রোমান প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস (অগাস্টাস কর্তৃক রোমান সাম্রাজ্যের গঠনের পূর্ব পর্যন্ত)

Table of Contents

ইতালী উপদ্বীপ ও রোমান সভ্যতার ভূমিকা

ইউরোপ মহাদেশ থেকে দক্ষিণ দিকে ভূমধ্যসাগরের দিকে এগোলে প্রায় পাচশ’ মাইল লম্বা আর জুতোর মতো আকৃতির একটি উপদ্বীপ অঞ্চল পাওয়া যায়। সেখানকার অধিবাসীদের কাছে উপদ্বীপটি ইতালিয়া বলে পরিচিত আর আমাদের কাছে ইতালি। সেই উপদ্বীপ অঞ্চলে এমন এক রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল যা প্রাচীন কালে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। একটি ছোট্ট নগর দিয়ে শুরু হবার পর ধীরে ধীরে রাষ্ট্রটি ক্ষমতাবান হতে শুরু করে। একসময় সেই শতাব্দী আসে যখন আটলান্টিক সাগর থেকে শুরু করে ক্যাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত আর ওদিকে বৃটেনের দ্বীপাঞ্চল থেকে নাইল নদী পর্যন্ত সে-ই হয়ে ওঠে সবচেয়ে শক্তিশালী। সেই রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থায় অনেক ভুলও হয়েছিল কিন্তু তার আগের যত সরকারের উদ্ভব হয়েছিল তাদের তুলনায় সেসব তেমন কিছু নয়। সেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্রের কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী শান্তি আর উন্নতি বজায় ছিল, যা তার আগের রাজ্যগুলোতে উপর্যুপরি যুদ্ধের কারণে সম্ভব ছিলনা। শেষ পর্যন্ত সেই রাষ্ট্রটি যখন ভেঙে পড়ল, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তার পরের হাজার বছর ধরেও মানুষ সেই সময়টাকে ইঙ্গিত করে বলতে লাগল যে তখন মানুষের মধ্যে কতটা সমৃদ্ধি আর সুখ বজায় ছিল। সেই রাষ্ট্র থাকাকালীন সময়টাকে তখনকার দিনের জন্য কিংবা এখন পর্যন্ত ইতিহাসে একমাত্র সময় বলা যায় যখন সমস্ত পশ্চিমা সভ্য দেশগুলো একই আইনের আওতায় ছিল। আর সে কারণেই সে রাষ্ট্রের আইন এবং সামাজিক রীতি আজ এতদিন পরেও আমাদের দেশসহ সমস্ত পশ্চিমা দেশগুলোকে একইভাবে প্রভাবিত করে যাচ্ছে।

রোমানদের পূর্ববর্তী জনগোষ্ঠী

ভিলানোভান্স

ইতালি রাষ্ট্রের জন্মের সাথে সাথেই প্রাচীন সভ্যতা একটা চরম উৎকর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল এমন নয়। খিস্টপূর্ব ১০০০ সালেও ইতালি একটা অতি সাধারণ সভ্যতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়া ভূখণ্ড ছিল। সেখানে ছিল মোটামুটি অসভ্য কিছু আদিবাসী। তখনকার সময়ে পৃথিবীর অন্য কোথাও বহু আগেই সভ্যতার বুৎপত্তি ঘটেছিল (তুর্কি, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইজরায়েল, জর্ডান, সৌদি আরব এবং আরব দ্বীপপুঞ্জ)। তখন নগরের পর নগর জেগে উঠছিল, আর তার মধ্যেই চরম সভ্যতা দেখা গিয়েছিল ক্রিট দ্বীপপুঞ্জে, যাদের নিজস্ব নৌবাহিনী এবং অভ্যন্তরীন সুযোগসুবিধা ছিল। তারপর খিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খিস্টপূর্ব ১০০০ সালের মধ্যে সেখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা শুরু হয়। মানুষ পরিবর্তনের জোয়ারে ভাসতে শুরু করে ও আগের তৈরি সভ্যতা থেকে দূরে সরে আসে। যে সমস্ত উপজাতি উত্তর দিকে থেকে ধেয়ে আসছিল তাদের অস্ত্র লোহার তৈরি অস্ত্র ছিল; তাদের ধারালো, শক্ত তলোয়ারগুলো সভ্য জাতির সেনাবাহিনীর তুলনামূলকভাবে নরম ব্রোঞ্জের অস্ত্রের তুলনায় শক্তিশালী ছিল, তাই উত্তর দিক থেকে আসা উপজাতিরাই বিজয়ী হয়। এরফলে কিছু সভ্যতার মৃত্যু হয়, আর কিছু সভ্যতা জোরেসোরে ধাক্কা খায়। লোহার অস্ত্রের ব্যবহারকারী জাতি তখন দক্ষিণদিকে আসতে আসতে খিস্টপূর্ব ১০০০ সাল নাগাদ ইটালি পর্যন্ত পৌছে গেল। সেখানে ধ্বংস করার মতো সভ্যতার কোনো অস্তিত্বই ছিল না, তবে নতুন আগত জাতিটি সেখানকার সভ্যতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। তাদের জীবন যাপনের চিহ্ন পরবর্তীকালে প্রত্নতাত্বিকেরা আবিষ্কার করেছে, প্রধানত বড় আবিষ্কার দেখা গেছে ভিলানোভায়, যা বোলোগনা নগরের একটি উপনগর, ইটালির মধ্যভাগের দক্ষিণ প্রান্তে এর অবস্থান। আর এই কারণেই লোহার অস্ত্র ব্যবহারকারী উপজাতিটির নামকরন করা হয়েছিল ভিলানোভান্স।

এট্রুসকানজ

এট্রুসকানদের ইতালিতে প্রবেশ ও তাদের পরিচয় : ভিলানোভান্সের উত্থান হবার পরের কোনো এক সময়ে ইতালিতে প্রথম প্রকৃত সভ্যতার বুৎপত্তি ঘটে। যারা এখানে সভ্যতার ধ্বজা বয়ে আনে তাদের কাছে নিজেদের পশ্চিম দিকে ভূমধ্যসাগরের অংশটুকু এখনো তিহ্‌রিনিয়ান সাগর বলে পরিচিত। ওই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী আমাদের কাছে এট্রুসকানজ বলেই বেশি পরিচিত, আর যে ভূখণ্ডে তারা বসবাস করে তার নাম এট্রুরিয়াহ্‌। ইতালির মধ্যভাগে টিবার নদী থেকে শুরু করে অরনো নদী পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম দিকে ২০০ মাইল পর্যন্ত পশ্চিম সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা এট্রুরিয়া ভূখণ্ড। আধুনিক যুগে ইতালির বেশিরভাগ জায়গাকেই সর্বজনীনভাবে তুসকানি বলা হয়, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই নামটি যেন এট্রুস্কানজ শব্দেরই প্রতিধ্বনি। সত্যিকার অর্থে এট্রুসকানজ কারা? তারা কি সেই ভিলেনোভান্স জাতি যারা কিনা ধীরে ধীরে সভ্যতার আলো দেখেছিল? অথবা তারা কি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ইতালিতে অনুপ্রবেশকারী এবং ততদিনে সভ্য হওয়া কোনো জাতির প্রতিনিধি? – এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া আসলে খুব কঠিন। এট্রুসকানদের ভাষার পাঠোদ্ধার কখনো সম্ভব হয়নি, তাই তার আবেদনও আমাদের কাছে আজীবন রহস্যময়। আরো বলতে গেলে, পরের শতাব্দীগুলোতে, তাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির ধারার যেটুকু অংশ পরে নানান জাতিকে প্রভাবিত করেছে তার থেকে আমরা তাদের প্রাচীন আচার ব্যবহার সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পারি। তবে এতকিছুর পরেও এট্রুসকানজ আমাদের কাছে একটা বড়ো প্রশ্নবোধক চিহের মতোই ঝুলে রয়েছে। প্রাচীন মানুষেরা মনে করত (যদিও তারা এ বিষয়ে সঠিক ছিল কি না তার কোনো প্রমাণ নেই), খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের পরপর এট্রুসকানরা এশিয়া মাইনর থেকে ইতালিতে এসেছিল। আবার এমনও হতে পারে যে এট্রুসকানজদেরও, যে দুর্ধর্ষ অভিযানের ফলে ভিলেনোভান্সরা ইতালিতে পৌঁছেছিল, সেই একইরকমের কোনো কারণ তাড়া করে এনেছিল। এট্রুসকান নগরগুলো খিস্টপূর্ব ৭০০ সাল থেকে খিস্টপূর্ব ৫০০ পালের মধ্যে কোনো এক সময়ে একত্র হয়ে জোট গড়ে তুলেছিল। তখন তারাই ক্ষমতার শীর্ষে ছিল। তখন ইতালির মধ্যভাগের কথাই বলা হোক আর উত্তরে পো নদীর পাশের উপত্যকা থেকে শুরু করে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্র পর্যন্ত যে কোনো জায়গার কথাই ধরা হোক, তারাই সবটা নিয়ন্ত্রণ করত। আমরা এ্রুসকানজদের সম্পর্কে এতটাই কম জানি যে মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে তাদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। প্রাচীন রোম বলতে গেলে প্রধানত একটি এট্রুসকান নগর এবং এর সংস্কৃতি ও কৃষ্টি পরবর্তীকালে রোমের বাইরে থেকে আগত। রোমানদের ধর্মপালনের অভ্যাসেও এট্রুসকানদের প্রভাব ছিল, যেমন তাদের প্রভাব ছিল নগরের সাংগঠনিক কার্যকলাপের উপরে, নগরের প্রচলিত খেলার উপরে, এমনকি রাজ্যশাসনে কিংবা কথাবার্তা বলার ঢঙেও। এট্রুসকান রাজ্য ছিল রোমের পত্তন হবার পূর্বের রোম, কিন্তু একটা সমস্যার কারণে তা ধ্বংস হলো, আর তা হলো, তাদের রাজ্যের নগরগুলো কখনো একটা কেন্দ্র থেকে অধ্যুষিত হতে পারেনি। এই কারণেই এট্রুসিয়ার বাইরে একটা নগর, যে নগর কিনা খানিকটা সংগঠিত হতে পেরেছিল আর যার বরাবর একটি লক্ষ্য ছিল, অন্য সমস্ত এট্রুসান নগরকে হারিয়ে দিয়েছিল, (যার প্রতিটিই ওই নগরের নিজের থেকে শক্তিশালী ছিল) একটার পর একটাকে ঘায়েল করে একটু একটু করে ধ্বংস করেছিল তাদের- সেই ধ্বংস প্রক্রিয়ায় আমাদের জন্য রয়ে গেছে শুধু অশেষ রহস্য যার কোনোদিন সমাধান হবে না।

এট্রুসকানদের সংস্কৃতি : এট্রুসকানদের সৃষ্ট শিল্পে কয়েক শতাব্দী ধরে গ্রিকদের প্রভাব ছিল, কিন্তু সেভাবে না ভাবলে এট্রুসকানদের শিল্পের অবশ্যই নিজস্ব ধারা বা স্বকীয়তা ছিল, নিজের গুণেই সেসব শিল্পকর্মের কদর রয়েছে। এট্রুসকানদের বানানো মূর্তিগুলোর বেশিরভাগের উপরের ঠোটটা বাইরের দিকে ওঠানো যাকে সাধারণত অনেক সময় “অদেখা হাসি” হিসেবে উল্লেখ করা হয়, আর উপমা ব্যবহার করে অনেক কৌতুকেরও সৃষ্টি করা হয়। এট্রুসকানদের শিল্পে প্রাচ্যের বিশেষ প্রভাব লক্ষ করা যায়। এটা থেকে আমরা তাদের সঙ্গে এশিয়ার লোকদের সঙ্গে পশ্চিমাদের ব্যবসা বানিজ্য কিংবা সামাজিক সম্পর্কের ব্যাপারে ধারণা পেতে পারি; যদিও দেখা যায় যে তাদের সভ্যতাসহ তারা সেসময় একরকম কোণঠাসা হয়েই ছিল। যদিও তাদের ভাষা পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, তবু এগুলো থেকে তাদের আদি চিন্তাভাবনার অনেকটাই বোঝা যায়। তাদের ভাষার বেশিরভাগ হরফের ছোটো ছোটো আর মন্দিরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা অবশ্য তাদের সেই হরফগুলোকে বিচিত্রভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে তাদের ভাষাটি অনেকটা ইন্দো-ইউরোপের, অন্যেরা বলেছেন যে ভাষাটি এশিয়ার মধ্যভাগ থেকে আফ্রিকার দিকের জনগোষ্ঠীর ভাষার মতো। আবার এমনটাও ধারণা করা হয়েছে যে ভাষাটির মধ্যে দুইরকম প্রভাবই ছিল, এক হলো ইন্দো-ইউরোপিয়ান নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর নিত্য ব্যবহার্য ভাষার এবং আরেক হলো আরবীয়, সিরিয় কিংবা হিব্রু ভাষাভাষী উচ্চবিত্ত শ্রেণির ভাষার। তাদের ভাষা সম্পর্কে আরেকটা কথা জানা গেছে, যা হলো, একইরকমের অন্য কোনো ভাষা খুঁজে পাওয়া যায়নি ঠিকই তবে অচেনা ভাষা হলেও কেন যেন তা ইউরোপে বিভিন্ন সময়ে আগত বাইরের লোকেদের ভাষার সঙ্গে খানিকটা মিলে যায়। এট্রুসকান জাতি মিশরীয় জাতির মতোই খানিকটা মৃত্যুকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনায় মগ্ন ছিল। সমাধিগুলো খুবই যত্ন নিয়ে বানানো আর হাতে আঁকা শিল্পকর্মের বেশিরভাগেরই মূল বিষয় মৃত্যু পরবর্তী শেষকৃত্যানুষ্ঠান। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো ছিল গুরুগন্তীর আর পরকাল বা ভবিষ্যতের ভাগ্য গণনার জন্য বলি হওয়া পশু, পাখির চালচলন, আকাশে বিদ্যুতের আনাগোনা, এসবের উপরে নির্ভর করত। রোমানরা তাদের আচার ব্যবহারের বেশিরভাগ গ্রহণ করেছে আর ইতিহাসে যা দেখা যায় যে রোমান রাজ্যে কুসংস্কারকে পুঁজি করে চলার বহু উদাহরণ আছে। সেই সময়ের জন্য এট্রুস্কানদের শিল্প আর কারিগরি দক্ষতা ছিল সবার মধ্যে প্রথম শ্রেণির। তাদের নগরগুলো ছিল প্রশস্ত আর মজবুত পাচিল দিয়ে ঘেরা । বড় বড় পাথরের টুকরো সিমেন্ট ছাড়াই জোড়া লাগিয়ে তারা প্রকাণ্ড সব পাঁচিল বানিয়ে ফেলেছিল। তারা বড়ো রাস্তাঘাট আর খাল বানিয়েছিল; বানিয়েছিল গ্রিকদের চেয়েও বড়ো বড়ো মন্দির যেসবে ছিল গম্বুজ আর আর্চের আকৃতি, যে আকৃতি গ্রিকদের মন্দিরে তেমন দেখা যায়নি। বাড়িতে তাদের মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অবস্থানে থাকত। প্রাচীন বেশিরভাগ সভ্যতায় এমনটা দেখা যায়নি তাই তাদের আচার ব্যবহারে যেহেতু এমনটা দেখা গেছে, তাদের সভ্যতা তথা কৃষ্টিকে ‘আধুনিক’ বলে আখ্যা দেয়া যায়।

ইতালিতে অন্যান্য জাতির প্রবেশ ও তদকালীন রোম

ফিনিশিয়ানদের আগমন ও কার্থেজ : কিন্তু এট্রুসকানরা যখন নিজেদেরকে ইতালিতে থিতু করার চেষ্টা করল, পূর্বের থেকে অন্যান্য জাতিও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হলো। ফিনিসিয়ানরা- ভূমধ্যসাগরের পূর্বদিক থেকে এগিয়ে আসছিল, তারা সংগঠিত হচ্ছিল এবং আফ্রিকার উত্তর দিকে অনেকগুলো নগরে বসতি স্থাপনে ব্যস্ত ছিল। সেসবের মধ্যে পরবর্তীকালে প্রভাবশালী নগর হিসেবে পরিচিত হয়েছিল কার্থেজ, আধুনিক তিউনিসিয়ার অবস্থান যেখানে। ইতিহাস অনুযায়ী কার্থেজের পত্তনের সময় হলো খিষ্টপূর্ব ৮১৪ সাল। ইতালির প্রান্ত থেকে কার্থেজের দূরত্ব ছিল মাত্র ২৫০ মাইল, আর ইতালি এবং কার্থেজের মাঝখানে সিসিলি নামের বিশাল ত্রিভূজাকৃতি এক দ্বীপ ছিল, বাকি পৃথিবী থেকে দেখলে হয়ত মনে হতো ইতালির পায়ের জুতোর সামনে ত্রিকোণাকৃতি একটি ফুটবল, এক্ষুণি লাথি মারা হবে। দ্বীপটির ত্রিভূজাকৃতির জন্য গ্রিকরা এর নাম দিয়েছিল ট্রিনাকট্রিয়াহ্‌, যার অর্থ হলো “তিনটি কোণ বিশিষ্ট”। তবে যে নামে সেই দ্বীপ বেশি পরিচিত ছিল তা হলো “সিসিলি” যা কিনা আদতে নেয়া হয়েছিল একটি উপজাতির নাম থেকে, সেখানকার সবচেয়ে আদিম উপজাতি, সিসেলস। সিসিলির পশ্চিম প্রান্ত থেকে কার্থেজ ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমে মাত্র ৯০ মাইল দৃরে।

গ্রিকদের আগমন : গ্রিকরাও তাদের জনবসতির সবচেয়ে বেশি ঘনত্বের কেন্দ্র থেকে পশ্চিম দিকে সরে যেতে থাকে, সরতে সরতে তারা ইতালির পর্বতাঞ্চলের ২০০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম পর্যন্ত চলে যায়। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দিতে দক্ষিণ ইতালিতে গ্রিকরা বহু উন্নত নগরের পত্তন ঘটায়; নগরগুলো এতই বড়োসড়ো হয়ে ওঠে যে ওই অঞ্চলটাকে পরবতীকালে ম্যাগনা গ্রেশিয়া নামে ডাকা হয়। ম্যাগনা গ্রেশিয়ার নগরগুলো, যা পরে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে, তাকে গ্রিকরা ডাকা শুরু করে টারাস বলে যেখানে কিনা রোমানরা বলত টুরেনটাম। খিস্টপূর্ব ৭০৭ সালে নগরগুলোর পত্তন শুরু হয় আর ইতালিয়ান পাহাড়ি অঞ্চলের পাশে ভেতরের দিকে সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চল দখল করে গড়ে ওঠে, যেখানে সমৃদ্র সৈকতটি পায়ের গোড়ালির মতো একটি অর্ধগোলাকৃতি গঠন নিয়ে বিস্তৃত।

ইতালীতে গ্রিকদের উপনিবেশ স্থাপন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান

তদকালীন ইতালিতে বিভিন্ন জাতির অবস্থান : সিসিলি দ্বীপটি গ্রিক এবং কার্থেজের অধিবাসীদের মিলিত বসবাসের জায়গা ছিল, পূর্ব দিকে গ্রিক এবং পশ্চিম দিকে কার্থেজ থেকে আগত মানুষেরা বাস করত। এর পত্তন হয়েছিল খিস্টপূর্ব ৭৩৪ সালে। দ্বীপটি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সমুদ্র সৈকতে এর অবস্থান। খিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে ওই অঞ্চলের অবস্থাটা এরকমই ছিল। ইতালির মধ্যভাগে শাসন করত এট্রুস্কানরা আর দক্ষিণ দিকে গ্রিকরা, যেখানে কিনা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দিগন্ত পর্যন্ত ছিল কেবলই কার্থেজ থেকে আগত লোকেদের দখলে। আর রোম সেই সময়ে কেবলই টিবার নদীর দক্ষিণ দিকের তীর ঘেঁষে একটা ছোটো গ্রাম, এ্রুসকানদের সীমানার ঠিক পরপর।

তদকালীন রোম – লাইশিয়াম : রোম ছিল ইতালিয়ান এক ভূখণ্ডের অংশ, যার নামকরণ করা হয়েছিল লাইশিয়াম, যে নগর সমুদ্রের তীর ধরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একশ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। লাইশিয়ামে, এট্রুরিয়ার মতই সুসংগঠিত কোন নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা ছিল না। বরং প্রতিটি জেলায় ছিল বেশ কিছু ছোটো ছোটো নগর; খামারের উপযুক্ত কিছু খণ্ড খণ্ড অঞ্চল এবং একটি কেন্দ্রীয় নগর। প্রতিটি নগরেই নিজস্ব নিয়মকানুন ছিল, তবে সর্বজনীন শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য আশেপাশের অন্যান্য নগরগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখত। লাইশিয়ামের প্রায় তিরিশটি নগরের সাধারণ ভাষা ছিল ল্যাটিন। একইরকম সামাজিক নিয়মকানুনও অনুসরণ করত, আর একইরকমের কিছু আচার ব্যবহারও ছিল। এইসবকিছু মিলিয়েই তারা খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ সালের দিকে ল্যাটিন জোট তৈরি করে, সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম দিকে এট্রুস্কানদের রাজ্যের যে আগ্রাসন তার সঙ্গে পালা দিতেই তারা একত্রিত হয়ে নিজেদের শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা করেছিল। সেই সময়ের ল্যাটিন জোটের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী নগরের নাম হলো অ্যালবা লঙ্গা, যে নগরটা ছিল ঠিক সেইখানে, পরবর্তীকালে রোম যেখানে তৈরি হয়েছিল সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় বারো মাইল দূরে। পরে সে নগর রোমেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।

রোমের পত্তন ও প্রাথমিক কাল

রোমের উত্থান সম্পর্কিত পুরাণ

রোমের পত্তন এবং তারও আগের আনুষঙ্গিক ইতিহাস রহস্যের আড়ালে এমনভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে যে তা হয়ত কখনোই প্রকাশিত হবে না। যাই হোক, পরের বছরগুলোতে রোম যখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে রোমের ইতিহাসবিদেরা রোমের পত্তনের ব্যাপারে মজার মজার সব কাহিনি নিয়ে হাজির হলেন, রোমের শুরুর দিনগুলোর আকর্ষণীয় সব ঘটনার বর্ণনা থাকল তাতে। তবে এগুলোর বেশিরভাগই পৌরাণিক কল্পকাহিনি। রোমানরা যখন তাদের কল্পকাহিনীগুলো বাড়িয়ে চড়িয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল, গ্রিক সভ্যতার স্বর্ণযুগ ততদিনে, কিন্তু তখনো গ্রিক সভ্যতার অতীত গৌরবের কথা প্রতি মুহূর্তে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হতো। গ্রিক সভ্যতার পথে গৌরবের প্রাচীন ইতিহাস হলো ট্রোজান যুদ্ধ, আর সেই যুদ্ধ এমন একটা সময় যেখান থেকে রোমান ইতিহাসবিদরা নিজেদের ইতিহাস শুরুর প্রয়াস পায়। ট্রোজান যুদ্ধের সময়ে গ্রিক সেনাবাহিনি এশিয়া মাইনরের ঈজিয়ান সাগরের উত্তর-পশ্চিম সৈকত পেরিয়ে চলে গেল যেখানে তখন ছিল বিখ্যাত নগর ট্রয়। বহুদিন ধরে সেই নগরটা দখলের প্রচেষ্টায় থাকা গ্রিকরা একবার সত্যিকার অর্থেই দখল নিয়ে নিল আর আস্ত নগরটা দিল পুড়িয়ে। সেই পুড়তে থাকা নগর (যেমনটা বিভিন্ন কাহিনিতে বর্ণিত হয়েছে) থেকে পালিয়ে বাঁচা ছিল সবচেয়ে সাহসী ট্রোজান কিংবদন্তী ঈনিয়াসের সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ এবং বড়ো সাফল্য। আরো কিছু উদ্বাস্তুদের নিয়ে তিনি বিশটি জাহাজে করে সমুদ্রে যাত্রা করলেন, বেরিয়ে পড়লেন নতুন নগরের পত্তন করার উদ্দেশ্যে যেখানে গ্রিকরা তাদের তাণ্ডব চালিয়ে আগেই ধ্বংস করেছে, সেসব জায়গার কোথাও।

বহু নতুন জায়গা ঘুরে তিনি আফ্রিকার উত্তর সমুদ্র সৈকতের এক নগরে গিয়ে উপস্থিত হলেন, যেখানে তখন সবে কার্থেজের পত্তন হয়েছে, রাণী ডিডো তখন সেই নগরের নেতৃস্থানীয়। রাণী ডিডো সুপুরুষ ঈনিয়াসের প্রেমে পড়ে যান। কিছুদিনের জন্য ট্রোজানরা আফিকায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়, ডিডোকে বিয়ে করে ঈনিয়াস কার্থেজের রাজা হিসেবে দিন কাটানোকেই তখন শ্রেয় মনে করেন। যদিও, পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, দেবতারা জানতেন যে এই ইচ্ছে তার ভগ্যে লেখা ছিল না। দেবতারা তাকে একজন প্রতিনিধি পাঠান, প্রতিনিধি এই নির্দেশ নিয়ে আসে যে ঈনিয়াস যেন জায়গাটা দ্রুত ছেড়ে দেন। ঈনিয়াস বরাবর দেবতাদের মেনে চলতেন তাই রাণী ডিডোকে না জানিয়েই তাড়াহুড়ো করে কার্থেজ ত্যাগ করেন। বেচারা রাণী নিজেকে পরিত্যাক্ত মনে করেন, আর তারপর বেদনায় নিজেকে হত্যাও করেন। ঈনিয়াসের কাহিনির এই পর্যায়টা সবচেয়ে আবেগের, আর রোমের লোকেরাও সেই আবেগে হাবুডুবু খেয়েছে কারণ রোমের প্রাথমিক ইতিহাসের সঙ্গে কার্থেজের যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে সেখানে। ডিডোর সময়ের অনেক দিন পর রোম আর কার্থেজের মধ্যে তুমুল লড়াই লেগে যায়, আর সেই যুদ্ধে কার্থেজ হার স্বীকার করে, তাই এসব দেখেশুনে মনে হয় কার্থেজের শাসক যেন রোমের মানুষের প্রেমে প্রাণ দিয়েছিল। কার্থেজ রোমের কাছে কি ভালোবাসায় কি যুদ্ধে, দুটোতেই হেরে গেল।

যাই হোক, এর কোনোটাই আদতে পৃথিবীতে হয়েছে বলে মনে হয় না, এমনকি কার্থেজ এবং ঈনিয়াসের কোনোদিন কোনো অস্তিত্ব থাকলেও। বাস্তব হলো, ট্রোজান যুদ্ধ খিস্টপূর্ব ১২০০ সালে সংঘঠিত হয়েছিল এবং কার্থেজ নগরের পত্তন সম্ববত তারও প্রায় চারশ বছর পরে। সত্যিকার অর্থে ভাবলে এই গল্পটি এমন যে কলম্বাস আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেবার জন্য রওনা দিলেন আর মাঝপথে ইংল্যান্ডে বিশ্রাম নেবার জন্য দাঁড়াল আর রাণী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়ে গেল। ঈনিয়াস কার্থেজ নগর ছেড়ে আসার পরে সোজা দক্ষিণ-পূর্ব সৈকত বরাবর রওনা দেন যেখানে ল্যাটিনাস নামে একজন রাজার রাজত্ব ছিল, রাজার নামেই সে রাজ্য, রাজ্যের মানুষ এবং ভাষার নাম দেয়া হয়েছিল। ঈনিয়াস ল্যাটিনাসের কন্যাকে বিয়ে করলেন (তিনি তার প্রথম স্ত্রীকে ট্রয় নগরে হারিয়েছিলেন) এবং আশেপাশের ছোটোখাটো নগরগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক কিছু যুদ্ধের পরে ঈনিয়াস লাইশিয়াম রাজ্যের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হলেন। ঈনিয়াসের পুত্র অ্যাসকেইনিয়াস এর তিরিশ বছর পরে আ্যালবা লঙ্গা রাজ্যের পত্তন করেছিলেন। আর তার উত্তরসূরিরাই রাজা হিসেবে সেই রাজ্যে শাসন করেছিলেন। অ্যালবা লঙ্গার পরের রাজা হয়েছিলেন তার বড় ভাই, ছোটো ভাই তাকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন বলে জানা যায়। প্রকৃত রাজার কন্যার কোলে দুই যমজ শিশু পুত্রের জন্ম হয়েছিল। আততায়ীরা তাদের খুঁজে বের করে মেরে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল যেন তারা বড়ো হতে না পারে আর রাজ্যের শাসকের আসনেও বসতে না পারে। তাই তারা বাচ্চাদুটিকে বাকশের মধ্যে করে টিবার নদীর জলে ভাসিয়ে দিল। সন্ত্রাসীর দল ভাবল, তাদের মেরে না ফেলে ওভাবে পাঠিয়ে দিলে এমনিতেই তারা মরে যাবে। কিন্ত নদীতে চৌদ্দ মাইল ভেসে যেতে না যেতেই বাকশোদুটো তীরে এক জায়গায় আটকে যায়। আটকে যায় একটা পাহাড়ের গায়ে, যেটাকে পরে প্যালেটাইন পাহাড় নাম দেয়া হয়েছিল। একটা মা নেকড়ে বাচ্চাদুটিকে পায় আর আদর যত্ন করে রাখে (এটাই হয়ত ওই গল্পের সবচেয়ে গাঁজাখুরি অংশ, আবার একই সঙ্গে সবচেয়ে জনপ্রিয়ও। এই কাহিনি রোমানদের এমনভাবে গর্বিত করে যে তারা মনে করে তাদের পূর্বপুরুষ শৈশবেও নেকড়ের মতো সাহসী আর শক্তিশালী ছিল)।

পরে এক রাখাল তাদেরকে নেকড়ের সঙ্গে দেখতে পায়। কোনোভাবে নেকড়ের বাহু থেকে তাদের নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যায়। নিজের বাচ্চার মতো করে তাদের মানুষ করে সে। তাদের নাম রাখে রোমুলাস আর রেমুস। ছেলেদুটো যখন বড়ো হয় তখন অ্যালবা লঙ্গায় ফিরে যায়। সিংহাসনের অবৈধ দখলদারের সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা আর তাদের হাত থেকে সিংহাসন দখল করে আবার সসম্মানে নিজেদের মাতামহের হাতে তুলে দেয়, যে কিনা আ্যালবা লঙ্গার সত্যিকারের বাজা। তারপর যমজ দুই ভাই টিবার নদীর তীরে নিজেদের জন্য নিজস্ব নগর তৈরির চিন্তাভাবনা করে । রোমুলাস চাচ্ছিল যে নগরটা হোক সেই প্যালেটাইন পাহাড়ের গা ঘেঁষে যেখানে নেকড়ে তাদের কুড়িয়ে পেয়েছিল। কিন্তু রেমুস বলেছিল তার থেকে দক্ষিণ দিকে আধা মাইল দূরত্বে অ্যাভেনটাইন পাহাড়ের কথা। মতের মিল না হওয়াতে তারা দুজনে দেবতাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে পরামর্শের কথা ভাবল। এক রাতে তারা যে যার পছন্দের জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, ভাবল দেখা যাক ভোর বেলা কার ভাগ্যে কী ঘটে। ভোর হতেই যেই আকাশে আলো দেখা গেল, রেমুস দেখল আকাশে ছয়টা ঈগল (মতান্তরে, শকুন) উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সূর্য উঠতে না উঠতেই রেমুলাস দেখতে পেল বারোটা ঈগল। রেমুস বলল যে সে জিতে গেছে কারণ সেখানে সে-ই প্রথম পাখি দেখেছে। ওদিকে রেমুলাস বলল যে সে দেখেছে বেশি সংখ্যক পাখি, সুতরাং জিতেছে সে। এই বিতর্কে দুজনের মধ্যে এমন মারামারি লেগে গেল যে রেমুলাস রেমুসকে হত্যা করে বসল। আর তারপর প্যালেটাইন, যেখানে সে নতুন নগর চেয়েছিল সেখানেই নগরের সীমানা ধরে পাঁচিল ওঠাতে লাগল। সেই নগরের শাসনকর্তা হলো সে নিজে আর নামও রাখল নিজেরই নামানুসারে, রোম (বলা যেতে পারে, এখানে রেমুলাসের পরিবর্তে রোমুলাস নামটাই হয়ত পরে ইতিহাস বর্ণনার সুবিধায় পরে কল্পিত। কারণ রোমুলাস শব্দের অর্থ হলো ছোট রোম। রোমের পত্তনের কাহিনিকে বিশ্বাসযোগ্য করতেই এই নামের আবির্ভাব)।

রোমের পত্তনের সময়কাল

সবখানে যে তারিখের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেই হিসেবে রোমের পত্তন হয়েছিল খিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে। প্রাচীনকালে, সময় বা বছরের হিসেব রাখার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। একেক অঞ্চলে বলতে গেলে দিন তারিখের হিসেব রাখার জন্য একেক নিয়ম অনুসরণ করা হতো। কখনো এমনও হতো যে একটা বছর সেই সময়ের কোনো শাসকের নামে নামকরণ করা হলো। যেমন, “সিরেনিয়াস যে বছরে গভর্নর ছিলেন” অথবা “ডারিয়াসের শাসনের দশম বছর”। আরেকটা ব্যাপার হলো, গুরুত্বপূর্ণ জাতিদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তারা তাদের অতীতের স্মরণীয় কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাল বা সময়ের গণনা করেছে। ঠিক সেভাবে রোমুলাস তাদের রোম নগরের পত্তনের সময়টাকে স্থির ধরে সেখান থেকে আগের এবং পরের বছর গোনার নিয়ম করল। এই নিয়মে একটি নির্দিষ্ট বছরকে তারা যেভাবে বলত, যেমন ২০৫ তম বছরকে বলত “Ab Urbe Condite,” মানে হলো গিয়ে “নগরটি পত্তনের পর থেকে”. আমরা হয়ত এরকম একটা সালকে 205 A.U.C লিখে প্রকাশ করতে পারি (তবে রোমানরা একে লিখবে CCV A.U.C)। অন্য নগর এবং অন্য জাতিরা সময় গননার ভিন্ন ব্যবস্থা অনুসরণ করত। আর এ কারণেই প্রাচীন কালের ঘটনাগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের হিসেবের আওতায় আনা দুরুহ। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন ঘটনার তুলনামূলক বিচারে দুই ভিন্ন স্থানের বা জাতির আওতায় এনে বিচার করার চেষ্টা করা যায়। সভ্য পৃথিবী বহুদিন থেকেই যিশু খ্রিস্টের জন্মের সময় থেকে আগে ও পরে গণনার নিয়ম চালু করেছে। আর আমরা যেমন বলি 1863 AD, এখানে “AD” বলতে বোঝায় “Anno Domini” (মানে হলো, যিশুখ্রিস্ট যে বছরে জন্মেছিলেন)।

খিস্টপূর্ব ৫৩৫ সালে সিরিয়ার একজন জ্ঞানী ব্যক্তি, ডিওনিসিয়াস এক্সিগাস, যিশুখিস্ট ৭৫৩ সালে জন্মেছেন বলে একটি দাবি তুললেন (তিনি উল্লেখ করলেন রোমের পত্তন থেকে ৭৫৩ বছর পরে যিশুর জন্ম হয়েছে)। কিন্তু এখন আমরা জানি যে ওই সালটা যিশুর জন্মের অন্তত চার বছর পরের। যিশু জন্মেছিলেন যখন হ্যারড ছিলেন জুডিয়ার রাজা। আর রোমের পত্তনের ৭৪৯ বছর পরে হ্যারডের মৃত্যু হয় জুডিয়ায়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ডিওনিসিয়াসের উল্লেখকৃত তারিখটিও নানান জায়গায় দেখা যায়। আমরা এখন শুদ্ধভাবে বলি যে যিশুখিস্ট জন্মেছিলেন রোমের পত্তনের ৭৫৩ বছর আগে আর সে বছরটাকে আমরা খ্রিস্ট পরবর্তী ১ বলে অভিহিত করি। এর মানে হলো রোমের পত্তন হয়েছিল যিশু খিস্টের জন্মের ৭৫৩ সালে। যাকে আমরা লিখব “খিস্টপূর্ব” ৭৫৩ অব্দ। এখন সেই সময়টাকে আরো সরলভাবে বুঝতে হলে, ভালো করে দেখা যাক খিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে, যে বছর রোমের জন্ম হলো, তখন পৃথিবীর অবস্থাটা সত্যিকার অর্থে কেমন ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ১২০০ মাইল দূরে ইজরায়েল রাজ্য তখন রাজা দ্বিতীয় জেরোবোয়াম এর তত্ত্বাবধানে দারুণভাবে ফুলেফেপে উঠছে। কিন্তু আরো পূর্ব দিকে এগোলে, অসিরিয়া রাজ্য তখনো পশ্চিম এশিয়ার বড়ো এলাকা জুড়ে একটি শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংখাম করে যাচ্ছে। মিশর তখন একটি দুর্বল সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছিল আর তার পরের অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই তারা আসিরিয়ার দখলে চলে যায়। গ্রিকরা তখন খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের বর্বর হামলার ক্ষয়ক্ষতি মুছে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত। অলিম্পিয়ান খেলার আসর রোমের পত্তনের মাত্র তেইশ বছর আগে শুরু হয় (পরবতীকালে লেখা গ্রিসের ইতিহাস অনুযায়ী), আর তখন গ্রিস সিসিলি দ্বীপ আর ইতালির দক্ষিণ উপকূলসহ ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের অঞ্চলে বিস্তার লাভ করছিল। ইজরায়েল, মিশর এবং গ্রিসের অধিবাসীদের কাছে ইতালির সাধারণ একটা পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট গ্রাম রোমের পত্তনের খবর এতটুকুও ছিল না তখন। অথচ তারপরেও, সেই গ্রামই ছিল সেই সম্ভাবনা যা কিনা সুদূর ভবিষ্যতে অসিরিয়ার শাসকদের চেয়েও শক্তিশালী রাজ্য স্বাপন করেছিল এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে তখনকার ইজরায়েল, মিশর আর গ্রিসের লোকেদের উত্তর প্রজন্মের উপর শাসনের ছড়ি ঘুরিয়েছে।

রোমের পত্তনের প্রথম দেড় শতাব্দী ও সাতজন রাজা

সাবিনিজদের সাথে যুদ্ধ : রোমান কাহিনি অনুযায়ী রোমুলাস খিস্টপূর্ব ৭১৬ সাল পর্যন্ত রোমের শাসন করে। আর তারপর একদিন সে ভয়ানক ঝড়ঝাপটায় উধাও হয়ে যায়। বলা হয়, যুদ্ধের দেবতা কুইরিনাস হিসেবে তাকে বসানোর অভিপ্রায়ে বিধাতা তাকে তুলে নিয়েছেন। তার মৃত্যুর সময়ে রোম নগর প্যালেটাইন থেকে ক্যাপিটোলাইন আর উত্তরে কুইরিনাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল। ওই এলাকা নিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে গল্পটা শোনা যায় তা হলো, রোমুলাসের সময়ে রোম স্থাপনে অদ্ভুত এক সমস্যা হয়েছিল। রোমুলাস দেখলেন, পুরুষেরা সেখানে গিয়ে বসবাস শুরু করছে কিন্তু নরীরা যাচ্ছে না। তাই পুরুষরা তখন সাবিনিজ নামে একটি জাতির সমস্ত মেয়েদের জোড়পূর্বক রোমে নিয়ে গিয়ে বসবাস করাতে শুরু করেছিলেন। সেই কাজটা করতে তাদের যেমন ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছিল তেমনি বলপ্রয়োগও করতে হয়েছিল। সাবিনিজদের কাছে সেটা ছিল একটা যুদ্ধের মতই। আর এভাবেই রোমের লোকেরা তাদের সর্বপ্রথম যুদ্ধটা লড়ে সাবিনিজ জাতির সঙ্গে। সাবিনিজেরা ক্যাপিটোলাইন পাহাড়ের দখল নিয়ে নেয়। আর রোমান এক কমান্ডারের কন্যা তারপেইয়ার বিশ্বাসঘাতকতায় তারা জয়ের মুখ দেখে। সবিনিজেরা তারপেইয়াকে তাদের বাম হাতে যে মুল্যবান জিনিস পরানো থাকত তার লোভ দেখিয়ে যুদ্ধে জিতে গেল, নগরের দরজা খুলে দিতে বলল তাকে (তারপেইয়া শর্ত দিয়েছিল যে সবিনিজদের বাম হাতে তারা যে সোনার চুড়িটা পরে সেসব তাকে দিয়ে দিতে হবে)। আর সেই রাতে তারপেইয়া গোপনে তাদের প্রবেশের জন্য নগরের দরজা খুলে দিল। কিছু সাবিনিজ সৈন্য সেদিক দিয়ে নগরে প্রবেশ করল। প্রথমেই তারা তাদের বাম হাতে ধরে রাখা ঢালগুলো তারপেইয়ার দিকে ছুঁড়ে মারল। যে হাতে সোনার চুড়ি ছিল, সেই একই হাতে লোহার ঢালও ধরে রেখেছিল তারা। বেশিরভাগ যোদ্ধা যেমন একজন বিশ্বাসঘাতককে ব্যবহার করে; সাবিনিজরা তা করেনি। তারা তারপেইয়ার সঙ্গে একমত হতে পারেনি এবং তর্কের এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করেছে। ক্যাপিটোলাইন পাহাড় থেকে বেরিয়ে থাকা একটা চুড়ার নাম তারপেইয়ান পাহাড়। তারপেইয়ার মতো বিশ্বাসঘাতককে স্মরণ করতে পাহাড়ের সেই চুড়াটিকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কার্যকরের জন্য নির্ধারিত স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মনে করা হতো যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা যেন জীবনের শেষ মুহূর্তেও তারপেইয়ার অপরাধের গুরুত্বের কথা ভেবে নিজের অপরাধের গুরুত্বের কথা ভাবতে পারে। সাবিনিজদের হাতে ক্যাপিটোলাইন পাহাড় বেদখল হয়ে যাবার পরেও তাদের এবং রোমানদের মধ্যে যুদ্ধ চলতে লাগল। শেষপর্যন্ত সাবিনিজ যেসব মহিলা রোমানদের বিয়ে করেছিল তারা যুদ্ধ থামাতে এগিয়ে এল (প্রাচীন গল্পে এমনই বর্ণনা দেয়া আছে)। তারা শান্তি আনতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর রোমান আর সাবিনিজরা একসাথে রোমের শাসনকার্ধ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিল আর তাদের দুই ভুখণ্ডকে একটি রাজ্য হিসেবে পরিচালনা করারও শুরু করল। সাবিনিজদের রাজার মৃত্যুর পরে রোমুলাস রোম এবং সাবিনিজদের রাজ্য দুটোতেই শাসনকার্য চালাতে লাগল। কোনো সন্দেহ নেই, এসব যুদ্ধের ঘটনায় এটুকু বোঝা যায় যে রোমের পত্তনের সময়ে রোমুলাস আর রেমুসের কাহিনী যতটা মজার ছিল পরের দিনগুলো মোটেও ততটা সুখের ছিল না। একে একে সেই পাহাড়ের আশেপাশে সাতটা পাহাড়ের সমস্ত গ্রাম রোমের আওতায় চলে এল। নগরটা প্রাথমিক অবস্থায় একইরকমের তিনটি গ্রাম নিয়ে শুরু হয়েছিল, প্রতিটি গ্রামে একেকটি পৃথক জাতি তৈরি করেছিল একটি ট্রাইব’, একটিতে ল্যাটিন, একটিতে সাবিনিজ এবং আরেকটিতে এট্রুস্কানস। ল্যাটিন শব্দ ট্রাইবের অর্থ হলো তিন।

রাজা নুমা পম্পিলিয়াস ও রোমানদের ধর্ম : রোমুলাসের মৃত্যুর পরে নুমা পম্পিলিয়াস নামে একজন সাবিনিজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার জন্য নির্বাচিত হলো। আর তারপর খিস্টপূর্ব ৬৭৩ সাল পর্যন্ত রোমে শাসন করল। নুমা পম্পিলিয়াস সেই ব্যক্তি যিনি রোমে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করেন, যদিও প্রকৃতপক্ষে সেই ধর্মের বেশিরভাগই এট্রুসকান আর সাবিনিজদের থেকে ধার নেয়া হলো। যেমন কুইরিনাস (যাকে পরবর্তীকালে রোমুলাসকে পরাজিত করতে শোনা গেছে) ছিল সাবিনিজদের যুদ্ধের দেবতা যে কিনা তখন ল্যাটিন যুদ্ধদেবতা মার্সের সঙ্গে তুলনীয় ছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে, রোমানরা যেহেতু মর্যাদাসম্পন্ন গ্রিকদের পছন্দ করত, সেই গ্রিকদের প্রাচীন কাহিনী থেকেই নিজেদের দেবতা বাছাই করে নিল। এভাবেই রোমান জুপিটার গ্রিকদের দেবতা জিউসের সাথে তুলনাযোগ্য হয়ে যায়; জুনো হয়ে যায় হেরা; মার্স হয় অ্যারেস; মিনার্ভা হয় অ্যাথিনা; ভেনাস হয় আফ্রোদিতি; ভলক্যান হয় হিফ্যাস্টাস, আরো অনেক উদাহরণ আছে। নামের এই পরিবর্তনগুলো এত দ্রুত এসেছিল এবং এতই দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল যে আজকালকার দিনে গ্রীক কাহিনির বর্ণনায় আমরা রোমানদের রাখা নামগুলো ব্যবহার করি। কারণ রোমান নামগুলোই পরবর্তী কালে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আর প্রাচীন গ্রীক কাহিনির ভিড়ে রোমানদের নিজস্ব পুরোনো গল্পগুলো হারিয়ে গেছে। তবে তারপরেও কিছু রোমান ধর্মীয় কাহিনি রয়ে গেছে যা কিনা কড়াকড়িভাবে রোমানই ছিল। কারণ সেই কাহিনিগুলোতে কোনো গ্রিক চরিত্র বা দেবতা ছিল না। সেই কাহিনির একটি হলো জানুস দেবতার কাহিনি, যার পুজা নুমা পম্পিলিয়াস প্রবর্তন করেছিলেন বলে জানা যায়। জানুস হল দরজার দেবতা, এখানে দরজার অর্থ গভীর। দরজা বলতে প্রবেশ এবং বাহির বোঝানো হতো। যার বিস্তারিত অর্থ দাঁড়ায় যে কোনো বিষয়ের শুরু এবং শেষ (জানুয়ারি মাস নামটি, যা বছরের প্রথম মাস, যার নাম তার নামে রাখা হয়েছিল। আর তাকে দিয়ে আরো একটা ব্যাপার বোঝানো হতো, তা হলো সেই একটি ইমারতের দরজার রক্ষক)। জানুসের ছিল দুটো মুখ। একটি মুখ পেছন থেকে সামনের দিকে এবং আরেকটি মুখ সামনে থেকে পিছনের দিকে তাকিয়ে থাকত। এই দুরকম দৃষ্টির মাধ্যমেই শুরু এবং শেষ বোঝানো হতো। জানুস দেবতার মন্দিরে দুটো অর্গোলাকৃতি দরজা ছিল যার মধ্যে দিয়ে কেউ ঢুকতে এবং বেরোতে পারত। অর্ধগোলাকৃতি দরজাদুটো দুটো দেয়ালের মাধ্যমে যুক্ত ছিল। রোমে যখন যুদ্ধ লাগত তখন জানুস দেবতার দরজা খুলে দেয়া হত আর শান্তি বিরাজ করার সময়ে থাকত বন্ধ। নুমার শান্তিপূর্ণ শাসনামলে দরজাদুটো বন্ধ থাকত। তবে রোমের যুদ্ধপ্রবণ ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে তার পরের সাত শতাব্দীতে, যতদিন রাজ্যে রোমান আধিপত্য চলেছে, জানুসের দরজা দুটো খুব কম সময়ই বন্ধ ছিল, ঠিকমতো বলতে গেলে মাত্র চার বার এবং প্রতিবার খুব অল্প সময়ের জন্য।

রাজা টুলুস হস্টিলিয়াস ও এট্রুসকানদের সাথে সম্পর্ক : খিস্টপূর্ব ৬৭৩ সালে নুমা পম্পিলিয়াস মারা গেলে টুলুস হস্টিলিয়াস তৃতীয় রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন। তার শাসনামলে রোম চতুর্থ আরেকটা পাহাড়ে রাজত্ব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, যে পাহাড়ের নাম ছিল সিলিয়ান পাহাড়, পাহাড়টা ছিল প্যালেটাইনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। সিলিয়ান পাহাড়ে টুলুস তার রাজপ্রাসাদ বানিয়েছিল। ততদিনে ল্যাটিনিয়াম নগরগুলোর মধ্যে রোমের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। টিবার নদীর তীরবর্তী অবস্থানের জন্য সেখান থেকে ব্যবসাবাণিজ্য খুব ভলোভাবে হতে পারত, যা নগরটাকে দ্রুত উন্নতির দিকে নিয়ে গেল। তার ওপরে নদীর অন্য দিকে এট্রুসকানদের সভ্য নগরী থাকায় রোম যতটুকু পেরেছে সেখান থেকে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে। আর রোম নগরের মধ্যেও বহু এট্রুস্কান থাকায় তাদের পুরোনো নগরের সঙ্গে রোমের সম্পর্ক ভালো থকার প্রয়াস পেয়েছে। তাদের কারণেই নিজেদের মধ্যে শর্ত বা সমঝোতায় সুবিধা হতো আর দুই নগরই বুঝত যে দরজার বাইরে বসে থাকা শত্রুর সঙ্গে খামোখা লড়ে লাভ নেই। কিন্তু তারপরেও, নিজেদের সুরক্ষার খাতিরে রোমানরা বরাবর একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বজায় রাখত।

অ্যালবা লঙ্গার সাথে যুদ্ধ ও হোরেইশির কাহিনী : অ্যালবা লঙ্গা নগরটি ল্যাটিয়ামের উপরে আধিপত্য বিস্তার করে ছিল বহুদিন, তাই পাশেই রোমের উত্থান তারা ততটা ভালো চোখে দেখেনি। দুই নগরের মধ্যে তাই প্রায়ই ছোটোখাটো যুদ্ধ লেগে থাকত আর এভাবেই খিস্টপূর্ব ৬৬৭ সালে একটা বড়োসড়ো যুদ্ধ লেগে যাবার সম্ভাবনা দেখা গেল। সেই যুদ্ধের প্রারম্ভে (রোমান কিংবদন্তীরা যেভাবে বর্ণনা করেছেন) একটি তলোয়ার লড়াইয়ের মাধ্যমে বিষয়টার ফয়সালা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। রোমানরা নিজেদের মধ্যে থেকে তিন জন মানুষ বেছে নিল। আর অ্যালবা লঙ্গা একইভাবে তিনজনকে বাছাই করল। সেই ছয়জন মানুষ তিন জনের বিরুদ্ধে তিনজন তলোয়ারের লড়াই চালিয়ে যেতে লাগল। তাদের লড়াইয়ের উপরে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল ছিল। রোমানরা একই পরিবারের তিনজনকে বেছে নিয়েছিল যাদের নামের শেষে পদবী ছিল হোরেইশিয়াস, আর ল্যাতিন ভাষায় তাদের সকলকে একত্রে বহুবচনে বলা হত হোরেইশি। অ্যালবানরাও তিনজন ভাইকে একই পরিবার থেকে বেছে নিল, তাদের পদবী ছিল কুরিয়াশি। সেই তলোয়ার যুদ্ধে দুজন হোরেইশি মৃত্যুবরণ করল। যদিও হোরেইশিদের মধ্যে যে বেচে গেল সে ছিল একেবারে অক্ষত যেখানে কিনা কুরিয়াশির প্রতিটি যোদ্ধাই ছিল রক্তাক্ত এবং আহত। তাই হোরেইশিরা তখন কৌশলের আশ্রয় নিল। অক্ষত হোরেইশি পালিয়ে যেতে চাইল। তিনজন আহত কুরিয়াশি তাকে ধাওয়া করল। তারপর হোরেইশি নতুন উদ্দমে ঘুরে দাড়াল আর প্রথমে সবচেয়ে বেশি আহত কুরিয়াশিকে হত্যা করল। একমাত্র হোরেইশিয়াস তারপর একে একে বাকি দুজন কুরিয়াশিকেও হত্যা করল। আর এভাবেই রোম আযালবা লংগাকে হারিয়ে তলোয়ার যুদ্ধ জিতে গেল। সেই যুদ্ধের কাহিনির পরেও তাদের গল্পগুলো আরো ডালপালা মেলেছে। তলোয়ার যুদ্ধে জিতে যাবার পর হোরেইশিয়াস যখন বিজয়ীর বেশে নগরে প্রবেশ করল, বিজয়োৎসবের এক পর্যায়ে তার আপন বোন এসে তাকে সম্মাননা জানাল। সেই বোনটি একজন কুরিয়াশির বাগদত্তা ছিল। তাই যুদ্ধে জেতার জন্য ভাইকে অভিবাদন জানাল ঠিকই তবে মনে মনে খুশি হতে পারল না বলেই হয়ত কিছ্টা প্রতিবাদ করে উঠল, এবং তা বেশ জোরেসোরে। তখন রেগে গিয়ে হোরেইশিয়াস কোমর থেকে তলোয়ার বের করে বোনকে হত্যা করল, চিৎকার করে বলল, যত রোমান মহিলা ওদের জন্য দুঃখ করবে তাদের সবার এই একই পরিণতি হবে। রোমানদের কাছে এই কাহিনি খুবই জনপ্রিয় কারণ এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চায় যে পরিবার বা আপনজনের অনুভূতির চেয়ে দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা বেশি। দেশের স্থার্থকেই তারা দায়িত্বের সবচেয়ে ওপরে রাখে বরাবর। প্রকৃতপক্ষে, এরকম ত্যাগ কেবল কাহিনিতেই দেখা গেছে, বাস্তব রোমান ইতিহাসে এর উদাহরণ কমই আছে। আ্যালবা লঙ্গা নগরটি যেন সেই তলোয়ার যুদ্ধেই তাদের চিরকালের পরাজয় বরণ করে নিয়েছিল, তাই পরে আর বিদ্রোহ করে ওঠার সাহস জোটাতে পারেনি। আর খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৫ সালে নগরটি রোমানরা দখল করে নিয়ে ধ্বংস করে ফেলে।

রাজা অ্যাংকাস মারশিয়াস, সিনেট, প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবিয়ান : খিস্টপূর্ব ৬৪১ সালে যখন টুলুস হস্টিলিয়াস মৃত্যুবরণ করেন, রোমানরা নুমা পলিম্পিয়াসের এক নাতিকে সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নিল (যে শাসক বরাবর রোমানদের বর্ণনায় ধার্মিক এবং গুণী একজন শাসক ছিলেন)। নতুন সেই চতুর্থ শাসকের নাম ছিল অ্যাংকাস মারশিয়াস। রোমান রাজ্যের শাসনের প্রথম শতাব্দী এবং রোমান সামাজ্যের অর্ধেক কাল পর্যন্ত রাজাদের এই কাহিনিগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট ভিত্তি নেই। রাজাকে বুড়ো লোকদের এক বিশাল বাহিনি রাজ্য শাসনে বুদ্ধি দিয়ে চলত। শাসকেরা সেই তৈরি করা বাহিনির উপরে সিদ্ধান্তের জন্য নির্ভর করত। সেই বয়স্ক বাহিনিকে বলা হতো সিনেট। সিনেট শব্দটি আসলে একটি ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ হলো “বয়স্ক মানুষ”। সিনেট রোমানদের মধ্যে এমভাবে দীড়িয়ে থাকত যেন কোনো পরিবারে বয়স্ক আর অভিজ্ঞ একজন অভিভাবক দাঁড়িয়ে আছেন। পরিবারের অভিভাবকের মতো সিনেটের দেয়া পরামর্শও মাথা পেতে নেয়া হতো। তাই সিনেটরদের প্যাট্রিশিয়ানসও বলা হতো, যে ল্যাটিন শব্দের অর্থ হলো “পিতা”। সিনেটরদের পরিবারকেও ওই একই নামে ডাকা হতো। সিনেটের পরবর্তী সদস্য ওই একই পরিবারগুলো থেকে বেছে নেয়া হতো। তাদের রীতিনীতি অনুযায়ী নতুন শাসক অ্যাংকাস মারশিয়াস দখলকৃত পৃথক ভূখণ্ড থেকে এক দল মানুষ রোমে নিয়ে এলেন, ক্রমশ বর্ধিত নগরটিতে কাজকর্ম করার জন্য যেন আরো কিছু মানুষ যোগ দেয়। তাদের নতুন বসতি হলো অ্যাভেন্টাইন পাহাড়ে, যেখানে রেমুস এক শতাব্দীরও আগে রোমের পত্তন করতে চেয়েছিলেন। তখন সেটি হলো রোমের বিস্তারের ক্ষেত্রে পঞ্চম পাহাড়। অ্যাভেন্টাইন পাহাড়ে বসতিস্থাপনকারী নতুন মানুষগুলো অবশ্যই রোমের প্রাচীন পরিবারগুলোর মতো সম্মানিত বা গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য হতো না, যদিও এ নিয়ে বহিরাগতদের তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিল না। নতুন পরিবারগুলোর কেউ সিনেটে বা সরকারি কাজে অংশগ্রহণ করতে পারত না। তাদেরকে বলা হতো প্লেবিয়ান, যার অর্থ হলো “সাধারণ মানুষ”।

তদকালীন এট্রুসকানদের অবস্থা : রোমের ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ে, এট্রুসকানরাও ছিল বেশ শক্তিশালী। টিবার নদীর তীরে গড়ে ওঠা ছোটো নগর রোমের চেয়ে তখন এট্রুসকানদের বড়ো নগর অনেক বেশি ক্ষমতাধর ছিল। এট্রুরিয়া যদি একটিমাত্র ক্ষমতাশালী নগরের মাধ্যমে পরিচালিত হতো তবে কোনো সন্দেহ নেই যে তারাই রোম দখল করে ফেলত আর এমনভাবে রোমকে নিজেদের নগরের ভিতরে মিশিয়ে ফেলত যে রোম বলে আলাদা কিছুর অস্তিত্বই কেউ কোনাদিন জানত না। কিন্তু এট্রুসকানদের নগরটা ছিল বলতে গেলে অনেকগুলো ছোটো ছোটো নগরের সমষ্টি এবং নগরগুলোর মধ্যে না ছিল কোনো সম্পৃক্ততা, বরং ছিল একের প্রতি অন্যের হিংসা। আর তাই এট্রুসকানদের ঝগড়ার সুযোগে পাশেই রোমের মতো নগরের বেড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। যদিও বাস্তব অবস্থাটা এমনই ছিল কিন্তু এটট্রুসকানরা আশেপাশে দখল চালাত। তারা উত্তর দক্ষিণে দখল প্রক্রিয়া চালু রাখলেও কোনো কারণে বলতে গেলে রোমের দিকে হাত বাড়ায়নি। রোমান এতিহাসিকরা অবশ্য বলেন যে রোমের উপরে এট্রুসকানদের তেমন কোনো অবদানই নেই, রোমান এতিহাসিকরা এমন কিছুই বলেননি যাতে মনে হতে পারে যে রোমানদের চেয়েও রাজ্যের বিস্তারে বা উৎকর্ষে অন্য কারো বেশি ভূমিকা ছিল।

রাজা লুসিয়াস টারকুইনিয়াস প্রিসকাস ও তার পরিচয় : রোমের পঞ্চম রাজা হলেন একজন এট্রুসকান, রোমান ঐতিহাসিকদের অবশ্য সেটা স্বীকার করতেই হয়েছে। তারপরেও রোমান ঐতিহাসিকেরা এট্রুস্কানদের মধ্যে থেকে পঞ্চম শাসক হওয়ার বিষয়টাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে রোমের পক্ষেই যেতে চেয়েছেন। পঞ্চম শাসক ছিলেন একজন গ্রিক উদ্বান্তুর পুত্র, যিনি এট্রুসকানে অভিবাসী হয়ে একজন এট্রুসকান রমনীকে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, তার মাতৃভূমি ছিল টারকুইনি নগরে, যে নগরটি এট্রুসকান সমুদ্র সৈকতে অবস্থিত, রোম থেকে ৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। তার নাম ছিল লুসিয়াস টারকুইনিয়াস প্রিসকাস। “লুসিয়াস” হলো তার নামের প্রথম অংশ, “টারকুইনিয়াস” হলো পদবী, রোমানরা তাকে এই নামটিই দিয়েছিল তার জন্মস্থান অনুসারে (ইংরেজরা যাকে আরো ছোটো করে বলে “টারকুইন”)। “প্রিসকাস” ছিল তার নিজস্ব নাম যা দিয়ে কেবল তাকেই বোঝানো হতো। তার নামের অর্থ হলো “বড়ো” অথবা “প্রথম”, যা দিয়ে বোঝানো হতো যে রোমের ইতিহাসে রাজ্য শাসনে তার পরিবার বা জাতির পক্ষ থেকে আসা মানুষ হিসেবে সেই প্রথম। টারকুইনিয়াস প্রিসকাস সম্ভবত রোমে অভিবাসী হিসেবে এসেছিলেন। তবে যুদ্ধে এবং কাউন্সিলে নিজের প্রসংসনীয় ভূমিকার মাধ্যমে তখনকার রাজা আ্যাংকাস মারশিয়াসকে এমনভাবে মুগ্ধ করেছিল যে রাজা তাকে শাসনকার্যের অন্তর্ভূক্ত তো করলই, নিজের ছেলেদের দেখাশোনার ভারও তার উপরে দিয়ে দিল। অ্যাংকাস মারশিয়াসের পুত্রদের মধ্যে কারো পূর্ণবয়স্ক হবার পরে অবশ্যই সিংহাসনে বসার কথা ছিল। কিন্তু রোমানরা টারকুইনিয়াস প্রিসকাসের উপরে এতটাই খুশি ছিল যে পরবর্তী রাজা অ্যাংকাস মারশিয়াসের পুত্রদের পরিবর্তে তাকে নির্বাচিত করল। (স্বাভাবিকভাবে ভাবতে গেলে এটা আসলে খুবই অবাস্তব। টারকুইনিয়াস মারশিয়াস রাজা থাকা অবস্থায় তিনি যেভাবে থাকতেন; কিন্তু রাজার মৃত্যুর পর খ্রিস্টপূর্ব ৬১৬ সালে তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।)

টারকুইনিয়াসের শাসনামলে রোমের উন্নতি ও এট্রুসকান সংস্কৃতির প্রবেশ : টারকুইনিয়াস প্রিসকাসের শাসনামলে রোমের উন্নতি হতে লাগল অনেকটা এট্রুসকানদের প্রথামতো। এট্রুসকানদের বিভিন্ন নিয়মকানুন বা কৃষ্টি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। সার্কাস ম্যাক্সিমাস টারকুইনিয়াসের বানানো যার নাম হলো “বিশালাকৃতি আংটি”। সেখানে স্টেজ হলো এক বিরাট ওভাল আকৃতির আর যার উপরে ঘোড়ার গাড়িগুলো দ্রুত চলে যেতে পারত, যেগুলোর টায়ারের উপরে অসংখ্য মানুষ বসে থাকত। এট্রুসকানদের মতো খেলাধুলারও প্রচলন করলেন টারকুইনিয়াস। খেলা বলতে দুই অস্ত্রধারীর যুদ্ধ, সেজন্য অংশগ্রহনকারীরা নিজেদের অন্যভাবে সাজাতে শুরু করলেন আর ধীরে ধীরে তাদের নাম হলো “গ্ল্যাডিয়েটর”। তাদের এরকম নামকরণের কারণ ছিল তাদের হাতের তলোয়ার, যাকে “গ্ল্যাডিয়াস” নামে ডাকা হত। আর তারপর টারকুইনিয়াস এট্রুস্কানদের ধর্মকেও সফলভাবে রোমে আনতে সক্ষম হলেন। ক্যাপিটোলিয়ান পাহাড়ের উপরে তিনি জুপিটারের মন্দির তৈরি করলেন। সেই মন্দিরটি যা কিনা নগরের একটি সুরক্ষিত জায়গা হিসেবে গণ্য হতো, তার নাম ছিল ক্যাপিটোল, ল্যাটিন শব্দ থেকে নামটা ধার করা হলো, যার অর্থ হলো “মস্তিষ্ক” (ক্যাপিটোল নামটা রোমের নাগরিকদের মনে অন্যরকম একটা ভাবের উদয় ঘটাত, যেন তাদের আপন এবং গুরুতৃপূর্ণ কিছু বোঝাত নামটি দিয়ে। সেই ভাবের অনুসারী হয়ে ওয়াশিংটন ডিসি-তেও যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার আচারের সভা বসত তাকে ক্যাপিটোল নামে তারা ডাকা শুরু করল)। রোমের সবচেয়ে প্রাচীন দুটো পাহাড়, ক্যাপিটোলাইন এবং প্যালেটাইনের মাঝখানের উপত্যকায় ছিল ফোরাম (বাজার), সেটা ছিল একটা খোলা জায়গা যেখানে মানুষ পণ্য বেচাকেনার জন্য হাজির হতো। ফোরাম যেন সবসময় কার্যকর থাকে, টারকুইনিয়াস প্রিসকাস সেখান থেকে একটা বড়ো ড্রেন বানিয়ে দিলেন যেন জায়গাটা বরাবর শুকনো রাখা সম্ভব হয়। সেটি পরে বিখ্যাত ক্লকা ম্যাক্সিমা (“বিশালাকার ড্রেন”) নামে রোমে পরিচিতি লাভ করল। রোমের সবচেয়ে উন্নতির সময়টাতেও তারা বিজ্ঞান বা গণিত নিয়ে তত গবেষণার উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য এবং প্রকৌশলী আবিষ্কারের জন্য গর্বিত ছিল। টারকুইনিয়াসে সময়কার স্থপতি এবং প্রকৌশলীরাই সেখানে স্থাপত্য নির্মাণ এবং নানারকম প্রকৌশল বিদ্যার প্রয়োগ শুরু করে। স্থাপন করা হয়েছিল। যদিও সেই প্রথমটি, যেটি প্যালেটাইন আর ক্যাপিটোলাইন পাহাড়ের উপত্যকায় স্থাপন করা হলো সেটিই একমাত্র রোমান ফোরাম নামে পরিচিত ছিল. যেখানে রোমান সিনেটররা জিনিসপত্রের বেচাকেনা দেখতে এবং তা নিয়ে বিভিন্ন তর্ক-বিতর্কে অংশগ্রহন করতে আসত (এভাবেই ফোরাম শব্দটি নির্দিষ্ট দলের মিলিত হওয়া এবং আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতে লাগল)। প্রতিবেশী বিভিন্ন জাতির সাথে ছোটোখাটো যুদ্ধে টারকুইনিয়াস বরাবর জিততে লাগল আর যখন জয়োৎসব হতো সেখানে এ্রসকানদের জয়ের উৎসবের আচারব্যবহার পালিত হতে লাগল। যুদ্ধজয়ী সেনাপতি নগরে প্রবেশ করত আর তার পিছনে সরকারি চাকুরেরা, সেনাবাহিনা আর ধরে আনা বন্দিদের দল হেটে চলত। এখানে সেখানে জনতা তাদের দেখে উল্লাস প্রকাশ করত। নগর প্রদক্ষিণ করা মিছিল নিয়ে উৎসব পালন করার সেই রীতিটার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধজয়ের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো হতো। ওরকম একটা সম্মান পেতে হলে অবশ্য সেনাপতিকে বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হত যেন রোমান ভূখণ্ড বৃদ্ধি পায়। খিস্টপূর্ব ৫৭৮ সালে পূর্বের রাজা আ্যাংকাস মারশিয়াসের পুত্রের ভাড়া করা সন্ত্রাসীরা রাজা টারকুইনিয়াস প্রিসকাসকে বন্দি করে ফেলল। কিন্তু যাই হোক, তখন মারকুইশিয়াসের এক জামাতা দ্রুত দেশের শাসনভার চালানোর প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। আ্যাংকাস মারশিয়াসের ছেলেরা বন্দী হবার ভয়ে পালিয়ে যান।

রাজা সারভিয়াস টুলিয়াস, তার দ্বারা রোমের উন্নয়ন ও পতন : রোমের নতুন এবং ষষ্ঠ রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন রাজা সারভিয়াস টুলিয়াস। তিনিও হয়ত একজন এটরুসকান ছিলেন, আর টারকুইনিয়াস প্রিসকাসের বন্দিত্বের পেছনে তারও হয়ত হাত থাকতে পারে কারণ তিনি ল্যাটিন সংস্কৃতির প্রেমে পড়ে রোমের ভেতরে এট্রুসকান সংস্কৃতির আধিপত্য ততটা ভালো চোখে দেখছিলেন না। এই তথ্যটা সঠিক হলে তিনি আদতেই একজন বিপ্লবী ছিলেন। এট্রুসকান রাজা যে কিনা রোমের জন্য নিবেদিত প্রাণ, এমনটা আর পাওয়া যেত না। কারণ তার শাসনামলে রোমের ভূখণ্ড বৃদ্ধি পেতে লাগল। নগরটা ষষ্ঠ এবং সপ্তম দুটো পাহাড়ে বর্ধিত হলো। দক্ষিণ-পূর্ব দিকের পাহাড়দুটো হলো এসকুইলাইন এবং ভিমিনাল। সার্ভিয়ান টুলিয়াস নগরের সাতটি পহাড়কে ঘিরে একটি পাঁচিল তৈরি করলেন। এই পাচিলের নাম হলো সার্ভিয়ান দেয়াল আর সেটাই নগরের সীমানা প্রকাশ করত। তবে প্রচণ্ড শক্তিশালী রোম পরের পাচশ বছরে সেই দেয়াল অতিক্রম করে চতুর্দিকে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। সার্ভিয়ান টুলিয়াস রোমের আশেপাশে ল্যাটিয়ামের বিভিন্ন নগরগুলোর সঙ্গে আলাদা একটা ল্যাটিন লিগ গড়ে তোলেন, যার উপরে প্রধান কর্তৃত্ব ছিল রোমের। উত্তরের দিকে অবস্থিত এট্রুসকান নগরগুলো হয়্ত তখন রোমের দিকে অবাক হয়ে এবং সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকত যে এই নতুন রাজাকে তারা কতদূর পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারে। সার্ভিয়াস টুলিয়াস শাসনকার্যে প্রভাবশালী পরিবারগুলোর ক্ষমতা কমাতে যেটা করলেন তা হল শাসনকার্যকে কিছু অংশে রোমের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ভাগাভাগি করে দিলেন। এতে করে সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন সার্ভিয়াস টুলিয়াসের উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তারা টুলিয়াসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে আরম্ভ করল, এবং অবশ্যই সেটা এট্রুসকানদের সহায়তায়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৪ সালে সার্ভিয়াস টুলিয়াসকে বন্দি করা হলো। পূর্বের শাসক টারকুইনিয়াস প্রিসকাসের পুত্র ছিলেন টুলিয়াসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। সেই পুত্র আগেই সার্ভিয়াস টুলিয়াসের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। সুতরাং টুলিয়াসকে যখন বন্দি করে হত্যা করা হলো জামাতা সহজেই রোমের সিংহাসনে সপ্তম রাজা হিসেবে আরোহন করলেন। সপ্তম রাজার নাম হলো লুসিয়াস টারকুইনিয়াস সুপারবাস। আর সার্ভিয়াস টুলিয়াসকে যদি এট্রুসকান হিসেবে ধরা হয় তাহলে লুসিয়াস হল রোমের তৃতীয় এট্রুসকান রাজা।

তদকালীন এট্রুসকানের ক্ষমতা ও গ্রিসের সাথে যুদ্ধ : এট্রুসকানরা তখন ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছিল। সাদা চোখে দেখলে ইতালির মধ্যভাগটা তখন পুরোপুরি তাদের হাতের মুঠোয়। ইতালির পশ্চিম দিকের সমুদ্রপৃষ্ঠে তাদের নৌবাহিনি ছিল খুবই ক্ষমতাবান। তাদের সেই ক্ষমতা প্রদর্শিত হলো যখন গ্রিসের বাহিনি পশ্চিম ইতালির দ্বীপ সারডিনিয়া এবং কর্সিকা দখল করার উদ্যোগ নিল। এট্রুসকানরা তখন কার্থেজের লোকেদের সঙ্গে মিলে একটি বাহিনি গড়ে তুলল আর করসিকা দ্বীপে আক্রমনকারী গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তাদের বিশাল বাহিনি সমুদ্রপথে যাত্রা করল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ সালের দিকে করসিয়ার পূর্ব দিকের সমুদ্র উপকূলে অ্যালালিয়া নামক স্থানে গ্রিক অভিবাসনকারীদের সঙ্গে সমুদ্রের উপরেই তাদের যুদ্ধ সংঘঠিত হলো। গ্রিকরা সেই যুদ্ধে হেরে গেল এবং তাদের দখলকৃত দুটো দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলো। দুটো দ্বীপের মধ্যে বেশি দক্ষিণে এট্রুস্কান উপকূল থেকে মাত্র ষাট মাইল দূরে অবস্থিত ছিল, সেটি এট্রুসকানদের দখলে চলে এল। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে নতুন টারকুইনরা কী করে রোমের উপরে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্র বিস্তার করতে সক্ষম হলো।

টারকুইনিয়াস সুপারবাসের নিষ্ঠুরতা, উন্নয়ন ও ডাইনির সাথে প্রতিযোগিতা : ঐতিহাসেকেরা বর্ণনা করেছেন কীভাবে টারকুইনিয়াস সুপারবাস একজন নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেটা বলতে গিয়ে তারা বলেছেন যে সার্ভিয়াস টুলিয়াসের প্রণিত আইনকানুন যেখানে শাসনকার্যে প্লেবিয়ানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিল, টারকুইনিয়াস সুপারবাসের হস্তক্ষেপে তা ধীরে ধীরে একেবারে বাতিল ঘোষিত হলো। তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে চাওয়া কিছু সিনেটরকে তিনি দ্রুত মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলেন এবং যারা এমনিতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাদের জায়গায় নতুন কোনো সিনেটর নিয়োগ করলেন না। তিনি একটি অস্ত্র বাহিনি গঠন করলেন এবং তার উপরে নিজের স্বৈরশাসন অব্যহত রাখলেন। দেশের সমস্ত আইনকানুন নিজের সুবিধামতো পরিচালিত করতে লাগলেন তিনি। তবে আর যাই হোক, তিনি রোমের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখলেন, তার বাবা যে ইমারত এবং অন্যান্য উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহন করেছিলেন তিনি তা বাস্তবায়ন করতে শুরু করলেন। টারকুইনিয়াস সুপারবাসের সম্পর্কে একটি বিখ্যাত গল্প আছে, যেখানে তাকে এক ডাইনির সঙ্গে পাল্লা দিতে দেখা যায়। সেই ডাইনি ছিল আাপোলো দেবতার ধর্মযাজিকা। সেই ধরণের ধর্মযাজিকা সাধারণত গুহায় বাস করত এবং মানুষকে বিভিন্ন বর দেয়ার ক্ষমতা রাখত। প্রাচীন কাহিনী লেখকেরা এরকম বহু যাজিকার ব্যাপারে জানিয়েছেন, তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল একজন যে কিনা ধারেকাছেই কুমি নগরে (আধুনিক গ্রিক নগর ন্যাপলসের কাছে অবস্থিত) বসবাস করত আর তাই তাকে কিউমিয়ান ডাইনি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল, ঈনিয়াস প্রতিটি পদক্ষেপ নেবার আগে তার সঙ্গে পরামর্শ করতেন বলে জানা যায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ডাইনি ভবিষ্যতবাণীর যে বইগুলো লিখেছিল, সেই নয় ভল্যুম বইয়ের উপরে কিউমিয়ান ডাইনির বিশেষ অবদান ছিল। শোনা যায় টারকুইনিয়াস সুপারবাস সেই বিখ্যাত ভবিষ্যৎ প্রবক্তা কিউমিয়ান ডাইনির সংস্পর্শে এল এবং ডাইনি তিনশটি সোনার টুকরোর বিনিময়ে সেই নয় খণ্ড বই তাকে বিক্রি করতে সম্মত হলো। টারকুইনিয়াস নয়টি বইয়ের জন্য ওই অস্বাভাবিক দাম মঞ্জুর করেননি। ডাইনিরা খেপে গিয়ে তার থেকে তিনটি বই পুড়িয়ে দিল এবং তারপর ছয়টি বইয়ের জন্য সেই একই তিনশ সোনার টুকরো দাবি করল। টারকুইনিয়াস তখনো রাজি হলেন না। তারপর ডাইনিরা আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং আরো তিনটি বই পুড়িয়ে ফেলল। শেষে বাকি থাকা মাত্র তিনটি বইয়ের জন্য সেই একই মূল্য তিনশ সোনার টুকরো দাবি করল। তখন টারকুইনিয়াস কিছুতেই চাইলেন না যে বাকি থাকা ওই তিনটি মাত্র ভবিষ্যৎ বাণীসমৃদ্ধ বইও পুড়ে শেষ হয়ে যাক। তাই তিনটি বইয়ের জন্য তাদের দাবিমতো দাম দিতে সম্মত হলেন। ভবিষ্যতৎবাণীর সেই তিনটি বই রোমের অধিবাসীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। বইগুলো বিশেষ যত্নে এবং পাহারায় রোমের ক্যাপিটোলে রাখা হলো। যখনই রোমে কোনো সমস্যা দেখা দিত জ্ঞানী মানুষ এবং ধর্ম যাজকেরা সেই বইগুলো নিয়ে বসে যেতেন এবং সেখান থেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন যে তখন কী উপায়ে ক্ষিপ্ত দেবতাদের শান্ত করা যাবে এবং বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে।

টারকুইনিয়াস সুপারবাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও রোমে রাজতন্ত্রের পতন : টারকুইনিয়াস সুপারবাসের ক্ষমতার দম্ভ এবং নিজের ছেলে, টারকুইনিয়াস সেক্সটাসকে নিয়ে আকাশচুম্বী গর্বের একসময় শেষ হলো। রোমের বেশিরভাগ ক্ষমতাবান মানুষই তার শত্রু বনে গেল। তারা একসঙ্গে হয়ে বহুদিন ধরেই একটা বিদ্রোহ গড়ে তোলার সুযোগ খুঁজছিল। এক যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সুযোগ এল। আশেপাশের ল্যাটিন নগরগুলোর সঙ্গে সার্ভিয়াস টুলিয়াসের গঠন করা দল আগেই টারকুনিয়াস সুপারবাস ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তার বদলে তিনি ল্যাটিয়ামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বসবাসকারী জাতি ভলশিয়ানজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সবাইকে তাতে অংশগ্রহণে বাধ্য করলেন। সেই যুদ্ধ যখন চলছিল ঠিক তখন, টারকুইনিয়াসের পুত্র তার এক আত্মীয় টারকুইনিয়াস কোলাশিনাসের স্ত্রীকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। সেই খবরটা যখনই নগরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে, কোলাশিনাসের নেতৃত্ব এবং তার অনুসারী লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাসের সহায়তায় বিদ্রোহ ঘনীভূত হয়। টারকুইনিয়াসদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার জন্য ব্রুটাসের কাছে হাজারো কারণ ছিল। তার পিতা এবং ভাইদের মৃত্যুদণ্ডের কারণ টারকুইনিয়াস। অবশ্য এখানে ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেছেন যে ব্রুটাসকেও তার পিতা এবং সহোদরদের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো যদি না তিনি নিজেকে কিছুটা হাবাগোবা প্রকৃতির হিসেবে উপস্থাপন না করতেন (“ব্রুস্টাস” শব্দের অর্থ হলো “বোকা”)। বিপদের সময়ে নিজেকে যথেষ্ট বোকা হিসেবে প্রতীয়মান করার অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন বলে তাকে এই নাম দেয়া হয়েছিল।) টারকুইনাসের রোমে ফিরে যাবার সময় হতে হতে প্রকৃতপক্ষে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। নগরের মূল দরজাগুলো ততক্ষণে তার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর তাকে বন্দিত্বে বাধ্য করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন রোমের সপ্তম এবং সর্বশেষ রাজা। তার পরে রোম আর কখনোই কোনো রাজার অধীনে শাসিত হয়নি; অন্তত আর কখনোই রাজা নামধারী কেউ রোমের বুকে শাসনকার্য চালায়নি। খিস্টপূর্ব ৫০৯ সালে, রোম যখন সাতজন রাজার অধীনে অর্ধশতাব্দী পার করেছে, তখন টারকুইনকে বন্দি করে হত্যা হলো।

রোমান প্রজাতন্ত্রের প্রথম অবস্থা, এট্রুস্কান ও গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

এট্রুস্কানদের পরাজয়

রােমানরা প্রজাতন্ত্রের অধীনে চলে গেলেও, কোনাে না কোনাে শাসককে তাদের ওপরে থাকতেই হতাে। শাসকদের হাতে যেন সর্বময় অধিকার চলে না যায় (যেমনটা গিয়েছিল টারকুইনিয়াসের সময়ে) এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে রােমানরা এক বছরের জন্য শাসককে নির্বাচিত করল। শর্ত থাকল যে শাসক কেনাে অবস্থাতেই নিজে থেকে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে পারবেন না আবার ক্ষমতার সময় বর্ধিতও করতে পারবেন না। এতকিছুর পরেও বিষয়টি যেন ভালােমতাে চলে তাই তারা দুজন করে শাসক নির্বাচন করল। তারা মনে করল শাসকের স্থানে দুজন ভিন্ন মানুষ থাকলে কেউ কোনাে দুর্নীতি করতে পারবে না। কারণ একজন যখনই কোনাে অন্যায় করতে চেষ্টা করবে তখন আরেকজন তাকে ঠেকানাের জন্য সিনেটের সহায়তা নেবে। দুজন শাসকের মধ্যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বরাবর এক ধরণের প্রতিযােগিতা থাকবে বলে মনে করত তারা। এই নিয়ম সফলভাবে কয়েক শতাব্দী চলতে থাকল। প্রথমদিকে নির্বাচিত ওই দুই শাসককে প্রিটর্জ বলে ডাকা হতাে, যে শব্দের অর্থ গলাে “যারা পথ নির্দেশনা দেয়”। পরবর্তীকালে শাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দুজন শাসক যখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে পরিচিত হলাে, তাদেরকে কনসল নামে ডাকা শুরু হলাে, যার অর্থ হলাে সহায়তাকারী। অর্থাৎ তারা দুজন যে কোনাে সিদ্ধান্ত নেবার আগে এক সঙ্গে সেটি নিয়ে আলােচনা করতেন এবং মিলিত সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে রাজ্য পরিচালনা করতেন। তবে কনসল হিসেবেই তারা পরিচিতি পান। কনসলদের অধীনে কিছু ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করত। তাদের ডাকা হতাে প্রিটর নামে। রােমের আধারী সেনাবাহিনির দায়িত্বও ছিল এই কনসলদের উপরে। যুদ্ধের সময়ে তারাই সেনাবহিনির দেখাশােনা করত। নগরের জন্য আরাে কিছু ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ােগ করা হতাে কোয়েসটর হিসেবে। সেখানেও দুজনকে একসঙ্গে নিয়ােগ দেয়া হতাে আর এই পদে থাকলে তাদের বিভিন্ন অপরাধের বিচার করতে হতাে কিংবা বিচারকার্যে সহায়তা করতে হতাে (কোয়েসটর শব্দের অর্থ হলাে “কারণ অনুসন্ধান”)। পরের বছরগুলােতে তাদের দায়িত্বে কিছু পরিবর্তন এল, তারা কোষাগারের দেখাশােনা শুরু করল।

রােমান প্রজাতন্ত্রের প্রাথমিক বছরগুলােতে শাসনকার্য চালানাে সত্যিই কঠিন ছিল। টারকুইনিয়াস যে রাজ্যের কাছে সিংহাসন হাসিল এবং ক্ষমতা রক্ষার জন্য নির্ভরশীল ছিল, শুরুতেই সেই এট্রুস্কানদের বিদ্বেষের সঙ্গে রোমানদের পাল্লা দিয়ে চলতে হতাে। এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে এট্রুস্কানদের থেকে রাজা না হলে এবং তাদের মন যুগিয়ে না চললে রােমের উপরে এট্রুস্কানদের কুদৃষ্টি পড়ত। এট্রুস্কানদের সঙ্গে বরাবর যুদ্ধে জয়লাভ করাটা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। আর তাই স্বাভাবিকভাবে প্রজাতন্ত্রের প্রাথমিক অবস্থায় এট্রুস্কানদের ভেতর থেকেই ব্রুটাস এবং কোলাশিনাস, এই দুজন প্রথম কনসল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমনকি রােমের ভেতরেও কোনাে না কোনাে কারণে মানুষ টারকুইনদের প্রত্যাবর্তনের প্রতি প্রত্যক্ষ এবং প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছিল, টারকুইনিয়াসের প্রত্যাবর্তনে তারা খুশি হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন প্রথম কনসল ব্রুটাসের নিজের দুই পুত্র। তার পুত্রদের করা ষড়যন্ত্রের খবর যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন তার দোষ তার ওপরে পড়ে, এমনকি সেই পুরােনাে ষড়যন্ত্রের বিহিত করার জন্য ব্রুটাসকেই বলা হয়। ব্রুটাস দেশের চাওয়া পাওয়াকে ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দেন এবং নিজের ছেলেদের মৃত্যুদণ্ডের বিচারে কোলাশিনাসের সঙ্গে হাত মেলান। সেই সময় থেকে, প্রচলিত প্রাচীন কাহিনি অনুযায়ী, ব্রুটাসের বেঁচে থাকার আগ্রহ চলে যায়, জীবনে কী নিয়ে বাঁচবেন এই ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকতে থাকতে তিনি যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুবরণ করার অপেক্ষায় থাকেন। শেষ পর্যন্ত টারকুইনদের সঙ্গে ছােটোখাটো একটা যুদ্ধে ব্রুটাসের ইচ্ছে পুরণ হয়। যুদ্ধের ময়দানে টারকুইনের পুত্র ব্রুটাসকে হত্যা করে।

টারকুইনিয়াস সুপারবাস কুশিয়ামের লার্স পরসিনাকে রােমের দিকে হাত বাড়ানাের সুযােগ করে দিলে রােমের বিপদ ভয়াবহ আকার ধারণ করল। কুশিয়াম ছিল মধ্য এট্রুরিয়ার একটি নগর, রােমের উত্তরে পচাত্তর মাইল দূরে। রােমান ঐতিহাসিকদের মতে এট্রুস্কান সেনাবাহিনি নিয়ে পরসিনা দক্ষিণ দিকে এগােতে এগােতে টিবার নদী পর্যন্ত চলে আসে, জানিকুলাম পাহাড়ে তারা রােমানদেরকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়। রােমানরা নদীর উপরের কাঠের সেতুটা সময়মতাে ধ্বংস করে না দিলে এট্রুস্কানরা নদীর পশ্চিম দিকে পরসিনা রােমে প্রবেশ করতে পারত আর সহজেই প্রজাতন্ত্রটিকে লণ্ডভণ্ডও করতে পারত। রােমান প্রজাতন্ত্রের প্রাচীন কাহিনিগুলাের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় একটা কাহিনি আছে সে সময়কার। পাবলিয়াস হােরাটিয়াস ককলিজ ছিল সেই ব্যক্তি যে কিনা টিবার নদীর ওপরে কাঠের ব্রিজ কাটার সময়ে এট্রুস্কান সেনাবাহিনিদের নদীর ওপারে অপেক্ষায় থাকতে বাধ্য করেছিল। প্রথমত সঙ্গে আরাে দুজন সঙ্গী নিয়ে এবং পরে কেবল একাই সে পুরাে সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায় । সেতুটি ভাঙতে ভাঙতে শেষ কাঠের টুকরােটি যখন ভাঙা হয়ে যায় তখন সে টিবার নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে। উত্তাল টিবার নদী পেরিয়ে সে রােমের দিকে পৌছতে সক্ষম হয়। আর তখন থেকেই “সেতুর উপরে হােরাটিয়াস” কথাটার প্রচলন হয় যা দিয়ে বােঝানাে হয় যে সমস্ত বিপদ উপেক্ষা করে একজন মানুষ এক দল ভয়াবহ লােকের মােকাবেলা করছে।

রােমের ভেতরে কোনাে ত্রাস সৃষ্টি করতে না পেরে পরসিনা সেই দ্বীপেই ঘাঁটি গাঁড়লেন। তাকে সেই ঘাঁটি থেকে সরানাের ব্যাপারে আরেকটি কাহিনি আছে। রােমের সম্ভান্ত পরিবারের এক তরুণ, গাইউস মুকিয়াস একবার নিজে থেকে ঠিক করল পরসিনাকে গ্রেফতার করে বন্দি করতে এট্রুসকান ক্যাম্পে যাবে। সেখানে গেলে এট্রুসকানরা তাকে ধরে ফেলল। রোমের ভেতরের শাসনকাজের বিষয়ে গােপন তথ্য তার কাছে উদ্ধারের চেষ্টা চালাল তারা। না পেরে তাকে পুড়িয়ে মারার হুমকি দিল। তরুণ আগুনের কাছে গিয়ে তার ডান হাতটি আগুনের দিকে বাড়িয়ে দিল এবং পুরাে হাতটা পুড়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত সেখানেই দাড়িয়ে থাকল। তখন থেকে তাকে “সিভােলা” নামে ডাকা হতাে, যার অর্থ হলাে “বামহাতি”। কাহিনী অনুসারে, পরসিনা তখন ছেলেটির বীরত্বে এতটাই মুগ্ধ হলাে যে রােমের ব্যাপারে তার ধারণা পালটে গেল। সে ভাবল যে নগরে এত সাহসী মানুষের বাস সেখানে তার গিয়ে কাজ নেই। তাই দ্রুত সেই দ্বীপ থেকে ঘাঁটি গুটিয়ে, টারকুইনিয়াস সুপারবাসকে সরিয়ে রােমের সিংহাসন দখলের স্বপ্ন বাদ দিয়ে সে নিজ দেশে চলে গেল। নব্য ঐতিহাসিকেরা অবশ্য আশ্চর্যজনকভাবেই রােমের বিচিত্র কাহিনির মধ্যে হােরাশিয়াস আর মুকিয়াসের ওই গল্পগুলােকে বানানাে বলে অভিহিত করেন। তারা বলেন যে রােমের বিব্রতকর কিছু ইতিহাস লুকানাের জন্যই এসব গল্প তৈরি করা হয়েছে। এট্রুসকানরা আসলে তখন রােমে প্রবেশ করছিল এবং এট্রুসকানদের আধিপত্য গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। রােমানদের ল্যাটিয়ামের ছােটো ছােটো নগরগুলােতে রােমান আধিপত্য সেই ঘটনার পর থেকেই ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়েছিল। তবে সে যাই হােক, রােমের তখনকার পরাজয় বড়াে কোনাে ব্যাপার ছিল না কারণ পরসিনা রােমে তার আধিপত্য বজায় রাখতে পারেনি। যেহেতু সেখান থেকে তাকে পালাতে হয়েছিল তাই রােমের প্রভাবই কাহিনিগুলাের মধ্যে মূল উপজীব্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

রােমান ইতিহাসে টারকুইনদের সর্বশেষ উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৬ সালে যখন ল্যাটিন নগরগুলাে পরসিনার হাতে রােমের পরাজয়ের সুফল পেয়েছিল। আর পরসিনাই টারকুইনিয়াসদের আধিপত্যের অবসান ঘটায়। টারকুইনিয়াস সুপারবাস এবং তার পুত্ররা ল্যাতিন সেনাবাহিনীর সাথে মিলে রেজিলিয়াস লেকের আশেপাশে কোথাও রোমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুখোমুখি  হয়। রােমানরা বিজয়ী ঘােষিত হয় এবং টারকুইন পরিবারের আধিপত্যের অবসান ঘটে। একমাত্র রাজা টারকুইনিয়াস সুপারবাস পরাজয় বরণ না করে অবসর গ্রহন করে কুমি দ্বীপে চলে যান এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেই যুদ্ধে, রােমান ঐতিহাসিকেরা যেমনটা বর্ণনা করেন, তাদের সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল দুজন ঘােড়ারূপী মানুষ যাদের শক্তি ছিল সাধারণ যােদ্ধার চেয়ে অনেক বেশি, আকৃতিতেও তারা ছিল বিশাল। ধারণা করা হয় যে তারা হয়তো বা ক্যাস্টর আর পােলাক্স (প্রাচীন গ্রিক কাহিনির হেলেন অব ট্রয়ের দুই সহােদর ভাই)। যুদ্ধের পরে রােমানরা সেই দুই ভাইয়ের নামে মন্দির তৈরি করে তাদের বিপুল সম্মানে ভূষিত করে।

পেট্রিশিয়ান ও প্লেবিয়ানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও লিখিত আইনের উদ্ভব

রােমে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান হয়ে যার উদ্ভব হয়েছিল তা হলাে, গােষ্ঠীশাসন; সােজাকথায় বলতে গেলে শাসনভার গিয়ে পড়ল “বিশেষ কয়েকজন মানুষের উপরে, যারা সবাই ছিল রােমান সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য অর্থাৎ পেট্রিশিয়ান। সিনেটর হতে হলেও একমাত্র তারা, কনসল, প্রিটরস এমনকি কোয়েসটরস হলেও তারাই। অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যেন সত্যিকারের রােমান বলতে কেবল পেট্রিশিয়ানরাই। আর সে দেশে যে আরাে বিশাল সংখ্যক নিম্নশ্রেণির লোক বা প্লেবিয়ান ছিল, তারা যেন কেবল খামারে বা সেনাবাহিনিতে কাজ করারই উপযুক্ত ছিল, তারা কিছুতেই সরকারি কাজের জন্য যােগ্য ছিল না। এট্রুসকান আর ল্যাটিনদের সঙ্গে যুদ্ধের পরে বাস্তবে একটা ভয়াবহ সময় এসে পড়ল, তখন প্লেবিয়ানদের বিপদ অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে গেল। খামারগুলাে উৎপাদন হারাল, খাবারের চালান গেল কমে, দরিদ্র লােকদের ঋণ বেড়ে আকাশচুম্বী হলাে, কিন্তু ক্ষমতায় থাকা সম্ভান্ত লােকেদের কোনাে টনক নড়ল না। আর পেট্রিশিয়ানদের সেদিকে নজর যাবেইবা কেন? খারাপ সময়টা উতরানাের জন্য তাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ ছিল আর ওদিকে প্লেবিয়ানদের মধ্যে কেউ যদি ঋণের দায়ে দেউলিয়া হবার উপক্রম হয় তবে ঋণ শােধ করতে বা বাঁচার দায়ে সে নিজেকে এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দাস হিসেবে বিক্রি করবে, এই ছিল সমাধান। খামারের শ্রমিক সাধারণত দায়গ্রস্থ থাকত সেই খামারের মালিকের কাছেই তাই ঋণ শােধের দায়ে তার কাছেই বিনা পয়সার দাস হয়ে থেকে যেত।

পেট্রিশিয়ানদের নেতা হিসেবে তখন ছিলেন অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস। জন্মগতভাবে অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস ছিলেন সাবাইন জাতির অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি রােমের বিভিন্ন যুদ্ধে নিষ্ঠার সঙ্গে লড়েছিলেন, তারুণ্যের শুরু থেকেই তিনি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এবং এই সমস্তকিছুর মধ্যে দিয়ে তিনি খাঁটি রােমান হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৫ সালে তিনি সম্ভ্রান্ত রােমান পরিবারের সদস্য বা পেট্রিশিয়ান হিসেবে গণ্য হন এবং কনসল হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি শুরু থেকেই শক্ত হাতে নিয়মের পালন শুরু করেন, বিশেষ করে প্লেবিয়ানদের উপরে। তাই প্লেবিয়ানদের তার উপরে বিশেষ ক্রোধ ছিল যে জন্মগতভাবে রােমান না হয়েও তিনি ঋণের দায়ে তাদের দাসপ্রথা মেনে নিতে বাধ্য করছিলেন। ওই অবস্থায় প্লেবিয়ানদের মনে হলাে রােম যেন তাদের নিজস্ব নগর নয়। তাই খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ সালে তারা সকলে মিলে রােমের তিন মাইল উত্তরে তাদের নিজেদের জন্য একটি নগর স্থাপনের কথা চিন্তা করল। প্লেবিয়ানদের মধ্যে একটা বড়াে অংশ সেই চিন্তাকে সমর্থন জানাল। এতে করে সম্ভ্রান্ত পরিবারের লােকেরা ভয় পেয়ে গেল, কারণ শ্রমিক হিসেবে এতগুলাে মানুষ হারালে হুট করে তাদের শ্রমিকের সংকট দেখা দেবে। তখন প্লেবিয়ানদের সঙ্গে তাদের বনিবনা করতে হলাে। প্লেবিয়ানদের এই বিদ্রোহকে সেকেসিও প্লেবিস (Secessio plebis) বা প্লেবিয়ান সেসেশন নামে পরিচিত।

ঐতিহাসিকদের মতে, নিম্নশ্রেণি বা প্লেবিয়ানদের জয় হয়েছিল একজন পেট্রিশিয়ানের মাধ্যমে, তার নাম মেনেনিয়াস অ্যাগ্রিপ্পা, যে তাদের শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পাকস্থলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সেই পুরােনাে গল্পটা শুনিয়েছিল। গল্পটা এমন ছিল, হাত একদিন অভিযােগ তুলল যে তাকে সমস্ত ভারী জিনিস ওঠাতে হয়। পা বলল, তাকে দিনভর হাটতে হয়। চোয়াল সুর মেলাল যে তাকে কেবল খাবার চিবােতে হয়। হৃদপিণ্ড পর্যন্ত ক্রমাগত নড়ে নড়ে শব্দ করার ক্লান্তির কথা বলল। আর তাদের সবার সাধারণ অভিযােগ হলাে পাকস্থলীর রিবুদ্ধে যে কিনা কেবল বসে বসে খায় আর কোনাে কাজই করে না। পাকস্থলী জবাব দিল যে সে যা খায় তা আবার রক্তে চালান করে দেয় যেন হাত, পা, চোয়াল আর হৃদপিণ্ডসহ প্রত্যেকে যে যার কাজ করে যেতে পারে, আর জানাল যে সে এটা না করলে অন্য কেউই কোনাে কাজ করতে পারত না। এই গল্পের মর্মার্থ ছিল এই যে, যদিও ক্ষমতাবান সম্ভ্রান্ত পরিবারের লােকজন সমস্ত অফিস আদালত দখল করে রেখেছিল, তাদের উপরেই ছিল সেসব চালানাের দায়িত্ব। তাই প্রকৃতপক্ষে নগর চালাচ্ছিল তারাই। তাই তারা যদি তাদের কাজ বন্ধ করে দেয় তবে নগরটাই অকেজো হয়ে পড়বে। সত্যি কথা বলতে কী, মেনেনিয়াসের গল্প প্লেবিয়ানকে ভােলাতে পারেনি। আর এটা ভাবাও হাস্যকর ছিল যে ওভাবে বােঝানােতেই বিপদে পড়া মানুষগুলাে তাদের কাজে ফিরে যাবে এবং চিরকালের মতাে বিপদেই নিমজ্জিত থাকবে।

প্রকৃতপক্ষে, পেট্রিশিয়ানদেরকে কেবল গল্প শােনানাে বাদ দিয়ে তখন তাদের কথামতাে চালানাের জন্য অনেকটা বল প্রয়ােগ করতে হয়েছে। তাই প্লেবিয়ানরা যেখানে নিজেদের অফিস গড়ে তুলছিল সেখানে সম্ভ্রান্ত শ্রেণির পক্ষ থেকে একটি চুক্তিপত্র এসে পৌঁছল। প্লেবিয়ানরা নিজেদের মধ্যে ভােট দেয়ার মাধ্যমে অফিসের কর্মীদের নির্বাচিত করেছিল। নির্বাচনের সময়ে তারা রােমান কি না সেই বিষয়ের চেয়ে তারা বেশি জোর দিয়েছিল তারা সকলে নিম্নশ্রেণির কি না, সেই বিষয়ে সেখানে অফিসের কর্মচারীদের নাম দেয়া হয়েছিল ট্রিবিউনস (এই নামটি অতীতে ছিল একটি জাতির প্রধানদের জন্য)। তাদের লক্ষ্য ছিল প্লেবিয়ানদের অধিকার রক্ষা করা এবং উচ্চশ্রেণির মানুষেরা নিত্য নতুন আইনকানুন করে তাদের উপরে যেন কিছু চাপিয়ে দিতে না পারে সে বিষয়ে খেয়াল রাখা। আর সত্যিই তারা কেবল “ভেটো” (“আমি নিষেধ করলাম”) উচ্চারণ করেই অনেক আইন বাতিল করার ক্ষমতা অর্জন করেছিল। ট্রিবিউনসের ভেটোকে উপেক্ষা করে রাজ্যের কনসল এবং সিনেট সে সময় অনেক আইনই পাশ করতে পারেনি।

স্বাভাবিকভাবেই ট্রিবিউনস প্রাথমিক পর্যায়ে সম্ভ্রান্ত লােকদের কাছে ভীষণ বিরক্তিকর ব্যাপার হয়ে উঠেছিল এবং তারা তাদের সাথে সংঘর্ষের কথাও ভেবেছিল কিন্তু পরে তারা বুঝতে পেরেছিল যে ট্রিবিউনস তাদের সরাসরি কোনাে ক্ষতি করতে চায় না। তাদের অফিস এবং তার কার্যকলাপকে কোনােভাবে অপমানিত হতে দেখলে ট্রিবিউনসরা নির্দিষ্ট অংকের ফাইন ধরত। ট্রিবিউনসরা এর জন্য কিছু লােককেও তৈরি করল, যারা সেই ফাইনগুলাে সংগ্রহ করে আনবে। তাদের বলা হতাে এইডিলেজ। তাদের ভূমিকাটা ধীরে ধীরে হয়ে দাড়াল আধুনিক পুলিশের মতাে। ফাইন হিসেবে যে অর্থ তারা উদ্ধার করে আনত, তা জনগণের বিভিন্নরকমের ত্রান কাজে লাগাত। যেমন, তারা এইডিল বা মন্দিরের দেখাশােনা করত (“এইডিল” শব্দটা এসেছে ল্যাটিন থেকে, যার অর্থ হলাে মন্দির)। মন্দির ছাড়াও তারা সেই টাকা দিয়ে পয়ঃনিষ্কাশন, জল সরবরাহ, খাবার সরবরাহের দেখাশােনা এবং জনগণের জন্য আনন্দদায়ক খেলাধুলার ব্যবস্থা করত। ব্যবসাবাণিজ্যও তারাই দেখাশােনা করত। ধীরে ধীরে প্লেবিয়ানরা রাজনীতিতে প্রবেশ করল এবং কিছু কিছু নিম্নবিত্ত পরিবারের ব্যাপক উন্নতিও হলাে। বিভিন্ন নগরের অফিস-আদালত থেকে শুরু করে কনসুলেটের দরজা পর্যন্ত তাদের জন্য খুলে যেতে লাগল।

ট্রিবিউনেটের প্রথম কয়েক বছর উচ্চশ্রেণির লােকেরা তাদের কাছ থেকে সমস্ত ক্ষমতা আর শাসনকার্যে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদ নিজেদের দখলেই রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এই প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে উচ্চশ্রেণির যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন কাইউস মারশিয়াস। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৩ সালে সেকেসিও প্লেবিসের এক বছর পর, একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যখন কাইউস মারশিয়াসকে গুরুত্বপূর্ণ ভলশিয়ান নগর করিয়লির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করতে হয়। তিনি তাই করলেন। তার বীরত্ব আর সেই যুদ্ধে জয়ের জন্য তিনি করিয়লানাস খেতাব অর্জন করলেন, যে নামে তিনি ইতিহাসে সবচেয়ে বেশে স্মরণীয়। পরের বছর রােমে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল আর তাই সিসিলি দ্বীপ থেকে খাদ্য শস্য আমদানি করতে হলাে। করিয়লানাস ঘােষণা দিলেন যে প্লেবিয়ানরা যদি ট্রিবিউনের কাজকর্ম বন্ধ না করে তবে তাদেরকে কোনাে খাদ্যশষ্য দেয়া হবে না। ট্রিবিউন সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিপদ ডেকে আনার প্রচেষ্টার জন্য তাকে দায়ী করল (যে কারণে সত্যিই তিনি দায়ী ছিলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষকে উপবাস রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন)। তাকে তখন রােম থেকে বহিষ্কার করা হলাে এবং তিনি তখনই ভলশিয়ানদের দলে যােগদান করলেন। তারপর তিনি ভলশিয়ান সেনাবাহিনি নেয়ে রােমের দিকে আক্রমনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন, যুদ্ধ করলেন সেই সেনাবাহিনির সঙ্গেই যার নেতৃত্ব কদিন আগেও তিনিই দিয়েছিলেন। রােমান সেনাবাহিনি তার হাতে পরাজিত হলাে। রােমের মাত্র পাঁচ মাইল দূরে ঘাঁটি গেড়ে তিনি চূড়ান্ত আক্রমনের জন্য প্রস্তুত হতে রাগলেন। রােমান ঐতিহাসিকেরা বর্ণনা করেছেন কীভাবে রােম থেকে আগত সকল আদেশ এবং অনুরােধ উপেক্ষা করে তিনি নিজের সেনাবাহিনিকে তখন রােমে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। ধর্মীয় নেতা, যাজক সকলের অনুরােধও তিনি উপেক্ষা করলেন। শেষ পর্যন্ত তার মাকে তার কাছে পাঠানাে হলাে ছেলেকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ঠাণ্ডা করার জন্য। আর তার অনুরােধের মুখে তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন, উহ, মা, তুমি রােমকে তাে বাঁচাচ্ছ কিন্তু নিজের ছেলেকে ধ্বংস করে দিলে।” করিয়লানাস তখন বাধ্য হয়ে ভলশিয়ান সেনাবাহিনি নিয়ে উলটো দিকে ফিরে চলে যেতে থাকেন। কিন্তু পরে তিনি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ভলশিয়ানদের হাতে খুন হন।

