জ্ঞানদীপ্তি ও জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার

জ্ঞানদীপ্তি (Enlightment)

যুক্তিবাদ

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে রেনেসাঁস বা নবজাগৃতির ফলে ইউরোপে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনীতি, ধর্ম, রাজধর্ম ও অর্থনীতি সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসার সৃষ্টি হয়। এ অনুসন্ধিৎসা থেকে জাগত হয় যুক্তিবাদ। যুক্তিবাদের প্রভাবে মধ্যযুগীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস মানুষের মন থেকে অনেকটা দূরীভূত হয় এবং মানুষের মধ্যে উদারতা ও মানবতা বিকশিত হয়। সপ্তদশ শতকে বিজ্ঞান ও দর্শনের নতুন চিন্তাভাবনা মানুষের মনে জ্ঞানপিপাসা আরো বৃদ্ধি করে। এ ধারাবাহিকতায় অষ্টাদশ শতকে রেনেসাঁর জাত যুক্তিবাদ প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা সকল ক্ষেত্রেই জাতীয় ধর্মের অনুরূপ মর্যাদা লাভ করে এবং এর মাধ্যমে প্রচলিত সকল ভাবনার যথার্থতা যাচাই হতে থাকে। এজন্য অষ্টাদশ শতককে আনদীপ্তির যুগ বলা হয়ে থাকে (Age of Enlightment)। এ শতকে অনুসন্ধিৎসু মানুষের নিকট যুক্তি ও বুদ্ধি ছিল শ্রেষ্ঠ।

যুক্তিবাদের ভিত্তি : অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে জ্ঞানদীপ্তির যে শিক্ষা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল তার পেছনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল ধ্রুপদী গ্রিক যুক্তিবাদের ভূমিকা ও আরবীয় শিক্ষা সংস্কৃতির প্রভাব, খ্রিস্টধর্মের মানবতাবোধ এবং পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রকৃতিবাদী চিন্তা। সপ্তাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানের নানা শাখায় গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রসার ঘটে এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের নানা প্রকার আবিষ্কার ইউরোপীয় মনীষাকে বিজ্ঞানচর্চায় অধিকতরভাবে নিয়োজিত করে। এর ফলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে জ্ঞানদীপ্তি বা মানসিক উৎকর্ষ ইউরোপীয় সমাজ, রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। এ শতাব্দীতেই বিজ্ঞান ইন্দ্রজাল (magic) ও কুসংস্কার (Superstition) যুক্ত হয়। রাজা, অভিজাত সম্প্রদায় এবং শিক্ষিত শ্রেণী, ব্যক্তিগতভাবে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। অনেক দেশে বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। জ্ঞানদীপ্ত রাজারা বিখ্যাত দার্শনিকদের সাথে পত্র বিনিময় এবং তাদের দর্শনের অনুশীলন শুরু করে। এর ফলে রাজপরিবার থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী সবাই বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের অনুরাগী হয়।

জ্ঞানদীপ্তির বৈশিষ্ট্য

জ্ঞানদীপ্তির উল্লেখযোগ্য কতগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল। যথা:

  • ১. প্রকৃতির রহস্যকে যুক্তির দ্বারা ব্যাখ্যার চেষ্টা এবং দৈব ও অতিপ্রাকৃতকে মানুষের চেতনা থেকে অপসারণ।
  • ২. মানুষের অভিজ্ঞতাকে যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করা।
  • ৩. প্রকৃতিবাদে (Naturalism) অনুগামী হওয়া এবং রাষ্ট্র ও সমাজে প্রকৃতির নিয়মকে কাজে লাগানো।
  • ৪. যুক্তিবাদকে (Rationalism) ধর্মের ওপর স্থান নেওয়া।
  • ৫. সামাজিক প্রথা (Customs) ও ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তির দ্বারা যাচাই করে গ্রহণ করা।

অষ্টাদশ শতকে চিন্তা ক্ষেত্রে যুক্তিবাদ (Rationalism) খুবই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। যুক্তিবাদ থেকে জন্ম লাভ করে মানবতাবাদ ও প্রকৃতিবাদ। সমাজে মানুষের মঙ্গলের জন্যই সবকিছু অর্থাৎ ধর্ম ও রাষ্ট্র মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষের মঙ্গলই মানবতাবাদের মূল কথা। মানুষের মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। জ্ঞানদীপ্তির মূল দর্শন ছিল রাষ্ট্র ও প্রকৃতিকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা।

