খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকের ভারত এবং মগধের উত্থান

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকের পুর্বে ভারতবর্ষে ছিল পরবর্তী বৈদিক যুগ (১১০০ – ৬০০ খ্রি.পূ.) ও তারও পূর্বে প্রাথমিক বৈদিক যুগ বা ঋগ্বৈদিক যুগ (১৫০০ – ১১০০ খ্রি.পূ.), এই সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে এখানে যান

Table of Contents

ষোড়শ মহাজনপদ

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের প্রারম্ভে ভারতে, বিশেষত উত্তর ভারতে, কয়েকটি শক্তিশালী রাজ্য গড়ে ওঠে। বৌদ্ধগ্রন্থ আঙ্গুত্তরনিকায় এবং জৈনগ্রন্থ ভগবতীসূত্রে এই রাজ্যগুলোকে ‘মহাজনপদ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গ্রন্থ দু’টিতে এরূপ ষােলােটি বা ষােড়শ মহাজনপদের উল্লেখ আছে। গ্রন্থ দুটিতে মহাজনপদের তালিকা কিন্তু এক নয়। অঙ্গুত্তরনিকায়ে অঙ্গ, মগধ, কাশী, কোসল, বৃজি, মল্ল, চেদি, বৎস, কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য, শূরসেন, অশ্বক বা অশ্যক, অবন্তি, গান্ধার ও কাম্বোজ রাজ্যগুলো ষােড়শ মহাজনপদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভগবতীসুত্রে মহাজনপদের তালিকায় অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, মলয়, মালব, অচ্ছ, বচ্ছ, কোচ্ছ, পঢ় (পাণ্ড বা পৌণ্ড ), লাঢ় (লাট বা রাঢ়), বজ্জি, মেলী, কাশী, কোসল, অবাহ ও স্যুত্তর রাজ্যের নাম আছে। আশ্বক বা অশ্মক রাজ্যটি ছাড়া অঙ্গুত্তর নিকায়ের বাকি রাজ্যগুলো সবই উত্তর ভারতের। কিন্তু ভগবতীসূত্রে উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলো ছাড়াও পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যেরও উল্লেখ আছে। ভগবতীসূত্রে বৃহত্তর ভারত প্রতিফলিত হয়েছে। অঙ্গুত্তরনিকায়ের তুলনায় ভগবতীসূত্রের তালিকা অর্বাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের রাজনৈতিক ইতিহাসের উপাদানরূপে অঙ্গুত্তরনিকায়ের গুরুত্ব ভগবতীসুত্রের থেকে অনেক বেশি। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দীঘনিকায়’, ‘চল্লনিদ্দেস’ ও ‘মহাবস্তু’ এবং পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’-তেও তখনকার রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক তথ্য নিহিত আছে।

কাশী : প্রথম দিকে ক্ষমতায় ও প্রতিপত্তিতে কাশী রাজ্যের স্থান ছিল সবার উপরে। রাজ্যের নাম যেমন কাশী, রাজধানীর নামও তেমনি কাশী। কাশী শহরের উত্তরে ও দক্ষিণে দু’টি নদী বরুণা ও অসি। তাই এর আর এক নাম বারাণসী। এক সময় কাশীর রাজারা খুবই শক্তিশালী হন এবং প্রতিবেশী কোসলের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করেন। এমনকী কাশীর রাজারা অঙ্গ ও মগধের রাজাদেরও পরাজিত করেন। গােদাবরী নদীর তীরে অশ্মক রাজ্যেও তারা সামরিক অভিযান পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কাশীর এ সৌভাগ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বুদ্ধের জন্মের কিছু পূর্বে রাজ্যটি কোসল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

কোসল : এখনকার ফৈজাবাদ-অযােধ্যাকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকালে কোসল রাজ্য গড়ে ওঠে। উত্তরে নেপাল থেকে দক্ষিণে সর্পিকা বা সাই নদী এবং পূর্বে সদানীরা বা গণ্ডক হতে পশ্চিমে। গােমতী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এ রাজ্যটি। সরযু নদী রাজ্যটিকে উত্তর ও দক্ষিণ এই দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে। শ্রাবস্তী ছিল উত্তরাঞ্চলের রাজধানী। দক্ষিণ অঞ্চলের রাজধানী ছিল কুশাবতী। শ্রাবস্তী ও কুশাবতী ছাড়া সাকেত নামে আরও একটি বড় শহর ছিল এ রাজ্যে। কাশী রাজ্য অধিগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে কোসলের প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কপিলবস্তুতে শাক্যরা রাজত্ব করতেন। এ রাজ্যটি কোসল অধিকার করে নেয়। ঠিক কখন কপিলবস্তু কোসল রাজ্যের অধিকারে চলে আসে তা বলা যায় না। প্রতিবেশী কেশপুত্র রাজ্যেও কোসলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজ্যটি সম্ভবত গােমতী নদীর অন্য তীরে অবস্থিত ছিল।

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রসেনজিৎ কোসলের সিংহাসন অলংকৃত করেন। এ রাজ্যের তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। বুদ্ধের সঙ্গে তার হৃদ্য সম্পর্ক ছিল। তবে তিনি স্বয়ং বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থে তার ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি অনুরাগের কাহিনি বিবৃত আছে। বৌদ্ধগ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে, প্রসেনজিৎ কপিলবস্তুর এক শাক্য কন্যার পাণিগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গােষ্ঠীর বাইরে শাক্যরা তাদের মেয়েদের বিবাহ দিতেন না। ফলে প্রসেনজিতের প্রস্তাব তাদের মনঃপুত হয়নি। অথচ প্রকাশ্যে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সাহসও তাদের ছিলনা। অভিজাত শাক্য মহানামার অবৈধ কন্যা বাসবক্ষত্রিয়ার সঙ্গে প্রসেনজিতের বিবাহ দিয়ে তারা সুকৌশলে সমস্যার সমাধান করেন। সংগত কারণেই বাসবক্ষত্রিয়ার আসল পরিচয় গােপন রাখা হয়। যথাসময় প্রসেনজিৎ ও বাসবক্ষত্রিয়ার বিড়ুড়ভ নামে এক পুত্র হয়। বড় হয়ে বিড়ডভ একবার মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে তার মার প্রকৃত পরিচয় জানতে পারেন। কথাটি প্রসেনজিতের কানে যায়। ক্রুদ্ধ প্রসেনজিৎ স্ত্রী ও পুত্রকে ত্যাগ করেন। কিন্তু পরে বুদ্ধের অনুরােধে তিনি তাদের সসম্মানে গ্রহণ করেন। প্রসেনজিৎ মগধরাজ অজাতশত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। অজাতশত্রুর পিতা বিম্বিসার প্রসেনজিতের ভগিনী কোসলাদেবীকে বিবাহ করে কাশীর এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল যৌতুকস্বরূপ পেয়েছিলেন। বিম্বিসারের মৃত্যু হলে প্রসেনজিৎ ভগিনীপতির মৃত্যুর জন্য অজাতশত্রুকে দায়ী করেন ও কাশী অঞ্চল কেড়ে নেন। প্রত্যুত্তরে অজাতশত্রু কোসল আক্রমণ করেন। মগধের সঙ্গে কোসলের দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলে। শেষ পর্যন্ত বিবদমান পক্ষ দুটির মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। প্রসেনজিৎ নিজ কন্যা বজিরার সঙ্গে অজাতশত্রুর বিবাহ দেন, জামাতাকে কাশী শহর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল যৌতুক দেন। 

প্রসেনজিতের শেষ জীবন সুখের হয়নি। পুত্র বিড়ুড়ভের সঙ্গে তার বনিবনা হত না। বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তিনি একবার কোসল ছেড়ে কপিলবস্তু যান। এ সুযােগে বিড়ুড়ভ মন্ত্রীদের সাহায্যে পিতার সিংহাসন অধিকার করেন। রাজ্যে ফিরে প্রসেনজিৎ দেখলেন সবাই তার বিপক্ষে। বিপদের দিনে জামাতা তাকে সাহায্য করবেন, এই আশায় অবসন্ন ও নিঃসঙ্গ প্রসেনজিৎ রাজগৃহ অভিমুখে যাত্রা করেন। প্রচণ্ড শীতের রাতে রাজগৃহে পৌঁছে তিনি দেখেন নগরদ্বার অবরুদ্ধ। সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন প্রসেনজিৎ। শাক্যদের বিশ্বাসঘাতকতা বিড়ুড়ভ কোনও দিনই ভুলতে পারেননি। সিংহাসনে বসেই তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে শাক্যদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা হল। শাক্যদের মধ্যে কেউ কেউ পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। শাক্যদের যখন নিধনপর্ব চলছে শাক্যসিংহ বুদ্ধ তখনও জীবিত। বিড়ুড়ভ কতদিন রাজত্ব করেন বা তার অন্য কৃতিত্বই বা কী তা আমরা জানি না। সম্ভবত তার মৃত্যুর পর কোসলে মগধের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

অঙ্গ : অঙ্গ রাজ্য ঝাড়খণ্ডের দেওঘর এবং বিহারের মুঙ্গের ও ভাগলপুর জেলায় অবস্থিত ছিল। অঙ্গের পশ্চিম সীমান্তে মগধ রাজ্য আর উত্তরে গঙ্গা নদী। রাজ্যের রাজধানী চম্পা। গঙ্গা ও চম্পা বা চন্দন নদীর সঙ্গমে অবস্থিত এ শহরটির পূর্বনাম মালিনী। দীঘনিকায়ে ভারতের ছয়টি প্রধান শহরের মধ্যে চম্পাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্য প্রধান শহরগুলো হল রাজগৃহ, শ্রাবস্তী, সাকেত, কৌশাম্বী ও বারাণসী। প্রথম দিকে অঙ্গ খুবই শক্তিশালী ছিল। মহাভারত ও বৌদ্ধগ্রন্থাদিতে গয়া ও রাজগৃহকে অঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ শহর দু’টি মগধে অবস্থিত। তাই মনে হয়, অঙ্গের পরাক্রান্ত রাজারা এক সময় মগধ অধিকার করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে অঙ্গের রাজা ছিলেন ব্রহ্মদত্ত। মগধের যুবরাজ তাকে পরাজিত করে অঙ্গ রাজ্য অধিকার করেন।

বৎস : বর্তমান এলাহাবাদ অঞ্চলে প্রাচীন বৎস রাজ্য অবস্থিত ছিল। রাজ্যের রাজধানী ছিল কৌশাম্বী। এলাহাবাদের নিকটবর্তী বর্তমান কোসাম গ্রাম প্রাচীন কৌশাম্বীর স্মৃতি এখনও বহন করছে। বৎস রাজপরিবার প্রাচীন কুরু বংশেরই এক শাখা। কৌশাম্বী ও সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে বশ রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই রাজ্যটি পরবর্তিকালে বৎস নামে পরিচিত হয়। পুরাণে বলা হয়েছে, গঙ্গার প্লাবনে হস্তিনাপুর বিধ্বস্ত হলে কুরুরাজ নিচক্ষুর কৌশাম্বীতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। এবং তখন থেকে নিচক্ষুর অধরেরা পুরুষ পরম্পরায় বৎস রাজ্যে রাজত্ব করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উদয়ন কৌশাম্বীতে রাজত্ব করেন। মহাকবি ভাসের স্বপ্নবাসবদত্তা ও প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ নাটকে তাকে ভারতবংশীয় বলা হয়েছে। উদয়ন সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে নানা চিত্তাকর্ষক কাহিনির বর্ণনা আছে। শােনা যায়, উদয়নের সৌভাগ্যে অবন্তিরাজ প্রদ্যোত ঈর্ষান্বিত হন। সম্মুখযুদ্ধে তাকে পরজিত করা অসম্ভব জেনে তিনি কৌশলে উদয়নকে বন্দি করার ষড়যন্ত্র করেন। পরিকল্পনামতাে প্রদ্যোত একটি কাঠের হাতি নির্মাণ করে সেটিকে বৎস রাজ্যের সীমানার কাছে রেখে দিলেন। হাতির ভিতর ৬০ জন সশস্ত্র সৈন্য আত্মগােপন করে রইলেন। একদিন হাতি শিকারে বের হয়ে উদয়ন প্রদ্যোতের ফাঁদে ধরা পড়েন। শত্রুসৈন্যরা তাকে বন্দি করে প্রদ্যোতের কাছে নিয়ে আসেন।  হস্তিচালনায় উদয়নের অসামান্য দক্ষতার কথা প্রদ্যোতের অজানা ছিল না। তিনি বললেন, উদয়নকে তিনি মুক্তি দেবেন কিন্তু প্রতিদানে উদয়ন তাকে হস্তিচালনার কলাকৌশল শেখাবেন। উদয়ন এ প্রস্তাবে রাজি হলেন কিন্তু শর্ত আরােপ করলেন, প্রদ্যোতকে ছাত্রসুলভ নম্র আচরণ করতে হবে। প্রদ্যোত বললেন, তিনি নিজে শিখবেন না কিন্তু তার পরিবর্তে অন্য একজন শিখবেন। সে ব্যক্তি অবশ্যই উদয়নকে গুরুর সম্মান দেবেন। এ গুপ্তবিদ্যা রাজপরিবারের বাইরের কেউ জানুক, প্রদ্যোত তা চাইলেন না। তাই কন্যা বাসবদত্তাকেই তিনি সে কাজের জন্য মনােনীত করলেন। কিন্তু বাসবদত্তার পরিচয় গােপন রেখে তিনি উদয়নকে বলে পাঠালেন, পর্দার আড়ালে থেকে এক কুজী হক্তিচালনা শিখবেন। কিন্তু বাসবদত্তার পরিচয় উদয়নের কাছে গােপন রইল না। তারা পরস্পরের প্রতি অনুরাগী হলেন। শেষে একদিন অবন্তি থেকে পালিয়ে তারা কৌশাম্বীতে এসে উপস্থিত হন। সেখানে তাদের বিবাহ হয়। বাসবদত্তা বৎস রাজ্যের মহিষী হন। 

সংস্কৃত সাহিত্যে উদয়ন এক বহু পরিচিত নাম। ভাসের স্বপ্নবাসবদত্তা আর হর্যের প্রিয়দর্শিকা ও রত্নাবলী নাটকে তারই নাম ভূমিকা। কালিদাসের মেঘদূত ও সােমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর’-এ তার সপ্রশংস উল্লেখ আছে। প্রথম জীবনে উদয়ন বৌদ্ধদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। শােনা যায়, তিনি বৌদ্ধশ্রমণ পিণ্ডোলকে নির্যাতন করেন। শেষে এই পিণ্ডোলকেই গুরুরূপে বরণ করে তার কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন। উদয়নের মৃত্যুর পর কে কৌশাম্বীর রাজা হন তা জানা যায় না। বৌদ্ধগ্রন্থাদিতে বােধি নামে তার এক পুত্রের উল্লেখ আছে। কিন্তু তিনি রাজপদ গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। শেষে বৎস রাজ্য মগধের অধিকারভুক্ত হয়।

কুরু : দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে কুরু রাজ্য গঠিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে কুরু রাজ্যের রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ। বুদ্ধের সময় রাজ্যটির রাজনৈতিক গৌরবের আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। কোরব্য নামে এক দুর্বল রাজা তখন সেখানে রাজত্ব করতেন। প্রথমে এ রাজ্যে রাজতন্ত্র ছিল কিন্তু পরে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। কুরু রাজ্যটি গড়ে ওঠে ভরত ও পুরু এই দু’টি বিখ্যাত জনগােষ্ঠীর সংমিশ্রণে। তৃৎসুরাও সম্ভবত এই দুটি উপজাতির সঙ্গে মিশে যান। অথর্ববেদে পরীক্ষিৎ নামে এক পরাক্রান্ত কুরুরাজের উল্লেখ আছে। এই রাজ্যের আর এক রাজা জন্মেজয়। তিনি পরীক্ষিতের বংশধর।

পাঞ্চাল : উত্তরপ্রদেশের বেরিলী-বুদাউন-ফরাক্কাবাদ অঞ্চলে পাঞ্চাল রাজ্য অবস্থিত ছিল। রাজাটি দক্ষিণে চম্বল নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গঙ্গা নদী রাজ্যটিকে উত্তর পাঞ্চাল ও দক্ষিণ পাঞ্চাল এই দুটি প্রদেশে বিভক্ত করেছে। মহাভারত, দিব্যাবদান ও জাতকে পাঞ্চালের দুই প্রদেশের উল্লেখ আছে। অহিচ্ছত্র (বেরিলী জেলার বর্তমান রামনগর) ছিল উত্তর অঞ্চলের রাজধানী, কাস্পিল্য (ফারুখাবাদ জেলার বর্তমান কামপিল) দক্ষিণ অঞ্চলের। পাঞ্চাল রাজ্যের আর একটি বিখ্যাত শহর কান্যকুব্জ (বর্তমান কনৌজ)। পূর্বে এ রাজ্যে রাজতন্ত্র ছিল কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক নাগাদ এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। তুর্বশ ও ক্রিবি এই দু’টি জনগােষ্ঠীর মিলনে পাঞ্চাল রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। উপনিষদে প্রবাহণ জৈবলি নামে পাঞ্চালের এক দার্শনিক রাজার উল্লেখ আছে। 

মৎস্য : রাজস্থানের জয়পুর, আলােয়ার ও ভরতপুর অঞ্চলে মৎস্য রাজ্য গড়ে ওঠে। প্রাচীন বিরাটনগর বা জয়পুরের নিকটস্থ বৈরাট ছিল এ রাজ্যের রাজধানী। মৎস্য এক সময় প্রতিবেশী চেদি রাজ্যের পদানত হয়। মহাভারতে রাজা সহজের উল্লেখ আছে। মৎস্য ও চেদি উভয় অঞ্চলেরই তিনি রাজা ছিলেন। মৎস্য রাজ্যটি পরবর্তিকালে মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখ্য, বৈরাটে সম্রাট অশােকের অনুশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে।

শূরসেন : মথুরা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে ছিল শূরসেন রাজ্য। রাজ্যের রাজধানী মধুরা বা মথুরা যমুনার তীরে অবস্থিত। বুদ্ধের সময় অবন্তিপুত্র নামে এক রাজা এখানে রাজত্ব করতেন। তিনি বুদ্ধের ভক্ত ছিলেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় এ অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের দ্রুত প্রসার হয়। অবন্তিপুত্র নাম থেকে মনে হয়, শূরসেন ও অবন্তির রাজপরিবার দু’টির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। মথুরার রাজারা যদু বা যাদববংশীয় ছিলেন। যাদবেরা বীতিহােত্র, সাত্বত ইত্যাদি কয়েকটি শাখায় বিভক্ত ছিলেন। সাত্বত শাখার আবার দৈবাবৃধ, অন্ধক, মহাভােজ ও বৃষ্ণি এই চারটি প্রশাখা। শেষে এ অঞ্চলে মগধের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

অশ্মক বা অশ্বক : গােদাবরী নদীর তীরে অশ্মক বা অশ্বক রাজ্য অবস্থিত। এর রাজধানী পােতলি, মতান্তরে পােতন বা পােদন। অন্ধপ্রদেশের বর্তমান বােধন সম্ভবত প্রাচীন পােতলি। সােননন্দ জাতকে অশ্মক ও অবন্তিকে দু’টি প্রতিবেশী রাজ্য বলা হয়েছে। অনুমান করা যায়, কখনও কখনও অশ্মক রাজ্য উত্তরে অবন্তি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বায়ু-পুরাণ থেকে জানা যায়, ইক্ষ্বাকুদের এক শাখা অশ্মকে রাজত্ব করতেন। অশ্বক জাতকে বলা হয়েছে, অঞ্চলটি এক সময় কাশী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। চুল্লকালিঙ্গ জাতকে অরুণ নামে অশ্মকের এক রাজার উল্লেখ আছে। মন্ত্রী নন্দিসেনের সাহায্যে তিনি কলিঙ্গ জয় করেছিলেন বলে জানা যায়। স্মরণ করা যেতে পারে, পাণিনি ও মেগাস্থিনিস প্রমুখ প্রাচীন লেখকরাও এক অশ্মক রাজ্যের উল্লেখ করেছেন। সে অশ্বক আর মহাজনপদ অশ্মক কিন্তু এক রাজ্য নয়। প্রথমােক্ত রাজ্যটি উত্তর-পশ্চিম ভারতের স্বাট অববাহিকায় অবস্থিত ছিল। 

অবন্তি : মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী ও বিদিশা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে অবন্তি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। রাজ্যের রাজধানী উজ্জয়িনী। উজ্জয়িনী ছাড়া এ রাজ্যে বিদিশা, মাহিষ্মতী ও দর্শার্ণ নামে আরও কয়েকটি বিখ্যাত শহর ছিল। যে গ্রামটি এতদিন পর্যন্ত বেসনগর নামে পরিচিত ছিল এবং বর্তমানে যার বিদিশা নামকরণ হয়েছে সেই গ্রামটিই ঐতিহ্যমণ্ডিত বিদিশা। কিন্তু মাহিষ্মতী ও দর্শার্ণের প্রকৃত অবস্থান অনিশ্চিত। অনেকের মতে প্রাচীন মাহিষ্মতী ও বর্তমান মান্ধাতা এক ও অভিন্ন। বিদিশা ও দশর্ণ এক, এরূপ মতও আছে। তবে এ সকল মত বিতর্কিত। এ রাজ্যে পূর্বে বীতিহােত্রবংশীয় রাজারা রাজত্ব করতেন। কিন্তু পরে পুলিক নামে এক অমাত্য তাদের উচ্ছেদ করে নিজ পুত্র প্রদ্যোতকে অবন্তির সিংহাসনে বসান। প্রদ্যোতের পুরাে নাম চণ্ড প্রদ্যোত মহাসেন। বুদ্ধের সমসাময়িক তিনি। শক্তিতে ও প্রতিপত্তিতে তিনি তখনকার দিনের শ্রেষ্ঠ রাজাদের একজন। কৌশাম্বীরাজ উদয়ন তার জামাতা, কিন্তু তারা পরস্পরের শত্রু। শােনা যায়, তিনি মগধ অভিযানের পরিকল্পনা করেন। তার আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মগধরাজ আত্রাতশত্রু তার রাজধানী রাজগৃহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেন। পুরাণ থেকে জানা যায়, প্রদ্যোত ২৩ বছর রাজত্ব করেন। তার মৃত্যুর পর পালক, বিশাখযূপ, অজক ও নন্দিবর্ধন ক্রমান্বয়ে অবন্তির সিংহাসনে আরােহণ করেন। পুরাণে আছে, তারা যথাক্রমে ২৪. ৫০, ২১ ও ২০ বছর রাজত্ব করেন। নন্দিবর্ধনের সময় মগধরাজ শিশুনাগ অবন্তি আধিকার করেন।

গান্ধার : পাকিস্তানের পেশােয়ার রাওয়ালপিণ্ডি অঞ্চলে গান্ধার রাজ্য গড়ে ওঠে। গান্ধারের রাজধানী তক্ষশিলা। শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্ররূপেও শহরটির অসামান্য খ্যাতি ছিল। সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চলও কখনও কখনও গান্ধার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ তথ্য রামায়ণের (সিন্ধোরুভয়তঃ পার্শ্বে)। সে কালের বিখ্যাত পুষ্কলাবতী শহরটি সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে গান্ধারের রাজা ছিলেন পুক্কুসাতি বা পুষ্করসারী। মগধরাজ বিম্বিসার তার বন্ধু ছিলেন। বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ তিনি মগধরাজকে একখানি চিঠি লেখেন ও তার দরবারে দূত পাঠান। বৌদ্ধসূত্রে বলা হয়েছে, তিনি অবন্তিরাজ প্রদ্যোতকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। গান্ধার রাজ্যের সৌভাগ্য অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পারস্যের পরাক্রান্ত হখামনিষীয় বা আকিমেনীয় রাজা দারয়বৌষ বা দারিউস (৫২২-৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) শীঘ্রই এ অঞ্চল অধিকার করেন। আনুমানিক ৫২০-১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে উৎকীর্ণ তার বেহিস্তুন লেখে গান্ধারকে পারসিক সাম্রাজ্যের এক প্রদেশরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

কাম্বােজ বা কম্বােজ : প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে কাম্বােজ বা কম্বােজকে সাধারণত গান্ধারের প্রতিবেশী রাজ্যরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কম্বােজের প্রকৃত অবস্থান কোথায় সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেকেই রাজ্যটি পুঞ্চ-রাজৌলি অঞ্চলে অবস্থিত বলে মত প্রকাশ করেছেন। (R. C. Majumdar (Ed.), The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1960)। হিন্দুকুশ পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্বে কাবুল-বেগ্রাম অঞ্চলই প্রাচীন কম্বােজ এমন মতও পােষণ করা হয়। (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, টাকাকড়ি আবির্ভাবের যুগ (কলকাতা, ১৩৯৯), পৃ. ৬৩)। তবে শেষােক্ত অঞ্চল কাপিশ নামেই বেশি পরিচিত ছিল। কাপিশ ও কম্বােজ বলতে এক ও অভিন্ন অঞ্চল বােঝায় কিনা তা ভাবার বিষয়। প্রথমে রাজতান্ত্রিক রাষ্টরূপে আবির্ভাব ঘটলেও পরে গণরাজ্যরূপে কম্বােজের অভ্যুদয় হয়। 

চেদি বা চেতি : গঙ্গার দক্ষিণে ও এলাহাবাদের পশ্চিমে চেদি বা চেতি রাজ্য। রাজ্যের রাজধানী শুক্তি বা শুক্তিমতী। রাজ্যের আর একটি বিখ্যাত শহর সহজাতি। শহরটি সম্ভবত যমুনা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে এ রাজ্যটির তেমন কোনও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল না। পরে এটি মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। চেদিদের এক শাখা ওড়িশায় এবং আর এক শাখা নেপালে বসতি স্থাপন করে।

মগধ : মহাজনপদগুলোর মধ্যে যে রাজ্যটি কালক্রমে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, অন্য মহাজনপদগুলোকে গ্রাস করে এক সুবিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে, সেটি মগধ। গৌরবের শীর্গে পৌঁছতে মাগধকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। পথ শুধু দীর্ঘই ছিল না, পথ ছিল দুর্গম, রুক্ষ ও কণ্টকাকীর্ণ। মগধের অভ্যুত্থানের সেই রােমাঞ্চকর কাহিনি পরে বর্ণনা করা হবে

