মৌর্য সাম্রাজ্য, শুঙ্গ-কাণ্ব যুগ এবং চেদিদের দ্বারা কলিঙ্গের অভ্যুত্থান

মৌর্য সাম্রাজ্য (২৫০ খ্রি.পূ.)

Table of Contents

মৌর্যদের রাজনৈতিক ইতিহাস (৩২২ – ১৮৪ খ্রি.পূ.)

মৌর্যদের জাতির পরিচয় ও নামকরণ

আলেকজান্ডারের ভারত পরিত্যাগের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক আকাশে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের উদয় হল। ম্যাসিডােনীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে, নন্দরাজদের নির্মূল করে, তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারত জুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেন। ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় পূর্বে তার মতাে কেউ সাফল্যের পরিচয় দেননি। তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

মৌর্যদের পরিচয় ও মৌর্য নামকরণ : যে বংশে চন্দ্রগুপ্তের জন্ম, তার নাম মৌর্য। কিন্তু কেন এই মৌর্য নাম এবং কী তার পূর্বপুরুষদের পরিচয়, সে সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন বিবরণ পরিবেশিত হয়েছে। মুদ্রারাক্ষস নাটকের টীকাকার ঢুণ্ডিরাজের মতে চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন নন্দরাজ সর্বার্থসিদ্ধি ও তার শূদ্র স্ত্রী মুরার পৌত্র এবং জনৈক মৌর্যের পুত্র। বিষ্ণুপুরাণের একজন টীকাকার চন্দ্রগুপ্তের পিতামহীকে নয়, মাকেই মুরা নামে অভিহিত করেছেন। তার পিতামহী বা মার নাম থেকে চন্দ্রগুপ্তের বংশের নাম মৌর্য হয়েছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। জৈনগ্রন্থ পরিশিষ্টপর্বনে চন্দ্রগুপ্তের মাতামহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ময়ুর প্রতিপালন তার পেশা ছিল। এর থেকে অনেকে অনুমান করেছেন, মুরা হতে নয়, ময়ূর থেকেই চন্দ্রগুপ্তের বংশের নাম মৌর্য হয়েছে। মৌর্য নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ব্যখ্যা দু’টির কোনওটিকেই সন্তোষজনক বলা যায় না। মহাবংসে চন্দ্রগুপ্তকে মােরিয় বা মৌর্য গােষ্ঠীভুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাপরিনির্বাণ সূত্র থেকে জানা যায়, বুদ্ধের সময় মােরিয় বা মৌর্যরা উত্তরপ্রদেশের পিপ্পলীবন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। মনে হয়, গােষ্ঠীর নাম থেকেই চন্দ্রগুপ্তের বংশের মৌর্য নামকরণ হয়েছে।

মৌর্যদের জাতি-পরিচয় : মৌর্যদের জাত-পাত সম্পর্কেও এক একটি প্রাচীন গ্রন্থ এক এক রকম তথ্য পরিবেশন করছে। মহাবংস, দিব্যাবদান প্রভৃতি গ্রন্থে মৌর্যবংশীয় রাজাদের ক্ষত্রিয় আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুদ্রারাক্ষসে চন্দ্রগুপ্তকে ‘বৃষল’ অর্থাৎ শূদ্র এবং ‘কুলহীন’ বা হরিজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রিক ঐতিহাসিক জাস্টিন চন্দ্রগুপ্তকে নীচকুলােদ্ভব বলেছেন। পিপ্পলীবনের মৌর্যরা কিন্তু জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন। সে কারণে চন্দ্রগুপ্ত ও তার বংশধরদের ক্ষত্রিয় বলেই গণ্য করা উচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে পিপ্পলীবনের মৌর্যদের যে গৌরব ছিল, চন্দ্রগুপ্তের জন্মের বহু পূর্বেই তা লােপ পেয়েছিল। রাজ্য হারিয়ে তারা বিন্ধ্যাঞ্চলে চলে আসেন এবং পশুপালন, বিশেষত ময়ূর প্রতিপালন ও শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এরূপ এক পশুপালকের গৃহে চন্দ্রগুপ্তের জন্ম। তার মাতামহ যে পশুপালক ছিলেন, তার স্পষ্ট উল্লেখ তাে পরিশিষ্টপর্বনে রয়েছে। মৌর্যদের অবস্থান্তর ঘটায় তাদের জাত-পাত সম্পর্কে সমাজে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে তারই অভিব্যক্তি দেখা যায়। মৌর্যরা যে ক্ষত্রিয় ছিলেন সিংহলীয় এক সূত্রেও তার পরােক্ষ সমর্থন আছে। (S. Chattopadhyava. Burnbisdra To Asoka (Calcutta, 1977), পৃষ্ঠা ৭৯)।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২২ – ২৯৮ খ্রি.পূ.)

রাজ্য-জয়ের পূর্বে চন্দ্রগুপ্ত

নন্দ রাজবংশের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের সম্পর্ক (?) : মৌর্যদের সঙ্গে পাটলিপুত্রের পূর্বর্তন নন্দ রাজপরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল বলে কয়েকখানি প্রাচীন গ্রন্থে মন্তব্য করা হয়েছে। বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস নাটকে চন্দ্রগুপ্তকে ‘নন্দান্বয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সােমদেবের কথাসরিৎসাগর ও ক্ষেমেন্দ্রের বৃহৎকথামঞ্জরীতে তাকে পূর্বনন্দের পুত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। ঢুণ্ডিরাজের মতে চন্দ্রগুপ্তের পিতামহ সর্বার্থসিদ্ধি নন্দবংশের এক রাজা ছিলেন। যেসব গ্রন্থে নন্দদের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের আত্মীয়তার কথা বলা হয়েছে সেগুলো অনেক পরবর্তিকালের রচনা। ঢুণ্ডিরাজের আবির্ভাবকাল তাে খ্রিস্টীয় ১৮শ শতক। চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কে এসব গ্রন্থ বা লেখকের সাক্ষ্য নির্ভরশীল নয়। তাই চন্দ্রগুপ্তকে নন্দবংশজ ভাবার কোনও যৌক্তিকতা নেই।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বাল্যজীবন : চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা নানা কাহিনি ছড়ানাে আছে দেশি-বিদেশি লেখকদের বিবরণীতে। কথিত আছে, তার জন্মের পূর্বেই তার পিতা মারা যান। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে তার মা পাটলিপুত্রে চলে আসেন। সেখানেই তার জন্ম হয়। অশেষ দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে তার বাল্যজীবন অতিবাহিত হয়। এই সময় তিনি চাণক্য নামে এক কাশ্মীরি ব্রাহ্মণের নজরে পড়ে যান। শােনা যায়, নন্দরাজ তাকে অপমান করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের সাহায্যে নন্দবংশ ধ্বংস করবেন সংকল্প করে তিনি এক হাজার কার্ষাপণ মুদ্রার বিনিময়ে তাকে ক্রয় করেন। বালক চন্দ্রগুপ্তকে নিজের বাসস্থান তক্ষশিলায় নিয়ে গিয়ে তাকে নানা শাস্ত্র ও অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত করে তােলেন। জাস্টিনের বিবরণ থেকে জানা যায়, চন্দ্রগুপ্ত একবার ম্যাসিডােনরাজ আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করেন। আলেকজান্ডার তখন পাঞ্জাবে। জাস্টিন বলেন, চন্দ্রগুপ্তের ঔদ্ধত্যে ক্রুদ্ধ হয়ে আলেকজান্ডার তাকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কৌশলে পালিয়ে এসে চন্দ্রগুপ্ত কোনওক্রমে নিজের জীবন রক্ষা করেন। উল্লেখ্য, চন্দ্রগুপ্তের ঔদ্ধত্যে যিনি কুপিত হয়েছিলেন জাস্টিনের বিবরণে তাকে Alexandrum অর্থাৎ আলেকজান্ডার বলা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, মূল বিবরণে Nandrum অর্থাৎ নন্দরাজের কথা বলা হয়েছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী শেষের পাঠ গ্রহণ করেননি (Political History Of Ancient India, পৃষ্ঠা ২৬৫)। এসব কাহিনিতে নিঃসন্দেহে অল্পবিস্তর কল্পনার সংমিশ্রণ ঘটেছে। তবে চন্দ্রগুপ্তকে যে বাল্যজীবনে নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছিল সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। সে যা হােক না কেন, দীন-হীন পরিবারে জন্ম হলেও ভাগ্য যার সহায়, সাফল্য তার অবশ্যম্ভাবী। একদা ভাগ্যবিড়ম্বিত এক বালক কালক্রমে আত্মপ্রকাশ করল অখিল ভারতের রাজচক্রবর্তী রূপে। চন্দ্রগুপ্তের এই বিস্ময়কর অভ্যুত্থানের কাহিনি অনেকটাই আমাদের অজানা। যেটুকু-বা জানা, তা বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন। 

অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ : সন্দেহ নেই, ভারতের তৎকালীন পরিস্থিতি চন্দ্রগুপ্তের অভ্যুত্থানের অনুকূল ছিল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল তখন ম্যাসিডােনীয়দের অধীন কিন্তু আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ ও অন্তর্দ্বন্দ্বে ম্যাসিডােনীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধুপ্রদেশের শাসনকর্তা ফিলিপ্পাস নিহত হন। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের অকাল মৃত্যুতে ম্যাসিডােনীয়শক্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশ্য ম্যাসিডােনীয়দের মিত্র রাজা পুরু তখনও জীবিত। কিন্তু ৩১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছু পূর্বে গ্রিক সেনাপতি ইউডিমাসের হাতে তিনি মারা যান। ফলে ভারতে ম্যাসিডােনীয় শক্তির শেষ স্তম্ভটিও ধসে পড়ে। উত্তর ও পূর্ব ভারতে নন্দ রাজশক্তিও তখন দুর্বল। মহাপদ্মের সামরিক নৈপুণ্য বা প্রশাসনিক দক্ষতা তার উত্তরসূরীদের ছিল না। উপরন্তু তাদের স্বেচ্ছাচার ও অর্থগৃধুতায় সাধারণ লােকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।  ম্যাসিডােনীয় শক্তির দুর্বলতা এবং নন্দ রাজাদের অক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করলেন চন্দ্রগুপ্ত।  

সৈন্য ও মিত্র সংগ্রহ : রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষীর প্রধান সহায় তার বিশ্বস্ত সৈন্যবাহিনী, তাই চন্দ্রগুপ্ত সৈন্যসংগ্রহে মনােনিবেশ করেন। শক, যবন, কিরাত, কম্বােজ, পারসিক, বাহ্লিক প্রভৃতি জাতি-উপজাতি সমন্বয়ে তার সৈন্যবাহিনী গঠিত হয়। যৌধেয়, অর্জুনায়ন ইত্যাদি শস্ত্রোপজীবী উপজাতির লােকেরাও তার সৈন্যদলে যােগদান করেন। হিমালয়ের পার্বত্য তাঞ্চলের রাজা পর্বতকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন। গ্রিক ঐতিহাসিক প্লুটার্কের মতে চন্দ্রগুপ্তের অধীনে ৬ লক্ষ সৈন্য ছিল।

চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য-জয় ও রাজ্য-বিস্তার

তদকালীন মেসিডোনীয় শাসনে উত্তর-পশ্চিম ভারতের অবস্থা : বিচক্ষণ আলেকজান্ডার ভারত ত্যাগের পূর্বে অধিকৃত ভূখণ্ডের রক্ষণাবেক্ষণ ও সুশাসনের সব আয়ােজনই সম্পন্ন করে যান। ভারতের যে সমস্ত অঞ্চল আলেকজান্ডারের অধিকারভুক্ত হয়েছিল সেসব অঞ্চলে তিনি সুনির্দিষ্ট শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রের আমূল পরিবর্তন করেন। পারস্য প্রভাব অনুযায়ী প্রশাসনিক স্বার্থে আলেকজান্ডার তার অধিভুক্ত অঞ্চল সাতটি প্রদেশ বা সত্রপিতে বিভক্ত করেন। এগুলাের পাঁচটি ছিল সরাসরি ভারতীয় অঞ্চল আর বাকি দু’টি ছিল কাবুল উপত্যকায় সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলাে গঠিত হয়েছিল হিন্দুকুশ পর্বত ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাজ্যগুলােকে নিয়ে। প্রথম দিকে টাইরিসপিস ও নিকানাের যথাক্রমে উচ্চ ও নিম্ন কাবুল উপত্যকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। কিন্তু পরে আলেকজান্ডারের শ্বশুর অক্সারটিসকে উচ্চ কাবুল উপত্যকার শাসনভার দেওয়া হয়। পাইথন ও ফিলিপপাস যথাক্রমে সিন্ধু ও দক্ষিণ পাঞ্জাবের শাসনকর্তা হন। আলেকজান্ডারের সহযােগিতা করার পুরস্কারস্বরূপ তক্ষশীলার রাজা আম্ভিকে ঝিলাম (বিতস্তা) ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। ঝিলাম ও বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন রাজা পুরু। অম্ভি যেমন বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বার্থপরতার পুরস্কার পেয়েছিলেন পুরু তেমনি দেশপ্রেম ও বীরত্বের পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার এই রাজ্যের সঙ্গে পনেরোটি প্রজাতন্ত্রশাসিত এলাকা যুক্ত হয়। অভিসারের রাজাকে অভিসার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়, এগুলোর মধ্যে কাশ্মীর অঞ্চল, আরসাকেস (হাজারা অঞ্চল ছিল)। নবগঠিত এ সমস্ত প্রদেশের নিরাপত্তার জন্য আলেকজান্ডার কিছু গ্রিক সৈন্য রেখে গিয়েছিলেন। তবে এই গ্রিক প্রদেশগুলাে দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই গ্রিক শাসনকর্তারা নিজেদের শাসন অঞ্চল ছেড়ে পশ্চিম দিকে চলে যান। ফলে দেশীয় শাসকরা নিজ নিজ অঞ্চলে স্বাধীন হয়ে যেতে থাকেন। নিজ সাম্রাজ্যের সুরক্ষার সব ব্যবস্থাই আলেকজান্ডার গ্রহণ করেছিলেন তবু তার ভারতে অবস্থানকালেই সাম্রাজ্যের নানা স্থানে গােলযােগ দেখা দেয়। তিনি যখন পাঞ্জাবে, তখন নিম্ন কাবুল উপত্যকায় এক বিদ্রোহের ফলে শাসনকর্তা নিকানাের নিহত হন। বিদ্রোহ দমন করা হয় ও ফিলিপ সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ পাঞ্জাবের শাসনকর্তা ফিলিপ্পাস নিহত হন। ইউডিমাস তার স্থলাভিষিক্ত হন। ইউডিমাসের সঙ্গে পুরুর সম্ভাব ছিল না। তারই ষড়যন্ত্রে পুরু নিহত হন। ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছু পরে সিন্ধুর শাসনকর্তা পাইথন নিম্ন কাবুল উপত্যকায় বদলি হন। সম্ভবত এই সময় সিন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করে। ম্যাসিডােনীয় শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ৩১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইউডিমাস ও পাইথন সদলে ভারত ত্যাগ করে পশ্চিম এশিয়ায় যাত্রা করেন। সেখানে তারা উভয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। এদের পরিবর্তে অন্য কাউকে ভারতে পাঠানাে হয়নি।

রাজ্য জয় : উত্তর-পশ্চিম ভারতের ম্যাসিডােনীয় শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ, না উত্তর ও পূর্ব ভারতের নন্দ রাজাদের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে চন্দ্রগুপ্তের সমরাভিযান শুরু হয়, তা এক বিতর্কিত বিষয়। আসলে দু’টি মতের সপক্ষেই কিছু যুক্তি আছে। যাদের সাহায্যে চন্দ্রগুপ্ত রাজপদ লাভ করেছিলেন সেই শক, যবন, কিরাত, আর্জুনায়ন প্রভৃতি উপজাতিরা ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। পর্বতক নামে যে রাজা তাকে সাহায্য করেছিলেন তিনি পুরু নন ঠিকই, কিন্তু তিনি নেপাল বা পূর্বাঞ্চলের কোনও রাজাও নন (পর্বতক নামে কোনও রাজা নেপালে রাজত্ব করেছিলেন বলে জানা যায় না। )। তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের এক পার্বত্য অঞ্চলের অধিপতি। এর থেকে মনে হয়, চন্দ্রগুপ্ত প্রথমে উত্তর-পশ্চিম ভারতেই তার সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডােনীয়দের হটিয়ে নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায় এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তখনও ম্যাসিডােনীয়রা রাজত্ব করছিলেন। সেক্ষেত্রে ৩১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাঞ্জাব জয় করার পরই তিনি সম্ভবত নন্দদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আবার ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ চন্দ্রগুপ্তের পক্ষে নন্দ শাসন উচ্ছেদ করে পাটলিপুত্রের সিংহাসন অধিকার করাও অসম্ভব নয়। পুরাণে নন্দ রাজাদের বর্ণনার পরই চন্দ্রগুপ্তের কথা বলা হয়েছে। এ কথাও স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে তিনি ২৪ বছর রাজত্ব করেছিলেন। অর্থাৎ পুরাণে যে রাজনৈতিক ছবি প্রতিফলিত হয়েছে তা পাটলিপুত্ৰ তথা মগধের। আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্তের রাজত্ব শেষ হয় বলে প্রায় সকল ঐতিহাসিক স্বীকার করেছেন। তাহলে ধরে নিতে হয়, ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত পাটলিপুত্র অধিকার করেছিলেন। 

চন্দ্রগুপ্ত প্রথম মগধ অধিকার করেন, না নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা জয় করেন, এই বিতর্কের নিষ্পত্তি করতে পারে এমন কোনও তথ্য এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় জাস্টিনের একটি উক্তির প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত করেছেন, চন্দ্রগুপ্ত নন্দ রাজাদের উচ্ছেদ করার পর ম্যাসিডােনীয়দের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন (H.C. Raychaudhuri, Political History Of Ancient India : Commentary, পৃ. ৫৯২)। তার অভিমত, ৩১৭-১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক শাসনভুক্ত অঞ্চল চন্দ্রগুপ্তের অধিকারভুক্ত হয়। অধ্যাপক মুখােপাধ্যায়ের এই অভিমত প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা প্রয়ােজন।

  • প্রথমত, জাস্টিনের যে উত্তির ওপর এই অভিমত প্রতিষ্ঠিত, সেই উক্তিটি হলো : “চন্দ্রগুপ্ত ভাড়াটে সৈন্য সংগ্রহ করে… ভারতীয়গণকে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্ররােচিত করেন… অতঃপর তিনি আলেকজান্ডার-কর্তৃক নিযুক্ত প্রশাসকদের আক্রমণকল্পে সচেষ্ট হন।” লক্ষ করতে হবে, জাস্টিনের সম্পূর্ণ উক্তি এখানে উদ্ধৃত করা হয়নি, কিছু অংশ বাদ পড়েছে। সংশ্লিষ্ট উক্তির পুরােটা উদ্ধৃত হলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হত।
  • দ্বিতীয়ত, জাস্টিন ‘বর্তমান সরকার’-এর (existing government—লক্ষণীয়, কথাটি এক বচনে ব্যবহৃত) কথা বলেছেন, নন্দরাষ্ট্রের বা নন্দদের কথা বলেননি।
  • তৃতীয়ত, চন্দ্রগুপ্ত ভাড়াটে সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং ভারতীয়দের যুদ্ধের জন্য প্ররােচিত করেন, এই কথা দু’টি সঙ্গতিহীন ও বিপরীতধর্মী। যদি ধরে নেওয়া হয়, চন্দ্রগুপ্ত ভারতীয়গণকে তদানীন্তন রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্ররােচিত করেন, তাহলে তাে তার অভিযান গণ-আন্দোলনের রূপ নেবে, কিন্তু তাই কি ঘটেছিল? অর্থাৎ, জাস্টিনের প্রাসঙ্গিক বিবরণের সত্যতা সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়।
  • চতুর্থত, চন্দ্রগুপ্ত ৩১৭-১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক অধিকৃত অঞ্চল অধিগ্রহণ করেন, এ ধারণা ঠিক নয়। আলেকজান্ডারের ভারতে অবস্থানকালেই গ্রিক-অধিকৃত অঞ্চলে গােলযােগ দেখা দেয়। ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর সিন্ধু অঞ্চলে গ্রিক আধিপত্য বজায় ছিল, এ কথা সুনিশ্চিতরূপে বলা যায় না। সন্দেহ নেই, ৩১৭ বা ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাইথন ভারত ত্যাগ করেন। কিন্তু তিনি তখন আর সিন্ধুর প্রশাসক ছিলেন না, ছিলেন নিম্ন কাবুল অববাহিকার অধিনায়ক। বস্তুত ম্যাসিডােনিয়দের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এ যুদ্ধ বছরখানেক স্থায়ী হয়, এমন ধারণা যথার্থ বােধ হয় না।
  • পঞ্চমত, অধ্যাপক মুখােপাধ্যায় (তদেব, পৃষ্ঠা ২১৫) নিজেই স্বীকার করেছেন, চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের কালানুক্রম সুনির্দিষ্টরূপে নিরূপণ করা যায় না।

এসব কারণে বলা যায়, সন্দেহের নিরসন ঘটাতে পারে, এমন তথ্য আবিষ্কৃত না হলে এ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে যাবে না। সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত, ভারতের পশ্চিমাঞ্চল হতে নয়, নেপাল হতেই চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যজয়ের সূচনা হয় (S. Chattopadhyaya, Bimbisara to Asoka (Calcutta, 1977), পৃষ্ঠা ৯৮)। চন্দ্রগুপ্তের মিত্র পর্বতকে তিনি নেপালাধীশ বলেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এ মত আপাতবিরােধিতার উর্ধ্বে নয়। তার ধারণা, চন্দ্রগুপ্তের অভ্যুত্থানের পেছনে মৌর্য-নেপাল মৈত্রীর এক বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বলেন, চন্দ্রগুপ্ত উত্তর সীমান্ত দিয়ে নেপাল অভিযান শুরু করেন। অর্থাৎ নেপাল অভিযান দিয়েই তার রাজ্যজয়ের সূচনা হয়। যে রাষ্ট্রের সঙ্গে তার মৈত্রীর সম্পর্ক, সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চন্দ্রগুপ্ত কেন অস্ত্রধারণ করবেন, তা বােধগম্য নয়।

ম্যাসিডােনীয়দের বিরুদ্ধে জয় : ম্যাসিডােনীয়দের বিরুদ্ধে চন্দ্রগুপ্তের অভিযান অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। ম্যাসিডােনীয়দের বিরুদ্ধে তার প্রথম সাফল্য আসে নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায়। পাঞ্জাবে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় আরও কিছু পরে। ৩১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ওই অঞ্চলের গ্রিক শাসনকর্তা ইউডিমাস ভারত ত্যাগ করেন। তখনই চন্দ্রগুপ্ত পাঞ্জাবে তার প্রভুত্ব বিস্তার করেন। প্রচুর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যে চন্দ্রগুপ্ত ভারতে ম্যাসিডােনীয় শাসনের অবসান ঘটান, তা গ্রিক ঐতিহাসিক জাস্টিন স্বীকার করে গেছেন।

মগধ অধিকার : নন্দরাজকে পরাজিত করতে চন্দ্রগুপ্তকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। মহাবংশটীকা ও পরিশিষ্টপর্বন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নন্দরাজের বিরুদ্ধে তার প্রাথমিক অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। ভ্রান্ত রণনীতি অনুসরণ করেছিলেন বলেই তাকে ব্যর্থ হতে হয়। প্রত্যন্ত জনপদ নিজের দখলে না এনে তিনি তড়িঘড়ি করে শত্রুর রাজধানী আক্রমণের পরিকল্পনা করেন কিন্তু নন্দসৈন্যের তাড়া খেয়ে তাকে পিছু হটতে হয়। শেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরে প্রত্যন্ত অঞ্চল জয় করতে করতে তিনি সসৈন্যে পাটলিপুত্রের দিকে অগ্রসর হন এবং নন্দরাজ ধননন্দকে পরাজিত করেন। মহাবংশটীকার মতে চন্দ্রগুপ্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ধননন্দ নিহত হন। কিন্তু পরিশিষ্টপর্বনে বলা হয়েছে, চন্দ্রগুপ্তের মার্জনাক্রমে ধননন্দের প্রাণ রক্ষা পায়। পুরাণ, অর্থশাস্ত্র, মুদ্রারাক্ষস প্রভৃতি গ্রন্থে নন্দরাজের বিরুদ্ধে জয়ে চাণক্য বা কৌটিল্যের ভূমিকাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। চন্দ্রগুপ্ত যেন সেখানে চাণক্যের হাতের পুতুল। চাণক্য বা কৌটিল্য যে ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন, সে সম্পর্কে সন্দেহের তাবকাশ নেই। কী। বৌদ্ধ, কী ব্রাহ্মণ্য বা জৈন, সকল সূত্রেই (পুরাণ, মুদ্রারাক্ষস, মহাবংস, পরিশিষ্টপর্বন, আবশ্যকসূত্র প্রভৃতি গ্রন্থে) চন্দ্রগুপ্তের সহযােগিরূপে চাণক্য বা কৌটিল্যের এবং নন্দ রাজবংশের পতনে তার ভূমিকার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। কোনও গ্রিক বৃত্তান্তে অবশ্য চাণক্যের উল্লেখ নেই। বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য ও জৈন গ্রন্থাদির সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, চন্দ্রগুপ্তের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পেছনে চাণক্যের অনেকখানি হাত ছিল। তবে চাণক্য যে চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী ছিলেন, সেকথা জোরের সঙ্গে বলা যায় না।

রাজ্যের বিস্তার :

  • পাকিস্তান, কাশ্মীর এবং গাঙ্গেয় অববাহিকা : ম্যাসিডােনীয় শাসককুল ও নন্দদের পরাজয়ের ফলে বেলুচিস্তান বাদে প্রায় সমগ্র পাকিস্তান ও কাশ্মীর এবং গাঙ্গেয় অববাহিকা চন্দ্রগুপ্তের অধিকারে চলে আসে। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য আরও বিস্তৃত ছিল।
  • তামিলনাড়ু : কয়েকখানি প্রাচীন তামিলগ্রন্থে বম্ব মােরিয়র বা ভুঁইফোড় মৌর্যদের দক্ষিণ ভারত অভিযানের কথা বলা হয়েছে। অনেকে এই ভুঁইফোড় মৌর্যদের চন্দ্রগুপ্ত ও তার বিজয়ী সেনাদল বলে সনাক্ত করেছেন। কোঙ্কণ থেকে যুদ্ধযাত্রা করে ক্যান্নানাের-কোয়েম্বাটুরের পথ ধরে এই বিজয়ী সেনাদল তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলী জেলার পদিয়িল পাহাড় বা মলয় পর্বত পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। তবে এই কাহিনির মূলে ঐতিহাসিক সত্য আছে বলে মনে হয় না। তামিলভাষী অঞ্চল যে মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, অশােকের লেখমালার সাক্ষ্যে তা স্পষ্ট।
  • কর্ণাটক : কিন্তু কর্ণাটকের ক্ষেত্রে সেকথা খাটে না। সেখানকার মধ্যযুগীয় কিছু লেখ থেকে জানা যায় যে ওই অঞ্চলে চন্দ্রগুপ্তের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তার জীবনের শেষ দিনগুলো হয়তাে শ্রবণবেলগােলাতেই অতিবাহিত হয়েছিল। কর্ণাটকের চিত্রদুর্গ জেলার সিদ্দাপুর, ব্রহ্মগিরি ও জটিঙ্গ রামেশ্বরে অশােকের লেখমালা আবিষ্কৃত হয়েছে। কর্ণাটকের আরও কয়েকটি স্থানে অশােকের অভিলেখ পাওয়া গেছে। স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে বেল্লারি জেলার নিট্টুর ও উডেগােলাম, রায়চুর জেলার গবীমঠ, পালকীগুণ্ডু ও মাসকি এবং গুলবর্গা জেলার সন্নতি। অশােক বা তার পিতা বিন্দুসার এ অঞ্চল জয় করেননি। সুদূর কর্ণাটকে মৌর্যরাজ্য বিস্তার নিঃসন্দেহে চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্ব।
  • অন্ধ্রপ্রদেশ : অন্ধ্রপ্রদেশ অবশ্যই চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। কুর্ণুল জেলার এড়ড়াগুডি এবং রাজুল-মণ্ডগিরিতে অশােকের অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। গুন্টুর জেলার অমরাবতীতে যে খণ্ডিত স্তম্ভলেখের সন্ধান পাওয়া গেছে সেটিও সম্ভবত অশােকই উৎকীর্ণ করেছেন।
  • মহারাষ্ট্র : মহারাষ্ট্রও চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। থানা জেলার সােপারায় অশােকের লেখমালা আবিষ্কৃত হয়েছে। মহাক্ষত্ৰপ রুদ্রদামার জুনাগড় শিলালেখ থেকে জানা যায়, পশ্চিম ভারতের গুজরাত অঞ্চল চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যভুক্ত ছিল। সেখানকার প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন পুষ্যগুপ্ত নামে জনৈক বৈশ্য।
  • কলিঙ্গ বা ওড়িশা : চন্দ্রগুপ্ত কলিঙ্গ বা ওড়িশা অধিকার করেছিলেন কিনা সন্দেহ আছে। তার সঙ্গে নন্দরাজের বিরােধের সুযােগ গ্রহণ করে ওড়িশা হয়তাে এক স্বাধীন রাজ্যরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সম্ভবত বেলুচিস্তান, কেরল, তামিলনাড়ু ও অবিভক্ত অসম বাদে সারা ভারত জুড়ে চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য বিস্তৃত ছিল।
  • আফগানিস্তান : পরবর্তিকালে সেলুকাসের বিরুদ্ধে জয়লাভের ফলে তার রাজ্য পশ্চিমে ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত প্রসারিত হয়। চন্দ্রগুপ্ত সমগ্র ভারত জয় করেছেন বলে প্লুটার্ক মন্তব্য করেছেন। জাস্টিনও প্রায় একই কথা বলেছেন। এদের দুজনের বক্তব্যে অতিশয়ােক্তি থাকলেও চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যের বিশালতার স্বীকৃতি আছে। 

সেলুসিড-মৌর্য যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫-৩০৩ অব্দ) এবং শান্তিচুক্তির মাধ্যমে এদের মৈত্রীজোট

সেলুসিড-মৌর্য যুদ্ধ ৩০৫ থেকে ৩০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এটি শুরু হয়েছিল যখন সেলুসিড সাম্রাজ্যের প্রথম সেলুকার নিকাটর (Seleucus I Nicator) (রা. ৩০৫-২৮১ খ্রি.পূ.) মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (রা. ৩২৪/৩২১-২৯৭ খ্রি.পূ.) দ্বারা দখল করা মেসিডোনিয়ান সাম্রাজ্যের ভারতীয় সত্রপিগুলো পুনরায় গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধটি সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চল এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশ মৌর্য সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্তির ফলে একটি মীমাংসায় শেষ হয়, চন্দ্রগুপ্ত তার চাওয়া অঞ্চলগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত করেন এবং দুই শক্তির মধ্যে বিবাহভিত্তিক জোট রচিত হয়। যুদ্ধের পর মৌর্য সাম্রাজ্য ভারতীয় উপমহাদেশের প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং সেলুসিড সাম্রাজ্য পশ্চিমে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করার দিকে মনোনিবেশ করে।

পটভূমি : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ নাগাদ মগধের শাসক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি সেই সময়ের গাঙ্গেয় সমভূমি শাসন করা নন্দ রাজবংশের শাসকদের জয় করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সফল গেরিলা অভিযানের সাথে এগারো বছর ধরে সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং পাটলিপুত্রনন্দ রাজধানী দখল করেন। এর ফলে নন্দ সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অধীনে শেষ পর্যন্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। আধুনিক আফগানিস্তানে অবস্থিত পারস্য প্রদেশগুলো, সাথে গান্ধার এবং সিন্ধু উপত্যকার ধনী রাজ্যগুলোর সবকটিই সম্রাট আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিল, এবং তার সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে গিয়েছিল। আলেকজান্ডার মারা গেলে ডায়াডোকির যুদ্ধের (ডায়াডোকির অর্থ উত্তরসূরি) মাধ্যমে তার সাম্রাজ্যকে বিভক্ত হয়ে যায়, তার সেনাপতিরা আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করেছিলেন। পূর্বাঞ্চলে এই সেনাপতিদের মধ্যে একজন ছিলেন প্রথম সেলুকাস নিকাটর, যিনি এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে সেলুসিড সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছিলেন। রোমান ইতিহাসবিদ অ্যাপিয়ানের (Appian) মতে, “সর্বদা প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ওঁত পেতে থাকা, সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী এবং কাউন্সিলে প্ররোচনামূলক সেলুকাস মেসোপোটেমিয়া, আর্মেনিয়া, ‘সেলুসিড’ ক্যাপাডোকিয়া, পারসিস, পার্থিয়া, ব্যাকট্রিয়া, আরব, তাপোরিয়া, সোগদিয়া, আরাকোসিয়া, হিরকানিয়া এবং অন্যান্য সংলগ্ন অঞ্চল শাসন করেন, যেখানকার জনগোষ্ঠী পূর্বে আলেকজান্ডার কর্তৃক বশীভূত হয়েছিল। তাই সাম্রাজ্যের সীমা সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যার ফলে আলেকজান্ডারের পরে তার সাম্রাজ্যই এশিয়ায় সর্বাধিক পরিমাণে বিস্তৃত ছিল, ফ্রিজিয়া থেকে সিন্ধু পর্যন্ত পুরো অঞ্চলটি ছিল সেলুকাসের অধীন।” — অ্যাপিয়ান, রোমের ইতিহাস, সিরিয়ান যুদ্ধ ৫৫। আলেকজান্ডার তার অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণের জন্য সত্রপ নিয়োগ করেছিলেন। একইভাবে সিন্ধু উপত্যকা পরিচালনার জন্য সত্রপ নিয়োগ করা হয়েছিল। এদিকে পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থাপনের পর চন্দ্রগুপ্ত সিন্ধুর দিকে পুনরায় মনোনিবেশ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩১৭ সালের মধ্যে তিনি আলেকজান্ডারের অবশিষ্ট গ্রিক সত্রপিগুলো জয় করেন। মৌর্যরা এই ধরনের চারটি সত্রপ দ্বারা পরিচালিত অঞ্চলগুলি দখল করেছিল : নিকানর, ফিলিপ, ইউডেমাস এবং পেইথন। এর ফলে সিন্ধুর তীরে মৌর্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সেনাপতি সেলুকাস প্রাচ্য ভূখণ্ডের আধিপত্য লাভ করেন। প্রথমে ব্যাবিলন ও পরে বর্তমান আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত ব্যাক্ট্রিয়া অধিকার করে ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তিনি সসৈন্যে সিন্ধু নদের তীরে উপনীত হন। এদিকে চন্দ্রগুপ্তের বিজয়গুলোর ফলে সেলুকাস তার সাম্রাজ্যের পূর্ব পার্শ্বটি সুরক্ষিত করতে চাইলেন। সেখানে মেসিডোনিয়ার অঞ্চলগুলি ধরে রাখার অভিপ্রায় থেকে সেলুকাস এভাবে সিন্ধু উপত্যকার উপর উদীয়মান এবং প্রসারিত মৌর্য সাম্রাজ্যের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। কথিত আছে যে চন্দ্রগুপ্ত সম্ভবত ৬,০০,০০০ পুরুষ এবং ৯,০০০ যুদ্ধহস্তির একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী দাঁড় করিয়েছিলেন।

যুদ্ধ : ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এই তারিখ নিতান্তই আনুমানিক। গ্রিক বিবরণ থেকে জানা যায়, এই যুদ্ধ সেলুকাসের ৩০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা উপাধি গ্রহণের পরে কিন্তু ৩০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এন্টিগােনাসের সঙ্গে যুদ্ধের কিছু পূর্বে ঘটেছিল। এটি অজানা যে আসলে একটি পিচড ব্যাটল, অর্থাৎ পূর্ব-পরিকল্পিত যুদ্ধ ছিল কিনা। চন্দ্রগুপ্ত ও সেলুকাসের সংঘর্ষ যে ৩০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছুকাল পূর্বে সংঘটিত হয়, তার প্রমাণ নিহিত আছে জাস্টিনের একটি উক্তিতে। জাস্টিন বলেছেন, চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর সেলুকাস স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে এন্টিগােনাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন (Historiarant Philippicarun Libri, XV, 4)। ভারত অভিযানে এসে সেলুকাস সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে উপনীত হন, না সিন্ধু নদ অতিক্রম করে আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। কিন্তু সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরেই যুদ্ধটি সংঘটিত হওয়ার অধিক সম্ভাবনা। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় (H. C. Raychaudhuri, Political History Of Ancient India: Commentary; পৃষ্ঠা ৫৯৩-৯৪) মনে করেন, সেলুকাসের সঙ্গে যুদ্ধের পূর্বেই সিন্ধু নদের পশ্চিমদিগবর্তী এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড চন্দ্রগুপ্তের অধিকারভুক্ত ছিল; তিনি আরও বলেন, সেলুকাস সিন্ধু নদ অতিক্রম করে চন্দ্রগুপ্তকে আক্রমণ করেন। সেলুকাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবার পূর্বেই চন্দ্রগুপ্ত সিন্ধুনদের পশ্চিমে রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, এরূপ অভিমত প্রমাণসিদ্ধ নয়। সেলুকাস যে সিন্ধু নদ অতিক্রম করেছিলেন, তাও সুনিশ্চিত নয়। অধ্যাপক মুখােপাধ্যায়েরও (তদেব, পৃষ্ঠা ৫৯৪) এ বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল মৌর্য রাজশক্তির উত্থানপর্ব। চন্দ্রগুপ্তও তখন ক্ষমতার শীর্ষে। সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যের মধ্য দিয়ে বীরদর্পে অগ্রসর হবেন, অবলীলায় সিন্ধু নদ অতিক্রম করবেন, আর আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত চন্দ্রগুপ্ত নিশ্চুপ হয়ে অবস্থান করবেন, এ ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়।সামরিক ইতিহাসবিদ জন ডি গ্রেইঙ্গার যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সিন্ধু অতিক্রম করার পর সেলুকাস “নিজেকে একটি ফাঁদে আবিষ্কার করেন, যার পেছনে রয়েছে এক বিশাল নদী, আর সামনে আছে এক প্রতিকূল মহাদেশ রয়েছে”, আর তার ফলে তিনি সিন্ধুর চেয়ে বেশি দূরে যেতে পারতেন না। গ্রেইঙ্গারের মতে, সংঘর্ষের বিবরণটি অস্পষ্ট, তবে ফলাফলটি অবশ্যই “একটি নির্ণায়ক ভারতীয় বিজয়” ছিল, চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসের বাহিনীকে হিন্দুকুশ পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং এর ফলে আধুনিক আফগানিস্তানের একটি বড় অঞ্চল অর্জন করেছিলেন। হুইটলি এবং হেকেলের মতে, যুদ্ধের পরে প্রতিষ্ঠিত বন্ধুত্বপূর্ণ মৌর্য-সেলুসিড সম্পর্কটি নির্দেশ করে যে, এদের শত্রুতা সম্ভবত “দীর্ঘায়িত বা গুরুতর ছিল না”।

ফলাফল : যাই হোক, চন্দ্রগুপ্তের কাছ থেকে গ্রিক রাজ্যের পুনরুদ্ধার ছিল সেলুকাসের উদ্দেশ্য। গ্রিক ঐতিহাসিকেরা চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সেলুকাসের সংঘর্ষের কোনও বিশদ বিবরণ দেননি, হার-জিতের কথাও বলেননি, শুধু উভয় পক্ষের দান-প্রতিদানের কথা বলেছেন। অ্যাপিয়ান বলছেন, সেলুকাস সিন্ধু অতিক্রম করে ভারতীয়দের রাজা সান্দ্রোকোটাস (মৌর্য) (অর্থাৎ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য) এর সাথে যুদ্ধ শুরু করেন, যিনি সেই নদীর তীরে বাস করতেন। একে অপরের সাথে বোঝাপড়ায় আসা অব্দি তারা যুদ্ধ করতে থাকেন, আর বোঝাপড়ার মাধ্যমে তারা একটি বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হন। এসবের মধ্যে কিছু কাজ অ্যান্টিগোনাসের মৃত্যুর আগে এবং কিছু কাজ পরে ঘটেছিল। — অ্যাপিয়ান, রোমের ইতিহাস, সিরিয়ান যুদ্ধ ৫৫। এছাড়াও অন্যদের কথায় ৫০০ রণহস্তীর বিনিময়ে সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে কয়েকটি অঞ্চল প্রদান করার কথা জানা যায়। এই অঞ্চলগুলো হল এরিয়া (হেরাট), এরাকোসিয়া (কান্দাহার) গেড্রোসিয়া (মকরান) ও প্যারােপনিস্যাডি (কাবুল)। অর্থাৎ সেলুকাস নিকাটর হিন্দুকুশ, পাঞ্জাব এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে দিয়েছিলেন। তাদের চুক্তির ফলে, সেলুকাস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের থেকে ৫০০ টি যুদ্ধহস্তি পান, যেগুলো পরবর্তীতে পশ্চিমের ডায়াডোকির যুদ্ধকে প্রভাবিত করে। সেলুকাস এবং চন্দ্রগুপ্তও একটি বিবাহ জোটে সম্মত হন, সম্ভবত চন্দ্রগুপ্তের সাথে সেলুকাসের মেয়ের (ভারতীয় পালি উৎসে বেরিনিস নামে) বিয়ে। স্ট্রাবো বলছেন, “সেলুকাস সিন্ধুর সীমানায় অবস্থিত যে সেলুসিড অঞ্চলগুলো ত্যাগ করেন সেগুলোর ছিল সিন্ধু বরাবর পারোপামিসেডি (Paropamisadae), যার উপরে পারোপামিসাস পর্বত (Paropamisus mountain) রয়েছে, দক্ষিণের দিকে, আরাখোটি (Arachoti), তারপর, দক্ষিণের দিকে সমুদ্রতট দখলকারী অন্যান্য উপজাতিদের অঞ্চল গেডরোসেনি (Gedroseni), এবং এই অঞ্চলগুলোর পাশেই ছিল সিন্ধু নদীর অবস্থান। কোন কোন অঞ্চলে নদীটি ভারতীয়দের অঞ্চলের পাশে ছিল, যদিও এইওঞ্চগুলোতে আগে পারশিয়ানরা থাকত। মেসিডোনের তৃতীয় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই অঞ্চলগুলোকে আর্যদের থেকে কেড়ে নেন এবং এগুলোকে দখল করেন, কিন্তু সেলুকাস নিকাটর এগুলো অন্তর্বিবাহ ও ৫০০ যুদ্ধহস্তির বিনিময়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে দিয়ে দেন।” স্ট্রাবো ১৫.২.৯। কোনও কোনও বিদ্বজ্জন অভিমত প্রকাশ করেছেন, সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের অনুকূলে এরিয়া বা হেরাট হস্তান্তর করেননি। ভিনসেন্ট স্মিথ (Early History Of India (Oxford, 1914) পৃষ্ঠা ১১৯), হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী (political History Of Ancient India (Calcutta, 1953), পৃষ্ঠা ২৭৩) এবং রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় (R. C. Majumdar (Ed.) The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960), পৃষ্ঠা ৬০) – সকলেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় চন্দ্রগুপ্তের আনুকূলে এরিয়া হস্তান্তরের কথা বলেছেন। যাই হোক, সন্ধির শর্ত সেলুকাসের পরাজয় প্রমাণ করে সন্দেহ নেই, নিজেদের পরাজয় গােপন রাখার জন্যই গ্রিক ঐতিহাসিকদের এই সতর্কতা। কতিপয় লেখক দাবি করেছেন যে, সেলুকাস যে আজকের দক্ষিণ আফগানিস্তানের অঞ্চলটি চন্দ্রগুপ্তকে সমর্পণ করেছিলেন তা অতিরঞ্জন। প্লিনি দ্য এল্ডারের রচনা থেকে এই সন্দেহের সৃষ্টি হয়, যেখানে তিনি নির্দিষ্ট করে চন্দ্রগুপ্ত কোন কোন অঞ্চল লাভ করেছিলেন তা লেখেননি, বরং তখনকার ভূগোলবিদগণ “ভারত” এর সংজ্ঞা দেবার ক্ষেত্রে একেক রকম মত প্রদান করার কথা লিখেছিলেন। তিনি লেখেন, “বেশিরভাগ ভূগোলবিদ তখন সিন্ধুকে ভারতের বাউন্ডারি ভাবতেন না, বরং সেইস আথে গেদ্রোস, আরাকোটে, এরিয়া আর পারোপামিসাডি – এই চারটি সত্রপিকেও যুক্ত করতেন, তাই কোফেস নদীই ছিল ভারতের বাউন্ডারি। কিন্তু অন্যান্য লেখকদের মতে, এগুলো ছিল এরিয়া অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত।” প্লিনি, প্রাকৃতিক ইতিহাস, ষষ্ঠ খণ্ড, ২৩। সে যাই হােক, সম্পর্ক নিবিড়তর করার জন্য দু’পক্ষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হল। সাধারণত মনে করা হয়, চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসের কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। এই ধারণা প্রমাণসাপেক্ষ। তবে এক সেলুকিড রাজকন্যার সঙ্গে জনৈক মৌর্য রাজকুমারের বিবাহ বােধহয় অস্বীকার করা যায় না। আপ্পিয়ানের বিবরণে এরূপ বৈবাহিক সম্পর্কেরই (Kedos) ইঙ্গিত আছে। স্ট্র্যাবাের বিবরণ থেকে জানা যায়, আন্তর্বিবাহের (epigamia) বিনিময়ে সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে গেড্রোসিয়া ইত্যাদি কয়েকটি ভূখণ্ড প্রদান করেন। আপ্পিয়ান ও স্ট্র্যাবাের উক্তির প্রেক্ষিতে অনুমিত হয়, সেলুকিড পরিবারের এক তনয়ার সঙ্গে জনৈক মৌর্য রাজপুত্রের পরিণয় অনুষ্ঠিত হয়। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় ঘটনাটি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন (H.C. Raychaudhuri, Political History Of Ancient India : Commentary, পৃষ্ঠা ৫৯৪-৯৫)। তিনি মনে করেন, উল্লিখিত বিবরণে দু’টি রাজপরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে ভারতীয়দের সঙ্গে গ্রিকদের বৈবাহিক সম্পর্কে দুই রাজার স্বীকৃতি দানের কথা। অর্থাৎ এতদিন ধরে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বহিরাগত গ্রিকদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, চন্দ্রগুপ্ত-সেলুকাসের চুক্তিতে তা সরকারি অনুমােদন পেল। তবে বেশ কিছু কারণে তার এই দাবিকে মেনে নেয়া যায়না –

  • প্রথমত, একটু খেয়াল করলেই বােঝা যাবে, অধ্যাপক মুখােপাধ্যায় স্বমতের সমর্থনে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন (Contracted connection by marriage), তাতে কিন্তু উভয়পক্ষে, অর্থাৎ, সেলুকিড ও মৌর্য রাজপরিবারে, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কথাই আভাসিত হয়।
  • দ্বিতীয়ত, উভয় পক্ষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত না হলে আন্তর্বিবাহর (epigamia) বিনিময়ে সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তকে কয়েকটি অঞ্চল প্রদান করেন বলে স্ট্র্যাবো যে উক্তি করেছেন, তা অর্থহীন মনে হয়।
  • তৃতীয়ত, কোনও এক স্থানে দুটি ভিন্ন গােষ্ঠী দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করলে তাদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, এটি একটি সহজ, অবশ্যম্ভাবী সামাজিক প্রক্রিয়া। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকে না, থাকা বাঞ্ছনীয়ও নয়। গ্রিক ও ভারতীয় দু’জন রাজা তাদের স্বজাতির মধ্যে আন্তর্বিবাহের বৈধতা স্বীকার করে সরকারি নির্দেশ জারি করেছেন, এ ধরনের ঘটনার কোনও নজির নেই।

যুদ্ধের পরবর্তী সেলুসিড-মৌর্য সীমান্তে স্থিতিশীলতা ও সুসম্পর্ক : উপরের বর্ণনা থেকে মনে হচ্ছে সেলুকাস আরাকোসিয়া, গেড্রোসিয়া, পারোপামিসেডি প্রদেশগুলোকে এবং সম্ভবত আরিয়া প্রদেশকে, অর্থাৎ আলেকজান্ডার কর্তৃক বিজিত সবচেয়ে পূর্বতম প্রদেশগুলি সমর্পণ করেন। অন্যদিকে সেলুকাস তার সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর অন্যান্য সত্রপরা সেগুলো গ্রহণ করে। তার ইরানীয় স্ত্রী আপামা হয়তো তাকে ব্যাকট্রিয়া এবং সোগদিয়ানায় তার শাসন বাস্তবায়নে সহায়তা করেছিলেন। স্ট্রাবোর উক্তিটি প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেও সমর্থিত, কেননা সেই অঞ্চলগুলোতে মৌর্য প্রভাবের দৃঢ় ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যেমন অশোকের এডিক্সটগুলির শিলালিপি আজকের দক্ষিণ আফগানিস্তানের গান্ধারে পাওয়া গেছে। এরপর থেকে সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলেন। তিনি এরাকোসিয়ার পদস্থ গ্রিক কর্মচারী মেগাস্থিনিসকে দূতরূপে চন্দ্রগুপ্তের কাছে পাঠান। দীর্ঘদিন পাটলিপুত্রে অবস্থান করে এই গ্রিক দূত ‘ইন্ডিকা’ নামে ভারত সম্পর্কে এক অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। চন্দ্রগুপ্তও প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ সেলুকাসকে কিছু ওষুধ ও উপঢৌকন পাঠান গ্রিক লেখক এথেনিয়াস-এর বিবরণে তার উল্লেখ আছে। (H. C. Raychaudhuri, Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953), পৃষ্ঠা ২৭৩)। এভাবে চন্দ্রগুপ্ত শুধু তার রাজ্যের সীমানাই বাড়ালেন না, ভারত ও গ্রিসের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযােগিতার পথও উন্মুক্ত করেন। সেলুকাস-চন্দ্রগুপ্তের ব্যবস্থাটি পারস্পরিক ক্ষেত্রে উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছিল। পরবর্তী প্রজন্মে সেলুসিড এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের মধ্যে সীমান্তটি স্থিতিশীল ছিল। সেলুকাস মৌর্য সাম্রাজ্যের পাটলিপুত্রের রাজসভায় চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে মেগাস্থেনিস নামে একজন রাষ্ট্রদূত এবং পরে তার পুত্র বিন্দুসারের শাসনামলে দেইমাকোস নামে একজন রাষ্ট্রদূত প্রদান করেন। মেগাস্থেনিস ভারত এবং চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বের বিস্তারিত বিবরণ লিখেছিলেন, যা আংশিকভাবে ডিওডোরাস সিকুলাসের মাধ্যমে আমাদের কাছে সংরক্ষিত হয়েছে। প্লিনি দ্য এল্ডারের মতে পরবর্তীতে মৌর্য সম্রাট অশোক দ্য গ্রেটের সমসাময়িক টলেমিড মিশরের শাসক দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাস মৌর্য রাজসভায় ডিওনিসিয়াস নামে একজন রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেছেন বলে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই গ্রিক রাষ্ট্রদূতগণ এবং চন্দ্রগুপ্তের নাতি অশোক দ্বারা পশ্চিমদিকে প্রেরিত দূতদের দ্বারা একটি বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়। চন্দ্রগুপ্তের যুদ্ধহস্তির উপহার “সেলুকাসের পশুখাদ্য এবং রিটার্ন মার্চের খরচের বোঝা লাঘব করে থাকতে পারে” এবং এর ফলে সেলুকাসও তার বিশাল সেনাবাহিনীর আকার এবং ব্যয় যথাযথভাবে হ্রাস করার সুযোগ পান, কারণ এখন পূর্ব দিকে আর কোন গুরুতর হুমকি নেই। মৌর্যদের কাছ থেকে অর্জিত যুদ্ধহস্তীদের নিয়ে সেলুকাস ইপ্সাসের যুদ্ধে তার মিত্রদের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বী এন্টিগোনাসকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর এন্টিগোনাসের অঞ্চলগুলোর মধ্যে সিরিয়া ও পূর্ব আনাতোলিয়া তার নিজের অঞ্চলে যুক্ত করে, সেলুকাস সেলুসিড সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা ৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যে একটি মহান শক্তি হিসেবে শাসন করে। এদিকে আফগানিস্তানের অঞ্চলটিতে মৌর্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ভারত উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণের থেকে সুরক্ষিত হয়। আর এজন্যই পরবর্তীতে মৌর্য সাম্রাজ্য ভারতে তার শাসনকে দক্ষিণদিকে ডেকানে প্রসারিত করতে যেতে পারেন।

চন্দ্রগুপ্তের শেষজীবন ও মৃত্যু

জৈনগ্রন্থ রাজাবলীকথে চন্দ্রগুপ্তকে জৈনধর্মাবলম্বী বলে বর্ণনা করেছে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে চন্দ্রগুপ্ত পুত্র সিংহসেনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে সংসার ত্যাগ করে গুরু ভদ্রবাহুর সঙ্গে কর্ণাটকের শ্রবণবেলগােলায় চলে যান। কথিত আছে, চন্দ্রগুপ্ত সেখানে জৈনরীতি অনুসারে অনশনে প্রাণত্যাগ করেন। ওই অঞ্চলে চন্দ্রগিরি নামে একটি পাহাড় এবং চন্দ্রগুপ্তবস্তি নামে একটি মন্দির এখনও বিদ্যমান। জনশ্রুতি বলে, ওই পাহাড়ে চন্দ্রগুপ্ত তার শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন, মন্দিরটি তিনিই নির্মাণ করেন। চন্দ্রগুপ্ত ও ভদ্রবাহু যে তাদের জীবনসায়াহ্নের দিনগুলো কর্ণাটকে যাপন করেছিলেন তার পরােক্ষ সমর্থন আছে খ্রিস্টীয় ১০ম শতকের কয়েকখানি লেখে। চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বের শেষভাগে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব, শ্রবণবেলগােলায় তার স্বেচ্ছায় আমৃত্যু অনশন ইত্যাদি যেসব ঘটনা জৈন সাহিত্যে বর্ণিত হয়েছে ভিনসেন্ট স্মিথ (The Oxford History of India, পৃষ্ঠা ৭৬), হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী (তদেব, পৃষ্ঠা ২৯৫) প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা তার সত্যতা স্বীকার করেছেন। চন্দ্রগুপ্ত ২৪ বছর রাজত্ব করেন। সম্ভবত ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যু হয়। যারা রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন, বৃহদায়তন রাজ্য গঠনের সুযােগ তারা বড় একটা পান না। ভারতে মােগল রাজবংশের স্থপতি বাবর এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এর ব্যতিক্রম যারা তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। চন্দ্রগুপ্তের স্থান এই বিরল ব্যতিক্রমদের পুরােভাগে।

মেগাস্থিনিস ও ইন্ডিকা

চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যশাসন সম্পর্কে মেগাস্থিনিস : চন্দ্রগুপ্তের প্রশাসন-ব্যবস্থা ও সমকালীন ভারতীয় জন-জীবনের নানা দিক মেগাস্থিনিস আলােচনা করেছেন তার ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে। কালের কপােলতলে এই গ্রন্থখানি বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু এর বহু উদ্ধৃতি ছড়িয়ে আছে এরিয়ান, প্লুটার্ক, স্ট্র্যাবো, প্লিনি প্রভৃতি পরবর্তী লেখকদের বিবরণে। এসব ছড়ানো-ছিটানাে উদ্ধৃতি থেকে মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’র বিষয়বস্তু সম্পর্কে মােটামুটি একটা ধারণা করা যায়। মেগাস্থিনিস মূলত বিদেশি। তাছাড়া সিন্ধু উপত্যকা ও পাটলিপুত্র ছাড়া ভারতে তিনি খুব যে একটা ভ্রমণ করেছেন, তা মনে হয় না। ফলে সত্য-মিথ্যা নানা তথ্য তার বিবরণে সন্নিবেশিত হয়েছে। সেই প্রাচীন যুগে প্লিনিরাও ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য মেগাস্থিনিসের সমালােচনা করেছেন।

  • কর্মব্যস্ততা : চন্দ্রগুপ্তের প্রশাসনিক ব্যবস্থার উল্লেখ প্রসঙ্গে মেগাস্থিনিস রাজার অপ্রতিহত ক্ষমতার কথা বলেছেন। প্রশাসনিক, সামরিক, বিচার ও আইন-প্রণয়ন সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব রাজা পালন করতেন। সারাদিন তার প্রচণ্ড কাজের চাপ থাকত। দিবানিদ্রার অবকাশ তার ছিল না। বিচার ও সরকারি কাজে তার সারাদিন রাজসভায় কাটত। কেশবিন্যাস ও পােশাক পরার সময়ও রাজকার্য থেকে তার অবসর মিলত না। তখন তিনি দূতদের সঙ্গে দেখা করতেন।
  • পরিদর্শক ও গুপ্তচর : মেগাস্থিনিস বলেন, রাজ্যের কোথায় কী ঘটছে, না ঘটছে, সেদিকে রাজার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। এ কাজে তাকে পরিদর্শক বা গুপ্তচরেরা সাহায্য করতেন। সৈন্যবাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কেও তারা রাজাকে অবহিত রাখতেন। দক্ষ ও বিশ্বস্ত লােকেরাই এ কাজের ভার পেতেন। সংবাদ সংগ্রহের কাজে অনেক সময় গণিকাদের সাহায্য গ্রহণ করা হত।
  • উপদেষ্টা ও নিয়ামকদের পরিষৎ : উপদেষ্টা ও নিয়ামকদের এক পরিষৎ প্রশাসনে রাজাকে সাহায্য করত। আয়তনে ছােটো হলেও এই পরিষদের হাতে প্রচুর ক্ষমতা ছিল। প্রদেশপাল, কোষাধ্যক্ষ, সেনাপতি, নাবাধ্যক্ষ, বিচারক, কষি-আধিকারিক প্রভৃতি পদস্থ কর্মচারীদের নিয়ােগের ভার ছিল এই পরিষদের ওপর।
  • জেলার বেসামরিক প্রশাসনে অ্যাগ্রোনোময় : পদস্থ রাজকর্মচারীদের মধ্যে এ্যাগ্রোনােময় এবং এ্যাস্টিনােময়দের কথা মেগাস্থিনিস বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন। এ্যাগ্রোনােময়রা জেলার বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নদ নদীর তত্ত্বাবধান, সেচের জন্য সংরক্ষিত জলাধার পরিদর্শন, জমি-জরিপ, শিকারিদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তাদের পুরস্কার ও শাস্তিদান, কর আদায়, কাঠুরে-সূত্রধর কর্মকার-খনিশ্রমিকদের তদারকি, রাজপথ পরিদর্শন, পথের ধারে দূরত্বজ্ঞাপক স্তম্ভ স্থাপন ইত্যাদি কাজ তাদের করতে হত।
  • পাটলিপুত্রের পৌর প্রশাসনে এ্যাস্টিনোময় : এ্যাস্টিনােময়’রা ছিলেন পাটলিপুত্রের পৌর প্রশাসনের দায়িত্বে। তারা ৬টি সমিতিতে বিভক্ত ছিলেন। এক একটি সমিতিতে ৫জন করে সদস্য ছিলেন। প্রতিটি সমিতির কর্মপরিধি সুনির্দিষ্ট ছিল। ৬টি সমিতি যথাক্রমে (১) শ্রম (2) বিদেশিদের তত্ত্বাবধান (৩) জন্ম-মৃত্যুর খতিয়ান (4) ব্যবসা-বাণিজ্য, ওজন ও মাপন (৫) শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও বিক্রয়-ব্যবস্থা এবং (৬) দ্রব্যের বিক্রয়লব্ধ অর্থের এক-দশমাংশ কর আদায়ের কাজে নিযুক্ত ছিল। কর যারা ফাকি দিতেন, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। নিজেদের নির্দিষ্ট কাজ ছাড়াও সমিতির সদস্যরা সংঘবদ্ধভাবে সরকারি গৃহাদির সংস্কার, মূল্যনিয়ন্ত্রণ, বাজার, পােতাশ্রয় ও মন্দিরাদির রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি জনসাধারণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখাশােনা করতেন।
  • সামরিক বিভাগ : তৃতীয় এক শ্রেণির পদস্থ কর্মচারীর উল্লেখ করেছেন মেগাস্থিনিস। সামরিক বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই কর্মচারীরা সংখ্যায় ছিলেন ৩০জন। এক এক সমিতিতে ৫জন করে মােট ৬টি সমিতিতে তারা বিভক্ত ছিলেন। এই ৬টি সমিতি যথাক্রমে (১) নৌবহর (২) যােগাযােগ ও সরবরাহ (৩) পদাতিক (৪) অশ্বারােহী (৫) রথবাহিনী ও (৬) হস্তিবাহিনী – এই ৬টি বিভাগ পরিচালনা করতেন।

রাজধানী পাটলিপুত্র ও চন্দ্রগুপ্তের রাজপ্রাসাদ : চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী পাটলিপুত্রকে মেগাস্থিনিস ভারতের বৃহত্তম নগর বলে বর্ণনা করেছেন। গঙ্গা ও শােণ নদীর সঙ্গমস্থলে শহরটি অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কি.মি., প্রস্থ প্রায় আড়াই কি.মি.। এর চারদিক ঘিরে ছিল ১৮২ মিটার চওড়া ও ১৮ মিটার গভীর এক জলপূর্ণ পরিখা। এছাড়া পরিখার সঙ্গে সমান্তরাল কাঠের এক বিরাট প্রাকার নগরটিকে ঘিরে রেখেছিল। নিরাপত্তার খাতিরে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। নগর প্রাকারে ছিল ৬৪টি তােরণ, আর ৫৭০টি মিনার। প্রাকারের গায়ে ছিল অসংখ্য ছিদ্র যেখান থেকে শত্রুসৈন্য লক্ষ্য করে তির নিক্ষেপ করা হত। গ্রিক ও রােমক লেখকরা একবাক্যে চন্দ্রগুপ্তের রাজপ্রাসাদের প্রশংসা করেছেন। তারা বলেছেন, প্রাসাদের সবচেয়ে আকর্ষণের বস্তু ছিল তার সােনা-রূপা খচিত সুদৃশ্য স্তম্ভগুলো যা প্রাসাদটিকে আরও রমণীয় করে তুলেছিল। এই প্রাসাদের তুলনায় সুসা বা একব্যাটানার পারসিক রাজপ্রাসাদ ছিল নিষ্প্রভ। যেমন অতুলনীয় রাজপ্রাসাদ, তেমনি তার অনুপম উদ্যান। সেখানে ছিল ময়ূরের বিচরণ, ছিল ছায়াঘন কুঞ্জ, ছিল দেশি-বিদেশি চিরসবুজ গাছ-গাছড়ার মেলা। আর ছিল কয়েকটি কৃত্রিম সরােবর যা উদ্যানটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। পাটনার কাছে কুমরাহারে মৌর্য রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। কাঠের তৈরি এই প্রাসাদ পারসিক স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল বলে কোনও কোনও পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের রাজপ্রাসাদ যে সৌন্দর্যে পারসিক রাজপ্রাসাদকে ম্লান করে দিয়েছিল, তা তাে গ্রিক ও রােমক লেখকদের সাক্ষ্যে প্রমাণিত। এই সাক্ষ্য হতে মনে হয়, চন্দ্রগুপ্তের রাজপ্রাসাদে পারসিক শিল্পের অন্ধ অনুকরণ ছিল না, ছিল পারসিক শিল্পভাবনায় সমৃদ্ধ ভারতীয় শিল্পীর সৃজনশীল মনের অভিব্যক্তি।

