পোল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদ (১৭৭২-১৭৯৫)

ষোড়শ শতকে পোল্যান্ড ইউরোপে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। এক সময় পোল্যান্ড রাশিয়া ও সুইডেনের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে পোল্যান্ড ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে এমনকি তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়। পোল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী রাশিয়া, প্রাশিয়া ও সুইডেন পোল্যান্ডকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ফলে ইউরোপের মানচিত্র থেকে পোল্যান্ডের অস্তিত্ব মুছে যায়।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের পটভূমি

  • মধ্যযুগে পোল্যান্ডের সাম্রাজ্য বাল্টিক সাগর থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পোল্যান্ডের রাজপদ ছিল নির্বাচনমূলক। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত জাগেলো রাজবংশ পুরুষানুক্রমে পোল্যান্ড শাসন করত। ১৫৭০ সালে জাগেলো বংশ উচ্ছেদ হলে পোল্যান্ডের রাজপদ নিয়ে গোলযোগের শুরু হয়। পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো নিজেদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে পোল্যান্ডের সিংহাসনে বসানোর জন্য চেষ্টা করত। দুর্নীতিপরায়ণ অভিজাত শ্রেণি এ নির্বাচনমূলক রাজপদ নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতো। তারা বিদেশী রাজগণের নিকট থেকে অর্থ সাহায্য গ্রহণ করে তাদের মনোনীত প্রার্থীদের স্বপক্ষে নির্বাচন প্রভাবিত করতে দ্বিধা করত না।
  • পোল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণি প্রভাবশালী হওয়ায় পোল্যান্ডে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। যার ফলে রাজতন্ত্রের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে স্বার্থপর অভিজাত সম্প্রদায় তাদের স্বার্থবৃদ্ধিতে মনোযোগী থাকত। অভিজাতদের শোষণে কৃষকরা ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিল। একমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে ডানজিক শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা অভিজাত সম্প্রদায়ের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো যোগ্য ছিলেন না।
  • দুর্নীতির কারণে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভিজাতরা ছিল খুবই শক্তিশালী। ডায়েট নামক (diet) কেন্দ্রীয় আইনসভায় অভিজাতদের একচেটিয়া স্থান ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে লিবেরাম ভেটো নামে এক প্রকার ভেটো প্ৰথা চালু ছিল। যে কোনো সদস্যই পরিষদের কার্যাবলিকে ভেটো দ্বারা বাতিল করতে পারতেন। যার ফলে পোল্যান্ডের ডায়েটে যে কোনো আইন পাস করা সহজ ছিল না। এটি ছাড়া ডায়েটের যে কোনো অভিজাত সদস্য ইচ্ছা করলে ডায়েটের অধিবেশন ভেঙে দিতে বা ডায়েট কর্তৃক গৃহীত যে কোনো আইন নাকচ করতে পারতেন।
  • পোল্যান্ডের জাতীয় অনৈক্য এর দুর্বলতার একটি অন্যতম কারণ ছিল। পোল্যান্ডের লোকসংখ্যা ছিল খুবই কম। এ অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যে বহু সম্প্রদায় ছিল। যেমন : লিথুনিয়ান, ইহুদি, রুমেনিয়ান ইত্যাদি। তারা প্রত্যেকেই নিজেদেরকে পৃথক জাতি হিসেবে মনে করত। এ মনোভাব ধর্মীয় মতবিরোধে আরো প্রকট হয়েছিল। পোল্যান্ডের অনেকেই পোল্যান্ডের জাতীয় চার্চের ক্যাথলিক ধর্ম না মেনে গ্রিক অর্থডক্স চার্চের বিধান মেনে চলত। প্রোটেস্ট্যান্টগণ পোল্যান্ডের শাসক অপেক্ষা প্রাশিয়ার শাসককে আপন মনে করত। অর্থডক্স চার্চের অনুসারীরা রাশিয়ার প্রতি আনুগত্যকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ বলে মনে করত। জনগোষ্ঠীর এই ভিন্নমুখী মতাদর্শ পোল্যান্ডের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করেছিল।
  • পোল্যান্ডের কোনো প্রাকৃতিক সীমারেখা ছিল না। একমাত্র অস্ট্রিয়া ও পোল্যান্ডের মধ্যবর্তী কার্পাথিয়ান পর্বতশ্রেণী ব্যতীত অপর কোনো দিকে পোল্যান্ডে রাজ্যসীমা সংরক্ষিত ছিল না। এ অবস্থায় জাতীয় ঐক্য, দেশপ্রেম, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী পোল্যান্ডের নিরাপত্তা রক্ষার একমাত্র রক্ষাকবচ ছিল। কিন্তু পোল্যান্ডের শাসক শ্রেণি শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী গঠন করতে সক্ষম ছিল না।
  • পোল্যান্ডের অর্থনৈতিক দুরবস্থা এর জাতীয় সংহতিকে দুর্বল করেছিল। সামন্তবাদী অর্থব্যবস্থা, অভিজাতদের শোষণ, কৃষকদের দুরবস্থা, পোল্যান্ডের অর্থনীতিকে দুর্বল করেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশ না হওয়ায় জাতীয় জীবনের প্রতি স্তরে দারিদ্র্য ও গভীর হতাশার সৃষ্টি করেছিল।
  • রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ অবস্থা যখন বিশৃঙ্খলাপূর্ণ তখন পোল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রাশিয়া ও রাশিয়ার ন্যায় শক্তিশালী দেশের উত্থান হয়। এসব দেশের সামরিক শক্তি মোকাবেলা করার মতো অবস্থা পোল্যান্ডের ছিল না। যার ফলে পোল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী দেশ অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও রাশিয়া পোল্যান্ডকে গ্রাস করার জন্য সচেষ্ট হয়।

তৃতীয় সিগিসমান্ড থেকে প্রথম মাইকেল (১৫৮৭-১৬৭৩)

তৃতীয় সিগিসমান্ড (১৫৮৭-১৬৩২): সপ্তদশ শতাব্দীতে পোল্যান্ড ও সুইডেনের ভ্যাসা রাজপরিবারদ্বয় সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়। পোল্যান্ডের রাজা তৃতীয় সিগিসমান্ড (১৫৮৭-১৬৩২) সুইডেনের রাজা নবম চার্লসের (১৬০৪-১৬১১) সিংহাসনের অধিকার মানতে অস্বীকার করেন। তিনি নিজেই সুইডেনের সিংহাসনের দাবিদার হয়ে বসেন। এমনকি তিনি মাস্কোভি (রাশিয়া) রাজ্যের সিংহাসন অধিকারে সচেষ্ট হন। এ অবস্থায় তৃতীয় সিগিসমান্ড পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ শাসনকার্যে আত্মনিয়োগ না করে বৈদেশিক বিষয়ে শক্তি ক্ষয় করেন। সুইডেনের সিংহাসন নিয়ে তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আল্টমার্কের (Altmark) সন্ধির দ্বারা লিভোনিয়া সুইডেনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ফলে পোল্যান্ডের শত্রুদেশ সুইডেনের শক্তিবৃদ্ধি পায়।  ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে (১৬১৮-১৬৪৮) সিগিসমাপ্ত পবিত্র রোমান সম্রাটের পক্ষে যোগ দেন। কিন্তু পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও অর্থ সংকটের জন্য এ যুদ্ধে তিনি কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন নি। তুরস্ক কর্তৃক খোচিম আক্রান্ত হলে তিনি তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় ওসমানকে (১৬১৮-১৬২২) খোচিমের খেকজিমের সন্ধি স্থাপন করতে বাধ্য করেন। এতে মোলডাভিয়া নামক অঞ্চলটি তুরস্ক ও পোল্যান্ডের মধ্যবর্তী দেশ হিসাবে নির্ধারিত হয়।

চতুর্থ ল্যাডিসলাস (১৬৩২-১৬৪৮): তৃতীয় সিগিসমান্ডের মৃত্যুর পর তার পুত্র চতুর্থ ল্যাডিসলাস (১৬৩২-১৬৪৮) পোল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে বসেই তিনি রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। রাশিয়ার মাস্কোভি রাজ্যের সিংহাসন দখল করা তার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু তিনি মস্কো আক্রমণ করে বিশেষ কিছু লাভ করতে পারেন নি। শেষে রাশিয়ার জার প্রথম মাইকেলের (১৬১৩-১৬৪৫) সাথে ভিয়াসমার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে মস্কোভির সিংহাসনের উপর দাবি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর বিনিময়ে রাশিয়ার জার পোল্যান্ডে বাল্টিক অঞ্চলের স্থানগুলো, শ্বেত রাশিয়া এবং সার্বিয়া অধিকারের সংকল্প ত্যাগ করেন। ল্যাডিসলাস পোল্যান্ডের শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তিনি পোল্যান্ডের জাতীয় উন্নতি সাধনে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি জনগণকে পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি পোল্যান্ডের উন্নতির জন্য রাজপথ, সেতু ইত্যাদির উন্নতি সাধন করেন এবং পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসোকে মনোরম নগরে পরিণত করেছিলেন। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উদার ও সহিষ্ণু। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিতে যোগদানের পূর্বে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যার ফলে ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিতে পোল্যান্ড কোনো কিছু লাভ করতে পারেনি।

