কাঠামোবাদ ও উত্তরকাঠামোবাদ

(সম্প্রসারিত হবে)

Table of Contents

কাঠামোবাদ

ভূমিকা

চিন্তার আদিকল্পের দিক থেকে আলোকময়তা, বিবর্তনবাদ, ব্যপ্তিবাদ, ঐতিহাসিক নির্দিষ্টতাবাদ, ক্রিয়াবাদের পরই চিন্তা-ঐতিহ্যের বিকাশের পরবর্তী ধাপ হিসেবে কাঠামোবাদের আলোচনা চলে আসে। এই কাঠামোবাদের পর্বটি আলােকময়তার সকল প্রকল্প সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপনের একটি প্রস্তুতিকালীন পর্ব হিসেবে দেখা যায়।

কাঠামােবাদ হল মানবিক বিজ্ঞানের একটি প্রস্তাবনা যা আন্তঃসম্পর্কযুক্ত জটিল পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে বিশ্লেষণ করে। কাঠামােবাদ একটি প্রভাবশালী অবয়ব এবং সাংস্কৃতিক তত্ত্বাবধায়নের মূল বিষয়। এখানে অস্পষ্ট ও সহজাত মানসিক কাঠামাে বিদ্যমান বলে ধরা হয়, যা সব মানুষের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযােজ্য। কাঠামােবাদ ভাষাতত্ত্ব গবেষণার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়েছে। ফার্দিনান্দ দ্যা সস্যুর (Ferdinand de Saussure, ১৮৫৭-১৯১৩ খ্রি, নামের আসল উচ্চারণ অনেকটা ফ্যাঘ্‌দিনান দ সস্যুঘ্‌) ভাষা নিয়ে যে কাজ করেন তা পরবর্তীকালে কাঠামােবাদ ধারণাটির উৎপত্তি ঘটায়। কিন্তু বহু ফরাসি বুদ্ধিজীবী এ ধারণাকে আরাে প্রশস্ত ক্ষেত্রে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। এটা খুব দ্রুত পরিশীলিত ও পরিবর্তিত হতে থাকে। এর ফলে পরবর্তীতে নৃবিজ্ঞান, মনােঃসমীক্ষণ, সাহিত্যতত্ত্ব সহ অন্যান্য জ্ঞানের শাখায় একে প্রয়ােগ করা হয়। কাঠামােবাদ শুধুমাত্র কোনাে ধারণা বা পদ্ধতি নয়, এটা ১৯৬০ দশকে সংগঠিত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন যা তদকালীন অস্তিত্ববাদকে ভিত্তি প্রদান করে।

কাঠামােবাদ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর মানবতাবিরােধী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পুরােপুরি সার্ত্রের অস্তিত্ববাদের বিপরীত। ১৯৭০ সালে কাঠামােবাদের সমালােচনা বৃহদাকার ধারণ করে অর্থাৎ উত্তর কাঠামােবাদ তত্ত্বের উদ্ভব হয় যা কাঠামােবাদকে আরাে দৃঢ়তা প্রদান করে এবং ঐতিহাসিক রূপ দান করে। অনেক কাঠামােবাদী তাত্ত্বিক মহাদেশীয় দর্শন এবং মৌলিক পূর্বানুমান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মিশেল ফুকো, জ্যাক লাকাঁ প্রমুখ তাত্ত্বিকগণ কাঠামােবাদের সমালােচনা করেন যা উত্তর-কাঠামােবাদের অনুগামী আলােচনাকে সমর্থন করে। কিন্তু তা কাঠামােবাদকে এক অর্থে চলমান রাখে।

কাঠামােবাদ প্রতীক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে কাজ করে এবং চিহ্নকারী ও চিহ্নিত-এর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে। এখানে প্রতীক ব্যবস্থার মধ্যকার পার্থক্য এবং প্রতিটি প্রতীককে আলাদাভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। নৃবিজ্ঞানে কাঠামােবাদ ধারণা নিয়ে আসেন লেভিস্ট্রস যিনি অন্যান্য বিষয়ের মধ্য থেকে স্থানীয় মিথকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বিপরীত জোড় (Binary Opposition)-এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তার মতে, মানুষ কীভাবে বাইরের বিশ্বকে দেখে তাই কাঠামোবাদের মূল ভিত্তি। কাঠামােবাদের এই ধরণের বিশ্লেষণ প্রত্নতত্ত্বেও দেখা যায়। এখানে কাঠামােবাদীরা বলে থাকে সংস্কৃতি একটি কাঠামাের অন্তর্গত যা ভাষার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় । তারা সাংস্কৃতিক কাঠামােকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে নয়। এলিসন এলিস্টারের মতে, চারটি প্রধান বিষয় কাঠামােবাদকে বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেগুলাে হল –

  1. কাঠামাে একটি সম্পূর্ণ বিষয়ের প্রতিটি উপাদানের অবস্থান নির্দিষ্ট করে।
  2. কাঠামােবাদীরা বিশ্বাস করে প্রতিটি পদ্ধতির একটি নির্দিষ্ট কাঠামাে রয়েছে।
  3. কাঠামােবাদীরা পরিবর্তনের চেয়ে সেই কাঠামােকৃত আইনের প্রতি বেশি আগ্রহী যা সহাবস্থান নিয়ে কাজ করে।
  4. কাঠামাে প্রকৃত বিষয় যা ডিপ লেভেলে থাকে তাকে এবং তার অর্থকে তুলে ধরে।

বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে কাঠামােবাদকে একাডেমির অন্তর্গত করা হয় এবং একাডেমির ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সমাজ-বিশ্লেষণের একটি জনপ্রিয় প্রস্তাবনা হিসেবে তা বেড়ে ওঠে। সস্যুরের ভাষা-সম্পর্কিত কাজকে ধরা হয় কাঠামােবাদের সূচনালগ্ন। মূলত কাঠামােবাদ শব্দটিকে পুরােপুরি পরিচয় করিয়ে দেয় ফ্রান্সের নৃবিজ্ঞানী ক্লদ লেভিস্ট্রসের (Claude Lévi-Strauss, ১৯০৮-২০০৯ খ্রি.) কাজ এবং যা ফ্রান্সে কাঠামােবাদী আন্দোলনের সূচনা করে। বিভিন্ন তাত্ত্বিক যেমন মিশেল ফুকো, লুই আলথুসার, মনঃসমীক্ষণবিদ জাক লাকাঁ, কাঠামােগত মার্ক্সবাদী নিকস্ পােলান্টজাস-এর কাজ কাঠামােবাদকে আরাে বেশি চালিত করে। এ আন্দোলনের প্রায় সব সদস্য নিজেদেরকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানায়। কাঠামােবাদ চিহ্নবিজ্ঞানের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অবিনির্মাণ বা বিনির্মাণবাদ কাঠামােগত চিন্তাকে ভেঙে ফেলার একটি প্রচেষ্টা।

নৃবিজ্ঞানের এবং সমাজবিজ্ঞানের কাঠামােবাদ অনুসারে একটি সংস্কৃতিতে অর্থ উৎপাদন এবং পুনঃউৎপাদন হয় বিভিন্ন অনুশীলন, বিষয় এবং কার্যাবলির মধ্য দিয়ে যা একটি পদ্ধতিকে অনুসরণ করে। কাঠামােবাদ আলােচনা করে বিভিন্ন কার্যাবলি যেমন খাদ্যাভাস, ধর্মাচরণ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, খেলাধূলা, সাহিত্য এবং সাহিত্য নয় এমন বিষয় নিয়ে এবং চেষ্টা করে একটি সংস্কৃতির ডিপ সারফেস এর অর্থ আবিষ্কার করতে। উল্লেখযােগ্য কাঠামােবাদী তাত্ত্বিক হলেন সস্যুর, লেভিস্ট্রস, রােমান জ্যাকবসন, মার্সেল মস, রােলা বার্থ, জ্যাক লাকাঁ প্রমুখ। এরাই মূলত কাঠামােবাদকে একটি ভিত্তির ওপরে দাঁড় করান।

ভাষাতাত্ত্বিক কাঠামোবাদ ও ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুর

প্রতিবিম্ব পন্থা বনাম মানবতাবাদ

ভাষাতাত্ত্বিক কাঠামোবাদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই সস্যুরের নাম আসে, যিনি কাঠামোবাদের তত্ত্বায়নের মাধ্যমে ভাষাতত্ত্ববিদ্যায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। তবে তার তত্ত্ব বোঝার আগে ভাষা সম্পর্কিত তদকালীন প্রচলিত ধারণা প্রতিবিম্ব পন্থা বা রিফ্লেক্টিভ বা মিমেটিক সম্পর্কে জানতে হবে। ভাষার প্রতিবিম্ব পন্থা অনুসারে, ভাষা হল আয়নার মত স্বচ্ছ মাধ্যম, যা এখানে স্বচ্ছভাবে অর্থের প্রতিচ্ছবি বা মিমেসিস ঘটায়। অর্থাৎ প্রতিটি জিনিসের অর্থ বস্তুগত ও প্রাকৃতিক গুণাবলি দ্বারা নির্ধারিত বা গঠিত হয়। যেমন ফল রসালো, পাখি ওড়ে। ফল মানেই রসালো এটা তার বস্তুগত ও প্রাকৃতিক গুণাবলি, পাখি ওড়ে বললে মনের মধ্যে পাখি ওড়ার ছবি ভেসে ওঠে। প্রতিবিম্ব পন্থা ধরে নেয় যে বস্তুর গুণাবলি দ্বারা নির্ধারিত তাই অর্থ বস্তুতেই বিরাজ করে। আর ভাষা এমন মাধ্যম যেখানে বাস্তবতা প্রতিলিপি বা কপি তৈরি করে। মানুষ এই প্রতিলিপিকে নান্দনিকভাবে পুনঃউপস্থাপন করে।

আরেকটি পন্থা আছে, যা পরিচিত মানবতাবাদ নামে। এটি অনুসারে জগতের কেন্দ্রে বসবাস করে মানুষ আর ভাষা হল মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম, অর্থাৎ মানুষের মানুষের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। ভাষা হচ্ছে মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা, চিন্তাভাবনা, অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। এই ধারণায় লেখক বা বক্তা হল অর্থের রূপকার। শব্দের অর্থ লেখক বা বক্তার সংকল্প অনুসারে ঘটে। ভাষার মাধ্যমে জগতের সকল কিছুতে লেখক অনন্য অর্থ আরোপ করে। (প্রথম চিন্তায় অর্থ অবজেক্টিভ ও মানুষের দ্বারা প্রভাবিত নয়, সমাজ দ্বারা প্রভাবিত, ভাষায় কেবল রিফ্লেকশন হয়, পরেরটায় অর্থ সাবজেক্টিভ, মানুষ নিজে তা তৈরি করে ভাষা তৈরি করে, স্ট্রাকচারালিজম প্রথমটার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, তবে এখানে রিফ্লেকশনের বদলে প্রোডাকশন ও প্র্যাক্টিসের বিষয়টা সামনে আসে।)

ভাষাগত কাঠামো

ভাষাগত কাঠামো বলতে বোঝায় ভাষার সুনির্দিষ্ট কাঠামো থাকবে, অর্থাৎ কিছু অর্থবোধক শব্দ পাশাপাশি বসে সম্পূর্ণ মনের ভাব প্রকাশ করবে, তাতে সুনির্দিষ্ট সাবজেক্ট ও অবজেক্ট থাকবে। অর্থাৎ ভাষাকে কাঠামোর ভেতর আসতে হবে। যেমন, মারলেন ছুড়ে বুশকে রাষ্ট্রপতি জুতা জর্জ সাংবাদিক ইরাকী মার্কিন – বাক্যে প্রতিটি শব্দে এসেন্স থাকলেও ভাষায় স্ট্রাকচারাল ভুল আছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে ইরাকি সাংবাদিক জুতা ছুড়ে মারলেন – বললে বাক্যের লিংগুইস্টিক স্ট্রাকচার ঠিক হবে।

ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুর (১৮৫৭-১৯১৩) এর তত্ত্বের পূর্বে যে প্রচলিত পন্থাগুলো ছিল সেগুলো থেকে তার তত্ত্ব পুরোপুরি ভিন্ন ধাঁচের। সস্যুর সুইজারল্যান্ডের একজন ভাষাবিদ ছিলেন, তিনি আধুনিক তাত্ত্বিক ও ভাষাতত্ত্বের জনক হিসেবে পরিচিত। তিনি সাধারণ ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে পৃথিবীর সমস্ত ভাষাকে ব্যাখ্যা বা বোঝানোর চেষ্টা করেন, যাতে কিছু বিষয়ের অনুপস্থিতি দেখা যায়। জন লকের মত অভিজ্ঞতাবাদীরা ভাষাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বলেছিলেন, কিছু শব্দ আছে যা নির্দিষ্ট বস্তুকে বোঝায় বা ঐ বস্তুর মানসিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। ভাষার ক্ষেত্রে কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলো সাধারণ বাস্তবে উপস্থিত যেমন কুকুর, আবার কিছু শব্দ আছে যা বিমূর্ত যেমন অপরাধ, গুণ। সস্যুরে তত্ত্ব কেবল বস্তুগত শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যাই হোক, সস্যুর বললেন, অর্থের উপাদান ভাষার উপর নির্ভরশীল।

সাইন, সিগ্নিফায়ার ও সিগ্নিফায়েড

সস্যুর বললেন language is a system of signs, বা ভাষা হচ্ছে একটি চিহ্ন ব্যবস্থা। তার দৃষ্টিতে language is a structural system of signs. অর্থাৎ ভাষা হচ্ছে চিহ্নসমূহের একটি কাঠামোকৃত অবস্থা। শব্দ হচ্ছে সাইন, যেমন গাছ। সাইন হল অর্থের প্রধান একক, অর্থাৎ সাইন মিনিং বহন করে। সাইনে রয়েছে সিগ্নিফায়ার বা চিহ্নকারী ও সিগ্নিফায়েড বা চিহ্নিত। সিগ্নিফায়ার হচ্ছে ওয়ার্ড ইমেজ বা শ্রুতিগত প্রত্যয়, আর সিগ্নিফায়েড হল মেন্টাল কনসেপ্ট বা মনগত প্রত্যয়। উদাহরণ, নদী একটি সাইন, নদী যদি সিগ্নিফায়ার হয় হবে সিগ্নিফায়েডটা হল নদী সম্পর্কে আমাদের মাথার ভেতর যে ধারণা, মানে নদী কথাটি শুনলে আমাদের মনে যে চিত্র ভেসে আসে, মানে নদীর যে এসেন্স আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের জ্ঞানতত্ত্বের কারণে আমাদের মাথায় আসে তা হল সিগ্নিফায়েড। সিগ্নিফায়ার ও সিগ্নিফায়েড দুটি ভিন্ন কিন্তু বাস্তবে দুটোকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব।

সস্যুরের তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, মনোজগতের নির্দেশকের সাথে সাইনের সম্পর্ক নেই, অর্থাৎ বাস্তব পাখির সাথে শব্দ পাখির মিল নেই, কারণ শব্দ পাখি হল একটা সাইন, যেমন বাঙ্গালিরা পাখি বললেও কিন্তু ইংরেজরা বার্ড বলছে, চাইনিজরা অন্য নামে ডাকছে। উচ্চারিত ভাষা হল মানুষের একটা স্বভাব, সাধারণ প্রবৃত্তি। খোদ ভাষার কোন ঐক্য নেই, ভাষাকে ঐক্য দেয় স্ট্রাকচার। লেঙ্গুয়েজ ও লিংগুইস্টিক স্ট্রাকচার এক নয়, লিঙ্গুইস্টিক স্ট্রাকচার হল ভাষার অপরিহার্য অংশ। মানুষের ভাষা ক্ষমতার সামাজিক প্রকাশ হল ভাষা কাঠামো। লিংগুইস্টিক স্ট্রাকচার হল সমাজ দ্বারা গৃহীত জরুরি নীতিগুলো। সমাজ এগুলোকে গ্রহণ করে যাতে সমাজের মানুষে এগুলোর সাহায্যে ভাষা ব্যবহার করতে পারে। ভাষার স্ট্রাকচারাল দিকটি দৃষ্টির অন্তরালে থাকে, সস্যুর একে ভিত্তিস্বরূপকারী কাঠামো বা আন্ডারলাইং স্ট্রাকচার বলেছেন।

সস্যুর চিহ্ন বা সাইনকে স্বেচ্ছাচারী বা আরবিটারি বলেছেন। সিগ্নিফায়ার ও সিগ্নিফায়েডের মধ্যে নিত্য ও অনিবার্য সম্পর্ক নেই। প্রতিটি ভাষা জগৎ সংসারকে ভিন্নভাবে ভাগ করে, বিভাজনের ভাষা প্রকাশিত হয় ভাষার নির্দিষ্ট প্রত্যয় দ্বারা। সস্যুরের মতে বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব শব্দের আগে বা প্রাক-শব্দগত নয়, কারণ প্রাক-শব্দগত হলে সব ভাষাতেই সমার্থক শব্দ পাওয়া যেত কিন্তু সব ভাষায় সব কিছুর সমার্থক শব্দ নেই। সস্যুরের মতে সাইনের কোন এসেনশিয়াল মিনিং বা অপরিহার্য অর্থও নেই, এটি কেবল সিস্টেমের অংশ, এর অর্থ তৈরি হয় অন্য উপাদান বা সদস্যের সাথে সম্পর্কের দ্বারা, যেমন ঋতু বিভাজন, গ্রীষ্মের কোন আলাদা অর্থ নেই, আগের ও পরের ঋতুর ভিত্তিতে, বিপরীত ঋতুর ভিত্তিতে এর অর্থ নির্ভর করে। এর উপর ভিত্তি করে সস্যুর বললেন ভাষা হচ্ছে এ সিস্টেম অফ ডিফারেন্স। অর্থাৎ কোন কিছুর অর্থ নির্ধারিত হয় সামগ্রিক অবস্থায় তার অবস্থান দ্বারা, তার বিপরীত দ্বারা।

