Table of Contents
বৃহত্তর প্রাশিয়া সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার ভিত্তি
সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ব্রান্ডেনবার্গ প্রাশিয়ার উত্থান। বাল্টিক সাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় প্রাশিয়া এক শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম দিকে এই অঞ্চলের জনবিরল অঞ্চল, অনুর্বর ভূমি, খনিজ সম্পদের অভাব সবদিক বিবেচনা করলে এই অঞ্চলটি সেক্সনি অথবা বোহেমিয়ার চেয়ে পশ্চাৎপদ ছিল। দক্ষিণ জার্মানি এবং পশ্চিম ইউরোপের কোনো অঞ্চলের সাথে এর তুলনা করা যেত না। প্রাশিয়ার কোনো প্রাকৃতিক সীমারেখা ছিল না এবং এর পার্শ্ববর্তী দেশ পোল্যান্ড, সুইডেন প্রভৃতি অঞ্চলের সাথে এর সীমারেখা ছিল না এবং এর অভ্যন্তরভাগের সাথে কোনো সমুদ্রের যোগাযোগ ছিল না। ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে হুহেনজোলার্ন (HobenZollern) বংশ এখানকার শাসন ক্ষমতা লাভ করে। মূলত দক্ষিণে জার্মানির একটি ক্ষুদ্র স্থানীয় শাসক পরিবার পবিত্র রোমান সম্রাট সিগিসম্যান্ডের (১৪৩৩-১৪৩৭) অনুগ্রহে সীমান্তবর্তী এ রাজ্যটি লাভ করেছিলেন। পবিত্র রোমান সম্রাট হোহেনজোলানোর রাজপরিবারকে ইলেকটর উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। পবিত্র রোমান সম্রাট নির্বাচনে এ পরিবার অংশগ্রহণ করত। পরবর্তী সময়ে ১৬১৮ সালে এই রাজবংশ ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়া নামক অঞ্চলটি অধিকার করে। ব্র্যান্ডেনবার্গ ও প্রাশিয়ার একত্রীতকরণ ভবিষ্যতে ইউরোপে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে ওঠার সুযোগ লাভ করে। ব্র্যান্ডেনবার্গ, পোমেরিনিয়া এবং পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী প্রাশিয়া বা বুরুশিয়ান (Borussian) অঞ্চলটি লিথুনিয়ান রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিম প্রাশিয়া পোল্যান্ডের অংশ ছিল এবং এ অঞ্চলটি ব্র্যান্ডেনবার্গ এবং পোমেরিনিয়াকে পূর্ব প্রাশিয়া থেকে পৃথক করেছিল। পূর্ব প্রাশিয়া টিউটনিক নাইটদের শাসনাধীনে ছিল এবং এরা ছিল সামরিক দিক থেকে খুবই দক্ষ। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের মানুষ খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। পূর্ব প্রাশিয়ার বান্টিক উপকূল পোল্যান্ড রাজ্য দ্বারা অধীকৃত ছিল। প্রাশিয়ার ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল জার্মান। প্রাশিয়ার উত্তরে বাল্টিক সাগর, ফিনল্যান্ড এবং লিথুনিয়ান, লেট এস্তোনিয়ান প্রভৃতি জনগোষ্ঠী ছিল। মধ্যযুগে জার্মান বণিকরা এসকল অঞ্চলে নগর প্রতিষ্ঠা করে এবং অনেক জার্মান ভূম্যধিকারীর বংশধররা ঐ এলাকার আধিপত্য করে আসছিল। তাদের মধ্যে জার্মান ভাবধারা ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে ওঠার জাতীয় চেতনা হিসেবে কাজ করেছিল।
ব্র্যান্ডেনবার্গ—প্রাশিয়ার রাজ্য বিস্তার : ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার জনগোষ্ঠী টিউটনিক জাতিগোষ্ঠীর লোক হওয়ায় ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার রাজ্যসীমা বৃদ্ধি পায়। ১৬১৮ সালে ব্র্যান্ডেনবার্গের ইলেকটর ডাচি অব প্রাশিয়া (East Prussia) উত্তরাধিকার হিসাবে লাভ করেন। ত্রিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধের (১৬১৮-১৬৪৮) আগ পর্যন্ত প্রাশিয়া টিউটনিক নাইটদের শাসনাধীন ছিল। পূর্ব প্রাশিয়া পোলিশ ডিউকদের অধীনস্থ ছিল এবং হোহেনজোলার্নের পরিবারের একটি শাখা প্রাশিয়া শাসন করত। সেখানকার শাসক পরিবার (Docal family) মারা গেলে ১৬১৮ সালে এটি হোহেনজোলার্মের পরিবারের শাসনাধীনে চলে আসে। এই ঘটনা ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার সীমান্ত বৃদ্ধি করে। আরেকটি ঘটনা ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার রাজনৈতিক উত্থান প্রশস্ত করে। ত্রিশবর্ষব্যাপী যুদ্ধে সুইডিশরা প্রোমেরিনিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল বিশেষ করে সেটিন (Settin) নগর লাভ করে এবং ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিতে ব্র্যান্ডেনবার্গ পূর্ব পোমেরিনিয়া (East Pomerania), ব্যারেন (Barren) প্রভৃতি গ্রাম্য এবং পোতাশ্রয়বিহীন অঞ্চল লাভ করেন, তবুও এগুলো ব্র্যান্ডেনবার্গের সাথে যুক্ত হওয়ায় বাল্টিক সাগরের সাথে ব্র্যান্ডেনবার্গের সংযোগ সম্ভব হয়। এর ফলে প্রাশিয়া ডাচি অব প্রাশিয়া এবং পশ্চিম প্রাশিয়া দখল করে বৃহত্তর প্রাশিয়া সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি হয়।
পূর্ব প্রাশিয়া এবং পূর্ব পোমেরিনিয়া প্রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়া রাজ্য পূর্ব ইউরোপ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার ঘটে। ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধিতে পূর্ব পোমেরিনিয়া লাভ করে এবং হলবাস্টার্ট (Halberstadt), ম্যাকডেবার্গ (Megdeburg) যা এলবা নদীর পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত বিশপ শাসিত অঞ্চলগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়।
ফ্রেডারিক উইলিয়াম, দি গ্রেট ইলেক্টর (১৬৪০-১৬৮৮)
ত্রিশবর্ষব্যাপী যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেডারিক উইলিয়াম প্রাশিয়ার গ্রেট ইলেক্টর নিয়োগ লাভ করেন। তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর। তিনি আধুনিক প্রাশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি কঠোর অবস্থার মধ্যে বড় হন। সে সময় ব্র্যান্ডেনবার্গ জার্মানির অংশ হিসেবে ত্রিশবর্ষব্যাপী যুদ্ধে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ব্র্যান্ডেনবার্গের ভৌগোলিক অবস্থান সুইডিশ সেনাবাহিনী এবং অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ সেনাবাহিনীর যুদ্ধের কেন্দ্র ছিল। ১৬৪০ সালে ত্রিশবর্ষব্যাপী যুদ্ধের ২২ বছর হয়েছিল এ সময় বার্লিনের জনসংখ্যা ১৪ হাজার থেকে কমে ৬ হাজারে নেমেছিল। ফ্রাঙ্কফুটের লোকসংখ্যা ১২ হাজার থেকে দুই হাজারে নেমে এসেছিল। শত শত গ্রাম বিলীন হয় এবং সময় দেশ নেকড়েদের বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছিল।
ফ্রেডারিক উইলিয়াম সিংহাসনে বসেই নিজের অবস্থা উপলব্ধি করেন তার অধীনস্থ ছোট্ট এবং উন্মুক্ত সীমান্ত কোনো রকমের প্রাকৃতিক সীমারেখা না থাকায় এর প্রতিরক্ষা দুর্বল ছিল। ব্র্যান্ডেনবার্গ শক্তিশালী প্রতিবেশি রাষ্ট্র দ্বারা আবদ্ধ ছিল। যার ফলে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। কিন্তু ত্রিশবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ব্র্যান্ডেনবার্গের আর্থিক কাঠামো ভেঙে পড়ায় ফ্রেডারিক উইলিয়ামের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এ ছাড়া ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার প্রত্যেকটি অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা ছিল পৃথক এবং প্রত্যেকটিরই একটি স্থানীয় সভা (Diet) এবং স্থানীয় কর্মচারী ছিল। এসময় উত্তর ইউরোপে সুইডেন শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। ওডার নদীর মোহনা সুইডেনের নিয়ন্ত্রণে থাকায় প্রাশিয়ার জন্য সমুদ্রে পৌঁছার পথ রুদ্ধ ছিল। এ সকল নানা সমস্যা মাথায় রেখে তিনি প্রাশিয়ার উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ফ্রেডারিক উইলিয়ামের কর্মপরিকল্পনা : ফ্রেডারিক উইলিয়াম ত্রিশবর্ষব্যাপী যুদ্ধের পর মাত্র আট হাজার সৈন্যের সামরিকবাহিনী পেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির সংবাদের প্রারম্ভেই তিনি সমগ্র পোমেরিনিয়াকে সুইডেনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে পেরেছিলেন। ফ্রেডারিক উইলিয়াম প্রাশিয়ার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করার জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন প্রবর্তন করেন। তিনি প্রাশিয়ার ঐক্য সুদৃঢ় করার জন্য বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত অঞ্চলগুলো কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও সুদক্ষ আমলা শ্ৰেণী গড়ে তোলেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
অভ্যন্তরীণ নীতি :
- (১) শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করেই ফ্রেডারিক স্থানীয় সভাগুলোর (Diet) ক্ষমতা বিলোপ করেন এবং কাউন্সিল অব স্টেট বা রাষ্ট্রসভা নামে একটি কেন্দ্রীয় সভা স্থাপন করেন। এই সভা ফ্রেডারিক উইলিয়ামের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করত। রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ড এই সভার সাহায্যে পরিচালিত হত।
- (২) রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসেন। আঞ্চলিক শাসকদের এ বিষয়ে কোনো ক্ষমতা ছিল না।
- (৩) রাষ্ট্রের শাসনকার্যে ফ্রেডারিক উইলিয়াম একটি নতুন রাষ্ট্রীয় সেবক শ্রেণী পড়ে তোলেন। এরা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত। এর মাধ্যমে তিনি অভিজাতদের ক্ষমতা বিলোপ করেছিলেন।
- (৪) রাজ্যের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য করার জন্য বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তবে রাজ্যের শিল্প বিকাশের জন্য আমদানির উপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করেছিলেন।
- (৫) রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করেন। এজন্য নতুন রাস্তাঘাট ও খাল তৈরি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে জল ও স্থলপথে বাণিজ্য চলাচলের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার সময় যে সকল খাল খনন করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে ফ্রেডারিক উইলিয়াম খাল বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল। এই খালটি ওডার ও এলব নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল।
- (৬) ফরাসি রাজ চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) ১৬৮৫ সালে অ্যাডিক্ট অব নান্টস (Edict of Nantes) বাতিল করলে অনেক ফরাসি প্রোটেস্ট্যান্টরা (হিউগেনো) ফ্রান্স ত্যাগ করলে ফ্রেডারিক উইলিয়াম তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানান। হিউগেনো শিক্ষা, জ্ঞান ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পারদর্শী ছিল। তাদের প্রচেষ্টায় প্রাশিয়া শিল্পের বিকাশ হয়।
- (৭) ফ্রেডারিখ উইলিয়াম সামরিক শক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করে সামরিকবাহিনীর উন্নতি করেন। অস্থায়ী সামরিকবাহিনীর পরিবর্তে তিনি আধুনকি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি ৮ হাজার সৈন্যবাহিনীকে বিশ হাজার সৈন্যবাহিনীতে উন্নীত করেন। তার সমকালীন প্রাশিয়ার সেনাবাহিনী দক্ষ ও দুর্ধর্ষ ছিল। পরবর্তীকালে ইউরোপে প্রাশিয়া সামরিক ক্ষেত্রে যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিল তার গোড়াপত্তন করে গিয়েছিলেন ফেডারিক উইলিয়াম।
- (৮) তিনি শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সামরিক ও বেসামরিক বিভাগকে পৃথক করেছিলেন।
পররাষ্ট্রনীতি :
- পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ফ্রেডারিক উইলিয়ামের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ১৬৪৮ সালে স্বাক্ষরিত ওয়েস্টফেলিয়ার সন্ধির পরবর্তী বিভিন্ন জার্মান প্রিন্সদের দ্বন্দ্ব মোকাবেলা। দক্ষিণ অঞ্চলে ব্র্যান্ডেনবার্গ ফ্রান্সের পক্ষ হয়ে হ্যাপসবার্গ (অস্ট্রিয়ার রাজবংশ) রাজ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অব্যবস্থার সুযোগে ১৬৮০ সালে ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই আলসেস কুক্ষিগত করেছিল। উত্তরাঞ্চলে সুইডেন, পোল্যান্ডের যুদ্ধে ব্র্যান্ডেনবার্গ সুইডেনকে সমর্থন করেছিল। ফ্রেডারিক উইলিয়াম পূর্ব প্রাশিয়া থেকে পোল্যান্ডের আধিপত্য দূর করেন। তিনি সুইডেনের সাথে এক গোপনচুক্তি করে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। যখন পোল্যান্ড তার প্রতিপক্ষদের পরাস্ত করে তখন তিনি পোল্যান্ডের সঙ্গে সুইডেনের বিরুদ্ধে সন্ধি করে তার সহায়তার মূল্য দাবি করেন এবং ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ওলিভার সন্ধির দ্বারা ডিউক শাসিত প্রাশিয়ার উপর ফ্রেডারিক উইলিয়ামের সার্বভৌম স্বীকার আদায় করেন।
- ফ্রেডারিক উইলিয়ামের পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ছিল রাজপদে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়। সে সময় জার্মানির বিভিন্ন শাসকগণ নিজেদের রাজ স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সচেষ্ট ছিল। সে সময় একমাত্র বোহেমিয়া ছাড়া আর কোন জার্মান রাজ্যের শাসকদের রাজা উপাধি ছিল না। তার এই পদক্ষেপ পরবর্তী সময় প্রথম ফ্রেডারিকের সময় রাজ উপাধি গ্রহণ করা সহজ হয়েছিল।
- ফ্রেডারিক উইলিয়াম পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে দূরদর্শী ও কূটনীতি অনুসরণ করে প্রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষা করতেন। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে যখন যুদ্ধে লিপ্ত হন তখন সুইডেন ফ্রান্সের মিত্রশক্তি হিসাবে প্রাশিয়া আক্রমণ করে। সুইডেনরাজ একাদশ চার্লস (১৬৬০-১৬৯৭) ফারবেলিন (Ferrbelin) এর যুদ্ধে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেডারিক উইলিয়ামের নিকট পরাজিত হন। এই যুদ্ধে জয় লাভের ফলে প্রাশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং ইউরোপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রাশিয়ার মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