জন দ্বিতীয় ক্যাসিমির (১৬৪৮-১৬৬৮): ল্যাডিসলাসের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা জন দ্বিতীয় ক্যাসিমির (১৬৪৮-১৬৬৮) পোল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন তৃতীয় সিগিসমান্ডের কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি সিংহাসনে বসে তদকালীন সুইডেনের রানী ক্রিশ্চিনার (১৬৩২-১৬৫৪) থেকে সুইডেনের সিংহাসন দখল করার পরিকল্পনা করেন। ফলে সুইডেনের সাথে পোল্যান্ডের বিরোধ দেখা দেয়। এ সময় পোল্যান্ডের দুর্যোগ দেখা দেয়। রাশিয়া, তাতার, কোসাক ও সুইডেন এ সময়ে পোল্যান্ড আক্রমণ শুরু করে। আক্রমণকারীরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু হওয়ায় তারা কেউ সফলভাবে পোল্যান্ড আক্রমণ করতে পারেনি। যার ফলে পোল্যান্ড এ সময় রক্ষা পায়। সুইডেনের রাজা দশম চার্লস (১৬৫৪-১৬৬০) পোল্যান্ড আক্রমণ করে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসো দখল করে। রাজা দেশ ছেড়ে অস্ট্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত সাইলেশিয়ায় আশ্রয় নেন। ইতোমধ্যে রাশিয়ার জার আলেক্সিস (১৬৪৫-১৬৭৬) কর্তৃক সুইডেনের বাল্টিক তীরবর্তী অঞ্চলগুলো আক্রান্ত হলে সুইডেনের রাজা দশম চার্লস পোল্যান্ড ছেড়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এবং তিনি ক্যাসিমিকে পোল্যান্ড ফিরিয়ে দেন। রাশিয়া ও সুইডেন যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় পোল্যান্ড আপাতত রক্ষা পায়।

প্রথম মাইকেল (১৬৬৯-১৬৭৩): পঞ্চম ক্যাসিমির-এর মৃত্যুর পর পোল্যান্ডের সিংহাসন নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। এই গোলযোগ কাটিয়ে মাইকেল উইজনোয়েস্কি (Michael wisnowieske) প্রথম মাইকেল (১৬৬৯-১৬৭৩) নাম নিয়ে পোল্যান্ডের রাজা নির্বাচিত হন। এ সময় চতুর্থ মেহমেদের (১৬৪৮-১৬৮৭) অধীনে তুর্কিরা পোল্যান্ড আক্রমণ করলে প্রথম মাইকেল এক গোপন চুক্তির দ্বারা তুর্কি সুলতানকে ইউক্রেন ও পোডেলিয়া ছেড়ে দেন এবং বাৎসরিক করদানে স্বীকৃত হন। এই গোপন চুক্তি প্রকাশিত হলে পোল্যান্ডে বিক্ষোভ দেখা দেয়। পোলিশ সেনাপতি জন সোবিয়েস্কি তুর্কি বাহিনীকে বেসারাবিয়ার খোকজিন নামক স্থানে পরাজিত করেন। ফলে পোল্যান্ডের অভিজাতগণ জন সোবিয়েস্কিকে পোল্যান্ডের রাজা নির্বাচিত করেন।

তৃতীয় জন সোবিয়েস্কি (১৬৭৪-১৬৯৬)

ইউরোপের ইতিহাসে জন সোবিয়েস্কি-এর নাম চিরস্মরণীয়। তিনি পোল্যান্ডের এক সংকট মুহূর্তে পোল্যান্ডের রাজা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো তিনি তুর্কি শক্তিকে প্রতিহত করে পোল্যান্ড তথা ইউরোপের খ্রিস্টধর্মকে রক্ষা করেছিলেন।

জন সোবিয়েস্তি প্রথম জীবনে সৈন্য বিভাগে চাকরি নেন। কালক্রমে নিজ যোগ্যতা বলে পোল্যান্ডের সেনাপতি হন। যৌবনকালে তিনি একবার সুইডেনের পক্ষে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। পরে তিনি ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে ক্যাথলিক ধর্ম ও দেশের জন্য অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। জন সোবিয়েস্কি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও মার্জিত রুচির মানুষ ছিলেন। তার কর্মদক্ষতা ছিল অসাধারণ। তার চরিত্রে বিভিন্ন মানবিক গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। সামরিক দক্ষতা, সাহিত্য অনুরাগ, ন্যায়পরায়ণতা, কঠোরতার সাথে দয়া, পরধর্মসহিষ্ণুতা, আশ্রিতের প্রতি অনুকম্পা তার চরিত্রকে এক অপূর্ব সৌন্দর্যে ভূষিত করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তার নেতৃত্ব যেমন ছিল প্রেরণাদায়ক তেমনি বীরত্বব্যঞ্জক। তার চরিত্রের নীচতা বা কঠোরতার স্থান ছিল না।

উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য : জন সোবিয়েস্কি খ্রিস্ট ধর্ম ও নিজ দেশের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ থেকে তুর্কি শক্তির উচ্ছেদ সাধন। এ লক্ষ্যে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলতেন, অসত্য তুর্কিদের বিজয়ের প্রত্যুত্তর আমাদের বিজয়ের দ্বারা দিতে হবে এবং যুদ্ধের পর যুদ্ধ জয় লাভ করে, যে সীমা অতিক্রম করে তারা ইউরোপে প্রবেশ করেছে সে সীমার বাইরে তাদেরকে নিক্ষেপ করতে হবে।

জুরাওনোর সন্ধি: সিংহাসন লাভ করে জন সোবিয়েস্কি সৈন্য নিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। তার অসাধারণ সামরিক দক্ষতায় তুর্কিরা পরাজিত হয়। তুর্কি সুলতান জুরাওনো (Zurawno) সন্ধির দ্বারা ক্যামিয়েনেক দুর্গ ভিন্ন সমগ্র পোডোলিয়া ও ইউক্রেন পোল্যান্ডকে ফিরিয়ে দেয়। তার পূর্ববর্তী রাজা প্রথম মাইকেল কর্তৃক তুরস্ককে বাৎসরিক কর দানের প্রতিশ্রুতি নাকচ করা হয়। জেরুজালেমের খ্রিস্টিয় তীর্থস্থানগুলো খ্রিস্টানদের তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দেয়া হয়।

ইউরোপ থেকে তুর্কি শক্তি বিতাড়নের পরিকল্পনা : জন সোবিয়েস্কি ইউরোপ মহাদেশ থেকে তুর্কি শক্তিকে বিতাড়নের পরিকল্পনা করেছিলেন। সে সময় ইউরোপের বিভিন্ন রাজশক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ থাকায় যুগ্মভাবে তুর্কিদের আক্রমণ করে বিতাড়ন করা সম্ভব হয় নি। ফরাসিরাজ চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) কূটকৌশলে পোল্যান্ডকে এ কাজে নিরস্ত্র করেন। কারণ ফ্রান্সের স্বার্থের দিক থেকে পোল্যান্ডকে নিরপেক্ষ ও নিরস্ত্র রাখা প্রয়োজন ছিল। এ ছাড়া সে সময় ফ্রান্স ও তুরস্কের মধ্যে গোপন চুক্তি ছিল।

তুর্কিদের কর্তৃক ভিয়েনা অবরোধ : চতুর্থ মেহমেদের শাসনকালেই ১৬৮৩ সালে তুর্কিরা কারা মুস্তফার নেতৃত্বে হাঙ্গেরি দখল করে। এরপর তুর্কিরা অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা অবরোধ করে। এ সংকটে অস্ট্রিয়ার সম্রাট ইউরোপের খ্রিস্টান দেশগুলোর সাহায্য প্রার্থনা করেন। এ আহ্বানে ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অস্ট্রিয়া রক্ষার জন্য হাজির হয়। জন সোবিয়েস্কি ভিয়েনা রক্ষার জন্য সর্বাধিক সামরিক সাহায্য প্রেরণ করেন। এমনকি তিনি নিজে সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভিয়েনায় প্রবেশ পথে তুর্কিদের সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন। তুর্কিদের পরাজিত করে তিনি কেবল ভিয়েনাকে রক্ষা করেননি, ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্ম ও সভ্যতাকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু এ মহৎ কার্যের উপযুক্ত পুরস্কার তিনি পান নি। যুদ্ধের পর ভিয়েনা নগরীতে তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় নি। তাকে যে অভ্যর্থনা দেওয়া হয়েছিল তা ছিল গতানুগতিক ও নিষ্প্রাণ। এমনকি তার কার্যের যথেষ্ট কৃতজ্ঞতার প্রকাশও তাকে দেখানো হয় নি। তখন অস্ট্রিয়ার শাসক ও  পবিত্র রোমান সম্রাট ছিলেন প্রথম লিওপোল্ড (১৬৫৮-১৭০৫)। ফ্রান্স জন সোবিয়েস্কির বিজয় গৌরবকে ম্লান করার জন্য অপপ্রচার চালিয়েছিল। তার প্রতি অস্ট্রিয়ার সরকারের অবহেলা তাকে হতোদ্যম করে। তবুও ১৬৮৩ সালে পার্কানির (Parkany) যুদ্ধে পুনরায় তুর্কি শক্তিকে পরাজিত করেছিলেন।

