অস্ট্রিয়ার ইতিহাস (১৭৪০-১৭৯০)

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে অস্ট্রিয়া একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। অস্ট্রিয়া ক্যাথলিক ধর্ম অধ্যুষিত রাজ্য এবং বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর লোক নিয়ে অস্ট্রিয়ার জনশক্তি তৈরি হয়েছিল। অস্ট্রিয়ার রাজা ও পবিত্র রোমান সম্রাট ষষ্ঠ চার্লসের (১৭১১-১৭৪০) কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। একমাত্র কন্যা মেরিয়া থেরেসা কীভাবে উত্তরাধিকারের নিরাপত্তা লাভ করতে পারে এজন্য সুষ্ঠু যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সম্রাট ষষ্ঠ চার্লস মেরিয়া থেরেসাকে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে উত্তরাধিকারীকে মনোনয়ন করে তার সমর্থনে ইউরোপীয় রাজাদের সমর্থন আদায় করেছিলেন। ইতিহাসে একে প্যাগম্যাটিক স্যাংশন বলা হয়। প্রাগম্যাটিক স্যাংশন দ্বারা ইউরোপীয় শক্তিবর্গের নিকট থেকে তিনি মেরিয়া পেরেসার উত্তরাধিকার সম্পর্কে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন। এ কার্যে ব্যস্ত থাকায় তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে পারেন নি। ফলে তার মৃত্যুকালে অস্ট্রিয়ার রাজনৈতিক সংহতি, সামাজিক শক্তি বা অর্থবল কোনো কিছুই সুগঠিত ছিল না। এ দুর্বলতার সুযোগে প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক দি গ্রেট (১৭৪০-১৭৮৬) অস্ট্রিয়ার রাজ্য দখলের জন্য সচেষ্ট হন। প্রাগম্যাটিক স্যাংশন সত্ত্বেও অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার নিয়ে ইউরোপে এক ভয়াবহ যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।

মেরিয়া থেরেসা (১৭৪০-১৭৮০)

১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার সম্রাট ৬৪ চালর্সের মৃত্যুর পর তার কন্যা মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে বসেন। মেরিয়া থেরেসা যখন সিংহাসন লাভ করেন তখন তিনি অনভিজ্ঞ ও অল্পবয়স্ক ছিলেন। প্রাগম্যাটিক স্যাংশন ইউরোপীয় রাজগণ এই শর্তে স্বাক্ষর করেছিলেন যে, মেরিয়া থেরেসা পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবেন না। কাজেই কেবল অস্ট্রিয়ার সম্রাট হিসেবে মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার সিংহাসন লাভ করেন। সে সময় অস্ট্রিয়ার সম্রাটই পবিত্র রোমান সম্রাট পদ লাভ করতেন।

মেরিয়া থেরেসার শাসন

১৭৪০ সালে সিংহাসন লাভ করেই মেরিয়া থেরেসা তার স্বামী বেভেরিয়ার ইলেক্টর প্রথম ফ্রান্সিসকে তার সাথে যুগ্ম শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। প্রথম ফ্রান্সিস ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র রোমান সম্রাটের পদ লাভ করেন এবং ১৭৬৫ সালে পর্যন্ত সম্রাট হিসেবে শাসন করেছিলেন। মেরিয়া থেরেসা সিংহাসনে বসে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কোনো রদবদল করেন নি। পিতার আমলের সকল মন্ত্রীকেই স্বপদে বহাল রেখেছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তাকে এক কঠিন উত্তরাধিকার যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। (মেরিয়া থেরেসা বয়সে অপাপ্ত হওয়ায় তাকে নিয়ে তার পিতা ষষ্ঠ চার্লস গভীর সংকটে পড়েছিলেন। কারণ অস্ট্রিয়ার সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে পবিত্র রোমান সম্রাট করা হত। কিন্তু মেরিয়া থেরেসা মেয়ে হওয়ায় তার জন্য পবিত্র রোমান সম্রাট পদ লাভ করা সম্ভব ছিল না।) প্রাশিয়া ও ফ্রান্সের শাসকশ্রেণী মেরিয়া থেরেসার জন্য এ সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। ফ্রান্স ছিল অস্ট্রিয়ার হ্যাবসবার্গ রাজবংশের পরম শত্রুদেশ এবং প্রাশিয়া ছিল সদ্য শক্তিশালী হয়ে ওঠা ইউরোপের নতুন শক্তি যা অস্ট্রিয়ার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক দি গ্রেটের (১৭৪০-১৭৮৬) পিতা প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়াম (১৭১৩-১৭৪০) প্রাগম্যাটিক স্যাংশন রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ফ্রেডারিক দি গ্রেট পিতার প্রতিশ্রুতি অগ্রাহ্য করে মেরিয়া থেরেসাকে অস্ট্রিয়ার রাণী মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ফ্রান্সও প্রাগম্যাটিক স্যাংশন অগ্রাহ্য করে। এই সূত্রে সাইলেশিয়াকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু হয়। দু পর্যায়ে এই যুদ্ধ হয়েছিল। এই লা-স্যাপেলের সন্ধিতে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ বা সাইলেশিয়ার যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।

