সাহারা পাম্প তত্ত্ব ও উপকূলীয় পথে আধুনিক মানুষের অভিবাসন

সাহারা পাম্প তত্ত্ব

ভূমিকা

সাহারা পাম্প তত্ত্ব (Sahara pump theory) একটি হাইপোথিসিজ যা ব্যাখ্যা করে কিভাবে উদ্ভিদ এবং প্রাণীরা লেভান্ট অঞ্চলের একটি স্থল সেতুর (land bridge) মাধ্যমে ইউরেশিয়া এবং আফ্রিকার মধ্যে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এটি অনুসারে আফ্রিকায় অনেক হাজার বছর ধরে স্থায়ী ঘন বৃষ্টিপাতের সময়কাল চলছিল (যা প্লুভিয়াল পিরিয়ড নামে পরিচিত) তা আশলে “ওয়েট-গ্রিন সাহারা” ফেজ বা দশার সাথে সম্পর্কিত। আর এই দশায় বৃহত্তর হ্রদ এবং এখনকার চেয়েও আরও অনেক নদী বিদ্যমান ছিল। এর ফলে এলাকায় পাওয়া উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতে পরিবর্তন ঘটে। নদী করিডোর বরাবর অভিবাসন বন্ধ হয়ে যায় যখন, ১৮ লক্ষ থেকে ৮ লক্ষ বছর পূর্বের মরু দশা বা ডেজার্ট ফেজ চলছিল। এই সময়ে নীলনদের প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং সম্ভবত নীল নদ অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক উত্থানের কারণে অন্যান্য সময়কালে তা কেবল সাময়িকভাবেই প্রবাহিত হয়

মেকানিজম বা প্রক্রিয়া

ওয়েট-গ্রিন সাহারা বা আর্দ্র-সমুজ সাহারার দশায় সাহারা এবং আরব অঞ্চল একটি সাভানা তৃণভূমিতে পরিণত হয় এবং আফ্রিকান উদ্ভিদ ও প্রাণী সেখানে সাধারণ হয়ে ওঠে। এরপর আন্তঃ-প্লুভিয়াল শুষ্ক পর্যায়গুলোর পরে, অর্থাৎ দুটো প্লুভিয়াল পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময়ে যে শুষ্ক পর্যায় থাকে, সেগুলোর পরে সাহারা অঞ্চলটি পুনরায় মরুভূমির পরিস্থিতিতে ফিরে আসে। পশ্চিম আফ্রিকান মৌসুমী বায়ুর দক্ষিণদিকে সরে আসার ফলে, বাষ্পীভবন বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেড়ে যায়, শাদ (Chad) হ্রদের মতো হ্রদে জলের স্তর পড়ে যায়, এবং নদীগুলো শুষ্ক হয়ে যায়। সাধারণত এসব কারণেই সাহারা মরুতে পরিণত হয়। এরফলে পূর্বে সাহারায় ছড়িয়ে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণীরা উত্তর দিকে এটলাস পর্বতমালা, দক্ষিণ দিকে পশ্চিম আফ্রিকা, বা পূর্বদিকে নীলনদের উপত্যকা, দক্ষিণ-পূর্বে ইথিওপীয় হাইল্যান্ড ও কেনিয়া, বা উত্তর-পূর্বে সিনাই হয়ে এশিয়ায় চলে যায়। এরফলে কিছু প্রজাতির পপুলেশনের মধ্যে বিভাজন হয়ে যায়, মানে একটা স্পিসিজের একটা অংশ একদিকে, অন্য অংশ অন্যদিকে। এরফলে একই প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ুর অঞ্চলে যায়, ও সেই অঞ্চলের পরিবেশ অনুযায়ী অভিযোজিত হতে বাধ্য হয়, আর তার ফলে অ্যালোপ্যাট্রিক স্পিসিয়েশন ঘটে, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজাতির জন্ম হয়

