আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ফরাসি বিপ্লব

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮৩)

ভূমিকা

ইউরোপীয় দেশগুলি মধ্যে স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে আমেরিকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। কালক্রমে উত্তর আমেরিকায় ইংল্যান্ডের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। ইংল্যান্ড আমেরিকার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সেখানে ইংল্যান্ডের শাসন কায়েম করে। আমেরিকার অভিবাসীদের অধিকাংশ ছিল ইংরেজ। তারা ইংল্যান্ডকে মাদারল্যান্ড মনে করত এবং স্পেন ও ফরাসি আধিপত্য থেকে আমেরিকাকে মুক্ত রাখার জন্য ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসন মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে আমেরিকা স্বাধীনতা লাভের জন্য ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৭৭৪ সালে জর্জিয়া ব্যতীত অন্যান্য উপনিবেশগুলোর প্রতিনিধিরা ফিলাডেলফিয়া নগরে সমাবেত হয়ে নিজেদের অধিকার ও দাবি ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডের পণ্য বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রতিনিধি সভা কংগ্রেস নামে খ্যাত। কংগ্রেস তার অভিযোগের প্রতিকারের জন্য ইংল্যান্ডের সরকারের নিকট আবেদন জানায় এবং গোপনে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করে। আমেরিকায় উদ্ভূত পরিস্থিতি ব্রিটিশ সরকারকে উদ্বিগ্ন করে। এই অবস্থার সমাধানের জন্য চ্যাথাম ও বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিং আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত বাগ্মী এডমন বার্ক দুই পক্ষের সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর লর্ডনর্থ প্রস্তাব করেন যে, যদি কোনো উপনিবেশ তাদের নিরাপত্তার জন্য উল্লেখযোগ্য অর্থ দিতে স্বীকার করে তবে তাদের শুল্ক দিতে হবে না। কিন্তু ইতোমধ্যে ম্যাচাসুসেটসের মিলিশিয়া বাহিনীর সৈনিকগণ সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলে ১৭৭৫ সালে যুদ্ধ শুরু হয়।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি

তৎকালীন ইউরোপে ঔপনিবেশিক প্রাধান্য নিয়ে বিভিন্ন শক্তির মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল এবং ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক নীতি ত্রুটির মধ্যে এই যুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল। তবে আমেরিকার ইংরেজদের সচেতন স্বার্থবোধ, সাহস ও বীরত্ব এ যুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়ে দিল। সপ্তদশ শতাব্দী হতে আরম্ভ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আটলান্টিক মহাসাগর উপকূলে ইংরেজগণ ১৩টি উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এ সকল উপনিবেশসমূহে একজন করে ইংরেজ গভর্নর নিয়োগ করা হত এবং প্রত্যেকটি উপনিবেশ নিজস্ব আইন সভা ছিল। ইংরেজগণ আমেরিকার উপনিবেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করত না। কিন্তু সপ্তবর্ষের যুদ্ধে (১৭৫৬-১৭৬৩) ইংল্যান্ডের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়ে যায়। ইংরেজ সরকার যুদ্ধব্যয় মেটানোর জন্য উপনিবেশগুলোর ওপর কর ধার্য করার পরিকল্পনা করে। এদিকে কানাডা থেকে ফরাসিদের বিতাড়নের পর আমেরিকার উপনিবেশসমূহে ফরাসি ভীতি দূর হয়। পাশাপাশি ইংল্যান্ডের প্রতি তাদের আনুগত্য হ্রাস পেতে থাকে। বাণিজ্য সচেতন আমেরিকান ব্যবসায়ীরা তাদের পুঁজির স্বার্থে ব্রিটিশ পুঁজির খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। বিশেষ করে আমেরিকার ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার নব্য পুঁজিবাদীদের বিদ্রোহ করার প্রেরণা দেয়।

ইংল্যান্ডের শাসনের প্রতি আমেরিকানদের বিদ্রোহ

সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের পর ইংল্যান্ড আমেরিকায় আধিপত্য বজায় রাখার জন্য শক্তিশালী নৌবহর মোতায়েনের পরিকল্পনা করে। এই সামরিক বায় মেটানোর জন্য ইংরেজ সরকার আমেরিকার উপনিবেশগুলোর ওপর নতুন কর আরোপনের পরিকল্পনা করে। ১৭৬৫ সালে ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গ্রেন্ডভিল স্টাম্প অ্যাক্ট (Stamp Act) নামে আইন প্রবর্তন করে উপনিবেশসমূহের সকল দলিলের উপর কর ধার্য করে। আমেরিকানরা এর প্রতিবাদ জানায় এবং ঘোষণা করে যে, যেহেতু ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে আমেরিকানদের কোনো প্রতিনিধি নেই, তাই ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট আমেরিকার উপনিবেশগুলোর উপর কোনো কর ধার্য করতে পারে না। এই ঘটনার পূর্বে ইংরেজ সরকার নেভিগেশন অ্যাক্ট আইনের মাধ্যমে আমেরিকার ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষতি করেছিল। কারণ এই আইন অনুসারে যে সকল পণ্য ইংল্যান্ডে উৎপন্ন হত তা উপনিবেশসমূহে প্রস্তুত করা যেত না। এ ছাড়া রপ্তানি বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। তারা নির্দিষ্ট কয়েকটি দ্রব্য ইংল্যান্ড ব্যতীত অপর কোনো দেশে রপ্তানি করতে পারত না। এ ছাড়া মালামাল পরিবহনে ইংল্যান্ডের জাহাজ ব্যবহার করতে হত। এ সকল কারণে আমেরিকার উঠতি বুর্জোয়া শ্ৰেণী ইংল্যান্ডের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিল। স্ট্যাম্প অ্যাক্ট পাস করার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় প্রচণ্ড বিদ্রোহ হয়। ফলে ১৭৬৬ সালে ইংরেজ সরকার স্ট্যাম্প অ্যাক্ট প্রত্যাহার করে।

