আর্যসমস্যা, বৈদিক সাহিত্য, ঋগ্বেদের যুগ ও পরবর্তী বৈদিক যুগ (১৭০০ – ৫০০ খ্রি.পূ.)

(পরিবর্ধিত হবে, আর্যদের নিয়ে তথ্যে অনেক ভুল আছে, সংশোধিত হবে)

Table of Contents

আর্যসমস্যা ও বৈদিক সাহিত্য

আর্য-ভাষাগােষ্ঠী

ভারতীয় ভূখণ্ডে যারা বৈদিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন তাদেরই সাধারণ নাম আর্য। (ঋ-ধাতুর অর্থ গমন করা। ঝ-ধাতুর সঙ্গে ণ্যৎ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে আর্য পদটি গঠিত হয়েছে। ঋগ্বেদের সুপ্রাচীন অভিধান রচয়িতা যাস্ক আর্য পদটিকে অর্যের পুত্র এই অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্যের অর্থ ঈশ্বর বা প্রভু। আবার কেউ কেউ মনে করেন আর্য জাতিবাচক পারসিক পদ ঐর্য হতে নিষ্পন্ন। আর্য পদের অর্থ সজ্জন, শ্রেষ্ঠ, গুণবান, পূজ্য, অভিজাত, মহান, মান্য, সম্রান্ত ইত্যাদি।) কিন্তু আর্য বলতে কোনও জাতি বা মানবগােষ্ঠীকে বােঝায় না, বােঝায় এক ভাষাগােষ্ঠীকে। সেই বিশেষ ভাষাগােষ্ঠীর মধ্যে বৈদিক ভাষা বা সংস্কৃতও আছে। আর্য ভাষাগােষ্ঠীর লােকদেরও আর্য বলে। কোনও এক ভাষাভাষী গােষ্ঠীকে আর্য বলা হয়তাে ঠিক নয় তবু এই রীতিই দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে।

সংস্কৃতই একমাত্র আর্যভাষা নয়। সংস্কৃতের সঙ্গে ল্যাটিন, গ্রিক, জার্মান, ইংরেজি, প্রাচীন পারসিক প্রভৃতি ভাষার পদগত ও ধ্বনিগত অদ্ভুত মিল আছে। এই ভাষাগুলোর প্রতিটিই আর্যভাষা। ফিলিপ্পো সসসেত্তি নামে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরবাসী জনৈক বণিক ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্যোপলক্ষে ভারতে আগমন করেন। গােয়ায় অবস্থানকালে তিনি স্থানীয় এক বিদ্বজ্জনের নিকট সংস্কৃত ভাষা অধ্যয়ন করেন। তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন, ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে জোসেফ স্কালিজার নামে এক বিদ্যোৎসাহী (১৫৪০-১৬০৯ খ্রিস্টাব্দ) এ বিষয়ে আরও অগ্রসর হন এবং গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, স্নাভনিক, প্রাচীন পারসিক ও সংস্কৃত ভাষাসমূহের মধ্যে গভীর যােগসূত্র লক্ষ করেন। এর প্রায় দু’শাে বছর পর ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়ম জোন্স কলকাতায় এশিয়াটিক সােসাইটির এক অধিবেশনে সংস্কৃতের সঙ্গে ল্যাটিন, গ্রিক কেলটিক, গথিক, প্রাচীন পারসিক প্রভৃতি এশিয়া ও ইউরােপের কয়েকটি ভাষার গভীর যােগসূত্রের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি মন্তব্য করেন, এই ভাষাগুলো একটি আদি বা মূল আর্যভাষা হতে উৎপন্ন হয়েছে। পরবর্তী গবেষকরাও বিভিন্ন ভাষায় পদের ব্যবহার, গঠন, বিন্যাস ও ধ্বনি পরীক্ষা করে এই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। মূল আর্যভাষাটি বহুদিন পূর্বেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। পণ্ডিতেরা এই মূল ভাষাটিকে আদি আর্য, আদি ইন্দো-ইউরােপীয়, আদি ইন্দো-জার্মান ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন। এই মূল আর্য ভাষায় যারা কথা বলতেন, তারাই আদি আর্য, এরাই বৈদিক ও ইউরােপীয় আর্যদের পূর্ব-পুরুষ। 

উল্লেখ্য, এই লেখায় আর্য বলতে ইন্দো-ইউরোপীয় বোঝানো হয়েছে।

ভারতবর্ষে আদি আর্যভূমি হওয়া না হওয়া নিয়ে বিতর্ক 

ভারতবর্ষে আদি আর্যভূমি থাকা নিয়ে দেখানো যুক্তি : বৈদিক সাহিত্য থেকে জানা যায়, বৈদিক আর্যরা প্রথম দিকে কাবুল ও সিন্ধু উপত্যকায় বাস করতেন। কিন্তু বৈদিক আর্যদের পূর্বপুরুষ আদি আর্যরাও কি এই উপমহাদেশের অধিবাসী ছিলেন? এই ধারণা সত্য হলে ভারতবর্ষকেই আর্যদের জন্মভূমি বলে স্বীকার করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ সিদ্ধান্তও স্বাভাবিক হয় যে এ দেশ থেকেই আর্যরা ধীরে ধীরে পথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু ঘটনাটা যদি অন্যরূপ হয় অর্থাৎ আদি আর্যরা যদি প্রথমে ইউরােপ বা এশিয়ার অন্য কোনও দেশে বাস করে থাকেন তাহলে কিন্তু এই ধারণাই বদ্ধমূল হবে যে আর্যরা বাইরের কোনও দেশ থেকে এ দেশে এসেছিলেন। অর্থাৎ ভারতবর্ষ আর্যদের জন্মভূমি নয়, এ দেশে তারা আগন্তুক। প্রথম দিকে আর্যরা ঠিক কোন দেশে বাস করতেন তা নিয়ে নানা মুনি নানা মত প্রকাশ করেছেন। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন ভারতবর্ষ হল আর্যদের জন্মভূমি। (এ দলে দেশি ও বিদেশি উভয়শ্রেণির পণ্ডিতই আছেন। এদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, মহামহােপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা, এ. ডি. পুসলকর, কোয়েনরাড এল্স্‌ট প্রভৃতির নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য।) এই মতের সমর্থনে বেশ কয়েকটি যুক্তি দেখানাে হয় : 

  • ১. আর্যদের আদি নিবাস সপ্তসিন্ধু বা সিন্ধু অববাহিকা ও সংলগ্ন অঞ্চল এমন একটি ধারণাই যেন বেদে ধ্বনিত হয়েছে। বেদে সপ্তসিন্ধুকে সাধারণ দেশ বলে বর্ণনা করা হয়নি, ‘দেবকৃতযােনি’ বা ‘দেবনির্মিত দেশ’ বলে বন্দনা করা হয়েছে।
  • ২. যারা চিরদিনের জন্য দেশ ত্যাগ করে চলে যান, দীর্ঘদিন তারা জন্মভূমির স্মৃতি সযত্নে লালন করেন। এটাই মানুষের সহজাত ধর্ম। সেই কবে পারসিরা তাদের দেশ ছেড়ে ভারতবর্ষে চলে এসেছেন অথচ আজও তারা তাদের মাতৃভূমি ইরানের স্মৃতি সগৌরবে মনে রেখেছেন। আর্যরা বিদেশ থেকে এসে থাকলে তাদের সাহিত্যে সে অভিপ্রয়াণের স্মৃতিচারণ থাকত। কিন্তু বেদে, পুরাণে, প্রাচীন সাহিত্যে বা জনশ্রুতিতে সে রকম কোনও ইঙ্গিত নেই।
  • ৩. যাগ-যজ্ঞ ছিল আর্যদের জীবনের অঙ্গ। যাগ-যজ্ঞ উপলক্ষে ও অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানে আর্যরা সােমরস পান করতেন। যে লতা থেকে সােমরস তৈরি হত তা পাওয়া যেত হিমালয়ের মূজবান বা মূঞ্জবান পাহাড়ে।
  • ৪. আর্যরা যদি বিদেশ থেকে ভারতে এসে থাকবেন তাহলে সেখানে অর্থাৎ বিদেশেই বেদের অনুরূপ সাহিত্য রচিত হত। কিন্তু তা হয়নি। এর ব্যাখ্যা কী? যদি বলা যায় নিজেদের জন্মভূমিতে নয়, ভারতের মতাে এক প্রত্যন্ত দেশে আর্যৰ্মনীষার পূর্ণ বিকাশ হয়েছিল, তাহলে কিন্তু প্রশ্নটির সদুত্তর পাওয়া যায় না। এ ব্যাখ্যা তেমন সন্তোষজনক নয়। বরং বিষয়টিকে উল্টো করেই দেখা যেতে পারে। আর্যদের এক ভ্রাম্যমান গােষ্ঠী ভারত ত্যাগ করে বিদেশে চলে যান, বিদেশগামী আর্যরা সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে অনুন্নত ছিলেন বলে সেখানে ঋগ্বেদের মতাে সাহিত্য রচিত হয়নি।
  • ৫. যারা বলেন ঋগ্বেদে বাঘের উল্লেখ নেই, চালের কথা নেই, (ঋগ্বেদে ধানের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে) অতএব আর্যরা তখন সবেমাত্র ভারতে এসেছেন, তাদের কথা সত্য নয়। পাঞ্জাবের লােকেরা যে বাঘের কথা জানতেন সিন্ধু উপত্যকায় পাওয়া সিলমােহরগুলোই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ঋগ্বেদে চালের উল্লেখ নেই এ কথা স্বীকার করে নিলেও কিছুই প্রমাণিত হয় না। ঋগ্বেদে তাে লবণেরও উল্লেখ নেই। তাহলে কি বুঝতে হবে বৈদিক আর্যরা নুনহীন বিস্বাদ খাদ্য গ্রহণ করতেন? ঋগ্বেদে হাতিকে মৃগহস্তী বলা হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে হাতির সঙ্গে তারা সবেমাত্র পরিচিত হয়েছেন। তারা যে অঞ্চলে বাস করতেন সেই পাঞ্জাবে হাতি অপরিচিত ছিল না। সিন্ধু উপত্যকার সিলমােহরগুলোতে অনেক হাতির ছবি অঙ্কিত আছে। মৃগহস্তী পদটির ব্যবহারে আর্যদের কাব্যিক মনের প্রকাশ ঘটেছে।

ভারতবর্ষের বাইরে আদি আর্যভূমি হবার যুক্তি : ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসভূমি, এ মত কিন্তু বেশির ভাগ পণ্ডিতই স্বীকার করেন না। তাদের এই স্বীকার না করার কারণগুলোও কিন্তু উপেক্ষণীয় নয় –

  • ১. ভারতবর্ষ যে আর্যদের আদি বাসভূমি তার সপক্ষে আজও কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
  • ২. ঋগ্বেদ অনেক পরবর্তী কালের সংকলন। এই সংকলনে বৈদিক আর্যদের কথা আছে কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষ আদি আর্যদের কথা নেই।
  • ৩. ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর ভৌগােলিক অবস্থান ভারতবর্ষের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। ১০টি আর্য ভাষাগােষ্ঠীর মধ্যে ৭টিরই অবস্থান ইউরােপে। এই সাতটি ভাষা হল গ্রিক, ল্যাটিন, কেল্টিক, টিউটনিক, বল্টিক, স্লাভনিক, লিথুয়ানিক ও আলবেনিয়ান। সারা এশিয়ায় রয়েছে মাত্র তিনটি ভাষা, তাও বিচ্ছিন্নভাবে। এগুলো হল সংস্কৃত, পারসিক ও আর্মেনিয়ান। ইউরােপে আর্য ভাষাগুলো ঘনসন্নিবিষ্ট ও সংখ্যায় অধিক, সেখানেই আর্যদের আদি নিবাসের অবস্থিতির সম্ভাবনা উজ্জ্বল। (ল্যাটিন ভাষাগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ইটালিয়ান, ফরাসি, স্প্যানিস, পুর্তুগিজ, রুমানিয়ান ইত্যাদি ভাষা। কেল্টিক ভাষাগােষ্ঠীর মধ্যে পড়ে ব্রেটন, ওয়েলস, কর্নির্স, আইরিস, গলিক ইত্যাদি। টিউটনিক ভাষার অন্তর্গত জার্মান, ইংরেজি, ডাচ ও স্ক্যান্ডিনেভীয় ভাষাসমূহ। বল্টিক ভাষাগােষ্ঠী বলতে বােঝায় লেটিস, লিথুয়ানিয়ান ও অধুনা লুপ্ত প্রাচীন প্রাশিয়ান। স্লাভনিক ভাষাগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত রাশিয়ান, পােলিস, চেক, স্নােভাক সার্বিয়ান, বুলগারিয়ান ইত্যাদি।)
  • ৪. যে ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাটি মূল আর্য ভাষার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, সেটি লিথুয়ানিয়ান। এর থেকে মনে হয়, আদি আর্যভূমি লিথুয়ানিয়ার নিকটবর্তী ছিল। 
  • ৫. ভারত যদি আর্যদের জন্মভূমি হত তাহলে তারা ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে নতুন দুঃসাহসিক অভিযানে বের হওয়ার পূর্বে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তেন, তাদের সংস্কৃতি বিস্তারের চেষ্টা করতেন। কিন্তু তা তারা করেননি। ভারতের একটি বৃহৎ অঞ্চল দক্ষিণ ভারত দীর্ঘদিন আর্য সংস্কৃতির বাইরে ছিল। এমনকি উত্তর-পশ্চিম ভারতের একাংশেও দ্রাবিড়ভাষী ব্রাহুই উপজাতির বাস ছিল। উত্তর ও পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অস্ট্রিক ও অন্যান্য ভাষা ভাষী লােকরা বাস করতেন। এরাই ভারতের আদি অধিবাসী। 
  • ৬. তালব্য বর্ণের ধ্বনির প্রাধান্য সংস্কৃত ভাষায় সহজেই লক্ষ করা যায়, অন্য কোনও আর্য ভাষায় এই ধ্বনির প্রাধান্য নেই। ভারতে বিদেশাগত আর্য ভাষার উপর স্থানীয় অস্ট্রিক বা দ্রাবিড় ভাষার প্রভাবের ফলে সংস্কৃতে এই ধ্বনি বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয়েছে। আর্যরা ভারতবর্ষ থেকে ইউরােপে ছড়িয়ে পড়লে অন্যান্য আর্য ভাষায়ও এই ধ্বনি বৈশিষ্ট্য দেখা দিত।
  • ৭. আর্যরা প্রায় প্রথম থেকে ঘােড়াকে পােষ মানাতে শিখেছিলেন। তাদের জীবনে। ঘােড়ার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে ঘােড়া ব্যবহারের বড় একটা নজির পাওয়া যায় না। কিন্তু কৃষ্ণসাগরীয় ও দক্ষিণ উরাল অঞ্চলে ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই ঘােড়ার ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
  • ৮. এশিয়া মাইনর অর্থাৎ আধুনিক তুরস্কের বােঘাজকোইতে ১৯০৬-১২ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত খননকার্যের ফলে কয়েক হাজার উৎকীর্ণ মৃলক আবিষ্কৃত হয়েছে। একই সঙ্গে সন্ধান পাওয়া গেছে লেখ-উৎকীর্ণ একটি বিশাল ফলকের। বৃহদায়তনের এই ফলকটিতে উৎকীর্ণ। হয়েছে হিটাইট ও মিতান্নিদের মধ্যে আনুমানিক ১৩৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্পদিত একটি সন্ধিপত্র। সন্ধিপত্রের শুরু হয়েছে ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র ও নাসত্যের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। ইন্দ্র, বরুণাদি সকলেই বৈদিক দেবতা। প্রায় একই সময়ের বা কিছুটা পূর্ববর্তী কয়েকখানি পােড়ামাটির ফলক মিশরের তেল এল আমানায় আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ফলকগুলোতে সিরিয়ার কয়েকজন প্রাচীন রাজার নাম পাওয়া যায়। নামগুলো আর্যদের নামের মতােই। এই লেখগুলো ঋগ্বেদের পূর্ববর্তী বলে অনুমিত হয়েছে। বােঘাজকোই ও তেল এল আমাৰ্নার লেখগুলো থেকে মনে হয় আর্যরা পশ্চিম এশিয়া হয়েই ভারতে এসেছিলেন। (বিষয়টিকে অন্যভাবেও দেখা যায়। বােঘাজকোই ও তেল এল আমাৰ্নার লেখাবলি হতে এরূপ অনুমানও সম্ভব, খ্রিস্টপূর্ব ১৪শ শতকের মধ্যেই আর্যরা ভারত হতে পশ্চিম এশিয়ায় এসে উপনীত হন। অর্থাৎ আর্যরা বােঘাজকোই হয়ে ভারতে আগমন করেন, না ভারত হতে যাত্রা শুরু করে বােঘাজকোইতে এসে উপনীত হন, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এই লেখগুলোতে নেই।)
  • ৯. সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতার প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। সিন্ধু সভ্যতা মূলত শহুরে সভ্যতা, বৈদিক সভ্যতা গ্রামীণ। বৈদিক সভ্যতার চেয়ে সিন্ধু সভ্যতা প্রাচীন। সম্ভবত অনার্যরাই সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তুলেছেন। ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা যদি অনার্যসভ্যতা হয়, তাহলে আর্যরা বিদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন, এই ধারণাই সুদৃঢ় হয়। 
  • ১০. যদি প্রমাণ করা যেত, সিন্ধু অববাহিকার লােকদের ভাষা ছিল সংস্কৃত, তাহলেও না হয় কথা ছিল। কারণ তাহলে বলা যেত, প্রাক-হরপ্পা যুগে পৃথিবীর কোথাও আর্য জাতির বা সংস্কৃতির কোনও প্রত্যক্ষ নিদর্শন পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখনও হরপ্পালিপির পাঠোদ্ধার হয়নি। তাই এ সম্পর্কে সঠিক কিছু বলা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।

বি. বি. লালের ভারতবর্ষের পক্ষে যুক্তি ও তার সমালোচনা : তবে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার পূর্বে প্রত্নতাত্ত্বিক বি. বি. লাল ভারতবর্ষের সপক্ষে যেসব যুক্তি উত্থাপন করেছেন সেদিকে একবার দৃষ্টিপাত করা যায় (B. B. Lal. The Earliest Civilization of South Asia (New Delhi, 1997): “Some Thoughts on the Home of the Indo-European Languages and Culture” in D. N. Tripathi ed. A Discourse on Indo-European Languages and Cultures (New Delhi, 2005).) :

  • ১. ঋগ্বেদ সংহিতায় এমন কোনও ইঙ্গিত নেই যা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে আর্যরা বহিরাঞ্চল হতে ভারতবর্ষে আগমন করেন। 
  • ২. ঋবেদকে যত অর্বাচীন মনে করা হয়, ঋগ্বেদ তা নয়। এই সংহিতা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে সংকলিত হয়।
  • ৩. ঋবৈদিক আর্যরা অর্ধ-যাযাবরও নন, গ্রামীণ গােষ্ঠীও নন; তারা কৃষির বিকাশ সাধন করেছেন, সুরক্ষিত পুর নির্মাণ করেছেন, সামুদ্রিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করেছেন, অশ্বের ব্যবহারে নৈপুণ্য অর্জন করেছেন।
  • ৪. ঋবৈদিক আর্যরা যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন, কালিবঙ্গান ও লােথালে যজ্ঞবেদি আবিষ্কৃত হয়েছে।
  • ৫. ঋগবৈদিক ও হরপ্পা সভ্যতার মধ্যে যে বৈসাদৃশ্যের কথা বলা হয়, তা অতিরঞ্জিত। ঋবৈদিক আর্যরাই হরপ্পা সভ্যতা সৃষ্টি করেন, হরপ্পীয় সিলমােহরে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। 
  • ৬. ঋগ্বেদে যাদের পুর বলা হয়েছে তা আসলে পাচিল-ঘেরা হরপ্পীয় শহর বা দুর্গ। 

বি. বি. লাল ঋগ্বেদের সাক্ষ্য এবং হরপ্পা ও মেহেরগড়ে প্রাপ্ত প্রত্নাবশেষের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে আ. ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে আ. ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সংস্কৃতির বিবর্তনের একটি চিত্র অঙ্কন করেছেন। ভারতবর্ষই আর্যদের আদি বাসভূমি এবং হরপ্পীয়রাই ঋবৈদিক আর্য, বি. বি. লালের এই অভিমত অনেকের নিকট যুক্তিযুক্ত বােধ হয়নি। তাদের যুক্তি হলো – প্রথমত, ঋগ্বেদে যে পুর কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে, তার অর্থ অস্থায়ী বেষ্টনীযুক্ত বসতি, তার অর্থ দুগ বা শহর নয়। দ্বিতীয়ত, মেহেরগড়ে বসতির ইতিহাস শুরু হয়েছে আ. ৭৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে। আ. ২৫০০-৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্থানটি বসতিহীন অবস্থায় পড়েছিল। আ. ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এখানে নতুন করে বসতি স্থাপিত হয়। আর্যরা এই নতুন বসতির প্রতিষ্ঠাতা হলে স্থানটি কেন হাজার বছর ধরে পরিত্যক্ত ছিল? সেক্ষেত্রে আর্যদের তাে নবাগত বলেই বােধ হয়। এখানে উল্লেখ করা যায়, পুর কথাটি বেষ্টনী, দুর্গ, শহর, প্রতিরক্ষা-ঢিপি ইত্যাদি বিবিধ অর্থ প্রকাশ করে। ঋগ্বেদে পুর পদটি অস্থায়ী বেষ্টনী-পরিবৃত বসতি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, অন্য কোনও অর্থে নয়, এরূপ ব্যাখ্যা একপেশে বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, মেহেরগড়ে তথাকথিত হাজার বছরব্যাপী সাংস্কৃতিক বিরতির বিষয়টি সুনিশ্চিত নয়। বহু প্রত্নতাত্তিক এই বিরতির কথা অস্বীকার করেছেন। 

ভারতবর্ষের বাইরে বিভিন্ন স্থানে আদি আর্যভূমি সংক্রান্ত বিতর্ক

দক্ষিণ ইউক্রেন (মেরিজা গিম্বুটাস) : যারা ইউরােপে আর্যদের আদি বাসভূমির সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন তারা কিন্তু ইউরােপের সেই বিশেষ অঞ্চলটির ভৌগােলিক অবস্থান সম্পর্কে সহমত নন। কেউ বলেন, ইউরােপের সেই অঞ্চলটি দক্ষিণ ইউক্রেন, কারাের মতে সেটি অস্ট্রিয়া-চেকোশ্লোভাকিয়া-হাঙ্গেরি অঞ্চল, আবার কেউবা সেই অঞ্চলটি পশ্চিমে পােল্যান্ড। থেকে পূর্বে এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। মার্কিন মহিলা প্রত্নতাত্তিক মেরিজা গিমবুটাস বলেন, দক্ষিণ ইউক্রেনই আর্যদের আদি বাসভূমি। (M. Gimbuas, Primary and Secondary Homeland of the Indo-Europeans in Journal of the Indo-European Studies (1985), Parts 1-2)। তিনি মনে করেন, ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেখানে এমন এক মানব গােষ্ঠী বাস করতেন যারা ঘােড়াকে বশে এনেছিলেন, চাকাওয়ালা গাড়ি ব্যবহার করতেন, পশুপালন ও চাষাবাদের কাজ করতেন, তামা ও ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র ব্যবহার করতেন। এদেরই তিনি আদি আর্য বলেছেন। এরা ক্রমশ পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়েন এবং ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভল্গা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে দুটি জিনিস মনে রাখা দরকার। প্রথমত, ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্ব থেকেই যে আর্যরা ভারতে বাস করছিলেন, সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। ইউক্রেন থেকে ভল্‌গা – এই সামান্য পথ অতিক্রম করতেই যাদের ২০০০ বছর লেগেছিল, তারা কী করে এর অর্ধেকেরও কম সময়ে ভঙ্গা থেকে সিন্ধু নদ এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করলেন? দ্বিতীয়ত, এই মত অনুসারে আর্যরা ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পশুপালন ও কৃষিকাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। ঋগ্বেদের যুগেও আর্যরা প্রধানত পশুচারণই করতেন, তখনও কৃষির ব্যাপক প্রসার হয়নি। তাহলে কি বুঝতে হবে, ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ঋগ্বেদের সময় – এই সুদীর্ঘ সাড়ে তিন হাজার বছরে আর্যদের আর্থ-সামাজিক জীবনে কোনও বড় ধরনের পরিবর্তন আসেনি? তা কি কখনও হয়?

অস্ট্রিয়া-চেকোশ্লোভাকিয়া-হাঙ্গেরি (গাইল্স‌) : অধ্যাপক গাইলস বিভিন্ন ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষা বিশ্লেষণ করে আদি আর্যদের ও তাদের সভূমির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করেছেন। তিনি মনে করেন, আদি আর্যভাষায় সমুদ্র বা ২ জাতীয় কোনও শব্দ ছিল না। এর থেকে তিনি অনুমান করেন, কোনও দ্বীপে বা সমুদ্র নয়, সমুদ্র থেকে বেশ দুরেই আর্যদের বাস ছিল। যে অঞ্চলে তারা বাস করতেন সে অঞ্চল ছিল নাতিশীতােষ্ণ। সেখানে ওক, বীচ, উইলাে প্রভৃতি গাছ জন্মাত। ভূর্জ, লেবু ও দেবদারু জাতীয় গাছও সম্ভবত সেখানে ছিল। আর্যরা তখন চাষাবাদের কাজ শুরু করেছিলেন। জমি পরিষ্কার ও কোপানাে থেকে আরম্ভ করে ঘরে ফসল তােলা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তাদের জমির কাছাকাছি স্থানে থাকতে হত। ফলে যাযাবরের জীবন ত্যাগ করে তারা স্থায়িভাবেই বসবাস শুরু করে দেন। ষাঁড়, গরু, ঘােড়া, ভেড়া, কুকুর, শুকর, হরিণ প্রভৃতি জন্তুকে তারা পােষ মানাতে পেরেছিলেন। হাঁস, ঈগল, নেকড়ে ও ভালুকের সঙ্গেও তাদের পরিচয় ছিল। কিন্তু সিংহ, উট, হাতি ও বাঘ সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণা ছিল না। আদি আর্যরা তাহলে এমন এক অঞ্চলে বাস করতেন যেখানে চাষাবাদের জন্য যেমন উর্বর জমি ছিল তেমনি ছিল চারণভূমি। সেখানে ঘােড়ার জন্য যেমন বিস্তীর্ণ তৃণভূমি পাওয়া যেত, তেমনি ভেড়া চরানাের জন্য উঁচু জমিরও অভাব ছিল না। সেখানে ওক, বীচ প্রভৃতি গাছ জন্মাত, গরু, ঘােড়া, ভেড়া প্রভৃতি প্রাণী বিচরণ করত, নেকড়ে ও ভালুকের আনাগােনা ছিল কিন্তু সিংহ, উট বা হাতির কোনও চিহ্ন ছিল না। অধ্যাপক গাইলসের বিশ্বাস, আদি আর্যদের বাসের অনুকূল এরূপ আদর্শ পরিবেশ অস্ট্রিয়া-চেকোশ্লোভাকিয়া-হাঙ্গেরি অঞ্চলেই আছে, ইউরােপ বা এশিয়ার অন্য কোথাও নেই। তবে গাইলসের মতের সমর্থনে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাছাড়া আর্যদের মতাে বৃহৎ এক মানবগােষ্ঠী অস্ট্রিয়া-চেকোশ্লোভাকিয়া-হাঙ্গেরির মতাে সংকীর্ণ অঞ্চলে বসবাস করতেন এরূপ ধারণা অসংগত বলেই মনে হয়। | অধ্যাপক এ. এল. ব্যাসাম মনে করেন পশ্চিমে পােল্যান্ড থেকে পূর্বে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চলই আর্যদের আদি বাসভূমি। এ মতের সপক্ষে ও বিপক্ষে অবশ্য অনেক কথাই বলা হচ্ছে। 

উরাল পর্বতমালার দক্ষিণ পাদদেশ (ব্রানডেনস্টাইন) : উরাল পর্বতমালার দক্ষিণ পাদদেশে অবস্থিত সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমির সপক্ষে জোরালাে বক্তব্য রেখেছেন প্রখ্যাত জার্মান পণ্ডিত ব্রানডেনস্টাইন। (ব্রানডেনস্টাইন নির্দেশিত স্থানটি বর্তমানে কিরগিজিয়া তৃণভূমি নামে পরিচিত। এই তৃণভূমি দক্ষিণ রাশিয়া ও কাজাকস্তানের অন্তর্ভুক্ত। স্মর্তব্য, কিরগিজিয়া এবং কিরঘিজিয়া দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চল। প্রথমটি ইউরােপ ও এশিয়ার সীমান্তবর্তী, অপরটি ইরানের পূর্বে কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরে অবস্থিত।) তিনি মনে করেন, আদি আর্যরা যেসব শব্দ ব্যবহার করতেন তাতে তাদের পাহাড় সংলগ্ন এক তৃণাঞ্চলের অধিবাসী বলে মনে হয়। সে অঞ্চলে হরিণ, ভোদড়, বন্য শুয়াের, নেকড়ে, শিয়াল, ভালুক ইত্যাদি নানা স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাস ছিল। ব্রানডেনস্টাইনের ধারণা, এই অঞ্চল উরাল পর্বতের দক্ষিণ পাদদেশ সংলগ্ন তণভূমি ছাড়া অন্য কোনও স্থান নয়। ব্রানডেনস্টাইন মনে করেন, পরে আর্যদের একটি গােষ্ঠী দেশ ত্যাগ করে পর্বদিকে চলে যান এবং কালক্রমে পারস্য ও ভারতে এসে উপনীত হন। আর্যদের যে শাখাটি স্বদেশে রয়ে যায় তারাও পরে তাদের বাসভূমি ছেড়ে পশ্চিমে চলে যান। এরা যেসব শব্দ ব্যবহার করতেন। তাতে জলাভূমির ইঙ্গিত আছে, সেতুর আভাস আছে এবং বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের কথা আছে। পশ্চিমা আর্যদের এই নতুন বাসস্থান কার্পেথিয়ান পাহাড়ের পূর্বদিকে অবস্থিত ছিল। ব্রানডেনস্টাইন আর্যদের আদি বাসভূমির যে সকল বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করছেন সেগুলো অনেকের কাছেই গ্রহণীয় বলে মনে হয়নি। ফলে তার সিদ্ধান্ত ঘিরে যথেষ্ট বাগ-বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। গর্ডন চাইল্ড এক সময় মনে করতেন, আদি আর্যভূমি উত্তর ইউরােপে অবস্থিত ছিল। পরবর্তিকালে তিনি তার মত পরিবর্তন করেন এবং অবিভক্ত রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের অনুকূলে অভিমত ব্যক্ত করেন। আরও পরে তিনি উপলব্ধি করেন, প্রাপ্ত নিদর্শনের আলােকে আর্যদের আদি বাসভূমি নির্ণয়ের প্রচেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হবে না।

ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা (আসকো পারপোলা) : আর্যদের আদি বাসভূমি অবিভক্ত রাশিয়ার দক্ষিণ প্রান্তীয় তৃণাঞ্চল, এ মতের আর এক প্রবক্তা অসকো পারপােলা। (Asko Parpola. “The Coming of the Aryans to Iran and India and the Culture and the Ethnic Entity of the Dāsas” in International Journal of the Dravidian Linguistics, Vol. XVII, Part II, পৃষ্ঠা ৮৫-২২৯)। তিনি মনে করেন, স্বদেশ হতে বহির্গত হয়ে আর্যরা দীর্ঘদিন ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। বিংশ শতকের শেষপাদে এই অঞ্চলে তানুষ্ঠিত উৎখননে আ. ২১০০-১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পুরানাে এক সমুন্নত সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কত হয়েছে। আবিষ্কৃত নিদর্শনসমূহের মধ্যে আছে প্রাকার-বেষ্টিত গৃহ, দেবায়তন, কুপ ও আরও বহুবিধ অভিজ্ঞান। এই সভ্যতা অক্সাস বা আমুদরিয়া সভ্যতা নামে পরিচিত। অসকো পারপালার অভিমত, ঋগবৈদিক আর্যরাই এই সভ্যতা গড়ে তােলেন এবং খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের একেবারে শুরুতেই তারা বেলুচিস্তানের সীমানা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তিনি দক্ষিণ রাশিয়ার সপক্ষে কোনও নতুন যুক্তি উপস্থাপন করেননি, ঋগ্‌বৈদিক সভ্যতার সুচনা অত্সস অববাহিকায়, এ অভিমতের সমর্থনেও কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণের সন্ধান দেননি।

আনাতোলিয়া (কলিন রেনফ্রু) : আনাতোলিয়া অর্থাৎ বর্তমান তুরস্ক আর্যদের আদি বাসভূমি, ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক কলিন রেনফ্রু এই অভিমত পােষণ করেন। (Colin Renfrew, Archaeology and Language-The puzzle of Indo-European Origins (London, 1987), পৃষ্ঠা ৮১ হতে)। ঋগবৈদিক আর্যরা পশুচারক এক অর্ধ যাযাবর গােষ্ঠী, এরূপ ধারণার সঙ্গে তিনি সহমত নন। তার অভিমত, পশুচারণের সঙ্গে কৃষিকার্য ও পশু পালনের সংযােগ অতি ঘনিষ্ঠ। পশুচারক গােষ্ঠীর যে খাদ্য তা মূলত কৃষিজাত; পশুপালনে আভ্যস্ত না হলে পশুচারণ অসম্ভব। পশুচারকেরা তাদের খাদ্য সংগ্রহ করেন প্রতিবেশী কৃষককুলের কাছ থেকে, এই কৃষিজীবীদের নিকট হতেই তারা পশুপালন আয়ত্ত করেন। খ্রিস্টের জন্মের দশ হাজার বছর পূর্ব হতে আনাতোলিয়ায় চাষ-আবাদের কাজ শুরু হয়। এই স্থানই আর্যদের আদি বাসভূমি। এই স্থান হতেই তারা ইউরােপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। কিন্তু ঋগ্বেদ রচনার বহু পূর্বেই তারা ভারতে এসে উপনীত হন। হরপ্পীয়দের তিনি আর্যরূপে শনাক্ত করেছেন, হরপ্পীয়দের ভাষাকে সংস্কৃতরূপে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব একাদশ-দশম সহস্রাব্দে প্রাচীন তুরস্কবাসীরা যে আর্যভাষাভাষী ছিলেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়? 

ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণ (রামশরণ শর্মা) : রামশরণ শৰ্মা আদি আর্যদের বাসভূমি ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণে, অর্থাৎ বর্তমান। (Sharma, Looking for the Arvans (Madras, 1995): Advent of the Aryans in India (New Delhi, 1999)। জর্জিয়া, অর্মেনিয়া ও আজেরবাইজান অঞ্চলে, অবস্থিত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। স্বমতের সমর্থনে তিনি বিশেষ কোনও যুক্তি প্রদর্শন করেননি কিন্তু ভারতবর্ষে আর্যরা বহিরাগত, এই মত প্রতিষ্ঠায় তিনি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভারতের বিপক্ষে তার উত্থাপিত যুক্তিগুলো হলো –

  • ১. ঋগ্বেদ সংহিতা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্ববর্তী নয়।
  • ২. আনুমানিক ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে ভারতবর্ষে অশ্ব ব্যবহারের সুস্পষ্ট নিদর্শন নেই।
  • ৩. কালিবঙ্গান ও লােথালে যজ্ঞবেদি আবিষ্কৃত হয়নি, আবিষ্কৃত হয়েছে চুল্লি।
  • ৪. বৈদিক সাহিত্যে স্বস্তিকা চিহ্নের উল্লেখ নেই, এই মাঙ্গলিক প্রতীকটি এলাম হতে এসেছে।
  • ৫. হরপ্পীয়রা আগুনে পােড়নাে ইট ব্যবহার করেছেন, বৈদিক আর্যরা এ ধরনের ইট ব্যবহার করেননি।
  • ৬. হরপ্পীয়রা অশ্ব ও যুদ্ধরথ সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন, আর্যরা অশ্ব ও যুদ্ধরথ ব্যবহারে সুনিপুণ ছিলেন।
  • ৭. বৈদিক গােষ্ঠী যদু, তুর্বশ, কুরু ও উত্তর মদ্রদের সম্পর্কে বেদ-পুরাণে বলা হয়েছে, তারা হিমালয় পেরিয়ে ভারতে আগমন করেন।

রামশরণ শর্মার অভিমত, আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব ৭ম-৬ষ্ঠ সহস্রাব্দে ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণ দিগবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতেন; আনুমানিক ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাদের একটি শাখা পূর্বদিকে অভিযান শুরু করেন। এই পূর্বশাখার আর্যরাই আ. ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে তরঙ্গের পর তরঙ্গের মতাে ভারতের বুকে আছড়ে পড়েন। এখানে এই কথাটি বলা প্রয়ােজন, ককেশাস পর্বতের দক্ষিণে এখনও পর্যন্ত এমন কোনও প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়নি যা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে, আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব ৭ম-৬ষ্ঠ সহস্রাব্দে এই অঞ্চলে বাস করতেন। কোনও কোনও ঐতিহাসিক কাসপিয়ান সাগরীয় অঞ্চলকে আর্যদের বাসভূমিরূপে চিহ্নিত করেছেন। আর্যগণ প্রথমে পামির মালভূমি অঞ্চলে বাস করতেন এমন মতও ব্যক্ত হয়েছে। জার্মানি আর্যদের আদি বাসভূমি, এ মতও প্রচারিত হয়েছে।

মােটকথা, আর্যদের আদি বাসভূমির অবস্থান সম্পর্কে নানা অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। এই অভিমতগুলোর কয়েকটি বেশ সম্ভাবনাপূর্ণ তবে কোনওটিই চূড়ান্ত নয়। এই মুহূর্তে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরােপ ও কাজাকস্তান সংলগ্ন অঞ্চলের দিকেই যেন পাল্লাটা বেশি ভারী বলে মনে হচ্ছে। অর্থাৎ, আর্যরা ভারতের আদি অধিবাসী নন, তারা বাহির হতে ভারতবর্ষে এসেছিলেন, এই মতই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে। (স্বামী বিবকোনন্দ (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ষষ্ঠ খণ্ড, উদবােধন কার্যালয়, কলকাতা, নবম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৬৩) মনে করেন, ভারতবর্ষই আর্যদের দেশ। বিদেশ থেকে আর্যরা এ দেশে এসেছেন, এসব উক্তিকে তিনি ‘আহাম্মকের কথা’, ‘মিথ্যা’, ‘অন্যায় বলে বাতিল করে দিয়েছেন।)

আর্যদের অভিপ্রয়াণ : ধরা যাক, আর্যদের আদি বাসভূমি দক্ষিণ-পূর্ব ইউরােপ ও কাজাকস্তানের তৃণভূমি অঞ্চল। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কেন তাদের আদি নিবাস ছেড়ে প্রবাসের পথে পা বাড়ালেন? কোন পথ দিয়েই বা তারা শেষে ভারতে এসে পৌঁছলেন? বিনা কারণে যে আর্যরা তাদের দেশ ছাড়েননি তা সহজেই বােঝা যায়। সন্দেহ নেই, জনসংখ্যার বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে জমির শুষ্কতা, পর্যাপ্ত চারণভূমির অভাব ইত্যাদি কারণে তারা মাতৃভূমি ত্যাগ করেন। তাদের একদল চললেন পূর্বদিকে, অন্য শাখা যাত্রা করলেন পশ্চিমে অর্থাৎ ইউরােপ অভিমুখে। আর্যদের যে শাখা পূর্বদিকে যাত্রা করেন তারা প্রথমে কাসপিয়ান সাগরের উত্তর দিক ধরে অগ্রসর হন। তখনকার দিনের কাসপিয়ান সাগর এখনকার তুলনায় আয়তনে অনেক বড় ছিল। পূর্বের আরল সাগরও সম্ভবত এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে আর্যদের পূর্ব শাখাটি পশ্চিম তুর্কিস্তানের সমভূমি বা সিরদরিয়া ও আমুদরিয়া নদী দু’টির অববাহিকা অঞ্চলে এসে উপনীত হন। এখানে দীর্ঘদিন অবস্থান কালে আর্যরা অসুর উপাসক ও দেব-অনুরাগী এই দু’টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েন। অসুর উপাসকরা ইরানের দিকে চলে যান। দেব উপাসকরা হিন্দুকুশ পর্বত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। 

অনেকের ধারণা, বৈদিক আর্যরা ভারতে আসার আগে দীর্ঘদিন ইরানে বসবাস করেন। সলে প্রাচীন পারসিকদের ধর্মগ্রন্থ জেন্দ আবেস্তা ও ঋগ্বেদের মধ্যে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মিল আছে। এই দু’খানি গ্রন্থে এমন অনেক পংক্তি আছে যেগুলো প্রায় এক। ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র যেমন ঋগ্বেদের দেবতা, তেমনি আবেস্তারও। আবেস্তার যিম বেদের যমরাজ। অগ্নি প্রাচীন পারসিক ও বৈদিক আর্য উভয় সম্প্রদায়েরই উপাস্য দেবতা। বেদে ও আবেস্তায় উপনয়ন অনুষ্ঠানের প্রায় একই বর্ণনা পাওয়া যায়। বেদে ৩৩ দেবতার কথা বলা হয়েছে, আবেস্তায়ও তাই। এই সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মনে করেন, বৈদিক আর্যরা ভারতে আসার পূর্বে সুদীর্ঘকাল ইরানে অবস্থান করেন। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব ইউরােপ ও কাজাকস্তানের তৃণভূমি আর্যদের জন্মভূমি হলে এ কথা নিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায় যে আর্যরা ইরানে ও ভারতে আসার পূর্বে সিরদরিয়া ও আমুদরিয়া অববাহিকা অঞ্চলে দীর্ঘদিন বসবাস করেন। সে ক্ষেত্রে দু’টি সম্ভাবনার কথা মনে হয় : এক. সিরদরিয়া-আমুদরিয়া অঞ্চল থেকে আর্যরা সদলে ইরানে চলে যান। সেখান থেকে তাদের এক গােষ্ঠী কালক্রমে ভারতে প্রবেশ করেন। দুই. সিরদরিয়া ও আমুদরিয়া অঞ্চল থেকে আর্যদের একটি গােষ্ঠী ইরানে ও অপর গােষ্ঠীটি হিন্দুকুশ পর্বত পার হয়ে সরাসরি ভারতে এসে উপনীত হন। 

প্রথম পথটি অনেক দীর্ঘ ও দুর্গম। আর্যরা ভারতে আসার জন্য সম্ভবত দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু যদি বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরােপ ও কাজাকস্তানের তৃণভূমি নয়, হাঙ্গেরি চেকোশ্লোভাকিয়া-অস্ট্রিয়া অঞ্চলই আর্যদের বাসভূমি, তাহলে কিন্তু আর্যরা ভিন্ন পথে ভারতে এসেছিলেন, এই ধারণাই সত্য হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে মনে করতে হবে, আর্যরা দানিয়ুব নদীর তীর ধরে অগ্রসর হয়ে ওয়ালাচিয়ার সমভূমি অঞ্চলে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে তারা দক্ষিণ দিকে যাত্রা করে দারদানেলিস ও বসপােরাস প্রণালী অতিক্রম করে এশিয়া মাইনরে এসে উপস্থিত হন। তারপর তারা মালভূমির ভেতর দিয়ে অথবা কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ তীর ধরে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর উজানে এসে পড়েন। সে সময় ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস অববাহিকা অঞ্চলে এক শক্তিশালী রাজ্য গড়ে উঠেছিল। ফলে আর্যরা দক্ষিণের পথ ছেড়ে তাবরিজ-তেহরানের পথ ধরে ইরানে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে আর্যদের এক ” আমুদরিয়া ও সিরদরিয়া নদীর অববাহিকা অভিমুখে অগ্রসর হন। আর্যদের আর এক শাখা বাপক আর্যরা হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে কাবুল উপত্যকার ভিতর দিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে এসে উপনীত হন। মনে রাখতে হবে, আর্যদের এই অভিপ্রয়াণ কোনও এক বিশেষ সময় এককালীন চেষ্টায় ঘটেনি এটি চলেছিল দীর্ঘদিন ধরে। দীর্ঘকাল ধরে তরঙ্গের পর তরঙ্গের মতো আর্যরা ভারতের উত্তর-পশ্চিম দ্বারদেশে এসে আঘাত করেন। সে আঘাতে ভারতের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল। ক্রমশ সারা ভারতে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হল। 

বৈদিক সাহিত্য

ঋগ্বেদের রচনাকাল : আর্যরা প্রথম কখন ভারতে প্রবেশ করেন? এই প্রশ্নের সঙ্গে ঋগ্বেদের রচনাকালের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বৈদিক আর্যদের প্রাচীনতম রচনা এই ঋগ্বেদ। ভারতে আসার পরই আর্যরা এটির রচনায় হাত দেন। ঋগ্বেদের রচনাকাল সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে বিতর্কের অন্ত নেই। বালগঙ্গাধর তিলক এর রচনাকাল ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধার্য করেছেন। ঋগ্বেদে গ্রহ-নক্ষত্রের যে বর্ণনা আছে তার উপর নির্ভর করেই তার এই সিদ্ধান্ত। ঋগ্বেদের প্রাচীন মন্ত্রগুলো ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের রচনা এ মত ইয়াকবি ও উইন্টারনিৎস-এর মতাে প্রখ্যাত ইউরােপীয় পণ্ডিত স্বীকার করেন। কিন্তু অন্তত দু’টি কারণে ঋগ্বেদের এই প্রাচীনত্বের দাবি স্বীকার করা যায় না। প্রথমত ঋগ্বেদ ও জেন্দ আবেস্তার মধ্যে আশ্চর্যরকমের ভাষাগত সাদৃশ্য রয়েছে। সন্দেহ নেই, গ্রন্থ দু’টি প্রায় একই সময়ের রচনা। আবেস্তার রচনাকাল ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এই তারিখের কাছাকাছি কোনও এক সময় ঋগ্বেদ রচিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে ছবি প্রতিফলিত হয়েছে তাতে মনে হয় ঋগ্বেদের শেষ স্তোত্রগুলোর রচনাকাল ও গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের মধ্যে অন্তত ৫০০ বছরের ব্যবধান ছিল। গৌতম বুদ্ধ সম্ভবত ৫৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাহলে ৫৬৬ + ৫০০ অর্থাৎ ১০৬৬ বা ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ঋগ্বেদের শেষ স্তোত্রগুলো রচিত হয়েছিল বলা চলে। বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত ম্যাসমূলার ঋগ্বেদের রচনাকাল ১২০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধার্য করেছেন। অধ্যাপক ব্যাসামও প্রায় একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন (১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। দেখা যাচ্ছে, আর্যদের এক বা একাধিক গােষ্ঠী ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বেই ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যদের আক্রমণে প্রাগৈতিহাসিক হরপ্পা শহরের পতন হয়, মর্টিমার হুইলার এরূপ একটি মত প্রকাশ করেছেন। হুইলারের এই মত গ্রাহ্য হলে স্বীকার করতে হয়, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় আর্যরা প্রথম ভারতে অনুপ্রবেশ করেন। আর্যদের ভারতে আসার তারিখ সম্ভবত আরও কয়েকশাে বছর পিছিয়ে যাবে। হরপ্পায় আবিষ্কৃত কয়েকটি সমাধি, বিশেষ করে সমাধি আর-৩৭ ও সমাধিএইচ এবং শাহীটম্প‌-এ আবিষ্কৃত একটি সমাধির কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। আনুমানিক ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এই সমাধিগুলোতে সম্ভবত আর্যদের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এই সিদ্ধান্ত থেকে মনে হয় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গােড়ার দিকেই আর্যরা বেলুচিস্তান ও সিন্ধু উপত্যকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন।

বেদ : সংস্কৃত বিদ ধাতুর অর্থ জানা। এই বিদ্ ধাতু থেকে বেদ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। বেদের অর্থ জ্ঞান। এই জ্ঞান পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান নয়; অনাদি, অনন্ত, অলৌকিক এই জ্ঞান। প্রাচীন ঋষি ও ঋষিকারাই বেদ রচনা করেছেন। গৃৎসমদ, বিশ্বামিত্র, বামদেব, অত্রি, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, কথ, শৌনক, যম, ভৃণ্ড, অঙ্গিরা, অথর্ব প্রভৃতি ঋষিদের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। হিন্দুদের অনেকে বিশ্বাস করেন ঋষিরা বেদের রচয়িতা নন, তারা বেদের দ্রষ্টা। তাদের ধারণা বেদ অপৌরুষেয় – স্বয়ং ঈশ্বর বেদের সৃষ্টিকর্তা। এ ধারণা বিশ্বাস সঞ্জাত, ইতিহাস সম্মত নয়। প্রথমদিকে বেদ লােকের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। গুরুর মুখে শুনে শিষ্য বেদ অধ্যয়ন করতেন। গুরুশিষ্য পরম্পরায় দীর্ঘদিন শ্ৰতিবাহিত হয়েছিল বলে এর অন্য নাম শ্রুতি। হিন্দুদের কাছে বেদের থেকে পবিত্রগ্রন্থ আর কিছু নেই। মনু বেদকে ধর্মের মূল বলে বর্ণনা করেছেন। ‘বেদোহখিলাে ধর্মমূলম’ যাজ্ঞবল্ক্যও বেদকে ধর্মের উৎস বলে স্বীকার করেছেন।

সংহিতা : বেদ চারখানি – ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। ঋক, যজুঃ ইত্যাদি বেদকে আবার সংহিতাও বলে। অর্থাৎ ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ ইত্যাদি খাক-সংহিতা, যজুঃ-সংহিতা নামেও পরিচিত। সংহিতা শব্দের অর্থ সংগ্রহ, সংকলন। এই সংগ্রহ মন্ত্রের সংগ্রহ। ঋক-সংহিতায় আছে প্রায় ১০৫০০ ঋক্ বা পদ্যময় স্তুতিমূলক মন্ত্র। কয়েকটি ঋক নিয়ে এক একটি সূক্ত। কয়েকটি সূক্ত নিয়ে এক একটি মণ্ডল। ( “The Vedic Age (পৃষ্ঠা ২২৫) এবং The Cambridge History of India, Vol. I (পৃষ্ঠা ৬৯), গ্রন্থ দু’টিতে ঋগ্বেদের ঋকের সংখ্যা ১০১৭ বলে যে উক্তি করা হয়েছে তা অবশ্যই ভ্রমাত্মক।) সমগ্র ঋগ্বেদে আছে এরূপ ১০টি মণ্ডল ও ১০২৮টি সূক্ত। যজুঃ অর্থাৎ যজ্ঞাত্মক মন্ত্রের সংকলন যজুর্বেদ। ঋগ্বেদের প্রায় দু’হাজার মন্ত্র এই সংহিতায় স্থান পেয়েছে। বাকি মন্ত্রগুলো যজুর্বেদের নিজস্ব। যজুর্বেদের দুটি ভাগ—শুক্র ও কৃষ্ণ। শুক্ল যজুর্বেদে আছে একটি মাত্র সংহিতা – বাজসনেয়ি সংহিতা। কাঠক, কপিষ্ঠলকঠ, মৈত্রায়ণী ও তৈত্তিরীয় বা আপস্তম্ব, এই চারটি সংহিতা নিয়ে কৃষ্ণ যজুর্বেদ। যজুর্বেদের শুক্ল ও কৃষ্ণ নামকরণ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা আছে। অনেকে বলেন, কৃষ্ণ ও শুক্ল পদ দুটি এখানে যথাক্রমে মিশ্রিত ও অমিশ্রিত বা পরিষ্কৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যজুর্বেদের যে অংশে গদ্য ও পদ্য মিশ্রিত আছে, তা কৃষ্ণ, আর যে অংশে সেই মিশ্রণ নেই, যেখানে গদ্য ও পদ্য পৃথকভাবে সন্নিবিষ্ট, তা শুক্ল। সাম বা গীতিমন্ত্রের সংকলন সামসংহিতা। ইন্দ্রজাল সংক্রান্ত মন্ত্রের সংকলন অথর্ববেদ সংহিতা। অথর্ববেদের প্রাচীন নাম অথর্বাঙ্গিরস। অথর্ব বলতে শুভ ইন্দ্রজাল বােঝায়, যেমন রােগনাশ, বিষনাশ ইত্যাদি। অঙ্গিরসের অর্থ অশুভ কর্ম, যেমন শক্রবধ, মারণ, উচাটন, অভিচার ইত্যাদি। অথর্ববেদে প্রায় ছ’হাজার মন্ত্র আছে। কয়েকটি মন্ত্র নিয়ে এক একটি সূক্ত। কয়েকটি সূক্ত নিয়ে এক একটি কাণ্ড। অথর্ববেদে মােট ২০টি কাণ্ড। বেদসমূহকে ত্রয়ী বলা হয়। ত্রয়ী বলতে ঋক, যজুঃ ও সাম এই তিন বেদকেই বােঝায়। বেদের তালিকা থেকে অথর্ববেদের বাদ পড়ার কারণ বােঝা দায়। যজ্ঞের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই বলেই হয়তাে এটি ত্রয়ীর মধ্যে গণ্য হয়নি। 

শাখা : প্রাচীন যুগে প্রতিটি সংহিতার অনেকগুলো করে শাখা বা সংস্করণ ছিল। মনে হয় আঞ্চলিক বিভিন্নতার কারণেই বিভিন্ন শাখার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ শাখারই আজ আর কোনও চিহ্ন নেই। বর্তমানে ঋগ্বেদের মাত্র তিনটি শাখা পাওয়া যায় – শাকল, বাষ্কল ও শাঙ্খায়ন বা বালখিল্য। শুক্ল যজুর্বেদের মাত্র দুটি শাখা বর্তমান – কাণ্ব ও মাধ্যন্দিন। কৃষ্ণ যজুর্বেদের চারটি শাখা তৈত্তিরীয়, কাঠক, মৈত্ৰায়ণী ও কপিষ্ঠল। পুরাণে ও মহাভাষ্যে সামবেদের সহস্র শাখার উল্লেখ আছে। কিন্তু এই বেদের মাত্র তিনটি শাখার খোঁজ পাওয়া গেছে – কৌথুম, রাণায়নীয় ও জৈমিনীয়। অথর্ববেদের দু’টি শাখা – শৌনকীয় ও পৈপ্পলাদ।

পরবর্তী বৈদিক যুগে (আ. খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ – ৫০০ অব্দ) সৃষ্টি হওয়া বেদের বিভিন্ন শাখা

ব্রাহ্মণ : মন্ত্রগুলোর অর্থ ও তার প্রয়ােগ ব্যাখ্যা করে প্রতিটি সংহিতাকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির গ্রন্থ রচিত হয়। এই গ্রন্থগুলোকে ব্রাহ্মণ বলে। মন্ত্রগুলোর উপলক্ষ যাগ-যজ্ঞ। তাই ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলো প্রায়ই যাগ-যজ্ঞের বিবরণসর্বস্ব হয়ে উঠেছে। এই গ্রন্থগুলো মুখ্যত গদ্যে লিখিত। ঋকসংহিতার উপর আছে দুখানি ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ও শান্থায়ন বা কৌষীতকি। জৈমিনীয় ও পঞ্চবিংশ এই দুটি প্রধান ব্রাহ্মণ সামসংহিতার (কঠ উপনিষদ ১/২/২৩) সঙ্গে সংযুক্ত। কৃষ্ণ যজুঃ সংহিতার অন্তর্ভুক্ত তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ। শুল্ক যজুঃ সংহিতার ব্রাহ্মণের নাম শতপথ। অথর্বসংহিতার একটি মাত্র ব্রাহ্মণের নাম গােপথ। (ষড়বিংশ ব্রাহ্মণ সামবেদের কোনও স্বতন্ত্র ব্রাহ্মণ নয় ; এটি পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণেরই পরিশিষ্ট।)

আরণ্যক: ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোর পরিশিষ্টরূপে আর এক শ্রেণির সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছে। এদের নাম আরণ্যক। অরণ্য থেকে আরণ্যক পদের উৎপত্তি। গ্রন্থগুলো অরণ্যের নির্জনতায় অধীত হত বলেই তাদের এই নাম। অথবা অরণ্যে রচিত হয়েছিল বলেই হয়তাে তাদের নাম আরণ্যক।

উপনিষদ : আরণ্যকের পরিশিষ্টরূপে আবার বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়। এগুলো উপনিষদ। উপ ও নিপূর্বক সদ্ ধাতু থেকে উপনিষদ পদ নিষ্পন্ন। এর অর্থ নিকটে উপবেশন। উপনিষদ গুরুমুখী বিদ্যা। শিষ্যকে গুরুর কাছে বসে এটি অধ্যয়ন করতে হত। সংখ্যায় উপনিষদ অনেকগুলো হলেও এদের ১৪ খানিই প্রধান। এদের মধ্যে ঐতরেয় ও কৌষীতকি ঋগ্বেদের, বৃহদারণ্যক ও ঈশ শুক্ল যজুর্বেদের, তৈত্তিরীয়, কঠ বা কাঠক, মৈত্রায়ণীয়, মহানারায়ণীয় ও শেতাশ্বতর কৃষ্ণ যজুর্বেদের, ছান্দোগ্য ও কেন সামবেদের এবং মুণ্ডক, প্রশ্ন ও মাণ্ডুক্য অথর্ববেদের সঙ্গে সংযুক্ত।

কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড : সংহিতা ও ব্রাহ্মণকে নিয়ে বেদের কর্মকাণ্ড, আরণ্যক ও উপনিষদ জ্ঞানকাণ্ড | আত্মা ও ব্রহ্ম বা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে কেন্দ্র করেই উপনিষদের মূল সুর ধ্বনিত হয়েছে। জীবের মধ্যে যে সত্তা তার নাম জীবাত্মা। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত যে সত্তা তার নাম ব্রহ্ম, পরব্রহ্মা, পরমাত্মা। ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’। তিনিই জগৎ এবং জগৎও তিনি। নিজে প্রচ্ছন্ন থেকে অচিন্ত্য, অবর্ণনীয় সেই মহাশক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। পরমাত্মা সর্বজীবে রয়েছেন। সে কারণে জীবই সেই ব্রহ্ম। “ত্বৎ তুম্‌ অসি”। তমিই সেই। ‘সঃ অহম’, আমিই সেই। জীবের জীবে কোনও ভেদ নেই। সর্বজীবে আত্মসত্তা উপলব্ধি করতে হবে – উপনিষদের মূল বাণী এই। কিন্তু এই আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান তর্ক, অধ্যয়ন বা বুদ্ধির অগম্য। এটি আসে দৈহিক শুচিতা ও চিত্তশুদ্ধির মাধ্যমে, আয়ত্ত হয় নিবিড় মননে ও গভীর অনুভবে। ‘নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যা ন মেধয়া ন বহুনা শুতেন’।  

বেদাঙ্গ : সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদকে নিয়ে বেদ। বেদের বর্ণ ও স্বরধ্বনি যাতে অবিকৃত থাকে, যাগ-যজ্ঞাদি যাতে সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হয় তার জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়ক গ্রন্থ রচিত হয়। এগুলো বেদাঙ্গ নামে পরিচিত। বেদাঙ্গের ছ’টি বিভাগ শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ। শিক্ষায় রয়েছে বৈদিক মন্ত্রের উচ্চারণসম্পর্কিত নির্দেশাবলি। কল্পে আছে যজ্ঞ প্রণালীর সংক্ষিপ্তসার। একে সংক্ষেপিত ব্রাহ্মণও বলে। কল্পসূত্র চার প্রকারের শ্রৌত, গৃহ্য, ধর্ম ও শুল্ক। শ্রৌতসূত্রের বিষয়বস্তু বৈদিক যাগ-যজ্ঞ। গৃহীর আচরণীয় সংস্কার ও যজ্ঞাদির বর্ণনা আছে গৃহ্যসূত্রে। এই জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে আশ্বলায়ন, বৌধায়ন ও আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্র খুবই উল্লেখযােগ্য। প্রথম গ্রন্থখানি ঋগ্বেদকে অনুসরণ করছে। পরের দুখানি গ্রন্থ কৃষ্ণ যজুর্বেদের সঙ্গে সংযুক্ত। বর্ণাশ্রমধর্ম, রাজধর্ম ও ব্যবহারের আলােচনাগ্রন্থ ধর্মসূত্র। যজ্ঞবেদির পরিমাপ ইত্যাদি সম্পর্কে নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে শুল্কসূত্রে। পদের শুদ্ধাশুদ্ধি জ্ঞানের জন্য ব্যাকরণের অধ্যয়ন। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী এই শ্রেণি গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। পদের অর্থবােধের জন্য নিরুক্ত। বর্তমানে শুধু যাস্কের লেখা একখানা নিরুক্তই আছে। ছন্দ জ্ঞানের জন্য ছন্দ। এতে মন্ত্রের উচ্চারণদোষ দূর হয়। যজ্ঞের দিন, ক্ষণ সঠিক জানার জন্য জ্যোতিষ।

ঋগ্বেদের যুগ

ভূমিকা

আনুমানিক ১৮০০ বা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে যে বৈদিক যুগের শুরু ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার সমাপ্তি। বৈদিক যুগের দু’টি পর্ব – আদি বৈদিক বা ঋগ্বৈদিক পর্ব এবং পরবর্তী বা উত্তর বৈদিক পর্ব। অনেকে মনে করেন ঋগ্বেদের শেষ স্তোত্রগুলো গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের অন্তত ৫০০ বছর পূর্বে রচিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। এ থেকে অনুমান হয়, ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ঋগ্বেদের শেষ স্তোত্রগুলো রচিত হয়েছিল। বস্তুত, ১৮০০ বা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত যে সময় তাকে পণ্ডিতরা ঋগ্বৈদিক পর্ব বলে চিহ্নিত করেছেন। এই পর্বের বেশির ভাগ তথ্য ঋগ্বেদ থেকেই সংগৃহীত। তখনকার দিনের কিছু কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তা সােয়ার্থ বা সোয়াট অববাহিকায় পাওয়া। গান্ধার-সমাধি সংস্কৃতির (গান্ধার গ্রেইভ কালচার বা সোয়াট কালচার) নিদর্শন এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

আর্য-বসতি

ঋগ্বেদে ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েকটি পর্বত ও নদীর উল্লেখ আছে। সে সব পর্বত ও নদীগুলোর অবস্থান থেকে ঋগ্বৈদিক যুগের আর্যবসতি সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যায়। ঋগ্বেদে হিমবৎ বা হিমালয় পর্বতশ্রেণির উল্লেখ আছে, মূজবান বা মূঞ্জবান নামে হিমালয়ের একটি শৃঙ্গেরও কথা আছে। শৃঙ্গটি সম্ভবত কাশ্মীর উপত্যকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ছিল। ঋগ্বেদে বিন্ধ্য পর্বতের কোনও উল্লেখ নেই, নর্মদা নদীরও কোনও বর্ণনা নেই। মনে হয়, ঋগ্বেদের সময় আর্যরা সম্ভবত দক্ষিণে বিন্ধ্যাচলের দিকে অগ্রসর হননি। শুধু কাশ্মীর নয়, আফগানিস্তানের কাবুল উপত্যকায়ও আর্যবসতি গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলের অন্তত চারটি নদীর উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে। নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে কুভা (কাবুল), ক্রুমু (কুরম), গােমতী (গােমাল) ও সুবাস্তু (সােয়াট)। রসা নামে একটি নদীর উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে। অনেকের অনুমান, এটি ভারত বা আফগানিস্তানের কোনও নদী নয়, কাজাকস্তানের সিরদরিয়া নদী। এর থেকে অনুমান হয়, মধ্য এশিয়ার কাজাকস্তান ঋগ্বেদের ভৌগােলিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

অসকো পারপােলা ঋগ্বৈদিক সভ্যতার আরও বৃহৎ ভৌগলিক পরিমণ্ডলের কথা বলেছেন। তার অভিমত, প্রথম অবস্থায় এই সভ্যতা অক্সাস বা আমুদরিয়া অধিত্যকা অর্থাৎ তাজকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং ব্যাক্ট্রিয়া  ও মার্জিয়ানাসহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিরাজমান ছিল। ঋগ্বৈদিক সংস্কৃতির এই বহুধা বিস্তৃতি হয়তাে প্রমাণসিদ্ধ নয় কিন্তু আফগানিস্তান যে এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। (অসকো পারপােলা তথাকথিত অক্সাস বা আমুদরিয়া সভ্যতাকে (আ. ২১০০-১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ঋগ্বৈদিক সভ্যতার এক প্রাথমিক অধ্যায়রূপে চিহ্নিত করেছেন। এই অভিমত গৃহীত হলে ঋগ্বৈদিক সভ্যতার সূচনাপর্ব আ. ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ধার্য করতে হবে। কিন্তু আমুদরিয়া সভ্যতা ঋগ্বৈদিক সভ্যতার প্রারম্ভিক অধ্যায় হলে এই সভ্যতার কিছু নিদর্শন সিন্ধু-সরস্বতী অববাহিকায় পাওয়া যেত। তা ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, অসকো পারপােলার মতাে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আর্যদের সঙ্গে অশ্বের অবিচ্ছেদ্য যােগসূত্রের কথা বলেছেন অথচ আমুদরিয়া অববাহিকায় অশ্বের কোনও নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়নি। তৃতীয়ত, অসকো পারপােলা যে সভ্যতাকে ঋগ্বৈদিক আখ্যা দিয়েছেন, অন্য বিদ্বজ্জনদের অনেকে তাকে ভারত-ইরানীয় সভ্যতারূপে চিহ্নিত করেছেন।)