সামাজিক বিভাগ : শুধু চন্দ্রগুপ্ত বা তার প্রশাসন নয়, ভারতীয় জন-জীবনেরও বিভিন্ন দিক মেগাস্থিনিস বর্ণনা করেছেন। এ দেশের জনসমষ্টিকে তিনি (১) দার্শনিক (২) কৃষক (৩) শিকারি ও পশুপালক (৪) কারিগর বা শিল্পী (৫) সৈনিক বা যােদ্ধা (৬) পরিদর্শক বা গুপ্তচর এবং (৭) উপদেষ্টা ও নিয়ামক, এই ৭টি গােষ্ঠিতে বিভক্ত করেছেন।

  • কৃষক : কৃষকেরা ছিলেন সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। জমির মালিকানা তাদের ছিল না, জমি ছিল রাজার সম্পত্তি। যে ফসল তারা উৎপন্ন করতেন, তার তিন-চতুর্থাংশই রাজাকে কর হিসাবে দিতে হত। যুদ্ধের দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এমনকী যুদ্ধের সময়ও যাতে তারা নির্বিঘ্নে চাষাবাদের কাজ করতে পারেন, রাষ্ট্রের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল। যুদ্ধরত কোনও সৈনিকের কৃষিযােগ্য জমির ওপর দিয়ে গমনাগমনের অধিকার ছিল না। কৃষকদের সম্পর্কে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন মেগাস্থিনিস। কৃষকেরা গ্রামেই থাকতেন, কখনও শহরে ভিড় জমাতেন না।
  • সৈনিক বা যােদ্ধা : সংখ্যার দিক থেকে কৃষকদের পরই ছিল সৈন্যদের স্থান। সরকার থেকে তারা নিয়মিত যে বেতন পেতেন, তা পরিবার প্রতিপালনের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। মেগাস্থিনিসের সমসাময়িক গ্রিক লেখক নিয়ারকাসের মতে ভারতীয় তিরন্দাজ বাহিনী প্রায় অপ্রতিরােধ্য ছিল। তাদের নিক্ষিপ্ত তির অক্লেশে শত্রুসৈন্যের ঢাল ও বর্ম ভেদ করে দেহে আঘাত করত। যুদ্ধই ছিল সৈনিকদের একমাত্র কাজ। শান্তির সময় পান-ভােজন, আলস্যে তাদের দিন কাটত।
  • দার্শনিক : সমাজে যারা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে ছিলেন, তারা হলেন দার্শনিক। সংখ্যায় তারা লঘিষ্ঠ ছিলেন। মেগাস্থিনিস দার্শনিকদের ‘ব্রাকমেনিস’ ও ‘সারমেনিস’, এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। ‘ব্রাকমেনিসদের’ জীবনের প্রথম ৩৭ বছর অতিবাহিত হত তপােবনে, সরল জীবনযাপন ও অধ্যয়ন-অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। পরে গৃহে ফিরে বহু পত্নী নিয়ে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতেন। ‘সারমেনিস’-দের একদল ছিলেন অরণ্যবাসী। তাদের খাদ্য ছিল ফল-মূল, বসন ছিল গাছের বাকল। অন্য দলটি লােকালয়ে বাস করতেন। গৃহস্থদের তারা দাতব্য চিকিৎসা করতেন, রােগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে ওষুধের চেয়ে পথ্যের ওপরই তারা বেশি গুরুত্ব আরােপ করতেন।
  • উপদেষ্টা ও নিয়ামক : মেগাস্থিনিস যাদের উপদেষ্টা ও নিয়ামক বলেছেন, তারা আসলে সরকারি কর্মচারী। রাজ্যের প্রশাসন, বিচার-ব্যবস্থা ও জনকল্যাণমূলক কাজের দায়িত্বে ছিলেন তারা। নিজের গােষ্ঠীর বাইরে কেউ বিবাহ করতে পারতেন না, একই সঙ্গে দুটি পেশা গ্রহণের অধিকারও কারাের ছিল না। পেশা বদলের কোনও সুযােগও ছিল না। এ সকল বিধি-নিষেধ দার্শনিকদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য ছিল না।
  • মেগাস্থিনিসের বিবরণের ভারতের বর্ণব্যবস্থা : লক্ষ করবার বিষয়, মেগাস্থিনিস ভারতীয় সমাজের কথা বলেছেন, অথচ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ইত্যাদি বর্ণের কথা বলেননি। তবে মনে হয়, তিনি যাদের দার্শনিক আখ্যা দিয়েছেন, তারা ব্রাহ্মণ বর্ণভুক্ত ছিলেন। যাদের তিনি যােদ্ধা, পরিদর্শক, উপদেষ্টা ও নিয়ামক বলেছেন, তারা প্রধানত ক্ষত্রিয় ছিলেন। আর যাদের কৃষক, কারিগর এবং শিকারি ও পশুপালক বলা হয়েছে তারা সম্ভবত বৈশ্য, শূদ্র ও মিশ্র বর্ণের লােক ছিলেন।

জন-জীবনের অন্যান্য কয়েকটি দিক : জনসাধারণের অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল বলে মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছেন। নদ-নদীর প্রাচুর্য এবং বছরে দু’টি বর্ষার কল্যাণে এ দেশের জমিতে প্রচুর ফলন ধরত। বেশির ভাগ জমিই ছিল দো-ফলা। দেশে খাদ্যের অভাব ঘটত না। দুর্ভিক্ষ কখনও দেখা দিত না। ভূগর্ভে সঞ্চিত ছিল সােনা, রূপা, তামা এবং লােহার মতাে মূল্যবান ও প্রয়ােজনীয় নানা ধাতু। অলংকার, হাতিয়ার ও যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কাজে ধাতুর ব্যবহার হত। ভারতীয়রা মিতব্যয়ী ছিলেন কিন্তু অলংকারের প্রতি তাদের আসক্তি ছিল। গ্রামেই বেশির ভাগ মানুষ বাস করতেন। অনেকের আবার শহরের প্রতি টান ছিল। দেশে যে প্রচুর শহর গড়ে উঠেছিল মেগাস্থিনিস তা গুণে শেষ করতে পারেননি। এই স্বীকারােক্তি স্বয়ং মেগাস্থিনিসের। নদ-নদী বা সমুদ্র তীরবর্তী শহরাঞ্চলে বন্যা বা অতিবর্ষণের ভয় ছিল। ফলে সেখানকার বাড়িগুলো সাধারণত কাঠ দিয়ে তৈরি হত। যে শহরে প্লাবন বা অতিবর্ষণের ভয় ছিল না, সেখানকার বাড়িগুলো হত মাটির, কখনওবা ইটের। দেশের সর্বত্র আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রজাদের নিরাপত্তার প্রতি ছিল রাজার সজাগ দৃষ্টি। লােকেরা ঘর-দোর প্রায়ই অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখতেন তবু চুরি-ডাকাতি খুব কমই হত। দেশে কোনও লিখিত আইন ছিল না। ভারতবাসীরা লিখতেও জানতেন না। মেগাস্থিনিস আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, এ দেশে দাসপ্রথা ছিল না।

ইন্ডিকার মূল্যায়ন : চন্দ্রগুপ্তের সমকালীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে মেগাস্থিনিস যে বর্ণনা দিয়েছেন তার গুরুত্ব অসীম। এরিয়ান, প্লিনিদের মতাে ঐতিহাসিকেরা তাদের গ্রন্থে মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। এর থেকে মেগাস্থিনিসের বিশ্বস্ততা প্রমাণিত হয়। মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় ত্রুটি-বিচ্যুতিও কম নেই। তিনি ভারতে ৭টি গােষ্ঠির কথা বলেছেন। পেশা বা কর্মের ভিত্তিতে তার এই সমাজ-বিভাজন। কিন্তু তখনকার দিনে সমাজ বিভাগের মূল ভিত্তি ছিল জন্ম, কর্ম বা পেশা নয়। ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন মেগাস্থিনিস। অথচ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং অশােকের লেখমালায় দাসপ্রথার সম্পষ্ট উল্লেখ আছে। ভারতে কখনও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি, মেগাস্থিনিসের এ উক্তিও সত্য নয়। মৌর্যদের আমলে উত্তর বাংলা, উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর অঞ্চল এবং মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে যে প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল তার জোরালাে প্রমাণ আছে। ভারতবাসীরা নিরক্ষর বলে মেগাস্থিনিস যে মন্তব্য করেছেন তাও সঠিক নয়। আগামী দিনের পূর্বাভাস যে দার্শনিকেরা লিখে রাখতেন, সে কথা গ্রিক দূত নিজেই স্বীকার করে গেছেন। পথের ধারে দূরত্বজ্ঞাপক স্তম্ভের কথাও তিনি বলেছেন। যে দেশে দূরত্বজ্ঞাপক স্তম্ভ বসানাে হত সে দেশের লােকেরা অবশ্যই সাক্ষর ছিলেন।

কৌটিল্য ও অর্থশাস্ত্র

অর্থশাস্ত্র ও তার রচনাকাল : চন্দ্রগুপ্তের রাজত্ব আলােচনা প্রসঙ্গে আর একখানি গ্রন্থের কথা সহজেই এসে পড়ে। গ্রন্থখানি অর্থশাস্ত্র, লেখক কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত। অর্থশাস্ত্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে কৌটিল্য বলেন, পৃথিব্যা লাভপালনােপায় : শাস্ত্রমর্থশাস্ত্রমিতি (১৫, ১, ১)। অর্থাৎ, যে শাস্ত্রে পৃথিবীর লাভ ও পালনের উপায় আলােচনা আছে, তাই তার্থশাস্ত্র। যে বস্তু এখনও পাওয়া যায়নি তাকে অধিকার করাই লাভ। যা অধিকৃত হয়েছে তার যথার্থ পরিচর্যাই পালন। পৃথিবী বলতে এখানে ভূমি ও সম্পদ উভয়ই বােঝানাে হয়েছে। যাই হোক, কোনও কোনও পণ্ডিতের বিশ্বাস, কৌটিল্যের আর এক নাম চাণক্য এবং তিনি চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী ছিলেন। কৌটিল্য বা চাণক্য যে চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী ছিলেন, এ কথা অনেকেই স্বীকার করেন না। তবু এদের কেউ কেউ মনে করেন যে অর্থশাস্ত্র চন্দ্রগুপ্তের সময় অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে রচিত হয়েছিল। অর্থশাস্ত্রকে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর রচনা মনে করার পেছনে বেশ কয়েকটি যুক্তি আছে।

  • প্রথমত, অর্থশাস্ত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে, গ্রন্থখানি সেই কৌটিল্যের রচনা যিনি নন্দ রাজবংশ উচ্ছেদ করেছিলেন।
  • দ্বিতীয়ত, অর্থশাস্ত্র ও ইন্ডিকার মধ্যে বিবরণগত সাদৃশ্য এত বেশি যে গ্রন্থ দুখানিকে একই যুগের রচনা বলে মনে করা হয়।
  • তৃতীয়ত, অর্থশাস্ত্রে যে বিজিগীষু রাজার কথা বলা হয়েছে। তিনি যেন চন্দ্রগুপ্তেরই প্রতিচ্ছবি।
  • চতুর্থত, খ্রিস্টীয় ১ম বা ২য় শতকের রচনা মনুসংহিতার তুলনায় অর্থশাস্ত্রকে বেশ প্রাচীন বলে মনে হয়। 

ওপরের যুক্তিগুলো যথেষ্ট জোরালাে কিন্তু অকাট্য নয়। গ্রন্থের রচয়িতা কৌটিল্যের নন্দ রাজবংশ ধ্বংসের দাবি অর্থশাস্ত্রে একবারই উত্থাপিত হয়েছে। সে অংশ প্রক্ষিপ্ত হতে পারে। অর্থশাস্ত্র এবং ইন্ডিকায় যেমন মিল রয়েছে তেমনি অমিলও বড় কম নয়। অর্থশাস্ত্রে বিজিগীষু রাজার কথা বলা হয়েছে সত্য কিন্তু আসলে এখানে ক্ষুদ্র এক রাষ্ট্রের কথাই চিন্তা করা হয়েছে। আয়তনে মৌর্য সাম্রাজ্য অনেক বিশাল ছিল। অর্থশাস্ত্র যে মনুসংহিতার পূর্ববর্তী এমতও সকলে স্বীকার করেন না। অর্থশাস্ত্রের প্রাচীনত্বের সমর্থনে অন্য যেসব যুক্তি প্রদর্শিত হয়েছে তা বড় দুর্বল। যেমন, অর্থশাস্ত্রের প্রাচীনত্বের প্রমাণরূপে দণ্ডী ও পঞ্চতন্ত্র-রচয়িতার এই গ্রন্থের সঙ্গে পরিচিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাণভট্ট অর্থশাস্ত্রের কথা জানতেন, এমন যুক্তিও দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কামন্দক, যাজ্ঞবল্ক্য, কালিদাস, বাৎস্যায়ন এবং জাতকমালার লেখক আর্যশূরকেও টেনে আনা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে তারা সকলেই কৌটিল্যের নিকট অল্পবিস্তর ঋণী ছিলেন। কিন্তু এদের কেউই খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের পূর্ববর্তী নন। ফলে অর্থশাস্ত্র বা কৌটিল্যের প্রভাব এদের ওপর পড়লেও অর্থশাস্ত্র খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকের রচনা, এ কথা প্রমাণিত হয় না। খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে ৩য় বা ৪র্থ শতকের মধ্যে অর্থশাস্ত্র রচিত হয়েছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক অভিমত প্রকাশ করেছেন। এদের যুক্তিগুলো ফেলার নয় –

  • প্রথমত, পতঞ্জলি মৌর্যদের কথা বলেছেন, চন্দ্রগুপ্তের সভারও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কৌটিল্য সম্পর্কে তিনি নীরব।
  • দ্বিতীয়ত, মেগাস্থিনিস কৌটিল্যের নামােল্লেখ করেননি, তার বিবরণের সঙ্গেও অর্থশাস্ত্রের যথেষ্ট অমিল।
  • তৃতীয়ত, অর্থশাস্ত্রে ‘সুরুঙ্গ’ শব্দের ব্যবহার আছে। শব্দটি গ্রিক Syrinx কথাটি থেকে এসেছে। অপরসায়নের ব্যবহারের কথাও আছে অর্থশাস্ত্রে। এতে গ্রিকদের সঙ্গে ভারতীয়দের ঘনিষ্ঠ সংযােগ প্রমাণিত হয়। এই যােগাযােগ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে, তার পূর্বে নয়।
  • চতুর্থত, অর্থশাহে ‘চীনপট্ট’ বা চিনা রেশমের উল্লেখ রয়েছে। এতে ভারতের সঙ্গে চিনের বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যিক সম্পর্কের আভাস মেলে। কিন্তু প্রাক্-খ্রিস্টীয় যুগে চিনের সঙ্গে ভারতের এরূপ সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না।
  • পঞ্চমত, অর্থশাস্ত্রে সংস্কৃতকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অশােকের সময় কিতা সরকারি কাজকর্মে প্রাকৃত ভাষারই ব্যবহার ছিল।
  • ষষ্ঠত, কৌটিল্য ৬৩টি বর্ণের উল্লেখ করেছেন কিন্তু অশােকের অনুশাসনে ৪১টি অক্ষরের সন্ধান পাওয়া যায়।

অর্থশাস্ত্রের অর্বাচীনতার সপক্ষে এরূপ আরও অনেক যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। কিন্তু এইসব যুক্তি যে অভেদ্য, তা নয়। প্রকৃতপক্ষে অর্থশাস্ত্রের কালনিৰ্ণায়ক নিশ্চিত কোনও প্রমাণের সন্ধান আজও আমরা পাইনি। তাই এ গ্রন্থের রচনাকাল সম্পর্কে আমাদের ধারণা অস্পষ্টই রয়ে গেছে। কিন্তু গ্রন্থটিতে মৌর্য যুগের যে অনেক মূল্যবান তথ্য বিধৃত আছে, এরূপ ধারণা নিতান্ত অমূলক নয়। হয়তােবা খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকের কোনও আদি গ্রন্থ যুগ পরম্পরায় পরিবর্তিত, পরিমার্জিত সংযােজিত হয়ে খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দী নাগাদ বর্তমান অর্থশাস্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করেছে।

শাসন-ব্যবস্থার বর্ণনায় কৌটিল্য : রাজার উল্লেখ প্রসঙ্গে কৌটিল্য বলেন যে রাজাই রাষ্ট্র নয়, তিনি রাষ্ট্রের অংশ মাত্র। রাষ্ট্রকে মানবদেহরূপে কল্পনা করে এর প্রতিটি অংশকে অঙ্গ বলে তিনি বর্ণনা করেছেন। স্বামী (রাজা), অমাত্য (পদস্থ আমলাগােষ্ঠী), পুর (শহরাঞ্চল), রাষ্ট্র (গ্রামাঞ্চল), কোষ (কোষাগার), দণ্ড (শাস্তিবিধান) এবং মিত্র (বন্ধু রাজা), এই সাতটি অঙ্গ নিয়েই একটি রাষ্ট্র বা রাজ্য। সার্বভৌমত্ব, সরকার, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং জনসমষ্টি প্রভৃতি রাষ্ট্রের যেসব আধুনিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়, কৌটিল্যের রাষ্ট্র বর্ণনায় তার সব কটি উপাদানের উল্লেখ আছে। 

  • রাজা : রাজা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। কী সামরিক বা বেসামরিক প্রশাসন, কী বিচার ব্যবস্থা, সর্বত্রই তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। কিন্তু ব্যক্তিগতস্বার্থে এই ক্ষমতার প্রয়ােগ নিন্দনীয়। সর্বসাধারণের স্বার্থরক্ষায় এর সার্থকতা। কৌটিল্য বলেন, “প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম। নাত্মপ্রিয়ং হিতং রাজ্ঞঃ প্রজানাং তু প্রিয়ং হিতম ৷৷” অর্থাৎ “প্রজার সুখে রাজার সুখ, প্রজার হিতে রাজার হিত। নিজের স্বার্থ নয়, প্রজার স্বার্থই রাজার কাম্য।” 
  • মন্ত্রী : কৌটিল্য বলেন, রাজ্য পরিচালনায় রাজার অন্য অনেকের সাহায্যের প্রয়ােজন। “সহায়সাধ্যং রাজত্বম্‌’। এ প্রসঙ্গে কৌটিল্য সর্বাগ্রে মন্ত্রীদের উল্লেখ করেছেন। মন্ত্রীরা সংখ্যায় তিন বা চারজন হবেন, এ নির্দেশ কৌটিল্যের। নানা রকম প্রলােভনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অমাত্যরাই মন্ত্রীর পদে উন্নীত হতেন। পদমর্যাদায় রাজার পরই তাদের স্থান। তারা প্রত্যেকে ৪ হাজার পণ করে বেতন পেতেন প্রতি মাসে। অর্থশাস্ত্রে ‘পণ’ বলতে তাম্রমুদ্রা, না রৌপ্যমুদ্রা বােঝানাে হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। কোনও কাজে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে রাজা মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন।
  • অমাত্য : রাজ্যে জরুরি অবস্থা দেখা দিলে রাজা মন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদের যুগ্ম অধিবেশন ডাকতেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের কৌটিল্য অমাত্য বলে বর্ণনা করেছেন। এরা সংখ্যায় ১২ জন। মন্ত্রীদের তুলনায় পরিষদের সদস্যদের ক্ষমতা অনেক কম ছিল। জরুরি কাজ ছাড়া অন্য সময় তাদের বিশেষ ডাক পড়ত না। তাদের মাসিক বেতনও ছিল অনেক কম। মাত্র ১ হাজার পণ। মন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণের সঙ্গে রাজা প্রয়ােজনবােধে আলােচনা করতেন সত্য কিন্তু রাজার ওপর তাদের বিশেষ নিয়ন্ত্রণ ছিল বলে মনে হয় না। তাদের পেছনে জনসমর্থন ছিল না, কোনও গােষ্ঠীর প্রতিনিধিও তারা ছিলেন না। রাজার প্রীতি-অপ্রীতির ওপর তাদের পদমর্যাদা নির্ভর করত।
  • পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন রকম অমাত্য : মন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছাড়া আর এক শ্রেণির তামাত্যের উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য। প্রশাসন ও বিচার বিভাগের উচ্চ পদগুলো এদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এজন্য অবশ্য তাদের বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হত। ধর্মীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অমাত্যরা দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারালয়ে নিযুক্ত হতেন। অর্থের প্রলােভন যারা জয় করতেন তাদের জন্য ছিল সমাহর্তা (রাজস্ব অধিকর্তা) এবং সন্নিধাতার (কোষাধ্যক্ষ) পদ। কামনা-বাসনা মুক্ত যারা, তারা নিযুক্ত হতেন প্রমােদ উদ্যানে। আর যারা ছিলেন ভয়লেশহীন, তারা আসন্নকার্যাদির ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ অমাত্যদের খনি, হস্তী অধ্যুষিত বনাঞ্চল এবং কলকারখানায় নিযুক্ত করা হত। অপরীক্ষিত অমাত্যদের সাধারণ কাজ দেওয়া হত। অমাত্যোচিত গুণের যারা অধিকারী, তাদের জন্য দূত, লেখক এবং বিভিন্ন বিভাগের অধ্যক্ষের পদ নির্দিষ্ট ছিল।  
  • অধ্যক্ষ : অধ্যক্ষরা এক একটি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। কোষ, খনি, লৌহ, টাকশাল, লবণ, স্বর্ণ, কোষ্ঠাগার, পণ্য, বনজ সম্পদ, আয়ুধাগার, ওজন-পরিমাপ, সময়-মান, শুল্ক, সূত্র, কৃষি (সীতা), সুরা, কসাইখানা, গণিকা, জলযান, গবাদি পশু, অশ্ব, হস্তী, রথ, পদাতিক বাহিনী, ছাড়পত্র বা মুদ্রা, গােচারণ ক্ষেত্র, গুপ্তচর, দেবপ্রতিষ্ঠান, কারাগার এবং পত্তন বা শহরের মতাে বিভাগের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে অর্থশাস্ত্রে।
  • গুপ্তচর : রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গৃঢ়পুরুষ বা গুপ্তচরদের গুরুত্ব কৌটিল্য স্বীকার করেছেন। সংস্থ বা অধিষ্ঠিত এবং সঞ্চার বা চলমান, গুপ্তচরদের তিনি এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। গৃহী, বণিক ও সাধুদের মধ্য থেকে প্রথমােক্ত শ্রেণির গুপ্তচর নিযুক্ত হতেন। ভিখারিনি, পরিব্রাজিকা ও গণিকাদের সাধারণত চলমান গুপ্তচরের কাজে লাগানাে হত।
  • গ্রামিক : গ্রামের দায়িত্বে ছিলেন গ্রামিক বা গ্রামমুখ্য। চোর ও ভেজালকারবারীদের বহিষ্কারের অধিকার তার ছিল। ছােটোখাটো বিচারের কাজও তিনি নিষ্পন্ন করতেন। গ্রামে চুরির ঘটনা ঘটলে গ্রামপ্রধান দায়ী হতেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ছিল। অর্থশাস্ত্রে বেতনভুক কর্মচারীদের তালিকায় গ্রামিকের উল্লেখ নেই। এর ফলে অনেকে তাকে গ্রামবাসীদের মনােনীত প্রতিনিধি বলে মনে করেন। এ ধারণা ঠিক না হতে পারে। তবে যে গ্রামবৃদ্ধদের সহায়তায় গ্রামিক তার দায়িত্ব পালন করতেন, তারা অবশ্যই গ্রামের প্রতিনিধি ছিলেন। পারিশ্রমিকস্বরূপ গ্রামিক নিষ্কর জমির স্বত্ব লাভ করতেন। 
  • গোপ : গ্রামিকের ওপরে ছিলেন গােপ। পাঁচ বা দশটি গ্রাম নিয়ে এক একটি ‘সংগ্ৰহণ’ গঠিত হত। গােপ ছিলেন সংগ্রহণের দায়িত্বে। গ্রামে সীমা চিহ্নিতকরণ, জন্ম-মৃত্যু তথা লােকসংখ্যা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, দান-বিক্রয়-বন্ধকমূলক কাজকর্ম নিবন্ধভুক্ত করা তার বিশেষ কাজ ছিল। 
  • স্থানিক : গােপের অনেক ওপরে ছিলেন ‘স্থানিক’। ৮০০টি গ্রাম নিয়ে ছিল তার প্রশাসনিক এলাকা। ‘সমাহর্তা’ ও ‘প্রদেষ্টা’ নামের দু’জন উচ্চপদস্থ কর্মচারী স্থানিকের কাজের তত্ত্বাবধান করতেন। তবে কৌটিল্য ‘সংগ্ৰহণ’ ও ‘স্থানীয়’-এর মধ্যবর্তী আরও দুটি প্রশাসনিক বিভাগের নাম করেছেন। এ দুটি হল ‘খার্বাটিক’ ও ‘দ্রোণমুখ। ২০০টি গ্রাম নিয়ে একেকটি “খার্বাটিক’ বিভাগ গঠিত ছিল। ৪০০টি গ্রাম নিয়ে ছিল একটি দ্রোণমুখ। ‘খার্বাটিক’ ও ‘দ্রোণমুখ’ বিভাগ দু’টির পরিচালনভার কাদের ওপর ন্যস্ত ছিল, সে সম্পর্কে কৌটিল্য সম্পূর্ণ নীরব। 

রাজার অর্থনৈতিক অধিকার ও দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে কৌটিল্য : অর্থশাস্ত্রে শুধু বিজিগীষু রাজার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দায়িত্ববােধের কথা বলা হয়নি, রাজা কীভাবে তার রাজ্য হলে সম্পদ আহরণ করবেন, কীভাবেই বা সেই সম্পদের পরিচর্যা করবেন, তার বিধিও বর্ণিত হয়েছে। যে কোনও কর্মোদ্যোগে অর্থের প্রয়ােজন। অর্থহ মুখ্য। কৌটিল্য বলেন, ‘অর্থ এব প্রধান ইতি’ (১/৭/৭)। তাই কৌটিল্য রাজাকে অর্থ সংগ্রহ করে বা সম্পদ আহরণ করে রাজকোয় সর্বদা পূর্ণ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। রাজা হবেন মধুমক্ষিকার মতাে। মধুমক্ষিকা ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে বেড়ায় অথচ ফুলের কোনও ক্ষতি করে না। রাজা তেমনি উৎপীড়ন না করে প্রজাদের কাছ থেকে অর্থ আহরণ করবেন। রাজার অর্থাগমের প্রধান উৎস ভূমিরাজস্ব। ভূমিরাজস্বের প্রধান এক ভাগ সীতা। রাজকীয় খামারে উৎপন্ন ফসলকে অর্থশাস্ত্রে সীতা বলা হয়েছে (U. N. Ghosal, The Agrarian System In Ancient India (Calcutta, 1973), পৃ. 981)। রাজকীয় খামারে সর্বত্র একই নিয়মে চাষাবাদ পরিচালিত হত না। যে জমিতে কয়েদি বা ক্রীতদাস চাষ করত, সরকার বীজ, বলদ ও অন্যান্য সরঞ্জাম যােগান দিত, সেখানে উৎপন্ন ফসলের সবটাই রাজকোষ্ঠাগারে জমা পড়ত। কখনও কখনও রাজকীয় খামার চাষীদের ইজারা দেওয়া হত এবং চাষাবাদের যাবতীয় সরঞ্জাম চাষীরাই যােগাড় করতেন। সেক্ষেত্রে উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ রাজার প্রাপ্য ছিল। অনেক সময় ইজারাদার শুধু কায়িক শ্রমের যােগান দিতেন। সেসব ক্ষেত্রে ফসলের তিন-চতুর্থাংশ বা চার-পঞ্চমাংশ রাজ-শস্যাগারে জমা পড়ত। | ‘সীতা’ ছাড়া আয়ের আর এক প্রধান উৎস ‘ভাগ’। ‘ভাগ’ বলতে বােঝায় জমি আছে, এমন প্রজার উৎপন্ন ফসলে রাজার প্রাপ্য অংশ। কৌটিল্যের মতে রাজার এই প্রাপ্য অংশ ফসলের যষ্ঠ ভাগ। অন্য যেসব সূত্র থেকে রাজার আয় হত সেগুলো ছিল –

  • ১. পিণ্ডকর : সমগ্র গ্রামের ওপর ধার্য এক কর বিশেষ
  • . সেনাভক্ত : সামরিক অভিযানকালে সৈন্যদলের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত প্রজাদের উপহার বা সৈন্যদলের প্রাপ্য উপহারের রাজদেয় অংশ
  • ৩. কর : সাময়িক খাজনাবিশেষ
  • ৪. উৎসঙ্গ : রাজপুত্রের জন্ম বা অন্য কোনও উৎসবে প্রজাদের দেয় উপঢৌকন
  • ৫. পার্শ্ব : অতিরিক্ত কর
  • ৬. বলি : ষড়ভাগ—অতিরিক্ত উৎপন্ন শস্যের ভাগ
  • ৭. পারিহীনিক : চতুষ্পদ জন্তুদ্বারা বিনষ্ট শস্যের জন্য মালিকের জরিমানা
  • ৮. উপায়নিক : উপহার
  • ৯. কৌষ্ঠেয়ক : রাজকীয় পুষ্করিণীর ব্যবহারজনিত কর। 

সরকারের আয়ের আরও অনেক উৎসের উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য। আমদানি ও রপ্তানির ওপর শুল্ক ধার্য করা হত। গণিকালয়, জুয়াখানা, পানশালা ও কসাইখানা থেকেও অর্থাগম হত। খেয়া ও জলসেচ হতে সরকারের অর্থলাভ হত। দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তির জরিমানা রাজকোষে জমা পড়ত। বন, খনি এবং গুপ্তধন রাষ্ট্রের সম্পত্তি বলে গণ্য হত। লবণ উৎপাদনে সরকারের একচেটিয়া কারবার ছিল। সরকারি রাজস্বের অনেকটাই ব্যয় করা হত রাজপরিবার, সৈন্যবাহিনী এবং রাজকর্মচারীদের ভরণপােষণে। রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিশ্রামাগার স্থাপন, ধর্মপ্রচার, আর্ত-পীড়িতের সেবা, বেকারদের রক্ষণাবেক্ষণ, জলসেচের ব্যবস্থাপনার মতাে জনকল্যাণমূলক কাজে সরকারের প্রচুর অর্থ ব্যয় হত। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সরকারের আশু কর্তব্য ছিল। এক্ষেত্রে সমাহর্তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি আয় বাড়ানাে এবং ব্যয় হ্রাসের দায়িত্ব মূলত তারই।

বিন্দুসার (২৯৮ – ২৭২ খ্রি.পূ.)

চন্দ্রগুপ্তের পর তার পুত্র বিন্দুসার অমিত্রঘাত আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য সিংহাসনে আরােহণ করেন। ‘অমিত্রঘাত’ পদের আর্থ শত্রুহন্তা। কেউ কেউ বলেন, কথাটি অমিত্রঘাত নয়, অমিত্রখাদ, অর্থাৎ শত্রুকে যিনি গ্রাস করেন। রাজাবলীকথে গ্রন্থে তাকে সিংহসেন বলা হয়েছে। তার মায়ের নাম ধুর্ধরা, এ কথা জানা যায় পরিশিষ্টপর্বন থেকে। অশােকের অষ্টম মুখ্য অনুশাসন থেকে জানা যায়, তিনি ‘দেবানাং প্রিয়’ উপাধি ধারণ করেছিলেন।

বিন্দুসারের রাজত্বকাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে বিন্দুসার গৌড় বা উত্তর বাংলার প্রদেশপাল পদে নিযুক্ত ছিলেন বলে কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারনাথের বিবরণে বিন্দুসারকে গৌড়ের রাজারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বিন্দুসার যে গৌড়ের প্রদেশপালরূপে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন, তা তারনাথের উক্তিতে প্রমাণিত হয় না। আর্যমঞ্জশ্রীমূলকল্পের রচয়িতা হেমচন্দ্র এবং তারনাথ একবাক্যে বলেছেন, বিন্দুসারের সিংহাসন আরােহণের পরও কিছুকাল চাণক্য মন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারনাথ আরও বলেন, চাণক্য ১৬টি জনপদের রাজাদের উচ্ছেদ করে বিন্দুসারের রাজ্য পূর্ব সমুদ্র থেকে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। তারনাথের এই উক্তির ভিত্তিতে অনেকে সিদ্ধান্ত করেছেন, বিন্দুসার দাক্ষিণাত্য জয় করেছিলেন। কিন্তু দাক্ষিণাত্যে মৌর্যশাসন প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে চন্দ্রগুপ্তের। অনেক পণ্ডিত তারনাথের বিবরণীর অন্যরকম ব্যাখ্যা করেছেন। তারা মনে করেন, বিন্দুসারের রাজত্বের প্রথম পর্বে মৌর্য সাম্রাজ্যের নানা স্থানে বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি কঠোর হস্তে সে বিদ্রোহ দমন করেন। তাদের ধারণা, তারনাথের উক্তিতে সম্ভবত বিদ্রোহ দমনে বিন্দুসারের সাফল্যের ছবি ফুটে উঠেছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের সপক্ষে বিশেষ কোনও যুক্তি নেই। বিন্দুসারের রাজত্বকালে তক্ষশিলায় বিদ্রোহ হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাই বলে সে বিদ্রোহ উত্তর ভারতের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে ভাবার কোনও যুক্তি নেই। 

বিন্দুসার সম্ভবত কোনও নতুন রাজ্য জয় করেননি। কিন্তু তিনি যে পৈতৃক সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলেন, তাতে কোনও সংশয় নেই। দিব্যাবদান গ্রন্থে উল্লেখ আছে, তার রাজত্বকালে তক্ষশিলায় একবার বিদ্রোহ দেখা দেয়। সে বিদ্রোহ ঘটেছিল স্থানীয় আমলাতন্ত্রের দমনমূলক কার্যকলাপের ফলে। রাজপুত্র অশােকের চেষ্টায় বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত বশ্যতা স্বীকার করেন।

বিন্দুসার ও সমসাময়িক বৈদেশিক নৃপতিবর্গ : বিন্দুসারের রাজত্বকালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মৌর্য সাম্রাজ্যের সুনাম যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। স্ট্র্যাবোর বিবরণী থেকে জানা যায়, সিরিয়ার সমকালীন গ্রিকরাজ প্রথম এন্টিওকাস বিন্দুসারের দরবারে ডাইমেকাস নামে জনৈক দূত প্রেরণ করেন। প্লিনি বলেন, মিশররাজ দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাসও (২৮৫-২৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) পাটলিপুত্রে ডায়ােনিসাস নামে আর একজন দূত পাঠান। তবে ডায়ােনিসাস বিন্দুসার, না তার পর অশােকের সময় ভারতে এসেছিলেন, সে সম্পর্কে প্লিনি স্পষ্ট নন। সিরিয়ার রাজা প্রথম এন্টিওকাসের সঙ্গে বিন্দুসারের সৌহার্দের উল্লেখ করেছেন গ্রিক লেখক এথেনিউস। প্রাচীন লেখক হেগেস্যান্ডার এন্টিওকাস ও বিন্দুসার সম্পর্কে এক কাহিনির অবতারণা করেছেন। মৌর্যসম্রাট নাকি একবার সিরিয়ার রাজার নিকট সুরা, কিছু শুষ্ক ফল এবং একজন তার্কিক চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। শেষেরটি ছাড়া বিন্দুসারের অন্য সব কটি অনুরােধ এন্টিওকাস রক্ষা করেছিলেন।

রাজত্বের স্থায়িত্বকাল : বিন্দুসার ঠিক কত বছর রাজত্ব করেছিলেন, সে সম্পর্কে তথ্যগুলো পরস্পর বিরােধী। পুরাণে তার ২৫ বছর রাজত্বের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধসূত্রে তার রাজত্বকাল ২৭ বা ২৮ বছর ধার্য করা হয়েছে। তারনাথের মতে বিন্দুসার ৭০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তারনাথের উক্তি যে অবিশ্বাস্য, তা বােধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। সাধারণত মনে করা হয়, ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ বিন্দুসারের রাজত্বের শুরু, আর ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার শাসনাবসান হয়েছিল।

অশােক (২৬৮ – ২৩২ খ্রি.পূ.)

অনুশাসন ও উপাধি

বিন্দুসারের মৃত্যুর পর তার পুত্র অশােক আনুমানিক ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আরােহণ করেন। পরাক্রম, প্রজ্ঞা, করুণা ও মানবহিতৈষণার মূর্ত প্রতীক এই রাজা পৃথিবীর সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ নৃপতিরূপে আজও বন্দিত।

অশােকের অনুশাসন : ভারতের ইতিহাসে অশােকই প্রথম রাজা যিনি তার বাণী ও কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ করে লেখ প্রচার করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি পূর্বতন পারসিকরাজ প্রথম দারিউসের রীতি অনুসরণ করেন। অশােকের বেশির ভাগ লেখ সাধারণত ব্রাহ্মী অক্ষরে ও প্রাকৃত ভাষায় উৎকীর্ণ। পাশ্চাত্য পণ্ডিত জেমস প্রিনসেপ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে এই লিপির পাঠোদ্ধার করেন। অশােকের যেসব গিরিশাসন পাকিস্তানের শাহবাজগঢ়ী ও মানসেরায় পাওয়া গেছে, সেগুলোর ভাষা প্রাকৃত কিন্তু হরফ খরােষ্ঠী (ক্ষরােষ্ঠী)। অশােক গ্রিক ও আরামীয় ভাষাভাষী প্রজাবৃন্দের জন্যও লেখ উৎকীর্ণ করেছেন। আরামীয় ভাষা ও লিপিতে উৎকীর্ণ তার লেখ পাওয়া গেছে তক্ষশিলায়, আফগানিস্তানের লঘমান অঞ্চলভুক্ত পুল-ই-দরুন্তায় ও কান্দাহারের নিকটবর্তী শর-ই কুনা গ্রামে। শর-ই-কুনায় গ্রিক ও আরামীয় ভাষা ও লিপিতে রচিত অশােকের একখানি দ্বিভাষিক অনুশাসনও আবিষ্কৃত হয়েছে (J. Filliozal. A Graeco-Armaic Inscription of Asoka Near Kandahar, Epigraphia Indica, XXXIV (1961-62), পৃষ্ঠা ১-৮। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত এই দ্বিভাষিক লেখে অশােকের চতুর্দশ মুখ্য গিরিশাসনের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ হয়েছে।J. Filliozal. A Graeco-Armaic Inscription of Asoka Near Kandahar, Epigraphia Indica, XXXIV (1961-62), পৃষ্ঠা ১-৮। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত এই দ্বিভাষিক লেখে অশােকের চতুর্দশ মুখ্য গিরিশাসনের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ হয়েছে।)। এ স্থানে অশােকের একখানি ভগ্ন গ্রিক লেখেরও সন্ধান পাওয়া গেছে (D. Schlumberger and E. Benveniste, A New Greek Inscription of Asoka At Kandahar, Epigraphia Indica, XXXVII, পৃষ্ঠা ১৯৩-২০০)। গিরি, স্তম্ভ ও গুহার গায়ে উৎকীর্ণ অশােকের লেখমালা পাঁচটি ভাগে বিভক্ত : 

  • (১) ১৪টি মুখ্য গিরিশাসন। প্রাপ্তিস্থান আফগাস্তিানের শর-ই-কুনা, পাকিস্তানের শাহবাজগঢ়ী ও মানসেরা, হিমাচলপ্রদেশের কালসি, গুজরাতের গিরনার, মহারাষ্ট্রের সােপারা, অন্ধ্রপ্রদেশের এড্‌ড়াগুডি, কর্ণাটকের গুলবর্গা জেলার সন্নতি এবং ওড়িশার ধৌলি ও জৌগড়। অশােকের দ্বাদশ মুখ্য গিরিশাসনের সিংহভাগ ও ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনের প্রারম্ভিক বিষয় শর-ই-কুনায় প্রাপ্ত এক শিলাখণ্ডে সংক্ষিপ্তাকারে গ্রিক ভাষা ও লিপিতে উৎকীর্ণ হয়েছে। শিলাখণ্ডটি ভগ্ন হতে পারে, মূল শিলাখণ্ডে ১৪টি মুখ্য গিরিশাসনই সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছিল। শর-ই-কুনায় প্রাপ্ত এই লেখটি অশােকের প্রাকৃত অনুশাসনের আক্ষরিক গ্রিক অনুবাদ নয়। সন্নতির প্রাপ্ত ভগ্ন শিলাখণ্ডের দু’টি পিঠই লেখ উৎকীর্ণ। এক পিঠে খােদিত রয়েছে অশােকের দ্বাদশ ও চতুর্দশ মুখ্য গিরিশাসন, অপর পিঠে উৎকীর্ণ আছে তথাকথিত দু’টি স্বতন্ত্র কলিঙ্গ অনুশাসন। সব কটি অনুশাসনই অতিশয় ক্ষতিগ্রস্ত। স্পষ্ট বােঝা যায়, ভগ্ন শিলাখণ্ডটি অশােকের অনুশাসন—খােদিত এক বৃহত্তর মূল শিলাখণ্ডের অংশ ছিল। একদিন হয়তো মূল শিলাখণ্ডের সেই ভগ্ন অংশগুলোর সন্ধান পাওয়া যাবে। তবে উল্লিখিত দশটি স্থানের সবকটিতেই যে পুরাে ১৪টি গিরিশাসন পাওয়া গেছে তা নয়। ধৌলি ও জৌগড়ে অশােকের একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়ােদশ অনুশাসন তিনটির পরিবর্তে দু’টি স্বতন্ত্র অনুশাসন উৎকীর্ণ হয়েছে। এই অনুশাসন দু’টি কলিঙ্গ অনুশাসনরূপে খ্যাত।
  • (২) ২টি গৌণ গিরিশাসন। প্রথম গৌণ গিরিশাসন ভারতের সতেরােটি বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে : বিহারের রােহতাস জেলার সহস্রাম বা সহসরাম, উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর জেলার আহরৌরা (দীনেশচন্দ্র সরকার, শিলালেখ-তাম্ৰশাসনাদির প্রসঙ্গ (কলকাতা, ২০০৯), পৃষ্ঠা ৩৬-৪০), মধ্যপ্রদেশের জবলপুর জেলার রূপনাথ, দাতিয়া জেলার গুজররা ও সীহাের জেলা পাঙ্গুড়ারিয়া, রাজস্থানের জয়পুর জেলার বৈরাট, কর্ণাটকের রায়চুর জেলার মাসকি, গবীমঠ ও পালকীগুণ্ডু, চিত্রদুর্গ জেলার সিদ্দাপুর, জটিঙ্গ-রামেশ্বর ও ব্রহ্মগিরি এবং বেল্লারি জেলার নিট্টুর ও উডেগােলাম, অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্ণুল জেলার এড্‌ড়াগুড়ি ও রাজুল-মণ্ডগিরি এবং দিল্লির উপকণ্ঠস্থ বাহাপুর (১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বা তার কিছুকাল পূর্বে বাহাপুরে অশােকের এ অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়েছে D. C. Sircar, “New Delhi Inscription of Asoka,” Epigraphia Indica, XXXVIII (1969-70), পৃষ্ঠা ১-8)। দ্বিতীয় গৌণ গিরিশাসন সাতটি মাত্র স্থানে পাওয়া গেছে : ব্রহ্মগিরি, সিদ্দাপুর, জটিভ রামেশ্বর, নিট্টুর, উডেগােলাম, এড্‌ড়াগুড়ি ও রাজুল-মণ্ডগিরি।
  • (৩) ৭টি মুখ্য স্তম্ভলেখ। প্রাপ্তিস্থান হরিয়ানার তােপরা, উত্তরপ্রদেশের মিরাট ও এলাহাবাদ এবং বিহারের চম্পারণ জেলার রাধিয়া বা লৌড়িয়া অররাজ, মাথিয়া বা লৌড়িয়া নন্দনগড় এবং রামপুরবা। ষষ্ঠ মুখ্য স্তম্ভলেখের অংশবিশেষ সম্বলিত একখানি ভগ্ন প্রস্তরখণ্ড পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তস্থিত বুনের অঞ্চলে পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত এই লেখাটির ভাষা প্রাকৃত, লিপি ব্রাহ্মী। কিন্তু প্রস্তরখণ্ডটি প্রকৃতই বুনের অঞ্চলের কিনা সে সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। দ্বিতীয়ত, লেখটি নকল বা জালও হতে পারে। সে কারণে অশােক বুনের অঞ্চলেও একখানি মুখ্য স্তম্ভলেখ উৎকীর্ণ করেছেন, এ কথা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায় না। 
  • (৪) ৬টি গৌণ স্তম্ভলেখ। এর এক একটি এক এক স্থানে পাওয়া গেছে। স্থানগুলো হল উত্তরপ্রদেশের সারনাথ, কৌশাম্বী ও এলাহাবাদ, মধ্যপ্রদেশের সাঁচী এবং নেপালের লুম্বিনী ও নিগলিব। 
  • (৫) ৩টি গুহালেখ। প্রাপ্তিস্থান বিহারের বরাবর পাহাড়। এক মহান রাজার মহতী ভাবনার অমূল্য স্মারক হয়ে আছে অশােকের এই লেখমালা।

নাম ও উপাধি : লেখমালায় অশােক বার বার নিজেকে ‘দেবানাং প্রিয়’ ও ‘প্রিয়দর্শী’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নিজেকে অশােক বলে পরিচয় দিয়েছেন মাত্র চারটি ক্ষেত্রে, তার গৌণ গিরিশাসনের মাসকি, গুজররা, নিট্টুর ও উডেগােলাম সংস্করণে। ‘দেবানাং প্রিয়’ বা ‘প্রিয়দর্শী’ অশােকের কোনও নাম নয়, উপাধি। কেউ কেউ মনে করেন, অশােকের পােশাকী নাম ছিল প্রিয়দর্শী। গুজররা গৌণ গিরিশাসনে অশােক ‘দেবতাদের প্রিয়’ ও ‘প্রিয়দর্শী’ বলে নিজের বর্ণনা দিয়েছেন। এ থেকে বােঝা যায়, অশােক ‘দেবানাং প্রিয়’ ও “প্রিয়দর্শী’ কথা দু’টি উপাধি হিসাবেই ব্যবহার করেছেন। ‘দেবানাং প্রিয়’ পদ দুটিকে অশােক ‘দেবতাদের প্রিয়’ অর্থে গ্রহণ করেছেন কিন্তু ‘নির্বোধ’ অর্থেই পদ দু’টির আভিধানিক প্রয়ােগ। দর্শনধারী এই অর্থে প্রিয়দর্শী। অন্যকে যিনি প্রিয়রূপে দেখেন, তিনিও প্রিয়দর্শী। অন্যের মঙ্গলাকাঙক্ষী যিনি, তিনিও প্রিয়দর্শী। অশােক সুভদ্ৰাঙ্গীর পুত্র, বহুপূর্বে এ মত প্রকাশ করেছেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। অশােক ধর্মার পুত্র, এ অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। এসব ধারণার কোনও সুদৃঢ় ভিত্তি নেই।

ক্ষমতা লাভ, কলিঙ্গ বিজয় ও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ

ক্ষমতায় আরোহন : অশােকের প্রথম জীবনের কিছু ঘটনার বিবরণ আছে দিব্যাবদান, দীপবংস ও মহাবংস গ্রন্থে। এসব গ্রন্থে স্বেচ্ছাচারী, নৃশংস ও ভ্রাতৃঘাতক বলে অশােকের পরিচয় বলা হয়েছে, অশােক পিতার মৃত্যুর পর নিজ শক্তিতে সিংহাসন অধিকার করেন এবং ৪ বছর ধরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার ৯৯জন ভাইকে হত্যা করে সিংহাসন নিষ্কণ্টক করেন। অধিকার সুদৃঢ় করার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যলাভের ৪ বছর পর তার রাজ্যাভিষেক হয়। আশােকের তথাকথিত নৃশংস, চরিত্রের সমর্থনে কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই। হয়তােবা স্বধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে বেদ্ধি লেখকরা অশােকের কৈশাের ও যৌবনের এই মসীময় রূপ কল্পনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে , অশােক তার চতুর্থ মুখ্য গিরিশাসনে আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে সম্প্রীতির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। পঞ্চম গিরিশাসনে তিনি স্পষ্ট তার ভাই-বােনদের উল্লেখ করেছেন। অনেকে অবশ্য মনে করেন, পঞ্চম গিরিশাসনে অশােকের ভাই-বােনদের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে তাদের পরিবার-পরিজনদের কথা। মােটকথা, অশােক তার ভাইদের হত্যা করে বলপূর্বক সিংহাসন অধিকার করেন, এরূপ ধারণার সমর্থনে এখন পর্যন্ত তেমন কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে তার সিংহাসনে আরােহণ ও রাজ্যাভিষেকের মধ্যে যে ৪ বছরের ব্যবধান ছিল, তা প্রায় সকল ঐতিহাসিক স্বীকার করেন। সেক্ষেত্রে মনে করতে হবে, ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশােকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। সিংহাসনে আরােহণের সঙ্গে সঙ্গেই অশােকের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হল না কেন, তার কোনও সদুত্তর নেই। কেউ কেউ মনে করেন, সিংহাসনে আরােহণ করলেও সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তাকে দীর্ঘ ৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়। আবার তানেকের ধারণা, প্রতিকূল শক্তিকে নির্মূল না করা পর্যন্ত অভিষেকের আয়ােজন করা অশােকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। 

কলিঙ্গ বিজয় : অশােকের রাজত্বকালের এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা তার কলিঙ্গ বিজয়। এখন যেখানে ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলম, বিশাখাপত্তনম ও পূর্ব গােদাবরী জেলা, প্রাচীন কালে সে অঞ্চলের নাম ছিল কলিঙ্গ। সে সময় রাজ্যটি যে বেশ শক্তিশালী ছিল, প্লিনির বর্ণনায় তা প্রকাশ পেয়েছে। প্লিনি তার বর্ণনায় বলেছেন, কলিঙ্গ রাজ্যে ৬০ হাজার পদাতিক, ১ হাজার অশ্বারােহী ও ৭০০ হস্তী ছিল। কিন্তু অশােকের ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে কলিঙ্গ সৈন্যের হতাহতের বর্ণনার তুলনায় এ সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। হয়তাে অশােকের কলিঙ্গ যুদ্ধের বর্ণনায় অতিশয়ােক্তি আছে। আবার এরূপ ভাবাও সম্ভব যে প্লিনি ও কলিঙ্গ যুদ্ধের অন্তর্বর্তিকালীন সময়ে কলিঙ্গের সৈন্য সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মগধের সীমান্তে কলিঙ্গের মতাে স্বাধীন এক রাজ্যের অস্তিত্ব সাম্রাজ্যলিপ্সু অশােকের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। মগধের প্রসারের জন্য কলিঙ্গ বিজয় অতি প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়েছিল। কলিঙ্গ জয়ের পেছনে অশােকের সম্ভবত অন্য উদ্দেশ্যও ছিল। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের যােগাযােগের ক্ষেত্রে কলিঙ্গ চিরকালই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। কলিঙ্গ ও মালব যেন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি প্রবেশদ্বার। এই সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের যােগাযােগ ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে কলিঙ্গের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কলিঙ্গ বিজয়ের অর্থ মগধের সামনে নতুন এক অর্থনৈতিক দিগন্তের প্রসার।

সিংহাসনে আরােহণ করেই অশােক কলিঙ্গ অভিযানে অগ্রসর হননি। এর জন্য তাকে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে হয়। তার রাজত্বের প্রথম ১২ বছর ধরে এই প্রস্তুতি চলে। ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসন থেকে জানা যায়, তার অভিষেকের ৮ বছর পর অর্থাৎ রাজ্যাভিষেকের নবম বছরে তিনি কলিঙ্গ জয় করেন। আনুমানিক ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশােকের রাজ্যাভিষেক হয়। সেই হিসাবে আনমানিত ২৬১-৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দই হবে তার কলিঙ্গ বিজয়ের তারিখ। কিন্তু এই বিজয় যে সহজসাধ্য হয়নি অশােকের ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনই তার প্রমাণ। কান্দাহারের নিকটবর্তী শর-ই-কুনায় প্রাপ্ত গ্রিক অনুশাসনেও অশােকের কলিঙ্গ বিজয়ের উল্লেখ আছে। ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে অশােক নিজেই স্বীকার করেছেন যে যুদ্ধে দেড় লক্ষ লােক বন্দি হন, ১ লক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ হারান, পরে মৃতের সংখ্যা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। অধ্যাপক ভাণ্ডারকর মনে করেন, অশােকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চোল ও পাণ্ড্যরা কলিঙ্গরাজের পক্ষে যােগদান করেন। কিন্তু এ মতের সমর্থনে কোনও প্রমাণ নেই। কলিঙ্গ অভিযানে অশােক সম্পূর্ণ সাফল্য অর্জন করেন। ওড়িশার ধৌলি ও জৌগড়ে পাওয়া তার লেখ এই অঞ্চলে তার আধিপত্য-প্রতিষ্ঠা প্রমাণ করে। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বিজিত রাজ্যটিকে দুটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এক মৌর্য রাজকুমারের হাতে উত্তরাঞ্চলের শাসনভার দেওয়া হল। দক্ষিণাঞ্চলের ভার পড়ল মহামাত্র নামে পদস্থ রাজপুরুষদের উপর। তােসলী (ধৌলি বা শিশুপালগড়) হল উত্তরাঞ্চলের সদর দফতর, সমাপা (জৌগড়ের নিকটবর্তী) হল দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান কেন্দ্র। রক্তক্ষয়ী কলিঙ্গ যুদ্ধ অশােকের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এক একটা যুদ্ধের পরিণাম কত মারাত্মক! কত প্রাণ অকালে ঝরে পড়ে! কত লােক ছিন্নমূল হয়ে বিজয়ীর দাসত্ব বরণ করেন! যুদ্ধের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নন, তাদেরও কী দুর্দশা কম! যুদ্ধের কুফল মর্মে মর্মে অনুভব করে অনুশােচনায় দগ্ধ হলেন তিনি। স্থিরপ্রতিজ্ঞ হলেন, ভবিষ্যতে নিতান্ত বাধ্য না হলে কখনও অস্ত্র ধারণ করবেন না। পুত্র-পৌত্রদেরও তিনি রাজ্যজয়ের নীতি পরিহারের আহবান জানালেন।

বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ : এই সময় বুদ্ধের ললিত বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে অশােক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু অশােকের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ কলিঙ্গ যুদ্ধের ঠিক অব্যবহিত পরের ঘটনা নয়। প্রথম গৌণ গিরিশাসনে অশােক বলেছেন, তার উপাসক অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর প্রায় আড়াই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই গিরিশাসনটি সম্ভবত তার অভিষেকের ত্রয়ােদশ বছরে উৎকীর্ণ হয়েছিল। এর থেকে প্রমাণিত হয়, অভিষেকের দশম বছরে অশােক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন (রাধাগোবিন্দ বসাক (Asokan Inscription, Calcutta, 1959. Introduction, xv) মনে করেন, কান্দাহার অনুশাসনের আরামীয় সংস্করণে অশােকের রাজ্যাভিষেকের দশম বছরে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষান্তরের উল্লেখ আছে। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সরকার (শিলালেখা-তাম্ৰশাসনাদির প্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা ১০) কান্দাহার গিরিশাসনের আরামীয় সংস্করণের যে ব্যাখ্যা করেছেন তা থেকে মনে হয়, অশােক তার অভিষেকের একাদশ বছর থেকে ধর্মপ্রিচার আরম্ভ করেছিলেন, তারই কথা ওই লেখে বলা হয়েছে)। অর্থাৎ কলিঙ্গ যুদ্ধের বছরখানেক পরই অশােক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। মহাবংস, দিব্যাবদান প্রভৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছে, অশােক তার অভিষেকের চতুর্থ বছরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এসব গ্রন্থে অশােকের সঙ্গে সমুদ্র ও উপগুপ্ত নামে দু’জন বৌদ্ধ শ্রমণকে জড়িয়ে নানা কাহিনির অবতারণা করা হয়েছে। এই ধরনের কাহিনির ঐতিহাসিক ভিত্তি বড় দুর্বল। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা অশােকের মনােজগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। তার এই মানসিক পরিবর্তন প্রতিফলিত হয় তার সকল কাজে, ধর্মের অনুশীলনে ও প্রচারে, শাসন-পরিচালনায় ও পররাষ্ট্রনীতিতে। 

অশােকের দৃষ্টিতে ধর্ম

ধর্মের লক্ষণ : অশােক তার লেখমালায় বার বার ধর্মের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। তিনি তার ধর্মানুরাগ, ধর্মানুশীলন এবং ধর্মপ্রচারের কথা সাগ্রহে ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন লেখে। ধর্মকে কী বিশেষরূপে তিনি দেখেছিলেন, তার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। দ্বিতীয় মুখ্য স্তম্ভলেখে অশােক ধর্মের ছ’টি লক্ষণের কথা বলেছেন। লক্ষণগুলো হল অপাসিনবে (অপাস্নব), বহুকয়ানে (বহুকল্যাণ), দয়া, দানে (দান), সচে (সত্য) এবং সােচয়ে (শুচিতা)। সপ্তম মুখ্য স্তম্ভলেখেও অশােক ধর্মের ছ’টি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হল দয়া, দানে, সচে, সােচবে (শুচিতা), মদবে (মার্দব) এবং সাধবে (সাধুতা)। লক্ষ করবার বিষয়, দয়া, দানে, সচে এবং সোচয়ে – এই চারটি বৈশিষ্ট্য উভয় তালিকায় স্থান পেয়েছে। প্রথম তালিকাটিতে অপাসিনবে এবং বহুকয়ানে বলে আরও দুটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ আছে। দ্বিতীয় তালিকায় এদের উল্লেখ নেই। সেখানে মদবে ও সাধবে বলে দু’টি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। বহুকয়ানে এবং সাধবের অর্থ একই। কিন্তু অপাসিনবে ও মদবে পদ দু’টির অর্থ ভিন্ন। তাহলে ধর্মের সর্বসমেত সাতটি বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণের কথা জানা গেল। এগুলো হল (১) অপাসিনবে (২) বহুকয়ানে বা সাধবে (৩) দয়া (4) দানে (৫) সচে (৬) সােচয়ে এবং (৭) মদবে। আসিনবের অর্থ পাপ প্রবৃত্তি বা পাপ প্রবণতা। এই প্রবৃত্তি বা প্রবণতা থেকে মুক্তি অর্থে অপাসিনবে। এর জন্য রাগ, নিষ্ঠুরতা, ক্রোধ, দর্প ও ঈর্ষার মতাে রিপুগুলোকে অবশ্যই জয় করতে হবে। কয়ানের অর্থ কল্যাণ। প্রভূত কল্যাণ অর্থে বহুকয়ানে। সচে বলতে বােঝায় সত্য। সোচয়ে যা, শুচিতাও তাই। মদবের অর্থ সৌজন্য। 

ধর্মকে রূপায়নের পথ : অশােক কেবল ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করেননি, এগুলো রূপায়ণের পথও নির্দেশ করেছেন। তার মতে জীবজগতের প্রতি অহিংস আচরণ, পশুহত্যা পরিহার ও দাস-ভৃত্যের প্রতি সদয় ব্যবহারেই দয়ার সার্থকতা। দানের প্রসঙ্গে তিনি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ব্রাহ্মণ-শ্রমণের উদ্দেশ্যে দানের কথা বলেছেন। মাতা-পিতা, গুরুজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ব্রাহ্মণ-শ্রমণ সকলের সেবায় মদবে বা সৌজন্যের সার্থকতা। বহুকয়ানে বা সাধবে বলতে অশােক পথের ধারে বৃক্ষরােপণ, কূপখনন, তৃষ্ণাতের জন্য জলপানের ব্যবস্থাপনার মতাে জনহিতকর কাজের কথা বলেছেন। 

লোকাচার : অশােকের ধর্মে স্থল লােকাচারের কোনও স্থান নেই। শারীরিক অসুস্থতা, পুত্রকন্যার বিবাহ, পুত্র কন্যার জন্ম, বিদেশযাত্রা ইত্যাদি ঘটনা উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে সাধারণত মেয়েদেরই উৎসাহ বেশি থাকে। অশােকের মতে এসব অনুষ্ঠান তুচ্ছ ও নিরর্থক, অতএব বর্জনীয়। 

ধর্মের উদ্দেশ্য : ধর্মের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অশােক বলেন, ধর্মানুশীলনের মধ্য দিয়ে মানুষ পরলােকে অনন্ত পুণ্য অর্জন করে। এই অনন্ত পুণ্যকে তিনি কখনও কখনও স্বর্গ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি মনে করেন, মানুষের কাছে স্বর্গের চেয়ে কাম্যতর বস্তু আর কিছু নেই। 

নিজস্ব নীতিবাদ নাকি গৃহীর বৌদ্ধধর্ম : স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, অশােক যে ধর্মের কথা বলেছেন, সে ধর্মে মানবিক গুণের বিকাশ ও সদাচারের ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। কোনও আচার-অনুষ্ঠানের কথা এখানে নেই, আছে সংযম, করুণা, চিত্তশুদ্ধি ও মানবিক ঔদার্যের কথা। এ কারণে অনেকে মনে করেন, অশােকের ধর্ম হিন্দু বা বৌদ্ধ বিশেষ কোনও ধর্ম নয়, এ ধর্ম আসলে শাশ্বত নীতিবােধের ওপর প্রতিষ্ঠিত, অশােকের স্বােদ্ভাবিত এক বিশেষ মানবিক মূল্যবােধ। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সর্বসাধারণকে নিয়ে এক সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ গঠন এর উদ্দেশ্য। তারা অশােকের দ্বৈত সত্তার কথা বলেন, একটি অশােকের ব্যক্তিসত্তা, অন্যটি অশােকের রাজসত্তা। ব্যক্তিগত জীবনে অশােক বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। কিন্তু রাজা অশােক ব্যক্তি অশােকের ঊর্ধ্বে উঠে ধর্মনিরপেক্ষ উদার এক নীতিবাদ প্রচার করেছেন। এই নীতিবাদই ধর্ম। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর, রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা অশােকের ধর্মের এই নৈতিক ব্যাখ্যা সমর্থন করেননি। তারা মনে করেন, অশােক যে ধর্ম প্রচার করেছেন তা আসলে বৌদ্ধধর্ম, বিশেষত বৌদ্ধ গৃহীদের আচরণীয় ধর্ম। সত্য বলতে কী, অশােক ধর্মের যে সকল বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন, তার সবকটি উপাসক-উপাসিকাদের অবশ্য পালনীয় বলে দীঘনিকায়ের লখনসুত্তান্ত এবং সিগালােবাদসুত্তে বলা হয়েছে। সংসারী লােকের স্বর্গলাভের কথা বুদ্ধ বলেছেন, যেমন বলেছেন অশােক। অশােকের প্রচারিত ধর্ম মূলত নীতিবাদ, না বৌদ্ধধর্ম, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের বাগ্‌বিতণ্ডার আজও অবসান হয়নি।

বুদ্ধ বা সংঘ সম্পর্কিত কথার অনুপস্থিতি : অশােক তার ধর্মে বুদ্ধ বা সংঘ সম্পর্কে কোনও কথা বলেননি। আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা নির্বাণের প্রসঙ্গও তিনি উত্থাপন করেননি। এসবের উল্লেখ থাকলে অশােকের ধর্মের বৌদ্ধস্বরূপ নিশ্চিতরূপে প্রকটিত হত। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিশেষ এক পরিস্থিতিতে অশােকের ধর্মানুরাগ ও ধর্মানুশীলন শুরু হয়েছিল। আর এ কথাও ভুললে চলবেনা,কলিঙ্গ যুদ্ধজনিত অশােকের মনস্তাপের ফলেই সে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। মানসিক শান্তির জন্যই তার পুরানাে ধর্মমত পরিহার ও বৌদ্ধধর্মে দীক্ষান্তর। তার মনে ধর্মেরও উন্মেষ ঘটে এই সময়। ফলে অশােকের ধর্মে বৌদ্ধধর্মের প্রতিফলন থাকা মােটেই বিচিত্র নয়। সর্বজনীন রূপ আছে, বৌদ্ধধর্মের এরূপ বৈশিষ্ট্যের অনুশীলনের উপর তিনি গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। তাই তার প্রচারিত ধর্মে বুদ্ধ ও সংঘের উল্লেখ নেই, অষ্টাঙ্গিক মার্গ, নির্বাণাদির কথাও সেখানে অনুচ্চারিত। ধর্মকে সর্বজনগ্রাহ্য করতে তার এই সতর্কতা। আর একটি কথা, তখনকার দিনের বৌদ্ধরা ধর্ম বলতে নিজেদের আচরিত ধর্মকেই বুঝতেন। 

