আকিমিনিদ সাম্রাজ্য ও পারসিক সভ্যতা

Table of Contents

ভূমিকা

হিট্টাইটদের মত ইরানী বা পারসিকরা কৃষ্ণ ও কাস্পিয়ান সাগরের উত্তর দিকে অবস্থিত স্তেপভূমি থেকে আগত ইন্দো-ইউরােপীয় জনগােষ্ঠি ছিল। প্রাচীন পারস্যের সভ্যতার কথা বিশ্ব ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলােচনা করা হয়। এই সভ্যতার সূচনা হয়েছিল অনেক আগে। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ের পূর্বে অর্থাৎ আকিমেনীয় রাজত্বের আগেকার পারসিকদের সম্বন্ধে জানার জন্যে বাস্তব প্রমাণ খুব একটা সহজলভ্য নয়। তারা ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষায় কথা বলত। আদি বাসস্থান থেকে বিভিন্ন কারণে তারা এমন এক স্থানে পাড়ি জমায় যেখানে আদিম জনগােষ্ঠির মানুষেরা বসবাস করত। কাস্পিয়ান সাগর এবং পারস্য উপসাগরের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন করার পর হিট্টাইটদের মত ইরানীরাও তাদের মেসােপটেমীয় প্রতিবেশীদের উন্নত সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। তবে ইরানীরা ইতিহাসের অন্যতম বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তােলে যা বিভিন্ন কৃষ্টি ও সভ্যতার অনুসারী জনগােষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত ছিল। ইরানী জনগােষ্ঠীর মধ্যে পারসিকরা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাদের একটি সামাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুদূরপ্রসারী ধারণা ছিল। সামরিক বিজয়ের প্রয়ােজনে সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করলেও তারা সাধারণত সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে কূটনীতির ওপর নির্ভর করত। ইরানীরা অধিককৃত ভূখণ্ডের জনগণকে নিজ প্রথা ও ধর্ম পালনের অধিকার বা স্বাধীনতা দিত। এভাবে ইরানী বা পারসিকরা নিকট প্রাচ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য গড়ে তােলে। এর আগে আর কোন জনগােষ্ঠি এত মেধা এবং মানবিকতা দেখাতে সক্ষম হয়নি। পারস্যের আকিমেনীয় বংশের বিখ্যাত সম্রাট সাইরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে মেসােপটেমিয়া এলাকায় সফল অভিযান চালিয়েছিলেন। তিনি ব্যাবিলন দখল করে হিব্রুদেরকে দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ইতিহাসে এ ঘটনা ব্যাপকভাবে আলােচিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার ওপর পারস্য সভ্যতার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। তারা একেশ্বরবাদী এক নয়া ধর্মমত বিশ্বকে উপহার দিয়েছিল। এই ধর্মমতের নানা দিক অন্যান্য জাতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। একসময় পারসিকরা এক মহা পরাক্রমশালী পরাশক্তি হয়ে ওঠে। ইউরােপের গ্রিস অব্দি তারা সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। মেসােপটেমিয়ার ক্যালদীয়দের সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেয়ার পর তাদের সভ্যতা সংস্কৃতির উপাদানসমূহকে তারা উপেক্ষা করেনি। নিজেদের প্রয়ােজনে এখান থেকে নানা উপাদান তারা আত্মস্থ করেছিল। বিভিন্ন জাতির সংস্পর্শে এসে তাদের শিল্পকলা সমৃদ্ধ হয়েছিল। তাদের চিত্রকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য রীতির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যান্য এলাকাতেও। পারস্যের অনুকরণে আর্য ভারতের সভ্যতার স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল। পারস্যের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা ও প্রাশাসনিক কাঠামাে বিশ্বের অন্যান্য জাতিকেও উদ্বুদ্ধ করেছিল। 

ইরানীয় অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থা

ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভির পর থেকে দেশটা ইরান নামে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায়। তার আগে পারসিয়া বা পারস্য নামে এর খ্যাতি ছিল। বড় বড় পর্বত, জ্বলন্ত মরুভূমি এবং দেশের মধ্যবর্তী স্থানে একটি প্রশস্ত মালভূমি নিয়ে ইরান গঠিত। ইরান দেশটি উত্তর দিকে কাস্পিয়ান সাগর থেকে দক্ষিণে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এদেশের বর্তমান আয়তন ১৬,৪৮,০০০ বর্গ কিলােমিটার। উত্তরাঞ্চলের কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী গামলার কানার মতাে এলাকাটি পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় সাড়ে ছ’শো কিলােমিটার দীর্ঘ। এই এলাকাটা ১৬ কি. মি. থেকে ১১৫ কি.মি. চওড়া। এছাড়াও কিছু কিছু সমভূমি আছে। তবে প্রাকৃতিক দেয়াল হিসেবে সুউচ্চ পর্বতমালার বিস্তৃতি আছে গোটা দেশে। প্রায় পুরাে ইরানেই স্থলভাগের উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ১৫০০ ফুট উঁচু। পশ্চিমে তাইগ্রীস-ইউফ্রেতিসের মধ্যবর্তী স্থান এবং পূর্বদিকে সিন্ধু উপত্যকার মধ্যে এক বিশাল আকৃতির মালভূমি অবস্থিত। এর চারদিকে পরিবেষ্টন করে রায়েছে অত্যুচ্চ পর্বত শ্রেণী যা ইরানের অভ্যন্তরীন ভূখণ্ডকে সমুদ্র থেকে পৃথক করেছে। ইরানের মধ্যবর্তী অঞ্চলের মালভূমি অত্যন্ত উঁচুতে অবস্থিত এবং এর ভূত্বক প্রশস্ত সমতল ভূমির সমন্বয়ে গঠিত। ইরানে দুটি বিশাল মরুভূমি রয়েছে। মরুভূমির বিভিন্ন স্থানে মরুদ্যান রয়েছে। সুউচ্চ ইরানী পর্বতমালা সাগর থেকে বাতাসে বয়ে আসা আর্দ্রতা বজায় রাখতে সহায়তা করে এবং এরফলে ইরানী সমভূমিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ইরানের অবশিষ্ট শুকনো এলাকার তুলনায় এই আধা-উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চল উর্বর ও সমৃদ্ধ। 

মধ্য অঞ্চলের মালভূমিকে পরিবেষ্টনকারী পর্বতশ্রেণী অসংখ্য মরুদ্যানের ফুটকি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এসব এলাকাও অত্যন্ত উর্বর। স্মরনাতীতকাল থেকে এ অঞ্চলটি ছােট ছােট জাগােষ্ঠির আবাসভূমি হিসেবে স্বর্গীয় পরিবেশের ন্যায় বিরাজমান। ইরানী মালভূমির কেন্দ্রস্থলে এমন একটি নীচু এলাকা রয়েছে যেখানে জল ও গাছপালা নেই। এই অঞ্চলটি গরমকালে এত বেশি গরম হয়ে ওঠে যে তা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। আবহাওয়ার এই নিম্নচাপ ও চরম প্রকৃতি এই অঞ্চলে দুটি পৃথক ও জ্বলন্ত লবণাক্ত মরু অঞ্চলের সৃষ্টি করেছে। সম্ভবত: এই অঞ্চলটি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবিরল এলাকা। এই দুটি মরুভূমি পূর্ব ও পশ্চিম ইরানকে পৃথক করেছে। ইরানের বিশেষ ভৌগলিক অবস্থান এবং দৈশিক ভূসংস্থানগত বিবরণ পর্যালােচনা করলেই বােঝা যাবে যে কেন এই দেশটি অতি পুরনোকাল থেকেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার সড়ক ও যাতায়াতের রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ভ্রাম্যমান পার্বত্য জনগােষ্ঠি রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার স্তেপভূমি বা স্তেপ অঞ্চল থেকে ইরানে স্রোতধারার মত প্রবেশ করে। কিন্তু অনতিক্রম লবণাক্ত মরুভূমির দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তারা হয় পূর্বদিকে অথবা পশ্চিমে চলে যায়। মেসােপটেমিয়া ও ভারতের বিভিন্ন উর্বর ও সমৃদ্ধশালী অঞ্চলে না পৌঁছানাে পর্যন্ত এই অগ্রসরযাত্রা অব্যাহত থাকে। এই অগ্রযাত্রা প্রক্রিয়ায় যােগাযােগ পথের দুধারে বিভিন্ন শহর গড়ে ওঠে। এ সময় থেকে ইরান এমন একটি অঞ্চলে পরিণত হয় যেখানে পার্বত্যবাসী যাযাবরেরা নগরবাসী সভ্য মানুষদের সাক্ষাৎ লাভ করে। ম্যাক কে. হিল এবং বাকলারের ভাষায় “যখন পূর্ব-পশ্চিম যোগাযোগের প্রাকৃতিক রেখা বরাবর নগরগুলোর উত্থান ঘটল, তখন ইরান হয়ে উঠল সেই অঞ্চল যেখানে যাযাবররা শহুরে বসবাসকারীদের সাথে সাক্ষাত করল। আর এই সাক্ষাতটি পূর্ব ও পশ্চিম উভয়দিকের সভ্যতার জন্যই খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।” (McKay et. al., 52-53) 

পারস্যের আদি ইতিহাস

ইরানের প্রাচীন ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল বহু আগে। প্রাচীন পারস্যের ইতিহাসকে প্রাগৈতিহাসিক, আদি ঐতিহাসিক ও আকিমেনীয় এই তিনভাগে ভাগ করা যায় –

১. প্রাগৈতিহাসিক যুগ

খননকাজের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহকে ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রাগৈতিহাসিক যুগ সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছেন পণ্ডিতরা। এই খননকাজ ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্যাপকভাবে পরিচালিত হতে শুরু করে। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে খননকাজের গতি মন্থর ছিল। বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আবারও জোরদার হয়েছে পুরাতাত্ত্বিক খননকাজ। খননকাজের ভিত্তিতে যে তথ্য পাওয়া গেছে তার ওপর নির্ভর করে এই যুগকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে – 

ক. প্রাচীন ও মধ্য প্রস্তর যুগের নিদর্শন : পারস্যের কারমান শাহ উপত্যকার খনন কাজের পর প্রত্নতত্ত্ববিদরা নিঃসন্দেহ হয়েছেন যে, পুরাতন প্রস্তর যুগের একেবারে প্রথম দিকেই এদেশে মানুষের বসতি ছিল। পশ্চিমাঞ্চলীয় জাগরােস পর্বতমালার গুহা নিদর্শন থেকে মধ্য পুরাতন পাথরের যুগের মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখান থেকে চকমকি পাথর ঘষে তৈরি করা মধ্য পাথরের যুগের হাতিয়ারের অস্তিত শনাক্ত করা গেছে। এছাড়াও বরদোস্তিয়ান নামে খ্যাত পুরাতন পাথরের যুগের মানুষের সন্ধানও পারস্যে পাওয়া গেছে। তেজস্ক্রিয় কার্বন বা কার্বন-১৪ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এসব মানুষ আনুমানিক খ্রি.পূ. ছত্রিশ হাজার অব্দের দিকে বাস করত। এরপর আনুমানিক খ্রি.পূ. ১২,০০০ থেকে খ্রি.পূ. ১০,০০০ অব্দের দিকে জর্জীয় মানুষরা এখানে বাস করতে শুরু করেছিল। 

খ. নব্যপ্রস্তর যুগ : নব্যপ্রস্তর যুগের গ্রাম-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। পারস্য থেকে তারা কৃষির আবিষ্কারের পর ঘরবাড়িতে স্থিতিশীল হতে শুরু করেছিল। শুরু করেছিল পশুকে পােষ মানাতে। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ বছর আগেকার কৃষিজীবী মানুষের বসবাসের প্রমাণ মিলেছে পশ্চিম ইরানের নানান জায়গায়। এগুলাের মধ্যে আছে আলিকোশ, আসিরাব, গঞ্জ-ই দরে, গুরান, জও ই-কেমি-শানির, করি, শাহি প্রভৃতি অঞ্চল। প্রাচীন পারস্যে আনুমানিক খ্রি.পূ. ৬০০০ অব্দের দিকে কৃষিজীবন বেশ ভালােভাবেই বিকশিত হয়েছিল। মেসােপটেমিয়া, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের সাথে সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যযুক্ত মানব বসতি এসময়ে গড়ে উঠেছিল। পারস্যে এসব বসতির মধ্যে লবণ মরুর প্রান্ত সীমানার তেপে সিয়াল্ক-এর প্রথম বসতি স্তর, খুজিস্তানের তেপে সব্জ‌, উত্তর-পূর্ব লুরিস্তানের গেদিন তেপের সপ্তম বসতিস্তর ও আজারবাইজানের হাজি ফিরােজ-এর বসতিস্তর বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। 

২. আদি ঐতিহাসিক যুগের সূচনাপর্ব 

পারস্যের আদি ঐতিহাসিক যুগের সূচনাপর্বের বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। লিখিত তথ্য প্রমাণও মেসােপটেমিয়া এলাকা থেকে পাওয়া গেছে। খ্রি.পূ. ৬ষ্ঠ শতাব্দীর গ্রিক ঐতিহাসিক হেরােডােটাসের লেখা থেকেও এ যুগের কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। মেসােপটেমীয় এলাকা থেকে পারস্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক যে আনুমানিক খ্রি.পূ. মধ্য তৃতীয় সহস্রাব্দের দিকেই বিকশিত হয়েছিল সে প্রমাণ বেশ ভালােভাবেই মিলেছে। হিসার সিয়াল্ক-এর বসতিস্তর থেকে প্রাপ্ত এলামীয় লেখ ও আফগানিস্তানের লাপিস লাজুলাই-এর মতাে আধা মূল্যবান পাথর এবং জাগরােসের পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনাবলি এই বাণিজ্যের প্রমাণ দেয়। আধুনিক খ্রি.পূ. ২৪০০ অব্দ ও তার পরবর্তীকালে উত্তর-পূর্ব ইরানের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসে। চিত্রিত মৃৎপাত্রের বদলে ধূসর ও ধূসর-কালাে মৃৎপাত্রের প্রচলন ঘটল ইরানে। ধারণা করা হয় যে, মানব বসতির পরিবর্তনের ফলেই রূপান্তর দেখা যায়। তামা ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ারের কিছু কিছু নমুনাও এযুগে পাওয়া যায়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে মেসােপটেমীয় প্রভাব বাড়তে থাকে ইরানে। 

এলামীয় সভ্যতা : আনুমানিক খ্রি.পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের দিকে খুজিস্তান এলাকায় গড়ে উঠেছিল এলামীয় সভ্যতা। এ সভ্যতা মেসােপটেমীয় সভ্যতার মতাে সমৃদ্ধি অর্জন করতে না পারলেও এ এলাকার সভ্যতার ইতিহাসে এর গুরুত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। যুক্তরাষ্ট্রীয় ধরনের শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল আদিযুগের এলামে। সুসা ছিল এর রাজ্যের রাজধানী। এখানকার শাসন পদ্ধতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এখানে রাজার পুত্রের বদলে পরবর্তী জীবিত ভাই তার উত্তরাধিকারী হতেন। রাজার জীবদ্দশা থেকেই তিনি তাকে সহায়তা করতেন। রাজার পুত্র বা পুত্রের অবর্তমানে ভাইপাে রাজধানী সুসার শাসক হতে পারতেন না। এই স্থান লাভ করতেন নতুন রাজার জীবিত পরবর্তী ছােট ভাই। যদি নতুন রাজার কোনাে ছােট ভাই না থাকত, শুধু সেক্ষণেই পরবর্তী রাজার পুত্র বা ভাইপাে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় মর্যাদাপূর্ণ আসনটি পেত। আনুমানিক খ্রি.পূ. ২৭০০ অব্দের দিক থেকেই আদি এলামীয় যুগের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু আনুমানিক খ্রি.পূ. ২০৯৪ থেকে খ্রি.পূ. ২০৪৭ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে তৃতীয় উর রাজবংশের রাজা শুলঘি-এর আমলে এলাম রাজ্য মেসােপটেমিয়ার অধীনে চলে যায়। একসময় এলামীয়রা বিদ্রোহ করে এবং আনুমানিক খ্রি.পূ. ২০০৪ অব্দে উর-এর শাসক ইব্বি-সিনকে বন্দি করে এলামে নিয়ে আসে। এরপর এলামের শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন এলাে। ক্ষমতার হাত বদলের পর আনুমানিক খ্রি.পূ. ১৭৬৪ অব্দে ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবি এলাম সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর ব্যাবিলনের রাজা সমসুইলুন (খ্রি.পূ. ১৭৪৯-১৭১২)-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যাবিলনীয়দের পরাস্ত করে এলামীয়রা নিজেদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে। এর পরবর্তী ইতিহাস ঘাত-প্রতিঘাত ও উত্থান পতনের। আসিরীয় হামলায় বিপর্যস্ত হলাে এলাম রাজ্য। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেল। এই যুগে আনুমানিক খ্রি.পূ. ৭৪২ অব্দে হুবন নুগশ নামের এক এলামীয় রাজার কথা জানা যায়। পরবর্তী একশাে বছরে এলামীয়রা অনেক শক্তি সঞ্চয় করল এবং বেশ কয়েকবার তারা হামলা চালাল মেসােপটেমীয়ায়। এতে যথেষ্ট বিরক্ত হলেন সেখানকার নৃপতিরা। ফলশ্রুতিতে আসিরীয় সম্রাট আসুরবানিপাল (আনু. খ্রি.পূ. ৬৬৮-খ্রি.পূ. ৬২৬) এলাম রাজ্যকে ধ্বংস করে দেন। রাজধানী সুসার স্থাপত্যকর্মসমূহও তখন ধ্বংস হয়ে যায়।

৩. আদি ঐতিহাসিক ও আকিমেনীয় যুগ 

পারস্যের ইতিহাসের আদি ঐতিহাসিক ও আকিমেনীয় যুগ লৌহযুগের অন্তর্ভুক্ত। এযুগেরই মিডিয়া ও পারসিকদের আগমন ঘটেছিল ইরানে। পারস্য সভ্যতার খ্যাতিমান যে অধ্যায় আমাদের পরিচিত তা এই পর্বের অন্তর্ভুক্ত।

ইরানের লৌহযুগ : পারস্য সভ্যতা বলতে যে সভ্যতাকে আমরা জানি তার বিকাশ ঘটেছিল লৌহযুগে। এই সভ্যতার ধারক ও বাহকরা বাইরে থেকে ইরানে এসেছিল। এযুগ আবার তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। এর তৃতীয় পর্যয়ে পারস্য সভ্যতা প্রকৃত খ্যাতি পেয়েছে। লৌহযুগের কালপর্বের প্রথম পর্ব ছিল আনু. খ্রি.পূ. ১৩০০ থেকে খ্রি.পূ. ১০০০ অব্দ পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্ব ছিল আনু. খ্রি.পূ. ১০০০ থেকে খ্রি.পূ. ৭৫০ অব্দ পর্যন্ত, এবং তৃতীয় পর্ব ছিল আনু. খ্রি.পূ. ৭৫০ – খ্রি.পূ. ৫৫০ অব্দ পর্যন্ত। পৃথিবীর নানা অঞ্চলের সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছিল যারা তাদেরই একদল মানুষ। ইরানে লৌহযুগের সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। এরা এসেছিল প্রাচীন পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলের তৃণভূমি বা স্তেপ থেকে। এদের নাম ইন্দো-ইউরােপীয়। প্রাচীন দুটি তৃণভূমি বা স্তেপের একটি হলো উত্তরাঞ্চলীয় তৃণভূমি যা দানিয়ুব নদীর নিম্নাঞ্চল থেকে পূর্ব দিকে অবস্থিত ও রাশিয়ার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে কৃষ্ণসাগরের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে ইন্দো-ইউরােপীয় জনগোষ্ঠী বাস করতো। এদের একটি শাখা ছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব শাখা। এই শাখার একটি শাখা দক্ষিণে অগ্রসর হয়। এদের একটি অংশ দক্ষিণ-পূর্ব ভারতে চলে যায়। আরেকটি অংশ দক্ষিণ পশ্চিম হয়ে ইরানে বসতি গাড়ে। এদের দুটো প্রধান গােত্র হলাে- মেডেস ও পার্মিয়। এরা খ্রি.পূ. ৬০০ অব্দের দিকে কৃষ্ণ সাগর ও পারস্য উপসাগরের মধ্যবর্তী এলাকায় পারস্য সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। ইন্দো-ইউরোপীয়দের আরেকটি শাখা ছিল পশ্চিম শাখা। এরা আনুমানিক খ্রি.পূ. ২০০০ অব্দের দিকে দানিয়ুব নদী পার হয়ে এরা বলকান উপদ্বীপে পৌছেছিল। এদের বংশধারাই রােমান ও গ্রিক সভ্যতা গড়ার দাবিদার। এছাড়া আরেকটি তৃণভূমি বা স্তেপ অঞ্চল হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলীয় তৃণভূমি যা আরবের মরুভূমির প্রান্তভাগে অবস্থিত। এখানে সেমিটিক জাতির বসবা।

পারস্য নামের উৎস ও ফার্সি ভাষার উদ্ভব : পারস্য শব্দটি এসেছে পার্স থেকে। এটি একটি ভাষার নাম। প্রাচীনকালে এই ভাষাটি ব্যবহৃত হতাে। দক্ষিণ ইরানের পার্সিস বা ফারস অথবা ফার্সিস্তান প্রদেশের আদিবাসীদেরকে পার্সি বা ফারসি বল হয়। এদের মুখের ভাষা ফারসি ইন্দো-ইউরোপীয় উৎসের একটি ভাষা। এই ভাষার সাথে প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত ভাষার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। ভারতীয় ও পারস্যের ভাষাগুলোর আদি উৎস একই স্থানে ছিল। ক্রম রূপান্তরের মাধ্যমে এই ভাষাগুলাের পৃথক পৃথক ভাবে বিকশিত হয়েছে। আদি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে ইন্দো-ইরানীয় ভাষার শাখাটি বের হয়ে যায়, এর থেকে একটি শাখা ভারতের দিকে গিয়ে ইন্দো-আর্য ভাষা তৈরি করে, সেখান থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১২০০ অব্দে ভারতের পাঞ্জাব পর্যন্ত অঞ্চলে বৈদিক ভাষার উদ্ভব হয়, সেখান থেকে ভারতের অন্যান্য ইন্দো-আর্য ভাষার উদ্ভব হয়। অন্যদিকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে ইন্দো-ইরানীয় শাখার আরেকটি শাখা পারস্যের দিকে গিয়ে ইরানীয় ভাষা তৈরি করে, সেই ভাষা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়, পশ্চিমে ইরানের দিকে পশ্চিম ইরানীয় শাখা ও পূর্বে আফগানিস্তানের দিকে পূর্ব ইরানীয় শাখার সৃষ্টি হয়। পশ্চিম শাখা থেকে প্রাচীন ফারসি ও মেডিয়ান ভাষা এসেছে, প্রাচীন ফারসি থেকে মধ্য ফারসি ও আধুনিক ফারসির উদ্ভব হয়েছে। অন্যদিকে পূর্ব শাখা থেকে আবেস্তান ভাষার উদ্ভব হয়, পরে আফগানিস্তানের পুশতো ভাষার উদ্ভব হয়। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী পাসীয়রা পার্সিপােলিস ও পাসারগাদিয়া নামের দুটো বিখ্যাত শহর গড়ার কৃতিত্বের অধিকারী। এই শহর দুটোকে গ্রিকরা বলত যথাক্রমে পার্সা ও পারসিস।