মেরিয়া থেরেসা সাইলেশিয়া হারিয়ে এ দুঃখ সহজে ভুলেন নি। তিনি সাইলেশিয়া উদ্ধারের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। প্রধান মন্ত্রী কৌনিজের পরামর্শে তিনি ফ্রান্সের সাথে দু’শত বছরের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফ্রান্সের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রিয়ার এই নতুন কূটনৈতিক সম্পর্ককে ইতিহাসে কূটনৈতিক বিপ্লব বলা হয়। কূটনৈতিক বিপ্লবের ফলে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধেও মেরিয়া থেরেসা সাইলেশিয়া উদ্ধার করতে পারেন নি। ১৭৬৩ সালে প্যারিসের সন্ধির দ্বারা মেরিয়া থেরেসা সাইলেশিয়ার অধিকার ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

১৭৭২ সালে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদের সময় তিনি অংশগ্রহণ করেন। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুত্র দ্বিতীয় যোসেফ (১৭৬৫-১৭৯০) ও মন্ত্রী কৌনিজের পরামর্শে তিনি প্রথম পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদে অংশগ্রহণ করেন। তিনি হোয়াইট রাশিয়ার অধিকাংশ, প্যালিসিয়া পোডোলিয়ার একাংশ, স্যান্ডামির ও ক্যাকো অধিকার করেছিলেন।

মেরিয়া থেরেসার শাসননীতি

অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে আরোহণের অল্পকাল পরেই মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রাশিয়ার নিকট সাইলেশিয়া হারান। তিনি অস্ট্রিয়ার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা দূর করে অস্ট্রিয়াকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন –

  • শাসন ব্যবস্থার সংস্কার : মেরিয়া থেরেসা যখন শাসন ক্ষমতা লাভ করেন তখন কেন্দ্রীয় রাজশক্তি দুর্বল ছিল। অস্ট্রিয়ার অভিজাত শ্রেণী ছিল খুবই প্রভাবশালী। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শাসন শক্তিশালী অভিজাতদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। যার ফলে রাজশক্তি ছিল দুর্বল। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসন ছিল বিভিন্ন রকমের এবং এগুলোর মধ্যে ঐক্যবোধ ছিল না। অভিজাত শ্রেণী ছিল দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বার্থপর। অস্ট্রিয়ার সামরিক শাসন পদ্ধতি ছিল সামন্ততান্ত্রিক ও প্রাচীন ধাচের। রাজস্ব প্রশাসনে দুর্নীতি ছিল। এ অবস্থায় মেরিয়া থেরেসা কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন।
  • শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীয়করণ : অস্ট্রিয়ার শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত কার্যকরী করার জন্য তিনি একটি কাউন্সিল অব স্টেট প্রতিষ্ঠা করেন। এই কাউন্সিলের উপর সাম্রাজ্যের (১) কার্যনির্বাহক, (২) রাজস্ব, (৩) সামরিক ও (৪) বিচার বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করেন। প্রাদেশিক গভর্নর কার্যনির্বাহক এবং রাজস্ব বিভাগের নির্দেশ মতো প্রাদেশিক শাসন পরিচালনা করতেন। ন্যায়বিচারের জন্য প্রত্যেক শহর এবং অভিজাতগণের জমিদারিতে প্রতিষ্ঠিত বিচারালয় থেকে প্রাদেশিক বিচারালয়ে আপিল করার ব্যবস্থা করা হয়। আবার প্রাদেশিক বিচারালয় থেকে প্রাদেশিক আপিল আদালতে আপিল করার ব্যবস্থা করা হয়। বিচার ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ছিল কেন্দ্রীয় হাইকোর্ট। সেখানেও বিচারপ্রার্থী হওয়া যেত। এভাবে শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে অধিকতর দক্ষ করা হয়। অভিজাতদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। এমনকি তাদের জমিদারিতেও তাদের অনেক ক্ষমতা কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষেত্রে অভিজাতদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়। সাম্রাজ্যের সর্বত্র কেন্দ্রীয় শাসনের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করা হয়েছিল।
  • সামন্ত শোষণের হ্রাস : এতদিন পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার কৃষকগণ ছিল জমিদারদের দ্বারা শোষিত। জমিদাররা কৃষকের কাছ থেকে বিভিন্ন শোষণমূলক কর আদায় করত। সকল রকম অর্থের কর নিষিদ্ধ করা হয়। অভিজাত শ্রেণী এতদিন পর্যন্ত যে সকল কর অগ্রাহ্য করে আসছিল তা কড়াকড়িভাবে আদায় করা হয়। অভিজাতদের শোষণ থেকে অনেকটা রক্ষার ফলে কৃষকদের অবস্থার উন্নতি হয় এবং এর ফলে কৃষির উন্নতি ঘটে।
  • শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন : মেরিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার শিক্ষা, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিয়োগের দায়িত্ব মেরিয়া পেরেসা গ্রহণ করেন। শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করে। ব্যবসা- বাণিজ্যের উন্নতির জন্য জাহাজ নির্মাণ, রাস্তা, খাল নির্মাণ করা হয় এবং বিভিন্ন শিল্পস্থাপনের জন্য সরকারিভাবে উৎসাহ দেয়া হয়। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য আন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক উঠিয়ে দেয়া হয়। ভূমধ্যসাগর ও আড্রিয়াটিক সাগরের অঞ্চলগুলোতে অস্ট্রিয়ার কনসাল নিয়োগ দেয়া হয়।
  • ডাক বিভাগের উন্নতি : সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ও খবর আদান-প্রদানের জন্য ডাক বিভাগের উন্নতি সাধন করা হয়। আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য আয়কর স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পোলট্যাক্স নামে মাথাপিছু কর আরোপ করা। রাষ্ট্রীয় আয় বৃদ্ধি এবং ব্যয় হ্রাসের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়।
  • সামরিক বিভাগের উন্নতি : অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীর দুর্বলতা অস্ট্রিয়ার পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল। এজন্য রাণী মেরিয়া থেরেসা সামরিক বাহিনীর উন্নতির জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি প্রাশিয়ার নিকট থেকে সাইলেশিয়া উদ্ধারে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এজন্য সুগঠিত, সুশিক্ষিত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের জন্য সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণ করেন। সৈনিক প্রশিক্ষণের জন্য সামরিক একাডেমি স্থাপন করা হয়। সেনাবাহিনীর আকার বড় করা হয়। কয়েক বছরের মধ্যে সেনাবাহিনী এক লক্ষ থেকে দুই লক্ষে উন্নীত হয়।
  • জ্ঞানদীপ্ত শাসন : মেরিয়া থেরেসা ছিলেন জ্ঞানদীপ্ত শাসক। অস্ট্রিয়ার কেন্দ্রীয় শাসন নিজ হস্তে গ্রহণ করলেও প্রজাদীপ্ত শাসকদের মধ্যে তার স্থান ছিল প্রথম স্থানে। রাষ্ট্রের ও জনগণের উন্নয়নের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।
  • চরিত্র ও কৃতিত্ব : মেরিয়া থেরেসা ছিলেন অসামান্য রূপবতী রাণী। তার আচার ব্যবহার ছিল মার্জিত। তার অকপটতা, দেশপ্রেম, ধর্মপ্রীতি তাকে সমকালীন ইউরোপের শাসকদের মধ্যে শ্রদ্ধার আসন দান করেছিল। নারী হলেও তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, ধৈর্যশীল ও সাহসী। তার সাহস ছিল পুরুষোচিত এবং কার্যক্ষমতা ছিল অপরিসীম এবং কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল অনন্য সাধারণ। তার অমায়িকতা ও চরিত্র মাধুর্য সকলকে মোহিত করত। এ মহান মহীয়সী শাসক ১৭৮০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