তুর্কি বিরোধী পবিত্র সংঘ স্থাপন : ১৬৮৪ সালে পোপ একাদশ ইনোসেন্ট (১৬৭৬-১৬৮৯) তুর্কি শক্তির আক্রমণ থেকে খ্রিষ্ট জগতকে রক্ষার জন্য পবিত্র সংঘ (Holy league) প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে জন সোবিয়েস্কি এ সংঘে যোগদান করতে পারেন নি। খ্রিস্টানদের সমবেত আক্রমণে তুর্কিরা পরাজিত হয়। ১৬৯৯ সালে কার্লোভিজের সন্ধির দ্বারা তুরস্ক দানিয়ুব অঞ্চল ত্যাগ করে। এ সন্ধির কয়েক বছর পূর্বে জন সোবিয়েস্কি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তবুও তুর্কি শক্তির এ পশ্চাদপসরণের প্রধান কৃতিত্ব জন সোবিয়েস্কিরই প্রাপ্য। জন সোবিয়েস্কি তুর্কি শক্তিকে ইউরোপ থেকে বিতাড়নের সংকল্প করেছিলেন। ভিয়েনা অবরোধের সময় তুর্কিদের পরাজিত করে তিনি তুর্কিদের উপর যে আঘাত হেনেছিলেন, তার কারণেই কার্লোভিজের সন্ধি সম্ভব হয়েছিল।

অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন : পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ছিল খুবই জটিল। তুর্কি আক্রমণের ভয় দূর হওয়ায় দেশের অভিজাত শ্রেণির মধ্যে ষড়যন্ত্র, হিংসা, নিঃস্বার্থপরতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। তবুও তিনি দেশে অভ্যন্তরীণ অবস্থা উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন। দানিয়ুর ও কৃষ্ণসাগরের পথে বাণিজ্য প্রসারের জন্য হল্যান্ডের সাথে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। শিল্প ও ব্যবসা- বাণিজ্যের উন্নতিকল্পে তিনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছিলেন। ১৬৮৬ সালে তিনি কিয়েভ ও স্মলেক্সের উপর পোল্যান্ডের দাবি ত্যাগ করার বিনিময়ে রাশিয়ার নিকট থেকে প্রচুর অর্থ লাভ করেছিলেন। ফলে নিপার নদী রাশিয়া ও পোল্যান্ডের সীমারেখা হিসেবে নির্দিষ্ট হয়েছিল।

শেষ জীবন : জীবনের অন্তিম সময়ে নিজ পুত্রদের মধ্যে একজনকে পোল্যান্ডের রাজপদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পোল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণির ষড়যন্ত্র তার এই আশাকে বিফল করেছিল। অভিজাতরা বিদেশীদের নিকট থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে জন সোবিয়েস্কির আশা নষ্ট করেছিলেন। এ হতাশা তাকে বিমর্ষ করে এবং জীবনের শেষ সময় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় অতিবাহিত করেন। ১৬৯৬ সালে এ মহান বীরের মৃত্যু হয়।

জন সোবিয়েস্কি-এর কৃতিত্ব : জন সোধিয়েঞ্চি পোল্যান্ডের দুর্যোগ মুহূর্তে রাজপথ গ্রহণ করে পোল্যান্ডকে অন্ততঃ কিছুকালের জন্ম শক্তিশালী করতে পেরেছিলেন। তিনি তুর্কিদের আক্রমণ থেকে পোল্যান্ড এবং পোল্যান্ড অধিকৃত স্থান রক্ষা করেছিলেন। তুর্কি আক্রমণ থেকে ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্ম ও সভ্যতা রক্ষা তার প্রধান কৃতিত্ব। ১৬৩০ সালে ভিয়েনা প্রবেশপথে তুর্কিদের পরাজিত করে ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেন।

দ্বিতীয় অগাস্টাস, প্রথম স্ট্যানিসলাস, পোল্যান্ড উত্তরাধিকার যুদ্ধ ও তৃতীয় অগাস্টাস (১৬৯৭-১৭৬৩)

জন সোরিয়েঙ্কির মৃত্যুর পর জার্মানির স্যাক্সনির ডিউক দ্বিতীয় অগাস্টাস পোল্যান্ডের রাজপদে নির্বাচিত হন। তিনি সুইডেনের বিরুদ্ধে ডেনমার্ক ও রাশিয়ার মিত্রতা লাভ করেছিলেন। এজন্য সুইডেনের রাজা দ্বাদশ চার্লস (১৬৯৭-১৭১৮) পোল্যান্ড ও স্যাক্সনি আক্রমণ করেছিলেন। সুইডেন অগাস্টাসকে বিতাড়িত করে সুইডেনের রাজা দ্বাদশ চার্লস তার মনোনীত প্রার্থী প্রথম স্ট্যানিসলাসকে (১৭০৬-১৭৩৩) পোল্যান্ডের সিংহাসনে বসান। কিন্তু দ্বাদশ চার্লস রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার সাথে সাথে ১৭০৭ সালে অগাস্টাস স্ট্যানিসলাসকে বিস্তাড়িত করে পোল্যান্ডের সিংহাসন অধিকার করে।

দ্বিতীয় অগাস্টাস-এর মৃত্যুর পর পোল্যান্ডের সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ইতিহাসে এ দ্বন্দ্ব পোল্যান্ডের উত্তরাধিকার যুদ্ধ (১৭৩৩-১৭৩৫) নামে পরিচিত। পোল্যান্ডের জনগণ বিশেষ করে জাতীয়তাবাদীরা স্যাক্সনির রাজবংশ হতে তাদের রাজা নির্বাচনের পক্ষপাতী ছিল না। তারা স্ট্যানিসলাসকে (স্ট্যানিসলাস লেকজিনস্কি) পোল্যান্ডের সিংহাসনে রাজা নির্বাচন করেন। ফ্রান্সের পঞ্চদশ লুই (১৭১০-১৭৭৪) এ নির্বাচনকে সমর্থন করে কিন্তু অস্ট্রিয়া ও রাশিয়া স্যাক্সনির দ্বিতীয় অগাস্টাসের পুত্র তৃতীয় অগাস্টাসকে (১৭৩৩-১৭৬৩) পোল্যান্ডের রাজা হিসেবে সমর্থন করে তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। রাশিয়া ও স্যাক্সনির সৈন্যবাহিনী পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস অবরোধ করে। অস্ট্রিয়ার সৈন্যবাহিনী সামরিক সাহায্য নিয়ে সাইলেশিয়া সীমান্তে সামরিক যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। স্ট্যানিসলাস পরাজিত হয়ে রাজধানী ওয়ারস ত্যাগ করে ডানজিক শহরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু ফ্রান্স স্ট্যানিসলাসকে প্রতিশ্রুত সাহায্য পাঠায় নি। কেবল ১৬০০ জন ফরাসি সৈন্য তার সাহায্যে প্রেরিত হয়েছিল। রুশ বাহিনী ডানজিক শহর অবরোধ করলে স্ট্যানিসলাস প্রাশিয়ায় পলায়ন করে। এ অবস্থায় তৃতীয় অগাস্টাস পোল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন। অস্ট্রিয়ার সম্রাট ষষ্ঠ চার্লস (১৭১১-১৭৪০) তার সাহায্যের বিনিময়ে প্র্যাগমাটিক স্যাংশন তৃতীয় অগাস্টাস কর্তৃক স্বাক্ষর করিয়ে নেন। ১৭৬৩ সালে তৃতীয় অগাস্টাস মৃত্যুবরণ করলে পোল্যান্ডের সিংহাসন নিয়ে পুনরায় বিরোধ শুরু হয়। এ সুযোগে রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ করে।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের পূর্ববর্তী ঘটনাবলি

