পঞ্চদশ শতকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পটভূমি

অর্থনৈতিক জীবন

রেনেশাঁস-ইউরােপের অর্থনৈতিক জীবন আলােচনা প্রসঙ্গে জে. আর. হেল লিখেছেন যে কোনাে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেনি (this was not a time of dramatic change)। যুদ্ধ, প্লেগ ও মুদ্রাস্ফীতি ছিল, স্থানীয়ভাবে খাদ্য ও ভােগ্যপণ্যের অভাব ছিল। তা সত্ত্বেও সাধারণভাবে ইউরােপে এক ধরনের অনুজ্জ্বল সমৃদ্ধি ছিল (muted over all prosperity)। এ যুগে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেনি; কৃষি ও শিল্প উৎপাদনেও বড়াে রকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। আমেরিকার মূল্যবান ধাতু তখনাে দ্রব্যমূল্য ও মজুরির ওপর বড় রকমের অভিঘাত নিয়ে আসেনি। মিলান, ভেনিস, টাসকেনিকে কেন্দ্র করে যে সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছিল তার স্থান নিতে শুরু করে দক্ষিণ পশ্চিম জার্মানি। ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর ফ্লোরেন্স ও ভেনিসের চেয়ে আটলান্টিক উপকূলের বন্দর লিসবন ও আন্টওয়ার্পের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষ, মালয়, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, আমেরিকা ও আফ্রিকার সঙ্গে ইউরােপের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। এতেও ইউরােপীয় অর্থনৈতিক জীবনের বড়াে রকমের পরিবর্তন হয়নি। কলম্বাস ও ভাস্কো-ডা-গামার প্রভাব ছিল সীমিত। রেনেশাঁস যুগে ইউরােপীয় অর্থনীতি ছিল প্রায় স্বয়ম্ভর (almost entirely a self-contained unit)।

পঞ্চদশ ও ষােড়শ শতকে ইউরােপের জনসংখ্যার নির্ভরযােগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। বাড়ি, জমি, কর, জন্ম-মৃত্যুর হিসেব এবং সৈন্যবাহিনীর হিসেবপত্র থেকে এক ধরনের হিসেব গড়ে তােলা হয়েছে। এই হিসেবে অবশ্যই ত্রুটি আছে। এসব অসুবিধা সত্ত্বেও ঐতিহাসিকরা ধরে নিয়েছেন যে রেনেশাঁস-ইউরােপে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছিল (general trend of population growth seems to be beyond doubt)। এ যুগের ইউরােপের পাঁচটি বড়াে শহর কনস্টান্টিনােপল, প্যারিস, নেপলস্, ভেনিস ও মিলানে লক্ষাধিক লােক বাস করত। ছােটো শহরগুলিও বেড়ে চলেছিল, অল্প কয়েকটি দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল, বেশিরভাগ শহরের সম্প্রসারণ চলেছিল। সম্প্রসারণশীল শহরগুলি হল ফ্লোরেন্স, স্যুবেক, ভিয়েনা, হামবুর্গ ও ডানজিগ। যেহেতু শহরের লােকসংখ্যা বাড়ছিল, ধরে নেওয়া যায় সামগ্রিকভাবে ইউরােপের জনসংখ্যাও বেড়ে চলছিল। শহরে মৃত্যুর হার বেশি ছিল তবে গ্রাম থেকে শহরে অভিপ্রয়াণ অব্যাহত ছিল, এজন্য জনসংখ্যা হ্রাস পেত না। শহরের উন্নত কেন্দ্রিয় শাসন, জীবনের নিরাপত্তা ও প্লেগের দৌরাত্ম্য কমে আসার জন্য জনসংখ্যা বেড়েছিল। গ্রামেও এসব কারণে জনসংখ্যা বেড়েছিল।

জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাষযােগ্য জমির চাহিদা বেড়েছিল। ইতালি ও নেদারল্যান্ড ছাড়া আর সর্বত্র চাষযােগ্য জমি অনাবাদী হয়ে পড়েছিল। পতিত জমি আবাদ করার জন্য দরকার ছিল অনেক লােকের এবং অঢেল মূলধনের। এসময়ে ইউরােপে এ দুয়েরই অভাব ছিল। ইতালি, ফ্রান্স ও দক্ষিণ জার্মানিতে জমি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বণ্টিত হত। স্বাধীন কৃষক কিছু জমি লীজ দিত। ভূস্বামীরা খাজনা বাড়িয়েছিল। পূর্ব ইউরােপে ভূমিদাস প্রথা ছিল, মধ্য ইউরােপের অনেক স্থানে ভূমিদাসদের দেখা পাওয়া যেত। বাড়তি জনসংখ্যার জন্য বাড়তি জমির যােগান দেওয়া সম্ভব হয়নি, এজন্য অনেক কৃষক জমি থেকে উৎখাত হয়েছিল। জমি থেকে উৎখাত হওয়া কৃষকদের একাংশ সৈন্যবাহিনীতে যােগ দিয়েছিল, কিছু লােক হয় ভবঘুরে ও সমাজবিরােধী। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটলে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ইউরােপের কৃষক গম, আলু, জোয়ার, ধান প্রভৃতি কৃষিজ পণ্য উৎপাদন করত, নতুন সবজি ও ফলের চাষ বসেছিল। ফুলকপি, গাজর, মটরদানা ইত্যাদি শহরবাসীর চাহিদা মেটাত। হল্যান্ড ছিল কৃষি উৎপাদনে উন্নত দেশ। পশু-খাদ্য টার্নিপ ও ক্লোভারের চাষ প্রথম এখানে শুরু হয়েছিল। চক্রাকার চাষ, একই বছরে একাধিক শস্য চাষ, উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা, সারের ব্যবহার হল্যান্ড ছাড়া ইউরােপের অন্য কোনাে দেশে ছিল না। রেনেশাঁস-ইউরােপে খাদ্যশস্যের চাহিদা বেড়েছিল, উৎপাদন সে তুলনায় বাড়েনি। উৎপাদনের ব্যয় বেড়েছিল কারণ জমির খাজনা ও কৃষি মজুরের মজুরি বেড়েছিল। চাহিদা ও উৎপাদন ব্যয় বাড়ার জন্য খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছিল।

ইউরােপের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছিল ভােগ্য পণ্য সরবরাহের ওপর। খাদ্যের চাহিদা যেমন বেড়েছিল তেমনি চাহিদা বেড়েছিল মাংস, পশম, শণ, গৃহ নির্মাণ দ্রব্য ও জ্বালানির। এ যুগে ইংলন্ড ও স্পেন ছিল পশম ও মাংসের সরবরাহকারী দেশ। ইংলন্ডের ভূস্বামীরা পতিত ও আবাদী জমি ঘিরে (enclosure) মেষ পালন করতে থাকে। স্পেনে পশম ব্যবসায়ীরা ব্যাপকভাবে মেষ পালন করত, এজন্য তারা মেস্টা (Mesta) নামক সংগঠন গড়ে তুলেছিল। ইতালি ছিল শিল্প পণ্য উৎপাদন, বাণিজ্য ও ব্যাঙ্কিং-এর একটি বড়াে কেন্দ্র। উত্তর ইতালির পাে উপত্যকা ছিল ইউরােপের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ কৃষি অঞ্চল। এখানে ব্যাঙ্কিং সংস্থাগুলির অর্থানুকূল্যে রেশম, রেশমী বস্ত্র, কাঁচ, অলঙ্কার ও গ্রন্থ প্রকাশকে কেন্দ্র করে বহু শিল্প স্থাপিত হয়। প্রাচ্য দেশ থেকে ইতালিতে আমদানি করা হত। মশলা ও অন্যান্য সৌখিন দ্রব্য দক্ষিণ জার্মানির হকস্টেটার (Hochstetter), ওয়েলসার ও ফুগার ব্যাঙ্কিং ও বাণিজ্য সংস্থা বহু রকম শিল্প ও বাণিজ্যিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফ্রান্সের লিঁও শহরে বসত আন্তর্জাতিক মেলা। আমস্টারডাম ছিল বাণিজ্য ব্যাঙ্কিং ও শিল্প উৎপাদন কেন্দ্র, এখানে ছিল মৎস্য শিল্পের একটি বড়াে কেন্দ্র। ইউরােপের শিল্প সংগঠন, পরিচালন, উৎপাদন, পণ্যের গুণগতমান বজায় রাখা ও পণ্যমূল্য নির্ধারণে গিল্ডের ভূমিকা ছিল! শিল্প প্রতিষ্ঠা বা পণ্য উৎপাদনে উদ্যোগী পুঁজিপতিদের স্বাধীনতা ছিল না। ইংলন্ড, ফ্লান্ডার্স, দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানি ও ইতালিতে গিল্ড ব্যবস্থা ছিল। রাষ্ট্র ও নগর প্রশাসন এদের কাছ থেকে নানাধরনের কর আদায় করত। স্বাধিকার নয়, নিয়ন্ত্রণ ছিল শিল্প-বাণিজ্য সংস্থায় প্রচলিত নীতি (tone was one not of free enterprise but of control)।