প্লিও-প্লেইস্টোসিন

আফ্রিকায় প্লিও-প্লেইস্টোসিন অভিবাসনের মধ্যে ছিল ৩২ লক্ষ বছর পূর্বে এবং ২৭ থেকে ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে দুটি তরঙ্গে ক্যাপ্রিনি (Caprinae) এর অভিবাসন; ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে Nyctereutes, এবং ২৩ লক্ষ বছর আগে Equus, ২৬ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে হিমালয়ের সিওয়ালিক্সে Hippotragus এর অভিবাসন। এশিয়ান বোভিডরা আফ্রিকা থেকে ইউরোপে যায়। প্রাইমেট থেরোপিথেকাসের (Theropithecus) সংখ্যা কমে যায়, এবং এর ফসিল কেবল ইউরোপ ও এশিয়াতেই পাওয়া যায়, যেখানে হোমো (Homo) ও ম্যাকাকা (Macaca) বিস্তৃত পরিসর জুড়ে বিস্তৃত হয়।

১৮৫,০০০ – ২০,০০০ বছর আগে

প্রায় ১৩৩ থেকে ১২২ হাজার বছর পূর্বের মধ্যে সাহারান-আরব মরুভূমির দক্ষিণ অংশে আব্বাসিয়া প্লুভিয়াল (Abbassia Pluvial) শুরু হয়েছিল। এই আব্বাসিয়া প্লুভিয়াল ছিল একটি আর্দ্র পর্যায় বা ওয়েট পিরিয়ড, যখন মৌসুমী বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২০০-১০০ মিমি/বছর অব্দি পৌঁছে যায়। এর ফলে ইউরেশীয় উদ্ভিদ ও প্রাণী (Eurasian biota) আফ্রিকা থেকে ইউরোপে ও ইউরোপ থেকে আফ্রিকায় আসার সুযোগ পায়। হোল-জাখ (Hol-Zakh), আশালিম (Ashalim), ইভেন-সিড (Even-Sid), মা’লে-হা-মেইশার (Ma’ale-ha-Meyshar), কতোরা ক্র্যাক (Ktora Cracks), নাগেভ তজাভোয়া গুহায় (Nagev Tzavoa Cave) স্পেলেওথেমের বৃদ্ধি ধরা পড়ে, স্পেলেওথেম দ্বারা গুহার মধ্যকার মিনারেল ডেপোজিটকে বোঝায়, অতীতের কোন সময়ে এগুলোর আকার-আকৃতি কেমন ছিল তা সনাক্ত-করণের মাধ্যমে সেই সময়ে সেই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এই সময়ে গুহাগুলোতে যে স্পেলেওথেম তৈরি হয়েছিল সেখান থেকে বোঝা যায় সে সময়ে সেসব স্থানে বৃষ্টিপাত ছিল বছরে ৬০০ – ১০০০ মিমি। কাফজেহ-স্কাল টাইপ (Qafzeh-Skhul type) অ্যানাটমিকালি মডার্ন হিউম্যান বা আধুনিক মানুষের দেহাবশেষ এর কালনির্ণয় করে দেখা গেছে তা সেই সময়েরই। কিন্তু সেখানকার মানব বসতি পরবর্তিকালের এরিড পিরিয়ড বা শুষ্ক পর্যায়েই পুরপুরি অন্তর্হিত হয় বলে মনে হয়। লোহিত সাগরের উপকূলীয় পথটি ১৪০ হাজার বছরের পূর্বের পূর্বে এবং ১১৫ হাজার বছর পূর্বের পর থেকে অত্যন্ত শুষ্ক ছিল। ৯০ থেকে ৮৭ হাজার বছর পুর্বের সময়ের মধ্যে সামান্য ভেজা অবস্থা এসেছিল বটে, কিন্তু ১২৫ হাজার বছর পূর্বেরও আগে সেখানে যে মাত্রার বৃষ্টিপাত ছিল তখন সেখানে বৃষ্টিপাত ছিল তার দশভাগের একভাগ মাত্র। এই সময়ে কেবল ইভেন-সিড-২ (Even-Sid-2) গুহাতেই স্পেলেওথেমকে সনাক্ত করা যায়। দক্ষিণ নেগেভ মরুভূমিতে ১৮৫ থেকে ১৪০ হাজার বছর পূর্বের সময়ের মধ্যে (MIS 6), ১১০ থেকে ৯০ হাজার বছর পুর্বের সময়ের মধ্যে (MIS 5.4–5.2), এবং ৮৫ হাজার বছর পূর্বের পর, এমনকি ইন্টারগ্লেশিয়াল পিরিয়ড বা আন্তঃহিম পর্যায়ের বেশিরভাগ সময়েও (MIS 5.1), গ্লেশিয়াল পিরিয়ডে বা হিমপর্যায়ে ও হলোসিনেও স্পেলেওথেম তৈরি হয়নি। এখান থেকে বোঝা যায়, দক্ষিণ নেগেভ এই সময়কালে অতিমাত্রায় শুষ্ক ছিল। পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের চারপাশের উপকূলীয় পথটি লাস্ট গ্লেশিয়াল বা শেষ হিমবাহের সময় মাঝে মাঝে খোলা থেকে থাকতে পারে; স্পেলেওথেমগুলো হল-জাখ (Hol-Zakh) এবং নাগেভ তজাভোয়া গুহাগুলোতে (Nagev Tzavoa Caves) বেড়ে ওঠে। ক্যালসাইট দিগন্তের সাথে স্পেলেওথেম গঠনের তুলনা থেকে বোঝা যায় যে সেখানে আর্দ্র সময়কাল কেবল দশ বা শত বছরের মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ৬০-৩০ হাজার বছর পূর্ব থেকে আফ্রিকার অনেক জায়গায় অত্যন্ত শুষ্ক পরিস্থিতি ছিল

