উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক ও মেসিডোনীয় গ্রিক অভিযান (খ্রি.পূ. ৬ষ্ঠ-৪র্থ শতক)

Table of Contents

পারসিক অভিযান

পারসিক আক্রমণের পটভূমি

ইন্দো-আর্যদের আদিবাস ছিল মধ্য এশিয়ায়। ভারতে প্রবেশের পূর্বে এরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। এদের একটি গােষ্ঠী পারস্য আধুনিক ইরানে প্রবেশ করে। তারা ইন্দো-পারসিক বা ইন্দো-ইরানীয় নামে পরিচিত হয়। আরেক দল প্রবেশ করে ভারতে। তারা আর্য নামেই পরিচিতি লাভ করে। সুতরাং বােঝা যায় পারসিকদের সঙ্গে ভারতীয়দের সাংস্কৃতিক যােগাযােগ বহু পুরনো। মগধ যখন সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল, খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর সেই কালপর্বে ইরানে চলছিল আকিমেনীয় বংশের শাসনকাল। আকিমেনীয় রাজারা প্রথমে ইরানের সুসা তাঞ্চলে রাজত্ব করতেন। ইরানের প্রাচীন কাহিনি থেকে জানা যায়, হখামনি বা আকিমেনিস নামে জনৈক ইরানীয় বীর এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু হখামনিষ বলে আদৌ কোনও রাজা ছিলেন কিনা তা নিয়েই সন্দেহ আছে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের প্রারম্ভে চইষপইষ নামে এক ভাগ্যান্বেয়ী পারসিক সম্ভবত এই রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম দিকে এই রাজ্যটির তেমন কোনও প্রতিষ্ঠা ছিল না। কিন্তু আনুমানিক ৫৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চইষপইষের প্রপৌত্র কুরুষ বা সাইরাসের (Cyrus) সিংহাসনে আরােহণের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যটির দ্রুত উন্নতি হয়। সমগ্র ইরান সাইরাসের পদানত হল। এছাড়াও লাইডিয়া, ব্যাবিলােনিয়া,পার্থিয়া, ব্যাকট্রিয়া প্রভৃতি অঞ্চল একে একে তার অধিকারে চলে এল। পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্বে আরব সাগর এবং উত্তরে কাসপিয়ান সাগর হতে দক্ষিণে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্যের তিনি অধীশ্বর হলেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর শেষ পাদ পর্যন্ত বিস্তৃত কালসীমার মধ্যে উত্তর-পশ্চিম ভারত দুই বার বিদেশীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। প্রথমবার এই আক্রমণের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন পারস্যের সম্রাটগণ এবং দ্বিতীয়বার গ্রীক বীর আলেকজান্ডার। প্রথম ক্ষেত্রে যখন খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ, মগধের নেতৃত্বে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের সূচনা হয়েছে, বিম্বিসার ও প্রদ্যোত নিজ নিজ কর্তৃত্ব স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন, মগধ ধীরে ধীরে ভারতের অনেক রাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজ্য গ্রাস করছে, বুদ্ধদেবমহাবীর ধর্ম প্রচারে ব্যস্ত, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে পূর্ব ও উত্তর ভারতে যখন এক নতুন যুগের আগমনী বার্তা ঘােষিত হয়েছে, তখন উত্তর-পশ্চিম ভারতে এক গভীর রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। প্রতিবেশী পারস্যের পরাক্রান্ত হখামনিষীয় বা আকিমেনীয় রাজারা উত্তর-পশ্চিম ভারত অভিযানের পরিকল্পনা করেন। তাদের প্রতিহত করার ক্ষমতা স্থানীয় ভারতীয় রাজাদের ছিল না। এই অঞ্চলে কম্বােজ, গান্ধার, মদ্র প্রভৃতি ছােট ছােট রাজ্য একে অন্যের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত ছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে মগধের মতাে কোন শক্তিমান রাজ্য গড়ে ওঠেনি যে বিবদমান রাজ্যগুলােক একটি কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে নিয়ে আসবে। বিম্বিসার বা প্রদ্যোত কেউই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। কিন্তু এই অঞ্চলের সম্পদের আকর্ষণ ছিল বরাবর। আর হিন্দুকুশ পর্বত দিয়ে যে কোন আক্রমণকারীর প্রবেশেরও সুযােগ ছিল। তাই দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর শেষ অধ্যায় পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম ভারত দুইবার বিদেশী শক্তির আক্রমণের শিকার হয়। ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অনিবার্যভাবে আকিমেনীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হল। আর পরবর্তীতে এই সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বার আধিপত্য বিস্তার করেন গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। পারস্যদের আক্রমণের ইতিহাসের উৎস পারস্য ও গ্রিক সূত্র থেকেই বেশি পাওয়া যায়। যেমন গ্রিক ইতিহাসবেত্তা হেরােডােটাস, জেনােফন, ও মেগাস্থিনিস এর লেখা এবং পারস্যে পাওয়া বেহিস্তন ও নাকস-ই-রুস্তম-এর ভাষ্য।

সাইরাসের গান্ধার জয়

পারস্য সম্রাট কুরুষ বা সাইরাস (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৮-৫৩০ অব্দ) পৃথিবীতে বৃহত্তম সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রয়াসী হয়েছিলেন এবং তিনিই এই আক্রমণের সূচনা করেন। কিন্ত সাইরাস ভারতের কোনও অঞ্চল অধিকার করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে প্রাচীন ইউরােপীয় লেখকরা পরস্পর বিরােধী বিবৃতি দিয়েছেন –

  • হেরােডােটাস বলেন প্রাচ্য দেশগুলো সাইরাস নিজে জয় করেছিলেন। কিন্তু এই বক্তব্যের সমস্যা হলো, হেরােডােটাস এখানে প্রাচ্য দেশগুলো বলতে বিশেষ কোনও অঞ্চলের উল্লেখ করেননি, ফলে তার এই উক্তিতে উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক আধিপত্য প্রমাণিত হয় না। হেরােডােটাস তার ইতিহাস গ্রন্থের আর এক স্থানে বলেছেন, সাইরাস গ্যান্ডারিটিস রাজ্য অধিকার করেছিলেন। সন্দেহ নেই যে এই গ্যান্ডারিটিস হলো ভারতের গান্ধার রাজ্য, যা সিন্ধু নদের দু’টি তীর জুড়ে অবস্থিত ছিল। ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারতের অন্তত কিছু অংশ যে সাইরাসের অধিকারভুক্ত ছিল, হেরােডােটাসের শেষ মন্তব্যটিতে তার সমর্থন পাওয়া যায়।
  • টেসিয়াস বলেন, ডার্বিকেস নামে এক উপজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সাইরাস একজন ভারতীয় সৈন্যের অস্ত্রে আঘাত পান। সেই আঘাতেই তার মৃত্যু হয়। ডার্বিকেসদের সামরিক বাহিনীতে ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি দেখে মনে হয় তারা ভারত সীমান্তে বাস করতেন। অর্থাৎ টেসিয়াসের এই বক্তব্য হতে অনুমান করা যায়, সাইরাস ভারত সীমান্তে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন।
  • জেনােফোন লিখেছেন যে, সাইরাস ব্যাকট্রিয় এবং ভারতীয়গণকে তার শাসনাধীনে এনেছিলেন এবং ভারত মহাসাগর পর্যন্ত তার অধিকার বিস্তৃত করেন। তিনি তার ‘কাইরােপেডিয়া’ গ্রন্থের এক স্থানে বলেছেন, পশ্চিমে সিরিয়া থেকে পূর্বে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল সাইরাস অধিকার করেছিলেন। বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর কিছু অংশ সাইরাস জয় করেছিলেন, এরূপ একটি সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করা যায়না। জেনােফোন তার গ্রন্থের আর এক স্থানে বলেছেন, জনৈক ভারত রাজা একবার সাইরাসকে অর্থ উপহার দেন। এই অর্থ রাজাধিরাজের উদ্দেশ্যে তার এক অনুগতের শ্রদ্ধার্ঘ হয়ে থাকতে পারে, আবার এও হতে পারে যে, সাইরাস ভারত ও ইরানের মধ্যবর্তী সীমান্ত তাঞ্চল দখল করেছিলেন এবং সেখানে তার প্রতিষ্ঠা এত বেশি হয়েছিল যে তিনি উত্তর ভারতের রাজার অধীনতা লাভ না করতে পারলেও, তার কাছ থেকে কর আদায় করতে পেরেছিলেন।
  • প্লিনি সাইরাস কতৃক কপিশ জয়ের উল্লেখ করেছেন। ‘পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় সাইরাস ঘােরবন্দ এবং পঞ্জসিরের সঙ্গমস্থলে ‘কাপিসি’ নামের নগরটি ধ্বংস করেন। সেই সময়ে কপিশ বর্তমান আফগানিস্তানের কাপিসা থেকে নুরীস্তান বা কাফিরিস্তান অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। অবশ্য এখান থেকে ভারত জয় সম্পর্কে কিছু বোঝা যায়না। তবে কপিশের পরেই কম্বোজ বা কাবুল, আর তারপর গান্ধার আসে।
  • এদিকে নিয়ারকাস ও মেগাস্থিনিসের মতাে পরবর্তী যুগের গ্রিক লেখকরা সাইরাসের ভারত বিজয়ের কথা দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করেছেন। নিয়ারকাস বলেন, সাইরাস ভারত জয়ের উদ্দেশ্যে একবার সসৈন্যে গেড্রোসিয়া বা বেলুচিস্তানের পথ ধরে অগ্রসর হন। কিন্তু পথে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ৭ জন মাত্র অনুচর সঙ্গে নিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে আসেন। তার ভারত জয়ের সংকল্প অপূর্ণই থেকে যায়।
  • মেগাস্থিনিসের বিবরণেও সাইরাস যে ভারত জয় করেননি তার উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছেন যে, ভারতীয়গণ হেরাক্লেস ও ডায়োনিসাস এবং আরও পরে ম্যাসিডনীয়গণ ছাড়া আন্য কোন বিদেশীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। তিনি আরও লিখেছেন যে, পারসিকগণ ভারত থেকে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে ক্ষুদ্রকগণকে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তারা নিজেরা কখনও ভারত আক্রমণ করেনি। অর্থাৎ তিনি স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করে গেছেন যে, আলেকজান্ডারের পূর্বে আর কোনও বৈদেশিক রাজা ভারত আক্রমণ বা জয় করেননি। 
  • এ্যারিয়ান মেগাস্থিনিসের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন যে, আলেকজান্ডারের আগে অন্য কেউ ভারত আক্রমণ করেনি। তবে তিনি বলেন, কাবুল ও সিন্ধু নদের মধ্যবর্তী অঞ্চল প্রথমে অ্যাসিরিয়া, পরে মিডিয়া এবং শেষে পারস্যের অধীনস্থ হয়। তিনি আরও বলেন, সাইরাস এই অঞ্চল থেকে কর আদায় করতেন। উল্লেখ্য সিন্ধু নদ ও কাবুলের মধ্যবর্তী স্থানে গান্ধারের একটি অঞ্চল পড়ে, তবুও তিনি বলছেন যে সাইরাস ভারতবর্ষ আক্রমণ করেননি, এর অর্থ এ্যারিয়ানের মতে সিন্ধু নদের পূর্ব থেকেই ভারতবর্ষের সূচনা।

দেখা যাচ্ছে, সাইরাসের ভারত বিজয় সম্পর্কে প্রাচীন ইউরােপীয় লেখকরা বিপরীতমুখী মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। হেরোডোটাস, টিসিয়াস, জেনোফোন এবং স্ট্রাবোর রচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম রাজ্য পারস্য সাইরাসের পূর্বাঞ্চল জয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল, আর এই পূর্বাঞ্চল বলতে স্বভাবতই বোঝাতো ড্রাঙ্গিয়ানা (সিস্তানের অংশ বিশেষ), সাট্রাগিডিয়া (কোথায়, ঠিক জানা যায় না, হয়ত গজনী, হয়ত হাজারা অথবা অন্য কোন স্থান) এবং গান্ডারাইটিস (গান্ধার)। ড্রাঙ্গিয়ানা আর সাট্রাগিডিয়াকে কখনও ভারতের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়নি, তবে গান্ডারাইটিস বা গান্ধার ছিল সিন্ধু নদের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকেই তীরবর্তী অঞ্চল জুড়ে ছিল। পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চলের অংশটিকে কেউ কেউ একে ভারতবর্ষের অংশ বলে মনে না করলেও প্রকৃতপক্ষে এটি হিন্দু কুশ পর্বতমালার পূর্বে অবস্থিত, এর অধিবাসীরা ইন্দো-আর্য ভাষাতেই কথা বলতো, এটি পাঞ্জাব অঞ্চলের অন্তর্গত এবং মহাভারত সহ বিভিন্ন ভারতীয় সাহিত্যে গান্ধারের উল্লেখ রয়েছে, ফলে এটি স্বাভাবিকভাবেই একে ভারতবর্ষের অংশ হিসেবেই ধরতে হয়। সেই সাথে ইতিহাসে গান্ধারের তিনটি রাজধানীর নাম জানা যায় – তক্ষশীলা, পুষ্কলাবতী (বর্তমান চারসাদা) ও পুরুষপুর (বর্তমান পেশোয়ার), এদের মধ্যে শেষের দুটো সিন্ধুর পশ্চিমেই অবস্থিত। কিন্তু নিয়ারকাস ও মেগাস্থিনিস বলছেন সাইরাস ভারতবর্ষের কোন অঞ্চল জয় করেননি। এখান থেকে Meyer এবং ডঃ দীনেশ চন্দ্র সরকার একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন, তা হলো নিয়ারকাস, মেগাস্থিনিস ও এ্যারিয়ান সিন্দু নদকেই ভারতবর্ষের সীমান্ত ভাবতেন, হিন্দুকুশ পর্বতমালাকে নয়, সাইরাস হয়তো গান্ধারের সিন্ধু নদের পশ্চিমাংশের ভাগই জয় করে থাকবেন, তাই তিনি সিন্ধু পার না হবার ফলে তারা সাইরাসের ভারতের অঞ্চল জয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন। অন্যদিকে হেরোডোটাস, টেসিয়াস, জেনোফোন ও স্ট্রাবো হিন্দুকুশ পর্বতমালাকে ভারতবর্ষের সীমান্ত ভেবেছেন ও এর পূর্বে অবস্থিত সকল অঞ্চলকেই ভারতবর্ষ বলে বিবেচনা করেছেন, ফলে এদের কাছে গান্ধারের সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চলও হয়েছে ভারতবর্ষের অংশ, আর তাই তাদের মতে সাইরাস ভারতবর্ষের একটি অংশকে শাসন জয় করেছেন। এই প্রসঙ্গে এরিয়ানের বক্তব্যও উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেছিলেন কাবুল ও সিন্ধু নদের মধ্যবর্তী অংশ অ্যাসিরিয়া, মেডিয়া ও পারস্যদের অধীনস্ত হয় আর সাইরাস এই অঞ্চল জয় করেন। এখন কাবুল ও সিন্ধু নদের মধ্যবর্তী অঞ্চলে একটি অঞ্চলই পড়ে – তা হলো গান্ধার। সুতরাং সমস্ত মতের বিচারসাপেক্ষে এই সিদ্ধান্তেই আসা যায় যে সাইরাস গান্ধারের সিন্দু নদের পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চল দখল করেছিলেন, অর্থাৎ তিনি ভারতবর্ষের একটি অংশ জয় করেছিলেন।

প্রথম দারিউসের পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চল বিজয়

৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাসের মৃত্যু হলে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ক্যাম্বাইসেস পিতার সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার রাজত্বকালে রাজ্যের নানা স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। তিনি বিদ্রোহ দমন করলেন ঠিকই কিন্তু এর বিনিময়ে তাকে প্রচুর সময় ও শক্তি ব্যয় করতে হয়। তারপর তিনি মিশর জয়ের পরিকল্পনা করেন। মিশরের রাজা এমেসিস ও তার পুত্র তৃতীয় স্যামেটিকাস যুদ্ধে পরাজিত হন। আকিমেনীয় রাজ্য দক্ষিণে নীল নদ পর্যন্ত প্রসারিত হল। কিন্তু পুনরায় রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। পতন আসন্ন বুঝে তিনি আত্মহত্যা করেন (৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্তের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার অবকাশ তিনি বড় একটা পাননি। ক্যাম্বাইসেসের মৃত্যুর পর রাজ্যের কর্তৃত্ব বিদ্রোহীদের হাতে চলে যায়। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তাদের বিতাড়িত করে ক্যাম্বাইসেসের জ্ঞাতি-ভাই প্রথম দারয়বৌষ বা দারিউস (Darius I) আকিমেনীয় সিংহাসনে আরােহণ করেন। তখন ৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। দারিউসের রাজত্বকালে (৫২২-৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আকিমেনীয় আধিপত্য ভারতের আরও কয়েকটি অঞ্চলে বিস্তৃত হয়। তার কয়েকটি লেখ থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারত জয়ের আভাস পাওয়া যায়। দারিউসের সময় ভারত সীমান্তে পারস্যের অধিকৃত অঞ্চলগুলোর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিতে গিয়ে বলা যায় যে, এখন যে প্রদেশগুলো আফগানিস্তানের অংশবিশেষ, সেগুলো এবং সিন্ধুুর নিকটবর্তী অঞ্চলগুলো, পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আকিমেনীয় লেখসমূহে যেমন ড্রাঙ্গিয়ানা (সিস্তানের অংশ), এ্যারিয়া (হেরাত), ব্যাক্ট্রিয়া (বালখ), সগডিয়ানা, সাট্রাগিডিয়া (হাজারা?), আরাকোসিয়া (কান্দাহার) এবং গেড্রোসিয়া (মাকরান) এর উল্লেখ আছে তেমনি গান্ডারাইটিস (গান্ধার) ও হিন্দু বা ‘ইন্ডিয়ান’ (সিন্ধু নদের পূর্বাঞ্চলের পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চল) এরও উল্লেখ আছে।