বৃজি : ৮টি বা ৯টি গণরাজ্য নিয়ে বৃজি রাষ্ট্রসংঘ গঠিত ছিল। এ রাজ্যগুলো মােটামুটিভাবে নেপালের দক্ষিণ ও পশ্চিমে, গঙ্গার উত্তরে এবং মল্ল রাজ্যের পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। রাজ্যগুলোর মধ্যে বিদেহ, লিচ্ছবি, জ্ঞাতৃক ও বৃজিই ছিল প্রধান। উগ্র, ভর্গ, ইক্ষ্বাকু ও কুরুকে অনেকে বৃজি রাষ্ট্রসংঘের বাকি সদস্য রাষ্ট্র বলে সনাক্ত করেছেন। কিন্তু এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। রাজ্যগুলোর সব কটিই যে প্রথম থেকে গণরাজ্য ছিল তা নয়। বিদেহ রাজ্যটি যে প্রথমে রাজতান্ত্রিক ছিল তার তাে প্রমাণই আছে। মনে হয়, রাজশক্তির দুর্বলতার সুযােগে সেখানে রাষ্টীয় ক্ষমতা অভিজাত সম্প্রদায়ের কুক্ষিগত হয়। বৃজি রাষ্ট্রসংঘের রাজধানী বৈশালী। বৈশালী আবার লিচ্ছবি রাজ্যের রাজধানী। বিহারের বর্তমান বৈশালী জেলায় এটি অবস্থিত। কিছুদিন পূর্বেও স্থানটি বসার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন বৈশালী নামেই এর প্রসিদ্ধি। উত্তর বিহারে বিদেহ অবস্থিত ছিল। বিদেহের রাজধানী মিথিলা। শহরটি নেপালের জনকপুরে অবস্থিত। লিচ্ছবি রাষ্ট্রের সংলগ্ন ছিল জ্ঞাতৃক রাষ্ট্র। কুণ্ডপুর বা কুণ্ডগ্রাম ও কোল্লাগ এ রাজ্যের দুটি প্রধান শহর। শহর দু’টি বৈশালীর খুবই নিকটবর্তী ছিল। বৃজি রাষ্ট্রের দুটি প্রধান শহর বৃজিগ্রাম ও উক্কাচেলা। প্রথমটি বৈশালীর নিকট এবং দ্বিতীয়টি গঙ্গা নদীর উত্তর কূলে অবস্থিত ছিল। লিচ্ছবিরা বিদেশি ছিলেন বলে অনেক পণ্ডিত অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ অভিমতের বিরুদ্ধবাদীদের সংখ্যাও বড় কম নয়। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে লিচ্ছবিদের ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। মনু লিচ্ছবিদের ব্রাত্য রাজন্য বা পতিত ক্ষত্রিয় বলে নিন্দা করেছেন। মনে হয়, লিচ্ছবিরা ক্ষত্রিয়ই ছিলেন। কিন্তু পরে তাদের ব্রাহ্মণ্য আচার-অনুষ্ঠান বর্জন এবং বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য তাদের নিন্দা করা হয়েছে। বুদ্ধ কিন্তু লিচ্ছবিদের তাদের ঐক্য, তেজস্বিতী মহানুভবতা ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। 

কোসলরাজ প্রসেনজিতের সঙ্গে লিচ্ছবিদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। প্রতিবেশী মল্লদের সঙ্গেও তাদের সদ্ভাব ছিল। মগধরাজ বিম্বিসারের সঙ্গে প্রথম দিকে লিচ্ছবিদের সম্পর্ক ভালাে ছিল না। লিচ্ছবিরা বিম্বিসারের রাজ্য আক্রমণও করেছিলেন। কিন্তু পরে উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। জৈনগ্রন্থ নিরয়াবলীসূত্র থেকে জানা যায়, বিম্বিসার অভিজাত লিচ্ছবি চেটকের কন্যা চেল্লনা বা বৈদেহীকে বিবাহ করেন। অনেকের মতে, চেল্লনা ও বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু । অজাতশত্রু যে লিচ্ছবিদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন, তা অবশ্য অনেকে স্বীকার করেন না। অজাতশত্রুর সিংহাসনে আরােহণের সঙ্গে সঙ্গে আবার মগধের সঙ্গে লিচ্ছবি রাজ্যের সংঘর্ষ দেখা দেয়। এই সংঘর্ষ সম্পর্কে বুদ্ধ তার শিষ্য আনন্দকে বলেছিলেন, যতদিন পর্যন্ত লিচ্ছবি তথা বৃজিরা তাদের পুরানাে রীতি নীতি বিসর্জন না দেবেন, যথাবিধি প্রতিনিধিসভার পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ডাকবেন, সভার অধিবেশনে ও শাসন পরিচালনায় ঐক্যবদ্ধ থাকবেন, দেশের নিয়ম-কানুন আমূল পরিবর্তন না করবেন, দেশের ঐতিহ্য, বয়ােজ্যেষ্ঠ ও সনাতন প্রতিষ্ঠানাদির প্রতি সশ্রদ্ধ থাকবেন, ততদিন অজাতশত্রু কেন, কোনও পরাক্রান্ত রাজাই তাদের স্বাধীনতা হরণ করতে পারবেন না। কিন্তু অজাতশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় লিচ্ছবি তথা বৃজিরা তাদের ঐক্য বজায় রাখতে পারেননি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন ঠিকই কিন্তু ঐক্যের অভাবে শেষ পর্যন্ত অজাতশত্রুর কাছে তাদের হার মানতে হয়। 

মল্ল : প্রতি রাষ্ট্রসংঘেরই এক প্রতিবেশী রাষ্ট্র মল্ল। রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে আবির্ভাব ঘটলেও পরে গণরাজ্যরূপে মল্লের অভ্যুদয় হয়। রাজ্যের দুটি প্রধান শহর – কুসিনারা বা কুশাবতী ও পাবা। গোরক্ষপুর শহরের প্রায় ৫০ কি. মি. পূর্বে গণ্ডক নদীর তীরে একটি গ্রাম কাসিয়া। এটিই প্রাচীন কুসিনারা। পাবা শহরটির অবস্থান সম্পর্কে দুটি মত বিদ্যমান। একটি মতে, এটি বর্তমান পাদারাওনা, অন্য মতে শহরটি আধুনিক ফাজিলপুর। দু’টি স্থানই কাসিয়ার সন্নিকটে। বুদ্ধের সময় মল্ল রাজ্যটি যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রতিবেশী লিচ্ছবিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব একায় মল্লদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। অবশ্য লিচ্ছবিদের সঙ্গে কখনও কখনও তাদের সংঘর্ষও বেঁধে যেত। ভদ্দসাল জাতকে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে এরূপ সংঘর্ষের উল্লেখ আছে। মগধরাজ বিম্বিসার তানেক রাজ্য জয় করেছেন কিন্তু মল্ল অধিকার করেননি। বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুর আমলে মল্ল সম্ভবত মগধ রাজ্যের আনুগত্য স্বীকার করে। লিচ্ছবিদের মতাে মল্লদের মনু ব্রাত্য বা পতিত ক্ষত্রিয় বলে নিন্দা করেছেন।

আরও কয়েকটি গণরাজ্য : বৃজি রাষ্ট্রসংঘভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলো ও মল্ল ছাড়া সে যুগে আরও কয়েকটি গণরাজ্য গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে শাক্য, কোলিয়, ভর্গ, বুলি, কালাম ও মােরিয় রাজ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। উত্তরে হিমালয়, পূর্বে রােহিণী এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমে রাপ্তী, এই চার সীমানার মধ্যে ছিল শাক্য রাজ্য। রাজ্যের রাজধানী কপিলবস্তু। কপিলবস্তুরই কাছে বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনীগ্রাম। নেপালের তরাই অঞ্চলের তিলৌরাকোট গ্রামই সম্ভবত প্রাচীন কপিলবস্তু বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। লুম্বিনীগ্রামের বর্তম নাম রুম্মিনদেঈ। কোসলরাজ মহাকোসল বা তার পুত্র প্রসেনজিৎ শাক্য রাজ্য অধিকার করেন। পরে প্রসেনজিতের পুত্র বিড়ূড়ভ শাক্যদের সমূলে উচ্ছেদ করেন। রােহিণী নদীর অপর পাড়ে কোলিয় গণরাজ্য। রামগ্রাম ও দেবদহ এ রাজ্যের দুটি প্রধান শহর। কোলিয় ও শাক্যরা চাষ-আবাদের কাজে রােহিণী নদীর জল ব্যবহার করতেন। নদীর জলের বণ্টন নিয়ে দুই গােষ্ঠীর মধ্যে প্রায়ই বিরােধ লাগত। একবার বুদ্ধের হস্তক্ষেপে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরােধের নিষ্পত্তি হয়।

যমুনা ও শােণ নদের মধ্যবর্তী স্থানে ভর্গ রাজ্য অবস্থিত ছিল। সুংসুমার পাহাড়ের গায়ে ছিল রাজ্যের রাজধানী। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বৎসরাজ উদয়ন ভর্গ রাজ্য অধিকার করেন ও পুত্র বােধির হাতে বিজিত রাজ্যের শাসনভার অর্পণ করেন। মােরিয় গণরাজ্যের রাজধানী পিপ্পলীবন। বর্তমান গােরক্ষপুরের নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে শহরটি অবস্থিত ছিল বলে মনে হয়। বুলি গণরাজ্যের রাজধানী অল্লকম্প। কালাম রাজ্যের রাজধানী কেসপুত্ত। রাজ্যটি পরে কোসলের অধিকারভুক্ত হয়। অল্লকম্প ও কেসপুত্তের অবস্থান এখনও জানা যায় না। এগুলো ছাড়া আরও কয়েকটি গণরাজ্য ছিল। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে এদের উল্লেখ আছে। এগুলো হল ক্ষুদ্রক, অম্বষ্ঠ, হস্তিনায়ন, প্রকণ্ব, মদ্র, মধুমন্ত, আপ্রীত, বসাতি, শিবি, অশ্বায়ন ও অশ্বকায়ন। এসব রাজ্য আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে অবস্থিত ছিল। আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের আলোচনায় এগুলোর কয়েকটির বিবরণ দেয়া হবে।

দক্ষিণ ভারত : যেসব রাজ্যের কথা এতক্ষণ আলােচনা করা হল একটি বাদে তাদের সব কটিই উত্তর ভারতে অবস্থিত। বিন্ধ্যের দক্ষিণে যে রাজ্যটির অবস্থান ছিল সেটি অশ্মক। অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও কেরল নিয়ে যে দক্ষিণ ভারত সেখানে এই পর্বে কোনও যথার্থ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়নি। এটা অঞ্চলের অধিবাসীরা তখনও উপজাতীয় স্তরেই থেকে যান, বিশেষ বিশেষ ভূখণ্ডে রাজনৈতিক শক্তিরূপে তারা আত্মপ্রকাশ করেননি। পশুচারণ ও কৃষিই ছিল তাদের প্রধান বৃত্তি। কৃষির উৎপাদন যা হত তাতে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়তাে কোনও রকমে হত কিন্তু উদ্বৃত্ত বিশেষ কিছু থাকত না। লােকদের প্রাচুর্য ছিল না ঠিকই কিন্তু মােটামুটি একটা সাম্যভাব বজায় ছিল। কিন্তু যখন কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটল তখন সমাজে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দেখা দিল, আইন-শৃঙ্খলা ঘটিত সমস্যার উদ্ভব হল। রাষ্ট্রের উদ্ভবের অনুকূল বাতাবরণ সৃষ্টি হল। দক্ষিণ ভারতে এটি ঘটল খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে। এখানে একটা কথা বলার আছে। দক্ষিণ ভারতে উৎখননের কাজ খুব একটা এগােয়নি। উৎখননা ব্যাপক হলে এই অঞ্চলে রাষ্ট্র উদ্ভবের ছবিটি হয়তাে সুস্পষ্ট হবে।

মহাজনপদসমূহের অবস্থান (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ)

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা

রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র

রাজা : এই যুগের বেশির ভাগ রাষ্ট্রই রাজতান্ত্রিক। রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজাই যে কর্ণধার তা বলা বাহুল্য। রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক। পূর্ববর্তী রাজা তার উত্তরাধিকারীকে মনােনীত করে যেতেন। সাধারণত পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্রই সিংহাসনে আরােহণ করতেন। রাজপুত্র তার পিতাকে পদচ্যুত করে রাজপদ দখল করেছেন এমন ঘটনাও কখনও কখনও ঘটত।

আমলাতন্ত্র : রাজার একার পক্ষে রাজ্য পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। এর জন্য তিনি কর্মচারী নিয়ােগ করতেন। প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে সর্বার্থক মহামাত্র, সেনানায়ক মহামাত্র, ব্যবহারিক মহামাত্র, রঞ্জুগ্রাহক অমাত্য, দ্রোণমাপক মহামাত্র প্রভৃতি কর্মচারীর উল্লেখ আছে। সাধারণ প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন সর্বার্থক মহামাত্র। সামরিক বিভাগের ভার ছিল সেনানায়ক মহামাত্রের উপর। জমি জরিপের তদারক করতেন রজ্জুগ্রাহক অমাত্য। দ্রোণমাপক মহামাত্রের কাজ ছিল রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করা। গ্রাম প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে যিনি ছিলেন তার পদবি ছিল গ্রামভােজক, গ্রামকূটক বা গ্রামণী। গ্রামের শান্তি বজায় রাখা ছাড়া রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ছিল তার। গ্রামণীদের সঙ্গে রাজার ঘনিষ্ঠ সংযােগ ছিল। শােনা যায়, মগধরাজ বিম্বিসার একবার পরামর্শের জন্য তার রাজ্যের আশি হাজার গ্রামণীর এক সভার আয়ােজন করেছিলেন।

বিচার-ব্যবস্থা : বিচার বিভাগের কর্তৃত্বে যিনি ছিলেন তাকে ব্যবহারিক মহামাত্র বলা হত। শাস্তির বিধান তখন একটু কঠোরই ছিল। চাবুক মারা, গায়ে গরম লােহার ছেকা দেওয়া, অঙ্গহানি করা, জিহ্বা কর্তন করা, কারারুদ্ধ করা ইত্যাদি নানা ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।

রাজস্ব : রাজপরিবারের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রা এবং সৈন্যবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের ভরণপােষণের জন্য অর্থের প্রয়ােজন ছিল। এই অর্থ আসত রাজস্ব থেকে। কৃষির উৎপাদনের একটা অংশ রাজা গ্রহণ করতেন। একে ‘ভাগ’ বলা হত। উৎপন্ন শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ গ্রহণ করতেন বলে রাজাকে ‘ষড়ভাগী’ বলা হত। শিল্পী-বণিকদের কাছ থেকে তিনি শুল্ক আদায় করতেন। তাছাড়া বলি নামে একটি কর তাে ছিলই। বনভূমি ও স্বত্বহীন সম্পত্তি রাজা অধিগ্রহণ করতেন।

রাজার শক্তিবৃদ্ধি : মােট কথা, এ সময় রাজার ক্ষমতা উল্লেখজনকরূপে বৃদ্ধি পায়। সৈন্যবাহিনী ও আমলাতন্ত্র ছিল রাজশক্তির দুই প্রধান স্তম্ভ। ‘ভাগ’, ‘বলি’ ও ‘শুল্ক’ রূপে রাজ্যের সম্পদের একটা বিরাট অংশ রাজভাণ্ডারে বা রাজকোষে জমা পড়ত। রাজ্য পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিত্বের কোনও অবকাশ ছিল না। গ্রামণী হয়তাে জনগণের প্রতিনিধি ছিলেন কিন্তু ক্রমবর্ধমান রাজশক্তিকে প্রতিহত করার ক্ষমতা তার ছিলনা।

সঙ্ঘ বা গণরাষ্ট্র

সে যুগে রাজতান্ত্রিক রাজ্য যেমন ছিল তেমনি ‘সংঘ’ বা ‘গণ’ নামে অরাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও ছিল। বৃজি, মল্ল, শাক্য, কোলিয়, ভল্ল, মােরিয় ও লিচ্ছবিরা এই ধরনের অরাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই রাষ্ট্রগুলোকে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট বলা চলে না। গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের হাতেই রাষ্ট্রের শাসনভার থাকে। সেখানে জাতিধর্মনির্বিশেষে ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই প্রতিনিধি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু বৃজি, মল্ল, শাক্য ও লিচ্ছবির যে রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন সেই রাষ্ট্রে অভিজাত ক্ষত্রিয়দেরই মুখ্য ভূমিকা ছিল। তারাই রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনা করতেন। সেখানে ব্রাহ্মণ, গৃহপতি ও অন্যান্য বর্ণ ও জাতির লােকেরা উপেক্ষিতই ছিলেন বলা চলে। সেদিক থেকে বিচার করলে এই রাজ্যগুলোকে ক্ষত্রিয় অভিজাততন্ত্র আখ্যা দেওয়া যায়।

সংঘমুখ্য : এই সকল গণ বা সংঘরাষ্ট্রে একজন করে সভাপতি বা মুখ্য প্রশাসক ছিলেন। তাকে ‘গণপতি’, ‘গণজ্যেষ্ঠ’, ‘গণরাজ’ বা ‘সংঘমুখ্য’ বলা হত। সম্ভবত প্রতিনিধি সভা বা পরিষদের মুখগরিষ্ঠের সমর্থনে নির্দিষ্ট এক মেয়াদে তিনি স্বপদে নির্বাচিত হতেন। প্রতিনিধি সভায় যে সকল প্রস্তাব গৃহীত হত সভাপতি বা মুখ্য প্রশাসকের ওপর তা রূপায়ণের ভার ছিল।

কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পরিষৎ : সভাপতি বা মুখ্য প্রশাসক নন, প্রতিনিধি সভা বা পরিষদের হাতেই রাষ্ট্রের প্রকৃত কর্তৃত্ব ছিল। লিচ্ছবিদের প্রতিনিধি সভার ৭৭০৭ সদস্য ছিলেন। কোনও কানও বৌদ্ধগ্রন্থে সদস্যসংখ্যা ৫০০তে ধার্য হয়েছে। প্রতিনিধি সভা বা পরিষদের সদস্যদের রাজা বলা হত। এক একজন রাজার অধীনে একজন করে উপরাজ, সেনাপতি ও ভাণ্ডারিক ছিলেন। ৭৭০৭ বা ৫০০ সংখ্যাটি হয়তাে কাল্পনিক কিন্তু এই সংখ্যা থেকে মনে হয়, লিচ্ছবি রাষ্ট্র কয়েকটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি অঞ্চলে একজন করে রাজা, উপরাজ, সেনাপতি ও ভাণ্ডারিক ছিলেন। অঞ্চলপ্রধানরাই সম্ভবত প্রতিনিধি সভার সদস্য হতেন। এরা সকলেই অভিজাত ক্ষত্রিয় ছিলেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে প্রতিনিধি সভার কাজকর্ম সম্পর্কে কিছু আলােকপাত করা হয়েছে। প্রতিনিধি সভায় কোনও প্রস্তাব আনতে হলে তা তিনবার করে উত্থাপন করতে হত। উপস্থিত সদস্যরা আপত্তি না জানালে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে বলে ধরা হত। কোনও আপত্তি উঠলে প্রস্তাবটি ভােটে দেওয়া হত। ভােট নেওয়া হত গােপনে। ভােটদানের সময় প্রতিনিধিরা গুপ্তমতপত্রীরূপে শলাকা ব্যবহার করতেন। কখনও কখনও কোনও বিষয়ে বিতর্ক দেখা দিলে বা কোনও জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বিষয়টি সালিশির জন্য এক বিশেষ কমিটির কাছে পাঠানাে হত।

বিচার-ব্যবস্থা : গণরাজ্যগুলোর, বিশেষ করে লিচ্ছবি রাষ্ট্রের, বিচার-ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করেছেন বৌদ্ধলেখক বুদ্ধঘোষ। নিম্নতম থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আটটি বিভিন্ন আদালতের উল্লেখ করেছেন তিনি। বিনিশ্চয় মহামাত্র ছিলেন নিম্নতম আদালতের বিচারক। উচ্চতম আদালতের বিচারকার্য পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন পরিষদেরই একজন সদস্য। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে উচ্চতম আদালতে হাজির থাকতে হত। যে কোনও একটি আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তিনি মুক্তি পেতেন। নিম্নতম থেকে উচ্চতম পর্যন্ত সব কটি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলেই তাকে দণ্ড দেয়া হতো। নাগরিকদের ব্র্যক্তিগত স্বাধীনতা যাতে যথাযথভাবে রক্ষিত হয় তার জন্যই এই ব্যবস্থা ছিল। 

বুদ্ধদেব ও গণরাষ্ট্র : বুদ্ধদেব বৃজি রাষ্ট্রসংঘের গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অবশ্য গণরাজ্যগুলোর দুর্বলতা সম্পর্কেও তিনি যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। এই সব অরাজতান্ত্রিক রাজ্যে নাগরিকদের মধ্যে যে মাঝে মাঝে বিরােধ বা সংঘর্য দেখা দিত তা তার নজর এড়ায়নি। এ বিরােধ বা সংঘর্ষ বাধত প্রাচীনপন্থীদের সঙ্গে সংস্কারবাদীদের। প্রিয়শিষ্য আনন্দকে বুদ্ধদেব একবার বলেছিলেন, যতদিন পর্যন্ত লিচ্ছবি তথা বৃজিরা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত তারা নিরাপদ। লিচ্ছবি তথা বৃজিদের সম্পর্কে বুদ্ধদেবের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। যতদিন পর্যন্ত বৃজিরা এক ছিলেন ততদিন পর্যন্ত মগধরাজ অজাতশত্রু তাদের পরাজিত করতে পারেননি। কিন্তু যখন তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিল তখন আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের আর কোনও পথ ছিল না। 

সমাজ-জীবন

বর্ণ ও শ্রেণিব্যবস্থা

ক্ষত্রিয় : এ সময় সমাজে বিশেষত পূর্ব ভারতে ক্ষত্রিয়দের প্রভাব ও মর্যাদা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। বুদ্ধদেব ও মহাবীর উভয়েরই জন্ম ক্ষত্রিয় পরিবারে। বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায় ক্ষত্রিয়দের সকলের উপরে স্থান দেবেন এ তাে স্বাভাবিক। তাছাড়া এখানে প্রতিবাদী ধর্মীয় আন্দোলন জনপ্রিয় হওয়ায় বৈদিক যাগ-যজ্ঞের আর তেমন গুরুত্ব থাকে না। ফলে উত্তর বৈদিক যুগে পুরােহিত সম্প্রদায়ের সমাজে যে দাপট ছিল তার ভিত্তি অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়ে। যুদ্ধবিগ্রহ ও প্রশাসনিক কাজেই ক্ষত্রিয়রা সাধারণত অংশগ্রহণ করতেন। তবে অবস্থা বিশেষে তারা কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য ও কুটিরশিল্পকেও বৃত্তিরূপে গ্রহণ করতেন। শাক্য ও কোলিয় গােষ্ঠীর ক্ষত্রিয়রা কৃষির কাজে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। বেদ ও নানা শাস্ত্রে ক্ষত্রিয়রা যে সে সময় প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তার প্রমাণ আছে। 

ব্রাহ্মণ : ব্রাহ্মণদের প্রধান জীবিকা ছিল যাজন এবং অধ্যাপনা। অধ্যাপনা করছেন এরূপ বেদবিদ, শাস্ত্রজ্ঞ ও বৈয়াকরণ ব্রাহ্মণের কথা আছে বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে। অধ্যাপক তার গৃহবাসী ছাত্রদের পিতৃস্নেহে পালন করতেন, সযত্নে তাদের লেখাপড়া শেখাতেন। এর জন্য ছাত্রদের গুরুকে নির্দিষ্ট কোনাে বেতন দিতে হত না, যা দিতে হত তা হল তাদের কায়িকশ্রম, গ্রাম বা শহর থেকে পাওয়া ভিক্ষা আর অধ্যয়ন শেষে গুরুদক্ষিণা। অধ্যাপনার অর্থকরী মূল্য বড় একটা ছিল না, ধনী যজমানের বাড়িতে যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান কমে আসে। ফলে পৌরােহিত্যের দ্বারা সংসার প্রতিপালনের সুযােগ সব ব্রাহ্মণের থাকে না। অধ্যাপনার কাজও সকলের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। বিপদের দিনে পরিবারের ভরণ-পােষণের জন্য ব্রাহ্মণ আপদধর্ম হিসাবে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের বৃত্তি গ্রহণ করতে পারেন, আপস্তম্ব, গৌতম, বশিষ্ঠ ও বৌধায়ন এরূপ নির্দেশই দিয়েছেন। অর্থাৎ সে রকম পরিস্থিতি হলে ব্রাহ্মণ যুদ্ধবিদ্যা, পশুপালন, কৃষি ও বাণিজ্য বৃত্তিরূপে গ্রহণ করতেন। তবে ব্রাহ্মণের সব পণ্যের কারবারে অধিকার ছিল না। ব্রাহ্মণ যে সুগন্ধি, দুধ, দুধের তৈরি জিনিস, মদ, মাংস, দাস, হরিণের চামড়া, জমি ও ঔষধির ব্যবসা করতে পারেন না সে সম্পর্কে গৌতম-ধৰ্মসূত্রে স্পষ্ট নির্দেশ আছে। ব্রাহ্মণের পক্ষে যে অস্ত্রশস্ত্রের কারবার নিষিদ্ধ, তা আপস্তম্বের ধর্মসূত্র থেকে জানা যায়। 

রােগীর চিকিৎসা করছেন, লাঙল ধরছেন, জিনিসপত্র বিক্রি করছেন, রাখালের কাজ করছেন, শিকার করছেন, স্বপ্নের ব্যাখ্যা করছেন, ভাগ্য গণনা করছেন, মােহিনীবিদ্যা প্রয়ােগ করছেন তখনকার দিনের এরূপ অনেক ব্রাহ্মণের কথা জানা যায়। সমাজে যেমন বিদ্বান, গুণবান, চরিত্রবান ব্রাহ্মণ ছিলেন তেমনি অশিক্ষিত লােভী, নিচুমন, অসাধু ব্রাহ্মণও কম ছিলেন না। শেষােক্ত শ্রেণির এদের ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থাদিতে স্পষ্ট ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে, তাদের শুদ্র আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য শ্রেণির তুলনায় ব্রাহ্মণদের সুযােগ সুবিধা কিছু বেশি ছিল কিনা সে সম্পর্কে ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধগ্রন্থে পরস্পর বিরােধী তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। গৌতম-ধর্মসূত্র থেকে জানা যায়, একই এবাধে যেখানে অন্যদের গুরুদণ্ড দেওয়া হত, ব্রাহ্মণদের, বিশেষত অধ্যাপক-পুরােহিতদের সেখানে লঘুদণ্ডের বিধান ছিল। গৌতম স্পষ্ট বলেছেন, ছয়টি দণ্ড ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয় – বেতের আঘাত, বন্ধন, জরিমানা, নির্বাসন, বাদণ্ড ও পরিত্যাগ। করের বােঝা শিক্ষিত ব্রাহ্মণদের বইতে হত না, ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থ থেকে সেরূপ ধারণাই জন্মে। আইনের চোখে ব্রাহ্মণদের বিশেষ মর্যাদা ছিল, এ রকম কোনও ইঙ্গিত অবশ্য বৌদ্ধ সাহিত্যে পাওয়া যায় না। দোষী ব্রাহ্মণ শাস্তি পেয়েছেন, এমনকী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, এরূপ ঘটনারই বর্ণনা আছে সেখানে।