- ফ্রেডারিক উইলিয়াম প্রাশিয়ার স্বার্থে যুদ্ধ এবং কূটনৈতিকের মধ্য যেটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন সেটি গ্রহণ করতেন। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে ওরেস্টফেলিয়ার সন্ধিতে তিনি কূটনৈতিক ক্ষমতাবলে হলবারষ্ট্রেডেট, কেমিন, মিনডেন, ম্যাগ্ ডেবার্গ ও পূর্ব পোমেরিনিয়া লাভ করেন। এ সকল স্থান লাভের ফলে প্রাশিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। এ ছাড়া রিভস, মার্ক ও র্যাভেন্সবার্গ নামক স্থান তিনটি প্রাশিয়ার অধিকারে চলে আসে। এ তিনটি স্থান আইনত প্রাশিয়ারই ছিল। কিন্তু সেগুলোর উপর প্রাশিয়ার কর্তৃত্ব ছিল না।
গ্রেট ইলেক্টরের কৃতিত্ব : ফ্রেডারিক উইলিয়াম প্রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাজ আনুগত্য, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভিতর থেকে সরকারি কর্মচারী নিয়োগ, স্থায়ী ও দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী গঠন। প্রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে প্রাশিয়ার সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার ভিত্তি স্থাপন করেন। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে দূরদর্শী কূটনীতির মাধ্যমে প্রাশিয়াকে ইউরোপের সম্মানজনক আসনে প্রতিষ্ঠা করেন। ফারবেলিনের যুদ্ধে সুইডেনকে পরাজিত করে প্রাশিয়াকে ইউরোপের একটি শক্তিশালী দেশে উন্নীত করেন। তার গৃহীত অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির সফলতার জন্য পরবর্তীকালে প্রাশিয়া ইউরোপের একটি শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছিল।
প্রথম ফ্রেডারিক (১৬৮৮–১৭১৩)
ফ্রেডারিক উইলিয়ামের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম ফ্রেডারিক ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়ার ইলেকটর পদ লাভ করেন। তিনি ছিলেন উচ্চবিলাসী ও আড়ম্বরপ্রিয় শাসক। তিনি প্রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রাশিয়াকে একটি সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। তবে তিনি জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। প্রাশিয়াতে “বিজ্ঞান একাডেমি” প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
প্রথম ফ্রেডারিকের রাজ উপাধি লাভ প্রথম ফ্রেডারিকের পূর্ববর্তী প্রাশিয়ার হুহেনজোলার্নের শাসকরা ইলেকটর উপাধি ধারণ করে শাসন করতেন। স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধে (১৭০১-১৭১৪) প্রথম ফ্রেডারিক অস্ট্রিয়ার পক্ষে যোগদান করে। অস্ট্রিয়ার সম্রাটের নিকট থেকে রাজ উপাধি প্রাপ্ত হন। ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে ইউট্ৰেক্টরের সন্ধির (১৭১৩) মাধ্যমে তার এ উপাধি ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ স্বীকার করে নেয়। রাজ পদ লাভের ফলে প্রথম ফ্রেডারিকের রাজসম্মান লাভ হয় এবং প্রাশিয়ার রাজা ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের সমপর্যায়ে উন্নীত হন।
প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়াম (১৭১৩-১৭৪০)
প্রথম ফ্রেডারিকের মৃত্যুর পর তার পুত্র ফ্রেডারিক উইলিয়াম প্রাশিয়ার রাজপদ লাভ করেন। তিনি ছিলেন কঠোর প্রকৃতির শাসক। প্রাশিয়াকে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য তিনি প্রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে অত্যন্ত শক্তিশালী করেছিলেন। তিনি প্রাশিয়ার রাজপদকে সামরিক নেতার পদে পরিণত করেছিলেন। সেকালীন ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের সামরিক শক্তি হয়তো তাকে সামরিক শক্তিবৃদ্ধিতে প্ররোচিত করেছিল। সামরিক কঠোরতার জন্য তার নিকট সাহিত্য ও শিল্পকলা গুরুত্বহীন মনে হত। এমনকি তিনি নিজ পুত্রের প্রতিও কঠোর আচরণ করেছিলেন। তাকে বন্দি করে সামরিক শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল। তার নিষ্ঠুরতার জন্য সরকারি কর্মচারীগণ সর্বদাই ভীতসন্ত্রস্ত থাকত। তার আদেশ পালনে কোনো কর্মচারী গাফিলতি করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হত। এইরূপ একটি কাহিনী আছে যে, তার আদেশ মতো এক ব্যক্তিকে ফাঁসি দিতে গিয়ে তাকে না পেয়ে অপর এক নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল, কারণ রাজ- আজ্ঞা পালনে বিলম্ব করবার অবকাশ ছিল না। ফ্রেডারিক উইলিয়াম প্রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধিতে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রথম ফ্রেডারিক সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে তা বাস্তবায়নে সকল পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ফ্রেডারিক দি গ্রেট (১৭৪০-১৭৮৬) প্রাশিয়াকে ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। প্রথম ফেডাবিক প্রাশিয়াকে শক্তিশালী করার জন্য তিনটি উদ্দেশ্যকে তিনি শাসননীতির মূল বিষয় করেছিলেন। যথা – (১) প্রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন, (২) প্রাশিয়ার সামরিকবাহিনী শক্তিশালীকরণ, (৩) রাজশক্তিকে সর্বাত্মক করে তোলা।
অভ্যন্তরীণ নীতি : প্রথম ফ্রেডারিক শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত করে সকল বিষয় নিজ নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। শাসন পরিচালনার জন্য জেনারেল ডাইরেক্টরি (General directory) নামে একটি কেন্দ্রীয় সভা গঠন করেছিলেন। এ সভা রাজনির্দেশে রাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগ পরিচালনা এবং রাজকর্মচারীদের সকল কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করত।
কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতি : অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের অনেক দেশ মার্কেন্টাইল অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিল। এই নীতি আমদানি হ্রাস এবং রপ্তানিকে উৎসাহিত করে। প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়াম এই নীতি অনুসরণ করে আমদানি পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক স্থাপন করেন। ফলে দেশীয় শিল্প বিকাশের সুযোগ পায়। তিনি প্রাশিয়ার জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন এবং কারিগরি বিদ্যার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি প্রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণ করেছিলেন। তিনি ক্ষুদ্র প্রাশিয়ার রাজ্যের সৈন্যসংখ্যা ৩৮ হাজার হতে ৮৪ হাজারে (কারো কারো মতে ৮০ হাজার) বর্ধিত করেন। তিনি পিতামহসুলভ আদর্শ নিয়ে প্রাশিয়ার সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনি সমগ্র প্রাশিয়া রাজ্যকে একটি স্কুল মনে করতেন এবং উৎসাহী শিক্ষকের ন্যায় অলস ও অকর্মণ্য প্রজাদেরকে নির্দয়ভাবে বেত্রাঘাত করতেন এবং তাদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করতেন। তিনি পোটস্ডাম গার্ডস অব জায়েন্টস (Potsdam Giards of Giants) নামে ৬ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট সৈনিকদের একটি রেজিমেন্ট গঠন করেছিল। অধিক বেতনের সুযোগ দেখিয়ে দেশী ও বিদেশী ৬ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট সৈনিকদের নিয়োগ দিতেন। তিনি রাজকীয় ব্যায়ের ক্ষেত্রে কৃপণ হলেও পোটসডাম বাহিনীর জন্য মুক্ত হস্তে ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হতেন না।
পররাষ্ট্রনীতি : পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়াম আগ্রাসী ছিলেন না। তবে প্রাশিয়ার স্বার্থে সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সুইডেন রাজা দ্বাদশ চার্লস (১৬৯৭-১৭১৮) পোস্টাভার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সামরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়াম সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তিনি সুইডেনের সর্বশক্তিকে পরাজিত করে ওডার নদীর মোহনায় পোমেরিনিয়ার একাংশ, ডানজিক ও স্ট্রেটিন অধিকার করেন। ১৭২১ সালে স্বাক্ষরিত নিষ্ট্যাডাটের সন্ধিতে এই সকল স্থানের উপর প্রাশিয়ার অধিকার স্বীকৃত হয়। ১৭২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়াম জার্মানির হেনোভার লীগে যোগদান করেন কিন্তু অস্ট্রিয়ার পবিত্র রোমান সম্রাট ষষ্ঠ চার্লস (১৭১১-১৭৪০) তাকে জুলিক ও বার্গ স্থান দুটি দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই লীগ ত্যাগ করাতে সমর্থ হন এবং ‘প্রাগম্যাটিক স্যাংশন’ নামক এক স্বীকৃতি পত্রে স্বাক্ষর নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে এই প্রতিশ্রুতি পূরণে অস্ট্রিয়া অস্বীকার করলে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে শত্রুতা যুদ্ধ সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়ামের অবদান : প্রাশিয়ার উন্নতিতে প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়ামের অবদান ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রাশিয়াকে ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি দূরদর্শী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। শাসন ক্ষেত্রে তিনি জনগণের মঙ্গলের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং অর্থের অপচয় বন্ধ করে শাসনব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করেছিলেন। তিনি প্রাশিয়ার জন্য একটি দক্ষ আমলা শ্ৰেণী, দুর্ধর্ষ সামরিকবাহিনী রেখে গিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে তার পুত্র ফ্রেডারিক দি গ্রেটের সময় অত্যন্ত কার্যকরী হিসাবে কাজ করেছিল। তিনি পোমেরিনিয়ার একাংশ ডানজিক ও স্ট্রেটিন দখল করে ওডার নদীর মোহনা পর্যন্ত প্রাশিয়ার রাজ্যসীমা বিস্তার ঘটিয়ে ছিলেন। বিশেষভাবে নিজ পুত্র ফ্রেডারিককে যোগ্য করে তোলার জন্য সামরিক ও বেসামরিক শিক্ষার পারদর্শী করেছিলেন। তার নীতি ও আদর্শ প্রাশিয়াকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল।
দ্বিতীয় ফ্রেডারিক বা ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট (১৭২২ – ১৭৮৬)
ভূমিকা
প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়ামের মৃত্যুর পর ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেডারিক প্রাশিয়ার সিংহাসন লাভ করেন। তিনি ইতিহাসে ফ্রেডারিক দি গ্রেট নামে পরিচিত। সমকালীন ইউরােপে জ্ঞানদীপ্ত শাসক, কূটনীতিবিদ, সামরিক দূরদর্শিতা অনেক গুণে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। শাসক হিসাবে তার প্রতিভা ও দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। লর্ড অ্যাক্টন তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন “He was the most consummate Practical genius that in modern times has ever inherited a throne.”
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা : ফ্রেডারিক দি গ্রেট ১৬১২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে ফ্রেডারিক সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু সাহিত্য ও শিল্পকলা মানুষের মনকে নারীসুলভ করে এবং তা চরিত্রকে দুর্বল করে এই ধারণায় তার পিতা প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়াম তাকে কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে জীবনযাপনে বাধ্য করেছিলেন। পিতার কঠোর শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি একবার পলায়ন করে ধৃত হন। এজন্য তাকে অত্যন্ত শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, এমনকি তার পিতা তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চাইলে কর্মচারীদের অনুরোধে তিনি রক্ষা পান। এরপর তাকে কঠোর সামরিক শিক্ষা এবং প্রশাসনিক শিক্ষা সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া হয়। তিনি সামরিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বনিম্নস্তর থেকে যোগ্যতা দেখিয়ে সর্বোচ্চ স্তরে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তার উপর এই কঠোর নীতি তাকে সামরিক ও বেসামরিক উভয় শিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট যোগ্য করেছিল। তার সম্পর্কে বলা হয় যে, এমন যথাযোগ্য শিক্ষা লাভ করে অপর কোনো রাজা সিংহাসনে আরোহণ করেননি।
তিনি সামরিক ও বেসামরিক শিক্ষা লাভ করলেও তার চরিত্রের মধ্যে পরস্পর বিরোধী গুণের সমাবেশ হয়েছিল। চরিত্রগত দিক থেকে তিনি কঠোর, স্বার্থপর ও উগ্র প্রকৃতির ছিলেন। আবার অন্যদিকে তিনি ভাবুক, সাহিত্যামোদি বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কূটনৈতিক বুদ্ধিতে তিনি সেকালের অদ্বিতীয় ছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তিনি কোনো ন্যায় অন্যায়কে বিবেচনায় আনতেন না। কপটতা, কূটনীতি, অসুবিধা বাধিতা তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। অপর রাজ্য ও অধিকার আত্মসাৎ করতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করতেন না। ছিলে বলে নিজ উদ্দেশ্য হাসিল করা তার উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বলতেন, “অপরের সম্পত্তি দখল করা অনুচিত নয়, যদি তা পুনরায় ফিরিয়ে দিতে না হয়।” (‘Take what you can you are never wrong unless you are obliged to give back.”)