  • দারিউসের সাম্রাজ্যে গান্ধারের অন্তর্ভূক্তি : ৫২০-১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উৎকীর্ণ তার বেহিস্তুন লেখে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত তেইশটি প্রদেশের উল্লেখ আছে, কিন্তু সেখানে ‘ইন্ডিয়ার’ কোন উল্লেখ নেই। তবে এই লেখে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, যেমন সগডিয়ানা, স্কুথিয়া এবং ব্যাক্ট্রিয়ার সঙ্গে গান্ধারকে (পেশােয়ার এবং রাওয়ালপিণ্ডি) অন্যতম প্রদেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এখান থেকে জানা যায়, গান্ধার তার অধিকারভুক্ত ছিল। দারিউসের সুসা প্রাসাদ লেখ ও নাকস ই-রুস্তম লেখেও এই কথার পরোক্ষ সমর্থন আছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, প্রাসাদ নির্মাণের জন্য সেগুন কাঠ গান্ধার থেকে আনা হয়েছিল। হেরােডােটাসও অধিকৃত এ অঞ্চলকে পারস্য সম্রাট দারিউসের প্রদেশ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। ভারতের এ অঞ্চলের অনেক সমৃদ্ধির কথাও গ্রিক লেখনীতে পাওয়া যায়। গান্ধারের রাজধানী তক্ষশীলা ছিল সে যুগের অত্যন্ত খ্যাতিমান শহর। শিক্ষা এবং বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূর দূরান্তে। মগধ থেকে অনেক শিক্ষার্থী তক্ষশীলায় আসতেন জ্ঞানচর্চার জন্য। শিল্পচর্চারও প্রাণকেন্দ্র ছিল তক্ষশীলা।
  • বেলুচিস্তান জয় : বেহিস্তুন লেখে গান্ধার ছাড়া দারিউসের শাসনভুক্ত আরও ২২টি প্রদেশের উল্লেখ আছে। এদের একটির নাম মক। প্রদেশটি সম্ভবত বেলুচিস্তানের মকরান উপকূলে অবস্থিত ছিল। সাইরাসের রাজত্বকালেই গান্ধার পারসিক সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। ৫১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে দারিউস দক্ষিণ বেলুচিস্তানে পারসিক আধিপত্য বিস্তৃত করেন।
  • পাঞ্জাব ও সিন্ধু জয় : সাইরাসের গান্ধার বিজয়ের কারণে দারিউস সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরবর্তী গান্ধারকে উত্তরাধিকারসূত্রেই লাভ করেছিলেন। এরপর তিনি সিন্ধু নদের পূর্বাঞ্চল, অর্থাৎ পাঞ্জাব ও সিন্ধু জয়ে মনোনিবেশ করেন। দক্ষিণ বেলুচিস্তান জয়ের কিছুকাল পর তিনি পাঞ্জাব ও সিন্ধু অধিকার করেন। ৫১৮-১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উৰ্কীর্ণ তার পার্সেপােলিস লেখে হিদু, হিন্দু বা সিন্ধু নামে আর একটি ভারতীয় অঞ্চলের উল্লেখ আছে। ৫১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উৎকীর্ণ তার নকস-ই রুস্তম লেখেও হিন্দু প্রদেশের উল্লেখ আছে। হামাদান স্বর্ণ ও রৌপ্য লেখেও হিন্দুকে পারসিক সাম্রাজ্যভুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ৫১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা তার কাছাকাছি কোনও এক সময় দারিউস হিন্দু অধিকার করেন। পারসিক লেখে যে অঞ্চলটিকে হিদু বা হিন্দু বলা হয়েছে, সেটি আসলে সিন্ধু উপত্যকা যা বর্তমানে পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাব এবং সিন্ধু নামে পরিচিত। সিন্ধু অববাহিকা যে দারিউস অধিকার করেছিলেন, হেরােডােটাসের বিবরণেও তার প্রমাণ আছে। হিন্দু অঞ্চলকে হেরােডােটাস দারিউসের সাম্রাজ্যের বিংশতিতম প্রদেশরূপে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, জনবল ও ধনসম্পদে এই অঞ্চল সমৃদ্ধ ছিল, এর মাটিও ছিল খুব উর্বর। এখান থেকেই পারস্যের সেনাবাহিনীতে অনেক ভারতীয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দারিউস যত রাজস্ব পেতেন তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শুধু এই একটিমাত্র প্রদেশ হতেই সংগৃহীত হত। সিন্ধুর বাৎসরিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৩৬০ ট্যালেন্ট স্বর্ণরেণু। তিনি আরও বলেছেন যে, গদারগণ, সত্‌ত-গুদীয়গণ, দদিকগণ, আপারুটেগণ ইত্যাদি তার সাম্রাজ্যের ৭ম প্রদেশ রচনা করেছিল এবং তাকে ১৭০ স্বর্ণমুদ্রা কর দিত। দারিউসের রাজত্বের আর একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন হেরােডােটাস। তার বিবরণে পাওয়া যায়, আনুমানিক ৫১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারসিক সম্রাট স্কাইল্যাকস নামে তার এক সেনাপতিকে সিন্ধু নদ বরাবর নৌ-অভিযানে পাঠান। গান্ধারের কোনও এক স্থান থেকে যাত্রা করে সিন্ধু নদ ধরে অগ্রসর হয়ে পারসিক সেনাপতি আরব সাগরে এসে পড়েন। সেখান থেকে পশ্চিমের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়ে যাত্রা আরম্ভের প্রায় ২ বছর তিন মাস পর তিনি মিশরে এসে উপনীত হন। হেরােডােটাস বলেছেন, স্কাইল্যাক্‌সের সিন্ধু নদ অভিযানের পরই দারিউস সিন্ধু উপত্যকা জয় করেন। গ্রিক ঐতিহাসিকের এই উক্তিটি সম্ভবত ঠিক নয়। পাঞ্জাব ও সিন্ধু নিজেদের কর্তৃত্বে না এনে পারসিক অভিযাত্রীদের পক্ষে সিন্ধু নদের বুকে জাহাজ ভাসানাে সম্ভব ছিল না।
  • দারিউসের ভারতবর্ষ জয়ের সীমা : প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের কতটা অঞ্চল জুড়ে দারিউস তার প্রভুত্ব বিস্তার করেছিলেন? তার আধিপত্য দক্ষিণ দিকে সম্ভবত সিন্ধু নদের মােহনা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। দারিউসের রাজ্যের পূর্বদিকে মরুভুমির অবস্থানের কথা বলেছেন হেরােডােটাস। সন্দেহ নেই, এই মরুভূমি সিন্ধু ও রাজস্থানের বৃহৎ ভারতীয় মরুভূমি। সিন্ধু নদের পূর্ব তীরবর্তী পাঞ্জাবের অনেকটা অংশই পারসিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমান পূর্ব পাঞ্জাবও পারসিকদের অধীন ছিল কিনা বলা কঠিন। সম্ভবত এই অঞ্চলে দেশীয় রাজারা রাজত্ব করতেন। হেরােডােটাস গাঙ্গেয় ভূভাগের কোনও উল্লেখ করেননি। মগধ রাজ্য বা সেখানকার হর্য্যঙ্ক রাজাদের সম্পর্কেও তিনি নীরব।

প্রথম জারেক্সেসের অধীনে উত্তর-পশ্চিম ভারত

দারিউসের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম ক্ষয়ার্ষা বা জারেক্সেস (Xerxes I) ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইরানের সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি তার পিতার মতাে পরাক্রান্ত ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন না। দারিউসের গ্রিস অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। গ্রিকদের হাতে পিতার পরাজয়ের প্রতিশােধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তিনি সুবিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে গ্রিস আক্রমণ করেনথার্মোপাইলির যুদ্ধে তার অসংখ্য সৈন্য হতাহত হলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে তার জয় হয়। এর পর জারেক্সেসের ভাগ্য-বিপর্যয় শুরু হয়। সালামিস, প্লাটিয়া ও সেসটোসের যুদ্ধে ইরানি বাহিনী উপর্যুপরি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। সেনাপতি মেরদোনিয়াস প্লাটিয়ার রণাঙ্গনে নিহত হন। পিতার মতো জারেক্সেসের গ্রিস অভিযানও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। প্রায় সারা এশিয়া সংঘবদ্ধ হয়েও গ্রিকদের দেশপ্রেমের কাছে নতি স্বীকার করল। হেরােডােটাসের বিবরণে পাওয়া যায়, জারেক্সেসের গ্রিস অভিযানে গান্ধার ও সিন্ধুর সৈন্যরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন (সিন্ধু বলতে পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চল বা হিন্দু বা ইন্ডিয়া)। যুদ্ধের সময় গান্ধারের সৈন্যরা বাঁশের তৈরি তির, ধনুক আর ছােট বর্শা ব্যবহার করতেন। সিন্ধুর সৈন্যদের হাতে থাকত বেতের তৈরি তীর ও ধনুক। তীরের কার্যকারিতা বাড়ানাের জন্য তার মুখে লােহার ফলক লাগানাে হত। গ্রিকদের কাছে জারেক্সেসের শােচনীয় বিপর্যয়ের কোনও প্রভাব তার সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তের ওপর পড়েনি। মকরান, গান্ধার ও সিন্ধু অঞ্চলে তার প্রভুত্ব পূর্বের মতােই অটুট ছিল।

তৃতীয় দারিউসের সময় পারস্য সাম্রাজ্যের পতনের সময় উত্তর-পশ্চিম ভারত

প্রথম জারেক্সেসের মৃত্যুর পর ভারতে পারসিক প্রভুত্ব ক্রমশ শিথিল হয়। দ্বিতীয় জারেক্সেসের (৪০৫-৩৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আমলের পার্সেপােলিস লেখে গান্ধার ও সিন্ধুকে পারসিক সাম্রাজ্যের অংশ বলা হয়েছে। সিন্ধু থেকে দ্বিতীয় জারেক্সেসকে দামি উপহার পাঠানাে হত বলে টেসিয়াস মন্তব্য করেছেন। আকিমেনীয় বংশের সর্বশেষ রাজা তৃতীয় দারিউস (৩৩৫-৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। এই সময় ম্যাসিডােনরাজ আলেকজান্ডার পারসিক সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরবেলার প্রান্তরে পারসিকরাজ সর্বশক্তি দিয়ে শেষ বারের মতাে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কিন্তু এবারও তিনি পরাজিত হন ও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন। কিন্তু শেষে নিজের সৈন্য বাহিনীর হাতেই তার মৃত্যু হয়। সিন্ধু থেকে তিন দল সৈন্য আরবেলার যুদ্ধে তৃতীয় দারিউসের পক্ষে যােগ দেন। ব্যাকট্রিয়ার ক্ষত্রপ এগুলোর একটি দলের নেতৃত্ব দান করেন। আরাকোসিয়ার ক্ষত্রপ দ্বিতীয় দলটি পরিচালনা করেন। সিন্ধু থেকে আরবেলায় পাঠানাে তৃতীয় বাহিনীটি গজারােহী সৈন্য নিয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু আরবেলার যুদ্ধে সিন্ধুর সৈন্যরা অংশগ্রহণ করেছিল – এর থেকেই প্রমাণ হয় না যে আকিমেনীয় রাজশক্তি ভারতে তাদের কর্তৃত্ব পারসিকদের পরাজয়ের  সময়, অর্থাৎ ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অটুট রাখতে পেরেছিলেন। (প্রকৃতপক্ষে গৌগমেলার প্রান্তরে যুদ্ধটি অনুষ্ঠিত হয়। স্থানটি আরবেলা হতে প্রায় ৪৪ কিমি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। যুদ্ধটি কিন্তু আরবেলার যুদ্ধ নামেই ইতিহাসে পরিচিত।) সিন্ধুর সৈন্যরা আরবেলার প্রান্তরে ব্যাকট্রিয়া ও আরাকোসিয়ার ক্ষত্রপদের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন, অর্থাৎ এখানে সিন্ধু ও গান্ধারের ক্ষত্রপদের ভূমিকার কোনও উল্লেখ নেই। সুতরাং সে সময় এই সিন্ধু (সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চল) ও গান্ধার – এই দুই অঞ্চলে পারসিক ক্ষত্ৰপ ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। সম্ভবত সিন্ধুর সৈন্যরা ভাড়াটে সৈন্যের ভূমিকায় আরবেলার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এর থেকে মনে হয় ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বেই ভারতে পারসিক শাসনের অবসান হয়। তবে ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কতকাল পূর্বে ভারতে পারসিক প্রভুত্বের অবসান ঘটে তা বলা সহজ নয়। অনেকের অনুমান, আকিমেনীয়দের প্রকৃত কর্তৃত্ব দ্বিতীয় বা তৃতীয় জারেক্সেসের সময় শেষ হয়ে যায়। এ ধারণা নিতান্তই আনুমানিক। এদিকে আমরা দেখি আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন, তখন তাকে কোনও পারসিক ক্ষত্রপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়নি, তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে বিভিন্ন ভারতীয় উপজাতি ও দেশীয় রাজাদের সঙ্গে। এ থেকে বােঝা যায়, আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের বেশ কিছুকাল পূর্বেই গান্ধার, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান অঞ্চলে দেশীয় উপজাতি ও রাজারা আকিমেনীয় প্রভুত্ব উচ্ছেদ করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পারসিক প্রভাব

ভারতের সঙ্গে পারস্যের সম্পর্ক প্রায় দুইশত বছর স্থায়ী ছিল। কিন্তু ভারতের ইতিহাসের ওপর পারসিক আক্রমণের প্রত্যক্ষ কোন প্রভাব নেই। কারণ পারসিক অভিযান সীমাবদ্ধ ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটি নির্দিষ্ট ভুখণ্ডে। এই ঘটনা ভারতীয় রাজনীতির ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। যে কারণে ভারতীয় পুরাণ বা প্রাচীন সাহিত্যে এই আক্রমণের তেমন কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। যে সময়ে পারসিক আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিল তখন সকলের মনােযােগ ছিল মগধের দিকে। শক্তিমান রাজারা পারস্পরিক আধিপত্য বিস্তারে সক্রিয় ছিলেন। তাই ভারতের লেখকরাও অন্য কোনদিকে মনােযােগী হতে পারেননি। ওপরের বক্তব্য অনুধাবন করেও গভীর অনুসন্ধানে দেখা যায় যে ভারতের অর্থনীতি, শিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্য অর্থাৎ সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারসিক অভিযানের একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল। ভারতের প্রশাসনিক ইতিহাসেও পারস্য প্রভাবের ছায়া লক্ষ করা যায়। প্রাচীন ভারতের স্থাপত্যরীতিতে আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের প্রভাব লক্ষ্য করে (নিচে “মৌর্য শিল্প” অংশটি দেখুন) ডঃ স্পুনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, মৌর্যরা ছিল পারসিক এবং অশোকের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ ভারতের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রয়াস মাত্র। ডঃ স্পুনারের মত গ্রহণযােগ্য নয়। কিন্তু তাই বলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে পারস্যের উত্তর-পশ্চিম ভারত জয়ের ফলাফলকে তুচ্ছ বলা যায় না। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে পারসিকরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে রাজত্ব করেন। তাদের রাজত্বের অবসান ঘটে বটে, কিন্তু বৃহত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তারা বিরাট অবদান রেখে গেছে। পারসিকদের সংস্পর্শে এসে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি এক নতুন মাত্রা পায়। হুইলার বলেছেন যে, ভারতীয় প্রদেশ অধিকার করে পারস্য ভারতকে শুধু শাসক দেয়নি, নুতন উপাদান এবং ভাবধারা দিয়েছিল। ভারতীয় সভ্যতায় তাদের অবদান নিয়ে আলোচনা করা যাক –

মৌর্যদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, কেন্দ্রীকরণ নীতি ও রাজসভার আচার ব্যবস্থা : পারসিক সম্রাটরা পশ্চিমে ঈজিয়ান ও ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্বে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এক সাগর থেকে আর এক সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রাজ্য পূর্বে কখনও গঠিত হয়নি। উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিকদের সাফল্য মগধের শক্তিমান রাজাদের প্রভাবিত করেছিল। তারা পারসিকদের অনুকরণে সাম্রাজ্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়, তারা সমুদ্রমেখলা রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখেন। সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যেভাবে ব্যস্ত ছিলেন অনুমান করা হয় এর পেছনে পারসিক প্রভাবের ভূমিকা ছিল। চন্দ্রগুপ্তঅশােক শাসনব্যবস্থায় যে কেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করেছিলেন তার পেছনেও সম্ভবত পারসিক অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়কাল থেকেই মৌর্য রাজসভার কয়েকটি আচার অনুষ্ঠানের ওপর (যেমন রাজার কেশচর্যা, প্রাসাদে নারী রক্ষী বাহিনী নিয়ােগ, প্রাসাদের অভ্যন্তরে পূতাগ্নি প্রজ্বলিত রাখা ইত্যাদি) পারস্যের প্রভাব ছিল। মৌর্যরাজেরা দেহরক্ষী রূপে মহিলা বাহিনী নিযুক্ত করতেন। প্রথাটি সম্ভবত ইরান থেকে আমদানি হয়, আর বলা হয় তিনি পারসিক নারীদেরকেই দেহরক্ষী নিযুক্ত করতেন। মৌর্য সম্রাটরা পারসিকদের অনুকরণে বেশ কিছু উৎসব পালন করতেন বলেও জানা যায়।

পারসিক শাসনপদ্ধতি ও ক্ষত্রপ : শাসনকার্যের সুবিধার জন্য পারস্য সাম্রাজ্য কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। এক একটি অঞ্চলের শাসনভার ক্ষত্ৰপ উপাধিধারী এক একজন পদস্থ কর্মচারীর ওপর ন্যস্ত ছিল। মৌর্যযুগের পরে উত্তর-পশ্চিম ভারতের শক-পহলব-কুষাণ রাজ্যগুলোতে এই পারসিক শাসনপদ্ধতি বহুলাংশে অনুসৃত হয়। এই রাজ্যগুলোতে আঞ্চলিক প্রশাসকরা সাধারণত ক্ষত্ৰপ নামেই পরিচিত ছিলেন। শক শাসকগণ ক্ষত্ৰপ অভিধা গ্রহণ করেছিলেন।

যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি, রাজপথে নিরাপত্তা প্রদান ও স্থানীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠা : পথ-ঘাট নির্মাণ ও তার সুরক্ষার প্রতি আকিমেনীয় রাজাদের সতর্ক দৃষ্টি ছিল। পথ-ঘাটের সুব্যবস্থা একদিকে যেমন সৈন্যচলাচল ও শৃঙ্খলা রক্ষার অনুকূল ছিল, অন্যদিকে তেমনি বাণিজ্যিক বিকাশকেও ত্বরান্বিত করেছিল। পারসিক রাজাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ভারতীয় রাজারাও পথ ঘাট নির্মাণ ও তার সুরক্ষার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকেই তক্ষশিলা থেকে রাজগৃহ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি অতি দীর্ঘ রাজপথ গড়ে ওঠে। পরে এই রাজপথটি পাটলিপুত্র পর্যন্ত প্রসারিত হয়। পথটি উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে পুষ্কলাবতী ছাড়িয়ে একেবারে আফগানিস্তানের বলখ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পথ-ঘাটের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যের ব্যাপকতাও বৃদ্ধি পায়। রাজপথে নিরাপত্তা প্রদানের ফলে রাজপথের পাশে কপিশ (বেগ্রাম), পুষ্কলাবতী (চারসাদা) এবং তক্ষশিলার মত নতুন স্থানীয় রাজধানী গড়ে উঠেছিল। জীর্ণ ধুলিমলিন এই স্থানগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ‘পারসিক শান্তি’র (Pax Persica) স্মারক হয়ে আছে।

বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্যবৃদ্ধি ও লোহার ব্যবহার : ভারত ও পারস্যের মধ্যকার যােগাযােগ বাণিজ্যিক দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। এই সময় থেকে অ্যাসিরিয়া, ব্যাবিলােনিয়া, মিশর ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। মকরানের উপকূল পথে ভারতীয় বাণিজ্যতরী পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল ও আরব দেশগুলোতে যাতায়াত করত। পারসিক লেখনী থেকে জানা যায় এ যুগে ভারতের সেগুন কাঠ এবং হাতির দাঁতের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা ছিল পারস্যে। অনেকে মনে করেন, পারসিকদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসায় ভারতে পশম বস্ত্র ও কম্বলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উভয় দেশের মধ্যে যে বাণিজ্য প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ হিসাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রচুর পারসিক মুদ্রা প্রাপ্তির বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পর থেকে ভারতে ব্যাপক লােহার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এর পেছনে পারসিকদের সঙ্গে যােগাযােগের বিষয়টি ভূমিকা রেখেছে বলে পণ্ডিতদের অনুমান। কারণ পারসিকদের কাছ থেকেই লােহার বিশেষ ব্যবহার সম্পর্কে ভারতীয়রা ওয়াকিবহাল হন। 

