স্টোয়িসিজম, নিওপিথাগোরিয়ানিজম, ফিলোর দর্শন ও নিওপ্লেটোনিজমের তুলনা

ঈশ্বরকে জানার উপায়

  • স্টোয়িসিজম : লোগোস বা প্রজ্ঞা ঈশ্বর, জগৎ প্রজ্ঞা দ্বারা যৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রিত। প্রজ্ঞা বা লোগোসই ঈশ্বর। প্রজ্ঞা ও বিচারবুদ্ধির দ্বারা এই ঈশ্বরকে জানা যায়। (ঈশ্বর মেটাফোরিক্যালি আগুন দ্বারা বর্ণিত)
  • নিওপিথাগোরিয়ানিজম : প্রজ্ঞার চেয়ে সজ্ঞা গুরুত্বপূর্ন, সজ্ঞার দ্বারাই ঈশ্বর বা পারমার্থিক জ্ঞানকে জানা যায়, কিন্তু প্রজ্ঞাও গুরুত্বপূর্ণ। বিচার-বিশ্লেষণের শক্তি সীমিত, জটিল তত্ত্বীয় সমস্যা সমাধানে অপারগ, তাই বিচার-বিশ্লেষণ বা প্রজ্ঞার স্থলে অনুভূতির বা স্বজ্ঞা প্রয়োজন, জ্ঞাতা মরমি অভিজ্ঞতার সাহায্যে পরমসত্তার অপরােক্ষ প্রতীতি লাভ করে যা জ্ঞান নয়, অনুভূতি।
    • প্লুটার্ক : বিভিন্ন গুণ দ্বারা ঈশ্বরের প্রকৃত সত্তাকে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি ইন্দ্রিয়জগতের বা মানুষের সীমিত বুদ্ধির বহু ঊর্ধ্বে অধিষ্ঠিত বলে তিনি আছেন তা জানা গেলেও তিনি কী তা জানা যায়না। ঘুমন্ত ও জাগ্রত (কৃত্রিম উপায়ে) অবস্থায় মানবাত্মা দেহের বন্ধনমুক্ত হয়ে দৈববাণী পেতে পারে।
    • হার্মেটিকগণ : ঈশ্বরকে অনেকটা মরমিভাবাপন্ন, কিন্তু তার প্রজ্ঞা ও ইচ্ছা রয়েছে। সূর্য থেকে আলাের আগমনের মতো ঈশ্বর থেকে প্রজ্ঞার আগমন, যা থেকে আত্মা উৎপন্ন।
  • ইহুদি দার্শনিক ফিলোজুডিয়াস : প্রজ্ঞাভিত্তিক চিন্তাবিদরা নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ইহুদি ধর্মশাস্ত্রে বিধৃত সত্যের অনুমান করতে পারেন, কেবল জ্ঞানের সাহায্যে সত্যানুমান সম্ভব। দার্শনিক ও পয়গম্বরগণ ভিন্ন উপায়ে একই সত্যের সন্ধান পান। জ্ঞানপ্রক্রিয়ায় একটি ক্রমোন্নতির ধারা আছে, দৈহিক সংবেদন থেকে শুরু করে ঐশ্বরিক জ্ঞানের (বা অনুভূতি) সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হওয়ার। প্রজ্ঞা নয়, জ্ঞানের সর্বোচ্চ রূপ স্বজ্ঞা। ঈশ্বর জগৎ থেকে অনেক দূরে অধিষ্টিত বলে সহজ অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধির সাহায্যে তাকে জানা অসম্ভব, যদিও উপমা, উপাখ্যান ও রূপকের মাধ্যমে সসীম মানবমনে ঈশ্বর নিজেকে ব্যক্ত করে থাকেন। বাহ্য চেতনার স্তর অতিক্রম করে উচ্চতর ভাবসমাধির পর্যায়ে মানুষের পক্ষে দিব্যদর্শন বা ঐশ্বরিক জ্ঞান (বা অনুভূতি) লাভ সম্ভব। এ পর্যায়ে ঈশ্বরকে তার বিশুদ্ধ একত্বে দর্শন করা সম্ভব। বিচারবুদ্ধির একটি ভূমিকা থাকলেও এর সাহায্যে ঐশ্বরিক জ্ঞানলাভ করা যায় না। ঈশ্বরের স্বরূপ বা সংজ্ঞার মতো ঈশ্বরের জ্ঞানও অনির্বচনীয় যাকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ভাষা কিংবা যুক্তিতর্কের সাহায্যে বর্ণনা করা যায় না, তিনি স্বয়ং তিনিই। ঈশ্বর পরম সৌন্দর্য, পবিত্রতা, একত্ব প্রভৃতি সসীম গুণের ঊর্ধ্বে, তিনি নির্গুণ ও নিরুপাধি। কেবল তার অস্তিত্ব জানা যায়, কিন্তু তিনি ঠিক কী তা জানা যায়না, তাই তার নাম জেহোভা।
  • নিওপ্লেটোনিজম :
    • প্লটাইনাস : আধ্যাত্মিক সত্তা সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিলাভই দার্শনিক চিন্তার মূল্য লক্ষ্য। সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত এবং কুসংস্কারবিহীন ও খেয়ালখুশিবিহীন মরমিবাদ ও ঈশ্বরভক্তি গুরুত্বপূর্ণ, যার ভিত্তি এমন এক সুসংবদ্ধ দর্শন যাতে মানুষের সঙ্গে জগৎ ও ঈশ্বরের সম্পর্কের এক সংহত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণের জরুরি কিন্তু শুধু বিচার বিশ্লেষণের সাহায্যে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করা যায় না, ঐশ্বরিক জ্ঞানের শেষ পরিণতি অপরোক্ষ অনুভূতি। যে বিশ্লেষণী চিন্তা থেকে জ্ঞানপ্রক্রিয়ার উদ্ভব তাকে তার শেষ পরিণতি পর্যন্ত এগিয়ে না নিলে ঐশ্বরিক জ্ঞানের জন্য প্রয়োজনীয় ভাবসমাধি (ecstasy) লাভ করা যায় না। সার্বিকের ন্যায় বিশেষ বস্তুরও প্রত্যয় আছে। ঈশ্বর সম্পর্কে যাই বলা যায় তা-ই তাকে সীমিত করে। তাই তার ওপর সৌন্দর্য মহত্ত্ব চিন্তা বাসনা ইচ্ছা অভীপ্সা ইত্যাদি কোনো গুণ আরোপ করা যায়না, কারণ এসব গুণ সীমিত শক্তি ও অপূর্ণতার আকর। ঈশ্বর কী নন, শুধু তা-ই বলা যায়। তিনি আসলে কী, তা বলা সম্ভব নয়। তাকে সত্তা বলে বর্ণনা করা যায়না, কারণ সত্তা চিন্তনীয়। যা চিন্তনীয়, তাতে বিষয় ও বিষয়ীয় ধারণা রয়েছে। ঈশ্বর বিষয়-বিষয়ীর দ্বৈততার দ্বারা শৃঙ্খলিত নন, বরং তিনি এর বহু ঊর্ধ্বে। ঈশ্বর সম্বন্ধে শুধু এটুকুই বলা যায় যে, তিনি সব চিন্তার অতীত।
    • প্রোক্লাস : তিনপ্রকার ত্রয়ীর সাহায্যে বহুদেববাদের একটি যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নির্ণয় করা হয়। দিব্য উপাদানের দ্বান্দ্বিক পরিকল্পনাটি কেবল বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের সবরূপ প্রকাশের জন্যই রচিত। সেই অনির্বচনীয় হচ্ছেন অতিপ্রাকৃত এবং অতিপ্রাকৃত উপায় মাধ্যমেই তাকে পাওযা যায়। ধর্মীয় সত্য আবিষ্কার করা যায় অলৌকিক জাদুশক্তির সাহায্যে।