ফ্রেডারিক দি প্লেটের হৃদয় ছিল কঠিন এবং মন ছিল পরদোষগ্রাহী। এ সকল দোষত্রুটি থাকা সত্ত্বেও রাত্রে তিনি লক, মন্টেস্কু, তুর্গো, ভলতেয়ার, এডাম স্মিথ প্রমুখ দার্শনিকদের রচিত গ্রন্থ পাঠ করতেন। তিনি রাশিয়ার জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন (১৭৬২-১৭৯৬), অস্ট্রিয়ার মেরিয়া থেরেসা (১৭৪০-১৭৮০) সম্পর্কে তিনি নানা প্রকার বিদ্রুপাত্মক কবিতা লেখতেন।
অভ্যন্তরীণ নীতি
- (১) মহান ফ্রেডারিকের ব্যক্তি চরিত্র স্বার্থপরতার দোষে দুষ্ট হলেও তিনি ইউরোপে প্রাশিয়াকে একটি সুশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। শাসন সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণ করলেও রাজকীয় ক্ষমতা সর্বোতভাবে জনকল্যাণে নিয়োজিত করেছিলেন। তার ন্যায় প্রজাহিতৈষী শাসক অষ্টাদশ শতকে দুর্লভ ছিল। তিনি নিজকে রাষ্ট্রের প্রধান সেবক মনে করতেন। তিনি বলতেন, ‘The Monarch is not the absolute master, but only the first servant of the state.” “শাসক নিরঙ্কুশ প্রভু নন; তিনি কেবল রাষ্ট্রের প্রধান ভৃত্য।”
- (২) প্রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তিনি বৈজ্ঞানিক খামার পদ্ধতি প্রচলন করেন, অনাবাদি জমি পরিষ্কার করে ফসলি ভূমিতে পরিণতকরণ, খাল খনন দ্বারা ফসল উৎপাদন গৃহপালিত পশুর প্রজননের উন্নতি সাধন ইত্যাদির উৎসাহ দিয়ে অর্থনীতিক উন্নতি সাধন করেন। তিনি সরকারি রাজস্বকে সঠিক কাজে ব্যয় করতেন। তিনি কোনো রকম রাজপ্রাসাদের আড়ম্বর বা জাঁকজমকে অর্থ ব্যয় করতেন না।
- (৩) প্রাশিয়া দুটি বৃহৎ ভূখণ্ডের সমন্বয়ে একটি রাষ্ট্র ছিল। এর মধ্যে ব্র্যান্ডেনবার্গ এবং পোল্যান্ডের এককালীন সামন্ত শাসিত অঞ্চল পূর্ব প্রাশিয়া এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন জার্মানের পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রটির চর্তুপাশে শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। এর মধ্যে সুইডেন, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সের নাম উল্লেখ করা যায়। ২২,০০,০০০ জন অধ্যুষিত এবং ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আয়তনে তেরতম ভৌগোলিক আয়তনবিশিষ্ট রাষ্ট্রটিকে থাকার প্রধান শর্ত ছিল এর শক্তিশালী সেনাবাহিনী। তার পিতা ফ্রেডারিক উইলিয়াম নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে প্রাশিয়ার মর্যাদা বহাল রেখেছিলেন। আর পুত্র মহান ফেডারিক প্রথমে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী গঠন করেন। তিনি সৈন্যবাহিনীর ব্যয় মেটানোর জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিকে শক্তিশালী করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে কঠোর শৃঙ্খলা নিয়মিত কুচকাওয়াজ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষিত অফিসার নিয়োগ করে প্রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন।
- (৪) তিনি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করেন এবং ফৌজদারি মামলার নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার বিলোপ করেন তবে রাষ্ট্রদ্রোহীতার ক্ষেত্রে নির্যাতন ব্যবস্থা বলবৎ ছিল।
- (৫) মহান ফেডারিক ধর্ম ক্ষেত্রে উদার ছিলেন। যদিও সেসময় প্রাশিয়া প্রোটেস্টান্ট অধ্যুষিত রাষ্ট্র ছিল কিন্তু প্রোটেস্টান্টবাদ সম্পর্কে তার কোনো উৎসাহ ছিল না। খ্রিস্ট ধর্মের নৈতিকতা সম্পর্কে তার সন্দেহ ছিল এবং বাইবেল সম্পর্কে তার আস্থা ছিল না। সকল ধর্মযাজকদের তিনি অবজ্ঞা করতেন এবং ঘোষণা করতেন সকল ধর্মকে সহিষ্ণুতার চোখে দেখতে হবে এবং প্রত্যেকের মতো করে প্রত্যেককে স্বর্গে যাবার অনুমতি দিতে হবে। তিনি ভূম্যধিকারীদের অতিরিক্ত নিপীড়ন থেকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি জনগণের মঙ্গলের জন্য নিজকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং সৈনিকদের জীবনমান উন্নত করেছিলেন। প্রোটেস্টান্ট প্রজাদের শাসক হলেও তিনি প্রাশিয়াতে ক্যাথলিকদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, ক্যাথলিকরা তাদের ইচ্ছামতো উঁচু বুরুজ এবং ঘণ্টা বাজিয়ে ইচ্ছামতো গির্জা তৈরি করতে পারবে। যদি তুর্কিরা তার দেশে বসবাস করতে চায় তা হলে তিনি নিজেই তাদের জন্য মসজিদ তৈরি করে দেবেন।
- (৬) ফ্রেডারিক প্রাশিয়ার বুদ্ধিভিত্তিক উন্নতির জন্য বিজ্ঞান ও শিল্পকলা শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি বার্লিনে ‘একাডেমি অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাধারণ প্রজাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
- (৭) মহান ফ্রেডারিক নিজেই অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি নিয়মিত সমগ্র রাষ্ট্রের কৃষি ও শিল্প দেখাশোনা করতেন।
- (৮) মহান ফ্রেডারিক ভূমিদাসত্ব প্রথাকে অপছন্দ করলেও ভূমিদাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তবে তাদের মঙ্গলের জন্য ভূম্যধিকারীদের উপদেশ দিতেন। তিনি বলতেন, ‘কৃষকরা ভূমিদাসত্ব অবস্থায় থাকবে কিন্তু তাদের আর্থিক বোঝা হ্রাস করতে হবে।’ তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি সারা দিন মাঠে কাজ করে তাকে কর আদায়কারীদের নির্যাতন করা উচিত নয়।
পররাষ্ট্রনীতি
ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট বা মহান ফ্রেডারিকের সময় ১৮শ শতাব্দীতে ইউরােপে অস্ট্রিয়া একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। অস্ট্রিয়া ক্যাথলিক ধর্ম অধ্যুষিত রাজ্য এবং বিভিন্ন জাতি গােষ্ঠীর লােক নিয়ে অস্ট্রিয়ার জনশক্তি তৈরি হয়েছিল। ইউরােপের পবিত্র রােমান সম্রাটের পদ লাভ করত অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ পরিবার। অনেক জার্মান রাষ্ট্রের ওপর অস্ট্রিয়ার অপ্রতিহত আধিপত্য ছিল। কাজেই ফ্রেডারিক সিংহাসনে আরােহণ করেই সাইলেশিয়াকে কেন্দ্র করে অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধ শুরু করেন। সাইলেশিয়া অস্ট্রিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। এখানকার জনগােষ্ঠী ছিল প্রােটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে অষ্ট্রিয়ার সম্রাট ষষ্ঠ চালর্সের (১৭১১-১৭৪০) মৃত্যুর পর তার কন্যা মেরিয়া থেরেসা (১৭৪০-১৭৮০) ২৪ বছর বয়সে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে বসেন। মেরিয়া থেরেসার পিতা সম্রাট ৬ষ্ঠ চার্লসের কোনাে পুত্র সন্তান না থাকায় মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্ব হতেই তার কন্যা মেরিয়া থেরেসাকে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করার পরিকল্পনা করেন। স্যালিক আইন অনুসারে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে স্ত্রীলােকের আসনের কোনাে সুযােগ ছিল না। ৬ষ্ঠ চার্লস এই আইনগত সমস্যা দূর করার জন্য ‘প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন’ নামে এক স্বীকৃতিপত্র ইউরােপের রাজগণ কর্তৃক স্বাক্ষর করিয়ে মেরিয়া থেরেসাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে ঘােষণা করেন। তবে ইউরােপীয় রাজগণ এই শর্তে স্বাক্ষর করেছিলেন যে, মেরিয়া থেরেসা পবিত্র রােমান সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বা পবিত্র রোমান সম্রাজ্ঞী হবেন না। কাজেই কেবল অস্ট্রিয়ার সম্রাট হিসেবে মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার সিংহাসন লাভ করেন। উল্লেখ্য সে সময় অস্ট্রিয়ার সম্রাটই পবিত্র রােমান সম্রাট পদ লাভ করতেন। প্রাশিয়াকে এই সম্মতি দেওয়ার জন্য মহান ফ্রেডারিকের পিতা প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়ামকে ১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে জুলিক ও বার্গ নামক স্থান দুটি দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে এই প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি। মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে বসলে তাই ফ্রেডারিক তাকে রানী বলে স্বীকার করেননি। জুলিক ও বার্গ নামক স্থান দুটি প্রদান না করায় পিতার স্বাক্ষরিত ‘প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন’ মানতে তিনি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। মূলত অস্ট্রিয়ার সামরিক দুর্বলতা, মেরিয়া থেরেসার অনভিজ্ঞতা এবং প্রাশিয়ার সামরিক ঐশ্বর্য ফ্রেডারিককে অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে প্ররােচিত করে।
সাইলেশিয়া অধিকার ও অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ (১৭৪০-১৭৪৮)
মেরিয়া থেরেসা যখন অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে বসেন তখন অস্ট্রিয়ার সামরিকশক্তি ছিল দুর্বল এবং কোষাগার ছিল শূন্য। তিনি অনভিজ্ঞ ও অল্প বয়স্ক ছিলেন। এছাড়া প্র্যাগম্যাটিক স্যাংকশনের কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধির দিকে মনােযােগ দিতে পারেন নি। বিভিন্ন জাতি ও ধর্ম অধ্যুষিত অস্ট্রিয়া ভূখণ্ড ছিল অসংগঠিত। দ্বিতীয় ফ্রেডারিক তাই এ দুর্বলতার সুযােগে অস্ট্রিয়ার সাইলেশিয়া অঞ্চল দখলের পরিকল্পনা করেন। সাইলেশিয়া ওডার নদীর উর্বর উত্তর উপত্যকায় বিস্তৃত ছিল। এটি পূর্বে স্লাভীয় পোলদের থেকে পশ্চিমে বোহেমিয়ার স্লাভীয় চেকদেরকে পৃথক করে রেখে ছিল। এই রাজ্যের লোকসংখ্যা সবই জার্মান এবং বেশিরভাগ প্রোটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বী ছিল। এর জনসংখ্যা প্রাশিয়ার রাজ্যের জনসংখ্যার সমান ছিল। এটি প্রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারলে প্রাশিয়া সমৃদ্ধ হবে। অপরদিকে জার্মান জনগোষ্ঠীর নিকট প্রাশিয়ার সম্মান বৃদ্ধি পাবে। অস্ট্রিয়া এই অঞ্চলটি হারালে সে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আরো দুর্বল হবে। সাইলেশিয়া দখলের জন্য মহান ফ্রেডারিক একটি সেকেলে দাবি উত্থাপন করে। এখান থেকেই প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটে, যার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল সাইলেশিয়া অধিকার। সাইলেশিয়ার ওপর বহু প্রাচীন পারিবারিক উত্তরাধিকারের অজুহাতে সাইলেশিয়ার ওপর দাবি জানিয়ে ফ্রেডারিক মেরিয়া থেরেসাকে এক চরমপত্র পাঠালেন। এই পত্রে জানানো হল যে,
- (১) মেরিয়া খেরেসা যদি সাইলেশিয়ার ওপর ফ্রেডারিকের অধিকার মেনে নেন, তা হলে ফ্রেডারিক অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্য রক্ষার্থে সর্বদা সাহায্য করবেন।
- (২) আর এ দাবি অস্বীকৃত হলে ফ্রেডারিক যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হবেন।
মেরিয়া থেরেসা এই চরমপত্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলে ১৭৪১ সালে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এই দাবির প্রতি উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে, মেরিয়া থেরেসার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফ্রেডারিক সাইলেশিয়া আক্রমণ করেন। এক বছরের মধ্যেই ফ্রেডারিক প্রায় সমগ্র সাইলেশিয়া দখল করে নেন। সাইলেশিয়ার রাজধানী ব্রেসল তার অধীনে আসে। কেবলমাত্র মিসি ও ব্রিগ নামক দুটি শহর তখনো অপরাজিত থাকে। ব্রিস নামক স্থানের নিকট ১৭৪১ সালে মলউইজের যুদ্ধে ফ্রেডারিক জয়লাভ করেন। প্রাশিয়ার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে স্পেন, স্যাভয়, বেভেরিয়া, সার্ডিনিয়া, স্যাক্সনি প্রভৃতি ইউরোপীয় শক্তি অস্ট্রিয়ার ভূখণ্ডের বিশেষ বিশেষ অঞ্চল দাবি করে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ও অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্য আক্রমণ করে।