রেনেশাঁস যুগে ইউরােপের দেশগুলির মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে খাদ্যশস্য, শিল্পের কাঁচামাল ও ভােগ্যপণ্যের আমদানি-রপ্তানি চলত। ইউরােপের রাজ্যগুলির ওপর অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী ধারণার প্রভাব পড়েছিল। সব রাষ্ট্র মনে করত আমদানি কম ও রপ্তানি বেশি হলে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পায়। এজন্য তারা সংরক্ষণ নীতি অনুসরণ করেছিল। দেশি শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া হত, বিদেশ থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা ছিল। এই অর্থনৈতিক ধারণাও ছিল যে, দেশের জাহাজে পণ্য পরিবহণের ব্যবস্থা হলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। অনেক দেশ এজন্য নৌ-পরিবহণ আইন (Navigation Act) চালু করেছিল। লিথুয়ানিয়া ও পােল্যান্ড পশ্চিম ইউরােপে পশম ও শণ রপ্তানি করত, উত্তরের দেশগুলিতে সিসিলি পাঠাত খাদ্যশস্য ও কার্পাস বস্ত্র। ইংলন্ড ও স্পেন পশম রপ্তানি করত পূর্বাঞ্চলের দেশগুলিতে, বাল্টিক ও উত্তর সাগর থেকে মৎস্য রপ্তানি হত দক্ষিণের দেশগুলিতে। রেনেশাঁস যুগে ইউরােপের শিল্প, বাণিজ্য ও আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রধান ঘাঁটি ছিল দক্ষিণ নেদারল্যান্ড, উত্তর-পূর্ব ফ্রান্স, দক্ষিণ জার্মানি ও উত্তর ইতালি। এ যুগে রাইন হল ইউরােপের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল নদী, ভেনিস, ইয়র্কশায়ার ও শেফিল্ড হল ব্যস্ত শিল্প কেন্দ্র।

এ যুগে জনসংখ্যা বেড়েছিল, যুদ্ধবিগ্রহ ছিল, যানবাহন, পরিবহণ ব্যবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। বিভিন্ন দেশের মধ্যে ছিল অসংখ্য শুল্কচৌকি। আমেরিকার সােনা ও রূপে ইউরােপের বাজারে আসতে শুরু করেছিল, এ সব কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছিল। তবে জিনিসের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শ্রমিক ও কৃষকের মজুরি বাড়েনি। টাকার অংকে মজুরি বাড়লেও সেই বর্ধিত মজুরি দিয়ে সে আগের দিনের মতাে খাদ্যশস্য ও ভােগ্যপণ্য কিনতে পারত না। অর্থাৎ তার প্রকৃত মজুরি কমেছিল। মজুরির অনুপাতে খাদ্যশস্য ও ভােগ্যপণ্যের দাম বাড়া সত্ত্বেও শ্রমিক অশান্তি বা বড়াে রকমের বিদ্রোহ ছিল। এ যুগে বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করত যেখানে তারা জমিতে কিছু শস্য ফলাত, মেষ পালন করত। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও অভিজাত বা বণিক শ্রেণীর মানুষ বিশেষ অসুবিধার মধ্যে পড়েনি। জমির খাজনা, চাকরির আয় বা বর্ধিত বাণিজ্য থেকে এই শ্রেণীর মানুষের আয় বেড়েছিল। দুর্দশার মধ্যে ছিল ভূমিহীন চাষী বা বেকার মানুষ। এ যুগের মূল্য বিপ্লবের সুদূর প্রসারী ফল হল ধনীদের হাতে ধন সঞ্চয় সম্ভব হয়, এই সঞ্চিত ধনের একাংশ আবার মূলধনের আকারে শিল্প-বাণিজ্যে লগ্নি করা সম্ভব হয়।