বৈশ্য-গৃহপতি-কুটুম্বিক : এই পর্বে সমাজে বৈশ্যদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। যে যুগে কারিগরি গল্পের বিকাশ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও নগরায়ণের উদ্ভব হয়, সে যুগে স্বাভাবিক কারণেই বৈশ্যদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ে। বৈশ্যদের এই গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়েছে সমকালীন বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে। বৈশ্যদের প্রতি বুদ্ধের মনােভাব ছিল শ্রদ্ধার ও সহানুভূতির। এই বৈশ্যদের অকৃপণ দানেই বৌদ্ধধর্ম মূলত বিকশিত হতে পেরেছেকেবল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের নয়, বৈশ্যদেরও দ্বিজ বলা হত। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মতাে তাদেরও বেদপাঠ, যজ্ঞ ও দান ছিল জীবনের অঙ্গ। কৃষি, পশুপালন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা। সুদের কারবারেও বৈশ্যদের প্রচুর অর্থাগম হত। অর্জিত সম্পদের বড় একটা অংশ বৈশ্যরা জনকল্যাণকর কাজে ব্যয় করতেন। রাজসভায় তাদের বেশ খাতির ছিল। বণিকপুত্র তার ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সতীর্থদের সঙ্গে গুরুগৃহে একত্রে অধ্যয়ন করছেন, বৌদ্ধ সাহিত্যে এ রকম বহু ঘটনার বর্ণনা আছে।

বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে গৃহপতি ও কুটুম্বিক নামে এক শ্রেণির লােকদের কথা বলা হয়েছে। তারা ধনী, প্রচুর ভূসম্পত্তি ও গােধনের মালিক। তারা মহাজনী কারবারী, কৃষি ও বাণিজ্যজীবী। গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই তাদের বাস ছিল। বৌদ্ধগ্রন্থের সাক্ষ্য থেকে মনে হয় গৃহপতি এবং কুটুম্বিকরা এক ও অভিন্ন শ্রেণির লােক ছিলেন। বিভিন্ন অভিধানেও গৃহপতি ও কুটুম্বিক পদ দু’টি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, গৃহপতিরা ছিলেন মূলত কৃষক, কুটুম্বিকরা ব্যবসায়ী। গৃহপতিরা ব্যবসায়ী ছিলেন, এরূপ অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। আসলে পালি গ্রন্থাদিতে গৃহপতি-কুটুম্বিকদের যেমন কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরূপে বর্ণনা করা হয়েছে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গেও তাদের সংযােগের উল্লেখ আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে গৃহপতি ও কুটুম্বিকদের বৃত্তিগত পার্থক্যের কোনও ইঙ্গিত নেই। গৃহপতি-কুটুম্বকরা ছিলেন এক স্বতন্ত্র গােষ্ঠী। তারা সাধারণ কৃষক বা সাধারণ ব্যবসায়ী নন, তারা আভিজাত্য, বৈভব ও প্রতিপত্তির অধিকারী। রাজা উদয়ন বৌদ্ধ সাহিত্যে একজন গহপতি বা গৃহপতিরূপে পরিচিত। জীবকের মতাে সেকালের এক প্রখ্যাত চিকিৎসকেরও পরিচয় গৃহপতি। বিত্তশালী শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিকও একজন গৃহপতিরূপে আখ্যাত। বৌদ্ধ সাহিত্যে ব্রাহ্মণ গৃহপতিরও লেখ আছে। অনুমিত হয়, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য, এই তিন বর্ণের যে কোনও ব্যক্তি আভিজাত্য, প্রতিপত্তি ও বৈভবের বলে সমাজে গহপতিরূপে বন্দিত হতেন। রাজাদের যেমন তারা ঘনিষ্ঠ তেমনি পৃষ্ঠপােষক ছিলেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের। দীঘনিকায়ে মেণ্ডক নামে জনৈক গৃহপতির কথা বলা হয়েছে। তিনি রাজার সৈন্যবাহিনীর রসদ জোগাতেন আবার বৌদ্ধ সংঘকেও নিয়মিত দধ সরবরাহ করতেন। গৃহপতি অনাথপিণ্ডিক বুদ্ধদেবকে জেতবন কানন উপহার দেন। গৃহপতি জীবক মগধ রাজপরিবারের বন্ধু ছিলেন আবার বৌদ্ধ সংঘেরও পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন।

কখনও কখনও বলা হয়, গৃহপতি সামাজিক মর্যাদায় ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদের সমকক্ষ ছিলেন। এ ধরনের মন্তব্য অর্থহীন। প্রথমত, বৌদ্ধ সাহিত্যে সাধারণত বুদ্ধদেবের স্বজাতি ক্ষত্রিয়দের স্থান ব্রাহ্মণদেরও উপরে। দ্বিতীয়ত, গৃহপতি একজন সাধারণ ক্ষত্রিয় বা ব্রাহ্মণের তুলনায় ধনে ও মানে সমাজে অনেক শ্রদ্ধেয় ছিলেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে গহপতিপুত্ত-এর উল্লেখ আছে। গহপতিপুত্ত নিছক গৃহপতির পুত্র নন, তিনিও স্বয়ং গৃহপতি। বুদ্ধশিষ্য চুন্দ কর্মকার ছিলেন অথচ তাকে কখনও কখনও কর্মকারপুত্র বলে আখ্যাত করা হয়েছে। বােঝা যায়, বৌদ্ধ সাহিত্যে গহপতি ও গহপতিপুত্ত প্রায়ই সমার্থকরূপে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন প্রযুক্ত হয়েছে কর্মকারের প্রতিশব্দরূপে কর্মকারপুত্র। নিজেদের মর্যাদা সম্পর্কে গৃহপতি বা কুটুম্বিকরা খুবই সচেতন ছিলেন। নিজেদের সমাজের বাইরে তারা বড় একটা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন না।

শূদ্র : ধর্মসূত্রে শূদ্রদের সম্পর্কে অনেক তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। ধর্মসূত্রকার গৌতম তাদের অনার্য বলেছেন। গৌতমের এই উক্তি পুরােপুরি সত্য নয়। বেশির ভাগ শূদ্র অনার্য ছিলেন ঠিকই কিন্তু আর্যদের মধ্যে অনেকেই আর্থিক দুরবস্থা ও সাংস্কৃতিক অবনতির ফলে শূদ্রের পর্যায়ে নেমে এসেছিলেন। গৌতম আরও বলেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে বেদপাঠ শুনলে শূদ্রের কানে গরম শিশা বা লাক্ষা ঢেলে দিতে হবে, বেদবাক্য উচ্চারণ করলে তার জিভ কেটে ফেলা হবে। গৌতম যাই বলুন না কেন, কোনও কোনও শূদ্র যে আপন নিষ্ঠা ও অধ্যয়নের বলে বেদবিরূপে সমাজে পরিচিতি লাভ করেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সংখ্যায় তারা অতি নগণ্য ছিলেন। আপস্তম্ব মনে করেন, সব শূদ্রই অশুচি নন। যারা নির্দিষ্ট কয়েকটি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন তাদের রান্নার কাজে নিয়ােগ করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। পাণিনির মতও অনেকটা একই রকম। তিনি শূদ্রদের নিরবসিত ও অনিরবসিত এই দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। নিরবসিত শূদ্ররা সাধারণত লােকালয়ের বাইরে থাকতেন। যারা অনিরবসিত তাদের বাস ছিল লােকালয়ে। 

প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে শূদ্রদের কোনও সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। কিন্তু সেখানে এমন অনেক গােষ্ঠী বা জাতির কথা বলা হয়েছে যারা নিঃসন্দেহে শূদ্র পর্যায়ভুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে রজক, কুম্ভকার, কর্মকার, দন্তকার, সূত্রধর, চর্মকার, নট, নর্তক, নিষাদ, বেণ, রথকার, পুরুস, তন্তুবায়, ঝুড়িপ্রস্তুতকারক ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ঝুড়ি তৈরি, মাটির কাজ, বস্ত্রশিল্প, ক্ষৌরকর্ম প্রভৃতি বৃত্তিকে ‘হীনশিল্প’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। রথকার, বেণ, চণ্ডাল, নিষাদ, পুরূস প্রভৃতি জাতিকে হীন জাতি বলে নিন্দা করা হয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থসমূহে ভৃত্য বা বেতনভুক শ্রমিক ও দাস বলে যাদের উল্লেখ করা হয়েছে তাদের সিংহভাগই ছিলেন শূদ্র। এদের মধ্যে চণ্ডালদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে করুণ। জাতিকাঠামাের নিম্নতম স্তরে ছিল তাদের অবস্থান। তারা শুধু অস্পৃশ্যই ছিলেন না, তাদের দিকে তাকানােও পাপ বলে গণ্য হত। অজান্তে চণ্ডালের স্পর্শ করা খাদ্য খেয়ে জাত খােয়ানাে বা আত্মহত্যার মতাে ঘটনা তখন একেবারে বিরল ছিল না। শহর বা গ্রামের বাইরে তাদের বাস ছিল। শবদেহ বহন ও ঘাতকের কাজে তাদের নিয়ােগ করা হতো। নটদের বৃত্তি ছিল নাচ, গান ও অভিনয়। তারা স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে অন্যদের আনন্দ দান করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। বৌদ্ধগ্রন্থে যাদের পুক্কস বলা হয়েছে ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থাদিতে তাদের পুল্কস বা পৌল্কস আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এরা শিকারজীবী ছিলেন। নিষাদদের জীবিকা ছিল শিকার ও লুণ্ঠন। যাদের বর্তমানে ভিল বলা হয় নিষাদেরা তাদের পূর্বপুরুষ। আয়ােগব বলে এক জাতি ছিল। তাদের পেশা ছিল কাঠ কাটা, তাত বােনা ও ধাতুর বাসনকোশন তৈরি করা। অম্বষ্ঠদের বৃত্তি ছিল চিকিৎসা ও কৃষিকার্য।

সংকর জাতি : ধর্মসূত্রে এদের কয়েকটিকে সংকর জাতি বলা হয়েছে। সংকর জাতির উদ্ভবের পেছনে একাধিক কারণ ছিল। এক বর্ণের লােকের সঙ্গে অন্য বর্ণের লােকের বিবাহ এর একটা প্রধান কারণ। অনেক সময় লােকেরা তাদের পৈতৃক বৃত্তি ছেড়ে অন্য জীবিকা গ্রহণ করতেন। নতুন পেশার লােকদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সামাজিক সম্পর্কের ফলেও সংকর জাতির উদ্ভব হত। তাই পেশা পরিবর্তনকেও সংকর জাতির উদ্ভবের এক পরােক্ষ কারণ বলে চিহ্নিত করা যায়। চণ্ডালদের সংকর জাতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গৌতম ও বৌধায়ন-ধৰ্মসূত্রে চণ্ডালদের শূদ্র পিতা ও ব্রাহ্মণী মাতার সন্তান বলা হয়েছে। নিষাদদের ব্রাহ্মণ পুরুষ ও শূদ্র নারীর মিলনজাত সংকর জাতিরূপে গণ্য করা হয়েছে। বৌধায়ন-ধৰ্মসূত্রে পুল্কসদের নিষাদপুরুষ ও শূদ্র নারীর বংশজ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সূতদের ক্ষত্রিয় পুরুষ ও ব্রাহ্মণ নারীর মিলনজাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়ােগবদের উদ্ভব হয়েছে শূদ্র পিতা ও বৈশ্য মাতা হতে। চর্মকারদের শূদ্র পুরুষ ও ক্ষত্রিয় নারীর সংকর বলা হয়েছে। অম্বষ্ঠরা ছিলেন ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্য মাতার মিলনজাত। মাহিষ্য বা মহিষকেরাও সংকর জাতি। ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্য নারী হতে তাদের উৎপত্তি।

দাসপ্রথা : সমাজে দাসপ্রথা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজপরিবার বা ধনী মহলে তাে বটেই সাধারণ পরিবারেও গৃহস্থালি ও মাঠের কাজের জন্য দাস-দাসী রাখা হত। দাস-দাসীদের কোনও নির্দিষ্ট বর্ণ বা জাতি ছিল না। অবস্থার বিপাকে যে-কোনাে বর্ণ বা জাতির লােক দাসত্বের জীবনযাপন করতেন। দাসত্বের কারণ অনেক। মা-বাবা দাস হলে সন্তানও দাস। নগদ টাকায়ও দাস-দাসী কেনা যেত। অভাবের তাড়নায় মানুষ অনেক সময় নিজেকে বা তার স্ত্রী-পুত্রকে বিক্রি করতেন। যুদ্ধ বন্দিদের অনেককেই দাস করা হত। দেনা শােধ করতে না পারলেও দাসত্ব স্বীকার করতে হত। অপরাধের শাস্তিস্বরূপ অনেক ক্ষেত্রে দাসত্বের বিধান ছিল। কোনও কোনও বৌদ্ধগ্রন্থে একজন ক্রীতদাসের মূল্য ৭০০ পণ ধার্য হয়েছে। আবার কখনও কখনও একজন দাসের মূল্য ১০ কার্ষাপণে নেমে গিয়েছে। রান্না করা, ঘরদোর পরিষ্কার করা থেকে আরম্ভ করে গৃহস্থের বাড়ি ও মাঠের যাবতীয় কাজ দাস-দাসীদের করতে হত। মনিব খুশি থাকলে গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বও তারা পেতেন। দাস প্রভুকে পরামর্শ দিচ্ছেন বা প্রভুর সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করছেন, বৌদ্ধ সাহিত্যে এরূপ বহু ঘটনার উল্লেখ আছে। সমাজে দয়ালু মনিব ছিলেন ঠিকই কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রভুর বাড়িতে দাস দাসীদের ভাগ্যে লাঞ্ছনা ও উৎপীড়ন জুটত। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে দাসেরা মাঠে কাজ করছেন, তাদের শরীর ক্লান্ত, চোখে জল, মনে সব সময় ভয়, না জানি কী শাস্তি পেতে হয়, দাস-জীবনের এ করুণ ছবি অঙ্গুত্তরনিকায়ে অঙ্কিত আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে ধনপালী নামে এক দাসীর উল্লেখ আছে। প্রভূ তাকে প্রায়ই নির্যাতন করতেন এবং প্রতিবেশীদের বাড়িতে ভাড়া খাটাতেন।

চতুরাশ্রম, বিবাহ, নারী ও বিদ্যাশিক্ষা

চতুরাশ্রম : উত্তর-বৈদিক যুগে উচ্চ বর্ণের লােকদের জীবনে তিনটি পর্যায় বা আশ্রমের কথা শােনা যায়। পর্যায়গুলো ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য ও তপস্যা। কিন্তু এ সময় আশ্রমের সংখ্যা তিন থেকে বেড়ে চারে গিয়ে দাঁড়ায়। নতুন কোনও পর্যায় অবশ্য সংযুক্ত হয়নি। তৃতীয় অর্থাৎ তপস্যা পর্যায়টিকে ভেঙ্গে দু’টি স্বতন্ত্র পর্যায় করা হয়। জাবাল-উপনিষদ্ ও ধর্মসূত্রেই সর্বপ্রথম তিন আশ্রমের পরিবর্তে চতুরাশ্রমের কথা বলা হয়েছে। চতুরাশ্রমের শেষ দুটি পর্যায়কে কখনও কখনও বৈখানস ও ভিক্ষু, কখনওবা বানপ্রস্থ ও পরিব্রাজক বলা হয়েছে। প্রথমটি আধ্যাত্মিকতার প্রস্তুতি পর্ব, দ্বিতীয়টি অনুশীলন পর্ব। ব্রহ্মচর্য উচ্চ বর্ণের সকলের ক্ষেত্রেই বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু পরে লােকেরা কী করবেন, আজীবন গৃহী থাকবেন, না কোনও এক সময় সংসার ত্যাগ করবেন, তা তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচির উপর নির্ভর করত। রাষ্ট্র বা সমাজ জোর করে কারাের উপর কিছু চাপিয়ে দিত না।

বিবাহ-ব্যবস্থা : ধর্মসূত্র গ্রন্থাদিতে আট রকম বিবাহের উল্লেখ আছে। এগুলো হল ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। পিতা বা অভিভাবক যখন বস্ত্র ও অলংকার দিয়ে সাজিয়ে কন্যাকে বিদ্বান ও চরিত্রবান পাত্রের হাতে সমর্পণ করতেন, তখন সেটি হত ব্রাহ্ম বিবাহ। যজ্ঞের অনুষ্ঠানকালে পুরােহিতকে সালংকরা কন্যা দানের নাম দৈব। যখন পিতা বরের কাছ থেকে একটি গােরু ও একটি বলদ অথবা দুই জোড়া বলদ গ্রহণ করে কন্যাকে পাত্রস্থ করতেন তখন সে বিবাহকে আর্ষ বলা হত। ‘তােমরা দু’জনে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করাে’ এই শুভকামনা জানিয়ে পিতা বা অভিভাবক বরের হাতে কন্যাকে সমর্পণ করলে তা হত প্রাজাপত্য বিবাহ। কন্যা ও বর উভয়ে পরস্পরকে ভালােবেসে যে বিবাহ করেন তার নাম গান্ধর্ব। প্রচুর দান-সামগ্রীর বিনিময়ে কন্যারত্ন লাভই হল আসুর বিবাহ। কন্যাকে গায়ের জোরে হরণ করে যে বিবাহ তার নাম রাক্ষস। নিদ্রিত, পানাসক্ত বা বিকৃতমস্তিষ্ক নারীকে নিয়ে গিয়ে নির্জনে গমনের নাম পৈশাচ বিবাহ। এই ধরনের বিবাহ সমাজে নিন্দনীয় ছিল। ধর্মসূত্রে আট প্রকার বিবাহের উল্লেখ থাকলেও জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যে দৈব, আর্ষ ও পৈশাচ বিবাহের কথা নেই। আসুর ও রাক্ষস বিবাহ দু’টির সঙ্গে আর্ষ ও পৈশাচ বিবাহের অনেক মিল থাকায় জৈন ও বৌদ্ধ লেখকরা সম্ভবত এ দুটি বিবাহের পৃথক উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ জৈন ও বৌদ্ধ সমাজে আর্য ও পৈশাচ বিবাহের প্রচলন ছিল না, এ কথা জোর করে বলা যায় না। তবে যাগযজ্ঞে অবিশ্বাসী জৈন ও বৌদ্ধ পরিবারে দৈব অর্থাৎ পুরােহিতের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ অবশ্যই অভাবনীয় ছিল।

বিবাহ সাধারণত হত একই জাতির মধ্যে, কিন্তু ভিন্ন গােত্রে। বৈদিক যুগে একই গােত্রের লােক বলতে তাদেরই বােঝাত যাদের গােরু একই গােশালায় থাকত। কিন্তু এ সময় থেকে কুল বা বংশ বা রক্তের সম্পর্ক আছে এমন গােষ্ঠী, এই ব্যাপকতর অর্থেই গােত্রের ব্যবহার হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সগােত্রেও বিবাহ হত। শাক্যদের মধ্যে ভাই-বােনে বিবাহ বিশেষ চালু ছিল। নিজ গােষ্ঠীর পবিত্রতা রক্ষা করার জন্যই এই ব্যবস্থা ছিল। বৈশালীর লিচ্ছবিরাও তাদের গােষ্ঠীর ভিতরেই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন। মহাবীরের বড় ভাই নন্দিবর্ধন জ্যেষ্ঠা নামে জনৈক মহিলার পাণিগ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠা ছিলেন সম্পর্কেনন্দিবর্ধনের এক রকম বােন। বৌধায়ন-ধৰ্মসূত্রে পিসতুতাে মামাতাে ভাই-বােনের বিবাহের উল্লেখ আছে। তবে বৌধায়ন এটিকে দক্ষিণা প্রথা বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তখন উত্তর ভারতেও যে এ ধরনের বিবাহের চল ছিল তার প্রমাণ আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে কাশী ও শিবির রাজকুমারদের সঙ্গে তাদের মামাতাে বােনদের বিবাহের অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে। কোসলরাজ প্রসেনজিতের বােনের সঙ্গে মগধরাজ বিম্বিসারের পরিণয় হয়। বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুর সঙ্গে প্রসেনজিত নিজ কন্যা বজিরার বিবাহ দেন। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও মামাতাে বােনের সঙ্গে তার পিসতুতাে ভাই-এর বৈবাহিক সম্পর্ক হয়েছিল। অনুলোম (উচু বর্ণের পুরুষের সঙ্গে নিচু বর্ণের মেয়ের বিবাহ) ও প্রতিলােম (নিম্নবর্ণ পুরুষের সঙ্গে উচ্চবর্ণ মেয়ের পরিণয়), এ ধরনের বহু বিবাহের উল্লেখ আছে বৌদ্ধ সাহিত্যে।

নারী : ঋগবৈদিক বা উত্তর-বৈদিক পর্বের তুলনায় এই সময় বিশেষত ব্রাহ্মণ্য পরিবারে মহিলাদের অবস্থার যথেষ্ট অবনতি দেখা দেয়। ধনােৎপাদনে তাদের ভূমিকা ছিল অতি নগণ্য। তাদের বিবাহ হতো অতি অল্প বয়সে, যৌবনারম্ভের সঙ্গে সঙ্গে। ফলে যােগ্যতা অর্জন বা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযােগ তাদের খুব একটা ছিল না। তাছাড়া অভিজাত পরিবারে তাে বটেই সাধারণ পরিবারেও পুরুষের বহু বিবাহের প্রচলন ব্যাপক হয়। বিম্বিসার, প্রসেনজিৎ, উদয়ন, অজাতশত্রুরা সকলেই বহুবল্লভ ছিলেন। অঙ্গুত্তরনিকায় ইত্যাদি বৌদ্ধগ্রন্থে আনেক রাজপুত্র ও বণিকের কথা বলা হয়েছে যারা বহু মহিলার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। পারস্কর-গৃহ্যসূত্রে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা একজন করে শূদ্রাণী ছাড়াও যথাক্রমে তিন, দুই ও একজন করে পত্নী গ্রহণ করবেন। পুরুষদের বহু বিবাহ নারী জাতিকে দুর্বল করে তুলেছিল। বাধা-বিপত্তি অনেক ছিল। তা সত্ত্বেও সে যুগের অনেক মহিলা আপন যােগ্যতায় শিক্ষার উচ্চ সােপানে আরােহণ করেছিলেন। পাণিনি ছাত্রী ও তাদের আবাস ছাত্রীশালার উল্লেখ করেছেন। সদ্যোদ্বাহা ও ব্রহ্মবাদিনী – ছাত্রীদের এই দুটি শ্রেণি ছিল। ছাত্রীদের মধ্যে যারা বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত অধ্যয়ন করতেন তাদের সদ্যোদ্বাহা বলা হত। আর যারা ব্রহ্মবিদ্যার অনুশীলনে আত্মনিয়ােগ করতেন তারা ব্রহ্মবাদিনী নামে পরিচিত ছিলেন। মহিলাদের মধ্যে কেউ কেউ অধ্যাপনাকে বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করতেন। আচার্য ও উপাধ্যায় নামে দু’শ্রেণীর অধ্যাপিকার উল্লেখ করেছেন পাণিনি। অনেক সময় মেয়েদের প্রতিরক্ষার কাজে নিয়ােগ করা হত। বর্শার ব্যবহারে মেয়েদের পটুত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন পাণিনি। জৈন ও বৌদ্ধ পরিবারে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার ও সমাজসেবার সুযােগ অনেক বেশি ছিল। তাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন। এ প্রসঙ্গে চন্দনা, জয়ন্তী, ধর্মদিহ্না, মহাপ্রজাপতি প্রভৃতি মহীয়সী নারীদের কথা উল্লেখ করা যায়। ধর্ম প্রচারেও তারা স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। স্বামী মারা গেলে অনেক মহিলাই পুনর্বার বিবাহ করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলারা মৃত স্বামীর কোনাে আত্মীয়কেই পতিরূপে বরণ করতেন। বশিষ্ঠ-ধৰ্মসূত্রে বিধবা কিন্তু পুনর্বার বিবাহিতা মেয়েদের ‘পুনর্ভু’ বলা হয়েছে। অবশ্য সব নারীই যে দ্বিতীয়বার বিবাহ করতেন তা নয়। অঙ্গুত্তরনিকায়তে এরূপ এক মহিলার কথা বলা হয়েছে যার স্বামী মৃত্যুশয্যায়। মহিলা মুমূর্ষু স্বামীকে আশ্বস্ত করে বলছেন, তিনি আর বিবাহ করবেন না, স্বামীর সংসার দেখবেন। স্বামী বর্তমান থাকলেও মহিলারা বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারতেন। ধর্মসূত্রকার বশিষ্ঠ বলেন, স্বামী ক্লীব বা বিকৃত মস্তিষ্ক হলে কিংবা প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলে স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করতে পারেন। আগের স্বামীকে ত্যাগ করে মহিলারা অন্য স্বামী বরণ করেছেন, বৌদ্ধ সাহিত্যে এরূপ অনেক ঘটনার বর্ণনা আছে।

বিদ্যাচর্চা : তক্ষশিলা, রাজগুহ, বৈশালী, বারাণসী, উজ্জয়িনী, মিথিলা প্রভৃতি শহর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ছিল। তখনকার দিনের নামকরা পণ্ডিতদের অনেকেই এসব শহরে বাস করতেন। তাদের বাড়িতেই ছাত্ররা অধ্যয়ন করতেন। শিক্ষায়তন বলতে সে সময় গুরুগৃহকেই বােঝাত। শিক্ষার কেন্দ্ররূপে তক্ষশিলার স্থান ছিল সকলের ওপরে। বেদ, ব্যাকরণ, দর্শনাদি ছাড়া এখানে অস্ত্রবিদ্যা, আয়ুর্বেদ, শল্যশাস্ত্র, শিল্প, বাণিজ্য, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা ইত্যাদি বিষয়ের অধ্যয়নের ব্যবস্থা ছিল। কোসলরাজ প্রসেনজিৎ যৌবনে তক্ষশিলায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। মগধের রাজবৈদ্য জীবক এখানে সাত বছর চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন।

শিল্প ও সাহিত্য

ভাষা ও সাহিত্য : এ সময় প্রাকৃত ও সংস্কৃত সাহিত্যের উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি হয়। দুঃখের বিষয়, এ যুগের অনেক সাহিত্যকীর্তি কালস্রোতে হারিয়ে গেছে।