ঈশ্বরের স্বরূপ

  • স্টোয়িসিজম : একত্ববাদ, সর্বেশ্বরবাদ, এবং ব্যক্তিগত ঈশ্বরে অবিশ্বাস, জগৎ ও ঈশ্বর এক, কিন্তু জগৎ এপিকিউরিয়ানিজমের মতো কার্যকারণ ভিত্তিক মেকানিক্যাল নয়, বরং লোগোস এর একটি পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য রয়েছে যা অনুসারে জগৎ পরিচালিত হয়।
  • নিওপিথাগোরিয়ানিজম : একত্ববাদ, জগৎ গণিত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে এখানে হারমোনি ও অর্ডার আছে, আর এজন্য জগৎ কোন ডিভাইন ইন্টেলিজেন্সের সাথে সম্পর্কিত, যা অতীন্দ্রিয় বা ট্রান্সেন্ডেন্ট বা আধ্যাত্মিক এবং জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু জগতের সাথে সম্পর্কিত ও জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। এই ঈশ্বরকে কেবল প্রজ্ঞা বা বিচারবুদ্ধি দ্বারা বোঝা যায়না।
    • ম্যাক্সিমাস : বিপরীতে গিয়ে স্টোয়িকদের মতো ঈশ্বরকে বিশ্বাত্মা বা প্রজ্ঞা বলেও মনে করেন।
    • আলবিনাস : ঈশ্বর ও জগতের মধ্যবর্তী দেবদেবীদের সাথে বিশ্বাত্মা ও প্লেটোনিক প্রত্যয়সমূহ সংযােজিত, বিশ্বসৃষ্টি অধঃস্থন দেবদেবীদের কাজ, ঈশ্বর জড়জগৎ থেকে বহুদূরে থাকেন, তাই তিনি জড়জগতের কোনাে কাজের সঙ্গেই সরাসরি জড়িত নন।
    • নিউমোনিয়াস : ঈশ্বর এরিস্টটলের প্রজ্ঞা, পিথাগােরীয়দের মােনাড এবং প্লেটোর শুভের ধারণার সমার্থক। ঈশ্বর এতই উচ্চস্থানীয় এবং এতই দূরবর্তী যে, জগতের সঙ্গে তার কোনাে সম্পর্কই থাকতে পারে না। জগতের কার্যকলাপে ঈশ্বরের কোনাে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই, এবং জগৎসৃষ্টিতেও ঈশ্বরের কোনাে হাত নেই। জগতের সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ এক অধঃস্থ দ্বিতীয় ঈশ্বরের কাজ। জগৎকে বলা চলে তৃতীয় ঈশ্বর। ঈশ্বরের সংখ্যা এক নয়, তিন – পরমেশ্বর, তারই সৃষ্ট সৃজনী ঈশ্বর, এবং সৃষ্ট জগৎ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঈশ্বরের স্বভাব দ্বৈত প্রকৃতির। বিশুদ্ধ স্পিরিট বা প্রজ্ঞা থেকে উদ্ভূত হলেও জড়ের সঙ্গে দ্বিতীয় ঈশ্বরের সংযােগ রয়েছে। এই দ্বিতীয় ঈশ্বরই হলেন জগতের অন্তর্নিহিত শুভ আত্মা।  ঈশ্বর স্বর্গীয় আত্মা ও জড়ের সংমিশ্রণ।
    • হারমেটিকদগণ : ঈশ্বর জগতের ঊর্ধ্বে, সুতরাং তিনি জগতের স্রষ্টা নন – এই মত সমালোচনাযোগ্য।
  • ইহুদি দার্শনিক ফিলোজুডিয়াস : এককত্ববাদ সঠিক। বহুঈশ্বরবাদের দেবতারা অংশত প্রাকৃতিক ঘটনাবলির, আর কিছুটা প্রাচীন বীরপুরুষদের স্মৃতির ব্যক্তিত্ত্বায়িত রূপবিশেষ। ইশ্বর স্বয়ংসম্পূর্ণ। সবকিছুকে তিনি বেষ্টন করে আছেন কিন্তু নিজে কোনো বস্তু দ্বারা বেষ্টিত নন। তিনিই সব। তিনি সদাসৃজনশীল এবং যাবতীয় সসীম পদার্থের পূর্ণতার উৎস ও কারণ, সব বস্তুর পরিণতিকারণ। শক্তি ও কল্যাণ তার দুটি স্বরূপগত গুণ। সর্বোত্তম কল্যাণসাধনেই তিনি তার শক্তি ব্যবহার করে থাকেন। জগৎ থেকে এত দূরে অবস্থিত যে তিনি সরাসরি কিছুই সৃষ্টি করেন না। সৃষ্টিকর্মের দায়িত্ব তিনি কিছু মধ্যবর্তী স্বর্গদূতের হাতে অর্পণ করেন, এবং তাদের প্রয়োজনীয় শক্তিপ্রদান করেন। এই শক্তিবলেই জগতের সৃষ্টি। ঈশ্বরের দুটি প্রধান গুণ কল্যাণ ও শক্তি, যাদের সমবায়ে লোগোস গঠিত, যা এমন এক সৃজনশীল শক্তি যার মাধ্যমে জগতের সৃষ্টি। ফিলো লোগোসকে কখনো ঈশ্বর থেকে পৃথক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সত্তা বলে, কখনো ঈশ্বরের দূত বলে, কখনো আবার ঈশ্বরের প্রথম পুত্র বলে, কখনো ঈশ্বরের গুণ, কখনো তার প্রত্যয় অথবা চিন্তা, কখনো জগতের সার্বিক শক্তি ও প্রজ্ঞা বলে ব্যাখ্যা করেছেন। একবার বলা হয়েছে ঈশ্বর স্বর্গদূতদের শক্তি দেন, আবার বলা হয়েছে স্বর্গদূতেরাই ঈশ্বরের শক্তি, যা লোগাসোর অন্তর্ভুক্ত এবং লোগোস হলো ঈশ্বরের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, কিন্তু এসব শক্তি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ কিনা তা ফিলো স্পষ্ট করেননি। লোগোস ঈশ্বরের প্রতিনিধি ও দূত, জগতের সৃষ্টি ও শাসনের যন্ত্র, স্বর্গদূতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, ঈশ্বরের প্রথম পুত্র এবং দ্বিতীয় ঈশ্বর। এটি জগতের প্যাটার্ন বা আদর্শ, জগতের সবকিছু যার সৃষ্টি। আবার স্বর্গদূতদের তিনি লোগোসের অন্তর্ভুক্ত এর বদলে লোগোসের অধীনস্তও বলেছেন, অসংখ্য স্বর্গদূত ও উপদূত লোগোসের অধীনস্ত হয়ে জগতের শাসন ও নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত। তাদের কেউ কেউ নক্ষত্ররাজিতে অবস্থান করে তাদের গতিপথ পরিচালনা করেন, কেউ কেউ আবার জগতের সংস্পর্শে এসে এবং ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে মানুষের দেহগ্রহণ করে এবং মানুষে পরিণত হয়।
  • নিওপ্লেটোনিজম :
    • প্লটাইনাস : একত্ববাদ ও সর্বেশ্বরবাদ সত্য। গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই এক অনন্ত সত্তার প্লাবনধারা, যার উদ্দেশ্য ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলন। ঈশ্বর সব অস্তিত্বের, সব বিরোধ ও বৈপরীত্বের, দেহ ও মনের রূপ ও উপাদানের উৎস। তিনি সর্বত্র অর্থাৎ বহুত্বে বিদ্যমান, কিন্তু তিনি নিজে সর্বপ্রকার বহুত্বের ঊর্ধ্বে। তিনি সম্পূর্ণরূপে এক। সবকিছুই তার মহা-একত্বের অন্তর্ভুক্ত। তিনি সাধারণ অর্থে এক নন; তিনি মহাএকত্ব। ঈশ্বর থেকেই সবকিছুর উদ্ভব। তার একত্ব সব বহুত্বের পূর্ববর্তী ও সব বহুত্বের ঊর্ধ্বে। জগৎ ঈশ্বর থেকে উদ্ভূত হলেও ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেন নি; কারণ সৃষ্টিকর্মের জন্য চেতনা ও ইচ্ছা আবশ্যক ও ঈশ্বরে চেতনা বা ইচ্ছা আরোপ করা মানে তাকে সীমিত করার। ঈশ্বর পরম পূর্ণসত্তা বলে ঈশ্বর জগৎসৃষ্টির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নি বা জগৎ থেকে বিবর্তিতও হন নি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বর থেকে নির্গত বা বিকীর্ণ হয়েছে বিকিরণ (emanation) প্রক্রিয়ায় যেমনটা  সূর্যরশ্মি সূর্য থেকে হয়। এই বিকিরণ কোনো একটি বিশেষ সময়ে সংঘটিত ব্যাপার নয়, বরং প্রকৃতির অনিবার্য পরিণতি। বিশুদ্ধ চিন্তা বা বুদ্ধি থেকে বিশ্বাত্মার বিকিরণ, জড়ের সৃষ্টি, বিভিন্ন বস্তুতে জড়ের বিভাজন ইত্যাদি সব মিলে একটি অবিরাম প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিমূর্ত চিন্তা এ প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু মূলত গোটা ব্যাপারটিই একটি নিত্য ও অবিভাজ্য ক্রিয়া। জগতের আদি কারণ হিসেবে ঈশ্বর জগতের ওপর নির্ভরশীল নন; বরং জগৎই ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল। জগৎসৃষ্টির পরও ঈশ্বর অপরিবর্তিত থেকে যান, তার পূর্ণতা বিঘ্নিত হয় না। বিকিরণের প্রধান স্তর তিনটি – বিশুদ্ধ চিন্তা বা বুদ্ধি, আত্মা এবং জড়। প্রথম স্তরে ঈশ্বরের সত্তা বুদ্ধি ও প্রত্যয়ে বিভক্ত হয়ে যায়, চিন্তার কর্তা ও চিন্তা এক ও অভিন্ন, অর্থাৎ ঈশ্বর চিন্তাকেই চিন্তা করেন, যে চিন্তা তার সারধর্ম থেকেই উদ্ভূত, তিনি বিশুদ্ধ আদর্শ জগৎকে ধ্যান করেন, এখানে চিন্তা ও ধারণাবলি, বিষয় ও বিষয়ী এ পর্যায়ে একীভূত, দৈশিক ও কালিকভাবে পৃথক নয়, ঈশ্বরের চিন্তা পরিপূর্ণ সত্য বলে চিন্তারত মন ও চিন্তায় প্রভেদ থাকে না, এই চিন্তা বিশ্লেষণী চিন্তা নয়, তা আশ্রয়বাক্য থেকে সিদ্ধান্তে গমন করে না, এই স্বাত্তিক স্থিরচিন্তার মাধ্যমে প্রত্যয়সমূহকে একই সঙ্গে ধ্যান করা হয়। প্রত্যয়ের সংখ্যা সহজ অভিজ্ঞতার জগতে অনেক বস্তুর সমান ও অনেক, যেগুলোর মধ্যে প্রভেদ থাকলেও এদের সমন্বয়ে একটি একক সিস্টেম গঠিত, যাতে ঈশ্বরের পরম একত্ব প্রতিফলিত হয়। প্রতিটি বিশিষ্ট বস্তুর জন্য ঈশ্বরের মনে একটি করে প্রত্যয় রয়েছে। এই বিশুদ্ধ চিন্তার জগৎ দেশকালহীন, পূর্ণ, চিরন্তন ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বুদ্ধিগ্রাহ্য জগৎ, ইন্দ্রিয় জগতের আদর্শস্বরূপ। একইসঙ্গে গতিশীল শক্তির আধার। প্রত্যয়গুলো ক্রিয়াশীলও, বিকিরণের প্রতিটি স্তরে তারা পরবর্তী স্তরের নিমিত্ত কারণ হিসেবে উপস্থিত থাকে।
    • ধারণা বা প্রত্যয়ের জগতে তিন জোড়া জ্ঞানের রূপ বা আকার (Categories) আছে – চৈতন্য এবং সত্তা (চিন্তা এবং বস্তু), ঐক্য এবং পার্থক্য, স্থিতি এবং গতি, ( অপরিবর্তনীয়তা এবং পরিবর্তন)। ধারণার জগতের এই চৈতন্য পৃথক পৃথকরূপে সত্তা, স্থিতি এবং গতি প্রত্যেকটি জানতে পারে, যা হলো চৈতন্যের নিজের সম্পর্কে জ্ঞান বা আত্মজ্ঞান। জানা একটি ক্রিয়া এবং ক্রিয়াই গতি বলে এই আত্মজ্ঞানের মধ্যেই গতি নিহিত। এই নিজেকে জানা নিজের অভিমুখী ক্রিয়া, এতে নিজেকে অস্তিত্বশীল বলে জানা যায় বলে সত্তাও প্রতিপাদিত হয়। জ্ঞান গতি ও এক গতি অন্য গতি থেকে উৎপন্ন বা শেষ হতে পারেনা বলে সেই জ্ঞানরূপ গতির অন্য কোন উৎস ও লক্ষ্য আছে, যা হলো সত্তা। সত্তায় চৈতন্য বা জ্ঞানে গতির উদ্ভব ও শেষ বলে সত্তা ক্রিয়ার সম্ভাবনা, আবার এটা ক্রিয়াও, কিন্তু তাহলে এটি নিজে গতি তৈরি করতে পারেনা, তাই অতিরিক্ত ঐক্য ও পার্থক্যের ধারণা কাজ করে।
    • বিকিরণের দ্বিতীয় স্তরে বিশুদ্ধ চিন্তা বা বুদ্ধি থেকে আত্মা বা বিশ্বাত্মা নির্গত হয়, যা বিশুদ্ধ চিন্তার বা বুদ্ধির প্রতিবিম্ব, এর মতোই চিরন্তন ও কালাতীত ও বিশুদ্ধ চিন্তাস্থিত প্রত্যয়জগৎ এর আধার হলেও বুদ্ধির চেয়ে দুর্বল। এটি জড় ও প্রত্যয়জগতের মধ্যবর্তী ও উভয়ের স্বভাব গ্রহণ করে। এটি অতীন্দ্রিয় জগতের অধিবাসী। আত্মা নিজেও বিশুদ্ধ একটি প্রত্যয়। বিশুদ্ধ চিন্তার অবভাস হিসেবে আত্মা প্রাণস্বরূপ ও সক্রিয়, যার  বিশুদ্ধ চিন্তার ক্রিয়া আত্মার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। আত্মা জড়জগতের বাইরে অবস্থিত ও জড়জগতের ওপর আত্মার কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব নেই। আত্মার আত্মসংবিদ আছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রতীতি, স্মৃতি ও ধ্যান নেই। বিশ্বাত্মা থেকে দ্বিতীয় আত্মা হিসেবে প্রকৃতি বিকীর্ণ হয়, যা জগতের সঙ্গে যুক্ত ও বিশ্বাত্মার সৃষ্টিশক্তি। বিশ্বাত্মা ও প্রকৃতি থেকে অন্যান্য আত্মার উদ্ভব। প্রকৃতির শক্তি বিস্তার জড়কে আকার সমন্বিত করে বিচ্ছুরিত করে, এই শক্তি যান্ত্রিক নয়, উদ্দেশ্যযুক্ত। এই উদ্দিষ্ট কারণই (Final Cause) একমাত্র সত্য কারণ, নিমিত্ত কারণ আত্মা যে সকল বস্তু প্রয়োগ করে তাদেরই অংশ। এই জগতের সামঞ্জস্যগুলো বিশ্বাত্মা চিহ্নিত আকার। আত্মার নিচের স্তরে ঐশ্বরিক শক্তি বিকীর্ণ হলে ভৌত পদার্থের সৃষ্টি। উপলক্ষ ব্যতীত আত্মা শক্তিপ্রয়োগ করতে পারেনা বলে আত্মা জড় সৃষ্টি করে, যা বিকিরণের তৃতীয় ও সর্বনিম্ন স্তর। জড় এক অন্ধকারময় অতল গর্ভের মতো, সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয়। এটি সর্বপ্রকার রূপ, সীমাবন্ধন ও অবধারণের অতীত। এর একমাত্র হলো তা বস্তুর আশ্রয়। জড়ের প্রভাব বুদ্ধিতে ও আত্মাতেও বিদ্যমান। মন জড়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হলেও দেহের অধীন। চিন্তা, ধারণা ও সংস্কারের সঙ্গে জড় অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। জড় পর্যায়ক্রমে রূপগ্রহণ করে, এবং বিশ্বাত্মা তার চলার সুবিধার্থে কালের সৃষ্টি করে। জগৎ সবসময় ছিল এবং সবসময়ই থাকবে। কাল একটি উদ্দেশ্যযুক্ত আকার (Category) যার সাহায্যে বিশ্বাত্মার সৃষ্টিশক্তি সৃষ্টি ও জনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একরূপ থেকে অন্যরূপে প্রকাশিত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই অগ্রগতি চৈতন্যনিহিত সেই গতিরই প্রতিরূপ যা পরিবর্তনহীন, নিত্য এবং সামান্যধারণা। জগৎ পর্যায়ক্রমে বিবর্তিত হয় যতদিন পর্যন্ত সকল ব্যক্তির সৃষ্টি বিশ্বাত্মা সম্পন্ন না করে, তারপর আরেক নুতন জগৎ-সংস্থার সূত্রপাত হয়, তাই বিশ্বকে অনন্ত বলা যায়।
