দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) ও তার উত্তরসূরীগণ

Table of Contents

ভূমিকা

রেনে দেকার্তকে (Rene Descartes) (১৫৯৬-১৬৫০) সাধারণত আধুনিক দর্শনের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। দর্শনের ইতিহাসে তিনিই প্রথম উচ্চ দার্শনিক যােগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি যার দৃষ্টিভঙ্গি নতুন পদার্থ বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিদ্যা দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত। স্কলাস্টিকবাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে নতুন প্রগতিশীল ধ্যানধারণার যে সংঘাত লক্ষণীয় দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০)-এর চিন্তায় তারই এক সার্থক পরিণতি ঘটে। তার চিন্তাধারায় প্রচুর স্কলাস্টিকবাদের উপাদান বিদ্যমান থাকলেও তিনি তার পূর্বসূরি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক ভিত্তি গ্রহণ না করে বরং একটি পরিপূর্ণ প্রাসাদসম দার্শনিক সৌধ গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। এরিস্টটল পরবর্তী দর্শনে আর কোনাে দার্শনিকই এরূপ চেষ্টা করেন নি। এরূপ প্রচেষ্টা বিজ্ঞানের প্রগতির ফলশ্রুতির প্রকাশ এবং নতুন আত্মপ্রত্যয়ের প্রতীক। বেকন বৈজ্ঞানিক গবেষণার এক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন সন্দেহ নেই; কিন্তু দেকার্ত শুধু দার্শনিক আলােচনার একটি নতুন পদ্ধতিই উদ্ভাবন করেননি, একটি সম্পূর্ণ নতুন দার্শনিক মতও প্রতিষ্ঠা করলেন। তার প্রতিষ্ঠিত এই নতুন দর্শন সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের দর্শনের গতিপ্রকৃতিকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। মানুষ দীর্ঘদিন যে নতুন আন্দোলনের স্বপ্ন দেখছিল, যার জন্য তারা বিভিন্নভাবে কর্মতৎপরতা চালিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তারই প্রতিফলন তারা লক্ষ্য করলাে দেকার্তের দর্শনে, তার চিন্তায় দর্শন খুঁজে পেলাে এক নতুন পথ ও পদ্ধতি।

দেকার্তের রচনায় এন ধরনের সজীবতা ও সরলতা রয়েছে যা প্লেটো পরবর্তী কোনাে বিখ্যাত দার্শনিকের রচনায় লক্ষ করা যায় না। এর মধ্যবর্তী সকল দার্শনিক ছিলেন শিক্ষক এবং তাদের ছিল উক্ত পেশায় পেশাগত শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু দেকার্ত একজন শিক্ষক হিসেবে লেখেন নি, তিনি লিখেছেন একজন আবিষ্কারক হিসেবে, অনুসন্ধিৎসু হিসেবে। তিনি তার আবিষ্কারের ফসল অন্যকে জানানাের জন্য উদগ্রীব ছিলেন। তার রচনাশৈলী ছিল সহজ-সরল এবং অ-পণ্ডিত মনােভাবসুলভ। ছাত্রদের চেয়ে বরং পৃথিবীর জ্ঞানীগুণী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যেই তিনি লিখেছেন। অধিকন্তু তার রচনাশৈলী অনন্য চমৎকার রীতিসম্পন্ন। আধুনিক দর্শনের জন্য এটি অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় যে, এর প্রবর্তকের সাহিত্যবােধ ছিল। কান্টের পূর্ব পর্যন্ত মহাদেশে এবং ইংল্যান্ডে তার উত্তরাধিকারীগণ তার রচনাশৈলীর অপেশাগত চরিত্র বজায় রাখেন, এবং এদের মধ্যে কয়েকজন তার রচনাশৈলীর কিছু গুণও ধরে রাখেন।

দেকার্ত অবিবাহিত ছিলেন, তার একটি দত্তক কন্যা ছিল, এই কন্যা পাঁচ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে। তিনি বলেন, এই কন্যার মৃত্যু তার জীবনের সবচে বড় দুঃখজনক ঘটনা। তিনি সব সময় ভালাে পােশাক-পরিচ্ছদ পরতেন, এবং সঙ্গে একটি তরবারি রাখতেন। তিনি পরিশ্রমী ছিলেন না। তিনি সামান্য কয়েক ঘণ্টা কাজ করতেন। এবং খুব সামান্যই পড়াশুনা করতেন। হল্যান্ডে যাবার সময় তিনি মাত্র কয়েকটি বই সঙ্গে নিয়ে যান। এগুলাের মধ্যে বাইবেল এবং টমাস একুইনাসের রচনাবলি ছিল। অনেকে এর সাথে একমত হয়ে বলেন তিনি স্বল্প সময়ে গভীর মনােযােগ সহকারে এগুলাে রচনা করেছেন। কিন্তু বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, দেকার্তের দর্শন, রচনা, চিন্তাধারার কথা বিবেচনায় এই দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ হয়। ভদ্রতার খাতিরেই তিনি হয়তো যে পরিমাণ সময় ব্যয় করেছেন তার থেকে কম সময় ব্যয়ের ভান করে থাকবেন।

শৈশব, শিক্ষাজীবন ও সেনাবাহিনীতে কর্মজীবন

ফ্রান্সের টুরাইন প্রদেশের অন্তর্গত ল্যা হ্যাই নামক এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে দেকার্তের জন্ম। তার বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার, পার্লেমেন্ট অব ব্রিটানির (Parlement of Brittany) একজন কাউন্সিলর এবং তিনি মাঝারি ধরনের ভূ-সম্পত্তির মালিক। পিতার মৃত্যুর পর দেকার্ত উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এই ভূ-সম্পত্তি বিক্রি করে অন্যত্র বিনিয়ােগ করেন। এই বিনিয়ােগকৃত অর্থ থেকে তিনি বছরে ছয় বা সাত হাজার ফ্রাঙ্ক অর্জন করেন। জন্মের সময়ই তিনি মাকে হারান। মার কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন তার দুর্বল শারীরিক গঠন। আট বছর বয়সে তিনি সম্ভ্রান্ত বক্তিবর্গের ছেলেমেয়েদের জন্য চতুর্থ হেনরি প্রতিষ্ঠিত তিনি লা ফ্লিচের (La Fleche) জেসুইট স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ১৬০৪ সাল থেকে ১৬১২ সাল পর্যন্ত শিক্ষালাভ করেন। এই কলেজের শিক্ষা তাকে আধুনিক গণিতশাস্ত্রের দৃঢ়ভিত্তি প্রদান করে যা তিনি সে সময়ের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হয়তাে পেতেন না। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ঐ স্কুলে তিনি শুধু লেখাপড়াই নয়, নিয়মশৃঙ্খলা, আদবকায়দা এবং সামাজিক শিষ্টাচার সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন। দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা-সহ কিছু বিশেষ সুযােগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। সারাজীবন তিনি এই অভ্যাস মেনে চলতেন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী। তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল গণিতের, বিশেষ করে জ্যামিতির প্রতি। সেদিনের সদ্য প্রচলিত বীজগণিতের সঙ্গে তার তখনাে পরিচয় ঘটেনি।

আট বছরের স্কুল জীবন শেষ করে তিনি পরবর্তী এক বছর নিরানন্দ পল্লীজীবন যাপন করেন। এরপর তার বাবা প্রচুর অর্থ দিয়ে এবং তার দেখাশােনার জন্য একজন গৃহভৃত্যসহ তাকে প্যারিসে বসবাসের জন্য পাঠান। তিনি ১৬১২ সালে প্যারিস গমন করেন, কিন্তু এখানকার সামাজিক জীবন তার কাছে ক্লান্তিকর মনে হয়। চলাফেরায় সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকা সত্ত্বেও একজন সতেরাে বছরের যুবক হিসেবে দেকার্ত তখন যথেষ্ট সংযম ও সততার পিরচয় দেন। বস্তুত, পূর্বাপর তিনি যাপন করেন এক নিস্পাপ নিষ্কলঙ্ক জীবন। অবশ্য জুয়াখেলার প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। কিন্তু এ কাজেও তিনি সবসময় মিতব্যয়িতার পরিচয় দেন এবং নিজেকে আর্থিক সংগতির মধ্যে সীমিত রাখেন। এজন্যই কেউ কোনােদিন তার এ অভ্যাসকে খারাপ বলেননি। শৈশব থেকেই তিনি একাকী থাকতে পছন্দ করতেন। আর এই একাকীত্বকে তিনি কাজে লাগাতেন পড়াশােনা ও দর্শনচর্চার কাজে। এ ব্যাপারে তার প্রাক্তন সহপাঠী সেদিনের প্রখ্যাত ধর্মযাজক ও গণিতবিদ মের্‌সেন তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। মের্‌সেনই তাকে ফ্রান্সের তদানীন্তন বিশিষ্ট গণিতবিদ মাইডর্জের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। প্যারিস ক্লান্তিকর হওয়ায় তিনি ফাউবর্গ সেন্ট জার্মেইনে (Faubourg St Germain) নির্জন জীবনযাপন শুরু করেন এবং জ্যামিতি নিয়ে গবেষণা করেন।

কিন্তু তার বন্ধুরা তাকে খুঁজে বের করেন, এবং অধিকতর নির্জন জীবনযাপনের আশায় তিনি ডাচ সেনাবাহিনীতে নাম তালিকাভূক্ত করেন (১৬১৭)। এছাড়া বিভিন্ন দেশ দেখা ও পর্যটন করা ছিল দেকার্তের এক বড়রকমের শখ। সে আমলে সেনাবাহিনীতে যােগদান করা ছিল এর এক উৎকৃষ্ট উপায়। এসব কারণে দেকার্ত উইলিয়ামের ছেলে ম্যাওরিস্ অব নাসুর অধীনে সৈনিক হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। সে সময় হল্যান্ডের অবস্থা ছিল শান্ত, এবং তিনি দুই বছর নিরুপদ্রবভাবে গভীর জ্ঞানসাধনায় নিমগ্ন থেকে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন বলে মনে হয়। স্পেনের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সেদিনের হল্যান্ড ইউরােপীয় দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী, উদারনৈতিক ও সুসভ্য দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। এছাড়া ম্যাওরিস্ নিজেও ছিলেন এমন একজন উদারনৈতিক বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি যিনি বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন রেনেসাঁর বিশ্বজনীন প্রেরণা দ্বারা। যুদ্ধবিদ্যা ও সামরিক প্রকৌশল বিষয়ে সুপণ্ডিত হওয়া ছাড়াও তিনি ছিলেন বিজ্ঞান ও গণিতের একজন আগ্রহী ছাত্র, এবং ব্যাডাস্থ তার ক্যাম্পে তার সঙ্গে যােগাযােগ হয়েছিল একদল প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর। ১৬১৭ থেকে ১৬১৯ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ঐ সমাবেশই দেকার্ত অতিবাহিত করেছিলেন। ঐ সময়েই তিনি রচনা করেছিলেন সংগীতবিষয়ক একটি গ্রন্থ এবং গণিতবিষয়ক কিছু রচনাসহ তার প্রাথমিক রচনাবলি। ঐ সময়েই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন বীজগণিতকে জ্যামিতিতে প্রয়ােগের সম্ভাবনা এবং আবিষ্কার করেছিলেন তার বিশ্লেষণী জ্যামিতি।

বােহেমিয়ার প্রােটেস্টান্টদের বিদ্রোহের ফলে ১৬১৯ সালে ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। সেই বছরেই তিনি দেকার্ত ক্যাথলিক ব্যাভারিয়ান (Bavarian) সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন। ১৬১৯-২০ সালের শীতকালে ব্যাভারিয়ায় থাকাকালে তার অভিজ্ঞতা তিনি তার ডিসকোর্স ডি লা ম্যাথড (Discours de la Method) গ্রন্থে বর্ণনা করেন। আবহাওয়া ঠাণ্ডা হওয়ার কারণে তিনি একটি চুলার ভিতর প্রবেশ করে সারাদিন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অতিবাহিত করতেন। (দেকার্ত বলেন, এটি একটি চুলা ছিল, কিন্তু তার অধিকাংশ ভাষ্যকার একথা অসম্ভব বলে মনে করেন। ব্যাভারিয়ার প্রাচীন ঘর-বাড়ি সম্পর্কিত তথ্য থেকে মনে হয় দেকার্তের কথা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসযােগ্য।) তার নিজ বর্ণনা অনুসারে তার দর্শন রচনা অর্ধ-সমাপ্ত অবস্থায় থাকাকালে তিনি উক্ত চুলা থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু তার এই ঘটনাকে একেবারে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার প্রয়ােজন নেই। সক্রেটিস সারা দিন বরফের উপর বসে ধ্যান করতেন, কিন্তু শরীর উষ্ণ হলেই শুধু দেকার্তের মন কাজ করতাে।

ক্যাথলিকরা যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং তাদের সঙ্গে দেকার্ত প্রাগ-এ যান। কিন্তু সৈনিক জীবনের আনন্দ হারিয়ে ১৬২১ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ইতালি ভ্রমণ করেন এবং ১৬২৫ সালে প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং পরবর্তী তিন বছর সেখানেই অতিবাহিত করেন। তিনি প্যারিসে ফিরে যান এবং প্যারিসের বুদ্ধিজীবী মহল তার প্রতি খুবই আকৃষ্ট ছিল। ঘুম থেকে ওঠার পূর্বেই (তিনি খুব কম সময়ই দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠতেন) তার বন্ধু-বান্ধব তার সঙ্গে দেখা করতে আসা শুরু করেন। কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের সাহচর্য তিনি পছন্দ করতেন না; কারণ এতে তার বিদ্যাচর্চায় বিঘ্ন ঘটতাে। সেজন্য তিনি ১৬২৮ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। এবারে তিনি যোগ দেন উগুনের দুর্গ লা রােচেলি (La Rochelle) অবরােধে নিযুক্ত সেনাবাহিনীতে যােগদান করেন।

হল্যান্ডে গমন ও অবস্থানকাল

প্যারিসে থাকার সময় তিনি জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি তার প্রিয় বিষয়ে গভীর পঠনপাঠনের সুযােগ পেয়েছিলেন। সেসময় তিনি মন পরিচালনার নিয়মাবলি (Rules for the Direction of the Mind) নামক একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। তবে তিনি সেসময়ে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়েও একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যার নাম ছিল লা মোনডি (Le Monde)। লিখেছিলেন কারণ তিনি একজন ভীরু প্রকৃতির ক্যাথলিক ধর্মানুসারী হলেও সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা তিনি এড়াতে পারেন নি। দেকার্ত গ্যালিলিওর নব্যতন্ত্র সমর্থন করতেন। তার লা মোনডি নামক একটি বৃহৎ গ্রন্থ রচনায় নিয়ােজিত ছিলেন, তাতে দুটি নব্যতান্ত্রিক মতবাদ ছিল – পৃথিবীর ঘূর্ণন, বিশ্বের অসীমতা। এদিকে পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘুর্ণন সংক্রান্ত রচনা ও কোপারনিকাসের জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক মত শিক্ষার দেয়ার জন্য গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে গোপনে দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। সেসময় এসব দণ্ডাদেশ গোপনেই দেয়া হত। কেউ কেউ মনে করেন যে, তিনি ১৬১৬ সালে গ্যালিলিওর প্রথম দণ্ডাদেশের (এই দণ্ডাদেশ গােপনভাবে দেওয়া হয়) কথা শুনেছিলেন। গ্যালিলিওর উপর যে নির্যাতন হয়েছিল তার কথা ভেবেই তিনি সম্ভবত তিনি তার লা মোনডি গ্রন্থটি কখনাে পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশ করেন নি, তার মৃত্যুর পর এই গ্রন্থের কিছু কিছু অংশ প্রকাশিত হয়। আর এই ঝুঁকি এড়াবার জন্যই তিনি হল্যান্ডে বসবাস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, এবং ১৬২৮ সালেই তিনি হল্যান্ডে যান, কারণ সেইসময় হল্যান্ড ছিল এইসব মত প্রকাশের জন্য সব থেকে উদার অঞ্চল।

খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কয়েকবার ব্যবসায় সংক্রান্ত কাজে ফরাসি এবং একবার ইংল্যান্ড ভ্রমণ ব্যতীত তিনি বিশ বছর (১৬২৯-৪৯) হল্যান্ডে বসবাস করেন। ইংল্যান্ডে গিয়েও দর্শনচর্চা ও গ্রন্থরচনার কাজে নিয়ােজিত ছিলেন। সতের শতকের হল্যান্ডের গুরুত্ব আজকের পাশ্চাত্য দর্শনের আলোচনায় অত্যন্ত বেশি। হল্যান্ডের মত প্রোটেস্ট্যান্ট দেশসমূহে চার্চ রাষ্ট্রের অধীনস্থ ছিল, ফলে ক্যাথলিক চার্চসমূহের চেয়ে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চগুলো ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল। একারণেই সেইসময় প্রোটেস্ট্যান্ট দেশসমূহ লাভবান হয়, সেখানে রাজা অনেক শক্তিশালী ছিল, আর তার ফলে রাজার বিরুদ্ধে গিয়ে ধর্মান্ধরা নিজেদের ইচ্ছামত কোন কিছু দাবি করতে পারত না। এই অবস্থা বিশ্বের আর কোথাও ছিল না। ধর্মের বিরুদ্ধে যায় এমন মত প্রকাশ করার উপযুক্ত স্থান হিসেবে তখন যদি হল্যান্ড মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতো তাহলে আজকের পাশ্চাত্য দর্শন, পাশ্চাত্যের উদার চিন্তাধারাকে আমরা যেভাবে দেখছি সেটা পাওয়া সম্ভব হত না, এই বিশ্বটাকে আমরা আজ যেভাবে দেখছি সেভাবে আমরা একে দেখতাম না। পৃথিবী পিছিয়ে থাকত কয়েক শতক। কারণ এ সময়ে শুধু এই একটি দেশেই স্বাধীন অনুধ্যানের সুযােগ ছিল। শুধু দেকার্ত নয়, ১৭ শতকে অনেকেই তাদের গ্রন্থগুলো এখান থেকেই প্রকাশ করেছিলেন। হবস তার গ্রন্থগুলোকে এখান থেকেই প্রকাশ করেন; ১৬৮৮ সালের পূর্বে ইংল্যান্ডের প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে দুঃসময়ের পাঁচ বছর লককেও এখানে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয় (হবস ও লককে ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্রদর্শন, বিশেষ করে গণতন্ত্রের কথা ভাবাই যায়না); অভিধান গ্রন্থের রচয়িতা বেইলে (Balyle) এখানে বসবাস করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন, এবং হল্যান্ড ব্যতীত অন্যকোনাে দেশে স্পিনােজাকে গবেষণা কাজে অনুমতি দেয়ার সম্ভাবনা খুব কমই ছিল।

হল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে দেকার্ত ১৬৩৭ সালে তার পদ্ধতিবিষয়ক পুস্তক (Discourse on Method) এবং ১৬৪১ সালে অনুধ্যান (Meditations) প্রকাশিত হয়। দার্শনিক চিন্তাজগতে এই দুটি গ্রন্থের মূল্য অপরিসীম, এ দুটি গ্রন্থই সেই সময়ের চিন্তাজগতে বিপ্লবের সূচনা করে। এদুটি গ্রন্থই তাকে সর্বাধিক খ্যাতি এনে দেয়। দেকার্ত ভীরু প্রকৃতির ছিলেন। তবে বিনয়ের সঙ্গে একথা বলাই হয়তাে ভালাে হবে যে, নিরুপদ্রব গবেষণা কাজের জন্য তিনি নির্জনে শান্তিতে বসবাস করার ইচ্ছাপােষণ করেছিলেন। তিনি সর্বদা ধর্মীয় প্রার্থনায়, বিশেষ করে জেসুইট রীতি অনুযায়ী প্রার্থনা করতেন। জেসুইটরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই শুধু তিনি এই রীতিতে প্রার্থনা করেন নি, দেশ ত্যাগ করে হল্যান্ডে যাওয়ার পরও তিনি এই রীতিতে প্রার্থনা করতেন। তার মনােদর্শন ছিল অস্পষ্ট, তবে বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে তিনি একজন অকৃত্রিম ক্যাথলিক ছিলেন, কিন্তু চাইতেন চার্চের ব্যবস্থায় সংস্কার আসুক, চার্চ গ্যালিলিওর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে যে বৈরী দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করেছে তা না করুক, আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি তারা উদার হোক। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি যেমন চার্চের নিজস্ব স্বার্থে প্রয়োজন, তেমনি তার নিজস্ব গবেষণার স্বার্থেও প্রয়ােজন। এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করার জন্য তিনি চার্চকে অনুপ্রাণিত করতেন। আবার অনেকে মনে করেন তার ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল শুধুই কূটকৌশলপূর্ণ, ঝুঁকি এড়াবার জন্য নিজেকে ধার্মিক প্রমাণ করতেই তিনি এভাবে প্রার্থনা করতেন।

তবে হল্যান্ডে অবস্থানকালেও যে তিনি ধর্মান্ধদের আক্রমণের সম্মুখীন হননি তা নয়। সেখানে ক্যাথলিক ধর্মান্ধদের প্রাধান্য না থাকলেও, ধর্মসংস্কারের ফলে প্রোটেস্ট্যান্ট নামে যে নতুন খ্রিস্টীয় ধারার জন্ম হয়েছিল তা ক্যাথলিকদের চেয়ে অনেক উদার হলেও ধর্মান্ধতাকে ত্যাগ করতেপারেনি। সেই প্রোটেস্ট্যান্ট ধারার ধর্মান্ধরাই দেকার্তের রচনাসমূহের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসে। তাদের অভিযােগ ছিল এই যে, তার দার্শনিক মত নিরীশ্বরবাদী। হল্যান্ডে নিয়ােজিত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত এবং প্রিন্স অব অরেঞ্জ হস্তক্ষেপ না করলে নিরীশ্বরবাদের জন্য দেকার্তের শাস্তি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এই আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে তিনি আরেকটি কম প্রত্যক্ষ আক্রমণের সম্মুখীন হন। আগের আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার কয়েক বছর পর লিডেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে আরেকটি আক্রমণ পরিচালনা করেন। তারা দেকার্ত সম্পর্কে অনুকূল প্রতিকূল যেকোনাে মত প্রকাশ করাকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। এবারও প্রিন্স অব অরেঞ্জই দেকার্তের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অর্থহীন আচরণ না করার নির্দেশ দেন। তারই প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের অবিবেচিত সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে সম্মত হন।

সুইডেনে গমন ও মৃত্যু

সুইডেনে নিয়োজিত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত স্যানট (Chanut) ছিলেন দেকার্তের বন্ধু। তারই মধ্যস্থতায় সুইডেনের রানী ক্রিশ্চিয়ানার সঙ্গে দেকার্তের পত্রযোগাযোগ শুরু হয়। রানী ক্রিশ্চিনা ছিলেন আবেগপ্রবণ, শিক্ষিতা এবং দর্শনে অনুরাগী। তিনি মনে করতেন, একজন সার্বভৌম শাসক হিসেবে তার বিখ্যাত ব্যক্তিদের সময় নষ্ট করার অধিকার রয়েছে। দেকার্ত তাকে একটি প্রেম-পুস্তক প্রেরণ করেন। তার এই প্রেম-পুস্তক তখন পর্যন্ত কিছুটা অবহেলিত ছিল। দেকার্ত মূলত ইলেক্টর পেলাটাইনের (Elector Palatine) কন্যা প্রিন্সেস এলিজাবেথের জন্য আত্মার প্রবল অনুরাগ সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। রাণী ক্রিশ্চিনাকে তিনি সেটাও পাঠান। এসব রচনা রানীকে অনুপ্রাণিত করে। তাই তিনি দেকার্তকে রাজদরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরােধ করেন। দেকার্ত যেতে রাজি হননি। কিন্তু ক্রিশ্চিনা তাকে সুইডেনে একটি সাইন্টিফিক একাডেমী গঠন করার অনুরোধ করলে অবশেষে দেকার্ত এতে রাজি হন। ১৬৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে রানী তাকে আনার জন্য একটি যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করেন। সেই বছরের অক্টোবরে দেকার্ত সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে পৌঁছান। এই সুইডেনে গমনই দেকার্তের কাল ছিল, আর চার মাসের মাথায় তার মৃত্যু হয়।

রাণী ক্রিশ্চিনা প্রতিদিন দেকার্তের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করতে চান। তিনি প্রতিদিন ভোর ৫টায় উঠতেন, আর ভোর ৫টা ছাড়া অন্য কোন সময় তিনি পাঠ গ্রহণ করবেন না। এদিকে দেকার্ত তার দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য কখনই এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে পারতেন না, তিনি প্রতিদিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠতেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার শীতল পরিবেশে এত ভোরে ওঠা ও এত শীতে আবাসস্থল থেকে ৪৫০ মিটার দূরের প্রাসাদে যাওয়া তার জন্য কষ্টকর ছিল। (স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, কখনও এদের সাথে ফিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডকেও ধরা হয়)। প্রথমে স্যানোট ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে দেকার্ত তাকে দেখাশোনা করতে থাকেন। রাষ্ট্রদূত সুস্থ হয়ে উঠলেও দেকার্ত নিউমোনিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং ১৬৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মৃত্যমুখে পতিত হন। থিওডোর এডবার্ট অবশ্য বলেন আরসেনিক বিষক্রিয়া তার মৃত্যুর কারণ ছিল।

গণিতশাস্ত্র ও বিজ্ঞানে দেকার্তের অবদান

দেকার্ত একজন দার্শনিক, গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানী ছিলেন। দর্শন এবং বিজ্ঞানে তার অবদান সর্বোচ্চ গুরুত্ব বহন করে। বিজ্ঞানে তার অবদান প্রশংসনীয় হলেও তার সমসাময়িকদের মতাে উন্নতমানের ছিল না। জ্যামিতিতে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল স্থানাঙ্ক বা বৈশ্লেষিক জ্যামিতির (Co-ordinate geometry) আবিষ্কার, এক্ষেত্রে সমতলে অবস্থিত দুটি অক্ষরেখার সাহায্যে সেই সমতলে অবস্থিত একটি বিন্দুর অবস্থান নির্ণয় করা হয়। অবশ্য এই বৈশ্লেষিক জ্যামিতি তিনি সম্পূর্ণ চূড়ান্ত আকারে আবিষ্কার করেন নি। তিনি বিশ্লেষণী পদ্ধতি ব্যবহার করেন, জ্যামিতিতে বীজগণিত প্রয়ােগ করেন। এই উভয় ক্ষেত্রেই তার পূর্বসূরি ছিলেন। বিশ্লেষণী পদ্ধতির ক্ষেত্রে তার সময়ের এমনকি অনেক প্রাচীন দার্শনিকেরও সন্ধান পাওয়া যায়। তবে দেকার্ত বৈশ্লেষিক পদ্ধতির সকল উপযোগিতা আবিষ্কার না করলেও এই পদ্ধতির অগ্রগতির পথ সহজ করার জন্য যথেষ্ট অবদান রাখেন। তিনি তার প্রিন্সিপিয়া ফিলােসেপিয়েই (Principia Philosophiae) গ্রন্থে অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক মতবাদ ব্যাখ্যা করেন। এই গ্রন্থ ১৬৪৪ সালে প্রকাশিত হয়। অবশ্য, এ ছাড়াও তার অন্যান্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে। এসেয়াস ফিলােসােফিকুইস (Essais philosophiques) (১৬৩৭) গ্রন্থে তিনি আলােকবিজ্ঞান এবং জ্যামিতি নিয়ে আলােচনা করেন, এবং তার একটি গ্রন্থকে ডি লা ফরমেশন ডিউ ফোয়েটাস (De la formation du foetus) নামে অভিহিত করা হয়। তিনি হার্ভের রক্ত সংবহন আবিষ্কারকে স্বাগত জানান, এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কারের জন্য সর্বদা আশাপােষণ (যদিও এটি ছিল বৃথা আশা) করতেন।

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, ধর্মীয় সমালােচনা সযত্নে পরিহার করতে দেকার্ত এক ধরনের সৃষ্টিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই সৃষ্টিতত্ত্ব প্লেটোপূর্ব দার্শনিকদের থেকে স্বতন্ত্র নয়। তিনি বলেন, আমরা জানি যে, জেনেসিসে পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে সে অনুসারেই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলাে পৃথিবীর বিকাশ স্বাভাবিকভাবেই হয়ে থাকতে পারে। তিনি ঘূর্ণাবর্ত গঠনের একটি তত্ত্ব প্রদান করেন – মহাবিশ্বে সূর্যের চতুর্দিকে একটি প্রকাণ্ড ঘূর্ণাবর্তন রয়েছে যা তার সঙ্গে গ্রহসমূহকে নিয়ে চলেছে। তত্ত্বটি সুযুক্তিসম্পন্ন কিন্তু এই তত্ত্ব থেকে গ্রহের কক্ষপথ বৃত্তাকার না হয়ে কেন উপবৃত্তাকার হলাে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এই মতবাদ সাধারণভাবে ফ্রান্সে স্বীকৃতিলাভ করলেও পরবর্তীতে নিউটনের মতবাদ দ্বারা তা প্রত্যাখ্যাত হয়। নিউটনের প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থের প্রথম ইংরেজি সংস্করণের সম্পাদক কোটস (Cotes) অত্যন্ত সুন্দরভাবে যুক্তি প্রদান করে বলেন যে, ঘূর্ণাবর্ত মতবাদ নিরীশ্বরবাদে উপনীত করে, অথচ নিউটন গ্রহসমূহের মধ্যে গতি স্থাপনের জন্য ঈশ্বরের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেন। এছাড়া দেকার্তের গ্রহসমূহের গতিপথ সূর্যাভিমুখী ছিল না। এসব কারণে কোটস তিনি নিউটনের মতবাদকে অগ্রাধিকার প্রদান করেন।

দেকার্দের দর্শনের উৎস্য, স্কলাস্টিকবাদ ও বিজ্ঞানের সমন্বয় চেষ্টা, কিছু পূর্বমত খণ্ডন

ডেকার্ট-দর্শনের উৎস্য মূলত দুটি –

  • (১) জেস্যুইটদের কাছে থেকে স্কলাস্টিক যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যা। তার অধিবিদ্যায় স্কলাস্টিক প্রভাবের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া যায়। অগাস্টিনের মতাে তিনি তার যাত্রাবিন্দু হিসেবে আন্তর নিশ্চিতিনীতির ওপর নির্ভর করেন। অতঃপর এ নীতি থেকে তিনি অবরােহ পদ্ধতিতে যা নিষ্কাশন করেন, তা অনেক দিক দিয়ে আগাস্টিনীয় ও স্কলাস্টিক যুক্তির মতই। স্কলাস্টিক দার্শনিকরা হলেন টমাস একুইনাস, ডান্‌স স্কোটাস, উইলিয়াম অফ অখাম, ফ্রান্সিস্কো সুয়ারেজ, ইবনে রুশদ, আলবার্টাস ম্যাগনাস, পিটার লম্বার্ড, বোনেভেনচার, আনসেল্‌ম অফ ক্যান্টারবিউরি ও পিটার আবেলার্ড। এদের মধ্যে দেকার্তের উপর একুইনাস, ডান্‌স স্কোটাস, অখাম, সুয়ারেজ, ইবনে রুশদ ও আনসেল্ম এর প্রভাব দেখা যায়।
  • (২) নতুন যুগের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তদানীন্তন বিজ্ঞান, বিশেষ করে গণিতশাস্ত্র। তিনি লিওনার্দো বেকনের মতো এক নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সম্ভাবনা দেখতে পান। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে ও বৈজ্ঞানিক প্রকল্প প্রণয়নে গণিত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।

এই দুটি উৎস্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি গাণিতিক বিজ্ঞানের যথার্থতার আলােকে স্কলাস্টিকবাদকে জোরদার করার প্রয়াস নেন। দেকার্ত তার জ্ঞানতত্ত্বে স্কলাস্টিক দর্শনের অনেক সাধারণ নিয়ম বা নীতিই কোনরকম বিচারমূলক পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই ব্যবহার করেছেন। যেমন, একটি কার্য কখনাে তার কারণের চেয়ে অধিকতর পূর্ণ হতে পারে না। এসব নীতি স্বতপ্রমাণিত না হলেও তিনি এগুলো স্বীকার করার কোনাে কারণ ব্যাখ্যা করেন নি। তার মেডিটেশনস (Meditations) গ্রন্থের সদর্থক দিকের অধিকাংশ আলােচনাই প্লেটো, সেন্ট অগাস্টিন, এবং সেন্ট টমাসের দর্শনে পাওয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞানের সাথে স্কলাস্টিকবাদের সামঞ্জস্য তৈরির জন্য তিনি স্কলাস্টিকবাদের দুটো গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ থেকে সরে আসেন। স্কলাস্টিক দর্শনে দ্রব্যকে গুণের অতিরিক্ত বলে চিন্তা করা হত, অর্থাৎ গুণ ছাড়াও দ্রব্যের অস্তিত্ব থাকতে পারে বা গুণকে দ্রব্য থেকে আলাদা করা যায় এই বিশ্বাস ছিল তাদের দর্শনে। কিন্তু দেকার্ত তাদের এই দর্শন থেকে সরে এসে গুণকে দ্রব্যের অপরিহার্য অংশ বলে মনে করেন, তার মতে গুণকে দ্রব্য থেকে আলাদা করা যায়না।

