ভারতে ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক আধিপত্য, শক-পহ্লব আধিপত্য, কুষাণ সাম্রাজ্য এবং কুষাণোত্তর যুগে ভারত

Table of Contents

ভারতে ব্যাকট্রীয় গ্রিক আধিপত্য

রাজনৈতিক ইতিহাস

ব্যাক্ট্রীয় গ্রিকদের উত্থান ও ডিমেট্রিয়াস পর্যন্ত ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক রাজারা

ব্যাক্ট্রীয় গ্রিকদের আগমন : শুঙ্গ ও কাণ্ববংশীয় রাজারা যখন ভারতের অভ্যন্তরে রাজত্ব করছিলেন, তখন এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল কার্যত অরক্ষিত হয়ে পড়ে। দেশের এই রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযােগে এক বিদেশি জাতি ভারতের বিশাল অঞ্চল অধিকার করে বসেন। এরাই হলেন ব্যাকট্রীয় গ্রিক। তারা বিদেশিরূপে ভারতে এসেছিলেন কিন্তু দীর্ঘদিন আর বিদেশি ছিলেন না। ধীরে ধীরে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে তারা ভারতীয় জনসমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান, ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করেন।

রাজনৈতিক বৃত্তান্ত : এখন যেখানে উত্তর আফগানিস্তানের বল্খ‌, প্রাচীনকালে সেই বল্খ‌ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে ছিল ব্যাকট্রিয়া রাজ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে আকিমেনীয় সম্রাট প্রথম সাইরাস ব্যাক্ট্রিয়া অধিকার করেন। এই বংশের শেষ রাজা তৃতীয় দারিউসকে পরাজিত করে আলেকজান্ডার ব্যাক্ট্রিয়ায় ম্যাসিডােনীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। আলেকজান্ডারের উৎসাহে তার অনুগামীদের অনেকে এখানে স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে ব্যাবিলােন শহরে তার মৃত্যু হলে ম্যাসিডােনীয় সাম্রাজ্য তার সেনাপতিগণের মধ্যে বিভক্ত হয়। ব্যাক্ট্রিয়াসহ প্রাচ্য প্রদেশগুলোর অধীশ্বর হন সেনাপতি সেলুকাস। 

স্বাধীন ব্যাক্ট্রিয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠা : সেলুকাসের রাজত্বকালে ডিওডােটাস নামে জনৈক গ্রিক ব্যাকট্রিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। সসাগডিয়ানা বা বােখারা-সমরকন্দ অঞ্চলের কিয়দংশও সম্ভবত তার শাসনভুক্ত ছিল। সেলুকাসের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম এন্টিওকাস ও পৌত্র দ্বিতীয় এন্টিওকাস যথাক্রমে সিংহাসনে আরােহণ করেন। তাদের সময়ও ডিওডােটাসই ব্যাকট্রিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় এন্টিওকাস বা তার পুত্র দ্বিতীয় সেলুকাসের রাজত্বকালে তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। প্রায় একই সময় পার্থিয়া বা খােরাসান প্রদেশের শাসনকর্তা আর্সাকেসও স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ঘটনা দুটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের মধ্যভাগে। ব্যাকট্রিয়ার রাজধানী ব্যাকট্রা। বর্তমান বল্‌খ প্রাচীন ব্যাকট্রা। স্বাধীন ব্যাকট্রিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠার অতি অল্প কাল পর প্রথম ডিওডােটাসের মৃত্যু হয়। তখন তার পুত্র দ্বিতীয় ডিওডােটাস ব্যাকট্রিয়ার সিংহাসনে আরােহণ করেন। মুদ্রায় তার তরুণ বয়সের মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। ফলে তিনি দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছিলেন বলে মনে হয় না। গ্রিক ঐতিহাসিক পলিবিয়াসের লেখা থেকে জানা যায়, ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছু পূর্বে ইউথিডেমাস নামে একজন গ্রিক ভাগ্যান্বেষী তাকে পরাজিত এবং সম্ভবত নিহত করে ব্যাকট্রিয়ার সিংহাসন অধিকার করেন।

প্রথম ইউথিডেমাস : রাজত্বের প্রথম ভাগে ইউথিডেমাস এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হন। সেলুকিড বংশীয় রাজা তৃতীয় এন্টিওকাস ব্যাকট্রিয়া অবরােধ করায় এই রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। শেষে পুত্র ডিমেট্রিয়াস ও দূত টিলিয়াসের সাহায্যে ইউথিডেমাস এন্টিওকাসের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন। সন্ধির শর্ত অনুসারে ইউথিডেমাস ব্যাক্ট্রিয়ার স্বাধীন রাজা বলে স্বীকৃত হন এবং এন্টিওকাস প্রতিদানস্বরূপ ইউথিডেমাসের নিকট হতে রণহস্তী উপহার পান। তারপর এন্টিওকাস সসৈন্যে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। সুভাগসেন প্রভৃতি কয়েকজন স্থানীয় ভারতীয় রাজাকে পরাজিত করে তিনি শেযে সিরিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। সম্ভবত ২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এন্টিওকাসের এই ভারত অভিযান সংঘটিত হয়। হিন্দুকুশ পবর্তশ্রেণির দক্ষিণে গ্রিক অধিপত্য বিস্তার ইউথিডেমাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। নতুন অধিকৃত অঞ্চলটি হল কাবুল উপত্যকা। এখানে ইউথিডেমাসের নামাঙ্কিত সােনা, রূপা, তামা ও মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রায় যেমন তার তরুণ বয়সের প্রতিকৃতি আছে তেমনি তার পরিণত বয়সের ছবিরও অভাব নেই। এর থেকে বােঝা যায়, তিনি দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছিলেন। আনুমানিক ১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইউথিডেমাসের মৃত্যু হয়।

প্রথম ডিমেট্রিয়াসের অধীনে ভারত আক্রমণ ও আধিপত্য

ইউথিডেমাসের মৃত্যুর পর তার সুযােগ্য পুত্র ডিমেট্রিয়াস পিতৃ-সিংহাসনে আরােহণ করেন। পাঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গ্রিক আধিপত্যের বিস্তার তার রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ডিমেট্রিয়াসের ভারত অভিযানের কাহিনি বিধৃত আছে প্রাচীন গ্রিক-রােমক লেখকদের বিবরণীতে, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে এবং তার উৎকীর্ণ মুদ্রায়। অবশ্য এসব তথ্যের ব্যাখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিক লেখক স্ট্র্যাবাে বলেন আলেকজান্ডারের পর দু’জন গ্রিক রাজা ভারত জয় করেন তাদের একজন ডিমেট্রিয়াস, অন্যজন মিনান্ডার। স্ট্যাবাের মতাে আর একজন প্রাচীন ইউরােপীয় লেখক টোগাস পম্পিয়াস। গ্রিকদের ভারত অভিযান প্রসঙ্গে তিনি ডিমেট্রিয়াসের নাম উল্লেখ করেননি, উল্লেখ করেছেন মিনান্ডার ও এপােলােডােটাসের নাম। প্রাচীন ঐতিহাসিকদের পরস্পর বিরােধী উক্তি সহজেই লক্ষণীয়। পতঞ্জলি তার মহাভাষ্যে জনৈক গ্রিক রাজার সাকেত বা অযােধ্যা বা তার নিকটবর্তী কোনও স্থান এবং মধ্যমিকা বা চিতােড়গড়ের অদূরবর্তী নাগরী অভিযানের কথা বলেছেন। কিন্তু এই গ্রিক রাজ যে কে সে সম্পর্কে তিনি নীরব। গার্গীসংতার যুগপুরাণ অধ্যায়েও গ্রিকদের ভারত অভিযানের উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে যবনরা একে একে সাকেত, পাঞ্চাল, মথুরা ও পাটলিপুত্র অধিকার করবেন। কিন্তু যার নেতৃত্বে এই গ্রিক অভিযান সেই যবন রাজার নাম সম্পর্কে গার্গীসংহিতায় কোনও কথা বলা হয়নি। সিন্ধু অর্থাৎ সিন্ধু নদ বা মধ্য ভারতের কালী সিন্ধুর তীরে গ্রিক সৈন্য সমাবেশের উল্লেখ আছে কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম’ নাটকে। 

কালিদাসও প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিক রাজার নাম সম্পর্কে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। বেশির ভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন ভারতীয় সাহিত্যে যে গ্রিক অভিযানের উল্লেখ আছে তার নায়ক হলেন ডিমেট্রিয়াস। খ্যাতনামা ইংরেজ পণ্ডিত টার্ন মনে করেন মিনান্ডার ও এপােলােডােটাসের সক্রিয় সাহায্যে রাজা ডিমেট্রিয়াস এই গ্রিক অভিযানের পরিকল্পনা করেন – মিনান্ডার সসৈন্যে পাঞ্জাবের ভেতর দিয়ে গঙ্গা নদীর তীর ধরে পূর্ব দিকে পাটলিপুত্র পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন, এপােলােডােটাস অগ্রসর হয়েছিলেন দক্ষিণ অভিমুখে, সিন্ধু নদের তীর ধরে। ডিমেট্রিয়াসকে ভারত অভিযানে মিনান্ডার এবং এপােলােডােটাস কতখানি সাহায্য করেছিলেন বা তারা তিনজন আদৌ সমসাময়িক ছিলেন কিনা সে বিষয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পাঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল যে ডিমেট্রিয়াস অধিকার করেছিলেন, ওই অঞ্চলে পাওয়া তার নামাঙ্কিত মুদ্রাগুলোই তার প্রমাণ। ডিমেট্রিয়াসের বেশির ভাগ মুদ্রার একদিকে দেখা যায় গ্রিক ভাষা ও গ্রিক লিপির ব্যবহার, বিপরীত দিকে লক্ষ করা যায় প্রাকৃত ভাষা ও খরােষ্ঠী লিপির প্রয়ােগ। অনুমান করতে দ্বিধা নেই, বিজিত ভারতীয় অঞ্চলে প্রচলনের উদ্দেশ্যেই ডিমেট্রিয়াস প্রাকৃত ভাষা ও খরােষ্ঠী লিপি সম্বলিত মুদ্রাগুলো উৎকীর্ণ করেছিলেন। অনেকে মনে করেন ডিমেট্রিয়াসের নামাঙ্কিত দ্বিভাষিক মুদ্রাগুলোর সবই ইউথিডেমাসের পুত্র ডিমেট্রিয়াস উৎকীর্ণ করেননি, এ ধরনের বেশ কিছু মুদ্রা দ্বিতীয় এবং সম্ভবত তৃতীয় ডিমেট্রিয়াস উৎকীর্ণ করেছেন। আবার এমন ঐতিহাসিকও আছে যারা মনে করেন ইউথিডেমাসের পুত্র ডিমেট্রিয়াস আদৌ কোনও দ্বিভাষিক মুদ্রা প্রচলন করেননি, ভারত ভূখণ্ডেও তিনি কখনও রাজত্ব করেননি। শেষােক্ত মত সম্ভবত ঠিক নয়। গ্রিক লেখকগণ যে ডিমেট্রিয়াসের কথা বলেছেন তিনি ইউথিডেমাসের পুত্র প্রথম ডিমেট্রিয়াস। দ্বিতীয় বা তৃতীয় ডিমেট্রিয়াস তুলনায় অনেক নিষ্প্রভ ছিলেন। দ্বিভাষিক মুদ্রাগুলোর সিংহভাগই প্রথম ডিমেট্রিয়াসের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ হয়েছিল এরূপ ধারণাই সংগত মনে হয়। 

মনে হয় নিজের অধিকার সুদৃঢ় করতে ডিমেট্রিয়াস অধিকৃত অঞ্চলে কয়েকটি স্থায়ী সামরিক শিবির স্থাপন করেন। পরে এগুলোকে কেন্দ্র করে মুখ্যত গ্রিক অধিবাসীদের নিয়ে এক একটি শহর গড়ে ওঠে। প্রাচীন শাকল বা পাঞ্জাবের বর্তমান শিয়ালকোট শহরটির পত্তন এভাবেই হয়। মহাভাষ্যের টীকায় সৌবীর বা নিম্ন সিন্ধু অববাহিকার পূর্বাঞ্চলে দত্তামিত্রি নামে এক নগরের উল্লেখ আছে। ডিমেট্রিয়াস সম্ভবত এ নগরটিও প্রতিষ্ঠা করেন। 

ভারতে নিজের অধিকার অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে ডিমেট্রিয়াস যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করুন না কেন ব্যাকট্রিয়ার নিরাপত্তার দিকে তিনি যথাযথ দৃষ্টি দিতে পারেননি। যাদের ওপর ব্যাকট্রিয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে তিনি ভারত অভিযানে বের হয়েছিলেন সে ভার বহনের ক্ষমতা তাদের ছিল না। এ সুযােগ পুরাে সদ্ব্যবহার করলেন ভাগ্যান্বেষী ইউক্রেটাইডিস। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তিনি ব্যাকট্রিয়ার একাংশ অধিকার করে নেন। বিপদ বুঝতে পেরে ডিমেট্রিয়াস ব্যাকট্রিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। ইউক্রেটাইডিসের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় সেখানে সম্ভবত তার মৃত্যু হয়। এরূপ সিদ্ধান্তও সম্ভব যে ইউক্রেটাইডিসকে পরাজিত না করতে পেরে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ঘটনাকাল আনুমানিক ১৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এর পরের গ্রিক ইতিহাস আফগানিস্তান ও ভারতের অধিকার নিয়ে ডিমেট্রিয়াস ও ইউক্রেটাইডিসের পরিবার দু’টির পারস্পরিক সংঘর্যকে কেন্দ্র করেই মূলত আবর্তিত হয়েছে।

ডিমেট্রিয়াসের বংশধরগণের সঙ্গে ইউক্রেটাইডিসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা

যার হাতে ডিমেট্রিয়াসের ভাগ্যবিপর্যয় সেই ইউক্রেটাইডিস যার সন্তান তিনি এক সাধারণ গ্রিক পরিবারের সদস্য। তার নাম হেলিওক্লিস। ইউক্রেটাইডিসের মা লাওডিকে ছিলেন সম্ভবত সেলুকিডরাজ তৃতীয় এন্টিওকাসের কন্যা। সুতরাং ইউক্রেটাইডিসের পিতা সাধারণ পরিবারের সন্তান হলেও বৈবাহিকসূত্রে তিনি সেলুকিড রাজবংশের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। তৃতীয় এন্টিওকাসের মৃত্যুর পর তার দুই পুত্র চতুর্থ সেলুকাস ও চতুর্থ এন্টিওকাস যথাক্রমে সেলুকিড সিংহাসনে আরােহণ করেন। ডিমেট্রিয়াসের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে ইউক্রেটাইডিস সম্ভবত তার মাতুল সেলুকিডরাজ চতুর্থ সেলুকাস বা চতুর্থ এন্টিওকাসের সাহায্য লাভ করেছিলেন। ইউক্রেটাইডিসের কিছু মুদ্রায় যমজ গ্রিকদেবতাদ্বয় ক্যাস্টর ও পােল্যাক্সের অশ্বারূঢ় মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। অনেকে মনে করেন সেলুকিডরাজ চতুর্থ সেলুকাস অথবা চতুর্থ এন্টিওকাসের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্কের নিদর্শনস্বরূপ ইউক্রেটাইডিস এই মুদ্রাগুলো প্রচার করেন।

সেলুকিড রাজপরিবারের সঙ্গে ইউক্রেটাইডিসের আত্মীয়তার এই বন্ধন সম্পর্কে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন মুদ্রায় উৎকীর্ণ হেলিওক্লিস ও লাওডিকে ইউক্রেটাইডিসের পিতা-মাতা নন, পুত্র-পুত্রবধূ। সে যা হােক, ইউক্রেটাইডিস সেলুকিড রাজপরিবারের সহায়তা পান বা না পান, ডিমেট্রিয়াসের বিরুদ্ধে তার সাফল্য সম্পর্কে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। গ্রিক ভাষা ও গ্রিক লিপিতে উৎকীর্ণ ইউক্রেটাইডিসের বেশ কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। ডিমেট্রিয়াসের হাত থেকে তিনি যে ব্যাক্ট্রিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল অধিকার করেন এই মুদ্রাগুলো তার স্পষ্ট প্রমাণ। ইউক্রেটাইডিসের অনেক মুদ্রায় গ্রিক ভাষা ও গ্রিক লিপির সঙ্গে প্রাকৃত ভাষা ও খরােষ্ঠী লিপির ব্যবহার দেখা যায়। এই মুদ্রাগুলো থেকে জানা যায় ইউক্রেটাইডিস ডিমেট্রিয়াসের বিরুদ্ধে ভারতীয় ভূখণ্ডেও সাফল্য লাভ করেন। ইউক্রেটাইডিসের ভাগ্যে এই যে সাফল্য এসেছিল তা কিন্তু আংশিক। আংশিক কারণ তিনি ডিমেট্রিয়াসের রাজ্যের সবটাই জয় করতে পারেননি। যেমন ব্যাকট্রিয়ার কিয়দংশে তেমন ভারতের একাংশেও ইউক্রেটাইডিস ও তার উত্তরাধিকারীদের প্রবল বিরােধিতা সত্ত্বেও ডিমেট্রিয়াসের বংশধরেরা রাজত্ব করতে থাকেন।

ডিমেট্রিয়াসের উত্তরাধিকারিগণের মধ্যে দ্বিতীয় ইউথিডেমাস, প্যান্টালিওন, এগাগােক্লিস, এন্টিমেকাস, দ্বিতীয় ডিমেট্রিয়াস, এপােলােডােটাস ও মিনান্ডার সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। এদের মধ্যে প্রথম পাঁচজন ছিলেন প্রথম ডিমেট্রিয়াসের পুত্র, ষষ্ঠজন ভাই এবং শেষােক্তজন জামাতা। তারা কে কখন, কার পর এবং কী পরিস্থিতিতে রাজপদ গ্রহণ করেছেন তা নিশ্চিতরূপে বলার উপায় নেই। তথ্যের অপ্রতুলতাই এক্ষেত্রে প্রধান বাধা। হয়তােবা তাদের কেউ কেউ প্রায় একই সময় স্ব স্ব অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। ইউক্রেটাইডিসের অগ্রগতি প্রতিহত করতে তারা প্রায় সকলেই সাধ্যমতাে চেষ্টা করেছেন। 

ইউক্রেটাইডিসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যাকট্রিয়ায় বসবাসকারী গ্রিকদের সক্রিয় সমর্থনের আশায় এগাথােক্লিস ও এন্টিমেকাস বিশেষ ধরনের স্মারক মুদ্রা প্রবর্তন করেন। এ ধরনের মুদ্রা প্রচলন করে তারা বােঝাতে চেয়েছেন আলেকজান্ডার হতে শুরু করে প্রথম ডিমেট্রিয়াস পর্যন্ত সকল বিখ্যাত গ্রিক রাজাদের তারাই প্রকৃত উত্তরাধিকারী, ব্যাকট্রিয়ার সিংহাসনে তাদেরই আইনত অধিকার, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউক্রেটাইডিস অনধিকারী। ইউক্রেটাইডিসের প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা কিন্তু ব্যাকট্রিয়ার কিয়দংশ এবং তক্ষশিলা অঞ্চলে তাদের শাসনকর্তৃত্ব বজায় রাখেন।

ভ্রাতুস্পুত্রদের অকাল মৃত্যুতে সম্ভবত তাদের পিতৃব্য এপােলােডােটাস সিংহাসনে আরােহণ করেন। ব্যাকট্রিয়া তার হাতছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু ভারতে তিনি আশাতীত সাফল্য লাভ করেন। কাপিশ-গান্ধার অঞ্চল যে তার শাসনভুক্ত ছিল তার মুদ্রার সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যভাগে তার মুদ্রা যে ভূগুকচ্ছ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল তা ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থের লেখক উল্লেখ করেছেন। মনে হয় কাপিশ, গান্ধার, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধুপ্রদেশ ও গুজরাত উপকূল এপােলােডােটাসের রাজ্যভুক্ত ছিল।  এপােলােডােটাসের এই সৌভাগ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। শীঘ্রই প্রতিদ্বন্দ্বী ইউক্রেটাইডিসের হাতে তার পরাজয় ঘটে। এপােলােভােটাসের কিছু তামার মুদ্রায় ইউক্রেটাইডিসের কাপিশ মুদ্রার ছাপ আছে। এই মুদ্রাগুলো আসলে এপােলােডােটাসেরই মুদ্রা, কিন্তু পরে ইউক্রেটাইডিস এই মুদ্রাগুলোর মুখ্য দিকে নিজের নাম ও প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ করেন, মুদ্রাগুলোর বিপরীত পৃষ্ঠে তিনি উৎকীর্ণ করেন জিউস-ইন্দ্রের মূর্তি ও দশ অক্ষরের প্রাকৃত লেখ ‘কবিসিয়েনগরদেবত’। এই মুদ্রাগুলো থেকে জানা যায়, এপােলােডােটাসকে পরাজিত করে ইউক্রেটাইডিস কাপিশ অধিকার করেন। শুধু কাপিশ নয়, এপােলােডােটাস বা ডিমেট্রিয়াসের অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের হাত থেকে ইউক্রেটাইডিস আরও অনেক অঞ্চল অধিকার করেন। তার মুদ্রার সংখ্যাধিক্য ও বৈচিত্র্য অন্তত সেরকম সিদ্ধান্তই নির্দেশ করে। কেবল তামা বা রূপার নয়, সােনার মুদ্রাও তিনি উৎকীর্ণ করেন। গ্রিক মুদ্রাগুলো সচরাচর সুদৃশ্যই বটে কিন্তু ইউক্রেটাইডিসের মুদ্রাগুলো এক কথায় অপূর্ব গ্রিক শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই মুদ্রাগুলো। ইউক্রেটাইডিসের আর্থিক সমৃদ্ধিরও নিদর্শন এই মুদ্রা।

জীবনের শেষ দিনগুলো ইউক্রেটাইডিস শান্তিতে অতিবাহিত করেননি। প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিক রাজপরিবারের প্রতিকূলতা তাে ছিলই। তার রাজ্যের উত্তরে ও পশ্চিমে শক ও পহ্লবদের অভ্যুত্থান পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তােলে। ইউক্রেটাইডিস যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন তিনি সম্ভবত শকদের ব্যাকট্রিয়ার উত্তর সীমান্তে আবদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু একাজে তাকে যে প্রচুর অর্থ ও শক্তি ব্যয় করতে হয় তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পশ্চিমে প্রতিবেশী পহ্লবদের বিরুদ্ধে তিনি একেবারেই ব্যর্থ হন। পহ্লবরাজ প্রথম মিথ্রিডেটিস ইউক্রেটাইডিসকে পরাজিত করেন। হেরাত ও কান্দাহার সম্ভবত পহ্লবদের অধিকারে চলে যায়। প্রাচীন লেখক জাস্টিনের বিবরণী থেকে জানা যায়, তার এই বিপদের দিনে পুত্র হেলিওক্লিস বিদ্রোহী হন। পুত্রের হাতেই ইউক্রেটাইডিসের জীবনাবসান হয়। পিতা ইউক্রেটাইডিসের মৃত্যুতে আনুমানিক ১৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে বসলেন পিতৃহন্তা হেলিওক্লিস।

মিনান্ডার ও পরবর্তী গ্রিকরাজগণ

ইউক্রেটাইডিসের প্রতিদ্বন্দ্বী এপােলােডােটাস লােকান্তরিত হয়েছেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মিনান্ডার। শক-পহ্লবদের সঙ্গে ইউক্রেটাইডিস ও তার পুত্রের সংঘর্ষের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে ভারতে এক বিশাল রাজ্য গঠন করেন তিনি। পশ্চিমে কাবুল হতে পূর্বে মথুরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মিনান্ডারের তামার ও রূপার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব অঞ্চল তাে বটেই এমনকী গুজরাত উপকূলও যে তার রাজ্যভুক্ত ছিল তা প্রায় নিশ্চিত। ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থের লেখক খ্রিস্টীয় ১ম শতকের মধ্যভাগে ভূগুচ্ছ পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে এপােলােডােটাস ও মিনান্ডার উভয়েরই মুদ্রার প্রচলন লক্ষ করেন। পেশােয়ার-তক্ষশিলা তথা বজৌর উপত্যকায় মিনান্ডারের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ একখানি লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। বুদ্ধের দেহাবশেষ সংরক্ষণ উপলক্ষে তারই অধীনস্থ স্থানীয় প্রশাসক বীর্যকমিত্র এই লেখটি উৎকীর্ণ করেন। পেশােয়ার-তক্ষশিলা অঞ্চল যে মিনান্ডারের অধিকারভুক্ত ছিল এই লেখটি তারই প্রমাণ। বলা বাহুল্য, প্রথমে ইউক্রেটাইডিস ও পরে তার পুত্র হেলিওক্লিসকে পরাজিত করেই মিনান্ডার তার বিশাল রাজ্য গড়ে তােলেন। পিতা ও পুত্র তখন পহ্লব ও শকদের বিরুদ্ধে জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত।

মিনান্ডার শুধু একজন দিগ্বিজয়ী বীরই ছিলেন না, প্রজাহিতৈষণা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ প্রভৃতি বিবিধ মানবিক গুণেরও অধিকারী ছিলেন। তার প্রশংসা করে মিলিন্দপঞ্হাে‌ নামে একখানি পালি গ্রন্থে বলা হয়েছে, বীরত্বে ও জ্ঞানে তিনি সারা ভারতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, তর্কযুদ্ধেও তিনি ছিলেন অপরাজেয়। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় শ্রমণ নাগসেনের অনুপ্রেরণায় তিনি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন। মিনান্ডারের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষান্তর সম্পর্কে অবশ্য অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মুদ্রার সাক্ষ্যেও এ সম্পর্কে কোনও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নেই। মিলিন্দপঞ্চ্হো‌ গ্রন্থে তাকে সুশাসক, প্রজানুরঞ্জক ও অসাধারণ জনপ্রিয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। খ্রিস্টীয় ১১শ শতকের সংস্কৃত কবি ক্ষেমেন্দ্র তার অবদানকল্পলতা কাব্যে মিনান্ডারের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। তিনি বলেন, মিনান্ডারের মৃত্যু হলে প্রজাগণের মধ্যে তার চিতাভস্ম সংগ্রহের জন্য অভূতপূর্ব আগ্রহের সঞ্চার হয়েছিল। 

আনুমানিক ১৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন মিনান্ডারের মৃত্যু হয় তখন তার পুত্র প্রথম স্ট্র্যাটো নাবালক মাত্র। ফলে রানিমা এগাথাক্লিয়া পুত্রের অভিভাবিকারূপে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। এসময় যে সকল মুদ্রা উৎকীর্ণ হয় তাতে মাতা ও পুত্র উভয়ের নামই উৎকীর্ণ থাকে। প্রথম দিকে মুদ্রায় শুধু এগাথােক্লিয়ার মূর্তিই অঙ্কিত থাকত কিন্তু পরে তার মূর্তির সঙ্গে স্ট্র্যাটোর মূর্তিও সংযুক্ত হয়। ইতিমধ্যে ইউ-চি গােষ্ঠীর তাড়া খেয়ে শকরা পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ব্যাকট্রিয়ার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। শত চেষ্টা সত্ত্বেও হেলিওক্লিস ব্যাক্ট্রিয়া রক্ষা করতে পারলেন না, বাধ্য হয়ে পিছু হটে তিনি সসৈন্যে স্ট্র্যাটোর রাজ্যভুক্ত কাপিশ-গান্ধার অঞ্চলে এসে উপনীত হন। এগাগােক্লিয়াকে পরাজিত করে তিনি এ অঞ্চলে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরিণত বয়সে স্ট্র্যাটো রাজ্যভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার দূরে থাকুক, ক্রমশই তার শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। হেলিওক্লিস তাকে পুনরায় পরাজিত করে বিতস্তা অববাহিকার একাংশ অধিকার করেন। বৃদ্ধ বয়সে স্ট্র্যাটো তার পৌত্র দ্বিতীয় স্ট্র্যাটোকে সহযােগী প্রশাসক নিযুক্ত করেন কিন্তু হেলিওক্লিস বা তার উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হলেন না। পূর্ব পাঞ্জাবের আধিপত্য নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। 

আনুমানিক ১২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হেলিওক্লিসের মৃত্যু হলে এন্টিয়ালকিডাস তার স্থলাভিষিক্ত হন। অনেকের ধারণা, এন্টিয়ালকিডাস হেলিওক্লিসের পুত্র ছিলেন। কিন্তু এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। তবে তিনি যে একজন সুযােগ্য রাজা ছিলেন তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। তার মুদ্রা থেকে জানা যায় তিনি কাবুল উপত্যকা ও কাপিশ-গান্ধার অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। তার কিছু মুদ্রায় শুধু গ্রিক ভাষা ও গ্রিক লিপি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এই মুদ্রাগুলো কাপিশ-গান্ধার অঞ্চলের, ব্যাকট্রিয়ার নয়।

সমসাময়িক শুঙ্গরাজ ভাগভদ্র বা ভদ্রকের সঙ্গে এন্টিয়ালকিডাস সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। হেলিওডােরাস নামে জনৈক গ্রিককে নিজের দূতরূপে তিনি শুঙ্গ রাজসভায় পাঠান। ঘটনাটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের অন্তিম পর্বে, শুঙ্গ রাজার চতুর্দশ রাজ্যবর্ষে। শুঙ্গরাজ্যে এসে গ্রিক দূত তার উপাস্য দেবতা বাসুদেবের উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রদেশে এক গরুড়স্তম্ভ নির্মাণ করেন। দেবদেব বাসুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এবং নিজ দৌত্যকার্যের বর্ণনা করে স্তম্ভের গায়ে তিনি একখানি লেখ খােদিত করেন। অনেকে মনে করেন, মিনান্ডারের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে শুঙ্গরাজের সাহায্যের আশায় এন্টিয়ালকিডাস এই দূত পাঠান। মিনান্ডার এবং এন্টিয়ালকিডাস উভয়েই তক্ষশিলা-পেশােয়ার অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দু’জন রাজা একই সঙ্গে একই অঞ্চলে রাজত্ব করবেন এ এক অসম্ভব ব্যাপার। তাই এদের দু’জনকে সমসাময়িক বলে ভাবা অনুচিত।

এন্টিয়ালকিডাস লিসিয়াস নামে আর একজন গ্রিক রাজার সঙ্গে একযােগে কিছু তাম্রমুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। এই মুদ্রার প্রধান পৃষ্ঠে লিসিয়াসের নাম লেখা আছে আর বিপরীত দিকে খােদিত আছে এন্টিয়ালকিডাসের নাম। লিসিয়াস শুধু এন্টিয়ালকিডাসের সঙ্গে যুগ্মভাবেই মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি, এককভাবেও তিনি কিছু মুদ্রা প্রচলন করেন। লিসিয়াসের এই স্বতন্ত্র মুদ্রার সঙ্গে ডিমেট্রিয়াস, এন্টিমেকাস ও মিনান্ডারের মুদ্রার আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য রয়েছে। এর থেকে মনে হয় লিসিয়াস পূর্ব পাঞ্জাবে স্ট্র্যাটোর উত্তরাধিকারী ছিলেন। সেই অর্থে তিনি এবং এন্টিয়ালকিডাস পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। হয়তােবা শক-পহ্লবদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার তাগিদে বিবদমান দু’টি গ্রিক গােষ্ঠী অন্তত কিছু দিনের জন্য পারস্পরিক বিভেদ ভুলে মৈত্রীর বন্ধনে ধরা দিয়েছিল। আনুমানিক ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এন্টিয়ালকিডাসের মৃত্যু হয়।

গ্রিক প্রভুত্বের বিলােপ

এন্টিয়ালকিডাস ও লিসিয়াসের মৃত্যুর পর শক-পহ্লব জাতি নিরন্তর আক্রমণ ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে গ্রিক শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। খ্রিস্টপর্ব ১ম শতকের দ্বিতীয় পাদে টেলিফাস প্রমুখ গ্রিক রাজাদের পরাজিত করে শক নৃপতি মউয়েস কাশি গান্ধার ও পশ্চিম পাঞ্জাব অধিকার করেন। কান্দাহার ও হেরাত তাে ইতিপূর্বেই গ্রিকদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় মিথ্রিডেটিসের মৃত্যুর পর পহ্লব ভাগ্যান্বেষী ভােনােনেস সে অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সংকুচিত হতে হতে গ্রিক আধিপত্য শেষে কাবুল উপত্যকা ও পূর্ব পাঞ্জাবে সীমাবদ্ধ হয়। এই পর্বে আর্কেবিয়াস, ডিওমেডেস, পিউকেলিয়ুস, এমিন্টাস, জৈলাস, ডিওনিসাস, এপােলােফ্যানেস, ফিলােকসেনাস, আর্টেমিডােরাস, নিসিয়াস প্রমুখ রাজারা রাজত্ব করেন। এদের মধ্যে অনেকেই ইউক্রেটাইডিস-এন্টিয়ালকিডাসের গােষ্ঠীর লােক ছিলেন আবার কেউবা ডিমেট্রিয়াস-লিসিয়াসের পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। গ্রিক শাসনের একেবারে অন্তিমপর্বে হারমেয়ুস কাবুল উপত্যকায় ও হিপপােসট্রেটাস পূর্ব পাঞ্জাবে রাজত্ব করতেন। মুদ্রার সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, প্রথম জন ইউক্রেটাইডিস-এন্টিয়ালকিডাসের গােষ্ঠীভুক্ত ছিলেন, দ্বিতীয় জন ছিলেন বিরােধী গােষ্ঠীর। 

মনে হয়, ক্রমবর্ধমান শক-পহ্লব আক্রমণে বিপর্যস্ত হারমেয়ুস ও হিপ্পােসট্রেটাস আত্মরক্ষার তাগিদে পরস্পর সংঘবদ্ধ হন। পরস্পরের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় করতে হারমেয়ুস হিপ্‌পোসট্রেটাসের কন্যা বা বােন ক্যালিওপেকে বিবাহ করেন। এত করেও হারমেয়ুস ও হিপপােসট্রেটাস আত্মরক্ষায় ব্যর্থ হলেন। কাবুল উপত্যকায় হারমেয়ুসের মুদ্রার সঙ্গে পহ্লবরাজ স্পলিরিসের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। পহ্লবরাজের বেশ কিছু মুদ্রায় দেবতা জিউসের সিংহাসনে উপবিষ্ট মূর্তি অঙ্কিত আছে। হারমেয়ুসের মুদ্রায়ও একই প্রতীক ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হয়, হারমেয়ুসকে পরাজিত করে স্পলিরিস কাবুল উপত্যকায় গ্রিক শাসনের অবসান ঘটান। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের মধ্যভাগে ঘটনাটি ঘটে। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন হারমেয়ুস গ্রিক শাসনের অন্তিমপর্বে রাজত্ব করেননি, রাজত্ব করেছেন খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের তৃতীয় পদে। কিন্তু মনে রাখতে হবে পহ্লবরাজ স্পলিরিস হারমেয়ুসের সমসামিয়ক ছিলেন, হারমেয়ুসকে পরাজিত করেই তিনি কাবুল উপত্যকা অধিকার করেন। স্পলিরিস খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের প্রথমার্ধে রাজত্ব করেন। হারমেয়ুসের রাজত্বের কালসীমাও তাই।

অনেকের অভিমত কুষাণরাজ কুজুল কদফিসেসের আক্রমণেই হারমেয়ুসের রাজ্য ধ্বংস হয়। তাদের আরও অনুমান পহ্লব আক্রমণ প্রতিরােধের জন্য হারমেয়ুস কুজুলের সাহায্য ভিক্ষা করেন কিন্তু পরে সুযােগ বুঝে ত্রাণকর্তা ঘাতকের মূর্তি ধারণ করেন। যে মুদ্রাগুলোর ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত, সেই মুদ্রাগুলো কিন্তু হারমেয়ুস ও কুজুলের যৌথ মুদ্রা নয ; হারমেয়ুসের রাজত্বের প্রায় সাত দশক পর কুজুল কদফিসেস স্বয়ং হায়মেয়ুসের অনুরূপ পহ্লব মুদ্রার অনুকরণে এই মুদ্রাগুলো উৎকীর্ণ করেছিলেন। হারমেয়ুসের মুদ্রার তুলনায় এই মুদ্রাগুলো অনেক নিকৃষ্টমানের। প্রায় একই সময় হিপ্পােসট্রেটাসের ভাগ্যেও বিপর্যয় নেমে আসে। বিপদ আসে শকরাজ প্রথম এজেসের কাছ থেকে। হিপপােসট্রেটাসের অনেক মুদ্রার উপর শক রাজার নাম ও প্রতীকের ছাপ আছে। সহজেই অনুমেয়, গ্রিক নৃপতিকে পূর্ব পাঞ্জাব থেকে বিতাড়িত করে শকরাজ বিজিত ভূভাগে এই পুনরঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করেন। পূর্ব পাঞ্জাব হতেও গ্রিক প্রভুত্ব বিলুপ্ত হল।

গ্রিক শাসনামলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় জীবন

প্রশাসনিক ব্যবস্থা 

  • রাজা : রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যা হয়, রাজাই ছিলেন গ্রিক রাষ্টের প্রাণপুরুষ। মৌর্য বা শুঙ্গ রাজাদের মতাে সাধারণ রাজকীয় উপাধিতে তিনি সন্তুষ্ট নন। ডিমেট্রিয়াসের উপাধি মহারাজ কিন্তু ইউক্রেটাইডিস শুধু মহারাজ নন, তিনি রাজাধিরাজ। বলতে বাধা নেই, ভারতীয় রাজারা পরবর্তিকালে গ্রিক নৃপতিদের অনুকরণে মহারাজ উপাধি ধারণ করেন।
  • দেবতা হিসেবে বর্ণনা : এন্টিমেকাস মুদ্রায় নিজেকে দেবতারূপে বর্ণনা করেছেন। রানি এগাথেক্রিয়া নিজেকে দেবােপমা বলে পরিচয় দিয়েছেন। মনে হয়, সকলের না হলেও কোনও কোনও গ্রিক রাজার ঈশ্বরত্বের অহংকার ছিল।
  • উপরাজের সাহায্য গ্রহণ : রাজা কখনও কখনও শাসনকার্যে উপরাজের সাহায্য গ্রহণ করতেন। সাধারণত রাজপরিবারের সদস্যরাই এই পদে নিযুক্ত হতেন। তারা কার্যত স্বাধীনভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন, নিজের নামে ও রাজকীয় উপাধিতে তারা স্বশাসিত অঞ্চলে মুদ্রা প্রচলন করতেন। কখনও কখনও রাজা সারা রাজ্যের জন্য একজন সহযােগী বা যুগ্ম প্রশাসক নিযুক্ত করতেন। প্রথম স্ট্যাটো বৃদ্ধ বয়সে তার পৌত্র দ্বিতীয় স্ট্যাটোকে এই পদে নিযুক্ত করেন।
  • ভারতীয় লিপির ব্যবহার : ভারত বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রিক রাজারা তাদের মুদ্রায় গ্রিক লিপির সঙ্গে ভারতীয় লিপির ব্যবহার শুরু করেন। বিজিত ভারতীয়দের নিকট নিজেদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বলতর করার জন্য তাদের এই উদ্যম। স্মরণ রাখা দরকার, গ্রিকরা সুদীর্ঘকাল পশ্চিম এশিয়া ও মিশর শাসন করলেও সেখানে তারা দেশীয় ভাষায় ও স্থানীয় লিপিতে মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি।
  • প্রদেশ : বিজিত ভারতীয় অঞ্চল সম্ভবত কয়েকটি প্রদেশে এবং এক একটি প্রদেশ কয়েকটি জেলায় বিভক্ত ছিল। শাসনকার্যের সুবিধার জন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। মনে হয়, ‘স্ট্র্যাটেগয়’ পদবিধারী সামরিক প্রশাসকেরা প্রদেশের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। মিনান্ডারের রাজত্বকালে জনৈক বীর্যকমিত্র বজৌর অঞ্চলের প্রশাসক ছিলেন। তার পদবি ছিল ‘অপ্রত্যগরাজ’। স্ট্র্যাটেগয়দের মতাে তিনি সম্ভবত একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন। বীর্যকমিত্র জাতিতে ভারতীয় না গ্রিক, তা জানা যায় না। তিনি ভারতীয়, একথা মানলে স্বীকার করতে হয় ভারতীয়রাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হতেন।
  • জেলা : ‘মেরিডর্ক’ পদবিধারী রাজপুরুষেরা জেলার ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। থিওডােরাস নামে জনৈক ব্যক্তি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে কাশ্মীরের স্বাট বা সোয়াট উপত্যকায় মেরিডর্কের কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন। থিওডােরাস গ্রিক ছিলেন।

অর্থনৈতিক জীবন

পালি গ্রন্থ মিলিন্দপঞ্হাে‌, গ্রিক ভাষায় লেখা ‘পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি’ ও রােমক ঐতিহাসিক প্লিনির বিবরণী থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২য় ও ১ম শতকের গ্রিক রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু আভাস পাওয়া যায়।

  • জমির মালিকানা : মিলিন্দপঞ্হাে‌তে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে জঙ্গলাকীর্ণ জমিকে যদি কোনও ব্যক্তি চাষ আবাদের উপযােগী করে তােলেন তবে তিনিই জমির মালিক হবেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমিরও উল্লেখ আছে মিলিন্দপহহাতে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভূমি ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নগর, বন্দর ও খনি।
  • ধনসম্পদ ও কৃষির বিকাশ : মিলিন্দপঞ্‌হো ও প্লিনির বিবরণে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বনসম্পদ ও কৃষির বিকাশের বর্ণনা আছে। এ অঞ্চলে বছরে তিনবার করে বর্ষার আগমন ঘটত। তাছাড়া মাঝে মধ্যে অল্পবিস্তর বৃষ্টিপাতও হত। জলের জন্য শুধু প্রকৃতির খেয়ালের উপর নির্ভর করা হত না, খাল খনন করে খেতে জলসেচের ব্যবস্থা করা হত। গ্রিক আমলে তৈরি এ ধরনের খালের নিদর্শন আফগানিস্তানের আইখানুমে আবিষ্কৃত হয়েছে। খেতে জলের জন্য কখনও কখনও পুকুর ও কূপের মতাে কৃত্রিম জলাশয় নির্মাণ করা হত। মিলিন্দপঞ্‌হোতে দুই প্রকার ধানের কথা উল্লেখ আছে – ব্রীহি অর্থাৎ সাধারণ ধান এবং শালি বা উৎকৃষ্ট ধান। রাজা-মহারাজ ও অভিজাত সম্প্রদায়ের আহার্য ছিল শালি ধান; সাধারণ মোটা চাল ছিল দীনদরিদ্রের ভক্ষ্য। ধান ছাড়া গম, যব, সরষে, জোয়ার, বাজরা, কলাই প্রভৃতি খাদ্যশস্যের উল্লেখ আছে মিলিন্দপঞ্হো‌তে। ধান, গম, যব, তিল, গােলমরিচ, এলাচ, সুগন্ধি, ধুনা ইত্যাদি কৃষিজ ও বনজ সম্পদের উল্লেখ করেছেন প্লিনি। প্লিনি অবশ্য কার্পাস চাষের সরাসরি উল্লেখ করেননি, করেছেন কিছুটা তির্যকভাবে। তিনি বলেছেন ভারতে বিশেষ এক জাতের বৃক্ষে পশম জন্য। এখানে তিনি নিঃসন্দেহে তুলাচাষের কথাই বলেছেন। আগাছা পরিষ্কার, খেত থেকে কাটা ও পাথর তােলা, লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ, বীজ বপন, জল সেচন, কৃষিখেতের চারদিকে বেড়া তােলা, খেত পাহারা দেওয়া, ফসল কাটা, শস্য ঝাড়াই মাড়াই প্রভৃতি ফসল ফলাবার বিভিন্ন পর্যায়ের উল্লেখ আছে মিলিন্দপঞ্চ্‌হোতে। 
  • কারিগরি শিল্প : এ পর্বে কারিগরি শিল্পের অগ্রগতির পরিচয় বিধৃত আছে মিলিন্দপঞ্হাে‌তে। গ্রন্থখানিতে পঁচাত্তর রকম বৃত্তি বা জীবিকার উল্লেখ আছে যার মধ্যে প্রায় ষাটটি বৃত্তি ছিল কারিগরি শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বৃত্তি সােনা, রূপা, সিসা, টিন, তামা, পিতল, কাসা, লােহা। প্রভৃতি ধাতু ও মূল্যবান প্রস্তরদিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। 
  • বাণিজ্যিক কেন্দ্র : বলখ, পুষ্কলাবতী, তক্ষশিলা, বেগ্রাম, শাকল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো গ্রিক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বারবারিকাম ও ভৃগুকচ্ছের মতো সমৃদ্ধশালী বন্দরগুলোও গ্রিক রাজ্যভুক্ত ছিল। এই সব বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও বন্দরগুলো সমকালীন ভারতের মথুরা, পাটলিপুত্র, গাঙ্গেয় বদ্বীপ, বিদিশা, উজ্জয়িনী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও অঞ্চলগুলোর সঙ্গে স্থলপথে সংযুক্ত ছিল। ফলে দেশীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে গ্রিক রাজ্যগুলোর ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাণিজ্য চলত চিন, পশ্চিম এশিয়া ও মিশরের সঙ্গেও। চিনের সঙ্গে পণ্যের আমদানি-রপ্তানি হত প্রধানত খােটান ও গিলগিটের দুর্গম অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। চিনে যাতায়াতের একটি নাতিদীর্ঘ পথও ছিল। একটি স্থলপথ ব্যাকট্রিয় হয়ে উত্তর ভারত, অসম, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের ভেতর দিয়ে দক্ষিণ চিন অবধি প্রসারিত ছিল। পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে স্থল ও জল উভয় পথেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। স্থলপথ ছিল দুটি একটি বলখ, হেকাটোমপিলেস ও একব্যাটানা হয়ে, অন্যটি দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের ভেতর দিয়ে। আরব সাগর, ওমান ও পারস্য উপসাগরের উপকূল ধরে ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার বাণিজ্যতরী যাতায়াত করত। বাণিজ্যতরী গমনাগমন করত ভারত ও মিশরের মধ্যেও, উপকূলের পথ ধরে। পরে দক্ষিণ-পূর্ব আরবের কোনও এক বন্দর হতে আড়াআড়িভাবে আরব সাগর অতিক্রম করে সরাসরি সিন্ধুপ্রদেশে পৌঁছবার সামুদ্রিক পথ আবিষ্কৃত হয়। আরও পর থেকে বাণিজ্যতরীগুলো। দক্ষিণ আরবের বন্দর থেকে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ভৃগুকচ্ছে পোঁছতে থাকে। তবে তখনও মৌসুমি বায়ুর রহস্য উদঘাটিত না হওয়ায় মাঝ সমুদ্রে যাতায়াত বিপজ্জনক ছিল। সে কারণে বেশির ভাগ বাণিজ্যতরী পুরানাে উপকূল পথেই যাতায়াত করত। 
  • পশ্চিম এশিয়ার সাথে রপ্তানি বাণিজ্য : এসময় পশ্চিম এশিয়ায় অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে গজদন্ত ও মশলা রপ্তানি হত। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৬ আন্দে সেলুকিডরাজ চতুর্থ এন্টিওকাস ডফনে শহরে ভারতীয় গজদন্ত ও মশলার এক প্রদর্শনীর আয়ােজন করেন। ১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ আর্মেনিয়ায় একটি ভারতীয় বসতি গড়ে ওঠে। ৩০০ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় ভারতীয়রা সদলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। চিন থেকে নিকেল, রেশমি বস্ত্র ও বাঁশের তৈরি জিনিস আমদানি হত। ১২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চিনা রাজদূত চ্যাঙ কিয়েন ব্যাক্ট্রিয়ায় আসেন। তিনি সেখানকার বাজারে চিনে তৈরি বাঁশের জিনিস ও বস্ত্র দেখে বিস্মিত হন। দেবী এথেনার মূর্তিসম্বলিত খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের এক কাচপাত্র চিনে পাওয়া গেছে। প্রাক খ্রিস্টীয় যুগে ব্যাকট্রিয়ায় তৈরি বস্ত্র মােঙ্গোলিয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারত থেকে যেসব। জিনিস মিশরে রপ্তানি হত তাদের মধ্যে গজদন্ত, কচ্ছপের খােল, মুক্তা, নীল, লােহা ও কাঠ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। মিশরে ভারতীয় গজদন্তের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় শঙ্কিত হয়ে সেখানকার রাজা দ্বিতীয় টলেমি গজদন্তের কারবারে সরকারের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন। এর ফলে ভারতীয় গজদন্ত শিল্প প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • মুদ্রা : সমকালীন মুদ্রায় এই যুগের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রয়েছে। রূপা, তামা ও নিকেলে এসময় অসংখ্য মুদ্রা নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয় ডিওডােটাস, প্রথম ইউথিডেমাস, প্রথম ডিমেট্রিয়াস, ইউক্রেটাইডিস এবং সম্ভবত মিনান্ডার কিছু স্বর্ণমুদ্রাও প্রচলন করেন। তবে প্রথম পর্বের স্বর্ণমুদ্রাগুলোর তুলনায় পরবর্তী অধ্যায়ের মুদ্রাগুলো ওজনে অনেক হালকা। শেষ পর্বের কোনও গ্রিক রাজা স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি। অর্থনৈতিক অবস্থান্তরই এর সম্ভাব্য কারণ। প্রথম পর্বের গ্রিক মুদ্রাগুলো থেকে সেযুগে ধাতু শিল্পের অগ্রগতির পরিচয় পাওয়া যায়। তক্ষশিলায় পাওয়া সেযুগের সােনা ও ব্রোঞ্জের তৈরি বিভিন্ন অলংকার ও লােহার বাসনপত্রেও এই অগ্রগতির স্বাক্ষর রয়েছে। সােনার গহনাগুলোর সূক্ষ্ম কারুকার্য দৃষ্টিনন্দন। 
  • নগরায়ন : সিরকাপের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে এযুগের নগরায়ণের চিত্র প্রতিফলিত। প্রাপ্ত নিদর্শন প্রমাণ করছে এই পর্বে তক্ষশিলার প্রাণকেন্দ্র ভিড়টিপি হতে সিরকাপে সরে আসে। মৌর্যযুগের তুলনায় এই পর্বের রাস্তাঘাট অনেক সুপরিকল্পিত, বাড়ি-ঘর অনেক সুবিন্যস্ত। এ জাতীয় পরিকল্পিত নগর ভারতে বড় একটা দেখা যায় না। কিন্তু গ্রিক ভূখণ্ডে এ এক সাধারণ ঘটনা। বলা বাহুল্য, তক্ষশিলার এই পরিকল্পিত নগরবিন্যাসে গ্রিক সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট।