দ্বিতীয় যোসেফ (১৭৬৫-১৭৯০)

অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের ইতিহাসে অস্ট্রিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় যোসেফ একজন জ্ঞানদীপ্ত শাসক হিসেবে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। দ্বিতীয় যোসেফ ১৭৬৫ সালে পিতা পবিত্র রোমান সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিসের (১৭৪৫-১৭৬৫) মৃত্যুর পর সম্রাট পদে নির্বাচিত হন এবং ১৭৮০ সালে মাতা মেরিয়া থেরেসার মৃত্যুর পর অস্ট্রিয়ার শাসনক্ষমতা লাভ করেন। দ্বিতীয় যোসেফ ছিলেন জনকল্যাণকামী স্বৈরাচারী শাসক। তাই ক্ষমতা লাভ করেই তিনি অস্ট্রিয়ার উন্নতির জন্য বিভিন্ন শাসন সংস্কারের নীতি গ্রহণ করেছিলেন।

অভ্যন্তরীণ নীতি

অভ্যন্তরীণ শাসন সংস্কারের উদ্দেশ্যে : অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যোসেফের শাসননীতির উদ্দেশ্য ছিল –

  • (১) শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীকরণ করে অস্ট্রিয়ার অসংলগ্ন রাজ্যগুলোর সর্বত্র একই ধরনের শাসন ব্যবস্থা চালু করা,
  • (২) অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীকে একই জাতীয়তাভাবে উদ্বুদ্ধ করা ও সকলের জন্য একই প্রকার বিচার ব্যবস্থা প্রচলন করা,
  • (৩) সামাজিক ক্ষেত্রে সামন্ত সমাজ কাঠামো ভেঙে সামাজিক বৈষম্য দূর করে একই রকম আইন ও রীতিনীতি চালু করা,
  • (৪) বিচার ব্যবস্থায় সকলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা,
  • (৫) সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার বাস্তবায়ন করে অস্ট্রিয়াকে এক আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা,
  • (৬) স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার অধীনে গণতান্ত্রিক সাম্য স্থাপন করা।