আরামীয় লিপি, পারসিক ভাষা, অনুশাসনে আকিমেনীয় রীতি ও খরোষ্ঠী লিপির উদ্ভব : পারসিকরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে আরামীয় ভাষা ও লিপির প্রচলন করেন। সম্রাট অশােক তার কয়েকখানি অনুশাসনে আরামীয় লিপি ব্যবহার করেছেন। ডঃ রায়চৌধুরী উল্লেখ করেছেন যে, অশােক-লেখে ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দের উৎপত্তি পারসিক ভাষায়। অশােক তার লেখে কখনও কখনও ‘দিপি’ ও ‘নিপিষ্ট’ পদ দুটি প্রয়ােগ করেছেন। “দিপি’ এর অর্থ “অনুশাসন” এবং “নিপিষ্ট’ এর অর্থ হলো ‘লিখিত’। অশােক অবশ্য প্রায়ই ‘দিপি’র পরিবর্তে ‘লিপি’ পদটি ব্যবহার করেছেন। ‘দিপি’রই রূপান্তর লিপি’। ‘দিপি’ ও ‘নিপিষ্ট’ পদ দু’টি পারসিক। অশােক তার অনুশাসনেও আকিমেনীয় রীতি তানুসরণ করেছেন। প্রথম দারিউস তার লেখে প্রথমে প্রথম পুরুষে ও পরে উত্তম পুরুষে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। অশােকের লেখেও একই রীতি অনুসৃত হয়েছে। খরােষ্ঠী প্রাচীন ভারতের এক বিখ্যাত লিপি। মূলত আরামীয় লিপি থেকেই এই লিপির উদ্ভব হয়েছে। আরামীয় লিপির মত এই লিপিও ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখা হত। সম্ভবত পারসিক কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে উত্তর-পশ্চিম ভারতে এই লিপির প্রচলন হয়। এটা করা হয়েছিল প্রধানত আরামীয়-জানা শাসনকর্তাদের কাজের সুবিধার জন্য, যাতে তারা মােটামুটি সহজবােধ্য বর্ণমালার সাহায্যে আঞ্চলিক ভাষা প্রকাশ করতে পারেন। এ কাজ আরামীয় লিপি দিয়ে হত না বলেই এই নতুন লিপি প্রবর্তন করা হয়েছিল। পরে সাধারণ মানুষের কাছেও এই লিপি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের পর থেকে আর এর ব্যবহার দেখা যায় না। অশোকের লেখে আরামীয় লিপির মতো খারোষ্ঠী লিপিও পাওয়া যায়।

স্থাপত্য শিল্প : ডঃ স্পুনার ১৯১৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে মৌর্যদের ওপর পারস্যের প্রভাবকে নিয়ে উল্লেখ করেছেন, অবশ্য অনেকের মতে তিনি এই প্রভাবকে অতিরঞ্জিত করেছেন। যাই হোক, তিনি বলেছেন যে, পাটলিপুত্রে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাঠের তৈরি রাজপ্রাসাদ পার্সিপােলিসে দারিউসের রাজপ্রাসাদের আদলে তৈরি হয়েছিল। পারস্যের মিস্ত্রিরাই এটি নির্মাণ করেছিল। বারাবারে এবং অন্যত্র গুহাগুলো পারস্যের রাজাদের সমাধিগুলোর অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন যে, অসুর মায়া (মহাভারতের ময়দানব) অশোকের রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। ডঃ স্পুনার মনে করেন যে, এই অসুর মায়া এবং পারস্যে আহুর মাজদা, যার অনুগ্রহে জারেক্সিস তার প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, অভিন্ন। যাই হোক, স্পুনারের অতিরঞ্জনের পরও প্রাচীন ভারতের স্থাপত্যকলায় পারসিক প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। মৌর্য শিল্পের উপর পারসিক শিল্পের প্রভাব পড়েছিল। মৌর্যযুগে নির্মিত স্তম্ভগুলোতে এই প্রভাব বেশি করে চোখে পড়ে। হুইলার মনে করেন যে অশােকের এই স্তম্ভগুলোর মধ্যে পারসিকদের শিল্পকুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। চুনারের বালিপাথরে তৈরি এই স্তম্ভগুলোর যে অপূর্ব পালিস তা পারসিকদের সৃষ্টি। সারনাথ স্তম্ভের সিংহমূর্তিগুলো তাদের অবদান। স্তম্ভনির্মাণে পাথরের ব্যবহার, এর দৃষ্টিনন্দন মসৃণতা, বােধিকায় ঘণ্টা বা ওলটানাে পদ্মের সংযােজন, সব কিছুর মধ্যেই পারসিক প্রভাব নীরবে কাজ করেছে। কিন্তু এখানেও মৌর্যশিল্পী পারসিক শিল্পকলার অন্ধ অনুকরণ করেননি, আপন স্বকীয়তার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সব মিলে এটি ছিল ভারতীয় ও পারস্যের শিল্পধারার সমন্বয়ে ইন্দো-পারসিক শিল্পরীতি। পাটনার কাছে কুমরাহারে স্তম্ভ এক সভাগৃহ আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেকে এটিকে পার্সেপােলিসের শতস্তম্ভবিশিষ্ট আকিমেনীয় দরবার কক্ষের আদলে নির্মিত বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ এ কথাও বলেন, এসব স্থাপত্য ও শিল্পকর্ম আসলে পারসিক শিল্পীদেরই হাতে তৈরি হয়েছিল। তারা মনে করেন, আলেকজান্ডার কতৃক খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে পার্সিপােলিস নগরীর ধ্বংস সাধন ভারতের ওপর পারস্যের প্রভাবকে আরও গভীর ও ব্যাপক করেছিল। এই ঘটনার পরে পারস্যের শিল্পীগণ স্বদেশে আশ্রয়চ্যুত হয়ে ভারতে তাদের নতন আবাসস্থল খুঁজে পান। এই ইন্দো-পারসিক অধ্যায়ে ভারতে স্থাপত্য শিল্পের সূচনা হয়। তবে মৌর্যযুগের বেশির ভাগ শিল্পকর্ম পারসিক শিল্পীদের হাতে তৈরি বলে যে অভিমত ব্যক্ত হয়েছে, তা প্রমাণসিদ্ধ নয়। মেগাস্থিনিস প্রদত্ত পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদের বর্ণনা পারস্যের রাজপ্রাসাদের স্মৃতি মনে আনে। এসব দেখেই হুইলার মনে করেছিলেন যে, মৌর্য সাম্রাজ্যকে একাধিক দিক থেকে পারসিক বা আকিমিনীয় (পারস্যের রাজবংশের নাম ছিল আকিমিনিদ বংশ) সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী এবং পরিশিষ্ট বলা যায়। 

ধর্মীয় ও সমাজ জীবন : প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় ও সমাজ-জীবনের উপরও পারসিক প্রভাব পড়েছিল। ভারতের নানা স্থান থেকে বিশেষ এক ধরনের প্রাচীন সূর্য মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মূর্তিগুলোর পায়ে পাদুকা, কোমরে মেখলা ও গায়ে বিদেশি পােশাক। এই সূর্যমূর্তিগুলোতে বৈদিক রীতি অনুসরণ নেই, আছে পারসিক দেবতা মিহিরের অনুকরণ। ইরানি গােষ্ঠীর মগ সম্প্রদায়ের লােকেরাই ভারতে সূর্য সম্পর্কে এই নতুন ধ্যানধারণা প্রবর্তন করেন। ভারতের কয়েক স্থানে মামাতাে ভাই-বােনদের মধ্যে বিবাহের বিশেষ প্রচলন আছে। প্রথাটি সম্ভবত পারস্য থেকেই এসেছে। 

মুদ্রা সম্পর্কিত ধারণা ও মুদ্রা প্রস্তুতির রীতি : পারসিক প্রভাব ভারতে মুদ্রা সম্পর্কিত ধারণার সৃষ্টি করেছিল। পারসিকরা স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রণয়নে দক্ষ ছিল। তাদের কাছ থেকে প্রভাবিত হয়ে ভারতীয়রা মুদ্রা তৈরিতে সফল হয়েছিল। প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রা কার্ষাপণের নামকরণ ও তৌলরীতির উপর কেউ কেউ পারসিক প্রভাব লক্ষ করেছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রাচীন পারসিক মুদ্রার সঙ্গে কার্ষাপণ মুদ্রার মিলের চেয়ে অমিলের ভাবটাই বেশি। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন ইরানে সিগলস ও দারিক মুদ্রার প্রচলন ছিল, কর্ষ নামের কোনও মুদ্রা প্রচলিত ছিল না। তৃতীয়ত, সংস্কৃত কর্ষের যে পারসিক প্রতিশব্দের কথা বলা হয়েছে, সেটি কর্ষের সমার্থক কিনা, তা ভেবে দেখা দরকার। (তক্ষশিলার ভিড়ঢিপি, কাবুল এলাকার চমান-ই-হুজুরি প্রভৃতি স্থান থেকে সামান্য কয়েকটি পারসিক সিগলস পাওয়া গেছে। এগুলো রূপার মুদ্রা। আফগানিস্তান ও অবিভক্ত ভারতের কোনও স্থানে পারসিক স্বর্ণমুদ্রা (দারিক) আবিষ্কৃত হয়নি। এ সকল স্থানে সমকালীন যুগের বাঁকা পাতের বিভিন্ন আকারের অনেক রূপার মুদ্রা পাওয়া গেছে। এগুলো শতমান, অর্ধ শতমান, পাদ শতমান প্রভৃতি শ্রেণির মুদ্রা। মনে হয়, উত্তর-পশ্চিম ভারতে সরকারি সিগলস চালু ছিল ঠিকই, কিন্তু সে সময় শতমান ও তার ভগ্নাংশ মূল্যের মুদ্রারই বেশি প্রচলন ছিল। এর ফলে এই অঞ্চলে সােনার দারিকের প্রয়ােজন হয়নি (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, টাকাকড়ি আবির্ভাবের যুগ, পৃ. ৭০-২))।

‘হিন্দু’ শব্দ : ‘হিন্দু’ ও ‘হিন্দ’ নামটি নিঃসন্দেহে পারসিকদের অবদান। এই নামটির প্রথম উল্লেখ আছে আকিমেনীয় সম্রাট প্রথম দারিউসের পার্সেপােলিস লেখে (৫১৮-১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। (পারসিক লেখে যে কথাটি পাওয়া যায় সেটি ‘হিদ। “হিদু’ ও ‘হিন্দু’ একই।)। নামটি সংস্কৃত সিন্ধুর পারসিক অপভ্রংশ। পারসিক লেখে জাতি বা ধর্ম অর্থে ‘হিদু’ বা ‘হিন্দু’ পদটির প্রয়ােগ হয়নি, দেশ বা অঞ্চল অথে এর ব্যবহার হয়েছে।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যােগাযােগ : পারস্য অভিযানের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। পারসিকরা এদেশ থেকে অনেক মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী নেয়ার পাশাপাশি অনেক ভারতীয়কেও পারস্যে নিয়ে গিয়েছিল। এসব ভারতীয় পারসিক সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়ে গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এরই সূত্র ধরে গ্রিকরা কৌতূহলী হয় ভারতীয়দের ব্যাপারে। অনুমান করা হয় আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পেছনে এই কৌতূহলের ভূমিকা ছিল। পারস্য অভিযানের ফলে অনেক ভারতীয় পণ্ডিত পারস্য সাম্রাজ্যে যাতায়াত করতেন। ফলে দুই দেশের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান সহজ হয়ে পড়ে। 

আলেকজান্ডারের ভারত তাভিযান

গ্রিসে মেসিডােনিয়ার উত্থান, ফিলিপ ও আলেকজান্ডারের বিজয় সম্পর্কে জানতে, ও ভরতে আলেকজান্ডারের আক্রমণের পটভূমি জানতে এখানে ক্লিক করুন।

আলেকজান্ডারের ক্ষমতায় আরোহন, পারস্যে অভিযান ও ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য

ক্ষমতায় আরোহন : প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান এক চমকপ্রদ ঘটনা। ঐতিহাসিক V.A. Smith এ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, “৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভারত অভিযান ছিল ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের অন্যান্য পর্যায়ের চেয়ে অধিকতর আগ্রহোদ্দীপক।” আলেকজান্ডার ছিলেন ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপের পুত্র। বাল্যকালে তিনি বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টোটলের কাছে গৃহশিক্ষা লাভ করেন। তবে আলেকজান্ডার এরিস্টোটলের দর্শন শাস্ত্র অপেক্ষা মহান বীরযােদ্ধাদের, বিশেষ করে হারকিউলেস, সাইরাসের কীর্তিকলাপ শ্রবণে অধিকতর উৎসাহ পেতেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দে পিতা রাজা ফিলিপের মৃত্যু হলে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি ম্যাসিডােনিয়ার সিংহাসনে আরােহণ করেন। ফিলিপ পারসিক সাম্রাজ্য আক্রমণের এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা রূপায়ণের পূর্বেই তিনি হঠাৎ নিহত হন। পিতার স্বপ্নকে সার্থক করার সংকল্প গ্রহণ করেন আলেকজান্ডার। ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৩০ হাজার পদাতিক ও ৫ হাজার অশ্বারােহী সৈন্য নিয়ে তিনি পারসিক সাম্রাজ্য অভিমুখে যাত্রা করেন। এরিস্টটলের প্রিয় শিষ্য আলেকজান্ডারের বয়স তখন মাত্র ২২ বছর।

পারস্য অভিযান : তখন পারস্যের সিংহাসনে ছিলেন তৃতীয় দারিউস (৩৩৫-৩৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)। আলেকজান্ডারকে প্রতিহত করার ক্ষমতা তার ছিল না। দুর্বার ম্যাসিডােনীয় আক্রমণের সামনে তার সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতাে ভেঙে পড়ল। ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার সার্ডেস অধিকার করেন। পরের বছর এশিয়া মাইনর তার পদানত হয়। ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিরিয়া ও মিশর অধিকৃত হল। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরবেলার প্রান্তরে তৃতীয় দারিউস সর্বশক্তি দিয়ে শেষ বারের মতাে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অবরােধ রচনা করেন। কিন্তু এবারও তিনি পরাজিত হন এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন। এরপর আলেকজান্ডার প্রায় বিনা বাধায় একে একে সুসা, পার্সেপােলিস ও একব্যাটানা অধিকার করেন। পার্সেপােলিস শহরটিকে অগ্নিদগ্ধ করা হয়। ওই বছরের শেষের দিকে আলেকজান্ডার সিস্তান অধিকার করেন। এর পর কান্দাহার হয়ে তিনি বলখে এসে উপস্থিত হন। বলখ ও বােখারা অধিকার করে তিনি উত্তর-পশ্চিমে সিরদরিয়া নদী পর্যন্ত অগ্রসর হন। তারপর ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীষ্মে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে তিনি চারিকর ও কাবুল নদের মধ্যবর্তী নাইকিয়া শহরে এসে উপনীত হন। এবার তার লক্ষ্য ভারতবর্ষ। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পারস্যের আধিপত্য টিকেছিল। পারসিক আক্রমণের প্রায় দু’শ বছর পর একই পথ ধরে ভারতে গ্রিকদের আগমন ঘটে। আলেকজান্ডার ৩২৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। 

ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য : ঐতিহাসিকগণ আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পেছনে একাধিক উদ্দেশ্যকে চিহ্নিত করেছেন –

  • আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। পারসিক সাম্রাজ্য ধ্বংস করবেন, এই ছিল তার স্বপ্ন। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল পারস্যের অধীন ছিল। সে অঞ্চল পুনরুদ্ধার না হলে তার স্বপ্ন সফল হত না।
  • আলেকজান্ডার ছিলেন একজন উচ্চাকাঙক্ষী রাজা। গ্রিক সাম্রাজ্য বিস্তার ও সামরিক গৌরব অর্জন করাই ছিল তার জীবনের প্রধান স্বপ্ন। ভারতবর্ষে তার সামরিক অভিযান ছিল এই স্বপ্নেরই বাস্তব প্রতিফলন। 
  • সম্পদের আকর্ষণও তার ভারত অভিযানের এক কারণ। ভারতের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের কথা গ্রিকদের কানে পোঁছেছিল। ইতিহাসের জনক বলে যার খ্যাতি, সেই হেরােডােটাস স্বয়ং ভারতের অপরিমিত সমৃদ্ধির উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য গ্রিক লেখকরাও ভারতের সম্পদের বর্ণনা দিয়েছিলেন।সুতরাং ভারতবর্ষের সম্পদ আলেকজান্ডারকে ভারত অভিযানে প্রলুব্ধ করে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। 
  • ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েই আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেন। তিনি যখনই কোনও অঞ্চল জয় করেছেন, তখনই সেখানে শাসন ও প্রতিরক্ষার সু-বন্দোবস্ত করেছেন। এর থেকে বােঝা যায়, নিছক ধ্বংস ও লুণ্ঠনই তার উদ্দেশ্য ছিল না, ভারতে স্থায়িভাবে রাজত্ব করাই তার লক্ষ্য ছিল।
  • আলেকজান্ডার কেবলমাত্র রাজ্য জয়ের উদ্দেশ্যেই ভারতবর্ষে অভিযান প্রেরণ করেননি। ম্যাসিডােনিয়া তথা গ্রিসের ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তার ও জল ও স্থলপথে ভারতের সঙ্গে স্থায়ী যোগাযােগ সব স্থাপন এবং ব্যবসায় বাণিজ্য সম্প্রসারণ করাও ছিল তার অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক Bury-র মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, “আলেকজান্ডারকে প্রায়ই এমন একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় যিনি কেবল জয়ের জন্যই জয় করতেন, যিনি জয়লাভের কামনার দ্বারা তাড়িত থাকতেন। কিন্তু নিছকই এই বিষয় দিয়ে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকে ব্যাখ্যা করা যায়না। ভারতবর্ষে আলেকজান্ডারের অভিযানের মূলে বাণিজ্যিক স্বার্থ নিহিত ছিল।”
  • প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা ছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জয় করে সে সব দেশে এই গ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানাে আলেকজান্ডারের অপর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। নতুন নতুন অঞ্চল জয় করে সেখানে গ্রিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল এই গ্রিক বীরের। ভারত আক্রমণের পেছনে এই আকাঙ্ক্ষারও ভূমিকা থাকতে পারে বলে ইতিহাসবিদদের অভিমত। আর একারণেই তিনি এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে গ্রিক উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। 
  • আলেকজান্ডারের ছিল তীব্র ভৌগােলিক অনুসন্ধিৎসা, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলকে জানার অদম্য কৌতূহল ছিল আলেকজান্ডারের। ভূগােল সম্পর্কে কৌতুহলী আলেকজান্ডার কাস্পিয়ান সাগরের বিস্তার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি শুনেছিলেন পূর্বদিকে কাস্পিয়ান সাগরের বিস্তার ভারতবর্ষ পর্যন্ত। এ কারণেই কাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছার উদ্দেশ্যে তিনি ভারত অভিযানে আগ্রহী হয়েছিলেন। হেরােডােটাসসহ অন্যান্য গ্রিক ইতিহাসবিদ ও পর্যটকগণের বিবরণও ভারত সম্পর্কে আলেকজান্ডারকে কৌতুহলী করে তুলেছিল।
  • উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারকে ভারত অভিযানে বিশেষভাবে প্রলুব্ধ করে।

উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা

অলেকজান্ডারের উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণের পূর্বে রাজনৈতিক দিক থেকে সেখানে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। দীর্ঘ দিনের পারসিক অধিকার সেখানে তখন লুপ্তপ্রায়। ফলে সেই সময় ভৌগােলিক এবং রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে উত্তর-পশ্চিম ভারতের চারদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য গড়ে ওঠে। ঝিলাম ও বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলেই ভিন্ন ভিন্ন সাতটি জাতি তখন বাস করছিল। রাজ্যগুলোর মধ্যে কতকগুলো ছিল রাজতান্ত্রিক, কতকগুলো গণরাজ্য, কতকগুলো উপজাতি সঙ্ঘ। অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্যগুলোর মধ্যে সদ্ভাব ছিল না, ছিল বিদ্বেষ ও বিরােধ। উত্তর-পশ্চিম ভারতের এই অনৈক্য আলেকজান্ডারকে প্রলুব্ধ এবং তার জয়লাভকে সহজ করেছিল। এই অঞ্চলের রাজারা বা রাষ্ট্রপ্রধানেরা আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে কোনও মিলিত প্রতিরােধ রচনার চেষ্টা করলেন না, একের বিপদে অন্য কেউ এগিয়ে এলেন না। ফলে আলেকজান্ডার সসৈন্যে কাবুল অববাহিকায় এসে উপস্থিত হলে উত্তর-পশ্চিম ভারতের এই সকল বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলোর স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ল। সেখানকার রাজ্য ও গণরাজ্যগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া যাক – 

  1. অলপসিয়োই বা আসপাসিয় বা অশ্বায়ন (Aspasians) : কাবুল নদের (খাইবার পাখতুনখোয়া ও পূর্ব আফগানিস্তান) উত্তরে ও কুনার নদের (পূর্ব আফগানিস্তান) পশ্চিমে রাজ্যটি অবস্থিত ছিল (বর্তমান পূর্ব আফগানিস্তানের নাঙ্গারহার ও লাঘমান প্রদেশের অংশ বিশেষ)। গাে ও কৃষিজ সম্পদে রাজ্যটি সমৃদ্ধ ছিল। এখানকার উপজাতি প্রধান কাবুলের শাখানদী কুনারের কাছে বাস করতেন।
  2. শশিশুপ্তের (Sisikottos) রাজ্য : শশিগুপ্ত সম্ভবত নুরিস্তান বা তার নিকটবর্তী কোনও এক অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। আলেকজান্ডার বল্‌খ আক্রমণ করলে তিনি স্থানীয় শাসকের পক্ষ অবলম্বন করেন। পরে তিনি ম্যাসিডােনীয় শিবিরে যােগ দেন ও আলেকজান্ডারকে নানাভাবে সাহায্য করেন।
  3. অস্‌সকেনােই বা আসসাকেনস বা অশ্বকায়ন বা অশ্বক (Assakenos) : বর্তমান খাইবার পাখতুনখোয়ার সােয়াট নদীর উপত্যকায় রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। রাজ্যের রাজধানী ছিল ম্যাস্‌সাগা বা প্রাচীন মশকাবতী। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই শহরটি প্রায় দুর্ভেদ্য ছিল। এর দু’দিকে ছিল বিপজ্জনক জলাভূমি, আর একদিকে একটি ছােট নদী, অন্য প্রান্তে ইট, পাথর ও কাঠের তৈরি কেল্লা। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে রাজ্যের সকলেই সাহসী যােদ্ধা। আলেকজান্ডারের আক্রমণকালে এখানে রাজত্ব করতেন আসসাকেনস।
  4. গুরিয়ান বা গুরিয়েন বা গৌরী অঞ্চল (Gureans) : এটি ছিল অশ্বায়ন অঞ্চল এবং অশ্বকায়ন রাজ্যের মধ্যবর্তী। এটি রাজ্য বা গণরাজ্য দুইই হতে পারে।
  5. নিসা (Nysa) : অশ্বকায়ন রাষ্ট্রের পশ্চিমে, কাবুল নদের উত্তরে ও কাবুল নদ এবং সিন্ধুু নদের মধ্যবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে এই নগর ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। এটি ছিল গণরাজ্য, অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র শাসনব্যবস্থা বলবৎ ছিল। এখানকার রাষ্ট্রপতি ছিলেন আকাউফিস। আলেকজান্ডারের আক্রমণের অনেক আগে গ্রীক উপনিবেশকারীরা এই নগররাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মনে করা হয়। এই রাজ্য থেকে আলেকজান্ডারের সাহায্যার্থে ৩০০ সুশিক্ষিত অশ্বারােহী সেনার একটি দল পাঠানাে হয়।
  6. অস্টকেনােই বা অষ্টক বা পিউকিলাওটেস বা পুষ্কলাবতী (Peukelaotis) : অসকেনােই রাজ্যের দক্ষিণে কিন্তু কাবুল নদের উত্তরে রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। রাজ্যের রাজধানী পুষ্কলাবতী বা বর্তমান খাইবার পাখতুনখোয়ার চারসাড্ডা। রাজধানীর চারদিকে ঘেরা প্রাকার গ্রিক ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এটি ছিল প্রাচীন গান্ধার রাজ্যের পশ্চিম অংশ। গ্রিকরা উল্লেখ করেছে রাজা ছিলেন আস্টে‌স (রাজ্যের নাম দিয়ে রাজাকে চিনত)।
  7. তক্ষশিলা (Taxila) : সিন্ধু ও তার শাখা নদী বিতস্তার (হাইডাসপেস বা ঝিলাম) মধ্যবর্তী ভূভাগ নিয়ে এই রাজ্যটি গঠিত ছিল। আসলে এটি প্রাচীন পূর্ব গান্ধার রাজ্য। মনে হয়, গ্রিক ঐতিহাসিকরা রাজ্যটি ও তার রাজধানীর একই নামকরণ করেছেন। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আম্ভি তক্ষশিলার সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার পুর্বে তার পিতাই এখানকার রাজা ছিলেন। গ্রিকরা বলেছেন ৩২৭ খ্রি.পূ.-তে এই রাজ্যের রাজা ছিলেন ট্যাক্সিলিস (নিশ্চই রাজ্যের নাম দিয়ে তারা রাজাকে চিনত), আর তার মৃত্যুর পর অম্ভি এই অঞ্চলের রাজা হন। যাই হোক, এই পিতা এবং পুত্র প্রভাবশালী প্রতিবেশী রাজা জ্যেষ্ঠ পুরুর ঘাের শত্রু ছিলেন। অম্ভি আলেকজান্ডারকে নিজের রাজধানীতে সাদর অভ্যর্থনা জানান ও তাকে সৈন্য ও সম্পদ দিয়ে ভারত অভিযানে অকুণ্ঠ সাহায্য করেন।
  8. অভিসার বা আবিসারেস : কাশ্মীরের পুঞ্চ ও এর সংলগ্ন কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে রাজ্যটি গঠিত ছিল। এই রাজ্যের রাজা অতি ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন। রাজা জ্যেষ্ঠ পুরুর সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আবার তক্ষশিলায় আলেকজান্ডারের দরবারে ছােট ভাইকে পাঠিয়ে তিনি তার প্রীতি লাভ করেন। এদিকে তিনি হাইডাসপেসের (ঝিলামের) যুদ্ধে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন। সন্তবত এটিও ছিল কম্বোজের একটি অংশ।
  9. আরসাকিস বা উরশা রাজ্য (Arsakes) : ভৌগােলিক দিক থেকে এটি বর্তমান হাজারা জেলা। অভিসার রাজ্যের নিকটবর্তী এই রাজ্যটি ছিল প্রাচীন কম্বোজ রাজ্যের অংশ বিশেষ। 
  10. সােফাইটিস বা সৌভূতির রাজ্য (Kingdom of Sophytes) : অনেকে মনে করেন, সােফাইটিস বা সৌভূতি সিন্ধু ও বিতস্তার (হাইডেসপাস বা ঝিলাম) মধ্যবর্তী সল্ট রেঞ্জ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। আবার অনেকের ধারণা তার রাজ্য বিতস্তার পশ্চিমে নয়, পূর্বে অবস্থিত ছিল। বিচক্ষণ ও সুশাসক বলে গ্রিক ঐতিহাসিকরা সােফাইটিসের প্রশংসা করেছেন। আলেকজান্ডারের সঙ্গে তার হৃদ্য সম্পর্ক ছিল। সােফাইটিসের নামে উৎকীর্ণ কিছু রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে। এই মুদ্রাগুলো গ্রিক মুদ্রার অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। অনেকের বিশ্বাস, গ্রিক ঐতিহাসিকরা যে সােফাইটিসের উল্লেখ করেছেন তিনিই এই মুদ্রাগুলো উৎকীর্ণ করেছেন। আবার অনেকের অভিমত, মুদ্রায় যে সােফাইটিসের উল্লেখ আছে তিনি অন্য এক ব্যক্তি। কার্টিয়াস লিখেছেন যে, এখানকার মানুষের আচরণবিধি প্রায় স্পার্টানদের মত ছিল। স্ট্রাবো সফাইটিসকে ‘নোয়ার্ক’ আখ্যা দিয়েছেন। তা থেকে মনে করা হয় যে, তিনি স্বাধীন নৃপতি ছিলেন না। কোন রাজার অধীন প্রদেশ পাল মাত্র ছিলেন।
  11. ফেগেলিসের রাজ্য : কেই বলেন ফেগেলিস বা ভগল সৌভূতির প্রতিবেশী রাজা ছিলেন, আবার কেউ বলেন এই রাজ্য রাবি (ইরাবতি বা পুরুশণি) এবং বিপাশা (বিয়াস) নদীর মধ্যস্থলে এটি অবস্থিত ছিল। অনেক ভারতীয় রাজার মতাে তিনিও আলেকজান্ডারকে ভারত অভিযানে সহায়তা করেন।
  12. জ্যেষ্ঠ পুরুর রাজ্য : বিতস্তা ও চন্দ্রভাগা (চেনাব বা আশিকনি) নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগের রাজা ছিলেন জ্যেষ্ঠ পুরু। উত্তর-পশ্চিম ভারতে তার মতাে শক্তিশালী রাজা আর কেউ ছিলেন না। আম্ভি ও কনিষ্ঠ পুরুর মতাে প্রতিবেশী রাজারা তার প্রতি বিদ্বেষ মনােভাব পােষণ করতেন। আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য তিনি ভারতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। পুরু পরে আলেকজান্ডারের পক্ষে যােগ দেন ও তাকে ভারত অভিযানে সাহায্য করেন। স্ট্রাবাে লিখেছেন যে, এটি একটি বিস্তৃত এবং উর্রব অঞ্চল ছিল এবং এর মধ্যে ৩০০টি শহর ছিল। ঐতিহাসিক ডায়ােডােরাস লিখেছেন যে, এই রাজ্যের ৫০,০০০ সৈন্য, ৩০০০ অশ্ব, ১০০০ এর বেশী রথ ও ১৩০টি হাতি ছিল। পুরুর সঙ্গে আবিসারেসের মৈত্রী সম্পর্ক ছিল। 
  13. গ্লৌগনিকৈ : রাজ্যটির সম্ভবত আসল নাম গ্লচুকায়নক। প্রজাতান্ত্রিক এই রাজ্যটি চন্দ্রভাগা নদীর পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। এ রাজ্যে ছিল ৩৭টি শহর। প্রতিটি শহরে ৫ থেকে ১০ হাজারেরও বেশি লােকের বাস ছিল। রাজ্যটি বিনা যুদ্ধে আলেকজান্ডারের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
  14. কনিষ্ঠ পুরুর রাজ্য বা গান্ডারিস (Gandaris) : চন্দ্রভাগা ও ইরাবতী (রাভি বা পুরুষণি) নদীর মধ্যবর্তী এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে কনিষ্ঠ পুরু রাজত্ব করতেন। তিনি জ্যেষ্ঠ পুরুর ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন কিন্তু তাদের উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব ছিল না। আলেকজান্ডার তার রাজ্য আক্রমণ করলে তিনি পলায়ন করেন ও নন্দরাজের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই রাজ্য গ্যান্ডারিস নামে পরিচিত ছিল, কারণ সম্ভবত এটি ছিল গান্ধার রাজ্যের পূর্বতম অংশ।
  15. আড্রিয়াস্টাই বা অদ্রৈস্টৈ বা অধৃষ্ট বা অরাষ্ট্রক : এটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, আবার অনেকের মতে এরা উপজাতিও হতে পারে। রাজ্যটির আসল নাম সম্ভবত অধৃষ্ট বা অরাষ্ট্রক। রাজতান্ত্রিক নয়, এই অর্থে অরাষ্ট্রক। ইরাবতী নদীর পূর্ব তীরে রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। এদের প্রধান ঘাঁটি ছিল পিম্পরাম।
  16. কথৈয়ৌ বা কথাইঅয় বা কথা বা কঠ : এটি ইরাবতী নদীর পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। এটি গণরাজ্য হতে পারে, তবে স্বাধীন উপজাতি সঙ্ঘ হবার সম্ভাবনাই বেশি মনে হয়। সংস্কৃতে এটি “কথা” নামে পরিচিত ছিল জানা যায়, তবে “কঠ”ও হতে পারে। এদের প্রধান কেন্দ্র ছিল সম্ভবত গুরুদাসপুর জেলার অন্তর্গত সাঙ্গল। যুদ্ধে সাহস এবং নৈপুণ্যের জন্য তাদের খ্যাতি ছিল। গ্রিক ঐতিহাসিকরা বীর বলে এখানকার জনসাধারণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গ্রীক লেখক ওনেসিক্রিটাস লিখেছেন যে, তাদের মধ্যে সুন্দরতম ব্যাক্তিকে রাজা নিবচিত করা হত। 
  17. ম্যাল্লয় বা মালব (Malloi) : নিম্ন ইরাবতী ও চন্দ্রভাগার মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই গণরাজ্যটি অবস্থিত ছিল। পাণিনি মালবদের আয়ুধজীবী রূপে বর্ণনা করেছেন। আয়ুধ অর্থাৎ যুদ্ধ (অস্ত্রশস্ত্র) এদের পেশা ছিল। গ্রিক ঐতিহাসিকরাও এদের সাহসিকতা ও যুদ্ধবিদ্যার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। প্রতিবেশী ক্ষুদ্রকদের সঙ্গে মালবদের বিশেষ সদ্ভাব ছিল না। কিন্তু আলেকজান্ডারের আক্রমণ প্রাক্কালে এই দু’টি গণরাজ্য জোট বেঁধে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম করে। কার্টিয়াস লিখেছেন যে, ক্ষুদ্রক এবং মালবগণের মিলিতভাবে ১০,০০০ পদাতিক এবং ১০,০০০ অশ্বারােহী সৈন্য ছিল। 
  18. অক্সিড্রাকয় বা ক্ষুদ্রক (Oxydrakai) : উচ্চ ইরাবতী ও বিপাশার (বিয়াস) মধ্যবর্তী অঞ্চলে, সম্ভবত পাঞ্জাবের মন্টগােমারি জেলায় আশপাশ অঞ্চল জুড়ে এই রাজ্য অবস্থিত ছিল। এটি গণরাজ্য অথবা উপজাতি সঙ্ঘ হতে পারে। উপজাতি হলে পাঞ্জাবের উপজাতিদের মধ্যে তারাই ছিল সংখ্যায় সর্বাধিক এবং যুদ্ধবিদ্যায় সর্বাপেক্ষা নিপুণ। ক্ষুদ্রকেরা মালবগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অবরােধ রচনা করেন। গ্রিক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে জানা যায়, ক্ষুদ্রক-মালব যৌথ সৈন্যবাহিনীতে ছিলেন ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার পদাতিক, ১০ হাজার অশ্বারােহী ও ৭০০-৯০০ রথারােহী।
  19. সিবয় বা সিবি বা শিবি : বিতস্তা-চন্দ্রভাগা সঙ্গমের পূর্ব দিকে শিবি গণরাজ্য বা উপজাতি সঙ্ঘ অবস্থিত ছিল। এরা ঝাঙ্গ জেলার অন্তর্গত সরকট অঞ্চলে বাস করত। গদা ছিল তাদের প্রধান যুদ্ধাস্ত্র। সমরনিপুণ উপজাতিরূপে শিবিদের সে রকম প্রতিষ্ঠা ছিল না।
  20. অগালাসয় বা অগলস্সৌ‌ বা অর্জুনায়ন : গ্রিক ঐতিহাসিকরা যাদের অগলস্সৌ‌ বলেছেন, তারা সম্ভবত আর্জুনায়ন উপজাতি। তারা শিবিদের প্রতিবেশী ছিলেন। সামরিক শক্তিরূপে তাদের যথেষ্ট সুনাম ছিল। আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে তারা প্রবল প্রতিরােধ রচনা করেন। আলেকজান্ডারের সময় ৪০ হাজার পদাতিক ও ৩ হাজার অশ্বারােহী নিয়ে তাদের সৈন্যবাহিনী গঠিত ছিল।
  21. আবাস্তনয় বা এবাস্টা‌নৌ বা অম্বষ্ঠ : চেনাব (চন্দ্রভাগা) নদীর নিম্ন উপত্যকায় এবাস্টানৌ বা অম্বষ্ঠ গণরাজ্যটি অবস্থিত ছিল। এই রাজ্যে ছিল ৬০ হাজার পদাতিক, ৬ হাজার অশ্বারােহী ও ৫০০ রথারােহী। আলেকজান্ডারের সময় এই শক্তিশালী উপজাতি গণতন্ত্র শাসিত ছিল। 
  22. জ্যাথরয় বা জথ্রৌ‌ বা ওক্সথরৌ : এই গণরাজ্যটিও সিন্ধুপ্রদেশের উত্তরাংঞ্চলে অথবা চেনাব নদীর নিম্নাংশে অবস্থিত ছিল, এটি উপজাতি সঙ্ঘও হতে পারে। এটি সম্ভবত ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত ছিল।
  23. অসসাডিঅয় বা ওস্সডিয়ৌ : ক্ষত্রিয়ের মতো এই গণরাজ্যটিও সিন্ধুপ্রদেশের উত্তরাংঞ্চলে অথবা চেনাব নদীর নিম্নাংশে অবস্থিত ছিল, এটি উপজাতি সঙ্ঘও হতে পারে।
  24. সােডরায় বা সােগডি বা সােগড্রি : সিন্ধুপ্রদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এই ছােটো গণরাজ্যটি সম্ভবত শূদ্র নামে পরিচিত ছিল। নামে শূদ্র হলে কী হবে, ব্রাহ্মণেরাই এই রাজ্যের প্রকৃত নিয়ন্তা ছিলেন।
  25. মাসসানয় : এটিও সিন্ধু প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
  26. মুসিকানসের বা মৌসিকেনােসের বা মুষিক উপজাতির রাজ্য : মৌসিকেনােস মূষিক উপজাতির রাজা ছিলেন। সিন্ধু প্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তিনি রাজত্ব করতেন। সুক্কু‌র জেলার আলাের সম্ভবত তার রাজধানী ছিল। গ্রিক লেখকরা এ অঞ্চলের লােকদের মিতাহার ও সুস্বাস্থ্যের প্রশংসা করেছেন। চিকিৎসা-বিদ্যা ছাড়া অন্য কোনও শাস্ত্রে তাদের আগ্রহ ছিল না। রাজ্যে সােনা ও রূপার খনি থাকা সত্ত্বেও এ দুটি ধাতুর প্রতি এদের এক অদ্ভুত ধরনের বিতৃষ্ণা ছিল। রাজ্যের রাজনীতিতে ব্রাহ্মণদের বড় রকমের ভূমিকা ছিল। স্ট্রাবো লিখেছেন যে, এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালী ছিল স্পার্টানদের মত। এ্যারিয়ানের বিবরণ থেকে মনে হয় যে, এই রাজ্যে ব্রাহ্মণদের বিশেষ প্রভাব ছিল এবং তারা আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহে ইন্ধন যুগিয়েছিল। 
  27. ওক্সি‌কেনােস বা পাের্টিকেনােস বা পার্থ : এই ক্ষুদ্র রাজ্যটি সম্ভবত সিন্ধুপ্রদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। ওক্সি‌কেনােস বা পাের্টিকেনােস সম্ভবত সংস্কৃত পার্থের অপভ্রংশ, এই অঞ্চলটি বর্তমান লারকানার কাছাকাছি অবস্থিত ছিল।
  28. স্যামবােস-এর রাজ্য : স্যামবােস ওক্সি‌কেনােস ও মুষিক এর প্রতিবেশী রাজা ছিলেন। সম্ভবত তার সংস্কৃত নাম ছিল শম্ভ। তার রাজধানী ছিল সিন্ডােনেলিয়া বা সিন্ডিম্যাল। শহরটির সঠিক অবস্থান জানা যায় না। মৌসিকেনােসের সঙ্গে তার শত্রুতা ছিল। আলেকজান্ডার মৌসিকেনােসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে তিনি তাকে সাহায্য করেন।
  29. প্যাটালিন বা পত্তল বা পতল নগররাষ্ট্র : সিন্ধুর বদ্বীপে এই নগর রাষ্টটি অবস্থিত ছিল। এর রাজধানী ছিল পাতাল নগরী। শহরটি সম্ভবত ব্রহ্ম‌নাবাদের নিকট অবস্থিত ছিল। অনেকে মনে করেন, পত্তল বর্তমান হায়দ্রাবাদ বা তার নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে অবস্থিত ছিল। কিন্তু এ ধারণা ভুল। এর সংবিধান ছিল স্পার্টার মত। স্পার্টার মত এখানে দ্বৈরাজ্য ছিল, অর্থাৎ দুইজন রাজা একসঙ্গে শাসন করতেন। বয়ােবৃদ্ধদের নিয়ে গঠিত এক পরিষৎ শাসনকার্যে তাদের সাহায্য করতেন।
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় ভারতের রাজ্যগুলো