গ্রিকদের সামাজিক জীবন

ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ : গ্রিকদের সামাজিক জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তারা যখন ব্যাকট্রিয়ায় ছিলেন তখন সেখানে ইরানিরাও অধিক সংখ্যায় বসবাস করতেন। এক স্থানে দীর্ঘদিন পাশাপাশি অবস্থান করায় দু’টি ভিন্ন গােষ্ঠী পরস্পরের নিকটবর্তী হয়। পারস্পরিক বৈবাহিক সম্বন্ধের ফলে এই সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। কিন্তু ভারতে আসার পর গ্রিকদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বিপুল পরিবর্তন ঘটে যায়। তারা নিজেরা উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী ছিলেন। ভারতবাসীর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি তারা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেন। পূর্বে তারা সাধারণত নিজেদের দেবদেবী ও রাজাদের নামানুসারে পুত্র-কন্যাদের নামকরণ করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা ভারতীয় ধর্ম গ্রহণ করেন, ভারতীয় নাম ধারণ করেন এবং ভারতীয় রীতিনীতি, আচার সংস্কার অনুসরণ করে ভারতীয় সমাজের অঙ্গীভূত হন। অভিজাত গ্রিক পরিবারে যে মহাভারত তথা সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চা হত বেসনগর গরুড়স্তম্ভ লেখে তার সুনিশ্চিত প্রমাণ আছে। 

ভারতীয় জাতিকাঠামোতে অন্তর্ভূক্তি : প্রথম দিকে ভারতীয়রা বৈদেশিক গ্রিকদের খুব একটা সুনজরে দেখেননি। গ্রিকদের সম্পর্কে ভারতীয়দের এই বিরূপ মনােভাবের প্রতিফলন ঘটেছে গার্গীসংহিতা গ্রন্থে। গ্রন্থখানিতে গ্রিকদের ‘দুষ্ট’ ও ‘রাজ্যলিঙ্গু’ বলে নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তিকালে গ্রিকদের সম্পর্কে ভারতীয়দের মনােভাবের পরিবর্তন ঘটে, বিদেশি গ্রিকদের ভারতীয় জাতিকাঠামাের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পতঞ্জলি গ্রিকদের বা জবনদের উচ্চশ্রেণির শুদ্র বলে অভিহিত করেছেন। যবনরা যাগযজ্ঞের আবকারী এবং আর্যদের সঙ্গে পান-ভােজনের যােগ্য বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মনুসংহিতা ও মহাভারতের অনুশাসনপর্বে বলা হয়েছে যবনরা প্রকৃতপক্ষে ক্ষত্রিয় কিন্তু স্বধর্মচ্যুত হয়ে বৃষল বা শূদ্রে পর্যবসিত হয়েছেন। মিলিন্দপঞ্চ্‌হোতে গ্রিকরাজ মিনান্ডারকে ক্ষত্রিয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এর থেকে মনে হয়, বিদেশিরূপে এদেশে এলেও দীর্ঘদিন এখানে বসবাস করার ফলে যবনরা আর স্বতন্ত্র জাতি হয়ে থাকলেন না, ভারতীয় জনসমাজের সঙ্গে মিশে যান।

ধর্মীয় জীবন

  • মিনান্ডারের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ ? : গ্রিকরা প্রথম দিকে তাদের পুরানাে ধর্মীয় আচার-বিশ্বাসই অনুসরণ করতেন। মুদ্রা ও মূর্তির সাক্ষ্য থেকে মনে হয় জিউস, হেরাক্লিস, এথেনা, পােসাইডন ও এপােলাে তাদের প্রধান দেবদেবী ছিলেন। কিন্তু এদেশে দীর্ঘদিন অবস্থানের ফলে ধীরে ধীরে তাদের উপর ভারতীয় ধর্মের প্রভাব এসে পড়ে। তাদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয় ধর্ম গ্রহণ করেন। মিলিন্দপঞ্চ্‌হোতে শ্ৰমণ নাগসেনের কাছে রাজা মিনান্ডারের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষান্তরের কাহিনি বর্ণিত আছে। মিনান্ডারের অসংখ্য চৈত্য ও বিহার নির্মাণের কথাও এই গ্রন্থে সবিস্তারে বলা হয়েছে। অনেকের বিশ্বাস বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগ বশে তিনি তার কিছু মুদ্রায় বৌদ্ধধর্মের প্রতীক ধর্মচক্র অঙ্কিত করেন, তাছাড়া মুদ্রায় তিনি নিজেকে ধার্মিক অর্থাৎ ধর্ম বা বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী রূপে বর্ণনা করেন। অবশ্য মুদ্রার চিহ্ন ও লেখের ব্যাখ্যা সম্পর্কে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতদ্বৈধ আছে। মিনান্ডার আদৌ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে অনিশ্চয়তা আছে ঠিকই তবু মিনান্ডারের বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগ সত্য ঘটনা বলেই মনে হয়। অনেকে মনে করেন এগাথােক্লিস তার মুদ্রায় বৌদ্ধস্তুপ ও বােধিবৃক্ষ অঙ্কিত করেছেন, নিজেকে হিন্দুজ বা ধর্মে হিন্দু বলে দাবি করেছেন। কিন্তু এসব ধারণা যথার্থ নয় বলেই মনে হয়।
  • অনেক গ্রিকের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ : শুধু রাজা মহারাজেরা নন, গ্রিকদের মধ্যে অনেকেই যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ আছে। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে স্বাট বা সোয়াট উপত্যকার গ্রিক প্রশাসক থিওডােরাস ‘ভগবান’ বুদ্ধের দেহাবশেষ রক্ষণাবেক্ষণের যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। থিওডােরাসেরই প্রায় সমসাময়িক ছিলেন এক গ্রিক শ্রমণ – নাম মহাধর্মরক্ষিত। রাজা দুট্টথগামণির মহাস্তুপ নির্মাণ উপলক্ষে তিনি অলস শহর হতে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। এক গ্রিক মেরিডর্ক তক্ষশিলার নাতিদূরে একটি বৌদ্ধস্থূপ নির্মাণ করেন। তিনি অবশ্য থিওডােরাস বা মহাধর্মরক্ষিতের একটু পরবতী। পশ্চিম ভারতের নাসিক, কার্লে ও জুন্নারে পাওয়া কয়েকটি লেখে স্থানীয় বৌদ্ধ চৈত্য ও বিহারের উদ্দেশ্যে গ্রিক জনগণের দানধ্যানের কথা আছে। এই প্রসঙ্গে ধেনুকাকটবাসী সিংহধ্বজ, ইরিল, চিত্র, চন্দ্র, ধর্ম ও ইন্দ্রাগ্নিদত্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। জন্মসূত্রে তারা সকলেই গ্রিক ছিলেন অথচ সকলেই বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে একমাত্র ইরিল বাদে বাকি সকলে ভারতীয় নাম পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন। তারা সকলেই খ্রিস্টীয় ১ম-২য় শতাব্দীর লােক।
  • অন্যান্য ভারতীয় ধর্মে আগ্রহ : গ্রিকরা যে শুধু বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছেন তা নয়, অন্যান্য ভারতীয় ধর্মের প্রতিও তাদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। রাজদূত হেলিওডােরাস ‘দেবদেব’ বাসুদেবের ভক্ত ছিলেন, তিনি তার উপাস্য দেবতার উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রদেশের বেসনগরে একটি গরুস্তম্ভ নির্মাণ করেন। এগাথােক্লিসের কিন্তু মুদ্রায় বলরাম ও বাসুদেবের মূর্তি অঙ্কিত রয়েছে। বৈষ্ণবধর্মের প্রতি তার অনুরাগের কথা এই মুদ্রা হতে জানা যায়।
  • গ্রিক ও ভারতীয় ধর্মের মিশ্রণ : একদিকে যখন গ্রিকদের অনেকে পৈতৃক ধর্ম ছেড়ে ভারতীয় ধর্ম গ্রহণ করছেন, অন্যদিকে তখন তাদেরই এক গােষ্ঠী গ্রিক ও ভারতীয় ধর্মের মধ্যে এক মিলনসেতু রচনা করছেন। ইউক্রেটাইডিসের সময় থেকেই এই প্রয়াস চলছিল। তার এক শ্রেণির মুদ্রায় সিংহাসনে উপিবষ্ট গ্রিক দেবতা জিউসের মূর্তি অঙ্কিত। জিউসেরই ডানদিকে উৎকীর্ণ রয়েছে হাতির মুখমণ্ডল, কখনওবা এক পূর্ণাঙ্গ হাতি। মুদ্রাগুলোতে স্পষ্ট বলা হয়েছে কাপিশ নগরের অধিষ্ঠাতৃ দেবতার মূর্তিই এখানে অঙ্কিত হয়েছে। কাপিশের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা কিন্তু ইন্দ্র। মুদ্রায় গ্রিক শিল্পী জিউসের মূর্তি একেছেন বটে কিন্তু তার লক্ষ্য এখানে ইন্দ্র। অর্থাৎ জিউসের মধ্যেই শিল্পী ইন্দ্রকে খুঁজে পেয়েছেন। ইন্দ্রকে শুধু জিউসরূপে অঙ্কিত করে শিল্পী সন্তুষ্ট নন তিনি জিউস ও ইন্দ্রের অভিন্নতা স্পষ্টতর করার উদ্দেশ্যে ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতকেও উপস্থাপিত করেছেন। এন্টিয়ালকিডাস ও আরও কয়েকজন গ্রিক রাজার মুদ্রায় একই ছবি উৎকীর্ণ হয়েছে।

গ্রিকদের ভাষ্কর্য ও ভারতবর্ষে গ্রিকদের অবদান

গ্রিক ভাস্কর্য

  • ডায়োনিসাসের মূর্তি : এই পর্বের তৈরি বেশ কিছু গ্রিক দেবদেবীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। সুরার দেবতা ডায়ােনিসিয়াসের একটি সুদৃশ্য মূর্তি তক্ষশিলায় পাওয়া গেছে। মূর্তিটি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের। এই প্রসঙ্গে লাহাের সরকারি সংগ্রহশালায় রক্ষিত দেবী এথেনার মূর্তিটিও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
  • বুদ্ধমূর্তি : অনেক ইউরােপীয় পণ্ডিতের ধারণা গন্ধরের গ্রিক শিল্পীরাই সর্বপ্রথম বুদ্ধমূর্তি তৈরি করেন। তারা মনে করেন বুদ্ধের মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের একেবারে গােড়ার দিকে বা গ্রিক শাসনের অন্তিম পর্বে। এই অভিমত সত্য হলে গ্রিক শাসনের অন্তিম পর্বকে গান্ধারশিল্পের শৈশবকাল বলে চিহ্নিত করতে হয়। গান্ধারশিল্পের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে গ্রিক শিল্পীদের বিরাট অবদান অস্বীকার করা যায় না। গান্ধার বুদ্ধের কেশবিন্যাস, কাপড়পরার ধরন, সগুল্ফ উপস্থাপনা, দৈহিক গঠন সব কিছুই গ্রিক দেবতা এপােলাের মতাে। এই বুদ্ধ যেন ছদ্মবেশী এপােলাে। তেমনি গান্ধারশিল্পের যক্ষ-নাগেরা ভারতীয় নন, তারা যেন হেরাক্লিস, পােসাইডন প্রমুখ গ্রিকদেবতাদের সমগােত্রীয়। তবে গ্রিক শৈলীর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠলেও গান্ধারশিল্প ব্যাকট্রীয় গ্রিক পর্বে আত্মপ্রকাশ করেনি, আত্মপ্রকাশ করেছিল শক-পহ্লব পর্বে। দ্বিতীয়ত, গ্রিক শিল্পীরাই সর্বপ্রথম বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করেন এমনটি ভাবাও ঠিক নয়। প্রায় একই সময় নির্ভেজাল দেশীয় শৈলীতে মথুরায় বুদ্ধ-বােধিসত্ত্ব মূর্তি নির্মিত হতে থাকে।

গ্রিকদের অবদান

গ্রিক রাজারা তাদের মুদ্রায় একই সঙ্গে গ্রিক ও প্রাকৃত ভাষা ব্যবহার করেছেন। তাদের পৃষ্ঠপােষকতায় প্রাকৃত ভাষা নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ হয়েছে।

  • সাহিত্যে ও নাটকে : অনেকে অবশ্য সংস্কৃত সাহিত্যে, বিশেষ করে নাটকের ক্ষেত্রে, গ্রিকদের অবদানের কথা বলেন। তাদের ধারণা গ্রিক প্রহসনের অনুকরণেই সংস্কৃত নাটকে পর্দা বা যবনিকার ব্যবহার হয়। ‘যবনিকা’ কথাটির মধ্যেও গ্রিক প্রভাব সহজেই লক্ষ করা যায়। ভারতীয় নাটকের সূত্রধার, সূত্রধারীরা যেন গ্রিক প্রহসনের আর্কিমিমাস ও আর্কিমিমাদের প্রতিকৃতি। নায়িকার প্রতি নায়কের বিস্মরণজনিত উপেক্ষা ও পরিশেষে উভয়ের পুনর্মিলনের যে ছবি ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ প্রভৃতি নাটকে দেখা যায় তাতেও অনেকে ইউরিপিডেস, মিনান্ডার প্রমুখ গ্রিকনাট্যকারদের প্রভাব লক্ষ করেন। কিন্তু এসব সাদৃশ্য নিতান্তই কাকতলীয়। তবে ভারতীয় নাটকে পর্দা ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রিক প্রহসনের প্রভাব থাকা বিচিত্র নয়।
  • ভারতীয় মুদ্রা : ভারতীয় মুদ্রার উপর যে গ্রিক মুদ্রার বিশেষ প্রভাব পড়েছিল তা অস্বীকার করা যায় না। আগেকার ভারতীয় মুদ্রা প্রতীকসর্বস্ব—সেখানে না আছে কোনও লেখ, না আছে কোনও রাজার বা দেবদেবীর মূর্তি। কালক্রমে গ্রিক মুদ্রার প্রভাবে এসব বৈশিষ্ট্য ভারতীয় মুদ্রায় আত্মপ্রকাশ করে। গ্রিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কুণিন্দ ও ঔদুম্বর উপজাতির মুদ্রায়। মুদ্রার চেয়ে ভারত যে কেবল গ্রহীতার ভূমিকাই পালন করেছে তা নয়, সে গ্রিক মুদ্রার উপরও কখন কখনও প্রভাব ফেলেছে। প্যান্টালিওন ও এগাথােক্লিসের মতাে গ্রিক রাজারা তক্ষশিলার স্থানীয় মুদ্রার আংশিক অনুকরণে তাম্রমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছিলেন। গ্রিক টাকশালে গ্রিক শিল্পীদের সয়ে সম্ভবত ভারতীয় শিল্পীরাও কাজ করতেন। 
  • চিকিৎসাবিজ্ঞান : চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গ্রিকদের সঙ্গে ভারতীয়দের হয়তাে পারস্পরিক ভাব বিনিময় ঘটেছিল যদিও এ সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান এবং ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবনে তার ফলাফল সম্পর্কে জ্যোতিষশাস্ত্রের কিছু পশ্চিম এশীয় ধ্যানধারণা সম্ভবত গ্রিকদের মাধ্যমে এসময় ভারতে আসে। 

সব মিলে বলা যায়, ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবর্তনে প্রাচীন ব্যাকট্রীয়-গ্রিকদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

ভারতে শক-পহ্লব আধিপত্য 

রাজনৈতিক ইতিহাস

শকদের আদি ইতিহাস

গ্রিক বা যবন শাসনের অন্তিম পর্বে শক-পহ্লবরা ভারত আক্রমণ করেন। তাদের আক্রমণে গ্রিক রাজ্যগুলো ভেঙ্গে পড়ে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের পদানত হয়। রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে তাে বটেই ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তৃতির পরিপ্রেক্ষিতেও শক-পহ্লব যুগ এই উপমহাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে।

শকরা ছিলেন আসলে মধ্য এশিয়ার এক যাযাবর গােষ্ঠী। অতি প্রাচীনকালেই মধ্য এশিয়ার কয়েকটি স্থানে তাদের বসতি গড়ে উঠেছিল। আধুনিক কিরগিজস্তানের উত্তর-পূর্বপ্রান্তস্থিত ইশিক্কুল হ্রদ সংলগ্ন অঞ্চলই ছিল এই শকদের এক প্রাচীন আবাস। কালক্রমে ইউ-চি, হুণ প্রভৃতি প্রতিদ্বন্দ্বী যাযাবর গােষ্ঠীর আক্রমণে তারা এই বাসভূমি ত্যাগ করে একটু পশ্চিমে সরে এসে উজবেকিস্তান ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করেন। শকদের দক্ষিণাভিমুখী একটি শাখা ইরানের সিস্তান অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। এ দু’টি শাখার শকরাই ভারত আক্রমণ করেছিলেন। উজবেকিস্তানে শকরা কারাকোরাম পর্বতশ্রেণির মধ্য দিয়ে কাশ্মীরে এসে উপনীত হয় আর সিস্তানের শকরা বেলুচিস্তান হয়ে বােলান গিরিপথের ভেতর দিয়ে সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে। মূল চীনা ইতিবৃত্তে স্থানটিকে কি-পিন বলা হয়েছে। অনেকেরই অভিমত, কি-পিন ও কাশ্মীর এক ও অভিন্ন। কোনও কোনও বিদ্বান কি-পিনের অবস্থান কাশি বা কফিরিস্তান (নুরীস্তান) অঞ্চলে নির্দেশ করেছেন। শেষে অভিমত যথার্থ হলে সিদ্ধান্ত করতে হবে, কারাকোরাম নয়, হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণী পেরিয়েই শকদের এই শাখা উওর-পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করে। তবে বেশির ভাগ শকরা সিস্তান থেকেই ভারতে আসে। শকরা দীর্ঘদিন তাদের পুরানাে বাসভূমি সিস্তানের কথা মনে রেখেছিল। তাদের ভারতে আসার অনেক পরে উৎকীর্ণ মথুরা সিংহস্তম্ভ লেখমালায় সিস্তান বা শকস্থানের উল্লেখ আছে।

শকরাজ মউয়েস

ভারতে শক-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব যার তিনি লেখে মােগ এবং মুদ্রায় মউয়েস ও মােঅ নামে অভিহিত। মউয়েসের পূর্বেও কয়েকজন করা ভারতে, বিশেষ করে কি-পিন অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। তারা সকলেই ছিলেন ক্ষুদ্র নরপতি। তাদের প্রকৃত নাম সম্পর্কেও নিশ্চয়তার অভাব রয়েছে। মউয়েসই শকদের প্রথম উলেখযােগ্য নৃপতি। তার প্রতিষ্ঠিত রাজ্যটিই দীর্ঘস্থায়ী হয়। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের দ্বিতীয় পদের প্রারম্ভেই তার রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত আর ঐ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ তার জীবনাবসান হয়। অবশ্য অনেকে মউয়েস-মােগ খ্রিস্টীয় ১ম শতকের প্রথম ভাগে রাজত্ব করেছিলেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। তখৎ-ই-বহি লেখ থেকে জানা যায়। পহ্লবরাজ গােন্ডােফারেস খ্রিস্টীয় ১ম শতকের প্রথম ভাগে গান্ধার অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। তিনি একজন পরাক্রান্ত নরপতি ছিলেন। মউয়েস-মােগও গান্ধার অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। দু’জন পরাক্রমশালী রাজা একই সময় একই অঞ্চলে রাজত্ব করবেন, এ এক অভাবনীয় বিষয়। সুতরাং তাদের মধ্যে একজন অবশ্যই পূর্ববতী। গােন্ডোফারেস ছিলেন শকরাজ দ্বিতীয় এজেসের সমকালীন। কিন্তু মউয়েস দ্বিতীয় এজেসের পূর্ববর্তী। মউয়েসের মৃত্যুর পর শক ভূখণ্ডের রাজা হন প্রথমে প্রথম এজেস, পরে এজিলিস এবং অবশেষে দ্বিতীয় এজেস। এর থেকে মনে হয় মউয়েস গােন্ডােফারেসের অন্তত চার-পাচ দশক পূর্ববর্তী।

ভারতে শকরাজ্যের যিনি স্থপতি সেই মউয়েসের বংশ পরিচয় বা আদি ইতিহাস সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। মনে হয় তিনি যখন সদলে কাপিশ-গান্ধার অঞ্চলে এসে উপনীত হন তখন সেখানে টেলিফাস নামে জনৈক যবনরাজ রাজত্ব করছিলেন। টেলিফাসকে পরাজিত করে তিনি তার রাজ্য দখল করেন। তার নামাঙ্কিত এক শ্রেণির তাম্রমুদ্রার প্রধান পৃষ্ঠে দেবতা জিউস ও হস্তীর মুখমণ্ডল উৎকীর্ণ। মুদ্রাগুলোর গৌণ পৃষ্ঠে রয়েছে হেরাক্লিসের মূর্তি। মুদ্রাগুলো নিঃসন্দেহে কাপিশ অঞ্চলের। এস্থানে মউয়েসেরও প্রচুর মুদ্রা পাওয়া গেছে। তার রাজত্বকালের একখানি তাম্ৰলেখ তক্ষশিলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। লেখটি উৎকীর্ণ করেন প্রদেশপাল লিঅক কুসুলুকের পুত্র পতিক। পশ্চিম পাঞ্জাবের ঝিলাম জেলায় একখানি প্রাচীন শক লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। অনেকে এটিকে মউয়েসের লেখ বলে শনাক্ত করেছেন। এ মত সঠিক হলে মউয়েস পশ্চিম পাঞ্জাবও অধিকার করেছিলেন বলে স্বীকার করতে হয়। এখানে পূর্বে যবনরা রাজত্ব করতেন। দীনেশচন্দ্র সরকার (R. C. Majumdar (Ed.), The Age Of Inpirial Unity (Bombay, 1963), পৃ. ১২৫-২৬) মাউসের রাজত্বকাল আ. খ্রিস্টপূর্ব ২০-আ. ২২ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন। তার অভিমত, যে অব্দের ৭৮ বৎসরে মউসের রাজত্বকালীন তক্ষশিলা তাম্ৰলেখ উৎকীর্ণ হয়েছে, সেটি ৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে গণিত শক-পহলব সংবৎ। এই মত অনুসারে তক্ষশিলা লেখ ২১ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই লেখে যে মাসের কথা বলা হয়েছে, তা কিন্তু খাটি পহ্লব। সে কারণে মনে হয়, তক্ষশিলা লেখে অনুল্লিখিত অব্দটি ১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পহলব সংবৎ। এই হিসাবে তক্ষশিলা লেখের তারিখ ৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। অর্থাৎ তখন মউসের রাজত্ব করছেন। পক্ষান্তরে যদি মনে করা হয়, মউয়েস খ্রিস্টীয় ১ম শতকের প্রথমা পাদে রাজত্ব করেন তাহলে ধরে নিয়ে হবে পূর্বদিকে তার রাজ্য মথুরা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। শোডস তথনি মথুরার মহাক্ষত্রপ। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, পূর্ব পাঞ্জাব মউসের রাজ্যভুক্ত ছিল না। পূর্ব পাঞ্জাব জয় না করে মউয়েস মথুরা অধিকার করেন কিরূপে? অর্থাৎ দীনেশচন্দ্র সরকারের বক্তব্যে অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে।

পহ্লবরাজ ভেনোফেস, স্প্লহোর, স্পলগদম, স্পরিলিস ও প্রথম এজেস

পহ্লবরাজ ভােনােনেস : মউয়েস যখন কাপিশ, গান্ধার ও পাঞ্জাবে শক আধিপত্য বিস্তার করছেন তখন কান্দাহার ও হেরাতেও রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গেল। এক পহ্লব ভাগ্যান্বেষী এই পালা বদলের নায়ক। তার নাম ভােনােনেস। বয়সে তিনি মউয়েসের থেকে হয়তােবা একটু ছােটোই ছিলেন। মউয়েসের যেমন প্রচুর মুদ্রা পাওয়া গেছে ভােনােনেসের মুদ্রা কিন্তু সেই তুলনায় অনেক কম। আর যেকটিই-বা পাওয়া গেছে তার সব কটিতেই ভােনােনেসের নামের সঙ্গে হয় তার ভাই স্পলহাের বা ভ্রাতুপুত্র স্পলগদমের নাম উৎকীর্ণ হয়েছে। এর থেকে দুটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে – এক. ভােনােনেস বেশিদিন রাজত্ব করেননি। তিনি দীর্ঘদিন রাজত্ব করে থাকলে তার মুদ্রা অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যেত। দুই. শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি তার রাজ্য দু’টি অঞ্চলে বিভক্ত করেন। তার ভাই স্পলহাের হলেন এক অঞ্চলের সহযােগী প্রশাসক, অন্য অঞ্চলের সহযােগী প্রশাসক হলেন তার ভ্রাতুস্পুত্র স্পলগদম। 

স্প্লহোর, স্পলগদম, স্পলিরিস ও প্রথম এজেস : ভােনােনেসের মৃত্যুতে তার ভাই স্পলহাের পহ্লব সিংহাসনে আরােহণ করেন। রাজা হয়েই স্পলহাের তার পুত্র স্পলগদমকে রাজ্যের যুগ্ম প্রশাসক নিযুক্ত করেন। পিতা ও পুত্রের নামে উৎকীর্ণ যৌথ মুদ্রার সংখ্যা অত্যন্ত কম। মনে হয় তারা বেশি দিন রাজত্ব করেননি, তারা শীঘ্রই ভােনােনেসের অপর এক ভাই স্পলিরিসের হাতে পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হন।

স্পলিরিস শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন। গ্রিকরাজ হারমেয়ুসকে পরাজিত করে কাবুল উপত্যকায় তিনি পহ্লব আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজত্বের প্রথম দিকে স্পলিরিস কোনও সহযােগী প্রশাসক নিযুক্ত না করে একাই রাজকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু শেষের দিকে এজেস নামে জনৈক ব্যক্তিকে তিনি সহযােগী প্রশাসক নিয়ােগ করেন। এদের দু’জনের নামে উৎকীর্ণ বেশ কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই এজেস আবার শকরাজ মউয়েসের উত্তরাধিকারীও বটে। ফলে এজেসের সঙ্গে একদিকে স্পলিরিস ও অন্যদিকে মউয়েসের সম্পর্ক নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিতর্কের নিরসন ঘটাতে পারে এরূপ কোনও তথ্য আজও পাওয়া যায়নি। অনেকের বিশ্বাস এজেস স্পলিরিসের পুত্র; মউয়েসের মৃত্যুর পর তিনি বাহুবলে শকরাজ্য অধিকার করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন এজেস স্পলিরিসের পুত্র কিন্তু মউয়েসের জামাতা। ফলে বাহুবলে নয়, বৈবাহিক সূত্রেই তিনি শকরাজ্যের আধিপত্য লাভ করেন। এরূপ অনুমানও করা যেতে পারে যে এজেস মউয়েসের পুত্র বা ভ্রাতুস্পুত্র ছিলেন। পরে স্পলিরিসের কন্যাকে বিবাহ করে প্রথমে পহ্লব রাজ্যের সহযােগী প্রশাসক ও পরে একাধিপত্য লাভ করেন। ঘটনা যাই হােক না কেন, মউয়েস ও স্পলিরিসের মৃত্যুর পর শক ও পহ্লব রাজ্যের আধিপত্য যে এজেসের হাতে চলে যায় তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

গ্রিক বা যবনদের হাত হতে পূর্ব পাঞ্জাব অধিকার করে এজেস তার রাজ্যের আয়তন আরও বৃদ্ধি করেন। যবনরাজ হিপপােসট্রেটাস সম্ভবত সে সময় পূর্ব পাঞ্জাবে রাজত্ব করছিলেন। এজেসের একার নামে উৎকীর্ণ মুদ্রা যেমন পাওয়া গেছে তেমনি এজিলিসের সঙ্গে তার একযােগে উৎকীর্ণ মুদ্রাও যথেষ্ট পরিমাণে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর তাৎপর্য সহজেই বােধগম্য। স্পলিরিসের মৃত্যুর পর এজেস একাকীই রাজকার্য পরিচালনা করতেন কিন্তু পরে তিনি এজিলিসকে সহযােগী প্রশাসক নিযুক্ত করেন। এজিলিস সম্ভবত এজেসের পুত্র বা ভ্রাতুস্পুত্র ছিলেন।

বিক্রমাব্দ ও শকাব্দ

প্রাচীন ভারতে দু’টি অব্দ খুবই জনপ্রিয় ছিল – এদের একটি বিক্রমাব্দ, অন্যটি শকাব্দ। প্রথমটির শুরু ৫৮-৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, দ্বিতীয়টির ৭৮ খ্রিস্টাব্দে। অনেকের ধারণা ৫৮-৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এজেস সিংহাসনে আরােহণ করে বিক্রমাব্দের প্রবর্তন করেন। ৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি কোনও এক সময় এজেস যে রাজপদ লাভ করেছিলেন তা মােটামুটি নিশ্চিত। তবে তিনি বিক্রমাব্দের প্রচলন করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে।

বিক্রমাব্দের উদ্ভব সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সরকার ভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন পহ্লবরাজ ভােনােনেস সিস্তান অঞ্চলে এই অব্দটি প্রথম চালু করেন, ভারতে শক-পহ্লব প্রভুত্বের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অব্দটি এদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে এই অব্দ অন্য এক নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তিকালে মালবদের এক রাজার নামানুসারে এর নাম হয় কৃতাব্দ। আরও পরে উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের নামে এর বিক্রমাব্দ নামকরণ হয়। অনেকেই মনে করেন, এই বিক্রমাদিত্য গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্ত বিক্রমাদিত্য। 

শক-কাল বা শকাব্দের সূচনাকাল ৭৮ খ্রিস্টাব্দ, এ কথা অসংকোচেই বলা যায়। কুষাণরাজ প্রথম কণিষ্ক সম্ভবত ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে মনে হতে পারে সিংহাসনে আরােহণের ঘটনাকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যেই প্রথম কণিষ্ক সম্ভবত শক-কাল বা শকাব্দ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, প্রথম কণিষ্ক কোনও অব্দের প্রতিষ্ঠাতা নন। তিনি তার লেখে নিজ রাজ্যবর্ষের উল্লেখ করেছেন। বস্তুত, প্রথম কণিষ্কের অভিলেখসমূহ তার রাজত্বের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষ হতে ত্ৰয়ােবিংশ বর্যের মধ্যে উৎকীর্ণ হয়েছে। (কখনও কখনও অভিমত প্রকাশ করা হয়, কণিষ্কের পেশােয়ার লেখ তার প্রথম রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই পাঠ ত্রুটিপূর্ণ।) কণিষ্কের দেহবসানের পর তার বংশের অধস্তন পুরুষেরা তার রাজ্যবর্ষ হতেই তাদের রাজত্বকাল গণনা করে লেখ উৎকীর্ণ করেছেন। বাসিষ্কের লেখ উৎকীর্ণ হয়েছে ২৪-২৮ কণিষ্ক রাজ্যবর্ষে, হাবিষ্কের ২৮-৬০ রাজ্যবর্ষে, দ্বিতীয় কণিষ্কের ৪১ রাজ্যবর্ষে এবং বাসুদেবের ৬৭-৯৮ কণিষ্ক রাজ্যবর্ষে।

পশ্চিম ভারতের ক্ষত্রপ শাসকেরা প্রথমদিকে কুষাণ রাজাদের অনুগত ছিলেন। তারা তাদের অভিলেখ ও মুদ্রায় কুষাণরাজদের অনুকরণে কণিষ্ক রাজ্যবৰ্ষই ব্যবহার করে গেছেন। ভারত ভূমি হতে কুষাণ রাজত্বের অবসানের পরও ক্ষত্ৰপ শাসকবৃন্দ একই রীতি অনুসরণ করেছেন। পশ্চিমী ক্ষত্রপরা জাতিতে শক ছিলেন এবং এই অব্দটি তারা সুদীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার করায় তাদের নামানুসারেই অব্দটি শক কাল বা শকাব্দ নামে পরিচিত হয়েছে। কুষাণরাজ কণিষ্কের রাজ্যবর্ষের গণনা হতেই শকাব্দের উদ্ভব হয়েছে, এ মত হয়তাে সকলেই স্বীকার করবেন না তবুও আপাতত এই মতই গ্রহণীয় বােধ হচ্ছে।

এজিলিস ও দ্বিতীয় এজেস

এজিলিস : এজিলিস শক্তিমান নরপতি ছিলেন। তার রাজত্বকালে শক রাজ্যের আয়তন আরও বৃদ্ধি পায়। জম্মু ও কাশ্মীরের দক্ষিণাঞ্চলে তার অনেক মুদ্রা পাওয়া গেছে। সমগ্র না হলেও জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তত কিছু অংশে এজিলিসের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মহাক্ষত্রপ পতিক এসময় তক্ষশিলায় প্রদেশপালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পূর্বতন প্রদেশপাল লিঅক কুসুলুকের পুত্র। পিতা ছিলেন ক্ষত্রপ কিন্তু পুত্র মহাক্ষত্রপ।

পূর্ব সীমান্তে শক রাজ্যের বিস্তার এজিলিসের রাজত্বের আর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। তখন মথুরা অঞ্চলে দত্ত ও মিত্র রাজারা রাজত্ব করতেন। তাদের পরাজিত করে এজিলিস মথুরায় শক তাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। মথুরা বিজয়ে যিনি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন সেই রাজুবুল বা রজবুল সেখানে ক্ষত্ৰপ নিযুক্ত হন। রাজুবুল পরে মহাক্ষত্ৰপ উপাধি ধারণ করেন। ক্ষত্ৰপ ও মহাক্ষত্ৰপরূপে নিজের নাম ও মূর্তি খােদিত করে তিনি যেসব মুদ্রা উৎকীর্ণ করেন তার কোনওটিতেই এজিলিস বা তার কোনও উত্তরাধিকারীর নাম নেই। এর থেকে মনে হয় ক্ষত্রপ বা মহাক্ষত্ৰপ উপাধি ধারণ করলেও রাজুবুল কার্যত স্বাধীনই ছিলেন। পূর্ব পাঞ্জাব হতে মথুরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাজুবুলের মুদ্রা পাওয়া গেছে। এসব অঞ্চল তার শাসনাধীন ছিল। 

প্রথম দিকে এজিলিস একাই রাজকার্য পরিচালনা করতেন। শেষের দিকে তিনি অবশ্য একজন সহযােগীর সাহায্য গ্রহণ করেন। তার এ সহযােগীর নাম দ্বিতীয় এজেস। তিনি সম্ভবত এজিলিসেরই পুত্র ছিলেন।

দ্বিতীয় এজেস : এজিলিসের মৃত্যুতে দ্বিতীয় এজেস শক রাজ্যের অধীশ্বর হন। তার সিংহাসনে আরােহণের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের চারদিকে গােলযােগ দেখা দেয়। উত্তর-পশ্চিম ভারতে গােন্ডোফারেস নামে জনৈক রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষীর আবির্ভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তােলে। যে বিষয়বৈচিত্র্য পূর্ববর্তী শক রাজগণের মুদ্রার বৈশিষ্ট্য, তা তার মুদ্রায় আর দেখা যায় না। দ্বিতীয় এজেসের মুদ্রার ধাতুগত ও গুণগত উৎকর্ষও বড় কম। আর্থিক দুর্গতি যে শক রাজ্যটিকে গ্রাস করেছিল তার প্রমাণ এই মুদ্রা। একটি একটি করে অঙ্গরাজ্যগুলো এজেসের হাতছাড়া হয়ে যায়। তার কর্তৃত্ব সংকুচিত হতে হতে শেষের দিকে পাঞ্জাবেই তা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু তাও খুব বেশি দিনের জন্য নয়। গােন্ডােফারেস শীঘ্রই পাঞ্জাব অধিকার করেন। অস্পবর্মা দ্বিতীয় এজেসের এক প্রদেশপাল ছিলেন। সুযােগ বুঝে তিনি গােন্ডােফারেসের পক্ষে যােগদান করেন। দ্বিতীয় এজেসের রাজ্য ধ্বংস হল। শকরাজ্যের ধ্বংসস্তুপের উপর নতুন এক পহ্লব রাজ্য গড়ে উঠল। নতুন এই পহ্লব রাজ্যটির স্থপতি গােন্ডােফারেস।

পহ্লবরাজ গােন্ডোফারেস ও তার উত্তরাধিকারীগণ

পহ্লবরাজ গােন্ডোফারেস : কান্দাহার অঞ্চলে পহ্লবরাজ ওর্থেগুনেসের সহকারী প্রশাসকরূপে গােন্ডােফারেস তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি শুধু একা নন, তার ভাই গুদ বা গুদনও একই সঙ্গে ওর্থেগনেসের সহকারীর পদে বৃত ছিলেন। গােলাকৃতির এক ধরনের তাম্রমুদ্রার এক পৃষ্ঠে উৎকীর্ণ আছে ওর্থেনেসের নাম, অন্যদিকে লেখা আছে গােন্ডােফারেস ও তার ভাই গুদ বা গুদনের নাম। যে কান্দাহারে ওর্থেগনেস বা গােন্ডােফারেসের রাজনৈতিক অভ্যুদয় ঘটে সেই কান্দাহারে পূর্বে শর্করা রাজত্ব করতেন। সম্ভবত দ্বিতীয় এজেসকে পরাজিত করে তারা কান্দাহার অধিকার করেন। কান্দাহার জয় করেই ওর্থের্গনেস সন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু উচ্চাভিলাষী গােন্ডােফারেস কেবল কান্দাহার জয় করেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার চাই ভারতে অধিকার প্রতিষ্ঠা। শকরাজ দ্বিতীয় এজেসের দুর্বলতার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে উত্তর-পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করলেন গােন্ডােফারেস। 

উত্তর-পশ্চিম ভারতের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল যে গােন্ডােফারেসের রাজ্যভুক্ত ছিল তা সুনিশ্চিত। পেশােয়ার অঞ্চলের তখৎ-ই-বহি গ্রামে তার একখানি লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখটি ১০৩ বিক্রমাব্দে বা ৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। তখন ছিল তার রাজত্বের ২৬তম বছর। এ লেখটি থেকে কয়েকটি সত্য উদঘাটিত হয়। প্রথমত, ১৯ খ্রিস্টাব্দ হতে তার রাজত্ব আরম্ভ হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, গােন্ডােফারেস কম করেও ২৬ বছর রাজত্ব করেন। অর্থাৎ অন্তত ৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আর পেশােয়ার যে গােন্ডােফারেসের রাজ্যভুক্ত ছিল তাতাে বলাই বাহুল্য। 

খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের গ্রিক লেখক ফিলােসট্রেটাস। ফ্রেওটেস নামে এক রাজার উল্লেখ করেছেন তিনি। ৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি তক্ষশিলার রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অনেকেই মনে করেন ফ্রেওটেস ও গােন্ডােফারেস এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। তাহলে তক্ষশিলা অঞ্চলে গােন্ডোফারেসের রাজ্যের বিস্তারের সপক্ষে আরও একটি ইঙ্গিত পাওয়া গেল। আবার অনেকে ফ্রেওটেসকে গােন্ডোফারেসের এক অধীনস্থ প্রদেশপাল বলে মনে করেন। এ সিদ্ধান্তেও তক্ষশিলায় গােন্ডোফারেসের আধিপত্যই সমর্থিত হয়। ইরানের আর্সেকিড রাজাদের অনুকরণে গােন্ডােফারেস কিছু মুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। মনে হয়, পূর্ব ইরানের কিয়দংশ তার শাসনাধীন ছিল। ওর্থেগনেসের মৃত্যুর পর কান্দাহারও তার অধিকারে চলে আসে। 

সুপ্রাচীন খ্রিস্টীয় উপকথায় গুডনাফর নামে এক ভারতীয় রাজার উল্লেখ আছে। জিশু তখন দেহরক্ষা করেছেন। তার প্রধান প্রধান শিষ্যরা জেরুজালেম শহরে সমবেত হয়ে দেশে দেশে তাদের গুরুর বাণী প্রচারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের দায়িত্ব পড়ল সেইন্ট টমাসের উপর। কিন্তু টমাস এ গুরুদায়িত্ব গ্রহণে তার অসম্মতি প্রকাশ করেন। স্বয়ং জিশু তত স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাকে ভারত ভ্রমণের অনুরােধ জানান। তবু টমাস তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। ইতিমধ্যে হব্বান নামে এক ভারতীয় বণিক জেরুজালেমে এসে উপস্থিত হন। রাজা গুডনাফর তাকে সেখানে পাঠিয়েছেন এক দক্ষ দারুশিল্পীর খোঁজে। জিশু দেখলেন এই সুযােগ। তিনি সশরীরে টমাসের কাছে উপস্থিত হয়ে, তাকে হব্বানের নিকট বিক্রি করে দেন। অগত্যা টমাস হব্বানের সঙ্গে ভারতে চলে আসেন। রাজা গুডনাফর টমাসকে তার জন্য এক মনােরম প্রাসাদ নির্মাণ করতে বলেন। আর এর জন্য তিনি টমাসকে প্রচুর অর্থও দেন। কিন্তু টমাস সব অর্থ গরিব দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করেন। বাড়িটি আর তৈরি করা হল না। রাজা রেগে টমাস আর বণিককে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। এমন সময় রাজার ভাই গ্যাড মারা যান। স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার পথে দেবদূতেরা গ্যাডকে টমাসের তৈরি এক স্বর্গীয় প্রাসাদ দেখালেন। আপন সুকৃতিতে টমাস সেটি তৈরি করেছেন। গ্যাড তার প্রাণ ফিরে পান। পরিশেষে তিনি ও তার ভাই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। 

খ্রিস্টীয় উপকথায় যাকে গুডনাফর বলা হয়েছে তিনি যে আসলে গােন্ডােফারেস এ অভিমত অনেকেই ব্যক্ত করেছেন। খ্রিস্টীয় উপকথার গ্যাড এবং মুদ্রার গুদ বা গুদন যে এক ও অভিন্ন ব্যক্তি এ সিদ্ধান্তও তাদের। কাহিনিটিকে সর্বৈব অনৈতিহাসিক বলে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সেন্ট টমাস গােন্ডােফারেসের রাজ্যে পদার্পণ করেছিলেন উল্লিখিত কাহিনি থেকে এরূপ ধারণা অসংগত নয়।

প্রশাসনিক স্বার্থে পূর্ব ইরান থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত তার রাজ্যটিকে গােন্ডােফারেস কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করেন। এক একটি অঞ্চলের শাসনভার এক একজন প্রদেশপালের হাতে ন্যস্ত হয়। সিস্তান-কান্দাহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন তার ভ্রাতুষ্পপুত্র অব্দগস। তক্ষশিলার শাসনভার গ্রহণ করেন অস্পবর্মা এবং পরে তার ভ্রাতুস্পুত্র সস। সপেদন ও সতবস্ত্রর উপর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শাসনভার অর্পিত হয়। প্রদেশপালদের অনেকেই পৃথকভাবে গােন্ডােফারেসের সঙ্গে একযােগে মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার রাজকীয় উপাধিও ধারণ করেছেন। স্ব স্ব অঞ্চলে তারা কার্যত স্বাধীনই ছিলেন বলা চলে।

মথুরার রাজনীতিতে গােন্ডােফারেসের অভ্যুত্থানের কোনাে প্রভাব পড়েছিল বলে মনে হয় না। শকরাজ মউয়েসের রাজত্বকালে মহাক্ষত্ৰপ রাজুবুল এক স্বাধীন রাজার মতােই মথুরার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। জৈন উপাসিকা আমােহিনীর ৭২ বিক্রমাব্দে উৎকীর্ণ একখানি লেখ থেকে জানা যায় ১৫ খ্রিস্টাব্দে শােডাস মথুরার মহাক্ষত্রপ পদে নিযুক্ত ছিলেন। সন্দেহ নেই, পিতা রাজুবুলের মৃত্যুর পরই তিনি মথুরার শাসনভার গ্রহণ করেন। গােন্ডােফারেসের মথুরা জয়ের সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। পক্ষান্তরে শােডাস এবং তার মৃত্যুর পর হগান, হগামাষ, শিদবত্ত ও শিবঘােষ প্রভৃতি কয়েকজন শক ক্ষত্ৰপ যে এ অঞ্চলের শাসনকর্তত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন, মুদ্রার সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত। ভারতীয় নাম গ্রহণ করলেও শেষােক্ত ক্ষত্ৰপ দুজনও সম্ভবত শকই ছিলেন।

গােন্ডােফারেসের রাজত্বকালে ৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দে তখৎ-ই-বহি লেখটি উৎকীর্ণ হয়। এ অল্পদিনের মধ্যেই সম্ভবত তার মৃত্যু হয়। গােন্ডোফারেসের মৃত্যুতে পহ্লবরাজ্যের সংহতি সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শক্তিশালী প্রদেশপালদের স্ববশে রাখার ক্ষমতা তার দুর্বল উত্তরাধিকারীদের ছিল না। উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে এবং অন্তর্দ্বন্দ্বে পহ্লব রাজ্যটি দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলে। 

গােন্ডােফারেসের উত্তরাধিকারিগণ : গােন্ডোফারেসের মৃত্যুর পর সম্ভবত তার ভ্রাতুপুত্র অব্দগস পহ্লব সিংহাসনে আরােহণ করেন। কিছু কিছু মুদ্রায় তাকে মহারাজ, রাজাধিরাজ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তার একার নামে উৎকীর্ণ মুদ্রার সংখ্যা অতি অল্প। তিনি সম্ভবত অল্প কয়েকদিনের জন্য রাজত্ব করেন (গােন্ডোফারেসের মৃত্যুর পর অব্দগস স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছেন এ মত অনেকেই মানেন না। অব্দগসের একক মুদ্রার অস্তিত্বও তারা স্বীকার কারেন না।)। পরবর্তী পহ্লবরাজ সম্ভবত পকুর বা প্যাকোরেস। তিনি সিস্তান অঞ্চলে রাজত্ব করেন। তখনও তক্ষশিলার প্রদেশপাল ছিলেন অস্পবর্মার ভ্রাতুস্পুত্র সস। প্যাকোরেস সসের সঙ্গে একযােগে কিছু মুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। পহ্লব রাজ্যের সর্বত্র না হলেও অন্তত তক্ষশিলায় তার কিছুটা কর্তৃত্ব ছিল। সনবরেস এবং আর্সসেস নামে আরও দু’জন পহ্লব রাজার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথমজন সিস্তান তথা পূর্ব ইরানে এবং শেষােক্ত জন কান্দাহারে রাজত্ব করতেন।

গােন্ডােফারেসের উত্তরাধিকারীরা যে দীর্ঘদিন ক্ষমতা ভােগ করেছিলেন তা নয়। তার মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কুষাণরাজ কুজুল কদফিসেস কাবুল উপত্যকা অধিকার করেন। ৬৫ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে কুজুলের পুত্র বিম কদফিসেস গান্ধার জয় করেন। এ অঞ্চলে ৬৫ ও ৭৯ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ দুখানি কুষাণ লেখ পাওয়া গেছে। বিম কদফিসেস পাঞ্জাবও অধিকার করেন। নিম্ন সিন্ধু অববাহিকায় তখনও পহ্লবরা রাজত্ব করছিলেন। কিন্তু প্রথম কণিষ্ক সেখান থেকেও পহ্লবদের বিতাড়িত করেন। তার রাজত্বের তৃতীয় বছরের মধ্যেই কণিষ্ক মথুরা অঞ্চলেও স্বীয় প্রভুত্ব বিস্তার করেন।

ক্ষত্রপ ভূমক, নহপান ও চষ্টন

ক্ষত্রপ ভূমক : কুষাণদের হাতে ভাগ্য বিপর্যয়ের ফলে উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর ভারতে শক প্রভুত্বের অবসান ঘটে। কিন্তু শীঘ্রই শকরা পশ্চিম ভারতে পরাক্রান্ত রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। পশ্চিম ভারতে শক অভ্যুত্থানের যিনি নায়ক তার নাম ভূমক। ক্ষহরাতবংশীয় এই শক নায়ক কুষাণরাজ প্রথম কণিষ্কের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি কীরূপে পশ্চিম ভারতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেন, তা জানা যায় না। হতে পারে তিনি কণিষ্ককে পশ্চিম ভারত বিজয়ে সাহায্য করেন। পরে হয়তাে কণিষ্ক তাকে পুরস্কারস্বরূপ পশ্চিম ভারতের ক্ষত্রপ নিযুক্ত করেছিলেন। এমনও হতে পারে, পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযােগ গ্রহণ করে ভূমক একটি রাজ্য গঠন করেন কিন্তু কণিষ্কের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে তিনি কুষাণরাজের আনুগত্য স্বীকার করেন। একটা কথা স্বীকার করতে হয়। ভূমক কখনও স্বাধীনতা ঘােষণা করেননি। তিনি মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন সত্য কিন্তু মুদ্রায় তিনি নিজেকে ক্ষত্ৰপ বলেই পরিচয় দিয়েছেন, কখনও নিজেকে রাজা বা মহাক্ষত্রপ বলে বর্ণনা করেননি। ভূমক তাম্রমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। তার মুদ্রা পাওয়া গেছে গুজরাতের উপকূল অঞ্চলে, রাজস্থানে ও মধ্যপ্রদেশে। সম্ভবত পশ্চিমে গুজরাত থেকে পূর্বে মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড তার শাসনাধীন ছিল। ভূমকের মুদ্রায় ব্রাহ্মীর সঙ্গে খরােষ্ঠী লিপিও ব্যবহৃত হয়েছে। এর থেকে অনেকে অনুমান করেন সিন্ধুর কিয়দংশও তার শাসনাধীন ছিল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের ন্যায় সিন্ধুপ্রদেশে তখন খরােষ্ঠী লিপির প্রচলন ছিল।