দ্বিতীয়ত তিনি উদ্দেশ্যবাদ ও দ্রব্যাত্মক আকারকে প্রত্যাখ্যান করেন। বিশ্বের অস্তিত্ব ও আচরণ ব্যাখ্যার উপায় হিসেবে দেকার্ত এরিস্টোটলের উদ্দেশ্য কারণ বা পরিণতি কারণের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। দেকার্তের মতে, কোন বস্তু বা ঘটনাকে পূর্ববর্তী ঘটনাবলির মাধ্যমে ব্যাখ্যা না করে পরিণতি বা ফলাফলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা বৃথা, তাই পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা ও শারীরবিদ্যার মত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহে পরিণতি কারণের কোনাে স্থান নেই। কোনাে ইন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব ও গঠনপ্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা যায় না, একটি বিশেষ কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই এই ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি। ইন্দ্রিয়সমূহ তাদের নিজ নিজ কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করে কিন্তু এসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য ঈশ্বর এসব ইন্দ্রিয় সৃষ্টি করেছেন তা বলা যায়না। এসব কারণে দেকার্তের মতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে উদ্দেশ্যবাদ নিষ্ফল ও অকার্যকরী।

এদিকে আমরা সসীম বলে অসীম ঈশ্বরের উদ্দেশ্য আমাদের কাছে অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়, তাই জগতের অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য জগৎ সৃষ্টির সময় ঈশ্বর কী বিশেষ উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন তা জানা সম্ভব নয়। এটি জানা সম্ভব নয় বলে এটি জানার চেষ্টা অপ্রয়োজনীয়। তাই দেকার্তের মতে, অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যবাদ (teleology) কোনাে উপকারে আসে না। একইভাবে দেকার্তের কাছে ব্যাখ্যাপদ্ধতি হিসেবে স্কলাস্টিক দার্শনিকদের দ্রব্যাত্মক আকারের ধারণা অসন্তোষজনক। অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে এসবের মূল্য নেই, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারাদির ক্ষেত্রেও এরা সহায়ক নয়। তাই ব্যাখ্যানীতি হিসেবে এদের গ্রহণ করে বিজ্ঞান অগ্রসর হতে পারে না। কোন কিছুর ব্যাখ্যার জন্য বিজ্ঞানকে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হয়, এক্ষেত্রে যদি বলা হয়, এই জিনিসের স্বভাব এমন তাই এই জিনিসটি এমন, বা এই জিনিসটি এভাবে কাজ করে, তাহলে এই বিষয়ের কিভাবে অব্যবহিতভাবে কার্যকারণ নিয়মে পূর্ব কারণের ভিত্তিতে এলো তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, এর ব্যাখ্যা কী এসংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারেরও সুযোগ থাকেনা, তাই এটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ নয়।

ঈশ্বর ও জগতের দ্বৈততা, দেহ ও মনের দ্বৈততা দেকার্তের দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই দ্বৈতবাদ থেকে অনেক সমস্যারই সৃষ্টি হয় যেগুলোর ব্যাখ্যা দেকার্ত দিতে পারেন নি। তার উত্তরসুরীগণ এই সমস্যাগুলোর সমাধানের প্রচেষ্টা নেন, যাদেরকে কার্তেসীয় বলা হয়। কিন্তু দেকার্তের এই দ্বৈতবাদ পূর্বের তুলনায় অনেক বিকশিত, অভিনব ও সমৃদ্ধ, এটি যেসব নতুন নতুন প্রশ্নের উত্থান করেছিল সেগুলো পরবর্তীতে অনেক নতুন চিন্তার দ্বার খুলে দেয়। আর দেকার্তের দর্শনের এই দ্বৈতবাদের অসঙ্গতিসমূহের উদ্ভবের কারণ ছিল তার নতুন বৈজ্ঞানিক ধারণা ও স্কলাস্টিক দর্শনের মেলবন্ধনের প্রচেষ্টা। লা ফ্লিচেতে দেকার্তের স্কলাস্টিক দর্শন শিক্ষা এবং সমসাময়িক কালে তার বিজ্ঞান শিক্ষা উভয়ের কারণে তার দর্শনের দ্বৈতবাদ অমীমাংসিত থেকে যায়। ফলে তার দর্শনে অসঙ্গতি লক্ষণীয়। কিন্তু বিজ্ঞান ও স্কলাস্টিক দর্শনের শিক্ষা তাকে ফলপ্রসূ ধারণা গঠনে যেরকম সাহায্য করেছিল তা আর কোনাে পূর্ণ যৌক্তিক দার্শনিকের পক্ষে করা সম্ভব হয় নি। তার দর্শনে সঙ্গতি থাকলে তিনি কেবল নব্য স্কলাস্টিকবাদের জনক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হতেন, কিন্তু তার দার্শনিক অসঙ্গতি তাকে দুটি গুরুত্বপূর্ন ও ভিন্নমুখী দার্শনিক মতবাদের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

দেকার্তের দার্শনিক পদ্ধতি, সন্দেহ ও কজিটো

দেকার্ত তার প্রথম গ্রন্থ “রুলস ফর দ্য ডিরেকশন অব দ্য মাইন্ড”-এ তার পদ্ধতির বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেন। তিনি তার ডিসকোর্স গ্রন্থে একে পুনরায় সংক্ষিপ্তভাবে ব্যাখ্যা করেন। এখানে যেসব ক্ষেত্রে নিশ্চিত ও তর্কাতীত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব, কেবল সেসব ক্ষেত্রেই তিনি তার চিন্তাকে সীমিত রাখতে চান। এরপর তিনি ঠিক করেন যে, অন্যদের মতামতকে সরল বিশ্বাসে তিনি গ্রহণ করবেন না। কেবল মাত্র স্বজ্ঞার (intuition) মাধ্যমে প্রাপ্ত সত্যই এমন স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল হয় যে তাকে এড়ানাে যায় না। তিনি ঠিক করেন, এই সত্যকে ছাড়া অন্য কোনােকিছুকে তিনি তার দার্শনিক জ্ঞান ও সত্যানুসন্ধানের যাত্রাবিন্দু বলে গ্রহণ করবেন না এবং এই স্বজ্ঞার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকেও তিনি বিশ্লেষণ, পর্যালােচনা ও প্রতিপাদন করবেন। কোনােরকম অসুবিধাকেই উপেক্ষা করা কিংবা সমাধান না করে ফেলে রাখা হবে না, আপাতদৃষ্টিতে যাকে সত্য বা স্বতঃপ্রতীত (self-evident) বলে মনে হবে, তাকেও স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হবে।

সেদিনের প্রখ্যাত কেমব্রিজ প্লেটোবাদী হেনরি মূরের কাছে লেখা এক চিঠিতে দেকার্ত বলেছিলেন, তার পদ্ধতি হবে পুরােদস্তুর ব্যবহারিক ও বাস্তব, যেখানে ভাবালুতার কোনাে স্থান থাকবে না। “একটি ধারণা বা বিশ্বাসের পক্ষে কোনাে গ্রহণযােগ্য যুক্তি নেই, কিন্তু তবু কেবল ইচ্ছার চাপে যদি আমরা একে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে যাই, তাহলে আমরা সত্যের পথ থেকে যত দূরে সরে পড়বাে, অন্য কোনােকিছু আমাদের সত্য থেকে তার চেয়ে বেশি দূরে ঠেলে দিতে পারবে না।” (Correspondence, vol. 1, P. 402, Haldane, Life of Rene Descartes, P. 936.)

ব্যবহারিক জীবনে সত্যের সন্ধান করতে গিয়ে দেকার্ত যেসব নিয়ম অনুশীলন করবেন, সেগুলােকে তিনি তার ডিসকোর্স অন মেথড গ্রন্থে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রাত্যহিক জীবনেও তিনি স্বাভাবিক ও সংযত থাকবেন, উগ্রতা ও পাগলামি পরিহার করবেন। ক্যাথলিক ধর্মমতের প্রতি তিনি আস্থাশীল থাকবেন, জনমত ও প্রচলিত প্রথার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন এবং ইতস্ততভাব বা দোলায়মান অবস্থার দোষ এড়িয়ে চলবেন। তার গতিপথ হবে সুদৃঢ়, যেখানে নিশ্চিতি লাভ অসম্ভব সেখানে সম্ভাব্যতার ওপর নির্ভর করবেন। দুর্বল ও অনিশ্চিত মনে যেসব অনুশােচনা স্থান পায়, সেগুলাে কোনােদিন তার চলার পথ রুদ্ধ করতে পারবে না। দেকার্তের অপর এক সূত্র : “ভাগ্যকে নয়, নিজেকে জয় করার চেষ্টা কর এবং জগতের বিধানকে নয়, নিজের বাসনাকে পরিবর্তন কর।” এই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি তার মনে এমন এক শৃঙ্খলাবােধ উদ্বোধনে অগ্রসর হন যার ফলে বাহ্য ভাগ্যের পরিবর্তনকে উপলব্ধি করা এবং তাদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকতে প্রয়াসী হওয়া যায়।

দেকার্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি গ্রন্থ হচ্ছে ডিসকোর্স অন মেথড (Discourse on Method) (১৬৩৭) এবং মেডিটেশনস (Meditations) (১৬৪২)। এই দুটি গ্রন্থেই বিশুদ্ধ দর্শন নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। গ্রন্থ দুটির আলােচিত বিষয় প্রায় একই রকম। এগুলোতে দেকার্ত ‘কার্তেসিয় সংশয় পদ্ধতির’ (Method of doubt) ব্যাখ্যা দিয়ে আলােচনা শুরু করেছেন। দেকার্ত তার দার্শনিক পদ্ধতি প্রয়ােগের ক্ষেত্রে তার প্রাথমিক দার্শনিক হাতিয়ার হিসেবে সন্দেহকে গ্রহণ করেন। প্রাথমিক সন্দেহ দ্বারা তিনি সিন্ধান্তে পৌঁছবার আগে মনকে সকল প্রকার পূর্বধারণা থেকে মুক্ত ও সম্পূর্ণ পক্ষপাতশূন্য রাখায় প্রয়াসী ছিলেন। আর এ জন্যই তিনি স্থির করলেন যে, যা-কিছুকে সন্দেহ করা যায় তাকেই তিনি সন্দেহ করবেন। দেকার্তের সন্দেহ তার দার্শনিক পথের গন্তব্যস্থল বা লক্ষ্য বা শেষ কথা নয়, বরং তা প্রাথমিক এবং সুনিশ্চিত ও অসন্দিগ্ধ দার্শনিক জ্ঞান লাভের উপায়। তিনি সন্দেহকে জ্ঞান ও সত্যকে অস্বীকার করার জন্য নয়, বরং মনকে সংস্কারমুক্ত করে নতুন ভিত্তির ওপর জ্ঞান ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যবহার করেছেন। তাই দেকার্তকে তাকে সংশয়বাদী বলা যাবে না। সন্ধেহ করতে গিয়ে তিনি দেখতে পান যে, সবকিছুকে সংশয় করার প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই তিনি সাধারণভাবে স্বীকৃত নিয়মাবলি দ্বারা তার সংশয় প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই প্রক্রিয়া গ্রহণে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সংশয় ক্রিয়ার সম্ভাব্য ফলাফলে তার চিন্তন বাধাপ্রাপ্ত হবে না।

সংশয় পদ্ধতি ব্যবহার করতে গিয়ে দেকার্ত প্রথমেই ইন্দ্রিয়ের প্রামাণ্যকে সন্দেহ করেন। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান সবসময় নিশ্চিত সত্যের নির্দেশ করে না, এটি সঠিক ও অসন্দিগ্ধ নয়, বরং ইন্দ্রিয় প্রায়শই আমাদের প্রতারণা করে; যেমন, স্বপ্নে অনেক সময় অনেক দূরে চলে গেছি বলে মনে হলেও চেতনালাভের পর তার বাস্তবতাহীনতা বোঝা যায়। দেকার্ত বলেন, আমি স্বপ্নে দেখছি যে আমি ড্রেসিং গাউন পরে আগুনের পাশে বসে আছি, কিন্তু বাস্তবে আমি বিছানায় উলঙ্গ অবস্থায় ঘুমিয়ে আছি (তখনও রাত্রিকালীন শােয়ার পােশাক আবিষ্কৃত হয় নি)। এছাড়া কখনাে কখনাে পাগলদের দৃষ্টিভ্রম হয়। তাই আমি যাই দেখি তা আমার স্বপ্ন কিনা বা আমার মানসিক সমস্যার কারণে দৃষ্টিভ্রম কিনা এই সন্দেহ করা যায়, তাই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে সন্দেহ করা যায়। দেকার্ত সন্দেহ ও নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়ের সাথে জ্যামিতি ও গণিতশাস্ত্রের বিষয়ের মধ্যে তুলনা করেছেন। তার মতে, আমরা বিশেষ বস্তুর ক্ষেত্রে স্বপ্ন ও ভ্রম দেখি। চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্মের মতাে স্বপ্ন প্রকৃত বস্তুর প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করে। এই উপস্থাপনে প্রকৃত বস্তুর উপাদানসমূহ বিদ্যমান থাকে। আমরা স্বপ্নে ডানাযুক্ত ঘােড়া দেখতে পারি কারণ আমরা বাস্তবে ঘােড়া ও পাখা দেখেছি। স্বপ্নে ডানাযুক্ত ঘোড়াকে বাস্তব মনে করার ভ্রম হচ্ছে বিশেষ বস্তুর ভিত্তিতে তৈরি ভ্রম। এই বিশেষ বস্তু দেখি তা পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়। অন্যদিকে বিস্তৃতি, প্রসারণ, সংখ্যা প্রভৃতি জ্যামিতি ও গণিতশাস্ত্রের বিষয়। স্বপ্নে দেখা বস্তুর সংখ্যা, বিস্তৃতি বাস্তব বস্তুর সংখ্যা এবং বিস্তৃতির চেয়ে আলাদা হয়না, ভ্রমের ক্ষেত্রেও আমরা সংখ্যা, বিস্তৃতির ধারণাগুলোকে ঠিক রেখেই বিশেষ বস্তুসমূহের ভ্রম দেখি। তাই জ্যামিতি ও গণিতশাস্ত্রের বিষয়গুলো তুলনামূলকভাবে সত্য। দেকার্তের মতে তাই পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়ের চেয়ে জ্যামিতি ও গণিতশাস্ত্র বেশি নিশ্চিত ও এদেরকে সন্দেহ করা বেশি কঠিন।

দেকার্তের মতে, গণিতশাস্ত্র ও জ্যামিতির বিষয়গুলো অধিকতর নিশ্চিত হলেও এদেরকে সন্দেহ করা যায়। দুই আর দুই যোগ করলে চার হয় – গণিতের এই সিন্ধান্তটিকে, বা বর্গক্ষেত্রের বাহুর সংখ্যা চারটি – জ্যামিতির এই সিদ্ধান্তটিকে নির্ভুল ও নিঃসন্দিগ্ধ বলে মনে হয়, কিন্তু ডেকার্টের মতে একেও সন্দেহ করা যায়, কারণ ঈশ্বর আমাকে ভুল গণনা করতে প্ররােচিত করতে পারে। ঈশ্বর এরকম নির্দয় কাজ করতে পারেনা দাবি করলে বলতে পারি কোনাে এক প্রতারণাপরায়ণ দুষ্ট দৈত্যের (Evil Demon) প্ররােচনায় আমরা একে সত্য বলে ধরে নেই। যদি এ ধরনের কোনাে দৈত্য থেকে থাকে, তাহলে এমন হতে পারে যে আমি যা দেখছি তার সবই শুধু মায়া বা অবভাস, এবং আমার বিশ্বাসকে অবভাসে পরিণত করার জন্য সে কৌশল অবলম্বন করছে। এছাড়া, গাণিতিক প্রমাণেও মানুষ ভুল করে, এবং তা নিয়ে বাদানুবাদ দেখা দেয়। এভাবে দেকার্ত তার প্রাথমিক সংশয় দ্বারা জ্ঞানের সব উৎস ও বাহনকে সন্দেহ করেন এবং সবকিছুকে মনের মিথ্যা কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু এমন কিছুই নেই, যাকে সত্য বলে গ্রহণ করা যেতে পারে?