স্ট্যাম্প অ্যাক্ট রহিত হলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঘোষণা করে যে আমেরিকার উপর কর ধার্য করার অধিকার ইংল্যান্ডের আছে। এ নিয়ে উপনিবেশসমূহের সাথে ইংল্যান্ডের বিরোধ চলতে থাকে। স্ট্যাম্প অ্যাক্ট রহিত করার ২ বছর পর চ্যাথাম মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য টাউন্ডসেন আমেরিকার আমদানি চা, কাগজ, বস্ত্র আরো কতিপয় পণ্যের উপর নতুন শুল্ক ধার্য করে। ফলে আমেরিকার নানা স্থানে দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়।

লর্ড নর্থ ১৭৭৩ সালে একমাত্র চা ছাড়া অপর সকল দ্রব্যের উপর শুল্ক প্রত্যাহার করেন কিন্তু তাতেও আমেরিকানদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। কিন্তু একদল বিদ্রোহী ছদ্মবেশে বোস্টন বন্দরে চা বোঝাই জাহাজে উঠে ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত চায়ের বার সমুদ্রে ফেলে দেয়। ইংরেজ সরকার বোস্টন বন্দরের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় এবং মেসাচুচেটসের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে। এতে আমেরিকানদের ক্ষোভ আরো বৃদ্ধ পায়।

উল্লিখিত অবস্থায় আমেরিকার উপনিবেশসমূহে স্বাধীনতা যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হতে থাকে। ১৭৭৫ সালে লেকসিংটনে ইংরেজদের সাথে আমেরিকানদের প্রথম যুদ্ধে আমেরিকানরা জয়লাভ করে। ইতোমধ্যে আমেরিকার উপনিবেশসমূহের নেতৃবৃন্দ দ্বিতীয় কংগ্রেসে মিলিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের নিকট প্রস্তাব করে যে, তারা ১৭৬৩ সালের অবস্থায় ফিরে যেতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু রাজা তৃতীয় জর্জের (১৭৬০-১৮২০) গোঁড়ামির কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমেরিকার প্রতি দমনমূলক নীতি গ্রহণ করার পরিকল্পনা হয়। কারণ উপনিবেশসমূহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কর্তৃত্বসমূহকে অস্বীকার করেছিল। দ্বিতীয় কংগ্রেস ভার্জিনিয়ার অধিবাসী জর্জ ওয়াশিংটনকে যুদ্ধের জন্য সেনাপতি নিযুক্ত করে। জর্জ ওয়াশিংটনের সাহস, অধ্যাবসায় ও রণপাণ্ডিত্যে আমেরিকানরা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সংকল্পবদ্ধ হয়। লেংসিনটনের যুদ্ধের পর আমেরিকানরা বোস্টন বন্দর অবরোধ করে ব্যাঙ্কার্স হিলে ইংরেজ বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়। ১৭৭৫ সালে আমেরিকানরা কানাডা দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৭৭৫ সালে শেষভাগে জর্জ ওয়াশিংটন বোস্টন বন্দর দখলের পরিকল্পনা করে ও আমেরিকানদের আক্রমণে ইংরেজরা বোস্টন বন্দর ত্যাগ করে। ১৭৭৬ সালে ৪ জুলাই আমেরিকানরা ফিলাডেলফিয়াতে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৭৭৬ সালে ইংরেজ সেনাপতি হো লং দ্বীপ (Long Island) দখল করে। এরপর ইংরেজরা নিউইয়র্ক ও ব্রুকলিন দখল করে। ১৭৭৭ সালে ওয়াশিংটন নিউজার্সি উদ্ধার করেন তবে ব্রান্ডিওয়াইসের যুদ্ধে পরাজিত হন। এ বছর ইংরেজ সেনাপতি জেনারেল বার্গোযেন সারাটোগর যুদ্ধে আমেরিকানদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। সারাটোগর যুদ্ধে আমেরিকানদের সাফল্যে ফ্রান্স সরকার আমেরিকাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ১৭৭৮ সালে।

এরপর ফ্রান্স আমেরিকার পক্ষে প্রকাশ্যে যুদ্ধে নামে, ফলে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ আমেরিকা ফ্রান্স বনাম ইংল্যান্ডীয় যুদ্ধে পরিণত হয়। এ সময় ইংরেজ রাজনীতিবিদ চেথাম মৃত্যুবরণ করলে আমেরিকার স্বার্থে বিরোধ মেটাবার আর কোনো সম্ভাবনা থাকল না। ১৭৭৯ সালে স্পেন, ১৭৮০ সালে হল্যান্ড আমেরিকানদের পক্ষ সমর্থন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সাথে যোগ দেয়। এই যুদ্ধের সময় রাশিয়া, প্রুশিয়া, ডেনমার্ক ও সুইডেন সশস্ত্র নিরপেক্ষ সংঘ গঠন করে। এর লক্ষ্য ছিল মহাসমুদ্রে ইংরেজ কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের জাহাজ তল্লাশি বন্ধ করা। ফলে সমুদ্র বক্ষেও ইংল্যান্ডের প্রাধান্য ব্যহত হয়। এ সময় ভারতে মহীশুরের হায়দার আলী এবং দাক্ষিণাত্যে মারাঠাগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। আয়ারল্যান্ডেও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাণিজ্য বিরোধ দেখা দেয়। এই অবস্থায় ইংরেজরা বিপদগ্রস্ত হয়। ১৭৭৯ সালে ফ্রান্স ও স্পেন সম্মিলিতভাবে জিব্রান্টার ও মিনরকা অবরোধ করে। ১৭৮২ সালে ফরাসিরা মিনরকা দখল করলেও জিব্রান্টার দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ সময় ইংরেজ নৌসেনাপতি এডমিরাল রডনি ফরাসি নৌ সেনাপতি ওডিগ্রাসকে পরাজিত করে ইংল্যান্ডের সুনাম রক্ষা করেন। অন্যদিকে লর্ড কর্নওয়ালিস আমেরিকার দক্ষিণ দিকস্থ উপনিবেশগুলিতে যুদ্ধে জয়লাভ করেন, তা সত্ত্বেও ১৭৮২ সালে ইয়র্কটাউনে তিনি ওয়াশিংটনের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। এ যুদ্ধের পর আমেরিকার যুদ্ধের অবসান হয়। ১৭৮৩ সালে ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে ইংল্যান্ড আমেরিকার স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়। ভার্সাই সন্ধির শর্তানুসারে কানাডা, নিউফাউন্ডল্যান্ড ও আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র জনপদ ও দ্বীপ ইংল্যান্ডের অধিকারে থাকে। ফ্রান্স লাভ করে টোব্যাকো, সান্তালুসিয়া ও সেনেগাল। স্পেন লাভ করে মিনরাকা দ্বীপ ও আমেরিকার ফ্লোরিডা।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফল

  • অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাসে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের ফলে ইংল্যান্ড তার বিরাট সাম্রাজ্য হারিয়েছিল। ইংল্যান্ড তার পূর্বেকার ঔপনিবেশিক নীতি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। উপনিবেশের উপর মার্কেন্টাইল নীতি প্রযোগ করার নীতি যে ভ্রান্ত নীতি তা ইংরেজরা বুঝতে পারে। এরপর থেকে ইংল্যান্ড তার অধীনস্ত উপনিবেশগুলোর উপর উদারনীতি গ্রহণ করে।
  • আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ফ্রান্সের রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল। সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ফ্রান্স আমেরিকার পক্ষে যোগদান করেছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডের সর্বনাশ করতে গিয়ে ফরাসি রাজতন্ত্র নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। এ যুদ্ধ ফ্রান্সের বিপর্যস্ত অর্থনীতির উপর আঘাত হানে।
  • ফ্রান্সের অর্থনীতির সংকট পরোক্ষভাবে ফরাসি বিপ্লবের পথ ত্বরান্বিত করে। ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব ইউরোপীয় চিন্তা ও দর্শনের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার ঘটায়।
  • আমেরিকায় প্রজাতান্ত্রিক শাসন কায়েম হলে ইউরোপে উদারনৈতিক ও চিন্তাশীল মানুষের মনে নতুন রাজনৈতিক ভাবনা অনুপ্রেরণা দেয় এবং আমেরিকার অনুকরণে ইউরোপেও প্রজাতান্ত্রিক শাসন কায়েমের জন্য প্রচেষ্টা শুরু হয়। আমেরিকার জনসাধারণের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র (Declaration of Rights) ইউরোপীয় সাধারণ মানুষের নিকট নতুন আশা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয় যা ইউরোপে বিপ্লব ও গণআন্দোলনের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে।
  • আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলে হল্যান্ড ও স্পেন পরবর্তী পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগস্ত হয়েছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা স্বীকৃত হলে আমেরিকা বিশ্বে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনীয় উপনিবেশগুলো আমেরিকার সমর্থনে স্বাধীনতা লাভ করে। হল্যান্ড ভার বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি অনেকটা হারিয়ে ফেলে।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংরেজদের বিফলতার কারণ

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংরেজদের ব্যর্থতার অনেকগুলো কারণ ছিল –

  • প্রথমত, সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ফরাসিদের মধ্যে তীব্র ইংরেজ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংরেজরা আমেরিকা ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কোনো মৈত্রী জোট গঠন করতে পারেনি। এ ছাড়া রাশিয়া, ডেনমার্ক, সুইডেন প্রভৃতি দেশের ইংরেজ বিরোধী মনোভাব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড মিত্রহীন হয়েছিল। ফ্রান্সের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য আমেরিকানদের সাফল্য নিশ্চিত করেছিল।
  • দ্বিতীয়ত, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ইংরেজগণ যথেষ্ট সামরিক শৌর্যবীর্য দেখাতে ব্যর্থ হয়। ইংরেজ সেনাপতিদের ভ্রান্ত সমরনীতি এবং সিদ্ধান্তহীনতা তাদের পরাজয়ের কারণ ছিল।
  • তৃতীয়ত, ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তৃতীয় জর্জের সহিত ইংরেজ রাজনীতিবিদদের মতানৈক্য ইংরেজদের পরাজয়ের কারণ ছিল।
  • চতুর্থত, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন চলছিল তখন ইংল্যান্ড নিরপেক্ষ দেশগুলোর জাহাজ তল্লাশি শুরু করে। এর ফলে নিরপেক্ষ দেশগুলো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সংঘ গঠন করে। এটি ইংল্যান্ডের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল।
  • পঞ্চমত, ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকার দূরত্ব, আমেরিকানদের তীব্র জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেম তাদেরকে যুদ্ধে অনুপ্রেরণা দিত। বিশেষ করে জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্ব ও রণনীতি, সাহস, দেশপ্রেম ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার বিজয়ের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। আমেরিকানদের ইংরেজসুলভ সাহস, চাতুর্য ও অধ্যবসায় আমেরিকানদের সক্ষমতা ও ইংরেজদের ব্যর্থতার কারণ ছিল।

ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯)

ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট

অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ফরাসি বিপ্লব আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে একটি যুগান্তরকারী (Turning Point) ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই ইউরোপে জাতীয়তাবাদী এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের ধারা, জাতিগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতার আদর্শ, স্বৈরাচারী প্রশাসনকে সংবিধানের সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত করার পদ্ধতি রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই বিপ্লবের প্রকৃতি, আদর্শ বিপ্লবের প্রেক্ষিত নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে এটি সম্ভবত স্বীকার করা যায় আধুনিক যুগের ব্যক্তি স্বাধীনতা, সাংবিধানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন প্রভৃতি মূল্যবোধ ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্যের ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছিল। এই বিপ্লব বিভিন্ন শ্রেণীর দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিপরীতমুখী আদর্শ একটি নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে পরিশালী হয়ে একটি নতুন সমাজব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল, যেখানে সম্পত্তির অধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিল যা কালক্রমে পুঁজিবাদী জীবনধারা এবং সকল মানুষের মানবিক অধিকার ও স্বীকৃতির আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট : ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হলেও এর কারণ লুক্কায়িত ছিল ফরাসি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার অতীত শেকড়ের মধ্যে। ফ্রান্সে যে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল তা ভূস্বামী ও যাজকদের স্বার্থরক্ষা করত। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভিজাত ও যাজকরা রাজতন্ত্রের অনুগত থাকলেও ফরাসি সমাজবিন্যাসে বিপ্লব-পূর্ব যুগে অভিজাতরাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। যার ফলে চতুর্থ হেনরির (১৫৮৯-১৬১০) আমল থেকে পরবর্তী সময় রিশল্যুর (১৬২৪-১৬৪২) সময়কালে অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতা দুর্বল করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। যার ফলে প্রাচীন কাল থেকেই ফরাসি রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। কালক্রমে সামাজিক প্রেক্ষাপটে ফরাসি কৃষকদের দারিদ্র্য এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক হতাশাবোধ ক্রমে অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উৎস যুগিয়েছিল। কালক্রমে শ্রেণী সচেতন ফরাসি মধ্যবিত্ত শ্রেণী অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে ফ্রান্সে গণতন্ত্র কায়েম করে।

ফরাসি বিপ্লবের কারণ

ফরাসি বিপ্লবের কারণগুলোকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক এই তিনটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে বুরবোঁঁ রাজবংশ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিপ্লবের সময় ষোড়শ লুই (১৭৭৪-১৭৯২) ফ্রান্সের রাজক্ষমতার অধিষ্ঠিত ছিলেন। ষোড়শ লুই অনভিজ্ঞ এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার দূরদর্শিতা ছিল খুবই কম। ব্যক্তিগতভাবে রাজা ভদ্র ও ধর্মভীরু হলেও তিনি তার পূর্বতন চতুর্দশ লুইয়ের (১৬৪৩-১৭১৫) মতো আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন না। তার পিতা পঞ্চদশ লুইয়ের (১৭১৫-১৭৭৪) আমল থেকেই রাজপরিবার বিলাসী এবং আরামপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রাজাদের গোপনতার আশ্রয় এবং গুপ্ত চক্রান্তপ্রিয়তা রাজদরবারকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সরকার পরিচালনায় আমলা ও রাজার উপপত্নীদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। ষোড়শ লুইয়ের সহধর্মিণী রাণী মেরি আতোয়ানে‍ ছিলেন কর্তৃত্বপরায়ন এবং অত্যন্ত বিলাসী। রাণীর বিলাসী জীবন ও তৎকালীন ফ্রান্সে রূপকথায় পরিণত হয়েছিল। রাণী রাজদরবারে একটি নিজস্ব গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন যা ক্রমে দলীয় দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। রাজা ষোড়শ লুই দৈরবাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তবে ফ্রান্সে সামন্তপ্রভুদের শক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি, যার ফলে অভিজাত শ্রেণী নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য তৎপর হয়েছিল। এ থেকেই রাজতন্ত্রের সঙ্গে অভিজাত তন্ত্রের বিরোধ শুরু হয়। অভিজাত শ্রেণী প্রথমে মধ্যবিত্তশ্রেণীর সমর্থনে ফ্রান্সে নিজেদের ক্ষমতা সুদৃঢ় করে রাজতন্ত্রকে অনেকটা দুর্বল করতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে জনগণ রঙ্গমঞ্চে এসে অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতা উচ্ছেদ করে জনগণের শাসন কায়েম করে। এজন্য ঐতিহাসিক গুডউইন মন্তব্য করেন, ‘১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ কৃষক শ্রেণীর অর্থনৈতিক অসন্তোষ, মধ্যবিত্তশ্রেণীর রাজনৈতিক অসন্তোষের মধ্যে না খুঁজে ফরাসি অভিজাতদের প্রতিক্রিয়াশীল আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই খুঁজতে হবে।”

রাজনৈতিক কারণ

স্বৈরতন্ত্রের ত্রুটি : ফ্রান্সের রাজতন্ত্র ছিল স্বৈরাচারী। চতুর্দশ লুইয়ের সময় থেকেই অভিজাতদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিল। এমনকি রাজার ক্ষমতাকে সর্বময় করার জন্য পার্লামেন্ট সভা স্টেইটস জেনারেলের অধিবেশন ১৬১৪ সাল পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছিল। বুরবোঁ রাজারা স্বৈরতন্ত্রকে নিরঙ্কুশ করার জন্য জাতীয় সভার অধিবেশন আহ্বান করত না। কিন্তু ষোড়শ লুইয়ের দুর্বল চিত্ততা অভিজাত শ্রেণীকে তাদের ক্ষমতা পূর্ণ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে। ইতোমধ্যেই সামন্ত অভিজাত ও যাজক শ্রেণী সরকারি ক্ষমতা হস্তগত করে। নিজেদের শাসক পরিবার রাজার প্রথম শ্রেণীভুক্ত মনে করতে থাকে। ফরাসি অভিজাতদের বংশগত কৌলিন্য ছিল এবং তারাও রাজক্ষমতা দাবি করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ফরাসি রাজতন্ত্রের এই দুর্বলতা ও যোগ্যতা অভিজাত শ্রেণীকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠানে সাহায্য করলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অভিজাত শ্রেণীর পথ অনুসরণ করে বিপ্লব ঘটায়।