সাইনের অর্থ অনড়-অপরিবর্তনশীল কিছু নয়, এর বদল ঘটতে পারে, তবে অর্থবহ হতে হলে সেই বিশেষ মুহূর্তের সাইন হতে হবে পূর্ণাঙ্গ অবস্থার অংশ। যদি কানে শোনা কোন শব্দের কারণে মাথায় ভাবনা জন্ম লাভ করে ও এটা সামাজিক রীতির ফল হয়, যদি বিভিন্ন ভাষা জগৎ সংসারকে ভিন্ন ভিন্নভাবে ভাগ করে এবং যদি শব্দের অর্থ পরিবর্নশীলই হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে –
(১) কোন ইতিহাস ও সংস্কৃতির নির্দিষ্ট অর্থ সৃষ্টি হয় সেই ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভেতরে
(২) এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতি ও এক কাল থেকে আরেক কালে অর্থসমূহ বদলায়

লেঙ্গু-প্যারোল ও সিনক্রোনিক-ডায়াক্রোনিক

সস্যুর লেঙ্গু (langue) ও প্যারোল (parole) এর পার্থক্য দেখিয়েছেন, লেঙ্গু হল ভাষা ব্যবস্থা ও প্যারল হল উক্তি বা কথন। লেঙ্গু হল একটি শেয়ারড সিস্টেম যেখানে নিয়মনীতির সংকেত থাকবে, যার সাহায্যে আমরা সহজভাবে ভাষাকে ব্যবহার অরতে পারি। প্যারোল হল মৌখিক, নিয়ম নেই্‌ বক্তা ইচ্ছামত কথা বলতে পারে। নিয়ম ও সংকেতের ভিত্তিস্বরুপ কাঠামো বা স্ট্রাকচার হচ্ছে ভাষার সামাজিক দিক আর একে বিজ্ঞানের নিয়মনিষ্ঠা, নির্ভুলতার মান অনুসারে অধ্যয়ন করা সম্ভব। সস্যুর ভাষাকে গভীর কাঠামোর পর্যায়ে স্টাডি করতে চেয়েছিলেন বলে তার ভাষার মডেলের নাম করা হয় স্ট্রাকচারালিস্ট। এখানে ব্যক্তি যা বলে তা হল সারফেস। সস্যুরের ভাষাতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ব্যক্তিক ও সামাজিকের বিভাজন। আমি কী বলব তা আমার ইচ্ছানুসারে ঘটে কিন্তু ভাষার নিয়ম ব্যবহার করব কি করব না তা আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার নয়।

সস্যুরের মতে ভাষার দুটো দিক থাকে – সিনক্রনিক, যা ভাষার কাঠামোগত দিক বা বিশেষ কোন মুহূর্তের বিদ্যমান অবস্থা; ডায়াক্রনিক, যা ভাষার ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত, এটি সময়সাপেক্ষ ফর্ম ও রীতির ফলকে নির্দেশ করে। সিনক্রনিক ভাষার তাৎক্ষণিক অর্থ বহন অরে, অন্যদিকে ডায়াক্রনিক হল সেই ভাষাটি বলার আগের প্রেক্ষাপটটা যুক্ত হয়ে যে ভাষার সৃষ্টি হয় সেটা।

সস্যুরের কাঠমোবাদের সমালোচনা ও প্রভাব

সস্যুরের কাঠামোবাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে এই দুটি পয়েন্ট দেখা যায় –
(১) সস্যুর কেবলমাত্র বস্তু ও অর্থ একটি অপরটির স্বচ্ছ মাধ্যম হিসেবে প্রত্যয়ন না করে অর্থকে উৎপাদন প্রক্রিয়া ও অনুশীলন হিসেবে দেখেছেন।
(২) সস্যুর ভাষার আনুষ্ঠানিক দিকের উপর নজর দিয়েছেন, ফলে ভাষার মধ্যে ক্ষমতার ক্রিয়াশীলতা অনুপস্থিত যেমন বক্তার মর্যাদা ও ক্ষমতার তারতম্য।

যাই হোক, সস্যুরের কাঠামোবাদ চিন্তা-ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে বেশ প্রভাবশালী ছিল। অনেকের মতে সস্যুর কেবল সেমিওলজি নয়, স্ট্রাকচারালিজমেরও জনক, তবে পূর্ণাঙ্গ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট হিসেবে কাঠামোবাদের সূত্রপাত সস্যুরের জীবদ্দশায় হয়নি, আরও পরে ১৯৫০ এর দশকে ফ্রান্সে ভাষাগতভিত্তির উপর কাঠামোবাদী ভাবনা গঠিত হয়, ফ্রান্সে এর প্রভাব চূড়ায় ওঠে ১৯৬০ এর দশকে। সস্যুরের ধারণাগুলো নতুনভাবে ভাষা ও অর্থ তৈরির প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। রোলাঁ বার্থ এগুলো ফরাসি কালচারাল প্র্যাক্টিস বিশ্লেষণে প্রয়োগ করে তার কাঠামোবাদকে রেপ্রিজেন্টেশন বিশ্লেষণের একটি মডেলে রূপান্তরিত করে। তার কাজের পরে পাওয়া যায় কাঠামোবাদ থেকে উত্তর কাঠামোবাদের প্রবর্তন যা রেপ্রিজেন্টেশন বিশ্লেষণের পরিসর ও ব্যবহৃত প্রত্যয়ে পরিবর্তন আনে।

কাঠামোবাদ ও উত্তর কাঠামোবাদের মধ্যে পার্থক্য

স্ট্রাকচারালিস্টরা ভাষা নিয়ে বলেন, ভাষার ঊর্ধ্বে কোন বাস্তবতা নেই, ভাষা দিয়েই অভিজ্ঞতা রূপ লাভ অরে। ভাষা ঐতিহাসিকভাবেই চলে আসছে, ভাষা জগৎ সংসারকে আকৃতি দান করে। তারা মনে করে আমরা একটি জিনিসকে যা হিসেবে চিনি তাকেই দেখি। এদিকে উত্তর কাঠামোবাদীরা কাঠামোবাদকে পুরোপুরি খারিজ করেনা, তারা বলছে কাঠামোবাদীরা কোন কিছুকে উচ্চাঙ্গে পৌঁছে দেয় কিন্তু তারপর যে আরও এগোনো যায় তা নিয়ে ভাবে না, যেখানে তারা বলেন আরও সামনে এগনো যায়। তাদের মতে ভাষা যেমন অভিজ্ঞতাকে রূপ দান করে, তেমনি অভিজ্ঞতাও ভাষাকে রূপ দান করে। তাদের মতে বিশ্বে বস্তুগত জিনিস আছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো অর্থ ধারণ করে বাতচিত, আলাপচারিতা, ডিসকোর্সের মাধ্যমে জ্ঞানের লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়। উত্তর কাঠামোবাদীরা শুধু ভাষায় জোড় না দিয়ে ভাষা, জ্ঞান ও ক্ষমতাকে কাজে লাগান।

সস্যুরকে উদ্ধার

সস্যুর নিজে কখনও নিজেকে কাঠামোবাদী বলেন নি, তার মৃত্যুর পর তার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ক্লাস নোটগুলো সংগ্রহ করে কোর্স ইন জেনারাল লিংগুইস্টিক্স তৈরি করা হয় এটা ১৯৫৯ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। এর থেকে বোঝা যায় ভাষা নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি কাঠামোবাদীদের মতই ছিল। তার কথাগুলো একটু পরিবর্তি করে বললে এমন দাঁড়ায় –

  • গাছ এর প্রতিশব্দ একেক ভাষায় একেক রকম, ইংরেজিতে Tree, বাংলায় গাছ। জিনিস একই কিন্তু একেকজন একেক নামে চিনছে। সিগ্নিফায়ার পর্যায়ে আরবিট্রেশনের ব্যাপারটা সহজে বোঝা গেলেও সিগ্নিফায়েড পর্যায়ে কঠিন।
  • ধুতির কথা বললে দেখা যায় ধুতি শব্দটা শুনলে আমাদের মেন্টাল কনসেপ্টে চলে আসে শব্দটা হল হিন্দু পুরুষদের পোশাক। কিন্তু এমন সময় ছিল যখন ধুতিতে হিন্দু-মুসলিম ভেদ ছিল না। মুসলমানদের পাজামা প্যান্ট আসার পর তার ধুতি পরা ছেড়ে দেয়। এখন আবার সব হিন্দুদেরও ধুতি পরতে দেখা যায় না। আবার সিঁদুরের কথা বললে হিন্দু বিবাহিতা মেয়ের প্রতীক বোজায় কিন্তু পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে শতশত মেয়েরা সাদা লাল পাড় শাড়ির সাথে সিঁদুর পরে। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায় না সবাই হিন্দু বিবাহিতা। এখন তারা সিঁদুর পরছে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে, ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে নয়, এভাবে অর্থগুলো এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে এক কাল থেকে আরেক কালে পরিবর্তিত হয়।
  • যদি কোন শিশুকে ছোট বেলা থেকে mango এর অর্থ কাঁঠাল শেখানো হয় তাহলে সে ম্যাংগো শিখলে তার চোখে কাঁঠাল ভেসে উঠবে।
  • একটি লেখা বা গল্প ১০ বছর আগে আমাদের ভাল লাগত, কিন্তু এখন তা নাও ভাল লাগতে পারে। ছোটবেলায় গরুর রচনা মুখস্থ করে লিখতে হত, এখন অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখতে পারব। এই অভিজ্ঞতা ভাষাকে রূপদান করে।

ক্লদ লেভিস্ট্রস এবং সামাজিক কাঠামোবাদ

লেভিস্ট্রসের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

ক্লদ লেভিস্ট্রসকে স্ট্রাকচারালিস্ট চিন্তার জনক বলা হয়, যদিও তার কাজগুলো ছিল সস্যুরের লিঙ্গুইস্টিক স্ট্রাকচারালিজমের ধারাবাহিকতা। লেভিস্ট্রস ছিলেন বেলজিয়ামে জন্মগ্রহণ করা একজন ফরাসি নৃবিজ্ঞানী। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে তিনি ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৩৪ সালে ব্রাজিলের সাওপাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশিওলজিতে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ঐ সময়েই তিনি ব্রাজিলের ট্রাইবালদের প্রথা, আচার, নকশা, মিথ, পুরাণ, জ্ঞাতি সম্পর্ক ও খাদ্যাভাস নিয়ে গবেষণা করেন ও তার ফলশ্রুতিতে বেশ কিছু তত্ত্বের অবতারনা করেন যা কাঠামোবাদী চিন্তার প্রতিফলক হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ফলে ১৯৬০ এর দশকে ফ্রান্সে কাঠামোবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সূচনা হয়। তিনি ৩ নভেম্বর ২০০৯ তে মৃত্যুবরণ করেন।

লেভিস্ট্রস প্রবলভাবে সস্যুরের কাঠামোকৃত ভাষাতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি তার পরের কাজগুলোতে কাঠামোবাদের ব্যবহার করেন। সস্যুরের ভাষাভিত্তিক তত্ত্বের সংযুক্ততা ও অন্যান্য পরিসরে প্রয়োগকে তিনি গ্রহণ করেন, আর সাথে যুক্ত হয় ভাবনা ও প্রতীকবাদ। তিনি প্রভাবিত হন রোমান জেকবসন, মার্শেল মস এর মত তাত্ত্বিকদের দ্বারাও। তার প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে ব্রাজিলের ইন্ডিয়ানদের ওপর নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে ট্রিসটেস ট্রপিক (১৯৫৫), জ্ঞাতিতত্ত্ব ও বিবাহের অধ্যয়নের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অগ্রসরতা নিয়ে প্রকাশ করেন দি এলিমেন্টারি স্ট্রাকচারস অফ কিনশিপ (১৯৪৯), স্ট্রাকচারাল অ্যান্থ্রোপলজি (১৯৫৮), টোটেমিজম (১৯৬২), দ্য স্যাভেজ মাইন্ড (১৯৬২), চার খণ্ড সম্বলিত মিথোলজিক (১৯৬৪-৭২), স্ট্র্যাকচারাল অ্যান্থ্রোপলজি (১৯৭৩, ২য় খণ্ড)।

লেভিস্ট্রসের কাজ ও চিন্তাধারা

তিনি ব্রাজিলের আদিম সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো নিয়ে আজ করার সময় সেই ট্রাইবাল লোকগুলোর দৈনন্দিন জীবনে প্রথা, আচার, নকশা, মিথ, পুরাণ, জ্ঞাতি সম্পর্ক ও খাদ্যাভাস কী বা কিভাবে পালন করে তা বিশ্লেষণ করতে চাননি, বরং বিষয়গুলোর মাধ্যমে তারা কী “বলতে চায়”, তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে কী বার্তা যোগাযোগ করতে চায়, তা উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন। তিনি বিষয়গুলোর নিগূঢ় অর্থ এসব উপাদানগুলোকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বের করেন নি, বরং ঐ বস্তু বা চর্চার অন্তঃস্থ যে নিয়ম নীতি ও সংকেত লিপি সে অর্থ উৎপাদন করে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করেন। এভাবে কাজ করে তিনি প্রকৃত অর্থে সস্যুরের কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্বকেই অনুসরণ করেন। এটা যেন সংস্কৃতির প্যারোলে থেকে অন্তস্থ কাঠামো সংস্কৃতির লেঙ্গুয়াতে উপস্থিত হওয়া।

লেভিস্ট্রস বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের সংস্কৃতিকে একটি স্ট্রাকচারের মধ্যে দিয়ে বুঝতে চেয়েয়ছেন। বিশ্লেষণও করেছেন একটি কাঠামোবাদী অংশ বা বিষয় হিসেবে। এখানকার প্রয়োগ পদ্ধতি সস্যুরের স্ট্রাকচারালিস্ট লিঙ্গুইস্টিক্স দ্বারা প্রভাবিত। এসময়গুলোতে তিনি বেশ কিছু তত্ত্বকে বিশ্বের সামনে তলে ধরে যা নৃবিজ্ঞানের খুওইগুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। লেভিস্ট্রসের মৈত্রীবন্ধন তত্ত্ব বা এলায়েন্স থিওরি সামাজিক নৃবিজ্ঞানে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এখানে বংশধারার পরিবর্তে এলায়েন্স বন্ধনের স্ট্রাকচারাল ও সাংগঠনিক দিকের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি দ্য এলিমেন্টারি স্ট্রাকচারস অফ কিনশিপ গ্রন্থে এই তত্ত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্যের একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেন। এর মাধ্যমে তিনি বলতে চেয়েছেন যে জ্ঞাতি সম্পর্ক তৈরিতে বিবাহ প্রথাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও নিকটবর্তী দলের নারী বিনিময়ের ফলে বৃহত্তর সামাজিক আত্মিক যোগাযোগ গটে ও গোত্রগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। তিনি আরও দাবি করেন, আদিম সমাজে নারীদের বিনিময়ের মাধ্যমে বিবাহ পরবর্তী যে নিয়ম আছে তা অনিবার্য হিসেবে পালন করতে হয় যা অন্যান্য সমাজের বিবাহ-পরবর্তী নিয়ম থেকে আলাদা। এর সাথে সাথে উপহার আদান প্রদানের মাধ্যমে গোত্রের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হয়। প্রকৃতি ও সংস্কৃতির মধ্যে লেভিস্ট্রস যে যোগসূত্র খোঁজেন তা তিনি স্ট্রাকচারাল কারণেই ধরে নেন।

যৌনতা ও সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদান সংস্কৃতিরই আওতাধীন, মানুষ শুধু তার অংশমাত্র। লেভিস্ট্রসের পূর্বে নৃবিজ্ঞানীগণ যৌন বিধিমালা ও বিয়ের বিধিমালা এই দুই এর মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন। তারা যুক্তি দিয়েছিলেন, বিয়ে ছাড়া যৌন সম্পর্ক তৈরি হতে পারে কিন্তু বিয়ের সম্পর্ক তৈরি হলে যৌন সম্পর্ক ঘটে না এমন নিয়ম নেই ও কোন সমাজেই দেখা যায় না। তারা বলেছিলেন, কিছু জ্ঞাতি সম্পর্কের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও যৌন সম্পর্ক স্থাপন হলে তা গ্রহণযোগ্য না হলেও মেনে নেয়া হয়। কিন্তু লেভিস্ট্রসের মতে যৌন বিধি নিষেধ ও বিয়ের বিধি নিষেধের মধ্যে পার্থক্য করা জরুরি নয়। তার মতে মূল বিষয় হচ্ছে অজাচার বা ইনসেস্ট। তার মতামত হল বিশেষ বিশেষ সম্পর্কে বিয়ে নিষিদ্ধ করার চেয়ে বিশেষ বিশেষ সম্পর্কে বিয়ে আবশ্যিক করে তোলা জরুরি। অজাচার সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি টেইলরকে অনুসরণ করেন। টেইলরের মতে সমাজকে সুসঙ্ঘত করতে গিয়ে বিয়ের মাধ্যমে স্থাপিত এলায়েন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আদি সময়কালে একটি বড় পরিবারের ক্ষেত্রে একা টিকে থাকাটা কঠিন ছিল, প্রতিকূল পরিবেশ বা বড় ধরণের শিকারে বা শত্রু থেকে রক্ষা পেতে হলে অন্যান্য পরিবার ও বন্ধুমহলের সাহায্য আবশ্যক ছিল। এই যুক্তি দেখিয়ে টেইলর বিয়ের গুরুত্বকে মৈত্রীসুলভ সম্পর্ক স্থাপনে বোঝাতে চেয়েছেন।