ক্ষত্ৰপ নহপান :

  • ভূমকের সাথে সম্পর্ক ও রাজত্বের কালসীমা : ভূমকের পর নহপান ক্ষত্রপপদে অভিষিক্ত হন। ভূমকের মতাে তিনিও ক্ষহরাত বংশের সন্তান। কিন্তু এ দুজনের মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল, তা এখনও জানা যায় না। তেমনি অনিশ্চয়তা রয়েছে নহপালের রাজত্বের কালসীমা সম্পর্কেও। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন নহপান ১১৯ এবং ১২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে রাজত্ব করেন। অনেকে আবার খ্রিস্টীয় ১ম শতকের শেষ পাদ হতে খ্রিস্টীয় ২য় শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত নহপানের রাজত্বকাল বলে ধার্য করেছেন। প্রথমটি যেমন অতি হ্রস্ব, দ্বিতীয়টি তেমনি অতি দীর্ঘ। যদি মনে করা হয় নহপান ১১৯ খ্রিস্টাব্দে ক্ষত্রপ পদ গ্রহণ করেন তাহলে ভূমকের মৃত্যু ও নহপানের শাসনকর্তৃত্ব গ্রহণের মধ্যে আরও দু’একজন ক্ষত্রপের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। কিন্তু এরূপ কোনও ক্ষত্রপের কথা জানা যায় না। ফলে আনুমানিক ১০০ হতে ১২৪ খ্রিস্টাব্দ নহপানের সম্ভাব্য কাল বলে গণ্য করা যায়।
  • রাজ্য বিস্তার : ক্ষত্রপের আসনে বসেই নহপান আপন প্রভুত্ব বিস্তারে মনােযােগী হন। তার সামনে সুযােগও এসে উপস্থিত হয়। প্রথম কণিষ্ক মারা যান, ফলে তার উপর কেন্দ্রীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। সাতবাহন রাজ্যেও এসময় দুর্দিন চলছিল। এ সুযােগে নহপান সাতবাহন রাজ্যের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করে বসেন। নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা, গুজরাত, রাজস্থান এবং পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ পূর্ব থেকেই ক্ষত্ৰপ রাজ্যভুক্ত ছিল। এসব অঞ্চলে নহপান যে তার কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রাখেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আজমীঢ়ে তার মুদ্রা পাওয়া গেছে। তার আমলের একখানি লেখ থেকে জানা যায় মালবরা একবার কোনও উত্তমভদ্ররাজকে অবরুদ্ধ করেন। নহপানের জামাতা ঋষভদত্ত মালবদের পরাজিত করে আক্রান্ত উত্তমভদ্ররাজকে মুক্ত করেন ও শেষে আজমীঢ় হ্রদে পুণ্যস্নান করেন। ঋষভদত্ত শুধু নহপানের জামাতা নন তিনি নহপানের অধীনস্থ এক অঞ্চল প্রশাসকও বটে। আজমীঢ় যে নহপানের রাজ্যভুক্ত ছিল এই লেখটি তারই প্রমাণ।
  • মহারাষ্ট্র অধিকার : কোঙ্কণ উপকূলসহ মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নহপানের বেশ কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। তার এক অমাত্যের একখানি লেখ পুণা জেলার জুন্নারে পাওয়া গেছে। তার জামাতা ঋষভদত্তের কয়েকখানি লেখ নাসিক ও পুণা জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। লেখগুলো সম্ভবত ১১৯-২৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। সন্দেহ নেই, সাতবাহন রাজাদের পরাজিত করে নহপান মহারাষ্ট্র অধিকার করেন। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, নহপানের পূর্ববর্তী কোনও ক্ষত্ৰপ সম্ভবত মহারাষ্ট্র অধিকার করেন। এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। ভূমক নিশ্চয় মহারাষ্ট্র জয় করেননি। মহারাষ্ট্র অধিকার করেছেন, ভূমকের পরবর্তী ও নহপানের পূর্ববর্তী এমন কোনও ক্ষত্রপের কথাও জানা যায় না। অধিকৃত মহারাষ্ট্র গােবর্ধন-আহার ও মামাল-আহার নামে দু’টি জেলায় বিভক্ত হল। জেলা দু’টির শাসনভার পেলেন তার কন্যা দক্ষমিত্রার স্বামী, তার নিজের জামাতা ঋষভদত্ত।
  • গৌতমীপুত্রের হাতে বিপর্যয় : তার শাসনের শেষের দিকে নহপান ঘাের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। দক্ষিণের সাতবাহন রাজ্য এসময় গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির নেতৃত্বে খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শক অধিকৃত পৈতৃক ভূখণ্ডের পুনরুদ্ধারের জন্য গৌতমীপুত্র নহপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। শকরাজের পক্ষে এ যুদ্ধের ফল হল মারাত্মক। নাসিক ও কার্লেতে গৌতমীপুত্রের রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে উৎকীর্ণ দুখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ লেখ দুখানি থেকে জানা যায়, সাতবাহনরাজ ১২৪ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে বা পরবর্তী বছরের প্রথম পর্বে নহপান ও ঋষভদত্তকে মহারাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করেন। গৌতমীপুত্রের নিকট যে নহপান পরাজিত হন, তা নাসিক জেলার জোগলথেম্বি গ্রামে পাওয়া মুদ্রার সাক্ষ্যেও প্রমাণিত। এই গ্রামে পাওয়া ১৩২৫০টি রৌপ্য মুদ্রার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শুধুই নহপালের, বাকি দুই তৃতীয়াংশও নহপানের কিন্তু সেগুলো গৌতমীপুত্র কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত। অর্থাৎ মহারাষ্ট্রের শক অধিকারভুক্ত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে গৌতমীপুত্র সেখানে নহপানের মুদ্রার প্রচলন অব্যাহত রাখেন তবে নহপানের মুদ্রার উপর নিজের নাম ও প্রতীক অঙ্কিত করে পুরনাে মুদ্রার একটু সংস্কার করেন মাত্র। ক্ষহরাত বংশ ধ্বংস করেছেন বলে নাসিক প্রশস্তিতে গৌতমীপুত্রকে বন্দনা করা হয়েছে। মনে হয়, গৌতমীপুত্রের সঙ্গে যুদ্ধে নহপান শুধু পরাজিতই হননি, নিজের প্রাণও বিসর্জন দেন। 

কার্দমক চষ্টন :

  • ক্ষত্রপ নিযুক্তি ও দায়িত্ব : গৌতমীপুত্রের হাতে নহপানের আকস্মিক ভাগ্যবিপর্যয়ে কুষাণ কর্তৃপক্ষ চষ্টনকে পশ্চিম ভারতের ক্ষত্ৰপ নিযুক্ত করেন। গৌতমীপুত্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিহত করার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত হয়। নহপানের মতাে চষ্টনও শক কিন্তু তাদের বংশ ভিন্ন। নহপান ক্ষহরাতবংশীয় কিন্তু চষ্টন কার্দমক পরিবারভুক্ত। যে কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করে চষ্টন পশ্চিম ভারতে আসেন অতি অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সে কাজ সম্পন্ন করেন। এ কাজে তাকে প্রথম দিকে সাহায্য করেন তার পুত্র ক্ষত্ৰপ জয়দামা ও পরে তার পৌত্র ক্ষত্ৰপ রুদ্রদামা। জয়দামা পিতার জীবিতকালেই মারা যান।
  • সাতবাহনদের বিরুদ্ধে জয় : সাতবাহন রাজ্যের বিরুদ্ধে চষ্টনের সাফল্যের পরিচয় বিধৃত আছে তার উৎকীর্ণ লেখ ও মুদ্রায়। আর গ্রিক ভৌগােলিক টলেমির বৃত্তান্তে। তিনি তার মুদ্রায় তিন খিলান বা চৈত্য প্রতীক ব্যবহার করেছেন। সম্ভবত গৌতমীপুত্রের মুদ্রা হতে এ প্রতীক তিনি গ্রহণ করেছেন। পৌত্র রুদ্রদামার সহযােগিতায় তিনি ৫২ শকাব্দ বা ১৩০ খ্রিস্টাব্দে কচ্ছ উপকূলের অন্ধৌ গ্রামে একখানি লেখ উৎকীর্ণ করেন। নহপানকে পরাজিত করে গৌতমীপুত্র পূর্বে এ অঞ্চল অধিকার করেছিলেন। টলেমি তার ভূগােল গ্রন্থে চষ্টনকে উজ্জয়িনীরাজ বলে উল্লেখ করেছেন। উজ্জয়িনী পূর্বে গৌতমীপুত্রের রাজ্যভুক্ত ছিল। জুনাগড় লেখে রুদ্রদামা আকর, অবন্তি, অনূপ, অপরান্ত, সুরাষ্ট্র ও আনর্ত সহ বিভিন্ন অঞ্চলের অধিপতিরূপে বর্ণিত হয়েছেন। সম্ভবত এসব অঞ্চল রুদ্রদামা তার পিতামহের শাসনকালেই গৌতমীপুত্রের হাত থেকে জয় করে নেন। চষ্টনের শাসনকালে শক ক্ষত্ৰপ তথা কুষাণদের পূর্ব গৌরব অনেকটাই ফিরে এল কিন্তু মহারাষ্ট্র পুনরুদ্ধার অসম্পূর্ণ থেকে গেল। সাতবাহন রাজারা সে অঞ্চলে পূর্বের মতােই রাজত্ব করেন। 
  • মহাক্ষত্রপ উপাধি ধারণ ও রাজত্বের কালসীমা : প্রথমে ক্ষত্ৰপ নিযুক্ত হলেও চষ্টন পরবর্তিকালে মহাক্ষত্রপ উপাধি ধারণ করেছেন। বলা বাহুল্য, রাজনৈতিক সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতেই তার এ উপাধি ধারণ। কতদিন চষ্টন শাসনকর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তা বলা যায় না। মনে হয় ১৩০ খ্রিস্টাব্দে অন্ধৌ লেখ উৎকীর্ণ হওয়ার অত্যল্পকাল পরই তার জীবনাবসান হয়। ১৪০ খ্রিস্টাব্দে রচিত টলেমির ভূগােল গ্রন্থে চষ্টনকে উজ্জয়িনীরাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। একারণে অনেকে মনে করেন চষ্টন ১৪০ খ্রিস্টাব্দেও জীবিত ছিলেন। কিন্তু এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। টলেমি চষ্টনের উল্লেখ করেছেন ঠিকই কিন্তু চষ্টন সম্পর্কে তিনি তথ্য আহরণ করেছেন তার গ্রন্থ রচনার পূর্বে।

মহাক্ষত্ৰপ রুদ্রদামা 

সিংহাসনে আরোহন ও মহাক্ষত্রপ পদ নিয়ে বিতর্ক : চষ্টনের মৃত্যর পর তার পৌত্র রুদ্রদামা মহাক্ষত্ৰপ পদে অভিষিক্ত হলেন। বীর্যবান, প্রজানুরঞ্জক ও ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক এই বিদেশি শাসক প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ১৫০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তার জুনাগড় লেখে তার শাসনকালের বিশদ বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে। জুনাগড় লেখে রুদ্রদামার কয়েকটি উক্তি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এ লেখে মহাক্ষত্রপের পদ তিনি স্বােপার্জিত বলে দাবি করেছেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে তাকে রাজা বলে বরণ করেছেন। উক্তি দু’টির বৈপরীত্য সুস্পষ্ট। যে পদ তিনি নিজের অর্জিত বলে ঘােষণা করছেন পরক্ষণে সে পদ অন্যের দান বলে স্বীকার করছেন। তাছাড়া, মহাক্ষত্ৰপ পদ তিনি চষ্টনের পৌত্ররূপে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছেন, নিজের বাহুবলে অর্জন করেননি। তবে কি রুদ্রদামা পশ্চিম ভারতে ক্ষত্ৰপ আধিপত্য পুনরুদ্ধারে পিতামহ চষ্টনকে তার সক্রিয় সাহায্যের কথাই প্রকারান্তরে ব্যক্ত করেছেন? হয়তাে ঠিক তাই। তার গণনির্বাচনের দাবির মধ্যে হয়তােবা জনসমর্থনের ইঙ্গিত ধ্বনিত হয়েছে।

রাজ্য বিস্তার : পশ্চিম ভারতের যে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল রুদ্রদামার অধিকারভুক্ত ছিল জুনাগড় লেখে তা প্রকাশিত। তার অধিকৃত অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল আকর বা পূর্ব মালব, অবন্তি বা পশ্চিম মালব, অনূপ – নীবৃৎ বা নর্মদা অববাহিকার মান্ধাতা, অথবা মহেশ্বর অঞ্চল, কুকুর বা নিম্ন সিন্ধু অববাহিকা ও পশ্চিম বিন্ধ্য পর্বতমালার মধ্যবর্তী অঞ্চল, আনর্ত বা দ্বারকা অঞ্চল, সুরাষ্ট্র, শ্বভ্র বা সবরমতী অববাহিকা, কচ্ছ, মরু বা মাড়ােয়ার, সিন্ধু বা নিম্ন সিন্ধু উপত্যকার পশ্চিমাঞ্চল, সৌবীর বা নিম্ন সিন্ধু উপত্যকার পূর্বাঞ্চল, অপরান্ত বা উত্তর কোঙ্কণ এবং নিষাদ বা পশ্চিম বিন্ধ্য ও আরাবল্লীর পার্বত্য অঞ্চল। এ সকল অঞ্চল তিনি সম্ভবত তার পিতামহের শাসনকালেই জয় করেছিলেন। যে সকল শত্রুদের পরাজিত করে তিনি এ সকল অঞ্চল অধিকার করেন তাদের সম্পর্কে কোনও বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। জুনাগড় লেখে রুদ্রদামার প্রতিপক্ষদের মধ্যে কেবলমাত্র সাতবাহনরাজ সাতকর্ণি ও যৌধেয়গণের কথা বলা হয়েছে। সাতকর্ণিকে পরাজিত করে তিনি সম্ভবত আকর, অবন্তি, অনুপ, অপরান্ত, সুরাষ্ট্র ও আনর্ত পুনরুদ্ধার করেন। অন্যান্য অঞ্চলে তার প্রতিপক্ষ কারা ছিলেন তা জানা যায় না।

সাতবাহন প্রতিপক্ষ ও কন্যার বিবাহ : জুনাগড় লেখে রুদ্রদামা দাবি করেছেন দক্ষিণাপথরাজ সাতকর্ণিকে তিনি একবার নয়, পর পর দু’বার পরাজিত করেছেন। কিন্তু সাতকর্ণির সঙ্গে তার নিকট সম্পর্ক থাকার ফলে তিনি তাকে সংহার করেননি। মনে হয় গৌতমীপুত্রের পুত্র বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণির সঙ্গে রুদ্রদামা নিজ কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন। কানহেরিতে পাওয়া একখানি লেখে বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণির উল্লেখ আছে। তিনি যে মহাক্ষত্রপ রুদ্র বা রুদ্রদামার কন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন সে কথাও লেখটিতে বলা হয়েছে। এই সাতকর্ণি গৌতমীপুত্রেরই এক পুত্র। কানহেরি লেখে রুদ্রদামার উক্তির যেন সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে অবশ্য মনে করেন, রুদ্রদামার প্রতিপক্ষ গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি নন, প্রতিপক্ষ ছিলেন গৌতমীপুত্রের পুত্র বাশিষ্ঠীপুত্র পুলুমাবি। তারা আরও মনে করেন কানহেরি লেখে যে বাশিষ্ঠীপুত্র সাতকর্ণির উল্লেখ আছে তিনি আসলে পুলুমাবি। রুদ্রদামার সাতবাহন প্রতিপক্ষ সম্পর্কে আরও কয়েকটি মত আছে তবে তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।

যৌধেয়দের বিরুদ্ধে  বিজয় : যৌধেয়রা রুদ্রদামার আর এক প্রবল প্রতিপক্ষ ছিলেন, তাদেরও তিনি পরাজিত করেন। ক্ষত্রিয় সমাজে বীর বলে যৌধেয়গণের সুখ্যাতি ছিল। যৌধেয়গণের বিরুদ্ধে বিজয়লাভকে তিনি তার এক শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব বলে চিহ্নিত করেছেন। যৌধেয়গণ সম্ভবত সেসময় দক্ষিণ পাঞ্জাব ও সন্নিহিত অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। রুদ্রদামা যৌধেয়দের পরাজিত করেছেন সত্য কিন্তু তাদের রাজ্য অধিগ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না।

রুদ্রদামার প্রশাসন : রুদ্রদামা শুধু রণনিপুণ রাজনীতি নন, তিনি এক উচ্চশিক্ষিত, কৃষ্টিবান, মানবদরদী প্রশাসকও।

  • হ্রদ সংস্কার : তার রাজত্বের প্রথম বছরেই জুনাগড়ের নিকটবর্তী সুদর্শন হ্রদের বাঁধে অতিবৃষ্টির কারণে ফাটল ধরে। মৌর্যরাজ চন্দ্রগুপ্ত এই জলাধারটি নির্মাণ করেন এবং তার পৌত্র অশােক হ্রদটির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করেন। সে যাই হোক, হ্রদটি বিনষ্ট হওয়ায় এর সঞ্চিত জলরাশি বেরিয়ে যায়। এর ফলে নিকটবর্তী কৃষির খেতগুলো জলের অভাবে মরুভূমির রূপ ধারণ করে। কৃষির উৎপাদন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থানীয় অঞ্চলে কৃষিজ ফসল অব্যাহত রাখার জন্য হ্রদটির সংস্কার অত্যন্ত জরুরি হয়ে দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে রুদ্রদামা কয়েকজন পদস্থ কর্মচারীকে সেখানে পাঠালেন। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হল না। অবশেষে তিনি জনৈক পহ্লব কুলের পুত্র সুবিশাখকে আনর্ত – সুরাষ্ট্রের প্রশাসক নিযুক্ত করে পাঠান। অসামান্য তৎপরতার সঙ্গে সুবিশাল জলাধারটিকে নতুন করে নির্মাণ করেন। হ্রদটির বাঁধ তিনগুণ দৃঢ় ও বিস্তৃত করা হয়। হ্রদটি সুন্দরতর হয়ে ওঠে। জলাধারটির সংস্কার করতে রুদ্রদামাকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। এরূপ ব্যয়বহুল কাজে তাকে অগ্রসর না হতে মন্ত্রীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে উপদেশে কর্ণপাত না করে তিনি হাসিমুখে সব খরচ বহন করেন। কোনও বাড়তি করভার চাপিয়ে প্রজাদের পীড়ন করেননি।
  • প্রজাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য : প্রজাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি রুদ্রদামার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। রাজ্যে অসুখ-বিসুখের প্রাদুর্ভাব, চোর-ডাকাতের উৎপাত ও বন্য প্রাণীর উপদ্রব বন্ধ করতে তিনি সারা জীবন নিরলস চেষ্টা করে গেছেন। 
  • শিক্ষা ও সাহিত্য : শিক্ষার প্রতি তার অকৃত্রিম আগ্রহ ছিল। সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন তিনি। সংস্কৃত ভাষায় গদ্য ও পদ্য রচনা করে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, তার রচনাগুলো কালের কপােলতলে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার নির্দেশনায় রচিত জুনাগড় লেখ কালের প্রভাব এডিয়ে। আজও মােটামুটি অক্ষত আছে। আগাগােড়া সংস্কৃতে লেখা এ লেখখানি পদ ও ছন্দের অনুপম প্রয়ােগে রসােত্তীর্ণ সাহিত্যে উন্নীত হয়েছে। সংস্কৃত ছাড়া ব্যাকরণ, রাজনীতি, সংগীত, তর্কবিদ্যা প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় তিনি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। প্রাচীন ভারতে সংস্কৃতির এক পীঠস্থান উজ্জয়িনী। সংস্কৃতির কেন্দ্ররূপে উজ্জয়িনীর জয়যাত্রা রুদ্রদামার রাজত্বকালেই শুরু হয়। এদিক থেকে বিচার করলে তাকে উজ্জয়িনীর প্রকৃত স্থপতি আখ্যা দেয়া যায়। 

দামঘ্স‌দ ও শক শাসনের অবসান

দামঘ্স‌দকে ক্ষত্রপপদে নিযুক্তি ও মৃত্যু : সম্ভবত তার রাজত্বের শেষ পর্বে প্রশাসনের স্বার্থে রুদ্রদামা তার পুত্র দামঘ্স‌দকে ক্ষত্রপপদে নিযুক্ত করেন। ক্ষত্ৰপ দামসদের কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। সন্দেহ নেই, এ মুদ্রাগুলো রুদ্রদামার জীবিতকালেই উৎকীর্ণ হয়েছিল। ১৫০ খ্রিস্টাব্দের পর কোনও এক সময় রুদ্রদামার মৃত্যু হয়।

উত্তর-পূর্বের শক ক্ষত্রপ-মহাক্ষত্রপগণ : রুদ্রদামার মৃত্যুর পর তার বংশধরেরা দুই শতাব্দীরও অধিককাল পশ্চিম ভারতে রাজত্ব করেন। তাদের শাসনকালে শকদের রাজনৈতিক গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অবশ্য এর কারণ ছিল। উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব তাে ছিলই। তার সঙ্গে যুক্ত হল রাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব। রুদ্রদামার পুত্র দামঘ্‌সদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এই অন্তর্দ্বন্দ্বের শুরু। গৃহবিবাদ এড়াবার জন্য উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে পিতা-পুত্র পরম্পরার পরিবর্তে দাদা-ভাই পারম্পর্য প্রবর্তিত হল। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হল না। দুর্বল নেতৃত্বে জরাগ্রস্ত ও গৃহকলহে জীর্ণ শকরাজ্য শক্তিশালী প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর আক্রমণে ভেঙ্গে পড়ল। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষের দিকে আভীররাজ ঈশ্বরদত্ত তাে একবার শকরাজ্য অধিকার করেই বসেন। রুদ্রদামার কনিষ্ঠ পুত্র প্রথম রুদ্ৰসিংহ কোনও প্রকারে অবস্থার সামাল দেন। কিন্তু সাতবাহনরাজ যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণিকে কিছুতেই প্রতিরােধ করা গেল না। তিনি ক্ষত্ৰপ রাজ্যের কিয়দংশ বলপূর্বক অধিকার করেন। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মধ্যভাগে রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ কার্দৰ্মক শকদের হাতছাড়া হয়। রাজস্থান ও পশ্চিম মধ্যপ্রদেশে মালবরা এবং মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে শক শ্রীধরবর্মা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকের ধারণা শ্রীধরবর্মা খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মাঝামাঝি নয়, ৪র্থ শতকের প্রারম্ভে আবির্ভূত হয়েছিলেন। মালব ছাড়া রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যৌধেয়, আর্জুনায়ন, সনকানীক, প্রার্জুন, কাক, খরপরিক প্রভৃতি আরও কয়েকটি স্বাধীন রাজ্য ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করল।

পশ্চিমা ক্ষত্রপ আধিপত্যের বিলুপ্তি : গুজরাতের সর্বশেষ মহাক্ষত্রপ তৃতীয় রুদ্ৰসিংহ। তার মুদ্রার সর্বশেষ তারিখের শতক ও দশকের ঘরে আছে যথাক্রমে ৩ এবং ১ সংখ্যা দুটি। কিন্তু এককের সংখ্যাটি অবলুপ্ত। শূন্য থেকে ৯-এর মধ্যবর্তী যে কোনও একটি সংখ্যা এখানে হতে পারে। তাহলে তার সর্বশেষ মুদ্রাগুলো ৩১০ শকাব্দ বা ৩৮৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্ববর্তী নয়। আবার মুদ্রাগুলো ৩৯৭ খ্রিস্টাব্দের উত্তর পর্বেরও নয়। তৃতীয় রুদ্ৰসিংহের পর যে রাজার রৌপ্যমুদ্রা গুজরাতে আবিষ্কৃত হয়েছে তিনি গুপ্তরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। গুজরাতে পাওয়া দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রাচীনতম মুদ্রাগুলোর তারিখ দু’টি সংখ্যায় দেয়া হয়েছে। দশকের ঘরে আছে ৯ কিন্তু এককের ঘরের সংখ্যাটি অবলুপ্ত। সম্ভাব্য সংখ্যাটি শূন্য হতে ৯-এর মধ্যে যে কোনও একটি সংখ্যা হতে পারে। ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ হতে ৪১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনও এক সময় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত লােকান্তরিত হন। সে কারণে মুদ্রায় এককের ঘরের সংখ্যাটি ৬ বা তার নিম্নতর কোনও সংখ্যা হতে পারে কিন্তু ৬-এর অধিক কিছুতেই নয়। অর্থাৎ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের এই শ্রেণির মুদ্রাগুলো ৯০ গুপ্তাব্দ বা ৪১০ খ্রিস্টাব্দের যেমন পূর্ববর্তী নয় তেমনি ৪১৯ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীও নয়। তৃতীয় রুদ্ৰসিংহ ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তর রৌপ্যমুদ্রার তুলনামূলক আলােচনায় দুটি জিনিস স্পষ্ট হয় : প্রথমত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের হাতে তৃতীয় রুদ্ৰসিংহের পরাজয়ের ফলেই গুজরাতে শক শাসনের অবসান হয়। দ্বিতীয়ত, ৩৮৮ হতে ৪১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনও এক সময় গুজরাতে গুপ্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের শেষ শক রাজ্যটিও ধসে পড়ল।  কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন তৃতীয় রুদ্রসেন ৩১০ এবং ৩১২ শকাব্দেও মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। তাদের মতে তৃতীয় রুদ্রসেনের রাজত্বের শেষভাগে গুজরাতে ক্ষত্ৰপ রাজ্যটি দ্বিধাবিভক্ত হয় – একাংশে তৃতীয় রুদ্রসেন ও অপরাধে মহাক্ষত্ৰপ সত্যসিংহ ও পরে তার পুত্র মহাক্ষত্ৰপ রুদ্ৰসিংহ রাজত্ব করেন। তারা আরও মনে করেন, তৃতীয় রুদ্ৰসিংহ ও তৃতীয় রুদ্রসেন উভয় মহাক্ষত্রপকে পরাজিত করে গুপ্ত সম্রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত গুজরাতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তৃতীয় রুদ্রসেনের মুদ্রায় ৩১০ এবং ৩১২ শকাব্দের তথাকথিত উল্লেখ সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ আছে। তৃতীয় রুদ্ৰসিংহই সম্ভবত গুজরাতের সর্বশেষ মহাক্ষত্রপ ছিলেন।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা

সহকারী : শক-পহ্লব রাজ্যে রাজাই ছিলেন প্রশাসনের প্রধান। শাসনকার্যে সাহায্য করার জন্য তিনি কখনও কখনও একজন সহযােগী প্রশাসক নিযুক্ত করতেন। এই সহযােগীরও রাজকীয় উপাধি ছিল। সাধারণত যুবরাজ বা রাজার ভাই সহযােগী প্রশাসক নিযুক্ত হতেন। সম্ভবত প্রথম জনই ছিলেন আসল কর্তৃত্বের অধিকারী, দ্বিতীয় জন তার সহকারী। অনেকে মনে করেন শক-পহ্লব যুগে দু’জন রাজা একই সময় সমান ক্ষমতা ও মর্যাদা ভােগ করতেন। রাজাদের দু’জনই সমান ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী, না একজন অন্যজনের সহকারী, এ সম্পর্কে উপযুক্ত তথ্যের অভাবে স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়। মুখ্য ও সহকারী রাজা দু’জনেই যৌথভাবে মুদ্রা উৎকীর্ণ করতেন। মুখ্য রাজার নাম সব সময়ই মুদ্রার প্রধান পৃষ্ঠে গ্রিক ভাষায় ও গ্রিক লিপিতে লেখা হত, সহকারীর নাম ও অভিধা লেখা হত প্রাকৃত ভাষায় ও খরােষ্ঠী বর্ণমালায়। প্রথম এজেস স্পলিরিসের, এজিলিস প্রথম এজেসের এবং দ্বিতীয় এজেস এজিলিসের সহযােগী প্রশাসক ছিলেন। পাশ্চাত্য ক্ষত্রপরাও দ্বৈত শাসন-ব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন। দু’জন ক্ষত্রপের মধ্যে যিনি মুখ্য তার উপাধি মহাক্ষত্রপ, যিনি গৌণ তিনি ক্ষত্রপ। পশ্চিমা ক্ষত্ৰপ রাজ্যে মহাক্ষত্ৰপ ও ক্ষত্রপ একযােগে মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি, করেছেন পৃথকভাবে।

উচ্চশিক্ষা : শক রাজগণের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রুদ্রদামা। তিনি ব্যাকরণ, সংগীত, তর্কশাস্ত্র ও অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করেন। সংস্কৃত সাহিত্যে তার অসামান্য ব্যুৎপত্তি ছিল। সাহিত্যিকরূপে তার খ্যাতি ছিল। জুনাগড় লেখে তার হস্তী, অশ্ব ও রথ চালনায় পটুত্বের কথা বলা হয়েছে। 

প্রদেশ : শাসনকার্যের সুবিধার জন্য শক-পহ্লব রাজারা তাদের রাজ্যটিকে কয়েকটি প্রদেশ বা অঞ্চলে ভাগ করতেন। প্রদেশ বা অঞ্চলের শাসনভার সাধারণত এক একজন মহাক্ষত্রপের উপর ন্যস্ত হত। অনেক সময় একজন করে ক্ষত্রপ মহাক্ষত্রপকে শাসনকার্যে সাহায্য করতেন। কখনও কখনও ক্ষত্রপদেরও প্রদেশপালরূপে নিয়ােগ করা হত। মহাক্ষত্রপের পুত্র বা অনুজই সাধারণত ক্ষত্রপপদে নিযুক্ত হতেন। মহাক্ষত্রপই সম্ভবত তার অধীনস্থ ক্ষত্রপকে মনােনীত করতেন।

প্রদেশপালদের কর্তৃত্ব : প্রদেশপালেরা সকলে একই রকম কর্তৃত্ব ভােগ করতেন বলে মনে হয় না। নহপান, চষ্টনেরা যে ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন লিঅক কুসুলুকের সে কর্তৃত্ব ছিল না। লিঅক কুসুলুকের শাসনকালে তার পুত্র পতিক একখানি লেখ উৎকীর্ণ করেন। সেই লেখে রাজা মউয়েসের নাম উচ্চারিত হয়েছে। পক্ষান্তরে নহপানের শাসনকালে তার জামাতা ঋষভদত্ত যে কয়েকখানি লেখ উৎকীর্ণ করেছিলেন তার কোনওটিতেই কুষাণ রাজাদের উল্লেখ নেই। চষ্টন ও তার বংশধরেরা প্রথম দিকে সম্ভবত কুষাণরাজগণের অধীনস্থ ছিলেন। কিন্তু তারা স্বাধীনভাবেই মুদ্রা ও লেখ উৎকীর্ণ করেছেন। কার্যত স্বাধীন হয়েও পশ্চিমা মহাক্ষত্রপরা রাজকীয় অভিধা ধারণ করেননি। এর কোনও সদুত্তর নেই। 

জেলা : এক একটি প্রদেশ সম্ভবত কয়েকটি জেলায় বিভক্ত ছিল। মউয়েস, এজেসদের আমলের কোনও জেলার নাম জানা যায় না। কিন্তু ঋষভদত্তের লেখে গােবর্ধন ও মামাল নামে দুটি আহার বা জেলার নাম পাওয়া যায়। প্রথমটি নাসিকে এবং দ্বিতীয়টি কার্লেতে অবস্থিত ছিল। জেলা দু’টির শাসনভার ঋষভদত্তের উপর ন্যস্ত ছিল। 

শাসনের কল্যাণকর দিক : রুদ্রদামার জুনাগড় লেখে পশ্চিমা ক্ষত্রপ শাসনের কল্যাণকর দিকটি প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখে বলা হয়েছে পুরবাসী ও জনপদবাসীদের কল্যাণই হল রাষ্ট্রের মুখ্য লক্ষ্য। প্রণয় ও বৃষ্টির মতাে পীড়নমূলক কর প্রজাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হত না। প্রজাদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের প্রতি রাষ্ট্রের সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তবে জুনাগড় লেখে প্রজাপালনের যে মহান আদর্শ ব্যক্ত হয়েছে তা যে। সর্বদাই অনুসৃত হত এমনটি ভাবা ঠিক নয়।

সামাজিক জীবন

যৌথপরিবার, বহুগামিতা, ক্ষত্রপদের নারীপ্রীতি : শক-পহ্লব লেখমালায় দানাদি প্রসঙ্গে দাতার সঙ্গে প্রায়ই তার আত্মীয় স্বজনদের উল্লেখ দেখা যায়। শক-পহ্লব সমাজে যৌথ পরিবারের জনপ্রিয়তার এটি একটি পরােক্ষ প্রমাণ। পহ্লব পুরুষসমাজে বহুগামিতার উল্লেখ করেছেন খ্রিস্টীয় ৩য়-৪র্থ শতকের লেখক বার্ডেসানেস। পহ্লব রমণীদের সতীধর্মের তিনি প্রশংসা করেছেন। পহ্লবদের তুলনায় শক রমণীরা চপলমতি ছিলেন। বিবাহ সম্পর্কে শক সমাজে বিশেষ কোনও সংস্কার ছিল না। হেরােডােটাস এক শক রাজার উল্লেখ করেছেন যার মৃত্যুর পর তার বিধবা পত্নী এক সতীন পুত্রকে বিবাহ করেছিলেন। মনে হয়, নিজের মা ও কন্যা ছাড়া অন্য কোনও মহিলার পাণিগ্রহণে শকদের বাধা ছিল না। পশ্চিমা ক্ষত্রপদের নারীপ্রীতির উল্লেখ আছে বাৎস্যায়নের কামসূত্রে। গুজরাতের শহর ও গ্রাম হতে অভিসারিকারা কখনও নিঃসঙ্গে কখনওবা সদলে উজ্জয়িনীর শক রাজপ্রাসাদে যে অবাধে যাতায়াত করতেন তা কামসূত্রে সবিস্তারে বলা হয়েছে। শক অভিজাত পরিবারে বিদেশিনী ক্রীতদাসী রাখার রেওয়াজ ছিল। বিদেশ থেকে শুধু ক্রীতদাসী নয়, দাসদেরও আমদানি করা হত। দাসদের বিভিন্ন শিল্প ও সরকারি কাজে নিয়ােগ করা হত।

শক-পহ্লব প্রভাবে ভারতীয় সমাজে পরিবর্তন ও সাহিত্যিক প্রতিক্রিয়া : শক-পহ্লবরা তাদের নিজস্ব আচার-ব্যবহার, ধ্যান-ধারণা নিয়ে ভারতে আসেন। তাদের আচার-বিচারের সঙ্গে ভারতীয় রীতিনীতির বিস্তর ব্যবধান ছিল। ফলে তাদের আগমনে ভারতীয় সমাজে পরিবর্তনের ঢেউ আসে। সমকালীন ভারতীয় সমাজপতিরা এ জিনিসটিকে সুনজরে দেখেননি। তাদের বিরূপ মনােভাব প্রতিধ্বনিত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের রচনা গার্গী সংহিতার যুগপুরাণ অধ্যায়ে। বৈদেশিক জাতির অনুপ্রবেশে ভারতীয় সমাজে পরিবর্তনের কথা ভবিষ্যদ্বাণীর আকারে খেদের সঙ্গে এই গ্রন্থে ব্যক্ত হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, কলি যুগের অন্তিম লগ্নে আর্য-অনার্য, ব্রাহ্মণ-শূদ্র ও ধার্মিক-নাস্তিকে কোনাে ভেদাভেদ থাকবে না; ব্রাহ্মণের সামাজিক প্রতিপত্তি ও ধর্মীয় অধিকার সবই শূদ্র আত্মসাৎ করবেন, পারিবারিক জীবনে অভিশাপ নেমে আসবে, অসংখ্য পুরুষহানির ফলে গড়ে প্রতি দশ থেকে কুড়িজন মেয়ের ভাগ্যে একজন করে স্বামী জুটবেন, বাইরের কাজ মেয়েদেরই করতে হবে। বৈদেশিক শাসন ও তার ফলে দেশব্যাপী অরাজকতা, অনাচার, অধর্মের জয় ও বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কথা মহাভারতেও বলা হয়েছে। বাহ্লিক ও মদ্র অঞ্চলের নারী-পুরুষদের নৈতিক অবক্ষয় এবং খাদ্য ও পানীয় সম্পর্কে অমিতাচারের উল্লেখ আছে মহাভারতে। গুজরাতি ও পাঞ্জাবি রমণীদের চরিত্র সম্পর্কে কামসূত্রে শ্লেষোক্তি আছে। এসব অঞ্চল শক-পহ্লবদের অধীনস্থ ছিল। ভাসের ‘চারুদত্ত’ ও শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিকম্‌’ নাটকে শকার নামে এক চরিত্রের বর্ণনা আছে। দর্শকদের নিকট নিজেকে হাস্যাস্পদ করাই যেন তার কাজ। শকপুত্র অর্থে সম্ভবত শকার পদের ব্যবহার হয়েছে। মনে হয়, বৈদেশিক শকদের প্রতি ঘৃণার বশে নাট্যকারেরা শকার চরিত্রের কল্পনা করেছেন।

শকদের দ্বারা ভারতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধি, ভারতীয় ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা ও দান : কিন্তু ভুললে চলবে না, শক-পহ্লবরা ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি ধ্বংস করেননি, তারা একে পরিপুষ্ট করেছেন। কালক্রমে তারা এদেশের ভাষা, ধর্ম, রীতি-নীতি, এমনকি ভারতীয় নাম পর্যন্ত গ্রহণ করে প্রকৃত পক্ষে ভারতীয়ই হয়ে যান। এ যেন বিজিতের কাছে বিজয়ীর স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ। প্রধানত বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং কখনও কখনও অন্য সম্প্রদায়ের অনুকূলে তারা নানাবিধ দানমূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। কার্লা, নাসিক ও জুমারে পাওয়া লেখে শকদের দানধ্যানের কথা সবিস্তারে বর্ণিত আছে। শুধু অভিজাত পরিবারের নয়, সাধারণ ঘরের শকরাও স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে দানধ্যানাদির কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শকদের অনেকেই ভারতীয় নাম গ্রহণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে নহপানের কন্যা দক্ষমিত্রা, নহপানের জামাতা ঋষভদত্ত, মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামা, আভীররাজ ঈশ্বরসেনের সমকালীন শকরমাণী বিষ্ণুদত্তা এবং চষ্টনের বংশধর জয়দামা, জীবদামা ও রুদ্ৰসিংহের কথা সহজেই মনে পড়ে।

ভারতীয় পরিবারে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন : ভারতীয় পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে শকদের ভারতীয় সমাজে প্রবেশের পথ প্রশস্ত হয়। রুদ্রদামা তার এক কন্যার সঙ্গে সাতবাহনরাজ গৌতমীপুত্র সাতকর্ণির এক পুত্রের বিবাহ দেন। পশ্চিমা ক্ষত্রপদের সঙ্গে অন্ধপ্রদেশের ইক্ষ্বাকু রাজপরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। ইক্ষ্বাকুরাজ বীরপুরুষদত্তের এক মহিষী রুদ্রভট্টারিকা। তিনি সম্ভবত মহাক্ষত্ৰপ দ্বিতীয় রুদ্রসেনের কন্যা।

অনিরবসিত বা শুচি শুদ্র : পতঞ্জলি শকদের অনিরবসিত বা শুচি শুদ্র বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি তাদের অস্পৃশ্য তাে বলেনইনি বরঞ্চ তাদের আর্যদের সঙ্গে পান-ভােজনের যােগ্য বলে মনে করেছেন। মনু বলেন শক-পহ্লবরা আসলে ক্ষত্রিয় কিন্তু কর্মলােপহেতু বৃষল বা শূদ্রের পর্যায়ে অবনমিত হয়েছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না মনুসংহিতা রচনার সময় তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। শক-পহ্লবদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির কথা মহাভারতের অনুশাসন ও শান্তিপর্বেও বলা হয়েছে। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের জন্যই তাদের এই সামাজিক উন্নতি। 

ধর্মীয় সাধনা ও জ্ঞানচর্চা : পরবর্তিকালে শকদের মধ্যে অনেকেই ধর্মীয় সাধনায় ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। এদের অনেকের নাম ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ গ্রন্থে উল্লিখিত আছে। বল্লভদেবের সুভাষিতাবলী ও শ্রীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃতে শক কবিদের লেখা বেশ কিছু সংস্কৃত শ্লোকের সন্ধান মেলে। ১২শ শতকের গােবিন্দপুর প্রস্তরলেখে শাকদ্বীপী মগব্রাহ্মণদের বিদ্যাবত্তার জন্য প্রশংসা করা হয়েছে।

বর্ণব্যবস্থা সম্পর্কে উল্লেখ : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়াদি বর্ণ সম্পর্কে শক-পহ্লব লেখমালায় বিশেষ কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। যেটুকু বা পাওয়া যায় তা মূলত দানধ্যানমূলক। সেখানে ব্রাহ্মণদের ভূমিকা গ্রহীতার। তবে মথুরা লেখে এক ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে যিনি মহাক্ষত্ৰপ শােডাসের কোষাগারের অধ্যক্ষ ছিলেন। এর থেকে মনে হয় কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ সেসময় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

অর্থনৈতিক অবস্থা

কৃষি অর্থনীতি

কৃষি ও শিল্পদ্রব্যের উৎপাদন, বনজ সম্পদের ব্যবহার  : পেরিপ্লাস গ্রন্থখানি থেকে জানা যায় উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম ভারত কৃষিজ ও প্রকৃত সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। গুজরাতে প্রচুর পরিমাণে ধান, যব, ইক্ষু ও তিল উৎপন্ন হত। গবাদি পশুর সংখ্যা অধিক হওয়ায় এখানে প্রচুর দুগ্ধজাত দ্রব্য তৈরি হত। এ সময় মহারাষ্ট্রের উপকূল অঞ্চলে নারকেল ফলের ব্যাপক উৎপাদন শুরু হয়। নহপানের নাসিকলেখে ৩২ শত নারকেল মূল ও নারকেল চারা রােপণের উল্লেখ আছে। উত্তর-পশ্চিম ভারত বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। প্রসাধন ও ওষুধের কাজে বনজ সম্পদ ব্যবহার করা হত। গুজরাতে প্রচুর তুলা জন্মাত। এখানে তৈরি তলার কাপড় দেশ ও বিদেশের বাজারে বিক্রি হত। মধ্যপ্রদেশের দশার্ণ শহর হাতির দাঁতের কাজের জন্য বিখ্যাত ছিল। হাতির দাঁতে চিরুনি, পাশা, তরবারির বাট এবং প্রয়ােজনীয় ও শোন নানা জিনিস এখানে তৈরি হত। পশ্চিম ভারতের সমুদ্র উপকূলে মুক্তা পাওয়া যেত। অবশ্য দক্ষিণ ভারতের সমুদ্র উপকূলেই মুক্তার উৎপাদন বেশি হত।

সেচ ব্যবস্থা : 

  • কূপ, পুষ্করিণী ও খাল : কৃষির ফলন বৃদ্ধির জন্য সুপরিকল্পিত ও উন্নত সেচব্যবস্থার প্রয়ােজন ছিল। সমকালীন লেখ ও পুরাবস্তুর সাক্ষ্য হতে কূপ, পুষ্করিণী ও খাল এই তিন ধরনের সেচ প্রকল্পের কথা জানা যায়। ৪-৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বশিশুগ নামে জনৈক ব্যক্তি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে একটি কূপ খনন করেন। ক্ষত্ৰপ শােডাসের শাসনকালে মথুরায় একটি করে কূপ ও পুষ্করিণী খনন করা হয়, আর একটি পুষ্করিণীর পাড় বাঁধিয়ে দেয়া হয়। ক্ষত্রপ নহপান ও তার জামাতা ঋষভদত্ত মহারাষ্ট্রে অনেক জলাশয় নির্মাণ করেছিলেন। সিরকাপে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে এক জলাশয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। এটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম শতকে তৈরি হয়েছিল। উজ্জয়িনী, মথুরা, নাসিক প্রভৃতি স্থানে কলশির খাড়াখাড়ি সারি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো সম্ভবত কূপ হিসাবে ব্যবহৃত হত। উজ্জয়িনীর কাছে পােড়ানাে ইটের তৈরি কূপ তাে আবিষ্কৃতই হয়েছে। সব কূপ ও পুষ্করিণীই যে শুধু সেচের কাজে ব্যবহৃত হত তা নয়, এদের কয়েকটিকে অবশ্যই পানীয় জলাগাররূপে ব্যবহার করা হয়েছিল।
  • বৃহৎ সেচব্যবস্থা : কূপ বা পুষ্করিণী খনন করে ক্ষুদ্র অঞ্চলের জলের চাহিদা মেটানাে সম্ভব কিন্তু বৃহত্তর অঞ্চলের জন্য বড় ধরনের সেচ প্রকল্পের প্রয়ােজন। ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভব কিন্তু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছাড়া বড় ধরনের প্রকল্প তৈরি হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নির্মিত এক বৃহৎ সেচ প্রকল্পের উল্লেখ আছে রুদ্রদামার জুনাগড় গিরিলেখে। এই লেখ থেকে জানা যায় মহাক্ষত্রপের শাসনকালে বর্ষায় জুনাগড়ের অনতিদূরে সুদর্শন হদের জলাধার গুরুতররূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জলাধার থেকে কয়েকটি খলের সাহায্যে পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষির খেতে জল সরবরাহ হত। জলাধারটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেচব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। সরকারি খরচে, অসামান্য তৎপরতার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসক সুবিশাখের সাহায্যে রুদ্রদামা জলাধারটিকে নতুন করে নির্মাণ করেন।
  • উদকযন্ত্রী : আভীররাজ ঈশ্বরসেনের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ একখানি নাসিক লেখে উদকযন্ত্রীর উল্লেখ আছে। এর থেকে এক ধরনের জলযন্ত্রের কথা জানা যায় যার সাহায্যে কূপ, পুষ্করিণী, খাল ও নদী হতে জল তােলা যেত। যন্ত্রটি সম্ভবত হালের গাথাসপ্তশতীতে বর্ণিত অরহট্টঘটিকার অনুরূপ ছিল না।

বহির্বাণিজ্য

অভূতপূর্ব উন্নতি : বহির্বাণিজ্যে এ সময় অভূতপূর্ব উন্নতি দেখা যায়। সিন্ধু-গুজরাত অঞ্চলের সঙ্গে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরােপের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। চিন ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গেও উত্তর-পশ্চিম ভারতের অনুরূপ বাণিজ্যিক সম্বন্ধ গড়ে ওঠে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে শক-পহ্লব রাজ্যগুলোর যে বাণিজ্যিক লেনদেন চলত তারও পরােক্ষ প্রমাণ আছে।

উপকূলের বদলে মাঝসমুদ্র : পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে পশ্চিম ভারতের বাণিজ্য চলত প্রধানত সমুদ্রপথে। পূর্বে প্রধানত উপকুলপথেই বাণিজ্যতরী যাতায়াত করত। কিন্তু ৪৫ খ্রিস্টাব্দে হিপ্পালাস মৌসুমি বায়ু আবিষ্কার করায় মাঝসমুদ্র দিয়ে বাণিজ্যতরী যাতায়াত করতে থাকে। ফলে পশ্চিমা জগতের সঙ্গে ভারতের জলপথের দূরত্ব অনেকখানি হ্রাস পায়। তাছাড়া উপকূলে জলদস্যুদের যে ভয় ছিল তাও অনেকটা প্রশমিত হয়।

সমুদ্র বন্দর ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো : পশ্চিমা ক্ষত্ৰপ রাজ্যের দু’টি বন্দর সামুদ্রিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এদের একটি বারবারিকাম, অন্যটি ব্যারিগাজা বা ভৃগুকচ্ছ। প্রথমটির অবস্থিতি সিন্ধু নদের মােহনায়, দ্বিতীয়টির অবস্থান গুজরাতের উপকূলে। সম্ভারবােঝাই আরব ও রােমক বাণিজ্যিক জাহাজগুলো যেমন অহরহ এই দু’টি বন্দরে এসে ভিড়ত তেমনি ভারতীয় বণিকরাও জাহাজে পণ্যসামগ্রী সাজিয়ে এখান থেকে নিয়মিত পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল, দক্ষিণ আরব উপকুল ও লােহিত সাগরীয় দেশগুলোর উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতেন। মিলিন্দপঞ্হাে‌ গ্রন্থে সমুদ্রগামী জাহাজের উল্লেখ আছে। এক একটি জাহাজে শত শত বাক্সবােঝাই সম্ভার থাকত। মাস্তুল, হাল ও পালের সাহায্যে জাহাজ চালানাে হত আর কাছি দিয়ে নােঙর বাঁধা হত। বন্দর দু’টি স্থলপথে প্রতিষ্ঠান, টগর, উজ্জয়িনী, মথুরা, কৃষ্ণা-গােদাবরী বদ্বীপ, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, পারস্য ও সিরিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বারবারিকাম ও ব্যারিগাজা ছাড়া তক্ষশিলা, উজ্জয়িনী ও মথুরার মতাে শহরগুলোর বাণিজ্যিক গুরুত্বও কম ছিল না। প্রতিটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র সড়কপথে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ফলে মথুরা এবং উজ্জয়িনীর মতাে শহরেও বৈদেশিক বণিকদের নিত্য আনাগােনা ছিল। গ্রামাঞ্চল থেকে লােকেরা দলে দলে শহরে এসে ভিড় করেন। সেখানে স্থান অনুপাতে অধিকসংখ্যায় নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মিত হতে থাকে। মথুরার উপর জনসংখ্যার চাপ বড় বেশি পড়েছিল। এখানকার বাড়িঘর অবিন্যস্ত, রাস্তাগুলো আঁকাবাঁকা। রাস্তার মােড়ের বেশির ভাগ বাড়ির সামনের দিক পাথরের তৈরি। যানবাহন চলাচলের ফলে বাড়ির যাতে কোনও ক্ষতি না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা। ধনীরা বাস করতেন ইট, পাথর, টালি ও কাঠের তৈরি বাড়িতে, গরিবেরা মাটির বাড়িতে। তক্ষশিলার উপর জনসংখ্যার চাপ কমাবার জন্য প্রথম এজেসের রাজত্বকালে সিরকাপ অঞ্চলে নতুন বসতি গড়ে ওঠে। এখানকার রাস্তাঘাট প্রশস্ত, পথের দু’পাশে বাড়ির সারি। কোনও কোনও বাড়ির সামনে থাকত বাগান, আর বাগান ও বাড়ি ঘিরে প্রাচীর।