যাজক শ্রেণীর ক্ষমতা বৃদ্ধি : ফ্রান্স ছিল ইউরোপে ক্যাথলিক রাষ্ট্র যার ফলে ফরাসি যাজকশ্রেণীর অনেক ক্ষমতা ছিল। ফরাসি গির্জা ছিল স্বয়ং শাসিত সংস্থা। রাজা গির্জার অভ্যন্তরীণ শাসনে হস্তক্ষেপ করতেন না। গির্জার ভূ-সম্পত্তির উপর কর আরোপ করা যেত না। ১৫৬১ সালে পোইসির চুক্তি অনুসারে যাজকেরা গির্জার ভূমির উপর স্বেচ্ছায় কর নিত। যাজকদের এই ক্ষমতা ফ্রান্সে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।

প্রাদেশিক আইনসভার ক্ষমতা বৃদ্ধি : ষোড়শ লুইয়ের আমলে অভিজাতরা তাদের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ায় প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছিল। এ সভাগুলোর সম্মতি ছাড়া রাজার কোনো নির্দেশ প্রদেশগুলোতে কার্যকরী করা যেত না। প্রাদেশিক সভাগুলোতে অভিজাতরা বিশেষ রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করত। রাজা কোনো নতুন আইন জারি করলে তা পার্লামেন্টের বিচার সভায় রেজিস্টারি বা নথিবদ্ধ করতে হত নতুবা এই আইন বৈধ হত না। পার্লামেন্ট ইচ্ছা করলে রাজার প্রস্তাবিত আইনে বাতিল করতে পারত। পার্লামেন্টের বিচারকরা অভিজাত শ্রেণীভূক্ত হওয়ায় অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে রাজা কোনো আইন রচনা করলে পার্লামেন্ট তা নথিবদ্ধ করত না। ফ্রান্সের বারটি পার্লামেন্ট সভা ছিল। এর মধ্য পার্লামেন্ট অব প্যারিস ছিল শক্তিশালী বিচারসভা। সেখানকার পার্লামেন্টের বিচারকরা এতই শক্তিশালী ছিল যে, তারা ষোড়শ লুইয়ের মন্ত্রী টুর্গোর প্রস্তাবিত মৌলিক সংস্কারের ব্যবস্থাকে কার্যকরী হতে দেয়নি। রাজা পার্লামেন্টের বিরোধিতা Lit de Justice প্রথা দ্বারা তা দমন করার বিধান থাকলেও রাজা পার্লামেন্টের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করতে সাহস করতেন না। রাজার এই দুর্বলতা অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করে যা পরবর্তী পর্যায়ে বিপ্লবের পটভূমি তৈরি করে।

বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি : অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে বিচারব্যবস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। সরকারি বিচারকের পদ অর্থের মাধ্যমে ক্রয় করা যেত, যার ফলে অভিজাত শ্রেণীভুক্ত এই বিচারকরা বিচার ব্যবস্থায় অনেক সময় শ্রেণীস্বার্থ রক্ষা করত। (Letters de Grass and Lettered cachet) লত্রে দ্যা গ্রাস ও লনে দ্যা কেসে দ্বারা রাজা বিচারের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করলেও অনেক ক্ষেত্রে তা করা হত না। রাজা আদালত দ্বারা প্রদত্ত শাস্তি মওকুফ এবং কোনো নাগরিককে বিনা বিচারে কারাগারে অটকাতে পারতেন। সরকারি কর্মচারী এবং অভিজাতরা পত্রে দ্যা কেসের অপপ্রয়োগ করত। বিচার ব্যবস্থা ব্যয়বহুল ও বিলম্বিত হওয়ায় এতে সাধারণ মানুষ ন্যায় বিচার পেত না। প্রদেশগুলোতে রাজস্ব আদায়কারী ইনটেন্ডেন্ট কর্মচারীরা জনগণের কাছ থেকে অবৈধ কর আদায় করে তা আত্মসাৎ করত। প্রাদেশিক সভা পার্লামেন্ট সরকারি কর্মচারি জনগণের নিকট ভীতিকর বিষয় হয়েছিল। এই দুরবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সবাই উদগ্রীব ছিল।