জ্ঞানদীপ্তির যুগে দার্শনিকদের ভাবনা

অষ্টাদশ শতকে জ্ঞানদীপ্তির প্রভাবে ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক প্রভৃতি দেশে প্রখ্যাত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের আবির্ভাব হয়। এদের প্রভাবে বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। যেমন: রোমের একাডেমি অব লিঙ্কসেস (Academy of linxes), ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্স (Academy of Science), ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির (Royal Society) নাম উল্লেখ করা যায়। এ সকল প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায় ইউরোপের সর্বত্র রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভূবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, শারীরবিদ্যা, দর্শন, ইতিহাস, শিল্পকলা, রাজনীতি, সঙ্গীত, সাহিত্য সব ক্ষেত্রেই চিন্তা ও গবেষণা শুরু হয়। জ্ঞানের এই বিচিত্র উন্মেষ জ্ঞানদীপ্তি সম্ভব করেছিল। এই জ্ঞানদীপ্তির প্রভাবে অনেক শাসক মানব সমাজের উন্নতিসাধনের জন্য দার্শনিকদের মতামতকে কাজে লাগাতে এগিয়ে আসে। জ্ঞানদীপ্ত যুগের দার্শনিকরা ধর্ম ও রাষ্ট্রের উদ্ভব, রাজার অধিকার, অভিজাতদের বিশেষ অধিকার, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের মতবাদ ও যুক্তি তুলে ধরেন। এর ফলে অষ্টাদশ শতকের প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বহু ত্রুটি মানুষের নিকট ধরা পড়ে। এই জ্ঞানদীপ্তির প্রভাবে ইউরোপের নতুন নতুন শহরে অধিবাসী বুর্জোয়ারা রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পর্কে নতুনভাবে ভারতে থাকে। বুর্জোয়া শ্রেণী দার্শনিকদের মতবাদে প্রভাবিত হে উপলব্ধি করে যে, যুক্তিবাদ পুরোনো সমাজব্যবস্থাকে লোপ করতে পারবে। আইনজীবী, শিক্ষক, চাকুরে, বণিক প্রভৃতি শ্রেণী ছিল দার্শনিকদের নতুন দর্শনের অনুরাগী ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজারা দার্শনিকদের মতবাদে অনুরক্ত হন এবং দর্শনের চর্চা শুরু করেন। প্রাশিয়ার ফ্রেডারিক দি গ্রেট (১৭৪০-১৭৮৬), অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় জোসেফ (১৭৬৫-১৭৯০), রাশিয়ার দ্বিতীয় ক্যাথেরিন (১৭৬২-১৭৯৬) ছিলেন জ্ঞানদীপ্ত রাজা (The Enlightened Monarchy) ।

যুক্তিবাদের প্রাধান্যের ফলে ইউরোপীয় মনীষা সবকিছুই অন্ধভাবে মেনে নেয়ার পরিবর্তে যুক্তির মাধ্যমে এর যথার্থতা যাচাই করতে শুরু করে। মানবতার দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন সামাজিক প্রথা, রাষ্ট্র, আইন, ধর্ম সবকিছুই মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি এবং যা মানব কল্যাণে সহায়ক তাই ভালো। প্রকৃতিবাদের মূলকথা হল ইন্দ্রজাল, অতীন্দ্রিয়বাদ, কুসংস্কার প্রভৃতি অগ্রাহ্য করে বিজ্ঞানের নিয়মকানুন বা প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে সবকিছুর ব্যাখ্যা। অষ্টাদশ শতাব্দীর চিন্তাশীল ও শিক্ষিত মানুষ মাত্রই যুক্তিবাদ (Rationalism) ও প্রকৃতিবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং জীবন সম্পর্কে আশাবাদী (Optimism) দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেছিল।