রপ্তানি পণ্য : বন্দর দুটি দিয়ে যেসব সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি হত তাদের মধ্যে ছিল চন্দন, সেগুন ও আবলুস কাঠ, পালঙ্ক সজ্জার জন্য কচ্ছপের খােল, গয়না তৈরির জন্য মুক্তা, গােলমরিচ, লঙ্কা, দারুচিনি, প্রসাধন সামগ্রী, আঠা, বার্নিশ, ওষুধের জন্য গাছের ছাল, হীরা, মূল্যবান পাথর, নীলকান্ত মণি, লােহা, সূক্ষ্ম ও মােটা সুতিবস্ত্র, মসলিন, বনৌষধি, চাল, যব, মাখন, নীল, তিলতেল ও ইক্ষু। রােম সাম্রাজ্যে ভারতীয় জীবজন্তু, বিশেষ করে বাঘ, সিংহ, বানর, উল্লুক ও তােতাপাখির বেশ চাহিদা ছিল। এই সব জীবজন্তু সাধারণত স্থলপথেই পাঠানাে হত।

আমদানি পণ্য : বিদেশ হতেও বেশ কিছু জিনিস আমদানি করা হত। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আনা হত রক্তিমাভ প্রবাল আর পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হত নিকৃষ্টমানের মুক্তা। অন্যান্য আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে ছিল খেজুর (আরব), মদ (ইতালি ও আরব), ধূপ, প্রসাধন সামগ্রী (পশ্চিম এশিয়া), বনৌষধি (পশ্চিম এশিয়া), বস্তু (পশ্চিম এশিয়া ও মিশর), কাচের পাত্র, আর্শি, মােমছাল, হরিতাল, সােনা (পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল), রূপা, তামা (আরব), টিন (স্পেন), সিসা, পােখরাজ (লােহিত সাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ) রেশম ও পশমের বস্ত্র (চিন) এবং ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী (পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল)। 

রোমের সাথে বাণিজ্য : যে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বহির্বাণিজ্য চলত সে সময় তাদের বেশির ভাগই রােমক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেজন্য এই বাণিজ্য রােম-ভারত বাণিজ্য বলে আখ্যাত। খ্রিস্টীয় ১ম শতকে এই বাণিজ্য জোর কদমে চলে। তারপর থেকে এর গতি মন্দীভূত হয়। রােম-ভারতবাণিজ্যে লাভের পাল্লা ভারতের দিকেই ঝুঁকে পড়ে। রােমে ভারতীয় পণ্য, বিশেষ করে বিলাসসামগ্রীর এতই চাহিদা ছিল যে সেখানকার লােকেরা উৎপাদন মূল্যের একশাে গুণ বেশি দামেও ভারতীয় জিনিস কিনতেন। এর ফলে প্রচুর সােনা ও রূপার রােমক মুদ্রা ভারতে আসত। ২২ খ্রিস্টাব্দে রােমক সম্রাট টাইবেরিয়াস ব্যবস্থাপক সভায় অভিযােগ করেন বৈদেশিক পণ্যের চাহিদা মেটাতে রাষ্ট্রের ধনভাণ্ডার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন রােমক ঐতিহাসিক প্লিনির বিবরণী থেকে জানা যায় রােমকে প্রতি বছর কম করেও ৫৫০,০০০,০০০ সেস্টারসেস পরিমাণ অর্থ ভারতীয় পণ্যের জন্য ব্যয় করতে হত।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে বাণিজ্য : শুধু চিন বা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও পশ্চিম ভারতের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। দুঃসাহসী নাবিকেরা জাহাজে পণ্যসামগ্রী সাজিয়ে ভৃগুকচ্ছ থেকে সুবর্ণভমি ও সুবর্ণদ্বীপের উদ্দেশ্যে সাগর পাড়ি দিচ্ছেন এরকম ঘটনার বর্ণনা আছে খ্রিস্টীয় ২য় শতকের রচনা অবদানশতকে। মায়ানমার, তাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের প্রাচীন ভারতীয় নাম সুবর্ণভূমি, ইন্দোনেশিয়াসহ পূর্ব ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের ভারতীয় নামকরণ সুবর্ণদ্বীপ।

বণিক ও শিল্পীদের সংগঠন : বাণিজ্য ও শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বণিক ও শিল্পী সংঘের কাজকর্মের একটা স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় সমকালীন লেখমালায়। এ সময় সংঘগুলো প্রায়ই ন্যাসরক্ষকের দায়িত্ব পালন করত। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অনেক সময় সংঘগুলোতে জমি ও টাকা জমা রাখতেন। সংঘগুলোর উপর গচ্ছিত সম্পদের আয় থেকে বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট হারে সাহায্য করার শর্ত থাকত, কিন্তু মূল সম্পদে হাত দেয়া চলত না। ঋষভদত্ত নাসিকের এক তন্তুবায় সংঘের কাছে ২০০০ কার্ষাপণ গচ্ছিত রাখেন। সংঘকে এ জন্য বছরে ২৪০ কার্ষাপণ সুদ দিতে হত। ওই সুদের টাকায় সংঘকে বিশেষ এক গুহাবাসী ২০ জন ভিক্ষুর বস্ত্রের সংস্থান করতে হত। নাসিকের আর এক তন্তুবায় সংঘের কাছে ঋষভদত্ত শতকরা ৯ কার্ষাপণ সুদ হারে ১০০০ কার্ষাপণ মুদ্রা গচ্ছিত রাখেন। এই সুদের টাকায় প্রতি বছর ভিক্ষুদের অতিরিক্ত বস্ত্র সরবরাহের দায়িত্ব সংঘকে গ্রহণ করতে হয়। বিষ্ণুদত্তা নামে এক রমণী ত্রিরশ্মি পবর্তবাসী ভিক্ষুদের সাহায্যের জন্য জলযন্ত্রশিল্পী, কুম্ভকার ও তেলকল মালিক সংঘের কাছে পৃথক পৃথকভাবে টাকা গচ্ছিত রেখেছিলেন। জুন্নারের এক সমকালীন লেখে বংশকার এবং কাংস্যকারদের দু’টি অর্থনৈতিক সংঘের উল্লেখ আছে।

রাজস্ব ও জমির মালিকানা

রাজস্ব : বেশি করের বােঝা চাপিয়ে প্রজাদের উৎপীড়ন করা হত না। সাধারণত বলি, শুল্ক ও ভাগ এই তিন প্রকার কর ধার্য করা হত। রাজাকে বা রাষ্ট্রকে আবশ্যিক প্রদেয় প্রজাদের উপঢৌকনের নাম বলি। ভাগ-এর অর্থ উৎপন্ন ফসলে রাজার বা রাষ্ট্রের ভাগ। এই ভাগ কখনও এক-চতুর্থাংশ, কখনও এক-ষষ্ঠাংশ আবার কখনওবা আরও কম। খেয়া-পার, বাণিজ্যিক পণ্যাদির উপর ধার্য রাজকরই শুল্ক। কখনও কখনও প্রজাদের উপর কর, বিষ্টি ও প্রণয় চাপিয়ে দেয়া হত। তবে এসব ঘটনা বিরল ঘটত। ভাগ ছাড়া জরুরি অবস্থায় বা ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্র প্রজাদের উপর অতিরিক্ত করের বােঝা চাপিয়ে দিত। এই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত রাজস্বই কর। বেগার শ্রম অর্থে বিষ্টি। প্রণয় বলতে বােঝায় প্রজাদের উপর চাপিয়ে দেয়া জরুরি কর বা সরকারি নির্দেশে রাজ্যের উন্নয়নমূলক কাজে প্রজাদের অনুদান। সম্ভবত দ্রব্যের বিনিময়ে এবং নগদে দু’ভাবেই কর পরিশােধের ব্যবস্থা ছিল।

জমির মালিকানা : শক-পহ্লব যুগে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। ঋষভদত্তের নাসিক লেখে এর অকাট্য প্রমাণ আছে। এই লেখ থেকে জানা যায়, রাজজামাতা ঋষভদত্ত একবার স্থানীয় বৌদ্ধসংঘকে একখণ্ড জমি দান করতে চান। কিন্তু জমিটি ছিল এক ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। জমিটি পাওয়ার জন্য ঋষভদত্ত জমির মালিককে ৪০০০ কার্ষাপণ মুদ্রা প্রদান করেন। নগদ মূল্যের বিনিময়ে জমিটি হস্তগত করে তিনি পরে সেটি বৌদ্ধসংঘের অনুকুলে দান করেন। এই ঘটনায় জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অস্তিত্বই প্রমাণিত হয়। মৌর্যযুগে যে রাজকীয় জমির সন্ধান পাওয়া। যায় শক-পহ্লব লেখমালায় তার কোনও উল্লেখ নেই।

ধর্মীয় জীবন

ধর্মে পৃষ্ঠপোষকতা : শক-পহ্লব রাজা-ক্ষত্রপরা ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের অকৃপণ পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। গােন্ডােফারেস তার কিছু মুদ্রায় নিজেকে দেবব্রতরূপে বর্ণনা করেছেন। দেবের অর্থ শিব। পহ্লবরাজ সম্ভবত শিবভক্ত ছিলেন। মথুরার মহাক্ষত্রপ রঞ্জুবুলের অগ্রমহিষী বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ শ্রমণদের অনুকূলে তার দানধ্যানের কাহিনি মথুরা সিংহস্তম্ভ লেখে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। ক্ষহরাত ঘটাকের আত্মীয়স্বজন মথুরার কাছে একটি বৌদ্ধস্তুপ নির্মাণ করেছিলেন। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি ঋষভদত্ত সমভাবে অনুরাগ প্রদর্শন করেছেন। তিনি ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে বিস্তর দানধ্যান করেছেন, বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য তীর্থস্থান পরিদর্শন করেছেন। বৌদ্ধ শ্ৰমণদেরও তিনি অকাতরে সাহায্য করেছেন। শােডাসের সময়কার এক লেখে জৈন সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে দান-ধ্যানের কথা আছে। অবশ্য এখানে দাতা শােডাস নন, আমােহিনী নামে জনৈকা মহিলা। 

সর্বাস্তিবাদী ও মহাসংঘিক বৌদ্ধ সম্প্রদায় : বৌদ্ধধর্মের মধ্যে সর্বাস্তিবাদী ও মহাসংঘিক সম্প্রদায় দু’টি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সর্বাস্তিবাদী ও মহাসংঘিকদের মতবাদে বেশ পার্থক্য আছে। সর্বাস্তিবাদীদের মূল কথা ‘সবর্ম অস্তি’। তারা বস্তুজগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন কিন্তু আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। বুদ্ধকে তারা লৌকিক সত্তারূপেই দেখেন, অর্থৎত্বের আদর্শে তারা আস্থাবান। পক্ষান্তরে মহাসংঘিকরা বস্তুজগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, বুদ্ধকে তারা লােকোত্তর সত্তারূপে দেখেন। অর্থৎত্বের আদর্শ তাদের কাছে প্রত্যাখ্যাত, অনেক বুদ্ধ ও বােধিসত্ত্ব ধারণার তারা অনুগামী। সর্বাস্তিবাদীদের প্রভাব বেশি ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতে, বিশেষত কাশ্মীরে ও গান্ধারে। এখান থেকেই বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ মধ্য এশিয়ার নানা স্থানে বিস্তার লাভ করে।

বুদ্ধের প্রতিমাপূজা ও তার ভগবান হয়ে ওঠা : এই সময় বৌদ্ধধর্মে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। প্রথমত, এতদিন পর্যন্ত বুদ্ধের প্রতীক পূজা প্রচলিত ছিল। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষের দিকে বা পরের শতকের একেবারে গােড়ায় বুদ্ধমূর্তি পূজা চালু হল। প্রাচীনতম বুদ্ধমূর্তিগুলো সবই শক-পহ্লব পর্বের। দ্বিতীয়ত, এ সময় থেকে বুদ্ধ ভক্তের দৃষ্টিতে দয়াল ভগবানরূপে প্রতিভাত হন। পূর্বে সংঘ ও শ্রমণদের উদ্দেশ্যে দানকালে দাতা তার সংকল্প অনুচ্চারিত রাখতেন। কিন্তু এ সময়কার বেশির ভাগ লেখেই দেখা যায় দাতা শুধু তার দানের বর্ণনাই করছেন না, তিনি তার দানের উদ্দেশ্যও ব্যক্ত করছেন। এ দান যে সকাম দান, তা প্রকাশে দাতার এতটুকু দ্বিধা নেই। যার উদ্দেশ্যে দাতার সংকল্প তিনি নিছক ঋষি গৌতম নন, তিনি স্বয়ং ভগবান, দয়াল তিনি। ভক্তের মনােবাঞ্ছা তিনি পূর্ণ করেন। এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়েই দাতা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। 

সিংহবাহিনী দুর্গা পূজার শুরু : ব্রাহ্মণ্যধর্মের ইতিহাসে শক-পহ্লব যুগ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময় থেকে মহিষাসুর মর্দিনী বা সিংহবাহিনী দুর্গা পূজার শুরু। সে সময় পশ্চিম এশিয়ায় সিংহবাহিনী দেবী নানার পূজা প্রচলিত ছিল। এই নানার অনুকরণেই মহিষাসুরমর্দিনীর রূপকল্পনা। প্রথমদিকের মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিগুলোতে দেখা যায় দুর্গা নিরস্ত্র অবস্থায় মহিষ নিধন করছেন। পশ্চিম এশিয়ায় নানা বৃষনিহন্তা রূপে কল্পিত হয়েছেন। কিন্তু বৃষ শিবের বাহন। তাই ভারতে বৃষের পরিবর্তে মহিষের উপ স্থাপনা হয়েছে। অশুভ শক্তির প্রতীক মহিষ। মহিষের রক্তপাতে একদিকে যেমন অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয় প্রকাশিত, অন্যদিকে তেমনি নতুন জীবনের আগমনি বার্তা ধ্বনিত। কুষাণ যুগের শেষপর্ব হতে দেবীর হাতে আয়ুধের ব্যবহার দেখা যায়। 

সূর্য উপাসনার জনপ্রিয়তা ও বিবর্তন : ভারতে সূর্য উপাসনার জনপ্রিয়তা ও বিবর্তনের ক্ষেত্রে শকদের, বিশেষ করে শক পুরােহিত সম্প্রদায়, তথা মগ ব্রাহ্মণদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। শকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন পারসিক দেবতা মিহির বা সূর্যের উপাসক। ভারতে আসার পরও তারা সূর্য পূজার নিজস্ব রীতি অনুসরণ করে চলেন। ফলে প্রথম প্রথম সূর্য উপাসনায় দেশি ও শক তথা পারসিক দুটি স্বতন্ত্র ধারা সমান্তরালভাবে বইতে থাকে। ধীরে ধীরে পারস্পরিক আদানপ্রদানের ফলে দু’টি স্বতন্ত্রধারা এক সংস্কৃত ও সমন্বিত ধারায় আত্মপ্রকাশ করে। পুরাণােক্ত শাম্ব উপাখ্যানে সূর্য উপাসনায় শক প্রভাব সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়েছে। শ্রীকৃষ্ণ ও জাম্ববতীর পুত্র শাম্ব কুষ্ঠরােগে আক্রান্ত হন। পিতার উপদেশে রােগমুক্তির আশায় তিনি সূর্য উপাসনায় ব্রতী হন। চন্দ্রভাগা নদীর তীরে সূর্যমন্দির তৈরি হল। কোনও ভারতীয় সেই মন্দিরে পূজারির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন না। তখন বাধ্য হয়ে শাম্ব শাকদ্বীপ বা পূর্ব পারস্য হতে মগ ব্রাহ্মণদের এনে পূজা সম্পূর্ণ করেন। ভারতে সূর্য উপাসনার সঙ্গে শকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি থাকায় কাহিনিটি তাৎপর্যপূর্ণ। বরাহমিহির বলেন সূর্য মন্দিরে মগ ব্রাহ্মণরাই পুরােহিতের কাজ করবেন। বরাহমিহিরের এই উক্তিতে সূর্য উপাসনায় শক প্রভাবের সমর্থন পাওয়া যায়। যেসব প্রাচীন সূর্যমূর্তি পাওয়া গেছে তাতে কখনও কখনও সুর্যের পায়ে বুট জুতা, পরনে কোট ও ট্রাউজার্স, হাতে খড়গ এবং পায়ের কাছে বা রথের নিচে উপবিষ্ট বিরাটকায় এক শ্বশ্রূল পুরুষ দেখা যায়। এসবই পারসিক বা শক প্রভাবের ফল।

বীরবাদ : ভাগবত সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সময় বীরবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করে। শুধু বাসুদেব-কৃষ্ণের নয়, সংকর্ষণ (রােহিণী ও বসুদেবের পুত্র, কৃষ্ণের বড় ভাই), প্রদ্যুম্ন (রুক্মিণী ও বাসুদেবের পুত্র), শাম্ব (জাম্ববতী ও বাসুদেবের পুত্র) ও অনিরুদ্ধ (প্রদ্যুম্নের পুত্র) এই আরও চারজন বৃষ্ণি বীরের পূজার ব্যাপক প্রচলন হয়। পঞ্চবীরের পূজায় যারা সামিল হয়েছিলেন তাদের মধ্যে বিদেশিনীরাও ছিলেন। শােডাসের শাসনকালে উৎকীর্ণ মােরা কূপ লেখে তােষা নামে এরূপ একজন বিদেশিনীর নাম আছে। তিনি স্থানীয় একটি মন্দিরে পাঁচ বৃষ্ণি বীরের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মােরার কাছে সমকালীন আর একখানি লেখে ভগবান বাসুদেবের ‘মহাস্থান’-এ তােরণ, বেদিকা ও চতুঃশাল নির্মাণের উল্লেখ আছে। লেখ দু’টি মথুরা অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে। মনে হয়, জৈনদের যেমন, ভাগবতদেরও তেমনি, এক প্রধান কেন্দ্র ছিল মথুরা।

শিল্প ও সাহিত্য

স্থাপত্য ও ভাস্কর্য

  • স্তূপনির্মাণ ও স্তূপের সংস্কার : শকরা শিল্পের অনুরাগী ছিলেন। ব্রহ্মযামল গ্রন্থে শক ব্রাহ্মণদের ‘চিত্রপণ্ডিত’ আখ্যা দেয়া হয়েছে। নতুন স্তূপনির্মাণ ও পুরােনাে স্তূপের সংস্কার, দু’টি কাজই এযুগে সমান তালে চলে। বেদিকে একটু উঁচু করে স্তূপকে উচ্চতর করার প্রয়াস এ সময় থেকেই লক্ষ করা যায়। এ সময় হতেই স্তূপের অঙ্গ সজ্জায় বুদ্ধ-বােধিসত্ত্বের মূর্তি ব্যবহার শুরু হয়। 
  • ঋষভদত্ত বিহার : নাসিকে পাহাড়ের গা কেটে নহপানের শাসনকালে ঋষভদত্ত বিহার তৈরি হয়। সামনে স্তম্ভশােভিত বারান্দা, মাঝখানে স্তম্ভবিহীন বর্গক্ষেত্রাকার বড় হলঘর আর তিন দিকে কক্ষ এই নিয়েই এই একতলা বিহার। সামনের কারুকার্যখচিত স্তম্ভশ্রেণি বিহারটিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে।
  • গান্ধার শিল্প ও বুদ্ধমূর্তি : এযুগেই উত্তর-পশ্চিম ভারতে গান্ধার শিল্পের উদ্ভব হয়। বৌদ্ধধর্মের আশ্রয়ে ও মূলত গ্রিক শিল্পরীতির প্রভাবে গান্ধার শিল্পের উৎপত্তি। এযুগের তৈরি উত্তর-পশ্চিম ভারতের বুদ্ধ প্রতিমা গান্ধার শিল্পের উজ্জ্বল নিদর্শন। লােরিয়ান টোঙ্গাই, তখৎ-ই-বহি প্রভৃতি স্থান থেকে এযুগের বুদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। মূর্তিগুলো খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষ পর্বে বা পরবর্তী শতকের একেবারে গােড়ার দিকে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমিত হয়। মূর্তিগুলো অবশ্যই সবচেয়ে প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিগুলোর অন্তর্ভুক্ত। লােরিয়ান টোঙ্গাই ও তখৎ-ই-বহির দু’টি বুদ্ধমূর্তিই দাঁড়ানাের ভঙ্গিতে নির্মিত, দেহ সুঠাম ও নমনীয়, মাথায় কুঞ্চিত কেশদাম ও উষ্ণীষ, পরনে ভারী পােশাক, গায়ে অলংকার, ভ্রূযুগলের মাঝখানে ঊর্ণা, পায়ে পাদুকা। গ্রিক দেবতা এপােলাের অনুকরণে এই বুদ্ধমূর্তিগুলো নির্মিত হয়েছে। গান্ধার বুদ্ধমূর্তিগুলোর অনেক কিছুই সুন্দর কিন্তু এই মূর্তিগুলোতে আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তির সেরকম প্রকাশ ঘটেনি। আফগানিস্তানের জালালাবাদের কাছে বিমারানে এক ভগ্নস্তুপের মধ্যে প্রথম এজেসের সমকালীন একটি গােলাকৃতির সােনার পাত্ৰাধার পাওয়া গেছে। পাত্ৰাধারটির বহিরঙ্গের চারদিকে বুদ্ধমূর্তি উৎকীর্ণ। মূর্তিগুলো আশ্চর্যরকমের গতিময়। কাধ থেকে গােড়ালি পর্যন্ত বিস্তৃত বহির্বাসের মধ্য দিয়েও এই গতিময়তা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত।
  • পােড়ামাটির কাজ : এযুগের পােড়ামাটির কাজের দু’টি প্রধান কেন্দ্র মথুরা ও তক্ষশিলা। খেলনা থেকে আরম্ভ করে মানবজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের নানা অভিজ্ঞতা লােকায়ত শিল্পীরা পােড়ামাটির ফলকে রূপায়িত করেছেন। লােকায়ত শিল্পীরা যেমন দেশি মানুষদের মূর্তি গড়েছেন তেমনি বিদেশিদের মূর্তিও তৈরি করেছেন। পােড়ামাটির শিল্পে এই দেশি-বিদেশি মানুষদের ভিড়ে বৈচিত্রময় সমকালীন চলমান সমাজ প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রাকৃত ও সংস্কৃত সাহিত্য

  • লেখ ও মুদ্রা : শক শাসকরা প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপােষকতা করে গেছেন। শক শাসনের আদি পর্বের লেখ ও মুদ্রা সবই প্রাকৃত ভাষায় লেখা। অঞ্চলভেদে প্রাকৃতের বিভিন্ন রূপ – মগধ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মাগধী ও অর্ধমাগধী, মথুরায় শৌরসেনী, গান্ধার, কাপিশ ও সন্নিহিত এলাকায় পৈশাচী প্রাকৃত, পশ্চিম ভারতে মহারাষ্ট্রী। পশ্চিমা ক্ষত্রপদের আমলে সংস্কৃত সাহিত্যের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। রুদ্রদামার শাসনকালে উৎকীর্ণ জুনাগড় লেখ এর সুনিশ্চিত প্রমাণ। সংস্কৃতে লেখা প্রাচীনতম ভারতীয় লেখমালার মধ্যে এটি একটি গদ্যে লেখা হলেও পদ ও ছন্দের সুনিপুণ প্রয়ােগে লেখটি রসাত্মক কাব্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। রুদ্রদামার উত্তরাধিকারীরাও সংস্কৃতে লেখ উৎকীর্ণ করেন। মুদ্রায়ও তারা কখনও কখনও সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করেছেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুদ্রায় প্রাকৃত ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে। 
  • সংস্কৃত নাটক : শক শাসকদের সক্রিয় পৃষ্ঠপােষকতায় সংস্কৃত নাটকের জন্ম, এ অভিমত সিলভা লেভি এবং স্টেন কোনাের মতাে পাশ্চাত্য মনীষীরা ব্যক্ত করেছেন। প্রথম জনের মতে সংস্কৃত নাটকের জন্মভূমি উজ্জয়িনী, দ্বিতীয় জনের ধারণায় সংস্কৃত নাটকের উৎসভূমি মথুরা। শক রাজারা সংস্কৃত সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন ঠিকই কিন্তু তাদের আমলেই সংস্কৃত নাটকের প্রচলন হয় এ ধারণা ঠিক নয়। অর্থশাস্ত্রে ও মহাভাষ্যে নাটক ও নাট্যানুষ্ঠানের উল্লেখ আছে। নটদের কথা স্বয়ং পাণিনিও বলেছেন।
  • পালি মিলিন্দপঞ্হাে‌ : পালি মিলিন্দপঞ্হাে‌ গ্রন্থখানি শ্রীলঙ্কায় রচিত হয়েছিল। অনেকে গ্রন্থখানিকে খ্রিস্টীয় অব্দের প্রারম্ভে উত্তর-পশ্চিম ভারতে রচিত কোনও এক মূল সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ বলে মনে করেন। তাহলে কোনও এক শক বা পহ্লব রাজার পৃষ্ঠপােষকতায় আদি মিলিন্দপঞ্হাে‌ গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল বলে সিদ্ধান্ত করতে হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। 
  • সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারে শক প্রভাব : সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডারে এমন কিছু কিছু পদ আছে যেগুলো শকপর্বের সংযােজন বলে মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ ‘গঞ্জবর’ পদের উল্লেখ করা যায়। কোষাধ্যক্ষ বা ভাণ্ডাগারিক অর্থে পদটি মহাক্ষত্রপ শােডাসের একখানি মথুরালেখে ব্যবহৃত হয়েছে। পদটি মূলত পারসিক। স্বামী, ভদ্রমুখ, সুগৃহীতনামা, রাষ্ট্রীয় প্রভৃতি পদগুলোও এই সময় থেকেই সংস্কৃত কাব্য ও নাটকে বহুল ব্যবহৃত হয়।

ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে শক-পহ্লব জাতির অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। বিজয়ীর বেশে ভারতে এসে বিজিতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতাই তারা করেছেন। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে শক-পহ্লব যুগ সমন্বয় ও সমৃদ্ধির যুগ। সমন্বয় ঘটেছিল ভারতের সঙ্গে বিদেশের, প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের। অনেকের অভিমত, ভারতীয় খাদ্য তালিকায় জিরা, ডালিম ও পেঁয়াজের সংযােজন শকদের কীর্তি।

কুষাণ সাম্রাজ্য

রাজনৈতিক ইতিহাস

আদি ইতিহাস, মিআওস ও কুজুল কদফিসেস

পহ্লবদের হটিয়ে যারা আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের ভাগ্যবিধাতা হলেন এবং কালক্রমে উত্তর ও পূর্ব ভারতে এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চলের আধিপত্য অর্জন করলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসে তারা কুষাণ নামে পরিচিত। বিদেশি এই কুষাণরা বিজয়ীর বেশে, বিদেশি ভাব ও সংস্কৃতির বাহকরূপে, ভারতে এসেছিলেন। কিন্তু এ দেশে দীর্ঘকাল অবস্থানকালে এ দেশের রীতি-নীতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে ভারতীয়গণের সঙ্গে তারা একাত্ম হয়ে যান। কুষাণরা ভারতীয় বনে যান ঠিকই কিন্তু ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবর্তনে তারা স্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। 

আদি ইতিহাস : কুষাণরা ছিলেন ইউ চি উপজাতির এক শাখা। ইউ চি উপজাতি এক সময় চৈনিক তুর্কিস্তানের কান সু অঞ্চলে বাস করতেন। কান সু অঞ্চলের একদিকে ছিল সেন হােয়াঙ্ রাজ্য অন্যদিকে ছিল কি লিয়েন পর্বতশ্রেণি। এখানে আনুমানিক ১৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রতিবেশী হিয়ুঙ্‌ নু উপজাতির হাতে ইউ চিদের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে। এর ফলে ইউ চিরা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে যান। বৃহত্তম দলটি পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়, ছােট শাখাটি চলে যায় অলতিনতঘ ও রিকেটাফেন পার্বত্য অঞ্চলে। বৃহত্তম দলটি প্রথমে ইলি উপত্যকায় উ সুন উপজাতিকে ও পরে শকদের পরাজিত করে জাকসারটেস বা সিরদরিয়া নদীর তীরে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই উ সুনেরা হিয়ুঙ নুদের সাহায্যে ইউ চিদের সেখান থেকে বিতাড়িত করেন। ভাগ্যান্বেষণে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে হতে ইউ চিরা অক্সাস বা আমুদরিয়া নদীর তীরে এসে উপনীত হন। সেখানে শকদের পরাজিত করে তারা তাহিয়া বা ব্যাকট্রিয়া অধিকার করেন। ইউ চিরা এতদিন যাযাবরদের মতাে জীবনযাপন করছিলেন। কিন্তু তাহিয়ায় তারা স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। এখানে ইউ চিরা হিউ সি, শুয়াঙ সি, কুই শুয়াঙ বা কুষাণ, হি তুন ও কাত ফু বা তু সি এই পাঁচটি গােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন। প্রতিটি গােষ্ঠী এক একজন দলপতির অধীনে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বাস করতেন। গােষ্ঠীগুলোর মধ্যে কালক্রমে কুষাণরা শক্তিশালী হন। যে দলপতির নেতৃত্বে কুষাণরা সর্বপ্রথম ব্যাকট্রিয়া অঞ্চলে এক স্বাধীন, সার্বভৌম রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেন, তার নাম মিআওস। ঘটনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষার্ধ।

মিআওস : এক সময় মনে করা হত, দলপতি কিউ সিউ কিও স্বাধীন কুষাণ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু ব্যাকট্রিয়া এবং আমুদরিয়া নদীর উত্তর দিগবর্তী ভূখণ্ডে মিআওস নামাঙ্কিত কতিপয় রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হওয়ায় এ ধারণার অবসান ঘটেছে। মিআওস কিউ সিউ কিও-এর পূর্ববর্তী। মুদ্রার সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, ব্যাকট্রিয়ার কিয়দংশ ও অকসাস বা আমুদরিয়া নদীর উত্তরদিগস্থ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এই কুষাণ নায়কের অধিকারভুক্ত ছিল। চিনা ইতিবৃত্ত হৌ হান শু–এর বিবরণ থেকে জানা যায়, তখনও ব্যাকট্রিয়ার অন্যান্য অঞ্চল অন্য চারটি ইউ-চি গােষ্ঠীর কর্তৃত্বাধীন ছিল। মিআওস এই প্রতিদ্বন্দ্বী গােষ্ঠীদের পদানত করতে পারেননি। এ কাজ সম্পন্ন করেন আর একজন কুষাণ দলপতি, নাম কিউ সিউ কিও। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই দু’জন কুষাণ অধিনায়কের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। ডব্লিউ ডব্লিউ টার্ন (W, W, Tarn, The Greeks in Bactria and India (Cambridge, 1938), পৃ. ৫০৩ হতে) মনে করেন, মিআওস কুজুলের পূর্বপুরুষ ছিলেন। ঘার্শম্যান-এর অভিমত, মিআওস কুজুলের পিতা। হতে পারে, মিআওস-এর মৃত্যুর অব্যবহিত পরই কিউ সিউ কিও কুষাণ সিংহাসনে আরােহণ করেন। আবার মিআওস-এর লােকান্তর এবং কিউ সিউ কিও-এর সিংহাসন আরােহণ, এই দুটি ঘটনার মধ্যে সময়ের কিছু ব্যবধান থাকাও বিচিত্র নয়।

কিউ সিউ কিও বা কুজুল কদফিসেস : যে পরাক্রমশালী কুষাণ নায়ক অপরাপর ইউ চি গােষ্ঠীদের পরাজিত করে ব্যাকট্রিয়ায় কুষাণদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন তিনি কিউ সিউ কিও। চিনা সাহিত্যে কিউ সিউ কিও বলে যার উল্লেখ মুদ্রায় তিনি কুজুল কদফিসেস নামে পরিচিত। তাকে প্রথম কদফিসেসও বলা হয়। কেউ কেউ মনে করেন প্রথম জীবনে কুজুল গ্রিকরাজ হারমেয়ুসের সাহায্যে বিভিন্ন ইউ চি গােষ্ঠীদের পরাজিত করেন কিন্তু পরে হারমেয়ুসকে বিতাড়িত করে কাবুল অববাহিকা অধিকার করেন। কুজুল এবং হারমেয়ুসের নাম সম্বলিত এক শ্রেণির মুদ্রার উপর ভিত্তি করেই এ ধরনের অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। এই মতের প্রবক্তরা মনে করেন মুদ্রাগুলো উভয় রাজা যৌথভাবে উৎকীর্ণ করেছিলেন। কিন্তু এই মুদ্রাগুলোকে কুজুল ও হারমেয়ুসের যৌথমুদ্রা না ভেবে কুজুলের একক মুদ্রারূপেই চিহ্নিত করা উচিত। স্মরণ রাখা দরকার, পহ্লবরা কাবুল অধিকার করে হারমেয়ুসের অনুরূপ মুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন। সেই পহ্লব মুদ্রার অনুকরণে স্বনামে কুজুল সম্ভবত এই মুদ্রাগুলো উৎকীর্ণ করেছিলেন। কুজুল কাবুল অঞ্চল অধিকার করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তা হারমেয়ুসকে পরাজিত করে নয়, পহ্লবদের বিতাড়িত করে। বস্তুত কুজুলের কাবুল অধিকার করার প্রায় সাত দশক পূর্বেই হারমেয়ুসের রাজত্বের অবসান ঘটেছিল।

কুজুলের রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা ভিন্ন মত পােষণ করেন। চিনা সাহিত্য হতে জানা যায় কাবুল ও কান্দাহার কুজুলের রাজ্যভুক্ত ছিল। সিন্ধু নদের পশ্চিমে পঞ্জরে তার একখানি লেখ পাওয়া গেছে। অনেকের অভিমত গান্ধার বা পেশােয়ার অঞ্চল প্রথম থেকেই তার রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। এ মত ঠিক নয়। পহ্লবরাজ গােণ্ডোফারেস যে ৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেখানে রাজত্ব করতেন তার নিশ্চিত প্রমাণ আছে। কুজুলই যে গান্ধার জয় করেন তা জোরের সঙ্গে বলা যায় না। গান্ধার জয় তার পুত্রের কীর্তি হতে পারে। চিনা সাহিত্যে স্পষ্টই বলা হয়েছে তার পুত্রই ভারতে সর্বপ্রথম কুষাণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। সিন্ধু নদের পূর্বতীরে তিনি সম্ভবত তার অধিকার বিস্তার করতে পারেননি। কুজুলের মুদ্রা তক্ষশিলায় পাওয়া গেছে বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকের বিশ্বাস এই মুদ্রাগুলো কুজুলের পুত্র বিম কদফিসেস উৎকীর্ণ করেছিলেন।

রােমক সম্রাট টাইবেরিয়াস (১৪-৩৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং ক্লডিয়াসের (৪১-৫৪ খ্রিস্টাব্দ) মুদ্রার অনুকরণে কুজুল মুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। কুজুল এই রােমক সম্রাটদের সমকালীন ছিলেন। ১৫-৬৫ খ্রিস্টাব্দ কুজুলের রাজত্বকাল বলে ধার্য করা হয়। কোনও কোনও মুদ্রায় তাকে ধর্মস্থিত বা সত্যধর্মস্থিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সত্যধর্ম বলতে সম্ভবত বৌদ্ধধর্মকে বােঝানাে হয়েছে। কুজুল সম্ভবত বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কুজুলের মুদ্রায় এক যােগীর মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। অনেকের মতে তিনি বুদ্ধদেব।

বিম কদফিসেস (৬৫-৭৮ খ্রিস্টাব্দ)

আনুমানিক ৬৫ খ্রিস্টাব্দে কুজুলের মৃত্যুর পর তার পুত্র বিম কদফিসেস পিতৃসিংহাসনে আরােহণ করেন। ৭৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগ পর্যন্ত তা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বলে মনে হয়। অনেকে মনে করেন বিম বা দ্বিতীয় কদফিসেস ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেন এবং শকাব্দ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বর্তমানে এ মত পরিত্যক্ত।

সিংহাসনে আরােহণ করেই বিম কদফিসেস ভারতের দিকে দৃষ্টি দেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি তক্ষশিলা ও পাঞ্জাব অধিকার করেন। তার একখানি বৃহদায়তন প্রস্তরমূর্তি মথুরার সন্নিকটে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ থেকে অনেকে তানুমান করেন তার রাজ্য পূর্বদিকে মথুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চিনা সাহিত্যে বলা হয়েছে বিম কদফিসেস ভারতের শাসনভার একজন প্রতিনিধির স্কন্ধে ন্যস্ত করেন। মুদ্রার তথ্যেও সেরূপ ইঙ্গিত আছে। কাবুল, কান্দাহার ও পাঞ্জাব অঞ্চলে এক নাম-গােত্রহীন প্রশাসকের বেশ কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলো বিম কদফিসেসের মুদ্রার সমকালবর্তী। মুদ্রাগুলোতে মুদ্রাকর্তার নাম নেই, আছে তার পদবির উল্লেখ। মুদ্রাগুলোর এক পিঠে আছে গ্রিক পদবি – ব্যাসিলেওস ব্যাসিলেওন সােটের মেগাস, অন্য পিঠে রয়েছে গ্রিক পদবির প্রাকৃত রূপান্তর – মহরজস রজতিরজস মহতস এতরস। বিম কদফিসেস যাকে ভারতের প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন এই মুদ্রাগুলো সম্ভবত তারই। অন্য কেউ নন, স্বয়ং বিম কদফিসেস সােটের মেগাস পদবি ধারণ করে এই শ্রেণির মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন, এ অভিমত ব্ৰতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়ের (B. N. Mukherjee. The Rise And Fall of the Kushana Empire (Calcutta, 1988). 9. 85-60))। তার দ্বিবিধ যুক্তি। প্রথমত, মুদ্রাকর্তার পদবি মহা রাজকীয়, এবং দ্বিতীয়ত, মুদ্রাগুলো সম্ভবত হিন্দুকুশ পর্বতমালার উত্তর ও দক্ষিণ, কুষাণ সাম্রাজ্যের উভয় অঞ্চলেই প্রচলিত ছিল। সােটের মেগাস মুদ্রার এই ব্যাপক প্রচলন সম্পর্কে অধ্যাপক মুখােপাধ্যায় নিজেই সুনিশ্চিত নন। হিন্দুকুশ পর্বতমালার উত্তরেও এই শ্রেণির মুদ্রা পাওয়া গেছে, এ কথা জোরের সঙ্গে বলা যাচ্ছে না। মুদ্রাগুলো প্রধানত পাওয়া গেছে মথুরা ও দক্ষিণ পূর্ব পাঞ্জাবে। মুদ্রাগুলো বিম কদফিসেসের উৎকীর্ণ হলে এগুলো কুষাণ সাম্রাজ্যের সর্বত্র। সমানভাবে পাওয়া যেত। কোনও অঞ্চলে একটি বা দুটি মুদ্রা পাওয়া গেলেই সে অঞ্চলে এই শ্রেণির মুদ্রা প্রচলিত ছিল, এ কথা প্রমাণিত হয় না। মুদ্রা অতি সহজে স্থান হতে স্থানান্তরে গমনাগমন করে। দ্বিতীয়ত, মুদ্রাগুলোতে পদবির উল্লেখ আছে, কিন্তু মুদ্রাকর্তার নাম নেই। মুদ্রাগুলো বিম উৎকীর্ণ করলে এই মুদ্রায় তার নাম খােদিত হত। তৃতীয়ত মুদ্রাগুলো সবই তামার। সােটের মেগাস পদবি উৎকীর্ণ কোনও রৌপ্য বা স্বর্ণ মুদ্রা আজও আবিষ্কৃত হয়নি। এরূপ ঘটনা ঘটলে এ ধরনের মুদ্রার সঙ্গে বিমের সংযােগের একটা সম্ভাবনা হয়তাে দেখা দিত। মুদ্রা থেকে কুজুল কর কদফিসেস নামে আরও একজন কুষাণ প্রশাসকের নাম জানা যায় (কুজুল কদফিসেস এবং কুজুল কর কদফিসেস এক ও অভিন্ন ব্যক্তি, এরূপ অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। (রতন্দ্রনাথ মুখাপাধ্যায়, তদেব, পৃষ্ঠা ৩৩)। যারা মনে করেন, এই দু’জন পৃথক ব্যক্তিত্ব তাদের মধ্যে আছেন আলেকজান্ডার কানিংহাম, পি, গার্ডনার ও ই. জে. র‍্যাপসন।) অনেকের মতে তিনি বিম কদফিসেসের অধীনস্থ প্রশাসকের পুত্র ছিলেন। এই শ্রেণির পণ্ডিতদের অভিমত, বিমের মৃত্যুর পর প্রথমে এক নামগােত্রহীন প্রশাসক এবং পরে শেষােক্ত প্রশাসকের পুত্র স্বাধীনভাবে কুষাণরাজ্য শাসন করেন।

দ্বিতীয় কদফিসেস শিবভক্ত ছিলেন। তার কিছু মুদ্রায় শিবের মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। কিছু কিছু মুদ্রায় তাকে মহীশ্বররূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মহীশ্বর-এর অর্থ মাহেশ্বর বা মহেশ্বরের ভক্ত। মুদ্রায় উৎকীর্ণ শব্দটি মহিশ্বর। এটি ভুল বানান। বিমের কতিপয় মুদ্রার অপ্রধান পৃষ্ঠে শিবমূর্তি উৎকীর্ণ আছে। তাই মনে হয়, মহিশ্বর শব্দের অর্থ মহেশ্বরের ভক্ত, মাহেশ্বর। এই অভিধায় শৈবধর্মের প্রতি বিমের অনুরাগ প্রকাশিত হয়েছে। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখেপাধ্যায় (তদেব, পৃষ্ঠা ৫৫) বলেন, মহিশ্বর (মহীশ্বর) শব্দের অর্থ মহি। অর্থাৎ পৃথিবীর পতিও হতে পারে। এ ব্যাখ্য ঠিক নয়। একটি খরােষ্ঠী অভিলেখে সদষ্কণ নামে কুজুল কদফিসেসের এক পুত্রের নাম উল্লিখিত হয়েছে। সদষ্কণ বিমের একটি নাম হতে পারে। বিমের এক ভাই সদষ্কণ, এরূপ সম্ভাবনাও উপেক্ষণীয় নয়। যাই হোক, পিতা সম্ভবত বৌদ্ধ ছিলেন আর পুত্র হলেন শৈব। 

বিম কদফিসেসের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ বেশ কিছু সােনা ও তামার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। মুদ্রাগুলো সে যুগের আর্থিক সংগতির পরিচয় বহন করে। বিমের রাজ্যের পশ্চিমে ছিল সুবিস্তীর্ণ রােমক সাম্রাজ্যের অবস্থান আর পূর্বদিকে ছিল চিনা জগৎ। সে সময় পূর্ব ও পশ্চিম দুনিয়ায় সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক লেনদেন চলছিল তাতে কুষাণরাজ্য মধ্যবর্তীর ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া কুষাণরাজ্য তথা ভারতের সঙ্গেও রােমের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অভিজাত রােমকরা ভারতীয় বিলাসসামগ্রীর ভক্ত ছিলেন, স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে রােমক বণিকরা ভারত থেকে বিলাসদ্রব্যাদি কিনতেন। যে রােমক স্বর্ণমুদ্রা ভারতে আমদানি হত সেগুলো গলিয়ে নিজেদের জন্য নতুন করে বিম কদফিসেস আর তার উত্তরাধিকারীরা স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করতেন। তখনকার দিনের বহিবাণিজ্যে রােমক স্বর্ণমুদ্রাগুলো মুদ্রারূপে ব্যবহৃত হত না, ব্যবহৃত হত বিনিময়ের মাধ্যস্বরূপ ধাতব পিণ্ড বা তালরূপে। সামরিক নৈপুণ্যের সঙ্গে আর্থিক সমৃদ্ধির সহযােগে কুষাণশক্তি এক দুর্বার, অপ্রতিরােধ্য শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে।

প্রথম কণিষ্ক (৭৮ – ১৪৪ খ্রি.)