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ একটি ঐতিহাসিক ভুল বা ইউরোপীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর পররাজ্য লিপ্সার বহিঃপ্রকাশ। এটি নিয়ে মতানৈক্য হতে পারে তবে পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা এবং অভিজাত শ্রেণির লোভ ও স্বার্থপরতার চরম পরিণতি একথা বলা যায়।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদে রাশিয়ার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। পিটার দ্য গ্রেটের (১৬৮২-১৭২৫) সময় থেকে রাশিয়া পোল্যান্ডকে নৈরাজ্যকর অবস্থায় রাখত, যাতে পোল্যান্ড রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল থাকে। একই উদ্দেশ্যে ১৭৬৩ সালে দ্বিতীয় ক্যাথারিন (১৭৬২-১৭৯৬) পোলরাজা তৃতীয় অগাস্টাসের (১৭৩৩-১৭৬৩) মৃত্যুর পর ১৭৬৪ সালে ১১ এপ্রিল প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটের (১৭৪০-১৭৮৬) সাথে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের সময় রাশিয়া এবং প্রাশিয়া পরস্পরকে সাহায্য করবে। এই চুক্তিতে পোল্যান্ডের সিংহাসনে কাউন্ট স্ট্যানিসলাস পনিয়াটভস্কিকে অধিষ্ঠিতকরণ, লিবারাম ভেটো বিলুপ্তির অনুমতি না দিতে এবং নির্বাচনীয় রাজতন্ত্রকে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত না করতে রাশিয়া ও প্রাশিয়া ঐকমত্য পোষণ করেছিল। রাশিয়া এবং প্রাশিয়া উভয়েই অন্য কোনো দেশকে পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। রাশিয়ার জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন পনিয়াটভস্কিকে পুতুল রাজা হিসেবে বসিয়ে তার মাধ্যমে পোল্যান্ড শাসন করার সংকল্প করে। ইতোপূর্বে তিনি ১৭৬৩ সালে পোল্যান্ড দখল, সুইডেনের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং কনস্টান্টিনোপল দখলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রাশিয়ার সাথে ১৭৬৪ সালের চুক্তি তাকে পোল্যান্ডের উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। ১৭৬৯ সালে রাশিয়া প্রাশিয়া ও ডেনমার্ক সুইডেনের তখনকার সংবিধানকে সমর্থন করে। পোল্যান্ড, সুইডেন ও তুরস্ক রাশিয়া আধিপত্য বিস্তারের পথে কোনো বাধা ছিল না। উল্লিখিত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা রাশিয়ার নীল নকশা বাস্তবায়নের পথ সুগম করে।

ইতোমধ্যে রাশিয়া তুরস্কে ও সুইডেনে রুশপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তুরস্কের সামরিক দুর্বলতা ত্বরান্বিত হতে থাকে। এ অবস্থায় রাশিয়া পোল্যান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রথম পদক্ষেপ নেয়। রাশিয়া ও প্রাশিয়ার হুমকিতে পনিয়াটভস্কিকে পোল্যান্ডের রাজা নির্বাচন করা হয়। পোল্যান্ড তখন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল থাকায় পোল্যান্ড সরকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতি করতে পারেনি। সাংবিধানিক বিশৃঙ্খলা পোল্যান্ডে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি। পোল্যান্ডের অভিজাতরা পোল্যান্ডে সামন্তবাদ বহাল রাখে যার ফলে কৃষকদের অবস্থা ক্রীতদাস পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যার দরুন কৃষকরা সামন্তদের ঘৃণা করত। এ অবস্থায় জারটোরিস্কিরা পোল্যান্ডে প্রশাসনিক সংস্কারের চেষ্টা করে। এদের উদ্দেশ্য ছিল পোল্যান্ডের সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন করে পোল্যান্ডকে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সমপর্যায়ে উন্নীত করা। তারা লিবারাম ভেটো বিলুপ্তিকরণ এবং রাজতন্ত্রকে বংশানুক্রমিক ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়। ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়া থেকে কোনোরূপ সাহায্যের আশা না করে তারা পোল্যান্ডের পুনরুজ্জীবনের জন্য রাশিয়ার শক্তিকে ব্যবহার এবং দেশের সংস্কার সম্পাদন শেষ করে তাদের অর্ধসত্যমিত্রকে পরিত্যাগ করার সাহসী উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এ নীতি বাস্তবায়নের সামর্থ্য তাদের ছিল না। এদের বিরোধী পটোকিরা অভিজাতদের একটি স্থায়ী কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার দ্বারা রাজার ক্ষমতাকে সীমিত করতে চেয়েছিল। পনিয়াটভস্কির নির্বাচনের পূর্বে রাশিয়ার সমর্থনে জারটরিস্কিরা তাদের প্রতিপক্ষদের বিরোধীতাকে প্রতিহত করে ডায়েট মধ্যবর্তী সংস্কারসমূহ পাস করে। পানিয়াটভঙ্কি রাজা নির্বাচিত হয়ে কনফেডারেশন বা অপ্রচলিত ডায়েট সংস্কারসমূহকে অনুমোদন করেন। এ সময় পোল্যান্ডের উন্নয়নের একটি সুযোগ আসে তবে দ্বিতীয় ক্যাথারিন বা ফ্রেডারিক কেউই এ সংস্কারের জন্য উদ্বিগ্ন হননি। পটোকিদের অধীনে জাতীয় দলের সাথে প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক আলোচনা শুরু করে। এ দল রাজার আনুগত্য স্বীকার করে।

পোল্যান্ডের রুশ প্রতিনিধি রেপনিন ফ্রেডারিকের সমর্থন পেয়ে ভিন্ন ধর্মমতালম্বীদের স্বপক্ষে হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়। এরা ছিল অর্থডক্স গ্রিক চার্চ মতাবলম্বী খ্রিস্টান এবং প্রোটেস্ট্যান্টপন্থীরা। এরা ১৫৬২ সালে থেকে ধর্মীয় অধিকার ভোগ করে আসছিল। রেপনিন দাবি করে যে, ভিন্ন ধর্মমতাবলম্বীরা ডায়েট ও সিনেটের সদস্য পদ লাভ করবে এবং আইন প্রণয়ন ও আইন প্রয়োগে তাদের অধিকার থাকবে। তখনকার পোল্যান্ডের ডায়েট ছিল ক্যাথলিকপন্থী। তাই ১৭৬৬ সালে যখন ভিন্ন ধর্মমতাবলম্বীরা তাদের দাবি উত্থাপন করে তখন ডায়েট তা প্রত্যাখ্যান করে ও সংস্কার বিলুপ্ত করার চেষ্টা করে। তখন রাশিয়ার ও প্রাশিয়া ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নামে পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। ভিন্ন ধর্মমতাবলম্বীরা কিছু দেশপ্রেমিক গোষ্ঠীর সহায়তায় কনফেডারেশন গঠন করে, যা ১৭৬৭ সালে জুন মাসে কনফেডারেশন অব ব্র্যানডামের অন্তর্ভুক্ত হয়। একটি পুনঃগঠিত সরকারের অধীনে পোল্যান্ড স্বাধীন থাকবে কিংবা রাশিয়ার অধীন হবে এ বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

১৭৬৭ সালে পনিয়াভস্কি ডায়েট আহ্বান করেন। এ সময় পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসোতে রুশ সৈন্য মোতায়েন করা হয়। রাশিয়া গ্রিক অর্থডক্স খ্রিস্টান ও প্রোটেস্ট্যানদের জন্য সমান অধিকার এবং পোল্যান্ডে সৈন্য মোতায়েন রাখার সুযোগ দাবি করে। রাশিয়ার প্ররোচনায় কয়েকজন কমিশনারকে ডায়েটের ক্ষমতা হস্তান্তর করার একটি প্রস্তাব রাখা হয়। রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন কমিশনার দ্বারা শাসিত হওয়ার আশঙ্কায় পোল্যান্ডে বিক্ষোভ দেখা দেয়। কিন্তু দ্বিতীয় ক্যাথারিন বিরুদ্ধবাদী প্রধান নেতাদের সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেন। এর ফলে ডায়েট ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ক্যাথারিনের নির্দেশে কাজ করে। ১৭৬৮ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি পোল্যান্ড ও রাশিয়ার মধ্যে এক চুক্তি হয় এবং এ চুক্তি মতে পোল্যান্ডকে রাশিয়ার অধীন করা হয়। অভিজাতরা ধর্ম ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে কনফেডারেশন অব বার গঠন করে। এতেও প্রবল গোলযোগ কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কৃষকরা বিদ্রোহ করে অভিজাতদের উপর আক্রমণ চালায়। এ অবস্থায় ক্যাথলিকরা ফ্রান্সের সাহায্য প্রার্থনা করে। গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা রাশিয়ার এবং প্রোটেস্ট্যান্টরা প্রাশিয়ার সাহায্য প্রার্থনা করে। পোল্যান্ডের ক্যাথলিকরা ধর্মের নামে প্রোটেস্ট্যান্ট ও অর্থোডক্স গ্রিক খ্রিস্টানদের হত্যা করে। রাশিয়া ভিন্ন ধর্মমতাবলম্বীদের ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে পোল্যান্ডে হত্যাকাণ্ড চালায়।