টেইলরের মতে দুটি পথ ছিল – বাইরের দলগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা বা তাদের আক্রমণের শিকার হওয়া। লেভিস্ট্রস এই যুক্তি ধরে অজাচারকে বিশ্লেষণ করলেন। অজাচার নিষেধাজ্ঞার মূল বিষয় নিজ বোন বা মা বা কন্যার সাথে যৌনসম্পর্ক নিষিদ্ধ নয়, অপরের কাছে তাদের প্রদান করা। এই বক্তব্যকে সাপোর্ট করার জন্য নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিড এর দ্বারা আরাপেশ জাতিসতার তথ্যদাতাদের সাথে আলাপচারিতার কিছু অংশ তার বইতে তুলে ধরেন। সেখানে বোনের সম্পর্কে জোটবন্ধন সম্পর্কে আরাপেশ তথ্যদাতা বলে, কখনই না, আমরা আমাদের বোনেদের সাথে সহবাস করিনা। অন্য পুরুষদের কাছে আমাদের বোনদের প্রদান করি, আর অন্য পুরুষেরা তাদের বোন আমাদের কাছে নিয়ে আসে। মিড এখানে প্রশ্ন তুললেন, অসম্ভব হলেও এটা কোনভাবে ঘটলে তাহলে কিভাবে দেখবেন? কী ভাষায় এই নিয়ে কথা বলবেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে তথ্যদাতার কষ্ট হল। তাদের মতে এরকম পরিস্থিতির কথা ভাবাই যায় না। সে বলল, তোমার কী হয়েছে বলোতো, তুমি কি ভগ্নিপতি চাওনা? তুমি কি বোঝ না যে তুমি অয় কোন পুরুষের বোনকে বিয়ে করলে আর অন্য পুরুষ তোমার বোনকে বিয়ে করলে তুমি দুজন ব্রাদার-ইন-ল পাবে, আর নিজে যদি নিজের বোনকে বিয়ে করো তাহলে কাউকেই পাবেনা, এক্ষেত্রে তুমি কার সাথে উদ্যান চাষ করবে? কার সাথে বেড়াতে যাবে? এই কথোপকথন লেভিস্ট্রসের বক্তব্যকে ভালভাবে ব্যাখ্যা দেয়। কাদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ তার উপর অজাচার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কিন্তু মুল বিষয় হওয়া উচিৎ কাদের সাথে সামাজিকভাবে এলায়েন্স অনুমোদিত সেই বিষয়গুলো।

বংশধারার তাত্ত্বিকদের সাথে লেভিস্ট্রসের পার্থক্য হল এরা মনে করে আদিম সমাজের সামাজিক সংগঠনের মূলে আছে বংশভিত্তিক সংগঠন ও সমাজগুলো বংশভিত্তিক সংগঠনের জন্য টিকে আছে। কিন্তু লেভিস্ট্রস বলেন, বংশভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে নয় বরং একটি বিশেষ ধরণের সম্পর্কের জন্য এটি টিকে আছে যা বিয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ও এর মধ্য দিয়ে আদিম সমাজ টিকে থাকে। বিয়ের মাধমে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে লেভিস্ট্রস বলছেন মৈত্রীবন্ধন বা এলায়েন্স।

আরও বলেন, আদিম সমাজে একটি এলিমেন্টারি স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামো থাকে। অস্ট্রেলীয়, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ ভারতের ও আমেরিকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের মধ্যে এই এলিমেন্টারি স্ট্রাকচার দেখা যায়। এসব অঞ্চলের বিভিন্ন সমাজে যে এলিমেন্টারি স্ট্রাকচার দেখা যায় তা ইউরোপ, আফ্রিকা ও ইনুইতদের সমাজের কমপ্লেক্স স্ট্রাকচার থেকে বিপরীত। যেসব সমাজে কমপ্লেক্স স্ট্রাকচার বিদ্যমান সেসব সমাজের বিবাহ রীতি লেভিস্ট্রসের ভাষায় নেতিবাচক, কারণ সেখানকার নিয়মে আছে কাকে বিয়ে করা যাবে না। আর এলিমেন্টারি স্ট্রাকচারের সমাজে বিবাহ রীতি ইতিবাচক কারণ সেখানে কাকে বিয়ে করা উচিৎ তা ঐ সমাজের নিয়ম দ্বারা বিধিবদ্ধ।

লেভিস্ট্রস এলিমেন্টারি স্ট্রাকচার নিয়ে কাজ অরেন। তার মতে এই স্ট্রাকচার দুই প্রকার। এক প্রকার এলিমেন্টারি স্ট্রাকচারে থাকে দুটো দল, ধরা যাক ক আর খ। এই সমাজের ইতিবাচক বিবাহরীতি অনুযায়ী ক দলের লোকদের খ দলের লোকদেরকে বিয়ে করা উচিৎ। এরকম বিবাহ ব্যবস্থাকে লেভিস্ট্রস বলেন, প্রত্যক্ষ বিনিময় বা ডিরেক্ট এক্সচেঞ্জ। তিনি যাদের মধ্যে গবেষণা করেছেন তারা বিবাহকে একদল হতে আরেকদলে নারী বিনিময় হিসেবে দেখেন। আরেক প্রকার এলিমেন্টারি স্ট্রাকচারে দেখা যায় অপ্রত্যক্ষ বিনিময় বা ইন্ডিরেক্ট এক্সচেঞ্জ। এই ব্যবস্থায় দলের সংখ্যা দুই এর বেশি। বেশি সংখ্যক দল হলে সামাজিক সংহতি ভিন্ন ধরণের বিয়াহ রীতির মাধ্যমে ভিন্নভাবে ঘটে। এখানে ক দলের মানুষের সাথে খ দলের মানুষের বিয়ে করার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু খ দলের মানুষের সাথে ক দলের লোকদের বিয়ে না করে বরং গ দলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। আবার দেখা যায় গ দল বিয়ে করছে ক দলে। এই ইন্ডিরেক্ট এক্সচেঞ্জ ঘটে চক্রাকারে, যার ইতি ঘটেনা।

ক্রস কাজিন বিবাহ ব্যবস্থা অনেক সমাজে প্রচলিত। লেভিস্ট্রস তার এলায়েন্স থিওরি এর প্রেক্ষিতে দাঁড় করান। তিনি মনে করেন নারী বিনিময় ব্যবস্থারই অংশ এই বিবাহ ব্যবস্থা। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ দলগুলো নারী বিনিময়ের মাধ্যমে এলায়েন্স গড়ে তোলে। দুই পরিবার বা দলের মধ্যে নারী বিনিময় আন্তঃনির্ভরশীলতা নিশ্চিত করে। যদি এক দলের সাথে অন্য দলের নারী বিনিময় না করে নিজ দল থেকেই সঙ্গী নির্বাচন করা হত তাহলে এলায়েন্স ও সংহতি তৈরি হত না। বহির্বিবাহ রীতি বা এক্সোগ্যামি পারিবারিক বিনিময় নিশ্চিত করে ও এর মাধ্যমে বৃহত্তম ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্তি সম্ভব হয়। ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী মার্সেল মস অনুসারে লেভিস্ট্রস মনে করেন উপহার বিনিময় হচ্ছে পারস্পরিক আন্তঃনির্ভরশীলতার প্রতীকী রূপ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে পরিবার ও দল অন্য কিছু বনিময় না করে কেন নারী বিনিময় করবে? তার উত্তর ছিল, যদি দুই দলের মধ্যে নারী বিনিময় না হয়ে কোন বস্তুর বিনিময় হত তবে একবার বস্তুর হস্তান্তরিত হবার পর সেই সম্পর্ক চুকে যেত। নারী বিনিময় হলে তা সম্ভব না। বস্তু বিনিময় প্রথার পূর্বে নারী বিনিময় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। লেভিস্ট্রস জ্ঞাতি বা কিনশিপ সম্পর্ককে আরও বেশি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।

সমালোচনা

তবে লেভিস্ট্রসের এই ধারণা সমালোচনার সম্মুখীন হয় –
(১) নৃবিজ্ঞানী লীচ মায়ানমার এ সম্পন্ন করা কাজের ভিত্তিতে বলেন, বিবাহ নীতি ও অর্থনৈতিক বিষয়াদির প্রেক্ষিতে বিচার করা জরুরি।
(২) বিবাহ নীতি ও সংযুক্তকরণের যে আবশ্যিক সম্পর্ক লেভিস্ট্রস দেখেছেন, তাকে প্রশ্নসাপেক্ষ করে তোলেন লুই ডুমো। তিনি বলেন, যদিও দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে লেভিস্ট্রস এলিমেন্টারি স্ট্রাকচার দখেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই নীতির সামাজিক অর্থ সব স্থানের জন্য একরকম নয়।
(৩) স্ট্রাকচারালিস্ট চিন্তার কারণে সামাজিক সম্পর্কগুলো সরলীকৃত ও একরৈখিক হয়ে গেছে।

উত্তর কাঠামোবাদ

ভূমিকা

চিন্তা-ঐতিহ্যের এক পর্যায়ে আধিপত্যবাদী চিন্তাজগতকে প্রতিরােধ করে এমন বিভিন্নরকমের চিন্তাসমূহের উদ্ভব ঘটে। এগুলোতে চিন্তার আদিকল্পকে ভেঙে দিয়ে একক কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে একাধিক কেন্দ্রে বিন্যস্ত করার বহুত্ববাদী স্বরকে সামনে নিয়ে আসা হয়। অনেক আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিক একে চিন্তার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলাকারী তত্ত্ব হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রহী। এ পর্বটির আলােচনাসমূহ উত্তর কাঠামােবাদকে বােঝাবুঝির আলােচনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

মহাদেশীয় দর্শন এবং সমালােচনাপূর্ণ তত্ত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি সাধন করে উত্তর কাঠামােবাদ ধারণাটি আসে যা বিশ শতকে ফ্রান্সে দর্শনের গণআন্দোলনরূপে উদ্ভূত হয়েছিল। ১৯৭০-এর দশকে ফ্রান্সে কাঠামােবাদী তত্ত্বের বিরােধিতা থেকে উৎসারিত এই তাত্ত্বিক ধারা সাহিত্য সমালােচনা এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা বৃহৎ প্রবণতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। উত্তর কাঠামোবাদ বিশ্বের পুরােপুরি সত্য বা পুরােপুরি বাস্তব আবিষ্কারের দাবি প্রত্যাখ্যান করে। আর খুব কম সংখ্যক মানুষই উত্তর কাঠামােবাদীদের মত গ্রহণ করে তার প্রয়ােগ সম্পর্কে সচেতন হয়। এ কারণে কোনাে ব্যক্তি উত্তর কাঠামােবাদের গঠনতত্ত্ব জোরালােভাবে বা সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পারে না। যা উত্তর কাঠামােবাদের প্রকৃত ধারাকে বিবেচনাপূর্বক একক দার্শনিক চর্চার গতিকে বিতর্কিত করে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে এই তত্ত্বটি ইউরােপে অর্থাৎ যেখানে তত্ত্বটির উদ্ভব হয়েছিল সেখানে বিস্তৃতভাবে ব্যবহৃত হয় নি। উত্তর কাঠামােবাদের তাত্ত্বিক ধারা আমেরিকান একাডেমি এবং প্রকাশনার বড় আবিষ্কার। 

কাঠামােবাদের সমালােচনা করে উত্তর কাঠামােবাদী চিন্তার প্রসার ঘটেছে। এর শুরু হয়েছিল ষাটের দশক থেকে। ১৯৬৮ সালের মে মাস ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার, যখন শিক্ষার্থী ও কর্মীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং যে কারণে ফ্রান্স সরকারের পতন ঘটেছিল। সেই সময়ে ফ্রান্স কম্যুনিস্ট পার্টি সোভিয়েত ইউনিয়নের নিষ্ঠুর নীতিগুলাে সমর্থন করেছিল। ফলে ফরাসীদের মধ্যে বিপরীত দর্শনের প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি হয়। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল নারীবাদ, পশ্চিমা মার্ক্সবাদ, ফেনােমেনােলজি এবং নায়ালিজম (Nihilism)। উত্তর কাঠামােবাদের আর্বিভাবের সাথে যাদের নাম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত তারা হলেন রোঁলা বার্থ ও জ্যাক দেরিদা। ১৯৬৬ সালের একটি প্রবন্ধে দেরিদা বলেন, নিৎশেহাইডেগারের দর্শন ও ফ্রয়েডের মনােবিজ্ঞান ছিল আধুনিক যুগের একটি বিশেষ বুদ্ধিবৃত্তিক ঘটনা যেগুলো পূর্বতন ভাবধারা হতে একটি তুমুল বিচ্ছেদ ঘটায় ও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতকে বি-কেন্দ্রীভূত করে। এর পূর্বে যে জ্ঞানগুলো ছিল, যাকে আমরা স্বাভাবিকতার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলাম, এরা তাকেই স্বাভাবিকতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে বিকেন্দ্রিভূত করেছিল। কিন্তু বিশ্বে চূড়ান্ত বলতে কিছু নেই। বিশ্বসংসারে কোনাে সুনিশ্চিত কেন্দ্র নেই। আমরা যেটিতে বসবাস করি সেটি বিকেন্দ্রীভূত এবং আপেক্ষিক। 

৬০ দশকের শেষ দিকে রোলাঁ বার্থের কাজ কাঠামােবাদী হতে উত্তর কাঠামােবাদিতার দিকে মােড় নেয়। ১৯৬৮ সালে বার্থ এর দ্যা ডেথ অফ দি অথর প্রকাশিত হয়। এতে তিনি রচয়িতার মৃত্যুর কথা ঘােষণা করেন। এটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে গ্রন্থের স্বাধীনতা হিসেবে অর্থাৎ, তার মতে কোনাে গ্রন্থ একীভূত নয়। গ্রন্থের পেছনে এর রচয়িতার আসল উদ্দেশ্য কী, তিনি কী বােঝাতে চান, তিনি এতে কী কারিগরি দেখিয়েছেন, এগুলাে দ্বারা সেই গ্রন্থ পরিসীমিত হয়। বার্থের বক্তব্য হচ্ছে, গ্রন্থ এসব সীমার পরিসীমানা হতে মুক্ত, এটি উদ্দেশ্য কিংবা প্রেক্ষিত দ্বারা নির্ধারিত নয়। এ কারণে বার্থ বলেন লেখকের মৃত্যু হল পাঠকের জন্ম। গ্রন্থ রচয়িতার দ্বারা উৎপাদিত এই ধারণা পরিবর্তনের জন্ম দেয়। পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য চিন্তকগণ উত্তর কাঠামােবাদী ভাবনাকে আরাে এগিয়ে নেন। আরাে কঠোরতা দান করেন। উদাহরণস্বরূপ বারবারা জনসন এর মতামত তুলে ধরা যায়, যিনি বলেন বিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশন হচ্ছে গ্রন্থীয় ক্ষমতার সূত্রের নিষ্ঠাবান অনুসন্ধান ও খুলে ফেলা। উত্তর কাঠামােবাদীরা বলেন যে, আত্ম বিষয়টি হল এমন একটি বিষয় যা একজন ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। এর কারণে কোনাে ব্যক্তি বা পাঠক যদি কোনাে বই পড়েন তাহলে সেই বইয়ের ব্যাখ্যাকে সে দাঁড় করাবে তার নিজস্ব ধারণার ওপরে যেহেতু ব্যক্তিগত জ্ঞান মানুষকে প্ররােচিত করে। আর এ কারণেই একজনের ব্যাখ্যা মূলত তার ব্যক্তিগত ধারণারই বহিঃপ্রকাশ।

মূলত লেখক যে অর্থে লেখেন পাঠকের কাছে তা স্ব-অবস্থানে না থেকে নতুন অবস্থানে আত্মপ্রকাশ করে। এ কারণেই উত্তর কাঠামােবাদীরা একটি গ্রন্থের একমাত্র উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করেছেন। পাশাপাশি তারা গ্রন্থের একমাত্র অর্থ অথবা একমাত্র বিষয়কেও অস্বীকার করেছেন। তারা এও দেখিয়েছেন একেকজন পাঠক একটি গ্রন্থের পৃথক পৃথক উদ্দেশ্য, অর্থ এবং বিষয়কে খুঁজে পায়। উত্তর কাঠামােবাদী সমালােচনায় অবশ্যই একটি গ্রন্থের নানামুখী সমালােচনা থাকবে, এমনকি যদি সমালােচনাগুলাে পারস্পারিক সাংঘর্ষিকও হয় তাহলেও। এই ধরনের বহুমুখী সমালােচনা একটি গ্রন্থ বিশ্লেষণের জন্য এ কারণে জরুরি যে গ্রন্থটি কীভাবে একেকটি বিষয়ের সাথে একেকভাবে জড়িত হয় এটি তার ব্যাখ্যা দেয়। কাঠামােবাদ এবং উত্তর কাঠামােবাদকে অধ্যয়নের মাধ্যমে এদের পার্থক্যগুলাে পরিষ্কার হয়। পার্থক্য নির্ণয়ের কাজের মাধ্যমে কাঠামােবাদ এবং উত্তর কাঠামােবাদের ধারা সমূহকে চিহ্নিত করা যায়। 