সৌহার্দ ও সম্প্রীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য : অশােক তার বর্মে বৌদ্ধধর্মের সর্বজনীন আদর্শগুলোকে তুলে ধরেছেন। এতে তার ধর্ম সমাজের সকলের কাছে গ্রহণযােগ্য হয়ে উঠেছে। বৌদ্ধরা অশােকের ধর্মে গৌতম বুদ্ধের শাশ্বত বাণীরই প্রতিধ্বনি শুনেছেন। অন্যান্য সম্প্রদায়ের লােকেরা অশােকের ধর্মে দেখেছেন তাদের নিজ নিজ ধর্মের প্রতিফলন। ধর্মের মাধ্যমে অশােক অসামান্য বিচক্ষণতার সঙ্গে একদিকে যেমন বুদ্ধের বাণী প্রচার করেছেন, অন্যদিকে তেমনি তার সাম্রাজ্যের নানা মত ও নানা পথ-এর প্রজাদের এক অখণ্ড চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের পরিবর্তে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টি করা, তার বা তার সরকারের সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটিকে সহজ করে তােলা।

প্রজাদের আনুগত্য সুনিশ্চিত করার প্রচেষ্টা? : ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় অশােকের ধর্মের এক অভিনব ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন (H.C. Raychoudhuri. Political History Of Ancient India : Commentary পৃ. ২৮)। তার অভিমত, রাজার প্রতি প্রজাসাধারণের ভক্তি অশােকের ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে মৌর্যসম্রাট প্রজাদের আনুগত্য সুনিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন, শর-ই কুনা দ্বিভাষিক অনুশাসনের গ্রিক সংস্করণে ধর্মের এক বৈশিষ্ট্যরূপে রাজস্বার্থের প্রতি প্রজাদের ভক্তির উল্লেখ আছে; সপ্তম ও ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে অশােক যে ‘দিঢ়ভতিতার’ কথা বলেছেন তা এই রাজভক্তি ; পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে রাজার প্রতি প্রজার ভক্তির উল্লেখ আছে। বলা বাহুল্য, অধ্যাপক মুখােপাধ্যায় অশােকের ধর্মের যে নতুন বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন তা গৃহীত হলে ধর্মের এক রাজনৈতিক তাৎপর্য প্রতিভাত হবে। অর্থাৎ রাজ্যমধ্যে মানবিক মূল্যবােধের সম্প্রচার ও একইসঙ্গে রাজকর্তৃত্বের সুপ্রতিষ্ঠা – এই দ্বিমুখী উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে অশােক ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়ােগ কবেন। অধ্যাপক মুখােপাধ্যায় ধর্মের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে এই প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় লক্ষ করার মতাে –

  • প্রথমত, এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়, শর-ই-কুনা দ্বিভাষিক অভিলেখ অশােকের কোনও মূল প্রাকৃত অনুশাসনের আক্ষরিক তানুবাদ নয়, এটি গ্রিক ও আরামীয় সংস্করণ। কান্দাহার অঞ্চলের মাহামাত্ররা এই সংস্করণের কাজ সম্পন্ন করেন। তারা এ কাজ করেন প্রাকৃত ভাষা ও মূল অভিলেখ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ও উলব্ধির ভিত্তিতে। সেক্ষেত্রে নিছক গ্রিক সংস্করণের উপর নির্ভর করে ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা যক্তিসঙ্গত হবে না।
  • দ্বিতীয়ত, দাবি করা হচ্ছে, গ্রিক সংস্করণে রাজস্বার্থের প্রতি প্রজাদের ভক্তির কথা বলা হয়েছে অথচ জাঁ ফিলিঅজা’ ‘এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা’ পত্রিকায় শর-ই কুনা অনুশাসনের যে গ্রিক ও আরামীয় পাঠ প্রকাশ করেছেন তাতে প্রজাদের রাজভক্তির কোনও উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই (Epigraplia Indica, Vol. XXXIV, পৃষ্ঠা ১ হতে)। দীনেশচন্দ্র সরকার গ্রিক সংস্করণের যে ইংরেজি, প্রাকৃত ও সংস্কৃত অনুবাদ প্রকাশ করেন তাতেও এ ধরনের কোনও উক্তি নেই (শিলালেখ, তাম্ৰশাসনাদির প্রসঙ্গ, দ্বিতীয় সংস্করণ (কোলকাতা, ২০০৯), পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)।
  • তৃতীয়ত, সপ্তম ও ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে অশােক যে দিঢ়ভতিতার কথা বলেছেন তাকে রাজার প্রতি প্রজাদের ভক্তি এই অর্থে গ্রহণ করলে অর্থের বিকৃতি ঘটে। দিঢ়ভতিতার আক্ষরিক অর্থ দৃঢ়ভক্তি বা দৃঢ়-আসক্তি। এই ভক্তি বা আসক্তি নিজ নিজ ধর্মের প্রতি হতে পারে, শুভ কর্মের প্রতি হতে পারে, সদাচারের প্রতিও হতে পারে। অশােক এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। শর-ই-কুনা গ্রিক সংস্করণে রাজভত্তির উল্লেখ থাকলে বুঝতে হবে, কান্দাহার অঞ্চলের স্থানীয় মহামাত্ররা বিষয়টিকে তাদের মতাে করে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু অশােক তেমন কথা বলেননি। অশােক যদি রাজভক্তির কথা বলতেন তাহলে পদটি হত ‘দিঢ়লাজভতিতা’, ‘দিঢ়ভতিতা’ (অন্যান্য সংস্করণে ‘দঢ়ভতিতা’, ‘দিঢ়ভতিত) নয়।
  • চতুর্থত, পাণিনির ৪/৩/১০০ সংখ্যক সূত্রে জনপদবাসীদের বা প্রজাদের জনপদীদের অর্থাৎ জনপদের অধিপতিদের প্রতি ভক্তির উল্লেখ ধর্মের অঙ্গ রূপে অশােকের রাজভক্তি প্রচারের প্রমাণরূপে উপস্থাপন করা যায় না।

ধর্মপ্রচার : ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে অশােক যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন সপ্তম স্তম্ভলেখে তার বিশদ বর্ণনা আছে। একটি ব্যবস্থা হল ধর্মস্তম্ভ স্থাপন। কিন্তু ধর্মস্তম্ভ বলতে ঠিক কী বােঝায়, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় আছে। কেউ কেউ ধর্মস্তম্ভ বলতে অশােকের প্রথম ছ’টি স্তম্ভলেখ বুঝেছেন। আবার অনেকে অশােকের ধর্মপ্রচারের কথা ভেবেছেন। ধর্মস্তম্ভ বলতে সম্ভবত অশােকের সমগ্র ধর্মলেখগুলো বােঝানাে হয়েছে। শিলা ও স্তম্ভগাত্রে লেখ খােদাই করে অশােক তার ধর্মবাণীকে স্থায়িরূপ দিতে চেয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন, এর ফলে লােকেরা ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হবেন ও ধর্মের তানুশাসনে মন দেবেন। তাছাড়া, লেখ খােদাই করে অশােক তার বংশধরদের সামনে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন, যাতে তারাও ভবিষ্যতে ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন।  ধর্মের প্রচারকল্পে অশােক ধর্মমহামাত্র নামে এক শ্রেণির রাজপুরুষ নিযুক্ত করেন। ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের লােকদের তত্ত্বাবধান ছিল তাদের কাজ। সাম্প্রদায়িক কলহের যাতে নিবৃত্তি হয় এবং বিভিন্ন ধর্মের সর্বজনীন আদর্শের প্রতি যাতে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, তার জন্য ধর্মমহামাত্ররা বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। রাজুক, যুক্ত এবং প্রাদেশিকদের মতাে রাজপুরুষদের উপর ধর্মপ্রচারের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে অশােক ধর্মের প্রচার আরও জোরদার করেন। একই উদ্দেশ্যে অশােক কুপখনন, বৃক্ষরােপণ, বিশ্রামাগার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি জনহিতকর কাজে হাত দিয়েছিলেন। তার এসব জনকল্যাণমূলক কাজ দেখে জনগণ ধর্মে উৎসাহী হবেন, তার এই বিশ্বাস ছিল। ধর্মের প্রসারকল্পে অশােক তার বিহার বা প্রমােদযাত্রা বন্ধ করে দেন, প্রবর্তন করেন ধর্মযাত্রা। তীর্থস্থানাদি পরিদর্শন, ব্রাহ্মণ, শ্রমণ ও বৃদ্ধদের উদ্দেশ্যে দান-ধ্যান, গ্রামাঞ্চল পরিভ্রমণ ও ধর্মালােচনা ধর্মযাত্রার অঙ্গ ছিল। অশােকের পরিকল্পিত রাজকীয় ধর্মযাত্রা ধর্মপ্রচারের পথ সুগম করেছিল। প্রতিবেশী এবং বিদেশি রাজ্যে ধর্মপ্রচারের মুখ্য দায়িত্ব অশােক দূতদের উপর দিয়েছিলেন।

র্মপ্রচার অভিযানের মুল্যায়ন : দেশে-বিদেশে তার ধর্মপ্রচারের অভিযান যে সফল হয়েছিল, অশােক তা অকপটে ব্যক্ত করেছেন। নিজের ধর্মপ্রচারকে তিনি ধর্মবিজয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। প্রথম গৌণ গিরিশাসনে তিনি বলেছেন, দেবগণ এবং জম্বুদ্বীপবাসীদের মধ্যে পূর্বে কখনও যােগাযােগ ঘটেনি কিন্তু তিনি দেবলােক ও জম্বুদ্বীপের মিলন ঘটিয়েছেন। ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে অশােক দাবি করেছেন, শুধু তার নিজের রাজ্যে নয় বা চোল-পাণ্ড্য অঞ্চলে নয়, ভারতের বাইরেও বিশেষ করে এন্টিওকাস, টলেমি ফিলাডেলফাস, ম্যাগাস, এন্টিগােনাস গােনেটাস, আলেকজান্ডার প্রমুখ বিদেশি রাজাদের রাজ্যেও তার ধর্মপ্রচার সফল হয়েছিল। এসব বিদেশি রাজারা যথাক্রমে সিরিয়া, মিশর, ম্যাসিডােনিয়া, উত্তর আফ্রিকার সাইরিন ও এপিরাস (মতান্তরে কোরিন্থ) অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। তাম্ৰপর্ণী বা শ্রীলঙ্কাও যে তার ধর্মমত গ্রহণ করেছিল ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কিন্তু পশ্চিম এশিয়া, ইউরােপ এবং আফ্রিকায় ধর্মপ্রচারে অশােকের সাফল্যের দাবি অনেকখানি অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। বৌদ্ধ সাহিত্যে অশােকের দাবির আংশিক সমর্থন আছে, কিন্তু পরিপূর্ণ সায় নেই। এসব অঞ্চলে যে অশােকের ধর্মমতের প্রসার ঘটেছিল, তার কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই।

অশােক ও বৌদ্ধধর্ম

অশােকের ধর্মপ্রচার আসলে বৌদ্ধধর্মের প্রসার, না শাশ্বত মানবিক মূল্যবােধের সম্প্রচার, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ বিতর্ক থাকবে। তবে অশােকের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকবার কথা নয়। কলিঙ্গ যুদ্ধের বছরখানেক পরই যে অশােক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতি তার আনুগত্য তিনি বৈরাট অনুশাসনে অকপটে ব্যক্ত করেছেন। বুদ্ধের ললিত বাণীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তিনি করেছেন ওই একই অনুশাসনে ‘ভগবতা বুধেন ভাসিতে সবে সে সুভাসিতে বা’ – এ কথা তারই। এর অর্থ, ভগবান বুদ্ধ যা বলেছেন, তা সুভাসিত। রাজত্বের শেষের দিকে তিনি বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী পরিদর্শন করেন। গ্রামবাসীদের রাজস্ব হ্রাস করে তিনি বুদ্ধের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। বৌদ্ধ সংঘের কাজ-কর্মে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। সংঘ যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকে, সেদিকে তার প্রখর দৃষ্টি ছিল। ভিক্ষু ভিক্ষুণীদের সতর্ক করে তিনি বলেছেন, সংঘে বিভেদসৃষ্টির কোনও অপচেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না। যদি কেউ বিভেদের বীজ বপন করেন, বহিষ্কারই হবে তার সমুচিত শাস্তি। এ আদেশ যথাযথ কার্যকর করতে তিনি মহামাত্রদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্মের মর্মবাণী সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে অশােক বিশেষ কয়েকটি বৌদ্ধ সূত্র বা অনুচ্ছেদের উপর সমধিক গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, ভিক্ষু-ভিক্ষুণী এবং উপাসক-উপাসিকারা তাদের আত্মােন্নতির জন্য নিয়মিতভাবে এগুলো পড়ুন ও এগুলো নিয়ে আলাপ আলােচনা করুন। অশােকের নির্বাচিত সূত্র বা অনুচ্ছেদগুলোর মধ্যে রয়েছে : 

  • (১) ‘বিনয়সমুকসে’ : বিনয়সমুৎকর্ষঃ, বিনয়ের উৎকর্ষতা। এখানে অশােক ‘মহাবগ্‌গ’-এর ‘ধম্মচক্কপবত্তন-সুত্ত’ না ‘সুত্তনিপাত’-এর ‘তুবটক-সুত্ত’-এর কথা বলছেন, তা স্পষ্ট নয়।
  • (২) ‘অলিয়বসানি’ : আর্যাবাসাঃ, আর্যোচিত জীবন-যাপন। অশােকের লক্ষ্য ‘দীঘনিকায়’ এর ‘সঙ্গীতিসুত্তন্ত’ ও ‘দসুত্তরসুত্তন্ত’ না ‘অঙ্গুত্তরনিকায়’-এর ‘অরিয়বংস সুত্ত’? বিষয়টি বিতর্কিত।
  • (৩) ‘অনাগতভয়ানি’ : ভবিষ্যতের ভয়। এখানে ‘অঙ্গুত্তরনিকায়’-এর ‘অনাগতভয়-সুত্ত’-এর কথা বলা হয়েছে।
  • (৪) ‘মুনিগাথা’ : গাথার অর্থ সঙ্গীত। মুনির গাথা বা মুনির উদ্দেশ্যে গাথা, এই অর্থে মুনিগাথা। ‘সুত্তনিপাত’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘মুনিসুত্ত’-এর স্তবকগুচ্ছ। 
  • (৫) ‘মােনেয়সূতে’ : মৌনেয়সূত্র, মুনিজীবনীমূলক সূত্র। ‘অঙ্গুত্তরনিকায়’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘মােনেয্যসুত্ত’।
  • (৬) ‘উপতিস-পসিনে’ : উপতিষ্যপ্রশ্নঃ উপতিষ্যের প্রশ্নাবলি। অশােকের লক্ষ্য নিঃসন্দেহে ‘সুত্তনিপাত’-এর ‘সারিপুত্তসুত্ত”।
  • (৭) ‘লাধুল-ওবাদে’ : রাহুল-অববাদঃ, রাহুলের উদ্দেশ্যে বুদ্ধের উপদেশাবলি। এখানে ‘মজ্ঝি‌মনিকায়’-এর ‘রাহুলােবাদ-সুত্ত’-এর কথা বলা হয়েছে।

অশােক শুধু কি একজন সাধারণ উপাসক ছিলেন, না শ্রমণ হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে পণ্ডিতেরা নানা অভিমত প্রকাশ করেছেন। কারাের কারাের ধারণা, অশােক কার্যত একজন শ্রমণই বনে যান। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি শ্রমণও ছিলেন না, আবার উপাসক বলতে যা বােঝায়, ঠিক তাও ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভিক্ষুগতিক। অশােক জীবনভাের উপাসকই রয়ে যান, এমন মতও ব্যক্ত হয়েছে। সংঘের পরিচালনভার অশােক স্বহস্তে গ্রহণ করেছিলেন বলেও অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এক ব্যক্তির পক্ষে একই সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে শ্রমণের জীবন যাপন করা সম্ভবপর ছিল বলে মনে হয় না। সংঘের কাজে অশােক হস্তক্ষেপ করেছেন সত্য কিন্তু সেখানে তিনি রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। রাজা সংঘের শুভার্থী, উন্নতিকামী, কিন্তু তিনি সংঘের পরিচালনকর্তা নন।

লেখমালায় নেই, অশােকের বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগের এরকম অনেক কাহিনি বৌদ্ধ সাহিত্যে পরিবেশিত হয়েছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে অশােকের লুম্বিনী ও বােধগয়া পরিদর্শনের কথা তাে আছেই, উপরন্তু তার কপিলবস্তু, সাঙ্কাশ্য এবং কুশীনগর ভ্রমণেরও উল্লেখ আছে। দীক্ষান্তরের পর তিনি ৮৪ হাজার স্কুপ নির্মাণ করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। অশােকস্তুপের উল্লেখ শুয়েন চাঙের বর্ণনাতেও আছে। তবে সংখ্যাটি অবশ্যই অতিরঞ্জিত। | অন্ধ্রপ্রদেশের অমরাবতীর আদি বৌদ্ধস্তূপটি সম্ভবত অশােকেরই কীর্তি। গুন্টুর জেলার অমরাবতীতে প্রাকৃত ভাষায় রচিত একটি প্রাচীন ব্রাহ্মী অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়েছে (Epigraphia Indica, Vol. XXXV, (1963), Part 1, পৃষ্ঠা ৪০-৪)। অতিভগ্ন এক স্তম্ভগাত্রে লেখটি উৎকীর্ণ। লেখটিতে রাজার নাম বা অভিধা পড়া যায় না। কিন্তু যে স্তম্ভগাত্রে লেখটি উৎকীর্ণ সেটি বেলে পাথরের। বেলে পাথরের স্তম্ভে অশােকের বেশ কিছু লেখ উৎকীর্ণ হয়েছে। এই লেখের ভাষা ও লিপিও অশােকের লেখেরই অনুরূপ তাছাড়া এই লেখে একবচনে উত্তম পুরুষের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। অশােকের লেখমালার এটিও একটি বৈশিষ্ট্য। স্তম্ভখণ্ডটিও অতি মসৃণ এই মসৃণতা সাধারণত অশােকস্তম্ভে লক্ষিত হয়। দীনেশচন্দ্র সরকার অনুমান করেন হয়তাে মৌর্যরাজ অশােকই এ লেখটি উৎকীর্ণ করেছেন। এ অনুমান সঠিক হলে বুঝতে হবে অমরাবতীর আদি বৌদ্ধস্তুপটি অশােকের রাজত্বকালেই নির্মিত হয়।

লেখে বলা নেই, অথচ বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লেখ আছে, অশােকের বৌদ্ধধর্ম পৃষ্ঠপােষকতার আর একটি নিদর্শন তৃতীয় মহাসংগীতির অনুষ্ঠান। অধিবেশনটি পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত হয়, পৌরােহিত্য করেন ভিক্ষু মােগগলিপুত্ত তিসস (মতান্তরে উপগুপ্ত)। অধিবেশন শেষে বৌদ্ধধর্মের প্রসারকল্পে শ্ৰমণদের নানা দেশে পাঠানাে হয়। শ্রমণ মজ্ঝ‌ন্তিক যান কাশ্মীরে ও গান্ধারে, মহারক্ষিত গিয়েছিলেন যবনদেশে বা গ্রিক অঞ্চলে, মজ্ঝি‌ম যাত্রা করেন হিমালয় অঞ্চলের উদ্দেশ্যে, যবন ধর্মরক্ষিত উপস্থিত হন অপরান্তকে, মহাদেব হাজির হন মহিষমণ্ডলে (সম্ভবত কর্ণাটক)। রক্ষিতকে পাঠানাে হয় বনবাসি বা কর্ণাটকের উত্তরাঞ্চলে এবং সােণ ও উত্তরকে সুবর্ণভূমিতে (মায়ানমার বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া)। মহেন্দ্র ও তার অনুগামীদের ওপর শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত হয়। অশােকের অনুশাসনে তৃতীয় মহাসংগীতির কোনও উল্লেখ নেই। সেজন্য অশােকের রাজত্বকালে বড় ধরনের কোনও বৌদ্ধ সম্মেলন আদৌ অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা, সে সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

শাসন-ব্যবস্থা

রাজ্যপরিচালন-ব্যবস্থায় প্রথমদিকে অশােক তার পিতা-পিতামহের অনুসৃত নীতিই অনুকরণ করেন। প্রশাসন, সামরিক ও বিচার, সর্ব ক্ষেত্রে রাজার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। কিন্তু রাজার এই কর্তৃত্ব সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্ববােধের জাগরণ হয়নি। অশােকের লেখে মন্ত্রীর উল্লেখ নেই। তবে বৌদ্ধ সাহিত্যে রাধাগুপ্ত নামে তার এক অগ্রামাত্য বা প্রধানমন্ত্রীর কথা বলা হয়েছে। উপরাজ এবং যুবরাজের কথাও আছে বৌদ্ধ সাহিত্যে। অশােকের অনুশাসনে পরিষদের উল্লেখ আছে। রাজার আদেশ নিয়ে পরিষদে মাঝে মাঝে বিতর্ক উঠত তার আভাসও আছে। অশােকের পরিষৎ সম্ভবত অর্থশাস্ত্রের মন্ত্রিপরিষদের অনুরূপ এক সংস্থা ছিল।

পূর্বে যেমন ছিল, অশােকের সময়ও মৌর্য সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। গান্ধার, অবন্তি, দক্ষিণাপথ, উত্তর কলিঙ্গ, দক্ষিণ কলিঙ্গ এবং সৌরাষ্ট্র, এই ছিল মােট ছ’টি প্রদেশ (অনেকে বলেন, অশােকের শাসনকালে ওডিশা একটি অখণ্ড প্রদেশ ছিল। কিন্তু কলিঙ্গ অনুশাসন দু’টির সাক্ষ্য অন্যরূপ)। তক্ষশিলা, উজ্জয়িনী, সুবর্ণগিরি, তােসলী এবং সমাপা যথাক্রমে প্রথম পাঁচটি প্রদেশের রাজধানী ছিল। গিরনার ছিল সম্ভবত সৌরাষ্ট্রের রাজধানী। তাছাড়া বাংলা-বিহারকে নিয়ে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলও ছিল। প্রদেশের শাসনভার সাধারণত রাজপুত্রদের ওপর পড়ত। এ নিয়মের যে ব্যতিক্রম হত না, তা নয়। মহামাত্র নামে পদস্থ কর্মচারীদের উপর দক্ষিণ কলিঙ্গের শাসনভার অর্পিত হয়েছিল। সৌরাষ্ট্রের শাসনকর্তা ছিলেন একজন গ্রিক, নাম তুষাস্ফ। কেউ কেউ তুষাকে পারসিক, কেউবা পহলব বলে সনাক্ত করেছেন।

অধ্যাপক ভাণ্ডারকর মনে করেন, অশােকের আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা সকলে সমান অধিকার ভােগ করতেন না। তার মতে কলিঙ্গের শাসনকর্তার তুলনায় গান্ধার ও অবন্তির শাসকদের ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল। স্বমতের সমর্থনে অধ্যাপক ভাণ্ডারকর কয়েকটি যুক্তির কথা বলেছেন –

  • প্রদেশের কোথাও অবিচারের ঘটনা ঘটছে কিনা, তা দেখার জন্য গান্ধার ও অবন্তির শাসনকর্তারা প্রতি তিন বছর অন্তর নিজেদের দায়িত্বে মহামাত্রদের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতেন। কিন্তু কলিঙ্গের শাসনকর্তার সে অধিকার ছিল না, অশােক নিজের হাতেই সে দায়িত্ব রেখেছিলেন।
  • কলিঙ্গের শাসককে কোনও নির্দেশদানের সময় অশােক স্থানীয় মহামাত্রদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। কিন্তু অবন্তি ও গান্ধারের ক্ষেত্রে তিনি শুধু সেখানকার শাসকদের প্রতিই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন।
  • কলিঙ্গে শাসনকর্তা থাকা সত্ত্বেও অশােক স্থানীয় মহামাত্র ও নগরব্যবহারকদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ রক্ষা করতেন, গান্ধার বা অবন্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা ছিল না।

উপরের যুক্তিগুলো উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তবে এগুলোর অন্য ব্যাখ্যাও সম্ভব। কলিঙ্গ নতুন প্রদেশ বলে হয়তাে অশােক একটু বেশি সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন। সাধারণ প্রজাদের সঙ্গে যিনি প্রত্যক্ষ যােগাযােগ রক্ষা করে চলতেন, সেই অশােকের অবন্তি বা গান্ধারের পদস্থ রাজপুরুষদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ থাকবে না, এ বিশ্বাস হয় না। সদ্য অধিকৃত অঞ্চলে দুর্বল প্রশাসক নিযুক্ত হবেন, তা ভাবা যায় না। 

অশােকের লেখমালায় উল্লিখিত অন্যান্য রাজপুরুষদের মধ্যে আছেন (১) মহামাত্র (২) মুখ্য (৩) রাষ্ট্রিক (৪) রাজুক (৫) প্রদেশিক বা প্রাদেশিক (৬) যুক্ত (৭) নগর-ব্যবহারক (৮) পুরুষ (৯) প্রতিবেদক (১০) দূত (১১) আয়ুক্ত (১২) ব্রজভূমিক (১৩) লিপিকর এবং (১৪) কারণিক বা কারণক। এদের কাজগুলো ছিল –

  • মহামাত্র : অনেকে মহামাত্রদের মন্ত্রীদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পদস্থ কর্মচারী হলেও মহামাত্ররা মন্ত্রী নন। তাদের আধুনিক ভারতের আই.এ.এস. অফিসারদের সঙ্গে তুলনা করা চলে। কেন্দ্রে ও প্রদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা অধিষ্ঠিত ছিলেন। কাজের বিভিন্নতা হেতু তাদের খেতাবও ভিন্ন। সাধারণ মহামাত্রদের উপর সাধারণ প্রশাসন, নগরপ্রশাসন, জরুরি ও পরিদর্শনমূলক কাজের ভার ছিল। যারা সীমান্তের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের অন্তমহামাত্র বলা হত। কেউ কেউ মনে করেন, অন্তমহামাত্ররা প্রতিবেশী রাজ্যে ধর্মপ্রচার ও জনকল্যাণমুখী কার্যাদি সম্পন্ন করতেন। এ মত সমর্থনযােগ্য নয়। প্রতিবেশী রাজ্যে এসব কাজ যে দুতেরা পালন করতেন, ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে তার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। স্ত্রধ্যক্ষ মহামাত্ররা মহিলাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশােনা করতেন। অনেকে এদের অর্থশাস্ত্রের গণিকাধ্যক্ষদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
  • মুখ্য : মহামাত্রদের মতাে মুখ্যরাও বিভিন্ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। রাজপরিবারের দান-ধ্যানাদি কাজের তত্ত্বাবধান তাদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল।
  • রাষ্ট্রিক : মৌর্যযুগের এক প্রশাসনিক বিভাগের নাম ছিল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র একটি প্রশাসনিক বিভাগ ঠিকই, কিন্তু প্রদেশ ও জেলার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী তা নির্ধারণ করা কঠিন। রাষ্ট্রের যিনি শাসক, তিনি রাষ্ট্রিক।
  • রাজুক : জেলার মুখ্য প্রশাসক রাজুক। ‘রজ্জু‌’ থেকে রাজুক। জমি জরিপ বা অপরাধীকে বাঁধার জন্য এই দড়ি। জমি জরিপ অথবা অপরাধীকে খুঁজে বের করা রাজুকের এক কাজ ছিল।
  • প্রাদেশিক : প্রাদেশিক ফৌজদারি মামলার বিচার করতেন। পদটি নিদের্শর্থক দিশ’ ধাতু থেকে নিস্পন্ন, প্রদেশ থেকে নয়। তারা অর্থশাস্ত্রের প্রদেষ্টার সঙ্গে তুলনীয়। তাদের প্রদেশপাল বলে ভাবা ঠিক নয়।
  • যুক্ত : যুক্তরা রাজস্ব বিভাগের কর্মচারী ছিলেন। অর্থগৃধতার জন্য অর্থশাস্ত্রে তাদের নিন্দা করা হয়েছে।
  • নগরব্যবহারকরা পৌর প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন।
  • পুরুষ : অশােক পুরুষ বলতে কোনও বিশেষ শ্রেণির কর্মচারী বা কর্মচারী-সাধারণকে বুঝিয়েছেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়। পদস্থ, মধ্যম এবং অধস্তন, এই তিন শ্রেণির পুরুষের কথা লেখমালায় বলা হয়েছে। অনেকে এই পুরুষদের সঙ্গে অর্থশাস্ত্রের গৃঢ়পুরুষদের তুলনা করেছেন।
  • প্রতিবেদক : রাজ্যের ঘটনাবলি রাজার গােচরে আনা প্রতিবেদকদের কাজ ছিল। তারা যে কোনও সময় রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারতেন। 
  • দূত : প্রতিবেশী এবং দূরবর্তী রাজ্যে রাজার প্রতিনিধিত্ব করা, বিশেষত ধর্মের প্রসার ঘটানাে, দূতদের কাজ ছিল। অর্থশাস্ত্রে নিসৃষ্টার্থ, পরিমিতার্থ এবং শাসনহর, এই তিন শ্রেণির দূতের উল্লেখ আছে।
  • আয়ুক্ত : সীমান্ত অঞ্চলে ধর্মপ্রচার প্রসঙ্গে দ্বিতীয় কলিঙ্গ অনুশাসনে আয়ুক্তদের কথা বলা হয়েছে। পরবর্তী যুগে তারা গ্রাম বা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
  • ব্রজভূমিক : ব্রজভূমিকরা চারণভূমির পরিদর্শক ছিলেন। এদের অর্থশাস্ত্রের বিবীতাধ্যক্ষদের সঙ্গে তুলনা করা চলে। ‘গােরুর খোঁয়াড়’ এই সংকীণ অর্থে অনেকে ‘ব্রজ’ পদের ব্যাখ্যা করেছেন।
  • লিপিকর : লেখ লেখার কাজ ছিল লিপিকরদের। তারা যে মাঝে মাঝে ভুল-ভ্রান্তি করতেন, অশােক তার উল্লেখ করেছেন।
  • কারণিক বা কারণক : কারণিক বা কারণকরা সম্ভবত বিচারবিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। 

প্রশাসনিক সংস্কার

অশােক শাসনব্যবস্থায় কয়েকটি উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন সাধন করেন। রাজার দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে এক নতুন মূল্যবােধ তিনি প্রচার করেন। তিনি ঘােষণা করলেন, প্রজারা রাজার সন্তান (প্রজা রাজার সন্তান, এ কথা অশােকের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ব্যাবিলােনিয়ার রাজা হাম্বুরাবি ঘােষণা করে গেছেন (T.W. Wallbank, A. N. Taylor and N. M. Bailkey, Civilization : Past and Present (Chicago, 1962) , পৃষ্ঠা ১৯))। ‘সবে মুনিসে পজা মমা’, এ অশােকের নিজের উক্তি। প্রথম কলিঙ্গ অনুশাসনের ধৌলি সংস্করণে এই উক্তিটি আছে। কথাটিকে সংস্কৃতে তর্জমা করলে এইরূপ দাঁড়ায় : ‘সর্বে মনুষ্যাঃ প্রজাঃ মম’। সংস্কৃত প্রজা শব্দের অর্থ পুত্র। তিনি বলেন, শুধু নিজ সন্তানদের নয়, সকল মানুষের ঐহিক ও পারলৌকিক সুখ-সমৃদ্ধি তার কাম্য। প্রজার প্রতি তার এই পিতৃত্ববােধ তিনি রাজপুরুষদের মধ্যেও সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। রাজুকদের তিনি সুনিপুণ ধাত্রীর আদর্শ অনুসরণের আবেদন জানালেন। তিনি বলেন, পিতা যেমন তার সন্তানের ভার নিশ্চিন্তে ধাত্রীর হাতে সঁপে দেন, তিনিও তেমনি প্রজাদের শুভাশুভের ভার রাজুকদের হাতে তলে দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, কর্মচারীরা যেমন তার নিকট দায়বদ্ধ, তিনি দায়বদ্ধ প্রজার কাছে। তার যাবতীয় কাজের লক্ষ্য একটাই – প্রজাদের ঋণ শােধ করা।

রাজার দায়িত্ব সম্পর্কে নিজস্ব মূল্যবােধের সঙ্গে সংগতি রেখে অশােক কয়েকটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথমত, তিনি যুক্ত, রাজুক এবং প্রাদেশিকদের প্রতি তিন বছর অন্তর রাজ্য সফরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অশােক পরিদর্শনমূলক ভ্রমণ বা সফর অর্থে ‘অনুসংযান’ পদটি ব্যবহার করেছেন। কেউ কেউ ভুল করে পদটিকে সরকারি কর্মচারীদের বদলি অর্থে গ্রহণ করেছেন। কলিঙ্গের মহামাত্রদের প্রতি পাঁচ বছর এবং অবন্তি ও গান্ধারের মহামাত্রদের প্রতি তিন বছর অন্তর এরূপ রাজ্য পরিদর্শনে বের হতে হত। যাতে অবিচারের প্রতিবিধান হয় এবং নির্দোষ ব্যক্তিদের অযথা হয়রানি বন্ধ হয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। একই উদ্দেশ্যে অশােক নিজেও মাঝে মাঝে রাজ্য পরিভ্রমণে বের হতেন। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচার এবং দুর্নীতির অপসারণের জন্য অশােকের এ প্রতিষেধক ব্যবস্থা।

জনকল্যাণের আদর্শ সামনে রেখে অশােক তার অভিষেকের ত্রয়ােদশ বছরে ধর্মমহামাত্র নামে নতুন এক শ্রেণির রাজকর্মচারী নিয়ােগ করেন। ধর্মের প্রচার ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের রক্ষণাবেক্ষণ তাদের আশু কর্তব্য ছিল। তাছাড়া যবন, কম্বােজ, গান্ধার, রাষ্ট্রিক, পিতিনিক, নাভপন্তি, ভােজ, অন্ধ, পুলিন্দ প্রভৃতি লােকদের স্বার্থ সংরক্ষণ, সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠা, আর্ত বৃদ্ধদের সেবা, ক্ষেত্র বিশেষে কয়েদিদের মুক্তিদান, প্রজাদের প্রতি রাজকর্মচারীদের অন্যায়-অবিচারের প্রতিবিধান ইত্যাদি বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব অশােক তাদের দিয়েছিলেন। প্রতিবেদক বা সংবাদদাতাদের অশােক রাজদর্শনের অবাধ সুযােগ প্রদান করেন। এর ফলে একদিকে যেমন প্রশাসনের উপর তার কর্তৃত্ব সুদৃঢ় হয়, অন্যদিকে তেমনি রাজ্যের ঘটনাবলি সম্পর্কে তিনি সদা অবহিত থাকতেন। বিচার ব্যবস্থায়ও অশােক কয়েকটি সংস্কার সাধন করেন। সংস্কারগুলো হল : (১) দণ্ড ও ব্যবহার সমতার প্রবর্তন ; (২) ফৌজদারি দণ্ডবিধির কঠোরতা হ্রাস এবং (৩) প্রতি রাজ্যাভিষেক বার্ষিকীতে কিছু সংখ্যক কয়েদির মুক্তিদানের ব্যবস্থা। 

অশােকের শাসনব্যবস্থা নিঃসন্দেহে উদার, মানবিক ও জনকল্যাণমুখী ছিল। কিন্তু এ শাসনব্যবস্থা জনপ্রতিনিধিমূলক ছিল না। তাছাড়া এই শাসনব্যবস্থা ছিল মূলত কেন্দ্রাভিমুখী। সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন রাজা। ফলে রাজার ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের উপরই শাসনব্যবস্থার সাফল্য সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অশােক আপন যােগ্যতাবলে যে শাসনযন্ত্রকে সক্রিয় ও সচল করে রেখেছিলেন, তার দুর্বল উত্তরাধিকারিগণের হাতে পড়ে সে শাসনযন্ত্র অচলায়তনের রূপ নেয়। বৈদেশিক নীতি প্রতিবেশী এবং বিদেশি রাজ্যগুলোর সঙ্গে অশােক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তােলেন। এই সম্পর্ক গড়ে তােলার পেছনে তার কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। কলিঙ্গ জয়ের পর তিনি সাম্রাজ্যবাদী নীতি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন। পরিবর্তে বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের উপর তিনি গুরুত্ব আরােপ করেন। 

দ্বিতীয় এবং ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে অশােক প্রতিবেশী এবং বিদেশি রাজ্যগুলোর উল্লেখ করেছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজ্যের পরিবর্তে তার রাজার নামােল্লেখ করা হয়েছে। এসব রাজ্য বা রাজাদের ভারতীয় এবং বিদেশি এই দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে চোল, পাণ্ড্য, সত্যপুত্র এবং কেরলপুত্র। দ্বিতীয় মুখ্য গিরিশাসনে কেরলপুত্র রাজ্যটিকে কখনও কেরলপুত্র, আবার কখনও বা কেতলগুতাে বলা হয়েছে। সত্যপুত্র রাজ্যটিকে সতিয়পুতাে বা সতিয়পুত্র বলা হয়েছে (R. G. Bask : Asokal Inscriptions (Calcutta, 1959), পৃষ্ঠা ৫)। রাজ্যগুলো সব দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত। বিদেশি রাজাদের মধ্যে অশােক যাদের উল্লেখ করেছেন তারা হলেন সিরিয়ার রাজা দ্বিতীয় এন্টিওকাস (২৬১-২৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), মিশররাজ দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাস (২৮৫-২৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), উত্তর আফ্রিকার সাইরিনের রাজা ম্যাগাস (৩০০-২৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), ম্যাসিডােনিয়ার রাজা এন্টিগােনাস গােনেটাস (২৭৮-২৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং এপিরাস (২৭২-২৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বা কোরিন্থের (২৫ ২-২৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজা আলেকজান্ডার। এসব রাজ্যে অশােক দু’ধরনের কাজের অনুষ্ঠান করেন। এক. জনহিতকর কাজের অনুষ্ঠান, এবং দুই. ধর্মের প্রচার। পশু ও মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা, ওষধি রােপণ, পথের ধারে কূপ খনন ইত্যাদি কাজ জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুচিকিৎসার ব্যবস্থাকল্পে তিনি সম্ভবত বিভিন্ন রাজ্যে চিকিৎসক পাঠিয়েছিলেন। লক্ষ করবার বিষয়, অশােক দ্বিতীয় মুখ্য গিরিশাসনে মনুষ্য চিকিৎসা ও পশু চিকিৎসার কথা বলেছেন কিন্তু চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করেননি। সুতরাং অশােক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও তিনি যে হাসপাতাল স্থাপন করেছিলেন তা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায়ের মত ভিন্ন। তার মতে চিকিৎসা কথাটির মধ্যে ডাক্তার, ওষুধ ও হাসপাতাল, এই তিনটি জিনিসই নিহিত আছে। বিদেশে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি দূতগণকে সেখানে প্রেরণ করেন। সর্বত্র তার ধর্মপ্রচার বা ধর্মবিজয় অভিযান পরিপূর্ণ সফল হয়েছিল বলে তিনি দাবি করেছেন। কিন্তু অশােকের ধর্ম গ্রিকদের উপর সেরকম প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে হয় না। অশােকের মৃত্যুর পর মৌর্যশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে এই গ্রিকরাই ভারত আক্রমণ করেন। 

খােটান, সুবর্ণভূমি এবং শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারে অশােকের অগ্রণী ভূমিকার উল্লেখ আছে বৌদ্ধ সাহিত্যে। অশােকের অনুশাসনে অবশ্য খােটান বা সুবর্ণভূমির কথা নেই। কথিত আছে, তিনি নাকি স্বয়ং খােটান পরিদর্শন করেন। এই সংবাদের উৎস তিব্বতি বৌদ্ধ সাহিত্য। সিংহলি বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায়, অশােকের রাজত্বকালে সােণ এবং উত্তর নামে দু’জন ভিক্ষু সুবর্ণভূমিতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। শ্রীলঙ্কার তদানীন্তন রাজা দেবানাং প্রিয় তিষ্য অশােকের অনুকরণে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন বলে সিংহলি বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লেখ আছে। অশােকের পুত্র এবং কন্যা (মতান্তরে ভাই ও বােন) মহেন্দ্র এবং সংঘমিত্রা বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীলঙ্কায় গমন করেন। তারা শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন। 

সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি

মৌর্য স্থাপত্য, ভাষ্কর্য, লেখ ও ফলক : বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন অশােক। তার পূর্বে বা পরে ভারতে এত বড় সাম্রাজ্য কখনও গড়ে ওঠেনি। অশােকের নিজস্ব অনুশাসন, তার স্থাপত্যের নিদর্শন এবং পরবর্তিকালের সাহিত্যিক উপাদানের সাক্ষ্যে এর সমর্থন মেলে। ভারতের বাইরে ও ভেতরে বিভিন্ন স্থানে অশােকের লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতের বাইরে যে সকল স্থানে অশােকের অনুশাসন পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে আছে আফগানিস্তানের লঘমান ও কান্দাহার, পাকিস্তানের শাহবাজগঢ়ী ও মানসেরা এবং নেপালের লুম্বিনী ও নিগলিব। ভারতে অবস্থিত স্থানগুলোর মধ্যে আছে উত্তর ভারতের হিমাচলপ্রদেশের কালসি, পাঞ্জাবের তােপরা এবং উত্তরপ্রদেশের মিরাট, এলাহাবাদ, কৌশাম্বী ও সারনাথ, পূর্ব ভারতের বিহারের সাসারাম, লৌরিয় অররাজ, লৌরিয় নন্দনগড়, রামপুরবা ও বরাবর পাহাড় এবং ওড়িশার ধৌলি ও জৌগড়, পশ্চিম ভারতের রাজস্থানের বৈরাট, গুজরাতের গিরনার এবং মহারাষ্ট্রের সােপারা, মধ্য ভারতের মধ্যপ্রদেশের সাঁচী, রূপনাথ, গুজররা ও পাঙ্গুড়ারিয়া এবং দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের এড্‌ড়াগুড়ি, গবীমঠ, পালকীগুণ্ডু ও রাজুলামণ্ডগিরি এবং কর্ণাটকের মাসকি, সিদ্দাপুর, জটিঙ্গ রামেশ্বর, ব্রহ্মগিরি, নিট্টুর এবং উডেগােলাম। দেখা যাচ্ছে, বেলুচিস্তান, সিন্ধুপ্রদেশ, কাশ্মীর, কেরল, তামিলনাড়ু, বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও মেঘালয় বাদে আফগানিস্তান ও নেপালসহ অবিভক্ত ভারতের প্রায় সর্বত্র অশােকের লেখমালা পাওয়া গেছে। মৌর্যস্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শনও মূলত উপরােক্ত ভৌগােলিক পরিমণ্ডলে আবিষ্কৃত হয়েছে। কর্ণাটকের গুলবর্গা জেলার কনগলহল্লিতে অন্যান্য প্রত্নাবশেষের সঙ্গে এক ভগ্ন ভাস্কর্যফলকের সন্ধান পাওয়া গেছে। ফুলকটিতে অঙ্কিত হয়েছে এক রাজা ও রানির দন্ডায়মান মূর্তি। রাজা ও রানি রমণী পরিবৃত। ফলকটিতে ব্রাহ্মী অক্ষরে ও প্রাকৃত ভাষায় মুদ্রিত আছে রাজা অশােকের নাম। ফলকটি সাতবাহন যুগের স্থানীয় এক মহাস্তুপের অঙ্গদেশে শােভমান ছিল (K. P. Poonacha, E.xcavations at Mahastupa, Kanaganahalli, Chitapur Taluk, Gulbarra District, Karnataka (11977 2000), Published by Archaeological Servey of India (New Delhi, 2007)।

বিভিন্ন জাতির উল্লেখ : ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে প্রজাদের প্রসঙ্গে অশােক যবন বা গ্রিক, কম্বােজ, নাভপংতি, ভােজ, পিতিনিক, অন্ত্র এবং পুলিন্দদের উল্লেখ করেছেন। পঞ্চম মুখ্য গিরিশাসনে যবন, কম্বােজ এবং পিতিনিকদের সঙ্গে গান্ধার ও রাষ্ট্রিকদের কথাও বলা হয়েছে। গ্রিকরা সম্ভবত ব্যাক্ট্রিয়া (বলখ) বা আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। কম্বােজগণের বাস ছিল কাফিরিস্তান (বর্তমান নুরীস্তান) – পুঞ্চ অঞ্চলে। পেশােয়ার-রাওয়ালপিণ্ডি-তক্ষশিলা অঞ্চলের প্রাচীন নাম গান্ধার। রাষ্ট্রিকরা মহারাষ্ট্রে বাস করতেন। বিদর্ভ ছিল ভােজদের বাসভূমি। নাভপংতিরা সম্ভবত কম্বােজগণের প্রতিবেশী ছিলেন। নেপালে তাদের বাস ছিল, এ মতও কেউ কেউ পােষণ করেন। গােদাবরী অববাহিকায় পিতিনিকদের বাস ছিল বলে অনেকের ধারণা। অন্ধরা সম্ভবত কৃষ্ণা-গুন্টুর অঞ্চলে বসবাস করতেন। পুলিন্দরা সম্ভবত বিন্ধ্য অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। অনেকে তাদের উত্তর বাংলার অধিবাসী বলে মনে করেন। কাশ্মীরে অশােকের কোনও লেখ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এ অঞ্চল তার রাজ্যভুক্ত ছিল। এখানকার অধিবাসী কম্বােজদের তিনি প্রজা বলে বর্ণনা করেছেন। চিনা পরিব্রাজক শুয়েন চাঙ কাশ্মীরে অশােকের তৈরি স্তুপ দেখেছিলেন। রাজতরঙ্গিণীর রচয়িতা কল্হ‌ণও কাশ্মীরে অশােকের অসংখ্য স্তুপ নির্মাণের কথা বলেছেন।

বাংলা : কাশ্মীরের মতাে পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশেও অশােকের কোনও লেখ আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু এ অঞ্চল নিঃসন্দেহে অশােকের শাসনাধীন ছিল। দিব্যাবদান গ্রন্থে প্রকাশ, উত্তর বাংলার পুণ্ড্রবর্ধনের জৈনরা বুদ্ধের প্রতিমূর্তির প্রতি একবার অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। এতে অশােকের মনে প্রতিহিংসা জেগে ওঠে। পুণ্ড্রবর্ধনের জৈনদের তিনি নাকি নির্বিচারে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। দিব্যাবদানের অশােকসম্পর্কিত কাহিনিটি হয়তাে সত্য নয়। কিন্তু অশােক যে এ অঞ্চলে, বিশেষত তাম্রলিপ্তি, কর্ণসুবর্ণ ও পুণ্ড্রবর্ধনে বৌদ্ধস্তুপ নির্মাণ করেছিলেন, শুয়েন চাঙ তার উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া বগুড়া জেলার মহাস্থান এবং নােয়াখালি জেলার সিলুয়া গ্রামে দুখানি লেখ আবিষ্কত হয়েছে। লেখ দুখানি মৌর্যপর্বের বা তার অব্যবহিত পরের। অসম ও মেঘালয় সম্ভবত অশােকের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এখানে শুয়েন চাঙ অপশােকের তৈরি কোনও বৌদ্ধস্তূপের সন্ধান পাননি।

কর্ণাটক : কর্ণাটক অবশ্যই অশােকের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত বহুসংখ্যক অনুশাসনই তার সুনিশ্চিত প্রমাণ। তার পিতা ও পিতামহ কর্ণাটকে রাজত্ব করেছেন। তিনি নিঃসন্দেহে উত্তরাধিকারসূত্রেই এ অঞ্চলের আধিপত্য লাভ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অশােক কেন সন্নতিতে দু’টি কলিঙ্গ অনুশাসন উৎকীর্ণ করলেন? তবে কি বুঝতে হবে তিনি কলিঙ্গের মতাে কর্ণাটকেও এক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন? এ ধারণার সমর্থনে যে কোনও ইঙ্গিত নেই, তা নয়। প্রথমত, এ অনুশাসন দু’টি ধৌলি ও জৌগড় সংস্করণের হুবহু পুনরুক্তি নয়। যে মূল ভাষ্য হতে এ দু’টি অনুশাসন উৎকীর্ণ হয়েছে সেটি ছিল এক স্বতন্ত্র উপাদান। দ্বিতীয়ত, এ দুটি অনুশাসনের যে অংশ পড়া যাচ্ছে তার কোথাও তােসলী বা সমাপার উল্লেখ নেই। হয়তাে এ দু’টি অনুশাসন কর্ণাটকের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে প্রচারিত হয়েছে, যেমনটি হয়েছে কলিঙ্গের ক্ষেত্রে। এসব ইঙ্গিত বা ভাবনা কিন্তু অশােকের তথাকথিত কর্ণাটক অভিযানের সুনিশ্চিত প্রমাণ নয়। মৌর্যনৃপতি কর্ণাটকে কোনও অভিযান পাঠালে তার কোনও এক অনুশাসনে সে ঘটনার উল্লেখ থাকত। তিনি তাে তার কলিঙ্গ বিজয়ের কথা স্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করেছেন। কর্ণাটকের ক্ষেত্রে তার অন্যথা হবে কেন? দ্বিতীয়ত, সন্নতিতে তথাকথিত কলিঙ্গ অনুশাসন দু’টিকে যে অবস্থায় পাওয়া গেছে তা মােটেই সন্তোষজনক নয়। অনুশাসন দু’টির সিংহভাগই বিনষ্ট, অবলুপ্ত। লুপ্ত অংশে কলিঙ্গের তােসলী ও সমাপার মতাে কর্ণাটকের দু’টি প্রশাসনিক কেন্দ্রের উল্লেখ ছিল, এমন ভাবনা কল্পনা-লালিত। তাছাড়া অশােকের অনুশাসনের কোনও দু’টি সংস্করণই ঠিক এক নয়। সেক্ষেত্রে প্রতিটি সংস্করণই স্বতন্ত্র, প্রতিটিরই উৎস ভিন্ন। তাহলে অশােক সন্নতিতে কলিঙ্গ অনুশাসন দু’টির স্থানীয় সংস্করণ প্রকাশ করলেন কেন? এ অনুশাসন দুটিতে তিনি রাজকীয় আদর্শ, রাজা-প্রজার পারস্পরিক সম্পর্ক ও মানবিক মূল্যবােধ সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন তা তার অপরাপর অনুশাসনে সচরাচর দেখা যায় না। এ অনুশাসন দু’টি প্রচার করে অশােক কর্ণাটকের ভারপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের তার নিজস্ব আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে অবহিত করেছেন, তাদের নিজস্ব দায়-দায়িত্ব, কর্তব্যকর্ম সম্পর্কেও তাদের সচেতন করে দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রশাসন-যন্ত্রকে আরও উদার, মানবিক ও প্রজামুখী করার আকুতি অশােককে কর্ণাটকে এ অনুশাসন দু’টির প্রচারে উদ্বুদ্ধ করেছে।

সাম্রাজ্যের সীমা : চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে পরাজিত করে সিন্ধু নদের পশ্চিমে হেরাট, কান্দাহার, মকরান ও কাবুল অধিকার করেছিলেন। এসব অঞ্চলে বিন্দুসার এবং অশােক তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। দক্ষিণ ভারতে অশােকের লেখ কর্ণাটক এবং অন্ধপ্রদেশে পাওয়া গেছে। চোল, পাণ্ড্য, সত্যপুত্র এবং কেরলপুত্রের মতাে রাজ্যগুলো দ্বিতীয় মুখ্য গিরিশাসনে প্রতিবেশী রাজ্যরূপে বর্ণিত হয়েছে। মনে হয়, দক্ষিণ দিকে অশােকের রাজ্যসীমা কর্ণাটকের চিত্রদুর্গ জেলা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের পেন্নার নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তাহলে বলা যায়, পশ্চিমে ইরানের পূর্ব সীমান্ত থেকে পূর্বে বাংলাদেশ এবং উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে চিত্রদুর্গ জেলা এবং পেন্নার নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন অশােক। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গিরিশাসন দুটিতে অশােক নিজের রাজ্য অর্থে “বিজিত” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ‘জম্বুদ্বীপ’ ও ‘পৃথিবী’ নাব্দ দু’টিও অশােক নিজের রাজ্য অর্থে ব্যবহার করেছেন।  

ইতিহাসে অশােকের স্থান

ভারতে তথা পৃথিবীতে কত রাজাই না এসেছেন! তাদের মধ্যে অনেকেই কালস্রোতে হারিয়ে গেছেন। কালের কপােলতলে যারা এখনও সমুজ্জ্বল, তারা সংখ্যায় বড় নগণ্য। অশােক সেই বিরল রাজাদেরই একজন, হয়তােবা অনন্য। রাজ্যজয় শক্তিমান রাজার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তির বশেই অশােকের কলিঙ্গ বিজয়। কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধে প্রভূত লােকক্ষয় এবং সাধারণ মানুষের অশেষ দুঃখ-দুর্দশা অশােকের মনে এক বিরাট পরিবর্তন আনে। সাধারণত বিজয় বিজয়ীকে প্রলুব্ধ করে, তাকে নতুন রাজ্যজয়ে প্ররােচিত করে। অশােকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটল। আত্মপ্রসাদের পরিবর্তে তার মন অনুশােচনায় ভরে গেল, তার অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল। লােকের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার জন্য তিনি নিজেকেই দায়ী করলেন। সংকল্প গ্রহণ করলেন, ভবিষ্যতে আর কখনও রাজ্যজয় করবেন না। রাজ্যজয়ের নীতি পরিহারের জন্য তিনি তার পুত্র-পৌত্রদেরও আহ্বান জানালেন। অথচ তখনও ভারতে চোল, পাণ্ড্য, প্রভৃতি কয়েকটি ছােট ছােট স্বাধীন রাজ্য ছিল। অশােক অনায়াসে তাদের জয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরঞ্চ সেসব প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সঙ্গে তিনি প্রেম ও সৌহার্দের সম্পর্ক গড়ে তােলেন। অশােকের এই আত্মিক উত্তরণ তার চরিত্রকে এক বিশেষ মর্যাদা দান করেছে। 

রাজকীয় দায়দায়িত্ব সম্পর্কে এক অভিনব মূল্যবােধের প্রবক্তারূপে অশােক বরণীয় হয়ে আছেন। রাজা-প্রজার সম্পর্ক শাসক-শাসিতের সম্পর্ক নয়, পিতা-পুত্রের মধুর সম্পর্ক, এই নীতি ভারতের মাটিতে তিনিই প্রথম ঘােষণা করেন। রাজা হয়েও তিনি স্বীকার করেন, রাজা প্রজার নিকট ঋণবদ্ধ, আর ন্যায় ও সত্যনিষ্ঠ আচরণের দ্বারাই রাজা সে ঋণ শােধ করেন। ধর্মমহামাত্র, নিয়ােগ, প্রতি তিন বা পাঁচ বছর অন্তর রাজকর্মচারীদের রাজ্য পরিক্রমার ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রশাসনিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে তিনি তার অকৃত্রিম প্রজানুরাগ প্রকাশ করেছেন। প্রজাদের প্রতি যথাযথ আচরণের জন্য তিনি বার বার রাজকর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য তিনি মাঝে মাঝে রাজ্যপরিক্রমায় বের হতেন,নানা বিষয় নিয়ে নিজে প্রজাদের সঙ্গে আলােচনা করতেন।

জাত-পাতের দেশ ভারতে সমদর্শিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শােক। আইনের চোখে ধনী দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার স্বীকার করে সামাজিক বৈষম্য তিনি অনেকখানি দুর করেন। ব্রাহ্মণ ও শ্রমণের প্রতি যেমন তিনি সকলকে শ্রদ্ধাশীল হতে বলেছেন, তেমনি ভৃত্য ও ক্রীতদাসদের প্রতি সদয় ব্যবহারের উপরও জোর দিয়েছেন। হিংসা-দ্বেষ মুক্ত এক অখণ্ড সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শে অশােক উদ্বুদ্ধ ছিলেন। লােকেরা নিজ ধর্মের প্রশংসা করবেন, আর অন্য ধর্মকে হেয় জ্ঞান করবেন, অশােক তার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি জনগণকে সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শুধু নিজ ধর্মের গ্রন্থ পাঠ করলেই চলবে না, অন্য ধর্মের গ্রন্থ পাঠ করে দৃষ্টির প্রসার ঘটাতে হবে। তিনি বলেছেন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লােকেরা সমবেত হবেন, পারস্পরিক ভাববিনিময়ের মাধ্যমে সহযােগিতার বাতাবরণ তৈরি করবেন। তার নিজের রাজ্যের ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ যাতে সদাচারে উদ্বুদ্ধ হন তার জন্য অশােক ধর্মপ্রচার করে গেছেন। তিনি তার ধর্মে মানুষের সর্বজনীন আদর্শগুলোকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, জীবজগতের প্রতি অহিংসা, পশুহত্যা পরিহার, দাস-ভূত্যের প্রতি সদয় ব্যবহারই ধর্ম। মাতা-পিতা, বন্ধু-বান্ধব, ব্রাহ্মণ-শ্রমণের সেবাই ধর্ম। বৃক্ষরােপণ, কূপখননের মতাে জনহিতকর কাজই ধর্ম। তার ধর্মে তিনি কোনও আচার অনুষ্ঠানের কথা বলেননি, বলেছেন সংযম, করুণা, আত্মশুদ্ধি ও মানবিক ঔদার্যের কথা। অশােকের ধর্মে হয়তাে বৌদ্ধধর্মের প্রতিফলন আছে কিন্তু এর সর্বজনীন, সর্বজনগ্রাহ্য রূপটি ভুলবার নয়। 

জনগণের ঐহিক ও পারত্রিক উন্নতিকল্পে অশােক যে কর্মযজ্ঞের আয়ােজন করেন, তা তার রাজ্যের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, প্রতিবেশী ও দূরবর্তী রাজ্যেও তা সম্প্রসারিত হয়। শুধু মনুষ্যজগতের জন্যই তার কর্মযজ্ঞ নয়, পশুজগতের প্রতি ছিল তার অন্তহীন সহানুভূতি। ফুলের চেয়েও যিনি কোমল, ক্ষেত্রবিশেষে আবার তিনি বজ্রের থেকেও কঠিন আদর্শের। প্রতি অবিচল নিষ্ঠা না থাকলে এমনটি ঘটে না। সর্বসাধারণের কল্যাণ যার কাম্য, তিনি নৈরাজ্য, বিচ্ছিন্নতাবাদ সমর্থন করবেন কেন? ইরানের পূর্ব সীমান্ত থেকে বাংলাদেশ এবং কাশ্মীর হতে পেন্নার নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের তিনি অধিপতি ছিলেন। অথচ এই বিশাল রাজ্য পরিচালনায় তিনি কিনা অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন! শাসনব্যবস্থাকে তিনি উদার, মানবিক ও জন কল্যাণমুখী করেছেন, অথচ নিজের কর্তৃত্ব শিথিল করেননি। তিনি তার রাজপুরুষদের সমদর্শী, হৃদয়বান হতে বলেছেন, দণ্ডবিধির কঠোরতা হ্রাস করেছেন, অনেক কয়েদির দণ্ড মকুফ করেছেন। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড তুলে দেননি। বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরও প্রশ্রয় দেননি। আইন অমান্যকারীদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, তারা যেন তাকে অস্ত্র ধরতে বাধ্য না করেন। রাজপুরুষদের কার্যকলাপ ও জনসাধারণের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য তিনি স্বয়ং রাজ্য পরিক্রমায় বের হতেন। তিনি জানতেন কী করে সারা রাজ্যে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হয়। রাজ্যের বিশালতা যে সুশাসনের পরিপন্থী নয়, অশােক তা প্রমাণ করে গেছেন। অশােকের চরিত্রে পরাক্রমের সঙ্গে প্রজ্ঞা ও মানবিকতার মণিকাঞ্চন যােগ ঘটেছিল। তাই তিনি মহান। 

অশােকের শেষ জীবন

বৌদ্ধগ্রন্থ দিব্যাবদানে অশােকের শেষ জীবনের কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা আছে। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বৃদ্ধ বয়সে অশােক রানি তিষ্যরক্ষিতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তিষ্যরক্ষিতা যুবরাজ কুণালের প্রতি বিরূপ ছিলেন। কুণাল যখন তক্ষশিলায়, তখন রানি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে সম্রাটের নামে মিথ্যা আদেশ পাঠিয়ে যুবরাজের দৃষ্টিশক্তি হরণ করান। দিব্যাবদানে বর্ণিত এই কাহিনির সত্যতা সম্পর্কে অনেকেই সংগত কারণে সংশয় প্রকাশ করেছেন। দিব্যাবদানে আরও বলা হয়েছে, জীবনের শেষ দিকে অশােক বৌদ্ধ সংঘের অনুকূলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করায় রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। তখন মন্ত্রীরা অনন্যোপায় হয়ে কুণালের পুত্র সম্প্রতির দ্বারস্থ হন। সম্প্রতি অশােকের যাবতীয় ক্ষমতা অধিগ্রহণ করে বৃদ্ধ সম্রাটকে কার্যত বন্দি করে রাখেন। জীবনের শেষ দিনগুলো তার বন্দিদশায় অতিবাহিত হয়। ঠিক এমনটি ঘটেছিল মােগল সম্রাট শাহজাহানের জীবনসায়াহ্নে, ঔরঙ্গজেবের কল্যাণে। দিব্যাবদানের এই কাহিনি সত্য হলে স্বীকার করতে হয় অশােক জীবনের গােধূলিবেলায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তার প্রমাণ কৈ? তবে জীবনের একেবারে পড়ন্ত বেলায় উত্তরাধিকারীর হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে তিনি স্বেচ্ছায় রাজকার্য থেকে অবসর নিয়ে ধর্মকার্যে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন, এমন একটি ধারণা হয়তাে অমূলক নয়। মহাবংস থেকে জানা যায়, অশােক ৩৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন। অভিষেক অনুষ্ঠানের পর থেকেই তার প্রকৃত রাজত্বের শুরু। কিন্তু কার্যত অশােক অভিষেকের ৪ বছর পূর্ব হতে রাজত্ব আরম্ভ করেন। তাহলে অশােক সর্বসমেত ৪১ বছর রাজত্ব করেছিলেন বলে মনে হয়। ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যার রাজত্বের সূচনা, ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার রাজত্বের পরিসমাপ্তি।

অশােকোত্তর পর্ব (২৩২ – ১৮০ খ্রি.পূ.) ও মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন

অশোকের পরবর্তী মৌর্য রাজাগণ

অশােকোত্তর পর্বের ইতিহাস এখনও অনেকটাই অস্পষ্ট। একেই তাে তথ্য কম, তার উপর তথ্যে তথ্যে অসংগতি। এমনকি অশােকের মৃত্যুর পর তার কোন পুত্র সিংহাসনে বসলেন, তা নিয়েও প্রাচীন গ্রন্থে পরস্পরবিরােধী তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। তবু মনে হয়, অশােকের মৃত্যুতে তার পুত্র কুণালই পিতৃসিংহাসনে আরােহণ করেন। কিন্তু কুণাল অন্ধ ছিলেন। স্বাভাবিক কারণে তার হয়ে তার পুত্র সম্প্রতি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। সম্ভবত কাশ্মীর এই সময় পাটলিপুত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে। সেখানে অশােকেরই আর এক পুত্র জলৌক স্বাধীন রাজা হয়ে বসেন। পিতার মৃত্যুর পর সম্প্রতি নিজের নামে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। জৈনধর্মের পৃষ্ঠপােষকরূপে প্রাচীন জৈন সাহিত্যে তার সপ্রশংস উল্লেখ আছে। দশরথ নামে অশােকের আর এক পৌত্রের কথা জানা যায়। বিহারের নাগার্জুনী পাহাড়ে তার তিনখানি গুহালেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকের মতে এই সময় মৌর্য সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম এই দুটি অংশে বিভক্ত হয়। দশরথ হন পূর্বাঞ্চলের রাজা, আর সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চলের। এ মত প্রমাণসাপেক্ষ। তেমনি এ কথাও জোর করে বলা যায় না যে সম্প্রতি ও দশরথ পর পর এক অখণ্ড মৌর্য সাম্রাজ্যের আধিপত্য করে গেছেন। এ কথা ঠিক, বিশাল রাজ্য পরিচালনায় যে ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতার প্রয়ােজন, তা অশােকের কোনও উত্তরাধিকারীরই ছিল না। ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সাম্রাজ্যের নানা স্থানে অশান্তি দেখা দেয়, বৈদেশিক শত্রুও প্রলুব্ধ হয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের শেষ পর্বে বা দ্বিতীয় শতকের প্রথম দিকে সুভাগসেন গান্ধার অঞ্চলে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ঠিক এই সময় গ্রিক সেনারাও ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন। ক্রমে ক্রমে অযােধ্যা, পাঞ্চাল ও মথুরা গ্রিকদের পদানত হয়। অশােকের উত্তরাধিকারিগণ এর কোনও প্রতিকার করতে পারলেন না। যে রাজদণ্ড অশােকের মতাে শক্তিমান রাজার হাতে শােভা পেত, তার দুর্বল বংশধরদের তা বইবার শক্তি কোথায়? অবশেষে মৌর্যবংশের শেষ রাজা বৃহদ্রথকে হত্যা করলেন তারই ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। ঘটনাকাল আনুমানিক ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। মৌর্য সাম্রাজ্য ধবংসতূপে পরিণত হল। তার উপর গড়ে উঠল নতুন একটি রাজ্য। সে রাজ্যটির নাম শুঙ্গ

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

অশােকের দেহাবসানের প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে মৌর্য সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ঐতিহাসিকেরা মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অনেকগুলো কারণ নির্দেশ করেছেন। কারণগুলোর সবগুলোই যে যথার্থ, এমন মনে হয় না –

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অসন্তোষ জনিত ব্যাখ্যা : মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কে মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বিশেষ এক অভিমত পােষণ করেন। তার মতে মৌর্য আমলে নিজেদের অধিকার ও ক্ষমতা সংকুচিত হওয়ায় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় পুষ্যমিত্র শুঙ্গের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। এই বিদ্রোহের ফলে মৌর্য সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। নিজ বক্তব্যের সমর্থনে শাস্ত্রী মহাশয় কয়েকটি যুক্তির অবতারণা করেছেন।

  • এক. অশােকের পশুবলি নিবারণের আদেশ ব্রাহ্মণদের যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানে বাধার সৃষ্টি করে। এই আদেশকে ব্রাহ্মণেরা সুনজরে দেখেননি। আদেশদাতা শূদ্র হওয়ায় ব্রাহ্মণদের অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। 
  • দুই. অশােক একবার দর্পভরে বলেছিলেন, একদিন যারা পৃথিবীতে দেবতাবলে গণ্য ছিলেন, তিনি তাদের অসারত্ব প্রতিপন্ন করেন। শাস্ত্রী মহাশয় মনে করেন, ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যেই অশােকের এই দম্ভোক্তি।
  • তিন. ধর্মমহামাত্র নামে এক শ্রেণির রাজপুরুষ নিয়ােগ করে অশােক ব্রাহ্মণদের অধিকার ও ক্ষমতা হ্রাস করেন।
  • চার. অন্যদের তুলনায় ব্রাহ্মণেরা বেশ কিছু অধিকার ভােগ করতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রাহ্মণকে শত অপরাধ সত্ত্বেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত না। কিন্তু অশােক দণ্ডসমতা ও ব্যবহার সমতা প্রবর্তন করে ব্রাহ্মণদের সেসব বিশেষ সুযােগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত করেন।

মহামহােপাধ্যায়ের যুক্তিগুলো যে নির্ভুল তা অবশ্য নয়, কেননা –

  • অশােক পশুবলির বিরােধী ছিলেন বলে ব্রাহ্মণেরা বিরূপ হয়েছিলেন, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অশােকের বহু পূর্বে বেদ উপনিষদের ব্রাহ্মণ ঋষিরাও পশুবলির নিন্দা করেছেন। তাছাড়া অশােক তথা মৌর্য সম্রাটেরা শুদ্র ছিলেন, এ ধারণাও সম্ভবত ঠিক নয়।
  • মহামহােপাধ্যায় ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে অশােকের এক কটুক্তির উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অশােকের লেখে সেরকম কোনও কথা নেই। আসলে প্রথম গৌণ গিরিশাসনে ব্যবহৃত ‘মিসা’ পদটির অপব্যাখ্যায় এই বিপত্তি। মহামহােপাধ্যায় পদটি ‘মৃষা’ অর্থাৎ মিথ্যা অর্থে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পদটির অর্থ মিশ্রণ বা মিলন। অর্থাৎ এখানে ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে অশােক কোনও ব্যঙ্গোক্তি করেননি। তিনি বলতে চেয়েছেন, এতদিন পর্যন্ত যা হয়নি, দেবতা ও মানুষের মধ্যে সেই মিলন, তিনি সাধন করেছেন। 
  • মহামহােপাধ্যায় ধর্মমহামাত্রদের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ধর্মমহামাত্র নিয়ােগের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের স্বার্থের কোনও বিরােধ ছিল না। বরঞ্চ, ব্রাহ্মণদের স্বার্থের প্রতি তাদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। তাছাড়া শুধু অব্রাহ্মণরাই যে ধর্মমহামাত্র নিযুক্ত হতেন, এমন কোনও প্রমাণ নেই।
  • অশােকের দণ্ডসমতা ও ব্যবহারসমতার কথা বলা হয়েছে। এই সমতার ফলে ব্রাহ্মণদের অধিকার হয়তাে কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বিচার তথা রাজকার্যে রাজুক প্রভৃতি রাজপুরুষদের স্বেচ্ছাচারের অবসান ঘটানােই ছিল অশােকের এই প্রশাসনিক সংস্কারের মুখ্য উদ্দেশ্য। দণ্ডসমতা এবং ব্যবহারসমতা প্রবর্তন করে অশােক তার নিজের কর্মচারীদের ক্ষমতাই খর্ব করেছেন। দ্বিতীয়ত, ধর্মসূত্র-ধর্মশাস্ত্রাদি গ্রন্থে ব্রাহ্মণদের বিশেষ অধিকার ভােগের কথা আছে বটে কিন্তু সে বৃত্তান্ত কতখানি বস্তুনিষ্ঠ বা বাস্তব, তা ভেবে দেখা দরকার। আর, প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত না, এ ধারণাও ভ্রান্ত। অর্থশাস্ত্র, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থে রাজদ্রোহের অপরাধে ব্রাহ্মণদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। 
  • অশােক ব্রাহ্মণবিদ্বেষী ছিলেন, এ ধারণা অমূলক। তার লেখে ব্রাহ্মণদের প্রতি তার শ্রদ্ধাই প্রকাশ পেয়েছে। ব্রাহ্মণদের উন্নতিকল্পে তার প্রশংসনীয় উদ্যম সর্বজনবিদিত সত্য বটে, মগধের শেষ মৌর্যরাজ বৃহদ্রথ ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্রের হাতে নিহত হন। কিন্তু পুষ্যমিত্র শুধু ব্রাহ্মণই ছিলেন না, মৌর্যরাজের প্রধান সেনাপতিও ছিলেন। কোনও ব্রাহ্মণ বিপ্লব ঘটিয়ে তিনি মগধের সিংহাসন অধিকার করেননি, ব্যক্তিস্বার্থে নিজের পদমর্যাদার অপব্যবহার করেছিলেন মাত্র। 

হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর অশোকের শান্তিবাদী নীতি জনিত ব্যাখ্যা : অশােকের শান্তিবাদী নীতি মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পথ ত্বরান্বিত করেছিল বলে হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী অভিমত প্রকাশ করেছেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশােক হিংসার পথ ছেড়ে ধর্মবিজয়ের আদর্শ গ্রহণ করেন। তিনি তার পুত্র-পৌত্রদেরও দিগ্বিজয়ের পরিবর্তে ধর্মবিজয়ের নীতি অনুসরণের নির্দেশ দেন। সর্বত্র ভেরিঘােষের পরিবর্তে ধর্মঘােষ ধ্বনিত হতে থাকে। এর ফলে সৈন্যবাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, সাম্রাজ্যের পতনও আসন্ন হয়। কিন্তু তার এই মতে সমস্যাটা এখানেই যে, ধর্মবিজয়ের আদর্শ গ্রহণ করলেও অশােক প্রশাসনে বা প্রতিরক্ষায় বিন্দুমাত্র শৈথিল্য দেখাননি। দিগ্বিজয়ের নীতি তিনি পরিহার করেছেন সত্য, কিন্তু পরিপূর্ণ যুদ্ধবর্জনের নীতি ঘােষণা করেননি। তিনি সেনাবাহিনী বহাল রাখেন। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সতর্ক করে তিনি বলেছেন, প্রয়ােজন হলে তাদের বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারণ করবেন। সাম্রাজ্যের অখণ্ডতার প্রতি তার তীক্ষ দৃষ্টি ছিল। অশােক বস্তুজগৎ ও ভাবজগতের মধ্যে সুন্দর সমতা বিধান করেছিলেন। ভাবজগৎকে তিনি বস্তুজগতের পরিপূরকরূপে দেখেছেন, খণ্ডিতরূপে নয়। সুতরাং অশােকের ধর্মবিজয়ের আদর্শ মৌর্য সাম্রাজ্যের ধবংসের পথ প্রশস্ত করেছিল কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে।

সুশৃঙ্খল ও দক্ষ আমলাতন্ত্রের অভাব : তবে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কয়েকটি কারণ অবশ্যই চিহ্নিত করা যায়। সুশৃঙ্খল ও দক্ষ আমলাতন্ত্রের ওপর সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব অনেকখানি নির্ভর করে। কিন্তু কী কেন্দ্রে, কী প্রদেশে, সর্বত্র কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিগত অভিরুচিই চুড়ান্ত ছিল। নিরপেক্ষ পরীক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে দক্ষ কর্মচারী নিয়ােগের যে প্রথা চিনদেশে চালু ছিল, তা ভারতে কখনও পরীক্ষিত হয়নি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিগত অভিরুচি যেখানে কর্মচারী নিয়ােগের মূলভিত্তি, সেখানে দক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে ওঠার অবকাশ কোথায়? শাসন পরিচালনায় মৌর্য আমলাতন্ত্র যে কখনও কখনও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তার প্রমাণ আছে। তক্ষশিলার স্থানীয় আমলাদের অপশাসন ও পীড়নমূলক কার্যকলাপের বিশদ বর্ণনা আছে দিব্যাবদান গ্রন্থে। কলিঙ্গেও যে আমলাদের স্বেচ্ছাচার ও পীড়ন অব্যাহত ছিল অশােকের নিজস্ব লেখে তার ইঙ্গিত আছে। অশােক আমলাদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, কিন্তু তার মৃত্যুর পর আমলাদের উপর কেন্দ্রের সে নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে আসে। ফলে শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।

প্রজাদের আনুগত্যের অভাব : প্রজাদের আনুগত্য সাম্রাজ্যরক্ষার আর একটি অপরিহার্য শর্ত। কিন্তু অশােকোত্তর পর্বে রাজশক্তির পেছনে প্রজাদের আর সমর্থন ছিল না। বিন্দুসার ও অশােকের রাজত্বকালে তক্ষশিলায় যে প্রজা বিদ্রোহ ঘটেছিল, তার তাে সুস্পষ্ট প্রমাণই আছে। আমলাতান্ত্রিক অপশাসন ও উৎপীড়ন যতই বৃদ্ধি পায় প্রজাদের অসন্তোষ ততই তীব্র হয়। পরবর্তী মৌর্যশাসকদের আমলে রাজপুরুষদের অপশাসনের ফলে প্রজা অসন্তোষ যে তীব্র আকার ধারণ করেছিল তা সহজেই অনুমেয়। প্রজা সমর্থন যেখানে নেই সেখানে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হতে বাধ্য।

কোশাম্বীর অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা : মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন দামােদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী। তার মতে অশােকোত্তর যুগে মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়। এই অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের দুটি লক্ষণ তিনি নির্দেশ করেছেন, প্রথমত, এই পর্বের ছাপমারা মুদ্রাগুলোতে খাদের পরিমাণ বেশি দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, এই সময় অত্যধিক হারে কর চাপানাে হয়। অভিনেতা ও গণিকাদেরও করের বােঝা থেকে রেহাই দেওয়া হয়নি। এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। কোশাম্বীর যুক্তিগুলো যথেষ্ট দুর্বল। যে মুদ্রাগুলোকে তিনি মৌর্যযুগের উত্তর পর্বের বলে সনাক্ত করেছেন, সেগুলোর তারিখ সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় আছে। মৌর্যযুগের উত্তর পর্বে করের বােঝা অত্যধিক ছিল বলে তিনি যে যুক্তির অবতারণা করেছেন তার সপক্ষে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। উপরন্তু, মেগাস্থিনিসের বৃত্তান্ত, নদনদীর আধিক্য, ভূ-প্রকৃতি, কৃষির কাজে ব্যাপকহারে লৌহ উপকরণের ব্যবহার ইত্যাদি ঘটনা বিপর্যস্ত অর্থনীতির পরিচয় দেয় না। মৌর্য অর্থনীতি অন্তিমপর্বে সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল, এ কথা রােমিলা থাপরও স্বীকার করেন। কিন্তু এর জন্য তিনি বিশাল সৈন্যবাহিনী, বিরাট আমলাতন্ত্র ও প্রতিনিয়ত উপনিবেশ স্থাপন এই তিনটি কারণকে দায়ী করেছেন। আসলে সম্পদ উৎপাদন ও সম্পদ সংগ্রহে সাফল্যের উপরই রাষ্ট্রের আর্থিক সংগতি নির্ভর করে। মৌর্য অর্থনীতিতে সরকার তথা রাষ্ট্রের অপ্রতিহত ভূমিকা ছিল। ফলে এই অর্থনীতির সাফল্য আমলাতন্ত্রের দক্ষতার উপর অনেকখানি নির্ভর করত। অশােকোত্তর পর্বে আমলাতন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তার প্রভাব যে অর্থনীতির উপর পড়েছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। তবে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল বলে ভাবার কোনও কারণ নেই। কৌশাম্বী, হস্তিনাপুর, শিশুপালগড়, পুষ্কলাবতী, মহাস্থান প্রভৃতি স্থানে উৎখননের ফলে নগরায়ণের যে চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে তাতে এই ধারণাই দৃঢ় হয়।

রাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব : রাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা বােধহয় অস্বীকার করা চলে না। সিংহাসন নিয়ে ভাইদের সঙ্গে অশােকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কাহিনি হয়তাে অতিরঞ্জিত। কিন্তু পরবর্তিকালে মৌর্য রাজপরিবারে এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটে যাতে অন্তর্দ্বন্দ্বের সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। অশােকের জীবিতকালেই তার পুত্র কুণালের দৃষ্টিশক্তি হরণ করা হয়। অশােকের মৃত্যুর অব্যবহিত পর তার আর এক পুত্র জলৌক কাশ্মীরের রাজা হয়ে বসেন। দুই ভাই সম্প্রতি ও দশরথের একই সঙ্গে বা ক্রমান্বয়ে সিংহাসনে আরােহণও পারিবারিক কলহের ইঙ্গিত বহন করে। 

নেতৃত্ব সংকট : একেই তাে পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার উপর দেখা দিল নেতৃত্ব সংকট। অবশ্য বিষয়টি এমনও হতে পারে যে নেতৃত্ব সংকট ছিল বলেই অন্তর্দ্বন্দ্ব বা গােষ্ঠীতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সুবিশাল রাজ্য রক্ষার জন্য যে ব্যক্তিত্ব এবং বিচক্ষণতার প্রয়ােজন, তা অশােকের উত্তরাধিকারিগণের ছিল না। পদস্থ রাজপুরুষদেরও রাজার প্রতি সে আনুগত্য ছিল না। মৌর্য রাজত্বের শেষের দিকে রাজদরবারে দুটি বিবদমান গােষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করল। একটি গােষ্ঠীর নেততে ছিলেন সেনাপতি পুষ্যমিত্র। প্রতিপক্ষের দলপতি ছিলেন একজন মন্ত্রী। সেনাপতির পুত্র অগ্নিমিত্রকে বিদিশার প্রদেশপাল করা হল। মন্ত্রীর আত্মীয় যজ্ঞসেন হলেন বিদর্ভের প্রশাসক। দুর্বল, অশক্ত মৌর্য সম্রাটের ঠিক যেন বাংলার নবাব মিরজাফরের গুলি খাওয়া আর ঘুমানাের অবস্থা। 

বৈদেশিক আক্রমণ : গােদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতাে এই সময় ঘটে গেল বৈদেশিক আক্রমণ। ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে গ্রিক অভিযানকারীরা মৌর্য সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। অযােধ্যা, পাঞ্চাল এবং মথুরা একে একে গ্রিকদের নিকট আত্মসমর্পণ করল। এদের পরবর্তী লক্ষ্য মৌর্য রাজধানী পাটলিপুত্র। বিদেশি শত্রুর মােকাবিলায় মৌর্যরাজশক্তি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। মৌর্য সাম্রাজ্যের সামরিক দুর্বলতা দিবালােকের মতাে প্রতিভাত হল।

পুষ্যমিত্র শুঙ্গের সশস্ত্র বিদ্রোহ : পুষ্যমিত্র শুঙ্গের সশস্ত্র বিদ্রোহ অবশ্যই মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের প্রত্যক্ষ কারণ। সেনাপতি পুষ্যমিত্র প্রকাশ্য দিবালােকে সেনাবাহিনীর সামনে রাজা বৃহদ্রথকে হত্যা করে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসলেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের ওপর শুঙ্গরাজ্য জন্ম নিল।

কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনা ও তাদের সম্ভাব্য তারিখ 

  • চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসন লাভ – ৩২৪ খ্রি.পূ.
  • খ্রিস্টপূর্বাব্দ ভারতে ম্যাসিডােনীয় শাসনের অবসান – ৩১৭ খ্রি.পূ.
  • চন্দ্রগুপ্ত-সেলুকাস সংঘর্ষ – ৩০৫ খ্রি.পূ. 
  • চন্দ্র গুপ্তের সিংহাসন ত্যাগ – ৩০০ খ্রি.পূ.
  • বিন্দুসারের সিংহাসন আরােহণ – ৩০০ খ্রি.পূ.
  • বিন্দুসারের শাসনাবসান – ২৭৩ খ্রি.পূ.
  • অশােকের সিংহাসনে আরােহণ – ২৭৩ খ্রি.পূ. 
  • অশােকের রাজ্যাভিষেক – ২৬৯ খ্রি.পূ.
  • অশােকের কলিঙ্গ বিজয় – ২৬১ – ৬০ খ্রি.পূ. 
  • অশােকের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষান্তর – ২৬০ – ৫৯ খ্রি.পূ. 
  • অশােকের রাজত্বের অবসান – ২৩২ (মতান্তরে ২৩৬) খ্রি.পূ. 
  • গ্রিকরাজ তৃতীয় এন্টিওকাসের ভারত অভিযান – ২০৬ খ্রি.পূ.
  • মৌর্য শাসনের অবসান – ১৮৭ খ্রি.পূ. 
  • এরিয়ানের ইন্ডিকা রচনা  – ১৫০ খ্রি.পূ.
  • স্ট্র্যাবোর সময় – ৫৪ খ্রি.পূ. – ২৪ খ্রি. 

মৌর্যযুগে প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সমাজ-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় জীবন ও শিল্প-সাহিত্য

মৌর্য রাজারা প্রায় ১৪০ বছর ভারতে রাজত্ব করেন। তাদের রাজত্বকালে ভারত-আফগানিস্তানের সিংহভাগ অঞ্চল জুড়ে শুধু এক অখণ্ডরাষ্ট্রেরই পত্তন হল না, প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুসংহত, সুবিন্যস্ত হল, অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে পরিবর্তন ঘটল, বৌদ্ধধর্ম তার আঞ্চলিকতার গণ্ডি ছেড়ে বিশ্বধর্মে পরিণত হল, প্রসার ঘটল ব্রাহ্মণ্যধর্মের এবং স্থাপত্য ও ভাস্কর্য-শিল্পে দেখা দিল অভূতপূর্ব উন্নতি। 

প্রশাসনিক ব্যবস্থা

মৌর্যযুগে রাষ্ট্র ছিল রাজতান্ত্রিক। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বৃজি, মল্ল, মদ্র প্রভৃতি কয়েকটি সংঘ বা গণরাজ্যের উল্লেখ আছে। সন্দেহ নেই, মৌর্যদের সময় সেসব রাজ্যগুলোর আর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা ছিল না, তারা মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

রাজা 

  • রাজকুমারদের শিক্ষা : রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক। রাজার মৃত্যু হলে সাধারণত তার জ্যেষ্ঠ পুত্ৰই সিংহাসনে আরােহণ করতেন। কখনও কখনও এই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা দিত। সম্ভবত অশােকই তার জ্ঞান ও বিচক্ষণতা ছাড়া রাজকার্য পরিচালনা করা যায় না। এই জ্ঞান ও বিচক্ষণতা আসে শিক্ষাগত যােগ্যতা থেকে। তাই রাজকুমারদের শিক্ষার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি দেয়া হত। তাদের বেদ-বেদান্ত, অর্থনীতি ও দণ্ডনীতি অধ্যয়ন করতে হত ; লেখ, গণনা ও সামরিক বিদ্যা আয়ত্ত করতে হত। রাজপুত্রদের শিক্ষাক্রমের বিশদ আলােচনা আছে অর্থশাস্ত্রে এবং মহাভারতের আদি ও শান্তিপর্বে।
  • উপাধি : প্রায় আসমুদ্র হিমাচল যারা রাজত্ব করতেন, সেই মৌর্যরা নিজেদের রাজা বলে পরিচয় দিয়েছেন, মহারাজ বা মহারাজাধিরাজ উপাধিতে নয়। তখন এটিই প্রথা ছিল। মৌর্য রাজারা দেবত্বেরও দাবি করেননি, দেবতাদের প্রিয় বলে নিজেদের উপস্থাপিত করেছেন। মৌর্যদের আর একটি উপাধি ছিল প্রিয়দর্শী। দেখতে সুন্দর যিনি তিনিই প্রিয়দর্শী। সকলে যার কাছে প্রিয় তিনিও প্রিয়দর্শী। সকলের প্রিয় বা হিত যিনি দেখেন তিনিও প্রিয়দর্শী।
  • রাজার ক্ষমতা : তাহলে কী হবে, রাজা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সৈন্যবাহিনী ছিল তার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে, কোষাগার ছিল তার তত্ত্বাবধানে। সে সময় প্রশাসনিক কাজে জনপ্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা ছিল না। মন্ত্রী ও আমলাদের নিয়ােগ ও পদচ্যুতি রাজার ব্যক্তিগত অভিরুচির ওপর নির্ভর করত। মন্ত্রী বা আমলারা রাজাকে সাহায্য করতেন, পরামর্শ দিতেন, কিন্তু কোনও বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন না। সে অধিকার ছিল রাজার। কৌটিল্যের মতে আইনের চারটি উৎস – ধর্ম, ব্যবহার, চরিত্র ও রাজশাসন। ধর্মের অর্থ বেদ-ধর্মশাস্ত্রাদি গ্রন্থে বর্ণিত মানুষের আচরণীয় ধর্ম বা সদাচার। ব্যবহার বলতে বােঝায় বিচারসংক্রান্ত প্রচলিত বিধি-নিয়ম। চরিত্রের অর্থ অঞ্চল, গ্রাম ও কুলের নিজস্ব রীতি-নীতি। রাজশাসনের অর্থ রাজার অনুজ্ঞা বা আদেশ। আইনের অন্যান্য উৎসগুলোর তুলনায় রাজশাসনের গুরুত্ব যে সর্বাধিক তা কৌটিল্য অকপটে স্বীকার করেছেন। কৌটিল্যের এই স্বীকারােক্তি রাজার অপরিসীম ক্ষমতার ইঙ্গিত বহন করছে। আদেশ প্রচারের উদ্দেশ্যে রাজা অনেক সময় অনুশাসন উৎকীর্ণ করতেন। অন্তত অশােক তাে তাই করেছেন। প্রথম মুখ্য গিরিশাসন উৎকীর্ণ করে তিনি রাজ্যমধ্যে পশুহত্যা ও সমবেত পান-ভােজন নিষিদ্ধ করেন, প্রথম কলিঙ্গ অনুশাসন প্রচার করে কয়েকটি শাসন-সংস্কার ঘােষণা করেন।
  • স্বেচ্ছাচারী নন : প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হলেও রাজা স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। প্রথম কলিঙ্গ অনুশাসন অশােক ঘােষণা করেছেন, সকল মানুষ তার সন্তান। যেমন নিজ সন্তানের, তেমনি সকল মানসেন তিনি ইহলৌকিক ও পারত্রিক কল্যাণ কামনা করেন। চতুর্থ স্তম্ভ অনুশাসনে অশােক বলেছেন পিতা যেমন সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ ধাত্রী নিয়ােগ করেন, তিনিও তেমনি প্রজাদের হিত ও সুখের জন্য রাজুক নামে এক শ্রেণির রাজপুরুষ নিযুক্ত করেছেন (প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখ না করলেও মৌর্য সম্রাট এই অনুশাসনে পিতার কথাই বলছেন)। নিজের সুখ বা স্বার্থ নয়, প্রজাদের কল্যাণই যে রাজার ধর্ম, তা কৌটিল্য স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন (অর্থশাস্ত্র ১/১৯)। কৌটিল্য বলেছেন, প্রজার সুখে রাজার সুখ, প্রজার হিতে রাজার হিত। রাজা যা প্রিয় মনে করেন, তা তার পক্ষে হিতকর নয়, প্রজার কাছে যা প্রিয়, রাজা তাকেই শ্রেয় মনে করবেন। দ্বিতীয়ত, তখনকার দিনে বিভিন্ন অঞ্চলে, বর্ণে, বণিক-সংঘে ও কুলে বা পরিবারে কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রথা-পদ্ধতি, নিয়ম-কানুন পুরুষ পরম্পরায় প্রচলিত ছিল। এসব রীতি-নীতি সকলের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য ছিল না কিন্তু বিশেষ কয়েকটি অঞ্চল বা গােষ্ঠীর মধ্যে সযত্নে লালিত হত। কোনাে দূরদর্শী রাজা জনসাধারণের সেই বিশেষ অধিকারে হস্তক্ষেপ করতেন না (তদেব, ৩/৭/৪০)
  • কর্মব্যস্ততা : প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে রাজার দিন অতিবাহিত হত। সূর্যোদয়ের পূর্ব হতে তার কাজ শুরু হত, আর তা চলত রাত পর্যন্ত। রাতে ঘণ্টা চারেকের বেশি নিদ্রার অবকাশ তার ছিল না। এ তথ্য কৌটিল্যের। মেগাস্থিনিস বলেন, সরকারি কাজেই রাজার সারা দিন কেটে যেত, দিবানিদ্রার সময় ছিল না। যখন তার কেশ পরিচর্যা বা পােশাক পরিধানের সময় হত, তখন একই সঙ্গে দূতদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর্বটিও শেষ করতেন। অশােক রাজকার্য নিয়ে প্রায় সর্বক্ষণই ব্যস্ত। থাকতেন অথচ ষষ্ঠ মুখ্য গিরিশাসনে তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, প্রজার কল্যাণে তার যতখানি উদ্যোগ নেওয়া উচিত, তা তিনি করতে পারছেন না। প্রতিবেদকদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি যেখানে এবং যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, এমনকী তার আহার বা বিশ্রামের সময়েও, তারা যেন তাকে প্রজাদের খবরাখবর জানান।
  • বিলাসিতা : প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যে তার দিন অতিবাহিত হলেও রাজার ভােগের ডালিতে উপকরণের কম আয়ােজন ছিল না। সােনার ও মূল্যবান পাথরের কাজ করা জমকালাে, দামি পােশাক ছিল তার পরিধেয়। সুরম্য প্রাসাদে ছিল তার বাস। সেখানে দীনতার স্পর্শ ছিল না, ছিল ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের সমারােহ। যে দরবার কক্ষে বসে তিনি রাজকার্য পরিচালনা করতেন সেটি ছিল যেমন বিশাল, তেমনি দৃষ্টিনন্দন। ধর্মকর্ম, মৃগয়া বা অন্য কোনও কাজে রাজা যখন প্রাসাদের বাইরে যেতেন তখন সৈন্য ও দেহরক্ষিবাহিনী-সহ বিরাট এক শােভাযাত্রা তার অনুগমন করত। রাজা বাইরে বেরােতেন সােনার পালকিতে চড়ে, কখনওবা রথ, ঘােড়া বা হাতিতে চেপে। কী অন্তঃপুরে, কী বাইরে, সর্বত্র রাজার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা যথেষ্ট জোরদার ছিল। অস্ত্রচালনায় নিপুণ মহিলারাই তার দেহরক্ষার কাজে নিযুক্ত হতেন। রাজা কোনও শয়নকক্ষে বেশি দিন রাত্রিযাপন করতেন না, প্রতিনিয়ত তার শয়নকক্ষ পরিবর্তন করা হত। রাজার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার খাতিরেই এই ব্যবস্থা।

মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষৎ ও বিভাগীয় অধ্যক্ষ

মন্ত্রী : কৌটিল্য বলেন, “সহায়সাধ্যং রাজত্বম’। অর্থাৎ রাজার একার পক্ষে রাজ্য পরিচালনা সম্ভব নয়, রাজ্য পরিচালনায় মন্ত্রী ও অমাত্যদের সাহায্যের প্রয়ােজন। শাসনকার্যে মন্ত্রী ও অমাত্যদের গুরুত্ব বলতে গিয়ে কৌটিল্য একটি সুন্দর উপমা ব্যবহার করেছেন। রাজ্য যেন একটি রথ, রাজা যেন সে রথের এক চাকা। একটি চাকার উপর ভর করে যেমন রথ চলতে পারে , তেমনি রাজা একা রাজ্য পরিচালনা করতে পারেন না। যাদের সাহায্যে রাজা রাজ্য পরিচালনা করেন, তাদের কথা প্রসঙ্গে কৌটিল্য সর্বাগ্রে মন্ত্রীদের উল্লেখ করেছেন। অশােকের অনুশাসনে কিন্তু মন্ত্রীদের কোনও কথা নেই। অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, মন্ত্রীরা প্রতি মাসে ৪০০০ পণ বেতন পেতেন। প্রধান পুরােহিত, সেনাধ্যক্ষ ও যুবরাজও একই বেতন পেতেন। এর থেকে বােঝা যায়, সমমর্যাদাসম্পন্ন মন্ত্রিগণ, প্রধান পুরােহিত, সেনাধ্যক্ষ ও যুবরাজ রাজার ঠিক নীচেই অবস্থান করতেন। অর্থশাস্ত্রে তিন বা চারজন মন্ত্রী নিয়ােগের কথা বলা হয়েছে। অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, বিভিন্ন প্রকার প্রলােভনের পরীক্ষায় যেসব অমাত্যরা সসম্মানে উত্তীর্ণ হতেন, তাদের মধ্য থেকেই মন্ত্রী নিয়ােগ করা হত। রাজা সব সময় মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন কিন্তু প্রয়ােজন বােধ করলে তিনি তাদের মতামত অগ্রাহ্য করতে পারতেন। রাজ্যে জরুরি অবস্থার উদ্ভব হলে। তিনি শুধু মন্ত্রীদের সঙ্গেই শলাপরামর্শ করতেন না, মন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের একসঙ্গে ডেকে আলােচনায় বসতেন। 

মন্ত্রিপরিষৎ : যাদের নিয়ে এই মন্ত্রিপরিষৎ তারা কিন্তু অমাত্য, মন্ত্রী নন। নামে মন্ত্রিপরিষৎ হলেও কার্যত এটি অমাত্যপরিষৎ। ১২ জন অমাত্য নিয়ে এই পরিষৎ। মন্ত্রীদের তুলনায় অমাত্যদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অনেক কম ছিল। কৌটিল্যের বর্ণনা হতে মনে হয়, মন্ত্রিপরিষদের অধিবেশন নিয়মিত হত না, হত রাজ্যে জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। পরিষদের সদস্যরা প্রতি মাসে ১০০০ পণ বেতন পেতেন। বলা বাহুল্য, মন্ত্রীদের তুলনায় এ বেতনহার অনেক কম।

পরিষৎ : অশােকের তৃতীয় ও ষষ্ঠ মুখ্য গিরিশাসনে পরিষৎ নামে এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ আছে। অনেকে মনে করেন এই পরিষৎ আসলে কৌটিল্যের মন্ত্রিপরিষৎ। অশােক পরিষদের কার্যাবলির যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে কৌটিল্যের মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ মিল নেই। প্রথমত, পরিষদের অধিবেশন ছিল নিয়মিত কিন্তু মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক বসত জরুরি পরিস্থিতিতে। দ্বিতীয়ত, রাজা মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক আহ্বান করতেন কিন্তু পরিষদের বৈঠক রাজার অনুপস্থিতিতে হতে পারত। তৃতীয়ত, রাজা কোনও আদেশ জারি করলে পরিষৎ তার সমালােচনা করতে পারত। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদের সে অধিকার ছিল না। তবে রাজা যখন রাজ্য পরিদর্শনে বের হতেন বা। কোনও কারণে রাজধানীর বাইরে থাকতেন, তখন হয়তাে মন্ত্রিপরিষদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেত। পরিষদের কার্যকলাপ রাজা যে সাগ্রহে লক্ষ করতেন, অশােকের যষ্ঠ মুখ্য গিরিশাসনে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। প্রতিবেদক নামে এক শ্রেণির রাজপুরুষ তাকে একাজে সাহায্য করতেন। মন্ত্রীদের মতাে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা কার্যত রাজার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তাদের পেছনে জনসমর্থন ছিল না। রাজার অনুগ্রহের উপরই তাদের প্রতিপত্তি, মানমর্যাদা নির্ভর করত। রাজা বিরক্ত হতে পারেন এমন কোনও কাজ তারা বড় একটা করতেন না।

সমাহর্তা ও সন্নিধাতা : কেন্দ্রীয় সরকারের দু’জন পদস্থ রাজপুরুষ হলেন সমাহর্তা ও সন্নিধা। অর্থের প্রলােভন যারা জয় করেছেন, সেসব অমাত্যদের মধ্য থেকেই সমাহর্তা ও সন্নিধাতা নিযুক্ত হতেন। সমাহর্তা ছিলেন রাজস্ববিভাগের অধিকর্তা। তিনি আয়ের বিভিন্ন উৎস থেকে নগদে কা দ্রব্যে রাজস্ব-সংগ্রহের তত্ত্বাবধান করতেন। রাজার খাস-জমি, চাষের ক্ষেত, গােচারণভূমি, সেচপ্রকল্প। পণ্যসামগ্রী, বণিকপথ, বিপণি, খেয়াঘাট, বনাঞ্চল, খনি, কারিগরি শিল্প, কুটিরশিল্প প্রভৃতি নানা উৎস হতে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রাজস্ব সংগৃহীত হয়, সেদিকে সমাহর্তার প্রখর দৃষ্টি ছিল। রাজপরিবার, সেনাবাহিনী ও রাজপুরুষদের ভরণপােষণ, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও নানা জনকল্যাণ। মূলক কাজে রাজার প্রচুর অর্থ ব্যয় হত। সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে, সেদিকেও সমাহর্তাকে লক্ষ রাখতে হত। যে অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী রাজকোষ ও কোষ্ঠাগারে জমা পড়ত, তার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সন্নিধাতা। কোষাগার ও কোষ্ঠাগারের ভার কোষাগারাধ্যক্ষ ও কোষ্ঠাগারাধ্যক্ষ নামে দু’জন রাজ পুরুষের উপর ন্যস্ত ছিল। এদেরই উপরে ছিলেন সন্নিধাতা।

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও তাদের অধিকর্তা : শাসনকার্য পরিচালনায় বিভাগীয় অধ্যক্ষদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অর্থশাস্ত্রে বিভাগীয় অধ্যক্ষদের এক বিস্তৃত তালিকা আছে। এদের। কয়েকজনের কথা এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। 

  • অক্ষপটলাধ্যক্ষ : সরকারি মহাফেজখানার তত্ত্বাবধায়ক। তাকে গাণনিকের দায়িত্বও পালন করতে হত।
  • আরাধ্যক্ষ : আকর বা খনি বিভাগের অধিকর্তা। খনি ও ধাতু বিদ্যায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। নতুন খনি আবিষ্কার ছিল তার এক প্রধান কাজ। 
  • স্ত্রী-অধ্যক্ষ-মহামাত্র : নারী-কল্যাণ বিভাগের অধ্যক্ষ।
  • খন্যাধ্যক্ষ : খনি খনন একটি স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল। সেই বিভাগের অধ্যক্ষই খন্যাধ্যক্ষ।
  • লবণাধ্যক্ষ : খনিজ লবণ বিভাগের অধ্যক্ষ।
  • লােহাধ্যক্ষ : খনিজ লােহাকে পরিশুদ্ধ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজপুরুষ।
  • রূপদর্শক : মুদ্রা-পরীক্ষক।
  • পণ্যাধ্যক্ষ : পণ্যদ্রব্যের মূল্যনির্ধারণ, ক্রয়বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক। 
  • নাবাধ্যক্ষ : রাজকীয় নৌবহরের তত্ত্বাবধান ও খেয়াপারাপারের শুল্কসংগ্রহের ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ। 
  • সূত্রাধ্যক্ষ : বয়নশিল্প বিভাগের পরিচালক।
  • রথাধ্যক্ষ : রথ ও যানবাহন নির্মাণ বিভাগের অধ্যক্ষ।
  • সুরাধ্যক্ষ : শুড়িখানা ও মদের বিক্রয় কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রক।
  • সংস্থাধ্যক্ষ : এর কাজ ক্রেতাসাধারণ যাতে ব্যবসায়ীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, তা দেখা।
  • শুল্কাধ্যক্ষ : শুল্ক বিভাগের অধিকর্তা। শুল্ক বলতে বােঝায় পণ্যদ্রব্যের উপর ধার্য কর। 
  • গণিকাধ্যক্ষ : গণিকাদের তত্ত্বাবধানের জন্য একটি বিভাগ ছিল। গণিকাধ্যক্ষ এই বিভাগের প্রধান ছিলেন। 
  • বিবীতাধ্যক্ষ : গােচারণভূমিতে যাতায়াতের জন্য সরকারপক্ষ থেকে লােকদের পাশ বা মুদ্রা দেওয়া হত। এই বিভাগের পরিচালক। 
  • মুদ্রাধ্যক্ষ : পাসপাের্ট বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক।
  • আয়ুধাগারাধ্যক্ষ : রাজকীয় অস্ত্রশালার অধ্যক্ষ।
  • ধর্মমহামাত্র : ধর্মের প্রচার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার কাজে নিযুক্ত এক শ্রেণির উচ্চপদস্থ রাজপুরুষ। সম্রাট অশােকই সর্বপ্রথম এদের নিয়ােগ করেন।
  • সীতাধ্যক্ষ : রাজার খাস জমির চাষাবাদের তত্ত্বাবধান করতেন।
  • গুপ্তচর : রাজ্যে কী ঘটছে, না ঘটছে, সে সম্পর্কে, এমনকি সেনাবাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কেও, বাজাকে অবহিত করাই ছিল তাদের কাজ। অর্থশাস্ত্রে দু’ধরনের গুপ্তচরের কথা বলা হয়েছে – সংস্থা ও সঞ্চার। সংস্থ গুপ্তচরেরা কোনও নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে তাদের কাজকর্ম নির্বাহ করতেন। সঞ্চার গুপ্তচরেরা স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে খবরাখবর সংগ্রহ করতেন। বণিক, সাধু, ভিক্ষণী ও গণিকাদেরও গুপ্তচরের কাজে নিয়ােগ করা হত। কৌটিল্য ছাড়া মেগাস্থিনিস, এরিয়ান এবং স্ট্রাবােও গুপ্তচরদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উল্লেখ করেছেন।
  • দূত : দূত নামে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ আর এক শ্রেণির রাজপুরুষ ছিলেন। পররাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে স্বরাজ্যের যােগাযােগের দায়িত্ব তাদের বহন করতে হত। নিসৃষ্টার্থ, পরিমিতার্থ ও শাসনহর – দূতদের এই তিনটি শ্রেণি। প্রথমােক্তরা পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন। পরিমিতার্থদের ক্ষমতা সীমিত ছিল। শাসনহর দূতেরা রাজনির্দেশ অনুসারে কাজ করতেন, তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার ছিল না।

প্রাদেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা

শাসনকার্যের সুবিধার জন্য মৌর্য সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রদেশগুলো নিম্নরূপ ছিল :

  • ১. উত্তরাপথ : কাশ্মীর, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব ও আফগানিস্তান নিয়ে এই প্রদেশটি গঠিত ছিল। তক্ষশিলা ছিল প্রদেশটির প্রধান কেন্দ্র।
  • ২. অবন্তি : গুজরাত, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে এই প্রদেশ গঠিত ছিল। অবন্তির কেন্দ্রীয় কার্যালয় উজ্জয়িনীতে অবস্থিত ছিল। 
  • ৩. দক্ষিণাপথ : মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটক এই প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর কেন্দ্রীয় দফতর সুবর্ণগিরি।।
  • ৪. উত্তর কলিঙ্গ : বর্তমান ওড়িশার উত্তরাঞ্চলে এই প্রদেশটি অবস্থিত ছিল। তােসলী ছিল প্রশাসনিক দফতর। 
  • ৫. দক্ষিণ কলিঙ্গ : প্রদেশের প্রধান কার্যালয় সমাপায় অবস্থিত ছিল। 
  • ৬. প্রাচ্য : উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ নিয়ে প্রদেশটি গঠিত ছিল। এই প্রদেশ তথা সমগ্র মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। 

প্রদেশের শাসনকর্তার পদে সাধারণত রাজকুমারদের নিয়ােগ করা হত। অশােক ও কুণাল উভয়েই রাজ্যভার গ্রহণের পূর্বে প্রাদেশিক শাসনকর্তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। প্রদেশের শাসনভার প্রাপ্ত রাজকুমারেরা সাধারণত কুমার বা আর্যপুত্র নামে পরিচিতি লাভ করতেন। রাজপরিবারের সদস্য নন, এমন ব্যক্তিও কখনও কখনও প্রাদেশিক শাসকের পদে নিযুক্ত হতেন। মহামাত্র নামে উচ্চপদস্থ রাজপুরুষদের উপর দক্ষিণ কলিঙ্গের শাসনভার অর্পিত হয়েছিল। চন্দ্রগুপ্তের সময় পুষ্যগুপ্ত নামে জনৈক বৈশ্য অবন্তি প্রদেশের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। অশােকের রাজত্বকালে যবনরাজ তুষাস্ফ অবন্তির শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। সম্রাট স্বয়ং প্রাচ্য প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। কেন্দ্রে যেমন মন্ত্রিসভা ছিল, প্রদেশেও তেমনি প্রদেশপালকে সাহায্য করার জন্য অমাত্য বা মহামাত্রদের নিয়ে গঠিত একটি মহামাত্রপরিষৎ ছিল। তাছাড়া পদস্থ কর্মচারীরা তাে ছিলেনই। উত্তরাপথ ও অবন্তির প্রাদেশিক শাসনকর্তারা প্রতি ৩ বছর অন্তর মহামাত্রদের প্রদেশ পরিদর্শনে পাঠাতেন। কোনও স্থানে অবিচারের ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবিধান করা হত। প্রাদেশিক সরকারের কার্যসূচি সম্পর্কে বিশেষ কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মনে হয়, প্রদেশে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা, রাজস্ব সংগ্রহ করা, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করা ছিল প্রাদেশিক সরকারের আশু কর্তব্য। প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনায় প্রাদেশিক শাসক কতখানি স্বাধীনতা ভােগ করতেন, অশােকের অনুশাসনে বা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তার কোনও ইঙ্গিত নেই। অধ্যাপক ভাণ্ডারকর মনে করেন, প্রদেশ পরিচালনায় অবন্তি ও উত্তরাপথের (গান্ধার) শাসকদের যে কর্তৃত্ব ছিল কলিঙ্গ প্রদেশের রাজ্যপালের সে অধিকার ছিল না। এ মতের যাথার্থ্য সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ আছে।

এককেন্দ্রিক প্রশাসন (?)

মৌর্য প্রশাসনের কেন্দ্রাভিমুখতার স্বরূপ সম্পর্কে বহুদিন ধরেই বিদ্বজ্জনেরা আলােচনা করছেন। সুবিখ্যাত ফরাসি ভারততত্ত্ববিদ ই. সেনার ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দেই মৌর্য প্রশাসনের তথাকথিত এককেন্দ্রিক চরিত্র সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন। তার অভিমত সাম্রাজ্যের যােন, কম্বােজ, রাষ্টীয়, পিতিনিক, নাভপংতি, অন্ধ্র, পুলিন্দ ইত্যাদি প্রত্যন্ত ভূখণ্ডে রাজ কর্তৃত্ব শিথিল ছিল, প্রত্যন্ত অঞ্চলবাসীরা কয়েকটি বিশেষ অধিকার ভােগ করতেন। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায়েরা মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় এককেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপরই আলােকপাত করেছেন। রােমিলা থাপর প্রথমদিকে রাজকর্তৃত্বের সর্বময়তার অনুকূলে অভিমত ব্যক্ত করেন কিন্তু পরবর্তিকালে কেন্দ্রীয় শক্তির সীমাবদ্ধতার উপরেই গুরুত্ব আরােপ করেন এবং মাতৃরাষ্ট্র (metropolitan state), কেন্দ্রীয় অঞ্চল (core) ও প্রত্যন্ত প্রদেশ ভেদে মৌর্য সাম্রাজ্যে ত্রিস্তরীয় রাজকর্তৃত্বের বিদ্যমানতার কথা স্বীকার করেন (The Mauryay Revisited (Calcutta, 1987), পৃষ্ঠা ১-৩১)। তিনি বলেন, অশােক নিজেকে মগধের রাজা বলে ঘােষণা করেছেন, মগধের প্রতিই ছিল তার সমধিক দৃষ্টি, মগধই ছিল সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। মৌর্যযুগে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের এক প্রবল সমর্থক জেরার্ড ফুসমান (Gerard Fussman, “The Central and Provincial Administration In Ancient India : The Problem of the Maurya Empire’ in Indian Historical Revie, Vol. XIV, No. 1-2, পৃষ্ঠা ৪৩-৭২)। তিনি অঞ্চল বিশেষের দুর্গমতা, সময়বহুল ও কষ্টসাধ্য যাতায়াত ব্যবস্থা, প্রদেশপালদের অসম প্রশাসনিক অধিকার, রাজধানী হতে দূরত্ব, মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় স্বশাসিত নগরের উল্লেখের মতাে ঘটনায় কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের গুণগত বৈচিত্রের সন্ধান পেয়েছেন। আফগানিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্তে গ্রিক, খরােষ্ঠী ও আরামীয় লিপির প্রয়ােগ, গ্রিক ও আরামীয় ভাষার ব্যবহার এবং ভিন্ন প্রকৃতির অনুশাসনের প্রচারের মধ্য দিয়ে এসব অঞ্চলে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতাই অভিব্যক্ত হয়েছে, এরূপ অভিমতই তিনি উপস্থাপন করেছেন। 

একবিংশ-বিংশ শতকের দৃষ্টিতে প্রাক্‌-খ্রিস্টীয় মৌর্য রাজতন্ত্রের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে তৎকালীন যুগের প্রকৃত চিত্র উদঘাটিত হবে না। রােমিলা থাপর মৌর্য সাম্রাজ্যের তথাকথিত ত্রিধা বিভাজন সম্পর্কে যে অভিমত পােষণ করেন তাতে বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয়নি। রোমিলা থাপার metropolitan state, core areas, এবং variegated, perepheral areas বলে তথাকথিত ত্রিস্তরীয় বিভাগের যে নামকরণ করেছেন তা যুক্তিযুক্ত নয়। মৌর্য সাম্রাজ্যের একটি বিভাগ রাজ্য বা রাষ্ট্র, অপর দুটি বিভাগ অঞ্চল, এ কথার তাৎপর্য বােধগম্য নয়। তিনটি বিভাগই যেখানে তিনটি অঙ্গ, সেখানে কোনওটিকে রাষ্ট্র বা রাজ্য আর বাকি দুটিকে অঞ্চলরূপে বর্ণনা করা সমীচীন নয়। দ্বিতীয়ত, ইংরেজি core শব্দের অর্থ কেন্দ্রগত, কেন্দ্রীয়, মূল। একটি অঞ্চলকে মূল অঞ্চলরূপে নির্দিষ্ট করলে, সেই মূল অঞ্চল বহির্ভূত কোনও স্থানে মাতৃরাষ্ট্রের কল্পনা অর্থহীন। তৃতীয়ত, আদি মৌর্য রাজ্যের সঠিক অবস্থান এখনও অনিশ্চিত। সে রাজ্যটি মগধে না নিম্ন সিন্ধু অববাহিকায় অবস্থিত ছিল, তা এখনও সুনিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয়নি। ফলে রােমিলা থাপরের মাতৃরাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা স্বীকৃতি পেলেও মগধকে মাতৃরাষ্ট্ররূপে অক্লেশে গ্রহণ করা যায় না। অশােক মগধের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেন, এ ধারণা লেখের সাক্ষ্যে সমর্থিত নয়। যখনই তিনি রাজ্যের কথা বলেছেন, সমগ্র রাজ্যের কথাই ভেবেছেন (সব বিজিতসি), যখন তিনি জনহিতকর কার্যাবলি এবং যুক্ত, রাজুক, প্রাদেশিকদের মতাে রাজপুরুষদের দায়-দায়িত্বের উল্লেখ করেছেন, তখন তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতেই বলেছেন। মগধের কথা অশােক একবারই বলেছেন, তাও বলেছেন তার একটি বৌদ্ধসংঘ পরিদর্শন (?) প্রসঙ্গে। সংঘটি মগধে অবস্থিত ছিল। নিজের রাজ্য সম্পর্কে অশােক পৃথিবী, বিজিত, জম্বুদ্বীপ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন, বিশেষ অঞ্চলবাচক কোনও শব্দ ব্যবহার করেননি। প্রায় আসমুদ্রহিমাচলের অধীশ্বর যিনি তিনি নিজেকে মগধের রাজা বলে পরিচয় দেবেন, এটি স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অশােক নিজেকে মগধরাজ বলে ঘােষণা করলে সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের প্রতি তার উপেক্ষার মনােভাব ব্যক্ত হত। তার মতাে একজন প্রিয়দর্শী ও সমদর্শী রাজার এরূপ আচরণ অনভিপ্রেত। যারা বলেন, অশােক নিজেকে মগধের রাজা বলে ঘােষণা করেছেন, তারা ভাবরু বা বৈরাট অনুশাসনের এই পাঠের ওপর নির্ভর করেন : ‘পিদসি লাজা মাগধে সংঘং অভিবাদনং আহা’। এর অর্থ, ‘প্রিয়দর্শী মগধরাজ (বৌদ্ধ)-সংঘকে অভিবাদন করে বলেন’। এই পাঠ সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয় অনেকে ‘মাগধে’-এর পরিবর্তে ‘মাগধং’ পাঠ গ্রহণ করেন। সেক্ষেত্রে ‘মাগধং’ সংঘের বিশেষণ হবে। অর্থাৎ বৌদ্ধসংঘটি মগধে অবস্থিত ছিল। তাছাড়া, যে কথাটিকে ‘মাগধে’ বা ‘মাগধং’ পাঠ করা হয়েছে, সেই কথাটি ‘মগধে’ হওয়ায় বিচিত্র নয়। অর্থাৎ সংঘ মগধে অবস্থিত ছিল। রােমিলা থাপর অশােকের ত্রিস্তরীয় শাসনব্যবস্থার উল্লেখ করেছেন কিন্তু এই স্তরগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোনও আলােকপাত করেননি। 

এ কথা অবশ্য স্বীকার্য, সে সময় যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম ছিল না, পাটলিপুত্রের প্রশাসনিক কার্যালয় হতে পুরাে সাম্রাজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ কঠোরতার সঙ্গে বজায় রাখা সহজসাধ্য ছিল না। তবুও সমগ্র সাম্রাজ্যে অশােকের পরাক্রম যে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল তা বােধহয় স্বীকার করা যায়। আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রাপ্ত অশােকের অনুশাসনই তার অকাট্য প্রমাণ। অশােকের অনুশাসন প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, অনুশাসনের মর্ম সকলে অবগত হােন, নিজেদের জীবনে তা পালন করুন। আফগানিস্তানে গ্রিক ও আরামীয় ভাষা প্রচলিত থাকায় অশােক সঙ্গত কারণেই সেই অঞ্চলে এই ভাষা দু’টি ব্যবহার করেছেন, এর অন্য কোনও প্রশাসনিক তাৎপর্য নেই। যে ভাষা স্থানীয় অঞ্চলে অপ্রচলিত, সে ভাষায় অনুশাসন প্রচার অর্থহীন। বিচ্ছিন্নবাদীরা যে অভ্যুত্থান ঘটাতেন না, তা নয়। কিন্তু বিন্দুসারের রাজত্বকালেই কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতায় তা দু’বার প্রশমিত হয়। ত্রয়ােদশ মুখ্য গিরিশাসনে অশােক অটবিবাসীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, তারা আচরণে সংযত না হলে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনবেন, তিনি তাদের ততক্ষণই ক্ষমা করবেন, যতক্ষণ তারা ক্ষমার যােগ্য হবেন (ছমিতবিয়মতে বাে দেবানং প্রিয়স যং শকো ছমনয়ে)। অটবিবাসীদের প্রতি অশােকের এই সতর্কবাণীতে সাম্রাজ্যের সর্বত্র নিজের কর্তৃত্ব (অশােকের ভাষায় ‘প্রভাব’) প্রতিষ্ঠায় তার ঐকান্তিক আগ্রহ প্রতিফলিত হয়েছে। অশােক যখন দণ্ডসমতা ও ব্যবহারসমতার কথা বলে তখন তার লক্ষ্য অখণ্ড মৌর্য সাম্রাজ্য, সাম্রাজ্যের কোনও খণ্ডিতাংশ নয়। প্রজারঞ্জক রাজা জাতি-জনপদ ধর্ম, শ্রেণিধর্ম ও কুলধর্মের প্রতি দৃষ্টি রেখে তার নীতি নির্ধারণ করবেন, এটিই স্বাভাবিক, অন্যথা ব্যতিক্রম (জাতি-জানপদান্ ধর্মান্ শ্রেণীধর্মাংশ্চ ধর্মবিদ। সমীক্ষ্য কুলধর্মাংশ্চ স্বধর্মং প্রতিপাদয়ে।। মনুসংহিতা ৮/৪১)। যতদিন অশােক রাজপদে সমাসীন ছিলেন ততদিন তিনি তার কর্তৃত্ব বা প্রভাব শিথিল হতে দেননি। কিন্তু তার লােকান্তরের পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। তার দুর্বল, অশক্ত পুত্র-পৌত্রদের পক্ষে পাটলিপুত্রের রাজসভাতেই তাদের কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রাখা দুরূহ হয়ে পড়ল। বিচক্ষণ ও শক্তিমান রাজা অনায়াসে কঠিন সমস্যা সমাধান করেন আর দুর্বল ও হঠকারী রাজা নিজবুদ্ধিদোষে অনুকূল পরিস্থিতিও জটিল করেন।

জেলার প্রশাসন-ব্যবস্থা

সাম্রাজ্য যেমন কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল, তেমনি এক একটি প্রদেশ আবার কয়েকটি জেলায় বিভক্ত ছিল। মৌর্যদের সময় জেলাকে কী বলা হত, তা জানা যায় না। অশােকের অনুশাসনে আহার ও কোট্টবিষয় বা বিষয় নামে দুটি প্রশাসনিক বিভাগের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিভাগ দু’টির উল্লেখ প্রসঙ্গে রাজুক নামে পদস্থ রাজপুরুষদের কোনও কথা নেই। অথচ এই রাজুকেরা জেলা বা তার সমতুল্য প্রশাসনিক বিভাগের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এর থেকে মনে হয়, অশােকের অনুশাসনে আহার বা বিষয় জেলা অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, ব্যবহৃত হয়েছে কোনও ক্ষুদ্রতর প্রশাসনিক বিভাগ অর্থে।

জেলার মুখ্য প্রশাসক ছিলেন রাজুক। ‘রজজু’ পদ থেকে রাজুক কথাটি এসেছে। রজজুর অর্থ দড়ি। এই দড়ি লাগত জমি জরিপের কাজে। অপরাধীকে বন্ধনের জন্যও দড়ির প্রয়ােজন। হত। বস্তুত রাজস্ব-সংগ্রহই রাজুকের একমাত্র কাজ ছিল না, তাকে বিচার বিভাগীয় কাজও সম্পন্ন করতে হত। শাস্তিপ্রদানের ক্ষেত্রে ও বিচারের কাজে রাজুক যাতে নিরপেক্ষতা ও সমদর্শিতার পরিচয় দেন, অশােক সেজন্য বার বার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রজাদের কল্যাণের জন্য রাজুকদের সদা সচেষ্ট রাখতে অশােকের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। রাজস্ব সংগ্রহ ও বিচারকার্য ছাড়া রাজুকরা জেলার রাস্তাঘাট সংস্কার, শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার, সেচপ্রকল্পের রূপায়ণ প্রভৃতি জনকল্যাণমুখী কাজের তত্ত্বাবধান করতেন। প্রজাদের মধ্যে ধর্মবােধ জাগ্রত করাও রাজুকদের আর একটি প্রধান কাজ ছিল। এই উদ্দেশ্যে তারা মাঝে মাঝে জেলা সফরে বের হতেন। রাজুকরা প্রদেশপালদের অধীনস্থ ছিলেন ঠিকই কিন্তু সম্রাট অশােক জেলাশাসকদের সঙ্গে সরাসরি সংযােগ রক্ষা করতেন, অবস্থা বিশেষে তাদের নির্দেশ দিতেন। আবার প্রাদেশিক শাসনকর্তারাও তাদের অধীনস্থ মহামাত্রদের জেলায় পাঠিয়ে খবরাখবর সংগ্রহ করতেন, স্থানীয় প্রশাসনকে যথাবিধি নির্দেশ দিতেন।

স্থানীয় প্রশাসন

অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, পাঁচ বা দশটি গ্রাম নিয়ে সংগ্রহণ নামে এক প্রশাসনিক বিভাগ ছিল। গােপনামে রাজপুরুষদের উপর সংগ্রহণের শাসনভার ন্যস্ত ছিল। গ্রামের সীমা চিহ্নিতকরণ, জন্ম-মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহ, দান-বিক্রয়-বন্ধক সম্পর্কিত কাজকর্ম নিবন্ধ-ভুক্ত করা, রাজস্ব-আদায়, জনকল্যাণমূলক কার্যাদির অনুষ্ঠান ইত্যাদি নানা দায়িত্ব তাকে পালন করতে হত। তিনি সম্ভবত স্থানীয় এলাকার বিচারবিভাগীয় কাজকর্মের দায়িত্বও বহন করতেন। অশােকের অনুশাসনে প্রাদেশিক নামে এক শ্রেণির কর্মচারীর উল্লেখ আছে। ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তির ভার ছিল তাদের উপর। প্রাদেশিক স্বতন্ত্রভাবে তার কাজকর্ম নিষ্পন্ন করতেন, নাকি গােপের অধীনস্থ ছিলেন, তা জানা যায় না। প্রাদেশিক বলতে কাদের বােঝায়, সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে বাগ-বিতণ্ডা আছে। অনেকে অঞ্চল বা প্রদেশের শাসনকর্তা, এই অর্থে প্রাদেশিক পদটির ব্যাখ্যা করেছেন। মনে হয়, প্রাদেশিক পদটি নির্দেশার্থক ‘দিশ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন, স্থানবাচক প্রদেশ থেকে নয়। 

গ্রামের দায়িত্বে ছিলেন গ্রামিক বা গ্রামমুখ্য। গ্রামৈক বা গ্রামকূট বলেও তিনি পরিচিত ছিলেন। গ্রামের বৃদ্ধ ব্যক্তিরা তাকে কার্য পরিচালনায় সাহায্য করতেন। এই বৃদ্ধ ব্যক্তিরা নিঃসন্দেহে গ্রামবাসীদের প্রতিনিধি ছিলেন। অনেকে অবশ্য গ্রামিককেও গ্রামবাসিগণের মনােনীত প্রতিনিধি বলে মনে করেন। অর্থশাস্ত্রের বেতনভুক রাজপুরুষদের তালিকায় গ্রামিকের অনুপস্থিতিই তাদের অনুমানের মূল ভিত্তি। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নাও হতে পারে। অর্থাৎ গ্রামিকের সরকারি রাজপুরুষ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করা যায় না। সে যাই হােক, গ্রামিক গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন, ছােটখাটো বিরােধের নিষ্পত্তি করতেন, চোর ও ভেজালকারবারীদের শাস্তির বিধান দিতেন। গ্রামে চুরির ঘটনা ঘটলে গ্রামপ্রধানই দায়ী হতেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তিনি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতেন। কেউ কেউ বলেন, গ্রামিকের রাজস্বসংক্রান্ত কোনও দায়দায়িত্ব ছিল না, সে কাজ গােপ করতেন। পারিশ্রমিক-স্বরূপ গ্রামিক নির্দিষ্ট পরিমাণ নিষ্কর জমির স্বত্ব লাভ করতেন। কাজে শৈথিল্য গ্রামিকের ক্ষেত্রে দণ্ডযােগ্য অপরাধ বলে গণ্য হত।

বিচার ও কারাবিভাগ

অর্থশাস্ত্রে ধর্মস্থ ও প্রদেষ্টা নামে দুই শ্রেণির বিচারকের উল্লেখ আছে। ধর্মীয় পরীক্ষায় যেসব অমাত্য উত্তীর্ণ হতেন, তাদের মধ্য হতেই বিচারক নিযুক্ত হতেন। কোন বিচারক কোন কোন বিষয়ের বিচার করবেন, অর্থশাস্ত্রে তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। সেই বর্ণনা থেকে জানা যায়, সে সময় বিষয়গুলো এখনকার মতাে দেওয়ানি ও ফৌজদারি এই দুটি সুনির্দিষ্ট ভাগে বিভক্ত ছিল না, কতকটা অবিন্যস্তভাবে শ্রেণিবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ ধর্মস্থ ও প্রদেষ্টাকে শুধু দেওয়ানি বা শুধু ফৌজদারি মামলার বিচার করতে হত না, প্রত্যেককেই উভয় বিভাগের নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ের নিষ্পত্তি করতে হত। ধর্মস্থ তথাকথিত দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় বিভাগেরই কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ের বিচার করতেন। প্রদেষ্টার কাজও ঠিক তাই ছিল। ধর্মস্থর আদালতের নাম ধর্মস্থীয়, প্রদেষ্টার কণ্টকশােধন। এই আদালতগুলো শুধু রাজধানীতে নয়, রাজ্যের প্রধান প্রধান শহর, এমনকি সীমান্ত অঞ্চলেও, স্থাপন করা হত। বিচারক অন্যায়ভাবে কাউকে দণ্ড দিলে সরকার তার উপর দ্বিগুণ শাস্তি আরােপ করবেন বলে অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রের আরও নির্দেশ, অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে বিচারক পদচ্যুত হবেন। অশােকের অনুশাসনে ধর্মস্থ বা প্রদেষ্টার কথা নেই, আছে নগরব্যবহারক নামে এক শ্রেণির বিচারকের উল্লেখ। নগরে বিচারাদি কাজ যিনি সম্পন্ন করেন, তিনিই নগরব্যবহারক। ধর্মীয় ও কণ্টকশােধন আদালত শহরেই অবস্থিত ছিল। সেক্ষেত্রে ধর্মস্থ ও প্রদেষ্টারাও নগরব্যবহারক। বিচারবিভাগে অশােক কয়েকটি সংস্কার সাধন করেন :