    • চৈতন্যের অন্তর্নিহিত ভেদ আছে, নাহলে ধারণা বা চৈতন্য-জগতে বিভিন্ন চেতন সত্তা বা ধারণার মধ্যে সংযোগ এবং পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থাকতো না। কিন্তু বিভিন্ন ধারণা একে অপরের মধ্যে বর্তমান বলে অভিন্নও। তারা একের মধ্যে বহু এবং বহুর মধ্যে এক। সমস্ত বিশেষ ধারণা এক সর্বব্যাপক ধারণা বা চৈতন্যে বিধৃত। প্রত্যেক বিশেষ ধারণা বা চেতন সত্তা একত্রে স্ব-নির্ভর এবং সর্বব্যাপক চৈতন্যে বা ধারণায় বিধৃত (প্রকৃত বিদ্যমান সকল বিশেষ চেতন সত্তা বা ধারণাসমূহের সমষ্টি) এবং সেই সর্বব্যাপক চৈতন্যও স্ব-নির্ভর এবং বিশেষ চেতনসত্তা সমূহে বিধৃত। ব্যক্তির চৈতন্য (spirit) সেই সর্বব্যাপক চৈতন্য বা ধারণার অন্তর্মুখী ক্রিয়ার ফল এবং ব্যক্তিআত্মা এটির বহির্মুখী ক্রিয়ার ফল।
    • চৈতন্য এবং চৈতন্য-জগৎ একটি অপরটি ছাড়া থাকতে পারে না। এই দুইয়ের মধ্যে একত্ব উচ্চতর আর একটি ঐক্যকে নির্দেশ করে যা বিশুদ্ধ ঐক্য বা এক, যার মধ্যে কোন দ্বিত্ব নেই। এই দ্বিত্ব-বর্জিত ঐক্য হলো পরম এক, ব্ৰহ্ম বা ঈশ্বর এবং সেই ‘পরম এক’ এবং ‘পরম শ্ৰেয়ঃ’ (The Good) অভিন্ন। তিনি উৎস-স্বরূপ যেখান থেকে একত্ব ও বহুত্ব উৎসারিত। তিনি অসীম। জ্ঞাত জগৎ থেকে পৃথক তার কোন জ্ঞান নেই, কেননা তাতে জ্ঞাতা-জ্ঞেয় সম্পর্ক অতিক্রান্ত। তিনি কেবল সাধারণ চৈতন্যযুক্ত নন, তিনি মহত্তর চৈতন্য সম্পন্ন। কারণ তিনি সাক্ষাৎ দ্রষ্টা। তার জ্ঞান সাধারণ বিশ্লেষণ যুক্তির এমনকি চৈতন্যের স্বজ্ঞা-প্রত্যঙ্গের তুলনায় উচ্চতর। তার ওপর ইচ্ছা শক্তিও আরোপ করা যায়না কারণ তার দ্বারা অবর্তমান কোনো বস্তুর আকাঙ্ক্ষা বোঝায়। তিনিই ইচ্ছাশক্তি, তিনি যা থেকে ইচ্ছা করেন তিনি তাই এবং তাতে এমন কিছু নেই যা তার ইচ্ছার পূর্ববর্তী। তিনি কোনো আবশ্যিকতার (necessity) অধীন নন, তাতে সবকিছুই অবশ্যিক। তিনি সর্বৈব মুক্ত, চৈতন্য-জগতের মুক্তির উৎস তিনি। যে উদ্দেশ্যময়তা বিবর্তনশীল জগতের লক্ষণ তার অধীন নন। তিনি আদি কারণ-স্বরূপ এবং পরম কল্যাণরূপে তিনি যা কিছু বর্তমান তার লক্ষ্য-কারণ। কিন্তু আদি ও লক্ষ্য-কারণরূপে তিনি যা কিছু ঘটান তার সাথে তিনি সমান নিত্য, কারণ তার উর্ধ্বে কিছু না থাকায় তিনি অন্যকিছুর অন্তর্গত নন-বরং তাতেই সকল কিছু বিধৃত। তিনি আদি ক্রিয়াস্বরূপ, অথবা আদি শক্তি, কারণ তিনি শক্তি ও ক্রিয়া এই দুইয়ের পার্থক্যের উর্ধ্বে। সেই পরম এক অথবা পরম কল্যাণ কেবল সাধারণ অর্থে কল্যাণ নন বরং সকল কল্যাণের উৎস। তিনি সৌন্দর্যসমন্বিত নন বরং তিনি সকল সৌন্দর্যের সৌন্দর্যস্বরূপ। তিনি আদি সৌন্দর্য, যা কিছু সুন্দর তার উৎস।
    • জীবাত্মা পরমাত্মা থেকে ভিন্ন নয়, অহং এর কারণে ভিন্ন মনে হয়। যিনি চৈতন্যরূপে দর্শন করেন তিনি এবং চিন্ময় এই জগৎ পরস্পর সাপেক্ষ, একটি ছাড়া অপরটির কোনো অর্থ হয় না। মানবাত্মা বিশ্বাত্মার অংশবিশেষ বলে তা অতীন্দ্রিয় ও স্বাধীন। দেহ ধারণের আগে আত্মা অতীন্দ্রিয় বুদ্ধিজগতের অধিবাসী ছিল, এবং তখন তা মরমি স্বজ্ঞার সাহায্যে চিরন্তন নওস বা বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার ধ্যানে আবিষ্ট ছিল। ঈশ্বরের দিকে দৃষ্টিপাত করে আত্মা শুভের জ্ঞানলাভ করে। এরপর যখনই তা তার দৃষ্টি জগৎ ও জড়ের দিকে নিবদ্ধ করলো, তখনই সূচিত হয় তার পতন। অহংজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের উদয় হওয়া মাত্রই আত্মা অনন্ত জীবনসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বার্থান্ধ ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পতন বা অবনতির ফলেই আত্মার দেহপ্রাপ্তি ঘটে, এবং বর্তমান জীবনে আমরা যেসব দুঃখভোগ করি, সেগুলোর সবই এ অবনতির শাস্তিস্বরূপ।
    • ইয়ামব্লিকাস : ঈশ্বরের অন্য নিরপেক্ষ অদ্বয়সত্তা থেকে গৌণ ত্রয়ী-সত্তা নির্ণয় করা যায়, যা থেকে তিন পর্যায়ের দেবতা – বুদ্ধিগ্রাহ্য, অতিপ্রাকৃত এবং জগৎ-নিহিত দেবতার আবির্ভাব ঘটে। প্রথমোক্ত দুই পর্যায়ের দেবতাগণ জগৎ-অতিক্রান্ত, তৃতীয় পর্যায়ের দেবতাগণ পিথাগোরাসের ‘সংখ্যা’, প্লেটোর সাপ্ত ধারণা বা অ্যারিসটোটলের ‘বিমূর্ত আকার’ ইত্যাদির সাথে অভিন্ন এবং তারাই আমাদের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণ করেন। আত্মা এবং চেতনসত্তা কেবল তৃতীয় পর্যায়ের দেবতাগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে কিংবা অংশগ্রহণ করতে পারে। পরমেশ্বর সম্পূর্ণরূপে জগদতীত (transcendent)। ঈশ্বরে কোনো গুণ আরোপ করা চলে না। জীবজগতের সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো যোগাযোগ নেই। এই পরমসত্তা থেকে উদ্ভূত হয় দ্বিতীয় এক একক সত্তা, যা জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং সংখ্যা ও বহুত্ব সৃষ্টিতে সক্ষম। অর্থাৎ জগৎ ও জীবসমূহ মূল একক সত্তা থেকে উদ্ভূত দ্বিতীয় সত্তার অংশবিশেষ। এই দ্বিতীয় একক সত্তা (যাকে বহুর মধ্যে এক বলা চলে) থেকে সৃষ্টি হয় তিন শ্রেণীর দেবতার। প্রথম শ্রেণীর দেবগণই কেবল বুদ্ধিবিশিষ্ট; দ্বিতীয় শ্রেণীর দেবগণ বিশ্বের বাইরে অবস্থান করেন, আর তৃতীয় শ্রেণীর দেবদেবীরা বিশ্বের অভ্যন্তরে অবস্থান করেন। তারাই সরাসরি আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সাহায্যে আমরা এসব দেবদেবীর সংস্পর্শে এসে থাকি। এরাই সত্যিকার দেবদেবী। এরাই আমাদের প্রার্থনার লক্ষ্যবস্তু, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপলক্ষ, এবং এদের জন্যই আমরা তৈরি করি যজ্ঞবেদী।
    • প্রোক্লাস : পরম একক সত্তা অনির্বচনীয়। ‘এক’-কে যেমন প্রাণ বা চেতনা বলা যায় না, তেমনি আবার একে চিন্তা ও সত্তাও বলা চলে না। ‘এক’ নিত্যতা ও দেবত্বের ঊর্ধ্বে। এর সম্পর্কে আমরা শুধু বলতে পারি যে, তা আমাদের জীবনের উৎস এবং সর্বপ্রকার প্রয়াস প্রচেষ্টার লক্ষ্য (এ অর্থে একে বলা চলে পরম শুভ)। তবে আল্‌ফা ও ওমেগা, আরম্ভ ও পরিণতি একই সঙ্গে প্রবহমান, কেননা ঐক্যই শৃঙ্খলা আর শুভই ঐক্য। ‘এক’ সৃজনশীল, কিন্তু সৃজনশীলতা এর একত্বে ব্যাঘাত ঘটায় না। যাবতীয় পদার্থ ‘এক’ থেকেই বিকীর্ণ। (প্লটাইনাস প্রভাবিত) পরম এক থেকে বহুপদার্থের জগৎ পর্যন্ত পরিবর্তনের ধারাটি দ্বান্দ্বিক। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিটি এই সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে কার্য কারণ থেকে স্বতন্ত্র হলেও মূলত অভিন্ন; তাই কার্য সেই স্বতন্ত্র অবস্থা থেকে কারণে ফিরে যেতে চায়। তাই প্রত্যেক সংঘটনে তিনটি পর্যায় আছে। এরা হলো কারণের স্থায়িত্ব, ঘটনার উদ্ভব এবং তার স্থায়ী কারণে প্রত্যাবর্তন ও একাত্মতালাভ। সমগ্র পদ্ধতিটি এইরূপ বিভিন্ন ত্রয়ীর (triad) শৃঙ্খল। তত্ত্ববিদ্যাগত ধর্মশাস্ত্র তিনভাগে বিভক্ত এবং প্রত্যেক বিভাগে এই ত্রয়ীপদ্ধতি অনুসরণ করেন।প্লটাইনাসের ত্রয়ী থেকে প্রোক্লাসের ত্রয়ী স্বতন্ত্র। প্রথমেই কল্পনা করতে হয় অনপেক্ষ ও অদ্বিতীয় এক এর, যাকে কেবল রূপকার্থে এক পরম শ্ৰেয়ঃ, পরম ব্ৰহ্ম এবং আদি কারণ বলা যেতে পারে। এই অদ্বিতীয় এক থেকে সৃষ্টি হয় সত্তা, জীবন ও বুদ্ধির। সেই পরম এক থেকে দিব্য উপাদানের প্রকাশস্বরূপ সত্তা (being), জীবন এবং তাদের ঐক্য অর্থাৎ চৈতন্য – এই তিনটি তত্ত্ব উদ্ভূত হয়। (১) সত্তার স্বভাব অনন্ত। অনন্ত সত্তা থেকে সান্ত বা সীমিতের উৎপত্তি। অর্থাৎ পুনরায় সত্তা থেকে উদ্ভূত হয় অসীম, আদর্শ (The end) এবং তাদের ঐক্য অর্থাৎ সসীম। (২) জীবন বলতে অব্যক্ততা ও অস্তিত্বকে বোঝায়। এ দুয়ের সম্মিলন থেকেই জীবনের উৎপত্তি। অর্থাৎ জীবন থেকে উদ্ভূত হয় সম্ভাবনা, অস্তিত্ব এবং তাদের ঐক্য বোধগম্য জীবন। (৩) বুদ্ধি বা চৈতন্য স্থির কিংবা চঞ্চল হতে পারে। বুদ্ধির এ দুই বৈশিষ্ট্যের মিলন থেকে সৃষ্টি হয় চিন্তা ও স্মৃতির। অর্থাৎ চৈতন্য থেকে উদ্ভূত হয় নিষ্ক্রিয় চিন্তা, সক্রিয় চিন্তা (প্রত্যক্ষ) এবং তাদের ঐক্য অর্থাৎ বিচারশীল চিন্তা। প্রথম ‘ত্রয়ী’ দিব্য উপাদানরূপে ঈশ্বরের পরিমণ্ডল। দ্বিতীয় ত্রয়ী অপ্রাকৃত শক্তিগুলোর এবং তৃতীয় ত্রয়ী চৈতন্য-জগতের পরিমণ্ডল। এক থেকে প্রথম ঐশ্বরিক প্রজ্ঞা বিকীর্ণ হয়নি, সংখ্যার জগৎ ‘এক’-এর প্রথম বিকিরণ। এর প্রতিটি সংখ্যায়ই ‘এক’ প্রতিফলিত। সংখ্যা থেকেই ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার উদ্ভব।
    • ঐশ্বরিক প্রজ্ঞা বিশ্বাত্মার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে থাকে; আর এই বিশ্বাত্মার মাধ্যমেই ঈশ্বরের বুদ্ধিমত্তা ও মঙ্গলময়তা ইন্দ্রিয়জগতে প্রতিফলিত হয়। ভৌত জগৎ বিশ্বাত্মার দেহস্বরূপ। বিশ্বাত্মা থেকেই তা বিকীর্ণ। বিশ্বাত্মার সাথে জগতের মিলন থেকেই প্রাণির সৃষ্টি। প্রকৃতির মাধ্যমেই বিশ্বাত্মা ও জগতের এই মিলন সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রকৃতিই যাবতীয় গতি ও পরিবর্তনের আকর। ঐশ্বরিক নির্দেশ অনুযায়ী প্রকৃতি নিরন্তর ইন্দ্রিয়জগতের যাবতীয় কার্যকলাপ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। বিশ্বাত্মা ও প্রকৃতির মধ্যে মূল পার্থক্য এখানে যে, বিশ্বাত্মার সব কার্যকলাপ প্রজ্ঞাসম্মত, অথচ প্রকৃতির কার্যকলাপ অংশত প্রজ্ঞা দ্বারা এবং কিছুটা জড় দ্বারা প্রভাবিত। এ জন্যই বিশ্বের গতিপ্রকৃতি উদ্দেশ্য ও আবশ্যিকতার সংমিশ্রণ। জড়ের কোনো সংজ্ঞানির্দেশ সম্ভব নয়। ইন্দ্রিয়জগৎ ও বুদ্ধিজগতের ব্যাখ্যায় জড়ের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হয়। তবে প্লটাইনাস যেমন বলেছেন জড় তেমন অশুভ নয়, আংশিকভাবে হলেও জড় সদ্গুণের অধিকারী, কোনো অশুভ সত্তা নয়, স্বয়ং ঐশ্বরিকদ্রব্যই জড়ের উৎপত্তির মূলে।
    • অনির্বচনীয় ঐক্য থেকে যা কিছু নিঃসৃত হয় সকলই দিব্য উপাদানের ক্রমাবনতি অথবা ক্রমক্ষয়, যাতে নিম্নতর পদার্থসমূহ সর্বদা উচ্চতর পদার্থসমূহের অধীন হয়। কিন্তু যখন তিনি বললেন যে অন্যান্য ত্রয়ীগুলোতেও চৈতন্যের তিনটি পর্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে তখন তিনি অন্তত পরোক্ষভাবে এই অধীনতার সম্পর্ক অস্বীকার করে থাকতে পারেন। মানবাত্মার উদ্ভব বিশ্বাত্মা থেকে, তাই তার স্বভাব শুভ।