কাঠামােবাদ চালিত হয় ভাষাতত্ত্ব থেকে। ভাষাতত্ত্ব জ্ঞানের সেই ব্যাখ্যা যা বাস্তব জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সহজাতভাবে আত্মবিশ্বাসী। এটি মনে করে, যদি সঠিকভাবে প্রত্যক্ষণ করা হয় এবং নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং যুক্তিসম্মত মতবাদ দেয়া হয়, তবে পৃথিবীর ভাষাগুলাে সম্পর্কে বিশ্বাসযােগ্য সিদ্ধান্তে পৌছানাে যাবে। কাঠামােবাদ একে পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিকরূপ দেয় যা পদ্ধতি, নিয়ম এবং কারণের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বাসযােগ্য সত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। কাঠামােবাদী তত্ত্বের আরেকটি দিক হল যে ভাষাকে কাঠামােকৃত এবং আয়নার মত স্বচ্ছ একটি মাধ্যম হিসেবে বিশ্বাস করা। অপরপক্ষে উত্তর কাঠামােবাদ চালিত হয় দর্শন থেকে। দর্শন জ্ঞানের সেই ব্যাখ্যা যা সবসময় বিভিন্ন বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জনকে জোরালােভাবে তত্ত্বাবধান করে। উত্তর কাঠামােবাদীরা আরাে মনে করে, ভাষাকে কখনও কাঠামাে প্রদান করা সম্ভব নয়। কারণ ভাষা হচ্ছে কল্পনার একটি বাস্তবতা। কাঠামােবাদীগণের লিখন বিমূর্ত ও স্বাভাবিকরণের প্রতি উদ্দেশ্য করে প্রতীয়মান। তারা মনে করে যে, প্রথা, রীতি, লিখন সংক্রান্ত বিষয়াবলি বিচ্ছিন্ন হলেও এরা প্রতিটি কাঠামাে দ্বারা নির্মিত এবং এদেরকে এর বাইরে কখনও ফেলা যাবে না। অপরদিকে উত্তর কাঠামােবাদীদের কাছে লিখন হল আবেগময়, যা আত্মসচেতনতা সৃষ্টি করে। তারা আবেগময়তা ও মানবতাকে কখনও কোনাে কাঠামাের মধ্যে আনেন নি। তাদের মত অনুযায়ী, স্বরভঙ্গি রীতি ও প্রথা ক্ষেত্র বিশেষে ও উচ্চারণের ভিন্নতার কারণে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে, যা কখনও কাঠামােকৃত করা সম্ভব নয়। 

উত্তর কাঠামােবাদকে বােঝা যেতে পারে কাঠামােবাদের বিরােধিতাকারী একটি অবস্থা হিসেবে। কাঠামােবাদ সংস্কৃতির উপাদানসমূহকে দৃঢ়সংলগ্ন করে একটি কাঠামাের ভেতর আলােচনা করে এবং ভাষাতত্ত্ব, মনােবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের বিশ্লেষণাত্মক ধারণাকে কাজে লাগিয়ে তা কাঠামাের ভেতর বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। উত্তর কাঠামােবাদীরা মনে করেন যেকোন একটি সংস্কৃতিকে কাঠামাে দেয়ার চেয়ে ঐ সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা ও গভীর অনুসন্ধান করা অনেক বেশি সহজ ও স্বতঃসিদ্ধ। তারা বলেন, সংস্কৃতির কোনাে একটি বিষয়কে বুঝতে হলে ঐ বস্তুটি, ঐ বস্তুর অবস্থান, অধ্যয়ন করার পদ্ধতি, এর সবগুলাে অর্থকে অবশ্যই ধারণার মধ্যে রাখতে হবে। অর্থাৎ ‘যা বলা হয়েছে এবং যা বলা হয় নি’ উভয়ের ডিসকার্সিভ প্রকাশ ঘটাতে হবে। উত্তর কাঠামােবাদীদের মতে, যেহেতু কোনাে কতৃত্বপূর্ণ কেন্দ্র নেই সেহেতু এই জগতে কোনাে সত্য নেই, আছে কেবলমাত্র ব্যাখ্যা।

রোলাঁ বার্থ ও রচয়িতার মৃত্যু

সংক্ষিপ্ত পরিচয়

রোলাঁ বার্থের (Roland Barthes, ১৯১৫-৮০ খ্রি.) প্রায় প্রতিটি কাজ ও লেখা কোনাে না কোনাে দিক থেকে বির্তকের সৃষ্টি করেছে; আমাদের ছকে বাধা চিন্তার জগতে ঝড় তুলেছে; সাজানাে গােছানাে চিন্তার পদ্ধতিকে আঘাত করেছে; ভেঙে দিয়েছে। বার্থকে নিয়ে চিন্তা করতে হয়, বির্তক করতে হয় কিন্তু এক বাক্যে হ্যাঁ বাচক বা না বাচক কোনাে বক্তব্যে পৌঁছানাে যায় না। রোঁলা বার্থ নরম্যান্ডির একটি শহর শেরবুর্গ-এ ১৯১৫ সালের ১২ নভেম্বরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা নৌ কর্মকর্তা বাবা লুই বার্থ এবং মা আঁরিয়েৎ বার্থে। জন্মের এক বছরের মধ্যেই তার বাবা মারা যায়। ফ্রান্সের বাইয়ন শহরে রোলাঁ বার্থ তার মা, মামী ও মাতামহীর কাছে বড় হন। পরে তিনি তার মার সঙ্গে প্যারিসে চলে আসেন। কিন্তু সারা জীবনই প্রাদেশিক শেকড়ের সঙ্গে একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে বার্থের। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে ছাত্র হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিলেও তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য পড়ালেখায় বিস্তর ক্ষতির সম্মুখীন হন। ১৯৪৮ সাল থেকে ফ্রান্স, রােমানিয়া, এবং মিশরের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে স্বল্প মেয়াদে চাকরি করেন। এর মধ্যে তিনি তার লেখা চালিয়ে যান। ১৯৫২ সালে তিনি জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের হয়ে লেক্সিকোলজি ও সমাজতত্ত্বে অধ্যয়ন করেন।

ষাটের দশকের গােড়ার দিকে বার্থ চিহ্নবিজ্ঞান এবং কাঠামােবাদ নিয়ে বিস্তর গবেষণায় নিয়ােজিত হন। তার প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাধারার কারণে আরেক ফরাসি চিন্তাবিদ রেমন্দ পিকারের সঙ্গে বিরােধে জড়িয়ে পড়েন। ষাটের দশকের দিকে রোলাঁ বার্থের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জনহপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে তার বিখ্যাত প্রবন্ধ দ্যা ডেথ অফ দি অথর পাঠ করেন। ১৯৭৭ সালে তাকে কলেজ ডি ফ্রান্স এর একটি বেশ সম্মানজনক পদের জন্য মনােনীত করা হয়। ১৯৮০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে লন্ড্রি ট্রাক তাকে ধাক্কা দেয় এবং আঘাতজনিত কারণেই ঐ বছরের ২৫ মার্চ তিনি মৃত্যু বরণ করেন। 

চিহ্ন নিয়ে সস্যুরের মতের সম্প্রসারণ, ডিনোটেশন-কনোটেশন

বার্থের লেখার সংখ্যা অজস্র নয়। কিন্তু তার লেখার বিষয়গত বিস্তার এবং ভাবনার গভীরতা দীর্ঘ আলােচনার দাবি রাখে। বার্থের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে রূপ নিয়েছে ৬০ এর দশকের শুরুতে। কাঠামােবাদী হলেও শেষের দিকে এসে তা উত্তর কাঠামােবাদে রূপ নিয়েছে। তার তাত্ত্বিক ভাবনায় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলেও তার মনােযােগ ছিল অপরিবর্তিত। তিনি ভাষা এবং সামাজিক জগতের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং এ দুই বিষয়ের মধ্যে সাহিত্যিক ফর্মের মধ্যস্থতা করতে চেয়েছেন। 

বার্থের ভাষা ও চিহ্ন নিয়ে কাজকে তার কাঠামােবাদী তাত্ত্বিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরা হয়। সস্যুরের সেমিওলােজি বা চিহ্নবিজ্ঞান ধারণার বাস্তব আকৃতিদানে এবং এর তাত্ত্বিক সম্প্রসারণে বার্থ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বার্থ সাংস্কৃতিক অনুশীলনে ভাষা মডেলকে প্রয়ােগ করার প্রতি বেশি মনােযােগী ছিলেন কিন্তু শব্দ কীভাবে চিহ্ন হিসেবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা দানে সচেষ্ট ছিলেন না। বার্থের সেমিওটিক্স পদ্ধতি সস্যুরের তত্ত্বের তুলনায় অনেক বেশি সরল কেননা তা ব্যাখ্যা দানের ক্ষেত্রে প্রায়ােগিক ছিল। সস্যুর দ্যোতক ও দ্যোতিতের সংযুক্তিকে চিহ্ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বার্থ সবসময় চিহ্নের বৃহৎ অর্থকে খুঁজে ফিরতেন। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, সস্যুরের চিহ্নের তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা “জিন্স” শব্দটির দ্বারা “জিন্স” নামে একটি পোশাকের কথা ভাবি, শব্দটি একটি বিশেষ পোশাককেই ইঙ্গিত করে। কিন্তু রোলাঁ বার্থ বলছেন, “জিন্স” শব্দটি কেবল মাত্র বিশেষ পোশাককেই ইঙ্গিত করছে না। শব্দটিকে একটি বিশেষ পোশাক হিসেবে চেনার পরও আমাদের মনে জিন্স এর একটি সামাজিক ধারণা ভেসে ওঠে, আমরা জিন্সকে কল্পনা করছি পোশাকের একটি অনানুষ্ঠানিকতার উদাহরণ হিসেবে, যেকারণে আমরা আনুষ্ঠানিক কোন কাজের ক্ষেত্রে জিন্স পরিধান করিনা। অর্থাৎ “জিন্স” শব্দটি যে চিহ্ন হিসেবে কাজ করছে তা মেনে নেয়ার পরও আমরা দ্বিতীয় একটি বিস্তৃত পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছি, যা এই চিহ্নকে বিস্তৃত পরিসরে একটি সাংস্কৃতিক অনুশীলন, ধারণা বা অর্থের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বার্থ এভাবে চিহ্নকে দুটো পর্যায়ে ভাগ করলেন। সস্যুরে যা বলেছিলেন, অর্থাৎ চিহ্নের প্রাথমিক বর্ণনাধর্মী পর্যায়টিকে বার্থ চিহ্নিত করলেন ‘ডিনােটেশন’ হিসেবে এবং দ্বিতীয় পর্যায়টিকে, যার মাধ্যমে জিন্স এর সাংস্কৃতিক-সামাজিক অর্থ পরিষ্কার হয় তাকে বার্থ চিহ্নিত করেন ‘কনােটেশন’ হিসেবে। উভয়ক্ষেত্রেই চিহ্নের ব্যবহার করার প্রয়ােজন রয়েছে। বার্থের মতে ডিনােটেশন হল সাধারণ, মৌলিক এবং বর্ণনাধর্মী পর্যায়। এখানে মতৈক্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বেশিরভাগ মানুষই অর্থটির ব্যাপারে একমত যেমন, পােশাক জিন্স। কনােটেশনের পর্যায়ে প্রথাগত পােশাকের ধারণাগত শ্ৰেণীকরণকে ব্যবহার করে অর্থ পাঠ ও দ্যোতকের সঙ্কেতােদঘাটন করা হয় এবং দ্বিতীয় ধরনের বৃহত্তর সংকেতলিপিতে প্রবেশ করা হয়, এখানে ফ্যাশনের ভাষা সামনে চলে আসে যা পোশাককে সংযুক্ত করে বৃহত্তম থিমে এবং অর্থের সঙ্গে। সেই সাথে এটি সংযুক্ত করে আমাদের সংস্কৃতির বৃহত্তর শব্দবিজ্ঞান জগতের আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক ধারণাগুলাের সঙ্গে। এ দ্বিতীয় বৃহত্তর অর্থ এখন আর কেবল বর্ণনাভিত্তিক ব্যাখ্যার পর্যায়ে নেই। এখানে আমরা সম্পূর্ণ চিহ্নকে সামাজিক আর্দশের বিস্তৃত আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করছি। এ আদর্শগুলাে হল, সাধারণ বিশ্বাস, ধারণাগত কাঠামাে ও সমাজের মূল্যবােধ পদ্ধতি। তিনি আরাে বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ের দ্যোতনায়ন হল অধিক সাধারণ, বৈশ্বিক ও বিস্তৃত । এটা কাজ করে আদর্শের খণ্ডসমূহ নিয়ে। এই দ্যোতিত সমূহের সংস্কৃতি, জ্ঞান, ইতিহাসের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রয়েছে।

রোঁলা বার্থ যখন তার প্রবন্ধ সংগ্রহ মিথােলজিস (১৯৭২)-এ ‘কুস্তির দুনিয়া’ ‘সােপ পাউডার ও ডিটারজেন্ট’, ‘গ্রেটা গার্বোর মুখ’, ‘ইউরােপের ব্লু-গাইড’ এবং ‘পানজানি’র বিজ্ঞাপন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করলেন তখন তিনি সেমিওটিক এপ্রােচে জনসংস্কৃতি নিয়ে অধ্যয়ন করলেন ও এর ব্যাখ্যা করলেন। তিনি এইসব ক্রিয়াকাণ্ড ও বিষয়কে চিহ্ন হিসেবে উপস্থাপন করলেন যে চিহ্নের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চারিত হয় এবং অর্থ তৈরি প্রক্রিয়া বিশ্লেষিত হয়। ‘কুস্তির দুনিয়া’ এর উদাহরণ দেয়া যাক। আমরা প্রায় সবাই মনে করি যে কুস্তি হল প্রতিযােগিতামূলক খেলা যেখানে একজন হারবে তাে অন্যজন জিতবে। বার্থ কিন্তু এসবে আগ্রহী নন, তিনি জানতে চান না কে জিতলাে। তিনি বরং জানতে চান যে এই খেলার মানে কী। তিনি একে পাঠ করেছেন ও বিবেচনা করেছেন একটি পাঠ্য হিসেবে। তিনি একে পাঠ করেছেন কুস্তিগীরের ক্রিয়াকলাপ হিসেবে যা একটি বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষার জন্ম দিচ্ছে। প্রতিযােগিতাটি সাজানাে কিনা তাতে আমরা মাথা ঘামাই না, আমরা হারিয়ে যাই তামাশার মূল বৈশিষ্ট্যে, কার মতলব কী, কিসের পরিণতি কী, এ সবে আমাদের কোনাে আগ্রহ থাকেনা, আমরা আসলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিযােগিতাটির তাক লাগানাে চরিত্রে ভেসে যাই কেননা ভেল্কি, আলাের কারসাজি, নিয়ম মানার অভিনয় আমাদের মনে করিয়ে দেয় সার্কাস, গ্রিক ড্রামা, ষাড়ের লড়াই ইত্যাদিকে। এজন্য বার্থ বলেন, এমন অনেকে আছে যারা মনে করে কুস্তির কোনাে অন্ত-অর্থ নেই। কুস্তি আসলে আতিশয্যের জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী।

বার্থের আরেকটি বিখ্যাত অর্থ নির্মাণের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে চিহ্ন তত্ত্বের ব্যবহার সংক্রান্ত উদাহরণ হলো তার পানজানি বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ, যা বার্থের রেটরি অব দ্যা ইমেজ প্রবন্ধে আলােচিত হয়েছে। পানজানি বিজ্ঞাপন সম্পর্কে বার্থ সেখানে লেখেন, এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি কয়েক প্যাকেট পাস্তা, একটি টিন, একটি স্যাশে (ছােট মসলার প্যাকেট), কিছু টমেটো, পেঁয়াজ, পেপার, মাশরুম সবই একটি অর্ধ-খােলা সুতলির ব্যাগ থেকে বের হয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে লাল ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর হলুদ, সবুজের ছড়াছড়ি। বার্থ এখান থেকে বার্তা উদ্ধারের চেষ্টা করেন। ইমেজের প্রথম বার্তা হচ্ছে ভাষাগত, ক্যাপশন এবং লেবেল থেকে তা ফুটে ওঠে। বার্তাটি যে সংকেত থেকে নেয়া তা ফরাসি ভাষার, ফরাসি ভাষা জানা থাকলে যে কেউ এর অর্থ বুঝতে পারবে। কিন্তু বার্তাটিকে ভাঙলে দেখা যায় পানজানি চিহ্নটি কেবলমাত্র ফার্মের নামকে প্রকাশ করে না, এটা ফরাসিদেরকে একটি অতিরিক্ত দ্যোতনা দেয়। সেটা হচ্ছে, ইতালীয়ত্ব বা ইতালীয়। সুতরাং বিজ্ঞাপনটির অর্থ দুটো। ডিনােটেশনাল অর্থে এটি হলো পানজানি, আর কনােটেশনাল অর্থে এটি হলো ইতালীয়তা। ভাষাগত বার্তা ছাড়াও বার্থের মতে বিজ্ঞাপনটির রয়েছে ইমেজীয় বার্তা যা আমাদের কতগুলাে অ-ধারাবাহিক চিহ্নের একটি সারিবদ্ধ সাংস্কৃতিক জ্ঞান দান করে –

  • প্রথমত, যেহেতু বিজ্ঞাপনে পণ্যগুলাে এলােমেলাে অবস্থায় রয়েছে তাই দৃশ্যটি রেপ্রিজেন্ট করে মার্কেটিং শেষে মাত্র বাড়ি ফেরার বিষয়টিকে অর্থাৎ ইঙ্গিত করে দুটি সুখানুভূতিকে – এক. দ্রব্যের তরতাজা অবস্থা, দুই. যা ঘরের জন্য কেনা। বার্থ বলেন, এই চিহ্ন ফরাসি সংস্কৃতির যান্ত্রিকতা (প্রক্রিয়াজাত, ফ্রিজে খাবারদাবার রাখার অভ্যাস), দ্রুত জীবন যাপনের বিপরীত অবস্থাকে প্রকাশ করে। 
  • দ্বিতীয়ত, টমেটো, পেপার এবং পােস্টারের তিন রঙের সমাহারে দ্যোতনা হচ্ছে ইতালীয়ত্ব। 
  • তৃতীয়ত, বিভিন্ন জিনিসের এই লাগালাগি সংগ্রহ একটি সামগ্রিক রন্ধনােপযােগী সেবার ধারণা দেয়। মনে হতে পারে পানজানি যত্ন করে ব্যালেন্স ডায়াটের জন্য প্রয়ােজনীয় সকল কিছু সরবরাহ করে, আবার এও মনে হতে পারে পানজানি প্রাকৃতিক উপাদানের সমার্থক। 
  • চতুর্থত, ইমেজটির দ্যোতনা নন্দনতাত্ত্বিক, যেন একটি স্টিল লাইফ পেইন্টিং।