দ্বিতীয় কদফিসেসের মৃত্যুর পর প্রথম কণিষ্ক কুষাণ রাজ্যের অধিপতি হন। দুঃখের বিষয়, পূর্ববর্তী রাজার সঙ্গে কণিষ্কের কী সম্পর্ক ছিল তা আজও জানা যায়নি। তিনি সম্ভবত বিমেরই অধীনস্থ এক কর্মচারী ছিলেন কিন্তু পরে প্রভুর মৃত্যুতে ক্ষমতালিপ্সু অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করে নিজের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায় (তদেব, পৃষ্ঠা ৬১) মথুরায় প্রাপ্ত দু’টি কুষাণ লেখের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত করেছেন, তথাকথিত কদফিসেস ও কণিষ্ক গােষ্ঠীর রাজারা একই পরিবারভুক্ত ছিলেন। অবশ্য লেখা দু’টিকে তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তা সকলের নিকট গ্রহণযােগ্য হবে, এমনটি নয়। তার অভিমত, একটি লেখে মথুরায় বিমের উদ্দেশ্যে একটি দেবকুল ও মূর্তি প্রতিষ্ঠার উল্লেখ আছে, অপর লেখে বলা হয়েছে সশ্লিষ্ট দেবকুলটি হুবিষ্কের পিতামহের। অধ্যাপক মুখােপাধ্যায়ের এই ব্যাখ্যায় প্রতীয়মান হয়, হুবিষ্ক বিম কদফিসেসের পৌত্র ছিলেন। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় সবিশেষ প্রণিধানযােগ্য। প্রথমত, প্রথমােক্ত মথুরা অভিলেখে বিমের নাম উল্লিখিত হয়েছে, এ কথা সুনিশ্চিতরূপে বলা যায় না। রাজার নামের আদ্যাক্ষর সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত, দ্বিতীয় অক্ষরটিও স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, প্রথম ও দ্বিতীয় লেখের দেবকুল এক ও অভিন্ন এ কথাও সুনিশ্চিত নয়। তৃতীয়ত, দ্বিতীয় মথুরা অভিলেখে হুবিষ্কের পিতামহকে ‘সত্যধর্মস্থিত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘সত্যধর্মস্থিত’ পদবি বিম গ্রহণ করেন বলে জানা যায় না। সত্যধর্ম বা সন্ধর্ম বলতে বৌদ্ধধর্ম বােঝায়। ধর্মমতে বিম মাহেশ্বর বৌদ্ধ নন। কখনও কখনও দাবি করা হয়, আফগানিস্তানের রবাতে প্রাপ্ত একটি লেখে কদফিসেস ও কণিষ্ক গােষ্ঠীর পারিবারিক অভিন্নতা নিঃসশয়ে প্রমাণিত হয়েছে। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখাপাধ্যায় নিজেই স্বীকার করেছেন, এই লেখের ভাষা ও লিপি এখনও অপঠিতই রয়ে গেছে (H. C Raychaudhuri. Political History of Ancient India : Commentary 81930)। মোট কথা কদফিসেস ও কণিষ্ক গোষ্ঠীর বংশগত সম্পর্ক সম্পর্কিত প্রশ্নের এখনও সন্তোষজনক মীমাংসা হয়নি। যাই হোক, সন্দেহ নেই, কুষাণ রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা প্রথম কণিষ্ক।। 

কণিষ্কের সময় : কণিষ্কের সিংহাসনে আরােহণের সময় সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন অভিমত প্রকাশ করেছেন । ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ বিষয়ে মতপার্থক্য এত বিস্তর যে অদূর ভবিষ্যতে কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফ্লিট মনে করেন কণিষ্ক প্রথম ও দ্বিতীয় কদফিসেসের পূর্ববর্তী। ৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে যে বিক্রমাব্দের সূচনা, ফ্লিটের মতে কণিষ্ক সেই বিক্রমাব্দের প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু কণিষ্ক যে কদফিসেসদের পূর্ববর্তী বা খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের মধ্যভাগে বর্তমান ছিলেন তার সমর্থনে কোনও বলিষ্ঠ প্রমাণ নেই। তথ্য বরঞ্চ বিপরীত সত্যই প্রকাশ করে।

  • কাপিশ-গান্ধার অঞ্চল যে প্রথম কণিষ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল লেখ, মুদ্রা ও শুয়েন চাঙের বিবরণে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের মাঝামাঝি সময় কাপিশ-গান্ধার অঞ্চল কুষাণগণের অধিকারভুক্ত ছিল না। তখন সেখানে য়িন সাে ফু নামে জনৈক রাজা রাজত্ব করতেন। চিনা সাহিত্যে এ তথ্য আছে।
  • দ্বিতীয়ত, চিনা গ্রন্থাদিতে কুজুল কদফিসেসকে প্রথম কুষাণরাজ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। চিনা গ্রন্থাদিতে আরও বলা হয়েছে যে বিম কদফিসেসই প্রথম কুষাণ নরপতি যিনি ভারতের কিয়দংশ জয় করেছিলেন। কণিষ্ক কুজল বা বিমের পূর্ববর্তী হলে চিনা সাহিত্যে কুষাণদের সম্পর্কে অন্যরূপ বিবরণ লিপিবদ্ধ থাকত।
  • তৃতীয়ত, প্রথম কদফিসেস কোনও স্বর্ণমুদ্রা প্রবর্তন করেননি। পক্ষান্তরে বিম কদফিসেস এবং কণিষ্ক প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছিলেন। কদফিসেস গােষ্ঠী কণিষ্কের পরবর্তী হলে প্রথম কদফিসেসের রাজত্বকালে এই স্বর্ণমুদ্রার অনুপস্থিতি ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
  • চতুর্থত, কদফিসেসদের মুদ্রার এক পিঠে রয়েছে গ্রিক অক্ষর ও গ্রিক তথা বাহিক ভাষার ব্যবহার, অন্যদিকে আছে খরােষ্ঠী লিপি ও প্রাকৃত ভাষার প্রয়ােগ। গ্রিক, শক ও পহ্লব রাজগণের মুদ্রায় মােটামুটি একই ধারা লক্ষ করা যায়। ফলে কদফিসেস গােষ্ঠীর মুদ্রাগুলোকে গ্রিক, শক ও পহ্লব মুদ্রার নিকটবর্তী বলে মনে হয়। কণিষ্কের মুদ্রায় কিন্তু এই ধারার অনুসরণ দেখা যায় না। যা দেখা যায় তা হল একটি ভাষা ও একটি লিপির প্রয়ােগ। যে ভাষা কণিষ্কের মুদ্রায় ব্যবহৃত হয়েছে তা বাহ্লিক ভাষা আর লিপি গ্রিক লিপি। ফলে কণিষ্কের মুদ্রাগুলোকে একটু পরবর্তিকালের বলেই মনে হয়।
  • পঞ্চমত, কণিষ্কের মুদ্রার অপ্রধান পিঠে নানা ধর্মের দেবদেবীর মূর্তি খােদিত আছে। প্রাক কণিষ্কযুগে বৈদেশিক রাজগণের মুদ্রায় এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। এসব ঘটনা প্রমাণ করে কণিষ্ক কদফিসেস গােষ্ঠীর পূর্ববর্তী নন, পরবর্তী।

মার্শাল, স্টেন কোনাে, স্মিথ, ঘার্শম্যান প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন ১২৫ বা ১৪৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কণিষ্কের রাজত্ব শুরু হয় আর ২য় শতকের শেষ পর্বে তার রাজত্বের অবসান হয়। এ মতও গ্রহণযােগ্য নয়।

  • প্রথমত, সুই বিহার লেখ থেকে জানা যায়, নিম্ন সিন্ধু অববাহিকা। কণিষ্কের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চল যে মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামার অধিকারভুক্ত ছিল তা মহাক্ষপের নিজস্ব জুনাগড় লেখ থেকে প্রমাণিত হয়। রুদ্রদাম ১৩০-১৫০ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করেন। তিনি একজন স্বাধীন, সার্বভৌম শাসক ছিলেন, কারাের আনুগত্য স্বীকার করেননি। ১২৫ বা ১৪৪ খ্রিস্টাব্দে কণিষ্কের রাজত্ব শুরু হলে প্রায় একই সময় কুষাণরাজ এবং রুদ্রদামা নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায় রাজত্ব করেছেন বলে সিদ্ধান্ত করতে হয়। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত বিভ্রান্তিকর।
  • দ্বিতীয়ত, কণিষ্ক, বাসিষ্ক, ভবিষ্ক ও বাসুদেবের লেখে যথাক্রমে ১-২৩, ২৪-২৮, ২৮-৬০ এবং ৬৭-৯৮ বর্ষের উল্লেখ আছে। অনুমান করা যায়, কণিষ্কের দেহাবসানের পরও তার উত্তর পুরুষেরা তার রাজ্যবর্ষ ব্যবহার করেন। কণিষ্কের রাজ্যবর্ষের ধারাবাহিক ব্যবহার হতেই একটি অব্দের জন্ম হয়। সে কারণে কণিষ্ক একটি অব্দের প্রতিষ্ঠাতা। খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দীতে উত্তর পশ্চিম ভারতে কোনও অব্দের প্রচলন হয়েছিল বলে জানা যায় না। 

রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন কণিষ্ক ত্রৈকূটক-কলচুরি-চেদি অব্দ প্রবর্তন করেন। ২৪৮ খ্রিস্টাব্দে এই অব্দের প্রচলন হয়। আর. জি. ভাণ্ডারকর বলেন, ২৪৮ নয়, ২৭৮ খ্রিস্টাব্দে কণিষ্কের রাজত্বকাল শুরু হয়েছিল। এ দুটি মতের কোনওটিই সমর্থনযােগ্য নয়। কেন সমর্থনযােগ নয় কেননা –

  • প্রথমত, বাসুদেব যে অন্তত ৯৮ কণিমার পর্যন্ত মথুরায় রাজত্ব করেন তার নিশ্চিত প্রমাণ আছে। ২৪৮ বা ২৭৮ খ্রিস্টাব্দে কণিষ্ক সিংহাসন আরােহণ করলে বাসুদেবকে ৩৪৬ বা ৩৭৬ খ্রিস্টাব্দেও মথুরার কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন বলে ভাবতে হয়। মথুরা নিঃসন্দেহে গুপ্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গুপ্তরা কিন্তু কুষাণগণের কাছ থেকে মথুরা জয় করেননি, মথুরা জয় করেছেন নাগ রাজাদের ক্ষমতাচ্যুত করে। অর্থাৎ কুষাণশাসনের অবসানের পর মথুরায় নাগপ্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরাণে সাতজন নাগরাজের উল্লেখ আছে। এতে নাগশাসনের দীর্ঘস্থায়িত্বই প্রমাণিত হয়। সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালেই মথুরায় প্রথম গুপ্ত আধিপত্য স্থাপিত হয়। ৩৪৬ বা ৩৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মথুরায় কুষাণশাসন অব্যাহত থাকলে সমুদ্রগুপ্তের মথুরা অধিকারের পূর্বে সেখানে সুদীর্ঘ নাগশাসনের অবকাশ থাকে না। এই যুক্তি পরিপ্রেক্ষিতে কণিষ্ক ২৪৮ বা ২৭৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরােহণ করেছিলেন বলে ভাবার কোনও কারণ থাকে না।
  • দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শেষাশেষি অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও কুষাণরাজ্যে পারস্যের সাসানীয় রাজবংশের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত গ্রহণ করলে ওই সময় হুবিষ্কের কুষাণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা। হুবিষ্ক কখনও সাসানীয় রাজাদের আনুগত্য স্বীকার করেননি। বাসুদেবের মৃত্যুর পর কুষাণ রাজ্যে রাজনৈতিক দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে। কিন্তু তার পূর্বে নয়। অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শেষপর্বে হুবিষ্কের মতাে কোনও পরাক্রমশালী কুষাণ নন, দুর্বল, পরবর্তী কুষাণদেরই একজন রাজত্ব করছিলেন।
  • তৃতীয়ত, চিনা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এ্যানসিকাও নামে একজন পণ্ডিত ‘মার্গভূমিপুত্র’ গ্রন্থখানির চিনা অনুবাদ প্রকাশ করেন। কণিষ্কের পুরােহিত সংঘরক্ষ মূল গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন। ১৭০ খ্রিস্টাব্দের অনেক পূর্বে যে কণিষ্ক সিংহাসনে আরােহণ করেছিলেন এ ঘটনায় সে সত্যই স্পষ্ট হয়।

ফার্গুসন, ওল্ডেনবার্গ, টমাস, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, দীনেশচন্দ্র সরকার এবং ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়ের মতাে ঐতিহাসিকরা কণিষ্কের সিংহাসনে আরােহণ ৭৮ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করেছেন। লেখমালায় কণিষ্কের রাজ্যবর্ষের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। কণিষ্কের রাজ্যবর্ষ যে তার উত্তরাধিকারীরা ব্যবহার করেছিলেন তারও প্রমাণ আছে। কুষাণ রাজারা ছাড়া তাদের অধীনস্থ বা স্বাধীন ক্ষত্রপ শাসকরাও কণিষ্করাজ্যব বা অব্দ ব্যবহার করেন। বেশির ভাগ ক্ষত্রপরা শক গােষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে শকরা এই রাজ্যবর্ষ বা অব্দ ব্যবহার করায় এই অব্দের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই তাদের নাম জড়িত হয়ে পড়ে। খ্রিস্টীয় ৫ম শতক থেকেই এই অব্দটি শককাল বা শকনৃপকাল নামে অভিহিত হতে থাকে। কণিষ্কের রাজ্যবর্ষ দীর্ঘকাল প্রচলিত থাকায় তাকে অবশ্যই একটি অব্দের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়। অথচ খ্রিস্টীয় ১ম-২য় শতকে এক শক ছাড়া অন্য কোনও অব্দের প্রবর্তনের কথা জানা যায় না। ফলে কণিষ্কের সিংহাসনে আরােহণের সঙ্গে সঙ্গে শকাব্দের শুরু, একথা ভাবতে অসুবিধা হয় না। 

৭৮ খ্রিস্টাব্দে কণিষ্কের রাজত্ব শুরু হয়েছিল এ মত অবশ্য এখনও অনেকেই স্বীকার করেন। না। তারা বলেন কুজুল কদফিসেস ৬৫ খ্রিস্টাব্দেও রাজপদে আসীন ছিলেন। কণিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাপে রাজত্ব করলে কুজুলপুত্র বিম কদফিসেসের শাসনকালের জন্য মাত্র ১৩ বছর অবশিষ্ট থাকে। বিমের রাজত্বের পক্ষে এ সময় খুবই কম। এ যুক্তি কিন্তু অকাট্য নয়। প্রথম কদফিসেস যখন মারা যান তখন তার বয়স আশির কোঠায় । সিংহাসনে আরােহণের সময় বিম কদফিসেসও প্রায় বৃদ্ধ। প্রায় বৃদ্ধ পুত্রের পক্ষে ১৩ বছরের রাজত্বকাল খুব একটা কম সময় নয়।

তাদের দ্বিতীয় যুক্তি হল, ৭৯ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ মহারাজ রাজাধিরাজ দেবপুত্র কুষাণের একখানি লেখ তক্ষশিলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এই দেবপুত্র নিঃসন্দেহে কুজুল কদফিসেস। কিন্তু এই যুক্তিও তেমন জোরালাে নয়। কুজুল যে তক্ষশিলায় রাজত্ব করতেন তার কোনও প্রমাণ নেই। কণিষ্কের পূর্বে কোনও রাজা দেবপুত্ৰ উপাধি ধারণ করেছিলেন বলে জানা যায় না। ফলে তক্ষশিলার লেখটি যে কণিষ্কের নয়, তা জোর করে বলা যায় না।

৭৮ খ্রিস্টাব্দে কণিষ্কের রাজত্ব শুরু হয়েছিল এই মতের বিরুদ্ধে আরও যুক্তি দেয়া হয়েছে। এরূপ একটি যুক্তি হল, কয়েকখানি চিনা ও তিব্বতি গ্রন্থে কণিষ্ককে ২য় শতকের রাজা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া চিনা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, পাে তিয়াও নামে এক ইউ চি রাজা ২৩০ খ্রিস্টাব্দে চিন দেশে দূত পাঠিয়েছিলেন। এই পাে তিয়াও হলেন প্রথম বাসুদেব। কণিষ্কের সিংহাসনে আরােহণের একশাে বছরের মধ্যেই বাসুদেবের রাজত্ব শেষ হয়ে যায়। এই ধারণা সঠিক হলে কণিষ্ক খ্রিস্টীয় ২য় শতকের প্রথমার্ধে রাজত্ব আরম্ভ করেছিলেন বলে সিদ্ধান্ত করতে হয়। কিন্তু এসব যুক্তির বিরুদ্ধেও পাল্টা যুক্তি আছে। খ্রিস্টীয় ২য় শতকে একজন কণিষ্ক ছিলেন এই মত স্বীকার করলেও ৭৮ খ্রিস্টাব্দেও কণিষ্কের ঐতিহাসিকতা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় না। ৪১ কণিষ্কাব্দে উৎকীর্ণ আরা লেখের কণিষ্কই সম্ভবত এই ২য় শতাব্দীর কণিষ্ক। এই কণিষ্ক বাসিষ্কের পুত্র। দ্বিতীয়ত, পাে তিয়াও যে প্রথম বাসুদেব তা সুনিশ্চিত নয়। মুদ্রা হতে একাধিক বাসুদেবের কথা জানা যায়। এরূপ একজন বসু বা বাসুদেব সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের দ্বিতীয় পাদে বর্তমান ছিলেন।

৭৮ খ্রিস্টাব্দে কণিষ্ক সিংহাসনে আরােহণ করেন বা তিনি শকাব্দ প্রতিষ্ঠা করেন, এ মতের সমর্থনে যেমন কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই তেমনি এ মতকে খণ্ডন করার মতাে কোনও সঠিক তথ্যও নেই। তবে কণিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব আরম্ভ করেন এ মতই আপাতত গ্রহণীয়। তার লেখমালায় ২৩তম রাজ্যবর্ষের উল্লেখ আছে। সুতরাং কণিষ্ক ১০১ বা ১০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন বলে আপাতত মনে করা যায়।

রাজ্যের বিস্তার : বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন কণিষ্ক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের নানা স্থানে কণিষ্কের উৎকীর্ণ লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দু’টি কথা মনে রাখা দরকার : প্রথমত, তার রাজত্বের প্রথম পর্বের লেখগুলো উত্তরপ্রদেশে পাওয়া গেছে। হয়তাে এই অঞ্চলেই তিনি সর্বপ্রথম রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, সারনাথের পূর্বদিকে কণিষ্কের কোনও লেখ পাওয়া যায়নি। এর থেকে অনেকে অনুমান করেন, সারনাথের পূর্বদিকে তিনি তার রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেননি। এ মত সম্ভবত ঠিক নয়। চিনা ও তিব্বতি গ্রন্থাদিতে কণিষ্কের সাকেত বা অযােধ্যা ও পাটলিপুত্রে সামরিক অভিযানের উল্লেখ আছে। শােনা যায়, পাটলিপুত্র হতে তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক অশ্বঘােষকে বন্দি করে নিয়ে যান। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় কণিষ্ক ও তার উত্তরাধিকারীদের প্রচুর মুদ্রা পাওয়া গেছে। মূল কুষাণমুদ্রা ছাড়াও কুষাণমুদ্রার অনুকরণে নির্মিত পুরী-কুষাণ নামে পরিচিতি এক ধরনের মুদ্রা পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে ওড়িশায় বিপুল সংখ্যায় পাওয়া গেছে। অনেকের ধারণা শুধু বিহার নয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশাও কণিষ্কের রাজ্যের অন্তত ছিল। বিহার যে কুষাণরাজ্যভুক্ত ছিল সে সম্পর্কে বােধ হয় কোনও সন্দেহ নেই। কণিষ্কের একখানি লেখে অন্তত সে ইঙ্গিতই আছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশায় কণিষ্কের রাজ্যবিজ্ঞান সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ পােষণ করেন। কণিষ্কের উত্তরাধিকারী বাসিষ্কের লেখ মধ্যপ্রদেশের সাঁচীতে পাওয়া গেছে। পশ্চিম ভারতের ক্ষহরাত শাসকরা কণিষ্কের অনুগত ছিলেন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরাঞ্চল, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড ও বিহার তাে ছিলই। উপরন্তু রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাতও কণিষ্কের রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।

আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ ভূভাগ যে কণিষ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল তার প্রমাণ আছে। চিনা গ্রন্থে কণিষ্ককে খােটান ও খােরাসানের রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুয়েন চাঙের বর্ণনায় প্রকাশ, কণিষ্কের রাজ্যের উত্তর সীমানা সুঙ্‌ লিঙ্ পর্বতমালা স্পর্শ করেছিল। চিনের হােয়াং হাে নদীর পশ্চিমেও যে তিনি তার অধিকার বিস্তৃত করেন সে কথার উল্লেখ করেছেন চিনা পরিব্রাজক। এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃত ভাষায় লেখা এবং খরােষ্ঠী লিপিতে উৎকীর্ণ কুষাণযুগের লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে।

প্রশাসনিক বিভাগ : প্রশাসন-কার্যের সুবিধার জন্য কণিষ্ক তার রাজ্যটিকে কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত করেন। তিনি এক একটি বিভাগের শাসনকার্য কখনও একজন, কখনওবা দু’জন প্রশাসকের স্কন্ধে ন্যস্ত করেন। এই প্রশাসকেরা মহাক্ষত্রপ এবং ক্ষত্ৰপ নামে পরিচিত ছিলেন। লিঅক এবং বেস্পসি নামে উত্তর-পশ্চিম ভারতে কণিষ্কের অধীনস্থ দু’জন ক্ষত্রপের নাম জানা যায়। বারাণসী-মথুরা অঞ্চলের শাসনকার্য মহাক্ষত্রপ খরপল্লান এবং ক্ষত্ৰপ বনস্ফর যৌথভাবে পরিচালনা করতেন। বনস্ফর সম্ভবত খরপল্লান-এর পুত্র ছিলেন।

চিন-অভিযান : কণিষ্কের রাজত্বের শেষের দিকে এক গভীর রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। অবশ্য তারই অদূরদর্শিতার পরিণামে এই সংকট ঘনিয়ে আসে। এসময় চিন দেশে সম্রাট হাে তি (৮৯-১০৫ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্ব করেন। হাে তির রাজত্বকালে চিনের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত চিনের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কণিষ্ক চিনা রাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। হাে তির সেনাপতি প্যান চ্যাও এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কণিষ্ক চিনা সম্রাটের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। এই অভিযানে ৭০ হাজার অশ্বারােহী সৈন্য অংশগ্রহণ করেন। চিনে যাবার পথে কণিষ্কের বহু সৈন্য প্রাণ হারান। পরিশ্রান্ত ও হতােদ্যম কুষাণ বাহিনীকে প্যান চ্যাও সহজেই পরাস্ত করেন। কণিষ্ক সম্পর্কে এক প্রাচীন কাহিনির উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ সিলভা লেভি। মৃত্যু শয্যায় কণিষ্ক আক্ষেপ করে তার অনুচরদের বলেছিলেন, সব লােক আমার বশ্যতা স্বীকার করেছেন কিন্তু উত্তরের লােকেরা করেননি। কণিষ্কের ব্যর্থ চিন-অভিযানের পরােক্ষ সমর্থন আছে এ কাহিনিতে।

রাজধানী ও অন্যান্য শহর : পুরুষপুর বা বর্তমান পেশােয়ার কণিষ্কের রাজধানী ছিল। কাশ্মীরে কণিপুর নামে এক নতুন শহরের পত্তন হয়। কণিষ্কপুরের সঠিক অবস্থান অজ্ঞাত। অনেকের মতে এ শহরটি শ্রীনগরের সন্নিকটে অবস্থিত ছিল।

বৌদ্ধধর্ম : দিগ্বিজয় নয়, বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতার জন্যই কণিষ্ক ভারতের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তার ইঙ্গিত আছে তার উকাণ লেখে, আর মুদ্রায়। সম্ভবত রাজত্বের প্রারম্ভে বা তার কিছু পূর্বে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। রাজধানী পেশােয়ারে সু-উচ্চ মিনার এবং সংঘারাম নির্মাণ করে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি তার অনুরাগ প্রকাশ করেন। বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির এক বড় কেন্দ্র ছিল এই কণিষ্ক মহাবিহার। শুয়েন চাঙ এবং আল বেরুনি তাদের ভ্রমণবৃত্তান্তে কণিষ্ক মহাবিহারের সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন। পালরাজ দেবপালের সময়ের একখানি লেখেও বৌদ্ধসংস্কৃতির পীঠস্থানরূপে কণিষ্ক মহা বিহারের উল্লেখ আছে। কথিত আছে, পার্শ্ব বা পার্ষিকের পরামর্শে তিনি এক বৌদ্ধ সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলন কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে সম্পর্কে অবশ্য মতবিরােধ আছে। কেউ কেউ কাশ্মীরের অনুকূলে মত প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকে এ প্রসঙ্গে গান্ধার এবং জলন্ধরের কথাও উল্লেখ করে থাকেন। বৌদ্ধদের মধ্যে মতবিরােধ ও দলাদলি দূর করার উদ্দেশ্যেই এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্ভবত কুন্দলবনবিহারে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বসুমিত্র সম্মেলনে পৌরােহিত্য করেন। সহ-সভাপতির আসন গ্রহণ করেন সেযুগের আর একজন খ্যাতনামা পণ্ডিত অশ্বঘােষ। 

অন্যান্য ধর্ম : বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি কণিষ্ক শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার মুদ্রায় যেমন শাক্যমুনি বুদ্ধের মূর্তি উত্তীর্ণ আছে তেমনি গ্রিক, পারসিক, সুমেরীয় ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তিও খােদিত আছে। ধর্ম সম্পর্কে কণিষ্কের সহিষ্ণু, উদার মনােভাবই মুদ্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। তবে কণিষ্কের মুদ্রায় উৎকীর্ণ বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তির অনেকে অন্য ব্যাখ্যাও করেছেন। তারা মনে করেন, সুবিশাল কুষাণ সাম্রাজ্যের ধর্মীয় বৈচিত্র্যই মুদ্রায় অভিব্যক্ত হয়েছে, কুষাণরাজের ব্যক্তিগত ভাবনার প্রতিফলন সেখানে নেই। 

বিদ্যোৎসাহী রাজা : বিদ্যোৎসাহী রাজারূপেও কণিষ্কের খ্যাতি ছিল। অশ্বঘােষ, পার্শ্ব এবং বসুমিত্রের মতাে বৌদ্ধ দার্শনিকদের তিনি পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। কথিত আছে, মহাযান মতের প্রবক্তা নাগার্জুন তার অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। সুপণ্ডিত সংঘরক্ষ তার অনুগ্রহভাজন ছিলেন। আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে সুপণ্ডিত চরক তার রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে। পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ মাঠর সম্ভবত কণিষ্কের একজন মন্ত্রী ছিলেন। সমকালীন লেখে এগেসিলাস নামে জনৈক গ্রিক যন্ত্রবিদের উল্লেখ আছে। এসব জ্ঞানিগুণিজনেরা সবাই যে প্রথম কণিষ্কের সমসাময়িক ছিলেন সেকথা জোরের সঙ্গে বলা যায় না। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তাে পরবর্তী কণিষ্কদের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিলেন।

সহযােগী প্রশাসক নিযুক্তি : অনেকের অভিমত রাজত্বের শেষ পর্বে কণিষ্ক শাসনকার্যের সুবিধার জন্য নিজের ভ্রাতা বা পুত্র বাসিষ্ককে সহযােগী প্রশাসক নিযুক্ত করেন। সকলে অবশ্য এ মত স্বীকার করেন না।

বাসিষ্ক, হুবিষ্ক, দ্বিতীয় কণিষ্ক, প্রথম বাসুদেব ও বাসুদেবোত্তর পর্ব

বাসিষ্ক (১০২-১০৬ খ্রিস্টাব্দ) : কুষাণবংশের পরবর্তী রাজা বাসিষ্ক। তার ২৪ এবং ২৮ কণিষ্ক রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ লেখ মথুরা ও ভূপালে আবিষ্কৃত হয়েছে। কল্‌হণের রাজতরঙ্গিণীতে জুষ্ক নামে এক তুর্কি নরপতির উল্লেখ আছে। তিনি কাশ্মীরে জয়স্বামিপুর ও জুপুর নামে দুটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন এবং বহু বৌদ্ধ মঠ ও চৈত্য নির্মাণ করেন। শ্রীনগরের উত্তরে বর্তমান জুকুর প্রাচীন জুপুর। পণ্ডিতদের বিশ্বাস জুষ্ক, বাসিষ্ক এবং ৪১ কণিষ্করাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ আরা লেখে উল্লিখিত কণিষ্কের পিতা বাঝেষ্ক একই ব্যক্তি। বাসিষ্কের কোনও মুদ্রা পাওয়া যায়নি। মনে হয় তিনি খুব অল্পদিন রাজত্ব করেছিলেন। বাসিষ্ক তার ভাই বা পুত্র হুবিষ্ককে রাজ্যের সহযােগী প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। 

হুবিষ্ক (১০৬-১৪৭) : বাসিষ্কের মৃত্যুতে হুবিষ্ক কুষাণরাজ্যের মুখ্য প্রশাসক হলেন। লেখগুলো ২৮-৬৯ কণিষ্ক রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ। কাবুলের নিকটবর্তী এক স্থানে তার একখানি লেখ পাওয়া গেছে। আফগানিস্তান নিঃসন্দেহে হুবিষ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল। মনে হয়, প্রথম দিকে দ্বিতীয় কণিষ্ক এবং পরে বাসুদেব হুবিষ্কের সহযােগী প্রশাসক ছিলেন। তিনি সম্ভবত রাজতরঙ্গিণীতে হুষ্ক নামে অভিহিত হয়েছেন। কাশ্মীরে হুষ্কপুর শহরের প্রতিষ্ঠা তার এক স্মরণীয় কীতি। মথুরা লেখ থেকে হুবিষ্কের পিতামহের কথা জানা যায়। সত্যধর্মস্থিত বলে তাকে বর্ণনা করা হয়েছে। মুদ্রায় প্রথম কদফিসেস নিজের সম্পর্কে একই বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। এর থেকে অনেকে সিদ্ধান্ত করেছেন হুবিষ্ক প্রথম কদফিসেসের পৌত্র ছিলেন। তবে এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে।

হুবিষ্ক বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। তিনি সম্ভবত মথুরায় একটি বিহার নির্মাণ করেন। অবশ্য এক সিলমােহর-ছাঁচে তাকে বিষ্ণুভক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। একখানি লেখ থেকে জানা যায় মধ্য এশিয়ার জনৈক ব্যক্তি হুবিষ্কের পুণ্যবৃদ্ধিকল্পে মথুরায় এক পুণ্যশালা বা দাতব্য ভােজনালয়কে ১১০০টি রৌপ্যমুদ্রা দান করেন। মধ্য এশিয়ায় হুবিষ্কের রাজ্যবিস্তৃতির প্রমাণরূপে এই লেখখানির বিশেষ গুরুত্ব আছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মনে করেন, হুবিষ্কের শাসনকালে রুদ্রদামা নিম্ন সিন্ধু অববাহিকায় স্বাধীন ক্ষত্ৰপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।  কণিষ্কের মতাে হুবিষ্কের মুদ্রায় বিভিন্ন ধর্মীয় দেবদেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। সম্ভবত তার ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় মুদ্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। 

দ্বিতীয় কণিষ্ক (১১৯ খ্রিস্টাব্দ) : ৪১ রাজ্যবর্ষে বা ১১৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তীর্ণ আরা লেখে কণিষ্ক নামে জনৈক কুষাণ রাজার কথা বলা হয়েছে। এই লেখে তাকে মহারাজ, রাজাতিরাজ, দেবপুত্র এবং সম্ভবত কৈসর বা সিজার বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া তাকে বাঝেষ্কপুত্র বলেও আখ্যাত করা হয়েছে। কোনও কোনও পণ্ডিত প্রথম কণিষ্ক ও আরা লেখের কণিষ্ককে এক ও অভিন্ন বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিকই তারা ভিন্ন বলে মন্তব্য করেছেন। অনেকের মতে দ্বিতীয় কণিষ্কই কাশ্মীরে কণিষ্কপুর নগর প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রথম বাসুদেব (১৪৫-১৭৬ খ্রিস্টাব্দ) : কণিষ্ক পরিবারের সর্বশেষ উল্লেখযােগ্য নরপতি হলেন প্রথম বাসুদেব। তার আমলের লেখগুলো ৬৭-৯৮ রাজ্যবর্ষে বা ১৪৫-১৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উৎকীর্ণ হয়েছিল। তার বেশির ভাগ মুদ্রায় দেবতা শিব এবং তার বাহন নন্দীর মূর্তি খােদিত আছে। মনে হয় বিষ্ণুর এক নাম ধারণ করলেও বাসুদেব ধর্মমতে শৈব ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, তার সব লেখই মথুরা অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তার লেখ আবিষ্কৃত হওয়ায় মনে হতে পারে সেসব অঞ্চল বাসুদেবের হস্তচ্যুত হয়। কিন্তু পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল এবং আফগানিস্তানও তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের ২য় দশক পর্যন্ত যে এসব অঞ্চলে কুষাণ রাজারা রাজত্ব করতেন তার প্রমাণ আছে।

বাসুদেবােত্তর পর্ব : বাসুদেবের মৃত্যুতে কুষাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। পশ্চিম ও মধ্য ভারতের শক ক্ষত্রপরা প্রথম কণিষ্কের অধীনস্থ ছিলেন কিন্তু ধীরে ধীরে তারা কার্যত স্বাধীন হয়ে বসেন। উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানের নানা স্থানে যৌধেয়, আর্জুনায়ন প্রভৃতি স্বাধীন গণরাজ্য গড়ে ওঠে। মথুরায় নাগশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ ভারতীয় অঞ্চলে কুষাণশাসন বিলুপ্ত হলেও পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আফগানিস্তানে আরও কিছুকাল কষাণপ্রভুত্ব অক্ষুন্ন থাকে। 

মুদ্রা থেকে এই পর্বের কয়েকজন কুষাণ রাজার কথা জানা যায়। তাদের একজন তৃতীয় কণিষ্ক, অন্যজন বসু বা দ্বিতীয় বাসুদেব। চিনা সাহিত্যে পাে তিয়াও নামে এক ইউ চি রাজার কথা বলা হয়েছে। তিনি ২৩০ খ্রিস্টাব্দে চিনা সম্রাটের দরবারে দূত পাঠিয়েছিলেন। মনে হয় পো তিয়াও এবং দ্বিতীয় বাসুদেব অভিন্ন ব্যক্তি। কণিষ্কপরিবারে কণিষ্ক ও বাসুদেব নামে একাধিক রাজা ছিলেন এমন ভাবা অংগত নয়।

উত্তর-পশ্চিম ভারত ও আফগানিস্তানে কুষাণরা বেশিদিন শান্তিতে রাজত্ব করতে পারেননি। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের প্রথম ভাগে পারস্যে সাসানীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথম সাসানীয়রাজ অর্দশীর ববগন (২২৬-২৪১ খ্রিস্টাব্দ) পূর্বদিকে বিজয়াভিযানে পাঞ্জাব পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন বলে মধ্যযুগের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ফিরিস্তা দাবি করেছেন। ফিরিস্তার এই দাবি হয়তাে অতিরঞ্জিত। কিন্তু তার বংশধর দ্বিতীয় বরহ্রান (২৭৬-২৯৩ খ্রিস্টাব্দ) যে কুষাণরাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জয় করেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের প্রথম ভাগেও যে সাসানীয় রাজারা উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রেখেছিলেন তা দ্বিতীয় শাপুরের (৩১০ ৩৭৯ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে উৎকীর্ণ পার্সেপােলিস লেখ থেকে জানা যায়। কিন্তু কুষাণরা বিপদাপন্ন ও হতমান হলেও তাদের উচ্ছেদ করা যায়নি। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশক্তিতে সমকালীন কুষাণনৃপতিকে “দৈবপুত্র-মাহি-ষাহানুযাহি” বলে আখ্যাত করা হয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের মধ্যভাগেও কুষাণ রাজাদের উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। সম্ভবত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে কুষাণরাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

প্রশাসনিক ব্যবস্থা

রাজার অভিধা : কুষাণ রাজারা বিদেশি ছিলেন। কিন্তু ভারতীয় প্রজারা যাতে তাদের সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারেন সেদিকে তাদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। এর জন্য একদিকে যেমন তারা এ দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছেন অন্যদিকে তেমনি গালভরা অভিধা ধারণ করে ভারতীয় প্রজাদের মনে সম্ভ্রম জাগাতে চেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বিম কদফিসেস এবং বাঝেষ্কপুত্র কণিষ্কের অভিধার উল্লেখ করা যায়। প্রথমােক্তজন মহারাজ, রাজাধিরাজ, দেবপুত্র, কুষাণপুত্র, ষাহি ও তম অভিধা গ্রহণ করেছিলেন, দ্বিতীয়জনের উপাধি ছিল মহারাজ, রাজাতিরাজ, দেবপুত্র ও কৈসর। তারা যেমন রাজাধিরাজ অভিধা পারসিক রাজাদের অনুকরণে গ্রহণ করেছিলেন তেমনি চিনা ও রােমক সম্রাটদের প্রথা অনুসরণ করে যথাক্রমে দেবপুত্র ও কৈসর অভিধা ধারণ করেছেন।

দেবত্ব আরোপ : কুষাণ রাজারা নিজেদের দেবপুত্র বলে পরিচয় দিয়েছেন। বাসিষ্ক তাে তার এক লেখে নিজেকে দেবমানব বলে উল্লেখই করেছেন। রােমক সম্রাটদের অনুকরণে কুষাণ রাজারা তাদের পূর্বপুরুষদের মূর্তি সংরক্ষণ করতেন। যে গৃহে বা মন্দিরে এসব মূর্তি সংরক্ষিত হত সমকালীন লেখে তাকে দেবকুল বলা হয়েছে। হুবিষ্ক তার পিতামহের আমলে তৈরি এরূপ একটি দেবকুল জীর্ণ হয়ে পড়লে সেটির সংস্কার করেন। এর থেকে প্রমাণ হয় কুষাণরা রাজার দেবত্ব প্রতিপন্ন করতে কতখানি সচেষ্ট ছিলেন। কিছু কিছু কুষাণ মুদ্রায় রাজার প্রতিকৃতির সঙ্গে মেঘ, জ্যোতির্বলয় ও অগ্নিশিখার উপস্থাপনা দেখা যায়। রাজা অন্য পাঁচজন মানুষের মতাে নন, তিনি দেবতারই অংশ, এ ধারণাই এখানে উচ্চারিত। আসলে রাজার উপর দেবত্ব আরােপ করে কুষাণরা ভারতে নিজেদের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। উল্লেখ্য, এযুগের রচনা মনুসংহিতাতেও রাজার মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে। মনু বলেন, ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, চন্দ্র, বরুণ ও কুবের এই অষ্ট দেবতার অঙ্গ নিয়ে রাজার দেহ গঠিত। বালক হলেও রাজা শ্রদ্ধার পাত্র। ‘বালােইপি নাবমন্তব্যো মনুষ্য ইতি ভূমিপঃ’। রাজা মহান দেবতা, তার ধরায় মানুষ্যরূপে অবস্থান। ‘মহতী দেবতা হ্যে নররূপেণ তিষ্ঠতি’। অপরাধীর প্রতি দণ্ডবিধানে রাজাকে তৎপর হতে বলা হয়েছে। আর বলা হয়েছে দণ্ড প্রজাদের বশে রাখে, তাদের পালন করে। দণ্ডই ধর্মের মূল। ‘দণ্ডং ধর্ম’।

সহযোগী প্রশাসক :  শাসনকার্যের সুবিধার জন্য কুষাণ রাজারা প্রায়ই সহযােগী বা যুগ্ম প্রশাসক নিযুক্ত করতেন। কণিষ্ক সম্ভবত বাসিষ্ককে, বাসিষ্ক হুবিষ্ককে এবং হুবিষ্ক সম্ভবত প্রথমে দ্বিতীয় কণিষ্ককে ও পরে বাসুদেবকে সহযােগী প্রশাসক নিযুক্ত করেন। কিন্তু যারা সহযােগী প্রশাসক নিযুক্ত হতেন তারা রাজার ভাই, না পুত্র, তা সঠিক জানা যায় না।

সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক অঞ্চল, মহাক্ষত্রপ ও ক্ষত্রপ : প্রশাসনের সুবিধার জন্য কুষাণ সাম্রাজ্য কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। কখনও কখনও অঞ্চলের শাসনভার মহাক্ষত্ৰপ এবং ক্ষত্রপ উপাধিধারী দু’জন প্রশাসকের উপর ন্যস্ত হত, আবার কখনওবা কোনও এক ক্ষত্রপ পদাধিকারীকে অঞ্চল শাসনের ভার দেয়া হত। প্রথম কণিষ্কের রাজত্বকালে মহাক্ষত্ৰপ খরপল্লান ও ক্ষত্রপ বনস্ফর একযােগে বারাণসী অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। বনস্ফর সম্ভবত খরপল্লানের পুত্র ছিলেন। কণিষ্কের রাজত্বের প্রথম দিকে লিঅক ও পরের দিকে বেস্পসি গান্ধার অঞ্চলের ক্ষত্ৰপ ছিলেন। হুবিষ্কের শাসন কালে নহপান পশ্চিম ভারতের ক্ষত্রপ ছিলেন। কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্যান্য মহাক্ষত্রপ-ক্ষত্রপদের তুলনায় নহপান অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন। নহপান স্বনামে মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। এ অধিকার সাধারণত ক্ষত্রপদের ছিল না। মুদ্রায় তাকে রাজা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ক্ষত্রপ হলেও নহপান যে কার্যত স্বাধীন ছিলেন তা অসংকোচে বলা যায়।

দণ্ডনায়ক পদ : প্রথম কণিষ্কের অষ্টাদশ রাজ্যবর্ষে উৎকীর্ণ মানিকিয়ালা লেখে লল নামে একজন দণ্ডনায়কের উল্লেখ আছে। দণ্ড কথাটি সৈন্যবাহিনী, শাক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। সে কারণে দণ্ডনায়ক পদটি হয়তাে এখানে সেনাপতি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার পদস্থ পুলিস কর্মচারী বা বিচারপতি অর্থেও দণ্ডনায়ক পদের ব্যবহার হতে পারে। লক্ষ করবার বিষয়, মহাক্ষত্রপ, ক্ষত্ৰপ এবং দণ্ডনায়ক পদাধিকারীরা সকলেই বিদেশি ছিলেন। অর্থাৎ, উঁচু প্রশাসনিক বা সামরিক পদে ভারতীয়দের সহসা নিয়ােগ করা হত না। 

সচিব বা মন্ত্রী : কুষাণ লেখমালায় কোনও সচিব বা মন্ত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু মনু শাসনকার্যে রাজার সহায়করূপে সাত বা আটজন সচিব বা মন্ত্রীর কথা বলেছেন। তিনি ব্রাহ্মণদের মধ্য থেকেই একজনকে মুখ্যসচিব বা মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগের কথা বলেছেন। কিন্তু কুষাণদের আমলে যে এরকমটি হত তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এক একজন মন্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে পৃথকভাবে ও পরে সকলের সঙ্গে একযােগে রাজাকে পরামর্শ গ্রহণের উপদেশ দিয়েছেন মনু।

গ্রামিক ও অন্যান্য : কুষাণ লেখে গ্রামিকের উল্লেখ আছে। গ্রামের মুখ্য প্রশাসকরূপে গ্রামিকের উল্লেখ করেছেন মনু। মনু বলেছেন রাজাই গ্রামিককে নিয়ােগ করেন। গ্রামিকের পদ পুরুষানুক্রমিক ছিল বলে মনে হয়। মনুসংহিতার সাক্ষ্য হতে মনে হয় গ্রামিক সরকারি কোষাগার থেকে বেতন পেতেন। গ্রামের রাজস্বের একটি অংশ ভােগ করতেন। গ্রামিক ছাড়া দশগ্রামপতি, বিংশতীশ, শতেশ, সহস্রপতি ইত্যাদি রাজপুরুষদের উল্লেখ করেছেন মনু। দশজন গ্রামিকের উপরে ছিলেন একজন দশগ্রামগতি। বিংশতীশের দায়িত্বে থাকত ১০টি গ্রাম, পাঁচজন বিংশতীশের উপরে ছিলেন একজন শতেশ, আর দশজন শতেশের পরিচালক ছিলেন একজন সহস্রপতি। এদের কাউকেই সরকার থেকে সরাসরি বেতন দেয়া হতো না। শতেশ ও সহস্রপতি যথাক্রমে একটি গ্রাম ও একটি নগরের রাজস্ব ভােগ করতেন। 

দুনীতিপরায়ণ কর্মচারী : মনু ঘুষখাের রাজপুরুষদের উল্লেখ করেছেন। এসব অসাধু, দুনীতিপরায়ণ কর্মচারীদের সর্বস্ব অধিগ্রহণ করে তাদের দেশ হতে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অসুস্থ হলে রাজা রাজ্যভার সুযােগ্য অমাত্যবর্গের হাতে ছেড়ে দেবেন, এই মনুর বিধান। লক্ষণীয়, এক্ষেত্রে তিনি রাজার ভাই বা পুত্রদের কথা বলেননি। 

সমাজ-জীবন

সে যুগের সমাজজীবনের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে সেযুগের লেখা দু’খানি গ্রন্থে – মনুসংহিতায় ও অঙ্গবিজ্জায়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারবর্ণ ও অনেক সংকর জাতির উল্লেখ আছে গ্রন্থ দু’খানিতে।

ব্রাহ্মণ : মনুসংহিতায় ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব উচ্চারিত। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মালেই ব্রাহ্মণত্ব বজায় থাকে না, বেদপাঠ, সততা ও স্ব-ধর্মের অনুশীলন না করলে ব্রাহ্মণ পতিত হবেন বলে মনু নির্দেশ দিয়েছেন। ব্রাহ্মণরা সাধারণত পুরােহিত, মন্ত্রী, বিচারক, অধ্যাপক প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি পদে নিযুক্ত হবেন। দুরবস্থায় ব্রাহ্মণ অন্য বৃত্তিও গ্রহণ করতে পারেন তবে তা হবে সাময়িক। অবস্থার উন্নতি হলেই বিপদকালে অর্জিত ধনসম্পদ ত্যাগপূর্বক প্রায়শ্চিত্ত করে পুনরায় স্ব-বৃত্তিতে ফিরে আসতে হবে। মনুর বিধানে আইনের দণ্ড ব্রাহ্মণদের উপরও প্রযােজ্য তবে তাদের ক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা হবে লঘু। গুরুতর তাপরাধ করলে ব্রাহ্মণদের বড়জোর নির্বাসন, জরিমানা প্রভৃতি দণ্ড দেয়া যায় কিন্তু তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা বা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা অবৈধ। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে মনু সকল প্রকার রাজস্বদানের দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দিয়েছেন।

ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য : ক্ষত্রিয়ের জীবিকা ছিল প্রশাসন ও যুদ্ধ। কিন্তু দুর্দশাগ্রস্ত হলে ক্ষত্রিয় জরুরিকালীন ব্যবস্থা রূপে বৈশ্যবৃত্তি অর্থাৎ কৃষি, পশুপালন ও ব্যবসা অবলম্বন করতে পারেন বলে মনু বিধান দিয়েছেন। বেদ-অধ্যয়নে শুধু ব্রাহ্মণদেরই একচেটিয়া অধিকার ছিল না, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদেরও যে সে অধিকার ছিল তা মনু স্পষ্ট করেই বলে গেছেন। মনুসংহিতায় বৈশ্যদের চারটি বৃত্তির কথা আছে – কৃষি, পশুপালন, মহাজনি কারবার ও ব্যবসা। এযুগে আন্তর ও বহির্বাণিজ্যের উন্নতির ফলে বৈশ্যদের আর্থিক সংগতি ও সামাজিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।

শূদ্র : মনুর মতে, উচ্চতর তিনবর্ণের, বিশেষত বেদজ্ঞ ও যশস্বী ব্রাহ্মণের সেবাই ছিল শুদ্রের পরম ধর্ম। ‘শুক্রযৈব তু শূদ্রস্য ধর্মো’। মনু বলেছেন, শূদ্রের বেদপাঠ নিষিদ্ধ, তার বেদের আলােচনা শােনাও বারণ, বৈদিক যাগযজ্ঞ করার অধিকারও তার নেই। অকারণে পশুহত্যায় মনুর যে প্রায়শ্চিত্তবিধান, শূদ্ৰহত্যাতেও মনুর সেই বিধান। শূদ্র তথা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের শােষণে ও নির্যাতনে তৎকালীন সমাজপতিদের অনেকেরই সমর্থন ছিল। মনু তাদের ব্যতিক্রম নন। বাধা যেমন আছে তাকে সবলে অতিক্রম করার শক্তিও তেমন আছে। শূদ্রদের মধ্যে কেউ কেউ যে আপন যােগ্যতায় সমাজে সম্মান ও খ্যাতি লাভ করেছিলেন তার প্রমাণ আছে। শূদ্রদের মধ্যে কেউ কেউ অধ্যাপনাকে বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করতেন। এ তথ্য মনুসংহিতাতেই আছে। ব্যবসা ও কারিগরি শিল্পকে যে শূদ্ররা কখনও কখনও বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করতেন তা মানুও স্বীকার করেছেন।

সংকর বা মিশ্র জাতি : সংকর বা মিশ্র জাতির উল্লেখ করেছেন মনু। সংকর জাতির উদ্ভবের দু’টি কারণ তিনি নির্দেশ করেছেন – অসবর্ণ বিবাহ ও স্ববৃতি ত্যাগ। মনু যেসব সংকর জাতির কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে অম্বষ্ঠ, সূত, চণ্ডাল, কৈবর্ত বা দাশ, দ্রাবিড়, কাম্বােজ, যবন, শক, পহ্লব, চিনা, কিরাত ও নিষাদ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মনু এদের বৃত্তিরও উল্লেখ করেছেন। অম্বষ্ঠের বৃত্তি চিকিৎসা, সূতের বৃত্তি অশ্ব ও রথ চালনা, নিষাদের বৃত্তি মৃগয়া, কৈবর্ত বা দাশদের জীবিকা মৎস্যশিকার। দেখা যাচ্ছে, মনুর সংকর জাতিসমূহে একদিকে যেমন খস, দ্রাবিড় প্রভৃতি অনার্যগােষ্ঠী স্থান পেয়েছে, তেমনি যবন, শক, চিনা প্রভৃতি নানা বৈদেশিক জাতিও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

অনার্য বা আদিম গোষ্ঠী ও বিদেশীদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রবেশ : অনার্য গােষ্ঠী তথা আদিম উপজাতিদের অনেকেই বিশেষ বিশেষ এলাকায় রাজনৈতিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। ফলে ব্রাহ্মণ্য সমাজে এসব অনার্য উপজাতিদের অন্তর্ভুক্তি জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া ব্রাহ্মণ্য সমাজে প্রতিনিয়ত অবৈদিক রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস, সংস্কার অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছিল। ব্রাহ্মণ্য সমাজের এই সর্বজনীন রূপ অনার্য উপজাতিদের ব্রাহ্মণ্য সমাজে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করে দেয়। যবন, শক, পহ্লব প্রভৃতি যেসব বিদেশি ভারতে এসেছিলেন তারা এদেশ হতে আর প্রত্যাবর্তন করেননি। এদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে, এদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে তারা ধীরে ধীরে ভারতীয় সমাজের অঙ্গীভূত হন। বলা যায়, পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় ভারতীয় সমাজ কুষাণপর্বে অনেক বেশি সমন্বিত, ঐক্যবদ্ধ রূপ লাভ করে।

দাস : সমকালীন সমাজে দাস অর্থাৎ ক্রীতদাসদের সংখ্যা কম ছিল বলে মনে হয় না। নানা কারণে দাসত্ব বরণ করতে হত। অনেকে ছিলেন জন্মসূত্রে দাস। যুদ্ধবন্দিদের দাসত্বের জীবনযাপন করতে হত। অন্নবস্ত্রর তাড়নায় বাধ্য হয়ে অনেকে দাসত্ব বরণ করতেন। বিদেশ হতে যে দাস আমদানি হত তারও প্রমাণ আছে।

কারখানায় বেতনভুক শ্রমিক : দাসপ্রথা ছিল ঠিকই তবু সেযুগের কারখানা ও খেত যে প্রধানত দাসনির্ভর ছিল, তা বলা যায় না। বরঞ্চ বেতনভুক শ্রমিকরাই সংখ্যায় বেশি ছিলেন। তাছাড়া ম্লেচ্ছ ও হীনজাতির লােকরাও শ্রমের জোগান দিতেন। শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিককে সাধারণত বেতন দেয়া হত। কখনও কখনও প্রজারা বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে শ্রমের জোগান দিতেন। বাধ্যতামূলক শ্রমদানকে সমকালীন এক লেখে সংস্কৃত পরিভাষায় বিষ্টি বলা হয়েছে। 

অনুলোম-প্রতিলোম বিবাহ : অনুলােম বা উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নিম্নবর্ণের কন্যার বিবাহ মনু অনুমােদন করেছেন। কিন্তু প্রতিলােম বা উচ্চ বর্ণের কন্যার সঙ্গে নিম্নবর্ণের পুরুষের বিবাহের তিনি ছিলেন ঘাের বিরােধী। সমাজপতিদের নিষেধ সত্ত্বেও এ ধরনের বিবাহ যে সেসময় অনুষ্ঠিত হত মনুসংহিতায় তার পক্ষে স্বীকৃতি আছে। 

নারীর বিবাহ : মনু মনে করেন ঋতুমতী হওয়ার পূর্বেই কন্যার বিবাহ দেয়া উচিত। তবে কন্যার পক্ষে বিবাহ বাধ্যতামূলক নয়। মনু বলেন, কন্যা আজীবন কুমারী থাকবেন, তবুও নির্গুণ পাত্রের সঙ্গে তার বিবাহ অবিধেয়। মনুর মতে পাত্রের বয়স কন্যার বয়সের প্রায় তিনগুণ হওয়া উচিত।

নারী বিষয়ক পরস্পরবিরোধী উক্তি : নারীদের সম্পর্কে মনু বেশ কয়েকটি পরস্পর বিরােধী উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, যেখানে নারীদের সম্মান, সেখানে দেবতাদের অধিষ্ঠান। যত্র নার্যস্ত পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। তিনি আবার অন্যত্র বলেছেন, স্ত্রীজাতির স্বাধীনতা নেই, নারী কৌমারে পিতার যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন : “পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে। রক্ষত্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমৰ্হতি।।” মনু আরও বলেন, কন্যারা কাম, ক্রোধ, হিংসা, কুটিলতা ও কদাচারে নিপুণ, মিথ্যা ও অসত্যের রাজ্যেই তাদের বিচরণ।

কুষাণ ও পহ্লব নারী নিয়ে বার্ডেস্যানেসের বিবরণ : সমকালীন কুষাণ ও পহ্লব রমণীদের সম্পর্কে এক মনােজ্ঞ বিবরণ দিয়ে গেছেন সেযুগেরই এক লেখক বার্ডেস্যানেস। তিনি বলেছেন কুষাণ মহিলারা পুরুষদের পােশাক পরে, ঘােড়ায় চড়ে রাস্তায় বের হতেন আর সােনা ও মুক্তার দামি অলংকারে নিজেদের সজ্জিত রাখতেন। আচরণে তারা উদ্ধত ও উচ্ছল ছিলেন। ক্রীতদাস-অতিথিদের সঙ্গে তাদের আচরণ না ছিল শােভন, না ছিল শালীন। অথচ স্বামীরা ছিলেন উদার ও সহিষ্ণু। পহ্লব রমণীদের অজস্র প্রশংসা করেছেন বার্ডেস্যানেস। তিনি বলেছেন পহ্লব মহিলাদের স্বামীগৃহে তানেক সপত্নী ছিলেন তবু স্বামীর প্রতি তাদের আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। 

আর্থিক বৈষম্য : কুষাণ আমলে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যজনিত সমৃদ্ধি সমাজের সর্বস্তরকে শ্রীমণ্ডিত করেনি, অনেকেই জীবিকাহীন, সম্বলহীন হয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিলেন। এপ্রসঙ্গে ২৮ কণিষ্কাব্দে উৎকীর্ণ মথুরা লেখের সাক্ষ্য বিশেষ অনুধাবনের দাবি রাখে। খরাসলেরপতি নামে জনৈক ব্যক্তি মথুরার দু’টি বণিক সংঘে বেশ কিছু টাকা গচ্ছিত রাখেন (অনেকে মনে করেন, খরাসলেরপতি নামে কোনও ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি খরাসলের নামে এক অঞ্চলের প্রশাসক ছিলেন)। গচ্ছিত টাকার সুদে একশাে জন ব্রাহ্মণকে দৈনিক খাওয়ানাে হত। তাছাড়া প্রতিদিন বণিক সংঘ দু’টিকে ৩ আঢ়ক জই, ১ প্রস্থ লবণ, ১ প্রস্থ সত্ত্ব এবং ৩ ঘটক ৫ মল্লক সবজির সংস্থান রাখতে হত। এসব জিনিস একটি হলঘরের সামনে রাখা হত আর যারা দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত তাদের মধ্যে বিতরণ করা হত। মথুরায় অবশ্য খরাসলেরপতি দুর্গতজনের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিলেন কিন্তু সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুধাপীড়িত জনগণের আর্তনাদ অন্য কোনও ধনাঢ্য ব্যক্তির অন্তর স্পর্শ করেছিল কি?