অমঙ্গলের সমস্যা

  • স্টোয়িসিজম : পৃথিবী শুভ ও পূর্ণ ও যাদের অশুভ বলা হয় তারা আসলে আপেক্ষিক অর্থেই অশুভ। অশুভের সমাবেশে সুখের মাধুর্যও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। অন্যায়, অমিতাচার ও ভীরুতার পাশে ন্যায়, মিতাচার ও সাহস অধিকতর উজ্জ্বল দেখায়। অশুভ ব্যক্তিগত, তাতে সর্বজনীন সুখের হানি না হয়ে বৃদ্ধিই হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে কারো সুখ, কারো দুঃখ; কোনো কাজ হিতকর, কোনো কাজ অহিতকর, কিন্তু সমষ্টি হিসেবে দুঃখ-কষ্টের অস্তিত্ব নেই। একমাত্র মানবচরিত্রই স্বকীয় মূল্যের অধিকারী আর বাহ্য অশুভ মানবচরিত্রের ক্ষতি করতে পারে না বলে একে সত্যিকার অর্থে অশুভও বলা চলে না। অশুভের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই শুভ অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গোটা বিশ্বই একটি সুন্দর শুভ ও পরিপূর্ণ সত্তা, এবং এর প্রতিটি অংশেরই একটি বিশেষ স্থান ও উদ্দেশ্য রয়েছে।
  • নিওপিথাগোরিয়ানিজম :
    • প্লুটার্ক : ঈশ্বরের মতো এত উচ্চ ও পবিত্র সত্তাকে জগতের অশুভ ও অপূর্ণতার জন্য দায়ী করা যায়না বলে স্টোয়িক মত ভুল। ঐশ্বরিক সত্তা থেকে স্বতন্ত্র কোনাে জড়ীয় নীতি বা শক্তির সাহায্যে জাগতিক অপূর্ণতাকে ব্যাখ্যা করা যায়না, কেননা জড় অনেকটা কুমােরের হাতের কাদার মতাে। জড় থেকে নয়, বরং জড়ের যখন যে রূপ দেয়া হয়, সেটি থেকেই মঙ্গল অমঙ্গলের উৎপত্তি। তাই অমঙ্গলের স্বরূপ ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের অতিরিক্ত একটি দ্বিতীয় তত্ত্বের অস্তিত্ব স্বীকার্য। জড় ছাড়াও ঈশ্বরবিরােধী এবং জগতের যাবতীয় অন্যায়-অশুভের ভিত্তি হিসেবে অশুভ জগদাত্মা বলে একটি পৃথক সত্তা রয়েছে।
    • ম্যাক্সিমাস : স্টোয়িক মতই ঠিক। অশুভ বিশ্বাত্মার অস্তিত্ব নেই, জড়ই বিশ্বের অশুভ ও অপূর্ণতার কারণ। প্রজ্ঞার বিধান অমান্য করে নিছক প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করা থেকেই পাপের সৃষ্টি।
    • নিউমোনিয়াস : স্বর্গীয় আত্মার বিরােধী এক অশুভ শক্তি দ্বারা জড় পরিচালিত, এবং এ শক্তিই জগতের সব অপূর্ণতার জন্য দায়ী। তার তিনজন ঈশ্বরের সঙ্গে একজন ডেভিল বা অশুভ সত্তাকে যুক্ত করা আবশ্যক। মানুষ একাধারে আধ্যাত্মিক ও দেহধারী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাহীন বলে উভয় প্রকার (শুভ ও অশুভ) জগদাত্মার সঙ্গেই তার সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের মধ্যে শুভ ও অশুভের সংগ্রাম অবিরাম চলছে, এবং এ নিয়েই তার নৈতিক জীবন গঠিত।
    • হারমেটিকগণ : সব অশুভ-অমঙ্গলের মূলে রয়েছে জড়। আধ্যাত্মিক ও জড়ের, ঐন্দ্ৰিয়িক ও স্বর্গীয় সত্তার মধ্যে কোনাে সংযােগ সম্ভব নয়।
  • ইহুদি দার্শনিক ফিলোজুডিয়াস : ঈশ্বর জগতের অতীত, এবং জগতের স্পর্শে ঈশ্বর কলুষিত নন। জগতের সব অন্যায় ও অশুভের মূলে রয়েছে জড়। জড় চিরদিনই ঈশ্বরের বিরোধী। জড় সবসময় লোগোসের কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। সব অকল্যাণের জন্য জড়ই দায়ী। ঈশ্বর শুভ বলে শুধু কল্যাণেরই কর্তা, তাই ইন্দ্রিয়জগতের কোনো অন্যায় অশুভ কিংবা অন্য কোনো অপূর্ণতার জন্য ঈশ্বর দায়ী নন। পূর্ব-অস্তিত্বশীল বিশৃঙ্খল জড় থেকে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন, তাই জগতের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। জগৎ সক্রিয় শক্তি দ্বারা পরিচালিত। জড় অসৃষ্ট, আকারহীন, নিষ্ক্রিয় ও বিশৃঙ্খল অসত্তা। আবার জড় ভৌত বস্তুর উপাত্ত প্রদানকারী সত্তা। জড় প্লেটো বর্ণিত শূন্যদেশের নামান্তর নয়, বরং গুণসম্পন্ন। দেহ আত্মার কবরস্বরূপ, দেহই যাবতীয় অশুভের আকর। দেহের প্রভাবেই পাপের সৃষ্টি। আমাদের সবার মধ্যেই আদিপাপ সংক্রমিত; কেননা আমরা সবাই দেহের অধিকারী।
  • নিওপ্লেটোনিজম : ঈশ্বর নির্গুণ ও অতিবর্তী, জগৎ সৃষ্টিতে ঈশ্বর অংশ নেননা। জগৎ থেকে ঈশ্বরের এই দূরত্ব তৈরির মাধ্যমে নিওপ্লেটোনিজম জগতের অমঙ্গলের একটি ব্যাখ্যা প্রদান করে।
    • প্রোক্লাস : জড় তেমন অশুভ নয়, আংশিকভাবে হলেও জড় সদ্গুণের অধিকারী, কোনো অশুভ সত্তা নয়, স্বয়ং ঐশ্বরিকদ্রব্যই জড়ের উৎপত্তির মূলে। ব্যক্তিমানুষ অশুভের নির্বাচন করলেও ঈশ্বর এই অশুভ এবং জগতের সামগ্রিক ব্যবস্থার মধ্যে এমনভাবে সামঞ্জস্যবিধান করেন যে, এসব অশুভ জগতের পূর্ণতার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আবার মানবাত্মা যেন বাহ্য অশুভ শক্তিসমূহের মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় তাই ঈশ্বর একে প্রয়োজনীয় শক্তিপ্রদান করেন।

বহুঈশ্বরবাদী ও দেবদেবী নিয়ে অবস্থান

  • স্টোয়িসিজম : বিশ্বজনীন রাষ্ট্রে দেবদেবী ও বিজ্ঞজনেরা বিশেষ সুবিধার অধিকারী, এবং যে-কেউ স্বেচ্ছায় তাদের সান্নিধ্যে আসতে পারে।
  • নিওপিথাগোরিয়ানিজম :
    • প্লুটার্ক : শুভ ও অশুভ জগদাত্মা ছাড়াও আরাে কিছু শুভ ও অশুভ সত্তা রয়েছে। নক্ষত্ররাজি পরিচালনার জন্য কিছু দেবতা রয়েছেন, এবং তাদের অধঃস্থন এমন আরাে কিছু দেবদূত রয়েছেন যারা ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী। তাদের মাধ্যমেই ঈশ্বর ও ঈশ্বরের পরবর্তী দেবতাগণ জগতের নৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন এবং তাদেরকেই পাপীদের শাস্তি ও পুণ্যাত্মাদের পুরস্কারপ্রদানের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এসব ডেমন বা দেবতাদের কেউ কেউ মানুষের মতােই স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী, এবং মানুষের মতােই তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে আবার ভালাে মানুষের পক্ষে দেবত্বলাভ সম্ভব। ঈশ্বর এক ও তিনি নিজেকে নানাভাবে ব্যক্ত করেন, বিভিন্ন দেবদেবী ঈশ্বরেরই অভিব্যক্তি, জুপিটার, এপােলাে প্রভৃতি দেবতা একই ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম, এবং একই ঈশ্বরকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন ধর্মতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ। প্রচলিত ধর্মে বর্ণিত অতিপ্রাকৃত দৈববাণী ও সত্যকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ঈশ্বর বিভিন্ন উপায়ে মানুষকে দৈববাণী দিতে পারে, ডেলফি ও অন্যান্য দৈববাণীপীঠের অধিষ্ঠাতা এক একজন ‘ডেমন’ তার নির্বাচিত পুরােহিতের মুখ দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন।
    • ম্যাক্সিমাস : ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যবর্তী বেশকিছু দেবদেবী রয়েছেন। তারা মানুষের স্বর্গীয় অভিভাবক ও ঈশ্বরের সেবকের ভূমিকা পালন করে থাকেন।
    • এপুলেইয়াস : ঈশ্বর ও জড়ের মাঝখানে শুধু দেবদেবীদেরই নয়, প্লেটোর প্রত্যয়সমূহ ও প্রজ্ঞাও আছে। আলবিনাসের মতে, ঈশ্বর ও জগতের মধ্যবর্তী দেবদেবীদের সাথে বিশ্বাত্মা ও প্লেটোনিক প্রত্যয়সমূহ সংযােজিত। বিশ্বসৃষ্টি ঈশ্বরের নয় অধঃস্থন দেবদেবীদের কাজ, ঈশ্বর জড়জগৎ থেকে বহুদূরে থাকেন; তাই তিনি জড়জগতের কোনাে কাজের সঙ্গেই সরাসরি জড়িত নন।
  • ইহুদি দার্শনিক ফিলোজুডিয়াস : বহুঈশ্বরবাদের কেও মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। গ্রিক দেবতারা অশুভ শক্তি নয়, বরং অংশত প্রাকৃতিক ঘটনাবলির, আর কিছুটা প্রাচীন বীরপুরুষদের স্মৃতির ব্যক্তিত্ত্বায়িত রূপবিশেষ। সৃষ্টিকর্মের দায়িত্ব ঈশ্বর কিছু মধ্যবর্তী স্বর্গদূতের হাতে প্রয়োজনীয় শক্তিপ্রদান করে অর্পণ করেন, এবং তাদের শক্তিবলেই জগতের সৃষ্টি। ফিলো কোথাও কোথাও স্বর্গদূতদের ঈশ্বরের ভৃত্য ও অনুচর এবং ঈশ্বর ও জগতের মধ্যস্থতাকারী সত্তা বলে বর্ণনা করেন। আবার কখনো কখনো তাদের স্রেফ অলৌকিক মনের ধারণা ও ক্রিয়া বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু এ দু’রকম বর্ণনার মধ্যে তিনি সন্তোষজনক সামঞ্জস্যবিধান করতে পারেন নি। এসব শক্তি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ কি-না, ফিলো তা-ও স্পষ্ট করে বলেন নি। এ সব শক্তিকে তিনি লোগাসোর অন্তর্ভুক্ত বলেছেন এবং লোগোসকে ঈশ্বরের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বলে বর্ণনা করেছেন।
  • নিওপ্লেটোনিজম :
    • প্লটাইনাস : বিভিন্ন দেবতা উচ্চতর পর্যায়ের অপ্রাকৃত শক্তি। সাধারণ অপ্রাকৃত শক্তিসমূহ এবং সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, পৃথিবী প্রভৃতি সৌরজাগতিক অন্যান্য সত্তা – সকলেই বিশ্বাত্মার সৃষ্টি। এরা সকলেই চৈতন্য-জগতের নিম্নতর এক পরিমণ্ডলে অবস্থান করেন এবং তারা সকলে মূলত এক অথবা বলতে গেলে একই সকলের মধ্যে বিরাজমান। চন্দ্র অবস্থান করেন চৈতন্য-জগৎ এবং নিম্নতর জগতের সীমান্তরেখায। চন্দ্র অপেক্ষা উধ্বতর যে কোনো সত্তাই দেবতা। বিভিন্ন অপ্রাকৃত এবং সৌরজাগতিক শক্তিসমূহ চৈতন্য জগতের নিম্নতর পরিমণ্ডলে অবস্থান করে। অপ্রাকৃত শক্তিসমূহ বিশ্বাত্মা থেকে উৎপন্ন হয়ে পৃথিবীতে বাস করে। তারা চিরন্তন এবং চৈতন্যের উপাদানে তাদের দেহ গঠিত। তারা উধ্বস্থিত চৈতন্য-জগৎ দেখতে পান ; তাদের অনুভবশক্তি ও স্মৃতিশক্তি আছে এবং তারা মানুষের আবেদন শুনতে পান। এছাড়া তারা নিজেদের আগ্নেয় এবং বায়বীয় আচ্ছাদনে নিজেদের আবৃত করতে পারেন। সূর্য নক্ষত্ররাজি এবং পৃথিবী আমাদের প্রার্থনা শোনেন এবং ভবিষ্যৎ সংঘটনের পূর্বাভাষ দেন। কিন্তু তারা প্রাকৃতিক নিয়মানুগ বলে কোনো কার্য ঘটাতে পারে না। তবে তিনি প্রকাশ্য পূজা-অর্চনার প্রতি অনাসক্ত ছিলেন, প্রত্যেক মানুষের উচিত স্বর্গীয় করুণা লাভের জন্য ঊর্ধ্বাভিসারী প্রেমের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করা; অবশ্য “দেবগণই আমাদের কাছে আসবেন, তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে না।” মন্দির নয়, মানুষের হৃদয়ই দেবতাদের বাসস্থান।
    • ম্যালকাস বা পরফিরি : প্রচলিত ধর্মমতের ঘোর বিরোধিতা। পরস্পরবিরোধী গোত্রসমূহ যেসব দেবদেবীর উপাসনা করে, তারা প্রকৃত দেবতা নয়, ভূতপ্রেত। যারা সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী নয়, রূপকের সাহায্যে তাদের শিক্ষার জন্য দেবদেবীদের কল্পনা করা হয়। আর এজন্যই পশু-পাখি, এমনকি গাছ-পাথরকেও দেবতা বলে গণ্য করা হয়েছে। দার্শনিকের ধর্মই যথার্থ ধর্ম। দার্শনিক কোনোদিন তথাকথিত দেবতা বা শয়তানের উপাসনা করেন না। দার্শনিক পরম আধ্যাত্মিক সত্তার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন।
    • ইয়ামব্লিকাস : বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার চেয়ে প্যাগান দেবগোষ্ঠী, অপ্রাকৃত জাদু-রহস্যের প্রভাব এবং অলৌকিক বিভিন্ন শক্তি সম্পর্কিত বিশ্বাসকেই অধিক সমর্থন করেন। তিনি এয়ী (Triad) সমন্বিত একটি যৌক্তিক পদ্ধতির পরিকল্পনা করেন, যার দ্বারা তিনি হোমার উল্লিখিত এবং অন্যান্য দেবতাবগের একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা দেন। পরমসত্তা থেকে উদ্ভূত হয় দ্বিতীয় এক একক সত্তা, যা জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং সংখ্যা ও বহুত্ব সৃষ্টিতে সক্ষম। অর্থাৎ জগৎ ও জীবসমূহ মূল একক সত্তা থেকে উদ্ভূত দ্বিতীয় সত্তার অংশবিশেষ। এই দ্বিতীয় একক সত্তা (যাকে বহুর মধ্যে এক বলা চলে) থেকে সৃষ্টি হয় তিন শ্রেণীর দেবতার। প্রথম শ্রেণীর দেবগণই কেবল বুদ্ধিবিশিষ্ট; দ্বিতীয় শ্রেণীর দেবগণ বিশ্বের বাইরে অবস্থান করেন, আর তৃতীয় শ্রেণীর দেবদেবীরা বিশ্বের অভ্যন্তরে অবস্থান করেন। তারাই সরাসরি আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সাহায্যে আমরা এসব দেবদেবীর সংস্পর্শে এসে থাকি। এরাই সত্যিকার দেবদেবী। এরাই আমাদের প্রার্থনার লক্ষ্যবস্তু, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উপলক্ষ, এবং এদের জন্যই আমরা তৈরি করি যজ্ঞবেদী।
    • প্রোক্লাস : তিনপ্রকার ত্রয়ীর সাহায্যে বহুদেববাদের একটি যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নির্ণয় করা হয়।

মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও নিয়ন্ত্রণবাদ

  • স্টোয়িসিজম : যৌক্তিক চিন্তার কর্তা হিসেবে মানুষ স্বাধীন। ইতর প্রাণীর মতো মানুষ নিছক আবেগ-প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত নয়; চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণের সাহায্যে সে যা নির্বাচন করে, তার পেছনে প্রজ্ঞার সমর্থন থাকে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ স্বাধীন তখনই, যখন সে প্রজ্ঞার বিধান অনুসারে, অর্থাৎ প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম অনুসারে চলে। বিজ্ঞজন যা করতে চান এবং প্রজ্ঞা বা প্রকৃতি যা করতে নির্দেশ দেয়, এ দুটির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। দার্শনিকমাত্রই সত্যের পরিপূর্ণ শৃঙ্খলার অধিকারী। তিনি ঈশ্বরের মতোই স্বাধীন। স্বাধীন ক্রিয়া হলো মানুষের তথা বিশ্বের প্রজ্ঞাসম্মত প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যাবলি। অর্থাৎ, যারা বিজ্ঞজন নন তারা জড় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, আর যারা বিজ্ঞবান তাদের স্বাধীনতা আসলে ঈশ্বর বা বিশ্বাত্মা বা লোগোসের উদ্দেশ্যের সাথেই সমন্বিত, আর এভাবেই নিয়ন্ত্রণবাদ কাজ করে।
  • নিওপিথাগোরিয়ানিজম :
    • প্লুটার্ক : মানবাত্মা শুভ ও অশুভ জগদাত্মা থেকে যথাক্রমে শুভ ও অশুভ শক্তি পেয়ে থাকে। এসব শক্তি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মানবাত্মার নিজের। অশুভ জগদাত্মা থেকে আসে ইন্দ্রিয় ও দৈহিক কামনা বাসনা ইত্যাদি; আর শুভ জগদাত্মা থেকে আসে উচ্চতর প্রজ্ঞা, যা মানুষের মধ্যে দেবতাস্বরূপ। স্বাধীন ইচ্ছা স্বীকার্য, নিয়ন্ত্রণবাদ ভুল। মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী; তাই মানুষের যাবতীয় দুঃখ-ক্লেশের জন্য মানুষ নিজেই দায়ী। নিম্নতর প্রবৃত্তির চাপে মানুষ যা করার ইচ্ছা অনুভব করে, মানুষের উচ্চতর প্রজ্ঞার সাহায্যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে। যারা এই ক্ষমতার ব্যবহার করেন তারাই পুণ্যাত্মা, আর যারা তা না করে দৈহিক শক্তির চাপে কুকর্মে লিপ্ত হয়, তারাই পাপী।
  • ইহুদি দার্শনিক ফিলোজুডিয়াস : লোগোস ইন্দ্রিয়ের প্রভাবে মানুষের দেহগ্রহণ করে এবং মানুষে পরিণত হয়। তাই প্রতিটি মানবাত্মা অলৌকিক সত্তার অংশবিশেষ, অলৌকিক মনের প্রতিচ্ছবি এবং তার উৎপত্তিস্থল থেকে বিচ্যুত ইন্দ্রিয় ও দেহের নিগড়ে সাময়িকভাবে আবদ্ধ ঈশ্বরের শক্তিবিশেষ। স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার থেকেই পাপের সৃষ্টি। প্রজ্ঞার নির্দেশ অমান্য করে দৈহিক সুখে নিমগ্ন হওয়ার অর্থই হলো স্বাধীন ইচ্ছার অপব্যবহার করা এবং পাপে লিপ্ত হওয়া। দেহ আত্মার কবরস্বরূপ, দেহই যাবতীয় অশুভের আকর। দেহের প্রভাবেই পাপের সৃষ্টি। আমাদের সবার মধ্যেই আদিপাপ সংক্রমিত; কেননা আমরা সবাই দেহের অধিকারী। এমতাবস্থায় আমাদের সকলেরই উচিত প্রজ্ঞার নির্দেশ মান্য করা এবং ইন্দ্রিয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। আমাদের উচ্চতর প্রকৃতির আদিনিবাস স্বর্গীয় জগৎ; আর প্রজ্ঞার অনুশীলন দ্বারা দেহের নিগড়মুক্ত হয়ে স্বর্গে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই চূড়ান্ত মুক্তি নিহিত।
  • নিওপ্লেটোনিজম :
    • প্রোক্লাস : আত্মা যখন স্বাধীনভাবে কাজ করে, তখন সে পাপাচারে লিপ্ত হতে পারে না। আত্মা নিয়ন্ত্রণের এই স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। অন্যায়-অশুভের অনুষ্ঠান এর স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপস্বরূপ। তাই অন্যায়-অশুভ অনুষ্ঠানের স্বাধীনতা অপূর্ণ স্বাধীনতা। অপূর্ণতার ফলেই মানুষ তার স্বাধীনতাকে ভুলপথ নির্বাচনে ব্যবহার করে থাকে। মানুষ অপূর্ণ বলে নিজ প্রকৃতি অনুসারে কাজ না করার ক্ষমতা তার থাকতেই হবে। আর এই ক্ষমতাই তাকে বাহ্যশক্তি ও কারণ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে বাহ্যশক্তির ক্রীড়নক করে তুলতে পারে। মানে পূর্বের দর্শনগুলোর মতই এখানে ধারণা করা হচ্ছে যে, ঈশ্বরের পথে থাকাটাই প্রকৃত স্বাধীনতা যেখানে ব্যক্তির কাজ ইশ্বরের উদ্দেশ্যের সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ, অন্যদিকে ইন্দ্রিয় প্রবণতা অপূর্ণ স্বাধীনতা যেখানে ব্যক্তি জড়ের অধীনে চালিত। সত্যি বলতে, তখনও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণবাদের ধারণার উদ্ভব ঘটেনি।

আত্মার অমরত্ব ও পুনর্জন্ম

  • স্টোয়িসিজম : কারো মতে, জগৎ ধ্বংস হওয়ার সাথে আত্মাও ধ্বংস হয়ে যাবে, করোও মতে সাধারণ লোকের আত্মা জড়ীয় বলে দেহের অবসানেই তা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বিজ্ঞজন ও পুণ্যবানদের আত্মায় জড়ের প্রভাব কম বলে দেহবিনাশের পরও তাদের আত্মা টিকে থাকে। তবু আত্মা অমর বলা যায়না, দীর্ঘদিন টিকে থাকলেও যে অনন্ত জীবনপ্রবাহ থেকে আত্মার উৎপত্তি, পরিণামে তার সাথেই আত্মা মিলিত হবে।
  • নিওপিথাগোরিয়ানিজম : আত্মা অমর ও অবিনশ্বর। আত্মার প্রাক-জন্ম অস্তিত্ব আছে।
    • প্লুটার্ক : আত্মা অমর। মৃত্যুতে আত্মার প্রজ্ঞাংশ দেবদূতের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয় এবং অনন্তকাল ধরে তাদের সঙ্গেই অবস্থান করে, কিংবা পূর্বজন্মের অশুভ কর্মের ফলে পুনরায় মানবদেহে প্রবিষ্ট হয়। দুষ্ট লােকের আত্মা পরবর্তী জন্মে ইতরপ্রাণীর রূপ নিতে পারে।
    • হারমেটিকগণ : মানুষের আত্মা ও প্রজ্ঞার উৎপত্তি স্বর্গীয় সূত্র থেকে, এবং পুণ্যকাজ অনুষ্ঠানের ফলে পরিণামে তারা তাদের আদিনিবাসে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন।
  • ইহুদি দার্শনিক ফিলোজুডিয়াস : দেহের প্রভাবেই পাপের সৃষ্টি। আমরা সবাই দেহের অধিকারী বলে আমাদের সবার মধ্যেই আদিপাপ সংক্রমিত, তাই সকলেরই প্রজ্ঞার নির্দেশ মান্য করা এবং ইন্দ্রিয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। আমাদের উচ্চতর প্রকৃতির আদিনিবাস স্বর্গীয় জগৎ; আর প্রজ্ঞার অনুশীলন দ্বারা দেহের নিগড়মুক্ত হয়ে স্বর্গে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই চূড়ান্ত মুক্তি নিহিত।
  • নিওপ্লেটোনিজম :
    • প্লটাইনাস : পার্থিব জীবন স্বর্গীয় বিশুদ্ধতা থেকে বিকীর্ণ, এবং আত্মা অবশ্যই ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলিত হবে। গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই এক অনন্ত সত্তার প্লাবনধারা। ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলনই এর উদ্দেশ্য। দেহ ধারণের আগে আত্মা অতীন্দ্রিয় বুদ্ধিজগতের অধিবাসী ছিল, এবং তখন তা মরমি স্বজ্ঞার সাহায্যে চিরন্তন নওস বা বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার ধ্যানে আবিষ্ট ছিল। ঈশ্বরের দিকে দৃষ্টিপাত করে আত্মা শুভের জ্ঞানলাভ করে। এরপর যখনই তা তার দৃষ্টি জগৎ ও জড়ের দিকে নিবদ্ধ করলো, তখনই সূচিত হয় তার পতন। অহংজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের উদয় হওয়া মাত্রই আত্মা অনন্ত জীবনসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বার্থান্ধ ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পতন বা অবনতির ফলেই আত্মার দেহপ্রাপ্তি ঘটে, এবং বর্তমান জীবনে আমরা যেসব দুঃখভোগ করি, সেগুলোর সবই এ অবনতির শাস্তিস্বরূপ। জীবদেহধারণ প্রথমে আত্মার ইচ্ছাধীন ছিল – আত্মা স্বেচ্ছায় দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বাসনা যখনই কার্যে পরিণত হলো, অমনি আত্মার স্বাধীনতা লোপ পায়। আর তখন থেকেই আত্মা প্রকৃতির অধীন হয়ে যায়। বিশ্বাত্মার ন্যায় মানবাত্মাও জড় ও বুদ্ধির সমবায়ে গঠিত। মানবাত্মা জড়দেহের মধ্যে আবদ্ধ বলে তা জড়জগতের নিয়মাবলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তার আদিনিবাস বুদ্ধির জগৎ, আর তাই জড়ের বন্ধনমুক্ত হয়ে আত্মা বুদ্ধির অভিমুখে অগ্রসর হতে চায়। বুদ্ধিজগৎ থেকে জড়জগতে অবতীর্ণ হলেও বুদ্ধির সাথে আত্মার সম্বন্ধ সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে যায় নি, মানবাত্মা বুদ্ধিজগৎ ও জড়জগতের সাথে যুক্ত। যে বুদ্ধির জগৎ থেকে পতনের ফলে আত্মা দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, দেহের বন্ধনমুক্ত হয়ে সেই জগতে প্রত্যাবর্তনই তার শেষ লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে সে ব্যর্থ হলে বা আত্মা দেহের বন্ধনে আবদ্ধই থেকে গেলে মৃত্যুর পর তা তার কর্মফল অনুসারে অন্যকোনো ব্যক্তি, ইতরপ্রাণী কিংবা উদ্ভিদের দেহের সঙ্গে যুক্ত হয়।
    • ম্যালকাস বা পরফিরি : মানুষ পরজন্মে পশুর পর্যায়ে অধঃপতিত হতে পারেনা।