রেনেশাঁস-ইউরােপের অর্থনৈতিক জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ব্যাপক ব্যাঙ্কিং ও মহাজনী কারবার। অ্যারিস্টটল ও যিশু খ্রিস্ট উভয়ে সুদের কারবারের বিরােধিতা করেছেন। তা সত্ত্বেও এ যুগে ব্যাঙ্কিং কারবারে সমৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল। ব্যাঙ্কিং কারবারে ইতালি, দক্ষিণ জার্মানি ও নেদারল্যান্ড প্রাধান্য অর্জন করেছিল। মেদিচি ও ফুগার পরিবারের বিস্তৃত ব্যাঙ্কিং কারবার ছিল, মেদিচিরা ছিল ফ্রান্সের আর ফুগাররা ছিল স্পেনের রাজপরিবারের ব্যাঙ্কার। এ যুগে উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত উন্নতি তেমন হয়নি। শ্রমিকের সরবরাহ ছিল, সেজন্য যন্ত্র নির্মাণের তেমন চেষ্টা হয়নি। খনি থেকে ধাতু নিষ্কাশনের প্রযুক্তি ছিল। কাঠ ও লােহা দিয়ে যন্ত্র বানিয়ে জল ও বাতাসের সাহায্যে চালানাে হত। ইউরােপের খনি থেকে কয়লা, লােহা, তামা, রূপাে ইত্যাদি উত্তোলনের ব্যবস্থা ছিল। ভেনিসের জাহাজ নির্মাণ ছিল এ যুগের ইউরােপের সবচেয়ে বড়াে শিল্প, এই শিল্পে চার হাজার শ্রমিক কাজ করত।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারি হস্তক্ষেপ ছিল। মার্কেন্টাইল অর্থনীতির ধারণা (Mercantilism) ক্রমশ স্পষ্ট রূপ নিতে থাকে। তবে অর্থনৈতিক কার্যকারণ সম্পর্ক সব সময় স্পষ্টভাবে ধরা পড়ত না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা বেকারত্ব বৃদ্ধির সঠিক কারণ তারা ধরতে পারতেন। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ধারণা গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রীয় বাজেট, আয়-ব্যয়ের হিসেব বা বাণিজ্যিক লেনদেনের পর ঘাটতি বা উদ্বৃত্তের ধারণাও ছিল না। একটি ধারণা বিশ্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেছিল—তা হল রাজা বা শাসক নিজ আয়ের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহ করবেন। খুব প্রয়ােজন না হলে নিত্য প্রয়ােজনীয় পণ্য রুটি, লবণ, মদ ইত্যাদির ওপর কর স্থাপন করবেন না। এ যুগে সব দেশে সরকারি ব্যয় বেড়ে চলছিল কারণ যুদ্ধ বিগ্রহ বেড়ে চলছিল। এজন্য সাধারণ ভােগ্যপণ্যের ওপর শাসকেরা কর বসিয়েছিলেন। রাজা সপ্তম হেনরির মতাে বিবেচক শাসক আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ওপর কর বসিয়ে আয় বাড়িয়ে নেন। ওলন্দাজ পণ্ডিত এরাসমাস ও মানবতাবাদী টমাস মাের অতিরিক্ত কর বসানাের বিরােধিতা করেছিলেন। এঁদের অভিমত হল রাজাকে যদি কর বসাতে হয় তাহলে ধনীদের ওপর তা বসাতে হবে, তাদের বিলাসদ্রব্যের ওপর কর বসবে, সাধারণ মানুষের কোনাে ক্ষতি হবে না।