সর্বশেষ হিমবাহ সর্বোচ্চ বা লাস্ট গ্লেশিয়াল ম্যাক্সিমাম

সাহারান পাম্পের একটি উদাহরণ শেষ হিমবাহ সর্বোচ্চ বা লাস্ট গ্লেশিয়াল ম্যাক্সিমামের (এলজিএম) পরে ঘটেছে। লাস্ট গ্লেশিয়াল ম্যাক্সিমাম চলাকালীন সাহারা মরুভূমি এখনকার চেয়ে বেশি বিস্তৃত ছিল, তখন গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরণ্যের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে, নিম্ন তাপমাত্রা হ্যাডলি সেলের শক্তি হ্রাস করে যার ফলে ইন্টারট্রপিকাল কনভার্জেন্স জোনের (ITCZ) ক্রমবর্ধমান গ্রীষ্মমন্ডলীয় বাতাস ক্রান্তীয় অঞ্চলে বৃষ্টি নিয়ে আসে, যখন শুষ্ক অবতরণকারী বাতাস, প্রায় ২০ ডিগ্রি উত্তরে, বিষুবরেখায় ফিরে আসে এবং এই অঞ্চলে মরুভূমির পরিস্থিতি নিয়ে আসে। এই পর্যায়টি উত্তর গ্রীষ্মমন্ডলীয় আটলান্টিক থেকে আসা সামুদ্রিক কোরগুলোতে পাওয়া বাতাসে বয়ে আসা খনিজ ধূলিকণার উচ্চ হারের সাথে সম্পর্কিত। খ্রিস্টপূর্ব ১২,৫০০ অব্দের দিকে, বলিং/অ্যালেরড (Bølling/Allerød) পর্যায়ে কোরগুলোতে ধূলিকণার পরিমাণ হঠাৎ হ্রাস পায় এবং সাহারার অনেক আর্দ্র অবস্থার একটি সময় দেখায়, যা ড্যানসগার্ড-ওশগার (Dansgaard-Oeschger বা DO) ইভেন্টের ইঙ্গিত দেয় (হঠাৎ উষ্ণায়নের পরে জলবায়ুর ধীর শীতলতা)। এই ওয়েট সাহারান পরিস্থিতি প্রায় ১২,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয়েছিল, উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মে ইন্টারট্রপিকাল কনভার্জেন্স জোন (ITCZ) উত্তরদিকে প্রসারিত হয়েছিল, সাহারার জন্য আর্দ্র অবস্থা এবং একটি সাভানা জলবায়ু নিয়ে এসেছিল, (যা ইয়াঙ্গার ড্রায়াস (Younger Dryas) পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত একটি সংক্ষিপ্ত শুষ্ক সময়কাল ছাড়াও) খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে হোলোসিন তাপীয় সর্বোচ্চ জলবায়ু পর্যায়ে শীর্ষে ছিল, যখন মধ্য-অক্ষাংশের তাপমাত্রা সাম্প্রতিক অতীতের তুলনায় ২ থেকে ৩ ডিগ্রির অধিক ছিল বলে মনে হয়। নীল নদের বদ্বীপে জমা পলল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সময়ের নীলনদ থেকে আসা পলল একটি উচ্চ অনুপাত ছিল, যা ইথিওপিয়ান উচ্চভূমিতে উচ্চ বৃষ্টিপাতের ইঙ্গিত দেয়। এটি মূলত উপ-গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল জুড়ে একটি শক্তিশালী মৌসুমী সঞ্চালনের কারণে ঘটেছিল, যা ভারত, আরব এবং সাহারাকে প্রভাবিত করেছিল। ভিক্টোরিয়া হ্রদ এসময় হোয়াইট নাইল উৎস হয়ে ওঠে এবং প্রায় সম্পূর্ণরূপে প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে শুকিয়ে যায়। একটি হাইনরিখ ইভেন্টের সাথে (ধীর উষ্ণায়নের পর হঠাৎ শীতলায়ন) ইন্টারট্রপিকাল কনভার্জেন্স জোনের (ITCZ) হঠাৎ দক্ষিণ দিকে সরে আসার সাথে এল নিঞো-সাউদার্ন ওসিলেশন (El Niño-Southern Oscillation) চক্রের পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে। এর ফলে সাহারান ও অ্যারাবিক অঞ্চল খুব দ্রুত শুষ্ক হয়ে যায়, যার ফলে তা খুব দ্রুত মরুতে পরিণত হয়। এর ফলে এই সময়ে নীলনদের বন্যার স্কেল ২৭০০ থেকে ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নেমে যায়। একটি তত্ত্ব অনুসারে, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ থেকে ২৫০০ অব্দে চারণজীবীরা সেখানে থাকা তৃণভূমিতে মাত্রাতিরিক্ত পশুচারণ করায় এই অঞ্চলের শুষ্কায়ন আরও ত্বরাণ্বিত হয়েছিল।

