শােষণকেন্দ্রিক সম্পদ আহরণের জোর প্রচেষ্টা মানুষের মুক্তির স্বপ্নকে অধরা করে দেয়। আবারাে মানুষ হয়ে ওঠে শৃঙ্খলিত। কিছু বুদ্ধিজীবী এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, আবার এজরা পাউন্ডের মত কিছু বুদ্ধিজীবী এই প্রক্রিয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। মূলত আধুনিকতার এই রাজনৈতিক অবস্থানের বিপক্ষে একটি এনকাউন্টার পলিটিকস হিসেবে ব্যাকগ্রাউন্ড প্রস্তুত হচ্ছিল উত্তরাধুনিকতাবাদের। ঔপনিবেশিক শাসনকে বহাল রাখার জন্য এও দেখা যায় যে, শাসক শ্রেণী কিছু বাধ্যতামূলক উন্নয়নের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল (যেমন, ভারতবর্ষে নারীদের জন্য আংশিক নমনীয়তা, কাঁচামাল পাচারের জন্য রেলওয়ে ইত্যাদি)। সমালোচকগণ একে টিকে থাকার জন্য আইওয়াশ বলে আখ্যা দেন, বলেন ঔপনিবেশিক প্রভুরা তাদের নিজেদের স্বার্থেই উপনিবেশগুলােকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়েছে।

১৯৫০-৬০ দশকের আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটু মার্ক্সকে টেনে আনা দরকার। কমিউনিস্ট আন্দোলন সমগ্র দুনিয়ায় পুঁজিবাদী এসব শক্তিগুলাের শোষণের প্রতিরােধের চেষ্টা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, কিংবা গণচীনের রাজনৈতিক মডেল পরিবর্তন যাই ঘটুক না কেনাে এটা ভীষণ সত্যি যে, কার্ল মার্ক্সই প্রথম এই পুঁজিবাদী শক্তিগুলাের শক্তি আহরণ, মুনাফা আর শােষণ করার চিত্রটিকে সমাজ-বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও প্রায়ােগিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুচারুভাবে বিশ্লেষণ করেন যা এতদিনের আধুনিকতার গর্ভে জন্মলাভকারী সমাজ বিজ্ঞানের লক্ষ্য থাকলেও ব্যাখ্যা করেনি কিংবা করতে চায়নি। সমালোচকদের মতে সেটা তাহলে তাদের অর্থাৎ উপনিবেশিক রাজনীতির বিপক্ষে চলে যেতো। একটি তত্ত্বের আদর্শগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারার ক্ষমতা, নতুন প্যারাডাইমের পথ করে দেয়া। এদিক থেকেও মার্ক্সের কৃতিত্ব আছে । কিন্তু ১৯৬০ দশকের আগে আমেরিকা মুলুকে একাডেমিকভাবে মার্ক্স পঠনে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল, যা আবারাে আমেরিকান রাজনীতির সাম্প্রতিক হেজিমনি সৃষ্টিকারক এবং ফ্যাসিবাদকে তুলে ধরে (আলথুসার, গােদলিয়ার, এঙ্গেলসের অ্যান্টি-ডুরিং আর উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দ্রষ্টব্য)। মার্ক্স তত্ত্বায়ন করেছিলেন, পুঁজিবাদী শক্তি কী করে একজন ব্যক্তিকে কেবলই শ্রমিকে রূপান্তরিত করে। তাদের একটি ভিন্ন মগজ আর বিনােদনের ভিন্ন রসায়ন আছে বলে মার্ক্স মন্তব্য করেছিলেন যা শােষণকেন্দ্রিক, আধিপত্যিক এমন স্বাভাবিক মনুষ্যবৃত্তিকে মুষড়ে দেয়।

১৯৫০-৬০ এর দশকের আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া ও উত্তরাধুনিকতাবাদী দর্শন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে অর্থাৎ ১৯৫০-৬০ এর দশকে উন্নয়নের একটি প্রক্রিয়া, ভাবনা, নীতি নির্ধারক ও রাষ্ট্র পলিসি হিসেবে, পুঁজিবাদী ব্লকগুলাে সদ্য-স্বাধীন উত্তর-উপনিবেশিক দেশসমূহের বাজার দখল ও সমাজতান্ত্রিক প্রতিরােধের প্রকল্প হিসেবে উন্নত, অনুন্নত, এবং উন্নয়নশীল স্তরায়নের ভিত্তিতে একটি এজেন্ডা নিয়ে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াটি চালু হয়। অনেকে এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে বলতে থাকেন, তৃতীয় বিশ্বে ঐতিহ্য-সংরক্ষণশীলতাকে আধুনিক হয়ে ওঠার অন্তরায় হিসেবে দেখানাে হচ্ছে, জনগণের ঐতিহ্যশীল সংস্কৃতি ও জীবনক্রিয়ার বাধাকে বা এক ধরনের প্রতিরােধকে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামাের সুচারুভাবে পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে, আর এর মধ্য দিয়ে আমজনতাকে বোঝানো হচ্ছে যে, এইতাে আপনি আধুনিক হয়ে উঠছেন।… তারা দেখান, আলােকময়তার ঔরসে যে নৃ-বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছিল তাকেও বেশ পক্ষপাতমূলক রাজনীতির মধ্য দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছিল। আধুনিকীকরণের ডিসকোর্সটি যেহেতু প্রভাবের বলয় নির্মাণ করেছিল তাই এর নিরীক্ষণও হয়ে পড়ে অতি জরুরি। ইভান্স প্রিচার্ডকে (Pritchard, 1902-73) একজন ক্ল্যাসিক্যাল এথনােগ্রাফার হিসেবে দেখতে পাওয়া গেলেও দেখা যায় যে একটা সময় পর্যন্ত তার পাণ্ডিত্য ছিল কলােনিয়াল বলয়যুক্ত। যদিও পরবর্তীতে তিনি তা স্বীকার করে নিয়ে বলয়টিকে ভেঙে বেরিয়ে আসেন এবং পরবর্তীতে সামাজিক নৃ-বিজ্ঞানের একজন অন্যতম রূপকারে পরিণত হন। 

মূলত ১৯৬০ এর দশকের সংকটই আধুনিকতা সম্পর্কে তীব্র সংশয় ও প্রতিবাদকে সামনে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। ১৯৬৮ সালে প্রায় আন্তঃইউরােপীয় আন্দোলন এবং সংঘাত ও ব্যর্থতা উত্তরাধুনিক ভাবনাটিকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে সাহায্য করে। মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা, জ্যা ফ্রাসােয়া লিওতার্দ, রােলা বার্থ, জ্যা বদ্রিয়ার প্রমুখের মত উত্তর-কাঠামােবাদীরা এর ক্ষেত্রটিকে আরাে উস্কে দেন। তারা চিহ্নিতের আগে স্থান দেন চিহ্নিকারীর। তারা ভাষার এক গতিময় উৎপাদনশীলতার কথা বলেন, অর্থের অস্থিতিশীলতা এবং প্রচলিত অর্থের কাঠামাে ভাঙনের ওপর জোর দেন । দেরিদার বয়ানটি খেয়াল করুন, “The meaning of meaning is infinite implication, the indefinite referrant of signifier to signified… it always signifies and differs.’ এই Signification আরােপিত যেকোনাে কাঠামােগত বাধা ও অবরােধকে প্রতিহত করে কিংবা ভেঙে দেয়। দেরিদার ভাষ্যমতে এটি হচ্ছে Dissemination। একই জিনিস লক্ষ করা যায় দেলুজের ইচ্ছা বা বাসনার ধারণায়, লিওতারের ‘ইনটেনসিটি’ তত্ত্বে, ফুকোর ‘ক্ষমতা’, কিংবা বদ্রিয়ারের Semiurgy ভাবনায়। এ সূত্রেই দর্শনের জ্ঞান ভিত্তি পাবার ‘অসার’ কল্পনাকে আক্রমণ করা হয়। দর্শনকে দেখা হয় একটি অসম্পূর্ণতা হিসেবে। নিৎসে, মার্টিন হাইডেগার, সরেন কিয়েৎগার্ড, লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন প্রমুখ দার্শনিকদের দর্শন দ্বারা এটি প্রভাবিত বলা যায় (এরা অস্তিত্ববাদী)। বিশেষত, নিৎসের সত্য, কার্য-কারণ, মূল্যবােধ (যেমন দ্যা গড ইজ নাে মাের এলাইভ, সত্য হচ্ছে অজাচার) ইত্যাদিকে যে ভয়াল মাত্রায় আক্রমণ করা হয়, তা এক নতুন শক্তি নিয়ে হাজির হয়। অবজেক্টিভ সত্য বলে কিছু নেই, বুদ্ধি বা যুক্তির ভানকে নিৎসে মারাত্নকভাবে আহত করেছিলেন। সামগ্রিকভাবে মানবিকতাবাদী, যুক্তিবাদী আলােকময়তার প্রকল্পটি এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকেই একজন বুর্জোয়া শক্তির বিস্তারক হিসেবে নিৎসেকে দেখিয়েছেন, কিন্তু এই মানব মুক্তির চিন্তাধারায় নিৎসের গুরুত্ব অনেক। নিৎসে মানুষের সীমাবদ্ধতা এবং ইচ্ছাশক্তির ওপর অতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, ফুকো মানুষের মৃত্যু ঘােষণা করে বসলেন। তিনি তার পাগলামির ইতিহাস গ্রন্থে মানুষের সৃষ্ট সভ্যতার জোড়াতালি দেয়া চেহারার নগ্ন দিকগুলােকে মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, পাগলের সংজ্ঞাটি আসলে আমাদের সমাজে কেমন হয়? ফুকো বর্ণিত পাগল (যেমন আমাদের লালন) আর কয়েদি কিংবা পাগলাগারদের পাগল এ দুয়ের ফারাকটি শনাক্ত করতে গিয়ে একটি দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। লিওতার উত্তরাধুনিক পরিস্থিতিকে দেখেন যখন গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভ (ঐতিহ্য, ধর্মমত ইত্যাদি) এবং আধুনিকতার আশা শেষ হয়ে যায়, আর প্রচলিত ইতিহাসের অবলুপ্তি ঘটে। ফলে মানুষ ইতিহাস থেকে উত্তর-ঐতিহাসিকে অর্থাৎ এক বিশেষ ধরনের বিল্ডিং আতিশয্যের কিনারায় এসে দাঁড়ায়। কারণ, সে দাঁড়াতেই বাধ্য হয়, তাকে বাধ্য করা হয়। 

আধুনিকতার মূল সত্তাটি ছিল ইতিহাস ও উদ্ভাবন-পরিবর্তন-প্রগতি আর বিকাশের এক বিশেষ প্রক্রিয়া। বিপ্লব, গণতন্ত্র, আর সমাজতন্ত্রও ছিল এই আধুনিকতারই সফর সঙ্গী। উত্তরাধুনিকতাবাদীরা বলে বসলেন যে, এসব এখন গুরুত্বহীন। এখন ইতিহাস একটি খেলনা মাত্র যা একটি বিশেষ এফেক্ট হিসেবে শুধুই সিমুলেশন। এই ইতিহাসচ্যুতি, কেন্দ্রচ্যুতি, অর্থের বেসামাল অবস্থা এসবই উত্তরাধুনিক চিন্তার অন্যতম সমগ্র এবং সমগ্রতার ধারণা (totality) এখানে প্রত্যাখ্যাত। আধুনিক উৎস জ্ঞানতত্ত্বকে তারা বাতিল করে দিতে চাইলেন। রেনেসাঁত্তোর দু’টি পর্যায়ের কথা বলেন ফুকো ১৬৬০-১৮০০ এবং ১৮০০-১৮৫০ সাল। প্রথমটি হচ্ছে ধ্রুপদী এবং একই সঙ্গে আধিপত্যের যুগ যা মানুষের ওপর সরাসরি আধিপত্য বিস্তারের একটি শক্তিশালী পদ্ধতি গড়ে তুলেছিল, এটি আধুনিক যুগে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয়। ঐতিহাসিক প্রগতির জ্ঞানতত্ত্বকে ফুকো নস্যাৎ করে দেন। এই চিন্তা-চেতনার ধারাবাহিকতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শিল্প-সাহিত্য, স্থাপন বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব এবং দর্শনসহ জীবনযাত্রার নানা ম্যাক্রো আর মাইক্রো স্তরে।

নৃবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের ধারণায় ক্রমপরিবর্তন এবং আধুনিকতা-উত্তরাধুনিকতা দ্বন্দ্ব

ফুকোর মতে নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞানকাণ্ডটি হল আলােকময়তাসহ ইউরােপের বর্তমান অবস্থানে আসা। জটিলসমগ্রকসহ আধুনিকতার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এক বুদ্ধিবৃত্তিক বৈশিষ্ট্যসমূহ হচ্ছে ব্যক্তিবাদ, যুক্তি ও যৌক্তিকতা, পুঁজিবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ, শিল্পায়ন, প্রযুক্তি এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আধুনিকতাকে ধারণ করে যে অবস্থা, ব্যক্তি, তত্ত্ব বা শাস্ত্র সেগুলােও নিশ্চিত আধুনিক। ফলে আধুনিকতার বাহক হিসেবে নৃ-বিজ্ঞানকে ঐতিহ্যশীল মানুষের ওপর আধুনিক মানুষের কৃত গবেষণার জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে দেখা সম্ভব। সাম্প্রতিক নৃ-বিজ্ঞানীরা অবশ্য এ বিষয়টিকে গুরুতরভাবে বিবেচনা করছেন এবং এই লজ্জা থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জোনাথন স্পেন্সার তার Encyclopaedia of Social and Cultural Antharopology গ্রন্থে নৃ-বিজ্ঞানের সঙ্গে আধুনিকতার সম্পর্ককে যে চারটি ধাপে তুলে ধরেন সেগুলো হল – 

  • ১. ১৯ শতকের শুরু থেকেই নৃ-বিজ্ঞান আধুনিক হিসেবে ‘আধুনিক’ ঐতিহ্যশীল সমাজ বা সংস্কৃতিকে গবেষণার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। বিবর্তনবাদী তত্ত্ব (cultural evolutionism) এ সময়েই গড়ে উঠেছিল। 
  • ২. ১৯৫০ এর দশক পর্যন্ত উত্তর-উপনিবেশিক দেশসমূহে গবেষণা করা হয়েছে। এ সময়ে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে এসে একজন নৃ-বিজ্ঞানী কেবল ‘অপর’কে নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হয় না বরং এর অধীনে তাকে পরিবর্তনও করতে চায়। 
  • ৩. তৃতীয় ধাপটি ১৯৮০ এর দশকে শুরু হয়। এটি উত্তর আধুনিকতাবাদের পর্যায়। এ সময়ে একজন উত্তরাধুনিক মানুষ ‘আধুনিকতা’ ও ‘আধুনিকীকরণের’ ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে সচেষ্ট। কী করে আধুনিক নৃ-বিজ্ঞানীরা ‘অপর’কে নির্মাণের ছলে নিজেদের রেপ্রিজেন্টেশনকেও নির্মাণ করে নিচ্ছিল, কী করে পশ্চিমের এজেন্ট হয়ে উঠেছিল, কী কারণে তা আধুনিক জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে বেড়ে উঠেছিল বা এখনাে উঠছে তা দেখতে চান।
  • ৪. ইউরােপ, আমেরিকায় ‘আধুনিকতা’কে পরিণত করা হল গবেষণার বিষয়বস্তুতে। এটাকেই এসকোবার বলছেন, এ্যানথ্রোপােলােজি অব মডার্নিটি অর্থাৎ যা কিছু ‘আধুনিক’ তাকে জাতিতাত্ত্বিকভাবে দেখা। এরা উত্তরাধুনিকতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও এটিকেও যেন ছাড়িয়ে যেতে চান। এখানে ‘আধুনিকতা’ কি করে কিংবা ঠিক কীভাবে ক্ষমতা স্থাপন করেছিল, তা দেখার জন্য পুঁজিবাদ, ভোগবাদ, মিডিয়ার নৃ-বিজ্ঞান গঠন করা হয়।

১৯শ শতাব্দীতে সমাজ বিজ্ঞানে এবং নৃ-বিজ্ঞানে বিবর্তনবাদী চিন্তা প্রভাবশালী হয়েছিল। এ সময়কার তাত্ত্বিকদের মধ্যে লুই হেনরি মর্গান, এডওয়ার্ড টেইলর ছিলেন অন্যতম। যদিও এটা সত্যি যে, তাদের সাথে সাথে এমিল ডুর্খেইম, সেন্ট সিমোঁ, অগাস্ট কোৎ না এগিয়ে আসলে একটি সাম্প্রতিক জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে এই নৃ-বিজ্ঞানকে পাওয়া যেত কিনা সংশয় আছে। বিবর্তনবাদীরা সমাজ বিবর্তনের ঘটনাকে একরৈখিক ভাবতেন যেখানে সমাজ আদিম বা বুনাে, বর্বর দশা পেরিয়ে ক্রমান্বয়ে সভ্য হয় এবং উপনিবেশিক রাজনীতিকে সুযােগ করে দেয়। পরবর্তীকালে ফ্রাঞ্জ বােয়াসের সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ এবং ঐতিহাসিক নির্দিষ্টতাবাদের ধারণা বিবর্তনবাদী তত্ত্বের তীব্র সমালােচনা করে উন্নত বা অনুন্নত স্তরায়ণের ধারণাকে তিনি বাতিল করে দেন। তিনি প্রশ্ন করেন, এটা কী করে সম্ভব যে, আমি আমার মানদণ্ডে অন্যকে ঠিকভাবে বুঝতে পারবাে? কোনাে স্ট্যান্ডার্ড ধরে মানুষকে বােঝা যাবে না, আর গেলেও সেটা ভ্রান্ত হতে বাধ্য। এ সময়ে ব্যাপ্তিবাদী তত্ত্ব সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তির ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা চালায়। তারা খোঁজার চেষ্টা করেন যে, সাংস্কৃতিক যােগাযােগের ফলে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে রূপান্তর বা পরিবর্তন ঘটে তা কেন ঘটে বা কীভাবে ঘটে। শেষ পর্যন্ত জার্মান ব্যাপ্তিবাদী স্কুল এটা বলল যে, কেবল নেয়াই নয়, একটি সংস্কৃতি তার স্ব-উদ্ভাবন ক্ষমতার উৎপাদনশীলতার হেতু হিসেবেও অন্য সংস্কৃতির কোনাে বৈশিষ্ট্যকে আত্মস্থ করতে পারে। আমেরিকান স্কুল বলল যে, সাংস্কৃতিক আত্মীকরণ (Acculturation) প্রক্রিয়াতে এমনটি ঘটতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক জটিলতর বৈশ্বিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই ব্যাপ্তি একটি নিত্য নৈমিত্তিক এবং অনিবার্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে যার কারণ হিসেবে দেখানাে যেতে পারে প্রয়ােজনীয়তা আর উপযােগিতাসম্পন্ন উদ্ভাবনের অভাবকে। রেডিক্যাল তরুণ প্রজন্মকেন্দ্রিক পরিবর্তন বা রূপান্তরের উদাহরণ এনে দেখানাে যায়, আফগানিস্তানে বিন লাদেনের অনুপস্থিতি এবং আমজনতার সুরত বদল এবং এসবের সাড়া জাগানো প্রকাশ| আধুনিকের সেই উপনিবেশিক রাজনীতি এখানেও সমান তালে রাজত্ব করতে চেষ্টা করেছে এবং বলেছে যে, তারা সর্বাধিক ভালােত্বকে গ্রহণ করে এতদূর এসেছে। ম্যাক্স ওয়েবার যৌক্তিকীকরণ বা র‍্যাশনালাইজেশন ধারণাটিতে বলছেন, কোনাে সমাজের পুঁজিবাদের মধ্য দিয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে যুক্তিশীলতার দিকে যাত্রা এবং যৌক্তিক হওয়া মানেই অগ্রসর বা ডেভেলপড হওয়া (যা তৈরি করে ভয়ংকর সামাজিক-সাংস্কৃতিক এলিয়েনেশনের; মার্ক্সও এই এলিয়েনেশনকে দেখে তবে শ্রম ও শ্রমিকের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্কের মাধ্যমে)।

মার্ক্স বলছেন যে, উন্নত শিল্পায়িত সমাজ হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম উন্নত সমাজের ভবিষ্যৎ রূপ। তিনি উৎপাদন শক্তি-সম্পর্ক-পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সমাজে বিকাশকে ঐতিহাসিকভাবে দেখেন এবং ভবিষ্যৎবাণী করেন। ডুর্খেইমের মতে পুরনাে ঐতিহ্যশীল সমাজ যেখানে শ্রম-বিভাজন নেই, সেখানে ‘মেকানিক্যাল সলিডারিটি’ আছে। সমাজ ক্রমে জটিল হয়েছে যেখানে নগরায়নের ধারণাটি বর্ধিষ্ণু হচ্ছে (যেমন, মেট্রোপলিটান), এবং শ্রম-বিভাজন চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। তিনি এ ধরনের লক্ষণাক্রান্ত সমাজকে বলছেন ‘অগানিক সলিডারিটি’। উলবার্ট মুর (১৯৬৩) বললেন যে, আধুনিকতা প্রত্যয়টি দ্বারা ঐতিহ্যবাহী সমাজ হতে সংগঠিত সামাজিক সংগঠন এবং প্রযুক্তিগত সামগ্রিক রূপান্তরকে প্রকাশ করা হয়। এর লক্ষ্য হল, সকল সমাজ অগ্রসর হবে, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশীল হবে, এবং রাজনৈতিকভাবে স্থিরতা অর্জন করবে। এগুলাে কিন্তু পশ্চিমা জাতিগুলাের বৈশিষ্ট্যে সুস্পষ্ট যা তারা করে বা করতে চায় ভদ্রতার খােলশে (রবি ঠাকুরের বিখ্যাত সেই বিলেত ভ্রমণের কাহিনিটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে)। নেইল স্পেন্সর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সামাজিক রূপান্তরকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। তার মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে জনগণের মাথাপিছু আয়ের উৎপাদন বৃদ্ধি, যা চারটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে, এগুলো হল – 

  • ১. প্রযুক্তির আধুনিকীকরণের ফলে ঐতিহ্যগত সরল প্রযুক্তির স্থলে নতুন প্রযুক্তি আসবে এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রয়ােগ করা সম্ভব হবে (যেমনটি ঘটছে কৃষকের হাতে বহিরাগত হাইব্রিড বীজ তুলে দেয়ার মাধ্যমে)। 
  • ২. অর্থকরী ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ এবং নাম দেখানাে বেতন-স্কেল কিংবা প্রাপ্য দিয়ে সন্তুষ্ট করে রাখা এবং এর খাতিরে কৃষি ব্যবস্থাকে নতুন করে প্রস্তুত বা নির্মাণ করা। এখানে পণ্যের সরবরাহ অতি গুরুত্বপূর্ণ। 
  • ৩. শিল্পায়ন যন্ত্র নির্ভরশীলতা এবং মানুষ কিংবা পেশীশক্তির ব্যবহার কমিয়ে আনা। পণ্যের উৎপাদন উন্নত শিল্পায়ন ঘটাবে। 
  • ৪. নগরায়ণের ফলে পরিবৈশিক পরিবর্তন সাধিত হবে এবং গ্রামীণ পরিস্থিতি রূপান্তরিত হতে থাকবে শহুরে ভাবধারায়। ভিড় জমবে শহরে কিংবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের আশেপাশে।

স্পেন্সরের ভাষ্য মতে, এই চারটি প্রক্রিয়া যুগপৎভাবে সংগঠিত নাও হতে পারে। যেমন, বহু উপনিবেশে শিল্পায়ন ব্যতীত কৃষি বাণিজ্যিক রূপ লাভ করেছিল। আধুনিকীকরণের এই চারটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দু’টি ঘটনা ঘটবে – 