বার্থ ইমেজ প্রসঙ্গে আরাে বলেন, ইমেজের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের ধারা প্রচলিত। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য একটি হচ্ছে ইমেজ শুধুমাত্র যাপিত জীবনই নয়। চূড়ান্ত অর্থে ইমেজ যাপিত জগতের রেপ্রিজেন্টেশন। তাই এর অর্থময়তার ক্ষমতা দুর্বল। বার্থ আরাে বলেন, এই দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকেই মনে করেন যে ইমেজের তুলনায় ভাষা অনেক বেশি শক্তিশালী। এই চিন্তার বিপরীত পক্ষও রয়েছে। তারা মনে করে ইমেজের অনেক বেশি নাড়া দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। বার্থের প্রশ্ন হল, ইমেজের ভেতরে অর্থের অনুপ্রবেশ কীভাবে ঘটে, এবং এর শেষ কোথায়। যদি এর শেষ থেকেই থাকে তাহলে তারপরে কী আছে। এইসব জিজ্ঞাসার অর্থ খুঁজতেই বার্থ বিজ্ঞাপনের ইমেজ পাঠে মনােযােগ দেন। প্রশ্ন হতে পারে কেনাে বিজ্ঞাপনের ইমেজ। এর উত্তর দিতে গিয়ে বার্থ বলেন, তার কারণ ইমেজের অর্থ উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে ইচ্ছাকৃত, দ্রব্যের গুণাবলি প্রকাশের লক্ষে বিজ্ঞাপনের বার্তা চিহ্ন গঠিত, বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে এইসব দ্যোতনাগুলােকে প্রকাশ করা। যদি ইমেজে চিহ্ন থাকে তবে বিজ্ঞাপনে তা অনেক বেশি ব্যবহৃত হবে। বিজ্ঞাপনের ইমেজ অকপট এবং দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত হয়। এভাবে বার্থ চিহ্নকে নিয়ে চিন্তার জগতে খেলা করেছেন, তাত্ত্বিকতায় পূর্ণ ভাবনাগুলােকে বাস্তব উদাহরণের মিশেলে প্রকাশ করেছেন আর ভাবিয়েছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চিন্তকদের।

১৯৬৭ সালে বার্থের লেখা এলিমেন্টস অব দ্যা সেমিওলজি তে তার ভাবনা জগতের পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। এখানে তিনি উল্লেখ করেন, কাঠামােবাদী পদ্ধতি মনুষ্য সংস্কৃতির সকল চিহ্ন ব্যবস্থার ব্যাখ্যাদান করতে পারে। সাথে সাথে তিনি কাঠামােবাদকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আওতাভুক্তও করেন। তিনি বলেন কোনাে ভাষাই ডিসকোর্স বহির্ভূত নয়। এমন কোনাে মহাভাষা, বা এমন কোনাে অবস্থান নেই যা পরীক্ষা বা বিশ্লেষণ বহির্ভূত। সকল ডিসকোর্সে জটিল ব্যাখ্যাও অন্তর্ভুক্ত যা সমানভাবে কল্পিত। কোনাে কিছুকেই একেবারে সব থেকে আলাদা বা সত্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়না।

বার্থের উত্তর কাঠামোবাদ

রোলাঁ বার্থের শেষের দিকের লেখনী ও চিন্তায় উত্তর কাঠামােবাদী ধারণার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রামান্য দলিল হচ্ছে দ্যা ডেথ অফ দি অথর নামক প্রবন্ধটি। তিনি এ প্রবন্ধে সমালােচনা, সমালােচক, রচনা, রচয়িতা প্রভৃতি বিষয়গুলাের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক এবং একটি বিষয়ে আরেকটি বিষয়ের ভূমিকা ইত্যাদির মত জটিল ভাবনাগুলােকে জড়াে করেছেন। খােদ বার্থ সমালােচক হিসেবে উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী এবং সৃষ্টিশীলতায় অতুলনীয় ছিলেন। রোলাঁ বার্থের প্রবন্ধ সংকলনের ভূমিকায় সুজান সন্ট্যাগ লেখেন, বার্থ সবসময় অনুসন্ধান করেছেন অন্য অর্থ, ভিন্ন অর্থ। বার্থ প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের কাজকে সামলােচনা করলেও তার পছন্দের কাজ ছিল প্রান্তিক সাহিত্যের প্রতি মনােযােগী হওয়া। তিনি আরাে মনে করতেন আপাতদৃষ্টিতে যা গুরুত্বহীন তা অদ্ভুতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হতে পারে। বার্থের মতে টেক্সট হিসেবে বিবেচিত হওয়া মানে প্রথাগত বিভেদ অর্থাৎ বড় সাহিত্য এবং ছােট সাহিত্যের মধ্যকার পার্থক্যকে উপেক্ষা করা এবং প্রতিষ্ঠিত শ্রেণীকরণের (শিল্প কলার মধ্যে বিদ্যমান শুচিবায়ুগ্রস্ততা) বিনাশ করা। সন্ট্যাগ আরাে বলেন, বার্থের দৃষ্টিতে সমালােচকের কাজ হচ্ছে আলােচিত পাঠ্যের বার্তার পুনর্গঠন নয় বরং সেটির ব্যবস্থা, কাঠামাের পুনর্গঠন। এর ফলে যা সবাই দেখে তা এড়িয়ে ভিন্ন পাঠ উপস্থাপন করা সম্ভব হয়। বার্থ বিশ্বাস করতেন, এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে মুক্তি লাভ সম্ভব। কেননা বার্থ মনে করতেন ফ্রান্সের ভাষা ও সাহিত্যের মনােভঙ্গি ঐতিহাসিক যা ঐ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রতিপালিত হয় এবং তিনি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধেও ছিলেন। এ প্রসঙ্গে বার্থ বলেন স্বাভাবিক ও নিরপেক্ষ বলে ধরে নেয়া মানদণ্ডগুলাে মােটেও স্বাভাবিক বা নিরপেক্ষ নয়। এমন কোনাে ফর্ম বা ঢঙের লেখা নাই যা লেখকের সাজেক্টিভিটি থেকে মুক্ত। লেখা সর্বদা সামাজিক এবং মতাদর্শিক মূল্যবােধে ভরপুর থাকে; ভাষা কখনই নির্দোষ নয়।

এখন আসা যাক রচয়িতার মৃত্যু ও ডেথ অফ দি অথর এর প্রসঙ্গে। প্রবন্ধটিতে বার্থ রচয়িতার রচনার অর্থ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তার আত্মপরিচয়ের বিভিন্ন দিকগুলাে যেমন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ধর্ম, মনস্তত্ত্ব বা অন্য কোনাে ব্যাক্তিগত বা জীবনীমূলক নানান দিক বিবেচনায় নেবার পাঠকদের প্রবণতার সমালােচনা করেন। বার্থ মনে করেন এটি পাঠের একটি গতানুগতিক এবং প্রথাগত পদ্ধতি যা মূলত ত্রুটিপূর্ণ এবং এলােমেলাে। তার মতে রচনা হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ সমন্বিত পরিসর যেখানে আমাদের সত্তা পথ হারায়। এখানে পরিচিতি বিয়ােগ হয় যা শুরু হয় রচয়িতার সত্তা দিয়ে। রচনা হচ্ছে প্রতিটি কণ্ঠস্বর, প্রতিটি উৎসের বিনাশকারী। বার্থ বলেন বাস্তবের ওপর প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়ারত (যেমন পূর্বদিকে সূর্য ওঠে) এমন বিষয় ছাড়া আর সকল কিছুর ক্ষেত্রে সংযােগবিঘ্নতা ঘটে, কণ্ঠস্বর তার উৎস হারায়, রচয়িতার মৃত্যু ঘটে, রচনা শুরু হয়। বার্থের মতে, এথনােগ্রাফিক সমাজে কখনােই একজন মানুষ একটি বয়ানের দায়বদ্ধতা গ্রহণ করে না, অর্থাৎ কেউই সেই বয়ানের প্রকৃত সৃষ্টিকারী নন, বরং তিনি সেই বয়ানের মধ্যস্থতাকারী বা বর্ণনাকারী হতে পারেন, যার কথার গুণপনায় মানুষ মুগ্ধ হতে পারে। এজন্য বার্থ মনে করেন কোনাে পাঠ বা টেক্সট একজন রচয়িতাকে আরােপ করা, অর্থাৎ একটি পাঠ বা টেক্সটকে তার রচয়িতা থেকে উৎসারিত বা রচয়িতারই বিষয় বলে দাবি করা যায়না। আর পাঠকে একটি একক যথােপযুক্ত ব্যাখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়ার মানে হচ্ছে একে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। বার্থ বলেন রচয়িতা বা অথর হচ্ছে পশ্চিমা সমাজে উৎপাদিত একটি আধুনিক চরিত্র যা মধ্যযুগে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ, ফরাসি যুক্তিবাদ এবং পুনর্গঠনের ব্যক্তিক বিশ্বাসের পরিসরে আবির্ভূত হয়।

সাহিত্যে, ইতিহাসে, লেখকের জীবনীতে, ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকারে কর্তৃত্ব হচ্ছে রচয়িতার। রচয়িতার মধ্যেও এ প্রবণতা দেখা যায়, তারা আত্মজীবনের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিসত্তাকে তাদের কাজের সঙ্গে একীভূত করার জন্য আগ্রহী হতে থাকে। সাধারণ সংস্কৃতিতে সাহিত্যের যে ইমেজ পাওয়া যায় সেটি স্বৈরাচারীভাবে রচয়িতা, তার ব্যক্তিসত্তা, তার জীবন, তার রুচি, তার আবেগ-অনুভূতিতে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং সমালােচনার পরিধির বিষয়গুলােকে ঘিরে রাখে। বােদলেয়ারের কাজে আমরা পাই মানুষ হিসেবে বােদলেয়ারের ব্যর্থতা, একইভাবে বলা যায় ভ্যান গগের উন্মাদনার কথা। বার্থ বলেন, যে নারী বা পুরুষ কাজ করেছে তার মধ্যেই খােঁজা হয় কাজটির শিল্প সাহিত্যিক ব্যাখ্যাটি। বিষয়টা এমন যেন এখানেই ব্যাখ্যার পরিণতি, যেন কথাসাহিত্য একটি স্বচ্ছ মাধ্যম। রচয়িতার কণ্ঠ হচ্ছে শুধুমাত্র একজন মানুষের, যিনি নিরন্তর তার কাহিনী শােনাচ্ছে। বার্থ বলেন, ফ্রান্সে ম্যালারমেই প্রথম লক্ষ করেন যে, জরুরি হচ্ছে ব্যক্তিমানুষের স্থানে ভাষাকে স্থান দেয়া। ম্যালারমে বলেন যে ব্যক্তি কর্তা নয়, কর্তা হচ্ছে ভাষা। বার্থ বলেন, ম্যালারমের দৃষ্টিতে রচয়িতা নয়, বরং ভাষাই কথা বলে। রচনার অর্থ হচ্ছে সেই বিন্দুতে পৌঁছানাে যেখানে ভাষা ক্রিয়া করে, ভাষা পারফর্ম করে, রচয়িতা নয়। বার্থ বলেন, একটি গ্রন্থ এক সারি শব্দ না, বরং গ্রন্থ হচ্ছে একটি বহু কোণাবিশিষ্ট পরিসর যেখানে থাকে বিবিধ রচনা যার কোনােটিই মৌলিক নয়, তারা মিশে যায় এবং সংঘাত করে। গ্রন্থ হচ্ছে সংস্কৃতির বিভিন্ন কেন্দ্র হতে সংগৃহীত এক রাশ উদ্ধৃতি। রচয়িতা শুধুমাত্র একটি কাজই করতে পারেন, পূর্ববর্তী কোনাে ঘটনাকে নকল করতে পারেন।

বার্থ মনে করেন পাঠককে অবশ্যই একটি সাহিত্যিক পাঠ থেকে তার স্রষ্টাকে পৃথক করতে হবে ব্যাখ্যামূলক উৎপীড়ন থেকে সেটাকে মুক্তি দেবার জন্য। কেননা প্রতিটি রচনা অনেকগুলাে স্তর ও অর্থ বিশিষ্ট। একটি রচনার মর্মার্থ নির্ভর করে পাঠকের ওপর বিস্তার করা তার প্রভাবের ওপর, রচিয়তার তীব্র আবেগ বা রুচির ওপর নয়। রচয়িতা নেহাতই একজন লিপিকার (বার্থ এখানে রচনা ও রচয়িতার মধ্যকার প্রতিনিয়ত যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হয় তা ধ্বংস করার জন্য লিপিকার শব্দটি ব্যবহার করেছেন)। তিনি তার সৃজনশীল প্রভাবের আকর্ষণবিন্দু নন। লিপিকার রয়েছেন শুধু রচনাটি প্রস্তুত করার জন্য তা ব্যাখ্যা করার জন্য নয়। প্রতিটি পূর্ণপাঠের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি গ্রন্থ চিরন্তনভাবে এখানে এবং এক্ষুণি লেখা হয়েছে বলে মনে হবে, কারণ অর্থের উৎস পুরােপুরি রয়েছে ভাষার ভেতর এবং তা নির্ভরশীল পাঠকের ওপর তার অন্তর্মুদ্রার ভেতর। কিন্তু সমালােচকগণ রচয়িতাকে আবিষ্কারের কাজটি অবিরাম করে যাচ্ছেন। কেননা তারা মনে করেন রচয়িতাকে পাওয়া গেলেই রচনার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। এ কারণেই বার্থ বলেন ঐতিহাসিকভাবেই রচয়িতার যুগ সমালােচকেরও যুগ। তিনি বলেন লেখার অর্থোদ্ধারের কিছু নেই, প্রতিটি বিন্দুতে কাঠামাে অনুসরণ করা যায়, প্রতিটি পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করা যায়, কিন্তু এর নিচে কিছু নেই। লেখার ওপর ঘুরে বেড়ালে তা থেকে কিছু বের করা যাবে না, অনেক ব্যাখ্যা প্রস্তাব করা যাবে আবার তা খারিজও করে দিতে হবে। একটি সাহিত্য সত্যিকার অর্থে একটি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড ঘটায় যখন তা একটি গােপন এবং চূড়ান্ত অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়।

বার্থ মনে করেন, লেখক ঠিক কী বলতে চেয়েছে সেটা আমরা সঠিকভাবে কীভাবে নির্ণয় করতে পারি তা আমরা জানি না। এই মতটি তিনি প্রবন্ধের শুরুতেই তুলে ধরেছেন, অঁরে দ্য বালজাকের গল্প সারাসিন, যেখানে প্রধান চরিত্র পুরুষ একজন খােজাকে নারী ভেবে তার প্রতি প্রণয়াসক্ত হন। সেখানে পুরুষটি সেই নারীর কল্পিত নারীত্ব নিয়ে ভাবনায় মশগুল হয়, তখন কথাগুলাে কে বলছে, কিসের ভিত্তিতে বলছে তা নির্ণয়ের চ্যালেঞ্জ জানান বার্থ। কে বলছে এভাবে? সেই নারীর পেছনে লুকিয়ে থাকা খােজা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে বদ্ধপরিকর নায়ক? নাকি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নারীবিষয়ক এক দর্শন লাভকারী ব্যক্তি বালজাক? অথবা নারীত্ব সম্পর্কে সাহিত্যিক ধারণা প্রদানকারী লেখক বালজাক? নাকি সার্বজনীন প্রজ্ঞা, রােমান্টিক এক মনস্তত্ত্ব? কখনােই জানতে পারব না আমরা। লেখা “প্রতিটি কণ্ঠস্বরের ধ্বংস” এবং কোনাে নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বা দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ থাকতে অস্বীকৃতি জানায়। এ আলােচনার সূত্র ধরেই বার্থ গ্রিক ট্রাজেডির কথা বলেন। তার মতে, এটি গতানুগতিকভাবে দ্ব্যর্থক যেখানের প্রতিটি চরিত্র একতরফাভাবে বােঝে এবং এই সারাক্ষণ ঘটতে থাকা ভুল বােঝাবুঝিই হচ্ছে ট্রাজেডি। কিন্তু এই ট্র্যাজেডিতে এমন একজন থাকে যিনি প্রতিটি শব্দের দ্বৈততা বােঝেন, তার সামনের কথা বলতে থাকা চরিত্রগুলাের না শুনতে পাওয়া তিনি ধরতে পারেন। আর তিনি হচ্ছেন পাঠক (গ্রিক ট্রাজেডির ক্ষেত্রে দর্শক)। এভাবেই রচনার সমগ্র অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। তিনি মনে করেন লেখা একটি সূক্ষ্ম বস্ত্র যা বােনা হয় বহুবিধ লেখা, বহু সংস্কৃতি থেকে ধার করে আনা সংলাপের মাধ্যমে যা কেন্দ্রীভূত হয় এতদিন ভেবে আসা লেখকের কাছে নয় বরং পাঠকের কাছে। একটি গ্রন্থের ঐক্য তার উৎস নয় তার গন্তব্যে। কিন্তু ধ্রুপদী সমালােচনায় গুরুত্ব পায় শুধুমাত্র লেখকই। পরিশেষে বার্থ বলেন যদি আমরা রচনার ভবিষ্যৎ চাই তাহলে মিথের পতন ঘটানাে জরুরি, রচয়িতার মৃত্যুর বিনিময়ে পাঠকের জন্ম হতে হবে।

রচয়িতার মৃত্যু নামক উত্তর কাঠামােবাদী এ ফরাসি দর্শন এবং দার্শনিকদের বিশেষত জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকোকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। ফুকো ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত “রচয়িতা কী” নামক একটি লেখায় একইভাবে রচয়িতার সম্পকে সমালােচনা করেছেন। সেখানে তিনি সাহিত্যিককে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, তা কোনাে একক স্বতন্ত্র ব্যক্তির সৃষ্টি নয়। সবশেষে বলা যায়, বার্থের চিহ্নবিজ্ঞান এবং সাহিত্যচিন্তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবনার অবকাশ থাকতে পারে। তবে এটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে বার্থের কাজের পরিধি, বহুত্ব এবং গভীরতা চিন্তকদের কাছে অভিজ্ঞতার, আবিষ্কারের এবং সম্ভাবনার উৎস বলেই মনে হবে।