প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ

  • (১) দ্বিতীয় যোসেফ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় শাসন সুদৃঢ় করেন। তিনি হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ড এবং লোম্বার্ড নামক বিভিন্ন অংশের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করেন।
  • (২) সমগ্র অস্ট্রীয় ভূখণ্ডসমূহকে একটি একক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা হয়। তেরটি প্রদেশ সমন্বয়ে একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র গঠন করা হয়। যথা- (১) গ্যালেসিয়া, (২) বোহেমিয়া; (৩) মরেভিয়া; (৪) নিম্ন অস্ট্রিয়া; (৫) মূল অস্ট্রিয়া (স্টিরিয়া, ক্যারেনথিয়া ও ক্যারেনিওলা); (৬) টাইরল; (৭) সোয়াবিয়াতে অস্ট্রীয় ভূখণ্ড; (৮) ট্রান্সিলভিনিয়া; (৯) হাঙ্গেরি; (১০) ক্রোশিয়া; (১১) লোম্বার্ডি; (১২) অস্ট্রীয় নেদারল্যান্ডস (১৩) টিয়েস্ট সহ গর্জ ও প্রভিস্কা কাউন্টিদ্বয় – প্রদেশগুলোতে সার্কেলে ভাগ করা হয়। প্রত্যেকটি প্রদেশের শাসনভার একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তার অধীনে ন্যস্ত করা হয়।
  • (৩) প্রাদেশিক ডায়েট বা আইনসভার ক্ষমতা খর্ব করা হয় এবং রাজকীয় শহরের বিশেষ সুবিধা বাতিল করা হয়।
  • (৪) অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য তৈরির জন্য জার্মান ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়।
  • (৫) সাম্রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য রাস্তাঘাট সংস্কার ও নতুন রাস্তা তৈরি এবং শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কার করেন। টিয়েস্টের প্রাক্তন গভর্নর জিনজেনডর্ফের নেতৃত্বে অস্ট্রীয় ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়। এড্রিয়াটিক সাগরের সমুদ্রবন্দরগুলো বিশেষ করে ফিউম বন্দরকে আধুনিকীরণ করা হয়। পশ্চিম আফ্রিকা, মরক্কো, তুরস্ক ও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করা হয়। ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে অস্ট্রীয়ার বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা হয়। চীন ও ভারতে কারখানা তৈরি করা হয় এবং ভিয়েনাতে শিল্পশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। অস্ট্রীয় শিল্পের বিকাশের জন্য ১৭৮৪ সালে আমদানি ক্ষেত্রে প্রোটেকশন ব্যবস্থা চালু করা হয়।
  • (৬) দ্বিতীয় জোসেফ অস্ট্রিয়ার আইন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করেন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন বিধি প্রস্তুত করেন। মৃত্যুদণ্ড প্রথা বিলোপ করা হয়। তবে এটা কেবল রাষ্ট্রদ্রোহীদের জন্য বহাল রাখা হয়। কয়েদিদের উপর নির্যাতন প্রথা বাতিল করা হয়। বিচার ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ভিয়েনা নগরীতে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর তত্ত্বাবধানে ভিয়েনা, প্রাগ, ক্লাগেন ফুর্থ, ব্রিসগের ফ্রিবার্ন, ব্রুন ও লোম্বাগ – এ ছয়টি আপিল আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
  • (৭) সামরিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়।
  • (৮) চার্চকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। দ্বিতীয় যোসেফের ধর্মীয় নীতির উদ্দেশ্য ছিল অস্ট্রিয়ার জনগণের উপর পোপের প্রভাব ধ্বংস করা ও গির্জাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা এবং সাধারণ খ্রিস্ট ভক্তদের উপর ধর্মযাজকদের ক্ষমতা হ্রাস করা। এক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য সংস্কার সমূহ –
    • দ্বিতীয় যোসেফ জেনসেনীয় মতবাদের অনুসারীদেরকে ধর্মীয় পদে নিয়োগ দেন।
    • ১৭৮১ সালে ১৩ অক্টোবর টোলারেশন আইন জারি করে ধর্মক্ষেত্রে সকল ধর্মাবলম্বীকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। প্রোটেস্টান্টদেরকে তাদের নিজস্ব গির্জা ও স্কুল স্থাপনের অধিকার দেয়া হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সম্পত্তি ক্রয়ের অধিকার দেয়া হয় এবং ইহুদিদের অনেক সুবিধা দেয়া হয়।
    • ক্যাথলিক ধর্মযাজক কর্তৃক ধর্মান্তর নিষিদ্ধ করা হয়।
    • অস্ট্রিয়ার ক্যাথলিক চার্চে পোপের ক্ষমতা বিলোপ করে সম্রাটের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।
    • সম্রাট নিজে বিশপ নিয়োগের ক্ষমতা নেন এবং চার্চকে কুসংস্কার মুক্ত করার জন্য চার্চে কোনো প্রতিকৃতি রাখা নিষিদ্ধ করা হয়।