  • ১. কাঠামােগত পৃথকীকরণ হবে। যেমন, যখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে তখন পরিবার থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং উৎপাদন পৃথক হয়ে পড়বে। পারিবারিক শ্রম রূপান্তরিত হবে মজুর শ্রমে। ফলে পরিবারের সদস্যদের আচরণ এ কাঠামােগত পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়বে। পরিবারে কর্তৃত্বের ধরনও পাল্টে যাবে। যৌথ পরিবার ভেঙে হুলুস্থুল পড়ে যাবে একক পরিবারে পরিণত হওয়ার, বদলে যাবে প্রথাগত জ্ঞাতিত্বের সম্পর্ক, বিবাহের রকম পাল্টে যাবে, যেহেতু সঙ্গীকে বাছাই করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর অধিক জোর দেয়া হবে এবং যেহেত নারী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অধিক স্বাধীন হয়ে পড়বে, পারিবারিক মত-প্রাধান্যও মামুলি হয়ে যাবে এবং যােগ্যতার ধারণাটি সামনে চলে আসবে। ভিয়েতনাম, চীন বা জাপান কিংবা ভারতের বহু নারী এখন সঙ্গী বাছাই করার ক্ষেত্রে নিজ মতকে প্রাধান্য দেয়, তার ইচ্ছেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে। বিভিন্ন ডেটিং ও ম্যাচমেকিং ওয়েবসাইট তৈরি করে দিচ্ছে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা। 
  • ২. একইসাথে একত্রীভবনের ঘটনাটিও ঘটবে যেখানে পৃথকীকৃত কাঠামােগুলাে একত্রিত হয়ে একটি নতুন পরিস্থিতি বা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে। এই নতুন সমাজের সদস্যদের মধ্যে যােগাযােগ ঘটানাের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটবে। যেমন, পূর্বেকার জ্ঞাতিদলের পরিবর্তে এখানে একটি আধুনিক রাজনৈতিক কাঠামাে প্রস্তুত হবে যা একটি বিশেষায়িত রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের মধ্যে একত্রীভবন গড়ে তােলার চেষ্টা করবে।

তিনি বলেন যে, পৃথকীকরণের সাথে সাথে একত্রীভবন সবসময় একত্রে ঘটে। ফলে তা সামাজিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে তৈরি করে কতগুলাে এলিয়েনেটেড বা বিচ্ছিন্ন প্রাণী বা নাগরিক। তিনি আফ্রিকান ট্রাইবদের উদাহরণ টেনে বলেন যে, সেখানে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষা কাঠামাে আধুনিক হলেও পারিবারিক মতাদর্শ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক চিন্তাকল্প ঐতিহ্যশীলই থেকে গেছে। ফলে নতুন কর্মকাণ্ড ও প্রতিষ্ঠানের সাথে ঐতিহ্যশীল কর্মকাণ্ড ও পরিস্থিতির দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তিনি মনে করেন, এ মডেলটি সামাজিক উন্নয়নের আদর্শ প্রক্রিয়াসমূহকে অনেকটাই বর্ণনা করতে পারে। আইজেনস্টাইন আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়াগত ভিন্নতার কথা বলেন এবং পৃথকীকরণ ও একত্রীভবনের সঙ্গে যােগ করেন অভিযােজনের ধারণা। বর্তমান সময়পর্বকে মার্ক্সের মন্তব্যের সঙ্গে একাত্ম হয়েই বলা হচ্ছে চূড়ান্ত ভােগবাদের যুগ।

আধুনিকতার ঐতিহ্যশীল সংস্কৃতিকে অ-উন্নয়ন ও দারিদ্র্যের মূল কারণ হিসেবে ভাববার প্রবণতাটিকে নব্য মার্ক্সবাদীরা মারাত্মকভাবে আক্রমণ করেন। আধুনিকীকরণের প্রতি শতাব্দীর প্রথম ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ হিসেবে তারা বললেন যে, ঐতিহ্যকে আক্রমণ করাটা সঠিক নয়। কারণ, ঐতিহ্যকে ধরে রেখেও অগ্রসর হওয়া অসম্ভব নয়। নৃ-বৈজ্ঞানিক গবেষণা কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও পরবর্তী দশকে অর্থাৎ ১৯৭০ এর দিকে ব্যাপারটি নিয়ে তীব্র সমালােচনা হতে থাকে। এ কতগুলাে কারণও ছিল। যেমন, হােবার্ট ও কেটি গার্ডনারের মতে, আধুনিকীকরণে ঠিক যেভাবে একরৈখিক ভাবনাদ্বারা উন্নয়নকে দেখা বা চাওয়া হয় তা দ্বারা সমাজসমূহের মধ্যকার সত্যিকারের ভিন্নতাকে চিহ্নিত করা যায় না বরং সকল সমাজের জন্যই উন্নয়নের একটি পদ্ধতি হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালানাে হয়। উত্তরাধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিক হােবার্ট আধুনিকীকরণের উন্নয়ন পন্থাকে দুর্ভাগা মানুষের জন্য পরার্থবাদী কোনাে চিন্তা হিসেবে না দেখে পশ্চিমা শিল্প-কারখানা এবং স্থানীয় সরকারের অবস্থা উন্নয়নের একটি লাভজনক বাণিজ্য বলেই ভাবতে চান। তার মতে, আধুনিকীকরণের একরৈখিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে এতদিনকার স্থানীয় মানুষের জ্ঞানকে অজ্ঞতায় পরিণত করা হয় এবং এ জ্ঞানের ধারকবাহকদের ‘অ-উন্নত’ ও ‘মুর্খ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। যে জ্ঞান আধুনিক পশ্চিমা সমাজ অর্জন করতে বলে বা করতে চায়, যে জ্ঞান আধুনিকতাকে ধারণ করে, কেবল মাত্র সে জ্ঞানকেই প্রকৃত জ্ঞান হিসেবে সে চিহ্নিত করে থাকে। ফলে জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে সচেতনভাবে অজ্ঞানতাকেও সৃষ্টি করা হয় অর্থাৎ সমাজকে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখে দেয়া হয় যা তার প্রতিরােধের ক্ষমতাটিকেও সম্মােহিত করে রাখতে সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল থাকে। কে টি গার্ডনার বলেন যে, আধুনিকতায় স্থানীয় জনগণকে অবজ্ঞা করা হয় এবং এ কারণেই বেশিরভাগ উন্নয়ন প্রকল্প ব্যর্থ হয়, সৃষ্টি হয় সীমাহীন দারিদ্র্য। পশ্চিমের এই মডেলটিকে অনুসরণের মধ্য দিয়ে অগ্রগতি সম্ভব এমন ধারণাকে তিনি স্রেফ এথনােসেন্ট্রিক বলছেন। তিনি এও বলছেন যে, এটি অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মারাত্নক রকমের ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।

আধুনিকীকরণ তত্ত্ব যে সামাজিক বাস্তবতার সদৃশ বা সামঞ্জস্যতাপূর্ণ নয় তা। এপস্টেইন এর ইকোনােমিক ডেভলপমেন্ট এন্ড সােশ্যাল চেইঞ্জ ইন সাউথ ইন্ডিয়া (১৯৬৭) শীর্ষক গবেষণাকর্ম থেকে বেশ সুস্পষ্ট। নেইল স্পেন্সারের তত্ত্বানুসারে আধুনিক কৃষি ও বাণিজ্যিক কৃষি স্থানীয় সমাজের সামগ্রিক জীবনে একটি। কাঠামােগত পরিবর্তন সাধন করে এবং উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু এপস্টেইন মহিশুরের ওয়ানগালা (Wangala) গ্রামে কাজ করে দেখেন যে, সেখানকার কৃষি অর্থনীতিতে সেচ প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও ঐতিহ্যশীল সামাজিক সংগঠন বজায় ছিল। আবার দালেনা গ্রামে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন না হলেও সেখানকার জনগণ ব্যাপকহারে শহুরে কর্মজীবনের সাথে যুক্ত হওয়ায় সেখানে সামাজিক কাঠামাে বিস্তৃতভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। তার মতামত হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঐতিহ্যবাহী অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তন ছাড়াই সূচিত হতে পারে। গার্ডনারের মতে, স্থানীয় সংস্কৃতি ও সমাজকে বাধা হিসেবে দেখার প্রবণতাটি আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া বা তত্ত্বটির প্রতিক্রিয়াশীলতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। কারণ, এটি দেখে না যে, দরিদ্র দেশের জনগণ তাদের স্বার্থের অনুকূলে পরিবর্তনমূলক কাণ্ডকে আমল দিয়ে থাকে এবং জটিল পরিস্থিতিতে কোন কৌশলটিকে বেছে নিতে হবে তা তারা উন্নয়ন পরিকল্পনাকারীদের চেয়ে ভালােই জানে। তিনি আরাে বলেন যে, মাইক্রো পর্যায়ে উন্নয়নের ক্ষেত্রে নৈতিক প্রভাবকেও আধুনিকীকরণ তত্ত্ব গুরুত্ব দেয় না। সমাজস্থ বিভিন্ন গােষ্ঠীকে এটি সমরূপ হিসেবে দেখে থাকে এবং সর্বত্র সমান উন্নয়ন সম্ভব বলে মনে করে থাকে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্ব প্রত্যয়টির অনকলে যে সমস্ত স্তরাভূত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে উন্নয়নের পরিকল্পনা বা নক্সা, কিংবা সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে তাও তাদের হাতে এসে পৌঁছায় না। আধুনিকতা প্রয়ােগকৃত অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিষয়সমূহকে আড়াল করে রাখে যা ঐসব অঞ্চলের পশ্চাৎপদতার আসল কারণ।

উত্তরকাঠামোবাদ এবং দেরিদার বিনির্মাণ

১৮৯০ থেকে ১৯১০ এর দশকব্যাপী রােমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে ‘ব্যক্তির স্বাধীনতা’ দাবি করা হয়। ফ্রান্সের আলফ্রেড লয়সি, লুসিয়ান ল্যবারথােনিয়ার, বন্ডেল, ইতালির রােমােলাে ট্যুরি, অ্যান্তোনও ফোরাজ্জারাে, বৃটেনের জর্জ টিরেল এবং ব্যারেন ফ্রিডারিখ, ভন হুগেল প্রমুখ এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন যেখানে হেগেল, হাইডেগার, মার্ক্স, কিয়ের্কেগার্ড প্রমুখের চেতনা জারিত হয়েছিল। আন্দোলনটিকে বােঝাতে আধুনিক’ শব্দটি নতুনভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল (বৃটিশ রােমান্টিসিজমে কিছু সংস্কারবাদী ক্ৰিয়ালাপ এবং এর খারাপ দিকগুলােকেও বিশেষ জোর দিয়ে বুঝতে হবে)। ফরাসি আলােকময়তার মানব মুক্তিকামী লক্ষ্যটির বর্ণনাগুলাে (যেমন, সেকুলারিজম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যাবাদ, নারী মুক্তি, গণতন্ত্র) ধারণ করে এগিয়েছে আধুনিকতার গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ। কিন্তু সূক্ষ্ম রাজনীতির করাল থাবায় পরিণত হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আখ্যানে। যখন হাবারমাস বলে বসলেন যে, আধুনিকতাও হচ্ছে একটি অসম্পূর্ণতা এবং চাপিয়ে দেয়ার অনৈতিক প্রকল্প। কিন্তু এর দিন ফুরিয়ে এসেছে, তখনই সৃষ্টি হয় একটি প্রতিক্রিয়াশীল উত্তরাধুনিক পরিস্থিতি।

এটি সুস্পষ্ট যে, একটি সম্পূর্ণ জ্ঞানতত্ত্ব বা জগৎবীক্ষা এবং জ্ঞানের বিশ্বায়ন হিসেবে আধুনিকতার যে রাজনীতি কিংবা মূল মানব মুক্তির জায়গাটি থেকে সরে আসা, তার তীব্র সমালােচনা এবং প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান থেকেই জন্ম নিয়েছিল উত্তর আধুনিকতাবাদের বীজ। বিভিন্ন পেইন্টিং বা শিল্প আন্দোলনের মাধ্যমে এই প্রতিক্রিয়াশীলতা বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে শিল্পের বিভিন্ন শাখায় তা ছড়িয়ে এবং প্রচলিত সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন জ্ঞানকাণ্ডের প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ তােলে এবং এটা বেশ র‍্যাডিক্যাল আকারেই সব জায়গাতে ছড়িয়ে পড়েছিল। 

উত্তরাধুনিকতা সত্যকে বহুবচন রূপে দেখতে চায়, সত্য নয়, সত্য ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানতত্ত্বের ওপর দাড়িয়ে পারিপার্শ্বিক তথা বিশ্ব সম্পর্কে যে প্রতীকায়ন এবং নিজস্ব অর্থময়তা কিংবা সত্যকে নির্মাণ করে। ব্যক্তির সাবজেক্টিভিটিই কি নৈর্ব্যক্তিক সত্যকে নির্মাণ করে? মূল্যবােধ যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে মূল্যহীনতার বােধটি কী সেটিও দেখতে হবে। তাছাড়া যে মূল্যবােধ আমি সাহিত্যে চাই, জীবনে তা চাই কি? সেটি নির্ধারণে আমার কী ভূমিকা ছিল? সেই মূল্যবােধ কি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে? ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলাের ওপর ‘মূল্যবােধ’ বা মূল্য চাপিয়ে দেয়ার ফলাফলটি কি সমর্থনযােগ্য? শিল্প-সাহিত্য রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা সমাজনীতিতে যে কাঠামােটি আছে তা কি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না? তাই কাঠামাের বিপরীতে উত্তরাধুনিকতার কাঠামােহীনতা। এর কাঠামােটি বলে যে, কোন সুনির্দিষ্ট কাঠামাের ভেতর থেকেই প্রকৃত অর্থকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, কেননা প্রকৃত অর্থ লুকিয়ে থাকে এবং সেই অর্থকে খুঁজতে হলে কাঠামােকে ছাড়িয়ে যেতে হবে এবং অর্থ খুঁজতে হবে যতটা সম্ভব সসীম আকারে। একটি অর্থের একটি ব্যাখ্যার আরাে প্রতিব্যাখ্যা কিংবা বিনির্মিত ব্যাখ্যা তৈরি করতে হবে। কারণ, তাতাে ভাষাতেই লুকিয়ে থাকে। শিল্প-সাহিত্য, দর্শন কিংবা জীবনযাত্রা সমস্ত ক্ষেত্রেই উত্তরাধুনিকতা চরম রকমের উদার।

আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব তৈরিতে অথরশিপ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটা সমাজতত্ত্ব, নৃ-বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য, রাজনীতি, দর্শন প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সমানভাবে স্বীকার্য। ১৮শ শতকের দিকে যখন ফরাসি দেশে আলােকময়তার আন্দোলনটি তার ভিত্তি রচনা করেছিল তাতে ভলতেয়ার, জাঁ জাক রুশাে, দিদেরাে, দেলুজ, ফ্রেজার, কিংবা অগাস্ট কোৎ প্রমুখের লেখালেখির তীব্র প্রভাব থেকেও অথরশিপের গুরুত্ব বেশ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি লেখা কিংবা সুচিন্তিত রচনা মানুষের মনােজগতকে তুমুলভাবে আন্দোলিত করতে পারে, তাকে হাসাতে পারে, কাঁদাতে পারে, কিংবা একটি নতুন বিপ্লবী রূপান্তরের সিদ্ধান্তের মুখােমুখি নিয়ে দাঁড় করাতে পারে, কিংবা বাজে বলে আপনার পাশে রাখা ছােট্ট ময়লার ঝুড়িটিতেও তার চমৎকার জায়গাটি করে নিতে পারে। আপনি কি টের পাচ্ছেন একটি রচনার কি পরিমাণ ক্ষমতা। মার্ক্স, নিৎসে, কিংবা রবি ঠাকুর আর নজরুলের সাহিত্য রচনার কথাই ভাবুন। লেখকের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব এবং তার সচেতন অংশগ্রহণ একটি আখ্যানের সৃষ্টিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত। একজন লেখক নানাভাবেই তার চিন্তাকল্পকে শেয়ার করেন, উস্কে দেন কিংবা নিরুৎসাহিত করতে চান কিংবা জন্ম দেন একটি আখ্যানের। উৎপাদিত এসব আখ্যানে লেখকের একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা থাকে। আধুনিক রচয়িতা হচ্ছেন একাধারে একজন সংস্কারক, পরিকল্পক এবং মেসেজ প্রদানকারী। চরিত্রটি প্রচণ্ড শক্তিমান। কিন্তু উত্তরাধুনিকতাতে রচয়িতার সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়। এখানে রােলাঁ বার্থ রচয়িতার মৃত্যুর কথা লেছেন। কারণ, রচয়িতার মৃত্যু থেকেই একজন পাঠকের জন্ম হয় (Barthes, 1977:148)। উত্তরাধুনিকতা নতুনভাবে-নাটকীয় কায়দায় রচয়িতা, টেক্সট এবং পাঠকের ভমিকাকে পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। বার্থের বিবেচনায় পাঠকের গুরুত্ব এবং ক্ষমতা অনেক বেশি। একজন উত্তরাধুনিক পাঠক অভূতপূর্ব সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং প্রত্যেক পাঠকই সমান। কারাে থেকেই কেউ কোনাে অংশে কম যাবেন না। এটি জগতের সবকিছুকেই একটি টেক্সট আকারে দেখে। তবে এই টেক্সটের কোনাে মূর্ত ও বাস্তব আকার নেই। পাঠক এবং টেক্সট হচ্ছে আন্তঃ নির্দেশক (inter referential)। টেক্সটে কোনাে অর্থ থাকে না, অর্থ থাকে পাঠক এবং টেক্সটের মিথস্ক্রিয়ার ভেতর। প্রতিটি মিথস্ক্রিয়া অনন্য, স্বতন্ত্র, সাময়িক এবং কখনােই চূড়ান্ত নয়। পাঠক টেক্সট নির্মাণ করে, টেক্সটও পাঠককে নির্মাণ করে (Rosenaue, 1992)। এখানে ব্যক্তি জ্ঞানার্জন বা সত্যকে জানার জন্য পড়েন না এবং লেখার জন্যও লেখেন না বরং সে অভিজ্ঞতার আনন্দ পেতে পড়ে। টেক্সটের যেকোনাে জায়গা, এমনকি শেষ পর্যন্ত শেষ থেকে শুরু কিংবা মাঝ থেকে শেষ করতে পারবে। তার পড়াশুনার জন্য বিশেষ কোনাে কায়দা নেই। এখানে রচয়িতাকে কর্তৃত্বমূলক গণ্য করে বাতিল করা হয়েছে। রচয়িতা কী লিখছেন, টেক্সটে তার নিজস্ব কী অর্থ লুকিয়ে আছে, কী অভিপ্রায় সুপ্ত থেকে গেছে, কিংবা রেপ্রিজেন্টেশনের রাজনীতিটা কী থেকে গেছে তাকেই টেক্সটের অর্থ হিসেবে নেয়া হয়। একজন উত্তরাধুনিক পাঠক সে অর্থকেই খুঁজে বের করবে। এজন্য রচয়িতার বায়ােগ্রাফি কিংবা লাইফ প্রােফাইলকেও বিবেচনায় আনতে হবে, প্রেক্ষিতকে মেলাতে হবে। কারণ, তিনি প্রেক্ষিত দ্বারা খানিকটা হলেও প্রভাবিত। বৃহৎ অর্থে, একজন আধুনিক রচয়িতা হচ্ছেন এমনই একজন এজেন্ট যিনি কোনাে অবস্থার সৃষ্টি করেন না কিংবা যিনি ঘটনার ঘটমানতার জন্য বা বিশেষ সামাজিক ফলাফল অর্জনে দায়ী। আধুনিক এই রচয়িতা সমাজের একজন আইন প্রণেতা, একাধারে একজন বিশেষজ্ঞ, ব্যবস্থাপক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, কিংবা শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন। তারা সত্য নির্ধারণ করেন। আরাে ব্যাপক অর্থে, এই রচয়িতা একজন একক ব্যক্তি বা সামষ্টিক প্রতিভূও হয়ে উঠতে পারেন।

ফুকো এই রচয়িতার চরিত্রটিকে একটি বুর্জোয়া উৎপাদন বলে মনে করেন। রচয়িতার কর্তৃত্ব প্রথমে সাহিত্যে উদ্ভব হয় নি বরং মধ্যযুগের বিজ্ঞানে এর উদ্ভব। আধুনিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যের রচয়িতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন নি। ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদ, ফরাসি যুক্তিবাদ এবং সংস্কারবাদী ধারার সাথে একই সঙ্গে উদ্ভব ঘটেছিল আধুনিক রচয়িতার (citation Harari, 1979; 143)। কাঠামােবাদীদের ধারণা থেকেই রচয়িতার পতন শুরু হয়। তাদের মত রচয়িতা কোনাে পাঠ্য উৎপাদন করার পরই প্রকাশনা বা পাবলিসিটির জন্য ছেড়ে দেন। এর ওপর তার আর বিশেষ কোনাে অধিকার বলবৎ থাকে না। কারন নানাজন নানাভাবে টেক্সটকে পাঠের মাধ্যমে নির্মাণ করবে। তাই তিনি তা কোনাে একক স্রষ্টা নন। রচয়িতার সৃষ্টিশীল কাজ তার টেক্সটি তার সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত অবস্থান থেকে উদ্ভূত। রচয়িতার কর্তৃত্ব নিয়ে সংশয়বাদী এবং আশাবাদী উত্তরাধুনিকতাবাদী- উত্তরকাঠামােবাদীদের দৃষ্টিগত পার্থক্য রয়েছে। সংশয়বাদীরা বলেন, রচয়িতার টেক্সট পাঠের (লেখ্য-পাঠ এবং পঠ্য-পাঠ) মাধ্যমে সত্যিকারের লােকটি ভাবার কোনাে কারণ বা সুযােগ নেই। রচয়িতার মানে এই নয় যে, তিনি তাই বোঝাতে চেয়েছেন (Spivak, translated, 1976: 158)। আশাবাদীরা রচয়িতাকে পুরােপুরি ত্যাগ করেন না। তবে এভাবে বলেন যে, রচয়িতা থাকবে কিন্তু সংশােধিত আকারে। সংশয়বাদীদের মতে, সামাজিক বিজ্ঞানে রচয়িতার মৃত্যু থেকে উত্তরাধুনিক ব্যাখ্যাকারীর জন্ম হয়েছে। এই ব্যাখ্যাকারীরা অন্যান্য আইন প্রণেতাদের মত নন। তারা কোনাে সত্য বাতলে দেন না, নির্মাণ করেন না, কিংবা নির্দেশনা বা সমাধানের পথও বাতলে দেন না। তারা শুধুমাত্র বিভিন্ন বিকল্পকে তুলে আনার জোর প্রচেষ্টা চালান এবং জন-বিতর্কে’ সমানভাবে অংশ নেন। ব্যাখ্যাকারীর মূল্যায়ন তখনই হয় যখন তার দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবান হয় অর্থাৎ যখন সেটি অর্থময় হয়। এটি ব্যক্তিকেন্দ্রিকভাবেও অর্থপূর্ণ হতে হবে। ব্যাখ্যার সত্যতা নির্ভর করে, যে সম্প্রদায় বা কমিউনিটির সদস্যদের যে পরিমণ্ডলে রেখে গড়ে তােলা হয়, তার ওপর। এক্ষেত্রে জ্ঞান এবং সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে প্রাসঙ্গিক। আর সত্য প্রাসঙ্গিক হয় তার সম্প্রদায়ের মূল্যবােধ সাপেক্ষে। অন্য সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সত্যটি ভিন্নও হতে পারে। আর তেমনটাই তাে স্বাভাবিক। যেকোনাে জ্ঞানের নীতি কেবলমাত্র তার সম্প্রদায়ের ভেতরেই প্রয়ােগযােগ্য, বাইরে নয়। যেমনটি আদি গ্রান্ড থিওরিগুলাে করার ফিকির করেছিল। কারণ, সেগুলাে ভুল, ভ্রান্তি, অলীক, কিংবা অপ্রয়ােগ সাপেক্ষ।