  • প্রাকৃত সাহিত্য : মহাবীর ও বুদ্ধদেব উভয়ে প্রাকৃতে ধর্মোপদেশ দিতেন বলে সমাজে বিশেষ করে জৈন ও বৌদ্ধ সমাজে প্রাকৃত ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বলা বাহুল্য, প্রাকৃত ভাষার এ সময় অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। বিনয় ও সূত্রপিটক সংকলনের কাজ অনেক দূর অগ্রসর হয়। এ সময় জৈন শাস্ত্র সংকলনের কাজেও হাত দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তখনকার দিনে সংকলিত কোনও জৈনগ্রন্থ আজ আর পাওয়া যায় না।
  • সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্য : যদিও মত বিরােধের অবকাশ আছে, তবু মনে হয় পাণিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কৃত ব্যাকরণের উপর তিনি অষ্টাধ্যায়ী নামে একখানি অতি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থে প্রায় চার হাজার সূত্রের আলােচনা আছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের শালাতুর গ্রামে তার জন্ম। বেদবিদ্যার অঙ্গ হিসাবে নয়, এক স্বতন্ত্র বিদ্যারূপে পাণিনি ব্যাকরণকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শাকটায়ন, শৌনক প্রভৃতি কয়েকজন পূর্বসূরির উল্লেখ করেছেন পাণিনি। দুর্ভাগ্য, এদের লেখা। কোনও গ্রন্থের সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। নিরুক্তকার যাস্ক পাণিনির পূর্ববর্তী। তিনি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে রাজনীতির আলােচনা প্রসঙ্গে মনু, বৃহস্পতি, পরাশর, উশন, ভরদ্বাজ, বিশালাক্ষ, পিশুন, কৌণপদন্ত, বাতব্যাধি প্রভৃতি কয়েকজন পূর্বাচার্যের উল্লেখ করেছেন। অনুমান করা যায়, এদের কেউ কেউ খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এদের কোনও গ্রন্থের সন্ধান এখনও মেলেনি। সন্দেহ নেই, কৌটিল্যের পূর্বসূরি মনু আর সংহিতাকার মনু এক ব্যক্তি নন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এ সময় কয়েকখানি সূত্রগ্রন্থ রচিত হয়েছিল। সূত্রগ্রন্থগুলো শ্রৌতসূত্র, গুহ্যসুত্র, ধর্মসূত্র ও শুল্কসূত্র – এই চারটি ভাগে বিভক্ত। এ সকল গ্রন্থে যথাক্রমে বৈদিক যাগ-যজ্ঞ, গার্হস্থ্য-জীবনের আচার-অনুষ্ঠান, বর্ণাশ্রম ধর্ম এবং যজ্ঞভূমি, যজ্ঞবেদি সম্পর্কে বিশদ আলােচনা আছে। ধর্মসূত্রগুলোর মধ্যে গৌতম-ধর্মসূত্রই সবচেয়ে প্রাচীন। গ্রন্থখানি খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের রচনা বলে বেশির ভাগ পণ্ডিতই অভিমত প্রকাশ করেছেন। এই গ্রন্থে বেশ কয়েকখানি ধর্মসূত্রের উল্লেখ আছে যাদের এখন আর কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না।

স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা : সে যুগের স্থাপত্যের বিশেষ কোনও নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়নি। আসলে তখনকার দিনে বাড়ি, ঘর, প্রাকার সবই সাধারণত কাঠ, খড, কাঁচা ইট ও মাটি দিয়ে তৈরি হত। এসবই ক্ষণভঙ্গুর উপকরণ। পােড়া ইট ও পাথরের তৈরি বাড়িও যে ছিল না তা নয়। তবে তার সংখ্যা বেশি ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকের কোনও দেব-দেবীর মূর্তি পাওয়া যায়নি। অনেকে মনে করেন, তখন কাঠ দিয়ে যক্ষ-যক্ষিণী মূর্তি তৈরি হত। কিন্তু এ মতও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। এই সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো –

  • আগাগােড়া পাথরের তৈরি এরূপ সমকালীন একখানি পুরাতন, জীর্ণ গৃহ রাজগিরে আবিষ্কৃত হয়েছে। গৃহটি বর্তমানে জরাসন্ধ কি বৈঠক নামে পরিচিত। রাজগির শহরটি প্রথম দিকে মাটির প্রাকার দিয়ে ঘেরা ছিল। পরে অজাতশত্রু পাথরের প্রকার নির্মাণ করে এটিকে আরও সুরক্ষিত করেন।
  • উত্তরপ্রদেশের পিঁপড়াওয়ায় একটি বৌদ্ধস্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছে। বুদ্ধের দেহাবশেষ সংরক্ষণের হন শাক্যরা পিঁপড়াওয়ায় এই স্তূপপটি নির্মাণ করেছিলেন। স্তূপটির মধ্যে সংরক্ষিত একটি আধারের ভেতর যেমন হাড়ের খণ্ড এবং নানা ধরনের পাত্র পাওয়া গেছে তেমনি সােনা, দামী পাথর ও অন্যান্য ধাতুর তৈরি অনেক সৌখিন জিনিসপত্রও দেখা গেছে। স্তুপটি পরবর্তীকালের কিন্তু আধারের ভেতর সংরক্ষিত উপকরণগুলো নিঃসন্দেহে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকের। সে সময় জহুরি ও মণিকারেরা যে অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, এ জিনিসগুলো তার প্রমাণ।
  • মথুরায় এক প্রাচীন জৈন স্তুপের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এটি প্রাচীন হলেও খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকের নয়, আরও পরবর্তী। অনেকে এটিকে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকের এক আদি কাপের নবীন সংস্করণ বলে মনে করেন। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

অর্থনৈতিক জীবন

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণ

শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতির এক প্রধান কারণ। শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে স্থানগত বিচ্ছিন্নতা দূর হল, শান্তি-শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা হল, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অনুকূল বাতাবরণ সৃষ্টি হল। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে, পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ও ধর্মসূত্রগ্রন্থাদিতে এ যুগের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় বিধৃত আছে। গাঙ্গেয় উপত্যকায়  শক্তিশালী অর্থনীতির বিকাশ ঘটার কারণ ছিল –

  • বৃষ্টিপাত : মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকার জলবায়ু ও ভৌগােলিক পরিবেশও তার দ্রুত অর্থনৈতিক উত্থানের পথ সুগম করে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় কৃষিকার্য সহজসাধ্য হয়েছে। মধ্য গাঙ্গেয় অববাহিকায় বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত একশাে সেন্টিমিটারেরও বেশি। (ভাগলপুর ১৩০ সে. মি. পাটনায় ১১৫ সে. মি.। নিম্নগাঙ্গেয় অববাহিকায় বৃষ্টিপাত আরও বেশি। কলকাতায় ১৬০ সে. মি., মালদহে ১৫০ সে. মি.)। উচ্চগাঙ্গেয় উপত্যকার পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এরই প্রায় কাছাকাছি। এসব অঞ্চল ধান চাষের পক্ষে ভাল। (বারাণসীতে ১০৫ সে. মি., এলাহবাদে ১০২ সে. মি., লখনউতে ৯০ সে. মি.)। দিল্লি, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৭০ সেন্টিমিটার বা তারও কম। এই পরিমাণ বৃষ্টিপাত গম ও যব চাযের পক্ষে অনুকূল কিন্তু সেচের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হলে এই স্বল্প পরিমাণ বৃষ্টিপাতে ধানচাষ সম্ভব হয় না।
  • হিমালয়ের বরফগলা জল : হিমালয়ের বরফগলা জলের কারণে উত্তর ভারতের নদ-নদীগুলোতে সারা বছরই জল থাকে। এতে সেচের সুবিধা হয়েছে। বেশির ভাগ নদ-নদী নাব্য হওয়ায় জলপথে যাতায়াত ও পরিবহন সহজ ও সুলভ হয়েছে। ভূমি সমতল বলে স্থলপথে যাতায়াতও সহজ ও নিয়মিত হয়েছে।
  • লােহার তৈরি যন্ত্রপাতি : লােহার তৈরি যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহারও কৃষির বিকাশের পথ উন্মুক্ত করেছে। বিহারের শােনপুর ও বৈশালী, উত্তরপ্রদেশের ঝাখেড়া ও কৌশাম্বী এবং মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী ও এরাণ প্রভৃতি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন চালিয়ে লােহার কুড়ল, কোদাল, কাস্তে ও লাঙলের ফলা পাওয়া গেছে।
  • গবাদি পশু : কৃষিকর্মে, বাণিজ্যে ও শকটাদি চালনার কাজে যে গবাদি পশুর প্রয়ােজন ছিল তা এই অঞ্চলে পর্যাপ্ত ছিল। বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় এখানে নির্বিচারে পশুহত্যার প্রবণতা হ্রাস পায়, গবাদি পশুর সংরক্ষণ ও প্রতিপালন সমাজে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। এ সময় উত্তর ভারতে পশুবধের প্রবণতা যে হ্রাস পাচ্ছিল অত্রঞ্জিখেড়ার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে তা প্রমাণিত। এই স্থানে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ও তার পূর্ববর্তী ভূ-সংস্তরে প্রভূত পরিমাণ পশুর দেহাস্থি আবিষ্কৃত হয়েছে। দেহাস্থিতে আঘাতের চিহ্ন বিধৃত। অর্থাৎ পশুগুলোকে নিধন করা হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে নিহত পশুর দেহাস্থি পরিমাণে স্বল্প হয়েছে।

অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি

গ্রাম : সন্দেহ নেই, কৃষিই ছিল অর্থনীতির মূল ভিত্তি। কৃষি ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। ৩০ থেকে ১০০০টি পরিবার নিয়ে ছিল এক একটি গ্রাম। গ্রামের চারদিকে থাকত বেড়া বা বেষ্টনী। বেষ্টনীর বাইরে ছিল কৃষিজমি বা ক্ষেত। ক্ষেতও ঘেরা থাকত। কৃষিক্ষেত্রের সীমানা পেরিয়ে ছিল চারণক্ষেত। 

জমির মালিকানা : চাষের জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল। নিবর্তন জমি একটি পরিবারের পক্ষে পর্যাপ্ত বলে বৌধায়ন-ধৰ্মসূত্রে উল্লেখ আছে। ভরদ্বাজ নামে এক ব্রাহ্মণের বৃহদায়তন ক্ষেতের উল্লেখ আছে সংযুক্তনিকায়তে। শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিকের কাহিনিতেও জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার সপক্ষে প্রমাণ মেলে। শ্রাবস্তীর এই বিখ্যাত বণিক বুদ্ধকে জেতবন উদ্যানটি দান করতে চান। কিন্তু জেতবন তার নিজের জমি নয়। তাই তিনি প্রচুর অর্থ দিয়ে আসল মালিকের কাছ থেকে ঐ বাগানটি কিনে পরে তা বুদ্ধকে উপহার দেন। নালা কেটে বা আল বেধে বিভিন্ন জমির মধ্যে সীমারেখা রচনা করা হত। সাধারণত পরিবার পিছু জমির পরিমাণ কমই থাকত। চারণক্ষেত ছিল গ্রামের এজমালি সম্পত্তি। পরিবারের লােকরাই চাষ-আবাদের কাজ করতেন। কিন্তু জমি বড় হলে চাষের কাজে ভাড়াটে শ্রমিকদের সাহায্য নেওয়া হত। সে যুগে যে চাষযােগ্য বড় জমি ছিল সংযুক্তনিকায়ের সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত। এই গ্রন্থে ৫০০ লাঙল খাটত এমন ক্ষেতের উল্লেখ আছে। শুধু পরিবারের নিজস্ব সদস্যদের দ্বারা এই সব বিশালায়তন ক্ষেত চাষ করা যেত না, কৃষিশ্রমিকের প্রয়ােজন হত। জৈন্মগ্রন্থ জ্ঞাতধর্মকথাতে কৃষিশ্রমিকের উল্লেখ আছে।

জমির প্রকারভেদ : কোনও কোনও জমি লাঙল ব্যবহারের পক্ষে আদর্শ ছিল। আবার লাঙল চালানাে যেত না, এমন জমিও ছিল। হলচালানাের পক্ষে প্রশস্ত জমিকে অষ্টাধ্যায়ীতে সুহলি বলা হয়েছে (৬/২/১৮৭)। হল ব্যবহারের অনুপযােগী জমি অষ্টাধ্যয়ীতে অহলিরূপে আখ্যাত। যে জমিতে হল চালনা কষ্টসাধ্য সে জমি দুহলি (৫/৪/১২১)। অষ্টাধ্যায়ীর সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, বিশেষ বিশেষ জমিতে বিশেষ বিশেষ ফসল উৎপন্ন হত (৫/২/১-৪)। যে জমিতে ব্রীহি ধান উৎপন্ন হত, সে জমি ব্রৈহেয়, যে জমিতে শালি ধান ফলানাে হত, সে জমি শালেয়, যে জমিতে তিলের চাষ হত, সে জমি তিল্য বা তৈলীন, যে জমিতে মাষ উৎপাদিত হত, সে জমি মায্য বা মাষীণ, যব উৎপন্ন হত যে জমিতে, সে জমি যব্য। যষ্টিকা ধান জন্মাত, এমন জমি যষ্টিক্য।

কৃষির যন্ত্রপাতি : কৃষির কাজে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার হত সমকালীন সাহিত্যে তার কিছু পরিচয় আছে। পাণিনি কাঠের ‘হল’ বা লাঙলের কথা বলেছেন। আবার লাঙলে যে কখনও কখনও লােহার ফল বা ফলা (অয়ােবিকার) ব্যবহার করা হত, তারও উল্লেখ করেছেন (৪/১/৪২)। পাণিনি কোদাল, নিড়ানি ও কাস্তেরও উল্লেখ করেছেন। অষ্টাধ্যায়ীতে কোদালকে বলা হয়েছে খনিত্র (৩/২/১৮৪) ও আখন বা আখান (৩/৩/১২৫), নিড়ানিকে স্তন্বঘ্ন (৩/৩/৮৩), কাস্তেকে দাত্র (৩/২/১৮২) ও লবিত্র (৩/২/১৮৪)। কৃষির এসব যন্ত্রপাতি লােহার তৈরি। বৌধায়ন লােহার তৈরি ‘কুদ্দালিকা’ বা কোদালের উল্লেখ করেছেন। ‘সুত্তনিপাত’-এ লােহার ফলার কথা আছে। পাঞ্জাবের রােপার, উত্তরপ্রদেশের ঝাখেড়া ও কৌশাম্বী এবং বিহারের বৈশালী প্রভৃতি স্থানে সে যুগের লােহার ফলকযুক্ত লাঙল আবিষ্কৃত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকে লােহার ফলা লাঙলে নিয়মিত ব্যবহার হত না। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের স্বল্পতা তাে তাই বলে। মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা উত্তর ভারতের নরম মাটিতে কাঠের ফলা ব্যবহার করেও পর্যাপ্ত ফসল ফলানাে যেত। এই অঞ্চলে লােহার লাঙলের ফলার ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় আরও শতাব্দী কাল পরে।

খাদ্য-শস্য : খাদ্যশস্যের মধ্যে ধান অবশ্যই মুখ্য স্থান অধিকার করেছিল। শালি, ব্রীহি, মহাব্রীহি, হায়ন, ষষ্টিকা ও নীবার, এই ছয় প্রকার ধানের উল্লেখ করেছেন পাণিনি। যাগ-যজ্ঞে ব্রীহি ধানের বহুল ব্যবহার ছিল। প্রভূত ব্রীহি ধানের অধিকারী যিনি, তিনি ব্রীহিমান। এই ব্রীহি হতেই বহুব্রীহি সমাসের নামকরণ। তৈত্তিরীয় সংহিতায় ব্রীহিকে শরৎকালীন ফসলরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বন্য যে ধান বা যে ধান আপনা-আপনি জন্মায়, তা নীবার। নীবার অকৃষ্টপচ্য ফসল। পাণিনি ফসলকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন – কৃষ্টচ্য ও অকৃষ্টপচ্য। যে ধান ৬০ দিনে পাকে তা ষষ্টিকা। (ষষ্টিকাঃ ষষ্টিরাত্রেণ পচ্যন্তে – ৫/১/৯০। কখনও কখনও বলা হয়, পাণিনি শালি ধান উৎপাদনে মগধের খ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। আসলে এ ধরনের উক্তি পাণিনি করেননি, করেছেন পতঞ্জলি।) জৈন সাহিত্যে চার ধরনের শালি ধানের কথা আছে – কলমশালি, রক্তশালি, মহাশালি ও গন্ধশালি। চারা রােপণ করে শালি ধানের চাষ হত। বীজতলায় শালিধানের বীজ বপন করা হত। বীজ ফুটে অঙ্কুর বের হলে চারাগাছগুলোকে মূল জমিতে রােপণ করা হত। ধানচাষে রােপণ পদ্ধতির প্রয়ােগে এই পর্বে ধানের উৎপাদন উল্লেখজনকরূপে বৃদ্ধি পায়। যে সমাজে ধান প্রধান খাদ্য, সে সমাজ সাধারণত জনবহুল হয়। অনুমান করা যায়, এই পর্বে গাঙ্গেয় উপত্যকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ধান ছাড়া অন্যান্য খাদ্যশস্যের মধ্যে ছিল গম, যব, বাজরা, ভুট্টা, মাষকলাই, মুগ, এর, তিল, সরষে, পান, বেগুন, মুলা, উচ্ছে, শশা, পেঁয়াজ, রসুন, লাউ, আদা, ইক্ষু, লবঙ্গ, হলুদ, গােলমরিচ ও লঙ্কা। অষ্টাধ্যায়ী ও বৌদ্ধ সাহিত্যে আখের গুড়াে উল্লেখ আছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে তুলাের চাষের কথা আছে। নীলীর উল্লেখ আছে অষ্টাধ্যায়ীতে (৪/১/৪২)। কাত্যায়নের বার্তিকে বলা হয়েছে, নীলের গাছই নীলী। সংস্কৃত সাহিত্যে নীলের এটিই প্রাচীনতম উল্লেখ। পাণিনি শুধু ফসলেরই উল্লেখ করেননি, কখন কী বীজ বপন করতে হয়, তারও উল্লেখ করেছেন। তিনি বীজ বপনের পক্ষে যে তিনটি ঋতু বা মাস শ্রেষ্ঠ তা হল গ্রীষ্ম, আশ্বিন ও বসন্ত। গ্রীষ্মকালে উপ্ত বীজ হতে যে ফসল জন্মে তা গ্রৈষ্মক। এ ফসল পরিপক্ক হয় মার্গশীর্ষে, অর্থাৎ হেমন্তে। আশ্বিন মাসে বপন করা বীজ হতে উৎপন্ন ফসল আশ্বযুজক। যব ও গম এই শ্রেণিতে পড়ে। এ ফসল পরিণত হয় বসন্তকালে। বসন্তে উপ্ত বীজ থেকে যে ফসল উৎপন্ন হয়, তা বাসন্ত বা বাসন্তক। বর্ষায় এ ফসল পক্কতা লাভ করে। কোন অঞ্চলে কি ফসল জন্মায়, সে সম্পর্কে অষ্টাধ্যায়ীতে বিশেষ কোনও তথ্য পরিবেশিত হয়নি। পতঞ্জলির মহাভায্য হতে জানা যায়, উশীনর ও মদ্র (১/১৪৭) অঞ্চলের প্রধান ফসল যব, মগধের শালি ধান (১/১৯)।

সেচ ও ফলন : জমিতে সেচের কাজে পুকুর ও কূপের জল ব্যবহার করা হত। খালও খনন করা হত। কখনও কখনও নদীর বুকে জলাধার নির্মাণ করে সংরক্ষিত জল সেচের কাজে ব্যবহার করা হত। বৌদ্ধশাস্ত্র থেকে জানা যায়, শাক্য ও কোলিয়রা রােহিণী নদীতে এরূপ এক জলাধার নির্মাণ করেছিলেন। প্রতি বছরই যে নিয়মিত ফসল ফলানাে যেত তা নয়। বন্যা, খরা, কীট-পতঙ্গের উপর ইত্যাদি কারণে ফসলের ক্ষতি হত। মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত।

শিল্প ও বাণিজ্য

বয়ন শিল্প : জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে কৃষির পরই ছিল বয়নশিল্পের স্থান। সুতি, পশম, রেশম ও ক্ষৌমের বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র তৈরি হত। শাসকগােষ্ঠী ও অভিজাত মহলে কারুকার্যময় সুদৃশ্য বস্তু জনপ্রিয় ছিল। বারাণসী, শ্রাবস্তী, কৌশাম্বী, চম্পা, বৈশালী, কুসিনার, মিথিলা প্রভৃতি শহর বস্ত্রশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।

লৌহশিল্প : লােহার ব্যাপক ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে লৌহশিল্পের উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি হয়। লােহা পাওয়া যেত ঝাড়খণ্ডের সিংহভূম ও ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলায়। লােহার সহজলভ্যতা এই অঞ্চলে লৌহশিল্পের বিকাশের পথ সুগম করেছিল। গৃহস্থালি, কৃষি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রয়ােজনে এ সময় প্রচুর লােহার যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হয়। গৃহস্থালি দ্রব্যের মধ্যে ছুরি, হুক, পেরেক, বাটালি, তুরপুন, কুঠার, হাতা ও পাত্র এবং অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছােরা, তরবারি, বল্লম, তিরের ফলক, তীক্ষ্ণ খোঁটা ও বর্ম বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে লােহার তৈরি সে যুগের বিভিন্ন জিনিস উত্তরপ্রদেশের অত্রঞ্জিখেড়া, নােহ, কৌশাম্বী, প্রদপুর, রাজঘাট, ম্যাসন, মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী ও এরাণ এবং বিহারের চিরান্দ, বৈশালী, পাটনা, শােণপুর, চম্পা প্রভৃতি স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে।  তবে এ প্রসঙ্গে দুটি জিনিস মনে রাখা দরকার। প্রথমত, উচ্চ গাঙ্গেয় অববাহিকায় যে পরিমাণ লােহার উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় তেমনটি পাওয়া যায়নি। তার অর্থ এই নয় যে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় লােহার ব্যবহার কম ছিল। আর্দ্র জলবায়ুর প্রভাবে লােহার তৈরি সে কালের বেশির ভাগ জিনিসপত্র হয়তাে বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া, প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন অল্প কয়েকটি নগর এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, কৃষির কেন্দ্র সেই গ্রামাঞ্চলে বড় একটা হয়নি। খননকার্য ব্যাপক হলে ছবিটা হয়তাে স্পষ্ট হতাে। দ্বিতীয়ত, উচ্চ গাঙ্গেয় উপত্যকায় লােহার জিনিসের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র বেশি। মধ্য গাঙ্গেয় অঞ্চলে গৃহস্থালির উপকরণই অধিক। এর থেকে মনে হয়, উচ্চ গাঙ্গেয় উপত্যকার তুলনায় মধ্য গাঙ্গেয় অববাহিকায় লােহা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সমধিক গুরুত্ব লাভ করেছিল। বৌদ্ধ সাহিত্যে লৌহশিল্পীকে ‘কম্মার’, ‘কম্মারপুত্ত’ বলা হয়েছে। কম্মারপুত্ত কথাটির মধ্য দিয়ে কর্মকারের বংশানুক্রমিক পেশার ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।

মৃৎশিল্প ও উদীচ্য কৃষ্ণচিক্কণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি বা নর্দার্ন ব্ল্যাক পলিশড অয়ার কালচার : অগ্রগতি ঘটেছিল মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রেও। এ সময় থেকেই কড়া পালিশের তথাকথিত উদীচ্য কৃষ্ণবর্ণের পাত্রগুলো নির্মিত হতে থাকে। পূর্ববর্তী যুগের চিত্রিত ধূসর বর্ণের মৃৎপাত্রের তুলনায় এদের কারিগরি কলাকৌশল অনেক উন্নত। উৎকৃষ্ট মাটি দিয়ে কুমােরের চাকের সাহায্যে এই ধরনের মৃৎপাত্র তৈরি হত। তারপর পাত্রগুলোকে উন্নত ধরনের চুল্লিতে নিয়ন্ত্রিত আঁচে পুড়িয়ে কালাে করা হত। পরে পাত্রগুলোর গায়ে উজ্জ্বল, মসৃণ এক পালিশ লাগানো হত। এই অত্যুজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণের পাত্রগুলোর কয়েকটি আবার গড়নে, পালিশে ও কারিগরি উৎকর্যে অতি চমৎকার। এগুলো সম্ভবত ধনীর ঘরে বিলাসের উপকরণ হিসাবে শােভা পেত। এই তাজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণের পাত্রগুলোর কোনওটি থালা, কোনওটি বাটি, কোনওটির উঁচু কান, কোনওটির বা কান নীচু। এই পাত্রগুলো ছাড়া কালাে ও লাল রঙের আরও এক ধরনের মৃৎপাত্রের ব্যবহার এই সময় লক্ষ করা যায়। উত্তরপ্রদেশের রাজঘাট ও প্রহ্লাদপুর, বিহারের শােণপুর ও চিরান্দ এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার পাণ্ডুরাজার ঢিপিতে এই শ্রেণির মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই শেষােক্ত শ্রেণির মৃৎপাত্রই সংখ্যাগরিষ্ঠ, গুণগত মানেও অনুন্নত। প্রথমােক্ত শ্রেণির তুলনায় এগুলো অতি সাধারণ, আটপৌরে। এরূপ অনুমানের পেছনে দু’টি কারণ বর্তমান। প্রথমত, যেসব প্রত্নস্থলে উদীচ্য কৃষ্ণচিক্কণ মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে, সেখানে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের মধ্যে তারাই সংখ্যালঘু। দ্বিতীয়ত, বেশ কিছু কৃষ্ণচিক্কণ মৃৎপাত্রের গায়ে মেরামতির চিহ্ন বিদ্যমান। অনুমিত হয়, এগুলো দুর্লভ পাত্র, তাই ভেঙ্গে গেলে বা ব্যবহারের অনুপযােগী হয়ে পড়লে এগুলোকে তৎক্ষণাৎ ফেলে না দিয়ে সংস্কার করে পুনরায় ব্যবহার করা হত। তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে। বারাণসীর নিকটবর্তী রাজঘাটে আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রের প্রায় অর্ধাংশই উদীচ্য কৃষ্ণচিক্কণ শ্রেণিভুক্ত। আবার মহাস্থানে প্রাপ্ত এই শ্রেণির মৃৎপাত্রের গায়ে কোনও মেরামতির চিহ্ন দেখা যায় না; যে পাত্রগুলোতে এই স্বার বিধূত, তারা সবই আটপৌরে শ্রেণির।