ওপরে যে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর বিবরণ দেওয়া হল, তাদের অনেকেই তখন পারস্পরিক কলহে লিপ্ত ছিল। কার্টিয়াস লিখেছেন, অম্ভির সঙ্গে তখন আবিসারেস এবং পুরুরাজের যুদ্ধ চলছিল। এ্যারিয়ান লিখেছেন, প্রতিবেশী উপজাতিদের সঙ্গে আবিসারেস এবং পুরুরাজের সম্পর্ক ভাল ছিল না। তারা একদা ক্ষুদ্রক এবং মালবগণের বিরদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। পুরুরাজ এবং তার ভ্রাতুষ্পত্রের মধ্যেও সম্পর্ক মােটেই ভাল ছিল না। সাম্বস এবং মুসিকানসের সম্পর্কের কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। এই অবস্থায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আলেকজান্ডারের ছিল না। বরং তিনি স্থানীয় সমর্থন লাভ করবেন, এমন সম্ভাবনা ছিল। তার পক্ষে এই অনুকূল পরিস্থিতিতে আলেকজান্ডার অভিযান শুরু করেন। 

আলেকজান্ডারের ‘অনুকূল পরিস্থিতির সুযােগ গ্রহণ  ও অভিযানের সূত্রপাত

দেখা যাচ্ছে, আলেকজান্ডারের আক্রমণকালে উত্তর-পশ্চিম ভারত অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে কোনও ঐক্য বা সমঝােতা ছিল না, ছিল পারস্পরিক ঈর্ষা-দ্বেষ, বাদ-বিসংবাদ। জ্যেষ্ঠ পুরুর সঙ্গে তার আত্মীয় কনিষ্ঠ পুরুর বিরােধ ছিল। তক্ষশিলারাজ আম্ভির সঙ্গেও জ্যেষ্ঠ পুরুর কলহ ছিল। রাজা স্যামবােসের সঙ্গে তার প্রতিবেশী মৌসিকেনােসেরও বিশেষ সদ্ভাব ছিল না। বিরােধ ছিল মালব ও ক্ষুদ্রকদের মধ্যেও। উত্তর-পশ্চিম ভারতের এই রাজনৈতিক অনৈক্য আলেকজান্ডারের পক্ষে শুভ হয়। এই অঞ্চলে কোনও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধের আশঙ্কা তার ছিল না। বরঞ্চ অভিযানে তিনি স্থানীয় রাজাদের অনেকেরই সাহায্য পাবেন, এমন সম্ভাবনাই প্রবল ছিল। এই অনুকূল পরিস্থিতিতে আলেকজান্ডার ভারত অভিযান শুরু করেন। অবশ্য আলেকজান্ডারেরও যে কিছু অসুবিধা ছিল না, তা নয়। যে ৩০ হাজার সৈন্য ভারত অভিযানে তার হাতিয়ার, তাদের মধ্যে একাত্মতা ছিল না, ছিল না কোনও আদর্শের প্রেরণা। এদের দেশ আলাদা, ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা। এদের কেউ লম্বা বর্শাধারী ম্যাসিডােনিয়ার পদাতিক বা অশ্বারােহী, কেউ বা গ্রিক ভাড়াটে সৈন্য, কেউ বলকান বা থ্রেসের তিরন্দাজ, কেউ ইরান বা মধ্য এশিয়ার অশ্বারােহী, আবার কেউবা ফিনিশিয়া বা মিশরের নাবিক। এদের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলা বড় সহজ কথা নয়।

আলেকজান্ডারের উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণ সাধারণভাবে তার প্রাচ্য বিজয় পরিকল্পনার অঙ্গ ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে তিনি পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিউসকে পরাজিত করেন এবং তার রাজধানী পার্সিপােলিস অগ্নিদগ্ধ করেন। তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের শেষসীমা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে তার আকিমেনীয় সাম্রাজ্য জয়কে সম্পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। পারস্যে তার অনায়াস জয়লাভ এবং সিন্ধু-পরবর্তী অঞ্চলের সম্পদকাহিনী তার উচ্চাশাকে বাড়িয়েছিল। তাছাড়া, পারস্যের সমগ্র সঞ্চিত সম্পদ এবং তার অতুলনীয় সমরসম্ভার তার উচ্চাশার ইন্ধন যুগিয়েছিল। পারস্য থেকে আলেকজান্ডার পূর্বদিকে অগ্রসর হন। পশ্চাদভাগ দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত করা, তার যুদ্ধ পরিকল্পনার অঙ্গ ছিল। এই উদ্দেশ্যে তিনি কান্দাহারে আলেকজান্ড্রিয়া নগর, হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশে একই নামের আর একটি নগর এবং আলেকজান্দ্রিয়া এবং কাবুল নদের মধ্যবর্তী ভূভাগে কারটানা, কাডরুসি এবং নাইকিয়া – এই তিনটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের শুরুতে তিনি ব্যাক্ট্রিয়া এবং বােখারা জয় করে জাকসারটেস নদী (সির দরিয়া) পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং এভাবে হিন্দুকুশ পরবর্তী পূর্ব ইরান জয় সম্পূর্ণ করেন। এরপর আসে ভারত অভিযানের পর্ব। 

তিনি প্রথমে তাবু গাড়লেন নাইকিয়া রাজ্যে। আলেকজান্ডার নাইকিয়া থেকে তক্ষশিলা ও কাবুল উপত্যকার বিভিন্ন ভারতীয় রাজা ও উপজাতি নেতাদের কাছে বশ্যতা দাবি করে দূত পাঠান। তক্ষশিলার রাজা স্বয়ং নাইকিয়ায় উপস্থিত হয়ে আলেকজান্ডারের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই ঘটনার অনেক আগেই তক্ষশিলারাজ পুত্র আম্ভির পরামর্শে ম্যাসিডােনিয়ার রাজার কাছে দূত পাঠিয়ে তার রাজ্য আক্রান্ত হবে না এই শর্তে তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন। কার্টিয়াস লিখেছেন যে, আম্ভি আলেকজান্ডারকে ৬৫টি হাতি এবং ৩০০ টি ষাঁড় উপহার দেন। ডঃ মজুমদার মন্তব্য করেছেন যে, ভারতের ইতিহাসে কোন রাজার পক্ষে বিশ্বাসঘাতকার এটিই প্রথম দৃষ্টান্ত। নুরীস্তান বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজা সিসিকোটাসও (Sisikottos বা শশিগুপ্ত) আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করেন। ইতিপূর্বে শশিগুপ্ত ব্যাক্ট্রিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে আলেকজান্ডারের বিরােধিতা করেন। এখন তিনি তার আনুগত্যের পরিবর্তন ঘটান। এছাড়াও কোফিউস (Cophaeus), সঞ্জয় (Sangaeus), অশ্বজিৎ (Assagetes) ও আরও অনেকে আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করেন ও তাকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এভাবে পশ্চাৎভাগ সুরক্ষিত করার পর আলেকজান্ডার ভারতের দিকে অগ্রসর হন। তার সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩০,০০০। কিন্তু সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে গৃহীত হওয়ায়, তাদের মধ্যে ঐক্যবোধ ছিল না। যে স্বাদেশিকতা নেতাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তাদের তা স্পর্শ করেনি। ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি সময় আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান শুরু হল। আলেকজান্ডারের উত্তর-পশ্চিম ভারত আক্রমণের কাহিনীকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে তিনি সিন্ধু নদ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন, দ্বিতীয় পর্বে বিপাশা নদী পর্যন্ত এবং শেষ পর্বে তিনি এখান থেকে ফিরে গিয়েছিলেন। 

সিন্ধু নদ অতিক্রমের পূর্বে কাবুল নদের অববাহিকায় আলেকজান্ডার

আলেকজান্ডার তার সেনাবাহিনীকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন। মূল বাহিনীটিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি স্বয়ং উত্তর-পূর্ব দিকে কুনার নদীর উজানে উত্তর কাবুল উপত্যকার পথ ধরে ওহিন্দ অভিমুখে অগ্রসর হলেন। অন্য দলটি হেফেস্টি‌ওন ও পার্ডিকাসের নেতৃত্বে এবং তক্ষশিলা রাজের সহযােগিতায় কাবুল নদের দক্ষিণ তীর ধরে অগ্রসর হয়ে খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে একেবারে পেশােয়ারের সমতলভূমিতে এসে পড়েন। এখানে হেফেস্টিওন ও পার্ডিকাসের সেনাদলকে অস্টকেনােই বা অষ্টক রাজ্য বা পুষ্কলাবতীর রাজা আস্টে‌স অপ্রত্যাশিতভাবে বাধা দেন। ৩০ দিন অবরােধের পর তার রাজধানী পুষ্কলাবতীর পতন হয়। আস্টে‌স সম্ভবত নিহত হন। তার রাজ্য তক্ষশিলারাজের অনুচর সঞ্জয়কে উপহার দেওয়া হয়। এরপর হেফেসটিওন ও পার্ডিকাস সদলে সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরবর্তী ওহিন্দে চলে আসেন। স্থানটি আটক থেকে ১৬ মাইল উত্তরে অবস্থিত। এখানে সিন্ধু নদের বুকে এক নৌসেতু নির্মাণ করে তারা সাগ্রহে আলেকজান্ডারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

এদিকে সিন্ধু নদ অতিক্রম করার জন্য আলেকজান্ডার ওহিন্দ বরাবর তার হেফেস্টিওন ও পার্ডিকাসের সেনাদলের সাথে মিলিত হতে আসছেন। আলেকজান্ডারের প্রকৃত বিপত্তি এই সময় থেকেই শুরু হয়। একথা সত্যি যে তার সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে বিশ্রাম পেয়েছিল, তিনি নিপুণ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন এবং তক্ষশিলা তার পক্ষে ছিল। তবুও প্রতিটি স্বাধীন উপজাতি-নগর দখল করা তখনও বাকি ছিল। এবং এ কাজ তার পক্ষে সহজ ছিল না। অস্ত্রে নিশ্চিত শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও আলেকজান্ডার প্রতিটি ক্ষেত্রে তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ভারতীয় উপজাতিগণ একতাবদ্ধ হতে পারেনি, কিন্তু যুদ্ধ তাদের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তাছাড়া  অর্থের বিনিময়ে ক্ষত্রিয়দের সাহায্য তারা লাভ করেছিল। সমর উপকরণের দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী অবশ্যই দুর্বল ছিল। তাদের রথ ম্যাসিডনের ২১ ফুট লম্বা বর্শার সামনে অসহায় বোধ করত। রথ ছিলও ঘোড়ার তুলনায় ধীর। শত্রুসৈন্য ব্রোঞ্জের বর্মে আবৃত হয়ে যুদ্ধ করত। ভারতীয় সৈন্যদের ছিল ঢাল, চর্ম নির্মিত বক্ষ ও পৃষ্ঠস্ত্রাণ এবং ধাতুর তৈরি শিরস্ত্রান। ভারতীয়দের প্রধান ভরসা ছিল হাতি। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে হস্তিবাহিনী পদাতিক বাহিনী বিদীর্ণ করতে পারত। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা সবদা সম্ভব হত না। তাই অনেক সময় এই হাতিই ভারতীয়দের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ত। তাছাড়া আক্রমণকারী হস্তিবাহিনীকে অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী দ্বারা রক্ষা করারও প্রয়ােজন ছিল। এত দুর্বলতা সত্ত্বেও একটি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল। সেটা ছিল তাদের তীরধনুক। শেষ পর্যন্ত এর দ্বারাই আলেকজান্ডার মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন।

ওহিন্দে পৌঁছতে আলেকজান্ডার যথেষ্ট বেগ পেয়েছিলেন। মূল বাহিনী সঙ্গে নিয়ে যে পথে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন, সেই উত্তর কাবুল উপত্যকায় তিনি প্রবল বাধা পান। সিন্ধু নদ অতিক্রমের পূর্বে কাবুল নদের উপত্যকা সহ ভারতবর্ষের যেসব অঞ্চল ছিল সেগুলো হলো শশিগুপ্তের রাজ্য, অশ্বায়ন, গৌরী, অশ্বকায়ন, নিসা, অষ্টক ও বরণ দুর্গ। ওহিন্দ হয়ে সিন্ধু অতিক্রম করতে হলে এই অঞ্চলগুলোর সাথে সঠিক বোঝাপড়া করে আসতে হবে, তা নাহলে সিন্ধু অতিক্রমের পর সাপ্লাই লাইনে সংকট দেখা দেবে। শশিগুপ্তের রাজ্য আগেই বশ্যতা স্বীকার করেছে, আর আলেকজান্ডারের সেনাপতি হেফেস্টিওন ও পার্ডিকাস অষ্টক বা পুষ্কলাবতীকে পরাজিত করে তা অনুগত শাসককে দান করেছেন। আলেকজান্ডারের জন্য এবার বাকি ছিল কাবুল উপত্যকার অশ্বায়ন, গৌরী, অশ্বকায়ন, কাশ্মিরের নিকট পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত বরণ দুর্গ ও কাবুল নদ ও সিন্ধু নদের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত নিসা নগররাষ্ট্র। আলেকজান্ডারকে এবার এইসব অঞ্চলের মোকাবেলা করতে হবে।

প্রথম বাধা আসে অস্প‌সিয়েই বা অশ্বায়নদের কাছ থেকে। আলেকজান্ডার শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজিত করেন ও ৪০ হাজার লােককে বন্দি করেন। এরপর বাধা আসে গৌরী বা গুরিয়েনদের কাছ থেকে। আলেকজান্ডার এদেরকেও পরাজিত করেন। এরপর এই অঞ্চলে অস্স‌কেনৌ বা অশ্বকায়নরাও আলেকজান্ডারে বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কার্টিয়াসের বর্ণনা অনুযায়ী অশ্বকায়নরাজ ৩৮ হাজার পদাতিক, ৩০ হাজার অশ্বারােহী, ও ৩০টি হস্তী নিয়ে রাজধানী ম্যাস্সা‌গা বা মশকাবতীতে অবরােধ রচনা করেন। তাদের সৈন্য দলের নেতৃত্ব করেছিলেন, রাণীমা ক্লিওফেস। তার দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে সমগ্র নারীসমাজ যুদ্ধে যােগ দিয়েছিল। এর বলে ভাড়াটে সৈন্যদের মধ্যেও নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল। আত্মরক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার জন্য প্রজাতন্ত্রের প্রধান আসসাকেনস, প্রতিবেশী রাজ্যের নৃপতি আবিসারেস বা অভিসাররাজের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। সমতলভূমি থেকেও তিনি ৮ হাজার ভাড়াটে সৈন্য সংগ্রহ করেন। সংঘর্য তীব্র আকার ধারণ করে। আলেকজান্ডার স্বয়ং আহত হন। কিন্ত অশ্বকায়নদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রবল প্রতিরােধের পর মাসসাগা নগরীর পতন হয়েছিল। তাদের রাজা নিহত হন, রানিমা ও রাজকন্যা বন্দি হন। নিহত রাজার ভাই অস্সগে‌টিসকে বিজিত রাজ্যের সিংহাসনে বসানাে হল। তিনি অনুগত মিত্রের মর্যাদা পেলেন। আলেকজান্ডার সেখানে ৭,০০০ ভাড়াটে সৈন্যকে অকারণ হত্যা করেছিলেন। প্লুটার্ক বলেছেন, এই কাজ তার সামরিক খ্যাতিতে একটি স্থায়ী কলঙ্ক-চিহ্ন হয়ে আছে।

এরপর আলেকজান্ডার নিসা প্রজাতন্ত্র অভিমুখে রওনা হন। সেখানে তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানানাে হয় ও তিনশাে অশ্বারােহী সৈন্য উপহার দেওয়া হয়। বিজিত অঞ্চলগুলো নিয়ে একটি প্রদেশ গঠিত হল। নিকানাের প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেন। আলেকজান্ডার সদলে পুষ্কলাবতীতে উপস্থিত হন। সেনাপতি ফিলিপের অধ্যক্ষতায় সেখানে এক সৈন্যাবাস স্থাপিত হয়। আর একটু পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে আলেকজান্ডার উরনাস বা বরণ নামে এক দুর্ভেদ্য পার্বত্য দুর্গ জয় করেন। এখানে এক সৈন্যাবাস স্থাপন করে মিত্র শশিগুপ্তকে তার দায়িত্বভার দেন। এরপর তিনি কাবুল নদ ও সিন্ধু নদের মধ্যবর্তী ভূভাগে অবস্থিত গ্রিক নগররাষ্ট্র নিসায় আসেন। নিসা আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে, ইতিমধ্যে নগরটি গ্রিক ছিল বলে তিনি নগরটি আর অধিগ্রহণ করেননি, এটি সায়ত্তশাসিতই থেকে যায়। সেখানে তিনি দেবতা ডায়োনিসাসের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন, সেখানকার শাসক অ্যাকিউফিসের পুত্র ও পৌত্র সহ অন্যান্য আরও অনেকে আলেকজান্ডারের অভিযানসঙ্গী হয়েছিলেন। যাই হোক, এভাবে পুষ্কলাবতী এবং সিন্ধুুনদের মধ্যবর্তী ক্ষুদ্র শহরগুলো দখল করে তিনি কাবুল নদীর নিম্ন উপত্যকা সংরক্ষিত করেন। অতপর তিনি সসৈন্যে সিন্ধুর পশ্চিম তীরে ওহিন্দে এসে উপনীত হন। সেখানে হেফেসটিওন ও পার্ডিকাস সাগ্রহে তার অপেক্ষায় ছিলেন। একটি নৌ-সেতুর সাহায্যে সিন্ধুুনদ অতিক্রম করেন। 