রাজতন্ত্রের দূর্বলতা : ষোড়শ লুইয়ের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি রাজতন্ত্রের মহিমা দুর্বল করেছিল। ষোড়শ লুইয়ের পিতা পঞ্চদশ লুই অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে (১৭৪০-৪৮) এবং সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে (১৭৫৬-৬৩) পরাজয় বরণ করে। এতে ইউরোপে ফ্রান্সের সামরিক মর্যাদা বিনষ্ট হয়। যুদ্ধের পরাজয় বৈদেশিক বাণিজ্যে ফরাসি বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মধ্য শ্ৰেণীভুক্ত এই বণিক শ্ৰেণী স্বাভাবিক কারণে রাজতন্ত্রের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। ষোড়শ লুই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে (১৭৭৫-১৭৮৩) ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার পক্ষে যোগদান করে। এই দীর্ঘ যুদ্ধগুলোতে ফ্রান্সের পরাজয় ফ্রান্সের মর্যাদা নষ্ট করে এবং রাজকোষে অর্থসংকট তৈরি করে। ষোড়শ লুইয়ের আমলে ফ্রান্সের শাসন ব্যবস্থায় রাজ পরিষদ কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণ করত। অভিজাত শ্রেণী এই পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করত। রাজপরিষদের সদস্যরা রাজপরিবারের প্রিয় পাত্র হওয়ার জন্য একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। মন্ত্রীদের মধ্যেও মর্যাদার রেষারেষি ছিল। এজন্য শাসন ব্যবস্থায় তোষামোদ, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রদেশগুলোতে ইনটেন্ডেন্ট কর্মচারীরা ক্ষমতার প্রভাব খাটাত। রাজ প্রতিনিধি হিসাবে তারা রাজস্ব আদায় ও আইনশৃঙ্খলার রক্ষা করত। কিন্তু এরা দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ায় জনগণ এদেরকে ভয় করত। ফ্রান্সে প্রচলিত আইন অভিজাতদের শ্রেণী স্বার্থ রক্ষা করত। এ ছাড়া ফ্রান্সের সকল অঞ্চলে একই রকমের আইন প্রথা, ওজন ও পরিমাপ না থাকায় জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয়েছিল। সরকারি রাজস্ব নীতি ও অর্থব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় এতে অভিজাত ও যাজকরা কর প্রদান থেকে অব্যাহতি পেত। কিন্তু কৃষক, পাতি বুর্জোয়া ও উচ্চ বুর্জোয়াদের উপর অধিক কর আরোপ হওয়ায় তারা যাজক ও অভিজাতদের প্রতি বিক্ষুব্ধ ছিল। বুরবোঁ রাজারা সবাই ছিলেন বিলাসী ও মিতব্যয়ী। রাজকীয় গৃহস্থালীর খরচ ছিল অনেক বেশি। প্রচলিত রাজস্ব সরকারি ব্যয় সংকলনে যথাযথ না হওয়ায় রাজা অর্থসংকটে পড়েন এবং তা থেকে মুক্তির জন্য স্টেস জেনারেলের অধিবেশন ডাকলে স্বৈররাজতন্ত্রের দুর্বলতা দেখা দেয় এবং বিপ্লব ত্বরান্বিত করে।

সামাজিক কারণ

যাজক শ্রেণী : অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি সমাজ ব্যবস্থার শ্রেণী বৈষম্যের মধ্যেই ফরাসি বিপ্লবের বীজ নিহত ছিল। অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের জনগোষ্ঠী তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে যাজক শ্রেণী প্রথম শ্রেণীভূক্ত ছিল (First Estate)। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে যাজকদের সংখ্যা ছিল মোট প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার। যাজক শ্রেণী ঊর্ধ্বতন যাজক ও অধঃস্তন যাজক এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ঊর্ধ্বতন যাজকরা বিত্তশালী ও রাজানুগ্রহভোগী ছিল। অধঃস্তন যাজকগণ ছিল দরিদ্র এবং তারা ঊর্ধ্বতন যাজক সমাজে অপাঙক্তেয় ছিল। কারণ উচ্চ যাজক বিশপ অভিজাত সম্প্রদায় থেকে আগত ছিল। ফ্রান্সের আইন অনুসারে ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীরা গির্জাকে টাইদ বা ধর্ম-কর দিত। এ ছাড়া নানা উৎস থেকে যেমন মৃত্যু কর, নামকরণ কর, বিবাদ কর প্রভৃতি থেকেও গির্জার প্রচুর আয় হত। প্রতিটি গির্জার যে বিরাট ভূসম্পত্তি ছিল তা থেকে অনেক অর্থ আয় হত। ফরাসি মন্ত্রী নেকারের মতে, ফরাসি গির্জার বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল আনুমানিক তের কোটি লিবর। খাদ্যশস্যের দাম বাড়লে গির্জা ফসল উচ্চদামে বিক্রি করে বেশি টাকা লাভ পেত। গির্জার এই সম্পদ বিশপ শ্রেণী ভোগ করত। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে বিশপের সংখ্যা ছিল ১৩৯; গীর্জার সকল ব্যাপার উচ্চ যাজকরাই নিয়ন্ত্রণ করত। Conttact de Poissey বা পেইসির চুক্তি অনুসারে গির্জার বিশপরা তাদের ভূসম্পত্তির উপর সরকারকে নিয়মিত কর দিত না। তারা স্বেচ্ছায় কর দিত এবং তার পরিমাণ তারাই নির্ধারণ করত। কিন্তু যাজকদের মধ্যে যারা অধঃস্তন পদে গ্রামে গির্জায় দায়িত্ব পালন করত তারা ছিল দরিদ্র কিন্তু ধর্মে নিষ্ঠাবান। এদের নিয়োগ দেওয়া হত তৃতীয় শ্রেণী থেকে। তাদের প্রতি বৈষম্য তাদেরকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময় তাই অধঃস্তন যাজকরা তাদের শ্রেণীকে (সাধারণ মানুষ) সমর্থন দিয়েছিল। ফ্রান্সে যাজক কোনো শ্রেণী না হলেও ফরাসি আইনে তাদের শ্রেণী হিসেবে গণ্য করে তাদের ভোটাধিকার দেয়া হয়েছিল।