পূর্বে উদীচ্য কৃষ্ণচিক্কণ মৃৎপাত্রের বা নর্দার্ন ব্ল্যাক পলিশড অয়ারের সূচনা পর্ব আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধার্য করা হত। কিন্তু বর্তমানে অনেকে মনে করেন, কৃষ্ণোজ্জ্বল মৃৎপাত্রের প্ররম্ভিক পর্ব আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কোনও কোনও বিদ্বজ্জন এই পর্ব ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে শুরু হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। দাবি করা হচ্ছে, প্রাপ্ত প্রত্ন-অভিজ্ঞান ও রেডিওকার্বন পরীক্ষায় এই মত সমর্থিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একই প্রত্নক্ষেত্রের বিভিন্ন নিদর্শনের উপর রেডিও-কার্বন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে বস্তুভেদে নির্ণীত তারিখে পার্থক্য দেখা দেবে। তাছাড়া, প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষকেরা জানেন, পূর্ববর্তী যুগের অভিজ্ঞানের পরবর্তী পর্যায়ভুক্ত ভূস্তরে বিদ্যমানতা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। অর্থাৎ উদীচ্য কৃষ্ণচিক্কণ মৃৎপাত্রের সূচনাকাল সম্পর্কে অনিশ্চয়তার নিরসন ঘটেছে, এ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে। ভারতের সর্বত্র একই সময় উদীচ্য কৃষ্ণচিক্কণ মৃৎপাত্রের আবির্ভাব ঘটেনি। রাজগির ও চারসর্দায় এই শ্রেণির মৃৎপাত্রের আবির্ভাব ঘটেছে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতকে, চিরান্দ ও উত্তরপ্রদেশের হেতিমপুরে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতকে। 

মৃৎপাত্র ছাড়া মৃৎশিল্পীরা নানা ধরনের পােড়ামাটির খেলনাও তৈরি করতেন। মৃৎশিল্পীদের অনেকেরই অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল। ‘উবাসগদসাও’ গ্রন্থে সন্দালপুত্ত নামে এক ধনাঢ্য কুম্ভকারের কথা আছে। তিনি চার-পাঁচ শাে দোকানের মালিক ছিলেন। মেয়েরাও মৃৎশিল্পে অংশ গ্রহণ করতেন। শ্রাবস্তীর এক ধনী মহিলা মৃৎশিল্পীর বাড়িতে আচার্য গােসল দীর্ঘদিন বাস করেছিলেন।

উদীচ্য চিক্কন কৃষ্ণ মৃৎপাত্র সংস্কৃতি বা নর্দার্ন পলিশড ব্ল্যাক অয়ার কালচার (খ্রি.পূ. ৭০০ – ২০০ অব্দ)

অন্যান্য শিল্প : স্বর্ণকার ও মণিকারেরা সােনা, রূপা, মুক্তা, দামী পাথর ও হাতির দাঁতের বিভিন্ন প্রকার সুদৃশ্য অলংকার তৈরি করতেন। ধনী লােকেরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শােভাবর্ধনের জন্য নানা ধরনের অলংকার পরতেন। হাতি, ঘােড়া ও রথগুলোকেও অনেক সময় অলংকার দিয়ে সাজানাে হত। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে গােমেদ, স্ফটিক, লােহিতাক্ষ, মরকত, ইন্দ্রনীল, বৈদূর্য, চন্দ্রকান্ত, সূর্যকান্ত ইত্যাদি নানা মূল্যবান পাথর, প্রবাল ও মুক্তার উল্লেখ আছে। হাতির দাঁত বনাঞ্চল থেকে সংগৃহীত হত। তবে তা বিত্তবান মানুষের শখ মেটাত, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে তার কোনও যােগ ছিল না। উত্তরপ্রদেশের শ্রাবস্তীতে ল্যাপিস লাজুলির মতাে মূল্যবান পাথরের পুঁতি পাওয়া গেছে। এসব দুর্মূল্য জিনিসও ধনী ব্যক্তিদেরই ভােগে লাগত। 

দারুশিল্প : বাড়ি-ঘর ও আসবাবপত্র তৈরির কাজে দারুশিল্পীদের ডাক পড়ত। তখনকার দিনে বাড়ি-ঘর সাধারণত কাঠ দিয়েই তৈরি হত। দারুশিল্পীরা জলযান, বাহন, গাড়ি, রথ ও যন্ত্র তৈরি করতেন।

চর্মশিল্প : সে যুগের চর্মশিল্পও বেশ উন্নত ছিল। চর্মকার বা পাকারেরা প্রধানত পাদুকা তৈরি করলেও চামড়া দিয়ে তারা আরও নানা জিনিস প্রস্তুত করতেন। সিংহ, বাঘ, বিড়াল, পেঁচা প্রভৃতি পশু পাখির চামড়া দিয়ে পাদুকা তৈরি হত। পাদুকা ছিল নানা রঙেরনীল, হলুদ, লাল, পিঙ্গল, কালাে, কমলা ইতাদি। পাদুকায় কখনও কখনও দামী পাথর বা সােনা বসানাে হত।

বৃত্তির দ্বিধা বিভাজন : সমকালীন বৌদ্ধ সাহিত্যে বৃত্তিকে প্রধানত দু’টি স্তরে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ওর দু’টি হল উক্‌কট্‌ঠ সিপ্‌প (উৎকৃষ্ট শিল্প) ও হীন সিল্প (হীন শিল্প)। কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য ইত্যাদি উৎকৃষ্ট বৃত্তি কিন্তু নলকার, কুম্ভকার, নহাপিত, চণ্ডাল, নিষাদদের বৃত্তি হীন বৃত্তি। অনেকে বলেন, স্বাধীনভাবে করণীয় শিল্পই উৎকৃষ্ট শিল্প বা বৃত্তি, এ বৃত্তিতে কারাের অধীনে থেকে কাজ করতে হয় না। কারাের অধীনস্থ হয়ে যে বৃত্তি সম্পাদন করতে হয়, সে বৃত্তি হীন বৃত্তি। বৃত্তি বিভাজনের এটিই যে মূল কারণ তা বােধ হয় না। বৃত্তি বিভাজনের ভিত্তি হবে বৃত্তির প্রকৃতি বা স্বরূপ, কর্মীর স্বাধীনতা বা অধিকারহীনতার মাপকাঠিতে নয়। আসলে যে বৃত্তি অত্যধিক শারীরিক শ্রমনির্ভর, সেই বৃত্তিই হীন বৃত্তি। অর্থাৎ তৎকালীন সমাজ কায়িক শ্রমকে সুনজরে দেখত না।

শিল্পের স্থানীয়করণ : সমকালীন শিল্পের ক্ষেত্রে স্থানীয়করণের একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বিশেষ বিশেষ শিল্পিগােষ্ঠী বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়ে তাদের কাজকর্ম চালাচ্ছে প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে এ ধরনের অনেক উল্লেখ আছে। সব সময় না হলেও কখনও কখনও এরূপ ঘটনা ঘটত। ‘উবাসগদসাও’-তে একটি গ্রামের কথা আছে যেখানে ৫০০ জন কুমােরের বাস ছিল। বিনয়পিটকে নলকারগ্রামের উল্লেখ আছে। প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে দারুশিল্পী, কর্মকার, তন্তুবায় প্রভৃতি শিল্পোপজীবীদের পৃথক পৃথক গ্রামের কথা আছে।

ব্যবসা-বাণিজ্য : মধ্য গাঙ্গেয় অববাহিকায় একদিকে যেমন কৃষি ও শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল অন্যদিকে তেমনি তারই ফলশ্রুতিরূপে ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটল। এক একটি অঞ্চল এক একটি শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্ররূপে গড়ে উঠল। বিদিশা ও দক্ষিণাপথ বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। কম্বােজ ও পুণ্ড বা উত্তর বাংলা যথাক্রমে ঘােড়া ও কালাে গরুর জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করল। চম্পা, রাজগৃহ, বৈশালী, বারাণসী, উজ্জয়িনী ও কৌশাম্বী বাণিজ্যিক কেন্দ্ররূপে আত্মপ্রকাশ করল।

যােগাযােগ : অঞ্চলে অঞ্চলে যােগাযােগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি ঘটল, রাজপথযােগে একটি অন্যটির সঙ্গে সংযুক্ত হল। সে সময়কার অতি বিখ্যাত এক রাজপথ উত্তরাপথ। পাণিনি এর উল্লেখ করেছেন। তক্ষশিলা, শাকল, ইন্দ্রপ্রস্থ, মথুরা, কৌশাম্বী ও বারাণসী হয়ে পথটি প্রথমে রাজগৃহ ও পরে পাটলিপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তক্ষশিলা থেকে একটি পথ চলে গিয়েছিল উত্তরে কাশ্মীরের দিকে, অন্যটি পুষ্কলাবতী হয়ে একেবারে আফগানিস্তানের ব্যাক্ট্রিয়া বা বল্‌খ অভিমুখে। রাজগৃহ থেকে একটি পথ কৌশাম্বী, বিদিশা, গােনৰ্দ, উজ্জয়িনী, মাহিষ্মতী হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। প্রতিষ্ঠান ও ভৃগুকচ্ছের মধ্যে সংযােগরক্ষাকারী এক পথ ছিল। রাজগৃহ থেকে একটি পথ মথুরা, শাকল হয়ে সিন্ধু ও সৌবীর অঞ্চলে চলে গিয়েছিল। স্থলপথ ছিল বিপদসংকুল। দস্যু ও বন্য প্রাণীর উপদ্রব তাে ছিলই, তার উপর ছিল খাদ্য ও পানীয়ের অভাব। বণিকরা সাধারণত দলবদ্ধ হয়ে বলদ, ঘােড়া ও গাধায় টানা গাড়িতে মাল বােঝাই করে স্থান থেকে স্থানান্তরে যাতায়াত করতেন। ভ্রাম্যমান বণিকদের দলপতিকে ‘সার্থবাহ’ বলা হত। ‘দীঘনিকায়’-তে এক সার্থবাহের কথা আছে যিনি হাজার শকট নিয়ে মরু অঞ্চল পাড়ি দিয়েছিলেন। ঐ গ্রন্থে আর একজন সার্থবাহের উল্লেখ আছে যিনি গুড়ের জালাভর্তি পাঁচশাে শকট নিয়ে বাণিজ্যে গিয়েছিলেন। নদীপথেও বণিকরা যাতায়াত করতেন। তাতে বিপদ কম ছিল, সময় বাঁচত, খরচও কম হত।

সামুদ্রিক বাণিজ্য : প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে সামুদ্রিক বাণিজ্য ও সামুদ্রিক জলযানের উল্লেখ আছে। ‘দিশাকাক’ নামে এক রকম পাখি ছিল যাকে নাবিকরা জলযান থেকে উড়িয়ে দিয়ে অনুসরণ করে অগ্রসর হতেন।শঙ্খজাতকে বারাণসীর এক ব্রাহ্মণ বণিকের কথা আছে যিনি সুবর্ণভূমি অর্থাৎ মায়ানমার ও ইন্দোচিনের উদ্দেশ্যে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন। মহাজনকজাতকে এক রাজকুমারের উল্লেখ আছে যিনি ৩৫০ জন অনুচর সহ সমুদ্রপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। তবে জাতকে ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যের যে ছবি অঙ্কিত হয়েছে তাতে সমকালীন যুগের কতখানি প্রতিফলন আছে বলা কঠিন। অনেকেই জাতকগুলো খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের পূর্ববর্তী নয় বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের সপক্ষে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। বিরস্‌ নিমরুদে নেবুচাদনেজারের (৬০৪-৫৬২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) যে প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া গেছে তাতে ভারতীয় কাঠের ব্যবহার দেখা যায়। উর-এ নেবুচেদনেজার চন্দ্রদেবের যে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তাতেও ভারতীয় কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। এ বাণিজ্য চলত স্থল ও জলপথে। ভারত থেকে রপ্তানি হত বনৌষধি, মুক্তা, হীরা, প্রবাল, স্ফটিক, লােহা, তামা, চন্দন কাঠ, পশুচর্ম, সুতিবস্ত্র, মসলিন, গজদন্ত, সুগন্ধি, নীলকান্ত মণি ও কচ্ছপের খােলা। বিদেশ থেকে আমদানি হত নানা ধরনের বস্ত্র, সুগন্ধি, ওষধি, কাচ, টিন, দামী পাথর ও রঙ।

গিল্ড বা পেশাদারি সংগঠন : খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে কারিগরি শিল্পে ও বিভিন্ন জীবিকায় একটি উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন ঘটল। সেটি হল পেশাদারি সংগঠন বা গিল্ডের প্রতিষ্ঠা। এ সময় থেকে বণিক, শিল্পী ও কারিগরেরা বৃত্তিমূলক সংগঠন গঠন করে নিজেদের সুগঠিত, সংঘবদ্ধ করেন। এক একটি স্থানে এক একটি শিল্প বা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে এক একটি শিল্পী বা বণিক সংগঠন গড়ে ওঠে। অর্থাৎ, এক একটি সংগঠন একই শহর বা গ্রামের একই বৃত্তির লােকদের নিয়ে গঠিত ছিল। এই সংগঠন ছিল মালিকদের, শ্রমিকদের নয়। সংগঠনের সদস্যদের বর্ণ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু বৃত্তি অভিন্ন। এই সংগঠনগুলোকে সাধারণভাবে ‘শ্রেণী’, ‘পুগ’, ‘গণ’ বা ‘সংঘ’ বলা হত। বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধগ্রন্থ এই জাতীয় বৃত্তিমূলক সংগঠনের গঠন ও কার্যাবলির উপর প্রভূত আলোকপাত করে। প্রতিটি সংগঠনের একজন করে সভাপতি ছিলেন। তাকে ‘প্রমুখ’ বা ‘জ্যেষ্ঠক’ বলা হত। বণিক সংগঠনের প্রধানকে ‘শ্রেষ্ঠী’ বলা হত। কখনও কখনও তাকে ‘মহাশ্রেষ্ঠী’ আখ্যা দেয়া হত। অনেক সময় দু’টি বা তারও অধিক সংগঠন সংযুক্ত হয়ে সম্মিলিত সংগঠন গঠন করত। প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে এ ধরনের সম্মিলিত সংগঠনের প্রধানকে কখনও কখনও ‘ভাণ্ডাগারিক’ বলা হয়েছে। সম্ভবত জরুরি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের নির্দেশেই বিভিন্ন সংগঠনের এরূপ সংযুক্তীকরণ ঘটত। সম্মিলিত সংগঠনের দায়িত্ব সাধারণত কোনও এক রাজপুরুষের উপরই ন্যস্ত হত। সংগঠনগুলো ছিল স্বশাসিত সংস্থা। প্রতিটি সংগঠনের নিজস্ব আইনকানুন ছিল। সরকার সাধারণত শ্রেণীর কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না। সদস্যদের উপর সংগঠনের অবাধ নিয়ন্ত্রণ ছিল। সদস্যদের মধ্যে কোনও বিরােধ দেখা দিলে বা কোনও সমস্যার সৃষ্টি হলে তার সমাধান করত সংগঠন, দাম্পত্যকলহের নিষ্পত্তির ভারও সংগঠনের উপর ছিল। সদস্যদের শৃঙ্খলা ও একতার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হত। জাতকের এক কাহিনী থেকে জানা যায়, একবার ১০০টি ছুতোর পরিবার রাতারাতি তাদের পুরানাে বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। সংগঠনগুলো কখনও কখনও ব্যাঙ্কের কাজ করত। লােকেরা সুদের বিনিময়ে সংগঠনগুলোতে টাকা গচ্ছিত রাখতেন, সংগঠনগুলো ওই টাকা ব্যবসায়ে খাটাত বা চড়া সুদে অন্যকে ধার দিত।

মুদ্রার প্রচলন ও তৌলরীতি

কার্ষাপণ : এই পর্বের আর একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য ধাতব মুদ্রার প্রবর্তন। প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘কার্ষাপণ’ নামে সােনা, রূপা ও তামার তৈরি তিন ধরনের মুদ্রার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে যে হাজার হাজার ছাপমারা বা অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে তাই এই “কার্ষাপণ”। এই মুদ্রাগুলো অতি আদিম এক পদ্ধতিতে তৈরি হত। প্রথমে ধাতু পিণ্ড গলিয়ে পরিশােধন করা হত। পরে পরিশুদ্ধ ধাতুর সঙ্গে খাদ মিশিয়ে তাকে গলিয়ে পাত তৈরি করা হত। এর পর পাতটিকে পরিমাপ মত খণ্ডে খণ্ডে কেটে খণ্ডগুলোকে একটু গরম করে তাদের পিঠে সজোরে ছাপ মারা হত। সাধারণত ধাতুখণ্ডের পেছন দিকে কোনও ছাপ থাকত না, যদিওবা থাকত তারা সংখ্যায় কম হত, আকারেও ছােটো হত। ছাপগুলো দেখতে নদী, পাহাড়, স্তুপ, গাছ, সূর্য, স্বস্তিকা চিহ্ন ইত্যাদির মতাে। আসলে এগুলো বণিকসভা, রাজা, স্থানীয় প্রশাসক, মুদ্ৰাপরীক্ষক, টাকশাল প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের প্রতীক। মুদ্রাগুলোর আকার ছিল বিভিন্ন – গােল, আয়ত, চৌকো। প্রথম দিকে কার্ষাপণমুদ্রা হয়তাে কাশী-কোসল-মগধ অঞ্চলেই প্রচলিত ছিল, পরে তা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। বণিকসমাজই হয়তাে প্রথম মুদ্রা চালু করে কিন্তু পরে মুদ্রার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুদ্রায় বৈদেশিক প্রভাব নিয়ে বিতর্ক : বিদেশের অনুকরণে ভারতে প্রথম মুদ্রার প্রচলন হয় বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। গ্রিক মুদ্রার প্রভাবে ভারতে মুদ্রা প্রবর্তিত হয়েছে এ মতের প্রবক্তা এইচ. এইচ. উইলসন ও জেমস প্রিনসেপ। জন এলান মনে করেন, গ্রিক মুদ্রার প্রভাবে নয়, ইরানের সুপ্রাচীন আকিমেনীয় রাজাদের সিগলয় (Sigloi) মুদ্রার আদলে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের শেষের দিকে বা খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর সূচনাপর্বে ভারতে মুদ্রার প্রচলন হয়েছে (Catalogue of The Coins Of Ancient India (London, 1936). পৃ. Lxxil)। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতার ফলে ব্যাবিলােনীয় মুদ্রার অনুকরণে ভারতে মুদ্রা প্রবর্তিত হয়, এ অভিমত কেনেডির। ভিনসেন্ট স্মিথ ব্যাবিলােনীয় প্রভাবের কথা বলেননি কিন্তু বৈদেশিক বণিকদের সাহচর্যের ফলেই যে এদেশে খ্রিস্টপূর্ব ৭ম-৬ষ্ঠ শতকের মুদ্রা প্রচলন হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি সুনিশ্চিত (Catalogue Of The Coins In The Indian Museum, Vol. পৃ. ১৮৩)। ই.জে. র‍্যাপসন ভারতীয় মুদ্রার উদ্ভবে বৈদেশিক অনুপ্রেরণা স্বীকার করেননি; ভারতীয় মুদ্রা ভারতের নিজস্ব উদ্ভাবন, এই অভিমত তার (Indian Coins, পৃ. ২)। আলেকজান্ডার কানিংহামের কণ্ঠেও একই অভিমত ধ্বনিত হয়েছে; তিনি ভারতীয় মুদ্রার উদ্ভবকাল ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধার্য করতেও কুণ্ঠিত নন (Coins of Ancient India, পৃ. ৪৩)। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের বদ্ধমূল ধারণা, বৈদিক সাহিত্যে, এমনকি ঋগবেদে, মুদ্রার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে (Carmichael Lectures (Calcutta, 1921) পৃ. ৭১)। বৈদিক যুগের সূচনা আনুমানিক ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, উইন্টারনিৎস-এর এই অভিমতের বিরুদ্ধে তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন, খিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মধ্যভাগে ভারতে মুদ্রার প্রচলন হয়। ভারতীয় মুদ্রার ইতিহাস আদি বৈদিক যুগ থেকে শুরু হয়েছে, এ কথা মানতে রাজি নন অনন্ত শদাশিব অলতেকর, (The Journal of The Numismatic Society Of India, Vol. XV, পৃ. ১-২৬), কিন্তু তিনি পরবর্তী বৈদিক পর্বে (তার মতে আনুমানিক ১৫০০-৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নিষ্ক, সুবর্ণ, শতমান ও পাদ শ্রেণির মুদ্রার প্রচলনের সপক্ষে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

ভারতবর্ষে মুদ্রার উদ্ভাবনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ : কিন্তু বর্তমানে উৎখনন ও বিভিন্ন সূত্র হতে আহৃত তথ্যের আলােকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশের প্রয়ােজনে, দেশীয় প্রযুক্তিতেই ভারতে মুদ্রার প্রচলন হয়েছে। ভারতীয় মুদ্রার উদ্ভবে যারা বৈদেশিক অনুপ্রেরণার কথা বলেন তাদের অভিমত যে কত অমূলক একটি উদাহরণেই তা স্পষ্ট হবে। যারা বলেন গ্রিকদের সংস্পর্শে আসার পর ভারতীয়রা মুদ্রার গুরুত্ব অবহিত হন তারা ভুলে যান, আলােকজান্ডারের অভিযানের পূর্বেই ভারতে রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল। প্রাচীন রােমক লেখক কুইন্টাস কার্টিয়াসের বিবরণে আছে, আলেকজান্ডার সসৈন্যে তক্ষশিলায় পৌঁছলে রাজা আম্ভি তাকে বহু সংখ্যক সিগনাটি আরগেনটি (Signati argenti) প্রদান করেন। এই সিগনাটি আরগেনটি অবশ্যই রৌপ্যনির্মিত কার্ষাপণ মুদ্রা। প্রাক্-আলেকজান্ডার পর্বে যে ভারতে রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ছিল প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যেও তা প্রমাণিত। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ভিড়ঢিপিতে উৎখননকার্য পরিচালনা করে দ্বিতীয় ভূ-সংস্তর থেকে ১০৫৫টি রূপার ছাপমারা বা অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে; একই সঙ্গে পাওয়া গেছে আলেকজান্ডারের দুটি এবং ফিলিপ অরিডিউসের একটি মুদ্রা। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, উল্লিখিত তিনটি গ্রিক মুদ্রা একেবারে নতুন অবস্থায় রয়েছে কিন্তু ছাপমারা মুদ্রাগুলো দীর্ঘব্যবহারে মলিন ও জীর্ণ হয়েছে। কয়েকটি মুদ্রায় আবার দু’বার করে প্রতীক অঙ্কিত হয়েছে। বােঝা যায়, মুদ্রাগুলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হওয়ায় তাদের ছাপগুলো এত অস্পষ্ট হয় যে নতুন করে প্রতীক অঙ্কনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। সিদ্ধান্ত করা যায়, ভিড়ঢিপির মুদ্রাভাণ্ডারটি মৃত্তিকাগর্ভে প্রােথিত হবার পূর্বে সংশ্লিষ্ট মুদ্রাগুলো অন্তত দু’শ বছর ধরে প্রচলিত ছিল। ভিড়ঢিপির দ্বিতীয় ভূ-সংস্তরের আনুমানিক সময় খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ বা ৩য় শতাব্দী। এরও দুই শতাব্দী পূর্ব হতে ছাপমারা মুদ্রা প্রচলন ছিল, এরূপ অভিমতই সমীচীন বােধ হয়। অর্থাৎ আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পূর্ব হতেই এদেশে মুদ্রার প্রচলন ছিল। গ্রিক মুদ্রার অনুকরণে ছাপমারা মুদ্রা উৎকীর্ণ হলে তাদের আকারে, তৌলরীতিতে এবং প্রতীক ও লেখের ব্যবহারে এই প্রভাবের প্রতিফলন থাকত। তেমনটি কিন্তু ঘটেনি। গ্রিক মুদ্রা প্রধানত বর্তুলাকার; ছাপমারা মুদ্রা প্রায়শই আয়তাকার, বর্গাকার, কদাচিৎ গােলাকার। গ্রিক মুদ্রা লেখ-উৎকীর্ণ, ছাপমারা মুদ্রা লেখ-বিহীন। গ্রিক মুদ্রার সামনের দিকে থাকে রাজার প্রতিকৃতি, পেছনের দিকে দেব-দেবীর প্রকৃতি। ছাপমারা মুদ্রায় অঙ্কিত থাকে বৃক্ষ, সূর্য, অর্ধচন্দ্র, নদী, পর্বত, স্থূপ, পশু, পাখি ইত্যাদির মূর্তি। গ্রিক মুদ্রার উভয় পিঠই অলংকৃত কিন্তু ছাপমারা মুদ্রার সাধারণত সম্মুখদিকই অঙ্কিত। গ্রিক মুদ্রা ছাঁচে ঢালা, ছাপনার মুদ্রা পেটানাে। তৌলরীতিতেও গ্রিক ও ভারতীয় মুদ্রা স্বতন্ত্র। একটি গ্রিক দ্রাকমার সাধারণ ওজন ৬৭.২ গ্রেন; একটি ছাপমারা বা কার্ষাপণ মুদ্রার সাধারণ ওজন-৫৬ গ্রেন। বস্তুত কোনও যুক্তিতেই ভারতের আদি মুদ্রাগুলোকে গ্রিক মুদ্রার অনুকরণরূপে চিহ্নিত করা যায় না।

কার্ষাপণ মুদ্রার ওজন : কার্ষাপণ মুদ্রার সাধারণ ওজন ৫৬ গ্রেন, এই বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করতে পারেন। সে কারণে বিষয়টি আর একটু বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রচীন ভারতীয় সাহিত্যে সােনা, রূপা ও তামার কার্ষাপণ মুদ্রার উল্লেখ আছে। সুবর্ণকার্ষাপণ মুদ্রার অস্তিত্ব এখনও সুপ্রমাণিত নয়। রৌপ্যকাৰ্যাপণই বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তামার কার্ষাপণ সংখ্যায় অল্প। সাহিত্যে সােনা ও রূপার কার্ষাপণের তৌলরীতির উল্লেখ আছে, তাম্ৰকার্ষাপণের ক্ষেত্রে সেরূপ তথ্য নেই। সুবর্ণকার্ষাপণের ওজন ছিল ৮০ রক্তিকা বা রতি, রৌপ্যকার্ষাপণের ৩২ রক্তিকা। রক্তিকা এক প্রকার বীজ। বীজে বীজে ওজনে পার্থক্য থাকবেই। আলেকজান্ডার কানিংহাম, এলিয়ট, দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর ও ভিনসেন্ট স্মিথ একটি রক্তিকা বীজের ওজন ১.৬৮ গ্রেন হতে ১.৮৩ গ্রেনে ধার্য করেছেন। এদের প্রত্যেকের মতই ভিন্ন। দীনেশচন্দ্র সরকার কানিংহােমের মত সমর্থন করেন (Studies In Indian Coins (Delhi, 1963) পৃ. ৪৮)। কিন্তু সুরেন্দ্রকিশাের চক্রবর্তী (Ancient Indian Numismatics, পৃ. ৪২) ও অনন্তসদাশিব অলতেকর (The Journal of the Numismatic Society of India, Vol. XV, পৃ. ৫) সমর্থন করেছেন দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের অভিমত। কানিংহাম তার Coins Of Ancient India (Varanasi, 1963) গ্রন্থের একস্থানে একটি রত্তিকা বীজের ওজন ১.৮ গ্রেনে ধার্য করেছেন (পৃষ্ঠা ৪৫) আবার গ্রন্থের অন্যত্র (পৃষ্ঠা ২) তিনি একটি রৌপ্যকার্ষাপণ মুদ্রার ওজন ৫৬ গ্রেন বলে উল্লেখ করেছেন। তার এই মত আপাতবিরােধী। ১ রক্তিকা ১.৭৫ গেরনের সমতুল্য, এই অভিমত গৃহীত হলে এক একটি বিশুদ্ধ রৌপ্যকার্ষাপণের ওজন হবে ৫৬ গ্রেন ; ১ রক্তিকার ওজন ১.৮৩ গ্রেন হলে একটি বিশুদ্ধ রৌপ্যকার্ষাপণের ওজন হবে ৫৮.৫৬ গ্রেন। প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধগ্রন্থে ‘মাষক’ নামে আর এক শ্রেণির মুদ্রার কথা আছে। চতুর্মাষক, ত্রিমাষক, দ্বিমাষক, অধর্মষক ইত্যাদি নামে মাষকের বিভিন্ন গুণিতক ও ভগ্নাংশ মূল্যের মুদ্রারও উল্লেখ পাওয়া যায়। মুদ্রা জনপ্রিয় হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বিনিময় প্রথাও পাশাপাশি চলছিল। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে তার প্রমাণ মেলে।