অর্থনৈতিক অবস্থা

কৃষি ও সেচ ব্যবস্থা

ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানা : কুষাণযুগে ভূমি ছিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। মৌর্যপর্বের মতাে সুবিশাল রাজকীয় জমির অস্তিত্ব এই যুগে আর দেখা যায় না। রাজা ভূমি দান করছেন এই ধরনের কোনও তথ্যও লেখে নেই। জমি কার এই প্রশ্নের উত্তরে মনু বলেন জমি তারই যিনি প্রথম জঙ্গল পরিষ্কার করে জমিকে চাষের যােগ্য করে তােলেন। জমির স্বামিত্ব ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মনু হরিণের উপমা দিয়েছেন। হরিণ তারই যিনি হরিণটিকে প্রথম শিকার করেন। তেমনি জঙ্গলাকীর্ণ ক্ষেত্র যিনি কর্ষিত করেন তিনিই ক্ষেত্রের মালিক। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সুপ্রতিষ্ঠিত হলে কৃষিজ উৎপাদনে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ শিথিল হয়। কুষাণযুগে কৃষির উৎপাদন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কোনও বড় ভূমিকা ছিল না।

কূপ, জলাশয় ও খাল খনন : সমকালীন লেখমালায় কূপ, জলাশয় ও খাল খননের উল্লেখ পাওয়া যায়। আরা লেখ থেকে জানা যায় দ্বিতীয় কণিষ্কের রাজত্বকালে দাসফোত নামে জনৈক ব্যক্তি একটি কূপ খনন করেছিলেন। হস্তিনাপুর, দিল্লি, রােপার, মথুরা প্রভৃতি স্থানে উৎখননের ফলে কলসির খাড়া খাড়ি সারি আবিষ্কৃত হয়েছে। কলশির এই লম্বালম্বি সারি সম্ভবত কূপ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। অনেকে অবশ্য এই কলসির সারিকে পয়ঃপ্রণালীরূপে চিহ্নিত করেছেন। উজ্জয়িনীর কাছে পােড়ানাে ইটের তৈরি যে কাঠামাের সন্ধান পাওয়া গেছে তা কিন্তু কূপই, পয়ঃপ্রণালী নয়। চাষের কাজে জলের প্রয়ােজন মেটাবার জন্য জলাশয় নির্মাণ করা হত। তক্ষশিলা, হস্তিনাপুর, উদয়পুর, অহিচ্ছত্র, কৌশাম্বী, ভিটা, মথুরা প্রভৃতি স্থানে পােড়ামাটি ও কাদামাটি দিয়ে তৈরি ক্ষুদ্রাকারের জলাশয়ের মডেল পাওয়া গেছে।

খাল বা প্রণালী : কূপই হােক বা জলাশয়ই হােক, তাতে স্থানীয় অঞ্চলের জলের প্রয়ােজন মেটে কিন্তু বৃহত্তর অঞ্চলের প্রয়ােজন মেটে না। সে প্রয়ােজন মেটে খালে বা প্রণালীতে। প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন হতে জানা যায় কুষাণ আমলে মধ্য এশিয়ার তাজিকিস্তান – উজবেকিস্তান অঞ্চলের দারগােম, বুলুঙ্গর, নরপাই, শাহরুদ প্রভৃতি স্থানে কয়েকটি খাল খনন করা হয়। খালগুলো জেরাভশান নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। আফগানিস্তানের সুর্খকোটালে পাওয়া একটি কষাণ। লেখেও খালের উল্লেখ আছে। খালটি সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল। 

জল সংরক্ষণ ও সরবরাহের কাজে কারিগরি দক্ষতা : জল সংরক্ষণ ও সরবরাহের কাজে সেযুগের কারিগরি দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় এলাহাবাদের নিকটবর্তী শব্দবেরপুরের চতুর্থ পর্বে নির্মিত (খ্রিস্টপূর্ব ২০০ খ্রিস্টাব্দ ২০০) এক বৃহৎ জলপ্রকল্পের নিদর্শনে। গঙ্গা নদী থেকে জল সংগ্রহ করে তাকে পরিশ্রুত করা ও শেষে পরিশ্রিত জল পানীয় বা সেচের কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই এই প্রকল্পটি রচিত হয়েছিল। একটি প্রণালীর মাধ্যমে গঙ্গার জল দু’টি পরিস্রাবণ কক্ষে আনা হত, পরে পরিশ্রুত জল আর একটি প্রণালীর মাধ্যমে পরপর দুটি পাকা ইটের তৈরি জলাধারে গিয়ে পড়ত। জলাধার দুটির মধ্যে সংযােগ রক্ষাকারী একটি নালী (৫.৩ মি. দৈঘ্য, ১.৩৫ মি. প্রস্থ) ছিল। প্রথম জলাধারটি দৈর্ঘ্যে ৩৪ মিটার, প্রস্থে ১০ মিটার ও গভীরতায় ৪ মিটার, দ্বিতীয়টির দৈর্ঘ্য অন্তত ১২০ মিটার প্রস ২৬ মিটার ও গভীরতা ৭ মিটার। দূরের উৎস হতে জল সংগ্রহ করা, সংগৃহীত জলকে পরিশ্রুত, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করার মতাে জটিল প্রক্রিয়া শৃঙ্গবেরপুর জলপ্রকল্পে সুসংহত রূপ পেয়েছিল। কার উদ্যোগে এরূপ একটি সুসংহত, কার্যকর জলপ্রকল্প রচিত হয়েছিল তা জানা যায় না কিন্তু এই প্রকল্পটি যে সেযুগের কারিগরি নৈপুণ্যের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তা বােধহয় নিঃসংকোচে বলা যায়।

সেচপ্রকল্পে মনু : মনু সেচপ্রকল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে যথাযথ সচেতন ছিলেন। তিনি বলেছেন যদি কোনও ব্যক্তি সেচপ্রকল্প বা জলাধার বিনষ্ট করেন তবে তাকে জলে ডুবিয়ে বা শিরচ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে; কিন্তু অপরাধী জলাধার মেরামত করে দিলে উত্তমসাহস দণ্ড অর্থাৎ হাজার পণ তাম্রমুদ্রা জরিমানাই তার পক্ষে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে (মনুসংহিতা ৯/২৭৯)। সেকালে জলপ্রকল্পের ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের প্রতি সমাজ কতখানি সচেতন ছিল তারই ইঙ্গিত মেলে মনুর উক্তিতে।

সেযুগে উৎপন্ন ফসল : সমকালীন লেখে ও সাহিত্যে সেযুগে উৎপন্ন কয়েকটি ফসলের উল্লেখ আছে। হুবিষ্কের এক মথুরা লেখে সত্ত্ব ও সমিকর-এর উল্লেখ আছে। সত্তুর অর্থ ছাতু। এই ছাতু সম্ভবত যব থেকে তৈরি হত। সমিৎকর-এর অর্থ ময়দা-প্রস্তুতকারী। ময়দা তৈরি হত গম হতে। প্লিনিও গম ও যবের উল্লেখ করেছেন। ভারতে আখের উৎপাদনের কথাও প্লিনি বলেছেন। কার্পাস ফলনের পরােক্ষ ইঙ্গিতও করেছেন তিনি। কৃষিজ পণ্যের মধ্যে ব্রীহি, মুগ, শালিধান, মাষ, লশুন এবং ইক্ষুর উল্লেখ আছে মনুসংহিতায়।

কারিগরি শিল্প

কুষাণ পর্বে শুধু কৃষির ক্ষেত্রে নয়, কারিগরি শিল্পের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ঘটেছিল।

তক্ষণ-শিল্প : তখনকার দিনের এক প্রধান শিল্প তক্ষণ-শিল্প। যে কারিগরেরা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন লেখে তাদের ‘বড্‌ঢকি’ বলা হয়েছে। সূত্রধর বা ছুতাের বলতে আমরা যাদের বুঝি বড্‌ঢকিরা ঠিক তাই। শুধু কাঠের জিনিসপত্র তৈরি করা নয়, কাঁচামাল সংগ্রহ ও তৈরি-জিনিস বিক্রির দায়িত্বও তাদের বহন করতে হত।

বাঁশ ও কঞ্চির কারিগর : সমকালীন লেখমালায় বাঁশের কারিগর ও কঞ্চির কারিগরেরও উল্লেখ আছে।

বস্ত্রশিল্প : সেযুগের এক প্রধান শিল্প ছিল বস্ত্রশিল্প। বস্ত্রশিল্পের মুখ্য কেন্দ্র ছিল মথুরা। প্রবর নামে এক বিশেষ ধরনের বস্ত্র সেখানে তৈরি হত। কিন্তু প্রবর থেকেও অনেক দামি ও উৎকৃষ্ট বস্ত্র ছিল মসলিন, পেরিপ্লাসের লেখক ও প্লিনির মতাে বিদেশিরা পঞ্চমুখে যার প্রশংসা করেছেন। বারাণসী, উজ্জয়িনী, ভৃগুচ্ছ, গ্যাঙ্গে প্রভৃতি স্থানে মসলিন তৈরি হত। গ্রিক-রােমক লেখকরা একবাক্যে গ্যাঙ্গের মসলিনকে সর্বোৎকৃষ্ট বলে বর্ণনা করেছেন। গ্যাঙ্গে শহরটি নিঃসন্দেহে গাঙ্গেয় বদ্বীপে অবস্থিত ছিল (অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সরকার গ্যাঙ্গে শহরটিকে আধুনিক গঙ্গাসাগর বলে মনে করেন (পাল-পূর্ব বংশানুচরিত, কলকাতা, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ৬১)।

সুগন্ধি প্রস্তুতি : সুগন্ধি প্রস্তুতির কাজে অনেক লােক নিযুক্ত ছিলেন। লেখমালায়। এই শ্রেণির কারিগরদের গন্ধিক, সােবাসক ইত্যাদি বলে আখ্যাত করা হয়েছে।

হাতির দাঁতের শিল্প : হাতির দাঁতের কাজে যেসব শিল্পী জড়িত ছিলেন সে যুগের সাহিত্যে ও লেখমালায় তাদের ‘দন্তকার’ বলা হয়েহে সেকালের তৈরি হাতির দাঁতের কয়েকটি শৌখিন জিনিস আফগানিস্তানের বেগ্রামে আবিষ্কৃত হয়ে সােনার অলংকার তৈরি করতেন ‘সুবর্ণকার’ বা ‘স্বর্ণকার’, মণি বা মূল্যবান পাথরের অন তৈরি করতেন ‘মণিকার’। বিভিন্ন স্থানে উৎখননের ফলে নানা ধরনের পাথরের পুঁতি পাওয়া গেছে।

হীরকশিল্প : কিছু কারিগর হীরার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। মালবের পূর্বভাগে হীরার খনি ছিল। তারনাথের বিবরণে এর উল্লেখ আছে। কণিষ্কের আমলে যে পূর্ব মালবে হীরার নিয়মিত খনন হত তারও উল্লেখ করেছেন তারনাথ। মনুসংহিতায় খনিকে রাজকীয় বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বলে ঘােষণা করা হয়েছে। হীরকশিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরেরা সম্ভবত রাষ্ট্রের পরিচালনাধীন ছিলেন।

লবণ শিল্প : লবণ খনিজপদার্থ হলেও লবণের উৎপাদন রাষ্ট্র সম্ভবত ব্যক্তিগত উদ্যোগের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট ভাগ অবশ্য কর বা শুল্ক রূপে রাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। লবণ থেকে কর বা অঞ্চ বাবদ রাষ্ট্রের বড় রকমের আয় হত। প্লিনি বলেন, অরােমেনাস পাহাড়ের লবণ থেকে যে পরিমাণ শুল্ক আদায় হত তা হীরকখনির শুল্কের তুলনায় অনেক বেশি ছিল (প্লিনি অরােমেনাস পাহাড় বলতে সম্ভবত পাকিস্তানের সল্ট রেঞ্জ-কে বুঝিয়েছেন)। মনে রাখতে হবে হীরার তুলনায় লবণ অতি সাধারণ এক পণ্য হলেও হীরার চাহিদা যেখানে সীমিত, লবণের অপিরহার্যতা সেখানে সর্বজনীন। লবণের উৎপাদন প্রচুর হত বলেই রাজকোষে অর্থাগমের পরিমাণ বেশি ছিল।

লােহাশিল্প : তক্ষশিলা, কৌশাম্বী, সাঁচী প্রভৃতি স্থান থেকে সেযুগের লােহাশিল্পের প্রচুর নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। নিদর্শনাদির মধ্যে যেমন লাঙল, কোদাল, কুঠার, কুড়াল, দা ও লাঙলের ফলার মতাে কৃষির উপকরণ আছে তেমনি অস্ত্রশস্ত্রেরও সন্ধান পাওয়া গেছে।

বাণিজ্য

কৃষি ও কারিগরি শিল্পে যেমন অগ্রগতি ঘটেছিল তেমনি উন্নতি ঘটেছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। কুষাণ যুগের এই বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির পিছনে যে কারণগুলো নিহিত ছিল তা অনুধাবনের যােগ্য –

  • অখণ্ড রাষ্ট্র হওয়ায় নিরাপত্তা ও শুল্কবিভাগের উপদ্রব থেকে মুক্তি : কুষাণদের সময় মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর ভারত এক অখণ্ড রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। কেন্দ্রীয় সরকার ছিল সুযােগ্য, সবল ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় তৎপর। এর ফলে বিশাল অঞ্চল জুড়ে বণিকদের পক্ষে নিরাপদে ব্যবসা-বাণিজ্য করা সহজ হয়। শুল্কবিভাগের ঘন ঘন উপদ্রব হতে যেমন তারা মুক্ত ছিলেন তেমনি বাণিজ্যিক পথগুলো দিয়ে তারা নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতেন।
  • নতুন পথের উদ্ভব : পুরানাে বাণিজ্য পথগুলো তাে ছিলই, উপরন্তু কয়েকটি পথকে দীর্ঘতর করা হয়, কয়েকটি নতুন পথও তৈরি হয়। ফলে ভারতের বিভিন্ন স্থানের মধ্যে স্থলপথে পণ্যের আমদানি-রপ্তানির কাজটিই যে শুধু সহজ হল তা নয়, ভারতের সঙ্গে চিন এবং পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেল।
  • সিল্ক রোডের একটি অংশ কুষাণ সাম্রাজ্যে : কুষাণ যুগের বাণিজ্যের, বিশেষ করে বহির্বাণিজ্যের সম্প্রসারণের আরও কারণ ছিল। রােম ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে চিনের বাণিজ্যিক লেনদেনে কুষাণ সাম্রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যে পথ ধরে বাণিজ্যিক সামগ্রীর আনাগােনা চলত সেই বিখ্যাত রেশম পথ বা সিল্ক রােডের অনেকটাই কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পথ চলে গিয়েছিল মধ্য এশিয়ার তারিম উপত্যকা ও তাকলামাকান মরুভূমির মধ্য দিয়ে, পামির মালভূমি, আফগানিস্তান ও ইরানের ভেতর দিয়ে। রেশম পথের একটি বড় অংশ কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হওয়ায় ভারত স্বাভাবিক কারণেই আন্তর্জাতিক স্থলবাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • সিল্ক রোডের বিকল্প সৃষ্টি : আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কুষাণ সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণের পিছনে আরও একটি কারণ ছিল। যে রেশম পথটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উপলক্ষে ব্যবহৃত হত সেটি ছিল যেমন দীর্ঘ, তেমনি দুর্গম ও সমস্যাসংকুল। এত দীর্ঘ ও দুর্গম পথ পাড়ি দেয়া সহজ ছিল না। এর জন্য বণিকদের যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করতে হত, বিপদ-আপদের সম্মুখীন হতে হত, অর্থব্যয় করতেও হত প্রচুর। তাছাড়া ছিল ইরানের আর্সাকীয় রাজাদের চাপানাে শুল্কের বিরাট বােঝা। রেশম পথ তাদের রাজ্যের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিল বলে আসাকীয় রাজারা সুযােগের পর সদব্যবহার করে পণ্যের উপর অত্যধিক হারে শুল্ক চাপিয়ে দেন। এসব করভার বহন করতে হত বলে পণ্যের মূল্য বাড়ানাে ছাড়া বণিকদের কোনও গতি ছিল না। পণ্য দুর্মূল্য হলে তার বাজার সংকুচিত হয়, ব্যবসায়ে লাভের পরিমাণও হাস পায়। ফলে রেশমপথের বিকল্প একটি বাণিজ্যিক পথের সন্ধান আবশ্যক হয়ে দেখা যায়। বিকল্প সে পথ পূর্ব হতেই জানা ছিল। সে পথ ছিল জলপথে, সিন্ধু, ইরান ও আরবের উপকূল আশ্রয় করে। এপথে যাতায়াত সময়সাপেক্ষ ছিল। সিন্ধুর বদ্বীপ হতে জলপথে পারস্যের রাজধানী সুসায় পৌঁছতে আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীর সাত মাস সময় লেগেছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় ১ম শতকের মধ্যভাগে মৌসুমি বায়ুর গতি-প্রকৃতি আবিষ্কৃত হওয়ায় পশ্চিম থেকে জাহাজগুলো অনেক কম সময়ে সিন্ধু নদের মােহনায় অবস্থিত বারবারিকাম বন্দরে ভিড়তে থাকে। আরও পরবর্তী ধাপে লােহিত সাগরের পূর্বমুখ থেকে জাহাজগুলো মাত্র চল্লিশ দিনে মালাবার উপকূলের মুজিরিস বন্দরে পৌঁছে যেত। এর ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বাণিজ্যের যােগসূত্ররূপে রেশম পথের আর সে অপরিহার্যতা থাকল না, জলপথ দিয়ে বণিকদের ব্যাপক আনাগােনা শুরু হল। সিন্ধুর বদ্বীপ ও মালাবার উপকূলের বন্দরগুলো জলপথের সংযােগকারীর ভূমিকা পালন করল।

বাণিজ্যপথ : সে যুগের ব্যবসা-বাণিজ্যের পথগুলোর বিবরণ আছে স্ট্রাবো ও প্লিনির বিবরণীতে এবং ‘পেরিপ্লাস্’ ও ‘জিওগ্রাফিকে’ গ্রন্থ দু’টিতে।

  • স্ট্র্যাবো একটি বাণিজ্যিক পথের কথা বলেছেন যেটি পশ্চিম এশিয়া থেকে বের হয়ে হিরাট, সিস্তান ও কান্দাহার অঞ্চলের ভেতর দিয়ে, কাবুল উপত্যকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বল্খ‌ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
  • বল্‌খ হতে একটি রাজপথ উত্তর ভারতের ভেতর দিয়ে সােজা পাটলিপুত্রের দিকে চলে গিয়েছিল। প্লিনিও এই রাজপথের উল্লেখ করেছেন তবে তার মতে পথটি গঙ্গা নদীর মােহনা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। টলেমিও একটি রাজপথের কথা বলেছেন যেটি ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে মথুরা হয়ে মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
  • চিন থেকে আফগানিস্তান, উত্তর ভারত, উজ্জয়িনী হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলবর্তী ভৃগুকচ্ছ পর্যন্ত প্রসারিত এক রাজপথের উল্লেখ আছে পেরিপ্লাস্ গ্রন্থে।
  • হৌ হান শু নামের এক চিন গ্রন্থে একটি পথের উল্লেখ আছে যেটি ইয়ারকন্দ ও পামির মালভূমির পথে চিনের সিন কিয়াঙ থেকে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ পথ দিয়ে কাশ্মীর ও আফগানিস্তানেও যাওয়া যেত।
  • চিনের সঙ্গে পূর্ব তথা উত্তর-পশ্চিম ভারতের সড়কপথেও যােগ ছিল। পথটি দক্ষিণ চিনের য়ুন্নান থেকে বের হয়ে মায়ানমার, মণিপুর, অসম, উত্তর বাংলা, উত্তর বিহারের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে আফগানিস্তানের বল্‌খ অভিমুখে চলে গিয়েছিল।

এসব রাজপথ একদিকে যেমন কুষাণ সাম্রাজ্যের বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করেছিল, কুষাণ সাম্রাজ্য ও বিভিন্ন ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সংযােগসূত্র স্থাপন করেছিল, তেমনি অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে চিন, মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও রােম সাম্রাজ্যের বাণিজ্য সেতুবন্ধ রচনা করেছিল।

বাণিজ্যিক লেনদেন ও ব্যাবসায়িক সংগঠন সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও লেখ : যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির ফলে সাম্রাজ্যের স্থান থেকে স্থানান্তরে বণিক সম্প্রদায়ের অবাধ গমনাগমন ও বাণিজ্যিক পণ্যের নিয়মিত লেনদেনের কাজটি সহজ হয়। সমকালীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে তার সমর্থন আছে। বিশালায়তন কুষাণ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যে লােকচলাচল, ভাব বিনিময় ও বাণিজ্যিক লেনদেন স্বচ্ছন্দগতিতে চলত তারই আভাস আছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে ও সমকালীন লেখের সাক্ষ্যে –

  • উৎখননের ফলে পুর্ব আফগানিস্তানের বেগ্রামে কুষাণ যুগের কিছু প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব জিনিসের মধ্যে আছে সিরিয়া বা মিশরে তৈরি কাচপাত্র, পশ্চিম এশীয় ব্রোঞ্জপাত্র, কলাইকরা চিনাপাত্র ও মথুরায় নির্মিত হাড় ও হাতির দাঁতে তৈরি ফলক।
  • উত্তরপ্রদেশের অহিচ্ছত্রে কুষাণযুগের সমতলবিশিষ্ট মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। এ ধরনের মৃৎপাত্র তক্ষশিলায়ও আবিস্কৃত হয়েছে।
  • তক্ষশিলায় নির্মিত নতুন ধরনের কিছু মৃৎপাত্র উত্তরপ্রদেশের কোসামে উৎখনিত হয়েছে। পশ্চিম এশীয় পােড়ামাটির মূর্তির সঙ্গে তুলনীয়।
  • বেশ কিছু কুষাণযুগের পােড়ামাটির মূর্তি উত্তর ভারতের নানা স্থানে পাওয়া গেছে। তাছাড়া উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্রে এমন সব পােড়ামাটির মূর্তির সন্ধান মিলেছে যাদের দেহগঠনে, উষ্ণীষে ও পােশাক-পরিচ্ছদে বিদেশি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। সম্ভবত লােকায়ত শিল্পীরা আগন্তুক বিদেশি রাজপুরুষ, বণিক ও পর্যটকদের অনুকরণে এই মূর্তিগুলো নির্মাণ করেছিলেন।
  • সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তবাসীরা যে তক্ষশিলা, মথুরা প্রভৃতি স্থানে আসতেন তারও প্রমাণ আছে সমকালীন লেখে।
  • তক্ষশিলা-পুষ্কলাবতী পথের দু’ধারে কুষাণযুগের কয়েকটি বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। বসতিগুলো বণিকদের চটি ছিল বলে মনে হয়। এসময় বলখ, পুষ্কলাবতী, তক্ষশিলা ও মথুরার বাণিজ্যিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। 
  • সমকালীন সাহিত্যে ও লেখমালায় বণিক, সার্থবাহ ও শ্রেষ্ঠী প্রভৃতি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে। ছােট ব্যবসায়ীদের সম্ভবত বণিক বলা হয়েছে। শকটে পণ্যসম্ভার সাজিয়ে স্থান হতে স্থানান্তরে ঘুরে যারা ব্যবসা করতেন তারাই সার্থবাহ। বিত্তশালী ব্যবসায়ী বা বণিক সংগঠনের যিনি মুখ্য পরিচালক তিনিই হলেন শ্ৰেষ্ঠী। ব্যবসায়ীদের অনেকেই সম্পন্ন ছিলেন। সরকারের সঙ্গে তাদের হৃদ্য সম্পর্ক ছিল। রাজা তাদের যথেষ্ট খাতির করতেন। 
  • ব্যবসায়ী সংগঠন বা শ্রেণীর উল্লেখ আছে ২৮ কণিষ্কাব্দে উৎকীর্ণ হুবিষ্কের এক মথুরা লেখে। লেখটিতে একটি নয়, দুটি সংগঠনের কথা বলা হয়েছে। সংগঠন দুটিতে কিছু টাকা গচ্ছিত রাখা হয়েছিল। সুদ বাবদ ওই টাকা হতে যা আয় হত তা দিয়ে সংগঠন দুটিকে সেবামূলক কিছু কাজ করতে হত। সংগঠন কখনও কখনও গচ্ছিত টাকা তার নিজস্ব কারবারে খাটাত আবার কখনও বা চড়া সুদে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ধার দিত।

রােম তথা পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য : রােম তথা পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে কুষাণ সাম্রাজ্যের জলপথে যে বাণিজ্য চলত তাতে সংগত কারণেই সিন্ধুর বদ্বীপ ও গুজরাতের উপকূল অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। পণ্যের লেনদেন ছিল –

  • প্লিনি, পেরিপ্লাসের অজ্ঞাতনামা লেখক এবং টলেমির বর্ণনা থেকে জানা যায় সিন্ধুর বদ্বীপ ও গুজরাতের উপকূল হতে চাল, চন্দন কাঠ, সেগুন, মেহগনি, মসলিন, সাধারণ মােটা কাপড়, দামি ও আধাদামি পাথর ইত্যাদি নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্য ও বিলাসসামগ্রী রপ্তানি হত।
  • চিনের রেশম ও রেশমি বস্ত্রের একটা মােটা অংশও এই পথেই রােমে পৌঁছত।
  • রােম ও পশ্চিম এশিয়া হতে আমদানি হত সুরা, সূচিশিল্প শােভিত কাপড়, কাচের পাত্র, তামা, টিন, সিসা, সােনা ও রূপা।

রােম তথা পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে কুষাণ সাম্রাজ্যের বাণিজ্য হুবিষ্কের শাসনকাল বা প্রথম বাসুদেবের রাজত্বের প্রাথমিক পর্ব পর্যন্ত জোর কদমে চলেছিল। প্লিনি বলেন, ভারতীয় পণ্য রােমের বাজারে একশাে গুণ চড়া দামে বিক্রি হত, আর ভারতীয় পণ্যের দাম মেটাতে প্রতি বছর অসংখ্য রােমক মুদ্রা ভারতে চালান যেত। রােমের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে কুষাণ রাজারা আগ্রহান্বিত ছিলেন। উভয় সাম্রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করার উদ্দেশ্যে তারা রােমে প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন। তাছাড়া রােমের সঙ্গে বাণিজ্যের খাতিরে নিম্নসিন্ধু অববাহিকায় এক নির্দিষ্ট মুদ্রানীতি চালু করা হয়। এ অঞ্চলে কুষাণযুগের যেসব রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে তা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বিশুদ্ধ, অনেক খাটি। এই মুদ্রাগুলো নিঃসন্দেহে সরকারি টাকশালে তৈরি হয়েছিল। নিম্নসিন্ধু উপত্যকার মতাে এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে নিম্নমানের মুদ্রা প্রচলিত থাকলে ভারত-রােম বাণিজ্যের স্বার্থ বিঘ্নিত হত। সন্দেহ নেই, বহির্বাণিজ্যের স্বার্থেই কুষাণ রাজারা নিম্নসিন্ধু অববাহিকায় উচ্চ মানের মুদ্রা প্রবর্তন করেন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা আজ সুপরিজ্ঞাত। খ্রিস্টীয় ১ম শতকে লেখা ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থে এই বাণিজ্যের এক মনােজ্ঞ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। প্রায় শতাব্দী কাল পরে রচিত টলেমির ‘ভূগােল’ গ্রন্থেও এই বাণিজ্যের কথা আছে। টলেমি তাে যবদ্বীপের সুস্পষ্ট উল্লেখই করেছেন। ‘নিদ্দেশ’-তেও ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের বর্ণনা আছে। বেত্রপথ, বংশপথ, অজপথ ইত্যাদি সাত রকম জলপথের বর্ণনা আছে এই বৌদ্ধগ্রন্থে। গ্রন্থটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ২য় শতক বা তার কিছু পূর্বে রচিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের পূর্বেই ভারতীয়রা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ভারতীয় শহরগুলোর নামে সেখানকার বহু স্থানের নামকরণ করেছিলেন। যে কুষাণ রাজারা রােমের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহী হবেন তা বােধ হয় না। অবিভক্ত বাংলা যে কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তা অনেক ঐতিহাসিকই স্বীকার করেছেন। প্রাচীনকালের বিখ্যাত বন্দর তাম্রলিপ্তি বাংলার মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত ছিল। টলেমি যে টামেলিটিস বন্দরের কথা বলেছেন তা এই তাম্রলিপ্তি। এখান থেকে জাহাজগুলো বাণিজ্যসম্ভারে সজ্জিত হয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করত, কখনও উপকূলের পথ ধরে, কখনওবা মাঝ সমুদ্রের মধ্য দিয়ে। অল্প পরিমাণে হলেও কুষাণ আমলের মুদ্রা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে। 

সমুদ্রবাণিজ্য নিয়ে মনুসংহিতা ও ভারতীয় ধারণা : লক্ষ করবার বিষয়, সমুদ্রযাত্রাকে সেসময়ের লােকেরা সুনজরে দেখতেন না। এই মনের অভিব্যক্তি ঘটেছে মনুসংহিতায়। মনু বলেন, কৃষি প্রাণী নাশ করে, বাণিজ্য মিথ্যাকে আশ্রয় করে। আর সমুদ্রযাত্রা শুচিতা বিনষ্ট করে। 

মুদ্রা ও তৌল্যরীতি

মুদ্রা : কুষাণপর্বের আর্থিক সমৃদ্ধির প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে সেযুগের মুদ্রার প্রাচুর্যে। পূবে কখনও এত অধিক সংখ্যায় মুদ্রা উৎকীর্ণ হয়নি। সােনা, রূপা ও তামা, এই তিন ধাতুতেই কুষাণরা মুদ্রা প্রস্তুত করেন। সম্ভবত বিম কদফিসেসের রাজত্বকালেই কুষাণ রাজ্যে প্রথম স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়। রােমক স্বর্ণমুদ্রার আদলে এই মুদ্রাগুলো তৈরি হয়েছিল। স্বর্ণমুদ্রার তুলনায় রৌপ্যমুদ্রা সংখ্যায় অনেক কম। স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাগুলো সম্ভবত দুর পাল্লার বাণিজ্য উপলক্ষে ব্যবহৃত হত। দৈনন্দিন কেনাবেচার কাজে তাম্রমুদ্রার ব্যবহার ছিল। রৌপ্যমুদ্রা পুরাণ এবং তাম্রমুদ্রা কার্ষাপণ নামে পরিচিত ছিল। অনেকে মনে করেন, এই পর্বের কার্ষাপণ বা তাম্রমুদ্রাগুলো গ্রিসদেশীয় দ্রাখমা মুদ্রার আদলে প্রস্তুত। কুষাণ মুদ্রা শুধু কুষাণ সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরেই পাওয়া যায়নি, সাম্রাজ্যের বাইরে এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইথিওপিয়ার মতাে দূর দেশেও আবিষ্কৃত হয়েছে। 

তৌল্যরীতি : কুষাণ সাম্রাজ্যের সর্বত্র একই ধরনের পরিমাপের প্রচলন ছিল বলে মনে হয় না। সাম্রাজ্যের উত্তর অঞ্চলে, বিশেষত অকসাস অববাহিকায়, স্ট্যাটের, দ্রাখমা প্রভৃতি পরিমাপ প্রচলিত ছিল। ৪.৩৫৪ গ্রামে এক দ্ৰাখমা, আর আনুমানিক ১৭ গ্রামে এক স্ট্যাটের। একশাে দ্রাখমায় ছিল এক মিন। ভারতীয় অঞ্চলে কর্ষ, আটক, ঘটক, দ্রোণ, মল্লক, প্রভৃতি দেশীয় পরিমাপের প্রচলন ছিল। ৫৩ গ্রেনে ১ কর্য, ৬৪ কর্ষে ১ প্রস্থ, ৪ প্রস্থে ১ আটক বা ২৫৬ কর্ষ। কুষাণ আমলের কিছু বাটখারা তক্ষশিলায় পাওয়া গেছে। লক্ষ করবার বিষয়, কয়েকটি বাটখারার গায়ে বেলনাকার ছিদ্র রয়েছে। ছিদ্রগুলো সম্ভবত সরকারি পরিদর্শকের বাটখারা অনুমােদনের প্রতীক। এই অনুমান সত্য হলে বুঝতে হবে অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে বাটখারার কারচুপি করে ক্রেতাসাধারণকে ঠকাতে না পারেন সেদিকে সরকারের প্রখর দৃষ্টি ছিল।

ধর্মীয় জীবন

বৌদ্ধধর্ম

তদকালীন বৌদ্ধধর্মের অবস্থা : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসে, বিশেষত বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রে কুষাণযুগের গুরুত্ব অপরিসীম। কুষাণ রাজাদের অনেকেই বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন কিন্তু এক্ষেত্রে কণিষ্কের সঙ্গে অন্য কোনও রাজার তুলনা চলে না। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত এই কুষাণরাজ পেশােয়ারে এক বিরাট মহাবিহার নির্মাণ করেন। শুয়েন চাঙের মতাে চিনা পরিব্রাজক এই বিহারটির নির্মাণশৈলী দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ধর্মের স্বরূপ ও তাৎপর্যকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধদের মধ্যে যে কয়েকটি দল উপদলের সৃষ্টি হয়েছিল তা ইতিপুর্বেই লক্ষ করা গেছে। এসব দল-উপদলগুলোকে মােটামুটিভাবে রক্ষণশীল ও উদারপন্থী এই দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। রক্ষণশীলদের আবার সর্বাস্তিবাদী ও মূলস্থবিরবাদী – এই দু’টি ভাগ ছিল। সর্বাস্তিবাদীরা পুনরায় বাৎসীপুত্রীয়, কাশ্যপীয়, মহীশাসক ও সৌত্রান্তিক – এই কটি গােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন। বাৎসীপুত্রীয়দের চারটি গােষ্ঠী ছিল – ধর্মোত্তরীয়, ভদ্রযানীয়, সাম্মিতীয় ও ষন্নগরিক। উদারপন্থীরা সাধারণত মহাসংঘিক নামে পরিচিত ছিলেন। তারা আবার একব্যবহারিক, লােকোত্তরবাদী, কৌক্কুটিক, বহুশ্রুতীয়, প্রজ্ঞপ্তিবাদী, চৈত্যশৈল, অপরশৈল, উত্তরশৈল, অন্ধ্রক ইত্যাদি কয়েকটি গােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন। সর্বাস্তিবাদীরা উত্তর ভারতে প্রাধান্য লাভ করেন। বিদিশা অঞ্চলে ছিল মূলস্থবিরবাদীদের আধিপত্য। দক্ষিণ ভারত ছিল মূলত মহাসংঘিকদের প্রভাবাধীন। 

চতুর্থ ধর্মসংগীতি : চিনা পরিব্রাজক শুয়েন চাঙ বলেন ধর্মের তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা নিয়ে বিভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের মধ্যে যে মতপার্থক্য ছিল তার নিরসনকল্পে কণিষ্ক চতুর্থ ধর্মসংগীতির আয়ােজন করেন। বৌদ্ধ দার্শনিক পরমার্থের মতে কণিষ্ক এ সম্মেলন আহ্বান করেননি, আহ্বান করেছিলেন সর্বাস্তিবাদী আচার্য কাত্যায়নীপুত্র। সম্মেলনটি কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। অনেকে মনে করেন কাশ্মীরের কুন্দলবনবিহারে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কেউ কেউ বলেন জলন্ধরের কুবনবিহারে এটির আয়ােজন হয়। সম্মেলনে পৌরােহিত্য করেন সেযুগের খ্যাতনামা মহাসংঘিক দার্শনিক বসুমিত্র। সম্মেলনে সহ-সভাপতির আসন গ্রহণ করেন তখনকার দিনের আর একজন প্রখ্যাত বৌদ্ধাচার্য অশ্বঘােষ। প্রাচীন তিব্বতি গ্রন্থ থেকে জানা যায়, পার্শ্ব এবং বসুমিত্র দুজনেই সম্মেলনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পার্শ্ব ছিলেন কণিষ্কের গুরু এবং সর্বাস্তিবাদের প্রবক্তা। তারা প্রত্যেকে পাঁচশাে জন অনুগামী-সহ সম্মেলনে যােগদান করেন। মনে হয়, সম্মেলনে রক্ষণশীল ও উদারপন্থী উভয় দলেরই সমসংখ্যক প্রতিনিধি আহুত হয়েছিলেন। শুয়েন চাঙের বিবরণ থেকে জানা যায়, সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম পিটকের উপর এক লক্ষ শ্লোকের এক একখানি বিভাষাশাস্ত্র রচনা করেন। পরে কণিষ্কের আদেশে এগুলো তাম্রপট্টে উৎকীর্ণ করে একটি স্তুপে সংরক্ষিত রাখা হয়। তারনাথ বলেন এ সম্মেলনে ১৮টি বিভিন্ন সম্প্রদায় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। তারনাথের বিবৃতি হতে মনে হয়, সম্মেলনে রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক দু’টি মতবাদই অনুমােদিত হয়েছিল। অধ্যাপক নলিনাক্ষ দত্ত মনে করেন এই বৌদ্ধ সংগীতিতে সর্বাস্তিবাদী মতই প্রাধান্য পায়। সেকারণে তিনি এই সম্মেলনটিকে সর্বাস্তিবাদীদের এক দলীয় অনুষ্ঠানরূপে চিহ্নিত করেছেন। 

মহাযান বৌদ্ধধর্মের অভূত্থান : প্রায় এই সময় বা তার কিছুকাল পূর্ব হতে মহাযান বৌদ্ধধর্মের অভূত্থান দেখা দেয়। এই মতের প্রবক্তারা নিজেদের মহাযানী বলে পরিচয় দিতেন, প্রতিপক্ষদের তারা হীনযানী রূপে আখ্যাত করতেন। উল্লেখ্য, হীনযানীরা নিজেদের কখনও হীনযানী বলেন না। মহাযানীরাই তাদের এরূপ নামকরণ করেছেন। হীনযানীরা নিজেদের স্থবিরবাদী বা থেরবাদী অর্থাৎ সনাতনপন্থী বলে পরিচয় দেন।  মহাযান বৌদ্ধধর্মে পরিবর্তনের ঢেউ নিয়ে এল। এই পরিবর্তন ছিল গুণগত। আদি বৌদ্ধধর্মের যেটুকু উপকরণ হীনযান বৌদ্ধধর্মে বজায় ছিল মহাযান বৌদ্ধধর্মে তাও কার্যত অস্বীকৃত হল। এপ্রসঙ্গে হীনযান ও মহাযান বৌদ্ধধর্মের মৌল পার্থক্যগুলো একবার স্মরণ করা যেতে পারে –

  • হীনযানীরা বুদ্ধকে এক মহামানব, পরমগুরু বলে মনে করেন। বুদ্ধের নীতিসমূহের কঠোর অনুশীলনেই তাদের আগ্রহ। তারা কোনও ঈশ্বর মানেন না। কিন্তু মহাযানীরা বুদ্ধকে দেবতার আসনে বসিয়েছেন। তারা মনে করেন বৃদ্ধ শাশ্বত, তিনি জন্ম-মৃত্যুর অতীত। তিনি অবর্ণনীয়। তিনি তিন প্রকার শরীর বা কায়া ধারণ করেন। ধমকায় অর্থাৎ বিশ্বজনীন, সর্বব্যাপী, অনাদি, অনন্ত ধর্মরূপে বুদ্ধ অবস্থান করেন। ধর্মেই বুদ্ধের প্রকৃত পরিচয়। ভক্তের ডাকে মাঝে মাঝে তিনি অলৌকিক দেহ ধারণ করেন। বুদ্ধের এ দেহ সম্ভোগকায় মানুষের হিতার্থে কখনও কখনও তিনি পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। তার এ রূপ নির্মাণকায় বা রূপকায়। গৌতমবুদ্ধ আসল বুদ্ধের নির্মাণকায়। অর্থাৎ গৌতমবুদ্ধ বুদ্ধের প্রকৃত পরিচয় নয়।
  • নিজেদের নির্বাণলাভেই হীনযানীদের আগ্রহ। তারা মনে করেন নিজের মুক্তির পথ নিজেকে খুঁজে নিতে হবে, প্রত্যেককে আত্মদীপ হতে হবে। অন্যের করুণায় বা সাহায্যে নিজের মুক্তি আসবে না। পক্ষান্তরে মহাযানীদের আগ্রহ সর্বজীবের নির্বাণে। তারা বলেন, জীবের দুঃখ মেচনের জন্য সিদ্ধার্থ জন্মজন্মান্তরে সাধনা করেছেন। ভবিষ্যতে মৈত্রেয় নামে তিনি পুনরায় থিতে অবতীর্ণ হবেন। বুদ্ধের মতাে বৌদ্ধ শ্রমণমাত্রেরই কর্তব্য সর্বজীবের মুক্তির জন্য সচেষ্ট হওয়া। ব্যক্তির মুক্তি নয়, গণমুক্তিই তাদের লক্ষ্য। একারণেই তারা নিজেদের মহান বা মহৎ বলে থাকেন। পক্ষান্তরে নিজের মুক্তির জন্য সচেষ্ট বলে প্রতিপক্ষদের তারা হীন আখ্যা দিয়েছেন। হীনযানীরা মনে করেন শ্ৰমণ অর্হৎত্ব অর্জন করতে পারেন, কিন্তু বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারেন না। তাদের বিশ্বাস, বুদ্ধ পৃথিবীতে একবারই জন্মেছেন, অন্য কারাের পক্ষে বুদ্ধত্বলাভ সম্ভব নয়। হীনযানীরা মনে করেন সকলের পক্ষেই বুদ্ধত্ব অর্জন সম্ভব, কিন্তু তার জন্য প্রথমে বােধিসত্ত্ব হতে হবে, বােধিসত্ত্ব পর্যায়ে বিশেষ দশটি গুণের অনুশীলন করতে হবে। এই দশটি গুণের মধ্যে রয়েছে দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য, ধ্যান, প্রজ্ঞা, উপায়-কৌশল্য, প্রণিধান, বল ও জ্ঞান – এই দশটি গুণ বা দশটি পারমিতার বিকাশের মধ্য দিয়েই বােধিসত্ত্ব বুদ্ধত্বে উপনীত হন।
  • হীনযানীরা বস্তুবাদী, বাহ্য। বস্তুর অস্তিত্বে তারা বিশ্বাসী। মহাযানীরা ভাববাদী, দৃশ্যমান বস্তুর সত্তা বা অস্তিত্ব তারা স্বীকার করেন না।

মহাযানের আনা পরিবর্তন ও এর উদ্ভবের কারণ : মহাযানবাদের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্মে যে পরিবর্তন এল তার মূলে ছিল ধর্মকে জনমুখী করার অনুপ্রেরণা। আদি বৌদ্ধধর্মে গৃহী মানুষদের কার্যত কোনও স্থান ছিল না, এ ধর্ম মূলত সংসার ত্যাগীদের ধর্ম। সাধারণ মানুষদের পক্ষে অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করা কঠিন কিন্তু দান, শীল ইত্যাদি পারমিতা বা গুণের অনুশীলন সম্ভব। তাই সাধারণ মানুষদের কথা মনে রেখেই মহাযান বৌদ্ধধর্মে পারমিতার আদর্শ প্রচার করা হয়। তাছাড়া সমাজের এক বৃহৎ অংশের মধ্যে ভক্তি ও পূজাবিধি প্রচলিত থাকায় বৌদ্ধধর্মে তা গ্রহণের প্রয়ােজন হয়। কিন্তু বুদ্ধকে দেবতার আসনে না বসালে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে না। ফলে বুদ্ধ দেবতারূপে কল্পিত হয়েছেন, জন্ম-মৃত্যুর অতীত এক শাশ্বত সত্তারূপে প্রতিভাত হয়েছেন।

শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদ : কুষাণ যুগের শ্রেষ্ঠ মহাযানী দার্শনিক নাগার্জুন। ‘সর্বং শূন্য’–এই মতবাদের তিনি প্রবক্তা। পরিদৃশ্যমান জগৎ, মানসিক প্রক্রিয়া ও জ্ঞান সবই শূন্য। শূন্য এখানে অলীক অর্থে নয়, শূন্যের অর্থ অবর্ণনীয়। অর্থাৎ, সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বস্তুর অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করা যায় না। নাগার্জুন ও তার অনুগামীগণ মাধ্যমিক বা মধ্যমপন্থী নামে পরিচিত। মহাযানীদের আর এক সম্প্রদায় যােগাচারী বা বিজ্ঞানবাদী। তারা বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না, তারা জ্ঞান ও চেতনার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। অসঙ্গ ও বসুবন্ধুর মতো দার্শনিকেরা এই মত পােষণ করেন।

কণিষ্ক ছাড়া অন্যান্য কুষাণ রাজার বৌদ্ধধর্মে পৃষ্ঠপোষকতা : শুধু কণিষ্ক নয়, আরও কয়েকজন কুষাণরাজ বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন। জুষ্ক বা বাসিষ্ক এবং হুষ্ক বা হুবিষ্কের বৌদ্ধধর্মানুরাগের কথা রাজতরঙ্গিণীতে বলা হয়েছে। তারা কাশ্মীরে চৈত্য, বিহার ইত্যাদি নির্মাণ করেন। মথুরায় হুবিষ্কের নামে একটি বিহার নির্মিত হয়। এ বিহারটি সম্ভবত হুবিষ্কই তৈরি করেছিলেন। 

মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে প্রাপ্ত বৌদ্ধ সাহিত্য : কুষাণ আমলে উত্তর ভারতে জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ যে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। উপরন্তু ব্যাকট্রিয়া, সােগডিয়ানা এবং এরাকোসিয়া বা কান্দাহার অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এ সময় মধ্য এশিয়া এবং চিনেও বৌদ্ধধর্মের বিস্তার ঘটে। মধ্য এশিয়ার কাসগড়, খােটান, ইয়ারকন্দ প্রভৃতি স্থানে কুষাণ যুগের স্তুপ, বিহার, বৌদ্ধমতি ও চিত্রকলা আবিষ্কৃত হয়েছে। বিস্মিত হতে হয়, ভারতে পাওয়া যায় না এমন অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি মধ্য এশিয়ায় পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে ‘উদানবর্গ’ ও ‘শারিপুত্রপ্রকরণ’-এর কথা উল্লেখ করা যায়। দুখানি পাণ্ডুলিপিই কুষাণযুগের। সংস্কৃত বা পালিতে লেখা অনেক বৌদ্ধগ্রন্থ খোটানি, তােখারি প্রভৃতি বিভিন্ন মধ্য এশীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। বর্তমানে এরূপ অনেক প্রাচীন পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। খােটানের গােমতী বিহার মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধশিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার এক প্রধান কেন্দ্র ছিল।

চিনে বৌদ্ধধর্ম প্রচার : চিনে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নেন সেযুগের দু’জন বৌদ্ধশ্রমণ – কাশ্যপ মাতঙ্গ ও ধর্মরক্ষ বা ধর্মরত্ন। ধর্মপ্রচার ও বৌদ্ধ সাহিত্যের চিনা অনুবাদের কাজে তারা জীবনের শেষ দিনগুলো চিনেই অতিবাহিত করেন। রাজাদের আগ্রহ ও অভিজাত সম্প্রদায়ের সক্রিয় সমর্থনে চিনে বৌদ্ধধর্ম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেযুগের এক বিখ্যাত পণ্ডিত মাও সে। কুনফুসীয় ধর্মমতের তুলনায় বৌদ্ধধর্ম অনেক উন্নত বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন। 