    • দ্বিতীয় যোসেফের ধর্মীয় স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে বোহেমিয়াতে একটি ঈশ্বরবাদী সম্প্রদায় গড়ে উঠে। যোসেফ তাদের বিরুদ্ধে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন এবং তাদের টলারেশনস এডিক্টের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করন এবং তাদের শাস্তি দেন। তবে তিনি ইহুদিদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিলে তাদের ধর্মবিশ্বাসের উপর সম্রাটের খবরদারি তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি।
    • দ্বিতীয় যোসেফ ধর্মীয় ক্ষেত্রে নিজ সমর্থনপুষ্ট একদল ধর্মযাজক গড়ে তোলেন। তারা পোপের ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নতুন তত্ত্ব প্রচার করেন। সে তত্ত্বটি ছিল “সেন্ট পিটারের উত্তরাধিকারীর পার্থিব ক্ষমতা দখলের কোনো অধিকার নেই।” এই মতবাদে সন্দিগ্ধ হয়ে পোপ ষষ্ঠ পিয়াস (১৭৭৫-১৭৯৯) সম্রাট দ্বিতীয় যোসেফকে পরীক্ষা করতে ভিয়েনা পরিদর্শনে আসেন এবং তা ক্যাথলিকদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি করে। সম্রাট পোপের সাথে কোনো কথা বলেন নি। তবে পোপের উপস্থিতি দক্ষিণ জার্মানিতে ক্যাথলিক ধর্মে পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করেছিল এবং সম্রাট তা দমনে কোনো ব্যবস্থা নেন নি।
    • দ্বিতীয় যোসেফ অস্ট্রীয় সাম্রাজ্যে পোপের ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য ১৭৮১, ১৭৮৪ ও ১৭৮৫ সালে নতুন আদেশ জারি করে রোমে আপিল অথবা সম্রাটের অনুমতি ছাড়া কোনো পেপাল বুল (Papal bull) প্রচার করতে বিশপদের নিষেধ করেন। মঠসমূহের উপর পোপের আধিপত্য বিলুপ্ত করেন। রোমে কোনো অর্থ প্রেরণে বিধিনিষেধ আরোপ করেন। রোমের জার্মান কলেজে শিক্ষা লাভের জন্য অনুমতি নিষিদ্ধ করা হয়। পোপ কর্তৃক প্রদত্ত বাণী মূল্যহীন করা হয়। সম্রাট যোসেফ অস্ট্রিয়াতে ছয়’শ মঠ উচ্ছেদ করেন। মঠগুলো ধর্ম প্রচারের কেন্দ্র হলেও এগুলো রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণজনক ছিল না। যাজকতন্ত্র এবং অনেক নান মঠ (নারী মঠ) বিলুপ্ত করা হয়। উচ্ছেদকৃত মঠের সম্পত্তির রাজস্ব জনহিতকর কার্যে ব্যয় করা হয়। অবিলোপকৃত মঠসমূহকে কঠোর পরিদর্শনে রাখা হয় এবং তাদেরকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনায় সম্রাটের নির্দেশ মানতে বাধ্য করা হয়।
  • (৯) সমাজের সকল মানুষকে একই শ্রেণীভুক্ত করার জন্য ভূমিদাসত্ব প্রথা বাতিল করেন।
  • (১০) তিনি বেগার শ্রম (corvee) বন্ধ করেন। পূর্বে কৃষকদের সরকারি রাস্তা, পুল ইত্যাদি প্রস্তুত করার জন্য বেগার শ্রম দিতে হত। দ্বিতীয় যোসেফ এই বেগার শ্রম (Corvee) বাতিল করে মজুরির পরিবর্তে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করেন।
  • (১১) দ্বিতীয় যোসেফ ১৭৮৭ সালে এক রাজকীয় আদেশ বলে অস্ট্রীয় রাজতন্ত্রের অধীনে নেদারল্যান্ডসকে একটি প্রদেশে রূপান্তর করেন। নতুন প্রদেশকে নয়টি সার্কেলে বিভক্ত করে শাসন কার্যের জন্য প্রতি সার্কেলে একজন করে ‘ইন্টেনডেন্ট’ নিয়োগ দেন। সার্কেলগুলোকে আবার জেলায় বা কাউন্টিতে বিভক্ত করা হয়। জেলাগুলো ‘ইন্টেনডেন্ট’ কর্তৃক নিয়োগকৃত কমিশনার দ্বারা শাসিত হত। প্রাচীন আদালত উচ্ছেদ করে নতুন কার্য প্রক্রিয়াসহ নতুন আদালত স্থাপন করা হয়। নেদারল্যান্ডসে শাসন সংস্কার জনগণের মধ্যে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করে। ভনডের নোট নামে একজন আইনবিদ দ্বিতীয় যোসেফের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডসে গণআন্দোলন সৃষ্টি করেন। এ অবস্থায় দ্বিতীয় যোসেফ ১৭৮৭ সালে এক আদেশ বলে পূর্বতন আদেশ বাতিল করেন। তার ধর্মীয় এডিক্টগুলো পুনঃপ্রয়োগ করে নেদারল্যান্ডসে সৈন্য সমাবেশ করেন। ১৭৮৮ সালে ব্রাবান্ট ও হেনল্টের প্রতিনিধি সভা সাবসিডি দিতে অস্বীকার করলে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হেনল্টের প্রতিনিধিসভা বিলুপ্ত করা হয় এবং জুন মাসে ব্রাবান্টের সংবিধান বাতিল করা হয়। এ অবস্থায় অনেক মানুষ হল্যান্ডে পালিয়ে যায়। নেদারল্যান্ডসে বিদ্রোহ শুরু হয়, ফলে অস্ট্রীয় সৈন্যবাহিনীকে নেদারল্যান্ডস ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। বিদ্রোহী প্রদেশগুলো স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৭৯০ সালে একটি ফেডারেল রিপাবলিক গঠন করে।