আফগানিস্তান নয়, সিন্ধু ও সরস্বতীর অববাহিকা অঞ্চলই ছিল ঋগ্বৈদিক আর্যদের প্রধান কর্মক্ষেত্র। ঋগ্বেদে বার বার নদী দুটির নাম করা হয়েছে। অনেকের ধারণা, সরস্বতী আসলে সিন্ধু নদেরই আর এক নাম। ঋগ্বেদে কম করেও পঁচিশটি নদীর বর্ণনা আছে কিন্তু কোনও নদীরই দু’টি নাম নেই। সরস্বতী ও সিন্ধুকে দুটি পৃথক নদী বলেই গণ্য করা উচিত। সরস্বতীকে ঋগ্বেদে ‘নদীতমা’ বা শ্রেষ্ঠ নদী বলা হয়েছে। নদীটির বর্তমান নাম সরশুতি, ভাতনেয়রের মরুভূমিতে এর যাত্রাপথ শেষ হয়েছে। নদীটি শতদ্রুর পূর্বদিকে কিন্তু যমুনার পশ্চিমে অবস্থিত। বর্তমান কালের এই ছােটো নদীটি বৈদিক যুগে আয়তনে বিশাল ছিল এবং সম্ভবত সিন্ধু নদ বা তার কোনও শাখার সঙ্গে এর সংযােগ ছিল। ঋগ্বেদে সিন্ধুর পাঁচটি শাখানদীর উল্লেখ আছে। এই শাখানদীগুলো বিতস্তা, অসিক্‌নী (চন্দ্রভাগা), পরুষ্ণী (ইরাবতী), বিপাশা ও শুতুদ্ৰী বা শতদ্রু। তাছাড়া দৃষদ্বতী, মরুদ্বৃধা ও আপয়া নামে আরও তিনটি নদীর কথা আছে। অনেকে দৃষদ্বতীকে আধুনিক ঘগ্‌গর বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ এটিকে চিত্তং বলে শনাক্ত করেছেন। মরুদ্বৃধার পরিচয় নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ এটিকে বিতস্তা ও চন্দ্রভাগার সম্মিলিত স্রোতধারা বলে চিহ্নিত করেছেন। আবার অনেকে মনে করেন এই নদী জম্মু-কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চন্দ্রভাগার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।

আর্যরা তখনও পূর্ব ভারতে প্রবেশ করেননি। গঙ্গা নদীর কথা ঋগ্বেদে বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু তা শুধু একবারের জন্যই। আর্যদের সঙ্গে এই নদীটির সে রকম একটা পরিচয় ছিল বলে মনে হয় না। ঋগ্বেদে যমুনা নদীর তিনবার উল্লেখ আছে। সরযু নদীর কথাও আছে এই সংহিতায়। মনে হয় ঋগ্বৈদিক যুগে আর্যরা পূর্বদিকে সরযূ নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। ঋগ্বেদে ব্যাঘ্রের উল্লেখ নেই। ব্যাঘ্র সংকুল দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে আর্যদের যে পরিচয় ছিল না এটা তারই প্রমাণ। পূর্ব ভারতের বিশেষ করে বাংলার প্রধান শস্য ধান। ঋগ্বেদে কিন্তু ধানের উল্লেখ আছে। 

ঋগ্বেদে ‘সপ্তসিন্ধবঃ’ নামে একটি অঞ্চলের উল্লেখ আছে। ‘সপ্তসিন্ধবঃ’ বলতে যেমন একটি অঞ্চল বােঝায় তেমনি সাতটি বিশেষ নদীও বােঝায়। এই সাতটি নদী কী কী সে সম্পর্কে বিতর্ক আছে। ম্যাক্সম্যূলার মনে করেন, সরস্বতী, সিন্ধু ও তার পাঁচটি শাখা নদী নিয়েই ঋগ্বেদের সপ্তসিন্ধু। এই মত অনুসারে সপ্তসিন্ধু বলতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ, পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে এক অখণ্ড অঞ্চল বােঝায়। কারাের কারাের ধারণা, সরস্বতী নয়, কুভা বা কাবুল ঋগ্বেদের সাতটি বিশেষ নদীর একটি। সে ক্ষেত্রে সপ্তসিন্ধু পশ্চিম দিকে কাবুল উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলেই মনে হয়। ঋগ্বেদের ৬ষ্ঠ মণ্ডলে ‘হরিযূপীয়া’র উল্লেখ আছে। এখানে অভ্যাবর্তী চায়মান বৃচীবন্ত নামে এক উপজাতিকে পরাজিত করেন। ‘হরিযূপীয়া’ কোনও স্থানের নাম, না কোনও নদী, তা কিন্তু স্পষ্ট নয়। কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমানে সিন্ধুপ্রদেশের যে স্থানটির নাম হরপ্পা, সেটিই ঋগ্বৈদিক যুগে ‘হরিযূপীয়া’ নামে পরিচিত ছিল।

উত্তর-পশ্চিম ভারতে সম্প্রসারণকালে আর্যরা সাধারণত দু’ধরনের বাধার সম্মুখীন হন। প্রথমত, স্থানীয় দ্রাবিড়ভাষী অনার্যদের প্রতিকূলতা ; দ্বিতীয়ত, বন-জঙ্গলের প্রাচুর্য। অনার্যরা শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করেন। তাদের অনেকেই দক্ষিণ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন, বাকিরা পুরানাে বাসস্থানেই থেকে যান। স্থানীয় তানায় অধিবাসীদেরই ঋগ্বেদে ‘দাস’, ‘দস্যু’ ইত্যাদি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর্যদের হাতে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করার মতাে সে ধরনের শক্তিশালী হাতিয়ার ছিল না। এই সব কাজে তারা সাধারণত পাথর, ব্রোঞ্জ ও তামার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতেন। ফলে তাদের সম্প্রসারণ খুবই মন্থর গতিতে চলে। পরে অবশ্য লােহার ব্যবহার শুরু হলে আর্যদের ক্রমবিস্তারের গতি দ্রুততর হয়।

আর্য উপজাতিসমূহ

উপজাতি, কুল ও গ্রাম : ঋগ্বৈদিক যুগে আর্যরা বিভিন্ন জনগােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন। কিন্তু তারা প্রধানত পশুপালক ছিলেন বলে তাদের পক্ষে দীর্ঘদিন একস্থানে বাস করা সম্ভব ছিল না। নিজেদের এবং গৃহপালিত পশুর খাদ্য জোগানের জন্য তাদের প্রায়ই স্থান থেকে স্থানান্তরে বসবাস করতে হয়েছে। ফলে ঋগ্বেদের যুগে এক একটি জনগােষ্ঠীকে কেন্দ্র করে এক একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড গড়ে উঠেনি। একটি জনগােষ্ঠী একস্থানে দীর্ঘদিন বাস করলে তবেই একটি জনপদ বা ভূখণ্ডের পত্তন হয়। ঋগ্বেদের যুগে আর্যরা সম্ভবত পশ্চিমে আমুদরিয়া-সিরদরিয়া নদী থেকে পূর্বে সরযূ নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাস করতেন। কিন্তু এই সুদীর্ঘ অঞ্চলে একটিও জনপদের উদ্ভব হয়নি। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হচ্ছে রাষ্ট্রের এক মৌলিক উপাদান। যখন ঋগ্বেদের যুগে কোনও নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা জনপদ প্রতিষ্ঠার প্রমাণ নেই তখন সে যুগে যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল তা বলা যায় না। তাছাড়া, সরকার বলতে যে বিশেষ এক সুবিন্যস্ত, সর্বব্যাপী, স্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামাে বােঝায় তাও যেন ঋগ্বেদের যুগে পরিপূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করেনি। ফলে আর্য জনগােষ্ঠীগুলো সে সময় উপজাতি স্তরেই থেকে গিয়েছিল, তারা রাষ্ট্রশক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেনি। ভারতের মাটিতে আর্য রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটল আরও পরে, পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষ পর্বে। আর্য জনগােষ্ঠীর মূল ভিত্তি ছিল পিতৃকেন্দ্রিক পরিবার বা ‘কুল’। পরিবার প্রধানকে ‘কুলপা’ বলা হত। এক একটি পরিবারে অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা ছিল। কয়েকটি পরিবার নিয়ে ছিল এক একটি গ্রাম। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে আবার এক একটি বিশ। কয়েকটি বিশ নিয়ে একটি জন বা গােষ্ঠী। অনেকের ধারণা ‘বিশ’ ও ‘জন’ পদ দু’টি একই অর্থে ঋগ্বেদে ব্যবহৃত হয়েছে। আর্য উপজাতিগুলো ছিল –

  1. ভরত : বিভিন্ন ঋগ্বৈদিক উপজাতির মধ্যে ক্ষমতায় ও প্রতিষ্ঠায় ভরতরা ছিলেন সকলের ওপরে। সরস্বতী, দৃষদ্বতী ও যমুনা নদীর অববাহিকায় তারা বাস করতেন। এই অঞ্চলই পরবর্তীকালে ব্রহ্মাবর্ত নামে পরিচিত হয়। সম্ভবত এই ভরতদের নাম থেকেই ভারত ও ভারতবর্ষ নামটির উদ্ভব। ঋগ্বেদে ভরতদের কয়েকজন রাজার নাম পাওয়া যায়। এমনি এক রাজা দিবােদাস। তিনি পূরু, যদু ও তুর্বশ নামে তিনটি আর্য উপজাতিকে পরাজিত করেন। তাছাড়া দাসরাজ শম্বর ও অনার্য পণিরাও তার হাতে পরাজিত হন। দিবােদাসের পুত্র পিজবন, পিজবনের পুত্র সুদাস। সুদাস শুধু এক বড় যােদ্ধাই ছিলেন না, গুণী বলেও তার খ্যাতি ছিল। ঋগ্বেদের অনেক মন্ত্র তারই রচনা।
  2. পুরু : সরস্বতী নদীর অববাহিকায় আর এক উপজাতির বাস ছিল। তারা পুরু, ভরত উপজাতির ঘাের শত্রু। ঋগ্বেদে তাদের চারজন রাজার কথা বলা হয়েছে। তারা হলেন দুর্গহ, দুর্গহের পুত্র গিরিক্ষিৎ, গিরিক্ষিতের পুত্র পুরুকুৎস ও পুরুকুৎসের পুত্র ত্রসদস্যু। পুরুকুৎস ভরতরাজ সুদাসেরই সমসাময়িক ছিলেন। পুরুকুৎস দাসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেন।
  3. তৃৎসু : তৃৎসু উপজাতি পরুষ্ণী বা ইরাবতী নদীর পূর্বতীরে বাস করত। ঋগ্বৈদিক যুগেই তৃৎসুরা সম্ভবত ভরতদের সঙ্গে মিশে এক হয়ে যান।
  4. ক্রিবি : ক্রিবিরা সিন্ধু ও অসিক্‌নী বা চন্দ্রভাগার তীরবর্তী অঞ্চলে বাস করতেন।
  5. সৃঞ্জয় : সৃঞ্জয় উপজাতির অবস্থান সম্পর্কে কোনও সঠিক ধারণা করা যায় না। কেউ কেউ বলেন তারা যমুনার পূর্বে পাঞ্চাল অঞ্চলে বাস করতেন। আবার অনেকের মতে তাদের বাস ছিল সিন্ধুর পশ্চিমে বা উচ্চ সিন্ধু অববাহিকায়। সৃঞ্জয় উপজাতির এক দলপতি দৈববাত। তুর্বশ ও বৃচীবন্ত নামে দুটি আর্য গােষ্ঠীকে তিনি পরাভূত করেন।
  6. তুর্বশ : দক্ষিণ পাঞ্জাব হরিয়ানায় তুর্বশদের অবস্থান ছিল। সেখানে যদু নামে আর এক উপজাতিরও বাস ছিল। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল বৃচীবন্তদের বাসস্থল।
  7. দ্রুহ্যূ ও অনু : চন্দ্রভাগা ও ইরাবতী নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগে দ্রুহ্যূ ও অনু উপজাতির বাস ছিল। অনু, দ্রুহ্যূ, যদু ও তুর্বশরা পুরুদের মিত্র ছিলেন। অনেকের ধারণা, এদেরই ঋগ্বেদে ‘পঞ্চজনা’ বলা হয়েছে। এ মত যে সকলেই মানেন, তা নয়।
  8. মৎস্য : মৎস্য উপজাতির লােকেরা আলােয়ার, ভরতপুর ও জয়পুর অঞ্চলে বাস করতেন।
  9. পক্থ‌ : পক্থ‌ উপজাতির অবস্থান ছিল সম্ভবত পূর্ব আফগানিস্তানে। আধুনিক পকথুনরা বােধহয় তাদেরই বংশধর।
  10. ভলানস : ভলানসদের বাস ছিল কাবুলিস্তান অঞ্চলে।
  11. অলিন : অলিনরা উত্তর-পূর্ব কাফিরিস্তানে বসবাস করতেন।
  12. বিষাণী : ক্রুমু ও গােমতী নদীর উপত্যকায় বিষাণীদের বসতি ছিল।
  13. শিব : সিন্ধু ও বিতস্তা নদীর মধ্যবর্তী স্থানে শিবদের বাস ছিল।
  14. চেদি : যমুনা নদী ও বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল চেদিদের বাস। ঋগ্বেদে কশু নামে এক পরাক্রান্ত চেদি রাজার কথা বলা হয়েছে। শােনা যায়, তিনি দশজন রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের ক্রীতদাস করে নিজের পুরােহিতকে উপহার দেন।
  15. উশীনর : উশীনররা সম্ভবত ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বাস করতেন। তারা মধ্যদেশ বা বিনশন-এলাহাবাদ সংলগ্ন অঞ্চলে বাস করতেন, এ মতও অনেকে পােষণ করেন।
  16. গান্ধারি : গান্ধারিরা ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বাস করতেন।
  17. পারাবত : পারাবতরা বাস করতেন যমুনা নদীর তীরে। অনেকে অবশ্য মনে করেন যে বেলুচিস্তানের উত্তরাঞ্চলে তাদের বাস ছিল। কিন্তু এ মত সকলে স্বীকার করেন না।
ঋগ্বৈদিক যুগে (আনু. ১৭০০ – ১১০০ অব্দ) বিভিন্ন ইন্দো-আর্য উপজাতি ও তাদের বিস্তার

উপজাতিগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ ও দশ রাজার যুদ্ধ : ঋগ্‌বেদের যুগে আর্য-উপজাতিগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। যুদ্ধবিগ্রহ সাধারণত লাগত গবাদি পশু ও পশুচারণ ভূমির অধিকার নিয়ে। অনেক সময় গােষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের পারস্পরিক বিদ্বেষ থেকেও যুদ্ধের সূত্রপাত হত। ঋগ্বৈদিক যুগের বৃহত্তম রাজনৈতিক ঘটনা দশ রাজার যুদ্ধের কারণও সেই পারস্পরিক বিদ্বেষ। ভরত উপজাতির রাজা ছিলেন সুদাস। বিশ্বামিত্র ছিলেন রাজপুরােহিত। বিশ্বামিত্রের কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে সুদাস তাকে পদচ্যুত করেন ও বশিষ্ঠকে পুরােহিত নিযুক্ত করেন। এতে বিশ্বামিত্র অপমানিত বােধ করেন। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তিনি দশ উপজাতির এক মিত্রজোট গঠন করে সদলে সুদাসকে আক্রমণ করেন। পূরু, যদু, তুর্বশ, অনু, দ্রুত্যু, অলিন, পক্থ‌, ভলানস, শিব ও বিষাণীরা বিশ্বামিত্রের মিত্রজোটে যােগ দেন। পরুষ্ণি নদীর তীরে বিবদমান পক্ষ পরস্পরের সম্মুখীন হলেন। কিন্তু এই যুদ্ধে ভরতরাজই জয়লাভ করেন। শত্রুপক্ষের অপূরণীয় ক্ষতি হয়, পূরুদের রাজা পুরুকুৎস যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারান। অনু ও দ্রুহ্যূদের রাজারা পরুষ্ণী নদীর জলে ডুবে মারা যান। পরাজয় সত্ত্বেও মিত্রজোটের সদস্যরা তাদের স্বাধীনতা হারাননি, পূর্বের মতােই তারা স্বাধীনভাবে বসবাস করতে থাকেন।

অনার্য উপজাতি ও আর্যদের সাথে যুদ্ধ : দশ রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছাড়াও সুদাস আর একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এবার বিপদ আসে তিন অনার্য উপজাতির কাছ থেকে। রাজা ভেদের নেতৃত্বে অজ, শিগ্রু ও যক্ষু নামে তিনটি অনার্য গােষ্ঠী সংঘবদ্ধভাবে সুদাসকে আক্রমণ করেন। যুদ্ধ ঘটে যমুনা নদীর তীরে। ভাগ্যলক্ষ্মী এবারও সুদাসের প্রতি প্রসন্ন হন। দেখা যাচ্ছে, ঋগ্বেদের যুগে বিভিন্ন আর্যগােষ্ঠী বা উপজাতিগুলোর মধ্যে বাদ-বিসংবাদ লেগেই ছিল। আবার তাদের অনার্যদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে হত। ঋগ্বেদে ইলিবিশ, ধুচি, চুমুরি, শম্বর, বৰ্চী, পিপ্রু, সিম্যু ইত্যাদি নামে কয়েকজন অনার্য রাজার উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদে কিরাত, কীকট, চণ্ডাল, পর্ণাক, সিম প্রভৃতি কয়েকটি অনার্য উপজাতিরও নাম আছে। তারা প্রধানত গাঙ্গেয় ভূ-ভাগেই বসবাস করতেন। আর্যরা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে এই অনার্য গােষ্ঠীরাই তাদের বাধা দেন। কিন্তু আর্যদের প্রতিহত করার শক্তি এই অনার্যদের ছিল না।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা

রাজা বা দলপতি : এক এক জনগােষ্ঠীর পরিচালক যিনি ঋগ্বেদে তাকে প্রায়ই রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কখনও তাকে ‘বিশপতি’, ‘গণপতি’ বা ‘জ্যেষ্ঠ’ও বলা হয়েছে। গােষ্ঠীপতিকে কখনও কখনও ‘সম্রাট’, ‘একরাট’, ‘অধিরাট’ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। একজনকে তাে ‘বিশ্বস্য ভুবনস্য রাজা’ অর্থাৎ ‘বিশ্বভুবনের কর্তা’ এই আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ থেকে অনেকে মনে করেন, ঋগ্বেদের যুগে বিশ্বজনীন রাজত্বের আদর্শ প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু যে যুগে রাষ্ট্র বা রাজ্যই ছিল না সে যুগে সর্বজনীন রাজত্বের আদর্শ প্রচারিত হয় কী করে? আর ঋগ্বেদের এই ধরনের উক্তিকে পরবর্তী সংযােজন বলে বাতিল করাও যায় না, কারণ এগুলো সংহিতার প্রায় সকল মণ্ডলেই ছড়ানাে রয়েছে। আসলে গােষ্ঠীপতিদের কেউ কেউ নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের গুণে আপন গােষ্ঠীতে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। এই ধরনের গােষ্ঠীপতিরা সংখ্যায় নগণ্যই ছিলেন। ঋগ্বেদের এরূপ বিভিন্ন উল্লেখে নিজ নিজ গােষ্ঠীতে দলপতির এই অসীম ক্ষমতাই যেন আভাসিত হয়েছে। সচরাচর যা হয়ে থাকে, গােষ্ঠীর মধ্য থেকেই একজন দলপতি মনােনীত হতেন। আবার একই পরিবারের লােক পুরুষানুক্রমে দলপতিত্ব করে গেছেন এমন ঘটনাও ঋগ্বেদে বিরল নয়। ভরতগােষ্ঠীতে সুদাসেরা অন্তত চার পুরুষ ধরে তাই করেছেন। সুদাসের পূর্বে তার প্রপিতামহ বধ্র্যশ্ব, পিতামহ দিবােদাস, পিতা পিজবন পর পর গােষ্ঠী প্রধানের পদ অলংকৃত করেছেন। তেমনি দুর্গহ, তার পুত্র গিরিক্ষিৎ, পৌত্র পুরুকুৎস ও প্রপৌত্র ত্রসদস্যু ক্রমান্বয়ে পুরুগোষ্ঠীকে পরিচালনা করেছেন।

রাজা বা দলপতির কাজ : অনার্য ও প্রতিদ্বন্দ্বী আর্য উপজাতির আক্রমণ থেকে নিজের গােষ্ঠীর লােকদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা ছিল দলপতির প্রধান কাজ। কিন্তু উপজাতির লােকেরা একে অন্যের প্রতি কোনও অপরাধ করলে বা উচ্ছৃঙ্খল হলে দলপতির ভূমিকা কী হবে ঋগ্বেদে তার কোনও আভাস নেই। তবে মনে হয়, উপজাতির লােকেরা যাতে শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় রাখেন সে দিকে দলপতির সতর্ক দৃষ্টি ছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার ও প্রয়ােজনে তাকে শাস্তি দানের অধিকারও বিশপতির ছিল। ঋগ্বেদে স্পশ বা গুপ্তচরের উল্লেখ আছে। মনে হয় অনার্য, প্রতিবেশী আর্য-উপজাতি এবং নিজের গােষ্ঠীর লােকদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্যই দলপতি গুপ্তচর নিয়ােগ করতেন। পূরু উপজাতির রাজা ত্রসদস্যুকে ঋগ্বেদে ‘অর্ধদেবতা’ বলা হয়েছে। অন্য কোনও রাজা বা গােষ্ঠীপতির ক্ষেত্রে এরূপ বর্ণনা নেই। রাজা বা গােষ্ঠীপতি সমাজের অন্য সকলের চেয়ে স্বতন্ত্র, এরূপ একটি ধারণাই যেন এ যুগের একেবারে শেষের দিকে মূর্ত হয়ে ওঠে।

রাজার আয়ের উৎস : ঋগ্বেদের যুগে রাজার বা দলপতির আয়ের উৎস কী ছিল? তখনকার দিনের লােকেরা রাজাকে কোনও নিয়মিত কত দিতেন না, যা দিতেন তা ‘বলি’। ‘বলি’ বলতে প্রণামী, দান বা উপহার বােঝায়। প্রথম প্রথম লােকেরা বিশেষ কোনও উৎসবে বা তানুষ্ঠানে রাজাকে বলি পাঠাতেন। বলি তারা দিতেন স্বেচ্ছায়, কোনও বাধ্যবাধকতার বশে না। কিন্তু পরে এই দান নিয়মিত এবং সম্ভবত আবশ্যিক হয়ে দাড়ায়। শত্রু পরাজিত হলে তার লুণ্ঠিত সম্পত্তির ভাগ বাজা পেতেন। দানস্তুতিগুলোতে রাজার অনেক দানের উল্লেখ আছে, কিন্তু ভূমিদানের কোনও কথা নেই। মনে হয়, সে যুগে রাজা জমির মালিক ছিলেন না, চারণভূমি ছাড়া বাকি জমি পরিবার বা পরিবারকর্তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। 

পুরোহিত : ঋগ্বেদের রাজার বা দলপতির সঙ্গে প্রাচীন মেসােপটেমিয়া, সুমের বা ব্যাবিলােনিয়ার মজার এক মৌল পার্থক্য আছে। ওসব দেশে রাজা শুধু সর্বোচ্চ প্রশাসকই ছিলেন না, রাজ্যের প্রধান পুরােহিতও ছিলেন। কিন্তু ঋগ্বেদের রাজার কাজ ছিল মূলত সামরিক ও কিছুটা প্রশাসনিক। যাগ-যজ্ঞ তথা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে রাজার ভূমিকা ছিল পৃষ্ঠপােষকের। পুরােহিতেরই সেখানে অগ্রণী ভূমিকা। গােষ্ঠীর ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতিতে যাগ-যজ্ঞের আবশ্যকতা সম্পর্কে রাজা বা গােষ্ঠীর সাধারণ লােকদের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। ফলে রাজা পুরােহিতের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরতা গড়ে উঠেছিল। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও রাজা পুরােহিতের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করতেন। তাছাড়া নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজা পুরােহিতের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। কখনও কখনও অবশ্য রাজা ও পুরােহিতের মধ্যে বিরােধও দেখা দিত। দশ রাজার যুদ্ধ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু এসব ঘটনা কদাচিৎ ঘটত। পুরােহিত বলতে প্রধান পুরােহিতকেই বােঝায়। প্রধান পুরােহিতকে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন অধস্তন পুরােহিতও ছিলেন। 

সেনানী : পুরােহিত ছাড়া আরও অনেকে রাজাকে গােষ্ঠী পরিচালনায় সাহায্য করতেন। এদের একজন হলেন সেনানী। তার কাজ ছিল যুদ্ধের সময় রাজাকে সাহায্য করা। ছােটখাটো যুদ্ধে রাজা নিজে অংশগ্রহণ করতেন না, সেনানীর উপর সে কাজের দায়িত্ব পড়ত। শান্তির সময় সেনানী প্রশাসনিক কাজে রাজাকে সাহায্য করতেন। গ্রামের সামরিক ও বেসামরিক কাজের দায়িত্বে ছিলেন গ্রামণী। তার আর এক নাম ব্রাজপতি। এক একটি উপজাতির লােকেরা অনেকগুলো গ্রাম জুড়ে বাস করতেন। ফলে এক একটি উপজাতিতে গ্রামণীর সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। অন্যান্য উপজাতির সঙ্গে যােগাযােগ রাখার জন্য দূত নামে এক শ্রেণির কর্মচারী নিযুক্ত হতেন। 

আইন : আইন বা রীতি অর্থে ঋগ্বেদে ধর্ম কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেই সময় চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা, গােধন-অপহরণের মতাে অপরাধমূলক ঘটনা প্রায়ই লেগে থাকত। খুন-খারাপিও যে হত না, তা নয়। কিন্তু রক্তের বদলে রক্ত বা প্রতিশােধ গ্রহণের সুযােগ তকালীন বিচার ব্যবস্থায় ছিল না। খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে অপরাধীকে ১০০টি গরু জরিমানা দিতে হত। দু’পক্ষে বিরােধ দেখা দিলে যিনি মধ্যস্থ হতেন তাকে ‘মধ্যমশী’ বলা হত। অধমর্ণ ঋণশােধে অপারগ হলে তাকে কিছুকাল উত্তমর্ণের দাসত্ব স্বীকার করতে হত।

সভা ও সমিতি : ঋগ্বেদে সভা ও সমিতি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ আছে। কিন্তু এদের মধ্যে সমিতি সম্পর্কেই যা কিছু জানা যায়, সভা সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। ঋগ্বেদের বিভিন্ন উল্লেখ থেকে মনে হয়, সমিতি ছিল উপজাতির সর্বসাধারণের পরিষৎ। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে উপজাতির সকল বয়স্ক লােকই এই পরিষদের সদস্য হতেন। রাজা সমিতির অধিবেশনে পৌরােহিত্য করতেন। তিনি সমিতিতে সদস্যদের নানাভাবে প্রভাবিত করতে চাইতেন, কিন্তু সমিতিতে একবার কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা অমান্য করার অধিকার তার ছিল না। ঋগ্বেদের সর্বশেষ স্তোত্রে সমিতির সদস্যদের বলা হয়েছে, তারা যেন একসঙ্গে চলেন (সংগচ্ছদ্ধম্‌), এক সুরে কথা বলেন (সংবদদ্ধম্‌), তাদের মন, চিত্ত ও মন্ত্র যেন একসূত্রে গাঁথা থাকে, একই সংকল্পে যেন তারা উদ্বুদ্ধ থাকেন। সে যুগে সমিতি যথেষ্ট সক্রিয় ছিল বলে। গােষ্ঠীপতি স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারেননি। ঋগ্বেদে সভা বলতে কখনও কখনও সভাকক্ষ বােঝানাে হয়েছে। অধ্যাপক কীথ সভাকে সভাকক্ষরূপেই ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু ঋগ্বেদের সর্বত্রই সভা বলতে সভাকক্ষ বােঝানাে হয়নি, কখনও কখনও প্রতিষ্ঠানও বােঝানাে হয়েছে। লুডউইগ-এর মতে সভা ছিল উপজাতি প্রধানদের পরিষৎ। কিন্তু জিমার সাহেব সভাকে গ্রাম-পরিষৎ বলেছেন। মনে হয় সমিতির তুলনায় সভার সদস্যরা সংখ্যায় অনেক কম ছিলেন। গােষ্ঠীর অভিজাত বা মঘবনরাই সভার সদস্য ছিলেন। ঋগ্বেদ থেকে জানা যায় যে সভায় পাশা খেলা হত। এর থেকে মনে হয় শুধু রাজনীতিই সভার আলােচ্য বিষয় ছিল না, সামাজিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার আয়ােজনও সেখানে হত। সমিতির মতাে অত সক্রিয় না হলেও রাজার কার্যকলাপের ওপর সভা সতর্ক দৃষ্টি রাখত।

সমাজ-ব্যবস্থা

পরিবার : ঋগ্বৈদিক যুগে সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার। পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক, অর্থাৎ পিতা ছিলেন পরিবারের কর্তা। তাকে গৃহপতিও বলা হত। পরিজনদের উপর তার সীমাহীন কর্তৃত্ব ছিল। অসৎ আচরণের জন্য পিতা পুত্রের দৃষ্টিশক্তি হরণ করেছেন বা তাকে ত্যাগ করেছেন, এ রকম ঘটনার উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে। কিন্তু সমাজে এই শ্রেণির পিতাদের সংখ্যা বেশি ছিল না। পিতারা সাধারণত স্নেহশীল ও সদাশয় হতেন। পরিজনদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল স্নেহ ও প্রীতির, সেখানে নির্মমতার কোনও অবকাশ ছিল না। পুত্রবধূ স্বামীর বাড়িতে এসে তার শ্বশুর-শাশুড়ি ও দেবরদের মন জয় করেছেন, এ রকম ঘটনার উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে। এ ছবি একান্নবর্তী পরিবারের ছবি। পিতা, পুত্র ও পৌত্র, সাধারণত এই তিন পুরুষের পরিজনদের নিয়েই এক একটি পরিবার গড়ে উঠত। কন্যার মাও অনেক সময় তার জামাতার বাড়িতে এসে বাস করতেন। গৃহপতির মৃত্যু হলে বা তিনি অশক্ত হয়ে পড়লে বয়ােজ্যেষ্ঠ সদস্য পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। কখনও কখনও পরিবারে কলহ দেখা দিলে বা পরিবারের আয়তন বৃদ্ধি পেলে পরিজনেরা মূল পরিবার থেকে পৃথক হয়ে যেতেন। কিন্তু তারা পরস্পরের উপর একান্ত নির্ভরশীল ছিলেন বলে মূল পরিবারেরই কাছাকাছি স্থানে বাস করতেন। অগ্নিদেবকে প্রায়ই ঋগ্বেদে অতিথিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। পরিবারের লােকেরা যে অতিথিকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, তা এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নারী : পুরুষশাসিত সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকার আশা করা যায় না। সন্দেহ নেই, পুরুষদের তুলনায় তাদের ভূমিকা ছিল গৌণ। স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার অধিকার তাদের ছিল না বললেই চলে। বিবাহের পূর্বে তারা পিতা বা ভ্রাতার অধীন ছিলেন আর বিবাহােত্তর জীবন কাটত স্বামী বা পুত্রের তত্ত্বাবধানে। আবার বিবাহ করেননি, চিরকুমারী থেকে গেছেন, এমন মহিলাও তখনকার দিনে বিরল ছিলেন না। অভিভাবকহীন তারা ছিলেন না ঠিকই কিন্তু সীমিত হলেও তাদের কিছু অধিকার ছিল। মেয়েদের সাধারণত একটু বেশি বয়সেই বিবাহ হত। ফলে পতিনির্বাচনে তাদের মতামতকে উপেক্ষা করা যেত না। কন্যার স্বেচ্ছায় স্বামী নির্বাচনের অজস্র দৃষ্টান্ত ঋগ্বেদে ছড়িয়ে আছে। গৃহস্থালিতে নারীর কর্তৃত্ব তাে সর্বময়ী। ধর্মীয় কাজে স্ত্রী স্বামীকে সহযােগিতা করেন তাই তিনি সহধর্মিণী। তারা পর্দানশিন বা গৃহবন্দি ছিলেন না। সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠানে তারা অবাধে যােগ দিতেন। যুদ্ধক্ষেত্রেও তারা বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। বিশ্‌পলা ও মুদ্‌গলানীর নাম এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। উচ্চশিক্ষার সুযােগ তাদের যথেষ্ট ছিল। লােপামুদ্রা, বিশ্ববারা, অপালা, ঘােষা প্রভৃতি সে যুগের কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা শিক্ষার উচ্চস্তরে আরােহণ করেছিলেন। তারা ঋগ্বেদের কিছু কিছু মন্ত্রও রচনা করেছেন। সে যুগে লােমশা, জুহু, পৌলােমী ও কামায়নীর মতাে মেয়েরা ধর্মীয় সাধনায়ও বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। এক পুরুষ, এক স্ত্রী – এই ছিল তখনকার দিনের রীতি। তবে পুরুষরা কখনও কখনও একাধিক পত্নী গ্রহণ করতেন। নারীদের বহুপতিত্বের কোনও নিদর্শন ঋগ্বেদে নেই। স্বামী নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে স্ত্রী পুনর্বার বিবাহ করতেন। সে ক্ষেত্রে সাধারণত স্বামীর ছােটো ভাই বা দেবরের সঙ্গেই তার বিবাহ হত। সন্তানবতী মহিলারা অনেক সময় স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় প্রাণ বিসর্জন দিতেন। কিন্তু এই সতীপ্রথা অভিজাত পরিবারেই সীমাবদ্ধ ছিল, সমাজের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি। মেয়েদের পাতিব্রত্যের অজস্র নিদর্শন আছে ঋগ্বেদে। তুলনায় পুরুষদের জীবনযাপন কিছুটা যেন অবাধ ও শিথিল ছিল। ঋগ্বেদের কিছু কিছু উল্লেখ থেকে মনে হয়, তখন গণিকাবৃত্তি প্রচলিত ছিল। বিবাহকে নর-নারীর মধ্যে পবিত্র বন্ধন বলে মনে করা হত। বংশ রক্ষার উদ্দেশ্যেই সে বিবাহ-বন্ধন। বিবাহে পণদানের প্রথা ছিল। সাধারণত সে পণ পেতেন কন্যার পিতা। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও ছিল। কন্যা প্রতিবন্ধী হলে বা অন্য কোনও বিশেষ কারণে অনেক সময় কন্যার পিতা বা অভিভাবককেই বরপণ জোগাতে হত। 