আধুনিক ইতিহাসবিদগণ করিয়লানাসের এই গল্পের পুরােটাই কেবল কল্পিত কাহিনি হিসেবে বর্ণনা করেন। তাদের যুক্তি হলাে, ধরে নেয়া যাক যে করিয়লি নগর দখলের মাধ্যমেই তার নাম করিয়লানাস হলাে এবং তার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু সেই নগরটা মােটেও ভলশিয়ান নগর ছিল না, বরং রােমেরই বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল। যাই হােক, যদিও এসব গল্প প্রাচীন আর গল্পের উৎসের কথা ভাবলে কিছু না কিছু বাস্তবতার সঙ্গে মিল থাকতেও পারে, কারণ প্লেবিয়ানরা রােম ত্যাগ করার পর থেকে তাদের এবং পেট্রিশিয়ানদের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলেই আসছিল। আর সংগ্রামের শেষে প্লেবিয়ানদের নেয়া পদক্ষেপগুলাে বাস্তবের আলােকে পূর্ণতা লাভ করেছে। তখন প্লেবিয়ানরা মনে করল তাদের অধিকার আদায় এবং নিজেদের রক্ষার জন্যই রােমের আইনকানুনগুলাে লিখিত আকারে তৈরি করা তাদের কর্তব্য। যতক্ষণ না সমস্ত বিষয়গুলাে লিখিত আকারে চোখের সামনে থাকছে না, ততক্ষণ তাদের এবং উচ্চশ্রেণির লােকদের মধ্যে বনিবনা হতে নানারকমের ঝামেলা হতাে। তারা বুঝতে পারত না কোন সময়ে কোনাে মিটমাটের কোন অংশ তাদের বা উচ্চশ্রেণির পক্ষে বেশি চলে গেল। সবকিছু পরিষ্কারভাবে লিখিত থাকলে প্লেবিয়ানদের জন্য তর্ক বিতর্ক করতে সুবিধা হতাে।

সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ সালের দিকে রােমান আইন প্রথম লিখিত আকারে প্রস্তুত করা হয়। সেই সংবিধান তৈরির জন্য উচ্চশ্রেণি থেকে দশ জন মানুষকে নির্বাচিত করা হয়। তাদেরকে বলা হতাে ডিসেমভারস, শব্দটি এসেছিল ল্যাটিন থেকে যার অর্থ হলাে “দশ জন মানুষ”। কনসলের অধিদপ্তরে তারা সংবিধান লেখা না হওয়া পর্যন্ত রাতদিন কাজ করতে থাকেন। ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি বারােটা ভারী বইয়ে আইনকানুনগুলাে খােদাই করে লিপিবদ্ধ করা হলাে। আর তাই সেই সংবিধানের নাম হয়েছিল বারাে টেবিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী রােমের আইনী কাজ সেই বারাে টেবিল সংবিধানই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। লিখিত সংবিধান তৈরি হয়ে গেল বলেই ব্যাপারটা এমন হয়নি যে সবকিছুই খুব সুন্দর আর উপভােগ্য হয়ে গেল। রােমান ঐতিহ্য অনুযায়ী সংবিধান লেখা শেষ হয়ে গেলেও যে দশজন ক্ষমতাবান সংবিধানটি লিপিবদ্ধ রলেন তারা ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করলেন। বারাে খণ্ডের সংবিধান লেখা শেষ হলেই তাদের সেই সময়কাল থেকে দূরে সরে যাবার কথা ছিল কিন্তু তারা অনৈতিকভাবে ক্ষমতা কুক্ষীগত কয়ে বসে থাকলেন। বরং নিজেদের সুযােগ সুবিধা অনুযায়ী আগের চেয়েও বেশি অনেক কিছু রাষ্ট্র থেকে আদায় করছিলেন তারা। যেমন তাদের প্রত্যেকে রাজ্যের খরচে নিজেদের জন্য বারােজন করে দেহরক্ষী রাখার ব্যবস্থা করলেন, তাদেরকে বলা হতো লিকটরস। লিকটরস নামের দেহরক্ষীরা ছিল প্লেবিয়ান। তারা সরকারি অফিস থেকে পাওয়া একটা বিশেষ অস্ত্র বহন করত, অস্ত্রটা ছিল অনেকগুলাে লৌহদণ্ডের সঙ্গে আটকানাে একটি কুড়াল। সেই অস্ত্রটিই শাসকের ক্ষমতার চিহ্ন হিসেবে ধরে নেয়া হতাে। (প্রথমত সেই চিহ্নটি ব্যবহার করত শুধু রাজা, পরে ধীরে ধীরে কনসল এবং ম্যাজিস্ট্রেটরাও ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন)। শত্রুকে ঘায়েল করতে প্রথমে লৌহদণ্ডগুলাে ব্যবহৃত হতাে এবং তাকে প্রাণে মারতে হলে তখন ব্যবহার হতাে কুড়ালটি। ওই অস্ত্রের চিহ্নটিকে বলা হতাে ফ্যাসিজ, নামটি এসেছে ল্যাটিন থেকে যার অর্থ হলাে “স্তূপ”।

সংবিধান প্রস্তুতকারী রােমান শাসক গােষ্ঠীর দশজন সদস্যের দলটির নেতা অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস ক্র্যাসাস, যিনি হয়ত ক্লডিয়াসের পুত্র কিংবা নাতি ছিলেন, যে ক্লডিয়াস অর্ধশতাব্দি পূর্বে সেকেসিও প্লেবিসের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ছিলেন। ক্লডিয়াস পরিবারের এই অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস প্রকটভাবে প্লেবিয়ানদের বিপক্ষে ছিলেন, আর সেই ঘটনার পরের ঘটনা পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে তিনি রােমে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার জন্য তলে তলে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন এতটাই বেপরােয়া হয়ে গিয়েছিলেন যে, এক প্লেবিয়ান সৈন্যের অপূর্ব সুন্দরী কন্যা, ভার্জিনিয়াকে অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন। অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস ভেবে রেখেছিলেন যে এই ঘটনার জন্য তার কাছে উপযুক্ত যুক্তিও আছে, আর তা হলাে, যেহেতু মেয়েটির বাবা তার দাস সুতরাং মেয়েটিও তার দাস। তাই দাস হবার সুবাদে তিনি তার সাথে যা খুশি করতে পারেন। ভার্জিনিয়ার বাবা দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়লেন, কারণ তিনি বুঝতে পারলেন যে, ক্ষমতাবান সংবিধান প্রস্তুতকারী দশজনের একজন মানুষের নজর থেকে মেয়েকে উদ্ধার করার বিষয়ে আইনগতভাবে তিনি কোনাে সাহায্যই পাবেন না। ঐতিহাসিকদের মতে তখন অসহায় বাবা একটা নাটকীয় ঘটনার জন্ম দেন। আকস্মিক তিনি মেয়ের শরীরে ছুরি বসিয়ে দেন এবং তার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবার পরিকল্পনার মাঝপথে তিনি তাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেন। তিনি জানান যে মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য এছাড়া তার কাছে অন্য কোনাে উপায় ছিল না। প্লেবিয়ানদের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। নিজেদেরকে পেট্রিশিয়ানদের থেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা আবার তাদের পেয়ে বসে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৯ সালে তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সংবিধান প্রস্তুতকারী দশজন ক্ষমতাবানকে আঁকড়ে ধরে রাখা ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস পরবর্তীকালে বন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন অথবা আত্মহত্যা করেন।

এই ঘটনার ফলে ট্রিবিউনদের মত প্রকাশের ক্ষমতা এবং সামগ্রিক শক্তি বাড়তে থাকে। এরপর থেকে তারা সিনেট সভায়ও বসতে শুরু করল, যেন নিয়ম কানুন প্রণয়নের ব্যাপারে তারা আরাে বেশি করে অংশগ্রহন করতে পারে। ধীরে ধীরে সেসব নিয়মকানুন নিয়ে সিনেটে বসে বিস্তর আলােচলার সুযােগ পেল এবং তাতে করে আইন তৈরি আরাে সহজ হলাে। তারা যদি দেখত কোনাে আইন তাদের কার্যকলাপ বা অধিকার আদায়ের বিপক্ষে যায় তবে তারা সহজেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাদের অংশগ্রহণ বন্ধ করে দিত, সাময়িক অসুবিধা হবার পরে তাদের দাবি মেনে নেয়া হতাে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৫ সালে নিম্নশ্রেণি এবং উচ্চশ্রেণির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন সামাজিকভাবে স্বীকৃত হলাে। আর খ্রিস্টপূর্ব ৪২১ সালে প্লেবিয়ানদের মধ্যে থেকে কোয়েস্টার নির্বাচিত হওয়া শুরু হলো।

এট্রুস্কানদের পতন

রােমের ভেতরকার রাজনৈতিক টানাপােড়েনের কারণে মনে হচ্ছিল যে প্রতিবেশী কোনাে রাজ্যের হাতেই যেন বেদখল হয়ে যাবে, কিন্তু সৌভাগ্য যেন আগের বহু শতাব্দীর মতাে তখনও রােমের দরজাতেই দাড়িয়ে ছিল। রােমের সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু ছিল এট্রুস্কান যারা নিজেরাই হঠাৎ করে পাহাড় বেয়ে নীচের দিকে সরে যেতে লাগল। রোম ও অন্যান্য ল্যাটিন নগরের বিরুদ্ধে পারসিনার সাফল্যের জন্য এই নগরগুলোকে এট্রুস্কানদের আর বিপজ্জনক বলে মনে হয়নি। ফলে এবার এট্রুস্কানরা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ল্যাটিয়ামের সবুজে ঘেরা উর্বর ভূমির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল। সেই অঞ্চলটি ছিল ক্যাম্পানিয়া, প্রাচীন যুগে ইতালির সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে নগরটির নাম ছিল। এট্রুস্কানদের অগ্রসর হওয়ার পথে বিক্ষিপ্ত কিছু গ্রিসের নগর ছাড়া অন্য কোনাে বাধা ছিল না, আর সেই নগরগুলাের মধ্যে বরাবরের মতােই তেমন কোনাে জোট ছিল না, তাই একের পর এক নগর দখল করতে তাদের কোনাে অসুবিধা হলাে না। খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৪ সালে এট্রুসকানরা কুমি (Cumae) নগর দখল করল, কুমি ছিল ম্যাগনা গ্রেশিয়া বা ইতালিতে গ্রিক উপনিবেশের সবচেয়ে উত্তর-পশ্চিমের নগর।

এট্রুস্কানদের জন্য দুর্ভাগ্য ছিল যে কুমির দখলটা ছিল এমন একটা সময়ে যখন গ্রিস ছিল উন্নতির চরম শিখরে। গ্রিসের ইতিহাসের কথা ভাবলে, শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্যকে উৎখাত করা হয়েছে; সিসিলিতে তাে কার্থেজিয়ান সেনাবাহিনিতে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তখন গ্রিসের এমন অবস্থা যে কোনাে অনুপ্রবেশকারীকেই যুদ্ধে হারিয়ে দেয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। আর সে কারণেই, কুমি দখল হবার সময়ে কোনাে না কোনাে নগর গর্জে ওঠার কথা ছিল। হয়েছিলও তাই। সিরাকিউসের শাসক জিলন ছুটে এসেছিলেন কুমি রক্ষা করতে। তার থেকে ছয় বছর আগে তিনি কার্থেজিয়ানদের পরাজিত করেছিলেন, আর ইতালিতে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাপারে তিনি এতটুকু কুণ্ঠিত ছিলেন না। তার জাহাজের বহর উত্তর দিকে এগিয়ে গেল আর এট্রুস্কানদের তুমুলভাবে পরাজিত করল। এই পরাজয়ের পর ইতালির দক্ষিণ দিকে দখলের কার্যক্রম চালানাের ব্যাপারে এট্রুস্কানদের আর কখনাে অগ্রসর হতে দেখা যায়নি। কিন্তু তখন এট্রুস্কানদের বদলে ইতালির বিভিন্ন জাতি দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল। সেই সমস্ত জাতির মধ্যে প্রধান ছিল স্যামনাইটস। স্যামনিয়ম ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী নগর, যে নগরটা ল্যাটিয়ামের পূর্ব এবং দক্ষিণপূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। গ্রিসের লােকেরা এট্রুস্কানদের তাড়াতে পারল ঠিকই কিন্তু স্যামনাইটসরা এদিকে ক্যাম্পানিয়ায় প্রবেশ করল এবং দখল করে নিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪২৮ সালের মধ্যে তারা কাপুয়াও দখল করে ফেল, ওই অঞ্চলের অগ্রিক নগরগুলোর মধ্যে সেটাই ছিল বৃহত্তম। কিন্তু দক্ষিণ দিক থেকে যদি এট্রুস্কানদের সরাতে হতাে, দেখা যেত উত্তর দিকে তারা গিয়ে আসন গেড়েছে যেটা তার চেয়েও খারাপ হতাে।

তখন ছিল সেই সময়টা যখন ভিলেনােভানরা ইতালিতে প্রবেশ করল, তাদের সঙ্গে সঙ্গে ইউরােপের আরেক দল মানুষ প্রবেশ করল যাদের নাম গাউলস, তারা ভিলেনােভানদের সাহায্য করে ইউরােপের আল্পসের উত্তর দিকটা দখলে নিয়ে নিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের পরে গ্যালিক জাতি ইতালির উত্তর দিকটাকে বৃত্তের মতাে পুরােপুরি ঘিরে রাখা আল্পসের মতাে বড়াে পর্বতমালার বাধাকে উপেক্ষা করে অগ্রসর হতে থাকে, সেখানে পাে উপত্যকায় তাদের মােকাবেলা করতে হলাে এট্রুস্কানদের সঙ্গে। একটু একটু করে যখন তার পরের যুগটি পার হচ্ছিল, গাউল বা গলরা তাদের দখলের মাত্রা বাড়াতে লাগল। গাউলরা ধীরে ধীরে এগােচ্ছিল, এট্রুসকানরা পশ্চাদপসরণ করতে থাকলো, এভাবে একদিন পুরাে পাে উপত্যকা তাদের দখলে চলে গেল যার নাম হলাে সিসালপাইন গাউল , যার অর্থ হলাে “আল্পসের এদিকে গাউলদের বাস”- নামের মধ্যে “এদিকে” বলতে তারা রােম থেকে তাদের দখলকৃত জায়গার দিকটা পর্যন্ত বােঝাত। (আল্পসের পশ্চিম আর উত্তর দিকের স্থানটি ট্রান্সলপাইন গাউল বলে পরিচিত ছিল, যা অর্থ হলাে “আল্পসের ওপারে গাউল”। তবে এই গাউল জাতির মধ্যে ট্রান্সলপাইন গাউলই বৃহত্তর ছিল বলে পরে কেবল তারাই গাউল নামে পরিচিত হয়।

৫ম শতাব্দীর শেষের দিকে এট্রুস্কানদের অবস্থান ভীষণ নড়বড়ে হয়ে উঠল। ক্যাম্পানিয়া থেকে তাদেরকে পরাজিত করার পরে এবং পাে উপত্যকা থেকে উৎখাত করার পর থেকে তারা ক্রমাগত গাউলদের এট্রুরিয়ার বাইরে বের করে দেয়া যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। আর গাউলরাও বারবার দেশটির কেন্দ্রে বড়াে ধরনের হামলা করে আসছিল। এট্রুস্কানরা কেবলমাত্র নিজেদের নগরগুলাের পাচিলের ভেতরেই কোনােরকমে বসবাস করে যাচ্ছিল। এট্রুস্কানদের জন্য বছরের পর বছর ধরে দুর্ভাগ্য আসতে থাকলো, রােমানরা ল্যাটিয়ামের বিভিন্ন নগরের সঙ্গে ছােটোখাটো ঝগড়াঝাটি করে দিন পার করা ছাড়া কিছু করার পাচ্ছিল না। সেই ছােটোখাটো মারামারিগুলােও সবসময়ে সহজ হতাে না। ভলশিয়ানরা দক্ষিণপূর্ব দিকে অগ্রসর হতে হতে ল্যাটিয়ামের (যে দখলটা পরে করিওলানাসের জন্য উপকার হয়েছিল) অর্ধেক পর্যন্ত দখলে নিয়ে নিল এবং ঈকুইয়ানদের (Aequians) সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে লাগল, ঈকুইয়ানরা ছিল ল্যাটিয়ামের পূর্বদিকের সীমানায় পর্বতে বসবাসকারী এক জাতি।

ঈকুইয়ানদের সঙ্গে রােমানদের যুদ্ধের কথা যদি ধরি, সেখানে এক বীর ছিলেন যিনি বরাবর ছিলেন জনপ্রিয়; তার নাম হলাে লুসিয়াস কুইনশিয়াস সিনসিনেটাস। কোরিয়ালানাসের মতাে তিনিও ছিলেন একজন পেট্রিশিয়ান, আর তিনিও ট্রিবিউনেট আর লিখিত আইনগুলাের ক্রমাগত বিরােধিতা করতেন। যাই হােক, তাকে অবশ্য প্রাচীন কালের মানসম্মান আর ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি নিজের জায়গায় বুক ফুলিয়ে বসবাস করতেন এবং মূলত একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে তার পুত্র ট্রিবিউনের বিরুদ্ধে তীব্র সমালােচনা করার দায়ে দোষী হিসেবে বন্দি ছিলেন বলে সেই দুঃখে তিনি আগেভাগেই অবসর গ্রহন করেন এবং রাজনীতি থেকে সরে দাড়ান। যাই হােক, খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৮ সালে ঈকুইয়ানরা রােমানদের মারাত্মকভাবে আঘাত করল। রােমান কনসল তেকে শুরু করে সেনাবাহিনী পর্যন্ত ধ্বংসের মুখে পড়ল তখন। আর সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে সিনসিনেটাসের ডাক পড়ল। তাকে রােমের একনায়ক হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হলাে। রােমান আইনে সেটা ছিল দাপ্তরিকভাবেই সর্বময় ক্ষমতা, ভয়ানক দুর্যোগের সময়ে এরকম একজনকে দায়িত্ব দেবার কথা তাদের সংবিধানে ছিল। একনায়ক (ডিক্টেটর) শব্দটা এসেছিল ল্যাটিন থেকে, শব্দটার অর্থ ছিল “বলা”, কারণ দুর্যোগের সময়ে একজন একনায়ক মুখ দিয়ে যা বলবেন সেটাই আইন হিসেবে গণ্য হবে। সিনসিনেটাসের কাছে যখন তার নিয়ােগের খবর পৌঁছল তখন তিনি জমিতে হাল চাষ করছিলেন। জমির মাঝখানে হাল ফেলে রেখে তিনি সােজা ফোরামের দিকে রওনা দিলেন, সেখানে গিয়ে নতুন একটা সেনাবাহিনী গঠন করে, তাদের নিয়ে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। সেখানে গিয়ে তিনি প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে কনসল এবং রােমের সেনাবাহিনীকে রক্ষা করে আনলেন। সেখান থেকে সবকিছু উদ্ধার করে দিনে দিনেই তিনি রােমে ফিরে এসেছিলেন (এই পুরাে ব্যাপারটা আসলে বাস্তব হিসেবে অতিরিক্তই ভালাে)। রােমে ফিরে সিনসিনেটাস সঙ্গে সঙ্গেই একনায়কের পদ ছেড়ে দিলেন, প্রয়ােজনের অতিরিক্ত একটি দিনও তিনি সেই সর্বময় ক্ষমতা ব্যবহার করেননি। আর ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে তিনি সােজা নিজের খামারে ফিরে গেছেন। ক্ষমতা পাওয়া এবং তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে তারপর এতটুকু অপব্যবহার না করে সেখান থেকে সরে দাঁড়ানাের এই চমৎকার উদাহরণ পরের প্রজনাের জন্য বিরাট শিক্ষা হয়ে দাড়িয়েছিল। আমেরিকান বিপ্লবের শেষের দিকে জর্জ ওয়াশিংটন যেন ঠিক সিনসিনেটাসের মতােই আচরণ প্রদর্শন করেছিলেন। সেই যুদ্ধের পরে বিপ্লবী সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাই “সিনসিনাটি সমাজ” নামে একটি সংগঠন প্রবর্তন করেছিলেন, ল্যাটিন ভাষায় সিনসিনেটাসকে বহুবচনে সিনসিনাটি বলা হতাে।

এট্রুরিয়া বা এট্রুসিয়া যেহেতু গাউলদের ছেড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তৃপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। রােমান সেনাবাহিনীও তাই পুরােনাে শত্রু এট্রুস্কানদের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এট্রুস্কানদের সর্ব দক্ষিণের নগর ছিল ভেই (Veii), যা ছিল রােম থেকে মাত্র বারাে মাইল দূরে। তবে সেটা রােমের চেয়ে আয়তনে অনেক বড়াে ছিল আর সম্ভবত এট্রুস্কানদের যাবতীয় নগরের মধ্যে ছিল সবচেয়ে বড়াে। ভেই নগরটা রােমের চিরকালের শত্রু ছিল। তাদের মধ্যে কম করে হলেও পরপর চৌদ্দবার যুদ্ধ লেগেছিল। সাড়ে তিনশ শতাব্দী জুড়ে রােমকে সেই যুদ্ধগুলাের ঘানি টানতে হয়েছে। কখনাে হয়তো ভেই রােমের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠত, তখন ভেইকে বেশ সতর্কতার সঙ্গেই দেখতে হয়েছিল রােমান সেনাবাহিনীর। কিন্তু সেবারে এটুরিয়া যখন গাউলদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত, রােমের সেনাবাহিনী তখন তাদের আক্রমনের জন্য এগােতে লাগল। খ্রিস্টপূর্ব ৪০৬ সালে রােমান সেনাবাহিনী নগরটা দখল করে নেয়। কাহিনী অনুযায়ী দখল পরবর্তী দশ বছর মার্কাস ফুরিয়াস ক্যামিলাসকে শাসক হিসেবে সেখানে নিয়ােগ দেয়া হয়। পরিশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৬ সালে মার্কাসের হাত থেকে নগরটি মুক্ত করে রােমের সীমানার মধ্যে নিয়ে নেয়া হয়। সেখানে রােমের বিজয়ের পরেও কাহিনীটা এগােতেই থাকে। ক্যামিলাসকে সেখানে দুর্নীতি এবয়ং অনাচারের অভিযােগে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযােগের কারণে তিনি মনােক্ষুন্ন হন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৯১ সালে শাসকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব গ্রহন করেন।

রোমে গাউল জাতির আক্রমণ

ভেই নগরে প্রথম বিজয়টি ছিল একটা ফাকা আওয়াজ। গাউলরা প্রতিদিন একটু একটু করে এট্রুরিয়ার কোনাে না কোনাে অঞ্চল দখল করছিল। তাদের কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছিল পুরাে দেশ দখল না করে তারা থামবে না। আর রােমানরা সেই সুযােগে যুদ্ধকবলিত এট্রুরিয়ায় হামলে পড়ে বিভিন্ন ফায়দা লুটছিল। তবে তখন তারা জানত না যে তাদের নিজেদের দেশেও শীঘ্রই ওরকম অসহায় পরিস্থিতির ছায়া পড়বে। ভেই নগরটি দখলের পরপরই এই বিষয়টি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল যে গ্যালিক সেনাবাহিনী রােমের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তারা সর্বপ্রথমে টিবার নদীর উত্তর-পশ্চিমে আত্রমন করল, এমনকি রােম পর্যন্ত তাদের আক্রমনের রেশ চলে এল। আর তখন রােমানদের সঙ্গে গাউলদের যুদ্ধ পুরােপুরিভাবেই শুরু হয়ে গেল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯০ সালের জুলাই মাসের ১৬ তারিখে গ্যালিক সেনাবাহিনী ব্রেনাস নামের একজন নেতার অধীনে ছােট্ট নদী আলিয়ার (Allia) তীরে রােমান সেনাবাহিনীর উপরে আক্রমন করল। রােম থেকে দশ মাইল দূরে রােমান সেনাবাহিনীকে তারা যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করে। তখন থেকেই জুলাই মাসের ১৬ তারিখ রােমানরা দুর্ভাগ্যের দিবস হিসেবে পালন করে। 

অবশ্য এই তারিখটা তখন রােমানদের কাছে ১৬ই জুলাই হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের তৈরি করা মাসের নামগুলােই পরবর্তীকালে আমরা গ্রহন করেছি, কেবল দুটো মাস ছাড়া। তখনকার সময়ে রােমান প্রজাতন্ত্রে যে মাস দুটোকে আমরা বলি জুলাই এবং অগাস্ট, সেই দুটো মাসের নাম ছিল যথাক্রমে কুইনটিলিস এবং সেক্সটিলিস। প্রতিটি মাসে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিন থাকত, প্রতি মাসের প্রথম দিন, যে দিনে মাসটা শুরু হবে বলে ধর্মীয় নেতা ঘােষণা দিলেন, তাদের ভাষায় “ক্যালেন্ডস”। এটা সেই শব্দ যেখান থেকে আমরা “ক্যালেন্ডার” শব্দটা পেয়েছি। দ্বিতীয়ত, মাসের ঠিক মাঝখানের একটা দিন, মার্চ, মে, জুলাই এবং অক্টোবরের ক্ষেত্রে মাসের ১৫ তারিখ এবং এছাড়া অন্য মাসের ক্ষেত্রে ১৩ তারিখকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হতাে। একে বলা হতাে “হাডস, যা এসেছিল এট্রুস্কানদের শব্দ থেকে, যার অর্থ হলাে “বিভাগ”। তৃতীয়ত, মাসের নবম দিনকেও গুরুত্বপূর্ণ ধরা হতাে। গুরুত্বপূর্ণ এই দিনগুলাে কোনাে একটা দিন থেকে কত দিন দূরে, এমন একটা হিসেবের মধ্যে দিয়ে তারা দিনের হিসেব করত। আর ঠিক সেভাবে জুলাইয়ের ১৬ তারিখকে তারা উল্লেখ করত “সেক্সটাইল মাসের শুরুর ১৬ দিন আগে” হিসেবে। দিন-তারিখ গােনার এই নিয়মটা ছিল ভয়ানকভাবে জটিল।

যাই হোক, বিজয়ের পরে গাউল সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে সরাসরি রােমে প্রবেশ করল। পরসিনা যেভাবে রােম দখল করেছিল, তারা ছিল তার চেয়েও ভাগ্যবান। রােমের ইতিহাসে সেটাই ছিল বাইরের মানুষের মাধ্যমে দখল হবার প্রথম উদাহরণ। আর তার পরের আটশ বছরেও রােমে ওরকম ঘটনা আর দ্বিতীয়টি ঘটেনি। ঘটনাটিকে ইতিহাসে স্থান দিতে গিয়ে ঐতিহাসিকেরা তাকে অনন্যসাধারণ ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেই ঘটনার মধ্যে দিয়ে অসংখ্য বীরের কথাও বর্ণিত হয়েছে। গ্যালিকদের ধেয়ে আসার খবরে রােমানদের মধ্যে বহু মানুষ রােমের কেন্দ্র ছেড়ে পালিয়ে গেল। তারা ক্যাপিটোলাইন পাহাড়ে গিয়ে নিজেদেরকে নিরাপদ রেখে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকল। কিন্তু কাহিনি অনুযায়ী, সিনেটররা রােম থেকে এক পা নড়লেন না। তারা নিজ নিজ বাড়ির সামনে ঠায় বসে থাকলেন। গাউলদেরকে সাহসের সঙ্গে মােকাবেলা করার জন্যই তারা এই পদক্ষেপ নিলেন। এই ঘটনাটি ভাবলে নেহায়েত বােকামি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না, তবে যারা পড়েছেন তাদের জন্য গল্পের মজাদার অংশ বটে। গাউল সেনাবাহিনী মহা সমারােহে নগরে প্রবেশ করে ধ্বংস আর পােড়ানাের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল আর তারই মধ্যে সিনেটরদের হাতির দাঁড়ের তৈরি ঘিয়ে রঙের চেয়ারগুলােতে নিষ্ক্রিয় বসে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। শেষপর্যন্ত সে হলাে যে, গাউল সেনাবাহিনীর এক সাধাসিধে সদস্য একজন সিনেটরকে ছুঁয়ে দেখতে গেল আদতেই তিনি মানুষ নাকি কেবল মূর্তি। মানুষের দাড়িকে অনেক সংস্কৃতিতেই পৌরষত্বের প্রতীক বলে মনে করা হয় এবং সেখানে অন্য কোনাে মানুষ স্পর্শ করলে তাকে চরম অপমান বলে ধরে নেয়া হয়। ঠিক তেমনই, গাউল সৈন্যের আঙুল যখন সিনেটরের দাড়িতে পড়ল, তিনি ভয়ানক রেগে গিয়ে কিছু একটা দিয়ে গাউল সৈন্যকে আঘাত করে বসলেন। গাউল সৈন্য মূর্তির কাছ থেকে আকস্মিক আঘাত পাওয়ার বিস্ময় থেকে বেরিয়ে এলেই উলটো সিনেটরকে আঘাত করল এবং তাকে হত্যা করল আর এভাবেই একটি মৃত্যু থেকে সেখানে ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল।

গাউলরা তখন ক্যাপিটলেও তাদের তাণ্ডব চালিয়ে দখল করে নিল আর সেখানে আবির্ভাব হলাে অদ্ভুত এক কাহিনীর। এক রাতে গাউলরা সেখান থেকে পাহাড়ে ওঠার সহজ এবং অপেক্ষাকৃত সরাসরি একটা রাস্তা আবিষ্কার করে ফেলল। রাজ্যের সমস্ত রােমানরা যখন ঘুমিয়ে তখন তারা চুপচাপ সেই রাস্তা ধরে পাহাড়ে উঠতে থাকল। তারা প্রায় উঠে পড়েছে, এমন সময়ে মন্দিরে পালন করা কিছু হাঁস, রাতের বেলা মানুষজন ঘুমিয়ে থাকার সময়ে যাদেরকে ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য রাখা হতাে, মানুষের পাহাড়ে ওঠার ক্ষীণ শব্দে তারা চেচামেচি আর ছােটাছুটি শুরু করল। মার্কাস ম্যানলিয়াস নামে একজন রােমান, যিনি তার বছর দুয়েক আগে কনসল ছিলেন, হাঁসদের আওয়াজে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। তিনি তার অস্ত্র নিয়ে গাউলদের দিকে প্রথম আঘাত করলেন। আর তার চিৎকারে আশেপাশে আরাে মানুষ জেগে উঠল। সবাই মিলে একযােগে চূড়ায় অনুপ্রবেশকারী গাউলদের প্রতিহত করতে লাগল, বাকিদেরও ডাকতে লাগল। সেই রাতে রােমানরা গাউলদের পরাজিত করতে পারল এবং নগর থেকেই তাড়িয়ে দিল তাদের। সেই আকস্মিক যুদ্ধের সাফল্যের কারণে ম্যানলিয়াসকে উপাধি দেয়া হলাে ক্যাপিটোলিনাস।

গাউলরা যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। পাহাড়ের চূড়ায় পরাজয়ের সময়ের সাত মাস আগে থেকে তারা যুদ্ধ করছিল। ততদিনে ক্ষুধাসহ নানারকমের অসুবিধায় ভুগছিল তারা। শেষপর্যন্ত যুদ্ধের বদলে শান্তির সিদ্ধান্ত নিল গাউলরা। তবে তারা এক শর্তে রােম ছাড়তে রাজি হলাে, রােমান শাসকদের কাছে তারা এক হাজার পাউন্ড সােনা দাবি করল। রােমান জেনারেল লক্ষ করলেন একটি সােনার টুকরাের ওজন তিনি যা জানতেন, বারবার নতুন করে ওজন মাপলেও তার থেকে কম ওজন দেখা যাচ্ছে। গাউলরা সােনা মেপে নেয়ার সময় নিজেদের বানানাে বাটখারা ব্যবহার করছিল যাতে বেশি ওজনের সােনা নিতে পারে। ঐতিহাসিকেরা রােমানদের এরকম ক্ষতি মেনে নিতে পারেননি। আর তাই তখন ইতিহাসটাও হয়ে গেছে অন্যরকম। সােনা বেশি চলে যাচ্ছে দেখে রােমানরা আবার হাতে অস্ত্র তুলে নিল এবং গাউলদের উপরে চড়াও হয়ে তাদের দেশছাড়া করল। ক্যামিলাসের অধীনে এক সেনাবাহিনী তাদের পরাস্ত করল এবং তাড়িয়ে দেবার আগে গর্বের সঙ্গে ঘােষণা দিল, “রােম তার স্বাধীনতা লােহা দিয়ে কেনে, সােনা দিয়ে নয়।” ইতিহাসের এই অংশের সত্য হবার যতরকম সম্ভাবনাই থাকুক না কেন, এটা আসলে রােমান অতি আবেগী ঐতিহাসিকদের বানানাে একটা ব্যাপার। সেই সময়ের ঘটনা পর্যালােচনা করলে বােঝা যায় যে রােমানরা তখন পুরােপুরিই ধরাশায়ী হয়েছিল এবং শত্রুকে দেশছাড়া করতে তাদের দেয়া শর্ত মেনে তাে নিয়েছিলই, তা দিতেও বাধ্য হয়েছিল।

রোমান সমাজের উদারীকরণ ও রোমানদের ঘুরে দাঁড়ানো

যাই হােক, নগরটা বেঁচেছিল, আর ক্যামিলাস, যিনি কিনা সত্যিকার অর্থে গাউলদের পরাজিত করেছিলেন কি না তার কোনাে প্রমাণ না থাকলেও রােমের শাসনকার্য ঠিকঠাক মতােই চালিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রায় ধ্বংসস্তুপের মতাে নগরটায় দাড়িয়ে রােমানরা বলাবলি করত যে নগরটা সরিয়ে ভেই নগরের দিকে তাদের চলে যাওয়া উচিত কি না। তারা ভগ্ন নগরে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বসবাসের চেয়ে ভেইয়ের দিকে গিয়ে নতুন করে জীবন যাপন শুরু করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। কিন্তু ক্যামিলাস এই চিন্তার বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলেন। রােমানরা রােমেই থাকতে বাধ্য হলাে এবং ক্যামিলাস “দ্বিতীয় রােমুলাস” হয়ে উঠলেন। রােম নগরকে ঢেলে সাজালেন তিনি। গ্যালিক সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ রােমে বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন রেখে গেল। প্রথমত, গাউলদের কাছে রােমের এই হার তার আগের সাড়ে তিনশ বছরের ইতিহাসে প্রথম একটি কালাে দাগ বসিয়ে দিল। সত্যি কথা বলতে গেলে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৯০ সালের পর থেকে ঐতিহাসিকেরা বাস্তব সম্মত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, সেই ঘটনার মাত্র একশ বছর আগে পারসিনার আক্রমনের পর থেকে রােমের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ যাচ্ছিল। দরিদ্র জনগােষ্ঠী কষ্টে দিনপাত করছিল। ম্যানলিয়াস ক্যাপিটোলিনাস, সম্ভান্ত সমাজের অংশ হয়েই একদিন যিনি রােমকে বাঁচিয়েছিলেন এবং ক্যাপিটোলে নিজের বিজয় লিখে দিয়েছিলেন, তখন সেখানে তাকে এক সৈন্য বীরত্বের সঙ্গে সহায়তা করেছিল বলেই। তিনি সেই সৈন্যকে দেনার দায়ে দাস হয়ে যেতে দেখলেন। সৈন্যের পরিস্থতি দেখে তার এত খারাপ লাগল যে তিনি নিজের সম্পদ থেকে অর্থ দিয়ে বীর সৈন্যের ঋণ শােধ করে দিলেন। আর তারপর থেকে তিনি ক্রমাগত নিজের সম্পত্তি বিক্রি করে আরাে অনেক মানুষের দায় শােধ করে তাদের দাসপ্রথা থেকে মুক্ত করতে লাগলেন। তিনি ঘােষণা দিলেন যে, মানুষকে দাসপ্রথা থেকে মুক্ত করতে তিনি তার শেষ বিন্দু পর্যন্ত ঐশ্বর্য দান করবেন। উচ্চশ্রেণির মানুষেরা এই ঘােষণায় তার প্রতি বিরক্ত হলেন। ম্যানলিয়াসের উদারতা তাদের কাছে বিব্রতকর এবং অপ্রয়ােজনীয় বলে মনে হলাে। তারা বিরক্ত হয়ে এই নিয়ে দরিদ্রদের মধ্যে উলটো ভাবনা ছড়াতে লাগলেন। তারা বললেন যে, ম্যানলিয়াস দরিদ্র জনগােষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের উদ্দেশ্যে এ কাজ করছেন। কারণ তিনি রােমের রাজা হতে চান। ম্যানলিয়াসকে বন্দি করা হলাে, তারা তাকে মেরে ফেলতেও চেষ্টা করলেন। কিন্তু ক্যাপিটলে ম্যানলিয়াস যে বীরত্ব দেখিয়ে রােমকে উদ্ধার করেছিলেন তার পরে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারলেন না। তাই তার বিচার বছরের পর বছর চলতে লাগল। শেষপর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ সালে প্যাট্রিশিয়ানরা বিচারে সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ম্যানলিয়াসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলেন।

কিন্তু এর পরেও প্লেবিয়ানদের সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছিল আর সেটাকে কিছুতেই সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। ক্যামিলাস উচ্চশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে দেখলেন যে দরিদ্র জনগােষ্ঠীর সমস্যা মেটানাে জরুরি। তিনি সেই সমস্যা মেটাতে তার বিশাল ক্ষমতার প্রয়ােগ করলেন আর তার পরিপ্রেক্ষিতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৭ সালে লিসিরিও সেক্সটিয়ান আইনের প্রবর্তন হলাে। আইনটির নাম গাইউস লিসিনিয়াস এবং লুসিয়াস সেক্সটিয়াসের নামে রাখা হলাে। আইন প্রণয়নের সময় তারা দুজন রােমের কনসল ছিলেন। সেই আইনটি দায়গ্রস্থ লোকেদের জন্য কিছুটা সুবিধা আনল। আইনটির মাধ্য একজন মানুষ কতটা সম্পত্তির মালিক হতে পারবে তার একটি সীমা নির্ধারণ করা হলাে। এভাবে পেট্রিশিয়ানদের একের পর এক জমি এবং সম্পত্তির মালিক হতে বাধা দেয়া হলাে বলে তারা নির্মমভাবে দায়গ্রস্থ প্লেবিয়ানদের জমি বা সম্পত্তি গ্রাস করার থেকে বিরত হতে বাধ্য হলাে। আইনে তার সাথে আরাে একটি জরুরি বিষয় যুক্ত হলাে, কনসল পদ প্লেবিয়ানদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল। পরে ধীরে ধীরে এমন হলাে যে কনসলদের মধ্যে অন্তত একজন কনসলকে প্লেবিয়ান হতে হবে। এই নিয়মের পর থেকেই বস্তুত প্লেবিয়ান ও পেট্রিশিয়ানদের দৃশ্যমান পার্থক্য দ্রুত কমে আসতে লাগল। রােমান ইতিহাসে দেখা যায় যে তারপর থেকে শাসনের ক্ষেত্রে পেট্রিশিয়ান এবং প্লেবিয়ান হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে লাগল। তারপর থেকে রােমের আইনকানুনকে নাম দেয়া হলাে S.P.Q.R. রােমান ইতিহাসবিদগণ কয়েকটি অক্ষর নিয়ে এরকম নাম দিলেন যাতে করে বােঝানাে হতাে “Senatus Populusque Romanus,” যার অর্থ হলাে “সিনেট আর রােমের সাধারণ মানুষ।”

শেষপর্যন্ত গ্যালিক সেনাবাহিনীর আক্রমন রােমের ইতিহাসে, বিশেষ করে ইতালির মধ্যভাগের জন্য একটা নতুন যুগের সূচনা করল। এট্রুসকানরা বিতাড়িত হবার পরে ক্ষমতার কেন্দ্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা যে কোনাে জায়গায় যেভাবে ভরে যাওয়ার সুযােগ থাকে, রােমেও সেভাবেই ভরে গেল। গাউলদের জন্য রােম বরাবরই একটা প্রতিরােধপূর্ণ অঞ্চল হয়ে থেকেছে। যতবার গাউলদের আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ততবারই পালটা আক্রমন করে ঘুরে দাড়িয়েছে। রােমের বৈশিষ্ট্য ছিল, তার যখনই সম্মানহানি হতাে, সে সেই সম্মান পুনরুদ্ধার করত। ক্যামিলাসের যােগ্য নেতৃত্বে পূর্বের হারিয়ে যাওয়া ভূখণ্ডগুলাে রােম দ্রুত উদ্ধার করল। প্রথমত তারা ভেই নগর পুনরুদ্ধার করল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৯ সালে তারা দক্ষিণ ল্যাটিয়ামে ভলশিয়ানদের পরাজিত করল এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৭ সালে দক্ষিণ দিকেই আরেক ভয়াবহ যুদ্ধে গাউলদের পরাজিত করল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৫ সালে ক্যামিলাস মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু তারপরেও রােম ক্রমাগত বাড়তেই থাকল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৪ সালে অন্যান্য ল্যাটিন নগরগুলাে ল্যাটিন লিগে যােগদান করতে বাধ্য হলাে, সেখানে অবশ্য সবার অধিকার কাগজে কলমে সমান থাকলেও দৃশ্যমানভাবেই রােম তার মধ্যে নেতার আসনে ছিল। একই সময়ে এট্রুরিয়ার দক্ষিণ দিকে, নগরের উত্তর দিকে চল্লিশ মাইল পর্যন্ত জায়গায় রােমানদেরই আধিপত্য ছিল। প্রকৃতপক্ষে গাউল সেনাবাহিনী রাজ্যটি ধ্বংস করে চলে যাবার মাত্র এক প্রজন্ম পরেই রােম ইতালির পশ্চিম এবং মধ্যভাগে ৩০০০ বর্গ মাইল জুড়ে মহা সমারােহে রাজত্ব করেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালের মধ্যেই ইতালির উপদ্বীপ অঞ্চলে চারটি শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান জাতির মধ্যে রােমানরা হয়ে দাঁড়ালো একটি। বাকি তিনটি জাতি হলাে উত্তর দিকে গাউলস, মধ্যভাগে স্যামনাইটস এবং দক্ষিণে গ্রিক।

ইতালি জুড়ে রোমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা

শত্রুদের দমন ও সমগ্র ল্যাটিয়াম নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রজাতন্ত্র গঠন

তদকালীন বিশ্ব ও প্রতিবেশী সাইরাকুজের অবস্থা : প্রথমে এখানে থেমে আমরা কিছুক্ষণ ভাবি, রােমের পত্তনের পর থেকে তার পরের চারটি শতাব্দীতে পৃথিবী কতটা বদলে গেছে। পূর্বদিকে অ্যাসিরিয়ান রাজ্য বহুদিন ধরে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকতে থাকতে প্রায় সমাপ্ত এবং বিস্মৃত হয়ে গেছিল। সে জায়গায় আরাে বড়াে, আরাে বেশি ক্ষমতাশালী এবং শাসনকার্যে আরাে সুশৃঙ্খল এক রাজ্যের উদ্ভব হলাে, যার নাম পারস্য সাম্রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালের মধ্যে পারস্য তার উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেল এবং পশ্চিম এশিয়ার বিশাল অংশ শাসন করা শুরু করেছে, ভারতের ঈজিয়ান সমুদ্রের আশেপাশের অঞ্চল, এমনকি তারা মিশরকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল। রােমান প্রজাতন্ত্রের প্রথম শতাব্দীতে গ্রিস সম্পদে প্রভাবশালী ছিল। রোমানরা যখন ধীরে ধীরে এট্রুস্কানদের নিয়মকানুন গ্রহণ করছিল তখন গ্রিক নগর এথেন্স সংস্কৃতির এমন প্রাণ কেন্দ্র হয়ে উঠল যা পথিবীর ইতিহাসে বিরল। দুর্ভাগ্যবশত গ্রিক নগরগুলাে নিজেদের মধ্যে বরাবর যুদ্ধ লাগিয়ে রাখত, ততদিনে গাউলরা ইতালির মধ্যভাগ দখলের নামে ধ্বংস করেছে, ওদিকে এথেন্স গ্রিকদের প্রধান শত্রু স্পার্টার মাধ্যমে এমনভাবে ধ্বংস হয়েছিল যে আর কখনােই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। কিন্তু তার পরপরই গ্রিক নগর থিব্‌স যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল স্পার্টাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালের মধ্যে গ্রিক নগরগুলাে বুঝে গিয়েছিল যে ক্রমাগত যুদ্ধে তাদের সকলেরই ক্ষতি হচ্ছে, অর্থাৎ যুদ্ধে সবাই হেরে যাচ্ছে, কারােরই জিত হচ্ছে না। ইতালির দক্ষিণ দিকে সিসিলি দ্বীপে তখনাে গ্রিক সভ্যতার জয়গান চলছিল, তখন মােটে গাউলদের আক্রমণ থেকে মুক্ত হয়েছিল রােম, তখন সাইরাকুজ নগর শাসন করতেন একজন শক্তিশালী শাসক, যার নাম ডায়োনিসিয়াস। প্রায় পুরাে সিসিলি দ্বীপ তার শাসনের অধীনে চলে এল, কেবল পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চল কার্থেজদের নিয়মে চলতে লাগল। এছাড়া, ডায়োনিসিয়াস দক্ষিণ ইতালিতে গ্রিকদের দখলে থাকা অঞ্চলগুলােকেও দখল করে ফেললেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৭ অব্দে ডায়োনিসিয়াসের মৃত্যুর পর সাইরাকুজ দুর্বল হয়ে যায়, ও তার উত্তরাধিকারীরা দুর্বলভাবে শাসন চালাতে থাকে। ফলে তারা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।

ফিলিপের অধীনে গ্রিসে মেসিডোনিয়ার অগ্রযাত্রা : ঠিক সেই সময়ে গ্রিসের উত্তর দিকে ছােটো একটি ভূখণ্ডে অপ্রত্যাশিতভাবে একটি ক্ষমতার উত্থান হতে দেখা গেল, নগরটির নাম ম্যাসিডােন। সেখানকার অধিবাসীরা যদিও গ্রিক ভাষায় কথা বলত, তবে দক্ষিণের সভ্য গ্রিকদের কাছে তারা তখনও সংস্কৃতির দিক দিয়ে কিছুটা অসভ্য জাতি বলে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৯ সাল পর্যন্ত ম্যাসিডােন নগরটি সে অঞ্চলের সভ্যতার ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হবার মতাে কোনাে যােগ্যতা অর্জন করেনি। কিন্তু সে বছর অসাধারণ একজন শাসক, ফিলিপ ক্ষমতায় এলেন। আর ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সেই ভূখণ্ডের সীমান্তবর্তী অসভ্য জাতিগুলােকে উৎখাত করলেন। ফিলিপের আগে সেখানে যেসব শাসক ছিলেন, সীমান্তবর্তী জাতিগুলােই ছিল তাদের মূল সমস্যা, তাদের কারণে শাসকদের কেবল সিংহাসন আঁকড়ে বসে থাকতে হতাে, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তারা কোনাে যােগাযােগ স্থাপন করতে পারতেন না। ফিলিপের প্রথম পদক্ষেপেই তারা বলতে গেলে স্বাধীন এবং সার্বভৌম হয়ে উঠল। এছাড়া, ফিলিপ এপিরাস রাজ্যের সঙ্গে ঐক্যজোট গঠন করেছিলেন। ম্যাসিডােনের পশ্চিম দিকে ইতালির পর্বতমালা থেকে ৫০ মাইল দীর্ঘ সরু এক সমুদ্রের ওপারে ছিল এপিরাস রাজ্যের অবস্থান। ফিলিপ বিবাহ করলেন এপিরাসের রাজকীয় পরিবারে। স্ত্রীর ভাইকে তিনি এপিরাসের সিংহাসনে বসালেন যার নাম ছিল আলেকজান্ডার। ফিলিপ একটি বিশাল এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী (ফ্যালাঙ্কস) দাঁড় করালেন, যার নেতৃত্বে থাকল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুধর্ষ গ্রিক সেনা। সেই বাহিনীতে ছিল বিভিন্ন দলে বিভক্ত পদাতিক সৈন্য যাদের পােশাক থাকত অস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত। তাদের বর্ষা ছিল অদ্ভূত রকমের লম্বা। প্রথম কয়েক সারির সৈন্যরা সামনের দিকে, এমনকি সামনের সারির সৈন্যদের ঘাড়ের উপর দিয়ে তাদের বর্ষা তাক করতো। তার পেছন দিকের সারিগুলোর সৈন্যরা কোনাকুনিতে বর্শা তাক করতো, আর সবার শেষের সারিগুলোর সৈন্যরা তাদের বর্শাকে খাড়া করে রাখতো। এদের নিয়েই ছিল মেসিডোনীয় ফ্যালাংক্স, যাদের একসাথে দেখতে সজারুর মতো লাগত। অতি আধুনিকভাবে সজ্জিত এই সেনাবাহিনীর দল সহজেই যে কোন দিকে শত্রুদেরকে আক্রমণ করতে পারত। তাদেরকে ব্যবহার করা হতাে শত্রুকে একেবারে পিষে ফেরার জন্য (ফ্যালাঙ্কস শব্দটি এসেছিল গ্রিক ভাষা থেকে যার অর্থ একটা বড়ােসড় গাছের গুঁড়ি, যা দিয়ে সবকিছু পিষে ফেলা যায়)। ফিলিপ তার ফ্যালাঙ্কসকে প্রয়ােজনীয় অর্থ এবং অস্ত্র সরবরাহ করে বরাবর ভরপুর রেখেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালে গ্রিসের সবখানে তার ক্ষমতার চিহ্ন ছড়িয়ে পড়ল। গ্রিক নগরগুলাে দুর্বলভাবে হলেও তার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করল। 

স্যামনাইটদের সাথে সংঘাত : রােমানরা অদম্য এই আগ্রাসন থেকে মুক্ত ছিল। তাদের আশেপাশের সমস্ত পরিবর্তন, এমনকি সিসিলিতে বা ম্যাসিডােনে নতুন ক্ষমতার উত্থান সেই খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালে তাদের থেকে অনেক দূরে বলেই গন্য হতাে। রােমের জন্য কেবল দুটো শক্তিকে বিপদ হিসেবে ধরা হতাে – উত্তর দিকে গাউল জাতি এবং পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে স্যামনাইট জাতি। নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য রােম এই দুই জাতির প্রত্যেকটি আগ্রাসনের সুযােগ নস্যাৎ করতে সতর্ক থাকত। একটি সাধারণ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্যামনাইটদের মােকাবেলা করার প্রথম সুযােগ এল রােমের জন্য। ক্যাম্পানিয়ায় এমনিতেই অনেক স্যামনাইট জাতির মানুষ ছিল। ক্যাম্পানিয়ার লােকেরা স্যামনাইটদের তাড়ানাের জন্য রােমের লােকদের সাহায্য চাইল (তার পরের কয়েক শতাব্দী জুড়ে, রােম বারবার অন্য কাউকে তাড়ানেরা ব্যাপারে সঙ্গ সঙ্গে সাড়া দিত, বরাবর সময়মতাে হাজির হতাে এবং শত্রু নিধন করত, আর তারপর নিজেদের জন্য আলাদা জায়গা করে নিত সেখানে। যত জাতি যতবার রােমকে শত্রু নিধনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, তারা পরবর্তী কালে জেনেছে যে এই রোমান সহায়তা তাদের জন্যই কতটা মারাত্মক হতে পারে।)। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৩ সালে রােমানরা ক্যাপুয়া নগরের শাসকদের সঙ্গে দল গঠন করল এবং স্যামনাইটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করল। সেটাই ছিল স্যামনাইটদের সঙ্গে রােমের প্রথম যুদ্ধ এবং ধরে নেয়া যায় যে, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ জাতিদের উপরে ছড়ি ঘােরানাের ব্যাপারে রােমের প্রথম পদক্ষেপ। সেটা অবশ্য খুব উল্লেখযােগ্য কোনাে যুদ্ধ ছিল না, তবে তার পরের দুই বছরে সেই অঞ্চলে তেমন কোনাে বড় যুদ্ধ না হওয়াতে স্যামনাইটরা ধীরে ধীরে সেখান থেকে উৎখাত হয়ে গেল এবং ক্যাম্পানিয়ার প্রতিটি কোণে রােমান আধিপত্য ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু পরে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৪১ সালে রােমানদের সঙ্গে স্যামনাইটদের একটি চুক্তি হয়ে গেল এবং কারােরই চূড়ান্ত বিজয় না হয়ে তাদের মধ্যে বরং একটা সমঝােতা তৈরি হলাে।

ল্যাটিন নগরগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ : সম্ভবত রােম ভেবেছিল যে স্যামসনাইটদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি তাদের জন্য ফলপ্রসু হবে, সবকিছু তছনছ করে বিজয় অর্জনের চেয়ে তাদের কাছে হয়তো শান্তির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করাকে শ্রেয় মনে হয়েছিল। ঘরের কাছে শুক্র পুষতে তারা হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। রােমান সেনাবাহিনী যখন ক্যাম্পানিয়ায় যুদ্ধ করছিল, রোমের ল্যাটিন মিত্রদের তখন স্যামনাইটদেরকে স্যামনিয়ামেই আক্রমণ করার কথা ছিল। কিন্তু ল্যাটিনদের অনেকেই তা করতে চায়নি, তারা নিজেদেরকে রোমের আধিপত্যের দ্বারা নিগৃহীত বলে মনে করত, আর তাই তারা রোমের এই আধিপত্যের অবসান চাইত। এবার তারা দেখল যে রােমে নানান ঝামেলা লেগেই রযেছে, সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণে নিযুক্ত, তাই তাদের কাছে এটাই ছিল রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সবচেয়ে ভাল সুযোগ। তাই খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০ সালে ল্যাটিন যুদ্ধ শুরু হলাে। দুর্ভাগ্যবশত ল্যাটিনদের জন্য সময়টা অনুকুল ছিল না। এদিকে ততদিনে রােম বুঝে গেছে তার ভেতরে এবং চারপাশে কী হচ্ছে। তারা স্যামনাইটদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে এল এবং নিজের সেনাবাহিনীকে উত্তরের দিকে পাঠিয়ে দিল। ধারাবাহিকভাবে পরপর দুটো যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ল্যাটিনদের দলটিকে পরাস্ত করল রােমান সেনাবাহিনী। সেই দুটো যুদ্ধের একটিতে রােমান কনসল পাবলিয়াস ডিশিয়াস মাস নিজেকে উৎসর্গ করলেন। তার ধারণা ছিল, তার নিজের জীবনের বিনিময়ে বিধাতা রােমান সেনাবাহিনীতে জিতিয়ে দেবেন (এরকম কাজ তখনই ফলপ্রসু হয়, যখন সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী মনে করে যে বিধাতা তাদের পক্ষে, তারা তখন দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারে, আর একই সঙ্গে তাদের প্রতিপক্ষও সেই শক্তি দেখে ভড়কে যায়)। তাই রােমানরা খুব সহজেই হেসে খেলে একের পর এক ল্যাটিন নগর জয় করে দখল করে নিল। ল্যাটিন নগরগুলাে প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে দাঁড়াতেই পারল না, এবং শত শত মানুষ মারা পড়তে লাগল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮ সালে ল্যাটিয়াম পর্যন্ত মৃত্যুর মিছিল এবং ত্রাস ছড়িয়ে পড়ল। 

গাউলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ : তারপরের কয়েক যুগ ধরে রােমান আর গাউল সেনাবাহিনীর মধ্যে টুকটাক যুদ্ধ লেগেই থাকল। প্রতিটি যুদ্ধেই রােমান সেনাবাহিনী কোনাে না কোনােভাবে জয়লাভ করল, তবে তাদের যে শক্তি প্রয়ােগ করতে হলাে তাতে উপযুক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে গাউলদের কথা তারা কখনাে ভুলতে পারেনি। আর এ কথাও সত্য যে গাউলরা ক্রমাগত রােমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে নিজেদের জন্যও কিছু লাভ অর্জন করেছিল। যেমন রােমানরা ল্যাটিন ভাষাভাষী স্যামনাইটদের সঙ্গে লড়ে ভবিষ্যতের জন্য তেমন কিছু অর্জন করেনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ সালে গাউলরা রােমানদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে এল এবং নিজেদের উর্বর ভূমি পাে উপত্যকায় ফিরে গেল। 

সমগ্র ল্যাটিয়াম নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রজাতন্ত্র : স্যামনাইট এবং গাউল দুই জাতিই রােমানদের কাছে শিক্ষা পেয়ে শান্ত হয়ে গেল এবং ল্যাটিন নগরগুলোরও উচিত শিক্ষা হলাে। আর রােম তখন ৪৫০০ বর্গ মাইলব্যাপী তার রাজত্ব চালানাের মতাে সাহস ও বীরত্ব অর্জন করল, রাজ্যের জনপ্রিয়তা যেমন বাড়তে লাগল, বাড়তে লাগল জনসংখ্যাও পাঁচ লাখে গিয়ে দাঁড়াল রােমের জনসংখ্যা। রােম যে কেবল ল্যাটিয়াম নামের এক সংগঠনের নেতৃত্বদানকারী রাজ্য ছিল, সেই স্মৃতিতে তাকে আর ফেরত যেতে হয়নি। বরং সম্পূর্ণ ল্যাটিয়ামই রােমের রাজত্ব হয়ে দাঁড়াল। ল্যাটিয়ামের প্রায় সব নগরগুলােরই নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, তারা রােমের কলােনিতে পরিণত হলাে। তারা নিজেদের মধ্যে সরাসরি কোনাে ধরনের চুক্তি করতে পারত না, করতে হলে কেবল রােমের মাধ্যমেই করতে পারত। তাদের উপরে যে আইনকানুন কার্যকর ছিল তা রােমেরই তৈরি এবং কোনােরকম বিচারআচারের প্রয়ােজন পড়লে তা করার অধিকার কেবল রােমেরই থাকত। তবে সেখানকার মানুষেরা অভিবাসনের মাধ্যমে রােমে চলে গেলে রােমরে নাগরিক হিসেবে গন্য হতাে। বিষয়টা ততটা খারাপ ছিল না যতটা মনে হচ্ছে। সর্বোপরি রােমান সরকার-ব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। আমরা যেসব সরকার ব্যবস্থায় অভ্যস্ত, তার তুলনায় রােমান সরকার ব্যবস্থা হয়তোবা খানিকটা শক্ত ছিল, আমাদের মতাে গণতন্ত্রের ধারণাও হয়তো রােমানদের ছিল না; কিন্তু সে যাই হােক, ল্যাটিন নগরগুলাে নিজেরাই নিজেদের যেমন শাসন করেছে, রােমও করেছে ঠিক তেমনই। অন্যদিকে বড়াে দেশের টুকরাে অংশ হবার কারণে তাদের নিজেদের মধ্যেও ঝুট-ঝামেলা লেগেই থাকত। রােম তাদের সবগুলােকে একসঙ্গে শাসন করাতে তাদের মধ্যে শান্তি এবং উন্নতি পরিলক্ষিত হলাে। উপযুক্ত সরকার ব্যবস্থা এবং ভালাে সময় হিসেবে ল্যাটিন নগরগুলাে এবং ইতালির অন্যান্য অংশ যা রােমের অধীনে ছিল, তারা রােমের প্রতি বিশ্বস্তও থাকত। এমনকি এক শতাব্দী পরে যখন রােমের উপরে ভয়াবহ আক্রমণ হয়েছিল। তখন তারা সবাই বিদ্রোহ করতে পারত এবং রােমকে চিরকালের জন্য ধ্বংস করে দিতে পারত (এর থেকে বােঝা যায় যে, রােমান প্রজাতন্ত্রের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই গর্বের ব্যাপার ছিল, ইতিহাস বইয়ে তাই তার গর্বের বর্ণনাটও খুব চিত্তাকর্ষক কিন্তু রােমান ইতিহাস আসলে চিরায়ত, প্রতিদিনের সাধারণ জীবনের মতাে, যার একটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, যা হলাে, দীর্ঘকাল টিকে থাকার ক্ষমতা)।

স্যামনাইটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, পরাজয় ও ঘুরে দাঁড়ানো

ম্যাগনা গ্রেশিয়ার গ্রিক নগরগুলোর অবস্থা ও তাদের আশ্রয় : রােমানরা যখন ল্যাটিন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত, স্যামনাইটরা দেখল ক্যাম্পানিয়ায় আক্রমণ করে দখল করে ফেলার সেটাই সুবর্ণ সুযােগ। রােমানদের দুর্ভাগ্যের সময় এসে পড়ল। শতাব্দীর পর শতাব্দী গেছে, রােমানদের কখনাে একই সঙ্গে দুটো বড়াে শত্রুর মােকাবেলা করতে হয়নি। বরং সবসময় এমন হয়েছে যে যখন তারা একজন শত্রুর মােকাবেলা করছে তখন অন্য শত্রুদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ঠান্ডা করে রেখেছে। তবে সেই সময়ে স্যামনাইটরা অন্য সমস্যায় পতিত হলাে। ততদিনে কয়েক যুগ হয়ে গেছে, স্যামনাইট এবং অন্যান্য কিছু ইতালীয় জাতি দক্ষিণ দিকে গ্রিক নগরগুলােকে বারবার আক্রমণ করে চলছিল। তিন থেকে চার শতাব্দী আগে গ্রিক নগরগুলাের যখন পত্তন হয়েছিল, কিন্তু এতদিনে প্রাচীন গ্রিক জাতিগুলাে দুর্বল এবং সম্পূর্ণভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। তাই গ্রিকদের সুদিনও গেছে চলে। আর তাই তখন তারা গ্রিসের বাইরের কোথাও থেকে সাহায্য চাইত, কারণ তারা নিশ্চিত ছিল যে ইতালি থেকে আগত দখলের চাপ তাদের একার পক্ষে সামলানাে সম্ভব নয়। অতীতে দক্ষিণ ইতালির গ্রিক নগরগুলাে সাইরাকুজ কিংবা স্পার্টার মতাে নগরের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পেতেছিল, কিন্তু তখন তাদের হাতের কাছেই তার চেয়ে বড়াে সম্ভাবনাময় সাহায্যকারী ছিল। সেই ক্ষমতাবান সাহায্যকারী হয়ে দাঁড়াল ম্যাসিডােন। ম্যাসিডােনের ফিলিপ তার ক্ষমতার প্রদর্শন করলেন, আর খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৮ সালে গ্রিক নগরগুলাের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো নগর এথেন্স আর থিব্‌সের সেনাবাহিনীর মুখােমুখী হলাে তারা। দুটো নগরকে পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে হয় তখন। গ্রিক নগরগুলাে ম্যাসিডােনের শাসনের আওতায় চলে আসে। আর সেভাবেই চলতে থাকে পরবর্তী দেড়শ বছর। এই সমস্ত পরিবর্তনের দিকেই স্যামনাইটদের সতর্ক দৃষ্টি ছিল, ফিলিপ যখন দক্ষিণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার আত্মীয় এপিরাসের আলেক্সান্ডারের মাথায় এল যে তিনিও পশ্চিমের দিকে একইরকমের আক্রমণ চালাবেন। রােমানরা যখন ল্যাটিন নগরগুলাে ধ্বংস করে গাউলদের সঙ্গে সমঝােতায় এল, স্যামনাইটরা তখন আক্রমণের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিল। সঠিকভাবে বলতে গেলে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৬ সালে ফিলিপ মারা যান, আর আরাে বেশি অদ্ভুত ব্যাপার হলাে, তার সুযােগ্য পুত্র আলেকজান্ডার (তার কিছু পরেই যিনি “মহান” উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন), সেনাবাহিনীসমেত পূর্বদিকে ঘুরে গেলেন এবং ইতালি থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে ধাবিত হলেন, কিন্তু এপিরাসের অন্য আলেকজান্ডার তখনাে সমুদ্রের পাশে বসে ইতালির পাহাড়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। 

স্যামনাইটদের বিরুদ্ধে এপিরাসের আলেকজান্ডারের অভিযান : খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে তার ডাক এল। ম্যাগনা গ্রেশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগর ট্যারেনটাম, আগেও বিভিন্ন বিপদে আপদে বাইরের কোনাে ক্ষমতাধরের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছিল, তেমনি সেবারে সাহায্য চাইল এপিরাসের আলেকজান্ডারের কাছে। আলেকজান্ডার সঙ্গে সঙ্গেই আবেদনে সাড়া দিলেন, দক্ষিণ ইতালির দিকে সেনাবাহিনীর একটা দলকে পাঠিয়ে দিলেন, সেখানে ধারাবাহিক যুদ্ধের মধ্যে কিছু যুদ্ধে তারা ইতালির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভও করলেন। কিছুদিনের জন্য ইতালিয়ানরা চোখে আঁধার দেখল, যেহেতু রােম এবং এপিরাস ইতালিয়ানদের এমনভাবে কব্জা করে রেখেছিল যে সেখানে নতুন কোনাে শক্তির উদ্ভব ঘটা অসম্ভব ছিল, আর স্যামনিয়ামের অবস্থা হয়েছিল শাঁখের করাতে পড়ার মতাে (রােমানরা বরাবরই প্রতিবেশী ছাড়াও বিভিন্ন জাতিকে সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকত। একবার যখন দূরবর্তী কাউকে সাহায্য করে যুদ্ধে জিতিয়ে দিত, তখন তাদের প্রতিবেশীর উপরেও হামলা চালাত এবং দখল করে নিত। রােমানদের এই কৌশল বারবার বাস্তব হতে দেখা গেলেও, তারা ছাড়া অন্য কোনাে জাতিকে তা প্রয়ােগ করতে দেখা যায়নি)। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এপিরাসের আলেকজান্ডার ছিলেন ট্যারেন্টামের মানুষদের জন্য অনেক বেশি সফল একজন শাসক। তারা সাহায্য চেয়েছিল কিন্তু এত বেশি সাহায্য হয়তোো চায়নি। তাই শীঘ্রই ট্যারেন্টামের মানুষেরা বীরত্বের তকমায় ঠাসা আলেকজান্ডার যে তাদের উপরে অতীতে হামলাকারী বিভিন্ন ইতালিয়ান জাতির চেয়ে বেশি বিপজ্জনক, সেটা বুঝতে শুরু করল। আর তাই তারা আলেকজান্ডারের সাহায্য নেয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে প্যানডােসিয়ায় তিনি পরাজিত হলেন, জুতাের আকৃতির ইতালিয় সমুদ্র উপকূলের নগর প্যানডােনিয়া, সেখানেই তাকে পরাজয় বরণের পরে হত্যা করা হলাে। তার পরিবারের উত্তরাধিকারীরা নিজের পরিবারের ভেতরের রাজনীতিতে এমনভাবে ডুবে ছিল যে পশ্চিমের আক্রমণ ঠেকানাের জন্য কোনাে চেষ্টাই করতে পারল না। ইতালির বাইরে থেকে অবশ্য তখন কোনাে আক্রমণ হয়নি। 

দ্বিতীয় স্যামনাইট যুদ্ধ : এর মানে হলাে স্যামনাইটরা তখন তাদের নজর রােমের দিকে ফেরাতে পারল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ সালে স্যামনাইটরা যখন আলেকজান্ডারকে ধরাশায়ী করার জন্য যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল, রােমানরা তখন ফ্রেজেলি নামক স্থানে একটি উপনিবেশ স্থাপন করে। জায়গাটা তাদের আওতার মধ্যেই কিন্তু তবে স্যামনিয়ামের সীমানার কাছে। স্যামনাইটরা নিশ্চিত হলাে যে রােম যে স্যামনাইটদের সঙ্গে কদিন পরেই যুদ্ধ শুরু করবে, এটা তারই প্রথম পদক্ষেপ। আর সত্যিই, স্যামনাইটদের ধারণা সঠিক ছিল। তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল দুই দলই যুদ্ধ লাগানাের ব্যাপারে এক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যুদ্ধ বাধিয়ে ফেলার কিঞ্চিত অজুহাত পাওয়া গেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত। অবশেষে ক্যাম্পানিয়ার ভেতরের একটা গণ্ডগােল সেই অজুহাত বয়ে আনার সুযােগ দিল। আর তার ফলশ্রুতি স্বরূপ খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে দ্বিতীয় স্যামনাইট যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। রােমের নিজস্ব অবস্থান তখন এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে সেখানে যুদ্ধ হলে সমস্ত ইতালিতে সাড়া পড়ে যায়। তখন যুদ্ধ কবলিত হয়ে রােম এবং স্যামনিয়াম, দুই শক্তিই ওই উপদ্বীপ অঞ্চলে অন্যান্য নগরের সঙ্গে দল পাকানাের ধান্দা করছিল। স্যামনিয়ামের পূর্বদিকে ছিল দুটো পৃথক অঞ্চল: লুসিনিয়া ও অ্যাপুলিয়া। লুসিনিয়া ছিল ইতালির জুতাের আকৃতির উপদ্বীপের বৃদ্ধাঙ্গুলটির ঠিক উত্তরে, এবং অ্যাপুলিয়া ছিল জুতাের আকৃতির দ্বীপাঞ্চলের গােড়ালির দিক থেকে উত্তর-পশ্চিমে। একসময় এই সমস্ত অঞ্চল নিজেদের কবলে নিতে ইতালির লােকেরা স্যামনাইটদের সঙ্গে একজোট হয়ে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে লড়েছিল, কিন্তু তখন কেবল ইতালির অধিবাসীদেরই ব্যাপার সেটা। তাদের কাছে মনে হলাে, দূরের রােমবাসীর চেয়ে হাতের কাছের স্যামনাইটরাই তাদের জন্য অনেক বেশি বিপজ্জনক। সুতরাং তারা রােমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্যামনাইটদের সঙ্গে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিল। পাঁচ বছর ধরে যুদ্ধ চলল, আর বারবার রােমানরাই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে লাগল। আর তারপর খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ সালে হঠাৎ রােমের জন্য বিপদ ঘনিয়ে এল।

রোমের বিপর্যয় : ক্যাম্পানিয়ায় বসে রােমান সেনাবাহিনী ভুল একটা সংবাদ পেল (সংবাদটা উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে স্যামনাইটরাই ছড়িয়েছিল), গুজবটা হলাে অ্যাপুলিয়া নগর স্যামনাইট সেনাবাহিনীর কবলে। রােমান সেনাবাহিনী নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে রাজা অ্যাপুলিয়া নগরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল, যার অর্থ দাঁড়াল, তারা স্যামনিয়ামের ঠিক মাঝ বরাবর হেঁটে চলে গেল। সেটা করতে গিয়ে তারা স্যামনাইটের পূর্বদিকে কডিয়াম নগরের একটা ছােটো উপত্যকার মধ্যে দিয়ে এগােচ্ছিল। উপত্যকাটি এমন ছিল যে কেবল একটিই দিকে অগ্রসর হওয়া যায়, আর সে পথে এসে মেলে অন্য দিক থেকে আসা আরেকটি পথ। উপত্যকাটির নাম কডিন ফোর্ক্স। স্যামনাইটরা ঠিক দুই রাস্তার সেই মিলনস্থলে রােমান সেনাবাহিনীর জন্য অপেক্ষা করছিল। রােমান সেনাবাহিনী ফোর্কটাতে কোনাে বিপত্তি ছাড়াই প্রবেশ করেছিল। কিন্তু তারা যখন উপত্যকা থেকে বেরােনাের প্রান্তে, তখন দেখল যে সেখানে গাছর গুড়ি এবং পাথর দিয়ে প্রতিরােধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর দেখার পরপরই তারা আবিষ্কার করল যে তাদের পেছনে যে রাস্তা দিয়ে তারা উপত্যকায় প্রবেশ করেছে, সেখানে স্যামনাইট সৈন্যেরা দেয়ালের মতাে দাঁড়িয়ে আছে। তারা পরিষ্কারভাবে একটা পরিকল্পিত ফাঁদে আটকা পড়ল। তাদের কাছে প্রকৃতপক্ষে সেই ফাদ অতিক্রম করার কোনাে উপায়ই ছিল না। সেই পর্যন্ত রােমান ইতিহাসে সেনাবাহিনীর কপালে এমন দুর্যোগ বা অপমানজনক বিষয় আর একটিও হয়নি। যুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ােগ করে ভয়ানকভাবে অংশগ্রহণের পরে পরাজয় বরণ করা এক, আর নির্বুদ্ধিতার কারণে অসহায়ের মতাে পরাজয় বরণ করা আরেক। স্যামনাইটরা হয়তো তখন রােমান সেনাবাহিনীর শেষ মানুষটিকে পর্যন্ত কুচি কুচি করে কেটে ফেলতে পারত, সেক্ষেত্রে অনেক মানুষকে হত্যার মাধ্যমে নিজেদের জয় অর্জন করতে হতাে। কিন্তু তখন মনে হলাে তারা কোনােরকম মারামারির মধ্যে না গিয়েই জয়লাভ করতে পারে। জয়ের জন্য কেবল যা করতে হবে তা হলাে, অন্ধগলির মতাে উপত্যকাটিতে আটকে রেখে তাদেরকে উপবাসে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করা। তাদের ভাবনা ঠিকই ছিল, রােমান সেনাবাহিনীদের কাছে খাদ্য যা ছিল তার সবই প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। তারা তখন স্যামনাইটদের কাছে কী শর্তে মুক্তি পেতে পারে তা জানতে চাইল। স্যামনাইটরা তাদের যাবতীয় শর্ত রােমান সেনাবাহিনীর সামনে প্রদর্শন করল। আর তখন যে সেনাপ্রধানরা সেনাবাহিনী নিয়ে স্যামনাইটদের আক্রমণের জন্য এসেছিল তাদেরই বলা হলাে যে জীবনের বিনিময়ে স্যামনিয়ামের যেখানে যতটুকু জায়গা তারা দখল করেছে সবটুকু স্যামনাইটদের ফেরত দিতে হবে। একমাত্র সেই শর্তে সেনাবাহিনীকে অক্ষত ছেড়ে দেয়া হবে। সেনাপ্রধানদের অবশ্যই শর্তে রাজি হবার ক্ষমতা ছিল না, ক্ষমতা ছিল সিনেটের হাতে, শান্তি স্থাপন করতে চাইলে একমাত্র সিনেটই পারে, স্যামনাইটদের সেটা জানা ছিল। কিন্তু সে যাই হােক, তারা মনে করল সেনাপ্রধানদের উপরে চাপ প্রয়ােগ করলেই সিনেট শর্তে রাজি হতে বাধ্য হবে এবং সেনাপ্রধানদের সই দিয়েই শান্তি স্থাপনের চুক্তিটা পাকাপােক্ত হবে। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা রােমান সেনাবাহিনীর ৬০০ জন বীর সদস্যকে বন্দি হিসেবে রাখল। 

ঘুরে দাঁড়ানো ও নতুন পরিকল্পনা : কিন্তু আসল কথা হলাে, স্যামনাইটরা তাদের প্রতিপক্ষের মানসিক জোরের ব্যাপারে সঠিক মূল্যায়ন করেনি। সেনাবাহিনীর মুক্তি পাওয়া অংশ যখন রােমে ফিরল। তখন সিনেটরগণ ভাবতে লাগলেন এ বিষয়ে কী করা যায়। সেনাবাহিনীর মধ্যে থেকে একজন সদস্য প্রস্তাব দিলেন যে, স্যামনাইটরা যেহেতু যুদ্ধে না গিয়ে কূটকৌশলের মাধ্যমে রােমের থেকে সুবিধা আদায় করতে চাচ্ছে তাই তারা বন্দিদের সঙ্গে যা খুশি করতে পারে। সিনেটের সমস্ত সদস্যদেরই কোনাে না কোনাে আত্মীয় ছিল বন্দিদের মধ্যে, কিন্তু তারা রাজি হয়ে গেল। স্যামনাইটরা প্রতিবাদ করে উঠল, যেহেতু শর্ত পূরণের আশায় সেনাবাহিনীর কিছু অংশকে তারা মুক্তি দিয়েছিল, তাই রােমানদেরকে তখন জানিয়ে দিল সেই পুরাে সেনাবাহিনীকে আবার কডিন ফোর্কে পাঠিয়ে দিতে। রােমানরা সংগত কারণেই সেই ভুল আর করেনি। স্যামনাইটরা রেগে গিয়ে বন্দি থাকা সেনাবাহিনীর সমস্ত সদস্যদের হত্যা করল। হত্যা করল ঠিকই কিন্তু তারা বুঝতে পারল যে, জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দিলে যুদ্ধের মাধ্যমে জয়ের একটা সম্ভাবনা হয়তো তাদের ছিল। তার পরিবর্তে তারা পরাজয় মেনে নিল এবং সেই সুযােগ তারা হয়তো আর পাবে না। তখন বীর লুসিয়াস প্যাপিরিয়াস কার্সার, যিনি রােমে পাঁচবার কনসল পদে (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩ সালে প্রথমবার এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩১৩ সালে শেষবার) কর্মরত ছিলেন এবং দুবার পরিচালকও ছিলেন, তার নেতৃত্বে রােম যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল। নিয়মকানুনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর, আর তাই তার অধীনে থাকা লােকজন তাকে বেশ অপছন্দ করত, কিন্তু যুদ্ধে তিনি জয় ছিনিয়ে আনলেন ঠিকই। রােমানরা তখন সেনাবাহিনী দিয়ে এবং রাজনৈতিকভাবে, দুভাবেই লড়াই করছিল। তারা আবার স্যামনিয়ামের সীমানার পাশে উপনিবেশ স্থাপন করল আর সেই উপনিবেশগুলাে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক এবং ল্যাটিন বন্ধুপ্রতীম নগরের মানুষ দিয়ে ভরে দিল। এই ব্যবস্থায় তারা নিশ্চিত করল যে স্যামনাইটরা যদি আবার রােমে প্রবেশ করতে চায় তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তাদের জন্য বাধার সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। তারা রােমের দিকে আসতে চাইলে সীমানার পাশেই তাদের বন্দিত্ব বরণ করতে হবে। আর এদিকে স্যামনাইটদের চোখের সামনেই রােমানরা স্যামনাইটদেরই সমস্ত শত্রু জাতির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে চলল। 

রাস্তা এবং লিজন

ক্লডিয়াসের উন্নয়ন : সেই সময়ে আরেকজন অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস, সাবাইন সম্ভ্রান্ত পরিবারের উত্তরাধিকারী এবং সংবিধান প্রস্তুতকারী আইন কুক্ষীগত করার অভিযােগে আভিযুক্ত দশজনের একজন, রােমের শাসন ক্ষমতায় পদার্পণ করছিলেন। তিনি অবশ্য ইতিহাসে অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস সিকাস নামেও পরিচিত, ল্যাটিন শব্দ সিকাসের অর্থ হলাে অন্ধ। তিনি শেষজীবনে তিনি অন্ধত্বের কবলে পড়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩১২ সালে তিনি সেনসর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই কার্যালয়ে যেটা খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৩ সালে স্থাপিত হয়েছিল। সেখানে দুজন সেনসর নির্বাচিত হতেন দেড় বছরের জন্য, একমাত্র কনসল তাদের চেয়ে উচ্চ পর্যায়ে ছিলেন। শুরুর দিকে কার্যালয়টি কেবল মাত্র পেট্রিশিয়ানদের জন্যই উন্মুক্ত থাকত, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৩৫১ সালে প্লেবিয়ানরাও সেখানে নির্বাচিত হওয়ার যােগ্যতা পেয়ে গেল। আর সেখানেই খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৯ সালে নিয়মটা গিয়ে দাঁড়াল যে সেনসরদের একজনকে প্লেবিয়ান হতেই হবে। প্রকৃতপক্ষে সেনসরের কার্যক্রমের মধ্যে কর আদায়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল (বস্তুত ল্যাটিন শব্দ “সেনসর”-এর অর্থই হলাে “কর আদায়”)। কর আদায়কে যথাযথ করতে প্রথমে যা করতে হয়েছিল তা হলাে জনসংখ্যা গণনা এবং তাদের প্রত্যেকের সম্পদের হিসাব তৈরি করা। কর আদায়ের প্রয়ােজনে তখন আরম্ভ হলাে আদমশুমারি (সেনসাস)। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আদমশুমারি করা হতাে। সেই তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত একইভাবে সেনসাস নামেই মানুষ গণনার কাজটি করে আসছি আমরা। আবার আদমশুমারী করার সময়ে কোনাে মানুষের অন্যায়-অনাচার ধরা পড়লে তাকে দোষী হিসেবে প্রতীয়মান করানােও প্রক্রিয়ার অংশ ছিল। কোনাে মানুষকে অন্যাভাবে সম্পদের পাহাড় গড়তে দেখলে তারা তাকে শাস্তি থেকে শুরু করে, সিনেট থেকে বহিষ্কার, এমনকি তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার পদক্ষেপ পর্যন্ত নিতে পারত। এখান থেকেই আমরা আদমশুমারী সম্পর্কে এমন ধারণা পাই যেন জনগণের আদর্শের প্রতিফলন তাতে ঘটে। সেই যুগে এইরকমের বহু নিয়মকানুন আবিষ্কারের কৃতিত্ব অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস সিকাসকে দেয়া যেতে পারে। রােমানদের মধ্যে যাদের কোনাে জমিজমা ছিল না, তাদেরকে নাগরিকত্ব প্রদানের নতুন নিয়ম তার হাত দিয়েই হয়েছিল। রােমে যে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেড়ে উঠছিল, এর থেকেই তা বােঝা যায়; তারা কেউ বণিক, কেউ শিল্পী- আবার কেউবা ব্যবসায়ী, অন্য কথায় যার উন্নতি কৃষি ছাড়া অন্য কোনাে ক্ষেত্র থেকে হয়েছিল এবং যার বেড়ে ওঠা ছিল রােমান সমাজে। ক্লডিয়াস ব্যকরণ পড়েছিলেন, কবিতাও লিখতেন এবং রােমান শাসকদের মধ্যে প্রথম যিনি নিজেই নিজের বক্তৃতা লিখে নিতেন। তাকে ল্যাটিন গদ্যের জনক হিসেবে ধরা হয়, এবং তার লেখায় দেখা যায় যে রােম কেবল খামার এবং সৈন্য দিয়ে ঘেরা সাধারণ কোনাে নগর ছিল না, ছিল এর চেয়েও বেশি কিছু; গুরুতর কাজের বাইরেও রােমানদের সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনার সূত্রপাত ঘটেছিল।

রোমান রাস্তা : যাই হােক, অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানটি এল খ্রিস্টপূর্ব ৩১২ সালে, যখন তিনি রােম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ল্যাটিয়াম এবং ক্যাম্পানিয়া হয়ে কাপুয়ার দিকে ১৩২ মাইল দীর্ঘ একটি রাস্তা নির্মাণ করছিলেন। প্রথমত রাস্তাটা নুড়ি পাথর দিয়ে বানানাে ছিল, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ২৯৫ সালে রাস্তাটা আগাগােড়া পাথরের বড়াে টুকরাে দিয়ে বাধানাে হয়েছিল (পরবর্তী কয়েক বছরে রাস্তাটা বাড়িয়ে স্যামনিয়াম এবং অ্যাপুলিয়ার মাঝখান দিয়ে, জুতাের মতাে আকৃতির ইতালীয় উপকূল অঞ্চলের গোঁড়ালি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল)। সেটাই ছিল রােমে বানানাে প্রথম পাথরের আস্তর দিয়ে বাঁধানাে পাকা করা রাস্তা, কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীগুলােতে, যথন রােম প্রাচীন বিশ্বের অনেকটা অংশ শাসন করত, তখন রােমে পাকা করা রাস্তা এত বেশি তৈরি করা হয়েছিল যে রােমান সেনাবাহিনী রাজ্যের আনাচে কানাচে যখন যেখানে দরকার পড়ত, ছুটে চলে যেতে পারত। অবশ্যম্ভাবী বিষয় যা ছিল তা হলাে, সমস্ত রাস্তাই রােম থেকে শুরু হতাে, আর আমরা এখনাে যে প্রবাদ ব্যবহার করি তা হলাে, “All roads lead to Rome”, যার অর্থ হলাে জীবনে যা কিছু এড়িয়ে যাবার নয়, হাজার চেষ্টা করলেও তা ঘটবেই। চতুর্দিকে শেষ পর্যন্ত রাস্তাগুলাে পাকা করে বাঁধানাে রােমানদের জন্য একটা বিশাল সফলতা ছিল, কারণ তার আগে পৃথিবীতে কোথাও এত বড়াে অঞ্চলকে সহজ যােগাযাে ব্যবস্থার আওতায় আনার কোনাে নজির নেই। রােমান রাস্তাগুলাে (শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেছে) ইউরােপের লােকদের জন্য এক হাজার বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে, এমনকি রােমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের পরেও, যােগাযােগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করে গেছে। কারণ তার পরে তত মজবুত রাস্তা আর বানানাে সম্ভব হয়নি, অন্তত ১৯শ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাে মােটেও হয়নি, সেই সময়ের পর থেকে রেললাইনের মাধ্যমে ওই অঞ্চলে নতুন যােগাযােগ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াসের বানানাে রাস্তাগ্রলাে তাই রােমান সাম্রাজ্যের প্রথম পাতা রাস্তাই কেবল নয়, বরং রােমের সবচেয়ে মজবুত রাস্তা হিসেবে উল্লেখিত। রােমানদের কাছে আদমশুমারীর পরে অ্যাপিয়াসের অবদান হলাে রাস্তা যাকে তারা বলত “ভায়া অ্যাপিয়া”, আর বাকি বিশ্বের কাছে তা অ্যাপিয়ান রাস্তা বলে পরিচিত। রাস্তাগলাে দ্রুত তৈরি করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল যে রােমান সেনাবাহিনী যেন দ্রুত ক্যাম্পানিয়ায় পৌঁছতে পারে এবং স্যামনাইটদের আক্রমণ হলে যেন দ্রুত সে স্থানে পৌঁছে আত্রমন প্রতিহত করতে পারে। সেই উদ্দেশ্য রাস্তা তৈরির মাধ্যমে খুব ভালােভাবেই সফল হয়েছিল। 

রোমানদের সমরকৌশল ও লিজন : এর সঙ্গে আরাে যা হয়েছিল তা হলাে রােমান সেনাবাহিনীর যুদ্ধের কৌশল বৃদ্ধি পাচ্ছিল। দুর্জয় স্যামনাইটদের বিরুদ্ধে তারা যথাযথভাবে নিজেদের প্রস্তুত করেছিল। গাউলদের হামলার আগে রােমানরা অন্যান্য সেনাবাহিনী যে সাধারণ কায়দায় যুদ্ধ করত, তেমনই কৌশল অবল্লম্বন করত। বড়াে এলাকা থেকে বিশাল এক বাহিনী বেছে নেয়া হতাে, যথেষ্ট বিশাল হলেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। দলটিতে ৩০০০ থেকে ৬০০০ মানুষ থাকত। সেই বিশাল বাহিনীতে বলা হতাে “লিজন” (Legion) (শব্দটি এসেছে ল্যাটিন থেকে, যার অর্থ সংগ্রহ করা)। লিজনের সেনাসদস্যদের হাতে দেয়া হতাে বল্লম যা শত্রুদের দেখলেই একযােগে লক্ষ্য করে ছুড়ে দেয়া যায়, তাতে করে এক লাইনে ধেয়ে আসা শত্রুদের একইসঙ্গে নিধন করা যায়। দুটো দল লাইনে দাঁড়ানাের পরে যে দল অতর্কিতে অন্য দলকে প্রথমে হামলা করে কাবু করে ফেলতে পারবে, তার উপরে নির্ভর করবে কোন দল জিতল। আবার কখনাে কোন দল বেশি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শত্রু ধ্বংস করছে তার উপরেও নির্ভর করে, যে দল অপর দলের লােককে ধরাশায়ী করতে করতে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারল, তারই দেখা যেত শেষ পর্যন্ত জয় হলাে। প্রাচীন যুগে সবখানেই দেখা যেত দলবদ্ধ আক্রমণের প্রচলন ছিল। ম্যাসিডােনিয়ার ফ্যালাঙ্কস সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দলবদ্ধ আক্রমণের ব্যাপারটা একটা শিল্পের পর্যায়ে উঠে এসেছিল – যতদিন কার্যকর ছিল। তবে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রােমানরা তাদের লিজনকে পৃথিবী দখলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করল। রীতি অনুযায়ী পরিবর্তনটা শুরু করলেন ক্যামিলাস। ভেই নগরে লম্বা সময়ের দখল কার্যক্রম চলার সময়ে বারবার সেনাবাহিনীকে আনা নেয়া করার বদলে তিনি লম্বা সময়ের জন্য সেখানেই তাদের রাখলেন। এই সময়ের মধ্যে তাদের যে খামারে কাজ করার কথা ছিল সেই কাজ তাদের করতে হলাে না। আর এভাবে সেনাসদস্যদের বিরতিহীনভাবে যুদ্ধের আশায় বসিয়ে রাখলে তাদের আয় বলতে কিছু থাকবে না তা তিনি জানতেন। ক্যামিলাস কাজ ছাড়াই তাদের অর্থের যােগান দিতে লাগলেন। যুদ্ধের কারণে অন্য কোথাও দিন যাপন করা সৈন্যের জন্য ক্যামিলাসই সর্ব প্রথম এই ব্যবস্থা চালু করলেন। তার ফলে সৈন্যরা বারেবারে একটু একটু না করে দীর্ঘদিন ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযােগ পেল। লিজনের আকৃতি এবং গঠন আরাে জটিল হতে লাগল।

লিজনের গঠন ও কার্যপদ্ধতি : প্রতি লিজনে ৩০০০ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য রাখা হলো মূল শক্তি হিসেবে। ১০০০ হালকা অস্ত্র বহনকারী থাকল দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আক্রমণ করার জন্য আর ৩০০ অশ্বারােহী সৈন্য (যাদের বলা হতাে ক্যাভালরি) আরাে দ্রুত শত্রুর মুখােমুখী হয়ে ঘায়েল করার জন্য। লিজন যখন এগিয়ে যেত তখন তিনটি সারিতে সারিবদ্ধ থাকত। প্রতিটি সৈন্যের কাছেই ছােটো-বড়াে তলােয়ার থাকত। প্রথম দুই সারির সৈন্যেরা বল্লমও বহন করত, আর তৃতীয় সারির সৈন্যেরা বহন করত তাদের চেয়েও ভারী বল্লম। প্রথম দুই সারির সৈন্যেরা ছােটো ছােটো দলে বিভক্ত হয়ে থাকত যাদের বলা হতাে ম্যানিপলস (ম্যানিপলস ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ হলাে “মুঠোভরা”)। প্রতি ছােটো দলে ১২০ জন সৈন্য থাকত। এক একটি দলকে বাকি দুটি সারির ফাকে ফাকে এমন বর্গক্ষেত্রে রাখা হতাে যাতে মনে হতাে দাবার ছক। প্রথম সারিটি শত্রুদের দিকে এগিয়ে যেতে পারত সহজেই, তাদের হাতে রাখা বল্লম ছুড়ে দিত প্রথমে, তলােয়ার দিয়ে মুখােমুখি আঘাত করত তারপর। যুদ্ধ কত করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে প্রথম সারিটি পেছনের দিকে সরে যেত এবং পেছন থেকে দ্বিতীয় সারি সামনে চলে আসত। তারাও ঠিক একইভাবে শত্রুকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালাত। দ্বিতীয় সারি যখন লড়ত তখন তৃতীয় সারি সামনে আসার জন্য প্রস্তুত হতাে। এভাবেই লড়াই চলতে থাকত। এমন যদি হতাে যে কোনাে কারণে শত্রুরা হঠাৎ আক্রমণ করে প্রথম সারির সৈন্যদের ঘায়েল করে ফেলল, তখন তার ঠিক পেছনে থাকা ১২০ জনের ম্যানিপল প্রথম সারির জায়গা দখল করত। দ্বিতীয় ম্যানিপল তখন দখল করত প্রথম ম্যানিপলের স্থান। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ম্যাসিডােনিয়ার ফ্যালাঙ্কস সেনাবাহিনী এই উপায়ে যুদ্ধ করার জন্য বিপুলভাবে প্রশিক্ষিত হয়েছিল। অন্যদিকে লিজন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ ছিল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার। তাদের মধ্যখানে যে ম্যানিপল তাকত সেই দলগুলাে প্রয়ােজন মতাে ছড়িয়ে পড়ে আবার মুহূর্তেই যথাস্থানে এসে দাঁড়াতে পারত। পক্ষান্তরে, ফ্যালাঙ্কস ছিল এক জায়গায় জমায়েত হওয়া একটা মুঠোর মতাে, যেটা সহজে খোলা হতাে না। লিজন ছিল হাতের আঙুলের মতাে, যেমন খুশি বন্ধ করা যেত আবার খােলাও যেত, তবে দ্রুত অথচ খুবই সতর্কভাবে, আবার প্রয়ােজনে একসঙ্গে হয়ে দৃঢ় একটা মুঠোর মতােও আচরণ করতে পারত তারা।

এট্রুস্কান, গাউল ও স্যামনাইটদের পরাজয়ের মাধ্যমে ইতালিতে রোমান আধিপত্য

এট্রুস্কান ও স্যামনাইটদের পরাজয় : লিজন অন্তর্ভূক্ত সৈন্যদের যুদ্ধ করার দক্ষতা এবং নিত্যনতুন কৌশল স্যামনাইটদের চেয়ে রােমান জাতিকে প্রস্তুতির দিক থেকে সবসময় এগিয়ে রেখেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩১২ শতাব্দীতে এট্রুস্কান নগরে তার প্রমাণ দেখা গেছে। লম্বা একটা যুদ্ধবিহীন শান্তির সময় এসেছিল তারপরে। যেন মনে হচ্ছিল রােমানরা ইতালির দক্ষিণ দিকটা দখল করে ছিল, নির্ভেজাল একটা সময়ে এট্রুরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমে পড়া উচিত। কিন্তু রােমানরা, কখনােই যুদ্ধ ছাড়া যে জাতি বসে থাকতে জানত না, উত্তর এবং দুক্ষণে দুর্ধর্ষ লিজন বাহিনী পাঠিয়ে দিল। রােমান সেনাপ্রধান কুইনটাস ফেবিয়াস ম্যাক্সিমাস রুলিয়ানাস সেই আক্রমণের মাধ্যমেই ইতিহাসে স্মরণীয় হলেন। স্যামনাইটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হবার আগে ফেবিয়াস হঠাৎ করে পরিচালক প্যাপিরিয়াস কার্সারের অনুপস্থিতিতে স্যামনাইটদের আক্রমণ করে পরাজিত করেছিল। প্যাপিরিয়াস ফিরে আসার পরে তাকে না জানিয়ে যুদ্ধ করার জন্য তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে গেলেন। তিনি ঠিক করলেন, বিজয় হয়েছে বলেই ফেবিয়াসের ঔদ্ধত্য তিনি ক্ষমা করতে পারেন না। কিন্তু সৈন্যদের কাছে এবং শেষ পর্যন্ত প্যাপিরিয়াসের কাছেও ফেবিয়াসের সিদ্ধান্ত গ্রহণযােগ্য হয়ে উঠল। আর তারপর ফেবিয়াস তার হঠকারিতার অপরাধবােধ থেকে একটা সেনাবাহিনীকে উত্তরের এট্রুরিয়া পর্যন্ত নিয়ে গেলেন এবং সেখানেই সুযােগ হলাে, তিনি এট্রুস্কানদের সঙ্গে লড়ে জয়লাভ করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৮ সালে এট্রুস্কানরা যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ানাের সিদ্ধান্ত নিল। আর এরই মধ্যে প্যাপিরিয়াস কার্সার ধীরে ধীরে স্যামনাইটদের তাড়া করতে করতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫ সালে স্যামনাইটদের উপরে চাপ প্রয়ােগ করতে করতে তাদের ক্যাপানিয়া থেকে বিতাড়িত করে বস্তুত স্যামনিয়ামে প্রবেশ করলেন। স্যামনাইটরা দেখল যে কোনােরকমে টিকে থাকতে হলেও শাস্তিস্থাপন করা ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোনাে রাস্তা খােলা নেই। তাই পরে কখনাে আবার নতুন উদ্যোমে লড়ার জন্য তখন শান্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিল তারা। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৪ সালে স্যামনাইটদের সঙ্গে দ্বিতীয় স্যামনাইট যুদ্ধের অবসান এবং শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হলাে। স্যামনাইটরা চিরকালের মতাে ক্যাম্পানিয়া থেকে চলে গেল, তবে স্যামনিয়ামে তাদের ক্ষমতা বজায় রাখল।

গাউলের যুদ্ধ পরিকল্পনা : রােম এই বিষয়টা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না যে স্যামনাইটরা তাদের হাতে পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি। শান্তিস্থাপনের পরের বছরগুলােতে, রােম সব দিক থেকে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেই যাচ্ছিল। ল্যাটিয়ামের পূর্বদিকে এবং স্যামনিয়ামের উত্তর দিকে বেশ কিছু জায়গা রােমানরা দখল করে নিতে নিতে সেই প্রথম তারা অ্যাড্রিয়াটিক সাগর পর্যন্ত পৌঁছে গেল। আর এভাবেই তারা ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে স্যামনাইটদের এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে গাউল এবং এট্রুস্কানদের মাঝখানের জায়গায় রােমান সাম্রাজ্যের নাম লিখে দিল। অ্যাপেনাইন পর্বতে নতুন রােমান নগর স্থাপিত হলাে (একটা মেরুদণ্ডের আকতিতে সেই নগর ইতালির উপদীপের দিকে নেমে গেল), তারা সেই নগরকে আক্রমণ প্রতিরােধের কেন্দ্রে পরিণত করল এবং সেখান থেকে আক্রমণের মহড়াও দিতে লাগল। গাউলরা স্বাভাবিকভাবেই রােমের ক্রমবর্ধিত ক্ষমতা নিয়ে শঙ্কিত ছিল। যে নগর একসময় তারা দখল করেছিল এবং ধ্বংস করে ছারখার করে ফেলেছিল, কোনাে না কোনােভাবে সেই নগর ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে আবার জেগে উঠেছে এবং নিজেকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে তৈরি করেছে। ইতালির মধ্যভাগের ১৫০০০ বর্গমাইল এলাকা তখন সেই নগরের দখলে। এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্র পর্যন্ত রাজ্যের বিস্তার এবং তার শক্তির সামনে অন্য কোনাে শক্তিই তখন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল (রােমের শত্রুরা বরাবর দেরিই করে ফেলত), গাউলরা নতুন করে রােমের শত্রু হবার সিদ্ধান্ত নিল এবং ওই দ্বীপাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর নগরটিকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লাগল। 

তৃতীয় স্যামনাইট যুদ্ধ : লুসেনিয়া নগর তখন রােমের জন্য আক্রমণের নতুন সুযােগ নিয়ে এল, লুসেনিয়ার সেনাবাহিনী রােমে এসে জানিয়ে গেল যে স্যামনাইটরা সেই আগের যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশােধ হিসেবে রােমের বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধের কথা ভাবছে। নােম প্রকৃতপক্ষে এরকম সুযােগই খুজছিল। সঙ্গে সঙ্গে রোমান সেনাবাহিনী স্যামনিয়ামে অনুপ্রবেশ করল এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৯৮ সালে তৃতীয় স্যামনাইট যুদ্ধ শুরু হলাে। যাই হােক, স্যামনাইটরা সেবারে রােমানদের একা একা আক্রমণ করার চিন্তা বাদ দিল। স্যামনাইট সেনাবাহিনীরা দক্ষিণদিকে এগিয়ে যেতে লাগল এবং এট্রুস্কান ও গাউলদের উস্কে তাদেরও সঙ্গে নিল। তারা একত্র হয়ে রােমের মুখােমুখী হলাে। রােমানদের জন্য সেটা ছিল সত্যি সত্যিই আতঙ্কগ্রস্থ হবার মতাে শত্রু-সমারােহ। তারা গাউলদের ধ্বংসলীলার কথা কখনাে ভােলেনি, আর তখনাে গাউল জাতির নামটা তাদের অস্বস্তিতে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিল।  ফেবিয়াস ম্যাক্সিমাস, যিনি কিছুদিন আগে শেষ যুদ্ধে এট্রুরিয়াকে ধরাশায়ী করেছিলেন, উত্তরের দিকে তাকে সেনাবাহিনীসহ পাঠিয়ে দেয়া হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ২৯৫ সালে রােমের উত্তরে প্রায় ১১০ মাইল দূরে প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাদের দেখা হলাে, যেটা ছিল গাউল রাজ্যের সীমানা থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরে। রােমানরা গাউলদের অর্ধেক রাস্তারও বেশি পেরিয়ে তারপরে মিলিত হলাে। তখন যে যুদ্ধ শুরু হলাে, স্যামনাইট এবং গাউলরা রােমানদের মুখােমুখী নিজেদের দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রাখল, কিন্তু ওদিকে রােমানরা যখন এট্রুরিয়ায় আরেক দল সেনাবাহিনী পাঠাল, এট্রুস্কানরা ধরাশায়ী হয়ে গেল। ফেবিয়াসের সতীর্থ-কনসল ছিলেন পাবলিয়াস ডেশিয়াস মাস, ল্যাটিন যুদ্ধের সময়ে যে বীর নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, তারই পুত্র এবং উত্তরাধিকারী। পুত্রও যুদ্ধক্ষেত্রে একই কাজ করার ব্যাপারে মনস্থ করলেন, এবং ধর্মীয় আচার পালনের পরে তিনি সামনের সারির দিকে তীরের মতাে এগিয়ে গেলেন। মৃত্যুর প্রত্যাশায়ই গিয়েছিলেন তিনি, আর মৃত্যু মিলেও গেল। শেষ পর্যন্ত রােমানদের জন্য উপায় ঠিকই বেরিয়ে এল। স্যামনাইটরা শােচনীয় পরাজয় বরণ করল এবং গাউলরা নিজেরাই সরে পড়তে বাধ্য হলাে। রােমানদের জয় নিশ্চিত হলাে, তিন তিনবার বিজয় অর্জিত হলাে। 

স্যামনাইট ও গাউলদের পরিণতি : গাউলদের নাম শুনতেই রােমানদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হওয়ার বাতিক শেষ হলাে। গাউলরা আর কোনাে যুদ্ধে রােমানদের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি; বস্তুত তাদের ঢের অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। আর তাই গাউলদের ব্যাপারে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯০ সালের যে দুঃসহ স্মৃতি রােমানরা বয়ে বেড়াচ্ছিল তার থেকেও তারা মুক্তি পেল। খ্রিস্টপূর্ব ২৯৪ সালে এট্রুস্কানরা আলাদাভাবে একটি শান্তিচুক্তি করল এবং স্যামনাইটরা দলছুট হয়ে একেবারে একা হয়ে পড়ল। প্যাপিরিয়াস কার্সার স্যামনিয়ামে হামলা করলেন। ওই অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বদিকে, রােম থেকে সম্পূর্ণ ৬ মাইল দূরত্বে, রােমান সেনাবাহিনী (যারা নিজেদের এলাকা থেকে এতদূরে কখনাে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি) অ্যাকুইলােনিয়ায় স্যামনাইটদের মুখােমুখী হলাে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৯৩ সালে তাদের পরাজিত করল। তারও পরের তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে স্যামনাইটদের বিরুদ্ধে তাদের টুকটাক যুদ্ধ করে যেতেই হলাে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৯০ সালে তারা নতুন করে বড়াে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলল। এমনকি তখনাে, অর্ধ শতাব্দী ধরে যুদ্ধ করেও রােম তাদের জেদি প্রতিপক্ষ স্যামনিয়ামের হাত থেকে ছাড়া পেল না। অল্প কিছু বিরতির পরপরই বারবারতাদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হলাে। স্যামনিয়ামকে রােমের সঙ্গে একজোট হতে বাধ্য করা হলাে একসময়, তবে সেই জোটেও দুই সদস্যই হলাে সমানে সমান। স্যামনিয়াম নিজস্ব সরকারি সিদ্ধান্তেই চলত, তাবে নিজেরা কোথাও যুদ্ধে যেতে পারত না; তাদের যুদ্ধে যেতে হলে যেতে হতাে রােমান সেনাপ্রধানদের অধীনে। স্যামনিয়ামসহ রােম সত্যিকার অর্থে এট্রুরিয়া জাতিকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং সেন্টিনামের পূর্বদিকে অবস্থানরত গাউলদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করার জন্য যথেষ্ট ছিল। খ্রিস্টপূর্ব সালের মধ্যে দক্ষিণের সীমানার সিসালপাইন গাউল থেকে শুরু করে দক্ষিণে নীচের দিকের গ্রিক নগরগুলাে পর্যন্ত ইতালির পুরােটাই রােমের অধীনে চলে এল। ওই ব-দ্বীপ অঞ্চলের অর্ধেকটাই রােম তখন দখল করে নিয়েছে।