তৌল রীতি : জিনিসপত্রের পরিমাপ নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন মাপের ওজন ব্যবহার করা হত। সমকালীন সাহিত্যে আঢ়ক, পল, দ্রোণ, প্রস্থ ইত্যাদি মাপের ওজনের উল্লেখ আছে। আঢক, পল ইত্যাদির ওজন ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকম। ক্ষীরস্বামীর (১১শ শতক) মতে ৪ তােলায় ১ পলি বা মুষ্টি, ৪ পলে ১ কুড়ব, ৪ কুড়বে ১ প্রস্থ, ৪ প্রস্থে ১ আটক ও ৮ আড়কে ১ দ্রোণ। কিন্তু কুল্লূকভট্টের (১৩শ শতক) মতে ৪ তােলায় ১ পল বা মুষ্টি, ৮ মুষ্টিতে ১ কুঞ্চি, ৮ কুঞ্চিতে ১ পুষ্কল, ৪ পুষ্কলে ১ আটক এবং ৪ আটকে ১ দ্রোণ (D. C. Sircar, Studies in Indian Coins (Delhi, 1968) pp. 89-90)। অর্থাৎ, ক্ষীরস্বামীর মতে, ৬৪ মুষ্টি বা পলে ১ আঢক, কিন্তু কুল্লূকভট্টের মতানুসারে ২৫৬ মুষ্টি বা পলে ১ আঢক। ওজনের ব্যাপারে রাজাকে সজাগ থাকতে ধর্মসূত্রকার বশিষ্ঠের স্পষ্ট নির্দেশ আছে। ওজনে কারচুপি করলে বিক্রেতাকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা যাবে না, আপস্তম্ব এরূপ কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। বুদ্ধও ব্যবসায়ীদের ওজনে কৌশলের আশ্রয় নিতে নিষেধ করেছেন। পাথরের তৈরি সেকালের বিভিন্ন বাপের বাটখারা এরাণ, বৈশালী, চিরান্দ প্রভৃতি স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে।

নগর সভ্যতার বিকাশ ও দ্বিতীয় নগরায়ন

এ পর্বের আর এক উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য নগরায়ণের বিকাশ। হরপ্পীয় শহরগুলোর পতনের প্রায় হাজার বছর পর দ্বিতীয়বার ভারতে নগরায়ণের সূচনা হল। সাধারণত, শিল্প, বাণিজ্য ও প্রশাসনের কেন্দ্র হিসাবে এক একটি স্থান নগররূপে আত্মপ্রকাশ করে। নগরে চাষাবাদ হয় না, খাদ্যের জন্য নগরকে গ্রামের কৃষিজ উদ্বৃত্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক থেকে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় রাজতন্ত্র উত্তরােত্তর শক্তিশালী হতে থাকে। রাজশক্তি তার আমলা ও সেনাবাহিনীর ভরণপােষণ এবং নিজের স্বার্থে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের দিকে দৃষ্টি দেয়। এই উদ্বৃত্তের একটা অংশ রাজা রাজস্বরূপে গ্রহণ করতেন, বাকি অংশ বেসামরিক নগরবাসীর প্রয়ােজন মেটাত। এই কৃষিজ উদ্বৃত্তের সংস্থান না থাকলে নগরের অভ্যুদয়ের পথটিই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

নগরের অভ্যুত্থানের  কারণ : একটি শহরের অভ্যুত্থানের পেছনে এক বা একাধিক কারণ বর্তমান থাকে। কৃষিজ উদ্বৃত্তের সংস্থান নগর উদ্ভবের একটি মৌল কারণ। শহরের লােকেরা সাধারণত সরাসরি খাদ্যোৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন না, তারা কারিগরি শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সরকারি বেসরকারি নানা বৃত্তিতে লিপ্ত থাকেন। শহরে খাদ্যের যােগান নিয়মিত ও পর্যাপ্ত হলে তবেই শহরবাসীদের পক্ষে এধরনের জীবিকা গ্রহণ সম্ভব হয়। গ্রামাঞ্চলে ফলন উদ্বৃত্ত হলে সেই উদবৃত্ত খাদ্যশস্য শহরবাসীদের চাহিদা পূরণ করে। সেই প্রাচীন যুগে যখন যােগাযােগ ব্যবস্থা অনুন্নত ছিল তখন খাদ্যশস্যে সমৃদ্ধ গ্রামগুলোরই সন্নিকটে শহর গড়ে উঠত। শহর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর মধ্যে ছিল এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। গ্রাম শহরকে যােগাত খাদ্য আর কাঁচামাল, বিনিময়ে পেত শহরজাত শিল্পসামগ্রী ও প্রাত্যহিক জীবনের নানা প্রয়ােজনীয় উপকরণ। সন্দেহ নেই, কৃষির বিকাশে নগরায়ণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। নগর বিকাশের কারণগুলো হলো – 

  • প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক গুরুত্ব : প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক গুরুত্ব নগর-উদ্ভবের অবশ্যই একটি কারণ। রাজার বসতিস্থান স্বাভাবিক কারণে রাজ্যের পদস্থ রাজপুরুষ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাসস্থানরূপে গড়ে ওঠে, সৈন্যবাহিনীর আবাসস্থলরূপেও পরিগণিত হয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য স্থানটিতে কারিগরি শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশলাভ করে। রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পেলে রাজধানী হতে সমগ্র রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করা দুরূহ হয়, তখন রাজ্যের কয়েকটি স্থান প্রশাসনিক কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বারাণসী, কৌশাম্বী, চম্পা, রাজগৃহ ও শ্রাবস্তীর মতাে সমৃদ্ধশালী শহরগুলোর অভ্যুত্থানের মূলে ছিল এই রাজনৈতিক গুরুত্ব। উল্লিখিত প্রতিটি শহর ছিল কোনও-না-কোনও মহাজনপদের রাজধানী। তবে সবকটি শহরই যে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে গড়ে উঠেছিল, এমনটি নয়। কয়েকটি শহরের শুরু হয় আর একটু পূর্বে। এ প্রসঙ্গে কৌশাম্বীর নাম উল্লেখ করা যায়। বৎস মহাজনপদের রাজধানী কৌশাম্বী। এখানে পরানাে যুগের এক বিশাল প্রাকার আবিষ্কৃত হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, প্রাকারটি আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মিত হয়েছিল। আবার কেউ কেউ এটির নির্মাণপর্ব ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সামান্য কিছু পূর্বে ধার্য করেছেন। কিন্তু শহরটি যে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বেই গড়ে উঠেছিল তা সুনিশ্চিত। প্রায় একই সময় বারাণসী ও উজ্জয়িনী শহর দু’টির অভ্যুদয় ঘটে। অর্থাৎ এই শহর দু’টিরও সূচনাকাল প্রাক ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। বারাণসীর উত্থান হয় কাশী জনপদের রাজধানীরূপে, উজ্জয়িনীর বিকাশ হয় অবন্তি জনপদের রাজধানীরূপে।
  • কারিগরি শিল্পের বিকাশ : কারিগরি শিল্পের বিকাশ নগর অভু্যত্থানের আর একটি কারণ। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকে উত্তর-ভারতে কারিগরি শিল্পে ব্যাপক অগ্রগতি হয়। উন্নতি ঘটে শিল্পের বৈচিত্র্যে ও প্রসারে এবং উৎপাদনের পরিমাণে। জাতক সাহিত্যে আঠারাে রকম শিল্পের উল্লেখ আছে। দীঘনিকায়ে শিল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে আঠাশে গিয়ে পৌঁছেছে। বৌদ্ধ সাহিত্যে বার বার ‘সিপ্প’ বা ‘শিল্প’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ সময় লােহা, তামা ও রূপার ব্যবহার উল্লেখজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। লােহা দিয়ে শুধু যুদ্ধের অস্ত্রই তৈরি হত না, কৃষির কাজে ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও লােহার জিনিসপত্র ব্যবহৃত হত। মুদ্রা নির্মাণে রূপা ও তামার মতাে ধাতু প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হতে থাকে। ফলে লৌহকার, রৌপ্যকার ও কাংসকারদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। মৃৎশিল্পও উল্লেখজনকভাবে বিকাশ লাভ করে। এ সময় কৃষ্ণ-লােহিত ও উদীচ্য উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র নির্মিত হতে থাকে। পূর্ববর্তী চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের তুলনায় এই পাত্রগুলো অনেক উন্নত, অনেক দৃষ্টিনন্দন। এক প্রাচীন পালিগ্রন্থে সন্দালপুত্ত নামে বৈশালীর এক বর্ধিষ্ণু কুম্ভকারের কথা বলা হয়েছে যিনি পাঁচশাে মৃৎশিল্পীকে তার কারখানায় নিয়ােগ করেছিলেন। শিল্পের আবশ্যক কাচামাল যেখানে সহজলভ্য অথচ শিল্পজাত সামগ্রীর বিক্রয়ের সুবিধা আছে এমন স্থানেই শিল্পীরা তাদের বসতি নির্বাচন করেন। প্রথম প্রথম হয়তাে তারা অল্পবিস্তর কৃষির কাজও করতেন কিন্তু যতই শিল্পজাত সামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং উন্নততর কারিগরি দক্ষতা প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে, ততই তারা শিল্পকর্মের দিকে বেশি করে আকৃষ্ট হন এবং কৃষিকর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এভাবে এক একটি স্থানে বিভিন্ন শিল্প গড়ে ওঠে, শিল্প সংগঠনও তৈরি হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে সেস্থান আর গ্রাম থাকে না, স্বভাবতই নগরে পরিণতি লাভ করে।
  • ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি : ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি নগরের উদ্ভবের আর একটি কারণ। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকে কৃষি ও শিল্পের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। বহু লােক বণিজ্জা বা বাণিজ্যকে বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করেন। শকটে কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যাদি সাজিয়ে বণিকের দল স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন করতেন। অশ্ব ও গাে-বণিকেরা জীব-জন্তুর ব্যবসা করতেন। বাণিজ্যোপজীবীরা যাতায়াত করতেন স্থলপথে, কখনওবা নদীপথে। ফলে বণিকদের যাতায়াতের পথের ধারে, নদীতটে, কখনওবা নদী বা পথের সঙ্গমস্থলে বিপণন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। বিনিময়ের মাধ্যমরূপে এ সময় থেকে মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতির সঞ্চার হয়। বিপণন কেন্দ্রগুলো উত্তরােত্তর সমৃদ্ধশালী হয় এবং শহরের রূপ পরিগ্রহ করে। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত শহর পাটলিপুত্র খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে এক বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। তখন এর নাম ছিল পাটলিগ্রাম। দীঘনিকায় গ্রন্থে পাটলিগ্রামকে ‘পূটভেদন’ বলা হয়েছে। ‘পূট’-এর অর্থ আচ্ছাদন, আবরণ; ভেদনের অর্থ উন্মােচন, উন্মুক্ত। ‘পূটভেদন’ অর্থে এমন এক বিপণন কেন্দ্র বােঝায় যেখানে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাদের পণ্যসম্ভার উন্মুক্ত রাখেন। অর্থাৎ পাটলিগ্রাম তখনও পুরাে শহর হয়ে ওঠেনি। রাজা অজাতশত্রুর দুই মন্ত্রী সুনীধ ও বর্ষকারের আমন্ত্রণে সশিষ্য বুদ্ধদেব পাটলিগ্রাম পরিদর্শনে আসেন। পাটলিগ্রাম তখনও ‘পূটভেদন’ নয়। সবেমাত্র সেখানে একটি দুর্গ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু স্থানটির অবস্থানগত গুরুত্ব ছিল অসাধারণ। তিন তিনটি নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই স্থানটি সড়কযােগে উত্তর ভারতের বিখ্যাত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। স্থানটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে বুদ্ধদেবের দেরি হয়নি। তিনি ঘােষণা করেন, স্থানটি অচিরে পূটভেদনরূপে আত্মপ্রকাশ করবে এবং ভারতের এক শ্রেষ্ঠ নগরে পরিণত হবে। বুদ্ধদেবের এই ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয়নি। শীঘ্রই পাটলিগ্রাম মগধ সাম্রাজ্যের রাজধানীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানটির নতুন নামকরণ হয় পাটলিপুত্র।
  • ধর্মীয় গুরুত্ব : ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে কোনও কোনও স্থান নগরে পরিণত হয়। মহাবীর ও বুদ্ধদেবের স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন স্থান জৈন ও বৌদ্ধদের নিকট ছিল পবিত্র ভূমি, তীর্থক্ষেত্র। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধার্মিক ব্যক্তিরা এসব স্থান দর্শন করে ধন্য হতেন, পুণ্য অর্জন করতেন। সারা বছরই এখানে তীর্থযাত্রীদের সমাগম হত। পুণ্যার্থীদের সুবিধার জন্য তীর্থস্থানে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এতে বহু লােকের কর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত হয়। ঘন বসতিপূর্ণ হওয়ায় তীর্থক্ষেত্রগুলো সহজেই ব্যবসায়ী ও কারিগরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসব স্থান ধীরে ধীরে শহরের রূপ নেয়। এভাবেই কুশীনগর, কপিলাবস্তু, সারনাথ, শ্রাবস্তী, বৈশালী, বােধগয়া প্রভৃতি শহরের উদ্ভব হয়। 
  • রাজা-মহারাজদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ : কখনও কখনও রাজা-মহারাজদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে শহরের পত্তন হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে ম্যাসিডােনরাজ আলেকজান্ডার উত্তর-পশ্চিম ভারতে কয়েকটি শহর নির্মাণ করেন। কুষাণ সম্রাট কণিষ্কহুবিষ্ক যথাক্রমে কণিষ্কপুর ও হুবিষ্কপুর নামে দুটি শহর স্থাপন করেন। পাল নৃপতি রামপাল উত্তর বাংলায় রামাবতী নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকে ব্যক্তিগত উদ্যমে কোনও শহর নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায় না।
  • বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র : বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র এমন স্থানও কখনও কখনও নগররূপে আত্মপ্রকাশ করে। তক্ষশিলা শহরের উদ্ভবের এটিই মুখ্য কারণ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের চর্চা হত এখানে। বারাণসী, রাজগৃহ, উজ্জয়িনী, মিথিলা প্রভৃতি দূরবর্তী স্থান হতে বিদ্যার্থীরা উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য এখানে আসতেন। অনেক পরবর্তিকালের দুটি শহর নালন্দা ও বিক্রমশীল। জ্ঞানচর্চার পীঠস্থানরূপেই শহর দুটি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল।
  • একাধিক কারণের উপস্থিতি : শহরের উদ্ভব সম্পর্কে একটি কথা মনে রাখতে হবে। কখনও কখনও শহরের অভ্যুত্থানের মুলে একটি নয়, একাধিক কারণ বর্তমান থাকে। এ প্রসঙ্গে তক্ষশিলা নগরের কথা উল্লেখ করা যায়। শহরটি বিদ্যাচর্চার এক পীঠস্থান ছিল সন্দেহ নেই কিন্তু শহরটির বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বও কম ছিল না। অর্থাৎ শুধু শিক্ষাজনিত কারণেই তক্ষশিলার উদ্ভব হয়নি, স্থানটির নগরে উত্তরণের মূলে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক মাহাত্মও সমানভাবে কাজ করেছিল।

তদকালীন দক্ষিণ ভারতে নগরের উদ্ভব না হবার কারণ : উপরের আলােচনা থেকে আর একটি জিনিস স্পষ্ট হচ্ছে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-পঞ্চম শতকে ভারতে যে নগরায়ণ ঘটে গেল তা উত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল, বিন্ধ্যপর্বতমালার দক্ষিণে তার প্রসার হয়নি। এর কারণ ছিল কৃষিজ উদ্বৃত্ত উৎপাদন নগরায়ণের এক অপরিহার্য শর্ত। উদবৃত্ত উৎপন্ন না হলে নগরবাসীদের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে, নগরের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। এমত অবস্থায় সকলেই খাদ্যোৎপাদনে সচেষ্ট হন, ব্যবসা-বাণিজ্য, কারিগরি শিল্প এবং সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত হবার মতাে লােকের অভাব দেখা দেয়। উদ্বৃত্তের উৎপাদন নিয়মিত ও সুনিশ্চিত হলে তবেই নগরায়ণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। উন্নততর যন্ত্রপাতির ব্যবহার উদ্বৃত্ত উৎপাদনের কাজটি সহজ করে তােলে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক হতে উত্তর ভারতে লাঙলের ফলাটি লৌহ ধাতুতে নির্মিত হতে থাকে, তামার কুড়ল, কুঠার ইত্যাদির পরিবর্তে লৌহ উপকরণ ব্যবহৃত হতে থাকে। এতে ফলন বেশি হয়। দক্ষিণ ভারতে যে লােহার ব্যবহার ছিল না তা নয়। বস্তুত, এ অঞ্চলে লৌহ উপকরণ ব্যবহারের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ লােহার উপযােগিতা সম্পর্কে এখানকার লােকদের স্পষ্ট ধারণা ছিল। কিন্তু উদ্বৃত্তের সংস্থানের জন্য কৃষির কাজে উন্নততর প্রযুক্তির ব্যবহারই যথেষ্ট নয়। এ কাজে রাষ্ট্রের এক বিরাট ভূমিকা আছে। রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের ভরণপােষণের জন্য কৃষিজ উদ্বৃত্তের প্রয়ােজন। রাষ্ট্র তার নিজস্ব তাগিদেই উদ্বৃত্ত উৎপাদনে সচেষ্ট হয়। এই উদ্বৃত্ত রাষ্ট্র রাজস্বরূপে প্রজাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকে দক্ষিণ ভারতে কোনও রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক কাঠামাে উপজাতিচক্রের মধ্যেই আবর্তিত হয়। ফলে সেখানকার পরিবেশ নগরায়ণের অনুকুল ছিল না।

নগরের অবস্থা : তখনকার দিনের শহরগুলোর চেহারা কেমন ছিল সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মহাপরিনির্বাণসূত্র প্রভৃতি প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থাদির নগরবর্ণনায় আর শহরগুলোর প্রত্নাবশেষে। এসব গ্রন্থাদি থেকে জানা যায়, সেকালের শহরগুলো ছিল বিশাল আয়তনের। তাদের চারদিকে ছিল প্রাকার, কখনওবা প্রকার ও গভীর পরিখার বেষ্টনী। শহরে প্রবেশের জন্য ছিল তােরণশােভিত দ্বার। গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি শহরগুলোর শােভাবর্ধন করত। কর্মব্যস্ত বণিক ও পথচারীদের সমাগমে শহরগুলোর প্রশস্ত রাজপথ সর্বদা মুখরিত ছিল। কিন্তু সাহিত্যে নগরের যে ঐশ্বর্যময় চিত্র অঙ্কিত হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে তার ইঙ্গিত নেই। অত্রঞ্জিখেড়া, কৌশাম্বী, রাজঘাট, এরাণ, উজ্জয়িনী প্রভৃতি শহরে নগর-প্রাকারের অবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সে প্রাকার কাদামাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিল। ব্যতিক্রম ছিল শুধু রাজগৃহের প্রাকারটি। সেটি পাথর দিয়ে তৈরি। এই পর্বের গৃহ-সৌধাদি সবই কাদামাটি বা কাঠ দিয়ে নির্মিত হত। কুমরাহারে কাঠের তৈরি প্রাসাদের নিদর্শন পাওয়া গেছে। চুল্লিতে পােড়ানাে ইটের ব্যবহার তখনও শুরু হয়নি। সংগত কারণেই এ পর্বে নভােস্পর্শী সৌধের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। প্রাচীন নগরগুলোর নিকাশী ব্যবস্থাও আদিম পর্যায়ের। পরিবার-পরিজনদের ব্যবহৃত জল ও আবর্জনা বাড়ির প্রাঙ্গণেই জমা হত। রাস্তা বরাবর পয়ঃপ্রণালী খননের কোনও নিদর্শন নজরে আসেনি। উৎখননের ফলে বিভিন্ন আকার ও ধরনের উদীচ্য উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের অবশেষ পাওয়া গেছে। পাত্রগুলো সম্ভবত বিলাসের উপকরণরূপেই ব্যবহৃত হত। আবিষ্কৃত অন্যান্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে লােহা ও তামার অস্ত্রশস্ত্র ও গৃহস্থালির নানা উপকরণ এবং রূপা ও তামার ছাপমারা মুদ্রা। 

মগধের অভ্যুত্থান

মগধের অবস্থান ও অভ্যুত্থানের কারণ

এখন যেখানে দক্ষিণ বিহারের পাটনা, নালন্দা, গয়া, নাওয়াদা, ঔরঙ্গাবাদ ও জেহানাবাদ জেলা, প্রাচীন যুগে সে অঞ্চল মগধ নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক থেকে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক গুরুত্ব উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। কালক্রমে ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিরূপে মগধের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ভারতের রাজনীতিতে মগধের এই অভ্যুত্থানের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। এগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো –

প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : অসংখ্য পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা মগধকে ঘিরে রেখেছে। প্রকৃতির অকৃপণ সাহায্যে এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়েছে। মগধের প্রাচীন রাজধানী গিরিব্রজ বা রাজগৃহ। বৈহার, বরাহ, বৃষভ, ঋষিগিরি ও চৈত্যক এই পাঁচটি পাহাড় শহরটিকে বেষ্টন করে আছে। ফলে শহরটি প্রায় দুর্ভেদ্য হয়েছে। মগধের পরবর্তী রাজধানী পাটলিপুত্রও কম সুরক্ষিত নয়। এর একদিকে গঙ্গা, অন্যদিকে শােণ ও গণ্ডক। সন্দেহ নেই, এই সুরক্ষিত প্রাকৃতিক পরিবেশ মগধের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের এক প্রধান কারণ। 

সমৃদ্ধ কৃষি অর্থনীতি ও খনিজ সম্পদ : মগধ নদীমাতৃক অঞ্চল। পলিমাটির প্রভাবে এখানকার ভূমি উর্বর। নদীগুলোতে সারা বছরই জল থাকে। এখানে বৃষ্টিপাতও সাধারণত নিয়মিত হয়। ফলে এই অঞ্চলে যেমন লােকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি কৃষিকার্যেও ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। অনিবার্যরূপে কৃষি-অর্থনীতিতে মগধ সুসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। তখনকার দিনেই এখানকার জমিতে বছরে দু’বার করে ফসল ফলানাে হত। খাদ্য ও জনসম্পদের প্রাচুর্য এই অঞ্চলের উন্নতির পথ প্রশস্ত করেছিল। শুধু কৃষিজ সম্পদে নয়, খনিজ সম্পদেও মগধ উন্নত ছিল। সে যুগের লােহার ও তামার খনিগুলোর বেশির ভাগই মগধ ও তার পার্শ্ববর্তী ধলভূম-সিংভূম অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। শুধু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নয়, যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণেও লােহা ও তামার ব্যাপক ব্যবহার ছিল।

সামরিক শক্তি : মগধের সামরিক শক্তির আর এক উৎস তার সুশিক্ষিত হস্তিবাহিনী। যুদ্ধের সময় শত্রু শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টির কাজে এই হস্তিবাহিনীর কোনও জুড়ি ছিল না। অজাতশত্রুর সময় হতে মগধে দুটি অভিনব অস্ত্র তৈরি হতে থাকে। এদের একটি মহাশিলা কণ্টক, অন্যটি রথমুষল। মহাশিলাকণ্টক থেকে শত্রুসৈন্য লক্ষ করে বড় বড় প্রস্তরখণ্ড নিক্ষিপ্ত হত। রথমুষল ছিল তীক্ষ্ণ ফলাসজ্জিত এক চলমান যান। যুদ্ধক্ষেত্রে যখন রথমুষল চালনা করা হত তখন এর তীক্ষ্ণ ফলার আঘাতে শত্রুসৈন্যরা মারা পড়তেন। বলা যেতে পারে, বর্তমানকালের ট্যাংকের পূর্বসূরি ছিল এই রথমুষল। বিধ্বংসী এই অস্ত্র দু’টি মগধের সামরিক শক্তিকে আরও দুর্বার করে তােলে।

বাণিজ্যিক গুরুত্ব : মগধের বাণিজ্যিক গুরুত্বও বড় কম ছিল না। স্থল ও জলপথে এই অঞ্চলের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশের ঘনিষ্ঠ সংযােগ ছিল। আন্তর ও বহির্বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। 

সুযােগ্য নেতৃত্ব : সুযােগ্য নেতৃত্ব মগধের আভ্যুত্থানের আর এক কারণ। বিম্বিসার থেকে শুরু করে শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথ পর্যন্ত মগধের সকল রাজাই যে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, তা নয়। কিন্তু এদের অনেকেই, বিশেষ করে বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শিশুনাগ, মহাপদ্ম নন্দ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যশােক নিঃসন্দেহে পরাক্রান্ত নরপতি ও সুদক্ষ প্রশাসক ছিলেন। রাজ্যস্থাপন বা বিশাল রাজ্য সুপরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় মানসিক দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার মতাে গুণাবলি এদের যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। এরা ছাড়া মগধের অভ্যুত্থানে দু’জন রাজনীতি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এদের একজন বর্ষকার যিনি অজাতশত্রুর মন্ত্রী ছিলেন। অন্যজন চাণক্য বা কৌটিল্য।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উদারতা : মগধের সাংস্কৃতিক তথা সামাজিক পরিমণ্ডল তার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণকে প্রসারিত করে। দু’টি সংস্কৃতির মিলনস্থলে মগধের অবস্থিতি। এর পশ্চিমে আর্য সংস্কৃতির দুর্গ পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশ, পূর্বে অনার্য সংস্কৃতির কেন্দ্র নিম্ন গাঙ্গেয় অববাহিকা। মগধে এই দুই সংস্কৃতির মিলন ঘটায় তার চিত্তবৃত্তি মধ্যদেশের তুলনায় উদার ও উন্নত হয়েছে। গােড়া ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিধিনিষেধের কঠোরতা এখানে শিথিল হয়েছে। বৌদ্ধজৈনধর্মের ব্যাপক প্রসারে জনমানস অনেকখানি পরিচ্ছন্ন ও সংস্কারমুক্ত হয়েছে। ব্রাহ্মণ এখানে স্বচ্ছন্দে ব্রাত্যের সঙ্গে মিশেছেন। শূদ্রকন্যা রাজার অন্তঃপুরে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। বৈশ্য ও যবন আপন যােগ্যতায় উচ্চ পদ লাভ করেছেন। নাপিতপুত্র নিজ বাহুবলে সিংহাসন অধিকার করেছেন। ব্রাহ্মণ সানন্দে ক্ষত্রিয় গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। মগধের এই উদার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণকে প্রসারিত করেছে, তাকে এক বিশাল সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। 

অখণ্ড ভারত গড়ার প্রেরণা : সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরূপে মগধের আত্মপ্রকাশের পেছনে আরও একটি বড় প্রেরণা কাজ করেছিল। সেই প্রেরণাটি হল, এক, অখণ্ড ভারত গড়ার প্রেরণা। অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতভূমিতে দুটি বিপরীতমুখী শক্তি কাজ করে চলেছে। এদের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদ, অন্যটি অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মরু-জঙ্গল ভারতকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করেছে, বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদকে চূর্ণ করে সারা ভারতকে একতাবদ্ধ করার একটা প্রয়াস বরাবরই সক্রিয় ছিল। মগধের পরাক্রান্ত রাজারা সেই চেষ্টায় সামিল হয়েছিলেন।

বিম্বিসার (রা. ৫৪৪ – ৪৯৩ খ্রি.পূ.)

