জাতি ও জাতীয়তাবাদ

ভূমিকা

জাতি শব্দটির প্রকৃত অর্থ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। জাতি গঠনের ইতিহাস নিয়ে গবেষণাকারী দার্শনিক বেজহট (Bagehot) মন্তব্য করেছেন। আমরা জানি জাতি কী, যদি তা না জিজ্ঞেস কর। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে চট করে তা ব‍্যাখ্যা করতে বা সংজ্ঞা দিতে পারি না। (We know what it is when you donot ask us, but we connot very quickly explain or define it.) E.J. Hobbes Brown উল্লেখ করেছেন, Nation-এর ধারণা এর অর্থ করা হতো কোনো একটি প্রদেশ, দেশ বা রাজ্যে বসবাসকারী জনসমষ্টি। এমনকি বিদেশিদের Nation-এর অন্তর্ভুক্ত বলেও মনে করা হতো। পরে এর সঙ্গে রাষ্ট্রের ধারণা যুক্ত হয়েছে। এখন Nation বা জাতি বলতে সাধারণত বোঝানো হয়- কোনো একটি রাষ্ট্রে সমস্বার্থ সম্পন্ন নাগরিকদের, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রশক্তি যাদের ঐক্যবদ্ধ করে রাষ্ট্রে রাখে।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর হতে জাতির বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা নিরূপণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট তৎপরতা দেখা যায়। তারা অনেকেই এর বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে যথেষ্ট সাফল্যেরও পরিচয় দান করেন। তাদের মতামত অনুসরণ করলে এটাই প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে যে, ধর্ম, গোত্র, সংস্কৃতি, ভাষা অথবা ঐতিহ্যগত ঐক্যবোধের ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হয়ে যে মানব সমাজ ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার’ দাবি করে অথবা রাষ্ট্র গঠনে সমর্থ হয় তারাই জাতি হিসেবে অভিহিত হতে পারে।

জাতির (Nation) সংজ্ঞা

ল্যাটিন শব্দ Natio যার অর্থ জন্ম বা বংশ হতে ইংরেজি Nation শব্দটির উৎপত্তি। Nation শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে জাতি। সুতরাং শব্দগত অর্থে একই বংশোদ্ভূত জনসমষ্টিকে জাতি বল হয়। জাতি হলো এমন এক জনসমাজ যা ক্রমবিকাশের পথে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। তাই জাতি জনসমাজেরই চূড়ান্ত রূপ। জাতি একটি বাস্তব ধারণা। জাতি হলো একটি সংগঠিত মানবগোষ্ঠি। জাতি বলতে সেই জনসমষ্টিকে বোঝায় যা কতকগুলো সাধারণ ঐক্যবোধে আবদ্ধ ও সংগঠিত। জাতি একটি স্বাধীন চেতনা বিশেষ। রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। জাতি সম্পর্কে দার্শনিকদের অভিমত –

  • ইংরেজ চিন্তাবিদ T.H. Green জাতির যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, “The nation underlines the state” এবং রাষ্ট্র বলতে বোঝায় “The nation organised in a certain way.”
  • লর্ড ব্রাইস (Professor Lord Bryce) বলেন, “A nation is a nationality which has or gained itself into a political body achieve independent of desiring to be independent.” (অর্থাৎ জাতি হলো একটি রাজনৈতিক সংগঠন যা স্বাধীন অথবা স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে সংগঠিত হয়েছে।)
  • Prof. Hayes-এর মতে, “একটি জাতীয় জনসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সার্বভৌম স্বাধীনতা অর্জন করলে জাতিতে পরিণত হয়।”
  • Prof. Garner-এর মতে, “জাতি কেবল সাংস্কৃতিক ও আত্মিক সূত্রে আবদ্ধ কোনো সংগঠন নয়। জাতি বলতে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনগোষ্ঠিকে বোঝায়।”
  • Prof. Gilchrist জাতি সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “It is the state plus something else; the state looked at from certain point of view, that of unity of the people organised in our state.” অর্থাৎ জাতি বলতে রাষ্ট্রাধীন এক সুগঠিত জনসমাজকে বোঝায়। সুতরাং জাতি বলতে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ সেই জনসমাজকে বোঝায়, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে বাস করে। জাতি স্বাধীন হতে পারে, আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্তও থাকতে পারে।

জাতীয়তার (Nationality) সংজ্ঞা

জাতীয়তা বলতে এমন এক মানব সম্প্রদায়কে বোঝায় যাদের গোত্র, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য, আবাসভূমি এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক আদর্শ অথবা ঐতিহ্যসিক বিকাশধারা প্রভৃতি অভিন্ন। জাতীয়তা একটি ঐক্যবোধ (Sentiment of Unity) যা একটি সম্প্রদায়কে ঐক্যের বন্ধনে বেঁধে রাখে। এই ঐক্যবোধ একটি বিশেষ কারণে অথবা একাধিক কারণে মানবমনে জন্মলাভ করতে পরে। অর্থাৎ শুধুমাত্র গোত্রগত অথবা ভাষাগত ঐক্যের ভিত্তিতে যেমন মানবমনে ঐক্যবোধের সঞ্চার হতে পারে তেমনি ধর্মগত, স্বার্থগত অথবা রাজনৈতিক আদর্শগত অভিন্নতার ভিত্তিতেও এর সঞ্চার হতে পারে। সুতরাং জাতীয়তা গঠনের জন্য উপর্যুক্ত কারণগুলোর একই সঙ্গে প্রয়োজন হয় না। এর জন্য অনেক সময় উপরোল্লিখিত যে কোনো একটি কারণও যথেষ্ট হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীগণ একই গোত্র হতে উদ্ভূত নয়, এমনকি এর বিভিন্ন এলাকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য স্বতন্ত্র, তবুও যে একটি মাত্র কারণে সর্বপ্রথম তাদের মনে ঐক্যবোধের সঞ্চার হয়েছিল তা হলো একই রাজনৈতিক লক্ষ্য। আবার এর জন্য সকল সময় ভৌগোলিক ঐক্যের প্রয়োজন হয় না। রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন ভূ-খণ্ডে বাস করে একটি মানবগোষ্ঠী ধর্মীয় অভিন্নতার কারণে ঐক্যচেতনা লাভ করতে পারে। জাতীয়তা সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতামত নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

  • Prof. Laski বলেন, “জাতীয়তা একটি ঐক্যবোধের পরিচায়ক এবং এই ঐক্যবোধ তাদেরকে বাকি মানবসমাজ হতে স্বতন্ত্ররূপে চিহ্নিত করে। এই ঐক্য এক ইতিহাস, বিজয়কাহিনী এবং যুগ্ম প্রচেষ্টা সৃষ্ট ঐতিহ্যেরই ফল। এখানে যে একাত্মবোধ সঞ্চারিত হয় তাই মানবসমাজকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে।”
  • ম্যাকাইভার এর মতে, “জাতীয় জনসমাজ হলো সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐক্যবোধ যা এক বিশেষ ঐতিহ্যসিক পরিবেশের ভেতর রাষ্ট্রের মাধ্যমে নিজের অভিব্যক্তির জন্য সক্রিয়।”
  • লর্ড ব্রাইস বলেছেন, “জাতীয়তা হচ্ছে ভাষা, সাহিত্য, ধ্যান-ধারণা, রাজনীতি এবং ঐতিহ্যের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ একটি জনসমষ্টি যা অনুরূপভাবে সংগঠিত অন্যান্য জনসমষ্টি থেকে নিজেদেরকে পৃথক মনে করে।”
  • সমাজতত্ত্ববিদ এমিল ডুর্খেইম বলেন, “A nationality is a group of which the members…. wish to live under the laws and form of a state.”

পরিশেষে বলা যায় যে, জাতীয়তা হচ্ছে এক ধরনের মানসিক চেতনা যার প্রেক্ষিতে মানুষ একই ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, বংশ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে উদ্বেলিত হয়ে অন্য একটি জনগোষ্ঠির থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র মনে করে এবং একটি জাতিতে পরিণত হয়।

জাতীয়তা ও ভাষাগত সমস্যা (The problems: National and Linguistics)

কোনো জাতির আদর্শ হলো তার জাতীয়তা। জাতীয়তা হতেই সাধারণত জাতির উৎপত্তি ঘটে থাকে। Hayes বলেন, “A nationaliy by acquiring unity and sovereign independence becomes a nation.” অর্থাৎ “জাতীয়তা ঐক্য এবং সার্বভৌম স্বাতন্ত্র্য দ্বারা জাতিতে পরিণত হয়।”

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনৈতিক সমস্যা আলোচনার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবোধ বা জাতীয়তাবাদে ভাষাগত প্রশ্নে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় কিনা তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে। জাতীয়তা সম্পর্কে আলোচনায় একথা একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে যে, ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য প্রভৃতির অভিন্নতা দৃঢ় জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি করতে সহায়ক। তবে বর্তমান বিশ্বে এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয় যে, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন ঐতিহ্যের জনগোষ্ঠি এক মানসিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে “একদেশ একজাতি” গঠন করেছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত সভ্যদেশে, যেখানে শুধুমাত্র বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের নিয়ে এক শক্তিশালী জাতি গঠন করা হয়েছে। আবার ভাষার ভিন্নতার ক্ষেত্রে ভিন্ন জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের নজির যেমন আছে, তেমনি ভাষাগত সংঘাতে অনেক রাষ্ট্রের অখণ্ডতাও হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর পর পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভাষার প্রশ্নে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে শুধুমাত্র ভাষার দাবিতে তীব্র অসন্তোষ ও আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল। পরবর্তীতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ফলে পৃথক জাতিসত্তার বিকাশ ঘটে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলন যা সাংস্কৃতিক আন্দোলন নামে পরিচিত, পরবর্তীতে তা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। এই রাজনৈতিক আন্দোলন পরবর্তীতে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়। বর্তমানে ভারত, রাশিয়া এবং কতিপয় ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রেও ভাষাগত সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাভাষী সম্প্রদায় সংখ্যালঘু ভাষাভাষীদের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। আবার এক রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তিশালী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাষার ক্ষেত্রেও অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। পাকিস্তানে সংখ্যালঘু পাঞ্জাবিদের ভাষা উর্দু না হওয়া সত্ত্বেও প্রবল প্রতিপত্তিসম্পন্ন পাঞ্জাবিরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকেই প্রতিষ্ঠা করে ছেড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চপদের সরকারি চাকরি, প্রতিরক্ষা বাহিনীতে উচ্চপদে আসীন ব্যক্তি, সর্বত্রই পাঞ্জাবের শ্রেষ্ঠত্ব অধিক হওয়ায় নিজেদের ভাষাকেও তারা শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন করেছে এবং সমগ্র জাতিকে উর্দু শেখার ও পড়ার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য অন্যান্য ভাষাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। পশতু, বেলুচ, সিন্ধিদের অসন্তোষ এবং ১৯৫২ সালের পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন এরই ফল। ভারতেও বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দানের দাবিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছে।

ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র যুগোশ্লাভিয়ায় এবং প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার বিভিন্নতার জন্য একক জাতীয়তার প্রশ্নে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে শুধুমাত্র ভাষাগত অনৈক্য বা অসন্তোষ রাষ্ট্রের অখণ্ডতাকে ধ্বংস করেছে এমন নজির খুব কম। যেহেতু জাতীয়তাবোধ সম্পূর্ণরূপেই একটি মানসিক ধারণা যা মনের গভীরে ঠাঁই নেয় এবং প্রয়োজনে প্রচণ্ড বেগে আন্দোলিত হয়ে ওঠে সেক্ষেত্রে ভাষার বিভিন্নতা জাতীয়তাবাদের প্রতিবন্ধক হয় না। যেমন- সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীরা তিনটি ভাষায় কথা বলে। রাশিয়ার অধিবাসীরা পাঁচটি ভাষায় কথা বলে, তবুও তাদের জাতীয়তাবোধ শক্তিশালী ও দৃঢ়। অন্যদিকে আরব দেশগুলোর ভাষা আরবি হওয়া সত্ত্বেও তারা একজাতিতে পরিণত হয়নি। ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা ইংরেজি ভাষায় কথা বললেও তারা পৃথক দুটি শক্তিশালী জাতি। ভাষার ঐক্য ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের মধ্যে কোনোদিন একাত্মতা সৃষ্টি করতে পারবে না, বরং উভয় জাতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই যথেষ্ট বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। তাই একথা বলা যায় যে, ভাষাগত প্রশ্নে জাতীয়তাবাদের সমস্যা কখনো কখনো পরিদৃষ্ট হলেও তা জাতিগঠনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য বিষয় নয়।

জাতিগত ও ধর্মীয় সমস্যা (Problems of Nationality and Religions)

বর্তমান বৃহদায়তন রাষ্ট্রসমূহে যেমন বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব প্রচুর, আধুনিককালে রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমে জাতিগোষ্ঠির অস্তিত্বও প্রচুর। আধুনিককালে রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমে জাতিগঠন করা হয়। একটি নির্দিষ্ট সীমানায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠিকেই জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আবার সংকীর্ণ অর্থে ভাষাভিত্তিক এবং ধর্মভিত্তিক জাতি হিসেবেও জনগোষ্ঠিকে বিভাজন করা হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এক নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে বসবাস করলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয় তবুও ধর্মের ভিন্নতার প্রশ্নে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু এভাবেও জনগোষ্ঠিকে বিভক্ত করা হয়। সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ই আধিপত্য করে থাকে। অবিভক্ত ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু ছিল বিধায় নেহেরু বলেছিলেন, ভারতে একটাই জাতি আছে এবং তা হলো হিন্দু জাতি। তার কথার প্রতিবাদে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, ভারতে দুটি বৃহৎ জাতি আছে, হিন্দু এবং মুসলমান, এছাড়াও আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক জাতি আছে। এই জাতি ধর্মীয় গোষ্ঠিগত জাতি। ১৯৪৪ সালের লাহোর প্রস্তাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা উল্লেখ ছিল। পরবর্তীতে এই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারত সৃষ্টি হয়েছিল। সাম্প্রাতক বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রে মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও তা নিয়ে সংঘাতের উদাহরণ হচ্ছে, বসনিয়া, চেচনিয়া, ফিলিস্তিন এবং কাশ্মীর। সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষের যুগেও নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য হিংস্রতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, নিরীহ মানুষ হত্যা দেখা যায়। বর্তমান ভারতে উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি এর ক্ষমতা গ্রহণ ও অন্য ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন ভারতীয় জাতীয়তাবোধের ক্ষেত্রে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। গোঁড়া ধর্মীয় মৌলবাদ রাষ্ট্রের জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে। মুসলিম জঙ্গিবাদের উত্থান মানবতাকে পদদলিত করছে। আল কায়দা এবং আই.এস.-এর মতে নৃশংস, উগ্র মুসলিম সন্ত্রাসী গোষ্ঠি নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