উত্তরাধুনিকতায় রচয়িতার একাডেমিক ফর্মটি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। রচয়িতার অনুপস্থিতি একজন ঐতিহাসিক, সমাজ তাত্ত্বিক, মনােবিজ্ঞানী, নৃ-বিজ্ঞানী, প্রত্নতাত্ত্বিক, ব্যাখ্যাকারী কিংবা যারা কোনাে একক ব্যক্তি বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তির জীবন-অভিজ্ঞতা খোঁজেন হতে পারেন তিনি এরিস্টটল, ফ্রয়েড, মার্ক্স, মাদার তেরেসা, মেরেলিন মনরাে, কিংবা পামেলা এন্ডারসন (রেপ্রিজেন্টেশনের প্রেক্ষিতে) – তাকে ভেঙে খান খান করে দিয়েছে। রচয়িতার এখানে কোনাে সামাজিক দায়িত্বশীলতা থাকবে কি থাকবে না, এটা নিতান্তই নৈর্ব্যক্তিক। কারণ, উত্তরাধুনিকতায় কর্তৃত্বের অস্তিত্ব বা কার্যকারণ কোনাে কিছুই আর কার্যকর বা অস্তিত্বশীল থাকে না। কার্যকারণ আরােপনের বিষয়টিকে উত্তরাধুনিকরা ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে গণ্য করেন। মনে করা হয় যে, নির্দিষ্ট কার্যকারণসম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। যাকে বলা হয় উত্তরাধুনিক ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি। কেননা, সবকিছুই সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি হচ্ছে সীমাহীন। জটিল এবং আন্তঃসম্পর্কেও আন্তঃবুনন। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে, উত্তরাধুনিক সমাজ বিজ্ঞানে প্রপঞ্চের উদ্ভব বা উৎস্যের পরিপ্রেক্ষিতের কারণ সন্ধানের ব্যাপারটিই আর থাকছে না। এটাও হয়ে পডছে অর্থহীন। এক্ষেত্রে সমস্ত পৃথিবী হচ্ছে ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি, যেখানে কোনাে কর্তৃত্ব থাকবে না, কোনাে এজেন্ট থাকবে না।

উত্তরাধুনিকতায় বাস্তব রচয়িতার (অধ্যাপক, রচয়িতা, বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি) পরিবর্তে একজন উত্তরাধুনিক রচয়িতার কথা বলা হচ্ছে। যিনি হবেন একজন অসীম ব্যাখ্যাকারী। এরা পাঠকের কাছে ব্যাখ্যার স্থান বর্ধিত এবং বিস্তৃত করার কাজে নিয়ােজিত থাকবেন অর্থাৎ পাঠককে ভাবাবেন এবং নানাভাবে কাঠামােকে আরাে ভেঙে বিস্তৃত হয়ে ব্যাখ্যা করতে উৎসাহ যােগাবেন। বস্তুত এর মাধ্যমে অর্থের বহুত্ব এবং বহু ব্যাখ্যায়নের প্রবণতাকে উদ্বুদ্ধ করবেন। উত্তরাধুনিক পাঠ্য বহুবাচনিক। এমনভাবে উন্মুক্ত যেনাে অসীমভাবে ব্যাখ্যাযােগ্য। এটি হচ্ছে লেখ্য পাঠ। কেননা, প্রতিটি পাঠে পাঠ্য পুনর্লিখিত হয়। এই লেখ্য-পাঠ পঠ্য-পাঠ এর বিপরীত। পঠ্য-পাঠে পাঠক নিস্ক্রিয়। উত্তরাধুনিক পাঠ্য হচ্ছে ব্যাখ্যা তৈরির যন্ত্র। সমাজ বিজ্ঞানে এর অর্থ দাঁড়ায়, একটি প্রপঞ্চকে তার ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা না করেই অধ্যয়ন করতে হবে। এর জবাবে উত্তরাধুনিকতাবাদীরা ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির কথা তােলেন এবং বলেন যে, প্রতিটি পাঠ্য অন্যসব পাঠ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি পাঠ্য থেকে যে ফলাফল বিকীর্ণ হয় তা অন্য পাঠ্যের ওপরও পড়ে এবং প্রভাব সৃষ্টি করে (Harari, 1979:77)।

পাঠক এবং পাঠ্য সম্পর্কিত উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত সমাজ বিজ্ঞানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যতাপূর্ণ। বৃহৎ অর্থে, পাঠ্যটিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, সমাজ বিজ্ঞানে উত্তরাধুনিকতার অনেক প্রায়ােগিক সম্ভাবনা থাকে (কবির, ১৩: ২৬১)। যদি মানুষের চিন্তা ও কর্মের ভুবনকে পাঠ্য হিসেবে দেখা হয়, তাহলে সমগ্র সমাজ বিজ্ঞানই উত্তরাধুনিক বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে ওঠে। উত্তরাধুনিকতা রাজনৈতিক উন্নয়নের পাঠ্যকে পাঠ হিসেবে বিবেচনা করে যেন, এটা জন-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের সৃষ্ট একটি বিষয়। এটি সমাজবিজ্ঞানের জন্য অভিনব এক প্রাণবন্ত বর্ণনা (Edelrman, 1988:2)। আশাবাদী উত্তরাধুনিকরা মনে করেন, সমাজবিজ্ঞানে উত্তরাধুনিক পাঠের মাধ্যমে সৃজনশীল সামাজিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে এতে জনগণের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। পাঠকের স্বাধীনতা হবে সমালােচনামূলক নাগরিক তৈরির প্রশ্রয়কেন্দ্র। পাঠ্য সম্পর্কিত উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত সমাজ বিজ্ঞানের চলকগুলাে, যেমন বয়স, লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি ইত্যাদির ধারণাকে বদলে দিয়েছে। অর্থনীতির মূল ধারা থেকেও এটি অনেক দূরে অবস্থান নিয়েছে। কোনাে পাঠ্য বিশেষকে বিন্যাস আরােপ করলে কিংবা বিশ্লেষণের ধরনে ভালোটাকে গ্রহণ করার মত আর কোনাে ব্যাপারই থাকছে না। এর মধ্যে এক ধরনের অবিন্যস্ততা থাকে যাতে একটি পাঠের সাথে অন্য পাঠের আন্তঃসম্পর্ক অসীমভাবে ক্রিয়া করে (Rosonaue, 1992:41)। পাঠ্যের কেন্দ্রে অর্থের এক আপেক্ষিকতা বিদ্যমান যা বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান অর্জনের দাবিকে খারিজ করে দেয় এবং একক ও পূর্ব-অনুমিতির ভিত্তিতে অর্থ নির্ণয় করার যৌক্তিকতাকে নাকচ করে দেয় (Rosonaue, 1992:41)।

মূলত সংশয়বাদী উত্তরাধুনিকরা এই রকম একটি সিদ্ধান্তে এসে উপনীত যে, এই উত্তরাধুনিক পৃথিবীতে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছে তা বলা যায় না, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা অন্য যেকোনাে ঘটনাই হােক না কেন তার কোনাে একক অর্থ নেই। যেকোনাে দৃশ্যপটকে অসীম সংখ্যকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। তাদের অন্যতম প্রবণতা হচ্ছে দেরিদীয় বিনির্মাণ তত্ত্ব। কোনাে নিশ্চিত জ্ঞান নেই কিন্তু এখন পর্যন্ত অন্তত এটা কোনাে রকমেই ভুল নয়। মানুষ তার সভ্যতার পালকে খুব কম কিছুই যুক্ত করতে পেরেছে যা অতিশয় ব্যক্তিক, মানবিক, কিংবা সামাজিক। মানুষের জ্ঞান হচ্ছে অসম্পূর্ণ, তাই কোনাে নিশ্চিত সত্য বলেও কিছু বলা যায় না। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, কিংবা কাঠামােটিও অনেকক্ষেত্রেই বিভ্রান্ত জ্ঞান কাঠামাে উৎপাদন করে। সূর্যের আবর্তন, গ্যালিলিও’র প্রচলিত মতবাদের প্রভাব, সমকালীন ক্যাথলিক চার্চ, আর কোপার্নিকাসের অগ্নিহুতি – যা একটি নতুন সত্যের সৃষ্টি করে এবং প্রচলিত জ্ঞান কাঠামােকে ভেঁপু দেয় নির্মমভাবে। এটা অনুসারে, আমি কখনােই বলতে পারব না যে, আমি নিশ্চিত জানি, বরঞ্চ আমাকে বলতে হবে যে, সম্ভবত, কিংবা আমি এমনটা মনে করছি। অনেকটা এরকমভাবেই নিশ্চয়তা প্রদান করার পক্ষপাতী উত্তরাধুনিকতা। আশাবাদী উত্তরাধুনিকরা, যেমন ফুকো, সত্যকে মতাদর্শিক এবং ক্ষমতার একটি এজেন্ট হিসেবে দেখেন। সত্য ক্ষমতাবানকে সুবিধা দেয়, আর দুর্বলদের মধ্যে বােধহীনতা ও ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দেয় (Foucault, 1980:132)। ফুকোর এই ক্ষমতার স্বরূপ অনেকটাই আন্তোনিও গ্রামসির ভাবনাকে আরাে তলিয়ে দেখার বিস্তৃত রূপ।

বিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশনের ধারণাটি মূলত জাক দেরিদারজাক লাকাঁ, বদ্রিয়ার, লেভিস্ট্রস প্রমুখকে বেশ খুঁটিয়ে নিয়ে তিনি ধারণাটিকে তুলে এনেছেন। এটি প্রধানত নেতিবাচক ক্রিটিক্যাল ক্যাপাসিটিকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং তা থেকে লুকোনাে অর্থাবলিকে বের করে আনতে চায়। বিনির্মাণ চেষ্টা করে একটি পাঠকে রহস্যমুক্ত করতে যাতে অন্তঃস্থ সিদ্ধান্তমূলক শ্রেণীব্যবস্থা এবং প্রাক-অনুমিতি উন্মোচিত হয়ে তার নগ্নতাকে বের করে আনতে পারে। একটি পাঠের বিন্যাসকে পুনঃপুনঃ নিরীক্ষণের মাধ্যমে এটি চেষ্টা করে ‘কাকে প্রচ্ছন্ন করা হয়েছে, কী বলা হয়েছে বা কী বলা হয় নি, পাঠ্য আর কী কী বলতে চেয়েছিল’। দেরিদার ভাষ্য ছিল, এটি পশ্চিমা ভাষাগুলাের অধিবিদ্যাগত দুর্বলতাকে শনাক্ত করে এবং যা সব ভাষার জন্যই প্রাসঙ্গিক। নিখুঁতভাবে ভূলকে পুরােপুরি উদঘাটন হয়ত সব সময় সম্ভব না হলেও এটি পাঠকে বারবার যাচাই-বাছাই আর পরীক্ষা করার কথা বলে। পাঠ্যে বিদ্যমান প্রান্তিক বিরােধিতাগুলােকে পাল্টে দিতে চায়। এটি অসঙ্গতিকে পুরােপুরি দূর করতে না পারলেও প্রদানকৃত তথ্য বা উপাত্তের শুদ্ধতা সংশ্লিষ্ট হায়রারকিগুলােকে উন্মোচনের চেষ্টা করে। এ বিষয়ে ফুকোর বক্তব্য হল, ‘Everything is interpretation’ (Dreyfus and Rainbow, 1983: 106). There is no final meaning for any particular sign, no notion of unitary sense of text, no interpretation can be regarded as superior to any other (Latour, 1988: 182-3)। এন্টি-পজিটিভিস্টরা যাকে আরেকটু বাড়িয়ে বলবেন ‘False’ (নকল)। এথনােগ্রাফি এবং সাংস্কৃতিক ধারণার চর্চায় এই বিনির্মাণের ধারণাটি ব্যাখ্যামূলক নৃ-বিজ্ঞান কিংবা প্রত্নতত্ত্বেও হয়ে থাকে। যদিও দেরিদার বক্তব্য এখানে খুব ভালােভাবে পরিষ্কার হয়েছে বলে মনে হয় না, কারণ দেরিদা কখনােই ‘আমি ভাত খাই, কলা খাই’ ইত্যাদিকে বিনির্মাণ করতে হবে বলেন নি। বিনির্মাণমূলক বিশ্লেষণের জন্য রুশেন একটি গাইড লাইন দিচ্ছেন অনেকটা এভাবে যে –

  • ১. একটি টেক্সটে সাধারণীকরণের খোঁজাখুঁজি বাদ দিন এবং নীতিকে ভাঙতে ব্যবহার করুন ব্যতিক্রম। 
  • ২. সর্বোচ্চ রকমের বিনির্মিত করে যুক্তিতর্কগুলােকে ব্যাখ্যা করুন এবং সাধ্যাতীত ব্যাখ্যায়নের চেষ্টায় পাঠ্যকে পাঠ করুন। 
  • ৩. পরম বয়ান বলতে যা কিছু আছে তা ত্যাজ্য করুন এবং চাষ করুন বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তেজনার সেসব বক্তব্যগুলাে যা বারবার পড়ার মত। 
  • ৪. দ্ব্যর্থকতা এড়িয়ে চলুন কারণ ব্যতিক্রম সবসময়ই থাকে। 
  • ৫. কিছুই গ্রহণ করা যাবে না এবং অগ্রাহ্য করার মতও কিছু নেই। একটি অবিনির্মিত যুক্তিতর্ককে সমালােচনা করা বড়ই শক্ত ব্যাপার যদি না তা একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। 
  • ৬. এমনভাবে লিখুন যাতে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। রচিত
  • পাঠকে পরিষ্কারভাবে উপলদ্ধি করুন। চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ আর অনুসন্ধানের চেয়ে বরং একটু অস্পষ্টতাই ভালাে কারণ এটি নিরাপত্তা দেয়। এমনভাবে লিখুন যাতে পাঠক অসংখ্য ব্যাখ্যায় উদ্বুদ্ধ হয়। (Wellberg, 1985: 234)।
  • ৭. নতুন এবং অপ্রচলিত পরিভাষা ব্যবহার করুন যাতে পরিচিত অবস্থানগুলােকেও খুব একটা পরিচিত মনে না হয়। অন্যথায়, অবশ্যম্ভাবী পাণ্ডিত্যকে অনিবার্যভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হবে না (Ellis, 1989: 142)। যদিও এটি নির্ভর করে ব্যাখ্যাকারীর সিমান্টিক প্রয়ােজনীয়তার ওপর।
  • ৮. বিনির্মাণমূলক একটি দৃষ্টিভঙ্গি বাছাই করে নিতে হবে যা দূরদর্শী হবে (Ellis, 1989: 145; Rosenau, 1993: 121)।

সাধারণীকরণের স্থলে বিশেষ, গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে বিশ্বাসের জায়গায় সাবজেক্টিভ বিশ্লেষণ

উত্তরাধুনিকতা বাস্তবতার ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করে। ব্যক্তি তার অনুধাবন প্রক্রিয়া ও আন্তব্যক্তিক যােগাযােগের মধ্য দিয়ে বাস্তবতার যে দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে উত্তরাধুনিকতা তাকেও নাকচ করে দেয়। এটি সাধারণীকরণের স্থলে ‘বিশেষ’কে গুরুত্ব দেয়। অনেক উত্তরাধুনিকতাবাদী বাস্তবতা এবং বাস্তবতার প্রকৃতি নিয়ে আদৌ মাথা ঘামানাের কোনাে প্রয়ােজন আছে কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন (Rosenaue, 1992: 110)। লিওতারের ভাষ্য অনুযায়ী ‘It is our business not to supply reality but to invent allusions to the conceivable which cannot be presented’ (Lyotard in Rosenaue, 1992: 110)। উত্তরাধুনিকতা মানবতাবাদকে স্রেফ ফাঁকা বুলি কিংবা অসম্পূর্ণ সান্ত্বনা বলে মনে করে। এটি মনে করে যে, এটি কেবল আই ওয়াশের একটি ভেল্কি দেখানাে রাস্তা যা বুর্জোয়া কিংবা আধুনিক ক্ষমতা বরাবরই চালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের বর্ণিত বাস্তবতাতেই মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত হয়ে চ্যাঙদোলা করে শুইয়ে বাখতে দেখা যায়। উত্তরাধুনিকতা ব্যক্তিকে সমালােচনামুখর এক সর্বোচ্চ সচেতন নাগরিক হিসেবে আশা করে। ফুকো ঠিক এ জায়গাতে এসেই কথা বলেন। উপমহাদেশীয় দর্শনের যেখানে সর্বোচ্চ নৈতিকতার স্তর নিয়ে আলােচনা করা হয়। উত্তরাধুনিকতা বলে, কোনাে বস্তু বা প্রাণী এবং সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে কোনাে প্রকার মহাবয়ান বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ হতেই পারে না। এ সূত্র ধরেই তারা প্রমাণ করতে চান যে, ‘সামন্তবাদ’, ‘পুঁজিবাদ’, ‘দাস সমাজ’ কিংবা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ইত্যাদি নিয়ে পৃথক পৃথক ডিসকোর্স সম্ভব হলেও এগুলােকে নিয়ে কোনাে ডায়ালেকটিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নামক সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। বস্তু, ঘটনা প্রবাহ বা যেকোনাে সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে কোনাে সুস্পষ্ট প্রপঞ্চ নির্ধারণ করা সম্ভব না। কেননা, সমাজ এমনই এক আপেক্ষিকতা যেখানে কোনাে সুনির্দিষ্ট নিয়ম প্রযােজ্য নয়। আর সামাজিক বাস্তবতার নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ দ্বারা সেই সমাজের প্রকৃত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে না। এ জন্য উত্তরাধুনিকতায় সামাজিক বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা চালানাে হয়েছে সাবজেক্টিভ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। উত্তরাধুনিকতাবাদীদের মতে, নির্মাণকারীর সত্যই নির্মিত সত্য। মার্ক্স একাধারে সত্যকে বলছেন, সাজেক্টিভ, আপেক্ষিক ও চরম।

উত্তরাধুনিকতাবাদ বস্তু, ঘটনা ও ঐতিহাসিক বিষয়াদির মাঝে কোনাে প্রকার কার্যকারণ সম্পর্ক নেই বলে ধরে নেয়। কোনাে ঘটনার কারণে, কোনাে ঘটনা ঘটে – এটি কেউই বলতে পারবে না, নয়তাে অনিশ্চিত থেকে যাবে। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এ্যাক্টর ভুলভাবে ব্যাখ্যায়িত হতে পারেন। অর্থবহ আন্তক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে প্রকৃত অনুধাবন (Weber, 1997)। তবে ফুকোর ভাষ্যমতে, অনেক সমাজের মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে অভিন্ন বৈশিষ্ট্য গােচরীভূত হলেও প্রতিটি ডিসকোর্সই নিজস্ব গুণাবলি সমৃদ্ধ। এদেরকে কেবলমাত্র পৃথক নির্ণয়কারী স্বতন্ত্র ডিসকোর্সের আলােকেই সেই সমাজগুলােকে অনুধাবন করা যেতে পারে (রাব্বী, ১৯৯৯: ১৯৫)। 

ইতিহাসের মহাবয়ান বা গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ এবং জ্ঞানের অখণ্ডতার ওপর আধুনিকের পক্ষপাত রয়েছে। এর বিশ্বাস রয়েছে মিথ ও সামজিক-সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক অগ্রগতির ওপর। অন্যদিকে, উত্তরাধুনিকতা এসবকে সন্দেহ করে, প্রত্যাখান করে। গ্র্যান্ড ন্যারেটিভকে সে irony এর মাধ্যমে বিনির্মাণ করে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহুত্বে বিশ্বাস করে, প্রযুক্তির প্রতি সংশয় দেখায়। ভেবে দেখুন, প্রযুক্তির সােনালী ফসলগুলাে কি একজন হতদরিদ্রের বসত-ভিটায় গিয়ে পৌঁছায়? আধুনিকতার বিশ্বাস রয়েছে আধুনিকতার বাইরে একটি প্রকৃত অবস্থানের ওপর, যা কোনাে প্রতিরূপায়নে বিকৃত হয় না। কিন্তু উত্তরাধুনিকতা তুলে ধরে হাইপার রিয়েলিটি এবং ভারচুয়াল-রিয়েলিটিকে। উত্তরাধুনিকতা কোনো প্রকৃত ‘ইমেজে’ বিশ্বাস করে না, কারণ একটি ইমেজের প্রতিরূপ হচ্ছে আরেকটি ইমেজ, আরেকটি ইমেজের প্রতিরূপ আবার আরেকটি ইমেজ, এভাবে অসীম প্রতিরূপায়ণ। এভাবে উৎপাদিত হতে হতে ইমেজগুলাে ‘প্রকৃত’কে ‘অপ্রকৃত’ করে তােলে। জাঁ বদ্রিয়ার এই অনন্ত প্রতিরূপায়নকে বলছেন সিমুলাক্ৰা (Simulacra) যা মূল বা প্রকৃতকে অস্বীকার করে। 

আধুনিকতার আছে এনসাইক্লোপেডিয়া; উত্তরাধুনিকতার আছে ওয়েব আধুনিকতায় জৈব ও অজৈবের মধ্যে, মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে পরিষ্কার বিভাজন আছে; উত্তরাধুনিকতায় জৈব ও অজৈব, মানুষ, যন্ত্র আর ইলেকট্রনিক্স মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তৈরি হয় সাইবর্গ বা যন্ত্র মানুষের ধারণা’। আধুনিকতায় যৌন পার্থক্যের একটি শৃংখলা তৈরি হয়, যৌনতার কতগুলাে অনুমােদিত নিয়ম থাকে, পর্নোগ্রাফি পরিত্যাজ্য হয়; অন্যদিকে উত্তরাধুনিকতায় লৈঙ্গিক বিভাজন থাকে না, পর্নোগ্রাফি অনুমােদিত হয়ে যায়। আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদকে বিভাজিত করা যেতে পারে এভাবে – 

  • ১. মানব-প্রকৃতি – আধুনিকতাবাদ অনুসারে, মানুষ কেবল বস্তুগত এবং যান্ত্রিক। আমরা কেবলমাত্র এক দৈহিক দুনিয়ায় বাস করি। আমি আমার ইন্দ্রিয়ানুভূতি দিয়ে যা বুঝি তার বাইরে কিছু নেই। উত্তরাধুনিকতাবাদ এই ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকলেও জ্ঞানের মতানুমতক্রমিক দাবিকে এটি চরমাকারে সন্দেহ করে। এদিকে বাইবেলীয় ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বর তার নিজের আকার অনুসারেই প্রত্যেকটি মানুষকে তৈরি করেছেন। এটা তিনি আর কোন সৃষ্টিকে দান করেননি। তিনি আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত। 
  • ২. স্বাধীন চেতনা এবং স্বেচ্ছাচার – আধুনিকতাবাদ অনুসারে মানুষ হচ্ছে আত্ম-শাসিত এবং নিজের পন্থা নিজেই বাতলে নিতে জানে। উত্তরাধুনিকতাবাদ অনুসারে ব্যক্তি হচ্ছে তার সংস্কৃতির একটি উৎপাদন মাত্র এবং তারা শুধুই কল্পনা করতে পারে যে, তারা নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এদিকে বাইবেলীয় ধর্মতত্ত্ব অনুসারে, পাপ মোচন করতে গিয়ে মানুষ স্বেচ্ছাচারিতার স্বাধীনতা হারিয়েছে, কিন্তু তাই বলে তার কাছ থেকে সবকিছুই কেড়ে নেয়া হয়নি। সে এখনও সেটার ব্যবহার চাইলেই করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সে সফল হতে পারে। 
  • ৩. যুক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি – আধুনিকতাবাদ অনুসারে, মানুষ অবশ্যই যুক্তিবাদী আর আশাবাদী হতে আপ্রে। কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ানুভূতি আর যুক্তির ওপরেই সে নির্ভর করতে পারে। উত্তরাধুনিকতাব্দ অনুসারে, বিষয়ীগত যৌক্তিকতা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই কারণ এটি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ফেরত আসতে পারে ঠিক যেমনটি আধুনিকতাবাদীরা চাচ্ছেন। যৌক্তিকতা হচ্ছে একটি মিথের স্বরূপ। এদিকে বাইবেলীয় ধর্মতত্ত্ব বলে যুক্তি প্রয়োজন, কিন্তু সত্যিকারের বাস্তবতাকে বুঝতে হলে এটা দিয়ে পুরোপুরি সেটাকে পূরণ করা সম্ভব নয়। একক যুক্তি বা কার্যকারণ বাস্তবতার সত্যকে বিভ্রান্ত করে তুলতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্বাস আর আধ্যাত্মিক পর্যায়ে আত্ম-উন্নয়ন যোগ করতে পারলে উপকার পাওয়া যেতে পারে। 
  • ৪. উন্নতির ধারণা – আধুনিকতাবাদ অনুসারে মানবজাতি বিজ্ঞান আর যুক্তির ভিতে দাঁড়িয়েই প্রগতি বা উন্নতি সাধন করতে পারে। উত্তরাধুনিকতাবাদ অনুসারে ইউরোপ কর্তৃক সৃষ্ট আধিপত্যের সুবিচার করতে গিয়ে আধুনিকতাবাদীরা উন্নয়নের কথা বলেন। এদিকে বাইবেলীয় ধর্মতত্ত্ব অনুসারে, মানুষেরা কোন গৌরবান্বিত সূর্যোদয়ের ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে না। সে সবকিছু বুঝেও ঠিক বোঝেনা। হেন পরিস্থিতিতে এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত একটা পথ যার মধ্য দিয়ে যাতনার মোচন আর বাদবাকি জীবনের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে হাজির করবে।