  • এক. বিচারব্যবস্থায় দণ্ড-সমতা ও ব্যবহার-সমতার নীতি প্রবর্তন। এর ফলে একদিকে যেমন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল, অন্যদিকে তেমনি রাজ্যের সর্বত্র একই প্রকার দণ্ড ও ব্যবহারবিধির প্রবর্তন হল।
  • দুই. ফৌজদারি দণ্ডবিধির কঠোরতা বহুলাংশে হ্রাস করা হয়।
  • তিন. অশােক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের তিন দিনের সময় দানের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তি তার দণ্ডাজ্ঞার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদন করার সুযােগ পাবে। তা না হলে সে ওই কটা দিন দানধ্যান ও ধর্মকর্মে ব্যয় করবে, যাতে পরলােকে সে শান্তি পেতে পারে।

কারাবিভাগের দায়িত্বে ছিলেন প্রশাস্তা নামে একশ্রেণির রাজপুরুষ। প্রতি বছর অশােকের রাজ্যাভিষেকবার্ষিকী উপলক্ষে কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হত। অশোকের পঞ্চম স্তম্ভ অনুশাসনে ২৫ বার বন্দিমুত্তির কথা বলা হয়েছে। মনে হয়, এই ব্যবস্থাটি অশােকের পূর্ব হতেই প্রচলিত ছিল। বলা বাহুল্য, অপরাধীর বয়স ও অপরাধের স্বরূপ বিবেচনা করেই শাস্তি মওকুফ করা হত, ঢালাও শাস্তি মকুফের ব্যবস্থা ছিল না। রাষ্ট্রের স্বার্থে সেটা বাঞ্ছনীয় ছিল না। অহিংসার পূজারি হয়েও অশােক সে কারণে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেননি, মানবিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কারাবন্দি সমস্যাটি অনুধাবন করেছেন।

পৌর প্রশাসন ও সমর-বিভাগ

পৌর প্রশাসন : অনেকে বলে থাকেন, মৌর্যদের আমলে পাটলিপুত্রের মতাে শহরগুলো স্বশাসিত ছিল। কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। একথা ঠিক, মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্রে ৩০ সদস্যের এক সংস্থার কথা বলেছেন কিন্তু আসলে এই সংস্থার সঙ্গে বর্তমানকালের পৌর প্রতিষ্ঠানের তুলনা চলে, শহরের সাধারণ প্রশাসনের সঙ্গে এই সংস্থার কোনও যােগ ছিল না। মেগাস্থিনিস বর্ণিত পাটলিপুত্র সংস্থার সঙ্গে আধুনিক পৌর সংস্থার একটি মৌল পার্থক্য আছে। আধুনিক পৌর প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা শহরবাসীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি কিন্তু পাটলিপুত্র সংস্থার সদস্যরা সকলেই রাজপুরুষ ছিলেন। মেগাস্থিনিস তাদের ‘এস্টিনােময়’ বলে আখ্যাত করেছেন। পাটলিপুত্রের পৌর সংস্থাটি ৬টি সমিতিতে বিভক্ত ছিল। এক এক সমিতিতে ৫ জন করে সদস্য ছিলেন। প্রতিটি সমিতিকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হত। ৬টি সমিতি যথাক্রমে (১) শ্রমশিল্প, (২) বিদেশিদের তদারকি, (৩) জন্ম-মৃত্যুর পরিসংখ্যান, (৪) জিনিসপত্রের খুচরা ও পাইকারি ক্রয়বিক্রয় পরিচালনা, (৫) শিল্পদ্রব্যের উৎপাদন ও বিক্রয়ের তত্ত্বাবধান এবং (৬) পণ্যের বিক্রয়লব্ধ অর্থের এক-দশমাংশ কর আদায়ের কাজে নিযুক্ত ছিল। তখনকার দিনে কর আদায়ে কোনওরূপ শৈথিল্য দেখানাে হত না। যিনি কর ফাঁকি দিতেন, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। নিজেদের নির্দিষ্ট কাজ ছাড়াও সমিতির সদস্যরা যৌথভাবে সরকারি গৃহাদির সংস্কার, মূল্য নিয়ন্ত্রণ, বাজার, পােতাশ্রয় ও মন্দিরাদির রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি জনকল্যাণমুখী বিভিন্ন বিষয় পরিচালনা করতেন। তখন পাটলিপুত্র ছাড়া তক্ষশিলা, উজ্জয়িনী ও বারাণসীও বড় শহর ছিল। সেসব শহরেও হয়তাে পাটলিপুত্রের মতাে পৌর সংস্থা ছিল।

সমর বিভাগ : মেগাস্থিনিস বলেন, সামরিক বিভাগের পরিচালনার ভার ৩০ সদস্যের এক সরকারি সংস্থার উপর ন্যস্ত ছিল। এই সংস্থা আবার ৫ সদস্যের ছয়টি সমিতিতে বিভক্ত ছিল। সমিতি ছয়টি যথাক্রমে (১) নৌবহর, (2) পদাতিক, (৩) অশ্বারােহী, (৪) রথবাহিনী, (৫) হস্তিবাহিনী এবং (৬) যােগাযােগ ও সরবরাহ ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিল। অর্থশাস্ত্রে ৩০ সদস্যের কোনও সামরিক সংস্থার উল্লেখ নেই কিন্তু পদাতিক, রথারােহী, অশ্বারােহী, হস্তিবাহিনী, নৌবহর, আয়ুধাগার ইত্যাদি। সামরিক বিভাগের বিভিন্ন শাখার কথা আছে। এক একজন অধ্যক্ষ এক একটি শাখা পরিচালনা করতেন। এদের উপরে ছিলেন সেনাপতি। রাজা ছিলেন সকলের ওপরে।

মৌর্য প্রশাসনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য

উপরের আলােচনা থেকে মৌর্য প্রশাসনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে –

  • প্রথমত, প্রশাসন ব্যবস্থায় এককেন্দ্রিকতার একটা ঝোঁক ছিল। রাজ্যের কোথায় কী ঘটছে, না ঘটছে, রাজপুরুষেরা কী করছেন, তাদের গতিবিধিই বা কী তা জানার ব্যাকুলতা রাজার মধ্যে লক্ষ করা যায়। সর্বস্তরের রাজপুরুষদের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ সংযােগ, প্রশাসনের সর্বস্তরে তার অপ্রতিহত কর্তৃত্ব।
  • দ্বিতীয়ত, রাজা আইনত সর্বশক্তিমান হলেও কার্যত স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারেনি। মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষৎ ও অমাত্যবর্গের একটা প্রভাব তাে ছিলই। তার উপর ছিল প্রশাসনিক কার্যধারাকে জনমুখী করার তাগিদ।
  • তৃতীয়ত, অপরাধের দণ্ড শাস্তি, এই নীতির যথাযথ প্রয়ােগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে মানবিকতাবােধ ও মৈত্রীর চেতনা জাগ্রত করে রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার যে অভিনব উদ্যম এই যুগে দেখা গিয়েছিল, তা এক কথায় অপূর্ব। তবে রাজতন্ত্রে এই সব লক্ষণ তখনই প্রকাশ পায় যখন রাজা হন বিচক্ষণ, কর্মোদ্যোগী ও প্রজাহিতৈষী। অশােকোত্তর পর্বে এই ধরনের রাজার একান্ত অভাব ঘটল ; প্রশাসন বিপথে চালিত হল ; সাম্রাজ্যের ভিত কেঁপে উঠল।

সমাজ-জীবন

মেগাস্থিনিস এবং তার পরবর্তী গ্রিক ও রােমক লেখকদের বর্ণনায় মৌর্যযুগে ভারতীয় সমাজ-জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। ভারতীয় সমাজব্যবস্থার পরিপূর্ণ রূপটি তাদের চোখে ধরা পড়েনি। কিন্তু তারা অনেকেই প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের বর্ণনার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

মেগাস্থিনিস ও সমাজ বিভাজন

মেরোস ও জেনোস : সমকালীন ভারতীয় জনসমষ্টিকে মেগাস্থিনিস সাতটি বিভাগ বা গােষ্ঠীতে বিভক্ত করেছেন। এই বিভাগ বা গােষ্ঠী প্রসঙ্গে ‘মেরােস’ (meros) এবং জেনােস (genos) এই দু’টি গ্রিক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, শব্দ দুটির প্রকৃত অর্থ নিয়ে বিদ্বসমাজে বিস্তর বাগ-বিতণ্ডা সৃষ্টি হয়েছে। ‘মেরাস’ কথাটিকে অলথাইম শ্রেণি (F Altheim. Weligeschichte Asiens in Griechischen Zeitalter, I (Halle, 1974). পৃ. ২৫৭-৬৪), ওল্ডফাদার (C.H. Oldfather, Diodorus of Sicily, I (Cambridge, 1979)) ও জোন্স (H. L. Jones, The Geography of Strabo (Cambridge, 1966)) জাতি এবং ম্যাকক্রিন্ডল (J. W. MOCrindle, Ancient India as described by Megasthenes and Arrian (London, 1987)) অশ, বিভাগ অর্থে গ্রহণ করেছেন। ‘জেনােস’ শব্দটিকে অলথাইম ও ম্যাকক্রিন্ডল যথাক্রমে শ্রেণি ও জাতি অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। মেগাস্থিনিস যখন বলেন, ভারতীয় সমাজে জেনােসের বাইরে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল এবং এক জেনােসের সদস্যদের অন্য জেনােসের জীবিকা ও ব্যবসা গ্রহণ পরিহার্য ছিল তখন সঙ্গত কারণেই অনুমিত হয়, মেগাস্থিনিসের জেনােস ও ভারতীয় শব্দ জাতি কার্যত সমধর্মী। স্বজাতি-বিবাহ ও বংশানুক্রমিক বৃত্তির অনুসরণ জাতিপ্রথার দু’টি প্রধান লক্ষণ। মেগাস্থিনিস জেনােসের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে জাতি প্রথার দুটি মূল বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতীয় জনসমষ্টির সপ্তধা বিভাজন সম্পর্কে মেগাস্থিনিস ঠিক কোন শব্দটি ব্যবহার করেছেন? সকলেই জানেন, মেগাস্থিনিসের মূল গ্রন্থখানি বর্তমানে অবলুপ্ত, এই গ্রন্থটি সম্পর্কে আমদের যা কিছু ধারণা তা গড়ে উঠেছে ডায়ােডােরাস স্ট্র্যাবাে ও এরিয়ানের বৃত্তান্তে উল্লিখিত উদ্ধৃিতির ভিত্তিতে। ডায়ােডােরাস ও স্ট্র্যাবাের উদ্ধৃতির জনসমষ্টির বিভাজন প্রসঙ্গে ‘মেরােস’ এবং ভারতীয়গণের বিবাহ ও বৃত্তি প্রসঙ্গে ‘জেনােস’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এরিয়ানের উদ্ধিতিতে এর ঠিক বিপরীত চিত্র ; সেখানে ভারতীয় সমাজের বিভক্তিকরণ প্রসঙ্গে ‘জেনি’ (genea) বা ‘জেনােস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে ভারতীয় জনসমষ্টির বিভাজন সম্পর্কে মেগাস্থিনিস যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেটি ‘মেরােস’ না ‘জেনােস’, এর মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত গ্রিক দূত ভারতীয় জনসমাজকে সাতটি জাতি না গােষ্ঠী বা বিভাগে বিন্যস্ত করেছেন, তার সদুত্তর পাওয়া কঠিন হবে। জাতি বিশেষ-অর্থবােধক এক পারিভাষিক শব্দ, গােষ্ঠী বা বিভাগ তা নয়। শ্রেণি কথাটিরও এক বিশেষ অর্থ আছে। সে কারণে মেগাস্থিনিসের ভারতীয় জনসমষ্টি বিভাজন প্রসঙ্গে গােষ্ঠী বা বিভাগ ব্যবহার করাই সমীচীন হবে।

সাতটি গােষ্ঠী : সমকালীন ভারতীয় জনসমষ্টিকে মেগাস্থিনিস যে সাতটি গােষ্ঠীতে বিভক্ত করেছেন, সেই গােষ্ঠী সাতটি হল—(১) দার্শনিক, (২) কৃষক, (৩) শিকারি ও পশুপালক, (৪) কারিগর, (৫) সৈনিক, (৬) পরিদর্শক বা গুপ্তচর এবং (৭) উপদেষ্টা ও প্রশাসক। লক্ষণীয়, মেগাস্থিনিস ভারতীয় জনসমষ্টিকে ছয়টি বা আটটিতে নয়, সাতটি সুনির্দিষ্ট বিভাগ বা গােষ্ঠীতে বিন্যস্ত করেছেন। কেন এই সাতটি বিভাগ? হেরােজোটাস প্রাচীন মিশরীয় সমাজকে সাতটি বিভাগে বিভক্ত করেছেন। হতে পারে জনসমষ্টির বিভক্তিকরণে মেগাস্থিনিস হেরােডােটাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। রােমিলা থাপর (The Mauryas Revisited (Calcutta, 1997), পৃষ্ঠা ৫১) মনে করেন, মেগাস্থিনিসকৃত ভারতীয় জনসমাজের সপ্তধা বিভাজনে কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে আলােচিত সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রতত্ত্বের ছায়া পড়েছে। এই অভিমত অভিনব কিন্তু সম্ভবত অগ্রহণীয়।

  • দার্শনিক : বিভিন্ন গােষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যায় যারা লঘিষ্ঠ অথচ সমাজে সবচেয়ে সম্মানিত, তারা হলেন দার্শনিক। দার্শনিকদের দু’টি ভাগ, ‘ব্রাকমেনিস’ ও ‘সারমেনিস’। মেগাস্থিনিস যাদের ‘ব্রাকমেনিস’ ও ‘সারমেনিস’ বলেছেন, তাদের অনেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ ও শ্রমণ বলে শনাক্ত করেছেন। কিন্তু মেগাস্থিনিসের বর্ণনার সঙ্গে এই শনাক্তকরণের কোনও মিল নেই। ‘ব্রাকমেনিস’দের জীবনে দু’টি পর্যায় ছিল। প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ বাল্যে ও যৌবনে তারা অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন ; নগরীর অনতিদুরে তপােবনে তারা বাস করতেন ; এ সময় তারা আমিষ আহার বর্জন করতেন ; ব্রহ্মচর্য এবং অধ্যয়ন-অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করতেন। এভাবে তাদের ৩৭ বছর যাপন করতে হত। দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা গৃহে প্রত্যাবর্তন করে বাকি জীবন পরম নিশ্চিন্তে ও আরামে কাটাতেন। তখন তাদের আহার-বিহার, বসন-ভূষণ, এমনকি বহুবিবাহে পর্যন্ত কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। ‘সারমেনিস’ নামে পরিচিত দার্শনিকদের দু’টি শ্রেণি যারা বেশি সম্মানের তারা ছিলেন অরণ্যবাসী। তারা বনের ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করতেন, গাছের বাকল পরিধান করতেন। অন্যরা ছিলেন চিকিৎসক। তারা লােকালয়ে বাস করতেন, বিনা পারিশ্রমিকে গৃহস্থদের চিকিৎসা করতেন। গৃহস্থরা অবশ্য তাদের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করতেন। রােগ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকরা ওষুধের থেকে পথ্যাপথের ওপরেই বেশি জোর দিতেন। সর্প দংশনের ক্ষেত্রে প্রাচীন গ্রিসের তুলনায় ভারতে চিকিৎসার মান উন্নত ছিল বলে গ্রিক ও রােমক লেখকরা এক বাক্যে স্বীকার করে গেছেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, ‘সারমেনিস’ নামে পরিচিত দার্শনিকদের মধ্যে মহিলারাও ছিলেন, তারা আজীবন কুমারী থেকে গেছেন। অন্য গােষ্ঠীদের তুলনায় সংখ্যালঘু হলেও সমাজে দার্শনিকেরা সকলের শীর্ষে ছিলেন। যাগ যজ্ঞ উপলক্ষে জনসাধারণ ও রাজা-মহারাজেরা তাদের আহ্বান করতেন। বছরের গােড়ায় তারা অনাগত দিনের জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্বিপাক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে পূর্বাভাস ঘোষণা করতেন। কারাের পূর্বাভাস পর পর তিনবার মিথ্যা প্রমাণ হলে তার আর পুনরায় ভবিষ্যদ্বাণী করার অধিকার থাকত না।
  • কৃষক : দার্শনিকদের পরই মেগাস্থিনিস কৃষকদের কথা বলেছেন। সমাজে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের স্বভাব ছিল ভদ্র ও নম্র। তারা জমির মালিক নন। উৎপন্ন ফসলের এক-চতুর্থাংশ তাদের প্রাপ্য ছিল। উৎপন্ন শস্যের নির্দিষ্ট একটা অংশ রাজাকে কর হিসাবে দিতে হত। ফসলের জোগান অব্যাহত রাখার জন্য তাদের সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হত ; এমনকি যুদ্ধের সময়ও সৈন্যরা কৃষকদের বসতি বা কৃষিযােগ্য জমির উপর দিয়ে গমনাগমন করতে পারতেন না। ফলে দেখা যেত, রাজ্যের একদিকে যখন যুদ্ধ চলছে অন্যদিকে কৃষকেরা নিরুপদ্রবে ও নির্ভয়ে চাষাবাদের কাজ করে চলেছেন বা ফসল কেটে ঘরে তুলেছেন। তারা সাধারণত গ্রামেই থাকতেন, শহরে বড় একটা ভিড় জমাতেন না।
  • শিকারি ও পশুপালক : তৃতীয় গােষ্ঠি শিকারি ও পশুপালক। বনে-জঙ্গলে পশু-পাখি শিকার করে আর গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। অনিষ্টকারী পশু-পাখির হাত থেকে খেতের ফসল রক্ষা করতেন বলে সরকারপক্ষ থেকে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হত। যাযাবরের জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই সব পশুপালক ও শিকারিরা তাবুতেই বসবাস করতেন।
  • কারিগর বা শিল্পী : কারিগর বা শিল্পীরা হলেন চতুর্থ বিভাগ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনভাবে শিল্পকার্য করতেন, আবার কেউবা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের কাজ করে দিতেন। কারিগরদের মধ্যে আবার এমন অনেকে ছিলেন যারা শুধু রাষ্ট্রের জন্যই যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র এবং জাহাজ নির্মাণ করতেন। রাজকোষ থেকে তাদের বেতন দেওয়া হত। তাদের কোনও কর দিতে হত না। কিন্তু অন্যান্যদের কর দিতে হত।
  • সৈনিক : সৈনিকরা হলেন পঞ্চম গােষ্ঠি। সংখ্যার বিচারে সমাজে কৃষকদের পরই তাদের স্থান ; যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছিল তাদের একমাত্র কাজ। যখন যুদ্ধ চলত না, তখন আলস্যে, পান-ভােজনে তাদের দিন কাটত। তাদের ভরণপােষণের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের।
  • পরিদর্শক বা গুপ্তচর : ষষ্ঠ বিভাগ পরিদর্শক বা গুপ্তচরদের কাজ ছিল রাজ্যের সব খবরাখবর জোগাড় করা এবং রাজাকে সে সম্পর্কে অবহিত রাখা। তারা ছিলেন সরকারি কর্মচারী। বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিরাই এই পদে নিযুক্ত হতেন। 
  • উপদেষ্টা ও প্রশাসক : রাজার উপদেষ্টা ও প্রশাসকদের নিয়ে সপ্তম বা সর্বশেষ গােষ্ঠি গঠিত ছিল। এই বিভাগের লােকেরাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে নিযুক্ত হতেন, ন্যায়ালয়ে বিচারপতির ভূমিকা পালন করতেন, রথরূপ রাজ্যের চাকাকে সচল রাখতেন। গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন বলে সমাজে তাদের বিশেষ মর্যাদা ছিল। বুদ্ধিজীবী বলতে যা বােঝায়, এরা ছিলেন তাই। 

গোষ্ঠীসমূহের উচ্চনীচ প্রসঙ্গে মেগাস্থিনিস : কখনও কখনও বলা হয়, মেগাস্থিনিস যে সমাজ-বিভাজনের কথা বলেছেন তা আনুভূমিক, অর্থাৎ এই বিভাজন যেন পাশাপাশি বিন্যস্ত, এই বিভাজন উচ্চাবচ ভেদাভেদ বর্জিত। এ কথা ঠিক, মেগাস্থিনিস ভারতীয় জনসমষ্টিকে উচ্চনিচ ক্রমে বিভাজিত করেননি, কোনও গােষ্ঠীকেও তিনি হেয় জ্ঞান করেননি। তবে এ কথাও সত্য, তার বর্ণিত গােষ্ঠীগুলো সমমাত্রিক নয়। তিনি যাদের প্রথম গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন সেই দার্শনিকদের সামাজিক আভিজাত্যের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে তার বৃত্তান্তে। তেমনি প্রশাসক ও উপদেষ্টাদের নিয়ে যে গােষ্ঠী, তারও সামাজিক গুরুত্বের কথা অকপটে ব্যক্ত হয়েছে তার বর্ণনায়। 

গােষ্ঠী বৈষম্যের তীব্রতা : গােষ্ঠী বৈষম্যের তীব্রতার উল্লেখ করেছেন মেগাস্থিনিস। এক গােষ্ঠীর পক্ষে অন্য গােষ্ঠীর জীবিকা গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। তেমনি গােষ্ঠীতে গােষ্ঠীতে বৈবাহিক সম্পর্কও নিয়ম বিরুদ্ধ ছিল। একথা সত্য, মেগাস্থিনিসের এই গােষ্ঠি বিভাজন কর্মভিত্তিক। তখন সমাজে নিত্য নতুন বৃত্তির উদ্ভব হচ্ছিল। এক এক বৃত্তিকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন গেষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটছিল। এরই প্রতিফলন রয়েছে মেগাস্থিনিসের বর্ণনায়। ভারতের সনাতন বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় ফুটে ওঠেনি। এসব ত্রুটি সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয়, মেগাস্থিনিস তার বর্ণনায় ভারতীয় জনসমাজের বিরাট এক অংশকে উপস্থাপিত করেছেন। ভারতীয় চাতুর্বর্ণ সমাজের বিভিন্ন বর্ণকে অনায়াসে তার সাতটি গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। মেগাস্থিনিস যাদের ‘ব্রাকমেনিস’ বলেছেন তারা নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। ‘সারমেনিস’ শ্রেণিভুক্ত দার্শনিকদের জীবনযাত্রার সঙ্গে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রমের তুলনা করা যায়। গ্রিক দূত যাদের যােদ্ধা, পরিদর্শক ও মন্ত্রণাদাতা বলে পরিচয় দিয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন ক্ষত্রিয়। আর কৃষক, শিকারি, পশুপালক ও কারিগরদের মধ্যে বৈশ্য ও শূদ্র উভয় বর্ণেরই লােক ছিলেন। 

স্বজাতি-বিবাহ ও বংশানুক্রমিক বৃত্তি : মেগাস্থিনিস তার বিবরণে স্বজাতি-বিবাহ ও বংশানুক্রমিক বৃত্তির উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। সমকালীন ভারতের সমাজ জীবনের ছবি কিন্তু ঠিক এমনটি ছিল না। ধর্মশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্রাদি গ্রন্থে অসবর্ণ বিবাহের বিধান আছে ; লােকের পৈতৃক বৃত্তির পরিবর্তে নতুন জীবিকা গ্রহণের উল্লেখ আছে। ভারতে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল না বলে মেগাস্থিনিস যে উক্তি করেছেন, তাও সত্য নয়। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে ও অশােকের অনুশাসনে দাসপ্রথার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বর্ণ, আশ্রম ও দাসপ্রথা

বর্ণব্যবস্থা : বর্ণ ও আশ্রমভিত্তিক সামাজিক জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন বর্ণের ও আশ্রমের দায়দায়িত্ব, ধর্মাধর্ম সম্পর্কে বিশদ আলােচনা আছে এই গ্রন্থে। ব্রাহ্মণদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তাদের কর্তব্য হল অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ বা দানগ্রহণ। ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম অধ্যয়ন, যজন, দান, শস্ত্রদ্বারা জীবিকা অর্জন বা সামরিক বৃত্তি গ্রহণ এবং ভূতরক্ষণ বা প্রাণীদের জীবন রক্ষা। বৈশ্যের স্বধর্ম অধ্যয়ন, যজন, দান, কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য। দ্বিজাতি অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবা, বার্তা অর্থাৎ সম্পদসৃষ্টি, কারুকর্ম বা শিল্পকার্য ও কুশীলবকর্ম বা সংগীত নৃত্যাদি প্রদর্শন হল শূদ্রের জীবিকা। 

চতুরাশ্রম : কৌটিল্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের জীবনের ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, ভিক্ষা ও সন্ন্যাস এই চারটি আশ্রম বা পর্যায়ের কথা বলেছেন। ব্রহ্মচর্য হল জীবনের প্রস্তুতি পর্ব। এই পর্বে গুরুগৃহে বাস করে চরিত্র গঠনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো অধ্যয়ন করতে হয়। অধ্যয়ন সম্পন্ন করে গৃহে ফিরে বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে গার্হস্থ্য আশ্রম বা সংসারধর্ম পালনের জীবন শুরু হয়। প্রৌঢ়ত্বে সংসার হতে দূরে একাকী বা স্ত্রীসান্নিধ্যে বনের মধ্যে ঈশ্বরচিন্তায় দিনযাপনের পর্যায় বানপ্রস্থ বা ভিক্ষা। সর্বশেষ পর্যায় সন্ন্যাস – এ হল সর্বস্ব ত্যাগের সময়, সকল প্রকার বন্ধন হতে মুক্তির সময়, ভিক্ষান্নের উপর নির্ভর করে, প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে একাকী ঈশ্বরচিন্তায় নিমগ্ন হওয়ার সময়। তবে মানুষ, কী বানপ্রস্থ, কী সন্ন্যাস, যে কোনও পর্যায়ে থাকুন না কেন, তাকে সর্বদা অহিংস হতে হবে, তাকে হতে হবে সত্যনিষ্ঠ, পবিত্র, কোমল, ক্ষমাপ্রবণ ও অন্যের গুণগ্রাহী। তখনকার দিনে উচ্চবর্ণের সকলেই যে জীবনের শেষ দুটি পর্যায়ে ভিক্ষু এবং পরিব্রাজক বা সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতেন, তা মনে হয় না। 

সংকর বা মিশ্র জাতি : অর্থশাস্ত্রে শুধু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়াদি বর্ণ বা তাদের চতুরাশ্রমের কথাই বলা হয়নি, বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে উৎপন্ন ‘সংকর’ বা মিশ্র জাতির কথাও বলা হয়েছে। মিশ্র জাতিদের মধ্যে আছেন :

  • অম্বষ্ঠ : যাদের পিতা ব্রাহ্মণ, মা বৈশ্য, তারা অম্বষ্ঠ।
  • নিষাদ বা পারশব : ব্রাহ্মণ স্বামী ও শূদ্র স্ত্রীর সন্তান নিষাদ বা পারশব।
  • উগ্র : শূদ্র মা ও ক্ষত্রিয় পিতার সন্তান উগ্র নামে পরিচিত।
  • আয়ােগব : শূদ্রের বৈশ্য স্ত্রীতে উৎপন্ন পুত্রের পরিচয় আয়ােগব।
  • ক্ষত্ত : যাদের পিতা শূদ্র কিন্তু মা ক্ষত্রিয়, তারা ক্ষত্ত।
  • চণ্ডাল : শূদ্রের ব্রাহ্মণী পত্নীতে উৎপন্ন পুত্র।
  • মাগধ : বৈশ্যের ক্ষত্রিয় স্ত্রীতে উৎপন্ন পুত্র।
  • বৈদেহক : বৈশ্য পিতা ও ব্রাহ্মণমাতার পুত্র।
  • সুত : যাদের পিতা ক্ষত্রিয়, কিন্তু মা ব্রাহ্মণ, তারা সূত। 

অর্থশাস্ত্রে বেশ কিছু ‘সংকরজাতির উল্লেখ আছে যাদের উদ্ভব হয়েছে দু’টি সংকরজাতির মধ্যে অন্তর্বিবাহের ফলে। এই প্রসঙ্গে কুক্কুটক, পুক্কস, কুশীলব, শ্বপাক প্রভৃতি ‘সংকর’ জাতির উল্লেখ করা যায়। উগ্র পিতার ও নিষাদ মাতার সন্তানের পরিচয় কুক্কুটক। নিষাদ স্বামী ও উগ্র পত্নীর পুত্র পুক্সক। যাদের পিতা অম্বষ্ঠ, মা বৈদেহক, তারা হলেন বৈণ। বৈদেহক পতি ও অম্বষ্ঠ পত্নীর পুত্রের পরিচয় কুশীলব। উগ্র পিতা এবং ক্ষত্ত মার পুত্র শ্বপাক। চণ্ডালসহ সব মিশ্র জাতি শূদ্রের পর্যায়ভুক্ত। 

বর্ণপ্রথার ব্যতিক্রম : বিভিন্ন বর্ণের বৃত্তির ক্ষেত্রে যেসব সাধারণ নিয়ম ছিল, ক্ষেত্রবিশেষে তার ব্যতিক্রম ঘটত। তাই অধ্যাপনা এবং যাজন ব্রাহ্মণের সাধারণ বৃত্তি হলেও অবস্থার চাপে অনেক সময় তাকে কৃষির কাজ বা অন্যের গৃহে পশুচারণের বৃত্তি গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হত। আবার অন্যদিকে বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে যেমন ধনী বৈশ্যরা তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটান, তেমনি সংগতিহীন বৈশ্যরা প্রায় শূদ্রদের পর্যায়ে নেমে আসেন।

শূদ্রদের কিছু সামাজিক অধিকার ভোগ : বর্ণকাঠামাের সর্বনিম্ন স্থানে অবস্থান করলেও এই পর্বে শূদ্রদের কিছু সামাজিক অধিকার ভােগ করতে দেখা যায়। অনুলােম (উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নীচবর্ণের কন্যার বিবাহ) ও প্রতিলােম (নীচবর্ণের পুরুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণের কন্যার বিবাহ) বিবাহের বহুল প্রচলনের ফলে উচ্চতর তিন বর্ণের সঙ্গে শূদ্রের বৈবাহিক সম্পর্ক সমাজে স্বীকৃতি লাভ করে। শূদ্রের সম্পত্তির অধিকারও স্বীকৃত হয়। আদালতে তার সাক্ষ্য দেওয়ার অধিকারও সামাজিক অনুমােদন লাভ করে। 

বৃত্তিভিত্তিক জাতি-পরিচয় : অর্থশাস্ত্রে ব্রাহ্মণাদি চারটি বর্ণ এবং অনুলােম ও প্রতিলােম বিবাহের ফলে উদ্ভূত ‘সংকর’ বা মিশ্র জাতির কথা তাে আছেই, তার উপর আছে বৃত্তিভিত্তিক কয়েকটি জাতির পরিচয়। বিভিন্ন প্রসঙ্গে যেসব বৃত্তিকেন্দ্রিক জাতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে কৃষক, গােরক্ষক (গােয়ালা), বৈদেহিক (বণিক), কর্মকার, পুরােহিত, কারু (শিল্পী), সুরাবিক্রেতা, মাংস-বিক্রেতা, তালাবচর (নট), উর্ণাকারু (পশমশিল্পী), সূত্রকারু (তন্তুবায়), বেণুকারু (বেতশিল্পী), চর্মকারু (চর্মকার), বর্মকারু (বর্ম-নির্মাতা), লৌহকার, মণিকার, জ্যোতিষী, চিকিৎসক, কল্পক (নাপিত), ধীবর (জেলে), নট, নর্তক, গায়ক, বাদক, সৌভিক (ঐন্দ্রজালিক), চারণ (ভাট) প্রভৃতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। 

দাসপ্রথা : কৌটিল্য দাসপ্রথার উল্লেখ করেছেন। দারিদ্র, জন্মসূত্র, যুদ্ধে পরাজয়, সরকারি দণ্ডাজ্ঞা ইত্যাদি দাসপ্রথার কয়েকটি সাধারণ কারণও তিনি নির্দেশ করেছেন। দাসেরা কাজ করতেন। রাজার অন্তঃপুরে ও ব্যক্তিগত খামারে, সরকারি শিল্পসংস্থায় ও কোষ্ঠাগারে এবং সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে ও খেতখামারে। কৌটিল্য দাসদের আর্য বা চাতুর্বর্ণের অন্তর্ভুক্ত এবং অনার্য বা ম্লেচ্ছ, এই দু’টি সাধারণ ভাগে ভাগ করেছেন। আর্য দাসদের প্রতি কৌটিল্য যে সহানুভূতির পরিচয় দিয়েছেন, অনার্যদের ক্ষেত্রে তিনি তা দেখাননি। তিনি বলেন, নাবালক ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্রকে দাসরূপে বিক্রয় বা বন্ধক রাখা আইনত দণ্ডনীয়। অনার্য দাসদের ক্ষেত্রে কৌটিল্য এই মনােভাবের পরিচয় দেননি। কৌটিল্য আর্য দাসদের তিনটি বিশেষ অধিকারের কথা বলেছেন – প্রভুর ক্ষতি না করে ধন উপার্জনের আধিকার, পৈতৃক সম্পত্তি ভােগের অধিকার এবং মুক্তিমূল্যের বিনিময়ে স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার অধিকার। এ অধিকার অনার্য দাসদের দেওয়া হয়নি। 

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পরিবার, নারী ও বিবাহ

পরিবার : সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার। পরিবার ছিল যৌথ এবং পিতৃতান্ত্রিক। পরিবারে পিতার প্রাধান্য প্রশ্নাতীত। মাতা অনাদৃত নন। তার স্থান সম্মানের, মর্যাদার। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস এবং পৈশাচ – এই আট প্রকার বিবাহ পূর্বের মতাে এযুগেও প্রচলিত ছিল। গ্রিক লেখকদের বর্ণনায় কৌটিল্যের উক্তির সমর্থন পাওয়া যায়। মেগাস্থিনিস ভারতীয়দের বিবাহ উপলক্ষে বলদ-দানের প্রথার উল্লেখ করেছেন। প্রথাটি আর্য বিবাহের। নিয়ারকাস বলেন, বিবাহের সময় ভারতীয়দের মধ্যে যৌতুক দেওয়া-নেওয়ার রীতি ছিল না। কন্যার বিবাহের বয়স হলে তার অভিভাবক তাকে এক স্থানে নিয়ে যেতেন। সেখানে দৌড়, কুস্তি ও মুষ্টিযুদ্ধের মতাে কোনও প্রতিযােগিতা অনুষ্ঠিত হত। এই প্রতিযােগিতায় যিনি বিজয়ী হতেন, তার সঙ্গে কন্যার বিবাহ হত। তখনকার দিনে যে স্বয়ংবর বিবাহের প্রচলন ছিল, নিয়ারকাসের এই বর্ণনায় তার সমর্থন পাওয়া যায়। 

বিবাহ : বিবাহ হত একই বর্ণের ভেতরে কিন্তু ভিন্ন গােত্রে এবং প্রবরে। তবে এসব নিয়ম শাস্ত্রসম্মত বিবাহেই প্রযােজ্য ছিল। অর্থশাস্ত্রে (৯/৬) আবাহ ও বিবাহের (আবাহ-বিবাহাভ্যাম্‌) উল্লেখ আছে (আবাহ বিবাহেসু)। অশােকের নবম মুখ্য গিরি অনুশাসনেও আবাহ ও বিবাহ কথা দু’টি ব্যবহৃত হয়েছে। সমকালীন সাহিত্যে বিবাহ অর্থে আবাহ ও বিবাহ পদে দু’টির প্রচলন লক্ষ করা যায়। দু’টি পদই বহন অর্থবােধক বহ ধাতু হতে নিষ্পন্ন। বহনপূর্বক আনয়ন, এই অর্থে আবাহ। পুত্রের বিবাহে নবপরিণীতা পতিগৃহে আগমন করেন। পুত্রের বিবাহই আবাহ। কন্যার বিবাহে কন্যাকে বহন করে পতিগৃহে নিয়ে যাওয়া হয়। কন্যার পরিণয়, এই অর্থে বিবাহ। পরবর্তিকালে আবহ কথাটি অপ্রচলিত হয়ে যায়, পুত্র ও কন্যার পরিণয়, এই বিস্তৃত ব্যঞ্জনায় বিবাহ কথাটি ব্যবহৃত হতে থাকে।

বিবাহবিচ্ছেদ : মেয়েদের স্বার্থের প্রতি কৌটিল্য উদাসীন নন। বিবাহােত্তর জীবনে উপযুক্ত কারণ ঘটলে যাতে মহিলারা বিবাহবন্ধন ছিন্ন করতে পারেন তা তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে ঘােষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, স্বামী দুশ্চরিত্র, চিরপ্রবাসী, রাজদ্রোহী, জীবন-সংশয়ক, ব্রাত্য বা ক্লীব হলে স্ত্রী সে বিবাহ ভেঙ্গে দিতে পারেন। তেমনি স্ত্রী যদি শুধু কন্যা সন্তানেরই জন্ম দেন, তাহলে আট বছর অপেক্ষা করার পর স্বামী তাকে ত্যাগ করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে স্বামীকে স্ত্রীর ভরণপােষণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মনের মিল না হলে উভয়পক্ষের সম্মতিতে সম্পর্ক ছেদ করা যেতে পারে বলে কৌটিল্য অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলেছেন, এক পক্ষের মতে এবং অন্য পক্ষের অসম্মতিতে কোনও বিচ্ছেদ কার্যকর হবে না। 

পুনর্বার বিবাহ ও সতীদাহ : স্বামীর মৃত্যুর পর মহিলারা সাধারণত পুনর্বার বিবাহ করতেন না। মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় স্ত্রী আত্মাহুতি দিয়েছেন, এ রকম ঘটনা কম হলেও ঘটত। মেগাস্থিনিস এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সতীদাহ প্রথার উল্লেখ অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায় না। আবার স্বামীর মৃত্যর পর স্ত্রী শ্বশুরের অনুমােদনক্রমে বা বিনা অনুমােদনে দ্বিতীয়বার পতি গ্রহণ করেছেন, এরূপ ঘটনা একেবারে বিরল ছিল না। অপুত্রবতী বিধবা রমণীর নিয়ােগ প্রথার মাধ্যমে সন্তানলাভের অধিকারও কৌটিল্য স্বীকার করেছেন।

সম্পত্তির অধিকার : মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার অর্থশাস্ত্রে স্বীকৃত হয়েছে। বৃত্তি ও আবন্ধ্য, এই দু’প্রকার স্ত্রীধনের কথা বলা হয়েছে। বৃত্তি বলতে ভূমি ও নগদ টাকাকড়ি বােঝায়। আবন্ধ্যের অর্থ আভরণ বা অলংকার। 

বিদ্যা অর্জন, সৈনিক, দেহরক্ষী ও রাজকার্যে নারী : মেয়েদের, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়েদের, বিদ্যা অর্জনের যথেষ্ট সুযােগ ছিল। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে বেদের বিভিন্ন শাখায় পাঠরতা ছাত্রীদের উল্লেখ আছে। এই সময় নারীরা যে সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করতেন, তারও প্রমাণ আছে। মেগাস্থিনিস বলেছেন, আলেকজান্ডারের আক্রমণ প্রতিরােধ করতে অসসকেনােই রাষ্ট্রের বধুরা অস্ত্রহাতে তাদের স্বামীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। গ্রিক দূত চন্দ্রগুপ্তের নারীরক্ষী বাহিনীর কথাও বলেছেন। পাণ্ড্য রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সে অঞ্চলের মহিলারাই পরিচালনা করতেন, সেকথাও মেগাস্থিনিস বলেছেন।

নারীর পেশা : অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, প্রয়ােজন হলে মহিলারা রাষ্ট্রীয় শিল্পসংস্থায় বস্ত্র রঙ করা, সেলাই, তাতের কাজ, ঝুড়ি বােনা ইত্যাদি কাজের দ্বারা পরিবার প্রতিপালন করতেন। তাছাড়া অর্থশাস্ত্রে এমন স্ত্রীলােকদের কথাও বলা হয়েছে, যারা নৃত্য, কণ্ঠ ও যন্ত্র সংগীতে অধ্যাপনা করে বা শত্রু শিবিরে গুপ্তচরের কাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করতেন। কৌটিল্য এবং মেগাস্থিনিস গণিকাবৃত্তিরও উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রের প্রয়ােজনেও যে গণিকাদের কাজে লাগানাে হত, তার কথাও তারা বলেছেন। 

অভিজাত পরিবারের মেয়ে : তবে অভিজাত পরিবারের মেয়েদের এমন অবাধ গতিবিধির অধিকার ছিল না। পাণিনি ‘অসূর্যম্পশ্যা’ রমণীদের কথা বলেছেন। অশােকের অনুশাসনে রাজপরিবারের মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘অবরােধন’ শব্দ প্রয়ােগ করা হয়েছে। এতে রাজ-অন্তঃপুরবাসিনীদের নিঃসঙ্গতার পরিচয় মেলে। রাজপরিবারের মহিলারা যে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতেন, তার আভাস আছে অর্থশাস্ত্রে। মৌর্য রাজকন্যা সংঘমিত্রার শ্রীলঙ্কা পরিভ্রমণের কাহিনি সত্য হলে বুঝতে হবে, কখনও কখনও সে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হত।

দেবদাসী : যােগীমারা ওহালেখে সুতনুকা নামে জনৈকা দেবদাসীর উল্লেখ আছে (Luder’s List No. 921 (Epigraphia Indica. Vol. X. Appendix, পৃ. ৯৩)। দেবদিন নামে বারাণসীর এক নাগরিক তার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। অনেকে মনে করেন, প্রাকৃত ভাষায় রচিত এই লেখটি খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে উৎকীর্ণ হয়েছিল। সেক্ষেত্রে যােগীমারা গুহালেখের সাক্ষ্য মৌর্যযুগে দেবদাসী প্রথার সপক্ষে জোরালাে প্রমাণের স্বীকৃতি পাবে। তবে লেখটি মৌর্যোত্তর পর্বেরও হতে পারে। দেবদাসীরা কুমারী মেয়ে। তারা দেবমন্দিরে পূজা-অর্চনার কাজে সাহায্য ও নৃত্য-গীত পরিবেশনের জন্য নিযুক্ত হতেন।

সমকালীন সাহিত্যে ও অনুশাসনে সমাজ ও রাষ্ট্র

সমাজে, বিশেষ করে বহুজাতিক সমাজে, রাষ্ট্রের বিরাট ভূমিকা আছে। যেখানে নানা জাতি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাস, সেখানে জনজীবনে অন্তর্দ্বন্দ্ব, ঘাত-প্রতিঘাতের সম্ভাবনা অধিক থাকে। সরকার তথা রাষ্ট্র সতর্ক না হলে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হতে পারে। অশােক তা বুঝেছিলেন। আর বুঝেছিলেন বলেই তিনি কোন বিশেষ গােষ্ঠীর সঙ্গে নিজেকে একাত্ম না করে সকল মানুষকে নিজের পুত্র বলে ঘােষণা করেছিলেন। যে সরকার জাতিধর্মনির্বিশেষে রাজ্যের সকল মানুষকে সমদৃষ্টিতে দেখে, সে রাজ্যে সামাজিক কল্যাণের কাজটি সহজেই সম্পন্ন হয়। অশােক বুঝেছিলেন, সমাজের কল্যাণের জন্য আইন-বিধি প্রয়ােগের চেয়ে মানুষের মধ্যে নৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটানাে অনেক বেশি জরুরি। নৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটলেই মানুষ তার সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়। মানুষের মধ্যে নৈতিক চেতনা জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে অশােক মােটামুটি তিনটি নীতি অনুসরণ করেছিলেন :

  • প্রথমত, তিনি তার অনুশাসনে বার বার পিতামাতা, বয়ােবৃদ্ধ-গুরুজন, আত্মীয়স্বজন, দাস ভৃত্য, ব্রাহ্মণ-শ্ৰমণ সকলের প্রতি সশ্রদ্ধ ও উদার ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছেন। 
  • দ্বিতীয়ত, ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে তিনি মানুষের মধ্যে সংযম, করুণা, আত্মশুদ্ধি ও মানবিক ঔদার্যের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন, মানুষকে জনহিতকর কাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন। 
  • তৃতীয়ত, বিবদমান ধর্ম সম্প্রদায়গুলোকে বিরােধ, সংঘর্ষ ত্যাগ করে সহযােগিতা ও সমন্বয়ের পথ গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন।

এভাবে জন্মের উপরে কর্মকে স্থান দিয়ে, মানবিকতার আদর্শ প্রচার করে অশােক সমাজজীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করলেন।

অর্থনৈতিক জীবন

মেগাস্থিনিসের বিবরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং সমকালীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে মৌর্যযুগের অর্থনীতি সম্পর্কে জানা যায়। 

জমির মালিকানা

মৌর্য অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। যে জমিতে কৃষির উৎপাদন, সেই জমি রাজার, না করদাতা প্রজার, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে এখনও বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, মৌর্যদের আমলে রাজাই রাজ্যের সব জমির মালিক ছিলেন। মেগাস্থিনিস এবং ডায়ােডােরাস এরূপ সাক্ষ্যই দিয়েছেন। কিন্তু ‘ইন্ডিকা’ ও অর্থশাস্ত্রের তুলনামূলক আলােচনা থেকে মনে হয়, রাজা রাজ্যের সব জমির মালিক ছিলেন না। রাজার মালিকানাধী অবশ্যই ছিল ; অর্থশাস্ত্রে এই ধরনের জমিকে বা জমির ফসলকে ‘সীতা’ বলা হয়েছে। ওই খাস জমি ছাড়া (১) পতিত, অকর্ষিত জমি (২) বনাঞ্চল (৩) নতুন জনপদ (৪) খনি ও খনিজ সম্পদ (৫) সেচ প্রকল্প (৬) গােচারণ ভূমি ও গুপ্তধনের উপরও রাজার এক বিশেষ কর্তৃত্ব ছিল। তবে সীতা যে অর্থে রাজকীয় সম্পত্তি, পতিত বা অকর্ষিত জমি, বনাঞ্চল ইত্যাদি সে অর্থে রাজকীয় সম্পদ নয়। এগুলো সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সীতা রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রাজার যে অধিকার, সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে রাজার সে নিরঙ্কুশ অধিকার নেই। করদাতা প্রজাদের ভােগদখলে যে প্রচুর বাস্তুজমি ও খেত ছিল, অর্থশাস্ত্রে তার ইঙ্গিত আছে –

  • প্রথমত, অর্থশাস্ত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে, জমির অধিকার নিয়ে কোনও বাদ-বিসংবাদ দেখা দিলে আইনের সাহায্যেই তা মেটাতে হবে। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে তবেই জমির দখল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরােধের সূচনা হয়।
  • দ্বিতীয়ত, কৌটিল্য বিশেষ এক ধরনের জমির প্রসঙ্গে বলেছেন, মালিক দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলে তার মালিকানা বাতিল হয়ে যাবে। কৌটিল্যের এই উক্তিও জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণাকেই সমর্থন করে।
  • তৃতীয়ত, অর্থ শাস্ত্রে স্পষ্ট নির্দেশ আছে, কোনও ব্যক্তি পতিত জমি চাষযােগ্য করে তুললে সেই ব্যক্তিই জমির মালিক বলে বিবেচিত হবেন।

তবে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলেও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে রাজ্যের সমস্ত জমির উপর রাজার, তথা সরকারের, এক বিশেষ কর্তৃত্ব ছিল। এই কর্তৃত্ববলে উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছেন, এই অভিযােগে রাজা যে কোনও ব্যক্তিকে জমি হতে উচ্ছেদ করতে পারতেন। রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে রাজার এই কর্তৃত্বভােগ।

একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ভারতে জমির মালিকানা সম্পর্কে মেগাস্থিনিস ভুল তথ্য পরিবেশন করলেন কেন? এর তিনটি ব্যাখ্যা দেওয়া যায়।

  • এক. মেগাস্থিনিস সম্ভবত রাজকীয় জমিতে রাজার ব্যক্তিগত মালিকানা এবং রাজ্যে রাজার সার্বভৌম কর্তৃত্ব—এই দুই-এর পার্থক্য অনুধাবন করতে পারেননি।
  • দুই, মেগাস্থিনিস সারা ভারত পরিদর্শন করেননি, পাটলিপুত্রে বসেই তিনি তথ্য আহরণ করেছেন। পাটলিপুত্র ও নিকটবর্তী অঞ্চল সম্ভবত রাজকীয় মালিকানাধীন ছিল। মেগাস্থিনিস ভুল করে পাটলিপুত্রের ভূমিব্যবস্থাকে সারা ভারতের ক্ষেত্রে আরােপ করেছেন। (রণবার চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে, পৃষ্ঠা, ১০৪, এরূপ সম্ভাবনার কথা বলেছেন। ‘অর্থশাস্ত্রে বা ইন্ডিকায় এই মর্মে কোনও স্পষ্ট তথ্য নেই।)
  • তিন. সমকালীন মিশরে রাজাই সব জমির মালিক ছিলেন। মেগাস্থিনিস ভেবেছিলেন, একই রীতি ভারতে অনুসরণ করা হচ্ছে (S. Chattopadhyaya, Binbisara To Asoka, পৃষ্ঠা ১৯০)

উৎপাদন বৃদ্ধি

মৌর্য অর্থনীতিতে কৃষির বিকাশ, তথা উৎপাদন বৃদ্ধির উপর প্রভূত গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছিল। মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত। শেষােক্ত গ্রন্থখানিতে তাে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বিশদভাবে আলােচিত হয়েছে। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যেমন উন্নত যন্ত্রপাতির প্রয়ােজন, তেমনি প্রয়ােজন অনাবাদী জমিকে চাষাবাদের উপযােগী করে তােলার। এই পর্বে লােহার যন্ত্রপাতির ব্যবহার যে বিপুল পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে তার সমর্থন আছে। অনাবাদী জমিকে চাষের আওতায় আনার এক বিরাট কর্মযজ্ঞ এই পর্বে গ্রহণ করা হয়। এ কাজে যেমন ব্যক্তিগত উদ্যোগকে সরকারের পক্ষ থেকে উৎসাহ দেওয়া হয়, তেমনি সরকারও নিজে উদ্যোগী হয়ে পতিত জমি উদ্ধারের কাজে হাত দেন, নতুন জনপদ পত্তন করেন। পতিত জমিকে চাষাবাদের উপযােগী করে তােলার ব্যক্তিগত উদ্যমকে সমর্থন জানিয়ে কৌটিল্য বলেছেন, যদি কোনও ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টায় অনাবাদী জমিকে চাষের উপযােগী করে তােলেন, তাহলে সরকার সেই জমিতে তার পূর্ণ মালিকানা স্বীকার করে নেবেন।

পতিত জমিকে আবাদযােগ্য করে তােলার কাজে সচেষ্ট হতে কৌটিল্য রাজা, তথা সরকারকে, আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেসব স্থানে মানুষের বসতি নেই বা যে স্থান বর্তমানে পরিত্যক্ত, সেসব স্থানে রাজার অতি সত্বর জনপদ গড়ে তােলা উচিত। এই সব নতুন জনপদে কৃষকরাই হবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের উৎসাহদানের জন্য সরকার তাদের মধ্যে বীজ, গবাদি পশু ও মুদ্রা বিতরণ করবেন। যা বিতরণ করা হবে, তা ঠিক দান নয়, কৃষিঋণ। যখন সুদিন ফিরে আসবে, তখন কৃষক সরকারের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিটি জিনিস কড়ায়-গণ্ডায় পরিশােধ করে দেবেন। আসলে কৌটিল্য চেয়েছেন, রাষ্ট্রের আনুকূল্যে ও কর্তৃত্বে অনাবাদী জমিগুলোতে কৃষকবসতি গড়ে উঠুক, খাদ্য-শস্য ও পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি হােক, রাজকোষ ও রাজকোষ্ঠাগার অর্থ ও শস্যে ভরে উঠুক, জনবহুল অঞ্চলে লােকসংখ্যার চাপ হ্রাস পাক।

নিজের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিতে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যও কৌটিল্য রাজাকে নির্দেশ দিয়েছেন। কৌটিল্য বলেছেন, এসব জমিতে দণ্ডিত আসামী অথচ জরিমানা দিতে অক্ষম, এমন ব্যক্তিদের কুষিশ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় দণ্ডিত শ্রমকে কাজে লাগিয়ে বিনা অর্থব্যয়ে রাজকীয় খেতে উৎপাদন অব্যাহত রাখা যায়। তাছাড়া জমিতে ভাড়াটে কৃষক নিয়ােগ করেও উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রাখা যায়। ভাড়াটে কৃষকরা জমি চাষ করতেন তাদের নিজস্ব মূলধন ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। আবার অনেক গরীব কৃষক ছিলেন, দৈহিক শ্রম ছিল যাদের মূলধন। প্রয়ােজন হলে রাজা তাদেরও নিয়ােগ করতেন এবং দরকার মতাে হাল, বলদ ও বীজের যােগান দিয়ে তাদের সাহায্য করতেন। এখানে রাজার ভূমিকা উৎপাদকের। এ কাজে তার প্রধান সহায় সীতাধ্যক্ষ। তারই হাতে ছিল রাজকীয় জমির কৃষিজ উৎপাদন ব্যবস্থার পরিচালনভার।

কৃষি-অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ

কৃষি-অর্থনীতিতে একদিকে যেমন ছিল উৎপাদন বৃদ্ধির প্রবণতা, অন্যদিকে তেমনি ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বলিষ্ঠ ছাপ। এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিফলিত হয়েছে অনাবাদী জমিতে কৃষকবসতি প্রতিষ্ঠায়, চাষ-আবাদের কাজে হাল, বীজ ও গবাদি পশু সংগ্রহে ও বণ্টনে, বিভিন্ন ধরনের কৃষক নিযুক্তিতে, রাজকীয় জমিতে কৃষিজ উৎপাদন ব্যবস্থার পরিচালনায় এবং সীতাধ্যক্ষসহ কৃষিবিভাগের অন্যান্য পদস্থ রাজপুরুষদের নিযুক্তিকরণে।

চাষ-আবাদের কাজে বৃষ্টির ওপর পুরােপুরি নির্ভর করলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। অনাবৃষ্টি হলে তাে ফলনের কোনও আশাই থাকে না। এই অবস্থার প্রতিবিধান কল্পে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কয়েকটি সেচপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। মেগাস্থিনিস ‘এ্যাগ্রোনােময়’ নামে এক শ্রেণির রাজ কর্মচারীর উল্লেখ করেছেন। জলসেচ-ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করা, সংরক্ষিত জলাধার থেকে সেচের জন্য জল সরবরাহ করা তাদের কাজ ছিল। মেগাস্থিনিস জলকপাট বা ‘সুইস’-এর কথা বলেছেন। অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নির্মিত খাল ও নানারকম সেচপ্রকল্পের উল্লেখ আছে। 

১৫০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ রুদ্রদামার জুনাগড় প্রশস্তিতে মৌর্য আমলের সেচপ্রকল্পের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের চেহারাটি প্রতিফলিত হয়েছে। এই প্রশস্তিতে বলা হয়েছে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে গুজরাতের জুনাগড়ে সুদর্শন হ্রদ নামে এক বিশাল জলাধার নির্মাণ করা হয়। এই লেখ থেকে জানা যায়, জলাধারটি নির্মাণে স্থানীয় মৌর্য প্রশাসক পুষ্যগুপ্ত সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অশােকের রাজত্বকালে স্থানীয় প্রশাসক তুষাস্ফের নির্দেশনায় কয়েকটি খাল বা প্রণালী খনন করে ওই জলাধার থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষিক্ষেত্রে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় মৌর্য আমলে তৈরি এক জলাধারের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। জলধারটির দৈর্ঘ্য ৫৬.৩৪ মিটার, প্রস্থ ২.১৬ মিটার ও উচ্চতা ১.৬৭৫ মিটার। অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের বৃহদায়তন ও ব্যয়বহুল জলাধার সম্ভবত সরকারি উদ্যোগেই নির্মিত হয়েছিল।

ফসল, খনিজ, দুর্ভিক্ষ ও গ্রামের চিত্র

শস্য, ফল-মূল ও খনিজ পদার্থ : মৌর্যযুগে কৃষির ফলন যে সন্তোষজনক ছিল মেগাস্থিনিস ও কৌটিল্যের বর্ণনায় তা প্রমাণিত। নদ-নদীর প্রাধান্য, ব্যাপক জলসেচ ব্যবস্থা, কৃষির কাজে ব্যাপক হারে লৌহ উপকরণের প্রয়ােগ প্রভৃতি কারণে ফলন বেশ ভালােই হত। তাছাড়া মেগাস্থিনিস ও পরবর্তী গ্রিক লেখকরা ভারতে দু’টি বর্ষার আগমন ও তার ফলে বছরে দু’বার ফসল ফলাবার উল্লেখ করেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, বর্তমানকালে দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে যথাক্রমে জুন ও নভেম্বর মাসে ভারতে দু’বার বৃষ্টিপাত ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ-৩য় শতকেও যে ঠিক এমনটি ঘটত, গ্রিক বিরণে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তখনকার দিনের উৎপন্ন শস্য-ফল-মূলের মধ্যে কৌটিল্য বিভিন্ন প্রকার ধান, তিল, গােলমরিচ, জাফরান, মুগ, মাষ, মসুর, যব, গম, কলাই, অতসী, সরষে, কলা, কুমড়া, লাউ, আঙ্গুর, ইক্ষু ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। হিমালয় অঞ্চলে পাওয়া যেত হাতি, ঘােড়া, সুগন্ধি, গজদন্ত, পশুচর্ম, সােনা ও রূপা। দক্ষিণ ভারতে পাওয়া যেত হীরা, মহার্ঘ পাথর, মুক্তা ও সােনা।

দুর্ভিক্ষ : মৌর্যপর্বে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি-অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ এড়ানাে যায়নি। অর্থশাস্ত্রে দুর্ভিক্ষের উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষের সময় রাজা প্রজাদের মধ্যে বীজ ও খাদ্য বিতরণ করবেন; তার পরিবর্তে রাজা প্রজাদের দুর্গ বা সেতু নির্মাণের কাজে নিয়ােগ করবেন বা কোনাে শ্রম গ্রহণ না করেও অনুদান দেবেন। জৈন সাহিত্যে কথিত আছে, চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বের শেষের দিকে উত্তর ভারতে বারাে বছরব্যাপী এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে পাওয়া মৌর্যযুগের একখানি শিলালেখে উত্তর বাংলায় এক দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত আছে। এই লেখে উল্লিখিত আছে, প্রজাদের বিপদের দিনে রাজভাণ্ডার হতে ধান ও মুদ্রা দিয়ে সাহায্য করা হয়েছিল। শর্ত ছিল, সুদিন ফিরে এলে প্রজাদের সরকারি ঋণ পরিশােধ করতে হবে। সম্ভবত নদীতে বন্যার ফলে এই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর জেলার সােগৌরা গ্রামেও মৌর্য আমলের একখানি অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখ হতে জানা যায়, দুর্ভিক্ষের সময় প্রজারা যাতে বিপদাপন্ন না হন, সেজন্য রাজভাণ্ডারে সর্বদা খাদ্যশস্য মজুত রাখা হত। বন্যাই দুর্ভিক্ষের একমাত্র কারণ ছিল না; অনাবৃষ্টির ফলেও দুর্ভিক্ষ দেখা দিত।

গ্রামের চিত্র : সমকালীন গ্রামের এক নিখুঁত ছবি এঁকেছেন কৌটিল্য। সাধারণত এক একটি গ্রাম কাঠের খোঁটা বা গোঁজের বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকত। বেড়ার ভেতরে থাকত বাস্তুভূমি, শ্মশান, প্রপা বা পানীয় জলাগার, দেবস্থান, স্থল (ডাঙা বা উষর জমি), কেদার (ফসলবােনা জমি), আরাম বা কুঞ্জ, ষণ্ড বা ফলের বাগান, মূলবাপ (আদা, হলুদ ইত্যাদির বাগান) ও পথ-ঘাট। বেড়ার বাইরে থাকত সুবিস্তীর্ণ কৃষির খেত। খেতও বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা থাকত। খেতের বেষ্টনীর বাইরে ছিল চারণভূমি বা বিবীত। ত্রিশটি পরিবার বাস করেন, এমন ছােট গ্রাম যেমন ছিল, এক হাজার পরিবারের বাস, এমন বৃহদায়তন গ্রামেরও অভাব ছিল না।

কারিগরি শিল্প

কৃষির উন্নতির পরােক্ষ ফসল শিল্পোন্নয়ন কৃষিজাত উদ্বৃত্তের সৃষ্টি হওয়ায় এক শ্রেণির লােক সর্বক্ষণের জন্য বিভিন্ন কারিগরি শিল্পে আত্মনিয়ােগ করার সুযােগ পান। এর ফলে একদিকে যেমন কারিগরদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে তেমনি শিল্পে প্রশংসনীয় অগ্রগতি দেখা দেয়। মৌর্যযুগের কারিগরি শিল্পগুলো –