অভ্যন্তরীণ সংস্কারের সমালোচনা

দ্বিতীয় যোসেফের সামাজিক সংস্কারের যথার্থতা উপলব্ধি করার যোগ্যতা ও মানসিকতা তৎকালীন অভিজাত ও সাধারণ মানুষের ছিল না। সংস্কারগুলো ছিল অনেক আধুনিক যা উপলব্ধি করার মতো মানসিকতা অস্ট্রীয় সমাজের ছিল না। অভ্যন্তরীণ সংস্কার কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এগুলো বাস্তবায়নে দ্বিতীয় যোসেফ ব্যর্থ হয়েছিলেন –

  • তার শাসন সংস্কার হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ড প্রভৃতি স্থানে গণবিক্ষোভ ও বিদ্রোহের সূচনা করেছিল।
  • দ্বিতীয় যোসেফের ধর্মীয় সংস্কারগুলো ছিল আধুনিক। কিন্তু এই ধর্মীয় সংস্কারের জন্য যোসেফ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশপ, অন্যান্য ধর্মযাজক, এমনকি জনগণের সমর্থন হারান, যারা ধর্মীয় শোভাযাত্রা ও তীর্থযাত্রায় তার হস্তক্ষেপে বিরক্ত হয়।
  • প্রজাদের জাতীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে তার সংস্কারগুলো ব্যর্থ হয়।
  • প্রদেশে সরকারি কর্মকর্তা দ্বারা পরিচালিত বিচারকার্য ও ভিয়েনায় একটি সুপ্রিমকোর্টের আপিল করার সুবিধা অভিজাতরা পছন্দ করেন নি।
  • বোহেমিয়া ও ক্রোশিয়ার রাজসভায় জার্মান ভাষার ব্যবহার সেখানকার জনগণ পছন্দ করে নি।
  • হাঙ্গেরীয় রাজার অধিকার লুপ্ত করে তিনি ম্যাগিয়ার প্রজাদের বিরাগভাজন হন।
  • প্রাদেশিক ডায়েটগুলো বিলুপ্ত করলে অনেক অভিজাত ক্ষুব্ধ হন।
  • জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় পার্থক্যকে আইন দ্বারা ধ্বংস করা সম্ভব হয় নি।
  • আইনের চোখে সবাইকে সমান করার আদর্শ কেউ সহজে মেনে নেয় নি।
  • জার্মান ভাষা রাষ্ট্রভাষা করায় স্থানীয় ভাষা বিলুপ্ত হবার উপক্রম হয়েছিল।
  • বিশেষ করে ধর্মীয় সংস্কারগুলো অনুপযুক্ত সময়ে গৃহীত হওয়ায় এগুলোর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছিল।

পররাষ্ট্র নীতি

যোসেফের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্যছিল অস্ট্রিয়ার শিক্ষিত রাজ্যাংশগুলোর সংহত করন এবং জার্মানীর উপর অস্ট্রিয়ার হ্যাবসবার্গ আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে হলে প্রয়োজন ছিল—

  • (১) সাইলেশিয়ার পুনরুদ্ধার ও হোহেনজোলান বংশের শক্তিনাশ করা, এ ছাড়া
  • (২) অস্ট্রিয়ার দক্ষিণ ও পূর্ব সীমান্তবর্তী স্থানসমূহ দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত করা এবং ভেনিস, ডালমেশিয়া, ওয়ালাচিয়া, বসনিয়া, বেলগ্রেড, হোর্জেগোবিনা, মন্টেনিগ্রো ও সার্বিয়ার কিছু অংশ দখল করা,
  • (৩) দূরবর্তী নেদারল্যান্ডসের পরিবর্তে ব্যাভেরিয়ার বিনিময় করা। কারণ বেভেরিয়া দখলের উপর নির্ভর করত জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার প্রভাব বজায় রাখা।

দ্বিতীয় যোসেফের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রধান বাধা ছিল ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার শত্রুতা। এজন্য যোসেফ রাশিয়ার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। মাতা মেরিয়া থেরেসার সময় থেকে ফ্রান্সের মিত্রতা লাভের প্রচেষ্টা চলছিল। দ্বিতীয় যোসেফ ১৭৭৭ সালে প্যারিস ভ্রমণ করে ফ্রান্সের মিত্রতা নিশ্চিত করেন।