মানুষের অভিবাসন

এই সাহারান পাম্প তত্ত্বকে ব্যবহার করে আফ্রিকা থেকে মানুষের অভিবাসনের বেশ কয়েকটি তরঙ্গের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে, যথা:

  • ১। নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগ : দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ায় হোমো ইরেক্টাস (ssp. ergaster) সম্ভবত দুবার অভিবাসিত হয়, প্রথমটি একটি ওল্ডওয়ান (Oldowan) প্রযুক্তি নিয়ে চীন এবং ভারত পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিল, এবং সেখানে চপার (Chopper) ট্রেডিশন তৈরি করেছিল, দ্বিতীয়টি আশুলিয়ান (Acheulian) হস্তকুঠার সহ কেবল মাত্র ভারতীয় উপমহাদেশ পর্যন্ত অভিবাসিত হয়েছিল।
  • ২। মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ : মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম ইউরোপে হোমো হাইডেলবার্গেনসিস।
  • ৩। উচ্চ প্রাচীন প্রস্তর যুগ : হোমো সেপিয়েন্স (সম্ভবত প্রাথমিক “আউট অফ আফ্রিকা” তরঙ্গ ৮০,০০০ বছরের পূর্বে আফ্রিকা ত্যাগ করেছিল, যা পরবর্তিতে ৭০,০০০ বছর পূর্বের কোস্টাল মাইগ্রেশন বা উপকূলীয় অভিবাসন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়)।
  • ৪। এপিপ্যালিওলিথিক : ৮.২ কিলোইয়ার ইভেন্টের সাথে সম্পর্কিত শুষ্কতার সাথে সম্পর্কিত লেভান্টে সম্ভাব্য আফ্রোএশিয়াটিক অভিবাসন।
  • ৫। নব্যপ্রস্তর যুগ : ৫.৯ কিলোইয়ার ইভেন্ট, যাকে কখনও কখনও নব্যপ্রস্তর যুগের নির্দিষ্ট জনসংখ্যার স্থানান্তরণের সাথে সম্পর্কিত করা হয়।
  • ৬। লিবু এবং মেশওয়েশ অভিবাসনসমূহ (Libu and Meshwesh migrations), যার ফলে নিউ কিংডমের শেষের দিকে মিশর আক্রান্ত হয়, যার ফলে ব্রোঞ্জ এজ কলাপ্স বা ব্রোঞ্জযুগের সমাপ্তি ঘটে, এবং সাহারায় রথের উপস্থিতি দেখা যায়।