উত্তরাধুনিকতাবাদের সমালোচনা

সমালােচনা এবং উত্তরাধুনিকতাবাদ সমার্থক বিষয়। সমালােচনা করার মধ্য দিয়ে উত্তরাধুনিকতার উথান এবং একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক প্যারাডাইম হিসেবে সমূহ সমালােচনার মুখােমুখি হতে হয় ও হয়েছে স্বভাবতই। রয় ডি এন্ডারাড (১৯৩১-) তার মােরাল মডেলস ইন এনথ্রোপােলােজি প্রবন্ধে উত্তরাধুনিক সাজেক্টিভিটি এবং অজেক্টিভিটির সংজ্ঞাকে তাদের নৈতিক চরিত্র দ্বারা নিরীক্ষা করেন এবং যুক্তি দেখান যে, এসব নৈতিক মডেলগুলাে ব্যাপকাকারে সাজেক্টিভ। যদিও একেবারে মূল্যবােধ বিবর্জিত অজেক্টিভিটি কখনােই সম্ভব নয়, সেহেতু একজন নৃ-বিজ্ঞানীর লক্ষ হবে যতটা সম্ভব আদর্শের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। নৈতিক এবং অজেক্টিভ মডেলগুলাের মধ্যে অবশ্যই একটি ব্যবধান থাকতে হবে, কারণ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সত্যিকার অর্থে কী ঘটছে, কিংবা ঠিক কীভাবে তা কাজ করছে তা সঠিকভাবে উদঘাটনে এগুলাে বিপত্তি তৈরি করবে। তার ভাষ্যে , ‘Objectivity is no way dehumanizing nor is objectivity impossible’। সত্য কিংবা প্রপঞ্চর ব্যাখ্যা কিংবা বর্ণনায় বিজ্ঞান এখনাে ব্যবহারােপযােগী যদিও এর পক্ষপাতদুষ্টতাকে এড়িয়ে যেতে হবে (D’ Andrade, 1995: 402-4)। Rosenaue (1993) উত্তরাধুনিকতার সাতটি স্ববিরােধিতা শনাক্ত করেন এভাবে –  

  • ১. এর তত্ত্ববিরােধী অবস্থানটিও এক ধরনের অনিবার্য তাত্ত্বিকতা। টনি ক্লিফ একই প্রসঙ্গে বলেন, এটি হচ্ছে তত্ত্ব ত্যাজ্যকরণের তত্ত্ব। 
  • ২. যখন এটি অযৌক্তিকতাকে গুরুত্ব দেয় তখনই এটি একটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে যায়।
  • ৩. প্রান্তিকদের গুরুত্ব দেয়ার মধ্য দিয়ে এটি একটি মূল্যায়নমূলক জোরারােপ করে যা নিঃসন্দেহে এর স্ববিরােধী। কারণ, এটি মূল্যায়নমূলক প্রক্রিয়াতে উৎসাহী নয় বলেই বিশ্বাস করে। 
  • ৪. ইন্টার-টেক্সচুয়ালিটিকে গুরুত্ব দিলেও প্রায়শই পাঠের মূল অর্থ উদঘাটিত না হয়ে বরং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। 
  • ৫. তত্ত্ব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আধুনিক শর্তাবলিকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়েও তারা এটি বিচারের জন্য কোনাে বৈধ শর্তের নির্দেশনা দেয় না।
  • ৬, এটি আধুনিকতার অস্থিতিশীলতার সমালোচনা করলেও দেখা যায় যে নিজেও খুব বেশি সুসংগঠিত নয়। 
  • ৭. সত্যের দাবিকে কেন্দ্র করে উত্তরাধুনিকতাবাদী রচয়িতারা নিজের মধ্যেই বিস্তর মতানৈক্য পােষণ করেন।

মেলফোর্ড স্পিরাে উত্তরাধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিকদের বলেন যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে কিন্তু রাজনীতি বা পক্ষপাতদুষ্টতা রাখা চলবে না। কারণ, তা না হলে নৃ-বিজ্ঞান কেবলমাত্র অর্থ খোঁজার বিজ্ঞান হয়ে উঠবে, কারণ উদঘাটন করা আর হয়ে উঠবে না যা মানুষকে আসলে মানুষ হয়ে উঠতে বাধ্য করেছিল। তিনি আরাে বলেন যে, ‘The causal accounts of cultures refers to echological niches, modes of production, subsistance techniques, and so forth, just as a causal account of mind refers to the firing of neurons the secretions of hormones, the action of neurotransmitters…’। তিনি জন সেরেল (1993) এর যৌক্তিকতা এবং বাস্তবতা থেকে ছয়টি আন্তসম্পর্কিত প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। এগুলো হল – 

  • ১. মানুষের রেপ্রিজেন্টেশনগুলােতে বাস্তবতা স্বাধীনভাবে অস্তিত্ববান। যদি এটা সত্য হয় তাহলে উত্তরাধুনিকতাবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে বলতে হয় যে, এই মতানুমতটিকে মন-স্বাধীন বাহ্যিক বাস্তবতা বা অধিবিদ্যাগত বাস্তববাদ বলে চিহ্নিত করা যায়। 
  • ২. ভাষা কেবলমাত্র অর্থই বিনিময় করে না, তা বৈশ্বিক বস্তু এবং পরিস্থিতিকেও বর্ণনা করে যা স্বাধীনভাবেই ভাষাতে কার্যকর থাকে। ভাষা তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যােগাযােগমূলক এবং বর্ণনাধর্মী কার্যাবলি করে থাকে। এই ধারণাটিকে উত্তরাধুনিকতাবাদের বিপরীতে স্থান দেয়া সম্ভব।
  • ৩. বস্তু কিংবা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে বর্ণনা সত্য বা মিথ্যা হতে পারে। বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কম বা বেশি মাত্রায় হলেও বস্তু এবং পরিস্থিতিকে যােগাযােগ ঘটায় ভাষা। সত্যের এই যােগাযােগ তত্ত্বটি যেকোনােভাবেই হােক উত্তরাধুনিকতাবাদীরাও কম বেশি শেয়ার করছেন। এটা অন্তত সত্যের ক্ষেত্রে ঘটছে। বহু উত্তরাধুনিকতাবাদী তত্ত্বটিকে সারসত্তাগত বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। 
  • ৪. নৈর্ব্যক্তিক বর্ণনাই জ্ঞান। একটি জ্ঞানের সত্যতা দাবি এটাই বলে যে, এটি ‘Independent of the motive, culture, or gender of the person who makes the claim. Knowledge depends on empirical support’ (ভিটগেনস্টেইনের সংশয়বাদের অর্থহীনতা প্রসঙ্গে একটি বক্তব্য ছিল এমন যে, সংশয় করতে হলেও একটি ন্যূনতম জ্ঞান রাখতে হবে, অন্তত যা নিয়ে সংশয় করা হবে সে সম্পর্কে…)।
  • ৫. যুক্তি এবং যৌক্তিকতা একটি প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির সেট যা উত্তরাধুনিকতাবাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ, বৈধতা এবং কারণের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের যথোপযুক্ত দাবিকে মূল্যায়ন করে একজন গবেষককে সামথ্যবান করে তােলে।
  • ৬. নৈব্যক্তিক এবং ইন্টার-সাজেক্টিভ বৈশিষ্ট্য দু’টি বক্তব্য, তত্ত্ব, ব্যাখ্যা এবং সব ধরনের জ্ঞানের যে বর্ণনা তার বুদ্ধিমত্তাকে বিচার করে। 

মেলফোর্ড স্পিরাে বলতে চান যে, “নৈর্ব্যক্তিকতা সবসময়ই একজন পর্যবেক্ষকের জন্য দুর্ভেদ্য সত্য”। তিনি উত্তরাধুনিকতাবাদীদের সমর্থন করেন এভাবে যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলাের তুলনায় মানবিকতার গবেষণামূলক শাস্ত্র তথা সমাজ বিজ্ঞানের জন্য খুবই ভিন্ন আবহের কৌশল খুঁজে বের করা দরকার। কিন্তু যখন মন এবং সংস্কৃতি গবেষণায় অন্তর্দৃষ্টি এবং সমবেদনা থাকে সংকটময় অবস্থানে … সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক দায়িত্বশীলতার জন্য দরকার নৈব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অন্তর্ভুক্তি। নৈব্যক্তিক কর্ম পদ্ধতি ব্যতীত জাতিতত্ত্ব বেশ বড়সড় রকমেই অভিজ্ঞতালব্ধ, সন্দেহমূলক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অদায়িত্বশীল হয়ে উঠতে পারে। ক্রিস্টোফার নােরিস বিশ্বাস করেন যে, লিওতার্দ, ফুকো এবং বদ্রিয়ার তিনজনই ‘নৈতিক মূল্যায়নের প্রাধান্য’ ধারণাটি দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন। 

নােয়াম চমস্কিকে অনেকেই উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক হিসেবে বিবেচনা করলেও তার কাজ এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি মূলত উত্তরকাঠামােবাদী কিংবা রূপান্তরমূলক ব্যাকরণকেন্দ্রিক। তিনি উত্তরাধুনিকতা কিংবা আধুনিকতা কোনাে কিছু নিয়েই আলােচনা করতে আগ্রহ বােধ করেন না। তিনি বরং ডেভিড হিউমকেই মানতে রাজি। তাকে বর্তমান সময়ের উঁচু মাপের তাত্ত্বিকদের মতই একজন হিসেবে দেখা হচ্ছে। উত্তরাধুনিকতা কিংবা উত্তরাধুনিকতাবাদ নিয়ে চমস্কির মনােজাগতিক অবস্থানটিকে বােঝা যায় তার একটি সাক্ষাতকারের মাধ্যমে। একবার নােয়াম চমস্কিকে উত্তরাধুনিকতাবাদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এটি আসলে কী বলে। আপনি মনে করেন? তিনি বলেছিলেন যে, “প্রথমত নানা কারণেই, এটা অর্থহীন। কারণ, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কিংবা বিশ্লেষণমূলক চিন্তার ক্ষেত্রে এটি কিছুই যােগ করে না।” তিনি অভিযােগ তােলেন যে, পদার্থবিদ্যা, অংকশাস্ত্র, জীববিদ্যা এবং অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ডের লােকদের কাছে সিরিয়াসলি ব্যাখ্যা জানতে চাইলে খুশি হয়ে তারা তা ব্যাখ্যা করতে থাকেন, কিন্তু উত্তরাধুনিক বুদ্ধিজীবীদের কাছে যদি সিরিয়াসলি জানতে চাওয়া হয় যে, আপনার দেয়া তত্ত্বের ভিত্তি কী, তাদের কাছে কী কী নমুনা-সাক্ষ্য আছে। তখন তারা কেন সেভাবে রেসপন্স করেন না। তারা কি এমন ব্যাখ্যা করেছেন যা আগে ছিল না এবং এমন একটি ব্যাপার কিংবা অনুরােধ সবার তরফ থেকেই আসতে পারে এবং তা স্বাভাবিকও বটে। যদি তারা সেভাবে ব্যাখ্যা না করতে পারেন বা না চান, তবে আমি বরং এহেন পরিস্থিতিতে ডেভিড হিউমের র‍্যাশনালিটিকেই স্মরণ করতে চাই।”

এই ধরনের উত্তরবাদিতা উত্তরাধুনিকতার সত্য নির্মিতিজনিত বিভ্রান্তি তৈরি করে। কোনাে তত্ত্ব চালিত না হওয়ায় এটিকে প্রচলিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে আলােচনা করা সম্ভব নয়। এটি মূলত রাজনৈতিক চেতনা এবং প্রকৃত মানুষের মানবতার কথা বলে বা বলতে চায়। নৃ-বিজ্ঞানকে আদতে প্রচলিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে দেখা সম্ভব, নাকি যেমনটি স্পিরাে বলতে চায় যে, এর জন্য আসলে খুবই ভিন্ন পদ্ধতি সৃষ্টি করা জরুরি?

উপসংহার

আধুনিকতার প্রকল্পটি যখন হেজিমনি সৃষ্টিকারীর ভূমিকায় পরিণত হয় এবং মানব মুক্তির নামে চাপিয়ে দেয় দমনের কৌশল তখনই উত্তরাধুনিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়। প্রচলিক সকল জ্ঞান কাঠামাে এবং তত্ত্বকে এটি সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে এবং বলতে চেষ্টা করে যে, মানব মুক্তির জন্য আদতে কোনাে গ্রান্ড থিওরি হতে পারে না। কারণ, কোনাে জ্ঞানকাণ্ডই সংশয়ের উর্ধ্বে নয়; এমনকি মার্ক্সবাদও নয়। আধুনিকতার সবচেয়ে বড় ন্যারেটিভ বিজ্ঞান ও যুক্তিশীলতাকে এটি অনন্য মনে করে না বরং সত্যের কোনাে একক রূপ নেই বলে এটি দাবি করে। বদ্রিয়ার মনে করেন, একটি ইমেজের প্রতিরূপ আরেকটি ইমেজ এবং প্রতিরূপায়ণ হচ্ছে। অসীম একটি ঘটনা যা ঘটছে তাে ঘটছেই। তিনি এর নাম দেন অনুকরণ ভান জনিত প্রতিরূপায়ণ। এটি মনে করে এই সমাজ, ব্যক্তি আর বিশ্ব সবই হচ্ছে একটি পাঠ্য এবং এদের মধ্যে ইন্টার-টেক্সচুয়ালিটি রয়েছে। প্রত্যেকটি পাঠ্যই প্রত্যেকটির ওপর নির্ভরশীল কিংবা একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত।

রচয়িতা-পাঠক এবং পাঠ্যর আন্তঃসম্পর্কের মধ্য দিয়ে একজন উত্তরাধুনিক পাঠকের জন্ম হয় যিনি সর্বোচ্চ ব্যাখ্যা প্রদানের মধ্য দিয়ে পাঠ্যকে পাঠ করবেন। এবং পাঠ্যের সুপ্ত অর্থকে খুঁজে বের করে তা থেকে রহস্য দূর করবেন। বিশেষ করে দেরিদা এক্ষেত্রে অধিবিদ্যা সম্পন্ন পাঠ্যকে অবিনির্মাণ পদ্ধতিতে বিরহস্যকরণ করার কথা বলেন। তার মতে এটি ভাষাকে ভানে রূপান্তরিত করে। মূলত একজন উত্তরাধুনিক পাঠক হচ্ছেন ব্যাখ্যা তৈরির যন্ত্র। পাঠ্যের ব্যাখ্যা অবশ্যই সমালােচনা এবং গঠনমূলক পদ্ধতিতে সম্পাদিত হবে যেখানে একজন রচয়িতার জ্ঞানগত এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থানটিকে বিবেচনায় নিতে হবে। উত্তরাধুনিক শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্য ইত্যাদি হচ্ছে একটি চরম উদারপন্থী ক্যানভাস যেখানে আয়রনি, ম্যাটাফিজিক্স তথা হাইপার সাবজেক্টিভিটিকে আমলে নেয়া হয়। ম্যাজিক বাস্তবধর্মী সাহিত্য-শিল্প সৃষ্টিকে (যেমন ওয়ালীউল্লাহ্, আবু ইসহাক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক প্রমুখের লেখালেখি) এটি অনুমােদন দেয়। তাই বলে এর মানে এই নয় যে ম্যাজিক রিয়েলিজম মানেই উত্তরাধুনিকতা। 

শিল্প-সাহিত্যে ব্যাপক পরিমান স্বাধীনতা এবং সাবজেক্টিভিটিকে অনুমােদন করার ফলে উত্তরাধুনিকতা শিল্প সৃষ্টির পরিমাণকে বিস্তৃত হারে বাড়ালেও, শিল্পী বা রচয়িতার সন্তুষ্টি বাড়াতে পারলেও একটি সমস্যা বয়ে নিয়ে চলেছে, আর তা হল দর্শক বা পাঠকের দুরত্ব এবং ভুল পাঠ যা মূলত আভাঁ-গার্দ আন্দোলনেও (AvantGrade) কম-বেশি উপস্থিত ছিল। চলচ্চিত্র, মাস মিডিয়া, প্রযুক্তি ইত্যাদি এটিকে আরাে শক্তিশালী করতে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সহায়তা করেছে। উইকিপিডিয়ার ধারণা যেমন আধুনিক এনসাইক্লোপেডিয়ার ধারণাকে আহত করেছে, তেমনি লিনাক্স ওপেন সাের্স পদ্ধতির মধ্য দিয়ে মাইক্রোসফট জায়ান্টের একচেটিয়া ব্যবসা বা আধিপত্যকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা চালাচ্ছে। হিপ্পি, বিট, গেনেট, পপ কিংবা রক এন্ড রােল সংস্কৃতি তৈরির পেছনে এর খানিকটা হলেও প্রভাব ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। যদিও এদের উত্থানকল্পে যে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিরােধের আয়ােজন বা লক্ষ ছিল তা থেকে এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রায় সরে আসে। হাইপার সাবজেক্টিভিটিকে আমলে নিয়ে মূল্যবােধকে সে অনুপাতেই নির্ধারণ করার পক্ষপাতি বলে অনেকেই এর জন্য এটিকে দায়ী করতে আগ্রহী।

এটা কখনােই জ্ঞান কিংবা জীবনবােধ কোনাে কিছুরই সামগ্রিকতাকে বিশ্বাস করে না। এটা সবকিছুকেই কেন্দ্রহীন বা বিকিরিত করতে চায়। সব রকমের লৈঙ্গিক পার্থক্যকে এটি মুছে ফেলতে চায় এবং একটি বহুরূপী লৈঙ্গিক পরিচয় তৈরি করার মধ্য দিয়ে সমলৈঙ্গিকতাকে অনুমােদন দেয়। যার ফলে নারীবাদকে এটা এক অর্থে উৎসাহ যােগায় এবং একটি উপনিবেশিক পরিস্থিতিতে নারীর অবস্থানকেও যাচাই-বাছাই করে দেখতে চায়। এটা ধর্মকে সুবিধাবাদী এবং সান্ত্বনামূলক উপদেশবাদিতার জন্য একদিকে চড়ান্ত রকমের আক্রমণ করে আবার অন্য দিকে যদি ব্যক্তি মনে করে যে এটিই তার জন্য শেষ আশ্রয়স্থল হতে পারে তবে সেক্ষেত্রে ধর্মের আশ্রয়কেই তার জন্য বিবেচ্য বলে মনে করে। এটা ব্যক্তির সাবজেক্টিভিটিকে আমল দিতে গিয়েই ঘটে থাকে। এটা প্রচলিত নব ধ্যান-ধারণা, রীতি-নীতি প্রথাকে ভেঙে তৈরি করতে চায় ব্যক্তির মুক্তি। অবদমিত যৌনতার মুক্তিকে এটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ব্যক্তির ‘আনন্দের উৎস হিসেবে বিবেচিত হলে এটি লেসবিয়ান কিংবা গে সংস্কৃতিকেও অনুমােদন দেয়। এমনকি মিনি ন্যারেটিভের আকারে মুভমেন্ট গড়ে তুলতে উৎসাহ দেয়।

এটি বিশ্বাস করে যে, অধিবিদ্যা হচ্ছে এক ধরনের চূড়ান্ত অনিশ্চিয়তা। কারণ এর কোনাে বস্তুগত প্রাপ্তিযােগ ঘটে না। এক অর্থে এটি হচ্ছে কল্পনাবিলাস। কিন্তু আবারও এটি গুরুত্ব দেয় ব্যক্তিকে, ব্যক্তির সাবজেক্টিভিটিকে। সত্য সম্পর্কে এর মত হল, কোথাও কোনাে নৈর্ব্যক্তিক সত্য বা বাস্তবতা নেই। কারণ, সত্য সবসময়ই বিজয়ীর, ক্ষমতাবানের।এটা ভাষাতাত্ত্বিক তথা কাঠামােবাদ থেকে উত্তর-কাঠামােবাদ এমনকি প্রায় সমগ্র মানব জ্ঞানতত্ত্বকে ধারণ করে। এমন কিছু নেই যেটা উত্তরাধুনিকতা ধারণ করে না। এটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল এবং সত্যতার মূল্য নিয়ে হত মনে করে যে, ঐসব ইতিহাস হচ্ছে বিজয়ির আর অধিপতিশীলদের। যাট/সত্তরের দশকের দিকে এডওয়ার্ড সাঈদ এবং অন্যান্য তাত্তিকদের ওরিয়েন্টালিজম, ওসিডেন্টালিজম, কলােনিয়াল অ্যান্ড কলােনিয়াল স্টাডিজ, সাবলটার্ন স্টাডিজ ইত্যাদি প্রচলিত জ্ঞানকাণ্ড সমালােচনা করতে শুরু করে। নৃ-বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব এবং অন্যান্য শাস্ত্রে যে জাতীয়তাবাদী ঝোক আছে তাকে এটা প্রশ্ন করে। সর্বোপরি এটা একজন প্রশ্নকারী ধুরন্ধর আর জটিলতা সমালােচক তৈরি করে। এথনােগ্রাফি কিংবা সমাজ বিজ্ঞানের ফিল্ড ওয়ার্কগুলো পর্যবেক্ষকের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব তথা তাত্ত্বিক ভাবনাকে এটি পুনঃনিরীক্ষা করতে বলে।

সংগ্রাম কিংবা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্র কাঠামাে দখল বা পরিবর্তন সাধন করলেই হবে না। এটা মনে করে বরং সমাজের নানাবিধ মাইক্রো বা ডিপ স্ট্রাকচারের টাইম, স্পেস, নিড ইত্যাদি মাত্রায় পরিবর্তন সাধনকেও আবশ্যক বলে মনে করে। প্রতিরােধ সংগঠনের ক্ষেত্রে এটা ব্যক্তিকে সর্বময় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী বলে মেনে নেয়। এটা আধুনিক রাজনীতির সমালােচনা করলেও এর রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির উপলক্ষে কি করা দরকার সে সম্পর্কে কোনাে সমাধান বাতলে দেয় না। এটি মার্ক্সবাদকে পুরােপুরি বাতিলও করে না, আবার মেনেও নেয় না। কারণ, এটি মনে করে মার্ক্সবাদ একটি সমাজের মানব সদস্যদেরকে তার মানুষ মাত্রা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এটি গণতন্ত্রকেও সমর্থন করে না, কারণ এটি মনে করে যে, একটি সুস্থির এবং চমৎকার গণতন্ত্র ব্যবস্থা তখনই সম্ভব হয় যখন তাতে ক্ষমতার লােভ এবং লেজুড়বৃত্তি থাকে না। কিন্তু সভ্যতার সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এটি কেবলই কল্পনায় সম্ভব। কারণ, ক্ষমতা কুক্ষিগত হতে বাধ্য এবং কিছু ভালাে মানুষি থাকলেও তাতে খুব একটা লাভ হয় না। মিশেল ফুকো এ প্রসঙ্গে একটি ক্লু দেয়ার চেষ্টা করেন এভাবে যে, কেবলমাত্র উচ্চ নৈতিকতার স্তরেই একটি উৎকৃষ্ট রাষ্ট্র কাঠামাে গঠিত হতে পারে যার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