মেডেস এবং পারসিকদের আগমন এবং মেডিয়া রাজ্য ও তার পতন

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে ইরানীরা এই এলাকায় প্রবেশ করে। ইরানীরাও ছিল অভিবাসী যারা তাদের লােকজন এবং পশুপাখীসহ কাস্পিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণসাগর এলাকা থেকে পাড়ি জমায়। ভারতে প্রবেশ করা তাদের ইন্দো-আর্য স্বজনদের মত তারাও ঘােড়া প্রজননকারী ছিল। ঘোড়ার ব্যবহার ইরানে বসবাসকারী অনান্য প্রাগৈতিহাসিক জনগােষ্ঠির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তাদেরকে সামরিক দিক থেকে সাহায্য করে। ইরানীরা ঘােড়ায় টানা রথে চড়ে বা ঘােড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করত এবং তাদের মুখােমুখি হওয়া মাত্র দেশীয় বা স্থানীয় পক্ষের সৈনিকদের অতি সহজেই পরাজিত করত। তবে ইরানীরা শত শত বছর যাবত এ ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে থাকে এবং এর ফলে নবাগত এবং স্থানীয় বিজেতাদের মধ্যে অব্যাহত সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময় চলতে থাকে। বর্তমান তেহরান থেকে ১২৫ মাইল দক্ষিণে সিয়ালক (Siyatk) নামক স্থানে খননকার্যের ফলে এমন কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে যা থেকে প্রমাণিত হয় যে ইরানীয় ও স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে পারস্পারিক সংঘাত হয়। সিয়াল গ্রামে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ইৱানীদের নিকট পরাজিত হওয়া পর্যন্ত মানুষ বাস করত। এই নবাগতরা যুদ্ধের মাধ্যমে স্থানীয় প্রতিদ্বন্দী ইরানী এবং এ্যাসিরিয়াদেরাকে পরাজিত করে। কারণ অ্যাসিরীয়রা তাইগ্রীসের পূর্বদিক পর্যন্ত আক্রমন করত। নবাগত ইরানীদের অধীনে সিয়াল একটি দূর্গ সজ্জিত শহরে পরিণত হয়। সেখানে একটি রাজপ্রাসাদ ও মন্দির ছিল। সবকিছুই প্রাচীর পরিবেষ্টিত ছিল। দুর্গ এবং কেল্লার চারপাশে নির্মিত সমতল উপরিভাগযুক্ত ঢিপির দ্বারা এই প্রাচীরের শক্তি বাড়ানাে হয়। শহরটি মাঠ ও খামার পরিবেষ্টিত ছিল। কারণ কৃষিকাজ ছিল এই উদীয়মান সমাজের ভিত্তি স্বরূপ। যাই হোক, ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠী পশ্চিম ইরানীয় ও পূর্ব ইরানীয়তে ভাগ হয়ে যায়, পূর্ব ইরানীয়রা আফগানিস্তান-বালখ এর দিকে আর পশ্চিম ইরানীয়রা মধ্য ও পশ্চিম ইরানের দিকেই মোটামুটি অবস্থান নেয়, পারস্যে পশ্চিম ইরানীয়রাই ছিল, যাদের মধ্যে মেডেস এবং পারসিকরা ঐতিহাসকভাবে খুবই গুরুত্ব লাভ করে। প্রাচীন পারস্যের ছােট ছােট কিছু রাজ্য বহুকাল আগে থেকে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। এগুলাের মধ্যে একসময় মিডিয়া রাজ্য শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পরে ঐ রাজ্যের পতনের পর পারস্য সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়। এরা ছাড়া আর যেসব জনগােষ্ঠির আগমন ঘটে তারা বিভিন্ন এলাকায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বসবাস করা শুরু করে। 

প্রথমদিকে ইরানীরা জোড়াতালি দিয়ে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গড়ে তােলে। এই জোড়াতালির একটি অংশ ছিল সিয়াক। এই রাজ্যের প্রধান বা ক্ষুদ্র রাজা ছিলেন মূলত একজন Warlord। তার ভ্যাসাল বা অধীনস্থ ভূস্বামী ও যােদ্ধারা তাকে সাহায্য ও সহযােগিতা দান করত। অভিজাত যােদ্ধার দল অনেকাংশে ইলিয়ডে বর্ণিত গ্রীক বীরদের মত ছিল। তারা সেনাবাহিনীর যুদ্ধের মল শক্তির উৎস ছিল। রাজা এবং অভিজাত শ্রেণীর ভরণপােষণের মাধ্যম ছিল জায়গীর বা এস্টেট। তবে অতিরিক্ত আয়ের জন্য তিনি করারােপ করতেন। প্রজারা অর্থের পরিবর্তে শস্য বা দ্রব্যসামগ্রীর মাধ্যমে এসব কর পরিশােধ করত। সামাজিক দিক থেকে রাজা এবং অভিজাত যােদ্ধাদের নীচেই অবস্থান ছিল স্বাধীন মানুষদের যারা জমির মালিকানা স্বত্ব লাভ করত অথবা করত না। সমাজের চাহিদা অনুযায়ী শিল্পী ও কারিগররা বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করত। তবে সমাজের তলদেশে অবস্থান ছিল সম্ভবত দেশীয় ও নবাগতদের। তারা রাজা ও অভিজাতদের জন্য কায়িক পরিশ্রমের কাজ করত। তারা কঠোর পরিশ্রম করত। প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হয়। লােহার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকে লােহার তৈরী কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এরফলে উৎপাদনও বাড়াতে থাকে। ফলে এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। জনগণের জীবন-যাত্রারও উন্নতি হয়। একই সময়ে ইরানী কৃষি ক্ষেত্রে ছােট ছােট জমিদারী বা তালুক গড়ে ওঠে। কৃষকেরা ছােট ছােট ভূখণ্ডে চাষাবাদ করত এবং দেশের সমৃদ্ধির সাথে সাথে একটি শক্তিশালী কৃষক শ্রেণী গড়ে ওঠে। এই কৃষক গােষ্ঠি সমকালীন মিশর এবং মেসােপটেমীয় কৃষকদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভােগ করত। ইরানে প্রচুর খনিজ সম্পদ মজুদ ছিল এবং এখানকার লােহা, তামা, এবং নীলকান্তমনি অ্যাসিরীয়দের ইরানের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলত। তবে ইরানীদের অশ্ব প্রজনন প্রক্রিয়া বিহির্বিশ্বের সাথে ইরানের লাভজনক বাণিজ্য বৃদ্ধি করে। ইরানী রাজারা প্রত্যাশা করতেন যে অ-ইরানী ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে এসে ইরানকে প্রচুর রাজস্ব প্রদান করুক এবং সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়তে সহায়তা করুক। স্থল বাণিজ্যের মাধ্যমে ইরানীদের সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সরাসরি যােগাযোগ গড়ে উঠে। 

এভাবে সময়ের ব্যবধানে মেডেস ও পারসিকরা একীভূত হয়ে বৃহত্তর একক জাতিস্বত্ত্বার সৃষ্টি করে। পারসিকরা দক্ষিণ ইরানের ফারস্ এলাকার পারসিস নামক বসতি গড়ে তোলে। অন্যদিকে তাদের স্বজন মেডেসরা মেডিয়া নামক স্থান দখল করে। মেডিয়া উত্তর দিকে আধুনিক হামাদান অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তাদের রাজধানীর নাম ছিল একবাতানা। মেডেসরা সব সময় উত্তরের বিভিন্ন পার্বত্য জাতির আক্রমনের শিকার হত। তবে তাদের সবচেয়ে বড় বিপদের হুমকি ছিল অ্যাসিরীয়রা। অ্যাসিরীয়দের চাপের মুখে মেডেসরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লেও খ্রিস্টপূর্ব ৭১০ অব্দে মেডেসরা পুনরায় একজন রাজার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং দক্ষিণে পারসিকদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার সম্প্রসারণ ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৬১২ অব্দে মেডেসরা এতবেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে তারা এসিরীয় সাম্রাজ্যকে উৎখাত করার জন্য ব্যবিলনীয়দের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে। মেডেসদের উত্থানের ফলে এই অঞ্চলের শক্তির ভারসাম্য প্রথমবারের মত মেসােপটেমিয়ার পূর্বদিকে চলে যায়। পারস্যের মিডিয়া অঞ্চলের মিডিয়া সাম্রাজ্য শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর প্রতিবেশী রাজ্যের ওপর তা প্রভাব বিস্তার করে। প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাস হেরােডােটাসের মতানুযায়ী এই রাজ্যটি ডাইওসেসের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল। আনুমানিক খ্রি.পূ. ৭২৮ থেকে খ্রি.পূ. ৬৭৫ অব্দের মধ্যে তিনি রাজত্ব করেছিলেন বলেও হেরােডােটাসের বিবরণ থেকে জানা যায়। তার রাজধানী ছিল একবাতানায়। জায়গাটা বর্তমান ইরানের হামাদানে অবস্থিত ছিল। প্রথম দিকে এই সাম্রাজ্য তেমন শক্তিশালী না থাকলেও পরে পরাক্রমশালী আসিরীয়দের প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেছিল। মিডিয়ার রাজা সাইয়াকসারিজ এক বিশাল সেনাদল গড়ে তুলেছিলেন। তার সেনাদল ছিল তিনভাগে বিভক্ত ছিল – ১। বর্শাধারী বাহিনী ২। তীরন্দাজ বাহিনী। ৩। অশ্বারােহী বাহিনী। আনুমানিক খ্রি.পূ. ৬১৪ অব্দে এই সেনাবাহিনী মেসােপটেমিয়ার নিনেভে হামলা চালায় বলে প্রাচীন বর্ণনা থেকে জানা যায়। অসিরিয়ার রাজধানী আসুর নগরীটি এই বাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়। ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠা মিডিয়ার রাজা সাইয়াকসারিজ ব্যাবিলানিয়ার সম্রাট নবােপোলাসারের পুত্রের সাথে নিজের নাতনীর বিয়ে দেন। ব্যবিলােনিয়ার সাথে জোটবদ্ধভাবে আসিরীয় সাম্রাজ্যের ওপর হামলা চালায় মিডিয়া এবং মিডিয়ার একক উদ্যোগেই আনুমানিক খ্রি.পূ. ৬১২ অব্দের আগস্ট মাসে নিনেভার পতন হয়। এমনকি আসিরীয় বাহিনীকে সিরিয়ার দিকে তারা ধাওয়া করে নিয়ে গেল। আসিরীয় সাম্রাজ্যের অবসানের পর মিডিয়ারাজ সাইয়াকসারিজের সাম্রাজ্য হেলিস নদীর পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র আনাতােলিয়া, তেহরান পর্যন্ত পুরাে পশ্চিম ইরান ও ফারস সহ দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের পুরাে এলাকায় বিস্তৃত হয়েছিল। সাইয়াকসারিজের (আনুমানিক খ্রি.পূ. ৬২৫-খ্রি.পূ. ৫৮৫) পর তার পুত্র আস্টিয়াজেস (আনু. খ্রি.পূ. ৫৮৫ খ্রি.পূ. – ৫৫০ খ্রি.পূ.) এই সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। ধারণা করা হয় যে, তিনিই ছিলেন মিডিয়ার শেষ শাসক। শেষ দিকে মিডিয়া সাম্রাজ্যের অধিপতি ভােগ-বিলাস ও স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করতে থাকেন। বিশাল সাম্রাজ্যের প্রশাসনের ওপর সুদঢ় নিয়ন্ত্রণ রক্ষার ব্যাপারে তিনি তেমন একটা নজর দেননি। ফলে এই সাম্রাজ্যের কাঠামাে হয়ে পড়ে শিথিল। এই পরিস্থিতিতে আনশান নামের ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা সাইরাস মিডিয়া রাজ্য দখল করেন। সেই সাথে অবসান হয় মিডিয়া সাম্রাজ্যের। 

আকিমিনিদ সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস

আকিমেনিস প্রতিষ্ঠিত আকিমিনিদ রাজ্য

দক্ষিণ পশ্চিম ইরানের ফার্স অঞ্চলের আনশান রাজ্যের রাজপুত্র আকিমেনিসে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাম অনুসারেই তার বংশধরদের প্রতিষ্ঠা করা পারস্য সাম্রাজ্যের নাম হয় আকিমিনিদ সাম্রাজ্য। কিন্তু হখামনিষ বলে আদৌ কোনও রাজা ছিলেন কিনা তা নিয়েই সন্দেহ আছে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের প্রারম্ভে চইষপইষ নামে এক ভাগ্যান্বেয়ী পারসিক সম্ভবত এই রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম দিকে এই রাজ্যটির তেমন কোনও প্রতিষ্ঠা ছিল না। সাইরাস এই চইষপইষের প্রপৌত্র ছিলেন। যাই হোক, চইষপইষ বা আকিমেনিস যেই হোন না কেন, তারপর একে একে তেইস্পেস, প্রথম সাইরাস এ প্রথম ক্যাম্বিসেস আকিমিনিদ রাজ্যের অধিপতি হন। ক্যাম্বিসেসের পর এই রাজ্যের আধিপতি হন দ্বিতীয় সাইরাস। তিনি খ্রি.পূ. ৫৫৯ অব্দে রাজ্যের অধিপতি হন। মিডীয়দের ভােগবিলাসী জীবনের বিপরীতে পরিশ্রমী ও আদর্শবান পার্সিকরা এক উন্নত সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল।

সাইরাস দ্য গ্রেট (৫৫৯ – ৫৩০ খ্রি.পূ.) 

সাইরাস কর্তৃক পারসিক সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা : বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে সাইরাসের (৫৫৯ – ৫৩০ খ্রি.পূ.) নাম অম্লান মর্যাদায় সমুজ্জ্বল। প্রাচীন সূত্র থেকে জানা যায় যে, তিনি ছিলেন মিডিয়ার শেষ রাজার জামাতা। কারাে কারাে মতে তিনি ছিলেন তার নাতি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই পারসিক জাতিকে তার শাসনাধীনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। সর্বকালের সেরা একজন শাসক ও বিজেতা হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। তার আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্ব তাকে জনপ্রিয় করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে পারস্যের রাজা এবং ইতিহাসের একজন বিখ্যাত রাষ্ট্রনীতিক মহান সাইরাস মেডেসদের শাসন কর্তৃত্ব উৎখাত করেন এবং তাদের পরাজিত ও দখল করেন। তিনি মেডিয়াকে তার সাম্রাজ্যের প্রথম সত্রপী (Satrapy) বা প্রদেশে পরিণত করেন। এরপর তার রাজ্য পারস্য সাম্রাজ্য নামে পরিচিত হয়। সাইরাস তার জীবদ্দশায় এই সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের অন্যতম বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দুটি বৈশিষ্ট্য সাইরাসকে সাধারণ যােদ্ধা ও রাজাদের থেকে পৃথক করেছে। প্রথমত তিনিই প্রথম ইরান দেশ সৃষ্টি করার কথা কল্পনা করেন। তিনি শুধুমাত্র পারস্য ও মেডিয়া রাজ্য গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন না। সাম্রাজ্য গঠন সংক্রান্ত তার এই চিন্তাধারা বহু উত্থান পতন, ঝড় ঝাপটা ও জটিল অবস্থার মধ্য দিয়ে এখনও বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে টিকে রয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে ইরান বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে সাইরাস অত্যন্ত জ্ঞানদীপ্ত ধারণা পােষণ করতেন। তিনি যথার্থই উপলদ্ধি করেন যে ইরানী সেনাবাহিনীর পদানত হয়েছে এমন অনেক সভ্যতা ও সংস্কৃতি রয়েছে যেগুলো ইরানী সভ্যতা ও সংস্কৃতির চেয়ে অনেক বেশি উন্নত, অনেক পুরনো এবং অনেক বেশি সমৃদ্ধ। তিনি মিশরীয়দের সংকীর্ণ চিত্তের হীনমন্যতা, ইহুদীদের ধর্মান্ধতা, এবং অ্যাসিরীয়দের পরিকল্পিত নিষ্ঠুরতার প্রভাবমুক্ত ছিলেন। তিনি পারসিক সাম্রাজ্যের সব অংশের জনগণকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সম্মান এবং নিরাপত্তা দান করেন। বিজিত অঞ্চলের জনসাধারণ সাইরাসের শাসনাধীনে অব্যাহতভাবে তাদের প্রথা, ধর্ম, প্রতিষ্ঠান, রীতিনীতি, ভাষা এবং জীবনযাত্রা প্রণালী উপভােগ করতে থাকে। সাইরাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পারসিক সাম্রাজ্য এমন এক রাজনৈতিক একক পরিণত হয় যার মধ্যে বিশাল এলাকা এবং বিচিত্র জনগােষ্ঠীর ওপর শাসন করতে অসাধারণ মেধা, বুদ্ধিমত্তা, অনুভবশীলতা এবং পৃথিবী সম্বন্ধে বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি থাকার প্রয়ােজন ছিল। পারসিকরা কোন কোন সময় নিষ্ঠুরতা দেখালেও (বিশেষ করে বিদ্রোহীদের প্রতি) অধিকাংশ পাবসিক শাসক ছিলেন জ্ঞানদীপ্ত। এরফলে পারসিকরা প্রাচীন নিকট প্রাচ্যকে দুশাে বছরের বেশি সময় ধরে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা দানে সক্ষম হয়। প্রতিবেশী রাজ্যসমূহের দূর্বলতা তার রাজ্য বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল। বিশেষ করে ক্যালদীয় সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সংকট সাইরাসের জন্যে সহায়ক হয়েছিল। সে যুগে দুর্বলকে সমীহ করার নীতির মূল্য ছিল না, অন্তত রাজনীতির ক্ষেত্রে। তাই নিজের অস্তিত্বের সুরক্ষার প্রয়ােজনে সাইরাসকে বহির্মুখী হতে হয়েছিল। এছাড়াও কৃষি নির্ভর অর্থনীতির যুগে কৃষিতে অনগ্রসর পারস্যের আর্থিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে অধিকতর সম্পদের প্রত্যাশায় সাইরাস সাম্রাজ্য বিস্তারে মনােযােগী হয়েছিলেন। 

তদকালীন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পরিস্থিতি : ইরানকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার পর সাইরাস বৃহত্তর পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। এক্ষেত্রে তার লক্ষ্য ছিল মূলত: দুটি। প্রথমত, পশ্চিম দিকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং ইরান ও আনাতােলিয়ার মধ্যবর্তী সড়ক পথের উভয় দিকের বন্দরগুলো দখল করা। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন পার্বত্য উপজাতির চাপ বা হামলার হাত থেকে সাইরাস পূর্ব ইরানকে রক্ষা করা। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে এসব লক্ষ্য অর্জন করা অত্যন্ত দুরূহ ছিল। কারণ ইরানের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত আনাতােলিয়ায় ছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত লিডীয় সাম্রাজ্য। লিডীয় সাম্রাজ্যের সম্রাট ক্রিসাস (croesus) সে যুগে নিজের বিত্ত ও বৈভবের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। এ সময় ইরানের পশ্চিম দিকে ছিল ব্যবিলন। অ্যাসিরিয়রা একসময় ব্যাবিলন দখল ও তা ধ্বংস করে। কিন্তু ব্যাবিলন এসময় একটি নতুন শক্তি হিসেবে প্রায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ইরানের দক্ষিণ পশ্চিমে ছিল মিশর যা সে সময় দুর্বল হলেও সাগর ও মরুভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত এ দেশের প্রতিরক্ষা বাবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। আবার ইরানের পূর্বদিকে এসময় বিভিন্ন অনমনীয়, উদ্ধত, শক্তিশালী ও ভ্রাম্যমান পার্বত্য জাতি বসবাস করত। এসব পার্বত্য জাতি যে কোন সময় ইরানী ভুখণ্ডে প্রবেশ ও গণধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাতে সক্ষম ছিল। সাইরাস প্রথমে ৫৪৯ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে মেডেসদের শাসককে পরাজিত করেন এবং পারস্য উপসাগর থেকে এশিয়া মাইনরের হালিস নদ (Haleys River) পর্যন্ত বিস্তৃত সমস্ত ভূভাগ দখল করেন। 

সাইরাসের লিডিয়া দখল : এশিয়া মাইনর দখলের ফলে ইরান এশিয়া মাইনরের অর্ধাংশে পশ্চিম দিকে হালিস নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত লিডিয়া রাজ্যের প্রতিবেশি শক্তিতে পরিণত হয় । লিডীয়রা ছিল ইন্দো-ইউরােপীয় বংশােদ্ভূত এবং এ অঞ্চলে হিট্টাইট শক্তির পতনের পর তারা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তােলে। হিট্টাইটরা অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধি লাভ করে। কারণ এ অঞ্চলে অনেক স্বর্ণখনি ছিল এবং লিডীয়রা মােসােপটেমিয়া থেকে ঈজিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী স্থল বাণিজ্যে মধ্যস্থকারী শক্তি অথবা ব্যবসায়ের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করত। এই বাণিজ্যিক তৎপরতার অংশ হিসেবে এবং বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে লিডীয়রা ধাতব মুদ্রা উদ্ভাবন করে। দ্রব্যের মূল্য ও কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে এ মুদ্রা প্রদান করা হত। এই মুদ্রা ব্যবস্থার প্রবর্তন মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে লিডীয়দের একটি অবিস্মরণীয় ও স্থায়ী অবদান ছিল। মিডীয় সাম্রাজ্যের ওপর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর ঐশ্বর্যশালী লিডীয় সাম্রাজ্যের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেছিলেন সাইরাস। সাইরাস লিডীয় সীমান্তে উপনীত হবার সময় লিডিয়ার রাজা ছিলেন ক্রিসাস। তিনি এত বেশি বিত্তবান ছিলেন যে, পরবর্তীকালে কয়েকটি ইউরােপীয় ভাষায় “rich as croesus” বা ক্রিসাসের মত ধনী প্রবচনটি চালু হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৬ অব্দে ক্রিসাস সাইরাসের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের আয়ােজন করেন। তিনি মিশরীয় ও ব্যাবিলনীয় মিত্রদের থেকে সাহায্য নেবার সুযোগ পাননি। লিডীয়ার রাজা ক্রিসাসের সাথে খ্রি.পূ. ৫৪৭ অব্দের দিকে হ্যালিস নদী তীরে সাইরাসের যুদ্ধ হয়। কিন্তু ফলাফল চূড়ান্ত হবার আগে ক্রিসাস রাজধানী সার্দিসে সৈন্য সংগ্রহের জন্যে ফিরে গেলে অতর্কিতে তার রাজধানীতে হামলা চালিয়ে সাইরাস লিডীয়ার রাজধানী দখল করে নেন, লিডীয়রা পারসিক বাহিনির উটের গন্ধে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল এমনও জানা যায়। যাই হোক, যুদ্ধের ফলস্বরূপ ক্রিসাস পরাজিত হন ও লিডীয় সভ্যতার অবসান ঘটে। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরােডােটাস-এর বিবরণ অনুযায়ী ক্রিসাস ডেলফির মন্দিরে গমন করেন এবং এই দৈববানী লাভ করেন যে ক্রিসাস হ্যালিস নদী অতিক্রম করলে একটি মহান জাতিকে ধ্বংস হবে। এই যুদ্ধে একটি মহান জাতি ধ্বংস হয় ঠিকই, কিন্তু তা পারসিক নয়, বরং লিডীয়। সাইরাস হ্যালিসের প্রান্তসীমায় লিডিয়ার রাজধানী সারদিস দখল করেন ও লিডিয়া পারসিক সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। সাইরাস ছিলেন একজন মানবতাবাদী নেতা যিনি ক্রিসাসকে একজন সম্মানিত অতিখির মর্যাদা দেন ও একবাতায়নায় তাকে বসবাস করার অনুমতি দেন। সেখানে খৃষ্টপূর্ব ৫২৫ অব্দে ক্রিসাসের মৃত্যু হয়। লিডিয়া ছাড়াও একই সাথে সাইরাস আনাতােলিয়ার উপকূলে অবস্থিত গ্রীক শহরগুলো দখল করেন। হ্যালিস নদীর পশ্চিম তীরবর্তী আনাতােলিয়ার পশ্চিমাংশের গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলাে সহ পুরাে লিডিয়া রাজ্য পারস্যের অধীনস্ত হলাে। অবশ্য গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলাের মধ্যে মিলেটাস ছাড়া অন্যগুলােকে যুদ্ধের মাধ্যমে বশে আনতে হয়েছিল তাকে। এভাবে বর্তমান তুরস্কের অর্ধাংশে বিস্তৃত লিডীয়া ও প্রতিবেশী গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলাে সাইরাসের শাসনাধীনে এলো। এরফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মত পারসিক ও গ্রীকদের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপিত হয়। লিডিয়া বিজয়কে সাইরাসের প্রকৃত প্রথম বিদেশী রাজ্য জয় বলে মনে করা হয়।

লিডিয়া ও সাইরাসের লিডিয়া ও আয়োনিয়া বিজয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান

সাইরাসের ব্যাবিলনিয়া বিজয় ও মৃত্যু : অতপর সাইরাস আরাে অনেক যুদ্ধ করেছিলেন। এসব যুদ্ধের ফলে পূর্বদিকে পারথিয়া, ব্যাকট্রিয়া এবং এমনকি ভারতের পশ্চিম দিকের প্রদেশগুলো সাইরাসের দখলে আসে। যখন সাইরাস মেডিয়ার সিংহাসন দখল করতে চাইছিলেন তখন তিনি ক্যালদীয় রাজা নাবোনিডাসের সহায়তা লাভ করেছিলেন, নেবুনিডাসের লক্ষ ছিল উত্তরের প্রতিবেশীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ উস্কে দেওয়া। ৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাস মেডিয়া দখল করে নেন। নাবোনিডাস অনেক দেরিতে বুঝতে পারলেন তিনি সাইরাসকে সাহায্য করে ভুল কাজ করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন যে দীর্ঘকাল ব্যাপী গৃহযুদ্ধ বজায় থাকবে এবং উভয়পক্ষই পুরুষানুক্রমে দুর্বল ও অসহায় অবস্থায় চলে যাবে। কিন্তু সেটা ঘটেনি। সাইরাসের বিজয়ে পারস্য একজন দুর্বল ও স্থবির রাজার বদলে একজন তেজস্বী যোদ্ধাকে খুঁজে পায়। এবার নেবুনিডাস মরিয়া হয়ে সাইরাসের বিরুদ্ধে মিত্র খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু অত্যন্ত বিলম্ব হয়ে গেছে, কেননা ৫৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাস পশ্চিম এশিয়া মাইনরে লিডীয়দের পরাজিত করে উপকূলবর্তী গ্রিক শহরগুলো সহ সমগ্র উপদ্বীপ তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছেন। এই সময়ে ব্যাবিলনের রাজা নাবোনিডাসের বিরুদ্ধে পুরােহিত সম্প্রদায় অসন্তুষ্ট ছিল। জনসাধারণের মধ্যে পুরােহিতদের অনেক প্রভাব ছিল। জেরুজালেম থেকে দাস বানিয়ে আনা ইহুদিরাও মুক্তির প্রহর গুণছিল। তারাও ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের পতন চাইছিল। ওদিকে আক্রান্ত হলে লিডীয়রা যে ব্যাবিলনের সাহায্যে আসবে সে উপায়ও রইল না, কারণ লিডিয়ার ইতােমধ্যেই পতন হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে সাইরাস খ্রি.পূ. ৫৪০ অব্দের গ্রীষ্মকালের শেষ নাগাদ ব্যাবিলনে তার বাহিনী নিয়ে ঢুকলেন। কথিত আছে যে, ব্যাবিলনে ঢুকে তিনি দেবতা মারদুকের দুহাত জড়িয়ে ধরেন। এভাবে স্থানীয় অধিবাসীদের মন জয় করে সেখানকার সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকারীর মতাে অতি দ্রুত কোন যুদ্ধ ছাড়াই ব্যবিলন দখল করলেন তিনি। ব্যবিলন দখলের পরপরই সম্রাট নেবুচাদনেজারের সমগ্র ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্য সাইরাসের দখলে আসে, আর ক্যালদীয় রাজবংশের ইতি ঘটে। সাইরাস ব্যবিলন দখলের পর সেখান থেকে প্যালেস্টাইনের নির্বাসিত ইহুদীদের বন্দীদশা থেকে মুক্তি দেন। তিনি প্যালেস্টাইনকে ইরানী সাম্রাজ্যের অধীনে একটি আধা-স্বাধীন করদ রাজ্যে পরিণত করেন। লিডিয়া, মিডিয়া, ব্যাবিলনিয়ায় এক বিশাল সাম্রাজ্য তিনি গড়ে তােলেন। মিশরের প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয় তার রাজ্যসীমা। উল্লেখ্য যে, সাইরাস বিজিত ভূখণ্ডের জনগণকে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখা ও তা পালনের অধিকার ও স্বাধীনতা দান করেন। তিনি পারসিক সাম্রাজ্যে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। আবার সাইরাস বিজিত ভুখণ্ডের সংস্কৃতিরও লালন-পালন করেন। ম্যাককে, হিল ও বাকলারের ভাষায়, “কোন দ্বিগ্বীজয়ী সাইরাস ও তার পারসিকদের মতো এরকম জ্ঞানী, সংবেদনশীল ও দূরদর্শী কমই হয়ে থাকে।” (Mckay et al., 56)। অবশেষে ৫২৯ সালে ইরানী সাম্রাজ্যের উত্তরে অবস্থিত উরাল সাগরের নিকট বর্বর গােষ্ঠীগুলোর সাথে যুদ্ধের সময় সাইরাস মারাত্মক ভাবে আহত হন। .পূ. ৫২৯ অব্দে বর্বরদের হাতে যুদ্ধরত অবস্থায় এই ধার্মিক ও প্রজাহিতৈষী রাষ্ট্রনায়ক নিহত হন। ইতিহাসের জনক হেরােডােটাস মনে করতেন যে, ধার্মিক রাজা সাইরাস দৈববাণী লাভ করতেন। তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্য রেখে যান। সাইরাসের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার পুত্র দ্বিতীয় ক্যাম্বিসেস, যিনি সমগ্র মিশর দখল ও তা পারসিক সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

দ্বিতীয় ক্যাম্বিসেস (৫২৯-৫২২ খ্রি.পূ.) 

ক্যাম্বিসেসের মিশর জয় : ৫২৯ পৃষ্টপূর্ব অব্দে মেডেস, লিডিয়ী, এশিয়ার বিভিন্ন গ্রীক উপনিবেশ এবং ব্যবিলন বিজয়ী বীর মহান সাইরাস মারা যান। এরপর তার পুত্র কামবিসেস হেলসপন্ট থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এক রাজ্য উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। একমাত্র মিশর তার রাজ্যভূক্ত ছিল না। পারসিকরা যখন ব্যবিলন দখল করেছিল তখন মিশরীয় রাজা দ্বিতীয় আমােস (আমাসিস) মিশরকে গ্রীক ও বাবিলনের প্রভাবমুক্ত করেছিলেন। সাইরাসের ব্যাবিলনিয়া জয় ও পারস্য সাম্রাজ্যের দ্রুত অভ্যুদ্বয়কে আমেসিস মিশরে বসে ভয়ের সাথে লক্ষ করছিলেন। এই বিশাল অভ্যুদয়ের তুলনায় মিশরের অ্যাসিরীয় ও ক্যালদীয় স্মৃতি যেন কিছুই ছিলনা। আমেসিস সাইরাসের ক্রমবৃদ্ধি হ্রাস করার জন্য তার সব শক্রকে সহায়তা দিয়েছিলেন, তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি ব্যর্থ হন। এবার মিশর পারস্যের পথে একা দাঁড়িয়ে রইল। পারস্যের বিরুদ্ধে যে দেশ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, তাকে পারস্য নিশ্চয় ক্ষমা করবে না। ৫২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় ক্যাম্বিসেস (৫২৯ – ৫২২ খ্রি.পূ.) একজন যােগ্য শাসক হিসেবে পারস্য সাম্রাজ্যের সিংহাসন অধিগ্রহণ করেন, আর পিতার নীতিকে তিনি অনেকাংশেই অনুসরণ করেন। তিনি ছিলেন একজন পোড়-খাওয়া শাসক, যিনি তার পিতার অভিযান চলাকালে ব্যাবিলনের শাসনের দায়িত্বে ছিলেন। পিতার সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের ধারা অব্যাহত রাখার জন্যই হোক, আর মিশরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্যই হোক, তিনি ৫২৬-৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরের উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করেন। তবে আমেসিসের ভাগ্য ভালো, কারণ তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর সমৃদ্ধ মিশরে রাজত্ব করে এবারে তার জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন। ক্যাম্বিসেসের আঘাত আসার পূর্বেই ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আমেসিসের মৃত্যু হয়। তার পুত্র ও মিশরের সিংহাসনে তার উত্তরাধিকারী ৩য় সামটিকের ঘাড়ে পড়ে ক্যাম্বিসেসকে মোকাবেলা করার ভার। নীল ব-দ্বীপের পূর্বে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে পার-আমেন বা পেলুসিয়াম দুর্গে মিশরীয় বাহিনী পারসিক বাহিনীর মোকাবেলা করে ও যুদ্ধে পরাজিত হয়, আর এর মাধ্যমে ক্যাম্বিসেস মেম্ফিস অধিকার করে মিশর দখল করেন ও মিশরের নতুন ফারাও হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তী চার প্রজন্ম মিশর পারস্যের একটি সত্রপী (প্রদেশ) হিসেবে নিয়ন্ত্রিত হত। পারসিক রাজাদের মিশরের ২৭শ রাজবংশ হিসেবে গণ্য করা হয় আর পারসিকরাই ছিল মিশরের প্রকৃত বৈদেশিক রাজবংশ, কেনন এর পূর্বে মিশর বিদেশী লিবীয় বা নুবীয় রাজবংশের দ্বারা শাসিত হলেও এই রাজবংশগুলো প্রকৃতপক্ষে সাংস্কৃতিকভাবে মিশরীয়ই হয়ে যায়। কিন্তু পারসিকরা সত্যিকারের বৈদেশিক রাজবংশরূপে শক্ত হাতে মিশর শাসন করেছিল।

ক্যাম্বিসেসের চরিত্র : দ্বিতীয় ক্যাম্বিসেস অনেকাংশেই তার পিতার নীতির অনুসরণ করলেও তিনি তার পিতার বিপরীত কাজও তিনি করেছেন বলে উল্লেখ আছে, সমসাময়িক অন্যান্য রাজার মতাে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করেন বলেও জানা যায়। ক্যাম্বিসেসের মিশরে অবস্থান সম্পর্কে হেরোডোটাস যা বলেছেন তার চাইতে বেশি কিছু আমরা জানি না (এই ঘটনার এক শতাব্দী পরে হেরোডোটাস এখানে এসেছিলেন)। তিনি একজন জাতীয়তাবাদী মিশরীয় পুরোহিতের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, যে ছিল তীব্র পারস্য-বিরোধী। তার কাছ থেকে ক্যাম্বিসেসের যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে যথেষ্ট অতিশয়োক্তি ছিল। তার মতে ক্যাম্বিসেস ছিলেন নিষ্ঠুর, অর্ধোন্মাদ, স্বেচ্ছাচারী। যিনি ইচ্ছাকৃতভাবে মিশরের পবিত্র স্থানগুলো অপবিত্র করেছিলেন এবং মিশরীয় রীতি-রেওয়াজকে ব্যঙ্গ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ক্যাম্বিসেস যখন মিশরে ছিলেন তখন মিশরীয়রা “এপিস” নামে এক ষণ্ডদেবতার পূজা করত, যিনি মিশরীয়দের ইচ্ছা পূরণ করতে পারতেন। তিনি ছিলেন দেবতা অসিরিসের পার্থিব অবতার। ষাঁড় ছিল উর্বরতার প্রতীক তারা বিশ্বাস করত, এপিস সন্তুষ্ট থাকলে ভালো ফসল পাওয়া যায় এবং সুসময় আসে। মিশরীয়রা এপিসকে পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখত। হেরোডোটাসের মতে একটি দুর্ভাগ্যজনক অভিযান থেকে ফিরে এসে মিশরীয়রা তার পরাজয়কে মহা আনন্দে উদযাপন করছিল এবং এপিসের সম্মানে তাকে পূজো দিয়েছিল। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ক্যাম্বিসেস তার তরবারি বের করে এপিসের মূর্তিকে আঘাত করেছিলেন।

অন্যান্য অঞ্চলে বিজয় অভিযান ও ব্যর্থতা : ক্যাম্বিসেস মিশরেই থেমে থাকতে চাননি। নীলের পশ্চিমে তিনি লিবীয়া এবং গ্রিক নগর সাইরেনি অধিকার করেন। এরপর তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় দক্ষিণে নুবিয়ার ওপর, এমনকি অনেক পশ্চিমে ফিনিসীয় উপনিবেশ কার্ধেজের দিকে। এরপর তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় দক্ষিণে নুবিয়ার ওপর, এমনকি অনেক পশ্চিমে ফিনিসীয় উপনিবেশ কার্ধেজের দিকে। তিনি নুবিয়ার দিকে যাত্রা করেন এবং পথে থিবিস অধিকার করে লুটপাট চালান। তিনি নুবিয়ার উত্তর অংশ দখল করতে সক্ষম হন এবং আরও রসদ এবং সৈন্য সরবরাহের জন্য ফিরে আসেন। নুবিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত তার অভিযান শেষ নাগাদ সৈন্যদের খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করতে পারল না, তবে উত্তর নুবিয়া তিনি দখল করেছিলেন। কার্থেজের বিরুদ্ধে আক্রমণকালে তার নৌবাহিনীর প্রধান শক্তি ফিনিশীয়রা কার্থেজবাসী ফিনিশীয় আদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানালে এই অভিযান ব্যর্থ হয়। নীলনদের পশ্চিম দিককার ওয়েসিস বা মরুদ্যান এলাকায় অভিযান চালিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু লিবীয় মরুভূমি পার হয়ে আন্মােন মরুদ্যানে (Oasis of Annon) গমনের সময় মরুভূমির ধূলি-ঝড়ের মধ্যে তার সেনাবাহিনীর একটি অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এভাবে ক্যাম্বিসেসের অন্যান্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা দুঃখজনকভাবে ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়, তাকে কেবল মিশর ও উত্তর নুবিয়া জয়ের মাধ্যমেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

বিদ্রোহ দমনের জন্য মিশর ত্যাগ ও মৃত্যু : অধিকাংশ ভাড়াটে ইহুদি সৈন্যদের নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীকে মিশরের রাজধানী মেম্ফিস, পূর্বের বদ্বীপ এলাকার উফনি ও এলিফেন্টাইনে মােতায়েন রাখার পর ক্যাম্বিসেস জানলেন যে, তার ভাই স্মেরদিস বা বরদিয়ার (একই ব্যক্তি) মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এক প্রতারক পারস্য দেশে অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে, কিন্তু ক্যাম্বিসেস জানতেন যে এই স্মেরদিস নকল, কারণ তিনি আগেই গোপনে স্মেরদিসকে হত্যা করেছিলেন (তবে এরকম মতও আছে যে ক্যাম্বিসেস পূর্বে স্মেরদিসকে হত্যা করেননি, আর এই স্মেরদিসই ছিলেন আসল স্মেরদিস, যাই হোক, বেহিস্তুন লেখে উল্লেখ আছে গৌমাতা নামে একজন ম্যাগি বা পুরোহিত নিজেকে স্মেরদিস দাবি করে এই বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিলেন)। যাই হোক, বিদ্রোহের খবর শুনে ক্যাম্বিসেস একটি সেনাবাহিনী জোগার করে পারস্যে ফিরে গেলেন, সেনাদেরকে তিনি বোঝালেন যে এই স্মেরদিস আসল নয়, কারণ আসল স্মেরদিসকে তিনি আগেই হত্যা করেছেন। তবে ক্যাম্বিসেস স্মেরদিসের সাথে কখনও যুদ্ধে মুখোমুখি হননি। তার আগেই তিনি “নিজের হাতে” মারা যান। এখন এই নিজের হাতে মারা যাবার বিষয়টাকে অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। হেরোডোটাস বলছেন, তিনি যখন একবাতায় ছিলেন তখন তরবারি কোষ থেকে বার করার সময় ভুলবশত নিজের উরুতে আঘাত করেন, ঠিক যেখানে মিশরে থাকতে পবিত্র এপিস ষাঁড়কে আঘাত করেছিলেন সেখানে। এরফলে সেখানে গ্যাংগ্রিন হয় ও তিনি মারা যান, দেবতাদের অভিশাপেই তার এই মৃত্যু হয়েছে। হেরোডোটাস এই কাহিনীটা সংগ্রহ করেছিলেন মিশরের পুরোহিতদের কাছে। স্বভাবতই তারা বিধর্মী ক্যাম্বিসেসকে পছন্দ করতেন না, আর তারা যে ক্যাম্বিসেসের মিশরীয় ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করার অভিযোগ তোলেন তাও অতিরঞ্জিত হয়ে থাকতে পারে। তাই এই ব্যাখ্যায় প্রশ্ন থেকেই যায়। এছাড়া অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেছেন তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন, অথবা গুপ্তঘাতকের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছিলেন। দারিউস তখন ক্যাম্বিসেসের বল্লমধারী হিসেবে কাজ করতেন। তিনি বলেছেন, ক্যাম্বিসেস স্মেরদিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করতে পারবেন না ভেবে বিষণ্ণতায় ভুগে আত্মহত্যা করেন। যাই হোক, ক্যাম্বিসেসের পর স্মেরদিস বা বরদিয়াই পারস্য সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। অনেকের মতে স্মেরদিস যে নকল ছিলেন এই কথাটি দারিউস নিজে বানিয়ে থাকতে পারেন, পরবর্তীতে তার ক্ষমতাদখলকে ন্যায়সঙ্গত করার উদ্দেশ্যে।

প্রথম দারিউস (৫২২-৪৮৬ খ্রি.পূ.) 

দারিউসের ক্ষমতায় আরোহন : দুর্ঘটনা, গুপ্ত হত্যা অথবা আত্মহত্যা যাই হােক না কেন, পুত্রহীন পারসিক সম্রাট ক্যাম্বিসেস মারা যাবার ফলে পারস্যের বিভিন্ন প্রদেশে গভর্নরগণ স্বাধীনতা ঘােষনা করেন এবং সাম্রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু সাইরাসের জামাতা ও উত্তরাধিকারী দারিউস (৫২১-৪৮৬ খ্রিস্টপূর্ব অব্দ) এসব ভূইফোড় সিংহাসনের দাবীদারকে দমন করেন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ আরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি, তিনি স্মেরদিসকে ক্ষমতাচ্যুত করেন, বিদ্রোহসমূহ দমন করেন ও এরপর সাম্রাজ্যকে রাজনৈতিকভাবে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করেন। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় দারিউসকে সহায়তা করে, যথা – দারিউসের সামরিক দক্ষতা এবং পারসিক রাজন্যবর্গ ও অভিজাতদের আনুগত্য। এসময় পারস্যে ছয়টি প্রধান পরিবার ছিল। এসব পরিবার দারিউসের পরিবারের সাথে সমন্বিতভাবে রাজকীয় পরিষদ গঠন করে। তারা উপলদ্ধি করে যে, এই অন্তবর্তীকালীন সময় পারসিক জাতির জন্য সংকটময় মুহুর্ত এবং এসব পরিবার রাজার শক্তি বৃদ্ধি করে। তাদের সহায়তায় দারিউস গৌমাতা (Gaumata) বা নকল স্মেরডিসকে দমন করেন। গৌমাতা মেডেসদের সহায়তায় কয়েকমাস রাজত্ব করেন। এই ছয় পরিবার দারিউসের রাজনৈতিক ক্ষমতা সুদৃঢ়করণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। এ সম্পর্কে ভিনসেন্ট এম স্ক্রামুজ্জা এবং পল এল. ম্যাককেন্ড্রিক লিখেছেন, “এই ছয় পরিবার পারস্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ অবস্থান দখল করে আছে, তাদের থেকেই রাজা নিয়মিত তার সঙ্গিনী নির্বাচন করতেন, তারা তাদের জায়গিরগুলো স্বাধীন অঞ্চলের মত শাসন করতেন।” (Scramuzza et. al., 111)। গৌমাতার সাথে দারিউসের এই শত্রুতা ছিল ব্যক্তিত্বের সংঘাত। দারিউস এই ঘটনাকে পারস্য ও মিডিয়ার মধ্যকার দ্বন্দরূপে উল্লেখ করেছেন এবং ম্যাগিবাদের ওপর জোরাষ্ট্রীয়বাদ বা জরাথুস্ট্রবাদের একটি বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন (মেডেসরা প্রাচীন পারস্য ধর্মের অনুসারী ছিল যা নিয়ন্ত্রণ করতো পুরোহিত বা ম্যাগিরা, গৌমাতা ছিলেন এমনই একজন ম্যাগি। অন্যদিকে আকিমেনীয় রাজবংশ সহ পারস্যরা ছিল জরাথুস্ট্রবাদী।) উল্লেখ্য যে, দারিউস জরাথুস্ট্রবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বাস্তব আদর্শবাদী। তিনি পারসিকদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। এই শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল আহুরা মাজদাকে ভালবেসে ধার্মিক হওয়া নয়, বরং এর উদ্দেশ্য ছিল সত্যের আদর্শ ভৃত্যদের মধ্য থেকে রাজার আদর্শের ভৃত্যকে খুঁজে বের করা। দারিউস মহান দারিয়ুস নামেও খ্যাত। ইনি ছিলেন একজন ধৈর্যশীল ও দক্ষ শাসক। তার শাসনতান্ত্রিক সংস্কার, মুদ্রা সংস্কার ও সামরিক সংস্কার তাকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। ইতােমধ্যেই পারস্য সাম্রাজ্য বিশালাকার ধারণ করেছিল। এই সাম্রাজ্যকে অনেকগুলাে প্রদেশ বা সত্রপিতে ভাগ করে সেখান থেকে মুদ্রা ও খাদ্যশস্যের রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন।

বেহিস্তুন পর্বতলেখ : দারিয়ুসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি লিপিবদ্ধ আছে তার বিসিতুন পর্বত লেখে। রাজা দারিয়ুস বেহেস্তুন পর্বতের পাথর খােদাই করে তার উল্লেখযােগ্য কীর্তি লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন। এতে তার প্রথম বছরে রাজত্বের বিবরণ ও ছয়জন অভিজাতের সাহায্য নিয়ে ক্যাম্বিসেসের ভাই সেজে বিদ্রোহকারী নকল বরদিয়কে দমনাভিযানের কাহিনী বর্ণিত আছে। 

উত্তর-পশ্চিম ভারতে দারিউসের রাজ্য বিস্তার : দারিউস তার সুদীর্ঘ রাজত্বকালে সাইরাস এবং ক্যাম্বিসেস প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের সীমানা বহুগুণ বৃদ্ধি করেন। এক্ষেত্রে তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্রতিরক্ষামূলক সীমান্তকে সম্প্রসারণ করা। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিদ্রোহ দমন করে তিনি তার রাজ্যকে বিস্তৃত করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমভাগের পাঞ্জাব সহ সিন্ধু তীরবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে মধ্য ইউরােপের দানিউব নদীর প্রান্ত পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য তিনি গড়েছিলেন। পূর্বদিকে তিনি পারসিক সেনাবাহিনীকে ভারতে নিয়ে যান। আনুমানিক ৫১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতের পশ্চিমাংশ (সিন্ধু নদ পর্যন্ত) পারস্যের হিন্দুকুশ সত্রপিতে (প্রদেশ} পরিণত হয়। সমগ্র সিন্ধু উপত্যকা এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। দারিউসের মাধ্যমেই ভারতে প্রত্যক্ষভাবে পারস্য প্রভাবের সূচনা হয়। ভারতের স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও মুদ্রায় পারস্য প্রভাবের ফলাফল হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী।

প্রথম দারিউসের ঈজিয়ান দ্বীপসহ ও বলকানের বিভিন্ন অঞ্চল দখল : এভাবে সাম্রাজ্যে শান্তি ফিরে আসার পর দারিয়ুস চিন্তা করলেন, এবারে সাম্রাজ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে নজর দেয়া যাক। সাইরাস এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখল করেছিলেন, ক্যাম্বিসেস তাতে আফ্রিকার অঞ্চলগুলো যোগ করেছিলেন। দারিয়ুসের জন্য তাই ইউরোপই বাকি ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫১২ সালে, দারিয়ুসের নেতৃত্বাধীন পারস্য সেনাদল ইউরোপের প্রণালি পেরিয়ে থ্রেসে অগ্রসর হল। এবারও পারস্যের সেনাবাহিনী সফল, এবং পারস্য সাম্রাজ্যে কৃষ্ণসাগরের পশ্চিম উপকূল থেকে দানিয়ুব নদীর মুখ পর্যন্ত বিস্তৃত হলাে। এই অভিযানে নতুন গ্রিক অঞ্চলগুলাে পারস্য সাম্রাজ্যে চলে আসে। দারিউসের পূর্বসূরী সাইরাস ইতিপূর্বে লিডিয়া দখল করেন। এই বিজয়ের ফলে পারসিকরা এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলের গ্রীক ভাষাভাষী নগরীগুলোর শাসকে পরিণত হয়। এরপর দারিউস গ্রিসে সমরাভিযান পরিচালনা করে গ্রিসের অংশবিশেষ ও ম্যাসিডােনিয়া পর্যন্ত এলাকাকে নিজের রাজ্যভুক্ত করতে পেরেছিলেন। অর্ধশতাব্দী পূর্বে পিসিস্ট্রটাস থ্রেসিয়ান কেরসােনিসে এথেনিয়ান বাহিনীকে পাঠিয়ে একটি যুদ্ধে যুদ্ধরত স্থানীয়দের সাহায্য করেছিলেন। থ্রেসিয়ান কেরসােনিস (থ্রেসিয়ান উপদ্বীপ) ছিল হেলেসপন্টের ইউরোপীয় পার্শ্বে অবস্থিত ষাট মাইল দীর্ঘ একটি একটি ভূখণ্ড (আধুনিককালে, এটি গালিপােলি উপদ্বীপ নামে পরিচিত)। সেনাবাহিনীর নেতা হিসেবে পিসিস্ট্রটাস তার পুরনাে রাজনৈতিক শত্রু মিলটিয়াডিসকে বেছে নিয়েছিলেন। যুদ্ধে এথেন্সবাসীরা জয়ী হয়েছিল, আর খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৬ সালে মিলটিয়াডিস সেই উপদ্বীপের টাইরান্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যাই হোক, এবারে এই থ্রেসিয়ান কেরনোসিস পারস্যদের অধীনে চলে এলো। এমনকি লেমনস আর ইমব্রোসের মতাে দক্ষিণের ঈজিয়ান দ্বীপও পারস্য সাম্রাজ্যের হয়ে যায়। এভাবে দারিউসের সৈন্যরা প্রোপন্টিস থেকে স্ক্রাইমন নদী পর্যন্ত থ্রেস এবং লেমন্‌স ও ইমব্রোস দ্বীপকে পারসিক প্রদেশে পরিণত করেন। দারিয়ুস ইউরোপে তার অধীনস্ত অঞ্চলগুলোকে শান্তিতে শাসন করবেন এই আশা নিয়েই ফিরে এলেন। আর এটাই হবার কথা ছিল, যদিনা মিলেটাস ও এথেন্স তার শান্তিতে বাধা না দিত। 