ধর্মের সাথে মানুষের হৃদয় ও বিশ্বাসের যোগসূত্র নিবিড়। ধর্ম সমাজের সংহতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একই ধর্মের অনুসারীরা একই উপাসনালয়ে একত্র হয় এবং একই ধর্মীয় অনুশাসনের অধীন থাকে। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও আন্তরিকতাবোধ জেগে ওঠে। ধর্মীয় দর্শনের দিক থেকে অভিন্ন জনগোষ্ঠি জীবনের বিভিন্ন কাজে-কর্মে এবং মন মানসিকতায় অনেকটা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই পোষণ করে থাকে যা শক্তিশালী জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির সহায়ক। একই ধর্মের মানুষ, সে যে জাতি, বর্ণ বা ভাষারই হোক না কেন, তারা সবাই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একত্র হয়। আবার ধর্ম সর্বদাই জাতীয় ও সামাজিক সংহতির অনুকূলে একথাও বলা যায় না। রাষ্ট্র ও সমাজে ধর্ম নানা রকম বিভেদ সৃষ্টি করে। ধর্ম মানুষকে নানা ধর্মগোষ্ঠিতে বিভক্ত রাখে। এসব ধর্মগোষ্ঠি অনেক সময় একে অপরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে অনৈক্য প্রকাশ করে, যার ফলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব হতে পারে। যা সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রতিকূলে। মধ্যযুগে ইউরোপে ধর্মকে শাসন ও শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তখন রাষ্ট্রের কর্ণধার দাবি করতেন যে, তিনি ঈশ্বরের পক্ষ থেকে দেশ চালাচ্ছেন। রাষ্ট্রের ক্ষমতা বেশি না চার্চের ক্ষমতা বেশি তা নিয়েও তদানীন্তন ইউরোপে বিরাট দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল।

ধর্মের মতো সাংস্কৃতিক কারণ ছাড়াও অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে বিভেদ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি হয়। আর্থিক বৈষম্য এবং ক্ষমতার অসমবণ্টনের ফলে জনসমষ্টির মধ্যে সৃষ্টি হয় সংঘাত। অন্যথায় একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে এত বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টি হতো না। হিন্দুপ্রধান ভারতের প্রায় সকল রাজ্যেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু। কিন্তু অন্যান্য বৈষম্যের কারণে ধর্মীয় সাদৃশ্য তাদের স্বার্থের কারণগুলোকে দূরীভূত করতে পারছে না। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, কেন্দ্র রাজ্য সংঘাত, রাজ্যে রাজ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ধর্মীয় সাদৃশ্য কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। অন্যদিকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি। ভাষা-সংস্কৃতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক পার্থক্য ও বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যার সর্বাধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ধর্ম মানুষের আবেগ ও অনুভূতির ব্যাপার। নিজ ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মকে স্বীকৃতি দিতে মানুষের প্রবল আপত্তি কাজ করে। এক্ষেত্রে ভাবাবেগের প্রশ্ন প্রকট। তবে ধর্মচর্চা আর রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। একটি পরজাগতিক, একটি ইহজাগতিক। উভয়কে একত্রিত করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি না করলে তবেই জাতিগত প্রশ্নে, রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্ম কোনো সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না।

একজাতি রাষ্ট্র  (Uninational States)

জাতির ক্রমবিকাশের ধারায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালাভ করে একথা যেমন স্বতসিদ্ধ, তেমনি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটলেই জাতি সৃষ্টি হবে অথবা রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটলেই জাতির বিলুপ্তি ঘটবে এটাও ভুল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু তার অধিবাসীদের মধ্যে একমাত্র রাজনৈতিক বন্ধন ছাড়া অন্য কোনো বন্ধন না থাকায় তা জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। অন্যদিকে ১৯৪৫ সালে জার্মানি ও জাপানের সার্বভৌমিকতা লুপ্ত হওয়ায় তাদের রাষ্ট্রত্ব লোপ পায়। কিন্তু জার্মান ও জাপানি জাতি বিলুপ্ত হয়নি। অর্থাৎ জাপানিরা এক অখণ্ড জাতি। পরবর্তীতে সার্বভৌমত্ব অর্জনের পরেও তারা তাদের জাতিসত্তাকে রাজনৈতিক সংগঠন রাষ্ট্রের মধ্যে সুসংহত করে। জার্মানদের ব্যাপারেও একই কথা বলা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দ্বিধাবিভক্ত জার্মানি জাতি দু’টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অধিবাসী হলেও এক জার্মান ‘জাতি’ হিসেবে তাদের অনুভূতি বিলুপ্ত হয়নি। পরবর্তীতে উভয় জার্মান একত্রীকরণের পরে আবার তারা একজাতি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ জার্মানি ও জাপানকে একজাতিক রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা যায়। হাঙ্গেরি, সুইডেন, বাংলাদেশ প্রভৃতিও একজাতিক রাষ্ট্রের উদাহরণ।

অপরদিকে বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের উদাহরণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কানাডা প্রভৃতি। ভারতবর্ষ একজাতিক রাষ্ট্র বা একটি জাতি কিনা এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীগণ ঐকমত্য পোষণ করেননি। স্তালিনের মতে জাতি হলো, “”ঐতিহ্যসিকভাবে সংগঠিত” এবং “স্থায়ী জনসমাজ”, যারা একই ভাষায় কথা বলে, একই অঞ্চলে বসবাস করে, যাদের অর্থনৈতিক জীবন একই রকম এবং মানসিক গঠনও একই ধরনের।” স্তালিনের দেওয়া জাতির সংজ্ঞাকে গ্রহণ করলে নিঃসন্দেহে বলা যায় ভারতবর্ষ একটি জাতি নয়, একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। ইরফান হাবিব মন্তব্য করেছেন, “ভারতবর্ষ একটি দেশ, কিন্তু জাতি নয়, কারণ এক ভাষা ও এক সংস্কৃতি এই দুই শর্তের কোনোটাই ভারতবর্ষ পূরণ করে না।” কিন্তু অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় একটি জনসমষ্টির মধ্যে ঐক্যবোধ থাকলে এবং তা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হলে জাতিতে পরিণত হয়। ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য জাতিগঠনের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নয়। ঐতিহ্যসিক উপাদান ও রাজনৈতিক ঐক্যবোধ এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে কানাডা বা সুইজারল্যাণ্ডের মতো একাধিক ভাষাভাষী ও সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষকে নিয়ে জাতি গঠনে অসুবিধা হয়নি। ভারতবর্ষও দীর্ঘকাল পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে জাতীয়তাবাদী প্রেরণায় ঐতিহ্যসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সুতরাং বলা যায় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পর বিজয়ী স্বাধীন দেশ গঠন করার পরবর্তীকালে ভারত একটি জাতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

জাতি ও রাষ্ট্র দুটি পৃথক সংগঠন ও সত্তা। জাতির মধ্যে আছে একই ঐতিহ্য, একই আনন্দ বেদনার মনোভাব, এই ভাষা সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য বিভিন্ন উপাদানের ঐক্য।  কিন্তু রাষ্ট্র হলো একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যার একটিমাত্র ভিত্তি হলো নাগরিকদের রাজনৈতিক আনুগত্য। একটি রাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক জাতি থাকতে পারে। পৃথিবীতে বহুজাতিক রাষ্ট্রের অনেক উদাহরণ আছে। বিভিন্ন জাতি তাদের জাতিসত্তাকে অক্ষুণ্ণ রেখে এক সার্বভৌম শক্তির অধীনে বসবাস করে। এ বিচারে বর্তমান ভারতকেও অনেকে বহুজাতিক রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেন। কারণ প্রত্যেক রাষ্ট্রে একটি মাত্র জাতীয় জনসমাজ বা জাতি নিয়ে গঠিত হওয়ার যে আদর্শ তাকে একজাতি রাষ্ট্রের আদর্শ বলে। এই আদর্শের অন্তর্ভুক্ত বলে ভারতকে বিবেচনা করা যায় না।

আবার যখন কোনো নিপীড়িত জাতি সচেতনভাবে নিজেদেরকে অন্য জাতির শাসন থেকে মুক্ত করে স্বাধীন ও স্বনিয়ন্ত্রিত সরকার গঠন করে স্বশাসিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায় তখন সেই দাবিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলা হয়। এই নীতির ভিত্তিতে “একজাতি একরাষ্ট্র” গঠনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতির ফলশ্রুতি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র যা একজাতি একরাষ্ট্র বলে পরিচিত।

একজাতি রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ (Uninational States Evolution)

একজাতি রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ ঘটে অষ্টাদশ শতাব্দিতে। মূলত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ধারণা থেকেই একজাতি রাষ্ট্রের ধারণা বিকাশ লাভ করে। এই ধারণাটি ১৭৭২ সালে যখন পোল্যান্ড দ্বিখণ্ডিত হয় তখন থেকেই কাজ করতে থাকে এবং উনিশ শতকের মধ্যভাগে বিশেষ প্রবল হয়ে ওঠে। তখন থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীগণ প্রচার করতে থাকেন যে, রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজের স্বাভাবিক অধিকার এবং বিশ্বজনীনভাবে তাকে স্বীকার করে নেওয়া হলে পৃথিবীতে আর কোনো রাজনৈতিক সমস্যা থাকবে না।

জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছেন, “যে রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতীয় জনসমাজ বাস করে সেখানে স্বাধীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব সম্ভবপর হয় না এবং তার জন্য জাতীয় জনসমাজের সীমারেখা রাষ্ট্রের সীমারেখার সমানুপাতিক হওয়া উচিত।” প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো  উইলসন ‘একজাতি’ রাষ্ট্রের আদর্শের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্যার চিরন্তন সমাধানের সন্ধান পেয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল যে, প্রত্যেক জাতীয় জনসমাজ বা জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি পূর্ণ করে পৃথিবী থেকে যুদ্ধের আতঙ্ক চিরকালের জন্য দূর করে দেওয়া সম্ভব হবে। উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি জনস্বার্থে মিল তার On Representative Government বইয়ে লেখেন, “জাতীয় চেতনার বলিষ্ঠ প্রকাশ যেখানে ঘটেছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট জাতির ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক জীবন এবং স্বতন্ত্র সরকার গঠনের অধিকার মেনে না নেবার কোনো যুক্তি নেই।” মিল-এর অভিমত ছিল, “বহুজাতি নিয়ে গঠিত দেশে স্বাধীন শাসনব্যবস্থা প্রায় অসম্ভব।” ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের পটভূমিতে জাতীয়তাবাদের উত্থানের পর জাতিভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার দাবি রূপায়ণের জন্য একজাতি এক রাষ্ট্রের ধারণা প্রথম বাস্তবরূপ লাভ করেছিল। ভিয়েনা কংগ্রেসের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করার আন্দোলন বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক স্তরে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নীতি স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই-এর শান্তিচুক্তিতে

প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মতো জন স্টুয়ার্ট মিল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তথা একজাতি এক রাষ্ট্রের তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বলেছেন বহুজাতি নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রায় অসম্ভব। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বহুজাতিকে সাম্রাজ্যগুলোর কথা মনে রেখেই মিল একথা বলেছিলেন। ইংরেজ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল এই নীতিকে সমর্থন করে মন্তব্য করেছেন, “একটি জাতীয় জনসমাজকে জাতীয় সরকার গঠন করতে না দিয়ে অন্য জাতির অধীনে থাকতে বাধ্য করা আর কোনো নারীকে সে যাকে ঘৃণা করে এমন পুরুষকে বিবাহ করতে বাধ্য করা একই কথা।” প্রত্যেকটি জাতিসত্তারই নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনধারা থাকে। স্বশাসনের অধিকার থাকলে এগুলো প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠার সুযোগ পায় এবং জাতির নিজস্ব গুণাবলি বিকাশ লাভ করতে পারে। অন্যদিকে বহুজাতিক রাষ্ট্রে অনেক সময়ই দেখা যায় একটি জাতির আধিপত্য ও প্রভাব। এই পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠির বিকাশ ব্যাহত হয়।

‘একজাতি এক রাষ্ট্রের’ নীতি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সাথে সহমর্মিতার পথে অগ্রসর হতে পারবে ও সহযোগিতার সম্পর্কের দ্বারা ভ্রাতৃত্বমূলক বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করতে পারবে। একজাতি রাষ্ট্রের ধারণা অষ্টাদশ শতাব্দিতে বিস্তার করলেও উনবিংশ শতাব্দি পর্যন্ত তা তত্ত্বের জগতে আবদ্ধ ছিল। বিংশ শতাব্দিতে এসে বিশ্বের নানাপ্রান্তে একজাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি বাস্তবে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে এশিয়া ও আফ্রিকার ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলো স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে।

একজাতি রাষ্ট্রের ধারণার বিরুদ্ধে মতামত/সমালোচনা (Criticism of Uninational States Nation)

অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, বহুজাতিক রাষ্ট্র ভেঙে একজাতিক রাষ্ট্র গঠন করলেই সকল সমস্যার সমাধান হবে তা সঠিক নয়, বরঞ্চ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং কলহের ফলে বিশ্ব রাজনীতি কলুষিত ও বিষাক্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও থাকে।

  • গামপ্লাউইজ বলেছেন যে, জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র হলে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিকাশ ঘটবে এবং গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হবে এ ধরনের অনুমানের কোনো ভিত্তি নেই। তিনি সুইজারল্যাণ্ডের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বহুজাতিক রাষ্ট্রেও ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ব্যাপারে কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না।
  • ব্লুন্টসলির মতে, “একজাতিক রাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়। একই রাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক জাতিসত্তার অস্তিত্ব থাকলে তাতে বরং সুবিধাই হয়। তাতে পারস্পরিক যোগাযোগ ও মিশ্রণের সুযোগ ঘটে। একদিকে যেমন রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে প্রতিটি জাতির বিভিন্ন গুণের বিকাশের সুযোগও ঘটে।”
  • অস্ট্রিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রান্সিসের মতে, একই রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থাকলে সুবিধা হলো যে, এরা কেউ কাউকে পছন্দ করে না। ফলে একে অপরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। একজাতিক রাষ্ট্রের এই সুবিধা থাকে না।
  • লর্ড অ্যাকটন (Lord Acton) বলেছেন, বিভিন্ন জাতি একই রাষ্ট্রের মধ্যে পরস্পরের সান্নিধ্যে এলে পশ্চাদপদ জাতিগুলো সুযোগ পায়। যার ফলে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। তার মতে, একজাতিক রাষ্ট্র গঠন করা মানে চারপাশে দেয়াল তুলে জাতির অগ্রগতিকে ব্যাহত করা। এটি ইতিহাসের পশ্চাদগতির লক্ষণ। অন্যদিকে বহুজাতিক রাষ্ট্র সভ্যতার অগ্রগতিতে সহায়ক।
  • একজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে অন্য একটি যুক্তি হলো, এই তত্ত্বকে কার্যকর করা অসম্ভব। সকল জাতীয় জনসমাজকে যদি রাষ্ট্র গড়ার অধিকার দেয়া হয় তাহলে অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্র সৃষ্টি হবে। শুধু ইউরোপেই এ ধরনের রাষ্ট্রের সংখ্যা হবে আশির বেশি। তার ফলে, প্রথমত হানাহানি, মারামারি বাড়বে। বিশ্বশান্তির সম্ভাবনা বিঘ্নিত হবে। দ্বিতীয়ত, ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো দুর্বল হবে এবং শক্তিশালী রাষ্টগুলোর ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়বে। ফলে নতুন ধরনের পরাধীনতা (Dependency) দেখা দেবে।

একজাতিক রাষ্ট্রের ধারণা থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম। কেননা জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র অবশ্যম্ভাবীরূপে জাতিতে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা জন্ম দেয়। এই শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা জাতিকে আগ্রাসী করে তোলে। জার্মান ও ইতালিতে এভাবেই নাৎসিবাদ ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছিল। কোনো কোনো দার্শনিক জাতি রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখেছেন। তাদের মতে, পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও যুদ্ধমুক্ত করার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার রূপায়ণ। কিন্তু একজাতি রাষ্ট্র ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক সংহতির পক্ষে একটি বড় বাধা। যে কারণে অধ্যাপক লাস্কি মন্তব্য করেছেন, পরস্পর প্রতিযোগী সার্বভৌম রাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত ব্যবস্থার পরিণাম সভ্যতার ধ্বংসসাধন। অবশ্য লাস্কির বক্তব্য জাতিরাষ্ট্র গঠনের অধিকারের বিরুদ্ধে নয়, এসব রাষ্ট্রের বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে। তিনি এই ক্ষমতাকে সীমিত করে বিশ্বজোড়া সরকার (World government) প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন। পরিশেষে বলা যায়, কোনো জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি মেনে নিয়ে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার প্রদান করলে বৃহৎ বহুজাতিক রাষ্ট্র ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হবে। পরবর্তীতে এই সকল ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় পুনরায় নতুন নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির দাবি জানাবে। জাতিগত সংখ্যালঘুর পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তারপর উপজাতীয় সংখ্যালঘু ইত্যাদির দাবিও মেনে নেয়ার নৈতিক দায়িত্ব থেকে যাবে। শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে অগণিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটবে। আধুনিক গণতান্ত্রিক বস্তুবাদী চিন্তার আলোকে বিচার করলে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একজাতি রাষ্ট্র গঠনের ঐতিহ্যসিক প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির ফলে গোটা পৃথিবী Global Village-এ পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রক্ষায় নিজের চারদিকে দেয়াল তুলে নিজেকে আরও ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সংকুচিত রাখার কোনো যুক্তি নেই। বরং তার পরিবর্তে বিশ্ব মানবিকতার আদর্শ রূপায়ণের জন্য বিশ্বায়নকে স্বীকার করে নিতে হবে।

বহুজাতিক রাষ্ট্র (Multinational States)

সু.

বর্তমান বিশ্বে বহুজাতিক বা Multinational জাতি হিসেবে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ভারত প্রভৃতি রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করা যায়। এসমস্ত রাষ্ট্রে বহুজাতি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে এবং তাদের নিজ নিজ জাতিসত্তা বজায় রেখেছে। মালয়েশিয়াতে চাইনিজ জাতি নিজ জাতি সত্তা নিয়েই মালয়েশিয়ান নাগরিক হয়ে আছে। মালয়েশিয়ার নাগরিক হয়েও তারা জাতিতে চাইনিজ, রাষ্ট্রীয় সকল প্রকার কর্যক্রমে মালয় জনগোষ্ঠির মতোই সমান অধিকার ও অংশীদারিত্ব ভোগ করে।

কানাডা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী কুইবেক জাতি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতিসত্তা নিয়ে কানাডীয় নাগরিক। কানাডীয় যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের উপাদান এবং তাদের কার্যকারিতার ফলে সৃষ্ট। ১৮৩৯ সালে যেখানে ডারহার রিপোর্ট (Darhar Report) প্রকাশের ফলে লোয়ার কানাডা ও আপার কানাডা বর্তমান সময়ের কুইবেক ও ওন্টারিও প্রদেশ ইউনাইটেড কানাডাতে একত্র হয়। কানাডাতে ব্রিটিশ ও ফরাসি জাতিভুক্ত জনগোষ্ঠিসমূহের মধ্যে অব্যাহতভাবে বর্ণগত বিরোধ চলছিল, প্রত্যক্ষভাবে তারই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়। লোয়ার কানাডাতে ইংরেজ ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মচারী এবং রক্ষণশীল ফরাসি ক্যাথলিকগণের চরমতম বিরোধ চলছিল। ওন্টারিও অঞ্চলে সীমান্তবর্তী স্বাধীনতাকামী কৃষকগণ এবং সম্পদশালী সরকারি কর্মচারীগণের মধ্যেও প্রবল বিরোধ চলছিল।

১৮৫৮ সালের পর সেখানে আইনসভা এবং প্রশাসনের ক্ষেত্রে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফরাসি ও ব্রিটিশ প্রত্যেক গোষ্ঠিই নিজেদের জন্য আলাদা আইন তৈরি করতে চেয়েছিল। কানাডাস্থ উপনিবেশগুলোর বিরূপ মনোভাব সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৭ সালে লন্ডনে এই উপনিবেশগুলোর এক সম্মেলন আহ্বান করে। নোভাস্কটিয়া, নিউ-ব্রান্সউইক এবং ইউনাইটেড কানাডার প্রতিনিধিগণ এই সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলনে “ব্রিটিশ নর্থ আমেরিকা অ্যাক্ট” পাস হয়। ইউনাইটেড কানাডা কুইবেক ও ওন্টারিও দুইটি প্রদেশে পূর্ণবিভক্ত, নোভাস্কটিয়া এবং নিউ ব্রান্সউইক এই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান প্রদেশ ছিল। ১৮৭০ সালে মেনিটোবা, ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ কলম্বিয়া, ১৮৭০ সালে প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জ এবং ১৮০৫ সালে সাস্কাচেওয়ান ও আলবার্টা এই কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। কানাডীয় যুক্তরাষ্ট্র আধুনিক বিশ্বে বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত।

সাবেক সোভিয়েত রাশিয়াকে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হতো। রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিনের প্রচেষ্টায় ইউরোপের অর্ধেকের বেশি এবং এশিয়ার দুই পঞ্চমাংশ ভূ-খণ্ড জুড়ে ১৫টি প্রজাতন্ত্র নিয়ে ১৯১৭ সালে ইউনিয়ন অব দি সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিকান (U.S.S.R) নামে বিশ্বমানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিশ্বযুদ্ধের পর লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার অঙ্গরাষ্ট্রগুলো যেমন রাশিয়া, বাইলোরাশিয়া, ইউক্রেন, কাজাখিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, জর্জিয়া প্রভৃতি নিজস্ব সত্তা নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল বহুবছর ধরে। ইসলামসহ এসব অঞ্চলের অধিবাসীরা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও ছিল। ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা, ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিশ্বাসে সোভিয়েত রাশিয়ার বহুজাতিক রাষ্ট্র ১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবে বর্তমানে পরিচিত। বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রের মানুষই কমবেশি বৈধ বা অবৈধভাবে আমেরিকায় বসবাস করছে। এসব জনগোষ্ঠির মধ্যে বিভিন্ন শর্তে অনেক ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। কালো মানুষেরা আলাদা বর্ণ ও স্বতন্ত্র সংস্কৃতির ধারক হয়েও নিজেদেরকে আফ্রিকান জাতি অথবা নিগ্রো জাতি হিসেবে পরিচয় দেয় না। তারা নিজেদেরকে “আফ্রিকান আমেরিকান” বলে পরিচয় প্রদান করে। অর্থাৎ তাদের উৎস বা উদ্ভব যেখান থেকেই হোক না কেন তারা আমেরিকান জাতি।

দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র ভারতবর্ষের জন্মলগ্ন থেকেই বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত। ভারতের পূর্বাঞ্চলের “সেভেন সিস্টার্স” নামে পরিচিত সাতটি অঙ্গরাজ্য ছাড়া দাক্ষিণাত্যের তামিলনাডুর তামিলরাও আলাদা জাতিসত্তা নিয়ে পরিচয় প্রদানে উন্মুখ। পাঞ্জাবের শিখজাতি, পশ্চিম বাংলার বাঙালি জাতিও নিজেদের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ। তদুপরিও এই বহুজাতিক ভারতবর্ষের সমগ্র জনগোষ্ঠি শুধুমাত্র একজাতি ভারতীয় হিসেবেই পরিচিত হতে চায়।

বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে অনুন্নত জাতিগুলো উন্নত জাতির সংস্পর্শে আসতে এবং উন্নতি লাভ করতে পারে। কারণ উন্নত জাতির শৌর্যবীর্য, জ্ঞান-সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর জাতিগুলোর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। তাই বহুজাতি সমন্বিত রাষ্ট্রের মাধ্যমে এই ধরনের সংমিশ্রণ মানব সমাজের সুষম উন্নয়নের পক্ষে সহায়ক। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অগণিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির অস্তিত্ব বিরাজমান। প্রতিটি জাতির পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি কার্যকরী হলে প্রতিটি রাষ্ট্র হচ্ছে জাতিভিত্তিক, “একজাতি একরাষ্ট্র” নীতিতে এক একটি জাতিকে নিয়ে এক একটি রাষ্ট্র গঠিত হবে। যদি কোনো রাষ্ট্র চারটি জাতির সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে তবে এই নীতি অনুসারে সেই রাষ্ট্রকে ভেঙে চারটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। বহুজাতিক রাষ্ট্রে বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দুর্বল ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে গ্রাস করেতে চায়। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নত জাতিগুলো অনুন্নত জাতিগুলোর উপর কর্তৃত্ব করে প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিলে সেই নীতির ভিত্তিতে “একজাতি একরাষ্ট্র” গড়ে উঠতে পারে।

তবে “একজাতি একরাষ্ট্র” এই নীতিতে পৃথিবীর দীর্ঘকালের সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রগুলো দ্বিধাবিভক্ত হলে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দেবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বশান্তি ও অগ্রগতির জন্য বহুজাতিক রাষ্ট্রই সকলের কাম্য হওয়া উচিত। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করলে সুইজারল্যান্ডে আরও ক্ষুদ্রাকৃতির তিনটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হবে। ইংল্যাণ্ড চারভাগে বিভক্ত হবে। ইউরোপের আটাশটি স্থানে কমপক্ষে ষাটটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হবে। বিশ্বজুড়ে জটিল রাজনৈতিক সমস্যা, বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা দেখা দেবে। ব্যাহত হবে অর্থনৈতিক বিকাশ।

লর্ড অ্যাকটন (Lord Acton) বলেছেন, মানুষ যেমন সমাজবদ্ধ, তেমনি একটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া সভ্য সমাজ জীবনের স্বার্থে দরকার। তিনি বলেছেন, “একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতির সমন্বয় সভ্য জীবনের একটি অপরিহার্য শর্ত যেমন সমাজে মানুষের সমন্বয়।”

একজাতিক ও বহুজাতিক রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য

একজাতিক রাষ্ট্র একটি মাত্র জাতি নিয়ে গঠিত হয়। পক্ষান্তরে বহুজাতিক রাষ্ট্র বিভিন্ন জাতি এবং বিভিন্ন ভাষা-ভাষী জনগণ নিয়ে গঠিত। নিম্নে একজাতিক রাষ্ট্র ও বহুজাতিক রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হলো:

  • ১. গঠনগত পার্থক্য: একজাতিক রাষ্ট্র সাধারণত একটি মাত্র জাতি নিয়ে গঠিত। তবে একজাতিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন উপজাতি বসবাস করে থাকে। তাদের কৃষ্টি-কালচার, ভাষাগত পৃথক সত্তা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের কথা বলা যায়। বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্ম লাভ করে। এ দেশে বিভিন্ন উপজাতি তাদের পৃথক সত্তা নিয়ে বসবাস করে। পক্ষান্তরে বহুজাতিক রাষ্ট্র বিভিন্ন জাতি এবং ভাষা-ভাষী জনগণ নিয়ে গঠিত। বিভিন্ন জাতি তাদের জাতিসত্তাকে অক্ষুণ্ণ রেখে এক সার্বভৌম শক্তির অধীনে বসবাস করে। এ বিচারে বর্তমান ভারত একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র।
  • ২. সরকার গঠন: একজাতিক রাষ্ট্রে একটি মাত্র জাতি বসবাস করে বিধায় তাদের নিজস্ব সরকার গঠন ও পরিচালনায় তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয় না। তবে কোনো কোনো একজাতিক রাষ্ট্রে জাতীয় সংহতির অভাবে সরকার গঠন ও পরিচালনায় অসহিষ্ণুতা ও বিভেদ পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে বহুজাতিক রাষ্ট্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলো রাষ্ট্র বা সরকার গঠন করার সুযোগ বা অধিকার পায় না। শক্তিশালী জাতির আধিপত্য ও প্রভাবের কারণে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব ব্যাহত হয়।
  • ৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: জন স্টুয়ার্ট মিল তার On Representative Government বইয়ে লিখেছেন, “জাতীয় চেতনার বলিষ্ঠ প্রকাশ যেখানে ঘটেছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট জাতির ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক জীবন এবং স্বতন্ত্র সরকার গঠনের অধিকার মেনে না নেবার কোনো যুক্তি নেই।” অর্থাৎ একজাতিক রাষ্ট্রে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রক্ষার মাধ্যমে সাম্প্রতিক স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। মিলের মতে, “বহুজাতি নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রে স্বাধীন শাসনব্যবস্থা প্রায় অসম্ভব।”
  • ৪. সংস্কৃতি ও জীবনধারার বিকাশ: প্রত্যেক জাতিসত্তারই নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনধারা থাকে। একজাতিক রাষ্ট্রে স্বশাসনের অধিকার থাকে বলে জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনধারা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠার সুযোগ পায় এবং জাতির নিজস্ব গুণাবলি বিকাশ লাভ করতে পারে। অন্যদিকে বহুজাতিক রাষ্ট্রে অনেক সময়ই দেখা যায় একটি জাতির আধিপত্য ও প্রভাব। এই পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠির বিকাশ ব্যাহত হয়।
  • ৫. দ্রুত সমস্যার সমাধান: একজাতিক রাষ্ট্রের জনগণ দ্রুত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারে। তারা সহজেই জনস্বার্থ সম্বলিত বিষয়গুলো সম্পর্কে একমত হয়। ফলে সরকারের পক্ষে সমস্যার সমাধান সহজ হয়। অন্যদিকে বহুজাতিক রাষ্ট্রে সাধারণ সমস্যার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতির কলহ, দ্বন্দ্ব, ঈর্ষা ও পারস্পরিক সংঘর্ষ বিদ্যমান থাকে। খুব সহজেই এ সমস্ত সমস্যার সমাধান করা যায় না। ফলে বহুজাতিক রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রে শোচনীয় ও মর্মান্তিক পরিণতি ভোগ করে।
  • ৬. বিচ্ছিন্নতা: ব্লুন্টসলির মতে, একজাতিক রাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়। লর্ড অ্যাকটনের মতে, একজাতিক রাষ্ট্র গঠন করা মানে চারপাশে দেয়াল তুলে জাতির অগ্রগতিকে ব্যাহত করা। অন্যদিকে একই রাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক জাতিসত্তার অস্তিত্ব থাকলে তাতে বরং সুবিধাই হয়। তাতে পারস্পরিক যোগাযোগ ও মিশ্রণের সুযোগ ঘটে। একদিকে যেমন রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে প্রতিটি জাতির বিভিন্ন গুণের বিকাশের সুযোগও ঘটে। লর্ড অ্যাকটনের মতে, “বিভিন্ন জাতি একই রাষ্ট্রের মধ্যে পরস্পরের সান্নিধ্যে এলে পশ্চাদপদ জাতিগুলো উন্নতির সুযোগ পায়। যার ফলে সভ্যতার বিকাশ ঘটে।”
  • ৭. শৃঙ্খলা রক্ষা: বহুজাতিক রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা রক্ষার সুবিধা হয়। অস্ট্রিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রান্সিসের মতে, “একটি রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠি থাকার সুবিধা হলো এই যে, এরা কেউ কাউকে পছন্দ করে না। ফলে একে অপরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।” অন্যদিকে একজাতিক রাষ্ট্রে এ সুবিধা থাকে না।
  • ৮. আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা: আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে বহুজাতিক রাষ্ট্র আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ ও যুদ্ধমুক্ত করার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার রূপায়ণ। আর তা বহুজাতিক রাষ্ট্রের মাধ্যমে সম্ভব। অন্যদিকে কোনো কোনো লেখক একজাতিক রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখেছেন। তাদের মতে, একজাতি রাষ্ট্র ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক সংহতির পক্ষে একটি বড় বাধা। যে কারণে অধ্যাপক লাস্কি মন্তব্য করেছেন, “পরস্পর প্রতিযোগী সার্বভৌম একজাতি রাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত ব্যবস্থার পরিণাম সভ্যতার ধ্বংস সাধন।”

জাতীয়তার অর্থ ও সংজ্ঞা (Meaning and Definition of Nationality)

জাতীয়তার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Nationality. এটি ল্যাটিন শব্দ “Natus” থেকে উদ্ভূত হয়েছে। “Natus” শব্দের অর্থ জন্ম। সুতরাং জাতীয়তার উৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে একই বংশোদ্ভূত জনসমষ্টি। জাতীয়তা বলতে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন একটি জনসমষ্টিকে বোঝায়। ঐ জনসমষ্টি বংশ, ভাষা, সাহিত্য, রীতি-নীতি এবং ঐতিহ্যের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ। তারা অন্যান্য জনসমষ্টি থেকে নিজেদের আলাদা মনে করে। জনসমষ্টি ক্রমান্বয়ে জাতীয়তায় পরিণত হয়। জনসমষ্টির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হলেই তাকে জাতীয়তা আখ্যা দেওয়া যায়। বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তার সংজ্ঞা দিয়েছেন। ফরাসি লেখক রেনান (Renan) জাতীয়তার সংক্ষিপ্ত ও সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার মতে, “জাতীয়তা একটি মানসিক সত্তা এবং এক ধরনের সজীব মানসিকতা।” (The idea of nationality is essentially spiritual in character).

  • ১. রাষ্ট্রচিন্তাবিদ কোকার (Cokar)-এর মতে, “জাতীয়তা গঠিত হয় অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে।” (Nationality is primarily a product of historical experiences and cultural tradition.)
  • ২. অধ্যাপক জিম্মার্ন (Zimmern) বলেন, “জাতীয়তা হলো নির্দিষ্ট আবাসভূমির সাথে সম্পর্কযুক্ত বিশেষ গভীরতা, ঘনিষ্ঠতা এবং মর্যাদাসম্পন্ন মিলিত অনুভূতির প্রকাশ।” (Nationality is a form of corporate sentiment of peculiar intensity, intimacy and dignity related to a definite home country.)
  • ৩. জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill)-এর মতে, “জাতীয়তা বলতে মানব জাতির সেই অংশকে বোঝায়, যারা পারস্পরিক সহানুভূতির দ্বারা আবদ্ধ, স্বেচ্ছায় পারস্পরিক সহযোগিতার নীতিতে বিশ্বাসী এবং নিজেদের একাংশের দ্বারা পরিচালিত সরকারের অধীনে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে।” (A portion of mankind may be said to constitute a nationality if they are united among themselves by common sympathies which do not exist between them and any others-which make them co-operate with each other more willingly than with the other people, desire to be under the same government and desire that it should be government by themselves or a portion of themselves exclusively.)
  • ৪. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফিল্ড (Field)-এর মতে, “বাস্তব দিক থেকে বিচার করলে জাতীয়তা হলো একটি জনগোষ্ঠি যারা নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে সাগ্রহে আকাঙ্ক্ষা করে।” (Nationality in the concrete sense indicates a group of people who aspire to become seprate state of their own.)
  • ৫. অধ্যাপক গিলক্রিস্ট (Prof. Gilchrist) বলেছেন, “জাতীয়তা হলো কোনো জনসমষ্টির মধ্যে উদ্ভূত হওয়া এক ধরনের আধ্যাত্মিক চেতনা বা নীতি যারা একই জাতি, একই ভূখণ্ডের অধিবাসী, একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সংঘ এবং ‘একই আদর্শের রাজনৈতিক, ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ।” (Nationality may be defined as a spiritual of the same race, residents on the same territory. sharing a common language, the same religion, similar associations and common ideals of political unity.)
  • ৬. লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেছেন, “জাতীয়তা হলো ভাষা, সাহিত্য, ধ্যান-ধারণা, প্রথা এবং ঐতিহ্যের বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ এক জনসমষ্টি যা অনুরূপভাবে ঐক্যবদ্ধ অন্যান্য জনসমষ্টি থেকে নিজেদেরকে পৃথক মনে করে।” (A nationality is a population held together by certian ties, as for example, lagnuage and literature, ideas customs and traditions in such wise so to feel itself a coherent unity distinct from other population similarly held together by like ties of their own).
  • ৭. অধ্যাপক গেটেল (R. G. Gettell) বলেছেন, “জাতীয়তা ব্যাপক অর্থে একটি ভাবগত ব্যাপার, একটি মানসিক অবস্থা, জীবনযাত্রা, চিন্তা ও অনুভূতির এক পদ্ধতি।” (Nationality, therefore, is largely a matter of sentiment; it is a state of mind, a way of living, thinking and feeling.)
  • ৮. অধ্যাপক গার্নার (Garmer)-এর মতে, “জাতীয়তা হলো বংশগত বা অন্যান্য ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ একটি জনসমষ্টি বা একটি অংশ”  (In the substantive sense, the term is employed to designate a group or portion of population which is united by racial or other bonds.)
  • ৯. অধ্যাপক আর, এম. ম্যাকাইভার ( R .M. MacIver)-এর মতে, “জাতীয়তা হলো সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐক্যবোধ যা এক বিশেষ ঐতিহ্যসিক পরিবেশের ভেতর রাষ্ট্রের মাধ্যমে নিজের অভিব্যক্তির জন্য সক্রিয়।” (Nationality is the sense of community which under the historical conditions of a particular epoch, has possessed or still seeks expression through the unity of a state.)
  • ১০. সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম (Durkheim)-এর মতে, “একটি জাতীয়তা হল এমন একটি দল যার সদস্যরা একটি রাষ্ট্রের আইন এবং গঠনের অধীনে বাস করতে চান।” (A nationality is a group of which the members wish to live under the laws and form of a state.)
  • ১১. অধ্যাপক লাস্কি (Harold J. Laski) বলেছেন, “জাতীয়তা সাধারণভাবে মানসিকতার ব্যাপার, যারা এর অংশীদার, এ ঐক্যবোধ তাদেরকে বাকি মানব সমাজ থেকে স্বতন্ত্ররূপে চিহ্নিত করে।” (Broadly speaking, in fact, the idea of nationality is essentially spiritual in character it implies the sense of a special unity which marks of those who share in it from the rest of mankind.)

উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, জাতীয়তা বলতে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী এমন এক জনসমষ্টিকে বোঝায় যারা বংশ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও ঐতিহ্যের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ এবং যারা অন্যান্য জনসমষ্টি থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র বলে মনে করে।

জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য

জাতি ও জাতীয়তার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে যথাক্রমে ‘Nation’ ও ‘Nationality’, ইংরেজি ‘Nation’. “Nationality” শব্দ দুটি ল্যাটিন শব্দ ‘Natio’ ও ‘Natus’ হতে উৎপন্ন হয়েছে। এদের অর্থ জন্ম বা বংশ। সুতরাং উৎপত্তিগত অর্থে জাতি ও জাতীয়তা বলতে একই বংশোদ্ভূত জনসমষ্টিকে বোঝায়।

কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন লেখক উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) জাতীয়তা ও জাতির মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন। তার মতে, “জাতীয়তা হলো ভাষা, সাহিত্য, ধ্যান- ধারণা, প্রথা এবং ঐতিহ্যের বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ এমন এক জনসমষ্টি যা অনুরূপভাবে ঐক্যবদ্ধ অন্যান্য জনসমষ্টি থেকে নিজেদেরকে পৃথক বলে মনে করে। আর জাতি হলো রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত এমন এক জাতীয়তা যা স্বাধীন হয়েছে অথবা স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করছে।” লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) আরও বলেন, “জাতীয়তা হচ্ছে জাতি গঠনের একটি প্রক্রিয়া। জাতীয়তা যত শীঘ্র রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করে তত শীঘ্র এটি জাতিতে পরিণত হয়।” (Nationality is a nation in the making. As soon as a nationality secures political independence it becomes a nation.) অধ্যাপক হায়েস (Hayes)-এর মতে, “একটি জাতীয়তা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এবং সার্বভৌম স্বাধীনতা অর্জন করে জাতিতে পরিণত হয়।” ফরাসি লেখক রেনান (Renan)-এর মতে, “জাতীয়তা মূলত মানসিক বা আত্মিক ধারণা কিন্তু জাতি একটি বাস্তব সত্তা।” অধ্যাপক গিলক্রাইস্ট (Gilchrist) বলেছেন, “রাষ্ট্রসহ জাতীয়তাকে জাতি বলে আখ্যা দেয়া যায়।” (Nation is very near in meaning to state plus nationality.) সুতরাং জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে নিম্নোক্ত পার্থক্য বিদ্যমান :