যার সময় থেকে মগধের রাজনৈতিক অভ্যুত্থান শুরু হয় তার নাম বিম্বিসার। পুরাণে বিম্বিসারকে শৈশুনাগ বলা হয়েছে। এর অর্থ, বিম্বিসার শিশুনাগের বংশের লােক, শিশুনাগ তার পূর্বপুরুষ। কিন্তু পুরাণের এই বর্ণনা ঠিক নয়। আসলে বিম্বিসার ও শিশুনাগ উভয়েই মগধের রাজা হলেও তারা ভিন্ন বংশের সন্তান ছিলেন। বিম্বিসার ছিলেন অবন্তিরাজ প্রদ্যোতের সমসাময়িক। শিশুনাগ সম্পর্কে পুরাণে বলা হয়েছে যে তিনি প্রদ্যোতের বংশধরদের পরাজিত করে অবন্তি অধিকার করেন। পুরাণের এই উক্তিটি কিন্তু সত্য। তাহলে শিশুনাগকে নয়, বিম্বিসারকেই মগধের পূর্ববর্তী রাজা বলা উচিত। এই প্রসঙ্গে আরও একটি প্রমাণ উল্লেখ করা যায়। বারাণসী ও বৈশালী শিশুনাগের অধিকারভুক্ত ছিল। বিম্বিসারই সর্বপ্রথম বারাণসীতে মগধের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। বৈশালী প্রথম মগধের অধিকারে চলে আসে বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুর রাজত্বকালে। বিম্বিসার যে শিশুনাগের অনেক পূর্বে মগধের সিংহাসনে আরােহণ করেন সে সম্পর্কে এখন আর কোনও সন্দেহ নেই। ঠিক কখন তিনি মগধের সিংহাসনে বসেন, তা নিয়ে কিন্তু এখনও সংশয় আছে। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের ধারণা, ঘটনাটি খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি কোনও এক সময় ঘটেছিল। 

বিম্বিসার যে বংশের সন্তান, সেই বংশের নাম হৰ্য্যঙ্ক। এমন হতে পারে, গােত্রের নাম থেকে বংশের নাম হৰ্য্যঙ্ক হয়েছে। কিন্তু হৰ্য্যঙ্ক নামে কোনও গােত্র নেই। তাহলে হৰ্য্যঙ্ককে বিম্বিসারের এক পূর্বপুরুষ বলে ধরা যেতে পারে। হরিবংশ ও বায়ু-পুরাণে হৰ্য্যঙ্গ নামে এক অঙ্গরাজের উল্লেখ আছে। বিম্বিসার কি এই হৰ্য্যঙ্গেরই বংশধর? এমন সম্ভাবনা বাতিল করার নয়। কোনও কোনও গ্রন্থে বিম্বিসারকে ‘শ্রেণিক’ বা ‘সেনিয়’ বলা হয়েছে। কেন তার এই উপনাম তা আমাদের কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। অনেকে সেনাপতি অর্থে ‘শ্রেণিক’ পদটির ব্যাখ্যা করেছেন। আবার কেউ বলেন, বিম্বিসার এক স্থায়ী সৈন্যবাহিনী গঠন করেছিলেন বলেই তার এই নামকরণ। শ্রেণী বা শ্রেণি বলতে বণিক সংগঠন বা গিল্ড বােঝায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছিলেন, বণিকগােষ্ঠীর পৃষ্ঠপােষক ছিলেন বলেই তাকে ‘শ্রেণিক’ বলা হত, এ মতও কেউ কেউ ব্যক্ত করেছেন। 

বিম্বিসারের পিতা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এমনকী তার প্রকৃত নাম কী ছিল সে বিষয়ে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে বিভিন্ন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। দীপবংসে তাকে বােধিস বলা হয়েছে। কোনও কোনও গ্রন্থে তার নাম দেওয়া হয়েছে ভাতিয় বা ভট্টিয় বলে। তিব্বতি গ্রন্থে তার নাম মহাপদ্ম। পুরাণে তাকে হেমজিৎ, ক্ষেমজিৎ, ক্ষেত্রোজা ও ক্ষত্রোজা বলা হয়েছে। তিনি চব্বিশ বছর রাজত্ব করেছেন, মৎস্যপুরাণে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। বিম্বিসারের পিতার রাজত্বকালেই পার্শ্ববর্তী অঙ্গ রাজ্য মগধের অধিকারে চলে আসে। অঙ্গ জয়ের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বিম্বিসারের। তখন অঙ্গের রাজা ছিলেন ব্রহ্মদত্ত। তিনি বিম্বিসারের পিতাকে একবার যুদ্ধে পরাজিত করেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই যুবরাজ বিম্বিসার ব্রহ্মদত্তকে পরাজিত ও নিহত করেন। অঙ্গ রাজ্য মগধের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিম্বিসার পেলেন বিজিত অঞ্চলের শাসনভার। 

যে মগধ বিম্বিসারের রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল সেই মগধ তিনি স্বয়ং জয় করেন, না তার পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন, তা এক বিতর্কিত বিষয়। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর মনে করেন, বিম্বিসার বৃজিদের পরাজিত করে মগধের শাসনভার গ্রহণ করেন। প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থ সুত্তনিপাতের বিবরণের ওপর ভিত্তি করেই ভাণ্ডারকর সাহেব তার অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পুরাণ, মহাবংস, দীপবংস প্রভৃতি গ্রন্থাদি থেকে জানা যায়, বিম্বিসারের পূর্বে তার পিতাই মগধে রাজত্ব করতেন। এর থেকে মনে হয়, পিতার উত্তরাধিকারী রূপেই তিনি মগধের সিংহাসনে আরােহণ করেন। মহাবংস ও দীপবংস এক বাক্যে বলছে, বিম্বিসারের পিতা তার মৃত্যুর পূর্বেই পুত্রকে মগধের সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। সিংহাসনে আরােহণের সময় বিম্বিসারের বয়স ছিল মাত্র পনেরাে বছর। রাজা বিম্বিসার নতুন করে আর কোনও রাজ্য জয় করেননি। মগধ ও অঙ্গে নিজের কর্তৃত্ব তিনি সুদৃঢ় করেন। যুবরাজ অজাতশত্রু অঙ্গের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মগধের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য বিম্বিসার চেষ্টার ত্রুটি করেননি। এক্ষেত্রে তিনি দুটি নীতি গ্রহণ করেন। এক. বিভিন্ন রাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। দুই. বিভিন্ন রাজগণের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, রাজ্য জয়ের চেয়ে রাজ্য সংরক্ষণের ওপর তিনি বেশি গুরুত্ব আরােপ করলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি সর্বত্র সহযােগিতা ও সম্প্রীতির হাত বাড়িয়ে দেন। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতির জনকরূপে বিম্বিসার ভারতের ইতিহাসে এক অনন্য স্থানের অধিকারী। যে সকল রাজপরিবারের সঙ্গে বিম্বিসার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, তাদের মধ্যে আভিজাত্যে ও প্রতিপত্তিতে কোসল রাজপরিবারের কোনও তুলনা ছিল না। কোসলরাজ মহাকোসলের কন্যা ও প্রসেনজিতের বােন কোসলাদেবীকে তিনি বিবাহ করেন। এই বিবাহে কাশীর এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিম্বিসারকে যৌতুক দেয়া হয়। এখান থেকে বছরে এক লক্ষ কার্ষাপণ মুদ্রার রাজস্ব আদায় হত। চেটক ছিলেন একজন লিচ্ছবি নেতা। তার কন্যা চেল্লনাকেও বিম্বিসার বিবাহ করেন। বিম্বিসার বিদেহ রাজ্যের রাজকন্যা বাসবীরও পাণিগ্রহণ করেন। তার আর এক পত্নী খেমা। তিনি মদ্র বা মধ্য পাঞ্জাবের রাজকন্যা ছিলেন। মহাবগ্‌গে বিম্বিসারের ৫০০ পত্নীর উল্লেখ আছে। এই সংখ্যা সম্ভবত অতিরঞ্জিত। বৈশালীর বিখ্যাত বারাঙ্গনা আম্রপালী বিম্বিসারের উপপত্নী। অন্য যে রাজগণের সঙ্গে বিম্বিসার সৌহার্দ স্থাপন করেছিলেন অবন্তিরাজ প্রদ্যোত তাদের অন্যতম ছিলেন। প্রদ্যোত একবার পাণ্ডুরােগে আক্রান্ত হন। তার চিকিৎসার জন্য বিম্বিসার রাজবৈদ্য জীবককে অবন্তি রাজ্যে পাঠান। গন্ধারের রাজা ছিলেন পুষ্করসারী। বিম্বিসারের নিকট তিনি দূত পাঠিয়েছিলেন। রােরুক রাজ্যের রাজা রুদ্রায়ণের সঙ্গেও তার সখ্যতা ছিল। এই রাজ্যটি সম্ভবত পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশে অবস্থিত ছিল। এই সময় ইরানের আকিমেনীয় রাজবংশের প্রভাব উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুষ্করসারী ও রুদ্রায়ণ হয়তাে আকিমেনীয়দের শক্তিবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে মগধরাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন। রাজ্য দু’টি শেষ পর্যন্ত আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিম্বিসার মিত্র রাজ্য দুটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, এমন কোনও প্রমাণ নেই। 

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করলেও বিম্বিসারের প্রকৃত কর্তৃত্ব মগধ, অঙ্গ ও কাশীর কয়েকটি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। মহাবগ্‌গে বলা হয়েছে, তার রাজ্যে মােট ৮০ হাজার গ্রাম ছিল। এই তথ্যের যাথার্থ্য সম্পর্কে সন্দেহ আছে। যাতায়াত ও প্রশাসনিক স্বার্থে তিনি অনেক রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করেন। শুয়েন চাঙের ভ্রমণ বৃত্তান্তে বিম্বিসারের তৈরি কয়েকটি রাজপথের উল্লেখ আছে। শুয়েন চাঙের বৃত্তান্ত থেকে আরও জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডে রাজধানী রাজগৃহ প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়। বিম্বিসার রাজধানীকে নতুন করে নির্মাণ করেন। এই প্রসঙ্গে ফা শিয়েনের বিবৃতি অন্যরকম। তিনি বলেন, অজাতশত্রু রাজগৃহকে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। মহা গােবিন্দ নামে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের ওপর রাজগৃহ পুনর্নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

বিম্বিসারের শেষ জীবন সুখের হয়নি। পুত্র অজাতশত্রু তার বিরুদ্ধাচরণ করেন। দীঘ নিকায়-তে বলা হয়েছে, অজাতশত্রু পিতাকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন। অজাতশত্রু তার পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন, এই কথা প্রাচীন জৈন লেখকরাও স্বীকার করেন। কিন্তু অজাতশত্ৰু পিতৃহন্তা, তা তারা মানেন না। বিম্বিসারই কারাগারে বিষপান করে আত্মহত্যা করেন, এই তাদের অভিমত।

অজাতশত্রু (রা. ৪৯৩ – ৪৬১ খ্রি.পূ.)

আনুমানিক ৪৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অজাতশত্রু মগধের সিংহাসনে আরােহণ করেন। যে পদ্ধতিতে তিনি সিংহাসন অধিকার করেছেন তা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু তিনি যে এক পরাক্রান্ত ও বিচক্ষণ রাজা ছিলেন তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায়। সিংহাসন লাভের অব্যবহিত পরই অজাতশ কোসলরাজ প্রসেনজিতের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত হন। অনেকে অজাতশত্রু ও প্রসেনজিতের সংঘর্ষকে মামা-ভাগ্নের বিরােধ বলে বর্ণনা করেছেন। তাদের ধারণা, অজাতশত্রু ছিলেন প্রসেনজিতের ভাগ্নে, কোসলাদেবীর পুত্র। কিন্তু কে অজাতশত্রর মা, কোসলাদেবী, না বিম্বিসারের অন্য কোনও পত্নী, সে সম্পর্কে পরস্পরবিরােধী তথ্য আছে। কোনও কোনও প্রাচীন গ্রন্থে কোসলাদেবীকে, কোনও কোনওটিতে চেল্লনাকে, আবার কোনওটিতে খেমাকে অজাতশত্রুর মা বলা হয়েছে। সে যা হােক, বিম্বিসারের মৃত্যুর জন্য প্রসেনজিৎ অজাতশত্রুকে অভিযুক্ত করেন। শুধু বিম্বিসারেরই মৃত্যু হল না, তার শােকে অল্প দিনের মধ্যে কোসলাদেবীরও দেহাবসান হয়। কোসলাদেবীকে বিবাহ করে বিম্বিসার কাশীর এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল যৌতুক পেয়েছিলেন। জাতশত্রু এই যৌতুক ভােগ করবেন তা প্রসেনজিতের মনঃপূত হল না। তিনি তার পিতার দেয়া যৌতুক প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু কাশীর ওপর অজাতশত্রু তার অধিকার ছাড়তে অসম্মত হলেন। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম প্রথম অজাতশত্রুই সাফল্য লাভ করেন। একবার প্রসেনজিতের তাবস্থা এমন সংকটাপন্ন হল যে তাকে শ্রাবস্তীতে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে হয়। শেষের দিকে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়। অজাতশত্রই প্রসেনজিতের হাতে বন্দি হন। কিন্তু প্রসেনজিৎ তার প্রাণ সংহার করলেন না, তার সঙ্গে নিজ কন্যা বজিরার বিবাহ দেন। কাশীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল তিনি অজাতশত্রুকে যৌতুকরূপে ফিরিয়ে দেন। কাশী অঞ্চলে আবার মগধের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। পরস্পর যুযুধান দু’জন রাজা তাদের বাদ বিসংবাদ ভুলে একজন অন্যজনের কন্যাকে নিজের পত্নী বা পুত্রবধূরূপে বরণ করেছেন, এধরনের ঘটনা ইতিহাসে একেবারে বিরল নয়। সেলুকাসের বংশধর রাজা তৃতীয় এন্টিওকাস ব্যাকটিয়ার নৃপতি প্রথম ইউথিডেমাসের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ইউথিডেমাসের পুত্র প্রথম ডিমেট্রিয়াসের বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তার সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দেন।

কিন্তু কাশী পুনরুদ্ধার নয়, লিচ্ছবি গণরাজ্য অধিকার অজাতশত্রুর রাজত্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা। যে কারণে লিচ্ছবিদের সঙ্গে অজাতশত্রুর বিরােধ, সেই কারণ সম্পর্কে প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন লেখকরা ভিন্ন মত পােষণ করেন। বৌদ্ধ লেখকদের মতে এক রত্নখনির ওপর কতৃত্ব নিয়ে উভয় পক্ষে বিরােধ দেখা যায়। খনিটি গঙ্গার তীরে কোনও এক পাহাড়ের নিচে অবস্থিত ছিল। খনিটির উপর অজাতশত্রু ও লিচ্ছবিদের সমান অধিকার থাকবে, প্রথম দিকে এই ব্যবস্থাই কার্যকরী ছিল। কিন্তু শেষের দিকে লিচ্ছবিরা প্রায়ই তাদের অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করতে থাকেন। ফলে অজাতশত্রু লিচ্ছবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। কিন্তু জৈনসূত্রে এই যুদ্ধের অন্য কারণ দেখানাে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিম্বিসার তার প্রিয় হাতি সেয়নগ ও একটি অমূল্য রত্নহার তার দুই পুত্র হল্ল ও বেহল্লকে উপহার দিয়েছিলেন। হল্ল ও বেহল্ল ছিলেন লিচ্ছবি নেতা চেটকের কন্যা চেল্লনার পুত্র। অজাতশত্রু মগধের সিংহাসন অধিকার করায় হল্ল ও বেহল্ল ভয় পেয়ে রাজগৃহ থেকে পালিয়ে বৈশালীতে মাতামহ চেটকের আশ্রয় নেন। অজাতশত্রু ভাইদের পিতার দেওয়া উপহার-সহ রাজগৃহে ফিরে আসতে অনুরােধ করেন। অনুরােধে কাজ না হওয়ায় তিনি চেটক তথা লিচ্ছবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। তবে অজাতশত্রুর সঙ্গে লিচ্ছবিদের সংঘর্ষের যে কারণের কথা জৈন লেখকরা বলেছেন তা তুচ্ছাতিতুচ্ছ। একটি হাতি ও রত্নহারের জন্য অজাতশত্রু এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হবেন, তা ভাবা যায় না। তুলনায় প্রথম কারণটিকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। তাছাড়া এই সংঘর্ষের একটি বাণিজ্যিক তথা অর্থনৈতিক কারণও হয়তাে ছিল। জল বাণিজ্যের বেশির ভাগটাই চলত গঙ্গা নদীর পথ দিয়ে। লিচ্ছবি রাজ্যটি গঙ্গার উত্তর পারে অবস্থিত ছিল। জলবাণিজ্যের ওপর মগধের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য লিচ্ছবি রাজ্য অধিগ্রহণ জরুরি হয়ে দেখা দেয়। লিচ্ছবিদের পরাজিত করা সহজ ব্যাপার ছিল না। একে তাে তাদের মধ্যে দারুণ একতা ছিল, তার উপর তারা বৃজি রাষ্ট্রসংঘের সদস্য ছিলেন। ফলে অনেকগুলো গণরাজ্য লিচ্ছবিদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এদের মধ্যে ছিল বিদেহ, জ্ঞাতৃক ও বৃজি গণরাজ্য। জৈন কল্পসূত্র থেকে জানা যায়, কাশী ও কোসলের ১৮ জন গণরাজও লিচ্ছবিদের পক্ষে যােগ দেন। কিন্তু কাশী ও কোসল বহুরাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল না। সেখানে ১৮ জন গণরাজ কী করে রাজত্ব করছিলেন, বােঝা দায়। লিচ্ছবিদের সঙ্গে কাশী ও কোসলের ১৮ জন গণরাজের যােগদানের কাহিনি অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়। 

লিচ্ছবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যে দীর্ঘদিন ধরে চলবে তা অজাতশত্রুর বুঝতে দেরি হয়নি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজগৃহ থেকে লিচ্ছবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বৈশালীর কাছাকাছি কোনও এক স্থান থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে। গঙ্গা ও শোণ নদের সঙ্গমস্থল পাটলিগ্রামকে তিনি উপযুক্ত স্থান মনে করে সেখানে একটি দুর্গ নিমাণ করেন। এই পাটলিগ্রাম পরবর্তিকালে পাটলিপুত্র নামে প্রসিদ্ধ হয়। বর্ষকার ও সুনীধ নামে বিশ্বস্ত দুই মন্ত্রীর ওপর দুর্গ নির্মাণের ভার পড়ল। তাছাড়া আরও একটি কাজের দায়িত্ব মন্ত্রী দু’জনকে দেওয়া হল। কাজটি হল লিচ্ছবিদের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করা। শােনা যায়, অজাতশত্রুর সঙ্গে যখন লিচ্ছবিদের সংঘর্ষ চলছিল তখন বুদ্ধ বৈশালীতে এসে উপস্থিত হন। তার সঙ্গে ছিলেন শিষ্য আনন্দ। প্রিয় শিষ্যকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, যতদিন লিচ্ছবিরা এক থাকবেন, ততদিন তারা নিরাপদ। বর্ষকার ও সুনীধ বুদ্ধকে পাটলিগ্রাম পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান। সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বুদ্ধ সেখানে এসে উপনীত হন এবং ঘােষণা করেন, একদিন স্থানটি সারা ভারতের একটি শ্রেষ্ঠ শহরে পরিণত হবে। বর্ষকার ও সুনীধ অতি নিপুণভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। পাটলিগ্রামে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ তৈরি হল। লিচ্ছবিদের শক্তির উৎস যে ঐক্য, তাতে ফাটল ধরল। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়। এই যুদ্ধে অজাতশত্রু দু’টি নতুন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেন। প্রথমটি মহাশিলাকণ্টক, অন্যটি রথমূষল। প্রথমটিকে অস্ত্র না বলে উৎক্ষেপণ যন্ত্র বলা উচিত। এই যন্ত্রের সাহায্যে শত্রুসৈন্য লক্ষ্য করে বড় বড় পাথরের টুকরাে নিক্ষেপ করা হত। রথমুল ছিল আসলে এক ধরনের রথ। ঘােড়ায় এ রথ টানত না, লােকচক্ষুর আড়ালে থেকে চালক এটিকে শত্রুসৈন্যের উপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যেতেন। রথের গায়ে থাকত লােহার তীক্ষ্ণ ফলা। রথটি যখন চলত, তখন তীক্ষ্ণ ফলার আঘাতে বিপক্ষ যােদ্ধারা মারা পড়তেন। রথমুষলের কাজ ছিল অনেকটা আধুনিক যুগের ট্যাংকের মতাে। লিচ্ছবিদের সঙ্গে অজাতশত্রুর যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। এই যুদ্ধ যখন আরম্ভ হয় আজীবিক সম্প্রদায়ের গুরু গােসাল তখনও জীবিত। আনুমানিক ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গােসলের দেহান্তর হয়। গােসলের মৃত্যুর ১৬ বছর পর অর্থাৎ ৪৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাবীরের দেহাবসান হয়। তখনও মিত্রপক্ষের শক্তি অটুট। অর্থাৎ আনুমানিক ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ৪৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ অন্তত এই ১৬ বছর ধরে লিচ্ছবিদের সঙ্গে অজাতশত্রুর সংঘর্ষ চলেছিল। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে শুধু বৈশালী নয়, বৃজি রাষ্ট্রসংঘের অন্যান্য সদস্য গণরাজ্যগুলোও মগধের অধিকারভুক্ত হয়। মজ্ঝিমনিকায় গ্রন্থ থেকে জানা যায়, অজাতশত্রুর শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে অবন্তিরাজ প্রদ্যোত রাজগৃহ অভিযানের পরিকল্পনা করেন। প্রদ্যোতের আক্রমণ আশঙ্কা করে অজাতশত্রু রাজধানীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেন। শেষ পর্যন্ত অবন্তিরাজ রাজগৃহে অভিযান পাঠাননি। অজাতশত্রুও আর প্রদ্যোতের রাজ্য আক্রমণ করেননি।

অজাতশত্রুর উত্তরাধিকারিগণ (৪৬১ – ৪১৩ খ্রি.পূ.) 

৩২ বছর রাজত্ব করার পর আনুমানিক ৪৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অজাতশত্রুর মৃত্যু হয়। পুরাণে মগধের পরবর্তী রাজারূপে দর্শকের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন লেখকরা একবাক্যে উদয়ভদ্র বা উদায়ীকে অজাতশত্রুর উত্তরাধিকারী বলেছেন। দিব্যাবদান-এ দর্শকের কোনও উল্লেখ নেই। এ ক্ষেত্রে পৌরাণিক তথ্য বিকৃত বলে মনে হয়। পিতৃহন্তা বলে উদায়ী মহাবংসে ধিকৃত। কিন্তু জৈনগ্রন্থাদিতে অজাতশত্রুর অনুগত ও বিশ্বস্ত পুত্র বলে তার প্রশংসা করা হয়েছে। মগধের রাজধানী রাজগৃহ থেকে তিনি পাটলিগ্রাম বা পাটলিপুত্রে স্থানান্তরিত করেন। ঘটনাটি তার রাজত্বের চতুর্থ বছরে ঘটে। অন্তত এই একটি কারণের জন্য উদায়ী ভারতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। মহাবংস ও দীপবংস থেকে জানা যায়, তিনি ১৬ বছর রাজত্ব করেছিলেন। উদায়ীর পর কে মগধের রাজা হন, তা বলা কঠিন। পুরাণে নন্দিবর্ধন ও মহানন্দি নামে মগধের দু’জন রাজার নাম পাওয়া যায়। মহাবংস ও দীপবংসে মগধের পরবর্তী রাজারূপে অনুরুদ্ধ, মুণ্ড ও নাগদাসকের উল্লেখ আছে। অঙ্গুত্তরনিকায় ও দিব্যাবদান-এ রাজা মুণ্ডের কথা আছে কিন্তু অনুরুদ্ধ ও নাগদাসকের উল্লেখ নেই। সে যা হােক, উদায়ীর পুত্র-পৌত্ররা শাসক হিসাবে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। তাদের না ছিল বীরত্ব, না ছিল যােগ্যতা। তাদের সময় রাজ্যের চারদিকে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, রাজ্যের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে পড়ে। মহাবংস থেকে জানা যায়, মগধের লােকেরা ক্রোধে ও বিরক্তিতে অজাতশত্রুর বংশধরদের বিতাড়িত করেন এবং শিশুনাগ নামে এক অমাত্যকে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসান। তবে মহাবংসের এই কাহিনি সত্য না হতে পারে। দুর্বল রাজাকে পদচ্যুত করে শিশুনাগের মতাে এক প্রভাবশালী মন্ত্রী সিংহাসন দখল করবেন, এই তাে স্বাভাবিক। সম্ভবত ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধ রাজ্যে এই রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে যায়। রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায় রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত The Age Of Imperial Unity (পৃ. ৩৮) গ্রন্থে এরূপ মতই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মনে করেন, শিশুনাগ আনুমানিক ৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধের সিংহাসনে আরােহণ করেন (Political History of Ancient India, পৃ: ২২৮)। শিশুনাগ আরও বছরখানেক পূর্বে সিংহাসনে বসেছিলেন বলে সুধাকর চট্টোপাধ্যায় মনে করেন (Bimbisara To Asoka, পৃ. ৫২)। 

শিশুনাগ (৪১২ – ৩৯৫ খ্রি.পূ.)