শক বা সিথিয়ানদের বিরুদ্ধে দারিউসের অভিযান : দারিউস পশ্চিমদিকে সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে কয়েকটি নতুন সমস্যার সম্মুখীন হন। এক্ষেত্রে মূল ভূখণ্ডের গ্রীকদের প্রতি তার নীতির ভিত্তি কি হবে তিনি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হন। আত্মীকরণ (absorption) করা ছিল এক্ষেত্রে একটি সমাধান। কিন্তু তিনি অবহিত ছিলেন যে, এশীয় ভূখণ্ডের গ্রীকরা ভাল যােদ্ধা, নাবিক, সভ্য, পৌরুষপূর্ণ এবং বিত্তবান। আবার গ্রীস আক্রমণ করার পূর্বে তাকে এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে হয় যে, গ্রীস পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাতায়াত পথের কোন স্থান শক বা সিথিয়ান জাতি কর্তৃক আক্রান্ত হবে না। এ সময় শকরা দারিউসের রাজ্য আক্রমন করত। আপাতদৃষ্টিতে দারিউস সদ্য প্রতিষ্ঠিত শক সাম্রাজ্যকে আক্রমন করার পরিকল্পনা করেন। কৃষ্ণ সাগরের উত্তরদিকে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইউরােপীয় দৃষ্টিকোন থেকে এই সাম্রাজ্য ছিল একটি অগ্রবর্তী এলাকা। সম্ভবত ফিরতি যাত্রায় তিনি শকদের মূলভূখণ্ড বিজয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে এক্ষত্রে তিনি এই অভিযানের সম্ভাব্য বিপজ্জনক দিক ও অসুবিধাকে ঠিকমত উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হন। যাই হােক, খ্রিস্টপূর্ব ৫১২ অব্দে দারিউস বসফরাস প্রণালীর ওপর নৌকা সংযুক্ত করে নির্মিত একটি কৃত্রিম সেতুর ওপর দিয়ে এক বিশাল সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দেন। এর ওপর দিয়ে প্রণালী পার হয়ে তিনি দানিয়ুব এলাকার দিকে চলে যান। অতপর আয়োনীয় অঞ্চলের স্বৈরাচারী শাসকগণ কর্তৃক সরবরাহকৃত একই ধরনের নৌকাযােগে গঠিত সেতুর ওপর দিয়ে তিনি দানিয়ুব অতিক্রম করেন। কিন্তু শকরা দারিউসের বাহিনীকে রণক্ষেত্রে মােকাবেলা করার পরিবর্তে তার বাহিনীকে উপর্যুপরি হয়রানি করতে থাকে। তাছাড়া রসদ ও পানীয়ের নিদারুন অভাব দেখা দেয়। এসব কিছুর ফলে শক ভূখণ্ড জয়লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি ভােলগা অঞ্চলে পর্যন্ত গমন করেন এবং এমনকি দক্ষিণ ইউক্রেন পর্যন্ত তিনি শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। কিন্ত্র শকরা ইউক্রেনের গভীর অভ্যন্তরভাগে আত্মগােপন করে এবং দারিউস তাদের খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হন। এই অভিযানের নেতিবাচক এবং ইতিবাচক উভয় দিকই ছিল। ভিনসেন্ট এম স্ক্রামুজ্জা এবং পল এল, ম্যাককেন্ড্রিক এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, “নেপোলিয়ন ও হিটলারের মতো তিনি খালি হাতে পশ্চাদপসরণ করেন, কিন্তু দানিউবের মুখ পর্যন্ত তিনি তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন। তার সাম্রাজ্য ছিল সেই সময়ের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ, এটি প্রায় বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বৃহৎ ছিল, এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অংশ নিয়ে এই সাম্রাজ্য গঠিত ছিল।” (Scramuzza et. al. 111)। এভাবে ৩৭ বছরের মধ্যে পারসিকরা নিজেদেরকে একটি শাসিত জনগােষ্ঠির পর্যায় থেকে শাসকের মর্যাদায় উন্নীত করে। তাদের এই সাম্রাজ্যে আনাতােলিয়া, মিশর, মেসােপটেমিয়া, ইরান এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সাম্রাজ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে ম্যাককে. হিল ও বাকলার লিখেছেন যে, ”তারা (পারসিক) একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল যার মধ্যে প্রাচীন ও সবচেয়ে সম্মানিত রাজ্যগুলো  ও প্রাচীন নিকট প্রাচ্যের জনসাধারণও অন্তর্ভূক্ত ছিল, এরকম বিশাল রাজনৈতিক সংগঠনের দ্বারা এই অঞ্চলগুলোর একত্রীকরণ এর আগে কখনও দেখা যায়নি।” (McKay et. al., 59)। তবে সাম্রাজ্য বিস্তৃতির চেয়ে যে নীতির ভিত্তিতে এই সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে তা ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিজিত অসংখ্য জাতিকে একই সরকারের অধীনে অনায়ন করা হয়, যদিও প্রত্যেক জাতির জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা হয়।

আকিমিনিদ সাম্রাজ্যের সম্রাট প্রথম দারিউস ৫১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইউরোপীয় সিথিয়ায় সামরিক অভিযানটি পরিচালনা করেন। সিথিয়ানরা হচ্ছে পূর্ব ইরানীয় ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী, তারা মেডিয়ায় আক্রমণ করেছিল, দারিউসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, সেই সাথে এরা দানিউব, ডন নদী ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বাস করত বলে এরা মধ্য এশিয়া ও কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছিল। তাই সিথিয়ানদের দমন করার জন্য দারিউস তাদের ভূমিতে অভিযান পরিচালনা করেন। তবে এটাই একমাত্র কারণ ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেননা। মধ্য থ্রেস থেকে জর্জিয়া এবং ইউক্রেইন থেকে উত্তর-পূর্ব ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত অঞ্চল ছিল একটি সংঘবদ্ধ অঞ্চল যার ছিল সিথিয়ান, থ্রেসিয়ান, আয়োনিয়ান (গ্রিক) ও ইরানিয়ানদের সাথে পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থ। কৌশলগত ক্ষেত্রে দারিউস অবশ্যই দেখেছিলেন যে কতিপয় সিথিয়ান উপজাতি ইউক্রেইন থেকে আজকের উজবেকিস্তান পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে বিপজ্জনক যাযাবর আক্রমণকারীদের একটি ধারাবাহিক বা অবিচ্ছিন্ন স্থানিক ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তা ছাড়া কৃষ্ণসাগরের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কোন রকম আন্তর্জাতিক বিভাগ ছিল না। পারশিয়ান ও গ্রিকদের ছিল সিথিয়ানদের স্বর্ণ, শস্য, চামড়া, পশম ইত্যাদি রপ্তানির উৎসসমূহের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের সাধারণ স্বার্থ। উল্লেখ্য, গ্রিকদের অনেক অঞ্চলই পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনস্ত ছিল, আবার আজকের দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউক্রেইনে অনেক গ্রিক উপনিবেশ ছিল। পারস্যের রাজসভার গ্রিক চিকিৎসক টেসিয়াস (Ctesias) খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ শতকে লেখেন, দারিউসের ইউরোপীয় সিথিয়ান ভূমিতে আক্রমনের পূর্বে কাপ্পাদোশিয়ার সত্রপ এরিয়ামনেস (Ariaramnes) কৃষ্ণসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপীয় সিথিয়ান অঞ্চলে ত্রিশটি পারটেকন্টার (যুদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত একরকম নৌযান) এর নৌবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন, এবং সিথিয়ানরাজের ভাই সহ অনেক সিথিয়ান নারী ও পুরুষকে সাথে নিয়ে ফেরেন। কেউ কেউ মনে করেন, দারিউসের এই আক্রমণের কারণ ছিল কেবলই সিথিয়ান ভূমিকে ধ্বংস করা। তবে হেলিসপন্টের ওপর দিয়ে একটি সেতু নির্মাণ এই ধারণার বিরুদ্ধে যায়।

যাই হোক, এই অভিযানটি যে অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল সেখানে বর্তমান বলকান, ইউক্রেইন ও রাশিয়ার অবস্থান। সিথিয়ানদের যাযাবর জীবন ও বসতির অভাবের কারণে (গেলোনাস (Gelonus) বাদ দিয়ে) তারা পারসিক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়, অন্যদিকে পারস্যরা সিথিয়ানদের স্কর্চড আর্থ ট্যাকটিক বা পোড়া মাটির কৌশলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পারস্যরা সিথিয়ানদের চাষযোগ্য অঞ্চলের অনেকটাই দখল করে নেয় এবং তাদের মিত্রদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আর এভাবে তারা সিথিয়ানদেরকে পারসিক বাহিনীকে সম্মান জানাতে বাধ্য করে। দারিউস যুদ্ধে লাভবান হবার পর তার অভিযান থামিয়ে দেন এবং একটি প্রতিরক্ষা রেখা বা ডিফেন্স লাইন নির্মাণ করেন।

হেরোডোটাস যদিও ৫১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঠিক কোন সময়ে দারিউস অভিযানটি পরিচালনা করেছিলেন তা বলে যাননি, তবে সেটা অনুমান করা সম্ভব। দারিউস সুসা থেকে ৫১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অভিযান শুরু করেন, তিনি মে মাসে ক্যালসেডনে পৌঁছে গিয়ে থাকবেন, এবং ইউরোপিয়ান অঞ্চলে তার সেনাবাহিনীকে জুনেই নিয়ে গিয়ে থাকবেন। আর তাই তিনি অগাস্টের শেষ দিকে দানিউব ক্রস করে থাকবেন। দারিউস একটি নৌকার সেতু তৈরি করে বসফোরাস প্রণালী পাড় হন। তিনি পূর্ব ইউরোপের বিশাল অংশ জয় করেন, এমনকি সিথিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তিনি দানিউব পাড় হন। তিনি তার সেনাপতি মেগাবেজিসের সাথে সিথিয়া আক্রমণ করেন। কিন্তু সিথিয়ানরা দারিউসের আক্রমণকে এড়িয়ে যায় ও কৃত্রিম আক্রমণের কৌশল ব্যবহার করে পূর্ব দিকে পশ্চাদপ্রসরণ করে। পশ্চাদপ্রসরণ করার সময় তারা গ্রামাঞ্চলে বর্জ্য ফেলে রাখে, কূপগুলো ব্লক করে দেয়, সরবরাহযানসমূহে বাধা দেয়, চারণভূমিসমূহ ধ্বংস করে, এবং দারিউসের সেনাবাহিনীর সাথে অবিরত ছোট ছোট সংঘাত চালিয়ে যায়। সিথিয়ানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য দারিউসের সেনাবাহিনী সিথিয়ান অঞ্চলের ভেতরে প্রবেশ করে, যার বেশিরভাগই ছিল আজকের ইউক্রেইন, যেখানে জয় করার জন্য কোন নগর ছিলনা, লুণ্ঠন করার জন্য কোন সরবরাহ ছিলনা। হতাশ হয়ে দারিউস সিথিয়ান শাসক ইডানথিরসাসকে (Idanthyrsus) যুদ্ধ করতে অথবা পরাজয় স্বীকার করতে নির্দেশনা দেন। ইডানথিরসাস জবাবে বলেন পারস্যরা সিথিয়ান পূর্বপুরুষদের খুঁজে বের করে তাদের সমাধিসমূহ অপবিত্র করার আগ পর্যন্ত তিনি দারিউসের সামনে যাবেন না ও যুদ্ধ করবেন না। এর আগ পর্যন্ত তারা তাদের এই কৌশলটিই অব্যাহত রাখবে কেননা তাদের হারাবার মত কোন নগর বা চাষযোগ্য জমি নেই। সিথিয়ানদের এই এড়িয়ে যাবার নীতির পরও দারিউসের অভিযান মোটামুটি সফল ছিল। হেরোডোটাস বলেন, সিথিয়ানদের এই কৌশলের ফলে তারা তাদের সর্বোত্তম জমিগুলো হারায়, এবং তাদের অনুগত মিত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া দারিউস পূর্ব দিকে গিয়ে সেখানে সিথিয়ানদের চাষযোগ্য জমি থেকে নিজেদের সরবরাহকে পুনরায় পূর্ণ করেন। পূর্ব দিকে ইউরোপীয় সিথিয়ান ভূমিতে তিনি গেলোনোসদের বন্দী করেন, যা ছিল বুদিনিদের (প্রোটো স্লাভ বা ফিনিক জাতি) দুর্গকৃত নগর। দারিউস নগরটিকে পুড়িয়ে দেন। বুদিনিরা ছিল সিথিয়ানদের মিত্র। দারিউস ওয়ারাস (Oarus) নদীর তীরে তার অভিযানটি থামিয়ে দেন (ওয়ারাস বলতে হেরোডোটাস খুব সম্ভবত বর্তমান ভোলগা নদী বুঝিয়েছেন)। সেখানে তিনি আট মাইল দূরে দূরে আটটি বিশাল দুর্গ নির্মাণ করেন, যেগুলো নিঃসন্দেহে পারস্য সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল।

দারিউস এর বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে চাননি, অন্তত সেই সময়ের জন্য হলেও। এক মাস ব্যাপী সময় ধরে সিথিয়ানদেরকে ধাওয়া করার পর দারিউসের সেনাবাহিনী ক্লান্তি, অভাব ও রোগে ভুগতে শুরু করে। হেরোডোটাস (৪৮৪-৪২৫ খ্রি.পূ.) লিখেছিলেন তিনি যখন এই অঞ্চলটি নিয়ে লেখেন তখনও দারিউসের তৈরিকৃত এই দুর্গগুলোর ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব ছিল। পাছে আরও সৈন্য হারাতে হয় সেই বিষয়ে চিন্তিত হয়ে দারিউস ভোলগার তীরে তার অভিযান থামিয়ে দিয়ে কৃষ্ণসাগরের পশ্চিমের অঞ্চল থ্রেসের (বর্তমান বুলগেরিয়া) দিকে রওনা দেন। তিনি সিথিয়ানদের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করতে ব্যর্থ হন, আর অভিযান শেষে তিনি সিথিয়ায় (বর্তমান ইউক্রেইন) তার বিজিত অঞ্চলসমূহকে রক্ষা করারও প্রয়োজন মনে করেননি। অন্যদিকে সিথিয়ানরা তাদের পোড়া মাটির নীতি বা স্কর্চড আর্থ ট্যাক্টিক্সের জন্য এই অভিযানে ব্যর্থতারই গ্লানি লাভ করে। অবশ্য ব্যর্থতা দারিউসেরও ছিল কারণ তিনি সিথিয়ানদের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করার সুযোগ পাননি। তবে তিনি সিথিয়ানদেরকে পারস্য বাহিনীর প্রতি সম্মান জানানোর মত পর্যাপ্ত পরিমাণে সিথিয়ান ভূমি দখল করে নিয়েছিলেন। দারিউস সিথিয়ান ও তাদের মিত্রদেরকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেন, রয়াল সিথিয়ানদের মর্যাদা ধুলোয় মিথিয়ে দেন, এবং সেই অঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শক্তিসাম্য বা ব্যালেন্স অফ পাওয়ারকে পালটে দেন। কিন্তু তিনি সিথিয়ানদের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়াতে ব্যর্থ হবার জন্য কোনরকম অঞ্চল দখল করতে ব্যর্থ হন, এবং তিনি সীমান্তে তিনি যে দুর্গগুলো গড়া শুরু করেন সেগুলোকেও সমাপ্ত করতে পারেননি। তার এই অভিযানটি বেশ ব্যয়বহুলও ছিল। শীতকাল চলে এলে দারিউস আর আক্রমণ করেননি, বরং থ্রেসের দিকে ফিরে যান, যে অঞ্চলটিতে তিনি শক্তভাবে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দারিউসের সেনা প্রত্যাহারের পরও সেখানে পারস্যের আধিপত্যের কিছুটা থেকে গিয়ে থাকতে পারে। নাকশ-ই-রুস্তমে “Sakā tayaiya paradraya” অর্থাৎ সমুদ্রের ওপারের সিথিয়ানদের কথা উল্লেখ আছে, যাদেরকে সম্রাট পারস্যের বাইরে গিয়ে জয় করেছিল। পারশিয়ানরা ইউরোপীয় সিথিয়ানদের দমন করার প্রচেষ্টা ত্যাগ করে। হেরোডোটাস বলেন, সিথিয়ানরা তাদের মোবিলিটি, বসতি কেন্দ্রের অভাব ও তাদের অশ্বারোহী তীরন্দাজদের দক্ষতার কারণে পালিয়ে বেড়াতে সক্ষম হয়। তিনি আরও বলেন, পারস্যের কাছে তাদের আনুগত্য স্বীকার না করার একটি কারণ ছিল তাদের রাজার স্বৈরাচার ক্ষমতা, বিদেশীদের প্রতি তাদের ঘৃণা, এবং তাদের বিশ্বাস যে শত্রুদের হত্যাই তাদের ও তাদের ট্রাইবের সম্মান নিয়ে আসে। বিভিন্ন সিথিয়ান ট্রাইব একে অপরকে সহায়তা করে, সেই সাথে তারা পার্শ্ববর্তী জাতিসমূহের সমর্থনও আদায় করতে সক্ষম হয়। কেম্ব্রিজ অ্যানশিয়েন্ট হিস্টোরি অনুসারে, গ্রেকো-পারশিয়ান যুদ্ধে গ্রিক নগর রাষ্ট্র সমূহ যে সেন্স অফ কমিউনিটি দেখিয়েছিল, সিথিয়ানদের সেন্স অফ কমিউনিটি তার চেয়েও বেশি ছিল।

দারিউসের গ্রিসে বিজয়, তার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও গ্রেকো-পারশিয়ান যুদ্ধের সূচনা : পারসিক শাসনের উদারতা সত্ত্বেও এসব নগরী অন্যান্য স্বাধীন গ্রীক নগররাষ্ট্রের মত স্বাধীনতা লাভের জন্য আকাঙ্ক্ষা পোষন করতে থাকে, তবে দারিউসের অধীনে পারস্য সাম্রাজ্য যে খুব উদার ছিল তাও বলা যাবে না। দার্দনেলিস বা হেলেসপন্ট অতিক্রমের পর থ্রেসীয় উপকূলের অংশবিশেষ জয়ের পর দারিউস সেখানে অতিরিক্ত করারােপ করেন। এই বিজয় এথেনীয়দের জন্যে হুমকির সৃষ্টি করেছিল। আয়ােনীয় গ্রিকরা তার নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। বিজিত এলাকার লােকদেরকে তিনি সেনাদলে জোর করে ভর্তি করাতে শুরু করেন। তার নীতিতে রুষ্ট আয়ােনিয়রা বিদ্রোহ করলে এথেন্স তাদের সাহায্য করে। ৪৯৯ থেকে ৪৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ চলে। এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের গ্রীকরাও এই স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং সাময়িকভাবে হলেও আয়োনিয়ার বিদ্রোহীরা এথেন্সের সেনাবাহিনীর সমর্থন লাভ করে। এথেনীয় সৈন্যরা এশীয় গ্রীকদের সাথে মিলিতভাবে তার সাম্রাজ্যের আনাতোলিয়া অঞ্চলের রাজধানী সার্দিস পুড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য যে, সার্দিস ছিল পারসিকদের আঞ্চলিক প্রশাসন কেন্দ্র ও আরও পূর্বে লিডিয়ার রাজধানী। এই বিদ্রোহ দমন করার উদ্যোগ নিলে প্রায় সব গ্রিক নগররাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পারসিকদেরকে যুদ্ধ করতে হয়। দারিউস খুব শীঘ্রই এই অভ্যুত্থান দমন করেন। তবে তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে তার গ্রীক প্রজারা আর কখনও বিদেশে অবস্থানকারী গ্রীকদের সহায়তা পাবে না। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ অব্দে এথেনীয়দের শাস্তি দিতে এবং সব ইউরােপীয় গ্রিককে এখন থেকে একথা জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ঈজিয়ান সাগর অতিক্রম করে একটি সেনাবাহিনী পাঠান। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এথেনীয়রা খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ অব্দে ম্যারাথনের যুদ্ধে পারসিক বাহিনীকে পরাজিত করে। এই পরাজয় ছিল দারিউসের সুদীর্ঘ রাজত্বকালে এক বড় ধরনের সামরিক বিপর্যয়। এই ইতিহাসখ্যাত গ্রিক-পারসিক যুদ্ধ শেষ হবার আগেই খ্রি.পূ. ৪৮৬ অব্দে দারিয়ুস মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ক্ষমতায় আসেন দারিউসের পুত্র জারেক্সেস, যার কাঁধে এই গ্রেকো-পারশিয়ান যুদ্ধের দায়িত্ব পড়ে।

প্রথম জারেক্সেস (৪৮৫ – ৪৬৫ খ্রি.পূ.)

এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৫ অব্দে প্রথম দারিউসের পুত্র ও উত্তরাধিকারী প্রথম জরেক্সেস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬-৪৬৫ অব্দ) এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সমগ্র গ্রীসকে ধ্বংস করতে উদ্যত হন। তিনি তার রাজত্বের সূচনাকালেই মিশরের বিদ্রোহ দমন করেন। কঠোরভাবে খ্রি.পূ. ৪৮১ থেকে খ্রি.পূ. ৪৮২ অব্দে তিনি ব্যাবিলনের বিদ্রোহ দমন করেন। আনুমানিক খ্রি.পূ. ৪৮০ অব্দের দিকে লিডীয় রাজধানী সার্দিসে কাটিয়ে নৌ ও স্থলবাহিনী নিয়ে খ্রি.পূ. ৪৮০ অব্দের গ্রীষ্মকালে গ্রিস আক্রমণ করে তার উত্তরাংশ দখল করে নেন। একই বছরের আগস্ট মাসে থার্মোপাইলে গ্রিক প্রতিরােধ তিনি ব্যর্থ করে দেনএরপর এথেন্সে অভিযান চালিয়ে তা দখল করে নিলেন তিনি। কিন্তু দক্ষিণের সালামিসের যুদ্ধে তিনি হেরে যান। এরপর মার্দোনিয়াসের ওপর অভিযানের ভার দিয়ে তিনি দেশে ফিরে যান। অতঃপর একে একে হার হলাে পারসিকদের। কিন্তু এথেন্স ও স্পার্টার বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধের মুখে প্লাটিয়ার যুদ্ধমিক্যালির যুদ্ধে পরাজয়ের পর খ্রি.পূ. ৪৭৯ অব্দে পারসিকদের হার স্বীকার করতে হলাে। গ্রিকদের বিরুদ্ধে পরাজয়ের উল্লেখযােগ্য কারণসমূহ – 

  • ১। বহুজাতির লােক নিয়ে গঠিত সেনাদলে একতার অভাব ছিল। 
  • ২। গ্রিকদের স্বজাতির প্রতি যে আনুগত্য ও মনােবল ছিল, পারসিকদের তা ছিল না। 
  • ৩। পারস্যভূমি থেকে বিরাট দূরত্বে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালানাে কঠিন কাজ ছিল।

এই পর্যায়ে পারসিকরা তাদের সম্প্রসারণের সীমাবদ্ধতা উপলদ্ধি করে এবং ইউরােপীয় গ্রীকদেরকে নিজেদের বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে মনে করতে থাকে। প্রকৃত পক্ষে, খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯ অব্দ থেকে মহাবীর আলেকজান্ডারের ৩৩৪ অব্দে এশিয়া মাইনর আক্রমন পর্যন্ত গ্রীকরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে পারস্যের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ফলপ্রসূ প্রতিরােধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। তবে পারস্য এ সময় অন্তর্দ্বন্দে দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রাদেশিক বিদ্রোহ ও উত্তরাধিকার দ্বন্দ ছিল এই দুবর্লতার মূল কারন। 

এখানে গ্রেকো-পারসিয়ান যুদ্ধ সম্পর্কে সেভাবে কিছুই আলোচনা করা হয়নি। আয়োনীয় বিদ্রোহ, ম্যারাথনের যুদ্ধ, থার্মোপাইলির যুদ্ধ, সালামিসের যুদ্ধ, প্লাটিয়ার যুদ্ধ ও মিক্যালির যুদ্ধ সহ সমগ্র গ্রেকো-পারসিয়ান যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান

আর্তাজারেক্সেস (৪৬৫ – ৪২৫ খ্রি.পূ.)