বিনোদন : আর্যদের দৈনন্দিন জীবনে বিনােদনের আয়ােজন কম ছিল না। নাচ, গান, রথের দৌড়, শিকার, মুষ্টিযুদ্ধ, পাশাখেলা প্রভৃতি আনন্দ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাদের অবসর কাটত। বীণা, বাণ (বাঁশি), মৃদঙ্গ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে। অধ্যাপক কীথ মনে করেন, সুদূর ঋগ্বৈদিক যুগে ধর্মীয় দৃশ্যাবলির অভিনয় হত। আমােদ-প্রমােদ যে সব সময় নির্ভেজাল হত তা নয়। পাশা খেলার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। পাশাখেলাকে কেন্দ্র করে সমাজে ব্যাপকভাবে জুয়াখেলা চালু হয়। জুয়াখেলা যে জনজীবনে অশেষ দুঃখ ও বিপর্যয় ডেকে আনে ঋগ্বেদে তার প্রচুর নিদর্শন আছে। 

পোশাক : আর্যরা সাধারণত পশম ও মৃগচর্মের পােশাক পরতেন। তারা নিম্নাঙ্গে পরতেন ধুতি, উর্ধ্বাঙ্গে চাদর। নিম্নাঙ্গ ও উর্ধ্বাঙ্গের বস্ত্র দু’টিকে যথাক্রমে বাস ও অধিবাস বলা হয়েছে। ঋগ্বেদে নীবি বা অন্তর্বাসের কোনও উল্লেখ নেই। পােশাক ছিল নানা রঙের। কোনও কোনও পােশাকে সােনার কারুকার্য থাকত। পুরুষ ও মহিলার পােশাকে ঠিক কতটা তফাৎ ছিল ঋগ্বেদে তা স্পষ্ট করে বলা নেই। ঋগ্বেদে সুবাস, সুবসন ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। এর থেকে মনে হয়, বেশভূষার দিকে আর্যদের যথেষ্ট দৃষ্টি ছিল। মহিলারা সােনা, রূপা ও দামী পাথরের অলংকার পরতেন। ফুলের গহনার দিকেও তাদের ঝোক ছিল। পুরুষদের মধ্যেও অলংকার পরার রেওয়াজ ছিল। ‘নিষ্ক’ নামে এক ধরনের কণ্ঠহার সে সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখনকার দিনের মহিলারা নানা ছাঁদে কবরী বাঁধতেন। চিরুনি ও তেল দিয়ে কেশ বিন্যাস করা হত। 

খাদ্য : দুধ, ঘি, ফলমূল ও যব ছিল আর্যদের প্রধান খাদ্য। যব ও দুধের তৈরি পুরােডাশ বা পিঠা তাদের খুব প্রিয় ছিল। তারা ঘােড়া, ভেড়া, ছাগল ও গরুর মাংসও আহার করতেন। গাভীকে ঋগ্বেদে ‘অঘ্ন্যা’ বলা হয়েছে। ‘অঘ্ন্যা’ শব্দের অর্থ অবধ্যা। দুগ্ধবতী গাভীকে সম্ভবত হত্যা করা হত না। অন্য গরুর মাংস গ্রহণ করা হত। অতিথিকে গােমাংস দ্বারা আপ্যায়িত করা হত তাই অতিথির আর এক নাম ‘গােঘ্ন’। আর্যরা সুরা বা মদ পান করতেন। সুরাপানকে ঋগ্বেদে নিন্দা করা হয়েছে। যাগ-যজ্ঞের দিনে সােমরস পান করা হত।

সামাজিক শ্রেণী : অনেক পণ্ডিত ঋগ্বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথা ছিল বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তারা ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অন্তর্গত পুরুষসূক্তের দ্বাদশ ঋক্ বা মন্ত্রটির উল্লেখ করেন। ঋক্টি‌ হলো – “ব্রাহ্মণােহস্য মুখমাসীদ্বাহু রাজন্যকৃতঃ। উরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।।” মন্ত্রটিতে বলা হয়েছে, আদি পুরুষ অর্থাৎ বিধাতার মুখ হল ব্রাহ্মণ, বাহু দু’টি হল রাজন্য, উরু দু’টি হল বৈশ্য আর তার পা দু’টি থেকে শূদ্রের জন্ম হল। এই শ্লোকটি উল্লেখ করে অনেক ঐতিহাসিক বলেন, ঋগ্বেদের সময় সমাজ ব্রাহ্মণ, রাজন্য বা ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারটি বংশানুক্রমিক জাতিতে বিভক্ত ছিল। যারা বিদ্যাচর্চা, যাগ-যজ্ঞ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তারা ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হলেন। যুদ্ধের কাজে যারা আত্মনিয়ােগ করেন তারা রাজন্য বা ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত হন। যারা কৃষি, পশুপালন ও ব্যবসা-বাণিজ্য পুরুষানুক্রমে পেশারূপে গ্রহণ করলেন তাদের পরিচয় হল বৈশ্য। যারা এই তিন জাতির সেবায় নিযুক্ত হলেন তাদের নাম হল শূদ্র। এই ভাবে ঋগ্বেদের যুগেই বৃত্তিকে অবলম্বন করে সমাজে চারটি বংশানুক্রমিক জাতির উদ্ভব হয়। ঋগ্বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথার সমর্থনে পুরুষসূক্তের যে মন্ত্রটিকে উদ্ধৃত করা হয়, সেটি কিন্তু প্রক্ষিপ্ত। অর্থাৎ মন্ত্রটি পরবর্তিকালের রচনা কিন্তু পরে এটিকে অনুপ্রবেশ করানাে হয়। এরূপ এক প্রক্ষিপ্ত ঋকে আর যাই হােক ঋগ্বৈদিক যুগের সমাজজীবনের প্রতিফলন নেই। তখন সমাজ শ্রেণিবদ্ধ ছিল ঠিকই কিন্তু শ্রেণিগুলো ছিল অর্থনৈতিক, বংশানুক্রমিক নয়। রাজন্য, বৈশ্য ও শূদ্র এই তিনটি শব্দ ঋগ্বেদে শুধু একবারই ব্যবহৃত হয়েছে। তাও আবার সেই পুরুষসূক্তে। ব্রাহ্মণ শব্দটির ব্যবহার ঋগ্বেদে খুব কমই লক্ষ করা যায়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে সিন্ধু উপত্যকাবাসী আর্যদের ব্রাত্য বলে নিন্দা করা হয়েছে। তাদের অপরাধ তারা জাতিভেদ প্রথার নিয়মকানুন মেনে চলতেন না। এই অঞ্চলই তাে ছিল ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের বাসভূমি। এই অঞ্চলেই যদি জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব হয়ে থাকবে, তাহলে এখানে জাতিধর্মের অনাচার বলে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কটুক্তি কেন? সব দিক বিবেচনা করে বলা যায় যে ঋগ্বৈদিক যুগে জাতিভেদ প্রথা ছিল না। পরিবারে পুরুষপরম্পরায় একই বৃত্তির অনুসরণ, কর্মের পরিবর্তে জন্মের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ, বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বিবাহ ও আহারাদির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি যেসব লক্ষণ জাতিভেদ প্রথার বৈশিষ্ট্য তার কোনওটিই ঋগ্বৈদিক যুগে আত্মপ্রকাশ করেনি। তখন সমাজে একই পরিবারের বিভিন্ন লোক বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থাকতেন। (ঋগ্বেদের এক সূক্ত-রচয়িতা জানাচ্ছেন, তার পিতা চিকিৎসক ছিলেন, মা শস্য পেষাই করতেন। (৯। ১১২। ৩)।) সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে অন্তর্বিবাহ প্রচলিত ছিল, একসঙ্গে আহার ও পানেরও কোনও বাধা ছিল না।

বর্ণ ও অনার্য : ঋগ্বেদে ‘বর্ণ’ কথাটির প্রয়ােগ দেখা যায়। কিন্তু এই বর্ণের অথ ব্রাহ্মণাদি জাতিবিভাগ নয়, বর্ণের অর্থ গাত্রবর্ণ। গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে সমাজ তখন দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত ছিল – আর্যবর্ণ ও দাস বা দস্যুবর্ণ। আর্যরা যখন পাঞ্জাব অতিক্রম করে আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হন, তখন তাদের জীবনে জটিলতা বৃদ্ধি পায়। তখন আর সকলের পক্ষে সকল কাজ করা সম্ভব হল না, বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ বিশেষ দক্ষতার প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হল। ফলে এক বা একাধিক বত্তিকে কেন্দ্র করে এক একটি বংশানুক্রমিক শ্রেণির উদ্ভব হয়। কিন্তু সেসব তাে পরবর্তী বৈদিক যুগের ঘটনা। সেই সময় আর্য সমাজের বাইরে যারা ছিলেন, তারা সংখ্যায় বড় কম ছিলেন না। ঋগ্বেদে তাদের ‘দাস’ বা ‘দস্যু’ বলা হয়েছে। সন্দেহ নেই, এরা অনার্য, ভারতের আদি অধিবাসী। সম্ভবত অনুগত অনার্যদের ঋগ্বেদে ‘দাস’ বলা হয়েছে। আর যারা আর্যদের কর্তৃত্ব স্বীকার করেননি তারা ছিলেন ‘দস্যু’। অনার্যরা ছিলেন কৃষ্ণকায় ও খর্বাকৃতি। আর্যদের কিন্তু নিজেদের গৌরবণ ও দীর্ঘকায় সম্পর্কে বেশ একটা গর্ববােধ ছিল। অনার্যদের প্রতি তাদের মনােভাব ছিল ঘৃণার ও তাচ্ছিল্যের। অনার্যদের নাক তীক্ষ্ণ ছিল না বলে আর্যরা তাদের ‘অনাসঃ’ বলে উপহাস করতেন। অনার্যদের গায়ের রঙ কালাে ছিল। তাই তাদের ‘কষ্ণত্বচ্‌’ বলা হত। তাদের ভাষা ছিল অবােধ্য, তাই তারা ‘মৃধ্রবাচ’। আর্যরা অনার্যদের পরাজিত করে তাদের অনেককেই ক্রীতদাসে পরিণত করেন কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনও সামাজিক সম্পর্ক রাখতেন না। ধীরে ধীরে অবশ্য অন্তর্বিবাহ ও প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে বিবদমান দুটি গােষ্ঠী পরস্পরের সন্নিকটবর্তী হয়। 

অর্থনৈতিক জীবন

গৃহপালিত পশু : ঋগ্বেদের যুগে পশুচারণ ছিল আর্যদের প্রধান জীবিকা, গােসম্পদ ছিল প্রধান ধনসম্বল। ধনী ব্যক্তিকে ‘গােমৎ’ বলা হত। গােধনের অধিকারী যিনি তিনিই ‘গােমৎ’। গােধনের জন্য আর্যদের যে তীব্র আকাঙক্ষা ছিল ঋগ্বেদের অনেক স্তোত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সংহিতায় যুদ্ধের প্রতিশব্দরূপে ‘গবিষ্টি’ পদের ব্যবহার আছে। পদটির শব্দগত অর্থ গরুর অনুসন্ধান। এর থেকে মনে হয়, বিভিন্ন আর্যগােষ্ঠীর মধ্যে গরু অপহরণের এক প্রবণতা ছিল। এই প্রবণতা আর্য গােষ্ঠীগুলোকে প্রায়ই সংঘর্ষের পথে ঠেলে দিত। গরুর মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য তার কানে সাংকেতিক চিহ্ন একে দেওয়া হত। মূল্যের একক ও বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবেও গরুর ব্যবহার ছিল। পশুচারক সমাজেই গরুর এ ধরনের ভূমিকা থাকে। ঋগ্বেদে উল্লেখ আছে, যমুনা উপত্যকা গােচারণের পক্ষে প্রশস্ত ছিল। অনেকে বলে থাকেন, ঋগ্বেদের যুগে গােধন ব্যক্তি বিশেষের নয়, সমগ্র গােষ্ঠীর মালিকানাধীন ছিল। কিন্তু মনে রাখা দরকার ঋগ্বেদে ‘গােম’ পদটি ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, গােষ্ঠীর ক্ষেত্রে নয়। দ্বিতীয়ত, একটি গরু যাতে অন্যটির সঙ্গে মিশে না যায়, সে জন্য তার কানে বিশেষ চিহ্ন একে দেওয়া হত। গরুগুলো গােষ্ঠীর এজমালি সম্পত্তি হলে তাদের এ ভাবে চিহ্নিত করার কোনও প্রয়ােজন ছিল না। ঋগ্বৈদিক আর্যরাই ভারতে ঘােড়ার ব্যবহার জনপ্রিয় করে তােলেন। যুদ্ধের জন্য বিশেষ উপযােগী হওয়ায় ঘােড়া আর্যদের জীবনে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। পশমের জোগান দিত বলে সে যুগের অর্থনীতিতে ভেড়ার বিরাট ভূমিকা ছিল। অন্যান্য গৃহপালিত পশুদের মধ্যে ঋগ্বেদে ছাগল, গর্দভ ও কুকুরের উল্লেখ আছে, শিকার ও পাহারার কাজে কুকুরকে ব্যবহার করা হত। বিড়াল ও মহিষকে তখনও পােষ মানানাে হয়নি।

চাষাবাদ : ঋগ্বেদের যুগে অর্ধ যাযাবর আর্যরা মূলত পশুচারক হলেও তারা যে কিছু কিছু চাষাবাদের কাজ করতেন তার লক্ষণ সুস্পষ্ট। জেন্দ আবেস্তায় কর্ষণ করা অর্থে কৃষ্‌ ধাতুর ব্যবহার আছে। ঋগ্বেদেও কৃষ্‌ ধাতু একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হচ্ছে, ঋগ্বৈদিক যুগের প্রায় সূচনা থেকেই আর্যরা চাষ সম্পর্কে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। আবাদি জমিকে ঋগ্বেদে ‘ক্ষেত্র’ ও ‘উর্বরা’ বলা হয়েছে। লাঙলকে ‘সীর’ বলা হয়েছে। জমিতে লাঙলের যে রেখা পড়ে তাকে ‘সীতা’ বলা হয়েছে। ঋগ্বেদে জমিতে হলকর্ষণ, বীজবপন, ফসলকাটা ও শস্য মাড়াই-এর উল্লেখ আছে। বলদ দিয়ে লাঙল টানা হত। জল সরবরাহ হত নদী থেকে, কখনওবা কূপ থেকে। নালার সাহায্যে জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা ছিল। কৃত্রিম জল-প্রণালীকে ঋগ্বেদে ‘কুল্যা’ বলা হয়েছে। ‘খনিত্রিমা আপঃ’ বা খনন করে যে জল পাওয়া যায়, এই বর্ণনায় কূপ খননের ইঙ্গিত আছে। এক রকম চাকার সাহায্যে কূপ থেকে জল তােলা হত। ফলন বাড়াবার জন্য জমিতে সার দেওয়া হত। ‘দাত্র’ বা ‘সৃণী’ অর্থাৎ দা বা কাস্তে দিয়ে পাকা ফসল কাটা হত।

লোহার ব্যবহার : অনেকে মনে করেন, তখনকার দিনে লাঙলের মুখে লােহার ফলা লাগানাে হত। কিন্তু সে যুগে লােহার ব্যবহার ছিল কিনা সে সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। ঋগ্বেদে ‘অয়স্‌’ বা ‘লােহিতায়স’ নামে এক ধাতুর উল্লেখ আছে। পরবর্তিকালে ‘অয়স্‌’ বলতে লােহা বােঝাত। কিন্ত ঋগ্বেদে ‘অয়স্‌’ শব্দটি লােহার প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা বলা কঠিন। এমন হতে পারে যে শব্দটি ল্যাটিন ‘aes’ অর্থাৎ ব্রোঞ্জের অনুরূপ। সে ক্ষেত্রে ‘অয়স্‌’ বলতে ঋগ্বেদের যুগে ব্রোঞ্জ অথবা তামাকেই বুঝতে হবে। এক সময় মনে করা হত, রাজস্থানের নােহ্‌ ভারতে লােহার প্রাচীনতম নিদর্শনস্থল। যে ভূ-সংস্তরে এই নিদর্শন পাওয়া গেছে সেটির আনুমানিক বয়স ১১০০ – ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিন্তু উৎখননকার্যের ব্যাপকতার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। লখনউ এর নিকটস্থ দাদুপুরের যে প্রাচীন ভূ-সংস্তরে লৌহ উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে তার বয়স আনুমানিক ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। আহারে জিশুখ্রিস্টের জন্মের দেড় হাজার বছরেরও পূর্ব হতে লােহা ব্যবহারের নজির আছে। মালহারে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম পর্বকার লৌহ উপকরণের সন্ধান পাওয়া গেছে। বেলান অববাহিকার রাজা নল কা টিলা ও এলাহাবাদের সন্নিকটবর্তী ঝুসিতে প্রাপ্ত লৌহ হাতিয়ারের বয়স আনুমানিক ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। (উপিন্দর সিংহ, তদেৱ, পৃষ্ঠা ২৪৮-৪৯)। লােহার এসব প্রাচীন নিদর্শনের ভিত্তিতে এখন আর ঋগ্বেদের অয়স পদটিকে ব্রোঞ্জ বা তামা অর্থেই গ্রহণ করতে হবে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় না। অর্থাৎ ঋগ্বৈদিক যুগে, একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ে না হােক, কিছুকাল পর থেকে আর্যদের লােহা ব্যবহারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলেই মনে হয়।

শস্য : ঋগ্বেদে শস্যের মধ্যে যবের উল্লেখ আছে। অনেকে বলেন, ঋগ্বেদের যুগে যব কোনও এক বিশেষ ফসলের নয়, ফসল মাত্রেরই সাধারণ নাম ছিল। তখন যব বলতে ধান ও গমকেও বােঝাত। কিন্তু এই ধারণা সম্ভবত ঠিক নয়। ঋগ্বেদের অন্তত পাঁচটি স্থানে কৃষিজ ফসল হিসাবে ধানের উল্লেখ আছে। পরবর্তী সংহিতাদি গ্রন্থে ধান অর্থে ‘ব্রীহি’ শব্দেরও ব্যবহার আছে। ঋগ্বেদে ব্রীহির কোনও উল্লেখ নেই। ঋগ্বেদের যুগে জমি গােষ্ঠীর এজমালি সম্পত্তি ছিল না, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী ও উপেন্দ্রনাথ ঘােষাল মনে করেন, সে যুগে বাস্তু ও আবাদি জমি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল কিন্তু চারণভূমির উপর ছিল গােষ্ঠী বা সর্বসাধারণের কর্তৃত্ব। দামােদর ধর্মানদ কোশাম্বীর মতে জমি গােষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল, ব্যক্তি বা পরিবারের অধীন ছিল না।

দারুশিল্প : কৃষির সঙ্গে শিল্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কৃষির ফলন বেশি না হলে উদবৃত্ত থাকে না, উদ্বৃত্ত না থাকলে কারিগরি বা কুটির শিল্পে সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত হবার মতাে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় না। ঋগ্বেদের যুগে শিল্পী ও কারিগরদের বিকাশের সুযােগ কতটা ছিল বলা শক্ত। তবে কিছু কিছু শিল্প যে সে সময় গড়ে উঠেছিল ঋগ্বেদের সাক্ষ্যই তার প্রমাণ। সে সময় সমাজে দারুশিল্পের বেশ চাহিদা ছিল। বাড়ি-ঘর, আসবাব, রথ, লাঙল ইত্যাদি জিনিসপত্র বিশেষ প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ায় কাঠের কাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কাঠুরে, তক্ষক ও রথকার এই তিন শ্রেণির লােক দারুশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কাঠুরে গাছ কাটতেন ও কাঁচামাল জোগান দিতেন, তক্ষক আসবাব, লাঙল ইত্যাদি তৈরি করতেন আর রথকার রথ নির্মাণ করতেন। একজন তক্ষকের চেয়ে একজন রথকারের মর্যাদা সাধারণত একটু বেশিই ছিল। শুধু যাতায়াত ও যুদ্ধের প্রয়ােজনেই নয়, খেলাধুলা ও বিনােদনের জন্যও রথের প্রয়ােজন হত। তখনকার দিনে বাড়ি-ঘরগুলো কাঠ ও বাঁশ দিয়ে নির্মিত হত।

বয়নশিল্প : দারুশিল্পের মতাে বয়নশিল্পেরও বেশ কদর ছিল। বস্ত্রগুলো সাধারণত মেষললাম দিয়ে তৈরি হত। ঋগ্বেদে কার্পাসের তৈরি সুতিবস্ত্রের স্পষ্ট উল্লেখ নেই। কিন্তু সেখানে ‘তন্তু’ ও ‘ওতু’ নামে দু’প্রকার সুতার কথা আছে। এদের প্রথমটি টানা সুতা, দ্বিতীয়টি পােড়েনের সুতা। কিন্তু এগুলো যে তুলারই, তার কোনও প্রমাণ নেই। অনেকে অবশ্য মনে করেন, সে কালে তুলা উৎপন্ন হত, তুলার বস্ত্রও তৈরি হত। 

ধাতুশিল্প : সে যুগের ধাতুশিল্পের কিছু পরিচয় ঋগ্বেদে বিধৃত আছে। ধাতুশিল্পীরা সােনা ও তামার অলংকার তৈরি করতেন। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ঋগ্বৈদিক আর্যদের অলংকারের প্রতি দারুণ আকর্ষণ ছিল। দুল, হার, নূপুর, বাজু প্রভৃতি অলংকারের বর্ণনা আছে-ঋগ্বেদে। এক বিশেষ ধরনের সােনার হারকে ঋগ্বেদে ‘নিষ্ক’ বলা হয়েছে। অলংকারে কখনও কখনও মণি বসানাে হত। ঋগ্বেদে ‘মণি’ বলতে সম্ভবত মূল্যবান পাথর বােঝানাে হয়েছে। অলংকার ছাড়া বেশ কিছু নিত্য প্রয়ােজনীয় উপকরণ তৈরির জন্যও ধাতুশিল্পীদের ডাক পড়ত। সন্দেহ নেই, কুড়াল, লাঙলের ফলা, দা, কাস্তে প্রভৃতি যন্ত্রপাতি নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের তালিকায় ছিল। এসব জিনিস সম্ভবত তামা দিয়ে তৈরি হত। ঋগ্বেদে ‘দ্রাবিণ’ নামে এক শ্রেণির কারিগরের উল্লেখ আছে। ধাতু গলানাে ছিল তাদের কাজ। 

চর্মশিল্প, কুম্ভকার, শিকার ও কসাই : ঋগ্বেদে চামড়ার কাজকে ‘চর্মম্না‌’ বলা হয়েছে। চামড়ার তৈরি জিনিসের মধ্যে থলি, ঘােড়ার বলগা ও চাবুক উল্লেখযােগ্য। কুম্ভকারের কাজেও কিছু লােক নিযুক্ত ছিলেন। উৎখননের ফলে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে ধূসর বর্ণের মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। এই পাত্রগুলো সে যুগেরই তৈরি বলে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিমত প্রকাশ করেছেন। শিকার একাধারে বিনােদন ও জীবিকার উপায় ছিল। ঋগ্বেদে সিংহ, ভালুক, মহিষ, কৃষ্ণসার মৃগ প্রভৃতি পশুশিকারের বর্ণনা আছে। কিছু লােক ‘কসাই’-এর কাজ করতেন। যাগ যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে পশু হত্যা করা ছিল তাদের কাজ।

বাণিজ্য ও সমুদ্রবাণিজ্যের সম্ভাবনা : সে সময় কৃষি ও কারিগরি ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে উৎপাদন হত না। উদবৃত্ত ভােগ্যপণ্যের পরিমাণও ছিল কম। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য বড় একটা বিকাশ লাভ করেছিল বলে মনে হয় না। তবে অল্প হলেও ঋগ্বেদে বাণিজ্য সংক্রান্ত কিছু তথ্য আছে। নিজেদের গােষ্ঠীর বাইরে দূর অঞ্চলেও যে আর্যরা বাণিজ্যের খাতিরে যাতায়াত করতেন এই সংহিতায় তার উল্লেখ আছে। ‘শতধন’-লাভে বণিকেরও উল্লেখ আছে সেখানে। পথে-ঘাটে বণিকেরা যেসব বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হন, তারও বর্ণনা আছে ঋগ্বেদে। ঋগ্বেদে বিহারের কীকট জনগােষ্ঠীর উল্লেখ আছে। পূর্ব ভারতের সঙ্গে আর্যদের এই যােগাযােগ ছিল বাণিজ্যিক তথা অর্থনৈতিক। হয়তাে এ অঞ্চলে ঘােড়ার ভালাে বাজার ছিল। ম্যাক্সম্যূলার, ল্যাসেন ও জিমার মনে করেন, ঋগ্বৈদিক আর্যরা সামুদ্রিক বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করতেন। সমুদ্র কথাটি ঋগ্বেদে বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। শতদাড়যুক্ত (শত-অরিত্র) জলযানেরও (নৌ) উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে। ধনলাভেচ্ছু ব্যক্তি সমুদ্রে যান, সমুদ্রের স্তুতি করেন, এরূপ উক্তিও আছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে পূর্ব সমুদ্র ও পশ্চিম সমুদ্রের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। এ সকল উল্লেখ থেকে মনে হয়, আর্য বণিকরা সমুদ্রপথে যাতায়াত করতেন। কিন্তু আর্থার ব্যারিডেল কীথ মনে করেন, ঋগ্বেদে সমুদ্র বলতে সাগর বােঝায় না, বােঝায় সিন্ধু নদের সুবিস্তীর্ণ মােহনা। কিন্তু ঋগ্বেদে সিন্ধুকে সমুদ্রগামী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই উক্তিতে সিন্ধু নদের মােহনা ও সমুদ্রের পার্থক্য পরিষ্কার। এর থেকে ধারণা হয়, ঋগ্বৈদিক আর্যরা সমুদ্রযাত্রায় অভ্যস্ত ছিলেন। আর্যদের এই সমুদ্রযাত্রা বাণিজ্য ছাড়া আর কী কারণে হতে পারে? এখনও এমন অনেক পণ্ডিত আছেন যারা ঋগ্বেদের যুগে সামুদ্রিক বাণিজ্যের কথা স্বীকার করেন না। তাদের দু’টি যুক্তি। এক. ঋগ্বেদে জলযানের যে বর্ণনা আছে তাতে হাল, মাস্তুলের কোনও উল্লেখ নেই। যে জলযানে হাল নেই, মাস্তুল নেই, সে জলযান সমুদ্র পাড়ির পক্ষে উপযােগী নয়। দুই. সে আমলে উৎপাদন কম হত। নিয়মিত না হলেও দূর অঞ্চলের সঙ্গে আর্যদের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল তা কিন্তু ঋগ্বেদের সাক্ষ্যে সুস্পষ্ট। সুতরাং উৎপাদনের যুক্তিটি খাটে না। আর সামুদ্রিক বাণিজ্যে বণিককে যে সাগর পাড়ি দিতেই হবে এমন কোনও কথা নেই। উপকূল ধরেও বাণিজ্যতরী যাতায়াত করতে পারে। সে ক্ষেত্রে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঋগ্বৈদিক আর্যদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঋগ্বেদে ‘পণি’ নামে এক শ্রেণির ধনী লােকদের কথা বলা হয়েছে। তারা স্বার্থপর, তারা দাস বা দস্যু বর্ণের লােক, তারা যাগ-যজ্ঞ বিরােধী, তারা আর্যদের শত্রু, পণিদের সম্পর্কে। এরূপ নানা মন্তব্য আছে ঋগ্বেদে। সংস্কৃতে বণিক, পণ্য, বিপণি প্রভৃতি পদের ব্যবহার দেখে মনে হয় পণিরা পেশায় বণিক ছিলেন। পণিরা অনার্য বণিক ছিলেন বলেই মনে হয়। এ. ডি. পুসলকর প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিত তাদের আর্য বণিক বলে শনাক্ত করেছেন।

ধাতব মুদ্রা : কেউ কেউ বলেন, ঋগ্বেদের যুগে ধাতব মুদ্রার প্রচলন ছিল। ঋগ্বেদে যে “নিষ্ক’-এর উল্লেখ আছে তাকে তারা স্বর্ণমুদ্রা অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু নিষ্কের প্রকৃত অর্থ নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। অনন্ত সদাশিব অল্তে‌কর প্রমুখ অনেক ঐতিহাসিক ‘নিষ্ক’ পদটিকে স্বর্ণমুদ্রা অর্থেই ব্যাখ্যা করেছেন। আবার কেউ কেউ ‘নিষ্ক’ বলতে নির্দিষ্ট ওজনের সােনা বা রূপার তাল বােঝেন। কিন্তু ‘নিষ্ক’ সম্ভবত সােনার অলংকার অর্থেই ঋগ্বেদে ব্যবহৃত হয়েছে। পশুচারণভিত্তিক অর্থনীতিতে ধাতব মুদ্রার প্রচলনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাছাড়া ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে যে প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া গেছে তার কোনওটিই খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের পূর্ববর্তী নয়। 

ঋণদান ও ঋণগ্রহণ : ঋগ্বেদে ঋণদান ও ঋণগ্রহণের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই দেওয়া-নেওয়া চলত দ্রব্যের মাধ্যমে, সেখানে টাকা-পয়সার কোনও ভূমিকা ছিল না। এই সময় ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যদের কেউ কেউ সুদের কারবার করতেন বলে অধ্যাপক আপ্তে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন তা সমর্থন করা যায় না।

যাতায়াত ব্যবস্থা ও দাস : সে যুগে যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল নিতান্ত প্রাথমিক পর্যায়ে। ঋগ্বেদে দূর অঞ্চলের সঙ্গে সংযােগরক্ষাকারী স্থলপথের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। পথপ্রদর্শকের কথাও সেখানে বলা হয়েছে। ঋগ্বেদে অগ্নিকে ‘পথিকৃৎ’ বলা হয়েছে। অনুমান করা যায়, আগুন দিয়ে জঙ্গল পুড়িয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করা হত। যানবাহন বলতে তখন ছিল রথ ও গাড়ি। রথ টানত ঘােড়ায়। ঋগ্বেদে চার ঘােড়ায় টানা রথেরও উল্লেখ আছে। গাড়ি টানত বলদে, কখনওবা অশ্বতর প্রাণীতে। এ যুগে দস্যুবর্ণের লােকদের দাসরূপে ব্যবহার করা শুরু হয়। মালিককে কৃষি, পশুপালন ও শিল্পের কাজে সাহায্য করাই ছিল তাদের কাজ। অনেকে মনে করেন, দাসেরা গােষ্ঠীর সম্পত্তি ছিলেন, ব্যক্তিবিশেষের অধীন ছিলেন না। কিন্তু ঋগ্বেদের যুগে, অন্তত শেষপর্বে ব্যক্তিগত সম্পত্তি গড়ে ওঠেনি, এ ধারণা ঠিক নয়। ঋগ্বৈদিক আর্যরা বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত ছিলেন। দাসেরা সম্ভবত গৃহপতি বা পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে গণ্য হতেন।

ধর্মীয় জীবন

সেই সুদূর অতীতে প্রকৃতির রহস্য ও বৈচিত্র্য আর্যদের মনকে গভীরভাবে আলােড়িত করেছিল। দিগন্তপ্রসারী নীল আকাশ, আকাশছোঁয়া হিমালয়, সুবিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, নিবিড় অরণ্য, বিশাল নদ-নদী, অসীম সমুদ্র, প্রভাতের অরুণােদয়, পূর্ণিমার চাদ, বর্ণময় ঋতুর সমারােহ তাদের মনকে ভীত, বিস্ময়াবিষ্ট ও ভক্তিপ্লুত করেছে, ভাবুকতা ও আধ্যাত্মিবতায় উদ্বুদ্ধ করেছে। এরই প্রতিক্রিয়ার বশে তারা বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তুতে ব্যক্তিত্ব ও দেবত্ব আরােপ করেছেন। এ ভাবে পৃথিবী, অন্তরীক্ষ ও দ্যুলােকের চেতন ও অবচেতুন বস্তু দেবপদে অভিষিক্ত হয়েছে। ফলে ঋগ্বৈদিক যুগে অনিবার্যভাবে বহুদেবতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (বৈদিক দেবকল্পনার এরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন ওয়েবার (The History of Indian Literature, London, 1914, পৃষ্ঠা ৩৫), উইন্টারনিৎস (History of Indian Literature, Vol. I, পৃষ্ঠা ৬৫), কীথ (The Cambridge History Of India, 1, Delhi, 1955, পৃষ্ঠা ৯২), ম্যাকডােনেল (Vedic Myt/iology, Delhi, Strassburg, London, পৃষ্ঠা ২), চার্লস ইলিয়ট (Hinduish and Buddhism, 1, পৃষ্ঠা ৫৬) প্রমুখ পণ্ডিতেরা। বলা বাহুল্য, সাধকেরা এ ব্যাখ্যা স্বীকার করেন না।) বৈদিক দেবকল্পনার রূপটিকে একটু অন্যভাবেও দেখা চলে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেতন-অবচেতন সকল পদার্থের মধ্যেই আর্যরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করেছেন, প্রতিটি প্রাকৃতিক বস্তুতে উপলব্ধি করেছেন এক অদৃশ্য শক্তির প্রকাশ। অর্থাৎ প্রকৃতি থেকে ঈশ্বরের জন্ম হয়নি, ঈশ্বর অনাদি, স্বয়ম্ভু। 