  • খনি ও ধাতুবিদ্যা : অগ্রগতি ঘটেছিল খনি ও ধাতুবিদ্যায়। খনিজ সম্পদে ভারতের সমৃদ্ধির উল্লেখ করেছেন মেগাস্থিনিস ও কৌটিল্য। গ্রিক দূত বলেছেন, ভারতে মাটির নীচে প্রচুর সােনা ও রূপা সংরক্ষিত আছে ; তামা, লােহা ও টিনের ভাণ্ডারও কম নয়। সােনা, রূপা, তামা, শিশা, টিন, লােহা এবং বৈকৃন্তক নামে এক অজানা ধাতুর উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য। খনি ও ধাতু বিদ্যায় যারা বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তারা বিভিন্ন লক্ষণ দেখে নতুন খনি আবিষ্কার করতেন। অর্থশাস্ত্রে সােনা, রূপা প্রভৃতি ধাতুর শ্রেণিকরণ, শুদ্ধিকরণ ও প্রয়ােগ-পদ্ধতির বিশদ আলােচনা আছে। এসব ধাত থেকে গৃহস্থালি-উপকরণ, অলংকার ও যুদ্ধাস্ত্র নির্মিত হত। 
  • অস্ত্রসম্ভার : অস্ত্রসম্ভারের বিস্তৃত তালিকা পাওয়া যায় অর্থশাস্ত্রে। গ্রন্থটিতে কাঠ, বাঁশ, হাড় ও শিঙের তৈরি তির-ধনুক, মহিষ ও গণ্ডারের শিঙ বা কাঠ, বাঁশ ও হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা বিভিন্ন ধরনের তরবারি, কুঠার ও ধারালাে ক্ষেপণাস্ত্র এবং লােহা, চামড়া ও অন্যান্য জিনিসের তৈরি। বিভিন্ন প্রকার অস্ত্রশস্ত্রের উল্লেখ আছে। তাছাড়া নয় ধরনের নিশ্চল ও ষােলাে প্রকার চলমান সমরযন্ত্রের কথাও আছে অর্থশাস্ত্রে।
  • বস্ত্রশিল্প : কৌটিল্য এবং প্রাচীন ইউরােপীয় লেখকেরা ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন। কৌটিল্য বলেছেন, মাদুরাই, অপরান্ত, কলিঙ্গ, কাশী, বঙ্গ, বৎস ও মহিষ অঞ্চলে উৎকৃষ্ট কার্পাস জন্মাত। ভারতীয় কার্পাসের ঔজ্জ্বল্য ও শুভ্রতার কোনও তুলনা ছিল না বলে এরিয়ান মন্তব্য করেছেন। অর্থশাস্ত্রের বর্ণনা থেকে জানা যায়, উত্তরবঙ্গ, পূর্ব বাংলা ও সুবর্ণকুণ্ড্য (সম্ভবত অসমে অবস্থিত) যথাক্রমে কালাে, সাদা ও লাল দুকূল বা তন্তুর উৎপাদনের জন্য খ্যাতি লাভ করেছিল। অর্থশাস্ত্রে রেশম ও পশম বস্ত্রের উল্লেখ আছে। সােনা ও পাথর বসানাে সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্রের প্রতি অভিজাত সম্প্রদায়ের আসক্তির পরিচয় মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় পাওয়া যায়। 
  • চর্মশিল্প : চর্মশিল্পে ভারতীয়দের দক্ষতার কথা বলেছেন এরিয়ান। সাদা চামড়া দিয়ে গােড়ালি-ভােলা বিভিন্ন ধরনের সুদৃশ্য জুতা তৈরি হত। এই জুতা পায়ে দিলে পরিধানকারীকে দীর্ঘতর দেখাত।
  • সুগন্ধি কাঠ : সুগন্ধি কাঠের দেশ এই ভারত। চন্দন, অগুরু, তৈলপর্ণিক, ভদ্রশ্রী ও কাসেয়ক নামে পাঁচ প্রকার সুগন্ধি কাঠের উল্লেখ আছে অর্থশাস্ত্রে। কামরূপ, হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল, দক্ষিণ ভারত এবং শ্রীলঙ্কায় এসব কাঠ প্রধানত উৎপন্ন হত। 
  • মূল্যবান ও বিলাস দ্রব্যাদি : দেশি-বিদেশি পদ্মরাগ ও নীলকান্ত মণি, মুক্তা, বর্জ্য, প্রবাল, স্ফটিক ও হীরার উল্লেখ আছে অর্থশাস্ত্রে। দ্রব্যাদির দোষ-গুণ ও প্রকারভেদের বিশদ বর্ণনাও এই গ্রন্থে পরিবেশিত হয়েছে। এসব মূল্যবান দ্রব্যাদি দিয়ে নানা ধরনের অলংকার তৈরি হত। রঙ ও গঁদের কাজে, ওষুধ ও সুগন্ধির উৎপাদনে এবং মাটির কাজেও এই সময় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়। এযুগের মৃৎপাত্রের উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য তার কালাে আর কড়া পালিশ। এ সময় উদীচ্য উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের (নদার্ন ব্ল্যাক পলিশড ওয়্যার) বহুল প্রচলন দেখা যায়। চুল্লিতে পােড়ানাে ইটের ব্যবহারও বৃদ্ধি পায়।
  • দারুশিল্প : পাটনার কাছে কুমরাহারে মৌর্য রাজপ্রাসাদের গােটা সাতেক পাটাতন আবিষ্কৃত হয়েছে। এক একটি পাটাতন দৈর্ঘ্যে ৯.১৩ মিটার, প্রস্থে ১.০১৫ মিটার ও উচ্চতায় ১.২৯৪ মিটার। গাছের গুঁড়ি দিয়ে এই পাটাতন তৈরি হয়েছে। কিন্তু একটি গুড়ির সঙ্গে আর একটি গুড়িকে এমনভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে যে তা বােঝার উপায় নেই। বিচক্ষণ শিল্পীদের পক্ষেই এ কাজ সম্ভব। মৌর্যযুগের দারুশিল্পের বিস্ময়কর অগ্রগতির সাক্ষ্য এই পাটাতন। মৌর্য আমলের উন্নত ভাস্কর্যেও সে যুগের দারুশিল্পের বিকাশের আভাস পাওয়া যায়।
  • প্রস্তর শিল্প : এই পর্বে প্রস্তর শিল্পেও বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখা দেয়। এই অগ্রগতি লক্ষণীয়রূপে ধরা পড়েছে বরাবর ও নাগার্জুনী পাহাড়ের গুহাবাস নির্মাণে, গৃহনির্মাণের উপকরণ হিসাবে পাথরের ব্যবহারে এবং অশােকের আমলের প্রস্তর স্তম্ভগুলোর সুঠাম, সুসমঞ্জস দেহগঠনে ও তাদের অত্যাশ্চর্য মসৃণতায়।

শিল্পক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা

গ্রিক লেককদের লেখায় রাষ্ট্রীয় ভূমিকায় বৈসাদৃশ্য : প্রাচীন ইউরােপীয় লেখকদের বিবরণে এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এযুগের শিল্পক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরাট ভূমিকা উল্লিখিত। এরিয়ান, স্ট্যাবাে, ডায়ােডােরাস প্রমুখ ইউরােপীয় লেখকেরা শিল্পে সাধারণভাবে রাষ্ট্রের গুরুত্ব স্বীকার করলেও তাদের বর্ণনায় বৈসাদৃশ্য আছে –

  • এরিয়ান বলেন সব শিল্পই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিচালিত। শিল্পী কারিগরেরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন পান, তারা কোনও কর দেন না। এরিয়ানের বক্তব্য থেকে মনে হয়, শিল্পে রাষ্ট্রের একচেটিয়া মালিকানা ছিল।
  • ডায়ােডােরাস ও স্ট্র্যাবো কিন্তু ঠিক একথা বলেননি। তাদের মতে, জাহাজ নির্মাণ ও অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদনে রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার ছিল; রাষ্ট্র এই দু’টি শিল্পে নিযুক্ত কর্মীদের ভরণ-পােষণের দায়িত্ব বহন করত, তাদের উপর কোনও কর ধার্য করত না। ডায়ােডােরাস ও স্ট্যাবাের উক্তি থেকে মনে হয়, বেশির ভাগ শিল্প ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হত, শুধু জাহাজ-নির্মাণ ও অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানা বলবৎ ছিল।
  • মেগাস্থিনিস এক শ্রেণির রাজপুরুষদের কথা বলেছেন, যাদের কাজ ছিল বিভিন্ন শিল্পের উপর তদারকি করা। সম্ভবত এই শিল্পোদ্যোগগুলো বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছিল। মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় একদিকে যেমন শিল্পে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ইঙ্গিত মেলে, অন্যদিকে তেমনি রাজ্যের শিল্পোদ্যোগে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্তৃত্বও আভাসিত হয়েছে।

খনিজ সম্পদে নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র : শিল্পক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকার চিত্রটি আরও স্পষ্টরূপ প্রতিফলিত হয়েছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে।  কৌটিল্য মনে করেন, অসাধু কারু বা কারিগরেরা রাষ্ট্রের কণ্টক, তাদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষার জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়ােজন। ব্যক্তিস্বার্থের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বলে ব্যক্তিগত উদ্যোগের প্রতি কৌটিল্য অনীহার মনােভাবই ব্যক্ত করেছেন। কয়েকটি বিশেষ শিল্পের ক্ষেত্রে কৌটিল্য রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার স্বীকার করেছেন। এদের মধ্যে একটি হল খনিজ শিল্প। কৌটিল্য বলেন, রাষ্ট্রের স্বার্থেই খনিজ শিল্পে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাঞ্ছনীয়। তার মতে, অর্থ ও সৈন্যবাহিনী ছাড়া কোনও রাষ্ট্র চলতে পারে না, সৈন্যবাহিনী আসে অর্থ থেকে, আর অর্থের মূল উৎস হল খনি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খনির অত্যধিক গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে কৌটিল্য খনি ও খনিজ শিল্পে কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যে রাজপুরুষের ওপর খনি ও খনিজ শিল্পের দায়িত্বভার ন্যস্ত, অর্থশাস্ত্রে তাকে ‘আরাধ্যক্ষ’ বলা হয়েছে। খনি খনন, ধাতু নিষ্কাশন, নিষ্কাশিত ধাতুকে কারখানায় পাঠানাে, ধাতব সামগ্রীর উৎপাদন ও উৎপন্ন দ্রব্যের বিক্রি, সব কাজের মূল দায়িত্ব তারই। তাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতেন খন্যাধ্যক্ষ, লােহাধ্যক্ষ, সুবর্ণাধ্যক্ষ, লবণাধ্যক্ষ ও রূপদর্শক। কৌটিল্য শুধু ভূগর্ভস্থ খনিগুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথাই বলেননি, সামুদ্রিক খনি থেকে সরকারি উদ্যোগে দুর্মূল্য মুক্তা, শুক্তি, শঙ্খ ও প্রবাল সংগ্রহের কথাও বলেছেন। অর্থশাস্ত্রের বর্ণনা থেকে মনে হয়, খনি ও খনিজ শিল্পে একচেটিয়া অধিকার থাকা সত্ত্বেও রাজা বা সরকার অনেক সময় রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে খনি খনন ও ধাতু নিষ্কাশনের দায়িত্ব বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর অর্পণ করতেন। যেসব খনিতে অল্প খরচে খনন ও ধাতু নিষ্কাশনের কাজ করা যেত, সেখানে রাষ্ট্রই সরাসরি উৎপাদনে অংশগ্রহণ করত। কিন্ত যেখানে একাজ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ছিল, সেখানে সরকার নিজে উদ্যোগী না হয়ে বেসরকারি ব্যক্তি বা সংস্থাকে আহ্বান জানাত। এর ফলে রাষ্ট্র দুদিক থেকে লাভবান হত। প্রথমত, ব্যয়বহুল খনিতে উৎপাদনে অংশগ্রহণ না করার ফলে সরকারি অর্থের সাশ্রয় হত। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র বিনা আয়াসে বিনা অর্থব্যয়ে, বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিষ্কাশিত খনিজ দ্রব্যের একটা বড় অংশ লাভ করত।

সুবর্ণগিরিতে প্রশাসনিক কেন্দ্র ও খনির উপর নিয়ন্ত্রণ : খনি ও খনিজ শিল্পে মৌর্য রাজাদের আগ্রহের সপক্ষে আরও একটি কথা বলার আছে (রণবীর চক্রবর্তী, প্রাচীন ভারতের তার্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে, পৃষ্ঠা ১০৭)। সুবৰ্ণগিরি ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের সর্ব দক্ষিণ প্রদেশটির প্রশাসনিক কেন্দ্র। সম্রাটের প্রতিনিধিরূপে স্বয়ং এক রাজপুত্র সেখানে উপস্থিত থাকতেন। স্থানটি বর্তমান কর্ণাটকে অবস্থিত। সুবর্ণগিরিতে বা সন্নিহিত অঞ্চলে যে সােনার খনি ছিল তা সম্ভবত স্থানটির নাম থেকে অনুমান করা চলে। মনে রাখা দরকার, ভারতের এক প্রধান স্বর্ণখনি কোলার কর্ণাটকেই অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার ফলে কর্ণাটক ও সন্নিহিত অঞ্চলে হীরকখনিরও সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব অঞ্চলে মৌর্য আমলের অনুশাসনের সংখ্যাও বড় কম নয়। এর ফলে এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়, স্থানীয় সােনা ও হীরক খনিগুলোতে মৌর্য সরকারের গভীর আগ্রহের ফলেই সুবর্ণগিরি প্রাদেশিক শাসনকেন্দ্ররূপে গড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সুপরিচালনার জন্য সেখানে মৌর্যবংশের এক রাজকুমারের থাকাটা বিশেষ জরুরি হয়ে দেখা দেয়। 

কাপড় ও মদের কারখানায় রাষ্ট্রীয় পরিচালনা : অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের পরিচালনাধীন কাপড় ও মদের কারখানার উল্লেখ আছে। সূত্রাধ্যক্ষ ও সুরাধ্যক্ষ যথাক্রমে রাষ্ট্রীয় বস্ত্র ও মদের কারখানার তত্ত্বাবধান করতেন। রাষ্ট্রীয় বস্ত্র কারখানায় দরিদ্র মহিলারাও কাজ করতেন। এখানে কোনও শ্রমিকই স্থায়িভাবে নিযুক্ত হতেন না; তাদের কোনও নির্দিষ্ট বেতনও ছিল না। উৎপাদনের পরিমাণের উপরই তাদের পারিশ্রমিক নির্ভর করত। অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রপরিচালিত বস্ত্র ও মদের কারখানার উল্লেখ থাকলেও বস্ত্র ও সুরাশিল্পে রাষ্ট্রের একচেটিয়া মালিকানা ছিল বলে মনে হয় না। মৌর্য সাম্রাজ্যের মতাে বৃহদায়তন অঞ্চলের চাহিদা মেটানাের জন্য যে কাঁচামালের যােগান ও পণ্যের আবশ্যক, তার ব্যবস্থাপনা শুধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সম্ভব ছিল না। এই দুটি শিল্পে সম্ভবত বেসরকারি উদ্যোগেরও ভূমিকা ছিল, তবে তা ছিল শর্তাধীন। বেসরকারি শিল্পসংস্থাগুলোর উপর নানা রকম করের বােঝা চাপিয়ে রাষ্ট্র তাদের লাভের একটা বড় অঙ্ক আত্মসাৎ করত।

ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ : মৃৎশিল্পের মতাে ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগগুলোতে রাষ্ট্র সরাসরি অংশগ্রহণ না করে, উৎপাদকের উপর নানা প্রকার কর বসিয়ে, বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরােপ করে, তার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত।

ব্যবসা-বাণিজ্য

মৌর্যযুগে কৃষি ও শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যেরও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। রাজ্যময় শান্তি-শৃঙ্খলা, সরকারি সহযােগিতা এবং উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থার কল্যাণে বাণিজ্যের এই সম্প্রসারণ। তদকালীন ব্যবসা-বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য –

  • অন্তর্বাণিজ্য : বাণিজ্য, বিশেষ করে অন্তর্বাণিজ্য, চলত স্থল ও জল, উভয় পথেই। মেগাস্থিনিস ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে পাটলিপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত এক সুদীর্ঘ রাজপথের উল্লেখ করেছেন। এই রাজপথটির দৈর্ঘ্য ছিল ১০ হাজার স্টেডিয়া বা ১৮৬০ – ৩৯৭০৪ কিলােমিটার। পাণিনি সম্ভবত এই রাজপথটিকেই উত্তরাপথ আখ্যা দিয়েছেন। পরে এই পথটি পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত হয়ে গঙ্গা নদীর মােহনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। অনেকে মনে করেন এই রাজপথ মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার কোনও এক প্রধান সড়কের সঙ্গে মিলিত হয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের সংযােগ রক্ষা করত। একটি রাজপথ শ্রাবস্তী থেকে বেরিয়ে রাজগৃহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর একটি রাজপথ শ্রাবস্তী হতে গােদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এখানে উল্লেখ করা যায়, আফগানিস্তানের লঘমানে অশােকের যে দু’টি আরামীয় অনুশাসন পাওয়া গেছে, তাতেও রাজপথের উল্লেখ আছে। আরামীয় অনুশাসন দুটিতে রাজপথের পরিবর্তে ‘কারপথি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরামীয় ভাষায় ‘কার’ বা ‘কর’ শব্দের অর্থ রাজা, ‘পথি’র অর্থ পথ।
  • রাজপথ সংরক্ষণ : রাজপথগুলোর সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। বণিকদের নিরাপত্তার জন্য পথগুলোতে সরকারি পাহারার ব্যবস্থা ছিল। মেগাস্থিনিস ‘এগ্রোনােময়’ নামে এক শ্রেণির রাজপুরুষদের কথা বলেছেন। রাজপথের পাশে দূরত্বজ্ঞাপক ও দিকনির্দেশক ফলক বসানাে ছিল তাদের কাজ। লঘমানে অশােকের যে দু’টি আরামীয় অনুশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে, তা আসলে দিক ও দূরত্বজ্ঞাপক ফলক। পথ-ঘাটের রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত একশ্রেণির রাজপুরুষদেরও উল্লেখ আছে এই দুটি লেখে। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির জন্য মৌর্য সরকার যে কতখানি সচেষ্ট ছিলেন, গ্রিক বিবরণ ও অশােকের অনুশাসন দুটির সাক্ষ্য থেকে তা স্পষ্ট বােঝা যায়। 
  • স্থলপথে বৈদেশিক বাণিজ্য : পূর্ব ও পশ্চিমের সঙ্গে যােগাযােগের ক্ষেত্রে স্থলপথও ব্যবহার করা হত। ১২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ চিনা দূত চ্যাঙ কিয়েন ব্যাকট্রিয়ায় এসে চিনদেশে উৎপন্ন বাঁশ ও কাপড় দেখে বিস্মিত হন। অনুসন্ধান করে তিনি জানতে পারেন, চিনা পণ্যসামগ্রী মুন্নান ও মায়ানমার ঘুরে পূর্ব ও উত্তর ভারতের পথে আফগানিস্তানে পৌঁছেছিল। চিন থেকে প্রধানত রেশম আমদানি হত। 
  • জলপথে বাণিজ্য ও সমুদ্রপথে বৈদেশিক বাণিজ্য : বণিকরা জলপথেও যাতায়াত করতেন। রাজ্যে নদ-নদীর প্রাচুর্য থাকায় জলপথের সংখ্যা কম ছিল না। জলপথের মধ্যে গঙ্গানদীপথই প্রধান ছিল। কথিত আছে, মহেন্দ্রর শ্রীলঙ্কা যাত্রার প্রাক কালে অশােক পাটলিপুত্র থেকে জলপথে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত এসেছিলেন। খরচ কম বলে কৌটিল্য নদীপথের প্রশংসা করেছেন, সব ঋতুতে উপযােগী বলে স্থলপথকে তিনি প্রশস্ত বলেছেন। জোরালাে প্রমাণ নেই, কিন্তু সংগত কারণে অনুমান করা যায় ভারতীয় বণিক বাণিজ্যতরীতে নানা পণ্য সম্ভার সাজিয়ে এশিয়া, ইউরােপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতেন। অশােকের রাজত্বকালে যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তার তাে প্রমাণই আছে। বাণিজ্যিক লেনদেন ছাড়া বিদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় রাখা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থশাস্ত্রে বহির্বাণিজ্যের উপযােগিতা সম্পর্কে আলােচনা আছে ; বিদেশের বাজার সম্পর্কে সঠিক ধারণার জন্য দূত পাঠানাের প্রয়ােজনীয়তার কথাও বলা হয়েছে। অনুমান করা যায়, রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে ছিল কার্পাস ও রেশমের বস্ত্র, মশলা, মূল্যবান পাথর ও মুক্তা, হাতির দাঁতের কাজ, দুর্মূল্য কাঠ ও ওষধি। এই সময় নাগাদ তিনটি বন্দরের উদ্ভব ঘটে। এদের একটি তাম্রলিপ্তি, পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। অন্য দু’টি হল, ভরুকচ্ছ ও শূর্পারক যাদের অবস্থান পশ্চিম উপকূলে। গভীর সমুদ্র বিপদসংকুল বলে কৌটিল্য তীর সংলগ্ন সামুদ্রিক পথের উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। 
  • বণিকসম্প্রদায়ের নিরাপত্তা : বণিকসম্প্রদায়ের নিরাপত্তার প্রতি রাষ্ট্রের সতর্ক দৃষ্টি ছিল। বণিকসম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধানে জন্য রাষ্ট্র শুধু পথঘাটই নির্মাণ করেনি, তার সংরক্ষণ ও সুরক্ষার দায়িত্বও গ্রহণ করেছিল। গ্রামের মধ্যে পণ্যদ্রব্য অপহৃত হলে গ্রামপ্রধান দায়ী হতেন, গ্রামের বাইরে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বিবীতাধ্যক্ষ, চোররজ্জুক, সীমাস্বামী প্রভৃতি রাজপুরুষদের উপর দায়িত্ব বর্তাত। অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, তখনকার দিনে কিরাত এবং ম্লেচ্ছ দস্যুদের উপদ্রব ছিল।
  • বণিক-সংগঠন : নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বণিক এবং কারিগরদের নিজস্ব সংগঠন ছিল। অর্থশাস্ত্রে এই ধরনের সংগঠনকে ‘শ্রেণী’ বলা হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে ‘শ্রেণিবল’ কথাটি পাওয়া যায়। বল বলতে সৈন্য বােঝায়। এর থেকে অনেকে অনুমান করেন, বণিক ও কারিগর সংগঠনগুলোর নিজস্ব সৈন্যবাহিনী ছিল। কেবল বণিক বা কারিগরদের নয়, কৃষিজীবী এবং পশুপালকদেরও ‘শ্রেণী’ বা সংগঠন ছিল। ‘শ্রেণী’র যেসব প্রথা-বিধি, রীতি-নীতি, আইন কানুন পুরুষ পরম্পরায় চলে আসছে, সেগুলোকে রাষ্ট্রের মেনে চলা উচিত বলে কৌটিল্য মন্তব্য করেছেন।

ব্যবসা-বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ

কী অর্থশাস্ত্র, কী গ্রিক বৃত্তান্ত, সর্বত্রই রাজ্যের ব্যবসা বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রের বলিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণের কথা ব্যক্ত হয়েছে। অর্থশাস্ত্রে তাে স্পষ্টই বলা হয়েছে, বণিককুল রাষ্ট্রের কণ্টক; তাদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। 

  • কয়েকটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সরাসরি ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত। রাষ্ট্রীয় কারখানায় যেসব ধাতব সামগ্রী তৈরি হত, যে বস্ত্র উৎপন্ন হত, রাজকীয় খেত-খামারে যে খাদ্য ও পণ্যশস্য উৎপাদিত হত, সেসব সামগ্রীকে অর্থশাস্ত্রে ‘রাজপণ্য’ বলা হয়েছে। এই ‘রাজপণ্য রাষ্ট্র দু’ভাবে বিক্রি করত রাষ্ট্রীয় বিপণির মাধ্যমে এবং বেসরকারি বণিকদের সহায়তায়। রাষ্ট্র বেসরকারি বণিকদের এক নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজপণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করত—অন্যথায় তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করত। রাজপণ্য বিক্রির মূল দায়িত্ব যে রাজপুরুষের উপর ন্যস্ত, অর্থশাস্ত্রে তাকে পণ্যাধ্যক্ষ বলা হয়েছে। পণ্যাদির উৎপাদন, চাহিদা, যােগান, আর্থিক মূল্যায়ন, বাজারের গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি অর্থনীতির নানা দিক সম্পর্কে পণ্যাধ্যক্ষ অবহিত। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যে জাহাজ নির্মিত হত, তা বিক্রি করা হত না, ভাড়া খাটানাে হত।
  • দ্বিতীয়ত, যাতে পণ্যের যােগান পর্যাপ্ত ও নিয়মিত থাকে এবং ক্রেতা ও উৎপাদকের স্বার্থ রক্ষিত হয়, সেজন্য রাষ্ট্র বাজার থেকে পণ্য কিনে মজুতভাণ্ডার গড়ে তুলত, আর আপষ্কালীন অবস্থায় সেই মজুত পণ্য বাজারে সরবরাহ করে চাহিদা ও যােগানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখত। কৌটিল্য বলেন, বাজারে কোনও পণ্যের প্রচুর আমদানি হলে ওই পণ্যের দাম পড়ে যায়, উৎপাদক ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই অবস্থায় রাষ্ট্র পণ্য ক্রয় করে মজুত ভাণ্ডার গড়ে তুললে, পণ্যমূল্যের নিম্নগতি বন্ধ হয়, উৎপাদক উপকৃত হন। কৌটিল্য আরও বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বণিকদের অপকর্মের ফলে বাজারে পণ্যের অভাব দেখা দিলে পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়, ক্রেতার স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র মজুতভাণ্ডার থেকে পণ্য বাজারে সরবরাহ করলে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রহিত হয়, ক্রেতা উচিত মূল্যে পণ্যক্রয়ের সুযােগ পান। উত্তর বাংলার মহাস্থান ও উত্তরপ্রদেশের সােগৌরা অভিলেখে সরকারি মজুতভাণ্ডারের উল্লেখ আছে, তবে অর্থশাস্ত্রের বক্তব্যের সঙ্গে এই লেখ দু’টির সাক্ষ্যের বিভিন্নতাও লক্ষণীয়। অর্থশাস্ত্রে নগদ মূল্যের বিনিময়ে পণ্যবিক্রির নির্দেশ আছে, কিন্তু লেখ দু’টিতে পণ্য বিক্রয়ের কথা নেই, ঋণবাবদ খাদ্যশস্য বিতরণের ইঙ্গিত আছে। পণ্য মূল্যের নিম্নগতি ও উধ্বগতি রদ করা ও পণ্য সামগ্রী মজুত করার দায়িত্ব পণ্যাধ্যক্ষের উপর ন্যস্ত ছিল।
  • তৃতীয়ত, ব্যবসায়ীরা যাতে ক্রেতাসাধারণের কাছ থেকে অতিরিক্ত মুনাফা না লুটতে পারেন, সেদিকে রাষ্ট্রের সতর্ক দৃষ্টি ছিল। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র দু’টি নীতি গ্রহণ করেছিল। প্রথমত, রাষ্ট্র খেত, কারখানা বা যত্রতত্র কৃষি ও শিল্পদ্রব্যের বেচাকেনা বন্ধ করে দেয়, পণ্যসামগ্রীর ক্রয় বিক্রয়ের জন্য বাজার নির্দিষ্ট করে দেয় (দুধ ও কাঁচা শাকসবজির মতাে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযােজ্য ছিল না (অর্থশাস্ত্র, ২/১৬))। সরকারি কর্মচারীরা দ্রব্যাদির পরিমাণ, গুণ ইত্যাদি পরীক্ষা করে তবেই ব্যবসায়ীদের পণ্যবিক্রির অনুমতি দিতেন। দ্বিতীয়ত, পণ্যাধ্যক্ষ ও তার সহকারীরা পণ্যসামগ্রীর মূল্য নির্ধারণ করে দিতেন। ফলে ব্যবসায়ীদের পণ্যের উপর বেশি মূল্য ধার্য করে ক্রেতাদের নিকট হতে অতিরিক্ত মুনাফা লােটার পথ বন্ধ হয়। পণ্যের মূল্য নির্ধারণের সময় উৎপাদনের খরচ, পরিবহনের খরচ, ব্যবসায়ীর রাহা খরচ, বণিকের লাভাংশ ইত্যাদি বিচার-বিবেচনা করে দেখা হত। দেশি বণিকদের ক্ষেত্রে শতকরা ৫ ভাগ ও বিদেশি বণিকদের ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ লাভের পরিমাণরূপে ধার্য হত। রাষ্ট্র বৈদেশিক বাণিজ্যকে উৎসাহদানের জন্যই বিদেশি বণিকদের প্রতি নরম নীতি গ্রহণ করেছিল।
  • চতুর্থত, ব্যবসায়ীরা যাতে ওজনের কারচুপি করে ক্রেতাগণকে ঠকাতে না পারেন, সেদিকে রাষ্ট্রের প্রখর দৃষ্টি ছিল। মেগাস্থিনিস ‘এ্যাস্টিনােময়’ নামে যে এক শ্রেণির রাজপুরুষদের উল্লেখ করেছেন, তাদের, পণ্যসামগ্রীর ওজনে ও পরিমাণে যাতে কারচুপি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য ছিল। চোরাকারবারী ও ভেজাল কারবারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। কর ফাঁকি দিলে ব্যবসায়ীদের কখনও কখনও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। 

দেখা যাচ্ছে, মৌর্য আমলে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কোনও কোনও পণ্যের উৎপাদন ও বিনিময় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রায় একচেটিয়া অধিকার ছিল ; কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিগত উদ্যোগ সমান্তরালভাবে বিরাজমান ছিল; আবার কোনও কোনও পণ্যের উৎপাদন ও বিনিময় ব্যবস্থায় কেবল রাষ্ট্রকর্তৃত্বাধীন ব্যক্তিগত উদ্যোগেরই ভূমিকা ছিল। মৌর্য অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের যে ভূমিকা ছিল, তা নেহাতই গৌণ। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মৌর্য অর্থনীতিকে রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনীতি আখ্যা দেওয়া যায়।

অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য : প্রশ্ন হচ্ছে, রাজ্যের অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ নিয়ন্ত্রণের পেছনে কি কি উদ্দেশ্য কাজ করেছিল? একটি উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল প্রজাকল্যাণ। অর্থশাস্ত্রে ও অশােকের অনুশাসনে পিতৃস্নেহে প্রজাপালনের আদর্শ উচ্চারিত হয়েছে। দুর্দিনে প্রজাদের সাহায্যের জন্য খাদ্যশস্য ও পণ্যসামগ্রীর মজুতভাণ্ডার গড়ে তােলার ইঙ্গিত পাওয়া যায় সমকালীন মহাস্থান ও সােগৌরা লেখ দু’টিতে। এ ধরনের ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমুখী কর্মধারার ছবি ফুটে উঠেছে। অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে রাজস্ববৃদ্ধির পথ সুগম করা ছিল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য। রাজ্যের প্রশাসন ও নিরাপত্তার খাতিরে যে বিশাল আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনী গড়ে তােলা হয়েছিল, তার প্রতিপালনের জন্য রাজস্ববৃদ্ধি জরুরি হয়ে দেখা দেয়। রাজস্ববৃদ্ধি তথা রাজকোষে অর্থাগমের উদ্দেশ্যেই রাজ্যের উৎপাদন ও বিনিময় ব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি হয়েছিল। 

মুদ্রা ও রাজস্ব

মুদ্রা : মৌর্যযুগের বাণিজ্য, বিশেষত আন্তর বাণিজ্যে, লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে মুদ্রার ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করে। এযুগের ছাপমারা বা ‘পাঞ্চ মার্কড’ মুদ্রা ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ধরনের মুদ্রায় রাজার নাম বা কোনও লেখ নেই, এদের মুখ্য দিকে আছে। সাধারণত পাঁচটি করে নকশা বা ছবি বিভিন্ন মুদ্রায় বিভিন্ন নকশা থাকায় কোনটি রাজকীয় ব রাষ্ট্রীয় প্রতীক, তা নির্ণয় করা দুষ্কর। অনেকে তােরণের ওপর বসা ময়ূরের নকশাটিকে রাজকীয় প্রতীকরূপে চিহ্নিত করেছেন (রণবীর চক্রবর্তী, প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে, পৃ. ১১২)। আবার কেউবা তিনটি স্তুপের ঢিপির উপর বাঁকা চাদের ছবিটিকে রাজকীয় প্রতীক বলে সনাক্ত করেছেন (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, টাকাকড়ি আবির্ভাবের যুগ, পৃ. ৫৩)। লক্ষণাধ্যক্ষ ছিলেন সরকারি টাকশালের ভারপ্রাপ্ত রাজ পুরুষ। সরকারি টাকশালে রূপা ও তামার মুদ্রা তৈরি হত। মুদ্রাবিভাগের আর এক পদস্থ রাজপুরুষ রূপদর্শক। তিনি মুদ্ৰাপরীক্ষক। অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, সে সময় মুদ্রা জাল হত। কিন্তু ধরা পড়লে অপরাধীর এক হাজার পণ অর্থদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি হতে পারত। সরকারি কর্মচারীরা নগদে বেতন পেতেন। সে সময় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪৮,০০০ ও ৬০ পণ। ২৪০০০, ১২০০০, ৮,০০০, ৪০০০, ২০০০, ১০০০, ৫০০, ২৫০ ও ১২০ পণ এই হারে আরও ৯টি মধ্যবর্তী বেতনক্রম প্রচলিত ছিল। অর্থশাস্ত্রে কোনও স্পষ্ট উল্লেখ নেই ঠিকই, তবু মনে হয়, এই বেতন ছিল রাজপুরুষদের বাৎসরিক পারিশ্রমিক।

রাজস্ব : আমলাতন্ত্রের পরিপালন, সৈন্যবাহিনীর ভরণপােষণ, প্রজাকল্যাণমূলক কাজের অনুষ্ঠান প্রভৃতি অবশ্য করণীয় কার্যাদি সম্পন্নের জন্য রাজা তথা রাষ্ট্রের রাজস্বের প্রয়ােজন ছিল। রাজস্বের বেশির ভাগটাই সংগৃহীত হত ‘ভাগ’ থেকে। এই ‘ভাগ’ আসলে প্রজার জমিতে উৎপন্ন ফসলে রাজার প্রাপ্য ভাগ। প্রজার জীবন ও সম্পত্তি সুরক্ষিত রাখবেন বলে রাজা এই ভাগ পাওয়ার অধিকার লাভ করেন। সাধারণত ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ বা এক-চতুর্থাংশ রাজভাগরূপে ধার্য ছিল। লুম্বিনী গ্রাম বুদ্ধদেবের জন্মস্থান বলে অশােক সেখানে ভাগের পরিমাণ এক-ষষ্ঠাংশ বা এক-চতুর্থাংশ হতে কমিয়ে এক-অষ্টমাংশ করেন। ‘ভাগ’ ছাড়া প্রজাদের যে হরেকরকম রাজস্ব দিতে হত, সেগুলো হল : 

  • বলি : ভাগের অতিরিক্ত একটি শস্যভাগ যা প্রজাদের দিতে হত।
  • কর : সম্পত্তির উপর ধার্য এক ধরনের সাময়িক খাজনা।
  • বিবীত : পশুচারণের খাজনা।
  • রজ্জু : জমি জরিপ ও পরিমাপের খাজনা।
  • চোররজ্জু : চৌকিদারি খাজনা।
  • পিণ্ডকর : এক গুচ্ছ গ্রামের ওপর ধার্য বিশেষ এক ধরনের খাজনা। 
  • সেনাভক্ত : সৈন্যরা গ্রাম বা শহরের মধ্য দিয়ে গমনাগমন করলে গ্রামবাসী ও শহরবাসীদের দেয় খাজনা। 
  • হিরণ্য : নগদে প্রদত্ত খাজনা। 
  • উদকভাগ : কৃষকের দেয় জলকর। কীভাবে সেচের জন্য জল নেওয়া হবে, তার উপর জলকরের হার নির্ভর করত। যন্ত্রের সাহায্যে জল সংগ্রহ করলে উৎপন্ন ফসলের এক-তৃতীয়াংশ কর দিতে হত।
  • অন্যান্য কর : উল্লিখিত রাজস্বের সিংহভাগ গ্রামবাসী ও কৃষকদের বহন করতে হত। কারিগর ও ব্যবসায়ীদের উপরও করের বােঝা নিতান্ত কম ছিল না। স্থান থেকে স্থানান্তরে পণ্যদ্রব্যের পরিবহন ও বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট স্থানে আমদানি কর, রপ্তানি কর, আবগারি কর, নগর প্রবেশ কর ইত্যাদি হরেকরকম কর দিতে হত। বিদেশি বণিকদের বর্তনী জাতীয় একটি অতিরিক্ত কর দিতে হত।
  • জরুরি অবস্থায় কর প্রণয় : উপরে যে কর-ব্যবস্থার কথা বলা হল তা রাজ্যের স্বাভাবিক অবস্থায় কার্যকর ছিল। কিন্তু রাজ্যে জরুরি অবস্থার উদ্ভব ঘটলে রাষ্ট্র আপদকালীন কর ব্যবস্থা আরােপ করত। অর্থশাস্ত্রে একে প্রণয় বলা হয়েছে। অধিকার বলে রাজা কৃষককে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন করতে বাধ্য করতেন, কৃষক-কারিগর-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে রাজস্ব আদায় করতেন। এত করেও যদি পরিস্থিতি সামাল না দেওয়া যেত, তাহলে রাজা রাজস্ববৃদ্ধির জন্য ছল, বল ও কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করতেন। সংকটজনক পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত কর চাপানাে ছাড়া রাজার আর অন্য কোনও পথ নেই ; ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রজাদের সাময়িক দুর্গতি ভােগ করতে হবে, এ বিধান আর্থশাস্ত্রের।

অশােকোত্তর পর্বে অর্থনৈতিক অবস্থা

অশােকোত্তর পর্বে মৌর্য অর্থনীতি বিপর্যয় হয়ে পড়েছিল বলে কোনও কোনও ঐতিহাসিক অভিমত প্রকাশ করেছেন। এই অভিমত সপক্ষে নিম্নরূপ যুক্তিগুলো উল্লেখ করা হয়েছে :

  • এক. অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় কৃষি-অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশের পথ অবরুদ্ধ করেছিল।
  • দুই. অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, জরুরিকালীন অবস্থা মােকাবিলার জন্য রাজস্ব থেকে আয়ের শতকরা ৫০ ভাগই রাজকোষে সঞ্চিত রাখা হত। ফলে রাষ্ট্রের আয়ের একটা বিরাট অংশ উৎপাদনে ব্যবহৃত না হওয়ায় নতুন সম্পদ সৃষ্টির কাজ ব্যাহত হয়। 
  • তিন. ভােগ্যপণ্যের ওপর করের বােঝা অত্যধিক হওয়ায় অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা রহিত হয়। 
  • চার. ব্যক্তিগত উদ্যোগের স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হলে অর্থনৈতিক প্রগতি ব্যাহত হয়। মৌর্যযুগে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে প্রশ্রয় না দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের উপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছিল, ফলে এই অর্থনীতিতে সংকট ঘনিয়ে আসে। 

উপরের যুক্তিগুলো যে অকাট্য, তা অবশ্যই নয়। যুক্তির বিরুদ্ধেও যুক্তি আছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রশাসনিক দক্ষতা ও সততার অবনতি ঘটেছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনীতির উপর এর ফল সম্ভবত শুভ হতে পারেনি। তবে মৌর্য অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, এমনটি ভাবার কোনও সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে সমকালীন যুগের নগরায়ণের যে চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে, তা হতে অন্তত সে ধারণা জন্মে না। এই সময় তক্ষশিলা, শ্রাবস্তী, পাটলিপুত্র, পুণ্ড্রনগর প্রভৃতি শহরে নগরায়ণ অবিরাম গতিতেই চলছিল। এটা বিধ্বস্ত অর্থনীতির পরিচয় নয়।

ধর্মীয় জীবন

ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসে মৌর্যযুগের গুরুত্ব অপরিসীম। এই পর্বে রাজশক্তি, বিশেষ করে অশােকের, অকৃপণ দান, পৃষ্ঠপােষকতা ও সমদর্শিতায় যেমন বিভিন্ন ধর্ম পরিপুষ্টি লাভ করেছিল, তেমনি সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে আদর্শ, এই পর্বে উচ্চারিত হয়েছিল, প্রাচীন ইতিহাসে তা বিরল। 

জৈনধর্ম

অশােক ছাড়া মৌর্যবংশের আর দু’জন রাজা জৈনধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করে গেছেন। এদের একজন চন্দ্রগুপ্ত, অন্যজন সম্প্রতি। চন্দ্রগুপ্তের গুরু ছিলেন উত্তর বাংলার কোতিকপ্র গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান জৈন আচার্য ভদ্রবাহু; সম্প্রতির গুরু সুহস্তী। কথিত আছে, উত্তর ভারতে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় চন্দ্রগুপ্ত, গুরু ভদ্রবাহু এবং তার ১২ হাজার অনুগামীদের সঙ্গে কর্ণাটকের শ্রবণবেলগােলায় চলে যান। সেখানে জৈনরীতি অনুসারে গুরু-শিষ্য উভয়ে অনশনে দেহরক্ষা করেন। এই কাহিনি হতে বােঝা যায়, চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে কর্ণাটকে জৈনধর্মের প্রসার ঘটে। (ভদ্রবাহুর মৃত্যু সম্পর্কে জৈন সাহিত্যে পরস্পরবিরােধী কাহিনির অবতারণা আছে। কোনও কোনও জৈনগ্রন্থে বলা হয়েছে, শ্রবণবেলগােলায় দীর্ঘকাল অবস্থান করার পর ভদ্রবাহু সদলে উত্তর ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং জৈন সংঘের মুখ্য পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অপর এক কাহিনি বলছে, ভদ্রবাহু সংঘের দায়িত্ব হতে অব্যাহতি গ্রহণ করে নেপালে গমন করেন। সে দেশেই তার মৃত্যু হয়।)

ভদ্রবাহুর পর স্থূলভদ্র জৈন সংঘের অধ্যক্ষ হন। তিনি পাটলিপুত্রে জৈনদের এক সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে ১১টি ‘অঙ্গ’ এবং ১৪টি ‘পূর্ব’ জৈনশাস্ত্ররূপে নিদিষ্ট হয়। পুস্তক আকারে এগুলো সংকলিত হয় আরও অনেক পরে। ‘অঙ্গ’ ও ‘পূর্ব’গুলোর প্রামাণ্য নিয়ে স্থূলভদ্রের অনুগামীদের সঙ্গে ভদ্রবাহুর অনুরাগীদের সংঘাত দেখা দেয়। তাছাড়া স্থূলভদ্রের অনুগামীরা শ্বেতবস্ত্র ও মাথায় অর্ধ ফালক ব্যবহার করতেন। ভদ্রবাহুর অনুরাগীরা এ দুটি জিনিস নিয়মবিরুদ্ধ বলে মনে করতেন। জৈনধর্মের মৌল আদর্শ নিয়ে এদের মধ্যে কোনও বিরােধ ছিল না, বিরােধ ছিল ধর্মের অনুষঙ্গ নিয়ে। এই বিরােধের ফলে জৈনরা দিগম্বর ও অর্ধফালক, এই দু’টি সম্প্রদায়ে। বিভক্ত হয়ে পড়লেন। অর্ধফালকেরা পরবর্তিকালে শ্বেতাম্বর নামে পরিচিত হন। জৈন সংঘের বিরােধ উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সম্প্রতি বা তার গুরু সুহস্তী অনেক চেষ্টা করেও এ বিরােধ মেটাতে পারেননি। দিগম্বর সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ পশ্চিম ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সম্প্রতির সময় আফগানিস্তান, অন্ধ্র ও দ্রাবিড় অঞ্চলে ধর্মপ্রচারক পাঠানাে হয়েছিল বলে জৈনগ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে। এযুগে তীর্থঙ্করদের মূর্তিপূজা প্রচলিত ছিল। কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাথীগুম্ফা শিলালেখে তার প্রমাণ আছে। কিন্তু এ সময়ের কোনও তীর্থঙ্কর মূর্তি আজও আবিষ্কৃত হয়নি।

বৌদ্ধধর্ম

বৈশালীতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতি অনুষ্ঠানে সংঘের আভ্যন্তরিক বিরােধ প্রকাশ্য রূপ নেয়। তারপর থেকে সংঘে বিভেদ বাড়তেই থাকে। প্রথম দিকে সংঘে দুটি গােষ্ঠী ছিল – স্থবিরবাদী (থেরবাদী) ও মহাসংঘিক। ক্রমে ক্রমে স্থবিরবাদীরা মহীশাসক, বাৎসীপুত্রীয়, (সাস্মিতীয়), যণ্ণগরিক, ধর্মগুপ্তিক, কাশ্যপীয়, উত্তরাপথক, ভদ্রযানীয়, ধর্মোত্তরীয়, সর্বাস্তিবাদী, হৈমবত ও সংক্রান্তিক এই ১১টি উপদলে বিভক্ত হলেন। মহাসংঘিকেরা বিভক্ত হলেন একব্যবহারিক, চৈত্যিক, কুক্কুটিক বা গােকুলিক, বহুশ্রুতীয়, প্রজ্ঞপ্তিবাদী, পূর্বশৈল ও অপরশৈল – এই ৭টি উপদলে। সম্ভবত অশােকের রাজত্বের পূর্বেই এই ১৮টি উপদলের উদ্ভব হয়েছিল। সমকালীন বৌদ্ধগ্রন্থ ‘কথাবত্‌থু’তে এদের অনেকেরই উল্লেখ আছে।

স্থবিরবাদীরা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হলেও বৌদ্ধধর্মের কয়েকটি মূল বিষয় সম্পর্কে তাদের মতবাদ মােটামুটি একই ছিল। তারা মনে করতেন –

  • বুদ্ধ একজন মানুষ; কিছু মানবিক ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও তিনি অতি মানবিক গুণাবলির অধিকারী।
  • দ্বিতীয়ত, স্থবিরবাদীরা মনে করতেন, বুদ্ধ একবারই জন্মগ্রহণ করেছেন, তিনি ভবিষ্যতে আর জন্মগ্রহণ করবেন না।
  • তৃতীয়ত, স্থবিরবাদীরা অর্হৎত্বকেই জীবনের পরম পাওনা বলে মনে করতেন, অর্হৎত্ব এমন একটি জীবন যেখানে কোনও জাগতিক আসক্তি বা মােহের বন্ধন নেই, যেখানে ভবিষ্যৎ জন্মেরও কোনও সম্ভাবনা নেই। নিজের চেষ্টা ও সাধনায় মানুষ এই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে, অপর জনের সাহায্য নিরর্থক।

পক্ষান্তরে, মহাসংঘিকরা মনে করতেন –

  • বুদ্ধ মানুষ নন; তিনি লােকোত্তর, অলৌকিক, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী, সর্বশক্তিমান এক সত্তা। উপনিষদে যে সত্তাকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে, মহাসংঘিকদের দৃষ্টিতে বৌদ্ধ অনেকটা সেই রকম।
  • দ্বিতীয়ত, মহাসংঘিকদের বিশ্বাস, বৌদ্ধ অনন্ত ও চিরন্তন হলেও কল্যাণের জন্য কখনও কখনও মানবরূপ ধারণ করেন। আমাদের জগতে গৌতম বুদ্ধ রূপে তিনি এভাবেই আবির্ভূত হয়েছেন। এটি আসল বুদ্ধের রূপকায় বা নির্মাণকার সাধারণের হিতার্থে রূপকায় ধারণ করে তিনি বার বার আবির্ভূত হন।
  • তৃতীয়ত, মহাসংঘিকরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন, অর্হৎত্বের সাধনা ব্যক্তিস্বার্থের সাধনা, এই সাধনায় সর্বসাধারণের কল্যাণ নেই, ফলে অর্হৎত্ব কখনওই মানুষের ঈপ্সিত লক্ষ্য হতে পারে না। তাছাড়া অর্হতের রাগ-দ্বেষ আছে, ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, অহত্বের সাধনা মানুষকে নির্বাণের লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। কিন্তু বুদ্ধত্ব অর্জনেই জীবনের চরিতার্থতা। পৃথিবীর সকল জীবের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় বুদ্ধত্ব আছে, সর্ব জীবে সেই অব্যক্ত বুদ্ধত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। নিজের বা ব্যক্তির মুক্তি নয়, সর্ব জীবের মুক্তি হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য।
  • চতুর্থত, বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সংসার ত্যাগের প্রয়ােজন নেই; যা প্রয়ােজন তা হল কয়েকটি পারমিতা বা সৎকর্মের অনুষ্ঠান।
  • পঞ্চমত, মহাসংঘিকরাই সর্ব প্রথম স্থূপ ও চৈত্য পূজার উপযােগিতা অনুভব করেন। 

দেখা যাচ্ছে, সংঘের নিয়ম-কানুন ও ভিক্ষুজীবনের আচরণীয় কর্মকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ সংঘে যে বিভেদের সূত্রপাত হয়েছিল কালক্রমে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। সংঘের এই বিরােধ ধর্মের মূল আদর্শ ও তাৎপর্যকে স্পর্শ করল। কিন্তু এত বিরােধ, দলাদলি সত্ত্বেও ভিক্ষুকেরা একই বিহারে বসবাস করতে থাকেন। এর ফলে বিহার তথা সংঘের কাজে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপােসথ অনুষ্ঠানে সমবেত হতে হত। সেখানে তারা নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি অকপটে আলােচনা করতেন ও প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। কিন্তু বিভিন্ন দল-উপদলে মতপার্থক্য এত তীব্র ছিল যে কোন কাজটি ভ্রান্ত, কোটি বা সঠিক, তা নির্ধারণ করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। পাটলিপুত্রের অশােকারামের মতাে অত বড় প্রতিষ্ঠানেও উপােসথ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। মহাবংস ও দীপবংস থেকে জানা যায়, সংঘে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে মৌর্যসম্রাট অশােক গুরু মুদ্গ‌লীপুত্র তিষ্যের পরামর্শে পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি আহ্বান করেন। বিরােধীদের মত খণ্ডন করে স্থবিরবাদীরা এই সম্মেলনে নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেন। শুধু তাই নয়, বিরােধীদের অশােকারাম থেকে বহিষ্কার করা হয়। ‘কথাবত্‌থু’ নামে একখানি অভিধর্ম গ্রন্থ এই উপলক্ষে সংকলিত হয়।

মহাবংস ও দীপবংসে দাবি করা হয়েছে, অধিবেশন শেষে মুদগলীপুত্র তিষ্য বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য শ্রমণদের ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিদেশের নানা স্থানে প্রেরণ করেন। এ ভাবে মধ্যন্তক কাশ্মীর ও গান্ধারে, মহারক্ষিত যবন বা গ্রিস দেশে, মধ্যমক হিমালয় অঞ্চলে, যবন ধরিক্ষিত অপরান্তকে, মহাধর্মরক্ষিত মহারাষ্ট্রে, মহাদেব মহিষমণ্ডলে বা কর্ণাটকে, রক্ষিত বনবাসি বা উত্তর কানাড়ায়, সােণ ও উত্তর সুবর্ণভূমিতে (মায়ানমার অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) এবং মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রা শ্রীলঙ্কায় প্রেরিত হন। দীপবংসে কাশ্যপগােত্র ও দুন্দুভিসর নামে আরও দু’জন শ্রমণের কথা বলা হয়েছে। হিমালয় অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রচার অভিযানে তারা মধ্যমকের সঙ্গী ছিলেন। কথিত আছে, ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অশােক স্বয়ং নেপাল পরিদর্শন করেন। ললিতপত্তন শহরটির চারদিকে চারটি বৌদ্ধ স্তুপ নির্মাণ করেন।

অশােকের রাজত্বকালে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতির অধিবেশন আদৌ অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। শুধু মহাবংস ও দীপবংসেই এই অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে ; সংস্কৃত সাহিত্য, চিনা বিবরণ, বা অশােকের অনুশাসন, কোনও সুত্রেই এ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য নেই। তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি নিঃসন্দেহে স্থবিরবাদীদের সম্মেলন। এর সাম্প্রদায়িক রূপ অস্বীকার করবার উপায় নেই। অশােকের মতাে একজন সমদর্শী রাজার পক্ষে বিশেষ একটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপােষকতা অবশ্যই দৃষ্টিকটু। অশােক রাজ্যময় স্তুপ স্থাপন করেছিলেন, বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলো পরিদর্শন করেছিলেন, বুদ্ধকে ভগবানরূপে দেখেছিলেন। অশােকের এসব কাজের মধ্য দিয়ে তার জীবনে মহাসংঘিকদের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতিতে তার স্থবিরবাদী ভূমিকা অসংগত বলে মনে হয়েছে। এসব কারণ সত্ত্বেও তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতির ঐতিহাসিকতা অগ্রাহ্য করা যায় না। সম্ভবত অশােক বা মৌর্য সরকারের সঙ্গে এই সম্মেলনের কোনও প্রত্যক্ষ যােগ ছিল না। 

তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতিতে অশােকের ভূমিকা সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু বৌদ্ধধর্মের উন্নতিকল্পে তার উদ্যম প্রশ্নাতীত। তিনি তার অনুশাসনে অকপটে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত লুম্বিনী ও বােধগয়া এবং সম্ভবত কপিলবস্তু, সাঙ্কাশ্য ও কুশীনগর তিনি পরিদর্শন করেছেন। সংঘে কয়েকটি বৌদ্ধসূত্র বা অনুচ্ছেদের বিশেষ অনুশীলনের উপর তিনি গুরুত্ব আরােপ করেছেন। সংঘের সংহতির প্রতি তার প্রখর দৃষ্টি ছিল। দিব্যাবদান গ্রন্থে উল্লেখ আছে, তিনি সারা ভারতে ৮৪,০০০ স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে অশােক-স্তূপের উল্লেখ শুয়েন চাঙও করেছেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অশােকের রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্ম আফগানিস্তান ও সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে, বৌদ্ধধর্ম তার আঞ্চলিকতার গণ্ডি অতিক্রম করে সর্বভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করে। তবে লক্ষ করবার বিষয়, অশােক ছাড়া আর কোনও মৌর্য রাজা বৌদ্ধধর্মের প্রসারে আগ্রহ দেখাননি। জলৌক তাে বৌদ্ধধর্মবিদ্বেষীই ছিলেন। রাজতরঙ্গিণীতে তাই বলা হয়েছে।

মৌর্যযুগে বৌদ্ধধর্মে অন্তত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। ধর্মকে জনমুখী করার উদ্দেশ্যেই এই দুটি পরিবর্তন। প্রথমত, এতদিন পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মে সংসারী মানুষদের কার্যত কোনও স্থান ছিল না; তাদের মুক্তিলাভের পথও নির্দিষ্ট ছিল না। মুক্তি, তথা নির্বাণ লাভের যে পথ নির্দিষ্ট হয়েছিল, গৃহীদের নিকট তার দ্বার ছিল রুদ্ধ ; সংসার ত্যাগ করে, সব জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে, তবেই সে পথ অনুসরণ করা যেত। কিন্তু এসময় গৃহস্থদের নির্বাণ লাভের অধিকার বৌদ্ধধর্মে স্বীকৃতি লাভ করে। বলা হয়, নির্বাণ প্রাপ্তির জন্য সংসার ত্যাগের প্রয়ােজন নেই, প্রয়ােজন বােধিসত্ত্বত্ব অর্জনের। বুদ্ধদেব নির্বাণ লাভের পূর্বে বােধিসত্ত্ব ছিলেন ; বােধিসত্ত্ব অবস্থায় দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য, ধ্যান ও প্রজ্ঞা এই ছ’টি পারমিতা বা সৎ কর্মের অনুষ্ঠানের ফলে তিনি বুদ্ধত্বে উপনীত হন। বৌদ্ধধর্মের এই নতুন বাণী সাধারণ মানুষকে আশান্বিত করল, সংসার ধর্ম পালনের সঙ্গে বােধিসত্ত্বের আদর্শ অনুসরণ করে বুদ্ধত্ব অর্জনের পথে প্রেরণা জোগাল। বােধিসত্ত্ব ও পারমিতা সম্পর্কিত ধ্যান ধারণার সূচনা ঘটল এই পর্বে। 

দ্বিতীয়ত, মানুষের অধ্যাত্ম-পিপাসা নিবারণের জন্য বুদ্ধ এই পর্বে ঈশ্বররূপে কল্পিত ও পূজিত হন। তবে বুদ্ধের মূর্তিপূজা তখনও প্রচলিত হয়নি, তার দেহভস্ম, অস্থি, দন্ত, কেশ ও ব্যবহার্য দ্রব্যাদির পূজা প্রবর্তিত হয়। বুদ্ধ উপাসনার জন্য ভারতের নানা স্থানে স্থূপ ও চৈত্য গড়ে উঠল ; লুম্বিনী (বুদ্ধের জন্মস্থান), বােধগয়া (বােধিজ্ঞান লাভ), সারনাথ (প্রথম ধর্মপ্রচার) ও কুশীনগর (দেহাবসান) বুদ্ধ-অনুরাগীদের কাছে তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠল। স্বয়ং সম্রাট অশােক বুদ্ধকে ভগবানরূপে দেখেছেন, বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান পরিদর্শন করে ধন্য হয়েছেন। 

স্থবিরবাদী বৌদ্ধসম্প্রদায়সমূহ : সমকালীন বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলো সম্পর্কে দু’চারটি কথা বলার আছে। স্থবিরবাদী সম্প্রদায় দিয়ে এ আলােচনা শুরু করা যায়। বৌদ্ধধর্মের কয়েকটি মৌল বিষয় সম্পর্কে সহমত পােষণ করলেও স্থবিরবাদীদের মধ্যে মতাদর্শের বিভিন্নতা ছিল। মতাদর্শের বিভিন্নতার কারণে স্থবিরবাদীদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে –

  • মহীশাসক : মহীশাসকেরা বুদ্ধদেবকে একজন মানবরূপেই গণ্য করতেন। তাদের বিশ্বাস, স্রোতাপন্নের স্খলন হতে পারে কিন্তু অর্হৎ নিষ্কলঙ্ক। তারা বুদ্ধকে দানের চেয়ে সংঘের অনুকূলে দানকেই শ্রেয় মনে করতেন। তাদের প্রতীতি ছিল, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম ও সম্যক জীবিকা যথার্থ অর্থে অষ্টাঙ্গিকমার্গের অঙ্গ নয়, তারা শীলবিষয়ক। তারা অতীত ও ভবিষ্যতের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, বিশ্বাসী ছিলেন স্কন্ধ, ধাতু ও আয়তনের সূক্ষ্মবীজরূপে অস্তিত্বেও। পরবর্তিকালে এ সম্প্রদায় দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। একটি পূর্বমহীশাসক, অপরটি উত্তরমহীশাসক। সর্বাস্তিবাদী সম্প্রদায়ের সঙ্গে উত্তরমহীশাসকদের বহু বিষয়েই মতের মিল ছিল।
  • হৈমবত : হিমালয় অঞ্চলে উদ্ভব হয়েছিল বলেই হয়তাে সম্প্রদায়ের এরূপ নামকরণ। তাদের বিশ্বাস ছিল বােধিসত্ত্বদের কোনও অসাধারণ বৈশিষ্ট্য নেই, তারা সাধারণ মানুষ। হৈমবতরা মনে করতেন অর্হতেরা নিষ্কলুষ নন, তারা অজ্ঞানতা, সংশয় ও লােভের বশবর্তী। অবৌদ্ধরা অলৌকিক জ্ঞানের অধিকারী হন না, ধ্যানাবস্থায় ভাবের আবেশে বিস্ময়সূচক শব্দের উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সত্যের উপলব্ধি হয়, ইত্যাদি ধারণায় তাদের বিশ্বাস ছিল।
  • বাৎসীপুত্রীয় : বাৎসীপুত্রীয়রা অবন্তিক নামেও পরিচিত। তারা পুদ্গলবাদী। জীবের মধ্যে পুদ্গল নামে এক সবস্তুর অস্তিত্বে তারা বিশ্বাসী। কিন্তু বৌদ্ধদের অনেকেই এ মত স্বীকার করেন না। তাদের বিশ্বাস, পুদ্গ‌ল নামে কোনও স্থায়ী বস্তু নেই; স্কন্ধ, আয়তন ও ধাতুর সমষ্টিই হচ্ছে পুদ্গল যা সতত পরিবর্তনশীল। মহীশাসক সম্প্রদায়ের মতাে এ সম্প্রদায়ও অষ্টাঙ্গিকমার্গের পাঁচটি মাত্র মার্গে বিশ্বাস করতেন।
  • ধর্মগুপ্তিক : ধর্মগুপ্তিকরা সংঘ ও বুদ্ধের উদ্দেশ্যে দানকে মহৎ বলে মনে করতেন। স্তুপের অনুকূলে কোনও সাহায্যও তারা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তাদের ধারণা, সাধক আকস্মিকভাবে বােধিজ্ঞান লাভ করেন, অবিশ্বাসীরা কখনও অলৌকিক জ্ঞান অর্জন করেন না, শ্রাবকযান ও বুদ্ধযান, উভয় যানের লক্ষ্য বিমুক্তি কিন্তু মার্গ ভিন্ন। মধ্য এশিয়া ও চিনদেশে এ মতবাদ বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
  • কাশ্যপীয় : তারা স্থাবিরীয়, সদ্ধর্মবর্ষক ও সুবর্ষক নামেও পরিচিত। তারা মনে করতেন, অর্হতের ক্ষয়জ্ঞান ও উৎপাদজ্ঞান আছে এবং অর্হৎ মােহের বশবর্তী নন। তারা বিশ্বাস করতেন, অতীত কর্মের ফলে সংস্কারের উৎপত্তি হয় আর প্রতি মুহুর্তেই সংস্কারের ক্ষয় হয়। 
  • সৌত্রান্তিক : এ সম্প্রদায় সংক্রান্তিক নামেও পরিচিত। সংক্রান্তিতে অর্থাৎ জীবের দেহান্তর প্রাপ্তিতে তারা বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, যে পাঁচটি স্কন্ধের সহযােগে জীবের উৎপত্তি সেই পাঁচটি স্কন্ধ ছাড়া আর একটি বস্তু আছে, যা সূক্ষ্ম বীজস্বরূপ। সেই বস্তুটিই এক জন্ম হতে অপর জন্মে সংক্রামিত হয়। সেই সূক্ষ্ম বস্তুটি মূলবিজ্ঞান যা সারা দেহ পরিব্যাপ্ত করে আছে। যার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে তাই সংস্কৃত ধর্ম। অসংস্কৃত ধর্মের প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। আমার্গ ছাড়া স্কন্ধের ও মূলবিজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিনাশ হয় না। এ সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ছিল, প্রতিটি মানুষের মধ্যে বুদ্ধ হবার শক্তি আছে।
  • সর্বাস্তিবাদী : সর্বাস্তিবাদীদের মূল কথা ‘সর্বম্ অস্তি’। এর অর্থ ধর্মের ত্রিকাল অস্তিত্ব। এ ধর্মমতে ধর্ম অর্থাৎ বস্তুজগতের অনাগত, বর্তমান ও অতীত, এই তিন কালের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। তারা মনে করতেন, অর্হতের স্খলন, পতন আছে, অন্য সম্প্রদায়ের লােকও অলৌকিক জ্ঞান অর্জন করতে পারেন, সৎকাজ জন্মের হেতু হতে পারে, মানুষ রাগ-ক্রোধ জয় করতে পারেন, সমাহিত অবস্থাতেও সাধক কথা বলতে পারেন। তারা বস্তুজগতের ৭৫টি উপাদান বা ধর্মের অস্তিত্ব স্বীকার করতেন। এর মধ্যে ৭২টি ধর্ম অনিত্য এবং ৩টি নিত্য। নিত্য তিনটি ধর্ম হল আকাশ, প্রতিসংখ্যানিরােধ ও অপ্রতিসংখ্যানিরােধ। তাদের মতে প্রতীত্যসমুৎপাদতত্ত্ব অনিত্য।
  • সাম্মিতীয় : বাৎসীপুত্রীয়দের মতাে সাম্মিতীয়রাও পুদ্গলকে এক বর্ণনাতীত, অপরিবর্তনীয়, সস্তুরূপে মনে করেন। তাদের বিশ্বাস, জীবের মধ্যে পুদ্গল আছে বলেই জীবের জন্মান্তর ঘটে। পুদ্গলবাদী হওয়ায় অনেকেই সাম্মিতীয় ও বাৎসীপুত্রীয়দের এক ও অভিন্ন সম্প্রদায় বলে গণ্য করেন। অর্হতের ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, অবৌদ্ধরাও অলৌকিক জ্ঞানের অধিকারী হন, দুই জন্মের মধ্যবর্তী একটি পর্যায় থাকা সম্ভব ইত্যাদি মতবাদে তারা বিশ্বাসী। শুয়েন চাঙের বিবরণী হতে জানা যয়, পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধনের ভগিনী রাজ্যশ্রী এ সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। 

স্থবিরবাদী অন্য তিনটি সম্প্রদায় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বসুমিত্রের রচনায় এদের উল্লেখ আছে। সম্প্রদায় তিনটি হল ভদ্রযানীয়, ষণ্ণগারিক ও ধর্মোত্তরীয়। এ তিন সম্প্রদায়ের কোনও গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়নি। 

মহাসংঘিক বৌদ্ধসম্প্রদায়সমূহ : মহাসংঘিকরা একব্যবহারিক, চৈত্যিক, কুক্কুটিক বা গােকুলিক, বহুশ্রুতীয়, প্রজ্ঞপ্তিবাদী, পূর্বশৈল ও অপরশৈল, এই সাতটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলেন। এই সম্প্রদায়গুলোর কয়েকটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া যায়।