জারেক্সেস মিশরের বিদ্রোহকে দমন করলেও মিশরকে গলা টিপে শান্ত করা যায়নি। পুরোহিতদের দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে মিশর সর্বদাই বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত থাকত। পারসিক শাসনের শেষ ভাগটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেখানে বিবদমান উত্তরাধিকার নিয়ে গৃহযুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই সুদূর মিশরে বিদ্রোহ দমনের তেমন সুযোগ ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা নতুন দুর্বল কোনো উত্তরাধিকারী দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, দূরবর্তী কোনো অভিযানে আগ্রহী নাও হতে পারেন। কাজেই ৪৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন জারেক্সেসের মৃত্যু হয়, তখন সেটা ছিল আর একটি বিদ্রোহের ইঙ্গিত। এবার বিদ্রোহের মূল শক্তি ছিল লিবীয় মরুভূমির কিছু যাযাবর গোষ্ঠী। তারা নামমাত্র পারসিক শাসনের অধীনে থাকলেও মূলত ছিল স্বাধীন। তাদের দলপতিদের একজন ছিলেন ইনারস। তিনি তার সকল শক্তি নিয়ে ব-দ্বীপের দিকে অগ্রসর হলেন। যেখানে অনেক মিশরীয়ই মহানন্দে তার পক্ষ নিল। একটি তীব্র যুদ্ধের পর জারেক্সেসের ভাই, মিশরের গর্ভনর, নিহত হন এবং মিশর আবার স্বাধীন হল বলে মনে করা হয়। পারস্য সমস্যার মধ্যে থাকলেই মিশরীয়রা নিজেদেরকে অধিকতর নিরাপদ মনে করত। সালামিসের যুদ্ধের সময় থেকেই এথেন্স পারস্যের সাথে অবিরাম যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিল। যে যুদ্ধে তারা সর্বদাই সাম্রাজ্যের সীমান্তে খোঁচা দিত। এসব এথেনীয় কার্যকলাপে মিশরের মূল শক্তিকে ব্যাহত করতে পারেনি। তবে এর ফলে পারস্য তার সর্বশক্তিকে মিশরের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারেনি। তার চেয়েও বড় কথা মিশরীয় বিদ্রোহের ইঙ্গিত পেয়েই এথেনীয় নৌবহর বিদ্রোহীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে।

তবে মিশরের দুর্ভাগ্য হলো নতুন পারস্য সম্রাট আর্তাজারেক্সেস তেমন দুর্বল ছিলেন না। তিনি মিশরে একটি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন এবং বিদ্রোহীদের সম্পূর্ণরূপে তাড়িয়ে দিয়ে ব-দ্বীপের নিকট একটি দ্বীপে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন। এখানে বিদ্রোহীদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না, কারণ তাদের সঙ্গে ছিল এথেনীয় নৌবহর। কিন্তু আর্তাজারেক্সেস নীলের একটি শাখা নদীকে দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলে জাহাজগুলো অসহায়ভাবে সৈকতে আটকা পড়ে গিয়েছিল এবং এথেনীয়দের ২য় একটি নৌবহর দৃশ্যপটে উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই অর্ধেকটা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। ৪৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে দমন করা সম্ভব হয়। গ্রিক শক্তির অধিকাংশই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয় এবং ইনারসকে বন্দী করে হত্যা করা হয়। সম্পূর্ণ বিষয়টি এথেনীয়দের জন্য এক মহাবিপর্যয়। তবে ইতিহাসে এ সম্বন্ধে বেশি কিছু উল্লেখ করা হয়নি, তার একটি কারণ ঘটনাটি ঘটে এথেন্সের স্বর্ণযুগে। তৎসত্ত্বেও এথেনীয় পরাজয়কে তার বৈদেশিক নীতির দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যাতে করে তার মিত্ররা হয়ে পড়ে নিরুৎসাহিত এবং শক্ররা হয় উৎসাহিত। যদি পারসিকদের বিরুদ্ধে প্রথম মিশরীয় বিদ্রোহ এথেন্সকে রক্ষা করে থাকে দ্বিতীয়টি তাকে ধ্বংস করায় সাহায্য করে। ৪৩১ থেকে ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ব্যাপী পেলোপোনেসীয় যুদ্ধের পর এথেন্স বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল, এবং তা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

তৃতীয় দারিয়ুস (৩৩৬ – ৩৩০ খ্রি.পূ.) ও সাম্রাজ্যের পতন

প্রথম জারােক্সেসের মৃত্যুর পর পারস্য সাম্রাজ্যে অরাজকতা চলতে থাকে। খ্রি.পূ. ৪৬৫ অব্দ থেকে খ্রি.পূ. ৩৩৬ অব্দ পর্যন্ত চলতে থাকা অসন্তোষ ও অরাজকতার মধ্যে প্রথম আর্তাজারেক্সেস (৪৬৫ – ৪২৫ খ্রি.পূ.), দ্বিতীয় জরেক্সেস (৪২৫ – ৪২৪ খ্রি.পূ.), দ্বিতীয় দারিয়ুস (৪২৩ – ৪০৪ খ্রি.পূ.) রাজত্ব করেন। খ্রি.পূ. ৩৩৬ অব্দে তৃতীয় দারিয়ুস সিংহাসনে বসেন। তার সময়ই পতন ঘটে পারস্য সাম্রাজ্যের। খ্রি.পূ. ৩৩০ অব্দে ম্যাসিডােনীয় বীর আলেকজান্ডার পারস্য আক্রমণ করেন। এ বছর এপ্রিল মাসে রাজধানী পার্সিপােলিসের পতন হবার পর গ্রীষ্মকালে পলায়ন কালে পারসিকদের হাতেই নিহত হন তৃতীয় দারিউস। 

পারসিক সাম্রাজ্যের বহু দুর্বলতা ছিল। একটা বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে এত বিচিত্র জনগােষ্ঠী ও জাতিস্বত্বা বসবাস করার ফলে এসব সমস্যা দেখা দেয়। ভিন্ন ধরনের নৃতাত্ত্বিক গঠন, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে বিভিন্ন ধৰনের সম্পৃক্ততা নিয়ে বিচিত্র জনগােষ্ঠি এখানে বাস কত। এই পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত মন্থর ধাঁচের। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ঐক্যের অভাব এবং সরকারের তেজশক্তির অভাবের ফলে সাম্রাজ্যের মধ্যে ধ্বংসাত্মক শক্তি সহজেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তাবে পারস্যের পতনের প্রধান কারণ ছিল সাম্রাজ্যের অতি বিস্তার, বিশেষ করে, গ্রীকদেরকে দমন করার জন্য পরিচালিত ব্যয়সাপেক্ষ বিভিন্ন অভিযান। এ সব অভিযান সাম্রাজোর অর্থনীতি ও শাসন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। এত বিশাল সাম্রাজ্যে যদি সম্রাট ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে স্বৈরাচার শুরু করেন তাহলে অবস্থা খারাপ হতে বাধ্য। সাইরাস যথেষ্ট প্রজাহিতৈষী হলেও পরবর্তী সম্রাটগণ সকল ক্ষেত্রে তেমনটা দেখাতে পারেননি। সম্রাট সাইরাসের প্রজাহিতৈষী মনােভাব ত্যাগ করে পরবর্তী সম্রাটরা স্বৈরাচারী আচরণ করে। প্রজাদের ওপর অতিরিক্ত করারােপ করা হয়, পারস্য সম্রাটরা ক্যালদিয়া থেকে ১.৬ মিলিয়ন আউন্স এবং মিশর থেকে ১.১ মিলিয়ন আউন্স রূপা কর হিসেবে আদায় করেছিল। গ্রিসসহ অন্যান্য এলাকার লােকদেরকে জোর করে সেনাদলে ভর্তি করা হয়। এসব ছাড়াও পরবর্তী সম্রাটদের যােগ্যতার প্রভাব ও সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলাও আকিমিনিদ সাম্রাজ্যের পতনের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। অবশেষে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে Arbela (আরবেলার যুদ্ধে)-র যুদ্ধে পারসিক রাজতন্ত্রের উপর মরণ আঘাত হানেন। প্রথমে আলেকজান্ডারের মাধ্যমে হেলনীয় রাজতন্ত্র এবং পরবর্তীকালে রােমান সাম্রাজ্যে পারসিক রাজকীয় শাসন ব্যবস্থা প্রভাব বিস্তার করেছিল। এভাবে তা ইউরােপে প্রবেশ করে। 

পারসিক শাসন ব্যবস্থা, স্থাপত্য শিল্প, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা ও অবদান 

ভূমিকা

পারস্য সভ্যতার অবদান ছিল বহুমুখী। একদিকে ভারত মহাসাগর থেকে কাস্পিয়ান সাগর, অন্যদিকে সিন্ধুনদ থেকে ইজিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিশাল সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হওয়ার পর সবচেয়ে যোগ্যতার সাথে একে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন সমাট প্রথম দারিয়ুস। সাইরাসের সময় সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এতটা না হলেও তিনি খুব যােগ্য শাসক ছিলেন। অবশ্য গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা পারসিক সাম্রাজ্যে বিস্তৃতি লাভ না করায় প্রশাসনে জনগণের মতামতের তেমন ভূমিকা ছিল না। কিন্ত সমাটের প্রজাহিতৈষী নীতির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছিল। এখানে দারিউসের সমৃদ্ধশালী সময়ে পারস্য সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও বিশ্বসভ্যতায় পারস্য সাম্রাজ্যের অবদানগুলো সম্পর্কে উল্লেখ করা হবে।

প্রশাসন : শাসন বিভাগ, সামরিক বিভাগ, অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা

সাম্রাজ্য যেহেতু বিশাল ছিল, তাই প্রশাসনিক কাঠামোও সুদৃঢ় হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। প্রশাসনকে সুদৃঢ় কাঠামাের ওপর প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব প্রথম দারিউসের। বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের একেক এলাকার লােকের ভাষা ছিল একেক। ধর্ম, গায়ের রং সবই ছিল আলাদা। এই বিচিত্র জনগােষ্ঠীকে একতার বাঁধনে বেঁধে রেখে সাম্রাজ্যকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার কঠিন কাজটি করেছিলেন প্রথম দারিয়ুস। তার প্রবর্তিত প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করে মৌর্যযুগে ভারতীয় সম্রাটরা দক্ষভাবে বিশাল সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। রােমান সম্রাটসহ ইউরােপের অনেক রাজা এমনকি আলেকজান্ডারও এই প্রশাসনিক কাঠামাের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

দক্ষ ও কৌশলী শাসক, এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা ও স্বর্গীয় অনুমোদন : একদিকে ভারত মহাসাগর থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত, অন্যদিকে সিন্ধুনদ থেকে ঈজিয়ান সাগর পর্যন্ত প্রসারিত বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যকে একক কর্তৃত্বে শাসন করার দক্ষতা দারিউস দেখিয়েছিলেন। জন বৈচিত্রে ভরপুর ছিল তার সাম্রাজ্য। জনগণের ভাষা, ধর্ম ও জাতীয়তার পরিচয়ের ব্যাপক পার্থক্য ছিল। এই সাম্রাজ্যকে এক বাঁধনে বাঁধার স্বার্থে তিনি জনসাধারণের জীবনাচরণে হস্তক্ষেপ করতেন না। তবে এর শর্ত হিসেবে তার প্রতি আনুগত্য পােষণ ও তাকে কর প্রদান করতে হতাে। তিনি বেসামরিক প্রশাসন, সামরিক বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থার ওপর তার সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন। পারসিক সাম্রাজ্যের প্রশাসন ব্যবস্থা আবর্তিত হত সম্রাটকে কেন্দ্র করে। সম্রাটের ক্ষমতা উত্তরাধিকার ভিত্তিক ছিল। তবে তিনিও তার স্বপক্ষে স্বর্গীয় অনুমোদন দাবী করতেন। অর্থাৎ সম্রাটের ক্ষমতার উৎস হিসেবে আহুরা মাজদার আর্শীবাদ বা অনুগ্রহকে বড় করে দেখা হত। মিশরীয় ও ব্যবিলনীয়নের শাসক হিসেবে তিনি তাদের দেব-দেবীর সৈন্য নিয়ে একটি ডিভিশন গঠিত হত।

রাজধানী : সাম্রাজ্যের রাজধানী সম্রাট প্রথম দারিউস হিসেবে চারটি নগরীকে নির্বাচন করেছিলেন। এগুলাে ছিল (১) পার্সেপেলস (প্রাসাদশােভিত নতুন রাজধানী), (২) একবাটানা (মিডীয়দের রাজধানী), (৩) সুসা (এলামীয়দের রাজধানী), (৪) ব্যাবিলন (বিখ্যাত মেসােপটেমীয় শহর)। রাজধানী সুসায় বড় রাজকোষাগার নির্মাণ করা হয় যার মধ্যে বহু মিলিয়ণ পাউন্ড স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চিত করে রাখা হত। এছাড়া এখানে প্রধান রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। এই প্রাসাদে ২৫০ বর্গফুটের বিশাল কক্ষ ছিল। গরমকালে রাজদরবার উত্তরে স্নিগ্ধ ও মনােরম আবহাওয়া সমৃদ্ধ একবাতানায় স্থানান্তর করা হত। উল্লেখ্য যে, একবাতানা ছিল প্রাচীন মেডিয়ার রাজধানী। আবার শীতকালে রাজদরবার নিয়ে যাওয়া হত আধা গরম এলাকার ব্যবিলন অথবা অন্য কোন দক্ষিণাঞ্চলীয় নগরীতে। সুতরাং পারস্য ছিল সাম্রাজ্যের আবেগময় কেন্দ্র। সব রাজাকে পারস্যে কবর দেওয়া হত, যদিও তারা খুব কমই এখানে আসত।

সত্রপি ও প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা সত্রপ: অ্যাসিরীয়ব্যাবিলনীয়দের কাছ থেকে পারসিকরা উত্তরাধিকারসূত্রে একটি প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা লাভ করে। এসব প্রদেশকে সত্রপি বলা হত। বিশাল সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়ােজনে সম্রাট দারিউস একে ২১টি সত্রপি বা প্রদেশে বিভক্ত করেন। সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত গভর্নর বা সত্ৰপ এসব প্রদেশ শাসন করত। এসব সত্ৰপ পারসিক রাজকীয় পরিবার অথবা অভিজাত পরিবারের সদস্য ছিল। সম্রাটের ওপর সত্রপের শাসনকাল নির্ভর করত। তবে সাধারণত সত্ৰপরা আজীবন স্বীয় পদে বহাল থাকত। অধিকাংশ সময় সত্রপের পুত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে উক্ত পদ লাভ করতেন। সম্রাট সত্রপিগুলোর বিভিন্ন গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত দিতেন। এজন্য সত্রপির কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সম্রাটের মতামত গ্রহণ না করা পর্যন্ত সত্রপের পক্ষে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে নিষিদ্ধ ছিল।

কেন্দ্রীয় পরিদর্শক দল বা সচিব নিয়োগ এবং সামরিক ও বেসামরিক বিষয়ে বিভাজন : সেকালে দূরবর্তী প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা সত্রপদের বিদ্রোহ করার ও বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা ছিল। যেকোন সময়ে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘােষণা করতে পারত। এই প্রবণতা এবং শাসকদের স্বেচ্ছাচার রােধকল্পে দারিউস দুটো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথমত তিনি সন্দেহজনক সত্রপদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সম্রাট উক্ত সত্রপিতে একজন সচিব নিয়ােগ করেন। এই সচিব তার কার্যকলাপের জন্য কেবলমাত্র সম্রাটের নিকট দায়ী থাকতেন। তার দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন সময়ে সত্ৰপদের সম্পর্কে সম্রাটকে গােপন তথ্য প্রেরণ করা; এই সচিবকে রাজার চক্ষু বলা হত। দ্বিতীয়ত তিনি প্রতিটি সত্রপিতে সামরিক ও বেসামরিক বিষয়কে বিভাজিত করে দেন। সত্রপদের হাতে কেবল বেসামরিক ক্ষমতা দেয়া হয়, আর সামরিক ক্ষমতা তিনি ন্যস্ত করেন প্রতি প্রদেশে একজন করে বিশেষ সামরিক কর্মকর্তা বা সামরিক অধিনায়কের ওপর। এই কর্মকর্তাটি প্রদেশে নিয়ােজিত স্থায়ী সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। সত্রপির সামরিক প্রধান হিসেবে তিনি বড় বড় শহরগুলোর সামরিক ছাউনীর অধিনায়কত্ব করতেন। প্রদেশের হাল-হকিকত তিনি নিজে সম্রাটকে আলাদাভাবে জানাতেন। তিনি সত্রপের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীন ছিলেন। সামরিক বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সত্রপরা সহজে সম্রাটের বিরাগভাজন হবার সাহস দেখাতে পারত না। তবে কোন সত্যিকার বিপদ বা জরুরী অবস্থা দেখা দিলে সত্ৰপ সীমিত সামরিক কর্তৃত্ব ভােগ করতেন।

সত্রপিদের মূল বেসামরিক দায়িত্ব কর আদায় : সম্রাট দারিউস পারসিক অর্থব্যবস্থাকেও নিয়মিত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন। একজন সত্রপের প্রধান কাজ ছিল সম্রাটের পক্ষে উপঢৌকন ও কর সংগ্রহ করা। আগেকার দিনে ফসল যেমনই হােক না কেন কর ছিল নির্দিষ্ট। কিন্তু দারিয়সের যুগে প্রতিটি সত্রপি থেকে কি পরিমান কর আদায় করা হবে তা নির্ধারণ করার আগে এ সম্পর্কে জরীপ চালানো হতো। গড় উৎপাদন নির্ধারণ করে এবং প্রতি বছরের সঠিক উৎপাদনের ভিত্তিতে কর নির্ধারণ করা হতাে। প্রতিটি সত্রপি থেকে তিন প্রকার কর আদায় করা হত। প্রথমত, অর্থ অথবা মূল্যবান ধাতব পদার্থের আকারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর আদায় করা হত। দ্বিতীয় প্রকার কর আদায় করা হত শস্যের মাধ্যমে, অর্থাৎ গম, যব, ফলমূল, ঘোড়া, গাধা, ভেড়া ও খচ্চরের মাধ্যমে। করের আকারে আদায়কৃত এসব খাদ্যশস্য ও গবাদি পশুর দ্বারা সেনাবাহিনীকে পােষন করা হত এজন্য এসব শস্য বিশাল গুদাম ঘরে সড়ক পথের ধারে সংরক্ষণ করা হতো। পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে মুদ্রাব্যবস্থা চালু থাকায় সেসব সত্রপির বার্ষিক কর ও রাজস্ব প্রদান করা হত অর্থের মাধ্যমে। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলীয় সত্রপিগুলোতে শস্য বা বস্তুগত সামগ্রীর মাধ্যমে তা প্রদান করা হত। তৃতীয় প্রকার কর ধার্য করা হত সাম্রাজ্যের মধ্যে মালামাল ও পণ্য সামগ্রীর ব্যবসাবাণিজ্য উপলক্ষো একস্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবহণের ওপর শুল্ক হিসেবে। এই করব্যবস্থা কিছুটা বােঝাস্বরূপ হলেও অ্যাসিরীয়দের তুলনায় তা ছিল অনেক হালকা ও আইনসঙ্গত। এসব করের বিনিময়ে প্রজারা সুশাসন, শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করত। ১ লাখ ২০ হাজার সৈন্যের জন্যে ১ বছরের প্রয়ােজনীয় গম মিশর রাজ্যের ওপর কর ধার্য করা হয়েছিল। এ জাতীয় কর অন্যান্য রাজ্যের ওপরেও ধার্য করা হয়েছিল। বিপুল পরিমাণে আদায়কৃত করে রাজভাণ্ডার ধনসম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ফারস প্রদেশ এই সাম্রাজ্যের ভিত্তিভূমি ছিল বলে এখানে কোনো কর ছিল না।

সামরিক বাহিনীর উন্নয়ন : দারিউস সেনা ও নৌবাহিনীতে সংস্কার সাধন করেছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যকে ৫টি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করেছিলেন। উন্নতমানের যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করে এবং ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার ও ফিনিশিয়ার দক্ষ নাবিকদেরকে নিজের নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এক বিশাল নৌবহর গড়ে তােলেন। ভারতের সিন্ধুনদ সংলগ্ন এলাকায় তার বিজয় সম্ভব হয়েছিল ভূমধ্যসাগরীয় নাবিক সাইল্যাক্স-এর তত্ত্বাবধানে গঠিত নৌবাহিনী থাকায়। আরব সাগরের সিন্ধুপ্রান্ত থেকে মিশর সংলগ্ন সমুদ্রতট পর্যন্ত তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পারসিক সামরিক বাহিনীর মূল শক্তি ছিল অশ্বারােহী ডিভিশনগুলো এবং দশহাজার সৈন্যের “অজেয় ও অমর” বাহিনী (ইমমরটাল)। শুধুমাত্র পারসিকদের সমন্বয়ে এই ডিভিশন গঠিত হত। সাধারণত সেনাপতিরা হতেন পারসিক। তবে রাজতন্ত্রের প্রতি বেশ কিছু বিশ্বাসী ও অনুগত মেডেস ও অ-ইরানীরাও এসব উঁচু পদে সমাসীন হতে পারত। মেডিয়া থেকে রাজকীয় সেনাবাহিনীতে সুদক্ষ ও সুশিক্ষিত সৈন্য সরবরাহ করা হত। তাছাড়া মেডিয়া থেকে দু হাজার অভিজাত পরিবারের সদস্যকে সম্রাটের দেহরক্ষী হিসেবে, দশহাজার অজেয় সেনাদলে এবং বহু সংখ্যক সুদক্ষ তীরন্দাজ সরবরাহ করা হত। যুদ্ধের সময় ইরানী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত সব জাতিকেই যোদ্ধাকোটায় সৈন্য সরবরাহ করতে হত। সেনাবাহিনীতে উপযুক্ত সৈনিক সরবরাহের জন্য দারিউসের প্রশাসন একটি কষ্টসহিষ্ণু কৃষক ও পর্বতারােহী শ্রেণী গড়ে তােলেন। সাম্রাজ্যের সব জায়গার প্রজাদেরকে রাজকীয় বাহিনীতে সৈন্য সরবরাহ করতে হত। প্রত্যেক অঞ্চলের সৈন্যরা নিজেদের আঞ্চলিক বা স্ব স্ব জাতীয় পােষাকে সুসজ্জিত থাকত এবং নিজেদের কায়দা ও কৌশলে যুদ্ধ করত। অন্যদিকে ফিনিশীয়, মিশরীয় ও এশিয়ায় বসবাসকারী গ্রীকদের নিয়ে নৌবাহিনী গঠিত হত।  

মুদ্রা সংস্কার : সমগ্র সাম্রাজ্যের মধ্যে একই প্রকার ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থা চালু থাকার ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সম্রাট দারিউস কর্তৃক মুদ্রাব্যবস্থা চালুর ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। লিডীয়দের মুদ্রা প্রচলনকে সার্থক করেছিলেন তিনি, পশ্চিম এশিয়াব্যাপী মুদ্রা প্রচলনের কৃতিত্ব তারই। এমনকি ভারতের মুদ্রাব্যবস্থায় উন্নয়নেও তার মুদ্রা সংস্কারের অবদান আছে। তবে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করার একচেটিয়া অধিকার ছিল সম্রাট ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের। এসব স্বর্ণমুদ্রাকে ডারিক (Daric) বলা হত। সত্ৰপদেরকে ব্রোঞ্জ এবং রৌপ্য মুদ্রা প্রচলনের অনুমতি দেওয়া হয়। স্বর্ণ ও রৌপ্যের আনুপাতিক বিনিময় হার ছিল ১৩:১। পশ্চিমাঞ্চলীয় সত্রপিগুলোতে মুদ্রা ছিল একটি জনপ্রিয় বিনিময় মাধ্যম। তবে পূর্বাঞ্চলে মুদ্রা ব্যবস্থার পরিবর্তে দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থা চালু ছিল। রাজকীয় কোষাগার ও ভাণ্ডারগুলোতে প্রচুর পরিমান স্বর্ণ ও রৌপ্য সংগ্রহ ও সঞ্চিত রাখা হত।

যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন : প্রাচীনকালে সাম্রাজ্যের সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা উন্নত পরিবহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল ছিল। সম্রাট প্রথম দারিউস সাম্রাজ্যের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রন করা এবং সবধরনের জরুরী পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য রাজকীয় মহাসড়ক সহ অসংখ্য রাস্তা নির্মাণ করেন ও ডাক ব্যবস্থা চালু করেন। প্রধান সড়কটি “রাজকীয় মহাসড়ক” বা “Royal Road” নামে পরিচিত ছিল। ১৬৭৭ মাইল বিস্তৃত এই রাস্তা আনাতোলিয়ার সার্দিস (Sardis) থেকে শুরু করে পারস্যের সুসা (Susa) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অন্যান্য সড়ক পথের দ্বারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের সত্রপিগুলোর সাথে বড় বড় শহরগুলোর সংযােগ স্থাপন করা হয়। সংযুক্ত এসব নগরীর মধ্যে পেসারগাদে (যে প্রাচীন নগরীতে সাইরাসের সমাধি আছে), পার্সিপােলিস (যেখানে রাজপ্রাসাদ অবস্থিত ছিল), ব্যবিলন, একবাতানা এবং মেমফিস-এর নাম উল্লেখযােগ্য। এসব সড়ক পথ নির্মাণের ফলে দ্রুত যােগাযােগ ও পরিবহণ সম্ভব হয়। পারসিক রাস্তাগুলাে ছিল রাস্তা নির্মাণ শিল্পের ক্ষেত্রে এক অনবদ্য অবদান। পারসিকদের পর রাস্তা নির্মানকাজে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি দেখা যায় রােমানদের সময়। দ্রুতগামী দূত বা বার্তা বাহকেরা ঘােড়ায় চেপে এ সব রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করত এবং সাম্রাজ্যের মধ্যে সর্বত্র যােগাযোগ স্থাপন করত। অন্যান্য শাখা রাস্তা ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল থেকে সিন্ধু উপত্যকা পর্যন্ত সমস্ত ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করে। এই উন্নত সড়কব্যবস্থা পারসিক রাজাদের সাথে জনগন ও কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ স্থাপনে সহায়ক হয়। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাককে হিল ও বাকলার লিখেছেন যে, “সম্রাট কার্যকরীভাবে শাসন করতে, তার মন্ত্রীদেরকে লাইনে রাখতে, এবং তার অধীনে জনগণের অধিকারকে রক্ষা করতে সক্ষম ছিলেন।” (McKay, et. al., 60)। সড়ক ছাড়াও জলপথেও সম্রাট দারিউস উন্নতি সাধন করেছিলেন। মিশরের নীলনদের সাথে লােহিত সাগরের সংযােগ রক্ষাকারী খাল তিনি সংস্কার ও পুনঃখনন করেছিলেন। ফলে মিশরীয় এলাকার যােগাযােগ উন্নত হয়।

উন্নত ডাকবিভাগের প্রবর্তন : রয়াল রোডের ১৬৭৭ মাইল দীর্ঘ দূরত্বকে ভেঙ্গে ১১১টি ডাক ঘাটিতে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক ডাক ঘাটিতে নতুন রাখা হত যাতে রাজার সংবাদবাহকেরা ক্লান্ত ঘােড়া রেখে আরেকটা সজীব ও প্রাণবন্ত ঘােড়াকে নিয়ে ছুটতে পারত। এই যােগাযােগ ব্যবস্থার ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে Barnes বলেন যে, “এই সকল ফ্যাক্টরগুলো, সেই সাথে নিম্ন কর, সাম্রাজ্যের মধ্যকার শান্তি, উদ্দিপীত বাণিজ্যিক কার্য – সকলই বস্তুগত মঙ্গলের উদ্দেশ্যেই ছিল।” (Barnes, 86)। অন্যান্য সড়ক পথের দ্বারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের সত্রপিগুলোর সাথে বড় বড় শহরগুলোর সংযােগ স্থাপন করা হয়। সড়কগুলোর একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর ডাক ও সংবাদ বাহকেরা নতুন ঘােড়া নিয়ে অপেক্ষা করত। ফলে ডাক ও সংবাদ দ্রুত আদান প্রদান হত। মেসােপটেমিয়ার আসিরীয় ডাকব্যবস্থার অনুসরণে মহাসড়কপথে চালু হয়েছিল পনি এক্সপ্রেস নামে পরিচিত রিলে পদ্ধতিতে ঘােড়ার ডাক। ফিলিপ লী র‍্যালফের ভাষায়, “খুব কম লোকই বুঝেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোস্ট অফিসের আদর্শ রয়াল রোড বরাবর পারসিক ডাকবাহকদের প্রশংসার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে : তুষার, বৃষ্টি, উত্তাপ বা রাতের বিষাদ – কোন কিছুই ডাকবাহকদেরকে তাদের কার্যসমাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত টলাতে পারতো না।” (Ralph et al., 200). স্ক্রামুজ্জা ও ম্যাককেন্ড্রিক সড়ক পথের ব্যবহার সম্পর্কে লিখেছেন যে, “ডাকবাহকরা রাজধানী থেকে সাম্রাজ্যের সকল প্রান্তে সম্রাটের নির্দেশ নিয়ে যেত বা সত্রপদের রিপোর্ট সম্রাটের কাছে নিয়ে আসতো, তাদেরকে সুসা বরাবর বিভিন্ন সড়কপথ ধরে দিবারাত্র চলাচল করতে দেখা যেত। মরুভূমির ভ্রমণকারীদের কাছে এই সড়কপথগুলো দৃশ্যমান নয়, কিন্তু এই সড়কগুলোর চিহ্ন আজ আকাশ থেকে টের পাওয়া যায়।” (Scramuzza et. al., 114)। সম্রাট সত্রপিগুলোর বিভিন্ন গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সিদ্ধান্ত দিতেন। এজন্য সত্রপির কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সম্রাটের মতামত গ্রহণ না করা পর্যন্ত সত্রপের পক্ষে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে নিষিদ্ধ ছিল। আবার ডাক বিভাগীয় পরিদর্শকদের একটি প্রধান কাজ ছিল রাজার নিকট তার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠানাে। পরিশেষে, “King’s Eye” নামে পরিচিত সম্রাটের একজন নিকট আত্মীয়, যিনি উচ্চমর্যাদার ও সামরিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, সমগ্র সাম্রাজ্যব্যাপী ভ্রমণ করতেন এবং কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও আনুগত্য পর্যবেক্ষণ করতেন। এসব রাজকীয় কমিশনারের আনেকাংশে মধ্যযুগে সম্রাট শার্লামেনের Missi Dominicy-র মত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তারা সম্রাট ও জনগনের মধ্যে সংযােগের মাধ্যম ছিলেন। সরাইখানা ও পাহারার ব্যবস্থাসহ প্রায় ১৫ মাইল পর পর একটা করে স্টেশন থাকত। এখানে ঘােড়া বদল করা হতাে। সুসা থেকে এই পথে সার্দিস যেতে একজন পর্যটকের তিন মাসের মতাে সময় লেগে গেলেও এই পদ্ধতিতে ডাক নিয়ে যেতে সময় লাগত মাত্র সাত দিন। 

কৃষি ও বাণিজ্যে উন্নয়ন : অধিকাংশ আবাদী জমি ছিল শক্তিশালী অভিজাতদের দখলে এবং ছােট ছােট কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যা অনেক কম ছিল। সিরীয় মালভূমির প্রান্তিকভাগে জলসেচের দ্বারা কৃষিকাজ করা সম্ভব হয়, এতে সাম্রাজ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সড়ক ও নৌ যােগাযােগের উন্নয়নের ফলে বাণিজ্যের প্রসার হয়েছিল। মিশরের খাল সংস্কারের ফলে ভূমধ্যসাগর থেকে পারস্য উপসাগরের বাণিজ্য সহজতর হয়েছিল। স্কাইল্যাক্স (Scylax) নামক জনৈক কর্মকর্তাকে সিন্ধুনদ জরীপ করার জন্য এবং সিন্ধু নদ হয়ে এশীয় উপকূল বরাবর সুয়েজ পর্যন্ত নৌ-চলাচলের সম্ভাব্যতা জরীপ করতে বলা হয়। দারিউস ব্যবসায়ী শ্রেণীকে বিভিন্ন প্রকার সাহায্য দান ও সহানুভূতি জ্ঞাপনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যে বানিজ্যিক সমৃদ্ধি আনায়নের চেষ্টা করেন। এছাড়া বাণিজ্যপথকে বর্বর জাতি ও ডাকাত-তস্করদের হাত থেকে নিরাপদ করতে নৌ ও সড়কপথে পাহারার ব্যবস্থা এবং অনেকগুলাে পর্যবেক্ষণ চৌকি তিনি স্থাপন করেছিলেন।

আইন সংস্কার : এ যুগে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় দু’ধরনের আইন প্রচলিত হয়েছিল। বিচারালয়ও দু’রনের ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। একটি ছিল স্থানীয় আইন, যা স্থানীয় নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে স্থানীয় আইন প্রবর্তিত হতাে। আরেক রকম আইন ছিল কেন্দ্রীয় আইন, যা ছিল সম্রাট প্রবর্তিত আইন।

সমাজ-কাঠামো

সমাজ ছিল শ্রেণী বিভক্ত। প্রধান তিনটি শ্রেণী ছিল – 

  • ক. যােদ্ধা ও সমরজীবী : এরাই শাসন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করত। অনেকটা ভারতের ক্ষত্রিয়দের মতাে। রাজা নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল এদের। 
  • খ. পুরােহিত : এরা দৈহিক শ্রমের সাথে জড়িত ছিল না। কিন্তু সমাজে এদের ছিল বিরাট প্রভাব। সংস্কৃতি ও ধর্মের বিষয়ে এরা প্রায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। 
  • গ. কৃষক ও গশুপালক : এরা মূল উৎপাদক শ্রেণী ছিল। কিন্তু ফলভােগের ক্ষেত্রে এদের তেমন একটা স্থান ছিল না। শােষণ নির্ভর সমাজে উৎপাদকরাই ছিল সবচেয়ে কম সুবিধাভােগী।

পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে পুত্রেরাই সম্পদের উত্তরাধিকারী হতাে। পিতৃতান্ত্রিকতার অধিকতর বিকাশে পারসিকদের অবদান ছিল। শােষণভিত্তিক সমাজ নির্মাণ ও বিকাশে এই সভ্যতার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। 

শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান

অভিজাতদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা : তরুণ পারসিকদেরকে সেনাপতি বা অধিনায়কের পদে, অথবা প্রাদেশিক গভর্নর বা সত্ৰপদের মত উঁচু প্রশাসনিক পদে, রাজার উপদেষ্টা অথবা রাজধানী ও সত্ৰপীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তােলার জন্য একটি বিশেষ শিক্ষা দান করা হত। প্রতিটি সত্রপী এবং রাজদরবারের সাথে একটি বিদ্যালয় থাকত যেখানে পারস্যের সবচেয়ে উঁচু অভিজাত পরিবারের তরুণদের ঘোড়ায় চড়তে, তীর ছুড়তে এবং একজন পারসিক ভদ্রলােকের জন্য প্রয়ােজনীয় তিনটি ‘R’ সম্বন্ধে শিক্ষাদান করা হত। পারসিক জীবন ধারণ ব্যবস্থা এবং এধরণের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তরুণ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে তেজশক্তি ও ধার্মিকতার সঞ্চার করত। তবে তরুণ অভিজাতগণ দুটি দায়িত্ব পালন করত যথা – সম্রাটের নিকট ও সৃষ্টিকর্তার নিকট। অভিজাতদেরকে সাধাসিদে জীবনধারায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে পারসিকরা অভিজাতদেরকে তাদের পূর্বপুরুষদের জমিজমা ও সাধারণ জীবন যাত্রার সংস্পর্শে রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু সাম্রাজ্যের এবং এর দায়দায়িত্ব বৃদ্ধির ফলে এই নীতি পরিত্যক্ত হয়। এসব কারণে সুসা নামক স্থানে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি : দারিয়ুসকে রাজকীয় তত্ত্বাবধানে প্রথম চিকিৎসা বিদ্যালয়-স্থাপনকারী এশীয় রাজা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি মিশরীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় সংস্কার করেছিলেন। নেবুরিমানু নামের ক্যালদীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীর এ সংক্রান্ত ধারণাকে তিনি সমর্থন করতেন। এভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চায় তার পৃষ্ঠপােষকতা ছিল। 

শিল্প ও স্থাপত্য

অন্যান্য জাতির প্রভাব : পারসিক জাতি ছিল কষ্টসহিষ্ণু ও কঠোর পরিশ্রমী একটি পার্বত্য জাতি। ভােগ বিলাসে পরিপূর্ণ এ পৃথিবীতে তারা দীর্ঘকাল যাবত একটি সাধাসিদে জীবনযাত্রা নির্বাহ করত। মহান ঐতিহাসিক হেরােডােটাসের মতে পারসিকরা তাদের সন্তানদেরকে মাত্র তিনটি বিষয় শিক্ষা দিত। এগুলো ছিল- ঘােড়ায় চড়া, তীর ছােড়া এবং সত্যকথা বলা। পারসিক সাম্রাজ্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে শিল্পকলা সম্বন্ধে অন্যান্য জাতির কাছ থেকে তাদেরকে গ্রহণ করতে হয়। মূলত পারসিকরা অ্যাসিরীয়, ব্যবিলনীয়, মিশরীয় এবং গ্রীকদের কাছ থেকে শিল্পকলা সম্বন্ধে ধারণা লাভ করে।

চারুকলা ও ভাস্কর্য : পারস্যের চিত্রকলার ইতিহাস অনেক পুরনাে। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দেও পারস্যে চিত্রিত মৃৎপাত্র তৈরি হতাে। আকিমেনীয় যুগে মৃৎপাত্রে অলংকরণ, পাথরের ওপর খােদাইকর্ম ও ঢালাই ব্রোঞ্জের শিল্পকর্মগুলাের প্রতি আধুনিক যুগের মানুষের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। তবে পরবর্তী পারস্য চারুকলায় গ্রিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ইরানের প্রাগৈতিহাসিক মৃৎপাত্রে নানা প্রাণী আর পাখির ছবি আঁকা হতাে। এসব মৃৎপাত্র সুসিয়ানা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। মেসােপটেমিয়ার আল উবেইদ সংস্কৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মৃৎপাত্রও পারস্য থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। মেসােপটেমিয়ার শিল্পরীতি প্রভাবিত এলামীয় সিল, মূর্তি ও খেদাইচিত্রও আবিস্কত হয়েছে। আনুমনিক খ্রি.পূ. ১০০০ থেকে ৮০০ অব্দের মধ্যে হুসনলুতে নির্মিত দোতলা প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ থেকে রূপার তৈরি একটি পাত্র পাওয়া গেছে। এটিতে ইলেকট্রামের সংকর ধাতু দিয়ে দুই স্তরের শিল্পকর্ম উত্তীর্ণ ছিল। ওপরের স্তরে সৈন্য ও রথের দৃশ্য উৎকীর্ণ আছে। নিচের স্তরে আছে তীরন্দাজ পরিবেষ্টিত অবস্থায় মুখােমুখি বসে থাকা একটি ঘােড়া ও একটি সিংহ। এ যুগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন আছে তেহরানের প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে। এটি হলাে সােনার তৈরি একটি বাটি। আকিমেনীয় সম্রাটদের পার্সেপােলিস প্রাসাদের ষড়মানবের মূর্তিগুলাে আধুনিককালের বােদ্ধারা অপূর্ব বলে বিবেচনা করেছেন। আকিমেনীয় যুগের খােদাইশিল্পের দ্বারা প্রাচীন পৃথিবীর বহু মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এগুলাের সাহায্যে সেযুগের ইতিহাসের অনেক কিছু জানা যায়। এ যুগের শিল্পকীর্তির উদাহরণ হিসেবে বেহিস্তানের দারিয়ুসের পর্বতলেখ এবং পার্সিপােলিস-এর নিকটবর্তী নখশ ই-রুস্তম-এর সমাধিসৌধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। পারস্যের ভাস্কর্যের খুব স্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল ভারতের শিল্পকলায়, বিশেষভাবে মৌর্যযুগে। অশােক স্তম্ভশীর্ষের পশুমূর্তি এবং স্তম্ভ নির্মাণকৌশলেও পারসিক প্রভাব স্পষ্ট। 

স্থাপত্য : স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও পারসিকরা অন্য জাতিসমূহের কাছে ঋণী। ব্যবিলনীয়দের কাছ থেকে পারস্যরা Terrace বা উঁচু চত্বরের নমুনা গ্রহণ করে, যা ছিল তাদের স্থাপত্য শিল্পের সবচেয়ে বড় দিক। পারস্যে চুনাপাথর প্রচুর পরিমান পাওয়া যেত। এজন্য পারসিকরা সর্বপ্রথম তাদের ইমারত নির্মানে প্রচুর পরিমান চুনাপাথর ব্যবহার করত। এছাড়া ব্যবিলনের স্থাপত্যবিদ্যার সাথে পারসিকদের কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ভবনে পাথরের স্তম্ভ সংযােজন তাদের স্থাপত্য শিল্পের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। মিশরের তুলনায় পারসিক স্তম্ভরাজি ছিল অনেক উঁচু ও সুষমামণ্ডিত। নিঃসন্দেহে পারসিক স্তম্ভ নির্মাণ কাজে গ্রিক প্রভাব লক্ষ্যনীয়। এরফলে পারসিক ভবনগুলো আরাে হাল্কা হত ও এতে আলাে বাতাস লাগত। পারসিক ভবনগুলোতে উজ্জ্বল ও রঙীন অলংকৃত টালি সংযােজনের দ্বারা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হত। এসব টালির উপর সিংহ, ষাঁঢ়, দৈত্য প্রভৃতি অ্যাসিরীয় স্মৃতিকথার ছবি থাকত। তবে এসিরীয়দের তুলনায় সেগুলো ছিল অধিক সুষম ও অধিক বাস্তব। কোন কোন প্রতিকৃতিতে দেখা যায় যে রাজা সিংহের সাথে লড়াই করছেন। আবার কোন কোনটিতে রাজকীয় আমােদ-প্রমােদ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানিকতার ছবি ফুটে উঠেছে। দারিয়ুসের সুসার লেখের ভাবানুবাদ পড়লে স্থাপত্যকর্মের জন্য পারসিকরা কিভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের উপকরণাদি ব্যবহার করতো তা বোঝা যায়। লেখে উল্লেখ আছে, “লেবানন পাহাড় থেকে আনানাে হয়েছে সিডার কাঠ। গন্দর আর রুমানিয়া থেকে যকা কাঠ আনানাে হয়েছে। বাকত্রিয়া ও সার্দিস থেকে সােনা আনা হয়েছে। সােগদিনিয়া থেকে কর্নেলিয়ান ও ল্যাপিস লাজুলাই নামের মূল্যবান পাথর আনা হয়েছে। মিশর থেকে আবলুস কাঠ ও রূপা আনা হয়েছে। আরকোসিয়া, সিন্দ ও ইথিওপিয়া থেকে হাতির দাঁত এবং আয়োনিয়া থেকে অলংকরণ সামগ্রী আনা হয়েছিল। গ্রিক ও আয়ােনীয় পাথর কাটা যন্ত্র দিয়ে পাথর কেটে মসৃণ করা হয়েছ। মিডীয়া ও মিশরের সােনার কারিগররা একটি নির্মাণে কাজ করেছে। সার্দিয়ান ও মিশরীয় কাঠের কারিগররা কাঠকে মসৃণ করেছে। ব্যাবিলনীয় রাজমিস্ত্রিরা ইট তৈরি করেছে ও গেঁথেছে। মিডিয়া ও মিশরীয় নকশাকাররা দেয়াল সুশােভিত করেছে।” যাই হোক, ক্যাম্বিসেসের রাজধানী পসরগদেই ও দারিউসের রাজধানী পার্সিপােলিসের স্থাপত্য কর্মসমূহ পারস্য সভ্যতার গৌরবময় অধ্যায়কে তুলে ধরে –

  • পসরগদেই : এই শহরটির নির্মাণশৈলীর ওপর তাদের পূর্বপুরুষদের যাযাবর জীবনের আবাসগৃহের নকশার ছাপ পড়েছিল। প্রাচীর ঘেরা এই নগরীর ভেতর নাম হয়েছিল দালানকোঠা। এখানে ছিল একটি বড় হলঘর। সেটির চার কোণায় ছিল চারটি মিনার। গৃহটি ছিল স্তম্ভ শােভিত। পাথরের তৈরি সাইরাসের সমাধিসৌধটিও একটি অপূর্ব স্থাপত্যকর্ম। তিনকোণা দেয়াল দিয়ে ছাদের কিনারগুলাে ঘেরা ছিল। সৌধটি ছিল ছয়টি ছাদে ঘেরা। 
  • পার্সিপােলিস : আনুমানিক খ্রি.পূ. ৫১৮ অব্দে পার্সিপােলিসে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন দারিউস। পাহাড়ের ওপর নির্মিত হয়েছিল এই নগরীর রাজপ্রাসাদটি যা আপাদানা প্যালেস নামে পরিচিত। এই রাজপ্রাসাদে দারিউস পাথরের নির্মিত একটি উঁচু চত্বর নির্মাণ করেন এবং এতে সুন্দরভাবে ভাষ্কর্য করা সিঁড়ি সংযােজন করেন। ১৩ মিটার উঁচু পাহাড় চত্বরটি ৫০০ মিটার লম্বা ও ৩০০ মিটার চওড়া। পাহাড় চত্বরের খােলা প্রান্তের ধারগুলাে কাদা মাটির তৈরি ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঢাকা ছিল। এর উত্তর পূর্ব কোণে আছে সােপানশ্রেণী। প্রাসাদ তােরণে পাখাওয়ালা ষাঁড়ের ভাস্কর্য উৎকীর্ণ আছে। স্পষ্টতই এগুলাে মেসােপটেমিয়ার আসিরীয় সভ্যতার প্রভাবে নির্মিত হয়েছিল। এর দেয়ালে খােদিত হয়েছিল মানুষের প্রতিকৃতি। এই চত্বরের একপাশে ছিল সম্রাটের আবাসিকভবন। এছাড়া বড় বড় হল ঘর ছিল যার সামনে বারান্দা ছিল এবং চত্বরের সামনের দিকে ও পাশে আরাে কক্ষ ছিল। এর খুব কাছাকাছি নির্মিত হয় রাষ্ট্রীয় সম্মেলন ও ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে ব্যবহার করার জনা স্তম্ভের উপর নির্মিত audience hall বা অভ্যাগতদের কক্ষ। এই গুরুত্বপূর্ণ সভাকক্ষটি ৮৩ মিটার বাহুবিশিষ্ট ও বর্গাকারে নির্মিত। এর প্রতি কোণায় ছিল একটি করে মিনার। এটির পরেই শত স্তম্ভবিশিষ্ট একটি মহাকক্ষ ছিল। এই প্রাসাদে অবস্থিত কোষাগারের স্তম্ভগুলাে ছিল কাঠের তৈরি। এর ওপরে ছিল প্লাস্টার করা। তার ওপরে রঙের প্রলেপ ও নকশা করা ছিল। এসব নকশায় গ্রিক ও মিশরীয় রীতির ছাপ ছিল। এই প্রাসাদের একটি খােদাইচিত্রে ইহুদি ও পারসিকদের পােশাকের মিশ্রণ দেখা যায়। দারিয়ুসের প্রাসাদ নির্মাণের বিবরণ সুসার লেখ থেকে পাওয়া যায়। এতে বােঝা যায় যে, আকিমেনীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে বিদেশি প্রভাব ছিল। পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই রাজপ্রাসাদ পুড়িয়ে দেন। পরে পার্সেপোলিস মেসিডোনীয় সাম্রাজ্যের পারস্য প্রদেশের রাজধানীতে পরিণত হয়।

ভাষা

প্রাচ্যের বর্ণমালা সৃষ্টিতে আরামীয় লিপির বিরাট ভূমিকা ছিল। প্রাচীন পার্সি ভাষা লেখা হতাে আরামীয় লিপিতে। পারস্যের প্রচলিত ভাষাগুলাের মধ্যে প্রাচীন পার্সি ভাষা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছিল পারস্যে প্রচলিত ভাষার উত্তর পশ্চিম কথ্যরূপ। তবে প্রাচীন ফার্সি ভাষার দক্ষিণ-পশ্চিম কথ্যরূপ মিডিয়ায় প্রচলিত ছিল। ইরানিদের নিজস্ব বর্ণমালার অভাবের কারণে তারা আরামাইক লিপিকেই ব্যবহার করত। তবে এ লিপি আবিষ্কারের আগে মেসােপটেমীয় প্রভাবিত ইরানে কিউনিফর্ম চিত্রলিপি প্রচলিত ছিল। মিডিয়ার রাজধানী একবাটানাতে খননকার্যের পর ৩৯টি কিউনিফর্ম চিহ্ন ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক কিছু ক্যালদীয় দলিলপত্রকে কিউনিফর্ম লিপি ব্যবহারের শেষ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। ইউরােপীয় পণ্ডিতরা পার্সীয় লিপির মর্মোদ্ধারে সফল হন। এ প্রসঙ্গে জার্মান স্কুল শিক্ষক গ্রোটেফেল্ড এবং ব্রিটিশ সেনা অফিসার স্যার হেনরি রাওলিনসন-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। স্যার রাওলিনসন ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে হামাদান শহরের বেহিস্তান পাহাড়ের ৩০০ ফুট উঁচুতে ২৫ ফুট লম্বা ও ৫০ ফুট চওড়া শিলালিপির পাঠোদ্ধার করে পার্সীয় ভাষার স্বরূপ উঘাটন করেছিলেন। এই লিপির মর্মোদ্ধারের মাধ্যমে প্রাচীন পৃথিবীর সভ্যতা সম্পর্কে জানার দ্বার উন্মােচিত হয়। এবং ব্যাবিলনে প্রচলিত কিউনিফর্ম লিপির মর্ম উদ্ধার করা হয়। বেহিস্তান লিপিটি উৎকীর্ণ করার আগে পার্সি ভাষার নতুন লিপি আবিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন দারিয়ুস। পার্সি, এলামীয় ও ব্যাবিলনীয় ভাষায়ই লেখ উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এলামীয় লিপির নমুনাও পাওয়া গেছে। পারস্যের বহু শাসকের প্রশাসনিক কাজের ভাষা ছিল এলামীয়। পার্সিপােলিসের ধ্বংসাবশেষে এর প্রমাণ হিসেবে নানা দলিল ও নথিপত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে সব ভাষা ও লিপিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল আরামীয় ভাষা ও লিপি। আকিমেনীয় যুগ থেকে শুরু হওয়া এই ধারা সাসানীয় যুগে জোরদার হয়। 