ঋগ্বেদে বহু দেবতার কথা বলা হলেও তাদের সংখ্যা তেত্রিশের বেশি নয়। বিশ্বভুবনের এক এক স্থানে এক এক দেবতার বাস। ঋগ্বেদের ঋষিরা বিশ্বভুবনকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। একএকটি ভাগকে স্থান, লােক বা মণ্ডল বলা হয়েছে। সকলের উপরে যে মণ্ডল তার বিভিন্ন নাম – দ্যুলােক, স্বর্গ, আকাশ, আলােক। সকলের নিচে ভূলােক বা পৃথিবী। স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে অন্তরীক্ষ, বায়ু বা মধ্যম মণ্ডল। দেবতাদের কারাের বাস দ্যুলােকে, কারাের। ভূলােকে, কারাের বা অন্তরীক্ষে। ভূলােকের দেবগণের মধ্যে রয়েছেন অগ্নি, সােম। ইন্দ্র, পর্জন্য, রুদ্র, মরুতেরা হলেন অন্তরীক্ষের দেবতা। দ্যৌঃ, বরুণ, সূর্য, বিষ্ণু দ্যুলােকের দেবতা। ঋগ্বৈদিক দেবতাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা –

  • ইন্দ্র : দেবতাদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় সকলের শীর্ষে ছিলেন ইন্দ্র। ঋগ্বেদের প্রায় ২৫০টি স্তোত্র তারই উদ্দেশে নিবেদিত। ইন্দ্রের ভূমিকা ত্রাণকর্তার। যুদ্ধের দেবতারূপে তিনি অসুরগণকে বিনাশ করেন, দেবতাগণকে রক্ষা করেন, বৃষ্টি ও আলাের দেবতারূপে তিনি পৃথিবীকে শস্যশ্যামলা করেন, জীবের প্রাণরক্ষা করেন। তিনি অসুরদের পুর বা শহর ধ্বংস করেন। তিনি পরমাত্মা, জগৎস্রষ্টা, জগৎনিয়ন্তা। সােমরসে তার অত্যধিক আসক্তি। তার পিতা দ্যৌঃ মতান্তরে ত্বষ্টা। তার মাতা পৃথিবী। বজ্র তার অস্ত্র। তিনি বৃত্রকে সংহার করেছেন বলে বৃত্ৰহা বা বৃত্ৰঘ্ন। ঋগ্বেদে ইন্দ্র ও বৃত্রঘ্ন অভিন্নরূপে কল্পিত কিন্তু জেন্দ আবেস্তায় তারা পৃথকরূপে বর্ণিত হয়েছেন। সেখানে বৃত্ৰগ্ন এক উপাস্য দেবতা কিন্তু ইন্দ্র দানব, দেবতা নন। অনেকে মনে করেন, ইন্দ্র আসলে একজন আর্যবীর ছিলেন কিন্তু পরে তার উপর দেবত্ব আরােপিত হয়। তাদের ধারণা ঋগ্বেদের বেশ কিছু স্তোত্রে ইন্দ্রের এই মানবরূপটি প্রকাশ পেয়েছে। ঋগ্বেদের অন্তত একস্থানে (২।১২।১) তিনি শ্রেষ্ঠ মানুষরূপে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সেনানায়ক বলেও তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে (২।১২।১)। বল, শুষ্ণ, চুমুরি, ধুনি, শম্বর, প্রিপ্রু প্রভৃতি যেসব অসুরকে তিনি হত্যা করেছেন তারা সকলেই সম্ভবত অনার্য গােষ্ঠীভুক্ত ছিলেন। অসুর অর্থাৎ অনার্যদের যে তিনি ধ্বংস করেছেন তারও স্পষ্ট উল্লেখ আছে ঋগ্বেদে। ইন্দ্র যে অনার্যদের তৈরি অনেকগুলো বাঁধ ভেঙেছিলেন তার ইঙ্গিতও এই পণ্ডিতেরা ঋগ্বেদে লক্ষ করেছেন। তবে ইন্দ্র নামে সত্যই কোনও আর্যবীর ছিলেন কিনা তা এখনও জোরের সঙ্গে বলা যায় না। এখানে যেসব অসুররাজদের কথা বলা হয়েছে তারা যে ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন তারও কোনও প্রমাণ নেই। যে অসুরদুর্গ ধ্বংসের কথা ঋগ্বেদে আছে সেগুলো প্রকৃতই দুর্গ কিনা সে সম্পর্কেও সন্দেহ আছে। ম্যাকডােনেল তাে স্পষ্টই বলেছেন, এগুলো অসুরদের দুর্গ নয়, আকাশের পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। ঋগ্বেদে ইন্দ্রের বৃত্রবধের প্রসঙ্গ বেশ কয়েকবারই ঘুরে ফিরে এসেছে। বলা হয়েছে, ইন্দ্র বজ্রের আঘাতে বৃত্রকে হত্যা করে বন্দি জলরাশিকে মুক্তধারায় প্রবাহিত করেন। ইন্দ্রের বৃত্রবধের তাৎপর্য সম্পর্কে পণ্ডিতেরা সহমত নন। কেউ কেউ মনে করেন, নদীর জল নিয়ে আর্য-অনার্য গােষ্ঠীর বিরােধ ও শেষে অনার্য বৃত্রকে পরাজিত করে ইন্দ্রের নেতৃত্বে আর্যগণের নদীর অধিকার লাভের কথাই বলা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, বৃত্র শব্দের অর্থ বাঁধ। অসুরদের তৈরি অনেকগুলো বাঁধ ইন্দ্র ভেঙে দিয়েছিলেন, এ কথাই এ কাহিনির মূল বিষয় বলে তারা মনে করেন। আবার কারাের ধারণা, মেঘ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে অন্ন, অন্ন থেকে জীবের প্রাণ রক্ষার কথাই এই আখ্যানের প্রতিপাদ্য বিষয়। তারা মনে করেন, বৃত্রের অর্থ মেঘ আর ইন্দ্র হচ্ছেন সেই বিশেষ শক্তি যে শক্তি পৃথিবী থেকে জলীয় পদার্থ শােষণ করে মেঘ সৃষ্টি করে, মেঘকে জলবিন্দুতে পরিণত করে পৃথিবীকে শস্যশ্যামলা করে, মুমূর্য পৃথিবীকে প্রাণ দান করে। আবার অনেকে মনে করেন, ইন্দ্র সৎস্বরূপ, বৃত্ৰ অসস্বরূপ ; ইন্দ্র-বৃত্রের যুদ্ধের রূপকের মধ্য দিয়ে সৎ-অসৎ প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বই প্রকাশ পেয়েছে। 
  • বরুণ : ইন্দ্রের মতাে অত জনপ্রিয় তিনি নন, তবু বরুণ ঋগ্বেদে এক প্রধান দেবতা। ‘বৃ’ ধাতু থেকে বরুণ শব্দের উৎপত্তি। বৃ’ ধাতুর অর্থ আবৃত করা, আচ্ছাদন করা। তার প্রভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। আবৃত, তাই তিনি বরুণ। তিনি দেবতাদের রাজা, সম্রাট। তিনি দ্যুলােক, ভূলােক ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র দীপ্যমান। তিনি অদিতির পুত্র, সমুদ্রের অধিপতি, সিন্ধুপতি। আকাশেরও অধীশ্বর তিনি। বৃষ্টিজলে তিনি পৃথিবীকে সিক্ত করেন। স্বর্ণরথে চড়ে তিনি অন্তরীক্ষে বিচরণ করেন। ঋত অর্থাৎ সত্যের ধারক ও বাহক এই বরুণ। তারই নির্দেশনায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ করে চলেছে। চন্দ্র-সূর্যের পথ-পরিক্রমা, দিনরাত্রির আনাগােনা, ঋতুচক্রের আবর্তন, সব কিছু তারই নির্দেশে চলছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সব কিছুই নিয়ম ও শৃঙ্খলে বাঁধা, সেই সুদূর অতীতে ঋগ্বৈদিক আর্যদের এই উপলব্ধি তাদের অসামান্য ধীশক্তির পরিচয় দেয়। দেবতাই হােন বা মানুষই হােক, ঋত লঙ্ঘন করলে তাকে বরুণের হাতে শাস্তি পেতে হবে। বরুণ সত্যদর্শী। তার আনুচরেরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন। তার অগােচরে কোনও পাপ কর্ম অনুষ্ঠিত হওয়ার জো নেই। অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে। তবে অপরাধী অনুতপ্ত হলে বরুণ তাকে মার্জনা করেন। অপরাধীর মনে অনুতাপ জাগলে বরুণ তার প্রতি প্রসন্ন হন, আর্যদের এই চেতনাই পরে পল্লবিত, বিকশিত হয়ে ভক্তিধর্মে রূপ নেয়। ম্যাকডােনেল মনে করেন, ঋগ্বেদের বরুণ আর আবেস্তার তাহুরমজদা একই দেবতা। (Vedic Mythology, পৃষ্ঠা ২৮) ম্যাক্সম্যূলার এর মতে বরুণ গ্রিক দেবতা উরনস-এর সঙ্গে তুলনীয়। (Chips from a German Workshop. II, পৃ. ৬৮)। চার্লস ইলিয়ট ইহুদিদের দেবতা জেহােবার সঙ্গে বরুণের তুলনা করেছেন। (Hinduism and Buddhism. I, পৃষ্ঠা ৬০-১)।
  • রুদ্র : রুদ্র অন্তরীক্ষ দেবতা। তিনি ঝড় ও ঔষধির দেবতা। অমিতশক্তির অধিকারী তিনি। তিনি সকলের মনে ত্রাস সঞ্চার করেন, অমঙ্গল হানেন। আবার কখনও কখনও রােগ নিরাময় করে। মানুষের অশেষ কল্যাণ সাধন করেন। শুভকর্মের জন্য তাকে ঋগ্বেদে শিব আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অন্তত একটি ক্ষেত্রে রুদ্র অন্যান্য দেব-দেবী থেকে স্বতন্ত্র। দেব-দেবীর অর্ঘ সাধারণত অগ্নিকে সমর্পণ করা হয়। কিন্তু রুদ্রের অর্ঘ চৌরাস্তায় বা অন্য কোনও বিশেষ স্থানে অর্পিত হয়। মনে হয় প্রথম দিকে রুদ্র অনার্য দেবতা ছিলেন কিন্তু পরে আর্যরা তাকে দেবতা বলে স্বীকার করেন। ঋগ্বেদে রুদ্র একজন গৌণদেবতাই থেকে গেছেন। 
  • বিষ্ণু : রুদ্রের মতাে বিষ্ণুও ঋগ্বেদের একজন গৌণ দেবতা। ৬টি মাত্র স্তোত্র তার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। ঋগ্বেদে বিষ্ণুকে সূর্যের এক বিশেষ সত্তারূপে কল্পনা করা হয়েছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিষ্ণুর ত্রিপাদভূমি এরূপ একটি ধারণার আভাস আছে ঋগ্বেদে।
  • মরুৎ : মরুতেরা হলেন বিদ্যুৎ ও ঝড়-বৃষ্টির দেবতা। তারা সংখ্যায় কখনও ৭, কখনও ২১, কখনও ৪৯, কখনওবা ৬৩। রুদ্র তাদের পিতা, পৃশ্নি মা। তারা পৃথিবীকে বৃষ্টিস্নাত করেন, লােকদের গরু ও অন্নদানে তুষ্ট করেন। তারা ইন্দ্রের গণ, অনুচর।
  • বায়ু, বাত ও পর্জন্য : অন্তরীক্ষের অন্য তিন দেবতা হলেন বায়ু, বাত ও পর্জন্য। বায়ু ও বাত বাতাসের দেবতা। অনেকে এ দু’জনকে এক ও অভিন্ন দেবতা বলে গণ্য করেন। পর্জন্য হলেন বৃষ্টির দেবতা।। আবার তিনি প্রজনন-শক্তি প্রতীকও।
  • অগ্নি : ঋগ্বেদের এক দেবতা অগ্নি। দ্বিশতাধিক স্তোত্র তার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। যজ্ঞাগ্নি আগুন, আবার গার্হপত্য-অগ্নিও আগুন। তাই অগ্নি যজ্ঞের দেবতা আবার গৃহেরও দেবতা। দৌঃ তার পিতা, ইন্দ্র তার যমজ ভাই। কখনও কখনও বলকে তার পিতা বলা হয়েছে। অগ্নি সাধারণ দেবতা নন, তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রাণ, সকল বস্তুর অন্তরে বিরাজমান। তিনি কখনও সূর্যের সঙ্গে অভিন্নরূপে কল্পিত, আবার কখনওবা তিনি দেবতাদের মুখরূপে বর্ণিত। দেবগণ অগ্নিমুখে হবি গ্রহণ করেন। অগ্নি দূতও বটে। দূতরূপে তিনি দেবতা ও মানুষের মধ্যে যােগসূত্র রচনা করেন, দেবগণের নিকট হব্য ও পিতৃগণের নিকট কব্য তিনিই পৌঁছে দেন। ঋগ্বেদে অগ্নিকে ঋত্বিক, বিপ্র, পুরােহিত, অধ্বর্যু প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই বর্ণনায় তার দেব পুরােহিতের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। 
  • সােম : ঋগ্বেদের নবম মণ্ডল সােমের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। সােমের দু’টি ভূমিকা। তিনি আকাশের চাঁদরূপে আলাে দান করেন। (এই আলাে যে চাদের নিজস্ব নয়, সূর্যের প্রতিফলিত আলাে, তা ঋগ্বেদের ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন। (১ | ৮৪। ১৫)।))। আর সােমলতার অমৃতরসরূপে মানুষ ও দেবতাদের তৃপ্ত করেন। জেন্দ আবেস্তায় বলা হয়েছে, সােমরস পান করলে বিবিধ রােগের উপশম হয়, অমরত্ব লাভ করা যায়। 
  • সূর্য : আলাের দেবতা সূর্য। তিনি তার কিরণে স্বৰ্গ, পৃথিবী ও অন্তরীক্ষ আলােকিত করেন। বিশ্বচরাচরের প্রাণশক্তি তিনি। সূর্যের অপর নাম সবিতা। সবিতা শব্দের অর্থ প্রসবিতা, অর্থাৎ সূর্য বিশ্বস্রষ্টা। নিরুক্তকার যাস্কের ভাষায় সূর্য ‘সর্বস্য প্রসবিতা। সায়নাচার্য বলেন, উদয়ের পূর্বে সূর্যের যে মূর্তি তাই সবিতা আর উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত যে মূর্তি, তাই সূর্য।
  • যম : ঋগ্বেদের যম পৌরাণিক যমের মতাে নরকের অধিকর্তা নন, মৃত্যুদাতাও নন। তিনি পিতৃলােকের অধিকর্তা, পুণ্যকাজের জন্য মানুষকে পুরষ্কৃত করেন। যমী যমের যমজ বােন।
  • অদিতি ও আদিত্য : অন্যান্য দেব-দেবীদের মধ্যে আছেন অদিতি। তিনি দেবজননী। সকল দেবতা নন, বিশেষ কয়েকজন দেবতা আদিত্য নামে পরিচিত। তারা হলেন মিত্র, অর্যমা, ভগ, বরুণ, দক্ষ ও অংশ। আদিত্যরা সূর্যের বিভিন্নরূপ বা অবস্থা ছাড়া আর কিছু নন।
  • ত্বষ্টা, বিশ্বকর্মা, প্রজাপতি, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, দৌঃ, পৃথিবী, অপ, পূষণ, সরস্বতী, ঊষা : ত্বষ্টা দেবশিল্পী। ঋগ্বেদে বিশ্বকর্মার উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদের বিশ্বকর্মা সর্বদ্রষ্টা, সর্বনিয়ন্তা, পরমেশ্বর। প্রজাপতি বিশ্বস্রষ্টা। তাকে হিরণ্যগর্ভ বলা হয়েছে। অশ্বিনীকুমারদ্বয় হলেন দেববৈদ্য। তাদের নাসত্য ও দ্যও বলা হয়েছে। গ্রিক পুরাণে ক্যাস্টর ও পােল্যাকস নামে দু’জন যমজ দেবতার কথা বলা হয়েছে। অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে তাদের সঙ্গে তুলনা করা চলে। দৌঃ আকাশের দেবতা। তিনি দেবতাদের পিতা। পৃথিবী হলেন সকল দেবতা ও প্রাণীর জননী। দৌঃ ও পৃথিবী একত্রে দ্যাব-পৃথিবী নামে স্তুত হয়েছেন। জলের দেবতা অপ। অপের পুত্র বা পৌত্র অপাংনপাৎ। মন্ত্র বা যজ্ঞের অধিপতি বৃহস্পতি বা ব্ৰহ্মণস্পতি। পুষ্টির দেবতা পূষণ, নদীর দেবী সরস্বতী, প্রত্যুষ অর্থাৎ সূর্যোদয়ের পূর্বকালীন মুহূর্তের দেবী ঊষা।
  • ঋভু, বসু, যূপ : ঋগ্বেদের ঋষিরা ঋভুগণের বন্দনা করেছেন। সূর্যরশ্মি ঋভু, আবার আগ্নেয় জ্যোতিও ঋভু। ঋগ্বেদে বসুগণেরও স্তুতি আছে। সেখানে তারা গৌণ দেবতা, গান্ধার্ব বা অপ্সরাদের মতাে দেবকল্পপ্রাণী নন। সূর্যরশ্মিই বসুরূপে বন্দিত হয়েছে। ঋগ্বেদের বেশির ভাগ দেবতাই প্রাকৃতিক দেবতা। প্রকৃতির লীলা-বৈচিত্র্যরূপে তারা রূপায়িত। কিন্তু ঋগ্বেদে এমন দেবতাও আছেন যার সঙ্গে প্রকৃতির কোনও যােগ নেই। যজ্ঞীয় দ্রব্যও কখনও কখনও দেবতারূপে কল্পিত হয়েছে, যেমন যূপ। মানুষের অন্তর জগতের ভাবসমূহও দেবত্বে উন্নীত হয়েছে, যেমন ঘটেছে শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে।
  • লিঙ্গপূজা : ঋগ্বেদে লিঙ্গপূজকদের ‘শিশ্নদেব’রূপে আখ্যাত করা হয়েছে। শিশ্ন অর্থাৎ লিঙ্গ যাদের দেব বা দেবতা, তারা শিশ্নদেব, এভাবে শিশ্নদেব কথাটির ব্যাখ্যা করা যায়। ঋগ্বেদে শিশ্নদেবদের নিন্দা করা হয়েছে। অর্থাৎ এ সময় লিঙ্গপূজা প্রচলিত থাকলেও আর্য সমাজে তা সমাদৃত ছিল। ঋগ্বেদের লিঙ্গ নিছক সৃজনশক্তির প্রতীক, না সৃষ্টির দেবতারূপে কল্পিত আদি শিব জাতীয় দেবতার প্রতীকরূপে পূজিত হত, সে বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। 

ঋগ্বৈদিক আর্যদের ধর্মবিশ্বাসের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এখানে উল্লেখ করা যায় : 

  • ১. আর্যরা বহু দেব-দেবীর উপাসনা করতেন। দেব-দেবীর অস্তিত্ব তারা অনুভব করেছেন প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুতে, প্রকৃতির বিচিত্র লীলায়। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, আর্যদের ধর্মসাধনা মূলত প্রকৃতিরই উপাসনা। 
  • ২. বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেতন-অবচেতন সকল পদার্থে আর্যরা দেখেছেন প্রাণের স্পন্দন, অনুভব করেছেন অসীম শক্তির প্রকাশ। ফলে তাদের ধর্মবিশ্বাসে সর্বপ্রাণবাদ স্বভাবতই এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।
  • ৩. ঋগ্বেদে পুরুষ দেবতার তুলনায় নারী দেবতার ভূমিকা গৌণ। প্রেম ও সৌন্দর্যের নায়িকারূপে তাদের যা প্রতিষ্ঠা, দেবতারূপে তা ছিল না। প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু উপত্যকার ছবিটা কিন্তু ভিন্ন। সেখানে দেব ও দেবীর প্রায় সমান গুরুত্ব।
  • ৪. ঋগ্বৈদিক ঋষিদের চোখে বিশেষ কোনও দেবতা সর্বশ্রেষ্ঠ বলে প্রতিভাত হননি। যখন যে দেবতা স্তুত হয়েছেন তখন তাকেই প্রধানরূপে গণ্য করা হয়েছে। যখন তারা ইন্দ্রের বন্দনা করেছেন তখন ইন্দ্রকেই তারা বরুণ, মিত্র, তিনিই সব বলে স্তুতি করেছেন। আবার বরুণের অর্চনার সময় তারা বরুণকেও একই ভাবে বন্দনা করেছেন। এই যে এক এক সময় এক এক দেবতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশক্তিমান, পরমেশ্বর বলে ভাবা, একে ‘অনেক-একেশ্বরবাদ’ (henotheism) বলা যায়। এই ‘অনেক-একেশ্বরবাদ’ থেকেই পরবর্তিকালে একেশ্বরবাদের উদ্ভব হয়। বিভিন্ন দেব-দেবীকে একই নামে স্তুতি করার সময় মাঝে মাঝে আর্য ঋষিদের মনে সংশয় জেগেছে — হবি দিয়ে যাকে অর্চনা করা হচ্ছে, তিনি কোন্ দেবতা? ‘কস্মৈ দেবায়। হবিষা বিধেম’?
  • ৫. ঋগ্বেদে বহু দেবত্বের পাশাপাশি একেশ্বরবাদের সুরও ধ্বনিত হয়েছে। ঈশ্বর বিভিন্ন নাম ধারণ করলেও তিনি এক ও অদ্বিতীয় – এই ধারণা ঋগ্বেদে প্রতিফলিত। প্রথম মণ্ডলের সেই বিখ্যাত উক্তি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় – ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’। অর্থাৎ, একই সৎবস্তু কিন্তু বিপ্রগণ তাকে বহু নামে ডেকে থাকেন। (১।১৬৪।৪৬)। ঋগ্বেদের আর একটি বিখ্যাত উক্তি – ‘একং বা ইদং বিবভূব সর্ব’। অর্থাৎ, তিনি এক কিন্তু সকল রূপ ধারণ করেছেন। (৮।৫২।২)
  • ৬. ঋগ্বেদে দেব-দেবীর রূপ বর্ণনা আছে কিন্তু তখনকার দিনে যে মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল তার কোনও প্রমাণ নেই। 
  • ৭. আর্যদের ধর্মে যাগ-যজ্ঞের এক বিরাট ভূমিকা ছিল। আর্যরা মনে করতেন, যাগ-যজ্ঞ করলে দেবতারা প্রসন্ন হন, তারা মানুষের প্রার্থনা পূর্ণ করেন। আর্যদের বিশ্বাস ছিল, দেবতাদের সঙ্গে মানুষদের দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক। তারা মনে করতেন, দেবতারা যজ্ঞস্থানে উপস্থিত হয়ে হবি (অর্থাৎ ঘি, পুরােডাশ, পরমান্ন ও পশু), সােমরস ও শ্রদ্ধা গ্রহণ করেন এবং প্রতিদানে তারা যজমানকে যুদ্ধে সাফল্য, দীর্ঘজীবন, সন্তান, গােধন ও সম্পদের আশ্বাস দেন। পুরােহিতদের কাজ ছিল দেবতাদের যজ্ঞস্থানে আহ্বান করা বা তাদের নিকট হবি পৌঁছে দেওয়া। তারাই ছিলেন যজ্ঞের প্রাণপুরুষ। যাগ-যজ্ঞের গুরুত্ব ক্রমশ বেড়েই চলে। শেষে লােকদের বিশ্বাস জন্মে, যজ্ঞের মধ্য দিয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে, যজ্ঞের সফল অনুষ্ঠানের উপরই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব নির্ভর করছে। এ ধরনের বিশ্বাসের ফলে যাগ-যজ্ঞের ব্যাপকতা। ও জটিলতা উভয়ই দ্রুত বেড়ে চলে। 
  • ৮. এ যুগে লিঙ্গপূজা প্রচলিত ছিল কিন্তু আর্যসমাজে এই উপাসনা নিন্দনীয় ছিল।
  • ৯. এ যুগের শেষের দিকে বিশেষজ্ঞ পুরােহিতদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। পুরােহিতদের মধ্যে ‘হােতা’ প্রধান ছিলেন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন (১) পােতা (২) নেষ্টা (৩) অগ্নীধ্র (৪) প্রশাস্তা বা উপবক্তা বা মৈত্রাবরুণ (৫) অধ্বর্যু (৬) ব্রহ্মা (৭) উদ্গাতা (৮) প্রস্তোতা এবং (৯) প্রতিহর্তা। 

পরবর্তী বৈদিক যুগ

ইতিহাসের উৎস

১০০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত যে সময় তা পরবর্তী বৈদিক যুগ নামে পরিচিত। এই যুগের ইতিহাস বিধৃত আছে সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ গ্রন্থাবলিতে। তাছাড়া এ যুগের অল্পবিস্তর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও আছে। এসব নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে অত্রঞ্জিখেড়া, হালুর, নােহ, হস্তিনাপুর, কৌশাম্বী, আলমগীরপুর প্রভৃতি স্থানে। কিন্তু এ যুগের ইতিহাস রচনায় সাহিত্যিক উপাদানের যে গুরুত্ব, প্রত্নতত্ত্বের তা নেই।

আর্য বসতি-বিস্তার

জনপদের পত্তন ও রাজ্যের উদ্ভব : ঋগ্বেদের যুগে আর্যরা পূর্বদিকে সরযু নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু কালক্রমে আর্যদের লােকসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া গােচারণ ভূমি ও বনজ সম্পদেরও অভাব দেখা দেয়। ফলে তারা নতুন অঞ্চলে বসতি বিস্তারের প্রয়ােজন অনুভব করেন। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার দক্ষিণে রাজস্থানের মরু অঞ্চল। ফলে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হতে সােজা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর না হয়ে তারা পূর্বদিকে যমুনা এবং গঙ্গার অববাহিকায় প্রবেশ করেন। সেখানকার জঙ্গল আগুনে পুড়িয়ে তারা সে অঞ্চল বাসযােগ্য করে তােলেন। যজুর্বেদে দেখা যায়, আর্যরা দেবতার কাছে বৃষ্টি, ফসল, লােহা, ব্রোঞ্জ ও তামা প্রার্থনা করছেন। গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় উর্বরা মাটি এবং তামা,ও লােহার প্রাচুর্য পূর্ব ভারতে আর্যদের বসতি বিস্তারের পথ সুগম করে। ঋগ্বেদের যুগে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা ছিল আর্য সভ্যতার কেন্দ্র। কিন্তু এই পর্বে সেই কেন্দ্র গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় সরে আসে। এই ভূখণ্ডের কাশী, কোসল, বিদেহ প্রভৃতি অঞ্চলের কথা বার বার পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে। বারাণসী ও তার পার্শ্ববর্তী ভূখণ্ড নিয়ে কাশী অঞ্চল গড়ে উঠে। কোসলের অবস্থিতি ছিল অযােধ্যা-ফৈজাবাদ অঞ্চলে। বিদেহ উত্তর বিহারের তিরহুতে অবস্থিত ছিল। মগধ বা অবিভক্ত পাটনা-গয়া জেলা, অঙ্গ বা ভাগলপুর অঞ্চল ও বঙ্গ বা দক্ষিণ বাংলার কথাও বলা হয়েছে তবে এ যুগের একেবারে শেষের দিকেই আর্যরা সেসব অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বসবাস শুরু করেন। শতপথ ব্রাহ্মণে একচক্রা, কাম্পীল, আসন্দীবৎ, কৌশাম্বী প্রভৃতি উত্তর ভারতের কয়েকটি শহরের উল্লেখ আছে। একচক্রা ও কাম্পীল শহর দু’টি পরস্পরের কাছাকাছি ছিল। উত্তরপ্রদেশে ফারুখাবাদের নিকট কামপিল নামে একটি গ্রাম আছে। এই গ্রামটিই সম্ভবত প্রাচীন কাম্পীল। হস্তিনাপুরের এক নাম আসন্দীবৎ। এলাহাবাদের নিকটবর্তী বর্তমান কৌশাম্বীই প্রাচীন যুগের কৌশাম্বী। কৌশাম্বী যে জেলায় অবস্থিত সেটিও কৌশাম্বী নামে পরিচিত। 

পূর্ব ভারতে আর্য বসতি বিস্তারের এক পথিকৃৎ বিদেঘ মাথব। তিনি সরস্বতী উপত্যকায় বাস করতেন কিন্তু পরে সদানীরা নদী পার হয়ে উত্তর বিহারের তিরহুত অঞ্চলে এসে উপস্থিত হন। তিনি বিদেহ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গােতম রাহুগণ নামে এক পুরােহিত তাকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন। এ সময় আর্যরা দক্ষিণ দিকে নর্মদা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। দক্ষিণ ভারতে তখন শবর, পুলিন্দ, অন্ধ্র প্রভৃতি নানা অনার্য জাতি বাস করতেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের ঋষি সমগ্র আর্য-অধ্যুষিত অঞ্চলকে বা তার জানা ভারতবর্ষকে পাঁচটি অঞ্চলে বিভক্ত করেছেন। ভাগ পাঁচটি হল ধ্ৰুবা মধ্যমা প্রতিষ্ঠা দিশ্‌ বা মধ্যদেশ, প্রাচী দিশ্‌ বা পুর্ব দেশ, দক্ষিণ দিশ্‌ বা দক্ষিণাঞ্চল, প্রতীচী দিশ্‌ বা পশ্চিমাঞ্চল এবং উদীচী দিশ্‌ বা উত্তর খণ্ড। এই অঞ্চলগুলোর প্রকৃত পরিসীমা ও আয়তন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

জনপদের পত্তন ও রাজ্যের উদ্ভব : পরবর্তী বৈদিক যুগের প্রথম পর্বে বিভিন্ন জনগােষ্ঠীগুলো উপজাতিস্তরেই থেকে যায়। কিছু পরিমাণে কৃষিকার্য হলেও পশুচারণই ছিল আর্যদের প্রধান উপজীবিকা। যে যাযাবর জীবন যাপনে আর্যগণ এতদিন অভ্যস্ত ছিলেন তার কোনও লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটল না। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষের দিকে পশুচারণভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা কমে আসে, কৃষি-অর্থনীতির প্রসার ঘটে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ হয়। ব্যক্তিগত মালিকানার সুপ্রতিষ্ঠা হয়। নির্দিষ্ট এক ভূখণ্ড জুড়ে স্থায়িভাবে বসবাসের প্রবণতা বাড়ে। জনগােষ্ঠীতে জনগােষ্ঠীতে সংমিশ্রণ ঘটে। ফলে বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর মানুষদের একই অঞ্চলে মিলিতভাবে বসবাসের এক অনুকূল পরিবেশ রচিত হয়। এই ভাবে এক একটি অঞ্চল বা জনপদকে কেন্দ্র করে এক একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। গােষ্ঠীপতিরা তাে পূর্ব থেকেই ছিলেন। কিন্তু ঋগ্বেদের যুগের পর এই যেসব পরিবর্তন ঘটে গেল তার ফলে অনেক গােষ্ঠীপতি নিশ্চিহ্ন হলেন, কেউবা পদমর্যাদা হারিয়ে ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে মিশে গেলেন। আর যেসব গােষ্ঠীপতিরা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে রইলেন তারাই নবােদিত রাষ্ট্রের রাজা বা কর্ণধারের নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। রাজপদ নতুন ব্যঞ্জনা পেল। ঋগ্বেদের রাজা ছিলেন গােষ্ঠীপতি। কিন্তু এই যুগের শেষপর্বে গােষ্ঠীপতি পরাক্রান্ত ভূপতিরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। এই সময় যে কটি রাজা-শাসিত রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করল তাদের মধ্যে কুরু, পাঞ্চাল, বশ, মৎস, মদ, গান্ধার, কেকয়, উশীনর, কোসল, কাশী ও বিদেহ রাজ্যগুলো বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