জ্ঞানের একটি আপেক্ষিকতামূলক তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে উত্তরাধুনিকতা বলতে চায়, ‘There are no certain, single truths about the world… every question has an infinite number of answers, each being equally as valid as each other’।

তথ্যসূত্র

  • ক্রিটিক্যাল তত্ত্বচিন্তা, সম্পাদক মাসউদ ইমরান, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১০, পৃ – ২৫১-২৮৬
  • চৌধুরী আ.ফ.হা., ২০০৩, নৃ বৈজ্ঞানিক প্যারাডাইম (রূপান্তরের ধারা); ইনস্টিটিউট অব এ্যাপ্লাইড এ্যানথ্রোপলজি, ঢাকা।
  • শানিন, থি., “প্রগতির ধারণা” নৃ বিজ্ঞান পত্রিকা, সং ৭, পৃ ১০৩-১১০। 
  • বন্দোপাধ্যায়, পা., ২০০৭, পােস্টমডার্ন ভাবনা এবং অন্যান্য; সং ২, র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেসন। 
  • উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলস; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো ১৯৭১ 
  • করিম, স.ফ., ১৯৭৩, দর্শনকোষ; বাংলা একাডেমি, হােসেন, মাে.শ., ২০০৪, সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শনের রূপরেখা; সং ২, ঢাকা।
  • লিরিক; উত্তরাধুনিকতার ভিন দিগন্ত সংখ্যা ১৩, ২০০৩
  • কবির, হু, “উত্তরাধুনিকতা: অথর, রিডার ও টেট পরিপ্রেক্ষিত” লিরিক লিটল ম্যাগ ১৩ সংকরণ; পৃ ২৫৮ 
  • Foucault, M., 1970, The Order of Things: An Archaeology of the Human Sciences; NY 
  • Lyotard, J., 1984, The Postmodern Condition: A Report of Knowledge; Manchester 
  • Marcus G.E., and M.M.J. Fischer, 1986, Anthropology as Cultural Critique: An Experimental Moment in Human Sciences; Chicago 
  • Norris, C., 1979, Deconstruction: Theory and Practice; NY; Routledge 
  • Vattimo, G., 1968, The End of Modernity: Nihilism and Hermenutics in Postmodern Critique; London 
  • Tyler, S., 1968, Postmodern Ethnography: From Document of the Occult to Occult Document; Bekerly; University of California Press 
  • Derrida, J., 1976, Of Grammatology; (trans: by Spivak) John Hopkins University Prss Kaviraj, N., 2005, What is Postmodernisin?; Kolkata, 
  • Eaglaton, T., 1996, The Illusions of Postmodernism; Oxford Press. Broomer, P., (edt), 1992, Modernism/Postmodernism; Longman. 
  • Kottak, C.P., 2002, Cultural Anthropology (9th ed.); McGraw Hill. 
  • Nietzsche, F., 1977 On Truth and Lies in a Nonmodern Sense: Philosophy and Truth Selections from Nietzsche’s Notebooks in Early 1970’s; Humanities Press; NJ. 
  • Hassan, I., 1985, The Culture of Postmodernism: Theory, Culture, and Society, V 2. 
  • The New Encylopaedia Britannica, Micropedia, vol. vii 
  • The Encylopaedia Americana, International Edition, vol.19

উত্তরাধুনিকতাবাদের ক্রিটিকাল প্রতিক্রিয়া

ভূমিকা

মানব অস্তিত্ব সম্বন্ধীয় উত্তরাধুনিকতাবাদী মতবাদের সমালােচনা করা হয়েছে বিভিন্ন আপত্তির মাধ্যমে। এখানে এই সমালােচনাগুলাের কিছু পর্যালোচনা দেখানো হচ্ছে। এগুলাে মূলত জার্মান সমাজ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্নস্ট গেলনার (Ernest Gellner, ১৯২৫-৯৫ খ্রি.). ইউর্গেন হাবারমাস (Jurgen Habermas, ১৯২৯-) এবং উলরিচ বেক (UIrich Beck, ১৯৪৪-২০১৫ খ্রি.) এর দর্শনের প্রতিফলন। তাছাড়া অ্যান্থনি গিডেন্স (Anthony Giddens, ১৯৩৮-) যিনি একজন ব্রিটিশ নেতৃস্থানীয় সমাজবিজ্ঞানী এবং বুদ্ধিজীবী তার সমালােচনাগুলােও নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। গিডেন্স হচ্ছেন University of Cambridge সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং তিনি London School of Economics এর সভাপতি।

আর্নেস্ট গেলনার এবং শাস্ত্রীয় সত্য

উত্তরাধুনিকতাবাদীদের সমালােচনা করা হয়েছে এই কারণে যে তারা মনে করে মানুষ কখনাে নিশ্চিত কোন ধারণার অধিকারী হতে পারবে না। কারণ সে কখনাে তার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। এই মতবাদ অনুযায়ী মানবজাতি কখনাে সত্য এবং মিথ্যা, ভালাে এবং মন্দ একটি সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত হওয়া ছাড়া কখনাে জানতে পারবে না। তবে তাদের এই ধরনের মতবাদ সবসময় মেনে নেয়া যায় না যে মানুষ কখনাে তার সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত হয়ে বাস্তবতা সম্বন্ধে কোন দিন কোন ধারণা লাভ করতে পারবে না। এই বাস্তবতা সম্বন্ধীয় প্রকৃত ধারণা লাভ করা সম্ভব বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়নের মাধ্যমে। তবে এই ধরনের বাস্তবতার প্রকৃতি সম্বন্ধে সত্য জ্ঞান লাভ করতে হলে আমাদেরকে প্রথমে নৈতিক, সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা এবং প্রায়ােগিক আপেক্ষিকতার পার্থক্যগুলাে বুঝে উঠতে হবে। সর্বপ্রথম যিনি উত্তর আধুনিকতার সমালােচনা করেন তিনি হচ্ছেন Ernest Gellner (1925- 95)। Ernest Gellner স্বীকার করেন যে, বিজ্ঞানসম্মত বস্তুনিষ্ঠ বিদ্যা কখনাে আমাদেরকে বলতে পারবে না কিভাবে জীবনযাপন করতে হবে কিংবা কিভাবে নিজেদেরকে সুসংগঠিত করতে হবে। এর অর্থ হলাে যে বিজ্ঞানের কাছ থেকে আমরা কখনাে নৈতিক দিকনির্দেশনা আশা করতে পারি না; এটা সম্ভব শুধু সাংস্কৃতিক গঠনের আওতাধীন হয়ে প্রভাবিত হওয়ার মাধ্যমে। তাই বলে এটা কখনাে বলা যাবে না যে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা পর্যালােচনা আমাদেরকে কখনাে আমাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধীয় বাস্তবতার সত্য সম্বন্ধে কোন জ্ঞান দান করতে পারবে না। Gellner এর মতে, সত্যের কাছে পৌঁছার জন্য বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা পর্যালােচনা প্রায়ােগিক প্রমাণাদি প্রয়ােগ করে যাতে ধারণা ও অনুমানকে মিথ্যা প্রতীয়মান করা যায়। বিজ্ঞানসম্মত বিদ্যাই হচ্ছে একমাত্র বিদ্যা যা যে কোন ক্ষেত্রেই প্রয়ােগ করা হােক না কেন, সবসময় অভিন্ন ধরনের ফলাফল আমাদের কাছে তুলে ধরে। তিনি বলেন আমরা যদি Kuhn এর মতবাদকে মেনেও নেই এবং বিশ্বাস করি যে, বিজ্ঞানসম্মত বিদ্যা চর্চাও কখনো সংস্কৃতির আওতামুক্ত হতে পারে না তবুও এর অর্থ এই নয় যে সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত যে বিষয়গুলাে আছে সেগুলো বিজ্ঞানসম্মত পর্যালােচনা ও সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। বিজ্ঞানীরা যে সংস্কৃতিতে বসবাস করুক না কেন পৃথিবীর যে অংশে যে সময়ই তারা জীবনযাপন করুক না কেন তারা নিজেদের নির্দিষ্ট কিছু অভিজ্ঞতা প্রয়ােগ করে এবং সকল ক্ষেত্রেই স্থান ও কালভেদে তাদের এই অভিজ্ঞতা অভিন্ন হয়ে থাকে। ফলে তাদের সবারই স্থান ও কালের উর্ধ্বে থেকে এক ধরনের ফলাফলে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়ে উঠে। এর কারণ হলাে এই বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা পর্যালােচনা যখন প্রকৃত সত্যের উঘাটন করতে যায় তখন সে কিন্তু মানবিক আশা ভরসা মতবাদ, ভীতি ও আশংকার ধার ধারে না। আর এই বাস্তবতাগুলাে হচ্ছে ভীতিপ্রদ, বিষন্নতার উদ্বেগকারী এবং হতাশার সৃষ্টিকারী। বিজ্ঞানের কথা হচ্ছে পৃথিবী হচ্ছে শীতল, কুৎসিত এবং নির্দয় জায়গা। তাই বৈজ্ঞানিকরাও অন্যান্য মানুষদের মতােই শুধু কল্যাণের আশা করে এবং ভাবতে থাকে তারা যা ভালােবাসে তাদের কাছে কোন ব্যথা বেদনা না থাকে, তারা যাতে অসুস্থ না হয়, তারা যাতে মৃত্যুবরণ না করে ইত্যাদি। তাহলে দেখা যায় পৃথিবীটাকে তারা একটি নিষ্ঠুর ক্ষেত্র মনে করলেও বৈজ্ঞানিকরা কিন্তু সর্বদা কল্যাণকামিতার পক্ষপাতী অন্য যে কোন দশজন সাধারণ মানুষের মতােই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পারিপার্শ্বিকতার বিষয়বস্তু বাস্তবে যা আসলেও তা, মানুষ এবং বৈজ্ঞানিকরা তা পছন্দ করুক আর না করুক। তাই দেখা যায় বিজ্ঞান প্রকৃত সত্য উঘাটন করার যে সক্ষমতা অর্জন করে তা মূলত এই জন্যই যে বিজ্ঞান সবসময় এমন মানবিক অনুসন্ধান কেন্দ্রিক পদ্ধতির প্রয়ােগ করে যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সত্য উদ্বাটন করা এবং শুধু সত্য উঘাটন করা। Gellner এর ভাষায়, “Truth is not beauty: nor virtue, nor utility, nor the advancement of any political cause.” অর্থাৎ, “সত্য কিন্তু সুন্দর কিছু নয়; গুণাবলি বলতে কিছু নয়; নয় উপকারিতা, নয় এটা কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করার অগ্রযাত্রা।” (Gellner, Ernest, Spectacles and Predicaments: Essays in Social Theory, Cambridge. 1979, p. 144)। বিজ্ঞান দেখা যায় নিরপেক্ষতার বিরােধিতা করে, প্রকৃত প্রথার ধস নামিয়ে আনে, যা কিছু বস্তু রূপ ধারণ করেছে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সুবিধাজনক ঘটনা বা সত্য প্রতিপাদন করতে তার কোন অস্তিত্ব নেই। এই সব ক্ষেত্রে বিজ্ঞান কখনাে উপলক্ষ, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের বিবেচনা করে না। অর্থাৎ বিজ্ঞান তার গবেষণা পর্যালােচনা কোন শব্দ এবং কোন অলৌকিক কিছু, কোন দাতা, কোন ধর্মীয় উপাসনালয় অথবা ধর্মীয় সমপ্রদায়ে বিশ্বাসী নয়। (Gellner. Ernest Postmodernism, Reason and Religion, London. Routledge)। এটা এই জন্যই আমরা পৃথিবীটাকে যেমন দেখতে ভালােবাসি এবং এর যে স্বরূপের উপর নির্ভর করে আমরা সত্য সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী বিজ্ঞান কিন্তু এগুলাে নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না।

Gellner তাই জোর দিয়ে বলেন যে খাওয়ার মাধ্যমেই একটি পুডিং এর অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। তাই যেখানেই বিজ্ঞানসম্মত বিদ্যা চর্চার প্রয়োগ করা হয় সেখানেই মানষের অস্তিত্বে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। মানবজাতিকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করতে হবে যে, শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণা পর্যালোচনা প্রয়ােগের কল্যাণেই মানুষ আধুনিকতা পূর্ব যুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পণ করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি আরাে কাকে দেখিয়ে বলেন যে, এই আধুনিক জগতের সৃষ্টিতে বিজ্ঞানের অবদান যদি না থাকত এবং বিজ্ঞান যদি আমাদের অতীব বাস্তবতা সম্বন্ধে ধারণা না দিত তাহলে অনুন্নত পশ্চাৎপদ সমাজগুলাে কেন বিজ্ঞানের ব্যবহার করে নিজেদেরকে আধুনিক সমাজে পরিণত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে? তাই গেলনার বলেন, দর্শনদী আপেক্ষিকতা হচ্ছে অমূলক বিষয়, নৈতিকতা হতে পারে আপেক্ষিক, কিন্তু সত্য কখনাে তা হতে পারে না।

গেলনার মানবজাতির প্রকৃত বাস্তবতা সম্বন্ধীয় জ্ঞান লাভ করার ক্ষেত্রে আপেক্ষিকতাবাদী যে মতবাদ ব্যক্ত করেন তার ঘাের বিরােধিতা করেন। তিনি শুধু নিজেকে এতটুকুতে সীমাবদ্ধ রাখেননি বরঞ্চ আরেকটু এগিয়ে এই যুক্তি দেখান যে, নৈতিকতা একটি আপেক্ষিক জিনিস হলেও সমস্ত সংস্কৃতির জন্য বিশ্বজনীন এই ধরনের নৈতিকতার প্রবর্তনও করা সম্ভব। এভাবে তিনি নৈতিকতার আপেক্ষিকতাও অস্বীকার করে বসেন। এরা কিন্তু এই বাস্তবতাটাকে অস্বীকার করে না যে, মানবজাতি মূলত সাংস্কৃতিকভাবে সংগঠিত- অর্থাৎ সত্য এবং মিথ্যা, ভালাে এবং মন্দ হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক গঠন সম্বন্ধীয় ধারণা। এটা উত্তরাধুনিকতাবাদের সমালােচকরা স্বীকার করে নিলেও তারা এটা মানতে রাজি নন যে সাংস্কৃতিক মূল্যবােধের কোন স্থায়ী রূপ নেই। কারণ নিঃসন্দেহে প্রকৃতি মানুষকে একে অপরের সাথে ঐকমত্যে পৌছার যােগ্যতাও দিয়ে দিয়েছেন। এই গুণের কল্যাণে এক মানুষ সম্পূর্ণ অচীন ও ভিন্ন এক সংস্কৃতির মানুষের সাথেও একীভূত হতে পারে। তারা নিজেদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট আচারবিধিও প্রবর্তন করতে পারে। এই উদারবাদী মনােভাবের উপর ভিত্তি করে তারা বলেন শুধু সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ হওয়ার জন্যই আমরা খােলামেলা এবং সৎ সংলাপের মাধ্যমে পার্থক্যগুলাে ভুলে ঐকমত্যে পৌছতে পারব না তা কিন্তু হতে পারে না। যতদিন ঐকমত্যে পৌঁছার মতাে আমাদের সদিচ্ছা থাকবে ততদিন আমরা একদিন আন্তঃসাংস্কৃতিক ঐকমত্যে পৌছার চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি। এই আন্তঃসংস্কৃতির ঐকমত্যের মূলভিত্তি হবে নৈতিকতা এবং সঠিক মূল্যবােধ। এই ধরনের উদারবাদী মতবাদের প্রবক্তারা যারা তারা মনে করেন যে, সাংস্কৃতিক প্রভাবমুক্ত সত্য ও মিথ্যার সঠিক ধারণা লাভ করার উপায়ও রয়ে গেছে। এবং এটা করা যায় নৈতিকতার সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে। এখানেই প্রকৃত সত্য উঘাটনের বৈজ্ঞানিক ভূমিকার অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই। জার্মান সমাজ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইউর্গেন হাবারমাস (Jurgen Habermas, ১৯২৯- ) হচ্ছেন এই ধরনের উদারপন্থি প্রথার প্রধান প্রবক্তা। সত্য উদ্ঘাটন করতে বিজ্ঞান যেমন তার গবেষণাগারের অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলাে ব্যবহার করতে পারে তেমনি মূল্যবােধ সম্বন্ধীয় সত্য প্রতিষ্ঠা। করতে আমরা ভাষা এবং যােগাযােগকে ব্যবহার করতে পারি । Jurgen Habermas এর মতে, মানুষের ভাষা প্রয়ােগের মাধ্যমে যােগাযােগ স্থাপনের যে অতুলনীয় যােগ্যতা রয়েছে তা আমাদেরকে নৈতিক জ্ঞান লাভেও সাহায্য করতে পারে ঠিক গবেষণাগুলাে ব্যবহার করে আমরা যেমন বাস্তবতা সম্বন্ধীয় বিদ্যাগুলাে অর্জন করতে পারি।

ইউর্গেন হাবারমাস এবং যােগাযোগ কেন্দ্রিক যৌক্তিকতা বা কমিউনিকেটিভ র‍্যাশনালিটি

ভূমিকা

হাবারমাস হচ্ছেন আলােকিত যুগের চিন্তাবিদদের উত্তরাধিকারী তবে তিনি ছিলেন একটু অতিমাত্রায় আধুনিক প্রকৃতির। আলােকিত যুগের উত্তরাধিকারী হওয়ার কারণে তিনি কিন্তু অন্যের জোরালাে প্রবক্তা ছিলেন এবং আমাদের যুগেও আধুনিক চিন্তাবিদদের মতবাদকে যথাযথ মূল্যায়ন করে আসছেন। তিনি উত্তর অধুনাবাদীদের সাথে এই বিষয়ে একমত নন যে মানবজাতি কখনাে প্রকৃত সত্য উদঘাটনে সক্ষম হবে না। হাবারমাসের মতে, আমাদেরকে এখনাে মানব যৌক্তিকতার শক্তি সম্বন্ধীয় আলােকিত যুগের মতবাদের মতাে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যাতে আমরা প্রকৃত সত্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারি। মানবজাতি হিসেবে যেহেতু আমরা একে অপরের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের জন্য ভাষার ব্যবহার করতে পারি সেজন্য সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত মতপার্থক্যসমূহ আমরা ভুলে গিয়ে ঐকমত্যে পৌছতে পারি। তার মতে, মানবজাতি কখনাে সংস্কৃতির শৃঙখল বন্দি হতে পারে না আধুনিকতাবাদীরা যেমনটা মনে করে আসছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক পটভূমি যতটা ভিন্ন হােক না কেন জীবন অভিজ্ঞতা সম্বন্ধীয় চিন্তাধারা যতই বিপরীত হােক না কেন মানবজাতিকে একটি অদ্বিতীয় যােগ্যতা দিয়েছে আর তা হচ্ছে একে অন্যের সাথে ভাষার মাধ্যমে যােগাযােগ স্থাপন করা। হাবারমাস মনে করেন, যতদিন আমাদের মাঝে একটি ঐকমত্যে পৌঁছার আকাঙ্ক্ষা থাকবে ততদিন একমাত্র ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে আমরাও সাংস্কৃতিক মতপার্থক্যগুলাে ডিঙিয়ে এক ধরনের আন্তঃসাংস্কৃতিক নৈতিক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করতে পারি। হাবারমাস তার মতবাদে বিভিন্ন মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং বলা যায় তার মতবাদ সম্বন্ধীয় পদ্ধতিগুলাে মূলত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মতবাদসমূহেরই পুনঃস্থাপন। তিনি তার মতবাদে পুনরায় মার্কস, ওয়েবার এবং ক্রিয়াবাদী মতবাদের সংশ্লেষণ ঘটান।

মার্ক্সীয় প্রভাব

মার্কস থেকে হেবারমাস সামাজিক সম্বন্ধীয় বৈষম্যের মতবাদটি ধার করেন। তাই তিনিও সামাজিক অস্তিত্বকে দুই ভাগে ভাগ করেন। একটি হচ্ছে সামাজিক ব্যবস্থা এবং আরেকটি হচ্ছে জীবন বিশ্ব। সামাজিক ব্যবস্থা বলতে এমন বিশ্বকে বুঝায় যেখানে জিনিসপত্র তৈরি হয় এবং গঠন কেন্দ্রিক প্রপঞ্চ তার প্রভাব প্রতিপত্তি চর্চা করে। পক্ষান্তরে, জীবন বিশ্ব হচ্ছে কর্মকাণ্ড এবং অর্থের রাজত্ব। 

ভেবারীয় প্রভাব

ভেবার বা ওয়েবারের সাথে তাল মিলিয়ে তিনি যৌক্তিকতা এবং মানবিক কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাধীনতার আলােকে তার মতবাদের বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া পরিচালিত করেন। হাবারমাস যৌক্তিক কর্মকাণ্ডের দু’টি ধরন সমাজবিজ্ঞানীদের সামনে তুলে ধরেন। একটি হচ্ছে কেন্দ্রিক যৌক্তিকতা। এই যৌক্তিকতার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানবজীবন কেন্দ্রিক যােগ্যতার উন্নয়ন সাধন করা। আরেকটি হচ্ছে মূল্যবােধ কেন্দ্রিক যৌক্তিকতা। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তির ব্যবহার করে সত্য এবং অসত্যের পার্থক্য সৃষ্টিকারী রেখাটি সুনির্দিষ্ট করা। ওয়েবার লক্ষ্য করেন যে, যন্ত্রকেন্দ্রিক যৌক্তিকতা লক্ষ্য করে আধুনিক জগতে মানুষ মানব আচরণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করছে। তিনি যন্ত্রকেন্দ্রিক যৌক্তিকতার এই শৃঙ্খল থেকে মানবজাতি কখনাে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে আশাবাদী ছিলেন না। ওয়েবারের মতাে আধুনিক যুগে মানবজাতি নিজেদের যােগ্যতা বৃদ্ধির জন্য অংক এবং ভবিষ্যৎ অনুমানকারী পদ্ধতির ব্যবহার করছে তাতে কিন্তু তাদের দ্বারা আধ্যাত্মিকতা উপেক্ষিত হয়ে আসছে। এর মাধ্যমে মানুষ একটি বিমর্ষ জগতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি অনুমান করেছেন যে, আধুনিক জীবনের ভবিষ্যৎ হচ্ছে অন্ধকার। তিনি বলেন যে, ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন মানবজাতি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সূক্ষ্মতা দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করার চেষ্টা করবে অথচ এটা করতে গিয়ে মূল্যবােধের প্রতি তাকানাের গুরুত্ব সে আর অনুভব করবে না এবং ভালাে ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার প্রয়ােজন অনুভব করবে না। সত্য ও মিথ্যা সম্বন্ধীয় তার তেমন একটা মাথা ব্যথা থাকবে না। তিনি তার দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেলেন যে, ভবিষ্যতে এমন এক বিশ্বের আবির্ভাব হবে যেখানে মানুষ কখনাে চিন্তা করে দেখবে না। কিভাবে আমাদের জীবন-যাপন করা উচিত, আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, এবং কোন ধরনের মানুষের সাথে আমাদের থাকা উচিত। ওয়েবার মনে করতেন যে, আধুনিকতা শুধু যৌক্তিকতার বিজয়কে প্রমাণিত করেনি বরঞ্চ যান্ত্রিক যৌক্তিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই আধুনিক জগতের এই বিপর্যয়ের জন্য যৌক্তিকতাকে দায়ী করা যায় না। নিঃসন্দেহে আমরা অঙ্ক কষে কিভাবে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করি তা করার পাশাপাশি কিভাবে আমরা আমাদের জীবন-যাপন করব তা নির্দিষ্ট করার জন্য বিবেক বুদ্ধির প্রয়ােগ করতে পারি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এটা আমরা করি না এবং ধীরে ধীরে তা থেকে আমরা দিনের পর দিন আরাে দূরে সরে আসছি। তাই দেখা যাচ্ছে বর্তমানে মানবজাতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিষন্ন, আধ্যাত্মিকতাহীন এবং বিমর্ষ প্রক্রিয়াহীন। 