নৈতিক মানুষের স্বরূপ ও ঈশ্বর প্রাপ্তির যোগ্যতা

  • স্টোয়িসিজম : মানুষের হয় সদিচ্ছা থাকবে, না হয় থাকবে না; এর মাঝামাঝি অন্যকিছু নেই। মানুষ হয় হবেন বিজ্ঞ, আর না হয় নির্বোধ। এদিক থেকে কোনো একটি বিষয়ে ধার্মিক হলে অন্য বিষয়ে অধার্মিক হওয়া অসম্ভব; কারণ এক ধর্মের উপস্থিতিতে অন্যান্য ধর্মও উপস্থিত থাকবে।
  • নিওপিথাগোরিয়ানিজম :
    • প্লুটার্ক : নিছক শুভকর্মে নয়, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতায়ই মানুষের প্রকৃত শান্তি ও মুক্তি নিহিত। এই ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বা ঐশ্বরিক জ্ঞানের ওপর নাস্তিকতার প্রভাব নিতান্তই ধ্বংসাত্মক, নাস্তিকতা মানবপ্রকৃতির আধ্যাত্মিক দিকটিকে দেউলিয়া করে দেয়। প্রচলিত ধর্মতত্ত্বে বর্ণিত গল্প ও উপাখ্যানসমূহে ঈশ্বর ও দেবদেবীদের সম্পর্কে বহু কুসংস্কার বিদ্যমান যেগুলোর প্রভাবও ক্ষতিকর।
    • এপুলেইয়াস : দেহের পিঞ্জর ও জগতের শৃঙ্খল থেকে আত্মার মুক্তিতেই প্রকৃত পরিত্রাণ নিহিত।
  • ইহুদি দার্শনিক ফিলোজুডিয়াস : পূর্ববর্তী সব চিন্তাবিদ, সমকালীন স্টোয়িকরা, এমনকি সংশয়বাদীরাও তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ইহুদি ধর্মশাস্ত্রে বিধৃত খাঁটি সত্যের অনুমান করেছিলেন। দার্শনিক ও পয়গম্বরগণ ভিন্ন উপায়ে একই সত্যের সন্ধান পান। নৈতিক জীবন ধর্মীয় জীবন থেকে মুক্ত নয় ও ধর্মের প্রারম্ভিক পর্ব। তাই বুদ্ধি অনপেক্ষ নয়, এটি বিশ্বাসের চেয়ে নিকৃষ্ট। ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী; যশ সম্মান ইত্যাদি সবই দৈবাধীন। ধনসম্পদ আপতিক সৌভাগ্যের ব্যাপার। শুধু বিশ্বাসের কথা স্বতন্ত্র। বিশ্বাস মানুষকে যথাযথভাবে মহৎ করে তোলে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত এবং আধ্যাত্মিক জীবনকে সমৃদ্ধ করে। বিশ্বাস মানুষের মনকে আশা প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ করে তোলে। একজন বিশ্বাসী মানুষের ধ্যান-ধারণা জীবনের ঘাত প্রতিঘাত দ্বারা বিঘ্নিত হতে পারে না, দুঃখকষ্টও তার আনন্দ কমাতে পারে না।
  • নিওপ্লেটোনিজম :
    • প্লটাইনাস : মানুষের উচিত সৎকাজের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন। ইন্দ্রিয়সংযম ও বৈরাগ্য অনুশীলন এ ব্যাপারে সহায়ক হতে পারে। কামনা বাসনাকে জয় করে নির্মল ভক্তিপূর্ণচিত্তে গভীর ধ্যানের সাহায্যেই কেবল আত্মা তার বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে। এভাবে মুক্তিলাভের পর পরিশেষে আত্মা শাশ্বত প্রত্যয়জগতে প্রত্যাবর্তন করে এবং ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করে। এর জন্য প্রবৃত্তি দমনই যথেষ্ট নয়, আত্মাকে অবশ্যই দৈহিক কামনা জয় করে বাসনার পর্যায় অতিক্রম করে পুরোপুরি বিশুদ্ধ হতে হবে, যার তিনটি পথ রয়েছে – ললিতকলা, প্রেম এবং তত্ত্বজ্ঞান, যেগুলো একই পথের তিনটি শাখা। সুন্দরের চিন্তা, সুন্দরের সংস্পর্শ এবং সুন্দর ও পবিত্রের জ্ঞানই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভে সহায়ক। যিনি একবার পরম সুন্দরের দর্শন পেয়েছেন, তিনি অন্য কোনো আনন্দের আকাঙ্ক্ষা রাখেন না। যিনি এই অনন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছেন, তিনিই দার্শনিক। তার কাছে পার্থিব যেকোনো সৌন্দর্য তুচ্ছ। তিনি যে অব্যক্ত আনন্দের সন্ধান পান, এর জন্য তিনি যেকোনো পার্থিব সুখ সানন্দে বিসর্জন দিতে পারেন। এ আনন্দ থেকে যে আবেশের সৃষ্টি হয়, তাই মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার সংযোগসূত্র।
    • যুক্তিতর্ক নয়, উচ্চতর ভাবসমাধি অবস্থায় উন্নীত হয়েই আত্মা ঈশ্বরের সাথে সংযোগস্থাপন ও একাত্মবোধ করতে সক্ষম হয়। আমাদের অভিজ্ঞতার কোনো মাধ্যমে এ মিলনের সংজ্ঞা নির্দেশ সম্ভব নয়। শুধু নঞর্থকভাবে একে ব্যাখ্যার চেষ্টা করা যেতে পারে। ভাবসমাধি অবস্থায় উত্তীর্ণ আত্মা আকারহীন, আত্মসংবিদহীন। এখানে আত্মা গতি ইচ্ছা আবেগ প্রজ্ঞা ও চিন্তাবিবর্জিত। এ অবস্থাকে দিব্যদর্শনও বলা চলে না। এটা বরং অন্য এক ধরনের ‘দেখা’ ও আত্মসমর্পণ। প্রচলিত অর্থে একে ঈশ্বরের সাথে মিলনও বলা চলে না; কেননা মিলন কথাটি দুটি স্বতন্ত্র জিনিসের একত্রে মিশ্রণকে নির্দেশ করে। কিন্তু আত্মা ঈশ্বর থেকে স্বতন্ত্র নয়, অভিন্ন। আত্মশুদ্ধিলাভের মাধ্যমে এবং পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা পুনরায় তার আদিনিবাসে প্রত্যাবর্তন করে এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হয়, যা আত্মার মুক্তিপ্রচেষ্টার শেষ ও চূড়ান্ত ধাপ, এবং এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে জন্মান্তরবাদের। এখানে স্বাতন্ত্র্যবোধ নেই, দেশ কাল ও বহুত্বের চেতনা নেই। দার্শনিক যুক্তিতর্কের মাধ্যমে এই অবস্থার ব্যাখ্যা করা যায় না বলে মরমি অভিজ্ঞতা বৌদ্ধিক বোধের অতীত।
    • আত্মচৈতন্যই আত্মার আত্মজ্ঞান, আত্নচেতনায় আত্মা বিম্বিত হয়। ব্যক্তির কাম্য, যেমন, সামাজিক ন্যায়, পরস্পরের সহানুভূতি প্রভৃতি আত্মিক জগতেরই অন্তৰ্গত; তার বাইরে এইরূপ কোন কাম্য নেই। আত্মা অপরাপর আত্মার সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে ব্যক্তিত্ব আত্মারই বৈশিষ্ট্য। আত্মা স্বরূপত ‘উদ্দেশ্যসাধক’ (teleological) এবং আত্মা ধারণা বা আদর্শাবলীকে মূর্ত করার জন্যই বেঁচে থাকে। আত্মার নিজস্ব বিশেষ কার্যাবলী আছে, কিন্তু যখন এটি ইচ্ছা করে এটির ঐচ্ছিক কার্য ওপর থেকে অনুপ্রাণিত হয়, যা এটির নীচে থাকে তাকে আত্মা প্রত্যক্ষ সৃষ্টি শক্তি দ্বারা পরিচালিত করে। ব্যক্তি-আত্মা উচ্চতর জীবন থেকে নিম্নতর জীবনে আগমন করে এবং পুনরায় উচ্চতর জীবনেই প্রত্যাবর্তন করে। এটি স্বেচ্ছায় নেমে আসে যাতে নিম্নতম পর্যায় অবধি এটির বৃত্তিগুলো সঞ্চারিত হয়। এই পদ্ধতিতে আত্মা নিজের শক্তি প্রকাশ করে এবং ভালমন্দের জ্ঞান লাভ করে। কিন্তু এটি ক্ষতিগ্রস্তও হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলেই এটির নিম্নতর জীবনে আগমন দোষজনক। যত স্বল্পস্থায়ী এই নিয়েগমন ততই ক্ষতি কম। অবশ্য এই নিম্নাগমন সত্বেও আত্মার মর্মকোষ সদা শুদ্ধই থাকে।
    • মানুষের দেহ, আত্মা ও চৈতন্য এই তিন অংশ পৃথক। চৈতন্য আত্মার মতই জীবন নিহিত সূত্র হলেও তুলনামূলকভাবে উচ্চতর পর্যায়েই এটি নিহিত। আত্মা চৈতন্যের নিম্নস্তরে হলেও আত্মা চৈতন্যাপেক্ষী, চৈতন্যের স্পর্শ-সংস্কার গ্রহণ করে এবং সুন্দরতর হয়ে ওঠে। যখন আমাদের বিচারশক্তি চৈতন্যের স্পর্শ-চিহ্ন পায় তখন কেবল আমাদের সৌন্দর্যই বর্ধিত হয় না, আমরা নিজেরাই চৈতন্যের সাথে একাত্ম হয়ে যাই। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের বিষয় আছে আমাদের নিম্নস্তরে, যুক্তি-বিচারের বিষয় থাকে আমাদের সমস্তরে; এবং চৈতন্যের বিষয় আমাদের উচ্চস্তরে; এবং এই শেষােক্ত বিষয় আমরা দেখতে পাই তখনই যখন চৈতন্যের আলোক আমাদের ওপর এসে পড়ে। চৈতন্যসদ্ভূত জ্ঞান বা চৈতন্য-প্রত্যঙ্গ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ এবং যুক্তি বিচার উভয় থেকে স্বতন্ত্র। এটি ধারণা বা আদর্শ জানার বৃত্তি এবং চৈতন্য এই ধারণাবলী জানার সময় নিজেকেই জানে। তাই যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে আত্মা অপর বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করে, চৈতন্য নিজের সম্পর্কে চিন্তা করে। আত্মজ্ঞানই এটির স্বরূপ-বৃত্তি। চৈতন্যের স্বরূপ যেহেতু জ্ঞান, তাই এটির জ্ঞান এবং সত্তা অভিন্ন। চৈতন্য-প্রত্যক্ষের সকল বিষয় (ধারণাবলী) সর্বদাই একত্রে অর্থাৎ এক নিত্য বর্তমানে তাদের নিত্য স্বরূপ নিয়ে চৈতন্যে বিধৃত হয়ে আছে, কিন্তু এই বিষয়গুলো চৈতন্য-বহির্গত নয়। উক্ত বিষয়গুলো নিয়েই চৈতন্য, যেমন বিভিন্ন অংশকে নিয়ে সমগ্র। প্রতিটি সামান্যধারণাই চৈতন্যরূপ এবং সমগ্র চৈতন্য আসলে সামান্যধারণা। চৈতন্যের মধ্যেই সত্য এবং পরমতত্ত্বের ক্ষেত্রেও এটি স্বীকৃত। সত্তা, চৈতন্য-জ্ঞান এবং চৈতন্য এক এবং অভিন্ন। ফলত চৈতন্য, প্রকৃতজগতের জ্ঞান এবং প্রকৃত জগৎ অভিন্ন। তাদের পারস্পরিক পৃথক আলোচনা সম্ভব হলেও তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন বা পৃথক সত্তা নয়।