দেকার্তের মতে সবকিছুকে সন্দেহ করা গেলেও অন্তত একটি বিষয়কে সন্দেহ করা যায় না, যা হচ্ছে সন্দেহক্রিয়া। এটি মানবমনের একটি বিশেষ অবস্থা, যার উৎপত্তি চিন্তা থেকে। চিন্তা কথাটি আপেক্ষিক। চিন্তাক্রিয়ার জন্য চিন্তার কর্তার প্রয়োজন, তাই চিন্তাক্রিয়া থেকে চিন্তার কর্তার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। এখানেই তিনি তার দর্শনের প্রথম নিঃসন্দিগ্ধ সূত্র আবিষ্কার করলেন, “আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি অস্তিত্বশীল” (cogito ergo sum বা I think, therefore I am.)। এখানেই দেকার্তের সংশয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। একে সন্দেহ করা যায় না বলে আত্মসত্তার অস্তিত্বের এ প্রামাণ্য নির্ভুল। একে সন্দেহ করার চেষ্টা করলেও এর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়ে যায়। চিন্তার মতো সন্দেহও একটি মানসিক অবস্থা; সন্দেহক্রিয়ার জন্য সন্দেহকারী প্রয়োজন। এ থেকে দেকার্ত ঘােষণা করেন, আমি সন্দেহ করি, অতএব আমি অস্তিত্বশীল (dubito ergo sum)।

দেকার্তের মতে, কেউ যখন বলে ‘আমি চিন্তা করি, অতএব আমি আছি’, তখন সে তার অস্তিত্বকে কোনাে সহানুমান (syllogism)-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে না, বরং একে এমন একটি অব্যবহিত সত্য (immediate truth) হিসেবে প্রত্যক্ষ করে (অপরােক্ষ প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে উপলব্ধি) যা তার নিজের আলােকেই উদ্ভাসিত। এটি চিন্তার এমন এক সরল গতিশীলতা, যা সহজ প্রত্যক্ষণ বা প্রত্যক্ষ স্বজ্ঞার কাছে পরিপূর্ণভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। ‘আমি চিন্তা করি’ বা ‘আমি সন্দেহ করি’ অব্যবহিতভাবে ‘আমি অস্তিত্বশীল’-এর ব্যঞ্জনা বহন করে, চিন্তার প্রাণবন্ত ক্রিয়ার মধ্যেই যার নিশ্চয়তাকে প্রত্যক্ষ করা যায়। যে প্রক্রিয়ায় তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন তাকে কার্তেসীয় সন্দেহ (Cartesian doubt) বলে। দেকার্ত এক্ষেত্রে ‘চিন্তন’ শব্দটিকে দেকার্ত বৃহত্তর অর্থে ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, যে চিন্তা করে সে সন্দেহ করে, উপলব্ধি করে, ধারণা করে, দৃঢ়তা সহকারে স্বীকার করে, অস্বীকার করে, ইচ্ছা করে, কল্পনা করে, এবং অনুভব করে। তার মতে, স্বপ্নের মধ্যে প্রাপ্ত অনুভূতিও এক প্রকারের চিন্তন। যেহেতু চিন্তন হচ্ছে মনের সারসত্তা, সেহেতু মন সর্বদা চিন্তা করে, এমনকি মন গভীর নিদ্রায়ও চিন্তা করে। মধ্যযুগের দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন প্রায় cogito এর অনুরূপ এক ধরনের যুক্তি প্রদান করেছিলেন। অবশ্য তিনি এই যুক্তিকে প্রাধান্য দেন নি, এবং এই যুক্তির সাহায্যে তিনি যে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন তা তার দর্শনে খুব সামান্যই রয়েছে। তাই দেকার্তের মৌলিকত্বের স্বীকৃতি যতখানি না এই যুক্তি আবিষ্কারের মধ্যে তার চেয়েও বেশি এই যুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধির মধ্যে বিদ্যমান।

বার্ট্রান্ড রাসেল তার “History of Western Philosophy” গ্রন্থে তার কজিটো নিয়ে বলেছেন, “দেকার্ত তার সবিচার সংশয় পদ্ধতিকে উৎসাহহীন মনােভাব নিয়ে প্রয়ােগ করলেও এর একটি বৃহৎ দার্শনিক গুরুত্ব রয়েছে। সংশয় পদ্ধতির ইতিবাচক ব্যবহার তখনই করা যায়, বা এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ তখনই সফল হয় যখন সংশয়বাদকে থামানো যায় বা সন্দেহকে দূর করা যায়। এখন জ্ঞান যদি অভিজ্ঞতামূলক ও যৌক্তিক দুই রকমই হয়, তাহলে সংশয়বাদকে থামানোর জন্যেও দুটো বিন্দু দরকার। অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞানের সন্দেহ দূর করার জন্য দরকার সন্দেহাতীত ঘটনা, এবং যৌক্তিক জ্ঞানের সন্দেহ দূর করার জন্য দরকার অনুমানের সন্দেহাতীত নীতিসমূহ। এখন দেকার্তের সন্দেহাতীত ঘটনা হচ্ছে আমার ‘চিন্তন’, যেখানে চিন্তনকে বিস্তৃত অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। “আমি চিন্তা করি” – এটাই তার চূড়ান্ত প্রতিজ্ঞা বা আশ্রয়বাক্য (যেখান থেকে অন্য বিষয়গুলোকে প্রমাণ করা হয়)। কিন্তু এখানে “আমি” শব্দটির ব্যবহার অবৈধ। প্রতিজ্ঞা বা আশ্রয়বাক্য হিসেব তার ব্যবহার করা উচিৎ ছিল “চিন্তার অস্তিত্ব আছে” কথাটি। “আমি” শব্দটি ব্যাকরণগতভাবে সঠিক, কিন্তু এটি কোন উপাত্তকে বর্ণনা করেনা। যখন তিনি বলেন, ‘আমি এমন একটি বস্তু যা চিন্তা করে’, তখন তিনি স্কলাস্টিকবাদের ঐতিহ্য অনুসারে প্রাপ্ত ক্যাটাগরির কলা-কৌশলকে পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়াই ব্যবহার করেন। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নি যে, চিন্তনের জন্য একজন চিন্তনকারীর প্রয়ােজন। তাই শুধু ব্যাকরণিক অর্থ ছাড়া এই উক্তিকে বিশ্বাস করার কোনাে কারণ নেই। অবশ্য, বাহ্যজগতের চেয়ে চিন্তনকে মুখ্য অভিজ্ঞতামূলক নিশ্চিত বিষয় হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্তটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং পরবর্তী দর্শনে এর একটি গভীর প্রভাব ছিল।” (পৃ ৫৬০-৫৬১)।

দেকার্তের ‘আমি’ হচ্ছে চেতনার ভিত্তি যেখানে জ্ঞান ও সত্যের মানদণ্ড নিহিত। এই ‘আমি’ এর স্বরূপ কী? দেকার্ত সিদ্ধান্তে এলেন, ‘আমি’ এমন একটি জিনিস যার মূলধর্ম চিন্তা করা। এটি সংশয় করে, উপলব্ধি করে, ধারণা করে, ইচ্ছা করে, কল্পনা করে এবং অনুভব করে। দেকার্তের মতে, যা চিন্তা করতে পারে তা অবশ্যই একটি আধ্যাত্মিক দ্রব্য যা জড় পদার্থের উপর নির্ভর করেনা, এটি হল আত্মা। অর্থাৎ মন বা আত্মা সম্পূর্ণভাবে দেহনিরপেক্ষ ও দেহের থেকে আলাদা। ফলে দেহের অবর্তমানেও আত্মা তার স্বরূপ বজায় রাখতে সক্ষম। দেকার্তের মতে, স্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতার কারণে আত্মসত্তা বা ‘আমি’ এর প্রতীতি এত সুনিশ্চিত হয়। এ থেকে দেকার্ত একটি সার্বিক প্রামাণ্যনীতি আবিষ্কার করেন – “যা-কিছুর প্রতীতি স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল, তা-ই নির্ভুল ও সুনিশ্চিত।” অর্থাৎ তার মতে সত্যের লক্ষণ হচ্ছে স্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতা। এর আর কোনাে প্রমাণ নেই। ‘আমি’- এর প্রতীতি স্বতঃসিদ্ধ ও প্রমাণনিরপেক্ষ সত্য। চেতনার সঙ্গে অস্তিত্বের এই নিবিড় সম্পর্কই দেকার্ত দর্শনের মূল ভিত্তি। দেকার্ত বলেন, এখন থেকে আমি যেসব জিনিসকে আমার আত্মসত্তার প্রতীতির মতাে স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল বলে প্রত্যক্ষ করবাে, তাদেরকেও নিশ্চিত ও নিঃসন্দিগ্ধ সত্য বলে গ্রহণ করবাে। সমালােচকের মতে, স্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতার ভিত্তিতে সত্যের মানদণ্ড স্থাপন যথার্থ নয়, কারণ এর স্বভাব সার্বিক ও বস্তুনিষ্ঠ নয়, বরং বক্তিসাপেক্ষ ও আত্মগত। কারও কাছে যা স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল তা অন্যের কাছে স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল নাও মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য সকলের জন্য ও সকল দেশ ও কালের জন্য সত্য হয়। তবে দেকার্ত যে পদ্ধতিতে আত্মসত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান, তা স্বতঃপ্রমাণিত। গণিতবিদরা এই মানদণ্ড গ্রহণ করে বিস্ময়কর ফল লাভ করেছেন।

দেকার্তের জ্ঞানোৎপত্তির তত্ত্ব ও বুদ্ধিবাদ

দেকার্ত আমাদের দেহ সংক্রান্ত জ্ঞানের প্রশ্ন উত্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মৌচাক থেকে এক টুকরাে মােমের উদাহরণ দেন। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা এর কিছু বিষয় আমরা বোধ করি – এর মধুর মতাে স্বাদ আছে, এতে ফুলের গন্ধ আছে, এর সুনির্দিষ্ট বর্ণ, আকার ও আকৃতি আছে, এটি শক্ত ও ঠাণ্ডা, এবং একে আঘাত করলে শব্দ নির্গত হয়। কিন্তু মােমটি দিয়ে বাতি বানিয়ে আগুনের সংস্পর্শে রাখলে মোমটি বস্তু হিসেবে ঠিক থাকলেও এর আকার, রং সহ অন্যান্য গুণাবলির পরিবর্তন হয়। তাই ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্থাপিত বস্তুটি মােম থাকেনা, কিন্তু বাস্তবে সেটি মোম। ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা তাই মোমের বাস্তব রূপ দেখতে পারছি না, কিন্তু মন দিয়ে মোমকে অনুভব করতে পারছি।

মোমটি বিস্তৃতি, নমনীয়তা, এবং গতি দিয়ে তৈরি বলে মন দিয়ে একে উপলব্ধি করা যায়, কল্পনা দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। মােম নামক বস্তুটি স্বয়ং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না, কারণ বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের কাছে বস্তুটির অবভাসসমূহ সমভাবে বিদ্যমান থাকে। মােমের প্রত্যক্ষণ দৃষ্টি বা স্পর্শ বা কল্পনার বিষয় নয়, এটি মনেরই সংবীক্ষণ। আমি যেমন রাস্তায় টুপি এবং কোট দেখে মনে করি আমি মানুষ দেখছি, কিন্তু আসলে মানুষকে আমি দেখিনা, ঠিক তেমনিভাবে আমি মােমটিকেও দেখি না। আমি আমার বিচারশক্তির উপলব্ধি দিয়ে যা চিন্তা করি তাকেই আমি আমার চোখ দিয়ে দেখি। আমার বিচারশক্তির এই উপলব্ধি আমার মনেই অবস্থান করে। ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের জ্ঞান বিভ্রান্তিমূলক, এবং মানবেতর প্রাণীরও এ ধরনের জ্ঞান রয়েছে। আমি মােমের কাপড় দিয়ে মােমকে আবৃত্ত করলেও মনের চোখ দিয়ে প্রত্যক্ষণ করার সময় আমি শুধু মােমটিকেই প্রত্যক্ষণ করি। ইন্দ্রিয় দিয়ে আমি মােমটি প্রত্যক্ষ করছি, এখান থেকে আমার নিজের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে প্রতিপাদিত হয়, কিন্তু মােমের অস্তিত্ব আমার নিজের অস্তিত্বের মতাে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় না। বাহ্যবস্তুর জ্ঞান ইন্দ্রিয় নয়, মন দিয়েই প্রাপ্ত হয়।

দেকার্ত অন্য কিছুকে বাদ দিয়ে কেবল বুদ্ধিকেই জ্ঞানোৎপত্তির মূল কারণ বলে নির্ধারণ করেন বলে দেকার্তের এই জ্ঞানোৎপত্তির মতবাদকে বুদ্ধিবাদ বা র‍্যাশনালিজম বলে। পরবর্তীতে স্পিনোজা ও লাইবনিজও বুদ্ধিবাদকেই অনুসরণ করেন বলে তাদেরকেও বুদ্ধিবাদী বলা হয়। পরবর্তীতে হিউম, লক ও বার্কলে এই মতবাদের সমালোচনা করে অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানোৎপত্তির বিষয় বলে চিহ্নিত করেন। তাদেরকে অভিজ্ঞতাবাদী বা এমপিরিসিস্ট বলা হয়।

মনের তিন প্রকার ধারণা

দেকার্ত তার জ্ঞানতত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ধারণা বা আইডিয়ার কথা বলেছেন। তার মতে ধারণা তিন রকম –

  • (১) আগন্তুক ধারণা (Adventitious idea) – অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বাইরের জগৎ থেকে সংগ্রীহিত বিশেষ ধারণাসমূহ, যেমন – চেয়ার-টেবিলের ধারণা, গােলাপ ফুলের ধারণা ইত্যাদি। আগন্তুক ধারণার বাস্তবতার কোনাে নিশ্চয়তা নেই, কারণ স্বপ্নবস্থায়ও এদেরকে পাওয়া যায়। এগুলো প্রায়ই ভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
  • (২) কৃত্রিম ধারণা (Factitious idea) – এমনসব ধারণা যাদের সরাসরি বাহ্যবস্তু থেকে পাওয়া যায় না, বরং জন্মগত কিংবা অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার সংযােগের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এগুলো কল্পনার সৃষ্টি, প্রকৃত বস্তুর সাথে এগুলোর কোন মিল নেই, কোন বাস্তবতা নেই, যেমন ডানাবিশিষ্ট ঘােড়ার ধারণা, কাঁঠালের আমসত্ত্বের ধারণা।
  • (৩) সহজাত বা অন্তর ধারণা (Innate idea) – এমনসব ধারণা যাদের অভিজ্ঞতা বা কল্পনার মাধ্যমে পাওয়া যায় না, বরং স্থান-কাল-পাত্র, জাতিধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মনে জন্ম থেকেই মুদ্রিত থাকে, যেমন – দেশ, কাল, নিত্যতা, অসীমতা, দ্রব্যত্ব প্রভৃতির ধারণা।

ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই বহির্জগৎ সম্পর্কে ব্যক্তি ধারণা লাভ করে, তাই একে ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণ বলে। এটাই দেকার্তের কাছে আগন্তুক ধারণা। দেকার্তের মতে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে সাধারণ ভুলটি হচ্ছে, আমরা আমাদের ধারণাকে বাহ্যবস্তুর অনুরূপ বলে মনে করি। একজন ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে অনুমান করে যে, আগন্তুক ধারণা বাহ্যবস্তুর অনুরূপ, বাহ্যবস্তুর প্রতিরূপ আমাদের মনে অঙ্কিত হয়। এর কারণ মূলত দুটি। একটি কারণ হল, আমাদের মনে হয়, প্রকৃতি আমাদের এরকম চিন্তা করার শিক্ষা দেয়। কিন্তু “প্রকৃতি আমাকে এরকম চিন্তা করার শিক্ষা দেয়” বলার অর্থ এই নয় যে, আমি স্বাভাবিক আলোয় একে দেখি, বরং এই যে, আমার এরকম বিশ্বাস করার পেছনে নির্দিষ্ট কোনো প্রবণতা আছে। স্বাভাবিক আলোয় দেখা কোন কিছুকে অস্বীকার করা যায়না, কিন্তু আমরা একে আমাদের প্রবণতা থেকে দেখছি বলে এটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। এরকম মনে করার আরেকটি কারণ হল, আমাদের ইচ্ছা ছাড়াই বা অনৈচ্ছিকভাবেই (যেমন সংবেদনের মাধ্যমে) স্বাধীনভাবে এরকম ধারণার আগমন ঘটে। কিন্তু অনৈচ্ছিক সংবেদনের দ্বারা জ্ঞান প্রাপ্ত হচ্ছে বলে এই যুক্তিকে এটা ধরে নেয়া যায়না যে এই জ্ঞান বাহ্যবস্তু থেকে আসছে। কেননা স্বপ্নেও আমরা অনৈচ্ছিক সংবেদনের দ্বারাই বাহ্যবস্তুকে প্রত্যক্ষ করি, সেখানে ইচ্ছা থাকেনা।