হাবারমাস কিন্তু উপরােল্লিখিত ওয়েবারের সকল মতবাদের সাথে ঐকমত্য পােষণ করেন নি। ওয়েবারের সাথে তিনি এই বিষয়ে একমত পােষণ করেন যে, মানুষের সূক্ষ্মতম যােগ্যতা অর্জন করার জন্য যন্ত্রপাতিসমূহের সাথে মানবিক যৌক্তিকতাকে জুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তবে তিনি মনে করেন ওয়েবারের সাথে এই ব্যাপারে পুরােপুরি একমত না হয়ে আরাে এক ধাপ আগে বেড়ে বলা যায় আরাে মহৎ কিছু উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যৌক্তিকতার প্রয়ােগ করা যেতে পারে। আর তা হচ্ছে ভালাে করা এবং ভালাে করার মানসিকতা অর্জন করা। এই জন্য আমাদেরকে যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে মূল্যবােধ কেন্দ্রিক যৌক্তিকতা বিশ্বাস করতে হবে। হাবারমাসের মধ্যে আমাদের সমস্যা হচ্ছে মূলত এই যে আমরা ব্যবহারের অযোগ্য জীবনের অনেক ক্ষেত্রে যান্ত্রিক যৌক্তিকতার প্রয়োগ করে চলেছি। আমরা বলতে পারি যে, সামাজিক ব্যবস্থাই হচ্ছে যান্ত্রিক যৌক্তিকতা ব্যবহার করার উপযুক্ত এবং এখানে যখন মানবজাতি নিজের যোগ্যতার বুদ্ধিতে এই যৌক্তিকতার ব্যবহার করে তখন ওয়েবারের মতাে চিন্তাবিদরা পুলকিত না হয়ে পারেন না। তবে সমস্যাটি হচ্ছে আমরা জীবনের অনেক ক্ষেত্রেও যান্ত্রিক যৌক্তিকতাকে মাপকাঠি হিসেবে প্রয়োগ করছি যে ক্ষেত্র কখনাে এই ধরনের যান্ত্রিক যৌক্তিকতা প্রয়ােগের উপযুক্ত নয়। যেমন মূল্যবােধের ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা অযাচিতভাবে যান্ত্রিকতা যুক্তিকতা প্রয়ােগ করে চলছি। এভাবে জীবন বিশ্বে যান্ত্রিকতা যৌক্তিকতার উপনিবেশ গড়ে তুলে মানবজাতি একটি বিরাট ভ্রান্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাবারমাসের মতে, আমরা যদি সত্য এবং মিথ্যা চিহ্নিত করার জন্য নিজেদের যােগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে যৌক্তিকতার ব্যবহার করি তাহলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন এক ভবিষ্যৎ। এই যৌক্তিকতা প্রয়ােগের মাধ্যমে আমরা প্রতিষ্ঠান এবং উৎপাদনে সূক্ষ্মতম যােগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটা কিভাবে সম্ভব? কিভাবে আমরা এমন এক উত্তম পৃথিবীর সৃষ্টি করতে পারি যেখানে যথাযােগ্য ক্ষেত্রে আমরা আমাদের সূক্ষ্মতা ও যােগ্যতা অর্জনের অদম্য ইচ্ছার সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারি এবং যেখানে সমাজের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির হওয়া সত্ত্বেও ভালাে এবং মন্দের সম্বন্ধে একে অপরের সাথে আলাপ-আলােচনা চালিয়ে যাবে? এই ধরনের প্রশ্নগুলাের উত্তর দিতে হাবারমাস ভাষা, মিথস্ক্রিয়া, যােগাযােগ এবং কর্মকাণ্ড মতবাদ সম্বন্ধীয় প্রবক্তাদের চিন্তাধারার আশ্রয় নেন। ক্রিয়াবাদী মতবাদের মধ্যে যেসব চিন্তাধারা হাবারমাসের কাজকে ব্যাপকভাবে প্রবাহিত করে তার মধ্যে জাতিতাত্ত্বিক মতবাদই (Ethnomethodology) সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য মতবাদ।

জাতিতাত্ত্বিক প্রভাব

মানবজাতি সামাজিক জীবনে যা বিশ্বাস করে তা উঘাটন করাই হচ্ছে জাতিতাত্ত্বিক মতবাদের মূল লক্ষ্য এবং এই অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের আলােকেই পৃথিবীর সামাজিক গঠনগুলাে তার স্বরূপ নির্ধারণ করে। জাতিতাত্ত্বিক মতবাদ সম্বন্ধে আমাদের জানতে হলে এতটুকু পুনরায় স্মরণ করতে হবে যে মানবজাতি মনে করে সমাজের একটি বাহ্যিক ব্যবস্থা থাকার কারণেই সামাজিক জীবন সক্রিয় হয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। আমাদের নিজস্ব চিন্তাচেতনার বলেই সামাজিক প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়ে আসলেও আমরা কিন্তু তা উপলব্ধি করি না। আমরা মনে করি যে, আমাদের বিশ্বে একটি নির্দিষ্ট অর্থ এবং নির্দিষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। এই অর্থ ও ব্যবস্থা সম্বন্ধীয় অনুমানের ভিত্তিতে একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে আমরা আমাদের সামাজিক কর্মকাণ্ডের স্বরূপ নির্ধারণ করি। যেহেতু আমাদের ধারণা হচ্ছে যে জীবনটা হচ্ছে মূলত একটি নির্দিষ্ট ব্যবস্থার অধীন সেহেতু আমরা আশা করি যে, আমরা যে ধরনের আশা-প্রত্যাশা করি অন্যরা সেই ধরনের আশা প্রত্যাশার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করবে। তাই আমরা যেহেতু মনে করি যে, জীবন নিঃসন্দেহে একটি ব্যবস্থার আওতাধীন তাই আমরা আমাদের প্রতিপক্ষের কাছ থেকে নিজেদের আশা প্রত্যাশার বাইরে কোন ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করি না। তেমনি প্রতিপক্ষের আশা প্রত্যাশা অনুযায়ী আমরা নিজেদের কর্মকাণ্ডকেও পরিচালিত করি। আমাদের চিন্তাধারা এবং অনুমানের সাথে প্রতিপক্ষের চিন্তাধারা ও অনুমান সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কারণে সামাজিক উপলক্ষগুলাে সক্রিয় হয়ে উঠে। আমরা একে অপরের সাথে সদাচরণ করি এই জন্য যে, পারিপার্শ্বিক বিষয়বস্তু সম্বন্ধীয় আমাদের ধ্যান-ধারণা সাদৃশ্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, গার্ফিংকেল (Garfinkel) এর মতবাদের কথা স্মরণ করলে দেখা যাবে যে, তিনি মনে করেন একজন যা কিছু ধারণা তাকে সত্য ধারণা করে কারণ সে আশা করে প্রতিপক্ষ একই ধরনের চিন্তাধারা করে। কোন বিষয়বস্তু সম্বন্ধীয় আমাদের চিন্তাচেতনা তখনই গড়ে উঠে যখন এই চিন্তাচেতনার সাথে সাদৃশ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। গার্ফিংকেলের মতে, জাতিতাত্ত্বিক মতবাদই হচ্ছে মানবজাতির সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক উপহার। এর মাধ্যমেই মানবজাতি সম্মিলিতভাবে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সক্ষম হয়। মানবজীবনের সামাজিক দিক যাতে সচল থাকে এই জন্য এটাকে হতে হবে সামঞ্জস্যমুখী প্রতিষ্ঠান। আমরা যখন একে অপরের সাথে যােগাযােগ করব তখন বিষয়বস্তু সম্বন্ধীয় আমাদের ধ্যান-ধারণা কি হতে হবে এটাই আমরা একে অপরের কাছ থেকে আশা করব। অন্যথায় আমরা কখনাে একে অপরের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে সামাজিক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারব না।

যোগাযোগমুখী ক্রিয়া বা কমিউনিকেটিভ একশন

হাবারমাস মনে করেন মানবসমাজে আমরা যদি একটি নৈতিক বন্ধনের সৃষ্টি করতে চাই তাহলে অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে আমাদের যােগাযােগ করতে হবে এবং আমাদেরও তাই করতে হবে পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতি সদা সর্বদা যা করে। এই ক্ষেত্রে বিশ্বজনীন সামাজিক উপলক্ষগুলােও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। আমাদেরকেও একে অপরের সাথে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে এবং অর্থের কোন সাদৃশ্যপূর্ণ স্বরূপ নির্ধারণের জন্য ঐকমত্যে পৌঁছার চেষ্টা করতে হবে। দৈনন্দিন সামাজিক জীবনের সাথে প্রতিপক্ষের সাথে সহাবস্থান করার জন্য আমরা আমাদের যৌক্তিক এবং বিবেকসম্পন্ন ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারি। একই পদ্ধতিতে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক বিভাজনগুলাে ডিঙিয়ে আসতে পারি। তবে এখানে লক্ষ্য রাখার বিষয় হচ্ছে যে মানবজাতি কিন্তু অর্থ সম্বন্ধীয় কোন ঐকমত্যে পৌঁছতে আশাবাদী না হওয়া ছাড়া সংলাপে লিপ্ত হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একজন মানুষ তখনই দোকানে প্রবেশ করে যখন সে নিশ্চিত হবে যে, দোকানদার তার কাছে জিনিসগুলাে বিক্রি করবে। অনুরূপ একজন দোকানদার যখন কাউকে প্রবেশ করতে দেখে তখন সে এই আশাই করে যে এই ব্যক্তি তার দোকানের জিনিসপত্র কিনবে। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে তারা প্রতিপক্ষ সম্বন্ধে এমন কিছু অনুমান করতে পারি তাদেরকে একে অপরের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করেন। ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয় এই আশা করে যে, প্রতিপক্ষ এমন আচরণ করবে যার মাধ্যমে একটি যৌক্তিক পরিণতিতে উপনীত হওয়া যাবে। হাবারমাসের মতে, এভাবে প্রান্তিক অনেক যােগাযোগ স্থাপন করা সব। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের কথা বলা যেতে পারে। একটি রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থা তখনই টিকে থাকে যখন এর সদস্যদের মধ্যে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করে, একে অপরকে সমানভাবে নিজস্ব আচরণ পরিচালিত করে এবং সবসময় ঐকমত্যে পৌঁছার আশা রাখে তখনই একটি রাজনৈতিক দল সক্রিয় থাকতে সক্ষম হয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তখনই ব্যাঘাত ঘটবে যখন বিনিময় হবে একতরফা এবং ঐকমত্যে পৌঁছার উদ্দেশ্য কেউ সদিচ্ছা পােষণ করবে না। তেমনি মানবজাতি ততদিন পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে সচ্ছিদা পােষণ করবে ততদিন পর্যন্ত তারা ঐকমত্যে পৌঁছার সম্ভাবনা বজায় রাখবে। পক্ষান্তরে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা যদি বৈষম্য এবং বৈসাদৃশ্য দেখা যায় তাহলে এ ধরনের ঐক্যে পৌঁছাটা অসম্ভব হয়ে যাবে। একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি যদি তার যােগাযােগ স্থাপনের ক্ষমতা শুধু অন্য একজন অপমানিত ও নিপীড়িত করার জন্য ব্যবহার করে তাহলে তাও সম্ভব। একজন ব্যক্তি যদি অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে না নিতে বদ্ধপরিকর থাকে এবং প্রয়ােজনে নিজের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ানাের জন্য নিজের সুযােগ না থাকে তাহলে যােগাযােগ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রত্যাশিত ফল আশা করা যায় না। আমাদের যােগাযােগ ভিত্তিক মিলন মেলা তখনই সফল হবে যখন আমাদের লক্ষ্যস্থল হবে অভিন্ন এবং সুনির্দিষ্ট। কিন্তু যখন মিলিত দলগুলাে নিজেদের অন্তরে ঐকমত্যে পৌঁছার ইচ্ছাপােষণ করবে এবং প্রত্যেকেই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার সুযােগ দেয়া হবে তখন একটি ইতিবাচক ফলাফলে উপনীত হওয়া সম্ভব। এর অর্থ হচ্ছে যে, মানুষে মানুষের মিলন যখন যৌক্তিকতার আলােক সাধিত হবে তখন মানবজাতি তাদের বৈষম্যগুলাে উতরে যেতে পারবে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলাে আমরা কিন্তু চাইলে অযৌক্তিক এবং হঠকারী আচরণ করতে পারি। পক্ষান্তরে, ইচ্ছা করলে আমরা যুক্তি ও বিবেক সম্পন্ন আচারআচরণও করতে পারি। যৌক্তিক যােগাযােগ স্থাপন হচ্ছে প্রাণী জগতে মানুষেরই একমাত্র অদ্বিতীয় গুণ এবং হাবারমাস মনে করেন যে, এই মহৎ গুণের কল্যাণেই আমরা এমন এক বিশ্বে বসবাস করতে পারি যেটা শুধু শারীরিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্র নয়। বরঞ্চ মানব এখানে একটি নৈতিক অংশীদারিত্ব চর্চা করতে পারবে।

এন্থনি গিডেনস ও উলরিচ বেকের শেষ পর্যায়ের আধুনিকতার বিশ্লেষণ

ভূমিকা

এন্থনি গিডেনস উত্তরাধুনিকতাবাদের সমালােচনা করেন অন্য দিক থেকে। প্রথমেই উত্তরাধুনিকতাবাদের সমালােচনা করেন এই জন্য যে, উত্তরাধুনিকতাবাদকে মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে এটা স্বীকার করা যে আমরা আর আধুনিক যুগে বসবাস করছি না এবং মানবজাতি তাদের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে আধুনিকতাকে পিছে ফেলে এসেছে। তিনি মনে করেন এটা হচ্ছে এক ধরনের চরম ভুল ব্যাখ্যা। তিনি মনে করেন যে, সমকালীন জীবনে হয়তাে আধুনিকতার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে এবং এখানে নিত্যনতুন পরিস্থিতি আবির্ভাব দেখা দিয়েছে। দেখা দিয়েছে নতুন শক্তি এবং নতুন ধরনের অস্থিতিশীলতা এই নয় যে আধুনিকতার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই তিনি মনে করেন সমকালীন যুগের সামাজিক অস্তিত্ব সম্বন্ধীয় চেতনার ভাব করতে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান এখনও আমাদের মতবাদ কেন্দ্রিক যন্ত্রপাতিগুলাে সরবরাহ করতে সক্ষম।

দ্বিতীয়ত, তিনি উত্তরাধুনিকতাবাদের সমালোচনা করেন এই জন্য যে উত্তরাধুনিকতাবাদ মানবিক কর্মকাণ্ডকে দেখে কিছু অবান্তর প্রভাবের আওতাধীন এবং এই মানবিক কর্মকাণ্ড কখনো স্বাধীন হতে পারবে না আর কখনো উদ্ভাবনী কোন ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারবে না। গিডেন্সের মতে বিষয় কিন্তু এখনো মৃত্যুমুখে পতিত হয়নি কিন্তু এটাও সত্য যে, মানবজাতি এখন কোন জাতিতাত্ত্বিক মতবাদের আলােকে সামাজিক সদস্য নয় যে গঠনমূলক বৈশিষ্ট্য এবং প্রভাবের উপস্থিতি ছাড়াই সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম। তবে তিনি কাঠামাে এবং ক্রিয়া পর্যায়ে মানব অস্তিত্বের সমকালীন একটি সংজ্ঞা দেন এবং এটাকে তিনি মনে করেন Late modernity শেষ পর্যায়ের আধুনিকতা বা বিলম্বিত আধুনিকতা। তিনি মনে করেন এই দুইটি বিষয় অর্থাৎ গঠন এবং ক্রিয়া আবার ক্ষুদ্র এবং সমষ্টিগত রূপে একে অপরের সাথে সংযুক্ত। তিনি তার গঠনায়ন সম্বন্ধীয় মতবাদে (১৯৮৪) এই ব্যাখ্যা দেন যে, কর্মী হিসেবে একজন ব্যক্তি শুধু নির্দিষ্ট গঠনকেন্দ্রিক পরিস্থিতির আওতায় নিজের ইচ্ছাগুলাে প্রকাশ করেন এবং গঠন কেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যগুলাে শুধু ইচ্ছা কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই বাস্তবতার মুখ দেখে। তাই আমরা বলতে পারি যে, জীবন সম্বন্ধীয় গিডেন্সের মতবাদ হচ্ছে গঠনায়ন মতবাদের আলােকে বিলম্বিত আধুনিকতার বিশ্লেষণ করা।

গঠনায়ন মতবাদ (Structuration theory)

গিডেন্স তার মতবাদের মাধ্যমে গঠনের দ্বৈততা সম্বন্ধীয় বিশ্লেষণগুলাে তুলে ধরেন। তার মতে, শুধু সামাজিক কাঠামােই তার প্রভাব বিস্তার করে মানবিক আচার আচরণের স্বরূপ নির্ধারণ করে না বরঞ্চ এটা আচার-আচরণকে পরিচালিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গঠনের মাধ্যমেই সুযােগ-সুবিধা এমনকি সীমাবদ্ধতারও সৃষ্টি হয়। গিডেন্স কিন্তু মানবিক কর্মকাণ্ডকে আবার প্রতিনিধি বলেও আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, এই গঠনকেন্দ্রিক সূত্রের আওতায় গঠনকেন্দ্রিক পরিস্থিতিগুলাে যার আওতায় মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তা সংগঠিত হয় এবং এরই মাধ্যমে পরবর্তী পর্যায়ে এর পুনর্গঠন, পুনঃসংজ্ঞায়ন সংগঠিত হয় এই মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এর অর্থ হলাে একটি ক্রিয়া যখন গঠনকেন্দ্রিক পরিস্থিতির প্রভাবে প্রবাহিত হয়ে সংগঠিত হয় তখন এই কর্মকাণ্ড দ্বারা পরিপ্রেক্ষিতসমূহ আবার পুনঃউৎপাদিত, পুনঃরূপান্তরিত অথবা রূপান্তরিত হতে পারে। এভাবেই গিডেন্স তার গঠনকেন্দ্রিক দ্বৈততার মতবাদের ব্যাখ্যা দেন, “Every act which contributes to the reproduction of a structure is also an act of construction, a novel enterprise, and as such may initiate change by altering that structure at the same time as it reproduces it.” অথাৎ, গঠনের পুনঃউৎপাদনে যে সমস্ত ক্রিয়াসমূহ কাজ করে সে সমস্ত কাজই হচ্ছে গঠনকেন্দ্রিক কাজ, এটা এক ধরনের মহৎ প্রতিষ্ঠান, তাই দেখা যায় যে, কাজের মাধ্যমে গঠনের যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি কাজের মাধ্যমেই এর মধ্যে রূপান্তর ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সাধিত হয়। (Giddens, Anthony, New Rules of Sociological Method, London, Hutchinson. 1976, p. 128 )। 

কেভিন বোনেট গিডেন্সের এই মতবাদের উপর নিম্নোক্ত মন্তব্যটি করেন, “This leads to a very different idea of structure to the common models in sociology. We often think of structures as like physical, immovable steel frames. Instead of this, Giddens distinguishes structure and system. He uses ‘system’ to refer to the lasting social arrangements and institutions that generally get reproduced over time; they are not immune to change, but they give a lasting context for action. This usage of ‘system’ is very close to what many sociologists have called ‘structure’. In contrast, Giddens uses the concept ‘structure in a very particular way to refer to the moving body of rules and resources that agents use for action. Because these ‘structures’ are fluid and not institutionalized, they can be continually modified as they are used in action. For example, we all use the English language in a way that is constantly changed and renewed as we use it, but we can pick up changes and still make sense of one another. The formal rules of ‘correct’ English lag far behind this practical usage.”। (Bonnett, 2002, Unpublished manuscript.)। অর্থাৎ, Giddens তার মতবাদের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানের কাঠামাে সম্বন্ধীয় প্রচলিত মতবাদগুলাের বিরােধিতা করেন। এই পর্যন্ত আমরা গঠনকে মনে করে এসেছি শারীরিক, অস্থাবর একটি সত্তা হিসেবে। কিন্তু গিডেন্স এসে গঠন এবং ব্যবস্থার মধ্যে একটি পার্থক্য নির্ণয় করেন। ব্যবস্থায় তিনি সামাজিক ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহকে বোঝায় যা সময়ের প্রবাহে সাধারণত পুনঃউৎপাদিত হতে থাকে। এটা কখনাে বলা যাবে না যে সামাজিক ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ সর্বদা পরিবর্তন বিরােধী সত্তা। তবে এতটুকু বলা যায় যে, মানবিক কর্মকাণ্ডসমূহের একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রেক্ষিত। হচ্ছে এই সামাজিক ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ। তবে গিডেন্স ব্যবস্থা বলতে যা বুঝিয়েছেন তা মূলত সমাজবিজ্ঞানীদের গঠন এর মতােই। কিন্তু সূক্ষ্ম পার্থক্য হচ্ছে গিডেন্স গঠন বলতে সমস্ত আইন ও উচ্ছেদ চলমান কাঠামােকে বোঝান। যেগুলােকে মানবজাতি তার কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে ব্যবহার করেন। যেহেতু এই ধরনের কাঠামোগুলো হচ্ছে তরল জাতীয় এবং অপ্রতিধ্বনিক সেহেতু কর্মকাণ্ডে এগুলোর প্রয়োগ হওয়ার সময় অবিরাম প্রক্রিয়ায় এর মধ্যে পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে আমরা সবাই ইংরেজি ভাষার এমন ব্যবহার করি যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু আমরা ইংরেজি ভাষার যে পরিবর্তিত রূপের ব্যবহার করি না কেন অনুভূতির এবং চেতনা প্রকাশের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অপরিবর্তনীয়। তাহলে বাস্তব জগতে দেখা যাচ্ছে যে, বিশুদ্ধ ইংরেজি কিন্তু ব্যবহারিক জগৎ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে।

গঠনায়ন মতবাদের প্রয়ােগ : ২০০১ সালে দেখা দেয়া গবাদি পশুর মহামারীর বিশ্লেষণ

২০০১ সালে যুক্তরাজ্যে গবাদি পশুগুলাে যে মহামারীর শিকার হয় তার মধ্যেই গঠনায়ন মতবাদের অধীন আমরা গঠন এবং ক্রিয়ার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পারি। Cumbria এলাকার শূকর চাষীরা (Pig-farmer) তাদের দায়িত্বহীনতার মাধ্যমেই এই মহামারী যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে দেয়। এই এলাকার শূকর চাষীরা জানত যে তাদের এলাকার রেস্তোরা এবং স্কুলগুলাে সাধারণত অব্যবহৃত খাদ্য এবং উচ্ছিষ্টগুলাে ফেলে দেয়। এই উচ্ছিষ্ট খাবারগুলাের মধ্যে শূকর চাষীরা তারা তাদের খাদ্য সংক্রান্ত খরচ কমানাের সম্ভাবনা দেখতে পান। তাই তারা বিভিন্ন কলাকৌশলে এই উচ্ছিষ্টগুলাে কেনার চেষ্টা করে। তাদের যুক্তি ছিল যে, স্কুল এবং রেস্তোরা তাদের কাছেই বিক্রি করে ফেলতে পারে এবং এগুলােকে তারা শূকর খাওয়ানাের মতাে ভালাে কাজে লাগাতে পারবে। উভয়পক্ষ এই যুক্তি মেনে নেয় এবং শূকর চাষীরা তাদের কলা-কৌশলের সফল হলে এই সব উচ্ছিষ্ট খাবার শূকরগুলােকে খাওয়াতে থাকে। এখানে আমরা যেটা দেখতে পাই সেটা হচ্ছে এই শূকর চাষীরা তাদের গঠন কেন্দ্রিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে এবং নিজেদের ব্যবসায়ে ভালাে লাভ করার জন্য সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে উদ্যোগ নেয়। এই শূকর চাষীদের কিন্তু সারা ইউরােপে গবাদী পশুর মধ্যে মহামারী ছড়িয়ে দেয়ার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ সে জানত না যে, উচ্ছিষ্ট খাবারসমূহ আসলে পচনের শিকার হয়ে যায়। যাই হোক, মহামারী ছড়িয়ে পড়ার ফলে যুক্তরাজ্যের কৃষি এবং পর্যটন শিল্পগুলােকে বিপদ চলে আসে। সরকারও তার কৃষি ভর্তুকির ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে লাগল। ফলে দেখা গেল যে ব্রিটেনের কৃষি ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন এসে গেছে। এই পরিবর্তনের ফলে কৃষি খামারগুলােতে অপ্রত্যাশিত কিছু পরিবর্তন দেখা যায় এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে কৃষদেরকে এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে পরিস্থিতির মােকাবিলা করতে হবে। এখন তাদেরকে গ্রামেগঞ্জে রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে, একই সাথে তাদেরকে ব্যবস্থাপনা এবং সংলাপ পরিচালনার ভূমিকাও পালন করতে হচ্ছে। এই সব করতে গিয়ে তার আর খাদ্য উৎপাদনে তাদের আসল মনোযোগটা দিতে পারছে না। এখানে তারা নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে অবস্থান করছে যাদের নিজ এখতিয়ার বলতে অনেক কিছুই আছে কিন্তু তাদের এই বর্তমান জগৎ আগের জগতের চেয়ে অনেক অনেক ভিন্ন।