অভিজাত শ্রেণী : ফ্রান্সের সমাজ কাঠামোতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল অভিজাতরা। ফরাসি বিপ্লবের সময় মূল অভিজাতদের সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৫০ হাজার। তারা কৌলীন্যে বিশ্বাস করত এবং সমাজে সকল সুবিধা তারা ধরে রাখত। কায়িক বা মানসিক শ্রমের দ্বারা জীবিকা অর্জনকে তারা নিন্দনীয় মনে করত। আলস্য ও অবসরভোগী বিলাসী জীবনযাত্রা তখনকার অভিজাত্যের সংস্কৃতি ছিল। তারা ফ্রান্স-বিজয়ী ফ্রাংকদের বংশধর দাবি করত। তারা ফরাসি রাজাদেরকে তাদের সাথে আত্মীয়তার দ্বারা সম্পর্কিত মনে করত এবং সেই সূত্রে বিশেষ অধিকার ভোগ করত। অভিজাতরা তাদের এই বংশানুক্রমিক সুবিধা বংশপরম্পরায় ভোগ করতে থাকলে সচেতন সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। এই অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে বিভিন্ন দল, উপদল ছিল। প্রাচীন বনেদি অভিজাতদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার। এরা রাজার সভাসদ প্রধান সেনাপতি, বিচার বিভাগের উচ্চপদ এবং ইনটেডেন্ট পদে নিয়োগ পেত। এদেরকে দরবারের অভিজাত বলা হত। রাজপরিষদ মন্ত্রী, রাজদূত, প্রাদেশিক শাসনকর্তা, সামরিক বিভাগের উচ্চপদ এদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরা ছিল রাজার সহযোগীগোষ্ঠী এবং এরা আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করত। বহু দাসদাসী ও অনুচর রাখার খরচায় ঋণগ্রস্ত হলেও এরা আড়ম্বর ত্যাগ করত না। এরা ছিল খুবই অহংকারী। এরা ফ্রান্সের রাজধানী ভার্সাই নগরে বাস করত। এরাই ফ্রান্সে জমিদারি আয় ও উচ্চপদের চাকরি এরাই ভোগ করত। এই অভিজাত শ্রেণী গ্রামীণ অভিজাতদের হেয় চোখে দেখত।

ফ্রান্সের অভিজাতদের মধ্যে যারা গ্রামাঞ্চলে জমিদারিতে বাস করত তারা প্রাদেশিক সভায় প্রভাব প্রতিপত্তি খাটাত এদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে বাড়তি অর্থ আয়ের পথ না থাকায় এরা অনেক দরিদ্র হয়ে পরেছিল। আভিজাত্যের কারণে কায়িক পরিশ্রম ও বাণিজ্যকে নিন্দার চোখে দেখত। এই শ্রেণী তাদের আয় বৃদ্ধির জন্যে কৃষকদের শোষণ করত। তাই কৃষক শ্রেণী এদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল।

ফরাসি অভিজাতদের মধ্যে একশ্রেণী ছিল চাকরিজীবী। ধনী বুর্জোয়াদের একাংশ সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা লাভের জন্য পার্লামেন্টের বিচারকের পদ বা প্রদেশে ইনটেন্ডেন্টের পদ বংশানুক্রমিকভাবে কিনে নিত। এরা সরকারি চাকরির পদমর্যাদার বলে অভিজাত বলে গণ্য হত। এদেরকে পোশাকি অভিজাত বলা হত। এরা প্রশাসক ও আইনবিদ এবং বিচারকের কাজ করত। এরা বংশানুক্রমে বিভিন্ন পদ ভোগ করত। পার্লামেন্ট বা বিচারসভাগুলোর বিচারকের পদ এদের একচেটিয়া ছিল। ফ্রান্সের এই অভিজাতশ্রেণী বিশেষ অধিকার ভোগ করত। সরকারি চাকরি, জমিদারি সরকারি চাকরি যাজকের পদ সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকত, ফ্রান্সের মোট কৃষি জমির তিন ভাগের এক ভাগ তাদের মালিকানাই ছিল। ভূমির উপর প্রত্যক্ষ করকে টাইলে বলা হত। কিন্তু ফরাসি আইনে অভিজাতরা টাইলে আদায় করতে বাধ্য ছিল না। ভিটিংয়েমে ও ক্যাপিটেশন প্রভৃতি কর থেকেও তারা অব্যাহতি পেত। রাস্তাঘাট তৈরি বা খাল খননের জন্য এ শ্রেণীকে বাধ্যতামূলক কর বা বেগার খাটতে হত না। জমিদারিতে নানা প্রকার স্বত্ব তাদের অধিকারে ছিল, যেমন – জমিদারির সামন্ত উপসত্ত্ব বা Champart জমিদারিতে সামন্ত আদালত গঠনের অধিকার, জরিমানা আদায়ের অধিকার যে কোনো একচেটিয়া ব্যবসায়ের অধিকার, গম পেষায় ও মদ চোলাই কারখানা রাখার অধিকার, বানালিতে বা উপকর আদায়ের অধিকার ও বেকার খাটার অধিকার ইত্যাদি। রাজার সভাসদ হিসাবে সরকারি ভাতা, পুরস্কার, পেনশন, সামাজিক মর্যাদা এরা ভোগ করত। সরকারি মর্যাদার প্রতীক হিসেবে সর্বত্র তরবারি বহন করত। তারা তাদের নামের আগে লর্ড বা ব্যরন বা মার্কুইস পদবি ব্যবহার করত।

তৃতীয় শ্রেণী : ফ্রান্সের প্রায় অধিকাংশ মানুষ তৃতীয় শ্ৰেণীভূক্ত ছিল (Third Estate) বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক দিনমজুর এরা সবাই তৃতীয় শ্রেণীভূক্ত ছিল। রাষ্ট্র ও সমাজে এরা ছিল অধিকারহীন শ্রেণী। বিপ্লবকালীন ফ্রান্সে মোট লোকসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫০ লক্ষ। এর মধ্যে প্রায় শতকরা ৯৩% লোক ছিল তৃতীয় শ্ৰেণীভুক্ত। ধনী বুর্জোয়া থেকে চালচুলোহীন ভবঘুরে সকলেই ছিল তৃতীয় শ্রেণীর লোক। এদের মধ্যেও বিভিন্ন স্তরের শ্রেণী বৈষম্য ছিল। এদের মধ্যে ধনী বুর্জোয়ারা শ্রমজীবীদের শ্রেণীভুক্ত হওয়ায় তারা বিপ্লবকালীন সময়ে বুর্জোয়াদের ডাকে অভিজাত ও যাজক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিপ্লবের জন্য সম্মিলিত হয়েছিল।