এছাড়া কখনাে কখনাে ব্যক্তির মনে একই বাহ্যবস্তুর বিভিন্ন ধারণা উপস্থিত হয়। যেমন, আমাদের ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের কাছে সূর্য যেভাবে প্রতীয়মান হয়, তা একজন জ্যোতিবিজ্ঞানী সূর্যের যে ধারণায় বিশ্বাস করেন তার থেকে পৃথক হবে। কিন্তু এই উভয় প্রকার ধারণা আসছে একই সূর্য থেকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূর্যের ধারণায় যে বৌদ্ধিক ব্যাপার আছে তা সাধারণের অভিজ্ঞতায় নেই, তাই সাধারণের ধারণাটি কম যুক্তিসঙ্গত হয়। দেকার্তের মতে তাই বাহ্যবস্তু থেকে ব্যক্তি যে আগন্তুক ধারণা লাভ করে সেগুলোকে নিশ্চিতভাবে গ্রহণ করা যায়না, এগুলোতে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাই দেকার্তের সংশয়বাদ বহির্জগতের অস্তিত্বের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। এই সন্দেহ থেকে মুক্ত হবার একমাত্র পথ হচ্ছে প্রথমেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা।

ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে দেকার্তের প্রমাণ এর জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যবহার ও তার প্রমাণের সমালোচনা

দেকার্তের ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণসমূহ খুব একটা মৌলিক নয়। তিনি এই প্রমাণসমূহ মূলত স্কলাস্টিক দর্শন থেকে গ্রহণ করেছেন। দেকার্তের চেয়ে লাইবনিজই এই প্রমাণগুলোকে বেশি ভালােভাবে বর্ণনা করেছিলেন। তার প্রমাণগুলো হল –

  • ১। প্রথম প্রমাণটি কার্যকারণ সম্বন্ধের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে এটি কারণিক প্রমাণ (Causal proof)। মানুষের মনে যেসব ধারণা রয়েছে তাদের মধ্যে অনন্ত অসীম সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মনে এ ধারণার সৃষ্টি হলাে কীভাবে? ঈশ্বরের ধারণা একটি অনন্ত অসীম সত্তার ধারণা। আমরা সবাই সসীম, এবং সসীমের পক্ষে অসীমের ধারণা সৃষ্টি কার্যকারণ নিয়ম অনুসারে অসম্ভব। তাই কোন মানুষের পক্ষে এই ধারণার জনক হওয়া সম্ভব নয়, একমাত্র পূর্ণসত্তা ঈশ্বর মানুষের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করতে পারেন। সুতরাং মানুষের মনে অনন্ত অসীম সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের যে সহজাত ধারণা বর্তমান, তার সংস্থাপক হিসেবে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল।
  • ২। দ্বিতীয় প্রমাণ অনেকটা কারণিক প্রমাণের মতো। এটি অনুসারে, আত্মসত্তা বা ‘আমি’ এর ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে চিন্তা করলে নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় যে, আমার ক্ষমতা এতই সীমিত যে আমি নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম নই। তাই আমি আমার নিজের অস্তিত্বের কারণ নই। আমি আমার সৃষ্টির কারণ হলে আমি নিজেকে পরিপূর্ণ করেই সৃষ্টি করতাম, কিন্তু আমি পরিপূর্ণ নই। আমার মা-বাবাও আমার অস্তিত্বের কারণ নন; কারণ তারা আমাকে রক্ষা করতে সক্ষম নন, যেমনটা তারা নিজেদেরকে রক্ষা করতেও সক্ষম নন। সুতরাং আমি বা আমার মাবাবা বা অন্য কেউ আমার অস্তিত্বের কারণ হতে পারে না। কোনাে সসীম সত্তা আমার অস্তিত্বের কারণ না হয়ে থাকলে আমার জনক, ধারক ও বাহক হিসেবে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল।
  • ৩। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত দেকার্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হল সত্তাতাত্ত্বিক প্রমাণ (ontological proof)। মধ্যযুগের ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তাবিদ ও দার্শনিক সেন্ট আনসেলম প্রথম এই প্রমাণ দান করেন। দেকার্তের যুক্তিটি আনসেলমের যুক্তির উন্নততর আধুনিক ভাষ্য। এখানে দেকার্ত বলেন, পুর্ণতার ধারণা অস্তিত্বের নির্দেশক। একটি ত্রিভুজের সংজ্ঞা থেকে যেমন ত্রিভুজের গুণাবলি অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়, ঠিক তেমনি পরিপূর্ণ ঈশ্বরের ধারণা থেকেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়। অর্থাৎ পূর্ণসত্তা হিসেবে ঈশ্বর অস্তিত্বশীল।

ঈশ্বরের অস্তিত্ব আলােচনা করার পর দেকার্ত অন্যান্য বিষয় সহজভাবেই আলােচনা করেছেন। ঈশ্বর যেহেতু মঙ্গলময়, তাই নিশ্চই তিনি কোনাে প্রতারক দৈত্যের মতাে কাজ করবেন না। এই প্রতারক দৈত্যকে দেকার্ত সংশয়ের ভিত্তি হিসেবে কল্পনা করেছেন। তার মতে ঈশ্বর আমাকে দেহকে বিশ্বাস করার এক শক্তিশালী প্রবণতা প্রদান করেছেন। কিন্তু দেহ বলে যদি কোনাে কিছু নাই থাকে তবে ঈশ্বর প্রতারক হিসেবে প্রমাণিত হবেন। তাই দেহের অস্তিত্ব আছে। এছাড়া ঈশ্বর ভ্রান্তি নিরসনের জন্য মানুষকে এক প্রকার মানসিক ক্ষমতা প্রদান করেছেন। যা কিছু স্পষ্ট এবং প্রাঞ্জল তাই সত্য—এই নীতি প্রয়ােগকালে ব্যক্তি এই মানসিক ক্ষমতা ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি মনে করে যে সে তার দেহ ও মন উভয়ের দ্বারা যৌথভাবে নয়, বরং কেবল তার মন দিয়েই দেহকে বুঝতে পারে। এর মাধ্যমেই ব্যক্তি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানকেও বুঝতে পারে।

দেকার্তের ঈশ্বরের প্রমাণগুলোর সমালোচনাও রয়েছে –

  • ১। লক, হিউম, বার্কলের মত অভিজ্ঞতাবাদীদের (Empiricist) মতে অসীমের ধারণা কেবলই একটি নঞর্থক ধারণা; সুতরাং তা পূর্ণতার নির্দেশক হতে পারে না।
  • ২। দেকার্তের প্রমাণপদ্ধতিকে বুদ্ধিসম্মত বলা চলে না, কারণ কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তিনি এতে স্কলাস্টিক সূত্রের ব্যবহার করেছেন। কোনাে যুক্তির অবতারণা না করেই তিনি ধরে নিয়েছেন, মানুষ জানে যে সে সান্ত ও সসীম, অথচ অনন্ত অসীম ঈশ্বরকে সে জানে।
  • ৩। দেকার্তের প্রমাণপদ্ধতিতে চক্রক দোষ (vicious circle) লক্ষ্য করা যায়। যেমন, প্রথমে চেতনার অস্তিত্ব প্রমাণ করে তারপর তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। কিন্তু এরপর তিনি ঈশ্বরকে চেতনা সহ সব সত্যের ভিত্তি হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করেছেন, অর্থাৎ চেতনার সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে আবার তিনি ঈশ্বরের সাহায্যে চেতনার সত্যতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তাই তার এ যুক্তি চক্রক দোষে দুষ্ট।

বহির্জগৎ, দ্রব্য, গুণ ও প্রত্যংশ

দেকার্তের মতে ঈশ্বর শুধু সর্বশক্তিমান তাই নয়, তিনি একই সাথে পরমশুভ। তাই ঈশ্বর মানুষের মনে যেসব ধারণা সংস্থাপিত করেছেন, তাদের কোনােটিই অমূলক হতে পারে না। এই ধারণাবলির মধ্যে একটি হল বহির্জগতের ধারণা। এই ধারণা এতই স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল যে তা মিথ্যা হতে পারে না। তাই বহির্জগৎ অস্তিত্বশীল। দেকার্তের মতে ঈশ্বর জড় ও মনের সমবায়ে জগৎ তৈরি করেছেন। এই জড়, মন ও ঈশ্বর নিয়ে দ্রব্য তিনটি – পরম দ্রব্য ঈশ্বর, চেতন দ্রব্য মন ও বিস্তৃতি দ্রব্য জড়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল নয় বলে ঈশ্বর পরম দ্রব্য। অসীম দ্রব্য হিসেবে ঈশ্বর নিজেই তার অস্তিত্বের কারণ। ঈশ্বরই সব কারণের কারণ ও তার ওপর সমগ্র জগৎ নির্ভরশীল। পদার্থ হিসেবে ঈশ্বর অনপেক্ষ (absolute) হলেও মন ও জড় আপেক্ষিক (relative), কারণ এরা ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হওয়ায় এদের অস্তিত্ব অনন্ত অসীম ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল।

দ্রব্যের অত্যাবশ্যক ধর্ম হল গুণ। গুণ ছাড়া দ্রব্যের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। গুণের মাধ্যমেই দ্রব্যকে জানা যায়। তাই জড় ও মনের নিজস্ব গুণেই তাদের স্বরূপ নিহিত। এদের অন্যান্য ধর্মগুলো এই স্বরূপ থেকে উদ্ভূত। জড়ের মৌলিক গুণ বা স্বরূপ বা অব্যবহিত ধর্ম হলাে বিস্তৃতি, অন্যদিকে আত্মা বা মনের স্বরূপ বা অব্যবহিত ধর্ম হলো চিন্তা। জড় চিন্তা করতে পারে না, কিন্তু তার আকার, পরিমাণ ও বিস্তৃতি আছে। মন চিন্তা করতে পারলেও তার আকার, পরিমাণ ও বিস্তৃতি নেই, মন অদেহধারী বা নিরবয়ব; এর পরিমাণ নেই ও তা স্থান দখল করে না। গুণ ছাড়াও দ্রব্যের অন্য যেসব গৌণ বৈশিষ্ট্য আছে, বা গুণ ছাড়া দ্রব্য সম্পর্কে আর যাকিছু কল্পনা করা যায় তাদের প্রকার বা প্রত্যংশ (modes) বলা হয়। প্রত্যংশ দ্রব্যের বিকার বা পরিবর্তনশীল অবস্থা। যেমন জড়ের ক্ষেত্রে গুণ হিসেবে বিস্তৃতি ছাড়া প্রত্যংশ হিসেবে আকার, গতি প্রভৃতি দেখা যায়, অন্যদিকে মনের ক্ষেত্রে গুণ হিসেবে চিন্তা ছাড়া প্রত্যংশ হিসেবে ইচ্ছা, অনুভূতি, কামনা, কল্পনা প্রভৃতি দেখা যায়। গুণ নিজেকে বিভিন্ন প্রত্যংশে প্রকাশ করতে পারে। প্রত্যংশকে বাদ দিয়ে দ্রব্য ও গুণকে কল্পনা করা যায়, কিন্তু দ্রব্য ও গুণকে বাদ দিয়ে প্রত্যংশকে কল্পনা করা যায়না। যেমন জড়ের গুণ বিস্তৃতি বা বিস্তৃত দেশ ছাড়া জড়ের আকার ও গতির কথা কল্পনা করা যায়না, তাই আকার, গতি জড়ের প্রত্যংশ। এদিকে মন বা আত্মার গুণ চিন্তা ছাড়া চিন্তাশীল সত্তার বিভিন্ন প্রত্যংশ যেমন অনুভূতি, ইচ্ছা, কামনা, কল্পনাকে কল্পনা করা যায়না, তাই এরাই মনের প্রত্যংশ। ডেকার্টের মতে সার্বিক (universal)-এর বাস্তব অস্তিত্ব নেই। স্থিতিকাল, শৃঙখলা, সংখ্যা প্রভৃতি সার্বিক ধারণা নয় বরং এগুলো বাহ্যবস্তুর বা চিন্তার প্রত্যংশ। চিন্তার প্রত্যংশ হিসেবে সার্বিক ধারণাবলি সাদৃশ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সদৃশ বিশেষের প্রতীক হিসেবে সার্বিক ধারণাসমূহ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

জড় জগতের ব্যাখ্যায় বিস্তৃতি ও গতি

দেকার্ত তার পদার্থবিদ্যার মত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পদার্থিক জগতের স্বরূপ এবং মানুষের ও মনের সম্পর্ক বিষয়ে আলােচনা করেন। দেকার্তের মতে জগৎ গঠনের জন্য বিস্তৃতি ও গতি যথেষ্ট, এবং জড়জগৎ যান্ত্রিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। তাই জগৎকে বিস্তৃতি ও গতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। একই যান্ত্রিক উপায়ে মানুষের দেহকেও ব্যাখ্যা করা যায়। জড়ের মূলতত্ত্ব হল বিস্তৃতি; ওজন, অচ্ছেদ্যতা, বর্ণ প্রভৃতি জড় থেকে পৃথক। দেকার্তের মতে পদার্থকে বাদ দিলে দেশের বিভিন্ন বিন্দু ও স্থানকে পৃথক করে রাখার মতো কোন কিছু অবশিষ্ট থাকে না বলে দেশ থেকে সব পদার্থকে সরিয়ে নিলে দেশের অস্তিত্ব থাকে না। তাই দেশ মাত্রই পূর্ণ, দেশ ও জড় এক ও অভেদ, তাই শূন্যদেশের অস্তিত্ব ও সম্ভাবনা নেই। বিস্তৃতির কোনাে শেষ নেই, কারণ জড় ও জগৎ অসীম। দেকার্তের মতে, দেশ অনন্ত খণ্ডে বিভাজ্য বলে এর কোনাে মৌলিক অংশ নেই, তাই পরমাণুর অস্তিত্ব নেই। তাই গ্যাসেন্ডি যে পারমাণবিক মতবাদকে পুনরুজ্জীবিত ও সমর্থন করেছিলেন দেকার্ত তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। ইচ্ছামতাে নির্বাচিত একটি স্থায়ী বিন্দুর সাহায্যে স্থানের সংজ্ঞা দেয়া হয় বলে অবস্থান বা স্থান আপেক্ষিক। জড় তার পূরণ করা দেশ এবং দখল করা স্থানের সঙ্গে অভেদ বলে যখনই এটি যেখানে যায়, তখনই তা তার দেশ ও সীমানাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তাই প্রথমে একটি এবং পরে অপর একটি স্থান দখল করার অর্থে বস্তু স্থান পরিবর্তন করতে পারে না। তাই দেকার্তের মতে জড়ের দ্বারা স্থান বা দেশ পরিবর্তনের ধারণাও ভ্রান্ত।

জড়ের গতি জড়ের বিস্তৃতির বিকার বা পরিবর্তনশীল অবস্থা বা প্রত্যংশ (mode), এটি জড়ের চলমান প্রত্যংশ। জড়ের যেকোনাে পরিবর্তন বা আকারের বৈচিত্র্য এই গতির ওপর নির্ভরশীল। দেকার্তের মতে, জড়ের মূলতত্ত্ব বিস্তৃতি নিষ্ক্রিয় ও গতিহীন, গতি জড়ের গুণ নয়, গতি ছাড়াও জড়ের অস্তিত্ব থাকে, তাই গতি জড়ের প্রত্যংশ। গতিকে তাই জড়ের বাইরে থেকে আরোপ করতে হয়েছে। তাই ধরে নিতে হয় যে, জড় সৃষ্টি করতে গিয়ে ঈশ্বরকে এর প্রতিটি অংশে গতি প্রদান করতে হয়েছে। তাই ঈশ্বর কর্তৃক উদ্ভূত গতিকে ঈশ্বর ছাড়া কোন কিছুর পক্ষে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তাই গতির সৃষ্টি ও ধ্বংস করা যায়না, কেবল পরিবর্তন করা যায়। এজন্য দেকার্ত জাড্য নিয়ম, অত্যল্প ক্রিয়া নিয়ম, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ম প্রভৃতি পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলোকে স্বীকার্য ধরে নেন। জাড্য নিয়ম (law of inertia) অনুসারে কোনাে বাহ্য শক্তি দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হলে প্রত্যেক পদার্থই একটা বিশেষ পরিমাণের গতি বা নিশ্চলতা সংরক্ষণ করতে চায় (এটাই নিউটনের গতির প্রথম সূত্র)। অত্যল্প ক্রিয়া নিয়ম (law of least action) অনুসারে গতি সবসময় নিজেকে সরল রেখায় পরিচালিত করে থাকে। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ম (law of action and reaction) অনুসারে, দুটি পদার্থ যখন একত্র হয় তখন এদের মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র তা তার লক্ষ্য হারায়, কিন্তু গতি হারায় না; অথচ যেটি অপেক্ষাকৃত বড়, তা তার লক্ষ্য হারায় না, কিন্তু ততটুকু গতি হারায় যতটুকু অপর পদার্থটিকে প্রদান করে। গতি সম্পর্কিত দেকার্তের অনেক ধারণাই নিউটন গ্রহণ করেন, কিন্তু নিউটন তার মহাকর্ষ সূত্রে বলেন, দুটো পদার্থ মহাকর্ষ বলের কারণে দূর থেকেই একে অপরকে আকর্ষণ করে। কিন্তু দেকার্তের তত্ত্বে বস্তুসমূহের এই দূর থেকে ক্রিয়ার ধারণা ছিল না।