জ্যাক দেরিদা এবং বিনির্মাণ

২০শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জ্যাক দেরিদা (Jacques Derrida, ১৯৩০-২০০৪ খ্রি.) তার Deconstruction বা বিনির্মাণ তত্ত্বের জন্য খ্যাত হয়ে ওঠেন। বিনির্মাণ বুঝতে হলে দেরিদাকে বুঝতে হবে। কেননা, তিনি আজীবনই বিনির্মাণ করেছেন। ফ্রান্স শাসিত আলজেরিয়ায় এক ফরাসি-ভাষী ইহুদী পরিবারে ১৯৩০ সালের ১৫ জুলাই জ্যাক দেরিদার জন্ম। স্কুলজীবন তার কাটে আলজেরিয়াতে। ১৯ বছর বয়সে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ফ্রান্সের একল্‌ নমালে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ডিগ্রি লাভের পর এক নমালেই অধ্যাপক হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৫২-১৯৫৬ সালে স্কুলে পড়ার সময় তিনি মূলত জার্মান দার্শনিক এডমুন্ড হুর্সাল ও মার্টিন হাইডেগারের রচনার প্রতি আকৃষ্ট হন। দার্শনিক এডমুন্ড হুসার্লের প্রপঞ্চতত্ত্ব (Phenomenology) দেরিদাকে বিশেষভাবে আলােড়িত করে। হুসার্লের প্রভাবেই দেরিদা ষাটের দশক থেকে বিভিন্ন দার্শনিক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। তার রচনাকর্ম শুরু হয়েছিল এডমুন্ড হুসার্লের অরিজিন অফ জিওমেট্রি বইয়ের অনুবাদ প্রকাশের মাধ্যমে। দর্শনের ক্ষেত্রে তার অভিঘাত প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯৬৭ সালে হুসার্লের প্রপঞ্চতত্ত্ব বইয়ের ভূমিকা হিসেবে প্রকাশিত রচনাটির মধ্য দিয়ে যা মূল লেখার চেয়ে দীর্ঘ ছিল। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তার ৩টি বই তাকে দার্শনিক হিসেবে পরিচিত করে তােলে। যদিও তার নামের সাথে দার্শনিক শব্দটি যুক্ত হবে কিনা এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তার বই তিনটি হল, ১. বচন ও প্রপঞ্চ (Speech and Phenomena); ২. লেখন ও ভিন্নতা (Writing and Difference) এবং ৩. ব্যাকরণতত্ত্ব সম্পর্কে (Of Grammatology)।

দেরিদার রচনায় সর্বদাই উপস্থিত হয়েছে অন্যান্য দার্শনিকের ভাষ্য কিংবা প্রতিষ্ঠিত দর্শনের সমালােচনা। এ কারণে দেরিদাকে দর্শনের সমালােচক হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়। তার দর্শনের সমালােচনা সবসময়ই অবস্থান করেছে অধিবিদ্যা বা Metaphysics এর বিরুদ্ধে। তিনি মনে করেন অধিবিদ্যার কারণে ভাষাকেন্দ্রিক মানুষের জ্ঞান কখনােই সত্যের সন্ধান পায় না। ১৯৬৭ সালে দেরিদা জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে মনােবিজ্ঞানের ওপর লেকচার প্রদান করে সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি পান। আইন বিষয়ক তার নতুন মতবাদ বিনির্মাণবাদ পৃথিবীব্যাপী আলােড়ন তােলে। দেরিদার বিনির্মাণ তত্ত্ব উদ্ভবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা দরকার। সেজন্য জানতে হবে তার ছেলেবেলাটা কেমন ছিল।

দেরিদার জন্ম ফ্রান্স শাসিত আলজেরিয়াতে হওয়ায় তার ছিল ঔপনিবেশিক একটি দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে বড় হওয়ার অভিজ্ঞতা। ফরাসি উপনিবেশের বহু আগে থেকেই আলজেরিয়ায় ইহুদি বসতি ছিল। ফ্রান্স সরকার উপনিবেশের পর তাদের ওপর শােষণ শুরু করে। নাৎসীদের উত্থানের সময় আলজেরিয়ায় জার্মান সৈন্য ছিল না। সেখানে ছিল ফ্রান্সের শাসন। ফ্রান্সের তৎকালীন সরকার এমন কিছু আইন তৈরি করেছিল যা ছিল চরমভাবে শােষণমূলক। মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শনের প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। সেই সময়ে তিনি একজন শিক্ষকের কাছ থেকে ধিক্কার শােনেন, “ফরাসি সংস্কৃতি নাবালক ইহুদির জন্য সৃষ্টি হয় নি।” এর অব্যবহিত পরেই দেরিদাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই দুর্বিষহ ছেলেবেলাটা তার জীবনে চরম রেখাপাত ঘটায়। তিনি শােষণ দেখেছিলেন, দেখেছিলেন ক্ষমতা, শক্তি। অন্যদিকে দেখেছেন, যে ব্যক্তি শােষিত সে কীভাবে শােষকের শােষণের শিকার এবং তার চোখের জল। আর এই বিপরীতধর্মী চরিত্র দেরিদার বিনির্মাণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা। কেননা মানুষ যখন পরাধীন থাকে, শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে তখন সে মুক্ত বা স্বাধীন হওয়ার জন্য উতলা হয়। আর এর মাধ্যমেই পৃথিবীতে বিভিন্ন স্বাধীনতার সৃষ্টি হয়। এছাড়া বিভিন্ন বিপ্লবের কথাও বলা যায়, যেমন রেনেসাঁ

দর্শনের কাজ হল জীবন ও জগতকে ব্যাখ্যা করা। এই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কতগুলাে তত্ত্ব গড়ে ওঠে। তার একটি জ্যাক দেরিদার বিনির্মাণ। হুসার্ল ও মার্টিন হাইডেগারের ওপর লেখালেখির মাধ্যমেই দেরিদা লেখকবৃত্তি শুরু করেছিলেন। জ্যাক দেরিদা তাত্ত্বিক হাইডেগারের ডিস্ট্রাকশনের (Destruction) আদলেই মূলত তার ডিকনস্ট্রাকশন (Deconstruction) বা অবিনির্মাণ তত্ত্বটি তুলে ধরেন। এক্ষেত্রে জানা দরকার হাইডেগারের ডিসস্ট্রাকশন কী। হাইডেগারের ডিস্ট্রাকশন মূলত ছিল ইতিহাসের মাঝে ইতিহাস অনুসন্ধান। অন্যভাবে বলা যায়, ইতিহাসকে খুঁজে বের করতে একটি শব্দকে এর বিভিন্ন অংশে ভেঙে ফেলা। যেমন, প্রত্নতত্ত্ব। প্রত্ন অর্থ ‘পুরাতন এবং তত্ত্ব অর্থ ‘জ্ঞান’। অর্থাৎ প্রত্নতত্ত্ব হচ্ছে পুরাতন সংক্রান্ত যে জ্ঞান বা বিজ্ঞান। প্রত্নতত্ত্ব একটি শব্দ হলেও একে ভেঙে ফেললে দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে গভীর অর্থ নিহিত। এতে ডিস্ট্রাকশন চিহ্নিত করা যায়। আর জ্যাক দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন তত্ত্বটি মূলত তাত্ত্বিক হাইডেগারের ডিস্ট্রাকশনের আদলেই উদ্ভাবিত।

বিনির্মাণের মূল কাজ হল কেন্দ্র ও প্রান্ত নিয়ে। বিনির্মাণবাদীদের মতে, একক কোনাে কেন্দ্র থাকবে না। সব প্রান্তই কেন্দ্রে পরিণত হয়ে কাঠামাে তৈরি করবে। প্রান্ত ভেঙে কেন্দ্র হবে এবং আবার প্রান্তের সৃষ্টি হবে। এভাবে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত এবং প্রান্ত থেকে কেন্দ্র হবে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অর্থাৎ বিনির্মাণ মানেই অনুশীলন। বিনির্মাণের জন্য কাজ করতে হবে। কোনাে তত্ত্বকে চিরকালীন সত্য বলে আঁকড়ে ধরলে, আমাদের পক্ষে যা সত্য সেখানে পৌছানাে যাবে না। তাই দার্শনিকরা পূর্বের তত্ত্বগুলােকে বর্জন করতে চান। এই বর্জনটাই দেরিদা এবং তার সঙ্গীরা যাকে অবিনির্মাণ বলেছেন তার একটি অংশ। কিন্তু, শুধুমাত্র বর্জনেই তারা সন্তুষ্ট থাকতে চান না। তারা নতুন কোনাে তত্ত্ব প্রণয়ন করতে চান। হয়ত তারা বলতে চান মানুষের জীবনে দেহ ও মনের সমান প্রাধান্য আছে, কিন্তু তার একটি আর একটি থেকে আলাদা নয়। বরং একই দেহের দুই দিকের প্রকাশই দেহ ও মনের স্বরূপ। এভাবে নতুন তত্ত্বকে গঠনের মধ্য দিয়ে পুরনাে তত্ত্বটি শুধু বর্জিত হল তা নয়, নতুনভাবে গৃহীত হল। পুরাতন ধ্বংস হল এবং নতুনের সৃষ্টি হল। একই সাথে ডিস্ট্রাকশন ও কনস্ট্রাকশন – এই দুটো মিলিয়ে ডিকনস্ট্রাকশন বা বিনির্মাণ। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে শুরু, এ প্রতিষ্ঠা বিনির্মাণের অর্থাৎ আমরা যে বর্তমান পৃথিবীতে বাস করছি সেটিও তাে একটি ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে। পৃথিবীতে যে সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছে যেমন রােমান সভ্যতা, মেসােপটেমিয়া সভ্যতা ইত্যাদি। এ সভ্যতাগুলাে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু তার সংস্কৃতি এখনাে আমরা লালন করি। এটা কি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেইখানে শুরু না? এটা কি বিনির্মাণ না?

এখন বিনির্মাণকে বুঝতে হলে তৎকালীন ভাষাতত্ত্ব বুঝতে হবে। একথা নিঃসন্দেহে বলা সম্ভব ২০শ শতাব্দীর ভাষাতত্ত্ব দর্শনের চিন্তা-চেতনায় নতুন উপাদান নিয়ে উপস্থিত হয়। মার্কিন ভাষাদার্শনিক এডওয়ার্ড সাপির তার দর্শনে উল্লেখ করেন যে, ভাষা কোনােভাবেই মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। একজন মানুষের মাতৃভাষা এবং ভাষা প্রয়ােগের নিয়মাবলিই নির্ধারণ করে একটি মানুষের চিন্তা, চেতনা, মনন, সামাজিক, আচার ব্যবহার এবং তার দৈনন্দিন কর্ম-ক্রিয়া। দার্শনিক বেঞ্জামিন লি হোর্ফ সাপিরের ভাষাদর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বলেন, “আমরা শুধু যে আমাদের মাতৃভাষা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত তা না, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় চিন্তা, চেতনা কিংবা অর্থের সমমাত্রিক অনুবাদ করা সম্ভব কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন বাঙালির কাছে নদী, গাছ, খাল, বিল, জোনাকি, পাটপচা গন্ধ, ধানক্ষেত ইত্যাদি শব্দের যে দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনা আছে, তা একজন আমেরিকান বা সৌদি আরবের মানুষের কাছে একই মাত্রার ব্যঞ্জনা নিয়ে আসবে না। একইভাবে যদি একজন বাঙালিকে সৌদি আরবের মরুভূমির বর্ণনা দেয়া হয় তবে সে কিছুতেই মরুভূমির প্রকৃত রূপ ও স্বরূপ মনের চিত্রপটে আঁকতে পারবে না। হয়তাে বা কেবল ধুলাে আর বালির এক বিশাল মাঠের কল্পচিত্ৰই আসবে বাঙালির মনে ‘মরুভূমি’ শব্দের বিপরীতে। একজন বাঙালি তার জন্মের পর মাতৃভাষায় যা পড়ে বা শেখে তাই নিয়েই তৈরি হয় তার সত্তার ঠিকানা, অবয়ব আর অস্তিত্ব। ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘােড়া চড়ে সে’, ছড়ার এ লাইনটি একজন দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত বাঙালিকে করে বস্তুবাদী। ‘সদা সর্বদা গুরুজনে ভক্তি করিবে’, এই বাণী একজন গুরু বা বয়ােজ্যেষ্ঠের ভুল কিংবা অন্যায়কেও প্রশ্রয় দিতে পারে বাস্তব ক্ষেত্রে। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালাে হয়ে চলি’ – এ ছড়ার বক্তব্য একজনের মনে এমন একটি ধারণা বপন করতে পারে যে, সে আসলে ভালাে নয়, তাই প্রতিদিন সকালে তাকে ভালাে হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিতে হচ্ছে। ‘অ-তে অজগরটি আসছে ধেয়ে, আ-তে আমটি আমি খাবাে পেড়ে’ – এরকম বর্ণমালা শেখার পরামর্শ থেকে আরম্ভ করে ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানাে রুটির মত’ কবিতার পঙক্তি আমাদের চেতনাতে আমাদের সমাজের প্রকৃত অবস্থা সাপেক্ষে দেশ ও কালকে গ্রাহ্য করে, তাতে কোনাে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা সাজাতেই পারে। আর একমাত্র সত্য যে, একজনের মাতৃভাষার দ্যোতনা/ব্যঞ্জনা অন্য এক ভাষায় একই মাত্রায় অনুবাদ করা অসম্ভব।

বিংশ শতাব্দীতে ভাষা দর্শনে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন সুইজারল্যান্ডের ভাষাতাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুর। সস্যুরের চিন্তাভাবনার সারাংশ হল, ভাষা হচ্ছে চিহ্নসমূহের একটি কাঠামােকৃত ব্যবস্থা। শব্দ হচ্ছে চিহ্ন (Sign), যেমন আম শব্দটি যখন বলা হয় তখন বাস্তবের আমের সাথে শব্দ আমের কোনাে সম্পর্ক নেই। কারণ শব্দ আম হচ্ছে একটি চিহ্ন। আম শব্দটি শােনার পর আমাদের চোখের সামনে আমের যে চিত্রটি ফুটে ওঠে তা হচ্ছে আম সম্পর্কে আমাদের মাথার ভেতরকার ধারণা। আমরা লাল রঙকে লাল রঙ হিসেবে গ্রহণ করি কারণ তা ‘সবুজ’ নয়, হলুদ নয় কিংবা বেগুনী নয়। আর সবুজ রঙ বর্ণালীর অন্যান্য রঙ এর মত না হওয়ার কারণে আমাদের কাছে ‘সবুজ’ হিসেবে অর্থবােধক। অর্থাৎ শব্দের কোনাে মানে নেই। কিন্তু শব্দের সাথে এক ধরনের মানসিক ধারণা জড়িত। শব্দ হতে বিমূর্ত বিষয়। সস্যুরের ভাষা প্রকল্পের একটা পর্যায়ে আপত্তি তােলেন দেরিদা, সস্যুর মুখের ভাষাকে প্রাধান্য দেন এবং লেখাকে মনে করেন কথার সম্পূরক, ভাষার অপ্রধান রূপ। দেরিদা মনে করেন এর কারণ কথার সাথে আছে মনের উপস্থিতি। যেহেতু বক্তা নিজেই উপস্থিত, তাই মনে করা হয় একথা অর্থপূর্ণ নিখুঁত ও সম্পূর্ণ। এভাবে কথা হয়ে ওঠে সত্যের প্রতীক। দেরিদা দেখান সেই আদিকাল থেকে সস্যুর পর্যন্ত এই মনােভাব প্রবাহিত হয়ে এসেছে পশ্চিমের মর্মমূলে। জ্যাক দেরিদার ভাষাদর্শন মূলত অধিবিদ্যার সমালােচনা। আর এ কাজ করতে গিয়ে তিনি হুসার্ল, হাইডেগার, নীৎসে, সস্যুর, ফ্রয়েড প্রমুখ দার্শনিক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, তিনি প্লেটো, হেগেল, রুশাে, সস্যুর, হাইডেগার, ফুকো, হুসার্ল, সার্ত, নীৎসে সহ অন্যান্য দার্শনিকের দর্শনের সমালােচক হিসেবে উপস্থিত করেছেন নিজেকে।

দেরিদা দাবি করেন, লেখন ভাষার পূর্বশর্ত। অর্থাৎ প্রথমে লেখন, তা না হলে কথন তাে দূরের ব্যাপার, ভাষাই অসম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হােয়াট ইজ ইট? অর্থাৎ এর অনুবাদ করলে হয় ইহা হয় কী? কিন্তু আমরা যখন বলব এর মানে কী? অথবা একটু জোর দিয়ে রাগের সাথে যখন বলব এর মানে কী তখনও বলা হয় হােয়াট ইজ ইট? এক্ষেত্রে দেখা যায়, অনুবাদই সব নয়। কে, কোন ক্ষেত্রে সেটাকে কীভাবে দেখবে সেটাই মুখ্য বিষয়। অর্থাৎ ভাষা রেপ্রিজেন্টেশনের একটা বড় বিষয়। লাকাঁর বক্তব্য “মানুষ একটি ভাষাময় পৃথিবীতে থাকে।” তার কথায় সমর্থন করার ধ্বনি উচ্চারিত হয়। বার্থের বিখ্যাত প্রবন্ধ ডেথ অফ দি অথার এর কথা স্মরণ করা যাক। তিনি বলেন, লেখক নয়, ভাষা নিজেই কথা বলে। বার্থের সাথে দেরিদার বিরােধ এই যে, দেরিদা কারণ হিসেবে কাঠামাের অস্তিত্ব মানতে নারাজ। দেরিদার মতে, সকল লেখন হচ্ছে গাছের কলম লাগানাের মত, আগে থেকেই অস্তিত্বশীল টুকরােটাকরা একসাথে ফিট করা। কাজেই দেরিদার লেখন কেবল লেখকের কর্তৃত্বাধীন ব্যাপার নয়, বরং ভাষারই একটি সার্বভৌম প্রক্রিয়া।

ভাষার কেন্দ্র প্রান্তের অবিনির্মাণকে আমরা “দ্যা টিচার টট দ্যা স্টুডেন্ট ইংলিশ” লাইনটির মাধ্যমে দেখতে পারি। দেরিদা টিচার এর ‘টট’কে কর্তৃত্বাধীন বলেছেন। তাই তিনি এখানে বলতে চান, “দ্যা টিচার কজ টু দ্যা স্টুডেন্ট ইংলিশ”। দেরিদার দাবি মতে, আমাদের কথনও লেখনেরই অংশ। তাই লেখন কথনের পূর্বের, এমনকি ভাষারও আগের ঘটনা। এ লেখনে লেখকের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি মূল্যহীন, পাঠ্যই মূল জিনিস। ভিনসেন্ট লেইচের ভাষায় গােটা পৃথিবীটাই একটা পাঠ্য, পেছনে কিছু নেই। প্রতিটি পাঠ্যই হচ্ছে ইন্টার-টেক্সট। এই ধারার লেখনের ভিত্তিতেই বিনির্মাণের কথা বলেন দেরিদা। বিনির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হল এক বিশেষ কেন্দ্র বা Centre সৃষ্টিকারী অর্থের উপস্থিতিকে শব্দের পেছন থেকে সরিয়ে অধিবিদ্যার অবসান ঘটানাে। বিনির্মাণকে বলা হয় বুনন খুলে পুনরায় বুনন করা। অর্থাৎ ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টি। দেরিদা তার অফ গ্রামাটোলজি গ্রন্থে সস্যুরের ‘চিহ্নবিজ্ঞান’এর বিপরীতে উপস্থিত করেন লেখবিজ্ঞান এবং ঘােষণা দেন যে প্রত্নলেখ (Archaeo Writing) এর ফলে উচ্চারিত ‘ভাষা’ ও ‘লিখিত ভাষা’ সমভাবেই অধিবিদ্যার উপাদান হতে পারে। সস্যুরের দর্শনকে পাল্টে দিয়ে বা বিনির্মাণ করে দেরিদা বলেন, “I shall call it (Grammatology)… Since the science does not yet exist one can not say what it would be, but it has a right to existence, as place staked out in advance. Linguistics is only a part of (that) general science. The laws discovered by (grammatology) will be applicable to linguistics.”