গ্রিকদের সাথে সংঘাত ও দক্ষিণ ইতালি ও সিসিলিতে পিরিক যুদ্ধ

গ্রিকদের তদকালীন অবস্থা ও পিরিক যুদ্ধের পটভূমি

গ্রিকরা : আর তারপরেও বরাবরের মতাে, বিজয় নির্ধারিত হলেও বিজয়ের পেছন থেকেও বিপদের উপলক্ষ তৈরি হয়। দক্ষিণের গ্রিক নগরগুলাে অবাক বিস্ময়ে রােমের দিকে তাকিয়ে থাকত আর নতুন প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠত। মাত্র একশ বছর আগেই রােম ছিল এক অখ্যাত নগর, তাও আবার বর্বর গাউল জাতিদের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত (তবে সেটা ছিল এমন একটা ঘটনা যা গ্রিক ইতিহাসবিদগণ বলতে গেলে কোথাও উল্লেখ করেননি)। আর তারপর আরাে এক শতাব্দী পরে, ইতালিয়ান অন্যান্য জাতি যাদের গ্রিকরা সাধারণ বর্বর জাতি হিসেবে তেমন পাত্তা দিত না, রােমানদেরও তেমনই মনে করত। অথচ রােমান সেনাবাহিনী তখন পুরাে ইতালিতে ছেয়ে গেছে, যেখানে হাত দিচ্ছে সেখানেই বিজয়ের মালা তাদের গলায় উঠে আসছে। ইতােমধ্যে কিছু গ্রিক নগর, যারা দেখল যে তারা রােমান সেনাবাহিনীকে কোনােভাবেই পরাস্ত করতে পারবে না, নিজেদের উদ্যোগে রােমের সঙ্গে যুক্ত হলাে। নিয়াপােলিস (এখনকার ন্যাপলস), গ্রিক শক্তিধরদের থেকে দক্ষিণ পশ্চিমদিকের অনেক দূরে অবস্থানরত, তারাও রােমের সঙ্গে এক জোটে যােগদান করল। ম্যাগনা গ্রেশিয়ার প্রধান নগর ট্যারেন্টাম, যদিও তখনাে বর্বরদের অধীনেই ছিল, তারা সাহায্যের জন্য বাইরের পৃথিবীর দিকে হাত বাড়াল, কারণ ততদিনে অনেক বেশি সংগ্রাম করে ফেলেছে তারা। ট্যারেন্টামই সেই নগর যার কারণে। এপিরাসের আলেকজান্ডার অর্ধ শতাব্দী আগে ইতালিয়দের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। রােম যখন স্যামনিয়ামের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, ট্যারেন্টামের লােকেরা মনে করল তাদের নেতা তখন সিসিলিতে অবস্থান করছেন। তিনি ছিলেন বীর একজন সেনা, আগাথোক্লিজ, খ্রিস্টপূর্ব ৩১৬ সালেই তিনি সিসিলির সবচেয়ে বড়াে নগর সাইরাকুজের নেতা হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। সিসিলির সর্বত্র যেমন করে তার তৈরি করা নিয়মকানুন ছড়িয়ে পড়ছিল তাতে করে মনে হতাে তিনি গ্রিক আইনের এক প্রবাদপুরুষ। সে যাই হােক, কার্থেজীয়রা, যারা গ্রিকদের সঙ্গে আগের দুই শতাব্দী ধরে যুদ্ধ করে আসছিল, নিজেদের তেরি করে নিল এবং অ্যাগাথোক্লেসের বিরুদ্ধে এক সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০ সালে তারা তাকে বিশ্রীভাবে পরাজিত করল এবং সাইরাকিউজে তাকে নজরবন্দি করে রাখল। অ্যাগাথোক্লেস তখন ভীষণ সাহসের একটা কাজ করে বসলেন, যার ধারাবাহিকতা। এক শতাব্দী পরেও দেখা গেছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কার্থেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করবেন। সাইরাকিউজ থেকে একটা ছােট্ট সেনাবাহিনীর দল নিয়ে তিনি রওনা দিলেন এবং আফ্রিকান সমুদ্র উপকূলে গিয়ে পৌঁছলেন কার্থেজীয় সমুদ্র জাহাজের উপরে আক্রমণ করার জন্য। কাৰ্থেজিয়ানরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেল। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে আফ্রিকান উপকূলে তাদের শত্রু বলতে কিছু ছিল না, আর তাদের বিশ্বাসও ছিল যে যতক্ষণ কার্থেজের নৌবাহিনী সমুদ্রের ঢেউগুলােকে শাসন করছে ততক্ষণ তার আশেপাশে কেউ ভিড়তে পারবে না। তাদের নগর এমনকি তার আশেপাশের সীমানাও ছিল সুরক্ষিত। আর তাই অ্যাগাথোক্লেসের এই পদক্ষেপ ছিল সম্পূর্ণ হঠকারিতা। অথচ কার্থেজীয়রা খ্রিস্টপূর্ব ৩০৭ সালে তার সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হলাে আর তিনি আগের চেয়েও শক্তিশালী নেতা হিসেবে সিসিলি ত্যাগ করলেন। 

ট্যারেন্টাইনদের সাথে যুদ্ধের পটভূমি : ট্যারেন্টাইনরা তখন অ্যাগাথোক্লেসকে ইতালিতে ডেকে নিলেন, আর তারপর অনেক বছর ধরে তিনি ইতালিতেই থেকে গেলেন। রােমের লােকেরা তখন স্যামনাইটদের ঝেটিয়ে বিদায় করতে ব্যস্ত ছিল, তাই তার দিকে মনােযােগ দেয়ার সময় হয়নি কারাে। অ্যাগাথোক্লেসের মতাে একজন মানুষ সেখানেই ছিলেন, যার উপস্থিতিতে গ্রিক নগরগুলাে একত্র হয়ে রােমানদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে পারত। যাই হােক, অ্যাগাথোক্লেস ট্যারেন্টাইনদের বরাবর তার সঙ্গে পাননি। ট্যারেন্টাইনদের অতীতে যারা সাহায্য করেছিল তাদের মতাে তারা অ্যাগাথোক্লেসকেও সাথে রাখতে চায়নি। নিজের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী সাহায্যকারীকে সঙ্গে রাখা কখনাে বিপদও হতে পারে, একথা নিশ্চয় তাদের মাথায় ছিল। অ্যাগাথোক্লেসের যখন সত্তরের মতাে বয়স হলাে, তিনি যুদ্ধে যােগদান করাই বন্ধ করে দিলেন। তিনি ইতালি ছেড়ে চলে গেলেন এবং তার পরপরই খ্রিস্টপূর্ব ২৮৯ সালে মৃত্যুবরণ করলেন। আর তাই ট্যারেন্টাম তখন আবার অ্যাগাথোক্লেসের অভাবে একা হয়ে পড়ল। যথারীতি তখন তাদের মুখােমুখীও হতে হলাে ভয়াবহ শক্তিশালী রােমানদের। কারণ কোনাে গ্রিক নগরকে শান্তিতে থাকতে দেবে, রােমান জাতিতে এই স্বভাব ছিল না। গ্রিক নগরগুলাের নিজেদের মধ্যে লেগে থাকা ঝগড়াঝাটিই রােমানদের এই সুযােগ করে দিয়েছে। যেমন, উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ইতালির পায়ের কাছের একটি গ্রিক নগর থিওরি রােমানদের সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছিল, ইতালিরই আরেক জাতি লুসানিয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে, যারা বরাবর একটি স্বাধীন জাতি হিসেবেই ছিল। রােমানরা তখনই থিওরি নগরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল এবং লুসানিয়ার হাত থেকে নগরকে রক্ষা করেছিল। ম্যাগনা গ্রেশিয়ার ঠিক মাঝামাঝি ট্যারেন্টাম রােমান সেনাবাহিনীর মনােবল ভেঙে দিল, নিজেরাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উদ্যত হলাে। রােমান যুদ্ধ জাহাজ যখন সমুদ্রের তীরে এসে উপস্থিত হলাে, ট্যারেন্টাইনেরা রােমান জাহাজের মানুষদের হত্যা করল এবং জাহাজগুলাে ডুবিয়ে দিল। জাহাজগুলাে ছিল ছােটো কারণ রােমে তখনাে যথাযােগ্য কোনাে নৌবাহিনী তৈরি হয়নি। অল্প সাফল্যে ভয়ানক আনন্দিত হয়ে ট্যারেন্টাইন সেনাবাহিনী তখন একটি দলকে থিওরির পথে পাঠিয়ে দিল, তারা সেখানে গিয়ে ছােট্ট রােমান বাহিনীকে বিতাড়িত করল। দক্ষিণ ইতালিতে লড়ার জন্য রােম তখনাে তৈরি ছিল না, আর উত্তরের দিকের কিছু বিষয়েরও মীমাংসা বাকি ছিল, কিন্তু তারপরেও নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানাের কথা ভাবল। রােমানরা থিওরিতে আরাে কিছু সেনাবাহিনী পাঠাল এবং ট্যারেন্টাইনদের সেখান থেকে সরে যেতে বলল। ট্যারেন্টাইনরা রােমানদের এই কথা শুনে হাসল, আর রােমান রাষ্ট্রদূতেরা যেহেতু সরকারের কেন্দ্রে বসবাস করত, ট্যারেন্টাইনদের এক নামকরা সন্ত্রাসী এসে তাদেরই একজনের পরিধেয় ঢিলেঢালা কাপড়ের উপরে পেশাব করে দিল। তখন উপস্থিত জনতা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। অপমানিত রােমান সেনাবাহিনী ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেল এবং সেখানেই প্রতিজ্ঞা করল যে পেশাবের দাগ তারা ট্যারেন্টাইনদের রক্ত দিয়ে ঢেকে দেবে। রােমান বাহিনী রােমে ফেরত এসে সেই পােশাকটি সিনেটরদের দেখাল। এভাবেই খ্রিস্টপূর্ব ২৮১ সালে সিনেটররা রাগের মাথায় ট্যারেন্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করল। আর তখন ট্যারেন্টাইনরা সত্যি সত্যি ভীষণ ভয় পেল। তাদের মতে কৌতুক তাে কৌতুকই কিন্তু রােমানদের যে কৌতুকপূর্ণ মনােভাবের অভাব ছিল, তা তারা জানত ট্যারেন্টাইনরা তখন রােমানদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আশেপাশের দেশে হাত পাততে লাগল। আর তাদের সৌভাগ্য ছিল যে অ্যাগাথোক্লেসের চেয়েও বড়াে একজন বীর ছিল তাদের হাতের কাছেই, যিনি সত্যিকার অর্থেই ট্যারেন্টাইনদের ঝগড়া মেটাতে আগ্রহীও ছিলেন। 

আলেকজান্ডার পরবর্তী গ্রিক জগতের অবস্থা : রােমানরা যখন তাদের পঞ্চাশ বছরের পুরােনাে শত্রু স্যামনিয়ামদের ঠেকাতে ব্যস্ত ছিল, ম্যাসিডােনের ফিলিপের পুত্র সেই প্রাচীন যুগের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন – কেবল প্রাচীন যুগের নয়, বলা যেতে পারে সব সময়ের ছােট্ট এবং ভয়ানকভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী, যার মধ্যে ম্যাসিডােনিয়ার ফ্যাল্যাঙ্কসও ছিল, তাদের নিয়ে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এশিয়া মাইনর পেরিয়ে গেলেন এবং পারস্য সাম্রাজ্যের লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি পার হয়ে গেলেন। যেতে যেতে পথে যতরকম প্রতিপক্ষের মুখােমুখী হলাে তারা, সকলকে পরাজিত করে এগিয়ে গেল। যুদ্ধে জয়ী হয়ে এগােতে এগােতে তিনি মধ্য এশিয়ায়, ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমানায় এবং মিশরে পর্যন্ত গ্রিসের অস্ত্র এবং গ্রিসের সংস্কৃতি নিয়ে উপস্থিত হলেন। বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের এমাথা-ওমাথা তার আয়ত্বে চলে এল। যদিও, খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে ব্যাবিলনে আলেকজান্ডার মৃত্যুবরণ করলেন। মৃত্যুর সময়ে তিনি উত্তরাধিকার হিসেবে কেবল এক মানসিক প্রতিবন্ধী সহােদর এবং শিশু পুত্র রেখে যান। তারা দুজন সহজেই সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত হলাে এবং তারই সেনাপ্রধানরা ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিল। তারা নিজেদের মধ্যে নির্লজ্জভাবে মারামারি শুরু করে দিলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৩০১ সালে এশিয়া মাইনরে এক ভয়ানক যুদ্ধের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হলাে যে তাদের মধ্যে কেউ ওই ভূখণ্ডের একচ্ছত্র অধিকার পেতে ব্যর্থ। আর এভাবেই আলেকজান্ডারের ভুখণ্ড টুকরাে টুকরাে হয়ে গেল। এশিয়ার প্রধান অঞ্চল বলতে সিরিয়া, ব্যাবিলনিয়া, পূর্বদিকের বিশাল অঞ্চল, সবই আলেকজান্ডারের সেনাপ্রধান, সেলুকাস, যিনি নিজেই তাকে রাজা ঘােষণা করেছিলেন, তার দখলে চলে এল। সেলুকাসের উত্তরাধিকারেরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ওই অঞ্চলে শাসন করেছিল, যার ফলে ওই সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় সেলুসিড সাম্রাজ্য। মিশর ছিল আলেকজান্ডারের আরেক সেনাপ্রধান, টলেমির দখলে। তার উত্তরাধিকারেরা, যাদের প্রত্যেকের নামই ছিল টলেমি, যুগ যুগ ধরে মিশরে শাসন করে আসছিল, আর তাই ইতিহাসে কোথাও কোথাও মিশরকে টলেমির মিশর (টলেমিক ইজিপ্ট) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এশিয়া মাইনর ছােটো ছােটো অনেকগুলাে রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেল। সেসবকিছুকে একসঙ্গে ভাবলে পারস্য সাম্রাজ্যের ম্যাসিডােনিয়ার শাসনকৃত অঞ্চলটিকে হেলেনিস্টিক রাজ্য সৃষ্টি করেছিল। আর খ্রিস্টপূর্ব ২৮১ সালের মধ্যে যখন রােম এবং ট্যারেন্টাম নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছিল, ছােটো ছােটো রাজ্যগুলাে তখন সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে তাদের মধ্যে প্রত্যেকেই এত দূরবর্তী যে রােমের বিরুদ্ধে ট্যারেন্টামকে সাহায্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, আর তাছাড়া তারা প্রতিষ্ঠিত হলেও, নিজেদের মধ্যে নানারকম ঝগড়াঝাটি লেগেই ছিল। 

পিরাসের উত্থান : হাতের কাছে সবচেয়ে ক্ষমতাধর বলতে ছিল ম্যাসিডােন নিজেই, কিন্তু সেখানে সমস্যা ছিল তার বেশিরভাগ নেতারাই তখন সাম্রাজ্যের বাইরে, তারা সেনাবাহিনী নিয়ে অন্য কোনাে ছােটো রাজ্যের শাসক কিংবা সেনাপ্রধান হওয়ার আশায় তখন পূর্ব বা দক্ষিণ অঞ্চলের কোথাও অবস্থান করছেন। বিষয়টা ম্যাসিডােনিয়ার জন্য আরাে বেশি দুর্বল হয়ে পড়ল কারণ ম্যাসিডােনিয়ার রাজকীয় পরিবারের সদস্যেরা সেখানকার সেনাপ্রধানদের নিজেদের ভেতরের মতবিরােধের কারণে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। এভাবে চলতে চলতে খ্রিস্টপূর্ব ২৮১ সালে ম্যাসিডােনিয়া পুরােপুরি অরাজকতায় ভরপুর এমন একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হলাে যার সামনে প্রকৃতপক্ষে আর কোনাে সম্ভাবনা অবশিষ্ট ছিল না। সেই অরাজকতার সুযােগ নিল ম্যাসিডােনিয়ার পশ্চিম সীমানায় থাকা এপিরাস রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব ২৯৫ সাল পর্যন্ত এপিরাসের রাজা ছিলেন পিরাস, যিনি আলেকজান্ডারের এক আত্মীয়ের কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন এবং একসময় ইতালিতে আক্রমণ করেছিলেন। তবে বিষয়য়টা এমন ছিল যে পিরাস ছিলেন সে সময়ের হেলেনিস্টিক শাসকদের মধ্যে সে পর্যন্ত সবচেয়ে সফল শাসক। তার চেয়ে বড়াে কথা হলাে, তিনি ছিলেন ট্যারেন্টামের সবার জন্য সবচেয়ে কাছের মানুষ। আর তাছাড়া তিনি ছিলেন এমন আবেগপ্রবণ যে সেনাবাহিনীর কোনাে গুরু দায়িত্বে নিয়ােজিত হতে পারলে নিজেকে সবচেয়ে বেশি সুখী বলে ভাবতেন (সত্যি কথা বলতে কী, তার ছিল একটাই দোষ, যা হলাে, তিনি কখনাে কোনাে বিজয়কে ধরে রাখতে পারতেন না যেটা রােমানরা সবসময়ে করে এসেছে, তিনি আগের বিজয়কে সংরক্ষণ না করে নতুন বিজয়ের জন্য উতলা হয়ে ঝাপিয়ে পড়তেন)। ম্যাসিডােনিয়ার দুর্দশার মধ্যে পিরাসও অংশগ্রহণ করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৮৬ সালে তিনি ম্যাসিডােনে আক্রমণ করলেন, আর সত্যিকার অর্থে তিনি সাত মাস ব্যাপী ম্যাসিডােনে তার কর্তৃত্ব বজায় রাখলেন যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে জোর করে বের করে দেয়া না হলো। আর তারপরের পাঁচ বছর অবশ্য তিনি শান্তিতেই ছিলেন তবে ছিলেন যে কোনাে ধরনের যুদ্ধের জন্য সদা প্রস্তুত। 

পিরিক যুদ্ধ ও তার ফলাফল

ট্যারেন্টামে পিরাসের সহায়তা : আর তাই তার কাছে ট্যারেন্টাইনরা ফিরে এল, তাকে যুদ্ধের আদেশ করতে বাধ্য করল। তার অবস্থান ছিল ট্যালেন্টাইনদের থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে; তিনি ছিলেন একজন প্রভাবশালী সেনাপতি; আর ছিলেন যুদ্ধে যােগদানের জন্য আকুল। ট্যারেন্টাইনদের আর কী চাওয়ার থাকতে পারে? অবধারিতভাবে পিরাস সেই আহ্বানে সাড়া দিলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৮০ সালে তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তবে নিশ্চিত করে বলা যায় যে তিনি কেবল সেখানে ট্যারেন্টাইনদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই উপস্থিত হননি। তার নিজেরও কিছু পরিকল্পনা ছিল। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন একটি গ্রিক সেনাবাহিনীর প্রধানের আসনে আসীন হতে যারা রােম এবং কার্থেজে হামলা চালাবে এবং তাদের ধ্বংস করে পশ্চিমে তাদের চেয়েও বড়াে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে, ঠিক যেমন তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় মহামতি আলেক্সান্ডার পূর্বদিকে করেছেন। নিজের সঙ্গে ফ্যালাঙ্কস কায়দায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২৫০০০ সৈন্যের, যারা পূর্বে সেনাবাহিনীতে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছে, সেই দল নিয়ে তিনি রওনা দিলেন, রােমানদের জন্য এমন বিশাল প্রশিক্ষিত বাহিনীর মুখােমুখী হওয়া সেই প্রথম। রােমের প্রতিপক্ষ তখন কোনাে সাধারণ ইতালীয় বাহিনী নয় যারা কোনাে নিয়মকানুন বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই কেবল সাহসের বাড়াবাড়ি দেখিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, তার আগপর্যন্ত রােমের জন্য প্রতিপক্ষের সেরকম অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। সেবারে তারা পড়ল এমন এক সেনাপতির সামনে যিনি যুদ্ধে লড়াই করাকে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা তথা শিল্প হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পিরাস কেবল চৌকষ সৈন্যের দলই আনেননি। আলেক্সান্ডার যখন ভারতে এসেছিলেন, তিনি দেখেছিলেন যে ভারতীয়রা যুদ্ধক্ষেত্রে সহায়তা করার জন্য বিশাল শরীরের তীক্ষ্ম দাঁতাল এক প্রাণীকে সঙ্গে রেখেছে – যা হলাে হাতি। তখন হাতিগুলাে যুদ্ধক্ষেত্রে এমনভাবে ব্যবহৃত হতাে যেমন আজকাল আমরা ব্যবহার করি ট্যাঙ্ক; ব্যবহার করি প্রতিপক্ষকে বিশাল ওজনদার একটা কিছু দেখিয়ে ভয় ধরিয়ে দিতে। বুদ্ধিমান আলেক্সান্ডার কৌশলে হাতিদের বশ করার ক্ষমতা রাখতেন, তবে তার অধীনে থাকা সেনাসদস্যরা ভেবে পেতেন না যে কেন তারা নিজেরাও যুদ্ধের সময়ে হাতি ব্যবহার করছেন না। আর তারপর থেকে পুরাে প্রজন্মব্যাপী ম্যাসিডােনিয়ার লােকেরা যত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, সবখানেই হাতির ব্যবহার হয়ে আসছিল (কখনাে এক দলে, কখনােবা দুই দলেই)। পিরাস ইতালিতে বিশটি হাতি নিয়ে এসেছিলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাদের কাজে নিয়ােজিত করলেন। তার প্রথম দায়িত্ব ছিল ট্যারেন্টাইনদের নিয়ন্ত্রণ করা। ট্রারেন্টাইনদের তখন সাহায্য চাওয়ার কোনাে সুযােগ ছিল না। পিরাস তাদের ক্লাব আর থিয়েটারগুলাে বন্ধ করে দিলেন সবচেয়ে প্রথমে আর তারপরে নাগরিকদের নানাভাবে উত্যক্ত করতে লাগলেন। ট্যারেন্টাইনরা বিপদে চিৎকার করতে লাগল আর পিরাস তার চেয়েও জোরের এক আর্তনাদ পাঠালেন এপিরাসে। সেখানেই বাকিটুকু যা ছিল, শেষ হলাে। 

রোমানদের বিরুদ্ধে পিরাসের যুদ্ধ : তারপর সেই একই বছরে তিনি রােমানদের মুখােমুখী হতে সেনাবাহিনীসহ হেরাক্লি পর্বতের দিকে রওনা দেন, যে জায়গাটা ছিল ট্যারেন্টাম আর থুরির মাঝামাঝি। মাটির সমতলে তিনি একটা জায়াগ্য বেছে নিয়ে সেখানে তার ফ্যালাংক্স সৈন্যদের এবং হাতিসহ পুরাে দলটির ঘাঁটি গাড়লেন। রােমানরা বিশাল হাতিগুলো দেখে ভীষণ ভড়কে গেল। এরকম বড়াে আকৃতির কোনাে প্রাণী পৃথিবীতে আছে এমন ধারণাই ছিল না তাদের। তারা তাদের নাম দিল ‘লুকেনিয়ার ষাঁড়’ (লুকেনিয়া হলাে প্রাচীন ইতালির দক্ষিণে অবস্থিত স্থান)। রােমানরা আক্রমণের মহড়া দিল, কিন্তু পিরাসের ফ্যালাঙ্কস অনঢ় হয়ে সেখানেই ওত পেতে থাকল, আর যখন তিনি হাতিগুলােকে সামনে এগিয়ে দিলেন। রােমানদেরও যুদ্ধে অংশ নিতে হলাে, তবে সারিবদ্ধভাবে। সেই ছিল প্রথম যুদ্ধ যাতে রােমান লিজনের বিপরীতে ফ্যালাঙ্কসদের বিজয় হয়েছিল এবং পিরাসকে রােমানরা বােকা বানাতে পারেনি। বিজয়ের পরে পিরাস যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে ঘুরে আহত রােমান সৈন্যদের পড়ে থেকে কাতরাতে দেখেছিলেন। তারা পিরাসকে দেখেও পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেনি, এমনকি হাতির ভয়েও পালায়নি তারা। পিরাসের কাছে মনে হয়েছিল যে তারা সব গ্রিসের বাইরে থেকে আসা অসভ্য জাতির সদস্য, কিন্তু তারা ঠিক ম্যাসিডােনিয়ার লােকদের মতাে যুদ্ধ করেছিল। হেরাক্লিতে রােমের বিরুদ্ধে জয়লাভ রােমের আশেপাশের শত্রুদের মাথা চারা দিয়ে উঠতে উৎসাহ দিল। বিশেষ করে স্যামনাইটরা পরম আনন্দে রােমানদের হারতে দেখল এবং তখনই পিরাসের বাহিনীতে যােগদান করল। পিরাস অবশ্য সেই বিজয়ের পরে রােমের সঙ্গে নতুন কোনাে যুদ্ধের ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। বরং তিনি ভাবলেন রােমের সঙ্গে একটা শান্তিচুক্তি হয়ে যাক, তারাও বাঁচুক, তিনি নিজেও বাচেন। তিনি তখন একজন গ্রিক বক্তাকে (সিনিয়াস) নিজের প্রতিনিধি হিসেবে রােমে পাঠালেন, রােমকে শান্তিচুক্তির ব্যাপারে বােঝানাে এবং রাজি করানােই তার উদ্দেশ্য ছিল।

যুদ্ধের পরবর্তী অবস্থা : সিনিয়াস রােমে গিয়ে সিনেটের সামনে দাঁড়ালেন, তার কৌশলী বক্তৃতা শান্তিচুক্তির ব্যাপারে রােমের সিনেটরদের প্রায় মানিয়েই ফেলেছিল। কাহিনি অনুযায়ী অবশ্য সেই দৃশ্যে উপস্থিত হয়েছেন বৃদ্ধ প্রাক্তন সেনসর অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস সিসাস। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় স্যামনাইট যুদ্ধের নায়ক এবং অ্যাপিয়ান রাজপথের প্রতিষ্ঠাতা, তবে তিনি তখন বৃদ্ধ আর অন্ধ। তিনি এতটাই দুর্বল ছিলেন যে হাঁটতে পারছিলেন না। তাই তাকে ধরে ধরে সিনেট কক্ষে আনা হয়েছিল। তবে তার কথাবার্তা মােটেও দুর্বল ছিল না। তার ভরাট গলায় তিনি একটা সহজ দাবির কথা জানালেন। পিরাসের সঙ্গে শান্তিচুক্তির কোনাে প্রশ্ন নেই, তিনি বললেন, যতক্ষণ ইতালির মাটিতে তার একজন মাত্র সৈন্যও বেঁচে থাকবে ততক্ষণ পিরাসের সঙ্গে কোনাে চুক্তি নয়। সিনেটের সকল সদস্য সঙ্গে সঙ্গে সেই কথায় সুর মেলালেন এবং পিরাসের প্রতিনিধি বক্তা সিনিয়াসকে তার অভিযান ব্যর্থ জেনে ফিরে আসতে। হলাে। পিরাস ছিলেন যুদ্ধ যাত্রায় সংকল্পবদ্ধ। তিনি উত্তরপশ্চিম দিকে যাত্রা করে ক্যাম্পানিয়ায় পৌঁছলেন, একটার পরে একটা নগর পেরিয়ে গেলেন তার আগে, এভাবে রােমের মাত্র ২০ মাইলের মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হলেন কিন্তু ল্যাটিন নগরগুলাের আনুগত্যের জায়গাটা কিছুতেই নাড়িয়ে দিতে পারলেন না। আর তাই তাকে শীতকালের ঝামেলার অজুহাতে ফিরে আসতে হলাে। সেই শীতকালে রােমানরা পিরাসের কাছে বন্দি বিনিময়ের আশায় দরাদরি করতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাল। সেই দলের প্রধান ছিল গেইয়াস ফ্যাব্রিশিয়াস, পূর্বে দুই বছর ব্যাপী তিনি কনসল ছিলেন। পিরাস ফ্যাব্রিশিয়াসকে সম্মানের সঙ্গে অভিবাদন জানালেন এবং রােমান সিনেটকে তার সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে আসার অনুরােধ জানালেন আবারও। ফ্যাব্রিশিয়াস এই অনুরােধ রাখতে পারবেন না বলে জানালেন। পিরাস তখন তাকে বিশাল অঙ্কের অর্থ ঘুষ হিসেবে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন, ফ্যাব্রিশিয়াস ধনী না হওয়া সত্ত্বেও সেই অর্থ নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তারপরেও ফ্যাব্রিশিয়াসকে পরীক্ষা করার জন্য (রােমান শােনা কাহিনি অনুসারে) তিনি ফ্যাব্রিশিয়াসের ঠিক পিছনে একটি হাতি এনে দাঁড় করালেন এবং এমন ভাব দেখালেন যে হাতি তার উপরে উঠে আসবে। ফ্যাব্রিশিয়াস তারপরেও নিজের কথা থেকে একচুল নড়লেন না। ফ্যাব্রিশিয়াসের সততা, আনুগত্য এবং সংকল্পে মুগ্ধ হয়ে পিরাস, যিনি বরাবর একজন সৎ এবং সহনশীল শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, বন্দি বিনিময়ের মূল্য নির্ধারণের আলােচনা ছাড়াই তার হাতে বন্দিদের তুলে দিলেন। পরবর্তী গ্রীস্মে ফ্যাব্রিশিয়াসের সুযােগ এল পিরাসের ভদ্রতার বিনিময়ে কিছু করার। পিরাসের ব্যক্তিগত চিকিৎসক একদিন রােমান ক্যাম্পে এলন এবং পিরাসকে বিষ প্রদানে হত্যা করার লােভ দেখিয়ে রােমান শাসকের কাছে কিছু অর্থ চাইলেন, তখন ফ্যাব্রিশিয়াস চিকিৎসককে বন্দি করে পিরাসের কাছে নিয়ে চললেন। 

পুনরায় পিরাসের সাথে যুদ্ধ : যেহেতু রােমের সঙ্গে শান্তিচুক্তির চেষ্টা বরাবর ভেস্তে যাচ্ছিল, তাই পিরাস খ্রিস্টপূর্ব ২৭৯ সালে আবার উত্তরের দিকে সেনাবাহিনীসহ রওনা দিলেন। তিনি রােমানদেরকে অসকিওলামে, ট্যারেন্টাম থেকে একশ মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকে, তার সঙ্গে দ্বিতীয় যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করলেন। আবার রােমান সেনাবাহিনী ফ্যালাঙ্কসের উপরে ঝাপিয়ে পড়ল কিন্তু অনঢ় বাহিনীটিকে নাড়াতে পারল না। আবার পিরাস তার হাতিগুলাে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসেন আর আবারাে হাতির মাধ্যমে রােমানদের তিনি বিপদে ফেলেন। সেই যুদ্ধে একজন রােমান কনসল ছিলেন পাবলিয়াস ডেসিয়াস মাস, যিনি ল্যাটিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণদানকারী এক কনসলের নাতি এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী এবং গাউলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ অকুতভয় বীর একজন কনসলের সন্তান ও একমাত্র উত্তরাধিকারী। নতুন ডেশিয়াস তখন কাহিনি অনুযায়ী রােমকে জিতিয়ে দেবার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তবে সেই সময়ে কেন যেন সেই চেষ্টা বৃথা যায়। যুদ্ধে পিরাসেরই জয় হয়। লিজন আর ফ্যালাঙ্কসের সেটা ছিল দ্বিতীয় যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় যুদ্ধে দ্বিতীয়বারের মতাে ফ্যালাঙ্কসেরই জয় হয়। আর সেটাই ছিল তাদের শেষ বিজয়। দ্বিতীয়বারের মতাে বিজয় হলেও সেই বিজয় পিরাসের জন্য খুব তৃপ্তিদায়ক ছিল। সেই যুদ্ধে পিরাসের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল অসামান্য। বিশেষ করে যে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী তিনি তার সঙ্গে এনেছিলেন, তাদের অনেকেই মারা পড়েছিল, আর এটা ছিল তার জন্য ভয়াবহ সমস্যা, কারণ তিনি ম্যাগনা গ্রেশিয়ার গ্রিক সৈন্যদের উপরে বিশ্বাস রাখতে পারছিলেন না। আবার ইতালির দলের আনুগত্যের উপরেও আস্থা রাখতে পারছিলেন না। আর তাই বিজয়ের পরে তার একজন যুদ্ধসঙ্গী যখন তাকে বিজয়-অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন, তিনি তাকে কষে এক চড় লাগিয়ে বলেছিলেন, “আর একটা বিজয়ও যদি হয়, তবে সবাইকে হারিয়ে আমাকে একা একা এপিরাসে ফেরত যেতে হবে।” এই ঘটনার পর থেকে ইংরেজি ভাষায় “পিরিক ভিক্টরি” নামে বাগধারাটি চালু হয়। যার অর্থ হলাে, এমন এক বিজয় যা অর্জন করতে এত বেশি ক্ষতি মেনে নিতে হয় যেন পরাজয় বরণ করা হলাে। 

যুদ্ধের পর পিরাসের অবস্থা : সেই ‘পিরিক ভিক্টরি’-র মধ্যে দিয়ে পিরাস এত দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে রােমকে দমিয়ে রাখার আর কোনাে মানসিক শক্তি তার ভেতরে ছিল না। তাই রােমানদের ক্ষমতাকে বাড়তে দেয়া ছাড়া আর কোনাে উপায় ছিল না তার। নিজের দেশ থেকে কোনাে সহযােগিতার আশা তার ছিল না, কারণ তিনি সেখান থেকে দবে ইতালিতে অবস্থান করছিলেন, ওদিকে গাউলরা হঠাৎ করেই ম্যাসিডােন, এপিরাস এবং গ্রিসের উত্তরের দিকটায় আক্রমণ করে বসলে পুরাে অঞ্চলে নিথর ভাব নেমে আসে (পিরাস হয়তো তখন রােমের কাছেধারে পড়ে না থেকে নিজের দেশে থাকলেই ভালাে করতেন, তবে নিজের দেশ রক্ষার কাজে ঝাপিয়ে পড়তে পারতেন)। পিরাস তখন সমস্যা থেকে বেরিয়ে যাবার উপায় খুঁজতে লাগলেন এবং দেখলেন অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে রােম কার্থেজের সঙ্গে এক হয়ে একটি দল গঠন করছে। আফ্রিকার ওই নগরটা গ্রিকদের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে লড়ে যাচ্ছিল। তাই রােমানরাও যেহেতু এখন একই প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়ছে তবে একজোট হতে অসুবিধা কী? কিন্তু সেই জোটগঠনের ঘটনাই এপিরাসের রাজা পিরাসকে রােমের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে নিরুৎসাহিত করল, এটা যেন পরাজয়ের চেয়েও দুঃখজনক। তিনি সিসিলি নদী পেরিয়ে কার্থেজে আক্রমণ করতে পারতেন, রােমানদের ঘাঁটি যাকে বলা হতাে। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৮ সালে তিনি সিসিলির দিকে রওনা দিলেন। সেখানে তাকে মােকাবেলা করতে হলাে দুটো পৃথক শক্রর সঙ্গে। প্রথমত সেখানে ছিল কার্থেজের লােকেরা, আর দ্বিতীয়ত ম্যামারটাইন (যাদের বলা হতাে মঙ্গলের সন্তান), যারা প্রকৃতপক্ষে ইতালির সৈন্য তবে অ্যাগাথোক্লেস তাদের নিয়ে এসেছিলেন সিসিলি থেকে নিজের ব্যাক্তিগত রক্ষক হিসেবে। এরকম বেতনভােগী সৈন্য, অর্থাৎ এমন সৈন্য যারা নিজের দেশের জন্য নয়, বরং কেবল অর্থের জন্য কাজ করে যায়, তাদের কোনাে নির্দিষ্ট গােষ্ঠীর উপরে যার কোনাে দায়বদ্ধতা থাকে না। তবে তাদের নিয়ে সুবিধা হলাে তারা যে তাদের পিছনে অর্থ ব্যয় করে তার প্রতিই আনুগত্য প্রকাশ করে। আর তাছাড়া যুদ্ধ যেহেতু তাদের পেশা, তাই সাধারণত তারা বেশ সাহস নিয়েই যুদ্ধ করে। তারা যে কোনাে যুদ্ধে নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেখাতে চায় যেন পরবর্তী যুদ্ধের আগে তাদের জন্য বরাদ্দ অর্থ বৃদ্ধি পায়। যাই হােক, তাদের অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হলে তারা সেই জনগণের কাছ থেকে যা পাওনা মনে করে তা যে কোনাে উপায়ে আদায় করে ছাড়ে; এবং যারা তাদের ভাড়া করেছে বা যাদের জন্য তারা কাজ করছে, তাদেরকেই চুষে খেয়ে শেষ করতে তাদের এতটুকুও বাধে না। আগাথাক্লিসের সময়ের পর থেকে তাই ম্যামারটাইনরা গ্রিক জনগণের উপরে এক বােঝা হয়ে দাঁড়াল। পিরাস দুই দলকেই সাফল্যের সাথে বুঝিয়ে আনতে পেরেছিলেন, ত্রিভুজের মতাে দ্বীপটিতে দুইটি ভিন্ন কোণ থেকে তাদের মগজ ধােলাই শুরু করেছিলেন তিনি; উত্তরের কোণে ম্যামারটাইনদের এবং পশ্চিমের কোণে কার্থেজীয়দের। যাই হােক, সিসিলি দ্বীপের গ্রিকরা পিরাসের যুদ্ধের প্রস্তুতির মতাে আয়ােজন দেখে বাঁধনহারা হয়ে পড়ল, আর পিরাসের অবর্তমানে পুরাে অগোচরে রােমানদের আধিপত্য যেখানে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে ট্যারেন্টাইনরা সর্বশক্তি দিয়ে পিরাসকে সমর্থন করছিল। 

রোমানদের বিরুদ্ধে পিরাসের শেষ যুদ্ধ ও রোমানদের জয় : খ্রিস্টপূর্ব ২৭৬ সালে তিনি ইতালিতে ফিরে আসেন এবং তারপর আরেকবার উত্তর পশ্চিমে ইতালির মধ্যভাগের দিকে বাহিনী নিয়ে যাত্রা করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৫ সালে তিনি তৃতীয় আরেকটি যুদ্ধর জন্য প্রস্তত হন। সেবারে বেনেভেন্টাম নগরে, অসকুলাম থেকে জায়গাটির দূরত্ব ছিল ৪০ মাইল। কিন্তু রােমানরা, যারা ফ্যালাঙ্কস বাহিনী এবং বিশাল হাতিদের দুই দুইবার মােকাবেলা করেছে, ততদিনে তার বিরুদ্ধে কী প্রস্তুতি নেয়া দরকার তাও ভেবেচিন্তে নিয়ে ফেলেছে। তাই তারা সমতলে পৌঁছবার আগেই একটা পাহাড়ি অঞ্চলে ফ্যালাঙ্কস বাহিনীকে আক্রমণ করল, পিরাসকে কোনাে সুযােগ দিল না ফ্যালাঙ্কস বাহিনী নিয়ে সমতলে যাবার। আর আক্রমণে আগেভাগেই তারা উত্তপ্ত মােমে ডােবানাে শত শত তীর ছুঁড়ে দিল হাতিগুলাের দিকে তাক করে। হাতিগুলাে গায়ে আগুন লেগে লেজ গুটিয়ে পিরাসের নিজের বাহিনীর সৈন্যদের গায়ের উপরেই দুমদাম করে পড়ে যেতে লাগল। সমতলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফ্যালাঙ্কস বাহিনী উঁচু-নীচু পাহাড়ি মাটিতে তাদের সূত্র অনুযায়ী সারি তৈরির চেষ্টা করে চলল কিন্তু নিজেদের মধ্যে ছােটো ছােটো দলে বিভক্ত হয়ে আর কিছুতেই সময়মতাে সারিবদ্ধ হতে পারছিল না। সেই সুযােগে রােমান লিজন বাহিনী আক্রমণ করল এবং রােমানদের সঙ্গে পািরসের তৃতীয় যুদ্ধে ভয়ানক পরাজয় হলাে তার। পিরাস ট্যারেন্টামে ফিরে গেলেন। রােমানদের সঙ্গে আর ককনাে কোনােরকমে যুদ্ধে জড়ানাে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, এমনকি তিনি গ্রিসের অন্যান্য যুদ্ধের কথা ভেবে এপিরাসের উদ্দেশে চলে গেলেন। তার তিন বছর পরে এক গ্রিক নগরের রাস্তায় তার মৃত্যু হয়, যখন এক মহিলা উপর থেকে তার মাথায় ছাদের একটি টালি ফেলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সকল সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন কিন্তু হেরে গেছেন কিছু যুদ্ধে। এর মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব ২৭২ সালে রােমানরা ট্যারেন্টাম দখল করে ফেলল, সেই নগরের নতুন করে যুদ্ধ শুরু করার সমস্ত সম্ভাবনা ভালােভাবে নষ্ট করে কেবল তার সরকারকে টিকিয়ে রাখল। ম্যাগনা গ্রেশিয়ার গ্রিক নগরগুলাের মধ্যে শেষ যে নগরটা টিকে ছিল তা হলাে ইতালির নীচের দিকের শেষ প্রান্তে অবস্থিত রেজিয়াম। এর পরের পালা ছিল স্যামনাইটদের। পিরাসকে রােমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা দানকারী জাতিটিকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য রােম উদগ্রীব ছিল। একটি মাত্র আহ্বানে (কখনাে তাকে বলা হয় চতুর্থ স্যামনাইট যুদ্ধ), খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯ সালে স্যামনাইটদের যা কিছু বেঁচে ছিল, সব গেল। এট্রুরিয়াকেও ধুয়েমুছে সাফ করা হয়ে গেল। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৫ সালে এরিয়ার শেষ নগরটি রােমানদের হাতে চলে এল।

কার্থেজীয়দের বিরুদ্ধের রোমানদের প্রথম ও দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ

কার্থেজ, রোমানদের সমুদ্রে গমন ও প্রথম পিউনিক যুদ্ধ

বিভিন্ন অঞ্চলে রোমের শাসনপদ্ধতি : তখন সিসালপাইন গাউলের দক্ষিণ সীমানার দিকে ইতালির পুরােটাই রােমের নিয়ন্ত্রণে। সেদিকের সীমানাটা ছােটো রুবিকন নদীর উপর দিয়ে গেছে। পরের শতাব্দীগুলােতে যখন রােমের ক্ষমতা সীমা পরিসীমা ছাড়িয়ে সেই জায়গার থেকে আরাে অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই রুবিকন নদীই ইতালির সীমা নির্ধারণ করত। পুরােটা রােমান ইতালি একই কায়দায় শাসিত হতাে না। প্রকৃতপক্ষে রােমের ছিল বহুরকম শাসনের উপায় এবং সেই সমস্ত উপায়ই সে বিভিন্ন অঞ্চলের উপরে প্রয়ােগ করেছে। কিছু অঞ্চল ছিল পুরােপুরি রােমান এবং সেসব অঞ্চলের বসবাসকারীদের ছিল সেই অঞ্চলের নাগরিকত্বের পুরােপুরি অধিকার (তারা রােমে এল কোনাে নির্বাচনে ভােটও দিতে পারত)। কিছু কিছু নগরে ছিল রােমের উপনিবেশ, সেখানকার লােকেরা তাদের পরিবারসহ সেনা জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করত। তারা সেনানিবাসের কাজকর্মের এলাকার মতাে বিপদসঙ্কুল অবস্থাতেই সেখানে অবস্থান করত। উপনিবেশ অঞ্চলগুলাে ছাড়া অন্যান্য নগরগুলাে হয় পুরােপুরি নয়তাে আধাআধি রােমের আওতায় ছিল। সেসব এলাকার শাসনে রােমের হস্তক্ষেপ থাকত। তবে যেসব নগরে রােমানরা আধিপত্য বিস্তারে সামান্য বেগ পেয়েছে, সেসব অঞ্চলের শাসন তারা পুরােপুরি নিজের হাতে তুলে নিল। সেসব নগরের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা বলে কিছুই রইল না। বিভিন্ন নগর তখন নিজেদের ব্যবহার, শত্রুতা বা বন্ধুত্বের উপর ভিত্তি করে রােমের ইচ্ছা অনুযায়ী সুযােগ সুবিধা পেত, যেমন বন্ধু হলে কিছুটা শাসনভার তাদের নিজেদের উপরে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা ছাড় দেয়া আর শত্রু হলে অবধারিতভাবে শাসনে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা। সব ক্ষেত্রেই অবশ্য শাসনের সুতাে রােমের হাতেই ধরা থাকত। কাছাকাছি নগরগুলাে যেন একসাথে হয়ে কোনাে সর্বজনীন দাবি তুলতে না পারে সেদিকে তাদের ছিল কড়া নজর। বুদ্ধি করে রােম একেক নগরে একেক ধরনের শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিল যেন তারা সবাই মিলে একটি সাধারণ দাবিতে এক হতে না পারে। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত রােমের ইতিহাসে, পাশাপাশি নগরের মধ্যে রােম আইনের কিছুটা গড়মিল রেখে দিত যেন তারা এক জোট হতে না পারে, আবার কিছু বিষয় এমনভাবে একরকম করে রাখত যেন তারা কোথাও না কোথাও কোনাে না কোনােভাবে এক সুত্রে গাঁথা থাকে, রােম তাদের বেঁধে রাখত হয় ভয় নয়তাে আশা দিয়ে। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ এতই বিখ্যাত হয়ে গেল যে এর ব্যবহার হতে হতে আজ আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত তা জনপ্রিয়।

কার্থেজের পটভূমি : রােম তখন ৫০,০০০ বর্গ কিলােমিটার জুড়ে প্রায় ৪,০০০,০০০ মানুষের উপরে শাসনকার্য চালাচ্ছিল। গাউলদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাবার এক শতাব্দী পরে কার্থেজ এবং হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলাের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রােম নিজেকে পৃথিবীর ক্ষমতাশালী একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলল। পৃথিবীর ক্ষমতাধরদের মধ্যে দাঁড়িয়ে, সবচেয়ে দ্রুত এবং সবার শেষে ক্ষমতার সারিতে পৌঁছে, রােমের প্রথম দায়িত্ব হলাে তার চেয়ে আগে গজিয়ে ওঠা শক্তিগুলােকে মােকাবেলা করা। সরাসরি বলতে গেলে, রােমের প্রথম কাজ হলাে কার্থেজের সঙ্গে শত্রুতা বাড়ানাে, কারণ কাছাকাছির মধ্যে বড়াে হুমকি ছিল তারাই, পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রােম এবং কার্থেজই ছিল দুটো বড়াে শক্তি যার একটি বিনষ্ট হলে পুরাে অঞ্চল জুড়ে আধিপত্য থাকবে কেবল একজনের (সত্যিকার অর্থে কার্থেজও তাই মনে করত)। পশ্চিম ভূমধ্যসাগরে ধারাবাহিকভাবে পত্তন হওয়া উপনিবেশগুলাের মধ্যে কার্থেজই একমাত্র যা ছিল ফিনিশীয়দের উপনিবেশ। আর সেটাই ছিল সবচেয়ে সফল উপনিবেশ। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ শতাব্দীর পরপর ব্যাবিলনের নেবুচাদনেজার ফিনিশিয়া দখল করেন এবং নগরটির ক্ষমতা ধ্বংস করেন। আর তখন ফিনিশিয়ার লােকেরা বাধ্য হয়ে কার্থেজে এসে উপনিবেশ তৈরি করে। তারপর তাদের নৌবাহিনী হয়ে ওঠে সেকালে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। গ্রিক উপনিবেশগুলােকেই কার্থেজ তার প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, যারা সেই সময় আগের আড়াইশো বছর ধরে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে হতে ইতালি এবং সিসিলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই গ্রিক শক্তির মোকাবেলা করতে গিয়ে কার্থেজকে ইতালির মূল ভূখণ্ডের বড়াে শক্তিগুলাের সঙ্গে হাত মেলাতে হলো। যাদের সাথে তারা সন্ধি করে তাদের মধ্যে প্রথমে বলতে হয় এট্রুস্কানদের কথা, গ্রিকদের বিরুদ্ধে অ্যালালিয়ার যুদ্ধে তারা এট্রুস্কানদের সাথে ছিল, আর যুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে তারা খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে ইতালীয় উপদ্বীপে গ্রিসের বৃদ্ধিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।

সার্ডিনিয়া ও সিসিলিতে কার্থেজ, রোমের সাথে মৈত্রী : কার্থেজের প্রথম সেনাপ্রধান, মেইগাের (Mago) হাত ধরে কার্থেজ সার্ডিনিয়ার বিশাল অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে চলল, ইতালির পশ্চিম থেকে শুরু করে সার্ডিনিয়ার পশ্চিম দিকে ২০০ মাইলের মধ্যে ব্যালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত কার্থেজের শাসন চলতে লাগল। সেই দ্বীপের সবচেয়ে পূর্বভাগে সম্ভবত মেইগো প্রথম নতুন নগর সৃষ্টি করলেন, প্রাচীন কালে যার নাম ছিল পাের্টাস ম্যাগােনিস (মেইগাের বন্দর) আর এমনকি আজকের দিনেও তার নাম পোর্ট মাহন। কার্থেজ ভূমধ্যসাগরীয় সমুদ্র উপকূল জুড়ে এখানে-ওখানে বানিজ্য ঘাঁটি তৈরি করে ফেলল আর তারপর ভূমধ্যসাগরের উপকূল ছাড়িয়েও ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি এরকম গল্পও আছে যে কার্থেজীয়রা ব্রিটিশ দ্বীপপূঞ্জ ও আফ্রিকার সর্বপশ্চিম উপকূলে পৌঁছেছিল, এমনকি তারা আফ্রিকা মহাদেশকে প্রদক্ষিণ করেও এসেছিল। কার্থেজের প্রধান এবং সবচেয়ে জটিল লড়াই ছিল গ্রিসের সিসিলির সঙ্গে। গ্রিকরা দ্বীপটির দুই তৃতীয়াংশ দখল করে ছিল কিন্তু কার্থেজের লােকদের হাতে ছিল পশ্চিম দিকের এক তৃতীয়াংশ, যার মধ্যে ছিল প্যানােরমুস নগর, আধুনিক কালে যার নাম হয়েছিল পালেরমাে, নগরটা ছিল উত্তরের উপকূলে, আর ওদিকে পশ্চিমের শেষ প্রান্তে ছিল লিলিবিয়াম। সিসিলির যুদ্ধ-ভাগ্য ছিল এমন যে যার সঙ্গেই যুদ্ধ লাগত, লেগেই থাকত, কোনাে পক্ষেরই পুরােপুরি হার জিত কিছু হতাে না। কার্থেজীয়দের যেখানে ছিল অনেক পারদর্শী সেনাপ্রধান, সাইরাকুজ ছাড়া দ্বীপের অন্যান্য অঞ্চলে নিজেদের আস্তানা গাড়তে সক্ষম হলাে। সাইরাকুজ হলাে সেই নগর যা তারা কখনােই দখল করতে পারেনি। গ্রিকরা যখন বাধ্য হয়ে শাসনভার নিয়েছিল, ডিওনিসিয়াস, অ্যাগাথোক্লেস অথবা পিরাসের অধীনে, তারা বহু নগর দখল করেছিল কেবল লিলিবিয়াম ছাড়া। এটা ছিল সেই নগর যা তারা কোনােদিন দখল করতে পারেননি। পিরাসও লিলিবিয়ামে অকৃতকার্য হয়েছেন, আর তিনি যখন সিসিলি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, সুদীরপ্রসারী দৃষ্টি দিয়ে তিনি যা বলেছিলেন তা হলাে, “কী সুন্দর একটা লড়াইয়ের ক্ষেত্র যে আমি কার্থেজের এবং রােমের লােকেদের দিয়ে যাচ্ছি!” সেই পর্যন্ত কার্থেজ এবং রােম আড়াই শতাব্দী ধরে বন্ধু ছিল, কেননা তখন পর্যন্ত তাদের একটি সাধারণ শত্রু ছিল, গ্রিকরা ছিল সেই সাধারণ শত্রু। খ্রিস্টপূর্ব ৫০৯ সালে যখন রােম ছিল টারকুইনদের অধীনে, কার্থেজ রােমের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৮ সালে সেই চুক্তিটি আবার নবায়ন করা হয়, এমনকি তারও পরে খ্রিস্টপূর্ব ২৭৭ সালে কার্থেজ এবং রােম পিরাসের বিরুদ্ধে এক হয়ে দাঁড়ায়।

গ্রিক হায়ারোর অধীনে সাইরাকুজ, রোমানদের বিরুদ্ধে পরাজয় ও শান্তির যুগ : কিন্তু এখন পিরাস চলে গেছেন আর ইতালির গ্রিক নগরগুলােও নিয়ে নেয়া হয়েছে। আর তাই সিসিলিই ছিল কার্থেজদের জন্য একমাত্র লড়াইয়ের স্থান। সাইরাকুজ তখনাে বেশ শক্তিশালী ছিল, আর পিরাস চলে যাবার পরে তার সেনাপতি হায়ারো (Hiero) ছিলেন পশ্চিমে সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রিক। তিনি পিরাসের অধীনে সফলতার সঙ্গে লড়েছিলেন এবং এবং তিনি ছিলে অসম্ভব সাহসী ও কর্মক্ষম একজন যােদ্ধা। হায়ারোর প্রথম দিকে আক্রমণ ছিল ম্যামারটাইনদের বিরুদ্ধে, যাদের পিরাস দ্বীপের উত্তর-পূর্ব কোণে মেসেনাতে ছেড়ে এসেছিলেন। তারা তখন ভেতরে ভেতরে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং ছড়িয়ে পড়ছিল। হায়ারো তাদের মােকাবেলা করতে যাত্রা করলেন, খ্রিস্টপূর্ব ২৭০ সালে তাদের পরাজিত করলেন এবং তাদের আবার মেসেনাতে পাঠিয়ে দিলেন। সাইরাকুজের কৃতজ্ঞ লােকেরা তাকে রাজা বানিয়ে ফেলল, তার নাম হলাে দ্বিতীয় হায়ারো। তিনি তার শাসন সুরক্ষিত করার পরে খ্রিস্টপূর্ব ২৬৫ সালে সিদ্ধান্ত নিলেন যে মেসেনিয়ায় ফিরে যাবেন ও মিত্র কার্থেজীয়দের সাথে মিলে তিনি সেখানে গিয়ে ম্যামারটাইনদের সমূলে উৎপাটন করবেন (হ্যাঁ, কার্থেজীয়দের কাছে এখন গ্রিকরা মিত্র ও রোমানরাই শত্রু)। যাই হোক, কাজটি হায়ারো তিনি সেটা ভালােভাবেই করতে পারতেন, কিন্তু সমস্যা ছিল এখানেই যে, হাজার হলেও তারা ছিল ইতালির সৈন্য, তারা ইতালির সর্বশক্তি রােমের কাছে রক্ষার জন্য আবেদন জানাল। রােম বরাবর এরকম আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসেছে, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তারা অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস কডেক্সের (ভূতপূর্ব একজন সেনসরের পুত্র) অধীনে খ্রিস্টপূর্ব ২৬৩ সালে সিসিলি নদী পেরিয়ে চলে গেল এবং হায়ারোর দলকে সহজেই পরাজিত করে ফেলল। দ্বিতীয় হায়ারো কোনাে পরাজয়ের জন্য আর এক মুহূর্তও সেখানে অপেক্ষা করেননি। তিনি তার ভবিষ্যৎ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন তাই তৎক্ষণাৎ সাইরাকুজের সাথে তাে বটেই, রােমের সঙ্গেও একটি শান্তি চুক্তিতে চলে এলেন। তার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের শাসনামলে (তিনি টানা পঞ্চাশ বছর শাসন করেছিলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ২১৫ সালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, যখন তার বয়স হয়েছিল নব্বই), তিনি রােমের অভিজাত এলাকাতেই পড়েছিলেন। সাইরাকুজে শান্তি ছিল এবং তার নিজস্ব শাসনই সেখানে বহাল ছিল। সত্যিকার অর্থে সেটাই ছিল সাইরাকুজের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শান্তির একটা অর্ধশতাব্দী আর অন্য স্থানে যখন গ্রিক শক্তি নিভু নিভু করছে তখন সাইরাকুজ ছিল তার স্বর্ণযুগে। 

কার্থেজীয়দের সাথে যুদ্ধের সূচনা এবং সমুদ্রে যুদ্ধের প্রস্তুতি : গ্রিকরা রোমানদের সাথে শান্তিচুক্তিতে গেলেও তাদের মিত্র কার্থেজীয়রা রোমের সাথে যুদ্ধ চালিয়েই গেল। রােমানদের কাছে কার্থেজীয়রা ছিল “পিওনি” নামে পরিচিত। রােমানরা পিওনিকাকে ছােটো করে পিওনি বলত। পিওনিকা হলাে সেই দেশ যেখান থেকে কার্থেজীয়দের আগমন হয়েছিল। আর এ কারণেই কার্থেজীয়দের সঙ্গে রােমের প্রথম যুদ্ধকে প্রথম পিউনিক যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। হয়তোবা তখন রােমানরা একটা সহজ এবং দ্রুত জয়লাভ করা যায়, এমন যুদ্ধ বাঁধানাের চেষ্টায় ছিল। যে করেই হােক গ্রিকরা সবরকমের ছােটোবড়াে যুদ্ধে কার্থেজীয়দের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তখন থেকে মাত্র পনেরাে বছর আগে পিরাস তাদের পরাজিত করেছিল এবং পালটা জবাব দিয়ে রােমও পিরাসের বাহিনীকে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করেছিল। সাদা চোখে দেখতে এমনই মনে হচ্ছিল যে রােমানরা খ্রিস্টপূর্ব ২৬২ সালে সিসিলির দক্ষিণ তীরবর্তী এলাকায় এগ্রিজেন্টামে কার্থেজীয়দের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল তা তাদের ভীষণ আশাবাদী করে তুলেছিল। তবে কার্থেজীয়রা আজীবনই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার আগ পর্যন্ত প্রাণপণ যুদ্ধ করে গেছে। তারাই একমাত্র জাতি যারা রােমানদের তাদের সর্বোচ্চ শক্তি কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। আর দূরবর্তী অঞ্চল লিলিবিয়ামে তারা যা দেখিয়েছে সেটা রােমের পক্ষে হজম করাই ছিল কঠিন। কাৰ্থেজিয়ানরা লিলিবিয়ামে কখনােই কোনাে গ্রিক জাতির কাছে হার মানেনি। আর রােমানরাও অবশ্য ভাবেনি যে তারা তার চেয়ে বেশি কিছু করে দেখাতে পারবে। আবার লিলিবিয়ামের পাশে অভুক্ত অবস্থায় ঠায় বসে থাকার মানসিকতাও তাদের ছিল না। কিংবা কার্থেজীয় নৌবাহিনী তাদের জন্য খাবার বয়ে নিয়ে আসবে, এমন প্রত্যাশাও ছিল না।  তাই রােমানরা একটা দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিল। তারা কার্থেজীয়দের সঙ্গে সমুদ্রের জলের ওপরেই লড়াই শুরু করে দেবে। শুরুতে মনে হয়েছিল এটা একটা উন্মাদের মতাে সিদ্ধান্ত, কারণ কার্থেজের লােকদের সমুদ্রপথে সাহসিকতার ইতিহাস বহুদিনের। পশ্চিমা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় কার্থেজীয়দেরই ছিল সবচেয়ে বিশাল নৌবাহিনী এবং সমুদ্রপথে ব্যবসা এবং যুদ্ধের ইতিহাস বা কৃষ্টি তাদের বহু শতাব্দীর। আর ওদিকে রােমানদের ক্ষেত্রে তাদের সব বিজয়ই প্রায় স্থলে। রােমানদেরও জাহাজ ছিল তবে তুলনামূলক ছােটো আকতির; তাদের কোনােটাই কার্থেজীয়দের যুদ্ধ জাহাজের সামনে দাঁড়ানাের ক্ষমতা রাখে না; তাই তারা সমুদ্রের উপরে কার্থেজীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিজয়ী হবার কথা ভাবেইবা কী করে? কিন্তু রােমের ভাগ্য ভালাে ছিল যে কার্থেজীয়দের একটা বিশাল জাহাজ (যার পাচটা লােহার তৈরি ধার ছিল, যেখানে রােমানদের ছিল মাত্র তিনটি ধারওয়ালা জাহাজ) ইতালির সমুদ্র উপকূলে ভেঙে যায়। রােমানরা সেই ভাঙা জাহাজের টুকরােগুলাে নিয়ে গবেষণা করে পাঁচ ধারওয়ালা জাহাজ বানানাের কৌশল বের করে ফেলল। তবে তারা নিঃসন্দেহে এ বিষয়ে তাদের গ্রিক শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তা পেয়েছিল (গ্রিকদেরও সমুদ্রপথের অভিজ্ঞতা ছিল বহুদিনের)। রাতারাতি রােমানরা বেশ কয়েকটা একইরকমের পাঁচ ধারবিশিষ্ট জাহাজ বানিয়ে ফেলল। আর যখন তারা জাহাজ বানানােতে সময় কাটাচ্ছে তখন স্থলে সৈন্যদের প্রশিক্ষণও একই সঙ্গে চলছিল। বিষয়টা তত কঠিন ছিল না যতটা শােনাচ্ছে, যদিও সমুদ্রের উপরে কার্থেজীয়দের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড়ানাের সাহস ছিল না। রােমানদের, তারা মােটামুটি জানত যে তারা পরাজিত হবে। তারা শত্রুদের অবস্থান লক্ষ করে জাহাজগুলােকে একটার পর একটা এক লাইনে আটকে দিল। এমনভাবে হুক দিয়ে আটকাল যেন ওখানেই জাহাজেরা চিরস্থায়ী আর সেই পাটাতন পেরোতে পেরোতে পৌঁছে যাওয়া যায় কার্থেজীয়দের জাহাজে। আসলে সত্যি কথা বলতে কি, রোমানরা পাটাতনের ওপরে যুদ্ধ করে তাদের স্থলে যুদ্ধের ক্ষিপ্রতা আনতে চেয়েছিল।

কার্থেজের বিরুদ্ধে প্রথম নৌযুদ্ধ : খ্রিস্টপূর্ব ২৬০ সালে রােমানরা তৈরি হলাে। তাদের জাহাজ বহরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কয়েকটা জাহাজের ছােটো একটা দল কার্থেজীয়দের হাতে ধরা পড়ল। এটা হয়তো রােমানদের মানসিক শক্তি অনেকটা কমিয়ে দিল। কিন্তু তারপরেও যে কোনােভাবে রােমানদের জাহাজের প্রধান বহরটি ইতালির জঙ্গলের পাশ দিয়ে ঠিকই জায়গামতাে পৌঁছে গেল, তারা গিয়েছিল গাইউস জুলিয়াস নিপােসের অধীনে। তিনিই সেই মানুষ যিনি একটির সঙ্গে আরেকটি জাহাজকে আটকে দেবার জন্য হুকের ব্যবস্থা করেছিলেন। কৌশলটা ছিল বড়াে বড়াে হুকওয়ালা কলাম যা জাহাজের তলা দিয়ে আটকানাে ছিল। হুকগুলাে শক্ত করে কলামগুলাে উপরের দিকে ওঠানাে থাকত যখন রােমান জাহাজের বহর এগিয়ে যেত এবং শত্রুর জাহাজের নাগালের মধ্যে এল হুকগুলাে আলগা করে কলামগুলাে নীচে নামিয়ে রাখা হতাে যেন যুদ্ধের সুবিধার জন্য জাহাজগুলাে পৃথক হতে পারে। তারপর আবার প্রয়ােজনমতাে হুকগুলাে শক্ত করে দুটো জাহাজকে এক করে শত্রু জাহাজের বহরের মধ্যে ঢুকে যাওয়া যেত। মাইলিতে (Mayle) গিয়ে রােমান জাহাজগুলাে কার্থেজীয় জাহাজগুলাের মুখােমুখি হলাে, সেটা ছিল মেসানা থেকে মাত্র পনেরাে মাইল পশ্চিমে একটা বন্দর। জাহাজগুলাে তখন একের পর এক পাশাপাশি চলে আসে, কাঠের লম্বা কলামগুলাে উপরে উঠিয়ে হুক দিয়ে তাদের একের পর এক দ্রুত আটকে দেয়া হয়, আর পাটাতনের উপরে রােমান সৈন্যরা বিস্মিত কার্থেজের বাহিনীর উপরে ঝাপিয়ে পড়ে। কার্থেজের চৌদ্দটা জাহাজ তারা ডুবিয়ে দেয় এবং একত্রিশটা জাহাজকে দখল করে নিয়ে যায়। সমুদ্র যুদ্ধে সবচেয়ে শেষে যােগদান করা যােদ্ধার কাছে সমুদ্রের এতদিনের রানি কার্থেজ বাহিনী অসহায় পরাজয় বরণ করল। ডুলিয়াস নিপোস রােমের প্রথম নৌবাহিনীর প্রথম সেনাপতি হিসেবে বিজয়ের গৌরব অর্জন করলেন।

কার্জেথের সাথে দ্বিতীয় নৌযুদ্ধ ও আফ্রিকায় গমন : তবে তবে সে যাই হােক, কার্থেজীয়রা তাদের অধিকার কিছুতেই ছাড়ল না। সিসিলির পশ্চিম দিকে তাদের অবস্থান আগের মতােই শক্ত রইল। অনেকগুলাে জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও তাদের বিপুল পরিমাণ জাহাজের বাকি অনেক জাহাজ সেখানেই ছিল। রােমানরা তাই বাধ্য হয়ে আরাে ভেতরে গিয়ে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিল যেন অ্যাগাথোক্লেসের মতাে সেই একই পরিকল্পনায় পরিচালিত হচ্ছিল তারা; তাই রােমানরা ঠিক করল তারা কার্থেজের একেবারে নিজস্ব ভূমির মাঝ বরাবর গিয়ে আক্রমণ করবে, অ্যাগাথোক্লেস যেভাবে রােমানদের আক্রমণ করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৫ সালের মধ্যে রােমান নৌবাহিনী ৩৩০ টি পাঁচ ধারওয়ালা জাহাজ তৈরি করে ফেলল এবং এই বিশাল নৌবহরের সেনাপতি হলেন মারকাস অ্যাটিলিয়াস রেগুলাস, যিনি তখন ছিলেন রােমের কনসল। নৌবহরটি ইতালির পূর্বদিকে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে রাখা ছিল এবং দক্ষিণ দিকের সমুদ্র উপকুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। সমুদ্র উপকূল ধরে অর্ধেক পথ এগােনাের পরে একনােমাস নামে এক স্থানে তারা কার্থেজের মােটামুটি বিশাল এক নৌবহরের মুখােমুখী হলাে। দ্বিতীয় নৌযুদ্ধ শুরু হলাে। সেটাই ছিল সে পর্যন্ত সবচেয়ে বড়াে নৌযুদ্ধ এবং আবারাে সেখানে রােমানদেরই বিজয় হলাে। সমুদ্রে কার্থেজীয়দের ক্ষমতা সেই সময়ে বলতে গেলে একেবারে ভেস্তেই গেল। তখন সমুদ্রে সামনের জগৎ একেবারে পরিষ্কার ছিল এবং আর কোনাে বাধাবিঘ্ন ছাড়াই রােমানরা সােজা কার্থেজদের ভূমিতে গিয়ে উপনিত হলাে। অ্যাগাথোক্লেসের সময়ে যেমনটা ছিল, সেই একই রকমের পরিস্থিতি তখন সেখানে। কার্থেজের লােকদের যেন তখনাে শিক্ষা হয়নি, তারা যেন বুঝতেই পারেনি যে তাদের জন্মভূমি যুদ্ধের ভয়াবহ সম্ভাবনা থেকে মুক্ত নয়। কারণ তখনাে তাদের স্থলভাগ ছিল তখনাে অরক্ষিত এবং নিরস্ত্র জনগণে ভরা। তাই কার্জেথের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে পুরাে দেশ দখল করতে রেগুলাসকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। তিনি সহজেই কার্থেজের দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, আর কার্থেজ যখন যুদ্ধ আর ধ্বংসের ভয়ে ভীত ছিল তখন তারা তার সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে আসার প্রস্তাব দিল। কিন্তু রেগুলাস সেই চুক্তিতে এতই কঠিন সব শর্ত আরােপ করলেন যে কার্থেজের পক্ষে তা রক্ষা করা সম্ভব হলাে না। তাই তারা তার বদলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। তাদের মনে হলাে শর্ত রক্ষার চেয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ সহজ।

জ্যান্থিপাসের নেতৃত্বে কার্থেজের জয়, সিসিলিতে পুনরায় যুদ্ধ ও শান্তিতে ব্যর্থতা : কার্থেজে তখন জ্যান্থিপাস নামে একজন স্পার্টান ছিলেন। স্পার্টানরা তাদের সুদিন বহুদিন আগেই হারিয়েছে, কিন্তু তাদের সেই প্রাচীন মনােভাব তখনাে অনেক স্পার্টানের মধ্যে বিরাজ করছিল। জ্যান্থিপাস তেমনই একজন যিনি শক্তভাবে কথা বলতেন, তিনি কার্থেজের মানুষদের বলেছিলেন যে তারা রােমানদের কাছে এমনি এমনি হারছে না বরং পরাজিত হচ্ছে তাদের নিজেদের সেনাপতির ভুল পরিচালনায়। তিনি এমনভাবে তাদের বােঝালেন এবং এত দৃঢ় সমালােচনা করলেন যে কার্থেজীয়রা উপায়ান্তর না দেখে তার হাতেই ক্ষমতা সঁপে দিল। জ্যান্থিপাস তখন একটি সেনাবাহিনী গঠন করল এবং তাতে ৪০০০ সৈন্য ও ১০০ হাতি যােগ কলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৫৫ সালে তিনি তাদের নিয়ে রােমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য রওনা দিলেন যখন রােমান সেনাবাহিনীর একটা অংশ সিসিলিতে যুদ্ধ করে এসে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তা না হলে রেগুলাস হয়তো বেশ ভালােভাবেই লড়তে পারতেন, খারাপ অবস্থা জেনেও মান-সম্মান রক্ষার্থে তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তিনি বেশ লড়লেন এবং পরাজিত হলেন আর তারপর তাকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হলাে। এভাবে আফ্রিকায় রােমানদের প্রথম যুদ্ধে তাদের শােচনীয় পরাজয় হয়। রােমান সিনেটে পরাজয়ের সংবাদটি পৌঁছতে না পৌঁছতেই তারা একটি দক্ষ সেনাবাহিনী আফ্রিকার উদ্দেশে পাঠিয়ে দিল। তাদের পৌঁছানাের পথে বাধা প্রদানকারী কার্থেজের একটি জাহাজকে গুড়িয়ে দিল। কিন্তু আরেকটি অপেক্ষাকৃত দুর্ধর্ষ শত্রুর কবলে পড়ে গেল। রােমানদের সমুদ্রের অভিজ্ঞতা ততদিনে হয়ে গেছে। আর তাই তাদের বুঝতে কষ্ট হরাে না ভয়ানক একটি ঝড় ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। তারা জেনে গেল যে ঝড় তাদের ধরে ফেলার আগেই তীরে ভিড়তে হবে। কিন্তু শত চেষ্টাতেও সফল হতে পারল না। ঝড় দ্রুত তাদের দিকে তেড়ে এল এবং রােমান জাহাজের বহর ধ্বংস হয়ে গেল। হাজার হাজার রােমান সৈন্য জাহাজসহ ডুবে গেল। কার্থেজের বাহিনী নতুন করে শক্তি পেয়ে গেল, তারা নতুন করে সেনাবাহিনী এবং হাতির বহর পাঠিয়ে দিল সিসিলির পথে। রােমানরা যতই ভেঙে পড়ক, মােকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিল এবং তিন মাসের মধ্যে নতুন নৌবহর সাজিয়ে ফেলল। বহরটি সিসিলির দিকে যাত্রা করল এবং আফ্রিকার সমুদ্র উপকূল ঘুরেফিরে তেমন ভয়ানক কিছুই করতে পারল না। আর তারপর ফিরে রােমের দিকে আসার পথে দুর্ভাগ্যবশত আবারাে ঝড়ের কবলে ধ্বংস হয়ে গেল। সিসিলিতে কোনাে কারণ ছাড়াই যুদ্ধ চলতে লাগল, আর খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে কার্থেজের লােকেরা ভেবে বসল যে তারা যুদ্ধের বদলে শান্তি চুক্তির ব্যাপারে আরেকবার ভাবতে পারে। একদল কূটনীতিককে তারা রােমের দিকে পাঠিয়ে দিল, এবং রেগুলাস, বন্দি রােমান সেই নেতাকেও তারা কূটনীতিকদের দলের সঙ্গে দিয়ে দিল যেন শান্তিচুক্তিটা নির্বিঘ্নে হতে পারে। রেগুলাসকে অবশ্য যাবার আগে কথা দিতে হলাে যে শান্তিচুক্তি স্থাপনে তারা ব্যর্থ হলে তাকে তাদের সঙ্গেই ফিরে এসে আবার কার্থেজে বন্দিজীবন কাটাতে হবে। যাই হােক, কূটনীতিক দলটি যখন রােমে পৌঁছল, রেগুলাস সবাইকে অবাক করে দিয়ে কার্থেজের লােকদের হতাশার মধ্যে ফেলে দিলেন, রােমের সিনিটের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, যে যােদ্ধা যুদ্ধে মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি বলে প্রতিপক্ষের হাতে ধরা দেয়, তাকে বাচানাের কোনাে চেষ্টার প্রয়ােজন নেই, তার চেয়ে বরং যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া দরকার। আর এই ঘটনার পরে তাকে কার্থেজে ফেরত নিয়ে যাওয়া হলাে যেখানে ক্রোধান্বিত কার্থেজের লােকেরা তাকে অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করল। (এই গল্পটা বানানােও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, গ্রিক আর রােমান লেখকরা কার্থেজীয়দের সম্পর্কে যা লিখে গেছে, আমরা সেটুকুই জানি, আর এই লেখকরা সরাসরি জাতিগতভাবে কার্থেজের শত্রু। তারা নিশ্চয় কার্থেজের শত্ৰুপরায়নতার কথাই বিশেষ। করে লিখতে পছন্দ করতেন আর দুর্ভাগ্যবশত এই সমস্ত গল্পের প্রতিক্রিয়ায় কার্থেজের কোনাে মানুষকে কিছু লিখতে দেখা যায়নি)। 

পুনরায় রোমান অভিযান ও ব্যর্থতা : খ্রিস্টপূর্ব ২৪৯ সালে রােমানরা আরেকটি নৌবহর তৈরি করল এবং লিলিবিয়ামের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিল, যে স্থানটি যুদ্ধের পনেরাে বছর পরেও কার্থেজীয়দের কাছেই গচ্ছিত ছিল। সেই নৌবহরের দায়িত্বে ছিলেন পাবলিয়াস ক্লডিয়াস পুলচার, বৃদ্ধ সেনসরের তরুণ পুত্র এবং সিসিলিতে প্রথম সেনাবাহিনী নিয়ে যাওয়া সেনাপ্রধান অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াসের ভাই। লিলিবিয়ামে আকস্মিক হামলা না করে ক্লডিয়াস পুলচার তার থেকে বিশ মাইল উত্তরে ডেপানামে কার্থেজের নৌবহরে হামলার ব্যাপারে ভাবলেন। আর তখনকার সময়ে যেটা স্বাভাবিক ছিল, জাহাজে কিছু ধর্মীয় নেতা সেখানে বহন করা কিছু মুরগির কাছ থেকে এক ধরনের সংকেত পেতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মুরগিরা খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, যেটা ছিল তাদের মতে খুবই খারাপ লক্ষণ। ক্লডিয়াস পুলচার ছিলেন এমন একজন রােমান যিনি এই সমস্ত কুসংস্কারের ধার ধারতেন না। তিনি তাই রাগের ঠেলায় মুরগিগুলােকে ধরে জাহাজ থেকে জলে ফেলতে লাগলেন, আর বললেন, “ঠিক আছে, তারা খাবে না যখন, তাদের জলে খেতে দাও।” যাই হােক, জাহাজের প্রধান কুসংস্কারে বিশ্বাসী না হলেও, জাহাজের নাবিক ছিল প্রচণ্ড বিশ্বাসী। নৌবহর প্রধানের এই কাজ দেখে তারা কেঁপে উঠল। তবে ক্লডিয়াস পুলচারের বিষয়ে যে ব্যাপারটা বিপজ্জনক ছিল তা হলাে তিনি তার নৌবহরের চলাচল গােপন রাখতে পারেননি এবং কার্থেজীয়দের উপরে অতর্কিতে হামলা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কার্থেজীয়রা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল এবং যুদ্ধ করে তাকে সহজেই পরাজিত করে ফেলল, নৌবহরের জাহাজগুলােও দিল ধ্বংস করে। নৌবহরের প্রধানকে তখন রােমে ডাকা হলাে এবং তার ভয়াবহ বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলাে (হয়তো সেই জলে ফেলে দেয়া মুরগির কারণেই), তার কাছে বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চাওয়া হলাে। তার পরপরই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। 

হ্যামিলকারের নেতৃত্বে কার্থেজ ও রোমানদের কাছে পরাজয়ের মাধ্যমে প্রথম পিউনিক যুদ্ধের সমাপ্তি : সব শেষে তখন কার্থেজীয়রা তখন সেই মানুষকে খুঁজে পেল যাকে তারা এতদিন ধরে খুঁজছিল। তিনি হলেন হামিলকার বারকা, খ্রিস্টপূর্ব ২৪৮ সালে তিনি ছিলেন সিসিলির সেনাবাহিনীর প্রধান, তখন অবশ্য তার বয়স অনেক অল্প। কার্থেজীয়রা মনে করল তার মতাে কাউকে নেতা হিসেবে পেলে জয় তাদের সুনিশ্চিত। প্রকৃতপক্ষে, তিনি অবশ্য বুঝতে পারলেন যে এমন একটা লক্ষ্যের পেছনে তাকে ছুটতে বলা হয়েছে যা বাস্তবে হয়তো হারিয়েই গেছে। অবশ্য তার পরেও, তিনি অসাধারণ ক্ষমতা প্রদর্শন করলেন। টানা দুই বছর ধরে তিনি ইতালির সমুদ্র উপকূলে দাপটের সঙ্গে যুদ্ধ করে গেলেন, আর তারপর প্যানরমাসে আক্রমণ করলেন, অতর্কিতে এলাকাটি দখল করে তিনি সিসিলির দিকে হাত বাড়ালেন। রােমানরা তাকে না পারল বন্দি করতে, না পারল থামাতে। আর অনেক চেষ্টার পরেও লিলিবিয়ামে রােমানরা কোনােরকমের সুবিধা করতে পারল না। তখনকার সময়ে রােমানদের একটা নীতি ছিল, তা হলাে, তারা কখনােই হার মানবে না। খ্রিস্টপূর্ব ২৪২ সালে তারা আবার একটা নৌবহর তৈরি করে ফেলল, আর সেটা নিয়ে গিয়ে সিসিলির পশ্চিম উপকূলে কার্থেজীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করল। তারা সেখানে এমনভাবে গেঁড়ে বসল যে দুঃসাহসী হ্যামিলকারের জন্য শাসনকাজ চালানাে কঠিন হয়ে দাঁড়াল। ফলে হ্যামিলকার দেখলেন যে রােমানদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি না করে কোনাে উপায় নেই। তখন কার্থেজীয়দের রাজ্য একের পর এক যুদ্ধে এমনই বিপর্যস্ত যে তখন তারা পুরােপুরি ধ্বংসের মধ্যেই বসবাস করছে। খ্রিস্টপূর্ব ২৪১ সালে হ্যামিলকার শান্তিচুক্তিতে সায় দিল। আর সেই চুক্তির মাধ্যমে ২৩ বছর চলার পরে প্রথম পিউনিক যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। এটা পরিষ্কার ছিল যে কার্থেজীয়রা পরাজয় বরণ করেছে। সিসিলি থেকে তারা বিতাড়িত হলাে, সিসিলি তখন পুরােপুরিই রােমানদের আওতায়, কেবল পূর্বদিকের শেষ প্রান্তে সাইরাকুজের দ্বিতীয় হায়ারো এর রাজত্ব ছিল, যে রাজ্য রােমানদের কথায় ওঠাবসা করত। তারপরেও, কার্থেজকে অনেক মূল্য দিতে হলাে। কার্থেজ অনেক আগেই পরাজয় মেনে নিতে পারত। তবে রােমও যদি নিজেদের সামর্থ নিয়ে মুষড়ে না পড়ত তাহলে যুদ্ধটা হয়তো আরাে অনেকদিন পর্যন্ত চলতেই থাকত। 

যুদ্ধবিরতিকালে রোমের সার্ডিনিয়া, কর্সিকা, কর্সিরা ও সিসালপাইন গাউল জয়

প্রথম পিউনিক যুদ্ধের পর রোম ও কার্থেজের অবস্থা, রোমের প্রথম প্রবেশ, কার্থেজের আর্থিক বিপর্যয় : ইতালির সীমানার বাইরে রােমের হাতে চলে আসার ক্ষেত্রে সিসিলিই ছিল প্রথম এলাকা। দূরত্ব বেশি এবং সমুদ্র দিয়ে বিচ্ছিন্ন বলে রােমান শাসকদের কাছে সিসিলিকে নিজেদের এলাকার চেয়ে অন্যরকম মনে হতাে। দেশ হিসেবে ইতালিকে আসলে ‘ইতালির সঙ্ঘ’ মনে করা হতাে; কিন্তু সিসিলি ছিল একেবারে একটি অন্যরকম জায়গা; সেখানকার অধিবাসীদের কথা যদি ভাবা হয় গ্রিক, কার্থেজীয় এবং কিছু আদিবাসী জাতি যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মিলেমিশে থাকত এবং তারা ছাড়া ইতালির অন্য মানুষদের সঙ্গে তাদের মিল খুব কমই ছিল। রােম তাই বরাবরই সিসিলিকে একটা দখলকৃত জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করত এবং তাদের জটিল সামাজিক পরিস্থিতির কারণে তারা ইতালির সামগ্র শাসন ব্যবস্থায় কোনােভাবে খাপ খাওয়াতে পারবে না বলেই মনে করত। রােম থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সিসিলির উদ্দেশ্যে পাঠানাে হতাে যার দায়িত্ব ছিল সেই এলাকার আইনকানুন দেখাশােনা করা। তার দায়িত্ব হতাে সিসিলির বিভিন্ন জায়গা ঘুরে রােমের খাজনা হিসেবে অর্থ আদায় করা এবং রােমের দূরবর্তী একটি প্রদেশ হিসেবে সিসিলিকে লাভজনক হিসেবে তুলে ধরা। “প্রভিন্সিয়া’ শব্দটা এসেছিল সিসিলিকে প্রদেশ হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে, এবং সিসিলি ছিল রােমের প্রথম প্রদেশ, খ্রিস্টপূর্ব ২৪১ সালে একে প্রদেশ হিসেবে ঘােষণা দেয়া হয়। তবে স্বাভাবিকভাবেই, একজন ম্যাজিস্ট্রেট যখন সেখানে শাসনকার্য পরিচালনা করতে যেতেন, তিনি যে সেখানে যত অর্থ আদায় হবে পুরােটা যে রােমে নিয়ে ফিরবেন না, এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিছু অর্থ তিনি নিজেই ব্যবহার করতেন। আর তাই রােমের শাসকদের মধ্যে এমন ধারণা ছিল যে সিসিলির দায়িত্বে যিনি থাকবেন তিনি রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠবেন। আর এভাবেই সেখানকার শাসনে অরাজকতা শুরু হলাে (সবসময় নয় অবশ্য, এখনকার মতােই, তখনাে কিছু সৎ আর কিছু অসৎ শাসক ছিলেন)। আর এর পরে সিসিলিই রােমের একমাত্র প্রদেশ রইল না। দীর্ঘদিনের যুদ্ধে কার্থেজ এমন বিপর্যস্ত হয়েছিল যে ধ্বংসের প্রন্তে এসে দাঁড়াল এবং দেশটির বাণিজ্য লাটে উঠল আর ব্যবসার সবখানে এলােমেলাে পরিস্থিতির উদ্ভব হলাে। বলতে গেলে প্রায় সব যুদ্ধই তারা লড়েছিল ভাড়া করা সৈন্যদের দিয়ে আর তখন তাদের ব্যয় বহন করবার শক্তিও আর রইল না। ভাড়া করা সৈন্যেরা অর্থ না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্রোহ ঘােষণা করল এবং তাদের পাওনা (এবং তার চেয়েও বেশি কিছু) মিটিয়ে নেবার জন্য নগরে লুটপাট শুরু করল। 

রোমানদের সার্ডিনিয়া ও কর্সিকা জয় : হ্যামিলকার ছিলেন একমাত্র কাথেজিয়ান যিনি সেই লুটপাটের সময় প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন, নিজস্ব সেনাবাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করালেন এবং টানা তিন বছর সংগ্রামের পর খ্রিস্টপূর্ব ২৩৭ সালে তিনি ভাড়াটে সৈন্যদের দেশ থেকে উৎখাত করতে সক্ষম হলেন। রােম দেখল যে তাদের হস্তক্ষেপ ছাড়াই কার্থেজ নিজেই নিজের সমস্যার সমাধান করে ফেলল। সার্ডিনিয়া দ্বীপটি তখনাে কার্থেজের অংশ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৩৯ সালে সেখানে ভাড়াটে সৈন্যেরা আশ্রয় নিয়ে স্থানটি রােমকে দিয়ে দিতে চাইল, তা না হলে হ্যামিলকার তাদের হত্যা করবে বলে তাদের ভয় ছিল। রােম সঙ্গে সঙ্গে সে আহ্বানে সাড়া দিল এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৩৮ সালে তারা সার্ডিনিয়া দখলের জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দিল। কার্থেজ তখন প্রতিবাদ করে বলল, এটা শান্তিচুক্তির লঙ্ঘন। এদিকে রোম ঠিকই তাদের স্বার্থ দেখে কার্থেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করল, এবং বলল তারা যুদ্ধ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেবে যদি কার্থেজীয়রা কেবল সার্ডিনিয়াই না, সাথে সার্ডিনিয়ার উত্তরের দ্বীপ কর্সিকাও ছেড়ে দেয়। কার্থেজ নিরুপায় হয়ে রাজি হলাে এবং তখন থেকে সার্ডিনিয়া ও কর্সিকা রােমান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলাে। সেই দুই দ্বীপে সেখানকার আদি অধিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে জায়গাগুলাে দখল করতে রােমানদের কয়েক বছর লেগে যায়, খ্রিস্টপূর্ব ২৩১ সালে পুরােপুরি দখলকৃত হয়ে গেলে সার্ডিনিয়া এবং কর্সিকা একত্রে রােমের দ্বিতীয় প্রদেশ হিসেবে পরিগণিত হয়। 

ইলিরীয় জলদস্যু সমস্যা ও রোমানদের হাতে নিষ্পত্তি : এটা ছিল তখনকার অবস্থা, আর এরপর রােম এই সীমানার বাইরেও কোথায় কোথায় শান্তিস্থাপন করা যায়, তা খুঁজতে লাগল। পাঁচশ বছর আগে নুমা প্ৰম্পিলিয়াসের রাজত্বের পর থেকেই রােমের জানুসের মন্দির বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রােমের সাফল্য তখন তার জন্য নতুন দায়িত্ববােধের সৃষ্টি করল। তখন যেহেতু সমুদ্রেও রােমের একটি দৃঢ় ক্ষমতার আবির্ভাব হয়েছে, তাই রােম তখন সামুদ্রিক অঞ্চলে নিজেদের ক্ষমতার চর্চার কথা ভাবতে শুরু করেছে। প্রথম পিউনিক যুদ্ধের সময় সমুদ্র পথে আক্রমণের ক্ষেত্রে কেবল অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের পূর্ব উপকূলের ইলিরিয়া নামের স্থানের কথা শােনা গিয়েছিল। পরে ম্যাসিডােনিয়ার ক্ষমতাশালী রাজা ফিলিপের এবং আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের তত্ত্বাবধানে ইলিরিয়া শক্ত নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিছু অরাজকতা এবং আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ইলিরিয়ান আদিবাসীরা আবার স্বাধীনতার মুখ দেখে এবং নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়। সমুদ্র উপকূলের একটি অংশ (এখন যাকে বলা হয় যুগােস্লাভিয়া) ছিল অসমতল, সেখানে ছিল অনেক দ্বীপ, তবে সেখানকার আদিবাসীরা সেখানে ব্যবসাবাণিজ্য করে চলতে পারত। তবে বড়াে কোনাে যুদ্ধজাহাজ যদি তাদের উপকূলে আক্রমণ করত। তবে তাদের ছােটোখাটো জাহাজগুলাে সহজেই পরাজিত হয়ে যেত। ইলিরিয়ার দক্ষিণ দিকে গ্রিকরা এই ধরনের অতর্কিত হামলার শিকার হয়েছে বহুবার। ইলিরিয়ার পূর্বদিকে ছিল ম্যাসিডােন, তারাই স্বাভাবিকভাবে ইলিরিয়ানদের এই জলদস্যুদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবার কথা ছিল। ২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যুদ্ধবাজ শাসক পিরাসের মৃত্যুর মেসিডোনিয়া আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের জেনারেল অ্যান্টিগোনাসের নাতি দ্বিতীয় অ্যান্টিগোনাসের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই অ্যান্টিগোনিডরাই সেখানে একশো বছর শাসন চালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মেসিডন গ্রিসের অবিরাম রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ব্যস্ত ছিল, সেই সাথে তাকে টলেমীয় মিশরের সাথেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। ফলে মেসিডনের আর ইলিরীয় জলদস্যুদের জন্য সময় বের করার সুযোগ ছিলনা। তাই গ্রিকদেরকে এই জলদস্যুদের কাছ থেকে পরিত্রাণের জন্য বিকল্প খুঁজে নিতে হলো, আর তারা রোমকেই বেছে নিল। রোমানরা এর মধ্যেই যুদ্ধে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে, আর তাদের অবস্থানও ছিল আড্রিয়াটিক সাগরের ওপারেই। রােম বরাবর যা করত, ঠিক তেমন করেই ইলিরীয় রাণীকে তাদের অসন্তুষ্টির ব্যাপারে সতর্ক করবার জন্য দূত পাঠালো। আর এর সাথে সাথেই রাণী দূতদেরকে হত্যা করালেন। এরপর রোম বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য ২২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইলিরিয়ার বিরুদ্ধে দু’শো জাহাজ পাঠালো, আর এতেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হলো। আর এরপর রাণীর উত্তরাধিকারীর বিরুদ্ধে রোম ২১৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইলিরিয়ায় দ্বিতীয় নৌ-অভিযান পাঠিয়েছিল। এতে ইলিরীয় জলদস্যুগিরি চিরকালের মত সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আর এই যুদ্ধের ফল হিসেবেই রোমানরা গ্রিক দ্বীপপুঞ্জ করসিরা দখল করে নেয়, যেটা তার প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ইরিরিয়ার দখলে ছিল। জায়গাটা ইলিরিয়ান সমুদ্র উপকূলের দক্ষিণ প্রান্তে এবং ইতালির পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। ইলিরীয় জলদস্যুদের পরাজিত করার কারণে গ্রিকরা রােমানদের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল এবং প্রতি ক্ষেত্রেই তাদের সম্মান দেখাতে লাগল। তারা নিজেদের ধর্মীয় কিছু উৎসবেও রােমানদের অংশগ্রহণ করতে দিত, যেটা ছিল তাদের মতাে সুসভ্য জাতির পক্ষে রােমানদেরকে সভ্য ভাবতে পারার লক্ষণ। 

গাউলদের আক্রমণ, পরাজয় ও সিসালপাইন গাউলে রোমান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা : যখন ইলিরিয়াকে ধ্বংস করা হচ্ছিল, উত্তরের দিকে তার চেয়েও বড়াে বিপদ তখন রোমানদেরকে সামলাতে হয়েছে। গাউলরা তখন আলপের উত্তরের সজাতি গাউল ট্রাইবদের নিয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ২২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণমুখে আক্রমণ শুরু করে। লার্স পরসিনার পুরােনাে নগর কুসিয়ামে উপস্থিত হবার পরে তারা এট্রুরিয়ায় আঘাত করে বসল। আর সেখানে গিয়ে অবশ্য তাদের মনােবল এবং লােকবলে টান পড়ল আর তাই সেখানেই থামতে হলাে তাদের। রােমানরা তখন তখন তাদের কনসল গাইয়াস ফ্লেমিনিয়াসের নেতৃত্বে চলছিল। রােমান শাসকদের মধ্যে ফ্লেমিনিয়াস ছিলেন একেবারে অন্যরকম, কারণ তার শাসনের মধ্যে এক ধরনের অন্য ব্যাপার ছিল, আজকের দিনে যাকে বলা যায় গণতান্ত্রিক চেতনা। খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ সালে তিনি যখন ট্রিবিউনে ছিলেন, তখন তিনি রাজ্যের সুবিধাঞ্চিত নিম্নবিত্ত শ্রেণিকে সম্পত্তি এবং ক্ষমতা পাইয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, শক্তিশালী প্রতিপক্ষ এবং উচ্চশ্রেণির দৌরাত্ম থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করতে পেরেছিলেন; আর সত্যি কথা বলতে কি, প্রতিপক্ষে ছিল তার নিজেরই পিতা। নিম্নবিত্তের মানুষদের জন্য তিনি খেলাধুলার প্রচলন করেন, এবং তিনিই প্রথম সিনেটরদের সরাসরি ব্যবসায় যুক্ত হবার ব্যাপারে আপত্তি তােলেন (যেখানে সিনেটররা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা করে অরাজকতা করতে পারেন বলে তিনি মনে করতেন)। সুতরাং তার এই সমস্ত কার্যকলাপে এটা মােটেই অস্বাভাবিক ছিল না যে, তিনি সাধারণ রােমানদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় এবং সিনেটরদের কাছে নিন্দিত ছিলেন। তবে ফেলিমিনিয়াস দুর্ভাগ্যবশত খুব ভালাে সেনাপতি ছিলেন না। যুদ্ধের সময়ে তিনি তেমন কোনাে হিসাব না কষেই সরাসরি আক্রমণ করতেন। গাউলদের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন, এবং পরে যখন পুরােপুরি তৈরি হয়ে আবার তাদের উপরে আক্রমণ করেন, তখন তার জয় হয়। যাই হােক, খ্রিস্টপূর্ব ২২২ সালে গাউলদের সঙ্গে দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয়ের পরে সিসালপাইন গাউলে রােমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। বিজয়কে ধরে রাখার জন্য ফ্লেমিনিয়াস সেই নগর থেকে উত্তর দিকে রােম পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২২০ সালে সেনসর থাকার সময়ে তিনি রাস্তা নির্মানের কাজে হাত দেন, আর রােমের বিজয়ের সময় আসতে আসতে তিনি ফ্লেমিনিয়ান রাস্তার কাজ শেষ করে অ্যাপেনাইনস হয়ে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপকূল ধরে সিসালপাইন গাউলের সীমানা পর্যন্ত চলে যান। গ্যালিক জাতির যে কোনােরকম বিদ্রোহে, রােমান বাহিনী সেই রাস্তার সাহায্যে দ্বিগুণ গতিতে আক্রান্ত স্থানে উপস্থিত হতে পারত। সিসালপাইন গাউলে রােমান উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে রােমানদের ক্ষমতা আল্পস পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। রােম তখন ১২০,০০০ বর্গ মাইল আয়তনের ভূখণ্ডের মালিক। আধুনিক ইতালিতে (সিসিলি এবং সার্ডিনিয়াসহ) যতগুলাে স্থান আমরা দেখতে পাই তার প্রতিটিই ছিল তখনকার রােমান প্রজাতন্ত্রের অংশ আর তাছাড়া করসিকা এবং করসিরাও ছিল রােমের অধীনে। 

হ্যানিবলের হাতে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের শুরুতে বিধ্বস্ত রোম

পুনরায় যুদ্ধের জন্য হ্যামিলকারের প্রস্তুতি : স্যামনাইট, গাউল এবং কর্থেজিয়ানদের সঙ্গে রােমানদের দেড় শতাব্দীর যুদ্ধ এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিজয়ের ব্যাপারে লক্ষ করলে, সামান্য একটা নগর থেকে তার ইতালির মধ্যভাগে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসহ আর সমস্ত সমুদ্রে তার দাপট দেখলে কেউ ভাবতেই পারত না যে কিছু কাল পরে সেই বিশাল শক্তির উপরে আঘাত আসতে পারে। কিন্তু তাই হলাে, কারণ রােমের ছিল এক অপ্রতিরােধ্য শত্ৰু, একজন মাত্র মানুষ, কার্থেজীয় নেতা, হ্যামিলকার বারকা। হ্যামিলকার ভালােভাবেই জানতেন যে সিসিলি বা ইতালিতে যুদ্ধের সময়ে রােমান সেনাবাহিনীকে পেলে তিনি ধরাশায়ী করে ফেলতেন। কিন্তু তার জাতি সেখানে পরাজয় বরণ করেছে কারণ তার তখনাে যুদ্ধে যাবার বয়স হয়নি। যােদ্ধা হিসেবে তিনি পরিণত হয়েছেন কেবল রােমের কাছে কার্থেজীয়দের পরাজয়ের পরে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি রােমানদের কাছে হারেননি এবং কখনােই হারবেন না। রােম নিজের চেষ্টায় বিজয়ী হয়েছে, সেখানে পরাজিত কার্থেজীয়দের পরাজয় মেনে নিয়ে শান্তির পথে থাকাই উত্তম – এসব কথা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। অথচ তিনি যুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ঘটনার উপস্থিতিকেই পরাজয়ের জন্য দায়ী করা শুরু করলেন। সিসিলি জয়ের ব্যাপারে রােমানদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা এবং রক্তপাতের ইতিহাস ছিল। সার্ডিনিয়া এবং করসিকায় রােমের জবরদখল যখন চলছিল, তখনাে কার্থেজ অসহায় পরিস্থিতিতেই ছিল, তাদের সেই নিষ্ক্রীয় প্রতিক্রিয়াই হয়তো হ্যামিলকারকে দ্বিগুণ উৎসাহে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল। হ্যামিলকার সিদ্ধান্ত নিল, রােমের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পাবার স্বপ্ন দেখার আর কোনাে প্রয়ােজন নেই। নির্মম আর নিষ্ঠুর এক বন্ধুরূপী শত্রুর হাতে কার্থেজীয়দের ধীরে ধীরে মৃত্যু ছাড়া আর কোনাে উপায় নেই। আর তাই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার পরে কার্থেজের উচিত আবার রােমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাে, রােমের বিরুদ্ধে বলার জন্য কার্থেজকে হতে হবে শক্তিশালী। সিসিলিতে তারা যা হারিয়েছে তার সমপরিমাণ পাওনা অন্য কোনাে জায়গা থেকে তারা মিটিয়ে নিতে পারে।

স্পেইনে কার্থেজীয়দের উপনিবেশ স্থাপন ও শক্তিবৃদ্ধি : খ্রিস্টপূর্ব ২৩৬ সালে হ্যামিলকার সত্যি সত্যিই পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন, তিনি কার্থেজীয় সরকারকে বাধ্য করলেন তাকে প্রধান করে স্পেনের দিকে একটি বাহিনী পাঠাতে। স্পেনের সীমানার কাছে আগে থেকেই কার্থেজের উপনিবেশিক ঘাঁটি ছিল, আর হ্যামিলকারের পরিকল্পনা ছিল ওসই সমস্ত ঘাঁটি থেকে যাত্রা করে স্পেনের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত দখল করে উপনিবেশ তৈরি করা। আর তার পরের কয়েক বছর, রােম যখন ইলিরিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে কার্থেজীয়দের অনুপ্রবেশের মাধ্যমে হ্যামিলকার নতুন এক কার্থেজ সাম্রাজ্য তৈরি করে ফেলল। আর কৃষ্টির প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি তৈরি করলেন বারসিনাে নগর, এখন যে নগর বারসিলােনা নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ২২৮ সালে স্পেনেরই এক আদিবাসী জাতির সঙ্গে যুদ্ধে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। হ্যামিলকারের জামাতা হাসদ্রুবাল তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এবং স্পেনের মধ্যে আগের চেয়েও বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে কার্থেজীয় শাসনের পত্তন করতে থাকেন। তিনি আরেকটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ল্যাটিন ভাষায় ছিল কার্থাজো নােভা, যার অর্থ হলাে “নতুন কার্থেজ”, এবং পরে আমরা সেই নগরের নামােল্লেখ পাই কার্থেজিনা হিসেবে। রােমানরা যখন ইলিরিয়া এবং সিসালপাইন গাউল থেকে সমস্ত অপশক্তির অপসারণ করল, তখন বিস্মত হয়ে দেখল যে কার্থেজীয়রা ততদিনে আগের যে কোনাে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। স্পেনে যখন কার্থেজীয় বাহিনী প্রথম প্রবেশ করেছিল তারা বলতে গেলে পাত্তাই দেয়নি। বরং রােমানরা মনে করেছিল যে শাসনের কেন্দ্র থেকে দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কার্থেজ বাহিনী থাকার একটা সুবিধা আছে। কিন্তু অবশ্যই তাদের এতটা উত্থান রােমানরা কল্পনাও করতে পারেনি। আর তাই তখন তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য রােমকে পদক্ষেপ নিতে হলাে। 

হ্যানিবলের উত্থান ও দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সূচনা : রােমান শাসকেরা তখন হাসদ্রুবালকে মেনে নিতে বাধ্য করল যে কার্থেজীয় ক্ষমতার দৌরাত্ম এব্রো নদীর অন্য পারেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। তার সঙ্গে আরাে শর্ত যােগ করা হলাে যে, এব্রো নগর থেকে আশি মাইল দক্ষিণে অবস্থিত গ্রিক নগর সাগুনটামকে স্বাধীন করে দিতে হবে। খ্রিস্টপূর্ব ২২১ সালে হাসদ্রুবালকে বন্দি করা হলাে, কিন্তু রােমানরা ভেবেছিল যে তাকে বন্দি করলেই স্পেনের জন্য আর কোনাে বিপদ থাকবে না, তাদের সেই চিন্তা ছিল ভুল। হ্যামিলকার বারকার ছিল এক সন্তান, সেই তরুণ পুত্রের নাম হ্যানিবল, তার বয়স তখন ছাব্বিশ আর শাসন বা যুদ্ধের দায়িত্ব নেবার জন্য উপযুক্ত। হ্যানিবল খ্রিস্টপূর্ব ২৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সেই ছিল একমাত্র পুত্র যার পিতা তাকে দখলের পর স্পেনে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তাকে রােমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা করিয়ে রোমকে চিরশত্রু হিসেবে বুঝাতে শেখান। পরাক্রমশালী পিতার কাছেই তখন বালকটির যুদ্ধের বিচিত্র কৌশলের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। তারপরে দেখা যায় যে হ্যামিলকার বারকার ভাগ্যেও ম্যাসিডােনের ফিলিপের মতােই সম্মান জোটে, তিনি বীর হলেও তার সন্তান বীরত্বে তাকেও ছাড়িয়ে যায়। হাসদ্রুবালের মৃত্যর সাথে সাথেই পুত্র হ্যানিবল স্পেন দখলের পরিকল্পনায় ব্রত হন এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টায় নামেন। দুই বছর ধরে তিনি তার সেনাবাহিনীকে পরীক্ষা করতে থাকেন। তিনি প্রথমে স্পেনের সেইসব জায়গায় হামলা চালিয়ে দখল করেন যা কখনােই কার্থেজীয়দের দখলে ছিল না। কার্থেজীয় সেনাবাহিনী একজন সুযােগ্য নেতার হাতে পড়ে সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকল্প নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। সাগুন্টাম তখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ভীত হয়ে গেল। কারণ সাগুন্টামের অধিবাসীরা জানত যে হ্যানিবলের একমাত্র উদ্দেশ্য ধ্বংসের মাধ্যমে দখল করে নেয়া এবং এখন এগােতে থাকলে তার সামনে প্রথমেই পড়বে তাদের নগর। তাই তারা রােমের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন পাঠাল। রােম সে আহ্বান পাওয়া মাত্র একদল কূটনীতিককে তরুণ হ্যানিবলের ঘাঁটিতে পাঠাল, তারা তাকে বােঝালেন যে তখনই যদি তিনি সংযত না হন তবে নিজের জন্য এবং সবার জন্যই প্রবল ধ্বংস ডেকে আনবেন। কিন্তু দুর্ধর্ষ কার্থেজীয় নেতা তাদের অনুরােধে কান দিলেন না। খ্রিস্টপূর্ব ২১৯ সালে হ্যানিবল স্বেচ্ছায় রােমান প্রজাতন্ত্রের উপর হামলা করলেন। এবং সাগুন্টামে ঘাঁটি করার পর আট মাস ধরে যুদ্ধ চালিয়ে নগরটা দখল করে ফেললেন। রােমান শাসকেরা হ্যানিবলের কাছে আরেক দফা কূটনীতিক পাঠাল, কিন্তু হ্যানিবল যেন জানতেনই, তাই সাজিয়ে রাখা কথাবার্তা বলে দিলেন তাদের; তিনি তাদের হুমকিও দিলেন যে ভালােয় ভালােয় তারা যেন তার ঘাঁটি ছেড়ে চলে যায় আর তা না হলে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না। এভাবে হ্যানিবল দুটো জিনিস অর্জন করলেন। প্রথমত, তিনি রােমকে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করতে বাধ্য করলেন এবং দ্বিতীয়ত, কার্থেজ বাহিনীকেও তিনি বাধ্য করলে তাকে যুদ্ধে সহায়তা দিতে, যেখানে কার্থেজের শাসক তখন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাননি এবং হ্যামিলকারের এই একরােখা উত্তরাধিকারীটিকে পছন্দও করতেন না। রােম যখন রুষ্ট হলাে তখন তাদের আক্রোশ এত বেশি হয়ে উঠল যে কার্থেজদের মােকাবেলা করা ছাড়া আর কোনাে পথ রইল না। এভাবেই দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সূচনা হলাে।