কুরু-পাঞ্চালাদি রাজ্য ও কয়েকজন বিখ্যাত রাজা : কুরু রাজ্যটি গড়ে ওঠে ভরত ও পুরু এই দু’টি বিখ্যাত জনগােষ্ঠীর সংমিশ্রণে। তৃৎসুরাও সম্ভবত এই দুটি উপজাতির সঙ্গে মিশে যান। থানেশ্বর-দিল্লি অঞ্চলে কুরু রাজ্য অবস্থিত ছিল। অথর্ববেদে পরীক্ষিৎ নামে এক পরাক্রান্ত কুরুরাজের উল্লেখ আছে। এই রাজ্যের আর এক রাজা জন্মেজয়। তিনি পরীক্ষিতের বংশধর। তুর্বশ ও ক্রিবি এই দু’টি জনগােষ্ঠীর মিলনে পাঞ্চাল রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। বেরিলী-ফারুখাবাদ অঞ্চলে এই রাজ্যটি অবস্থিত ছিল। উপনিষদে প্রবাহণ জৈবলি নামে পাঞ্চালের এক দার্শনিক রাজার উল্লেখ আছে। কৌশাম্বী ও সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে বশ রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই রাজ্যটি পরবর্তিকালে বৎস নামে পরিচিত হয়। কুরু রাজ্যের দক্ষিণে ছিল মৎস্য রাজ্য। শতপথ ব্রাহ্মণে ধ্বসন্‌ দ্বৈতবন নামে এক পরাক্রান্ত মৎস্য রাজার কথা বলা হয়েছে। মদ্র নামে অন্তত দু’টি রাজ্য ছিল। একটি কাশ্মীরে, সেটি উত্তর মদ্র। অন্যটি পশ্চিম পাঞ্জাবের শিয়ালকোট ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে, সেটি দক্ষিণ মদ্র বা আদি মদ্র। বেদজ্ঞ বলে মদ্রদের খ্যাতি ছিল। পাকিস্তানের পেশােয়ার ও রাওয়ালপিণ্ডি অঞ্চলে গান্ধার রাজ্য গড়ে ওঠে। নগ্নজিৎ নামে গান্ধারের এক রাজার কথা ঐতরেয় ব্রাহ্মণ থেকে জানা যায়। কেকয় রাজ্যটি পশ্চিম পাঞ্জাবে অবস্থিত ছিল। শতপথ ব্রাহ্মণ ও ছান্দোগ্য উপনিষদে অশ্বপতি নামে এক বিদ্বান কেকয়রাজের কথা বলা হয়েছে। উশীনর রাজ্য সম্ভবত দেরাদুন-ঋষিকেশ অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, কৌষীতকি উপনিষদ ও গােপথ ব্রাহ্মণে এ রাজ্যের কথা বলা হয়েছে। অযােধ্যা ফৈজাবাদ অঞ্চলে কোসল রাজ্যের পত্তন হয়। শতপথ ব্রাহ্মণে হিরণ্যনাভ নামে এক পরাক্রান্ত কোসলরাজের উল্লেখ আছে। বারাণসী অঞ্চলে কাশী রাজ্যের অভ্যুদয় হয়। শতপথ ব্রাহ্মণে ধৃতরাষ্ট্র নামে একজন কাশীনৃপতির কথা আছে। উপনিষদ থেকে অজাতশত্রু নামে আর একজন কাশীরাজের কথা জানা যায়। প্রতিবেশী কোসলরাজ্যের সঙ্গে কাশীরাজ্যের প্রায়ই সংঘর্ষ হত। উত্তর বিহারের তিরহুত অঞ্চলে বিদেহ রাজ্যটি গড়ে ওঠে। বিদেহের রাজা ছিলেন জনক। জ্ঞানী বলে তাকে উপনিষদে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।

রাজকীয় অভিধা : এখানে একটি কথা বলার আছে। উপরে যে রাজ্যগুলোর কথা বলা হয়েছে। তাদের কোনওটিকেই বৃহৎ আখ্যা দেওয়া যায় না। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে সম্রাট, স্বরাট, বিরাট, ভােজ ইত্যাদি রাজকীয় অভিধা আছে। বৈদিকোত্তর যুগে বৃহদায়তন রাজ্যের অধিপতিরা এই সকল অভিধা ধারণ করতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযােজ্য নয়। সে সময় কোনও বৃহদায়তন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই হয়নি। সে ক্ষেত্রে সম্রাট, স্বরাট ইত্যাদি অভিধাগুলোকে রাজারই প্রতিশব্দরূপে গণ্য করতে হবে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের একটি উক্তি থেকেও এই সিদ্ধান্তের সমর্থন মেলে। সেখানে বলা হয়েছে, পূর্ব দেশের রাজাদের ‘সম্রাট’ বলা হত, দক্ষিণের রাজারা ‘ভােজ’ নামে পরিচিত ছিলেন, উত্তরের রাজাদের ‘বিরাট’ আখ্যা দেওয়া হত, মধ্যদেশের নৃপতিরা ‘রাজা’ বলে অভিহিত হতেন।

পরবর্তী বৈদিক যুগে (আ. খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ – ৫০০ অব্দ) ইন্দো-আর্যদের বিস্তার ও বিভিন্ন জনপদের সৃষ্টি

রাজনৈতিক জীবন

রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজার ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। রাজা এখন আর ভ্রাম্যমান গােষ্ঠীর নিছক এক দলপতি নন, তিনি বিভিন্ন গােষ্ঠী অধ্যুষিত এক নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিপতি। রাজ্যের সর্বত্র তার সার্বভৌম ক্ষমতা প্রসারিত। তিনি রাজ্যের অন্য দশ জনের মতাে নন। শতপথ ব্রাহ্মণে রাজাকে প্রজাপতি ব্রহ্মার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি বলা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, দেবত্বের অধিকারী হওয়ায় রাজা একা হয়েও অনেককে শাসন করেন। তৈত্তিরীয় সংহিতায় রাজাকে নিছক প্রজাপতির প্রতিনিধি বলা হয়নি, তাকে প্রজাপতির সঙ্গে অভিন্ন বলে কল্পনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে, রাজপদ লাভ করলেই রাজা প্রজাপতি হন। না, প্রজাপতি হতে হলে রাজাকে রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে হয়।

শক্তিশালী রাজতন্ত্র : বলা বাহুল্য, তখনকার দিনের শক্তিশালী রাজারা নিজেদের পরাক্রম ও বৈভব প্রকাশের জন্য এই দু’টি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতেন। রাজসূয় এক ধরনের অভিষেক অনুষ্ঠান। তবে এ অনুষ্ঠান সাধারণ রাজ্যাভিষেক নয়, পরাক্রান্ত শক্তিরূপে রাজার আত্মপ্রকাশের এক বর্ণাঢ্য আয়ােজন। এই অনুষ্ঠানে পুরােহিত রাজাকে অভিষিক্ত করেন। তারপর রাজা বাঘছালের উপর তার পা দুখানি স্থাপন করেন। রাজা যে ব্যাঘ্রের মতাে বলবান তারই ব্যঞ্জনা এখানে পরিস্ফুট। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে রাজা এক নকল গােহরণে অংশগ্রহণ করেন। তির-ধনুক হাতে তিনি চার দিকে এক পা করে অগ্রসর হন। তার এই এক পা করে চারদিকে পদচারণার অর্থ তার চতুর্দিকে আধিপত্য দাবি করা। রাজার পাশা খেলার মধ্য দিয়ে রাজসূয় যজ্ঞের সমাপ্তি ঘটত। অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠানকালে যজ্ঞের ঘােড়া এক বছর স্বেচ্ছায় বিচরণ করত। তাকে অনুসরণ করতেন একদল বাছাই করা সৈন্য। ঘােড়া কোথাও বাধা পেলে যুদ্ধ হত। আর বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে বৎসরান্তে ঘােড়া নিরাপদে যজ্ঞস্থানে ফিরে এলে তাকে বলিদান করা হত। যে অঞ্চলগুলো পাড়ি দিয়ে ঘােড়া ফিরে আসত সে অঞ্চলগুলো যজমান রাজার অধিকৃত বলে গণ্য হত। সন্দেহ নেই, অশ্বমেধের মতাে যজ্ঞের অনুষ্ঠান সে কালের আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তুলেছিল।

বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র : রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির অর্থ রাজপদের উপর বংশানুক্রমিক কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা। দশ পুরুষ ধরে এক পরিবারের লােকেরা রাজত্ব করেছেন (দশপুরুষ রাজ্যম) শতপথ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এরূপ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ আছে। রাজার মৃত্যুর পর সাধারণত তার জ্যেষ্ঠ পুত্রই সিংহাসনে আরােহণ করতেন। তবে রাজা অত্যাচারী বা অকর্মণ্য হলে প্রজারা অনেক সময় তাকে পদচ্যুত করতেন। অথর্ববেদে ও ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থে এরূপ অনেক ঘটনার নজির আছে। সৃঞ্জয়রা তাদের রাজা দুষ্টরীতু পৌংসায়নকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। দুষ্টরীতু পৌংসায়ন ও তার পূর্বপুরুষরা দশ পুরুষ ধরে রাজত্ব করেছিলেন। তাণ্ড্য ব্রাহ্মণে এক রাজদ্রোহী পুরােহিতের কথা আছে। তিনি এক অত্যাচারী রাজার শাসনের অবসান ঘটাতে রাজ্যের বৈশ্যদের প্ররােচিত করেন। কোনও রাজাকে পদচ্যুত করা হলে সাধারণত তারই পরিবারের অন্য কাউকে সিংহাসনে বসানাে হত।

রাজশক্তির সীমাবদ্ধতা : রাজার ক্ষমতা বাড়ছিল ঠিকই তবু তা নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠেনি। কারণ –

  • কোনও কাজে হাত দেওয়ার পূর্বে তাকে প্রজাদের প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে হত। প্রজাদের অসন্তোষ রাজার পক্ষে কত মারাত্মক হতে পারে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে তার অজস্র নিদর্শন আছে। 
  • ধর্মের অনুশাসন মেনেই রাজা রাজ্য শাসন করতেন। ধর্ম সকলের উপরে। সমাজ তথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সবকিছু ধর্মই ধারণ করে আছে। এই বিধান অলঙ্ঘনীয়। রাজা নিজে ধর্মের বিধান দিতে পারতেন না, ধর্মের ব্যাখ্যা করার অধিকারও তার ছিল না। তিনি তার রাজ্যের মধ্যে ধর্মের অনুশাসন কার্যকর করতেন। 
  • ঠিক আগের মতাে তত গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এ যুগেও সভা ও সমিতির একটা প্রভাব তাে ছিলই। সভা ও সমিতির এই প্রভাবের আভাস আছে তাথর্ববেদ ও শতপথ ব্রাহ্মণে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা যেন তাকে সর্বপ্রকার সাহায্য করেন, জনৈক রাজার এই আশার কথাও সে ব্রাহ্মণে ব্যক্ত হয়েছে। অথর্ববেদে রাজাকে সভা ও সমিতির সঙ্গে সংঘর্ষের পথে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এতেও তখনকার দিনে রাজনীতির ক্ষেত্রে এই দুই সংস্থার গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়েছে। 
  • সকলে না হলেও সে যুগের কোনও কোনও রাজা মনে করতেন, স্বাধিকার নয়, অছি বা ন্যাসরক্ষকরূপেই তারা রাজত্ব ভােগ করতেন। তারা সিংহাসনে বসেছেন। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, প্রজাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য, প্রজাদের রক্ষণা বেক্ষণের জন্য।

সে যুগের রাজাদের বেশির ভাগ সময় যুদ্ধ-বিগ্রহে কাটলেও তাদের অনেকেই জ্ঞানে, গুণে ও বিদ্যাবত্তায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। অনেক বিদ্বান ও গুণবান ব্রাহ্মণ তাদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তেজস্বিতার সঙ্গে জ্ঞানের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল তাদের চরিত্রে। ব্রাহ্মণে, উপনিষদে এরূপ কয়েকজন রাজর্ষির উল্লেখ আছে।

আমলাতন্ত্র : শাসনাদি কাজে রাজার সহযােগী রূপে এক শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের উদ্ভব হয়। রাজার অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল ছিলেন বলে আমলারা ‘রত্ন’ বলে গণ্য হতেন। তৈত্তিরীয়। ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় সংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থে এরূপ ১০ জন রত্নের উল্লেখ আছে। এরা হলেন পুরােহিত, সূত, মহিষী, পরিবৃত্তী, বাবাতা, সংগ্রহীতৃ, অক্ষাবাপ, সেনানী, গ্রামণী ও ভাগদুঘ। এদের মধ্যে মহিষী, পরিবৃত্তী ও বাবাতা হলেন রাজার তিন পত্নী। রাজ্যশাসনে এই তিন রানি কী ভূমিকা পালন করতেন তা জানা যায় না। সেনানী, গ্রামণী ও পুরােহিত ঋগ্বেদের যুগেও ছিলেন। যে গ্রামণীকে রাজার রত্ন বলে গণ্য করা হত তিনি পদমর্যাদায় অন্য গ্রামণীদের উপরে ছিলেন। সংগ্রহীতৃকে অনেকে কোষাধ্যক্ষ বলে মনে করেন। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। তখনকার দিনে মুদ্রার প্রচলন ছিল না। সুতরাং রাজার কোষাগারও ছিল না। সংগ্রহীতৃকে রাজার ভাণ্ডাগারিক বলেই ভাবা উচিত। অক্ষ বা পাশা ক্রীড়া বিভাগের অধ্যক্ষ অক্ষাবাপ। রাজার রথচালক ও ভ্রমণসঙ্গী যিনি তিনিই সূত। রাজস্ব যিনি সংগ্রহ করেন তিনিই ভাগদুঘ। শতপথ ব্রাহ্মণে ক্ষতৃ (রাজ পরিবারের সরকার), গােবিকর্তন (রাজার শিকারের সঙ্গী) ও পালাগল (দূত) নামে আরও তিন রত্নের উল্লেখ আছে। মৈত্রায়ণী সংহিতা থেকে তরুণ বা ছুতার এবং রথকার নামে আরও দুই রত্নের কথা জানা যায়। রত্ন নন অথচ গুরুত্বপূর্ণ, এরূপ এক কর্মচারী স্থপতি। তিনি সম্ভবত প্রধান বিচারপতি ছিলেন। আবার তিনি সীমান্ত অঞ্চলের অধিকর্তাও হতে পারেন। এই সকল কর্মচারীদের রাজাই নিয়ােগ করতেন। তবু রাজার উপর এদেরও একটা প্রভাব ছিল। শতপথ ব্রাহ্মণে সূত ও গ্রামণীকে ‘রাজকৃৎ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যিনি রাজপদে নিযুক্ত করেন তিনিই রাজকৃৎ।

বিচার ব্যবস্থা : বিচার ব্যবস্থায়ও রাজার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তবে সব বিচারের ভার নিজের হাতে না রেখে কিছু কিছু বিচারের দায়িত্ব তিনি অধ্যক্ষদের উপর ছেড়ে দিতেন। ‘গ্রাম্যবাদী’ নামে এক শ্রেণির বিচারকদের উপর গ্রামের ছােটো ছােটো মামলার বিচারের ভার ছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার সততা প্রমাণের জন্য হাতে আগুন বা গরম লােহা রেখে কঠোর পরীক্ষা দিতে হত। লােকদের বিশ্বাস ছিল, দোষী হলেই হাত পুড়বে, অন্যথায় নয়। চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, নরহত্যা, মদ্যপানের মতাে অপরাধমূলক ঘটনাগুলো তখনকার দিনে সচরাচর ঘটত। অপরাধীকে বেশ কঠিন শাস্তিই দেওয়া হত। কোনও চোর হাতে-নাতে ধরা পড়লে হয় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত, নয় তার হাত দুখানি কেটে ফেলা হত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অপহৃত দ্রব্য ফেরত দিলেই চোরকে ছেড়ে দেওয়া হত।

রাজস্ব : এ সময় থেকে নিয়মিত কর আদায়ের ব্যবস্থা চালু হয়। প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যয় নির্বাহের জন্য নিয়মিত কর প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে। এই নিয়মিত করকে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘বলি’ বলা হয়েছে। ‘বলি’ ঋগ্বেদেও ছিল। কিন্তু তখন বলি দেওয়া বা না-দেওয়া দাতার ইচ্ছার উপরই নির্ভর করত। যা ছিল ঐচ্ছিক তা এখন হল আবশ্যিক। প্রজাদের সকলেই যে রাজাকে ‘বলি’ দিতেন তা নয়। যাজন ও অধ্যাপনা ছিল ব্রাহ্মণদের জীবিকা। ক্ষত্রিয়রা ছিলেন যুদ্ধোপজীবী। ধনােৎপাদনের সঙ্গে এরা কেউ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না কর প্রদানের দায়িত্ব থেকে। এদের সম্ভবত রেহাই দেওয়া হয়েছিল। কৃষি-শিল্পোপজীবী ও বণিক সম্প্রদায়ের লােকেরাই প্রধানত করভার বহন করতেন। অথর্ববেদে প্রদেয় বলির পরিমাণ এক-ষােড়শ অংশে ধার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ উৎপন্ন ফসলের ক্ষেত্রে মােট উৎপাদনের এক-ষােড়শ অংশ ও বাণিজ্যিক পণ্যের ক্ষেত্রে মুনাফার এক-ষােড়শ অংশ রাজভাণ্ডারে জমা দিতে হত। বলি দিতে হত জিনিসে, মুদ্রায় বা টাকায় নয়। টাকার ব্যবহার তখনও চালু হয়নি।

সমাজ-জীবন

ঋগ্বেদের যুগে যেমন এ যুগেও তেমনি সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার বা কুল। পরিবার ছিল একান্নবর্তী। পিতা বা তার অবর্তমানে জ্যেষ্ঠ পুত্র পরিবারের অভিভাবক হতেন। পরিজনদের ওপর অভিভাবকের অপ্রতিহত কর্তৃত্ব ছিল। পিতা পুত্রকে বিক্রি করছেন, ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এ রকম ঘটনারও বর্ণনা আছে। তবে অভিভাবকের সঙ্গে পরিবারের সকলের সম্পর্ক ছিল স্নেহ ও প্রীতির। এক এক পরিবারে সাধারণত তিন পুরুষের পরিজনেরা বাস করতেন। দত্তক গ্রহণের রীতি ছিল। অনেক সময় সন্তান থাকলেও পিতা দত্তক গ্রহণ করতেন। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ভ্রাতৃকলহের উল্লেখ বিরল নয়। বড়দের পূর্বে ছােটোদের বিবাহ নিন্দনীয় ছিল। পুত্র কন্যাদের বিবাহে পিতা সাধারণত হস্তক্ষেপ করতেন না। গৃহস্থকে উদ্দেশ্য করে তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে, “অতিথি দেবাে ভব”। অর্থাৎ অতিথিকে দেবতাজ্ঞান করাে। তখন আতিথেয়তাকে পরিবারে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া হত, এই উক্তিই তার প্রমাণ।

জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব ও বিকাশ : এই যুগে সমাজ-জীবনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যায়। এই সময় বর্ণ বা জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব হয় এবং তা ধীরে ধীরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের জীবন ছিল সহজ ও অনাড়ম্বর – সেখানে বৈষম্য বড় একটা দেখা দিত না। কিন্তু পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে বসতি বিস্তার ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনে জটিলতা বাড়ে। আত্মরক্ষা ও প্রভুত্ব বিস্তারের স্বার্থে যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। এর জন্য যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী সর্বক্ষণের জন্য একদল কর্মীর প্রয়ােজন হয়। যাগ-যজ্ঞাদিও খুবই জটিল হয়ে পড়ে। বিশেষ দক্ষ লােক ছাড়া অন্য কারাের পক্ষে যাজনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হল না। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের কাজেও বিশেষ ধরনের দক্ষতার আবশ্যক হয়। ফলে বিশেষ বিশেষ বৃত্তিকে কেন্দ্র করে বিশেষ বিশেষ গােষ্ঠী বা শ্রেণি গড়ে উঠল। যারা যজন, যাজন, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত হলেন তারা ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হন। যুদ্ধোপজীবীরা ক্ষত্রিয় বলে গণ্য হলেন। কৃষি, বাণিজ্য, শিল্পের মতাে উৎপাদনমূলক কাজে যারা জড়িত ছিলেন তারা হলেন বৈশ্য। সমাজে সকলের নিচে যারা পড়ে রইলেন তাদের নিয়ে শূদ্ৰবৰ্ণ গড়ে উঠল। এই ভাবে গুণ ও বৃত্তি বা কর্ম অনুসারে সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, এই চারটি বর্ণ বা জাতির সৃষ্টি হল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বর্ণ কথাটি আর গাত্রবর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হল না, সামাজিক বিভাগ বােঝাতেই ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রথম প্রথম বর্ণান্তরের ঘটনা অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল। (শতপথ ব্রাহ্মণে (১০, ৪, ১, ১০) দেখা যায় শ্যাপর্ণ সত্যকামের কোনও পুত্র ব্রাহ্মণ, কোনও পুত্র ক্ষত্রিয় এবং কোনও পুত্র বৈশ্য ছিলেন।)। কিন্তু বৃত্তিগুলো দক্ষতামূলক হওয়ায় এগুলো সহজেই পিতা-পুত্র পরম্পরায় অনুসৃত হতে থাকে ফলে বৃত্তিগুলো বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। বর্ণান্তরের ঘটনা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। পংক্তি ভােজন ও অসবর্ণ বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। বর্ণপ্রথা কঠোর ও জন্মগত হয়ে দাঁড়ায়। মূল চারটি বর্ণ থেকে কতকগুলো উপশ্রেণির উদ্ভব হয়। উপশ্রেণিগুলো কোনও স্বতন্ত্র বর্ণ সৃষ্টি করেনি, তারা কোনও না কোনও প্রচলিত বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হয়। উপশ্রেণিগুলোর উদ্ভবের পেছনে কতকগুলো কারণ ছিল। প্রথমত, কয়েকটি শিল্পী সংস্থা কঠোরতার সঙ্গে পুরুষানুক্রমে তাদের পৈতৃক বৃত্তি অনুসরণ করতে থাকে। কালক্রমে এই সংস্থাগুলো এক একটি জাতিতে পরিণত হয়। ছুতার, কর্মকার, মুচি, ধীবর ইত্যাদি জাতির উদ্ভব এই ভাবেই হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অসবর্ণ বিবাহের ফলেও বিভিন্ন জাতির উদ্ভব হয়েছে। পিতা-মাতার অসবর্ণ বিবাহ হলে তাদের সন্তান এক স্বতন্ত্র জাতির পরিচয় লাভ করতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনও ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে শুদ্রের বিবাহ হলে তাদের সন্তান ‘চণ্ডাল’ অ্যাখ্যা পেতেন।

ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় : পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বর্ণে বর্ণে বৈষম্যের ছবি সুস্পষ্ট। সমাজে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। যাগ-যজ্ঞের গুরুত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই সমাজে পুরােহিত তথা ব্রাহ্মণের প্রাধান্য বাড়ে। সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলে ক্ষত্রিয়ের প্রভাবও বৃদ্ধি পায়। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এই শ্রেণি দুটি পরস্পরের ওপর আশ্রয় করে উন্নতি লাভ করে। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধির জোরালাে সমর্থক ছিলেন। ক্ষত্রিয়ও প্রতিদানে নানা ভাবে ব্রাহ্মণকে অনুগ্রহ প্রদর্শন করতেন। ব্রাহ্মণকে ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ক্ষত্রিয়দের প্রতিনিধিরূপে রাজাও দেবত্বের স্বীকৃতি পান। আর একটি কারণে ব্রাহ্মণের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। অন্য কোনও বর্ণের লােক সরাসরি দেবতার সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করতে পারেন না, দেবতাকে নিজের হাতে অর্থ দেওয়ার অধিকার তার নেই। এই অধিকার শুধু ব্রাহ্মণেরই আছে, দেবতা ও মানুষের মধ্যে তিনি মিলনসেতু রচনা করেন। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সম্পর্ক সহযােগিতামূলক হলেও কখনও কখনও তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও দেখা দিত। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও কাঠক সংহিতায় ক্ষত্রিয়কে ব্রাহ্মণের চেয়ে উঁচু আসন দেওয়া হয়েছে। অবশ্য বাজসনেয়ি সংহিতা, শতপথ, ঐতরেয় ও পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণকেই শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বের মূলে ছিল তাদের পাণ্ডিত্য ও অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা।

বৈশ্য ও শূদ্র : ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়দের কেউই সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। রাজ্যের সম্পদ ও খাদ্য উৎপাদন মূলত যাদের উপর নির্ভর করত তারা হলেন বৈশ্য। বৈশ্যদের যতটা আর্থিক সংগতি ছিল ততটা তাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। রাজা ও রাজকর্মচারীদের ভরণ পােষণের ভার তাদেরই গ্রহণ করতে হত। তাদের উপর রাষ্ট্রের দাবি ছিল অত্যধিক। রাষ্ট্রের স্বার্থে তাদের প্রকারান্তরে শােষণই করা হত। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বৈশ্যদের এক করুণ ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে তাদের বলি বা কর দাতারূপে (অন্যস্য বলিকৃৎ) বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে অন্যে অর্থাৎ রাজা তাদের ভক্ষণ করেন (অন্যস্যাদ্যো), যথেচ্ছ অত্যাচার করেন। (যথাকামজ্যেয়ঃ)। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রাজাকে ‘বিশামাত্তা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যিনি ‘বিশ’ ভক্ষণ করেন তিনিই ‘বিশামাত্তা’। ‘বিশ’ বলতে এখানে বৈশ্যদের বােঝানাে হয়েছে। কায়িক শ্রমের প্রতিব্রাহ্মণদের অশ্রদ্ধা ছিল। সেই কারণে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বৈশ্যদের প্রতি তাচ্ছিল্যের মনােভাব প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া, বৈশ্যদের কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য প্রভৃতি বৃত্তির খাতিরে শূদ্রদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসতেই হত। শূদ্রদের সঙ্গে বৈশ্যদের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তখনকার দিনের সমাজপতিরা সুনজরে দেখেননি। সমাজে শূদ্রদের অবস্থা ছিল মর্মান্তিক। তারা রাজ্যের সর্বত্র কায়িক শ্রমের জোগান দিতেন। রাজ্যের সম্পদ ও খাদ্য উৎপাদনে তাদের বিরাট ভূমিকা ছিল। অথচ তাদের পীড়ন (অন্যস্য প্রেষ্যঃ), উৎখাত করা হত (যথাকামােখাপ্যঃ), যথেচ্ছ অত্যাচার করা হত (যথাকামবধ্যঃ)। সাধারণের দৃষ্টিতে তারা অশুচি ছিলেন। তাদের গাভি দোহন করতে দেওয়া হত না। যজ্ঞস্থানে বা কোনও শুভ অনুষ্ঠানে তাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। তখন প্রতিনিয়ত আদিবাসী গােষ্ঠীর আর্য সমাজে সংযুক্তির ফলে শূদ্রদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল।

ব্রাত্য ও নিষাদ : সে যুগে ব্রাত্য ও নিষাদ নামে দুটি পৃথক জনগােষ্ঠী ছিল। ব্রাত্যরা সম্ভবত আর্য ছিলেন। কিন্তু তারা বেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না, কৃষিকার্যকেও সুনজরে দেখতেন না। পুরানাে বৃত্তি পশুপালনকেই তারা আঁকড়ে থাকেন। ব্রাত্য কথাটি ব্রত শব্দ থেকে নিষ্পন্ন। ব্রত থেকে পতিত অর্থাৎ বিধিবিরােধী গােষ্ঠী এই অর্থে ব্রাত্য। আবার কেউ কেউ বলেন, “ব্রাত্য” শব্দ থেকেই ব্রাত্য পদ নিষ্পন্ন হয়েছে। ‘ব্রাত’ শব্দের অর্থ দল। নিষাদরা ছিলেন অনার্য। এখন যাদের ভিল বলে নিষাদরা ছিলেন তাদেরই পূর্বপুরুষ। তারা ব্রাত্যদের মতাে পশুপালনেই অভ্যস্ত ছিলেন।

নারী : এ যুগে নারীর মর্যাদা বিশেষভাবে ক্ষুন্ন হয়। অধিকাংশ পিতা-মাতা কন্যার জন্মকে সানন্দে গ্রহণ করতেন না, তারা পুত্র কামনা করতেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে স্পষ্টই বলা হয়েছে, কন্যা পরিবারে দুঃখ নিয়ে আসেন, পুত্র পরিবারকে রক্ষা করেন। অথর্ববেদে কন্যার জন্মকে দুর্ভাগ্যজনক বলা হয়েছে। কন্যা তার পিতার বংশধারাকে রক্ষা করতে পারেন না, তিনি তার পিতৃপুরুষকে জলও দিতে পারেন না। কন্যা যা পারেন না পুত্র অনায়াসে তা সম্পন্ন করতে পারেন। উপরন্তু কন্যার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে পিতা-মাতার দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। কন্যার জন্মের প্রতি পিতা মাতার অনীহার পেছনে এই কারণগুলোই নিহিত রয়েছে। তাছাড়া নারীর সামাজিক অবমূল্যায়নের পেছনে কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণও ছিল। কৃষির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার ক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় থেকেই নারী অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেন, তার পুরুষ-নির্ভর জীবন শুরু হয়। আর্য পুরুষদের অনেকেই অনার্য নারী বিবাহ করতেন। এ ধরনের বিবাহকে সমাজ পরিপূর্ণ স্বীকৃতি দেয়নি। এর ফলেও সাধারণভাবে সমাজে নারীর মর্যাদা হাস পায়। মৈত্রায়ণী সংহিতায় নারীকে মদ ও পাশার মতাে সর্বনাশা বলে নিন্দা করা হয়েছে। তখনও ঋগ্বেদের যুগের মতাে মেয়েদের সাধারণত একটু বেশি বয়সেই বিবাহ হত। গুহ্য ও ধর্মসূত্রাদি গ্রন্থে বাল্যবিবাহের উল্লেখ আছে। কিন্তু এই গ্রন্থগুলোর কোনওটিই খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের পূর্ববর্তী নয়। তবে পুরুষমহলে বহুবিবাহের প্রচলন নিঃসন্দেহে নারী জাতির সামাজিক মর্যাদাহানির একটা প্রধান কারণ ছিল। মৈত্ৰায়ণী সংহিতায় মনুর দশ পত্নীর উল্লেখ আছে। রাজপরিবারে বহুবিবাহ প্রথা খুবই জনপ্রিয় হয়। সাধারণত, এক একজন রাজার কম করেও চারজন রানি ছিলেন। রানিদের মধ্যে যিনি প্রধান, তাকে মহিষী বলা হত। যিনি স্বামীর প্রিয়তমা ছিলেন তিনি বাবাতা বলে গণ্য হতেন। যিনি (পুত্রহীনা বলে?) অবহেলিত ছিলেন তিনি ‘পরিবৃক্তী’। চতুর্থ রানি ‘পালাগলী’। তিনি সম্ভবত রাজার এক সভাসদের কন্যা ছিলেন।

ঋগ্বেদের যুগে যেমন, তেমনি এ যুগের প্রথম দিকে নারীকে স্বামীর গৃহে মুখ্যত দু’টি ভূমিকায় দেখা যেত। একদিকে যেমন তিনি পত্নীরূপে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে স্বামীকে সহযােগিতা করতেন অন্যদিকে তেমনি জায়ারূপে দাম্পত্য জীবনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু তার সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের পরিধি ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসে। গৃহের যে সকল ধর্মীয় কাজ কর্ম একদিন তারই পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হত সেসব কাজের দায়িত্ব ক্রমশ পুরােহিতের হাতে চলে যায়। মৈত্রায়ণী সংহিতায় বলা হয়েছে নারীরা সভায় যােগ দিতে পারতেন না। সভায় রাজনীতি, বিচারকার্য ও সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত। সভায় যােগদানের অধিকার হারিয়ে ফেলায় নারীর আর ঘরের বাইরে বৃহত্তর জীবনে কিছু করার থাকল না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য পরিবারের ছেলেদের উপনয়ন হত। উপনয়নের মধ্য দিয়ে তারা দ্বিতীয় জন্ম লাভ করতেন, ‘দ্বিজ’ বলে গণ্য হতেন। মেয়েরা উপনয়নের অধিকারী ছিলেন। (মেয়েদের পুরাকালে উপনয়ন হত বলে স্মৃতিশাস্ত্রকার যম ও হরীত মন্তব্য করেছেন। কোনও কোনও আধুনিক গবেষক এই তথ্যের ভিত্তিতে বৈদিক যুগে নারীদের উপনয়নের সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পুরাকাল সম্পর্কে যম বা হারীত যা বলেছেন তা কতদূর সত্য বলা কঠিন। ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থে এ ধরনের কোনও তথ্য নেই।) পুত্র ও কন্যা উভয়ের জন্যই জাতকর্ম, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়ােজন হত। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও পুত্র ও কন্যাতে বৈষম্য করা হত। পুত্রদের ক্ষেত্রে এই অনুষ্ঠানাদিতে বৈদিক মন্ত্র পাঠ হত, কন্যাদের ক্ষেত্রে মন্ত্র পাঠ নিষিদ্ধ ছিল। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সে যুগের কয়েকজন নারী জ্ঞান ও গৌরবের উচ্চতম শিখরে আরােহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে মৈত্রেয়ী ও গার্গী বাচক্‌নবীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। গার্গী যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। সূক্ষ্ম ও অন্তর্ভেদী প্রশ্ন তুলে তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে বিব্রত করেছিলেন। ‘যেনাহং নামৃতা স্যাম কিমহং তেন কুর্যাম’ অর্থাৎ যা আমাকে অমৃত দেবে না তা দিয়ে আমি কী করব — যাজ্ঞবল্ক্যর প্রতি মৈত্রেয়ীর এই উক্তি আজও বিখ্যাত হয়ে আছে। ধন সম্পত্তি প্রত্যাখ্যান করে স্বামীর নিকট ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্যই প্রার্থনা জানিয়েছিলেন তিনি। তৈত্তিরীয় সংহিতা, মৈত্ৰায়ণী সংহিতা ও অথর্ববেদে সে যুগের মেয়েদের নৃত্যগীত অনুশীলনের কথা আছে। অথর্ববেদে সতীপ্রথার উল্লেখ আছে। তবে সে কালে বিধবা বিবাহেরও বিধান ছিল। ফলে সতীপ্রথা সমাজে খুব একটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল বলে মনে হয় না।