হ্যাপসবার্গ রাজবংশের ষষ্ঠ চার্লসের মৃত্যুর পর ব্যাভেরিয়ার ইলেক্টর চার্লস আলবার্ট (১৭২৬-১৭৪৫) চাচ্ছিলেন পরবর্তী পবিত্র রোমান সম্রাট হতে। কিন্তু তিনি অস্ট্রিয়াকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার বিষয়ে সতর্ক ছিলেন। এদিকে ফ্রান্স ছিল অস্ট্রিয়ার হ্যাবসবার্গ রাজবংশের পরম শত্রুদেশ, এতদিন পর্যন্ত দেশটি অস্ট্রিয়ার এই দুর্বলতার অপেক্ষায় ছিল। তাই এই মোক্ষম সুযোগে ফ্রান্সের পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-১৭৭৪) পবিত্র রোমান সম্রাট হিসেবে বেভেরিয়ার ইলেক্টর চার্লস আলবার্টের দাবিকে সমর্থন করে। এর ফলে প্যাগম্যাটিক স্যাংশনকে প্রত্যাখ্যান করা হলে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে অন্তর্ভুক্ত ছিল সাইলেশিয়া যুদ্ধ। ফ্রেডারিক প্রথম দিকে অস্ট্রিয়া বিরোধী সামরিক জোটে যোগদান করেননি। প্রাশিয়া কর্তৃক সাইলেশিয়া দখল স্বীকার করে নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় ফ্রেডারিক মেরিয়া থেরেসাকে প্রস্তাব দেন এবং এর বিনিময়ে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মেরিয়া থেরেসা এ শর্ত প্রত্যাখ্যান করায় দ্বিতীয় ফ্রেডারিক অস্ট্রিয়ার বিরোধী যুদ্ধে যোগদান করেন এবং ফ্রান্স ও বেভেরিয়া ফ্রেডারিকের সাথে এক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ চুক্তিতে স্থির হল যে, প্রাশিয়া কর্তৃক সাইলেশিয়া দখল ফ্রান্স ও বেভেরিয়া মেনে নেবে। কিন্তু বেভেরিয়ার ইলেক্টর সপ্তম চার্লস (১৭৪৩-৪৫) উপাধি ধারণ করে পবিত্র রোমান সম্রাটের পদ লাভ করবে, এবং ফ্রেডারিক বেভেরিয়ার ইলেক্টরকে অস্ট্রিয়ার সম্রাট পদ লাভে সাহায্য করবেন এবং রাইন অঞ্চলের দাবি ত্যাগ করবেন। এদিকে ফ্রান্স অস্ট্রিয়া-নেদারল্যান্ডস অধিকার করবে। ফ্রান্স ও বেভেরিয়া প্রাশিয়ার পক্ষে যোগদান করলে ফ্রেডারিকের সামরিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। তিনি অনেকটা নিশ্চিত হলেন।
এই প্রেক্ষিতে অস্ট্রিয়ার অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনী সাইলেশিয়াতে পরাজিত হয়। ১৭৪১ সালে ফ্রান্স ও বেভেরিয়ার সেনাবাহিনী বোহেমিয়া আক্রমণ ও দখল করেন। ব্যাভেরিয়ার ইলেক্টর চার্লস আলবার্ট হন বোহেমিয়ার রাজা। চার্লসের লক্ষ্য বোহেমিয়ারও ঊর্ধ্বে ছিল। তিনি পবিত্র রোমান সম্রাট তো হতে চাইতেনই, সেই সাথে তিনি মারিয়া থেরেসার হ্যাপসবার্গ উত্তরাধিকারী হবার দাবিকে চ্যালেঞ্জ করতেন, আর এর মাধ্যমে তিনি সমগ্র অস্ট্রিয়াই অধিকার করতে চাইতেন। যাই হোক, এরপর চার্লস আলবার্ট সপ্তম চার্লস (১৭৪২-১৭৪৫) সম্রাট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই অবস্থায় মেরিয়া থেরেসা তার অনুগত হাঙ্গেরীয় প্রজাদের সাহায্য প্রার্থনা করে। হাঙ্গেরীয় প্রজাদের সাহায্যে অস্ট্রীয় বাহিনী বেভেরিয়া দখল করে। এর ফলে নতুন পবিত্র রোমান সম্রাট সপ্তম চার্লস হয়ে পড়েন স্বদেশবিহীন সম্রাট। কিন্তু ১৭৪২ সালে চলুসিজের যুদ্ধে ফ্রেডারিক অস্ট্রিয় বাহিনীকে পরাজিত করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৭৪২ সালে ব্রেসলাউ এর সন্ধি মেরিয়া থেরেসা ফ্রেডারিকের সাথে সন্ধি করে সাইলেশিয়ার ওপর ফ্রেডারিকের অধিকার স্বীকার করে। বিনিময়ে ফ্রেডারিক নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে প্রাশিয়া যুদ্ধ ত্যাগ করে কিন্তু ফ্রান্স ও বেভেরিয়া এবং অপর দিকে অস্ট্রিয়ার মধ্যে যুদ্ধ হতে থাকে।
ব্রেসলাউ এর সন্ধির ফলে ফ্রেডারিক যুদ্ধ ত্যাগ করলে অস্ট্রিয়া অন্যান্য শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয় এবং যুদ্ধের গতি অস্ট্রিয়ার অনুকূলে পরিবর্তিত হয়। এছাড়া ১৭৪৩ সালে ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ওয়েস্টমিনিস্টারের চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার ফলে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস অস্ট্রিয়ার পক্ষে এই যুদ্ধে যোগদান করে। ইংল্যান্ডের অস্ট্রিয়ার সাথে মৈত্রী করার কারণ ছিল। কিন্তু সেদিকে যাবার আগে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দ্বন্দ্ব নিয়ে কিছু ইতিহাস বলে নেয়া দরকার। ১৬৮৯ সালে হল্যান্ডের তৃতীয় উইলিয়াম ইংল্যান্ডের সিংহাসন লাভ করেন। এরপর থেকে ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করে। সেই সময় ফরাসি রাজ চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫) হল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে ইংল্যান্ড লিগ অব অগসবার্গে যােগদান করে হল্যান্ডের পক্ষে চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ১৬৯৭ সালে রাইসুইগের সন্ধি দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং ইংল্যান্ড যেসব স্থান ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ থেকে দখল করেছিল তা ফিরিয়ে দেয়। ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সিংহাসনে তৃতীয় উইলিয়ামের দাবি স্বীকার করে নেয়। কিন্তু ১৬৯৭ সালে রাইসুইকের সন্ধি ফ্রান্সের জন্য কোনাে বিশেষ সুবিধা এনে দেয়নি। ফলে পাঁচ বছর পর স্পেনীয় উত্তরাধিকার যুদ্ধে ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়ার সম্রাট এবং অন্যান্য ইউরােপীয় রাজার সাথে এক গ্রান্ড অ্যালায়েন্সে (Grand Alliance) স্বাক্ষর করে চতুর্দশ লুইয়ের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ইউট্রেক্টের সন্ধি (১৭১৩-১৫) দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই সন্ধির শর্তানুসারে ইংল্যান্ড ফ্রান্স থেকে নােভাস্কশিয়া, হাস্টেনবে টেরিটোরি, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিটস দ্বীপগুলাে দখল করে। ফরাসি মিত্র স্পেনের নিকট থেকেও ইংল্যান্ড অনেক সুবিধা আদায় করে এবং কতিপয় স্থান দখল করে। সন্ধি হলেও দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা ছিলই।
যাই হোক, এবারকার অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে ইংল্যান্ডের যোগদান নিয়ে বলা যাক। তদকালীন ইংল্যান্ডে যে রাজবংশের শাসন চলে তা হলো হ্যানোভারীয় রাজবংশ, রাজা ছিলেন রাজা দ্বিতীয় জর্জ (১৭২৭-১৭৬০)। রাজবংশের নাম হ্যানোভারীয় কারণ এই বংশের উদ্ভব জার্মানির হ্যানোভার থেকেই। এই বংশ বংশ পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্ত ও হ্যানোভারের ইলেক্টর ছিল। কাজেই ইংল্যান্ডের তদকালীন রাজা দ্বিতীয় জর্জের মনে হ্যানোভার প্রীতি ছিল, হ্যানোভারের কোন ক্ষতি হোক তা তিনি কখনই চাইতেন না। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জর্জ হ্যনােভারের নিরাপত্তা সম্পর্কে আশঙ্কিত হয়ে হ্যানােভারের রক্ষার্থে অস্ট্রিয়ার পক্ষে অংশগ্রহণ করতে উৎসুক ছিলেন। ইংল্যান্ডের জনমতও তার অনুকূলে ছিল। কিন্তু তদকালীন ইংল্যান্ডের প্রধামন্ত্রী ওয়ালপােল এ যুদ্ধে ইংল্যান্ডের অংশগ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে তার মন্ত্রিসভার পতন হয় এবং লর্ড কার্টারেট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কার্টারেট জর্জের হ্যানােভার প্রীতির সমর্থক ছিলেন। যেহেতু জার্মানির হ্যানােভার ছিল ইংল্যান্ডের হ্যানােভার বংশের জন্মস্থান, সেহেতু জার্মানিতে ফরাসি প্রাধান্য স্থাপিত হােক তা দ্বিতীয় জর্জের অভিপ্রেত ছিল না। এছাড়া, ফ্রান্স ইউট্রেকটের সন্ধির শর্তাদি ভঙ্গ করতে অগ্রসর হয়েছে, এই ভয়ও তার ছিল। এসকল কারণে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যােগদান করেন।
অস্ট্রিয়া রক্ষার যুদ্ধ হতে ক্রমে এই যুদ্ধে (ইংল্যান্ডের পক্ষে) ফ্রান্স বিরােধী যুদ্ধে পরিণত হয়। ফ্রান্স ও স্পেন উভয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরস্পরকে সাহায্যের চুক্তিতে ১৯৪৩ সালে ‘ফন্টেনব্লা-এর সন্ধি’ সম্পাদন করেছিল, তাই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সাথে স্পেইনও দাঁড়ায়। যাই হোক, দ্বিতীয় জর্জ স্বয়ং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। তিনি সৈন্য পরিচালনা করে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে ডেটিনজেনে (Dettingen) ফরাসি বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন। এর ফলে জার্মানি হতে ফরাসি বাহিনী বহিষ্কৃত হয়। এদিকে মেরিয়া থেরেসা মিত্রদের সহায়তায় শক্তি অর্জন করে যুদ্ধে জিততে থাকেন ও দক্ষিণ জার্মানি বিধ্বস্ত করেন। এই অবস্থায় অস্ট্রিয়া জার্মানিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাশিয়ার জারিনা এলিজাবেথও (১৭৪১-১৭৬২) অস্ট্রিয়ার সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হন। স্যাক্সনি শুরু থেকে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু অস্ট্রিয়ার মিত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ও অস্ট্রিয়া যুদ্ধে অর্জন করতে থাকলে স্যাক্সনি ১৭৪৩ সালে অস্ট্রিয়ার পক্ষে দল বদল করে।
কিছুকাল পর অস্ট্রিয়া যুদ্ধে জয়লাভ করতে আরম্ভ করলে ফ্রেডারিক ভীত হন। এই অবস্থা ফ্রেডারিকের কাম্য ছিল না। তিনি এ আশঙ্কা করেন যে, যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলে অস্ট্রিয়া হয়তো সাইলেশিয়া দখল করতে অগ্রসর হবে। মেরিয়া থেরেসার অব্যাহত সাফল্য ভবিষ্যতে প্রাশিয়ার জন্য সংকট সৃষ্টি করতে পারে এবং একসময় মেরিয়া থেরেসা সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারের জন্য সচেষ্ট হতে পারে। এজন্য ১৭৪৪ সালে ফ্রেডারিক পুনরায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। এভাবে দ্বিতীয় সাইলেশিয়া যুদ্ধের সূচনা হয়। এ সময় থেকে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ দুই প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত হয় – ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব এবং অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার দ্বন্দ্ব। নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে মেরিয়া থেরেসার বিরোধী জোটে যোগদান করে কয়েকটি যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে। ১৪৪৪ সালে অস্ট্রিয়া বোহেমিয়া পুনর্দখল করার চেষ্টা করছিল যখন তা পবিত্র রোমান সম্রাট সপ্তম চার্লস ও তার ব্যাভেরিয়ান বাহিনীর অধীনস্ত ছিল। প্রাশিয়া এইসময় বোহেমিয়ায় অস্ট্রিয়ান বাহিনীকে আক্রমণ করেছিল। এদিকে অস্ট্রিয়া ও স্যাক্সোনির বাহিনী সাইলেশিয়ায় আক্রমণ করলে ফ্রেডারিক বোহেমিয়া থেকে তার সেনাবাহিনী সরিয়ে সাইলেশিয়া ও অন্যান্য জায়গায় সরিয়ে নেয় ও বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ী হয়ে সাইলেশিয়াকে রক্ষা করে। কিন্তু বোহেমিয়া এতে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় তা ১৭৪৪ সালে অস্ট্রিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
১৭৪৫ সালের জানুয়ারিতে অসুস্থতার কারণে পবিত্র রোমান সম্রাট সপ্তম চার্লসের মৃত্যু হয়। তার পুত্র তৃতীয় ম্যাক্সিমিলিয়ান জোসেফ (১৭৪৫-১৭৭৭) পিতার মত সংঘাত টেনে নিয়ে যেতে চাননি। ব্যাভেরিয়া অস্ট্রিয়ার দখলে ছিল। তিনি যুদ্ধ থেকে সরে আসার বিনিময়ে ব্যাভেরিয়া ফিরে পেতে চান ও ব্যাভেরিয়ার ইলেক্টর হয়ে ওঠেন। এজন্য তিনি ফিউসেনে অস্ট্রিয়ার সাথে এক মৈত্রি চুক্তি সম্পাদন করেন। অস্ট্রিয়া স্যাক্সনি ও পোল্যান্ডের সাথে এক মিত্রতা চুক্তি স্থাপন করে প্রাশিয়াকে দু’দিক থেকে আক্রমণ করে এবং রাশিয়াও ঐ সময়ে অস্ট্রিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে। এ সময় একমাত্র ফ্রান্সই প্রাশিয়ার মিত্র ছিল।
এডমিরাল ম্যাথু দক্ষতার সাথে ভূমধ্যসাগরে ইংরেজ স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন। ভারতবর্ষ এবং আমেরিকাতেও ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে যুদ্ধ বিস্তৃত হয়েছিল। ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সিংহাসনের ছােট দাবিদারের (Young Pretender) (দ্বিতীয় জেমসের (১৬৮৫-১৬৮৮) পৌত্র চার্লস এডওয়ার্ড) পক্ষ অবলম্বন করে ইংল্যান্ড আক্রমণের করে। কিন্তু প্রবল ঝড়ে ফরাসি নৌবহর ধ্বংস হওয়ায় ফ্রান্সের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর ফ্রান্স ও প্রাশিয়া যুদ্ধে পরপর কয়েকটি সাফল্য লাভ করে। এদিকে ফ্রান্স ১৭৪৫ সালে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস (বর্তমান বেলজিয়াম) দখল করতে গিয়ে ব্রিটিশ ও হল্যান্ডের এর বাহিনীকে ফন্টেনয়ের যুদ্ধে ভীষণভাবে ফন্টনয়ে পরাজিত করে ও এর মাধ্যমে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের উপর ডেন্টিনজেনের যুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়। ১৯৪৫ সালের ৮ই জানুয়ারিতে ফ্রান্স ছাড়া অন্যান্য বিবদমান জাতিগুলাের মধ্যে ‘প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন’ রক্ষা করার শর্তে ‘ওয়ার্সের সন্ধি’ হয়। সাইলেশিয়ার পুনর্দখলের জন্য অস্ট্রিয়ার সৈন্য অগ্রসর হয়ে হােহেনফ্রিডবার্গের যুদ্ধে পরাজিত হয়। ফ্রেডারিক অষ্ট্রিয়ার সৈন্যের পশ্চাদ্ধাবন করে বােহেমিয়ার সােহরের যুদ্ধে পুনরায় তাদেরকে পরাজিত করেন। এই অবস্থায় মেরিয়া থেরেসা ১৭৪৫ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ড্রেসডেনের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী মেরিয়া থেরেসা দ্বিতীয় ফ্রেডারিককে সাইলেশিয়া ছেড়ে দেন বিনিময়ে দ্বিতীয় ফেডারিক মেরিয়া থেরেসার স্বামী, ডিউক অফ টাস্কেনি ও ডিউক অফ লোরেইন ও বার ফ্রান্সিসকে প্রথম ফ্রান্সিস (১৭৪৫-১৭৬৫) হিসেবে পবিত্র রোমান সম্রাট বলে স্বীকার করে নেন (ইতোমধ্যে মেরিয়া থেরেসার স্বামী প্রথম ফ্রান্সিস পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটপদে নির্বাচিত হন)। এভাবে দ্বিতীয় সাইলেশিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