হ্যানিবলের সসৈন্যে ইতালিতে আগমন : খ্রিস্টপূর্ব ২১৮ সালে ৯২,০০০ সৈন্যের বাহিনী (এবং বেশ কিছু হাতি) নিয়ে হ্যানিবল এব্রো (Ebro) নদী পেরিয়ে এলেন, যেই নদীটি ছিল স্পেনের উত্তরে তাদের দখলের সীমানা, এবং তারপরে তারা আরাে উত্তরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। সেদিকে অগ্রসর হতে হতে যত আদিবাসীদের সামনে পেলেন তাদের সঙ্গেও কার্থেজীয় বাহিনীকে লড়ে যেতে হলাে। তিনি তাদের সঙ্গে লড়ে ধীরে সুস্থে অগ্রসর হতে লাগলেন, তার কোনাে তাড়া ছিল না, তিনি কেবল চাইতেন যে রােমের শাসকেরা যেন তার গতিবিধি নিয়ে আগে থেকে কোনাে অনুমান না করতে পারে। তারা পারেওনি। রােমান শাসকেরা ভেবেছিল যে তারা সমুদ্রের ওপারে কার্থেজীয়দের সঙ্গে লড়বে, তারা লড়বে আফ্রিকায় বা স্পেনে, আর তাই সেসব জায়গায় তারা সৈন্যবাহিনীও পাঠিয়ে দিয়েছিল। যে সেনাবহিনীটা স্পেনে পাঠানাে হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন রােমান কনসল, পাবলিয়াস কর্নেলিয়াস সিপিও। পনেরাে বছর আগে সার্ডিনিয়া আর করসিকায় যিনি কার্থেজীয়দের সঙ্গে বীরত্বের সাথে লড়েছিলেন এবং তাদের সেসব জায়গা থেকে উৎখাতও করেছিলেন, তখন তারই পুত্র গিয়েছে হ্যামিলকার বারকার পুত্রের সঙ্গে লড়াই করতে। কিন্তু যখন সিপিও সমুদ্রপথে ইতালি ছেড়ে চলে গেল এবং স্পেনের উদ্দেশে রওনা দিল, হ্যানিবল হঠাৎ করেই গর্জে উঠলেন। সমাধান হয়ে যাওয়া বিষয়গুলােকে তিনি অস্বীকার করলেন। গ্রিক আর রােমানরা তাদের সমুদ্রযানগুলাে কার্থেজের দেয়াল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল; যাই হােক, হ্যানিবল স্পেনে শত্রুকে মােটেও অপেক্ষমান রাখতে চাননি, তিনি তখন হামলা করে বসলেন রােমে। পিরেনিসের পূর্বদিকের শেষ প্রান্ত দিয়ে ঘুরে তিনি দ্রুত দক্ষিণ গাউল পেরিয়ে গেলেন। রন নদীর কাছে দুর্ধর্ষ গ্যালিক জাতি তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। কিছু জাহাজের পিছন থেকে যখন গাউলরা আক্রমণ করল তখন হ্যানিবল তাদের অলক্ষে কিছু জাহাজ নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। সেখানে তাদের চরমভাবে পরাজিত করে হ্যানিবলের বাহিনী সােজা আল্পসের দিকে চলে গেল। সত্যি কথা বলতে কী, রােমানরা উত্তর দিক থেকে কোনােরকমের কোনাে বিপদের আশঙ্কা করেনি। সেদিকে আল্পস পর্বত যে প্রশস্ত আর উঁচু দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সেদিক থেকে শত্রুর আক্রমণ তাই তাদের চিন্তার বাইরে ছিল। হ্যানিবল ঠিক সেই জায়গা দিয়েই আক্রমণটা করেছিলেন। হ্যানিবল তার শক্তিশালী বাহিনী এবং ঐতিহাসিক হাতির বহরকে আল্পস অতিক্রম করতে বাধ্য করেছিলেন। সিপিও যখন স্পেনে পৌঁছলেন, তার নিশ্চয় নিজেকে বােকা বােকা লাগছিল। কারণ তিনি দেখলেন, যে শক্রর আশায় সেখানে গেছেন তারা আর সেখানে নেই। তবে তিনি তাড়াতাড়ি করে শত্রুকে ধাওয়া করলেন, রন (Rhone) নদীতে তিনি যখন পৌঁছেছিলেন, ততক্ষণে হ্যানিবল তার বাহিনী নিয়ে রন নদী পেরিয়ে চলে গেছেন। সিপিও অচিন্তনীয় কার্থেজীয়দের পিছনে পিছনে দুর্গম আল্পস অতিক্রম করার ঝুঁকি নেননি। তিনি তখন সমুদ্রপথে ইতালিতে ফিরে আসেন, ভেবেছিলেন সিসালপাইন গাউলে তার শত্রু হ্যানিবলের মুখােমুখী হবেন তিনি, অবশ্য তখনাে যদি দুর্গম আর বরফের স্তর অতিক্রম করে দুর্ধর্ষ হ্যানিবলের বাহিনীর কোনাে অস্তিত্ব থাকে, তবে। হ্যানিবল ভালােভাবেই পার্বত্য অঞ্চল অতিক্রম করে এসেছিলেন। যদিও সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ বড়াে সংখ্যক সৈন্য তিনি হারিয়েছিলেন বিভিন্ন আদিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে। আল্পসের শরকাল হলেও বরফের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে অপারগ বেশ কিছু হাতিও হারিয়েছিলেন তিনি। পাঁচ মাস আগে স্পেন থেকে তিনি যত সৈন্য আর হাতি নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন, তার এক তৃতীয়াংশেরও কম সৈন্য ও হাতি নিয়ে তিনি অবশেষে আল্পস পেরিয়ে তিনি ইতালিতে পৌঁছলেন। তবে প্রকৃতপক্ষে সেই এক ততীয়াংশ ছিল তার সৈন্যবাহিনীর সেরা সৈন্যের দল। যে কোনাে পরিস্থিতিতে তারা তাদের নেতার আদেশে ঝাপিয়ে পড়তে গর্ববােধ করত। তাদের মধ্যে থেকেই একজন পরবর্তী কালে ইতিহাসে সর্বকালের জন্য শ্রেষ্ঠ সেনাপ্রধান হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। 

রোমানদের পরাজয় ও সিসালপিয়ান গাউল হারানো : খ্রিস্টপূর্ব ২১৮ সালে অপমানিত এবং অপদস্ত সিপিও ২৬,০০০ সৈন্যের এক সেনাবাহিনী নিয়ে সিসালপাইন গাউলে ঘাঁটি গাড়লেন, তারপর সেখান থেকে ক্রোধে পাগলপ্রায় হয়ে উত্তরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। সৈন্যবাহিনীর সবচেয়ে প্রথমে সামনে পড়ল টিসিনাস নদী, উত্তরের দিকে থেকে ওই নদীটা পাে নদীতে এসে পড়েছে। আর সেখানেই তাদের প্রতিপক্ষ তাদেরকে ধরাশায়ী করে দিল, রােমানরা তাদের কাছে পরাজিত হলাে। সিপিও নিজেও বেশ আহত হলেন আর কাহিনি অনুযায়ী, তার উনিশ বছর বয়সী পুত্র আহত সিপিওকে উদ্ধার না করলে তিনি মারাই যেতেন। সিপিওর উত্তরাধিকারী এই পুত্রের বিষয়ে আমরা পরে আরাে জানব। সিপিও এবং তার সৈন্যবাহিনী পাে নদী পার হতে পেরেছিলেন এবং পূর্বদিকে আরাে খানিকটা এগিয়ে ট্রেবিয়া নদী পর্যন্ত গিয়েছিলেন, এই নদীটি দক্ষিণ দিক থেকে পাে নদীতে এসে মেলে। সেখানে সিপিও তার সঙ্গীসাথি সেনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, বিশেষ করে টিবারিয়াস সেমপ্ৰােনিয়াস লংগাসের জন্য, যথন তাকে হ্যানিবলের মতাে দুর্ধর্ষ সেনাপ্রধানের মুখােমুখী হতে হবে। ওই নদীটাই তাদের দুই জাতিকে পৃথক করে রেখেছিল; পূর্বদিকে ছিল রােমানরা এবং পশ্চিমে কার্থেজীয়রা। হ্যানিবল চেয়েছিলেন যুদ্ধ; তবে তিনি রােমানদের ক্ষমতা এবং তার সামনে নিজের সৈন্যবাহিনীর অস্তিত্ব নিয়ে কিছুটা চিন্তায় ছিলেন; যদিও রােমানরা যদি যুদ্ধ শুরু করে তবে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে তাদের পর্যুদস্ত করবেন, এ ব্যাপারেও তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর তাই যখন সেমপ্রােনিয়াসের সেনাবাহিনী এসে পৌঁছল, হ্যানিবল তাদেরকে যুদ্ধের জন্য সুগঠিত এবং দলভূক্ত হতে এক চুলও বাধা দিলেন না। যুদ্ধের আগে একত্র হয়ে দল গঠন এবং কার্যকলাপ নিয়ে ভাবা অবশ্যই যুদ্ধে উত্তম রূপে লড়ার লক্ষণ। হ্যানিবলের সঙ্গে সিপিওর যুদ্ধের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবং তাদের প্রবল শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও আবার তাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্থ হননি। পক্ষান্তরে, সিমপ্রােনিয়াস হ্যানিবলের মুখােমুখী হওয়ার সুযােগ কখনাে পাননি, তাই তিনি তার সঙ্গে যুদ্ধের জন্য উৎসাহী এবং উত্তেজিতও ছিলেন বটে। তাই যথাসময়ে যুদ্ধে নামতে তিনি একটুও ভাবেননি। হ্যানিবলের পরিকল্পনা এমনটাই ছিল যে রােমানদেরকে তিনি পারতপক্ষে নদী। পার হবার মতাে উপলক্ষ্য তৈরি করে দেবেন। তার সৈন্যবাহিনীর একটা অংশকে রােমানদের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দিয়ে তিনি সেটা করতে পেরেছিলেন। রােমানরা তৎক্ষণাত কার্থেজীয় বাহিনীর উপরে হামলা করল, হামলা যতটা পারে ঠেকানাের পরে কার্থেজীয় বাহিনী পালিয়ে গেল। রােমানদের আক্রোশ গেল না, তারা জয়ের আশায় তাদের পিছনে ধাওয়া করল এবং নদীর অপর প্রান্তে চলে গেল। তখন শীতকাল আর তাই পানি ছিল বরফশীতল। রােমানরা নদী পেরােতে গিয়ে ভিজে জবজবে হয়ে গেল এবং শীতে কাবু হয়ে পড়ল। আর ওদিকে কার্থেজীয় বাহিনীর বড়াে অংশ শুকনাে ডাঙায় তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। তখন রােমানরা বুঝতে পারল যে বাহিনীর সামান্য একটি অংশ লেলিয়ে দিয়ে তাদের সেখানে ডেকে আনা হয়েছে বড়াে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করানাের জন্য। কিন্তু তারপরেও রােমান সৈন্যেরা সাহসের সঙ্গে লড়ে গেল। হ্যানিবলের বাহিনীকে তারা একের পর এক সারিবদ্ধভাবে আক্রমণ করতে লাগল। কিন্তু হ্যানিবলের বাহিনী তাদের হাতির সাহায্যে এবং আগে থেকে তৈরি করে রাখা পরিকল্পনা মতে রােমানদের অনেক বেশি সূক্ষ্মভাবে আক্রমণ করতে পারল। হ্যানিবলের ছােটো ভাই, মাগাে, যাকে হ্যানিবল দুই হাজার সৈন্যের এক বাহিনী দিয়ে রেখেছিলেন, সেই সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি রােমান বাহিনীকে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করলেন। রােমান বাহিনী যতক্ষণ পরল যুদ্ধ করে গেল, তারপর বাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হারিয়ে শােচনীয় পরাজয় বরণ করল। পাে নদীর আশেপাশে কেবল দুটো নগর, প্ল্যাসেনশিয়া এবং ক্রিমোনা ছাড়া সিসালিপাইন গাউলের বাকি পুরাে অংশ রােমানদের হাতছাড়া হয়ে গেল, যে নগরগুলাে তারা মাত্র চার বছর আগে যুদ্ধের মাধ্য দখল করেছিল। গাউলরা এই বিজয়কে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখল এবং তখনই হ্যানিবলের সঙ্গে হাত মেলাল। হ্যানিবল ইতালিতে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন তার চেয়ে প্রাপ্তি অনেক বেশি হয়েছিল তার। সিপিও, যিনি হ্যানিবলকে কিছুতেই থামাতে পারেননি, তাকে তখন স্পেনে পাঠিয়ে দেয়া হলাে যে হ্যানিবলের আড়ালে সেখানে বসে তিনি তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেন কি না। আর ঠিক কখন অন্যান্য সেনাপ্রধানেরা দুর্ধর্ষ কার্থেজীয়দের বিরুদ্ধে কিছু করার পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

ফ্লেমিনিয়াসের নেতৃত্বে সেনাভিযান ও পুনরায় রোমানদের পরাজয় : রােমানরা যদি আরাে আগে এতটা গুরুত্ব দিয়ে তার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করতে শুরু করত তবে এতদিনে অনেকটা এগিয়ে যেত। হ্যানিবল তখন দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছেন তাই যে কোনাে মূল্যে রােমানদের তখন তাকে থামানাে জরুরি হয়ে পড়ল। সিসালপাইন গাউল দখলের কৃতিত্ব অর্জনকারী ফ্লেমিনিয়াসের অধীনে একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী তাকে ঠেকানাে এবং ধ্বংস করার জন্য পাঠানাে হলাে। হ্যানিবলের মুখােমুখী হওয়ার জন্য ফ্লেমিনিয়াসকে খুব দূরে যেতে হলাে না। কার্থেজীয় সেনাপ্রধান তখন উত্তর এট্রুরিয়া পেরিয়ে রােমান শক্তিকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে খ্রিস্টপূর্ব ২১৭ সালে ট্রাসিমিনাস লেকের কাছে দিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সেই যাত্রায় হ্যানিবল তার একটা চোখ হারিয়েছিলেন, কিন্তু বাকি একটি মাত্র চোখ দিয়ে তিনি এতটাই ভালাে দেখতেন যা বেশিরভাগ রােমান নৌ বাহিনী প্রধান দুই চোখ দিয়েও ভালাে করে দেখতে পেতেন না। ফ্লেমিনিয়াস তখন জয়ের আশায় তুমুল উত্তেজনার মধ্যে ছিলে কিন্তু রােমান বাহিনীর সেনাপ্রধান হিসেবে চিন্তা করলে তিনি মােটামুটি দুর্বল প্রকৃতির একজন সেনাপ্রধান ছিলেন। কার্থেজীয় বাহিনীর মুখােমুখী হয়ে তাদের পরাজিত করার সংকল্পে তিনি এতটাই বিহ্বল ছিলেন যে আগে থেকে পরিকল্পনামাফিক চর পাঠিয়ে খবর সংগ্রহ করা এবং সেভাবে তৈরি হওয়া, এসব বিষয়ে তিনি সময় নষ্ট করতে চাননি। আর ওদিকে হয়তো হ্যানিবল ততদিনে ফ্লেমিনিয়াসের বিষয়ে এই সমস্ত জেনেছিলেন বলেই তার বিরুদ্ধে আরাে ভালােভাবে সদাপ্রস্তুত থাকতে পেরেছিলেন। ট্রাসিমিনাস লেকের চারদিক দিয়ে ঘিরে রাখা একটি সরু রাস্তা যা আরেকদিকের পাহাড়ে গিয়ে পৌঁছেছে, সেই রাস্তাটি হ্যানিবলের চোখে পড়ল। তিনি তার সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী সেই পাহাড়ের পিছনে অপেক্ষমান রাখলেন। রােমান সেনাবাহিনী অপেক্ষমান শত্রুর ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অবস্থায় ভােরবেলা সেই রাস্তায় উপস্থিত হলাে। চারদিকে কুয়াশার উপস্থিতি শত্রুকে আড়াল করার ব্যাপারে সাহায্য করল। রােমান বাহিনী যখন সরু রাস্তা পার হবার জন্য একটি লম্বা লাইনে হাঁটছিল, অতর্কিতে কার্থেজীয়রা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের সকলকে জবাই করে ফেলল। রােমানরা কিছু বুঝে উঠতেও পারল না এবং কোনাে পালটা আক্রমণ করারও সুযোগ পেল না। একেকজন কার্থেজীয় সেনার হাতে দশ জন করে রােমান সৈন্য নিহত হলাে। এভাবে ফ্লেমিনিয়াসসহ পুরো বাহিনীই উজাড় হয়ে গেল সেই রাস্তায়।  রােমানদের বিস্ময়ের সীমা থাকল না, তারপরেও তারা হ্যানিবলের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় আরেকটি বাহিনী পাঠাল, আগের বাহিনীর চেয়েও বড়াে আর তাদের পরাজয়ও হয়েছিল আগের চেয়েও ভয়াবহ। রােমানরা তারপর আর ততটা আক্রোশে ভেগেনি; বরং তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। গ্যালিক আক্রমণের পরের দুই শতাব্দীতে তারা কখনাে এমন ভয়াবহ বাসের মধ্যে পড়েনি। হ্যানিবলকে তাদের কাছে এক ভয়ানক যাদুকর মনে হচ্ছিল, যার সামনে কোনাে শত্রই টিকতে পারে না।

ফ্যাবিয়াস ম্যাক্সিমাসের দায়িত্ব রোমান সেনাবাহিনী : রােমানরা তখন কুইন্টাস ফেবিয়াস ম্যাক্সিমাস নামে একজন নেতাকে নিয়ােগ করল। যে সেনাপ্রধান আশি বছর আগে গাউলদের শােচনীয় পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করেছিলেন, মাক্সিমাস ছিলেন তারই উত্তরাধিকারী। ফেবিয়াস ম্যাক্সিমাস সরাসরি হ্যানিবলের মুখােমুখী হওয়ার জন্য কোনাে পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। তিনি চুপচাপ হ্যানিবলের গতিবিধি অনুসরণ করছিলেন এবং নিজস্ব সেনাবহিনী নিয়ে হ্যানিবলকে আক্রমণের উপযুক্ত একটি সুযােগের সন্ধানে ছিলেন। হ্যানিবল তখন সােজাসুজি রােমের দিকে রওনা দিতে পারতেন কিন্তু তিনি কী করবেন তিনি তা ভালােই জানতেন। অতর্কিতে হামলা করে তিনি রােমান সৈন্যদের মাঠের উপরেই ধরাশায়ী করে ফেলতে পারতেন কিন্তু তার সৈন্যবাহিনী ছিল ছােটো এবং নিজ এলাকা থেকে তারা তখন অনেক দূরে। তাই তিনি নিজের ছােটো বাহিনীর উপরে ভরসা করে, অন্য কারাে সাহায্য ব্যাতিত রােমকে হুমকির মুখে ফেলতে সাহস পেলেন না। আর এই সাহায্য তিনি প্রত্যাশা করলেন ইতালিরই বিভিন্ন নগরের সম্মিলিত সংগঠনের কাছে। সাহায্যের আশায় তিনি প্রথমে পূর্ব এবং পরে দক্ষিণে ভ্রমণ করলেন। রােমের চারদিকে বিভিন্ন জাতির সঙ্গে আঁতাতের ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন আদিবাসীদের এলাকায় গেলেন। তিনি বিশেষ করে মিলিত হলেন স্যামনিয়ামদের সঙ্গে, যাদের তিনি রােমের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। আর তাদের এই কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তার কাছে বন্দি ইতালির সৈন্যদের তিনি কোনাে পণ ছাড়াই মুক্ত করে দিলেন। আর রােমের আশেপাশের সমস্ত জাতিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে বন্ধুবিহীন রােমকে তিনি ধ্বংস করে দেবার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু এই ব্যাপারে, যে কারণেই হােক, হ্যানিবলের পরিকল্পনা সেভাবে কাজ করল না। রােমের সেনাবাহিনী সামান্য ধাক্কা খেতে পারে কিন্তু মনে রাখতে হবে যে রােম পরিচালিত হতাে একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক পদ্ধতিতে, কেবল অস্ত্র হাতে লড়াই করে টিকে থাকা জাতি ছিল না তারা। ইতালির অন্যান্য নগরগুলাে রােমের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী সরকারের অধীনে রােমের উন্নতিকে প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখত। আশেপাশের জাতিগুলাে জানত যে তারা যদি রােমের বিরুদ্ধে হ্যানিবলের সঙ্গে হাত মেলায়, তারপরেও তারা স্বাধীন হতে পারবে না। তারা কেবল রােমের পরিবর্তে কার্থেজের লােকদের অধীনে চলে যাবে এবং তারা মনে করত যে সেটা রােমের অধীনে থাকার চেয়ে ভয়ঙ্কর। আর তাছাড়া, ফ্যাবিয়াস এমন এক পদক্ষেপ নিলেন যা রােমের বিরুদ্ধে কিছু করতে হ্যানিবলকে সবচেয়ে কম সুবিধা দিতে পারবে। আর সরাসরি হ্যানিবলের বাহিনীর উপরে হামলা না করে রােমের বাহিনী যা করল তা হলাে, তারা ফ্ল্যালাংক্সের কাছাকাছি চলে গেল, তারপর একদিকে খানিকটা ছন্নছাড়া করল আবার আরেকদিকে একটু হামলা চালাল, এভাবেই চলতে লাগল। ফ্যাবিয়াস পারতপক্ষে সম্মুখযুদ্ধ এড়িয়ে চলতেন, সেক্ষেত্রে হ্যানিবল তাকে যতভাবেই উস্কানাের চেষ্টা করুন না কেন, তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। যুদ্ধ ঠেকিয়ে রাখার এই প্রবণতাকে ফ্যাবিয়াসের ঢিলেমি হিসেবে দেখা হতাে। এটা থেকে ফ্যাবিয়াসকে ‘ঢিলে’ হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল (আর তাই আজও কেউ যখন কোনাে কাজে ঢিলেমি করে তবে তার চিন্তাধারাকে ফ্যাবিয়াসের নিয়ম বলা হয়)। ফ্যাবিয়াস নিজস্ব পদ্ধতিতে হ্যানিবলের সেনাবাহিনীর মােকাবেলা করছিলেন, কিন্তু একই নিয়মে যখন মাসের পর মাস পার হতে লাগল আর রােমানরা ফ্যাবিয়াসের উপরে অধৈর্য হয়ে গেল। ফ্যাবিয়াসের নিয়ম কানুন রােমান শৌর্যের প্রতি অবমাননাকর মনে হতে লাগল তাদের। পরপর দুবার হ্যানিবলের কাছে হেরে যাবার। জ্বালাটা মিটিয়ে নেবার মতাে যথেষ্ট সময় পেয়েও যখন রােমানরা সে ব্যাপারে কিছুই করল না তখন বােঝাই যাচ্ছিল যে হ্যানিবল আসলে রােমানদের তেমন একটা ভয় পাননি। তাই বেশিরভাগ রােমান মনে করছিল যে হ্যানিবলের বাহিনীর উপরে তাদের শক্তপােক্ত আক্রমণ করা উচিত। তখন অবস্থাদৃষ্টে এমনই মনে হচ্ছিল যে ফ্যাবিয়াস কাঙ্কটেটর আসলে ভীতু, রােমান জাতির বীরত্বের ইতিহাসে যেন এক কলঙ্ক তার নাম।

ক্যানিতে রোমানদের নির্মম পরাজয় : ফ্যাবিয়াসের দীর্ঘসূত্রতার কড়া সমালােচকদের মধ্যে একজন ছিলেন গাইয়াস ট্যারেনশিয়াস ভ্যারাে, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ২১৬ সালে কনসল নির্বাচিত হন; তার সঙ্গে আরেকজন জ্ঞানী ব্যক্তি লুসিয়াস এইমিলিয়াস পলাসও কনসল নির্বাচিত হন। ফ্যাবিয়াসকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে তখন ওই দুই কনসল মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন যে হ্যানিবলের বিরুদ্ধে লড়বেন এবং এজন্য যুদ্ধ ঘােষণা করবেন। রােম থেকে ২০০ মাইল দক্ষিণ পূর্বে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের তীরবর্তী অঞ্চল ক্যানিতে তারা হ্যানিবলের মুখােমুখী হলেন (হ্যানিবল সে বছর সৈন্যবাহিনী নিয়ে ইতালির এ মাথা ও মাথা সফর করছিলেন। আল্পস পেরিয়ে আসার পরেই পার হয়েছিলেন। ইতালির অর্ধেক দূরত্ব)। দুইজন কনসল মিলে একযােগে সৈন্যবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন। একদিন একজন এবং পরের দিন আরেকজন, এভাবে পর্যায়ক্রমে তারা নির্দেশনা দিতে লাগলেন। একদিন যেদিন ছিল ভ্যারাের দায়িত্ব, তিনি যুদ্ধে নেমে পড়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। সেম্পােনিয়াস আর ফ্লেমিনিয়াসের তুলনায় তার ছিল অনেক বড়াে সেনাবাহিনী। হ্যানিবলের ৫৬০০০ সৈন্যের জায়গায় তার ছিল ৮৬০০০ সৈন্য। হ্যানিবলও নিজের সমস্ত দুর্বলতা জেনেই ভ্যারাের মােকাবেলা করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। কার্থেজের বাহিনী রােমানদের বাহিনীকে ঘিরে অর্ধবৃত্তাকারে এগিয়ে এল। রােমানরা যখন পালটা আক্রমণের ভঙ্গি নিয়ে তাদের দিকে বাড়ল তখন তারা পিছনে সরে গিয়ে সােজা লাইন করে দাঁড়াল। আর তারপর তাদের লাইন এঁকেবেঁকে পেছনে সরে যেতে লাগল। কিন্তু লাইনটি সরে গেলেও সারির শেষপ্রান্তের সৈন্যেরা কিন্তু নিজের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে ছিল। রােমানরা সারির শেষ প্রান্তের দিকে খেয়াল করেনি। কার্থেজীয়দের সারির মধ্যভাগকে লক্ষ করে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল; তখন এমন অবস্থা হলাে যে আরেকটু এগােলেই কার্থেজীয়দের সারিটা ভেঙে যাবে আর যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু রােমানদের অতিরিক্ত উৎসাহে এগিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে কার্থেজীয়দের সারিটি একটি ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের আকৃতি ধারণ করল। হ্যানিবলের আদেশে ঠিক তখনই সারির শেষ দুই প্রান্ত নিজেদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সংখ্যায় অধিক রােমান সৈন্যদের তখন এমনভাবে ঘিরে ফেলা হলাে যে বৃত্তের মাঝখানে তলােয়ার তুলে ধরা তাে দূরের কথা, গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকাই তাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। দলের পিছন দিক থেকে রােমান সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করল তারা। রােমান সৈন্যবাহিনী যেন তখন একটা বস্তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে আর হ্যানিবল বস্তার মুখটা শক্ত করে আটকে দিয়েছেন। বস্তার ভেতরেই তারা হাজারে হাজারে মারা পড়ল। কনসল পাউলাসও তাদের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করল। বলতে গেলে সেই বৃত্ত থেকে খুব কম সৈন্যই পালিয়ে বাঁচতে পারল। ভ্যারাে ছিলেন তাদের মধ্যে একজন যারা পালাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু রােমে ফিরে গিয়ে নিজের মুখ দেখানাে লজ্জায় তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন। বীরত্বের দিনগুলােতে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী রােমের জন্য এই পরাজয় ছিল শােচনীয় এক পরাজয়। রােমানরা তখন তৃতীয় একটি সৈন্যদল পাঠাল হ্যানিবলের উদ্দেশ্যে। তৃতীয় সেনাবাহিনীটি ছিল আগের দুইটির থেকেও শক্তিশালী, আর দুঃখজনক হলেও সত্য যে হ্যানিবলের হাতে আগের দুই দলের চেয়ে আরাে বেশি শােচনীয় পরাজয় হয়েছিল তাদের। আর তাই ক্যানি রােমানদের জন্য পর্যুদস্ত হবার স্থান হিসেবে পরিচিত হলাে। স্থানটি মানুষ বরাবর মনে রাখল এভাবে যে সেখানে একটি দুর্বল। সেনাবাহিনী অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি শক্তিশালী এক সেনাবাহিনীকে শুধু সেনাপ্রধানের দুর্দান্ত কৌশলের কারণে নির্মমভাবে হত্যা করে পরাজিত করেছিল। তবে এটা জানা দরকার যে এমন অনেক সেনাবাহিনীর উদাহরণ আছে যারা সংখ্যায় বেশি এবং শক্তিতেই বিপুল হওয়া স্বত্বেও তাদের চেয়ে কম শক্তিশালী এবং সংখ্যায় কম সৈন্যের সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছে। আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট পারস্যের সেনাবাহিনীকে এবং রবার্ট ক্লাইভ বিশাল ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন এরকম অবস্থাতেই, প্রতি ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনী ছিল প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক ছােটো। ব্যাপক সংখ্যক সেনাসদস্য নিয়ে গঠিত। সেনাবাহিনীকে সংগঠিত এবং পরিচালিত করা অনেক সময় একটি কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়, সে তুলনায় রবার্ট ক্লাইভ এবং আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের বাহিনী ছিল ছােটো এবং সুগঠিত। হ্যানিবল তৈরি করেছিলেন ঠিক সেইরকম এক সেনাবাহিনী যা প্রবল পরাক্রম আর অপরাজেয় রােমান বাহিনীকে পরাজিত করেছিল বহু শতাব্দী ধরে অপরাজেয় থাকার পরে, এবং হ্যানিবলের পরে অন্য কেউ পরের বহু শতাব্দীতেও রােমানদের পরাজিত করতে পারেনি। আর এ কারণে বহু মানুষ মনে করে যে হ্যানিবল হলেন পৃথিবীর সব কালের সবচেয়ে বেশি কৌশলী ও বীর সেনাপ্রধান। 

রোমের ঘুরে দাঁড়ানো ও দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে তাদের বিজয়

পরাজয়ের ফলাফল ও যুদ্ধের জন্য রোমের পুনরায় প্রস্তুতি গ্রহণ : ক্যানির যুদ্ধ রােমকে ধ্বংসের চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে গেল। বাকি পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে পরপর তিন বছর রােমানদের তিনটি ভরাডুবি দেখল, সকলেরই ধারণা হতে যাচ্ছিল যে তারা দুর্দমনীয় রােমের পতনের দৃশ্য দেখছে। ইতালীর কিছু কিছু রাষ্ট্রের সংগঠন ধরে নিল যে রােম হয়তোবা অচিরেই হ্যানিবলের সঙ্গে হাত মেলাবে এবং হেরে যাবার বা ধ্বংস হয়ে যাবার পরিবর্তে নতুন করে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। গুরুত্বপূর্ণ নগরগুলাের মধ্যে কার্থেজিয়া দের জন্য সবচেয়ে প্রথমে নিজেদের দরজা খুলে দিল কাপুয়া। আর রােমের বাইরে, দূরবর্তী অঞ্চলের মধ্যে কার্থেজীয়দের স্বাগত জানাল সাইরাকিউজ। ক্যানিতে যখন যুদ্ধ চলছিল, ওদিকে সিসিলিতে সাইরাকিউজের হায়ারো মৃত্যুবরণ করেন। তার পৌত্র হাইয়ের অনিমাস উত্তরাধিকারসূত্রে সিংহাসনে বসলেন এবং পক্ষ বদলের সিদ্ধান্ত নিলেন। রােমানদের যদি শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়, তাদের অবশ্যই সিসিলিকে দিয়ে দিতে হবে কার্থেজের হাতে। আর সাইরাকিউজ, যা নাকি রােমের অধীনে নেই, তার প্রতি কার্থেজীয়রা বিন্দুমাত্র মায়া দেখাবে না। তাই ওই মুহর্তে তার কাছে যা সহজ এবং যথাযথ মনে হলাে তিনি তাই করলেন, যা হলাে ভবিষ্যতে ভালাে কিছু পাবার আশায় কার্থেজীয়দের সঙ্গে যােগ দেয়া। রােমের উপরে আরাে বেশি হুমকিস্বরূপ যা হলাে, ম্যাসিডোন নগরও হ্যানিবলের সঙ্গে এক দল গঠন করল। তখন রােম তার সীমানার যেদিকেই তাকায় না কেন, কেবল শত্রু, যেন বিরূপ প্রকৃতি চারদিক থেকে তার দিকে ধেয়ে আসছে। কঠোর এবং বিপদসংকুল পৃথিবীর মুখােমুখী হয়ে রােম এমন এক সমাধানের উদাহরণ তৈরি করল যা বাকি পৃথিবীর কাছে তার আগে পর্যন্ত ছিল অচেনা। কোনাে শান্তিচুক্তির ধরণার মধ্যেই তারা গেল না। কোনাে রাষ্ট্রীয় সংগঠনের কথা শুনল না। এমনকি ক্যানিতে যে হাজার হাজার যােদ্ধা নির্বিচারে মারা পড়ল তাদের জন্য প্রকাশ্যে হা-হুতাশ বা বিষাদ উদযাপনের অনুষ্ঠানও আইন করে বন্ধ করল। ধৈর্য ধরে নিজের পরপর তিনটি পরাজয়ের এবং হাজার হাজার সৈন্যের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে রােম যা সিদ্ধান্ত নিল তা হলাে, নতুন একটি সেনাবাহিনী তৈরি করা। নতুন সেনাবাহিনীকে তারা ভয়ানক প্রশিক্ষণ দিতে লাগল যেন আশেপাশের এবং অতীতের সমস্ত শক্রর সঙ্গে একযােগে মােকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকে। শত বিজয়ও রােমকে এত সম্মান দিতে পারেনি যা তখন এনে দিল, ভরাডুবির দিনে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে রােম আবার ঘুরে দাঁড়ানাের জন্য মাথা তুলে ধরল।  রােম দেখল যে হ্যানিবল যদিও যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করার উর্ধ্বে, কিন্তু এমনিতে তাকে উত্যক্ত না করলে যুদ্ধের কোনাে সম্ভাবনা নাই। আর এই কারণে কার্থেজীয়দের সঙ্গে ইতালির মাটিতে আর কোনাে যুদ্ধের পরিকল্পনা রােম ত্যাগ করল। কিন্তু ইতালির বাইরে হ্যানিবলের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধানাের দ্বিগুণ প্রস্তুতি নিতে লাগল রােমানরা। স্পেনে তখন রােমানদের দুইজন সিপিওর অধীনে যুদ্ধ করতে হলাে, টিসিনাস নদীতে যে সেনাপ্রধান যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি, আর তার ভাই। স্পেনের তদকালীন শাসক হাসদ্রুবাল তখন ইতালিতে কার্থেজীয় রিইনফোর্সমেন্ট পাঠানো নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২১২ সালে যুদ্ধে ওই দুজন সিপিও সেনাপ্রধানের মৃত্যু হয়। কিন্তু সিপিওর উত্তরাধিকারী ও পুত্র, যিনি টিসিনাসে পিতার জীবন রক্ষা করেছিলেন, নিজ কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিলেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন বীর সেনাপ্রধান হিসেবে প্রমাণিতও হয়েছেন এবং পরের অনেকগুলাে বছরব্যাপী তিনি হাসদ্রুবালকে দমন করে রেখেছিলেন।

রোমানদের সিসিলি দখল ও আর্কিমিডিসের মৃত্যু : এর মধ্যে রােমান যুদ্ধজাহাজের বহর এড্রিয়াটিকে বসে দেখল যে ম্যাসিডােন থেকে হ্যানিবলের কোন রিইনফোর্সমেন্ট এসে পৌঁছয়নি। (অবশ্য হ্যানিবলের কৌশল চাতুর্যের মধ্যে এইটুকু ফাঁক ছিল যে তিনি কখনােই ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন স্থানে রােমানদের আধিপত্য কমানাের চেষ্টা করেননি। একজন কার্থেজীয় হিসেবে হ্যানিবলের প্রধান দুর্বলতা ছিল স্থলে সাংঘাতিক শক্তিশালী, অথচ জলে ভীষণ ভীতু)। রােম সেখানে অপেক্ষা করতে করতে ম্যাসিডােনে একটি কূটনৈতিক দল পাঠিয়েছিল এবং তার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছিল যে কার্থেজীয়দের তখন ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে তাদেরকে আক্রমণ করার কোনাে অভিপ্রায় নেই। এরপর এল সাইরাকিউজের অধ্যায়। ক্যানির বিজয়ের পরপরই রােমানরা মারকাস ক্লডিয়াস মারসেলাসকে কনসল নিয়ােগ করল। হ্যানিবল ইতালিতে প্রবেশের কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সিসালপাইন গাউলকে যারা পরাজিত করেছেন, তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী। ক্যানির বিজয়ের পরে হ্যানিবলের বাহিনী যখন ন্যাপলসের কাছাকাছি নােলা নগরে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়ে এগােতে থাকে, মারকাস ক্লডিয়াস তাদেরকে তাড়া করে উলটোদিকে ফিরিয়ে দিয়ে রােমানদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। হ্যানিবলের পরাক্রমশালী বাহিনীর জন্য এটা তেমন কিছুই না, তবে কার্থেজীয়দের জন্য নেতিবাচক কিছু করতে পারলেই রােমানরা উল্লসিত হয়ে উঠত। কাৰ্থেজিয়ান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে সাইরাকিউজে দখল প্রক্রিয়া চালানাের পরে মারসেলাস তখন সিসিলিতে ফিরে এলেন। কিছুই ঠিকমতাে চলছিল না। সাইরাকিউজের অনেক সৈন্য পূর্বে রােমান বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করত। পরে তারা কাৰ্থেজিয়ানদের সঙ্গে যােগ দেয়। তারা জানত যে রােমানদের হাতে ধরা পড়লে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ফাঁসিতে ঝােলানো হবে। আর তখন আর্কিমিডিস নামে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন ওই নগরের নাগরিক। তখন তার বয়স ছিল সত্তরের উপরে। প্রাচীন সভ্যতায় তার মতাে বড়াে বিজ্ঞানী এবং জ্ঞানী আর জন্মায়নি। আর্কিমিডিস বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। ভারী পাথর নিক্ষেপের যন্ত্র থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র পর্যন্ত আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। রােমানদের জাহাজগুলাে জ্বালিয়ে দেবার জন্য নির্দিষ্ট তরল বা পাথর ছিল তার কাছে। তিনি এমন কপিকল আবিষ্কার করেছিলেন যা দিয়ে রােমান জাহাজগুলােকে উলটে দেয়া যেত সহজেই কিংবা সূর্যের আলাে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত করে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়া তার কাছে কোনাে কঠিন বিষয় ছিল না। একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রতিপক্ষ হিসেবে একজন মাত্র মানুষের এই রুখে দাঁড়ানাে পরবর্তীকালের গ্রিক ইতিহাসবিদদের কাছে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। গ্রিক বুদ্ধি আর রােমান বীরত্বের মােকাবেলা ছিল সেটি। যাই হােক, মারসেলাসকে সাইরাকিউজ নগর থেকে হাত মােটামটি উঠিয়েই নিতে হলাে এবং দুই বছর ব্যাপী নগরটি থেকে দূরে অবস্থান করতে হলাে। আর সেই ফাঁকে কার্থেজীয়রা সিসিলির আরাে কিছু নগর দখল করে ফেলল। শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব ২১২ সালে এক রাতের উৎসবের সময়ে সিসিলির দেয়ালের কিছু অংশ হয় উদাসীনতায় অথবা অতিরিক্ত গর্বের কারণে অরক্ষিত রাখা হয়েছিল। রােমান সেনাবাহিনী সেই সুযােগে নগরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আর তারপর যথারীতি নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, জ্বালানাে-পােড়ানা চলতে লাগল। রােমানরা ক্রমাগত লুটপাট করতে লাগল কিন্তু মারসেলাসের কড়া নির্দেশ ছিল যে আর্কিমিডিসকে জীবন্ত বন্দি করে আনতে হবে, কারণ তার কাছে গুণীর কদর এবং সম্মান আছে। তবে প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, আর্কিমিডিস তখন আক্রমণ বা ঘেরাও নিয়ে কিছুই ভাবছিলেন না। বরং তিনি বালুর উপরে আঙুল দিয়ে দাগ কেটে কিছু সংখ্যা লিখছিলেন, তিনি তখন একটি জটিল জ্যামিতিক সমস্যার মধ্যে নিমজ্জিত ছিলেন। সেখানে একজন রােমান সৈন্য এসে তাকে তার সঙ্গে আসতে বললে গ্রিক বিজ্ঞানী রেগে যান এবং অধৈর্য হয়ে বলেন, আমার বৃত্তগুলাের বারােটা বাজিও না! আর এই কথা শুনে ক্রোধান্বিত সৈন্য তাকে হত্যা করে। এই ঘটনায় মারসেলাস খুব ভেঙে পড়েন, আর্কিমিডিসকে সম্মানের সঙ্গে সমাহিত করেন এবং তার পরিবার যেন সবরকম বিপদ থেকে মুক্ত থাকে সেটি নিশ্চিত করেন। আর তারপর নিজেও চলে যান সিসিলিতে, কার্থেজীয়দের হাত থেকে নগরটিকে উদ্ধার করতে।

ইতালিতে হ্যানিবল : কিন্তু ইতালি আর হ্যানিবলের তখন কী হলাে? রােমানরা শেষ পর্যন্ত তাদের উপযুক্ত শিক্ষা পেল। ইতালিতে তারা কার্থেজীয়দের সঙ্গে আর কোনাে যুদ্ধ চায়নি। ফ্যাবিয়াসের এই আইন পরবর্তী তেরাে বছর পর্যন্ত মেনে চলেছে তারা, তখন হ্যানিবল যেখানেই যেতেন, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই যেতেন; এখানে খানিকটা লণ্ডভণ্ড করতেন, ওখানে খানিকটা ধড়পাকড়, কিন্তু রােমানদের কিছুতেই উত্তেজিত করতে পারতেন না। রােমানরা তার উপস্থিতি এবং যুদ্ধের আগ্রহ দেখলেই সেখান থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিত। এই কাজটা রােমানদের জন্য খুব ভালাে বা প্রশংসার যােগ্য হয়নি, কিন্তু এটা কাজ করেছিল ঠিকই। হ্যানিবল একেবারে নিষ্কর্মা হয়ে গেলেন। অনেকে মনে করেন, হ্যানিবল আসলে তার সুযােগ হারিয়েছিল। ক্যানির বিজয়ের পরপরই তার সেনাবাহিনীসহ রােমে আক্রমণ করা উচিত ছিল। তবে সে যাই হােক, হ্যানিবল তার নিজের জায়গামতােই ছিলেন, এক বাক্যে সকলকে স্বীকার করতে হবে যে হ্যানিবল সেই সময়ের সবচেয়ে সাহসী এবং একইসঙ্গে ভয়ঙ্কর বীর। তার যদি মনে হয়ে থাকে যে রােমের আক্রমণ করার সময় তার তখনে আসেনি তবে তিনি তার সিদ্ধান্তে নিশ্চয় সঠিক ছিলেন। রােম তখনাে প্রবল ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হ্যানিবলের সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ পুরােনাে সদস্যেরা অভাবনীয় বীরত্ব দেখিয়েছে, অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে কিন্তু তখন তাদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয়েছিল। তাই হ্যানিবলকে তখন চলতে হতাে ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে। আর এদিকে রােমের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে নিরুৎসাহ তাকে হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়। এভাবে তার পরের আরাে দুই বছর চলে যাবার পরে তার মনে হলাে যে বিশ্রাম দরকার। আর তাই তিনি ক্যানির পরে কাপুয়ায় থাকা শুরু করলেন। একটি গল্প প্রচলিত আছে যে কাপুয়ার আরাম আর সুখ-শান্তিতে হ্যানিবলের সৈন্যবাহিনী আলসে হয়ে গেল। তবে ঠিক জানা নেই যে এটি সত্য কি না। তার প্রবল পরাক্রমশালী সৈন্যবাহিনী তেরাে বছর ধরে অপরাজেয় ছিল। আর তার পরেও তারা যে নতুন কোনাে বিজয় অর্জন করেনি সেটা কেবল রােমানদের অসহযােগিতার ফল।

কার্থেজীয়দের বিরুদ্ধে রোমানদের একের পর এক বিজয় : খ্রিস্টপূর্ব ২১২ সালে হ্যানিবল বাহিনী নিয়ে দক্ষিণে ট্যারেন্টামের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল। এবং ট্যারেন্টাইনদের সহায়তায় নগরের উপরে কব্জা করে ফেলল। রােমান সেনা দপ্তর সমস্যার মধ্যে পড়ল। তবে তারা মুহূর্তের সিদ্ধান্তে কাপুয়ায় ঘাঁটি গাড়ল। ক্যানিতে পরাজিত হয়ে তারপর থেকেই তারা কাপুয়ার দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছিল। হ্যানিবল তখন পড়লেন মহা ফ্যাসাদে, কাপুয়া রক্ষার জন্য এগিয়ে যাবেন নাকি ট্যারেন্টামের দখল নিয়ে বসে থাকবেন, সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। হ্যানিবল তড়িঘড়ি করে কাপুয়ার দিকে এগােতে লাগলেন এবং রােমান বাহিনী তার আসার খবর পাওয়া মাত্রই সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল। তারপর তিনি যখন বাহিনী নিয়ে ট্যারেন্টামে পৌঁছলেন, রােমান বাহিনী আবার পোঁছে গেল কাপুয়ায়। হ্যানিবলের জন্য এটা ছিল খুবই হতাশার। শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব ২১১ সালে তিনি ঠিক করলেন রােমের মধ্যখান দিয়ে যাত্রা করবেন। পৌরানিক কাহিনির মাধ্যমে জানা যায় যে তিনি তার বাহিনী নিয়ে রােমের আড়াআড়ি যাত্রা করেছিলেন এবং শেষ প্রান্তে একটি গােলক নিক্ষেপ করেছিলেন। রােমানরা তারপরেও যুদ্ধের সাজে সেখানে পৌঁছেনি বা কাপুয়ায় পাঠানাে তাদের বাহিনীকেও ডাকেনি। তার উপরে, হ্যানিবলের কাছে খবর পৌঁছল যে তার বাহিনী নিয়ে তিনি যেখানটায় থাকছেন সেই জায়গাটা নিলামে উঠেছে এবং একজন রােমান চড়া দামে তা কিনে নিয়েছে। এই বিষয়ে হ্যানিবলের অবশ্য এমনই মনে হলাে যে তিনি রােমান এলাকা দখল করেই আছেন। হ্যানিবলকে নিজে থেকে সরে যেতে হলাে, এটাই ছিল রােমানদের দিক থেকে বিজয়। তখন হ্যানিবলের প্রকোপে রােমকে ধ্বংস হতে দেখার জন্য যারা অপেক্ষা করছিল, তাদের সকলেই রােমের ধৈর্য দেখে বিস্মিত হলাে। যুদ্ধবিহীন, কেবল মৌনতার মধ্যে দিয়ে রােমান বিজয়কে পৃথিবী চিরকাল মনে রেখেছে। খ্রিস্টপূর্ব ২১১ সালে, রােমের আড়াআড়ি হ্যানিবলের সফরের পরপর, রােমানরা কাপুয়া নগর পুরােপুরি দখল করে নেয় এবং সেখানকার নেতাসহ অধিবাসীদের শাসন করতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ২১০ সালে তারা সিসিলিতে অনুপ্রবেশ করে এবং নগরটি থেকে কার্থেজীয়দের উৎখাত করে। খ্রিস্টপূর্ব ২০৯ সালে তরুণ সিপিও সেনাপ্রধান স্পেনের নতুন কার্থেজ দখল করে নেন, আর ওদিকে বৃদ্ধ ফ্যাবিয়াস দখল করেন ট্যারেন্টাম। রােম এবং একটি পরিপূর্ণ বিজয়ের মধ্যে তখন কেবল একটি মাত্র বাধা দাঁড়িয়ে ছিল, আর তা হলাে হ্যানিবল নিজে। তিনি তখনাে ইতালিতেই ছিলেন, তখনাে অপরাজেয়, তখনাে যথেষ্ট বিপজ্জনক। আর ওদিকে রােমানদের একের পর এক বিজয়ের পরেও হ্যানিবলকে ঘাটাতে তখনাে তাদের সাহস হয়নি।

হ্যানিবল ও হাসদ্রুবালের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি : যাই হােক, ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া যদি হ্যানিবলের অন্য কিছু করার থাকত তবে তিনি নিশ্চই তা করতেন। তিনি কার্থেজ থেকে রােমানদের সরাতে চেষ্টা করেননি, পারেননি শেষ পর্যন্তও। কার্থেজীয় শাসকেরা হ্যানিবলের ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিল, হ্যানিবলকে বরং তারা ভয় পেত, যে সেনাপ্রধান একটাই পরাক্রমশালী বীর, তিনি খােদ তাদের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে কতক্ষণ! কার্থেজীয়রা তাই ইতালি ছাড়া অন্য বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করে জয়লাভ করছিল, হ্যানিবলকে তারা ব্যবহার করেনি, তার বুদ্ধি আর বীরত্ব নিয়ে তিনি পড়ে ছিলেন একা। হ্যানিবল স্পেনের দিকে মনােযােগ দিলেন, যেখানে তার সহােদর হাসদ্রুবাল ছিলেন ক্ষমতায়। খ্রিস্টপূর্ব ২০৮ সালে, হ্যানিবলের অতিরিক্ত উত্তেজনার জন্য সহােদর হিসেবে তিনি যেটা করলেন তা হলাে রােমানদের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধংদেহী মনােভাব ফিরিয়ে আনলেন। একটি নতুন সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি রােমানদের ধাওয়া করলেন। গাউল আর স্পেনের উপরে পাড়ি দিয়ে, আল্পস পর্বত ডিঙিয়ে তিনি ইতালিতে নামলেন। হ্যানিবলের কাছে তিনি খুব দ্রুত আসতে পারলেন, তা নয়, যদিও তার সঙ্গে ছিল একেবারে নতুন একটি সেনাবাহিনী। খ্রিস্টপূর্ব ২০৮ সালে কার্থেজীয়দের জন্য একটিই ভালাে ঘটনা ঘটল, তা হলাে মারসেলাসের মৃত্যু। আর তখন সবকিছু হ্যানিবলের উপরে নির্ভর করছিল। তিনি ছিলেন ইতালির দক্ষিণে আর তার ভাই উত্তরে। তখন তিনি পারতেন তারা ভাইয়ের সঙ্গে এক হয়ে একত্র শক্তি প্রদর্শন করতে। একমাত্র রােমানদের উপরে নির্ভর করছিল যে তারা তাকে তা করতে বাধা দেবে কি না। উত্তরে একটি রােমান বাহিনি অপেক্ষা করতে লাগল হাসদ্রুবালের চালচলনের উপরে নজর রাখার জন্য, যেখানে আরেকটি বাহিনি রওনা দিল হ্যানিবলের উপর নজরদারী করতে। রােমান সেনাবহিনীর হ্যানিবলকে আক্রমণ করার কোনাে পরিকল্পনা কিংবা সাহস ছিল না, সাহস ছিল না হাসদ্রুবালকে আক্রমণ করারও। আর তখন হাসদ্রুবাল এবং হ্যানিবলকে একত্র হতে দেয়ার মতাে ভুল তারা কিছুতেই করতে চায়নি। ঠিক তখনই তাদের যুদ্ধের মােড় ঘুরে গেল। হাসদ্রুবাল হ্যানিবলের কাছে তাদের মিলিত হবার স্থান এবং সময়ের ব্যাপারে খবর পাঠাল। যদিও তার আগে-পরে অনেক ধরনের উদ্ভট ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু তখন যা হলাে, সেই খবর বহনকারী চিঠিটি রােমানদের হাতে পড়ে গেল। রােমান সেনা সদস্যরা জেনে গেল কোথায় দুই বাহিনীর মিলন হবে। তারা হ্যানিবলের উপরে নজর রাখল এবং হাসদ্রুবালের অপেক্ষা করতে লাগল নির্দিষ্ট স্থানে, যার কোনাে খবরই রােমানদের হাতে ছিল না। সেই অবস্থায় রােমান সেনাপ্রধান গাইউস ক্লডিয়াস নিরাে (মারসেলাসের অধীনে যিনি কাজ করতেন) মনে করলেন পরিকল্পনা অনুযায়ী না চললেও চলবে। হ্যানিবলের উপরে নজর রাখা বন্ধ করে তিনি বাহিনী নিয়ে উত্তরের দিকে রওনা দিলেন।

হ্যানিবলের পরাজয় : রােমান যৌথ বাহিনী রােম থেকে ১২০ মাইল উত্তর-পূর্বে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্রের কাছে হাসদ্রুবালের বাহিনীর মুখােমুখী হলাে। হাসদ্রুবাল বাহিনীসহ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু মেটারাস নদী পেরােনাের কোনাে উপায় খুঁজে পেল না অথচ নদীর তীরে দাঁড়িয়েই উপায় বের করার চেষ্টা করল। শুধু শুধু সময় নষ্ট হলাে, তারা কোনােভাবেই সেখান থেকে পালাতে পারল না, সময় নষ্ট করাতে সেখানেই ধরা পড়ে গেল। রােমানরা তাদের উপরে চড়াও হয়ে উঠল, যুদ্ধ করে তাদের সবাইকে হত্যা করল। কাৰ্থেজিয়ানরা বীরের মতাে যতক্ষণ পেরেছে যুদ্ধ করে গেছে কিন্তু হ্যানিবল সেখানে ছিল না, এবং সে কারণেই রােমানদের একটি পরিপূর্ণ বিজয় হলাে। হাসদ্রুবাল যে তার বাহিনীসহ রােমানদের হাতে মারা পড়েছে, এই সংবাদটি হ্যানিবলের কাছে পৌঁছল খুব বিশ্রীভাবে। যুদ্ধ শেষে রােমানরা হাসদ্রুবালের খণ্ডিত মস্তক নিয়ে দক্ষিণে হ্যানিবলের ক্যাম্পের দিকে রওনা দিল এবং দূর থেকে মস্তকটি ক্যাম্পের দিকে ছুঁড়ে দিল। নিজের বাধ্য ভাইয়ের খণ্ডিত মস্তটির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হ্যানিবল জানতে পারলেন যে তিনি রােমানদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেছেন। তিনি নিজের ভিতর তেকে নতুন করে যুদ্ধ ঘােষণার কোনাে তাড়না অনুভব করলেন না, এবং রােমানরা এমনভাবে তাকে দিনের পর দিন ধাওয়া করতে লাগল যে তিনি নিজে থেকে সরে পড়া ছাড়া অন্য কোনাে রাস্তা দেখলেন না। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধে পরাজিত না হয়ে এমনি এমনি সরে পড়াটাও তার আন্তরিক ইচ্ছে ছিল না। তিনি সেনাপ্রধানের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন এবং ইতালির শেষ প্রান্ত ব্রুটিয়ামে পরের চারটি বছর কাটিয়ে দিলেন। অথচ তারপরেও রােমান বাহিনী তাকে আক্রমণের সাহস করেনি।

কার্থেজীয়দের পরাজয়ের মাধ্যমে রোমের স্পেইন দখল ও নতুন নায়কের আবির্ভাব : রােমে মানুষেরা শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, আর তখন তাদের নেতা ছিল তরুণ। পাবলিয়াস কর্নেলিয়াস সিপিও, যিনি তার পিতার উত্তরাধিকারী বীর এবং খ্রিস্টপূর্ব ২১০ সালে স্পেনের বাহিনীপ্রধান। সিপিও, যিনি ক্যানির ভরাডুবির সময়ে ছিলেন এবং সেখান থেকে বেঁচে ফিরে আসা অল্প কিছু যােদ্ধার মধ্যে একজন (রােমের জন্য অবশ্যই সৌভাগ্যবান), স্পেনে টিকে থাকার আরাে ভালাে একটা উপায় খুঁজে বের করলেন তিনি, সেখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ জিতে রােমানদের জন্য সাফল্য বয়ে আনলেন। হাসদ্রুবালকে তিনি দুর্বল সেনাবাহিনী নিয়ে ইতালিতে আসতে বাধা দিতে পারেননি, কিন্তু তার ফলে যা হলাে, মনে হলাে স্পেনে কার্থেজীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করা অনেক সহজ। খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ সালে কার্থজিয়ানরা স্পেনে বাহিনী পাঠাল এবং সিপিওদের পুরােপুরি ধ্বংস করতে সেখানে তারা সুসংগঠিত হলাে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনী স্পেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে ইলিপা নামে এক স্থানে জড়াে হলাে আজকে যেখানে সেভিল বন্দর দাঁড়িয়ে আছে, তার থেকে ষাট মাইল উত্তরে। সেখানে রােমানরা ছিল প্রয়ােজনীয় সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি এবং অত্যন্ত দক্ষ বাহিনী প্রধান দ্বারা পরিচালিত। বেশ কয়েকদিন যাবৎ সেখানে দুই বাহিনী মুখােমুখি অপেক্ষা করল, কেউ কাউকে আক্রমণ করল না। তারা যেন এক বাহিনী আরেক বাহিনীর দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে বসে থাকল, তারা যেন অপেক্ষায় থাকল, পাহারায় থাকল, যেন মনে হচ্ছিল তারা একটা উপযুক্ত সময়ের জন্য বসে আছে যখন একজন আরেকজনকে সবচেয়ে নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করতে পারে। তাদের কার্যকমের পুরােটাই মনে হচ্ছিল সয়ংক্রিয়, দুই বাহিনীই সকালের পরপর যুদ্ধের মাঠে উপস্থিত হচ্ছিল, একই কাজের পুনরাবৃত্তি হয়ে চলছিল। আর তারপর একদিন সকালে যুদ্ধের মাঠে সারিবদ্ধভাবে যাওয়া বাদ দিয়ে লিজন বাহিনী ছিল মধ্যভাগে আর স্পেনের বাহিনী শেষের দিকে, সিপিওরা ভােরবেলা মধ্যভাগে আক্রমণ করে বসল স্পেনের বাহিনী নিয়ে আর লিজনরা আক্রমণ করল শেষ মাথায়। কার্থেজীয়দের বিস্ময়ের মাঝখানে সকালের নাস্তার আগেভাগেই তারা ধরা পড়ল। তাদের সবচেয়ে ভালাে বাহিনীটিকে ধ্বংস করতে সামান্যই যুদ্ধ করতে হলাে প্রতিপক্ষের। রােমানরা প্রতিপক্ষের শেষ মাথা থেকে ঘিরে নিয়ে সামনে দুর্বল বাহিনীর যাকে পেল তাকেই আক্রমণ করে বসল, এভাবে ধীরে ধীরে পুরাে কার্থেজীয় বাহিনীকেই ধ্বংস করে ফেলল। ইলিপার যুদ্ধের দুটো বড়াে ফলাফল ছিল – প্রথমত, কার্থেজীয়দের স্পেন ছাড়তে হলাে, হ্যামিলকার বারকার বিশ বছর ধরে গড়ে তােলা সাম্রাজ্য ছেড়ে তাদের সরে দাঁড়াতে হলাে। দ্বিতীয়ত, রােমানরা আবিষ্কার করল যে তাদের একজন মূল্যবান সেনাপ্রধান আছে, যার হ্যানিবলের সামনে দাঁড়িয়ে লড়ে যাবার সাহস আছে। এবং সেখানে বিজয়ী হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। 

রোমানদের আফ্রিকা আক্রমণ এবং হ্যানিবলের মুখোমুখি সিপিও : কার্থেজীয়দের জন্য তখন নিজেদের মধ্যে ভেঙে ভেঙে বিভক্ত হওয়ার সময়। সেসময় কার্থেজের আধিপত্য থেকে স্বাধীন হওয়া একজন ছিলেন ম্যাসিনিসা, যিনি ছিলেন কার্থেজের পশ্চিমে অবস্থিত নুমিডিয়া অঞ্চলের রাজা, যেখানে বর্তমান আলজেরিয়া অবস্থিত। সিপিও তখন ম্যাসিনিসার সঙ্গে একটি গােপন চুক্তিতে চুক্তিবদ্ধ হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ২০৫ সালে সিপিও ইতালিতে ফিরে এলেন এবং দেখলেন নগরের মানুষের কাছে সে বেশ জনপ্রিয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র বত্রিশ, কনসল হবার জন্য আবেদন করার জন্য অনেক কম বয়স সেটা। তবে তাকে কনসল হিসেবে নির্বাচিত করা হলাে। হ্যানিবল তখনাে ব্রুটিয়ামে, আগের মতােই ভয়াবহ, বরাবরই ভয়ঙ্কর। যাই হােক, সিপিওর মনে হলাে হ্যানিবলের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে কোনাে লাভ নেই। তার কাছে মনে হলাে, আগাগােক্লিস এবং রেগুলাস তাদের সময়ে যা করে গেছেন, সেটা অনুসরণ করলেই তাে হয়। সেখানে লড়াই না বাঁধিয়ে আফ্রিকায় চলে গিয়ে কার্থেজদের উপরে আক্রমণ করলে হয় না? কিন্তু প্রবীণ সেনাপ্রধানরা এই সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। অন্তত কিছুটা হলেও আপত্তি ছিল তাদের, তাদের কাছে মনে হয়েছিল এই সিদ্ধান্ত ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনবে (যত কথাই বলা হােক, আগাথাক্লিজ এবং রেগুলাস কার্থেজকে পরাজিত করতে সফল তাে হননি!) আর তাছাড়া ওই টগবগে তরুণ সিপিওকে তারা কিছুটা হিংসাও করতেন। কিন্তু সিপিওর জনপ্রিয়তা তখন এমন তুঙ্গে যে তাকে অগ্রাহ্যও করা যায়নি। সিনেট যখন তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে রুখে দাঁড়াল, হাজার হাজার মানুষ স্বপ্রণােদিত হয়ে তাকে সহযােগিতা করার জন্য এগিয়ে এল। ফলশ্রুতিতে খ্রিস্টপূর্ব ২০৪ সালে তিনি জাহাজের বহর নিয়ে আফ্রিকায় যাত্রা করলেন। আর তখন ম্যাসিনিসা ঘােষণা দিয়ে কার্থেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে তার সঙ্গে যােগ দিল, আর নুমিডিয়ান থেকে অশ্বারােহী সেনাবাহিনী, একসময় ইতালিতে অবস্থানকালে হ্যানিবলের বড়াে শক্তি ছিল যে বাহিনী, সেই বাহিনীই তখন কার্থেজের কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়াল। সিপিওর বিজয়ের ইতিহাস কার্থেজীয়দের উপরে মানসিক চাপ তৈরি করল। প্রথমে তারা হ্যানিবলকে খবর পাঠালেও পরে উত্তেজিত হয়ে তার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিল। তারা সিপিওর সঙ্গে একটা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে আসার সিদ্ধান্ত নিল। সিপিওর সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে ফেলার সিদ্ধান্তও হয়ে গেল। কিন্তু শান্তিচুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হবার আগেই বিশ্বস্ত হ্যানিবল তার দুর্ধর্ষ বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলাে। হ্যানিবলের বাহিনী পৌঁছতেই কার্থেজীয়রা যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে ফেলল। তখন যুদ্ধ আরম্ভ হলাে প্রকৃতপক্ষে সিপিও আর হ্যানিবলের মধ্যে। প্রাচীন কালের সবচেয়ে বড়াে সেই যুদ্ধটা সংঘঠিত হলাে জামা (Zama) নামের এক জায়গায় যেটা কার্থেজ থেকে ১০০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। যুদ্ধ শুরু হলাে খ্রিস্টপূর্ব ২০২ সালের ১৯ অক্টোবরে।

রোমানদের হাতে কার্থেজের পরাজয় ও দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সমাপ্তি : হ্যানিবল তার সমস্ত জমিয়ে রাখা শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন, কিন্তু সিপিওর হাতে ছিল তার চেয়ে আরাে উন্নতভাবে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। হ্যানিবলের সেনাবহিনীতে বেশিরভাগ মানুষই ইতালির এবং কার্থেজের ভাড়াটে সৈন্য, যাদের উপরে শেষ পর্যন্ত ভরসা করা কঠিন। হ্যানিবলের ছিল আশিটা হাতি, যে সংখ্যাটা তার আগের যে কোনাে যুদ্ধের চেয়ে বেশি। কিন্তু সেই যুদ্ধে হাতির উপস্থিতি কাজে তাে লাগলই না বরং বিপদ ডেকে আনল। হ্যানিবল একটি হাতিকে সামনে এগিয়ে দিয়ে যুদ্ধ শুরু করলেন। কিন্তু রােমানরা ঠিক তখনই খুব জোরে ট্রাম্পেট বাজানাে শুরু করল যার শব্দে ভয় পেয়ে অগ্রসর হওয়া হাতিটিসহ অন্যান্য হাতিগুলােও রােমানদের দিকে না গিয়ে হ্যানিবলেরর অশ্বারােহী সৈন্যদের দিকে তাড়া করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। বাকি হাতিগুলাে রােমান বাহিনীর মাঝখানের শূন্যস্থান ধরে সােজা রওনা দিল। যেন মনে হলাে তাদের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু জায়গা খালি রাখা হয়েছিল। আর যেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তীরন্দাজদের এড়াতেই হাতিদের এই মধ্যখানে ঢুকে পড়া (বলতে গেলে হাতির বুদ্ধিশুদ্ধি ভালােই)। আর তখন রােমানদের সুযােগ এল সামনে এগিয়ে যাবার। সিপিওর নির্দেশনায় একে একে সারিবদ্ধভাবে তারা এগিয়ে গেল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একটি করে সারিকে প্রতিপক্ষের দিকে পাঠিয়ে দেয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। কার্থেজীয় বাহিনীর শুরুর দিকের সৈন্যেরা পালিয়ে গেল অথবা মারা পড়ল। কেবলমাত্র শেষের সারি হ্যানিবলসহ তখনাে দাঁড়িয়ে থাকল, যারা ছিল সত্যিকার অর্থে বহুদিন ধরে ইতালির সমর্থক, তারাই কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকল। তারা লড়ে চলল, যুদ্ধটা হলাে সত্যি সত্যিই প্রচণ্ড সাহসের। ওদিকে সিপিও নিজেও ইচ্ছাকৃতভাবে একখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন, ম্যাসিনিসার অশ্বারােহীদের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি, যেন তাদেরকে পিছন থেকে আক্রমণ করতে পারেন (আগে দুবার কার্থেজীয় অশ্বারােহীরা ট্রেবিয়া এবং ক্যানিতে রােমানদের যেভাবে আক্রমণ করেছিলেন)। এই বুদ্ধি কাজে লাগল খুব। হ্যানিবলের প্রতাপশালী বাহিনীকে কচুকাটা করা হলাে। হ্যানিবল সারাজীবনে একটি মাত্র যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু এই জামার যুদ্ধে তিনি এমনভাবে পরাজিত হলেন যে তার আগের সমস্ত বিজয়ের গর্ব যেন ধুয়েমুছে গেল। আর কিছুই বাকি থাকল না। কার্থেজকে অবধারিতভাবে পরাজয় স্বীকার করতে হলাে। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ এভাবেই সমাপ্ত হলাে, হ্যানিবল থাকা সত্তেও, ক্যানির যুদ্ধের গর্ব গায়ে লেগে থাকলেও, সেবারে এটা ছিল রোম, যে সর্বময় বিজয় অর্জন করল। 

দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের পর কার্থেজের অবস্থা : খ্রিস্টপূর্ব ২০১ সালের শান্তিচুক্তির মাধ্যমে চিরকালের জন্য কার্থেজীয় শক্তির বিনাশ হলাে। তবে কার্থেজীয়দের একেবারে নিশ্চিহ্ন করা হয়নি যেটা অধিকাংশ প্রতিশােধপরায়ন রােমানের মনের সাধ ছিল, সিপিও তাদের সঙ্গে সাংঘাতিক অসামঞ্জস্যপূর্ণ এক চুক্তি করল, যা ছিল কার্থেজীয়দের জন্য যথেষ্ট বিধ্বংসী। কার্থেজীয় রাজ্য কেবল আফ্রিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল (আফ্রিকার উত্তর দিকটায়, যেটা এখন তিউনিসিয়া বলে পরিচিত) এবং সত্যিকার অর্থে, স্পেনকে চিরকালের জন্য ছেড়ে দিতে হলাে কার্থেজীয়দের। নৌবহর এবং হাতির বাহিনীও ছেড়ে দিতে হলাে কার্থেজীয়দের। তার উপরে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ব্যাপী বড়াে অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিয়ে যেতে হলাে কার্থেজীয়দের। প্রতিজ্ঞা করতে হলাে যে রােম রাজ্যের অনুমতি ছাড়া আফ্রিকার ভেতরেও কারাে সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারবে না তারা। এরপর বাকি থাকল ম্যাসিনিসা। তাদের সাহায্যের পুরস্কার স্বরূপ সীমানা বর্ধিত করে নুমিডিয়া পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলাে, যে নগরটা কার্থেজের হাত থেকে স্বাধীন করে রােমের সঙ্গে জুড়ে রাখা হয়েছিল। এই বিষয়টা একদম পরিস্কার ছিল যে, ম্যাসিনিসা চাইলেই কার্থেজকে নিয়ে যা খুশি করতে পারে, চাইলে নানানভাবে উত্যক্ত করতেও পারে, আর কার্থেজ রােমের অনুমতি ছাড়া ম্যাসিনিসার সঙ্গে লড়তেও পারবে না, আর সবাই জানত যে রােম বরাবর থাকবে ম্যাসিনিসার পক্ষে। জামার যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরে দীর্ঘজীবী ম্যাসিনিসা কার্থেজের উপরে অত্যাচার করে করে তার জীবন অতিষ্ট করে তুলল। এক সময় যে নগর ছিল আফ্রিকার মধ্যমণি, হ্যানিবলের কারণে রােমের অত্যাচারের স্বীকার হলাে। জামা থেকে নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে যাবার মুহূর্তে কার্থেজকে এই আত্মবিধ্বংসী শান্তি চুক্তি উপরােধে গিলতে বাধ্য করেছেন হ্যানিবল নিজে। হ্যানিবল জানতেন যে কার্থেজ চাইলেও আর আগের বীরত্ব নিয়ে লড়তে পারবে না আর তাই বােকার মতাে সেখানে নতুন করে যুদ্ধ বাধালে পুরাে রাজ্যই ভেঙে পড়বে, অধিবাসীরাও প্রত্যেকে মারা পড়বে। হ্যানিবলকে সরকার প্রধান বানানাে হলাে এবং তার যাবতীয় ক্ষমতা শান্তির দিকেই ধাবিত তখন। তিনি তখন কার্থেজীয় অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং কর্মক্ষমতায় উন্নতি সাধনের চেষ্টায় এমনভাবে মনােযােগী হলেন যে সেখানে কিছুদিনের মধ্যেই উন্নতি দৃশ্যমান হলাে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই ভালাে হলাে যে রােমের চাপিয়ে দেয়া ক্ষতিপূরণের বােঝা খুব দ্রুতই হালকা হয়ে আসছিল, তারা সময়ের আগে আগেই পরিশােধ করছিল। রােমানরা তাদের এই উন্নতির দিকে কেবল একটি বাঁকা দৃষ্টি দিয়ে রাখত। তারা হ্যানিবলকে নিজেদের ক্ষতির জন্য কখনাে ক্ষমা করেনি। খ্রিস্টপূর্ব ১৯৬ সালে তারা কার্থেজে একটি বিশেষ বাহিনী পাঠাল এই অভিযােগে যে হ্যানিবল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাঁয়তারা করছেন এবং তাদের দাবি ছিল যে হ্যানিবল যেন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। হ্যানিবল তখন পূর্বের দিকে হেলেনিস্টিক রাজ্যে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন, যদিও তার পরে সেখানেই বাকি জীবন পড়ে থাকতে বাধ্য হন। তিনি রােমের প্রতি ঘৃণা পােষন করা বন্ধ করেননি আবার রােমের বিরুদ্ধে মাথা চারা দিয়ে ওঠার সাহসও অর্জন করতে পারেননি।

দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের পর রোমান অঞ্চলের অবস্থা :

  • কনসাল হিসেবে সিপিও : সিপিও রােমের সর্বকালের বীর সেনাপ্রধান হিসেবে ফেরত এসেছিলেন, তার প্রতিপক্ষ হ্যানিবলকে পরাজিত করে। তাকে ‘আফ্রিকানুস’ নাম দেয়া হলাে। আর তখন থেকেই তিনি সিপিও আফ্রিকানুস বলে পরিচিত। সে যাই হােক, সিনেটের বয়স্ক সদস্যগণ সিপিওর তারুণ্য এবং প্রাণময়তাকে ভালাে চোখে দেখতেন না, যখন সিপিওর কাজকর্মে প্রাচীনপন্থী হিসেবে অনেক বিব্রত বােধ করতেন। তাই তার পর থেকে তিনি রােমান শাসনে বড়ােসড়াে কোনাে ভূমিকা রাখতে পারেননি।
  • রোমান স্পেন : রােমের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ ভূমি চলে এসেছিল। সিসিলি প্রদেশসহ পুরাে দ্বীপটাই, যেখানে ছিল সাইরাকিউজের শাসন, সেই অঞ্চলও রােমের অধীনে চলে এল। আর তা ছাড়া, স্পেনকে কার্থেজদের হাত থেকে রক্ষা করে রােম তার সীমানা আরাে বাড়িয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ সালে স্পেনে দুটো পৃথক প্রদেশ হয়ে গেল। হিস্পানিয়া সিটেরিয়ার (“কেন্দ্রীয় স্পেন”) যা ছিল পূর্বদিকে, এবং হিস্পানিয়া প্রিয়ার (“বাইরের স্পেন”) যা প্রধানত পশ্চিম দিকে। এই দুই প্রদেশ অবশ্য উপকুলেৱ কেবল দক্ষিণ দিকটাই দখল করে ছিল। উপকূলের উত্তর দিকটা নার পরের প্রায় দু’শ বছরেও রােমের হাতে আসেনি, ছিল কিছু স্থানীয় আদিবাসীদের। পশ্চিমের সবচেয়ে দূরবর্তী প্রদেশ হিসেবে স্পেন রােমের আইনকানুনে এবং রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। এক বছরেরও বেশি সময়ের জন্য রোম থেকে স্পেনে গভর্নর পাঠানাে হতাে যেন সেখানকার প্রদেশ শাসনকর্তা রােমের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন। তারপরেও রােম থেকে যখন তখন সেখানে বাহিনী পাঠানাে বা কৃষিকাজের তদারকী করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর তাই স্পেনেই একটি বাহিনী তৈরি করা হলাে, যারা সেখানকার সৈন্যের দায়িত্ব পালন করবে কিন্তু কৃষিকাজে জড়িত খাকতে না। এভাবে সেখানকার সৈন্যেরা দরবর্তী রােমের শাসনের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের শাসনকর্তার প্রতি দায়বদ্ধ হতে শুরু করল। প্রায় একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রােমান শাসনের প্রভাব সেখানকার সৈন্যদের স্থিতিশীল রেখেছিল। কিন্তু তার পর থেকে কিছু কিছু ধ্বংসের সম্ভাবনা ঘনীভূত হতে থাকল। 
  • ইতালিতে গ্যালিক ও এট্রুস্কানদের রোমান সংস্কৃতি গ্রহণ ও গ্রিকদের দুর্বলতা : ইতালি নিজেও অনেক পরিবর্তন দেখেছে। ইতালি সেই স্থান যা হ্যানিবলকে সবরকমভাবে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করেছে। সিসালপাইন গাউল ধীরে ধীরে ঝুকে গিয়েছিল ল্যাটিন নগরগুলাের দিকে এবং গ্যালিক জাতি ক্রমে রােমান জীবন যাপন পদ্ধতি অনুসরণ করছিল। ল্যাটিনরা দক্ষিণের শেষ মাথা পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে ফেলল এবং গ্রিক নগরগুলাে এতটাই দুর্বল হয়ে গেল যে আর কখনােই আগের মতাে শক্তিশালী হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারল না, তাদের কোনাে রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকল না। এট্রুরিয়া রাজ্য ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল এবং রােমান সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। 
  • সব দিক থেকে একচ্ছত্র আধিপত্য নেবার জন্য রোমের প্রস্তুতি : রােম তখন সবদিক থেকে মােটামুটি তৈরি ছিল, একচ্ছত্র আধিপত্য অর্জনের পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। তার ক্ষমতার রাস্তায় তখন কেবল একটিই বাধা ছিল, তা হলাে, হেলেনিস্টিক রাজতন্ত্র, যার দ্বারা প্রাচীন গ্রিক প্রথা অনুযায়ী পরিচালিত রাজতন্ত্রকে বোঝায়।

গ্রিক অঞ্চল জয় ও ভূমধ্যসাগরের উপকূল জুড়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা

গ্রিক অঞ্চলে রোমের প্রভাব বৃদ্ধি ও দ্বিতীয় মেসিডোন যুদ্ধে বিজয়

গ্রিসের অবস্থা : খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালে রােম পূর্বদিকের হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলাের দিকে ভালাে করে তাকানাের সুযােগ পেল। তাদের সবচেয়ে কাছে এবং সবচেয়ে বেশি বিপদের সম্ভাবনা যে রাজ্য থেকে ছিল তা হলাে ম্যাসিডােন। সেখানে ছিলেন একজন ক্ষমতাবান রাজা, পঞ্চম ফিলিপ, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ২২১ সালে সিংহাসনে আরােহন করেন, আর তারপর থেকেই গ্রিসের উপরে ম্যাসিডােনিয়ার প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। গ্রিস তখন প্রাচীন প্রতাপশালী গ্রিসের ছায়ামাত্র। তখন গ্রিসের ক্ষমতা প্রধান দুটো নগরগুচ্ছের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে ছিল। একটি গুচ্ছ ছিল গ্রিসের উত্তর দিকে, তার নাম এটোলিয়ান লিগ; অন্যটি ছিল গ্রিসের দক্ষিণ দিকে, যাকে বলা হতাে আকিয়ান লিগ। এই দুই লীগের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না এবং দুই দলেরই ম্যাসিডােনের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক ছিল। তারা ম্যাসিডােনের প্রতিপক্ষ হিসেবে সুসংগঠিত হয়ে ওঠার জন্য নিজেদের মধ্যে মিলিত হতে পারত, কিন্তু নিজেরাই আশেপাশের বর্বর কিছু জাতির উপস্থিতি নিয়ে এমন সমস্যায় ছিল যে একজোট হতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কী, গ্রিক নগরগুলাে নিজেদের কোনাে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাের মতাে একতা কখনােই দেখায়নি। অবশ্য এ কথা সত্য যে, আকিয়ান লিগ বরাবরই স্পার্টার সঙ্গে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে রাখত, এটা যেন করত গ্রিসের প্রাচীন ক্ষমতা নিজেদের মধ্যে ধরে রাখার অনুশীলন করার জন্য, এটাই ছিল নিজেদের উপস্থিতি জানান দেবার জন্য দক্ষিণ দিকের গ্রিক নগর জোটের চাল। এই চাল চালতে চালতে তারা এতটাই অপ্রতিরােধ্য হয়ে উঠেছিল যে গ্রিক জোটগুলাের সাধারণ শত্রু ম্যাসিডােনকেও আহ্বান করে বসল স্পার্টার বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করাবার জন্য। 

মেসিডোনিয়ার সাথে রোমের শত্রুতার সূচনা : ফিলিপের সিংহাসনে আরােহণের আগের বছরেই ম্যাসিডােন স্পার্টাকে যুদ্ধে হারিয়েছিল। আর তখন আকিয়ান লিগ নিজেদের প্রয়ােজনেই ম্যাসিডােনিয়ার হাতের পুতুল বনে গেল। ফিলিপ তখন পর্যন্ত ম্যাসিডােনের শত্রু হয়ে থাকা ঈটোলিয়ান লিগের বিকছে যুদ্ধ ঘােষণা করল এবং বিজয়ী হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ২১৭ সালে যুদ্ধ শেষ হলাে, বেশ দ্রুততার সঙ্গে শান্তিচুক্তি হয়ে গেল তাদের মধ্যে কারণ ফিলিপ রােমের বিরুদ্ধে, যারা হ্যানিবলের কাছে কখনাে পরাজিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাের জন্য অন্য ঝামেলা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাচ্ছিলেন। ক্যানির যুদ্ধের পরে ফিলিপ হ্যানিবলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কিন্তু রােমের বিরুদ্ধে মাথাচারা দিয়ে উঠতে পারেনি কারণ সমুদ্রের বেশিরভাগ অংশ রােমের দখলে ছিল। রােম পরােক্ষভাবে কোনে যুদ্ধে জয় করে খুশি থাকত না। তাই ঈটোলিয়ান লিগ এবং স্পার্টার বাহিনীর সঙ্গে রােম একজোট হয়ে গেল, যে দুই দলই ম্যাসিডােনের কাছে পাওয়া আঘাতের প্রত্যুত্তর দেবার জন্য মুখিয়ে ছিল, অ্যাড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে তারা একটি ছােটো বাহিনীও পাঠাল। সেটাই ছিল প্রথম ম্যাসিডােনিয়ার যুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে সেটা এমন কোনাে বড়াে যুদ্ধ ছিল না। কিন্তু কার্থেজমুখী লড়াইয়ের গতি পরিবর্তন হওয়াতে ফিলিপ এতে কিছুটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ সালের মধ্যে গ্রিক জোটগুলাে যথেষ্ট খারাপ অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং ফিলিপের সঙ্গে পূণরায় জোট তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হয়, ফিলিপও তাদের সহায়তা পাবার জন্য খুবই উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০৫ সালে রােম সমঝােতার মাধ্যমে একটি শান্তিচুক্তি করতে রাজি হয়। কিন্তু সেটা কোনােভাবেই রােমের মতাে ক্ষমতাধর রাজ্যের জন্য শেষ কথা ছিল না। ফিলিপ হ্যানিবলকে সাহায্য করেছিলেন; প্রকৃতপক্ষে প্রথম ম্যাসিডােনিয়ার যুদ্ধর সময়ে ফিলিপ একটি ছােটো বাহিনী পাঠিয়েছিলেন হ্যানিবলের দলে যােগ দেবার জন্য। আর সে কারণেই রােম হয়তো তার উপরে বেশি ক্ষিপ্ত ছিল এবং সুযােগের অপেক্ষায় ছিল তাকে উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য।

রোমানদের গ্রিক সংস্কৃতি গ্রহণ : ম্যাসিডােনের সঙ্গে শত্রুতার ক্ষেত্রে রােমের আরাে যুক্তি ছিল। রােম যেহেতু পিরাসকে হারিয়ে ম্যাগনা গ্রেশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল, গ্রিসের সৌন্দর্য এবং তার কৃষ্টির কাছে এসে রােমকে নত হতেই হয়েছিল। আর সে কারণেই রােমের অভিজাত পরিবারের সন্তানরা গ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষিত হয়ে উঠছিল গ্রিক স্কুলে। তরুণ প্রজন্ম যখন গ্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলাে তারা স্বভাবতই গ্রিক ভাষা এবং সাহিত্যের প্রেমে পড়ে গেল। রােমানরা তখন গ্রিক পৌরাণিক কাহিনী পাঠ করত এবং নিজেদের পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে তাকে মিলিয়েও দিত। ঈনিয়াস এবং ট্রোজান যুদ্ধের মাধ্যমেই হয়তো রােমানরা প্রথম গ্রিক সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছিল। আর তখন গ্রিক সাহিত্যের অনুকরণে ল্যাটিন সাহিত্যের সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা দেখা গেল।

  • প্লটাস : গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকারের মধ্যে প্রথম রােমান নাট্যকার হলেন টাইটাস ম্যাকিয়াস প্লটাস (Titus Maccius Plautus), যিনি জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ২৫৪ সালে। জামার যুদ্ধর আগে এবং পরের বে সময়টা জুড়ে তিনি তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করেছিলেন। তিনি প্রধানত স্থুল রসিকতা এবং মােটামুটি নিম্নমানের কিছু নাটক রচনা করেছিলেন। তার সর্বমােট রচনা ছিল ১৩০ টির মতাে, তার মধ্যে মাত্র বিশটি বহুবছর বেঁচে ছিল। তিনি গ্রিক রম্যরচনা থেকে সরাসরি নেয়া পটভুমিকে নিজের রচনার পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করতেন।
  • এনিয়াস : অপেক্ষাকৃত তরুণ সমসাময়িক সাহিত্যিক কুইন্টাস এনিয়াস (Quintus Ennius) জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ২৩৯ সালে। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সময়ে তিনি সারডিনিয়ায় লড়েছিলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ২০৪ সালে রােমে ফিরে আসেন। তিনি কিছু বিয়ােগান্তক রচনা এবং কিছু মহান কবিতা লিখেছিলেন। গ্রিক সাহিত্য তিনি তার লেখায় কেবল প্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তাকে রােমান অভিজাত শ্রেণির অনেকেই বিশাল সাহিত্যিক মনে করতেন, এমনকি সিপিও আফ্রিকানাসও।

গ্রিক সংস্কৃতির বহুল প্রসারে এবং প্রচারে এটাই ছিল খুব স্বাভাবিক যে বেশিরভাগ রােমান তখন ফিলিপকে অপছন্দ করতে শুরু করল কারণ ফিলিপ ছিল গ্রিকদের ধ্বংস করার জন্য এক পায়ে খাড়া। আর এভাবেই ফিলিপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা তাকে শূলে চড়ানাে যেন গ্রিক কৃষ্টির সপক্ষে এক যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াল।

গ্রিক মিশর, পারগামাম, রোডস ও এথেন্সের রোমের সাথে মৈত্রীজোটে যোগদান : কিন্তু তারপরেও একটি প্রশ্ন থেকে গেল, একজন রােমান যখন ফিলিপের বিরুদ্ধে কথা বলে, তার মানে তাে এই নয় যে সম্পূর্ণ হেলেনিস্টিক রাজ্য ফিলিপের বিরুদ্ধে চলে যায়, তাই রােমান শাসনকর্তা এমন চুপচাপ অবস্থাটি অবলােকন করছিলেন যেটা ছিল খুবই সন্দেহজনক। টলেমিদের মিশর ছিল বেশ শক্তিশালী, অন্তত প্রথম তিনজন টলেমির শাসনে, কিন্তু তৃতীয় টলেমি মৃত্যুবরণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ২২১ সালে। চতুর্থ টলেমি ছিলেন খুবই দুর্বল একজন শাসক এবং খ্রিস্টপূর্ব ২০৩ সালে তিনি যখন মৃত্যুবরণ করেন, সেটা ছিল জামার যুদ্ধের ঠিক আগে, মাত্র আট বছর বয়সি একটি শিশু, পঞ্চম টলেমি হিসেবে সিংহাসনে আরােহণ করেন। তাই তখন মিশরের পক্ষে রােমকে আক্রমণ করার মতাে কোনাে বিষয়ে জড়ানাে অসম্ভব ছিল। কারণ মিশর তখন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামেই দিশাহারা। তাছাড়া, পিরাসের কাছে পরাজিত হবার পর থেকে রােমের সঙ্গে মিশরের একটি জোটও ছিল, বিশেষ করে জ্ঞানী দ্বিতীয় টলেমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে শক্তিশালী রােমের শত্রু না হয়ে বন্ধু হয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের, তখন থেকেই মিশর সেই জোটের প্রতি বিশ্বস্ত। এশিয়া মাইনর কিছু হেলেনিস্টিক রাজ্য দিয়ে পূর্ণ ছিল। সেখানকার মধ্যে সবচেয়ে পশ্চিমে গ্রিসের দিক থেকে ঈজিয়ানের পরে ছিল পারগামামের (Pergamum) অবস্থান। পারগামামের সবচেয়ে বড়াে শত্রু ছিল তার চারপাশের হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলাে, তার মধ্যে ছিল ম্যাসিডােনও। পারগামামের রাজা প্রথম অ্যাটালাস তাই নিজেদের ভালাের কথা চিন্তা করে রােমের সঙ্গে মৈত্রীজোট তৈরি করলেন, যে বিষয়টি তার মতে ছিল প্রাকৃতিক সুরক্ষার মতাে। সাইরাকিউজ যেহেতু নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, তাই, রােডস, ঈজিয়ান সমুদ্রের দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি দ্বীপ, ছিল একমাত্র গ্রিক অঞ্চল যা তখনাে স্বাধীনতা ধরে রেখে উন্নতি করে যাচ্ছিল। এক সময় তারাও রােমের সঙ্গে মৈত্রীজোটে চলে এল সেই একই কারণে, যে কারণ কাজ করছিল পারগামামের জন্য। এরপর এথেন্সও সময় নষ্ট না করে সেই জোটে যােগ দিল।

সেলুসিড ও টলেমিডদের মধ্যে শত্রুতা : তখন গ্রিক রাজ্যগুলোর মধ্যে বাদ থাকল কেবল সেলুসিড রাজ্য, যা তখন তার ক্ষমতার চরমে প্রবেশ করেছে, সেটাই ছিল হেলেনিস্টিক রাজ্যের শেষ প্রদীপ। খ্রিস্টপূর্ব ২২৩ সালে তৃতীয় অ্যান্টিওকাস সেলুসিড রাজ্যের সিংহাসনে আরােহণ করলেন এবং পরপরই বেশ কিছু সফলতার মুখ দেখলেন। হাজার হলেও, তার পূর্বপুরুষরা মধ্য এশিয়ার যে বিশাল এলাকা হারিয়েছিলেন তা তাে একসময় শক্তিশালী পারস্য রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল যা মহান আলেক্সান্ডার জয় করেছিলেন। তখন অ্যান্টিওকাস বেশ কিছু কঠিন যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সেই হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০৪ সালের মধ্যে সেলুসিড রাজ্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারত এবং আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেল। রাজ্যটি যথার্থই চমৎকার আকৃতির ছিল। সম্মান প্রদর্শন করে অ্যান্টিওকাসকে “মহামতি অ্যান্টিওকাস” বলে ডাকা শুরু হলাে। তিনি নিজের কর্মদক্ষতায় নিজেও তৃপ্ত ছিলেন, যে কারণে নিজেকে আরেকজন আলেকজান্ডার ভাবতেন। যাই হােক, পূর্বদিকের এলাকা তার দখলে থাকলেও অ্যান্টিওকাসের ক্ষমতা সিরিয়া এবং ব্যাবিলনিয়ায় বেশি পরিলক্ষিত হতাে। তরুণ পঞ্চম টলেমি যখন মিশরের সিংহাসনে আরােহন করলেন, অ্যান্টিওকাসের মনে হলাে যে প্রায় শতাব্দীব্যাপী ঝুলে থাকা লড়াইয়ের বােঝাটা হালকা করার তখনই সময়, তাই ধীরে ধীরে তিনি সেই যুদ্ধের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন, সেলুসিড এবং টলেমির মধ্যেকার যুদ্ধ। খ্রিস্টপূর্ব ২০৩ সালে তৃতীয় অ্যান্টিওকাস রাজা পঞ্চম ফিলিপের সঙ্গে মিশরের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য একটি জোট তৈরি করলেন এবং মিশরের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন। পারগামাম এবং রােডস উভয়ের শাসকই অ্যান্টিওকাসের আগ্রাসনে ভীত হয়ে পড়লেন, তারা বুঝলেন যে দুই শক্তির জোট নিশ্চয় অনেক বেশি ক্ষমতাবান হয়ে দাঁড়াবে যা বাকি থাকা হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলাে জন্য ত্রাস। রােম এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিল এবং তার সঙ্গে দীর্ঘকালের সম্পর্ক রাখা মিশরকে নিয়ে চিন্তিত ছিল। রােমানদের মনে ছিল যে হ্যানিবল যখন কার্থেজ থেকে পালিয়েছিলেন, তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন সেলুসিড রাজ্যেই, এবং অ্যান্টিওকাস তখন রােমের শত্রু সেই সমস্ত রাজ্যের জন্যই ওকালতি করছিলেন। এই সমস্ত কারণে রােম বিষয়টি নিয়ে একটা কিছু করার কথা ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখল। আর তখন, রাজা পঞ্চম ফিলিপের ব্যাপারটা প্রথমে প্রাধান্য পেল। অন্তত অ্যান্টিওকাস ম্যাসিডােনে রােমানদের তখন ঘাটাবেন না এটুকু পরিস্কার ছিল, কারণ তিনি তখন মিশরকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

দ্বিতীয় মেসিডোনীয় যুদ্ধ ও রোমের বিজয় : খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালে রােমানরা রােডসের অনুরােধে পঞ্চম ফিলিপের কাছে এক কূটনৈতিক দল পাঠাল, তাদের সঙ্গে নির্দেশ পাঠাল যে তিনি যেন রােডস এবং পারগামামের ক্ষতি হয়, এমন কেনাে কাজ না করেন। ফিলিপ যখন সেই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন তখন দ্বিতীয় ম্যাসিডােনিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। চলমান ঘটনাগুলাে রােমের কাছে খুবই হতাশাজনক বলে মনে হয়েছিল। রোম আশা করেছিল যে পুরাে গ্রিক সাম্রাজ্য জেগে উঠবে এবং ফিলিপের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। তার উপরে ফিলিপ সেনা প্রধান হিসেবে নিজের যােগ্যতারও প্রমাণ করেছিল ততদিনে। তাই দুই বছর ব্যাপী এই বিষয়টা নিয়ে রােম ক্রমাগত গড়িমসি করছিল। রােমানরা তখন টাইটাস কুইনটিয়াস ফ্লেমিনিয়াসকে দায়িত্ব দিল। তিনি মারসেলাসের অধীনে কাজ করেছিলেন, সাইরাকিউজ দখল করেছিলেন, এবং তিনি ছিলেন সেই রােমানদের মধ্যে একজন যিনি গ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট। ফ্লেমিনিয়াস শক্তহাতে শাসন কাজের ভার নিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ সালে সিনােসিফেলি, যেটা ছিল থেসালিতে, উত্তর-পূর্ব গ্রিসের একটি অঞ্চল, সেখানে যুদ্ধ বাধিয়ে বসলেন। এক শতাব্দী আগে পিরাসের যুদ্ধের পরে সেটাই ছিল প্রথম যেখানে। ম্যাসিডােনের ফ্যালাঙ্কস এবং রােমান লিজন মুখােমুখী হলাে। সেনাসদস্য ছিল দুই বাহিনীতেই সমান। কিন্তু রােমানদের দিকে ছিল কিছু শক্তিশালী ভাড়াটে গ্রিক সৈন্য এবং বড়ােসড়াে এক হাতির বহর। ফিলিপের সেনাবাহিনী ছিল দুটো ফ্যালাঙ্কস দিয়ে গঠিত। যে বাহিনী কিছুকালের জন্য বেশ ভালােভাবেই লড়ছিল। কিন্তু সে যাই হােক, সেখানকার ভূমি ছিল খানিকটা অসমতল, তাই ফ্যাল্যাংস প্রতিটি পদক্ষেপে দ্বিধায় ভুগছিল। তার ওপরে লিজনের চট করে জায়গা পরিবর্তনের ক্ষমতা ফ্যালাঙ্কসকে বিপদে ফেলেছিল। রােমান লিজনের বাম দিকের অংশ ফ্যাল্যাংক্সের সঙ্গে মুখােমুখী হওয়া মাত্রই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু ডান অংশের একজন সেনাপ্রধান (যারা আগে থেকেই সেখানে ভালােভাবে লড়ছিল) হুট করে নিজের দিকের এক দল সৈন্যকে সেখানে থেকে সরিয়ে নিয়ে পিছন দিক থেকে ফ্যাল্যাংক্সের উপরে তখন আক্রমণ করালেন। ফ্যালাঙ্কস তখন দেখল, ওই আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানাে খুবই কঠিন এবং তার ওপরে আরাে নতুন হামলা আসতে লাগল। হামলার প্রাদুর্ভাব সামলাতে না পেরে তারা ধ্বংস হলো। লিজন তাদের বীরত্ব প্রমাণ করল আবারও। পঞ্চম ফিলিপ তখন শান্তিচুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হলেন, বিশেষ করে যখন অন্যান্য ম্যাসিডোনিয়ান সেনাবাহিনী গ্রিসের অন্যান্য গ্রিক শক্তি ও এশিয়া মাইনোরে পারগামেনেসের কাছে পরাজিত হয়েছিল। ফ্লেমিনিয়াস তখন নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন যা পেয়েছেন তা রক্ষা করার জন্য, তা হলাে তার বিজয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৯৬ সালে, সিনােসিফেলির ঠিক পরের বছরে তিনি ইস্থমিয়ান খেলার আসরে (গ্রিক নগর করিন্থে প্রতি দুই বছর অন্তর আয়ােজিত একটি ধর্মীয় উৎসব) উপস্থিত হয়েছিলেন। আর সেখানে, খুব আনন্দের সঙ্গেই তিনি সমস্ত গ্রিক নগরকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম হিসেবে ঘােষণা করেছিলেন, এই ঘােষণা ম্যাসিডােনের প্রভূত্ব শেষ হবার প্রায় একশ বছর পরের ঘটনা। গ্রিকরা ঘােষণা শুনে বিপুল করতালির মাধ্যমে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিল, তবে তাদের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই সেই স্বাধীনতার অর্থ ছিল দীর্ঘদিন ধরে পুষে রাখা দ্বন্দ্বের স্বতঃস্ফূর্ত বহিপ্রকাশ ঘটানোর স্বাধীনতা।

স্পার্টার পরিণতি : স্পার্টা একজন শাসকের অধীনে কাজ করতেন যার নাম ছিল নাইবিস, যিনি ওই নগরটিকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন এবং যার তত্বাবধানে নগরটি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। আকিয়ান জোটকে রােম আহ্বান করেছিল ম্যাসিডােনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে এবং স্পার্টাকে পরাজিত করতে। খুব স্বাভাবিকভাবেই, ফ্লেমিনিয়াস স্পার্টায় রোমানদের লেলিয়ে দিয়েছিলেন। স্পার্টা সাংঘাতিক প্রতিবাদী হয়ে সেই আক্রমণ ঠেকিয়েছিল এবং এরপর ফ্লেমিনিয়াসের প্রকৃতপক্ষে নগরটা ধ্বংস করার কোনাে আগ্রহ ছিল না। তিনি সমস্ত গ্রিক নগরগুলােকে জোরপূর্বক একটা শান্তিচুক্তিতে আসতে বাধ্য করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৯৪ সালে নাইবিসকে ক্ষমতায় রেখে নিজের বাহিনী সহ রােমে ফিরে আসেন। তিনি নগর ছেড়ে চলে আসার পরে গ্রিকরা যুদ্ধ শুরু করে। যাই হােক, খ্রিস্টপূর্ব ১৯২ সালে নাইবিসকে বন্দি করা হয় এবং স্পার্টা তার শেষ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে। আর কখনাে যুদ্ধে জড়ানাের শক্তি অর্জন করতে পারেনি সে। 

অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে রোমানদের বিজয় ও ফলাফল

রোমের বিরুদ্ধে অ্যান্টিওকাসের যুদ্ধের পটভূমি : রােম যখন ম্যাসিডােনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত, অ্যান্টিওকাস তখন মিশরে অনুপ্রবেশ করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালে অ্যান্টিওকাস একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে জয়ী হন এবং এশিয়ার কিছু অঞ্চল এবং মিশর দখল করে রাখেন প্রায় একশ বছরের জন্য। তার সেনাবাহিনী এশিয়া মাইনরেও প্রবেশ করে। খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ সালে পারগামামের অ্যাটালাস মৃত্যুবরণ করেন। তার পুত্র দ্বিতীয় ইউমিনিজ রােমের সঙ্গে জোটে থাকতে সম্মতি প্রকাশ করেন। ফ্লেমিনিয়াস তখন সম্প্রতি ফিলিপের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে একটু চুপ ছিলেন, তিনি ফ্লেমিনিয়াসের কাছে আকুতি জানান যেন অ্যান্টিওকাসকে তিনি এশিয়া মাইনরের বাইরে বের করে দেন। ফ্লেমিনিয়াস এই অনুরােধ রক্ষা করতে উদ্যোগ নেন। অ্যান্টিওকাসের কাছে বার্তা যায়। কিন্তু তিনি সেই আদেশ পালন করার প্রয়ােজন বােধ করেন নি, কেননা পরপর অনেকগুলাে যুদ্ধেই তখন তার বিজয় হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৯২ সালে তিনি শেষ পর্যন্ত মিশরের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে ফেললেন এবং যতগুলাে স্থান নিজের দখলে ছিল তা ধরে রাখলেন। এতগুলো যুদ্ধের পর অ্যান্টিওকাস যখন দম নেবার জন্য বিশ্রামে গেলেন, তখন তিনি দেখলেন তার মিত্ররাষ্ট্র মেসিডোন রোমানদের দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছে, আর এখন রোমই গ্রিসে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এটা তার কাছে স্পষ্ট ছিল যে, যতক্ষণ রেমের মিত্র টলেমীয় মিশরের কিছু অংশ তার দখলে রয়ে গেছে ততক্ষণ রােম কোনােভাবেই শান্তিতে বসে থাকবে না। প্রশ্নটা ছিল তিনিই প্রথমে আক্রমণ করতে বাধ্য কিনা। দুটো বিষয় তাকে রোমে আক্রমণ করতে বাধ্য করেছিল।

  • প্রথমত, ফিলিপের পরাজয়ের পর থেকে ঈটোলিয়ান লীগ নতুন নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছিল। যেখানে রােম স্পার্টার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, আকিয়ান লীগ ছিল বলতে গেলে রােমেরই প্রতিনিধি, আর যেখানে আকিয়ান লীগ রােমের পক্ষে সেখানে ঈটোলিয়ান লীগকে অবশ্যই রােমের বিপক্ষে থাকতে হয়েছিল। ঈটোলিয়ান লীগ তাই অ্যান্টিওকাসের কাছে রােমানদের থেকে তাদের মুক্ত করার জন্য আবেদন করেছিল।
  • দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টপূর্ব ১৯৫ সালে হ্যানিবল প্রদেশীয় নগর টায়ার থেকে অ্যান্টিওকাসের কার্যালয়ে এসে পৌঁছান। রােমকে পরাজিত হতে দেখাই ছিল তার জীবনের লক্ষ্য। আর তাই তিনি অ্যান্টিওকাসের কাছে রােমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ধর্না দিতে থাকেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে এশিয়ান রাজা তাকে যদি একটি বাহিনী দিতে চান তাে তা নিয়ে তিনি নিশ্চয় রােমকে পরাজিত করে দেখাবেন, তবে তার আগে অ্যান্টিওকাসকে গ্রিসে ঢুকে পড়তে হবে এবং সেখান কিছু ধ্বংসাত্বক কার্যকলাপ চালাতে হবে। 

এই অবস্থায় অ্যান্টিওকাসের আত্মাভিমান তাকে গ্রিসকে রোমের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য প্ররোচিত করে। কিন্তু তিনি হ্যানিবলের উপদেশ শুনলেন না। তিনি কার্থেজীয়দের সেনাবাহিনী দিলেন না। বরং গ্রিসকেই তিনি তার যুদ্ধের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিলেন, এবং ঈটোলিয়ানদের কথার উপর ভরসা করলেন যারা বলেছিল তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দাঁড়ালেই গ্রিকরা তার পক্ষে উঠে দাঁড়াবে ও তার সাথে যোগ দেবে।

রোমানদের কাছে অ্যান্টিওকাসের পরাজয় ও এর ফলাফল : খ্রিস্টপূর্ব ১৯২ সালে অ্যান্টিওকাস প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলেন। এশিয়া মাইনরে যা কিছু বাকি রয়ে গেছে তাকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ নিলেন, তিনি ঈজিয়ান সাগর পেরােলেন। এবং সেনাবাহিনীকে গ্রিসের মধ্যে ঠেলে দিলেন, শুরু হয়ে গেল সিরিয়ার যুদ্ধ। এটা সত্য যে গ্রিকরা যুদ্ধের জন্য সেভাবে জেগে ওঠেনি। রােমান বাহিনী ঈজিয়ান উপকূলের থার্মোপাইলি অঞ্চলে, সিনােসিফিলি থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দক্ষিণে, অ্যান্টিওকাসের সেনাবাহিনীর মুখােমুখী হলাে। রােমানরা সহজেই এক বীরত্বের জয় ছিনিয়ে নিল এবং অ্যান্টিওকাস ভয়ে এবং দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এশিয়া মাইনরে ফিরে গেলেন। এত কিছুর পরেও রােমানরা তৃপ্ত হলাে না। অ্যান্টিওকাস রােমানদের জায়গা, পারগামাম দখল করে থাকবেন এটা তাদের ভালাে লাগল না। রােডস এবং পারগামামের জাহাজ দিয়ে গঠিত একটি রােমান যুদ্ধের বহর অ্যান্টিওকাসের নৌবহরকে পরাজিত করল, এভাবেই লিজন এশিয়া মাইনরের উপকূলে তাদের প্রথম পদক্ষেপটি রাখল। তাদের মাথায় ছিল লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সিপিওর চিন্তা, যিনি হলেন সিপিও আফ্রিকানাসের ভাই (লুসিয়াস যেই প্রদেশের দায়িত্বে থাকতেন সেখানে রােমান সিনেটের আইন কিছুটা শিথিল থাকত। এরপর আফ্রিকানাসও সেই প্রদেশেই দ্বিতীয় নেতা হয়ে যেতে চাইলেন। এতেও রােমান সিনেটের কোনাে সমস্যা ছিল না)। খ্রিস্টপূর্ব ১৯০ সালে ম্যাগনেশিয়ায়, ঈজিয়ান সমুদ্র উপকূল থেকে চল্লিশ মাইল ভূমির দিকে একটি অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হলাে। সিপিও আফ্রিকানাস যুদ্ধের সময়ে বেশ খানিকটা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। কিন্তু রােমানরা তেমন কোনাে চেষ্টা ছাড়াই জয়লাভ করল। আর সেই জয়ের মধ্যে দিয়েই লুসিয়াস সিপিও ‘এশিয়াটিক’ নামটি অর্জন করলেন। অ্যান্টিওকাসের সঙ্গে হিসাবনিকাশ শেষ হয়ে গেল। শান্তিচুক্তিতে যে সমস্ত বিষয় ছিল তা মানতে গিয়ে অ্যান্টিওকাসকে এশিয়া মাইনর থেকে বহিষ্কৃত হতে হলাে। সেলুসিড রাজ্যের অর্থে পারগামাম এবং রােডস ধনী হয়ে উঠছিল। আর ওদিকে ঈজিয়ান সমুদ্রের এশিয়ার উপকূলে গ্রিক রাজ্যগুলাে স্বাধীনতা লাভ করল। অ্যান্টিওকাসকে বড়াে অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বােঝা ধরিয়ে দেয়া হলাে, আজকের দিনের হিসেবে কম করে হলেও তা তিরিশ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, অ্যান্টিওকাসকে রােমানদের চাপে স্বীকার করতে হলাে যে হ্যানিবলকে তিনি তাদের হাতে তুলে দেবেন। তিনি ভাবলেন এরকম একটা কাজ করা খুবই অবমাননার হবে এবং তাই নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন এবং হ্যানিবলকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করলেন।

হ্যানিবল ও সিপিওর মৃত্যু : বীর সে কার্থেজীয় পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন বিথিনিয়ায়, পারগামামের উত্তর-পশ্চিমে একটি হেলেনিস্টিক রাজ্য। সেখানে তিনি বিথিনিয়ান রাজ্যের রাজা প্রসিয়াসের মূল্যবান উপদেষ্টা হয়ে উঠলেন। আর তারপর বিথিনিয়ান রাজ্য যখন পারগামামের সঙ্গে ছােটোখাটো একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল, একটি সামুদ্রিক যুদ্ধে হ্যানিবলের নেতৃত্বে বিথিনিয়ান রাজ্যের বিজয় লাভ করল। এই বিজয় আবারাে রােমানদের দৃষ্টি তাদের প্রতি ফিরিয়ে আনল। তবে আগে থেকেই পারগামাম ছিল তাদের নিজস্ব এলাকা এবং হ্যানিবল ছিল তাদের চিরশত্রু। ফ্লেমিনিয়াসকেও খ্রিস্টপূর্ব ১৮৩ সালে বিথিনিয়ায় পাঠানাে হলাে, উদ্দেশ্য ছিল হ্যানিবলকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা। বিথিনিয়ার রাজাকে রাজি হতে হলাে। কিন্তু হ্যানিবল যখন দেখলেন সৈন্যেরা তার বাড়ি ঘেরাও করার জন্য এগিয়ে আসছে, তিনি রােমানদের হতাশ করে ফেললেন নিজের কাছে বরাবর রাখা বিষের শিশিটি ভেঙে। এভাবেই হ্যানিবলের মৃত্যু হলাে। ঘটনাটি ঘটেছিল ক্যানিতে তার বিজয় অর্জনের তেত্রিশ বছর এবং জামায় তার পরাজয় বরণের ঊনিশ বছর পরে। ম্যাগনেশিয়ায় যুদ্ধের পরে সিপিওর জীবনও হয়ে দাঁড়াল অনিশ্চিত। তিনি যখন এশিয়া থেকে ফিরে এলেন, দেখলেন যে তার রাজনৈতিক শত্রুরা রােমে বসে তার এয়ং তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা অভিযােগ আনল যে অ্যান্টিওকাস যখন ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশােধ করেছেন তখন তারা দুই ভাই সেখান থেকে কিছু অংশ সরিয়ে ফেলেছেন নিজেদের ব্যবহারের জন্য। লুসিয়াস সিপিও হিসাবনিকাশের বই তাদের দেখানাের জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু আফ্রিকানাস এই ব্যাপারটিতে অনেক ক্ষেপে গেলেন, হয় তিনি এতে অপমানিত হয়েছিলেন অথবা তিনি সত্যিই দোষী ছিলেন। সেজন্য তিনি ভাইয়ের কাছে থেকে হিসাবের বইগুলাে নিয়ে ছিড়ে ফেললেন। তখন শত্রুরা বইয়ের অভাবে আরাে বেশি করে নিশ্চিত হয়ে গেল যে তারা দুই ভাই সত্যিই দোষী। লুসিয়াসকে বড়াে অঙ্কের জরিমানা দিতে হলাে এবং অ্যান্টিওকাসের কাছে থেকে ঘুষ নেয়ার অপরাধে খ্রিস্টপূর্ব ২৮৫ সালে সিপিওকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলাে। তাকে দোষী ভাবার জন্য দিনটাও ছিল উপযুক্ত। সেটা ছিল জামার যুদ্ধের বর্ষপুর্তি এবং সে কারণে উপস্থিত মানুষজন উল্লাস প্রকাশ করছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৮৩ সালে সিপিও মৃত্যুবরণ করলেন এবং সেই একই বছরে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন হ্যানিবল। 