জ্ঞানদীপ্ত ধারণার প্রচারক দার্শনিকগণ

অষ্টাদশ শতাব্দীর জ্ঞানদীপ্তির যুগের উল্লেখযোগ্য দার্শনিকদের মধ্যে মঁতেস্কু (Montesquiea), ডেনিস দিদেরো (Denis Diderot), ডি এলেমবার্ট (D Alembert), কুয়েসনে (Quesney), ভলতেয়ার (Voltaire). রুশো (Rousseau) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ (Adm smith) তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ Wealth of Nations-এ এক যুগান্তকারী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির গুরুত্ব এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইলিজমের পরিবর্তে অবাধ বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেন। ইতিহাসের ক্ষেত্রে ইতালির ঐতিহাসিক ভিকো নতুন ধারণা প্রচার করেন। তিনি সমালোচনামূলক ইতিহাস রচনার ধারা তৈরি করেন। হারডার (Harder) ইতিহাস আলোচনার এই নতুন ধারাকে মানবধর্মী তথ্য সমাজধর্মী করে তোলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিকদের মধ্যে মঁতেস্কু “স্পিরিট অব দি লজ’ (The spirit of the laws) গ্রন্থে সরকার ও আইনের একটি সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব গড়ে তুলে দেখান যে, এগুলোর কাঠামো ও কার্যাবলি সে সমস্ত পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল যেখানে জনগণ বাস করে ভৌগোলিক পরিবেশ, জলবায়ু ও ভূমি জাতীয় মানসিকতার সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে বলে তিনি মনে করতেন। শিল্পকলা, ব্যবসা ও উৎপাদন পদ্ধতির এ মানসিক ও নৈতিক মনোবৃত্তি ও প্রবৃত্তি, রাজনৈতিক সংবিধানের আকার এবং জাতীয় চরিত্রের অন্তর্গত প্রথা ও অভ্যাসসমূহ ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। শাসনব্যবস্থা বলতে এমন এক সামগ্রিক ব্যৱস্থাকে বুঝায় যার মধ্যে সমস্ত জনসংস্থার পারস্পরিক বোঝাপড়া বিদ্যমান এবং যেখানে সরকার স্থিতিশীল ও আইনবদ্ধ থাকে। তিনি মনে করতেন রাজনৈতিক স্বাধীনতা উচ্চমানের পৌরনৈতিকতার ফল নয় বরং তা সঠিক রাষ্ট্র সংগঠন হতে উদ্ভূত। সমাজের মৌল প্রাকৃতিক বিধানের ধারণা যাকে তিনি প্রজ্ঞার সঙ্গে সাধারণভাবে অভিন্ন মনে করতেন এবং বিভিন্ন পরিবেশে কাজ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংস্থা গড়ে ওঠে। জলবায়ু, ভূমি, পেশা, সরকারের প্রকারভেদ, ব্যবসা-বাণিজ্য ধর্ম, প্রথা প্রভৃতি প্রাসঙ্গিক শর্তাবলি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রজ্ঞা (আইন প্রতিষ্ঠা করে), ভৌগোলিক, মানসিক ও সংস্থাগত শর্তাবলির উপযুক্ততা অথবা সম্পর্ক আইনের অন্তরাত্মাকে সৃষ্টি করে।

প্রাশিয়ার সম্রাট ফ্রেডারিক দি গ্রেট ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের অনুরাগী ছিলেন। ভলতেয়ার সমাজ ও রাজনীতিতে খ্রিস্টধর্মের প্রভাবকে নেতিবাচক মনে করতেন। ভলতেয়ার বিশ্বাস করতেন প্রজ্ঞার মাপকাঠিতেই মানবিক আচরণ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ভালোমন্দ বিচার করা সম্ভব। নিউটনীয় প্রাকৃতিক নিয়মের মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়েও প্রাকৃতিক নিয়মের অনুরূপ করা যায়। অর্থাৎ বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক ইতিহাসকে মূলত নিউটনের রসায়নশাস্ত্রের মতোই সার্বজনীন বলে মনে করা হয় এবং এই তত্ত্ব ইতিহাস অথবা সংস্থাসমূহের সামাজিক বিবর্তনের সীমাবদ্ধতা ব্যতীতই সামাজিক প্রক্রিয়ার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দান করে।

দার্শনিকদের প্রভাবে ইউরোপের অনেক রাজা তাদের দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে নতুন সংস্কার সাধন করেন।