  • বহুশ্রুতীয় : অমরাবতী ও নাগার্জুনকোণ্ড শিলালেখে বহুশ্রুতীয়দের উল্লেখ আছে। এক বহুশ্রুত অর্থাৎ শাস্ত্রে সুপণ্ডিত বৌদ্ধাচার্য এ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। বহুশ্রুত থেকে সম্প্রদায়ের নাম বহুশ্রুতীয় হয়েছে বহুতীয়দের মতে বুদ্ধদেব অনিত্যতা, দুঃখ, শূন্য ও নির্বাণ সম্পর্কে যেসব উপদেশ দিয়েছেন তা মুক্তিপ্রদ, তা লােকোত্তর। বুদ্ধের অন্য সব উপদেশ লৌকিক। সত্য দু’প্রকার পরমার্থ এবং সংবৃতি। পরমার্থ বলতে লােকোত্তর বা পরমার্থিক জ্ঞান বােঝায়। সংবৃতির অথ মােহ বা ব্যবহারিক সত্য। ববহারিক দৃষ্টিতে প্রতীত্যসমুৎপাদ জাগতিক কার্যকারণ কিন্তু পরমার্থিক দৃষ্টিকোণে এটি শূন্যতা। তাদের মতে বর্তমানের অস্তিত্ব আছে কিন্তু অতীত ও অনাগতের সেরূপ কোনও অস্তিত্ব নেই। স্থানাস্থান জ্ঞান, কর্মবিপাকজ্ঞান ইত্যাদি বুদ্ধের দশ বলে ও বিশেষ শক্তিতে তারা বিশ্বাসী, প্রতিবাদী ভিক্ষু মহাদেবের পাঁচটি তত্ত্বেরও তারা সমর্থক। হরিবর্মা প্রণীত সত্যসিদ্ধিশাস্ত্র এ সম্প্রদায়ের প্রামাণ্য গ্রন্থ।
  • প্রজ্ঞপ্তিবাদী : তাদের মতে স্কন্ধ ও দুঃখ সহগামী নয়, দ্বাদশ আয়তন বা ইন্দ্রিয়ের কোনও অস্তিত্ব নেই। মার্গলাভ বা মৃত্যু কর্মের উপর নির্ভর করে। মার্গলাভের পর কোনও স্খলন হয় না।
  • চৈত্যিক : চৈত্যবাদী ছিলেন বলে এই সম্প্রদায়ের এরূপ নামকরণ। তাদের মতে চৈত্য-নির্মাণ, চৈত্যপূজা ও চৈত্য-প্রদক্ষিণ পুণ্যকর্ম। দানও পুণ্যকর্ম। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবর্গের হিতার্থেও দান করা যায়। তাদের বিশ্বাস, বুদ্ধরা রাগ, দ্বেষ ও মােহ হতে মুক্ত; তারা দশ বলের অধিকারী হওয়ায় অর্হতের চেয়েও মহান।
  • শৈল : চৈত্যিক হতে পরবর্তিকালে শৈল সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। শৈলদের আবার দু’টি ভাগ — পূর্বশৈল ও অপরশৈল। এদের প্রভাব ছিল মূলত অন্ধ্রপ্রদেশ অঞ্চলে। খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের প্রথমার্ধে ধান্যকটক অর্থাৎ গুন্টুর জেলার বর্তমান অমরাবতী (মতান্তরে কৃষ্ণা জেলার বর্তমান ধরণিকোট) পরিদর্শনে এসে শুয়েন চাঙ দেখলেন, শহরটির পূর্বদিকে রয়েছে পূর্বশৈল বিহার আর পশ্চিম প্রান্তে অপরশৈল বিহার। বিহার দুটির বেশির ভাগ শ্রমণ মহাসংঘিক সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। চিনা পরিব্রাজকের সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে অনুমিত হয়, অমরাবতীর পূর্ব ও পশ্চিমে অবস্থিত বিহার দুটির নাম হতেই শৈল সম্প্রদায় দুটির এরূপ নামকরণ হয়েছে।

আজীবিকধর্ম

অশােকের সপ্তম স্তম্ভ অভিলেখে আজীবিক সম্প্রদায়ের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। পাণিনি বংশদণ্ডধারী মস্করি পরিব্রাজকদের উল্লেখ করেছেন। অনেকে তাদের আজীবিক সম্প্রদায়ভুক্ত বলে বর্ণনা করেছেন। যজ্ঞস্থানে ও শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানে আজীবিকদের যােগদান অর্থশাস্ত্রে নিষিদ্ধ হয়েছে। তাদের প্রতি কিন্তু মৌর্য সরকারের মনােভাব ছিল সহানুভূতির ও আনুকূল্যের। আজীবিক সন্ন্যাসীদের বসবাসের উদ্দেশ্যে অশােক ও তার পৌত্র দশরথ যথাক্রমে বরাবর ও নাগার্জুনী পাহাড়ে তিনটি করে গুহাবাস খনন করেন। এ সময় যে পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে, মগধ অঞ্চলে আজীবিক ধর্ম জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল মৌর্য আমলের বরাবর ও নাগার্জুনী পাহাড়ে উৎকীর্ণ গুহালেখে তার প্রতিফলন দেখা যায়।

ব্রাহ্মণ্যধর্ম

ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ এসময় বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু বেশির ভাগ লােকই পৈতৃক ধর্মমতে অবিচল ছিলেন। অর্থশাস্ত্র হতে জানা যায়, সে সময় শহরগুলোতে শিব, মদিরা বা বারুণী, দুর্গা, শ্রী, কুবের বৈশ্রবণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, জয়ন্ত, বৈজয়ন্ত প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর অনেক মন্দির গড়ে উঠেছিল। নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়, সমাজের এক বিরাট অংশ ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুরাগী ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্ভবত প্রথম জীবনে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেন। বিন্দুসার যে ব্রহ্মবাদী ব্রাহ্মণদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন তা মহাবংসে বলা হয়েছে। জলৌক যে একজন রক্ষণশীল শৈব ছিলেন রাজতরঙ্গিণীতে তার ইঙ্গিত আছে। অগ্নি, নদী, গঙ্গা, ইন্দ্র ইত্যাদি দেব-দেবীর পূজার উল্লেখ আছে অর্থশাস্ত্রে। লােকদের দৈত্য-দানব সম্পর্কে ভীতি ছিল। এসব অনিষ্টকারী সত্তাদের তুষ্টির জন্য জনসাধারণ বৃক্ষ ও পাহাড়-পর্বতের পূজা করতেন। পতঞ্জলির মহাভাষ্য থেকে জানা যায়, মৌর্য রাজারা শিব, স্কন্দ ও বিশাখের মূর্তি তৈরি করিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন। 

সমকালীন ব্রাহ্মণ্যধর্ম সম্পর্কে মেগাস্থিনিসের বক্তব্য উল্লেখের দাবি রাখে। গ্রিক দূত বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা ডায়ােনিসাসের পূজা করতেন, কিন্তু সমতল ভূমির লােকের হেরাক্লিসের উপাসক ছিলেন। পণ্ডিতেরা মনে করেন, মেগাস্থিনিসের ডায়ােনিসাস আসলে শিব বা গিরীশ, আর হেরাক্লিস হলেন বাসুদেব-কৃষ্ণ। মেগাস্থিনিসের বিবরণ হতে মনে হয়, উত্তর পশ্চিম ভারতে শৈব সম্প্রদায়ের প্রাধান্য থাকলেও উত্তর ভারতে বিশেষত মথুরা অঞ্চলে বাসুদেব-কৃষ্ণের উপাসনা জনপ্রিয় ছিল। বাসুদেব ও অর্জুনের ভক্তদের কথা পাণিনিও উল্লেখ করেছেন। হেরাক্লিসের উল্লেখ প্রসঙ্গে মেগাস্থিনিস বলেন, মানবজ্ঞানেই তাকে পূজা করা হত। এর থেকে মনে হয়, পাণিনি বাসুদেব কৃষ্ণের উপর দেবত্ব আরােপ করলেও মেগাস্থিনিসের সময়েও বাসুদেব কৃষ্ণের দেবপরিচয় সমাজে সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেনি। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বাসুদেব কৃষ্ণকে নারায়ণ-বিষ্ণুর সঙ্গে অভিন্নরূপে কল্পনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে বিষ্ণু সাধারণ দেবতা নন, দেবতাশ্রেষ্ঠ। মহাভারতের শান্তিপর্বের নারায়ণীয় পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণ, নারায়ণ, নর ও হরি এক অভিন্ন দেবতারূপে কল্পিত হয়েছেন। পর্বাধ্যায়টি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে রচিত হয়েছিল। মেগাস্থিনিসের বর্ণনা ও তৈত্তিরীয় আরণ্যকের সাক্ষ্য হতে মনে হয়, মৌর্য যুগের শেষের দিকে ভক্তরা বাসুদেবকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করতেন। এ সময় থেকে দেবী অম্বিকা রুদ্রের পত্নীরূপে উপাসিত হতে থাকেন। সমকালীন গ্রন্থ তৈত্তিরীয় আরণ্যকে অম্বিকা রুদ্রের পত্নীরূপে বর্ণিত হয়েছেন। যজুর্বেদের বাজসনেয়ি সংহিতা ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের মতাে প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে তিনি কিন্তু রুদ্রের ভগিনীরূপে চিহ্নিত হয়েছেন।

ভাষা, সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও লোকায়ত শিল্প

ভাষা ও সাহিত্য

মৌর্যযুগে প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষার উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি হয়। লােকভাষা বলে বৌদ্ধ ও জৈন মহলে প্রাকৃত ভাষার যথেষ্ট সমাদর ছিল। মৌর্য রাজারা তাে প্রাকৃত ভাষার পৃষ্ঠপােষকতাই করে গেছেন। অশােকের বেশির ভাগ অনুশাসন এই ভাষাতেই রচিত। মৌর্য লেখমালায় প্রাকৃতের প্রাচ্য বা মাগধী, উদীচ্য, পাশ্চাত্য, আবন্তী ও দক্ষিণাত্য এই পাঁচটি আঞ্চলিক রূপ লক্ষণীয়ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বেশির ভাগ ত্রিপিটক মৌর্যপূর্ব যুগে সংকলিত হলেও এই পর্বে অবশ্যই কয়েকখানি বৌদ্ধশাস্ত্র রচিত হয়েছিল। এরূপ একখানি গ্রন্থ কথাবতথ বা বিজ্ঞানপদ। মুদ্গলীপুত্র তিষ্য অশােকের রাজত্বকালে গ্রন্থখানি সংকলন করেন। জৈনগুরু ভদ্রবাহু ও স্থূলভদ্র এই যুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। ভদ্রবাহু ‘কল্পসূত্র’ নামে একখানি গ্রন্থ ও কয়েকখানি নিযুক্তি বা টীকা রচনা করেন। ভদ্রবাহুর শিষ্য স্থূলভদ্র এগারােটি অঙ্গ ও ‘দৃষ্টিবাদ’ নামে আর একখানি গ্রন্থ সংকলন করেন। এসব মূল্যবান গ্রন্থ কালস্রোতে হারিয়ে গেছে। এযুগে সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থাদির মধ্যে শ্বেতাশ্বর উপনিষদ ও তৈত্তিরীয় আরণ্যক বিশেষ উল্লেখযােগ্য। প্রখ্যাত বার্তিককার কাত্যায়ন এই পর্বের লােক ছিলেন। পাণিনির সূত্রের উপর লেখা তার গ্রন্থ বাজসনেয়ি প্রতিশাখ্য। পাণিনির প্রচুর সুত্রের তিনি পরিমার্জন করেছেন। তিনি বররুচি নামেও পরিচিত ছিলেন। পূর্বমীমাংসাসূত্রকার জৈমিনি ৫০০-২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে মহামহােপাধ্যায় পাণ্ডুরঙ্গ বামন কানে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মহাভারতের কিছু অংশ এই পর্বেই সংকলিত হয়েছিল। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র সম্পর্কেও এ কথা প্রযােজ্য। অনেকে মনে করেন, মহাকবি বাল্মীকি এই যুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। (R. C. Majumdar (Ed.) The Age Of Imperial Unity. পৃষ্ঠা ২৫৪)।

মৌর্য স্থাপত্যের নিদর্শন বড় একটা চোখে পড়ে না। যে কটি-বা আছে, তাদের মধ্যে কুমরাহারের ভগ্ন প্রাসাদ, সারনাথের একশিলা বেষ্টনী, বােধগয়ার বােধিমণ্ড এবং বরাবর ও নাগার্জুনী পাহাড়ের গােটা সাতেক গুহাবাস বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

স্থাপত্য

  • কুমরাহারের রাজপ্রাসাদ : কুমরাহারের রাজপ্রাসাদ আসলে চন্দ্রগুপ্তের তৈরি কিন্তু অশােক এটির সংস্কার ও সংযােজন করেন। রাজপ্রাসাদটির সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য তার স্তম্ভশােভিত ৭৬.১২৫ বর্গ মিটার আয়তনের সভাগৃহ। চন্দ্রগুপ্তের সময় স্তম্ভগুলো ছিল কাঠের কিন্তু অশােক পাথরের স্তম্ভ তৈরি করে সভাগৃহটি সুরক্ষিত করেন। প্রতি সারিতে ১৫টি করে মােট ১৫ সারির প্রস্তরস্তম্ভ ছিল এই সভাগৃহে। বর্তুলাকার ও আশ্চর্যরকমের মসৃণ এই স্তম্ভগুলো স্কুল থেকে ক্রমশ সরু হয়ে উপরে উঠেছে। স্তম্ভবিশিষ্ট এই মৌর্য সভাগৃহটি পারস্যের পার্সেপােলিসে আকিমেনীয় রাজাদের শতস্তম্ভবিশিষ্ট দরবার কক্ষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অশােকের মৃত্যুর প্রায় ছ’শ বছর পর ফা শিয়েন মৌর্য রাজপ্রাসাদ পরিদর্শন করে বিস্মিত হন। মানুষের তৈরি জিনিস এত সুন্দর হতে পারে, তা তিনি কল্পনা করেননি। (অনেকে বলেন, কুমরাহারে মৌর্য রাজপ্রাসাদের নিদর্শন পাওয়া যায়নি ; যা পাওয়া গেছে, তা এক সভাগৃহের।)
  • গুহাচৈত্য : অশােক ও তার পৌত্র দশরথ আজীবিক সম্প্রদায়ের জন্য বরাবর ও নাগার্জুনী পাহাড়ে গােটা সাতেক গুহাচৈত্য খনন করান। ধনুকাকৃতির খিলানযুক্ত এই গুহাচৈত্যগুলো প্রধানত কাঠ, বাঁশ বা খড়ের বাড়ির অনুকরণে নির্মিত। লােমশঋষি গুহা ছাড়া অন্য কোনও গুহায় অলংকরণ নেই, কিন্তু গুহাগুলোর অন্তরঙ্গ এত মসৃণ যে বিস্মিত হতে হয়। দশরথের রাজত্বকালে খনন করা গােপীগুহা বেশ বড়, দৈর্ঘ্যে ১৩.৪ মিটার, প্রস্থে ৫.৭৮ মিটার এবং উচ্চতায় ৩.০৪৫ মিটার। এই গুহাগুলো নিশ্চয় উন্নত স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন নয়, শিল্পীদের যা কিছু মুনশিয়ানা তা পালিশের কাজেই প্রকাশিত। 
  • ইটের তৈরি একটি স্তুপ : সাঁচীতে অশােক ইটের তৈরি একটি স্তুপ নির্মাণ করেন। প্রায় শতাব্দী কাল পর এটিকে প্রস্তরময় করা হয়, এর আকারও প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানাে হয়। সাঁচীর এটিই বৃহত্তম তূপ।

ভাস্কর্য ও পোড়ামাটির শিল্প

  • অশোকস্তম্ভ : দীর্ঘ, সুঠাম, উপরের দিকে ক্রমশ সরু, এককভাবে দাঁড়িয়ে থাকা, অতি মসৃণ অশােকস্তম্ভ মৌর্য ভাস্কর্যশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। বাখিরা, সাঙ্কাশ্য, লৌরিয় অররাজ, রামপুরবা, লৌরিয় নন্দনগড়, রুম্মিনদেঈ, সারনাথ, সাঁচী প্রভৃতি স্থানে এরূপ ত্রিশটিরও বেশি স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের মধ্যে বাখিরা, সঙ্কাশ্য ও লৌরিয় অররাজের স্তম্ভগুলোকে অনেকে বিন্দুসারের আমলে নির্মিত বলে মনে করেন। তবে এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। প্রতিটি স্তম্ভ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনও সৌধ বা স্থাপত্যকীর্তির অঙ্গরূপে এদের স্থাপন করা হয়নি ; সেজন্য স্থাপত্যের নয়, ভাস্কর্যের নিদর্শনরূপেই এদের স্বীকৃতি। বিশ্বের বৃহদায়তন স্তম্ভের রাজ্যে অশােকস্তম্ভ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এর মসৃণতায়, সুঠাম ও সুসমঞ্জস দেহগঠনে এবং পুষ্প-লতা, পশু-পাখির রূপায়ণে ভাস্কর্যশিল্পের যে অভিব্যক্তি ঘটেছে, তা বিস্ময়কর। এতদিন ভারতীয় শিল্পভাবনা আদিমতা ও উপজাতীয়তার বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ ছিল। মৌর্যযুগে বদ্ধঘরের জানালা খুলে যায়। রাজার আনুকূল্যে উন্মুক্ত বাতাবরণের স্পর্শে শিল্প বিকশিত হয়। শিল্প সর্বভারতীয় রূপ পরিগ্রহ করে। 
  • দণ্ড ও বোধিকা : চুনার বেলে পাথরে তৈরি অশােকস্তম্ভের দু’টি ভাগ, দণ্ড ও বােধিকা। দণ্ড গােলাকার, একশিলা। এগুলো কোনও ভিতের উপর দাঁড়িয়ে নেই, সরাসরি ভূমি থেকে তাল বা পাইন গাছের মতাে ক্রমশ সরু হয়ে সােজা উপরের দিকে উঠে গেছে। উচ্চতায় এগুলো ৯.১৩৫ থেকে ১২.১৮০ মিটারের মধ্যে। এক একটি দণ্ডের ওজন অনেক। বৃহত্তম যেটি, সেটির ওজন ৫০ টনের মতাে। দণ্ডগুলোর মসৃণতা বিস্ময়কর। দণ্ডের উপরে বােধিকা। এটিও একটি অখণ্ড পাথর। একটি তাম্ৰকীলক দিয়ে দণ্ডের সঙ্গে বােধিকাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। বােধিকার তিনটি ভাগ। নীচে ঘণ্টা আকারের ওলটানাে পদ্ম। মাঝখানে আয়তাকার বা বর্তুলাকার মঞ্চ। উপরে পশুমূর্তি। মঞ্চের গায়ে কখনও পশু বা পাখির মূর্তি উৎকীর্ণ, কখনওবা লতাপুষ্পের সমারােহ। মঞ্চের উপরে পশুমূর্তির উপস্থাপনায় বৈচিত্রা লক্ষণীয় ; কখনও একটি বা চারটি সিংহ, কখনও বৃষ, কখনও হস্তী, আবার কখনওবা অশ্ব।
  • সারনাথের অশোকস্তম্ভ : অশােকস্তম্ভের মধ্যে সারনাথের স্তম্ভটি নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। এর অভিনবত্ব এর বােধিকার রূপকল্পনায় মঞ্চের গায়ে চারদিকে হস্তী, বৃষ, অশ্ব ও সিংহ এই চারটি পশুমূর্তি উৎকীর্ণ। দুটি পশুর মাঝখানে রয়েছে একটি করে চক্র। মঞ্চের গায়ে এই চারটি পশু ও চক্রের উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে গভীর ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে। ঘােড়ার পিঠে চড়ে বুদ্ধদেব সংসার ত্যাগ করেছিলেন। ঘােড়া বুদ্ধদেবের সংসার ত্যাগের প্রতীক। মায়াদেবী গর্ভাবস্থায় স্বপ্নে শ্বেতহস্তী দর্শন করেছিলেন। তারই ব্যঞ্জনা হস্তী। বৃষ রাশিতে বুদ্ধের জন্ম। বৃষ বুদ্ধের প্রতীক। শাক্যসিংহ বুদ্ধ মঞ্চে সিংহরূপে উপস্থাপিত। সারনাথে প্রথম বাণী প্রচার করে বুদ্ধ ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন। চক্র ধর্মচক্র প্রবর্তনের প্রতীক। মঞ্চের উপরে রয়েছে চারটি সিংহের মূর্তি। আর একেবারে শীর্ষদেশে, সিংহ চতুষ্টয়ের। পিঠের উপরে রয়েছে ৮৪১ মিটার ব্যাসের একটি প্রস্তর চক্র, ধর্মচক্র। এই চক্রটিকে বাদ দিয়ে সারনাথের স্তম্ভ বােধিকাটিকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতীকচিহ্নরূপে গ্রহণ করা হয়েছে।
  • ত্রুটি-বিচ্যুতি : কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি মৌর্য ভাস্কর্যশিল্পে অবশ্যই আছে। পরিকল্পনায় ও গঠনতন্ত্রে অশােক স্তম্ভের ভাস্কর্য যেন অনেকটা গতানুগতিক, প্রথাসর্বস্ব। উদ্ভাবনে নয়, অনুকরণেই যেন শিল্পের সার্থকতা। যে জীবনীশক্তি এবং বাস্তবানুগতা শিল্পের প্রাণ তা এখানে ব্যাহত। সামাজিক জীবনের প্রতিফলন মৌর্যভাস্কর্যে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত। এ যেন সম্রাটের উৎসাহে ও নির্দেশনায় গড়ে ওঠা এক দরবারি শিল্প।
  • ধৌলির হাতি : মৌর্যযুগের অন্যান্য পশুমূর্তির তুলনায় ধৌলির হাতি অনেক প্রাণবন্ত, অনেক বাস্তব। হাতিটি যেন অশােকেরই প্রতীক। নম্র, বীরােদাত্ত সম্রাট যেন স্বয়ং বিজিত কলিঙ্গবাসীদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ধৌলির হাতির মতাে আর একটি ব্যতিক্রম রামপুরবার বৃষমূর্তি। ভাবব্যঞ্জনা ও গতিময়তার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর বহন করছে এই বৃষমূর্তি। 
  • বৈদেশিক প্রেরণা ও স্বকীয় শিল্পভাবনা : মৌর্যযুগে শিল্প সৃষ্টির পেছনে বৈদেশিক প্রেরণা অবশ্যই কাজ করেছিল। সে প্রেরণা এসেছিল মুখ্যত পারস্য থেকে, আর এসেছিল আয়ােনিয়া, তথা গ্রিস হতে। মৌর্যশিল্পে পারসিক প্রভাব ধরা পড়েছে তার পাথুরে উপাদানে, স্তম্ভের অত্যাশ্চর্য মসৃণতায়, ঘণ্টা বা ওলটানাে পদ্মের সংযােজনায় ও প্রাণী ভাস্কর্যের উপস্থাপনায়। গ্রিক প্রভাব ধরা পড়েছে খাঁজকাটা বােধিকায়, কিছু প্রাণী-ভাস্কর্যে ও লতা-পাতা-পুষ্পের ব্যবহারে। বৈদেশিক প্রভাব থাকলেও মৌর্যশিল্পে পারসিক, তথা বৈদেশিক শিল্পের অন্ধ অনুকরণ নেই। মৌর্যশিল্পী স্বকীয় শিল্পভাবনারও স্বাক্ষর রেখেছেন। মৌর্যস্তম্ভদণ্ডে কোনও নকশা বা কারুকার্য নেই কিন্তু পারসিক স্তম্ভদণ্ড খাঁজকাটা। মৌর্যক্তদণ্ড একশিলা, পারসিক স্তম্ভদণ্ড কয়েক খণ্ড শিলায় তৈরি। মৌর্যস্তম্ভদণ্ডে রয়েছে দারুশিল্পের ছাপ, আকিমেনীয় বা পারসিক স্তম্ভদণ্ডে রয়েছে স্থাপত্যবিদ্যার প্রতিফলন। প্রতিটি অশােকস্তম্ভ যেন এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সৌধ। পারসিক স্তম্ভ বৃহদায়তন সৌধের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অনাবশ্যক জটিলতা ও বৈসাদৃশ্যে পারসিক স্তম্ভ ভারাক্রান্ত। তুলনায় অশােকস্তম্ভ নিরাভরণ ও দৃষ্টিনন্দন। পারসিক ও মৌর্যশিল্পের এই পার্থক্যের মূলে রয়েছে মৌর্যশিল্পীর নিজস্ব শিল্পভাবনা। শিল্পীর শিল্পভাবনার পটভূমি তার পরিবেশ। মৌর্যশিল্পীর পরিবেশ ভারতবর্য। তবে স্বীকার করতে বাধা নেই, মৌর্যশিল্পীর শিল্পভাবনায় সমাজ সচেতনতার কোনও পরিচয় নেই। তবে শিল্পে পাথুরে উপাদান প্রবর্তন করে মৌর্যশিল্পী দুরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। মৌর্যোত্তর পর্বে ভারতীয় শিল্পে পাথুরে উপকরণ প্রয়ােগের যে ব্যাপকতা দেখা যায়, তার ভিত্তি মৌর্যযুগে রচিত হয়। পরবর্তিকালের ভারতীয় শিল্পকলায় ধৌলি ও রামপুরবা মূর্তিভাস্কর্যের অল্পবিস্তর ছাপ যে পড়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু ভারতীয় শিল্পের উপর মৌর্যশিল্প খুব যে একটা প্রভাব রেখে গেছে, তা মনে হয় না। জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, বিদেশি ভাবধারায় পুষ্ট, দরবারি মৌর্যশিল্পের পক্ষে তা সম্ভবও ছিল না।
  • যক্ষ-যক্ষিণী : চুনারের বেলে পাথরে তৈরি, অতি মসৃণ কয়েকটি যক্ষ-যক্ষিণী মূর্তি পাটনা, দিদারগঞ্জ, লােহানিপুর, পরখাম, মথুরা প্রভৃতি স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকে এই মূর্তিগুলোর কয়েকটিকে মৌর্যযুগের বলে সনাক্ত করেছেন। তবে এ সম্পর্কে এই মুহূর্তে কোনও সঠিক মন্তব্য করা সম্ভব নয়। যক্ষ-যক্ষিণীদের আদিম গ্রাম্যদেবতা বলে মনে করা হয়। মূর্তিগুলো মানুষ সমান, অনেক ক্ষেত্রে আকারে মানুষের চেয়েও বড়। মূর্তিগুলোর দেহগঠন ভারী, উদর স্থূল, বুক চওড়া, হাত-পা মােটাসােটা। পাদপীঠের উপর সােজা দাঁড়িয়ে থাকা বেশির ভাগ যক্ষ-যক্ষিণীর মূর্তিগুলোতে কমনীয়তার আভাস নেই, আছে শক্তিমত্তার ভাব।
  • লােকায়ত শিল্প : বুলন্দীবাগ, কুমরাহার, কৌশাম্বী, বক্সার প্রভৃতি স্থানে গৈরিক, লাল, ধূসর ও কালাে রঙের মৌর্যযুগের পােড়ামাটির মূর্তি ও খেলনা পাওয়া গেছে। মূর্তিগুলোর মুখের অংশটুকু ছাঁচে ঢালা, কিন্তু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, সাজসজ্জা ও অলংকারাদি পৃথক পৃথক তৈরি করে মুখের সঙ্গে জোড়া লাগানাে হয়েছে। বেশ কিছু মূর্তির মাথায় গােল, চৌকো ও নানা ধরনের অদ্ভুত পাগড়ি দেখা যায়। শিল্পের বিচারে উঁচু মানের না হলেও লােকায়ত শিল্পের নিদর্শনরূপে এই পােড়ামাটির শিল্পকর্মের বিশেষ গুরুত্ব আছে।

মূল্যায়ন : নানা কারণে মৌর্যযুগ ভারতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। এসময় প্রায় সারা ভারত জুড়ে যে এক অখণ্ড, ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রগঠনের সার্থক প্রয়াস দেখা গিয়েছিল, ঠিক তেমনটি আর কখনও ঘটেনি। প্রাকৃত ভাষার প্রসার, শাশ্বত ও মানবিক মূল্যবােধের সম্প্রচার, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে একই শৈলীর অনুসরণ এবং দেশজুড়ে একই দণ্ডবিধি ও বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে জনগণের সাংস্কৃতিক ও ব্যবহারিক জীবনে সেই ঐক্যের সুরই ধ্বনিত হয়েছে। ঐকতান বেজে উঠেছিল জনগণের ধর্মীয় জীবনেও। ধর্মে ধর্মে বিরােধ বা সংঘাতের কথা নয়, বিভিন্ন ধর্মের পারস্পরিক সম্প্রীতি এবং পরিপুষ্টির যে আদর্শ এই যুগে উচ্চারিত হয়েছিল, তা মৌর্যপর্বকে অভিনবত্ব দান করেছে। রাজ্যের, তথা দেশের, বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতার কথাও এই যুগেই প্রথম ঘােষিত হয়েছে। মৌর্যযুগ প্রসঙ্গে আর একটি কথা অবশ্য স্মরণীয়। অশােকের লেখেই প্রথম সংখ্যা বােঝাতে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে (G. Bühler, Indian Palaeography, Plate IX.)। এবং ২৫৬ সংখ্যা নির্দেশ করা হয়েছে। নয়টি সংখ্যা এবং একটি শূন্য চিহ্নদ্বারা অঙ্ক-লিখনের প্রণালী তখনও অজানাই ছিল। সে উন্নত পর্যায়ে পৌঁছতে ভারতবর্ষকে আরও কয়েক শতাব্দীকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে। 

শুঙ্গ-কাণ্ব যুগ (আ. ১৮৭-৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

শুঙ্গ-কাণ্ব রাজারা (পুষ্যমিত্র ব্যতিক্রম) হয়তাে কোনও বৃহদায়তন রাজ্য গঠন করেননি, বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হয়তাে উল্লেখযােগ্য সাফল্যও তারা অর্জন করেননি, কিন্তু ভারতের ইতিহাসে এই যুগ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়রূপে স্বীকৃত। কৃষি-বাণিজ্যের প্রসার, আন্তর-রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের উন্নতি, ভাগবত ধর্মের বিস্তার, সাহিত্যিক অগ্রগতি, সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসার, শিল্পকলায় নতুন চেতনার উন্মেষ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য শুঙ্গ-কাণ্ব পর্বকে ঔজ্জ্বল্য দান করেছে।

শুঙ্গ রাজবংশ (আ. ১৮৭-৭৫ খ্রি.পূ.)

পুষ্যমিত্র (আ. ১৮৭-১৫১ খ্রি.পূ.)

শেষ মৌর্যরাজ বৃহদ্রথকে হত্যা করে তার সেনাপতি পুষ্যমিত্র আনুমানিক ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাটলিপুত্রের সিংহাসন অধিকার করেন। পুরাণে এবং বাণভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থে মগধের এই রাজনৈতিক পালাবদলের কাহিনির বর্ণনা আছে।

বংশ পরিচয় : পুষ্যমিত্রকে ‘দিব্যাবদান’-এ মৌর্য সন্তান বলা হয়েছে। এই তথ্য ঠিক নয়। কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্রম্‌ নাটকে পুষ্যমিত্রের পুত্র অগ্নিমিত্র কাশ্যপগােত্রীয় এবং বৈম্বিকবংশীয় বলে অভিহিত হয়েছেন। পুরাণে পুষ্যমিত্রকে শুঙ্গ বলে বর্ণনা করা হয়েছে । হর্ষচরিতেও পুষ্যমিত্রের একজন বংশধরকে শুঙ্গ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। শুঙ্গদের পাণিনি ভরদ্বাজগােত্রীয় ব্রাহ্মণরূপে বর্ণনা করেছেন। বেদে ও উপনিষদে শুঙ্গ ঋষিদের উল্লেখ আছে। সম্ভবত শুঙ্গবংশীয় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে পুষ্যমিত্রের জন্ম হয়েছিল। পুষ্যমিত্রের পূর্বপুরুষেরা কখন অধ্যয়ন-অধ্যাপনা ছেড়ে সামরিক বৃত্তি গ্রহণ করেন, তা জানা যায় না। তবে পুষ্যমিত্র যে সিংহাসন লাভের পূর্বে বৃহদ্রথের সেনাপতি ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি গর্হিত উপায়ে সিংহাসন দখল করেছিলেন সত্য কিন্তু রাজারূপে যে দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। 

বিদর্ভের সাথে সংঘর্ষ : সিংহাসনে আরােহণের অল্পদিনের মধ্যেই পুষ্যমিত্র বিদর্ভরাজ যজ্ঞসেনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। প্রাক্তন বেরার এবং ওয়ার্ধা ও বেণগঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে বিদর্ভ রাজ্যটি গঠিত ছিল। তখন শুঙ্গ রাজপুত্র অগ্নিমিত্র বিদিশার প্রদেশপাল ছিলেন। বােন মালবিকার সঙ্গে বিদিশায় আসার পথে অগ্নিমিত্রের শ্যালক মাধবসেন যজ্ঞসেনের হাতে বন্দি হন। আসলে যজ্ঞসেন পুষ্যমিত্রের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ নিতে চাইলেন। পুষ্যমিত্র তার শ্যালককে বন্দি করে রেখেছিলেন। এই শ্যালক ছিলেন মৌর্যরাজ বৃহদ্রথের এক মন্ত্রী। অগ্নিমিত্র মাধবসেনের মুক্তি দাবি করলে যজ্ঞসেনও অগ্নিমিত্রের কাছে অনুরূপ প্রতিশ্রুতি চাইলেন। যজ্ঞসেনের ঔদ্ধত্বে ক্রুদ্ধ অগ্নিমিত্র সেনাপতি বীরসেনকে বিদর্ভ অভিযানে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে যজ্ঞসেন পরাভূত হন। মাধবসেন মুক্তি লাভ করেন। বিদর্ভ দ্বিখণ্ডিত হল। একাংশ থাকল যজ্ঞসেনের অধীনে, বাকি অংশের রাজা হলেন মাধবসেন। উভয়েই পুষ্যমিত্রের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করেন। ফলে নর্মদার দক্ষিণে শুঙ্গ আধিপত্য বিস্তৃত হয়।

গ্রিকদের বিরুদ্ধে জয় : গ্রিকদের বিরুদ্ধে জয় পুষ্যমিত্রের রাজত্বের আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। মালবিকাগ্নিমিত্রে বলা হয়েছে, পুষ্যমিত্রের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘােড়া সিন্ধুতীরে উপনীত হলে যবন বা গ্রিক সৈন্যরা তার গতিরােধ করেন। কিন্তু অগ্নিমিত্রের পুত্র বসুমিত্র যুদ্ধে গ্রিকদের পরাজিত করে যজ্ঞের ঘােড়াটিসহ রাজধানী পাটলিপুত্রে প্রত্যাবর্তন করেন। মালবিকাগ্নিমিত্রে পুষ্যমিত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিকরাজের নামােল্লেখ নেই। পণ্ডিতেরা তাকে ডিমেট্রিয়াস বা তার এক উত্তরাধিকারী রূপে শনাক্ত করেছেন। পুষ্যমিত্রের সমসাময়িক বিখ্যাত বৈয়াকরণ পতঞ্জলি তার মহাভাষ্যে গ্রিক অভিযানের উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজে দেখেননি, অথচ তার দেখার সম্ভাবনা ছিল, এরূপ দু’টি ঘটনার দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে তিনি জনৈক যবনরাজের সাকেত ও মধ্যমিকা অবরােধের উল্লেখ করেছেন। ‘অরুণদ যবনঃ সাকেত, অরুণদ যবনঃ মধ্যমিকাম্‌’। অযােধ্যার এক নাম সাকেত, মধ্যমিকার অবস্থান চিতােড়গড়ের নিকটবর্তী নাগরী গ্রামে। অনেকের ধারণা, যবনদের সাকেত এবং মধ্যমিকা অভিযান আর সিন্ধুতীরে বসুমিত্রের সঙ্গে যবনদের সংঘর্ষ একই গ্রিক অভিযানের দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু এই মত সমর্থনযােগ্য নয়। মহাভাষ্য থেকে জানা যায়, গ্রিক অভিযানকারীরা ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন। যুগ-পুরাণেও গ্রিকদের পাঞ্চাল, মথুরা এবং পাটলিপুত্র আক্রমণের কথা বলা হয়েছে। গ্রন্থ দুটিতে গ্রিক অভিযানের বর্ণনায় আশ্চর্যরকমের সাদৃশ্য দেখা যায়। যুগ-পুরাণ থেকে জানা যায়, এই গ্রিক অভিযান মৌর্যযুগের একেবারে শেষের দিকে সংঘটিত হয়েছিল। অর্থাৎ তখনও পুষ্যমিত্র পাটলিপুত্রের সিংহাসন অধিকার করেননি। পক্ষান্তরে, কালিদাস যে শুঙ্গ-গ্রিক সংঘর্ষের কথা বলেছেন, সেখানে কিন্তু শুঙ্গদেরই আক্রমণকারীর ভূমিকা। এই সংঘর্ষ যখন ঘটে, তখন পুষ্যমিত্রের পৌত্র বসুমিত্র বয়সে যথেষ্ট পরিণত। শুঙ্গ সেনাবাহিনী তিনিই পরিচালনা করেন। গ্রিকদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ সম্ভবত পুষ্যমিত্রের রাজত্বের একেবারে অন্তিমপর্বে ঘটেছিল। ধনদেবের অযােধ্যা শিলালেখে পুষ্যমিত্রকে ‘দ্বিরশ্বমেধযাজী’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি দুটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। মহাভাষ্যে পতঞ্জলি বলেছেন তিনি এবং তার সহযােগীরা পুষ্যমিত্রের জন্য একটি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করছেন। ‘ইহ পুষ্যমিত্রং যাজয়ামঃ’। যজ্ঞটি আরম্ভ হয়েছে কিন্তু তখনও সমাপ্ত হয়নি। এটি সম্ভবত পুষ্যমিত্রের দ্বিতীয় অশ্বমেধ যজ্ঞ ছিল। যজ্ঞটির সমাপ্তি ঘটে যবনদের বিরুদ্ধে বসুমিত্রের বিজয়লাভের পর। যজ্ঞসেনের বিরুদ্ধে জয়লাভের পর তিনি প্রথম যজ্ঞটির আয়ােজন করেছিলেন বলে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মৌর্য আমলের শেষের দিকে যবনেরা ভারত আক্রমণ করলে সেনাপতি পুষ্যমিত্র সে আক্রমণ প্রতিহত করেন। পরে সিংহাসনে বসে নিজের পূর্ব কৃতিত্বের স্মরণে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। 

খারবেল ও সাতকর্ণির সাথে যুদ্ধ নিয়ে ভুল ধারণা : কলিঙ্গাধিপতি খারবেল তার হাথীগুম্ফা লেখে বৃহস্পতিমিত্র নামে মগধের জনৈক রাজার বিরুদ্ধে জয়লাভের দাবি করেছেন। বৃহস্পতিমিত্র এবং পুষ্যমিত্রকে একই ব্যক্তি বলে কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল সনাক্ত করেছেন। এই মত বর্তমানে পরিত্যক্ত হয়েছে। সাধারণত মনে করা হয়, খারবেল পুষ্যমিত্রের প্রায় এক শতাব্দী কাল পর আবির্ভূত হয়েছিলেন। ইংরেজ পণ্ডিত র‍্যাপসন মনে করেন, সাতবাহন রাজা প্রথম সাতকর্ণি পুষ্যমিত্রকে পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু প্রথম সাতকর্ণি পুষ্যমিত্রের প্রায় শতাব্দী কাল পর আবির্ভূত হয়েছিলেন। সে কারণে এই মতও গ্রহণ করা যায় না।

রাজ্যের বিস্তৃতি : পুষ্যমিত্রের রাজ্যটি আকারে বেশ বড়ই ছিল। পাটলিপুত্র, অযােধ্যা এবং বিদিশা তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দিব্যাবদান এবং তারনাথের সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, পাঞ্জাবের জলন্ধর ও শাকল বা শিয়ালকোট তার রাজ্যভুক্ত ছিল। জৈন লেখক মেরুতুঙ্গ পুষ্যমিত্রকে অবন্তিরাজ বলে বর্ণনা করেছেন। এর থেকে মনে হয়, পুষ্যমিত্রের আধিপত্য অবন্তি অঞ্চলেও সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। বাংলা, কলিঙ্গ এবং উত্তর অন্ধ্র মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব অঞ্চলে পুষ্যমিত্রের কর্তৃত্বের সপক্ষে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। বিদিশায় শুঙ্গ আধিপত্য বহাল ছিল। সে অঞ্চলের শাসনভার পুত্র অগ্নিমিত্রের ওপর ন্যস্ত ছিল। পরিবারের আর একজনের হাতে কোসলের শাসনভার অর্পিত হয়। অগ্নিমিত্রের শ্যালক বীরসেন নর্মদা তীরবর্তী সীমান্ত অঞ্চলে দুর্গাধ্যক্ষ ছিলেন। পূর্বে বিহার থেকে পশ্চিমে পাঞ্জাব এবং দক্ষিণে বেরার পর্যন্ত সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন পুষ্যমিত্র। 

বৌদ্ধ বিদ্বেষ : প্রাচীন বৌদ্ধ লেখকেরা পুষ্যমিত্রের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের প্রতি বিদ্বেষের অভিযােগ এনেছেন। তারনাথ স্পষ্ট অভিযােগ করেছেন শুঙ্গরাজ পাটলিপুত্রের সুবিখ্যাত কুক্‌কুটারাম বিহারটি ধবংস করতে উদ্যত হন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভয় পেয়ে সে অপচেষ্টা হতে বিরত হন। দিব্যাবদানে বলা হয়েছে, তিনি পাটলিপুত্র থেকে শাকলের পথে প্রচুর স্তুপ ধবংস করেন, অসংখ্য বিহার ভস্মীভূত করেন এবং বহু শ্রমণের প্রাণ সংহার করেন। এ গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে, প্রতি ভিক্ষুর মাথাপিছু তিনি এক শত স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘােষণা করেন। পুষ্যমিত্রের বিরুদ্ধে যে নির্যাতনের অভিযােগ বৌদ্ধ লেখকেরা করেছেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। পুষ্যমিত্র যে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন, সে সম্পর্কে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। তার ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রীতির জন্যই তিনি সম্ভবত বৌদ্ধদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। বিধর্মী রাজগণের প্রতি বৌদ্ধ লেখকেরা প্রায়ই বিরূপ মনােভাব প্রকাশ করেছেন। পুষ্যমিত্রের ক্ষেত্রেও সম্ভবত তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পুষ্যমিত্র, তথা শুঙ্গ রাজারা যে বৌদ্ধধর্মবিদ্বেষী ছিলেন, তার কোনও বিশ্বাসযােগ্য প্রমাণ নেই। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, ভারহুতের জগৎ বিখ্যাত স্থূপটি শুঙ্গ রাজাদের আমলেই নির্মিত হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন, পাঞ্জাবের বৌদ্ধরা গ্রিকদের পক্ষে যােগদান করে পুষ্যমিত্রের বিরাগভাজন হন। কিন্তু এরূপ ধারণার কোনও ভিত্তি নেই।

পুষ্যমিত্রের উত্তরাধিকারিগণ

অগ্নিমিত্র থেকে বসুমিত্র : প্রায় ৩৬ বছর সগৌরবে রাজত্ব করার পর পুষ্যমিত্রের মৃত্যু হলে তার পুত্র অগ্নিমিত্র পিতৃ-সিংহাসনে আরােহণ করেন। অগ্নিমিত্রের পর যথাক্রমে সুজ্যেষ্ঠ বা বসুজ্যেষ্ঠ এবং বসুমিত্র বা সুমিত্র রাজপদ লাভ করেন। যৌবনে গ্রিকদের হারিয়ে যিনি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন সেই বসুমিত্র শাসকরূপে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দেন। রাজ্য পরিচালনা অপেক্ষা বিলাসব্যসনের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল বেশি। এ সুযােগে মূলদেব নামে জনৈক রাজপুরুষ তাকে হত্যা করেন।

ভদ্রক : তারপর রাজা হলেন ভদ্রক। তিনি পুরাণে অন্ধ্রক, অন্তক, আর্দ্রক এবং ওদ্রুক নামেও অভিহিত হয়েছেন।  এলাহাবাদের নিকট পভোসা গ্রামে আষাঢ়সেন নামে জনৈক স্থানীয় রাজা বা প্রশাসকের দু’খানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর একখানি লেখে উদাক নামে একজন রাজার কথা বলা হয়েছে। আষাঢ়সেন উদাকের অধীনস্থ ছিলেন। অনেকে উদাক এবং ভদ্রককে এক ও অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু সাধারণত আষাঢ়সেনকে ভদ্রকের পরবর্তী বলে গণ্য করা হয়। ভদ্রকের রাজত্বকালে একখানি লেখ মধ্যপ্রদেশের বেসনগরে পাওয়া গেছে। এই লেখটি হেলিওডােরাস নামে একজন গ্রিক দূত উৎকীর্ণ করেছিলেন। ভদ্ৰককে কাশীপুত্র ভাগভদ্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হেলিওডােরাস গ্রিকরাজ এন্টিয়ালকিডাসের প্রতিনিধিরূপে শুঙ্গরাজের কাছে এসেছিলেন তার রাজত্বের চতুর্দশ বছরে। ঘটনাকাল আনুমানিক ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। পুরাণ থেকে জানা যায়, প্রথম চারজন শুঙ্গ রাজা সর্বসমেত ৬১ বছর রাজত্ব করেন। তাহলে পঞ্চম শুঙ্গরাজ ভদ্রক বা ভাগভদ্র পুষ্যমিত্রের সিংহাসনে আরােহণের ৬১ বছর পর রাজপদ গ্রহণ করেছিলেন। পুষ্যমিত্র সম্ভবত ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। সেক্ষেত্রে ১২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভদ্রক সিংহাসনে বসেছিলেন, এরূপ ধারণা সমীচীন বােধ হয়। ভদ্রক বা ভাগভদের রাজত্বের চতুর্দশ বছরে অর্থাৎ আনুমানিক ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হেলিওডোরাস যবনরাজ এন্টিয়ালকিডাসের দূতরূপে বিদিশায় এসেছিলেন। যাই হোক, এই উপলক্ষে ভদ্রক বেসনগরে তার আরাধ্য দেবতা বাসুদেবের উদ্দেশ্যে একটি গরুড়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করেন। এই লেখ থেকে একদিকে যেমন শুঙ্গদের সঙ্গে গ্রিকদের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা জানা যায়, অন্যদিকে তেমনি পদস্থ, কৃষ্টিসম্পন্ন গ্রিকদের ভারতীয় ধর্মের প্রতি অনুরাগও প্রমাণিত হয়।

ভাগবত ও দেবভূতি : ভদ্রকের পর পুলিন্দক, ঘােষ এবং বজ্ৰমিত্র ক্রমান্বয়ে সিংহাসনে আরােহণ করেন। তাতে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এই বংশের নবম রাজা ভাগবত। তার দ্বাদশ রাজ্যর উৎকীর্ণ একখানি গরুড়স্তম্ভ লেখ বেসনগরের নিকটবর্তী ভিলসা গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। গৌতমীপুত্র নামে জনৈক ব্যক্তি এই স্তম্ভটি নির্মাণ করেন। অনেকে অবশ্য হেলিওডােবাসের লেখখানিকেও ভাগবতের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু হেলিওডােরাসের লেখে যে শুঙ্গরাজের উল্লেখ আছে, তিনি ভাগভদ্র, ভাগবত নন। বেসনগর ও ভিলসা দু’টি পাশাপাশি গ্রাম। প্রায় একই স্থানের সমকালীন দুটি লেখে একই রাজা দু’টি ভিন্ন নামে উল্লিখিত হবেন, তা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। ঠিক এই কারণেই ভিলসার ভাগবতকে বেসনগরের ভাগভদ্র বা পঞ্চম শুঙ্গরাজ ভদ্রকের সাথে এক ও অভিন্ন বলে মনে করা যায় না। ভাগবতের উত্তরাধিকারী দেবভূতি বা দেবভূমি। কামাসক্ত এই রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন তারই ব্রাহ্মণ মন্ত্রী বসুদেব। মন্ত্রীর প্ররােচনায় এক দাসীকন্যার হাতে নিহত হন দেবভূতি (আনুমানিক ৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।

শুঙ্গ বংশের পতন ও কাণ্ব বংশের উদ্ভব : দেবভূতির হত্যার সঙ্গে সঙ্গে শুঙ্গ রাজবংশের উচ্ছেদ ঘটেনি। অন্তত আরও কিছুকাল যে শুঙ্গরা রাজত্ব করেছিলেন, পুরাণে তার প্রমাণ আছে। তবে তারা কোন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন, বা তাদের সঙ্গে বসুদেব ও তার কাণ্বায়ন বংশধরদের কীরূপ সম্পর্ক ছিল, সে বিষয়ে পুরাণের সাক্ষ্যে বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। পুরাণে বসুদেবের বংশকে গােত্রের নামে কাণ্ব বা কাণ্বায়ন আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বসুদেব এবং তার পুত্র, পৌত্র ও প্রপৌত্র অর্থাৎ ভূমিমিত্র, নারায়ণ এবং সুশর্মা সর্বসমেত ৪৫ বছর রাজত্ব করেছিলেন (আ. ৭৫-৩০ খ্রি.পূ.)। এর থেকে মনে হতে পারে, দেবভূতির হত্যার পর কাণ্ব রাজারা সমগ্র শুঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর হন। কিন্তু এ ধারণা অমূলক, কেননা প্রথমত, বসুদেবসহ কাণ্বদের পুরাণে শুঙ্গভৃত্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক কাণ্বরাজ সুশর্মা এবং অবশিষ্ট শুঙ্গদের পরাভূত করেন বলে পুরাণে বলা হয়েছে। অর্থাৎ কাণ্ব এবং পরবর্তী শুঙ্গরা একই সময়ে রাজত্ব করতেন। পৌরাণিক সাক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে দু’টি সিদ্ধান্ত করা যায় – এক. দেবভূতি নিহত হলে তার বংশধরেরা রাজা হন কিন্তু তারা নামেই রাজা ছিলেন। রাজ্যের প্রকৃত কর্তৃত্ব ছিল বসুদেব এবং তার পুত্র-পৌত্রদের হাতে। এ যেন শিবাজীর দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলের মারাঠা রাজ্য। রাজ্যের সর্বময় কর্তা পেশবা, রাজা নিছক ক্রীড়নক। আর দুই. দেবভূতিকে হত্যা করে বসুদেব শুঙ্গরাজ্যের একাংশে স্বাধীন কাণ্ব রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। বাকি অংশে দেবভূতির বংশধরেরা রাজত্ব করেন। এই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটিকেই অধিকতর গ্রহণীয় বলে মনে হয়।

কাণ্ব রাজবংশ (৭৫-৩০ খ্রি.পূ.) 

দেবভূতিকে নিহত করে যিনি কাণ্ব বা কাণ্বায়ন রাজ্য স্থাপন করেন, তিনি বসুদেব। তিনি মাত্র ৯ বছর রাজত্ব করেন। বসুদেবের পর রাজা হন তার পুত্র ভূমিমিত্র। তিনি ১৪ বছর রাজত্ব করেন। ভুমিমিত্রের পর তার পুত্র নারায়ণ পৈতৃক সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার রাজত্ব ১২ বছর স্থায়ী হয়। এই বংশের সর্বশেষ নরপতি সুশর্মা। তিনি নারায়ণের পুত্র ছিলেন এবং মাত্র ১০ বছর রাজত্ব করেন। 

কাণ্ব রাজগণ সম্পর্কে সব তথ্যই মূলত পুরাণ থেকে আহুত। পুরাণে কাণ্ব রাজগণকে ‘শুঙ্গভৃত্য’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রথম কাণ্বরাজ বসুদেব শুঙ্গদের একজন মন্ত্রিরূপে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন বলেই হয়তাে কাণ্বদের ‘শুঙ্গভৃত্য’ বলা হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন, রাজা হলেও কারা শুঙ্গদের নামেই রাজ্য পরিচালনা করতেন। এই ধারণার মূলে কোনও ভিত্তি নেই। কাণ্ব রাজগণ সর্বসমেত মাত্র ৪৫ বছর রাজত্ব করেন। দক্ষিণ ভারতীয় ‘অন্ধ্রভৃত্য’ বা অন্ধ্রগণের আক্রমণের ফলে তাদের রাজত্বের অবসান হয়।

কাণ্বগণ কোন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন সে সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকে পাটলিপুত্র ও সন্নিহিত অঞ্চলে কাণ্বরাজ্যের অবস্থান নির্দেশ করেছেন। কিন্তু যাদের বিতাড়িত করে কাণ্বরা রাজপদ লাভ করেন, সেই পরবর্তী শুঙ্গরা মধ্য ভারতেই রাজত্ব করতেন, পাটলিপুত্র বা মগধে নয়। রাজস্থানের পূর্বাঞ্চলও সম্ভবত পরবর্তী শুঙ্গ রাজগণের রাজ্যভুক্ত ছিল। আজমীঢ় জেলার বারলি গ্রামে পাওয়া একখানি ভগ্ন শিলালেখে ভাগবত নামে জনৈক রাজার উল্লেখ আছে (Bela Lahiri, Indigenous States Of Northern India (Calcutta, 1974), পৃষ্ঠা ৫৫)। তিনি সম্ভবত নবম শুঙ্গরাজ ভাগবত। দ্বিতীয়ত, অন্ধ্রভৃত্যরা কখনও মগধ অধিকার করেননি কিন্তু মধ্য ভারত জয় করেছিলেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, মগধে নয়, মধ্য ভারতের বিদিশা অঞ্চলেই কাণ্বরা রাজত্ব করতেন। রাজস্থানের আজমীঢ় অঞ্চলে তখনও সম্ভবত দেবভূতির বংশধরেরা রাজত্ব করতেন।

শুঙ্গ-কাণ্ব যুগের সামাজিক জীবন

শুঙ্গ-কাণ্ব যুগের সামাজিক জীবন প্রতিফলিত হয়েছে পতঞ্জলির মহাভাষ্যে। এ সময় ব্রাহ্মণদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা সন্দেহাতীতভাবে বৃদ্ধি পায়। এর প্রধান কারণ হল, শুঙ্গ ও কাণ্ববংশীয় রাজারা সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলেন। সন্দেহ নেই, স্বাধ্যায় ব্রাহ্মণদের প্রধান উপজীবিকা হলেও অনেকেই যুদ্ধবিদ্যা, প্রশাসন ইত্যাদি ভিন্নতর বৃত্তিও গ্রহণ করেছিলেন। শস্ত্রোপজীবী ব্রাহ্মণেরা সাধারণত দলবদ্ধভাবে বসবাস করতেন। সমাজে তাদের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না, শিক্ষাদীক্ষার অভাবে বা অন্য কোনও কারণে স্বধর্ম হতে বিচ্যুত হয়ে ব্রাহ্মণ শূদ্রের বৃত্তিও গত করতেন। মহাভাষ্যে এই শ্রেণির ব্রাহ্মণদের কর্মে শূদ্র বলা হয়েছে। ক্ষত্রবিদ্যা ও ধনােৎপাদন মহাভাষ্যে যথাক্রমে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের উপজীবিকারূপে বর্ণিত হয়েছে। যেসব ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য শূদ্রের বৃত্তি গ্রহণ করতেন, মহাভাষ্যে তাদের কর্মে শূদ্র আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

শূদ্রদের মধ্যে বেশির ভাগই জন্মসূত্রে শূদ্র। তারা শূদ্র পিতামাতার সন্তান। শূদ্রদের নানা জাত ধীবর, আভীর, রথকার, তন্তুবায়, কুম্ভকার, নাপিত, ত্বষ্টা, কর্মকার, অয়স্কার, রজক, চর্মকার, চণ্ডাল, শক, যবন, কিষ্কিন্ধ, শৌর্য, ক্রৌঞ্চ ইত্যাদি। মর্যাদায় তার সমগােত্রীয় নন। কেউ নিম্ন, কেউ মধ্যম, কেউবা উচ্চ। নিম্ন যারা, তারা যাগযজ্ঞে অনধিকারী, আর্যদের সঙ্গে পঙক্তি ভােজনের অযােগ্য। তারা অস্পৃশ্য, নিরবসিত। গ্রামের বাইরে তাদের বাস। মধ্যম যারা, তাদের যাগযজ্ঞে অধিকার ছিল না ঠিকই, কিন্তু তারা অস্পৃশ্য নন। রজক, কর্মকার, তন্তুবায়রা ছিলেন এই শ্রেণিতে। চণ্ডাল বা মৃতপদের মতাে তাদের অস্পৃশ্যতার গ্লানি বহন করতে হত না। তারা অনিরবসিত শূদ্র। শক-যবনেরা ছিলেন উচ্চ শ্রেণিভুক্ত শুদ্র। তারা আর্য অধ্যুষিত এলাকায় বাস করতেন, যাগযজ্ঞের অধিকারী ছিলেন, এবং আর্যদের সঙ্গে একাসনে আহার গ্রহণের অধিকারী ছিলেন। স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে, গ্রিক, শক প্রভৃতি যেসব বিদেশি জাতি ভারতে আগমন করেছেন, ভারতকেই তারা তাদের স্বদেশ বলে মনে করেছেন, আর্য সংস্কৃতিকে স্বীকার করে নিয়েছেন, শূদ্র নাম দিয়ে পতঞ্জলি তাদের সকলকে ব্রাহ্মণ্য বর্ণব্যবস্থার পরিকাঠামাের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। বৈদেশিকগণের ভারতীয় করণের মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজজীবনে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেল।

অভক্ষ্যভােজী ও মদ্যপ বৃষলদের উল্লেখ করেছেন পতঞ্জলি। তারা দস্যু, চোর এবং দাসদের পর্যায়ভুক্ত বলে বর্ণিত হয়েছেন। সাধারণত, দেবদেবীর অনুকরণে ব্রাহ্মণদের নামকরণ হত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা যথাক্রমে বর্মান্ত এবং পালিতান্ত বা গুপ্তান্ত নাম গ্রহণ করতেন। মায়ের নাম থেকেও অনেক সময় সন্তানের নামকরণ হত। এ ধরনের নামকরণে পরিবারে সপত্নীপ্রথার আভাস আছে। পুরুষের একাধিক পত্নীগ্রহণে কোনও বাধা ছিল না। একই স্বামীর আটজন পত্নীর সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে মহাভাষ্যে। সেযুগে স্ত্রীশিক্ষার সাধারণ মানের অবনতি ঘটলেও সমাজে উচ্চশিক্ষিতা মহিলাও ছিলেন। তারা অধ্যাপনার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। অস্ত্রবিদ্যায় যে মহিলারা পটিয়সী ছিলেন, পতঞ্জলি তার উল্লেখ করেছেন। ভারহুতের ভাস্কর্যেও অশ্বারােহী এক নারীসেনার প্রতিকৃতি অঙ্কিত আছে। মেয়েদের অনেক সময় বেশি বয়সে বিবাহ হত। আজীবন কুমারী থাকতেন, এমন মহিলাও একেবারে বিরল ছিলেন না। সভাসমিতিতে মহিলাদের যােগদান বাঞ্ছিত ছিল না। পুরুষদের উপপত্নী, কুমারীদের ভ্রূণহত্যা বা গর্ভধারণ, বিবাহিত মহিলার অবৈধ প্রণয় প্রভৃতি ঘটনার উল্লেখ আছে মহাভাষ্যে। এসব ঘটনায় সেযুগের সামাজিক জীবনের অবক্ষয়ের ছবিই ফুটে উঠেছে। তখনকার দিনে চিত্তবিনােদনের নানা উপকরণ ছিল। লাঠি খেলা, মুষ্টিযুদ্ধ, মৃগয়া, উপবন বিহার, কুস্তি, পাশাখেলা ইত্যাদি বিবিধ অনুষ্ঠানের আয়ােজন হত। নাট্যাভিনয় দেখতে দর্শকেরা প্রেক্ষাগৃহে সমবেত হতেন। শােভনিক নামে এক শ্রেণির মূকাভিনেতার উল্লেখ করেছেন পতঞ্জলি।

শুঙ্গ-কাণ্ব যুগের অর্থনৈতিক জীবন

মুদ্রা উৎকীর্ণকরণ : শুঙ্গ ও কাণ্ব বংশীয় নরপতিরা তাম্রমুদ্রা প্রচলন করেছিলেন বলে কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল প্রমুখ অনেক পণ্ডিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিমিত্র, ভদ্রঘােষ, জ্যেষ্ঠমিত্র এবং ভূমিমিত্রের নামাঙ্কিত তাম্রমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকেই এই সব রাজাদের শুঙ্গ ও কাণ্ববংশীয় নরপতিরূপে সনাক্ত করেছেন। নানা কারণে এই মত গ্রহণযােগ্য নয়। প্রথমত, এই ধরনের মুদ্রায় এমন অনেক রাজার নাম আছে, পুরাণের শুঙ্গ ও কাণ্ব রাজবংশের তালিকায় যাদের কোনও উল্লেখ নেই। তারা শুঙ্গ ও কাণ্ব বংশের রাজা হলে পুরাণে তাদের অবশ্যই উল্লেখ থাকত। দ্বিতীয়ত, উল্লিখিত নৃপতিরা শুঙ্গ বা কাণ্ববংশীয় হলে তাদের মুদ্রা মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানেই পাওয়া যেত। কিন্তু লক্ষ করবার বিষয়, এই মুদ্রাগুলোর বেশির ভাগই উত্তরপ্রদেশে পাওয়া গেছে। রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশে এ ধরনের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়নি। তৃতীয়ত, অগ্নিমিত্র ইত্যাদির নামাঙ্কিত মুদ্রাগুলোর কোনওটিই খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের পূর্ববর্তী নয়। এই মুদ্রাগুলোতে যে সকল মিত্র-নামান্ত রাজার নাম অঙ্কিত আছে তারা সম্ভবত অযােধ্যা, কৌশাম্বী, মথুরা, পাঞ্চাল প্রভৃতি বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় রাজা ছিলেন। মুদ্রাগুলোর বৈশিষ্ট্য ও প্রাপ্তিস্থান থেকে মনে হয় এই ‘মিত্র’ রাজারা বিভিন্ন বংশের লােক ছিলেন, তাদের রাজ্যও ছিল বিভিন্ন (তদেব, পৃষ্ঠা ১৯২-১৯৩)। 

কৃষি : পূর্ববর্তী যুগের মতাে এই পর্বেও অর্থনীতির মূল বুনিয়াদ ছিল কৃষি। কিন্তু মৌর্যযুগের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের যে কঠোর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু ছিল, এপর্বে তা বহাল ছিল বলে মনে হয় না। অন্তত সমকালীন সাক্ষ্যে তার আভাস নেই। এর ফলে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি অর্থনৈতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পুনরুত্থান ঘটে। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে যেমন, পতঞ্জলির মহাভাষ্যেও তেমনি কৃষ্টপচ্য ও অকৃষ্টপচ্য এই দু’ধরনের ফসলের উল্লেখ আছে। চাষ করা হয়নি এমন জমিতে অর্থাৎ অকর্ষিত বা জংলা ভূমিতে আপনা-আপনি যে ফসল জন্মায় তা অকৃষ্টপচ্য। নীবার এই জাতীয় ফসল। আর জমি চাষ করে বা জমিতে বীজ বপণ করে যে ফসল ফলানাে হয়, তাই কৃষ্টপচ্য। খাদ্যানু, ডাল, পাট, কার্পাস ও ইক্ষু এই শ্রেণিতে পড়ে। জলের জন্য প্রধানত বৃষ্টির উপরই নির্ভর করা হত। কখনও নদী থেকে, কখনওবা কূপ খনন করে নালার সাহায্যে খেতে জলসেচের ব্যবস্থা করা হত। ফসল চুরি যাওয়ার ভয় যেমন ছিল, পশু-পাখিও তেমনি ফসল বিনষ্ট করত। তিন প্রকার ধানের কথা মহাভাষ্যে বলা হয়েছে : ব্রীহি, শালি ও যষ্টিক। মদ্র ও উশীনর অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে যব জন্মাত। মহাভাষ্যে উল্লিখিত অন্যান্য কৃষিজ দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে মুগ, জৈ, তিল, মাষ কলাই, পাট, তিসি, জোয়ার, বাজরা, অড়হর, সরষে, মটর লাউ, কার্পাস ইক্ষু, মুলাদি এবং চিনি বা শর্করা।

শিল্প ও বাণিজ্য : কারিগরি শিল্পের ব্যাপক প্রসার এই যুগের অর্থনৈতিক জীবনের এক উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। এই পর্বের এক প্রধান শিল্প বস্ত্রশিল্প। মহাভাষ্যে কার্পাসবস্ত্র ছাড়া রেশমি এবং ঔর্ণবস্ত্রেরও উল্লেখ আছে। তন্তুবায় ছাড়া আর যেসব শিল্পোপজীবীদের কথা পতঞ্জলি বলেছেন, তাদের মধ্যে কুম্ভকার, দারুশিল্পী, ধনুস্কার, অয়স্কার, কর্মকার, মূর্তিকার, সুবর্ণকার, খনক ও রজকদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বণিকরা তাদের পণ্যসম্ভার নিয়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে যাতায়াত করতেন। পণ্যদ্রব্য বিক্রি হত দু’ভাবে—নগদ দামে ও বিনিময়ের মাধ্যমে। স্থল ও জল উভয় পথেই যাতায়াত চলত। স্থল পথ কত প্রকার : জঙ্গলপথ, কান্তারপথ, অজপথ, রথপথ, করিপথ, রাজপথ, সিংহপথ এবং হংসপথ। পণ্যসামগ্রীর উপর কয়েকটি কর ধার্য ছিল। এগুলো শুল্ক, আপণকর, আকরকর এবং গুল্মকর। বিভিন্ন বণিক এবং শিল্পী গােষ্ঠীর পৃথক পৃথক সংগঠন ছিল। এই সংগঠনকে মহাভাষ্যে ‘শ্রেণী’ বলা হয়েছে। 

পরিমাপ, মুদ্রা ও নগরায়ন : পরিমাপের বিভিন্ন মান প্রসঙ্গে কুডব, প্রস্থ, আটক, দ্রোণ, খারী এবং শূর্পের উল্লেখ আছে। কুডবের অর্থ অঞ্জলি। এক কুডব বা অঞ্জলি ধানের ওজন ৫ ছটাকের মতাে। ৪ অঞ্জলিতে ১ প্রস্থ। ৪ প্রস্থে ১ আটক। ১ আটক মােটামুটি ৫ সের। ৪ আঢকে ১ দ্রোণ। ৩ দ্রোণে ১ খারী। ২ দ্রোণে ১ শূর্প। রূপার তৈরি কার্ষাপণ মুদ্রা যে এই সময় বহুল প্রচলিত ছিল, পতঞ্জলির লেখায় তা প্রকাশ পেয়েছে। ভারহুতের ভাস্কর্যে জমি বিক্রয়ের এক কাহিনি প্রসঙ্গে গােল, চৌকো, আয়ত ইত্যাদি নানা আকারের কার্ষাপণ মুদ্রার ছবি অঙ্কিত হয়েছে। এতে সমকালীন যুগে জিনিসপত্রের ক্রয়বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মুদ্রার গুরুত্বই প্রকাশ পেয়েছে। এ পর্বে নগরায়ণের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে পতঞ্জলির মহাভাষ্যে। কত না নগরের নাম এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে! অহিচ্ছত্র, অবন্তি, উজ্জয়িনী, কাণ্বীপুর, কান্যকুজ, কাশী, কৌশাম্বী, মথুরা, মধ্যমিকা, মাহিষ্মতী, পাটলিপুত্র, সাকেত, সাঙ্কাশ্য, হস্তিনাপুর এবং আরও কত না নগর! 