জ্যাক দেরিদার গ্রামাটোলজি কেন্দ্রিক ভাষা দর্শন পরবর্তীকালে বিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশন নামে বহুল পরিচিতি লাভ করে। বিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশন বলতে কোনাে লেখার ধ্বংস বোঝানাে হয় না, যদিও বিনির্মাণের তত্ত্ব ধারণায় অধিবিদ্যাকে ধ্বংস করার চিন্তা-চেতনা নিহিত রয়েছে। কিন্তু অধিবিদ্যাকে ধ্বংসের মাধ্যমেই বিনির্মাণ তত্ত্বটি উঠে এসেছে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে দেরিদার কোনাে মাথাব্যথা নেই। যেমন, আমি ভাত খাব, আমি একটি কবিতা লিখছি ইত্যাদি। দেরিদার তত্ত্ব চিন্তা করে দর্শন, নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক রচনাবলি নিয়ে। এটা প্রতিনিয়ত আমাদের অজান্তেই অধিবিদ্যাজাত কেন্দ্র সৃষ্টি করে অহংকে উপস্থিত রাখছে।

বিনির্মাণের সাথে লােগােসেন্ট্রিসিজম গভীরভাবে সম্পৃক্ত। দেরিদা প্রশ্ন জিজ্ঞাসায় যতটা আগ্রহী উত্তর প্রদানে ততটাই নিস্পৃহ। দেরিদার তত্ত্ব অনেকটা সংশয়ের ওপর দাঁড়িয়ে। এছাড়া দেরিদার তত্ত্বটির শত্রু জাতীয়তাবাদ। বন্ধুত্বসংঘর্ষ বিনির্মাণের কার্যকরী বর্ণনা। জার্মান দার্শনিক হাইডেগার বলেন, “বিনির্মাণ বিস্মৃতি ভাঙায়।” কথা ও জগত-এ বিমলকৃষ্ণ নিজে নাগার্জুনের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা বিনির্মাণী। তবে সেখানে বলেছেন যে নাগার্জুনের মতে, “কিছু বলা মানে তাকে মিথ্যা করে দেওয়া। সেখানে বিনির্মাণ যােগ করবে, এই তথাকথিত মিথ্যাই তথাকথিত সত্য, এর চাইতে অধিক সত্য নেই অথবা আহরণ করা যায় না।”

দেরিদার দৃষ্টিতে পশ্চিম কেমন? এক্ষেত্রে বলতে হয়, এই তত্ত্ব কি একটি মানবতাবাদী তত্ত্ব না? এই তত্ত্ব কি শ্রেণী বিভাজনকে অস্বীকার করে না? সাদাকালাে, শােষক-শােষিতকে অস্বীকার করে না? যদিও দেরিদা কোনাে কিছুর সিদ্ধান্ত দেয় না। বিনির্মাণ কিছু বিষয়কে উপস্থিত করে মাত্র। সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব অন্যদের। এখন প্রশ্ন থেকে যায় প্রত্নতত্ত্বের সাথে বিনির্মাণের সম্পর্ক কী? বলা হয়, প্রত্নতত্ত্ব একটি ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া। প্রত্নতত্ত্ব ধ্বংসাবশেষ নিয়ে কাজ করে। বিনির্মাণের কাজও ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টি।

এই আলােচনার পরও বিনির্মাণে কী সে প্রশ্ন থেকে যায়? এক্ষেত্রে দেরিদার এক সাক্ষাৎকারের বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। সেই সাক্ষাৎকারে দেরিদাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল বির্নিমাণ কাকে বলে? এর উত্তরে ১৯৯৮ সালে তিনি টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদক দিনি স্মিথকে শীতল স্বরে বলেছিলেন, “আপনি বরং কোনাে পদার্থবিদ বা গণিতবিদকে ‘জটিল’ কাকে বলে এ প্রশ্নটা করুন না কেন?” আরাে বলেন, বিনির্মাণের জন্য কাজ করতে হয়। যদি বিনির্মাণ তত ধােঁয়াটেই হবে তাহলে বক্তৃতার সময় হাজার হাজার শ্রোতা উপস্থিত থাকেন কেন? তারা ভালাে করেই জানেন যে, তারা যথেষ্টই বােঝেন যা তাদেরকে আরাে বুঝতে সাহায্য করবে। একই সাক্ষাৎকারের শেষদিকে দেরিদাকে অনুরােধ করা হয় তিনি অন্তত যেন বিনির্মাণকে সংজ্ঞায়িত করেন। তার উত্তরে তিনি বলেন, এ প্রশ্নে সাড়া দেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আমাকে অতৃপ্ত রাখতে পারবে এমন কিছুই শুধু আমার পক্ষে করা সম্ভব। সর্বশেষে বলা যায়, আমরা সবসময়ই বিনির্মাণের অনুশীলন করে চলেছি। তাই জ্যাক দেরিদার ভাষায় বলতে হয়, “There is nothing outside text”।

মিশেল ফুকো এবং জ্ঞান ও ক্ষমতা

মিশেল ফুকো একাধারে ফ্রান্সের একজন দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, সমালােচক এবং সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি মার্ক্সবাদী এবং মার্ক্সবাদের সমালােচক ছিলেন। তাকে একজন উত্তর আধুনিকতাবাদী বলা হলেও তিনি সর্বদাই উত্তর কাঠামােবাদ এবং উত্তর আধুনিকতাবাদের সমালােচনা করেছেন। ফুকো তার আলােচনায় যে বিষয়গুলাে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন তা হল, জ্ঞান ও ক্ষমতার সম্পর্ক, জ্ঞান ও ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিকরণের ধারণা এবং ডিসকোর্সের বিষয়গুলাে। ফুকোর প্রধান আগ্রহ ছিল সেই নিয়মাবলি এবং অনুশীলন যা বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্বকালে সংঘটিত হয়, বক্তব্যকে অর্থবহ করে তােলে, ডিসকোর্স নিয়ন্ত্রণ করে। ফুকোর এ্যাপ্রােচ ডিসকার্সিভ, এই এপ্রােচে আমরা তিনটি বিষয় পাই, ১. ক্ষমতা ও জ্ঞানের প্রসঙ্গ; ২. ডিসকোর্সের প্রসঙ্গ এবং ৩. সাবজেক্ট প্রসঙ্গ। ফুকো বলেন, “ডিসকোর্স’ হচ্ছে একরাজি বক্তব্য যা কথা বলার একটি ভাষাজ্ঞান রেপ্রিজেন্টেশনের একটি ধরন প্রদান করে। ফুকো ভাষা নয়, রেপ্রিজেন্টেশনের একটি মাধ্যম হিসেবে ডিসকোর্সকে অধ্যয়ন করেছেন। ফুকো বেশি গুরুত্ব দেন বিভিন্ন ঐতিহাসিককালের নিয়ম ও চর্চা, যা অর্থপূর্ণ বক্তব্য ও নিয়ন্ত্রিত ডিসকোর্স উৎপন্ন করে তার ওপর। ডিসকোর্স ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান উৎপাদন করে। এটি কেবল ভাষাগত ধারণা নয়। এটি ভাষা ও অনুশীলন সম্পর্কিত। ভাষা হচ্ছে একজন কী বলবে, আর একজন কী করবে তার অনুশীলন। ফুকো আরাে বলেছেন, ডিসকোর্স টপিক নির্মাণ করে এবং এই টপিক যে উপায়ে অর্থপূর্ণভাবে আলােচিত হয় এবং যৌক্তিক হয়ে ওঠে, তা নিয়ন্ত্রণ করে ডিসকোর্স। ফুকোর মতে, ডিসকোর্সের কখনােই একটিমাত্র বক্তব্য, পাঠ্য, ক্রিয়া অথবা উৎস থাকে না। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের খেলা দেখতে দেখতে যখন আলােচনা করা হয় তখন এ আলােচনায় খেলার টপিকই সীমাবদ্ধ থাকে না, এর সাথে সারসত্তাকৃতভাবে আলােচিত হয় সে দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলােও। 

ফুকোর মতে, যেহেতু কেবল কোনাে কিছুর অর্থ থাকলেই তা আমাদের জ্ঞানের অঙ্গ হয়, তাই বস্তু নিজে নয়, ডিসকোর্স জ্ঞান উৎপাদন করে। হিস্টিরিয়া, যৌনতা, রােমান্টিক লাভ ইন লেট নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি এই বিষয়গুলাে ডিসকোর্সের বাইরে কোনাে অর্থ লাভ করে না। হিস্টিরিয়া, শাস্তি, যৌনতা বা রােমান্টিক লাভের ডিসকোর্স সম্পর্কে যেসব উপাদান সারসত্তাকৃত, সেগুলো হল – 

  • ১. পাগলত্ব, যৌনতা বিষয়ে বক্তব্যসমূহ আমাদের নির্দিষ্ট ধরনের জ্ঞান প্রদান করে;
  • ২. পাগলত্ব, যৌনতা বিষয়গুলাে একটি নির্দিষ্ট ধরনকে অনুমােদন করে এবং অন্যান্য বিষয়গুলােকে বাদ দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তে জ্ঞান ও ক্ষমতার নিয়মাবলিকে অনুশাসন করে; 
  • ৩. সাবজেক্ট অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যিনি ডিসকোর্সকে পার্সোনিফাই করেন। যেমন, উন্মাদ ব্যক্তি, অপরাধী, বিপথগামী ইত্যাদি; 
  • ৪. কোনাে বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান কীভাবে ক্ষমতা লাভ করে, কীভাবে সত্য বা স্বাভাবিক হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোনাে ঐতিহাসিক মুহূর্তে স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে গঠিত হয়, তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; 
  • ৫. কর্তাকে সামলাবার ক্ষেত্রে যে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা যেমন: উন্মাদের জন্য চিকিৎসা, অপরাধীর জন্য শাস্তি যার আচরণ নিয়ন্ত্রিত ও সংগঠিত হয় এইসব ধারণা অনুসারেই এবং 
  • ৬. ভিন্ন ডিসকোর্স বা এপিস্টিম পরবর্তী ঐতিহাসিক মুহূর্তে আসবে, বিদ্যমান ডিসকোর্সকে উচ্ছেদ করবে, নতুন ডিসকার্সিভ পরিকাঠামাে গড়ে উঠবে এবং উন্মাদনা, শাস্তি অথবা যৌনতার নতুন ধারণার উদয় হবে, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বসহ নতুন ডিসকোর্স আসবে এবং সত্য প্রতিষ্ঠা করবে। তারা আসবে, নতুনভাবে সামাজিক চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং এসব কিছুকে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।

যখন এই ডিসকার্সিভ বিষয়াবলি একই লক্ষ্যে কাজ করে কিংবা একই কৌশলে একই প্রাতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক ছকের অংশ হয় ফুকো তখন সেগুলােকে ডিসকার্সিভ ফর্মেশনের অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেন। যেমন, উন্মাদনাকে একটা অর্থবহ ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মিতি হিসেবে দেখা যায়। এটা “ক্রমাগত গঠিত হয়েছে, বক্তব্যসমূহের নাম দিয়েছে, বিভক্ত করেছে, বর্ণনা করেছে, ব্যাখ্যা করেছে, এর অগ্রগতির পথ অনুসরণ করেছে, অন্যের সাথে এর সম্পর্ককে চিহ্নিত করেছে এবং এর বিচার করেছে, বিশদভাবে একে বর্ণনা করেছে এর নামের ভেতরে…।” ডিসকার্সিভ চর্চার মধ্যে ‘উন্মাদ’ শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করার পরেই কেবল এর কর্তা, উন্মাদ’কে চলমান চিকিৎসা ও মনােবৈজ্ঞানিক জ্ঞানের আওতায় এনে তাকে সংজ্ঞায়িত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

এখন আসা যাক, জ্ঞান ও ক্ষমতার যে সম্পর্ক সে আলােচনায়। ফুকো ক্ষমতা ও জ্ঞানের কৌশলকে দু’স্তরের বিকাশে দেখেছেন। প্রাথমিকভবে জ্ঞানের বিষয়গুলাে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত হয়েছিল এবং উৎপাদিত জ্ঞানগুলাে ধীরে ধীরে অভিযােজিত হয়ে কোন কোন প্রেক্ষিতে প্রয়ােগ করা হয়েছিল। ফুকোর মতে, ক্ষমতার ব্যবহার এবং জ্ঞানের উৎপাদন পারস্পরিক। ক্ষমতা ও জ্ঞানের ধারণা অনেক বেশি বিস্তৃত মনে করেন ফুকো, যা কোনাে না কোনাে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জ্ঞানের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়। ফুকো বলেন, জ্ঞান কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, আধিপত্যকেও প্রকাশ করে। ফুকো বলেন, জ্ঞান নিজেই ক্ষমতার একটি রূপ। অর্থাৎ জ্ঞান, ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠান একটি চক্রাকার বলয় যা বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্বকালে সংগঠিত হবে এবং স্থান, কাল অনুসারে পরিবর্তিত হবে। জ্ঞান ও ক্ষমতার ধরন প্রাতিষ্ঠানিকতার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। যেমন, একটা অফিসের প্রধানের সাথে অন্যান্যদের যে সম্পর্ক সেটা একটা নির্দিষ্ট ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সম্পর্ক, যা একটি বিশেষ জ্ঞানকে প্রতিফলিত করে। আবার একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতার বিভিন্ন ভাগ থাকে। এই প্রত্যেকটি ভাগের সাথে একটা না একটা ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটি একটি প্রতিষ্ঠান হলেও তা ক্ষমতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যে ক্ষমতা বিকীর্ণ।