রেনেশাঁস-ইউরােপের অর্থনীতি ছিল অনেকখানি রক্ষণশীল। পরিবর্তনমুখী শক্তিগুলি সক্রিয় ছিল না। ভূস্বামী ও কৃষক নতুন পদ্ধতিতে চাষ করে উৎপাদন বাড়াতে পারেনি, শিল্পে নতুন প্রযুক্তির প্রয়ােগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। শুধু বয়ন শিল্পে শ্রমবিভাজন অনেকখানি এগিয়েছিল। রাষ্ট্র নেতারা ছিলেন রক্ষণশীল, অর্থনৈতিক কার্য-কারণ সম্পর্ক তারা অনেক সময় ধরতে পারতেন না। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উত্থান লক্ষ্য করা যায়। রাজ্যের অভ্যন্তরে এবং বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে শুল্ক প্রাচীর অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের ক্ষতি করত। এই আপাত গতিহীনতার মধ্যে এক ধরনের মন্থর গতিশীলতা ইউরােপের অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল।

সামাজিক পটভূমি

রেনেশাঁসের সমকালীন বুদ্ধিজীবীরা সমাজকে তিনভাগে ভাগ করেছেন—যাজক, অভিজাত ও সাধারণ মানুষ। পােপ, কার্ডিনাল, প্যাট্রিয়ার্ক, বিশপ, অ্যাবট ও সন্ন্যাসীদের নিয়ে গঠিত ছিল প্রথম স্তরটি। অভিজাতদের মধ্যে ছিলেন সম্রাট, রাজা, ডিউক, কাউণ্ট ও নাইটরা। সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, জ্যোতিষী, উপদেষ্টা, বণিক, ম্যাজিস্ট্রেট, বেইলিফ, সৈনিক, কৃষক, কারিগর, রাধুনি ও চিত্রকর। ক্যাক্সটন তাঁর Mirror of the world গ্রন্থে সমাজের এই প্রথাগত বিভাজন মেনে নিয়েছেন। অভিজাতরা যুদ্ধ করেন, যাজকরা প্রার্থনা করেন, সাধারণ মানুষ কাজ করে ও কর দেয়। ঈশ্বরের ত্রিত্বের ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে (পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা) সমাজকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষ অভিজাত ও যাজকদের সব প্রয়ােজন মিটিয়ে থাকে, অভিজাত ও যাজক সাধারণ মানুষকে রক্ষা করেন, যাজক এদের শিক্ষা দেন। সমাজে ঐক্য ও ভারসাম্য ছিল।