গণসমর্থন বা বাহুবল যে উপায়েই শিশুনাগ সিংহাসনে বসুন না কেন, তিনি যে একজন সুযােগ্য শাসক ছিলেন, সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। রাজপদ গ্রহণ করেই শিশুনাগ পাটলিপুত্রের পরিবর্তে রাজগৃহকে পুনরায় মগধের রাজধানী করলেন। রাজগৃহকে পুনরায় রাজধানী করার কারণ স্পষ্ট নয়। হয়তােবা পাটলিপুত্রে কোনও এক বিধ্বংসী বন্যার তিক্ত অভিজ্ঞতা শিশুনাগকে রাজধানী পরিবর্তনে উৎসাহিত করেছিল। বৈশালী শহরটিকে রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী করা হল। রাজগৃহের গুরুত্ব ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, বৈশালীর গুরুত্ব উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পায়। শেষে বৈশালীই মগধের একমাত্র রাজধানীর মর্যাদা পেল। 

অবন্তি রাজ্য জয় শিশুনাগের রাজত্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ঘটনা। উত্তর ও মধ্য ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে একমাত্র অবন্তিই মগধের প্রায় সমকক্ষ ছিল। প্রদ্যোত তাে বিম্বিসার ও অজাতশত্রুকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই মনে করতেন। তিনি মগধ জয়ের সংকল্পও গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যান। প্রদ্যোতের মৃত্যুর পর তার বংশধরেরা অবন্তিতে রাজত্ব করেন। আর্যক নামে একজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি প্রদ্যোতের বংশধরদের গদিচ্যুত করে অবন্তির সিংহাসন অধিকার করেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে প্রদ্যোতের প্রপৌত্র অবন্তিবর্ধন পুনরায় ক্ষমতা দখল করেন। অবন্তিতে গৃহবিবাদের সুযােগে শিশুনাগ রাজ্যটি জয় করেন। তখন সম্ভবত অবন্তিবর্ধন সেখানে রাজত্ব করছিলেন। অবন্তি অধিকারভুক্ত হওয়ায় দক্ষিণ দিকে মগধ রাজ্য মধ্য ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত হল। বৎস ও কোসল রাজ্য দু’টিও সম্ভবত এই সময় মগধের অধিকারভুক্ত হয়।

কাকবর্ণ-কালাশােক (৩৯৫ – ৩৭৭ খ্রি.পূ.) 

শিশুনাগের পর তার এক পুত্র মগধে রাজত্ব করেন। মগধের এই নতুন রাজাকে পুরাণে কাকবর্ণ এবং দীপবংস ও মহাবংসে কালাশোক বলা হয়েছে। কাকবর্ণ ও কালাশােক যে একই ব্যক্তি, এ কথা প্রায় সকল ঐতিহাসিকই স্বীকার করেন। কাকবর্ণ কালাশােকের রাজত্বকালে দু’টি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে। এক, তার পৃষ্ঠপােষকতায় বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। মহাস্থবির যশ সে অনুষ্ঠানে পৌরােহিত্য করেন। দুই, মগধের বাজধানী বৈশালী থেকে পুনরায় পাটলিপুত্রে স্থানান্তরিত হয়। কাকবর্ণ কালাশােকের শেষ জীবন সুখের হয়নি। তার মহিষী তার বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং এক নাপিতের প্রতি আসক্ত হন। গ্রিক বিবরণে উল্লেখ আছে রানি ও নাপিতের ষড়যন্ত্রে রাজা নিহত হন। নাপিত প্রথমে নিহত রাজার পুত্রদের অভিভাবকরূপে রাজ্য শাসন করেন, কিন্তু পরে সুযােগ বুঝে বাজপুত্রদের হত্যা করে নিজেই সিংহাসনে আরােহণ করেন। কাকবর্ণ কালাশােককে ষড়যন্ত্র করে পাটলিপুত্রের উপকণ্ঠে হত্যা করা হয়, এ রকম একটি উক্তি হর্ষচরিতে আছে। হর্ষচরিতের সাক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, শৈশুনাগ রাজত্বের শেষদিনগুলো সম্পর্কে গ্রিক বৃত্তান্ত মােটামুটি বিশ্বাসযােগ্য। যে রাজদ্রোহীর হাতে কাকবর্ণ-কালাশােক ও তার পুত্ররা প্রাণ হারান তিনি নন্দ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্ম। আনুমানিক ৩৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শৈশুনাগ রাজবংশের পতন হয়। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী (Political History Of Ancient l/ida, পৃ. ২২৮) শৈশুনাগ রাজবংশের পতন আনুমানিক ৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধার্য করেছেন।

মহাপদ্ম-উগ্রসেন (৩৪৫ – ৩৪০ খ্রি.পূ.)

গ্রিক বৃত্তান্তে মহাপদ্মকে নাপিত বলা হয়েছে। আরও কয়েকটি সূত্রে মহাপদ্মের নাপিত পরিচয়ই ব্যক্ত হয়েছে। পরিশিষ্টপর্বন-এ বলা হয়েছে, মহাপদ্মের বাবা ছিলেন নাপিত, মা ছিলেন গণিকা। আবশ্যকসূত্র-এ তাকে ‘নাপিতদাস’ বা নাপিতের ভৃত্য বলে পরিচিত করা হয়েছে। পুরাণে মহাপদ্ম ও তার বংশধরদের অধার্মিক বলা হয়েছে। ওই সূত্রে আরও বলা হয়েছে, মহাপদ্মের পিতা রাজা মহানন্দি, মা শূদ্র রমণী। বৌদ্ধ লেখকরা মহাপদ্মের পিতা-মাতার উল্লেখ করেননি, তার বংশকে ‘অজ্ঞাত’ বা অনামী বলে বর্ণনা করেছেন। দেখা যাচ্ছে, গ্রিক, বৌদ্ধ, জৈন বা পুরাণ, কোনও সূত্রেই মহাপদ্মের বংশ সম্পর্কে সপ্রশংস মন্তব্য নেই, সর্বত্র শূদ্র বা নাপিত বলে তার পরিচয়। নন্দ রাজারা জাতিতে শূদ্র ছিলেন বলেই মনে হয়। সাধারণ এক শূদ্র বা নাপিতের ঘরে জন্মগ্রহণ করে আপন যােগ্যতায় মহাপদ্ম মগধের সিংহাসনে অভিষিক্ত হন। আমাদের দুর্ভাগ্য, উপন্যাসের চেয়েও আকর্ষণীয় মহাপদ্মের সে উত্থানের কাহিনির অনেকটাই আমাদের অজানা। গ্রিক লেখকরা মহাপদ্মকে লম্পট, কুচক্রী রূপে বর্ণনা করেছেন। রানির যােগসাজসে মগধের রাজা ও তার পুত্রদের হত্যা করে তিনি সিংহাসন দখল করেন, এই তাদের মত। কিন্তু মহাবংশটীকায় মহাপদ্মের এক দস্যু সদারের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, গ্রামের পর গ্রাম ও শহর জয় করে তিনি ক্রমশ শক্তিশালী হন। শেষে রাজাকে নিহত করে তিনি মগধের সিংহাসন দখল করেন। অর্থাৎ, ষড়যন্ত্র করে নয়, বাহুবলে মহাপদ্ম মগধের সিংহাসন অধিকার করেন, বৌদ্ধগ্রন্থখানি থেকে এরূপ ধারণাই জন্মায়। নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতার প্রকৃত নাম কী, সে প্রসঙ্গে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন তথ্য। পুরাণে তার নাম মহাপদ্ম বা মহাপদ্মপতি। বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবােধিবংস-এ তাকে উগ্রসেন বলা হয়েছে। প্রাচীন গ্রিক লেখকরা মহাপদ্মের এক উত্তরাধিকারীকে এগ্রামমেস (Agrammes) বা জ্যান্ডামেস (Xandrames) নামে উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত সংস্কৃত পদ ঔগ্রসৈন্য থেকে গ্রিক নাম এগ্রামমেস নিষ্পন্ন হয়েছে। ঔগ্রসৈন্য পদের অর্থ উগ্রসেনের পুত্র বা বংশধর। মনে হয়, মহাপদ্ম উগ্রসেন নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।

কৌশল বা বাহুবল, যে উপায়েই মহাপদ্ম মগধের সিংহাসন দখল করুন না কেন, তার যােগ্যতা সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন তােলা চলে না। পুরাণে তাকে দ্বিতীয় পরশুরাম আখ্যা দেওয়া হয়েছে, সর্বক্ষত্রান্তক বলা হয়েছে। পরশুরাম যেমন ক্ষত্রিয়দের উচ্ছেদ করেন, তেমনি মহাপদ ক্ষত্রিয়দের অন্তক বা যম ছিলেন। মহাপদ্মকে দ্বিতীয় পরশুরাম বা সর্বক্ষত্ৰান্তক বলার অর্থ তিনি ক্ষত্রিয়দের সংহার করেন। তাছাড়া পুরাণে তাকে একরাট বা একচ্ছত্র রাজা আখ্যা দেওয়া হয়েছে। পুরাণে আছে, শৈশুনাগ রাজাদের সময় ঐক্ষ্বাকু, পাঞ্চাল, কাশী, হৈহয়, কলিঙ্গ, অশ্যক, মৈথিল, শূরসেন ও বীতিহােত্র রাজারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। এই সকল রাজাদের উচ্ছেদ করে মহাপদ্ম বিশাল মগধ রাজ্য গঠন করেন। মহাপদ্ম যে এক বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন, বিভিন্ন সূত্র থেকে সে রকম আভাসই পাওয়া যায়। প্রথমত, প্রাচীন ইউরােপীয় লেখকরা এক পরাক্রান্ত রাজার উল্লেখ করেছেন। আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় তিনি পূর্ব ভারতে রাজত্ব করতেন। প্রাসিয়াই বা প্রাচ্য বা মগধ এবং গ্যাঙ্গারিড বা গাঙ্গেয় বাংলা তার রাজ্যভুক্ত ছিল। রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। ইউরােপীয় লেখকরা যে পূর্ব ভারতীয় রাজার বর্ণনা দিয়েছেন, তিনি নিঃসন্দেহে একজন নন্দ রাজা ছিলেন। নন্দ রাজাদের মধ্যে মহাপদ্মই রাজ্য জয় করেছেন, অন্য রাজাদের সে কৃতিত্ব ছিল না। অর্থাৎ, বাংলা ও বিহার যে মহাপদ্মের সময় থেকেই নন্দ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, গ্রিক বৃত্তান্তে তা প্রমাণিত হয়। কথাসরিৎসাগর-এ উল্লেখ আছে, জনৈক নন্দ রাজা অযােধ্যায় সৈন্য শিবির স্থাপন করেছিলেন। এ থেকে মনে হয়, অযােধ্যাসহ কোসল মহাপদ্মের অধীন ছিল। 

১২শ শতকে উত্তীর্ণ কয়েকখানি স্থানীয় লেখ হতে জানা যায়, নন্দ রাজারা কর্ণাটকের কুন্তল অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীর হাথীগুম্ফা লেখে জনৈক নন্দ রাজার উল্লেখ আছে। ওই সূত্রে বলা হয়েছে, তিনি কলিঙ্গ বা ওড়িশায় একটি খাল খনন করেন এবং সেখান থেকে একটি জৈন মূর্তি মগধে নিয়ে যান। নন্দ রাজার ওড়িশায় খাল খনন বা সেখান থেকে একটি জৈন মূর্তি অপসারণের ঘটনায় ওই অঞ্চলে নন্দ রাজার আধিপত্য প্রমাণিত হয়। হাথীগুম্ফা লেখের নন্দ রাজা যে মহাপদ্ম নন্দ সে কথা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন। গােদাবরী নদীর তীরে নান্দের নামে একখানি গ্রাম আছে। অনেকে মনে করেন, নন্দ রাজাদের নাম থেকেই গ্রামটির নামকরণ নান্দের। এ থেকে বােঝা যায়, নন্দ রাজাদের অধিকার গােদাবরী অঞ্চলেও বিস্তার লাভ করেছিল। 

মৎস্যপুরাণ অনুসারে মহাপদ্ম ৮৮ বছর রাজত্ব করেন। কিন্তু বায়ু-পুরাণে তার রাজত্বকাল ২৮ বছর বলে উল্লেখ আছে। তিব্বতি লেখক লামা তারনাথ নন্দ রাজার ২৯ বছর রাজত্বের কথা বলেছেন। মহাবংস ও দীপবংসে বলা হয়েছে, মহাপদ্ম ও তার উত্তরাধিকারীরা মােট ২২ বছর রাজত্ব করেন। মৎস্য ও বায়ু-পুরাণের তুলনামূলক বিশ্লেষণে মনে হয়, মহাপদ্ম সম্ভবত ২৮ বছর রাজত্ব করেন। মনে হয়, পুরাণের অষ্টাশীতি (৮৮) সংখ্যাটি ভুল, সংখ্যাটি হওয়া উচিত ছিল অষ্টাবিংশতি (২৮)। লিপিকারদের অনবধানতার জন্যই ভুলটি ঘটে থাকবে। মহাপদ্ম যে ২৮ বছর রাজত্ব করেছেন তা হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীও স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি মনে করেন, এই ২৮ বছরের মধ্যে প্রায় ২২ বছরই মহাপদ্ম কালাশােকের পুত্রদের অভিভাবকরূপে মগধরাজ্য পরিচালনা করেছেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহাপদ্ম মগধের সিংহাসন লাভের জন্যই কালাশােককে হত্যা করেন। কালাশােকের হত্যার পর সেই সিংহাসনের জন্য তিনি আরও দীর্ঘ ২২ বছর অপেক্ষা করবেন, এই যুক্তির অভাবনীয়। পক্ষান্তরে, কালাশােকের হত্যা ও মহাপদ্মের সিংহাসনে আরােহণ ঘটনা দুটি যুগপৎ ঘটার সম্ভাবনাই অধিক। আনুমানিক ৩৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাপদ্ম মগধের সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার দেহাবসান হয় আনুমানিক ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।

মহাপদ্মের উত্তরাধিকারিগণ (৩৪০ – ৩২১ খ্রি.পূ.)

পুরাণে বলা হয়েছে, মহাপদ্মের মৃত্যুর পর তার ৮ জন পুত্র ক্রমান্বয়ে রাজত্ব করেন। এই ৮ জন পুত্রের মধ্যে শুধু সুমাল্য বা সুকল্পের নামই উল্লেখ আছে। মহাবােধিবংসে অবশ্য বলা হয়েছে, উগ্রসেনের পর তার ৮ জন ভাই পর পর মগধের রাজা হন। তারা হলেন পণ্ডুক, পণ্ডুগতি, ভূতপাল, রাষ্ট্রপাল, গােবিষাণক, দশসিদ্ধক, কৈবর্ত ও ধন। এই প্রসঙ্গে বলা যায়, পৌরাণিক, বৌদ্ধ ও জৈন সকল সুত্রেই ৯ জন নন্দ রাজার উল্লেখ আছে। সহজেই অনুমান করা যায়, প্রাচীন গ্রন্থাদিতে নন্দ রাজাদের যে কখনও কখনও ‘নবনন্দাঃ’ বলা হয়েছে তা এই ‘নয়’ সংখ্যাটির জন্যই। পূর্বে অনেকে ‘নব’ পদটিকে ভুল করে ‘নতুন’ অর্থে গ্রহণ করতেন। তারা মনে করতেন, মহাপদ্মরা নব বা নতুন নন্দ কিন্তু নন্দিবর্ধন বা মহানন্দির মতাে মগধের পূর্ববর্তী রাজারা পূর্ব নন্দ বা প্রাচীন নন্দ। বলা বাহুল্য, এই ব্যাখ্যা এখন আর গ্রহণ করা হয় না। মহাপদ্মের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে শুধু শেষের জন সম্পর্কে কিছু তথ্য মেলে। তিনি বৌদ্ধ সুত্রের ধননন্দ, প্রাচীন ইউরােপীয় সাহিত্যের এগ্রামমেস বা জ্যান্ডামেস। ইউরােপীয় লেখকরা সকলে এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, এগ্রামমেস বা জ্যান্ডামেস প্রবল পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। পূর্বে গঙ্গা নদী থেকে পশ্চিমে বিপাশা নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জুড়ে তার বিশাল রাজ্য ছিল। যেমনি বিস্তত তার রাজ্য, তেমনি সুবিশাল তার সৈন্যবাহিনী। তার সৈন্যদলে ছিলেন ২ লক্ষ পদাতিক ও ২০ হাজার অশ্বারােহী সৈন্য। তাছাড়া ছিল ২ হাজার চার ঘােড়ায় টানা রথ এবং ৩ হাজার রণহস্তী। দু’জন প্রাচীন ইউরােপীয় লেখক, ডায়ােডােরাস ও প্লুটার্ক, নন্দ রাজার সামরিক শক্তি সম্পর্কে প্রায় একই তথ্য পরিবেশন করেছেন। তবে তারা লিখেছেন, নন্দ রাজার রণহস্তীর সংখ্যা যথাক্রমে ৪ এবং ৬ হাজার ছিল। সামরিক শক্তিতে বলবান হলে কী হবে, নন্দরাজ প্রজাদের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারেননি। দরিদ্র প্রজাদের উপর ভারী করের বােঝা চাপিয়ে তিনি অর্থ সংগ্রহ করতেন। কথাসরিৎসাগর থেকে জানা যায়, সংগৃহীত অর্থ নন্দ রাজা গঙ্গা নদীর বুকে লুকিয়ে রাখতেন। অর্থের প্রতি রাজার অত্যধিক আসক্তি, গঙ্গা বক্ষে অর্থ লুকিয়ে রাখা ইত্যাদি ঘটনার উল্লেখ প্রাচীন তামিল সাহিত্যেও আছে। তবে এই সব গ্রন্থাদিতে নন্দ অপশাসনের যে ছবি অঙ্কিত হয়েছে, তা অতিরঞ্জিত। 

ভারত আক্রমণে এসে ম্যাসিডােনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার পূর্ব দিকে বিপাশা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হন। এই নদীরই ঠিক অপর পারে এগ্রামেসের রাজ্য। আলেকজান্ডার নন্দ রাজ্য আক্রমণের কোনও চেষ্টা করেননি। শােনা যায়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নন্দ রাজার বিরুদ্ধে ম্যাসিডােনীয় সৈন্যদের উত্তেজিত করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। নন্দ রাজার জনপ্রিয়তার অভাব, তার নিচ বংশের কথা, সবই তাদের তিনি জানান। রাজা পুরুও নন্দ রাজা সম্পর্কে আলেকজান্ডারকে একই কথা বলেছিলেন। তবু ম্যাসিডােনিয়ারাজ নন্দ রাজ্য আক্রমণে কোনও উৎসাহ দেখাননি। আলেকজান্ডার নন্দ রাজ্য আক্রমণ করলেন না ঠিকই তবু এর আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে আসে। তার ভারত ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের রাজনৈতিক আকাশে এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রের উদয় হয়। তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তিনি ভারত থেকে শুধু বিদেশিদেরই বিতাড়িত করলেন না, নন্দদের উচ্ছেদ করে পাটলিপুত্রের সিংহাসন অধিকার করেন। কোনও কোনও প্রাচীন গ্রন্থে নন্দ রাজাদের উচ্ছেদের কৃতিত্ব চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী চাণক্য বা কৌটিল্যের ওপর আরােপ করা হয়েছে। তবে চাণক্য বা কৌটিল্য চন্দ্রগুপ্তের সমসাময়িক, না পরবতী, সে সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে বাগ-বিতণ্ডার অন্ত নেই। সে যা হােক, নন্দ রাজত্বের অবসানকল্পে চন্দ্রগুপ্তের এক মুখ্য ভূমিকা ছিল। সম্ভবত ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বা তার কিছু পর নন্দ রাজত্বের অবসান হয়।

ভারতের ইতিহাসে নন্দ রাজবংশের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথমত, বিম্বিসার, অজাতশত্রু ও শিশুনাগ মগধকে কেন্দ্র করে যে সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, নন্দ রাজারা তার বাস্তব রূপ দেন। পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে বিপাশা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাদের সাম্রাজ্য। ভারতে প্রথম সাম্রাজ্য নির্মাণের কৃতিত্ব তাদেরই। তারা সাম্রাজ্যের স্বার্থে রাজকোষে অর্থাগমের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। সৈন্যবাহিনী ও রাজকর্মচারীদের ভরণপােষণের জন্য যে অর্থের প্রয়ােজন, তা প্রধানত জমির খাজনা থেকে সংগৃহীত হত। ফসল ভালাে হলে নিয়মিত ও সুচারুরূপে খাজনা আদায় সম্ভব। এই উদ্দেশ্যে তারা যেমন খাল খনন করেছিলেন, তেমনি জলসেচেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় করার জন্য তারা প্রশংসনীয় উদ্যম গ্রহণ করেন। তৃতীয়ত, মগধের রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিগ্রহণ করে তারা প্রমাণ করলেন, যােগ্যতা থাকলে অব্রাহ্মণ-অক্ষত্রিয়রাও রাজপদ অলংকৃত করতে পারেন। নন্দদের অভূত্থান শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই আলােড়ন সৃষ্টি করেনি, ভারতের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের উপরও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল

কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনা ও তাদের সম্ভাব্য তারিখ 

  • বুদ্ধের আবির্ভাব – ৫৬৬ খ্রি.পূ.
  • বিম্বিসারের সিংহাসনে আরােহণ – ৫৪৪ খ্রি.পূ.
  • বুদ্ধের সঙ্গে বিম্বিসারের সাক্ষাৎকার – ৫৩০ খ্রি.পূ.
  • বিম্বিসারের মৃত্যু – ৪৯৩ খ্রি.পূ.
  • অজাতশত্রুর রাজ্যলাভ – ৪৯৩ খ্রি.পূ.
  • বুদ্ধের দেহাবসান – ৪৮৬ খ্রি.পূ.
  • অজাতশত্রর মৃত্যু – ৪৬১ খ্রি.পূ. 
  • রাজধানীরূপে পাটলিপুত্রের প্রতিষ্ঠা – ৪৫৮ খ্রি.পূ.
  • শিশুনাগের সিংহাসনে আরােহণ – ৪৩০ (মতান্তরে ৪১৩) খ্রি.পূ.
  • মহাপদ্ম-উগ্রসেনের রাজ্যলাভ – ৩৬৪ (মতান্তরে ৩৪৫) খ্রি.পূ.
  • নন্দ বংশের পতন – ৩২৪ খ্রি.পূ.
  • মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা – ৩২৪ খ্রি.পূ.

গ্রন্থপঞ্জি

ষোড়শ মহাজনপদ থেকে নগর সভ্যতার বিকাশ ও দ্বিতীয় নগরায়ন পর্যন্ত

  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে – প্রথম পর্ব, সাহিত্যলোক, ২০২০, পৃ. ২২১ – ২৫১
  • নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য : ভারতীয় জাতিবর্ণপ্রথা (কলকাতা, ১৯৮৭)
  • ব্রতীন্দ্রনাথ মুখােপাধ্যায়, টাকাকড়ি আবির্ভাবের যুগ (কলকাতা, ১৩৯৯)
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (কলকাতা, ১৯৯৪)
  • রণবীর চক্রবর্তী : পাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)
  • Agarwala, V. S. : India as known to Pánini (Lucknow, 1953)
  • Chakrabarti, R. : Warfare for Wealth : Early Indian Perspective (Calcutta, 1986).
  • Chakrabarti, U. : Social Dimensions of Early Buddhism (New Delhi, 1988)
  • Chattopadhyaya, S.: Bimbisára To Asoka (Calcutta, 1977)
  • Fick, R. : The Social Organizations in North-East India in Buddha’s Time (Calcutta. 1920)
  • Ghosh, A.: The City in Early Historical India (Simla, 1973)
  • Kane, P. V: History of Dharmasastra (Poona, 1930-46)
  • Kosambi, D.D.: An Introduction to the Study of Indian History (Bombay, 1956)
  • Majumdur, R. C. (Ed.) : The Age of Imperial Unity (Bombay, 1968)
  • Mehta, R. N. : Pre-Buddhist India (Bombay. 1939)
  • Motichandra : Sarthavaha (Patna. 1953)
  • Rapson. E. J. (Ed.) : Cambridge History Of India, Vol. I (Delhi, 1968)
  • RayChaudhuri. H.C.: Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953)
  • Rhys Davids. T. W.: Buddhist India (London, 1903) 
  • Sastri. K. A. N. (Ed.): A Comprehensive History of India, Vol. II. (Bombay, 1957) 
  • Sharma. R. S. : Perspectives in Social and Economic History of Early India (Delhi. 1993) : The Material Culture and Social Formations in Ancient India (Delhi, 1985)
  • Thapar, Romila : Ancient Indian Social History (Delhi, 1978). From Lineage 10 State (Bombay, 1984).
  • Upadhyay. G. P. : Brahmanas in Ancient India (Bombay, 1964) 
  • Wagle, N. K.: Society at the Time of the Buddha (Bombay, 1966). 

মগধের উত্থান

  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে – প্রথম পর্ব, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ২০২০, পৃ. ২৫২ – ২৬২
  • Chattopadhyaya, S. : Bimbisara To Asoka (Calcutta, 1977).
  • Eggermont, P. H. L.: The Chronology of the Reign of Asoka Moriya (Leiden, 1956).
  • Majumdar. R. C. (Ed.): The Age Of Imperial Unity (Bombay, 1968).
  • Mishra, Y. : An Early History of Vaisāli (Delhi, 1962).
  • Pargiter, F. E. : The Purana Text of the Dynasties of the Kali Age (Oxford Press, 1913).
  • Pathak, V. : History of Kosala (Delhi, 1963).
  • Rapson, E. J. (Ed.): Cambridge History Of India (Delhi. 1968).Voli.
  • Raychaudhuri, H.C. : Political History Of Ancient India (Calcutta, 1953).
  • Sastri, K. A. N. (Ed.): A Comprehensive History Of India, Vol. II (Bombay, 1957): The Age of the Nandas and the Maurvas (Delhi, 1967). 

সম্পর্কিত মানচিত্র-ভিত্তিক ভিডিও

ঋগ্বৈদিক উপজাতিসমূহ থেকে মহাজনপদসমূহের উদ্ভব

মহাজনপদসমূহ ও মগধের উত্থান

দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস

ভারতের ইতিহাস

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.