দেহ ও মন

দেকার্ত তার যান্ত্রিক ব্যাখ্যানীতিকে পদার্থবিদ্যার মত জীববিদ্যা ও শারীরবিদ্যা সহ প্রকৃতির প্রতিটি বিভাগেই ব্যবহার করেন। তার মতে, আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকলে আমরা রসায়নবিদ্যা এবং জীববিদ্যাকে বলবিদ্যায় পর্যবসিত করতে সক্ষম হতাম। এখান থেকে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, প্রাণী মাত্রই চেতনাবিহীন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র (automata) স্বরূপ। দেকার্ত মন ও আত্মাকে সমরূপ চিন্তা করেছেন। তার মতে প্রাণী ও উদ্ভিদের বেড়ে ওঠা, পুষ্টিসাধন, সংবেদন সহ বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ায় আত্মার কোন ভূমিকা নেই কেবল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সংঘাত বা যান্ত্রিকভাবেই এগুলোর ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এভাবে তিনি এরিস্টোটলের মতের বিরুদ্ধে যান।

এরিস্টোটলের মতে মানুষের তিন ধরণের আত্মা রয়েছে – পুষ্টিসাধক, সংবেদনশীল ও বৌদ্ধিক আত্মা। এর মধ্যে উদ্ভিদের মধ্যে কেবল পুষ্টিসাধক আত্মা থাকে যার ফলে তারা বৃদ্ধি পায়, মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে সংবেদনশীল আত্মা থাকে যার ফলে তারা সংবেদনশীলতা দেখায়। আর মানুষের ক্ষেত্রে এগুলো ছাড়াও বৌদ্ধিক আত্মা থাকে যার দ্বারা মানুষ চিন্তা করতে পারে।  এর বিরুদ্ধে গিয়ে দেকার্ত বলেন, মানুষ সহ অন্যান্য জীবের মধ্যে সংবেদন ও পুষ্টিসাধনের মত বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি যান্ত্রিক, তাই এগুলোকে ব্যাখ্যার জন্য আত্মার প্রয়োজন নেই। আত্মা কেবল মাত্র একটাই, আর তা হল বৌদ্ধিক আত্মা, যার সাহায্যে মানুষ চিন্তা করে, আর এই আত্মা কেবল মানুষেরই আছে। সংবেদন ও পুষ্টিসাধনের ক্রিয়া আত্মিক নয়, দৈহিক ও এরা যান্ত্রিক, তাই মানবেতর প্রাণী ও মানুষের দেহ যান্ত্রিক। এদের মধ্যে আত্মচেতনা বা চিন্তা নেই, এদের প্রাণশক্তি যন্ত্রের ক্রিয়া স্বরূপ, স্নায়ু ও পেশীর সঞ্চালনের ফল, এদের আচরণে যে চেতনা বা বুদ্ধিময় ক্রিয়া দেখা যায় তা তাদের জটিল দেহযন্ত্রের প্রতিক্রিয়া মাত্র। কেবল মানুষের মধ্যে আত্মা থাকায় অ-মানব প্রাণীরা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম দ্বারা পরিচালিত অনুভূতি বা চেতনাহীন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র মাত্র। অ-মানব প্রাণীরা স্বয়ংক্রীয় যন্ত্রস্বরূপ এই মতবাদটি ১৮শ শতকের বস্তুবাদকে প্রভাবিত করে, বিজ্ঞানীরা তখন অ-মানব প্রাণীর মত মানুষকেও যন্ত্রস্বরূপ ভাবা শুরু করে।

মানুষের আত্মা প্রসঙ্গে দেকার্ত বলেন, দেহ ঈশ্বরসৃষ্ট একটি স্বতশ্চালিত যন্ত্র যেখানে আত্মা বা মনের অধিষ্ঠান ঘটে। এভাবে মানুষের মধ্যে চিন্তাশীল দ্রব্য মন ও বিস্তৃত দ্রব্য জড় (দেহ) সংযুক্ত থাকে, দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে মানুষ গঠিত হয়। দেহ ও মনের এরকম পৃথক অস্তিত্বের মতবাদকে দ্বৈতবাদ বলে। দেহ এবং মনের দ্বৈতবাদের ধারণা প্লেটোর থেকে শুরু হয়, এবং প্রধানত ধর্মীয় কারণে খ্রিষ্টদর্শন দ্বারা এর বিকাশসাধন হয়। দেকার্ত এই দেহ এবং মনের দ্বৈতবাদের বিকাশকে সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণ করেন। দেহ ও মনের দ্বৈততা ও বৈপরীত্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মন চিন্তা করে, কিন্তু জড় চিন্তা করতে পারে না। অন্যদিকে জড়ের গুণগুলো যেমন আকার, পরিমাণ, বিস্তৃতি প্রভৃতি মনের মধ্যে নেই। মন নিরবয়ব, এর পরিমাণ নেই, স্থান দখল করে না। মন সক্রিয় ও স্বাধীন, কিন্তু জড় নিশ্চল ও অচেতন। তাই এরা কেবল একটি অপরটি থেকে ভিন্ন নয়, এরা পরস্পর বিপরীতধর্মী। দেহের মধ্যে আত্মার অধিষ্ঠান হলেও এদের মধ্যে কোনাে অভ্যন্তরীণ সম্বন্ধ নেই।

কিন্তু দেহ ও মন এরকম পরস্পরবিরােধী হলে তাদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্ভব হতাে না। কিন্তু তাদের উভয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক দেখা যায়। তাই প্রশ্ন হল মানব দেহে এই বিপরীতধর্মী মন ও দেহের সমন্বয় ও সম্বন্ধ কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দেকার্তের মতে, মস্তিষ্কের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পিনিয়াল গ্রন্থি (pineal gland) দেহ ও মনের সংযােগস্থল। এর মধ্যস্থতায় দেহ ও মনের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হয়, এর সাহায্যে মন দেহের ওপর এবং দেহ মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তার মতে, বিশ্বে মােট গতির পরিমাণ অপরিবর্তিত, তাই আত্মা একে প্রভাবিত করতে পারে না। কিন্তু আত্মা প্রাণসত্তার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে, এবং এভাবে পরােক্ষরূপে দেহের অন্যান্য অঙ্গের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু এই মতের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পিনিয়াল গ্রন্থি দেহ-মনের মিশ্রণজাত কিছু হলে তা দেহ ও মনকে যুক্ত করতে পারতাে। কিন্তু পিনিয়াল গ্রন্থি দেহেরই অংশ। দেকার্ত এর সঙ্গে মনের সম্পর্ক দেখাতে পারেননি। তাই দেকার্ত দেহ ও মনের সমন্বয়সাধনে ব্যর্থ হন। তবে দেকার্তের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিলেন। এই অমীমাংসিত সমস্যাটি স্পিনােজা ও লাইবনিজের দর্শনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

দেকার্তের দর্শনের প্রভাব

দেহ ও মনের সমস্যা উত্থাপন, প্রচলিত কর্তৃপক্ষীয় মত খণ্ডন, জ্ঞানের ওপর গুরুত্ব আরােপ, যৌক্তিক স্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতার পক্ষে দাবি উত্থাপন এবং পদার্থবিদ্যা ও শারীরবিদ্যা সহ উন্নয়নশীল বিজ্ঞানসমূহের প্রতি আগ্রহের কারণে দেকার্ত বৈজ্ঞানিক আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, যা পরবর্তী দুইশ বছরে সমগ্র পৃথিবীর চেহারা বদলে দেয়। দেকার্তের ডিসকোস অন মেথড গ্রন্থটিকে বৈজ্ঞানিক মানবতাবাদের একটি সুস্পষ্ট দলিল বলে অভিহিত করা যায়। পরবর্তীকালের কোনাে দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক এই গ্রন্থের প্রভাব এড়াতে পারেননি। বিশেষ করে ফরাসি সভ্যতায় এর প্রভাব ছিল অসামান্য। এর প্রায় এক শতাব্দী পরে প্রকাশিত সামাজিক চুক্তি নামক রুশাের বৈপ্লবিক গ্রন্থের পেছনে দেকার্তের ডিসকোর্সের প্রভাব দেখা যায়। অনেকের মতে, পরবর্তী কালে ফরাসি বিদ্বৎসমাজে যুক্তিবাদিতার প্রতি যে আকর্ষণ দেখা যায়, তার পেছনে দেকার্তের প্রভাব বিদ্যমান।

দেকার্ত পরবর্তী অধিকাংশ দার্শনিক জ্ঞানতত্ত্বের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন, এবং জ্ঞানতত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরোপের জন্য তারা প্রধানত দেকার্তের কাছে ঋণী। ‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি’ – এই উক্তিটি বস্তুর চেয়ে চিন্তনকে অধিকতর নিশ্চয়তা প্রদান করে, এবং আমার চিন্তন আমার কাছে অন্যদের চিন্তনের চেয়ে অধিকতর নিশ্চিত। এভাবে প্রায় সকল প্রকার দর্শনেই বিষয়ীবাদের (subjectivism) প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই বিষয়ীবাদের ধারণা দেকার্তের দর্শন থেকেই উদ্ভব হয়েছে। বস্তু সম্পর্কে আদৌ যদি কিছু জানা যায় তা মন সম্পর্কে যা জেনেছি তার অনুমান দ্বারাই জানতে হবে। দর্শনের এই দুই ধারা মহাদেশীয় ভাববাদ এবং ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদে বিদ্যমান (মহাদেশীয় ভাববাদ বলতে ইংল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের বাকি অংশের ভাববাদকে বোঝানো হয়েছে)। মহাদেশীয় ভাববাদে এই ধারা বিজয়দৃপ্তরূপে এবং ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদে দুঃখজনকভাবে বিদ্যমান। অনেক পরে করণবাদ (instrumentalism) নামে এক ধরনের দর্শনের সাহায্যে এই বিষয়ীবাদ থেকে মুক্তির চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ব্যতিক্রম ছাড়া আধুনিক দর্শন তার সমস্যা গঠনে প্রধানত দেকার্তের দর্শনই গ্রহণ করেছে, কিন্তু তার সমাধানের পথ গ্রহণ করে নি।

দেকার্ত যে দেহ-মনের দ্বৈতবাদের ধারণা দিয়েছিলেন তাতে কেবল মানুষেরই মনকে স্বীকার করা হয়, অ-মানব প্রাণীদেরকে স্বয়ংক্রীয় যন্ত্র বলে মনে করা হয়। যারা দেকার্তের জ্ঞানতত্ত্বের চেয়ে তার বিজ্ঞানের প্রতি অধিক মনােযােগী হন, তাদের পক্ষে প্রাণী স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র – এই মতবাদ বিস্তৃত করা সহজ ছিল। ১৮শ শতকের বস্তুবাদীগণ প্রাণীর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র হবার মতবাদ মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এই ধারণাটির সাধারণীকৃত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেহ এবং মনের দ্বৈতবাদের ধারণা প্লেটোর থেকে শুরু হয়, এবং প্রধানত ধর্মীয় কারণে খ্রিষ্টদর্শন দ্বারা এর বিকাশসাধন হয়। দেকার্ত এই দেহ এবং মনের দ্বৈতবাদের বিকাশকে সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণ করেন। তিনি যে দেহ ও মনের সংযোগ সাধনের জন্য পিনিয়াল গ্রন্থির কথা বলেন, তার অনুসারীগণ এই মতকে প্রত্যাখ্যান করেন। পিনিয়াল গ্রন্থির এই অদ্ভুত সংযােগের কাজটি উপেক্ষা করলে দেখা যায় কার্তেসিয় পদ্ধতি দেহ ও মনের দুটি সমান্তরাল অথচ স্বাধীন দুটি জগৎ উপস্থাপন করে। তার দর্শনে এইযে দুটি জগতকে স্বতন্ত্রভাবে এবং একে অন্যের প্রসঙ্গ ছাড়াই আলােচনা করার একটা সুযোগ তৈরি হয় তা এর আগে এভাবে দেখা যায়নি। এটাই পরবর্তীতে দেহ ও মনের সমান্তরবাদী ধারণা তৈরিতে প্রভাব রাখে ও জিউলিঙ্ক্‌স এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করেন। দেকার্তের কারণেই একথা বলা সম্ভব হয়েছে যে, দেহ মনকে পরিচালিত করে না।

দেকার্তের দর্শনের আপত্তি ও তার উত্তরসুরি

দেকার্তের যুগান্তকারী দার্শনিক মতসমূহ তদকালীন চিন্তার জগতে বিপুল প্রেরণা ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। সমসাময়িক চিন্তাবিদ ও দার্শনিকগণ তাকে কেন্দ্র করে নানারকম অভিমত প্রকাশ করেন। তার মতের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি ও অনুপপত্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মত ও পাল্টা মতের এক ক্রমাগত ধারা চলতে থাকে। দেকার্তের দর্শনের আপত্তিগুলো –