সাংস্কৃতিক উদারতা

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পারসিক শাসন জ্ঞানদীপ্ত ছিল। পারসিক ভাষা ব্যবহার করার জন্য অথবা কিউনিফর্ম লিখন পদ্ধতি চালু করতে অথবা জরাথুস্ট্রবাদ গ্রহণ করার জন্য প্রজাদের কখনও বাধ্য করা হতাে না। প্রকৃত পক্ষে, রাজকীয় কাজকর্মের জন্য সরকারীভাবে আরামীয় ভাষা ব্যবহার কব্রা হলেও বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ভাষাও চালু ছিল। বিজাতীয় সামাজিক প্রথা ও অর্থনৈতিক কর্মসূচীর প্রতিও একই নীতি প্রযােজ্য ছিল। এসব বিষয়ে স্থানীয় এলাকাগুলােকে দমন বা নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে গতানুগতিকভাবে তাদের পুরনো প্রথা বা অভ্যাসগুলােকে পালন করতে উৎসাহিত করা হত। রাজকীয় শাসনব্যবস্থা ছিল এর ওপর গড়ে ওঠা এমন এক কাঠামাে যা সামান্য রদবদলের মাধ্যমে প্রজাদের অনুসরণ করতে বলা হত। সবক্ষেত্রে শাসনের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করা হত না। উদাহরণস্বরূপ, পারসিক সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশে টাকশালে তৈরী মুদ্রা ব্যবহার করা হত। কিন্তু একই সময়ে সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী অঞ্চলে মূল্যবান ধাতব বস্তু এবং পূর্বাংশে দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থা চালু ছিল। এমনকি, স্থানীয় সরকারের ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। পারসিক সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ বিজয়ের পূর্বে যে শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল, বিশেষ করে, এশিয়া মাইনরের ফিনিশীয়গ্রিক শহরগুলােতে সেসব শাসন পদ্ধতি চালু রাখা হয়। দারিউস অন্যান্য জাতির উন্নত বিষয়গুলোকে গ্রহণ করেছিলেন, যেমন আসিরীয়দের কাছ থেকে ডাকব্যবস্থা, মিশরীয় অনুসরণে ১২ মাসে বছর ও ৩০ দিনে মাস নির্ধারণ প্রভৃতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। 

ধর্মীয় ক্ষেত্রেও পারসিকদের অবদান আছে। তা “পারসিক ধর্মব্যবস্থা ও জরাথুস্ট্রবাদ” অংশে উল্লেখ করা হলো।

সাসানীয় রাজবংশ 

গ্রিকদের হাতে বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের পতনের পর গ্রিক রাজবংশ ২৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পারস্য শাসন করে। এর কিছুকাল পর পার্থিয় বা পাহলভি বংশ উত্তর-পূর্ব ইরানের শাসন ক্ষমতায় আসীন হয়। ২২৬ খ্রিস্টাব্দে পার্থিয় রাজবংশের উৎখাতের মাধ্যমে সাসানীয় বংশের রাজা প্রথম আরদাসির এই বংশের শাসনের সূচনা করেন। চার শতাধিক বছর ধরে এই বংশের রাজত্বকালে পারস্য আবার বিশ্বের নজরে আসে। অবশ্য যুদ্ধ এবং হানাহানিও এযুগে কম হয়নি। জ্ঞানের নানা শাখার ব্যাপক চর্চা হয় এই সময়ে। প্রকৌশল বিদ্যার বিরাট উন্নতি হয়। যেসব গ্রিক দার্শনিক কনস্টান্টিনােপল থেকে বিতাড়িত হন তারা পারস্যে আশ্রয় লাভ করেন। এযুগে চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়নের জন্যে পৃথক বিদ্যায়তন স্থাপিত হয়। স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার বিরাট অগ্রগতি সাধিত হয়। কনস্টান্টিনােপল, আরব এলাকা, ভারত ও চীনের সাথে বাণিজ্যে অগ্রগতি আসে। কর সংস্কার, কৃষি ও বিচার ব্যবস্তায় উনতি হয়। জাতীয় ঐক্যও সুদঢ় হয়। সাসানীয় রাজা নসিরবানের যুগে হযরত মুহাম্মদ আরবের মক্কায় জনুগ্রহণ করেন। এই বংশের সম্রাট খসরুর সময় মদিনায় মুসলমানদের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মুসলিম রাজ্যের প্রতাপ অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে এবং ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে আরবদের হাতে এই বংশের পতনের মাধ্যমে পারস্য মুসলিম শক্তির অধীনে আসে।

পারসিক ধর্মব্যবস্থা ও জরাথুস্ট্রবাদ

ভূমিকা

পাশ্চাত্য তথা বিশ্বসভ্যতায় পারসিকদের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ধর্মীয় ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে তাদের বড় প্রতিদ্বন্দী ছিল ইহুদীরা। পারসিরা ছিল সূর্যের উপাসক। পরবর্তীকালে জরাথুস্ট্র পারসিক ধর্ম ব্যবস্থায় বিভিন্ন সংস্কার সাধন করেন। র‍্যালফ, লার্নার, মেকাম ও বার্নস এর ভাষায়, “পারস্যের ধর্মীয় কিংবদন্তী হছে জরাথুস্ট্রবাদ, যা বৌদ্ধধর্ম ও ইহুদিধর্মের সাথে মিলে তিনটি প্রধান বৈশ্বিক ও ব্যক্তিগত ধর্মের একটিতে স্থান পায় যা খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামপূর্ব বিশ্বে অস্তিত্বশীল ছিল।” (Ralph et al., 202)। জরাথুস্ট্রবাদের উৎপত্তি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৬শ শতকে। কিন্তু এর প্রকৃত প্রবর্তক এবং যার হাতে এই ধর্মের নামকরণ হয়েছিল তিনি ছিলেন জরাথুস্ট্র। তাকে গ্রীক ভাষায় Zoroaster বলা হয়। তিনি ছিলেন মেডিয়ার অধিবাসী একজন পারসিক যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দের সামান্য কিছু পূর্বে জীবিত ছিলেন। তবে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তিনি আরাে পূর্বে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে জীবিত ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে জরাথুস্ট্র ছিলেন ইতিহাসে প্রথম প্রকৃত অর্থে একজন ধর্মতত্ববিদ। তিনিই প্রথম নবী যিনি একটি পুরাপুরিভাবে বিকশিত ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিধি বিধানের প্রবর্তন করেন। তিনি পারসিক গোত্রগুলোর সনাতন প্রথাকে দোষত্রুটিমুক্ত করার প্রয়াস লাভ করেন। বিশেষ করে তিনি বহু দেবদেবী বা উপাস্যের পূজা করা, প্রাণী বলি দেওয়া এবং যাদু প্রদর্শন প্রভৃতি বিলুপ্ত করার পক্ষে প্রচারণা চালান। তিনি অধিকতর সুসংবদ্ধ এবং নৈতিক ভিত্তির উপর পারসিক ধর্ম ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করেন। 

প্রাচীন পারসিক ধর্ম

আদি পারসিকদের ধর্মবিশ্বাসের সাথে অন্যান্য ইন্দো-ইউরােপীয়দের ধর্মবিশ্বাসের সাদৃশ্য ছিল। প্রকৃতি পূজা, মূর্তি পূজা, পশু বলি প্রভৃতি ছিল তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। আগুন ছাড়াও জল, সূর্য, আকাশ, বাতাস মাটি প্রভৃতির পূজা তারা করত। তারা প্রাকৃতিক শক্তিগুলাের উদ্দেশ্যেই নিবেদন করত তাদের ক্ষেতে উৎপাদিত ফসল, বাগানের ফুল, গৃহপালিত পশুর দুধ প্রভৃতি। ভারতীয় আর্যদের সাথে পারসিকদের ধর্মীয় বিশ্বাসের যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য বাণিজ্য ও যুদ্ধের সূত্রে তারা এশিয়া ও ইউরােপের নানা অংশে গিয়েছে। সেখান থেকে নানান ধর্মীয় উপাদান সংগ্রহ করেছে এবং নিজেদের বিশ্বাসের বহু কিছুকে আদান প্রদানের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছে। পারসিক ধর্মের নীতিবােধ দিনে দিনে পরিশীলিত ও বিশেষ ঢং ধারণ করেছে। ভারতীয় আর্যদের মধ্যে প্রচলিত ছিল সােমরস পানের রীতি। ইরানিরাও এমন এক ধরনের রসের তৈরি মদ পান করে উপাসনায় নিয়ােজিত হতাে। এতে উত্তেজনার সৃষ্টি হতাে। উত্তেজিত অবস্থাতেই তারা পূজা করত। দেবতাদের এই ধর্মে আনুষ্ঠানিকতার প্রাধান্য থাকায় পুরােহিতদের প্রতিপত্তি ছিল। পারস্যের সাম্রাজ্যে পুরােহিতরা ম্যাগি নামে খ্যাত ছিল। অন্যান্য সমাজের মতােই এখানকার পুরােহিতরাও পার্থিব ধন-সম্পদ অর্জনের প্রতি বিশেষভাবে মনােযােগী হয়ে উঠেছিল। তারা পূজা করতে আসা মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করত ধর্মের নামে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকায় পুরােহিততন্ত্রের প্রতি মানুষের মনে দিনে দিনে সৃষ্টি হয় বিতৃষ্ণার। এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে জরাথুস্ট্রের আবির্ভাবের পর। 

জরাথুস্ট্রবাদ সম্বন্ধে আলােচনা করার পূর্বে ইরানের প্রচলিত ধর্মব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়ােজন। ইরানীদের ধর্মব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সরল ও আদিম প্রকৃতির। পারসিকদের মতে আহুর মাজদা নামক ঈশ্বর বা দেবতা এই পৃথিবীকে একটা মহাজাগতিক রণক্ষেত্র বা কর্মক্ষেত্ররূপে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মতে, এই পৃথিবীতে ভাল ও মন্দের মধ্যে অবিরত দ্বন্দ চলছে এবং তা চলবে এবং অবশেষে ভালর বিজয় ও মন্দের সম্পূর্ণ পরাজয় ও ধ্বংসের ভিতর দিয়ে এই দ্বন্দ শেষ হবে। ভালর প্রতীক হলাে আলাে এবং এর নেতা হলেন পারসিক দেবতা ওরমুজদ (Ormuzd)। তাকে আবার সাহায্য করেন পরসিক ত্রাণকর্তা মিথ্রাস। অন্যদিকে খারাপ বা মন্দের প্রতীক হলাে অন্ধকার এবং পারসিক শয়তান আহ্‌রিম্যান (Ahriman) এর স্রষ্টা। তাকে আবার সাহায্য করেন দোজখ বা নরকের সর্বোচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টারা এবং অসংখ্য ছােট ছােট শয়তান বা নারকীয় সহকারী। 

প্রাচীন ইরানী ধর্মানুযায়ী এই পৃথিবীর যে সব মানুষ ভাল কাজ করবে বা ভালোর প্রতি আনুগত্য দেখাবে তারা মৃত্যুর পর একটি পুরােপুরি সুখী জীবন লাভ করবে এবং এটা হবে তাদের পুরস্কার। ওরমুজদ বা আহুরামাজদা তাকে উত্তম পুরষ্কার দেবেন। অন্যদিকে নির্বোধের মত দুষ্টুমি করে যারা আত্মভিমানকে সমর্থন ও অনুসরন করবে এবং মন্দ কাজ করবে তাদের ঠাঁই হবে আগুনের সরােবরে এবং গন্ধকের হ্রদে। তবে একবার যদি ভাল চূড়ান্তরূপে মন্দের উপর বিজয়লাভ করতে পারে এবং আহ্‌রিম্যান ও তার নারকীয় সহযােগীদের পরাজিত ও ধ্বংস করতে পারে তাহলে এই Physical Universe বা ভৌগলিক বিশ্বজগতের অবসান ঘটবে। দ্বিতীয়ত; এরফলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পশ্চাতে যেসব উদ্দেশ্য ছিল তা পূরণ হবে। বিশ্বব্রহ্মান্ডের এই প্রহেলিকা ও ভালমন্দের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছুকেই পরবর্তীতে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা গ্রহণ করে। এখনও পর্যন্ত তা পাশ্চাত্য জগতে মহাজাগতিক বিভিন্ন সমস্যা ও তা সমাধানের নিমিত্ত সামাজিক দর্শন বা উত্তর হিসেবে পাশ্চাত্য সভ্যতায় সাধারণভাবে গৃহীত হয়ে আসছে। সুমেরীয়রা ঘােষনা করে যে, ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে পারসিকরা তাদের ধর্মে পৃথিবী সৃষ্টির পিছনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছে। 

ভবিষ্যৎ জীবনের প্রকৃতি সম্পর্কে পারসিকদের আধ্যাত্মিক এবং ভাল মন্দের বিবেচনাবােধ বা চুড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গী পাশ্চাত্যে ধর্ম ব্যবস্থার পরিবর্তন ও বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। ব্যবিলনীয়, প্রাথমিক ইহুদী, প্রাচীন গ্রীক ও রোমানদের নিকট মৃত্যুর পর মানুষের অবস্থান বা অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নের খুব একটা গুরুত্ব ছিলনা। ইহুদীরা বিশ্বাস করত যে, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তি শেয়ােল (Sheol) নামক স্থানে সমবেত হয়। প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর মানুসের ভবিষ্যৎ আবাসস্থল হলাে হেডিস  (Hades)। তবে এই দুই স্থানের কোনটিতেই প্রবেশের নিমিত্ত নিয়মিত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য পুরস্কার এবং খারাপ বাজের জন্য শান্তি সম্বন্ধে কিছুই বলা হত না। কিন্তু কোন ব্যাক্তি ভালাে না মন্দ তা নিরূপন করা পরিসিকদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে যদি ভাল বিবেচিত হতাে তবে তাকে ওরমুজদের উপস্থিতিতে স্বর্গসুখের জন্য সূর্যে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু সে যদি খারাপ হিসেবে চিহ্নিত হত তাহলে তাকে অত্যন্ত বীভৎস শাস্তি পেতে হত। পরবর্তীকালে পারসিকরা এ সম্পর্কে আরাে অনেক মতবাদ ও তত্ব গড়ে তুলেছিল যা ইহুদী ও খ্রিস্টানরা গ্রহণ করেছিল। পারসিকদের সর্বশেষ বিশ্বাসের ভিত্তিতে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা বেহেশত ও দোজখের ধারণা গড়ে তুলেছিল। এতে বলা হয় যে, সংক্ষিপ্ত বা সাময়িক শাস্তিলাভ মন্দ মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। 

ইরানীরা বিশ্বাস করত যে, আহুরামাজদা হলেন এই বিশ্বের সব জীবজন্তু ও প্রাণীর স্রষ্টা ও মালিক। তবে ইহুদীদের ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ এর ন্যায় তিনি একমাত্র উপাস্য ছিলেন না। ইরানীরা বহু ঈশ্বরবাদী ছিল। মিথ্রা ছিলেন সূর্যের দেবতা যার ধর্ম বা পূজাপদ্ধতি পরবর্তীতে সমস্ত রােমান সাম্রাজ্যে বিস্তারলাভ করে। তিনি ছিলেন ন্যায়বিচারকর্তা ও পরিত্রাণকারী। ইরানের অন্যান্য উপাস্যরা হলেন চন্দ্র, পৃথিবী, জল এবং বাতাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদানের প্রতীক। প্রাচীন ভারতবর্ষের মত আগুনের দেবতা অত্যন্ত গুরুতুপূর্ণ ছিল। পবিত্র অগ্নি বিভিন্ন দেবতার উদেশে বলিদান করা পশুর রক্ত শােষণ করে নিত বা ধারণ করত। প্রাচীন ইরানীয় ধর্ম ছিল প্রকৃতির সাথে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ এবং তা বিভিন্ন প্রকার মাথাভারী বা জটিল ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে ভারমুক্ত রেখেছিল। মেডেসদের ভেতর থেকে ম্যাগি (Magi) নামের একটা যাজক শ্ৰেণী বলিদান পরিচালনা করত, দেবতালের উদ্দেশ্য সুর করে প্রার্থনা সঙ্গীত, আবৃত্তি এবং পবিত্র অগ্নিশিখার পরিচর্যা করত। জার্মান ঐতিহাসিক এডােয়ার্ড মেয়ার  (Eduard Meyer) প্রাচীন ইরানের উপাসনা পদ্ধতি সম্বন্ধে লিখেছেন যে, “ইরানীয় ধর্মগুলোতে স্বর্গীয় প্রতিকৃতি বা মন্দির কোন কিছুই ছিল না। একটি পর্বতচূড়ায় একজন ঈশ্বর ও তার প্রকাশসমূহ যেমন সূর্য ও চন্দ্র, পৃথিবী ও অগ্নি, জল ও বায়ুকে আহ্বান করত, এবং তাদের শাশ্বত অগ্নি দিয়ে তারা বেদী প্রস্তুত করত। কিন্তু অন্যান্য উপযুক্ত স্থানে কেউ এরকম প্রস্তুতি ছাড়া ম্যাগিদের সহায়তায় দেবদেবীদেরকে প্রার্থনা করতে পারত ও তাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে পারতো।” (Meyer, 114-15)। 

পারসিক ধর্মমত অনুযায়ী দুষ্টু লােকেদেরও ভালাে মানুষের মত দীর্ঘ ও অবিনশ্বর জীবন থাকবে। কিন্তু তারা অমরণশীলভাবে একটা সুদীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির জীবন ও যন্ত্রনা ভােগ করবে। ইহুদী ও খ্রিস্টানরা পারসিকদের এই দ্বৈতমতবাদকে গ্রহণ করেছে। প্রাথমিক যুগের ইহুদী লেখনীর ভিতর শয়তান বা মন্দ এবং দোজখ সম্পর্কে কোন উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তীকালে বাইবেলের অপ্রামানিক অংশ Book of Enoch-এ নারকীয় সহকারীবাদ, ও নরক সম্বন্ধে ব্যাপক তথ্য সংযােজন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পারসিক Eschatology-এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব দেখা যায়। খ্রিস্টানরা জাগতিক জীবনের উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিৎ এ সম্পর্কে পারসিকদের দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছিল। তাছাড়া পরবর্তী জীবন কি হবে সে সম্পর্কেও ইহুদীদের দ্বারা সংকলিত ইহুদী লােক কাহিনীতে এসব বিষয়ের উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে মিথ্রাবাদ এবং মানিবাদ (Manicheanism)-এর ধর্ম বিশ্বাস বা পূজা পদ্ধতির কয়েকটি দিককে খ্রিস্টানরা আংশিকভাবে গ্রহণ করে। এসব কিছুর প্রভাবে পরজাগতিক বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা গােড়া খ্রিস্টধর্মের একটা বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। এবং সেন্ট অগস্টিনের বহু পূর্ব থেকেই বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের মধ্যে বেহেশত লাভ এবং দোজখ এড়াবার জন্য একটা কামনা ও প্রচেষ্টা গড়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যায়। পারসিক ধর্মীয় জীবনের এ সব গুরুত্বপূর্ণ দিক ছাড়াও পারসিকরা জরাথুস্ট্রবাদের বাইবেল জেন্দ আভেস্তা রচনা করে, যা ছিল ইহুদী ওল্ড টেস্টামেন্টের একমাত্র সাহিত্যিক প্রতিদ্বন্দী। সময়ের ব্যবধানে ইরানীরা অগ্নি মন্দির প্রতিষ্ঠা করত অথবা বলি উৎসর্গদান কাজ পরিচালনা করত। এমনকি ১৯শ শতকেও রাশিয়া-ইরান সীমান্তের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বাকু শহরে অগ্নিপূজা করা হত।

জরাথুস্ট্রের দেয়া ধর্ম বা জরাথুস্ট্রবাদ

বিশ্ব ইতিহাসের সেরা সম্মানিত মহাপুরুষদের তালিকায় অনায়াসে যাকে স্থান দেয়া যায় তিনি হলেন জরাথুস্ট্র। পারস্যের ইতিহাসে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দের কাছাকাছি কোনাে সময়ে তিনি পারস্যের মিডিয়া এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স যখন মাত্র পনরাে বছর তখন থেকেই তিনি উশিদারায়ন পর্বতে গিয়ে সাধনায় নিয়ােজিত হন। ধারণা করা হয় যে, দীর্ঘ সাধনার পর আনুমানিক ত্রিশ বছর বয়সে তিনি সত্য প্রচারের নির্দেশ পান। কিন্তু মিডিয়ার মানুষ তাকে ভালাে নজরে দেখেনি। তারা তাকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। পরে তিনি পারস্যের অন্যান্য এলাকায় যান। ৪২ বছর বয়সে তিনি ব্যাক্ট্রিয়া প্রদেশে গিয়েছিলেন। বিশ্বাস করা হয় যে, তিনি স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করে ঐশীবাণী ও ঐশীজ্ঞান লাভ করেছিলেন। কিন্তু সাধনাকালে তাকে মন্দের প্রতিভূ শয়তান নানাভাবে উত্যক্ত করতে থাকে। শয়তানের প্ররােচনাকে উপেক্ষা করে সত্যসন্ধানী জরাথুস্ট্র তার সাধনায় অটল থাকেন। ফলে আলাে বা জ্ঞানের অধিপতি মহান সর্বশক্তিমান আহুরমাজদা তাকে জ্ঞান ও সত্যপথের দিশা দেন। তার প্রতি অবতীর্ণ হয় জেন্দ আবেস্তা। পারস্যের আনশান রাজ্যে ধর্মপ্রচারে তিনি বেশ সাফল্য লাভ করেন এবং তার অনেক অনুসারীর সৃষ্টি হয়। আনুমানিক ৩৫ বছর ধরে তিনি ধর্মপ্রচার করেছিলেন বলে জানা যায়। 

ইরানের এই প্রাচীন ধর্মব্যবস্থা নবী জরাথুস্ট্রের শিক্ষা ও দর্শনের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। জরাথুস্ট্রের শিক্ষা পারসিক ধর্ম পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। সংক্ষেপে, জরাথুস্ট্র ইরানী ধর্ম ব্যবস্থার নয়া ব্যাখ্যা দান করেন এবং ধর্মীয় শিক্ষা বহুদিন পর্যন্ত টিকে ছিল এবং আজ পর্যন্ত চালু রয়েছে। জোরােষ্ট্রার বা জরাথুস্ট্র সম্পর্কে জানার জন্য একমাত্র নির্ভরযােগ্য তথ্য হচ্ছে  Zend Avesta বা জেন্দাভেস্তা। এটা স্তোত্র এবং কবিতার একটি সংগ্রহ যার প্রাচীন অংশে জোরােষ্ট্রার এবং আদিম পারসিক ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে। মোজেসের মত জোরােষ্ট্রার স্বর্গীয় বিষয় এবং মানব জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা বড় বা উঁচু ধারণা পােষন করতেন। তিনি এই শিক্ষাদান করেন যে মানব জীবন হচ্ছে ভালাে ও মন্দের মধ্যে একটা অবিরাম বা অবিরত যুদ্ধক্ষেত্র। আহুরামাজদা হাচ্ছেন ভালাে ও সত্যের প্রতীক। কিন্তু তার শত্রু হলাে আহ্‌রিম্যান। সে একটা ঘৃণিত শক্তি, এবং খারাপ ও মিথ্যার প্রতীক। আহুরামাজদা এবং আহ্‌রিম্যান মানব সমাজকে নিয়ে একটা মহাজাগতিক যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। এই যুদ্ধ হাজার হাজার বছর যাবৎ চলে আসছে। কিন্তু জরাথুস্ট্রের মতে মানুষ এই সংগ্রামের নামমাত্র তেজারতির বস্তুসামগ্রী নয়। প্রত্যেক ব্যক্তি কোন দিকে যাবে সে সম্পর্কে নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তার মতে মানুষকে হয় ভালাে ব্যবহার এবং সত্য কাজ করতে হবে অথবা শয়তানী বা দুষ্টের পথ বেছে নিতে হবে। 

এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জরাথুস্ট্র ব্যক্তির দায়িত্বশীলতার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি এই শিক্ষাদান করেন যে, আহুরা মাজদা এবং আহ্‌রিম্যানকে পছন্দ করা বা না করা সম্পর্কে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি রয়েছে এবং সমস্ত জীবনব্যাপী নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মানুষের নিজেদের বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। তাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত। কারণ জরাথুস্ট্র হুশিয়ার করে দেন যে একদিন চূড়ান্ত হিসাব নিকাশের সময় আসবে তিনি প্রতিশ্রুতিদান করেন যে, আহুরা মাজদাই শেষ পর্যন্ত খারাপ, মন্দ এ মিথ্যার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়লাভ করবেন। প্রত্যেক ব্যক্তিকেই মৃত্যুর পর ভাল মন্দের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। মিশরীয় দেবতা ওসিরিসের মত আহুরা মাজদা মৃত ব্যক্তি ধার্মিক ছিল কিনা তা বিচার করবেন এবং তাদের জীবিতকালীন কর্মতালিকার ওজন গ্রহণ করবেন। এ সময় ভাল ও সত্য খারাপ এবং মিথ্যার উপর জয়লাভ করাবে। সংক্ষেপে, জরাথুস্ট্র এমন এক শেষ বিচারের ধারণা ব্যক্ত করেছেন যাতে আহুরা মাজদা প্রত্যেক ব্যক্তির মরনােত্তর জীবনের ভাগ্যকে ঐ ব্যক্তির জীবিত কালের কাজ কর্মের আলােকে বিচার করবেন। 

জরথুস্ট্রের দর্শন অনুযায়ী শেষ বিচার প্রক্রিয়া একটা স্বর্গীয় রাজ্যের ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত। যারা জীবিতকালে ভালাে কাজ করবে এবং সৎপথে চলবে তাদের জন্য এই স্বর্গীয় রাজ্য সৃষ্টি করা হবে। তারা আহুরা মাজদার সাথে একটা মরনােত্তর জীবনে প্রবেশ করবে যাকে জরথুস্ট্র “House of Song” বা সঙ্গীতের আবাসগৃহ এবং “Abode of Good Thought” বা ভালাে চিন্তার অবস্থান হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই আবাসগৃহে তাৱা আহুৱামাজদার সাথে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। কিন্তু মিথ্যাবাদী ও খারাপ লােকদের এই আর্শীবাদপুষ্ট অবিনশ্বর জগতে ঠাঁই হবে না এবং তারা মরণযন্ত্রনা, অন্ধকার এবং শাস্তিলাভ করবে। এই ভাবে জরাথুস্ট্র এমন এক শেষ বিচারের কথা বলেছেন যেখান থেকে বেহেশ্‌ত বা দোজখে প্রবেশ করতে হবে। জরাথুস্ট্রের অনেক বিরােধিতা করা হয় ও তার অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বহু লােক এই ধর্মমত গ্রহণ করে। এই ধর্মান্তরিতদের মধ্যে একজন ছিলেন সম্রাট দারিউস (৫২১-৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। পারসিক রাজকীয় পারিবার জরথুস্ট্রবাদ গ্রহণ করলেও তারা অন্যের উপর তা চাপিয়ে দিতে চায়নি। পারসিক রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতা ও নিরাপত্তাধীনে জরথুস্ট্রবাদ সমস্ত ইরানব্যাপী প্রচার ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করে। ফলে বহু লােক ধর্মান্তরিত হয় এবং এই ধর্মের শিকড় গভীর ভাবে প্রােথিত হয় যা শতাব্দীর পর শতাব্দী সুষ্ঠ বিকাশের দিকে ধাবিত হয়। তবে পারসিক সাম্রাজ্যের পতনের পরও জরথুস্ট্রবাদ টিকে ছিল এবং তা যিশুর যুগের ধর্মীয় চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। জরথুস্ট্রবাদ মানিবাদের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রেখেছিল। উল্লেখ্য যে, মানিবাদ এমন এক প্রকার ঈশ্বরত্ব যা বাইজান্টীয় আমল পর্যন্ত টিকে ছিল এবং তা খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রূপে দেখা দেয়। এখন পর্যন্ত জরথুস্ট্রবাদে বিশ্বাসীরা মানব জীবন ও ঈশ্বরের অস্তিত্বের ধারণাকে বিভিন্ন শতাব্দী অতিক্রম করে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। 

গ্রিকরা জরাথুস্ট্রকে তাদের ভাষায় জরয়্যাস্টার বলে অভিহিত করত। তারা মতবাদকে জরয়্যাস্টারবাদ বলত। আমাদের ভাষায় এই মতবাদ জরাথুস্ট্রবাদ নামে পরিচিত। জরাথুস্ট্র পার্থিব কর্ম সম্পাদনকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এই ধর্মে কৃষিকাজকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে বিবেচনা করে গরুকে সম্মানিত বলে মনে করা হতাে। কৃষিভিত্তিক সভ্যতার উৎকর্ষসাধনে এই ধর্ম বিশেষভাবে অবদান রেখেছিল। পশুবলি, জাদুটোনা ও দেবদেবীর পূজার মূলােৎপাটন করেছিলেন জরাথুস্ট্র। যাই হোক, জরাথুস্ট্রবাদের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাে হলো – 

  • ১। স্রষ্টা এক এবং তিনি জ্যোতির উৎস। মঙ্গলের প্রতীক এই স্রষ্টাকে বলা হয় আহুর মাজদা। 
  • ২। শয়তান অমঙ্গল ও অন্ধকারের প্রতীক। অমঙ্গলের প্রতীকের নাম হলাে আহরিমান। 
  • ৩। মানুষের উচিত আহরিমানকে বর্জন করে আহুরমাজদাকে গ্রহণ করা। সদা সত্য কথা বলা, মিথ্যা না বলা, ভালাে চিন্তা করা, মানুষের উপকার ও ভালাে কাজ করা। 
  • ৪। আহুর মাজদার ৭টি প্রধান বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলাে হলাে জ্যোতি, জ্ঞান, সত্য, পরাক্রম, দয়া ও কল্যাণ। 
  • ৫। প্রকৃতিতে সর্বদাই চলছে মন্দের সাথে ভালাের লড়াই এবং শেষ পরিণতি হলাে ভালাের বিজয় ও মন্দের পরাজয়। 
  • ৬। ফেরেশতার অস্তিত্ব আছে। 
  • ৭। মৃত্যুর পর মানুষের পুনরুত্থান ও শেষ বিচার হবে। 
  • ৮। শেষ বিচারের পর পাপীরা নরকে ও পুণ্যবানরা স্বর্গে যাবে। তবে পাপীরা চিরকাল নরকে থাকবে না। যার যার পাপ যতটুকু তাকে ততটুকুই সাজা ভােগ করতে হবে। সাজার মেয়াদ শেষ হলে তাকে নরক থেকে মুক্তি দেয়া হবে। এই ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী নরক হলাে চিকিৎসালয়, আর পাপী হলাে সেখানকার রােগ। রােগী যেমন চিকিৎসা শেষে চিকিৎসালয় থেকে মুক্তি পায়, পাপীও তেমনি তার পাপবােধের যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে একসময় পরিশুদ্ধি লাভ করে মুক্তির যােগ্য বলে বিবেচিত হবে। একসময় সব পাপীই নরক থেকে মুক্তি পাবে এবং নরক হবে পাপী শূন্য। 
  • ৯। এই ধর্মে স্রষ্টা সম্পর্কে গুপ্ত জ্ঞানের সন্ধান দেয়া হয়েছে এবং এই ধর্ম হলো একটি ঐশীধর্ম। 
  • ১০। মানুষের মধ্যে উচ্চমানের নৈতিকতার প্রসারের উদ্যোগ আছে এই ধর্মে। এই ধর্ম চেয়েছে মানুষ যাবতীয় পাপ কাজ থেকে দূরে থেকে সৎকর্মে নিয়ােজিত হােক। 
  • ১১। এই ধর্ম জন্মান্তরবাদে আস্থাশীল নয়। বৌদ্ধ, জৈন ও সনাতন ধর্মের সাথে এখানে এই ধর্মের পার্থক্য আছে। পক্ষান্তরে ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের সাথে সাদৃশ্য আছে। 
  • ১২। শেষ যুগে জরাথুস্ট্র পুনরায় পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন। মানবজাতিকে তিনি আবারও সত্যের দিকে আহ্বান জানাবেন। পরিশেষে আহুর মাজদার কাছে আহরিমানের পরাজয় হবে। 
  • ১৩। দেবদেবীর পূজা অবশ্য পরিত্যজ্য। স্রষ্টার কোনাে অংশীদার থাকতে পারে না, তিনি একক। 

 সার্বজনীন ও ব্যক্তিগত ধর্ম জরাথুস্ট্রবাদ

জরাথুস্ট্রবাদ একটি সার্বজনীন ধর্ম। কারণ তিনি প্রচার করেন যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেবলমাত্র একজন সর্বোচ্চ উপাস্য বা খােলা আছেন যাকে তিনি আহুরা মাজদা নামে অভিহিত করেন। আহুরা মাজদা শব্দের অর্থ হলাে The Wise Lord বা জ্ঞানী প্রভূ। তার মতে আহুরা মাজদা হলেন আলােক, সত্য এবং ধার্মিকতা বা ধর্মানুরাগের প্রতীক। তিনি পাপ এবং শয়তানীর উর্ধ্বে। তার মৃত্যুর আলােক সর্বত্র ব্যাপৃত। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে এই পৃথিবীর পাপ অথবা দুঃখ আহুরা মাজদার সাথে সম্পৃক্ত নয়। এজন্য জরাথুস্ট্র আরেকটি প্রতি উপাস্য বা শক্তির কথা বলেছেন। তার নাম আহ্‌রিম্যান। র‍্যালফ, লানার, মেকাম ও বার্ণস্ আহ্‌রিম্যানকে “অন্ধকার ও অপশক্তির তত্ত্বাবধানে থাকা বিশ্বাসঘাতক ও ক্ষতিকর”(Ralph at al., 203) রূপে উল্লেখ করেছেন। জরাথুস্ট্রের মতে আহুরা মাজদা আহরিম্যানের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আহুরা মাজদা আহ্‌রিম্যানকে উদাসীন বা বেখেয়ালীভাবে টিকে থাকতে দিয়েছেন। কিন্তু ম্যাগি (Magi) নামে পরিচিত জঙ্গীবাদের পুরােহিতদের মতে আহুরা মজদা এবং আহ্‌রিম্যান প্রাধান্য স্থাপনের জন্য এক মারাত্মক দ্বন্দে ব্যাপৃত। তাদের মতে, কেবলমাত্র চূড়ান্তপর্বের দিনগুলোতেই আলােক অন্ধকারের উপর চুড়ান্ত বিজয়লাভ করবে। এসময় আহুরা মাজদা আহরিম্যানকে পরাজিত করবেন এবং তাকে দোজখের গহ্বরে নিক্ষেপ কবেন। এভাবে জরাথুস্ট্রের চিন্তাধারার দ্বৈত বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। 

আবার জরাথুস্ট্রবাদ হলাে একান্তভাবে একটি ব্যক্তিগত ধর্ম। কারণ এতে সমষ্টিগত অপেক্ষা ব্যক্তির উপর অধিকতর দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে। কারণ ব্যক্তিকেই তার কাজ ও কথার জন্য দায়ী করা হবে। আর ব্যক্তিকেই পুরস্কৃত করা হবে বা শাস্তিদান করা হবে। বিশেষ করে, জরাথুস্ট্রবাদে বলা হয়েছে যে, আহুরা-মাজদা রাষ্ট্র বা গোত্র কাউকেই পৃষ্ঠপােষকতা করেন না। তিনি কেবলমাত্র সেসব ব্যক্তির অভিভাবকত্ব করেন যারা অহুরা মাজদার নির্দেশমত সত্য ও ন্যায়ের জন্য কাজ করেন। তবে জরথুস্ট্রবাদে প্রত্যেক মানুষকেই পাপ কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং সত্যবাদী হওয়া ও সৎ কাজ করতে বলা হয়েছে। তাছাড়া মানুষকে সাধ্য অনুযায়ী পরস্পরকে ভালবাসতে ও সাহায্য করতে, গরীবদের সাহায্য করতে এবং উদারভাবে আতিথেয়তা করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। যারা এসব উপদেশ ও নির্দেশ মেনে চলবে তাদেরকে পরকালে পুরস্কৃত করা হবে। কারণ জরথুস্ট্রবাদে শেষ বিচারের দিনে মৃতদের পুণরুত্থানের কথা বলা হয়েছে। অতপর হিসাব-নিকাশ গ্রহণের পর তাদেরকে হয় শান্তির জগত অথবা আগুনের সরােবরে পাঠানাের কথা বলা হয়েছে। জরাথুস্ট্রবাদের ধর্মগ্রন্থ হলাে জেন্দাভেস্তা, যা বহুশতক যাবত রচিত ও সম্পাদিত হয়। আভেস্তায় অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে ধার্মিকদের পুরষ্কারদানের কথা নিম্নলিখিত ভাষায় বলা হয়েছে “যে বিশ্বাসীদের একজনকে মাংস দান করবে… সে স্বর্গে যাবে।”(Ralph, et. al., 203)। 

ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের সাথে জরথুস্ট্রবাদের সাদৃশ্য 

জরাথুস্ট্রবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে আলােচনা করলে দেখা যাবে যে, ইহুদী ও খ্রিস্টধর্মের সাথে এর যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। জরাথুস্ট্রবাদের নৈতিক দিকের সাথে ইহুদী নবীদের দীক্ষার অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। এর eschatology বা পরকালতত্ত্বের সাথে খ্রিস্টধর্মের পারলৌকিক জীবন সংক্রান্ত শিক্ষার সাদৃশ্য আছে। র‍্যালফ, লার্নার, মেকাম ও বার্নসের ভাষায় “… the existence of anthoritative scriptures in zoroastrianism is reminiscent of the weight accorded by Jews to the Old Testament and by Christians to the Old Testament and the New” (Ralpfi et al., 203), ‘দুঃখজনকভাবে হলেও একথা সত্য যে, কাল ও দিনপঞ্জি নিরূপণ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে একথা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না যে, কোন কোন ক্ষেত্রে জরাথুস্ট্রবাদ ইহুদি ও খ্রিস্টানধর্মকে প্রভাবিত করেছিল। এ সম্পর্কে র‍্যালফ, লার্নার, মেকাম এবং বার্নস এর উক্তি বিশেষভাবে প্রতিধনযোগ্য। তাদের মতে, “…. it is surely not coincidental that central aspects of Jewish religious thought took shape in an Asian World dominated by Cyrus and Darius- both convinced zoroastrians of that later Jewish beliefs about a judgment day, which themselves influenced Christianity, evolved in a Hellenistic world in which Zoroastrianism continued to exert influence” (Ralph. et. al., 203)। ইহুদী ধর্মকে প্রভাবিত করার কথা বাদ দিলেও পারসিক ধর্ম পশ্চিম এশিয়ার গ্রীক বিজেতাদেরকে অধিকতর বিশ্বজনীন এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোন থেকে ধর্ম সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করতে প্রভাবিত করে। 

হেলেনীয় চিন্তাধারার সংশ্লেষনের ক্ষেত্রে পারসিকদের সাংস্কৃতিক অবদানের ভিতর দিয়েও বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গীর পরিস্ফুটন ঘটেছে। অ্যাসিরীয়দের মত নয়া ব্যবিলনীয় এবং মিশরীয় প্রভৃতি যেসব শক্তি বিজিত জনগােষ্ঠির উপর নিজেদের প্রথাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল পারসিকরা তাদের অনুসরন করেনি। এক্ষেত্রে পারসিকরা একটি সহিষ্ণুতার নীতি বা ‘One World’ নীতি অনুসরন করে । পারসিকরা এসব ক্ষেত্রে একটি যুক্ত জাতিপুঞ্জের উপর নিজেদেরকে একটি পরিচালিকা শক্তি হিসেবে মনে করত মাত্র। যেখানে মেসােপটেমীয় শাসকেরা নিজেদেরকে সত্যিকার রাজা মনে করত সেখানে পারসিক সম্রাটরা ‘King of kings’ উপাধি গ্রহন করে। এই উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে পারসিক সম্রাটেরা বিভিন্ন শাসকের শাসনাধীন বিভিন্ন জনগােষ্ঠির অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেন এবং নিজেরা সব শাসনের উর্দ্ধে ছত্রছায়ার মত অবস্থান করতেন। এছাড়া পারস্যের দুই মহান নরপতি সাইরাস ও দারিউস তাদের বিজিত জনগােষ্ঠির কাছ থেকে তাদের প্রথা ও বিজ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতেন। উদাহরণস্বরূপ, তারা লিডীয়দের কাছ থেকে ধাতব মুদ্রা তৈরীর কায়দা আয়ত্ব করেন এবং ব্যবিলনীয় জ্যোতির্বিদ্যার দ্বারা রাত্রির আকাশ জরীপ করা এবং ফিনিশীয় নাবিকদেরকে দূর সমুদ্রে অভিযাত্রা চালাতে পৃষ্ঠপােষকতা করেন। আলেকজাল্ডারের আগমনের পর থেকে পারসিকরা মূলভূখণ্ডের গ্রীক শাসিত প্রায় পরিনত হয়। কিন্তু গ্রীকরা সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারসিকদের কাছ থেকে গ্রহণ করত। 

জরাথুস্ট্রবাদের প্রভাব 

মানব সভ্যতার ইতিহাসে অনিবার্যভাবে জরাথুস্ট্রবাদের কথা উচ্চারিত হয়। জরাথুস্ট্রবাদ পারস্যেই শুধু নয়, বিভিন্নভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধর্মক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল। একসময় এটি হয়ে উঠেছিল পারস্যের প্রধান ধর্মমত । সম্রাট সাইরাস এই ধর্মে একজন বিশিষ্ট অনুরাগী ছিলেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় এই ধর্মমত খুবই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। আকিমেনীয় সম্রাটদের সুবাদে মিশর ও মেসােপটেমিয়ার মানুষও এই ধর্মমতের কথা জেনেছিল। তবে এই ধর্মমত দীর্ঘদিন অবিকৃত ছিল না। প্রথম প্রথম জরাথুস্ট্রের অনুসারীরা তার শিক্ষাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করেছিল। তারা তাকে স্রষ্টার একজন প্রেরিত পুরুষ বলে মনে করত। জরাথুস্ট্রবাদ চীনেও উত্তর রাজবংশের আমলে প্রচারিত হয়েছিল। তার অনুসারীরা দেব-দেবীর পূজা এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে মদ বা পশু উৎসর্গ করত না। কিন্তু একসময় তারা তার শিক্ষা থেকে দূরে সরে আলাের দেবতা মিথ্র এবং জল ও চাঁদের দেবী আনাহিতা-এর পূজা শুরু করে। আলাের প্রতীক হিসেবে প্রচলন হয় অগ্নিপূজার। এই বিকৃতিতে ম্যাগি বা পারসিক পুরােহিতদের অবদান ছিল। আকিমেনীয় সম্রাট দ্বিতীয় আর্তজারেক্সেস (আনু. ৪০৪- ৩৫৯ খ্রি.পূ. )-এর শিলালিপিতে এই দেব-দেবীর নাম উৎকীর্ণ থাকতে দেখা যায়। আলেকজান্ডারের সৈন্যরা পারস্য সাম্রাজ্য দখল ও রাজধানী পার্সিপােলিসকে পুড়িয়ে দেয়ার পর জরাথুস্ট্রবাদের মূল শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক দলিলপত্র নষ্ট হয়ে যায়। তারপর থেকে এই মতবাদে গ্রিক প্রভাব প্রবল হয়। সাসানীয় যুগে যখন পুনরায় পারস্য সাম্রাজ্যের উত্থান হলাে তখন আবারও জরাথুস্ট্রবাদ ইরানে প্রবল হলাে। কিন্তু এই মতবাদে ততদিনে অনেক বিকৃতি ঢুকে গেছে।

জরাথুস্ট্রবাদের বিকৃতি 

জরাথুস্ট্রবাদের বিকৃতির সূত্র ধরে মিথ্রাসবাদমানিবাদ নামের দুটি ধর্মমত পারস্যে বিস্তৃত হয়। এছাড়াও অন্যান্য ধর্মমতও প্রচারিত হয়েছিল গ্রিক, ক্যালদীয় ও পারসিক পুরােহিতদের প্রভাব এসব মতবাদের উত্থানের ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। 

মিথ্রাসবাদ : মিথ্রাসকে আহুরমাজদার প্রধান সহচর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এই মতবাদে। আহরিমানের সাথে আহুরমাজদার লড়াইয়ে তিনি আহুর মাজদার সহায়ক হয়েছিলেন বলে একসময় তিনি প্রধান উপাস্য দেবতায় পরিণত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকের দিকেই মিথ্রাসবাদের প্রভাব বেড়ে যায়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার বিশাল সাম্রাজ্যের পতনের পটভূমিতে এই মতবাদ বিদেশেও বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। রােমানরা খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দী থেকে ব্যাপকভাবে মিথ্রাসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। একসময় এটি রােমের প্রধান ধর্মমত হয়ে ওঠে। এমনকি খ্রিস্টধর্ম ও রােমের অন্যান্য ধর্মমতের এটি কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। অবশ্য এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের শেষ নাগাদ এই ধর্মমতের প্রভাব কমে যায়। কিন্তু খ্রিস্টধর্মের মতাে প্রভাবশালী একটি ধর্মমতের মধ্যেও এর প্রভাব রেখে যায়। 

মানিবাদ : পারস্যের একবাটানায় অভিজাত শ্রেণীতে জন্মগ্রহণকারী পুরােহিত মানি আনুমানিক ২৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই মতবাদ প্রচার করেন। মিথ্রাসবাদর মতাে মানিবাদকে জরাথুস্ট্রবাদের বিকৃতি হিসেবে বিবেচনা করে একে অনেকটা স্বতন্ত্র। বৈশিষ্ট্যের ধর্মমত বলে অনেকেই বিচেনা করে থাকেন। পারস্যের অধিবাসীদের প্রবল প্রতিরােধের কারণে ধর্মসংস্কারক মানি নিজের দেশে টিকতে পারেননি। পশ্চিম চীন ও ভারতে ধর্মপ্রচারের পর পারসিক প্রতিদ্বন্দ্বিদের হাতে ২৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার ধর্মমতের প্রসার অব্যাহত থাকে। পশ্চিম এশিয়ায় এই ধর্মমত প্রচারিত হয়। ইটালিতেও ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে এই ধর্মমত প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু শেষে এই ধর্মমতের অনুসারীরা খ্রিস্টধর্মকে তাদের ধর্মমত হিসেবে মেনে নিয়েছিল।

জেন্দ আবেস্তার সংকলন

অন্য অনেক ধর্মপুস্তকের মতাে জেন্দ আবেস্তাও দীর্ঘদিন ধরে সংকলিত হয়েছে। এই কাজে মাঝে মাঝেই বাধা এসেছে। আলেকজান্ডারের পারস্য বিজয়ের পর মূল ধর্মগ্রন্থের বহুকিছুই আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এর পরও চলতে থাকে সংকলন। সাসানীয় যুগে এই কাজ মােটামুটিভাবে শেষ হয়েছিল। জেন্দ আবেস্তার অংশগুলো হলো – 

  •  ১। ইয়াসনা – প্রার্থনা সঙ্গীত
  • ২। ভিসপেরাদ – আহুর মাজদা বা স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদিত শ্লোক বা মন্ত্র
  • ৩। ইয়াস্ত – শয়তান বিতাড়ণ ও দেহ পবিত্র করার মন্ত্র
  • ৪। ভিদেভদাত – শয়তান বিতাড়ণ ও দেহ পবিত্র করার মন্ত্র
  • ৫। খােরদেহ্ আবেস্তা – দৈনিক প্রার্থনার বিবরণী, সাসানীয় ও পরবর্তী যুগের প্রার্থনাসমূহ এতে আছে

তথ্যসূত্র

  • Barnes, Harry Elmer, Western Civilization.
  • Cambridge History of Iran Vol l & II. 
  • McKay, John P. Hill, Bennett D. Buckler, John, A History of World Societies (Boston: Houghton Mifflin, 1992.
  • Meyer, Eduard, Geschichte des Altertums. 7th edition, vol. 4, (Dramstadt: Wissenchaftliche Buchgesellschaft: 19975).
  • Ralph, Philip Lee, Lerner, Rabert E. Meacham, Standish, Burns, Edward McNau, World Civilizations, (New York: W.W, Norton, 1991).
  • V Scramuzza, V.M. and Mackendrick, The Ancient World  (New Your: Holt, Rinehart and Winston, 1958). 
  • Isaac Asimov, The Greeks : A Great Adventure, Houghton Mifflin Company Boston
  • The Egyptians, Isaac Asimov, Houghton Mifflin, 1967
  • A History of World Civilization – J. E. Swain (1976)
  • বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পার্ল পাবলিকেশন্স, ২০১২, পৃ. ২৮৮ – ৩১১
  • প্রাচীন পৃথিবী : পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের সভ্যতা, ডঃ এ. এফ. এম. শামসুর রহমান, অক্ষর বিণ্যাস প্রকাশনী, ২০০২, পৃ. ২৪৪ – ২৮৮
  • Cambyses II – World History Encyclopedia (ancient.eu)
  • উইকিপিডিয়া নিবন্ধ – Cambyses II

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.