পোল্যান্ডে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি ফ্রান্সকে আশঙ্কাগ্রস্ত করে। ফ্রান্স কনফেডারেশন অব বারকে সাহায্যের জন্য অর্থ ও কর্মকর্তা পাঠায় এবং ক্যাথারিনের শত্রুদের উদ্বুদ্ধ করতে কূটনীতি ব্যবহার করে। তুরস্ক পোল্যান্ডে রুশ সৈন্য অবস্থানের বিরোধী ছিল। কিন্তু ১৭৫৭ সালে পর্যন্ত তুরস্ক প্রশাসনের কর্তব্য ব্যক্তিদেরকে উৎকোচ দেওয়ার জন্য তুরস্ক পোল্যান্ডের ব্যাপারে উদাসীন ছিল। কিন্তু ১৭৬৮ সালে থেকে তুর্কি সুলতান পোল্যান্ডে রুশ প্রভাব বৃদ্ধিকে ঈর্ষা ও ভীতির চোখে দেখতে শুরু করে। এ ছাড়া ১৭৬৫ সালের পর থেকে রুশ এজেন্টরা গ্রিক, মন্টিনিগ্রো ও বসনিয়াদেরকে তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করে। রাশিয়ার ষড়যন্ত্রে তুর্কি সুলতান তৃতীয় মুস্তফা (১৭৫৭-১৭৭৪) উত্তেজিত হন। এ সুযোগ নিয়ে ফ্রান্স তুর্কি সুলতানকে পোল্যান্ড থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার দাবি করতে উৎসাহিত করে। ইতোমধ্যে রাশিয়া তুর্কি সাম্রাজ্য আক্রমণ করে ক্রাকো দখল করে। ১৭৬৮ সালে ৬ অক্টোবর তুরস্ক রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

কনস্টান্টিনোপলের অবস্থানরত অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত ব্রোগনার্ড শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। অস্ট্রিয়ার সরকার এ যুদ্ধ চাইত না কারণ তাদের মিত্র রাশিয়াও ফ্রান্সকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধা প্রদানের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। অস্ট্রিয়া জার্মানিতে শান্তি অব্যাহত রাখার আগ্রহী ছিলেন। রাশিয়ার সাথে মিত্রতা থাকা সত্ত্বেও ফ্রেডারিক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পক্ষপাতী ছিল না এবং এ যুদ্ধে প্রাশিয়ার কোনো স্বার্থও ছিল না। তবে পোলিশ- রাশিয়া দখল করতে ফ্রেডারিক আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী কৌনিজ সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এ অবস্থায় ফ্রেডারিকের নিকট পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের সম্ভাবনা দেখা দেয়। ১৭৬৯ সালে জানুয়ারি মাসে ভিয়েনাতে সিদ্ধান্ত হয় যে, আগস্ট মাসে ফ্রেডারিক ও দ্বিতীয় জোসেফের (১৭৬৫-১৭৯০) মধ্যে একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।

একই সময়ে ফ্রেডারিক সুইডেন ও তুরস্কে রুশ আধিপত্য স্থাপনকে সমর্থন করতে সম্মত হয়। ফ্রেডারিক জানতেন রুশ-তুর্কি যুদ্ধ প্রাশিয়ার রাজ্য সীমানার বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। তবে যুদ্ধের সম্প্রসারণ বন্ধে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু অস্ট্রিয়ার সহায়তা ছাড়া শান্তি রক্ষা সম্ভব ছিল না। যদি অস্ট্রিয়া ফ্রান্সের মিত্রতা ধরে রাখে ফ্রেডারিক তুর্কি ও পোলিশদেরকে সাহায্য করতে পারবে এবং রুশ মিত্রতা অব্যাহত রেখে তিনি আবার অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারবেন। যদি অস্ট্রিয়া রাশিয়ার সাথে মিলিত হয়ে পোল্যান্ডের আংশিক ব্যবচ্ছেদ করে তখন ফ্রেডারিক বিপজ্জনক নিঃসঙ্গ অবস্থায় পড়বেন। কাজেই এ প্রেক্ষিতে পোল্যান্ডে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও প্রাশিয়ার ক্ষতি পূরণ করে ফ্রেডারিক যুদ্ধ বন্ধ করার পরিকল্পনা নেন। ১৭৬৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের প্রস্তাব নিয়ে রুশ প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ করার জন্য ফ্রেডারিক সেন্ট পিটার্সবুর্গে প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। আলোচনার পর রুশ প্রতিনিধি প্রস্তাব করে যে, অস্ট্রিয়া, সাইলেশিয়া, হারানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবে পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চল, প্রাশিয়া পাবে পোলিশ প্রাশিয়া এবং রাশিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যের অধিকার করে কনষ্টান্টিনোপলকে রাজধানী করে একটি তুরস্ক প্রজাতন্ত্র গঠনে সন্তুষ্ট থাকবে।

যখন প্রাশিয়ান ও রুশ প্রতিনিধিরা পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের পরিকল্পনা করছিলেন তখন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী কৌনিজ মনে করেছিলেন একটি অস্ট্রো-পোলিশ যুদ্ধ দ্বারা অস্ট্রিয়া লাভবান হবে এবং ফ্রেডারিক ঈর্ষান্বিত হবে। ১৭৬৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে অস্ট্রিয় সেনাবাহিনী একটি প্রাচীন হাঙ্গেরি অধিকার দাবি ব্যক্ত করে পোল্যান্ডের জিপস কাউন্টি দখল করে নেয়। অপর দিকে জুলাই মাসে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৭৬৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়া মলডাভিয়া ও ওয়ালাচিয়া দখল করে। এই যুদ্ধের সময় ১৭৬৯ সালে অগাস্ট মাসে সাইলেশিয়ার মিলিতে জোসেফ ও ফ্রেডারিক এক বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকের খবর রাশিয়ার দ্বিতীয় ক্যাথারিনকে উদ্বিগ্ন করে। ফলে তিনি ফ্রেডারিকের সকল দাবি মেনে নিতে রাজি হন। অক্টোবর মাসে তাদের মিত্রতা ১৭৮০ সালে পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। এ বৈঠকের সংবাদ পেয়ে ফরাসি মন্ত্রী চয়সিউল ভীত হন এবং ধারণা করেন যে ফ্রাংকো-অস্ট্রীয় মিত্রতার জন্য ক্ষতিকারক প্রাশো—অস্ট্রীয় মিত্রতা গঠিত হতে পারে। তিনি ঘোষণা করেন যে, রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ফরাসি স্বার্থের অনুকূলে যাবে। এ অবস্থায় অস্ট্রীয় প্রধানমন্ত্রী কৌনিজ শান্তি কামনা করেন এবং রাশিয়াকে ভূখণ্ডজনিত সুবিধা নিতে যুদ্ধরত রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে রাজি ছিলেন।

১৭৭০ সালে যুদ্ধ তুরস্কের জন্য ক্ষতিকারক হয়েছিল। ইংরেজ সামরিক অফিসার দ্বারা পরিচালিত রুশ নৌবাহিনী চেশমে তুর্কি নৌবাহিনীকে পরাজিত করে এবং কাগোলে রুশবাহিনী তুর্কিদের বিষন্ত করে। তুর্কি সুলতান ফ্রান্সের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফরাসি মন্ত্রী, কিছু সৈন্য ও অর্থ তুরস্ককে সাহায্য দেন। ইংল্যান্ড রুশ নৌবাহিনীতে কর্মরত অফিসারদের ডেকে পাঠায় এবং কনস্টান্টিনোপলে ইংরেজ রাষ্ট্রদূত ইংল্যান্ডের মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়। ইতোমধ্যে অস্ট্রিয়া পোল্যান্ডের অনেক ভূখণ্ড দখল করে। এ জটিল পরিস্থিতিতে ১৭৭০ সালে ১০ সেপ্টেম্বর নিসটাডে ফ্রেডারিক ও জোসেফের মধ্যে দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় এটা ভাবা হত যে, যদি রাশিয়া দানিয়ুর অতিক্রম করে তাহলে একটি ইউরোপীয় যুদ্ধ শুরু হবে। অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী কৌনিজ ঘোষণা করে যে, যদি রাশিয়া পোল্যান্ডে প্রবেশ করে অথবা তুর্কি সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে চায় তবে অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।