আধুনিক মানুষের আফ্রিকার বাইরের অভিবাসনের সাউদার্ন ডিসপার্সাল

আধুনিক মানুষের সাম্প্রতিক আফ্রিকান উৎপত্তির (recent African origin of modern humans) প্রেক্ষাপটে, সাউদার্ন ডিসপার্সালের ( Southern Dispersal) ঘটনা (এছাড়াও উপকূলীয় অভিবাসন বা মহান উপকূলীয় অভিবাসন হাইপোথিসিজ) দ্বারা এশিয়ার দক্ষিণ উপকূলে মানুষের প্রাথমিক অভিবাসনকে বোঝায়, যা পারস্য হয়ে আরব উপদ্বীপ এবং ভারত থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়া বরাবর চলে গিয়েছিল। এই অভিবাসন পথের বিকল্প নামগুলোর মধ্যে রয়েছে “southern coastal route” বা “rapid coastal settlement” (দ্রুত অভিবাসনের জন্য এই নাম)। এই অভিবাসনে অভিবাসিত হওয়া মানুষের বংশধরেরাই পরবর্তীতে ইউরেশিয়ার বাকি অংশ (ইউরোপ সহ), ওশেনিয়ার  বাকি অংশে ও আমেরিকায় অভিবাসিত হয়েছিল। উপকূলীয় রুট তত্ত্ব বা কোস্টাল রুট থিওরিটি প্রাথমিকভাবে পশ্চিম এশিয়া, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, নিউ গিনি, অস্ট্রেলিয়া, ওশেনিয়ার কাছে এবং উপকূলীয় পূর্ব এশিয়ার প্রাথমিক পিপলিং বা মানব আবির্ভাবকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়, যে মানব-আবির্ভাব প্রায় ৭০,০০০ থেকে ৫০,০০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল। এটি এই অঞ্চলগুলোতে মাতৃ-হ্যাপ্লোগ্রুপ M এবং N-এর উপস্থিতি এবং বিচ্ছুরণের সাথে যুক্ত, সেইসাথে পিতৃ-হ্যাপ্লোগ্রুপ F, C এবং D এর নির্দিষ্ট বিতরণের সাথে সম্পর্কিত।

তত্ত্বটি প্রস্তাব করে যে প্রাথমিক আধুনিক মানুষ, মাতৃ-হ্যাপ্লোগ্রুপ L3 বাহক কিছু বাহক, প্রায় ৭০ থেকে ৫০ হাজার বছর পূর্বে পূর্ব আফ্রিকা থেকে বাব-এল-মানদেব প্রণালি অতিক্রম করে আরব উপদ্বীপে পৌঁছেছিল। অনুমান করা হয়েছে যে আফ্রিকার ২,০০০ থেকে ৫,০০০ মানুষের জনসংখ্যার মধ্যে শুধুমাত্র ১৫০ থেকে ১,০০০ মানুষের একটি ছোট দল লোহিত সাগর অতিক্রম করেছিল। এই দলটি কয়েক হাজার বছরের মধ্যে আরব ও পারস্যের আশেপাশের উপকূলীয় পথ ধরে অপেক্ষাকৃত দ্রুত ভারতে ভ্রমণ করে, যাকে প্রথম প্রধান বসতি স্থাপন বিন্দু বলে মনে হয়। ভারত থেকে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (“সুন্দাল্যান্ড”) এবং ওশেনিয়া (“সাহুল”) পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ওয়েলস (২০০৩) প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে এশিয়ার দক্ষিণ উপকূল বরাবর প্রায় ২৫০ কিলোমিটার (১৫৫ মাইল) পথ অতিক্রম করে অভিবাসীদের অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছানোর পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন। আজ বাব-এল-মানদেব প্রণালিতে, লোহিত সাগর প্রায় ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল) চওড়া, কিন্তু ৫০,০০০ বছর আগে সমুদ্রের স্তর ৭০ মিটার (২৩০ ফুট) নিচু ছিল (হিমায়ন বা গ্লেসিয়েশনের কারণে) এবং জলও অনেক সংকীর্ণ ছিল। যদিও প্রণালিটি কখনই পুরোপুরি বন্ধ ছিল না, তারা যথেষ্ট সংকীর্ণ ছিল, আর সেকারণে ভেলা ব্যবহার  করে পারাপার সম্ভব ছিল। সেই সাথে প্রণালির মধ্যে দ্বীপের উপস্থিতিও থাকতে পারে। ইরিত্রিয়ায় ১২৫,০০০ বছর পুরানো ঝিনুকের মত মোলাস্ক জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণীর শেল বা খোলের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, এই মোলাস্করা ছিল আদিম মানুষের খাদ্য। সমুদ্র তীর থেকে তারা তারা এগুলো বিচকোম্বিং (beachcombing) করে সংগ্রহ করে তা সি-ফুড হিসেবে খেত।