ক্ষমতা সম্পর্কে ফুকো মনে করতেন, ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শারীরিক বল নয়, বরং প্রত্যেক মানব সভ্যতার অন্তঃসলিলা এক শক্তি প্রবাহ। নিরাকৃতি এই ক্ষমতা কখনও আচরণ, কখনও মননের বিবিধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, জ্ঞান চর্চার পদ্ধতি, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক সংগঠন ইত্যাদির মধ্যে প্রতিফলিত হয়। ফুকোর বিশ্লেষণে ক্ষমতার তিনটি পৃথক মাত্রা রেরিয়ে আসে, তা হল প্রথমত, সার্বভৌমত্ব, দ্বিতীয়ত, অনুশাসন, এবং তৃতীয়ত, প্রশাসনিকতা। সার্বভৌমত্ব বলতে তিনি, সনাতন রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলেছেন যেখানে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার অধিকারী রাজা অথবা সার্বভৌমত্ব সম্পন্ন রাষ্ট্রের সরকার। ফুকো সার্বভৌমত্বের মাধ্যমে ক্ষমতার যে প্রয়ােগের কথা বলেছেন তা একেবারেই আধুনিক সমাজের জন্য উপযােগী নয়। সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার মাধ্যমে এক সময় জনগণের ওপর জোরপূর্বক বল খাটানাে হত। অন্যায় করলে তাকে অমানবিক ও কুৎসিত শাস্তি প্রদান করা হত। যেমন, আইনের ক্ষেত্রে যে সব নিয়ম কানুন জারী করা হয়েছে সেগুলাে ভঙ্গ করলে শাস্তি প্রদান করা হত। তবে এই সার্বভৌমত্ব ক্ষমতাটিকে মানুষ যখন স্বেচ্ছায় মেনে নেয় তাদের স্বশাসনের উদ্দেশ্য তখন তাকে বলা হচ্ছে অনুশাসন। ফুকো প্রবলভাবে আক্রমণ করে বলেছেন, ‘সংগঠিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের’ প্রত্যেকটির ভেতরে যে ধরনের অসম ক্ষমতা বণ্টন চলছে, যে ধরনের উলম্বিক স্তর বিভাজন চলছে, এসব প্রতিষ্ঠানে তাই দেখা যায় প্রত্যেকে প্রত্যেককে পাহারা দিয়ে রাখছে। বর্তমানের এই পাহারাদাররা আগের মত বেত মেরে, কারাগারে বন্দি করে বা অর্থদণ্ড আরােপ করে শাস্তি দিচ্ছে না, কিন্তু তাদের মর্জির ওপর নির্ভর করছে ব্যক্তির বেতন বৃদ্ধি বা বেতন হাস, পদোন্নতি বা পদাবনতি। নিয়ত অনুশীলনের দ্বারা কতকগুলি স্ট্যান্ডার্ডকে নরমালাইজ করার মাধ্যমে যেকোনাে শৃঙ্খলকে তা অবশেষে শৃঙ্খলায় রূপান্তরিত করে ফেলে। তখন ব্যক্তি অবচেতনভাবেই ক্ষমতার ক্রীড়নক বিষয়ে পরিণত হয়। সে ভুলে যায় সে পরাধীন ও অবদমিত। ফুকো দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে ক্ষমতার এই ইতিবাচক ‘মেকানিক্স’ গুলি চালু রয়েছে। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে তথাকথিত শৃঙ্খলা, কর্মবিধি এবং নির্দিষ্ট মান সংরক্ষিত হচ্ছে। ফুকো মনে করেন, এই ইতিবাচক ক্ষমতা প্রয়ােগের জন্য দরকার সমগ্রের সকল উপাদানের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা। আদিতে তাই যখন প্রথম কারাগার সৃষ্টি হল তখন কারাগারের ঠিক মাঝখানে তৈরি করা হয়েছিল সুউচ্চ ‘ওয়াচ টাওয়ার’। যেখান থেকে পরিদর্শক একই সময়ে সকল বন্দিকে নজর রাখতে পারতেন। এই স্থাপত্য মডেলটি ইংরেজিতে যাকে বলা হয় প্যানােপটিক মডেল। এ থেকে আধুনিক ক্ষমতার বৈশিষ্ট্যটি নিষ্কাশন করে ফুকো তার নাম দিয়েছেন প্যানােপটিসিজম। ফুকো মত দিয়েছেন, কি সমাজতন্ত্র, কি ধনতন্ত্র, কি স্কুল, কি কারাগার, কোনাে কিছুই এই প্যানােপটিসিজম থেকে মুক্ত নয়। এরপরই পাঠককে ফুকো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, “এটা কি মােটেই বিস্ময়কর যে কারাগার, ফ্যাক্টরি, স্কুল, সেনাছাউনী, হাসপাতালের মত এবং এগুলি সবই কারাগারের মত?” অর্থাৎ অনুশাসন হচ্ছে এমন এক অদৃশ্য ক্ষমতার প্রয়ােগ যা রাষ্ট্রের সকল নাগরিক তাদের স্বেচ্ছায় মেনে নেয় তাদের স্বশাসনের লক্ষ্যে। আরেকটি কথা বলেছেন ফুকো, তা হচ্ছে প্রশাসনিকতা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণে বিভিন্ন ধরনের সুযােগ-সুবিধা প্রণয়নের মাধ্যমে এক ধরনের অদৃশ্য ক্ষমতার বিস্তার। যেমন, যদি বলা হয়, যে দম্পতির একটি মাত্র সন্তান থাকবে তাদের বিশেষ কিছু সুবিধা প্রদান করা হবে। এভাবে বিশেষ কিছু সুবিধার লােভ দেখিয়ে জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

ফুকো মূলত দৃষ্টি দিয়েছেন সেই প্রক্রিয়ার প্রতি যেখানে ক্ষমতার অভিঘাতে জন্ম নেয় বিষয় ও তার বাস্তবতা। ক্ষমতা কোনাে ব্যক্তি বা শ্রেণীর সম্পত্তি নয়, ক্ষমতা পণ্য নয়, ক্ষমতার চরিত্র অনেকটা নেটওয়ার্কের মত যেটি সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়ােজন ক্ষমতার পূর্বক্ষেত্রে এবং তার মেকানিজমের বিশ্লেষণ। জ্ঞান ও ক্ষমতার ধরন প্রাতিষ্ঠানিকতার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ভিত্তিরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। ফুকো তার অর্ডার অফ থিংস গ্রন্থে বলেছেন, কোনাে অঞ্চলের জ্ঞান ও ক্ষমতা সময়, কাল ও অবস্থা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে এবং যে সময় যে রাজনৈতিক অবস্থা থাকে তার সাথে জ্ঞান ও ক্ষমতা যেভাবে যুক্ত থাকে তা সম্বন্ধে অন্য স্থান, কাল ও অবস্থার মানুষের হয়তাে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। ফুকো বলেন, এই সময়ের রাজনৈতিক কৌশলের সাথে ক্ষমতার যে ব্যবহার তা বুঝতে সাহায্য করে মাত্র একটি শব্দ এবং তা হচ্ছে ‘জ্ঞানতত্ত্ব’।

ফুকোর জ্ঞান ও ক্ষমতার আলােচনায় ভাষা থেকে ডিসকোর্স, ডিসকোর্স থেকে ক্ষমতা/জ্ঞান এবং ক্ষমতা ও জ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক আলােচনা করা হলেও প্রশ্ন করা হতে পারে এসবের মধ্যে কর্তা কোথায়? প্রথাগত ধারণায় ‘কর্তা’ হল একজন ব্যক্তি যিনি পূর্ণমাত্রায় সচেতন; একটি স্বায়ত্তশাসিত ও স্বাধীন সত্তা; নিজস্বতার চূড়ান্ত তিনি এবং তিনি ক্রিয়া ও অর্থের স্বাধীন ও নির্ভেজাল উৎস। ফুকোর মতে, ‘কর্তা’ শব্দটির দুইটি অর্থ আছে; কারাে নিয়ন্ত্রণ ও নির্ভরতার অধীন সত্তা এবং নিজ পরিচয়ের সঙ্গে বিবেক ও নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে নিজ পরিচিতির সাথে সংযুক্ত এক সত্তা। কর্তা কখনাে জ্ঞান উৎপন্ন করে না, ডিসকোর্সই জ্ঞান উৎপাদন করে। কর্তারা বিশেষ বিশেষ গ্রন্থ উৎপাদন করেন কিন্তু তাদের সত্যের অনুশাসনের মধ্যে, ডিসকার্সিভ ফর্মেশন, নির্দিষ্ট সময়কালে এবং সংস্কৃতিতে ক্রিয়াশীল থাকতে হয়। ‘কর্তা’ ডিসকোর্সের ভেতরে জন্ম নেয়। ডিসকোর্সের কর্তাকে অবশ্যই ডিসকোর্সের ভেতরে কর্তৃত্ব ফলাতে হবে, ডিসকোর্সের বাইরে ডিসকোর্সের কর্তা ক্রিয়াশীল থাকতে পারে না। ডিসকোর্স যা উৎপন্ন করে, কর্তা সেই জ্ঞানের বাহক হতে পারে মাত্র। ক্ষমতা যার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়, কর্তা কেবল তার উদ্দিষ্ট বস্তু হতে পারে। উৎস ও কর্তৃত্বকারী হিসেবে ক্ষমতা-জ্ঞান এর বাইরে কর্তা অবস্থান করতে পারে না। ডিসকোর্সের কর্তার মধ্যে অনেকগুলাে কর্তা পজিশন থাকতে পারে যার ক্ষমতা ও পরিচয় সুনির্দিষ্ট হয় জ্ঞান ও অনুশীলনের মাধ্যমে। অনেকগুলাে মানদণ্ড থাকে সাজেক্টিভিটি তৈরির জন্য কর্তাকে অবশ্যই ডিসকোর্সের অধীনস্ত হতে হবে। দুইটি সাবজেক্ট এর মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয় তাদের মধ্যে যে ক্ষমতার ক্রিয়া হয় তা ফুটে উঠবে ডিসকোর্সের মাধ্যমে। ফুকোর মতে, প্রত্যেকটি সাবজেক্টই জ্ঞান তৈরি করে। যেমন, ফুকো একজন পাগলের দিকে তাকিয়ে থাকলে ফুকো কেবল সাবজেক্ট হবে না পাগলও এখানে একটা সাবজেক্ট।

জ্ঞানের বিভিন্ন দশাকে ফুকো এপিস্টিম বলেছেন। একই ডিসকোর্স যেটি বারবার ধরন কিংবা জ্ঞানের দশাকে বিশিষ্টতা দান করে এটিকে ফুকো এপিস্টিম বলেছেন। কোনাে বিশেষ যুগে সমস্ত মানবিক অভিজ্ঞতাগুলির ঐতিহাসিক কারণ বিচার করে সে অনুসারে এক একটি জ্ঞানের ক্ষেত্র নির্ধারণ করাই হল এপিস্টিমের কাজ। রেনেসাঁ যুগের এপিস্টেম শেষ হলে ধ্রুপদী যুগে সম্পূর্ণ নতুন এপিস্টেম গড়ে ওঠে, ফলে নতুন চিন্তাতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে। তবে ফুকোর এপিসটিম কোনাে গ্রহণযােগ্যতা পায় নি। জ্ঞানতত্ত্বে ইমানুয়েল কান্ট বলেছেন, কেবল ধারণাই বস্তুর সম্পর্কে জ্ঞান দিতে পারে না, সাথে অভিজ্ঞতারও প্রয়ােজন হয়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে আকার ও উপাদান একই বস্তুতে বিদ্যমান থাকে। অপরদিকে ফুকোর যুক্তি হচ্ছে, বস্তু কিংবা জিনিসের সম্বন্ধে আমরা তখনই জানি যখন সেগুলাের অর্থ থাকে এবং অর্থ আকৃতি দান করে এবং ডিসকোর্স জ্ঞান উৎপাদন করে। ‘উন্মাদনা’, ‘শাস্তি’ ও ‘যৌনতা’ ইত্যাদি বিষয় কেবল সেসব বিষয় সম্পর্কিত ডিসকোর্সের মধ্যেই অর্থপূর্ণভাবে বিরাজ করে। ফুকো সবসময় জ্ঞান বােঝাতে নলেজকে বুঝিয়েছেন। তিনি জ্ঞানতত্ত্বকে পুরােপুরি খারিজ করেন নি আবার জ্ঞানতত্ত্বের পক্ষেও পুরােপুরি দাঁড়ান নি। কারণ জ্ঞানতত্ত্ব ডিসকার্সিভ নয়।

ফুকো ডায়ালেক্টিক ও সেমিওটিক্সকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফুকো হেগেলীয় মার্ক্সবাদকে ডায়ালেক্টিক বলেছেন। মাকর্সবাদ কর্তৃক আদর্শকে বাতিল করে দেয়ার প্রতি ফুকোর সুনির্দিষ্ট ও সুদৃঢ় অবস্থান ছিল। মার্ক্সের মতে, প্রতিটি যুগে মতাদর্শ আসলে তাদের শ্রেণী স্বার্থেই পরিচালিত হয়। ফুকো শ্রেণীর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন নি কিন্তু মার্ক্সীয় তত্ত্বের অর্থনৈতিক অথবা রিডাকশনিজমের শক্তিশালী উপাদানকে তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। ফুকো মনে করেন, মার্ক্সবাদ বুর্জোয়া জ্ঞানের ‘বিকৃতি’র বিপরীতে অবস্থান করে যা সত্য ধারণার বিরােধী। ফুকো মনে করেন, কোনাে মতাদর্শই ডিসকোর্সের বাইরে থেকে এ ধরনের সত্য দাবি করতে পারে না। সব ধরনের মতাদর্শকেই জ্ঞান ও ক্ষমতার খেলার মাঠে নামতে হয়। ফুকো বলেন, পুঁজিবাদী সমাজ শুধু সেটুকুই জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে আনে যা থেকে তার মুনাফা লাভ সম্ভব বা সেটুকুই সুস্থ যা থেকে সে লাভবান হবে। পুঁজিবাদী সমাজে একটি শিশু সন্তানকে গড়ে তােলা হয় উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে। সেখানে তার অন্য অস্তিত্বগুলাে নেই হয়ে যায় বা সেগুলাের কোনাে অস্তিত্ব থাকেনা।

ফুকো সেমিওটিক্সকে বাতিল করে দিয়েছেন। সস্যুরের সেমিওটিক্স তত্ত্ব অনুসারে, তিনি ভাষার আনুষ্ঠানিকতার প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছেন যেখানে বিশেষ কোনাে পরিস্থিতিতে এটি ক্রিয়াশীল, বিভিন্ন বক্তার মর্যাদা এবং ক্ষমতার তারতম্য অর্থাৎ ভাষার মধ্যে ক্ষমতার ক্রিয়াশীলতা অনুপস্থিত। ফলে সেমিওটিক্স রেপ্রিজেন্টেশন প্রক্রিয়ায় ‘ভাষা’কে পরিসীমিত করে ফেলে কিন্তু ফুকো অনুশীলন, ক্ষমতা ও জ্ঞানের দ্বারা ডিসকোর্সের মাধ্যমে জ্ঞান ও অর্থ উৎপাদন নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি কেবল ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চান নি, তার ডিসকোর্স বিষয়ক ভাবনা ভাষার ভাবনার চেয়ে আরাে বেশি ব্যাপক। আসলে ফুকোর কাজ অনুশীলন ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের অনেক উপাদানকে তালিকাভুক্ত করে যা সস্যুরের তত্ত্বকে অতিক্রম করে গেছে। ফুকো অনেক বেশি ইতিহাসনিষ্ঠ এবং ক্ষমতা-জ্ঞানের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটে প্রােথিত থাকে বলে তিনি মনে করেন।

ফুকোর সম্পর্কে প্রধান সমালােচনা হল, তিনি খুব বেশি ‘ডিসকোর্স’-এ নিমজ্জিত থাকেন এবং এটি তার অনুসারীদের ক্ষমতা-জ্ঞানের বস্তুগত, মার্ক্সবাদ ও কাঠামােবাদকে প্রত্যাখ্যান করতে প্ররােচিত করতে পারে। এটি আবার সত্যতার যেকোনাে মানদণ্ডকে অবহেলা করে সত্যের শাসন ও সত্যের নির্মাণ করার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে। নতুবা রেপ্রিজেন্টেশনের ক্ষেত্রে তার যে প্রভাব তা নিয়ে কোনাে সংশয়ের অবকাশ নেই।

তথ্যসূত্র

  • ক্রিটিক্যাল তত্ত্বচিন্তা, সম্পাদক মাসউদ ইমরান, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১০, পৃ – ১৭৯-২২৪
  • আহমেদ, রে., ২০০৪, রেপ্রিজেন্টেশন ও (বাস্তবতা) কিছু পরিসর, কিছু প্রসঙ্গ, কাউন্টার ফটো, দৃক আলােকচিত্র গ্রন্থাগার লিমিটেড, ঢাকা এবং কাউন্টার ফটো-এ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন, ঢাকা
  • আহমেদ, রে ও মা. চৌধুরী ২০০৩, নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ: সমাজ ও সংস্কৃতি, একুশে পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ঢাকা
  • হাবীব, জি.এইচ. ২০০৮ (অনুঃ) রচয়িতার মৃত্যু-বার্থ রােলাঁ, সন্দেশ প্রকাশনী, ঢাকা
  • শূর, চিরঞ্জীব, ২০০৭, মনন বিশ্বে পরিচয়, বাসনা প্রিন্টার্স, কলকাতা
  • হােসেন, পারভেজ ও ফয়েজ আলম (সম্পাদিত), ২০০৬, জ্যাক দেরিদা, পাঠ ও বিবেচনা, ঢাকা: সংবেদ প্রকাশনী।
  • যুগান্তর ৪ই জুলাই ২০০৮, সাময়িকী, জ্যাক দেরিদার সঙ্গে আলাপন।
  • চক্রবর্তী, অভিজিৎ, ১৯৯৭, মিশেল ফুকো।
  •  চ্যাটার্জি, পার্থ, ২০০০, ইতিহাসের উত্তরাধিকার। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা।
  • Barnard, A., and J.Spencer, 1996, Encyclopedia of Social & Cultural | Anthropology, London.
  • Hodder, I., Reading The Past.
  • Loyton, R., 1997, An Introduction to Theory in Anthropology, U.K.
  • Smith, C., 1986, Mcmillian Dictionary in Anthropology, London.
  • Triggar, B.G., 1990, A History of Archaeological Thought, London.
  • Allen, G., 2003, (Edition:illustrated, reprint), Roland Barthes, Routledge, ISBN 0415263611, 9780415263610.
  • Barthes, R., 1967, Elements of semiology, Cape.
  • Chambon, A.S., A. Irving, and L. Epstein, 1999, Reading Foucault for social work, Columbia University Press, ISBN 023110717X, 9780231107174
  • Hall, S., 1997, Cultural Representation and Signifying Practices.
  • Barthes, R., and A. Lavers, 1972, Mythologies, Noonday Press, ISBN 0809071932, 9780809071937
  • Derrida, J., 1998, (trans) Gayatri Chakravorty Spivak,(Edition:reprint, illustrated), of grammatology, JHU Press, ISBN 0801858305, 9780801858307
  • Derrida, J. 1985, Derrida and Différance, (ed.)
  • Foucault, M., 2002, (edition:2, illustr., reprint), The order of things: an archaeology of the human sciences, Routledge, ISBN 0415267366, 9780415267366.
  • Foucault, M., and A. Sheridan, 1995, (trans.) Alan Sheridan, (edition:2, reprint, illustr.), Discipline and punish: the birth of the prison, Vintage Books, ISBN 0679752552, 9780679752554.

1 Trackback / Pingback

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.