তৃতীয় মেসিডোন যুদ্ধ ও গ্রিক অঞ্চলের ওপর রোমান কর্তৃত্ব

রোমের কর্তৃত্ব ও গ্রিকদের পরাধীনতা : সিপিও আর হ্যানিবলের মৃত্যুর সময়ে রােমের অবস্থা এমন ছিল যে কোনাে দিক দিয়েই তার বিপদের কোনাে আশঙ্কা নেই, পূর্বের কথাই বলা হােক কিংবা পশ্চিমের। ভূমধ্যসাগরের উপকূল ধরে এগােলে একের পর এক অঞ্চল হয় রােমের আওতাভুক্ত, নয়তাে তার সঙ্গে কোনাে জোটের অন্তর্ভূক্ত কিংবা রােমের আগ্রাসনের ভয়ে কোণঠাসা। আর তাছাড়া পূর্বদিকে রােমের বাড়তি কোনাে জায়গা ছিল না। রােমের চারদিকের রাজ্যগুলাের প্রতি রােমের দু’রকমের দায়িত্ব ছিল, শক্তিশালী রাজ্য যেন দুর্বল হয়ে পড়ে সে চেষ্টা করা এবং দুর্বল রাজ্য যেন অবধারিতভাবে রােমের সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভরশীল হয় সেই ব্যবস্থা করা। এতকিছুর পরেও রােম খুব একটা শান্তিতে ছিল না। ম্যাসিডােনে বিদ্রোহের সম্ভাবনাটা রয়েই গিয়েছিল। পঞ্চম ফিলিপ যদিও অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়ে রােমকে সমর্থন দিয়েছেন এবং সিনােসিফিলির পরের কয়েক বছরে রােমের বিরুদ্ধে কোনাে পদক্ষেপ না নেয়ার ব্যাপারেও সতর্ক ছিলেন। যাই হােক, তলে তলে তিনি কাজ করে গেছেন, উত্তরের রাজ্যগুলাের মধ্য ম্যাসিডােনকে আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নিয়ােজিত থেকেছেন। অন্যদিকে নানান কৌশলে তিনি গ্রিক রাজ্যগুলােকে ভেতরে ভেতরে ক্ষেপিয়ে তুলছিলেন যারা চিরকাল ম্যাসিডােনের শাসনের ভারে অতিষ্ট ছিল আর তখন রােমান শাসনের ভারে। তারা যাকে “স্বাধীনতা” বলে জেনেছিল, তা আসলে ছিল কেবলই শাসকের পরিবর্তন।

তৃতীয় মেসিডোন যুদ্ধ ও মেসিডোনিয়ার পরিণতি : ফিলিপ ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করছিলেন, খুব ধীরে আর খুব সতর্কভাবে আর তখন নিজেরই এক পুত্র রােমের সমর্থক হয়ে উঠলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তিনি। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৯ সালে ফিলিপ তার পরিকল্পনা আধাআধি রেখেই মৃত্যুবরণ করলেন। তার পুত্র, পারসিয়াস তার জায়গায় অধিষ্ঠিত হলাে, যিনি ম্যাসিডােনকে আরাে শক্তিশালী করার কাজে নিয়ােজিত হলেন এবং গ্রিক রাজ্যগুলাে নিয়ে একটি নতুন জোট তৈরি করলেন। ইউমেনিস এবং পারগামাম শেষপর্যন্ত যুদ্ধের আশঙ্কা করতে শুরু করলেন এবং রােমে একটি বাহিনী পাঠালেন, বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিতে তারা সিনেটের কাছে অনুরােধ পাঠালেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৭২ সালে রােম বিপদের আশঙ্কা সত্য বলে ধরে নিল এবং যুদ্ধ শুরু করল। শুরু হয়ে গেল তৃতীয় ম্যাসিডােন যুদ্ধ। গ্রিকরা সঙ্গে সঙ্গে পারসিয়াসকে ত্যাগ করলো, এবং বিথিনিয়ানের উপরে যে ভরসা রাখা যাবে বলে ভাবা হয়েছিল, সেখানেও হতাশ হতে হলাে, তবে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের সময়কার মতােই বিশাল ম্যাসিডােনিয়া বাহিনীকে যুদ্ধে নামানাে হলাে যা হয়েছিল দেড় শতাব্দী আগে। প্রথম দিকে রােমানরা যুদ্ধে অতটা ভালাে করতে পারছিল না। ম্যাসিডোনীয় বাহিনী তাদের আগের ক্ষিপ্রতায় আক্রমণ করে যাচ্ছিল যেটা কয়েক বছর ধরে রােমানরা কল্পনাও করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত রােমান সিনেট একজন নতুন সেনাপ্রধানকে দায়িত্ব দিল। তিনি ছিলেন লুসিয়াস ঈমিলিয়াস পাউলাস, ক্যানিতে যে কনসল মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তার পুত্র। পাউলাস স্পেনের আদিবাসী দলের বিরুদ্ধে একসময় তার তীক্ষতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। ম্যাসিডােনিয়ার যুদ্ধেও তিনি মনােযােগের সঙ্গে আত্মনিয়ােগ করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৮ সালে তিনি পারসিয়াস বাহিনীকে পিডনায় যুদ্ধ করতে বাধ্য করলেন, যেটা ছিল ঈজিয়ান সমুদ্র উপকূলে ম্যাসিডােনেরই একটি অংশ। আর তারপর আবার, শেষবারের মতাে, ফ্যালাঙ্কস লিজনের মুখােমুখী হলাে। যতক্ষণ যুদ্ধটা সমতলে চলছিল, ফ্যালাঙ্কস ছিল অপরাজেয়; তাদের লম্বা তলােয়ারগুলাে নিয়ে তারা ক্রমাগত এগিয়ে আসছিল, তাদের একসঙ্গে দেখে মনে হচ্ছিল যেন বিশাল এক ভয়ঙ্কর সজারু যা লিজনকে গিলে খাবে। পাউলাস তার বাহিনীকে ফ্যালাঙ্কসের তলােয়ারগুলাের মাঝখান দিয়ে ঢুকে তাদের দুইভাগ করে ফেলতে নির্দেশ দিলেন। তাতে করে তাদের একতা নষ্ট হয়ে গেল এবং আর কোনােভাবেই একযােগে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারল না। ফ্যালাঙ্কস বাহিনী আর কখনােই কোনাে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। এবারে রােম ম্যাসিডােনের বিরুদ্ধে শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। পারসিয়াসকে রােমের বন্দিখানায় নিয়ে যাওয়া হলাে। সেখানেই বন্দি অবস্থায় তার মৃত্যু হলাে। যেখানে পাউলাস বীরের সম্মান পেলেন এবং তার নামের সঙ্গে “ম্যাসিডােনিকাস” শব্দটি জুড়ে দেয়া হলাে। মহামতি আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর ১৫৫ বছর পরে ম্যাসিডােনের আধিপত্যের অবসান হলাে। সেই রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে সেখানে চারটি পৃথক প্রজাতন্ত্রের উদ্ভব হলাে।

এপিরাস, রোড্‌স দ্বীপ ও আকিয়ান লীগের পরিণতি : রােম তখনাে পূর্ব দিকে তার ভূমি বাড়ানাের কোনাে চেষ্টা করেনি। কিন্তু পারসিয়াসের জন্য গ্রিকদের মায়াকান্নায় রােম যারপরনাই বিরক্তিতে ছিল। তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করার পরিকল্পনায় ছিল সে। রােমান সেনাবাহিনী এপিরাসে আক্রমণ করল, খানিকটা তখনকার রাগে আর খানিকটা সােয়া-একশ বছর আগে পিরাসের স্মৃতি মনে করে সেই পুরােনাে হিসাব নিকাশ শুধতে। রােডস ছিল আরেকটি শিকার। ফিলিপের এবং অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে, দুটো যুদ্ধের সময়েই সে রােমকে একান্তভাবে সমর্থন জানিয়ে আসছিল কিন্তু পারসিয়াসের বেলায় এসে দ্বিধায় পড়ল। ফলাফল হিসেবে রােম রােডসের ১৬০ মাইল উত্তর পশ্চিমে ডেলােস নামে এক স্থানে রােম একটি বন্দর প্রতিষ্ঠা করল এবং নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য সেখানে স্থানান্তর করল। রােডস নগরটি এতদিন তার নিজস্ব ব্যবসার উপরে নির্ভর করেই উন্নতি সাধন করে যাচ্ছিল, তখন রােমের বাণিজ্যের চাপে তার ক্রমাবনতি ঘটতে লাগল। তার আগে নগরটি দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে স্বাধীন ছিল। আরেকটি শিকার ছিল আকিয়ান জোট। ফিলিপের মৃত্যুর পর থেকেই এই ক্রোটটি পুরােপুরি রােমের সমর্থক হয়ে উঠল। পারসিয়াসের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও তারা কাকে সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। যদিও এর শাসনব্যবস্থার এক বড়াে অংশ ওই যুদ্ধের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছিল। রােম সেই সহায়তা নিতে আঙ্গীকার করে, রােমের মাথায় ছিল যে গ্রিকদের উপরে কোনাে কিছুতেই ভরসা করা যায় না। যুদ্ধের পরে ওই জোটকে অল্প স্বল্প শাস্তি দেবার কথাও ভেবেছিল রােম। ওই জােটের হাজারখানেক নেতাকে বন্দি করে রােমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। 

পলিবিয়াস, ছোট সিপিও ও টেরান্স :

  • পলিবিয়াস : রোমে নিয়ে যাওয়া বন্দী আকিয়ান লীগ নেতাদের মধ্যে পলিবিয়াসকেও নিয়ে যাওয়া হলাে, যিনি পারসিয়াসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়ে একটি আকিয়ান বাহিনী নিয়ে রােমের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। তবে এ কথা জানা ছিল যে পলিবিয়াস একজন নিরপেক্ষ মানুষ। তাই তার নেতৃত্বে বাহিনী আসাতেও রােমানরা তৃপ্ত হয়নি। তবে তার জন্য সৌভাগ্যের কথা যে পলিবিয়াস নিজে ছিলেন খুবই উঁচুদরের মানুষ এবং রােমান সেনাপ্রধান পাউলাস ম্যাসিডােনিকাসের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পাউলাসের পুত্রদের শিক্ষক হিসেবে নিয়ােগ পান তিনি।
  • ছোট সিপিও : পাউলাসের কনিষ্ঠ পুত্র, যিনি তার পিতার সঙ্গে পিনডার যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, পরে সিপিও আফ্রিকানাসের দত্তক পুত্র হয়ে গিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে পাবলিয়াস কর্নেলিয়াস সিপিও ঈমিলিয়ানাস নামে খ্যাত হন। তবে এই নামের চেয়ে তিনি “ছােটো সিপিও” নামে এখন বেশি পরিচিত এবং তার বিখ্যাত দাদার পরিচয় হলাে “বড়াে সিপিও”। ছােটো সিপিও ছিলেন গ্রিকপ্রেমী রােমানদের মধ্যে বড়াে উদাহরণ। রােমে তিনি ছেলেদের দাঁড়ি কামানাের নিয়ম চালু করেছিলেন, এই সংস্কৃতি গ্রিস থেকেই এসেছিল, যেখানে মহামতি আলেক্সান্ডার এটি প্রথম করেছিলেন। তিনি মানুষকে শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করারও চেষ্টা করেন, তিনি গ্রিক এবং রােমান শিক্ষা চালু করেন।
  • টেরান্স : সিপিও আশেপাশে, যেমন ছিলেন গাইয়াস লুসিয়াস, যিনি প্রথম রােমান রম্যরচয়িতা। তার সঙ্গীসাথিদের মধ্যে আরেকজন হলেন পাবলিয়াস ট্যারেনটিয়াস, ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষ যাকে বলে টেরান্স। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন কার্থেজের মানুষ এবং রােমের একজন সিনেট সদস্যের দাস হিসেবে তাকে রােমে আনা হয়। দাস টেরেন্সের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে সিনেট সদস্য তাকে পড়ালেখা করার সুযােগ দেন এবং দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেন। আর তারপর তরুণ শিক্ষিত কার্থেজীয় মানুষটি সিনেট সদস্যের নামের পদবী নিজের নামে ব্যবহারেরও সুযােগ পান। টেরান্স পরবর্তী কালে নাটক লেখার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন, যেমন হয়েছিলেন প্লটাস। তাদের কিছু নাটক গ্রিক পটভূমিতে আর কিছু নাটক গ্রিক নাটকের অনুবাদ। টেরান্সের নাটকগুলাে তার সমৃদ্ধ ভাষার জন্য বিশেষভাবে স্মরণযােগ্য, টেরান্স সৈন্যের মুখের ল্যাটিন থেকে সেটিকে কৃষকের মুখে বসিয়েছিলেন নিজস্ব ভঙ্গিতে করা পরিবর্তনের মাধ্যমে। তবে প্লুটাসের নাটকের চেয়ে টেরান্সের নাটকে রম্যরস কম ছিল।

প্রাচীনপন্থী কাটো : রােমের স্বভাব হয়ে দাঁড়াল গ্রিসের যাবতীয় কৃষ্টিকে সমর্থন করা। তবে তাদের মধ্যে যারা প্রাচীনপন্থী রােমান ছিলেন তারা এটাকে বিদেশি আগ্রাসন হিসেবে দেখতেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন মারকাস পরশিয়াস কাটো। খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ফেবিয়াসের নেতৃত্বে হ্যানিবলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। জামার যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানে সিপিওর চক্ষুশূল হয়ে পড়েন যার কড়া সমালোচনা করেছিলেন তিনি। পরে তিনি স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধেও লড়েন। কাটো ছিল রােমের প্রাচীন কৃষ্টির প্রতীক; তিনি ছিলেন সৎ, দায়িত্বের প্রতি ভীষণ সচেতন, ঠান্ডা মাথার মানুষ, কিছুটা নিষ্ঠুর, কিছুটা অনুমানের বাইরে এবং খানিকটা সংকীর্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন। তার নিজের স্ত্রী-সন্তানের প্রতি তিনি যেমন উদাসীন ছিলেন, দাসদের প্রতিও ছিলেন নিষ্ঠুর। খ্রিস্টপূর্ব ১৮৪ সালে তিনি সেনসর নির্বচিত হন এবং রাতারাতি যেসব নিয়মকানুন তার মতের বিরুদ্ধে, সেসব নিয়মকানুন তুলে দেন। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লুসিয়াস সিপিও এশিয়াটিকাসকে তিনি নিজ সন্তানদের সামনে তার নিজ স্ত্রীকে চুম্বন করার জন্য জরিমানা করেন (অবশ্য সিপিওদের প্রতি তার অবজ্ঞা এই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে)। দাপ্তরিক কাজেকর্মে তাকে প্রায়ই “কাটো দ্য সেনসর” বলে ডাকা হতাে। সুনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বেশ উচু মানের কর্মদক্ষতার মধ্যে দিয়ে কাটো কাজ করতেন এবং কোনাে অন্যায়ের ব্যাপারে কোনােরকমের সহানুভূতি প্রদর্শন করতেন না। পরে রােমানরা তার প্রশংসাই করত তবে কখনাে তার পথ অনুসরণ করেনি। কাটো ছিলেন ল্যাটিন ভাষয়ায় প্রথম দিককার গদ্য লেখকদের মধ্যে একজন। তিনি রােমের ইতিহাসও রচনা করেন যেটিতে বিশেষ করে কৃষিকাজে উল্লেখ ছিল। সম্ভবত কবি ঈনিয়াসের কাছে তিনি গ্রিক ভাষার শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে গ্রিক ভাষা থেকে শুরু করে বাকি সমস্ত গ্রিক জিনিসের প্রতি তার বিরূপ মনােভাব ছিল। 

পলিবিয়াসের সাথে কাটোর দ্বন্দ্ব, দ্বন্দ্বের অবসান, গ্রিকদের প্রত্যাবর্তন ও আন্দোলনের স্ফূলিঙ্গ : যেহেতু পলিবিয়াস এবং আরাে কিছু গ্রিক বন্দি, যারা বন্দি হয়ে রােমে ছিলেন, তারা ছিলেন ছােটো সিপিওর বন্ধু, তাই তারাও সিপিওদের শত্রু কাটোকে শত্রু জ্ঞান করতেন। আর তাই বছরের পর বছর ধরে পলিবিয়াস সিপিওদের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মিলে আকিয়ান বন্দিদের রােম থেকে ছাড়িয়ে গ্রিসে ফেরত পাঠানাের চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু এরকম কোনাে চেষ্টা দেখলেই কাটো সেখানে বাধা দিতেন। সিপিও কাটোর বিরুদ্ধে সেভাবে লড়েননি, আবার তাকে সমর্থনও করতে পারেননি, তবে জীবনভর তিনি গ্রিক সংস্কৃতির পূজা করে গেছেন। শেষপর্যন্ত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে যখন ছােটো সিপিও সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। যদিও তখন স্পেনে রােমের ঘাঁটি পাকাপােক্ত, তবুও, স্পেনের কিছু আদিবাসী তখন বেশ বিদ্রোহ করে চলেছিল এবং উত্তর দিকে তারা নাছােড়বান্দার মতাে রােমানদের বিরুদ্ধে ছােটোখাটো লড়াই বাধিয়ে রেখেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৫১ সালে ছােটো সিপিও সেখানে যান এবং তার বুদ্ধিমত্তার কৌশল, তথা সুস্থ বিবেচনাবােধ ব্যবহার করে স্পেনের উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করেন। তিনি সেখানে শান্তি স্থাপনের পরে যখন রােমে ফেরত আসেন, প্রাচীনপন্থী কাটো তার উপরে খুশি হয়ে তার চাহিদামতাে গ্রিক বন্দিদের মুক্ত করে গ্রিসে পাঠানাের ব্যবস্থা করেন। তবে সেই বন্দিমুক্তির ঘটনাটা তিনি ঘটিয়েছিলেন হঠাৎ করেই। গ্রিক বন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে কি না, এই নিয়ে যখন সিনেটে বিতর্ক হচিছল, তিনি মাঝপথে তাদের থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আচ্ছা, আমাদের কি এখানে দিনভর বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই? আমরা কি সারাদিন এই নিয়েই থাকব যে বুড়াে গ্রিকদের কফিনগুলাে এখানে বানানাে হবে নাকি গ্রিসে?” সুতরাং, সতেরাে বছর বন্দিত্বের পরে গ্রিক বন্দিরা তখন নিজেদের জায়গায় ফিরতে পারল। পলিবিয়াস সিপিওদের কাছে তার ঋণ শােধ করেছিলেন অনেক আগেই, পৃথিবীর ইতিহাসে রােমের প্রকাণ্ড হয়ে ওঠার কাহিনি তিনি রচনা করেছিলেন। সেই ইতিহাসের কিছুটা অংশ এখনাে বিদ্যমান। তবে রােমের সবচেয়ে বড়াে বড়াে বীরত্বের কাহিনির যে ইতিহাস আমাদের সামনে বিদ্যমান, তা গ্রিক ভাষাতেই লেখা। গ্রিক বন্দিদের উপরে সবচেয়ে বড়াে যে অবিচার করা হয়েছিল, তা হলো, সামান্য কারণে তাদেরকে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়, আর খামােখাই গ্রিকদেরকে রােমের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তােলার ক্ষেত্রে মদদ দেয়া হয়। তাই গ্রিকরাও সুন্দর একটি সুযােগের জন্য অপেক্ষা করছিল। 

কার্থেজের সমাপ্তি 

কার্থেজের অবস্থা ও কাটোর কার্থেজ ধ্বংসের অভিপ্রায় : জামার যুদ্ধের পর থেকেই কার্থেজ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। নিজেদের ভেতরের সমস্যারও সমাধান যেমন করতে চাচ্ছিল তারা, তেমনি রােমানরা যেন তাদের বিরুদ্ধে নতুন কোনাে যুদ্ধের কারণ খুঁজে না পায়, সে ব্যাপারেও সচেষ্ট ছিল। তবে সত্যি কথা বলতে কী, যুদ্ধ লাগানাের ব্যাপারে রােমানদের খুব সামান্য কারণ হলেই চলত। আর তাছাড়া হ্যানিবলের বিজয় এবং কার্থেজের আক্রমণের কথা ভােলা রােমানদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ম্যাসিনিসা, রােমানদের উপযাজক হয়ে যাবতীয় কাজ করেছিলেন যাতে কার্থেজের লােকেদের জীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি কার্থেজদের এলাকায় প্রবেশ করে তাদেরকে নানারকমের অত্যাচার থেকে শুরু করে তাদের এলাকায় তল্লাসী চালাতেন। আর কার্থেজের লােকেরা যখন রােমান শাসকদের কাছে অভিযােগ নিয়ে আসত, তারা কানে তুলতেন না। খ্রিস্টপূর্ব ১৫৭ সালে কার্থেজের সবচেয়ে বড়াে শত্রু ছিলেন কাটো, ম্যাসিনিসা এবং কার্থেজের মধ্যে ঝামেলা মেটানাের জন্য রােম যে বাহিনী আফ্রিকায় পাঠিয়েছিল, তিনি ছিলেন সেই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। কাটোর জন্য সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় ছিল যে কার্থেজ দিনদিন উন্নতি করছে এবং তার অধিবাসীরা সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। কাথেজের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখলেই তিনি অসহিষ্ণু হয়ে পড়তেন এবং এর বিরুদ্ধে। কী করা যায় সেই বিষয়ে মানুষের মতামত নিতেন। আর সেই সময় থেকে তিনি যে কারণেই হােক, আর যে স্থানেই হােক বক্তৃতা দিতে গেলে তার বক্তব্য শেষ হতাে একটিই বাক্যে, “আমার মত হলো কার্থেজকে ধ্বংস করতেই হবে।” আসলে কার্থেজের উন্নতির বিষয়টা তার কাছে কেবল গর্ব খর্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কার্থেজ যেখানে বাণিজ্য পুনরুদ্ধার করে চলছিল, দেখা গেল ওয়াইন এক জ্বালানী সরবরাহের ক্ষেত্রে কার্থেজ ইতালির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগােচ্ছিল। এতে করে ইতালির অধিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। কিন্তু, এটা সত্য যে তার নিজস্ব সবিধান বিষয়টা দেশপ্রেমের মােড়কের নীচে লুকানাে ছিল।

তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধের পটভূমি : খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ সালে কাটো শেষ পর্যন্ত সুযােগ পেয়ে গেলেন। ম্যাসিনিসার কারণে অতিষ্ট কার্থেজ তার ক্লান্তিহীন শত্রুদের মােকাবেলা করার জন্য অস্ত্র তুলে নিল। তখন যুদ্ধ শুরু হলাে, যে যুদ্ধে ম্যাসিনিসার বিজয় হলাে এবং কার্থেজের লােকেরা বুঝে গেল যে রােম নিশ্চই তাদের উপরে নজর রেখেছে, ভাবছে যে কার্থেজ তাদের অনুমতি না নিয়ে অন্য জাতির উপরে আক্রমণ করে শান্তিচুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে। কার্থেজ রােমকে বুঝিয়ে বলার জন্য একটি দল পাঠাল এবং যুদ্ধের আয়ােজনে যেসব সেনাপ্রধানের ভূমিকা ছিল তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করল। আর এত কিছুর পরেও কার্থেজ আসলে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, আর তাই, তখন শান্তি স্থাপনের জন্য যা প্রয়ােজন তাই করার জন্য রাজি ছিল। কিন্তু রােম তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করল। 

তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধ : রােমান সেনাবাহিনী কার্থেজে এসে পৌঁছানাে মাত্রই তারা তাদের দাবি অনুযায়ী সমস্ত কিছু করার প্রস্তুতি নিয়ে নিল, এমনকি তারা তাদের অস্ত্র সমর্পণ করতেও প্রস্তুত হলাে। কিন্তু রােমানরা যা চাইল, তা হলাে কার্থেজের লােকদের কার্থেজ ছেড়ে চলে যেতে হবে; তারা যেন সমুদ্র থেকে অন্তত দশ মাইল দূরে কোনাে একটা জায়গায় নতুন নগর তৈরি করে সেখান গিয়ে বসবাস শুরু করে। আতঙ্কিত কার্থেজবাসী এই পদক্ষেপে একমত হতে পারল না। তাদের নগর যদি ধ্বংস করা হয় তবে তারাও তার সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যাবে, এমন অপেক্ষায় থাকল। সাহস সঞ্চয় করে কার্থেজবাসী নিজেদের জায়গায় অনঢ় থাকল এবং নগরের তােরণগুলাে বন্ধ করে নিজেদেরকে নিজেদের নগরের ভেতরে বন্দি করল তারা। হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে অস্ত্র তৈরি করতে লাগল, নতি স্বীকার না করে তারা কেবল লড়াই করে যেতে লাগল। দুই বছর ধরে যুদ্ধে চলার পরে বিস্মিত রােমানরা আবিষ্কার করল যে কার্থেজের মানুষদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত পদক্ষেপ তারা হাতে নিয়েছে, সবই ব্যর্থ হয়েছে। ওই যুদ্ধের দুই বছরের মধ্যে কার্থেজের দুই প্রধান শত্রু কাটো এবং ম্যাসিনিসার মৃত্যু হয়েছে। কাটো মারা গেছেন পঁচাশি বছর বয়সে এবং ম্যানিনিসা নব্বইয়ে। কার্থেজকে পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে দেখা ওই দুই প্রৌঢ়ের ভাগ্যে জোটেনি। তার ওপরে, বলতে গেলে দুজনেই দিনের পর দিন কার্থেজের মনােবলের কাছে রােমের ভারী অস্ত্রকে হার মেনে যেতে দেখে গেছেন। তবে শেষ যে প্রাপ্তি কার্থেজের ঝুলিতে এসেছিল, তা হলাে, পরবর্তী প্রজন্মের পক্ষপাতিত্ব এবং সম্মান অর্জন করেছিল কার্থেজ, যেখানে তার বিরুদ্ধে রােমের যুদ্ধকে কেবল নিষ্ঠুর এবং কাপুরুষােচিত কাজ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৭ সালে ছােটো সিপিওকে কার্থেজে পাঠানাে হয়। তিনি নতুন করে মানুষের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন, হয়তো তার উপস্থিতি কিংবা নামেই কাজ হবে, এমনটাই ভেবেছিল রােম। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ সালে কার্থেজকে শেষ পর্যন্ত পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়।

কার্থেজের পরিণতি : কার্থেজের অধিবাসীদের মধ্যে যারা আগুনে আত্মাহুতি দিতে চায়নি, তাদেরকে হয় জবাই করা হয়েছিল, নয়তাে দাসে পরিণত করা হয়েছিল এবং এই অসামান্য কাজের জন্যই ছােটো সিপিওর নামের সঙ্গে আরেকটি পদবী যুক্ত হয়েছিল, “ছােটো আফ্রিকানাস”। কার্থেজকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার পরে স্থানটি রােমের আওতায় নিয়ে নেয়া হলাে, আফ্রিকার একটি প্রদেশ হিসেবে নেয়া হলাে তাকে। রােমানদের ইচ্ছে ছিল যে ধ্বংসপ্রাপ্ত কার্থেজের জায়গায় অন্য কোনাে নগর তৈরি হবে না। তবে তারও এক শতাব্দী পরে নতুন এক কার্থেজের জন্ম হয়। তবে এবারের কার্থেজ রােমান কার্থেজ। আগের কার্থেজের সেই ফিনিশীয় সংস্কৃতি চিরকালের মতাে হারিয়ে যায়। পলিবিয়াস গ্রিসে বেশিদিন থাকতে পারেননি। কিন্তু আফ্রিকায় তার বন্ধু সিপিওর সঙ্গে থাকার জন্য ছুটে গেছেন, এবং দেখতে গেছেন সেই বিশাল ঘটনা যা তার ইতিহাস সমাপ্ত করে। তার ভাষ্যমতে, সিপিও চিন্তিত মুখে কার্থেজকে পুড়ে পুড়ে ধ্বংস হতে দেখেছেন এবং হােমারের কবিতা থেকে কলি উদ্ধৃত করে নিজেকে বলেছেন। পলিবিয়াস জানতে চেয়েছিলেন যে সিপিও তখন কী ভাবছেন, আর সিপিও উত্তর দিয়েছিলেন যে ইতিহাসের যেমন উত্থান আছে, তেমনি পতনও আছে এবং তার এই চিন্তাকে তিনি কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছেন না যে আজ কার্থেজ যেভাবে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে, একদিন রােমও সেভাবেই হতে পারে। সিপিওর ভাবনা সত্য ছিল। তখন থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাব্দী পরে কােন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং অনুপ্রবেশকারীরা এসেছিল সেই কার্থেজ থেকেই। 

মেসিডোনিয়া ও আকিয়ান লীগের অবসান

চতুর্থ মেসিডোনের যুদ্ধ ও মেসিডোনিয়ার অবসান : রােমানরা যখন কার্থেজ ধ্বংসের আগে শেষ যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল, পূর্ব দিক থেকে নতুন ধ্বংসের আলামত পাওয়া গেল। গ্রিস এবং ম্যাসিডােনের মধ্যে পরােক্ষ যুদ্ধ লেগে গেছে। রােমান রাজ্য সেই স্থানগুলােতে নিজেরা সরাসরি শাসনকাজ চালায় না তবে সেই স্থানের নিজস্ব কোনাে সরকারকেও শক্তিশালী বা পাকাপােক্ত হিসেবে আবির্ভূত হতে দেয় না। আর তাই সেই পুরাে এলাকাগুলােই ছিল নির্মম রাজনীতির শিকার এবং সমুদ্র উপকূল ছিল সন্ত্রাসের আড্ডা। সেখানে ছিল চারটি ভিন্ন রাজ্য যাদের সঙ্গে ম্যাসিডােনের ক্রমাগত বােঝাপড়া করে চলতে হতাে। অনেক গ্রিক তখন মনে করল যে এটাই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ঝাপিয়ে পড়ার উপযুক্ত সময়। ম্যাসিডােনের একজন অতি উৎসাহী মানুষ, যার নাম ছিল অ্যাসিকাস, যিনি নিজেকে পারসিয়াসের পুত্র বলে দাবি করেছিলেন, তিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৪৮ সালে নিজেকে ম্যাসিডােনের রাজা হিসেবে ঘােষণা করেছিলেন। তিনি গ্রিক নগরীগুলাের মধ্যে জোট তৈরিতে সমর্থ হন এবং কার্থেজের দরিদ্র ও মৃতপ্রায় কিছু নগরকেও সেই জোটে নিয়ে আসেন। রােমানরা তখনই কুইন্টাস সিসিলিয়াস মেটেলাসের অধীনে একটি বাহিনী পাঠায়, যারা সহজেই অ্যাসিকাসকে যুদ্ধে পরাজিত করে। এই যুদ্ধটি ইতিহাতে চতুর্থ ম্যাসিডােনের যুদ্ধ বলে খ্যাত। সেটাই ছিল ম্যাসিডােনের দীর্ঘ স্বাধীনতা ভােগের অবসানের যুদ্ধ। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ সালে সেটি পুরােপুরি রােমান প্রদেশে পরিণত হলাে। আর এর মাধ্যমেই রােম পূর্বদিকে বর্ধিত হতে শুরু করল। 

আকিয়ান লীগের পরাজয় ও অবসান : কিন্তু গ্রিসের বিষয়টা অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। আকিয়ান জোট রােমকে পরাজিত করার জন্য এতটাই অধীর হয়ে উঠেছিল যে পিছিয়ে যাবার কোনাে উপায় আর তাদের হাতে ছিল না। মেটেলাসের বাহিনীকে লাঞ্ছিত করায় তারা দক্ষিণের দিকে রওনা দেয়। তিনি ছিলেন গ্রিক সংস্কৃতিপ্রেমী, আর তাই তিনি গ্রিসকে কোমলভাবে নাড়াচাড়া করতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ১৪৬ সালে তার জায়গায় লুসিয়াস মিউমিয়াসকে বসিয়ে দেয়া হলাে, যার শিক্ষাদীক্ষা ছিল কম। স্পেনে মিউমিয়াস সৈন্য থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন এবং তার কাছে গ্রিসের মানুষের কোনাে কদর ছিল না। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। আকিয়ান জোটের প্রধান নগর ছিল করিন্থ। মিউমিয়াস যখন আক্রমণ করে বসল তখন কারিন্থ কোনােরকমের প্রতিরােধ করল না, বরং আত্মসমর্পণ করল, আর তাই বােঝা গেল যে আকিয়ান যুদ্ধ আসলে শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেছিল। কিন্তু মিউমিয়াস এটা চায়নি। সে যত ধ্বংস চালাবে ভেবেছিল, তাই করতে লাগল, মনে হলাে যেন করিন্থ নগরটার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল, লুটপাট আর হত্যার ঝড়। সেখানকার অধিবাসীরা হয় হত্যার শিকার হলাে, নয়তাে তাদের দাস বানিয়ে নিয়ে যাওয়া হলাে আর সেখানে যত মূল্যবান শিল্প ছিল, সমস্ত রােমে স্থানান্তর করা হলাে। মিউমিয়াস, যার শিল্পের সম্পর্কে কোনে ধারণাই ছিল না, চিত্রশিল্পগুলাে জাহাজে উঠানাের সময়ে তিনি জাহাজের ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত চিৎকার শুরু করলেন তিনি বললেন, “এই চিত্রশিল্পগুলাে কোথাও যেন এতটকু নষ্ট না হয়, আর পরে তিনি আরাে হাস্যকর একটি হমকি দিলেন তাদের, যদি একটুও নষ্ট হয় তবে তােমাকে সেটি আবার বানিয়ে দিতে হবে কিন্তু।” আকিয়ান জোটের সমাপ্তি ঘটল এবং বিপুল সমাদৃত গ্রিক সংস্কৃতির স্বাধীনতাও ধ্বংসপ্রাপ্ত হলাে। 

স্পেন, পারগামাম ও সেলুসিড সাম্রাজ্যের পরিণতি

স্পেনের আদিবাসীদের রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, পরাজয় ও পরিণতি : পশ্চিমের শেষ প্রান্তেও রােমান অস্ত্রের ঝনঝনানি শােনা যাচ্ছিল। পশ্চিম স্পেনের আদিবাসী মানুষেরা (“লুসিতানিয়া”, যারা নিজেদের অঞ্চলটিকে পর্তুগালের একটি আধনিক নগরে পরিণত করতে চাচ্ছিল), রােমের নিষ্ঠুর শাসকদের বিরুদ্ধে জোর আওয়াজ তুলছিল, তাদের নেতা ছিল লুসিতানিয়ার একজন মেষপালক, ভিরিথাস। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৩৯ সাল পর্যন্ত ভিরিথাসের নেতৃত্বে সফলভাবে বােমের বিরুদ্ধে এক গেরিলা যুদ্ধ চলতে থাকে। একবার এক পাহাড়ের পাশের উপত্যকায় একটি রােমান সেনাবাহিনীকে তিনি আটক করেন এবং একটি সাময়িক শান্তি চুক্তিতে সাক্ষর করতে বাধ্য করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৯ সালে ভিরিথাসের কিছু বন্ধকে রােমের শাসকেরা অর্থ দিয়ে নিজেদের পক্ষে নিয়ে নেয়। আর তাদের সাহায্যেই লুসিতানিয়ান মেষপালক রােমানদের হাতে বন্দি হয়ে যায়। আর একইভাবে লুসিতানিয়ার জনগণকেও নজরবন্দি করে ফেলা হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩ সালে ছোট সিপিও আবার ফিরে এলেন (অনেকদিন বিরতির পরে), এসেই উত্তর পশ্চিমে স্পেনের নামিবিয়া নগর দখল করে ফেললেন। ওটাই হয়ে উঠল স্পেনে রােমের ঘাঁটি এবং উত্তর স্পেন হয়ে উঠল রােমান আওতাভুক্ত। আর তারপর স্পেনের কেবল উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের শেষ মাথায় সামান্য কিছু আদিবাসীদের কাছেই কেবল স্বাধীনতা নামক বস্তুটি তখনাে অক্ষত ছিল। 

রোমের কাছে পারগামামের সমর্পন : একই বছরে রােম এশিয়ায় প্রথম পা রাখতে পরল। পারগামামের রাজা, রােমের চিরকালের সমর্থক এবং দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিলেন তৃতীয় অ্যাটালাস। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮ সালে তিনি সিংহাসনে আরােহণ করেছিলেন, সরাসরি তার কোনাে উত্তরাধিকারী ছিল না এবং কাউকে আশাও করা যায়নি। তিনি যদি সে বিষয়টির সমাধান না করেই মরে যান, তবে, তার রাজ্য এশিয়া মাইনরের অন্য কারাের হাতে চলে যাবার সম্ভাবনা এবং রােমানরা তখন তাদের উপরে অত্যাচার চালাবে। সেই অবধারিত ঘটনাকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়া ছাড়া তার আর কোনাে উপায় ছিল না। তাই তিনি নিজের রাজ্য রােমের হাতে দিয়ে চলে যাবার জন্য একটি দলিল করে ফেললেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩ সালে তিনি যখন মৃত্যুবরণ করলেন, রােম উপহারটা মেনে নিল। এবং ভূমিটিকে এশিয়ার একটি প্রদেশ হিসেবে পরিচিত হলাে। কিছু পারগামিনিস আদিবাসীদের তখন তাদের পরাস্ত করতে হলাে, কারণ তারা রােমের অধীনে থাকতে রাজি হচ্ছিল না। তবে সেটা করতে রােমের খানিকটা কষ্ট করতে হয়েছিল, তবে, খ্রিস্টপূর্ব ১২৯ সালের মধ্যে অঞ্চলটি পুরােপুরি শান্ত হয়ে গেল। 

সেলুসিড সাম্রাজ্যের দুর্বল হয়ে যাওয়া : খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩ সালে তাই ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের যেদিকেই তাকানাে যেত, রােমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা কোনাে না কোনাে অঞ্চল চোখে পড়ত। তার মাত্র এক শতাব্দী আগে তারা কেবল ইতালিকেই নিয়ন্ত্রণ করত। আর তখন বলতে গেলে স্পেনের প্রায় পুরােটাই তাদের। এমনকি মধ্য আফ্রিকার উত্তর দিকটাও তাদের, ম্যাসিডােন, গ্রিস, এবং পারগামাম, আর ওদিকে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের পশ্চিম এবং মধ্যবর্তী অঞ্চল। সাগরের তীরবর্তী কিছু নগর ছিল যা সরাসরি রোমের অধীনে নয় তবে কোনাে না কোনােভাবে তারা রোমের সঙ্গে কোনো অন্তর্ভুক্ত, তাই রােমান শাসনেই তাদের চলতে হতাে। ওদিকে মিশরের শাসন ব্যবস্থা তখন এমন যে সেখানে স্বাধীন রাজা ছিলেন কিন্তু তিনি রােমান শাসকদের হাতের পুতুল ছাড়া অন্য কিছু ছিলেন না। সেলুসিড রাজ্য কিছু কালের জন্য কিছু ক্ষমতা অর্জন করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭ সালে তৃতীয় অ্যান্টিওকাস মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তারপরে তার পুত্রেরা রাজ্যের ভার গ্রহণ করলে রােমের দ্বারা সংগঠিত ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে এনেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫ সালে চতুর্থ অ্যান্টিওকাস সিংহাসনে আরােহণ করলেন। ম্যাগনেশিয়ার যুদ্ধের পরে তাকে রােমে যেতে হলাে বন্দি হিসেবে এবং সেখানে তাকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হলাে। সে যাই হােক, রাজা থাকা অবস্থায় তিনি ভাবতেন মিশরীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনবেন। কিন্তু তার আগেই রােমানরা তার সম্ভাবনা ধ্বংস করল। চতুর্থ অ্যান্টিওকাস তখন আশেপাশে নতুন এবং তুলনমূলকভাবে বিজয়ের সম্ভবনা বেশি হতে পারে এমন যুদ্ধের অপেক্ষায় ছিলেন। জুডিয়া তার অধীনে ছিল। তিনি হঠাৎ করে ইহুদি ধর্ম নিষিদ্ধ ঘােষনা করলেন এবং ইহুদিদের গ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে যেতে আদেশ দিলেন। ফলশ্রুতিতে ইহুদিরা বিদ্রোহ করে বসল এবং ম্যাকাবিসের অধীনে একটি নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করল। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৩ সালে চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের মৃত্যুর পরে সেলুসিড রাজ্য শেষবারের মতাে ভেঙে পড়তে লাগল। পূর্বদিকে আদি অধিবাসীরা, মহামতি আলেক্সান্ডার যাদের দমিয়ে রেখেছিলেন আর তারপরে তৃতীয় অ্যান্টিওকাস তাদের একইভাবে বিদ্রোহবিহীন রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন, তখন তারা হঠাৎ জেগে উঠল এবং নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হলাে। কিছুদিনের মধ্যে তারা ব্যাবিলনও দখল করল। এরপর বিশাল সেলুসিড রাজ্য কেবলমাত্র সিরিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। তাদের ক্ষমতার যাবতীয় চর্চা এবং যুদ্ধ তখন সেলুসিড রাজ্যগুলাের মধ্যেই ঘটতে থাকল। আর রােমকে ঠেকানাের মতাে কোনাে শক্তি আর তাদের মধ্যে অবশিষ্ট রইল না।

রোমের আভ্যন্তরীন সমস্যাসমূহ

সম্পদ ও দাসত্বের সমস্যা

রোমের আর্থিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি : অবধারিতভাবে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রােম ছিল লাভজনক একটি রাজ্য, বিশেষ করে পূর্বদিকে তার যে প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলাে ছিল, সেই বহুবছরের সভ্যতা অর্জনকারী রাজ্যগুলােকে পরাজিত করে প্রচুর ধনসম্পদ আয়ত্ব করেছিল। সম্পদের আহরণ বলতে গেল কার্থেজ থেকে শুরু করে ম্যাসিডােন, সিরিয়া, এমনকি বিভিন্ন প্রদেশসহ সমস্ত দিক থেকে সমস্ত সম্পদ কেবল রােমেরর দিকে ধাবিত হয়েছে। সােজা কথায়, রােম যেন চতুর্দিক থেকে সম্পদের বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৭ সালে, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে পিডনার যুদ্ধের পরে এবং ম্যাসিডােনের সর্ব শেষ পরাজয়ের পরে রােমের শাসকদের হাতে এত বেশি সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠল যে রােমের নাগরিকদের সব ধরণের কর মওকুফ করে দেয়া হলাে। অন্য রাজ্যের যে নাগরিকদের পরাজিত করে রােমানরা রাজ্য দখল করেছিল, সেসব স্থানের নাগরিকরাও তাদের সমর্থন করতে শুরু করল। 

কৃষকের সংখ্যার হ্রাস : তবে রােমের মতাে রাজ্যও কোনাে ত্যাগ স্বীকার না করে নিজেদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাবান রাজ্য হিসেবে পরিচিত করতে পারেনি। এক শতাব্দীর যুদ্ধ এবং সংগ্রাম রােমান সমাজকে বদলে দিয়েছিল। পিউনিক যুদ্ধের আগে, ক্ষুদ্র কৃষকেরা রােমের প্রধান শক্তি ছিল, বলতে গেলে মেরুদণ্ড। কৃষকেরা বছরের কিছু সময়ে কষিকাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত এবং বাকি সময় সেনা সদস্য হয়ে যুদ্ধ করতে যেত। তাদের বাড়ির আশেপাশেই তাদের জন্য ছােটোখাটো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হতাে। এক শতাব্দী ব্যাপী বিচিত্র যুদ্ধের কারণে দেখা গেল সেইরকম অনেক যােদ্ধা তথা কৃষক মারা পড়েছেন (হিসাবমতাে খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩ সালে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালের চেয়ে অনেক কম মানুষ তথা কৃষক ছিলেন রোমে)। আর এই কারণে তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলাে। ইতালির বড়াে অংশ হ্যানিবলের হাতে ধ্বংস হয়েছিল, কিংবা ধ্বংস হয়েছিল রােমের নিজেরই হাতে, কার্থেজ বাহিনীর সঙ্গে যােগদান করার অপরাধের শাস্তি হিসেবে। এরপরে যুদ্ধে যােগদানের আহ্বান এত বিস্তৃত হলাে যে মানুষ যেখানেই থাকুক সে আহ্বানে সাড়া দিতে শুরু করল। তখন আর একজন মানুষ একই সঙ্গে কৃষক এবং যােদ্ধা থাকতে পারল না। যােদ্ধাকে তখন অস্ত্র চালানাের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করতে হলাে।

কৃষকদের দূরবস্থা ও প্রোলেতারিয়েত : রােমের কোষাগারে যেহেতু অর্থ জমা হয়ে যাচ্ছিল এবং কোনাে না কোনােভাবে রােমের অধিবাসীরা সেই অর্থের সুবিধা পেয়ে আসছিল, তার মধ্যে থেকেও এই অর্থ কারাে চেয়ে কাউকে খানিকটা বেশি সুবিধা দিয়ে আসছিল সিনেটর, প্রশাসনে। নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ, সরকারি চাকুরিরত মানুষেরা এবং সেনাপ্রধানরা বিশেষভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছিলেন। এদের মধ্যে যারা বিদেশি অর্থ আদায় এবং হিসাব নিকাশের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা যুদ্ধে মারা পড়া কৃষকদের ছােটো ছােটো খামারগুলাে কিনে ফেলল। আর এভাবেই কেবল ক্ষুদ্র গােষ্ঠীর অধীনে থাকা কৃষিকাজ তখন সম্মানিত মানুষের ব্যবসা হিসেবে পরিগণিত হলাে। একদিকে কৃষিক্ষেত্রে যেমন প্রশিক্ষণ এবং পেশাদারিত্বের বিষয় এসে পড়ল, ঠিক তেমনই, যুদ্ধে যােদ্ধা হবার ক্ষেত্রেও চরম পেশাদারিত্ব দেখা গেল। ওদিকে ইতালি, আফ্রিকা, গ্রিস, এশিয়া এবং স্পেন থেকে সমানে মানুষ রােমে আসতে লাগল দাস হিসেবে, আর এই চলমান প্রবাহ রােমের ক্ষুদ্র কৃষকদের জীবন যাপনকে দুরুহ করে তুলল। দাস হিসেবে যারা এসেছিল তারা কখনাে বিশাল দলে এক হয়ে কৃষিকাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেনি, তাদের কেবল একজন মানুষের অধীনে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন কাজে লাগানাে হয়, সেই অভিজ্ঞতাই হয়েছিল। মালিকেরা রােমে বসবাস করতে পারতেন, তারা যেহেতু কৃষিকাজে জড়িত মানুষদের কাজ এবং কাজের অভিজ্ঞতা দেখার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতেন, তাই, তাদের দুর্বিসহ জীবন বােঝাও তাদের পক্ষে সম্ভব হতাে না। এসবের জন্য তাই মালিকেরা কোনাে দায়িত্ববােধও অনুভব করতেন না (এরকম “গায়েবি মালিকানা” তাই জমি বা খামার ভাড়া নেয়া। লােকদের তথা দাসদের, উভয়ের জীবনই জটিল করে তুলল)। ক্ষুদ্র কৃষকেরা, যারা বছর বছর যুদ্ধে যাবার পরেও কৃষিকাজকে জীবিকা হিসেবে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, তারা বিশাল দাস-কৃষকদের দলের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় তারা টিকতে পারলেন না। এর ফলে অনেক ইতালির দূরবর্তী অঞ্চলের কৃষক নিজ ভূমি ছেড়ে রােম নগরের দিকে চলে আসতে লাগল, সেখানে গিয়ে তারা নিজেদের জন্য উপযুক্ত কাজ খুঁজতে লাগল। এক বিশাল প্রলেতারিয়েত শ্রেণির আবির্ভাব হলাে রােমে (প্রলেতারিয়েত শব্দটি ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে, যা অর্থ হলাে, “সন্তান জন্ম দেয়ায় অগ্রণী”, যেটা ছিল তখন ওই শ্রেণির একমাত্র কাজ। তখন নগরে ওই গজিয়ে ওঠা শ্রেণিটি ছিল দরিদ্র এবং সন্তান জন্ম দিয়ে লিজন বাহিনীতে সৈন্য সরবরাহ করা ছাড়া শ্রেণিটির অন্য কোনাে কাজ ছিল না)। 

ভোটের জন্য বিভিন্ন খেলা ও বিনোদন : রোমের মধ্যে বসবাসকারী রোমান নাগরিকদের নির্দিষ্ট ক্ষমতা ছিল। নাগরিকটি যতই দরিদ্র হােক না কেন, রােমের অভিজাত নাগরিকদের মধ্যে যারা বড়াে বড়াে সরকারি অফিসে বসার জন্য প্রতিদিন রওনা দিতেন, তারাও তাকে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখতেন না। কারণ, রােমের নাগরিক হলেই তার অন্তত ভােট দেবার অধিকার থাকত। রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা চালাক-চতুর, তারা দেখলেন যে ওই রােমান নাগরিকদের ভােট চাইলে কিনে ফেলা যায়। নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়ানাের জন্য তারা নিজেদের মধ্যে নিলামের মতাে বিষয়ের অবতারণা করলেন। বিনাপয়সায় খাদ্য এবং নানারকমের সুযােগসুবিধা দিয়ে ভােটারদের আকৃষ্ট করতে চাইল। তারা বিনাপয়সায় নানারকম খেলার ব্যাবস্থা এবং বিভিন্ন প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা করল। আর এভাবেই মানুষগুলােকে ঘুষের সহায়তায় বিভিন্ন রাজনৈতিক খেলায় ব্যবহার করা শুরু হলাে। কখনাে তারা ব্যবহৃত হলাে স্বেচ্ছায় কখনাে নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। এই সমস্ত নিয়মকানুন, যা রাজনীতিবিদদের পকেট ভারী হবার জন্য এবং রােমকে ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত হতাে, তাকে রােমে স্থানীয়ভাবে “ব্রেড এন্ড সার্কাস” বলা হতাে। কিন্তু এখানে সার্কাস বলতে আমরা যা বুঝি তাকে বােঝানাে হতাে না। সার্কাস শব্দটা ল্যাটিনে একটি রিং বা বৃত্ত বােঝায়। সহজ করে বলতে গেলে এটা বােঝায় একটি গােলাকার স্থানকে (বাস্তবে উপবৃত্তকার) যেখানে প্রতিযােগীদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের খেলা হয় এবং দর্শকরা আনন্দ পায়। ঘােড়াগাড়ির দৌড় প্রতিযােগিতা, গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই, পশুর সঙ্গে লড়াই ইত্যাদি দেখানাে হতাে রিং-এর মধ্যে। ওই অনুষ্ঠানকে তারা বলত “প্যানেম এট সারসেনসেস” বা “ফুড এন্ড শোজ”।

দাস বিদ্রোহের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব : যখন ধনীরা আরাে বেশি ধনী হয়ে উঠছিল, দরিদ্ররা হয়ে পড়ছিল আরাে বেশি দরিদ্র, যখন স্বাধীন খামারীরা বলতে গেলে উধাও হয়ে গেল আর দাসের সংখ্যা বেড়ে গেল ভয়াবহভাবে। এভাবে রােম রাজনৈতিকভাবে একটুও এগােলাে না। কার্থেজের সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকেই রােমের শাসন ব্যবস্থার নীচের অংশ বিস্তার লাভ করছিল যেন রাজ্যটি গণতন্ত্রের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছিল। হ্যানিবলের আক্রমণের পরে এই বিষয়টি শুরু হয়েছিল। একটা বিষয়, দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের ভয়াবহ বিপদের সময়ে, সবার কাছেই মনে হয়েছিল যে একটি শক্ত সরকারের প্রয়ােজন আছে। তখন বিষয়টা এমন ছিল না যে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তাদের হাতে বিপুল সময় আছে। সিনেট সেই শক্তিশালী সরকারের নিশ্চয়তা দিল। দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে তার পর পর্যন্ত এত দক্ষ হাতের সরকার পরিচালনা রােমে আর কখনাে দেখা যায়নি।  কিন্তু কোনাে দলই তাদের ক্ষমতা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে সহজে পারেনি। ভূমি করায়ত্ব করার যে নিয়ম রােমের সিনেটে গড়ে উঠেছিল তারা তাই নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, রাজনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনে তাদের কোনাে আগ্রহ দেখা যাচ্ছিল না কারণ পরিস্থিতি ছিল তাদেরই অনুকূলে। আর এভাবেই ইতালিতে একটি অসহায় অধ্যায় কেটে যাচ্ছিল। হ্যানিবল সেই এলাকা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে রােমের আর এমন কোনাে ভয় ছিল না যে ভবিষ্যতে বাইরের কোনাে শক্তি তাকে কোনােরকম অন্যায়ভাবে নিজেদের ভূমির উপরে আক্রমণ করতে পারবে না। আর সত্যিই তারপরের পাঁচ শতাব্দী ইতালিকে বাইরের শত্রুর মােকাবেলা করতে হয়নি। কিন্তু তবুও ইতালিতে শান্তি থাকা যেন অসম্ভব। সিনেট সদস্যদের সংকীর্ণ নিয়মকানুন এবং ক্ষমতা কুক্ষীগত করে রাখবার প্রয়াস ধীরে ধীর মারাত্মক যুদ্ধের দিকেই নিয়ে যাচ্ছিল ইতালিকে। আর এভাবেই রােমে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল দাস এবং স্বাধীন মানুষে, ধনী এবং দরিদ্রে, রােমের জনগণ এবং তাদের বিভিন্ন জোটের মধ্যে, এমনকি রােমের লােকদের সঙ্গে রােমের লােকদেরই। সামাজিকভাবে যে একটি নতুন বিপ্লবের সূচনা হতে যাচ্ছে তার প্রথম আভাস বােঝা গেল, যা ছিল অনেক বড়াে বড়াে যুদ্ধের চেয়েও বেশি, তা হলাে দাসত্বের মধ্যে বন্দি মানুষদের বিদ্রোহ। 

ইউনাসের অধীনে দাস-বিদ্রোহ ও সারভাইলের যুদ্ধ : সিসিলি থেকেই সাধারণত বড়াে দলের কৃতদাস নিয়ে আসা হতাে। তাদের আনা হতাে বিশাল আয়তনের জমিতে অধিক হারে গম চাষাবাদের জন্য গম। তাদের উৎপন্ন করতে হতাে রােমের প্রলেতারিয়েত জনগােষ্ঠীর জন্য। সিসিলির কৃতদাসদের সঙ্গে পশুর চেয়েও নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হতাে। তাদেরকে মূল্যহীন পণ্য ধরে নিয়ে যে কোনাে জায়গায় সহজে স্থানান্তরিত করা যায় বলে মনে করা হতো। যাই হােক, সেই কৃতদাসেরা বেশিদিন হয়নি যে নিজেরাই স্বাধীন ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই নিজের জায়গায় সম্মানিত নাগরিক ছিল এবং দখলকৃত ভূমির অধিবাসী হওয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনাে অপরাধ ছিল না; অথবা সেখানকার সৈন্যদের একমাত্র অপরাধ ছিল যে তারা পরাজিত হয়েছিল। মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ একটি জীবন নিয়ে তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সংগ্রাম চালিয়ে যাবার মতাে একজন নেতা খুঁজে পাওয়া। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫ সালে সিরিয়া থেকে আগত একজন কৃতদাস ইউনাস প্রচার করলেন যে তিনি অভিজাত পরিবার থেকে আগত এবং নিজের নাম অ্যান্টিওকাস হিসেবে প্রচার করলেন। হয়তোবা কেউই তখন তাকে তেমন গুরুত্বের সাথে নেয়নি। কিন্তু তার বিদ্রোহ করার আকাঙ্ক্ষাটি খুঁটি ছিল বলে তাকে অনুসরণ করে কৃতদাসেরা এক হয়ে বিদ্রোহ করে উঠল। সেরকম একটা বিদ্রোহে কৃতদাসেরা উন্মত্তের মতাে আচরণ করা শুরু করল। কারণ তারা জানত, পরাজিত হলে তাদের জন্য কারাে কোনাে ক্ষমা থাকবে না। তাই তারা যেখানেই সুযােগ পেল সেখানেই লুটপাট এবং হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে লাগল। কৃতদাসদের মনিবেরা (যারা সাধারণত ইতিহাস আর কাহিনির বই রচনা করতেন), তারা কৃতদাসদের সাথে নিজেদের মিথস্ক্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছেন খুব সতর্কভাবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী তারা যা লিখেছেন, কুতদাসদের সাথে তাদের বর্ণনার চেয়েও অনেক রূঢ় ঘটনা ঘটত। দাসত্বের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ (যাকে বলা হয় সারভাইল যুদ্ধ, ল্যাটিন শব্দ “সারভাস” থেকে সারভাইল শব্দটি এসেছে) তেমন আলাদা কিছু ছিল না। কয়েক বছর ব্যাপী কৃতদাসেরা সিসিলি নগরকে ভয়ানক একটা আতঙ্কের রাজ্যে পরিণত সবল। দ্বীপের মধ্যভাগে ইনা নগরে তাদের অবস্থান ছিল সবচেয়ে সুদৃঢ়, এবং কাউরােমিনিয়াম, আধুনিক যুগে যাকে বলা হয়েছিল তারমিনা, যার অবস্থান ছিল উত্তর-পূর্ব সমুদ্র উপকূলে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করতে রােমের লােকদের পুরােপুরি তিনটি বছর লেগে গেল। প্রথম প্রথম নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তারা নানারকমের বিপদে পড়ল, অপমানিত হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ১৩২ সালের আগপর্যন্ত সিসিলিকে শান্ত করা যায়নি এবং দাসত্বের স্বীকার মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের রক্তে ডুবে থেকেছে সেই সময় পর্যন্ত। তবে রােমের শাসকেরা সেই বিদ্রোহের ফলে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছিল, এই বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। তারা বিপুল আতঙ্কে ভােগা এবং ইতালির অর্থনৈতিক অবস্থার ভয়াবহ অবনতি দর্শনের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছিল। তাদের মধ্যে অন্তত কিছু শাসক ছিলেন যারা মনে করেছিলেন যে রােমকে ঢেলে সাজানাের সময় এসেছে। 

গ্র্যাকাই বা গ্র্যাকাস ভ্রাতৃদ্বয়ের ব্যর্থ সংস্কার প্রচেষ্টা

গ্র্যাকাই বা গ্র্যাকাস ভ্রাতৃদ্বয়ের পরিচয় : যারা প্রথম রােমের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা উচিত বলে মনে করেছিলেন তারা হলেন দুই ভাই, টিবারিয়াস সেম্পােনিয়াস গ্র্যাকাস এবং গাইয়াস সেম্পােনিয়াস গ্র্যাকাস তাদের দুজনকে এক নাম থ্যাকাই বলে বােঝানাে হয়। তাদের মাতা ছিলেন সিপিও আফ্রিকানাসের কন্যা, এবং তার নাম ছিল কর্নেলিয়া (তখন এমনটাই নিয়ম ছিল যে অভিজাত পরিবারের কোনাে মহিলা তার গােষ্ঠী বা পরিবারের নামের একটি মহিলা সংস্করণ নামের মধ্যে জুড়ে দেবেন। পাবলিয়াস কর্নেলিয়াস সিপিও কর্নেলিয়া পরিবার থেকে এসেছিলেন আর তাই তার কন্যার নাম ছিল কর্নেলিয়া)। কর্নেলিয়ার স্বামী, যিনি কনসল হিসেবে দুই দুইবার দায়িত্ব পালন করে গেছেন এবং বীরত্বের সঙ্গে স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব ১৫১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন যখন টিবারিয়াস ছিলেন বারাে বছর বয়সি এবং গাইয়াস ছিলেন মাত্র দুই বছর বয়সি। কর্নেলিয়া তার দুই পুত্রকে মানুষ করার জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন (তিনি দ্বিতীয় বিবাহের বহু প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও কখনাে সেদিকে পা বাড়াননি। সেই সময়ের জন্য এটা ছিল খুবই অস্বাভাবিক) এবং দুই পুত্র যেন সবচেয়ে ভালাে গ্রিক শিক্ষা পায় সে ব্যাপারে বরাবর সচেষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন নিজের দুই পুত্র নিয়ে দারুণ গর্বিত। রােমের একজন অভিজাত মহিলা যখন তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন, তিনি নিজের গয়নাগাটি দেখাচ্ছিলেন কর্নেলিয়াকে এবং কর্নেলিয়ার গয়নাও দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। কর্নেলিয়া তখন নিজের দুই ছেলেকে ডাকেন এবং নিজের দুইপাশে দাঁড় করিয়ে বলেন যে, “এরা দুজনই আমার অলঙ্কার।” গ্র্যাকাইদের ছিল এক বােন, সেম্পােনিয়া, যিনি তরুণ সিপিওকে বিয়ে করেছিলেন। 

টিবেরিয়াস গ্র্যাক্সের সংস্কার : গ্র্যাকাইদের মধ্যে বড়াে যিনি, সেই টিবারিয়াস রােমের সেনাবাহিনীতে বীরের মতাে যুদ্ধ করতেন। তিনি ছিলেন কার্থেজে যেখানে তিনি তরুণ সিপিওর অধীনে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং রােমানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম যিনি সীমানার বাইরেও রােমান শাসনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি স্পেনেও সিপিওর সঙ্গে কাজ করেন। টিবারিয়াস কেবল একজন সৈন্যই ছিলেন না, তবে সে যাই হােক, তার গ্রিক পড়াশােনা তার দৃষ্টি কেবল রােমের শাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। রােমের আনাচেকানাচে যে সামাজিক শত্রুদের আডডা ছিল, তাদের নিয়ে তিনি খুব ভয়ের মধ্যে ছিলেন। আর সে সময়ে সিসিলির ক্রীতদাসদের সঙ্গে যুদ্ধকে মনে হচ্ছিল যেন রােমের জন্য শেষ সামাজিক যুদ্ধ। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে রােমকে নতুন করে গুছিয়ে তৈরি করতে হবে। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪ সালে, উনত্রিশ বছর বয়সে তিনি ট্রিবিউনের কার্যালয়ের জন্য নির্বাচনে দাঁড়ান এবং মনােনিত হন। তিনি বছরের শেষের দিকে কার্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ভূমিটিকে নতুন করে সাজানাের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অতিরিক্ত বিস্তৃত ভূমিকে তিনি ভাগে ভাগে বিভক্ত করে কয়েকটি খামারে পরিণত করেন এবং ভূমিহীন বা দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করেন। তার এই পদক্ষেপ ছিল তাদের আইন দ্বারা সমর্থিত (আইনটি প্রায় দশ বছরেরও আগের) যে আইন একজনের জমির পরিমাণ এবং সীমানার বিধিনিষেধ সম্পর্কে বলে। যাই হােক, ভূমির যখন সুষ্ঠু বণ্টন হয়ে গেল, টিবারিয়াস আইন প্রণয়ন করলেন যে ভূমির বণ্টন আগে যে অবস্থায় ছিল। সেখানে আর কখনােই ফেরত যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ একজন মানুষ আর কখনােই বিশাল ভূমি ক্রয় করে উল্লেখ করে দেয়া পরিমাণের চেয়ে বিস্তৃত খামার তৈরি করতে পারবেন না। সাধারণভাবে, তখন বড়াে ভূমির অধিকারী মালিকেরা টিবারিয়াসের উপরে বিরূপ মনােভাব পােষণ করলেন (তখনকার সময়টা যদি আধুনিক হতাে তবে তারা নিশ্চয় টিবারিয়াসকে একজন সমাজতান্ত্রিক বলে ঘােষণা দিতেন)। 

টিবেরিয়াসের বিরুদ্ধে অবস্থান ও বিরোধিতা : ভূমির মালিকেরা পদক্ষেপ নিলেন। শাসনব্যবস্থায় ছিল দুইটি ভিন্ন ট্রিবিউন। তাদের মধ্যে যে কোনাে একটি যদি কোনাে সিদ্ধান্তে সহমত পােষণ না করত তবে সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হতাে না। এক ট্রিবিউনের নেতা ছিলেন মার্কাস অক্টাভিয়াস, যিনি টিবারিয়াসের বন্ধু, কিন্তু তাকে যখন অর্থ দিয়ে কিনতে চেষ্টা করা হলাে, দেখা গেল তিনি রাজি হলেন না। একইভাবে টিবারিয়াস যখন বেশিরভাগ রােমান নাগরিকের মনোভাবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তটি নিতে চাইলেন তখন একটি ট্রিবিউনের অসম্মতির কারণে নিতে পারলেন না। টিরারিয়াস তখন বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে অক্টাভিয়াসকে খুশি করার জন্য যা ভেদ করতে পারেন, করতে লাগলেন। কিন্তু কোন কিছুই কোনাে কাজে এল না। আর তাই রাগের মাথায় তিনি অক্টাভিয়াসের বিরুদ্ধে কার্যালয়ের অনেককে ভুলিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযােগ এনে তাকে কার্যালয় থেকে বিতাড়িত করলেন। তাকে বহিষ্কারের পরে কার্যালয়ের বাকি শাসকদের সম্মতিতে আইনটি কার্যকর করা হলাে। কিন্তু অক্টাভিয়াসকে ওভাবে কার্যালয় থেকে বহিষ্কার করা ছিল অন্যায়, এবং টিরারিয়াসের শত্রুরা এই অজুহাত তুলে তার বিরােধিতা শুরু করল। তাদের ভাষ্য ছিল যে টিবারিয়াস একজন বিপ্লবী এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লােকদের অসন্তুষ্ট করে ফেলেছেন। তাদের আরাে বক্তব্য ছিল যে অন্যায়ভাবে একজনকে কার্যালয় থেকে বহিষ্কার করে যে আইন পাশ করতে হয়, সেই আইনের কোনাে মাহাত্ম নেই।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, দাঙ্গা ও টিবেরিয়াসের মৃত্যু : টিবারিয়াস দেখলেন যে এরকম তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়ে তিনি রােমে তার সমর্থন হারাচ্ছেন। তাই তিনি হারিয়ে যাওয়া জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য অন্য পথ অবলম্বন করলেন। তখন পারগামামের তৃতীয় অ্যাটালাস মাত্র মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এবং তার ভূমি রােম রাজ্যকে দান করে গিয়েছিলেন। টিবারিয়াস ততক্ষণাৎ ঘােষণা করলেন যে পারগামাম রাজ্য থেকে যে অর্থ বা সম্পদ পাওয়া গিয়েছিল তা রােমের যারা নতুন করে ছােটো ছােটো খামার প্রতিষ্ঠা করছেন তাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। এই ঘােষণা সিনেটরদের আরাে ক্ষেপিয়ে তুলল এবং মনে হলাে যে টিবারিয়াস একমাত্র ট্রিবিউনে আছেন বা সমর্থন পাচ্ছেন বলেই টিকে আছেন। তার দায়িত্বকাল যখন শেষ হবে তখন তাকে কেউ একটি তামার পয়সার সমান দামও দেবে না। এই বিষয়টি বুঝতে পেরে টিবারিয়াস আগেভাগেই একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেন। তবে সেটির ব্যাপারেও অনেকে মন্তব্য করলেন যে বিষয়টি অন্যায়। তারা মনে করল যে টিবারিয়াস প্রকৃতপক্ষে নিজেকে রােমের রাজার আসনে দেখতে চান আর সেজন্যেই এই পদক্ষেপগুলাে নিচ্ছেন। এইরকমের একটি অভিযােগ রােমান নাগরিকদের মনে টারকুইনের দুঃসহ স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। নির্বাচনের দিন যখন উপস্থিত হলাে, রাজ্যে অনিয়ম এবং অভিযােগ বাড়তে বাড়তে তা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হলাে। টিবারিয়াসের বিপক্ষের লােকেরা সুসংগঠিত ছিল এবং তারা টিবারিয়াস সহ তার অনুসারী বহু মানুষকে হত্যা করল। গ্র্যাকাই ভাইদের মধ্যে জ্যোষ্ঠজনের লাশ সম্মানের সঙ্গে শেষকৃত্য করার ব্যাপারেও তাদের আপত্তি ছিল এবং টিবারে নিয়ে গিয়ে তাদের লাশগুলাে স্তুপ করে রাখা হলাে।  

রক্ষণশীল ও উদারপন্থীদের মধ্যে যুদ্ধ : টিবারিয়াস গ্র্যাকাসকে যে দলটি হত্যা করেছিল তার নেতা ছিল সিপিও পরিবারের, কর্নেলিয়ার ভাতৃস্থানীয়। তখন সেই নেতার বিরুদ্ধে আবার বহু মানুষ সােচ্চার হয়ে ওঠে, তাই সিনেটের সিদ্ধান্তে তাকে রােমের বাইরে প্রেরণ করা হয়। কেবলমাত্র জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্য মৃত্যুপর্যন্ত তিনি আর কোনোদিনও রােমের ফিরে আসতে পারেননি। তরুণ সিপিও তখন ছিলেন স্পেনে। তিনি তখন নিউম্যাশিয়া দখলে ব্যস্ত। তিনি যখন তার ভ্রাতৃস্থানীয় টিবারিয়াসের মৃত্যুসংবাদ শুনলেন, তিনিও একই মতামত প্রকাশ করলেন। তিনি জানালের যে টিবারিয়াস তার কৃত কর্মের জন্যই হত্যার যােগ্য। খ্রিস্টপূর্ব ১৩২ সালে সিপিও রােমে ফিরে এলেন গাইয়াস গ্র্যাকাসকে সঙ্গে নিয়ে, যিনি তার সঙ্গে ছিলেন এবং সম্ভবত রােমের বাইরে থাকার কারণেই যিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে হত্যার শিকার হননি। টিবারিয়াস গ্র্যাকাসের মৃত্যুর পরও রক্ষণশীল এবং উদারপন্থীদের মধ্যে যুদ্ধ চলতে লাগল। রক্ষণশীল দলের নেতা ছিলেন সিপিও। তিনি ভূমি অধিগ্রহণ আইনের নতুন পরিবর্তনের সমালােচনা করে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন এবং সেটি পরিবর্তনের পথে ছিলেন, কিন্তু সে সময়ের ভেতরেই খ্রিস্টপূর্ব ১২৯ সালে তিনি ঘুমের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। রক্ষণশীলেরা অভিযােগ করল যে তাকে ঘুমের মধ্যে উদারপন্থী দলের মানুষেরা হত্যা করেছে। কিন্তু তারা নিজেদের অভিযােগ সত্য ঘােষণার মতাে কোনাে প্রমাণ দেখাতে পারলেন না। এরই মধ্যে উদারপন্থীরা ট্রিবিউনে নতুন করে সদস্য নির্বাচনের ব্যাপারে চাপ প্রয়ােগ করতে শুরু করল, যেন অন্য কেউ নির্বাচিত হলেও টিবারিয়াসের মতাে দুর্ভাগ্য তাদের মেনে নিতে না হয়, সেটি প্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের লক্ষ্য। সিপিও যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি নতুন নিয়ম বা নির্বাচন করতে দেননি। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে সে ব্যাপারে আর কোনাে বাধা ছিল না। 

গাইয়াস গ্র্যাকাসের সংস্কার : ধীরে ধীরে তরুণ গ্র্যাকাস সামনে এগিয়ে এলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১২৩ সালে। (নিজের মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, যে মা তার বড়াে সন্তানকে একই জায়গায় মৃত্যুবরণ করতে দেখেছেন, স্বাভাবিকভাবেই আরেকজনকে একই কাজ থেকে বিরত করতে চেয়েছিলেন)। তিনি ট্রিবিউনের জন্য নির্বাচনে দাঁড়ালেন এবং নির্বাচিত হলেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি তার ভাইয়ের করে যাওয়া ভূমি সংক্রান্ত আইনটি (সেটি কেবল কাগজে কলমেই ছিল, সিপিওর হস্তক্ষেপের কারণে বাস্তবায়িত হয়নি) বাস্তবায়ন করার জন্য ঝাপিয়ে পড়লেন। তিনি খাদ্য উৎপাদনকারী বড় প্রতিষ্ঠানকে তাদের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন মানতে বাধ্য করলেন যেন রাজ্যের বিপুল জনগণ সহজে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে (এটাই ছিল রােমের প্রলেতারিয়েত জনগােষ্ঠীকে বিনামূল্যে খাবার পরিবেশনের প্রথম পদক্ষেপ)। তিনি রােমের নির্বাচনের সময়ে ভােট দেয়ার ক্ষেত্রে প্রলেতারিয়েত জনগােষ্ঠী যেন অংশগ্রহণ করতে পারে সেজন্য তাদের ক্ষমতায়নের চেষ্টা আরম্ভ করলেন; এমনকি তিনি বিভিন্ন প্রদেশের কর আদায়ের নিয়মকানুনও শিথিল করলেন এবং কর সংক্রান্ত আইনকে এতটাই পরিবর্তন করে আনলেন যে সেখানে সিনেটের হস্তক্ষেপের জায়গা খুব কমে গেল। গাইয়াস যােগাযােগ ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি সাধন করলেন নতুন রাস্তাঘাটের মাধ্যমে। তার এই পদক্ষেপ যেমন মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করল তেমনি কর্মসংস্থানও বাড়িয়ে দিল। আর এরপর তিনি উপনিবেশ স্থাপনের ব্যাপারে মনােযােগ দিলেন। রােমের বিভিন্ন যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু স্থান, যেমন, কাপুয়া, ট্যারেন্টাম, কার্থেজ- এই সমস্ত গানগুলাে রােমেরই উপনিবেশ স্থাপনের কাজে ব্যবহৃত হলাে। এই সমস্ত পদক্ষেপ তিনি নিচ্ছিলেন রােমে বসবাসকারী প্রলেতারিয়েত জনগােষ্ঠীকে সাধারণ নাগরিকের উন্নত জীবন প্রদানের জন্য। যদিও এই সমস্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে সেটাই হবার কথা ছিল কিন্তু উপনিবেশিকতার চিন্তা সফল হয়নি এবং যে উদ্দেশ্যে এসব করা হয়েছিল তাও হয়ে ওঠেনি। তবে গাইয়াস গ্র্যাকাস ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এবং তার ফলশ্রুতিতে তিনি ট্রিবিউনের জন্য দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হলেন। তার দ্বিতীয় বছরটিতে গাইয়াস আরাে উদার একটি পদক্ষেপ নিলেন যার মাধ্যমে ইতালির সমস্ত অধিবাসী রােমের নাগরিক হয়ে যেতে পারল। এই পদক্ষেপটি এমন জনপ্রিয় হলাে যে ইতালির সবাই রােমান রাজ্যকে ভালােবাসতে শুরু করল, রােমের প্রতি অনুগত হলাে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে রােমান রাজ্যকে যারা ঢেলে সাজাতে চেয়েছিল তাদের লাভ হলাে অনেক। তারা নির্বাচনের সময়ে তাদেরকে সমর্থন করার জন্য রাতারাতি প্রচুর ভােটার পেয়ে গেল। 

গাইয়াস গ্র্যাকাসের পরাজয়, মৃত্যু ও রক্ষণশীলদের বিজয় : যাই হােক, গাইয়াস অবশ্য ইতালীর সকল অধিবাসীর রোমের নাগরিক হবার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রােমের তুলনামূলকভাবে দরিদ্র জনগােষ্ঠীর অনুভূতিতে কিছুটা আঘাত দিয়েছিলেন। তাদের মনে প্রশ্ন এসেছিল, এক দল বিদেশি কেন রােমের নাগরিকের মর্যাদা পাবে? তারা ছাড়া অন্য কেউ কেন বিনামূল্যে খাদ্য এবং কর মওকুফের সুবিধা পাবে? এরকম একটি অনুভূতিকে পুঁজি করেই রক্ষণশীলরা গাইয়াসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল এবং তার জনপ্রিয়তা কমিয়ে আনতে সফল হলাে। উপনিবেশিক আইন নিয়ে আফ্রিকায় রক্ষণশীলেরা তাকে ভীষণভাবে আক্রমণ করল। তার অবর্তমানেই সেখানে তারা নির্বাচনের ডাক দিল। তৃতীয় কিস্তির জন্য তিনি আর নির্বাচিত হতে পারলেন না। আর এই সমস্ত ঘটনার ফলশ্রুতিতেই সিনেটরগণ উপনিবেশিক আইন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেন। রােম রাজ্যের নতুন পরিবর্তনগুলাের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এটাই ছিল তাদের প্রথম পদক্ষেপ। আবার নতুন দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল এবং যারা পরিবর্তন চায় লড়াই আর হাঙ্গামায় তাদের কিছু লােক মারা পড়ল। খ্রিস্টপূর্ব ১২১ সালে গাইয়াস গ্র্যাকাসকে হত্যা করা হলাে। আর তারপরের দশ বছরে গ্র্যাকাই ভাইয়েরা যত পরিবর্তন এনেছিল, তার প্রায় সবকিছু থেকেই রােমানরা মুক্ত হয়। আর এদিকে দুর্ভাগা কর্নেলিয়া দুই পুত্র হারিয়ে অবসরে যান। ন্যাপলসের কাছাকাছি এক অট্টালিকায় তিনি নিজেকে অন্তরীণ করেন। সেখানে তিনি সাহিত্যে মনােনিবেশ করেন এবং বাকি পৃথিবীর সঙ্গে তার আর কোনাে যােগাযােগ থাকে না। মৃত্যুর পরে তার কবরে এটা লেখা হয়নি যে তিনি ছিলেন বিখ্যাত সিপিওর কন্যা যিনি নাকি ভয়ানক হ্যানিবলকে পরাজিত করেছিলেন, বরং লেখা হয়, “কর্নেলিয়া, গ্র্যাকাই ভ্রাতাদের মাতা”।  গ্র্যাকাই ভাই যুগলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই রোমকে পরিবর্তিত করে আধুনিক গণতন্ত্রে নিয়ে যাবার স্বপ্নটিরও মৃত্যু ঘটেছে। সিনেটের রক্ষণশীল দলের সদস ক্ষমতা কুক্ষীগত করে ধরে রাখার জন্য সবরকমের পদক্ষেপ নিলেন এবং কেবলই নিজেদেরকে বিপদের দিকে ঠেলে দিলেন। 

সেনানায়ক ও কনসল মারিয়াস 

আদিবাসীদের আক্রমণ ও রোমের প্রতি ম্যাসিলিয়ার সাহায্য প্রার্থনা : রােম যদিও নিজেকে একটি সুস্থ সমাজে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তাই বলে একেবারে হুট করে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার মতােও কিছু ছিল না। তার পরের দুইশ বছর ধরেও রােমের ক্ষমতা আরাে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে কেবল বাড়তেই থাকল, তবে আগের মতাে দ্রুত গতিতে নয় এবং দুই-একটি ক্ষেত্রে অনেক বেশি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই এর মাধ্যমে। পশ্চিম ইউরােপের কেল্টিক জাতি ছিল এমন, রােমের শত্রুদের মধ্যে যারা বেশ প্রভাবের সঙ্গে যুদ্ধে করতে পারত। স্পেনের আদিবাসীরা প্রায় পৌনে এক শতাব্দী আগে তাই করেছিল, স্পেনের প্রদেশ এবং ইতালির মাধ্যখানের ৩০০ মাইল এলাকা কেল্টিক আদিবাসীদের দখলে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯০ সালে গ্যালিক জাতি রােমকে দখল করেছিল, এবং অন্যান্য জাতিরা ম্যাসিডােন এবং গ্রিস দখল করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ২৮০ সালে। আর তাই প্রাচীন পৃথিবী জেনেছিল যে আদিবাসীদের শক্তি কত ভয়ঙ্কর। যদিও রােমের পক্ষে তখন তাদেরকে ভয় পাওয়া সমীচিন ছিল না। যে আদিবাসী জাতি পাে উপত্যকায় (সিসালপাইন গাউল) বসবাস করত, রােমান রাজ্য তাদের দখল করে তাদের সংস্কৃতিকে রােমান বানিয়ে ফেলেছিল, তাদের ভূমিও কাগজে কলমে ছিল ইতালির, যদিও ওটা তখনাে একটা ভিন্ন প্রদেশ হিসেবেই পরিগণিত হতাে। আল্পসের অপর দিকে থাকলেও গাউলরা সেখানে কোনাে ঝামেলা বাঁধায়নি। গাউলের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল অঞ্চলে ছিল ম্যাসিলিয়া নগর, যে নগর গ্রিক উপনিবেশিকরা আবিষ্কার করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে, যখন রােম ছিল কেবল এট্রুস্কানদের দখলকৃত একটি স্থান। গ্রিক সাম্রাজ্যের সর্ব পশ্চিমের চমক হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল ম্যাসিলিয়া। বলাবাহুল্য, ব্যাবসার ক্ষেত্রে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কার্থেজ, আর তাই ম্যাসিলিয়া পিউনিক যুদ্ধের পুরাে সময়টাতে রােমের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ছিল। পরবর্তী কালে গ্যালিক রাজ্যে রােমের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিল নগরটি।

গাউল দেশ বা ফ্রান্স অঞ্চলে রোমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : খ্রিস্টপূর্ব ১২৫ সালে ম্যাসিলিয়া রােমের কাছে গাউলদের অনুপ্রবেশের নালিশ নিয়ে আসে। রােমানরা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়। এই একটা বিষয়, যা রোমানরা সুযােগ পেলেই করত, আর দ্বিতীয় কারণ ছিল এই প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে রোম আরাে একজন কনসল খুজে পেয়েছিল, যিনি হলেন মার্কাস ফুলভিয়াস ফ্ল্যাকাস। ফ্ল্যাকাস ছিলেন গ্র্যাকাই ভাতৃদ্বয়ের ঘাের সমর্থক এবং তাদের সংস্কারের নীতিতে বিশ্বাসী। তাই তিনি কোনাে না কোনাে কারণে রােম ছেড়ে বাইরে চলে যান, অন্য সিনেট সদস্যরা এমনটাই চেয়েছিলেন। ফ্ল্যাকাস গাউলদের পরাজিত করে বিজয়ের বেশে রােমে ফেরত এলেন। কিন্তু তার পুরস্কার বলতে ছিল কয়েক বছর পরে গাইয়াস গ্র্যাকাসের সঙ্গে মৃত্যু। যাই হোক, ফ্ল্যাকাসের বিজয়ের মধ্য দিয়ে রােমানরা দক্ষিণ গাউলে পাকাপােক্তভাবে স্থানান্তরিত হলাে। হ্যানিবল যে পথ দিয়ে স্পেন থেকে ইতালি গিয়েছিল তারা সেই পথের দুইদিকে বসবাস শুরু করল। খ্রিস্টপূর্ব ১২৩ সালে ম্যালিসিয়া থেকে বিশ মাইল উত্তরে তারা একটি সেনাবাহিনী ক্যাম্প খুঁজে পেল এবং তার নাম রাখল অ্যাকুই সেক্সটি, নামটা রাখল সেক্সটিয়াস ক্যালভিনের নামানুসারে, খ্রিস্টপূর্ব ১১৮ সালে যিনি ছিলেন একজন কনসল। খ্রিস্টপূর্ব ১১৮ সালে তারা নার্বো মার্শিয়াস নামে একটি নগর স্থাপন করেন (আধুনিক কালে যাকে বলা হয় নারবােন)। নগরটি ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় অঞ্চলে। নগরটি ছিল ম্যালিসিয়া থেকে ১২০ মাইল পশ্চিমে। খ্রিস্টপূর্ব ১২১ সালে গাউলের রােমান অংশ একটি প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং নার্বো মার্শিয়াস এর প্রধান নগর হয়ে ওঠে। প্রদেশটিকে গালিয়া নার্বেনেন্সিস নাম দেয়া হয়েছিল। যেহেতু সেই জায়গাটি ছিল ওই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর স্থান, নানাস্থান থেকে আগত ভ্রমণকারীদের জন্য আদর্শ স্থান, তাই খুব দ্রুতই এটি রােমান প্রদেশে পরিণত হলাে। পরে ওই অঞ্চলটি ফ্রান্স হয়ে গেলেও দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ওই স্থানটিকে এখনাে সেই আগের নামেই ডাকা হয়। এইক্সকে সেই অঞ্চলের প্রধান নগর ধরে নেয়া হয়, যাকে ডাকা হয় প্রভেন্স (Provence বা প্রভাঁস)। 

আফ্রিকার নিউমিডিয়ার শাসনক্ষমতায় জুগুর্থা : রােম হয়তো তখন পুরাে গাউল দখলের দিকে মনােযােগ দিতে চাচ্ছিল, কিন্তু তার পরেও প্রায় পৌনে এক শতাব্দী লেগে গেল এর প্রস্তুতি নিতে নিতে, কারণ আরাে অনেক বিষয়ের ফয়সালা করতে রােমের সময় লেগে গেল। কারণ আফ্রিকায় বেশ বড়াে একটা সমস্যার সৃষ্টি হলাে, সমস্যাটা এমন ভয়াবহ আকৃতি নিল যে দ্রুত পুরাে রােমান রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল। তৃতীয় পিউনিক যুদ্ধের শুরুর দিকে ম্যাসিনিসার নিউমিডিয়ার মৃত্যুর পরে তার পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ালেন জুগুর্থা, তার পৌত্র। তার আংকল, যিনি ম্যাসিনিসার সিংহাসনে বসতে সফল হয়েছিলেন, তিনি তরুণ জুগুর্থাকে স্পেনে পাঠালেন। তাকে পাঠানাের উদ্দেশ্য কিছুটা ছিল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ আর কিছুটা ছিল তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। সিপিও সেখানে তার কাজেকর্মে খুবই উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন এবং তাকে পুনরায় ম্যাসিনিসায় পাঠিয়ে দিলেন, আদেশ করলেন তাকে যেন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তার আংকলের মৃত্যুর পরে জুগুৰ্থা তার কিছু কাজিন ভাইয়ের সঙ্গে মিলে ম্যাসিনির শাসনভার গ্রহণ করলেন। জুগুৰ্থা দেখলেন তাদের সঙ্গে কোনাে বিষয়ে শলাপরামর্শ করা বৃথা। খ্রিস্টপূর্ব ১১৭ সালে তিনি তার একজন ভাইকে হত্যা করলেন এবং আরেকজনকে বন্দি করে নিজেকে নিউমিডিয়ার রাজা হিসেবে ঘােষণা করলেন। এটা ছিল আইনের চরম লঙ্ঘন (আর সামাজিকভাবেও চরম অন্যায়, যদিও রােমানরা এই বিষয়ে মােটেও মাথা ঘামাত না), এবং নিউমিডিয়া যেহেতু রােমের ধ্বজাই ওড়াত সেখানে রােম তার দিকে তাকিয়ে কোনাে ভুলভ্রান্তি দেখবে এটা আশা করাও ছিল অর্থহীন। যাই হােক, জুগুর্থারও ছিল রােমের সামনে এইসব বিষয় তুলে ধরার আলাদা কায়দা। রােম থেকে সিনেটররা যখন নিউমিডিয়ায় এসেছিলেন সেখানকার অবস্থা সরজমিনে প্রত্যক্ষ করতে, তিনি তাদের সবাইকে বিভিন্ন উপহার দেন এবং তারা ফিরে যান। তারা সবাই রােমে ফিরে গিয়ে সিনেটকে জানান যে জুগুৰ্থা একজন চমৎকার শাসক এবয়ং নিউমিডিয়ায় যা করছেন ন্যায়ের পথে সুন্দরভাবেই করছেন। রােমানরা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছিল, যেমন নিউমিডিয়াকে বিভক্ত করে জুগার্থার ভাইদের কম জনপ্রিয় এলাকাগুলাে দিয়ে দিয়েছিল তারা। জুগার্থা তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করল, তাকেও হত্যা করল এবং খ্রিস্টপূর্ব ১১২ সালে পুরাে দেশটাই দখল করে ফেলল। 

জুগুর্থার সাথে মেটিলাসের দ্বন্দ্ব : রােম তার আদেশ অমান্য করাকে অত সহজে মেনে নিতে পারল না। এবং সিনেট খ্রিস্টপূর্ব ১১১ সালে একদল সৈন্য পাঠাল নিউমিডিয়ায় এবং এভাবেই জুগার্থার যুদ্ধ শুরু হলাে। রােমের এই পদক্ষেপ অবশ্য জুগার্থাকে কোনাে সমস্যায় ফেলতে পারল না। তিনি আগত সেনা সদস্যদের আবারাে উপহার দিয়ে ঘায়েল করে ফেললেন এবং আরাে একবার একই পদ্ধতিতে প্রদেশে শান্তি কায়েম করলেন। এই পরিস্থিতিতে রােমের সিনেটের পক্ষ থেকে জুগার্থার কাছে তার প্রদেশের জমাখরচের হিসাব দিতে বললেন। জুগার্থা ততক্ষণাৎ রােমে ফিরে এলেন এবং একজন সিনেটরকে ঘুষ প্রদান করে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বললেন। রােমে অবস্থানকালীন সময়েও তিনি নিউমিডিয়ায় একজন বিদ্রোহীকে বন্দি করিয়েছিলেন। তারপর, তিনি যখন নিউমিডিয়ায় প্রবেশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হলেন, তিনি অবলীলায় বললেন যে, “এই নগরটা বিক্রির করা দরকার, একমাত্র নতুন একজন ক্রেতাই পারেন নগরটিকে টিকিয়ে রাখতে।” জুগার্থার সঙ্গে যুদ্ধ বাধাটা ছিল তখন খুব স্বাভাবিক। যেন লৌহগােলকের প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়ছিল সােনার মুদ্রা। রােমান সেনাবাহিনীকে নিউমিডিয়া থেকে বিতাড়িত করা হলাে। যে করেই হােক, একজন সৎ সেনাপ্রধান খুঁজে বের করার দরকার ছিল। আর ঠিক তখন থেকেই রােম নিজের বাহিনীতে সৎ এবং যােগ্য নেতার সংকট বাস্তবে। অনুভব করা শুরু করেছিল (অসুস্থ একটা সমাজে সুস্থ একজন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দায় ছিল তখন)। শেষপর্যন্ত রােমানরা একজনকে খুঁজে পেল, কুইন্টাস সিসিলিয়াস মেটিলাস, চতুর্থ ম্যাসিডােনিয়ান যুদ্ধ জিতেছিলেন যে সেনাপ্রধান, তার ভাগনে। মেটিলাস ছিলেন প্রাচীন কালের মানুষদের মতাে সৎ এবং নিষ্ঠাবান। খ্রিস্টপূর্ব ১০৯ সালে তিনি নিউমিডিয়ার জন্য রওনা দেন। এবং জুগার্থা, শেষপর্যন্ত এমন একজন সেনাপ্রধানের মুখােমুখী হন যাকে তিনি ঘুষ দিয়ে ঘায়েল করতে পারেননি, বরং যার সঙ্গে তাকে লড়াই করতে হয়েছিল। তিনি তার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন এবং গরিলার মতাে আচরণ করতে লাগলেন। দুই বছর ব্যাপী তিনি মেটিলাসকে কোনােভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে গেলেন (ঠিক যেমনভাবে ফেবিয়াস একবার হ্যানিবলকে হতাশ করেছিলেন যুদ্ধে ঠিকমতাে অংশগ্রহণ না করে)।

মেটিলাসের সাথে মারিয়াসের দ্বন্দ্ব ও জুগুর্থার মৃত্যু : মেটিলাসের অধীনে যুদ্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিল গাইয়াস মারিয়াস। তিনি খুব একটা আকর্ষণীয় ছিলেন না, খুব একটা জ্ঞানও ছিলনা। কিন্তু ছিলেন একজন কঠিন যোদ্ধা, সেই সাথে মনের মধ্যে ছিল ভাল রকমের ঘৃণা। তিনি ছিলেন দরিদ্র কৃষকের পুত্র এবং অভিজাত লােকদের প্রতি তার ছিল অনেক ঘৃণা। খ্রিস্টপূর্ব ১১৯ সালে তিনি ট্রিবিউনের সদস্য হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং তিনি জনপ্রিয় দলের হয়ে, অর্থাৎ যারা সংস্কারপন্থী ছিল, তাদের হয়ে বেশ জোরালােভাবে কাজ করেছিলেন। জুগুৰ্থার মতাে মারিয়াসও তরুণ সিপিওর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ সালে তিনি স্পেনের নেতার আসনে আসীন হন অনেকটা স্বঘােষিতভাবে। এবং কিছু আদিবাসীদের সমর্থনে যারা রােমান শাসন কখনাে মেনে নেয়নি। তখন তিনি নিউমিডিয়ায় শাসনভার বহন করছিলেন, যেটি মেটিলাসের বিরুদ্ধে তার ঘৃণার চর্চার জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল তখন, যে মেটিলাস এক প্যাট্রিশিয়ান পরিবার থেকে আগত এবং একজন মানুষের পক্ষে যতটা রক্ষণশীল হওয়া সম্ভব, তিনি ছিলেন ততটাই। নিউমিডিয়ায় মারিয়াসের অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সেখানকার সমর্থনের শক্তিতে তিনি যদি কনসলের জন্য নির্বাচনে দাঁড়ান তাে জিতেও যেতে পারেন। তিনি রােমে ফিরে আসেন এবং তার সমর্থনের শক্তিতে বলা শুরু করেন যে মেটিলাস শুধু শুধু সেখানে যুদ্ধ বাঁধাতে চাচ্ছেন তার নিজের সুবিধার জন্য। যদিও কথাটা সত্য ছিল না কিন্তু এর রাজনৈতিক ফায়দা ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১০৭ সালে মারিয়াস নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘােষণা করে দেন যেন মারিয়াসকে পুরােপুরি স্থানচ্যুত করা যায়। সিনেটের ইচ্ছা এবং আদেশের বিরুদ্ধে এটা ছিল সরাসরি একটা পদক্ষেপ। আর তাই সিনেট সেনাপ্রধানের পদে তাকে মানতে অস্বীকার করল। সিপিও আফ্রিকানাস এক শতাব্দী আগে যা করেছিলেন, মারিয়াস তখন ঠিক সেটাই করলেন, নিজেকে সেনাপ্রধান ঘােষণা করে তিনি একদল সমর্থক নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগলেন। তিনি তার বক্তৃতায় রক্ষণশীলদের যাচ্ছেতাইভাবে গালাগালি করতে লাগলেন। তিনি সমর্থন আদায় করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সমাজের দরিদ্র জনগােষ্ঠী থেকে মানুষ বেছে নিলেন, যেন সেই মানুষগুলাে সিনেটের চেয়ে তার প্রতি বেশি অনুগত হয়। তাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি নিউমিডিয়ায় ফেরত চলে গেলেন। মারিয়াসের সেনাপ্রধান হিসেবে ছিলেন লুসিয়াস কর্নেলিয়াস স্যুলা, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং রক্ষণশীলদের প্রতি বিশেষ দুর্বল। তারা দুইজন মিলে যে ঘটনা ঘটালেন তাতে নিউমিডিয়ায় ত্রাসের সৃষ্টি হলাে এবং খ্রিস্টপূর্ব ১০৫ সালে তারা জুগার্থাকে বন্দি করলেন। স্যুলাই নানারকম গভীর কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কাজটা সম্পন্ন করলেন এবং জুগার্থার শ্বশুর, যিনি তখন ছিলেন মৌরিতানিয়ার রাজা, তাকে অর্থের বিনিময়ে জুগার্থার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে এই বিষয়ে সমর্থন আদায় করলেন। জুগার্থা মারিয়াসের কাছে আত্মসমর্পন না করে স্যুলার কাছে করলেন, এবং রক্ষণশীলদের কাছে এটাই প্রকাশ করতে চাইলেন যে তিনি যুদ্ধে হেরেছেন স্যুলার কাছে, মারিয়াসের কাছে মােটেই নয়। এই বিষয়টির মাধ্যমে স্যুলা এবং মারিয়াসের মধ্যে বেশ খানিকটা শত্রুভাব জেগে উঠল যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে বেশ কিছু ধারাবাহিক ঘটনা ঘটেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১০৪ সালে জুগার্থাকে রােমে নিয়ে আসা হয়। এবং বন্দি অবস্থায় তিনি অসহায় মৃত্যু বরণ করেন। জুগার্থার মৃত্যুর পরেনি নিউমিডিয়ার পূর্বদিক সেখানকার নিজস্ব নিয়মে পরিচালিত হতে থাকে। আর ওদিকে পশ্চিম দিকটা মৌরিতানিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।

বর্বর জাতি কিম্ব্রিদের আক্রমণ ও তাদের দমনের জন্য মারিয়াসের ক্ষমতায় আরোহন : এদিকে তখন যেন অতীতের কোনাে বর্বর জাতির হুঙ্কারের প্রতিধ্বনি রােমকে গ্রাস করে। উত্তর দিক থেকে বিরাট এক বর্বর জাতি ইউরােপে এসে পৌঁছে; তারা ছিল ব্যবহারে কর্কশ এবং উলঙ্গ এক জাতি যারা কখনাে রােমের সভ্যতার কথা শােনেইনি। রােমানরা তাদের নাম দিল কিম্ব্রি (সিম্ব্রি, Cimbri), এবং তাদের আদি বসবাস হতে পারে এখনকার ডেনমার্কে, যদিও এ বিষয়ে এতদিন পরে আর সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। তারা তখন রােমে অভিবাসী হয়ে আসছিল এবং মধ্য ইউরােপেও ছড়িয়ে পড়ছিল, এবং খ্রিস্টপূর্ব ১১৩ সালে তারা রাইন নদী পেরিয়ে গাউলে প্রবেশ করল। দক্ষিণ দিকে তারা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের অসভ্য দলটা নিয়ে। কিম্ব্রি জাতি দুই দুইবার তাদের পরাভূত করার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া রােমান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করল। কিন্তু দুইবারের একবারও বর্বর জাতিটি ইতালিতে অনুপ্রবেশের কোনাে চেষ্টা করল না। তারা তাদের যাত্রাপথে যেই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল তাকেই হত্যা করছিল, কিন্তু বড়াে কোনাে পরিকল্পনার কথা বলেনি, কেবল জানিয়েছে যে তারা বসতি স্থাপনের জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজছে। জায়গা খুঁজতে খুঁজতেই তারা স্পেনে উপস্থিত হলাে। রােম তখন ছিল একটা আতঙ্কের মধ্যে। যেন মনে হচ্ছিল সেই গাউলদের আক্রমণের দিনগুলাে ফিরে এসেছে। একদিকে রােমান সেনাবাহিনী বর্বর জাতি কিম্ব্রির কাছে পরাজিত হচ্ছিল বারাবর, অন্যদিকে নিউমিডিয়ায় জুগার্থার সঙ্গে তারা কিছুতেই পেরে উঠছিল না। মারিয়াস যখন পুরােপুরিভাবে জুগার্থাকে পরাজিত করল, রােমানরা উত্তর থেকে আসা বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও তার শরণাপন্ন হবার কথাই ভাবল। সিনেট নিজেও ভড়কে গেল এই ভেবে যে জনগণের দাবি কোন পর্যন্ত উঠবে, তারা মারিয়াসকে আসলে কোন অবস্থানে দেখতে চায় না। মারিয়াস দ্বিতীয়বারের মতাে কনসল নির্বাচিত হলেন, তিনি অবশ্য তখনাে আফ্রিকাতেই ছিলেন। আর তারপর এমন হলাে যে তিনি ক্রমাগত কনসল নির্বাচিত হয়েই চললেন যতদিন বিপদ থাকল, খ্রিস্টপূর্ব ১০৩, ১০২, ১০১ এবং ১০০ সাল পর্যন্ত তিনি টানা পাঁচ বছর কনসল নির্বাচিত হলেন। রােমের আইনে একই মানুষ বারবার কনসল নির্বাচিত হওয়া ছিল বেআইনি কিন্তু রাজ্যের বিপদের কথা ভেবে তারা ঠিক করলেন যে তখন আইন অনুযায়ী চলে বিপদে পড়ার চেয়ে ওই বেআইনী সিদ্ধান্তই উত্তম। (খ্রিস্টপূর্ব ১০৭ সালে তার নির্বাচনের কথা চিন্তা করলে, খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সাল পর্যন্ত মারিয়াস ছয় ছয়বার কনসল নির্বাচিত হয়ে গেলেন। তিনি যখন তরুণ ছিলেন, একটি গল্প রােমে প্রচলিত ছিল যে তাকে দীক্ষা দেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যত্বাণী করা হয়েছে। যে তিনি সাতবার কনসল নির্বাচিত হবেন। যাই হােক, সপ্তমবার কনসল হতে হতে বহু সময় লেগে গেল)।

কিম্ব্রি ও টিউটোনিজদের বিরুদ্ধে মারিয়াসের অধীনে রোমানদের বিজয় : রােমের প্রাচীনকালের ক্ষমতার কথা চিন্তা করে মারিয়াস সেভাবে একদল সেনাবাহিনীকে তৈরি করলেন। যদিও, তিনি সেখানে ব্যবহার করলেন নিম্নবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা সৈনিকদের এবং এমনভাবে তৈরি করলেন যেন বাহিনীটি তার প্রতি পুরােপুরি অনুগত থাকে। তারা এমনভাবে তৈরি হয়ে গেল যে মারিয়াসের অবর্তমানেও মারিয়াসের প্রতি দায়িত্বশীল। উচ্চপদস্থ সৈনিকরা ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এবং নানা দিক দিয়ে স্বাধীন। তাদের নিজস্ব দেহরক্ষী ছিল। অবশ্য উচ্চপদস্থ সৈনিকেরা কনসল না হলেও প্রেটর ছিলেন। তাই তাদের দেহরক্ষীদের বলা হতাে প্রেতােরিয়ান গার্ড। তাই দেহরক্ষীদের লােহার ঢালের পিছনে উচ্চপদস্থ সেনা সদস্যরা ছিলেন এতটাই নিরাপদ যে প্রকাশ্যে রােমান আইনের বিরােধিতা করতে পারতেন। সৌভাগ্যবশত, মারিয়াস কিম্ব্রিদের আক্রমণ করার আগে সুসংগঠিত হওয়ার জন্য বেশ খানিকটা সময় পেয়ে গেলেন, কারণ কিম্ব্রি উপজাতি স্পেনে যুদ্ধ করে বেশ কিছু ছােটোখাটো পরাজয়ের পরেও নিজেদের অবস্থান তৈরি করাতে ব্যস্ত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১০৩ সালে পূর্ব ডেনমার্কের বাল্টিক সাগর উপকূল অঞ্চলের এক জাতি তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। এই দ্বিতীয় আদিবাসী জাতি, যাদের নাম ছিল টিউটোনিজ, তরা সম্ভবত এমন একটা ভাষা বলতেন যা থেকে আধুনিক জার্মান ভাষার উদ্ভব। তাই যদি হয়ে থাকে, তবে তারাই জার্মানের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রথম জাতি যারা প্রাচীনকালে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল (তাদের নাম থেকেই আমরা “টিউটোনিক” শব্দটি পাই, যার প্রতিশব্দ হলাে জার্মান)। কিম্ব্রি এবং টিউটোনিজ জাতিসহ তদের বাহিনী দাঁড়াল ৩০০,০০০ শক্তিশালী সৈন্যের এক দল। তারা একত্র হয়ে ইতালির দিকে যাত্রা শুরু করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১০২ সালে মারিয়াস তাদের সেনাবাহিনীকে গাউলের দিকে যাত্রা করিয়ে দিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল রন নদীর উপরে টিউটোনিজদের মুখােমুখী হওয়া, তাই দক্ষিণ দিকে তাদেরকে অনুসরণ করতে লাগল মারিয়াসের বাহিনী, তাদের জানিয়েই অনুসরণ করলেন যেন তারা নিজে থেকে আক্রমণ করে এবং আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে তাদের হত্যা করা যায়। বর্বর জাতির এলােমেলাে হামলা শুরু হলাে সুসংগঠিত রােমান বাহিনীর উপরে। টিউটোনিজরা যখন রােমান বাহিনীকে ঘায়েল করে ফেল তখন রােমান সেনাবাহিনীর পিছনে লুকিয়ে রাখা আরেক অংশ অতর্কিতে তাদের উপরে ঝাপিয়ে পড়ল। তাদেরকে ঘিরে ফেলল এবং বলতে গেলে শেষ মানুষটিকে পর্যন্ত হত্যা করল। কিন্তু তার আগেই কিন্ত্রি জাতির আরেক অংশ আল্পস পর্বত পেরিয়ে সিসালপাইন গাউলে পৌঁছে গিয়েছিল। রােমান বাহিনী সেদিকে গিয়ে প্রায় ইতালির সীমানার কাছে পাে উপত্যকায় তাদের আক্রমণ করেছিল। মারিয়াস গাউল ত্যাগ করে পাে উপত্যকায় চলে যান এবং সেখানকার বাহিনীতে যােগদান করেন। তার চমৎকার নেততে রােমান বাহিনী ভার্সেলিতে কিম্ব্রি জাতির মুখােমুখী হতে আবার নদী পেরােয়, যে অঞ্চলটি পাে উপত্যকা এবং আল্পসের মধ্যবর্তী অংশে। খ্রিস্টপূর্ব ১০১ সালে কিমি জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। রােম তার ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং মারিয়াস তার সাফলতার তুঙ্গে পৌঁছেন। (রােমানদের বিপদ কেবল উত্তর দিকেই ছিল না। ইতালির অস্থিতিশীল অবস্থা এবং সন্ত্রাসের সুযােগে খ্রিস্টপূর্ব ১০৩ সালে সিসিলির কৃতদাসেরা আবারাে বিদ্রোহ করার জন্য জেগে উঠেছিল যাকে বলে কৃতদাসদের দ্বিতীয় যুদ্ধ। দুই বছর ব্যাপী সিসিলি ক্রমাগত সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসের জবাবে সন্ত্রাসের কবলে পড়েছিল)। 