সাউদার্ন ডিসপার্সালের কাল নির্ণয় বিতর্কের বিষয়। এটি টোবা ক্যাটাস্ট্রফির পূর্ব অথবা পরবর্তী সময়ে হতে পারে, টোবা ক্যাটাস্ট্রফি ছিল একটি প্রলয়ংকরী আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত যা ৬৯,০০০ থেকে ৭৭,০০০ বছর আগে বর্তমান টোবা হ্রদের স্থানে ঘটেছিল। ভারতে নিষ্কাশন করা ছাই স্তরগুলোর নীচে আবিষ্কৃত পাথরের সরঞ্জামগুলো একটি প্রাক-টোবা অভিবাসনের দিকে ইঙ্গিত করছে তবে সরঞ্জামগুলোর উৎস বিতর্কিত। টোবা পরবর্তী সময়ের একটি ইঙ্গিত হল হ্যাপ্লো-গ্রুপ L3, যা আফ্রিকার বাইরে মানুষের ছড়িয়ে পড়ার আগে উদ্ভূত হয়েছিল এবং ৬০,০০০-৭০,০০০ বছর আগে তা ঘটে থাকতে পারে। অ্যাপেনজেলার (২০১২) বলছেন, “এটি টোবা ক্যাটাস্ট্রফির কয়েক হাজার বছর পরে মানব জাতি আফ্রিকা ছেড়ে অভিবাসনকে নির্দেশ করছে”। ২০১২ সালে কিছু গবেষণা প্রকাশিত হয়, মানুষের জেনেটিক মিউটেশনের গতি যা হবার কথা, এই গবেষণাগুলো বলছে আদতে তার চেয়ে ধীরগতিতে মিউটেশন ঘটেছিল। এটা নির্দেশ করছে যে, আসলে এই মানব অভিপ্রায়ণ এত পরে না, বরং ৯০,০০০ থেকে ১,৩০,০০০ বছর আগেই ঘটেছিল। এরপর আরও কিছু গবেষণা হয়েছে, সেগুলো বলছে এই অভিপ্রায়ণ ঘটেছিল বর্তমান আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের থেকে মানুষেরা প্রায় ৫০,০০০-৬৫,০০০ বছর পূর্বে আফ্রিকার বাইরে অভিবাসিত হয়েছিল, অর্থাৎ এটি পূর্ববর্তী বেশিরভাগ গবেষণার ফলাফলকেই সমর্থন করছে।

পিতৃ ও মাতৃ হ্যাপ্রোগ্রুপ আফ্রিকা ছাড়ার পর তিনটি পথে ছড়িয়ে পড়ে: ইরান থেকে ভারত হয়ে ওশেনিয়া বরাবর পথ ছিল “সাউথ রুট” বা দক্ষিণা পথ, ইরান থেকে আলতাই বরাবর পথ ছিল “নর্থ রুট” উত্তরা পথ এবং ইরান থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত “ওয়েস্ট রুট” বা পশ্চিমা পথ। পিতৃ-হ্যাপ্লোগ্রুপ বিবেচনায় হ্যাপ্লোগ্রুপ A, B ও E আফ্রিকায় থেকে যায়, হ্যাপ্লোগ্রুপ C1B2, F, K, M, S, H, L দক্ষিণা পথের দিকে যায়, হ্যাপ্লোগ্রুপ D, C1A1, C2, N, O, Q উত্তরা পথ বরাবর যায়, এবং হ্যাপ্লোগ্রুপ C1A2, I, J, G, R, T পশ্চিমা পথে যায়।