বেভেরিয়া দখলের চেষ্টা : ১৭৭৭ সালে বেভেরিয়ার ইলেক্টর তৃতীয় ম্যাক্সিমিলিয়নের (১৭২৭-১৭৭৭) মৃত্যু হলে অস্ট্রিয়া বেভেরিয়া দখলের চেষ্টা করলে প্রাশিয়া তাতে বাধা দেয়। ঐ সময় ফ্রান্স অস্ট্রিয়াকে কোনো প্রকারের সহযোগিতা করে নি। যোসেফ বেভেরিয়ার এক ক্ষুদ্র অঞ্চল পেয়ে সন্তুষ্ট হতে চেয়েছিল। এ কারণে যোসেফ ফরাসি মিত্রতা ত্যাগ করে রাশিয়ার সাথে মিত্রতা স্থাপনের জন্য ১৭৮১ সালে মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুসারে যোসেফ তুর্কি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রুশ আক্রমণাত্মক নীতির সমর্থন দেবে। এই চুক্তির সুযোগ গ্রহণ করে রাশিয়া তুরস্কের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে। প্রাচ্যে রুশ হস্তক্ষেপে ফ্রান্স প্রাচ্য সমস্যায় জড়িত হয়। ১৭৮৩ সালে অক্টোবর মাসে ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রী ভারজিনস যোসেফকে জানায় যে, অস্ট্রিয়া তার পূর্বাঞ্চলের পরিকল্পনা পরিত্যাগ না করলে ফ্রাঙ্কো—অস্ট্রিয়া মিত্রতা পরিত্যাক্ত হবে। অন্যদিকে ফ্রান্সের ষোড়শ লুই (১৭৭৪-১৭৯২) তুর্কি সুলতান প্রথম আব্দুল হামিদকে (১৭৭৪-১৭৮৯) যা ঘটেছে তা মেনে নিতে অনুরোধ করেন। ১৭৮৪ সালে ৬ জানুয়ারি কনস্টান্টিনোপল চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তুর্কি সুলতান ক্রিমিয়া ও কুবান হারানো মেনে নেন। দ্বিতীয় যোসেফ রাশিয়াকে সমর্থন করেছিলেন এই শর্তে যে রাশিয়া তাকে নেদারল্যান্ডসের পরিবর্তে বেভেরিয়া দখলে সমর্থন করবে। কিন্তু দ্বিতীয় যোসেফ প্রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে বেভেরিয়া দখল করতে পারেন নি।

১৭৮৪ সালে দ্বিতীয় যোসেফ নেদারল্যান্ডসের মেইস্ট্রিশট দখল করে শ্লেট নদীতে অস্ট্রিয়ার জাহাজ চলাচলের অধিকার দাবি করেন। এ সময় হল্যান্ড ইংল্যান্ডের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় অস্ট্রিয়াকে বাধা দিতে পারে নি। কিন্তু ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ নেদারল্যান্ডসে জোসেফের আক্রমণাত্মক নীতি মেনে নেয় নি। ইতোমধ্যে রাশিয়ার জরিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন (১৭৬২-১৭৯৬) অস্ট্রিয়াকে সমর্থন না করে বিরোধ মীমাংসার জন্য পরামর্শ দেন। এ অবস্থায় কূটনৈতিক বেকায়দায় পড়ে যোসেফ ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর ‘ফন্টেইনরো সন্ধি’ দ্বারা মেইস্ট্রিশট ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উপর দাবি ত্যাগ করেন শ্লেট নদীর একাংশের উপর অস্ট্রিয়ার অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। নেদারল্যান্ডসে হল্যান্ড কর্তৃক নির্মিত দুর্গগুলোর মধ্যে কয়েকটি ভেঙে দেয়া হয় এবং যোসেফ লিলো ও লিফকেনসফ দুর্গ দুটি লাভ করেন।

দ্বিতীয় যোসেফ দক্ষিণ জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার ভূখণ্ডসমূহকে সংহত এবং অস্ট্রীয় নেদারল্যান্ডসকে একটি বার্গান্ডি রাজ্যে পরিণত করার পরিকল্পনা করেন। প্রাচ্য অঞ্চলে রাশিয়ার নীতি ছিল রাশিয়ার আধিপত্য স্থাপন। অনুরূপভাবে জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার নীতি ছিল জার্মানিতে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য স্থাপন। যোসেফের এই পরিকল্পনা মতে বেভেরিয়ার বিনিময়ে ইলেক্টর প্যালাটিনি পাবেন রাজা পদবিসহ অস্ট্রিয়া নেদারল্যান্ডসের বৃহদাংশ এবং এর জন্য উৎকোচ হিসেবে ফ্রান্স লাভ করবে লুক্সেমবুর্গ ও নামুর। প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক দি গ্রেট (১৭৪০-১৭৮৬) এই পরিকল্পনা জানতে পেরে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সে প্রতিবাদপত্র প্রেরণ করেন। এরপর তিনি জার্মান রাজাগণের সমন্বয়ে ফাস্টেনবান্ড (Fustenbund) নামে ইউনিয়ন গঠন করেন। ফলে দ্বিতীয় যোসেফের বেভেরিয়া দখলের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