শুঙ্গ-কাণ্ব যুগের ধর্মীয় জীবন

বৈষ্ণব মত : ব্রাহ্মণবংশীয় শূঙ্গ-কাণ্ব রাজাদের আমলে স্বাভাবিক কারণেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের অগ্রগতি হয়। এসবের অগ্রগণ্য ব্রাহ্মণ্যদেবতা হলেন বাসুদেব-কৃষ্ণ। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে লেখা তৈত্তিরীয় আরণ্যক গ্রন্থে বাসুদেব-কৃষ্ণ এবং নারায়ণ বিষ্ণু এক ও অভিন্ন দেবতারূপে কল্পিত হয়েছেন। এর থেকে মনে হয়, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকেই ভাগবত সম্প্রদায়ের অনেকে তাদের আরাধ্য দেবতা বাসুদেবকে বিষ্ণুরূপী দেবতাজ্ঞানে পূজা করতে থাকেন। বাসুদেব ও বিষ্ণুর অভেদত্ব এই পর্বে বহুল পরিচিতি লাভ করে। সমকালীন বেসনগর গরুড়স্তম্ভ লেখটি এর জাজ্বল্যমান প্রমাণ। তবে তখনও বাসুদেব ও বিষ্ণুর এই অভেদত্ব সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেনি। গুপ্তযুগে এটি ঘটল। বেসনগর গরুড়স্তম্ভ লেখে বসুদেবতনয় ‘দেবদেব’রূপে বর্ণিত হয়েছেন। এই দেবতার সম্মানে হেলিওডােরাস নামে তক্ষশিলাবাসী জনৈক গ্রিক দূত বেসনগরে একটি গরুড়স্তম্ভ নির্মাণ করেন। গরুড় বিষ্ণুর বাহন। বাসুদেবের উদ্দেশ্যে গরুড়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার অর্থ বাসুদেব ও বিষ্ণুর অভেদত্বের স্বীকৃতি। বেসনগর গরুড়স্তম্ভ লেখ হতে প্রমাণিত হচ্ছে, খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের উত্তর পর্বেই বাসুদেব আর নিছক উপাস্য বীর বা সাধারণ দেবতা মাত্র নন; তিনি ভগবানের ভগবান। আর শুধু ভারতীয়রা নন, অভিজাত গ্রিকরাও তার ভক্ত। বাসুদেবের ভক্ত হেডিওডােরাস এই উচ্চবিত্ত গ্রিকদের একজন। কেশব বা বাসুদেবকৃষ্ণের মন্দিরের উল্লেখ আছে পতঞ্জলির মহাভাষ্যে। এসব মন্দিরে যন্ত্রসংগীতের আসর বসার কথাও পতঞ্জলি বলেছেন। রাম অর্থাৎ বলরাম বা সংকর্ষণের মন্দিরেরও উল্লেখ আছে তার গ্রন্থে। পতঞ্জলির একটি উক্তি থেকে মনে হয়, বাসুদেবের পূজার সঙ্গে সংকর্ষণের পূজাও একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হত। হেলিওডােরাসের লেখে সংকর্ষণের উল্লেখ নেই। মনে হয়, সে সময় বাসুদেব-সংকর্ষণের যুগপৎ পূজার রীতি সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করেনি। লক্ষ্ণৌ সংগ্রহালয়ে সংরক্ষিত খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের একটি মূর্তিকে অনেকে সংকর্ষণের মূর্তি বলে শনাক্ত করেছেন। 

শৈবমত : এ সময় রুদ্রের জনপ্রিয়তাও কিছু কম ছিল না। পতঞ্জলির যােগসূত্রে রুদ্রকে এক ও অদ্বিতীয় দেবতারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। একো হি রুদ্রঃ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের তিনি কর্তা। সৃষ্টি ও স্থিতির কাজে যেমন তার মঙ্গলময় রূপের প্রকাশ, ধ্বংসের মধ্যে তেমনি তার সংহার লীলার অভিব্যক্তি। মৌর্যযুগে রচিত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে রুদ্র ও শিবকে অভিন্ন কল্পনা করা হয়েছে। পতঞ্জলির যােগসূত্রের মতাে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে রুদ্রকে একেশ্বররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি ঈশ্বরগণের মধ্যে পরম মহেশ্বর, দেবতাগণের মধ্যে পরম দেবতা, বিশ্বকে তিনি সৃষ্টি করেন, অনেক রূপ তিনি ধারণ করেন। পতঞ্জলি যেমন রুদ্রের উল্লেখ করেছেন, তেমনি শিবেরও উল্লেখ করেছেন কিন্তু তিনি তাদের ভিন্ন দেবতারূপে বর্ণনা করেছেন। মনে হয়, দেশের অনেক স্থানে রুদ্র ও শিবের উপাসকেরা এক সম্প্রদায়ে মিশে গেলেও কয়েকটি অঞ্চলে তারা দু’টি স্বতন্ত্র গােষ্ঠী রূপেই অবস্থান করছিলেন। শিব-ভাগবত নামে এক শ্রেণির শৈব সাধকদের উল্লেখ আছে মহাভাষ্যে। তাদের হাতে থাকত লৌহশুল ও দণ্ড, মাথায় জটা আর পরনে পশুচর্ম। তারা উগ্র স্বভাবের ছিলেন। মহাভাষ্যে বলা হয়েছে, কংসবধ নাটকের অভিনয়কালে দর্শকরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়তেন – একদল হতেন কৃষ্ণের অনুরাগী, অন্যদল কংসের সমর্থক। কংস ছিলেন শিবের ভক্ত। মহাভারতেও বাসুদেবের সঙ্গে শিবভক্ত শিশুপালের বিরােধের উল্লেখ আছে। মনে হয়, সে সময় শৈব ও ভাগবতদের মধ্যে কখনও কখনও বিরােধ ও সংঘর্ষ ঘটত।

বৌদ্ধ ধর্ম : শুঙ্গ ও কাণ্ব বংশের ব্রাহ্মণ রাজারা বৌদ্ধধর্মের অনাদর করেছেন, এরূপ এক মত বর্তমানে অনেক ঐতিহাসিক পােষণ করেন। তারা দিব্যাবদান ও তারনাথের বিবরণে বর্ণিত পুষ্যমিত্রের বৌদ্ধবিদ্বেষের কাহিনিগুলোকে সত্য ঘটনা বলে গ্রহণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, বিধর্মী রাজাদের আলােচনায় প্রাচীন বৌদ্ধ লেখকরা প্রায়ই আক্রমণাত্মক মনােভাব প্রকাশ করেছেন। ফলে পুষ্যমিত্র প্রকৃতই বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। তবে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বৌদ্ধদের সম্পর্ক যে খুব সৌহার্দপূর্ণ ছিল, তা বলা যায় না। মহাভাষ্যে এই দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্ককে কাক ও পেঁচার শাশ্বত বিরােধের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। শুঙ্গ-কাণ্ব যুগে যে বৌদ্ধধর্মের অগ্রগতি অব্যাহত ছিল, তার প্রমাণ ভারহুত ও সাঁচীর প্রধান দু’টি স্তুপ। গণ উদ্যোগের সঙ্গে রাজশক্তি, তথা রাষ্ট্রের সহযােগিতা না হলে এরূপ বিরাট আকারের স্তূপ নির্মাণ সম্ভব হত না। ভারহুতের স্তুপবেষ্টনী বা তােরণে কোনও বুদ্ধমূর্তি উৎকীর্ণ হয়নি, বুদ্ধের পরিবর্তে বােধিবৃক্ষ, ধর্মচক্র প্রভৃতি প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। সন্দেহ নেই, বুদ্ধের মূর্তিপূজা তখনও চালু হয়নি; উপাসকেরা সাধারণত স্তুপ প্রদক্ষিণ ও স্তূপপূজার মাধ্যমে উপাস্য দেবতার উদ্দেশ্যে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতেন।

শুঙ্গ-কাণ্ব যুগের স্থাপত্য-ভাস্কর্য ও সাহিত্য

দরবারি শিল্পের বদলে শিল্পীর স্বাধীনতা : ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ইতিহাসে শুঙ্গ-কাঘ যুগ এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়। পূর্ববর্তী মৌর্যযুগে শিল্পকলা বিকাশ লাভ করেছিল মূলত রাজা-রাজড়াদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করে। সেযুগের শিল্পী কাজ করেছেন রাষ্ট্রীয় নির্দেশে ও রাষ্ট্রের অনুপ্রেরণায়। ফলে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও ধ্যান-ধারণাকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার বিশেষ সুযােগ তার ছিল না। কিন্তু শুঙ্গ-কাণ্ব যুগে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটল, শিল্পী তার স্বাধীনতা ফিরে পেলেন, তিনি শিল্পকর্মে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও ধ্যানধারণাকে রূপায়িত করলেন। শুঙ্গ-কাণ্ব যুগের শিল্প আর দরবারি শিল্প রইল না – সে সমকালীন সমাজ-জীবনের দর্পণ হয়ে দেখা দিল। যে অত্যাশ্চর্য মসৃণ মৌর্যশিল্পের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য, শুঙ্গ কাণ্ব শিল্পে তার কোনও আভাস নেই। কিন্তু মৌর্যযুগের দরবারি শিল্পে যে ভাবনার প্রতিফলন নেই, সেই সামাজিক ভাবনার পূর্ণ রূপায়ণ ঘটেছে শুঙ্গ-কাণ্ব যুগের শিল্পকলায়। দরবারি মৌর্যশিল্পীরা এক কল্পলােকে বিচরণ করেছেন। রাজশক্তি তথা রাষ্ট্রের নির্দেশেই এই কল্পলােকের রূপকল্পনা। কিন্তু শুঙ্গ-কাণ্ব যুগের শিল্পীরা অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে মনুষ্যলােকে বিহার করেছেন, মানুষের ধ্যানধারণা, আচার-আচরণ, ধর্মবিশ্বাস ও দৈনন্দিন জীবনের এক শিলীভূত ভাষ্য রচনা করেছেন। শুঙ্গ কাণ্ব শিল্পের আবেদন অনেক ব্যাপক, অনেক গভীর, অনেক অর্থবহ।

ভারহুত স্তুপ : ভারহুত স্তুপ নিঃসন্দেহে এই যুগের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য কীর্তি। এই স্থূপটি বর্তমানে বিলুপ্ত, তবে অনুমান করা যায় তলদেশে গােলাকার ‘বেদি’, মধ্যিখানে অর্ধ গােলাকার ‘অণ্ড’ এবং উপরে বর্গক্ষেত্রাকার ‘হর্মিকা’ এই নিয়েই ছিল ভারহুত স্থূপ। হর্মিকার চারদিক ঘিরে থাকত এক বেষ্টনী। হর্মিকার মাঝখানে একটি দণ্ডে এক বা একাধিক গােল ছত্র বিরাজ করত। ভক্তদের স্তুপ পূজার সুবিধার জন্য অণ্ডের চারদিকে বেষ্টন করে থাকত প্রদক্ষিণ-পথ। স্তূপের চারদিকে ছিল পাথরের এক বেষ্টনী, আর এক এক দিকে একটি করে তােরণ। স্তূপবেষ্টনী এবং তােরণ প্রচুর কারুকার্যে মণ্ডিত। স্তূপতােরণের গঠনাকৃতি অভিনব। দু’টি দণ্ডায়মান স্তম্ভের মাথায় তিনটি পাথরের ফলক সমান্তরালভাবে যুক্ত থেকে তােরণটিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। স্তম্ভ দু’টির শীর্ষদেশে একটি করে প্রস্তরের আচ্ছাদক ফল আছে। প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পে এদের ‘উষ্ণীষ’ বলে। স্তম্ভ দু’টির মধ্যবর্তী সমান্তরাল ফলক তিনটির নাম ‘সূচি’। স্তুপবেষ্টনী ও তােরণগুলোকে একটু লক্ষ করলেই বােঝা যায়, এগুলো আগেকার যুগের কাঠের বেষ্টনী ও কাঠের তােরণের আদলে নির্মিত হয়েছে। ভারহুত স্তূপবেষ্টনী ও স্তূপতােরণের কিছু অংশ কোলকাতার ভারতীয় সংগ্রহশালায় এবং এলাহাবাদের পৌর সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। পূর্ব তােরণে উৎকীর্ণ একখানি লেখ হতে জানা যায়, স্তুপটি শুঙ্গ রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। 

সাঁচীর বৃহত্তম স্তূপ : আজ যেটি সাঁচীর বৃহত্তম স্তূপ, অশােকের সময় সেটি ইট দিয়ে ক্ষুদ্রাকারে নির্মিত হয়েছিল। সম্ভবত শুঙ্গ রাজত্বে এটিকে পাথর দিয়ে সজ্জিত করা হয়, এর আকারও দ্বিগুণ হয়। কিন্তু তখন এর বেষ্টনী ও তােরণ তৈরি হয়নি। সাঁচীর দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থূপটিও সম্ভবত এই পর্বে নির্মিত হয়। খ্রিস্টীয় ১ম শতকের সূচনা নাগাদ বােধগয়ার স্তুপটি নির্মিত হয়েছিল। এটির সঙ্গে শুঙ্গ রাজাদের কোনও যােগ ছিল বলে মনে হয় না। প্রাচীন পর্বের এই সকল স্তূপে অণ্ডের ভূমিকাই ছিল প্রধান। বেদি ও হর্মিকা তখন গৌণ।

ভারহুত স্তূপের বিভিন্ন নান্দনিক বিষয় : 

  • সেযুগের ভাস্কর্যের নিদর্শন বিধৃত আছে ভারহুতের ভূপবেষ্টনীতে, আর তােরণে। যক্ষ-যক্ষিণী, বােধিসত্ত্ব, রাজা, উচ্চবিত্ত, সাধারণ মানুষ, জীবজন্তু, ফুল-লতা সকলেই সেখানে উপস্থাপিত।
  • জাতকের অনেক কাহিনি, মায়াদেবীর স্বপ্ন ও অনাথপিণ্ডদের জেতবন বিহার দানের মতাে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও অলৌকিক ঘটনাবলিও এখানে বর্ণিত দৃশ্য পরিচিতিও আছে প্রতিটি দৃশ্যে।
  • ভারহুতের ভাস্কর্যে বুদ্ধদেবও রূপায়িত হয়েছেন। তবে তাকে মনুষ্যদেহে উপস্থাপন করা হয়নি, প্রতীকের মাধ্যমে তার উপস্থিতি আভাসিত হয়েছে। পদচিহ্ন, পাদুকা, ছত্র প্রভৃতি বস্তুকে প্রতীকরূপে শিল্পায়িত করে তার উপস্থিতির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। শুধু ভারহুতের ভাস্কর্যে নয়, সমকালীন ও আদি পর্বের ভারতীয় ভাস্কর্যে বুদ্ধদেবের জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনা বিশেষ বিশেষ প্রতীকের সাহায্যে বর্ণিত হয়েছে। হাতি হয়েছে বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের প্রতীক, পদ্ম ও বৃষ হয়েছে তার জন্মের, দ্বার ও ঘােড়া হয়েছে তার সংসার-ত্যাগের, বেদিকা ও বেষ্টনীসহ বােধিবৃক্ষ হয়েছে তার বুদ্ধত্বলাভের, চক্র বা চক্র ও মৃগ হয়েছে সারনাথে তার প্রথম ধর্ম প্রচারের এবং স্তুপ হয়েছে কুশীনগরে বুদ্ধদেবের মহাপরিনির্বাণের প্রতীক। 
  • ভারহুতের ভাস্কর্য নিদর্শনের মধ্যে চন্দা ও সুদর্শনা যক্ষিণী, চুলকোকা দেবতা প্রভৃতির মূর্তি এবং প্রসেনজিৎ স্তম্ভের রিলিফগুলো শিল্পসৌকর্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে। মূর্তিগুলোর সজীবতা ও ছন্দায়িত রূপ মন আকর্ষণ করে। শুধু দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নয়, একই দৃশ্যের বিচ্ছিন্ন বস্তুসমূহও অনেক সময় ছন্দোবদ্ধরূপে একসূত্রে গ্রথিত হয়েছে। শিল্পীর রসবােধের পরিচয় বিধৃত আছে বিভিন্ন ফুল ও ফলের রূপায়ণে, লতাপাতার চিত্রায়ণে, মর্ত্যজগৎ ও কল্পলােকের জন্তু-জানােয়ারের মূর্তির উপস্থাপনায় ও অন্যান্য সূক্ষ্ম সাজসজ্জায়। তুলনায় অজাতশত্রু স্তম্ভের রিলিফগুলো, সিরিয়া দেবতা ও কুবেরের মূর্তি অনেক নিষ্প্রভ। মূর্তিগুলোতে সজীবতা এবং অখণ্ডতার কোনও পরিচয় নেই; আছে কাঠিন্য, বিচ্ছিন্নতা ও গতানুগতিকতার ছাপ। যে পটভূমিতে তাদের উপস্থাপনা, সে পটভূমিতে তাদের যেন কোনও সক্রিয় ভূমিকা নেই – ভাবলেশহীন, নিশ্চল ভঙ্গিতে তারা যেন দাঁড়িয়ে আছে। 

সীমাবদ্ধতা : তৃতীয় মাত্রা বা বেধের সংযােজনায় ভারহুতের শিল্পীরা সেরকম দক্ষতার পরিচয় দেননি। কখনও হালকা করে, কখনওবা গভীরভাবে খােদাই করে, শিল্পী বেধ রূপায়ণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই তৃতীয় মাত্রার সংযােজন অপরিণত থেকে গেছে। ভারহুত শিল্পের উপস্থাপনায় দর্শকের দৃষ্টি উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে দূরের জিনিস ছােট এবং কাছের জিনিস বড় হয়ে, কাছের জিনিস নীচে এবং দূরের জিনিস তার উপরের সারিতে পরিবেশিত হয়েছে। মূর্তিগুলোর বেশির ভাগই সামনে তাকানাে ভঙ্গিতে উৎকীর্ণ। পাশ ফিরে দেখছে, এমন মূর্তির সংখ্যা খুবই কম। ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনায় ভারহুতের শিল্পীর আগ্রহ অপরিসীম। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও বস্তু তার নজর এড়ায়নি। ফলে ভারহুতের রিলিফগুলো বিষয়বাহুল্যে ভারাক্রান্ত হয়েছে।

ভাষা ও সাহিত্য : এযুগের সাহিত্যিক জগতের দিকপাল পতঞ্জলি শুঙ্গনৃপতি পুষ্যমিত্রের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি একাধারে বার্তিককার, সাহিত্যিক ও দার্শনিক। মধ্যপ্রদেশের গােনর্দ গ্রামে তার জন্ম। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর ওপর তার লেখা টীকা গ্রন্থখানির নাম “মহাভাষ্য”। পাণিনির অনুগামী হয়েও ক্ষেত্রবিশেষে তিনি পাণিনির সূত্রের সমালােচনা করেছেন, প্রয়ােজনবােধে সংশােধন ও সংযােজন করেছেন। সমকালীন সমাজ, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য ও শিল্পকলার বিভিন্ন দিক এই গ্রন্থে উদ্ভাসিত হয়েছে। গ্রন্থখানির সাহিত্যিক মূল্যও বড় কম নয়। সামবেদের ছন্দের উপর ‘নিদানসূত্র’ নামে একখানি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। দর্শনের উপর লেখা তার একখানি গ্রন্থ ‘যােগসূত্র’।

চেদিদের দ্বারা কলিঙ্গের অভ্যুত্থান

প্রাচীন ওড়িশা ও প্রাক-খারবেল পর্ব

প্রাচীন ওড়িশার বিভিন্ন নাম : বর্তমানে যে রাজ্যটির নাম ওড়িশা প্রাচীনকালে তার বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। এমন দিন ছিল যখন উত্তরে মেদিনীপুর হতে দক্ষিণে গােদাবরী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড কলিঙ্গ নামে চিহ্নিত হত। কখনও কখনও বালেশ্বর থেকে গঞ্জাম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলভূমি তোসল বা তােসলী নামে খ্যাত ছিল। তখন কলিঙ্গ বলতে আর বিস্তৃত ভূখণ্ড বােঝাত না, বােঝাত গঞ্জাম-শ্রীকাকুলম-বিশাখাপত্তনমের মতাে এক সীমিত অঞ্চল। ওড়িশার উপকূলভাগকে কখনও কখনও উৎকলও বলা হত। বােলাঙ্গীর-বৌধ-ঢেনকানাল অঞ্চলের নাম ছিল ওড্র। সম্বলপুর ও নিকটবর্তী অঞ্চল দক্ষিণ কোসলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দক্ষিণ কোসল বা তােসল কখনও সমগ্র ওড়িয়া ভাষাভাষী অঞ্চলের সমার্থক হয়ে ওঠেনি, কিন্তু কলিঙ্গ, ওড্র ও উৎকলের ক্ষেত্রে তা ঘটেছিল।

মৌর্যদের পতনের মধ্য দিয়ে মহাবেঘবাহন বংশের উত্থান : প্রিয়দর্শী অশােক যে কলিঙ্গ রাজ্যটি জয় করেছিলেন তা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। যে পরাক্রম ও বিচক্ষণতা অশােকের বৈশিষ্ট্য ছিল তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তার একান্ত অভাব ছিল। ফলে মৌর্য রাজগণের দুর্বলতার সুযােগে এক স্বাধীন রাজ্যরূপে কলিঙ্গের উদয় হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষ পর্বে এই রাজ্যটি সমকালীন ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। যাদের রাজত্বকালে কলিঙ্গের এই অভ্যুত্থান তারা চেদি রাজবংশের মাহামেঘবাহন শাখার লােক। পুরী জেলার উদয়গিরি পাহাড়ের একটি গুহা হাথীগুম্ফা। এই গুহার সম্মুখভাগে উৎকীর্ণ এক লেখে চেদি রাজবংশের কীর্তিকলাপ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। হাথীগুম্ফা লেখের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এই লেখটির অস্তিত্ব না থাকলে প্রাক্-খ্রিস্টীয় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অজানা থেকে যেত।

খারবেলের পূর্ববর্তী রাজারা : হাথীগুম্ফা লেখ থেকে জানা যায় মহারাজ খারবেলের পূর্বে অন্তত দু’জন চেদি রাজা ওড়িশায় রাজত্ব করেছেন। কিন্তু লেখটিতে তাদের সম্পর্কে কোনও তথ্য পরিবেশিত হয়নি। অনেকে মহামেঘবাহন ও বক্রদেবকে খারবেলের দু’জন পূর্বসূরি বলে শনাক্ত করেছেন। খারবেল চেদি বংশের মহামেঘবাহন শাখার লােক ছিলেন। মহামেঘবাহনের নাম হতেই শাখার নাম মাহামেঘ বাহন হয়েছে। সেক্ষেত্রে মহামেঘবাহনকে ওড়িশায় চেদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন মহামেঘবাহন খারবেলের পিতামহ ছিলেন। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনও সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত করা যায় না। মহামেঘবাহনের পর সম্ভবত বক্রদেব চেদি সিংহাসনে আরােহণ করেন। উদয়গিরি পাহাড়ের পাতালপুরী গুহাটি বক্রদেবের আমলে তৈরি হয়েছিল। পাতালপুরী গুহার ঠিক উপরেই বৈকুণ্ঠপুরী গুহা। গুহাটি খারবেলের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। এটি পাতালপুরী গুহার পরবর্তী বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই মত গ্রহণ করলে বক্রদেবকে খারবেলের পূর্ববর্তী রাজা বলেই গণ্য করতে হয়। কিন্তু পাতালপুরী ও বৈকুণ্ঠপুরী গুহা দু’টির মধ্যে কোনটি পূর্ববর্তী, কোনটিই-বা পরবতী, তা এখনও সুনিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয়নি। ফলে বক্রদেব খারবেলের উত্তরাধিকারী ছিলেন। এমন তাভিমতও ব্যক্ত হয়েছে। অনিশ্চয়তা রয়েছে বক্ৰদেবের সঙ্গে মহামেঘবাহন ও খারবেলের সম্পর্ক সম্পর্কেও। আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে হয়তাে এই অনিশ্চয়তার অবসান ঘটবে।

মহারাজ খারবেল

ভূমিকা : মহারাজ খারবেল ওড়িশার চেদি রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি। অমিত শক্তির অধিকারী এই রাজা শুধু উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজের প্রভূতুই স্থাপন করেননি, প্রজানুরঞ্জক ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসকরূপেও প্রসিদ্ধি অর্জন করেছেন। দুঃখের বিষয়, পুরাণাদি প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থাদিতে কীর্তিমান এই রাজার কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু তারই ত্রয়ােদশ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ হাথীগুম্ফা শিলালেখ তার কীর্তিকলাপের এক মনােজ্ঞ বিবরণ পরিবেশন করে তাকে কালের কপােলতলে সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। 

বাল্যকাল : লেখাপড়া ও খেলাধুলার মধ্য দিয়ে খারবেল জীবনের প্রথম পনেরােটি বছর অতিবাহিত করেন। মুদ্ৰাতত্ত্ব, গণনা, আইন ইত্যাদি জটিল বিষয় তিনি অধ্যয়ন করেন। ষোলাে বছর বয়সে তিনি যুবরাজের পদ গ্রহণ করেন। তিনি যখন যুবরাজ তখন কলিঙ্গের রাজা কে ছিলেন তা জানা যায় না। চব্বিশ বছর উৎকীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খারবেল কলিঙ্গের রাজপদে অভিষিক্ত হন। সিংহাসনে আরােহণ করে তিনি মহারাজ, কলিঙ্গাধিপতি, কলিঙ্গচক্রবর্তী, মহাবিজয় প্রভৃতি রাজকীয় অভিধা ধারণ করেন। খারবেলের মহিষী কে ছিলেন তা জানা যায় না তবে তিনি ছিলেন ললাক রাজপরিবারের কন্যা। চেদিদের আমলে কলিঙ্গের রাজধানীর অবস্থান সম্পর্কে পণ্ডিতরা সহমত নন। প্রাচীন কলিঙ্গনগর বা কলিঙ্গনগরী তৎকালীন কলিঙ্গের রাজধানী ছিল বলে কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রাচীন কলিঙ্গনগর আন্ধ্রপ্রদেশের একাকুলম জেলায় অবস্থিত ছিল। আবার অনেকে বলেন, উদয়গিরি পাহাড়ের অনতিদূরেই ছিল চেদি রাজ্যের রাজধানী। এ প্রসঙ্গে দুটি স্থানের কথা বলা হয়। এদের একটি শিশুপালগড়, অন্যটি বোলি। বিষয়টি বিতর্কিত।

সাতকর্ণির সাথে যুদ্ধ : তার রাজত্বের দ্বিতীয় বছর হতে শুরু হয় তার বিজয়াভিযান। হাথীগুম্ফা লেখ থেকে জানা যায় ওই বছরই খারবেল সাতকর্ণির কথা মনে না এনে অশ্বারােহী, গজারােহী, পদাতিক ও রথিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত তার বিশাল সেনাদলকে পশ্চিম দিকে পাঠান। কলিঙ্গের সৈন্যগণ কৃষ্ণবেণী (কৃষ্ণা নদী) নদীতটে উপস্থিত হয়ে অসিকনগর অধিকার করেন (দীনেশচন্দ্র সরকারের হাথীগুম্ফা লেখের পাঠে শহরটির নাম অসিকনগর বলা হয়েছে। প্রাকৃত আসিকনগর এর সংস্কৃত প্রতিরূপ ঋষিকনগর। অধ্যাপক সরকার নগরটির অবস্থান কৃষ্ণা নদীর তীরে নির্দেশ করেছেন। কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠে শহরটিকে মুসিকনগর বলা হয়েছে। প্রাকৃত এই শব্দটির সংস্কৃত রূপ মুষিকনগর। কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল বলেন, মুসী ও কৃষ্ণা নদীর সঙ্গমে শহরটি অবস্থিত ছিল। কিন্তু রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, শহরটি পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ছিল এবং গ্রিক গ্রন্থাদিতে বর্ণিত মুজিরিস ও হাথীগুফা লেখের মুসিকনগর এক ও অভিন্ন। শহরটির নামের আদ্যাক্ষর অস্পষ্ট থাকায় শহরটির সঠিক নাম সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না।)। লক্ষ করবার বিষয় এই অভিযানে খারবেল সাতকর্ণির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন কিনা, হাথীগুম্ফা লেখে তার কোনও স্পষ্ট উল্লেখ নেই। অসিকনগর যে সাতকর্ণির রাজ্যভুক্ত ছিল তারও কোনও ইঙ্গিত লেখটিতে নেই। হাথীগুম্ফা লেখের প্রাসঙ্গিক বিবৃতি এত অস্পষ্ট যে তার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা কঠিন। খারবেল সম্ভবত অসিকনগরের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। সাতকর্ণির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব থাকায় তিনি সাতকর্ণির রাজ্যের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন এবং অসিকনগর অধিকার করেন। এ ধারণাও সংগত যে স্বয়ং সাতকর্ণিই খারবেলের প্রতিপক্ষ ছিলেন এবং সাতকর্ণির অধিকারভুক্ত অসিকনগর তিনি অনায়াসে জয় করেন। আবার এ ধারণাও সম্ভব যে খারবেল সাতকর্ণিকেই পরাজিত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়ে অসিকনগর অভিমুখে অগ্রসর হন। হাথীগুম্ফা লেখে যে সাতকর্ণির কথা বলা হয়েছে তিনি সম্ভবত সাতবাহনরাজ প্রথম সাতকর্ণি। মহিষী নাগনিকার নানাঘাট গিরিলেখে এই সাতকর্ণির কীর্তিকলাপ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।

চতুর্থ বছরে অভিযান : রাজত্বের চতুর্থ বছরে খারবেল পুনরায় রাজ্য জয়ে বের হন। এবার তিনি বিদ্যাধর নামে জনৈক রাজাকে পরাজিত করেন, তার রাজধানী অধিকার করেন। বিদ্যাধর সম্ভবত আধুনিক মধ্যপ্রদেশের কোনও এক অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। বিদ্যাধরকে পরাজিত করে খারবেল মহারাষ্ট্রের রাষ্ট্রিক ও ভােজকদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। রাষ্ট্রিক ও ভােজকরা সাতবাহন রাজাদের অনুগত মিত্র ছিলেন। খারবেলের বিরুদ্ধে সংঘর্যে সাতবাহনরাজ রাষ্ট্রিক ও ভােজকদের সাহায্য করেছিলেন কিনা জানা যায় না। হাথীগুম্ফা লেখের বর্ণনা হতে অনুমান করা যায় কলিঙ্গরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাষ্ট্রিক ও ভােজকরা শােচনীয়রূপে পরাজিত হন।

অষ্টম বছরে অভিযান : রাজত্বের অষ্টম বছরে খারবেল পুনরায় দিগ্বিজয়ে বহির্গত হন। এবার তার লক্ষ্য উত্তর ভারত এই অভিযানকালে তিনি গােরথগিরি ও রাজগৃহ অধিকার করেন। বিহারের অবিভক্ত গয়া জেলার বরাবর পাহাড়ের প্রাচীন নাম গােরথগিরি। বর্তমানে যে স্থানের নাম রাজগির প্রাচীন যুগে তা রাজগৃহ নামে পরিচিত ছিল। হাথীগুম্ফা লেখের গােরথগিরি কোনও পাহাড়ের নাম, না কোনও রাজার পরিচয় বহন করছে, সে সম্পর্কে সংশয় আছে। অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার গােরথগিরিকে খারবেলের এক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজারূপেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি মনে করেন গােরথগিরিকে পরাজিত করে খারবেল তার রাজধানী রাজগির অধিকার করেন। কিন্তু খারবেলের সময় রাজগিরের অধিপতি ছিলেন মগধরাজ বৃহস্পতিমিত্র, গােরথগিরি নন। সে কারণে রাজগৃহকে রাজগির অর্থেনা ধরে গােরথগিরির রাজপ্রাসাদ অর্থেই ভাবা উচিত। সে যা হােক, খারবেলের এই সামরিক অভিযান জনৈক যবনরাজের মনে ভীতির সঞ্চার করে। ভীত, সন্ত্রস্ত যবনরাজ মথুরা নগরীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

একাদশ রাজ্যবর্ষে অভিযান : একাদশ রাজ্যবর্ষে কলিঙ্গরাজ দক্ষিণ ভারতে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। করমণ্ডল উপকূলের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত পিথুণ্ড বা পৃথুল শহরটি ধ্বংস করা হয়। অনেকে মনে করেন এই অভিযান উপলক্ষে কলিঙ্গসেনারা দক্ষিণে তামিলনাড়ু পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং শতাধিক বছর ধরে গড়ে ওঠা তামিল রাষ্ট্রসংঘকে বিপর্যস্ত করেন। অধ্যাপক বেণীমাধব বড়ুয়া মনে করেন হাথীগুম্ফা লেখে তামিল রাষ্ট্রসংঘের উল্লেখ নেই, আছে জঙ্গলাকীর্ণ এক প্রান্তরকে আবাদি জমিতে রূপান্তরের বর্ণনা।

পরের বচর উত্তরাপথে অভিযান : হাথীগুম্ফা লেখে বলা হয়েছে, দক্ষিণ ভারত অভিযানের পরের বছরই খারবেল উত্তরাপথ বিজয়ে মনােনিবেশ করেন। এই উত্তরাপথ উত্তর-পশ্চিম ভারত, না উত্তর ভারত, সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে মতদ্বৈধ আছে। হাথগুিম্ফা লেখে উত্তরাপথ প্রসঙ্গে পাঞ্জাব উত্তর-পশ্চিম ভারতের অন্য কোনও অঞ্চলের সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। কলিঙ্গ হতে এসব অঞ্চলের দূরত্বও বড় কম নয়। পক্ষান্তরে উত্তরাপথের উল্লেখ প্রসঙ্গে হাথীগুম্ফা লেখে মগধ, অঙ্গ ও গঙ্গা নদীর কথা বলা হয়েছে। এর থেকে মনে হয় উত্তরাপথ বলতে হাথীগুম্ফা লেখে সাধারণভাবে হিমালয় ও বিন্ধ্যের মধ্যবর্তী অঞ্চলকেই বােঝানাে হয়েছে, পৃথুদকাৎ পরতঃ উত্তরাপথঃ, এই সংকীর্ণ অর্থে নয়। উত্তরাপথ অভিযানে খারবেল যে সকল প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাদের পরাজিত করেছিলেন তাদের মধ্যে মগধরাজ বৃহস্পতিমিত্র বা বৃহৎস্বাতীমিত্র সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। এই রাজার নামাঙ্কিত প্রচুর তাম্রমুদ্রা এলাহাবাদের নিকটবর্তী কৌশাম্বীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এলাহাবাদেরই কাছাকাছি পভােসা গ্রামে পাওয়া একখানি লেখে তাকে জনৈক আষাঢ়সেনের ভাগিনেয়রূপে বর্ণনা করা হয়েছে, বৃহস্পতিমিত্র বা বৃহৎস্বাতীমিত্র সম্ভবত মগধের মিত্র বংশের রাজা ছিলেন। বিজিত মগধ ও অঙ্গ হতে খারবেল প্রচুর ধন-রত্ন সংগ্রহ করেন। মগধ হতে প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি কয়েকটি জৈন মূর্তি সঙ্গে নিয়ে যান। মূর্তিগুলো অনেক বছর আগে নন্দরাজ কলিঙ্গ হতে মগধে নিয়ে এসেছিলেন। 

পাণ্ড্যরাজের আত্মসমর্পণ : হাথীগুম্ফা লেখে দাবি করা হয়েছে, ওই একই বছর সমকালীন পাণ্ড্যরাজ মণি-রত্নসহ কলিঙ্গরাজের নিকট আত্মসমর্পণ করেছিলেন। হাথীগুম্ফা লেখে খারবেলের পাণ্ড্যরাজ্য জয়ের বর্ণনা হয়তাে অতিরঞ্জিত। হতে পারে পাণ্ড্যরাজ খারবেলকে কিছু উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। প্রীতির নিদর্শনকে প্রশস্তিকার সম্ভবত আনুগত্যের অঙ্গীকাররূপে পল্লবিত করেছেন।

বৃহত্তম শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ : কলিঙ্গরাজ খারবেল প্রাচীন ভারতের একজন উল্লেখযােগ্য নৃপতি। বিচক্ষণতা ও বাহুবলের সাহায্যে তিনি যে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা ওড়িশার ভৌগােলিক সীমানা অতিক্রম করে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। তারই রাজত্বকালে ওড়িশা ভারতের বৃহত্তম শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে।

সুশাসন ও প্রজানুরঞ্জন : খারবেল শুধু দিগ্বিজয়ী বীর ছিলেন না, সুশাসক ও প্রজানুরঞ্জক রাজারূপেও তিনি অশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। রাজত্বের প্রথম বছর বা তার কিছু পূর্বে কলিঙ্গের রাজধানী ঘূর্ণিবাত্যায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে খারবেল উদ্যান, প্রাকার, গৃহাদির সংস্কার করেন। তৃতীয় রাজ্যবর্ষে তিনি নগরবাসীদের মনােরঞ্জনের জন্য নৃত্য-গীতাদি অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেন। এর বছর দুই পর তিনি পুরানাে একটি খালের সংস্কার করে তার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করেন। ফলে বেশি পরিমাণ চাষের জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা হয়, কৃষির ফলনও বেড়ে যায়। তার রাজত্বকালে প্রজারা একবার বিপদাপন্ন হয়ে পড়লে তিনি তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য সব রকম কর মকুব করে দেন। জনহিতকর এসব কাজের মধ্য দিয়ে খারবেলের প্রজানুরাগের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে।

জৈনধর্মের প্রসার : খারবেল জৈনধর্মের অনুগামী ছিলেন। কুমারী পর্বত বা উদয়গিরি পাহাড়ে জৈন সন্ন্যাসীদের বাসের উদ্দেশ্যে তিনি কয়েকটি গুহা খনন করেন। গুহাগুলোর গঠন দেখে মনে হয় জৈন সন্ন্যাসীরা কঠোর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, জাঁকজমক, বিলাসবৈভব তারা বর্জন করতেন। কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল মনে করেন খারবেল ত্রয়ােদশ রাজ্যবর্ষে উদয়গিরি পাহাড়ে এক জৈন সম্মেলন আহ্বান করেন। হারিয়ে যাওয়া জৈন গ্রন্থগুলোকে সংকলন করা তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু অধ্যাপক বেণীমাধব বড়ুয়া হাথীগুম্ফা লেখের প্রাসঙ্গিক বিবৃতির ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন খারবেল জৈনশাস্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজে হাত দেননি, তিনি কারুকার্যমণ্ডিত একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। মগধ হতে জৈন মূর্তিগুলোকে উদ্ধারের মধ্য দিয়েও খারবেলের জৈনধর্মের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে।

অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা : জৈনধর্মের প্রতি অনুরক্ত হলেও খারবেল অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার মনােভাবই প্রকাশ করে গেছেন। সকল ধর্মের তিনি সমাদর করতেন, সকল ধর্মের দেবদেবীর মন্দির তিনি সংস্কার করতেন বলে হাথীগুম্ফা লেখে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে।

খারবেলের শাসনের কালসীমা

খারবেল খুব বেশি দিন রাজত্ব করেননি। হাথীগুম্ফা লেখে তার রাজত্বের প্রথম ত্রয়ােদশ বছরের কার্যকলাপ বর্ণিত আছে। সম্ভবত লেখখানি উৎকীর্ণ হওয়ার অল্পকাল পরই তার মৃত্যু হয়। কিন্তু তার ক্ষণস্থায়ী রাজত্বকালে কলিঙ্গরাজ্যটি ভারতের রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে মর্যাদা ও গৌরবের আসন লাভ করেছিল তেমনটি আর কখনও সে অর্জন করতে পারেনি। খারবেল ঠিক কোন সময় রাজত্ব করেন সে সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল প্রমুখ পণ্ডিতরা মনে করেন খারবেল খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথম পর্বে রাজত্ব করেন। এ মৃতের সমর্থনে নিম্নরূপ যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে –

  • এক, খারবেল সাতবাহনরাজ প্রথম সাতকর্ণির সমসাময়িক ছিলেন। প্রথম সাতকর্ণি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথম ভাগে রাজত্ব করেছেন।
  • দুই, যে মগধরাজ বৃহস্পতিমিত্র বা বৃহৎস্বাতীমিত্র খারবেলের নিকট পরাজিত হন তিনি শুঙ্গ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। আনুমানিক ১৮৭-১৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পুষ্যমিত্র মগধে রাজত্ব করেছেন। 
  • তিন, যে গ্রিক নৃপতি খারবেলের ভয়ে ভীত হয়ে মথুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তিনি গ্রিকরাজ ডিমেট্রিয়াস। এই গ্রিকরাজ খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথম ভাগে ব্যাকট্রিয়া ও উত্তর পশ্চিম ভারতে রাজত্ব করেন।
  • চার, খারবেল ১৬৫ মৌর্যাব্দে হাথীগুম্ফা লেখ উৎকীর্ণ করেন। ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে মৌর্যাব্দের শুরু হয়। তাহলে ১৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখটি উৎকীর্ণ হয়েছিল। লেখটি খারবেলের রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে উৎকীর্ণ হয়েছিল। সেই হিসাবে খারবেল খ্রিস্টপূর্ব ২য়। শতকের প্রথম পর্বেই রাজত্ব করেছিলেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। 

উপরের যুক্তিগুলো যে খুব জোরালাে তা কিন্তু বলা যায় না। কারণ –

  • সাতবাহনরাজ প্রথম সাতকর্ণি অবশ্যই খারবেলের সমকালীন ছিলেন কিন্তু তিনি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের অন্তিম পর্বে রাজত্ব করেছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে নয়।
  • হাথীগুম্ফা লেখের বৃহস্পতিমিত্র বা বৃহৎস্বাতীমিত্র পুষ্যমিত্র শুঙ্গ নন, তিনি একজন মিত্র বংশীয় রাজা। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি মগধে রাজত্ব করেন। হাথীগুম্ফা লেখে বৃহস্পতিমিত্র বলে কোনও রাজার উল্লেখ নেই এমন অভিমত ব্যক্ত হয়েছে।
  • খারবেলকে যবনরাজ ডিমেট্রিয়াসের সমসাময়িক ভাবা অনুচিত। হাথীগুম্ফা লেখে ডিমেট্রিয়াসের নাম উল্লিখিত আছে কিনা সে সম্পর্কে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে। খারবেলের আক্রমণ আশঙ্কা করে যে যবনরাজ মথুরায় আশ্রয়গ্রহণ করেন তিনি সম্ভবত ডিওমেডেস বা ডিওনিসাস-এর মতাে এক পরবতী গ্রিক নৃপতি ছিলেন।
  • হাথীগুম্ফা লেখ ১৬৫ মৌর্যাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছিল বলে যে অভিমত ব্যক্ত হয়েছে তা আসলে কাশীপ্রসাদ জায়সওয়ালের এক ত্রুটিপূর্ণ পাঠের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। হাথীগুম্ফা লেখের মূল অংশে ‘মৌর্যকাল’-এর উল্লেখ নেই, আছে ‘মুখিয়কলা’বা মুখ্যকলার উল্লেখ।

উপরােক্ত যুক্তিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথম পর্বকে খারবেলের রাজত্বকালরূপে চিহ্নিত করা যায় না। খারবেলের কাল নির্ণয়কালে কয়েকটি জিনিস মনে রাখা দরকার।

  • প্রথমত, লিপির বিচারে হাথীণ্ডা লেখ অবশ্যই গ্রিকদূত হেলিওডােরাসের বেসনগর গরুড়স্তম্ভ লেখের পরবর্তী। হাথীগুম্ফা লেখে ব, ম, প, হ এবং য বর্ণগুলো শেষােক্ত লেখের তুলনায় অনেক পরিণত, পরিশীলিত। শেষােক্ত লেখটি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের একেবারে শেষের দিকে উৎকীর্ণ হয়েছিল। সেক্ষেত্রে হাথীগুম্ফা লেখটিকে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষার্ধে ধার্য করা যায়।
  • দ্বিতীয়ত, খারবেল ‘মহারাজ’ অভিধা ধারণ করেছিলেন। তার পূর্বে কোনও ভারতীয় রাজা এ উপাধি গ্রহণ করেননি। বিদেশি গ্রিক রাজারাই খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের প্রথম ভাগে ব্যাক্ট্রিয়া ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে সর্বপ্রথম এই রাজকীয় অভিধা প্রচলন করেন। সুদুর পশ্চিম হতে বিদেশি প্রথার প্রত্যন্ত কলিঙ্গে স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছিল।
  • তৃতীয়ত, উদয়গিরি পাহাড়ের মঞ্চপুরী গুহাটি খারবেলের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। এই গুহায় যে ভাস্কর্যের নিদর্শন আছে তা নিঃসন্দেহে শুঙ্গযুগের ভারহুত স্তূপের ভাস্কর্যের পরবর্তী।

স্পষ্ট বােঝা যায়, খারবেল ডিমেট্রিয়াস বা পুষ্যমিত্রের পরবর্তী ছিলেন কিন্তু তিনি ঠিক কখন রাজত্ব করেন তা জানার জন্য হাথীগুম্ফা লেখের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বিচার আবশ্যক হয়ে পড়ে। তথ্যটি খারবেল কর্তৃক একটি খালের সংস্কারসংক্রান্ত। হাথীগুম্ফা লেখে বলা হয়েছে, কলিজ রাজ তার রাজত্বের পঞ্চম বছরে যে খালটির সংস্কার করেন সেটি এক নন্দরাজ তি-বস-সত’ বছর পূর্বে খনন করেছিলেন। ‘তি-বস-সত’ কথাটির অর্থ তিন শত বছর। হাথীগুম্ফা লেখের নন্দরাজ সম্ভবত মগধরাজ মহাপদ্ম নন্দ (৩৬৪-৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। কলিঙ্গরাজ মহাপদ্মের তিনশাে বছর পর রাজত্ব করেছিলেন। খারবেল খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কলিঙ্গের সিংহাসনে আরােহণ করেছিলেন এই মতই সেক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়।

পরবর্তী চেদিরাজগণ

বক্রদেব : খারবেলের পর কে কলিঙ্গের সিংহাসনে আরােহণ করেন তা স্পষ্ট নয়। অনেকে মনে করেন খারবেলের পর তার পুত্র বক্রদেব কলিঙ্গের রাজা হন। বক্ৰদেব খারবেলের মতাে আর্য, মহারাজ ও মাহামেঘবাহন বলে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তিনি খারবেলের পুত্র, না কোনও পূর্বপুরুষ, সে সম্পর্কে এখনও বিতর্ক রয়েছে। পাতালপুরী গুম্ফার একখানি লেখে বড়ুখ নামে জনৈক রাজকুমারের নাম উল্লিখিত আছে। বড়ুখ সম্ভবত চেদি রাজপরিবারভুক্ত ছিলেন কিন্তু তিনি কোনও রাজকীয় অভিধা ধারণ করেননি। ফলে তিনি রাজপদ লাভ করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। 

মানসদ : অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর জেলার বেলপুরু গ্রামে খ্রিস্টীয় ২য় শতকের প্রথমভাগে উৎকীর্ণ একখানি প্রাকৃত লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে (Epigraphia Indica, Vol. XXXII. পৃ. ৮২-৮৭)। এই লেখে মানসদ নামে জনৈক মহারাজের উল্লেখ আছে। তিনি খারবেলের মতাে ঐর বা আর্য অভিধায় আখ্যাত হয়েছেন। অনেকেই তাকে খারবেলের এক উত্তরাধিকারী রূপে চিহ্নিত করেছেন। এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। ঐর বা আর্য একটি অভিধা, এটি কোনও রাজবংশের নাম নয়। খারবেলের বংশ চেদি বা মাহামেঘবাহন নামে পরিচিত। মহারাজ মানসদ নিজেকে চেদি বা মাহামেঘবাহন বলে পরিচয় দেননি। খারবেল নিজেকে কলিঙ্গরাজ বলে বর্ণনা করেছেন। মানসদ নিজেকে কলিঙ্গরাজরূপে পরিচয় দেননি। অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর অঞ্চল কলিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তাছাড়া লেখে মানসদ হারীতীপুত্র বলে বর্ণিত হয়েছেন। খারবেলের ক্ষেত্রে সেরূপ কোনও বর্ণনা নেই। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহারাজ মানসদকে খারবেলের একজন উত্তরসূরি বলে ভাবা সমীচীন বােধ হয় না।

সদ : অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিম গােদাবরী জেলার গুণ্ডুপল্লিতে প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় ২য় শতকীয় এক ব্রাহ্মী লেখে সদ নামে জনৈক মহারাজের উল্লেখ আছে (Journal of Ancient Indian History. Vol. III. পৃ. ৩০-৩৭)। মহারাজ সদের অধীনস্থ এক রাজপুরুষের স্থানীয় অঞ্চলে একটি মণ্ডপ প্রদান উপলক্ষে লেখটি উৎকীর্ণ হয়। প্রাকৃত ভাষায় রচিত এই লেখটিতে মহারাজ সদকে ‘মহামেখবাহন’ (মাহামেঘবাহন?) এবং ‘কলিঙ্গ-মহিসকাধিপতি’ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মহামেখবাহন (মাহামেখবাহন ?) মাহামেঘবাহনেরই এক রূপান্তর। সেক্ষেত্রে সদকে মাহামেঘবাহন বংশের এক মহারাজ অর্থাৎ খারবেলের এক অধস্তন পুরুষরূপে চিহ্নিত করা যায়। তিনি খ্রিস্টায় ২য় শতকের মধ্যভাগে পশ্চিম গােদাবরী জেলায় রাজত্ব করেন। এই অঞ্চল মহিষক নামে পরিচিত ছিল। লেখে তিনি কলিঙ্গাধিপতিরূপে বর্ণিত হলেও কলিঙ্গ তার রাজ্যভুক্ত ছিল বলে মনে হয় না। অত্যুক্তিমূলক এই দাবির মধ্যে মাহামেঘবাহন রাজবংশের অতীত গৌরবগাথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। একদিন তাে তারাই কলিঙ্গ অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন। কলিঙ্গে তাদের রাজত্বের অবসানের পর মাহামেঘবাহনের দীর্ঘকাল অন্ধপ্রদেশে রাজত্ব করেন, এরূপ ধারণা সঙ্গত বােধ হয় না। মহারাজ সদের মাতা সাতবাহন রাজবশের দুহিতা এবং সদ ও বেলপুরু লেখের মহারাজ মানসদ এক ও অভিন্ন ব্যক্তি, এরূপ অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু এ মত প্রমাণসিদ্ধ নয়। এক সময় মনে করা হত, লেখটি খারবেলের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ হয়েছিল। এ ধারণা ভ্রান্ত। অনেকের ধারণা খারবেলের মৃত্যুর অল্পকাল পরই পরাক্রমশালী সাতবাহন রাজারা কলিঙ্গ রাজ্য অধিকার করেন। কিন্তু সাতবাহন রাজারা কলিঙ্গ জয় করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে সংশয় আছে।

চেদি রাজত্বের মূল্যায়ন

চেদি রাজারা যে খুব বেশি দিন রাজত্ব করেছেন তা নয় কিন্তু নানা কারণে তাদের রাজত্বকাল ওড়িশার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই সময়, বিশেষত খারবেলের রাজত্বকালে, কলিঙ্গ ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে; উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি খারবেলের চরিত্রে পরাক্রমের সঙ্গে প্রজাহিতৈষণার অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটেছিল। ঘূর্ণিবাত্যায় রাজধানী বিপর্যস্ত হলে খারবেল কালবিলম্ব না করে রাজকোষ হতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে নগর সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করেন। প্রজাদের আনন্দ দানের জন্য তিনি কয়েকটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। জৈনধর্মের প্রতি ব্যক্তিগত প্রীতি সত্ত্বেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার মনােভাব পােষণ করে। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই যুগে অভাবনীয় উন্নতি দেখা যায়। ভুবনেশ্বরের প্রায় ৮ কিলােমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত উদয়গিরি পাহাড়ের গায়ে খনন করা গুহাগুলো এই পর্বের শিল্পোন্নতির স্বাক্ষর বহন করছে। এই গুহাগুলো আসলে প্রাকৃতিক গুহা কিন্তু ছেনি ও হাতুড়ির সাহায্যে এগুলোকে বর্ধিত ও মার্জিত করা হয়েছে। হাথীগুম্ফা, সর্পগুম্ফা, পবনগুম্ফা ও ব্যাঘ্র গুম্ফার মতাে গুহাগুলো একতলা। মঞ্চপুরী গুহাটি দ্বিতল। এর নিচের তলা মতপুরী, উপরের তলা স্বর্ণপরী বা বৈকুণ্ঠপুরী। জৈন সন্ন্যাসীদের বাসস্থানরূপেই গুহাগুলো নির্মিত হয়েছিল। ব্যাঘগুম্ফাটির নির্মাণে শিল্পী যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ঝুঁকে পড়া এক খণ্ড বৃহদায়তন পাথরকে সুন্দরভাবে খনন করে মুখ ব্যাদান করা বাঘের রূপ দেয়া হয়েছে। গুহাগুলোর গায়ে দেখা যায় গজলক্ষ্মী, নাগ-নাগিনী, বােধিবৃক্ষ, মকর, স্বস্তিকা, ত্রিরত্ন, নারীমূর্তি প্রভৃতি ভাস্কর্যের উপস্থাপনা। কখনও কখনও ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে চিত্ৰকাহিনি পরিবেশিত হয়েছে। যুদ্ধ, ধর্মকর্ম, প্রণয়, বিয়ােগ-ব্যথা, প্রাত্যহিক জীবনের হাসি কান্না সব কিছুই শিল্পী গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। উদয়গিরি পাহাড়ের ভাস্কর্যে প্রতিফলিত হয়েছে শিল্পীর সমাজ-সচেতনতা, প্রকাশ পেয়েছে তার সামাজিক দায়বদ্ধতা। 

এই সময়ের পর ভারতবর্ষে কুষাণোত্তর যুগের সূচনা ঘটে। সেই যুগ সম্পর্কে জানতে এখানে যান।

গ্রন্থপঞ্জি

চন্দ্রগুপ্ত ও বিন্দুসার অংশ

  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে – প্রথম পর্ব, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ২০২০, পৃ. ২৮১-২৯৬
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪)
  • Chatterjee, Asoke : Studies In Kautilya’s Vocabulary (Delhi, 1990)
  • Chattopadhyaya, S. : Bimbisara To Asoka (Calcutta, 1977)
  • Kangle, R. P. : The Kautiliva Arthasastra, Vols. I-II (Bombay, 1960-63)
  • Majumdar, R. C. (Ed.) : The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1963)
  • Mc Crindle, J. W. : Ancient India as Described by Megasthenes and Arrian (Calcutta, 1960)
  • Mookerjee, R. K. : Chandragupta Maurya And His Times (Delhi, 1966)
  • Raychaudhuri. H.C. : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • Sastri K A N. (Ed.) : The Age Of The Nandas And The Mauryas (Delhi, 1967) : The Comprehensive History of India. Vol. II (Calcutta, 1957)
  • Smith, V. : Early History of India (Oxford, 1924) 

অশোক ও তার উত্তরাধিকারী অংশ

  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে – প্রথম পর্ব, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ২০২০, পৃ. ২৯৭-৩১৮
  • Barua, B. M. : Asoka And His Inscriptions (Calcutta, 1954)
  • Basak, R. G. : Asokan Inscriptions (Calcutta, 1959)
  • Bhandarkar, D. R.: Asoka (Calcutta, 1955)
  • Chattopadhyaya, S. : Bimbisara To Asoka (Calcutta, 1977)
  • Eggermont, P. H. L. : The Chronology of The Reign Of Asoka Moriya (Leiden, 1956)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960)
  • Mookerji, R. K.: Asoka (Delhi, 1962)
  • Raychaudhuri, H.C. : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • Sastri, K. A. N. (Ed.): The Age Of The Nandas And The Mauryas (Delhi, 1967); A Comprehensive History Of India, Vol. II (Bombay, 1957)
  • Sircar, D. C.: Inscriptions Of Asoka (Delhi, 1957)
  • Smith, V.: Asoka (Oxford, 1924): Early History Of India (Oxford, 1924)
  • Thapar. R. : Asoka And The Decline Of The Mauryas (Oxford, 1961): The Mauryas Revisited (Calcutta, 1993) 

মৌর্যযুগে ভারতবর্ষ অংশ 

  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে – প্রথম পর্ব, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ২০২০, পৃ. ৩১৯-৩৫৮
  • নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস (কলকাতা, ১৩৮৪), ভারতীয় জাতিবর্ণপ্রথা (কলকাতা, ১৯৮৭)
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪); ভারতের সংস্কৃতি (কলকাতা, ১৯৯৫)
  • রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)
  • রাধাগােবিন্দ বসাক : কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র, ১ম ও ২য় খণ্ড (কলকাতা, ১৯৬৪-৬৭)
  • Agarwala, V. S. : India As Known To Pāņini (Lucknow, 1953)
  • Altekar, A. S.: Position of Women In Hindu Civilization (Benares, 1958)
  • Chanana, D. : Slavery In Ancient India (Delhi, 1960)
  • Chattopadhyaya, S. : Bimbisāra To Asoka (Calcutta, 1977)
  • Dikshitar, V.R.R.: Mauryan Polity (Madras, 1932)
  • Ghosal, U. N.: A History Of Hindu Political Ideas (Bombay, 1959); The Agrarian System In Ancient India (Calcutta, 1973)
  • Kangle, R. P.: The Kauțili ya Arthasastra, Parts I-III (Bombay, 1963-65)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age of Imperial Unity (Bombay, 1960): Classical Accounts Of India (Calcutta, 1960). Mc Crindle, J. W.: Ancient India as Described by Megasthenes and Arrian (Calcutta, 1960)
  • Rapson, E.J. : The Cambridge History Of India, Vol. I (Cambridge, 1922). Sastri, K. A. N. (Ed.): Age Of The Nandas And The Mauryas (Delhi, 1967); A Comprehensive History Of India, Vol. II (Bombay, 1957)
  • Sharma, R. S. : Perspectives In Social And Economic History Of Early India (Delhi, 1983); Material Culture And Social Formations In Ancient India (Delhi, 1985)
  • Thapar, Romila : Asoka and the Decline of the Mauryas (Oxford, 1961)
  • Winternitz, M.: A History Of Indian Literature, Vol. II, (Calcutta, 1933)

শুঙ্গ-কাণ্ব যুগ অংশ

  • নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস (কলকাতা, ১৩৮৪); ভারতীয় জাতিবর্ণপ্রথা (কলকাতা, ১৯৮৭)
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪); ভারতের সংস্কৃতি (কলকাতা, ১৯৯৫)
  • রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)
  • Agarwala, V. S. : India As Known To Fanini (Lucknow, 1953)
  • Altekar. A. S. : Position of Women In Hindu Civilization (Benares, 1958)
  • Chanana, D.: Slavery in Ancient India (Delhi, 1960)
  • Chattopadhyaya, S. : Early History of North India (Calcutta, 1968)
  • Lahiri, Bela : Indigenous States of Northern India (Calcutta, 1974)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960); Classical Accounts of India (Calcutta, 1960)
  • Sastri K. A. N. (Ed.) : Age or The Nandas And The Mauryas (Delhi, 1967); A Comprehensive History of India, Vol. II (Bombay, 1957)
  • Winternitz, M.: A History of Indian Literature, Vol. II (Calcutta, 1933)

কলিঙ্গের অভ্যুত্থান ও চেদি রাজবংশ অংশ

  • Agarwala, Sadananda : Kharawela (in Hindi, Cuttack, 1993)
  • Ganguly. DK. Historical Geography And Dynastic History Of Orissa (Calcutta 1975)
  • Majumdar. R. C. (Ed.): The Age of Imperial Unity (Bombay, 1960)
  • Raychaudhuri. HC. Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • Sastri, K. A. N. (Ed.): A Comprehensive History Of India, Vol. II (Calcutta, 1957) 

সম্পর্কিত মানচিত্র-ভিত্তিক ভিডিও

মহাজনপদ থেকে মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস

ভারতের ইতিহাস

1 Comment

  1. Fake map of Mauryan Empire . … Remove it with new one.

    Chandrgupta Maurya (322BCE) already won the Aria ,Kamboj ,Arachosia ,Gedrosia from Selucus.Bindusara expanded the empire by capturing whole Dakshinapatha. Ashoka defeated the Kalinga. ‘ Major Rock Edict XIII ‘ mentions about the victory of Ashoka over Kalinga.In Girnar Second Rock inscription Ashoka mentioned some detail about his Empire.

    This map don’t show kalinga in mauryan empire … but ashoka won it … What about Gedrosia that chandragupta won from selucus.

    According to Strabo (64/63 BC–c.24 AD), the ceded territories bordered the Indus:

    ” The geographical position of the tribes is as follows: along the Indus are the Paropamisadae, above whom lies the Paropamisus mountain: then, towards the south, the Arachoti: then next, towards the south, the Gedroseni, with the other tribes that occupy the seaboard; and the Indus lies, latitudinally, alongside all these places; and of these places, in part, some that lie along the Indus are held by Indians, although they formerly belonged to the Persians. Alexander [III ‘the Great’ of Macedon] took these away from the Arians and established settlements of his own, but Seleucus Nicator gave them to Sandrocottus [Chandragupta], upon terms of intermarriage and of receiving in exchange five hundred elephants. ” — Strabo 15.2.9

    According to Pliny (23/24 AD–c.79 AD) Seleucus surrendered the easternmost provinces of Arachosia, Gedrosia, Paropamisadae and perhaps also Aria. On the other hand, he was accepted by other satraps of the eastern provinces.

    ” Most geographers, in fact, do not look upon India as bounded by the river Indus, but add to it the four satrapies of the Gedrose, the Arachotë, the Aria, and the Paropamisadë, the River Cophes thus forming the extreme boundary of India. According to other writers, however, all these territories, are reckoned as belonging to the country of the Aria. ” — Pliny, Natural History VI, 23

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.