(যাই হোক, দক্ষিণা পথ ছিল আসলে ট্রপিকাল অঞ্চল জুড়েই। আপনি লাস্ট গ্লেশিয়াল ম্যাক্সিমাম এর ভেজিটেশন বা বায়োমের ম্যাপ ঘাটলেই দেখা যাবে, একেবারে আফ্রিকা থেকে সিন্ধু পর্যন্ত ট্রপিকাল এক্সট্রিম ডেজার্ট ছিল। এই অঞ্চলের উপকূল বরাবর এরা মাইগ্রেট করেছে। এরপর গুজরাটের কাছে এসে এরা ট্রপিকাল সেমি ডেজার্ট পেলো। সেটার অবস্থাও ডেজার্টের চেয়ে খুব একটা ভাল না। তবু সেই অঞ্চলে পিতৃ-হ্যাপ্লোগ্রুপ L স্যাটল করল, আরও পথ পাড়ি দিয়ে যখন এরা মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের উপকূলের দিকে গেল তখন এরা পেল ট্রপিকাল গ্রাসল্যান্ড, হ্যাঁ গ্রাসল্যান্ড, আমরা এখন এই অঞ্চলগুলোকে যেমন জানি অমন ছিলনা। এই অঞ্চলে কেউ স্যাটলড হলো, হ্যাপ্লোগ্রুপ H স্যাটল করল। উড়িষ্যার দিকে তখন ছিল ট্রপিকাল উডল্যান্ড, এরপর বাংলার কাছে ট্রপিকাল থর্ন স্ক্রাব এন্ড স্ক্রাব উডল্যান্ড। এগুলোতে ওই H ই স্যাটল করে থাকতে পারে। এরপর যেতে যেতে মিয়ানমারে গিয়ে পেল প্রথম মনসুন বা ড্রাই ফরেস্ট। আর তারপর ইন্দোনেশিয়ার দিকে গেলে এইবার পেলো ট্রপিকাল রেইন ফরেস্টের এলাকা। খুবই উপযোগী এলাকা। ভালই খাদ্য পাওয়া যায়। সেদিকে হ্যাপ্লোগ্রুপ MS স্যাটল করল। পরে আরও অগ্রসর হয়ে ওশেনিয়ায় ট্রপিকাল গ্রাসল্যান্ড, C1b2 কিছু সেখানে স্যাটল করল। আর এরপর এরাই গেল অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার একেবারে মাঝে তখন ট্রপিকাল ডেজার্ট, তার থেকে একটু দূরে ট্রপিকাল সেমি ডেজার্ট, তার থেকে একটু দূরে ট্রপিকাল থর্ন স্ক্রাব, যা উপকূলের অনেক অঞ্চলকেও স্পর্শ করেছে। কিন্তু উপকূলের একটা বড় অংশ জুড়ে, মূলত পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ছিল ট্রপিকাল উডল্যান্ড। সেই অঞ্চলে মানুষ ভালভাবে টিকে যেতে পারে। ভাল কথা, এই কথাগুলো লাস্ট গ্লেশিয়াল ম্যাক্সিমামের সাপেক্ষে বলা। কিন্তু সেটা তুলনামূলক পরে এসেছিল। সেটা এক্সট্রিম ছিল। কিন্তু মাইগ্রেশনের সময় লাস্ট গ্লেশিয়াল পিরিয়ড চললেও তা অত এক্সট্রিম ছিলনা। একটু কম ছিল। কিন্তু এর সাপেক্ষে অনুমানটা অন্তত করা যায়।)