সিন্ধু নদ অতিক্রম ও জ্যেষ্ঠ পুরুর সঙ্গে সংঘর্ষ

৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের বসন্তে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ অতিক্রম করে তক্ষশিলা রাজ্যে প্রবেশ করেন। ইতিমধ্যে তক্ষশিলার বৃদ্ধ রাজার মৃত্যু হয়েছে, রাজকুমার আম্ভি তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। আম্ভি আলেকজান্ডারকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। তক্ষশিলায় ম্যাসিডােনিয়ারাজ এক বর্ণাঢ্য দরবার অনুষ্ঠান করেন। সেই দরবারে আম্ভি প্রকাশ্যে আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করেন ও তাকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। সেখানে অনুষ্ঠিত একটি দরবারে আশেপাশের ক্ষুদ্র নৃপতিগণ অনেকেই তার বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তাকে নানারকম উপহার দেন। পাঞ্জাবের আঞ্চলিক রাজা কনিষ্ঠ পুরু আম্ভির পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। অভিসাররাজও আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ তার এক অনুজকে উপঢৌকন-সহ তক্ষশিলায় পাঠান।

বিতস্তা (ঝিলাম) ও চন্দ্রভাগা (চেনাব) নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগের রাজা জ্যেষ্ঠ পুরু ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। তিনি তার ভ্রাতুপত্র কনিষ্ঠ পুরু সহ অনেকের আত্মসমর্পণের কাহিনী শােনেন, কিন্তু নিজে অবিচলিত থাকেন। যে কোনও মূল্যে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, এই ছিল তার সংকল্প। তক্ষশিলায় তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আলেকজান্ডার পুরুর কাছে দূত পাঠালেন। দূতকে পুরু সদর্পে বলেন, তক্ষশিলায় নয়, যুদ্ধক্ষেত্রেই তাদের দেখা হবে। বর্ষা আসন্ন জেনেও আলেকজান্ডার তক্ষশিলায় আর অবস্থান করলেন না। ফিলিপের তত্ত্বাবধানে একদল সৈন্যকে সেখানে রেখে বাকি সৈন্যদের নিয়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রওনা হন ও বিতস্তা বা ঝিলাম নদীর পশ্চিম তীরে এসে উপস্থিত হন।

আলেকজান্ডারের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরােধের জন্য জ্যেষ্ঠ পুরু বিতস্তার অপর পারে ইতিমধ্যে তার সৈন্য সমাবেশ করেছেন। পুরু ভেবেছিলেন, আলেকজান্ডার প্রকাশ্যে বিতস্তা পার হবেন না, শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। কিন্তু ম্যাসিডােনিয়ারাজ এখানে অসাধারণ চাতুর্যের পরিচয় দেন। মূল বাহিনীকে তিনি ক্রটেরসের নেতৃত্বে পূর্ব স্থানে রেখে নিজে মাত্র ১১ হাজার সৈন্যের এক অগ্রগামী দল নিয়ে একদিন প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে সবার অলক্ষ্যে ১৬ মাইল উত্তরে এক বাঁক দিয়ে বিতস্তা পার হয়ে পুরুর রাজ্যে প্রবেশ করেন। পুরুর জ্যেষ্ঠ পুত্র ২ হাজার তাশ্বারােহী ও ১২০টি রথ নিয়ে আলেকজান্ডারকে বাধা দিতে এসে প্রাণ হারান। তখন বাধ্য হয়ে পুরু অল্প সংখক সৈন্য শিবিরে রেখে সসৈন্যে আলেকজান্ডারকে বাধা দিতে আগ্রসর হন। এ্যারিয়ানের বর্ণনা অনুসারে তার সঙ্গে ছিল ৩০ হাজার পদাতিক, ৪ হাজার অশ্বারােহী, ৩০০ যুদ্ধরথ ও ২০০ রণহস্তী। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি তার সেনাবাহিনীর কেন্দ্রস্থলে হস্তী সমাবেশ করেন। তাদের দুই পাশে পদাতিক এবং পদাতিকবাহিনীর দুই পাশে অশ্বারােহীদের স্থাপন করেন। দুইদিকে অশ্বারােহীদের সামনে রথের সন্নিবেশ করা হয়। বিতস্তার পূর্ব তীরে কররি প্রান্তরে উভয় পক্ষ পরস্পরের সম্মুখীন হয়। পুরুর তুলনায় আলেকজান্ডারের সৈন্য ছিল অনেক কম। কিন্তু আলেকজান্ডারের সুদক্ষ পরিচালনায় ম্যাসিডােনীয় অশ্বারােহীদের প্রবল আক্রমণে পুরুর সৈন্যরা বিপর্যস্ত হন। এই যুদ্ধে সামরিক কৌশলের দিক থেকে পুরু একটি ভুল করেছিলেন। তিনি শত্রুপক্ষের যােগ্যতর অশ্বারােহীবাহিনীকে আক্রমণ করার সুযােগ দিয়েছিলেন। ভারতীয় তিরন্দাজেরা হয়তাে শত্রু শিবিরে আঘাত হানতে পারতেন কিন্তু বর্ষণসিক্ত কাদামাটিতে ধনুক রেখে নিশানা ঠিক করতে না পারায় তারা তাদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হন। হাতিগুলোকেও হয়তাে শত্রুদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া যেত কিন্তু তাদের ঠিকমতাে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারায় তারা শত্রুদের বদলে মিত্রদেরই বেশি ক্ষতি করে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরালাে করার জন্য পুরু অশ্বারােহীদের সামনে ৩০০টি রথ সাজিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এতে অশ্বারােহীদের অবাধ চলাচলের পথ রুদ্ধ হয়, তারা কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। মাঠ আর্দ্র থাকায় রথগুলোও কোনও কাজে লাগেনি। রথের চাকা মাটিতে বসে যায়। ম্যাসিডােনীয় অশ্বারােহীদের আক্রমণে ভারতীয় সৈন্যরা যখন দিশেহারা, তখন সেনাপতি ক্রটেরস সদলে বিতস্তা অতিক্রম করে যুদ্ধরত অগ্রগামী বাহিনীর সঙ্গে যােগ দেন। একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর! পুরুর অবস্থা হল মর্মান্তিক। তার হাজার হাজার সৈন্য নিহত হন। তার দুই পুত্র যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন। তিনি নিজে গুরুতররূপে আহত হন। এক দিনের যুদ্ধেই তার শােচনীয় পরাজয় ঘটে। তিনি বন্দি হন। ইতিহাসে এই যুদ্ধ হাইডাসপেস বা ঝিলামের যুদ্ধ নামে পরিচিত।

আলেকজান্ডারের কাছে পুরুকে আনা হয়। আলেকজান্ডার পুরুকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি তার কাছে কীরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা করেন। সাড়ে ছ’ফুট দীর্ঘ পুরু মাথা উঁচু করে জবাব দেন, রাজার মতাে ব্যবহারই তিনি আশা করেন। আলেকজান্ডার পুরুকে তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে বলেন। পুরু উত্তর দেন, ‘রাজার মতাে’ কথার মধ্যেই তার যা বলার, তা তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, তার নতুন কিছু বলার নেই। পুরুর উত্তরে আলেকজান্ডার অভিভূত হলেন। প্লুটার্ক লিখেছেন যে, আলেকজান্ডার তাকে রাজ্য ফিরিয়ে তাে দিলেনই, উপরন্তু আরও পনেরােটি প্রজাতন্ত্র শাসিত অঞ্চল তিনি তার রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন। তিক্ততা যা ছিল, তা দূর হল। উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপিত হল। পুরু আলেকজান্ডারের আনুগত্য স্বীকার করলেন ও তাকে ভারত অভিযানে নানা ভাবে সাহায্য করেন। পুরুর প্রতি আলেকজান্ডারের এই আচরণের পেছনে তার গভীর রাজনীতিক জ্ঞান কাজ করেছিল। আলেকজান্ডারের এই উদারতায় একদিকে যেমন তার মহানুভবতা প্রকাশ পেয়েছে, অন্যদিকে তেমনি তার গভীর রাজনীতিজ্ঞানের পরিচয় ফুটে উঠেছে। তিনি স্থানীয় নৃপতিদের সহানুভূতি হারাতে চাননি। তার সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল থেকে বহুদূরে সদ্য বিজিত অঞ্চলে যােগ্য মিত্রের মূল্য তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। ভারতে তার কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রাখতে হলে পুরুর মতাে কয়েকজন তেজস্বী দেশী রাজার সাহায্য একান্ত প্রয়োজন, এ সত্য তিনি বুঝতে পারেন। তিনি জানতেন যে তার আস্থাভাজন এই ব্যক্তিরা এই দূরবর্তী অঞ্চলে তার অধিকার বলবৎ রাখতে সচেষ্ট হবেন, এবং প্রয়ােজন মত অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করবেন। তার এই নীতি সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে যে, তিনি পােষা হাতির সাহায্যে বন্য হস্তী ধরতে চেয়েছিলেন। বিজয়ের নিদর্শন স্বরূপ তিনি বিতস্তা নদীর তীরে বুকিফেলা ও নাইকিয়া নামে দুটি বসতি প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রিয় ঘোড়া ছিল বুকিফেলা। তার নামেই প্রথম বসতির নাম। 

বিতস্তার যুদ্ধে পুরুর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম আলেকজান্ডারের মনে দারুণ রেখাপাত করে। এই যুদ্ধের কথা স্মরণ করে তিনি এক প্রকার রূপার মুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। এই মুদ্রাগুলোর একদিকে এক পুরুষের প্রতিকৃতি। তার মাথায় শিরস্ত্রাণ, দেহে বর্ম, কোমরে তরােয়াল, এক হাতে বর্শা, অন্য হাতে বজ্র। পুরুষ ব্যক্তিটি সম্ভবত আলেকজান্ডার। মুদ্রাগুলোর অন্যদিকে রয়েছে হাতির পিঠে বসা দুই ব্যক্তি। এদের একজন পেছন ফিরে বর্শা ছুড়ছেন পেছনে ছুটে আসা এক অশ্বারােহীকে লক্ষ করে। অশ্বারােহীও এক লম্বা বর্শা দিয়ে হাতিটিকে আঘাত করছেন। হাতির পিঠে বসা ব্যক্তি দু’জনের একজন সম্ভবত পুরু, অন্যজন তার দেহরক্ষী বা মাহুত। অনেকের ধারণা, আলেকজান্ডারের আরও দু’ধরনের মুদ্রায় বিতস্তার যুদ্ধের দৃশ্য প্রতিফলিত হয়েছে। এই মুদ্রাগুলো ইরাক প্রভৃতি দেশে পাওয়া গেছে, কিন্তু ভারতে নয়। (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, টাকাকড়ি আবির্ভাবের যুগ, পৃ. ৭৭-৭৮)। 

এরপর আলেকজান্ডার ঝিলাম ও চেনাবের  মধ্যবর্তী ভূভাগের আরেক প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য গ্লৌগনিকৈ আক্রমণ করেন। রাজ্যটি জয় করে তিনি তার শাসনভার পুরুর হাতে ন্যস্ত করেন। এরপর আলেকজান্ডারের অগ্রগতি সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়। কেননা, বিজিত অঞ্চল থেকে বিদ্রোহের সংবাদ আসে। তবে থ্রেস থেকে সামরিক সাহায্য এসে পৌঁছলে তার অবস্থার উন্নতি হয় এবং তিনি চেনাব বা চন্দ্রভাগা নদী অতিক্রম করেন। চন্দ্রভাগা পার হয়ে ম্যাসিডােনীয় সৈন্য কনিষ্ঠ পুরুর রাজ্যে প্রবেশ করেন। কনিষ্ঠ পুরু রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে মগধের নন্দরাজের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার রাজ্যটিও পুরুকে উপঢৌকন দেয়া হয়। ইরাবতী বা রাবী নদী অতিক্রম করে আলেকজান্ডার আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হন। অদ্রৈস্টৈ বা অধৃষ্ট প্রজাতন্ত্র বিনা যুদ্ধে তার বশ্যতা স্বীকার করে। কিন্তু কঠ বা কথা উপজাতির লােকেরা তাকে প্রচণ্ড বাধা দেন। এই সময় পুরু আলেকজান্ডারকে রণহস্তী ও হাজার সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। কঠেরা পরাজিত হন ও পুরুরাজের সাহায্যের পুরস্কারস্বরূপ তাদের রাজ্যটিও পুরুকে দেওয়া হয়। এরপর আলেকজান্ডার আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে সৌভূতি ও ভগল নামে দু’জন রাজার আনুগত্য লাভ করেন। এভাবে আলেকজান্ডার সদলে পাঞ্জাবের পঞ্চম নদী, হাইফাসিস বা বিপাশা তীরে উপস্থিত হন। তখন শ্রাবণ মাস, ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তন

বিপাশা নদী পার না হওয়ার কারণ : বিপাশা পার হয়ে আরও পূর্বদিকে অগ্রসর হবেন, এমনকি গঙ্গা অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবেন – এই ছিল আলেকজান্ডারের সংকল্প। কিন্তু ম্যাসিডােনীয় সৈন্যরা আর এক পাও এগােতে রাজি হলেন না। আলেকজান্ডার তাদের অনেক বােঝালেন কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। সৈন্যরা কেন বিদ্রোহ করেছিল, সে সম্পর্কে নানা রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। একটি ব্যাখ্যা অনুসারে, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকায় তারা দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়। তাছাড়া বছরের পর বছর যুদ্ধ করে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে রাজ্য জয়ের নেশায় তারা দেশ ছেড়ে বেরিয়েছিলেন। তাদের সহযাত্রীদের মধ্যে অনেকেই হয় নিহত হয়েছেন, নয় অসুখে মারা গেছেন, নয়তােবা প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন। আরও অগ্রসর হওয়ার অর্থ আরও যুদ্ধ, আরও মৃত্যু। ম্যাসিডােনীয় সৈন্যদের গৃহমুখী ও অবসাদগ্রস্ত মন আলেকজান্ডারের প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলেছেন যে বিপাশা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে আলেকজান্ডার উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারস্য সাম্রাজ্যের শেষ সীমায় পৌঁছেছিলেন। পারস্য জয়ের পর তার পক্ষে এই অগ্রগতি একান্ত স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নতুন অঞ্চল জয়ের জন্য আরও অধিক দূর অগ্রসর হওয়া, সৈন্যদের কাছে অকারণ ও অর্থহীন মনে হয়েছিল। এদিকে প্রাচীন ইউরােপীয় লেখক ডায়ােডােরাস এবং প্লুটার্কের বিবরণে ম্যাসিডােনীয় সৈন্যদের প্রত্যাবর্তনের আর একটি কারণের পরােক্ষ উল্লেখ আছে। হাইডাসপেসের যুদ্ধের ফলে ম্যাসিডনীয়দের সাহস অনেকটা কমে যায় এবং ভারতে তাদের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়। কেননা, তারা দেখেছিল যে, আপেক্ষিকভাবে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করলেও পুরুকে পরাজিত করা তাদের পক্ষে সহজ ছিল না, অনেক পণ্ডিতের মতে ভারতীয়দের সামরিক কৌশল দেখে গ্রিকরা আতঙ্কিত হয়েছিল। এদিকে বিপাশা পার হলেই মগধের রাজা এগ্রাম্মে‌সের রাজ্য অর্থাৎ মগধের নন্দরাজ্য, আর এগ্রাম্মেস দ্বারা নন্দ বংশের শেষ শাসক ধননন্দকেই বোঝানো হয়ে থাকবে। তার পরাক্রম সম্পর্কে ম্যাসিডােনীয় সৈন্যদের মনে এক দারুণ আতঙ্ক ছিল। তারা শুনেছিল তাদের বাধা দিতে এগ্রাম্মে‌স আড়াই লক্ষ সৈন্য সমাবেশ করেছেন, এই সংবাদে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হন (গঙ্গাহৃদির কথাও শুনেছিল, কিন্তু তা দিয়ে এগ্রাম্মেসকেই বোঝানো হতে পারে)। তাদের এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক ছিল, তা বোধ হয় বলা যায় না। কেননা, পূবাঞ্চলে গঙ্গা ও যমুনা নদী ছিল ভারি পণ্য বহনের প্রধান ধমনী। মগধের নেতৃত্বে এই অঞ্চল রাজনৈতিক দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ ছিল, পাঞ্জাবের মত উপজাতীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জীর্ণ ও বহুধাবিভক্ত ছিল না। সুতরাং পাঞ্জাবের তুলনায় এখানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃঢ়তর হবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। তাই তারা গঙ্গা অতিক্রম করে অসংখ্য শত্রু অধ্যুষিত নতুন অঞ্চলে প্রবেশ করতে চায়নি। 

প্রত্যাবর্তন : অন্তরের সায় ছিল না, তবু সৈন্যদের প্রবল আপত্তিতে আলেকজান্ডার প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যে পথ দিয়ে তিনি বিপাশার তীরে এসেছিলেন সেই পথ ধরে তিনি বিতস্তা নদীর তীরে ফিরে যান। জাহাজ নির্মাণ ও আরও কয়েকটি জরুরি কাজের জন্য সেখানে কয়েক মাস অবস্থানের পর ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে আবার যাত্রা শুরু হয়। একদল সৈন্যসহ আলেকজান্ডার নদীপথে এগিয়ে চলেন। আর একদল সৈন্য নদীর দুই তীর ধরে একই সঙ্গে অগ্রসর হন। সেনাপতি ফিলিপের নেতৃত্বে আর একদল সৈন্য ৩ দিন পর মূল বাহিনীর পিছু পিছু তাগ্রসর হতে থাকেন। দশ দিনের মধ্যে আলেকজান্ডার সসৈন্যে বিতস্তা ও চন্দ্রভাগা নদীর সঙ্গমে এসে উপনীত হন। এখানে মালব ও ক্ষুদ্রক নামে দুটি দুধর্য উপজাতি তাদের ৯০ হাজার পদাতিক, ১০ হাজার অশ্বারােহী ও ৯০০ রথ নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে আলেকজান্ডারকে বাধা দেন। এই যুদ্ধে আলেকজান্ডার গুরুতররূপে আহত হন কিন্তু শেষ পর্যন্ত মালব ও ক্ষুদ্রকেরা আত্মসমর্পণ করেন। আলেকজান্ডার আরও কিছুদূর অগ্রসর হলে আগলস্সৌ‌ বা আর্জুনায়ন উপজাতি ৪০ হাজার পদাতিক ও ৩ হাজার অশ্বারােহী নিয়ে তাকে বাধা দেন। আর্জুনায়নদের এক শহরে ২০ হাজার নাগরিক আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরােধ রচনা করেন। যখন তারা দেখলেন, পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, তখন তারা শক্রর হাতে ধরা না দিয়ে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে জ্বলন্ত আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেন। অর্জুনায়নরা বাধা দিলেও সেই অঞ্চলের শিবিরা তাকে বাধা দেয়নি, তারা তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিল। সিন্ধু নদ ধরে আরও অগ্রসর হয়ে আলেকজান্ডার একে একে অম্বষ্ঠ, ক্ষত্রিয়, ওস্স‌ডিয়ৌ, সােগড্রি ও মূষিক রাজ্য জয় করেন। মুষিক রাজ্যের ব্রাহ্মণেরা তাদের ধর্ম বিপন্ন ভেবে আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা নিষ্ফল হয়। এখানে অবস্থানকালে আলেকজান্ডার সেনাপতি ক্রটেরসের নেতৃত্বে একদল সৈন্যকে কান্দাহার ও সিস্তানের পথে স্বদেশে পাঠিয়ে দেন। বাকি সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে তিনি সিন্ধু নদের পথ ধরে অগ্রসর হন। পথে রাজা ওক্সিকেনােস বা পাের্টিকেনােসকে পরাজিত করে তার রাজ্য দখল করেন। শেষে তিনি সদলে পট্টলে এসে উপস্থিত হন। শহরটি সিন্ধু নদের বদ্বীপে অবস্থিত। এখানে কয়েক দিন বিশ্রামের পর ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ভাদ্র মাসে তিনি একদল সৈন্য সঙ্গে নিয়ে বেলুচিস্তানের ভেতর দিয়ে স্বদেশ অভিমুখে রওনা হন। তার নির্দেশে সেনাপতি নিয়ারকাস একদল সৈন্যসহ তখনও পট্টলে থেকে যান, কিন্তু আশ্বিন মাসে তিনিও সদলে সমুদ্র পথে পারস্য উপসাগর অভিমুখে যাত্রা করেন। আলেকজান্ডারের আর দেশে ফেরা হল না। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের জুন মাসে ব্যাবিলন শহরে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই তিনি রোমান্স ও লোককাহিনীর অন্যতম অবিনশ্বর পুরুষে পরিণত হন। 