স্পেনের এক পরিসংখ্যানে পাওয়া যায় যাজকদের সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ। অভিজাতদের ২ শতাংশ, বাকী ৯৫ শতাংশ হল সাধারণ মানুষ। ডাডলে (Dudley) তার Tree of Common Wealth গ্রন্থে বলেছেন যে তৃতীয় শ্রেণীতে ছিল বণিক, কারিগর, শ্রমিক, ফ্রি হােল্ডার, কৃষক এবং সমাজের বেশিরভাগ মানুষ। ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক ক্লদ দ্য সিসেল (Claude de Seyssel) সমাজকে অভিজাত, বণিক ও আমলাতন্ত্র এবং উৎপাদক (শ্রমিক ও কৃষক) এই তিনভাগে ভাগ করেছেন। সন্দেহ নেই। সমাজের উচ্চতম স্তরে অবস্থিত ছিল অভিজাতরা। অভিজাতদের মধ্যে ছিলেন কার্ডিনাল, আর্চবিশপ, ডিউক, মারকুইস ও আর্ল। অভিজাততন্ত্রের মাপকাঠি ছিল বংশগত পরিচয় (blood) এবং সম্পদ (wealth)। ইউরােপের বিভিন্ন দেশে আইন প্রণয়নের জন্য পরামর্শ পর্ষদ ছিল। প্রত্যেক পর্ষদে তিনটি সামাজিক স্তরের প্রতিনিধিত্ব করত অভিজাত, যাজক ও সাধারণ মানুষ। অভিজাতদের প্রায় সকলে ভূস্বামী ছিলেন। যুদ্ধ, শাসন ও কূটনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এরা জীবিকা অর্জন করতেন। ফ্রান্স, স্পেন ও হাঙ্গেরিতে অভিজাতদের কর দিতে হত না। যে সব দেশে অভিজাতদের কর দিতে হত, তাদের জন্য বিশেষ তালিকা তৈরি হত। অভিজাতদের শিকারের অধিকার ছিল, এদের শাসন, বিচার ও কর স্থাপনের অধিকার ছিল।

ইউরােপের অভিজাতরা জাঁকজমক ও ঐশ্বর্যের মধ্যে বাস করত, দামী পােশাক পরত। অভিজাতদের সন্তানরা চার্চের উচ্চপদগুলিতে নিযুক্ত হতেন। অভিজাতদের সকলে বংশানুক্রমিকভাবে নাইট উপাধি পেতেন। শিভালরি হল অভিজাতদের আচরণবিধি, অল্প বয়স থেকে অভিজাত সন্তানদের আচরণবিধি শেখানাে হত, যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত করে তােলা হত। বর্মাবৃত অশ্বারােহী বীরপুরুষ সত্য ও নারী জাতির সম্মান রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকত। বিপন্নকে আশ্রয় দান, আর্তত্রাণ ইত্যাদি ছিল বীরপুরুষের পালনীয় কর্তব্য। জার্মান অভিজাতরা কুকুর ও বাজপাখি নিয়ে শিকার করতে ভালােবাসত। ইংরেজ অভিজাতরা শিক্ষাকে অবহেলা করতেন না, শিক্ষিত অভিজাতরা শিক্ষিত উপদেষ্টা ও আমলা রাখতেন। শিক্ষিত বুর্জোয়ারা এ সব পদে নিযুক্ত হত, এতে অবশ্যই প্রশাসনিক উন্নতি ঘটেছিল। রাশিয়াতে অভিজাতরা শাসন, ভূ-সম্পত্তি দেখাশােনা ও যাজকের কাজ করতেন। এখানকার অভিজাতরা বাণিজ্যের সঙ্গেও যুক্ত হতেন। ফ্রান্স ও স্পেনের মতাে রাশিয়াতে বাণিজ্যকে সামাজিক সম্মান হানিকর বলে মনে করা হত না।

অভিজাততন্ত্রের মধ্যে ছিল উচ্চশ্রেণীর যাজকেরা, এরা নানা ধরনের সুযােগ সুবিধা ভােগ করতেন। উচ্চশ্রেণীর আর্চবিশপ ও বিশপরা ছিলেন ভূস্বামী। তাছাড়া ধর্মীয় কর থেকে এদের আয় হত। শাসন ও বিচার বিভাগীয় কিছু দায় দায়িত্ব এদের পালন করতে হত। এই সম্প্রদায়ের এক স্বতন্ত্র সামাজিক অস্তিত্ব ছিল। নিম্নশ্রেণীর যাজকেরা ছিল অশিক্ষিত ও দরিদ্র। সব শ্রেণীর যাজক রােমের কাছে দায়বদ্ধ ছিল। যাজকেরা সমাজের সব রকমের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করত। বিভিন্ন দেশে যাজক-বিরােধী মনােভাব গড়ে উঠেছিল (anti-clericalism)। যাজকদের দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে কৌতুক ও প্রহসন লেখা হয়। তবে ইউরােপের অনেক দেশে যাজকেরা ছিল একমাত্র শিক্ষিত সম্প্রদায়, সম্পন্ন, শাসক এবং সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। আর্তত্রাণ, দুঃস্থ মানুষের সেবা, চিকিৎসা ইত্যাদি কাজের সঙ্গে যাজকেরা যুক্ত ছিল।