ইতালীয়দের নাগরিকত্ব নিয়ে সামাজিক যুদ্ধ ও নাগরিকত্ব লাভ

মারিয়াস ও সাটার্নিনাসের সংস্কার প্রচেষ্টা ও ব্যর্থতা : খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সালের মধ্যে যদিও রােম আবার একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পেরেছিল। কারণ জুগুৰ্থা মৃত্যুবরণ করেছিলেন; টিউটোনিজ এবং কিম্ব্রি উপজাতিকে হত্যার মাধ্যমে বিলুপ্ত করা হয়েছিল; কৃতদাসেরা নীরব হয়ে গিয়েছিল; সব কিছুই সাফলতা বলে মনে হচ্ছিল। আর সে কারণেই রােমান আইনকানুনকে ঢেলে সাজানাের জন্য উপযুক্ত সময় বলেও মনে হচ্ছিল। মারিয়াস তখন ছিলেন তার ষষ্ঠবারের মতাে কনসল হবার সময়টিতে। সৈন্যদের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি নিজের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করলেন। তাদের পুরস্কৃত করার জন্য তার প্রয়ােজন পড়ল কিছু খামার, যেগুলােকে ভাগ ভাগ করে তিনি সৈন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। তিনি সৈন্যদের জন্য কলােনি প্রতিষ্ঠা করলেন। সােজা কথায় বলতে গেলে গাইয়াস গ্র্যাকাসের চিন্তাভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই তার ওইসমস্ত কাজ করার প্রয়ােজন পড়েছিল। এভাবে তিনি জনপ্রিয় দলের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, যাদের প্রতি যে কোনাে কারণেই হােক তার সমর্থন ছিল। মারিয়াস নিজে মােটেও রাজনীতিবিদ ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষার বাইরে, তিনি তাই বুদ্ধিদীপ্ত কোনাে বক্তৃতা দিতে পারতেন না, এমনকি নতুন কোনাে রাজনৈতিক কৌশলও আবিষ্কার করতে পারতেন না। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ সৈনিকের মতাে এবং তার চেয়ে চালাক বা কৌশলী লােকদের হাতের পুতুল। আর এ কারণেই মারিয়াস পড়ে যান ট্রিবিউনের হাতে। লুসিয়াস অ্যাপুলিয়াস স্যাটার্নিনাস নামে একজন ট্রিবিউনের লোক ছিলেন, যিনি কিছু বছর আগে সিনেটের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক পদ থেকে বাতিল ঘােষিত হন এবং তার বিরুদ্ধে নানাভাবে অবিবেচক হবার অভিযােগ ছিল। মারিয়াস যেমন আইন চেয়েছিলেন স্যাটার্নিনাস সেগুলো পাশ করানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করলেন, তিনি সিনেটের ক্ষমতা ব্যবহার করে এবং যত্রতত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয় দেখিয়ে এসব করলেন। তিনি যত নতুন আইন করলেন, আইন করে সিনেটের সদস্যদের তার পাঁচ দিনের মধ্যে সেসবের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করতে বাধ্য করালেন। একমাত্র মেটিলাস, যে সেনাপ্রধানের অধীনে নিউমিডিয়ায় মারিয়াস নিয়ােজিত ছিলেন, তিনি আইনগুলাের প্রতি সম্মতি প্রদানে বিরত থাকলেন তিনি স্বেচ্ছা বন্দিত্ব গ্রহণ করলেন। স্যাটার্নিয়াস, গ্র্যাকাসের মতােই রােমান নাগরিকত্বের জন্য চাপ প্রয়ােগ করতে থাকলেন। গাইয়াস গ্র্যাকাসের কথা ধরলে স্যাটার্নিয়াস সেখানে নিম্নবিত্তের মানুষদের অনেক বেশি অস্থিতিশীল করে তুললেন। ওইরকম অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে সিনেটের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হলাে। নগরের জনগণকে সেভাবে তৈরি করতে চাচ্ছিল তারা, ট্রিবিউনের মধ্যে যারা বিদ্রোহী ছিল তাদেরকে চিহ্নিত করা হলাে। দুই পক্ষের সংঘর্ষ এবং দাঙ্গা অব্যহত থাকল। সিনেট নগরে বিশেষ আইন প্রণয়ন করল, জরুরি অবস্থা ঘােষণা করল এবং মারিয়াসকে ডেকে এনে কনসল পদে অধিষ্ঠিত হতে অনুরােধ করল। তাকে বলা হলাে তার নিজেরই দলের নেতাদের গ্রেফতার করে বন্দি করতে। মারিয়াস তখন এই দোটানা থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজতে ব্যর্থ হলাে। এবং শেষ পর্যন্ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে সিনেটের আদেশ মানতেই মনস্থ করল। তারপর বেশ কিছু হাঙ্গামার পরে স্যাটার্নিনাস এবং তার দল আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলাে। আর আত্মসমর্পণের পরপরই তাদের সকলকে নির্বিচারে হত্যা করা হলাে। মারিয়াস দেখলেন যে তার জনপ্রিয়তা একেবারে কমে গেছে। স্যাটার্নিনাসের মৃত্যু তার জন্য পরিবর্তনের পক্ষের দলের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়ানাের ব্যাপারে অযােগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হলাে। সেখানে দাঁড়াতে হলে তাকে রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হতাে। আর তাই তখনকার জন্য মারিয়াস রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এতে করে পরিবর্তনের পক্ষের প্রগতিশীল দলের সমস্যা কমল না।

কর আদায়কারী বিত্তশালী ও সিনেটরদের অবস্থা  ও এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব : একের পর এক রাজ্য দখলের সময়ে রােমে এমন একটি শ্রেণি গড়ে উঠল যে যারা কেবল দূরদৃষ্টির জোরে অথবা ব্যবসা করে কিংবা সরকারের জন্য অধিক করের ব্যবস্থা করে দিয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে উঠল। রােম নিলামের মাধ্যমে কর আদায়ের নিয়ম রেখেছিল, যে ব্যক্তি নিলামে সবচেয়ে বেশি টাকা কর আদায় করে দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করল সেই নিলামে জিতল। আর এভাবেই রােম নানারকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে প্রতিটি কর প্রদানকারী মানুষের কাছে কর আদায় করার ঝামেলা থেকে মুক্ত হলাে। নিলামে যিনি যত বড়াে অঙ্কের অর্থের প্রতিশ্রুতি দিতেন, কর আদায়ের জন্য নিজ নিজ প্রদেশে সাধারণ জনগণের উপরে তিনি ততটাই চাপ প্রয়ােগ করতেন। আর তাছাড়া নিলামে যে অর্থের প্রতিজ্ঞা তিনি করতেন, তার চেয়ে বেশি যদি সংগ্রহ করতে পারতেন তবে বাকি অর্থ তার নিজস্ব লাভ হিসেবে গণ্য হতাে। আবার প্রয়ােজন পড়লে সেই ব্যক্তিই নাগরিকদের কর প্রদানের জন্য অর্থ ধার দিতেন, তবে খুবই উচ্চ হারের সুদে। আর তখন নাগরিকদের কাছে কর এবং সুদ, দুটোই এক সঙ্গে আদায় করা যেত। বিত্তশালী ব্যক্তিরা সিনেটের সদস্য ছিলেন না, কর নিলাম এবং আদায়ের উপায়ে আকস্মিক আরাে বেশি বিত্তশালী হয়ে ওঠা মানুষগুলাে আগে কখনােই শাসনকার্য বা কর আদায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাদের বেশিরভাগ আয় হতাে ভূমি থেকে। নতুন ধনী হয়ে ওঠা লােকগুলােকে বলা হতাে ইকুইটিজ। এই শব্দটি এসেছিল ‘ঘােড়সওয়ার’ শব্দের ল্যাটিন থেকে। কারণ প্রাচীনকালে কেবলমাত্র ধনী ব্যক্তিরাই ঘােড়ার মালিক হতে পারত এবং যারা দরিদ্র তারা পায়ে হেঁটে চলাফেরা করত। তাই ঘােড়সওয়ার শ্রেণিকে “ব্যবসায়ী শ্রেণি” বলে অভিহিত করা হয়েছিল। সিনেটের লােকেরা দ্ররিদ্র শ্রেণির প্রতি বরাবর বাঁকা চোখে তাকাত, কিন্তু সমর্থনের জন্য আবার ঠিকই আড়ালে তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখত। কর আদায়কারীরা যখন কেবল অর্থের মালিক হয়ে উঠছিলেন, তখন সিনেটের সদস্যরাও যদি চাইত তাে অনেক অর্থের মালিক হয়ে উঠতে পারত। গাইয়াস গ্র্যাকাস যখন সিনেটের সদস্যদের সঙ্গে মতপার্থক্যের লড়াইয়ে ব্যস্ত, তিনি ব্যবসায়ী শ্রেণির চেয়েও মহান হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন যেন তারা শাসকদের ক্ষমতা সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারে। কিন্তু সে যাই হােক, সিনেটের সদস্যগণ দিন দিন এত বেশি অরাজকতায় লিপ্ত হয়ে পড়ছিল যে তাদের সকলকে এক সঙ্গে শাস্তি দেয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছিল, কারণ সিনেটের সদস্যরাই কেউ বিচারক আবার কেউ উকিল হিসেবে কাজ করতেন, যারা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযােগপত্র তৈরি করতে মােটেও রাজি ছিলেন না (পরে আবার কখনাে তাদের নিজেদের মধ্যেই কারাে এরকম অর্থ উপার্জনের উপায় খুলে যেতে পারে বলে হয়তো তারা মনেও করত)। 

ড্রুসাসের সংস্কার প্রচেষ্টা, ব্যর্থতা ও মৃত্যু : খ্রিস্টপূর্ব ৯১ সালে মার্কাস লিভিয়াস ড্রুসাস নামে সংস্কারপন্থী এক ট্রিবিউন এই সমস্যা সামলেছিলেন। তিনি ছিলেন শাসক গাইয়াস গ্র্যাকাসের পুত্র যিনি নিজেই গাইয়াস গ্র্যাকাসের প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু সেই পুত্র অন্য এক দিকে আবার ছিলেন প্রগতিশীল। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে তিনশ সিনেট সদস্যের সঙ্গে তিনশ কর আদায়কারী একসঙ্গে মিলে কাজ করুক। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে কর আদায়কারীদের কাজকর্মে সিনেট সদস্যরা যেমন কড়া নজর রাখতে পারবে, তেমনি সিনেট সদস্যদের ভুলভ্রান্তিও কর আদায়কারীদের চোখ এড়াবে না। এই দুই দলের ক্রমাগত বিতর্কের মধ্যে নতুন শাসকশ্রেণিকে বাধ্য হয়ে সৎ থাকতে হতাে। সম্ভবত বিষয়টি এভাবে কাজ করেনি; যেভাবে করেছিল তা হলাে, ওই দুই শ্রেণি এক হয়ে নতুন উদ্যমে যুক্তভাবে অরাজকতা শুরু করল। এরকম দ্বিগুণ অরাজকতার সঙ্গে লড়াই করার জন্য ড্রুসাস একটি বিশেষ কমিশন গঠন করলেন এবং প্রতিটি অনিয়ম তদন্ত করে দেখার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। সিনেট এবং কর আদায়কারী নব্য ধনী শ্রেণি কেউই আমাদের জন্য আত্মত্যাগ করবে না এরকম একটি বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ড্রুসাস নতুন করে প্রগতিশীলতার চিন্তাধারা ছড়িয়ে দিলেন এবং উপনিবেশ আইনের বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেন। আর স্বাভাবিকভাবেই তিনি ইতালির অধিবাসীদের নাগরিকত্বের আওতায় এনে তাদের মধ্যে থেকে সমর্থক দল তৈরি করার প্রয়াস পেলেন। ড্রুসাসের তৈরি নতুন সমস্ত আইন পাশ হয়ে গেলেও সিনেট সদস্য এবং কর আদায়কারীরা মিলে সেসব আইনকে বাতিল ঘােষণা করতে সমর্থ হলাে, আর এরই সঙ্গে সঙ্গে ড্রুসাসকে নির্মম এবং রহস্যজনকভাবে বন্দি করা হলাে। সেখানেই তার মৃত্যু হলাে এবং তার হত্যাকারীকে কোনােদিন চিহ্নিত করা সম্ভব হলাে না।

ইতালীয়দের রোমান নাগরিকত্বের প্রশ্ন নিয়ে সমস্যা : বহু ইতালিয়ানের কাছে ড্রুসাসের খুনীকে খুঁজে বের করাকেই শেষ রক্ষা বলে মনে হয়েছিল। দুই শতাব্দী ধরে তারা ইতালিতে বসবাস করে সুখে-দুঃখে রােমের পাশে ছিল। সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করার মতাে ব্যাপার হলাে, সেই ক্যানির যুদ্ধের পরের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টাতেও তারা রােমের সঙ্গে ছিল। এখন তাদের ভাগ্যে কি কোনাে পুরস্কার থাকবে না? আর তাই তাদেরকে রােমের নাগরিকত্ব পাইয়ে দেয়া খুব বেশি কিছু দেয়া হবে না হয়তো। এই নাগরিকত্বের অর্থ হলাে রােমের নির্বাচনের সময়ে ভােট দেয়া। তাদেরকে বলা হলাে যে তারা রােমের নির্বাচনের সময়ে ভােট দিতে পারবে তবে দিতে চাইলে রােমে যেতে হবে, অর্থাৎ সশরীরে রােমে উপস্থিত থাকতে হবে। দূরবর্তী এলাকায় থাকা ইতালির অধিবাসীগণ যতবার রােমে ভােট দেয়ার প্রয়ােজন পড়বে ততবার শত শত মাইল রাস্তা পেরিয়ে সেখানে উপস্থিত থাকবার কথা কল্পনাও করতে পারত না। সুতরাং রােমানদের জন্য ইতালির অধিবাসীদের নাগরিকত্বের দাবি তােলা একটা আকাশকুসুম কল্পনাই ছিল। তাই ইতালিয়ানরা সেখানে এসে সরকার পরিচালনা করবে তারও প্রশ্ন ওঠেনি। (দুর্ভাগ্যবশত রােম কখনাে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেনি। প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থায় দূরবর্তী প্রদেশের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি রােমে এসে বসবাস করতে পারতেন এবং তার এলাকার প্রয়ােজন বা সমস্যা রােমের সিনেটে তুলে ধরতে পারতেন। কিন্তু রােমে সেরকম ব্যবস্থা কখনাে করা হয়নি)। এমনকি ভােট দেয়ার দায়িত্ব ছাড়াও, রােমান নাগরিকত্ব ছিল তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং আকাঙ্ক্ষিত। রােমান নাগরিক হবার কারণে ইতালির যে কোনাে অধিবাসীর আইন ব্যবহারে এবং আদালতে বিচরণের ক্ষেত্রে নানারকমের সুবিধা হতাে, বিভিন্ন কর প্রদানের ক্ষেত্রে মওকুফের সুবিধা পেত এবং অন্য রাজ্য দখলের সময়ে যে সম্পদের বন্যা বয়ে যেত রােমে, তাতে ভাগ বসাতে পারত। সবচেয়ে বড়াে কথা হলাে তারা তাদের নিজের দৃষ্টিতে নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত বােধ করত। তবে সত্যি কথা বলতে কী, তাদের আনুগত্যের হিসেবে নাগরিকত্বের সুবিধা তেমন কোনাে ব্যাপারই ছিল না, এবং তার পরের অর্ধ শতাব্দী ধরে বারংবার তারা এই বিষয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়েছিল। তখন রােমের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিল এমন কিছু লােক আবার নিজ নিজ নাগরিকত্বে ফেরত যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সেই প্রচেষ্টা শুরু করতেই রােমান সিনেটের নির্দেশে হত্যার শিকার হয়। সিনেটের প্রতিটি বিজয়ের পরে ইতালির বিভিন্ন স্থান থেকে যারা রােমের নাগরিকত্বের লােভে রােমে এসে পৌঁছত তাদের পরিণতি ভয়াবহ হতাে।

সামাজিক যুদ্ধ বা পঞ্চম স্যামনাইট যুদ্ধ : সে যাই হােক, রােম যখন ইতালিয়দের চায়নি তখন স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় যে, ইতালিয়রাও রােমকে চায়নি। ক্রোধের চাপে ইতালির অনেক নগর নিজেদেরকে রোমের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং স্বাধীন হিসেবে ঘােষণা দিয়েছিল। তাই ক্রোধ হােক হতাশা, সেখান থেকেই তারা নিজেরা একত্র হয়ে একটি পৃথক রাজ্য প্রতি করেছিল, যার নাম দিয়েছিল ইতালিয়া। তারা রােম থেকে আশি মাইল পূর্ব দিকে কফিনিয়াম নামের অঞ্চলে নিজেদের রাজধানী স্থাপন করেছিল। সাধারণভাবে তাদের এই পদক্ষেপ যা বয়ে এনেছিল তা হলাে যুদ্ধ, ওই যুদ্ধের নাম ছিল সামাজিক যুদ্ধ, ল্যাটিন শব্দ ‘অ্যালিস’ অর্থাৎ জোট থেকে এই নামকরণ করা হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ৯১ সালে রােমের বিরুদ্ধে যে আদিবাসী জাতি বিদ্রোহ করে উঠেছিল, সেই বিদ্রোহের সিংহভাগে ছিল স্যামনাইট জাতি। ওই বিদ্রোহের মাধ্যমেই পঞ্চম স্যামনাইট যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। আপােষের ব্যাপারে রােমের কোনাে আগ্রহই ছিল না কিন্তু বিস্মিত হয়ে রোম দেখল যে রােমের বাইরে ইতালির অন্যান্য নগরগুলাে নিজেদের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এমন একটা পর্যায়ে এনেছে যে সেই দিন, উপস্থিত যে কোনাে দিনে তারা নিজ নিজ এলাকায় একযােগে রােমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। আর ওদিকে রােমের অবস্থা তখন এমন ছিল যে তার কোনাে প্রস্তুতিই ছিল না। এমনকি হ্যানিবলের সময় থেকেই রােমের চারপাশের পাচিল পর্যন্ত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনা অবশ্য এক শতাব্দী আগের। রােম দ্রুত একটি সেনাবাহিনী তৈরি করার উদ্যোগ নিল যারা ছােটোখাটো কিছু পরাজয় বরণ করল। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে তারা স্যামনাইটদের বিরুদ্ধে লড়ে পরাজিত হলাে, যেখানে কনসল লুসিয়াস জুলিয়াস সিজারকে বিশ্রীভাবে আহত হতে হলাে। খ্রিস্টপূর্ব ৯০ সালে সিজারের তত্ত্বাবধানে এট্রুস্কান এবং আমব্রিয়ানদের রােম থেকে দূরে উত্তর দিকে রাখা হলাে। রােমান নাগরিকরা কেবল সেই সমস্ত ইতালিয়ানকে তাদের মাটিতে সহ্য করল যাদের রােমের প্রতি আনুগত্য আছে।

মারিয়াস ও স্যুলার নেতৃত্বে রোমানদের বিজয় : সিনেট চলে গেল বিপক্ষে, মারিয়াসকে (যিনি তখনই পূর্বাঞ্চল থেকে এক সফর শেষে ফিরে এসেছিলেন) রােমান সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতে বাধ্য করল, কিন্তু আবার তাকে সর্বময় ক্ষমতাও দেয়া হলাে না। মারিয়াসের আগ্রহ পুরােপুরি তার কাজের মধ্যে ছিল না, তিনি ছিলেন ইতালিয়দের নাগরিকত্ব দেয়ার পক্ষে। আর তখন তার নিজের লােকদের সঙ্গে তার নিজেরই লড়াই করতে হচ্ছিল, সােজা কথায় বরতে গেলে যে সিনেট সদস্যদের তিনি ঘৃণা করতেন, তাদের পক্ষেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছিল এবং স্যাটার্নিনাসকে ধ্বংসও করতে হলাে সেভাবেই। তিনি মানুষ হত্যার ঘটনা সবচেয়ে কমের দিকে রাখতে চাচ্ছিলেন। যাই হােক, লুসিয়াস সিজার মৃত্যুবরণ করলে মারিয়াসের নিউমিডিয়ায় থাকাকালীন সাহায্যকারী সুলা দক্ষিণাঞ্চলে রােমান সেনাবাহিনীতে সেনাপ্রধান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তিন তখন আর আর মারিয়াসের অধীনে নন, তাই নিজেই বীরত্বের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই প্রথম সুলা কারাে সাহায্য ছাড়াই সেনাবাহিনীকে পরিচালিত করছিলেন এবং মারিয়াসের চেয়ে ভালােই করছিলেন। সিনেট শেষ পর্যন্ত একজন সেনাবাহিনী প্রধানকে নিজেদের হয়ে খাটতে বাধ্য করেছিলেন। বিদ্রোহী ইতালিয়ানদের আবারাে নাগরিকত্বের লােভ দেখিয়ে ষাট দিনের মধ্যে আবেদন করার একটি আহ্বান জানানাে হলাে। যেহেতু নাগরিকত্বই ছিল সেই দাবি যার জন্য তারা জোটবদ্ধ হয়েছিল, তখন তাই অনেক ইতালিয়ানই আবেদন করল। স্যামনাইটরা অবশ্য তারপরেও রােমের বিরুদ্ধে লড়েই যাচ্ছিল, তবে খ্রিস্টপূর্ব ৮৮ সালে সামাজিক যুদ্ধের অবসান হলাে।

যুদ্ধের ফল ও ইতালীয়দের নাগরিকত্ব লাভ : যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে ইতালির অধিবাসীদের নিজস্ব স্বাধীনতার শেষ ঝিলিকটিও নিভে গেল। স্যামনাইটরা কাগজে কলমে হাওয়া হয়ে গেল। রােম পর্যন্ত বিষয়টা এমনভাবে দেখছিল যে ইতালিয়ান ভাষা এবং অসকান ভাষাকে (ল্যাটিনের মতাে একই উৎস থেকে আসা ভাষা) নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ল্যাটিনই বলতে গেলে প্রায় সমগ্র ইতালির ভাষা হয়ে দাঁড়াল। তখন মনে হচ্ছিল যে রােম যেন নিজেকে বড়াে কোনাে বিপদে ফেলতে যাচ্ছে। তবে তারা ইতালির অধিবাসীদের জন্য নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করেছিল ঠিকই কিন্তু এর কোনাে উত্তর নেই যে এই কাজটা তারা আরাে তিন বছর আগে কেন করেনি, করলে অনেক মৃত্যু এবং ধ্বংস এড়াতে পারত? রােমানদের হৃদয়ে পরিবর্তন আসতে লাগল, কারণটা এমন নয় যে হঠাৎ কোনাে আলাের ঝলকানি লেগেছিল, কিংবা কোনাে জোটের প্রতি তাদের বাধভাঙা কোনাে ভালােবাসার উদ্রেক হয়েছিল অথবা যা কিছু অন্যয় তারা ইতালির অধিবাসীদের প্রতি করে ফেলেছিল তার জন্য তারা অনুতপ্ত হয়ে পড়েছিল, এমনটাও নয়। সত্যি কথা বলতে কী, পূর্ব দিকে একটি অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত বিপদ ঘনিয়ে আসছিল, যা তার আগের এক শতাব্দী ধরে ছিল সুপ্ত এবং উপেক্ষিত। নতুন বিপদকে মােকাবেলা করতে রােম একমাত্র যা করতে পারত তা হলাে শান্তি আনয়ন এবং নিজের রাজ্যে নিজের শান্তি বজায় রাখা, যা করতে সবচেয়ে প্রথমে তাকে যা করতে হয়েছিল, তা হলাে ইতালিয়ানদের নাগরিকত্বের দাবি মেনে নেয়া।

স্যুলা এবং পম্পেই এর কাল

পন্টাসের মিথ্রাডেইটিস ও মারিয়াস বনাম স্যুলা

এশিয়া মাইনোরের অবস্থা ও স্বাধীন রাষ্ট্র পন্টাস : এশিয়া মাইনরে নতুন বিপদ দেখা গেল, যেটা এর আগে রােমের উপরে তেমন কোনাে চাপ তৈরি করেনি। পশ্চিম দিকের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল রােমের প্রতি অনুগত ছিল। পারগামাম ততদিনে রােমান অঞ্চল এবং এশিয়ার প্রদেশ হিসেবে গণ্য হবার চল্লিশ বছর কেটে গিয়েছিল। সেই প্রদেশটির উত্তর-পশ্চিমে ছিল বিথিনিয়া, যে এলাকায় এক শতাব্দী আগে হ্যানিবল আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন সেই অঞ্চলটিও পারগামামের মতােই রােমের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ছিল নানান রাজ্যের সমাহার, সেই সমস্ত রাজ্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মহামতি আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পরে। পূর্বদিকে কৃষ্ণসাগরের উপকূলে, উদাহরণ হিসেবে যে রাজ্যের কথা বলা যায়, তা হলাে পন্টাস, যার নামকরণ করা হয়েছিল গ্রিক ভাষায় কৃষ্ণসাগরের নাম অনুযায়ী। পন্টাস ছিল প্রকৃতপক্ষে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত কিন্তু পারস্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল ঢিলেঢালা প্রকৃতির। মহামতি আলেক্সান্ডার যখন পারস্য সাম্রাজ্য দখল করে নেন এবং তারপর মৃত্যুবরণ করেন, ম্যাসিডােনের সেনাপ্রধানরা তখন পন্টাসকে দখল করতে চাইলেও নানান কারণে পারেননি। খ্রিস্টপূর্ব ৩০১ সালে পন্টাস রাজ্যটি পারস্যের শাসকের উত্তরাধিকারী মিথ্রাডেইটিসের সঙ্গে নিজেদের পাকাপােক্তভাবে জড়িয়ে ফেলে। পন্টাসের দক্ষিণ দিকে ছিল গ্যালাশিয়া এবং ক্যাপাডােশিয়া, যাদের ইতিহাস পন্টাসের সময়কারই। দুই শতাব্দী আগে গ্যালিক জাতি যখন এশিয়া মাইনরে অনুপ্রবেশ করেছিল, তখন তারা ঘাঁটি গেড়েছিল গ্যালাশিয়ায় এবং তাদের নাম থেকেই রাজ্যটি ওই নামটি পেয়েছিল। পন্টাসের পূর্বদিকে কৃষ্ণসাগর থেকে শুরু করে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত, আর ওদিকে দক্ষিণের ককেশিয়ান পর্বত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল আর্মেনিয়া। এই সমস্ত রাজ্যের মধ্যে পন্টাসই একমাত্র, যে একজন বীর এবং আগ্রাসী রাজার (যার ডাকা হতাে মিথ্রাডেইটিস বলে) অধীনে প্রভূত উন্নতি করেছিল। রাজ্যটি বিশাল হেলেনিক রাজ্যের বিপক্ষে বীরত্ব নিয়ে লড়েছিল, সেলুসিড রাজ্যের মধ্যে সেই ছিল তার সবচেয়ে বড়াে শত্রু। তৃতীয় অ্যান্টিওকাস যখন রােমানদের কারণে কিছুটা নমনীয়, পন্টাস তখন সুযােগ বুঝে নিজেদের এলাকা বৃদ্ধি করেছিল এবং কৃষ্ণ সাগরের উপকূল থেকে পশ্চিম দিকে বিথিনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।

পন্টাসরাজ মিথ্রাডেইটিস : রােম যখন পারগামাম দখল করে নিল, পঞ্চম মিথ্রাডেইটিস তখন পন্টাসের রাজা। এশিয়া মাইনরের অন্যান্য রাজারা যা করেছিল, তিনিও তেমন রােমের সঙ্গে একটি জোট তৈরি করলেন এবং দখলকৃত ভূখণ্ডে কোনাে ধ্বংসযজ্ঞ না চালানাের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তবে তিনি আর যাই করেন, পন্টাসের প্রতিপত্তি বাড়ানােরই চেষ্টা করেছিলেন, এবং বাড়তি ভূমি হিসেবে গ্যালাশিয়া এবং কাপাডােশিয়ায় তার প্রভাব বেড়েছিল। রােম যেন তার প্রভাব বৃদ্ধির ব্যাপারে আপত্তি না করে, সেই চেষ্টাতেও তিনি অবিচল ছিলেন। সে যাই হােক, খ্রিস্টপূর্ব ১২১ সালে তার নিজের অধীনে থাকা পন্টাসের মানুষেরাই তাকে বন্দি করেছিল এবং তার এগারাে বছরের সন্তান ষষ্ঠ মিথ্রাডেইটিস তার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল (তাকে কখনাে মহামতি মিথ্রাডেইটিস বলা হতাে)। ষষ্ঠ মিথ্রাডেইটিস সম্পর্কে নানান ধরনের কাহিনির প্রচলন আছে। তিনি নানান উপায়ে হত্যা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তার অভিভাবক তথা আত্মীয়রা তাকে নানাভাবে সাহস যুগিয়ে সহায়তা করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত উন্নত শিক্ষার সুযােগ পেয়েছিলেন এবং বলা হয় তিনি বাইশটি ভাষা সফলভাবে শিখতে পেরেছিলেন। তার সম্পর্কে যতগুলাে গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে অদ্ভুত এটাই যে তিনি বিভিন্ন ধরনের জীবন ধ্বংসকারী বিষ সামান্য পরিমাণে প্রতিদিন সেবন করতেন, যেন ওই সমস্ত বিষের কোনাে কার্যকারিতা তার শরীরে না থাকে। এই উপায়ে তিনি বন্দি হয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যবরণ ঠেকাতে পারবেন বলে তার ধারণা ছিল (অবশ্য সত্যিকার অর্থেই সামান্য কিছু বিষের ক্ষেত্রে এই উপায়ে তাদের প্রতি সহ্য ক্ষমতা তৈরি করা সম্ভব)। মিথ্রাডেইটিস যখন পূর্ণবয়সে পৌঁছলেন, তিনি রাজ্যের পরিধি বাড়ানাের ব্যাপারে একটি আগ্রাসী পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন, অবশ্য তার এই পরিকল্পনা রােমান রাজ্য থেকে দূরের ভূমির জন্য কার্যকর ছিল। তিনি প্রথমেই অনেক কাহিনির প্রনয়ণকারী ভূমি কল্কিস দখল করলেন, যেখানে জেসন এবং আর্গোনটসের অভিযানের কাহিনি শােনা যায়, তারা সােনালি পালকের খোঁজে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন, এই কাহিনি বর্ণিত আছে গ্রিক প্রাচীন আখ্যানে। তার ক্ষমতা কৃষ্ণসাগরের উত্তর দিকের উপকুলে ছড়িয়ে পড়ল, যেখানে ছয় শতাব্দী আগে গ্রিক নগরের দাপট ছিল এবং যেখানে তখন স্থাপিত হলাে ক্রিমিন পেনিনসুলা। তিনি গ্যালাশিয়া এবং ক্যাপাডােশিয়ার উপরে পন্টাসের শাসন বজায় রাখতে সক্ষম হলেন আর ওদিকে আর্মেনিয়ার সঙ্গে এক শক্ত জোট তৈরি করলেন।

মিথ্রাডেইটিসের রোমান পূর্বাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ ও রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা : রােমের সাহায্য ছাড়াই তিনি এই সমস্ত অর্জন করে ফেললেন, কারণ রােমের মনােযােগ তখন দক্ষিণে জুগুর্থা এবং উত্তরে অসভ্য কিছু জাতির উপরে। তাই দূরবর্তী পাহাড় কিংবা সমুদ্র উপকূলে কোন রাজার সঙ্গে কোন রাজার কী দখলের যুদ্ধ চলছে তার দিকে নজর দেয়ার মতাে সময় তখন রােমের নেই। মিথ্রাডেইটিস তার তরুণ বয়সে রােমের শাসনকে ঘৃণা করতেন, কারণ তখন এশিয়া মাইনরের কিছু অঞ্চলকে মিথ্রাডেইটিস তার নিজের মনে করতেন, আর সেসব অঞ্চলকে রােম দখল করে তাদের নিজেদের বলে ঘােষণা দিয়ে দিয়েছিল। জায়গাগুলাে এশিয়া মাইনরের রাজার উপরে টেক্কা দিয়ে তিনি দখল করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন দখল প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী তার নিজের লােকেরা আফ্রিকায় অত্যাচারের শিকার হয়েছিল এবং উত্তরাঞ্চলের অসভ্য জাতি তাদের উপরে অত্যাচার করেছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের বিজয় হয়েছিল কিন্তু ইতালিতে ততদিনে এক ব্যাপক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। মিথ্রাডেইটিস নিশ্চয় অনুভব করেছিলেন যে তার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। খ্রিস্টপূর্ব ৯০ সালে সন্দেহাতীতভাবে তিনি এশিয়া মাইনর (একমাত্র রােম বাদ দিয়ে) অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক ছিলেন, যা তিনি জানতেন। তখন তিনি দখল প্রক্রিয়া চালু রাখতে পশ্চিম দিকে এগােতে লাগলেন। সেদিকে তিনি বিথিনিয়া দখল করে বসলেন। রাজ্যের ভেতরে সামাজিক যুদ্ধ চলা সত্ত্বেও, রােম সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাল। বিথিনিয়া ছিল রােমের অনুগত রাজ্য, তাই রােমকে তৎক্ষণাৎ এই বিষয়ে ভাবতে হয়েছিল। আর সে কারণেই রােম শক্তভাবে আদেশ দিয়েছিল মিথ্রাডেইটিসকে বিথিনিয়া ছেড়ে চলে যেতে, এবং পন্টাসের দেবতা রােমের ক্রোধ দেখে বিস্মিত হয়ে বিথিনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। যাই হােক, তারপরে রােম যা করল, তা হলাে, বিথিনিয়াকে পন্টাসে আক্রমণ চালাতে উৎসাহ দেয়া, যে কারণে মিথ্রাডেইটিস চরম অসন্তুষ্ট হলেন এবং রােমের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিলেন। আর এভাবেই প্রথম মিথ্রডেইটিক যুদ্ধ আরম্ভ হলাে। মিথ্রাডেইটিস খুব ভালােভাবেই তৈরি হয়েছিলেন, তার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন গ্রিক সেনা সদস্য দল, এশিয়া মাইনরের আনাচে কানাচে বন্য দাবানলের মতাে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে চলে গেলেন তারা। তিনি কেবল বিভিন্ন আদিবাসীদের রাজ্য দখল করলেন না, এশিয়ার নিজস্ব প্রদেশও দখল করে ফেললেন। আর তারপরে আগের কোনাে ব্যবসায়িক সম্পর্ক যেন টিকে না থাকে, সে উদ্দেশ্যে তিনি এশিয়া মাইনরে অবস্থানরত প্রতিটি ইতালিয়ান ব্যবসায়ীকে হত্যা করার আদেশ দিলেন। একই দিনে ৮০,০০০ মানুষকে হত্যা করার ইতিহাস রচিত হলাে। এই সংখ্যাটা অবশ্য সুনির্দিষ্ট নয়, সামান্য কম-বেশি হতে পারে। মিথ্রাডেইটিস এরপরে গ্রিসে সেনাবাহিনী পাঠালেন। গ্রিকরা বিস্মিত হলাে যে চারদিকে দখলের রাজত্ব চালানাে রােমান শাসকদেরকে বুড়াে আঙুল দেখানাের মতাে কেউ তবে পৃথিবীতে বর্তমান। তাই তারা সঙ্গে সঙ্গে মিথ্রাডেইটিসের বাহিনীতে যােগদান করল এবং পূর্বাঞ্চলে রােমানদের প্রতিপত্তি নেমে শূন্যের কোঠায় চলে এল।

কে মিথ্রাডেইটিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তা নিয়ে মারিয়াস ও স্যুলার মধ্যে যুদ্ধ : হ্যানিবলের মতাে নাছােড়বান্দা শত্রুর বিনাশের পর থেকে রােমানরা তেমন কোনাে পরাক্রমশালী শত্রু পায়নি, তাই নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তির পথে এরকম দেয়ালের মতাে বাধার সম্মুখীন হয়ে যারপরনাই চমকে উঠল। তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল মিথ্রাডেইটিসের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাধা প্রদান করা, কিন্তু তারপরেও তা তারা করতে পারল না, যদিও দুইজন শক্ত সমর্থ মানুষ ছিলেন রােমান সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেয়ার জন্য, যাদের পিছনে সমর্থক হিসেবেও ছিল একাধিক শক্তিশালী দল, কিন্তু কেউই এগিয়ে যেতে সম্মত হলেন না। দুজন শক্তিশালী মানুষ বলতে, রক্ষণশীল দলের স্যুলা এবং প্রগতিশীল দলের মারিয়াস। তার কিছু বছর আগেই দুজনেরই পূর্বাঞ্চলে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবং দুজনেরই মিথ্রাডেইটিসের সঙ্গে লড়ার অভিজ্ঞতা ছিল। সিনেট জানত যে এই দুই ক্ষমতাধরের মধ্যে কে মিথ্রাডেইটিসকে মােকাবেলা করতে সক্ষম। আর তাই তারা স্যুলাকে তার সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাবার আদেশ দিল। তাদের ধারণা ছিল মারিয়াসের পক্ষে এই লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়। তখন মারিয়াস ট্রিবিউনের কাছে আবেদন করলেন তাকে পাঠানাের জন্য। পাবলিয়াস সালফিসিয়াস রুফাস ছিলেন তখন সিনেটের মধ্যে যিনি আকণ্ঠ দেনায় ডুবে ছিলেন। মারিয়াস তাকে যুদ্ধ থেকে পাওয়া আয়ের সাহায্যে তার সমস্ত দেনা শােধে লােভ দেখালেন। তখন তিনি একটি নতুন আইন প্রনয়ণ করলেন, যার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভােট প্রদানের জন্য দূরে অবস্থানরত ইতালির অধিবাসীদের রােমে ডেকে নেয়া হলাে। তারা সকলে মিথ্রাডেইটিসের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য মারিয়াসকে নির্বাচিত করে ভােট দিলেন। এই বিষয়টি ইতালির অধিবাসীদের জন্য ছিল খুবই স্বাভাবিক। গৃহযুদ্ধের আগে মারিয়াস তাদের যথেষ্ট সাহায্য সহযােগিতা করেছিলেন এবং যুদ্ধের সময়ে তাদের প্রতি নরম হয়ে লড়েছিলেন, যেখানে স্যুলা ছিল তাদের পরাজয়ের পিছনে মূল কারণ। আর তাই তখন রােমের পক্ষে মিথ্রাডেইটিসের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য দুই দুইজন বীর নিজেদের তৈরি করে ফেললেন, কিন্তু কেউই এগিয়ে যেতে পারছিলেন না, যতদিন না বিষয়টির ফয়সালা হয়। স্যুলা রােম থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন, পালিয়ে গিয়ে তিনি সােজা যােগদান করলেন সেই সেনাবাহিনীতে যা যুদ্ধে গেলে তার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, বাহিনীটি অপেক্ষা করছিল ন্যপলসে। তবে সে যাই হােক, তিনি সেনাবাহিনীকে গ্রিসের দিকে নিয়ে যাননি। এই পদক্ষেপ নেয়ার সাহস তার ছিল না, যতক্ষণ তার শত্রু, মারিয়াস রােমে অবস্থান করছেন এবং রােমের শাসকদের সুনজরে আছেন। তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে বরং রােমের দিকে যেতে লাগলেন। ইতিহাসে সেই প্রথম একজন রােমান সেনাপ্রধান, একটি রােমান বাহিনী নিয়ে রােমকে আক্রমণ করবে বলেই রােমের দিকে রওনা দিয়েছিল (এমনকি কোরিওলানাস, যিনি তার নিজের দেশের বিপক্ষে গিয়ে সেদিকে ধেয়ে যাচ্ছিলেন আক্রমণের উদ্দেশ্যে, তার সঙ্গেও ছিল একটি শত্রুপক্ষীয় সেনাবাহিনী)। আর এভাবেই রােমান সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে রোমান সেনাপ্রধানের প্রথম যুদ্ধ শুরু হলাে, পরের অর্ধ শতাব্দীতে রোমকে ধ্বংস করার জন্য যা যথেষ্ট ছিল। মারিয়াস রােমকে বাঁচানাের আপ্রাণ চেষ্টা করল, কিন্তু স্যুলার প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সামনে রােমের জনগণের শক্তি হয়ে গেল নগণ্য। অ্যালা তার বাহিনীকে এমনভাবে পরিচালনা করছিলেন যেখানে তার চমৎকারিত্ব প্রকাশ পাচ্ছিল। মারিয়াস এবং সালফিসিয়াস রুফাস বাধ্য হয়ে রােম থেকে পালিয়ে গেলেন। দ্বিতীয়জনকে রােম থেকে বিশ মাইল দূরে এক জায়গায় পাওয়া গেল। তাকে বন্দি করে হত্যা করা হলাে। একাধিকবার মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে মারিয়াস কোনােরকমে ইতালির উপকূলে পৌঁছতে সক্ষম হলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কার্থেজ উপকূলের একটি ছােট্ট দ্বীপে নিরাপদ থাকার নিশ্চয়তা পেলেন। 

স্যুলার একনায়কতন্ত্র

মিথ্রাডেইটিস-স্যুলার যুদ্ধ, স্যুলার জয় ও হারানো অঞ্চলের পুনর্দখল : স্যুলা তখন হয়ে উঠলেন অবিসংবাদিত কনসলের মতাে (অর্থাৎ, কনসল না হয়েও তিনি সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যেতে পারেন এমনভাবে যেন তিনিই কনসল) এবং নিরাপদে ইতালি ত্যাগ করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৮৭ সালে তিনি গ্রিসে অবতরণ করলেন এবং পূর্বদিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলেন। তিনি গ্রিক সেনাবাহিনীকে পরাজিত করলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৮৬ সালে এথেন্সে আক্রমণ করেন। এথেন্সের জন্য নিজের মাটিতে কোনাে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা বহু বছর পরের অভিজ্ঞতা। তার আগের দুই শতাব্দী ধরে এথেন্স হয়ে উঠেছিল কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় নগর, সেখানে ছিল কেবল দর্শনের বিদ্যালয় এবং প্রাচীন ইতিহাস চর্চার বিকাশ কেন্দ্র। কিন্তু তারপরেও মিথ্রাডেইটিস যখন গ্রিসে গিয়ে উপনিত হলেন, এথেন্স শেষবারের মতাে একটা ঝাকুনি খেল। এথেন্স নিজের দরজা তার জন্য খুলে দিয়েছিল এবং রােম বিরােধী চিন্তাভাবনাকেই স্বাগত জানাল প্রকৃত অর্থে। আর তখন এথেন্সের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্যুলা, কিন্তু মিথ্রাডেইটিসের সেনাবাহিনীরা কোথায়? কেউ কেউ ততক্ষণে পরাজিত এবং কেউ আবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্যুলা সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ৮৬ সালে যা করলেন তা হলাে নিজের সেনাবাহিনী দিয়ে দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালানাে। এটাই ছিল সেই প্রাচীন নগরটিতে সর্বশেষ ধ্বংসযজ্ঞ। সামান্য কিছু প্রচেষ্টা ছাড়া প্রাচীন নগরটি আর কখনােই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার সুযােগ পায়নি। স্যুলা তখন উত্তর দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন, নিজের ক্ষমতার মধ্যে সহজেই সামনে প্রতিপক্ষের যত বাহিনী পড়ল সবাইকে পরাজিত করে এগিয়ে যেতে লাগলেন এবং এশিয়া মাইনরের মধ্যে উত্তর দিকের এইগান সমুদ্রের উপকূল ধরে এগােতে লাগলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৮৪ সালের মধ্যে মিথ্রাডেইটিস দেখলেন যে রোমান আক্রমণকে এর চেয়ে বেশিক্ষণ যাবৎ প্রতিহত করা অর্থহীন, তাই তিনি শান্তি স্থাপন করলেন। তবে শান্তি স্থাপনের ফলে তার অনেক ক্ষতি হলো। তিনি এতদিন যাবৎ যেসব অঞ্চল জয় করেছিলেন সেগুলো ফেরত দিতে হলো, তার নৌবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হলো, আর অনেক বড়াে অংকের অর্থ ক্ষতিপূরণও দিতে হলাে। স্যুলার কাছে মনে হয়েছিল দ্রুত শান্তি স্থাপন করা জরুরি, কারণ আরাে বেশি দেরি করলে যে আরাে বেশি অর্থ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তা তার জন্য বহনযােগ্য নাও হতে পারে এবং পন্টাসের রাজার জন্যও তা সুখকর হতাে না।

রোমে সিনার ক্ষমতা দখল : কিন্তু সমস্যা দেখা দিল রােমের নিজ ভূমিতে। স্বাভাবিকভাবেই স্যুলা যখন ইতালি ছেড়ে গেলেন, জনপ্রিয় দলটি, যে দলটিকে তিনি সাময়িকভাবে ভেস্তে দিয়েছিলেন, সেটি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। একজন কনসল, লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সিনা নির্বাচিত হয়েছিলেন স্যুলা গ্রিসের জন্য রওনা দেবার পরপরই। তিনি জনপ্রিয় দলের হয়ে স্যুলাকে থামাতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পারেননি। স্যুলা চলে গেলে সিনা জনপ্রিয় দলের পক্ষ থেকে কিছু নতুন আইন মেনে চলার চেষ্টা করেছিলেন যে আইনগুলাে তার দলের পক্ষে যায়। আর এইসব করতে গিয়ে অন্য কনসলেরা তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেল। তারা সদলবলে সিনাকে রােম থেকে বহিষ্কার করল। রােমের বাইরে গিয়েও তিনি ইতালিয়দের সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন, তার উদ্দেশ্য ছিল মারিয়াসকে দ্বীপান্তর থেকে ফিরিয়ে আনা। সিনার বাহিনীর সঙ্গে এক জোট হয়ে তারা রােমের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সেদিকে অগ্রসর হলেন। ততদিনে মারিয়াসের বয়স দাঁড়াল সত্তর, কিন্তু ততদিনে রােমান সিনেটে বিদ্যমান তার শত্রুদের উপরে তার রাগও উঠল চরমে। জুগার্থা এবং কিছু অসভ্য জাতির কবল থেকে তিনি রােমকে বাঁচিয়েছিলেন তারও পনেরাে বছর আগে এবং তার পুরস্কার হিসেবে রােমের কাছে তিনি পেয়েছেন রােমান সিনেট এবং তাদের প্রিয় স্যুলার কাছ থেকে ক্রমাগত অপমান। তিনি তাই নিজের ভেতরে ক্রোধটা জারি রাখতেন এবং শত্রুপক্ষের কাউকে পেলেই হত্যা করতেন। কিছু সিনেট সদস্যও তার হাতে হত্যার শিকার হয়েছিল এবং বাকিদেরও তিনি কখনাে ক্ষমা করবেন না বলেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সিনেটের প্রতি অসম্মান এবং অনাস্থা তার মাধ্যমেই শুরু হয়। তার পর থেকে কোনাে রােমান সেনা প্রধান মনে করতেন না যে সিনেটের মাধ্যমে তাদের উপরে কিছু চাপিয়ে দিলেই তারা তা করতে বাধ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৮৬ সালে মারিয়াস এবং সিনা জবরদস্তি নিজেদের জন্য নির্বাচনের আয়ােজন করেন। এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে মারিয়াস সপ্তমবারের মতাে কনসল নির্বাচিত হন যেই বিষয়টা কাহিনি অনুসারে তার তারুণ্যেই তার সম্পর্কে ভবিষ্যত্বাণী করা হয়েছিল। তবে নির্বাচনের মাত্র আঠারাে দিন পরে মারিয়াস আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরে সিনার হাতেই নগরের শাসনের দায়িত্ব এসে পড়ে। 

স্যুলা বনাম সিনা গৃহযুদ্ধ ও স্যুলার বিজয় : তখন সবকিছুই নির্ভর করছিল স্যুলার সিদ্ধান্তের উপরে। জনপ্রিয় দলটি একজন সেনাপ্রধানসহ একটি বাহিনিকে এশিয়া মাইনর অঞ্চলে পাঠিয়ে দিল, তারা যেন স্যুলার কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারে। কিন্তু একজন বিজয়ী সেনাপ্রধানকে অগ্রাহ্য করা কঠিন। তাই নতুন বাহিনিটি স্যুলার পাশে গিয়েই দাঁড়াল এবং তার সেনাপ্রধান আত্মহত্যা করে বসল। এশিয়া মাইনরে স্যুলা দুইটি লিজন বাহিনি ফেলে তার বাকি বাহিনি নিয়ে ইতালিতে ফিরে গেলেন। তার ফিরে যাবার পরে নতুন করে গৃহযুদ্ধের সূচনা হলাে। সিনা এবং অন্যান্য প্রগতিশীলরা তাদের শক্তির জন্য প্রধানত নির্ভর করত। ইতালিয়দের উপরে, এবং তখন তারা খ্রিস্টপূর্ব ৮৬ সালে, পুনরায় একই সেনাপ্রধানের মুখােমুখী হলাে যার মােকাবেলা তাদের করতে হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। ভাগ্য সেবারে ইতালিয়দের আর সহায়তা করল না। সিনা নীরব থাকলেন এবং মৃত্যুবরণ করলেন, জনপ্রিয় দলেরও দাঁড়াবার কোনাে স্থান রইল না। শেষপর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব ৮২ সালে রােমের কলিন তােরণের (যেখানে দেড় শতাব্দী আগে হ্যানিবল রােমে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন) কাছে স্যুলা ইতালিয়দের বিরুদ্ধে এক বড়াে বিজয় অর্জন করলেন। এটাই ছিল তৎকালীন রােমের অস্থিরতার অবসান এবং এর মধ্যে দিয়েই প্রথম গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। 

স্যুলার আধিপত্য, একনায়কতন্ত্র ও নিষ্ঠুর স্বৈরাচার : স্যুলার জীবন ছিল বিজয় সমৃদ্ধ। তিনি সেবারের বিজয় উদযাপন করলেন এবং যেখানে তাকে একটি বাড়তি নাম দেয়া হলাে, ফেলিক্স, যার অর্থ সুখী। সিনসিনাটাসে যেমন একদিন একনায়কতন্ত্রের উত্থান হয়েছিল, ঠিক তেমনি খ্রিস্টপূর্ব ৮১ সালে তিনি রােমের একনায়ক হয়ে উঠলেন। রােমের জন্য সেটা কোনাে জরুরি অবস্থা ছিল না, কিন্তু তিনি সেভাবেই কার্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তবে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। তিনি ক্রমে সেখানকার সত্যিকারের একনায়ক হয়ে পড়লেন, আধুনিক যুগে যাকে বলা হয় একচ্ছত্র আধিপত্যের শাসন। আর তারপর স্যুলার সুযােগ এল প্রতিপক্ষের হাজার হাজার রাজনৈতিক শত্রুকে বিনাস করার। তিনি তাদের হত্যার আদেশ দিলেন জনপ্রিয় দলের এবং এমনকি সিনেটের কিছু সদস্যকেও তখন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলাে। ঘটনাটা কোনাে স্বাভাবিক নিষ্ঠুরতা কিংবা রক্তারক্তির ব্যাপার ছিল না। যাদেরকে মৃত্যুদণ্ডের জন্য তালিকাভূক্ত করা হয়েছিল তাদের মধ্যে এমন মানুষ ছিলেন, যিনি কখনাে রােমের বা স্যুলার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন না। কিন্তু তাদের অপরাধ ছিল যে তাদের অনেক সম্পদ ছিল। তাদের মৃত্যুর পরে সম্পদগুলাে নিলামে চড়ানাে যেত এবং স্যুলা এবং তার বন্ধুবান্ধবরা সেসবের জন্য সস্তা দাম হাঁকাতে পারত। যেহেতু তাদের বলা দামের উপরে অন্য দাম বলার সাহস কারাে হতাে না, তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্যুলা এবং তার বন্ধুরা নামমাত্র দামে সম্পদের মালিক বনে যেত। সােজা কথায় নিজের এবং সহচরদের সম্পদ বাড়ানাের জন্যই ক্রমাগত মানুষ হত্যা করছিলেন স্বৈরাচারী স্যুলা। যাদের হত্যা করা হতে পারত তাদের মধ্যে একজন ছিলেন এক অভিজাত তরুণ, যার নাম ছিল গাইয়াস জুলিয়াস সিজার, তিনি ছিলেন স্যুলার দ্বারা বিতাড়িত হওয়া গৃহযুদ্ধের সময়কার সেনাবাহিনীর এক সেনাপ্রধানের তার ভাগনে। তাছাড়া তরুণ সিজার ছিলেন মারিয়াসের স্ত্রীরও ভাগনে ছিলেন বটে এবং তার নিজের স্ত্রী ছিলেন সিনার কন্যা। স্যুলা তাকে আদেশ দিলেন তার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে। সিজার স্যুলার নির্দেশ অমান্য করলেন, ফলে তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ আসাটা ছিল খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু তার অভিজাত পরিবারের হস্তক্ষেপে সেবারের মতাে বেঁচে গেলেন। স্যুলা তাকে মেনে নিলেন কিন্তু বলে দিলেন, “এই তরুণ থেকে সাবধান থাকতে হবে, এর মধ্যে অসংখ্য মারিয়াস লুকিয়ে আছে।” স্যুলা সিনেটের সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকলেন এবং সিনেটের ক্ষমতার বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে, এমন সব ক্ষমতাকে দুর্বল করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। মারিয়াস যাদের হত্যা করেছিল, সিনেটের সেই সদস্যদের শূন্য স্থানে তিনি নতুন করে নিজের পছন্দের লােক বসাতে লাগলেন, আর তারপর সদস্য বাড়াতে বাড়াতে সিনেটের আকৃতি ৩০০ থেকে ৬০০ সদস্যে নিয়ে গেলেন। কর আদায়কারী ব্যবসায়ীদেরও তিনি সিনেটের সদস্য হতে দিলেন (যেমনটা দশ বছর আগে ড্রুসাসের পরিকল্পনা ছিল) যেন শাসক এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভালাে যােগাযােগ থাকে। সেনসর এবং ট্রিবিউনের কার্যালয়ের যাবতীয় ক্ষমতা তিনি নিজের হাতে নিয়ে নিলেন এবং বিভিন্ন প্রদেশের সেনাপ্রধানদের আদেশ দিলেন যে তারা তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে নিজ এলাকার বাইরে কোনােমতেই যেতে পারবে না। রােমের আইন কানুনকেও তিনি নতুন করে ঢেলে সাজালেন, প্রাচীন কালের মতাে কেবল বারােটি টেবিলের উপরে নির্ভরতা বন্ধ করলেন, এই সমস্ত কিছু বদলে তিনি আইন সংক্রান্ত সমস্ত সমস্যা সিনেটের প্রধানের হাতে দিয়ে রাখলেন। ইতালির যে সমস্ত এলাকার মানুষ মারিয়াসকে সহায়তা করেছিল, তাদেরও স্যুলা কঠিন শাস্তি দিলেন। স্যামনাইটদের মধ্যে যেটুকু ছিল তা তিনি ধ্বংস করলেন এবং এট্রুস্কান সংস্কৃতি ততদিনে এমনিতেই হাওয়া হয়ে গেছে। এই বিষয়টিও তিনি সিনেটের সুবিধা হিসেবে নিলেন, সেসব শূন্য স্থানে তিনি নতুন করে রােমানদের উপনিবেশ করে দিলেন, ধরে রাখলেন যে এই নতুন স্থানগুলােই ভবিষ্যতে সিনেটের লােকদের জন্য ক্ষমতার উৎস হবে। খ্রিস্টপূর্ব ৭৯ সালের মধ্যে স্যুলার কাছে মনে হলাে যে তার হিসেবে রােমকে নতুন করে ঢেলে সাজানাে শেষ হয়েছে এবং রােমে সেই প্রাচীন সময়ের মতাে শান্তি ফিরে এসেছে। আর তাই তিনি তখন একনায়কতন্ত্র থেকে নিজেকে অব্যহতি দিয়ে সমস্ত ক্ষমতা সিনেটের হাতে হস্তান্তর করলেন। তার পরের বছর ষাট বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। 

স্যুলার মৃত্যুর সুযোগে মিথ্রাডেইটিসের উত্থান ও তৃতীয় মিথ্রাডেইটিক যুদ্ধের সূচনা : কিন্তু স্যুলার পূণর্গঠন নামের বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণই অর্থহীন। তিনি আইনগুলােকে এমনভাবে বদলে ফেলেছিলেন যে সিনেট কিছুতেই আর তার আগের অবস্থায় ফিরতে পারছিল না। সমস্তকিছুতেই একটা জগাখিচুড়ি লেগে গেল। আর সে কারণেই তখন থেকে সিনেট কেবল সেনাপ্রধানদের তাবেদারি করে যেতে লাগল। স্যুলার একনায়কতন্ত্রের সময়ে তিনি পূর্বাঞ্চলে যেন কোনাে ঝামেলা না হয়, সেদিকে কড়া নজর রেখেছিলেন। তখন কয়েকটি ছােটোখাটো বাহিনীর সেনাপ্রধান মিথ্রাডেইটিসের প্ররােচনায় সামান্য কিছু বিদ্রোহ করেছিল বটে (যাকে কখনাে বলা হয় দ্বিতীয় মিথ্রাডেইটিস যুদ্ধ), তবে স্যুলা খ্রিস্টপূর্ব ৮১ সালে সেসব নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন সেই একই চুক্তির উপরে নির্ভর করে, যা প্রথম যুদ্ধটা টিকিয়েছিল।  মিথ্রাডেইটিস অবশ্য জানতেন যে তিনি চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না। রোমের ভেতরে যদি গােলমাল শুরু হয় তবে রােম তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু ওই সমস্ত অনিয়ম যে চিরকাল চলতে থাকবে, এমনটাও তিনি ভাবেননি। রােমানরা ক্যানিতে কার্থেজদের হত্যাযজ্ঞ মেনে নিলেও এশিয়া মাইনরে ইতালিয়ানদের ঢালাও হত্যা কখনাে মেনে নেবে না, এটুকু ধারণা তার ছিল। এর প্রমাণ তাে এই ছিল যে রােমান সিনেট সদস্যরা মিথ্রাডেইটিসের সঙ্গে চুক্তিতে কখনাে রাজি হতে পারেননি। আর তাই শান্তি চুক্তির নামে যা হয়েছিল, তা আসলে কেবল স্যুলার সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত সমঝােতা; এবং খ্রিস্টপূর্ব ৭৮ সালে স্যুলা মৃত্যুবরণ করলেন। আর তাই, মিথ্রাডেইটিস মনে করলেন এটাই সময় নতুন করে যুদ্ধ শুরু করার এবং নতুন কিছু সুযােগ খুঁজে বের করার। এরকম সুযােগ এল খ্রিস্টপূর্ব ৭৬ সালে। যখন বিথিনিয়ায় তৃতীয় নিকোমিডিস কোনাে উত্তরাধিকারী না রেখে মৃত্যুবরণ করলেন। নিকোমিডিস বরাবরই রােমের অনুগত ছিলেন এবং মিথ্রাডেইটিসকে বেশ কয়েকবার রােমের পক্ষে প্রতিহত করেছেন। তখন মৃত্যু আসছে জেনেই নিকোমিডিস বিথিনিয়া দখল করে একে পন্টাসের শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করলেন। বিথিনিয়াকে তিনি রােমের কাছে লিখে দিলেন এবং স্থানটি রােমের একটি প্রদেশ হয়ে গেল। মিথ্রাডেইটিস এই ঘটনাকে মানতে অস্বীকার করলেন, তিনি একটি বড়াে সেনাবাহিনী নিয়ে বিথিনিয়ায় প্রবেশ করলেন। আর এভাবেই তৃতীয় মিথ্রাডেইটিক যুদ্ধ শুরু হলাে। আগের মতােই আরেকবার মিথ্রাডেইটিস নিজেই সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে লাগলেন।

লিউকুলাস, পম্পেই, ক্র্যাসাস, স্পার্টাকাস, ভেরিজ ও সিসেরো

লিউকুলাসের হাতে মিথ্রাডেইটিস ও টিগ্রানিসের পরাজয় : এশিয়া মাইনর থেকে চলে যাবার পরে স্যুলা ক্ষমতায় তার পরের জনের উপরে দায়িত্ব দিয়ে যান। তিনি ছিলেন লুসিয়াস লিসিনিয়াস লিউকুলাস, মেটিলাস নিউমিডিয়াসের ভাগনে, যিনি জুগার্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। লিউকুলাস, যদিও দক্ষ এবং বীর যােদ্ধা ছিলেন কিন্তু তেমন ভালােবাসা অর্জন করতে পারেননি, তিনি মিথ্রাডেইটিক যুদ্ধের মাঝপথে নিজের সেনাসদস্যদের উপরে যুদ্ধের দায়িত্ব দিয়ে এশিয়া মাইনরে পুণর্গঠনের কাজে চলে গেলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি মিথ্রাডেইটিসকে যেসব নগর সমর্থন দিয়েছিল তাদের কাছে বড়াে অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করলেন, আর সেখান থেকে অর্জিত অর্থ অনেকটাই তার নিজের হস্তগত হলাে। তখন যেহেতু মিথ্রাডেইটিস আবার কোমর বেঁধে যুদ্ধ করতে নেমেই পড়েছেন, লিউকুলাস শক্ত হলেন। তিনি পরপর বেশ কয়েকটা যুদ্ধে মিথ্রাডেইটিসের বিরুদ্ধে লড়লেন এবং বিজয় অর্জন করলেন। মিথ্রাডেইটিসকে তিনি পন্টাসে চলে যেতে বাধ্য করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ সালে তিনি পন্টাসে আক্রমণ চালালেন এবং মিথ্রাডেইটিসকে পূর্বদিকে আর্মেনিয়া পর্যন্ত ঠেলে পাঠালেন। আর্মেনিয়ার শাসনে তখন ছিলেন একজন একনায়ক, টিগ্রানিস, যিনি আর্মেনিয়ার সিংহাসনে বসেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৯৫ সালে, তখন থেকেই তিনি আশেপাশে দখল করে নিজের রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে নতুন করে রাজ্যটাকে গঠন করছিলেন, ঠিক যেমন মিথ্রাডেইটিস করেছিলেন পন্টাসে। বাস্তবে টিগ্রানিস বিবাহ করেছিলেন মিথ্রাডেইটিসের কন্যাকে, আর তাই দুই রাজ্য এক জোট হয়ে শাসনকাজ চালাত। টিগ্রানিস সেনাবাহিনী দিয়ে না হলেও শুরু থেকেই নানা সময়ে নানাভাবে মিথ্রাডেইটিসকে সাহায্য করেছিলেন। আর তখন মিথ্রাডেইটিস যেখান পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন, সে জায়গা তারই কন্যার জামাতার। টিগ্রানিস হয়তো এ নিয়ে কোনাে প্রতিক্রিয়াই দেখাতেন না, রােমান বিজয়ের প্রতি তিনি অভিভূতই ছিলেন, কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৭০ সালে রােম থেকে যে একদল কুটনীতিক এলেন মিথ্রাডেইটিসকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবি নিয়ে, তারা প্রয়ােজন ছাড়াই মাত্রাতিরিক্ত উদ্ধত ছিলেন, আর তাতে করে আর্মেনিয়ান শাসক অপমানিত বােধ করলেন। তিনি যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। লিউকুলাস সেটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই আর্মেনিয়ায় আক্রমণ করলেন এবং টিগ্রানিসের বিশাল অথচ প্রশিক্ষণহীন সেনাবাহিনীকে বিশ্রীভাবে পরাজিত করলেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে আর্মেনিয়ার রাজধানী দখল করে ফেললেন এবং মিথ্রাডেইটিস ও টিগ্রানিসকে বহিষ্কার করলেন। লিউকুলাস জানতেন তারা কোনদিকে যেতে পারে, যাই হােক, লিউকুলাসের মতাে তীক্ষ এবং গম্ভীর চরিত্রের মানুষ নিজের লােকদের সাথে এ নিয়ে কোনাে আলােচনায় গেলেন না। ওদিকে তারা দুজনে পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে হতে ক্র্যাগি পর্বতের কাছে পৌঁছে গেলেন যেখানে মিথ্রাডেইটিস এবং টিগ্রানিস দুজনে মিলে তাদের রাজ্যের অন্তত কিছুটা অংশ পুণর্দখল করতে সক্ষম হলেন।  লিউকুলাস তার বিদ্রোহী সেনাবাহিনী নিয়ে কিছুই করতে পারলেন না, তারপর খ্রিস্টপূর্ব ৬৬ সালে তাকে রােমে ডেকে নেয়া হলাে।

রোমে লিউকুলাস : রােমেও তিনি ততটাই অজনপ্রিয় ছিলেন যতটা ছিলেন এশিয়া মাইনরে, এবং তিনি রাজনীতিতে প্রবেশের কোনাে চেষ্টাও করেননি কখনাে। জনপ্রিয় দলটি তার বিজয় সম্বর্ধনা দিতে অনেক দেরি করেছিল কিন্তু একসময় ঠিকই তা দেয়া হয়, আর তার নামের সঙ্গে আরেকটি নাম যােগ হয়, যা হলাে, “পন্টিকাস”। তখন তিনি অবসর গ্রহণ করে একটি পরিপাটি বাসস্থানে থাকা শুরু করেন এবং এশিয়া মাইনরের দুর্ভাগা অধিবাসীদের কাছে যে অর্থ আদায় করেছিলেন, নিজের বিলাসিতার পিছনে সেই অর্থ নিশ্চিন্তে ব্যয় করতে থাকেন। লিউকুলাস তখন তার বিপুল খরচ করে অন্যকে আপ্যায়ণ করা এবং অমূল্য খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুতের জন্য বিখ্যাত হন। সিরাসাস থেকে ছােট্ট একটি লাল ফলকে রােমে আনার জন্য তার কথাই স্মরণ করা হয়, সিরাসাস নগরটি ছিল পন্টাসের। রােমানরা সেই ফলকে তার আদি বাসস্থান নগরটির নামেই “সেরিস” বলে ডাকত, যা একটি ফ্রেঞ্চ শব্দ, ইংরেজিতে যে ফলের নাম হয়েছিল “চেরি”। লিউকুলাস একই সঙ্গে অনেক মেহমানকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন, যখন ব্যাপক খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতেন তিনি, আবার কখনাে তার পরিচারকেরা যদি জানতে চাইত যে আজ রাতে কার দাওয়াত কারণ তাদের জানামতে কোনাে মেহমানকে দাওয়াত করা হয়নি তখনাে। তখন লিউকুলাস ব্যাখ্যা করতেন, “আজ রাতে লিউকুলাসই লিউকুলাসের অতিথি”, আর তারপর একা একাই রাতের খাবার সারতেন। আর তখন থেকেই এই প্রবচনটির উদ্ভব, “লিউকুলাস কেবল লিউকুলাসের সনে খায়”, যা মানুষের চরম বিলাসিতা প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয় এবং “লিউকুলান ফিস্ট” বলতে সর্বোচ্চ খাবার দাবারের আয়ােজনকে বােঝায়। এটা নিশ্চিত যে লিউকুলাস সবচেয়ে উচ্চমার্গীয় জীবনাচরণের অধিক হয়েছিলেন, তিনি অনেক কবি এবং শিল্পীকে নানাভাবে সাহায্য করতেন তাল সাহচর্য পেতেন, তার ছিল এক বিশাল লাইব্রেরি, রােমের গৃহযুদ্ধের ইতিহাস লিখেছিলেন তিনি, যেখানে তিনি স্যুলার অধীনে লড়েছিলেন। 

পম্পেই এর পরিচয় : মারিয়াস এবং স্যুলার মৃত্যুর পরে, রােমের নাম নতুন করে উজ্জ্বল করার জন্য নতুন এক দল মানুষ জেগে উঠল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছিলেন নেইয়াস পম্পেইয়াস, ইংরেজিতে যাকে পম্পেই বলা হয়।  খ্রিস্টপূর্ব ১৯৬ সালে তার জন্ম, তার তারুণ্যে তিনি পিতার দলের হয়ে রােমান গৃহযুদ্ধে ইতালীয় জোটের বিপক্ষে লড়েছিলেন। যদিও তিনি খুব সাধারণ একটি পরিবার থেকে এসেছিলেন কিন্তু তার পিতা মারিয়াস এবং স্যুলার মধ্যে সতর্কভাবে সমান গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারে তাকে বুঝিয়েছিলেন (যতদিন পর্যন্ত আকাশের বিদ্যুৎ তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়নি), তরুণ পম্পেইয়ের অবশ্য সিনেটের আভিজাত্যের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। মারিয়াস আর সিনা যখন রােমের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে, পম্পেই তখন তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখত যেন কোনােরকমে বেঁচে থাকতে পারে। স্যুলা এশিয়া মাইনর থেকে ফিরে এসেছেন শুনে তিনি তাড়াতাড়ি তার পাশে দাঁড়াতে চাইলেন, তার সম্মানে একটি সেনাদল সাজিয়ে ফেললেন। তিনি স্যুলার হয়ে যুদ্ধ করলেন এবং একনায়কদের সুনজরে থাকলেন। স্যুলা তাকে সিসিলি পাঠিয়ে দিলেন যেন তিনি মারিয়াসের পক্ষের লােকদের দেখাশােনা করতে পারেন, আর এই পম্পেই সেখানে এত সুনাম অর্জন করলেন যে খ্রিস্টপূর্ব ৮১ সালে তিনি যখন ফিরে এলেন তখন স্যুলা তার জন্য এক বিজয় অনুষ্ঠানের আয়ােজন করলেন, যদিও সেই রাজকীয় অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হবার পক্ষে তার অন্তত দুটো সমস্যা ছিল, প্রথমত তিনি কোনাে সরকারি লােক ছিলেন না আর দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন অপরিণত বয়সের। বিজয় উৎসবের বাইরের স্যুলা তাকে আরাে বড়াে এক উপহার দিলেন, তা হলাে তার নামের সঙ্গে বাড়তি “ম্যাগনাস” (“মহামতি”) শব্দটি যােগ করে দিলেন, যে পদবি তার জন্য ছিল অনেক বেশি দায়িত্বের মতাে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে পম্পেইয়ের স্থান পাকাপােক্ত হলাে স্যুলার মৃত্যুর পরে।

স্পেইনে লিপিডাস ও সেক্টোরিয়াসের বিরুদ্ধে পম্পেই : খ্রিস্টপূর্ব ৭৭ সালে তিনি একজন রােমান সেনাপ্রধানকে পরাজিত করলেন, তিনি ছিলেন মার্কাস আর্মেনিয়াস লিপিডাস, যিনি স্যুলার নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। লিপিডাসকে স্পেনে পালিয়ে যেতে হয়েছিল, যেটি ছিল মারিয়াসের পক্ষের লােকদের জন্য একটি প্রধান পদক্ষেপ। স্পেনে তখন শাসক ছিলেন কুইন্টাস সেক্টোরিয়াস। স্যুলা যখন রােমের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তিনি তখন পশ্চিমদিকে অগ্রসর হতে থাকলেন। তিনি স্পেনে যুদ্ধ করলেন এবং উত্তর পশ্চিম আফ্রিকাতেও লড়লেন। স্পেনের কিছু বিদ্রোহী জাতি তাকে তাদের সঙ্গে হয়ে রােমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অনুরােধ করল। সেক্টোরিয়াস সেটাই করেছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব ৮০ সালে যে স্বাধীন স্পেন ছিল সেইটিকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ এবং বীর যােদ্ধা। তিনি স্পেনের আদিবাসীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেছিলেন। আবার তাদেরকে রােমান উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নতও করতে চেয়েছিলেন, তিনি আদিবাসীদের মধ্যে একটি সিনেট আর তাদের সন্তানদের জন্য বিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন। এর চেয়েও বড়াে যে কাজটি তিনি করেছিলেন, তা হলাে, রােমানরা মাঝেমধ্যে যে বাহিনী পাঠাতেন তাদের শায়েস্তা করার জন্য, তাদের তিনি বেশ কয়েকবার পরাজিত করেছিলেন। পম্পেইয়ের কাছে পরাজিত লিপিডাসকে ধাওয়া করা যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৭৭ সালে লিপিডাস সিনেটকে প্রভাবিত করে এই অনুমতি নিয়ে নিলেন যে তাকে স্পেনে পাঠানাে হবে যাতে করে তিনি দুই রকমের বিদ্রোহীকেই দমন করতে পারেন। কিন্তু সেটি আর তার করা হয়নি, কারণ, লিপিডাস স্পেনে পৌঁছেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু সেক্টোরিয়াস ছিল তরুণ সেনাপ্রধানের বিপক্ষে অনেক বড়াে শক্তি। তাই পম্পেইকে করুণ পরাজয় মানতে হলাে। তাকে রােমের কাছে আবেদন করতে হলাে যেন নতুন কিছু সেনা সদস্য দেয়া হয়। এটাই ছিল এক রকম লক্ষণ যে পম্পেই আসলে প্রথম শ্রেণির সেনাপ্রধান হিসেবে যােগ্য নন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি টিকে থাকলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭২ সালে সেক্টোরিয়াস বন্দি হলেন (তাকে বন্দি করতে অঢেল রােমান অর্থ ব্যয় হলাে), আর তিনি স্পেনে যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তা সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে পড়ল। এই কাজের জন্য প্রশংসিত হবার যােগ্য না হওয়া সত্বেও পম্পেইকেই এর জন্য স্বীকৃতি দেয়া হলাে। 

স্পার্টাকাসের অধীনে তৃতীয় ক্রীতদাস যুদ্ধ : এদিকে পম্পেই যখন স্পেনে, ইতালিতে তখন একটি নতুন ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলাে। গ্ল্যাডিয়েটরের খেলা নিয়ে রােমানদের যে আয়ােজন হতাে তা নির্মম এবং ভয়ানক দিকে চলে গেল। বস্তুত, ওই খেলায় দেখানাে হতাে যে প্রতিপক্ষ আক্রমণ করলে কেউ কতরকমের কৌশলে তা প্রতিহত করতে পারে। তাদের জীবনে এই কৌশলের প্রদর্শনের বিশেষ প্রয়ােজন ছিল, তারণ এটা তাদের সৈন্যদের উজ্জীবিত থাকতে সাহায্য করত, সেই খেলা থেকেই তারা বাস্তব যুদ্ধে আক্রমণ প্রতিহত করার কৌশল শিখত এবং সাহস সঞ্চয় করত। যাই হােক, ইতালিতে যেহেতু ইতালির বাইরে থেকে প্রচুর দাস আনা হলাে, তখন নিয়মটা এমন দাঁড়াল যে সেই দাসদের মধ্যে থেকে গ্ল্যাডিয়েটর বেছে নেয়া হতাে। রােমানরা মােটেও লক্ষ রাখত না যে গ্ল্যাডিয়েটরের খেলায় দাস গ্ল্যাডিয়েটরের কী পরিণতি হচ্ছে, আর দুজন দাস নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে করতে তারা কী মাত্রায় যাচ্ছে, এটা তাদের কাছে আনন্দের বিষয় ছিল, একজন দাস কোনাে বন্য জন্তুর সঙ্গে লড়লেও তারা তা দেখে মজা পেত। তারা দুজন যােদ্ধার মধ্যে খােলাখুলি অর্থ লগ্নী করত, এখনকার দিনে আমরা যেমন অর্থের বিনিময়ে যারা লড়তে আসে, তাদের জন্য করি। কিছু সত্যিকারের ভালাে গ্ল্যাডিয়েটর কখনাে অনেক লম্বা সময় ধরে লড়তে পারত এবং শেষ পর্যন্ত জিততেও পারত, কিন্তু বেশিরভাগের জন্যই লড়াইটা হতাে ছােটো আর নির্মমভাবে রক্তের স্রোতের উপরে মৃত্যু। একজন গ্লাডিয়েটর ছিলেন থ্রেস (ঈজিয়ান সাগরের উত্তরে এবং ম্যাসিডােনের পূর্বে অবস্থিত) থেকে আগত, নাম ছিল স্পার্টাকাস। রােমানরা তাকে ধরে এনেছিল, (হয়তোবা কোনাে যুদ্ধের পরে রােমান সেনাবাহিনীর হাতেই তিনি ধরা পড়েছিলেন) এবং তার শারীরিক আকৃতি আর শক্তির জন্য তাকে একটি গ্লাডিয়েটর বিদ্যালয়ে পাঠানাে হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৭৩ সালে তিনি তার সহপাঠীদের নিয়ে একটি দল গঠন করতে সক্ষম হন, তারা তাদের অস্ত্রগুলাে নিয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করে তাদের প্রভূদেরকে আঘাত করতে ব্যবহার করেন। সত্তর জন গ্ল্যাডিয়েটর বিদ্রোহ করে এবং তারা দাসদের সঙ্গে যােগদান করে নিজেদের জন্য স্বাধীনতা দাবি করে। এভাবেই গ্লাডিয়েটরদের যুদ্ধ শুরু হয় যাকে বলা যায় তৃতীয় কৃতদাস যুদ্ধ। এরকম প্রথম দুটো যুদ্ধে সিসিলি প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর তখন ক্ষতি হওয়া শুরু হলাে ইতালির, ভয়ানক অবস্থা চলতে থাকল। সেখানে, সেবারে সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব চলল, কারণ, তখন কৃতদাসেরা একজন প্রশিক্ষিত নেতার হয়ে লড়াই করছিল। দুই বছর ব্যাপী স্পার্টাকাসকে ধ্বংস করার জন্য যত রােমান সেনাবাহিনী পাঠানাে হয়েছিল, তাদের সবাইকে তিনি পরাজিত করেছিলেন। তার ক্ষমতা এত বেড়ে গিয়েছিল যে তিনি ৯০,০০০ মানুষকে নিজের অধীনে রাখতেন এবং ইতালির সম্পূর্ণ দক্ষিণাঞ্চল তার হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৭২ সালে তিনি উত্তরে আল্পসের দিকে দখলের আশায় এগিয়ে যান এবং সেদিকে বসবাসরত কিছু আদিবাসীদের এলাকায় চিরকালের মতাে অধীনস্ত করেন। তার সৈন্যেরা অবশ্য ইতালিতে থাকতেই বেশি পছন্দ করত, কারণ সেখানে অভিজাত মানুষদের সম্পদ লুট করা যেত, আর তখন স্পার্টাকাস আবার দক্ষিণের দিকে রওনা দিল। শেষপর্যন্ত রােমানরা সেই মানুষকে খুঁজে পেল যে তাদের মার্কাস লিসিনিয়াস ক্র্যাসাসের শিকার হওয়া থেকে বাচাবে।

ক্র্যাসাস ও তার হাতে স্পার্টাকাসের দাস বিদ্রোহের পরাজয় : খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ সালে ক্র্যাসাস জন্মগ্রহণ করেন নামকরা এক অভিজাত পরিবারে। তার পিতা এবং ভাই ছিল সেই যােদ্ধাদের একজন যারা মারিয়াসের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়, আর তিনি নিজে কেবলমাত্র ইতালি থেকে দ্রুত পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন বলে বেঁচে গিয়েছিলেন। স্যুলা যখন ফিরে এলেন, তখন ক্র্যাসাস ঠিক পম্পেইয়ের মতােই স্যুলার সঙ্গে যােগদান করলেন, তিনি স্যুলার একজন প্রিয় সহচর হয়ে উঠলেন। স্যুলার সহচরদের মধ্যে ক্র্যাসাসই সবচেয়ে বেশি কাজ করতে পেরেছিলেন। তিনি দ্রুত বিশাল সব ভূমি তিনি দখল করে ফেললেন যা ছিল স্যুলার ধারণার বাইরে। আর ভূমি দখল করতে গিয়ে যখন কোনাে মালিককে হত্যা করতে হলাে, তা করতে তিনি বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করলেন না। তিনি লােভী রাক্ষস হিসেবে খ্যাত হলেন। কিন্ত তিনি অচিরেই এমন ধনী হয়ে উঠলেন যা রােমের মানুষেরা কোনােদিন দেখেনি। তাকে ডাকা হতাে ক্র্যাসাস ডিভিজু বা ধনী ক্র্যাসাস। স্বর্ণের পিছনে ছােটা, ক্র্যাসাসের এই নেশার কথা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। রােমে ছিল অসংখ্য নড়বড়ে কাঠের বাড়ি, যেখানে বলতে গেলে, মানবেতর অবস্থায় দরিদ্র লােকেরা বসবাস করত। নগরটিতে আধনিক কোনাে আগুন নির্বাপক প্রতিষ্ঠানও ছিল না। আর তাই যখন সেই কাঠের বাড়ির সারিতে আগুন লাগত, বিশাল এলাকা ধ্বংস হয়ে যেত। ক্র্যাসাস নিজের উদ্যেগে আগুন নির্বাপক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। যখন কোনাে বাড়িতে আগুন লাগত, ক্র্যাসাস সেই বাড়ির মালিকের সঙ্গে দামদর করতেন, নামমাত্র দামে বাড়িটি বিক্রির অঙ্গীকার পেয়ে তারপর তিনি আগুন নেভানাের জন্য প্রতিষ্ঠানের লােকজনকে সেখানে যেতে নির্দেশ দিতেন। আবার কখনাে দামদরে না মিললে তিনি কাউকে সেখানে পাঠাতেন না, এবং সম্পত্তিটি পুড়ে ছারখার হলে তারপর দখল করে নিতেন। আর এভাবে তিনি রােমের আবাসিক এলাকার একটা বড়াে অংশের মালিক হয়ে গেলেন। সে যাই হােক, তিনি ছিলেন মােটামুটি বীর একজন যােদ্ধা, আর তাকে যখন স্পার্টাকাসের বিরুদ্ধে লড়তে পাঠানাে হলাে, তিনি দুটো যুদ্ধের পর পরই স্পার্টাকাসকে পরাজিত করলেন। দুটো যুদ্ধের মধ্যে দ্বিতীয়টিতে খ্রিস্টপূর্ব ৭১ সালে স্পার্টাকাসের মৃত্যু হয় এবং তার সেনাবাহিনীও বলতে গেলে পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। পম্পেই ঠিক তখনই স্পেন থেকে ফিরে আসেন এবং একইরকমের কর্মকাণ্ডে যােগ দেন। তিনি আর ক্র্যাসাস মিলে সেনাবাহিনীর বাকি যেটুকু ছিল তাদের বিনাস করেন এবং আবারও পম্পেই যেটুকু কৃতিত্ব পাওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়ে যায়। বন্দি হওয়া কৃতদাসদের জন্য এত নিষ্ঠুর এবং ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় যে রােমে আর কখনােই তেমন বড়াে কোনাে কৃতদাস বিদ্রোহ সংঘঠিত হয়ে উঠতে পারেনি। 

ক্র্যাসাস ও পম্পেই এর ক্ষমতায় আরোহন : পম্পেই তখন ক্র্যাসাসের সঙ্গে বেশ ভালােমতােই মিলে গেলেন। ক্র্যাসাসের অর্থবিত্ত যতই থাকুক, তা তাকে সাধারণ মানুষদের চোখে সিনেটের অভিজাত সদস্যদের মতাে গ্রহণযােগ্যতা এনে দিতে পারেনি, তাই তাদের সামনে তিনি একজন সমাজসেবক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চেষ্টা শুরু করলেন। তিনি সুদ ছাড়া অর্থ ধার দেয়ার নিয়ম চালু করলেন, যারা কোনাে আইনি জটিলতায় পড়লে আদালতে এসে নিজেদের অভিযােগ দাখিল করতে পারতেন না কেবল অর্থের অভাবে, তাদের তিনি বিশেষভাবে সাহায্য করতে লাগলেন যেন তারা অন্তত একজন উকিলের পাওনা মেটাতে পারেন, এসব নানারকম সহায়তা দিতেন তিনি। আর ওদিকে পম্পেইয়ের সাহস এবং সফলতার ব্যাপারে সিনেট বেশ খানিকটা সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠল। তিনি এত অল্প বয়সে তার অনুসারীদের কাছে এত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন, যেটি সিনেটের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল, সিনেট তার হাত থেকে নিরাপদ বােধ করছিল না। পম্পেই নিজেও এটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাই সিনেটের বিরােধিতা করা শুরু করলেন। সিনেট এ ব্যাপারে দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়নি, কারণ, পম্পেই আর ক্র্যাসাস যখন একজোট হয়ে গেলেন, তারা কনসলের জন্য প্রচারণা শুরু করলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৭০ সালে তারা বিজয়ী হলেন। কনসল হিসেবে অধিষ্ঠিত হতেই তারা সিনেটের ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া শুরু করলেন। তারা সেনসর এবং ট্রিবিউনে মূল ক্ষমতা ফিরিয়ে আনলেন, যেন স্যুলার মৃত্যুর মাত্র আট বছর পরে তার। অর্ধসমাপ্ত কাজের সমাপ্তি হতে যাচ্ছিল- হতে যাচ্ছিল স্যুলারই প্রিয় দুই অনুসারীর হাতে, সিনেট যাদের ক্ষমতাকে ঠিকমতাে আন্দাজ করতে পারেনি। পম্পেই এবং ক্র্যাসাস মিলে আদালতকেও ঢেলে সাজালেন, যেটিকে স্যুলা কেবলমাত্র সিনেটের হাতে অর্পণ করে গিয়েছিলেন, এবং যেখানে ভয়ঙ্কর অরাজকতা চলছিল।

ভেরিজের অরাজকতা : অরাজকতার একটি বিশেষ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় একজন রোমান রাজনীতিক গাইয়াস ভেরিজের নাম। ভেরিজ ছিলেন নীতিহীন এবং অসৎ একজন মানুষ, যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই ছিল অন্যের জিনিস চুরি করা বা হাতিয়ে নেয়া। তিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন মারিয়াসের অনুসারী কিন্তু তিনি যখন দেখলেন স্যুলা বিজয়ী হতে চলেছে, হুট করে স্যুলার পক্ষ অবলম্বন করলেন। স্যুলা তাকে তার আগের ডাকাতি এবং অন্যান্য কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করলেন, খ্রিস্টপূর্ব ৮০ সালে তাকে এশিয়ায় গভর্নর কার্যালয়ে নিয়ােজিত করলেন। এশিয়ার সেই প্রদেশের অধিবাসীদের কাছ থেকে গভর্নরসহ দুজনেই নির্লজ্জভাবে অর্থ আদায় করতে লাগলেন এবং পরবর্তীকালে রােমে যখন তাদের বিচার বসল, ভেরিজ নির্লজ্জভাবে গভর্নরের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযােগ প্রমাণ করে নিজে বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭৪ সালে তাকে সিসিলির গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হলাে, যেখানে তিনি নিজের আখের গােছানােতে আরাে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তখনকার দিনে গভর্নররা যে নিজ অঞ্চল থেকে নিজেদের পকেট ভরবে, এটা ছিল একটি প্রকাশ্য গােপন বিষয়। আর তারপর একদিন যখন তাদের গভর্নর থাকার কাল ফুরিয়ে আসত। এবং তখন সেই এলাকার লােকজন তাদের বিরুদ্ধে সিনেটের কাছে অভিযােগ আনত, সেই অভিযােগের ব্যাপারে না শােনার ভান করা ছিল সিনেটের জন্য অলিখিত নিয়ম। সিনেটের প্রতিটি সদস্যই সুযােগ পেলে অভিযােগকারীদের হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ত কিংবা সুযােগের অপেক্ষা করত। যুদ্ধ চলাকালে দখল বা লুটের পিছনে কারণ থাকতে হবে বলে স্বাভাবিক একটি ধারণা ছিল রােমে, কিন্তু ভেরিজ কোনাে কারণের ধার ধারতেন না। তার কাজকর্ম বলে দিত যে তিনি শত্রু হবার সমস্ত উদাহরণকে ছাড়িয়ে গেছেন। তার ডাকাতির ধরণ ছিল মানুষের ভাবনারও অতীত। তিনি স্বয়ং রােম থেকেও চুরি করতেন, সিসিলি থেকে আগত শষ্যভরা জাহাজ খালাসের জন্য তাকে অর্থ প্রদান করার হয়েছিল, সিই অর্থও তিনি নিজ কাজে ব্যয় করেন।

ভেরিজের বিপক্ষে সফল সিসেরো : ঠিক সেই সময়ে রােমে আরেকটি নতুন সম্ভাবনার সম্ভাবনা দেখা গেল, নতুন একজন মানুষ এলেন, মার্কাস টুলিয়াস সিসেরাে। খ্রিস্টপূর্ব ১০৬ সালে সিসেরাে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি যােদ্ধা ছিলেন না, বরং তারুণ্যে তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন এবং ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবি। সামাজিক যুদ্ধের সময়ে তিনি অবশ্য তিনি ভালাে পদে থেকেই লড়েছিলেন; তবে সেটি ছিল কেবলই সেনা জীবনের অভিজ্ঞতা লাভের মতাে, তার থেকে বেশি কিছু নয়। যুদ্ধের সময়ে তার সহানুভূতি ছিল স্যুলার প্রতি, কিন্তু যখন যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার সময়ে এল, তিনি কোনােরকমে তা এড়িয়ে গেলেন। তার বদলে তিনি অন্য এক পড়াশােনায় মনােযােগী হলেন তখন, তিনি তখন পূর্বাঞ্চলের সভ্য এলাকাগুলাে ভ্রমণে ব্যস্ত ছিলেন, সেখানকার বিশেষ জ্ঞানীদের পায়ের কাছে বসে থেকে সে সময়টা ব্যয় করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭৭ সালে রােমে ফিরে তিনি ট্যারেনশিয়াকে বিবাহ করেন, তিনি ছিলেন একজন অভিজাত নারী (বাড়িতেও তিনি মােটেও কোনাে বড়াে যােদ্ধা ছিলেন না)। সিসেরাে ছিলেন একজন অসামান্য লেখক এবং বক্তা। পূর্বাঞ্চলে গিয়ে তিনি কীভাবে সুন্দর করে বক্তব্য উপস্থাপন করতে হয়, সেই বিষয়ে শিখছিলেন, এবং তারপর তিনি রােমান ইতিহাসে সবচেয়ে তুখােড় বক্তা হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। তার সঙ্গে কেবল একটি নাম উচ্চারিত হতে পারে, ডেমােস্থিনিস, গ্রিক বক্তা, যিনি তার দুই শতাব্দী আগে জন্মেছিলেন। যুদ্ধ যদি কেবল কথা বলা আর তর্ক করা হতাে তবে সিসেরাে সাবার চেয়ে ভালাে করে আক্রমণ করতে পারতেন এবং অবশ্যই বিজয়ী হতেন। তখনকার দিনে বিচারের আইনসম্মত যে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতাে, তা যে সবই উপযুক্ত প্রমাণ আর সাক্ষীর উপস্থিতিসহ নেয়া হতাে, তা নয়। কখনাে কখনাে বিচারকরা (এবং সাধারণ মানুষও) বিপক্ষের উকিলের বক্তব্যের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়তেন, যারা নানাভাবে আবেগ এবং প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে নিজের মক্কেলকে বাঁচানাের আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন। সিসেরাে এই বিষয়ে ছিলন সবার উপরে, তার বাগীতার সৌন্দর্যের জোরে তিনি অচিরেই বিখ্যাত উকিলে পরিণত হলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৭৫ সালে সিসেরাে সিসিলিতে নিয়ােজিত ছিলেন, এবং তখন থেকেই তিনি ছিলেন একজন সৎ মানুষ, সিসিলির লােকেরা তাকে বিশ্বাস করত। খ্রিস্টপূর্ব ৭০ সালে ভেরিজ যখন তার পদ ছেড়ে চলে আসেন, তার জায়গায় সিসিলির লােকেরা স্বাভাবিকভাবেই সিসেরােকে দেখতে চাইলেন। ভেরিজের বিপক্ষে একটি মামালায় তারা তাকে তাদের হয়ে লড়তে অনুরােধ করলেন।  সিসেরাে আনন্দের সঙ্গেই মামলাটি পরিচালনা করতে রাজী হলেন, যদিও ভেরিজের পিছনে তাবৎ অভিজাত শ্রেণির সমর্থন ছিল (সৌভাগ্যবশত সেই মামালার বিচারক ছিলেন সিনেট সদস্যদের মধ্যে সামান্য কিছু সৎ সদস্যের একজন)। মাসের পর মাস সিনেটররা বইপত্র ঘেঁটে ভেরিজকে থামানাের নানান উপায় খুঁজে বের করতে লাগলেন। তারা একজন কৌশলী উকিলও খুঁজে বের করলেন তার বিপক্ষে লড়ার জন্য। সিসেরাের জায়গায় একজন পুতুল উকিল বসানাের চেষ্টাও করল তারা, তারা বিচারটি বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে দিতে থাকল যেন একজন নতুন বিচারক নিয়ােগ দিতে পারে। এই সমস্ত কিছু করে তারা প্রকৃতপক্ষে যা করেছিল, তা হলাে, মামলাটির ব্যাপারে আরাে বেশি মানুষের নজর কাড়া এবং মনােযােগ আনা। আর ওদিকে সিসেরাে তার স্বভাবজাত কৌশলের মাধ্যমে তাকে ঠেকানাে যাবতীয় পদ্ধতিকে পাশ কাটাতে সক্ষম হলেন। শেষ পর্যন্ত সিসেরাে ভেরিজের বিপক্ষে প্রমাণ আনতে সফল হলেন, এবং সেই মামলাটি আগাগােড়া প্রভুর বিরুদ্ধে এমন সুচারুভাবে সাজানাে হলাে যে কারাে সাধ্য হলাে না তার বিপক্ষে দাঁড়াতে। ভেরিজ তখন পালিয়ে ম্যাসিলিয়ায় চলে গেলেন এবং মামলাটিতে লড়ার জায়গায় অনুপস্থিত থাকলেন (যাই হােক, তার আগের জীবনে চরি করে জমানাে বিপুল অর্থের সাহায্যে তিনি তার পরের প্রায় অর্ধ শতাব্দী বেশ ভালােভাবেই কাটালেন)। ভেরিজের মামলাটির করুণ পরিণতি রােমান প্রদেশগুলােতে অরাজকতা কমাতে কিছুটা হলেও সাহায্য করল। কিন্তু মূল জায়গায় এটাই প্রচারিত হলাে যে এটা সিসেরােরই কৃতিত্ব। আর সে কারণেই এই ঘটনা সিনেটের জনপ্রিয়তা কমাতে সাহায্য করল, যেন পম্পেই আর ক্র্যাসাস পরবর্তীকালে আদালতটিকে ঢেলে সাজাতে কোনাে বাধার সম্মুখীন না হন। 

পূর্বাঞ্চলে পম্পেইয়ের অভিযান ও সাফল্য 

পূর্বাঞ্চলে ডাকাতির সমস্যা : পম্পেই তখন নতুন বিশাল এক জনপ্রিয়তার নাম। সিসিলি, ইতালি এবং স্পেনে তিনি একযােগে বিজয়ী থেকে গেছেন; তিনি আভিজাত্যের দেয়াল ভাঙতে এবং প্রগতিশীলতার পথে নিজেকে নতুন এক শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাহলে তার জন্য সামনে সমাধান করার মতাে অন্য আর কী সমস্যা ছিল? নিশ্চিত করে বলা যায়, পূর্বাঞ্চলে তখনাে গণ্ডগােল চলছে, আর এজন্য কেবল একজনকে কৃতিত্ব দেয়া যায়, তা হলাে, মিথ্রাডেইটিস। তখনকার সেই সময়ে যদিও লিউকুলাস সেসবের খেয়াল রাখছিলেন, তিনি পন্টাস এবং আর্মেনিয়ায় বিজয় অর্জন করেছিলেন। এটা আসলে, সত্যি কথা বলতে কী, ঘরের কাছের সমস্যা ছিল। রােম যখন গ্রিসের গুরুত্বপূর্ণ শেষ বাণিজ্যিক নগর রােডসকে দুর্বল করে দেয়, সেখান থেকে একজন বিশেষ পুলিশ সদস্যকে সরিয়ে ফেলে, যিনি ছিলেন সমুদ্র পথের ডাকাতদের বিরুদ্ধে এক ত্রাস। তাকে সরিয়ে নেয়ার পরে পুরাে ভূমধ্যসাগর এলাকা তাদের অত্যাচারে ভরে যায়, বলতে গেলে দুই শতাব্দী আগে ইলিরিয়ান সামুদ্রিক ডাকাতদের অত্যাচারে মানুষ যেমন অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল, ঠিক সেই অবস্থায় পৌঁছে। সৎ ব্যবসায়ীদের জাহাজের পক্ষে রােম রাজ্যের এক স্থান থেকে জলপথে আরেক স্থানে যাওয়া, সামুদ্রিক দস্যুদেরকে চাঁদা না দিয়ে যাওয়া ছিল অসম্ভব, না দিলে তাদের ভাগ্যে থাকত কেবল ধ্বংস হয়ে যাওয়া। প্রতিটি শষ্যবহনকারী জাহাজকে আটকিয়ে ইচ্ছেমতাে চাঁদা আদায় করা হতাে, আর এভাবেই রােমে আমদানিকৃত শষ্যের মূল্য ক্রমাগত বাড়তে লাগল। তারপরেও তারা সন্তুষ্ট হতাে না। দস্যুরা নগরের এখানে সেখানে হামলা করত, শিশু এবং নারী-পুরুষদের অপহরণ করত, এবং কৃতদাসের পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিত। ইতালির উপকূলীয় অঞ্চল তাদের নিষ্ঠুর কার্যকলাপের জন্য মােটেও নিরাপদ ছিল না (অদ্ভুত ব্যাপার হলাে, সামুদ্রিক দস্যুরা নিজেরাই অনেক ক্ষেত্রে পালিয়ে যাওয়া কৃতদাস, কারণ কৃতদাস পেশা থেকে পালিয়ে দস্যু হওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোনাে নিরাপদ রাস্তা খােলা থাকত না)। সকল যুদ্ধে জোটের বিরুদ্ধে, কৃতদাসের বিরুদ্ধে, এমনকি কোনাে কোনাে সময় নিজের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াতে রােমের অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সামুদ্রিক দস্যুদের বিরুদ্ধে কোনাে কার্যকর পদক্ষেপ সহজে নিতে পারল না। খ্রিস্টপূর্ব ৭৪ সালে রােম আফ্রিকান উপকূলে অবস্থিত গ্রিক নগর সাইরিন, যা তখন মিশরের দখলে ছিল, সেই পর্যন্ত নিজের ভূমি বাড়িয়ে নিল। দুই শতাব্দী ধরে সাইরিন টলেমির মিশরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর শেষ পর্যন্ত এটি সামুদ্রিক দস্যুদের যথেচ্ছ আনাগােনার জায়গা হয়ে উঠল। কিন্তু রােম যখন নগরটি দখল করে নিল তখন সেই আনাগােনা বন্ধ হয়ে গেল। দস্যুদের অন্য কেন্দ্রগুলােও চালু ছিল। একটি ছিল ক্রিট দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে, গ্রিক নগর সাইরিনের উত্তর-পূর্ব দিকে এবং আরেকটি ছিল সিলিশিয়ার মধ্যে, এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের একটি অংশ।

দস্যুদের পরজয় : খ্রিস্টপূর্ব ৬৮ সালে কুইন্টাস সিসিলিয়াস মেটিলাস পিয়াস (জুগার্থায় সফলভাবে যুদ্ধ করা সেনা সদস্য মেটিলিয়াস নিউমিডিকাসের পুত্র) সমুদ্রে দস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তিনি ছিলেন স্যুলার অত্যন্ত ঘনিষ্ট সহচরদের একজন। আর তখনাে তিনি ব্যর্থ হননি, কারণ তিনি ক্রিট দ্বীপপুঞ্জ দখল করেছিলেন যেটি খ্রিস্টপূর্ব ৬৭ সালে রােমের প্রদেশ হিসেবে গণ্য হয়ে ওঠে। যদিও সামুদ্রিক দস্যুরা তখনাে ভালােমতােই ছিল সিলিশিয়া দ্বীপে। খ্রিস্টপূর্ব ৬৭ সালে, তাই, পম্পেই নিজেই সেখানকার সমস্যার সমাধান করলেন বলে ভাবলেন। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকা থেকে পঞ্চাশ মাইল স্থল পর্যন্ত এলাকায় তিনি টানা তিন বছর কাটান এবং বলা হয় যে সেই পুরাে সময়টাতেই তিনি সামুদ্রিক দস্যুদের বিরুদ্ধে তৎপর ছিলেন। পম্পেইয়ের উপরে রােমের বিশ্বাস এত বেশি ছিল যে তার সেখানে এসে যােগদান করার খবর আসতে না আসতেই নগরে খাদ্যের মূল্য কমে এল। তিনি রােমকে হতাশ করেননি। তিনি যা করার সর্বোচ্চ বীরত্বের সঙ্গেই করেছেন। বলতে গেলে তৎক্ষণাত তিনি ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলকে সামুদ্রিক দস্যুমুক্ত করে ফেলেছিলেন; আর তারপর পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকেন, তিনি তারপরে সিলিশিয়ার দস্যুদের পরাজিত করেন এবং তাদেরকে ক্ষমা বা শাস্তি কমানাের চুক্তিতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। এই পুরাে কাজগুলাে করতে তার মাত্র তিন মাস সময় লেগেছিল।

পম্পেই এর দ্বারা মিথ্রাডেইটিসের পরাজয় ও এশিয়া মাইনোর বিজয় : আগে পম্পেই ছিল কেবল জনপ্রিয়, আর তখন হয়ে দাঁড়াল রােমের হৃদয়। এটা ছিল একদম পরিষ্কার যে লিউলুকাস, তার সেনাবাহিনীর মৌনতার জোরেই মিথ্রাডেইটিসের বিরুদ্ধে তেমন কোনাে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারল না। আর তাই, তাকে সরানাের জন্যই তার স্থানে পম্পেইকে আমন্ত্রণ জানানাে হলাে।  পম্পেই এশিয়া মাইনরের মধ্যভাগ পর্যন্ত অগ্রসর হলাে, এবং সেখান থেকে ফিরে এল, লিউলুকাস আগে থেকেই সেই অঞ্চলে যা করার করে রেখেছিলেন, পম্পেই ফিরে এসে কৃতিত্বটুকু নিলেন। পম্পেই তখন সহজেই মিথ্রাডেইটিসকে পরাজিত করলেন, যিনি তখন পূর্বদিকে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি আর্মেনিয়ার টিগ্রানিসের কাছে সাহায্যের জন্য সেদিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। আর তখন টিগ্রানিস আগে থেকেই সমস্যার মধ্যে ছিলেন। তাই মিথ্রাডেইটিসকে প্রবেশে বাধা দিয়ে নতুন করে রােমানদের ডেকে শাসকের আসনে বসানােতে তাদের আপত্তি ছিল। মিথ্রাডেইটিস কৃষ্ণ সাগরের উত্তর দিকে অগ্রসর হলেন যেদিক থেকে পম্পেই তাকে আর অনুসরণ করবেন না বলে ঠিক করলেন। কিছুদিনে জন্য মিথ্রাডেইটিস সেই এলাকার বন্য কিছু আদিবাসীকে একত্র করে নিজের সমর্থনে এনে ইতালি আক্রমণ করার স্বপ্ন দেখলে, কিন্তু তার পুরােনাে কিছু অনুসারী যারা তার সঙ্গে সঙ্গেই ছিল, তারা ইতালির সঙ্গে নতুন করে অর্থহীন যুদ্ধ বাধানাের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তার নিজের পুত্রই যখন অনুসারীদের সঙ্গে এক হয়ে মিথ্রাডেইটিসের সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করলেন, মিথ্রাডেইটিস তখন পুরােপুরি ভেঙে পড়লেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে আত্মহত্যা করে তার সাতান্ন বছরের রাজত্বের সমাপ্তি টানলেন। এর মধ্যে পম্পেই পূর্বাঞ্চলের সমস্যা সমাধান করছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ সালে পন্টাস রােমের প্রদেশ হিসেবে পরিগণিত হলাে এবং সিলিশিয়াও রােমের প্রদেশ হলাে সেই একই বছরে। বলতে গেলে তখন এশিয়া মাইনরের সম্পূর্ণ এলাকাই রােমের অধীনে। ভেতরের দিকে তখনাে অনেকগুলাে স্থান ছিল, যেমন ক্যাপাডােকিয়া বা গ্যালাশিয়া, যেগুলাে তখনাে সেখানকার অধিবাসীদের নিজস্ব শাসকের অধীনে ছিল।  যদিও সেসব রােমের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল না। পরবর্তী তিরিশ-চল্লিশ বছরে সেই স্থানগুলাে রােমের অধীনে আসারই কথা ছিল। 

রোমের কাছে সেলুসিড সাম্রাজ্যের পতন : এশিয়া মাইনরের সবকিছু ঠিকঠাকমতাে গুছিয়ে পম্পেই ভূমধ্যসাগরের পূর্বদিকের উপকুল ধরে যাত্রা শুরু করলেন। সেখানে তিনি সেলুসিড রাজ্যের শেষ চিহ্ন খুঁজে পেলেন, সেটি ছিল তৃতীয় অ্যান্টিওকাস এর অধীনে, তাও বলতে গেলে সােয়া এক শতাব্দী আগের কথা, তারা রােমের বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার দুঃসাহস করেছিল। তখন সেটি চারদিক থেকে খানিকটা ছােটো হয়ে আসা রাজ্য, কেবলমাত্র সিরিয়া ছিল তার সঙ্গে, যার ভূমি রাজধানী অ্যান্টিওককে ঘিরে ছিল। এক শতাব্দী ধরে সেলুসিড রাজ্যের ইতিহাস তখন কেবল বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহিংসতা আর মূল্যহীন মানুষদের সিংহাসনে আরােহণের কথা বলত। তখন সিংহাসনে আসীন ছিরেন ত্রয়োদশ অ্যান্টিওকাস, যিনি লিউলুকাসের চার বছর আগে সেখানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। পম্পেই তখন রাজ্যটির এলােমেলাে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের। করছিলেন। তিনি সিংহাসন থেকে রাজাকে সরিয়ে রাজ্যটিকে রােমের সঙ্গে জুড়ে দিলেন। সিরিয়ার মতােই একটি প্রদেশ হয়ে রইল স্থানটি।