অন্যান্য ধর্ম

অন্যান্য ধর্মের বিকাশ : কুষাণরাজত্বকালে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্যান্য ধর্মের বিকাশ অব্যাহত থাকে। রাষ্ট্রের উদার দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন ধর্মের যুগপৎ বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল। মথুরা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কুষাণযুগের অনেক তীর্থঙ্করমূর্তি পাওয়া গেছে। এ অঞ্চলে পাওয়া জৈন লেখের সংখ্যাও বড় কম নয়। জৈনধর্ম যে এখানে ব্যাপক প্রসারলাভ করেছিল। তাতে কোনও সন্দেহ নেই। হুবিষ্কের সময়ের এক সিলমােহরের ছাঁচে এক দেবমূর্তি উৎকীর্ণ আছে। দেবতা চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও অঙ্গুরীয়ের মতাে একটি দ্রব্য ধারণ করে আছেন। দেবতার সামনে রাজা বিনীতভাবে করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কানিংহাম সাহেব দেবতাটিকে বিষ্ণু বলে শনাক্ত করেছেন। অনেকের ধারণা, এই সিলমােহরের ছাঁচ হুবিষ্কের নয়, প্রায় তিনশাে বছর পরেরকার এক হূণরাজের। হুবিষ্কের কিছু তামার মুদ্রায় উস্ন নামে আর এক চতুর্বাহ দেবতার মূর্তি খােদিত আছে। এ দেবতাটিকেও কেউ কেউ বিষ্ণু বলে মনে করেন। তাদের ধারণা হুবিষ্ক, অন্তত কিছু কালের জন্য হলেও, বাসুদেব-বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, হুবিষ্কের মুদ্রায় উৎকীর্ণ মূর্তিটি শিবের, বিষ্ণুর নয়। হুবিষ্ক হয়তাে বিষ্ণুভক্ত ছিলেন না কিন্তু এই বংশের এক রাজা যে বাসুদেব নাম ধারণ করেছিলেন তা তাে অস্বীকার করা যায় না। শুধু বাসুদেবের কেন, আরও চারজন বৃষ্ণি বীরের পূজার উল্লেখ আছে মথুরার নিকটবর্তী মােরা গ্রামে পাওয়া এ যুগের একখানি লেখে। এই বৃষ্ণি বীরদের ভগবান আখ্যা দেয়া হয়েছে। তারা হলেন বসুদেব ও রােহিণীর পুত্র সংকর্ষণ, বাসুদেব ও রুক্মিণীর পুত্র প্রদ্যুম্ন, প্রদ্যুম্নপুত্র অনিরুদ্ধ এবং বাসুদেব ও জাম্ববতীর পুত্র শাম্ব। পাঁচজন বীরের মধ্যে বাসুদেবের স্থান সকলের উপরে। জ্ঞান, বল, বীর্য, ঐশ্বর্য, শক্তি ও তেজ গুণের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে তার মধ্যে। সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ ও শাম্বের মধ্যে রয়েছে দুটি করে গুণ। 

পঞ্চরাত্র সম্প্রদায় ও ব্যূহবাদ : প্রায় এই সময় বাসুদেব-উপাসকদের এক গােষ্ঠী এক অভিনব দৃষ্টিকোণ ও রীতিতে বৃষ্ণিবীর পূজার প্রচলন করেন। এই গােষ্ঠী সম্ভবত আদিতে নারায়ণের উপাসক ছিলেন। এসময় যে পাঁচজন বৃষ্ণিবীরের উপাসনা প্রচলিত ছিল, তাদের মধ্যে শাম্বকে বাদ দিয়ে বাসুদেব, সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ, এই চার বৃষ্ণি পুরুষকে তারা পরবাসুদেব নামে এক সর্বশক্তিমান যৌগিক দেবতারূপে পূজার প্রচলন করেন। শাম্ব মূলত পারসিক দেবতা হওয়ায় তিনি এই যৌগিক দেবকল্পনায় স্থান পাননি। যে তত্ত্বের ভিত্তিতে এই যৌগিক দেবতার রূপকল্পনা হয়েছে সেই অস্ত্র বূহ্যবাদ নামে পরিচিত। আর বাসুদেব-উপাসকদের যে গােষ্ঠী এই মতবাদ অনুসরণ করেন তাদের নাম হল পাঞ্চরাত্র বা পাঞ্চরাত্রিক। মহাভারতে সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের যে পরিচয় দেয়া হয়েছে, ব্যূহবাদে তা উপেক্ষিত। মহাভারতে বলা হয়েছে, সংকর্ষণ বাসুদেবের অগ্রজ; প্রদ্যুম্ন বাসুদেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র, রুক্মিণীর গর্ভে তার জন্ম; অনিরুদ্ধ প্ৰদ্যুম্নের পুত্র। কিন্তু ব্যূহবাদ সংকর্ষণাদির এ পরিচয় স্বীকার করে না। ব্যূহবাদ বলে, সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ বাসুদেবের তিনটি ক্রমিক বিবর্তিত রূপ। বাসুদেব প্রথমে নিজের শরীর হতে সংকর্ষণ ও প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেন। সংকর্ষণের সঙ্গে প্রকৃতির সংযােগে প্রদ্যুম্ন ও মনঃ বা বুদ্ধির সৃষ্টি হয়। প্রদ্যুম্ন ও বুদ্ধির সংযােগে অনিরুদ্ধ ও অহংকারের উদ্ভব হয়। অনিরুদ্ধ ও অহংকারের সংযােগে পঞ্চমহাভূত ও ব্রহ্মার উৎপত্তি হয়। ব্রহ্মা পঞ্চমহাভূত থেকে জগৎ সৃষ্টি করেন। দেখা যাচ্ছে, পঞ্চরাত্ররা ব্যূহবাদের মধ্য দিয়ে বিশ্বসৃষ্টির রহস্য ব্যাখ্যা করেছেন। সৃষ্টিরহস্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তারা প্রকৃতি, মনঃ বা বুদ্ধি, অহংকার ও পঞ্চমহাভূত, সাংখ্যদর্শনের এই চারটি পরিভাষাও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তারা সাংখ্যের মতের দ্বারা প্রভাবান্বিত হননি। সাংখ্যমত অনুসারে চেতন পুরুষ ও জড়া প্রকৃতির সংযােগে প্রকৃতির বিকার হয় ও জগতের সৃষ্টি হয়। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযােগ জগতের নিমিত্ত কারণ। প্রকৃতি জগতের উপাদান কারণ। সৃষ্টির কাজে ঈশ্বরের কোনও ভূমিকা নেই। ঈশ্বর যে আছেন, তারও কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু ব্যূহবাদে বাসুদেবই জগতের স্রষ্টারূপে প্রতিভাত। সাংখ্যের প্রকৃতি নিত্য কিন্তু ব্যূহবাদের প্রকৃতি বাসুদেবের সৃষ্টি। সে যাই হােক, সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা আরােপিত হওয়ায় বাসুদেব আরও মহিমময় হয়ে উঠলেন। এই পর্বের কোনও পরবাসুদেব-মূর্তির নিদর্শন পাওয়া যায় না। যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে তা সবই পরবর্তী যুগের। শিল্পশাস্ত্রে এ ধরনের মূর্তিকে বৈকুণ্ঠ, বিষ্ণুঃ চতুর্মূর্তি ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই মূর্তির চারটি মুখ। সামনের বা পূর্ব দিকের মুখটি মানুষের। এটি বাসুদেবের প্রতীক। ডান বা দক্ষিণ দিকের সিংহমুখটি সংকর্ষণের। বাম বা উত্তরের বরাহমুখটি প্রদ্যুম্নের। পিছনের বা পশ্চিমদিকের ভীষণাকৃতির মুখটি অনিরুদ্ধের। যৌগিক দেবতাটি কখনও চতুর্ভুজ, কখনওবা অষ্টভুজ।

অবতারবাদ : ব্যূহবাদের পাশাপাশি পাঞ্চরাত্ররা আর একটি তত্ত্ব প্রচার করেন। সেটি বিভবতত্ত্ব বা অবতারবাদ। এই তত্ত্বের মর্মকথা হল, অধর্মের যখন প্রভুত্ব হয়, ধর্ম যখন হয় পীড়িত, শিষ্টকে দমন করে দস্তুত যখন জয়যুক্ত হয়, তখন ঈশ্বর পার্থিব রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। পৃথিবীতে অবতরণ করে ঈশ্বর শিষ্টদের বক্ষা করেন, দুস্কৃতদের বিনাশ করেন এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। গীতার সেই বিখ্যাত শ্লোক দুটি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় : ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।। পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কতাম। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।’ পঞ্চরাত্ররা বাসুদেব-বিষ্ণুর অবতারত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রাচীন বীরদের ও প্রজাপতি প্রভৃতি বিভিন্ন দেবতার কার্যকলাপ তাদের উপাস্য দেবতার উপর আরােপ করেন। দুই একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করা যায়। শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, প্রজাপতি কুর্মরূপে জীব সৃষ্টি করেছিলেন। শতপথ ব্রাহ্মণের আর এক কাহিনিতে আছে, এমুষ নামে এক বরাহ বিশাল এই পৃথিবীকে উত্তোলন করে প্রজাপতির সন্তোষ বিধান করেন। শতপথ ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে বর্ণিত আর একটি কাহিনি হতে জানা যায়, পৃথিবী যখন জলমগ্ন তখন প্রজাপতি ব্রহ্মা মৎস্যরূপ ধারণ করে মনুকে উদ্ধার করেছিলেন। পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায় তাদের উপাস্য দেবতার মহিমা বৃদ্ধির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার এসব কার্যকলাপ বাসুদেব-বিষ্ণুর উপর আরােপ করে তার অবতারত্ব প্রচার করেন। পরশুরাম, রাম-দাশরথি এবং কৃষ্ণ-বাসুদেবের সঙ্গে বিষ্ণুর সমীকরণ যখন সর্বজনীন ও পরিণত রূপ লাভ করল তখন তারাও বিষ্ণুর অবতাররূপে কল্পিত হন। কুষাণপর্বে বাসুদেব-বিষ্ণুর অবতারবাদ অঙ্কুরিত হলেও তা সুস্পষ্ট ও পরিণত রূপ লাভ করেনি। অবতারদের সংখ্যা ও স্বরূপ নিয়ে তখন কোনও স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি। আপামর জনসাধারণ যে সাদরে এই নতুন তত্ত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তাও মনে হয় না। সমকালীন যুগে অবতার-মূর্তির অপ্রতুলতা তাই প্রমাণ করে।

বিস্তৃতি: কুণযুগেও ভাগবতধর্ম তার আঞ্চলিকতার পরিচয় ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। ভারতের কয়েকটি অঞ্চলেই এর প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকে। মথুরা অঞ্চলে এর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। মধ্যপ্রদেশের বিদিশা ও উত্তরপ্রদেশের অহিচ্ছত্র অঞ্চলেও এর সুপ্রতিষ্ঠা ছিল। এই ধর্মের আর একটি উল্লেখযােগ্য কেন্দ্র ছিল মধ্যপ্রদেশের গুণা অঞ্চল। খ্রিস্টীয় ২য় – ৩য় শতকের এক বলরামমূর্তি এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে এক প্রাচীন মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া গেছে। মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যে কৃষ্ণের জীবনের নানা কাহিনির রূপায়ণ দেখা যায়। বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের বরেন্দ্র সংগ্রহশালায় লাল বেলে পাথরের তৈরি এক চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি সংরক্ষিত আছে। মূর্তিটি মালদহ অঞ্চলে পাওয়া গেছে। মূর্তিটি সম্ভবত কুষাণপর্বের। ভাগবতধর্ম সম্ভবত এই পর্বেই উত্তর বাংলায় বিস্তার লাভ করেছিল। 

নামকরণ : আর একটি কথা। বাসুদেব, কৃষ্ণ, নর, নারায়ণ ও বিষ্ণুর উপাসনা প্রসঙ্গে আমরা কখনও কখনও বৈষ্ণব নামটি ব্যবহার করেছি। কিন্তু প্রাক-গুপ্তপর্বে এই কথাটির প্রয়ােগ দেখা যায় না। আদি গ্রন্থাদিতে এই উপাসনাকে একান্তিক, ভাগবত, সাত্বত, পাঞ্চরাত্র ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতি একান্ত নিষ্ঠা, এই অর্থে একান্তিক। এই সম্প্রদায় একায়নপন্থী হিসাবেও পরিচিত। বাসুদেব সাত্বত শাখায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নাম সাত্বত হয়েছে। বাসুদেব ভগবৎ। ভগবতের উপাসক এই অর্থে ভাগবত। পঞ্চরাত্র শব্দটির ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। পাঁচটি রাত লাগত সম্পন্ন করতে, এমন কোনও যজ্ঞের নাম থেকে হয়তো পাঞ্চরাত্র কথাটি এসেছে। যে ধর্মে উপাস্য দেবতা ব্যূহ, পর, বিভব, অন্তর্যামী ও অর্চা এই পাচটি রূপে কল্পিত হয়েছেন, সেই ধর্মই পাঞ্চরাত্র, এমন অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। আবার এমন যুক্তিও দেয়া হয়েছে, যে ধর্মে তত্ত্ব, যুক্তি, ভক্তি, যােগ ও বৈশেষিক সংশ্লিষ্ট, সেই ধর্মই পাঞ্চরাত্র।

শিব-উপাসনা : বিম কদফিসেস, প্রথম কণিষ্ক, হুবিষ্ক প্রভৃতি কুষাণরাজগণের মুদ্রায় শিবের মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। মুদ্রায় শিব কখনও নিঃসঙ্গ, আবার কখনওবা পত্নী উমা তার সহচরী। কখনও তিনি এক মুখ, কখনওবা ত্রিমুখ। শিবের পুত্র স্কন্দ-কুমার, বিশাখ এবং মহাসেনের মূর্তিও খােদিত আছে। স্কন্দ, বিশাখ ও মহাসেন কার্তিকেয়ের বিভিন্ন নাম। কিন্তু কুষাণযুগে তারা এক একজন স্বতন্ত্র দেবতা ছিলেন। আফগানিস্তানে বলখের নিকট কুষাণযুগের এক শিব মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই অঞ্চলে শৈব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের এটি একটি বড় প্রমাণ। উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রাপ্ত এক কুয়াণ লেখে শিবস্থলের উল্লেখ আছে। শিবস্থলকে অনেকে শিবমন্দিররূপে ব্যাখ্যা করেছেন। মথুরার কাছে কুষাণ আমলের একখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন এই লেখে সর্ব (শিব) এবং চণ্ডবীরের উদ্দেশ্যে হুবিষ্কের পিতামহের রাজ্যসম্প্রদানের কথা বলা হয়েছে।

শিব ও বিষ্ণুর অভেদত্ব : মনে হয়, সেসময় শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনেকে শিব ও বিষ্ণুকে অভিন্ন দেবতাজ্ঞানে পূজা করতেন। এ প্রসঙ্গে হুবিধের এক ধরনের সুবর্ণমুদ্রার কথা মনে। পড়ে। এই মুদ্রার বিপরীত দিকে শিবের মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। তিনি উলিঙ্গ, চারটি হাত দিয়ে তিনি ছাগ বা হরিণ, ত্রিশূল, বজ্র ও চক্র ধারণ করে আছেন। বজ্র এবং চক্ৰ বিষর আয়ুধ। শিবের হাতে বিষ্ণুর আয়ুধ উপস্থাপনা করে সম্ভবত শিব ও বিষ্ণুর অভেদত্ব বােঝানাে হয়েছে। পরবর্তিকালে হরিহর মূর্তি নির্মাণ করে শিব ও বিষ্ণুর একাত্মতা আরও সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। হরিহর মূর্তির বাম ও দক্ষিণাঙ্গ যথাক্রমে বিষ্ণু ও শিবের আদলে কল্পিত।

পাশুপত উপসম্প্রদায় : এসময় শৈবদের মধ্যে পাশুপত নামে এক নতুন উপসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এই উপ-সম্প্রদায়ের প্রবর্তক লকলীশ বা নকুলীশ। তিনি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ২য়। শতাব্দীর প্রথম দিকে গুজরাতের কায়াবতার বা কায়ারােহণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাশুপত উপসম্প্রদায়ের লােকেরা লকুলীশকে শিবের আঠাশতম বা সর্বশেষ অবতাররূপে গণ্য করেন। পাশুপত ধর্মের মূল কথা হল, দুঃখের নিবৃত্তি। জীব দুঃখ ভােগ করে যতক্ষণ পর্যন্ত সে পাশে। বা বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, সে অবিশুদ্ধ থাকে। বন্ধন হতে মুক্ত হলেই জীব শুদ্ধ হয়, তার দুঃখের নিবৃত্তি হয়। জীবের এই বন্ধনমুক্তি তথা দুঃখের নিবৃত্তির দু’টি পথ – একটি যােগ ও অপরটি বিবি। যােগ বলতে বােঝায় মন্ত্রপাঠ, ধ্যান আর অনুভূতি। বিধি হচ্ছে আচার-অনুষ্ঠান । এর মধ্যে। রয়েছে দেহে ছাই মাখা, ছাই-এর গাদায় শয়ন করা, হাসি-গান-নাচ-হুড়ার ধ্বনি করা, উচ্ছিষ্ট খাদ্য গ্রহণ করা, পাগলের মতাে আচরণ করা, প্রলাপ বকা ইত্যাদি আচরণ। এসব আচরণের মাধ্যমে ভক্ত তার পাশ বা বন্ধন মুক্ত করেন, পশুপতি বা ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হন। 

সুর্য : কুষাণ মুদ্রায় সূর্যমূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। সূর্যকে মুদ্রায় মিহির বা মিথ্র বলা হয়েছে। অতি প্রাচীনকাল হতেই ভারতে সুর্যোপাসনা প্রচলিত ছিল। কিন্তু কুষাণ মুদ্রায় উৎকীর্ণ সূর্যমূর্তি মুলত ইরানীয় সূর্যদেবতার অনুকরণ। বস্তুত সূর্যের জাঁকজমকপূর্ণ পূজাবিধি ইরান থেকেই আমদানি হয়। মগদ্বিজ বা শাকদ্বীপী পুরােহিতরাই এই পূজা করতেন। তারা ইরান থেকে এদেশে আসেন। বরাহমিহির বলেছেন, মগ ব্রাহ্মণরাই সূর্যমন্দিরে পুরােহিতের কাজ করবেন। বরাহমিহির আরও বলেছেন, সূর্য উদীচ্যবেশে সজ্জিত হবেন, তার কটিদেশে থাকবে বিয়ঙ্গ। উদীচ্যবেশ বলতে শক, পহ্লব, কুষাণ প্রভৃতি বৈদেশিক রাজন্যবর্গের পােশাক বােঝায়। বিয়ঙ্গ হল এক ধরনের মেখলা। সুর্যমতির পায়ে কখনও কখনও বুটজুতা দেখা যায়। এসব জিনিস নিঃসন্দেহে বৈদেশিক প্রভাবের ফল। মথুরায় এই পর্বের কয়েকটি পাথরের সূর্যমূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে।

নাগ : হুবিষ্কের সময় নির্মিত এক বিরাটকায় নাগমূর্তি ছারগাঁও গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। মূর্তিটির পাদদেশে ‘ভগবান নাগ’ কথা কটি লেখা আছে। কণিষ্কের সময়কার এক নাগমূর্তি মথুরার সরকারি প্ৰত্বশালায় সন্ত্রক্ষিত আছে। ব্রাহ্মণ্যদেবতা শিবের সঙ্গে সপের নিবিড় সম্পর্ক, কিন্তু বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের সঙ্গে নাগকুলের ঘাের শত্রতা।

লিঙ্গপূজা : দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর মনে করেন কুষাণযুগে লিঙ্গপূজার প্রচলন ছিল কিন্তু লিঙ্গ তখনও শিবের প্রতীকরূপে স্বীকৃত হয়নি। এ মত ঠিক নয়। মথুরার সরকারি প্রত্নশালায় খ্রিস্টীয় ১ম শতকের একটি ভগ্ন প্রস্তরফলক সংরক্ষিত আছে। এ ফলকটিতে একটি লিঙ্গমূর্তি উৎকীর্ণ – লিঙ্গের সামনে দু’জন বিদেশি বিনম্রভাবে দাঁড়িয়ে। বিদেশিদের গায়ে ভারী কোট, পায়ে জুতা এবং হাতে দ্রাক্ষার মালা। লিঙ্গটি অবশ্য সম্পূর্ণ বাস্তবানুগ নয়। এটি শিবলিঙ্গ বলেই মনে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের একটি পাথরের লিঙ্গ অন্ধ্রপ্রদেশের গুডিমল্লম গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। লিঙ্গটির গায়ে একটি পরশু ও মৃগধারী দ্বিভুজ শিবের মূর্তি উৎকীর্ণ। লিঙ্গটি যে শিবলিঙ্গ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শিবের লিঙ্গরূপে পূজার প্রথা যে কুষাণ আমলের পূর্বেই প্রচলিত ছিল গুডিমল্লম লিঙ্গ তার অকাট্য প্রমাণ।

স্থাপত্য, ভাষ্কর্য ও সাহিত্য

স্থাপত্য 

  • বুদ্ধের দেহাবশেষের উপর কণিষ্কের নির্মিত সু-উচ্চ মিনার : বর্তমান পেশােয়ারের নিকট শাহ-জী-কী-ঢেরিতে বুদ্ধের দেহাবশেষের উপর কণিষ্ক যে সু-উচ্চ মিনার নির্মাণ করেছিলেন সেটিই নিঃসন্দেহে কুষাণযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি। কালের প্রভাবে বর্তমানে এটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এই ধ্বংস স্তূপের মধ্য হতে বুদ্ধের দেহাবশেষ সম্বলিত ক্ষুদ্রাকারের এক পাত্ৰাধার পাওয়া গেছে। পাত্ৰাধারটি বর্তমানে পেশােয়ারের সরকারি প্রশালায় সংরক্ষিত আছে। তখনকার দিনে এই মিনারের খ্যাতি সারা এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। মূলত কাঠের তৈরি ত্রয়ােদশতল এ মিনার উচ্চতায় ছিল ২০৩ মিটার। প্রায় দু’শাে বছর পর যখন চিনা পরিব্রাজক ফা শিয়েন এটি দেখেন তখন এর কিছুটা অংশ ভেঙে পড়েছিল। যা অবশিষ্ট ছিল তা দেখে মুগ্ধ, বিস্মিত চিনা পরিব্রাজক বলেন এ মিনারের কোনও তুলনা নেই। শুয়েন চাঙ তার ভারত বৃত্তান্তে এই মিনারের উল্লেখ করেছেন।
  • ভগ্নস্তুপসমূহ : পেশােয়ার ও সন্নিহিত অঞ্চলে এ যুগে নির্মিত অনেক ভগ্নস্তুপের সন্ধান পাওয়া যায়।। পাঞ্জাবের মানিকিয়ালার বড় স্তুপটিও এসময় নির্মিত হয়। কুষাণপের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ে। স্তূপগুলোকে দীর্ঘায়িত করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পূর্ববর্তী যুগের স্তূপগুলোতে বেদিকার পরই অণ্ডের অবস্থান। কিন্তু এই পর্বে বর্গাকার বেদিকা ও অণ্ডের মাঝখানে হয়েছে নলাকার মেধির উপস্থাপনা। বেদিকা ও মেধি সুচারু ভাস্কর্যে মণ্ডিত। অণ্ডের উপরে রয়েছে বর্গাকার হর্মিকা। হর্মিকাশীর্ষে শ্রেণিবদ্ধ ছত্রাবলি। কণিষ্কের রাজত্বকালে এগেসিলাস নামে জনৈক গ্রিক স্থপতি ছিলেন। তিনি তক্ষশিলার কাছে একটি বৌদ্ধ স্তূপ নির্মাণ করেন।
  • দেবকুল : উত্তরপ্রদেশের মাহেট ও আফগানিস্তানের সুখকোটালে কুষাণযুগের দু’টি দেবকুলের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেবকুল দুটি আয়তাকারের। প্রথমটি ইটের তৈরি, দ্বিতীয়টি ইট ও পাথরের। প্রতিটি দেবকুলের একটি করে মূল কক্ষ। মাহেটের মূল কক্ষটি বর্গাকার, সুখকোটালের কক্ষটি বর্তুলাকার। এই ধরনের কক্ষে মৃত রাজাদের মূর্তি সযত্নে রক্ষিত হত। মাহেটে দেবকুলের মূল কক্ষে বিম কদফিসেসের এক বিরাটকায় মূর্তি পাওয়া গেছে।

ভাস্কর্য

  • গান্ধার ও মথুরা অঞ্চলে কুষাণ ভাস্কর্যের বিকাশ : স্থাপত্যের তুলনায় কুষাণযুগের ভাস্কর্যের নিদর্শন প্রচুর। আফগানিস্তান ও পাঞ্জাব জুড়ে বৃহত্তর গান্ধার ও মথুরা অঞ্চলেই কুষাণ ভাস্কর্যের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। গান্ধার ও মথুরা উভয় শিল্পধারায় অনিবার্যভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এসে পড়েছে। বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ সময় প্রচুর বুদ্ধমূর্তি নির্মিত হয়। মূর্তিনির্মাণে প্রথম দিকে কালাে রঙের ধূসর শ্লেট পাথর ও পরের দিকে স্টাকো ব্যবহৃত হতে থাকে। বুদ্ধমূর্তিগুলোকে স্থানক বা দাঁড়ানাে, আসন বা উপবিষ্ট ও শয়ান, এই তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়। বুদ্ধ কখনও নিঃসঙ্গ, কখনও বা পরিজন, পরিবৃত। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার জীবনের কোনও না কোনও ঘটনা উপস্থাপিত। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধের শয়ান মূর্তির উল্লেখ করা যায়। এখানে শিল্পীর কুশীনগরে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ দৃশ্যের রূপকল্পনা। বুদ্ধ পাশ ফিরে শায়িত। তার মাথার নিচে একটি হাত। পাশে ভবণ দুটি শালতরু। কুশীনগরের যে শালকুঞ্জে বুদ্ধের দেহত্যাগ এ শালতরু তারই প্রতীক। শয্যাপার্শ্বে রয়েছেন শােকমগ্ন বজ্ৰপাণি আর তার প্রিয় শিষ্য আনন্দ। রয়েছেন ধ্যানমগ্ন শ্রমণ সুভদ্র। বুদ্ধের পায়ের কাছে যষ্টিহাতে দাঁড়িয়ে আছেন কাশ্যপ।
  • গ্রিকরীতিতে বুদ্ধ-বােধিসত্ত্বের মূর্তি গঠন : বুদ্ধ-বােধিসত্ত্বের মূর্তি গঠনে গান্ধার-শিল্পী গ্রিকরীতি অনুসরণ করেছেন। গ্রিকরীতির প্রতি ফলন ঘটেছে মূর্তিগুলোর শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিখুঁত রূপায়ণে, তাদের গায়ের চাদর ও কাপড়ের ভাজে, কেশের বিন্যাসে, পাদুকার ব্যবহারে, গুল্ফের উপস্থাপনায় ও দাড়ানাের ভঙ্গিমায়। কিন্তু শিল্পী শুধু অনুকরণ করেননি তিনি তার স্বকীয়তার পরিচয়ও প্রদর্শন করেছেন। স্বকীয়তা প্রকাশ পেয়েছে অর্ধনিমীলিত নয়নের গঠনে ও নাসাগ্রে নিবদ্ধ দৃষ্টির রূপায়ণে। সুঠাম ও নমনীয় দেহগঠন সত্ত্বেও গান্ধারের বুদ্ধ-বােধিসত্তমূর্তি ভাব ও গাম্ভীর্যে তেমন মহিমান্বিত হয়ে ওঠেনি।
  • দেশীয় শিল্পরীতিতে মথুরার ভাষ্কর্য : তুলনায় মথুরার ভাস্কর্যে দেশীয় শিল্পরীতি প্রাধান্য পেয়েছে। যক্ষ ও দ্বারপালদের অনুকরণে এ অঞ্চলের বুদ্ধ-বােধিসত্ত্ব মূর্তিগুলো নির্মিত হয়েছে। এখানকার বুদ্ধ-বােধিসত্ত্ব বিশালকায়, গুরুভার, মুণ্ডিতমস্তক, স্মিত-আনন, অবারিতনয়ন, গুম্ফহীন, ঊর্ণা-বিহীন; ডান হাত অভয় মুদ্রার ভঙ্গিতে আস্কন্ধ বিস্তৃত, বাম হাত আ-ঊর্ণু প্রসারিত। যে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা দেবপ্রতিমাকে দিব্যশ্রী দান করে মথুরার মূর্তিতে তা অপ্রতিভাত। এ মূর্তি পার্থিবতায় মলিন, স্থূল। সিক্রি থেকে সংগৃহীত লাল ছােপযুক্ত বেলে পাথর দিয়ে মথুরার বুদ্ধ-বােধিসত্ত্ব মূর্তিগুলো তৈরি হয়েছে। তবে মথুরার ভাস্কর্যে গান্ধারশিল্পরীতির প্রভাব যে একেবারে পড়েনি তা নয়। রাজ-রাজড়াদের মূর্তিতেই এ প্রভাব বেশি। এই মূর্তিগুলোর মাথায় শিরস্ত্রাণ, পায়ে পাদুকা, ডান হাতে রাজদণ্ড ও অন্য হাতে কৃপাণ। কুষাণপর্বের রাজ-রাজড়াদের মূর্তিগুলোর মধ্যে কণিষ্কের মুণ্ডহীন মূর্তি সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। মথুরায় পাওয়া কুষাণযুগের যক্ষ-যুক্ষিণী মূর্তিগুলোর কথাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। মূর্তিগুলো স্থূল, বিশাল ও গুরুভার। 
  • বাহ্লিক শিল্পশৈলী : গান্ধার ও মথুরার মতাে কুষাণ শিল্পধারার আর এক উল্লেখযােগ্য কেন্দ্র আফগানিস্তানের বাহ্লিক। আফগানিস্তান ও সন্নিহিত অঞ্চলে কুষাণযুগের যেসব মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো মুখমণ্ডলের আকারে ও উপস্থাপনায়, চোখের দৃষ্টিতে এবং কেশের বিন্যাসে সমকালীন মথুরা ও গান্ধারের মূর্তি হতে পৃথক, স্বতন্ত্র। এসব মূর্তিতে যে শিল্পধারার অনুসরণ দেখা যায় পণ্ডিতেরা তাকে বাহ্লিক শিল্পশৈলী আখ্যা দিয়েছেন। 
  • পোড়ামাটির মূর্তি : পােড়ামাটি দিয়ে তৈরি গ্রিক, রােমক, পারসিক, শক প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মূর্তি পাটনা, মথুরা, অহিচ্ছত্র প্রভৃতি স্থানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে। সাত ঘােড়ার রথে বসা সূর্যদেব, ভেড়ার পিঠে অগ্নিদেব, হাতির পিঠে ইন্দ্র ও স্থূলােদর কুবেরের পােড়ামাটির মূর্তিও পাওয়া গেছে। পােড়ামাটির নানা প্রকার খেলনাও আবিষ্কৃত হয়েছে।

সাহিত্য

  • মনুসংহিতা : বর্তমানে কবিতার আকারে মনুর নামে যে গ্রন্থখানি পাওয়া যায় সেই মনুসংহিতা সম্ভবত কুষাণপর্বেরই রচনা। ধর্মশাস্ত্রকার মনু সম্ভবত কুষাণযুগের পূর্বেই আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং সুত্রের আকারে একখানি গ্রন্থ লেখেন। বর্তমান মনুসংহিতা সেই আদি মানব ধর্মশাস্ত্রের পরিবর্তিত সংস্করণ। বর্ণাশ্রম ও শাস্ত্র-নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের উপরই এই গ্রন্থে জোর দেয়া হয়েছে। এই গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে সর্বজ্ঞ মনু ধর্ম সম্পর্কে যা বলেছেন বেদে তার সমর্থন আছে : যঃ কশ্চিদ কস্যচিৎ ধর্ম মনুনা পরিকীর্তিতঃ স। সর্বোহভিহিতাে বেদে সর্বজ্ঞানময়াে হি সঃ।। বলতে দ্বিধা নেই, মনুসংহিতা গ্রন্থের স্থানে স্থানে এক রক্ষণশীল ও সংকীর্ণমনা সমাজপতির ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
  • অশ্বঘােষ : এ যুগের এক বিখ্যাত সাহিত্যিক অশ্বঘােষ। তার লেখা নাটক ‘শারিপুত্রপ্রকরণ’ মধ্য এশিয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে। কী কারণে মৌদগল্যায়ন ও শারিপুত্র বুদ্ধের ধর্মমত গ্রহণ করলেন তা এই নাটকে বর্ণিত আছে। নাটকটি মূলত সংস্কৃতে রচিত হলেও নাট্যকার কয়েকজন পাত্রপাত্রীকে প্রাকৃত ভাষায় কথা বলিয়েছেন। অশ্বঘােষের লেখা দুটি শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সৌন্দরনন্দ’ও ‘বুদ্ধচরিত’। বুদ্ধের বৈমাত্রেয় ভাই নন্দর বৌদ্ধধর্মে দীক্ষান্তর প্রথম কাব্যের উপজীব্য। গৌতমবুদ্ধের জীবনী দ্বিতীয় কাব্যখানির বিষয়বস্তু। বুদ্ধচরিত কাব্যে রামায়ণের প্রভাব পড়েছে। সিদ্ধার্থের পিতা শুদ্ধোদন দশরথের সঙ্গে তুলনীয়। সুন্দরী সীতার ছায়া। রামকে বনে রেখে শূন্য রথ অযােধ্যায় ফিরে এলে পুরবাসীরা শােকে মুহ্যমান হন। তেমনি সিদ্ধার্থকে কিছু দূরে ছেড়ে দিয়ে তার বাহন কণ্ঠক কপিলাবস্তুতে ফিরে এলে নগরবাসীরাও গভীর দুঃখে আচ্ছন্ন হন। ‘মহাযানশ্রদ্ধোৎপাদ’, ‘বজ্রসূচী’, ‘গণ্ডীস্তোত্রগাথা’ প্রভৃতি আরও কয়েকখানি গ্রন্থ অশ্বঘােষ রচনা করেন। প্রথম গ্রন্থখানি মহাযান বৌদ্ধধর্মের উপর লেখা। দ্বিতীয় গ্রন্থে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লেখকের প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। ‘সুত্রালংকার’ বা ‘কল্পনামণ্ডিটিকা’-কে পূর্বে অশ্বঘােষের লেখা বলে মনে করা হত। আসলে গ্রন্থখানি কুমারলাতের লেখা। কুমারলাত অশ্বঘােষের পরবর্তী। 
  • ভরত : এ যুগের এক বিখ্যাত সাহিত্যসমালােচক ভরত। নাট্যশাস্ত্রের প্রণেতা তিনি। গ্রন্থখানি কবিতা, ছন্দ, গান, নৃত্য ও নাটকের ব্যাকরণের মতাে। ভরত বলেন, কাব্যে রসই প্রধান, অলংকার গৌণ। ভরত কোনও কুষাণরাজের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিলেন বলে জানা যায় না। 
  • চরক ও সুশ্রত : চরক কুষাণরাজ প্রথম কণিষ্কের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন, এরূপ একটি ধারণা প্রচলিত আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর তিনি এক সংহিতা রচনা করেন। চরকের মূল গ্রন্থখানি পাওয়া যায় না। যেটি পাওয়া যায় সেটি মূল গ্রন্থের সংশােধিত সংস্করণ। সংস্করণের কাজ করেন খ্রিস্টীয় ৯ম শতকের কাশ্মীরি বৈদ্য দৃঢ়বল। শুধু ভারতে নয়, ঐস্লামিক জগতেও এই গ্রন্থটি এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। আরবি ও ফারসি ভাষায় পর্যন্ত গ্রন্থটি অনূদিত হয়। শারীরিক ও মানসিক রােগ, অস্ত্রোপচার, বিষক্রিয়ার প্রতিষেধন, পুনর্নবীকরণ, শিশুরােগ, বাজীকরণ প্রভৃতি চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা সমস্যা এই গ্রন্থে আলােচিত হয়েছে। চরকেরই প্রায় সমসাময়িক সুশ্রুত চিকিৎসাবিজ্ঞান বা আয়ুর্বেদের উপর লেখা তার বইটি বিখ্যাত হয়ে আছে (সুশ্ৰত চরকের বহুকাল পূর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন, এরূপ অভিমত ব্যক্ত হয়েছে)। তবে মূল সুশ্রুতসংহিতা পাওয়া যায় না। গ্রন্থটির দুটি সংস্করণ আছে – একটি চন্দ্রট, অপরটি নাগার্জুন সম্পাদিত। 
  • জৈন অঙ্গ ও উপাঙ্গের উপর ছন্দে লেখা নিযুক্তিগুলো : জৈন অঙ্গ ও উপাঙ্গের উপর ছন্দে লেখা নিযুক্তিগুলো কুষাণযুগের রচনা বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন।

ভারতের ইতিহাসে কুষাণযুগ বিশেষভাবে স্মরণীয়। এ সময় ভারতের সঙ্গে একদিকে মধ্য এশিয়া ও চিন এবং অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়া ও রােমক সাম্রাজ্যের নিবিড় যােগসূত্র স্থাপিত হয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিরও পরিপুষ্টি সাধন হয়। অথচ যারা হােতা সেই কুষাণরা বিজয়ীর বেশে ভিনদেশ হতে ভারতে এসেছিলেন। কিন্তু অতি অল্পদিনের মধ্যে এ দেশকে তারা আপন করে নেন। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে, এ দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতিকেই আশ্রয় করে, তারা ভারতের মহামানবের মহাসাগরে বিলীন হয়ে যান।

কুষাণােত্তর পর্ব

রাজনৈতিক ইতিহাস

কুষাণােত্তর পর্বে কী উত্তর, কী দক্ষিণ, ভারতের কোনও অঞ্চলেই বৃহদায়তন রাষ্ট্রের পত্তন হয়নি, পত্তন হয়েছিল সংখ্যাতীত ক্ষুদ্র আঞ্চলিক রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যেমন ছিল রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তেমনি ছিল গণরাষ্ট্র। খণ্ডিত, বিক্ষিপ্ত রাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম এমন কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়নি এই পর্বে। ফলে কুষাণােত্তর পর্ব ভারতের ইতিহাসে এক রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার ও অনৈক্যের পর্ব বলে চিহ্নিত।

ভারশিব রাজ্য

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল এই পর্বের ভিন্নতর চিত্র অঙ্কন করেছেন। তিনি বলেন, এই পর্বে ভারশিব রাজবংশ প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল এবং বিদিশা, মথুরা, কান্তিপুরী ও পদ্মাবতীর মতাে বিখ্যাত নগরগুলো-সহ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে বিশাল এক সাম্রাজ্য গঠন করেছিল। মালব, যৌধেয়, আর্জুনায়ন প্রভৃতি গণরাজ্যগুলো ভারশিবদের প্রভুত্ব স্বীকার করেছিল। এই বংশের রাজারা যে দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন বাকাটক লেখে তা স্পষ্ট বলা হয়েছে। কাশীপ্রসাদ মনে করেন দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান ভারশিব রাজাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের পরিচয় বহন করে। তিনি আরও বলেন যৌধেয়, আর্জুনায়ন প্রভৃতি অনুগত মিত্র রাজ্যগুলোর সক্রিয় সমর্থন ও সাহায্যে ভারশিবরা যে আঘাত হানেন তার ফলে কুষাণ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। 

কুষাণােত্তর পর্বে ভারশিবরা যে রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না। পুরাণে তাদের উল্লেখ নেই সত্য কিন্তু বাকাটক লেখে তাদের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। ভারশিবনৃপতি ভবনাগের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার কথা বাকাটক রাজারা সদম্ভে ঘােষণা করেছেন। কিন্তু ভারশিবরা উত্তর ও দক্ষিণ ভারত জুড়ে বিশাল এক রাজ্য গঠন করেছিলেন বলে কাশীপ্রসাদ যে অভিমত প্রকাশ করেছেন তা নানা কারণে গ্রহণীয় নয় –

  • প্রথমত, কুষাণােত্তর ভারতে কোনও বৃহদায়তন রাষ্ট্রের কল্পনা করা কঠিন। সে সময় উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এক একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ে উঠেছিল; পশ্চিম গান্ধার তখন ষাক রাজাদের অধীনস্থ, গুজরাত ছিল পশ্চিমা ক্ষত্ৰপরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত, পাঞ্জাব ছিল ষীলদ ও গডহর রাজগণের অধিকারভুক্ত, মধ্যপ্রদেশের রেওয়া অঞ্চল জুড়ে ছিল মঘ রাজাদের রাজত্ব, আর পাটলিপুত্র ও সন্নিহিত অঞ্চল ছিল মুরুণ্ডরাজগণের পদানত। সমকালীন ভারতের এই রাজনৈতিক চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বিশাল এক ভারশিব রাজ্যের অস্তিত্ব যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
  • দ্বিতীয়ত, তখন বিদিশা, কান্তিপুরী, মথুরা ও পদ্মাবতী জুড়ে হয়তাে এক অখণ্ড নাগরাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল কিন্তু এই রাষ্ট্র কাশীপ্রসাদের কল্পিত বৃহদায়তন ভারশিব রাজ্যের তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র ছিল। তাছাড়া এই নাগ রাজারাই যে ভারশিব ছিলেন, তার সপক্ষে কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই।
  • তৃতীয়ত, তখনকার দিনে অশ্বমেধ যজ্ঞের তেমন কোনও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল না। ক্ষুদ্র নরপতি অথচ একাধিক অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন এমন দৃষ্টান্ত ভারতের ইতিহাসে দুর্লভ নয়।
  • চতুর্থত, ভারশিবদের কুষাণ রাজাদের বিরুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ সাফল্যের সপক্ষে যেমন কোনও প্রমাণ নেই তেমনি ভারশিদের প্রতি আর্জুনায়ন, যৌধেয় ইত্যাদি গণরাজ্যগুলোর আনুগত্যের সমর্থনেও কোনও বিশ্বাসযােগ্য তথ্য নেই।

মেঘ বা মঘ রাজ্য

বরঞ্চ তথ্য যা তাতে কিন্তু সে সময় উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ক্ষুদ্র, স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বই প্রমাণিত হয়। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের প্রথম ভাগে মধ্যপ্রদেশের রেওয়া অঞ্চলে মেধা বা মঘ নামে এরূপ একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজ্যের স্থপতি বাশিষ্ঠীপুত্র ভীমসেন প্রথম দিকে সম্ভবত কুয়াণরাজ হুবিষ্কের অধীনস্থ ছিলেন। পরে তিনি কুষাণশক্তির দুর্বলতার সুযােগে বান্ধোগড়ে এক স্বাধীন রাজ্যের পত্তন করেন। মুদ্রার সাক্ষ্য হতে জানা যায় তার রাজত্বের শেষের দিকে কুষাণদের হাত থেকে তিনি কৌশাম্বীর একাংশ অধিকার করেন। ধনদেব নামে আর একজন রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী প্রায় একই সময় কৌশাম্বীর অপরাঞ্চল অধিকার করেন। 

ভীমসেনের মৃত্যুর পর তার বৈমাত্রেয় ভাই বা পুত্র শিবমঘ বান্ধোগড়ের সিংহাসনে আরােহণ করেন। ধনদেব বা তার উত্তরাধিকারীকে পরাজিত করে তিনি সমগ্র কৌশাম্বী অধিকার করেন। শিবমঘের মৃত্যুর পর রাজপরিবারে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিলে রাজ্যটি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। বান্ধোগড় ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের কর্তৃত্ব করেন ভীমসেনের পুত্র প্রৌষ্ঠশ্রী আর কৌশাম্বী চলে যায় ভদ্রমঘের (শিবমঘের পুত্র?) অধিকারে। 

প্ৰেষ্ঠিশ্রীর মৃত্যুর পর তার পুত্র ভদ্রদেব (ভট্টদেব) বান্ধোগড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। বান্ধোগড়ের আর একজন রাজা ছিলেন বাশিষ্ঠীপুত্র চিত্রসেন। অনেকে মনে করেন চিত্রসেন প্রৌষ্ঠশ্রী ও ভদ্রদেবের মধ্যবর্তী সময়ে বান্ধোগড়ে রাজত্ব করেন। এ সময় বৈশ্রবণ কৌশাম্বীর সিংহাসনে আসীন ছিলেন। তার কয়েকখানি লেখ বান্ধোগড় ও সন্নিহিত অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর থেকে মনে হয় তিনি ভদ্রদেব বা তার উত্তরাধিকারীকে পরাজিত করে বান্ধোগড় অধিকার করেন। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টাব্দে বৈশ্রবণের মৃত্যু হলে ভীমবৰ্মা বান্ধোগড় ও কৌশাম্বার অধীশ্বর হন। ২২৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তার রাজত্বের অবসান হয়। কিন্তু বান্ধোগড-কৌশাম্বী রাজ্যটি আরও অর্ধশতাব্দী কাল অটুট থাকে। এই পর্বে শতমঘ, বিজয়মঘ, পুরুমঘ, যমঘ, শমঘ এবং জয়মঘ প্রভৃতি রাজা রাজত্ব করেন। এসব রাজাদের নামাঙ্কিত মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। কীভাবে মঘ রাজ্য ধ্বংস হল তা জানা যায় না। ভিটায় গৌতমীপুত্র বৃষব্বজ নামে জনৈক স্থানীয় রাজার কয়েকখানি সিলমােহর পাওয়া গেছে। সিলমােহরগুলো খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের বলে মনে হয়। গৌতমীপুত্রই সম্ভবত মঘদের বিতাড়িত করেন। কৌশাম্বীতে রুদ্র নামে এক রাজার মুদ্রা পাওয়া গছে। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে রুদ্রদেব নামে একজন রাজার কথা বলা হয়েছে যিনি গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্তের হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। মুদ্রার রুদ্র ও এলাহাবাদ প্রশস্তির রুদ্রদেব সম্ভবত একই ব্যক্তি ছিলেন। এই ধারণা সঠিক হলে স্বীকার করতে হয়, কৌশাম্বী গুপ্তবাজ সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে গুপ্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

মগধ

কুষাণােত্তর পর্বে মগধের রাজনৈতিক ইতিহাস স্পষ্ট নয়। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের মাঝামাঝি সময় শকগােষ্ঠীভুক্ত মুরুণ্ড জাতি এই অঞ্চলে রাজত্ব করেন। টলেমির বিবরণে এ তথ্যের উল্লেখ তাছে। টলেমির পরবর্তী বৈদেশিক লেখক ওপ্পিয়েন-এর বিবরণেও মুরুণ্ডরাজ্যের কথা আছে। জৈনগ্ৰন্থ ‘প্রভাবচরিতে’ পাটলিপুত্রের এক মুরুণ্ডনরপতির বর্ণনা আছে যিনি শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। পাটলিপুত্রের আর একজন মুরুণ্ড রাজার উল্লেখ আছে অপর একখানি জৈনগ্রন্থ ‘আবশ্যকবৃহদ্ধৃত্তি’-তে। এই মুরুণ্ডরাজ পুরুষপুরের রাজার কাছে দূত পাঠান। পুরাণ থেকে বিশ্বস্ফাণি নামে এক রাজার কথা জানা যায় যিনি প্রাক-গুপ্তপর্বে মগধে রাজত্ব করেন। নাম থেকে মনে হয় বিশ্বস্ফাণি জাতিতে মরুণ্ড ছিলেন। খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষপর্বে আর্য বিশাখমিত্র মগধে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সম্ভবত তারই আক্রমণের ফলে মুরুণ্ড শক্তির পতন হয়। বিশাখমিত্র ও তার বংশধরেরা পাটলিপুত্রে কতদিন রাজত্ব করেন তা বলা কঠিন। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শেষের দিকে পাটলিপুত্রে সম্ভবত গুপ্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন গুপ্তদের পূর্বে লিচ্ছবিরা পাটলিপুত্রে রাজত্ব করতেন এবং তাদের কন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করে। গুপ্তসম্রাট প্রথম চন্দ্র গুপ্ত যৌতুকস্বরূপ এ অঞ্চল লাভ করেন। তবে কুষাণােত্তর পর্বে লিচ্ছরিরা বাজত্ব করতেন ঠিকই, কিন্তু তা পাটলিপুত্রে নয়, বৈশালী বা উত্তর বিহারে। গুপ্তদের আবির্ভাবের পূর্বে কোতবংশীয় রাজারা পাটলিপুত্রে রাজত্ব করেন বলে কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল বহুদিন পরেই এক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই অভিমতের সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় আছে। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে এধরনের কোনও মন্তব্য নেই।

বিদিশা, মথুরা, কান্তিপুরী ও পদ্মাবতী

বিদিশা, মথুরা, কান্তিপুরী (কুটোয়ার), পদ্মাবতী (পদম পাওয়া) প্রভৃতি স্থানে নাগ রাজারা রাজত্ব করতেন। এসব স্থান থেকে আবিষ্কৃত প্রচুর নাগমুদ্রায় বৃষভ (বৃষনাগ), ভীমনাগ, স্কন্দনাগ, বৃহস্পতিনাগ, ব্যাঘ্ৰনাগ, দেবনাগ, গণপতিনাগ, বিভুনাগ, বসুনাগ, প্রভাকরনাগ, ভবনাগ ও রবিনাগের উল্লেখ আছে। মুদ্রাগুলোর গঠন, ধরন, প্রতীক, লেখের ব্যবহার, ওজন থেকে জানা যায় প্রধান কেন্দ্র পদ্মাবতী ও অন্য দুই কেন্দ্র মথুরা ও কান্তিপুরী নিয়ে এই নাগ রাজারা একই বংশােদ্ভব ছিলেন ও এসব অঞ্চল জুড়ে একটাই রাজ্য ছিল, তবে এলাহাবাদ স্তম্ভলেখ অনুসারে, খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের একেবারে গােড়ার দিকে উত্তর ভারতে একাধিক নাগরাজ্য ছিল। এই লেখে গণপতিনাগ ও নাগসেন নামে আরও দু’জন নাগ রাজা ও অচ্যুত, নাগদত্ত ও নন্দির মতাে আরও কয়েকটি সম্ভাব্য নাগরাজের উল্লেখ আছে। অনেকের মতে বাকাটক লেখের ভারশিবরা এরাই।

  • মথুরা : পুরাণ অনুসারে, মথুরায় সাতজন নাগ রাজা রাজত্ব করতেন। মথুরা আগে কুষাণদের দখলে ছিল। ১৭৬ খ্রিস্টাব্দে শেষ কুষাণরাজ প্রথম বাসুদেবের মৃত্যুর পর কুষাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। পশ্চিম ও মধ্য ভারতের শক ক্ষত্রপরা প্রথম কণিষ্কের অধীনস্থ ছিলেন কিন্তু ধীরে ধীরে তারা কার্যত স্বাধীন হয়ে বসেন, উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানের নানা স্থানে যৌধেয়, আর্জুনায়ন প্রভৃতি স্বাধীন গণরাজ্য গড়ে ওঠে, আর মথুরায় নাগশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • পদ্মাবতী : পুরাণ অনুসারে পদ্মাবতীতে ন’জন নাগ রাজা রাজত্ব করতেন। পদ্মাবতী আধুনিক পদম পাওয়া গ্রাম। গ্রামটি মধ্যপ্রদেশের শিবপুরী জেলায় অবস্থিত।
  • কান্তিপুরী : বর্তমান কুটোয়াল বা কুটোয়ার গ্রাম প্রাচীন কান্তিপুরী।
  • বিদিশা : বিদিশার রাজনৈতিক গুরুত্ব না থাকলেও বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল।