এই দিকে খাদ্যের ক্ষেত্রে ভােক্তাদের ঠিক একই ধরনের খাদ্যের দর দাম অনেক বেড়ে যাবে এবং কৃষি খামারগুলাে যে সরকারি ভর্তুকি দিত তাও বন্ধ হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হবে তার একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। এখন কি পয়সা বাঁচানাের জন্য আমরা নতুন কোন ধরনের খাদ্য গ্রহণ করব? বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে Mad cow রােগ দেখা দিলে ভােক্তাদের অন্তরে খাদ্য সম্বন্ধে একটি ভীতি অনুপ্রবেশ করে। তাই বলে আমরা কি আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করব? তাছাড়া আমরা কি এখন জৈবিক খাদ্যসমূহই খাব? এই ধরনের প্রশ্নের জবাবে নিজেদের বাছাই নিশ্চিত করাটাই হচ্ছে গঠন কেন্দ্রিক অর্থ। এর অর্থ হচ্ছে আমরা যদি জৈবিক খাদ্য খাওয়া আরম্ভ করি তাহলে জৈবিক এবং অজৈবিক খাদ্য উৎপাদনকারীদের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিবে এবং বাস্তবেও কিন্তু হচ্ছে তাই। দেখা যাবে যে অর্থনৈতিক মন্দা এড়িয়ে লাভজনক ব্যবসার লক্ষ্যে কৃষকরা জৈবিক খাদ্য উৎপাদনে উঠে পড়ে লাগবে। এই খাদ্যের জগতে আমাদের সমাজে যে পরিবর্তন এসেছে তা কিন্তু হতাে না যদি শূকর কৃষকরা এই ধরনের ভুলগুলাে না করতেন। শূকর খামারি যে ভুলটি করেছে তার কারণে নতুন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই এখন আমাদের সিন্ধান্ত নিতে হবে কি করে এই পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারি। একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কৃষকরা সজ্ঞানে তারা একটি কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নেয় কিন্তু এর পরিণতি সম্বন্ধে তাদের কোন নির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল না, বরং পরিণতির আবির্ভাব হয় তাদেরই অজ্ঞাতে। এখন এই পরিণতির কারণে তাদের অজ্ঞাতে নতুন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যা জনগণকে নতুন করে তাদের দৈনিক কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করতে বাধ্য করে। এতে সামাজিক কাঠামােগত বৈশিষ্টের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। গঠনায়ন মতবাদ সবসময় এই বিষয়ে জোর দেয় যে, নির্দিষ্ট কাঠামােগত পরিস্থিতিতে মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়। পক্ষান্তরে, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা না করা সম্পৃক্ত পরিস্থিতিসমূহকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।

এই পর্যন্ত আমরা যে উদাহরণ দিয়ে এসেছি তার আলােকে আমরা বলতে পারি যে, গঠনায়ন হচ্ছে এক ধরনের কার্যকরী বিশ্লেষণ। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি গঠনায়ন কিভাবে কাজ করে। তবে এই কাঠামােকরণ কিংবা গঠনায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গিডেন্স আধুনিক জগতের একটি নতুন বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন তা হচ্ছে ঝুঁকি। তিনি মনে করেন যে, ঝুঁকির কারণেই আমরা যে জগতে বাস করি সে জগতের অনেক মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ উঘাটিত হয়। (Giddens, Anthony, Runaway World: How Globalization is Reshaping our Lives, London. 1999, p. 21)।

ঝুঁকি

গিডেন্স মনে করেন যে ঝুঁকির দুইটি মৌলিক ধরন রয়েছে, একটি হচ্ছে বাহ্যিক ঝুঁকি, আরেকটি উৎপাদিত ঝুঁকি। External risk বা বাহ্যিক ঝুঁকি বলতে তিনি এই সমস্ত অভিজ্ঞতাকে বোঝাতেন যেগুলােকে মানুষ অর্জন করে বাহ্যিক দিকটি থেকে অর্থাৎ তাদের সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে। আর Manufactured risk বা উৎপাদিত ঝুঁকি বলতে তিনি এমন সব ঝুঁকিকে বোঝান যা আমাদের জগৎ সম্বন্ধীয় ধন-ধারণার উন্নতিকরণের প্রভাবে সৃষ্টি হয়। (Giddens, ibid., 1999, p. 26)। গিডেন্স বলেন যে, এই ধরনের পার্থক্য মূলত প্রকৃতি সম্বন্ধে আমরা যে ধারণা করি তার সাথে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের কথা বলা যেতে পারে। পক্ষান্তরে, প্রকৃতির উপর আমরা কি ধরনের প্রভাব ফেলেছি সেটাও একটা চিন্তার বিষয়। যেমন আমাদের কর্মকাণ্ডের কারণেই পৃথিবীতে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয়। তার মতে, একটি হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। তিনি মনে করেন বিলম্বিত আধুনিকতার সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য মাইলফলকটি হচ্ছে উৎপাদিত ঝুঁকির আবির্ভাব। গিডেন্স মনে করেন জীবনের ঝুঁকি শুধু বৈশ্বিক বিপর্যয়গুলাের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় যেমন পারমাণবিক দুর্ঘটনা অথবা পারমাণবিক যুদ্ধ। এগুলাের গুরুত্ব কোন অংশে কম না হলেও তিনি মনে করেন ব্যক্তিগত জীবনেও উৎপাদিত ঝুঁকির অনেক প্রভাব আমরা দেখতে পাই।

সনাতন বিশ্বে তা কৃষি হােক কিংবা শিল্প বিশ্ব হােক জনগণ কিন্তু তখন কিভাবে জীবন-যাপন করতে হবে কিভাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হবে আমরা এসব নিয়ে যেভাবে চিন্তা করি তারা কিন্তু সেভাবে চিন্তা করতেন না। এটাই হচ্ছে সনাতন জীবন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য জিনিস ভবিষ্যতে তেমনিই থাকবে অতীতে যেমন ছিল। তবে গিডেন্স বলেন যে, বিলম্বিত আধুনিকতার যুগে জীবনযাত্রা করতে গিয়ে মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, আমরা এখন আর স্থিতিশীলতা এবং অপরিবর্তনীয় পরিস্থিতির আশা করতে পারি না। চলমান জগতের একমাত্র বৈশিষ্ট্য হয়ে গিয়েছে পরিবর্তন অনিশ্চয়তা। এই পরিবর্তন এবং অনিশ্চয়তার সাথে আমাদের নিজেদেরকে মানিয়ে চলতে হবে জীবন-যাপন পদ্ধতির মধ্যে গঠন এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার চর্চার মাধ্যমে। এই ধরনের গঠন এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন Reflexivity বা প্রতিফলনশীলতা। 

উলরিচ বেক : একটি ঝুঁকিপূর্ণ সমাজ (A Risk Society)

গিডেন্স যে ঝুঁকি সম্বন্ধীয় সমাজ ব্যক্ত করে গেছেন তা কিন্তু মূলত জার্মান সমাজবিজ্ঞানিক উলরিচ বেকের এর মূল মতবাদেরই প্রতিফলন। বেক নিজেও উত্তরাধুনিকতাবাদকে অস্বীকার করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যেভাবেই বসবাস করেছি এবং যেভাবেই আমরা আমাদের জীবনধারণের স্বরূপ নির্ধারণ করেছি তা তিনি স্বীকার করে নিলেও তিনি কিন্তু নতুন এক বিশ্বের আবির্ভাবের কথা বলেন এটাকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন নতুন আধুনিকতা বা New modernity হিসেবে। তবুও তিনি এই পর্যায়েও উত্তরাধুনিকতাবাদকে মেনে নিতে রাজি হননি। গিডেন্সের মতো বেক সমকালীন জীবনকে গঠন এবং ক্রিয়া পর্যায়ে বিশ্লেষণ করেন। তিনি মনে করেন যে, উৎপাদিত ঝুঁকির মূল কারণ হচ্ছে মডার্নিটি ও নিউ মডার্নিটি – এই দুই পর্যায়ের বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতা। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিশ্ব বিপর্যয়ের অধীনে মানবজাতি এবং প্রকৃতির ধ্বংস সাধনের মূল নিয়ামকে দাঁড়িয়েছে এই বিজ্ঞান। তাহলে এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বিজ্ঞান বিভিন্ন বিপর্যয় ও ঝুঁকির মুখে যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে সেভাবে কিন্তু নিজের অপচয় হচ্ছে মাত্র। বিজ্ঞানের এই অপচয় যৌক্তিকতা আবির্ভাব পর্যন্ত প্রতিরােধ যাবে না।” (Beck, Ulrich, Risk Society: Towards a New Modernity, Sage. 1992, p. 70.)। 

বেক আরেকটি যে বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিকের ঐক্য বিগত কয়েক বছরে পরিবর্তনের শিকার হয়েছে। বিগত জীবনে আমাদের শুধু এই বিশ্বাসই ছিল না যে, সত্য উঘাটনে আমরা বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করতে পারি। তাছাড়া আমাদের এই বিশ্বাসই ছিল যে অনিশ্চয়তামুখী পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানিকরাই একমাত্র দক্ষ ব্যক্তি যা আমাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারবে। তখন ব্যাপারটা এমন ছিল যে “আমাদের বিশ্বাস হলাে কেননা আমরা বৈজ্ঞানিক” যেমনটা এই পূর্বে এমন ধারণার প্রচলন ছিল “আমাকে বিশ্বাস কর কেননা আমি ডাক্তার।” এ প্রসঙ্গে Giddens বলেন, “বিগত দুই শতাব্দীতে পশ্চিমা সমাজে বিজ্ঞান অনেকটা সংস্কৃতির ভূমিকা পালন করতাে। মনে হচ্ছিল যখন বৈজ্ঞানিক বিদ্যা চর্চায় আমাদের সংস্কৃতিও প্রথাকে ছাড়িয়ে যাবে, বাস্তবে কিন্তু হলােও তাই। জনগণের সবচেয়ে শ্রদ্ধার বিষয় ছিল এই বিজ্ঞান তবে তাদের এই শ্রদ্ধা শুধু বাহ্যিক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ ছিল। এই যুগটাতে সাধারণ জনগণ তাদের ধ্যান-ধারণা আহরণ করতে বিশেষ পর্যায়ের লােকজনের কাছ থেকে।” (Giddens, Anthony, Runaway World: How Globalisation is Reshaping Our Lives, Profile Books, 1999, p. 31)।

তবে এটা অস্বীকার করা যায় না যে, এই যুগগুলােতে বিজ্ঞান সংক্রান্ত কোন ব্যর্থতার ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। তবে আমরা এই ব্যাখ্যা দিয়ে বিজ্ঞানের ব্যর্থতাকে ধাপাচাপা দিতে পারি যে এটা ব্যক্তিগত অবহেলা এবং অযােগ্যতার ফল। এভাবেই আমরা বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিকদের উপর আমাদের বিশ্বাস বজায় রেখেছিলাম। বাস্তবে কিন্তু কোন পেশাদার ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দোষারূপ করলে এটা কিন্তু এক ধরনের খােদ পেশাটাকে দোষারূপ করা হয়ে যাচ্ছে। তাই দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানের জগতে অনেক অবৈধ চর্চা এবং অযােগ্য লােকজনের অভাব না থাকলেও আমরা কিন্তু জীবনযাত্রার উন্নতিতে বিজ্ঞানের উপর ভরসা করে বসেছিলাম। বিজ্ঞানের আশ্রয়ে আমরা নিজেদের জীবনে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করে আসছিলাম। বেক বলেন যে, মানবজাতির এই ধরনের ধারণার আলােকে আমরা আর বিজ্ঞানের সাথে বৈজ্ঞানিকের সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারছি না। এতদিন আমাদের বিজ্ঞান সম্বন্ধে সুধারণা ছিল সেটি হচ্ছে যে আমাদের বিশ্বাস ছিল যে, বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিকদের সমন্বয়ের ফলে আমরা প্রাকৃতিক শক্তিগুলােকে নিজেদের সেবায় নিয়ােজিত করতে পারব। তবে বিজ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের এই স্বপ্নের ভাঙ্গন ঘটে ১৯৭০ সালে। তবে কাকতালীয় হলেও এটা সত্য যে, এই সময়টাতে সামাজিক কিছু আন্দোলন দেখা দেয় Green peach এবং French of the earth নামের অনেক পরিবেশবাদী দলসমূহ নিজেদের বৈজ্ঞানিকদের ব্যবহার করতে লাগল ঐ সমস্ত বৈজ্ঞানিকদের সমালােচনা করতে যারা সরকার এবং ব্যবসায়ী গােষ্ঠীর সেবা দাস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছিল। বেক এটা বলেন যে, বিজ্ঞান এখন নিজেদের বিরুদ্ধেই উঠে পড়ে লেগেছে। এখন আর বিজ্ঞান এটা প্রমাণ করতে পারে না যে একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ভালাে জানে। অথচ এই ধারণাই ছিল এযাবৎ বিজ্ঞানের মূল প্রেরণা। এখনকার বিশেষজ্ঞদের কাজ হচ্ছে শুধু নিজেদের মধ্যে মারামারি করা। আপাতদৃষ্টিতে এটা বর্তমান যুগের বিষয় মনে হলেও আমরা কিন্তু লক্ষ্য করিনি যে, পূর্বেকার যুগেও পৌরাণিক বিজ্ঞানিকরা নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে লিপ্ত ছিল। বৈজ্ঞানিকরা নিজেদের বাস্তবতা ও সত্যের ক্ষেত্রে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়লে সামাজিক ও বৈশ্যিক ব্যবস্থাপনায় বিরাট বিপর্যয় দেখা দেয়, ফলে নিরাপত্তা সম্বন্ধীয় চেতনাবােধ এবং একটি ব্যক্তিগত দায়িত্বে পরিণত হয়। তাই দেখা যায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনিশ্চয়তাবোেধ ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে। এবং ঝুঁকি সম্বন্ধীয় আমাদের চেতনাবােধেরও প্রবণতা বেড়ে চলছে। নতুন বিশ্ব সম্বন্ধে গিডেনস যে চিত্র তুলে ধরেন তা হচ্ছে, “বৈজ্ঞানিকরা যা উৎপাদন করে তা আমরা কিন্তু এখন আর সহজে গ্রহণ করতে পারছি না। উৎপাদিত ঝুঁকির ক্ষেত্রে তাদের অহরহ মতানৈক্য আমাদের জন্য একটি নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। সবাই কিন্তু এখনও বিজ্ঞানের গতিশীল বৈশিষ্ট্য হয়ে আসছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মতানৈক্যের কারণে দেখা যায় যে, একজন লােক যখন সকালে নাস্তা করতে উঠে তখন সে বৈজ্ঞানিক মতপার্থক্য বিবেচনায় নিয়ে আসে। সে বৈজ্ঞানিকদের মতপার্থক্যের আলােকে চিন্তা করে কফি খাওয়া ঠিক হবে কি হবে না। কারণ এই সামান্য বিষয়েও বৈজ্ঞানিকদের মতপার্থক্য রয়েছে।” (Giddens, Anthony, Runaway World: How Globalisation is Reshaping Our Lives, Profile Books 1999, p. 31)।

বেক এই ধরনের প্রক্রিয়াকে বলেন প্রতিফলনশীল আধুনিকতা এবং তিনি জোর দেন যে এটা ব্যক্তিগত এবং কাঠামােগত পর্যায়ে প্রতিফলিত হয়। এই প্রসঙ্গে গিডেন্সের মতবাদ হলো, “বর্তমান জীবন-যাপনকে ব্যাখ্যা করি না কেন এটা আমাদের মেনে চলতে হবে যে, আমরা এখন মূলত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জালে আটকা। উৎপাদিত ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণে সরকার এই কথা বলতে পারবে না যে এতে তাদের কোন ভূমিকা নেই। সরকার নিজেদের দায়িত্ব এড়ানাের জন্য এটা বলতে পারে না যে, বর্তমান উৎপাদিত ঝুঁকিসমূহের মুখে তার কিছু করার নেই কারণ দেখা যায় যে উৎপাদিত ঝুঁকিসমূহের অনেকটা তার পেছনে বিরাজ করছে না। এই দিকে ব্যক্তি পর্যায়ে একজন ব্যক্তি দায়দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে এই বলে যে, হয়তাে নতুন কোন বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা দেখা দেয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত ঝুঁকি হ্রাস পেতে পারে। ভােক্তা হিসেবে আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে Genetically modified খাদ্যদ্রব্য কিংবা অন্যান্য বিষয়গুলাে আমরা ব্যবহার করব কিনা। খাদ্যদ্রব্য হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটা অপরিহার্য অংশ তাই আমরা বলতে পারি যে, Genetic Engineering এর কারণে যে সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন হয় তা কিন্তু মূলত মানবজাতিকে ঝুঁকি এবং দ্বন্দ্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে।” (Giddens, ibid., 1999, p. 34)। তাই আমরা বলতে পারি যে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় এখন কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি পর্যায়ের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। তবে বেক এবং গিডেন্স মনে করেন পরিস্থিতির ঝুঁকির দিকে লক্ষ্য রাখলে এটা বলা যায় যে, ঝুঁকির মাত্রা মূলত ব্যক্তি পর্যায়েই বেশি। এই নিয়ে মানুষ এখন আর শুধু বিজ্ঞানের উপর ভরসা করতে পারে না। সর্বক্ষেত্রে মানুষকে এখন অনিশ্চয়তার ব্যবস্থাপনায় নিজ নিজ দক্ষতা দেখাতে হবে। এই প্রসঙ্গে বেক বলেন, “এখন আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবেই সামাজিক সম্পর্কসমূহ এবং বুননসমূহের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় বেছে নিতে হবে। কেননা এখন সামাজিক বন্ধনও হয়ে উঠছে প্রতিফলনশীল। তাই এটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, পরিচালিত এবং প্রমাণ করতে হবে ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে।” (Beck, Ulrich, Risk Society: Towards a New Modernity, Sage. 1992, p. 97.)।

বেক এবং গিডেন্স মনে করেন যে সমষ্টিগত পর্যায়ে ২১শ শতাব্দীর জীবন আর এখন শুধু ঘন ঘন পরিবর্তন এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অজ্ঞতার মােকাবেলা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরঞ্চ ব্যক্তিগত পর্যায়েও মানুষের ঝুঁকি এখন অনেক। তাই যেমনটা সমষ্টিগত জীবনে আমাদেরকে আধুনিক জীবনে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে তেমনি ক্ষুদ্র এবং ব্যক্তিগত পর্যায়েও আধুনিক জীবনকে আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে। তাই ব্যাপারটা এখন শুধু আর মতবাদ এবং লক্ষ্যের আলােকে ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা মধ্যে জানা নয়, বরঞ্চ এখন আমাদেরকে নৈর্ব্যক্তিক এবং বতুনিষ্ঠ ঝুঁকিসমূহের মধে পার্থক্যগুলাে আমাদের বুঝে উঠতে হবে। এর অর্থ হলাে আমাদের বুঝে উঠতে হবে যে, আমাদের পরিচিতি এখন আর প্রাতিষ্ঠানিক নিশ্চয়তার ছাতার তলে নয়। এখান থেকে এবং অনিশ্চয়তার সংস্কৃতির অভ্যুদয়। আর ব্যক্তিগত জীবনে ঘন ঘন পরিবর্তনের কারণে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আবার নিত্যনতুন পরিবর্তনও দেখা যায়। আমরা এর আগেই লক্ষ্য করেছি যে, গিডেন্স তার কাঠামাে সম্বন্ধীয় মতবাদে কাঠামে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সামাজিক জীবনের যে সম্পর্ক রয়েছে তা হচ্ছে মূলত দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। এই কাঠামাে এবং ব্যক্তির দ্বান্দ্বিক সম্পর্কসমূহের উপরই বিশেষ আলােকপাত করেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই ধরনের ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তার মােকাবেলা করার যে রূপরেখা তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন সেটাই হচ্ছে তার পরিভাষায় বিলম্বিত আধুনিকতা।

গিডেনস : বিলম্বিত আধুনিকতায় প্রতিফলনশীলতা (Reflexivity in Late Modernity)

কাঠামাে কেন্দ্রিক পর্যায়ে গিডেন্স মনে করেন যে, মানবজাতি যে আমূল পরিবর্তনের স্বীকার হয়েছে তারই আলােকে এখন থেকে আধুনিক সমাজের বিশ্লেষণ করতে হবে। এর আগেই আমরা উল্লেখ করেছিলাম যে আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখন নিত্যনতুন কিছু বিপর্যয় এবং ঝুঁকি। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যেতে পারে, পারমাণবিক অস্ত্র এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকিসমূহ। এর সাথে যােগ হয়েছে দ্রুত বিশ্বায়ন ব্যবস্থা যার প্রভাব শুধু বিশ্ব পর্যায়ে নয়, বরঞ্চ তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও প্রভাব বিস্তার করছে। তাছাড়া এর প্রভাব যেমন বিশ্বময় দেখা যায় তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও এর প্রভাব আমরা উপলদ্ধি করতে পারি। আমাদেরকে দেখতে হবে যে, প্রযুক্তির কল্যাণে মানবিক যােগাযােগ ব্যবস্থার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এইখানে যােগাযােগ ব্যবস্থা বলতে মানবজাতির মনােভাবের বহিঃপ্রকাশকেই বোঝাচ্ছে। তাছাড়া আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মানুষ প্রযুক্তির কল্যাণেই এখন সময় এবং কালের পক্ষে চলে আসতে সক্ষম হয়েছে। নিঃসন্দেহে মানবিক অবস্থানের এই পরিবর্তনের প্রভাব আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও উপলব্ধি করতে পারি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টা এখন আর সরকার কেন্দ্রিক বিষয় হয়ে দাঁড়াল মানুষকে নিজেদের নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