জ্ঞানদীপ্তির ধারা

জ্ঞানদীপ্তির ধারাকে তিনটি পর্যায়ে আলোচনা করা যায়। যথা –

  • প্রথম পর্ব (১৭১৫-১৭৫০): প্রথম পর্বে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সময়কালকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পর্বে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রবার্ট রয়েলের মানবদেহে রক্ত সঞ্চালনের তত্ত্ব, স্যার আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জন লকের সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব (Social contract theory) প্রচার করেন। লকের মতে, মানুষ যখন প্রাক-রাষ্ট্রীয় সমাজে বাস করত সে সময় তাদের কতকগুলো বিশেষ অধিকার রক্ষার জন্য এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য তারা রাষ্ট্র শাসনের অধিকার শাসক বা রাজাকে দান করে। জন লক তার এই তত্ত্বে প্রচার করেন যে, রাজা দৈব ক্ষমতা বলে দেশ শাসন করেন না। তিনি সামাজিক চুক্তি দ্বারা যে অধিকার পান তার বলেই শাসন করেন। এই মতবাদে রাজার স্বৈরাচারী ও স্বেচ্ছাচারী রাজক্ষমতার প্রতিবাদ করা হয়। জন লকের এই চিন্তা ইংরেজ ও ফরাসি শিক্ষিত জনসমাজকে প্রভাবিত করে। প্রথম পর্বের দার্শনিকদের প্রধান ছিলেন মঁতেস্কু। তিনি The Spirit of laws (আইনের মর্ম) গ্রন্থে রাষ্ট্রতত্ত্বের নতুন ব্যাখ্যা দেন। এই পর্বে দার্শনিকদের মধ্যে ভলতেয়ার ক্যাথলিক ধর্মের অলৌকিকত্ব ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে সমালোচনা করেন। এ যুগের সামাজিক রীতিনীতি ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। রক্ষণশীল গোষ্ঠী ধর্মের অজুহাতে প্রগতি ও সামাজিক অগ্রগতিতে বাধা দান করত। দার্শনিকরা ক্যাথলিক ধর্মের গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসের সমালোচনা করে গির্জার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিরোধী করে তোলেন। এতে গির্জার প্রভাব কমে আসে সমাজে স্বাধীন চিন্তা বিকাশের পথে উন্মুক্ত হয়। জ্ঞানদীপ্তির প্রথম পর্বে মানবতাবাদের প্রসার ঘটান বেকারিয়া (Beccaria) নামে জনৈক ইতালীয় অধ্যাপক। তিনি দণ্ডিত অপরাধীদের প্রতি মানবিক আচরণের যুক্তি তুলে ধরেন। এ পর্যায়ে ইংল্যান্ডে কোয়েকার সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এরা নিপীড়ন ও নির্যাতনমূলক প্রথাগুলোর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন। দাসপ্রথা ও দাস ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে তারা জনমত সংগঠন করেন।
  • দ্বিতীয় পর্ব (১৭৫০-১৭৭৪): জ্ঞানদীপ্তির দ্বিতীয় পর্যায়ে ফরাসি দার্শনিকরা রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির নতুন ব্যাখ্যা দেন। এতে খ্যাতি লাভ করেছিলেন দার্শনিক ভলতেয়ার। তার বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে কাঁদিদ (Candide), দার্শনিক অভিধান (Dictionary of Philosophy) প্রভৃতি রচনায় সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্ম সহিষ্ণুতা, স্বাধীন চিন্তার মূল্য তুলে ধরেন এবং যাজকদের দুর্নীতি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভণ্ডামি প্রকাশ করেন। এই পর্বের আর একজন দার্শনিক ছিলেন রুশো। তিনি Social contract, confession প্রভৃতি গ্রন্থে রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং সামাজিক অসাম্যের কারণ তুলে ধরেন। এই পর্বের আর একজন দার্শনিক দেনিস দিদেরো। তিনি এনসাইক্লোপিডিয়াতে দার্শনিকদের মৌলিক চিন্তাগুলো সংকলন করেছিলেন। এই গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখেছিলেন দালেম্বার্ট (Dalembert)। দিদেরো ও দালেম্বার্ট অভিজাত শ্রেণীর বিশেষ অধিকারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এ পর্বে ফিজিওক্র্যাফট অর্থনীতিবিদরা কোয়েসনের নেতৃত্বে মার্কেন্টাইলবাদ ও সংরক্ষণবাদের সমালোচনা করেছিলেন।
  • তৃতীয় পর্ব (১৭৭৪-১৭৮৯): জ্ঞানদীপ্তির তৃতীয় পর্বে দার্শনিকদের মতবাদের বাস্তব প্রয়োগের চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। ফ্রান্সে টুগো (Turgot), নেকার (Necker) প্রমুখ মন্ত্রী দার্শনিকদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সংস্কারের পদক্ষেপ নেন। দার্শনিকদের মতবাদগুলো এ পর্যায়ে পত্রপত্রিকা, সালোঁ (Salon) বা আড্ডাখানা এবং কফি হাউসে আলোচনার মাধ্যমে জনসমাজে ছড়িয়ে পড়ে। কনডরসেট (Candorset) বা রেনাল (Raynal) প্রভৃতি লেখক দার্শনিকদের মতবাদ সহজভাবে ব্যাখ্যা করে জনসমাজে প্রচার করেন।

জ্ঞানদীপ্তির ফলাফল

জননীতির ফলে মানুষের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটে। সাধারণ শিক্ষিত মানুষ ক্যাথলিক গির্জার সর্বাত্মক প্রভাবের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। ফলে যাজকতন্ত্র মর্যাদা হারায়। খ্রিস্টীয় গির্জা মানুষকে বিশ্বাস করাত যে, জন্মই পাপ তাই ইহজীবনে কৃচ্ছ্রসাধন করলে পরজন্মে ঈশ্বরের করুণা পাওয়া যাবে। কিন্তু দার্শনিকরা আত্মপীড়ন ও পাপবোধ হতে মুক্ত হয়ে ঐহিক জীবনকে সুন্দর ও এই জীবনকে ভালবাসার কথা তুলে ধরেন। দার্শনিকদের এই প্রচারের ফলে পাপ ও ঈশ্বর সম্পর্কে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ধারণার পরিবর্তন ঘটে। সমাজে বুর্জোয়া শ্ৰেণী ছিল দার্শনিকদের আলোকিত দর্শন দ্বারা সবচেয়ে প্রভাবিত। তারা কৃষি অর্থনীতিকে ত্যাগ করে শিল্প-বাণিজ্যের মাধ্যমে সমাজে সম্পদ সৃষ্টি করেন। দার্শনিকদের যুক্তিবাদের প্রভাবে মানুষের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় ও ধারণা জন্মে যে, প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার আছে, ব্যক্তির নিজ মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে। জ্ঞানদীপ্তি ইউরোপীয় সমাজে তন্ত্রকে ভেঙে দেয়। স্বৈরতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, বিশেষ অধিকার এবং পুরোহিতদের প্রভাব সমাজে কমে আসে। গির্জার ব্যয়বহুল আচার অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় মানুষের বিশ্বাস অনেকটা শিথিল হয়। মানুষ অন্যায়, শোষণ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য বিপ্লবী হিসেবে তৈরি হয়।