    • দিব্যতত্ত্বেরও ত্রিধাবিভাগ – বিশ্বাত্মা, দিব্যচৈতন্য এবং অদ্বৈতসত্তা বা পরমব্রহ্ম। দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞান (Dialectic) চেতন-জগৎ নিয়ে আলোচনা করে যার মূল সূত্রগুলোর উৎপত্তি চৈতন্য থেকে। মানবাত্মা এই বিজ্ঞান অনুশীলন করে, মানবাত্মা যে সূত্রাবলী গ্ৰহণ করতে সমর্থ চৈতন্য সেই সূত্রাবলী আত্মাকে দেয়। এই সূত্রাবলী গ্ৰহণ করে মানবাত্মা উক্ত বিজ্ঞান প্রদত্ত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে, সংগ্রথিত করে যতক্ষণ না চৈতন্য-জ্ঞানে এসে উপনীত হয়। যে অনুপাতে মানবাত্মা ঐ মূলসূত্রাবলী গ্ৰহণ করতে সমর্থ সেই অনুপাতে মানবাত্মাই চৈতন্যে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি একটি যৌক্তিক পদ্ধতি, কিন্তু এটি যুক্তিশাস্ত্রকে অতিক্রম করে স্বজ্ঞাস্তরে (intuition) উন্নীত হয়।
    • পরম এক, সকল কিছুর মূলাধার, আমাদের অজ্ঞেয়, এমনকি চৈতন্য যখন নিজস্ব স্বজ্ঞা (intuition) এবং চৈতন্যজগৎ নিয়ে ব্যাপৃত থাকে তখন একে জানতে পারে না। কিন্তু প্রেমাকাঙ্ক্ষায় যখন চৈতন্য নিজেকে অতিক্রম করে তখন সেই মুহুর্তের জন্য এটি পরম একে রূপান্তরিত হয়, যাকে সে কখনও জানতে পারবে না। এসব মুহূর্তে দ্রষ্টা এবং দৃষ্টের, অন্বেষণকারী এবং অম্বিষ্টের একাত্মতা এতই সম্পূর্ণ হয় যে এটি জ্ঞাতা-জ্ঞেয় পার্থক্য অতিক্রম করে যায় এবং ফলত জ্ঞানের বা জ্ঞানের সম্ভাবনার প্রশ্ন সেক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এইসকল মুহূর্ত তখনই আসে যখন আমরা সেই পরম একের প্রতি প্রদীপ্ত প্রেমে নিজেদের নিরাবরণ করে ফেলি, এমন কি চৈতন্য-জগতের সব কিছু যখন খলিত হয়ে যায়। কারণ পরম একের উপলব্ধি তখন অসম্ভব যখন আমরা ‘অপর’-কে নিয়ে বিব্রত থাকি। মানবাত্মা কোনো কিছুর জন্য এমন কি স্বর্গের স্বর্গলাভের পরিবর্তেও সেই পরম একের সাথে নিজের একাত্ম অবস্থা ত্যাগ করবে না। তখন আত্মা এত উন্নতশীর্ষে আরোহণ করে যে এটি পূর্বে যে চৈতন্য-স্বজ্ঞাকে (spiritual intuition) অতিমূল্যবান মনে করেছিল তাকে তুচ্ছ ভাবে। চৈতন্য চিন্তার মাধ্যমে চৈতন্য-জগতকে জানে। চৈতন্য কোনো কোনো মুহূর্তে পরম একের প্রেমে সেই একেই রূপান্তরিত হয়। মানবাত্মা এবং পরম এক দুটো যখন সমকেন্দ্রিক বৃত্তের মতো যখন পরস্পর মিলে যায় তখন তারা অভিন্ন এবং পৃথক হলেই দুই। আত্মা যখন পরম ব্রহ্মের সাথে একাত্ম হয়ে যায় তখন এটির যে দিব্য প্রত্যক্ষ হয় (vision) তা এতই সাক্ষাৎ যে বর্ণনা করা যায় না, কেননা যা প্রত্যক্ষ হচ্ছে তা যদি প্রত্যক্ষকারীর সাথে অভিন্ন বলে প্রতিভাত হয় তবে তিনি তাকে আপন থেকে পৃথক বলে বর্ণনা করতে পারেন না। অপর ব্যক্তি যিনি নিজে সেই দিব্য প্রত্যক্ষের আনন্দ লাভ করেননি তাকে তা দেখানো যায়না। এইরূপ দিব্য-প্রত্যক্ষের সামর্থ্য যদিও সকল ব্যক্তিরই আছে তবুও অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই এটি কার্যে প্রয়োগ করতে পারেন।
    • ম্যালকাস বা পরফিরি : জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি কথায় ও কাজে ঈশ্বরের উপস্থিতি স্বীকার করতে হবে এবং ঈশ্বরকে সাক্ষী রাখতে হবে। সব শুভ কাজের জন্য যেন ঈশ্বরকেই কৃতিত্ব দেয়া হয়; কিন্তু সব অপকর্মের জন্য আমরা নিজেরাই যে দায়ী, একথা যেন মনে রাখি। ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ। সব কাজকর্মে আমাদের ঈশ্বর সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। সর্বোপরি আমাদের উচিত অধর্মকে এড়িয়ে চলা।
    • ইয়ামব্লিকাস : প্লটাইনাস কথিত ‘আত্মা’র ‘চৈতন্যে’ অংশ গ্রহণ এবং চৈতন্যের ‘পরম এক’-এ অংশগ্রহণ সম্পর্কিত পরিকল্পনা ভুল, কারণ সেই পদ্ধতি সেই অনির্বচনীয় এক-এর অন্যনিরপেক্ষ অদ্বয়সত্তার ব্যাঘাত ঘটায়। এই যুক্তিতে খ্রীষ্টীয় ‘মানুষ-ঈশ্বর’ তত্ত্বও ভুল। অশুভ ভূতপ্রেতের অস্তিত্ব সত্য। মানবাত্মা অসংখ্য ভূতপ্রেত দ্বারা পরিবৃত। মানুষ যতই ধর্মকর্ম করুক-না কেন, তার পক্ষে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ অসম্ভব। মানুষ কোনো অবস্থাতেই ইন্দ্রিয়ের প্রভাব বা দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। মরণোত্তর জীবনেও মানুষ সহজে ইন্দ্রিয় ও দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না। শুভ কাজের মাধ্যমে আত্মার পক্ষে ঈশ্বরের সাথে সংযোগস্থাপন সম্ভব নয়। মানবাত্মা ও ঈশ্বরের মধ্যে যে দূরত্ব, তা অনতিক্রম্য। আত্মা কোনোদিন নিজস্ব চেষ্টায় তার নিজস্ব শক্তিতেই অশুভ থেকে দূরে থাকতে এবং মোক্ষলাভ করতে সক্ষম পারে না। অশুভ প্রেতাত্মাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হলে আত্মাকে অবশ্যই দেবদেবীদের সাহায্য নিতে হয়। আর এ জন্য তাকে নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হবে।
    • প্রোক্লাস : মানবাত্মার এক পা বুদ্ধির জগতে, অন্য পা ইন্দ্রিয়জগতে, তাই সে একদিকে যেমন চিন্তা করে, অন্যদিকে তেমনি অনুভবও করে। আত্মার প্রজ্ঞাংশকে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করাতেই নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতি নিহিত। আত্মা নিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা, আত্মা স্বাধীনভাবে কাজ করলে পাপাচারে লিপ্ত হতে পারে না। অন্যায়-অশুভের অনুষ্ঠান এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে সেটার স্বাধীনতা অপূর্ণ স্বাধীনতা, যে অপূর্ণতার কারণে মানুষ তার স্বাধীনতাকে ভুলপথ নির্বাচন করে। কিন্তু মানুষ ইচ্ছা করলে শুভকে নির্বাচন করতে পারে। মানবাত্মা যেন অশুভ শক্তিসমূহের মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় তাই ঈশ্বর একে প্রয়োজনীয় শক্তিপ্রদান করেন। ঐশ্বরিক সাহায্য না পেলে মানবাত্মার পক্ষে মোক্ষলাভ কখনো সম্ভব হতো না। চূড়ান্ত মুক্তি বা মোক্ষলাভের জন্য মানুষের পক্ষে দেবতাদের সাহায্য অপরিহার্য। এ জন্যই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে দেবতাদের সন্তোষবিধান কাম্য। এ ব্যাপারে প্রার্থনা বা উপাসনার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর সাহায্যে মানুষ ঐশ্বরিক সত্তার দিকে অগ্রসর হতে এবং পরিণামে তার সাথে মিলিত হতে পারে। নৈতিক দর্শন হচ্ছে সেই অনির্বচনীয় পরম একের দিব্যদর্শন। মানবাত্মা তখনই কেবল এটি লাভ করতে পারে যখন আত্মা নিজের অন্তরতম সবরূপে প্রবেশ করে যেখানে সেই পরম একের অবস্থিতি। যখন এটি ঘটে তখন আমরা দিব্যানন্দে অথবা ভাবোন্মত্ত অবস্থায় থাকি। কেবল এই অবস্থাতেই পরম একের সাথে একাত্ম হওয়া যায়, এবং এই একাত্মতার মধ্যেই পরম অভীষ্টে উপনীত হওয়া যায়। তিনি স্বর্গীয় শক্তি এবং অপ্রাকৃত শক্তিসমূহের করুণালাভের উপায়রূপে জাদু-কৌশল চর্চা এবং ধর্মসম্মত বিধি ও অভ্যাসাদি পালনেরও নির্দেশ দেন।