  • ১। কোনাে কোনাে সমালােচক বলেন – ঈশ্বর ও প্রকৃতি দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সত্তা হয়ে থাকলে তাদের মধ্যে কোনাে সত্যিকারের যােগাযােগ থাকতে পারে না। তাই ঈশ্বর মানুষের মনের ওপর তার নিজের ছাপ মুদ্রিত করতে পারেন না; আবার মানুষও ঈশ্বর সম্পর্কে কিছু জানতে পারে না। তাহলে প্রশ্ন ওঠে একটি বিশুদ্ধ চেতনা হিসেবে ঈশ্বর কিভাবে জড়ে গতি সৃষ্টি করেন। দেকার্ত ঈশ্বর, আত্মা ও জড়ের দ্রব্যত্বের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে এই জটিলতা এড়াবার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, ঈশ্বরই একমাত্র প্রকৃত দ্রব্য, অন্য দ্রব্যগুলো ঈশ্বরনির্ভর, ঈশ্বররূপ কারণের পরিণতি, এক কথায় ঈশ্বরের সৃষ্ট। কিন্তু দেকার্ত দ্রব্য হিসেবে দেহ ও মনকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বলেছেন। কিন্তু ঈশ্বরই প্রকৃত দ্রব্য হলে এবং দেহ ও মন ঈশ্বরনির্ভর ও ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হলে এগুলো স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হতে পারেনা। প্রকৃতিকে ঈশ্বরের থেকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র্য ভাবা হল দ্বৈতবাদ। দেকার্ত এই দ্বৈতবাদকে বর্জন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং পরবর্তিতে স্পিনােজার সর্বেশ্বরবাদের পথ সুগম করে দেন।
  • ২। মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী, একথা বলে দেকার্ত ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে আরেক রকম দ্বৈতবাদের সৃষ্টি করেন। তিনি এই দ্বৈতবাদের ফলে সৃষ্ট প্রশ্নসমূহের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
  • ৩। দেহ ও মনের মধ্যে বিরোধিতা রয়েছে। দেহ ও মন সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিরোধপূর্ণ হলে তাদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্ভব নয়। দেকার্ত ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার কথা স্বীকার করেন কারণ দেহ ও মন স্বাধীন হলেও বাস্তবে তাদেরকে পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়। কিন্তু কিভাবে এই ভিন্নধর্মী দুটো দ্রব্যের মধ্যে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠিত হবে দেকার্ত সেই সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। দেকার্তের মৃত্যুর ৪০ বছর পর বলবিদ্যার সূত্র দিয়ে নিউটন তার প্রতিপাদনও করেছিলেন তার ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা গ্রন্থে। কিন্তু এই সূত্রের ধারণা আরও অনেক আগেই পদার্থবিদগণ দিয়েছিলেন, দেকার্তও একে স্বীকার করেছিলেন গতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে। গতিসূত্রগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য দেকার্ত বলেছিলেন মন দেহের গতিকে সৃষ্টি করতে পারে না, একে পরিবর্তন করতে পারে মাত্র, কেননা গতির সূত্রগুলো অনুযায়ী তার মতে, ঈশ্বর ছাড়া কারও পক্ষে গতিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। কিন্তু মনের দ্বারা দেহের গতির পরিবর্তনের ধারণাটি ভরবেগের নিত্যতা সূত্রের সাথে খাপ খায় না। ভরবেগের নিত্যতা অনুসারে বিশ্বের সকল পদার্থের মোট ভরবেগ সবসময় নিত্য বা অপরিবর্তিত। ভরবেগের নিত্যতা থেকে অনুমান করা যায়, সকল বস্তুগত ক্রিয়া সংঘাতের প্রকৃতির মতোই, কোন জড়বস্তুর গতি নির্ধারণের জন্য গতির সূত্রগুলোই যথেষ্ট, এর জন্য আত্মা বা মনের প্রয়োজন নেই। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বস্তুর উপর মনের ক্রিয়া অসম্ভব। তাই এই সূত্র দেকার্তের দেহ-মনের দ্বৈতবাদে আপত্তির সৃষ্টি করে। কিভাবে মনের দ্বারা দেহের গতির পরিবর্তন হয় ও এর মাধ্যমে কিভাবে মন দেহকে প্রভাবিত করে তার আপত্তিবিহীন যথার্থ ব্যাখ্যা দেকার্ত দিতে পারেন নি। এদিকে ভরবেগের নিত্যতা সূত্রের ভিত্তিতে দেহের কাজে মন প্রভাব সৃষ্টি করে না এই কথা বললে নতুন সমস্যার উদয় হয়। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে ব্যক্তি যখন ইচ্ছা করে তখনই কেন সে তার বাহু পরিচালন করতে পারে। এখানে ব্যক্তির ইচ্ছা একটি মানসিক ঘটনা, কিন্তু তার বাহুর গতি একটি বস্তুগত ঘটনা। তাহলে যদি মন ও দেহ পরস্পর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া না করে, তাহলে দেহ পরিচালন করলে কেন মনে হয় মনই দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখান থেকে দেখা যায়, গতিসূত্রের ধারণাগুলো ইচ্ছা প্রভাবিত দেহের গতির ব্যাখ্যা দিতে পারেনা। এই বিষয়ে দেকার্তের থেকে কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না।
  • ৪। অ-মানব প্রাণীর দেহ যন্ত্রস্বরূপ হয়ে থাকলে মানুষের দেহকে যন্ত্র বলা যাবে না কেন, দেকার্ত তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেননি।

দেকার্তের এসব অসঙ্গতিপূর্ণ ও পরস্পরবিরােধী মত পােষণের পেছনে আধুনিক বিজ্ঞানের মতবাদের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের অধ্যাত্মবাদী ধর্মতত্ত্বঅধিবিদ্যার সমন্বয়সাধনের ইচ্ছা কার্যকরী ছিল। দেকার্তের দার্শনিক চিন্তার অন্তর্নিহিত প্রায় সব বিরােধ ও অসঙ্গতির মূলে এই সমন্বয়ের প্রেরণা ও প্রচেষ্টা। দেকার্তের উত্তরসুরি দার্শনিকগণ এসব বিরােধ ও অসঙ্গতির কথা ভাবতে গিয়ে হয় এদের স্পষ্ট করে ঘােষণা করেন, নাহয় এদের এড়াবার পথ আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন।

প্যাস্কেল (১৬২৩-১৬৬২)

ফ্রান্সের পাের্ট রয়েল স্কুল প্রথমে পরিচিত ছিল সিস্টাসীয় (Cistersian) মঠ হিসেবে। পরে তা প্রখ্যাত আঁতোয়া আর্নল্ডের নেতৃত্বে জ্যানসেনবাদীদের আশ্রয়স্থল এবং কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির মিলনস্থল হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। পেনসিজ (Pensees) ও লেটারস প্রভিনসিয়ালস (Letters Provinciales)-এর রচয়িতা ব্লেইজ প্যাস্কেল এসব বিখ্যাত ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি একজন বিশিষ্ট গণিতবিদ এবং দেকার্তের বন্ধু ছিলেন। তিনি তার সময়ের একজন বিখ্যাত গণিতবিদ ও বৈজ্ঞানিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ষােল বছর বয়সে তিনি ‘কনিক সেকশন্স’ (conic sections)-এর ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। তদানীন্তন গণিতবিদদের মধ্যে তিনি ক্যালকুলাসের ভিত্তি রচয়িতা এবং সম্ভাব্যতা মতবাদের (theory of probability) স্রষ্টা ছিলেন। তিনি ব্যারােমিটার আবিষ্কার করেন এবং বাতাসের যে ওজন আছে তা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি পাের্ট রয়্যালের জ্যানসেন অগাস্টিন প্রভাবিত মতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি দেহমনের সম্পর্ক বিষয়ে কার্তেসীয় দ্বৈতবাদ গ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি দেশ, কাল, গতি, সংখ্যা, জড় প্রভৃতি আদিতত্ত্বের বৈধতা স্বীকার করেন। তবে তার মতে পরমনীতি বা পরমতত্ত্বের জ্ঞান মানুষের ক্ষমতার বাইরে।

প্যাস্কেলের জ্ঞানতত্ত্বে দেকার্তের প্রভাব দেখা যায়। দেকার্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বাইরের জগৎ থেকে সংগ্রীহিত বিশেষ ধারণাসমূহ বা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে (যেমন – চেয়ার-টেবিলের ধারণা, গােলাপ ফুলের ধারণা ইত্যাদিকে) আগন্তুক ধারণা বলেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন যে, আগন্তুক ধারণার বাস্তবতার কোনাে নিশ্চয়তা নেই, কারণ স্বপ্নাবস্থায়ও এদেরকে পাওয়া যায়। এগুলো প্রায়ই ভ্রান্তি সৃষ্টি করে। কিন্তু বুদ্ধির সাহায্যে এদের জ্ঞান লাভ করা যায়। বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান নিয়ে দেকার্তের মধ্যে যে সন্দেহ দেখা যায় তাকে প্যাস্কেল সম্প্রসারণ করে বলেন বস্তুর স্বরূপকে জানা যায়না। দেকার্ত বস্তুর দ্রব্যাত্মক আকার ও এর লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে এটি অজ্ঞেয় ও পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে এটি অকার্যকরী। প্যাস্কেল বলেন বস্তুর লক্ষ্যকেও জানা যায়না। এখানে দেকার্তের সাথে প্যাস্কেলের জ্ঞানতত্ত্বে পার্থক্য হল, দেকার্ত তার সন্দেহের পদ্ধতিকে ব্যবহার করে কেবল মাত্র অহং এর জ্ঞানকেই নিশ্চিত বলেছিলেন, এর বাইরে তিনি জগৎ সম্পর্কিত আগন্তুক জ্ঞানকে অনিশ্চিত বলেছিলেন। কিন্তু অনিশ্চিত বললেও তিনি এই জ্ঞান লাভ করা যায়না তা স্বীকার করেননি, তার মতে বুদ্ধিকে ব্যবহার করে বাহ্যবস্তু সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা যায়। কিন্তু প্যাস্কেলের মতে এই জ্ঞান লাভ করা যায়না।

এভাবে দেকার্তের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্যাস্কেল নিজস্ব জ্ঞানতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন, যা অনুসারে বস্তুকে জানা যায়না। আর তার এই জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তার অধিবিদ্যাগত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। তার মতে, বস্তুর স্বরূপ, ভিত্তি ও লক্ষ্যকে যেমন জানা যায়না, তেমনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা আত্মার অমরত্বকেও প্রমাণ করা যায়না। তার মতে, দার্শনিক যুক্তিপ্রমাণের পথে বড়জোর সত্যের ঈশ্বরে উপনীত হওয়া যায়, কিন্তু প্রেমের ঈশ্বরকে জানা যায়না। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, দার্শনিক বিচার ও প্রজ্ঞার দ্বারা শেষ পর্যন্ত কিছুই জানা যায়না, তা সংশয়ই তৈরি করে। তাই তা শেষ পর্যন্ত আমাদের জ্ঞানালােকের সন্ধান দিতে পারে না। কিন্তু প্যাস্কেলের মতে, এই অজ্ঞানতার পরও মানুষের মাঝে থাকা ধর্মীয় অনুভূতিতে ঈশ্বরকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় ও শান্তি লাভ করা যায়। প্যাস্কেলের মতে হৃদয়ের এমন কিছু যুক্তি আছে যা বুদ্ধির বাইরে। প্যাস্কেল আরও বলেন, মানবপ্রকৃতি, মানবসমাজ সবই পাপময় ও কলুষতাপূর্ণ। আর এখান থেকে মুক্তি লাভের জন্য দরকার ঐশী কৃপা, প্রত্যাদেশ ও চার্চের সাহায্য।

জিউলিঙ্ক্‌স (১৬২৫-১৬৬৯)

দেকার্তের শিষ্য ও সমর্থকদের কার্তেসীয় মতাবলম্বী বলে অভিহিত করা হয়। এদের অনেকেই দেহ ও মনের সম্পর্ক বিষয়ে দেকার্তের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ (interactionism) প্রত্যাখ্যান করেন, ও এর স্থলে তারা উপলক্ষবাদ (occasionalism) নামে একটি মতবাদ প্রচার করেন। মুসলিম দার্শনিক আশারিগাজ্জালির দর্শনে উপলক্ষবাদ প্রথম দেখা যায়। দেকার্তের দ্বৈতবাদী সমস্যার সমাধানের জন্য তার উত্তরসুরীরাও উপলক্ষবাদকে ব্যবহার করেন। যারা এই উপলক্ষবাদের মাধ্যমে দেকার্ত দর্শনের আপত্তি দূর করতে চেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আর্নল্ড জিউলিঙ্ক্‌স (Arnold Geulincx)। দেকার্তের উত্তরসুরিদের মধ্যে লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক জিউলিঙ্ক্‌স অন্যতম ছিলেন। দেকার্তের মতো উপলক্ষবাদীরাও বিশ্বাস করেন যে, স্বরূপের দিক থেকে দেহ ও মন সম্পূর্ণ বিরুদ্ধভাবাপন্ন, তাই এদের মধ্যে কোনাে প্রত্যক্ষ ও স্বাভাবিক সংযােগ সম্ভব নয়। ভরবেগের নিত্যতা সূত্র অনুসারে বলা যায় দেহের গতিতে মনের কোন প্রভাব থাকতে পারেনা, তা দেকার্তের দেহ-মনের দ্বৈতবাদ, অর্থাৎ এদের পৃথক সত্তার অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু ভরবেগের নিত্যতা সূত্র দিয়ে ইচ্ছার দ্বারা দেহের গতিকে ব্যাখ্যা করা যায়না। দেকার্ত যে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াবাদ বা ইন্টারেকশনিজমের ধারণা দিয়েছিল তা এইসব সমস্যার সমাধানে সক্ষম নয় বলে জিউলিঙ্ক্‌সকে অকেশনালিজমের আশ্রয় নিতে হয়।

জিউলিঙ্ক্‌সের মতে, মনের মূল কাজ চিন্তা করা বলে আমাদের অচেতন ও অনৈচ্ছিক সব কার্যকলাপ মনে নয়, দেহে সংঘটিত হয়। তাই এরা দৈহিক গতির সমার্থক। কিন্তু একটি বিশুদ্ধ চিন্তাশীল সত্তার কার্যকলাপকে দৈহিক গতিতে পরিণত করা যায় না এবং মন দেহের সাথে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া করতে পারে না। কিন্তু দেহ ও মনের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হতে, অনুভূতি ও ইচ্ছার দ্বারা দৈহিক পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। তাই স্বীকার করতে হবে, ঈশ্বরই মানুষের ইচ্ছাকে উপলক্ষ করে দেহকে চালিত করেন এবং দেহে গতি উৎপন্ন হলে তিনি মনে তার প্রত্যয় সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ এখানে দেহের গতি ও মনের চিন্তন – একটি আরেকটির কারণ নয়, বরং উপলক্ষ। ঈশ্বরই এদের প্রকৃত কারণ। আমাদের মনে যখনই ইচ্ছার উদ্রেক হয় তখনই ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমাদের শরীর সঞ্চালিত হয়, আর আমরা ইচ্ছানুযায়ী কাজ করি। অর্থাৎ আমাদের কার্যাবলির আসল কর্তা ঈশ্বর, এবং আমাদের নিজেদের মনের ইচ্ছা নিমিত্ত মাত্র। আমাদের ইচ্ছার নিজস্ব কোনাে কার্যকারিতা নেই, ঈশ্বরের ইচ্ছা থেকে এই কার্যকারিতা আসে।

তবে ঈশ্বর সব সময় প্রত্যেকের মনে প্রত্যয় সৃষ্টি করেন না ও প্রত্যেক দেহকে চালিত করেন না। আবার ঈশ্বর আগে থেকেই দেহ ও মনের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে রাখেননি। ব্যক্তি কী ইচ্ছা করতে যাচ্ছে, ঈশ্বর তা জানেন; কিন্তু তবু ব্যক্তির ইচ্ছা স্বাধীন। ঈশ্বর তার এই জ্ঞানের ভিত্তিতেই সমগ্র বিশ্বকে সাজিয়েছেন। ঈশ্বর তার অনন্ত প্রজ্ঞার আলােকে এমনভাবে গতির নিয়মাবলি সৃষ্টি করেছেন যে, গতি সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির ইচ্ছা ও ক্ষমতানিরপেক্ষ হয়েও ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছার সঙ্গে মিলে যায়। ব্যক্তির দেহ ও আত্মা, এ দুয়েরই স্রষ্টা ঈশ্বর। ঈশ্বর নিজেই জড়ে গতিশক্তি প্রদান করেছেন ও এই গতির নিয়ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তাই জড়ের গতি ও মনের ইচ্ছা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতীয় পদার্থ হলেও ঈশ্বরের পক্ষে এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব হয়েছে।

জিউলিঙ্ক্‌সের ‘দুই ঘড়ি’র (Two clocks) মতবাদ দিয়ে এই ব্যাপারটিকে সহজে বোঝানো যায়। ধরা যাক কারও কাছে দুটি ঘড়ি আছে, এবং দুটি ঘড়িই সঠিক সময় প্রদান করে। যখন একটি ঘড়ির ঘণ্টা বাজে, তখন অন্য ঘড়িটিরও ঘণ্টা বাজবে। ঘটনাটি তাই এমন মনে হবে যে, আপনি একটি ঘড়ি দেখেছেন এবং অন্য ঘড়ির ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনেছেন। এথেকে একটি ঘড়ি অন্য ঘড়ির ঘণ্টা বাজার কারণ বলে মনে হবে। দেহ এবং মনের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও এ রকম। তার মতে, ঈশ্বরের দ্বারা নির্ধারিত হয়েই একটি ঘড়ি অন্য ঘড়ির সঙ্গে একই সময় প্রদান করে। আমার ইচ্ছা উপলক্ষে ঈশ্বর আমার বাহু পরিচালন করেন। বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক নিয়ম আমার বাহু পরিচালনার কারণ হলেও প্রকৃতপক্ষে আমার ইচ্ছা আমার দেহের উপর ক্রিয়া করেনি। উপলক্ষবাদের এ ভাষ্যে মানসিক ও দৈহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনাে কার্যকারণ সম্পর্ককে প্রত্যাখ্যান করে দেহ ও মনকে একে অপরের সাথে সমান্তরাল ধরা হয় বলে একে সমান্তরবাদ (parallelism) বলে। এখানে দেহ ও মনের কার্য সমসাময়িক হওয়া সত্ত্বেও এরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল নয়।

প্যাস্কেলের জ্ঞানতত্ত্বের মত জিউলিঙ্ক্‌সের জ্ঞানতত্ত্বও দেকার্ত প্রভাবিত, আর প্যাস্কেলের মত তিনিও দেকার্তকে ছাড়িয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দেকার্ত বস্তু সম্পর্কিত তার আগন্তুক ধারণায় বস্তু সম্পর্কে যে সন্দেহ প্রকাশ করে, প্যাস্কেল তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে বলেন বস্তুর স্বরূপকে জানা যায়না। জিউলিঙ্ক্‌সের জ্ঞানতত্ত্বের পেছনেও দেকার্তের দেহ ও মনের দ্বৈতবাদী সমস্যা নিরসনে উপলক্ষ্যবাদের ধারণা রয়েছে। জিউলিঙ্ক্‌সও প্যাস্কেলের মতই বলেন ব্যক্তির পক্ষে বস্তুকে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি এখানে তিনি তার উপলক্ষ্যবাদকে ব্যবহার করে বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞানোৎপত্তির প্রক্রিয়ায় ঈশ্বরকে নিয়ে আসেন।