কাঠামাের উপর অতিরিক্ত জোর দিতে গিয়ে গিডেন্স উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রবক্তাদের অর্থের উপর অতিরিক্ত জোর দেয়ার সমালােচনা করেন। উত্তরাধুনিকতাবাদী চিন্তাবিদরা মনে করেন যে, মানুষ নিজের কর্মকাণ্ড এবং পরিস্থিতি সম্বন্ধীয় অর্থ তৈরির প্রক্রিয়া সর্বদাই সংস্কৃতি পরিস্থিতির প্রভাবে প্রবাহিত থাকে। গিডেন্স এটাকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে করেন যে, শুধু অর্থ সম্বন্ধীয় ধ্যান-ধারণার উপরই মানব অস্তিত নির্ভরশীল। তিনি মনে করেন অর্থের চেয়েও বাস্তব জগতে অনেক কিছু আছে যার কারণে অস্তিত্ব পুরােপুরি হুমকির সম্মুখীন। তিনি বলেন পারমাণবিক হুমকির চেয়ে বড় ধরনের বাস্তবতা আর কি হতে পারে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আমরা যে হুমকির সম্মুখীন। সেটা ছাড়াও বিশ্বায়নের কারণে সম্পত্তি কেন্দ্রিক বৈষম্যের শিকার এই পৃথিবী তার চেয়ে বড় অর্থ এবং বাস্তবতা কি হতে পারে। তবে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন এই ধরনের কাঠামােগত ব্যাখ্যা মানব পরিস্থিতির মূল্যায়নে যথেষ্ট নয়। কারণ গিডেন্সের কাঠামােগত মতবাদে কাঠামাে এবং ক্রিয়া এক হয়ে যাওয়ার কারণে এর মধ্যে প্রয়ােজনীয় পৃথকীকরণ আমরা দেখতে পাই না। অথচ কাঠামাে এবং ক্রিয়া নিঃসেন্দেহে দুইটি ভিন্ন বিষয়। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, আধুনিক জীবন-যাপন পদ্ধতিতে তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার যে চিত্র আমাদের তুলে ধরেছেন তাও নিঃসন্দেহে গুরুত্ববহ। গিডেন্সের মতে, বিজ্ঞানের অবদানের কারণে পৃথিবীতে কাঠামােগত ‘আমূল পরিবর্তন এসেছে এবং তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের জীবনকে প্রবাহিত করেছে। তাই ব্যক্তিগত পর্যায়েও একজন ব্যক্তিকে নিজ সম্বন্ধেও ভাবতে হবে। তাই বলা যায় পূর্ববর্তী যুগে মানবজাতি পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে আমরা বসবাস করছি। তাই নতুন এই পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে মানিয়ে চলতে আমাদরকে জীবন-যাপনের নতুন পদ্ধতি বেছে নিতে হবে। তাই পূর্ববর্তী মানবজাতির তুলনায় বিলম্বিত আধুনিক যুগের মানুষদের হতে হবে। অধিকতর উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন এবং ব্যাখ্যামুখী মানবজাতির এই নতুন রূপ নিঃসন্দেহে আমাদের বিশ্বের কাঠামােগত অবস্থানে বিরাট প্রভাব ফেলবে।

বিলম্বিত আধুনিকতাই মানবজাতির পরিচিতি : প্রতিফলনশীল অহমের (Reflexive Self) অভ্যুদয় 

আধুনিক এবং পূর্ব আধুনিক যুগে মানবজাতির সামাজিক শৃঙ্খলা সম্বন্ধীয় একটি ঐক্যবদ্ধ ধারণা ছিল। এই ধারণার আলােকে তারা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেদেরকে মানিয়ে চলত এবং এই প্রক্রিয়ায়ই তারা তাদের পরিচিতি নির্ধারণ করতাে। গিডেন্স এই ধরনের অস্তিত্ব সম্বন্ধীয় পরিস্থিতিকে অস্তিত্বমুখী নিরাপত্তা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তখনকার যুগে বিবাহ, পারিবারিক জীবন, কর্মজীবন এবং সামাজিক জীবনের একটি স্থায়িত্ববােধ এবং স্থিতিশীলতা ছিল। তখনকার যুগে সংস্কৃতি ছিল একটি জীবনী শক্তির মূল উৎস। কারণ তখন আমরা আমাদের নিজস্ব পরিচিতি নির্ধারণে ছিলাম অধিকতর অক্ষম এবং ভবিষৎ সম্বন্ধীয় আমাদের ধারণা ছিল মােটামুটি স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। তবে এখন কিন্তু আর সেই ধরনের শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। এখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামােগত দ্রুত পরিবর্তন ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এখনও আমাদের চিন্তা করতে হয় নিজ অস্তিত্ব সম্বন্ধে এবং আমাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে। তবে সমাজে যে দ্রুত কাঠামােগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন এসেছে নিঃসন্দেহে অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণাসমূহ তার উপর এই পরিবর্তনগুলাের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। গিডেন্স নিম্নোক্ত উদাহরণটি দিয়েছেন, “Two or three generations ago, when people got married, they knew what it was they were doing. Marriage, largely fixed by tradition and custom, was akin to a state of nature- as of course remains true in many countries. Where traditional ways of doing things are dissolving, however, when people marry or form relationships, there is an important sense in which they don’t know what they are doing, because the individuals are striking out afresh, like pioneers. It is inevitable in such situations, whether they know it or not, that they start thinking more and more in terms of risk. They have to confront personal futures that are much more open than in the past, which all the opportunities and hazards this brings.” (Giddens, Ibid., 1999, pp. 27-8)। অর্থাৎ, দুই তিন পুরুষ আগে জনগণ জানত যে তারা বিয়ে করছে। বিয়ে সম্বন্ধে তাদের ধারণা ছিল স্পষ্ট তাই যখন তারা বিয়ে করতে যাচ্ছিল তখন তাদের জন্য বিয়ে সম্বন্ধে কোন স্পষ্টতটা ছিল কারণ এটা একটি নির্ধারিত বিষয় ছিল। যে কোন সংস্কৃতিতে বিবাহের স্বরূপ নির্ধারিত হতাে তাদের সনাতন প্রথা কর্তৃক এবং আজও এই উত্তর আধুনিকতার যুগে অনেক দেশেই এটাকে জীবন-যাপনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করা হয়। তবে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই প্রথা ও কৃষ্টির প্রভাব দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে এবং মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ কিংবা অন্য কোন রূপে আত্মীয়তা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয় তখন তারা কি করতে যাচ্ছে এই নিয়ে তাদের কোন স্পষ্ট ধারণা থাকে না। কেননা এই যুগে বিবাহ এবং পারিবারিক প্রতিষ্ঠারগুলাের মধ্যে এসেছে ব্যাপক রদবদল। এখানে পরিবারের চেয়ে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভূমিকাই মুখ্য এবং সমাজে তারা এখন অগ্রপথিকের দায়িত্ব পালন করছে। তবে বিবাহ জাতীয় সম্বন্ধে স্থাপনের পরিণতি যাহােক না কেন এই এ ধরনের সম্বন্ধে চর্চা করতে গিয়ে মানুষ শুরু থেকেই বিভিন্ন ঝুঁকিসমূহ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে আসছে। বর্তমানে সুযােগ সন্ধানের দুয়ার যেমন উন্মুক্ত তেমনি তার সাথে মানুষের জন্য বয়ে আসে অনেক ধরনের জটিলতা। তাই একজন মানুষকে এখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভবিষ্যতের অনেক জটিলতা মোকাবেলা করতে হয় অতীতে যা ছিল কল্পানাতীত। এর মূল কারণ হচ্ছে যে বর্তমান যুগে জীবন-যাত্রা স্বাভাবিক বলতে কিছু নয় এবং এর চলার পথ সম্বন্ধেও কারাে স্পষ্ট ধারণা নেই।

গিডেন্সের মতে, আধুনিক সমাজে বসবাস করার অর্থই হচ্ছে বর্তমানে আমাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে থাকা পরিবর্তনসমূহের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে চলতে গিয়ে নিজেদের গঠন এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়া মত্ত থাকা এবং যেহেতু জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এখন আমাদেরকে নিত্য নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় সেহেতু এই সম্বন্ধীয় অনুভূতি ও চেতনাও আমাদের অর্জন করতে হয়। এই লক্ষ্যে আমাদেরকে সদা পরিবর্তনশীল ও অস্থিতিশীল বিশ্বের জন্য তৈরি করতে হয় কিছু অর্থ এবং সেই অর্থ অনুযায়ী আমাদের নিজেদেরকে মানিয়ে চলতে হয়। তাই দেখা যায়, উম্মুক্ত ও পলায়ন পথ এই পৃথিবীতে আমাদেরকে বসবাস করতে হলে আগের জীবন ধারাকে অনুসরণ করলে চলবে না। (Giddens, Ibid.,1999)। আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমের একমাত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির পর্যালােচনা করা এবং সেই অনুযায়ী নিজেদেরকে মানিয়ে চলা। তাই দেখা যাচ্ছে বর্তমানে জীবন-যাপনের অর্থ হচ্ছে রুটিন মাফিক পারিপাটি পরিস্থিতির সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে চলতে গিয়ে নিত্যনতুন বােধ এবং অর্থের সৃষ্টি করা; সেই অনুযায়ী অহমের একটি স্বরূপ নির্ধারণ করা, এবং সেই অনুযায়ী নিজে পরিচয় নির্ধারণ করা। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই ধরনের প্রক্রিয়া শুধু আজকের জন্য প্রযােজ্য যা কিনা কালকের জন্য অনুপযােগী হয়ে দেখা দিতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে গিডেন্স reflexive project বা প্রতিফলনশীলতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই দেখা যাচ্ছে বিলম্বিত আধুনিক যুগে বসবাস করার অর্থ হচ্ছে এক প্রতিফলনশীল প্রকল্পের আওতাধীন থাকা জীবনময় : পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সমছে আমাদের বােধ ও চেতনার সৃষ্টি করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের জীবনধারণের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। তবে এই ধরনের প্রক্রিয়া নিত্য পরিবর্তনশীল কারণ আমরা যেসব পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির অধীনে বসবাস করছি তাই কিন্তু নিত্য পরিবর্তনশীল। তাই আমরা নির্দিষ্ট কোন জিনিসের ব্যাপারে বেশি দিন আশাবাদী থাকতে পারি না কারণ বর্তমান বিশ্বের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গিডেন্সের বর্ণনায় – “বর্তমান যুগটা হচ্ছে পলায়নপর একটি শক্তিশালী ইঞ্জিনের মতাে যা কিন্তু দ্রুত ধাবমান, এই ইঞ্জিনটিকে মানবজাতি হিসেবে সম্মলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা পরিচালনা করতে পারি তবে এই ইঞ্জিনটি যে কোন সময় আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যেতে পারে, এমনকি তা পদচ্যুত হয়ে খণ্ডবিখণ্ডিত হয়ে যেতে পারে। এই পাগল পড়া ইঞ্জিনের সামনে যে বাধা হয়ে দাড়াতে চায় সেই পিষ্ট হয়ে পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। কদাচিৎ এই ইঞ্জিনটি হয়তাে ধীরগতিতে আগে বাড়তে থাকে কিন্তু মাঝে মধ্যে দেখা যায় হঠাৎ করে এমন এক দিকে ছুটে যে দিক সম্বন্ধে আমাদের পূর্ববর্তী কোন ধারণা ছিল না। আমরা যে ইঞ্জিনটির কথা বলছি সেই ইঞ্জিনটির নিয়ন্ত্রণ কঠিন হলেও এর অর্থ এই নয় যে এটি একটি রস ও প্রতিদানহীন উপাদান। এই উন্মুক্ত পরিস্থিতি আমাদের জন্য বয়ে নিয়ে আসতে পারে অনেক ধরনের আশা এবং ভরসা। তবে আধুনিক যুগের প্রতিষ্ঠানসমূহ যতদিন টিকে থাকবে ততদিন আমরা পথের কিংবা যাত্রার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারব না, বরঞ্চ আমরা নিজেদের জন্য স্থায়ী কোন নিরাপত্তার বিধানও করতে পারব না। কারণ আমরা যে ইঞ্জিন এবং যে যাত্রার অধীনে নিজেদের জীবনযাপন করছি তা দ্রুত পরিবর্তনমুখী প্রবতনা সম্পন্ন।” (Giddens, Ibid., 1990, pp. 139)

এই আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, সামাজিক জীবনে ব্যক্তি পর্যায়ে যে এখন প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্কৃতির প্রভাব এখন আর মূল বৈশিষ্ট্যের ভূমিকা পালন করছে না। এখন শুধু মানবজাতি নিজেদের অহম সম্বন্ধীয় চিন্তা-চেতনার সৃষ্টি করতে পারবে। বিলম্বিত আধুনিকতা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন নিজের আবেগ এবং মানসিকতার যে পাণ্ডুলিপি আছে তার লিখন এবং পুনর্লিখনকে। তাই দেখা যাচ্ছে যে, বাহ্যিক সাংস্কৃতির অধীনে যেই মাইলফলক রয়েছে তার অনুপস্থিতিতে বর্তমান যুগে যে মানুষ যে নিরাপত্তাহীন জীবন-যাপন করছে। গিডেন্সের মতে, তাই হচ্ছে Reflexivity বা প্রতিফলনশীলতা।

ব্যক্তিগত অনিশ্চয়তার সমাধান-সমাধানের উৎস

গিডেন্সের মতে, প্রতিফলনশীল প্রকল্পের আওতাধীন মানুষে যে জীবনযাপন করছে তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া হিসেবে এমন কিছু পেশাদার লােকের আবির্ভাব ঘটেছে যাদের কাজ হচ্ছে কিভাবে এই প্রতিফলনশীল প্রকল্পের মানবজাতি কিভাবে নিজেদেরকে মানিয়ে চলতে পারবে তার দিকনির্দেশনা দেওয়া। যেহেতু এখন মানবজাতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের অহম্ সম্বন্ধীয় পথের অনুসন্ধান করা সেহেতু এখন পরামর্শ ও মানসিক চিকিৎসা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের আবির্ভাব দেখা দেয়াটা অবাক করা কিছু নয়। তবে এই ধরনের মনােবিজ্ঞানের চিকিৎসার সরণাপন্ন হয়ে মানবজাতি তাদের জীবনের গতিধারা নিয়ন্ত্রণ করবে গিডেন্সের এই ধরনের মতবাদের সমালােচনা করা হয় ব্যাপকভাবে। কারণ দেখা যাচ্ছে শুধু যে সকল সমাজের লােকজন এই একই ধরনের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উৎসের সাহায্য নিতে পারে সেই ধরনের লােকজনের জন্য হয়তাে এই ধরনের জীবন-যাপন হচ্ছে একটি আধুনিক বিলম্বিত আধুনিক যুগের বিশেষ প্রপঞ্চ। কারণ অনেক অনুন্নত দেশেই দেখা যাচ্ছে। বিলম্বিত আধুনিকতার ছােয়া লাগলেও তারা আর নিজেদের জীবন-যাপন সম্বন্ধীয় সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শকদের কাছে যায় না। তবে সমালােচনা যাই হােক না কেন বিলম্বিত আধুনিকতায় দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু লােক তাদের নিজস্ব জীবন-যাপনের গতিধারা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা নিয়মিত পেশাদার পরামর্শক মনােবিজ্ঞানীদের কাছে যাতায়াত করছেন।

প্রতিফলনশীল দেহ (The Reflective Body) 

আত্মপ্রতিফলনশীলতা সম্বন্ধীয় মতবাদের উপর জোর দিতে গিয়ে গিডেন্স বিলম্বিত আধুনিকতার উপর যে আলােচনা করেন সেই আলােচনায় তিনি আবার সমকালীন দেহ কেন্দ্রিকতার কথাও বলেন। এই ক্ষেত্রে তিনি বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ফুকোর মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। গিডেন্স এই ব্যাপারে জোর দেন যে, মানব অস্তিত্বের মূলে হচ্ছে মানব ব্যক্তিত্ব। তবে তাই বলে তিনি ফুকোর মানবজাতি সমকালীন দেহ পূজা সম্বন্ধীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হতে পারেন নি। তিনি মনে করেন ফুকো যে দেহ পূজার কথা বলে আসছেন তা হচ্ছে মূলত প্রতিফলনশীলতারই ভিন্ন প্রতীক মাত্র।

গফম্যানের মতো মিথস্ক্রিয়বাদীরা প্রথাগতভাবে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় দেহের উদ্ভাবনশীল প্রয়ােগের কথা বলে এসেছেন। তিনি মনে করেন যে মনোভাব সম্বন্ধীয় গতিধারা নির্ভর করে অনেকটা মানবজাতির দেহ সচেতনতার উপর। সামাজিক জীবন যাতে আমাদের আশানুরূপ পরিচালিত হয় সেই জন্য সামাজিক জীবনে অন্যান্যদের মুখােমুখি হতে আমরা আমাদের দৈহিক আবরণ, প্রকাশ ভঙ্গি এবং আচরণগুলাের সুচিন্তিত প্রয়ােগ করে থাকি। আমরা প্রকাশ্য জীবনে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার অংশ হিসেবে নাটকীয় পদ্ধতিতে নিজেদের শরীরটাকে ব্যবহার করি। এই ধরনের সংগঠিত জীবনের ছােটখাট নাটকগুলাে আমাদের ক্ষেত্রে সঠিক এবং সত্য বলে প্রমাণিত হলেও মাঝে মধ্যে তাকে অসার বলে মনে হয়। তবে এই ক্ষেত্রে যায় গফম্যানের সাথে গিডেন্সের মতপার্থক্য অনেক। গিডেন্স মনে করে বিলম্বিত আধুনিকতার অর্থ হচ্ছে আমরা আমাদের চাকুরি, উৎসস্থল, আবাসস্থল, আমাদের পরিবার সম্বন্ধে নিজেদের মনে করে কিছু বলতে পারি না। নিজেদের অস্তিত্ব ও পরিচিতি নির্ধারণ করতে হলে আমাদের বিভিন্ন পথের আশ্রয় নিতে হয় এবং অন্যান্যদের সামনে নিজেদের তুলে ধরতে গেলেও আমাদের একটি পথের আশ্রয় নেয়া যথেষ্ট নয়। এই কারণে তিনি এই ক্ষেত্রে বাউম্যানের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেন। তিনি বাউম্যানের সাথে এই ব্যাপারে একমত যে শুধু বাজারের জিনিসপত্রের ভােগের মাধ্যমেই সমকালীন জীবন-যাপনের স্বরূপ নির্ধারণ করা সম্ভব। বর্তমান যুগে দেখা যায় যে, আমাদের মালিকানাধীন জিনিসপত্রের মাধ্যমেই আমরা আমাদের পরিচিতি নির্ধারণ করি। ভােগ সম্ভোগের এই যুগে এটাই হচ্ছে একমাত্র উপাদান যার মাধ্যমে আমরা আমাদের পরিচয় প্রকাশ করতে পারি। তাই বাউম্যান বলেন, বর্তমান যুগে জীবনটার কোন অর্থ খুঁজে পেয়ে সমকালীন সমাজের আত্মপরিচয় নির্ধারণ করার একটি মাত্র উপায় হচ্ছে নিত্য নিয়মিতভাবে বাজারগুলােতে ঘুরে বেড়ানাে”। (Baulian, Ibid., 1922, p. 26.)।

একারণেই আমরা বলতে পারি যে, বিলম্বিত আধুনিকতায় দেহের কোন গুরুত্ব নেই বলেই চলে। এটাকে বরঞ্চ আমরা বলতে পারি প্রতিফলনশীল প্রক্রিয়ার একটি দিক মাত্র। বিলম্বিত আধুনিকতার যুগে আত্মপরিচয় নির্ধারণ করার যে অনেকগুলাের মাধ্যম রয়েছে তার একটি হচ্ছে দেহ। এই দেহ সম্বন্ধে গিডেন্সের মতবাদ এলিজাবেথ জ্যাগার নিম্নোক্ত প্যারাটিতে তুলে ধরেছেন, “By providing a series of ‘expert knowledges’, for instance in relation to lifestyle, health, fashion and beauty, consumer culture is understood…to have contributed to an increasingly reflexive understanding of the self, an awareness that identity is chosen and constructed….As Giddens (1991) has pointed out, the self in ‘late modernity’ has become a reflexive project; it is created (and recreated) through a plurality of consumer choices and lifestyle decisions. In his view, individuals can now draw on a wide repertoire of symbolic goods with which to fashion and display their own identities,” (Jagger, Elizabeth, In Hancock, Philip, et al., The Body, Culture and Society, 2000, pp. 51-2.)।অর্থাৎ, বিশেষজ্ঞদের জীবন-যাত্রার, স্বাস্থ্য, ফ্যাশন এবং সৌন্দর্য। তীয় ব্যাপক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আমরা ভােক্তা সংস্কৃতির স্বরূপ বুঝে উঠতে পারি…। এরই মাধ্যমে কিন্তু আমরা অহম সম্বন্ধীয় প্রতিফলনশীলতা সম্বন্ধেও জানতে পারি। ফলে গিডেন্স (1991) যেভাবে চেয়েছেন সেইভাবেই আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষের পরিচয় নির্ধারণ করতে পারি। এই প্রক্রিয়া থেকে আমরা দেখতে পাব যে এর শেষ পরিণতি হচ্ছে প্রতিফলনশীল প্রকল্পের আওতায় বিলম্বিত আধুনিকতার আবির্ভাব। এই বিলম্বিত আধুনিকতার সৃষ্টি হয় ভােগ সম্ভোগের বহুমাত্রিকতার মাধ্যমে। তাই দেখা যাচ্ছে সমকালীন বিলম্বিত আধুনিক যুগে ব্যক্তি পর্যায়ে একজন বাকি বিভিন্ন প্রতীকী পণ্যের মাধ্যমে ফ্যাশন এবং জীবন-যাত্রার পরিচালনা করে নিজেদের আত্মপরিচয় নির্ধারণ করতে পারে। তাহলে বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, গিডেন্সের (1991, p. 31) মতবাদ অনুযায়ী বিলম্বিত আধুনিকতায় এর ভূমিকা মুখ্য না হলেও এর প্রভাব তিনি অস্বীকার করেন নি। তিনি মনে করে যে, “দেহ হচ্ছে বিলম্বিত আধুনিকতার যুগে আত্মপরিচয় নির্ধারণ করার মুহ্যমান বাহন এবং এটা দিন দিন মানুষের জীবন-যাপন সম্বন্ধীয় সিদ্ধান্ত তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিফলনশীলতার সাথে একীভূত হয়ে ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি করে যাচ্ছে।” 

গিডেন্স এবং আধুনিকতার মতবাদীকরণ : উপসংহার

তাই দেখা যায় গিডেন্স মনে করেন যে উত্তরাধুনিকতাবাদ হচ্ছে এমন এক সামাজিক মতবাদ যা নিম্নোক্ত তিনটি কারণে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে – 

  • ১. এটা ২১শ শতাব্দীর মানবিক জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতার ভূমিকাকে উপেক্ষা করেছে।
  • ২. এটা এই ক্ষেত্রে নিজেদের ভুল প্রমাণিত করেছে যে, নিত্যনতুন পরিবর্তনের মুখে ব্যক্তি পর্যায়ে মানবজাতি হচ্ছে ভীষণ অসহায়। 
  • ৩. এই মতবাদ মনে করে যে বর্তমানে আর পৃথিবীটাকে নিরাপদ এবং উত্তম জায়গায় পরিণত করার মতাে কোন ভূমিকা মানবজাতি পালন করতে পারে না। কারণ উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রবক্তারা মনে করেন বাস্তবতা সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট চেতনাবােধ তৈরি করার ক্ষমতা আমাদের আর থাকছে না।

গিডেন্স সরাসরি মনে করেন যে উত্তরাধুনিকতাবাদ হচ্ছে এমন একটি মতবাদ যা সমাজবিজ্ঞানী মতবাদসমূহের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অযােগ্য। কারণ তিনি মনে করেন যে, মানবজাতির কোন কল্যাণ নিশ্চিত করার অক্ষমতার কারণেই প্রাচীন সমাজবিজ্ঞানী মতবাদসমূহকে অস্বীকার করা হয়। তাই উত্তর অধুনাবাদের এই ধরনের নিস্ক্রীয় মতবাদ যা মানব কল্যাণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ তাকে আমরা সমাজবিজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করব কেন?

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ও উত্তরাধুনিক সমাজচিন্তা, ড. মোঃ আহসান হাবিব, গ্রন্থ কুটির, ২০১৩, ঢাকা, পৃ. ৪৭৭-৫০২

2 Comments

  1. একটি পদ হিসেবে মডার্ন’ শব্দটি আবির্ভূত হয় ১৬শ শতকের শেষ দিকে. মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক রেমন্ড উইলিয়াম তার কি ওয়ার্ডস গ্রন্থে বলেছেন, মডার্ন শব্দটি যখন উদ্ভূত হয় তথন এটি বােঝাত বর্তমানকে।

    কেমন হইলো তথ্যটা?

  2. ভালো অনুবাদের জন্য চেষ্টা করা হয়েছে-এর চেয়ে বেশি বলতে পারলাম না বলে ক্ষমা প্রার্থী।

    এত বানান ভুল acceptable না DEAR!!!

1 Trackback / Pingback

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.