বিভিন্ন অঞ্চলে অভিবাসন –

  • পশ্চিম এশিয়া : ৫৪,৭০০ বছর আগে ইজরায়েলের মানোট গুহায় (Manot Cave) একটি আধুনিক মানুষের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিল, যার নাম ছিল মানোট ১, যদিও এর কাল নির্ণয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে গ্রোউকাট এট আল (২০১৫) গবেষণাটি।
  • দক্ষিণ এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া : ধারণা করা হয় যে প্রায় ৬৫,০০০-৫০,০০০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় মানুষ বসবাস শুরু হয়েছিল। ২০১৭ সালের হিসাব অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ায় মানুষের প্রাচীনতম প্রমাণ কমপক্ষে ৬৫,০০০ বছর পুরানো। যখন ম্যাকচেসনি তার গবেষণাপত্রে বলেছিলেন “… জেনেটিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে মার্কার M168 সহ একটি ছোট ব্যান্ড ইন্দোনেশিয়া হয়ে আরব উপদ্বীপ এবং ভারতের উপকূল বরাবর আফ্রিকা থেকে চলে আসে এবং ৬০,০০০ থেকে ৫০,০০০ বছর আগে খুব তাড়াতাড়ি অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছায়। অস্ট্রেলিয়ায় এই খুব প্রাথমিক অভিবাসন কে সমর্থন করেছেন রাসমুসেন এট আল (২০১১)।” অস্ট্রেলিয়ার মুঙ্গো হ্রদ থেকে জীবাশ্ম প্রায় ৪২,০০০ হাজার পূর্ব বলে কাল-নির্ণয় করা হয়েছে। মাদজেদবে (Madjedbebe) নামক একটি স্থানের অন্যান্য জীবাশ্মগুলো কমপক্ষে ৬৫,০০০ বছর পূর্বের বলে নির্ণিত হয়, যদিও কোন কোন গবেষক এই প্রাথমিক অনুমান এবং প্রাচীনতম প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে মাদজেদবে জীবাশ্মের তারিখ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।
  • পূর্ব এশিয়া : চীনের তিয়ানইউয়ান মানব (Tianyuan man) ৩৮,০০০ থেকে ৪২,০০০ বছর বয়সী, অন্যদিকে একই অঞ্চলের লিউজিয়াং মানব (Liujiang man) সম্ভবত ৬৭,০০০ থেকে ১,৫৯,০০০ বছর বয়সী। ২০১৩ সালের একাধিক ডিএনএ ভিত্তিক গবেষণা অনুযায়ী, তিয়ানইউয়ান মানব “বর্তমান অনেক এশীয় এবং নেটিভ আমেরিকানদের” সাথে সম্পর্কিত। তিয়ানইউয়ান মানব ও লিউজিয়াং মানব সাথে শারীরিক দিক থেকে অনুরূপ, এবং জাপানে প্রাপ্ত কিছু জমন পর্যায়ের (Jōmon period) আধুনিক মানুষ ও আধুনিক পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জনগোষ্ঠীর সাথে এদের আকারগত মিল আছে।
  • ইউরোপ : ম্যাকাউলে এট আল (২০০৫) গবেষণা অনুসারে, পিতৃ-হ্যাপ্লোগ্রুপ N এর সাথে সাউদার্ন ডিসপার্সালের একটি প্রাথমিক শাখা পূর্ব আফ্রিকা থেকে নীল নদের অনুসরণ করে, উত্তর দিকে এগিয়ে যায় এবং সিনাই দিয়ে এশিয়ায় প্রবেশ করে। এই দলটিতে তখন আরও শাখা তৈরি হয়, কেউ ইউরোপে চলে যায় এবং অন্যরা পূর্ব দিকে এশিয়ায় চলে যায়। এই অনুমান ইউরোপে অপেক্ষাকৃত দেরিতে আধুনিক মানুষের আগমন এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ও ডিএনএ গবেষণাগুলোর সাথে মিলে যায়। শিকারী-সংগ্রাহক বা হান্টার-গ্যাদারারদের ৫৫টি মানব মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম (mtDNAs) বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, পোশ্‌থ এট আল (২০১৬) গবেষণাটি বলছে “আজ থেকে ৫৫,০০০ বছর পূর্বের মধ্যে সকল অ-আফ্রিকান মানব দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে।”

তথ্যসূত্র

Sahara pump theory, Recent African origin of modern humans, Southern Dispersal

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.