সমুদ্রগুপ্ত অনেক নাগ রাজা পদ্মাবতীরাজ (সম্ভবত) গণপতি নাগ, মথুরারাজ নাগসেন (হর্ষচরিত অনুসারে পদ্মাবতীরাজ, দীনেশচন্দ্রের মতে গণপতিনাগের পর তিনি আসেন), অচ্যুত (অহিচ্ছত্ররাজ) ও নন্দিকে পরাজিত করেছেন ও রাজ্যচ্যূত করেন। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত যে সকল নাগরাজ্য ধ্বংস করেন তা থেকে মনে হয় না সমুদ্রগুপ্তের বধূমাতা কুবেরনাগা এক নাগ রাজপরিবারের কন্যা ছিলেন। স্কন্দগুপ্তের আমলে সর্বনাগ নামে এক পদস্থ রাজপুরুষ গঙ্গা-যমুনা দোয়াবের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন, যিনি সম্ভবত এক অনুগত নাগ রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন।

পাঞ্চাল ও জগৎগ্রাম

অহিচ্ছত্রে কুষাণােত্তর ভূসংস্তর হতে শ্রীনন্দি ও অচ্য বা অচ্যুত নামে দু’জন রাজার তামার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতেও এই দু’জন রাজার নাম উল্লিখিত হয়েছে। তারা উভয়েই সমুদ্রগুপ্তের হাতে পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হন। প্রশ্ন হচ্ছে, নন্দি ও অচ্যুতকে আহিচ্ছত্রের সমকালীন নৃপতিরূপে চিহ্নিত করা সমীচীন কিনা। অহিচ্ছত্রে পাঞ্চালগােষ্ঠীর যেসব রাজার মুদ্রা পাওয়া গেছে তাদের সঙ্গে অচ্যুতের মুদ্রার ঘনিষ্ঠ যােগ রয়েছে। এই ঘনিষ্ঠতা নন্দির মুদ্রায় নেই তাথচ সাধারণভাবে নন্দির মুদ্রা পাঞ্চাল শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত। সমুদ্রগুপ্তের সময় অচ্যুত সম্ভবত অহিচ্ছত্র বা উত্তর পাঞ্চালের অধিপতি ছিলেন আর নন্দি ছিলেন দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজা। সমুদ্রগুপ্তের হাতে পরাজয়ের ফলে উত্তর ও দক্ষিণ পাঞ্চাল রাজ্য দুটি গুপ্তরাজবংশের অধিকারভুক্ত হয়। নন্দির মুদ্রার সঙ্গে শিবনন্দিশ্রী নামে আর এক রাজার মুদ্রার গভীর সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি সম্ভবত নন্দির পূর্বে দক্ষিণ পাঞ্চালে রাজত্ব করেন।

দেরাদুন জেলার একটি গ্রাম জগৎগ্রাম যা প্রাচীনকালে যুগশৈল নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে এই অঞ্চলে শীলবর্মা নামে এক নৃপতি রাজত্ব করতেন। তিনি চারটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, যুগশৈল ছিল তার রাজধানী। এই রাজার বংশপরিচয় বা তার রাজবংশের স্থায়িত্ব সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কোনও কোনও পণ্ডিত শীলবর্মাকে যৌধেয়রাজরূপে চিহ্নিত করেছেন। লক্ষ করবার বিষয়, তার কোনও লেখে তাকে যৌধেয় বলে আখ্যাত করা হয়নি, শীলবর্মার কোনও মুদ্রাও আবিষ্কৃত হয়নি। শীলবর্মার মৃত্যুর পর এই অঞ্চলে সম্ভবত যৌধেয়গণের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এই রাজ্যটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

যৌধেয় প্রজাতন্ত্র

কুষাণােত্তর যুগে লুধিয়ানা-বিকানীর-রােটক অঞ্চলে যৌধেয় প্রজাতন্ত্র এক শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। অবশ্য যৌধেয়দের অভ্যুত্থানের ইতিহাস শুরু হয় অনেক পূর্বে, খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে যখন তারা সমরনিপুণ জাতি হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের মাঝামাঝি সময় মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর যৌধেয়গণ গুরগাঁও রােটক কর্ণাল-সাহারাণপুর অঞ্চল জুড়ে এক স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করেন। এই পর্বের তামা ও পােটিনের তৈরি যৌধেয় মুদ্রাগুলো আকারে ছােটো, তাতে কোনও রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধানের নাম নেই, আছে যৌধেয় জাতির উল্লেখ এই পর্বের মুদ্রার বেশ কিছু মৃন্ময় ছাঁচ রােটক শহরে পাওয়া গেছে। রােটক সম্ভবত যৌধেয় গণরাষ্ট্রের রাজধানী ছিল।

খ্রিস্টীয় ১ম শতকে কুষাণ রাজশক্তি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং পশ্চিমে কাবুল হতে পূর্বে বারাণসী বা বঙ্গদেশ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড অধিকার করে। এই অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতাে যৌধেয়রাজ্যও কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। যৌধেয়গণ কুষাণ রাজশক্তির যে আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন তা ছিল সাময়িক। সম্ভবত প্রথম কণিষ্কের রাজত্বের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং ধীরে ধীরে পূর্ব পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেন। কিন্তু তাদের এই সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শীঘ্রই শক মহাক্ষত্ৰপ রুদ্রদামা যৌধেয়াদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। নিজেদের সেই ঘাের বিপদের দিনে যৌধেয়রা তাদের রাজ্য আরাধ্য দেবতা ব্রহ্মণ্যদেব বা কার্তিকেয়কে উৎসর্গ করেন। তবু তারা শেষরক্ষা করতে পারেননি। রাজস্থান, পূর্ব-পাঞ্জাব ও হরিয়ানার আধিপত্য হারিয়ে তারা আরও উত্তরে দেরাদুন ও পার্শ্ববর্তী তাঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই পর্বে যৌধেয়গণ যেসব মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছিলেন তাদের মান অতি নিম্ন, মুদ্রাগুলোর নির্মাণে কোনও যত্ন বা শৃঙ্খলার ছাপ নেই। রুদ্রদামার হাতে তাদের ভাগ্যবিপর্যয়ের সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করছে এই মুদ্রাগুলো।

কিন্তু রুদ্রদামা ও কুষাণরাজ প্রথম বাসুদেবের মৃত্যুর পর খ্রিস্টীয় ২য় শতকের শেষ পর্বে যৌধেয়গণ পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং পশ্চিম দিকে শতদ্রু নদী পর্যন্ত তাদের অধিকার বিস্তার করেন। এই পর্বে যৌধেয়গণ যে মুদ্রা প্রবর্তন করেন তার প্রধান পৃষ্ঠে উৎকীর্ণ আছে বাহন ময়ূরসহ দেবতা কার্তিকেয়ের মূর্তি, আর বিপরীত দিকে অঙ্কিত আছে দেবী লক্ষ্মীর বা ষষ্ঠীর মূর্তি। মুদ্রাগুলোতে লেখা আছে যৌধেয়গণস্য জয়ঃ – এই উক্তি, আর উক্তির শেষে রয়েছে দ্বি বা ত্রি কথাটি। যৌধেয়দের এই জয় নিঃসন্দেহে কুষাণ শক শক্তির বিরুদ্ধে জয়। এই জয়ের সুবাদেই যৌধেয়রা পূর্ব পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় তাদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু মুদ্রায় যে দ্বি বা ত্রি অর্থাৎ দ্বিতীয় বা তৃতীয় কথা দু’টি উৎকীর্ণ আছে তার তাৎপর্য সম্পর্কে পণ্ডিত মহলে মতদ্বৈধ বর্তমান। অধ্যাপক অলতেকর মনে করেন দ্বি ও ত্রি বলতে আর্জুনায়ন ও কুণিন্দ নামে অপর দু’টি জাতির কথা বলা হয়েছে যারা যৌধেয়দের সঙ্গে যােগ দিয়ে এক অখণ্ড প্রজাতন্ত্র গঠন করেছিল। আবার অনেকের ধারণা, দ্বি ও ত্রি বলতে রােহিতক বা রােটুক, মরুভূমি বা বিকানীর-বাহাওয়ালপুর ও শিরীক্ষিক বা লুধিয়ানা-সুনেত, যৌধেয় রাষ্ট্রের এই তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চলকে বােঝানাে হয়েছে। সমুদ্রগুপ্তের উত্তর ভারত অভিযানের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যৌধেয়গণ যমুনা ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগে সগৌরবেই রাজত্ব করেন। মুদ্রার সাক্ষ্যে এ সত্য পরিস্ফুট। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলেখ থেকে জানা যায় যৌধেয়গণ গুপ্তসম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করে তাকে নিয়মিত কর, উপঢৌকনাদি প্রদান করতেন। অর্থাৎ, সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালে যৌধেয়রাষ্ট্র আপন সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে গুপ্তদের অধীনে এক করদ রাজ্যে পর্যবসিত হয়। সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের প্রথম ভাগে দুর্বার হূণ আক্রমণের জোয়ারে যৌধেয়রাজ্য ধসে পড়ে। 

কুণিন্দ রাজ্য

যৌধেয় গণরাজ্যের ঠিক উত্তরে অর্থাৎ বিপাশা ও শতদ্রু নদীর অববাহিকা অঞ্চলে কুণিন্দ নামে আর একটি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই রাজ্যটি সম্পর্কে আমাদের ধারণার মূল উৎস হল মুদ্রা। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থাদিতে কুণিন্দদের অল্প-বিস্তর উল্লেখ থাকলেও রাজ্যটি গণরাষ্ট্র, না রাজতান্ত্রিক, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। এই রাজ্যের একজন পরিচালক অমােঘভূতি। মুদ্রায় তাকে মহারাজ আখ্যা দেয়া হয়েছে। গণরাষ্ট্রের পরিচালকগােষ্ঠীর সদস্যরা অনেক সময় রাজা নামে পরিচিত হতেন। প্রশাসক গােষ্ঠীর অধ্যক্ষ ছিলেন বলে অমােঘভুতি সম্ভবত মহারাজ অভিধা ধারণ করেছিলেন। বিপরীতশ্রমে, প্রকৃত অর্থে রাজা ছিলেন বলেই অমােঘভূতি মহারাজ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন, এরূপ সিদ্ধান্তও যুক্তিগ্রাহ্য।

কুণিন্দরাজ্যটির অভ্যুত্থান হয় খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের শেষার্ধে বা পরবর্তী শতকের প্রথম পর্বে। মহারাজ অমােঘভূতির নামাঙ্কিত যেসব তামার ও রূপার মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে তা এই পর্বেই উৎকীর্ণ হয়েছিল। শীঘ্রই কুষাণ রাজারা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং কুণিন্দরাজ্য অধিকার করেন। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে কুণিন্দরাজ্য পুনরায় স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই পর্বে উৎকীর্ণ মুদ্রাগুলোতে ছত্ৰেশ্বর বা শিবের নাম উল্লিখিত আছে। এর থেকে মনে হয়, কুণিন্দরা তাদের রাজ্যটিকে দেবতা শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন। এই পর্বের মুদ্রাগুলো সংখ্যায় অতি অল্প, তাছাড়া সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে কুণিন্দরাজ্যের কোনও উল্লেখ নেই। মনে হয়, রাজ্যটি অল্পদিনের মধ্যেই তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে যৌধেয় গণরাজ্যের অঙ্গীভূত হয়। 

মদ্র রাজ্য

প্রাচীন ভারতের এক সুপ্রাচীন রাষ্ট্র মদ্র। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে যে কটি প্রধান রাজ্য গড়ে উঠেছিল মদ ছিল তাদের অন্যতম। মধ্য পাঞ্জাব অর্থাৎ শিয়ালকোট ও সন্নিহিত অঞ্চলে রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। এটি ক্রমশ শক-পহ্লব ও কুষাণ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে মদ্র গণরাজ্যের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। সন্দেহ নেই, কুষাণশক্তির দুর্বলতার সুযােগে মদ্রগণ মধ্য পাঞ্জাবে এক স্বাধীন গণরাষ্ট্রের পত্তন করেছিলেন। বরাহমিহির ও শুয়েন চাঙের মতাে পরবর্তী যুগের লেখকরা মদ্ররাজ্যের উল্লেখ করেছেন। শিয়ালকোট সম্ভবত মদ্ররাজ্যের রাজধানী ছিল। 

আর্জুনায়ন গণরাজ্য

রাজস্থানের ভরতপুর-আলােয়ার অঞ্চল নিয়ে গঠিত আর্জুনায়ন রাজ্যটি সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের মধ্যভাগে। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে এই রাজ্যটি কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে গুপ্তসম্রাটের অধীনস্থ এক করদ রাষ্ট্ররূপে আর্জুনায়নের উল্লেখ আছে। এর থেকে মনে হয়, কুষাণােত্তর পর্বে রাজ্যটি পুনরায় স্বাধীনতা ঘােষণা করে। আর্জুনায়নদের কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলো খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে উৎকীর্ণ হয়েছিল বলে পণ্ডিতরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। লক্ষ করবার বিষয়, আর্জুনায়নদের এক শ্রেণির মুদ্রায় ‘আর্জুনায়নানাং জয়ঃ’-এই কথা মুদ্রিত আছে। মুদ্রাগুলো অবশ্যই যৌধেয়দের ‘যৌধেয়গণস্য জয়ঃ’ লেখ সম্বিলিত মুদ্রাগুলোর সঙ্গে তুলনীয়। যৌধেয় মুদ্রাগুলো কুষাণােত্তর পর্বে উৎকীর্ণ হয়েছিল। এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট আর্জুনায়ন মুদ্রাগুলোকে কুষাণােত্তর পর্বের বলে ধার্য করা যায়। আর্জুনায়ন রাষ্ট্র পরবর্তিকালে যৌধেয়রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বলে অনন্ত সদাশিব অলতেকর অভিমত প্রকাশ করেছেন। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে আর্জুনায়ন ও যৌধেয় রাষ্ট্র দুটির স্বতন্ত্র উল্লেখ কিন্তু তা বলে না।

আভীর, কাক ইত্যাদি কয়েকটি গণরাজ্য

আভীররা বিদেশি ছিলেন। ম্যাসিডােনরাজ আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পর কোনও এক সময় তারা সম্ভবত ভারতে প্রবেশ করেন। পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য, জনৈক গ্রিক নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস’ ও টলেমিরচিত ‘ভূগােল’ গ্রন্থাদিতে আভীরগণের উল্লেখ আছে। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের মধ্যভাগে আভীররা মহারাষ্ট্র অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। ঈশ্বরসেন ছিলেন তাদের রাজা। পরে তারা ঝাসি ও ভিলসার মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে একটি গণরাজ্য স্থাপন করেন। ভিলসার অনতিদূরে ছিল প্রার্জুন গণরাজ্য। গােয়ালিয়র অঞ্চলে সনকানীক নামে আর একটি গণরাজ্য ছিল। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে কাক ও খরপরিক নামে আরও দুটি গণরাজ্যের উল্লেখ আছে। সাঁচীর প্রাচীন নাম যে কাকনাদবােট তা তাে সকলেরই জানা। সম্ভবত সাঁচী বা তার পার্শ্ববর্তী কোনও অঞ্চলে কাক গণরাষ্ট্র অবস্থিত ছিল। খরপরিক রাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত করা যায় না। ভাণ্ডারকর সাহেব মধ্যপ্রদেশের দামাে অঞ্চলে এই রাজ্যটির অবস্থান নির্দেশ করেছেন।

মালব গণরাজ্য

সমরনিপুণ জাতি হিসেবে মালবগণ প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকের শেষভাগে ম্যাসিডােনরাজ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালে তারা পাঞ্জাবে অবস্থান করেন। কিন্তু কালক্রমে মালব জনসাধারণের একটি বিরাট অংশ পাঞ্জাব ত্যাগ করে পূর্ব রাজস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে সেখানে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকের প্রচুর মালব মুদ্রা পূর্ব রাজস্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। মালবনগর ছিল তাদের রাজধানী। বর্তমান কর্কোটনাগর বা নাগরই প্রাচীন মালবনগর।

খ্রিস্টীয় ২য় শতকের প্রথম ভাগে শক ক্ষত্রপরা এক পরাক্রান্ত রাজনৈতিক শক্তিরূপে পশ্চিম ভারতে আবির্ভূত হন। চষ্টন রুদ্রদামার সময় তাদের ক্ষমতা ও গৌরব উন্নতির শীর্যে আরােহণ করে। মালবগণ এ সময় সম্ভবত ক্ষত্রপগণের অধীনতা স্বীকার করেন। কিন্তু খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দীর শেষভাগে প্রথম দামঘ্স‌দের মৃত্যুর পর ক্ষত্রপশক্তি হীনবল হয়ে পড়লে মালবগণ পুনরায় স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। এই পর্বে মালবদের কয়েকখানি লেখ ও বেশ কিছু মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। লেখাগুলো মুলত পাওয়া গেছে রাজস্থানের উদয়পুর জেলার নান্দসা গ্রাম হতে। এই লেখগুলো থেকে নন্দিসােম ও মহাসেনাপতি ভট্টিসােম নামে দু’জন মালব দলপতির নাম জানা যায়। এই দলপতি দু’জনের মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল তা অজ্ঞাত। তাদের কেউই রাজা অভিধা ধারণ করেননি। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের প্রথম পর্ব তাদের প্রশাসনকাল বলে পণ্ডিতরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। 

এই পর্বের মুদ্রাগুলোতে প্রায়ই ‘মালবগণস্য জয়ঃ’ এই লেখের ব্যবহার দেখা যায়। যেসব প্রশাসকের নাম এই পর্বের মুদ্রায় উৎকীর্ণ আছে তাদের মধ্যে সপক, যম, জামক, পয়, মহারায়, মরজ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বেশির ভাগ মুদ্রা রাজস্থানের জয়পুর অঞ্চলে পাওয়া গেছে। উদয়পুর অঞ্চল হতে মালবদের লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। ঋষভদত্তের নাসিক গুহালেখে আজমীঢ় ও সন্নিহিত অঞ্চল সম্ভবত মালবগণের আবাসস্থলরূপে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ, এ সময় তারা উদয়পুর-জয়পুর অঞ্চলেই রাজত্ব করতেন। এর কিছুকাল পর মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলও তাদের রাজ্যভুক্ত হয়। 

বাংলা

যে অঞ্চল নিয়ে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ, সেখানে সমতট, ডবাক ও বর্মা রাজ্য নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্য অবস্থিত ছিল। এছাড়া পুরাণে পৌণ্ড, কোসল, ওড্র ও তাম্রলিপ্ত অঞ্চল জুড়ে দেবরক্ষিত রাজবংশের শাসনের কথাও জানা যায় – 

  • সমতট : গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের বদ্বীপের ভুখণ্ড নিয়ে প্রাচীনকালে সমতট গঠিত ছিল। কোন রাজবংশ এই অঞ্চলে রাজত্ব করত তা জানা যায় না।
  • ডবাক : ডবাক রাজ্যটির সঠিক অবস্থান অনিশ্চিত। ফ্লিট ঢাকা ও সন্নিহিত ভূখণ্ডে এই রাজ্যটির অবস্থান নির্দেশ করেছেন। ভিনসেন্ট স্মিথের মতে উত্তর বাংলায় রাজ্যটির অবস্থান ছিল। অসমের কপিলা উপত্যকার একটি স্থানের নাম দবােক। সেজন্য অনেকে অসমেই এই রাজ্যটির অবস্থান নির্দেশ করেছেন।
  • বর্মা : বর্মা রাজ্যটি বাঁকুড়া অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। বাঁকুড়া শহরের প্রায় আট কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে শুশুনিয়া পাহাড়। এই পাহাড়ের গায়ে মহারাজ চন্দ্রবর্মার একখানি লেখ খােদিত আছে। লেখটি আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের প্রথম পর্বের। লেখটি হতে জানা যায় চন্দ্রবর্মার পিতাও একজন মহারাজ ছিলেন। পিতা ও পুত্রের রাজধানী ছিল পুষ্করণ। ফরিদপুর জেলার ঘুঘরাহাটি গ্রামে পাওয়া একখানি লেখে চন্দ্রবর্মকোট নামে এক স্থানের উল্লেখ আছে। অনেকে মনে করেন মহারাজ চন্দ্রবর্মার নাম হতেই স্থানটির এরূপ নামকরণ হয়েছে। তারা আরও মনে করেন চন্দ্রবর্মার রাজ্য পশ্চিমে বাঁকুড়া থেকে পূর্বে ফরিদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বলা বাহুল্য, এই ধারণার সপক্ষে কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই।
  • দেবরক্ষিত রাজবংশ : পুরাণে দেবরক্ষিত নামে গুপ্ত রাজাদের সমকালীন এক রাজবংশের উল্লেখ করে বলা হয়েছে তারা পরাক্রমশালী নরপতি ছিলেন এবং পৌণ্ড্র, কোসল, ওড্র ও তাম্রলিপ্ত তাঞ্চল জুড়ে এক বিশাল রাজ্য গঠন করেছিলেন। পৌণ্ড্র সম্ভবত উত্তর বাংলা, কোসল হয়তাে অযােধ্যা বা ওড়িশা-ছত্তীসগঢ়ের সম্বলপুর, বিলাসপুর ও রায়পুর অঞ্চল, ওড্র ওড়িশা এবং তাম্রলিপ্ত মেদিনীপুরের তমলুক অঞ্চল। পৌরাণিক বিবরণ এক বিশাল দেবরক্ষিত রাজ্যের অস্তিত্বের সপক্ষেই সাক্ষ্য দেয় কিন্তু এ সাক্ষ্য কতদূর বস্তুনিষ্ঠ তা বলা কঠিন।

কোটা ও গয়ার মৌখরি পরিবার

কুষাণােত্তর পর্বে কয়েকটি মৌখরি পরিবারের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় কিন্তু কোনও স্বাধীন মৌখরি রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে রাজস্থানের কোটা অঞ্চলে অন্তত দু’টি মৌখরি পরিবার ছিল। একটি পরিবারের সদস্য ছিলেন মহাসেনাপতি বল এবং তার তিন পুত্রবলবর্ধন, সােমদেব ও বলসিংহ। অন্যটির সদস্য ছিলেন হস্তী ও তার পুত্র ধনুস্রাত। পরিবার দু’টির সদস্যরা বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন, অন্তত একজন মহাসেনাপতি অভিধা ধারণ করেছেন কিন্তু কেউই রাজা উপাধি গ্রহণ করেননি।

বিহারের গয়া অঞ্চলে আর একটি মৌখরি পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। যজ্ঞবৰ্মা, তার পুত্র শার্দূলবর্মা এবং পৌত্র অনন্তবর্মা এই পরিবারভুক্ত ছিলেন। যজ্ঞবৰ্মা ও তার বংশধরেরা গয়ায় এক স্বাধীন মৌখরি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে হয় না। এই পরিবারটির আবির্ভাবকাল সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কোনও কোনও পণ্ডিত পরিবারটিকে খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে ধার্য করেছেন কিন্তু অনেকেই মনে করেন যজ্ঞবৰ্মা ও তার উত্তরাধিকারিগণ আরও দুশাে বছর পর আবির্ভূত হয়েছিলেন।

উত্তর-পশ্চিম ভারত

প্রথম বাসুদেবের মৃত্যু এবং যৌধেয়, আর্জুনায়ন প্রভৃতি গণরাজ্যগুলোর অভ্যুত্থান কুষাণশক্তিকে দুর্বল করে দেয় কিন্তু নির্মূল করতে পারেনি। আফগানিস্তান ও উত্তর পশ্চিম ভারতে তখনও কুষাণরাজত্ব অক্ষুন্ন। কিন্তু খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের প্রথম ভাগে পারস্যে শক্তিশালী সাসানীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে কুষাণরাজ্য সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। সাসানীয় আক্রমণের ফলে কুষাণরাজ্যটি সম্পূর্ণরূপে ধসে যায়, না কোনও প্রকারে আপন অস্তিত্বটুকু বজায় রাখে, সে সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত করা যায় না।

খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের মধ্যভাগে কিদার নামে একজন কুষাণনৃপতি কাবুল উপত্যকায় এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিদারগােষ্ঠীর কুষাণরা কণিষ্কগােষ্ঠীভুক্ত কুষাণগণ হতে স্বতন্ত্র ছিলেন বলে পণ্ডিতরা তাদের ‘ক্ষুদ্র কুষাণ’ নামে আখ্যাত করেছেন। প্রথম দিকে কিদার দ্বিতীয় শাপুরের (৩০৯-৩৭৯ খ্রি.) অনুগত হলেও পরের দিকে তিনি সাসানীয়রাজকে পর পর দু’বার পরাজিত করেন। একবার তাে দ্বিতীয় শাপুর যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করে কোনও মতে নিজের প্রাণ রক্ষা করেন। শুধু কাবুল উপত্যকা নয়, উচ্চ সিন্ধু অববাহিকাও কিদারের রাজ্যভুক্ত ছিল। এলাহাবাদ স্তম্ভলেখে গুপ্তরাজ সমুদ্রগুপ্তের সমকালীন যে কুষাণরাজের উল্লেখ আছে তিনি সম্ভবত কিদার। বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসন-ব্যবস্থা জোরদার করার উদ্দেশ্যে কিদার বরাে, ষাহি, পিরােচ, ভাস, বুদ্ধবল প্রভৃতি কয়েকজন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। এসব প্রশাসকেরা স্বনামে মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। 

তার রাজত্বের শেষের দিকে জুয়ান জুয়ান জাতি তার রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অনুপ্রবেশ করলে কিদার রাজ্যপ্রশাসনের ভার পুত্র পিরাে-এর হাতে অর্পণ করে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সসৈন্যে অগ্রসর হন। কুষাণগণের এই বিপদের দিনে সাসানীয়রাজ তৃতীয় শাপুর (৩৮৩-৩৮৮ খ্রি.) কুষাণরাজ্য আক্রমণ করেন। রাজ্যের একাংশ আক্রমণকারীদের সমর্পণ করে পারসিক রাজের অনুগত মিত্ররূপে পিরাে রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে রাজত্ব করতে থাকেন। পিরাের মতাে তার পুত্র বরহ্রানও সাসানীয় আধিপত্য স্বীকার করেন।

কুষাণরাজ দ্বিতীয় বাসুদেবের রাজত্বের অবসানের পর কোনও এক সময় পশ্চিম গান্ধার অঞ্চলে ষাক নামে এক কুষাণ বা শক রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই বংশীয় রাজাদের প্রচুর মুদ্রা সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলো হতে স্য বা সস্য, শয়থ, সিত এবং সেন বা সেণ নামে চারজন ষাক রাজার নাম জানা যায়। মুদ্রাগুলোতে রাজাদের নাম ছাড়া এক বা একাধিক অক্ষরেরও উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সম্ভবত অক্ষরগুলো টাকশাল-অধিকর্তাদের নাম বহন করছে। 

পশ্চিম গান্ধারে যেমন যাক রাজ্য ছিল তেমনি পাঞ্জাবে ছিল ষীলদ ও গডহর রাজ্য। মুদ্রা হতে বচর্ণ, ভদ্র এবং পাসন এই তিনজন ষীলদ রাজার নাম জানা যায়। পেরয় ও কিরদ ছিলেন গডহরদের দু’জন রাজা। গডহর শ্রেণির একটি মুদ্রায় সমুদ্র অর্থাৎ সমুদ্রগুপ্তের নাম খােদিত আছে। এর থেকে দু’টি সিদ্ধান্ত করা যায়। এক, গডহর রাজারা সম্ভবত সমুদ্রগুপ্তের অনুগত ছিলেন। দুই, রাজ্যটি অন্তত খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল।

গুজরাত ও সন্নিহিত অঞ্চল

গুজরাতে তখন পশ্চিমা ক্ষত্রপরা রাজত্ব করতেন। কিন্তু ক্ষত্রপদের তখন দুর্দিন। একদিন তারা মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে এক বৃহদায়তন রাজ্য গঠন করেছিলেন কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্ব, সামরিক দুর্বলতা ও বহিরাক্রমণের ফলে ক্ষত্রপশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। মহারাষ্ট্র সাতবাহনদের অধিকারে চলে যায়, রাজস্থান ও পশ্চিম মধ্যপ্রদেশে মালবগণের অভ্যত্থান হয় এবং মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে শক শ্রীধরবর্মা এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। আয়তন হ্রাস পেতে পেতে ক্ষত্ৰপ রাজ্যটি গুজরাত অঞ্চলেই আবদ্ধ হয়ে পড়ে। গুজরাতের সর্বশেষ মহাক্ষত্ৰপ তৃতীয় রুদ্ৰসিংহ। তাকে পরাজিত করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য গুজরাতে গুপ্তপ্রভুত্ব স্থাপন করেন। ৩৮৮-৪১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনও এক সময় ঘটনাটি ঘটে যায়।

কুষাণােত্তর পর্বের তাৎপর্য, রাজনৈতিক তাৎপর্য : কুষাণােত্তর পর্বে উত্তর ভারতে কোনও বৃহদায়তন রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি, বিভিন্ন অঞ্চলে অনেকগুলো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন এই রাজ্যগুলোকে এক সূত্রে বেঁধে একটি অখণ্ড রাজ্য গঠন করতে সক্ষম কোনও শক্তিমান রাজপুরুষের আবির্ভাব ঘটেনি এপর্বে। তবু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই যুগের এক বিশেষ তাৎপর্য আছে। এযুগের রাষ্ট্রপ্রধানেরা বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করতে পারেননি সত্য কিন্তু তারা অনুভব করেছিলেন ক্ষুদ্র রাজ্য দুর্বল, বিপদাপন্ন। তারা বুঝেছিলেন, একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের যা অসাধ্য, সংঘবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে তা সহজসাধ্য। যৌধেয়, আর্জুনায়ন ও কুণিন্দ রাষ্ট্র প্রধানেরা বুঝেছিলেন, কুষাণ ও ক্ষত্রপদের মতাে প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একক শক্তিতে সাফল্য লাভ অসম্ভব। তাই তারা অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে এক যুক্তরাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। ঐক্য মানে নিরাপত্তা আর ঐক্যের অভাব হল ধ্বংস এই সত্য তারা উপলব্ধি করেছিলেন। ভারতীয় রাজনীতির মূল দুর্বলতা যেমন এই পর্বে ধরা পড়েছিল তেমনি তার সমাধাসূত্রও এই পর্বেই উদ্ভাবিত হয়েছিল। কুষাণােত্তর পর্বের রাজনৈতিক তাৎপর্য এখানেই। 

রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রকৃতি : এই পর্বে রাজতান্ত্রিক ও গণশাসিত, দু’ধরনের রাষ্ট্রের উদ্ভব লক্ষ করা যায়। মঘ, নাগ, বর্মা প্রভৃতি রাজ্যগুলো রাজতান্ত্রিক ছিল; যৌধেয়, আর্জুনায়ন, মালব ইত্যাদি রাজ্যগুলো গণশাসিত বা প্রজাতান্ত্রিক ছিল। রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রশাসনের শীর্ষে রাজার অবস্থান, গণরাজ্যে সংঘমুখ্যই রাষ্ট্রপ্রধান। রাজা ও সংঘমুখ্য উভয়েই রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করলেও তাদের ক্ষমতা ও অধিকার সমান নয়। রাজপদ পুরুষানুক্রমিক, পিতার মৃত্যুর পর তার পুত্র উত্তরাধিকারসূত্রে রাজপদ লাভ করেন। সংঘমুখ্য মূলত সংঘের একজন সদস্য, সংঘের সদস্যরা তাকে সংঘমুখ্যের পদে নির্বাচিত করেন। সংঘ্যমুখ্য সংঘের সদস্যদের পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। সংঘের মুখ্য সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি ক্ষুদ্র পরিষদ সম্ভবত শাসনকার্যে তাকে সাহায্য করতেন। রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ সংঘের সদস্য ছিলেন এমন মনে হয় না, সম্ভবত ক্ষত্রিয় বা অভিজাতরাই সংঘের সভ্য ছিলেন। তারাই রাষ্ট্রের প্রকৃত নিয়ামক ছিলেন। সংঘমুখ্যরা অনেক সময় মহারাজ, মহাসেনাপতি ইত্যাদি অভিধা ধারণ করতেন। রাজস্থানের ভরতপুর জেলার বিজয়গড় গ্রামে পাওয়া এক লেখে এরূপ একজন যৌধেয় সংঘমুখ্যের উল্লেখ আছে যিনি মহারাজ ও মহাসেনাপতি পদবি গ্রহণ করেছিলেন। যৌধেয়গণ তাকে সংঘমুখ্যের পদে নির্বাচিত করেছিলেন এ তথ্যও সেই লেখে সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। গুপ্তযুগের পর থেকে ভারতে গণরাষ্ট্রের কথা আর শােনা যায় না। অন্তর্দ্বন্দ্ব, জরুরি পরিস্থিতিতে নীতির নির্ধারণে ও রূপায়ণে অযথা কালক্ষেপ ইত্যাদি ত্রুটির জন্য গণরাজ্য কখনওই প্রাচীন ভারতে আদর্শ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেনি।

বিদেশিগণের ভারতীয়করণ প্রক্রিয়া : এই পর্বে একদিকে যেমন বিদেশিগণের ভারতীয়করণ প্রক্রিয়া সক্রিয় ছিল, অন্যদিকে তেমনি ভারতীয়দের বিদেশি রীতিনীতি, ধ্যান-ধারণার আত্মীকরণের কাজটিও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব বিদেশি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছিলেন তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে, এদেশের আচার-আচরণ, ধর্ম ও ভাষা গ্রহণ করে, এদেশীয় নাম ধারণ করে ভারতীয় জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এই প্রসঙ্গে সেসব আভীর এবং শকদের কথা স্মরণ করা যায় যারা বিদেশি হয়েও শিবঘােষ, শিবদত্ত, রুদ্রসেন, বিশ্বসিংহ, ঈশ্বরসেন, অগ্নিবর্মা, বিশ্ববর্মা, বিষ্ণু দত্তা প্রভৃতি ভারতীয় নাম গ্রহণ করেছিলেন।

বিদেশিগণ কর্তৃক ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপুষ্টিসাধন : বিদেশিরা শুধু ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণই করেননি তারা একে সমৃদ্ধ ও পরিপুষ্ট করেছেন। তখনকার দিনে বিদেশিরা ভারতবাসীদের মনে কতখানি প্রভাব বিস্তার করে ছিলেন দু’একটা উদাহরণ দিলে তা স্পষ্ট হবে। প্রথমত, কোনও ঘটনার উল্লেখ প্রসঙ্গে ভারতীয়গণ প্রথম দিকে তারিখ ব্যবহার করতেন না। এ রীতি তারা বিদেশি শক কুষাণদের কাছ থেকেই আয়ত্ত করেছিলেন। তাছাড়া ভারতীয়রা প্রথম প্রথম যেসব মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন তা ছিল ছাপ-মারা বা নিম্নমানের ছাঁচেঢালা, তাতে না ছিল রাজার নাম ও পদবির উল্লেখ, না ছিল রাজার প্রতিকৃতি। বৈদেশিক মুদ্রায় এসব লক্ষণ কিন্তু প্রথম থেকেই বর্তমান ছিল। উপরন্তু সেগুলোর বেশির ভাগই ছিল উন্নত শ্রেণির পাটায় আহত। বিদেশিদের অনুকরণেই ভারতীয়রা উন্নত শ্রেণির পাটায় আহত মুদ্রার প্রবর্তন করেন, মুদ্রায় রাজার নাম, অভিধা ও প্রতিকৃতি ব্যবহার করেন।

ব্রাহ্মণ্যধর্মের অভ্যুত্থান ও বৌদ্ধধর্মের কম উপস্থিতি : ব্রাহ্মণ্যধর্মের অভ্যুত্থান এই পর্বের আর এক উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। এসময় একদিকে যেমন বৈদিক যাগযজ্ঞের সমাদর বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে তেমনি শিব, বিষ্ণু ও কার্তিকেয়ের উপাসনা ব্যাপকতা লাভ করে। মালব রাষ্ট্রপ্রধান নন্দিসােম একষষ্টিরাত্র প্রভৃতি বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, বর্ধন নামান্ত আর একজন মালব রাষ্ট্রনায়ক সাতবার সােমযজ্ঞের আয়ােজন করেন। ভারশিব রাজারা বহুবার অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করেন। আর্জুনায়ন এবং যৌধেয়দের মুদ্রায় যজ্ঞযুপের উপস্থাপনার মধ্য দিয়েও সমকালীন যুগে বৈদিক যাগযজ্ঞের জনপ্রিয়তা প্রতিফলিত হয়েছে। যুগশৈলের রাজা শীলবর্মা চারটি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। রেওয়া কৌশাম্বীর মঘ রাজারা শৈব ছিলেন, শৈব সাধুদের সুবিধার জন্য তারা বান্ধোগড়ে গুহা, কূপ, উদ্যান ও মণ্ডপ নির্মাণ করেন। তাদের মুদ্রায় ও সিলমােহরে শিবের বাহন নন্দির মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। ভিটা অঞ্চলের রাজা গৌতমীপুত্র বিন্ধ্যবেধন মহেশ্বর ও মহাসেনের ভক্ত ছিলেন। প্রিয় দেবতাদের অনুগ্রহে রাজপদ লাভ করেছেন বলে তিনি সদম্ভে তার লেখে ঘােষণা করেছেন। বৈবকি ও কুণিন্দরা ছত্রেশ্বর বা মহাদেবের উপাসক ছিলেন এবং আরাধ্য দেবতার নামে মুদ্রাও উৎকীর্ণ করেছেন। তারা তাদের রাজ্য দু’টিকে মহাদেবের নামে উৎসর্গ করেন; রাষ্ট্রপ্রধানরা মহাদেবের প্রতিনিধিরূপে রাষ্ট্র শাসন করতেন। ভারশিবরা শিবের উপাসক ছিলেন। তারা তাদের স্কন্ধদেশে শিবের প্রতীক অর্থাৎ ত্রিশূল বহন করতেন। তারা যে মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন তাতে নন্দি ও ত্রিশূলের ছবি দেখা যায়। যৌধেয়গণের এক শ্রেণির মুদ্রায় যড়ানন কার্তিকেয়ের মূর্তি খােদিত আছে, তাছাড়া আছে যষ্ঠী বা দেবসেনার মূর্তির উপস্থাপনা। যৌধেয়গণ এক সময় তাদের রাজ্যটিকে কার্তিকেয়ের নামে উৎসর্গ করে ব্রহ্মাণ্যদেব নামে এক শ্রেণির মুদ্রা চালু করেন। এই পর্বে যেসব রাজা ও রানি শৈব নামা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে রুদ্র, শিবনন্দিশ্রী, শ্রীনন্দি, শংকরসিংহ, শিবমঘ, রুদ্রমঘ, মহাদেবী রুদ্রমতী প্রভৃতির নাম সবিশেষ উল্লেখ্য। এই যুগের এক রাজা অচ্যুত যিনি বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। তার মুদ্রায় সুদর্শন চক্রের ছবি উৎকীর্ণ আছে। এযুগের আর এক বিভক্ত রাজা চন্দ্রবর্মা যিনি আরাধ্য দেবতার উদ্দেশ্যে দানাদি কার্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তুলনায় সমকালীন লেখমালায় বৌদ্ধধর্মের উল্লেখ অনেক কম। এই পর্বের কিছু লেখে কয়েকজন ঔদুম্বর দাতার উল্লেখ আছে যারা সাঁচীর বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে উদার হস্তে দান করেছিলেন। কৌশাম্বীর ঘােষিতারাম বৌদ্ধবিহার সম্ভবত মঘ রাজাদের আমলে নির্মিত হয়েছিল। গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মের যে অভূতপূর্ব প্রসার ঘটেছিল তার ভিত্তিপ্রস্তর কুষাণােত্তর পর্বেই রচিত হয়েছিল। 

ভাষা ও সাহিত্য

সংস্কৃত সাহিত্য : এই পর্বে সংস্কৃত ভাষা যে গুরুত্ব লাভ করে তা এক কথায় অভূতপূর্ব। এতদিন লেখগুলো সাধারণত প্রাকৃত ভাষায় লেখা হত কিন্তু এসময় হতে লেখমালায় সংস্কৃত ভাষার ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। এই পর্বেই সংস্কৃত সর্বপ্রথম সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করে। রামায়ণ ও মহাভারতের মতাে জনপ্রিয় মহাকাব্য দুখানির সংকলন পর্ব এই যুগেই প্রায় সম্পন্ন হয়। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি সম্ভবত এই পর্বেই রচিত হয়েছিল। বৈষ্ণব ধর্মশাস্ত্র বা বিষ্ণুস্মৃতি ও নারদস্মৃতির মতাে আরও দুখানি ধর্মশাস্ত্র বা স্মৃতিগ্ৰন্থ এই সময়েই রচিত হয়েছিল বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। জলিসাহেব অবশ্য নারদস্মৃতিকে আরও শতাব্দী দুই পরের সংকলন বলে মনে করেন। কুমারলাত-এর ‘সূত্রালংকার’ বা ‘কল্পনামণ্ডিটিকা’, আর্যশূরের ‘জাতকমালা’, আর্যদেবের ‘চতুঃশতিকা’ এবং অসঙ্গের ‘মহাযান সূত্রালংকার’ এই পর্বেরই রচনা। সবকটি গ্রন্থই সংস্কৃত ভাষায় রচিত। 

ভাসের নাটক : এই পর্বের সাহিত্যগগনের আর এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ভাস। ভাস তার সংস্কৃত নাটকগুলোতে যে প্রাকৃত ভাষা ব্যবহার করেছেন তা অশ্বঘোষের প্রাকৃতের পরবর্তী কিন্তু কালিদাসের পূর্ববর্তী। তাছাড়া স্বয়ং কালিদাস ভাসের সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন। ফলে যথােপযুক্ত কারণেই ভাসকে খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে ধার্য করা যেতে পারে। ভাসের নামে যে তেরােখানি নাটক বর্তমানে প্রচলিত তার সবগুলো ভাসেরই লেখা কিনা সে সম্পর্কে কোনও কোনও পণ্ডিত সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে বেশির ভাগ পণ্ডিতই নাটকগুলোর মধ্যে গঠনগত ও ভাষাগত সাযুজ্য লক্ষ করে নাটকগুলোকে ভাসেরই রচনা বলে মনে করেন। ভাসের নাটকগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা –

  • ভাসের শ্রেষ্ঠ নাটক স্বপ্নবাসবদত্তা। বৎসরাজ উদয়ন ও তার প্রণয়িণী বাসবদত্তার বিরহ-মিলনকে কেন্দ্র করে এই ঐতিহাসিক নাটক রচিত হয়েছে। আরুণির ষড়যন্ত্রে উদয়ন রাজ্য হারান, মন্ত্রী যৌগান্ধারায়ণ ও মহিষী বাসবদত্তা নিরুদ্দিষ্ট হন। কিন্তু পরে উদয়ন তার রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন এবং মন্ত্রী ও মহিষীকে ফিরে পান। দীর্ঘ অদর্শনের পর যখন তিনি মহিষীকে প্রথম দেখেন তখন তার মনে হয় তিনি স্বপ্ন দেখছেন।
  • ‘প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ’ও আর একটি ঐতিহাসিক নাটক। মন্ত্রী যৌগান্ধরায়ণ কী করে উদয়নকে উজ্জয়িনীতে বন্দিদশা হতে মুক্ত করেন এবং রাজপ্রণয়িণী বাসবদত্তাকে উদ্ধার করেন তাই এই নাটকের বিষয়বস্তু।
  • ভাসের লেখা ‘চারুদত্ত’ একটি সামাজিক নাটক। গণিকা বসন্তসেনা ও দরিদ্র চারুদত্তের প্রণয়কাহিনি এই নাটকের উপজীব্য।
  • মহাভারতের কাহিনি অবলম্বন করেও ভাস কয়েকখানি নাটক লিখেছেন। এরূপ নাটক ‘মধ্যম-ব্যায়ােগ’। ভীম ও হিড়িম্বার প্রণয়কাহিনি এই নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয়। এই শ্রেণির আর একখানি নাটক ‘দূতঘটোৎকচ’। অভিমন্যুবধের পর কৌরব শিবিরে ঘটোৎকচের দৌত্য এই কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। ‘কর্ণভার’ নাটকে আছে ব্রাহ্মণের বেশে ইন্দ্রের কর্ণের কবচ-কুণ্ডল হরণের কাহিনি। ‘দুতবাক্য’-এ কৌরব শিবিরে কৃষ্ণের বিফল দৌত্য বর্ণিত হয়েছে। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ ‘উরুভঙ্গ’ নাটকের বিষয়বস্তু। পাঁচ রাত্রির মধ্যে পাণ্ডবদের হদিশ জানতে পারলে তিনি তাদের অর্ধেক রাজত্ব দেবেন দ্রোণের নিকট দুর্যোধনের এই প্রতিশ্রুতি অবলম্বন করে ভাস তার ‘পঞ্চরাত্র’ নাটক লিখেছেন। 
  • রামায়ণের কাহিনি অবলম্বন করে ভাস ‘প্রতিমানাটক’ ও ‘অভিষেকনাটক’ নামে দুখানি পৌরাণিক নাটক লেখেন। রামের নির্বাসন ও রাবণবধের পর রামের অযােধ্যায় প্রত্যাবর্তনের কাহিনি নিয়ে প্রথম নাটক। দ্বিতীয় নাটকখানিতে বালিবধ থেকে রামের রাজ্যাভিষেকের বর্ণনা আছে। 

গ্রন্থপঞ্জি

ভারতে ব্যাকট্রীয় গ্রিক আধিপত্য

  • Banerjee, G. N. : Hellenism in Ancient India (Calcutta, 1920)
  • Gardner, P. : British Museum Caralogue of Coins of the Greek and Scythic Kings of Bactria and India (London, 1886)
  • Lahiri, A. N. : Corpus of Indo-Greek Coins (Calcutta, 1965)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age of Imperial Unity (Bombay, 1960)
  • Narain, A. K. : The Indo-Greeks (Oxford, 1962)
  • Rapson, E. J. (Ed.): The Cambridge History of India, Vol. 1 (New Delhi, 1955)
  • Raychaudhuri, H. C.: Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • Sastri, K. A. N. (Ed.): A Comprehensive History Of India, Vol. II (Calcutta, 1951)
  • Tarn, W. W. : The Greeks in Bactria and India (Cambridge, 1951)
  • Whitehead, R. B.: A Catalogue of Coins in the Punjab Museum, Vol. 1 (Oxford, 1914)

ভারতে শক-পহ্লব আধিপত্য 

  • নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস (কলকাতা, ১৩৮৪); ভারতীয় জাতিবর্ণপ্রথা (কলকাতা, ১৯৮৭)
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪); ভারতের সংস্কৃতি (কলকাতা, ১৯৯৫)
  • রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)
  • Chattopadhyaya, S. : Early History of North India (Calcutta, 1968); The Sakas In India (Santiniketan, 1967)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960)
  • Rapson, E. J. (Ed.): The Cambridge History of India, Vol. I (New Delhi, 1955): Catalogue Of The Coins Of The Andhra Dynasty, The Western Ksatrapas, The Traikutaka Dynasty And The Bodhi Dynasty (New Delhi, 1975)
  • Raychaudhuri, H.C. : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • Sastri, K. A. N. (Ed.): A Comprehensive History Of India, Vol. II (Bombay, 1957)
  • Thapar, Romila : Ancient Indian Social History (Delhi, 1978)
  • Whitehead, R. B.: A Catalogue of Coins in the Punjab Museum, Vol. I (Oxford, 1914)

কুষাণ সাম্রাজ্য

  • রণবীর চক্রবর্তী, প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪); ভারতের সংস্কৃতি (কলকাতা, ১৯৯৫)
  • নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস (কলকাতা, ১৩৮৪); ভারতীয় জাতিবর্ণ প্রথা (কলকাতা, ১৯৮৭)
  • Bapat, P. V. (Ed.): 2500 Years of Buddhism (Delhi, 1956)
  • Chakraborti. Haripada : Trade And Commerce of Ancient India (Calcutta, 1966)
  • Chattopadhyay. B.: The Age Of The Kushanas Calcutta, 1967)
  • Chattopadhyaya. S. : Early History Of North India (Calcutta, 1968)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age of Imperial Unity (Bombay, 1960)
  • Mukherjee, B. N.: The Economic Factors in Kushana History (Calcutta. 1970): The Rise And Fall Of The Kushana Empire (Calcutta)
  • Rapson, E. L. (Ed.): The Cambridge History Of India (New Delhi. 1955)
  • Raychaudhuri, H.C. : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • Sastri, K. A. N. (Ed.): A Comprehensive History Of India, Vol. II (Calcutta, 1957)
  • Upadhyaya, V.: Prachina Bharatiya Stupa. Guha Evarit Mandir (Patna, 1989)

কুষাণােত্তর পর্ব

  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের সংস্কৃতি (কলকাতা, ১৯৯৫)
  • Chattopadhyaya, S. : Early History of North India (Calcutta, 1958)
  • Ghosh. N. N. An Early History Of Kausambi (Allahabad, 1935)
  • Jayaswal, K. P. : An Imperial History Of India (Lahore, 1934)
  • Lahiri, Bela : Indigenous States of Northern India (Calcutta, 1974)
  • Law. B. C. : Some Kshatriya Tribes of Ancient India (Calcutta, 1926)
  • Majumdar, R. C. (Ed.) The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1951)
  • Rapson, E. J. (Ed.): Cambridge History of India, Vol. I (New Delhi, 1955)
  • Raychaudhuri. H.C. : Political History of Ancient India (Calcutta. 1953)
  • Sastri, K. A. Nilakanta (Ed.): A Comprehensive History Of India, Vol. II. (Calcutta, 1957)

সম্পর্কিত মানচিত্র-ভিত্তিক ভিডিও

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস

ভারতের ইতিহাস

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.