দেকার্ত তার সন্দেহের পদ্ধতিকে ব্যবহার করে কেবল মাত্র অহং এর জ্ঞানকেই নিশ্চিত বলেছিলেন, এর বাইরে তিনি জগৎ সম্পর্কিত আগন্তুক জ্ঞানকে অনিশ্চিত বলেছিলেন। কিন্তু অনিশ্চিত বললেও তিনি এই জ্ঞান লাভ করা যায়না তা স্বীকার করেননি, তার মতে বুদ্ধির সাহায্যে জ্ঞান লাভ করা যায়। কিন্তু প্যাস্কেল ও জিউলিঙ্ক্‌সের মত ছিল ব্যক্তির পক্ষে জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। জিউলিঙ্ক্‌স এখানে উপলক্ষ্যবাদের ধারণা দিয়ে বললেন, ব্যক্তি কেবল তার অহং সম্পর্কেই জানতে পারে, অন্য কিছু সম্পর্কে সে জানতে পারেনা, ঈশ্বরের কারণে বস্তুর প্রত্যয় সম্পর্কে মানসিক সংবেদ সৃষ্টি হয় ও আমরা বিষয়টি জানতে পারছি বলে মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাইরে থেকে বায়ুতরঙ্গ এসে যখন আমাদের কানকে উদ্দীপিত করে ও সেই উদ্দীপনা যখন আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তখন ঈশ্বর আমাদের মধ্যে মানসিক সংবেদ সৃষ্টি করেন। তাই উদ্দীপিত মস্তিষ্ক নিমিত্ত মাত্র। একে উপলক্ষ করে ঈশ্বরই আমাদের মনের ওপর ক্রিয়া করেন।

জিউলিঙ্ক্‌সের মতবাদের দুটি গুণ রয়েছে। এর প্রথম গুণটি হচ্ছে, এই মতবাদ এক অর্থে আত্মাকে সম্পূর্ণরূপে দেহ নিরপেক্ষ করে তােলে, কারণ আত্মা কখনােই দেহের উপর ক্রিয়া করে না। দ্বিতীয় গুণটি হচ্ছে, এই মতবাদ মেনে নেয় যে, মন ও জড়দ্রব্য একে অপরের উপর ক্রিয়া করতে পারে না, এই দুটি দ্রব্য এতটাই বৈসাদৃশ্যপূর্ণ যে তাদের পরস্পর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অচিন্তনীয় বলে মনে হয়। জিউলিঙ্ক্‌সের মতবাদ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এর বাইরের দিকটাই বাখ্যা করে। কিন্তু এই মতবাদেরও সমস্যা রয়েছে। যেহেতু প্রাকৃতিক ঘটনাসমূহ প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত, তাই এর একই সমান্তরালে চালিত মানসিক ঘটনাসমূহও সমভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। এটি সত্য হওয়া অর্থ হচ্ছে এটা দাবি করা যে মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণকরা গতিসূত্রাদি সূত্রসমূহকে ব্যবহার করে আমাদের মানসিক ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, অর্থাৎ আমরা কি চিন্তা করছি, কি অনুভব করছি, কি ইচ্ছা করছি তাতে আমাদের নিজেদের স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ নেই, প্রকৃতি যেসব সূত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তার দ্বারাই আমাদের মানসিক প্রক্রিয়াসমূহও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই এই সূত্রগুলোর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ এটি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়। তাই এই মতবাদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বা ধর্মতাত্ত্বিক নীতিবিদ্যাসমূহ এবং পাপের শাস্তির সামঞ্জস্যবিধান করা যায়না। নীতির ক্ষেত্রে এটি অশুভের সমস্যা তৈরি করে। ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা না থাকলে, তার ইচ্ছা ঈশ্বরেরই ইচ্ছা হলে ব্যক্তির পাপাত্মক ইচ্ছা ও পাপাত্মক কর্মগুলোও ঈশ্বরের দ্বারাই চালিত হয়। কিন্তু পরমশুভ হিসেবে ঈশ্বর পাপাত্মক ইচ্ছার কারণ হতে পারেন না। তাহলে ব্যক্তি ব্যক্তি কিকরে পাপ কর্মে উদ্যোগী হয়? জিউলিঙ্ক্‌স এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাননি। ম্যালব্রাঞ্চ এর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন। নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রে এটি একটি নতুন প্রশ্ন তৈরি করে, কোন অপরাধীর অপরাধকার্যে যদি স্বাধীন ইচ্ছা না থাকে তাহলে তাকে শাস্তি দেয়া কতটা সঙ্গত হবে।

ম্যালব্রাঞ্চ (১৬৩৮-১৭১৫)

ম্যালেব্রাঞ্চ ‘অরেটরী অব জিসাস্’ নামক যাজক সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। এ সম্প্রদায়ের সদস্যদের কাছে অগাস্টিনের মতাবলি খুবই জনপ্রিয় ছিল, তারা কার্তেসীয় দার্শনিক মতের প্রতিও বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। দেকার্তের ‘ট্রিটিজ অন ম্যান’ পাঠ করার পর ম্যালব্রাঞ্চ দেকার্তের সমগ্র দর্শন পাঠে মনােনিবেশ করেন। ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘সত্যের অনুসন্ধান প্রসঙ্গে’ (On the Investigation of Truth) শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ম্যালব্রাঞ্চের যশ চারদিকে বিস্তার লাভ করে। এ ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। জিউলিঙ্ক্‌সের মত ম্যালব্রাঞ্চ বলেন, জড় নিষ্ক্রিয় বলে তা নিজ চেষ্টায় দৈহিক গতি সৃষ্টি ও সম্পারণ করতে পারে না, গতিমাত্রই এর সঞ্চালন ও অগ্রযাত্রার জন্য ঈশ্বরের সার্বক্ষণিক হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল, তাই ঈশ্বর ব্যক্তির দৈহিক ও সচেতন অভিজ্ঞতার কারণ। কিন্তু এখানে প্রশ্ন ওঠে, ঈশ্বর পরমশুভ হলে তিনি ব্যক্তির পাপাত্মক অনৈতিক কার্যাবলির ইচ্ছা সৃষ্টি হয় কেন, কেন ঈশ্বরের ইচ্ছায় দৈহিক রিপুর কাছে মানসিক শক্তির পরাভব ঘটে। ম্যালব্রাঞ্চ এর উত্তর দিয়ে জিউলিঙ্ক্‌সের মতের সম্প্রসারণ ও পরিপূরণ সাধন করেন। তিনি বলেন, ঈশ্বরের পক্ষে পাপমুক্ত পৃথিবী তৈরি করা সম্ভব ছিল, কিন্তু সেটা আরও জটিল হত। তিনি প্রাকৃতিক অশুভ তৈরির মাধ্যমে তার কাজের অন্তর্নিহিত জটিলতা ও তার নিয়মের সারল্যের মধ্যে একটি ভারসাম্যের সৃষ্টি করেছেন। এছাড়াও তিনি বলেন, আদমের স্বর্গচ্যুতির ফলে মানুষ বস্তুর যথার্থ সম্পর্কের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে; তাই সকল প্রকার পাপাচার শুরু হয়। আদমের স্বর্গচ্যুতির ফলে মানুষ যে দৃষ্টি হারিয়েছে তার পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে মানুষ পাপ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে।

এখানে নতুন প্রশ্ন ওঠে, এই পাপমুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় এই জ্ঞানদৃষ্টি লাভের উপায় কী। দেকার্তের দ্বৈতবাদ নিরসনে জিউলিঙ্ক্‌স যে উপলক্ষবাদ প্রণয়ন করেন তা অনুসারে মানুষ অহং ছাড়া অন্য কোন জ্ঞান লাভ করতে পারেনা, ঈশ্বরের দ্বারাই বহির্জগতের ধারণা ব্যক্তির মনে প্রতীত হয়। এই জ্ঞানলাভে মানুষের ইচ্ছা ও ভূমিকাই যদি না থাকে তাহলে এই জ্ঞানদৃষ্টি লাভে ব্যক্তির কোন ভূমিকা থাকেনা, তাহলে পাপমুক্তিও সম্ভব হয়না। এক্ষেত্রে ম্যালব্রাঞ্চ জিউলিঙ্ক্‌সের জ্ঞানতত্ত্বের বিকাশ সাধন করেছেন, কিন্তু তার এই জ্ঞানদৃষ্টি লাভ ও পাপমুক্তির আপত্তির সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

ম্যালব্রাঞ্চের মতে, জড়বস্তু মনে জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারে না, কারণ ইন্দ্রিয়ে জড়ের প্রতিমূর্তি পৌঁছবার আগেই বিভ্রান্ত হয়ে যায় ও শেষপর্যন্ত এটি দেহকে উদ্দীপিত করে চেতন অবস্থা সৃষ্টি না করে কেবল দৈহিক গতিই সৃষ্টি করে থাকে। মনে বস্তুর প্রত্যয় প্রবেশ করে, কিন্তু ব্যক্তির সমীম মনের পক্ষে বাহ্যবস্তুর প্রত্যয় সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। বাস্তব প্রত্যয়ের অস্তিত্ব মনের ইচ্ছার উপর নির্ভর করেনা বলে মন যে প্রত্যয় সৃষ্টি করে বলে মনে করে তা অবাস্তব। মানুষের পক্ষে বস্তুর প্রত্যয় সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, একে কেবল গ্রহণ করা যায়। বাহ্যদ্রব্য ও মানবমন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী বলে বাহ্যদ্রব্যের ছাপ মানবমনের ওপর পড়া অসম্ভব। তাই ধরে নিতে হয়, বহির্জগৎ ও আত্মার অতীত ঈশ্বর ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের একমাত্র উৎস। তবে ঈশ্বর ব্যক্তির মনের সম্ভাব্য জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করে দেন ও এরপর মনকে সেই জ্ঞান ক্রমশ নিজ উপায়ে সম্প্রসারিত করার ক্ষমতা প্রদান করেন এমনটা নয়। সসীম মনের পক্ষে চেতনা প্রদত্ত অসংখ্য ধারণাকে ধারণ করা অসম্ভব বলে ঈশ্বরকেই মানবমনে সব অভিজ্ঞতার প্রতিটি সূক্ষ্ম অংশ আলাদাভাবে এক এক করে প্রদান করতে হয়। এভাবে ম্যালব্রাঞ্চ শেষ পর্যন্ত এমন একটি বােধগম্য ব্যাপ্তি বা বিস্তৃতির কল্পনা করেন, যার মধ্যে সব ধারণা বস্তুর দৈহিক বিস্তৃতির সঙ্গে সমান্তরালভাবে সহ-অবস্থান করবে। তিনি ঈশ্বরের মনকে এমন একটি আধ্যাত্মিক স্থান বলে মনে করেন যা সব সসীম মনের নিবাসস্থল। তার মতে, সব দৃষ্টি ঈশ্বরের দৃষ্টি; সব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান।

পিয়েরে বাইল (১৬৪৭-১৭০৬)

দেকার্ত দ্বারা প্রভাবিত হয়েও যারা দেকার্তকে অতিক্রম করেছিলেন পিয়েরে বাইল তাদের মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন। তিনি সিডান ও রটেরডামের অধ্যাপক, সুদক্ষ চিন্তাবিদ ও লেখক ছিলেন। তার বিভিন্ন দার্শনিক রচনার মাধ্যমে তদানীন্তন বিদ্বৎসমাজে এক বিরাট উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। তিনি সে দিনের বিখ্যাত ঐতিহাসিক সমীক্ষামূলক অভিধান (Dictionnaire Historique et Critique)-এর রচয়িতা ছিলেন। তিনি দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক নির্বিচারবাদের (dogmatism) পর্যালােচনা ও সমীক্ষা কাজে স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল জ্ঞানের কার্তেসীয় মানদণ্ড ব্যবহার করেন। ধর্মীয় বিধান, মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠানে তথ্য ও যুক্তির মধ্যকার অসঙ্গতি ও বিরােধ, বিজ্ঞান ও ধর্মের বিরোধ, বুদ্ধি ও প্রত্যাদেশের বিরােধকে তিনি বিশেষ দক্ষতার সাথে বিশ্লেষণ করেন। তার মতে, ধর্মের গণ্ডি প্রত্যাদেশের মধ্যেই সীমিত। কিন্তু ধর্মীয় প্রত্যাদেশ দার্শনিক প্রত্যাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রত্যাদেশ যৌক্তিক বিচার-বিশ্লেষণের উর্ধ্বে নয়, বরং এর অধীন। প্রত্যাদেশ যেসব ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত তাদের সত্যতা পরীক্ষা ও প্রতিপাদনের অপেক্ষা রাখে। ধর্ম বিশ্বাসের ওপর এবং দর্শন যুক্তিবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত; তাই এদের সংযােগ ও সমন্বয় সম্ভব নয়।

ব্যক্তিগত জীবনে বাইল ছিলেন খ্রিস্টধর্মের মূলনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানাদিতে গভীরভাবে বিশ্বাসী। তিনি খ্রিস্টীয় নীতিশাস্ত্রকে অত্যন্ত পবিত্র এবং সমালােচনার ঊর্ধ্বে বলে বিশ্বাস করতেন। তার মতে, খ্রিস্টধর্মের সব সম্প্রদায়ই নৈতিক নিয়মাবলির ব্যাপারে একমত; আর তাদের বিশ্বাসের এই ঐক্য খ্রিস্টীয় প্রত্যাদেশের স্বর্গীয় উৎপত্তির পক্ষে একটি বড় প্রমাণ। কিন্তু তার মতে, ধর্মে বিশ্বাস ধর্মানুশাসন অনুযায়ী আচরণ পরিচালনার নিশ্চয়তা দিতে পারেনা। ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের নৈতিক আচরণকে সরাসরি ও সুনিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করেনা, বিশ্বাসের অভাব বা নিরীশ্বরবাদকে অনৈতিকতার কারণও বলা যায়না। তার মতে, শুভের জ্ঞান এবং শুভ আচরণের মধ্যে পার্থক্য আছে। নৈতিক সত্য বা শুভ সম্পর্কে সচেতন হলেও ব্যক্তি একে নাও ভালোবাসতে বা অনুসরণ করতে পারে। জীবনে সুখের তুলনায় দুঃখ ও বিরক্তির, ন্যায়ের তুলনায় অন্যায় ও অশুভের অনুষ্ঠান অনেক বেশি।

তার মতে, ইচ্ছার ওপর কর্মের নৈতিক মূল্য নির্ভর করে। তাই নিছক অহঙ্কার বা আত্মম্ভরিতা থেকে দয়া-দাক্ষিণ্য করা এক রকম পাপ, এবং প্রেমের বশবর্তী হয়ে দয়া-দাক্ষিণ্য করা পুন্য। এই ইচ্ছা বিবেক ও প্রজ্ঞার দ্বারা নির্ধারিত হয়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নৈতিক নিয়মের ধারণা সহজাত ও বদ্ধমূল থাকে, যেখান থেকে এই বিবেক ও প্রজ্ঞা তৈরি হয়। তার মতে, খ্রিস্টীয় নীতিশাস্ত্রে মানুষের নৈতিক আচরণের সর্বোত্তম প্রতিফলন ও বিকাশ লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু বিবেক বা প্রজ্ঞা থেকে যে জ্ঞানের উৎপত্তি, তা প্রত্যাদেশের ওপর নির্ভরশীল নয় বলে প্রত্যেক মানুষের, এমনকি একজন অধার্মিক ও নাস্তিকের মধ্যে বিবেক ও প্রজ্ঞার দ্বারা নৈতিক নিয়মকে বােঝার ও অনুসরণ করার ক্ষমতা রয়েছে। তাই সৎ ও শুভ আচরণের জন্য খ্রিস্টান নাহলেও চলে। প্রত্যাদেশ নয়, বিবেক বা প্রজ্ঞাবিরােধী কোনাে কাজ না করা মানুষের পরম কর্তব্য।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন, ডঃ আমিনুল ইসলাম, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, জুন ২০১৬, পৃ. ৭০-৮২
  • পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস : থেলিস থেকে হিউম, ১ম খণ্ড, ডঃ আমিনুল ইসলাম, জানুয়ারি ২০০৯, পৃ. ৩৭৭-৯০
  • History of Western Philosophy, Bertrand Russel, 1945, Ch. DESCARTES

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.