বিনােদন : এ যুগে সংগীত ও নৃত্যে যেমন অগ্রগতি হয় তেমনি বিনােদনের উপকরণও অনেক বেড়ে যায়। সংগীতে অগ্রগতির জ্বলন্ত প্রমাণ সামবেদ। সামবেদের মন্ত্রগুলোকে স্বরযােজনা করে নানা ভঙ্গিতে ও ধারায় গাওয়া হত। গাওয়া হত গীতিমূলক গাথা ও নারাশংসী। (মানুষের উদ্দেশ্যে রচিত প্রশস্তিবাচক মন্ত্র বা গীত। নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন : যেন নরাঃ প্ৰশস্যন্তে স নারাশংসাে মন্ত্রঃ। ৯.৯)। গানকে আরও সুশ্রাব্য করার জন্য বাঁশি, বীণা, মৃদঙ্গ, করতাল ইত্যাদি নানা যন্ত্র ব্যবহার করা হত। যন্ত্রগুলো ছিল নানা আকারের ও নানা প্রকারের। অথর্ববেদে শততন্ত্রী বীণার মতাে সূক্ষ্ম বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে। বাজসনেয়ি সংহিতায় ‘শৈলুষ’ নামে এক শ্রেণির শিল্পীর কথা বলা হয়েছে। অনেকে এদের নট বলে শনাক্ত করেছেন। এ মত সত্য হলে স্বীকার করতে হয়, তখনকার দিনে নাট্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিল। কেউ কেউ শৈলুষদের নর্তক বলেছেন। আগেকার যুগের মতাে এ যুগেও পাশা খেলায় লােকের উৎসাহ ছিল। এই ধরনের জুয়াখেলার কুফল সম্পর্কে যে তারা অজ্ঞ ছিলেন তা নয়। ঘােড়দৌড় এই সময় খুবই জনপ্রিয় হয়। বাজপেয়, রাজসূয় প্রভৃতি যজ্ঞ উপলক্ষেও ঘােড়দৌড় অনুষ্ঠিত হত।

খাদ্য ও পানীয় : এই সময় খাদ্যতালিকায় ধান ও যবের সঙ্গে গম যুক্ত হয়। তবে মাংসাহারের প্রতি লােকদের আকর্ষণ যেন ক্রমশ কমে আসছিল। সাধারণত উৎসবের দিনেই মাংস ভক্ষণের রেওয়াজ ছিল। ব্রত পালনের সময় মাংসাহার নিষিদ্ধ ছিল। সাধারণত ভেড়া, ছাগ ও ষাঁডের মাংসই ভােজন করা হত। পানীয়রূপে পূর্বের মতােই সসাম ও সুরার ব্যবহার ছিল। সােমলতা দুর্লভ হওয়ায় এর বিকল্প রূপে পূতিকা ও অর্জনানি লতার ব্যবহার চালু হয়।

পােশাক-পরিচ্ছদ : ঋগ্বেদের যুগে পশম ও চামড়ার তৈরি পােশাকের ব্যবহার ছিল। কিন্তু এ সময় কার্পাস ও রেশম বস্ত্রেরও প্রচলন হয়। পূর্বে আর্যরা সাধারণত নিম্নাঙ্গে বাস ও উর্ধ্বাঙ্গে অধিবাস পরতেন। কিন্তু এখন থেকে নীবি বা অন্তর্বাসের ব্যবহার শুরু হয়। পুরুষদের মতাে মহিলারাও সময় বিশেষে উষ্ণীষ ব্যবহার করতেন। শতপথ ব্রাহ্মণে চামড়ার তৈরি পাদুকার উল্লেখ আছে। এ সময় থেকে চিরুনি (শললী) ও ধাতব আয়নার (প্রাকাশ) ব্যাপক চলন দেখা যায়।

বিবাহ-ব্যবস্থা : জাতিভেদ প্রথা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বিবাহে নানা রকম বিধিনিষেধ আরােপিত হতে থাকে। ভিন্ন গােত্রে বিবাহই কাম্য ছিল। একই গােত্রে বিবাহের উপর তখনও কোনও সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছিল না। সবর্ণ বিবাহই অভিপ্রেত ছিল। কিন্তু এর ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়। এমনও দেখা যেত, উচ্চ বর্ণের পাত্র নিম্ন বর্ণের কন্যাকে বিবাহ করছেন বা নিম্নবর্ণের পাত্র উচ্চ বর্ণের পাত্রীকে গ্রহণ করছেন। প্রথমােক্ত শ্রেণির বিবাহগুলো অনুলােম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বিবাহগুলো প্রতিলােম নামে পরিচিত। বিবাহের সময় সাধারণত পাত্রীপক্ষ যৌতুক প্রদান করতেন। পাত্রীপক্ষ শুল্ক বা পণ গ্রহণ করছেন এমন ঘটনাও দেখা যেত। এ ধরনের বিবাহই পরবর্তী কালে আসুর বিবাহে রূপ নেয়। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আর্য-অনার্যদের মধ্যে বিবাহ ঘটত। বাজসনেয়ি সংহিতায় এ ধরনের বিবাহের অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়।

আশ্রম-ব্যবস্থা : এ সময় অভিজাত আর্য সমাজে আশ্রম নামে এক নতুন ব্যবস্থার প্রচলন হয়। আশ্রম বলতে জীবনের পর্যায় বােঝায়। এক একটি আশ্রম হল জীবনের এক একটি পর্যায়। এ পর্বে জীবনকে কয়েকটি আশ্রম বা পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়; প্রতিটি আশ্রম বা পর্যায়ের জন্য বিশেষ বিশেষ কর্তব্য নির্দিষ্ট হয়। এ যুগে এরূপ তিনটি পর্যায় বা আশ্রমের কথা শােনা যায়। আশ্রম তিনটি হল ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য ও তপস্যা। ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য ও তপস্যার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে কিন্তু বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস সম্পর্কে কোনও স্পষ্টোক্তি নেই। এর থেকে মনে হয় পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষের দিকে সমাজের তিন উচ্চ শ্রেণির মধ্যে তিন আশ্রম প্রথার প্রচলন হয়। ব্রহ্মচর্য বলতে জীবনের প্রথম পর্যায় বােঝায়। শৈশব ও কৈশাের নিয়ে এ পর্যায়। এ সময় গুরুগৃহে থেকে ব্রহ্মচর্য পালনের সঙ্গে সঙ্গে বেদ, বেদাঙ্গ, ব্যাকরণ, শিক্ষা, ছন্দ প্রভৃতি বিদ্যা অধ্যায়ন করতে হত। (তখনকার পাঠক্রমের তালিকায় সর্পবিদ্যা, উপদেবতা বিষয়ক জ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্য, ধাতুবিদ্যা ও জ্যামিতিও সংযুক্ত হয়েছে। সুকুমারী ভট্টাচার্য (ইতিহাসের আলােকে বৈদিক সাহিত্য, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ২৫০-৫১) মনে করেন মিশর ও ব্যাবিলােনের প্রভাবে ভারতে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা শুরু হয়।) শিক্ষা সমাপন করে স্বগৃহে ফিরে এসে বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় গার্হস্থ্য বা গৃহীর জীবন শুরু হত। সকল ব্রহ্মচারীই যে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন, তা নয়। অনেকে ব্রহ্মচারী রূপে গুরুগৃহেই থেকে যেতেন ও অধ্যাপনা বৃত্তি গ্রহণ করতেন। তাদের নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী বলা হত। যারা গৃহে ফিরে আসতেন তারা ‘উপকুর্বাণ’ নামে পরিচিত হতেন। গার্হস্থ্য ধর্ম পালনের অর্থ বিবাহ করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদি সহ সাংসারিক জীবন যাপন করা। প্রৌঢ়ে সর্বশেষ পর্যায় বা তপস্যা-আশ্রম। এ সময় আর্যরা সংসার ত্যাগ করে সম্ভব হলে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে লােকালয়ের বাইরে কোনও নির্জন স্থানে বা অরণ্যে গিয়ে বাস করতেন। বনজ ফল মূল ও বন্য ধান্যাদি আহার করে ঈশ্বর চিন্তায় দিন যাপন করতেন। এ ভাবেই তাদের জীবনের সমাপ্তি ঘটত। উত্তর বৈদিক পর্বে আশ্রমের সংখ্যা তিন হলেও বৈদিকোত্তর যুগে তপস্যা পর্যায়টিকে ভেঙে বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস নামে দু’টি স্বতন্ত্র আশ্রমের প্রবর্তন হয়। (এই পর্যায়কে বনপ্রস্থও বলে। নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়ম পালনপূর্বক বনবাসই বনপ্রস্থ বা বানপ্রস্থ। ‘বনে প্রকর্ষেণ নিয়মেন চ তিষ্ঠতি চরতীতি’।) ফলে শেষ পর্যন্ত আশ্রমের সংখ্যা তিন থেকে চারে গিয়ে দাঁড়ায়। বনবাসের পর্যায় বানপ্রস্থ। এ সময় আর্যরা সংসার ছেড়ে অরণ্যে গিয়ে বাস করতেন। অনেক সময় স্ত্রীরাও তাদের সঙ্গে যেতেন। বনের ফল-মূল ও শস্য ছিল তাদের আহার্য; ঈশ্বর ছিলেন তাদের ধ্যান-জ্ঞান। সর্বশেষে চতুর্থ পর্যায় বা সন্ন্যাস আশ্রম। তারা এ সময় সর্বস্ব ত্যাগ করে, সর্ব প্রকার জাগতিক ও মানবিক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে নিঃসঙ্গভাবে ঈশ্বর চিন্তায় নিমগ্ন হতেন। লােকালয়ের বাইরে কোনও বৃক্ষতল বা কোনও পরিত্যক্ত গৃহ ছিল তাদের আশ্রয়স্থল। বর্ষাকাল ছাড়া অন্য কোনও সময় তারা এক স্থানে দীর্ঘদিন বাস করতেন না। ভিক্ষাবৃত্তি সম্বল করে পরিব্রাজকের মতাে তারা স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। আশ্রম ব্যবস্থার এই পরিপূর্ণ রূপটি দেখা গেল বৈদিকোত্তর যুগে, তার পূর্বে নয়।

লিপির আবিষ্কার : আর্যদের বেদের মতাে উন্নতমানের সাহিত্য থাকলেও প্রথম দিকে তা লিখে রাখার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। গুরু-শিষ্য, পিতা-পুত্র পরম্পরায় সে সাহিত্য লােকের মুখে মুখেই ফিরত। আনুমানিক ৭০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আর্যরা বর্ণমালা বা লিপির ব্যবহার শুরু করেন।

অর্থনৈতিক জীবন

ঋগ্বেদের যুগে যেমন এই যুগের প্রথম দিকেও পশুচারণই ছিল তেমনি আর্যদের প্রধান জীবিকা। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের গাঙ্গেয় ভূভাগে অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কৃষির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কৃষিকৰ্মই তাদের প্রধান জীবিকা হয়ে দাঁড়ায়।

কৃষির বিকাশ : পরবর্তী বৈদিক আর্যদের অর্থনৈতিক জীবনে কৃষির এই গুরুত্বের মূলে অনেক কারণ ছিল। সিন্ধু উপত্যকার তুলনায় গাঙ্গেয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি, জলবায়ু অধিক পরিমাণে আর্দ্র, নদ-নদীও সংখ্যায় প্রচুর। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ নদ-নদীর উৎস হিমালয়, ফলে নদ-নদীতে সারা বছরই জল থাকে। তাছাড়া উত্তর ভারতে রয়েছে বিস্তীর্ণ সমভূমি যা মূলত পলিমাটি দিয়ে গঠিত। পলিমাটির আধিক্য সমতলভূমিকে উর্বর, শস্যশ্যামল করেছে। জলের প্রাচুর্য ও ভূমির উর্বরতার গুণে গাঙ্গেয় অববাহিকায় কৃষির বিকাশের পক্ষে এক অতি অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠেছে। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিও যে ছিল না তা নয়। এই অঞ্চলে গহন অরণ্যের সমাবেশ কৃষির বিকাশের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। অরণ্য পরিষ্কার না করে এই অঞ্চলকে আবাদি ও বাসযােগ্য করে তােলা সম্ভব ছিল না। দুটি উপায়ে অরণ্য পরিষ্কার করা হত। এক. আগুন জ্বালিয়ে অরণ্য ধ্বংস করা হত। দুই. তামা ও লােহার তৈরি দা, কুড়াল ইত্যাদি হাতিয়ারের সাহায্যেও বন কেটে জমিকে বাস ও চাষের উপযােগী করে তােলা হত। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে গাঙ্গেয় ভূভাগে অরণ্য পরিষ্কারের এই দুটি পদ্ধতিরই উল্লেখ আছে। 

আর্যদের সকলেই যে কৃষিকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা নয়। এই যুগেও আর্যদের কয়েকটি গােষ্ঠী পরানাে বৃত্তি পশুচারণকেই আঁকড়ে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী আর্যরা পশু চারণকারী গােষ্ঠীর লােকদের হেয় জ্ঞান করতেন, ‘ব্রাত্য’ অ্যাখ্যা দিয়ে তাদের কার্যত একঘরে করে রাখতেন। কৃষির বিকাশের অর্থ ফলনের বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধি আসে দু’টি ক্ষেত্রে – পরিমাণে ও বৈচিত্র্যে। কৃষি আর্যদের প্রধান জীবিকা হওয়ায় পরিমাণ ও বৈচিত্র্য উভয় ক্ষেত্রেই কৃষিজ দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ঋগ্বেদের যুগে কৃষি বলতে প্রধানত যব বােঝাত। এই যুগেও যব অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য ছিল। যবের বীজ শীতকালে বপন করা হত, ফসল পাকত গ্রীষ্মে। পূর্ববর্তী যুগের মতাে এ যুগেরও আর একটি প্রধান ফসল ‘ধান’। এই পর্বেই প্রথম ‘ব্রীহি’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। ব্রীহি’ বলতে সম্ভবত বন্য ধান বােঝায়। তৈত্তিরীয় সংহিতায় বলা হয়েছে, ধানের বীজ বর্ষায় বপন করা হত, ফসল কাটা হত হেমন্তে। অর্থাৎ যে ধানকে আমরা আমন বা আঘায়নি বলি, শুধু সেই ধানেরই তখন চাষ হত। হস্তিনাপুরে আনুমানিক ৮০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মৃত্তিকাস্তর থেকে সে যুগের ধানের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সময় থেকে কয়েকটি নতুন ফসলের উৎপাদন শুরু হয়। নতুন ফসলের মধ্যে যেটি প্রধান সেটি হল ‘গােধূম’ বা গম। গম বা যব থেকে ‘সত্তবঃ’ বা ছাতু তৈরি হত। তৈত্তিরীয় সংহিতায় এর উল্লেখ আছে। তিল চাষের সূত্রপাতও এই যুগে। তিলের বীজ গ্রীষ্মে বপন করা হত, ফসল কাটা হত শীতকালে। এই তথ্যও তৈত্তিরীয় সংহিতার। অন্যান্য দ্রব্যাদির মধ্যে তুলা সবিশেষ উল্লেখযােগ্য।

ফসল বাড়াবার জন্য জমিতে সার দেওয়া হত। দু’প্রকার সার ব্যবহার হত – “শকুৎ’ বা পশুর মল ও ‘করীষ’ বা শুষ্ক গােময়। যৎসামান্য হলেও জমিতে সেচের ব্যবস্থা ছিল। শতপথ ব্রাহ্মণে চাষের চারটি প্রধান পর্যায়ের উল্লেখ আছে – জমি কর্ষণ, বীজ বপন, ফসল কাটা ও ফসল ঝাড়াই-মাড়াই। লাঙল চালিয়ে জমিকে বীজ বপনের উপযােগী করে তােলা হত। লাঙল টানত বলদে। হয়তাে চাষের কাজে মহিষকেও ব্যবহার করা হত। অথর্ববেদ, বাজসনেয়ি, মৈত্ৰায়ণী, তৈত্তিরীয় ও কাঠক সংহিতা এবং তৈত্তিরীয় ও শতপথ ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এক প্রকার লাঙল চালনার জন্য ছয়, আট, বারাে, এমনকি চব্বিশটি বলদের প্রয়ােজন হত। এক একটি লাঙল চালনার জন্য বেশি সংখ্যক বলদ কেন প্রয়ােজন ছিল, তার তিনটি সম্ভাব্য কারণ নির্দেশ করা যেতে পারে। লাঙলগুলো সম্ভবত আয়তনে বিশাল ও ওজনে ভারী ছিল। কৃষিক্ষেত্রগুলোও হয়তাে বৃহদায়তনের ছিল। গাঙ্গেয় উপত্যকার মাটি ঘন ও এটেল হওয়ায় জমিতে লাঙল টানার জন্য সম্ভবত অধিক সংখ্যক বলদের প্রয়ােজন ছিল। লাঙলের ফলা খদির বা ডুমুর গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি হত। তবে তামা ও লােহার ফলারও ব্যবহার ছিল। জমিতে লাঙলের যে রেখা পড়ত তাকে ঋক সংহিতার মতাে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যেও ‘সীতা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ব্যবহারের সুবিধার জন্য লাঙলের হাতল মসৃণ করা হত, ফলাকে করা হত সূচ্যগ্র, ‘পবীরবৎ। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কৃষককে ‘কীনাশ’ বলা হয়েছে। লাঙলে বলদ জুড়ে ‘কীনাশ’ জমি চাষ করছেন আর মাঝে মাঝে হাতের লাঠি দিয়ে বলদগুলোকে চালনা করছেন, পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে এই ধরনের বিস্তর বর্ণনা আছে।

চাষ-আবাদের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু কয়েকটি সমস্যাও ছিল। পােকা ও ইদুরের উপদ্রব তাে ছিলই। পােকা-মাকড়ে গাছের কচি শিকড় ও পাতা নষ্ট করত, ইদুরে ক্ষতি করত সদ্য উপ্ত বীজের। খরা ও অতিবৃষ্টি চাষের ক্ষতি করত। এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অথর্ববেদে জাদুমন্ত্রের বিধান আছে। ঋতুচক্র সম্পর্কে তখনকার দিনের কৃষকদের ধারণা বেশ স্পষ্ট ছিল। কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা চাষের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটাত। তখন বৃষ্টির জল ধরে রেখে অনাবৃষ্টির সময় তা সেচের কাজে ব্যবহারের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। খাল কেটে খেতে জলসেচেরও কোনাে সুবন্দোবস্ত ছিল না। তাই অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির সময় অসহায় কৃষকদের তুকতাক বা জাদুমন্ত্রই একমাত্র অবলম্বন ছিল।

শিল্পের উন্নতি : কৃষির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পেরও উন্নতি ঘটল। ফলন বেশি হওয়ায় উদ্বৃত্ত দেখা দিল। ফলে একদল কর্মী চাষ-আবাদের কাজ ছেড়ে কারিগরি ও কুটির শিল্পে আত্মনিয়ােগ করেন। ঋগ্বেদের যুগে শিল্প ছিল লােকদের অস্থায়ী বৃত্তি কিন্তু এখন শিল্প স্থায়ী জীবিকার রূপ নিল। এই সময় নৌশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে লােহাকে শ্যামায়স্‌ ও কৃষ্ণায়স্‌ বলা হয়েছে। কর্মার বা কর্মকারেরা লােহা দিয়ে তির, বর্শা ও লাঙলের ফলক, কুড়াল, কোদাল, দা, কাস্তে ইত্যাদি হাতিয়ার তৈরি করতেন। বর্শাফলকের মুখ প্রায়ই চেরা থাকত। কড়ালের মাঝখানে থাকত বড় ছিদ্র। এই ছিদ্রের মধ্যে কাঠ বা হাড়ের হাতল লাগানাে থাকত। সে যুগের লােহার তৈরি অস্ত্রশস্ত্র হালুর, ঝাখেড়া, অত্রঞ্জিখেড়া, হস্তিনাপুর, কৌশাম্বী, আলমগীরপুর, নােহ প্রভৃতি স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। ঋগ্বেদের যুগে লােহার ব্যবহার শুরু হয় কিন্তু আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। কর্মকার ছাড়া অন্যান্য ধাতুশিল্পীদের মধ্যে ছিলেন স্বর্ণকার, রৌপ্যকার, কাংসকার, পিত্তলকার, তাম্রকার প্রভৃতি কারিগরেরা। শতপথ ব্রাহ্মণে সিসার উল্লেখ আছে। বাজসনেয়ি সংহিতায় মণিকারের উল্লেখ পাওয়া যায়। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ও মণির ব্যবহার ঋগ্বেদের যুগেও ছিল। কিন্তু এই পর্বে টিন, সিসা ও দস্তা এই তিনটি নতুন ধাতুর সংযােজন ঘটল।

মৃৎশিল্প : নােহ, হস্তিনাপুর, অত্রঞ্জিখেড়া, জাখেরা পানিপথ, ইন্দ্রপ্রস্থ, ভগবানপুর, আলমগীরপুর প্রভৃতি স্থানে এ যুগের মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ঋগ্বেদের যুগের শেষের দিকে যে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের নির্মাণ শুরু হয়, তা এই যুগে ব্যাপকতা লাভ করে। মৃৎপাত্রগুলোর বেশির ভাগই বাটি ও থালা। এগুলো কৌলাল বা কুমােরের চাকে তৈরি। এদের রঙ ধূসর, গায়ে বিচিত্র রঙের নানা নকশা। বিভিন্ন প্রকারের রেখা ও বিন্দু দিয়ে নকশাগুলো আঁকা হয়েছে।

বস্ত্রশিল্প : ঋগ্বেদের যুগের মতাে এই যুগে পশমই ছিল বস্ত্রশিল্পের প্রধান উপকরণ। সংহিতা ও ব্রাহ্মণসাহিত্যে উর্ণসূত্র বা পশমের সুতার বহু উল্লেখ আছে। পশমের বস্ত্র ছাড়া কার্পাস, রেশম ও শণের বস্ত্র তৈরি হত। চামড়া, বিশেষ করে হরিণের চামড়া বা অজিনের পােশাকও ছিল। চামড়ার পােশাক সাধারণত মুনি-ঋষি ও ব্রহ্মচারীরাই পরতেন। কখনও কখনও পােশাক রাঙানাে হত। রাঙানাের কাজ সাধারণত মেয়েরাই করতেন।

বৃত্তি : সে যুগের বৃত্তি ও কারিগরি শিল্পের বিস্তৃত তালিকা পাওয়া যাবে বাজসনেয়ি সংহিতা ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে। বৃত্তিজীবী ও শিল্পোপজীবীদের তালিকায় (১) কৌলাল (কুম্ভকার), (২) কর্মার (কর্মকার), (৩) মণিকার (জহুরি), (৪) ইষুকার (তিরনির্মাতা), (৫) ধনুষ্কার (ধনুকনির্মাতা), (৬) জ্যাকার (ধনুকের ছিলা নির্মাতা), (৭) রজ্জুসর্জ (দড়িনির্মাতা), (৮) সুরাকার (শুড়ি), (৯) বাসঃপল্‌লী (রজকিনী), (১০) রঞ্জয়িত্রী (কাপড় রাঙানাের মহিলা শিল্পী), (১১) চর্মন্ন (চর্মকার), (১২) হিরণ্যকার (স্বর্ণকার), (১৩) ধীবর (জেলে), (১৪) হক্তিপ (হস্তিপালক), (১৫) অশ্বপ (অশ্বপালক), (১৬) গােপালক (রাখাল), (১৭) সূত (বন্দী, পুরাণবক্তা), (১৮) শৈলূষ (নট), (১৯) মৃগয়ু (ব্যাধ), (২০) তক্ষক (ছুতার), (২১) অনুক্ষত্তা (দ্বারপ্রহরী), (২২) কীনাশ (কৃষক), (২৩) অনুচর (ভৃত্য), (২৪) শমিতা (ঘাতক), (২৫) রথকার (রথনির্মাতা), (২৬) ভিষক (চিকিৎসক), (২৭) গণক (জ্যোতিষী), (২৮) নক্ষত্ৰদৰ্শক (জ্যোতির্বিদ), (২৯) বনপ (বনরক্ষী), (৩০) পিশুন (চর) প্রভৃতির উল্লেখ আছে। অন্যান্য গ্রন্থাদিতে (১) মলগ (ধােপা), (২) পুরুষ (ভৃত্য), (৩) ব্যপ্তা (নাপিত), (৪) দূত (বার্তাবহ) প্রভৃতির কথা আছে। সন্দেহ নেই, এই সময় বৃত্তি ও কারিগরি শিল্প ঋগ্বেদের যুগের তুলনায় সংখ্যায় ও বৈচিত্র্যে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। চিকিৎসা ছিল তখনকার দিনে এক উল্লেখযােগ্য পেশা। অথর্ববেদের ‘পৌষ্টিকানি সূত্রাণি’ অধ্যায়ে নানা ধরনের ব্যাধি এবং তাদের প্রতিকারের উপায় বর্ণনা করা হয়েছে। (অথর্ববেদে মাথা-ধরা, সাধারণ ঘা, পূষ জমে এমন ঘা, সর্পাঘাত, পাগলামি, কুষ্ঠ, যক্ষা, গলগণ্ড, ফোড়া, সর্দিকাশি, রক্তাল্পতা, ফোলা, হৃদরােগ, কাঁপুনি (ম্যালেরিয়া?), বাত, জ্বর, কামলা, জরা, হাড়ভাঙা, কৃমি, খিল-ধরা, চুল-ওঠা ইত্যাদি অসুখ-বিসুখের উল্লেখ আছে।)। ভিষক বা চিকিৎসককে খুব একটা শ্রদ্ধার চোখে দেখা হত না। (শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে, সােমরস পানে দেবতার অধিকার আছে, কিন্তু দেব-চিকিৎসক অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সে অধিকার নেই। তখনকার সমাজে চিকিৎসকদের যে অশ্রদ্ধা করা হত তা শতপথ ব্রাহ্মণের বর্ণনায় প্রতিফলিত।) বৃত্তির খাতিরে চিকিৎসককে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে যেতে হত। সমাজপতিরা সম্ভবত এটি পছন্দ করতেন না। এমনও হতে পারে, রােগীর অসহায় অবস্থার সুযােগ গ্রহণ করতেন বলে চিকিৎসকেরা লােকদের বিরাগভাজন ছিলেন। তৎকালীন সমাজে ভিষকদের হীন চোখে দেখার আরও একটি সম্ভাব্য কারণ নির্দেশ করা যেতে পারে। তখনকার দিনের পুরােহিত সম্প্রদায় যাগ-যজ্ঞাদি ব্রাহ্মণ্য আচারগুলোকে সর্বার্থসাধক, এমনকি রােগ নিরাময়কারী বলে প্রচার করতেন। কিন্তু ভিষকরা ওষুধকেই রােগনিরসনের একমাত্র পন্থা বলে বিশ্বাস করতেন। তাদের এ জাতীয় প্রচেষ্টার সাফল্য ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা স্বাভাবিক কারণেই ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বিরূপতা অর্জন করেন।

ব্যবসা বাণিজ্য, সমুদ্র ও যাতায়াত ব্যবস্থা : কৃষি ও কারিগরি শিল্পের বিকাশের অর্থ বাণিজ্যের অগ্রগতি। এই সময় যে বাণিজ্যের অগ্রগতি হয়েছিল পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে তার অজস্র নিদর্শন আছে। বাণিজ্য ছিল বৈশ্যদের হাতে। অথর্ববেদে বাজারের উল্লেখ আছে। জিনিসপত্রের বেচা-কেনা নিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে যে দরদাম চলত তারও আভাস আছে এই বেদে। অথর্ববেদে কিছু কিছু বাণিজ্যিক পণ্যের উল্লেখ আছে। এই প্রসঙ্গে পােশাক, চাদর ও ছাগচর্মের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। শ্ৰেষ্ঠী কথাটির উল্লেখ এই সময় থেকেই পাওয়া যায়। বিরাট ধনী বণিক এই অর্থেই পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে শ্রেষ্ঠী পদের ব্যবহার হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য মানেই ধনলাভ এরূপ একটি ধারণা এই সময় দৃঢ়মূল হতে থাকে। যজুর্বেদে ‘বাণিজ’ পদের ব্যবহার দেখা যায়। বাণিজের অর্থ বণিজ বা বণিকের পুত্র। বণিকের বৃত্তি বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে সমুদ্রের প্রসঙ্গ বার বার উত্থাপিত হয়েছে। এই যুগে সমুদ্র বলতে নিঃসন্দেহে সাগরই বােঝাত। শতপথ ব্রাহ্মণে পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রের উল্লেখ আছে। পূর্ব সমুদ্র সম্ভবত বঙ্গোপসাগর, পশ্চিম সমুদ্র আরব সাগর। মনে হয় পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহের সঙ্গে আর্যরা বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার মতাে জলযান তখনও তৈরি হয়নি, উপকূল ধরেই নৌযান যাতায়াত করত। এই যুগে বণিক নিগম বা গিল্ডের উদ্ভব হয়েছিল বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। সঠিক প্রমাণ নেই তবে এরূপ সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করা যায় না। বাণিজ্য ও লােকচলাচলকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু পথঘাট নির্মিত হয়। উত্তর মদ্র, গান্ধার প্রভৃতি পশ্চিমী রাজ্যগুলোর সঙ্গে কাশী, মগধ, বিদেহ প্রভৃতি পূর্ব রাজ্যগুলোর সড়কপথে যােগ ছিল। রাজপথ বা শ্রুতি ও মহাপথ, অথর্ববেদে এই দুই ধরনের পথের উল্লেখ আছে। রাজপথগুলো সম্ভবত সরকারি উদ্যোগে তৈরি হত। এগুলো ছিল সুগম ও সুরক্ষিত। রাজপথগুলোর তুলনায় মহাপথগুলো দৈর্ঘ্যে বড় ছিল কিন্তু এই পথগুলো নিরাপদ ছিল না। অথর্ববেদে ‘বিপথ’ কথাটি পাওয়া যায়। বিপথ’ বলতে বন্ধুর পথ বােঝায়নি, বুঝিয়েছে বন্ধুর পথের পক্ষে প্রশস্ত যানকে। মালবাহী যানগুলো সাধারণত বলদেই টানত। কখনও কখনও ঘােড়া, হাতি, অশ্বতর প্রাণী ও গাধাকেও মালবহনের কাজে লাগানাে হত।

বিনিময়-মাধ্যম ও ঋণ : পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে নিষ্ক, শতমান, কৃষ্ণল পদের উল্লেখ আছে। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর এবং আরও অনেক পণ্ডিত এগুলোকে ধাতব মুদ্রা বলে শনাক্ত করেছেন। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর প্রাচীন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু এই মুদ্রাগুলোর কোনওটিই খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকের পূর্ববর্তী নয়। মনে হয়, পরবর্তী বৈদিক যুগের একেবারে শেষের দিকেও মুদ্রার প্রচলন হয়নি। কৃষ্ণল, মান ও নিষ্ককে ওজনের বিশেষ একক বলেই ভাবা উচিত। একশত মানের ওজনের সােনার তাল বা বাটকে শতমান বলা হত। এক কুফলের ওজন এক রতি বা ১.৭৫ গ্রেন। কিন্তু এক মানের প্রকৃত ওজন কী তা বলা কঠিন। অনেকে এক মানকে এক কৃষ্ণলের সমান বলে মনে করেন। আবার কারাের মতে এক মানের ওজন তিন কৃষ্ণলের ওজনের চেয়েও একটু বেশি। তখনও গােধনই বিনিময়ের মাধ্যমরূপে গণ্য হত। বিভিন্ন ওজনের ধাতু খণ্ডগুলোকেও বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হত। শতপথ ব্রাহ্মণে ‘কুসীদিন’ ও তৈত্তিরীয় সংহিতায় ‘কুসীদ’ শব্দের ব্যবহার আছে। কুসীদিন বলতে উত্তমর্ণ বা মহাজন বােঝায়। কুসীদ-এর অর্থ হল ঋণ। তখনকার দিনে ঋণপ্রথা ছিল – এ কথা মানতেই হয় কিন্তু এই ঋণ দেওয়া-নেওয়ার কাজ চলত জিনিসে, মুদ্রায় নয়।