ড্রেসডেনের সন্ধির পর ইংরেজ-ফরাসি দ্বন্দ্ব এবং অস্ট্রিয়ার সন্ধিতে আসতে বাধ্য হওয়া
ড্রেসডেনের চুক্তির মধ্য দিয়ে অস্ট্রিয়া-প্রাশিয়ার যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছিল বটে, কিন্তু এদের যুদ্ধের টানে যে ঈঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল সেটা ১৭৪৮ সাল পর্যন্ত চলে, তাছাড়া অস্ট্রিয়ার সাথে অস্ট্রিয়া-বিরােধী দেশগুলাের যুদ্ধও অব্যাহত থাকে। ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়ার পক্ষে যুদ্ধ শুরু করায় এই যুদ্ধ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে সংঘর্ষ রূপ লাভ করে। এই প্রেক্ষিতে দাক্ষিণাত্যে প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৬-৪৮) সংঘটিত হয়।
অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে যে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধের সূচনা হলো তা ভারতবর্ষে কী প্রভাব ফেলেছিল ও ভারতের তদকালীন পরিস্থিতি কী ছিল তা জানতে দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসী দ্বন্দ্ব (১৭৪৬-৬৩ খ্রী.) শীর্ষক নিবন্ধটি পড়তে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
আমেরিকায় অস্ট্রিয়ায় উত্তরাধিকারের যুদ্ধ পরিচিত ছিল রাজা জর্জের যুদ্ধ (১৭৪৫-৪৮) নামে। এটি আমেরিকাতেও সমান রক্তক্ষয়ী রূপ নেয় কিন্তু তা অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। নিউ ইংল্যান্ডের যােদ্ধাদের বিশাল বিশাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ফ্রান্সের অধীনে থাকা নোভাস্কোটিয়ার লুইসবার্গ দুর্গ দখল করেছিল।
নেদারল্যান্ডসে আরও কয়েকটি যুদ্ধে ইংল্যান্ড পরাজিত হয়। ফরাসিরা প্রায় সমগ্র নেদারল্যান্ডস দখল করে নেয়। ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে কিছুই করতে পারলনা। পক্ষান্তরে ফ্রান্সও নৌযুদ্ধে সুবিধা করতে পারছিল না। ফলে শেষে উভয় পক্ষ সন্ধির জন্য ব্যগ্র হয়ে ওঠে এবং ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘আয়-লা-শ্যাপেলের সন্ধি” (Peace of Aix-la-Chapelle) স্বাক্ষরিত হয়। অস্ট্রিয়া এতে অনিচ্ছার সাথে যােগ দেয়। কারণ এ সন্ধির শর্তানুযায়ী ফ্রান্স মেরিয়া থেরেসাকে অস্ট্রিয়ার শাসক এবং তার স্বামী লােরেনের ফ্রান্সিসকে সম্রাট হিসেবে স্বীকার করে নিলেও তাকে সাইলেশিয়া ও লম্বার্ডির কিয়দংশ হারাতে হয়। প্রাশিয়া সাইলেশিয়া দখল করে নেয়, সার্ডিনিয়া স্যাভয় ও নিস পুনরুদ্ধার করে এবং ইতালিতে লােম্বার্ডির কিছু অংশ পায়।
এই সন্ধির দ্বারা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পরস্পরের অধিকৃত স্থানসমূহ প্রত্যর্পণ করতে স্বীকৃত হয়। ফরাসিরা ইংরেজদেরকে মাদ্রাজ ফিরিয়ে দেয় বিনিময়ে আমেরিকা লুইসবার্গ লাভ করে। এত কষ্ট করে নিউ ইংল্যান্ডের সৈন্যদের লুইসবার্গ দুর্গ দখল করার গর্ব হতাশায় রূপান্তরিত হল, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পর যখন দেখা গেল তা ফরাসীদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরিশেষে ১৭৪৮ সালে আইল্যা-শ্যাপল এর সন্ধি (Peace of Aix-la-Chapelle) দ্বারা এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
পররাষ্ট্রক্ষেত্রে দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের শক্তিশালী নীতি তাকে ইউরােপে শ্রেষ্ঠ সম্রাটের পদ দান করে। ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্যাক্সনদের ওপর তার বিজয় তার অপরিসীম সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেয় এবং ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার ফ্রেডারিককে ‘দি গ্রেট’ উপাধি দেন।
১৭৪৮ সালের এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি
এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধির মাধ্যমে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। নিম্নে এই-লাশ্যাপেলের সন্ধির শর্তগুলাে ছিল –
- (১) সাইলেশিয়া ও গ্ল্যাৎসর ওপর প্রাশিয়ার আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়া হয়।
- (২) ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার রাণী মেরিয়া থেরেসার স্বামী ফ্রান্সিসকে পবিত্র রােমান সম্রাট এবং দ্বিতীয় জর্জকে ইংল্যান্ডের রাজা হিসেবে স্বীকার করে নেয়। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডসে হল্যান্ডের সীমান্ত রক্ষার জন্য ইউট্রেক্টের সন্ধির ফলে ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে যেসব দুর্গ স্থাপিত হয়েছিল সেগুলাের যে কটি ফ্রান্স ইতােমধ্যে দখল করেছিল সেগুলাে ফ্রান্স ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ডানকার্ক বন্দরের রক্ষা প্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট বংশের যারা ফ্রান্সে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের বিতাড়িত করতে ফ্রান্সকে বাধ্য করা হল।
- (৩) স্পেন ফ্রান্সিসকে সম্রাট হিসেবে মেনে নেয় এবং আমেরিকায় ইংল্যান্ডকে ব্যবসাবাণিজ্যের সুযােগ দিতে বাধ্য হয়।
- (৪) সার্ডিনিয়ার চার্লস ইমালুয়েল লােম্বার্ডি, স্যাভয় ও নিস লাভ করেন। কিন্তু তিনি ফিনেইল নামক স্থানটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
এই সন্ধির বেশ কিছু সমালােচনাও রয়েছে –
- (১) এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি আপাতত অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটালেও এই সন্ধি কোনাে পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি।
- (২) অস্ট্রিয়ার রাণী মেরিয়া থেরেসা ইংল্যান্ডের অনুরােধে প্রাশিয়াকে সাইলেশিয়া ছেড়ে দিলেও সাইলেশিয়ার মতাে সমৃদ্ধিশালী অঞ্চল ছেড়ে দেয়ার কষ্ট মেরিয়া থেরেসা ভুলে যেতে পারেন নি। তাই সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য অস্ট্রিয়া আবার তৎপরতা শুরু করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ (১৭৫৬-১৭৬৩) শুরু হয়েছিল।
- (৩) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তাদের মধ্যকার বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক স্বার্থে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের শত্রুতা প্রশমন করতে পারে নি। এই দুই দেশের বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক শত্রুতা প্রশমনের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে।
- (৪) এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধির মাধ্যমে প্রাশিয়া মধ্য ইউরােপে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
- (৫) রাশিয়া অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পক্ষে দ্বিতীয় সাইলেশিয়ার যুদ্ধে যােগদান করে এবং এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি স্থাপনে অংশগ্রহণ দাবি করে ভবিষ্যতে ইউরােপের রাজনীতিতে রাশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছিল।
- (৬) অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ফ্রান্স। এই সন্ধিতে ফ্রান্সকে অপমানজনকভাবে নতি স্বীকার এবং কয়েকটি স্থান ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। এ ছাড়া এই যুদ্ধে ফ্রান্সের বৈদেশিক বাণিজ্য ও নৌবাহিনীর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল।
- (৭) এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধি ইউরােপীয় শক্তিগুলাের মধ্যে রাজনৈতিক বিরােধ দূর করতে পারে নি। এই সন্ধি কোনাে পক্ষের স্বার্থ রক্ষা না করায় সকলে তাদের স্বার্থ উদ্ধারে পুনরায় যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যার ফলে পরবর্তী পর্যায়ে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ শুরু হয়। এজন্য অনেক ঐতিহাসিক এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধিকে সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তি মনে করেন।
ফেডারিকের কৃতিত্ব বিচার
পৃথিবীর ইতিহাসে যে কজন শাসক শ্রেষ্ঠ আসন দখল করে আছেন তাদের মধ্যে ফ্রেডারিক দি গ্রেট অন্যতম। তিনি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অথনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার দ্বারা এবং পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে প্রাশিয়াকে মধ্য ইউরােপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রে পিরণত করেছিলেন। তিনি কূটনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহ দ্বারা অস্ট্রিয়ার নিকট থেকে সাইলেশিয়া অধিগ্রহণ এবং পােল্যান্ড ব্যবচ্ছেদে অংশগ্রহণ করে পশ্চিম প্রাশিয়া নামক স্থানটি প্রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেন। ফলে প্রাশিয়া আয়তনে ও জনসংখ্যায় শক্তিশালী হয়। তিনি কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও ফ্রান্সের আক্রমণ থেকে প্রাশিয়াকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি জার্মানিতে প্রাশিয়াকে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করে প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানিকে একত্রীকরণ করেন। মােট কথা আধুনিক জার্মানি ফ্রেডারিকের পরিশ্রমের ফল।
- রাজনীতিবিদ হিসেবে ফ্রেডারিক : রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফ্রেডারিক ছিলেন সুবিধাবাদী। স্বীয় স্বার্থে তিনি কোনো ন্যায়নীতির ধার ধারতেন না। তিনি বলতেন, ‘যা পার তা অধিকার করে লও, ফিরিয়ে দিতে বাধ্য না হলে এতে তোমার কোনো অন্যায় নেই।’ (Take what you can, you are never wrong unless you are obliged to give back)। সাইলেশিয়া অধিকার এবং পোল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদ ন্যায়নীতির দিক থেকে আন্তর্জাতিক আইনে অত্যন্ত অন্যায় ছিল। কিন্তু এটি তৎকালীন অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নিন্দনীয় ছিল না। কারণ ইউরোপীয় রাজগণের মধ্যে রাজনৈতিক সততা বলতে কিছুই ছিল না। ইউরোপ তখন মেকিয়াভেলির রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করত। ফ্রেডারিক দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে এ কাজ করেছিলেন।
- শাসক হিসেবে ফ্রেডারিক : ফ্রেডারিক ছিলেন জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী শাসক। তার স্বৈরাচারীর পশ্চাতে দেশ ও জনগণের কল্যাণ ছিল। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করলেও সে ক্ষমতা জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতির উন্নতি সাধন করেছিলেন। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সুবিধার্থে রাস্তাঘাট প্রস্তুত ও খাল খনন করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি কৃষকদের ঋণ দান, প্রাশিয়ার আইনের উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থানে ইত্যাদি জনকল্যাণ কাজে অর্থ ব্যয় করেছিলেন। তিনি রাজপদকে ব্যক্তিগত সুখভোগের উৎস মনে করতেন না। তিনি নিজেকে রাষ্ট্রের প্রধান সেবক মনে করতেন। তার জনকল্যাণকর কার্যের প্রশংসা করে ঐতিহাসিক কার্লাইল তাঁকে ‘রাজাদের শেষ’ (Last of the kings) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
- ধর্মীয় উদারতা : ফ্রেডারিক দি গ্রেট ছিলেন ধর্ম ক্ষেত্রে উদার ও পরধর্মসহিষ্ণু। তিনি তার সাম্রাজ্যে সকল ধর্মের মানুষকে নির্দ্বিধায় ধর্মপালনের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তার কর্মদক্ষতা, দূরদৃষ্টি, মানসিক উৎকর্ষের জন্য তাকে তদানীন্তন ইউরোপীয় রাজাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান দেওয়া যায়। ঐতিহাসিক হ্যাসাল মন্তব্য করেছেন, ‘He stands pre-eminent among the great rulers of the century.’
- জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার হিসেবে ফ্রেডারিক : ফ্রেডারিক ছিলেন জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার। তিনি শাসনকার্যে ব্যস্ততার মধ্যেও সাহিত্যচর্চা করতেন এবং সমকালীন দার্শনিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার তার উপদেশ গুরু ছিলেন। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন উদার, দেশপ্রেমিক ও জনকল্যাণকামী শাসক।
সমালোচনা : ফ্রেডারিক দি গ্রেট প্রজা কল্যাণকামী শাসক হলেও তার নীতি সমালােচনার উর্ধ্বে ছিল না। তিনি অত্যধিক সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে প্রাশিয়াকে সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেছিলেন। তিনি অস্ট্রিয়ার নিকট থেকে সাইলেশিয়া দখল করে একাধিক ইউরােপীয় রাষ্ট্রের শক্রতা অর্জন করেছিলেন যা প্রাশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য শুভ হয় নি। তার অনুসৃত সামরিক নীতি অনুসরণ করে তার পরবর্তী বংশধররা জার্মানিকে যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। এজন্য প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সাথে অন্যান্য দেশের যুদ্ধ তার নীতির চূড়ান্ত পরিণতি বলা যায়। ফ্রেডারিক দি গ্রেট প্রজাহিতৈষী শাসক হলেও তিনি প্রজাদের ওপর অধিক কর আরােপ করেছিলেন। কৃষকদের করভার লাঘবের চেষ্টা তিনি করেন নি। তিনি প্রাশিয়ার গৌরব বৃদ্ধি করলেও প্রাশিয়ার সামাজিক দুনীতি, অনাচার ও অসাম্য দূর করার চেষ্টা করেন নি। তাই ঐতিহাসিক রাইকার মন্তব্য করেছেন, ‘ফ্রেডরিকের রাষ্ট্রনায়কত্ব সমালোচনা থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়।’
উল্লিখিত সমালােচনা সত্ত্বেও তদকালীন ইউরােপের রাজনীতিতে প্রাশিয়ার উন্নতির জন্য তিনি যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন তা জার্মানির যে কোন শাসকের জন্য আদর্শস্বরূপ ছিল। ঐতিহাসিক রাইকার বলেন, “ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট তার সময়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং তিনি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা কিছুটা হলেও তার রাজবংশের গুণাবলীর সাক্ষ্য ছিল। হোহেনজোলার্নের চার প্রজন্ম একটি শক্ত কাঠামো তৈরিতে অবদান রেখেছিল যা পরবর্তী বিপর্যয়গুলিও পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেনি। এটা নিশ্চিত যে প্রাশিয়া এখন অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে তার নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারে এবং জার্মানির আধিপত্যের জন্য তার সাথে মিলিত হতে পারে।” (A short history of moder Europe. P-118)
১৭৪৮-৫৬ এর মধ্যে ইউরোপের কূটনৈতিক বিপ্লব
কূটনৈতিক বিপ্লব ও এর প্রেক্ষাপট
১৮শ শতাব্দীর ইউরােপের রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল ১৭৫৬ সালে সংঘটিত কূটনৈতিক বিপ্লব। কূটনৈতিক বিপ্লবের ফলে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া তাদের বিগত দু’শ বছরের শত্রুতা পরিহার করে পরস্পরের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হয় যা পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯) পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অস্ট্রিয়া সমুদ্র তীরবর্তী দেশসমূহের সাথে তার দীর্ঘদিনের অনুসৃত মিত্রতা রক্ষার নীতি ত্যাগ করে ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। অপরপক্ষে ইংল্যান্ড প্রাশিয়ার সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে সমরাভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ইউরােপীয় শক্তিগুলাের পরস্পর কূটনৈতিক সম্পর্কের এ পরিবর্তনকে ইউরােপের ইতিহাসে কূটনৈতিক বিপ্লব নামে আখ্যায়িত। (“একটি বিশাল সেনাবাহিনী, একটি সুসজ্জিত কোষাগার এবং একটি প্রাণবন্ত মেজাজ বাকি কাজ করেছিল। তাই এই অঞ্চলের শুধুমাত্র একটি অংশে একটি দুর্বল আইনি দাবি নিয়ে তিনি যাত্রা করেন, সমগ্র প্রদেশের সঙ্গে মিলিত হন এবং তারপর প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। অস্ট্রিয়ানরা অবিলম্বে অস্ত্রের দিকে তাকায়, সাইলেশিয়ায় পরাজিত হয় এবং চার বছরের বিক্ষিপ্ত যুদ্ধের পরে ফ্রেডরিক একজন মহান সামরিক সেনাপতি এবং কূটনীতিক হিসাবে আবির্ভূত হন, এমনকি সেই যুগের মান বিবেচনা করলেও বিবেকবর্জিত।”[John canning, too Great kings, Queens and Rulers of the world, P-498-499])
কূটনৈতিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপট : কূটনৈতিক বিপ্লবের পূর্বে ১৭শ শতকে ফ্রান্সের বুরবোঁঁ রাজবংশ এবং অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশ পরস্পরের শত্রু ছিল। ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজবংশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য থাকত অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ রাজবংশকে দুর্বল করে ফ্রান্সের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরি (১৬৮৯-১৭১০) এবং পরে প্রধানমন্ত্রী রিশল্যু (১৭২৪-১৭৪২) অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক নীতি গ্রহণ করে অস্ট্রিয়ার প্রভাব খর্ব করেছিলেন। কার্ডিনাল রিশল্যু ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ক্যাথলিক ধর্মের প্রধান রক্ষক অস্ট্রিয়া ও স্পেনের বিরুদ্ধে ত্রিশবর্ষ যুদ্ধে (১৬১৮-১৬৪৮) প্রােটেস্ট্যান্টদের পক্ষে যােগদান করেছিলেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অস্ট্রিয়াকে হীনবল করা। ১৮শ শতকে ইউরােপের রাষ্ট্রগুলাে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক স্বার্থের কারণে দুটি পরস্পরবিরােধী জোটে বিভক্ত হয়। সামুদ্রিক শক্তি ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও পর্তুগাল একপক্ষে ছিল, অন্যজোটে ফ্রান্স, প্রাশিয়া, স্পেন, ডেনমার্ক, পােল্যান্ড, তুরস্ক ও সুইডেন অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটে ১৭৫৬ সালে কূটনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে। ১৭৫৬ সালে কূটনৈতিক বিপ্লবের কারণ ইউরােপের রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের গভীরে নিহিত ছিল।
কূটনৈতিক বিপ্লবের কারণ
১৭৪৮ সাল থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত এই বিপ্লবের পশ্চাতে যেসব কারণ বিদ্যমান ছিল সেগুলো হলো –
- (১) এই.লা-শ্যাপেলের সন্ধির ক্রটি : কূটনৈতিক বিপ্লবের প্রধান কারণ ছিল এই লা-শ্যাপেলের সন্ধিতে স্বাক্ষরিত সকল পক্ষের অসন্তুষ্টি। (“১৭৫৬ সালে একটি পুরনো ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হয়। অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স ২০০ বছরের শত্রুতা সরিয়ে রেখেছিল, প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল এবং একটি জোট গঠন করেছিল যা ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল, অস্ট্রিয়া সামুদ্রিক শক্তির সাথে তার দীর্ঘস্থায়ী সংযোগ ছিন্ন করে, যখন ইংল্যান্ড প্রাশিয়ার মাঝে তার একটি মিত্র খুঁজে পেয়েছিল।” Arthur Hassall, The Balance of power. P. 208.) সন্ধিতে অস্ট্রিয়া সাইলেশিয়া উদ্ধার করতে পারে নি। ইংল্যান্ড তার দখলকৃত অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ফ্রান্স যুদ্ধে প্রচুর অর্থ ও সৈন্য হারালেও তার প্রাপ্তি কিছুই ছিল না। যুদ্ধের সময় অস্ট্রিয়া ইংল্যান্ডের আচরণে ক্রুদ্ধ হয়েছিল। সাইলেশিয়া ছাড়াও অস্ট্রিয়া ইতালিতে ভূখণ্ড হারিয়েছিল। অস্ট্রিয়া যুদ্ধে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। মেরিয়া থেরেসা ইংল্যান্ডের প্রতি ক্রদ্ধ হওয়ায় ইংল্যান্ডও বিরক্ত হয়ে মেরিয়া থেরেসাকে জানিয়েছিল যে, ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়ার সপক্ষে অস্ট্রিয়ার সৈন্য ছাড়া ডেটিনজেন (Dettingen) এবং ফোন্টিনয়ে (Fontenoy) যুদ্ধ চালিয়েছিল। অপরদিকে ফ্রান্স প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের পরামর্শ ছাড়াই বার্লিন ও ড্রেসডেনের সন্ধির সমালােচনা করেছিল। প্রাশিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযােগ এনেছিল।
- (২) প্রাশিয়ার উত্থান : ১৭শ শতকে প্রাশিয়া ইউরােপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে শক্তিসাম্য (Balance of power) ভেঙে পড়ে। প্রাশিয়া অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়ায়। ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার আধিপত্য ধ্বংস করার জন্য প্রাশিয়াকে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে মদদ দিতে শুরু করে। প্রাশিয়া অস্ট্রিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চল সাইলেশিয়া দখল করে নেয়। পূর্ব ইউরােপে তুরস্ক ও রাশিয়ার দ্বন্দ্ব, উত্তর ইউরােপে সুইডেন ও পােল্যান্ডের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব সুইডেন ও পােল্যান্ডকে ফ্রান্সের নেতৃত্বে গঠিত শিবিরে যােগদানে প্ররােচিত করে। এদিকে জার্মানির হ্যানােভার অঞ্চল প্রাশিয়ার কবল থেকে রক্ষার জন্য রাশিয়ার সাথে ইংল্যান্ডের গােপন সমঝােতা হয়। ফলে ইউরােপে কূটনৈতিক বিপ্লবে ফ্রান্স, প্রাশিয়া, স্পেন, ডেনমার্ক, পােল্যান্ড ও তুরস্ক একপক্ষে আসে। অপরদিকে অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, ইংল্যান্ড ও পর্তুগাল একপক্ষভুক্ত হয়।
- (৩) মেরিয়া থেরেসা কর্তৃক সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারের সংকল্প : অস্ট্রিয়ার শাসক মেরিয়া থেরেসা কর্তৃক সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারের সংকল্প কূটনৈতিক বিপ্লবের অন্যতম কারণ ছিল। ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দের পর অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার কূটনৈতিক সমঝােতার প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রাশিয়ার ক্ষমতা হ্রাস ও প্রাশিয়াকে ব্যবচ্ছেদ করা। অপরদিকে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে আমেরিকা ও ভারতে ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব পারস্পরিক যুদ্ধের আবহ তৈরি করেছিল। মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার স্বার্থে রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের সাথে মিত্রতাবদ্ধ ছিলেন। অস্ট্রিয়া উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের নীতি অস্ট্রিয়ার মনঃপূত হয় নি। ১৭৪৯ সালে মার্চ মাসে মেরিয়া থেরেসা তার উপদেষ্টাদের লিখিতভাবে বৈদেশিক নীতির নতুন সম্পর্ক কী হওয়া উচিত তা জানাতে বলেন। প্রাচীনপন্থী উপদেষ্টারা পুরােনাে মৈত্রী নীতি অনুসরণ করতে মত দেন। কিন্তু যুবক মন্ত্রী এন্টন ওয়ানজেল ভন কৌনিজ (Anton wengel von kaunitz) মনে করেন, সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য ইংল্যান্ড অপেক্ষা ফ্রান্সের সামরিক সমর্থন অপরিহার্য। এই পরামর্শ মন মত হয় মেরিয়া থেরেসার। কৌনিজের নীতি সমর্থন করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় পররাষ্ট্র দপ্তরকে।
কৌনিজের পরিচয়
এই কূটনৈতিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি হলেন অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত কৌনিজ। কৌনিজের প্রকৃত নাম এন্টন ওয়ানজেল ভন কৌনিজ। তিনি ১৭১১ সালে ভিয়েনায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতা তাকে গির্জায় চাকরি নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। তার বয়ােজ্যেষ্ঠ চার ভ্রাতার মৃত্যু তার জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন করে দেয়। তিনি কূটনৈতিক বিষয়ে শিক্ষার জন্য ভিয়েনা, লিপজিক, লিডেন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অধ্যয়ন শেষে তিনি ষষ্ঠ চার্লসের সময় কূটনৈতিক পেশায় চাকরি নেন। তিনি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইতালি, উত্তর জার্মানি এসব দেশ চাকরির পূর্বেই ভ্রমণ করেছিলেন। অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকারী যুদ্ধের সময় তিনি রােম, তুরিন, ব্রাসেল প্রভৃতি দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। এইলা-শ্যাপেলের সন্ধির সময় তিনি অষ্ট্রিয়ার প্রতিনিধিদলে ছিলেন। তার মধ্যে খামখেয়ালি, বাবুগিরি প্রভৃতি দোষ ছিল। তার স্বাস্থ্য ভালাে ছিল না কিন্তু কূটনৈতিক জ্ঞানে তিনি শ্রেষ্ঠ স্থান লাভ করেছিলেন। গভীর দূরদৃষ্টি এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তাকে সব সময়ের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিকে ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক। মেরিয়া থেরেসার মতাে তিনিও সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য সদা ভাবতেন। এজন্য মেরিয়া থেরেসা তাকে পছন্দ করতেন।
ফ্রান্সের বংশানুক্রমিক শত্রুতা দূর করার জন্য কৌনিজ ১৭৫০ সালে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফ্রান্সে যােগদান করেন। কিন্তু ১৭৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে সফল হননি। ১৭৫০ থেকে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ফ্রান্স তিনজন রাষ্ট্রদূত ভিয়েনায় প্রেরণ করে। এসব দূতকে অস্ট্রিয়া সরকার আন্তরিকতার সাথে সংবর্ধনা দেয়। এসব দূত জানান যে, ফরাসি সরকার অস্ট্রিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চান। যতদিন ইংল্যান্ড প্রাশিয়ার মিত্র থাকবে ততদিন ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার শত্রু প্রাশিয়ার সাথে মৈত্রী রাখতে বাধ্য হবে। কৌনিজ যদিও ফ্রান্সকে প্রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন নি তবুও ফরাসি রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের সাথে সৌহার্দ্যমূলক আচরণ করেন এবং বোঝান যে, ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রিয়ার বিশেষ কোনাে বিরােধ নেই। ইতােমধ্যে স্পেনের সাথে অস্ট্রিয়ার সম্পর্ক উন্নত হয় এবং ১৭৫২ সালে অস্ট্রিয়া ও স্পেন অরুণজুয়েজ চুক্তি স্বাক্ষর করে। অস্ট্রিয়ার ইতালীয় প্রদেশসমূহের অস্তিত্বকে গ্যারান্টি দিয়ে সার্দিনিয়া, নেপলস ও পার্মা উক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অপরদিকে রাশিয়ার এলিজাবেথ (১৭৪১-১৭৬২) প্রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে ১৭৫৩ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত একটি কাউন্সিলে বলেছিলেন, প্রাশিয়ার আগ্রাসী শক্তি রুদ্ধ করা এবং অস্ট্রিয়া, স্যাক্সনি ও ইংল্যান্ডের সহায়তায় প্রাশিয়াকে তার আদি সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত। এদিকে ইংল্যান্ডের সাথে রাশিয়ার বন্ধুত্বের প্রধান কারণ ছিল জার্মানির হ্যানােভারের নিরাপত্তার জন্য রাশিয়ার সামরিক সহায়তা পাওয়া। কিন্তু এর জন্য রাশিয়াকে বার্ষিক দু লক্ষ পাউন্ড ও যুদ্ধের সময় আরাে অর্থ দান করতে হয়েছিল। বাণিজ্যিক কারণেও রাশিয়ার সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক ছিল।
ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রিয়ার সাম্প্রতিক সম্পর্ক এবং অস্ট্রিয়ার সাথে রাশিয়ার গােপন চুক্তি সম্পর্কে ফ্রেডারিক (১৭২২-১৭৮৬) অবহিত হন। ১৭৫৩ সালে ফ্রেডারিক মেঞ্জেল নামে একজন স্যাক্সন কেরানিকে উৎকোচ দিয়ে ১৭৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে সম্পাদিত অস্ট্রো-রুশ চুক্তির গােপন ধারাগুলাে হাত করেন। উইনগারটেন নামে বার্লিনের অষ্ট্রিয় দূতাবাসের একজন এটাশেকে ঘুষ দিয়ে ফ্রেডারিক অনেক গােপন তথ্য সম্পর্কে অবহিত হন। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া প্রাশিয়ার ধ্বংসের জন্য যে পরিকল্পনা করেছিল তার নথি হস্তগত করেন। এতে বলা হয়েছিল অস্ট্রিয়া বােহেমিয়াতে সৈন্য সমাবেশ করবে এবং প্রাশিয়ার আক্রমণে রাশিয়া সৈন্য পাঠাবে। ফ্রেডরিক এজন্য প্রয়ােজনীয় সামরিক প্রস্তুতি নেওয়ায় রাশিয়া প্রাশিয়া আক্রমণ করে নি। এদিকে ফ্রান্স ইংল্যান্ডকে প্রাশিয়া আক্রমণের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে।
অপরদিকে আমেরিকা ও ভারতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বে প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক উদ্বিগ্ন হন। ফ্রান্সের নৌবাহিনী ইংল্যান্ডের নৌবাহিনী অপেক্ষা দুর্বল হওয়ায় সমুদ্রে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সাথে প্রতিযােগিতায় পেরে ওঠে না, এতে ফ্রান্স ইংল্যান্ডকে মহাদেশে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এ যুদ্ধ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দ্বন্দ্বে সীমিত থাকে। ফ্রেডারিক উপলব্ধি করেন যে, ফ্রান্সের পক্ষে যুদ্ধে যােগদানের সাথে সাথে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়া প্রাশিয়া আক্রমণ করবে। যদি ফ্রান্স সমুদ্রে নৌযুদ্ধে পরাজিত হয় তাহলে ইংল্যান্ড, হ্যানােভার, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও স্যাক্সনি প্রাশিয়া আক্রমণ করবে এবং তা প্রতিরােধ করা কঠিন হবে। ফ্রান্স প্রাশিয়াকে হ্যানােভার আক্রমণের পরামর্শ দিলেও তিনি হ্যানােভার আক্রমণ করেন নি এবং ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ থাকার কৌশল নেন। ১৭৫৫ সালের জুলাই মাসে ফ্রেডারিক ফ্রান্সকে অস্ট্রীয় নেদারল্যান্ডস আক্রমণের আহ্বান জানালে ফ্রান্স দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। এদিকে ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত ১৭৪১ সালের চুক্তির মেয়াদ ১৭৫৬ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা। ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার সাথে আলােচনা চালালেও ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়ার চুক্তি বর্ধিত করার জন্য ফ্রান্স বার্লিনে প্রতিনিধি পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রতিনিধি পাঠাতে বিলম্ব হয়। এদিকে প্রাশিয়া উপলব্ধি করে যে, ফ্রান্স অপেক্ষা ইংল্যান্ডের সাথে মিত্রতা প্রাশিয়ার জন্য নিরাপদ হবে। ফ্রেডারিক ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় ছিলেন।
ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়ার মধ্যে ওয়েস্টমিনিস্টারের সন্ধি
ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের দ্বন্দ্বকে ফ্রেডারিক তাদের বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব মনে করত। ১৭৫৫ সালে ফ্রেডারিক শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানালে ফ্রান্স এ বিষয়ে সন্তোষজনক সাড়া দেয় নি। ইতােমধ্যে প্রাশিয়া ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এজন্য ফ্রেডারিক ১৬৫৬ সালে ১৬ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের সাথে ওয়েস্টমিনস্টারের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এ সন্ধি দ্বারা ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়া বিদেশী সৈন্যকে জার্মানির অভ্যন্তরে প্রবেশ অথবা জার্মানির ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে দেবে না। ইংল্যান্ড জার্মানিতে রুশ সৈন্য ব্যবহার করবে না; ফরাসি সৈন্য দ্বারা হ্যানােভার আক্রান্ত হলে ফ্রেডারিক হ্যানােভার রক্ষা করবেন। ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়ার এ চুক্তি অস্ট্রিয়াতে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। রাশিয়ার এলিজাবেথ ক্রুদ্ধ হন। ফ্রান্স এ চুক্তির কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়। এ অবস্থায় কৌনিজ তার পরিকল্পনাকে কাজে লাগান। তিনি ফ্রান্সের সাথে ১৭৫৬ সালের ১লা মে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল তিনটি চুক্তি – দুটি প্রকাশ্য ও একটি গােপন –
- প্রথম চুক্তি ছিল নিরপেক্ষ চুক্তি। এর দ্বারা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দ্বন্দ্বে অস্ট্রিয়া নিরপেক্ষ থাকবে এবং ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার কোনাে ভূখণ্ড আক্রমণ করবে না।
- দ্বিতীয়টি ছিল প্রতিরক্ষা ও বন্ধুত্ব চুক্তি। বিদেশী শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে (ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্য চলমান যুদ্ধ ব্যতীত) একে অপরের ভূখণ্ড রক্ষা করবে।
- তৃতীয় চুক্তিতে পাঁচটি গােপন শর্ত ছিল। এতে বলা হয়েছিল যে, ইংল্যান্ডের যে কোনাে মিত্র দ্বারা ফ্রান্স আক্রান্ত হলে অস্ট্রিয়া তাকে সাহায্য করবে। (Arthur Hassall. The Balance of power. P-208.)।
পরবর্তী বছরের জানুয়ারি মাসে সেন্ট পিটার্সবুর্গে কনভেনশন দ্বারা রাশিয়া ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে পূর্বে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি গ্রহণ করে ও ১৭৫৭ সালের ১ মে স্বাক্ষরিত দ্বিতীয় ভার্সাই চুক্তি সাক্ষর করে, যার দ্বারা ফ্রান্স প্রাশিয়ার ব্যবচ্ছেদে অস্ট্রিয়াকে একটি বার্ষিক সাবসিডি দিতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে একটি বৃহৎ সেনাবাহিনী রাখতে সম্মত হয় ও বিনিময়ে ফ্রান্স নেদারল্যান্ডসের একাংশ পাবে। এই চুক্তি কূটনৈতিক বিপ্লবেরই একটি অংশ ছিল। (The Treaty of Westminster and the Treaties of Versailles introduced a new system into Europe ; England and Prussia, the two vigorous advancing powers, allied together against France and Austria, aided by the young pushing Russian nation.)।
দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৮-৫৫ খ্রীঃ)
ইউরোপে যখন নানান শক্তির পক্ষ বদলের মাধ্যকে কূটনৈতিক বিপ্লব চলছে, তখন ভারতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে শুরু হয় দাক্ষিণাত্যে দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৮-১৭৫৫)।
ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতবর্ষ-ব্যাপী সপ্তবর্ষ যুদ্ধ (১৭৫৬-৬৩)
সপ্তবর্ষ যুদ্ধ ও এর কারণ
১৮শ শতাব্দীর ইউরােপের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনা ছিল সপ্তবর্ষ যুদ্ধ (Seven years war)। ১৭৫৬ সালে ইউরােপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স তাদের দু’শ বছরের বিবাদ ভুলে গিয়ে মিত্ৰতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। অস্ট্রিয়া সামুদ্রিক শক্তিবর্গের সঙ্গে বহুকাল অনুসৃত মিত্রতা রক্ষার নীতি ত্যাগ করে ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। ইংল্যান্ড ফ্রান্সের সঙ্গে সামুদ্রিক, বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রাধান্য আর দ্বন্দ্বের শেষ মীমাংসার জন্য প্রাশিয়ার সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ইউরােপীয় শক্তিগুলাের পররাষ্ট্রনীতির এ আকস্মিক পরিবর্তনকে কূটনৈতিক বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই কূটনৈতিক বিপ্লব সপ্তবর্ষ যুদ্ধের অন্যতম কারণ। ছিল। কূটনৈতিক বিপ্লবের পূর্বে ইউরােপ দুটি শিবিরে বিভক্ত ছিল। ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, পর্তুগাল একপক্ষে থাকত। অপরপক্ষে ফ্রান্স, প্রাশিয়া, স্পেন, ডেনমার্ক, পােল্যান্ড, তুরস্ক ও সুইডেন এক শিবিরে জোটবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৭৬৫ সালে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে। ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়ার মধ্যে ওয়েস্টমিনস্টারের মিত্রতা চুক্তি এবং অস্ট্রিয়া ও ফান্সের মধ্যে ভার্সাই চুক্তি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করে। এগুলাে ছাড়াও সপ্তবর্ষ যুদ্ধের পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান ছিল সেগুলো হলো –
- (১) আমেরিকার ইংরেজ ও ফরাসি দ্বন্দ্ব : আমেরিকায় ইংরেজ ও ফরাসিদের বাণিজ্যিক ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব সপ্তবর্ষ যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। ১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। আমেরিকায় ফরাসি ও ইংরেজদের উপনিবেশ ছিল। আমেরিকায় ইংল্যান্ডের অধিকৃত স্থানগুলাে যাতে পশ্চিম দিকে আরাে বিস্তৃত না হতে পারে সে কারণে ফ্রান্স কানাডা ও লুইসিয়ানার মধ্যবর্তী স্থানে কতকগুলাে দুর্গ নির্মাণ করে। ফ্রান্স কর্তৃক ইংরেজদের উপনিবেশ বিস্তারের পথ বন্ধ করার চেষ্টায় বাধা দেওয়া ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক স্বার্থের দিক দিয়ে প্রয়ােজন ছিল। ফলে উভয়ের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব সপ্তবর্ষ যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে।
- (২) ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের দ্বন্দ্ব : ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব ছিল। ভারতের দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটকে ফরাসি গভর্নর ডুপ্লে ইংরেজ প্রাধান্য ধ্বংস করার পরিকল্পনা করলে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব ত্বরান্বিত হয়। এই দ্বন্দ্ব সপ্তবর্ষ যুদ্ধের কিছু ইন্ধন জুগিয়েছিল।
- (৩) হেনােভারের স্বার্থরক্ষা : ইউরােপের জার্মানীয় হেনােভার ছিল ইংরেজ রাজবংশের পিতৃভূমি। সুতরাং হেনােভারের নিরাপত্তা রক্ষা করা ইংল্যান্ডের জন্য খুব জরুরি ছিল। ফলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
- (৪) মেরিয়া থেরেসা কর্তৃক সাইলেশিয়া উদ্ধারের সংকল্প : এই-লা-শ্যাপেলের সন্ধিতে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের অবসান ঘটলেও সত্যিকারভাবে এটা কোনাে স্থায়ী রাজনেতিক সমস্যা সমাধান করতে পারে নি। মেরিয়া থেরেসা এই সন্ধিকে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি মনে করতেন এবং প্রাশিয়ার কাছ থেকে সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য বদ্ধপরিকর হলেন। এজন্য মেরিয়া থেরেসা ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রিয়ার দু’শ বছরের বিরােধ মিটিয়ে মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করে সপ্তবর্ষ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন।
- (৫) প্রাশিয়ার সাথে ফ্রান্সের দ্বন্দ্ব : ইউরােপে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রাশিয়ার উথান শক্তিসাম্য বিনষ্ট করে এবং ফ্রান্সের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়। এ ছাড়া অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে ফ্রেডারিকের স্বার্থপরতা ফ্রান্সের বিরক্তির কারণ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ফ্রেডারিক একাধিক বার নিজ স্বার্থসিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মিত্রশক্তির মতামতের অপেক্ষা না করেই অস্ট্রিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ফলে ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে সদ্ভাব ছিল না।
- (৬) ইউরােপীয় রাজনৈতিক জটিলতা : ইউরােপের অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক জটিলতা ও পরস্পরের প্রতি হিংসা সপ্তবর্ষ যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল।
- (৭) রাশিয়ার পূর্ব প্রাশিয়া দখলের চেষ্টা : সপ্তবর্ষ যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল রাশিয়ার রানী এলিজাবেথের ইউক্রেনের পরিবর্তে পূর্ব প্রাশিয়া দখলের ইচ্ছা। এ সূত্রে প্রাশিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে মনােমালিন্যের সৃষ্টি হয়।
- (৮) ফ্রেডারিকের সাথে রাশিয়ার জারিনা ক্যাথারিনের শত্রুতা : প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক রাশিয়ার জারিনা ক্যাথারিনকে উপলক্ষ করে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। ফলে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং এটা সপ্তবর্ষ যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল।
যুদ্ধের ঘটনাবলি
উল্লিখিত ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের পটভূমি রচিত হয় এবং ১৭৫১ সালে ফ্রেডারিক স্যাক্সনি আক্রমণ করলে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ শুরু হয়। অল্পকালের মধ্যের ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, স্যাক্সনি ও অন্যদিকে পােল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও প্রাশিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধ ইউরােপ, আমেরিকা ও ভারতবর্ষ এই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়। ইংল্যান্ডের যুদ্ধমন্ত্রী পিট এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার চেষ্টায় ইংল্যান্ড যুদ্ধে জয়লাভ করে বিশাল উপনিবেশ সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েছিল।
ইউরোপে যুদ্ধ : প্রথমেই ইউরােপীয় যুদ্ধ শুরু হয় –
- ফ্রেডারিক প্রথমে স্যাক্সনি আক্রমণ করেন এবং ১৭৫৬ সালে ড্রেসডেন দখল করেন।
- কিন্তু পরের বছর বােহেমিয়া আক্রমণ করতে গিয়ে ফ্রেডারিক কোলিনের যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ট্রিয়ার নিকট পরাজিত হন।
- এমন সময় রাশিয়া পূর্ব প্রাশিয়া আক্রমণ করে।
- সুইডেন পােমেরেনিয়া নামক স্থানে সৈন্য সমাবেশ করে।
- ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার যুগ্ম বাহিনী জার্মানিতে প্রবেশ করলে ফ্রেডারিক রসব্যাকের যুদ্ধে তাদের যুগ্ম বাহিনীকে পরাজিত করে।
- এরপর ফ্রেডারিক লিউথেনের যুদ্ধে অস্ট্রিয়া বাহিনীকে পরাজিত করে সাইলেশিয়া উদ্ধার করেন।
- উত্তর জার্মানিতে হ্যানােভারের ইংরেজ সৈন্য হ্যাসেনবেকের যুদ্ধে ফরাসি বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়।
- রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীকে ফ্রেডারিক জর্ন ডরফের যুদ্ধে পরাজিত করেন।
- কিন্তু হচকাৰ্চ নামক স্থানে ফ্রেডারিক অস্ট্রিয়ার নিকট পরাজিত হন।
- ১৭৫৯ সালে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার যুগ্ম বাহিনীর নিকট কনসারডর নামক স্থানে ফ্রেডারিক পুনরায় পরাজিত হন।
- অস্ট্রিয়া স্যাক্সনি দখল করে।
- একমাত্র হ্যানােভার অঞ্চলে প্রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের সেনাবাহিনী ফরাসি বাহিনীকে পরাজিত করে।
- ১৭৬০ সালে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার যুগ্ম বাহিনী বার্লিন দখল করে।
- কিন্তু রাশিয়ার রানী এলিজাবেথের (১৭৪১-১৭৬২) মৃত্যুকালে প্রাশিয়ার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। কারণ রাশিয়ার তৃতীয় পিটার (১৭৬২) ছিলেন ফ্রেডারিকের বন্ধু। তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেই রাশিয়া প্রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ মিটিয়ে ফেলে।
- এ অবস্থায় প্রাশিয়া বার্কাসডরফের যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে সাইলেশিয়া থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করে। ফলে সপ্তবর্ষ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
- ইউরােপ মহাদেশে যখন এই স্থলযুদ্ধ সংঘটিত হয় তখন ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে একাধিক নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইংরেজ নৌবাহিনী ফরাসি উপকূল আক্রমণ করে ব্যর্থ হয় এবং ফ্রান্স ইংল্যান্ড আক্রমণ করার চেষ্টা করে কিন্তু ল্যাগােস ও কুইবেরন উপসাগরে দুটি ফরাসি নৌবহর বিধ্বস্ত হয়। ফলে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমেরিকায় যুদ্ধ : ইউরােপে সপ্তবর্ষ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই আমেরিকায় ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। প্রথম দিকে ফরাসিদের সাফল্য লাভ হলেও শেষের দিকে কুইবেক মন্টরিয়েলের যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজয়ের ফলে কানাডায় ফরাসিদের প্রাধান্য বিলুপ্ত হয়।
ভারতে যুদ্ধ : ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। বাংলায় ইংরেজ ও ফরাসিরা দুর্গ সুরক্ষিত করতে থাকলে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তাদেরকে দুর্গ তৈরি করতে নিষেধ করেন। ফরাসিরা নবাবের আদেশ মানলেও ইংরেজরা অগ্রাহ্য করে। ফলে নবাব ১৭৫৬ সালে ইংরেজদের নিকট থেকে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গটি দখল করেন। কিন্তু ক্লাইভ ও ওয়াটসন সেটি পুনরুদ্ধার করেন। এরপর ক্লাইভ ফরাসি চন্দননগর কুঠি দখল করেন। পলাশী যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর বাংলায় ইংরেজদের আধিপত্য স্থাপিত হয়। ১৫৫৮ সালে ইংরেজ সেনাপতি আয়ারকুট ফরাসি সেনাপতি কাউন্ট লালীকে পরাজিত করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে ইংরেজ আধিপত্য কায়েম করেন। ফলে ভারতে ফরাসি শক্তির সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন বিলুপ্ত হয়। এভাবে সপ্তবর্ষের যুদ্ধে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া পরাজিত হয়।
ফ্রান্সের পরাজয়ের কারণ
এই যুদ্ধে ইউরােপ, আমেরিকা এবং ভারতে ফ্রান্সের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় –
- (১) ফ্রান্সের কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা : ফ্রান্সের কূটনৈতিক অদূরদর্শিতা সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ফ্রান্সের পতনের প্রধান কারণ ছিল। ফ্রান্সের নতুন মিত্র অস্ট্রিয়া সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য ফ্রান্সের সাথে মিত্রতা তৈরির জন্য কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন নীতি গ্রহণ করেছিল। ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার কারণে ইউরােপে প্রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। ফলে ফ্রান্স একই সঙ্গে ইউরােপ, আমেরিকা এবং ভারতে ইংরেজ ও তার মিত্রদের স্বার্থে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ফ্রান্সের যুদ্ধে জয়লাভের জন্য প্রয়ােজন ছিল ইউরােপে শান্তি রক্ষা করে আমেরিকা ও ভারতে ইংরেজদের মােকাবেলা করা।
- (২) ইংল্যান্ডের চতুর্দিক ছিল সমুদ্রবেষ্টিত : নৌশক্তিতে বলীয়ান ইংল্যান্ডের মােকাবিলা করার জন্য ফ্রান্সের শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল না। ফ্রান্সের নৌশক্তির দুর্বলতা তার পতনের কারণ ছিল।
- (৩) সাহসের অভাব : ফ্রান্সের নৌবাহিনীর সৈন্যরা ইংরেজদের ন্যায় সাহসী ও দুর্ধর্ষ ছিল না। তাই সমুদ্রবক্ষে যুদ্ধে ফরাসিরা ইংরেজদের নিকট পরাজিত হয়।
- (৪) শিল্পবিপ্লব ও বাজার তৈরির প্রেরণা : ফরাসিদের প্রেরণার অভাব তাদের পতনের কারণ ছিল। ১৮শ শতাব্দীতে ইংরেজরা ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছিল। শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পপণ্যের বাজার তৈরির জন্য ইংরেজরা সচেষ্ট ছিল কিন্তু ফরাসিদের মধ্যে তেমন প্রেরণার অভাব ছিল।
- (৫) জাতিগত স্বার্থের পার্থক্য : ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক স্বার্থ ছিল ইংরেজদের জাতীয় স্বার্থের দ্বারা প্রণােদিত। তাই ইংরেজ বণিকরা ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বার্থকে নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে এক করে দেখত। কিন্তু ফরাসি উপনিবেশগুলাে রাজকীয় স্বার্থে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। জাতীয় স্বার্থে উপনিবেশগুলাে গড়ে না ওঠায় ফরাসি বণিকরা এগুলাে রক্ষার জন্য ইংরেজদের ন্যায় নিজ উদ্যোগে অর্থ ব্যয় করত না।
- (৬) নেতৃত্বের দুর্বলতা : সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ইংরেজরা যুদ্ধ পরিচালনায় দক্ষ সংগঠক পেয়েছিল। পিট দি এলডারের ন্যায় যােগ্য যুদ্ধমন্ত্রী ফরাসিদের ছিল না। বড় পিট যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সেনাপতি নিয়ােগ, যুদ্ধকৌশলে যে দূরদর্শিতা দেখিয়েছিল ফরাসিরা সে ক্ষেত্রে বড় পিটের ন্যায় যােগ্য যুদ্ধমন্ত্রী নিয়ােগ করতে পারে নি। বড় পিট প্রাশিয়ার ফ্রেডারিককে অর্থ সাহায্য দিয়ে প্রাশিয়াকে ইউরােপে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখেছিল। যার ফলে ফরাসিদের পক্ষে আমেরিকা ও ভারতে যুদ্ধ উপকরণ ও সৈন্য প্রেরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পিটের যুদ্ধকৌশল ফরাসিদের পতন ডেকে এনেছিল।
- (৭) ফরাসিদের অর্থনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতা : ফরাসিদের অর্থনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতা তাদের পতনের কারণ ছিল। আমেরিকা ও ভারতে উপনিবেশ রক্ষার মতাে প্রয়ােজনীয় নৌবল ও সামরিক শক্তি ফরাসিদের ছিল না। ইংরেজরা স্থানীয় উৎস থেকে অর্থ ও সামরিক শক্তি সংগ্রহ করে তা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযােগ পেয়েছিল। বিশেষ করে ভারতে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইংবেজরা বাংলার অর্থসম্পদ ও সামরিক শক্তি ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযােগ পেয়েছিল। কিন্তু ফরাসিদের ক্ষেত্রে অর্থ ও সামরিক সাহায্যের জন্য নিজ দেশ ফ্রান্সের দিকে চেয়ে থাকতে হতাে।
- (৮) ভুল যুদ্ধকৌশল : উল্লিখিত কারণগুলাে ছাড়াও ফরাসি নীতিনির্ধারকদের ভুল যুদ্ধকৌশল এবং যােগ্য লােককে যথাস্থানে নিয়ােগের অদূরদর্শিতা তাদের পতনের কারণ ছিল। যেমন ভারত থেকে ডুপ্লের মতাে যােগ্য গভর্নরকে প্রত্যাহার করে সে স্থলে যাদের নিয়ােগ দিয়েছিলেন তারা ডুপ্লের মতাে যােগ্য ছিলেন না। এটিও তাদের ভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে পতনের কারণ ছিল।
প্যারিস শান্তিচুক্তি (১৭৬৩)
ইউরােপ-আমেরিকা-ভারতবর্ষ এই তিন যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধার অসম্ভব বলে মনে করে প্রাশিয়ার সাথে শান্তি স্থাপনে বাধ্য হয়। দুটি সন্ধির মাধ্যমে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এরফলে ১৭৬৩ সালে দুটি সন্ধি সাক্ষরিত হয়েছিল – (১) প্যারিসের সন্ধিতে (Peace treaty of Paris) ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেন স্বাক্ষর করে। (২) হিউবার্টস্বার্গের সন্ধি (Peace of Hubertsburg) দ্বারা প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও স্যাক্সনি স্বাক্ষর দান করে। এই দুই সন্ধি একত্রে প্যারিসের সন্ধি নামে পরিচিত। প্যারিস শান্তিচুক্তিতে স্পেনের ক্ষতি হয়। ইংল্যান্ড ফ্রান্স ও স্পেনের মধ্যে প্যারিসের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সপ্তবর্ষ ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধে স্পেন ফরাসি পক্ষ অবলম্বন করে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিল এবং নির্বুদ্ধিতার শাস্তিস্বরূপ
- (১) স্পেনকে দক্ষিণ আমেরিকার হন্ডুরাসের দুর্গগুলাে ভেঙে দিতে হয়।
- (২) নিউফাউন্ডল্যান্ডে স্পেনের মৎস্য শিকারের অধিকার নাকচ করা হয়।
- (৩) যুদ্ধের সময়কালে ইংল্যান্ড কর্তৃক অধিকৃত কিউবা ও ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ ইংল্যান্ড স্পেনকে ফিরিয়ে দিলেও তার পরিবর্তে আমেরিকায় ফ্লোরিডা ইংল্যান্ড লাভ করে।
ফ্রান্সের ক্ষতি ও ইংল্যান্ডের লাভ :
- প্যারিস শান্তিচুক্তির শর্ত মােতাবেক ফ্রান্স ইংল্যান্ডকে কানাডা, নােভাস্কশিয়া, কেপব্রেটন দ্বীপ, গ্রানাডা, গ্রেনেডাইন্স, টোবাগাে, ডমিনিকা ও সেন্ট ভিনসেন্ট দিতে বাধ্য হয়।
- এ ছাড়া লুইসিয়ানা নামক স্থানটি তারা স্পেনকে দিতে বাধ্য হয়।
- ভারতীয় উপমহাদেশে ফ্রান্স চন্দননগর, মাহে, পণ্ডিচেরী, কারিকল ও জিজ্ঞি – এই পাঁচটি স্থান ফিরে পেলেও ফরাসি অধিকৃত কোনাে স্থানে দুর্গ বা সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করা হবে না – এই শর্ত ফ্রান্সকে দিতে হয়েছিল। শুধুমাত্র বাণিজ্য উদ্দেশ্যে এসব স্থান ব্যবহৃত হবে এই শর্ত সন্ধিতে রাখা হয়েছিল।
- ইউরােপ মহাদেশে ইংল্যান্ড মিনরকা ফিরে পায়।
- আফ্রিকার সেনেগাল ফরাসি উপনিবেশ হলেও ফ্রান্স সেনেগাল ইংল্যান্ডকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
এভাবে ইংল্যান্ড আমেরিকা, ইউরােপ এবং ভারতীয় উপমহাদেশে জয়লাভ করে বিশ্বের সর্বত্র ইংল্যান্ড বাণিজ্য ও উপনিবেশ স্থাপনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ও বিশ্বে শ্রেষ্ঠ সামরিক ঔপনিবেশিক শক্তিতে পরিণত হয়, অন্যদিকে আমেরিকা ও ভারতে উপনিবেশ স্থাপনে ফরাসি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
হিউবার্টসবার্গের সন্ধি (১৭৬৩): অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া ও স্যাক্সনির মধ্যে হিউবার্টসবার্গের সন্ধি (১৭৬৩) স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধির শর্ত মােতাবেক প্রাশিয়া, স্যাক্সনি এবং অস্ট্রিয়ার মধ্যে যুদ্ধকালীন সময়ে অধিকৃত স্থানগুলাে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। প্রাশিয়া ফ্রেডারিক অধিকৃত স্যাক্সনি পরিত্যাগ করেন কিন্তু সাইলেশিয়ায় স্থায়ীভাবে প্রাশিয়ার অধিকার স্থাপিত হয়।
সপ্তবর্ষ যুদ্ধের ফলাফল
সপ্তবর্ষ যুদ্ধ ইউরােপের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এ যুদ্ধকে ইউরােপের ইতিহাসের অন্যতম নিষ্পত্তিকারী যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী –
- (১) সপ্তবর্ষ যুদ্ধে জয়লাভ করে প্রাশিয়া ইউরােপীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। জার্মানিতে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযােগিতায় অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে প্রাশিয়াই শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
- (২) মধ্য ইউরােপে ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রাশিয়া শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়।
- (৩) সপ্তবর্ষ যুদ্ধের ফলে ফ্রান্স সকল দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ফ্রান্সের নৌবাহিনী সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ফ্রান্সের আর্থিক অবস্থা শােচনীয় হয়েছিল। পরাজয়ের ফলে ফ্রান্সকে বহু স্থানের ঔপনিবেশিক অধিকার ত্যাগ করতে হয়। ইউরােপের রাজনীতিতে ফ্রান্সের প্রতিপত্তি ও গৌরব ম্লান হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই মর্যাদাহানি এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় গােলযােগ অদূরভবিষ্যতে ফ্রান্সে এক মহাবিপ্লবের সূচনা করেছিল।
- (৪) সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ইংল্যান্ড আমেরিকা ও ভারতীয় মহাদেশের সকল যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভ করেছিল। আমেরিকার যেসব স্থানে ইংল্যান্ড এই যুদ্ধের ফলে জয়লাভ করেছিল তাতে পশ্চিম দিকে মিসিসিপি নদী ইংরেজ উপনিবেশগুলাের সীমারেখায় পরিণত হয় এবং উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূল ইংরেজদের অধীনে আসে। ভারতে ফরাসিদের পতনের ফলে ইংরেজ সাম্রাজ্য স্থাপনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। সপ্তবর্ষ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ইংল্যান্ড বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক ক্ষেত্রে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়।
এই যুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ড কর্তৃক কানাডা অধিকারের মধ্যেই ভবিষ্যতে আমেরিকার স্বাধীনতা সগ্রামের অন্যতম কারণ নিহিত ছিল। ইংল্যান্ডের কানাডা বিজয়ের ফলে আমেরিকাবাসীদের ফরাসি আক্রমণের ভীতি দূরীভূত হয় এবং তারা ইংরেজদের অধীনতা-পাশ ছিন্ন করে স্বাধীনতা লাভের স্বপ্ন দেখে। সপ্তবর্ষ যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য পরবর্তীকালে ফ্রান্স ও স্পেন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের সাহায্য ও সহযােগিতা দিয়েছিল। এদিকে এই যুদ্ধের ফলে ফ্রান্সের রাজতন্ত্র দুর্বল হয়ে যায়, যা ফরাসী বিপ্লব সংগঠনে ভূমিকা রাখে। সপ্তবর্ষ যুদ্ধে ইংল্যান্ড ফ্রেডারিককে ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের প্রতিশ্রুত অর্থ সাহায্য প্রদানে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এ ছাড়া প্রাশিয়া যখন চতুর্দিকে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল তখন ইংল্যান্ড সাহায্যদানে বাল্টিক অঞ্চলে নৌসাহায্য প্রেরণ করেন নি। ফলে প্যারিস সন্ধির সঙ্গে সঙ্গেই প্রাশিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের মিত্রতা ভেঙ্গে যায়।
তথ্যসূত্র
- আধুনিক ইউরোপ, মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ২৬২-২৮৮
Leave a Reply