১৭৭০ সালে ১২ অক্টোবর প্রাশিয়ার প্রতিনিধি আবার সেন্ট পিটার্সবুর্গে যান। ইতোমধ্যে রাশিয়া তুরস্কের আরো অঞ্চল দখল করে নেয় এবং বিজয় লাভ করে দ্বিতীয় ক্যাথারিন শান্তি আলোচনায় সম্মত হয়। ১৭৭১ সালে জানুয়ারি মাসে ক্যাথারিনের সাথে বৈঠকে প্রাশিয়ান প্রতিনিধি পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের প্রস্তাব দেয়। এ সময় রাশিয়া অনেক তুর্কি অঞ্চল অধিকার করে রেখেছিল। অস্ট্রিয়া জিপসসহ অন্যান্য পোলিশ অঞ্চল দখল করে রেখেছিল। প্রাশিয়া পোলিশ প্রাশিয়াতে সৈন্য পাঠিয়ে ছিল। ক্রাকোতে রুশ সৈন্য অবস্থান নিয়েছিল। এ সময় পোল্যান্ড তিন রাষ্ট্রের দয়ার উপর বেঁচে থাকে। একই সময়ে অস্ট্রীয় রাষ্ট্রদূত বার্লিনে ফ্রেডারিকের সাথে ও প্রাশিয়ান প্রতিনিধি সেন্টপিটার্সবুর্গে ক্যাথারিনের সাথে আলোচনার ভিতর থেকে তুর্কি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ হিসেবে বেরিয়ে আসে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের সংকেত।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের কারণ

অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য এবং কলঙ্কজনক অধ্যায় ছিল পোল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদ। পোল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদে রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশ অংশগ্রহণ করে পোল্যান্ডের ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বাকে ধ্বংস করে এবং তারা পোল্যান্ডকে ভাগ করে নেয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর নবজাগ্রত জাতীয়তা ও স্বদেশ অনুরাগের ভাবধারার প্রতি কোনো শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে পোল্যান্ডের প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ নীতিহীন পন্থায় নিজেদের রাজনৈতিক মতলব হাসিল করে। এটি তৎকালীন রাজনীতিবিদদের কুটিল মনোভাব এবং পররাজ্য গ্রাসের এক নগ্ন উদাহরণ ছিল, সম্ভবত এ কারণেই ঐতিহাসিক Guedalla উল্লেখ করেন, It’s destruction was the most shameless and berren act of European diplomacy -Partition of Europe. p. 123-24

অষ্টাদশ শতাব্দীর পোল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদ বা তার দুর্ভাগ্যজনক অবস্থার জন্য সেদেশের রাজনৈতিক দুর্বলতা বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, নির্বাচনমূলক রাজতন্ত্র, অভিজাত শ্রেণির স্বার্থপরতা এবং লোভ, জনগণের মানসিক দুর্বলতা, ধর্মনীতির বিভেদ, সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভাব, অর্থনৈতিক সংকট, পার্শ্ববর্তী রাজ্য প্রাশিয়া, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া প্রভৃতি রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ –

(১) রাজতন্ত্রের দুর্বলতা : পোল্যান্ডের রাজতন্ত্র ছিল দুর্বল। পোল্যান্ডের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রাজা উত্তরাধিকারী সূত্রে সিংহাসন লাভ করতেন না। রাজা অভিজাত শ্রেণির দ্বারা গঠিত ‘ডায়েট’ বা প্রতিনিধি সভা দ্বারা নির্বাচিত হতেন। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বৈদেশিক ষড়যন্ত্রের দ্বারা রাজার সুষ্ঠু নির্বাচন শোচনীয়ভাবে ব্যহত হত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ মনোনীত ব্যক্তিকেই সিংহাসনে বসিয়ে পোল্যান্ডের উপর আধিপত্য করত। ফলে পোল্যান্ডের রাজতন্ত্রের নির্বাচন ইউরোপীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি করে ইউরোপের শক্তি বিপন্ন করত এবং বিভিন্ন দেশ অভিজাত শ্রেণিকে হাত করে নিজেদের পছন্দ ব্যক্তিকে পোল্যান্ডের সিংহাসনে বসাতে চাইত। এ অবস্থায় রাজা বিদেশী শক্তি ও স্থানীয় অভিজাতদের হাতের পুতুলের ন্যায় ভূমিকা পালন করত। রাজতন্ত্রের এ দুর্বলতা পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।

(২) অভিজাত শ্রেণির স্বার্থপরতা: পোল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণির স্বার্থপরতা পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। অভিজাতরা নিজেদের মনোনীত প্রার্থী পোল্যান্ডের সিংহাসনে স্থাপনের চেষ্টা করতেন। স্বার্থপর অভিজাত সম্প্রদায় “লিভেরাম ভেটো’ নামক শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে ‘ডায়েট’ নামক অভিজাত সভার অধিবেশন বন্ধ, আইন নাকোচ বা আইনের প্রস্তাব বাতিল করতে পারত। নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিদেশীর নিকট হতে ঘুষ নিয়ে দেশের ক্ষতি করতে তারা কুণ্ঠাবোধ করত না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোনো অস্তিত্ব না থাকায় অভিজাত শ্রেণি অপ্রতিহতভাবে নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করত।

(৩) সামাজিক সমস্যা : পোল্যান্ডের জনগণ অভিজাত এবং ভূমিদাস এ দু শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক না থাকায় দরিদ্র ভূমিদাসরা শোষণের শিকার ছিল। অভিজাত শ্রেণির নির্যাতন ও অকথ্য অত্যাচার সামাজিক জীবনে অনৈক্য এবং দুর্বলতার শিকার হয়েছিল।

(৪) ধর্মীয় অনৈক্য : এতভিন্ন পোল্যান্ডে কোনোরকম ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐক্য ছিল না। জনসাধারণ ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। সংখ্যাগুরু ক্যাথলিক সম্প্রায় ছিল দেশের কর্ণধার। ফলে তাদের হস্তে সংখ্যালঘু প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়কে নানাভাবে লাঞ্চিত হতে হয়।

(৫) ভৌগোলিক অনৈক্য : পোল্যান্ডের ভৌগোলিক ঐক্যের অভাব ছিল। সমগ্র পোল্যান্ডে তিনটি পৃথক এলাকায় বিভক্ত ছিল এবং এটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে বিশেষ অন্তরায় ছিল। এ ছাড়া পোল্যান্ডের কোনো স্বাভাবিক সীমারেখা ছিল না, ফলে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে পোল্যান্ড কোনো দৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত না। পোল্যান্ডের এই প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ পোল্যান্ডের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করে।

(৬) অর্থনৈতিক সংকট : পোল্যান্ডে অর্থনৈতিক সংকট এর ব্যবচ্ছেদের অন্যতম কারণ ছিল। পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতার এবং উত্তর ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে সুইডেনের উত্থান পোল্যান্ডের বাণিজ্যিক প্রাধান্য নষ্ট করে, ফলে অর্থাভাবে সেনাবাহিনী শক্তিশালীকরণ সম্ভব হয়নি।

(৭) প্রাশিয়া ও রাশিয়ার স্বার্থপরতা : পোল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র রাশিয়া ও প্রাশিয়ার আগ্রাসী নীতি পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের অন্যতম কারণ ছিল।

(৮) উত্তরাধিকার সংক্রান্ত গোলযোগ : পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ অবস্থা যখন চরমে পৌঁছে তখন ১৬৬৩ সালে তৃতীয় অগাস্টাসের মৃত্যু ঘটলে স্বভাবতই পরবর্তী রাজা নিয়ে অভিজাত শ্রেণি প্রাশিয়া, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স প্রভৃতি শক্তিগুলোর মধ্যে এক দারুণ তৎপরতা শুরু হয়। এ সকল দেশমাত্রই একজন করে মনোনীত প্রার্থী স্ট্যানিসলাস পনিযাটোস্কি পোল্যান্ডের সিংহাসনে নির্বাচিত হলেন। অল্পদিনের মধ্যেই স্ট্যানিসলাস পোনিয়াটোভি পোল শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন সাধনে সচেষ্ট হলেন। তিনি অভিজাত শ্রেণির “লিরোম ভিটো’ ক্ষমতা নাকচ করে পোল্যান্ডের শাসন ব্যবস্থাকে কার্যকরী করার চেষ্টা করেন। প্রাশিয়া ও রাশিয়ার বিরোধিতায় তিনি সংস্কার নীতি গ্রহণ করতে সমর্থ হলেন না। উপরন্তু প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক পোল্যান্ডের রেসিডেন্ট ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে উসকিয়ে দিলেন। ফলে পোল্যান্ডে এক অন্তঃযুদ্ধ দেখা দিল।