তৃতীয় স্তরে ছিল সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, এরা কোনমতেই একটি শ্রেণী নয়। এদের মধ্যে ছিল বণিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, কৃষক, কারিগর, সৈনিক ও অন্যান্য পেশাদার গােষ্ঠির মানুষ। এদের জীবনযাত্রা ছিল স্বতন্ত্র ধরনের। অভিজাত ও যাজকদের সঙ্গে তার মিল ছিল না। সমকালীন পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন যে তৃতীয় স্তরে ছিল সম্পত্তিবান কৃষক, কৃষি শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, বণিক, চুক্তিবদ্ধ কারিগর, গৃহভৃত্য ও শহুরে শ্রমিক। এদের সঙ্গে ছিল পেশাদার গােষ্ঠির আইনজীবী, চিকিৎসক, পেশাদার। মানবতাবাদী, শিল্পী, মুদ্রাকর, খনি শ্রমিক ও ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। শহর ও গ্রামের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন ছিল। গ্রামের অনেক কাজ যেমন সব্‌জি উৎপাদন, দুগ্ধ উৎপাদন ইত্যাদি শহরেও হত, আবার শহরের কাজ সুতাে কাটা, বস্ত্র বয়ন যন্ত্রপাতি নির্মাণ ইত্যাদি গ্রামেও হত। গ্রামের কৃষক কাজের সন্ধানে শহরে চলে আসত।

গ্রাম ও শহরের মধ্যে যােগাযােগ থাকা সত্ত্বেও শহরের মানুষ গ্রামের মানুষকে পছন্দ করত না। ইতালি, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডে নগরায়ণ অনেকখানি এগিয়েছিল, এজন্য ওসব দেশের সাহিত্যে গ্রামীণ মানুষকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। শহর ও নগর রাজা ও সামন্ত প্রভুদের কাছ থেকে স্বাধীনতা আদায় করে নিয়েছিল। গ্রাম ছিল দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ, শহরে ছিল শিক্ষা, স্বাধীনতা ও উন্নতমানের রুচি। এসব কারণে গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে চলেছিল। সমাজে অর্থের চাহিদা বেড়েছিল, সময়ের মূল্য সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়েছিল (time is money), শহরগুলির মধ্যস্থলে ঘড়ি বসানাে হয়েছিল। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ, অভিজাত, যাজক, মধ্যবিত্ত, কৃষক সকলে জীবনযাত্রার মানােন্নয়নে মন দিয়েছিল। বেশি কর চাপানাে হলে বা রুটির দাম বাড়লে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিত। বুর্জোয়ারা ধনী হয়ে অভিজাত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়, সামাজিক গতিশীলতা ছিল (social mobility), কোন বাধা ছিল না। তবে শুধু শহর জীবনে এটা সম্ভব হত, গ্রামে তা সম্ভব হত না, গ্রাম ছিল অনেক বেশি রক্ষণশীল। এ যুগে ইউরােপের ৯০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করত।