প্রজাহিতৈষী বা জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার (Benevolent or Enlightenment Despotism)

ভূমিকা

অষ্টাদশ শতকে জ্ঞানদীপ্তির প্রভাবে ইউরোপীয় অনেক দেশের রাজন্যবর্গের রাজক্ষমতা সম্পর্কীয় ধ্যানধারণার পরিবর্তন হয়। পূর্বে সপ্তদশ শতক থেকে রাজারা কেবল রাজকীয় অধিকার ভোগ করতেন। তারা স্বর্গীয় অধিকার (Divine Right) বলে শাসন করতেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, যেহেতু তারা ঈশ্বর প্রেরিত সেহেতু তারা পৃথিবীর কোনো শক্তির কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। প্রজাদের মঙ্গলের কোনো কাজ তাদের দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। রাজারা মানবীয় আইনের উর্ধ্বে। ইংল্যান্ডে এ নিয়ে রাজা ও বিচারকদের মধ্যে বিরোধও চলছিল। অষ্টাদশ শতকের যুক্তিবাদী দর্শন উপরোক্ত স্বর্গীয় অধিকারের নীতির দুর্বলতা উদ্ঘাটন করে। দার্শনিকরা এই মত প্রচার করেন যে, সবকিছুর পশ্চাতে নিয়ম বা যুক্তি কাজ করে। প্রকৃতি নিজেই নিয়ম মেনে চলে। সুতরাং মানব সমাজ ও রাষ্ট্র প্রকৃতির অধীনতার নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য। ইংরেজ দার্শনিক এবং ফরাসি দার্শনিক মঁতেস্কু রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও রাজার দায়িত্ব সম্পর্কে নতুন ধারণা প্রদান করেন। এ সময় রাষ্ট্র সম্পর্কে দার্শনিকরা মত পোষণ করেন যে সমাজের মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। যিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেন অর্থাৎ রাজার যেমন অধিকারে আছে সেইসঙ্গে তার কর্তব্যও আছে। রাজার অধিকার ভোগ করলে সেইসঙ্গে তাদের কর্তব্যও পালন করতে হবে। কর্তব্যহীন নিছক অধিকার ভোগ করা যুক্তিবাদ ও প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধী।

অষ্টাদশ শতাব্দীর জ্ঞানদীপ্ত ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে অনেক রাজা প্রজাহিতৈষী শাসন প্রবর্তন করেন। তবে রাজারা স্বেচ্ছাচারী ভাবধারা ত্যাগ করেন, কারণ তারা মনে করেন রাষ্ট্রই হল রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্র, জাতি বা দেশের জনসমাজ কিছুই নয়। এরূপ রাষ্ট্রে রাজাই হলেন সর্বাত্মক ক্ষমতার অধিকারী কিন্তু রাজা জনগণের উপকার সাধনে রাজক্ষমতা ব্যবহার করেন, রাজা বংশপরম্পরায় শাসন করবেন। আইনত এবং কার্যত তার ক্ষমতা হবে অসীম ও অপ্রতিহত কিন্তু তিনি জাতির সমৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করবেন। প্রজাবর্গের মঙ্গল সাধন হবে তার শাসন কাজের ভিত্তি। এই মতবাদে বিশ্বাসী বাজারা সমকালীন দার্শনিকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় পত্র বিনিময় করতেন। রাজারা নির্ভেজাল স্বৈরাচারের পরিবর্তে সংস্কারপন্থী স্বৈরাচার প্রবর্তন করেন। অধ্যাপক হেইজ (Hyes) এজন্য আলোকিত স্বৈরাচারকে ‘স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্তিবাদের সমন্বয়’ বলে অভিহিত করেছেন। –

এসব জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী শাসক দার্শনিকদের রচনা পাঠ করতেন। কেউ কেউ দার্শনিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন। তবে দার্শনিকদের প্রভাবে প্রজাহিতৈষী শাসন প্রবর্তন করলেও রাজার ক্ষমতা যাতে খর্ব না হয় সেদিকে নজর রাখতেন। আসলে সংস্থার নীতির আড়ালে তারা তাদের স্বাধিকার রক্ষা করতে চেষ্টা করতেন।

জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারের বৈশিষ্ট্য

  • ১. প্রজাদের কোনো মৌলিক অধিকার না দেওয়া এবং নির্বাচন বা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা এড়িয়ে চলা অর্থাৎ প্রজাদের জন্য শাসন পরিচালিত হলেও প্রজাদের শাসনকার্যে কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না।
  • ২. রাজারা নিজেদের রাষ্ট্রের সেবক মনে করবেন এবং তাদের কর্তব্য হল জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করা।
  • ৩. জ্ঞানদীপ্ত শাসকরা মনে করতেন যে, রাষ্ট্র সবকিছুর ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রের জন্য রাজা প্রজা সকলের কাজ করতে হবে। রাষ্ট্র থাকলে তবেই জনসাধারণের নিরাপত্তা ও সুখ-সুবিধা থাকবে।
  • ৪. জ্ঞানদীপ্ত রাজারা নিজেদের রাষ্ট্রের প্রতিনিধি মনে করতেন। তাদের নিকট রাজা ও রাষ্ট্রের ভিন্নতা ছিল না। দেহকে যেরূপ মস্তিষ্ক চালনা করে, রাষ্ট্রকে রাজা চালনা করে তদ্রূপভাবে। রাষ্ট্রের সাথে জনগণ রাজার আদর্শ মেনে চলবে। রাষ্ট্র যেরূপ সর্বশক্তিমান সেরূপ রাষ্ট্রের প্রতিভূ রাজাও সর্বশক্তিমান।
  • ৫. রাষ্ট্র ও প্রজার মঙ্গলের জন্য রাজা সুষ্ঠুভাবে জনকল্যাণের নীতি বাস্তবায়ন করবেন। শাসন সংস্কার রাজার কর্তব্য। দেহ যেরূপ মস্তিষ্কের নির্দেশ মেনে চলে প্রজা সেরূপ রাজার প্রবর্তিত সংস্কার মেনে চলবে।

ঐতিহাসিক রেডডাওয়ের মতে (Reddaway) ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের পর যে ২৫০ বছর অতিবাহিত হয় তাকে প্রধানত আলোকিত স্বৈরাচারের যুগ বলা হয়। এই যুগের জ্ঞানদীপ্ত রাজাদের প্রধান ছিলেন প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক (১৭৪০-১৭৮৬)। তিনি নিজেকে রাষ্ট্রের প্রধান ভৃত্য বলে ঘোষণা করেছিলেন। কৈশোর ও যৌবনে তিনি ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের রচনা পড়তেন। সিংহাসনে বসে তিনি কেন্দ্রীভূত শাসন, বৈজ্ঞানিক প্রথায় কৃষি ও সামরিক বিভাগে সংস্কার করেন। তিনি বিচার বিভাগে জুরি প্রথা, আইনের শাসন এবং উদার ফৌজদারি আইন প্রবর্তন করেন। তিনি ধর্মসহিষ্ণুতা ও ন্যায়বিচারের প্রবর্তন করেন।

রাশিয়ার জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন (১৭৬২-১৭৯৬) ছিলেন অন্যতম জ্ঞানদীপ্ত শাসক। তিনি ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের সঙ্গে পত্রালাপ করতেন। তিনি রাজধানীকে সুশোভিত করার জন্য বহু উদ্যান ও প্রাসাদ তৈরি করেন। তিনি রাশিয়ায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতা প্রসারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি শাসন ব্যবস্থা কেন্দ্রীকরণ করে পশ্চিমে ইউরোপের অনুকরণে শিল্পে প্রসার এবং সমাজে আধুনিক ভাবধারা ও আদব-কায়দা চালুর চেষ্টা করেছিলেন।

অস্ট্রিয়ার রাজা দ্বিতীয় জোসেফ (১৭৬৫-১৭৯০) ছিলেন জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারদের মধ্যে প্রধান। তিনি বলতেন, ‘আমি দর্শনশাস্ত্রকে আমার রাজ্যের আইন রচনার ভার দিয়েছি। দর্শনের যুক্তিবাদী নীতি অস্ট্রিয়ার জীবনধারাকে বদলে দেবে।” তিনি যুক্তিবাদের ওপর নির্ভর করে শাসন, বিচার, অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রেই সংস্কার প্রবর্তন করেন। তিনি বাস্তব জ্ঞানের অভাবে একাধিক সংস্কার কর্মসূচি সম্পন্ন করতে পারেননি। তবুও তিনি ছিলেন প্রকৃত জ্ঞানদীপ্ত শাসক।