সমালোচনা : দ্বিতীয় যোসেফের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ছিল অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যকে সংহত করার জন্য যুদ্ধ ও কূটনীতি গ্রহণ করা। প্রাশিয়া ও ফ্রান্স তার উদ্দেশ্য সাধনে প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই তিনি রাশিয়ার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। কিন্তু রাশিয়াকে প্রাচ্য অঞ্চলে তুর্কি সাম্রাজ্য দখল করার সুযোগ দিয়ে পরিণামে অস্ট্রিয়ার স্বার্থ নষ্ট করেছিলেন। প্রাশিয়ার সাথে শত্রুতা ভুলে গিয়ে যদি প্রাশিয়ার সাথে যুগ্মভাবে পশ্চিম ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব ধ্বংস করতে পারতেন তা হলে অস্ট্রিয়ার লাভ হত। কিন্তু সেটি তিনি উপলব্ধি করেন নি। রাশিয়ার আগ্রাসী নীতিতে অস্ট্রিয়া সাহায্য করে বিশেষ করে তুরস্ক সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে রাশিয়াকে ক্রিমিয়া দখলে সহায়তা করে। এর বিনিময়ে তিনি রাশিয়ার কোনো সাহায্য পান নি বেভেরিয়া দখলের সময়। নেদারল্যান্ডসের পরিবর্তে বেভেরিয়া দখলের মধ্যে দ্বিতীয় যোসেফের দূরদর্শিতা ও দেশপ্রেম ছিল কিন্তু সেটা বাস্তবায়নের জন্য যে কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করা দরকার ছিল দ্বিতীয় যোসেফ তা করতে পারেন নি।

দ্বিতীয় যোসেফের বিফলতার কারণ

আনদীপ্ত স্বৈরাচার হিসেবে দ্বিতীয় যোসেফ সমকালীন ইউরোপের যে কোনো রাজার চেয়ে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তার প্রজাহিতৈষী শাসন ও দেশপ্রেম তাকে ইতিহাসে শ্রদ্ধাশীল শাসকের আসনে স্থান দিয়েছে। তিনি যে সকল সংস্কারের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো আধুনিক চিন্তা চেতনায় নিঃসন্দেহে ভালো ছিল। এদিক থেকে তাকে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রথম স্থানে জায়গা দেয়া দরকার। কিন্তু তার সফলতায় মাপকাঠিতে বিচার করলে তাকে ইউরোপের সবচেয়ে বিফল রাজা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নিম্নে বিফলতার কারণগুলো আলোচনা করা হলো :

  • (১) তিনি সংস্কারগুলোর যথার্থতা সম্পর্কে তার প্রজাদের অনুধাবন করাতে পারেন নি।
  • (২) সংস্কারের মাধ্যমে সামন্ত অভিজাতদের সুযোগ-সুবিধা নষ্ট হওয়ায় তারা শ্ৰেণীস্বার্থে তাকে গ্রহণ করে নি।
  • (৩) ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা অস্ট্রিয়ার জনগণের মনে এত প্রবল ছিল যে, ধর্মীয় সংস্কারগুলোকে তারা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ মনে করেছিল।
  • (৪) ধর্মীয় যাজকদের বিরোধিতা ও প্রচারণায় দ্বিতীয় যোসেফের সংস্কারকে ব্যর্থ করেছিল।
  • (৫) অস্ট্রিয়ার জনগণ ছিল বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের অনুসারী। যার ফলে একই রকম ভাষা স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বিষয়টিকে অনেকে তাদের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ মনে করত।
  • (৬) ভূমিদাসত্ব বিলোপ করে সমাজের সকল মানুষকে একই শ্রেণীতে আনার তার পরিকল্পনা ও নীতি সাধারণ মানুষ মূল্যায়ন ও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
  • (৭) দ্বিতীয় যোসেফের স্বৈরতন্ত্র কর্তৃক শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য তার আনাড়ি হস্তক্ষেপের জন্য মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বিরক্ত হয়েছিল।
  • (৮) দ্বিতীয় যোসেফ অনেক সংস্কার একসাথে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোনোটিই বাস্তবায়ন করতে পারেন নি। তিনি প্রথম পদক্ষেপের পূর্বেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।

উপসংহার

দ্বিতীয় যোসেফের সংস্কারগুলো তার জ্ঞানদীপ্ত রাষ্ট্রনায়কোচিত মনোভাবের পরচায়ক। কিন্তু জনগণের কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা এগুলোকে ব্যর্থ করেছিল। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ না করে সংস্কারসমূহ জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় এবং প্রায় সকল জনগণ রক্ষণশীল ও অনগ্রসর হওয়ায় এই সংস্কারগুলোকে তাদের স্বার্থ ও সুবিধার পরিপন্থী মনে করত। তিনি আত্মপর স্বার্থ এবং জাতীয় ও শ্রেণী প্রতিকূলতার শক্তিকে অবজ্ঞা করেছিলেন। সুতরাং তার সংস্কার দেশে অসন্তুষ্টি ও বিদ্রোহের সৃষ্ট করেছিল।

বহু জাতি অধ্যুষিত দেশে একই রকমের প্রশাসন, একই রকম আইন ও ভাষার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা বিপদ ডেকে এনেছিল।

১৭৯০ সালে মৃত্যুশয্যায় তিনি উপলব্ধি করেন যে, তিনি সংস্কার কার্যে ব্যর্থ হয়েছেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি আদেশ দেন যে, তার প্রায় সকল সংস্কার বাতিল করতে হবে। তিনি নিজেই নিজের সমাধির উপর এই কথাগুলো উৎকীর্ণ করতে আদেশ দেন, “Here lies the man who never succeeded in any thing that he attempted.” অর্থাৎ “এখানে এমন একজন ব্যক্তি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন যিনি সৎ উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো কিছুতেই কৃতকার্য হন নি।”

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ, মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ৩০৫-৩১৫

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.