ফ্রান্সে তৃতীয় শ্রেণীর বুর্জোয়ারা ছিল ধনিক শ্রেণীর লোক এরা শহরের উপকণ্ঠে বসবাস করত ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পে কারিগরী দ্বারা এরা জীবিকা নির্বাহ করত। শহরবাসী ধনিক বণিক, সাধারণ দোকানদার, কারিগর, বুদ্ধিজীবী, সরকারি চাকরিজীবী এরা সকলেই বুর্জোয়া শ্ৰেণীভুক্ত ছিল। এদের মধ্য আবার পাতি বুর্জোয়া ছিল। সাধারণত চাকরিয়া আইনজীবী, চিকিৎসক, অধ্যাপক প্রভৃতি পেশা পাতি বুর্জোয়া বলে পরিচিত ছিল। এরা ছিল বুদ্ধিমান, সাহসী ও সমাজ সচেতন গোষ্ঠী। এরা জ্ঞানদীপ্ত বা দার্শনিকদের ভাবধারায় প্রভাবিত হত।

অর্থনৈতিক কারণ

ফরাসি বিপ্লবের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক সংকট। সমাজে কৃষক, বুর্জোয়া এবং সাধারণ মানুষ ছিল করভারে জর্জরিত। রাষ্ট্রের সমগ্র করভার কৃষক এবং বুর্জোয়াদের বহন করতে হত। সামন্ত প্রভুদের এবং গির্জার করভারে জর্জরিত ছিল কৃষক, ভূমিদাস, বর্গাচাষি, খাজনা চাষি, ভূমিহীন, ঝুপড়িবাসী ক্ষেতমজুর। তারা সামন্ত প্রথা, টাইস (Tithes), টেইলি (Taille), ক্যাপিটেশন (Capitation) এবং ভিংটিয়েমে (Vingtiemes) প্রভৃতি কর থেকে অব্যাহতি চাইত। সাকুলেৎদের (শ্রমজীবী) মধ্যে শ্রমিক, কুলি, দিনমজুর প্রমুখ কম মজুরি এবং খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্যের জন্য কষ্টে পিষ্ট হচ্ছিল। বিপ্লবের প্রাক্কালে মজুরি হার বৃদ্ধি ছিল ২২% এবং খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে ৬০%। এর সাথে ১৭৮৮-৮৯ সালে পরপর দু বছরের অনাবৃষ্টি ও অজন্মার ফলে দীন দরিদ্র ভূমিহীন ও শ্রমজীবীদের মধ্যে হাহাকার তৈরি হয়। ব্রিটিশ পর্যটক আর্থার ইয়াং ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে ভয়ানক দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন। এভাবে তৃতীয় শ্রেণীর নিচের তলার মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও দারিদ্র্য বিপ্লবের জন্য বারুদের সঞ্চার করে। রাজা ষোড়শ লুই জাতীয় সভা আহ্বান করলে জাতীয় সভার অধিবেশনে বুর্জোয়া নেতারা পুরাতনতন্ত্র ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে এ শোষিত শ্রেণী তাদের বঞ্চনার জন্য অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রকে দায়ী করে ফ্রান্সে বিপ্লব ঘটায়।

দার্শনিকদের অবদান

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের প্রচারণা বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। দার্শনিকদের প্রভাবেই ফরাসি বুর্জোয়া শ্রেণী বিপ্লবী মানসিকতায় অনুপ্রাণিত হয়। অষ্টাদশ শতকের ফরাসি দার্শনিকরা প্রয়োগবাদের সূচনা করেন। প্রয়োগবাদের মূলকথা ছিল যুক্তির সাহায্যে ভালো-মন্দ যাচাই করা এবং ভালো বিষয়কে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত করা। দার্শনিকরা তাদের যুক্তিবাদকে পুরাতনতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভগুলোর উপযোগিতার পরীক্ষায় নিয়োগ করেন। এর ফলে তারা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র, অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা, সামন্ত শোষণের অন্যায় দিকগুলো উদ্ঘাটন করেন। তারা কর ব্যবস্থার বৈষম্য, অন্তঃশুল্ক প্রথার অযৌক্তিকতা দেখতে পান। গির্জাকে তারা সামন্ত শোষণ ও স্বৈরাচারী রাজশাসনের পৃষ্ঠপোষতা করতে দেখেন। প্রগতি ও সংস্কারের প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল ক্যাথলিক গির্জা। গির্জা নিজেই ছিল সামন্ত শোষণের অংশীদার, রক্ষণশীলতা ও কুসংস্কারের গর্ভগৃহ। এ অবস্থায় হেলভিসিয়াস, মঁতেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো, দিদেরো এবং অর্থনীতিবিদ কোয়সনে ফিজিওক্যাটগণ তীব্র সমালোচনার দ্বারা পুরাতনতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে করে দেন। এজন্য ফ্রান্সে বিপ্লব ঘটে।

ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার চার্চের দুর্নীতি, যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের বিশেষ সুবিধার সমালোচনা করেছিলেন। তিনি ফ্রান্সের গির্জাগুলোকে দুর্নীতির ঘাঁটি মনে করতেন। ফরাসি দার্শনিক রুশো সমাজের শ্রেণী বৈষম্যের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করলেও সমাজে সকল স্তরে সে শৃঙ্খলিত। (Man is born free but every where he is in chains)। তার ‘Social contract’ গ্রন্থটি সমাজে বিপ্লবের বন্যা সৃষ্টি করেছিল। তিনি প্রচার করতেন যে, রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির মালিক জনগণ। রাজা বা শাসক জনগণের মতানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা না করলে জনগণ তাকে পদচ্যুত করতে পারে। রুশোর মতবাদ ফ্রান্সে বিপ্লবের আবহ তৈরি করেছিল। কাজেই ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের চিন্তা ও প্রচারণা মানুষের মনোজগৎকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করেছিল।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ইউরোপ, মোঃ রমজান আলী আকন্দ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ৩২৫-৩৩৫

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.