  • ১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য: জাতি বলতে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনসমষ্টিকে বোঝায়, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্বাধীনভাবে বসবাস করে। অপরদিকে, জাতীয়তা বলতে একই বংশ, ভাষা, সাহিত্য, রীতি-নীতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদির বন্ধনে আবদ্ধ জনসমষ্টিকে বোঝায় যারা নিজেদেরকে অন্যান্য জনসমষ্টি থেকে পৃথক মনে করে।
  • ২. রাজনৈতিক সংগঠনের দিক থেকে: জাতি গঠনে রাজনৈতিক সংগঠন অত্যাবশ্যক। কিছু জাতীয়তার জন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের দরকার হয় না।
  • ৩. সুসংহতের দিক থেকে: জাতি খুব সুসংহত। স্বাধীন ও সার্বভৌম অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত। কিন্তু জাতীয়তা খুব সুসংহত নয়।
  • ৪. অনুভূতির দিক থেকে: জাতি হচ্ছে সক্রিয় বা বাস্তব ধারণা, এটি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের ফল। অপরদিকে, জাতীয়তা হচ্ছে মূলত মানসিক বা আত্মিক অনুভূতি। এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম নেয়।
  • ৫. আদর্শগত পার্থক্য: জাতি একটি সুসংহত ও সুসংগঠিত আদর্শ। কিন্তু জাতীয়তা হচ্ছে কতকগুলো অনুভূতির সমন্বয় মাত্র। জাতীয়তার অনুভূতি থেকে ধীরে ধীরে জাতির আদর্শ গড়ে ওঠে।
  • ৬. সহজাত দিক থেকে: জাতি গঠনের মূলসূত্র হচ্ছে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ, কিন্তু জাতীয়তা গঠনে ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম ইত্যাদির মিল থাকতে হয়।
  • ৭. পর্যায়গত দিক থেকে: জাতি হচ্ছে জাতি গঠন প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ পর্যায়। কিন্তু জাতীয়তা হচ্ছে জাতি গঠনের প্রাথমিক পর্যায়। এককথায় বলা যায়, জাতি হচ্ছে জনসমষ্টির পরিপূর্ণ রূপ আর জাতীয়তা হচ্ছে প্রাথমিক অবস্থা।
  • ৮. ঐক্যের দিক থেকে: জাতি হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত জনসমষ্টি। অপরদিকে, জাতীয়তা গঠনে ভাবগত উপাদানই হচ্ছে প্রধান।
  • ৯. স্থায়িত্বের দিক থেকে: জাতি অধিকতর স্থায়ী একটি জনসমষ্টি। জাতি গঠিত হলে জাতীয়তা ব্যতীত টিকে থাকতে পারে। কিন্তু জাতীয়তা অধিকতর কম স্থায়ী তার স্থায়িত্বের জন্য জাতি গঠন প্রয়োজন।
  • ১০. উৎপত্তির দিক থেকে: রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মতে, প্লেটো (Plato), এরিস্টটল (Aristotle) এর সময় থেকে জাতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এবং তা বেশ প্রাচীন। কিন্তু জাতীয়তার ধারণা প্রস্ফুটিত হয় আধুনিককালে। ম্যাকিয়াভেলি (Machivelli) সর্বপ্রথম জাতীয়তা সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন।
  • ১১. পরিধির দিক থেকে: জাতির পরিসীমা নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু জাতীয়তার ক্ষেত্র সারা বিশ্বব্যাপী।
  • ১২. গাণিতিক সূত্রের দিক থেকে: গাণিতিক সূত্র প্রয়োগ করে জাতি ও জাতীয়তার পার্থক্য দেখানো যায়:
    জনসমষ্টি = একই ধরনের জীবন যাপনে অভ্যস্ত জনসমাজ।
    জাতীয়তা= জনসমষ্টি + রাজনৈতিক চেতনা
    জাতি = জাতীয়তা + রাজনৈতিক সংগঠন + স্বাধীনতা

পরিশেষে বলা যায় যে, জাতীয়তা হচ্ছে একটি মানসিক চেতনা বিশেষ। আর জাতি হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সংগঠন। জাতীয়তা গঠনের জন্য সমজাতীয় রাজনৈতিক চেতনার দরকার। আর স্বাধীন রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে জাতীয়তা জাতিতে পরিণত হয়।

জাতীয়তাবাদ (Nationalism)

জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শ। আধুনিককালের রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রগুলো জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার ফসল। মূলত জাতীয় রাষ্ট্রগুলোর উদ্ভবের সাথে সাথে এ আদর্শ মানব ইতিহাসকে নাড়া দিয়েছে। জাতীয়তাবাদ একদিকে বহু নির্যাতিত জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেছে। অন্যদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদের সংহারক মূর্তি মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক বিশ্বে বহু যুদ্ধ বিগ্রহ ও দ্বন্দ-সংঘাতের পেছনে উগ্র জাতীয়তাবাদকে দায়ী করা হয়। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় জাতীয়তাবাদ প্রবল বিতর্কের সূচনা করেছে।

জাতীয়তাবাদের অর্থ ও সংজ্ঞা: বিশেষ্য পদ জাতি (Nation) থেকে এর বিশেষণ পদ জাতীয়তা (Nationality)-এর উৎপত্তি এবং এ থেকে রাষ্ট্রদর্শনে যে মতবাদের জন্ম হয়েছে তাকে জাতীয়তাবাদ (Nationality) নামে অভিহিত করা হয়। সুতরাং জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক মতবাদ বা মতাদর্শের নাম।

জাতীয়তাবাদ মূলত একটি আত্মিক ধারণা, একটি মানসিক অনুভূতি। ঐ আত্মিক ধারণা এবং মানসিক অনুভূতির মাধ্যমে কোনো জাতির রাজনৈতিক ইতিহাস, অতীতের স্মৃতি, উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার ধারণা আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয়তাবাদ হলো জনসমাজের মধ্যে এক গভীর ঐক্য সাধনকারী ধারণা। এ ধারণা এক মানব জনগোষ্ঠি থেকে অন্য মানব গোষ্ঠিকে স্বতন্ত্র বলে বিবেচনা করে। সুতরাং জাতীয়তাবোধের দুটি মূল বৈশিষ্ট্য বর্তমান। যথা: ১. নিজেদের মধ্যে গভীর ঐক্যবোধ এবং ২. পৃথিবীর অন্যান্য জনসমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্যবোধ। সুতরাং কোনো জাতি যখন স্বজাত্যবোধ এবং স্বকীয়তার ফলে নিজেদের অন্য জাতি থেকে পৃথক বলে মনে করে এবং স্বকীয়তাকে কেন্দ্র করে একটা আবেগ, অনুভূতি ও আত্মিক ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি করে, সেই মানসিক অবস্থা এবং চেতনাকেই জাতীয়তাবাদ বলে।

  • ১. অধ্যাপক হ্যান্স কোহন (Hons Kohn) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ প্রথমত এবং চূড়ান্তভাবে একটি মানসিক অবস্থা এবং একটি চেতনা বিশেষ।” (Nationalism is first and foremost a state of mind and an act of conciousness.)
  • ২. বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হায়েস (Hayes)-এর মতে, “জাতীয়তাবাদ হলো জাতীয়তা এবং স্বদেশপ্রেম নামক দুটি প্রাচীন উপাদানের আধুনিক আবেগমণ্ডিত সমন্বয় এবং অতিরঞ্জন।” (Nationalism consists of a modern fusion of emotional and exaggeration of two very old phenomena.)
  • ৩. আরনল্ড জে. টয়েনবী (Arnold J. Toynbee) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ কোনোরূপ বস্তুগত বা যান্ত্রিক অনুভূতি নয় বরং এক প্রকার আত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি।” (Nationalism is nothing material or mechnical, but a subjective, psychological feeling in a living people.)
  • ৪. অধ্যাপক পাডেলফোর্ড ও লিংকন (Prof. Padelford and Lincoln) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ দুটি উপাদানের সংমিশ্রণ বিশেষ। এর একটি উপাদান হচ্ছে জাতীয়তার ধারণা সম্পর্কিত কোনো আদর্শবাদ এবং অপরটি হচ্ছে জাতীয় রাষ্ট্রের ভেতর ঐ আদর্শবাদকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপদান।” (Nationalism is an amalgam of two elements, an idealogy embroidered about the idea of nationality and the political institutionalization of that ideology into national states.)
  • ৫. অধ্যাপক স্নাইডার (L. Snyder) বলেন, “জাতীয়তাবাদ হচ্ছে ইতিহাসের কোনো অধ্যায়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিগত উপাদানের ফল। এটি একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে বসবাসকারী জনগণের একটি মানসিকতা, অনুভূতি ও আবেগ।” (Nationalism is a product of political, economic, social and intellectual factors at a certain stage in history, is a condition of mind, feeling or sentiment of a group of people living in a well defined geographical area.)
  • ৬. বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell)-এর মতে, “জাতীয়তাবাদ হলো একটি সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি (a sentiment of similarity and solidarity) যা পরস্পরকে ভালোবাসতে শিক্ষা দেয়।”
  • ৭. অধ্যাপক লয়েড (Prof. Lioyd) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদকে একটি ধর্ম বলে অভিহিত করা যায়, কারণ এর উৎস মানুষের গূঢ়তম প্রবৃত্তির মধ্যে নিহিত আছে।” (Nationalism may called a religion because it is rooted in the deepest instincts of man.)
  • ৮ অ্যালফ্রেড ডি. গ্রেজিয়া (Alfred D. Gragia)-এর মতে, “জাতীয়তাবাদ দেশের প্রতি ভালোবাসা ও বিদেশিদের প্রতি সন্দেহপরায়ণতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে। দেশের প্রতি ভালোবাসা একই ধরনের মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত হয় এবং বিদেশিদের সন্দেহ করার প্রবণতা উৎসারিত হয় এই ধারণা থেকে যে তারা একই মূল্যবোধের ধারক ও বাহক নয়।” (Nationalism combines love of country and suspiciousness of foreigners. Love of country comes from shared values and suspiciousness of foreigners comes from the belief that foreigners do not share such values in the same strength.)
  • ৯. অধ্যাপক লিপসন (Leslie Lipson) বলেছেন, “রাষ্ট্র পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ও সমৃদ্ধি সাধন করতে সক্ষম হলে নাগরিকদের কাছ থেকে একটি আনুগত্যবোধ দাবি করতে পারে। এই আনুগত্যবোধ সকল শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপ্ত হলে এবং বিভিন্ন ব্যাপারে বহিঃপ্রকাশ ঘটলে তাকে জাতীয়তাবোধ নামে আখ্যা দেয়া যায়। জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে একটি বিশেষ ধরনের আবেগ ও অনুভূতি, মনোভাব, আশা, সহানুভূতি, ঘৃণা এবং আত্মিক বন্ধনের মানসিকতা প্রকাশ পায়।”
  • ১০. অধ্যাপক হ্যারল্ড জে. লাস্কি (Harold J. Laski) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ মূলত প্রত্যেক জাতীয় গোষ্ঠির নিজ বাসভূমি; নিজেদের সাদৃশ্য, অন্যের সাথে নিজেদের বৈসাদৃশ্য, বংশগত বন্ধন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।”

উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদ হলো একটি মানসিক চেতনা বা অনুভূতি যা কোনো জনগোষ্ঠিকে নিজেদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য, জীবনযাত্রা ও গৌরব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এবং নিজেদের অন্যান্য মানবজনগোষ্ঠি থেকে পৃথক ভাবতে শেখায়।

জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

জাতীয়তাবাদের ধারণা ঠিক কবে, কখন জন্মলাভ করেছিল তা সঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়। তবে ইতিহাসে জাতীয়তাবাদের উত্থান, বিকাশ ও আধুনিক ভাবধারায় জাতীয়তাবাদের পূর্বাপর যোগসূত্র তা বহুলাংশে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। চতুর্দশ শতাব্দিতে জাতীয়তাবাদের ধারণার অস্পষ্ট ও অপ্রত্যক্ষ উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তবে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দিতে জাতীয়তাবাদের প্রথম বিকাশ ঘটে। সি. ডি. বার্নস ( C .D Burns)-এর মতে, নবজাগরণ প্রসূত সার্বভৌমত্বের সাথে বৈপ্লবিক অধিকারসমূহের সমন্বয় সাধিত হওয়ার ফলে জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি হয়। (Out of Renaissance sovereignty combined with revolutionary rights comes nationalism.) তবে আধুনিক জাতীয়তাবাদকে অষ্টাদশ শতাব্দির বৈপ্লবিক যুগের সন্তান বলা যায়। এভাবে বিংশ শতাব্দির প্রথম ভাগে জাতীয়তাবাদ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়।

প্রাচীনকালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কেবল গ্রিক ও হিব্রুদের মধ্যে সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদের ধারণা গড়ে ওঠে। এরা উভয়ই পৃথিবীর নৃ-জনগোষ্ঠির মধ্যে নিজেদেরকে পৃথক ও শ্রেষ্ঠ বলে ভাবত। কালের বিবর্তনে গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোর অধঃপতন ঘটে এবং রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রোমান সাম্রাজ্য ও খ্রিস্টধর্মের অধীনে সংকীর্ণ জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের ভাব সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়ে এক বিশ্বজনীন আদর্শের উৎপত্তি হয়।

মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে থাকে। এ সময় শাসনব্যবস্থায় গির্জার কর্তৃত্ব বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন দেশে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গির্জা ও রাজার মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়ে রাজার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তখন রাজার নেতৃত্বে শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। মার (Muir)-এর মতে, সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে জাতীয়তাবাদের অনুভূতি বিকাশ লাভ করে, ইংল্যান্ড সর্বপ্রথম সংগঠিত ও সচেতনভাবে জাতীয় সত্তা অর্জন করে। রোমের সাথে ইংল্যান্ডের ধর্মীয় সংঘর্ষ ফ্রান্সের সাথে শত বর্ষব্যাপী যুদ্ধ– এ দুটো ঘটনা ব্রিটিশদের মনে তাদের স্বতন্ত্র জাতি সম্পর্কে ধারণার সৃষ্টি করে। আবার ইংল্যাণ্ড কর্তৃক ফ্রান্সকে পদানত করার চেষ্টা পঞ্চদশ শতাব্দিতে ফ্রান্সে জাতীয়তাবাদের আবেগ সঞ্চার করে। ষোড়শ শতাব্দিতে সুইডেন ও ডেনমার্কের জনগণ জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করে। ষোড়শ শতাব্দিতে দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি (Machiavelli) ইতালির জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচার করলেও জনগণ তার আহ্বানে সাড়া দেয়নি।

রেনেসাঁ বা নবজাগরণ জাতীয়তাবাদ বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। নবজাগরণের যুগে সর্বপ্রথম সার্বভৌমত্বের একটা ব্যাপক ধারণা গড়ে ওঠে। এ ধারণার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল রাজতন্ত্রের মাধ্যমে একটা স্বাধীন ও প্রতিষ্ঠিত সরকারের ধারণা সৃষ্টি এবং গোষ্ঠির নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী সুযোগ প্রদান। সি. ডি. বার্নস ( C, D Burns)-এর মতে, রেনেসাঁর সময়ে গড়ে ওঠা সার্বভৌমত্বের ধারণা মূলত একটা রাষ্ট্রীয় আদর্শ ছিল। তা কোনো জাতীয় আদর্শের ধারণা নয়। কিন্তু তার মধ্যে পরবর্তীকালের আধুনিক জাতীয়তাবাদের ধারণা সুপ্ত ছিল। (Renaissance sovereignty therefore was a state ideas rather than a national idea, but it had within it implicity the later ideal of modern nationalism.)। তার মতে, রেঁনেসা ইউরোপকে এক জাতিতে পরিণত করেনি। রেনেসাঁ ইউরোপকে বহু স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করেছিল।

মার্টিন লুথার (Martin Luther)-এর নেতৃত্বে ধর্ম সংস্কারের আন্দোলন (Reformation Movement) ইউরোপে জাতীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (National Church) এবং জাতীয় শাসকের (National Rulers) ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় রাষ্ট্রের প্রসারে সহায়তা করেছে। প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের ঐক্যকে বিনষ্ট করেছে। এ সময়ে ইল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

জাতীয়তাবাদ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে। জর্জ নোভাক (George Noveck)-এর মতে, “দীর্ঘকাল ধরে জাতীয়তাবাদের আনুষঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যের পরিস্ফুটন ঘটলেও অষ্টাদশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশকের পূর্বে আধুনিক জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেনি।” (Although its prerequisites had ripend over a longer time, modern nationalism is not much older than the second half of the eighteenth century.) প্রকৃতপক্ষে ১৭৭২ সালে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও প্রুশিয়া কর্তৃক পোল্যান্ড বিভক্ত হবার পূর্বে জাতীয়তার অনুভূতি প্রবল আকার ধারণ করেনি। অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেছেন, “আধুনিক জাতীয়তাবাদ, সংক্ষেপে বলতে গেলে, পোল্যান্ডের প্রথম বিভাজনের চেয়ে বেশি পুরোনো নয়।” (Modern Nationalism is broadly speaking, hardly older than the first partition of Poland.) পোল্যান্ডের ভাগাভাগির ফলে জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে। বাজারের পণ্যের মতো দেশের বিভিন্ন অংশ জনগণের সম্মতি ছাড়া বিক্রি হতে বা ভাগাভাগি হতে পারে না- এ দাবিই তখন উঠতে থাকে।

জাতীয়তাবাদের ধারণা পরিপূর্ণতা লাভ করে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময়। সি. ডি. বার্নস (C. D. Burns)-এর মতে, আধুনিক অর্থে জাতীয়তাবাদ বলতে যা বোঝান হয়, তা ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯)-এর মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৮৯ সালের ১ অক্টোবর সরকারের মৌলিক আদর্শের ঘোষণায় বলা হয় যে, জাতিই হলো সকল ক্ষমতার উৎস এবং একমাত্র জাতি থেকে তার উৎপত্তি ঘটতে পারে। ফরাসি বিপ্লবের সমসাময়িক দার্শনিকগণ জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বৈপ্লবিকত্ব প্রচার করেন। এর ফলে ফরাসিদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আদর্শ ক্রমে ক্রমে সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩০ সালে বেলজিয়াম একটি জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জোসেফ ম্যাৎসিনি (Joseph Mazzini) ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার করেন। ম্যাৎসিনি বলেছেন, “দেশ একটি ভূখণ্ড নয়; এটি সেই ‘ধারণা’ যা থেকে এটি জন্ম নেয়।” (Country is not a territory; it is the ‘idea’ to which it gives birth.) তিনি আরও বলেছেন, “ঐক্যবদ্ধ ইতালি শুধুমাত্র ইতালিয়ান জনগণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।” (United Italy can only be founded by the Italian people.) একই সাথে গ্যারিবন্ডি (Garibaldi)ক্যাভুর (Cavour)-এর প্রচেষ্টায় ১৮৭০ সালে ঐক্যবদ্ধ ইতালি জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৮০৭ সালে ফিকটে (Fichte) প্রচার করেছিলেন যে, জার্মানরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। ফলে জাতীয়তাবাদের চেতনায় জার্মানিতে জাতীয় ঐক্য সাধিত হয়। উনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে জাতীয়তাবাদ আক্রমণাত্মক রূপ লাভ করে।

বিংশ শতাব্দি জাতীয়তাবাদের গৌরবোজ্জ্বল যুগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার গুরুত্ব অর্জন করে এবং জাতীয়তার ভিত্তিতে বহু নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। চেক, পোল্যান্ড ও স্লাভ জাতিগুলো রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকায় জাতীয়তার ভিত্তিতে বহু জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। কোরিয়া, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বিংশ শতাব্দির পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জাতীয়তার ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রায় একশটি নতুন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।

সুতরাং বলা যায় চতুর্দশ শতাব্দিতে জাতীয়তাবাদ অনেকটা অস্পষ্ট, ঘোলাটে এবং ধোঁয়াটে মতবাদ ছিল। ষোড়শ শতাব্দিতে ম্যাকিয়াভেলি ইতালির জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচার করেন। অষ্টাদশ শতাব্দিতে জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। উনবিংশ শতাব্দিতে জাতীয়তাবাদ “রাষ্ট্রধর্ম” হিসেবে বিবেচিত হয়। বিংশ শতাব্দিতে জাতীয়তাবাদ পরিপূর্ণ বিকশিত হয়। জাতীয়তাবাদের বিকাশের ধারা আজও অব্যাহত আছে।

জাতীয়তাবাদের উপাদান বা জাতি গঠনের উপাদান (Elements of Nationalism)

যে সব উপাদান সম্মিলিতভাবে কোনো জনসমষ্টিকে জাতীয়তায় রূপান্তরিত করে, সেগুলোকে জাতীয়তার উপাদান বলে। অধ্যাপক লাস্কি (Laski)-এর মতে, “জাতীয়তার ধারণা সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কারণ কোনো বিশেষ উপাদানের মধ্যে তার উৎস খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।” (The idea of nationality is not easy to define, for there is no measurable factor to which it can be traced.)

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ জাতীয়তার উপাদানসমূহকে প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- ক. বাহ্যিক উপাদান ও খ. ভাবগত বা মানসিক উপাদান। বংশ, ভাষা, ভৌগোলিক, ইতিহাস, ধর্মগত ঐক্য প্রভৃতি উপাদান বাহ্যিক দিক থেকে জাতীয়তা গঠনে সহায়তা করে। আর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, অর্থনৈতিক সমস্বার্থ, অতীত এবং বর্তমানের ঐতিহ্য সম্পর্কে সমচিন্তা, অতীতের গৌরব, বীরত্ব, সুখ-দুঃখ, অভাব- অভিযোগ সম্পর্কে অভিন্ন অনুভূতি নিয়ে জাতীয়তার মানসিক বা ভাবগত উপাদান গঠিত হয়।