জমির মালিকানা : সে সময় ক্ষেত ও বাস্তুজমি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল কিন্তু চারণভূমি ছিল সর্বসাধারণের সম্পত্তি। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে অনেক সময় রাজাকে জমি সংক্রান্ত চুক্তির তত্ত্বাবধান করতে দেখা যায়। ব্রাহ্মণ বা বৈশ্যকে রাজা জমি থেকে উচ্ছেদ করেছেন এমন ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু এতে রাজার জমিতে নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। জমির মালিক বলে নয়, রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসক বলেই বৃহত্তর স্বার্থে তিনি জমির তত্ত্বাবধান করতেন | শতপথ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে রাজা বিশ্বকর্মা ভৌবনের ভূমিদানের এক কাহিনির অবতারণা আছে। বিশ্বকা সমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠানের সময় তার পুরােহিতকে জমি দান করতে চান, কিন্তু জননী বসুন্ধরা রাজা ভূমির অধিকারী নন বলে তাকে নিরস্ত করেন। রাজা যে রাজ্যের অখণ্ড জমির মালিক ছিলেন না, তা বিশ্বকর্মা ভৌবনের এই কাহিনিতেই প্রমাণিত হয়। কিন্তু রাজা যে ভূমিদান করতেন না, তা নয়। রাজার নিজস্ব খাস জমি তাে ছিলই। সে ক্ষেত্রে ভূমিদান বলতে মালিকানার হস্তান্তর বােঝাত না, বােঝাত রাজস্ব সংক্রান্ত সুযােগ-সুবিধার হস্তান্তর। বেশির ভাগ জমির মালিকরা নিজেরাই চাষ-আবাদের কাজ করতেন না। এই শ্রেণির ভূস্বামীদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।

চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি ও গান্ধার-সমাধি সংস্কৃতি

চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি : কোনও কোনও বিদ্বজ্জন চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি বা পেইন্টেড গ্রে অয়ার কালচারের নিদর্শনের প্রেক্ষাপটে উত্তরকালীন বৈদিক আর্যদের আর্থ-সামাজিক জীবনের চালচিত্র রচনা করেন। তাদের এই প্রয়াসের মূলে যে কোনও ভিত্তি নেই তা নয়। এ কথা ভুললে চলবে না, যেসব স্থানে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে সেসব স্থান তাে পরবর্তী বৈদিক সংস্কৃতির ভৌগােলিক পরিমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত। চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি আর উত্তরকালীন বৈদিক সংস্কৃতি যে প্রায় সমকালবর্তী তাও তাে সুবিদিত। এই চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির সময় হতে গাঙ্গেয় অববাহিকায় যে লােহার ব্যবহার ক্রমশ ব্যাপকতা লাভ করে তাও সুপ্রমাণিত। সাধারণত এসব যুক্তির ভিত্তিতে উত্তরকালীন বৈদিক আর্যদের চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির স্রষ্টারূপে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এই মতের বিপক্ষেও অনেক কিছু বলার আছে। প্রথমত, পরবর্তী আর্য সভ্যতার যে বিশাল ব্যাপ্তি ও বিকাশ তার তুলনায় চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির তাৎপর্য অতি ক্ষীণ। দ্বিতীয়ত, আর্যরাই যদি এই শিল্প নির্মাণ করবেন, তাহলে আজও কেন সিন্ধুনদের পশ্চিম তীর, উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চল ও বিহারে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র-বসতি অনাবিষ্কৃত? অথচ এসব অঞ্চলেও তাে উত্তরকালীন বৈদিক আর্যদের বাস ছিল। আর চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির সঙ্গে লৌহ উপকরণের সংযােগ স্বীকার করেও বলা যায়, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির আবির্ভাবের পূর্ব হতেই রাজস্থান এবং মধ্য ও নিম্ন গাঙ্গেয় অববাহিকার কয়েকটি স্থানে লােহা ব্যবহারের সুনিশ্চিত প্রত্নতাত্ত্বিক অভিজ্ঞান আবিষ্কৃত হয়েছে।  ফলে সংশয় জেগেছে যে, কারা চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন? যারা এই সংস্কৃতির স্রষ্টা তারা কি উত্তরকালীন বৈদিক আর্য না বৈদিক সাহিত্যে উল্লিখিত দাস ও দস্যু সম্প্রদায়ের লােক? তারা যারাই হােন না কেন এই সংস্কৃতি যে উত্তরকালীন বৈদিক যুগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তা তাে সহজেই অনুমেয়। চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতির যে জীবন সে জীবন গ্রামীণ জীবন। বেশিরভাগ বসতিই ছােটো। ৫, ১, ২, ৩, ৪, ৫ হেক্টর আয়তনের বসতি যেমন আছে তেমনি আছে কৌশাম্বীর মতাে ১০ বা পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর অঞ্চলের সাতওয়ালির মতাে ১৩.৭ হেক্টর পরিমাণ বসতি। বসতির ভেতরে মাটির তৈরি কয়েকটি বাড়িঘর। আছে উনুন, কুমােরের ভাটা ও কর্মকারের কারখানার নিদর্শন। কৃষির বিস্তার ঘটেছে; চাষ হচ্ছে ধান, গম ও যবের। সেচ ব্যবস্থার বড় একটা নিদর্শন নেই। তবে অত্রঞ্জিখেড়ায় বসতির বাইরে গােলাকার গভীর গর্ত দেখা যায়। সম্ভবত এ ধরনের কাচা কুয়াে হতে খেতে জলসেচ করা হত। থালা, বাটি ইত্যাদি নানা ধরনের মৃৎপাত্র তৈরি হচ্ছে, মাটিকে ভালভাবে তৈরি করে, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পাত্রকে ভালভাবে পুড়িয়ে। পাত্রগুলো কুমােরের চাকে তৈরি। এদের রঙ ধূসর, বহিরঙ্গে বিচিত্র রঙের নানা নকশা। বিভিন্ন রকমের রেখা ও বিন্দু দিয়ে নকশাগুলো আঁকা হয়েছে। যুদ্ধ ও কৃষির কাজে লােহার হাতিয়ার ব্যবহার হচ্ছে। হাতিয়ারের মধ্যে আছে তিরফলক, বর্শাফলক, সাঁড়াশি, কুঠার, চাচনি, ছেদক, ছুরি এবং ব্লেড। তামা, ঝিনুক, হাড় ও কাচের জিনিসপত্রও পাওয়া যাচ্ছে। শূকর, গরু, ঘােড়া ও মেষ ছিল গৃহপালিত পশু।

গান্ধার-সমাধি সংস্কৃতি : উৎখননে আবিষ্কৃত আর একটি সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য বর্তমান প্রসঙ্গে অবান্তর বিবেচিত হবে না। সেই সংস্কৃতি গান্ধার-সমাধি সংস্কৃতি। পেশােয়ার হতে চিত্রল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের বীরকোট ঘুণ্ডাই, খেরারি, তিমরগড়, বালামবাট, জরিফ কারুনা, আলিগ্রাম, গালিঘাই প্রভৃতি স্থানে এই সংস্কৃতির অভিজ্ঞান আবিষ্কৃত হয়েছে। এই অঞ্চলের সাধারণ নাম গান্ধার। এই সংস্কৃতি-সম্পর্কিত যাবতীয় ধ্যান-ধারণা বিভিন্ন সমাধিতে প্রাপ্ত নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সে কারণে এই সংস্কৃতি গান্ধার-সমাধি সংস্কৃতি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। গান্ধার-সমাধি সংস্কৃতির তিনটি পর্যায়, আদি, মধ্য ও উত্তর। আদি পর্যায়ের শুরু আ. ১৭১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, উত্তর পর্যায়ের পরিসমাপ্তি আ. ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই সংস্কৃতির প্রথম পর্যায়ের সমাধিগুলো প্রায়শই আয়তাকার, সমাধির ভেতরে পাথরের বেষ্টনী, মাথার উপর উল্লম্ব পাথর চাপানাে। পূর্ণ, আংশিক ও দাহােত্তর, তিন ধরনের সমাধিরই নিদর্শন আছে তবে দাহােত্তর সমাধিই বেশি। একজনকে সমাহিত করা হয়েছে, এমন সমাধি যেমন আছে তেমনি একাধিক ব্যক্তিকে একই কবরে সমাহিত করা হয়েছে, এমন নিদর্শনও আছে। এই পর্যায়ে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে আছে কুমােরের চাকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের অতি সাধারণ মৃৎপাত্র ও হাড়ের তৈরি জিনিস। দ্বিতীয় পর্যায়ে পূর্ণ সমাধির নিদর্শনই বেশি। এই পর্যায়ের মৃৎপাত্রও চাকে তৈরি তবে পাত্রের চাকচিক্য বেড়েছে। স্বল্পপরিমাণ তামার জিনিসও পাওয়া যাচ্ছে। তৃতীয় পর্যায়ের পাত্র আরও দৃষ্টিনন্দন। এ পর্যায়ে পাওয়া যাচ্ছে পােড়ামাটির নারী ও পুরুষ-মূর্তি, তামার জিনিসপত্র ও অল্পসংখ্যক লৌহ উপকরণ। ঘােড়ার ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। গান্ধার-সমাধি সংস্কৃতির নিদর্শনসমূহের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসব প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা আজও বিদ্যমান। গান্ধার-সমাধি সংস্কৃতি যাদেরই সৃষ্টি হােক না কেন, তারা যে বৈদিক পর্বের সমকালীন তা অসঙ্কোচে বলা যায়। বৈদিক যুগের অবসানের পরও সােয়াট অববাহিকায় এই সংস্কৃতি আরও কয়েক শতাব্দী বিরাজমান ছিল।

চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি বা পেইন্টেড গ্রে অয়ার কালচার (১২০০ – ৫০০ খ্রি.পূ.), গান্ধার সমাধি সংস্কৃতি বা গান্ধারা গ্রেইভ কালচারের অবস্থানও দেখানো হয়েছে 

ধমীয় জীবন

ঋগ্বেদের যুগের তুলনায় উত্তর-বৈদিক পুর্বে আর্যদের ধর্মীয় জীবনে তাকে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে যায়। পশুচারক সমাজে যে আচার-অনুষ্ঠান, মত-বিশ্বাস উপযােগী ছিল। তা কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনেকাংশে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তাছাড়া পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে বসতি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আর্যদের সঙ্গে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষাভাষীদের ঘনিষ্ঠ সংযােগ স্থাপিত হয়। এর ফলে আর্যরা অনার্যদের কিছু কিছু ধ্যান-ধারণা, আচার-অনুষ্ঠান সাগ্রহে আত্মসাৎ করে নিজেদের ধর্মাচারের অঙ্গ করেন। উত্তর-সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদে যে ধর্মাচার প্রতিফলিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে আর্য-অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণেরই ফসল। বৈদিক ধর্মের এই নতুন রূপকে হিন্দুধর্মের শৈশবকাল বলে আখ্যা দেওয়া যায়।

দেব-দেবী : ঋগ্বেদের যুগ ছিল মূলত সংঘর্ষ ও সংঘাতের যুগ। সে সময় যুদ্ধের দেবতা ইন্দ্রের জনপ্রিয়তাই ছিল সর্বাধিক। কিন্তু কৃষিজীবী সমাজে ইন্দ্রের গুরুত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। আকাশের দেবতা দৌঃ ও সূর্য হীনপ্রভ হয়ে পড়েন। ঊষা, ভগ, অর্যমা, মার্তণ্ড, দক্ষ ও পন্যের মতাে দেবতারা অদৃশ্য হয়ে যান। এ সময় কিছু নতুন দেব-দেবীর আবির্ভাব ঘটল, পুরানাে দেবতাদের কেউ কেউ নতুনরূপে দেখা দিলেন। যারা প্রাধান্য পেলেন তারা হলেন মূলত প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা, আলাে ও বর্ষণের দেবতা। এরা ভূমিকে উর্বর করেন, বীজের জন্য প্রয়ােজনীয় তাপ সঞ্চার করেন, পৃথিবীকে বৃষ্টিস্নাত করেন, শস্যের ফলন বাড়ান, গােসম্পদ বৃদ্ধি করেন। নতুন দেব-দেবীর মধ্যে প্রজাপতি, মীঢ়ষী, জয়ন্ত, কুবের, বৈশ্রবণ, বিশ্বাবসু, দণ্ডী, গরুড়, কন্যাকুমারী, নারায়ণ, বাসুদেব, উমা ও হৈমবতী বিশেষ উল্লেখযােগ্য।

প্রজাপতি-ইন্দ্র-বরুণ : নতুন দেব-দেবীর মধ্যে গুরুত্বে প্রজাপতি ছিলেন সকলের উপরে। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে যজ্ঞকে শ্রেষ্ঠ ধর্মচর্চার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রজাপতি এই যজ্ঞের সহিত অভিন্ন ও একাত্মরূপে কল্পিত হয়েছেন। তিনি স্রষ্টা ও রক্ষাকর্তা, উর্বরতা ও বৃদ্ধির অধিষ্ঠাতৃ দেবতা। তিনি শান্তি, প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি দান করেন, অশুভ শক্তিকে বিনাশ করেন। ব্রাহ্মণ গ্রন্থাদিতে ইন্দ্রকে প্রজাপতির কৃপাপ্রার্থী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। যে সকল পুরানাে দেবতা নতুনরূপে এ যুগে আবির্ভূত হয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন বরুণ। তিনি ছিলেন মূলত আকাশের দেবতা। কিন্তু কৃষিনির্ভর সমাজে তিনি ধীরে ধীরে সমুদ্রের দেবতারূপে পরিচিত হলেন।

রুদ্র-শিব : পূর্ববর্তী যুগে রুদ্র ও বিষ্ণু গৌণ দেবতা ছিলেন কিন্তু এই সময় তাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ঋগ্বেদে রুদ্র মূলত ধ্বংসের কর্তারূপে বর্ণিত হয়েছেন। কিন্তু যজুর্বেদে তাকে শিব বা কল্যাণপ্রদরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। রুদ্রের আর এক নাম শম্ভু। অনেকে মনে করেন, বৈদিক রুদ্র দ্রাবিড় দেবতা চিবন ও চেম্বুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে শিব-শস্তুতে পরিণত হয়েছেন। রুদ্র যজুর্বেদে চোর-ডাকাত, গুণ্ডা-ছিনতাইকারীদের দেবতারূপে কল্পিত হয়েছেন। তাছাড়া তিনি গিরীশ ও পশুপতি নামেও অভিহিত হয়েছেন। এই সব বর্ণনায় রুদ্র-শিবের অনার্য পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। সন্দেহ নেই, আর্য-অনার্য উপাদানের সংমিশ্রণ রুদ্র-শিবকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তিনি সকলের নিকট গ্রহণীয়রূপে প্রতিভাত হয়েছেন। তিনি এখন আর সাধারণ দেবতা নন, মহান দেবতা, মহাদেব। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রুদ্র-শিবের ভব, শর্ব, মৃড়, ঈশান, উগ্র ইত্যাদি আরও কয়েকটি নাম পাওয়া যায়।

বিষ্ণু-বাসুদেব-কৃষ্ণ : রুদ্রের সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুর প্রাধান্যও বৃদ্ধি পায়। কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও তাণ্ড্য ব্রাহ্মণে বিষ্ণু যজ্ঞের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন – ‘যজ্ঞাে বৈ বিষ্ণুঃ’। শতপথ ব্রাহ্মণে তার পালনকর্ত রূপটি ফুটে উঠেছে। তিনি দুঃখী মানুষের মুক্তিদাতা, দেবতাদের পরিত্রাতা। সম্ভবত এই সময় বিষ্ণু-উপাসনায় আর্য-অনার্য উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। বিষ্ণুর গুরুত্ব বৃদ্ধির এটি প্রধান কারণ। ছান্দোগ্য উপনিষদে কৃষ্ণের উল্লেখ আছে। সেখানে কৃষ্ণ ঋষি, তিনি ঘাের আঙ্গিরসের শিষ্য, দেবকী তার মা। শতপথ ব্রাহ্মণে সর্বনিয়ন্তা, ঋষি নারায়ণের কথা বলা হয়েছে। ঋগ্বেদের খিলসূক্ত সম্ভবত এই পর্বেই রচিত হয়েছিল। এই সূক্তে বিষ্ণুকে বাসুদেব-কৃষ্ণের সঙ্গে এক ও অভিন্নরূপে কল্পনা করা হয়েছে। সম্ভবত বৈদিক যুগের শেষ পর্বে বিষ্ণু বাসুদেব-কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দেখা দেন। কিন্তু নারায়ণের সঙ্গে বিষ্ণুর একাত্ম হতে আরও কিছু সময় লেগেছিল। শতপথ ব্রাহ্মণে বিষ্ণুর ত্রিপদ-নিক্ষেপের বর্ণনা আছে। 

অভিচার-ইন্দ্রজাল : অনার্যদের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংশ্রবের ফলে তাদের বেশ কিছু ধর্মীয় ধ্যান ধারণা, সংস্কার আর্যদের প্রভাবিত করে। জাদু, ডাকিনীবিদ্যা ইত্যাদি প্রক্রিয়া অনার্য সমাজে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তারা বিশ্বাস করতেন, এই সব অনুষ্ঠান যেমন নিজের অভীষ্ট সিদ্ধি করে, তেমনি শত্রুর অপূরণীয় ক্ষতি ঘটায়। অনার্যদের কাছ থেকে আর্যরা এই সব অভিচার সােৎসাহে গ্রহণ করেন। অথর্ববেদের অনেক স্তোত্রে বিভিন্ন অভিচারের সুফল বর্ণনা করা হয়েছে। তাছাড়া, অনার্যদের অনুকরণে আর্যরা সাপ, গাছ, পাথর, গান্ধার্ব ও অপ্সরাদেরও উপাসনা শুরু করেন। দানব, ভূত, প্রেত ও পিশাচে এ যুগের আর্যদের অগাধ বিশ্বাস ছিল। এর মূলেও ছিল সেই অনার্য অনুপ্রেরণা। এই সব অন্ধকারের অপশক্তিগুলোর কোপ থেকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য আর্যরা নানা ধরনের ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া অনুষ্ঠান করতেন। 

পুরােহিতের মর্যাদা ও শ্রেণিবিভাগ : যজ্ঞের ব্যাপকতা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় সমাজে পুরােহিতদের মর্যাদা বহুগুণে বেড়ে যায়। যজ্ঞ পরিচালনার মুখ্য দায়িত্ব এখন আর হােতার হাতে থাকল না। ব্রহ্মারূপে বর্ণিত পুরােহিতের উপর সে কাজের দায়িত্ব অর্পিত হল। যাগ-যজ্ঞে নতুন নতুন উপাচারের সংযােজন হওয়ায় ছয়টি নতুন পুরােহিত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এরা হলেন অছাবাক, গ্রাবস্তুৎ, সুব্রহ্মণ্য, উন্নেতা, ব্রাহ্মণাচ্ছংসী ও প্রতিস্থাতা। ফলে এই যুগে পুরােহিত শ্রেণির সংখ্যা বেড়ে ষোলােতে গিয়ে দাঁড়ায়। ব্রহ্মা, হােতা, উদ্গাতা ও অধ্বর্যর সহকারী রূপে পুরােহিতেরা আবার চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত ছিলেন।

একেশ্বরবাদ : একেশ্বরবাদের ধারণা ঋগ্বেদের যুগেও ছিল কিন্তু এ সময় সে তত্ত্ব আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। বহু দেবতার ভেতর দিয়ে একই ঈশ্বর বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। প্রজাপতি ব্রহ্মাই সেই এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বর। ইন্দ্র, রুদ্র-শিব, বিষ্ণু বাসুদেব প্রভৃতি দেবতারা সেই এক ও অদ্বিতীয় প্রজাপতিরই বিভিন্ন রূপ মাত্র।

জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদ : এ যুগের ধর্মীয় ক্ষেত্রে আর একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদের উন্মেষ ও বিকাশ। আরণ্যক ও উপনিষদে এর পরিচয় আছে। দেহের বিনাশ আছে কিন্তু আত্মার মৃত্যু নেই। মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মা অন্য দেহ ধারণ করে। মৃত্যুর সঙ্গেই মানুষের সব কিছুই শেষ হয়ে যায় না, সে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে। এই জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে তার অব্যাহতি নেই। তবে পুনর্জন্মের প্রকৃতি কী হবে তা মানুষের পূর্বজন্মের কৃতকর্মের উপরই নির্ভর করে। এ জন্যে কৃতকর্ম অনুযায়ী সে পরজন্মে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূকর, কুকুর বা চণ্ডালরূপে জন্মগ্রহণ করবে। সুতরাং মানুষের ভাগ্য দেবতারা নির্ধারণ করেন। মানুষ নিজেই তার ভাগ্য গড়ে।

যজ্ঞের প্রতি বিরূপতা : এ সময় একদিকে যেমন যাগ-যজ্ঞের ব্যাপকতা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে তেমনি যাগ-যজ্ঞের প্রতি অনেকের মন বিরূপ হয়ে ওঠে। এর একটি কারণ ব্যয়বহুলতা। যাগ-যজ্ঞের খরচ এমন বেড়ে যায় যে সাধারণ লােকের পক্ষে আর এ ধরনের ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা সম্ভব হত না। যজ্ঞে গবাদি পশু হত্যার ব্যাপারটা অনেকের কাছেই নিষ্ঠুর ও অনাবশ্যক বলে মনে হয়। তাছাড়া যজ্ঞের আর তেমন উপযােগিতাও ছিল না। যজ্ঞে ছিল সম্পদ, দীর্ঘায়ু, সন্তান ও স্বর্গের আশ্বাস। কিন্তু সেখানে জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মানুষের মুক্তির কোনও আশ্বাস ছিল না। অথচ পুনর্জন্ম পরম্পরার সমাপ্তি ঘটানােই এখন জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল। মানুষের বিশ্বাস হল, তপস্যা তথা জ্ঞানের অনুশীলনের মধ্যেই মুক্তির চাবিকাঠি রয়েছে; সম্পদ, প্রাচুর্য বা স্বর্গ নয়, ব্রহ্ম বা পরমাত্মা হচ্ছে একমাত্র সত্য। আত্মা বা জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার বাস। সর্বভূতে আত্মদর্শনই হল মনুষ্য জীবনের সার্থকতা। আসক্তি ও অজ্ঞতার বন্ধন ছিন্ন হলে জীবাত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়, মানুষকে আর জন্ম মৃত্যর বৃত্তে ফিরে আসতে হয় না। সবার মধ্যে আমি আছি, আরণ্যক-উপনিষদের এই বাণী এক কথায় তুলনারহিত। (যা সর্বাণি ভূতান্যাত্মনোবানুপশ্যতি। সর্বভূতেষু চাত্মানং ততাে ন বিজুগুপ্সতে – ঈশােপনিষদ, ৬। অর্থাৎ যিনি আত্মায় সর্বভূত এবং সর্ব ভূতে আত্মাকে দর্শন করেন, তিনি কাউকে দ্বেষ করেন না।) সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এক সূত্রে গাঁথার এমন বলিষ্ঠ প্রয়াস অন্যত্র বড় একটা দেখা যায় না।

জড়বাদ, বিজ্ঞান ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে বৈদিক আর্যদের অবদান

জড়বাদ : আরণ্যক-উপনিষদে এ ধরনের অধ্যাত্মবাদই শুধু প্রচারিত হয়নি, জড়বাদী তত্ত্বও উচ্চারিত হয়েছে। শাণ্ডিল্য ও যাজ্ঞবল্ক্যর মতাে ঋষিরা অধ্যাত্মবাদ প্রচার করে গেছেন কিন্তু ঋষি উদ্দালকের কণ্ঠে জড়বাদ ধ্বনিত হয়েছে। যা প্রত্যক্ষ হয় তার অতিরিক্ত কিছুর অস্তিত্ব জড়বাদীরা স্বীকার করেন না; ঈশ্বর, পরজন্ম ও আত্মার অস্তিত্ব তারা বিশ্বাস করেন না। তাদের ধারণা, দেহের বিনাশের সঙ্গে মানুষের সব কিছু শেষ হয়ে যায়। সুতরাং এ জীবনে যতখানি সম্ভব সুখ ভােগ করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এই সুখভােগের জন্য যদি অন্যের কাছে ঋণ করতে হয় তাও ভালাে।

বিজ্ঞানে অগ্রগতি : বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আর্যদের উন্নতির উল্লেখ না করলে বৈদিক সভ্যতার মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আর্যদের অগ্রগতি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এই উন্নতি ঘটেছিল বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, জ্যামিতি, ভেষজবিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে। শুধু চন্দ্র-সূর্য সম্পর্কেই নয়, অন্যান্য গ্রহনক্ষত্রাদি সম্পর্কেও তাদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। তাদের কাল-গণনা পদ্ধতি ছিল বিশদ ও প্রায় নিখুঁত। বছরকে তারা বারােটি মাসে ও মাসকে তারা ত্রিশটি তিথিতে ভাগ করেছিলেন। বিভিন্ন গাছ-গাছড়ার সাহায্যে তারা নানা প্রকার ওষুধ তৈরি করতেন। মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল গভীর। বৈদিক সাহিত্যে শরীরের প্রায় তিনশাে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উল্লেখ আছে। মানবদেহে যেসব রােগ দেখা দিত সে সম্পর্কেও আর্যদের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে বৈদিক আর্যদের অবদান : ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে বৈদিক আর্যদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কার আজও ভারতীয় জনজীবনকে ধারণ করে আছে তাদের বেশির ভাগেরই সূচনা হয় বৈদিক যুগে। ভারতীয় সমাজে যে বর্ণব্যবস্থা আজও চলে আসছে তা এই আর্যরাই প্রবর্তন করেছেন। জঙ্গল পরিষ্কার করে অধিকাংশ জমিকে কষির আওতায় এনে তারা ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির পথ প্রশস্ত করেছেন। কিন্তু ভারতীয় সভ্যতায় আর্যদের মহত্তম অবদান হল সংস্কৃত সাহিত্য ও উপনিষদের দর্শন। অনৈক্য যা তা বাইরে, ভেতরে মানব জাতি এক ও একাত্ম। এই বাণী উপনিষদের। অনার্যদের কাছ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করে আর্যরা আমাদের দেখিয়েছেন সংঘাত বা বিরােধ নয়, সমন্বয় বা সহমর্মিতা হল মানুষের আত্মােন্নতির পথ। বৈদিক ভাবধারা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের গ্রহণ, বিয়ােজন ও সংযােজনের মধ্য দিয়ে পরবর্তিকালে ভারতে নতুন নতুন চিন্তা ও প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। এমনকী, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি প্রতিবাদী ধর্মগুলোকে বৈদিক সংস্কৃতির পরােক্ষ ফসল বলে আখ্যাত করা বােধহয় অত্যুক্তি হবে না।

পরবর্তী বৈদিক যুগের পর ভারতবর্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ – ৫ম শতকে ষোড়শ মহাজনপদের উত্থান ঘটে। একই সময়ে ভারতবর্ষে মগধভিত্তিক সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটতে থাকে এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে পারসিক আক্রমণ ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ-৫ম শতকের ভারতবর্ষ ও মগধের উত্থান সম্পর্কে জানতে এখানে যান।

গ্রন্থপঞ্জি

আর্যসমস্যা ও বৈদিক সাহিত্য

  • খোন্দনাথ দাশগুপ্ত : আর্য-সভ্যতার সন্ধান (কলকাতা, ১৯৮৫)
  • গােপেন্দু মুখােপাধ্যায় : বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির রূপরেখা (কলকাতা, ১৯৮৮)
  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে – প্রথম পর্ব, সাহিত্যলোক, ২০২০, পৃ. ১৩৫-১৪৭
  • নৌরীনাথ শাস্ত্রী : সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস (কলকাতা, ১৩৮৪)
  • জাহ্নবীচরণ ভৌমিক : সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস (কলকাতা, ১৩৯০)
  • বিমানচন্দ্র ভট্টাচার্য : সংস্কৃত সাহিত্যের রূপরেখা (কলকাতা, ১৯৮০)
  • রামেশ্বর শ : সংস্কৃত ও প্রাকুত সাহিত্য : সমাজচেতনা ও মূল্যায়ন (কলকাতা, ১৯৮৩)
  • সরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় : সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস (কলকাতা, ১৩৮৯)
  • Lal, B. B. : The Earliest Civilization of South Asia (New Delhi, 1997)
  • Macdonell, A. A. : History of Sanskrit Literature (London, 1972)
  • Macdonell, A. A. and Keith, A. B. : Vedic Index of Names and Subjects: (Varanasi, 1958)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Vedic Age (London, 1951)
  • Renfrew. Colin : Archaelogy and Language-The puzzle of Indo-European Origins (London, 1987)
  • Sharma, R. S.: Looking for the Aryans (Madras, 1955): Advent of the Aryans in India (New Delhi, 1999)
  • Vaidya, C. V. : History of Sanskrit Literature, Vol. I: Sruti (Vedic) Period (Poona, 1930)
  • Winternitz, M : History of Indian Literature (Eng. Trans. By Mrs. S. Ketkar). Vol. I, (Calcutta, 1972) 

ঋগ্বেদের যুগ

  • খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত : আর্য সভ্যতার সন্ধান (কলকাতা, ১৯৮৫)
  • বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য : বৈদিক দেবতা
  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে – প্রথম পর্ব, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ২০২০, পৃ. ১৪৮-১৬৬
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা : প্রাচীন যুগ (কলকাতা, ১৯৯৪)
  • রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)
  • হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য : হিন্দুদের দেব-দেবী : প্রথম পর্ব (কলকাতা, ১৯৭৭)
  • Chakraborty, H. P. : Socio-Economic Life Of India In The Vedic Period (Calcutta, 1986)
  • Ghosal, U. N.: A History Of Indian Political Ideas (Bombay, 1959): Agrarian System In Ancient India (Calcutta, 1973).
  • Keith, A. B. : Religion and Philosophy of the Veda and Upanishads (Cambridge, Mass. 1925)
  • Macdonell, A. A. : Vedic Mythology (Strassburg, 1897)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Vedic Age (London, 1951)
  • Makhanlal : Senlement History And The Rise Of Civilization In The Ganga-Yamuna Doab: 1500 B.C.300 A.D. (Delhi, 1984)
  • Rapson, E.J. (Ed.): Cambridge History of India, Vol. I (Delhi, 1955)
  • Sharma, R. S.: Perspectives in Social and Economic History of Early India (Delhi, 1983) ; Material Culture and Social Formations in Ancient India (Delhi, 1985)

পরবর্তী বৈদিক যুগ

  • খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত : আর্য সভ্যতার সন্ধান (কলকাতা, ১৯৮৫)
  • গােপেন্দু মুখােপাধ্যায় : বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির রূপরেখা (কলকাতা, ১৯৮৮)
  • দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত-ইতিহাসের সন্ধানে – প্রথম পর্ব, কলকাতা, সাহিত্যলোক, ২০২০, পৃ. ১৬৭-১৮৬
  • বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য : বৈদিক দেবতা
  • ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় : ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা : প্রাচীন যুগ (কলকাতা, ১৯৯৪)
  • রণবীর চক্রবর্তী : প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে (কলকাতা, ১৩৯৮)
  • হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য : হিন্দুদের দেব-দেবী : প্রথম পর্ব (কলকাতা, ১৯৭৭)
  • Chakraborty, H. P. : Socio-Economic Life Of India In The Vedic Period (Calcutta, 1986)
  • Dange, S. A. : India From Primitive Communism To Slavery (Bombay, 1949)
  • Drekmeir. C. : Kingship And Community In Early India (Bombay, 1962)
  • Ghosal, U. N.: A History Of Indian Political Ideas (Bombay, 1959): Agrarian System In Ancient India (Calcutta, 1973).
  • Keith, A. B. : Religion and Philosophy of the Veda and Upanishads (Cambridge, Mass. 1925)
  • Koenraad, Elst: Indigenous Indians : Agastya to Ambedkar (New Delhi, 1993) 
  • Macdonell, A. A. : Vedic Mythology (Strassburg, 1897)
  • Majumdar, R. C. (Ed.): The Vedic Age (London, 1951)
  • Makhanlal : Senlement History And The Rise Of Civilization In The Ganga-Yamuna Doab: 1500 B.C.300 A.D. (Delhi, 1984)
  • Rapson, E.J. (Ed.): Cambridge History of India, Vol. I (Delhi, 1955)
  • Sethna, K. D. : The Problem Of Aryan Origins (New Delhi, 1992).
  • Sharma, R. S.: Perspectives in Social and Economic History of Early India (Delhi, 1983) ; Material Culture and Social Formations in Ancient India (Delhi, 1985)

সম্পর্কিত মানচিত্র-ভিত্তিক ভিডিও

ইন্দো-ইউরোপীয়দের অভিপ্রায়ণ (আর্কিওলজিকাল কালচার সহ)

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহ

ইন্দো-আর্য ভাষা

বৈদিক যুগ ও ঋগ্বৈদিক উপজাতিসমূহ

মহাজনপদ থেকে মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.