প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ : বিচক্ষণ আলেকজান্ডার ভারত ত্যাগের পূর্বে অধিকৃত ভূখণ্ডের রক্ষণাবেক্ষণ ও সুশাসনের সব আয়ােজনই সম্পন্ন করে যান। ভারতের যে সমস্ত অঞ্চল আলেকজান্ডারের অধিকারভুক্ত হয়েছিল সেসব অঞ্চলে তিনি সুনির্দিষ্ট শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রের আমূল পরিবর্তন করেন। পারস্য প্রভাব অনুযায়ী প্রশাসনিক স্বার্থে আলেকজান্ডার তার অধিভুক্ত অঞ্চল সাতটি প্রদেশ বা সত্রপিতে বিভক্ত করেন। এগুলাের পাঁচটি ছিল সরাসরি ভারতীয় অঞ্চল আর বাকি দু’টি ছিল কাবুল উপত্যকায় সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলাে গঠিত হয়েছিল হিন্দুকুশ পর্বত ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাজ্যগুলােকে নিয়ে। প্রথম দিকে টাইরিসপিস ও নিকানাের যথাক্রমে উচ্চ ও নিম্ন কাবুল উপত্যকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। কিন্তু পরে আলেকজান্ডারের শ্বশুর অক্সারটিসকে উচ্চ কাবুল উপত্যকার শাসনভার দেওয়া হয়। পাইথন ও ফিলিপপাস যথাক্রমে সিন্ধু ও দক্ষিণ পাঞ্জাবের শাসনকর্তা হন। আলেকজান্ডারের সহযােগিতা করার পুরস্কারস্বরূপ তক্ষশীলার রাজা আম্ভিকে ঝিলাম (বিতস্তা) ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। ঝিলাম ও বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন রাজা পুরু। অম্ভি যেমন বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বার্থপরতার পুরস্কার পেয়েছিলেন পুরু তেমনি দেশপ্রেম ও বীরত্বের পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার এই রাজ্যের সঙ্গে পনেরোটি প্রজাতন্ত্রশাসিত এলাকা যুক্ত হয়। অভিসারের রাজাকে অভিসার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়, এগুলোর মধ্যে কাশ্মীর অঞ্চল, আরসাকেস (হাজারা অঞ্চল ছিল)। নবগঠিত এ সমস্ত প্রদেশের নিরাপত্তার জন্য আলেকজান্ডার কিছু গ্রিক সৈন্য রেখে গিয়েছিলেন। তবে এই গ্রিক প্রদেশগুলাে দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই গ্রিক শাসনকর্তারা নিজেদের শাসন অঞ্চল ছেড়ে পশ্চিম দিকে চলে যান। ফলে দেশীয় শাসকরা নিজ নিজ অঞ্চলে স্বাধীন হয়ে যেতে থাকেন।

ম্যাসিডােনীয় আধিপত্যের বিলােপ : নিজ সাম্রাজ্যের সুরক্ষার সব ব্যবস্থাই আলেকজান্ডার গ্রহণ করেছিলেন তবু তার ভারতে অবস্থানকালেই সাম্রাজ্যের নানা স্থানে গােলযােগ দেখা দেয়। তিনি যখন পাঞ্জাবে, তখন নিম্ন কাবুল উপত্যকায় এক বিদ্রোহের ফলে শাসনকর্তা নিকানাের নিহত হন। বিদ্রোহ দমন করা হয় ও ফিলিপ সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ পাঞ্জাবের শাসনকর্তা ফিলিপ্পাস নিহত হন। ইউডিমাস তার স্থলাভিষিক্ত হন। ইউডিমাসের সঙ্গে পুরুর সম্ভাব ছিল না। তারই ষড়যন্ত্রে পুরু নিহত হন। ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিছু পরে সিন্ধুর শাসনকর্তা পাইথন নিম্ন কাবুল উপত্যকায় বদলি হন। সম্ভবত এই সময় সিন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করে। ম্যাসিডােনীয় শাসকদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ৩১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইউডিমাস ও পাইথন সদলে ভারত ত্যাগ করে পশ্চিম এশিয়ায় যাত্রা করেন। সেখানে তারা উভয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। এদের পরিবর্তে অন্য কাউকে ভারতে পাঠানাে হয়নি।

ভারতবর্ষে আলেকজান্ডারের অভিযানের পথ

আলেকজান্ডারের সাফল্য ও ভারতীয়দের ব্যর্থতার কারণ

আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান সম্পর্কে ভিনসেন্ট স্মিথ মন্তব্য করেছেন, আলেকজান্ডারের বিজয়ী সৈন্যদলের হিমালয় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত অগ্রগতি ও বিজয় পরিক্রমায় ইউরােপীয় সেনাবাহিনীর সমরকুশলতা এবং নিয়মানুবর্তিতার সামনে এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ বৃহত্তম সেনাবাহিনীর দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছিল। ভারতের মাটিতে আলেকজান্ডারের সামরিক কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না। এখানে প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি জয়লাভ করেছেন। যারাই তার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, তিনি তাদের সমূলে চূর্ণ করেছেন। কররি প্রান্তরে যেভাবে তিনি পরাক্রান্ত পুরুকে এক দিনের যুদ্ধে পরাজিত করেন, তা তার অসামান্য সামরিক প্রতিভার পরিচয় দেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি প্রায়ই প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মুষ্টিমেয় সঙ্গী নিয়ে শত্ৰুব্যুহে প্রবেশ করেছেন। এ শুধু তার নির্ভীকতার প্রকাশ নয়, সৈন্যদের উদ্দীপ্ত করার তার অমােঘ আহ্বান। 

কিন্তু এখানে এই কথাটি মনে রাখতে হবে যে আলেকজান্ডারের অভিযান শুধু পশ্চিম ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সামান্য পথ পরিক্রমাতে তার প্রায় আড়াই বছর সময় লেগেছিল। ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রীষ্মে তিনি এ দেশে আসেন, আর ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ভাদ্র-আশ্বিন মাসে তিনি এ দেশ ত্যাগ করেন। ভিনসেন্ট স্মিথের মন্তব্যকে ডঃ মজুমদার “অদ্ভুত” বলেছেন। তিনি বলেছেন, সামরিক দিক থেকে এই আক্রমণকে একটি বিরাট সাফল্য বলা যায় না, কেননা ভারতে তিনি কোন বৃহৎ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি। ভারতে তিনি মগধ রাজ্যের মতাে কোনও বৃহদায়তন ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধ করেছেন ক্ষুদ্র, বিচ্ছিন্ন ও পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কয়েকটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কিছু সংখ্যক ভারতীয় নৃপতির বিশ্বাসঘাতকতা তাকে সাহায্য করেছিল। শশিগুপ্ত, আম্ভি ও শেষের দিকে পুরু তাকে অভিযানে অকুণ্ঠ সাহায্য করেন। পুরু এবং পাঞ্জাবের গণরাজ্যগুলো তাকে প্রবলভাবে বাধা দিয়েছিল। আলেকজান্ডার ভারতের প্রতিরােধ কেন্দ্রগুলো একটি একটি করে ভাঙ্গবার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এই চতুর নীতিও তাকে সাহায্য করেছিল। মালব ও ক্ষুদ্রক রাজ্য দুটি ছাড়া এ অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো একতাবদ্ধ না থাকায় তাদের বিচ্ছিন্নতার সুযােগে আলেকজান্ডার তাদের একটি একটি করে গ্রাস করেন। অথচ এই অনুকূল পরিস্থিতিতেও ভারতের এক সামান্য অংশ জয় করতেই তার প্রায় আড়াই বছর সময় লাগে। শেষদিকে ক্ষুদ্রক এবং মালবগণ মিলিতভাবে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু তখন আর সময় ছিল না। এসব কারণে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানকে সামরিক সাফল্যের এক উজ্জ্বলতম নিদর্শনরূপে গণ্য করা যায় না।

তবে ডঃ মজুমদারের এই আপত্তি সত্ত্বেও এই অভিযানের মধ্য দিয়ে ভারতের সেনাবাহিনীর, সংগঠনের এবং রণনীতির ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা যে প্রকটিত হয়েছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। তবে বিষ্ময়ের বিষয় এই যে, ভারতীয় রাজারা এই অভিজ্ঞতা থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেন নি। এর পরেও তারা তাদের অভ্যস্ত রীতিতে এবং প্রধানত হাতি, রথ এবং পদাতিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। এই ব্যাপারটি থেকে এই সিদ্ধান্তেও আসা যায় যে,  আলেকজান্ডারের রণনীতি ও সমরােপকরণও সমকালীন ভারতীয়দের মনে কোনও রেখাপাত করেনি। এর পরেও তারা দীর্ঘদিন অভ্যস্ত রীতি ও সমরােপকরণের উপর নির্ভর করে যুদ্ধ পরিচালনা করে গেছেন।

আলেকজান্ডারের অভিযানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা

সামরিক দিক থেকে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান অনেকখানি সফল হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার এই অভিযান তেমন সার্থক হয়নি। তিনি যখন ভারতে তখনই তার অধিকৃত অঞ্চলে একবার বিদ্রোহ দেখা দেয়। তার মৃত্যুর প্রায় ৫ বছরের মধ্যেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিজয় অভিযানে ভারতে ম্যাসিডােনীয় শাসনের সম্পূর্ণ অবসান হয়, এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধু থেকে গ্রিক অধিকার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর ফলে পাজাব ও সিন্ধুতে গ্রীক শাসন স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভারত জয় যদি আলেকজান্ডারের অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তার অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। তার ভারত আক্রমণ আসলে নিছক বিরাট আকারের এক সফল সামরিক অভিযান ছাড়া আর কিছু নয়। আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ করে তিনি ভারতকে পারস্য শাসনমুক্ত করেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে সেখানে তার শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। পারসিকগণ যে অঞ্চল দুশো বছর অধিকার করেছিল, সেখানে তিনি তার ধ্বংসলীলা চালিয়েছিলেন।

সমকালীন ভারতীয় মানসে এই অভিযান কোনও রেখাপাত করেনি। ভারতীয় সাহিত্যে ও লােকগাথায় এই অভিযানের কোনও উল্লেখ নেই। গ্রিক ঐতিহাসিকদের বিবরণ না থাকলে তার ভারত অভিযানের কথা আমাদের সম্পূর্ণ তাজানাই থেকে যেত। ভারতে ম্যাসিডােনীয় আধিপত্য দ্রুত বিনষ্ট হয় ঠিকই কিন্তু তার জন্য আলেকজান্ডার দায়ী নন। এখানে তার কৃতিত্ব বিচারে দুটি বিষয় মনে রাখা প্রয়ােজন। প্রথমটি তার অকালমত্যু, যে জন্য তিনি তার আরব্ধ কাজ সমপন্ন করতে পারেন নি, এজন্য ম্যাসিডােনীয় শাসন দীর্ঘায়িত হতে পারেনি। তিনি দীর্ঘ দিন জীবিত থাকলে ভারতে ম্যাসিডোনীয় আধিপত্য শুধু সুদৃঢ়ই হত না, সম্প্রসারিতও হত। দ্বিতীয়টি, ভারতের দুরত্ব এবং ভারত ও ম্যাসিডনের মধ্যে যােগাযােগ ব্যবস্থার অভাব। তখনকার দিনে যােগাযােগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় সুদূর ম্যাসিডােনিয়া থেকে ভারতের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব ছিল না। এই ভৌগােলিক কারণেই ভারতে তার স্থায়ী সাফল্য লাভের কোন সম্ভাবনা ছিল না। তাছাড়া চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মতাে একজন প্রবল পরাক্রান্ত নেতা সে সময় আবির্ভূত না হলে ভারতে ম্যাসিডােনীয়দের কর্তৃত্ব আরও কিছুদিন স্থায়ী হত। ভারতে তিনি যে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তা থেকে তিনি যে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তা বোঝা যায়। ভারতের যে অঞ্চল তিনি জয় করেছিলেন তাকে তিনি সাতটি প্রদেশে বিভক্ত করেন। তবুও এই প্রাদেশিক শাসকগণ যে প্রথম থেকেই কার্যত স্বাধীনতা ভােগ করবেন এবং প্রথম সুযোগেই তারা আলেকজান্ডারের প্রতি তাদের আনুগত্যকে অস্বীকার করবেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না।

ভারতীয় দৃষ্টিতে আলেকজান্ডারের উত্তর-পশ্চিম ভারত জয় একটা আকস্মিক বহিরাক্রমণ মাত্র। ভারতীয় সাহিত্যে বা ঐতিহ্যে এর কোন উল্লেখ নেই। ভারতীয় সমাজের ধর্ম ও শিল্পে, এককথায়, জীবন ও সংস্কৃতিতে এর কোন প্রভাব পড়েনি। V. A Smith যথার্থই বলেছেন, “ভারতবর্ষে আলেকজান্ডারের হিংস্র অভিযানে ভারতের চিন্তাধারা ও প্রতিষ্ঠানে কোন প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েনি।” ভারতীয়দের যুদ্ধরীতিও এর ফলে পরিবর্তিত হয়নি। তারা শুধু দুঃখ ভােগ করেছে, বিনিময়ে আগে যা জানত তার চেয়ে বেশি কিছু জানতে পারেনি। গ্রীকদের জানবার জন্য, ভারতীয়দের পক্ষে, ম্যাসিডনীয় অভিযানের প্রয়ােজন ছিল না। আলেকজান্ডার গ্রীক সংস্কৃতির যে সামান্য চিহ্ন এই অভিযানের ফলে রেখে গিয়েছিলেন পরবর্তীকালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা ধুয়ে গিয়েছিল। গ্রীসও এই অভিযান থেকে খুবই অল্প পরিমাণে লাভবান হতে পেরেছিল।  গ্রীসের সঙ্গে ভারতের এই সংযোগ অত্যন্ত স্বল্পকালীন। সেই সাথে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলে ভারতবর্ষের অগণিত মানুষের প্রাণনাশ হয় এবং বিপুল সম্পদ ধ্বংস হয়। ঐতিহাসিক বিবরণে জানা যায়, এই আক্রমণে এক লক্ষ লােক নিহত এবং দেড় লক্ষ মানুষ আহত ও বন্দী হয়। অর্থাৎ এই অভিযান যথেষ্ট রক্তাকও ছিল। এভাবে অভিযান স্বল্পকালীন এবং রক্তাক্ত হওয়ায় গ্রীকরাও এর ফলে ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি। সুতরাং ভারত ও গ্রীস উভয়ের দৃষ্টিতে এই আক্রমণ একটি “নিষ্ফল’ ঘটনা।

আলেকজান্ডারের অভিযানের পরোক্ষ প্রভাব

মহামতি আলেকজান্ডারের অভিযান ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক উল্লেখযােগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। একথা সত্য যে, আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে মাত্র কয়েকমাস অবস্থান করেন। কিন্তু ভারতে তার স্বল্পকালীন অবস্থান সত্ত্বেও নানা দিক দিয়ে তার আক্রমণ ভারতের ইতিহাসকে প্রভাবিত করে। আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের ফলাফল সম্পর্কে Paul Masson মন্তব্য করেন, “আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের গুরুত্ব একই সাথে অতিমূল্যায়িত ও অবমূল্যায়িত হয়েছে।” কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন, আলেকজান্ডারের আক্রমণের ফলে ভারত সম্পূর্ণরূপে গ্রিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়। সব মিলে বলা যায়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আলেকজান্ডের অভিযান ব্যর্থ হলেও এটি ভারতবর্ষের রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তার অভিযানের পরোক্ষ প্রভাবগুলো হলো –

রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বৃদ্ধি : উত্তর-পশ্চিম ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোকে নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করে আলেকজান্ডার এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে চন্দ্রগুপ্তকে একটি একটি করে এই অঞ্চলের রাজ্যগুলোকে জয় করতে হয়নি, এক ম্যাসিডােনীয়দের পরাজিত করেই তিনি উত্তর পশ্চিম ভারতের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেন। আলেকজান্ডারের আক্রমণের ফলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা যে যুগােপযােগী নয় তা প্রমাণিত হয়েছিল এবং একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। আলেকজান্ডার উত্তর-পশ্চিম ভারতের জটিল মানচিত্রের আমূল পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি সেখানে অসংখ্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পরিবর্তে পুরু, অম্ভি এবং অবিসারেসের অধীনে তিনটি বৃহৎ রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। এভাবে তার আক্রমণের পরোক্ষ ফল হিসেবে ভবিষ্যৎ ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। এই ফলটি ছিল অব্যবহিত এবং অপ্রত্যাশিত। এর ফলে মৌর্যগণ কর্তৃক প্রায় সমগ্র ভারত জয় স্বরান্বিত হয়েছিল। আলেকজান্ডার বিজিত রাজ্যগুলােকে পুরু, অম্ভি, অভিসার প্রভৃতি রাজগণকে দান করার ফলে উত্তরাঞ্চলের রাজনৈতিক ঐক্যের পথ অনেক দূর এগিয়ে যান। তার মৃত্যুর পর উত্তর-পশ্চিম ভারতে এক রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য রাজনৈতিক শূন্যতার সুযােগ নিয়ে অল্পকালের মধ্যেই ঐ সকল অঞ্চল দখল করে তা মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। সেই সাথে আলেকজান্ডার উত্তর-পশ্চিম ভারত জয় করে তা গুটি কয়েক শাসকের হাতে ছেড়ে যাওয়ায় মৌর্য সেনাবাহিনী পশ্চিম পাঞ্জাবে পৃথক পৃথক ভাবে প্রতিটি উপজাতিকে জয় করার কঠিন দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি পেয়েছিল। ম্যাসিডনীয় আক্রমণ এবং যুদ্ধে যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব ক্রীতদাস লাভের গ্রীক নীতির ফলে সেখানকার জটিল ও কঠিন বাধা চুর্ণ হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিম পাঞ্জাবের গােসম্পদকে গ্রীক সৈন্যদল তাদের খাদ্য এবং যুদ্ধের লুণ্ঠিত দ্রব্য হিসেবে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছিল। এই ভাবে গোসম্পদ হারিয়ে আক্রমণের পরে সেখানকার উপজাতি জীবন বিপন্ন হয়েছিল। আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তনের পাঁচ বছরের মধ্যে পুরু তার রাজ্য থেকে উৎখাত হয়েছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তক্ষশিলাসহ সমগ্র পাঞ্জাব অধিকার করেছিলেন। গান্ধারের অবশিষ্ট অংশ তিনি সেলুকাসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। এই কাহিনী স্মরণ করে ডঃ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী বলেছেন, উগ্রসেন মহাপদ্ম যদি পূর্ব ভারতে চন্দ্রগুপ্তের পূর্বসূরি হন, তাহলে আলেকজান্ডারই উত্তর-পশ্চিম ভারতে চন্দ্রগুপ্তের পথিকৃৎ।