  • ১. বংশগত বা কুলগত ঐক্য (Racial Unity): যখন কোনো জনসমষ্টি মনে করে যে, তাদের দেহের শিরা ও ধমনীতে একই রক্তধারা প্রবাহিত এবং তারা একই পূর্বপুরুষের বংশধর তখন তাদের মধ্যে একাত্মবোধের ধারণা জন্মে। তারা অন্যান্য জনসমষ্টি থেকে নিজেদেরকে পৃথক মনে করে, এভাবে বংশগত ঐক্য জাতীয়তা সৃষ্টি করে। অধ্যাপক বার্জেস ও লীক বংশগত বা কুলগত ঐক্যকে জাতীয়তার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গণ্য করেছেন। অধ্যাপক জিম্মার্ন (Zimmern)-ও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। তার মতে, “Every nationality enjoys the feeling of group institution which is primarily determined by racial unity and the purity of blood.” তবে বংশগত ঐক্যকে জাতীয়তা গঠনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গণ্য করা যায় না। যেমন- ইংরেজ, জার্মান ও ডাচদের মধ্যে বংশগত ঐক্য থাকলেও তারা আলাদা জাতীয়তায় পরিণত হয়েছে। আবার আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, কানাডা, ভারত প্রভৃতি দেশের জনসমষ্টির মধ্যে বংশগত ঐক্য না থাকা সত্ত্বেও তারা এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক গিলক্রাইস্ট (Gilchirst) তাই বলেছেন, “একটি জাতীয়তা খাঁটি পারিবারিক বংশধারা হিসেবে গণ্য করা যায় না।” (A nationality cannot be regarded as a pure family descent.)
  • ২. ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য (Community of language, literature and culture): ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি মনের ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন বা মাধ্যম। এগুলোর মাধ্যমে মানুষ ভাবের আদান-প্রদান করে এবং পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। ভাষার মাধ্যমে নিজেদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণা প্রকাশিত হয়। একই ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জনসমাজের মধ্যে একাত্মবোধ সৃষ্টি করে। যেমন- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে সহায়তা করেছিল। রামজে ম্যুর (Ramsay Muir)-এর মতে, “জাতীয়তা সংগঠনের ক্ষেত্রে ভাষাগত ঐক্য বংশগত ঐক্য অপেক্ষা অধিক সহায়ক।” তার ভাষায়, “কোনও ভিন্ন জাতিকে একত্রিত করার মতো একটি সাধারণ ভাষার ব্যবহারের মতো কিছু নেই এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার ঐক্য এবং এটি যে চিন্তাধারার সম্প্রদায় তৈরি করে তা একটি জাতি গঠনের শক্তি প্রমাণিত হয়েছে।” (There is nothing that will give unity to divergent races as the use of common tongue and in very many causes unity of language and community of ideas which it brings have proved the nation building force in a nation.) ভাষা কোনো জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতি গঠনে সহায়তা করে। অধ্যাপক গার্নার (Garmer) বলেন, “ভাষিক সম্প্রদায় একটি জাতিকে জাতীয়তায় গড়ে তোলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ।” (Community of language is the most important factor in moulding a people into a nationality.) তবে সাংস্কৃতিক ঐক্যও কোনো জনগোষ্ঠিকে অন্যান্য মানবজনগোষ্ঠি থেকে পৃথক করে। তবে ভাষাগত ঐক্য জাতীয়তার একমাত্র উপাদান নয়। সুইজারল্যান্ডে তিনটি ভাষাভাষীর মানুষ বাস করা সত্ত্বেও তারা এক জাতি। বহু ভাষা-ভাষী ভারতবাসীরা একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। আবার ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার জনগণ ইংরেজি ভাষায় কথা বললেও তারা ভিন্ন জাতি।
  • ৩. আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য (Community of behaviour, manners and customs): জাতীয়তার একটি অপরিহার্য উপাদান হলো আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য। একটি জনসমষ্টির মধ্যে একই ধরনের আচরণ ও রীতি-নীতি গড়ে উঠলে তারা নিজেদেরকে অন্য জনসমষ্টি থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। ফলে আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য জনসমষ্টিকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে। বাংলাদেশের জনসমষ্টি তাদের আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্যের কারণে যুক্ত পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য না থাকায় উত্তর আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সুতরাং আচরণ ও রীতি-নীতিগত ঐক্য বিভিন্ন জনগোষ্ঠিকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে। আচরণ ও রীতি-নীতিগত মিল না থাকলে জাতীয়তা গড়ে ওঠে না।
  • ৪. ধর্মগত ঐক্য (Religious Unity): ধর্মগত ঐক্য জাতীয়তা গঠনে বিশেষভাবে সহায়তা করে। সম ধর্মমতাবলম্বী জনসমষ্টির মধ্যে খুব সহজে ঐক্যের মানসিকতা গড়ে ওঠে। ধর্মের ভিত্তিতে প্রাচীন ও মধ্যযুগে অনেক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। আধুনিক কালেও ধর্মের গুরুত্ব একেবারে হ্রাস পায়নি। ধর্মের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। আরব জাতীয়তাবাদ ধর্মের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অধ্যাপক গার্নার (Garner) বলেন, “ধর্মের সম্প্রদায় এক সময় জাতীয়তার চিহ্ন হিসেবে গণ্য হতো এবং পূর্বের সময়ে এটি জাতীয় ঐক্যবদ্ধতার প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।” (Community of religion was once regarded as a mark of nationality and in earlier times it played an important part in the process of national consolidation.” ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল ধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তবে জাতীয়তাবাদ গঠনে ধর্মগত ঐক্য অত্যাবশ্যক উপাদান নয়। যেমন- ধর্মগত ঐক্য থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ নামক পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আবার মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর জনসমষ্টি একই ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও তারা আলাদা জাতিতে পরিণত হয়েছে। আধুনিককালে জাতি গঠনে ধর্মের ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে।
  • ৫. ভৌগোলিক ঐক্য (Geographical Unity): একই ভূখণ্ডে বহুদিন ধরে যদি কোনো জনসমষ্টি বাস করতে থাকে, তবে তাদের মধ্যে গভীর ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। একই ভৌগোলিক সীমায় বসবাসের দরুন আদান-প্রদানের মাধ্যমে জনসমষ্টির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে পরস্পর একাত্মতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। রামজে ম্যুর (Ramsay Muir) বলেছেন, “একটি স্বতন্ত্র জাতি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করে। দীর্ঘদিন যাবৎ একটি ভূখণ্ডে বাস করার ফলে একটি জনসমাজ তাদের মতপার্থক্য দূর করে এক এবং অভিন্ন ভাবধারায় গড়ে ওঠে।” তার ভাষায়, “সন্দেহাতীতভাবে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত জাতিগুলি একটি ভৌগোলিক ঐক্য উপভোগ করেছে এবং তাদের জাতীয়তার মালিকানা আংশিকভাবে এই তথ্যের কাছে স্বীকৃত হয়েছে।” (Undoubtedly the most clearly marked nations have enjoyed a geographical unity and have owned their nationhood is part to these facts.) ভৌগোলিক দূরত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা জাতি গঠনে বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করে। যেমন ভৌগোলিক অবাস্তবতার কারণে ১৯৭১ সালে যুক্ত পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু জাতীয়তা গঠনে ভৌগোলিক ঐক্য অপরিহার্য উপাদান নয়। যেমন- ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার আগে ইহুদিরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করত। কিন্তু তারা নিজেদের একই জাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করত।
  • ৬. ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঐক্য (Common history and heritage): কোনো ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠি যদি মনে করে যে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অভিন্ন এবং তারা সুখ-দুঃখ, হাসি- কান্না, গৌরব-গ্লানির সমান অংশীদার তখন সেই জনগোষ্ঠির মধ্যে জাতীয়তা জাগ্রত হয়। প্রত্যেক জাতি তার অতীত স্মৃতি ও ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখে। এভাবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অভিন্নতা জাতীয়তা গঠনে সাহায্য করে। জন স্টুয়ার্ট মিল ও রামজে ম্যুর ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত ঐক্যকে জাতীয়তার আবশ্যক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রামজে ম্যুর (Ramsay Muir) বলেছেন, “বীরত্বপূর্ণ অর্জন, যন্ত্রণা, বীরত্বপূর্ণভাবে কষ্ট সহ্য করা, এগুলি হলো উচ্চদরের খাদ্য যা দ্বারা জাতীয়তাবোধের আত্মা পুষ্ট হয়।” (Heroic achievements, agonies, heroically endured, these are the sublime food by which the spirit of nationhood is nourished.) ইতিহাসের উপকথা, ঘটনাপঞ্জি, বীরত্বগাথা মানুষকে প্রেরণা দেয় এবং তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে। কোনো জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য জাতীয়তা গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। যেমন- ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভিন্নতার কারণে বাঙালি জনগোষ্ঠি পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে নিজেদের পৃথক বলে মনে করে এবং এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।
  • ৭. রাজনৈতিক ঐক্য (Political unity): কোনো জনসমষ্টি দীর্ঘদিন ধরে একই সরকারের অধীনে থাকলে এবং অভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বারা অনুপ্রাণিত হলে তাদের মধ্যে একাত্মবোধ সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে বংশ, ভাষা, ধর্মগত পার্থক্য কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। রাজনৈতিক ঐক্য একই বংশ, ভাষা ও ধর্মগত উপাদানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক জাতি এই উপাদানের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তবে জনসমষ্টির মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া জাতীয়তা গড়ে উঠতে পারে না। আর জাতীয়তা রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে জাতিতে পরিণত হয়। জার্মানরা উনবিংশ শতাব্দিতে অস্ট্রিয়ার অধীনে বসবাস করে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জার্মান রাষ্ট্র গঠন করে। দীর্ঘকাল ধরে ব্রিটিশ সরকারের শাসনাধীনে থাকায় ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও স্কটল্যান্ডের জনসমষ্টি একই জাতীয়তায় পরিণত হয়েছে। ডুর্খেইম (Durkheim) বলেছেন, “একটি জাতীয়তা এমন একটি গোষ্ঠী যার সদস্যরা একই আইনের অধীনে বাস করতে এবং একটি রাষ্ট্রের আকার গঠন করতে চান।” (A nationality is a group of which the members. – wish to live under the same laws and form of a state.) সুতরাং রাজনৈতিক ঐক্য জাতীয়তা গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অধ্যাপক অরগ্যানস্কি (Organski) তাই বলেন, “একদল ব্যক্তিকে একটি জাতি হিসেবে বেঁধে রাখতে রাজনৈতিক বন্ধনের গুরুত্ব অতিরঞ্জিত করা কঠিন।” (It is hard to overestimate the importance of political ties in binding a group of individuals into a nation.” এই রাজনৈতিক ঐক্য ও জাতীয়তা গঠনের অত্যাবশ্যক উপাদান নয়। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগে ইহুদিরা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের অধীনে বসবাস করত। রাজনৈতিক ঐক্য তাদের মধ্যে ছিল না। তবুও তারা নিজেদের পৃথক জাতি বলে গণ্য করত।
  • ৮. অর্থনৈতিক ঐক্য (Economic Unity): কোনো জনসমষ্টির মধ্যে একই ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন জাতীয়তা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে কোনো জনসমষ্টি সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে একই ধরনের অর্থনৈতিক বন্ধন থাকায় তারা এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তারা পাকিস্তানের কাছে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে। পরবর্তীতে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।
  • ৯. একই স্বার্থ (Common interests): জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে একই স্বার্থ। একই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কৃষ্টিগত স্বার্থ কোনো অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার প্রেরণা যোগায়। জনগণের স্বার্থ অভিন্ন হলে তারা একত্রে কাজ করতে উৎসাহ ও আনন্দ পায়। অধ্যাপক গিলক্রাইস্ট (Gilchirst) বলেন, “সাধারণ আগ্রহসমূহ মূলত সংঘের ঐক্যকে শক্তিশালী করার সহায়ক অপেক্ষা ঐক্যের মৌলিক কারণ নয়।” (Common interests are rather aids towards strengtheing union than fundamental agents of union.) একই সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ইংলিশ ও স্কচদের একতাবদ্ধ করেছিল। তবে একই স্বার্থ জাতীয়তা গঠনের অপরিহার্য উপাদান নয়। ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু মুসলিমদের অভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলেও ১৯৪৭ সালে ভারত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
  • ১০. ভাবগত বা আত্মিক ঐক্য (Spiritual Unity): জাতীয়তা গঠনের ক্ষেত্রে ভাবগত বা আত্মিক ঐক্য মুখ্য ও প্রধান ভূমিকা পালন করে। অধ্যাপক গেটেল (Gettell) বলেছেন, “আধুনিক রাষ্ট্রের ঐক্যের ভিত্তি বাহ্যিক নয় বরং মনস্তাত্ত্বিক।” (The basis of unit in modern state is psychological rather than physical). ফরাসি অধ্যাপক রেনান (Renan) যথার্থই বলেছেন, “জাতীয়তা সম্পর্কে ধারণা মূলত ভাবগত।” (The idea of nationality is essentially spiritual in character.) জাতীয়তার বাহ্যিক উপাদানের সব কয়টি ছাড়াও কোনো জনসমষ্টির মধ্যে জাতীয়তা গড়ে উঠতে পারে যদি তারা নিজেদের এক মনে করে এবং অন্য জনসমষ্টি থেকে পৃথক ভাবতে শেখে। তাই জিম্মার্ন (Zimmern) বলেন, “যদি কোনো জনসমষ্টি নিজেদেরকে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করে সেটাই জাতীয়তা।” (If a people feels itself to be a nationality, it is a nationality.) জাতীয়তা মূলত একটি মানসিক অবস্থা। জিম্মার্ন (Zimmern)-এর মতে, অনুভূতি, চিন্তা এবং জীবনধারণের পদ্ধতি নিয়ে ঐ মানসিক অবস্থা তৈরি হয়। অধ্যাপক গেটেল (Gettell) বলেছেন, “জাতীয়তা আসলে একটি ভাবগত ব্যাপার। একটি মানসিক অবস্থা, জীবন-যাপন চিন্তা এবং অনুভূতির একটি পদ্ধতি।” (Nationality, therefore, is largely a matter of sentiment, it is a state of mind, a way of living, thinking and feeling.)

পরিশেষে বলা যায়, জাতীয়তা গঠনে সকল উপাদান সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে জাতীয়তার কোনো না কোনো উপাদান মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভারতবর্ষ দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক ভিত্তি ছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক। পরবর্তীকালে তার সাথে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দাবি যুক্ত হয়। সুতরাং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত বাঙালি জনগোষ্ঠির মধ্যে পৃথক জাতীয়তার ধারণা গড়ে ওঠে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

জাতীয়তাবাদ কি আধুনিক সভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ

রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে জাতীয়তাবাদ জাতীয় সার্বভৌমত্ব, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিটি জাতির স্বকীয় সত্তা এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশে অকুন্ঠ অনুপ্রেরণার সঞ্চার ঘটিয়ে এক নব অধ্যায়ের সূচনা করেছে। অপরদিকে, অন্ধ স্বদেশপ্রেম, জাতিগত সংকীর্ণতা, অন্য জাতির প্রতি বিদ্বেষ, জাত্যাভিমান, জাতিগত প্রাধান্য বিস্তারের লোলুপতা, জাতির শৌর্য-বীর্য প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য রাষ্ট্র দখল প্রভৃতির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ বারবার সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে। জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একদিকে যেমন প্রত্যেক জাতি পরাধীনতা এবং শোষণের শৃঙ্খল ভেদ করে স্বাধীন হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি প্রকট জাতি বিদ্বেষের মাধ্যমে, সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ সিদ্ধির সাহায্যে মানবজাতির বিকাশের ধারাকে ব্যাহত করেছে। এসব কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচিত জাতীয়তাবাদে দুটি রূপ দেখা যায়। একটি হলো জাতীয়তাবাদের প্রকৃত রূপ যার ফলে একটি জাতি মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীন সত্তাকে উপভোগ করায় সুযোগ পায়। আরেকটি হলো জাতীয়তাবাদের বিকৃত রূপ যার দংশনে একটি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ধারণ করে। আর তখনই জাতীয়তাবাদ সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাই বলা হয়ে থাকে “Nationalism is a menance to civilization.” অর্থাৎ “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার পথে একটি হুমকি।” অধ্যাপক লাস্কির (Laski) মতে, “যখন জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন, অর্থাৎ সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবি জানায়, তখন সভ্যতার প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ পেতে শুরু করে।” (When nationalism demands political autonomy, that is, sovereign state, the needs of civilization begin to emerge.) প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদ সভ্যতার পথে হুমকি কি-না সেটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

জাতীয়তাবাদের প্রকৃত রূপ: জাতীয়তাবাদের প্রকৃত রূপ সভ্যতার প্রতি হুমকি নয় বরং আশীর্বাদ। আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানুষের সুসভ্য জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো:

  • ১. জাতির সার্বিক বিকাশের সহায়ক: জীবনে জাতীয়তাবাদ একটি সুমহান আদর্শ। এটি জাতিকে ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে এবং দেশপ্রেমে জাগ্রত করে। এই আদর্শ দেশ ও জাতির স্বার্থে জনগণকে আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করে। এভাবে জাতির সার্বিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।
  • ২. ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে: জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক ধারণা এবং একটি আত্মিক অনুভূতি। জাতীয়তাবাদের চেতনা জাতির মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে। এই আদর্শ জাতিকে আত্মপ্রীতি এবং আত্মপ্রত্যয়ের শিক্ষা দেয়। এটি একটি জনসমাজকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা যোগায়।
  • ৩. মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করে: জাতীয়তাবাদের জনক ইতালির দার্শনিক ম্যাৎসিনি (Mazzini)-এর মতে, বিভিন্ন গুণ ও প্রতিভার বিকাশ সাধনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করে। বিশ্বের প্রত্যেক জাতির কোনো না কোনো নিজস্ব কিছু গুণ থাকে। জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে এসব গুণের বিকাশ ঘটে। এভাবে প্রত্যেক জাতির গুণাবলির বিকাশের মাধ্যমে মানবসভ্যতা সমৃদ্ধ ও উন্নত হয়। ম্যাৎসিনি সম্পর্কে লয়েড (Lioyd) বলেছেন, “তিনি মনে করতেন প্রতিটি জাতি নির্দিষ্ট কিছু প্রতিভা অধিকার করে, যা একত্রে মিলিত হয়ে মানব জাতির সম্পদ গঠন করে।” (He thought each nation possessed certain talents, which taken together formed the wealth of the human race.)
  • ৪. স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দীপক: পরাধীন জাতির কাছে জাতীয়তাবাদ আশীর্বাদস্বরূপ, জাতীয়তাবাদের সুমহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরাধীন ও দুর্বল জাতি মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলা যায়। জাতীয়তাবাদ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার জাতিসমূহকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করেছে। তাছাড়া জাতীয়তাবাদ এবং প্যান-আফ্রিকানিজম সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগ্রামে ইন্ধন যুগিয়েছে।
  • ৫. পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় হয় : জাতীয়তাবাদ জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত ও সংঘর্ষের আশঙ্কা দূর করে এবং সহযোগিতা ও সম্প্রীতির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জাতিসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবর্তে সৌভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যবোধ জাগ্রত হয়। আদর্শ জাতীয়তাবাদ কোনো জাতির বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব রক্ষার পরিবর্তে অন্যান্য জাতির সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এভাবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির মাধ্যমে প্রত্যেকের উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। জাতীয়তাবাদের মূল কথাই হলো- “নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচতে দাও।” (Live and let others live)
  • ৬. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক: জাতীয়তাবাদ গণতান্ত্রিক চেতনা ও অধিকারের বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠির নিজ ইচ্ছানুযায়ী আত্মবিকাশের অধিকার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তাই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জনগণ সম অংশীদারিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
  • ৭. দেশপ্রেম জাগ্রত করে: জাতীয়তাবাদের আদর্শ জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করে। এটা বীরত্ব ও আত্মত্যাগ সৃষ্টি করে। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ মানুষের মন থেকে স্বার্থপরতা দূর করে জাতীয় স্বার্থে কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগায়। এটি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশ মাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহী করে।
  • ৮. অভ্যন্তরীণ স্থায়িত্বের সহায়ক: জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে জনগণ অতি সহজেই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। জনগণের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ, হিংসা, দ্বেষ প্রভৃতি দূরীভূত হয়। ফলে রাষ্ট্রকে তারা নিজের বলে ভাবতে শেখে।
  • ৯. বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায়: জাতীয়তাবাদ অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানের সাথে সাথে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জনগণকে অনুপ্রাণিত করে। জাতীয়তাবাদ উদারতাবাদ ও মানবতাবাদী দর্শন বিকাশে সহায়তা করে। বিশ্বশান্তির পথ প্রশস্ত করে। শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তুলতে জাতীয়তাবাদী আদর্শের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।
  • ১০. শাসক ও শাসিতের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক: প্রকৃত জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের মধ্যে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক করে। এটি শাসক ও শাসিতের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করে সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। অধ্যাপক বার্জেস (Burgess)-এর মতে, জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বকে দৃঢ় করে এবং সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যে সংহতি স্থাপন করে।
  • ১১. সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ রোধ: জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদঔপনিবেশিকতাবাদকে প্রতিহত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। এ সকল দেশ সাম্রাজ্যবাদের শিকল ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জন করে।
  • ১২. আন্তর্জাতিকতার পরিপুরক: জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের সহায়ক ও পরিপূরক। এটি জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি সমুন্নত রেখে বিশ্ব সভ্যতার প্রসারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রথম সোপান। এ প্রসঙ্গে জিম্মার্ন (Zimmern) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে যাবার জন্য একটি মহাসড়ক।” (Nationalism is a high way to internationalism.)