জুডিয়ায় রোমান নিয়ন্ত্রণ : সিরিয়ার দক্ষিণে ছিল জুডিয়া। এক শতাব্দী আগে জুডিয়া সেলুসিড সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তারপর স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, সেখানকার শাসকরা ম্যাকাবিজ নামে পরিচিত ছিলেন। জুডিয়া তাদের শাসনে বেশ ভালােই উন্নতি করছিল শুরুর দিনে, কিন্তু তারপর সেসব ইতিহাস হয়ে গেছে, তারপরে শুরু হয়েছিল অভিজাত শাসক পরিবারগুলাের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই আর বিরােধিতা। পম্পেই যখন গিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন, ম্যাকাবি পরিবারের দুইজন ভাই তখন নিজেদের মধ্যে তুমুল লড়াই করছিলেন। একজনের নাম হিরকানুস এবং অন্যজন অ্যারিস্টেবুলাস- যদিও নাম দেখে তাদের গ্রিক বলে মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে তারা ছিলেন ইহুদি। পম্পেই আদেশ দিলেন জুডিয়ার সমস্ত দূর্গকে তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তারা তাকে অমান্য করল এবং উলটো জেরুজালেমে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করল। তিন মাস পম্পেই নগরটা জবর দখল করে রাখলেন আর তারপরে কঠোর ইহুদিরা নিজে থেকেই নগরটা তার হাতে তুলে দিল। পম্পেই নগরটা নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল এবং কৌতূহলবশত তিনি জেরুজালেমের পবিত্র তথা পবিত্রতম মন্দিরে প্রবেশ করেছিলেন যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সেটা এতই সংরক্ষিত একটা এলাকা যে সেখানে কেবল উচ্চস্তরের পুরােহিতরা শুধু প্রায়শ্চিত্যের অনুষ্ঠানের দিনটাতে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন। সন্দেহাতীতভাবে অনেক ইহুদি তখন মনে করেছিলেন যে পম্পেই ওখানে দাঁড়ানাের পাপের কারণে তখনই মৃত্যুবরণ করবেন, কিন্তু দেখা গেল তার কোনাে ক্ষতিই হলাে না। তবে সে যাই হােক, এটা বেশ মজার যে তখন থেকে, মন্দিরের নিয়ম ভাঙার সেই সময়টা থেকে, পম্পেইয়ের সফলতা যেন সমাপ্তিতে ঠেকে গেল। তার পর থেকে তার বাকি জীবন ছিল বেশ হতাশার। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে ম্যাকাবিজ পরিবারের রাজ ক্ষমতায় থাকাকে পম্পেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হিরাকুনাসকে সর্বোচ্চ পুরােহিত হিসেবে বহাল রেখেছিলেন। জুডিয়ার সত্যিকারের ক্ষমতা হিসেবে (রােমের তত্ত্বাবধানে) পম্পেই অ্যান্টিপ্যাটারকে প্রতিষ্ঠিত করলেন, যিনি ইহুদি ছিলেন না, ছিলেন ইদুমাইন জাতির অন্তর্ভুক্ত, দক্ষিণ জুডিয়ার একটি আদিবাসী জাতি ছিল সেটি। অ্যান্টিপ্যাটার রােমের অনুগত একটি স্থান ছিল, আর তাই, ঠিক তখন থেকে জুডিয়া ভালােমতাে রোমের অধীনে চলে। পম্পেই তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।

ইতালিতে ফিরে এসে পম্পেই : খ্রিস্টপূর্ব ৬১ সালে, পয়তাল্লিশ বছর বয়সে তিনি ইতালিতে ফিরে এলেন এবং তার ফেরার জন্য এত ব্যাপক উৎসবের আয়ােজন হলাে, যা রােমানরা তখন পর্যন্ত আগে কখনাে দেখেনি। সিনেট তখন আতঙ্ক অনুভব করল যে স্যুলার মতাে একই কায়দায় পম্পেই নিজেকে রােমের একনায়ক ঘােষণা করতে পারেন। কিন্তু তার পরিবর্তে পম্পেই তার সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রােমের সাধারণ একজন নাগরিক হয়ে থাকা শুরু করলেন।  পম্পেই নিশ্চয় ভেবেছিলেন, কোনাে সৈন্যের সমর্থন ছাড়াও, আড়ালে বসবাস করে কেবল নামের জোরেই তিনি রােমানদের উপরে তার জাদু চালিয়ে যাবেন। তাই যদি ভেবে থাকেন, তবে তিনি ভুল ভেবেছিলেন। যেমন, কেবলমাত্র হ্যানিবলকে পরাজিত করার গৌরব নিয়ে সিপিও আফ্রিকানাস রােমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি; এমনকি কিম্ব্রি এবং টিউটোনিজকে পরাজিত করে সেই জাদু কাজে লাগিয়ে মারিয়াসও পারেননি রােমের মানুষদের উপরে বেশিদিন ছড়ি ঘােরাতে। ঠিক একইভাবে পম্পেইও সফল হলেন না। রােমকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়ােজন ছিল ভয়ানক বিচক্ষণতা, একই সঙ্গে ঠান্ডা মাথা, সুস্থভাবে চাতুর্য প্রয়ােগের দক্ষতা এবং প্ররিশেষে একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী। এর কোনােটাই পম্পেইয়ের ছিল না। 

পম্পেই-ক্র্যাসাস-সিজার এর ত্রিশাসন বা ট্রায়াম্ভিরেট

ক্যাটিলাইনের ষড়যন্ত্র 

রোমের বাইরে সিজার : এশিয়ায় পম্পেইয়ের অবর্তমানে ক্র্যাসাস জনপ্রিয় দলের নেতা হিসেবে ব্যপক পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিলেন। তার ছিল বিশ্বস্ত রাজনৈতিক মােসাহেব, সুদর্শন এবং অভিজাত, গাইয়াস জুলিয়াস সিজার, যিনি একবার স্যুলার পক্ষে বুক বেধে দাঁড়িয়েছিলেন এবং পরে পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছেন। খ্রিস্টপূর্ব ১০২ সালে সিজার জন্মগ্রহণ করেন, তিনি জন্মেছিলেন রােমের প্রাচীন এবং সবচেয়ে অভিজাত এক পরিবারে, এবং তার অবস্থান অনুযায়ী এটাই স্বাভাবিক ছিল যে তিনি সিনেটের রক্ষণশীল দলের শক্ত সমর্থক হবেন। তিনি যে বছরে জন্মেছিলেন, সে বছরেই মারিয়াস কিছু বর্বর জাতির সঙ্গে যুদ্ধে বড়াে জয় লাভ করেন; তার আন্ট মারিয়াসের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে তিনি মারিয়াসের একজন সহচরের কন্যা, সিনাকে বিবাহ করেন। আর তাই মারিয়াসের সময়টা নিয়ে পম্পেইয়ের মধ্যে খুব আবেগপূর্ণ একটা অনুভূতি কাজ করত, যার কারণে তিনি নিজেকে রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে সরিয়ে প্রগতিশীলদের পক্ষে টেনে আনতে পেরেছিলেন। সিজার বিচক্ষণভাবে স্যুলার সঙ্গে জোট বাঁধলেও, যে জোটের কারণে তিনি তার সম্পদ এবং রাজনৈতিক পদ হারিয়েছিলেন, তবু তিনি ভাগ্যের উপরে জোর দেননি। এশিয়া মাইনরে যে রােমান সেনাবাহিনী যুদ্ধ করছিল, সেই বাহিনীতে যােগ দেয়ার জন্য তিনি ইতালি ছেড়ে চলে যান। স্যুলা নিরাপদে মৃত্যুবরণ করার আগপর্যন্ত তিনি ফিরে আসেননি। আর তারপর সিসেরাের মতাে তিনিও নিজেকে আদালতে একজন ভালাে বক্তা হিসেবে গড়ে তােলার চেষ্টায় ব্যস্ত হন। সত্যি কথা বলতে কী, চেষ্টা হসফল হয়েছিল, সিসেরাের পরে বক্তা হিসেবে যদি দ্বিতীয় কারাে নাম উচ্চারিত হয়, তাে সেই লোক তিনিই। আরাে ভালাে করে বক্তৃতা দিতে শেখার আশায় তিনি বড়াে শিক্ষকদের কাছে তালিম নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৭৮ সালে তিনি রােড দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা। করেন। যাত্রাপথে তিনি সামুদ্রিক দস্যুদের কবলে পড়েন, যারা তার কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। তারা এখনকার যুগের হিসেবে ১০০,০০০ ডলার অর্থ দাবি করে। সিজার তার অপহরণকারীদের নানাভাবে মুগ্ধ করে ফেলেন (তার সামনে যে থাকত তাকেই তিনি মুগ্ধ করার দক্ষতা রাখতেন)। তারা তার সঙ্গে বেশ ভালােই সময় কাটাচ্ছিল। বন্ধুত্বপূর্ণ এক কথােপকথনের মাঝখানে দস্যুরা সিজারকে জিজ্ঞাসা করল যে তাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি কী করতে চান। সিজার শান্তভাবে উত্তর দিলেন যে তিনি নিজ রাজ্যে ফিরে যাবেন, তারপর এক নৌবহর তৈরি করে তা নিয়ে সমুদ্রের ঠিক ওই স্থানে আসবেন এবং তারপর যারা তাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছিল তাদেরকে বন্দি করে হত্যা করবেন। সামুদ্রিক দস্যুরা তার উত্তর শুনে এবং তার রসবােধ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। তারা একযােগে হেসে উঠেছিল। কিন্তু যখন সেখানে সিজারের মুক্তিপণ এসে পৌঁছল এবং তাকে মুক্তি দেয়া হলাে, তিনি সােজা চলে গেলেন নৌ বহর তৈরি করতে। তৈরি হলে তিনি ঠিক সেইখানে ফিরে এসেন, দস্যুদেরকে বন্দি করলেন এবং এক এক করে তাদের সবাইকে হত্যা করলেন ঠিক যেমনটা তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাদের সামনে বসেই। সুদর্শন এবং তরুণ আর অভিজাত বক্তাটির সামনে এমন কেউ ছিল না যে সামান্য উলটোপালটা আচরণ করতে পারত। রােডসে অল্প কিছুদিন বসবাস করার পরে সিজার এশিয়া মাইনরে চলে গেলেন এবং মিথ্রাডেইটিসের বিরুদ্ধে প্রচারণায় মনােযােগী হলেন।

রোমে এসে সিজার : আর তারপর তিনি রােমে ফিরে এসে রাজনীতিতে প্রবলভাবে জড়িয়ে পড়ার কথা ভাবলেন। জনপ্রিয়তার বলে তিনি নিজেই অনেকগুলাে কার্যালয়ে নিজেকে প্রধান হিসেবে ঘােষণা করে দিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদগুলাে তিনি তখন জনপ্রিয়তা পাওয়ার লক্ষ্যে জলের মতাে খরচ করছিলেন। তার কাছে কেউ আসলে তাদে কাউকে তিনি খালি হাতে ফেরত যেতে দিতেন না। জনগণের নানারকমের মিলনমেলা এবং খেলাধুলার আয়ােজনে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করলেন। প্রত্যেককে তিনি তার পরিপাটি জীবনাচরণ দিয়ে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। এর বেশি আর কী, তিনি মৃত মারিয়াসের ইচ্ছেপূরণে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করলেন, যার স্মৃতি তখনাে সে রাজ্যের জনগণের মনে জ্বল জ্বল করছিল। স্যুলা মারিয়াসের মূর্তি অপসারণ করেছিলেন, তবে রাজধানীতে তার প্রাপ্ত পদকগুলাে তখনাে ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬৮ সালে, যদিও, সিজারের খালা (মারিয়াসের বিধবা পত্নী) মৃত্যুবরণ করলেন, সিজার তখন শেষকৃত্যের যাত্রায় মারিয়াসের বিশাল এক কারুকার্যময় প্রতিকৃতি যােগ করলেন। তারপর খ্রিস্টপূর্ব ৬৫ সালে তিনি রাজধানীতে মারিয়াসের মূর্তি আর পদকগুলাে স্থানান্তর করে নতুন করে সাজিয়ে রাখলেন। সিনেট প্রতিবাদে গুমরে মরছিল কিন্তু টু-শব্দ করার সাহস পায়নি সিজারের হুঙ্কারের ভয়ে। সিজারের মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতা তাকে ভয়ানক বিপদের মধ্যে ফেলল। খরচের মাত্রা বাড়াতে বাড়াতে তিনি নিজের ভাগ্যকে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেললেন এবং নিজেকে লাখ লাখ ডলার ঋণের মধ্যে ফেললেন। সেটা তাকে ধ্বংস করে দেবার কথা ছিল, কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। ক্র্যাসাস অবশ্য তার অনুসারী হিসেবে সিজারের মাহাত্ম বুঝতে পেরেছিলেন। এমন ভালাে বক্তা, জনগণের মধ্যে এমন জনপ্রিয় এবং যার ক্রমাগত অর্থের প্রয়ােজন হয়, এমন মানুষ সিজারের গুণ আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ক্র্যাসাস যদি তাকে সেই অর্থ সরবরাহ করতেন তবেও সিজার আগের মতােই অপচয়কারীই থাকতেন।  জনপ্রিয় দলটি বিপুল সংখ্যক লােককে তাদের দিকে আর্কষণ করার চেষ্টা করছিল এবং তারাই আকৃষ্ট হচ্ছিল যারা রােমান সমাজের আমূল পরিবর্তন চাইত অথবা যারা সে সময়ে একটি বিপ্লব ঘনিয়ে উঠতে দেখার প্রত্যাশায় ছিল। এই অনুভূতি সবসময় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া থেকে কিংবা দরিদ্র জনগােষ্ঠীর প্রতি মায়া মমতা থেকে তৈরি হতাে না। যার এটা চাইছিল, তারা কখনাে কখনাে নিজেদের স্বার্থোদ্ধার, সম্পদ সংগ্রহ এবং মূলত প্রতিহিংসা উদ্ভুত প্রতিশােধ নেবার আকাঙ্ক্ষা থেকে চাইছিল।

কাটিলাইন : উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় একজন ঋণগ্রস্থ অভিজাত ব্যক্তির কথা, যার নাম ছিল লুসিয়াস সারজিয়াস ক্যাটিলিনা, ইংরেজিতে যিনি ক্যাটিলাইন নামে পরিচিত। সিজারের মতাে তিনিও একটি অভিজাত পরিবার থেকে এসেছিলেন, তিনিও তেমনই নিজের যাবতীয় সম্পত্তি বিলাসিতায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাবে সিজারের মতাে তার সৌন্দর্য বা সফলতার দীর্ঘ ইতিহাস ছিল না। ক্যাটিলাইন সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, তা হলাে তার শত্রুদের দীর্ঘ তালিকা, এবং কোনাে সন্দেহ নেই যে তারাও ছিলেন ভীষণভাবে বিলাসী। সে যাই হােক, তার সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, সেটুক পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে তিনি ছিলেন একজন ভয়ঙ্কর মানুষ, ছিলেন নিষ্ঠুর, এমনকি খুনিও। তিনি স্যুলার তােষামােদকারী এবং রক্ষণশীল দলের একজন সদস্য ছিলেন। যাই হােক, তার আর্থিক অবস্থা যখন পড়ে গেল, তিনি তখন অর্থ আদায়ের জন্য রক্ষণশীল দলের উপরেই চাপ প্রয়ােগ করে তাদের চোখে শত্রু হয়ে গেলেন। তার মনে হলাে যে একমাত্র কনসল হিসেবে নির্বাচিত হলেই তিনি তার ঋণের বােঝা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। এই প্রত্যাশা সফল করতে তিনি জনপ্রিয় দলকে উসকে দিতে লাগলেন তারা যেন ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমির বন্টন এবং রােমের কোষাগারের জন্য দূরের প্রদেশ থেকে লুটপাট আরাে ভালাে করে চালিয়ে যায়। ক্র্যাসাস তাকে সমর্থন দিলেন, যেমন তিনি সিজারকেও সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্যাটিলাইন কনসল নির্বাচিত হতে পারলেন না। আর তাই তিনি তখন ভয়াবহ এক পরিকল্পনা নিলেন, সেটি হলাে, নির্বাচিত কনসলদের বন্দি করা এবং নগরটির দখল নেয়া (তার শত্রুরা তার এরকম একটি পরিকল্পনার কথাই বলেছিলেন)। তবে এটা সন্দেহজনক যে ক্র্যাসাস এবং সিজার এই অন্যায় অনাচারের মধ্যে কতদূর পর্যন্ত ক্যাটিলাইনকে সমর্থন জানাতে পেরেছিলেন। এটাই বিশ্বাসযােগ্য নয় যে ক্র্যাসাস নিজেই যেখানে লুটপাট করে সম্পদ গড়েছেন, সেখানে তিনি নিজের নগরে লুট হতে থাকাকে কতটা সমর্থন দিয়েছিলেন। আর তারা হয়তো ক্যাটিলাইনের সর্বশেষ পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগতও ছিলেন না; অথবা এমন হতে পারে যে, ক্যাটিলাইনের পরিকল্পনা এমন দুর্ধর্ষ ছিল না যতটা তার শত্রুদের হস্তক্ষেপে হয়ে উঠল। পরবর্তীকালে, যে কোনাে কারণেই হােক না কেন, রক্ষণশীলেরা কেবল এটাই প্রমাণ করতে চেষ্টা করতেন যে ক্র্যাসাস এবং সিজার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এবং বেশিরভাগ ইতিহাসবিদগণও মনে করতেন যে, সত্যিই তারা একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

ক্যাটিলাইনের বিপক্ষে কাটো : ক্যাটিলাইনের বিপক্ষে ছিলেন সিনেটের রক্ষণশীল দলের নেতা মার্কাস পর্শিয়াস কাটো, পুরােনাে সেনসর কাটোর উত্তরাধিকারী এবং নাম বহনকারী (এই নতুন কাটোকে ইতিহাসে কখনাে “তরুণ কাটো” বলা হয়েছে, আবার কখনাে বলা হয়েছে “উটিকার কাটো”। উটিকা সেই স্থান যেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন)। তরুণ কাটো ছিলেন রক্ষণশীল স্বভাবের আদর্শ। তিনি এশিয়া মাইনরে লিউলুকাসের অধীনে শাসনকাজে অংশগ্রহণ করেন, যার প্রচলন করা নিয়ম কানুন তিনি ভয়ানকভাবে মেনে চলেছিলেন। প্রাচীন রােমের যেসব উপকথা প্রচলিত ছিল, কাটো সেই সমস্ত অনুসরণ করে নিজের জীবনে সিদ্ধান্ত নিতেন। যেহেতু তিনি এক কথার মানুষ ছিলেন এবং নিজের চিন্তা ধারা থেকে সরতে পারতেন না, তাই, অন্য লােকেরা তার এই স্বভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বিরক্ত হতেন। তিনি কখনাে মানুষের প্রতি মায়া পরবশ হতে পারতেন না। তিনি কেবল কারাে উপরে রাগ দেখাতে পারতেন। আর যেহেতু তিনি কখনােই সমঝােতায় যেতে পারতেন না, তাই বরাবরই শেষে তাকে হার মানতে হতাে (পরের প্রজন্ম, যাদেরকে তার সঙ্গে সরাসরি কাজ করতে হয়নি, তারা তাকে তার রক্ষণশীল স্বভাব এবং দায়িত্বে প্রতি নিষ্ঠার জন্য ব্যাপকভাবে সম্মান করে গেছে)।

ক্যাটিলাইনের বিপক্ষে সিসেরো ও ক্যাটিলাইনের ষড়যন্ত্র ফাঁস : ক্যাটিলাইনের বিপক্ষে সিসেরােও ছিলেন, যিনি না ছিলেন সিনেটের সদস্য, না ছিলেন জনপ্রিয় দলের অন্তর্ভুক্ত। সিসেরাে প্রধানত একজন দয়ালু মানুষ ছিলেন এবং যার আদর্শ ছিল বেশ উঁচুদরের। সিসেরাের মধ্যে ছিল কাটোর মতােই সততা, তবে তার একরােখা আর অহঙ্কারী স্বভাবটা বাদ দিয়ে। আর তাছাড়া সিসেরাে তত শক্ত সমর্থও ছিলেন না। আবার তিনি মাঝেমধ্যে এত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন যে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। তার এই সিদ্ধান্তহীন স্বভাবের জন্য অনেক ক্ষেত্রে ভীরু বা কাপুরুষ আখ্যা পেয়েছিলেন। যদিও তখন সিসেরাে তার জীবনের জন্য সবচেয়ে বড়াে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে ক্যাটিলাইনের বিরুদ্ধে লড়ে তিনি জয়ী হয়েছিলেন এবং কনসল হিসেবে যােগদান করেছিলেন। কনসল হিসেবে সিসেরোকে নানারকম উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছে। একজন ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন সামান্য অসতর্ক, যার কারণে সিসেরাের বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রের খবর তার কানে চলে আসে। এমনকি তাকে জড়িয়ে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেটিও তার কাছে ফাঁস হয়ে যায়। নিজ আগ্রহে তিনি কিছু প্রমাণ যােগাড় করেন। তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য তৎপর হয়ে ওঠা সেনাবাহিনীকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি রােমের দেয়ালে মানুষের সারি দাঁড় করিয়ে দিলেন, নাগরিকদের হাতে তুলে দিলেন অস্ত্র, আর তারপর সিনেটের সভা আহ্বান করলেন। ক্যাটিলাইন সাহস করে সেই সভায় উপস্থিত হলেন, তাকে আসতেই হলাে, কারণ, সবকিছুর পরেও তিনি ছিলেন একজন সিনেট সদস্য। সিসেরাে সেখানে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতাটি দিলেন। বক্তব্যে তিনি ক্যাটিলাইনের মুখের উপরে তার করা ষড়যন্ত্রের আদ্যপান্ত বর্ণনা করলেন, পরিকল্পনার ছােটো ছােটো অংশ, সিসেরাের ইচ্ছা, যাবতীয় সব কিছুই তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করলেন। বক্তৃতা চলাকালে সিনেটের সভায় ক্যাটিলাইনের আশেপাশের চেয়ারে যারা বসে ছিলেন তারা ধীরে ধীরে উঠে চলে গেলেন। চারদিকের শুন্য চেয়ারগুলাের মাঝখানে ক্যাটিলাইন বসে থাকলেন একা। সেই দিনটি শেষ হয়েছিল সিসেরাের আবেগপূর্ণ উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে।

ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তি, রোমের বিরুদ্ধে ক্যাটিলাইনের যুদ্ধ, পরাজয় ও মৃত্যু : ক্যাটিলাইনের পক্ষে সেখানে আর টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। রােমে থাকার সাহস তার হয়নি। তাই সে রাতেই তিনি রােম ছেড়ে পালিয়ে যান, চলে যান দূরে এক সেনাবাহিনীর কাছে, তার অনুসারীরা আগেই তার জন্য সে বাহিনী তৈরি করে রেখেছিল। তিনি তখন খােলাখুলি রােমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। যারা সিনেটে বসে সিসেরাের বক্তব্য শুনেছিলেন তারা তৎক্ষণাত ক্যাটিলাইনের বিরুদ্ধে এবং রােমের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপরে সিসেরাে আরাে এক ষড়যন্ত্র ফাঁস করেন। ক্যাটিলাইনের বন্ধুরা যে তখনাে রােমে বসে মধ্য এবং উত্তর গাউলের বিভিন্ন স্বাধীন জাতির প্রতিনিধির সঙ্গে মিলে রােমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল, তা তিনি সবার সামনে আনেন। তাদের মিলিত পরিকল্পনা ছিল যে গাউলরা এসে রােমের সীমানায় এবং একইসঙ্গে ক্যাটিলাইন রােমের মধ্যভাগে আক্রমণ করবেন। ষড়যন্ত্রকারীদেরকে তখনই গ্রেফতার করে বন্দি করা হয় কিন্তু তখন মূল চিন্তা হয়ে দাঁড়ায় যে তাদের নিয়ে কী করা হবে। রােমান আইন অনুযায়ী তাদেরকে সংশােধনের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করার কথা, কিন্তু সিসেরাের ইচ্ছা ছিল তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া। তিনি আশঙ্কায় ছিলেন যে তারা তাদের প্রভাব এবং অসততা কাজে লাগিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন এবং পূণরায় রােমের পরিণতি ভয়ানক হতে পারে। ক্র্যাসাস সতর্কভাবে নিজেকে এই সবকিছুর বাইরে রাখতে সক্ষম হলেন। ষড়যন্ত্রে তার ভূমিকা থাকার গুজব তার কানেও এসেছিল। আর সিজার, যার বিরুদ্ধে একই অভিযােগের গুজোব ছিল আরাে জোরালাে তিনি একটি যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা তুলে ধরেন। যে ষড়যন্ত্রকারীদের মৃত্যুদণ্ড না হয়ে সাজা হওয়া উচিত। তার বক্তৃতা এতটাই প্রভাব বিস্তারকারী ছিল যে মনে হচ্ছিল অপরাধীদের ফাঁসির পরিবর্তে সাজার ব্যাপারে তখনই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তখন তরুণ কাটো আরাে বেশি যুক্তিপূর্ণ এবং একইরকমের আবেগপুর্ণ এমন এক বক্তব্য তুলে ধরলেন যে তারপর বিচারের কাজ আর না বাড়িয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড হকার্যকর করে ফেলা হলাে। এরপর, রােমের সেনাবাহিনী রােম থেকে উত্তরে ২০০ মাইল দূরে ক্যাটিলাইনের সেনাবাহিনীর মুখােমুখী হয়। ক্যাটিলাইনের পরাজয় হলাে সেই যুদ্ধে। ক্যাটিলাইন তখন এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র যে উপায় খুঁজে পেলেন, তাই করলেন, খ্রিস্টপূর্ব ৬২ সালে তিনি আত্মহত্যা করে জীবনাবসান ঘটান। ষড়যন্ত্রের সমাপ্তিতে এর ফলাফল স্বরূপ যা হলাে, ক্যাটিলাইন নিতে সিসেরােকে তার রাজনৈতিক বিকাশধারার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠিয়ে দিয়ে গেলেন। সেই সময়টাতে তিনি রােমের রক্ষক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন, অথবা, কাটোর রসিকতা সহ বলা যায়, “দেশ ও জাতির পিতা”। 

পম্পেই-ক্র্যাসাস-সিজার – তিন ব্যক্তির শাসনের সূচনা

রাজনীতিতে পম্পেই এর বিরুদ্ধে অবস্থান : সিসেরাে, যিনি নিজেই নিজেকে নিয়ে ছিলেন গর্বিত, হয়তো ভেবেছিলেন তার জীবন হওয়া উচিত একটি লম্বা সফলতার সফর, কিন্তু তেমন হয়নি। একটি কারণ ছিল, পম্পেই ফিরে এসেছিলেন; পম্পেই ছিলেন সেই অপরাজেয় সেনাপ্রধান যিনি তাবৎ পূর্বাঞ্চলকে রােমের পায়ের কাছে এসে রেখেছিলেন; যিনি সামুদ্রিক দস্যুদের নিশ্চিহ্ন করেছিলেন, মিথ্রাডেইটিসের অদম্য হুমকিতে চিরসমাপ্তি টেনেছিলেন, আর্মেনিয়াকে হাঁটু গেড়ে প্রণতি জানাতে বাধ্য করেছিলেন এবং সিরিয়া ও জুডিয়াকে হাতের ইশারায় দখল করেছিলেন। পম্পেই একটি বিশাল আগমন উৎসব উপভােগ করলেন। তার পরপরই নিজের সেনাবাহিনীকে অকার্যকর করা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস এবং অধিকারবোেধ নিয়ে। পূর্বাঞ্চলে তার সিদ্ধান্তে করা সমস্ত কাজের বৈধতা দিতে সিনেটকে তিনি আদেশ করলেন। তিনি প্রত্যাশা করলেন সিনেট বিপুল ভােটে তার করা সমস্ত শান্তিচুক্তি, তার দখলকৃত প্রদেশসমূহ, তার সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠা কিংবা উৎখাত করা রাজ্য বা রাজা, এই সমস্ত কিছুর বৈধতা দেবে। তারা তা দেননি। পম্পেই, ঠিক সিসেরাের মতােই আবিষ্কার করলেন যে আগের বছরের কৃতকর্ম এই বছরে এসে আর মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে না। আশ্চর্যজনকভাবে পম্পেইকে অগ্রাহ্য করা হলাে, নিজের সেনাবাহিনী অকার্যকর করবার পর যে পুরস্কারটি তার মিলল, তা হলাে ক্ষমতা থেকে তাকে অবৈধ ঘােষণা। কিছু কিছু সিনেট সদস্য তাকে সন্দেহ করতেন, অন্যরা করতেন হিংসা। কাটো প্রস্তাব পেশ করলেন যে পম্পেইয়ের ক্ষমতায় থাকার শেষের দিককার প্রত্যেকটি কাজকে খতিয়ে দেখা উচিত এবং প্রত্যেকটিকে আলাদা করে বিবেচনা করা উচিত। লিউলুকাস (যাকে পম্পেই তার পদ থেকে সরিয়েছিলেন এবং যার কাজকর্ম পম্পেইয়ের কোনাে বিজয়ের পথেই তেমন কোনাে কাজে আসেনি) ছিলেন সবচেয়ে জোরালাে বিপক্ষ। তিনি পম্পেইয়ের কাজকর্মের ব্যাপক সমালােচনা করতে লাগলেন। ক্র্যাসাস পম্পেইয়ের বিরুদ্ধে হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলেন, আর এর মধ্যে দিয়ে জনপ্রিয় দলটিই পম্পেইয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল।

সিজার-পম্পেই-ক্র্যাকাস তিনজনের ক্ষমতা বা ট্রায়াম্ভিরেট ও কনসল হিসেবে সিজার : রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন গরম হয়ে উঠল, তখন সেখানে সিজার ছিলেন অনুপস্থিত। পম্পেইয়ের ইচ্ছা অনিচ্ছা কিছু না জেনেই, তিনি স্পেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন, কারণ, ক্যাটিলাসইনের ষড়যন্ত্র তখন তার রাজনৈতিক অবস্থানে অনেকটা দাগ লাগিয়ে গেছে। স্পেনে গিয়ে সিজার কিছু বিদ্রোহী জাতির সঙ্গে লড়াই করলেন এবং পশ্চিম দিকের প্রদেশে উপস্থিত হলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দুটো জিনিস অর্জন করলেন। প্রথমত, তিনি অনেক সম্পদ অর্জন করলেন, যা কাজে লাগিয়ে ক্র্যাসাসের কাছে এবং আরাে অনেককের কাছে করা ঋণ শােধ করলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণের দক্ষতা অর্জন করেছেন বলে ধরে নেয়া হলো। খ্রিস্টপূর্ব ৬০ সালে তিনি যখন ইতালিতে ফিরে এলেন, তিনি দেখলেন সেখানকার পরিস্থিতি তার জন্য তৈরি। পম্পেই তখন ভীষণ হতাশাবােধে ভুগছেন এবং প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত, সিনেটের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সম্ভব হলে যে কোনাে পদক্ষেপ নিতে তৈরি – কেবল যেন কারাে জন্য অপেক্ষা করে আছেন যে কেউ বলে দেবে তার সত্যিকার অর্থে কী করা উচিত। সিজার তার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার জন্য অতি উৎসাহী ছিলেন।  সিজারের মত অনুযায়ী তারা দুজনে মিলে নতুন দল গঠন করলেন: পম্পেই হলেন সেনাপ্রধান এবং সিজার তুখােড় বক্তা। তাদের একমাত্র যে অভাব ছিল তা হলাে অর্থ, যা সহজেই ক্র্যাসাসের কাছে মিলে গেল। তিনি তাদের সঙ্গে যােগ দিলেন। পম্পেই এবং ক্র্যাসাসের সম্পর্ক খারাপ ছিল, কোনাে সন্দেহ নেই, কিন্তু সিজার নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠাতে সাহায্য করতে পারবেন। আর তিনি সত্যিই তা করতে পেরেছিলেন। তারা তিনজন একে অন্যের স্বার্থ রক্ষায় একজোট হয়ে গেলেন। আর এভাবেই প্রথম তিন ব্যক্তির শাসনামল (ট্রাইয়ামভিরেট- ল্যাটিন থেকে আসা শব্দ, যার অর্থ “তিনজন মানুষ”) শুরু হলাে। সিজারের পরিকল্পনা সঠিক ছিল। ক্র্যাসাসের অর্থ, পম্পেইয়ের সেনাবাহিনীতে থাকার অভিজ্ঞতা ও সুনাম এবং সিজারের নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতা, তিনে মিলে রােম পরিচালনা করা খুবই অর্থবহ হলাে। সিসেরাে, ক্যাটিলাইনের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদের বিশাল সুনাম থাকা সত্ত্বেও নিজেকে বিস্মৃত হয়ে যেতে দেখলেন, আর ওদিকে কাটো দেখলেন তার রক্ষণশীল দল তাকে ক্ষমতাচ্যত হিসেবেই গণ্য করছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৯ সালে সিজার সহজেই কনসল নির্বাচিত হয়ে গেলেন। কনসল হিসেবে তিনি তিন ব্যক্তির শাসনের অন্য সদস্যদের স্বার্থ রক্ষায় ব্রতী হলেন। অন্য আরেকজন কনসল ছিলেন রক্ষণশীল দলের প্রতিনিধি এবং তিনি নাক গলানাের চেষ্টা করলেন, কিন্তু সিজার (স্যুলা একবার তার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন) ছিলেন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ এবং মারিয়াসের মতাে সিদ্ধান্তহীনতায় ভােগার পাত্র ছিলেন না। তাই তিনি সােজাসুজি অন্য কনসলকে ফোরাম থেকে সরিয়ে দিলেন এবং তাকে গৃহবন্দি করার নির্দেশ দিলেন। তারপর থেকে তিনি একক কনসল হিসেবে কাজ শুরু করলেন। পম্পেইয়ের আগের সমস্ত সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপকে তিনি বৈধতা দিয়ে ফেললেন। পম্পেইয়ের সেনাবাহিনীকে নতুন করে তৈরি করার আদেশ দিয়ে তিনি তাদের নতুন লক্ষ্য দিয়ে ইতালিতে পাঠালেন। একজন মাত্র মানুষ ছিলেন, যার সাহস ছিল যুক্তি দিয়ে সিজারের সামনে এসে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ানাের, বন্দিত্ব কিংবা মৃত্যুদণ্ডের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও, তিনি কাটো। সিজার তাই তাকে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে দূরবর্তী দ্বীপ সাইপ্রাসে পাঠিয়ে দিলেন, এবং তাকে সেখানে যেতেই হলাে। সিসেরাে, আরেক প্রতিপক্ষ, কাটোর মতাে অত সাহসী ছিলেন না। তাকে এটা সেটা করে ভােলানাে সহজ ছিল, আর তাই সিজার সেই পরাক্রমশালী মানুষটিকে শান্ত করে ফেললেন। 

ক্লডিয়াসকে দিয়ে সিসেরোকে তাড়ানো ও সিজারের একনায়ক হয়ে ওঠা : পাবলিয়াস ক্লডিয়াস মানুষ হিসেবে ছিলেন সম্পূর্ণভাবে অসৎ অভিজাত, চিন্তার ক্ষেত্রে দৃঢ় এবং নিজের খুশিতে চলাফেরা করার ক্ষমতাসম্পন্ন। তিনি ক্রমাগত নানান ঝামেলা তৈরি করছিলেন, এবং তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের উপরে সেসবের আঁচ যেন না আসে সে চেষ্টাও করছিলেন সফলভাবে। তিনি এশিয়া মাইনরে লিউলুকাসের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু সেনাবাহিনী থেকে সম্মানজনক কোনাে খেতাব বা পদবী পাননি। খ্রিস্টপূর্ব ৬২ সালে তিনি প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন, অবশ্য পুরাে বিষয়টাই ছিল এক বােকা বােকা কৌতুকপূর্ণ, সিজারের বাড়িতে কিছু বিশেষ ধর্মীয় আয়ােজন চলছিল, তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে কেবলমাত্র নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল, তাই ক্লডিয়াস নিজেকে নারীর পােশাকে আবৃত করে, নারীর ছদ্মবেশে সেখানে প্রবেশ করলেন। সিজারের মাতা তাকে ঠিকই চিনে ফেললেন এবং ধর্মীয় বিশেষ আচারের অবমাননার দায়ে তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হলাে। তারপর ঘুষ প্রদান করে তিনি সেই বিচার থেকে পরিত্রাণ পেতেও সক্ষম হন। এরকম একটি গুজোব চালু ছিল যে ক্লডিয়াসের সঙ্গে সিজারের দ্বিতীয় পত্নী পম্পেইয়ার বিশেষ রসিকতার সম্পর্ক ছিল (ক্লডিয়াস ছিলেন দারুণ সুদর্শন, তাই তিনি একটি ডাক নাম অর্জন করেন, পুলচার- যার অর্থ হলাে “সুশ্রী”)। সিজার তার স্ত্রীর যে কোনাে কাজ, ভুল হলেও, সমর্থন করতেন। অথচ শােনা যায় বিভিন্ন ভুল কাজের কারণে অতিষ্ট হয়েই তিনি তার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন। তিনি একবার বলেছিলেন যে, “সিজারের স্ত্রী সব বিষয়ে সন্দেহের উর্ধ্বে।” তার এই কথাটি একজন মানুষের কোনাে বিষয় নিয়ে স্থির ধারণা বােঝাতে ব্যবহৃত হয়। ক্লডিয়াসের বিচারের সময়ে, শুনানিতে সিসেরাে শক্তভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করলেন। তার কঠিন রসিকতা ক্লডিয়াসকে ব্যথিত করল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৯ সালে রােমের নিম্নশ্রেণির একটি পরিবার ক্লডিয়াসকে দত্তক নিয়েছিলেন বলে দেখিয়েছিলেন। ট্রিবিউনে অংশ গ্রহণের যােগ্যতা হিসেবে নিজের আভিজাত্য ছেড়ে গিয়ে এই কাজটি তাকে করতে হয়েছিল। ক্লডিয়াস ট্রিবিউনে নির্বচিত হন, সিসেরাের সুনাম কমাতে, প্রথমেই ক্যাটিলাইনের সঙ্গে মিলিত ষড়যন্ত্রকারীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনাকে বেআইনি বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, উপযুক্ত বিচারের মাধ্যমে সাক্ষী-প্রমাণসহ সিদ্ধান্ত না নিয়েই তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, যা একান্তভাবেই আইনের লঙ্ঘন, যা করেছেন সিসেরাে। সুতরাং, তার মতে, সিসেরাের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। সিসেরাে অনুনয় করে বললেন যে সেই সময়টাতে রােম ছিল হুমকির মুখে এবং রােমকে বিপদ থেকে বাঁচানাের জন্য তখনকার জন্য যা সঠিক তাই তাকে করতে হয়েছিল। দোষারােপ করার পরিবর্তে দ্রুত এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তিনি প্রশংসার দাবিদার। সিসেরােও যদি সিজারের মতাে বলিষ্ট হতেন তবে নিজের যুক্তি টেনে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখতেন। কিন্তু তার সাহসে কুলায়নি সেটা। উপরন্তু ক্লডিয়াস নিজ খরচে এক দল লােককে তার বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেন যেন তারা সিসেরােকে আচ্ছামতাে যন্ত্রণা করতে পারে। সিসেরাের এমন পরিস্থিতি দাঁড়াল যে তিনি তার বাড়ি থেকে অফিস পর্যন্তও যাতায়াত করতে পারছিলেন না, তার দেহরক্ষীদের উপরে হামলা হয়ে একজনের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছিল। সিসেরাে লড়াই থেকে অব্যহতি চাইলেন। তিনি স্বেচ্ছা নির্বসনে এপিরাসে চলে গেলেন, বিষন্ন মনে নিজের জন্য কষ্টের অনুভূতি নিয়ে তিনি নগর ত্যাগ করলেন। তার অবর্তমানে তার যাবতীয় সম্পত্তি ক্লডিয়াস দখল করে নিলেন। এভাবেই সিজার রােমের সমস্ত ক্ষমতাবান মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে দুইজন, পম্পেই এবং ক্র্যাসাস, এদের দুজনেকে তিনি নিজের সঙ্গে শক্ত করে জোটবদ্ধ রেখেছিলেন। আরাে দুজন, কাটো এবং সিসেরাে, তাদের তিনি বিতাড়িত করেছেন। তখন তিনি শাসনকাজে যে কোনাে পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন, যা তার জন্য সেনাবাহিনীতে থেকে যুদ্ধ জয়ের সম্মানের মতাে ছিল। এই পরিস্থিতির অবতারণা করার পরেই তিনি একনায়ক হয়ে উঠলেন। 

সিজারের গাউল জয়

সিজারের গাউলের দায়িত্ব গ্রহণ : বিশেষ কোনাে কারণে সিজারের মনােযােগ আটকে থাকল গাউলদের প্রতি। গাউল ছিল এক রােমান প্রদেশ। কিন্তু উত্তর দিকে ছিল বিস্তৃত এলাকা যেগুলাে তখনাে দখল করা হয়নি। তখন মনে হচ্ছিল তিনি একাই সেসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এই বিষয়ে, অন্য সবাই সত্যিকার অর্থে তার উপরে একটু বেশিই ভরসা করে ফেলেছিল। তখন তিনি ছিলেন মধ্যবয়সি, চুয়াল্লিশ বছর বয়স হয়েছিল তার। তার আগপর্যন্ত যুদ্ধের ক্ষেত্রেও তার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই অল্প; সামান্য কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল এশিয়া মাইনরে এবং তার চেয়ে অল্প কিছু বেশি হয়েছিল স্পেনে। কিন্তু সেগুলােকে খুব বড়াে কিছু বলা যায় না। তিনি বরং আভিজাত্যের মধ্যে এমন বিলাসী একটি জীবন যাপন করেছিলেন যে উত্তর গাউলের অসভ্য জাতিদের সঙ্গে ওইরকম অসহনীয় পরিবেশে লড়ে যাওয়ার আশা করা তার জন্য ছিল কঠিন। সে যাই হােক, সিজার ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে আলােচিত মানুষ এবং সত্যি কথা বলতে কী, তিনি নিজেও সেটা জানতেন। তিনি নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি যা করবেন বলে ঠিক করেন সেটাই করে দেখাতে পারেন। আর তার জীবনকাহিনি বিচার করলে দেখা যায় যে তিনি সত্যিই তা পারতেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮ সালে তিনি নিজে থেকে সিসালপাইন গাউল এবং ট্রান্সলপাইন গাউলের ভার পাঁচ বছরের জন্য নিজের হাতে তুলে নেন। সেখান থেকে চলে আসার আগে তিনি নিশ্চিত করতে চেষ্টা করেছিলেন যে তার অবর্তমানে পম্পেই যেন কিছুতেই তার শত্রু হয়ে না ওঠে। আর এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি তার নিজের কন্যা জুলিয়াকে পম্পেইয়ের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দেন। সিজার নিজেও তৃতীয়বারের মতাে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, পম্পেইয়ের বন্ধুর কন্যা কালপুনিয়াকে বিবাহ করেন তিনি। 

সিজারের গাউল অভিযান : সিজার উত্তর গাউলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং সেনাবাহিনীতে সুনাম করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। রাইন নদী গাউলের জাতিগুলােকে দুটো ভাগে বিভক্ত করেছিল। পশ্চিম দিকে ছিল জার্মান ভাষাভাষী জাতি এবং পূর্বদিকে অন্যেরা। দ্বিতীয় দলে তখন পরিবর্তনের জোয়ার লেগেছে। জার্মান ভাষাভাষী অধিবাসীদের একজন নেতা, অ্যারিওভিসটাস (Ariovistus), খ্রিস্টপূর্ব ৬০ সালে রাইন নদী পার হলেন এবং গাউলের বড়াে একটি এলাকা দখল করে নিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮ সালে হ্যালভিশি নামের একটি গ্যালিক জাতি অ্যারিসটোভিসটাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে চেষ্টা করল। তারা তাদের আবাসভূমি আধুনিক যুগের (সুইজারল্যান্ড) ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তারা চলে যেতে চাইল আটলান্টিকের উপকূলবর্তী এলাকায়। হ্যালভিশি জাতি সিজারে কাছে রােমান এলাকা ছেড়ে শান্তিপূর্ণভাবে চলে যাবার জন্য সিজারের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করল। সিজার এই বিষয়টিকে এমনভাবে দেখলেন যে ৪০০,০০০ বন্য গাউলের এই স্থানান্তরের চিন্তার পেছনের মানুষটি ক্ষমার অযােগ্য। নির্দিষ্ট স্থানে দ্রুত গমন এবং নানারকমের ভয়ানক কায়দায় তিনি হ্যালভিশিকে পরাজিত করলেন, আধুনিক অটানের কাছাকাছি একটি অঞ্চলে, সুইজারল্যান্ডের একশ মাইল পশ্চিমে এই লড়াই সংঘঠিত হলাে। বিলাসী মানুষটি তখন নিজেকে কঠিন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং বেশ বিপজ্জনকভাবে নিজ বাহিনীর লােকদের পরিচালনা করার ক্ষমতাও প্রদর্শন করলেন তিনি। গ্যালিক জাতি তখন অ্যারিওভিসটাসের সঙ্গে লড়াই করার জন্য সিজারের সাহায্য প্রর্থনা করল। সিজার মনে মনে ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। তিনি অ্যারিওভিসটাসের কাছে এক রূঢ় চিঠি পাঠালেন, সেখানে এমন মনােভাবই প্রকাশ করা হলাে যা হাতে পেয়ে অ্যারিওভিসটাসের পক্ষে রাগান্বিত হওয়াটা স্বাভাবিক। আর পরপরই তাদের একের প্রতি অন্যের হুমকি দেয়া শুরু হয়ে গেল। সিজার উত্তরদিকে বাহিনী নিয়ে রওনা দিলেন এবং আধুনিক বিসানকনের কাছে লড়াই আরম্ভ হলাে, অটানের থেকে স্থানটি ছিল একশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে, অ্যারিওভিসটাসকে পরাজিত করে তাকে রাইন পর্যন্ত ঠেলে সরাতে সক্ষম হলেন। সিজার তখন রক্ষকের ভূমিকা পালন করলেন। এবং তখন থেকেই মধ্য গাউলের জাতিগুলাের অভিভাবকের মতাে কাজ করা শুরু করলেন। সিজার নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। গ্রীস্মকালের প্রচেষ্টা এবং বিজয়ের পরে শীতকাল এলে তিনি সিসালপাইন গাউলে তিনি বসবাস শুরু করেন। আসলে গ্যালিক যুদ্ধ যতদিন চরছিল, ততদিন ধরে প্রতি শীতে তিনি একই কাজ করতেন। এটা করে তিনি রােমের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করলেন। গাউল থেকে বছরের বিশেষ একটা সময়ে দূরে থাকার ফলে গাউলকে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। গ্রীস্মকালে সিজারের বিজয় যাই হােক (এবং তার সেনাপ্রধান হিসেবে থাকাটাও যতই সফলতার হােক না কেন) শীতকাল এরেই অদম্য গাউল জাতি কোথাও না কোথাও বিদ্রোহ জাগিয়ে তুলত, যখন সিজার সেখানে অনুপস্থিত থাকতেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ সালে সিজার উত্তর গাউলে যুদ্ধ করলেন এবং জবরদস্তি করে প্রায় পুরাে এলাকাটা দখল করে নিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৬ সালে যে জাতিটি এখন ব্রিটানি বলে পরিচিত, গাউলের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে তারা ফুসে উঠেছিল। সিজার তাদের উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের জাতির সকলকে ক্রীতদাস পেশার জন্য বিক্রি করে দেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫ সালে রাইনের অপর তীর থেকে জার্মান আরেকটি জাতি অনুপ্রবেশ করল। সিজার তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন এবং এখন যে অঞ্চলটি বেলজিয়াম, সেখানে তাদের সঙ্গে একটি আলােচনা সভায় বসলেন। তিনি তখন জার্মান জাতির সেই বাহিনীকে অতর্কিতে হামলা করলেন। বাহিনীটির ধারণা ছিল যে তাদের সেনাপ্রধান যেহেতু সিজারের সঙ্গে সভায় ব্যস্ত, তাই তারা নিরাপদে বিশ্রাম নিতে পারে। জার্মান সেনাবাহিনীদেরকে ধুয়েমুছে সাফ করলে সিজার রাইনের উপরে একটি সেতু নির্মান করান এবং তার বাহিনীসহ জার্মানে অনুপ্রবেশ করেন। অঞ্চলটি দখল করার কোনাে ইচ্ছে তার ছিল না। তিনি কেবল রােমান ক্ষমতার কিছুটা প্রদর্শনী দেখাতে চেয়েছিলেন যেন জার্মান জাতি নীরব থাকে।

সিজারের ব্রিটেইন গমন ও গাউলদের বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করে গাউলকে রোমান প্রদেশ বানানো : তারপর সিজার আগের চেয়েও ভয়ানক পদক্ষেপ নিলেন। তিনি উত্তর গাউলে ব্রিটেন দ্বীপে গ্যালিক বিদ্রোহীদের কাছে পৌঁছে গেলেন (আর তখনই প্রথম ওই দ্বীপটির নাম ইতিহাসে স্থান করে নিল)। সিজারের মনে হলাে ওইদিকে একটি ক্ষমতার প্রদর্শনী না করলেই নয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫ সালে তিনি চ্যানেলের চার দিকে এক ঝটিকা সফর করে এলেন যাকে এখন বলা হয় কেন্ট, যে স্থানটি ব্রিটেনের দক্ষিণ পশ্চিম দিকের সবচেয়ে উপরের দিকে। সেখানে তখনাে কিছু অরাজকতা চলছিল এবং রােমানরা সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। পরের বছর (গাউলে নিজের অবস্থান আরাে পাঁচ বছরের জন্য পাকাপােক্ত করার পর) সিজার আরাে ভয়াবহ একটি উদ্দেশ্যের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। তার বাহিনী আবারাে ব্রিটেনে অবস্থান নিল। এবং সেখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে লড়াই শুরু করলেন ক্যাসিভেনাসের অধীনে। সিজার পাঁচটি লিজন বাহিনী নিয়ে দূরে এক দ্বীপে অবস্থান করছিলেন, তারপর টেমস নদী পার হয়ে নদী থেকে বিশ মাইল দূরে ক্যাসিভেনাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে হারিয়ে দেন। ক্যাসিভেনাস তখন বার্ষিক চাঁদা দেয়ার জন্য সম্মত হন আর সিজার গাউলে ফিরে আসেন। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেনে অভিযান চালিয়ে তেমন কোনাে লাভ হয়নি, একমাত্র যা হয়েছে, তা হলাে উত্তরের শেষ মাথায় নাটকীয় রােমান ক্ষমতার প্রদর্শন। ক্যাসিভেনাস তার প্রতিজ্ঞা করা চাঁদা কখনােই পরিশোধ করেনি আর সেই অঞ্চলে পরের এক শতাব্দী ব্যাপী কোনাে রােমান সৈন্যকেও দেখা যায়নি। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩ সালে সিজার রাইনের পাশে আবার উপস্থিত হয়েছিলেন, আর তখন খ্রিস্টপূর্ব ৫২ সালে মধ্য গাউলে যে জাতি বসবাস করত, তারা রােমান আইন পুনরায় অমান্য করার চেষ্টা করল। সিজারের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ ঘােষণা করল, সেরে বিদ্রোহ করল ভার্সিনজেটোরিক্সের নেতৃত্বে। সিসালপাইন গাউলে সিজার হাতেনাতে ধরা পড়লেন কিন্তু দ্রুত ভার্সিনজেটোরিক্সের সেনাবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে নিজের বাহিনীর দিকে ধাবিত হলেন। তারপর বেশ কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে সিজার শেষ এই বিদ্রোহটিরও সমাপ্তি ঘােষণা করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫০ অব্দে সম্পূর্ণ গাউল শান্ত হয়ে গেল। সিজার গাউলকে একটি রােমান প্রদেশ হিসেবে ঘােষণা দিয়ে দিলেন। আর তখন থেকে তার পরের পাঁচশ বছর ধরে স্থানটি রােমান রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে গণ্য হয়েছিল। সিজার শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে গৌরব করার মতাে কিছু করতে পেরেছিলেন যা রােম তার নাটকীয় উত্থানের জন্য ব্যবহার করতে পারে। তারা যেন সত্যিই তা করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য সিজার ইতিহাসগুলাে বই আকারে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। গ্যালিক যুদ্ধ বিষয়ে মন্তব্য নামের বইটিতে চমৎকার গদ্যে ঘটনাগুলাে বর্ণনা করা আছে। তিনি নিজের সম্পর্কে তৃতীয় পুরুষে বর্ণনা করেছেন সেই গদ্যে এবং অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নিরপেক্ষ থেকেছেন। কিন্তু বইটি যেই পড়ুক না কেন সিজারের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তার পরিচয় না ঘটেই যায় না, এবং সত্যিকার অর্থে সিজারের লেখার উদ্দেশ্য ছিল এটাই। 

ক্র্যাসাসের পার্থিয়া অভিযান ও ব্যর্থতা

রোমে রক্ষণশীলদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্লডিয়াসের মৃত্যু ও পম্পেইকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা :  সিজার গাউলে যে আট বছর কাটিয়েছিলেন সেই আট বছর রােমও ছিল উত্তাল। সিজার যখনই গাউলের উদ্দেশ্যে রােম ত্যাগ করেন, সিনেটে রক্ষণশীলরা তাদের অবস্থান পাকাপােক্ত করার চেষ্টা শুরু করেন। কাটো সাইপ্রাসের গভর্নর পদে ফিরে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন বিপুল অর্থের ভাণ্ডার যা তিনি আইনসম্মতভাবে সংগ্রহ করেছিলেন। অর্থগুলাে তিনি নগরের কোষাগারে জমা করেন (তিনিই ছিলেন একমাত্র রােমান যিনি সংগৃহীত অর্থ থেকে এতটুকু না সরিয়ে কোষাগারে জমা করবেন, রােমের অধিবাসীদের এটা জানাই ছিল)। কাটো তখন তিন ব্যক্তির শাসনের নিয়মের বিরােধিতা শুরু করলেন এবং তিনি বিশেষভাবে বিরােধিতা করলেন সিজারের। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫ সালে সিজার যখন জার্মান নেতাদের বন্দি করেছিলেন এবং জার্মান বাহিনীকে ধ্বংস করেছিলেন তখন রােমে খবরটি আসতেই কাটো সিজারের কার্যকলাপের প্রকাশ্য এবং লিখিত নিন্দাবাদ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি আরাে বলেছিলেন যে সিজারকে জার্মান বাহিনীর হাতে অপরাধী হিসেবে তুলে না দেয়া পর্যন্ত রােমের হারানাে সম্মান কিছুতেই ফিরে আসবে না। কিন্তু সে যাই হােক, শক্রর প্রতি অবিশ্বস্ততাকে রােমের লােকেরা চিরকাল না দেখার ভান করেই ছিল, তখনও তাই থেকেছে। এরপরে ক্লডিয়াস ওদিকে সিসেরােকে চরম বিরক্ত করা শুরু করলেন। বিদেশ থেকে আসা সিসেরাের অনুনয় করে লেখা চিঠিগুলাে তার অনুভূতি জাগানাের মতােই ছিল, অথচ তার পরেও ক্লডিয়াস সিসেরাের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা করতে থাকেন। সিনেট সদস্যদের মধ্যে সিসেরাের বন্ধুরা নানাভাবে তার রােমে ফেরার নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত পম্পেইয়ের (যিনি বরাবর সিসেরাের বন্ধু ছিলেন) সাহায্যে সেটা সম্ভব হয়েছিল, এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ সালে সিসেরাে রােমে ফিরে আসেন। এরপরে সিনেট ক্লডিয়াসের ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করার চেষ্টায় লেগে পড়েন। দরিদ্রদের মধ্যে বিনা পয়সায় শষ্য বিতরণের মাধ্যমে ক্লডিয়াস ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন, কিন্তু তার দলের লােকেরা গ্ল্যাডিয়েটর হবার জন্য আরাে বেশি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। সিনেট যেন আগুনের সঙ্গে আগুন দিয়ে খেলা শুরু করেছিল। ট্রিবিউনের একজন সদস্য, যিনি সিসেরাের কার্যকলাপকে সবচেয়ে বেশি সামনে আনার চেষ্টা করতেন, তিনি হলেন টাইটাস অ্যানিয়াস মাইলাে প্যাপিনিয়ানাস, যিনি স্যুলার কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। মাইলাে নিজস্ব একটি গ্ল্যাডিয়েটরের দল গঠন করেন, আর ঠিক তখন থেকেই রােমে প্রতিযােগী দুই দলের মধ্যে ক্রমাগত মারামারি চলতে থাকে। সাধারণ জনগণ এই বিভীষিকার মধ্যে অনিরাপদ হয়ে ওঠে (আজকের দিনে আধুনিক সন্ত্রাসীদের হাতে মানুষ যেমন জিম্মি থাকে), এবং গ্ল্যাডিয়েটরের দল যেন রােমের দখল নিয়ে নেয়। শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ সালে দুটো দল আকস্মিক মুখােমুখী পড়ে যায়, সঙ্গে তাদের দুই নেতা মাইলাে এবং ক্লডিয়াসও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাদের মধ্যে যে লড়াই শুরু হয় তাতে ক্লডিয়াস মৃত্যুবরণ করেন। এটা ছিল রােমের চলমান অরাজকতার একটা বড়াে উদাহরণ। ক্লডিয়াসের অনুসারীরা হুঙ্কার ছাড়তে থাকে। মাইলােকে বিচারের আওতায় আনা হয় এবং অবধারিতভাবে তার জন্য ওকালতি করেন সিসেরাে। উত্তাল এবং উদভ্রান্ত জনগণের হুঙ্কারে আর সৈন্যদের লম্বা সারি থেকে বেসে আসা ব্যাপক ধ্বনি শুনতে শুনতে সিসেরাের কথা হারিয়ে যায়। তিনি দুর্বলভাবে কিছু কথা বলতে সমর্থ হন কেবল। বিচারে মাইলাের সাজা হয় এবং তাকে বন্দি করা হয়। যদিও ক্লডিয়াস মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তবু অবস্থাটা রক্ষণশীলদের জন্যই সুবিধার ছিল। তার বহুদিন আগে থেকেই তারা বুঝতে পারছিল যে এশিয়া মাইনর থেকে পম্পেইয়ের ফিরে আসাকে হেয় করে তারা অন্যায় করেছিল। তারা এটাও বুঝতে পেরেছিল যে পম্পেইকে তারা যে চোখে দেখছে তা অনুচিত, কারণ আর যাই হােক, পম্পেই এমন মানুষ নন যিনি জবরদস্তি রােমের দখল নেবেন। আবার তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে তাকে যদি সিনেটে রেখে দেয়া হয় তবে রক্ষণশীলরা তাকে সিজারের বিপক্ষে ব্যবহার করবে, আর ততদিনে সিনেটররা ঠিকই বুঝেছিলেন যে সিজারই একমাত্র মানুষ যিনি রােম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। 

পম্পেই এর সিজারের বিরুদ্ধে যাওয়া : সিজার জানতেন যে তার সাফল্য পম্পেইয়ের জন্য হিংসা উদ্রেগকারী বিষয় হবে। এমনকি ক্র্যাসাসের জন্যেও, তাই তখন তাকে চেষ্টা করতে হবে অন্যভাবে তাদেরকে শান্ত করতে। সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৫৬ সালে লুকা নামক স্থানে পম্পেই এবং ক্র্যাসাসের সঙ্গে মিলিত হন, স্থানটি আধুনি লুক্কা, সিসালপাইন গাউলের দক্ষিণ সীমানায় অবস্থিত। বিষয়টি মােটামুটি পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল যে পম্পেই এবং ক্র্যাসাস খ্রিস্টপূর্ব ৫৫ সালে কনসল হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। আর তাছাড়া এর মধ্যে পম্পেই এবং ক্র্যাসাস চাইলে নিজেদের জন্য কিছু সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতাও তার মধ্যে অর্জন করতে পারবেন। সিজার রােমে অন্তত আরাে পাঁচ বছর রাজত্ব করবেন, আর ওদিকে পম্পেই পেতে পারেন স্পেনের দায়িত্ব এবং ক্র্যাসাস সিরিয়ার। এই ব্যবস্থা ক্র্যাসাসের জন্য ভালাে ছিল। পম্পেই যেখানে এশিয়া মাইনরে এবং সিজার গাউলে তাদের সেনাবাহিনীতে থাকার এবং গৌরব অর্জনের সুযােগ পেয়েছিলেন, যেখানে ক্র্যাসাস কেবলমাত্র ক্রীতদাসদের যুদ্ধে কিছু সফলতার মুখ দেখেছিলেন। ক্র্যাসাস তখন বুঝলেন যে তিনি কী করতে পারেন তা দেখানাের এটাই সুযােগ। তাছাড়া, পূর্বাঞ্চল এমন জায়গা যেখানে তিনি সাংঘাতিকভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করতে পারেন। ক্র্যাসাসের সেখানে যাওয়ার চুক্তিতে এমন কোনাে উল্লেখ ছিল না যে তিনি সেখানে গিয়ে কোনাে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবেন কিন্তু এমনটা জানাই ছিল যে সেখানকার সেনাবাহিনীর উন্নতিকল্পেই তাকে সেখানে যেতে হচ্ছিল। পম্পেইয়ের কথা ভাবলে, নতুন চুক্তি তাকে যথেষ্ট স্বস্তি দিয়েছিল। তিনি অবশ্য নিজে স্পেনে যাননি, তার বদলে তিনি সেখানে উচ্চপদস্ত কিছু সেনা সদস্য পাঠিয়ে দেন। তিনি রােমেই অবস্থান করেন, তিনি সেখানে থেকে শাসনকাজের মধ্যমণি হয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করেছিলেন। ক্র্যাসাস বা সিজার, দুজনের মধ্যে কারাে কিছু হয়ে গেলে, পম্পেই কল্পনা করতেন, সেই শূন্যস্থানে ঝাপিয়ে পড়ার সুযােগ তার হাতে ছিল। রােমে তিনি যখন একা, তিন শাসকের মধ্যে বাকি দুজন যখন অনুপস্থিত, কূটবুদ্ধিসম্পন্ন রক্ষণশীলদের কাছে তিনি ছিলেন পুতুল। নতুন চুক্তি এবং সিজারের কন্যার জন্য তার ভালােবাসা, দুটো মিলে পম্পেইকে কিছু কাল সিজারের অনুগত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত খ্রিস্টপূর্ব ৫৪ সালে তিরিশ বছর বয়সে জুলিয়ার মৃত্যু হয়, যার ফলে তিন ব্যক্তির ত্রয়ী শাসনব্যবস্থায় দুজনের মধ্যে সম্পর্কে চির ধরে। 

পার্থিয়ার উত্থান ও রোমের আশঙ্কা হয়ে ওঠা : আর ঠিক এইসময়ে পূর্বাঞ্চল থেকে এক নাটকীয় সংবাদ আসে। ক্র্যাসাস যথােপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে পূর্ব দিকে রওনা দিয়েছেন। সিনেট অবশ্য নব্যবস্থার তিন জনের মধ্যে তৃতীয় জনকেও সেনাপ্রধান হিসেবে দেখতে চায়নি। আর তাছাড়া রােমানদের নানারকমের কুসংস্কাকারও ছিল যে কোনাে উসকানি ছাড়াই এভাবে যুদ্ধ ঘােষণা করে রওনা দেয়া অনুচিত। ক্ষমতার পুরাে সময়টা জুড়েই রােমানরা যুদ্ধ লাগানাের বিভিন্ন অজুহাতের অপেক্ষায় বসে থাকত, কখনাে কখনাে সেই অজুহাতটা হতাে নেহায়েত নাটকীয়, কিন্তু সেবারে ক্র্যাসাস তেমন বলবার মতাে কোনাে অজুহাতও তৈরি করেননি। তখন ক্র্যাসাস যেই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ করলেন, রােমানরা এশিয়ার সেই সমস্ত অংশ, যেখানে গ্রিক ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রচলন ছিল, অর্থাৎ এশিয়া মাইনর এবং সিরিয়া, সেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। সেই ভূমি ছাড়িয়ে পূর্বদিকে আরাে সামনের দিকে এগােলে যে বিস্তৃত এলাকা পাওয়া যায় তা একসময় পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং মহামতি আলেক্সান্ডার তা দখল করেছিলেন। আলেক্সাজান্ডারের মৃত্যুর দেড় শতাব্দী পরেও ওই অঞ্চলগুলাে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়া সেলুসিড সাম্রাজ্যের দখলেই ছিল, কিন্তু গ্রিক সংস্কৃতি কখনােই সেখান থেকে পুরােপুরি উঠে যেতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের আদি অধিবাসী কিছু জাতি সেলুসিড সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করল এবং নিজেরাই একটি রাজ্যের উদ্ভব ঘটাল যে অঞ্চলটিকে পরে আধুনিক ইরান হিসেবে পাওয়া গেছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০ সালের মধ্যে তারা মেসােপটেমিয়া (আধুনিক ইরাক) দখল করে ফেলল এবং তাকে সিরিয়ার সঙ্গে এক করে শাসনকাজ চালাতে লাগল। পূর্বদিকের রাজ্যের নাম ছিল পার্থিয়া, এই শব্দটি এসেছে “পারস্য” শব্দটি থেকে। রাজ্যটি খ্রিস্টপূর্ব ১৩০ সালে পূর্বদিকে আরাে বর্ধিত করা হলাে। বাড়তে বাড়তে আফগানিস্তান সেই রাজের মধ্যে এসে পড়ল এবং ভারতের সীমা ছুয়ে ফেলল। পশ্চিম দিকে পন্টাসের মিথ্রাডেইটিস এবং আর্মেনিয়ার টিগ্রানিস পারস্যকে আরাে বেশি বর্ধিত হতে বাধাপ্রদান করেন। কিন্তু রােম যখন সেই সমস্ত একনায়কদের পরাজিত করল তখন পশ্চিম দিকের দেয়াল বাস্তবিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ল। পার্থিয়া তখন রােমের বিরুদ্ধে বড়াে একটি শক্তি ছিল যা নিয়ে রােম আশঙ্কা করতে পারে। আর তখন, খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ সালে পারস্যের একনায়ক দ্বিতীয় ফ্রাতেস (Phraates) টিগ্রানিজকে পরাজিত করলেন, যিনি কেবল রােমান আনুগত্যে যােগদান করেছিলেন।

ক্র্যাসাসের পার্থিয়া অভিযান : ফ্রাতেস টিগ্রানিজকে যখন পরাজিত করেছিলেন তখন সিরিয়ায় অবস্থান করছিলেন পম্পেই। তিনি কিছু কূটনীতিককে পাঠিয়েছিলেন বিষয়টি সমাধান করে আর্মেনিয়ার রাজাকে বাঁচাতে। ফ্রাইতিজের মৃত্যুর পরে তার দুই পুত্র সিংহাসনের জন্য লড়াই শুরু করে দিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অরােডিজ, একটি যুদ্ধে জয়লাভ করলেন তিনি এবং ক্র্যাসাস সেখানে পৌঁছতেই অরােডিজ নিজেকে পার্থিয়ার রাজা ঘােষণা করলেন। ক্র্যাসাস তখন পারস্যের গৃহযুদ্ধ থেকে কিছু সুবিধা আদায়ের কথা ভাবছিলেন, সেই যুদ্ধের সূত্র ধরে জায়গাটি দখল করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সেখানে তার কার্যকলাপ থেকে এই লক্ষণও দেখা গিয়েছিল যে তিনি পারস্যের সীমা পেরিয়ে ভারত দখল করার কথাও ভাবছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪ সালে ক্র্যাসাস মেসােপটেমিয়ায় অনুপ্রবেশ করেন এবং সামান্য কিছু বাধার সম্মুখীন হন। তিনি সেখানকার প্রধান কিছু অঞ্চলে তার সেনাবাহিনীর দলকে বসিয়ে রেখে আসেন এবং পরের বছর মূল আক্রমণ শুরু করার পরিকল্পনা করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩ সালের বসন্তকালে তিনি সাতটি লিজন বাহিনী সহ ইউফ্রাতিস নদী পরিয়ে যান, যাত্রাপথে ভূমধ্যসাগরীয় উপকুলের এক শত মাইলের উপরে এলাকা দল করতে করতে এগিয়ে যান তারা। তার পরিকল্পনা ছিল নদীর স্রোত ধরে এগােতে এগােতে তিনি টেসিফোন পর্যন্ত যাবেন, যে নগরটি তখন পরস্যের রাজধানী। যাই হােক, ক্র্যাসাসকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন একজন আরবীয় নাবিক, যিনি গােপনে পারস্য সাম্রাজ্যের বেতনভুক্ত ছিলেন। ক্র্যাসাস নিজেকে পুরােপুরি সেই আরবীয় লােকটির হাতে তুলে দিয়েছিলেন যেন তারা পূর্বদিকে আরাে এগিয়ে যেতে পারেন। তারা নদী থেকে দূরে এবং মরুভমিক দিকে এগিয়ে গেলেন। পারস্যের সেনাবাহিনী কারি (Carrhae) নামক স্থানে অপেক্ষমান ছিল যে নগরটার প্রাচীন নাম ছিল হারান, বাইবেলের বিখ্যাত আব্রাহাম কালডিস থেকে ক্যানানে চলে যাবার আগে যে স্থানে কিছুকাল বসবাস করেছিলেন। 

পার্থিয়ার সাথে যুদ্ধে ক্র্যাসাসের পরাজয় ও মৃত্যু : পারস্যের সেনাবাহিনী সংগঠন হিসেবে শক্তিশালী ছিল, যারা তির ধনুকের ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই পারদর্শী ছিল। তারা তিরের সাহায্যে ত্রাস সৃষ্টি করে এগিয়ে যেতে থাকল এবং চারদিকের যতটা সম্ভব ধ্বংস করতে করতে এগােতে লাগল। উলটোদিকে প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনীর যত যােদ্ধা কিংবা অশ্বারােহী সামনে পড়ল, তারা তিরের সাহায্যে তাকে কাবু করে ফেলল। আকস্মিক ধেয়ে আসা তিরের প্রকোপে প্রতিপক্ষের যােদ্ধারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। তাদের হামলার ধরনের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে “পারস্যের তির” কথাটির ব্যাবহার প্রচলিত হয়েছিল, যার অর্থ অব্যর্থ কথা বা কাজ। ক্র্যাসাস ওই পরিস্থিতিতে কী করবেন বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্র্যাসাস তখন আর ভেবেচিন্তে সময় অপচয় করেননি। তিনি বাহিনী নিয়ে তাদের সামনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন যেন আবার সেই স্পার্টাকাসের বাহিনীর বিপরীতে যুদ্ধ করছেন তিনি। ক্র্যাসাসের পুত্র রােমান সেনাবাহিনীকে এমন ক্ষিপ্রতায় ধ্বাবিত করছিলেন যেন তারা পারস্যের সেনাবাহিনীকে ধুলিস্যাৎ করে দেবে। কিন্তু তিনি নিজেই পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। রােমান সেনাবাহিনীর মাঝখান দিয়ে পারস্যের একটি বাহিনী এমনভাবে এসে পড়ল যেন মধ্যখানে দাঁড়িয়ে তাদের ভেংচি কাটছে। তাদের দেখে মনে হলাে তারা যুদ্ধ করতে আসেনি। সবার শেষে তাদের একটি অস্ত্র তারা তাক করল ক্র্যাসাসের পুত্রের মাথা বরাবর। এই দৃশ্য দেখে সেনাবাহিনীর যােদ্ধারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ক্র্যাসাস তখন রােমান বাহিনীর সাহস বাড়ানাের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললেন, “কেউ হতাশ হয়াে না যেন, এটা আমার নিজের ক্ষতি, তােমাদের নয়!” কিন্তু এটা সেনাবাহিনীর ক্ষতি ছিল বটে। প্রতিটি সেনাসদস্যকেও পারস্যের বাহিনী টুকরাে টুকরাে করে কেটে ফেলল। আর বেগতিক অবস্থা দেখে ক্র্যাসাস যখন তাদের সঙ্গে চুক্তিতে আসতে চাইলেন, তখন পারস্যের যােদ্ধারা মিলে তাকেও হত্যা করল। আর তারপরে পারস্যের বাহিনী ফিরে গেল সিরিয়ায়। এই নিয়ে একটি কাহিনী প্রচলিত ছিল। পারস্যের বাহিনী ক্র্যাসাসের খণ্ডিত মস্তক নিয়ে পারস্যের রাজার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছিল, যিনি খণ্ডিত মস্তকের মুখের মধ্যে গলিত সােনা ঢেলে দিতে আদেশ করেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, “এই যে এইখানে ঢালাে,” বলেছিলেন, “জীবনভর তুমি সােনার পিছনে ছুটেছ, এখন যত খুশি সােনা খাও” (এই গল্প রােমান ঐতিহাসিকরা হয়তো লােভের বিপরীত আদর্শটি প্রচার করার উদ্দেশ্যেই রচনা করেছিলেন)। রােমানরা সেই সময়ে এই বিষয়টি জানত না। কিন্তু কারিতে ক্র্যাসাসের দুঃখজনক মৃত্যু তাদের শাসনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি মােড় হিসেবে কাজ করেছে। তখন পর্যন্ত পিরাস, হ্যানিবল এবং মিথ্রাডেইটিসের মতাে বড়াে বীরদের হাতে রােমান বাহিনীর পরাজয়টিও তাদের কাছে যথেষ্ট গৌরবের ছিল। রােমান শত্রুরা কোনাে না কোনােভাবে পরাভূত হয়েই যেত, এবং শেষে তাদের নিজস্ব ভূমি এপিরাস, কার্থেজ বা পন্টাস- সবই রােমের গর্ভে ঢুকে যেত। কিন্তু পার্থিয়ার ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। পার্থিয়ার সেনাবাহিনীকে রােমানরা বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করেছে কিন্তু তাদের ভূমি কখনাে দখল করতে পারেনি। পূর্বদিকের শেষ মাথায় পার্থিয়াই ছিল একটি স্থায়ী সীমানা, যার পরে রােমান ভূমি বর্ধিত হতে বাধা প্রাপ্ত হয়েছিল চিরকালের তরে। আর তাই এই বিষয়টি চিন্তার উদ্রেগ করে যে কারির যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ৫৩), যা ৭০০ এ. ইউ. সি. তে সংঘঠিত হয়, সুতরাং ওই যুদ্ধ রােমান রাজ্যের পত্তনের ঠিক সাত শতাব্দী পরের ঘটনা। 

সিজারের কাল

দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ ও সিজারের কাছে পম্পেই এর হার

পম্পেই এর ক্ষমতায় আরোহন : খ্রিস্টপূর্ব ৫৩ সালে ক্র্যাসাস এবং তার বাহিনীর ধ্বংস পম্পেই এবং সিজারকে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলল। সিজার অবশ্য তখনাে গাউলে অবস্থান করছিলেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক গ্যালিক উত্থান দেখার অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন তখন। অন্যদিকে, পম্পেই তখন ছিলেন রােমে, তিনি সেখান থেকে সর্বোচ্চ যা আদায় করা সম্ভব, তাই করছিলেন। রােমের পথেঘাটে অরাজকতা মারাত্মকভাবে বেড়ে চলছিল তখন, তিনি তা থামানাের কোনাে চেষ্টা করেননি। তিনি হযত অরাজকতা বাড়িয়ে দিয়ে এই পরিস্থিতি দেখার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন যে পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে অপরিহার্য একনায়ক হিসেবে ঘােষণা করতে পারেন। ক্লডিয়াসকে দল বেঁধে হত্যা করার পর থেকেই সত্যিকার অর্থে ওইরকমের একটা অরাজকতাময় পরিবেশ রােমের আকাশে ভর করে। সেই অরাজকতার পথ ধরে খ্রিস্টপূর্ব ৫২ সালে পম্পেই সিনেটে নিজেকে একক কনসল হিসেবে ঘােষণা করেন। পম্পেইয়ের অধীনে সিনেট নতুন করে তার আইনকানুন বহাল করতে ব্যস্ত হলাে, তাদের এই পদক্ষেপ সিজারের বিরুদ্ধে একটি রক্ষাকবচ হিসেবেও কাজ করবে বলে তারা ধারণা করল। পম্পেই তখন সহজেই বিভিন্ন নতুন পদক্ষেপ নিতে পারতেন। তিনি নতুন আরেকটি বিবাহ করলেন, সিনেটের রক্ষণশীল দলের প্রধানদের মধ্যে একজনের কন্যাকে বিবাহ করলেন তিনি। তিনি তার শ্বশুরকে নিজেরই সতীর্থ হিসেবে কনসল হিসেবে নিয়ােগ দিলেন। এই পদক্ষেপটি সিনেটে তার অবস্থান এবং ধারাটি নিশ্চিত করল এবং সিজারের সঙ্গে বিরােধিতার ব্যাপারে সংশয় দূর করল। এর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল সিজারের নিরাপত্তা কমানাে। এরপর সিজারকে যদি সিনেট থেকে সরানাে যায় তবে তাকে নানান বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে (যে কোনাে রােমান সেনাপতি বা গভর্নরকে তার কৃতকর্মের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যবস্থা থাকত। আর যদি কাউকে অপরাধী হিসেবে ধরা হয়, তবে তাে বটেই)।

সিজারের বিরুদ্ধে পম্পেই : সিজার জানতেন সামনে কী হতে যাচ্ছে, এবং তার চারপাশের বিষয়গুলােকে সেভাবেই সাজিয়ে নিয়েছিলেন, যেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ পেরিয়ে গেলেও তিনি তার প্রদেশ নিজের মুঠোর ভেতরে রাখতে পারেন। আর তাই তখন তাড়াহুড়াে করে নিজেকে কনসল ঘােষণা দেন। কিন্তু তার পরপরই তাকে কার্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়। পম্পেই তখন পারস্যের ধ্বংসকে সিজারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার ফন্দি আটলেন। পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধটা ছিল তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুতর ব্যাপার। সিনেট ঘােষণা দিয়েছিল, খ্রিস্টপূর্ব ৫০ সালে প্রত্যেক সেনাপ্রধানকে একটি করে লিজন বাহিনী যুদ্ধে পাঠাতে। তখন পম্পেই সিজারের কাছে সেই লিজন বাহিনীটি ফেরত চেয়েছিলেন যা তিনি তখন দিয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশত গাউল তখন দখল হয়ে ছিল এবং সিজার দুটো লিজনে ভাগ করতে সক্ষম হয়েছিল সেনাবাহিনীকে। নিজের নাম নিজেই ভেঙে তিনি তা করলেন। সিনেট এটাকে তার দুর্বলতা হিসেবে ধরে নিল। আর পম্পেই সিনেটকে নিশ্চিন্ত করল যে সিজারকে যে সেনাবাহিনী দেয়া হছে তা তখন স্পেনে অবস্থানরত, তাই সিজারের পক্ষ থেকে হামলার কোনাে সম্ভাবনা নেই। পম্পেই বললেন “ আমাকে মাটিতে পা ঠুকতেও হবে না, তার আগেই লিজন বাহিনী জেগে উঠবে আমার সমর্থনের জন্য।” রক্ষণশীলরা তখন শেষ পদক্ষেপ নেবার জন্য উদগ্রীব। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ সালের ৭ই জানুয়ারি সিনেট একটি আদেশ জারি করল। যেখানে বলা হলাে যে সিজার যদি নিজের বাহিনী নিষ্ক্রিয় না করে রােমে ঢােকার চেষ্টা করে তবে তাকে আইনগত বাধা দেয়া হবে। তাকে আসতে হবে একজন সাধারণ নাগরিকের মতাে হয়ে (একসময় পম্পেই যেমন এসেছিলেন)। অবশ্য পম্পেই যখন তার সেনাবাহিনী পরিত্যাগ করেন, তাকে বন্দি করার বা হাতে পেলে মৃত্যুদণ্ড দেবার আশায় কোনাে শত্রু বাহিনী রােমে তার অপেক্ষায় বসে ছিল না। সিজার ভালােভাবেই জানতেন যে তিনি তার সেনাবাহিনীকে পরিত্যাগ করতে পারবেন না। কিন্তু তার পরেও, অন্য কোনাে উপায় ছিল কি? সৌভাগ্যবশত রােমে সিজারের শত্রু যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিপুল পরিমাণ অনুসারীর দল।

মার্কাস এন্টোনিয়াস ও সিজারের নেতৃত্বে দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের সূচনা : সিজারের সেই বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন মার্কাস অ্যান্টোনিয়াস। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় মার্ক আন্টোনি। খ্রিস্টপূর্ব ৮৩ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অনেক অল্প বয়সেই তিনি তার পিতাকে হারান। একজন মানুষ তাকে সন্তান হিসেবে দত্তক নেন যিনি পরে ক্যাটিলাইনের ষড়যন্ত্রের সহচর হিসেবে সিসেরাের হাতে মৃত্যুদণ্ডের শিকার হন। এই কারণে মার্ক অ্যান্টোনির সিসেরাের প্রতি ছিল দারুণ ঘৃণা। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪ সালে গাউলে তিনি সিজারের বাহিনীতে যােগ দেন (সিজারের সঙ্গে তার মায়ের সূত্র ধরে আত্মীয়তা ছিল) এবং সিজারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচরদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন। খ্রিস্টপূর্ব ১ সালে তিনি রােমে ফিরে আসেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ সালে তিনি ট্রিবিউনে যােগ দেন। ট্রিবিউন হিসেবে মার্ক অ্যান্টোনি সিজারকে সাহায্য করার জন্য সবচেয়ে জরুরি সিদ্ধান্তগুলাে নিতে থাকলেন। তিনি এবং ট্রিবিউনের অন্তর্গত তার অন্য সাথিরা ঘােষণা দিলেন যে রােমে বিপদ অনেক বেড়ে গেছে এবং নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার কারণে তারা সিজারের সিসালপাইন গাউলের বাহিনীর কাছে চলে গেলেন। তারা সিজারের হাতে একটি মােক্ষম অজুহাত তুলে দিলেন। তারা সিনেটের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য ট্রিবিউনের মাধ্যমে সিজারের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সিজার অবশ্যই ট্রিবিউনকে বাঁচাতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য ছিল, কারণ ট্রিবিউনই ছিল সাধারণ জনগণের একমাত্র সহায়। সিনেটের কাছে তার পদক্ষেপ বিদ্রোহের মতাে লাগলেও তিনি জানতেন জনগণ তাকে স্বাগত জানাবে। জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখে সিজার সিদ্ধান্ত নিলেন যে নদী সিসালপাইন গাউলকে ইতালি থেকে পৃথক করেছে তিনি সেই রুবিকন নদী পার হয়ে যাবেন এবং তারপরে তিনি দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের সূচনা করবেন (প্রথমটি ঘটেছিল মারিয়াস আর স্যুলার মধ্যে)। তখন থেকেই “রুবিকন পার হওয়া” কথাটি যে কোনাে কঠিন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ বােঝাতে ব্যবহৃত হয়।

সিজারের ইতালি দখল : সিজার যখন নদী পেরিয়ে গেলেন, মৃদুস্বরে বললেন, “মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী পরিণতি”- এখন একইরকমের। পরিস্থিতিতে এই কথাটি ব্যবহৃত হয়। নিজের লিজন বাহিনীর কাছে লাফিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পম্পেইয়ের কাছে সেটাই ছিল উপযুক্ত সময়। কিন্তু তিনি নিজেকে এবং সিনেটকেও যথেষ্ট বােকা বানিয়েছিলেন। ততদিনে পূর্বদিকের ভূমির দখলদার কিংবা রােমের প্রিয়জন হিসেবে পম্পেইয়ের নাম তখন আর উচ্চারিত হয় না। বহুদিন ধরেই তিনি আর নিজের সেই জায়গাটিতে ছিলেন না। রােমে তার বসবাসের প্রায় বারাে বছর হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। ওই সময়টাতে তিনি ক্রমাগত সিজারের মাধ্যমে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন এবং ক্লডিয়াসের জনপ্রিয়তার কারণে পম্পেইয়ের জনপ্রিয়তার সমস্যা হয়েছে। তাই পম্পেই তাদের দুজনের থেকে অনেক পিছনে পড়ে গিয়েছিল। সিজার যখন তার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লিজন নিয়ে গাউল থেকে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, পম্পেই তখন তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে তার আগে আগে রওনা দিয়ে দিলেন। তিনি এগােচ্ছিলেন কিন্তু সিজার তাকে ধাওয়া করছিলেন। পম্পেই ধরা পড়তে পড়তেও এক চুল দূরত্বে সিজারের চেয়ে আগে গ্রিসে প্রবেশ করতে সক্ষম হলেন। আর তার সঙ্গে রোমের অভিজাতরাও রোম ত্যাগ করল, যাদের মধ্যে অনেক সিনেটরই ছিল। রুবিকন নদী পার হবার তিন মাসের মধ্যেই ইতালির পুরােটাই সিজারের নিয়ন্ত্রণে চলে এল।

সিজারের কাছে পম্পেই এর পরাজয় : তখন তার জন্য জরুরি ছিল পম্পেইয়ের সেনাবাহিনীকে ইতালির বাইরে গিয়ে মােকাবেলা করা। তিনি দ্রুত স্পেনের দিকে রওনা দিলেন। প্রথমে তিনি গেলেন ইলার্দাতে, যেটিকে আধুনিক যুগে বলা হয় লেরিদা, সেখানে গিয়ে তিনি সিনেটের অধীনে থাকা লিজন বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হলেন। সেখানে গিয়ে পম্পেই সিজারের সঙ্গে একজন ব্যালে নৃত্যশিল্পীর মতাে ভারসাম্য রাখা না-রাখার খেলায় মত্ত হলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পম্পেই এর জলের সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন। দুই বাহিনীর মধ্যে কারােরই মাথায় আসছিল না যে রােমান কেন রােমানের বিরুদ্ধে লড়ছে? আর তারপরে একেবারে অল্প সময়ের মধ্যে সিজার যুদ্ধ লাগানাের চেয়ে ভালাে কিছু করলেন, তা হলাে, তিনি পম্পেই এর সঙ্গে মিটমাট করে নিজের বাহিনী দ্বিগুণ করে ফেললেন। তারপর দ্রুত বাড়ি ফিরে এলেন, ওদিকে গাউলের দক্ষিণ উপকূল অঞ্চল থেকে ম্যাসিলিয়ার আত্মসমর্পণকে সহজভাবে নিলেন। পশ্চিম ইউরােপ সব দিক দিয়ে ঝামেলামুক্ত করে ফিরলেন তিনি। আফ্রিকায় শাসনকাজ ভালাে মতাে চলছিল না। নুমিডিয়ার রাজা জুবার নেতৃত্বে পম্পেইয়ের বাহিনী সেখানে সিজারের প্রতিনিধি বাহিনীকে পরাজিত করেছিল (সিজার সেখানে নিজে উপস্থিত ছিলেন না)। কিন্তু আফ্রিকাকে তখন অপেক্ষা করতেই হতাে। সিজার নিজেই খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সালে নিজেকে কনসল ঘােষণা করেন এবং গ্রিসে, যেখানে পম্পেইয়ের বাহিনী বেশ শক্তিশালী, সেখানে গিয়ে পম্পেইয়ের বাহিনীর উপরে আঘাত করলেন এবং সেখানে পম্পেইকেও পাওয়া গেল। পম্পেই যে একটি বড়াে বাহিনী পরিচালনা করতে পারেন এবং তার যে একটি বিশাল নৌবহর আছে, এই বিষয়টি সিজার পুরােপুরি অবজ্ঞা করলেন। সিজার ইতালির পার্বত্য অঞ্চল ডিরাকিয়াম অতিক্রম করে গেলেন- পৌঁছে গেলেন ডুরিসে, যা আলবেনিয়ার প্রধান বন্দর। ডিরাকিয়াম ছিল পম্পেইয়ের অনুসারীদের তত্ত্বাবধানে এবং সিজার সেখানে অচলাবস্থার সৃষ্টি করলেন। সেখানে যে করেই হােক, তিনি একটি ভুল করে বসলেন। যে কোনাে ভাবেই হােক না কেন পম্পেইয়ের জাহাজ সেখানে পৌঁছানাের কথা এবং পৌঁছেও গেল, নগরের অধিবাসীদের মধ্যে সিজারের প্রতি আত্মসমর্পণের কোনাে লক্ষণ দেখা গেল না এবং সিজার দেখলেন যে তার বাহিনীকে গােড়া থেকে উৎখাত করে নগরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে পম্পেই সেখানে পৌঁছে সিজারের বাহিনীকে আরাে ভয়ানকভাবে আক্রমণ করলেন আর তাদের সামনে নিজেকে বিজয়ী হয়ে দেখাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না, তিনি সিজারের মতাে দ্রুত ভাবনাচিন্তা করতেন না। তিনি ছিলেন ধীরস্থির এবং সিজার ছিলেন ধোকা দেয়ার ওস্তাদ। তাই সিজার সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আরাে এগিয়ে গেলেন এবং গ্রিসে প্রবেশ করলেন। পম্পেই আবারাে একটা সুযােগ হারালেন। সিজার যখনই গ্রিসের মধ্যে উধাও হয়ে গেলেন, পম্পেই ইতালিতে নিজের প্রভাব বিস্তারের কাজে নেমে পড়তে পারতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পম্পেই তা না করে সিজারের সঙ্গে ব্যক্তিগত বােঝাপড়া করার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। পম্পেই সিজারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন এবং সরাসরি সিজারের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে পুরাে পৃথিবীকে দেখাতে চাইলেন যে তাদের দুজনের মধ্যে বড়াে সেনাপ্রধান কে। পম্পেই তাই কাটোকে ডিরাকিয়ামে কিছু সেনাসদস্যসহ ফেলে চলে গেলেন। সেনাবাহিনীর প্রধান অংশ সঙ্গে নিয়ে তিনি সিজারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সালে ২৯ শে জুন থেসালির ফারসেলস নগরে সিজারের সঙ্গে তার দেখা হলাে। পম্পেইয়ের সেনাবাহিনী সিজারের বাহিনীর চেয়ে তখনাে অনেক ভালাে ছিল। আর পম্পেই বিজয়ের ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিলেন। তিনি হয়তো সিজারকে আতসমর্পণ করতে বলে নিজেকে বিজয়ী ঘােষণা করতে পারতেন। কিন্তু বীর সেনাপতিরা কখনো তা করতে পারে না বলেই তার ধারণা ছিল, তিনি যুদ্ধ করে জয়ী হতে চেয়েছিলেন। পাম্পেই বেশি ভরসা রেখেছিলেন তার বাহিনীর উপরে। তার ক্যাভালরি বাহিনী মূলত রােমান অভিজাত শ্রেণি থেকে আগত সৈন্যে পরিপূর্ণ ছিল। পম্পেইয়ের বাহিনী সিজারের বাহিনীর শেষ প্রান্ত থেকে আক্রমণ শুরু করল। কিন্তু সিজারের বাহিনীকে তিনি নির্দেশ দিলেন তাদের হাতের বল্লমটা ছুঁড়ে না মারতে এবং কেবল প্রতিপক্ষের ঘােড়সওয়ারদের চোখে সােজাসুজি আঘাত করতে। তার কাছে মনে হয়েছিল যে অভিজাত শ্রেণির সৈন্যরা মরতে রাজি থাকলেও অঙ্গহানী ঘটতে দেবে না। আর এই অনুমাণে তিনি সত্যিই সঠিক প্রমাণিত হয়েছিলেন। চোখে গুতাে খাওয়ার ভয়ে পুরাে সেনাবাহিনীই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। তার চেয়েও বড়াে কথা, সিজারের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কারণে সহজেই প্রতিপক্ষের বাহিনী হার মানল। পম্পেই তার আগে কখনাে পরাজিত হননি। কিন্তু তিনি যতবার জিতেছেন, জয়ী হয়েছেন নিজের চেয়ে দুর্বল বাহিনীর বিপক্ষে। যেখানে পরাজয় বরণ করার কথা সেখানে বিজয় ছিনিয়ে আনার কৌশল পম্পেই এর জানা ছিল না, সিজারকে যা বহুবার করতে হয়েছিল। পম্পেই তাই অবস্থা বেগতিক দেখে পালিয়ে গেলেন এবং তার বাহিনীকে পরাজিত করে সিজার সম্পূর্ণ বিজয় অর্জন করলেন। বেহ এইভাবে, এই বিষয়টির নিশ্চয় সমাধান হয়ে গিয়েছিল যে কে কার চেয়ে বড়াে সেনাপ্রধান। কেবল সিদ্ধান্তটা তেমন হয়নি যা পম্পেই চেয়েছিলেন। 

মিশরের রাজনীতি, পম্পেই এর মৃত্যু ও ক্লিওপেট্রার ক্ষমতালাভ

তদকালীন মিশরের অবস্থা : যুদ্ধে হেরে পম্পেইয়ের সেনাবাহিনী গ্রিস এবং এশিয়া মাইনরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ল। সরকারী কর্মচারীরা সময় নষ্ট না করে বিজয়ী দলে যােগদান করল। পম্পেই অসহায় হয়ে পড়লেন এবং জীবন বাঁচানাের তাগিদে রােমের আওতার বাইরের এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। একমাত্র রােম অধ্যুষিত এরাকার বাইরে গিয়ে তিনি শান্তিতে নিশ্বাস ফেলতে পারলেন। এরকম একটি এলাকা সেখানে ছিল বটে, ভূমধ্যসাগরীয় পূর্ব উপকূলবর্তী এলাকা, মিশর। মিশর ছিল ম্যাসিডােনিয়ার শেষ রাজ্য। তখনাে টলেমি রাজারাই মিশরে শাসনকাজ চালাচ্ছিলেন। প্রধানত তাদের তত্ত্বাবধানেই মিশর চলছিল, আর রােমের সঙ্গে তাদের ছিল জোট, পিরাসের আমল থেকেই রােমের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধ হয়ে চলছিল। কখনাে রােমের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মতাে কোনাে বিষয় টলেমির মিশর সৃষ্টি করেনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সাল থেকে ২২১ সাল পর্যন্ত প্রথম তিনজন টলেমি, যারা প্রত্যেকে ছিলেন যথেষ্ট কাজের মিশরকে শক্তিশালী এবং সুষ্ঠু একটি সরকার ব্যবস্থা ছিল। এরপরে অনেক শাসক আসেন যারা কেউ শিশু, কেউ শাসক হবার অযােগ্য, কেউ আবার দুটোই। কিন্তু স্থানটি বিত্তশালীই থেকে যায়, নীল নদের কারণে তারা বরাবরই কৃষিকাজে উন্নত একটি দেশ হিসেবে থেকে যায়, কিন্তু তলে তলে তাদের সরকার খুবই দুর্বল এবং অযােগ্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন কারণে রােমানরা বরং মিশরকে সেলুসিড রাজ্যের হাতে চলে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল, যতদিন না সেলুসিড রাজ্য নিজেই এতটা দুর্বল হয়ে পড়ে যে সেটি আর কাউকে দখল করার মতাে শক্তি রাখে না। রােম মিশরের দূরবর্তী কিছু এলাকা দখল করে, যেমন সিরিন, সাইপ্রাস ইত্যাদি। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ সালে মিশর সত্যিকার অর্থে অখণ্ড ছিল। মিশরের বড়াে এবং জনবহুল রাজধানী আলেক্সান্দ্রিয়া। আকৃতির দিক দিয়ে রােমকে টেক্কা দিতে পারত। আবার সংস্কৃতি বা বিজ্ঞানেও রােমের চেয়ে উপরের স্তরে ছিল। তবে যত কিছুই হােক, মিশরীয় শাসকগণ রােমের হাতের পুতুল ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। তখনকার রাজা টলেমি রােমান শাসকদের পক্ষ থেকে বড়াে সাহায্য নিয়েছিলেন, তাই, পম্পেই সেখানে গিয়ে টলেমির কাছে থেকে ভালাে খাতির যত্ন আশা করেছিলেন। তখন ছিলেন একাদশ টলেমি, যাকে সাধারণত অলেটিজ বলে ডাকা হতাে, যার অর্থ হলাে “বংশীবাদক”, কারণ সেটিই ছিল তার একমাত্র গুণ। শেষ পর্যন্ত, তিনি পম্পেইয়ের সাহায্য পেতে সক্ষম হন (পম্পেইয়ের অনুসারীদের দেয়া ঘুষের কারণে)। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৫ সালে সিংহাসনে আরােহণ করেন। এই কারণে, পম্পেই মনে করছিলেন যে মিশর রাজ্যের রাজা তার কাছে ঋণী। বাস্তবে টলেমি অলেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৫১ সালে মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু তার তরুণ পুত্র দ্বাদশ টলেমি সিংহাসনে আরােহণ করলেন। অলেটিস তার শেষ ইচ্ছার পত্রে রােমান সিনেটে তার তরুণ পুত্রের স্থান নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন, যেটির বাস্তবায়ন তখন পম্পেইয়ের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল। অল্পবয়স্ক রাজা তখন পম্পেইকে অভিভাবক ধরে নিয়ে তাকেই মান্য করা শুরু করলেন। পম্পেই তাই মিশর থেকে সৈন্য এবং অর্থ সংগ্রহ করে রােমে নিজের ভাগ্য পুনরায় স্থাপন করার লক্ষ্যে মিশরের দিকে যাত্রা করলেন। কিন্তু মিশর নিজেই তখন সমস্যার সম্মুখে। তরুণ রাজা তখন মাত্র তেরাে বছর বয়সে। আর তার পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে তার একুশ বছর বয়সি বড়াে বােনের সঙ্গে মিলে রাজ্য শাসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যার নাম ক্লিওপেট্রা।

বিদ্রোহী ক্লিওপেট্রা ও মিশরে পম্পেই এর মৃত্যু : রাজা একাকী রাজ্য চালানাের ক্ষেত্রে খুবই অল্পবয়সী ছিলেন, তাই তাকে সাহায্য করার জন্য ছিলেন একজন উপদেষ্টা, যার নাম, পথিনাস। পথিনাস ক্লিওপেট্রার সামনে খুব বিব্রত বােধ করতেন, কারণ ক্লিওপেট্রা, একে নারী, তার উপরে তরুণ, অথচ আগের সমস্ত টলেমির চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি সম্পন্ন। ক্লিওপেট্রা রাজধানী থেকে পালিয়ে একটি বাহিনীর সঙ্গে এক হয়ে পুরাে মিশরকে দখল করার জন্য যখন পদক্ষেপ নিয়েছেন, ঠিক তখন পম্পেইয়ের জাহাজ আলেক্সান্দ্রিয়ার সমুদ্র উপকুলে গিয়ে ভিড়ল। পথিনাস তখন সত্যিকার অর্থেই বিপদে পড়লেন। তার তখন ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য রােমান সহায়তার প্রয়ােজন পড়ল। কিন্তু তিনি তখনকার পরিস্থিতিতে কোন রােমান শাসকের সাহায্য চাইবেন যেখানে তিনি তখন জানতেন না যে শেষ পর্যন্ত কোন রােমান শাসক টিকে থাকবে? এদিকে তিনি যদি পম্পেইকে তার জাহাজ ভিড়াতে বাধা দেন, তবে পম্পেই হয়তো আশেপাশের অন্য কোনাে রাজ্য থেকে সহায়তা নেবেন এবং পরে তাদের সঙ্গে মিলেই এসে মিশরে আক্রমণ করবেন। অন্য দিকে তিনি যদি পম্পেইকে সেখানে আপ্যায়ণ করেন তবে সিজার ক্রোধান্বিত হয়ে যেতে পারেন এবং অতর্কিতে এসে পম্পেইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারেন। আর তারপর সিজার যদি বিজয়ী হন তবে তবে এই মিশরের বুকেই তিনি খুনােখুনি শুরু করে দেবেন। বুদ্ধিমান পথিনাস তখন একটা উপায় খুঁজে বের করলেন। পম্পেইয়ের জাহাজের কাছে একটি নৌকা পাঠালেন। পম্পেইকে আনন্দের সঙ্গে বরণ করা হলাে এবং পম্পেইকে সেখানে আসতে বলা হলাে যেখানে বহু মিশরীয় মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তারপর পম্পেই যেই তীরে পা রাখলেন (পম্পেইয়ের স্ত্রী-পুত্র জাহাজ থেকে সে দৃশ্য দেখছিলেন) তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হলাে। পম্পেই তখন মৃত, তাই তিনি তখন আর কখনাে মিশরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলেন না। সিজার হয়তো তার শত্রুকে মেরে ফেলাতে খুশিই হয়েছিলেন, আর তাই মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার কোনাে কারণ আর তার হাতে ছিল না। আর এভাবেই পথিনাস মিশরকে রক্ষা করলেন।

মিশরে সিজার ও ক্লিওপেট্রার সাথে সম্পর্ক : কিন্তু এর মাঝখানে সিজার পম্পেইকে ধাওয়া করেছিলেন। তিনি পম্পেইকে একটি নতুন সেনাবাহিনী নিয়ে তার নতুন কর্মদক্ষতা দেখাতে দিতে চাননি। আর ওদিকে মিশর ছিল এমন একটি জায়গা যেখানে অর্থ তৈরি করা খুব সহজ যা সিজারের প্রয়ােজন ছিল। আর তাই পম্পেইকে ধাওয়া করতে করতে তার মৃত্যুর কয়েক দিন পরে মাত্র ৪০০০ সৈন্য নিয়ে সিজার মিশরের উপকূলে এসে উপস্থিত হলেন। মিশরীয়রা দ্রুত গিয়ে পম্পেইয়ের খণ্ডিত মস্তকটি সিজারকে দেখিয়ে দিল যেন প্রথমেই সিজারের তৃপ্তি এবং সহানুভূতি পায়। তাদেরকে বিস্মিত করে দিয়ে সিজার এক সময়ের সহকর্মী এবং মেয়ের স্বামী পম্পেইয়ের খণ্ডিত মস্তক দেখে ব্যথিত হলেন। পম্পেইকে ধোকা দিয়ে হত্যা করে সিজার হয়তো কিছু অর্থ নিয়ে সেখান থেকে চলে যেতেন। কিন্তু পথিনাস বুঝতে পারলেন যে সিজার সেখানে আরাে কিছুদিন থেকে গেলে টলেমিকে ঠিকঠাকমতাে সিংহাসনে বসে যেতে দেখতে পারবেন, আর এও দেখবেন যে তার বােন ক্লিওপেট্রার সহচররা পরাজিত হয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। সিজার হয়তো তা দেখে আর অর্থ সংগ্রহ করেইি ফিরে যেতেন, টলেমি মিশরে কী করছে না করছে তা তার মাথাব্যথার কারণ হবার কথা ছিল না। কিন্তু সেখানে ক্লিওপেট্রার অনুচরেরা জেগে উঠল। তার ছিল এমন এক সম্পদ যা পথিনাসের ছিল না, তা হলাে, ক্লিওপেট্রা ছিল তরুণী এবং সুন্দরী। তিনি যদি সিজারের সঙ্গে কেবল একবার দেখা করতে পারতেন তবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে সিজার তার সঙ্গে বারবার দেখা করতে চাইতেন, তার দিকের স্বার্থটাও সিজারকে জানানাে যেত। তিনি সিরিয়া থেকে নৌবহরে যাত্রা করলেন (সেটাই ছিল তার সাময়িক প্রধান ঘাঁটি), তারপর আলেক্সান্দ্রিয়ায় এসে নােঙর করলেন এবং সিজারকে একটি বিশাল আকৃতির গালিচা উপহার দিতে সমর্থ হলেন। পথিনাসের বাহিনী এই উপহার পৌঁছে দেয়াতে বাধা প্রদানের কোনাে কারণ খুঁজে পেল না। কারণ তারা কোনােমতেই জানতে পারেনি যে গালিচার মােড়কের ভেতরে ছিলেন ক্লিওপেট্রা নিজেই। ক্লিওপেট্রার অনুমান সত্য ছিল। সিজার যখনই সেই অতি সুন্দরী কন্যার সংস্পর্শে এলেন তিনি তখনই বুঝতে পাররেন যে ক্লিওপেট্রা চমৎকার একজন রানি হতে পারেন। আর তাই তখন তিনি পূর্বে যে নিয়ম বলবৎ থাকার কথা ছিল, অর্থাৎ, ক্লিওপেট্রা এবং তার ভাইয়ের একই সঙ্গে রাজ্য পরিচালনার যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তাদের পিতা, সিজারের হুকুমে সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন হলাে। 

সিজারের কাছে পথিনাসের পরাজয় ও মিশরে ক্লিওপেট্রার ক্ষমতায় আরোহন : এই বিষয়টি পথিনাসের একেবারে পছন্দ হলাে না। পথিনাস জানতেন যে মিশর যদি রােমের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তবে জিততে পারবে না। কিন্তু সিজারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলে মিশরের বিজয় নিশ্চিত। সিজার সেখানে ছােটো একটি বাহিনী নিয়ে উপস্থিত ছিলেন, মিশরের বিশাল বাহিনীর তুলনায় সেই বাহিনীকে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব। আর সিজারকে যদি একবার হত্যা করে ফেলা যায় তবে রােমে সিজারের যে প্রতিপক্ষের দল আছে তাদের কাছে ব্যাপক প্রশংসা এবং সাহায্য পাওয়া যাবে। তখন তিনি সিজারের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহী বাহিনী দাঁড় করালেন এবং সেখানে কয়েক মাস ধরে সিজার কেবল ব্যক্তিগত বুদ্ধি আর কৌশলের জোরে পথিনাসের কয়েকটি দলের সঙ্গে লড়ে টিকে রইলেন। কিন্তু পথিনাস যে আলেক্সান্দ্রিয়ার যুদ্ধের নীল নকশা তৈরি করেছিলেন তা সাফলতার মুখ দেখেনি। সিজার তাকে বন্দি করে হত্যা করলেন। তাদের ছােটো যুদ্ধে আলেক্সান্দ্রিয়ার বিখ্যাত পাঠাগার ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিজারের বিরুদ্ধে মিশরীয়রা বিদ্রোহ করেছিল। কিন্তু যুদ্ধে তাদের পরাজয় হলাে। সেই যুদ্ধের সময়ে তরুণ টলেমি পালানাের জন্য একটি ছােটো নৌকায় করে নীলনদ পাড়ি দিচ্ছিলেন। নৌকাটি এক বেশি জিনিসপত্রে ঠাসা ছিল যে অতিরিক্ত ভারের কারণে ডুবে যায়। সেখানেই তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। সিজার তখন মিশরের গােলমালগুলাে সমাধান করার চেষ্টা শুরু করেন। তিনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গে আরাে বেশি ঘনিষ্ট হন এবং এক পর্যায়ে তাকে মিশরের সিংহাসনে বসান। কিন্তু সিংহাসনে আরােহণের জন্য ক্লিওপেট্রার একজন পুরুষ সঙ্গীর প্রয়ােজন ছিল। তাই তার আরেক ভাই ত্রয়োদশ টলেমিকে তিনি তার সহচর হিসেবে বসিয়ে দিয়ে যান। টলেমির বয়স তখন ছিল মাত্র দশ। মিশরের যাবতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য তখন সেটাই ছিল উপযুক্ত সময়। কারণ ওই সমস্ত কাজ শেষ করার পরে সিজারের আরাে অনেক কিছু করার ছিল।