(৯) পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের পূর্ব পরিকল্পনা : পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোকে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের উৎসাহ যোগায়। ১৭৭২ সালে পোল্যান্ডের প্রথম ব্যবচ্ছেদের পূর্বেই ১৫৭৩ সালে সম্রাট দ্বিতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ান (১৫৬৪-১৫৭৬) প্রথম ব্যবচ্ছেদের প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। এরপর প্রায় এক শতাব্দী পরে সুইডেনের রাজা দশম চার্লস পুনরায় এ প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি ১৫৫৬ সালে প্রাশিয়ার গ্রেট ইলেক্টরের সাথে ম্যারিয়েনবার্গ চুক্তি নামক এক গোপন চুক্তি দ্বারা ব্রান্ডেনবার্গ ও সুইডেনের মধ্যে পোল্যান্ড ভাগ করে নেওয়ার এক পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। রাশিয়ার পিটার দ্য গ্রেটও পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঐ সকল পরিকল্পনা কার্যকরী হয়ে উঠেনি। রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথারিন এবং প্রাশিয়ার সম্রাট ফ্রেডারিক পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদকে বাস্তবে রূপ দেন। ক্যাথারিন অবশ্য সমগ্র পোল্যান্ডকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ পোল্যান্ড রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলে মধ্যে ও পশ্চিম ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তার সহজ হবে। কিন্তু ফেডারিক রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল। অপরদিকে ফ্রেডারিক পশ্চিম বা পোলিশ, প্রাশিয়া অধিকার করে ব্র্যান্ডেনবার্গ ও পূর্ব প্রাশিয়ার ঐক্য সাধনে বদ্ধপরিকর ছিলেন এবং পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের জন্য প্রাশিয়ার উপর কূটনৈতিক চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপে শক্তিসাম্য বজায় রাখার জন্য অস্ট্রিয়ার সম্রাজ্ঞী মেরিয়া থেরেসা পোল্যান্ডের অখণ্ডতা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে নিজেও পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদে অংশগ্রহণ করেন।

পোল্যান্ডের প্রথম ব্যবচ্ছেদ

প্রথম ব্যবচ্ছেদ

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে ১৭৭২ সালে ফ্রেডারিকের উদ্যোগে ক্যাথারিন ও মেরিয়া থেরেসা (১৭৪০-১৭৮০) প্রথম পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

প্রথম ব্যবচ্ছেদ : পোল্যান্ডের রাজনৈতিক গোলযোগের সুযোগে ইউরোপের প্রাশিয়া, রাশিয়া এবং অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের পরিকল্পনা করে। ইতোমধ্যে পোল্যান্ডে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পোল্যান্ডে অভিজাত শ্রেণি তাদের স্বার্থে বিদেশী শক্তির ষড়যন্ত্রের নিরুদ্বেগ থাকে। ১৬৬৭ সালে পোল্যান্ডে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অস্ট্রিয়া ও ব্র্যান্ডেনবার্গ পোল্যান্ডের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। রাশিয়া ও প্রাশিয়া পোল্যান্ডে অস্ট্রিয়ার প্রভাব বিনিষ্ট করার জন্য অস্ট্রিয়ার প্রতি অনুগত সেকসন বংশকে বহিষ্কার করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। ১৭৬৩ সালে সেকসনির ইলেক্টর ও পোল্যান্ডের রাজা তৃতীয় অগাস্টাসের মৃত্যু হলে ফ্রেডারিক এবং ক্যাথারিন এর সুযোগ গ্রহণ করে। উভয়ের সম্মিলিত চাপে ‘পোলিশ ডায়েট’ স্ট্যানিসলাস পোনিয়াটোস্কি নামক ক্যাথারিনের পোলিস অভিজাতকে রাজা বলে নির্বাচিত করে। নতুন রাজা এক চুক্তির দ্বারা লিভেরাম ভেটো বহাল রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। এভাবে পোল্যান্ডকে রাশিয়ার প্রভাবাধীন আনায়ন করা হয় এবং এর ব্যবচ্ছেদ পথ প্রস্তুত করা হয়।

পোলদের রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিরোধিতা : রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও হস্তক্ষেপের ফলে পোল্যান্ডের দেশপ্রেমিক জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং রাশিয়ার প্রভাব বিনষ্ট করার জন্য ‘কনফেডারেশন অব বার’ নামক এক লীগ গঠন করে। ফলে উভয় পক্ষে শত্রুতা আরম্ভ হয় এবং রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী পোল্যান্ডে প্রবেশ করে অভিজাত সম্প্রদায়কে কঠোর হস্তে দমন করে এবং লীগ ভেঙে দেয়।

প্রাশিয়ার পরিকল্পনা : পোল্যান্ডে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারে ভীত হয়ে ফ্রেডারিক ক্যাথারিনের নিকট হতভাগ্য দেশটির বাটোয়ারার প্রস্তাব করেন। কিন্তু ক্যাথারিন এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

অস্ট্রিয়ার পরিকল্পনা : রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হলে অস্ট্রিয়া এ সুযোগে পোল্যান্ডের কিংদাংশ অধিকার করে নেয়। ফ্রেডারিক এ সময় অস্ট্রিয়ার সাথে বিশেষ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পোল্যান্ডের ব্যাপারে রাশিয়াকে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার সম্মিলিত হস্তক্ষেপের হুমকি প্রদান করে। এতে ক্যাথারিন অত্যন্ত বিব্রত হয়ে এ রাষ্ট্রদ্বয়ের সাথে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের আলোচনায় প্রবৃত্ত হন।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের চুক্তি : ১৭৭২ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের চুক্তির দ্বারা রাশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং প্রাশিয়া এ তিনটি রাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে পোল্যান্ড বাটোয়ারার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

বাটোয়ারা : প্রথম ব্যবচ্ছেদ চুক্তি দ্বারা প্রাশিয়া ডানজিগ ও থর্ন ভিন্ন পশ্চিম-প্রাশিয়া এবং গ্রেট পোল্যান্ডের একাংশ লাভ করে। অস্ট্রিয়া রেড রাশিয়ার অধিকাংশ, গ্যালিসিয়া পোল্যান্ডের একাংশ, স্যান্ডোসির এবং ক্রাকো দখল করে। রাশিয়া হোয়াইট রাশিয়া এবং ডুইনা ও নিপার নদীর মধ্যবর্তী স্থানসমূহ পায়। এ ব্যবচ্ছেদের ফলে পোল্যান্ড এক তৃতীয়াংশ রাজ্য প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা হারায় আর সর্বাধিক লাভবান হয় প্রাশিয়া। পশ্চিম প্রাশিয়া দখল করায় বান্ডেনবার্গ ও পূর্ব প্রাশিয়ার রাজ্যাংশ দুটি ঐক্য লাভ করে।

দ্বিতীয় ব্যবচ্ছেদ

১৭৮৩ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে পোল্যান্ডের জনগণ রাশিয়ার অধীনতাপাশ ছিন্ন করার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়। তারা প্রাশিয়ার সাথে সন্ধি স্থাপন করে দেশের শাসনতন্ত্রের সংস্কার করে নির্বাচনের পরিবর্তে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। লিভেরাম ভেটো উচ্ছেদ করা হয়। ক্যাথলিক ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয় এবং অন্য সকল ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়। অস্ট্রিয়ার রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড (১৭৪৭-১৭৯২) এ সংস্কারের সমর্থন দান করেন। রাশিয়া পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের ক্ষুব্ধ হয়। প্রাশিয়ার সম্রাট ফ্রেডারিকও শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ পোল্যান্ডের উত্থানে বিচলিত হন। তাই রুশ-তুর্কি যুদ্ধাবসানের পর রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন পোল্যান্ড আক্রমণ করে। পোল্যান্ডের কতিপয় অভিজাত রাশিয়ার সৈন্যদলকে সহায়তা করে, ফলে পোল্যান্ড বাহিনী পরাজিত হয়। এদিকে অস্ট্রিয়ার রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড মৃত্যুবরণ করলে পোল্যান্ড বৈদেশিক সামরিক সহায়তা লাভে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় স্টেনিসলাস সমগ্র সংস্কার বাতিল করেন। এদিকে প্রাশিয়া রাশিয়ার সাথে গোপন চুক্তি করে দ্বিতীয় পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের ব্যবস্থা করে। দ্বিতীয় ব্যবচ্ছেদের চুক্তি অনুসারে রাশিয়া পূর্ব পোল্যান্ড, লিটল রাশিয়া, পোডোলিয়ার অবশিষ্টাংশ এবং মিঙ্কস দখল করে, প্রাশিয়া ডানজিগ, থর্ন, পোজেন, লেজেন ও কেনিস্ক লাভ করে। অস্ট্রিয়া দূরবর্তী নেদারল্যান্ডসের পরিবর্তে বেভেরিয়া দখল করার জন্য প্রাশিয়া ও রাশিয়ার সমর্থন পাবে, এ প্রতিশ্রুতি পায়।

তৃতীয় ব্যবচ্ছেদ

যেটুকু স্থান তখনো পোল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল তার স্বাধীনতার জন্য কোসিয়াস্ক নামে একজন দেশপ্রেমিক পোলগনকে এক গভীর জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৭৯৪ সালে পোল্যান্ডে কোসিয়াঙ্কের নেতৃত্বে এক বিদ্রোহ দেখা দেয়। রাশিয়ার সৈন্য দ্রুত পোল্যান্ডে উপস্থিত হয়ে এই বিদ্রোহ দমন করে। পোল্যান্ডকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৃতীয় ব্যবচ্ছেদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি দ্বারা রাশিয়া, গ্যালিসিয়া এবং ডুইনা নদীর মধ্যবর্তী স্থানসমূহ লাভ করে। প্রাশিয়া পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশো এবং পাশ্ববর্তী স্থানসমূহ দখল করে। অস্ট্রিয়া ক্র্যাকো ও গ্যালিসিয়ার যে সকল অংশ প্রথম ব্যবচ্ছেদের সময় পায়নি সে সকল স্থান দখল করে। পোল্যান্ডের আর কোনো চিহ্নই রইল না। ইউরোপের মানচিত্র হতে স্বাধীন পোল্যান্ড রাজ্যটি সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়।