জাতীয়তাবাদের বিকৃত রূপ: জাতীয়তাবাদ একটি সুমহান রাজনৈতিক আদর্শ সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এর বিকৃত রূপ মানবসভ্যতার জন্য খুবই ভয়ঙ্কর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার “Nationalism” গ্রন্থে জাতীয়তাবাদকে নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার জন্য একটি হুমকি।” (Nationalism is a menace to civilization.) নিম্নে জাতীয়তাবাদের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাসমূহ আলোচনা করা হলো:

  • ১. সভ্যতার সংকট: স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি গভীর অনুরাগের ফলে জাতীয়তাবাদ, জাত্যাভিমানে পরিণত হয়। তারা নিজেদের সকল কিছুকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে এবং অন্য জাতির সকল কিছুকে হেয় প্রতিপন্ন করে। এক সময় গ্রিকগণ মনে করত তারাই পৃথিবীতে সভ্য জাতি। অপর জাতিগুলো হলো দাস। জার্মানরা নিজেদেরকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করত। সুতরাং অন্যান্য জাতির উপর প্রভুত্ব করার অধিকার তাদের আছে। এভাবে জাতীয়তাবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়, এর ফলে জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ বাধে এবং দেখা দেয় সভ্যতার সংকট। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মতে, “এই সংকট দূরীকরণের জন্য প্রয়োজন হলো জাতি ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত সমগ্র ধারণাকে পরিহার করা।” (I am not against one nation in particular, but against general idea of all nations.”)
  • ২. সাম্রাজ্যবাদের আশঙ্কা: উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রসারের ফলে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের পথে অগ্রসর হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদের তাড়নায় অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দুর্বল জাতিগুলোকে পদানত করতে প্রয়াসী হয়। এ ধরনের জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলোর মনে বিশ্বাস জন্মায় যে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতির উপর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কায়েম করার স্বাভাবিক অধিকার তাদের রয়েছে। কালক্রমে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত হয়। অধ্যাপক লাস্কির (Laski) মতে, “ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়।” (As power extends, nationalism becomes transformed into imperialism). পুঁজিবাদের প্রসারের সাথে জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। এভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দুর্বল ও অনুন্নত জাতিগুলো শোষণের শিকারে পরিণত হয়। রাষ্ট্রচিন্তাবিদ লেনিন (Lenin) তার সাম্রাজ্যবাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, পুঁজিবাদ নিজের স্বার্থ সংরক্ষণার্থে দেশের জনগণকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নকরূপে ব্যবহার করে।
  • ৩. জাতি বিদ্বেষে পরিণত হয়: বিকৃত জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বন্ধনকে ছিন্ন করে জাতিবিদ্বেষে পরিণত হয়। অন্ধ স্বদেশপ্রেম অন্য জাতির প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসার ইন্ধন যুগিয়েছে। বিকৃত জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে নিজ জাতি সম্পর্কে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা এবং অন্য জাতির কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রতি ঘৃণার মনোভাব বারবার আত্মপ্রকাশ করেছে। ফিকটে প্রচার করেছিলেন জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা। তিনি প্রচার করেন যে, জার্মান জাতিই মানব জাতির পথ প্রদর্শক ও আদর্শ। ইংরেজ কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর “শ্বেতাঙ্গের বোঝা” (Whitemen’s burden) কিংবা নরডিক বংশের শ্রেষ্ঠত্ব (Superiority of the Nordic Race)-এর কথা প্রচার করে হিটলার তাদের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করেছিলেন।
  • ৪. যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে: উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। চরম জাতীয়তাবাদের পরিণতি হলো যুদ্ধ। যেমন- জার্মান উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধে। তাই জাতীয়তাবাদের বিকৃত রূপ কোনো অর্থে জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। এডলফ হিটলার বলতেন, “যুদ্ধই জীবন, যুদ্ধই শাশ্বত” (War is life, war is eternal)। ইতালির একনায়ক মুসোলিনী বলতেন, “নারী জাতির নিকট মাতৃত্ব যেমন স্বাভাবিক, পুরুষের নিকট যুদ্ধও তেমনি স্বাভাবিক।” আধুনিক যুগে যুদ্ধের অর্থই সামগ্রিক ধ্বংসকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (Bartrand Russell)-এর বক্তব্য হলো, “হয় মানুষ যুদ্ধকে ধ্বংস করবে, নয়তো যুদ্ধই মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।” (Either man will abolish war, or war will abolish man), অধ্যাপক হায়েস (Hayes) বলেছেন, “আধুনিক জাতীয়তাবাদ একটি অভিনব ধর্মে পরিণত হয়েছে। ব্যাপকভাবে মধ্যযুগের চারশ বছরের ক্রুসেড থেকে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বর্তমান প্রথমার্ধের জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে।” (Modern nationalism has indeed been a peculiar bloody religon. Vastly more persons have been slained in the nationalist wars of the first half of the present century than in the four centuries of medieaval crusading.)
  • ৫. অন্যায়-অবিচারের উৎস: বিকৃত জাতীয়তাবাদকে অন্যায় ও অমঙ্গলের উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। অধ্যাপক হায়েস (Hayes) মন্তব্য করেছেন যে, আমাদের যুগে জাতীয়তাবোধ, জাতীয় রাষ্ট্র ও দেশপ্রেমের সংমিশ্রণে যে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয়েছে তা চরম, অন্যায় ও অমঙ্গলের প্রধান উৎসস্থলে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ন্যায়-নীতি ও আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জাতীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো সম্পূর্ণ আইন বিরুদ্ধভাবে কাজ করে চলে। অসভ্য বর্বর ভারতীয়দের শিক্ষিত ও সুসভ্য করার মহান দায়িত্বের কথা ইংরেজরা প্রচার করেছে। অন্যায় ও অমঙ্গল প্রতিষ্ঠাকারী ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদকে বঙ্কিমচন্দ্র “ঘোরতর পৈশাচিক পাপ” বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন।
  • ৬. অগণতান্ত্রিক: জাতীয়তবাদের উগ্র হিংস্র ও বীভৎস প্রকাশ গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও সমগ্র মানবিক চেতনার পরিপন্থী। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগুলো সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা গণতন্ত্রের এই সুমহান, নীতিগুলোকে ধ্বংস করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকটস্বরূপ।” (Nationalism is a menance to civilization) অধ্যাপক ইবেনস্টাইন (Ebenstain)-এর মতে, “ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে জাতীয়তাবাদ, অভ্যন্তরীণ, সাম্রাজ্যবাদী ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।”
  • ৭. বিশ্ব শান্তির বিরোধী: উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিক শাস্তির পক্ষে ক্ষতিকর। স্বদেশপ্রীতি খারাপ কিছু নয়। কিন্তু অপর দেশকে ঘৃণা করা বা অপর দেশের স্বার্থ নষ্ট করার কাজ জাতীয়তাবাদ হতে পারে না। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ বিশ্ব শান্তির পরিপন্থী। ফরাসি ও জার্মানিদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণাবোধ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ। উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা মুসোলিনী বলেছেন, “আন্তর্জাতিক শান্তি কাপুরুষের স্বপ্ন।” (International peace is a cowards dream).
  • ৮. সংকীর্ণতার সৃষ্টি করে: বিকৃত জাতীয়তাবাদ প্রতিটি জাতির মধ্যে সংকীর্ণতার সৃষ্টি করে। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ অন্ধ আবেগ ও উন্মাদনা সৃষ্টি করে। এর ফলে অন্যান্য জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার মানসিকতা বিনষ্ট করে দেয়। একটি জাতির নিজস্ব যা কিছু আছে তার বাইরে তারা কিছুই শিখতে বা জানতে পারে না।
  • ৯. অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করে: জাতীয়তাবাদ বিশ্ব জুড়ে অনৈক্য ও বিভেদের সৃষ্টি করে এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের এবং জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ ও কলহের জন্ম দেয়। জাতীয়তাবাদী চেতনা বড় বড় রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সৃষ্টি করে। যেসব রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিজনগোষ্ঠির লোক বসবাস করে সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করে। ভারত, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশে এ ধরনের সমস্যা বিদ্যমান।
  • ১০. অনৈতিহাসিক: অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, জাতীয়তাবাদের কোনো ঐতিহ্যসিক ভিত্তি নেই। জোসেফ বলেছেন, “এটি মূলনীতির দিক দিয়ে বিপজ্জনক এবং বিশ্ব প্রগতিতে প্রধান বাধা সৃষ্টি করে।” (It is dangerous in principle and constituted chief obstacle to world progress.) লর্ড অ্যাকটন বলেছেন, “এটা জাতির অধিকার ও ইচ্ছাকে পদদলিত করে।” (It over-rules the rights and wishes of the inhabitants) সুতরাং জাতীয়তাবাদ জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করে তার কোনো ঐতিহ্যসিক ভিত্তি নেই।
  • ১১. সুস্থ মানবিক সংস্কৃতি বিকাশের বিরোধী: উগ্র জাতীয়তাবাদ সমগ্র মানব জাতির মানবিক গুণাবলি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাদের সৃজনশীল বিকাশের পর রুদ্ধ করে দেয়। এরূপ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের শাসক গোষ্ঠি নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নিজেদের দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চায়। অপরদিকে অন্য জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অসত্য ও বিকৃত ধারণা গড়ে তোলে। এভাবে সুস্থ ও সাবলীল সংস্কৃতির বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। ফলে মানবসভ্যতা সংকটের আবর্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
  • ১২. মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা: উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ একদিকে ক্ষুধার তাড়নায় জর্জরিত, অন্যদিকে চলছে মারণাস্ত্রের তীব্র প্রতিযোগিতা। এভাবে মানবিক মূল্যবোধ ও মানবতা পদদলিত হয়।
  • ১৩. অর্থনৈতিক শোষণ: জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ অর্থনৈতিক শোষণের পথকে উন্মুক্ত করে দেয়। বর্তমানে বিত্তশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর শাসক শ্রেণি বিভিন্ন দুর্বল ও অনগ্রসর জাতিকে অর্থ সাহায্যের নামে তাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে শোষণ করতে থাকে। এসব রাষ্ট্র বৃহৎ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর উপর অর্থনৈতিক দিক থেকে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এরূপ অর্থনৈতিক শোষণকে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ (Economic Imperialism) বলে। অর্থনৈতিক দিক থেকে নির্ভরশীল জাতি রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে।
  • ১৪. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উদ্ভব: জাতীয়তাবাদ প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে। কিন্তু প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করলে প্রতিটি বড় রাষ্ট্রই শতধাবিভক্ত রাষ্ট্র হতে বাধ্য। যেমন- ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডেই আরও ক্ষুদ্রাকৃতির তিনটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হবে। যুক্তরাজ্য চার ভাগে বিভক্ত হবে। তাহলে বিশ্ব জুড়ে জটিল রাজনৈতিক সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানব সভ্যতার সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়ে মানবসভ্যতার সংকট সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ যদি সত্যিকার দেশপ্রেম থেকে আসে, তবে তা মানব সভ্যতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায় না। জাতীয়তাবাদ বিশ্ব সভ্যতা ও বিশ্ব শান্তির সহায়ক। অধ্যাপক হায়েস (Hayes) বলেন, “জাতীয়তাবাদ যদি দেশপ্রেমের সাথে সম্পৃক্ত হয় তা হলে তা মানব জাতি ও বিশ্বের জন্যকল্যাণ বয়ে আনবে।” (Nationalisin when it becomes synonymous with purest patriotism will prove a unique blessing to humanity to the world.)

তথ্যসূত্র 

  • শাসনের সমস্যাবলি, মাসুম মিল্লাত মজুমদার, এন এস পাবলিকেশন্স

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.