পন্টাসে সিজারের হাতে ফারনুসিজের পরাজয় : সিজার সেখান থেকে সােজা চলে গেলেন এশিয়া মাইনরে যেখানে নতুন সমস্যা দানা বাঁধছিল। কৃষ্ণসাগরের উত্তরে ফারনুসিজ থাকতেন, যিনি পন্টাসের মিগ্রাডেইটসের সন্তান, রােমের পুরােনাে শত্রু। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে ফারনুসিজ তার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং সেটাই ছিল বার্ধক্যে পৌঁছে তার পিতার আত্মহত্যার কারণ। তিনি তখন পম্পেইয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেন যিনি তাকে কৃষ্ণসাগরের উত্তর দিকের অঞ্চলে দেখাশােনা করার দায়িত্ব দেন (যে অঞ্চলকে আধুনিক পেনিনসুলা এবং ক্রিমিয়া বলা হয়ে থাকে)। ফারনুসিজ তার পরের বছরগুলােতে পম্পেইয়ের অধীনেই থাকে, কিন্তু বেসামরিক যুদ্ধের সূত্র ধরে পন্টাসে অনুপ্রবেশ করে তার পরিবারের হারানাে গৌরব ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে চেষ্টার ত্রুটিও করেন না। সেই চেষ্টায় তিনি সিজারের এক রােমান বাহিনীকেও পরাজিত করে ফেলেন। সিজার এশিয়া মাইনরে গিয়ে পৌঁছেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৭ সালে এবং জিলা নামের স্থানে ফারনুসিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, নগরটি ছিল পন্টাসের পশ্চিম সীমানায়। ফারনুসিজের বাহিনী তখন ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল এবং পালিয়ে গেল। এটাই ছিল এই ধাওয়া পালটা-ধাওয়ার সমাপ্তি। আবার এটাই ছিল পন্টাসের শেষ লড়াই, সিজার রােমকে একটি বড়াে সংবাদ জানান, যেভাবে তিনি সেখানে আসেন এবং দ্রুত জয়লাভ করেন। “ভিনি, ভিডি, ভিসি” (আমি এলাম, আমি দেখলাম, আমি জয় করলাম)। 

একনায়ক সিজার

সিজারের ক্ষমতাগ্রহণ ও উদারনীতি : ফারনুসিজের সঙ্গে হিসাব নিকাশ শেষ করে সিজার বহুদিন পরে রােমে ফিরে এলেন, বলতে গেলে এক বছরেরও বেশি সময় তিনি রােমে অনুপস্থিত ছিলেন। অবশ্য এই সময়টাতে তিনি রােমকে অরক্ষিত রাখেননি। মার্ক অ্যান্টনি (ফারসালাসের যুদ্ধে সিজারের একান্ত সহচর) রােমের শাসনকাজ দেখাশােনা করছিলেন সিজারের অবর্তমানে। মার্ক অ্যান্টনি রােমকে যথেষ্ট নিরাপদ রেখেছিলেন, যদিও তার সিজারের মতাে দক্ষতা ছিল না, তাই কখনাে কখনাে হিমশিম খেয়েছিলেন, বিশেষ করে মিশর থেকে যখন সিজারের মৃত্যুর গুজব এসে পৌঁছেছিল রােমে। তবে ওই সময়ে রােমে যখনই কোথাও অরাজকতা দেখা গেছে, মার্ক অ্যান্টনি তার সৈন্যদের দিয়ে কিছু রােমান নাগরিককে হত্যা করিয়ে ফেললেই যে কোনাে ধরনের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে পারতেন, তাই এই উপায়েই সিজার মিশরে থাকাকালীন সময়টাতে তিনি রােমের শাসন ঠিক রাখলেন। তবে সবকিছুর পরেও সিজারের ফিরে আসা মানে ছিল রােমের শাসনে আবারাে শক্ত একজন পরিচালকের আবির্ভাব। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সিজার কোথাও সমস্যা হলেই বহু মানুষ হত্যা এবং নিজের অনুসারীদের মধ্যে সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা করে নেবার ধারায় চলা বন্ধ করলেন। তার বদলে তিনি কোমল আর নরম পদ্ধতিতে শাসনব্যবস্থা চালানাে শুরু করলেন এবয় তার বিরুদ্ধে থাকা প্রচুর রােমানের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হলেন। সিসেরাে তখন তার সমস্যা নিয়ে এলেন। সিসেরাের ছিল পম্পেইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ বন্ধুত্বের ইতিহাস। কিন্তু যে সময়টাতে পম্পেই আর সিজারের মধ্যে শত্রুতা চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল, সিসেরাে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তার কী করা উচিত। শেষে তিনি পম্পেইয়ের বাহিনী নিয়ে ইতালি ত্যাগ করেছিলেন, তবে তার কার্যকলাপে পরিষ্কার হয়নি যে তিনি পম্পেইয়ের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন নাকি ক্ষতি সাধনের। ফারসালুসের যুদ্ধে তিনি চরম ধাক্কা খেয়ে আবার ইতালিতে ফিরে এসেছিলেন। সিজার ইচ্ছা করলে সিসেরােকে হত্যা করতে পারতেন; সিজারের এই কাজে কেউই তখন বিস্মিত হতাে না, এবং সেটা করাই ছিল সময়ােপযােগী। আর যাই হােক, এটা তাে স্পষ্ট ছিল যে সিসেরাে পম্পেইকে তার অর্থ এবং সুনামের ভাগীদার হতে দিয়েছিলেন। তার চেয়ে বড়াে কথা, অ্যান্টনি, যিনি সিসেরােকে ঘৃণা করতেন, তিনি সিজারকে সিসেরাের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রভাবিত করতে পারতেন। যাই হােক, সিজার সিসেরােকে দয়ার মাধ্যমেই ঘৃণা দেখিয়েছেন এবং তাকে সবরকমের সম্মানও দেখিয়েছেন। আর এদিকে সিসেরােও সিজারের প্রতি খােলাখুলি বৈরি কোনাে আচরণ করেননি। 

সেনা-অভ্যুত্থান ও তার দমন : তবে সিজারের কোমলতা তাকে কিছু সমস্যার মধ্যে পড়তে বাধ্য করেছে। যা প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল তেমন পুরস্কার পায়নি, এই অজুহাতে সিজারের একটি লিজন বাহিনী বিদ্রোহ করে বসল (তারা হয়তো অপছন্দের কাউকে কাউকে হত্যা করে তাদের সম্পদ ভাগ বাটোয়ারা করতে চেয়েছিল, যা সময়মতাে করা হয়নি)। তারা রােমের উদ্দেশ্যে রওনা দিল এবং রােমে তাদের অতৃপ্তির সংবাদ পৌঁছে দিতে চাইল। সিজার সেই বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে একাকী মিলিত হলেন। যদিও তিনি জানতেন যে তাদের মধ্যে হুট করে কোনাে সংঘর্ষ ঘটানাের মানুষের অভাব ছিল না। তারা সেই মানুষটিকে তাদের সামনে দণ্ডায়মান দেখলেন যিনি বহু বিপদের মধ্যে চমৎকার নির্দেশনার মাধ্যমে নিরাপদে তাদের উত্তোরণ ঘটিয়েছেন। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে শ্বাসরুদ্ধকর নিস্তব্ধতা নেমে এল। অবজ্ঞাভরে সিজার তখন উচ্চারণ করলেন, “নাগরিকগণ, আপনাদেরকে আপনাদের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হলাে।” সিজারের মুখে “নাগরিক সম্বােধন শুনে তাদের সেনাবাহিনীতে থাকার গৌরব খানখান হয়ে ভেঙে গেল। তারা সিজারের কাছে আকুল আবেদন জানাল তাদের সৈন্য থাকার গৌরব ফিরিয়ে দিতে। এমনকি সেনাবাহিনীতে বহাল রাখার জন্য তাদেরকে যদি কিছু শাস্তিও সহ্য করতে হয় তবে তার জন্যেও তারা প্রস্তুত বলে জানাল (একজনকে যখন রােমান গৌরবান্বিত সৈন্য থেকে নামিয়ে একজন সাধারণ রােমান নাগরিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়, সেটা ছিল রােমান সংস্কৃতিতে ভয়াবহ অপমান)।

কাটো, জুবি ও গাইয়াস পম্পেইয়াসের বিদ্রোহ দমন : পম্পেই ততদিনে পরাজিত এবং মৃত, কিন্তু তার একটি সেনাবাহিনী তখনাে ডিরাকিয়ামে অবস্থান করছিল, তাদের প্রধান ছিলেন কাটো। তারা তখনাে যথেষ্ট ভালাে অংকের অর্থ সরবারাহ পেয়ে যাচ্ছিল এবং তাদের ছিল একটি নৌবহর। তার চেয়ে বড়াে কথা, তারা আফ্রিকায় সিজারের বাহিনীকে পরাজিত করেছিল, আর তাই নির্দিষ্ট ভূমিতে তাদের নির্দিষ্ট একটি ঘাঁটি ছিল যেখানে বসে পরিকল্পনা করতে পারে। কাটো তার বাহিনীকে আফ্রিকায় নিয়ে গেলেন এবং মিডিয়ার জুবা রাজার বাহিনীর সঙ্গে যােগদান করলেন। তার অনেক আগে দশটি লিজনের সমান একটি বাহিনী ছিল উটিকায়, একসময় যেখানে কার্থেজ ছিল তার থেকে পনেরাে মাইল উত্তর-পশ্চিম দিকের একটি নগর। জুবা তার সঙ্গে ১২০ টি হাতি এনেছিলেন এবং গাইয়াস পম্পেইয়াস, পম্পেইয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র সঙ্গে এনেছিলেন নৌবহরটি। দুয়ে মিলে বেশ ভালাে একটি বাহিনী এবং পম্পেইয়ের সমর্থকদের বেশ ভালােই সুযােগ ছিল পুরাে চিত্রটি পালটে দেয়ার। কিন্তু সে যাই হােক, কেবল দেরি করার কারণে তারা আবারাে তাদের সুযােগ হারাল। সিজারের আলেক্সান্দ্রিয়ায় অবতরণের সুযােগ নিতে পারত তারা, সুযােগ নিতে পারত এশিয়া মাইনরে সিজারের অনুপস্থিতির; এমনকি তারা ইতালিতে অনুপ্রবেশ করেও দেখিয়ে দিতে পারত। দুর্ভাগ্যবশত, আফ্রিকার বাহিনী বেশিরভাগ সময়ে নিজেদের সেনাপ্রধানদের নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য অপেক্ষায় বসে থাকল। তাদের মধ্যে কাটোই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যার ব্যক্তিগত ক্ষমতা বলে কিছু ছিল। বাহিনীটি আফ্রিকায়ই অবস্থান করছিল যখন যখন সিজার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ উটিকা থেকে ১০০ মাইল দূরে থাপসাসে তারা প্রতিপক্ষের সঙ্গে মিলিত হয়। সিজারের বাহিনীতে অনেক মানুষ নিয়ােজিত ছিল এবং তাদের প্রত্যেকের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে সিজারের তেমন ধারণাও ছিল না। আর তাই তিনি তাদের নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন, অপেক্ষায় থাকলেন আক্রমণের জন্য একটি উপযুক্ত মুহূর্তের জন্য। তার বাহিনী তার নির্দেশের অপেক্ষায় বসে থাকল ঠিকই কিন্তু রাগে ফুসতে থাকল। প্রতিপক্ষের হাতির বহর তাদেরই ছোঁড়া তিরের আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে গেল। সেই যুদ্ধে তেমন কিছু না করেই সিজারের পূর্ণ বিজয় সংঘঠিত হলাে। পরাজিত বাহিনী যখন উটিকায় ফিরে এল, কাটো তাদেরকে সেই নগরটি প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহার করতে লাগলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে আর কোনাে মনােবল অবশিষ্ট ছিল না। কাটো তাই তাদেরকে স্পেনে নিয়ে যাবার জন্য নৌবাহিনীর জাহাজ তৈরি করলেন। তার পরিবার এবং বন্ধুরা ভেবেছিলেন তিনি নিজেও বাহিনীর সঙ্গে রওনা দেবেন, কিন্তু সেই রাতেই তিনি আত্মহত্যা করেন। জুবাও আত্মহত্যা করেছিলেন, আর তার রাজ্য নুমিডিয়া যেটি একসময় ম্যাসিনিসা এবং পরে জুগুৰ্থা শাসন করেছিলেন, তা শেষ পর্যন্ত সমাপ্তিতে এসে ঠেকল। পূর্বদিকের অংশটা রােমের সঙ্গে জুড়ে গেল আফ্রিকার সঙ্গে, পশ্চিম দিকটা যুক্ত হলাে মৌরিতানিয়ার সঙ্গে, পুরাে রাজ্যটিই কোনাে না কোনােভাবে সিজারের আয়ত্তে চলে এল।

গাইয়াস পম্পেইয়াসের বিদ্রোহ দমন : সিজার আবারাে রােমে ফিরে এলেন। আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাধর হয়ে ফিরলেন তিনি। ফারসুলাসের যুদ্ধের পরে তিনি নিজেকে পাঁচ বছরের জন্য কনসল নিযুক্ত করেছিলেন এবং প্রতিবছর তিনি একনায়কও ছিলেন একই সঙ্গে। আর তখন থাপসাসের যুদ্ধের পরে তিনি দশ বছরের জন্য একনায়ক হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালের জুলাই মাসে সিজার তার চারটি বিজয়ের উৎসব চারদিন ব্যাপী পালন করেন, বিশেষ করে গাউল জাতির সঙ্গে তার বিজয়, তা ছাড়া মিশর, পন্টাইনস এবং নিউমিডিয়ার জাতিদের সঙ্গে বিজয়, সমস্ত বিজয় উপলক্ষে উৎসব চলতে থাকে। তারপর, শেষ যুদ্ধের সময় চলে এল, পম্পেইয়ের সমর্থকরা তখনাে গাইয়াস পম্পেইয়াসের অধীনে স্পেনে যুদ্ধ করছিলেন। সিজার তার বাহিনীকে স্পেনে নিয়ে গেলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালের মার্চ মাসে মুন্ডা নামক স্থানে একটি যুদ্ধ সংঘঠিত হলাে। পম্পেইয়ের সমর্থক বাহিনী খুব ভালাে লড়াই চালাল এবং সিজারের বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করল। সিজার নিশ্চয় তখন ভাবছিলেন যে বছরের পর বছর তার বিজয়ের যে সুদীর্ঘ ইতিহাস, তা হয়তো সামান্য একটা হারের কারণে ধুলােয় মিশে যাবে, ঠিক যেমনটা হয়েছিল হ্যানিবলের। এমনটা ভাবতে ভাবতে সিজার একটাই হতাশাগ্রস্থ এবং একই সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে হাতে ঢাল তলােয়ার নিয়ে নিজেই সেনাবাহিনীর মধ্যভাগে ছুটে চলে গিয়েছিলেন, চিক্কার করে নিজের সৈন্যদের বলেছিলেন, “তােমরা কি চাও তােমাদের সেনাপ্রধানকে শত্রুদের হাতে উঠিয়ে দিতে?”। তার এই চিৎকারে যেন সৈন্যদের মধ্যে নতুন প্রচেষ্টা জাগ্রত হলাে। তারা আরেকবার নতুন করে হামলা চালাতে শুরু করল এবং পম্পেইয়াসের বাহিনীকে মুহূর্তেই কোণঠাসা করে দিল। গাইয়াস পম্পেইয়াস ধরা পড়ে তাদের হাতে বন্দি হলাে এবং তাকে হত্যা করল তারা। 

সিজারের শাসন ও সংস্কার : সিজার কয়েক মাসের জন্য স্পেনে থেকে গেলেন, দেশটি পুরাে হাতের মুঠোয় উঠে আসার পরে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালের অক্টোবর মাসে তিনি রােমে ফিরে এলেন এবং শেষ আরেকটি বিজয়ের জন্য উৎসব পালন করলেন। তিনি জীবনকালের জন্য একনায়ক নিয়ােজিত হলেন। এ নিয়ে কারাে কোনাে প্রশ্ন ছিল না কিন্তু তিনি নিজেকে একটি উপযুক্ত সময় বুঝে রাজা ঘােষণা করার সুযােগ খুঁজছিলেন। সিজার রােমের ক্ষমতায় থাকার সময়ে বেশিরভাগ তাকে দেখা গেছে রােমে অবস্থান না করে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি রােমে কমই অবস্থান করেছিলেন, সঠিকভাবে বলতে গেলে, খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালের অক্টোবর থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের মার্চ পর্যন্ত, সব মিলিয়ে মােটে আট মাস। কিন্তু ওইটক সময়েই তিনি রােমের শাসন ব্যবস্থা এবং আইনকানুন শক্তভাবে ঢেলে সাজিয়েছেন দ্রুত হাতে। সিজার জানতেন যে রােমের বিস্তৃত এলাকা কেবল রােম নগরে বসে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তিনি সিনেট সদস্য বাড়িয়ে ৯০০ করে ফেললেন এবং বর্ধিত সদস্যদেরকে বিভিন্ন প্রাদেশিক নগর থেকে নিয়ে এলেন। এই বিষয়টিতে রক্ষণশীলরা অনেক দুর্বল হয়ে পড়ল কারণ সিনেট তখন আর রােমের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল না যে কেবল রােমের ক্ষুদ্র স্বার্থের ব্যাপারে মনােনিবেশ করবে। কিন্তু এতে করে রােম প্রজাতন্ত্রের আনাচে কানাচে ক্ষমতা ছড়িয়ে পড়ল এবং দূর দূরান্তের অধিবাসীদেরও মতামত প্রকাশের উপায় হলাে। সিজার অন্যভাবে প্রদেশগুলােকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছিলেন, সেটি হলাে কর আদায়ের নিয়মগুলােকে নতুন করে তৈরি করে। সিজারই ছিলেন প্রথম শাসক যিনি রােমান নাগরিকত্বের সুবিধা ইতালির বাইরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেটি ছড়িয়ে গিয়েছিল গাউলের বিভিন্ন স্থানে এবং স্পেনেও। সিজার জ্ঞানী ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রগণ্য হিসেবে ঘােষণা করেছিলেন, তারা যেখানেই জন্মাক না কেন। এরপর তিনি সিসিলির অধিবাসীদেরও নাগরিকত্ব দেয়ার চেষ্টায় ছিলেন। অবশ্য এই কাজটি করার আগেই তার সময় শেষ হয়ে এসেছিল। তিনি কার্থেজ এবং করিন্থকে পুনর্গঠন করা শুরু করেছিলেন, এক শতাব্দী আগে নগর দুইটি রােমের আগ্রাসনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। প্রথমটিতে থাকত রােমানরাই, দ্বিতীয়টিতে গ্রিস থেকে আগত মানুষেরা। তিনি রাজ্যের নিয়মকানুনগুলােকে এমনভাবে পুননির্মান করতে চাইলেন যেন যে অর্থ আদায় হচ্ছে তার সিংহভাগ যােগ্য নাগরিকদের পিছনে সুষ্ঠুভাবে ব্যয় হতে পারে। মায়েদের অতিরিক্ত গয়না ব্যবহারের আবেদন গ্রহণ করার মাধ্যমে তিনি বিবাহ এবং সন্তান ধারণকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং বাবাদের করের পরিমাণ কমিয়ে তিনি বিবাহ এবং সংসার করাকে উৎসাহিত করেছিলেন। রােমের প্রথম পাঠাগারটি তিনি নির্মাণ করেন; রােমান রাজ্যের আনাচেকানাচে মানচিত্র ধরে তার জলাভূমির সংস্কার, উপকূলবর্তী এলাকার উন্নয়ন এবং সামাজিক জীবনের উন্নয়নে নতুন কিছু আইন প্রনয়ণ তার পরিকল্পনার মধ্যে ছিল (অবশ্য এই সমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি মৃত্যুর কারণে)।

ক্যালেন্ডারের সংস্কার : সিজারের যে পদক্ষেপটি সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং বহুল ব্যবহৃত, তা হলাে ক্যালেন্ডার তৈরি। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সাল পর্যন্ত রােমান ক্যালেন্ডার চাঁদের উপরে নির্ভরশীল ছিল। প্রাচীনকালের নুমা পম্পিলিয়াসের যুগ থেকেই সেটা চলে। আসছিল। কিন্তু চাঁদের উপরে নির্ভর করে বারােটি মাস হিসেব করলে (চাঁদ দৃশ্যমান হওয়া থেকে অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত সাড়ে উনত্রিশ দিন হিসেবে) বছরে ৩৫৪ দিন হয়। চাঁদের হিসেবে বছর চললে প্রতিটি বছর সৌর বছরের, যা ৩৬৫ দিন হয়, তা থেকে এগারাে দিন পিছিয়ে থাকে। সৌর বছরের মাধ্যমে। মাসকে তার নিজস্ব ঋতুতে ফেলা সম্ভব। | কৃষিকাজের ক্ষেত্রে একই মাসে বীজ বপন, ফসল কাটা ইত্যাদি করার জন্য সৌরবছর উপযােগী। আর তাই একটি বাড়তি মাস বছরের হিসেবে যােগ করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ব্যাবিলনের লােকেরা প্রথম এই নিয়ে বেশ জটিল একটা হিসাব আবিষ্কার করেছিল কিন্তু সেটি বেশ ভালােভাবেই গ্রিক এবং ইহুদিরা অনুসরণ করছিল। রােমানরা সেই নিয়মটি গ্রহণ করেনি। তার বদলে তারা ক্যালেন্ডারের হিসাবনিকাশ পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাসের হাতে দিয়ে দিয়েছিল (তিনি ছিলেন রােমের সর্বোচ্চ পুরােহিত; তাকে ডাকা হতাে “পন্টিপ” পােপ বলে), তিনি আদতে ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি বছরের হিসাবের যে কোনােখানে একটি মাস বসিয়ে দিতে পারতেন যেখানে তার ইচ্ছা, প্রধানত যখন তার সুহৃদরা ক্ষমতায় থাকতেন, আবার চাইলে তিনি একটি মাস কমিয়েও দিতে পারতেন যখন তার শত্রুরা ক্ষমতায় থাকতেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে তাই রােমান ক্যালেন্ডার ছিল দারুণ এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে। ক্যালেন্ডারটি সৌর বছর থেকে আশি দিন পিছিয়ে ছিল। আর সেই কারণে শীতকালের মাসগুলাে শরতে আর শরতের মাস গ্রীস্মে এসে উপস্থিত হয়েছিল। মিশরে সিজার দেখে এসেছিলেন যে তারা আরাে ভালােভাবে মাস-বছরের হিসাবটা রাখতে পারে। তিনি দেখেছিলেন যে সেটা ঠিক সেইরকম যেমনটা তিনি চান। তিনি একজন মিশরীয় জ্যোতির্বিদের সাহায্য নিয়েছিলেন, যার নাম ছিল সসিজুনিজ, তার সাহায্যে একটি নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করলেন তিনি। প্রথমে তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালটাকে ৪৪৫ দিন পর্যন্ত পার হতে দিলেন, তারপর শেষে দুটো মাস যুক্ত করলেন। এভাবে রােমান ক্যালেন্ডার সৌর বছর মাফিক চলা শুরু করল (এই বছরটিই ছিল সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে লম্বা একটি বছর, যাকে সংক্ষেপে বলা হয়, “বিভ্রান্তির বছর”। সত্যিকার অর্থে একে বলা উচিত “বিভ্রান্তির শেষ বছর।”) জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সাল শুরু হলাে। বছরটিতে বারাে মাসকে ৩০ বা ৩১ দিন করে দেয়া হলাে (একমাত্র ফেব্রুয়ারিকে দেয়া হলাে না, কারণ রােমানরা মনে করত ফেব্রুয়ারি একটি দুর্ভাগ্যের মাস, তাই তার জন্য থাকল ২৮ দিন)। বছরের ব্যাপ্তি হলাে ৩৬৫ দিন। তখন থেকে চাঁদের হিসেবে সময়ের হিসাবকে উপেক্ষা করা হলাে। একেবারে সঠিকভাবে বলতে গেলে একটি বছরের ৩৬৫ এবং ১/৪ দিন থাকে। ক্যালেন্ডারকে সৌর বছরের তুলনায় পিছনে পড়ে যাওয়া থেকে বাচানাের জন্য চার বছর পরে একটি করে অতিরিক্ত দিন বছরে যােগ করার নিয়ম তৈরি হলাে। চার বছর পরের সেই বছরটিকে ডাকা হলাে লিপ ইয়ার এবং সেই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসটি ২৯ দিন হিসেবে বছরটিতে ৩৬৬ দিন থাকার কথা বলা হলাে। সিজার বছরের শুরুর দিনটাও বদলে ফেললেন। মার্চ ১ থেকে সরিয়ে বছরের প্রথম দিন জানুয়ারির ১ করে দিলেন, কারণটা ছিল যে ওইদিন রােমান ম্যাজিস্ট্রেটগণ বরাবর আদালতে উপস্থিত থাকতেন। মাসের নামের পরিবর্তনের কারণগুলােও ছিল হাস্যকর, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের নামের মধ্যে ল্যাটিন সংখ্যা “সেভেন”, “এইট”, “নাইন” এবং “টেন” ছিল, যেহেতু তারা যথাক্রমে বছরের সপ্তম, অষ্টম, নবম এবং দশম বছর ছিল যখন মার্চ থেকে বছর গণনা শুরু হয়েছিল। এখনকার গণনায় সেপ্টেম্বর হয়ে গেল নবম মাস, সপ্তম নয়, এবং অন্য মাসগুলাে একইভাবে পিছনের দিকে সরে গেল। তবে যাই হােক, কেউ এতে কোনাে অভিযােগ করল না। জুলিয়াস সিজারকে সম্মান জানানাের জন্য ক্যালেন্ডারটিকে বলা হলাে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। সেই থেকে সামান্য পরিবর্তন ছাড়া বলতে গেলে সেই ক্যালেন্ডারটি আমরা আজও ব্যাবহার করছি। তা ছাড়া, যে মাসটি রােমানদের কাছে “কুইন্টিলস” বলে পরিচিত, তার নাম বদলে “জুলিয়াস” রাখা হলাে জুলিয়াস সিজারের জনামাস বলে। মাসটি এখন আমাদের কাছে জুলাই বলে পরিচিত।

সিজারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সিজারের মৃত্যু

সিজারের সময় শাসনব্যবস্থার সংস্কারের সীমাবদ্ধতা ও সিজারের একনায়ক হবার ইচ্ছা : সিজার যা করতে চেষ্টা করছিলেন তা যদি আমরা বুঝতে পারি তবে তাকে সমর্থন না করে আমাদের কোনাে উপায় থাকে না। আর যাই হােক রােমান প্রজাতন্ত্রকে আপাদমস্তক ঢেলে সাজানাে ছাড়া সিজারের পক্ষে আর কিছু করার ছিল না। রােমান আইনকানুন বা নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছিল একটি ছােটো নগরকে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে; আর সে কারণেই যখন বিশাল একটি এলাকা, এখনকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান। একটি এলাকাকে শাসন করার জন্য সেই নিয়মকানুন ভয়ানকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। রােমান আইনে অনেক কিছুই ছিল যা গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। তাদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতাে ভিন্ন ভিন্ন কার্যালয়ে। তবে কেবল রােমে যারা উপস্থিত থাকত তারাই নির্বাচনে ভােট দিতে পারত। সিনেটের হাতে সর্বময় ক্ষমতা থাকত, যা কেবল সমাজের ছােটো একটি ভাগের প্রতিনিধিত্ব করত। আমরা মনে করতে পারি যে রােমানরা কখনােই একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থা চালু করেনি, যেখানে দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষেরা নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাকে তাদের কথা বলার জন্য রােমে পাঠাতে পারে। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে এটা সেইরকম সময়ের একটি সরকার ব্যবস্থা যখন দ্রুততম বাহন হিসেবে ছিল কেবল ঘােড়া। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিদের রােমে একত্র করা এবং বিভিন্ন চলমান সমস্যা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাদের মতামত যাচাই করা অসম্ভব একটি বিষয় ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের আবিষ্কৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বড়াে আয়তনের রাষ্ট্রে আধুনিক যােগাযােগ ব্যবস্থা চালু হবার আগে কোনাে মতেই বাস্তবায়িত হতে পারত না। রােমান সময়ে একনায়কতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যে বেছে নেওয়ার কোনাে ব্যাপার ছিল না, বেছে নেয়ার ব্যাপার ছিল কেবল সৎ এবং দক্ষ সরকার এবং অসৎ এবং অদক্ষ সরকারের মধ্যে একটিকে। গ্র্যাকাই এর সময়ের পর থেকে রােমান সরকার ভীষণভাবে অসৎ এবং অদক্ষ হতে আরম্ভ করেছিল। তার চেয়ে বড়াে কথা সিনেটে অবস্থানরত বিরােধী দল তখন থেকেই ঘৃণ্য কৌশল এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি প্রয়ােগ করতে শুরু করেছিল। সরকারী এবং বিরােধী দল, প্রত্যেকেই তখন থেকে যে কোনাে কারণে বিজয় লাভের জন্য উন্মত্ত জনতার সমর্থনের উপরে নির্ভর করা শুরু করেছে। সেই সময়ের সীমাবদ্ধতাগুলাে বিবেচনায় রাখলে, এটিই ছিল উত্তম ব্যবস্থা যে একজন সৎ এবং সুযােগ্য একনায়ক থাকবেন এবং তার অধীনে অন্য সকলেও সততা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাবে, এমন একটি সরকার ব্যবস্থাই ছিল কাম্য। জুলিয়াস সিজার তাই সেইখানে তাদের আদর্শ হবার কথা নয়, কোনাে মানুষই হয়তো পরিপূর্ণ আদর্শ হতে পারে না। কিন্তু ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে যােগ্য শাসক হিসেবে পরিচিত, এবং সেই সময়ে রােমে তার চেয়ে বেশি দক্ষ আর কোনাে শাসক তৈরি হয়নি। তার জীবনে এমন সময় এসেছিল যখন তিনি নিজেকে অযােগ্য, অসৎ বা কৌশলী কিংবা নিষ্ঠুর প্রমাণ করেছেন; কিন্তু একই সঙ্গে তিনি নিজেকে তীক্ষ্ণ এবং দক্ষ, নরম স্বভাবের এবং ক্ষমা প্রদর্শনকারী হিসেবেও উপস্থাপন করেছেন। সবচেয়ে বড়াে কথা হলাে, তিনি রােমকে সুন্দর একটি শাসন ব্যবস্থার আওতায় আনতে চেয়েছেন। আর সেই কারণেই তিনি নিজের কাছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে প্রয়াস পেয়েছেন। কারণ তার কাছে এ ছাড়া অন্য কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। জীবনভর তিনি রােমের একনায়ক ছিলেন, আর তাই সারাজীবনই তার হাতে ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য কিন্তু তিনি বরাবর রাজা হতে চেয়েছিলেন। এই বিষয়ে অবশ্য কিছু ব্যাখ্যা আছে। তিনি যদি কেবলমাত্র একনায়ক হয়েই থাকেন তবে তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নতুন একটি ক্ষমতার উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা তাকে; কিন্তু তিনি যদি রাজা হন, তার মৃত্যুর পরে তার পুত্র কিংবা অন্য কোনাে আত্মীয় সিংহাসনে বসবে। এবং এভাবেই রাজ্যে চিরশান্তির নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে (অবশ্য সেই সময়েই অন্যান্য বিভিন্ন রাজ্যের অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে রাজকীয় পরিবারের মধ্যেই নানারকমের দলাদলি এবং কূট কৌশল চলতে থাকত। কিন্তু একজন মানুষ আশা তাে করতে পারেন যে তার অবর্তমানে তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এমনটা হবে না এবং সমস্তকিছু রােমান আইন অনুযায়ী চমৎকার চলতে থাকবে)। 

সিজার-বিরোধিতা : যাই হােক, টারকুইনদের সময় থেকেই রােমানদের মনে রাজার অবস্থান নিয়ে এক ধরনের ভীতি কাজ করত। রােমান শিশুরা প্রাচীন রােমান শিক্ষায় শিক্ষিত হতাে। এবং সে কারণেই টারকুইনদের রাজ্য পরিচালনার কাহিনির সঙ্গে পরবর্তীকালে প্রজাতন্ত্র স্থাপনের চমকপ্রদ কাহিনি পড়ে রাজাদের বিরুদ্ধে একরকমের বিরূপ মনােভাব তৈরি হয়ে থাকত তাদের মনে। তা ছাড়া, রােমান ইতিহাস তাদের দেখিয়েছে কী করে একের পর এক পূর্ব দিকের রাজ্য তাদের উপরে শক্তি খাটিয়েছে। আর সেখান থেকেই তারা বুঝতে পেরেছে যে একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার একটি একনায়কতন্ত্রের চেয়ে বেশি স্বস্তিকর। তাই স্পেন থেকে সিজার ফিরে আসার পরে গােপনে গােপনে তার প্রতিপক্ষ তৈরি হয়ে গেল। কিছু কিছু প্রতিপক্ষ পুরােনাে সিনেটসদস্যদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গেল, যারা সিজারকে প্রাচীন রােমের শাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন করে সাজাতে দেখেছে, প্রাচীন শাসন ব্যবস্থা, যার সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল যে সেটাই রােমকে মহান করেছে। কেউ কেউ এমন কোনাে জনগােষ্ঠী থেকে এসেছিল, যারা মনে করত যে একনায়কতন্ত্র দেশের জন্য একরকমের শত্রু। কেউ কেউ এমন গোষ্ঠী থেকে এসেছিল, যারা সিজারকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করত, ভাবত, কদিন আগেই যে কেবলমাত্র একজন রাজনীতিবিদ ছিল, এখন তাকে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হবে আর প্রজা হিসেবে সবসময় তার পূজা করতে হবে। সত্যিকার অর্থেই সিজারকে অপার্থিব সম্মান প্রদর্শন করা আরম্ভ হলাে। আর যারা তার রাজা হবার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তারা তার দেবতা হওয়া দেখে আরাে বেশি ক্ষেপে গেলেন। 

ষড়যন্ত্রকারী ব্রুটাস, ক্যাসিয়াস ও অন্যান্যরা : সিজারের বিরুদ্ধে যারা সােচ্চার হয়ে উঠেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস, যিনি জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৮৫ সালে। তিনি ছিলেন তরুণ কাটোর ভাগনে, যিনি সাইপ্রাসে তরুণ কাটোকে সঙ্গ দিয়েছিলেন যখন সিজার আর পম্পেই মিলে কাটোকে নগরছাড়া করেছিলেন। সাইপ্রসে ব্রুটাসের স্বভাব সম্পর্কে ভালাে কোনাে কিছু জানা যায়নি, কেবল জানা যায় যে প্রদেশের অর্থ তিনি খােলাখুলিভাবে পাচার করেছেন। কাটোর ভাগনের পক্ষে পম্পেইয়ের সমর্থক হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। তিনি কাটো এবং পম্পেইয়ের সঙ্গে গ্রিসে যান এবং ফারসালুসের যুদ্ধে তাদের হয়ে লড়াই করেন। ব্রুটাসকে সেখানে বন্দি হতে হয় কিন্তু সিজার তাকে ক্ষমা করে মুক্তি দেন। এটা সত্য যে সিজার আফ্রিকা ছেড়ে যান কাটোর অধীনে যুদ্ধ করার জন্য, তিনি সিসালপাইন গাউলের দায়িত্ব দেন ব্রুটাসকে। কাটো যখন সিজারের সঙ্গে কাজ না করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তখন তার ভাগনে ব্রুটাস পাে উপত্যকায় সিজারের জন্য ভালাে কাজ করছিল। সিজার স্পেনে ফিরে আসার পরে, ব্রুটাস তার আত্মীয়াকে বিবাহ করেন, বিবাহ করেন পর্শিয়াকে, যিনি কাটোর কন্যা, এবং সিজারের বদৌলতে ব্রুটাস তখন রােমের কার্যালয়ে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন। সেই ব্রুটাসই তখন সিজারের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র শুরু করেন কারণ তিনি মনে করেন যে সিজার নিজেকে রাজা ঘােষণা করবেন। ব্রুটাসকে উঁচুদরের দেশপ্রমিক হিসেবে ভাবা হতো, বেশিরভাগ লােকেরা এখনাে তাই মনে করেন, কারণ শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার নাটকে তাকে প্রেমাস্পদ এক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে তাকে “রােমানদের মধ্যে সবচেয়ে মহান” (এখানে অবশ্য সেইসব রােমানদের কথা বলা হয়েছে যারা বিছিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল) হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ একমাত্র তিনিই ছিলেন এমন এক ষড়যন্ত্রী যিনি হিংসা থেকে নয়, বরং একটি আদর্শ থেকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। তবে এটা দেখতে আরাে ভালাে লাগত যদি তিনি আরেকটু আগে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতেন এবং সিজারের কাছ থেকে সবরকম সুযােগ সুবিধা আর সম্মান গ্রহণ করার আগেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেন। আরেকজন ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন গাইয়াস ক্যাসিয়াস লংগিনাস। ক্যাসিয়াস পার্থিয়ায় ক্র্যাসাসের সঙ্গে ছিলেন। কারিতে শােচনীয় পরাজয়ের পরে তিনি সেনাবহিনী নিয়ে সিরিয়ায় ফিরে আসেন। আর তারপর যখন পার্থিয়ার লােকেরা সিরিয়ায় আক্রমণ করে তখন ক্যাসিয়াস তাদের সঙ্গে জিতে যান, তাদেরকে সিরিয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য করেন। ক্যাসিয়াস পম্পেইয়ের সঙ্গেও ছিলেন। পম্পেইয়ের নৌবহরে তিনি একজন বাহিনী প্রধান ছিলেন, কিছু বিজয় অর্জন করেন। ফারসালুসের যুদ্ধের পরে তিনি স্থান পরিবর্তন করেন। তিনি এশিয়া মাইনরে চলে যান, সেখানে তিনি সিজারের সঙ্গে দেখা করেন। সিজার তখন সেখানে ফারসুনিসের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। ক্যাসিয়াস দখলদার সিজারের অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন এবং সিজার তাকে ক্ষমা করে তার অধীনে কাজ করার অনুমতি দেন। সিজারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ক্যাসিয়াসই ছিলেন প্রধান চালিকা শক্তি। তিনি ব্রুটাসের বােন জুনিয়াকে বিবাহ করেন। আর স্ত্রীর মাধ্যমেই তিনি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবার ব্যাপারে ব্রুটাসকে অনুরােধ করেন এবং রাজি করান। অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিল ডেসিমাস জুনিয়াস ব্রুটাস, যিনি গাউলে সিজারের সেনাপ্রধান ছিলেন, যিনি গাউলের গভর্নর হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছেন। সিজার তাকে নিজের একজন উত্তরাধিকার হিসেবেও ঘােষণা দেন। আরেকজন ছিলেন লুসিয়াস কর্নেলিয়াস সিনা, মারিয়াসের সহ-কনসলের উত্তরাধিকারী এবং সিজারের প্রথম স্ত্রীর ভাই। 

ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে সিজারের মৃত্যু : খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ষড়যন্ত্রকারীরা উপলব্ধি করলেন যে তাদের যা করার দ্রুত করতে হবে। ততদিনে সিজার সিজার প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন রােমানদের জীবন যাপনের সঙ্গে রাজার শাসন কত স্বাভাবিকভাবে মিলে যায়। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে একটি সাদারণ ছুটির দিনে সিজারের বিশ্বস্ত বন্ধু মার্ক অ্যান্টনি সিজারকে একটি ডায়াডেম, অর্থাৎ লিনেন কাপড়ের একটি ফিতা উপহার দিলেন, যেটি পূর্বাঞ্চলে একনায়কতন্ত্রের চিহ্ন। সিজার তখন চমকে ওঠেন। এবং বলেন, “আমি রাজা নই, আমি সিজার।” রাজার শাসন কায়েম করার চিন্তাটা তখন ব্যর্থ হয়ে গেল। তবে, ষড়যন্ত্রীরা জানতেন যে সিজার আবারাে চেষ্টা করবেন, এবং কদিনের মধ্যেই করবেন। সিজার তখন জাহাজের বহর তৈরি করছিলেন লিজন বাহিনী নিয়ে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পার্শিয়ানদের বিরুদ্ধে সতর্কতা জানাতে। রােম ছাড়ার আগেই সিজার তখন নিজেকে রাজা ঘােষণা করতে চাইলেন। আর একবার যখন তিনি লিজন বাহিনীর মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াবেন, তখন চারদিকে সৈন্য পরিবেষ্টিত থাকবেন, তখন তাকে হত্যা করা অসম্ভব। মার্চের ১৫ তারিখে (রােমান ক্যালেন্ডারে আইডস অফ মার্চ) সিনেটের বৈঠক ডাকা হলাে, এবং সিজারের পরিকল্পনা ছিল সেইদিনই নিজেকে রাজা ঘােষণা করা, সবাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। ওই আইডিস অফ মার্চকে নিয়ে বহুরকমের গল্প প্রচলিত ছিল। গল্পগুলােকে বলা হয়েছিল যে সিজারকে দেবতাদের পক্ষ থেকে ওইদিনের জন্য সতর্ক বার্তা পাঠানাে হয়েছিল; সিজারের স্ত্রী আগের রাতে একটি দুঃস্বপ্ন দেখেন এবং তাকে অনেক অনুরােধ করেন যেন সেইদিন তিনি সেখানে না যান। সিজার সেই সকালটা অনিশ্চিতভাবে কাটান এবং ডেসিমাস ব্রুটাস যতক্ষণ না তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন ততক্ষণ ভাবতেই থাকেন যে তিনি যাবেন নাকি ওই সমস্ত কুসংস্কারের কথা শুনে বাড়িতেই থাকবেন। ডেসিমাস ব্রুটাস তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে তিনি যদি বাড়িতে থাকেন তবে সবাই তাকে কত হেয় নজরে দেখবে। আর সিজার তার কথায় ও মুখভঙ্গিতে ভুলে গিয়ে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। সিনেট কক্ষে পৌঁছানাের সময়ে কেউ একজন তার হাতে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে একটি বার্তা গুজে দেন, কিন্তু প্রায় পৌঁছে গেছেন বলে তখন আর সেটি খুলে দেকার সময় তিনি পান না। তিনি বার্তাটি হাতের মুঠোয় নিয়েই সিনেট কক্ষে প্রবেশ করেন। ষড়যন্ত্রকারীরা, যারা সবাই সিজারের বন্ধু বা বন্ধুস্থানীয়, তারা সিনেটে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ঘিরে ফেললেন। পম্পেইয়ের মূর্তির পাশে তিনি যখন তার চেয়ারে উপবিষ্ট হলেন তারা তার দিকে এগিয়ে গেলেন। মার্ক অ্যান্টনি হয়তো সিজারকে বাঁচানাের চেষ্টা করেছিলেন, তখন ষড়যন্ত্রকারীদের একজন তাকে কোনাে ছুঁতােয় অন্যদিকে ডেকে নিয়ে যান (কেউ কেউ অ্যান্টনিকে হত্যা করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু মার্কস ব্রুটাসের কাছে মনে হয়েছিল যে এটা অপ্রয়ােজনীয় রক্তপাত)। সিজার একা ছিলেন, যখন চারদিক তেকে আকস্মিক ছুরিগুলাে এগিয়ে আসছিল। নিরস্ত্র সিজার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন আঘাতগুলাে ফিরিয়ে দেবার, যতক্ষণ না তিনি আক্রমণকারীদের মধ্যে ব্রুটাসকে সনাক্ত করতে পারেন, ব্রুটাস ছিলেন তাদের মধ্যে সিজারের আত্মার খুব কাছের। “Et tu Brute?” (“ব্রুটাস, তুমিও?”) তার কণ্ঠস্বর সেখানেই আটকে গিয়েছিল এবং প্রতিরােধ করার মনােবলও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি তখন। তাকে তেইশটি ছুরির আঘাত করা হয়েছিল। আর তারপর পম্পেইয়ের মূর্তির পায়ের কাছে রােমের একনায়ক রক্তের বন্যায় ভেসে যেতে লাগলেন। 

রোমান প্রজাতন্ত্রের অবসান ও অক্টাভিয়ানের সম্রাট হয়ে ওঠা 

সিজারের উত্তরাধিকারী 

ষড়যন্ত্রকারীদের দমনের প্রস্তুতি ও মার্ক অ্যান্টনির ভাষণ : সিজারকে হত্যার পরে ব্রুটাস লাফিয়ে উঠলেন, রক্তে রঞ্জিত ছুরিটি বাতাসে কয়েক পাক ঘুরিয়ে সিনেট সদস্যদের চিৎকার করে ডাকলেন, বললেন যে রােমকে এক স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। রােমের সরকার ব্যবস্থার প্রকৃতি কী হওয়া উচিত সেই বিষয়ে নেতৃত্ব দানের জন্য তিনি তখন সিসেরােকে স্মরণ করলেন। নগরটি তখন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রত্যেকের তখন একটিই মাত্র চাওয়া ছিল যে কোথাও যেন আর কোনাে রক্তপাত না ঘটে। ঘটনার আকস্মিকতায় সিজারের সমর্থকরা একটাই হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন যে কোনাে প্রতিক্রিয়া দেখানাের মতাে অবস্থায় ছিলেন না; এমনকি মার্ক অ্যান্টনিও আত্মগােপন করাকে শ্রেয় মনে করেছিলেন। কিন্তু যখন রাত নেমে এল, বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে লাগল। সিজারের অনুগত সেনাপ্রধান মার্কাস ঈমিলিয়াস লিপিডাস, যিনি ছিলেন তেত্রিশ বছর আগে পম্পেইকে যুদ্ধে পরাজিত করা সেনাপ্রধানের উত্তরাধিকারী, তার অধীনে সিজারের এক লিজন বাহিনী ছিল। সেই বাহিনীকে রাতারাতি রােমে ডেকে আনা হলাে যেন ষড়যন্ত্রকারীদের উচিত শিক্ষা দিতে পারে। এর মধ্যে মার্ক অ্যান্টনিও নিজেকে সামলে নিলেন এবং সেনাবাহিনী গঠনের জন্য সিজার যে অর্থ আলাদা করে আগলে রেখেছিলেন, কালপুর্নিয়াকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেই অর্থ ব্যবহার করতে চাইলেন। বন্দিদের কথা ভাবলে তারা সিসেরাের সঙ্গে জয়লাভের আশায় লড়েছিল, যারা তাদের সঙ্গে যােগদান করতে রাজি হলাে (লিপিডাসের দলের উপরে তাদের নজর ছিল)। তারা তখন মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে সমঝােতার মাধ্যমে এক হয়ে গেল। রােমে তখন গৃহযুদ্ধ আসন্ন। একটি সমঝােতার বিষয় তখন আয়ােজন করা হচ্ছিল। সিনেটকেও সিজারের যাবতীয় পুনর্গঠনকে নতুন করে বিবেচনায় আনতে হচ্ছিল যে কীভাবে সিজারের করা পুনর্গঠনের বিষয়গুলাে অনেকটাই অবিকৃত রাখা যায়। সিজারের দলিলপত্রও না দেখেই সব বৈধ বলে স্বীকার করা হয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে প্রধানদের রােমের বাইরে বিভিন্ন প্রদেশে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলাে যেন রােম তাদের অবর্তমানে নানান সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর এই সমস্তকিছুর পরে সিজারের জন্য প্রকাশ্যে একটি শেষকৃত্য করায় কোনাে বাধা রইল না। মার্কাস ব্রুটাস (অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের আপত্তি সত্ত্বেও) মনে করলেন যে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সিজারের সমর্থকদের কিছুটা হলেও শান্তি দেয়া যাবে। সিজারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে মার্ক অ্যান্টনি একটি বক্তৃতা দিতে উঠলেন। তিনি সেখানে সিজারের লিখিত বিভিন্ন ইচ্ছার কথা পড়ে শােনালেন। সেখানে তার বাগানগুলাে রােমে নাগরিকদের মধ্যে দান করার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিটি রােমান নাগরিক সেখান থেকে এখনকার আধুনিক টাকার মূল্যে ২৫ ডলার করে পেল। তার চিন্তার উদারতা নাগরিকদেরকে গভীরভাবে স্পর্শ করল। মার্ক অ্যান্টনি বলে যেতে লাগলেন যে এইসমস্ত উদারতার বিনিময়ে সিজার কী পরিমাণ আঘাত এবং শঠতা বরণ করেছেন, আর তখন সেখানেই এক মহর্তের মধ্যে দর্শক-শ্রোতারা সিজারের ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের দাবিতে ফেটে পড়ল। ষড়যন্ত্রকারীদের কাছের লােকেরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন। মার্ক অ্যান্টনি কিছুক্ষণের মধ্যে রােমানদের প্রভূ হয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু তখন রােমে এসেছিলেন এক নতুন তরুণ, নাম, গাইয়াস অক্টাভিয়াস। 

অক্টাভিয়াস সিজার ও মার্ক অ্যান্টনির সাথে তার দ্বন্দ্ব : গাইয়াস অক্টাভিয়াসের পিতার নামও ছিল গাইয়াস অক্টাভিয়াস, যিনি ছিলেন জুলিয়াস সিজারের বোন জুলিয়ার পুত্র, সুতরাং গাইয়াস অক্টাভিয়াস সিজার হলেন সম্পর্কে জুলিয়াস সিজারের নাতি। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন, যে বছর ক্যাটিলাইনে ষড়যন্ত্র সংঘঠিত হলাে। সিজারের নিজের কোনাে সন্তান ছিল না এবং অক্টাভিয়াস ছিল যুক্তি অনুসারে তার উত্তরাধিকারী। অক্টাভিয়াস তারুণ্যে বেশ অসুস্থ ছিলেন আর তাই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিলেন না। তার ঠাকুরমার ভাই বা গ্রেট আংকল সিজারও তাকে যুদ্ধে যেতে দিতে সম্মত ছিলেন না; তিনি তাকে জীবিত রাখতে চেয়েছিলেন কেবল একজন উত্তরাধিকারী হিসেবে। আর তাই সিজার যখন পার্থিয়ার যুদ্ধে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, তিনি অক্টাভিয়াসকে তার উচ্চতর শিক্ষার জন্য ডিরহাকিয়ামের দক্ষিণে অ্যাপােলনিয়ায় যেতে আদেশ দেন। সিজারের মৃত্যুর ঘটনা যখন তিনি জানতে পারলেন, তিনি তখনই ইতালির পথে রওনা হলেন। সিজারের দলিলে উত্তরাধিকার হিসেবে তার নাম ছিল, আরা সেটি সিনেট সমর্থনও করেছিল। অক্টাভিয়াস যে ধীরে ধীরে রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছিলেন তা তিনি টের পাচ্ছিলেন যদিও তার পরিবার তাকে সে পথে যাবার ব্যাপারে বহুবার নিষেধ করেছেন। রােমে অক্টাভিয়াসের আগমন মার্ক অ্যান্টনির মােটেও ভালাে লাগেনি, কারণ রাজনৈতিক সূত্র ধরে তিনি সিজারের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। একজন অসুস্থ তরুণের সঙ্গে তিনি ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে মােটেও রাজি ছিলেন না। সিজারের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি অক্টাভিয়াসকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মার্ক অ্যান্টনি সিনেটের সঙ্গে কথা বলে সেই বিষয়টি স্থগিত রাখেন। এছাড়া অক্টাভিয়াস গাইয়াস জুলিয়াস সিজার অক্টাভিয়ানুস নামটি পেয়েছিলেন, ইংরেজিতে যাকে সাধারণত অক্টাভিয়ান বলে উল্লেখ করা হতাে। মার্ক অ্যান্টনি যা চেয়েছিলেন, সমস্ত কিছু তার মনমতাে হয়নি। কেবলমাত্র সিজারের নাম বহন করার জন্যই সেনাবাহিনীর একটি বড়াে অংশ ছিল অক্টাভিয়ানের পক্ষে। তার চেয়ে বড়াে কথা, মার্ক অ্যান্টনির শত্রু সিসেরােও অক্টাভিয়ানকে সমর্থন দেয়া শুরু করেছিলেন (যাকে মার্ক নিজের স্বার্থ উদ্ধারে জন্য ব্যবহার করবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন), তারা দুজনে মিলে তখন লাগাতার মার্ক অ্যান্টনির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে থাকেন।

অক্টাভিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণ ও ডেসিমাস ব্রুটাসের মৃত্যু : মার্ক অ্যান্টনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে তখন সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। একজনের পর একজন ষড়যন্ত্রকারীরা রােম ছেড়ে নিজ নিজ প্রদেশে চলে গিয়েছিল এবং নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিল। মার্কাস ব্রুটাস ছিলেন গ্রিসে, ক্যাসিয়াস এশিয়া মাইনরে এবং ডেসিমাস ব্রুটাস ছিলেন সিসালপাইন গাউলে। ডেসিমাস ব্রুটাস রােমের সবচেয়ে কাছে অবস্থান করছিলেন, এবং মার্ক অ্যান্টনি তাকেই শিকার হিসেবে চিন্তা করলেন। লিপিডাসকে স্পেনে পাঠানাে হয়েছিল যেন তিনি পম্পেইয়ের ফেলে যাওয়া বাহিনীর দিকে নজর রাখেন। কিন্তু মার্ক অ্যান্টনি এ বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন যে ডেসিমাস ব্রুটাসের ব্যাপারে তাকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি সিনেটের উপরে চাপ প্রয়ােগ করে নিজের জন্য সিসালপাইন গাউল বরাদ্দ করলেন এবং উত্তর দিকে বাহিনী নিয়ে রওনা দিলেন। এভাবেই তৃতীয় গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হলাে। মার্ক অ্যান্টনি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই, তখন সিনেটকে সিসেরােই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, তরুণ অক্টাভিয়ান মার্ক অ্যান্টনিকে জনগণের শত্রু হিসেবে উল্লেখ করলেন এবং তার বিরুদ্ধে অভিযানে একটি বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন। সেই বাহিনীটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন দুজন কনসল এবং অক্টাভিয়ান ছিলেন দ্বিতীয় সারির পরিচালক (এভাবেই অক্টাভিয়ান মার্ক অ্যান্টনির বিরুদ্ধে লড়াই করে গেলেন, সিজারের সবচেয়ে ঘনিষ্ট এবং অনুগত সহচরের বিরুদ্ধে। অবশ্য এটা ছিল অক্টাভিয়ানের দূরদর্শিতার প্রথম পরিচয়। তবে তখনাে কারাে ধারণা ছিল না যে সিজারের উত্তরাধিকারী, সেনাপ্রধান না হয়েও, ছিলেন প্রাজ্ঞ এবং রাজনৈতিক চালে সিজারের মতােই তুখােড়)। ডেসিমাস ব্রুটাস গিয়ে থামলেন মিউটিনায়, যাকে আধুনিক যুগে মডেনা বলা হয়। মার্ক অ্যান্টনি নগরে বাইরে একদল এবং নগরের ভেতরে আরেক দল শত্রু নিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩ সালে হার মানলেন। তারপর নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে আল্পস পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ গাউলে পশ্চাদপ্রসরণ করলেন, যেখানে লিপিডাস স্পেন থেকে যাত্রা শুরু করে সেখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। অক্টাভিয়ানের জন্য সবকিছুই ঠিকঠাকমতাে চলছিল। মার্ক অ্যান্টনিই কেবল সেনা অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হননি, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে দুজন কনসল ছিলেন, তারাও যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করলেন, সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য রেখে গেলেন কেবল অক্টভিয়ানকে। তিনি তার সেনাদল নিয়ে রােমে ফিরে এলন এবং সেনাদের জোরে সিনেটকে তাকে সিজারের দত্তকপুত্র হিসেবে মানাতে, এবং কনসল হিসেবে নির্বাচিত করাতে কোন বেগ পেতে হলোনা। তখন রােমের নিয়ন্ত্রণ চলে এল তার হাতে, এবারে সময় এলো সিজারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বদলা নেবার। তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পদক্ষেপ নিতে সিনেটের উপরে চাপ প্রয়ােগ করা শুরু করলেন এবং সেই সেপ্টেম্বরে আবারাে সিসালপাইন গাউলে গিয়ে উপস্থিত হলেন, তবে সেবারে গেলেন ডেসিমাস ব্রুটাসের জন্য। মার্ক অ্যান্টনি যা পারেননি তিনি তা করে দেখালেন। ব্রুটাসের সৈন্যরা ধাওয়া খেয়ে পালাবার পথ পেল না। তারা ধরা পড়ল এবং তাদের হত্যা করা হলাে। 

অক্টাভিয়ান, অ্যান্টোনি ও লিপিডাসকে নিয়ে দ্বিতীয়বারের ত্রয়ী শাসন বা সেকন্ড ট্রায়াম্ভিরেট

ট্রায়াম্ভিরেট গঠন ও সিসেরোর মৃত্যু : এর মধ্যে, গ্রিসে মার্কাস ব্রুটাস এবং এশিয়া মাইনরে ক্যাসিয়াস, দুজনেই একইভাবে অর্থ এবং বাহিনী তৈরি করছিলেন (প্রদেশের সবচেয়ে অসহায় মানুষদের কাছে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে ক্যাসিয়াস ছিলেন সিদ্ধহস্ত)। লিপিডাস তাই সিজারের পুরেনাে বন্ধু এবং সিজারের উত্তরাধিকারীকে মুখােমুখি করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তাদের সবার দেখা হলাে বনোনিয়ায়, আধুনিক যুগে যাকে বলা হয় বলােগনা, এবং রােমান শাসনের ভার নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করার চুক্তিও হয়ে যায়। এভাবেই খ্রিস্টপূর্ব ৪৩ সালের ২৭ নভেম্বর তারিখে দ্বিতীয়বারের মতাে ত্রয়ী শাসনব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা পায়, মার্ক অ্যান্টনি, অক্টাভিয়ান এবং লিপিডাসকে নিয়ে। অক্টাভিয়ান ত্রয়ী শাসনব্যবস্থায় প্রবেশ করার পরপরই সিনেটের ক্ষমতা ছেড়ে দেন, অর্থাৎ আবারাে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। সিসেরাে, যিনি বিশেষ করে অক্টাভিয়ানকে সহায়তা করার জন্য যাবতীয় সবকিছুতে ঝুঁকি নিয়েছেন, অন্যদিকে অ্যান্টনির উপরে হামলা চালিয়েছেন, তখন নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনা স্পষ্ট দেখতে পেলেন। অ্যান্টনি ত্রয়ী শাসন ব্যবস্থার অংশ হওয়া মাত্রই সিসেরাের মৃত্যুদণ্ডের দাবি করলেন এবং অক্টাভিয়ান রাজি হয়ে গেলেন। তারা তিনজনে মিলে সত্যিই এমন একটি শাসন ব্যবস্তার সৃষ্টি করলেন যা প্রায় চল্লিশ বছর আগে স্যুলার সময়ে ছিল। তখনাে অবস্থাসম্পন্ন প্রচুর মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছিল এবং তাদের সম্পত্তি লুটেপুটে খাওয়া হয়েছিল। সিসেরাে ইতালি থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উলটো হাওয়া যেন তার জাহাজ আবারাে রােমের উপকূলে এনে ভিড়িয়ে দিল। তিনি আরেকবার পালিয়ে যাবার চেষ্টাও করলেন কিন্তু তাকে হত্যার জন্য পাঠানাে সৈন্যেরা তার আগেই সেখানে পৌঁছে গেল। তিনি তার অধীনস্তদেরকে বাধা দিতে নিষেধ করলেন, কারণ সেটা করে কোনাে লাভ হবে না বলেই ধারণা করলেন। তিনি সাহসীর মতাে একা একাই মৃত্যুকে বরণ করলেন। 

ক্যাসিয়াস ও ব্রুটাসের মৃত্যু : অদ্ভুত ব্যাপার হলাে, মার্ক অ্যান্টনি সিসেরাের পুরােনাে বন্ধু ভিরাসকেও শত্রুর তালিকায় ফেলে দিলেন এবং তাকে প্রাণদণ্ডের আদেশ দিতে চাইলেন। ভিরাস তখনাে ম্যাসিলিয়ায় পালিয়ে থেকে আরাম করেই কাটাচ্ছিলেন। তবে শেষের দিকে তিনি তার লালসার চিহ্ন রেখে গেছেন, সেখানকার কিছু শিল্প এবং আঁকা ছবি তিনি কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছিলেন না, মার্ক অ্যান্টনিও একসময় ঠিক যা করেছিলেন সেইসবের জন্য ভিরাস তার জীবনটাই দিয়ে দিলেন। তৃতীয় ত্রয়ী শাসনব্যবস্থা চালু হবার পর থেকেই ইতালি নড়েচড়ে শক্ত হয়ে বসল। এবং সিনেটের লােকেরা আশঙ্কায় কুকড়ে গেল। তখন ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসের মুখােমুখী হবার সময়। ত্রয়ী শাসনের সেনাবাহিনীরা তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য গ্রিসে প্রবেশ করল (ডিরাকিয়ামে অক্টাভিয়ান অসুস্থ হয়ে পড়াতে তাকে বহন করে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয়)। ঈজিয়ান সমুদ্র থেকে দশ মাইল উত্তরে ম্যাসিডােনিয়ার পূর্ব দিকে ফিলিপি নামের স্থানে যুদ্ধ সংঘঠিত হচ্ছিল তখন (ফিলিপি নগরটি ম্যাসিডােনের রাজা ফিলিপের হাত ধরে প্রথম প্রবর্তিত হয়, যিনি ছিলেন মহামতি আলেক্সান্ডারের পিতা নগরটি স্থাপন করেছিলেন তিন শতাব্দী আগে এবং তার নামেই নগরটির নামকরণ করা হয়)। ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য হয়তো আরেকটু দেরি করাই সমীচিন হতাে। কারণ অ্যান্টনি এবং অক্টাভিয়ানকে সময়মতাে কোনাে কাজই সমাধা করতে পারেননি বলে নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতিও নেয়া হয়নি। ক্যাসিয়াস তাদের অপেক্ষা করতে বলেছিলেন কিন্তু ব্রুটাসের ধৈর্যে কুলাচ্ছিল না, তিনি বিষয়টির দ্রুত সমাধান চাচ্ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪২ সালের অক্টোবরে একটি যুদ্ধ সংঘঠিত হলাে এবং তাতে ব্রুটাস বেশ ভালােভাবেই অক্টাভিয়ানের বাহিনীকে পরাজিত করল। ক্যাসিয়াস ভালাে কিছুই করতে পারলেন না আর একটি অযৌক্তিক যুদ্ধে অর্থহীনভাবে মারা পড়লেন, যেই যুদ্ধে বলতে গেলে দুই পক্ষই ছিল সমানে সমান, কোনাে হারজিৎ ঘটেনি। ব্রুটাস এই খবর শুনে সাংঘাতিকভাবে মুষড়ে পড়লেন এবং কয়েক সপ্তাহ পরে নতুন আরেকটি যুদ্ধের আহ্বান জানালেন যেখানে তিনি বেশ ভালােভাবে বিজয়ী হলেন। পরে অবশ্য তিনিও আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন।

মার্ক অ্যান্টনি, ক্লিওপেট্রা ও প্রেম : ত্রয়ী শাসন ব্যবস্থা তখন রােমে পুরােদমে চলতে লাগল তবে তারা অবশ্য আলাদা হয়ে নিজের মতাে করে শাসন করাকেই শ্রেয় মনে করেছিল। লিপিডাস পেয়েছিলেন পশ্চিমের দিকের ভার আর অ্যান্টনি পূর্বের, আর অক্টভিয়ানকে রােমেই থাকতে হয়েছিল। এরকম হওয়াতে মনে হচ্ছিল যে অ্যান্টনি সবচেয়ে ভালাে আছে। পূর্ব দিকে রােমান শাসকেরা দীর্ঘদিন ধরে লুটপাট চালিয়ে এলেও সেখানে তখনাে গ্রাস করার মতাে বহু কিছু পড়ে ছিল। তাই অ্যান্টনি নতুন করে সেসব লুটপাট করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪১ সালের গ্রীস্মকালের মাঝামাঝি তিনি টারসাসে এসে পৌঁছেন, যে নগরটি এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ দিকের উপকূলে অবস্থিত, তখনাে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে ধনী নগর বলে পরিচিত ছিল। মিশরকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন ফল পেড়ে নেবার মতো পেকে গেছে সেখানে সিজার যখন থেকে ক্লিওপেট্রা এবং তার ছােটোভাইকে দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তখন থেকে মিশরে শান্তি বিরাজ করছিল। সেখানে না ছিল কোনাে যুদ্ধ, না বিদ্রোহ। এরকম কিছু গল্প প্রচলিত ছিল যে সিজার নাকি ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে রােমে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই ধরনের গল্পের কোনাে ভিত্তি নেই। গল্পগুলাে হয়তো বিভিন্ন নাটক-সিনেমার জন্য তার উপযােগী করেই তৈরি করা হয়েছে। ক্লিওপেট্রা বরাবর সেখানেই ছিলেন ঠিক যেখানে তার থাকার কথা ছিল, অর্থাৎ মিশরে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালে যখন তার ছােটোভাই তার চতুর্দশ জন্মদিনে উপস্থিত হলেন এবং রাজ্য পরিচালনায় একটি প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ দাবি করলেন, ক্লিওপেট্রা নীরবে এবং নিখুঁতভাবে বিষয়টির সমাধান করেছিলেন তাকে খাবারের সঙ্গে বিষ দিয়ে। আর তারপর থেকে মিশরের শাসন চলেছিল ক্লিওপেট্রার হাতে। এই হত্যাকাণ্ডের পরের কয়েক মাসে ক্লিওপেট্রা একটি চমৎকার নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিলেন, তিনি দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন যে ঘটনা কোনদিকে যায়। অ্যান্টনির মনে হচ্ছিল ক্লিওপেট্রা যেহেতু ত্রয়ী শাসন ব্যবস্থাকে সমর্থন করেননি এবং নিরপেক্ষ হিসেবে নিজেকে জাহির করেছেন, তাই তাকে ঠিকমতাে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। তিনি তাকে টারসাসে ডেকে পাঠালেন। ক্লিওপেট্রা একটি রাজকীয় জাহাজে চড়ে সেখানে এসে পৌঁছলেন এবং তার দিক থেকে আগে থেকে ঠিক করে রাখা সমস্ত যুক্তি ভালােমতাে বর্ণনা করলেন। সাত বছর আগে সিজারকে ঠিক যেমনভাবে মােহিত করেছিলেন, তেমনই মার্ক অ্যান্টনিকে যুক্তি দিয়ে নিজের মতে টেনে আনতে তার একটুও সময় লাগল না। আর তখন ক্লিওপেট্রার বয়স আঠাশে উন্নিত হয়েছে, আগের চেয়েও অনেক সুন্দরী তিনি তখন। কিছুক্ষণ একসঙ্গে থাকার পরে মার্ক অ্যান্টনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে ক্লিওপেট্রার কোনাে কারণেই কোনাে ক্ষতিপুরণ দেয়ার প্রয়ােজন নেই। তার বদলে তিনি ক্লিওপেট্রার সঙ্গে আলেক্সান্দ্রিয়া বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললেন। সেখানে গিয়ে তিনি একটি চমৎকার ছুটি কাটালেন, রানি ক্লিওপেট্রার সাহচর্যে তিনি যুদ্ধ আর রাজনীতির মারপ্যাঁচের কথা ভুলেই গেলেন।

ফুলভিয়ার অক্টাভিয়ানকে আক্রমণ ও তার দমন : ইতালিতে ফিরে এসে অক্টাভিয়ানও অতি আনন্দে সময় কাটাচ্ছিলেন। অ্যান্টনির স্ত্রী ফুলভিয়া (যিনি পূর্বে ক্লডিয়াসের স্ত্রী ছিলেন, আর তপ্ত আগুনের মতােই ছিল তার ক্রোধ) ওই পরিস্থিতিতে তিনি মারাত্মক রেগে গেলেন। তিনি দেখলেন যে অক্টাভিয়ান রােমে উপস্থিত আছে, সুতরাং অক্টাভিয়ানই সেই মানুষ যিনি পরবর্তীকালে রােমের শাসনের ভার হাতে তুলে নেবেন। আলেক্সান্দ্রিয়ায় ক্লিওপেট্রার সঙ্গে অ্যান্টনির আরামের ছুটিটা তিনি কখনােই পছন্দ করেননি। ফুলভিয়া তাই তখন সে বছরে তিনি কনসল হওয়া লুসিয়াস অ্যান্টনিয়াসকে (মার্ক অ্যান্টনির ভাই) বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটি বাহিনী তৈরি করে অক্টাভিয়ানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে বলেন। এভাবে ফুলভিয়া অক্টাভিয়ানকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিলেন, যাতে স্ত্রী এবং ভাইকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মার্ক অ্যান্টনি যেন অক্টাভিয়ানের উপরে ক্ষেপে উঠতে পারে। অক্টাভিয়ান কখনােই যােদ্ধা ছিলেন না, তাই নিজের বাহিনীর দায়িত্ব মার্কাস ভিপসানিয়াস অ্যাপ্রিপার হাতে দিয়ে রাখলেন, তিনি অক্টাভিয়ানের বয়সীই ছিলেন এবং অ্যাপােলনিয়ায় তিনি অক্টাভিয়ানের সঙ্গে লেখাপড়া করেছিলেন। অ্যাগ্রিপ্পা বিদ্রোহীদের বাহিনীকে উত্তর দিকে পারুসিয়ার দিকে (যেটি আধুনিক কালের পেরুগুয়ে) ঠেলে দিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৪০ সালে তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। মার্ক অ্যান্টনি নিজের পরিবারকে সহায়তা করার জন্য ছুটে আসছিলেন, কিন্তু ঘটনাগুলাে খুব দ্রুত ঘটে গেল, আর ফুলভিয়া গ্রিসে পালিয়ে গিয়েছিলেন ততদিনে, সেখানে যাওয়ার পরপরই তার মৃত্যু ঘটে। এভাবেই ঘটনাটির পরিসমাপ্তি ঘটে। 

সেক্সটাস পম্পেইয়াস : তবে তখন দেখে মনে হচ্ছিল যে ত্রয়ী শাসনব্যবস্থাকে আরেকবার খতিয়ে দেখা দরকার এবং যে সমস্ত সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, সেসব মেটানাে দরকার। আর তাই তিন শাসক দক্ষিণ ইতালিতে মিলিত হলেন এবং রােমকে শাসন করার জন্য নতুন করে শাসনের এলাকা ভাগ করলেন। মার্ক অ্যান্টনি পূর্ব দিকেই থাকলেন, কিন্তু অক্টাভিয়ান নিলেন ইতালি, গাউল এবং স্পেন। লিপিডাস ছিলেন তাদের মধ্যে যেন বেমানান, তাকে দেয়া হলাে আফ্রিকা। এই দলটিকে কার্যকর রাখতে একটি বিবাহ জরুরি হয়ে পড়ল। ঠিক যেমন সিজারের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল পম্পেইয়ের, কেবলমাত্র পম্পেইকে পরিবারে আটকে রাখার উদ্দেশ্যে; আর তখন অক্টাভিয়ানের সুন্দরী বােনের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হলাে মার্ক অ্যান্টনির।  কিছুকালের জন্য সমস্তকিছু সুন্দর আর প্রশান্তির বলে মনে হচ্ছিল। তবে তারপর অক্টাভিয়ান এবং অ্যান্টনি যে যার রাস্তায় হাঁটা দিলেন। অন্তত অক্টাভিয়ানের জন্য বিপদ চলতেই থাকল। সমস্যা হয়ে দাঁড়াল নতুন একজন পম্পেই; সেক্সটাস পম্পেইয়া, পম্পেইয়ের কনিষ্ঠ পুত্র। সেক্সটাস তার পিতার সঙ্গে ফারসুলাসের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরে তার সঙ্গে তিনি মিশরেও যান। মিশরের উপকূলে যেখানে তার বাবাকে হত্যা করা হচ্ছিল, সেখানে জাহাজে বসে তিনি সেই দৃশ্য দেখেছিলেন। মুন্ডার যুদ্ধেও ছিলেন তিনি, যে যুদ্ধের পরে তার বড়াে ভাইকে হত্যা করা হয় এবং তখন তিনি নিরাপদে পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু সিজার স্পেন ছেড়ে চলে যাবার পরেই তিনি নতুন করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করেন। ধীরে ধীরে সেক্সটাস তাদের সমস্ত খবরাখবর রাখতে শুরু করেন। সিজারকে যখন হত্যা করা হলাে, তখন তিনি একটি নৌবহর তৈরি করে সমুদ্রে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। পরে তিনিই সবচেয়ে সফল সামুদ্রিক দস্যু হিসেবে পরিচিত হন। তিনি সিসিলি দখল করেছিলেন এবং সেটাই তার বড়াে বিজয়। কারণ রােম তার খাদ্য সরবরাহের জন্য সিসিলির উপরে নির্ভর করত। সিসিলি দখল করার মানে হলাে রােমের টুটি চেপে ধরা। আর যখন ইচ্ছে তখনই তিনি সেই চাপে জোর দিতে পারতেন। এছাড়াও যদি মিশর থেকে খাদ্য বহনকারী কোনাে জাহাজ এসে ভিড়ত, তিনি সেখানে জলদস্যুর কায়দায় তাকে আটকে রাখতে পারতেন। খাদ্যে অভাব এবং অব্যবস্থা পম্পেইয়াসের সঙ্গে রােমকে একটি সমঝােতা আসতে বাধ্য করলল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯ সালে ত্রয়ী শাসক ন্যাপলসের উত্তর-পশ্চিমে একটি বন্দর, মিসেনামে তার সঙ্গে মিলিত হলেন। সেখানে তাদের আলােচনায় সিসিলি, সার্ডিনিয়া, কর্সিকা এবং গ্রিসের দক্ষিণ দিকের অংশ পম্পেইয়াসকে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে।

সেক্সটাসের পরাজয় ও মৃত্যু, পথের কাঁটা কেবল মার্ক অ্যান্টনি : অক্টাভিয়ানের জন্য এটা বিশাল উদারতা কিন্তু তিনি সময় নষ্ট করতে চাননি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ সালের মধ্যে অক্টাভিয়ান নানান সমস্যা উতরে নিজের একটি নৌবহর দাঁড় করাতে সক্ষম হলেন, যেটি তিনি আগে অ্যাগ্রিপ্পার অধীনে দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি তখন সেক্সটাস পম্পেইয়াসের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য রওনা দিলেন। এবং অ্যাগ্রিপ্পার নৌবহর তার বহরের পিছনে অনুসরণ করতে শুরু করল। ঝড়ে অ্যাগ্রিপ্পার নৌবহরের ব্যাপক ক্ষতি হলাে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতালি এবং সিসিলির মাঝপথে সেক্সটাসকে তিনি ঘায়েল করতে পারলেন। সেখানে নৌ যুদ্ধ শুরু হরাে এবং সেক্সটাস পরাজিত হয়ে অ্যাগ্রিপ্পার বিজয় হলাে। সেক্সটাস পালিয়ে গেলেন এবং এশিয়া মাইনরে আশ্রয় নিতে সমর্থ হলেন। কিন্তু এই আশ্রয় তাকে বাঁচাতে পারল না। সেখানে তিনি অ্যান্টনির সৈন্যদের হাতে ধরা পড়লেন এবং তাকে হত্যা করা হলাে। এর মধ্যে লিপিডাস সেক্সটাসের বিরুদ্ধে অক্টাভিয়ানের সঙ্গে ছিলেন, সিসিলিতে এসে নােঙর করলেন। তিনি কম করে হলেও ত্রয়ী শাসন ব্যবস্থায় নিজের প্রাপ্য সম্পর্কে বুঝতেন। আর তাই সিসিলিকে নিজের করে পেতে চাইলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর সৈন্যরা অক্টাভিয়ানের পক্ষেই ছিল, যিনি চাইতেন যে লিপিডাস সমস্ত দায়িত্ব থেকে নিজেকে অব্যহতি দিয়ে রােমে শান্তিতে বসবাস করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ সালের মধ্যে পশ্চিমের সম্পূর্ণ এলাকা অক্টাভিয়ানের হাতে চলে এল। ফুলভিয়া ততদিনে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেক্সটাস পম্পেইয়াসও মৃত আর লিপিডাস একেবারেই শীতল। কেবলমাত্র মার্ক অ্যান্টনি তার সঙ্গে নানান বিরােধিতা তৈরি করেন। আর মার্ক অ্যান্টনির আচরণ দেখে তার মনে হতাে যে তিনি ছাড়া আর কারাে সঙ্গে মার্ক লড়াই করার কোনাে আগ্রহই রাখেন না।

অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা

পার্থিয়ায় লেবিয়েনাস : অক্টাভিয়ার সঙ্গে মার্ক অ্যান্টনির বিবাহ কোনাে ভালাে পরিণতি বয়ে আনেনি, কারণ মার্ক অ্যান্টনি কখনােই তাকে ততটা মূল্য দেননি। তিনি যত তাড়াতাড়ি পেরেছেন, ক্লিওপেট্রার সঙ্গে আলেক্সান্দ্রিয়ায় চলে গেছেন, তিনি সেটাই করেছেন যা করলে তার ভালাে লাগে। তিনি যখন মিশরের বাইরে ছিলেন, তখন পার্থিয়ার লােকদের সঙ্গে কিছু রেষারেষি চলছিল। রােমের একজন বন্ধুরূপী শত্রু কুইন্টাস লেবিয়েনাসের কারণে এমনটা ঘটেছিল। তিনি সিজারের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন সেনাপতির পুত্র, যিনি গাউলে সিজারের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন এবং পরে পম্পেইয়ের পক্ষ অবল্লম্বন করেছিলেন। আর তারপর মুন্ডার যুদ্ধে তিনি নিহত হন। তরুণ লেবিয়েনাস সিজারের শক্ত বিরােধী হয়ে উঠলেন এবং ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াসের অধীনে থাকা বাহিনীতে যােগদান করলেন। এমনকি ফিলিপির যুদ্ধের পরেও তিনি আত্মসমর্পন না করে পার্থিয়ার পক্ষে যােগ দিলেন। তখন পার্থিয়ারাজ ছিলেন অরােডিস, যার বাহিনী ক্র্যাসাসকে পরাজিত করেছিল। নিজেকে বাঁচিয়ে তিনি রােমকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন। লেবিয়েনাস অবশ্য তাকে রােমের ত্রয়ী শাসনব্যবস্থার বিপক্ষের মতটাকে ব্যবহার করে লাভজনক পরিস্থিতিতে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যে বিপক্ষ মত সিরিয়া এবং এশিয়া মাইনরে বিদ্যমান ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৪০ সালে পার্থিয়ার বাহিনী লেবিয়েনাসের নেতৃত্বে পশ্চিম দিকে এগােনাে শুরু করল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সিরিয়া এবং এশিয়া মাইনরে দখলের কাজ চালালেন। রােমান বাহিনীর অনেক সৈন্য তখন বিশ্বাসঘাতকের খাতায় নাম লেখাল।

পার্থিয়া সংকট নিরসনে মার্ক অ্যান্টনির ব্যর্থতা : এই ধরনের রােমান পরাজয় মার্ক অ্যান্টনির রােমান অংশে সংঘঠিত হয়েছিল আর পালটা আক্রমণ করাটা ছিল তার দায়িত্ব। এই উদ্দেশ্যে মার্ক অ্যান্টনি পাবলিয়াস ভেনটিডিয়াস ব্যাসাসের সাহায্য নেন। প্রথম জীবনে ভেনটিডিয়াস একজন দরিদ্র মানুষ ছিলেন যিনি যানবাহন ভাড়া খাটাতেন। গাউলে সিজারের বাহিনীতে যুদ্ধ করে তিনি সেনা সদস্যের আখ্যা পান। লেবিয়েনাসের ঠিক উলটো কাজ করেন তিনি, তিনি যুদ্ধের পরে সিজারের পক্ষই থেকে যান এবং সিজারের হত্যার পরে মার্ক অ্যান্টনির পক্ষে কাজ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯ সালে ভেনসটিডিয়াস এশিয়া মাইনরে চলে যান এবং শত্রুদের মুখােমুখি পান। উপকূলের পূর্বাঞ্চলে তিনি পার্থিয়ার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং তাদের দখলকৃত স্থানগুলাে থেকে তাদের উৎখাত করেন। পরের বছর পার্থিয়ার বাহিনী আবার একই চেষ্টা করে, আর ভেনটিডিয়াস তাদের আগের চেয়েও করুণভাবে পরাজিত করিয়ে পাঠিয়ে দেন। সেই দ্বিতীয় যুদ্ধের দিনটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৮ সালের ৯ই জুন। ক্র্যাসাসের পরাজয়ের পনেরােতম বার্ষিকী সেদিন। অরোডিস সেই বছরে মৃত্যুবরণ করেন। পার্থিয়া রােমানদেরকে তাদের পরিধি বিস্তার করতে বাধা দিচ্ছিল, আরেক দিকে তাদের নিজেদের পরিধিও কোনােক্রমেই কমছিল না, কখনাে কমেওনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭ সালে মার্ক অ্যান্টনি পূর্বাঞ্চলে ফিরে এলেন এবং ভেনটিডিয়াসের বিজয়ে কোনােমতেই আনন্দিত হতে পারলেন না। তিনি ভেনটিডিয়াসকে অব্যহতি দিয়ে রােমে পাঠিয়ে দিলেন তার বিজয়ােৎসবের জন্য। তারপর পার্থিয়ায় নিজের বাহিনী নিয়ে একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন (তার আগে অবশ্য আলেক্সান্দ্রিয়ায় কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে এলেন)। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ সালে অ্যান্টনির যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলাে, যা হলাে একটি অসফল কাজ। তিনি পার্থিয়ার বাহিনীকে পরাজিত করতে পারলেন না। তার উপরে পার্থিয়ায় আক্রমণ করে তার প্রভূত ক্ষতি হলাে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তিনি পরের বছর আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জিতলেন। এই সমস্ত করে তার ক্ষমতা কিছুটা ক্ষুন্ন হলো। তিনি আলেক্সান্দ্রিয়ায় ফিরলেন নিজের বাহিনীর সুনাম বেশ খানিকটা খুইয়ে। 

মার্ক অ্যান্টনির বিরুদ্ধে প্রচারণা ও যুদ্ধের পরিস্থিতির সূত্রপাত : অন্যদিকে, সেই একই সময়ে পশ্চিমাঞ্চলে অক্টাভিয়ান তার ক্ষমতার চূড়ান্তে অবস্থান করছিলেন। অক্টাভিয়ানের কাছে মনে হলাে যে এটাই সময় তার পুরােনাে শত্রুর সঙ্গে হিসেবনিকেশ সেরে নেয়ার। তিনি রােমে নিজেকে তুমুল জনপ্রিয় করে তুললেন, ইতালিতে তিনি পার্বত্য অঞ্চলের ডাকাতি বন্ধ করলেন, রােমের ইমারতগুলােতে নানারকমের সংস্কার কাজ করলেন, এবং নানাভাবে নিজেকে বিশ্বাসযােগ্য এবং আস্থাভাজন শাসক হিসেবে প্রমাণ করলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮ সালে তিনি লিভিয়াকে বিবাহ করলেন, যিনি তার সঙ্গে দীর্ঘকাল থাকার প্রতিজ্ঞা করলেন এবং অ্যান্টনির বিদেশি রানির সঙ্গে তুলনা করার মতাে একজন হয়ে উঠলেন। রােমান নাগরিকদের কাছে মনে হলাে যে অ্যান্টনি তার শাসনকাজের সমস্ত চিন্তা পূর্বাঞ্চলে ফেলে রেখে ক্লিওপেট্রার সঙ্গে জীবন কাটানাের মনস্থ করেছেন। তিনি যে মিশরে গ্রিক কাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেই খবর রােমে আসতে সময় লাগল না। আর তিনি কেবল মিশরের রানিকে খুশি করার কাজেই নিয়ােজিত আছেন, তাও জানা গেল। সন্দেহাতীতভাবে এই খবরগুলাে ছিল বাড়িয়ে চড়িয়ে বলা। অক্টাভিয়ান ক্লিওপেট্রাকে লেখা অ্যান্টনির চিঠি এবং তার দলিল সংগ্রহ করলেন, যা দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে চাইলেন যে তিনি ক্লিওপেট্রার হাতে রোমকে তুলে দেবেন (হয়তো সেগুলো অক্টাভিয়াসের দ্বারা জাল করা নথি ছিল। কিন্তু আবার এগুলো সত্যিও হতে পারে, যদি হয় তাহলে বলতে হবে অ্যান্টনি আসলে ছিলেন ভীষণ বােকা ছিলেন, যিনি এইসমস্ত কথা কাগজে লিখিতভাবে রেখে দিয়েছিলেন)। খ্রিস্টপূর্ব ৩২ সালে অ্যান্টনি অক্টাভিয়ার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান। এই ঘটনা দেখে মনে হচ্ছিল যেন ক্লিওপেট্রাকে আইনের চোখে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করতে পারেন, তারই জন্য এই পদক্ষেপ। অক্টাভিয়ান খুব যত্ন করে রােমান জনগণের মধ্যে মিশরীয় রানী সম্পর্কে ঘৃণা এবং ভয়ের বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর তখন সিনেটকে মিশরীয় রানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণায় রাজি করিয়ে ফেললেন। মার্ক অ্যান্টনি বুঝতে পারলেন যে এই যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে তার বিরুদ্ধে এবং সেটা বুঝতে পেরেই তিনি তার তিন বছরের ছুটি শেষে যেন কাজে যােগদান করলেন। তিনি জাহাজ সংগ্রহ করে গ্রিসে চলে গেলেন, সেখানকার পশ্চিম দিকের এক স্থানে নিজের জন্য ঘাঁটি গাড়লেন এবং প্রথমে এপিরাস আর তারপরে পর্যায়ক্রমে ইতালিতে অনুপ্রবেশ করার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু অক্টাভিয়ানের নৌ-বহর অ্যাগ্রিপ্পার নেতৃত্বে সেই গ্রিসের পশ্চিমেই এসে ভিড়ল। অ্যান্টনির জাহাজের বহর অক্টাভিয়ানের চেয়ে দ্বিগুণ বড়াে। ক্লিওপেট্রা তাকে যুদ্ধ অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ দিলেন। তিনি বললেন যুদ্ধে অ্যান্টনির জয় নিশ্চিত।

অ্যাক্টিয়ামের  যুদ্ধে মার্ক অ্যান্টনির পরাজয় ও আত্মহত্যা : খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে যুদ্ধ শুরু হলাে। দক্ষিণ এপিরাসের একটি বন্দর অ্যাকটিয়ামে যুদ্ধ শুরু হলাে। যুদ্ধটাকে বলা হয় চতুর্থ গৃহযুদ্ধ। প্রথমে অ্যান্টনির বিশাল জাহাজের বহরের সামনে অক্টাভিয়ান সামান্য সাহসিকতা দেখালেন এবং তখন মনে হচ্ছিল যুদ্ধে অনেক বেশি সম্পদ থাকলেও কোনাে লাভ নেই। শেষপর্যন্ত অ্যাগ্রিপ্পা অ্যান্টনিকে তার জাহাজগুলােকে এক সারিতে রেখে নিজের জাহাজ নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলেন। এর ফলে যা হলাে, তিনি সােজা ক্লিওপেট্রার আটটি জাহাজের বহর গিয়ে আঘাত করলেন। কাহিনি অনুযায়ী, ক্লিওপেট্রা তখনই তার জাহাজের বহর নিয়ে পিছন দিকে পালিয়ে গেলেন। অ্যান্টনি যেই জানতে পারলেন যে ক্লিওপেট্রা এবং তার জাহাজের বহর যুদ্ধের স্থান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি তার জীবনের সবচেয়ে নির্বুদ্ধিতার কাজটি করলেন। তিনি নিজের নৌবহর (যা হয়তো পরে জিততেও পারে) ফেলে একটি ছােটো নৌকা নিয়ে পলায়নপর ভীতু রানির পিছনে ছুটলেন। তার নৌবহর চরম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু পরিচালক ছাড়া বেশিক্ষণ চালাতে পারছিল না। সন্ধ্যার আগে আগে তার নৌ-বহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হলাে। অক্টাভিয়ান নিকোপােলিস নগর, অথবা “বিজয়ের নগর” খুঁজে পেলেন যুদ্ধক্ষেত্রের পাশেই। সেই নগরটি পরে এপিরাসের রাজধানী হয়েছিল। তারপর তিনি অসম্ভব বিজয় সম্ভব করে বিশাল উৎসবের আমেজে রােমে ফিরলেন। এর মধ্যে অ্যান্টনি এবং ক্লিওপেট্রা মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে তাদের পক্ষে অক্টাভিয়ানের পালটা আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে সেই আক্রমণের ঘটনা ঘটে। অক্টাভিয়ান পূর্ব দিক থেকে জুডিয়ার পথ ধরে আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসেন। অ্যান্টনি বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু কোনাে লাভ হয় না। অগাস্টের এক তারিখে অক্টাভিয়ান আলেক্সান্দ্রিয়ায় প্রবেশ করেন এবং মার্ক অ্যান্টনি সেইদিনই আত্মহত্যা করেন। 

ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যা ও অক্টাভিয়াসের অধীনে মিশর : তখন আর বাকি থাকল কেবল ক্লিওপেট্রা। তখনাে তিনি পরমা সুন্দরী। তিনি তার সৌন্দর্য এবং কমনীয়তা যেমন সিজার আর অ্যান্টনির উপরে প্রভাব ফেলার জন্য ব্যবহার করেছেন, তেমনি অক্টাভিয়ানের উপরেও করতে পারবেন বলে তার মনে হলাে। আর তার বয়স তখন মাত্র উনত্রিশ বছর, মােটেও ততটা বয়স্কা নন। এই উদ্দেশ্যে তিনি অক্টাভিয়ানের সঙ্গে একটি সাক্ষাতকার প্রার্থনা করলেন। তাদের কথাবার্তা ভালােই চলল, কিন্তু অতি ভদ্র অক্টাভিয়ান তার বাকচাতুর্যে তেমন মােহিত হলেন না। তিনি সিজারও নন, আর অ্যান্টনিও নন, কোনােকিছুই তাকে তার লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দিতে পারত না। ক্লিওপেট্রা বুঝলেন যে অক্টাভিয়ান একমাত্র তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারে তার বিজয় উৎসব দেখানাের জন্য, যেখানে তার সমর্থকদের মিছিলের পেছনে হয়তো শিকল দিয়ে বন্দি ক্লিওপেট্রাকে বেঁধে নিয়ে এগােনাে হবে। তবে এই শেষ অপমান থেকে বাঁচার জন্য একটি পথ ক্লিওপেট্রার সামনে খােলা ছিল। তিনি সেই বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। পরে অক্টাভিয়ানের পত্রবাহক তাকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার লিখিত আদেশ নিয়ে উপস্থিত হলেন এবং তাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করলেন। অক্টাভিয়ান আগেই জানতেন ক্লিওপেট্রার এরকম একটা পরিণতির সম্ভাবনার কথা, তাই তিনি তার বাড়ি থেকে সমস্ত ধরনের ছুরি-কাঁচি এবং কাটা যায় এমন যে কোনাে কিছু সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্লিওপেট্রা কোনাে না কোনােভাবে আত্মহত্যাকে সফল করতে পেরেছিলেন এবং সেটাই ছিল তার শেষ বিজয়। প্রচলিত কাহিনিতে দেখা যায় যে তিনি ফিগ ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে সাপ আনিয়েছিলেন এবং সইে সাপের দংশনে আত্মহত্যা করেছিলেন। ধরা যেতে পারে যে তার নাটকীয় জীবনের নানান অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্যে এইটিই সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগানাে। তবে সত্যি কথা বলতে কী, তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ কারােরই জানা নেই এবং জানার আর কোনাে সুযােগও নেই। মিশরকে রােমান প্রদেশ হিসেবে ঘােষণা দেয়া হলাে এবং অলিখিতভাবে সেটি হয়ে গেল অক্টাভিয়ানের সম্পত্তি। এবাবেই টলেমিড রাজবংশের শেষ বাতিটি নিভে গেল এবং আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর তিন শতাব্দী পরে তার বন্ধু টলেমির লেগেসি সমাপ্ত হলো।

রোমান শান্তি, রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা ও সেই সময়ের কতিপয় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব

রোমান শান্তি, অক্টাভিয়ানের সম্রাট হয়ে ওঠা ও রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা : অক্টাভিয়ান তখন তার উৎকর্ষের চরমে পৌঁছে গেছেন। সেই সময়টা টিবারিয়াস গ্র্যাকাসের রােমের শাসনকে পুনর্গঠন করার প্রচেষ্টার সময় থেকে মাত্র এক শতাব্দী পরের ঘটনা। এক শতাব্দী ধরে সন্ত্রাসের রাজনীতি এবং চারটি পৃথক গৃহযুদ্ধ, সবকিছুরই অবসান ঘটেছে তখন। শতাব্দীজুড়ে বিশেষ কিছু নাম মানুষের মুখে মুখে উঠে এসেছে : মারিয়াস, স্যুলা, পম্পেই, সিজার, মার্ক অ্যান্টনি, আর তখন বাকি ছিল কেবল একটি নাম, অক্টাভিয়ান। তখন আর কোনাে শত্রু বাকি ছিল না, আর কোনাে প্রতিপক্ষ ছিল না যাকে ভয় পেতে হবে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সালে অক্টাভিয়ান রােমের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী শাসক হিসেবে গণ্য হলেন। পরপর দুই শতাব্দীর মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব ২৯ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখে জানুসের মন্দির প্রথমবারের মতাে বন্ধ করা হলাে। শেষপর্যন্ত শান্তি বিরাজ করতে শুরু করল। তখনকার দিনের বিষয়টা এমন ছিল না যে সংস্কৃতিটা কেবল যুদ্ধ এবং আক্রমণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। অক্টাভিয়ানের শান্তি পরিস্থিতি আসার ফলে রােমের সংস্কৃতি আরাে নতুন মাত্রা পেয়েছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে অশান্তির পরে সম্পূর্ণ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি নেমে এসেছিল। পশ্চিমা জগতে এটাই ছিল সবচেয়ে লম্বা সময়ের জন্য বিরাজমান শান্তি যাকে বলা হয় “প্যাক্স রােমান” (রােমান শান্তি)। তবে এই শান্তি এসেছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পরে, পাঁচশ বছরের ত্যাগ এবং ক্রমাগত যুদ্ধ ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। তবে এর সৃষ্টি সেই ছােট্ট একটি গ্রাম থেকে, যে গ্রামই একদিন পুরাে পৃথিবী শাসন করে ছেড়েছে। আর শেষ পর্যন্ত একজনই সেই শান্তির জন্য স্বীকৃতি পেতে পারতেন এককভাবে, একজন শাসক, অক্টাভিয়ান। খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে অক্টাভিয়ান অগাস্টাস পদবী পান, যার অর্থ “ভালাে মানুষ”। নামটিকে বরাবরই ইতিহাসে সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসেবে ধরা হতাে।সিজারের মতো তিনিও সবসময় নিজের জন্মের মাসটির নাম নিজের নামে হােক, এটা চাইতেন। প্রজাতন্ত্রের দিনে যে মাসটির নাম ছিল “সেক্সটিলিস” তখন নামকরণ হলাে “অগাস্টাস”, যে মাসের নাম আমরা জানি “অগাস্ট”। অগাস্টাস বরাবরই বলতেন যে তার ইচ্ছা রােম প্রজাতন্ত্র হিসেবেই থাকুক। তিনি কখনাে নিজেকে রাজা হিসেবে দেখেননি এবং প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেই বরাবর শাসনকাজ চালিয়েছেন। যাই হােক, তিনি যাবতীয় কার্যালয়ে নিজের সমর্থকদের বসিয়ে দিলেন। তিনি নিজেকে “ইমপারেটর” হিসেবে, অর্থৎ নেতা হিসেবে গণ্য করতেন। ল্যাটিন সেই শব্দটিই আমাদের কাছে “এমপেরর” (সম্রাট) হিসেবে এসেছে। আর সেই সম্রাট যেই রাজ্যে শাসন করেছেন তার পরিচয় হয়েছে রােমান সাম্রাজ্য হিসেবে। 

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বগণ : সেই সময়ে রোমান সমাজে সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছিল, আর সেই সব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য অনেকের নামই স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন –

  • সিসেরো : শেষ এক শতাব্দীর ঝড়ের পরেও, রােম সংস্কৃতি আর সামরিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রইল। সিসেরাে নিজেই রােমের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির বাহক হয়ে ছিলেন। রােমান যে কোনাে লেখকের তুলনায় তার লেখাগুলাে অনেক বেশিদিন ধরে পঠিত হয়েছে এবং গ্রহণযােগ্য হয়েছে। তার বিখ্যাত বক্তৃতাগুলাের মধ্যে সাতান্নটি পুরােপুরি লিখিত আকারে দেখতে পাওয়া যায় এবং বাকি আশিটি আংশিকভাবে পাওয়া যায়। বক্তৃতাগুলাে তিক্ত ভাষায় রচিত, তবে সেখানে যে ভাব পাওয়া যায়, তা কোনাে মানদণ্ডেই নিম্নমানের রুচিকে ইঙ্গিত করে না। কিন্তু তখনকার যুগে এখনকার মতাে খেলােয়াড়সুলভ মনােভাব কিংবা মুখােমুখি সুস্থ কাজ বা কথার মাধ্যমে যুক্তিতর্কের সংস্কৃতি ছিল না। তাই তখনকার সময়ের জন্য তাদের আচার আচরণ স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নেয়া হয়; ল্যাটিন ভাষায় সিসেরাের যে দখল এবং পারদর্শিতা ছিল, তা ওই সময়ের আর কোনাে লেখকের মধ্যেই দেখা যায়নি। দুই হাজার বছর পরেও তাকেই ল্যাটিন ভাষার সবচেয়ে সম্মানিত লেখক বলে মনে করা হয়। সিসেরাে ভাষাবিজ্ঞান এবং দর্শন সম্বন্ধেও প্রচুর লিখেছেন। অবশ্য এইসমস্ত বিষয়ে তিনি নিজের আবিষ্কৃত নতুন কোনাে তথ্য উপস্থাপন করেননি, কিন্তু প্রাচীন গ্রিক দর্শন বা ভাষাজ্ঞানকে নতুন রূপে এবং রােমান সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে উপস্থাপন করেছেন। এ ছাড়াও, তার লেখা প্রায় এক হাজার চিঠি এখনাে পঠিত হয়; যে একেকটি চিঠিতে তিনি সেই কালের একটি দিনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তথা সামগ্র কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আলােকপাত করেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, তার চিঠিগুলােতে তিনি এতটাই খােলাখুলি লিখেছেন যে নিজের বিভিন্ন দূর্বলতার প্রসঙ্গও এড়িয়ে যাননি। তার লােকদেখানাে কাজকর্ম, প্রশংসা পাওয়ার জন্য তার অপেক্ষা, তার নিরাসক্ত থাকার স্বভাব, নিজেরে প্রতি করুণা জাগার মতাে অক্ষমতা, কিছুই লুকাননি তিনি। এইসমস্ত কিছুর পরেও সিসেরাে তাদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় এবং মানবিক রােমান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি ছিরেন সৎ এবং মানবিক, অথচ বােকা ছিলেন না, তিনি ছিলেন শান্ত অথচ একটি নির্দিষ্ট পরিসরে যে কোনাে সাহসী প্রতিবাদ করার নজির আছে তার।
  • সিজার : সিসেরাের সময়ের গদ্য লেখকদের মধ্যে তার পরেই যার অবস্থান, তিনি সিজার। গাউলের যুদ্ধে সিজারের আদেশ নির্দেশ এবং তার ব্যাখ্যা এখনাে বিদ্যালয়ে পড়ানাে হয়। সেই বক্তব্যের প্রথম বাক্য, “গাউলকে তিনটি ভিন্ন ভাগে ভাগ করা হবে”- ছিল তার রাজনৈতিক চরিত্রের প্রাণ। সেই বক্তব্যটি লিখিত হয়েছিল একজন যুদ্ধরত সৈনিকের মনােবল দিয়ে; স্পষ্ট, সহজ এবং সরাসরি, সেখানে ভাষায় কোনাে অনর্থক অলঙ্কার ব্যবহার করা হয়নি। তবে দুর্ভাগ্যবশত তার বিভিন্ন বক্তৃতা, যা সেই সময়ে তুমুল সাড়া জাগিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে আর পঠিত হতে দেখা যায়নি। 
  • লুক্রেটিয়াস : সেই সময়ের রােমান কবিদের মধ্যে দুটো নাম উল্লেখ না করলেই নয়। তাদের মধ্যে একজন হলেন টাইটাস লুক্রেটিয়াস কারুস, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৫ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার রচিত দীর্ঘ কবিতা “De Natura Return.” (“জিনিসপত্রের স্বভাব”), যা খ্রিস্টপূর্ব ৫৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, এই কবিতাই তাকে বিখ্যাত হতে সাহায্য করে। এই কবিতায় লুক্রেটিয়াস গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরাসের দর্শন অনুসারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই দর্শন অনুসারে প্রতিটি জিনিসই একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা থেকে সৃষ্টি, কি ভাষায় যাকে অ্যাটম” (“অনু”) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার এই রচনায় বিশ্বকে একটি যৌক্তিক, ভিন্ন দ্রব্যে পরিপূর্ণ এবং সৌন্দর্যে মণ্ডিত স্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।  প্রাচীন যত সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা আছে, তার মধ্যে লুক্রেটিয়াসের কবিতাই আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে কাছাকাছি এবং একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা। পরের শতাব্দীগুলােয় এই কাব্যগ্রন্থ প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু ১৪১৭ সালে এই রচনার একটি লিখিত রূপ হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া যায়। বলতে গেলে ছাপানাের কায়দা আবিষ্কার হবার ঠিক পরপর। তাই কবিতাগুলাে অনেক বেশি করে ছাপা হতে থাকে এবং অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতাগুলাে নিঃসন্দেহে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ে আধুনিক চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখে। 
  • ক্যালুটাস : এ ছাড়া হালকা চালে রচিত অথচ অনেক বেশি সুন্দর শব্দসম্ভার পাওয়া যায়। গাইয়াস ভ্যালেরিয়াস ক্যাটুলাসের রচনায়। তার অসংখ্য রচনার মধ্যে অন্তত ১১৬টি গীতিকবিতা দীর্ঘকাল ধরে বেঁচে ছিল। তার মধ্যে কিছু কিছু অবশ্য আজকালকার যুগে অশ্লীল বলে গণ্য হতে পারে, কিন্তু বাকিগুলাের মধ্যে বেশ কিছু মূল্যবান এবং মানুষের মনকে স্পর্শ করে। তাদের মধ্যে অনেকগুলাে “লেসবিয়া” নামের এক নারীর কথা বলে, এবং তিনি (ক্লডিয়াসের বােন) ক্লডিয়া ছাড়া আর কেউ নন, যার সঙ্গে ক্যাটলাস লক্ষ্যবিহীন এবং মাত্রাতিরিক্ত ভালােবাসায় নিমজ্জিত ছিলেন। গ্রিক কবিতার বহমানতা ক্যাটুলাসের হাত ধরেই ল্যাটিন ভাষার কবিতায় সংযােজিত হয়েছে। 
  • স্যালাস্ট : সেই সময়ে রােমে অনেক ইতিহাসবিদের উদ্ভব হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন গাইয়াস ক্রিসপাস স্যালাসটিয়াস, ইংরেজিতে যাকে বলা হয়। স্যালাস্ট। তিনি ক্লডিয়াসের অনুসারীদের মধ্যে একজন ছিলেন আর পরে অনুসারী হয়েছিলেন সিজারের। কাটোর বাহিনী নিউমিডিয়ায় তাণ্ডব চালানাের পরপর সিজার তাকে নিউমিডিয়ায় গভর্নর নিযুক্ত করে রেখে গিয়েছিলেন। কিছু সামঞ্জহীন কাজের জন্য তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। বিষয়গুলাে কখনােই আইনের আওতায় আনা হয়নি। কিন্তু স্যালাস্ট, যিনি তার আফ্রিকায় তার নিয়ােগের আগে অনেক দরিদ্র ছিলেন, পরবর্তীকালে ধনী হিসেবে পরিচিত হন, যেটা তখনকার সময়ে তার অভিযােগ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল। তিনি ক্যাটিলাইনের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে লিখেছিলেন এবং অন্য এক ইতিহাসে (হয়তো তার আফ্রিকায় থাকা থেকে প্রভাবিত হয়ে লেখা) জুগার্থার সঙ্গে ঘটিত পরাজয় নিয়েও লিখেছিলেন। তিনি রােমের সাধারণ ইতিহাস নিয়েও লিখেছিলেন কিন্তু তার অল্প অংশই পরবর্তীকালে পঠিত হয়েছে।
  • কর্নেলিয়াস নেপােস : কর্নেলিয়াস নেপােস ছিলেন ক্যাটুলাস এবং সিসেরাের বন্ধু। তিনি রােমান এবং গ্রিকদের মধ্যে মহান মানুষদের ইতহািস লিপিবদ্ধ করেছেন। 
  • মার্কাস টেরেনটিয়াস ভারােস : মার্কাস টেরেনটিয়াস ভারােসের দীর্ঘ নব্বই বছরের জীবনটা পুরােটাই নানান ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে (খ্রিস্টপূর্ব ১১৬ সাল থেকে খ্রষ্টপূর্ব ২৭ সাল পর্যন্ত) তিনি পম্পেইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, কিন্তু সিজারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন এবং ক্ষমা পান। তিনি এই কাহিনি লিখে গেছেন এবং এ ছাড়াও তিনি ৬০০ ভলিউম লিখেছেন বলে জানা যায়। তার মধ্যে বেশিরভাগই ল্যাটিন ভাষায় লেখা। ভারােস যখন আশি বছর বয়ষ্ক তখনকার তখন তিনি কৃষিকাজের উপরে একটি বই লিখেছিলেন যা তার মৃত্যুর পরেও বহুবছর পঠিত হয়েছে। 

এর পর রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয়, রোমান সাম্রাজ্য সম্পর্কে জানতে এখানে যান। 

তথ্যসূত্র

  • The Roman Republic, Isaac Asimov, Houghton Mifflin Harcourt (March 1, 1973)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.