সুখবাদ নিয়ে অবস্থান ও ইন্দ্রিয়-প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ

  • স্টোয়িসিজম : সুখবাদ গ্রহণযোগ্য নয়, প্রত্যেক প্রাণীই তার নিজকে ও তার জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাই আত্মসংরক্ষণ ও নিজ জাতির সংরক্ষণই মানুষের কর্মপ্রচেষ্টার লক্ষ্য। সুখ কর্মপ্রচেষ্টার লক্ষ্য নয়, সহগামীমাত্র। নৈতিক বৈরাগ্যবাদ ঠিক।
  • নিওপিথাগোরিয়ানিজম : সংসার ও রক্তমাংসের দেহ আত্মার শত্রু। ইন্দিয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা তার স্বর্গীয় আদি নিবাসে প্রত্যাবর্তন করলে মুক্তি আসে। জীবন পরিশুদ্ধির জন্য দৈহিক আমােদ-প্রমােদ ও ভােগবিলাস বর্জন করা দরকার। তবে মাংসভক্ষণ ও মদ্যপান নিষিদ্ধ নয়, চিরকৌমার্য সমর্থনযোগ্য নয়, জৈবিক প্রয়ােজনের জন্য নয়, স্রেফ বংশবৃদ্ধির খাতিরেই যৌনক্রিয়া অনুমােদনীয়।
    • প্লুটার্ক : একমাত্র সুখই শুভ নয়। তবে সুখ বাহ্যশুভ, এবং মানুষের আনন্দের সঙ্গে দৈহিক কার্যকলাপের সম্পর্ক আছে। এসব জিনিস অনাবশ্যক নয় বলে এদের উপেক্ষা করে যথার্থ আনন্দ পাওয়া যেতে পারে না। শুভ ও উন্নত জীবনের পক্ষে প্রবৃত্তির কামনা বাসনা আবেগ অনুভূতি ইত্যাদি প্রয়ােজনীয়; কেননা এগুলােও মানবপ্রকৃতির আবশ্যিক উপাদান।
    • ম্যাক্সিমাস : আত্মা স্বর্গীয় সত্তার স্ফুলিঙ্গবিশেষ, ক্ষণিকের জন্য দেহের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলেও সৎকার্যের ফলে পরিণামে আত্মা তার তার আদি স্বর্গীয় নিবাসে ফিরে যেতে পারে।
    • নিউমেনিয়াস : নৈতিক মতের কঠোরতা সমর্থনযোগ্য নয়, দৈহিক কার্যকলাপকে যেকোনাে অবস্থায়ই অশুভ বলা চলে না। প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত না হয়ে অযৌক্তিক ও অশুভ বিশ্বাত্মার শিকার হলেই কেবল তারা অশুভ। তবে এক উচ্চতর অবস্থা থেকেই আত্মার প্রজ্ঞাংশ দেহে প্রবিষ্ট হয়েছে। দেহের শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে উচ্চতর স্বর্গীয় আদিআত্মায় প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই আত্মার মুক্তি বা পরিত্রাণ নিহিত। বিদেহী অবস্থা থেকে কয়েকবার দেহপ্রাপ্ত হওয়ার মাধমে সম্পূর্ণ পাপমুক্ত হয়েই মানুষ চূড়ান্ত মুক্তিলাভ করতে পারে। প্রজ্ঞার বিধান অনুসারে কাজ করা এবং ঈশ্বরের সঙ্গে যােগাযােগ রাখাই আমাদের বর্তমান জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
    • হারমেটিকগণ : একদিকে তারা বাহ্যজগৎ ও ইন্দ্রিয় থেকে নিজেদের বিযুক্ত করে ঈশ্বরের সঙ্গে অপরােক্ষ যােগাযােগ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন, অন্যদিকে আবার বলেছেন যে, আমরা যে জগতে বাস করছি তাকে ঘৃণা ও উপেক্ষা করা অনুচিত। শুধু তাই নয়, উপদেশ দিচ্ছেন যে, প্রতিষ্ঠিত ধর্মের চর্চা এবং দেবদেবীদের মূর্তির উপাসনা করা মানুষের কর্তব্য।
  • ইহুদি দার্শনিক ফিলোজুডিয়াস : পৃথিবীকে যিনি সঠিকভাবে বোঝেন, তিনি কখনো বিষণ্ন বা নৈরাশ্যবাদী হতে পারেন না। তার মন সর্বদা প্রশান্ত ও সুস্থির থাকে। প্রতি কাজেই তিনি থাকেন প্রফুল্ল। তাই বিজ্ঞজনের জীবন ঈশ্বরের ক্ষমতারই সাক্ষ্য বহন করে। মানুষ সর্বদাই অবাঞ্ছিত কামনার তাগিদ অনুভব করে। আমরা যেন আত্যন্তিক ভোগবিলাসের অপকারিতা সম্পর্কে সতর্ক থাকি। দৈহিক সুখ মানুষের শত্রুস্বরূপ। দৈহিক সুখে নিমগ্ন না হয়ে আমাদের উচিত আত্মিক আনন্দের দিকে মনোনিবেশ করা। একজন বিশ্বাসী মানুষের ধ্যান-ধারণা জীবনের ঘাত প্রতিঘাত দ্বারা বিঘ্নিত হতে পারে না, দুঃখকষ্টও তার আনন্দ কমাতে পারে না। নির্মল অনুধ্যান এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মরমি সংযোগ জীবনের পরম লক্ষ্য। ব্যবহারিক জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অগ্রাহ্য করে এ লক্ষ্য অর্জন করা যায় না। সংসারবিরাগী সন্ন্যাসজীবন পুণ্য ও পবিত্রতালাভের একমাত্র উপায় নয়। সামাজিক জীবনের আচার-অনুষ্ঠান ও আদানপ্রদানে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ থেকে এবং জড়ীয় কামনায় সংযম অনুশীলন করে আমরা পুণ্যবান হতে পারি। আমরা সবাই দেহের অধিকারী বলে আমাদের সবার মধ্যেই আদিপাপ সংক্রমিত, তাই সকলেরই প্রজ্ঞার নির্দেশ মান্য করা এবং ইন্দ্রিয়ের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। আমাদের উচ্চতর প্রকৃতির আদিনিবাস স্বর্গীয় জগৎ; আর প্রজ্ঞার অনুশীলন দ্বারা দেহের নিগড়মুক্ত হয়ে স্বর্গে ফিরে যাওয়ার মধ্যেই চূড়ান্ত মুক্তি নিহিত।
  • নিওপ্লেটোনিজম :
    • প্লটাইনাস : দেহ ধারণের আগে আত্মা অতীন্দ্রিয় বুদ্ধিজগতের অধিবাসী ছিল, এবং তখন তা মরমি স্বজ্ঞার সাহায্যে চিরন্তন নওস বা বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার ধ্যানে আবিষ্ট ছিল। ঈশ্বরের দিকে দৃষ্টিপাত করে আত্মা শুভের জ্ঞানলাভ করে। এরপর যখনই তা তার দৃষ্টি জগৎ ও জড়ের দিকে নিবদ্ধ করলো, তখনই সূচিত হয় তার পতন। অহংজ্ঞান বা আত্মজ্ঞানের উদয় হওয়া মাত্রই আত্মা অনন্ত জীবনসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বার্থান্ধ ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পতন বা অবনতির ফলেই আত্মার দেহপ্রাপ্তি ঘটে, এবং বর্তমান জীবনে আমরা যেসব দুঃখভোগ করি, সেগুলোর সবই এ অবনতির শাস্তিস্বরূপ। জীবদেহধারণ প্রথমে আত্মার ইচ্ছাধীন ছিল – আত্মা স্বেচ্ছায় দেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বাসনা যখনই কার্যে পরিণত হলো, অমনি আত্মার স্বাধীনতা লোপ পায়। আর তখন থেকেই আত্মা প্রকৃতির অধীন হয়ে যায়। আত্মার পরিশুদ্ধি এবং ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য শুধু প্রবৃত্তি দমনই যথেষ্ট নয়, আত্মাকে অবশ্যই দৈহিক কামনা জয় করে বাসনার পর্যায় অতিক্রম করে পুরোপুরি বিশুদ্ধ হতে হবে।
    • সর্বোচ্চ আদর্শ হচ্ছে পরম কল্যাণ বা পরম ব্রহ্মের অনুধ্যান ও ক্রমশঃ তার সাথে একাত্মতায় উপনীত হওয়া এবং এই আদর্শ-অন্বেষায় যে পরিতৃপ্তি মানুষ পায় তা আত্মকেন্দ্রিক বা পরার্থে কাম্য সুখ নয়, কারণ সুখ পরম শ্রেয়ের সূচক নয়, তা আমাদের কল্যাণ বা আপেক্ষিক শ্রেয়সূচক। এই আপেক্ষিক অর্থে জড়ের কল্যাণ হচ্ছে আকার (form); আকারের কল্যাণ দেহ; দেহের কল্যাণ আত্মা; আত্মার কল্যাণ ধর্ম এবং ধর্মোপরি যে চৈতন্য আছে তা; এবং চৈতন্যের কল্যাণ সেই পরম কল্যাণ (The Good)। এভাবে অগ্রবর্তী এক জগতের দিকে, অন্য এক জগতের অর্থাৎ চৈতন্য-জগতের দিকে এবং তা অতিক্রম করেও সেই পরম একের অনিরপেক্ষ ঐক্য, যা সকল কিছুর আদি উৎস, তার দিকে বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে উন্নীত হওয়ার মধ্যেই সকলকিছুব কল্যাণ নিহিত। এই জগতাভিমুখিতা কৃচ্ছ্রতাবাদী এবং প্রাচীন খ্রীষ্টানদের মতের সাথে এক নয়, কারণ তারা অবিবাহিত জীবন যাপন সমর্থন করেন ও দেহগত সকল ব্যাপার বর্জন করতে বলেন। কিন্তু দাম্পত্যপ্রেম হচ্ছে পরম একের সাথে চৈতন্যের যে একাত্মতা তারই প্রতিচ্ছবি এবং হয়তো চৈতন্য-জগতাভিমুখে উন্নীত হওয়ার প্রথম সূত্রপাত। যদিও দেহের সাথে সংযোগ ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তবুও দেহকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা উচিত নয়। মানুষ তার দেহকে যা কিছু প্রয়োজন এবং দেয়া সম্ভব দেবে যদিও সে নিজে অন্য এক জগতের অন্তর্গত। একজন সঙ্গীতজ্ঞ যেরূপ তার তার যন্ত্রটি ব্যবহার করে-যন্ত্রটি জীর্ণ হয়ে গেলেও সে যেরূপ বিনা যন্ত্রে গান গাহিতে পারে সেইরূপ মানুষও তার দেহের ব্যবহার করবে।
    • জড় হচ্ছে অকল্যাণ (evil) কিন্তু জড় থেকে মুক্তিলাভের জন্য আত্মহত্যার আদর্শ সমর্থনযোগ্য নয়। এই মুক্তি লাভ করতে হবে জড়-কে আকারের (form) অধীন করে—জড়ত্বগ্রস্ত মানুষ ও তার দৈহিক কামনা ও আকাঙ্ক্ষাকে উচ্চতর এক মানবসত্তা ও তার পৃদ্ধিবৃত্তির অনুগত করে। মানুষের সর্বাত্মক নৈতিক নীচতা সম্পর্কে নস্টিক (Gnostic) মতবাদ ভুল। নৈতিক অপরাধ সর্বদা কিছু না কিছু মঙ্গলের সাথে মিশে থাকে এবং কোনো মানুষই সম্পূর্ণত মন্দ না। দোষ-প্রবণতা চরিত্র থেকে আসে এবং চরিত্রের ভিত্তি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা। সর্বব্যাপক আত্মা স্বাধীনতা ও আবশ্যিকতা এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে।
    • ম্যালকাস বা পরফিরি : সুখমাত্রই পাপের আকর। ঘোড়দৌড়, যাত্রা-থিয়েটার, নাচ-গান, যৌনাচার প্রভৃতি যেকোনো অবস্থায়ই বর্জনীয়। মাংস খাওয়া একটি গর্হিত কাজ।
    • প্রোক্লাস : আত্মা নিয়ন্ত্রণের এই স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। অন্যায়-অশুভের অনুষ্ঠান এর স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপস্বরূপ। তাই অন্যায়-অশুভ অনুষ্ঠানের স্বাধীনতা অপূর্ণ স্বাধীনতা। অপূর্ণতার ফলেই মানুষ তার স্বাধীনতাকে ভুলপথ নির্বাচনে ব্যবহার করে থাকে। ঐশ্বরিক সত্তা কখনো অশুভকে নির্বাচন করতে পারে না। অন্যদিকে, মানুষ অপূর্ণ বলে নিজ প্রকৃতি অনুসারে কাজ না করার ক্ষমতা তার থাকতেই হবে। আর এই ক্ষমতাই তাকে বাহ্যশক্তি ও কারণ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে বাহ্যশক্তির ক্রীড়নক করে তুলতে পারে। কিন্তু সে ইচ্ছা করলে শুভকে নির্বাচন করতে পারে বলে শুভকে বাদ দিয়ে অশুভের নির্বাচনের নৈতিক দায়-দায়িত্ব তাকেই গ্রহণ করতে হবে। ঐশ্বরিক সাহায্য না পেলে মানবাত্মার পক্ষে মোক্ষলাভ কখনো সম্ভব হতো না।

সামাজিক চেতনা, সামাজিকতা ও রাজনীতি

  • স্টোয়িসিজম : সামাজিক চেতনা বলেও মানুষের একটি বিশেষ প্রবৃত্তি রয়েছে, যা তাকে ক্রমশ সামাজিক জীবনের দিকে চালিত করে। বিবেকবুদ্ধির আলোকেই সে তার সামাজিক প্রবৃত্তিসমূহকে সচেতন ও সক্রিয় করে তোলে। প্রজ্ঞার কল্যাণেই সে বুঝতে পারে যে, সব মানুষই প্রজ্ঞাময় জীবনের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশ্বসমাজের সদস্য। মানবজাতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়া রাষ্ট্রের মূলতত্ত্বের পরিপন্থী। বিশ্বব্যাপী একটিমাত্র রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে, একই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে বসবাস করা সব মানুষের কর্তব্য। কোনো একটি বিশেষ দেশকে স্বদেশ মনে করে অন্যান্য দেশকে বিদেশ মনে করা অনুচিত। মানুষের সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভ্রাতৃত্বই সমর্থনযোগ্য, যার মাধ্যমে বিশ্বসমাজ বা বিশ্বজনীন রাষ্ট্র তৈরি হবে। এ রাষ্ট্রের একমাত্র আইন প্রাকৃতিক নিয়ম, একমাত্র অধিকার প্রাকৃতিক অধিকার। এই বিশ্বজনীন রাষ্ট্রে নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য করার একমাত্র মানদণ্ড হলো নৈতিকতা। সব মানুষের মধ্যে এক বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান, সবাই একে অপরের ভাই, তাদের উৎস এক, লক্ষ্যও অভিন্ন। তাদের সবার মধ্যে একই সর্বজনীন প্রজ্ঞা বিদ্যমান; তারা সবাই আইনের অধীন এবং একই রাষ্ট্রের নাগরিক। পরস্পরের প্রতি সুবিচার ও মানবোচিত ব্যবহারই মানুষের কর্তব্য। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি নয়, সর্বজনীন মঙ্গলকামনা এবং প্রয়োজনবোধে অপরের জন্য আত্মোৎসর্গ করা মানুষের নৈতিক আদর্শ।
  • নিওপিথাগোরিয়ানিজম :
    • প্লুটার্ক : মানুষ একটি রাজনৈতিক জীব। সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেক বিরত না থেকে এসব কাজে অংশগ্রহণ করেই মানুষ তার যথার্থ কর্মক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে। মানুষের মহৎ কাজ বা পেশার মধ্যে রাজনীতি অন্যতম। কর্তৃত্বের অধিকার যাদের দেয়া হয় তাদের দায়িত্বও অনেক ও নিঃস্বার্থভাবে সমাজের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাওয়া তাদের কর্তব্য। বিভিন্ন প্রকার সরকারের মধ্যে রাজতন্ত্রই সর্বোত্তম, তবে রাজার পক্ষে ঈশ্বরের সেবক ও প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা উচিত।
  • ইহুদি দার্শনিক ফিলোজুডিয়াস : অনুধ্যানী জীবনে প্রবেশ করার আগে প্রচলিত সাধারণ গুণাবলির অনুশীলন করা উচিত। পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী; কিন্তু যে ক’দিন আমরা এখানে আছি, সে ক’দিন আমাদের পার্থিব প্রয়োজনের তাগিদ মেটাবার চেষ্টা করা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা, সমাজের অন্যান্য নাগরিকের সঙ্গে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি বজায় রাখা উচিত। মোটকথা, ঈশ্বরের সেবা করার আগে আমাদের উচিত মানুষের সেবা করা। আদর্শ বিশ্বনাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই আমাদের সব কার্যকলাপ পরিচালিত হওয়া উচিত। ধর্ম দ্বারা পরিচালিত ঈশ্বরতন্ত্র (theocracy) আদর্শ সরকার। আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা মুসার বিধির (Mosaic Code) ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এটি হিব্রু আইন স্বয়ং ঈশ্বর দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট, তাই এই আইন অকাট্য এবং অন্য সব আইনের চেয়ে উৎকৃষ্ট। একে কোনোদিনই বাতিল করা যাবে না। কেননা তা ঈশ্বরের তরফ থেকে মানুষের জন্য একটি উপঢৌকনস্বরূপ। সর্বোত্তম রাষ্ট্রের একটি মিশ্র সংবিধান থাকবে। ঐশ্বরিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি হবে এ রাষ্ট্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বর বিশ্বের শুধু শাসকই থাকবেন না, মানুষের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিচালকও হবেন। আদর্শ নতুন সমাজ সুবিচার ও শান্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সমাজে কোনো যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা কোনো শোষণের অস্তিত্ব থাকবে না; সব জাতি সমানভাবে ঈশ্বরের গুণকীর্তন করবে। মানবজাতি একদিন কুসংস্কার ও ভয় থেকে মুক্তিলাভ করবে। এক জাতি অন্য জাতির বিরুদ্ধে অস্ত্র চালাবে না, বরং সবাই আধ্যাত্মিক আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করবে। ইতিহাস ঈশ্বর কর্তৃক পরিচালিত। এর একটি নির্দিষ্ট শুরু ও নির্দিষ্ট শেষ রয়েছে।
  • নিওপ্লেটোনিজম :
    • প্লটাইনাস : দার্শনিক রাজার সাহায্যে মানুষের সংস্কার সম্ভব নয়, তাই অধিবিদ্যার আদর্শাবলিকে রাষ্ট্রনীতিতে প্রয়োগ করা যায়না।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.