সমালোচনা

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ যে অত্যন্ত লজ্জাজনক কাজ হয়েছিল সেই বিষয়ে দ্বিমত নেই। রাশিয়া, প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলোপ করে নীচ, স্বার্থপরতা এবং নীতিজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছিল সন্দেহ নেই। তারা একটি দুর্বল রাষ্ট্রের জনসমাজের রাজনৈতিক আশাআকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে কেবল পেশিশক্তির সাহায্যে দেশটিকে আত্মসাৎ করে আন্তর্জাতিক, নৈতিক এবং মানবতার দাবি অগ্রাহ্য করেছিল। পোল্যান্ড রাজ্যটিকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সর্বদা বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতাপূর্ণ রাখার যে গোপন শর্ত রাশিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে স্থিরকৃত হয়েছিল তা কোনো নীতিতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া যে ন্যাকারজনক কাজ করেছিল তা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। ঐতিহাসিক গিডেলার মতে, পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ ইউরোপীয় কূটনীতির এক অতিশয় লজ্জাজনক ও নিষ্ফল কার্য ভিন্ন অপর কিছু নয়।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া পোল্যান্ডের মতো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলোপ করে ইউরোপে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এ ধরনের সাম্রাজ্যবাদী লিঙ্গার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। পোল্যান্ড রাজ্যটিকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সর্বদা বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা জিয়ে রাখার কূটকৌশল গ্রহণ করে রাশিয়া ও প্রাশিয়া ন্যক্কারজনক কাজ করেছিল। রাশিয়া ও প্রাশিয়া অপর রাষ্ট্র বিষয়ে যৌথভাবে গোপন সমঝোতা করে ঐ রাষ্ট্রটি বণ্টন করে নেয়ার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে মানব ইতিহাসে একটি কুকীর্তির নজির স্থাপন করেছিল।

কূটনৈতিক বিবেচনা

সফলতা-বিফলতা

তৎকালে কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে রাশিয়া প্রাশিয়ার সাথে এবং অস্ট্রিয়াকে পক্ষভুক্ত করে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ করে ভবিষ্যতে ইউরোপে প্রাশিয়াকে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। এ ক্রমবর্ধমান শক্তি অর্জন করে প্রাশিয়া জার্মানিতে রূপান্তরিত হয়। যার ফলে জার্মানি পরবর্তী যুগে ইউরোপ গ্রাস করার পরিকল্পনা করে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিল। রাশিয়ার পক্ষে প্রয়োজন ছিল পোল্যান্ডের ন্যায় একটি মধ্যবর্তী নিরপেক্ষ রাষ্ট্র রক্ষা করে রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া সীমারেখা বলবৎ রাখা। পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের ফলে এ তিন রাষ্ট্রের সীমারেখা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় নানা রকম সীমান্ত সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।

রাশিয়া পোল্যান্ডের ন্যায় স্লাভজাতি অধ্যুষিত দেশ ছিল। রাশিয়া পোল্যান্ড গ্রাস না করে তাবেদার রাজাকে পোল্যান্ডের সিংহাসনে রেখে সমগ্র পোল্যান্ডের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারত। কিন্তু দ্বিতীয় ক্যাথারিন পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ করে শত্রুদেশ প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার শক্তি বৃদ্ধি করে অনভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পোল্যান্ডকে অনুগত রাজ্য হিসেবে রক্ষা করা রাশিয়ার স্বার্থের দিক দিয়ে প্রয়োজন ছিল। জারিনা ক্যাথরিনের মন্ত্রী পেনিন এরূপ দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করতেন। অস্ট্রিয়ার স্বার্থের দিক থেকে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ একেবারে লাভজনক হয়নি। অস্ট্রিয়ার পক্ষে রাশিয়া রাজ্যসীমা বিস্তার করতে দিয়ে রাশিয়ার সাম্রাজ্য বৃদ্ধি ও প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করেছিল। একমাত্র প্রশিয়ার জন্য পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ লাভজনক হয়েছিল। প্রাশিয়ার প্রাপ্ত অঞ্চল জনবহুল এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক হওয়ায় ভবিষ্যতে প্রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল।

ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ না করার কারণ

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বাধাদানের অপারগতা পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের অন্যতম কারণ ছিল। ইংল্যান্ড সে সময় আমেরিকার সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিল এবং ইংল্যান্ড তার স্বার্থে রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিল। ইংরেজরা মনে করেছিল ফ্রান্স কর্তৃক আক্রান্ত ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক স্বার্থ লন্ডন ও সেন্টপিটার্সবুর্গ রাজদরবারের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ বোঝাপড়ার দ্বারা সম্প্রসারিত হবে। ইংল্যান্ডের ভারত উপনিবেশে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেনি, ভূমধ্যসাগর অথবা কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার আধিপত্যের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। ইংল্যান্ডকে ভারতে ফ্রান্সের প্রতিযোগিতার মোকাবেলা করতে হচ্ছিল এবং সে সময় রাশিয়ার সাথে ফ্রান্সের সুসম্পর্ক ছিল না। পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ইংরেজ ও ফরাসি দ্বন্দ্ব ছিল এবং রাশিয়ার সম্মতিতে ইংল্যান্ড বাল্টিক অঞ্চলে একচেটিয়া আধিপত্য ভোগ করত।

ফ্রান্স পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের সময় কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে নি। পোল্যান্ডে রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে ফ্রান্স তুর্কি হস্তক্ষেপ, পোলদের প্রতিরোধ ও অস্ট্রিয়ার নিরপেক্ষতা বিশ্বাস করত। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী চয়সিউল যদিও রাশিয়া, প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়াকে বাধা দানের নিমিত্তে কূটনৈতিক পন্থা গ্রহণে বিশ্বাসী ছিলেন, পোল্যান্ডের অখণ্ডতা রক্ষায় ইউরোপকে যুদ্ধে লিপ্ত করতে তার কোনো ইচ্ছা ছিল না। এ ছাড়া রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া এমন ন্যক্কারজনক কাজ করবে এটা তিনি ভারতে পারেননি। ১৭৭০ সালে চয়সিউল মন্ত্রীসভার পতন পোল্যান্ড ব্যাপারে ফ্রান্সের সক্রিয় হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নষ্ট করে। এবং দ্বিতীয় জোসেফ ও কৌনিজের পথের প্রতিবন্ধক দূরীভূত হয়। এতে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদে ফ্রান্স মৌনসম্মতি দিয়েছিল এমন ধারণা করা যায়।

উপসংহার

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ ইউরোপের রাজনীতিতে দস্যুবৃত্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। অপর স্বাধীন রাষ্ট্র হরণ করে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল কালক্রমে সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই নেপোলিয়ন (১৭৯৯-১৮১৫) সমগ্র ইউরোপ গ্রাস করতে চেয়েছিল।

পোল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদ পোলিশরা সহজে মেনে নেয় নি। তারা এজন্য প্রতিবাদ করেছিল। ব্যবচ্ছেদে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলোকে পোলিশরা কোনো সময় ভুলে যায় নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) পর পোল্যান্ড স্বাধীনতা লাভ করে। এ থেকে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের অযৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছিল।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করলেও এর জন্য পোল্যান্ডের রাজনৈতিক কাঠামো, রাজাদের দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতা এবং অভিজাতদের স্বার্থপরতা এবং জনগণের জাতীয় চেতনাবোধের অভাব অনেকটা দায়ী ছিল।

পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ প্রাশিয়ার জনগণ যুক্তিসংগত মনে করত। প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক পোল্যান্ডের অধিকৃত অঞ্চল উন্নত করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তিনি খাল খনন করে ওডার নদীকে ভিস্টুলা নদীর সাথে সংযুক্ত করেছিলেন। তিনি পোল্যান্ডের প্রাপ্ত অংশে নগরায়নের বিকাশ সাধন করেছিলেন এবং পতিত জমিকে চাষের আওতায় এনেছিলেন যার ফলে এই অঞ্চলটি প্রাশিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। এখানে কৃষির উন্নতির ফলে কৃষকরা স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছিল এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেছিল। তা সত্ত্বেও প্রাশিয়ার পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদকে আইনসঙ্গতভাবে মেনে নেওয়া যায় না। অনেকের মতে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ দ্বারা পরিশেষে প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া লাভবান না হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ, মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২৮৯-৩০৪

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.