বণিক শ্রেণীর মধ্যে সম্পদশালী হবার বাসনা ও মনােভাব সক্রিয় ছিল। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বিভিন্ন ধরনের পােশাক পরত। লেখক ও শিল্পীদের অনেক সুযােগ ও সম্ভাবনা ছিল, প্রতিভাবানরা সম্পদ ও সামাজিক সম্মান পেতেন। পঞ্চদশ শতকে ইউরােপের বেশিরভাগ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। বেশিরভাগ কৃষি জমিতে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিজ পণ্যের চাষ হত। গম, যব, ওটস্ ও, রাই ছিল প্রধান উৎপন্ন কৃষিজ পণ্য। ইউরােপে রাস্তা-ঘাট ও পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। চাষ আবাদ ও মাংসের জন্য পশু পালন করা হত। বিভিন্ন শ্রেণীর কৃষক ছিল, কেউ কেউ সম্পত্তিবান, বেশিরভাগ সম্পত্তিহীন। অনেক কৃষক ছিল ভূমিদাস (serf)। কৃষকেরা সাধারণভাবে ছিল অশিক্ষিত রক্ষণশীল, ক্লান্ত ও নিঃসঙ্গ। ইংলন্ড ও ফ্রান্সে কৃষকের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালাে ছিল। রাশিয়া ও পােল্যান্ডে বেশির ভাগ কৃষক ছিল। ভূমিদাস যাদের ভূমির অধিকার ও মানবিক অধিকার ছিল না। এরা ছিল প্রভুর সম্পত্তি। ইউরােপের সব দেশে কৃষককে অনেক কর দিতে হত। পর্তুগালে কৃষকের উৎপাদনের ৭০ শতাংশ কর হিসেবে নিয়ে নেওয়া হত। অনেক দেশে কৃষকদের সামন্তকর দিতে হত। কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মেছিল। জার্মানিতে গুপ্ত বিদ্রোহী কৃষক সংস্থা ‘বুন্ডসচু’ (Bundschuh) গড়ে উঠেছিল। ঘােড়শ শতকের গােড়ার দিকে হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে কৃষক বিদ্রোহ হয়।

ইউরােপের শহরগুলিতে শিল্প উৎপাদন, বাণিজ্য, আর্থিক লেনদেন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বুর্জোয়া শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছিল। সম্পন্ন কৃষক, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রশাসক, বণিক, কারিগর, উৎপাদক সকলে ছিল এই শ্রেণীভুক্ত। ফ্রান্স, ইংলন্ড, ইতালি ও জার্মানিতে অনেক শহর গড়ে উঠেছিল। আইনজীবী ও চিকিৎসকদের ভালাে আয় হত, তবে এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার মান তেমন উন্নত ছিল না। বণিকরা ধনী হয়ে অভিজাততন্ত্রে স্থান গ্রহণ করত, শাসন, বিচার ও আইনজীবীর কাজ পেত। ইউরােপের শহর ও গ্রামের কারখানাগুলিতে শ্রমিকরা কাজ করত। জার্মানি ও ফ্রান্সের খনিগুলিতে এদের কর্মরত অবস্থায় পাওয়া যেত। বণিক ও কারিগরদের ছিল গিল্ড’ (Guild)। তবে শ্রমিকরা তেমন সংঘবদ্ধ ছিল না, মজুরি ছিল কম, কাজের সময় ছিল বেশি। শ্রমিকরা ধর্মঘট করত। ইউরােপের সব দেশে ভ্রাম্যমান কারিগররা ছিল, ছিল দিনমজুর ও গৃহভৃত্য। এদের বেশিরভাগ দুর্দশার মধ্যে দিন যাপন করত। এদের সামাজিক সম্মান ছিল না। পঞ্চদশ শতকে মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার (গুটেনবার্গের মুদ্রণ যন্ত্র ১৪৩৮ খ্রি.) চিন্তা ও শিক্ষার জগতে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। এই যন্ত্রে প্রথম বাইবেল ছাপা হয়। পঞ্চদশ শতকে ইউরােপের জীবনে যুদ্ধ ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এ জন্য ভাগ্যান্বেষী ভাড়াটিয়া সৈনিকদের চাহিদা বেড়েছিল। বাণিজ্য, ব্যাঙ্কিং, শিক্ষা ও সঙ্গীতে বিশিষ্ট অবদান থাকা সত্ত্বেও সমাজে ইহুদিরা ছিল অবাঞ্ছিত। তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হত, সমকালীন সাহিত্যে, প্রবাদে ও লােকগাথায় এর প্রতিফলন ঘটেছিল।

তথ্যসূত্র 

  • আধুনিক ইউরোপের আদিপর্বের রূপান্তর (১৪০০ – ১৭৮৯), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, ৪র্থ সংস্করণ, ২০১৪, পৃ – ২২-২৮

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.