জ্ঞানদীপ্ত শাসকদের সমালোচনা

অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, জ্ঞানদীপ্ত শাসকদের অনেকেই তাদের স্বৈরতন্ত্রকে জ্ঞানদীপ্তির মোড়কে ঢেকে দিয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রাশিয়ার দ্বিতীয় ফ্রেডারিক তার স্বৈরতন্ত্রকে জ্ঞানদীপ্তির পর্দায় ঢেকে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন স্বৈরশাসক। রাজশক্তি ছিল তার প্রাণ, উদারতন্ত্র ছিল তার পোশাকি নীতি (fashion)। সে তুলনায় অস্ট্রিয়ার দ্বিতীয় জোসেফ ছিলেন অনেকটা বেশি পরিমাণে আদর্শবাদী। তিনি ধর্মসহিষ্ণু নীতি প্রবর্তন করে ভূমিদাস প্রথা লোপ করে গিল্ড বা সংঘ প্রথা লোপের চেষ্টা করেন। সমগ্র সাম্রাজ্যে জার্মান ভাষা প্রবর্তন করে প্রকৃত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন প্রগতিশীল শক্তির বিরোধিতায় তিনি বিফল হন। এক্ষেত্রে তার বিফলতাকে এক মহৎ চেষ্টার বিফলতা বলা যায়। দ্বিতীয় জোসেফের তুলনায় প্রাশিয়ার দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের সংস্কারগুলো ছিল অনেকটা গুরুত্বহীন। ফ্রেডারিক ভূমিদাস প্রথা বিলোপের চেষ্টা করেননি। প্রাশিয়ার সামন্ত প্রভাব দূর করার চেষ্টা করেননি। তিনি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোপ করে কেন্দ্রীয় রাজশক্তি সুদৃঢ় করেন। তার নিকট রাজাই ছিলেন রাষ্ট্র। এ ছাড়া তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সৈন্যদল গঠন করে জনগণের ওপর এর ব্যয় নির্বাহের জন্য কর বৃদ্ধি করেছিলেন। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার এজন্য বলেছিলেন, ‘প্রাশিয়া হল সেই দেশ যেখানে সেনাদলই জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। জনগণ সেনাদলকে নিয়ন্ত্রণ করে না।’ দ্বিতীয় জোসেফ ও দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের তুলনায় রাশিয়ার দ্বিতীয় ক্যাথারিন ছিলেন অনেক অগভীর সংস্কারক। তার শাসননীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল নিজ সিংহাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তিনি রাশিয়ার অভিজাতদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছিলেন। নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তিনি একটি সংবিধান রচনার উদ্যোগ নিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই প্রচেষ্টা ত্যাগ করেন। রাশিয়ার ভূমিদাসদের রক্ষার কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। তিনি রাশিয়ার অভিজাতদের মধ্যে পশ্চিম ইউরোপীয় ফ্যাশন ও চালচলন প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। তার লক্ষ্য ও সংস্কৃতিমূলক সংস্কার ছিল শৌখিন শখের ব্যাপার মাত্র। রাশিয়ার সমাজজীবনে এই সংস্কারের কোনো প্রভাব ছিল না। ঐতিহাসিক রাইকারের মতে, ‘দ্বিতীয় ক্যাথারিনের কোনো সৃজনশীল প্রতিভা ছিল না।’ অভিজাতদের সমর্থন হারানোর ভয়ে তিনি কোনো মৌলিক সংস্কার প্রবর্তনে বিরত থাকতেন।

জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারের বিফলতা

সপ্তদশ শতাব্দীর স্বৈরতন্ত্রের মহিমা কীর্তনের জন্য জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচাররা শাসন ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার জন্য যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার বিকাশ ঘটিয়েছিল। এ সময় রাজকীয় কর্তব্যবোধের সঙ্গে রাজকীয় অধিকারবোধ যুক্ত হয়ে আলোকিত স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু কালক্রমে এই ব্যবস্থা যুগের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হলে অচিরেই জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার ব্যবস্থা ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়।

অষ্টাদশ শতকে জন লক, মঁতেস্কু, রুশো প্রমুখ দার্শনিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ (Social contract theory) তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন। এ তত্ত্ব মতে, সমাজের সঙ্গে চুক্তির দ্বারা রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। রাজা সে চুক্তি অনুসারে দেশ শাসন করেন। এই চুক্তি দৈবতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করে অর্থাৎ রাজপদ ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট নয় দার্শনিকদের এই ব্যাখ্যা জনগণের মনে বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে, রাজক্ষমতা প্রজার কাছ থেকে এসেছে। এজন্য স্বৈরশাসকদের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস কমে আসে। জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচার কোনো পরিপূর্ণ আদর্শ ছিল না। এ আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে কোনো মৌলিক ধারণা দিতে পারেনি। রাজারা স্বৈরক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রেখে কিছু প্রজা সংস্কার চালু করেন মাত্র। এটি অনেক ক্ষেত্রে শাসকদের মনমানসিকতা এবং তাদের শুভ ইচ্ছার ওপর নির্ভর ছিল। এজন্য প্রয়োজনীয় গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলা হয়নি। উল্লিখিত স্বৈরাচারী জ্ঞানদীপ্ত শাসকগণ তাদের মতো, রুচিশীল ও যোগ্য উত্তরাধিকারী গড়ে তুলতে পারেননি। যার ফলে পরবর্তী শাসকরা এ ধরনের জ্ঞানদীপ্ত ভাবধারায় আলোকিত হননি।

জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারে একটি বড় ত্রুটি ছিল তারা এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য সাধারণ মানুষের সহযোগিতা নিতেন না এবং জনগণও এ সম্পর্কে সচেতন ছিল না। কেবলমাত্র স্বীকৃত কিছু মানুষ এই ব্যবস্থাটি উপলব্ধি করতে পারতেন। জনসাধারণের জন্য সকল ব্যবস্থা বা সংস্কার গ্রহণ করা হলেও জনসাধারণের দ্বারা কিছু করা হবে না এটি ছিল শাসকগণের মূলনীতি। তাই জনগণ এটিকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থা মনে করত। ফলে সংস্কারগুলো জনপ্রিয়তা হারায়। প্রজাদের সচেতন সমর্থন ছাড়া যে কোনো সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ কথা জ্ঞানদীপ্ত শাসকরা বোঝার চেষ্টা করতেন না। এ ছাড়া স্বৈরশাসনের নিপীড়ন মানুষের মনে স্বৈরশাসকদের প্রতি অনাস্থা ও ভীতি সৃষ্টি করেছিল। শাসকরা দার্শনিকদের ভাবধারায় আলোকিত হয়ে জনগণের কল্যাণ কামনা করেন।

এটি জনগণ বুঝতে পারেনি। এ ছাড়া সুষ্ঠু প্রচারণার অভাবে সংস্কারগুলোর মূল লক্ষ্য প্রজারা জানতে পারেনি। এ ছাড়া সামন্ত সমাজে হতাশা, দরিদ্রতা মানুষের মনে একধরনের অনীহা ও নিয়তিবাদ কাজ করত এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার সম্পর্কে মানুষকে সন্দেহে নিমজ্জিত করত। স্বৈরশাসকরা ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদ করেনি এবং সরকারি খাসজমি ও গির্জার সম্পদ জনগণের মধ্যে বণ্টনের তেমন কোনো উদ্যোগও ছিল না। স্বৈরশাসকরা সংস্কার বাস্তবায়নে যে রাষ্ট্র প্রশাসনকে ব্যবহার করত তা ছিল দুর্নীতিপরায়ণ ও নিপীড়নমূলক। সরকারি কর্মচারীরা অভিজাত সামন্তশ্রেণীভুক্ত থাকায় এবং জনগণের ওপর নিপীড়ন চালাত। এতে জনগণের মধ্যে শাসকদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো আগ্রহ সৃষ্টি হত না।

উল্লিখিত কারণ ছাড়াও স্বৈরশাসকদের ভুলত্রুটি ও দূরদৃষ্টির অভাব তাদের মহান উদ্দেশ্যকে বার্থ করেছিল। অস্ট্রিয়ার আনদীপ্ত শাসক জোসেফ বাস্তববুদ্ধির অভাবে তার আদর্শ কর্মপন্থা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছিলেন। দ্বিতীয় জোসেফের নীতি ও আদর্শ বোঝার মতো দক্ষতা ও চিন্তাবোধ অস্ট্রিয়ার অধিকাংশদের মধ্যে ছিল না। এ ছাড়া বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষাগত ও কৃষ্টিগত পার্থক্য থাকায় অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার শাসকরা তাদের মহান কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কারণ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে স্বার্থ ও ভাষাগত বিরোধ ছিল তীব্র। তা সমাধানে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা উদ্ভাবনে ব্যর্থ হওয়ায় সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব ছিল।

জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরশাসকরা তাদের দেশের সিংহাসনের ওপর বংশানুক্রমিক অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের মৃত্যু হলে তাদের বংশধররা জ্ঞানদীপ্ত শাসকদের ন্যায় মানসিকতা পোষণ করত না। তারা জনগণের কল্যাণ সম্পর্কে উদাসীন ছিল। এ ছাড়া পরবর্তীকালে অভিজাতরা শক্তিশালী হলে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা জ্ঞানদীপ্ততার বিষয়টিকে খুব গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় রাখত না। প্রজাহিতৈষণা অপেক্ষা রাজতন্ত্র শক্তিশালীকরণ, সাম্রাজ্য বিস্তার, উপনিবেশ স্থাপন এগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হত। বিশেষ করে যুদ্ধ জয় রাজকোষে অর্থ সংকট তৈরি করত। যার ফলে অর্থাভাবে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হত না।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ, মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ৩১৬-৩২৪

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.