ভারতবর্ষে ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক শাসন : যারা বলেন যে, ভারতবর্ষে আলেকজান্ডারের অভিযান একটা নিষ্ফল ঘটনা, তার অভিযান ভারতকে কিছু দেয়নি, গ্রিসের অভিযান ভারতে স্বল্পকালীন ও রক্তাক্ত হওয়ায় তাতে ভারতের সাথে গ্রিসের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সাংস্কৃতিক আদান প্রদানও কিছু হয়নি, তারা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর গ্রীসের প্রভাব সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন না। তারা বলেন এই প্রভাবের জন্যে ব্যাকট্রিয় গ্রীকরা দায়ী। কিন্তু এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, পরবর্তীকালে উত্তর-পশ্চিম ভারতে ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের উপস্থিতি, আলেকজান্ডারের এই অভিযানের অন্যতম পরোক্ষ ফল। তাছাড়া আলেকজান্ডার ভারতে গ্রীক সংস্কৃতিকে না আনলেও পারস্য সাম্রাজ্যকে ধবংস করে তিনি একে ভারতের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং বলা যায় যে ভারতের ওপর গ্রীসের প্রভাব তার পরবর্তীকালের হলেও তারই কার্যকলাপের ফল। এশিয়া অভিযানে এসে আলেকজান্ডার আফগানিস্তানের বল্খ বা ব্যাক্ট্রিয়া‌ অঞ্চলে এক ম্যাসিডােনীয় উপনিবেশ স্থাপন করেন। ভারতে ম্যাসিডােনীয় আধিপত্য দ্রুত বিলুপ্ত হলেও এই অঞ্চলে তা দীর্ঘকাল অব্যাহত থাকে। মৌর্য সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে বলখের ব্যাকট্রীয়-গ্রিক শাসকেরা উত্তর-পশ্চিম ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করেন। উত্তর পশ্চিম ভারতে প্রায় দেড় শতাব্দীকাল স্থায়ী এই ব্যাকট্রীয় আধিপত্য আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণেরই এক পরােক্ষ ফসল।

ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক শাসনে ভারতীয় ও গ্রিকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় : ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে অনিবার্যভাবে ম্যাসিডােনীয় তথা গ্রিক প্রভাব এসে পড়েছে। আলেকজান্ডার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গ্রিক নগরগুলোতে মৌর্য বিজয়ের পরও গ্রিকরা থেকে গিয়েছিল, সেসব স্থানে গ্রিক সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয় ও সেগুলোতে ভারতীয় ও গ্রিকদের সাংস্কৃতিক আদান প্রদান দৃঢ় হয়। পরবর্তীতে উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক শাসন ও ইন্দো-গ্রিক শাসনে এই সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান আরও শক্তিশালী হয়েছিল। যেসব ক্ষেত্রে গ্রিকদের সাথে ভারতীয়দের সাংস্কৃতিক বিনময় দেখা যায় –

  • প্রথম প্রথম ভারতীয় মুদ্রায় শুধু প্রতীক উৎকীর্ণ হত, কিন্তু পরে গ্রিক মুদ্রার প্রভাবে লেখ ও রাজার প্রতিকৃতি অঙ্কিত হতে থাকে। গ্রিক মুদ্রার উপরও ভারতীয় মুদ্রার প্রভাব পড়েছিল। গ্রিক রাজা প্যান্টালিওন ও এগাথােক্লিস তক্ষশিলার মুদ্রার আংশিক অনুকরণে তাম্রমুদ্রা উৎকীর্ণ করেন। মৌর্যোত্তর যুগে ইন্দো-গ্রিক শাসনকর্তারা ভারতের প্রচলিত মুদ্রার পরিবর্তে গ্রিক মুদ্রার অনুকরণে নতুন মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন করেন। এভাবে ভারতীয় মুদ্রা অনেক বেশি পরিশীলিত হয়।
  • জ্যোতির্বিদ্যার ওপর দু’খানি প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ রােমকসিদ্ধান্ত ও পৌলশসিদ্ধান্ত। গ্রন্থ দুটির নামকরণে গ্রিক প্রভাব স্পষ্ট। জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে কেন্দ্র, আপােক্লিম, লিপ্ত, হােরা প্রভৃতি বেশ কিছু গ্রিক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার দেখা যায়। গ্রহদের গতি সম্বন্ধে উৎকেন্দ্রীয় বৃত্ত ও পরিবৃত্তের ধারণা, সূর্যের আপাত গতিপথকে ১২টি রাশিতে বিভক্ত করার রীতি, রাশিগুলোর নামকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের ধ্যান-ধারণায় গ্রিক প্রভাব লক্ষণীয়। গর্গ ও বরাহমিহিরের মতাে দু’জন নামকরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী যবন বা গ্রিক জ্যোতির্বিদদের সম্পর্কে বলেছেন, তারা ম্লেচ্ছ হলেও ঋষিপদবাচ্য, শ্রদ্ধেয় (P. Ray ed. The cultural Heritage Of India, Vol. VII, Calcutta, 1991, পৃ. ২৪০-৪১)।
  • এছাড়া ভারতীয় সাহিত্য এবং শিল্পকলার দিকে দৃষ্টি দিলে স্পষ্টতই গ্রিক প্রভাব লক্ষ করা যাবে। গ্রিক ভাস্কর্যের অনুকৃতিই যেন গান্ধার শিল্প। এভাবে গ্রিক প্রভাবে ভারতীয় ভাস্কর্য উচ্চাঙ্গে পৌঁছেছিল।
  • ভারতীয় নাট্য সাহিত্যে গ্রিক প্রভাব লক্ষ করা যায়। নাটকে যবনিকা বা পর্দার ধারণা (স্মরণীয় যবনিকা পতন শব্দটি) ধারণা গ্রিক সংস্কৃতি থেকেই ভারতীয় নাটকে প্রবেশ করে।
  • অনেকে বলেন, পাটলিপুত্রে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাঠের প্রাসাদ নির্মাণে গ্রিক প্রভাব লক্ষ করা যায়। অশােকের স্তম্ভগুলাে এবং তার গায়ে খােদিত লিপি গ্রিক প্রভাবের ফল বলে অনেকে বলেন। (তবে বেশিরভাগের মত সেগুলো পারস্য প্রভাবে প্রভাবিত)।
  • অনেকে মনে করেন ভারতীয় শব্দ ‘দাম’ (মূল্য) গ্রিক শব্দ ‘দ্ৰোকমা’ থেকে উদ্ভুত।
  • পক্ষান্তরে ভারতীয় দর্শন, ধর্ম ও সাহিত্য গ্রিকদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। ক্রমে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান বৃদ্ধি পেলে ধর্মীয় ক্ষেত্রেও কৌতূহল বৃদ্ধি পায়। প্রাচীন গ্রিক ধর্মের প্রতি যেমন ভারতীয়দের কৌতূহল দেখা যায় তেমনি গ্রিক আঞ্চলগুলােতে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রভাবও স্পষ্ট হতে থাকে। মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম গ্রিকদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। এদিকে মৌর্যোত্তর যুগে বৌদ্ধধর্মের মহাযান সম্প্রদায়ের মধ্যে পৌত্তলিকতার যে ঝোঁক দেখা যায় তা মূলত ছিল গ্রিক পৌত্তলিকতার প্রভাবেরই ফল। কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রিকরা বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবদের কাছ থেকে ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এরকম দু’জন গ্রিক রাজার নাম মিনাল্ডারহেলিওডােরাস। একসময় খ্রিস্টধর্মের সন্ন্যাসবাদী ধারণার ওপর বৌদ্ধ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। 

গ্রিক ও ভারতীয় সংস্কৃতির এই পারস্পরিক ভাব বিনিময় মূলত ভারতে বল্খী‌য় বা ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক শাসনেরই পরােক্ষ ফল। বলখে গ্রিক উপনিবেশ আলেকজান্ডারই স্থাপন করেছিলেন। সেই হিসাবে বলা যায়, গ্রিক ও ভারতীয়দের মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের বীজ প্রকৃতপক্ষে আলেকজান্ডারই বপন করেন। ঐতিহাসিক V.A. Smith এ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, “ভারতীয় সভ্যতায় যেসব হেলেনিস্টিক উপাদান দেখা যায় সেগুলোর সবই আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পরোক্ষ ফলাফল”।

আলেকজান্ডারের অভিযানের প্রত্যক্ষ প্রভাব

ভারতবর্ষের ইতিহাসে আলেকজান্ডারের অভিযানের ক্ষেত্রে পরোক্ষ প্রভাবের মতো কিছু প্রত্যক্ষ প্রভাবও ছিল। যেমন –

গ্রিক বসতির প্রতিষ্ঠা : অভিযান উপলক্ষে তিনি এ দেশে কয়েকটি গ্রিক বসতির প্রতিষ্ঠা করেন। এক আলেকজান্ড্রিয়া নামেই তিনি তিন তিনটি বসতি পত্তন করেন। প্রথম দুটি আফগানিস্তানের কান্দাহার ও চারিকার অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তৃতীয়টির অবস্থান ছিল সিন্ধু ও চন্দ্রভাগার সঙ্গমস্থলে বা তার নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে। এছাড়া তিনি পাঞ্জাবে নাইকিয়া ও বুকিফেলা নামে দুটি বসতিও প্রতিষ্ঠা করেন। যে অঞ্চলে ঝিলাম নদী অতিক্রম করেছিলেন সেখানে বুকিফালা (Boukephala), আর পুরুর সঙ্গে যে প্রান্তরে যুদ্ধ হয়েছিল সেখানে নিকাইয়া নগর প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এদের কোনওটিই ঠিক শহর হয়ে উঠতে পারেনি। আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গ্রিক বাসিন্দারা এখানকার বাসস্থান গুটিয়ে অন্যত্র চলে যান। তবে এখানেই এই গ্রিক উপনিবেশগুলোর লেগেসি শেষ হয়ে যায়নি। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পরেও এই উপনিবেশগুলোর পৃথক অস্তিত্ব ছিল। অশােক তার সাম্রাজ্যের প্রান্তে এদের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি যবনরাজ তুষাষফকে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করেছিলেন। এই উপনিবেশগুলো গ্রীক সংস্কৃতি বিকিরণ করত এবং এগুলো ভারতীয় এবং গ্রীক সংস্কৃতির পরম্পরিক আদান প্রদানের মাধ্যম রূপে কাজ করত। পরবর্তীকালে গ্রীকরা ভারতীয় বৌদ্ধভাগবতদের কাছ থেকে দর্শন ও ধর্ম বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করেছিল। আবার ভারতীয়গণ গ্রীকদের কাছ থেকে মুদ্রা, গ্রহ-নক্ষত্র বিজ্ঞান এবং শিল্প বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেছিল। উভয়ের মধ্যে এই সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পেছনে এই উপনিবেশগুলোর অবদান খুব কম ছিল না।

পশ্চিমের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতর যােগাযােগ, বাণিজ্য ও ভৌগােলিক দিগন্তের প্রসার : এই অভিযানের অন্যতম স্থায়ী ফল ছিল প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ স্থাপন। দীর্ঘকাল ধরে গ্রিস ও ভারতবর্ষের সঙ্গে পারস্যের মাধ্যমে যােগাযােগ চলত। কিন্তু এই অভিযানের পর উভয় দেশের মধ্যে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপিত হয়। শুধু পাশ্চাত্যের দেশসমূহের সঙ্গেই নয়, মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই অভিযানের ফলে কাবুল, বেলুচিস্তানের মুল্লা গিরিপথ এবং মাকরণের মধ্য দিয়ে তিনটি স্থলপথ এবং পারস্য উপসাগরের মধ্য দিয়ে নতুন একটি জলপথ আবিস্কৃত হয়। এর ফলে বাণিজ্যের এবং সামুদ্রিক ক্রিয়াকলাপের নতুন পথ উন্মুক্ত হয়। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ভারতবর্ষের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী কাস্পিয়ান ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্য দিয়ে ইউরােপের বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছতাে। শুধু ইউরােপ নয় নতুন আবিষ্কৃত পথ ধরে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সমকালীন মানুষের ভৌগােলিক দিগন্তও প্রসারিত হয়। আলেকজান্ডারের সৈন্যরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ভারত সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন তাতে ভারত তথা প্রাচ্য সম্পর্কে ভৌগােলিক ও অন্যান্য জ্ঞান পাশ্চাত্য দেশে বিস্তার লাভ করে। বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল আলেকজান্ডারের। ভারত অভিযানের ফলে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তার আলােকে সিন্ধু থেকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত বিভিন্ন নৌ ও সমুদ্র বন্দরের অনুসন্ধান চালাবার জন্য অভিজ্ঞ গ্রিক নিয়ারকাস এর নেতৃত্বে তিনি একটি অভিযাত্রী দল পাঠিয়েছিলেন। এরই পথ ধরে প্রাচ্য সম্পর্কে ইউরােপীয়দের জ্ঞান যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।

ভারতে লিখিত ইতিহাসের সূচনা : অন্যভাবে বিচার করলেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এই আক্রমণের গুরত্বকে অস্বীকার করা যায় না। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেকজান্ডারের পাঞ্জাব অভিযান প্রথম ঐতিহাসিক তারিখের সন্ধান দেয়। তাছাড়া তিনি শুধু সৈন্যসহ ভারতবর্ষে আসেন নি। তার সঙ্গে ঐতিহাসিকেরাও এসেছিলেন। তারা এই অভিযানের যে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন তা তৎকালীন ভারত ইতিহাসের অপরিহার্য উপাদানরূপে বিবেচিত হয়। সমকালীন ভারত সম্পর্কে তারা মনােজ্ঞ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। তাদের অনুকরণে পরবর্তীকালে আরও কয়েকজন গ্রিক ঐতিহাসিক ভারত সম্পর্কে বিবরণ রচনা করেন। তারা যে ধারার প্রবর্তন করেন পরবর্তী কালে মেগাস্থিনিসের রচনায় তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। আলেকজান্ডারের আক্ৰমণের সময় থেকে ভারতের লিখিত ইতিহাস শুরু হয়। এর পূর্বে ভারত ইতিহাসের কোন ঘটনার তারিখ এত স্পষ্ট জানা যায়নি। এর ফলে ভারতে মৌর্য রাজাদের সময়ানুক্রমিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়েছে। এজন্য আলেকজান্ডারের অভিযান ভারতের ইতিহাসে ‘sheet anchor’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। সুতরাং বলা চলে যে, এই ঘটনার সময় থেকে ভারত ইতিহাস প্রাগৈতিহাসিক যুগ অতিক্রমের পর ঐতিহাসিক যুগে প্রবেশ করে। তাই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় এই সকল গ্রিক ঐতিহাসিকদের বিবরণের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু একথাও স্মরণীয় যে, এসবের জন্য ভারতবর্ষকে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে। ম্যাসিডােনীয়দের শাণিত অস্ত্রে কত সহস্র প্রাণ অকালে ঝরে পড়েছে, কত সমৃদ্ধ জনপদ শ্মশানে পরিণত হয়েছে, কত না সম্পদ লুষ্ঠিত হয়েছে। গ্রিক ঐতিহাসিকরা আলেকজান্ডারকে যতই মহানুভব আখ্যা দিন না কেন, পরবর্তিকালে ভারতবর্ষের বুকে যারা নির্বিচারে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন, সেই সুলতান মাহ্‌মুদ, তৈমুরলঙনাদির শাহ’র সঙ্গেই তার তুলনা চলে। 

কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনা ও তাদের সম্ভাব্য তারিখ 

  • কুরুর আকিমেনীয় সিংহাসনে আরােহণ – ৫৪৪ খ্রি.পূ.
  • দারিউস কর্তৃক গান্ধার ও সিন্ধু বিজয় – প্রাক ৫১৮ খ্রি.পূ.  
  • প্রথম জারেক্সেসের  সিংহাসন লাভ – ৪৮৬ খ্রি.পূ. 
  • ভারতে পারসিক শাসনের অবসান – ৩৩০ খ্রি.পূ.
  • আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সূচনা – ৩২৭ খ্রি.পূ.
  • আলেকজান্ডারের সিন্ধু নদ অতিক্রম – ৩২৬ খ্রি.পূ. 
  • আলেকজান্ডার-পুরু সংঘর্ষ – মে বা জুলাই, ৩২৬ খ্রি.পূ. 
  • বিপাশা নদীর তীর থেকে আলেকজান্ডারের প্রত্যাবর্তন – জুলাই বা সেপ্টেম্বর, ৩২৬ খ্রি.পূ. 
  • আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগ – সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর, ৩২৫ খ্রি.পূ
  • আলেকজান্ডারের দেহান্তর – জুন, ৩২৩ খ্রি.পূ. 

গ্রন্থপঞ্জি 

  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে – প্রথম পর্ব, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ২০২০, পৃ. ২৬৩-২৮০
  • সুনীল চট্টোপাধ্যায়, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস – প্রথম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ১৫২-১৬৮
  • দিলীপ কুমার সাহা, মোল্লা আমীর হোসেন, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস : প্রাচীনকাল থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, সৌরভ প্রকাশনি, খুলনা, ২০১৬, পৃ. ৯৯ – ১১০
  • এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ, ভারত ইতিহাস : প্রাচীন যুগ, প্রতীক প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ১৩০-১৩৯
  • ব্ৰতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, টাকাকড়ি আবির্ভাবের যুগ
  • সমরেন্দ্রনাথ সেন : বিজ্ঞানের ইতিহাস (কলকাতা)
  • Chattopadhyaya, S. : The Achaemenids and India (Delhi 1974)
  • David Brainerd Spooner, The Zoroastrian period of Indian history, 1915
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1968).
  • Mortimer Wheeler, Early India and Pakistan: To Ashoka, 1959, Thames and Hudson (London)
  • Olmstead, A. T. : History of the Persian Empire (Chicago, 1940).
  • Rapson, E. J.(Ed.): The Cambridge History Of India, Vol. I (Delhi, 1968)
  • Ray, Priyadaranjan (Ed.): The Cultural Heritage Of India, Vol. VI (Calcutta, 1991)
  • Raychaudhuri, H.C. : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • H. C. RoyChowdhury, Political History of Ancient India
  • Vincent Arthur Smith, The Early History of India, from 600 B. C. to the Muhammadan conquest, (Oxford, 1924)
  • Vincent Arthur Smith, Oxford History of India
  • Tarn, W. W. : Alexander the Great, Vols. I-II (Cambridge, 1950). 
  • P. Ray ed. The cultural Heritage Of India, Vol. VII, Calcutta, 1991

সম্পর্কিত মানচিত্র-ভিত্তিক ভিডিও

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস

ভারতের ইতিহাস

আলেকজান্ডারের অভিযান

আলেকজান্ডারের অভিযান (২)

আলেকজান্ডারের ভারত অভিযান ও হাইডেসপাসের যুদ্ধ

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.