জার্মানি (১৯১৯-১৯৩৯): ভার্সাই চুক্তি, ক্ষতিপূরণের সমস্যা, ভাইমার প্রজাতন্ত্র ও এর পতন, নাৎসিবাদ ও হিটলারের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি

ভার্সাই চুক্তি

জার্মানি প্রেসিডেন্ট উইলসনের চোদ্দ দফা ঘোষণায় আশ্বস্ত হয়েছিল, জার্মানরা ধরে নিয়েছিল এর ওপর ভিত্তি করে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হবে। কিন্তু প্যারিসকে শান্তি সম্মেলনের স্থান হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী শক্তিবর্গ পরাজিতের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের মনোভাব প্রকাশ করেছিল। যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়নি। পরাজিত শত্রুর প্রতি বিদ্বেষ, ক্ষতিপূরণ ও উপনিবেশের লোভ এবং বলশেভিক ভীতি বিজয়ী শক্তিবর্গের কার্যকলাপকে প্রভাবিত করেছিল। জার্মানিকে দুর্বল করে ইউরোপে শক্তিসাম্য ফিরিয়ে আনা এবং তা বজায় রাখা ছিল বিজয়ী শক্তিবর্গের নীতি। প্রেসিডেন্ট উইলসনের চোদ্দ দফার ভিত্তিতে যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে শান্তি রক্ষার জন্য লিগ অব নেশনস গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আবার সুবিধাবাদী নীতি অনুসরণ করে জার্মানিকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করে ক্ষতিপূরণ আদায় ও উপনিবেশ দখলের প্রয়াস চালানো হয়। প্যারিস শান্তি সম্মেলনে পরাজিত জার্মানির প্রতিনিধিদের কোনো ভূমিকা ছিল না। জার্মান প্রতিনিধিদের সঙ্গে যুদ্ধবন্দীর মতো আচরণ করা হয়, যুদ্ধ শুরু করার ভয় দেখিয়ে তাদের ভার্সাই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। চুক্তি রচনা ও স্বাক্ষর করার পদ্ধতি জার্মান জাতির মনের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছিল।

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন জার্মানি ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই সন্ধির শর্তানুযায়ী জার্মানি ফ্রান্সকে আলসাস-লোরেন, বেলজিয়ামকে মর্সনেট, ইউপেন, মালমেডি এবং লিথুয়ানিয়াকে মেমেল বন্দরটি ছেড়ে দেয়। পোজেন ও পশ্চিম প্রাশিয়ার একাংশ পেয়েছিল পোল্যান্ড, ডানজিগকে আন্তর্জাতিক মুক্ত বন্দরে পরিণত করা হয়, লিগ এর শাসনের ভার পায়। জার্মানির মধ্য দিয়ে পোলিশ করিডর গঠন করা হয়। জার্মানির খনিজ সমৃদ্ধ সার অঞ্চল জাতিসংঘের অধীনে স্থাপিত হয়, ফ্রান্স এখানকার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের অধিকার পেয়েছিল। জার্মানি তার সব উপনিবেশ (দশ লক্ষ বর্গমাইল) মিত্র শক্তিবর্গের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। উইলসনের ঘোষণায় উপনিবেশের নিরপেক্ষ ও ন্যায্য ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল (an impartial adjustment of colonial claims)। অন্য কোনো দেশের ঔপনিবেশিক ক্ষেত্রে কোনোরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লিগের ম্যানডেট হিসেবে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এগুলি দখল করেছিল। বিজয়ী শক্তিবর্গের সুপ্রিম কাউন্সিল উপনিবেশগুলির বণ্টন করেছিল। চিনে অবস্থিত জার্মান উপনিবেশগুলি পেয়েছিল জাপান, প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপনিবেশগুলি পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। জার্মান দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা, ক্যামেরুন, টোগোল্যান্ড প্রভৃতি উপনিবেশগুলি ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভাগ করে নিয়েছিল।

ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির সামরিক শক্তি হ্রাস করা হয়েছিল (The Allies imposed heavy limitations on the nature, size, and weaponry of Germany’s future military establishments) –

  • চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি এক লক্ষের বেশি সৈন্য রাখতে পারবে না, বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগদান নীতি বাতিল হয়ে যায়।
  • রাইন অঞ্চল থেকে সমস্ত সামরিক ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হয়, বিজয়ী শক্তিবর্গ এখানে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করেছিল।
  • জার্মানির নৌবহর ভেঙে দেওয়া হয়, একটি ক্ষুদ্র নৌবহর, কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ ও টর্পেডো জার্মানিকে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
  • জার্মান গোলন্দাজ বাহিনীর আয়তন হ্রাস করা হয়েছিল।
  • হেলিগোলান্ডে জার্মানির যে সামরিক ঘাঁটি ছিল তা ভেঙে ফেলা হয়।
  • জার্মানির সেনাপতিমণ্ডলী, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদির ওপরও বিধিনিষেধ আরোপিত হয়।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে উইলসনের ঘোষণায় সার্বিক নিরস্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। মিত্রশক্তিবর্গ জার্মানিকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছিল। জার্মানির সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়ামকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বলা হয় আন্তর্জাতিক আইন, নৈতিকতা ইত্যাদি ভঙ্গ করে তিনি অপরাধ করেছেন। কাইজার হল্যান্ডে পালিয়ে যান, কিন্তু জার্মানির বারোজন ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়। যুদ্ধাপরাধী শর্তকে প্রসারিত করে মিত্রদেশগুলিতে সবরকম ক্ষয়ক্ষতির জন্য জার্মানিকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য মিত্র শক্তিবর্গ ক্ষতিপূরণ কমিশন গঠন করেছিল, ক্ষতিপূরণ কমিশন জার্মানিকে ৩৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছিল। জার্মানি কয়লা, জাহাজ, রেল ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেবে। জার্মানি এই শর্তটি মানতে চায়নি, এর কারণ ছিল দুটি। জার্মানির ভূখণ্ড, উপনিবেশ, সম্পদ, বাণিজ্য জাহাজ কেড়ে নিয়ে তাকে দুর্বল করে দেওয়া হয়, এত ক্ষতি পূরণ দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না (It was not foreseen that Germany’s means to pay would be seriously weakened by its forced loss of territory, population, colonies, and natural resources and by the confiscation of its merchant fleet) | দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের সব দায়িত্ব তার ওপর চাপানো হয় (It was the revulsion of the German people against this article of the treaty which, above all else, laid the foundation for the Germany of Hitler)। ক্ষতিপূরণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত রাইন অঞ্চল মিত্রশক্তিবর্গের অধিকারে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ভার্সাই চুক্তিতে পোল্যান্ড ও চেকোশ্লোভাকিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হয়। জার্মানি ও অস্ট্রিয়া শুল্ক সংঘ স্থাপন করতে পারবে না, সংযুক্তি মেনে নেওয়া হবে না। জার্মানি রাশিয়া ও রুমানিয়ার সঙ্গে ব্রেস্ট-লিটোভস্ক ও বুখারেস্টের চুক্তি করেছিল, এগুলি বাতিল হয়ে যায়। এসব চুক্তির শর্তাবলি মিত্রশক্তিবর্গ মানেনি। জার্মানির জলপথ-কিয়েল খাল, এল্ব, ওডার, দানিয়ুব ও নিমেন নদী আন্তর্জাতিক পরিবহনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ভার্সাই সন্ধিতে লিগ অব নেশনস গঠিত হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ভার্সাই সন্ধির বিরুদ্ধে জার্মানির অনেকগুলি আপত্তি ছিল। জার্মানির কাছে এই সন্ধি ছিল অত্যন্ত কঠোর, জবরদস্তিমূলক চাপানো সন্ধি (dictated peace), জার্মানির পক্ষে অবমাননাকর। চুক্তির শুরুতে মিত্রশক্তিবর্গ উইলসনের চোদ্দ দফা নীতি ভঙ্গ করে গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিল (open covenants openly arrived at)। উইলসনের ঘোষণায় আশ্বস্ত হয়ে জার্মানি আত্মসমর্পণ করেছিল, কিন্তু পরাজিত জার্মানির সঙ্গে বিজয়ী শক্তিবর্গ কখনও সম্মানজনক আচরণ করেনি। সন্ধির খসড়া ফেলে দিয়ে জার্মান প্রতিনিধিদের শুধু মতামত জানাতে বলা হয়েছিল, তাদের আপত্তি কার্যত অগ্রাহ্য হয়ে যায়। এজন্য জার্মান জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। ভার্সাই সন্ধির শর্তানুযায়ী জার্মানি পঁচিশ হাজার বর্গমাইল অঞ্চল, সত্তর লক্ষ লোক, ১৫ শতাংশ কৃষি জমি ও ১২ শতাংশ শিল্পাঞ্চল হারিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে জার্মানরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিল, এই সন্ধি অমান্য করার দাবি উঠেছিল। উইলসনের চোদ্দ দফায় উপনিবেশের নিরপেক্ষ পুনর্মূল্যায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল। অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু জার্মানির উপনিবেশগুলি মিত্রশক্তিবর্গের অধীনে ম্যানডেট হিসেবে স্থাপন করা হয় (These and other discrepancies between principle and practice gave an easy handle to those who wished to argue that the Versailles Treaty was a tainted document and that the Allies had violated the conditions on which the armistice was concluded)।

ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। জার্মানির সৈন্যবাহিনীর আয়তন ক্ষুদ্র দেশ বেলজিয়ামের চেয়ে ছোটো ছিল। রাইনল্যান্ডে বিদেশি সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করা হয়। মিত্রশক্তিবর্গ উইলসনের আদর্শ অনুযায়ী সবদেশের নিরস্ত্রীকরণের কথা বলেছিল, কিন্তু জার্মানি ছাড়া আর কোনো দেশের নিরস্ত্রীকরণ হয়নি। হিটলার পরবর্তীকালে এটাকে চুক্তিভঙ্গের কারণ হিসেবে ব্যবহার করেন। মহাযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে এককভাবে দায়ী করা হয়। কাইজার উইলিয়ামকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করা হয়, কয়েকজন জার্মানকে এই অপরাধে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়। জার্মানিকে মহাযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী করা হয়। জার্মানি থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বিজয়ী শক্তিবর্গ ক্ষতিপূরণ কমিশন গঠন করেছিল। কমিশন পণ্যের মাধ্যমে ক্ষতিপুরণ আদায়ের ব্যবস্থা করেছিল, জার্মানি থেকে কয়লা, লোহা, দস্তা, সিসা, পটাশ, খাদ্যশস্য রপ্তানি করার ব্যবস্থা হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানির ৩৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দানের ক্ষমতা ছিল না। ক্ষতিপূরণ আদায় শুরু হলে জার্মানিতে ভয়ংকর মুদ্রাস্ফীতি, শিল্পোৎপাদন হ্রাস ও বেকারত্ব দেখা দেয়, এই হতাশা ও বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে হিটলার ক্ষমতা দখল করেন। উইলসনের ঘোষণায় সব জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছিল, জার্মানির ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম করা হয়। জার্মানির মধ্য দিয়ে পোল্যান্ডকে করিডর দেওয়া হয়, সাইলেশিয়ার একাংশ পোল্যান্ড পেয়েছিল। অন্যান্য আঞ্চলিক ব্যবস্থায় জার্মান জনগণ অন্য রাষ্ট্রের অধীনে স্থাপিত হয়। আন্তর্জাতিক নৌপরিবহন নীতি শুধু জার্মানিতে প্রয়োগ করা হয়, অন্য দেশের ক্ষেত্রে এই নীতির প্রয়োগ হয়নি (absolute freedom of navigation)। জার্মানির মিত্রদেশ অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও তুরস্কে যে ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় তা জার্মানির মনঃপূত হয়নি। এসব দেশের সঙ্গে বিজয়ী শক্তিগুলি কঠোর আচরণ করেছিল, এসব কারণে জার্মানি সন্ধির পর থেকে এর বিরোধিতা করতে থাকে।

জার্মানরা বলেছিল যে, ভার্সাই চুক্তি হল জোর করে চাপানো একটি সন্ধি (dictated peace)। ই. এইচ. কার জানিয়েছেন যে, সব শান্তিচুক্তির মধ্যে অল্প-বিস্তর জবরদস্তি থাকে (Nearly every treaty which brings a war to an end is, in one sense, a dictated peace)। কোনো পরাজিত শক্তি যুদ্ধের দায় নিতে চায় না, তবে একথা ঠিক ভার্সাই চুক্তির মধ্যে জবরদস্তিমূলক মনোভাবটি বেশি মাত্রায় ছিল। মিত্রশক্তিবর্গ ধরে নিয়েছিল জার্মানি যুদ্ধ বাধিয়ে নৈতিকতা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, সেজন্য জার্মানিকে শাস্তি দেওয়া হয়। ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে মহাযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তারা লিগ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফ্রান্সের জার্মান ভীতি ভার্সাই সন্ধির কঠোরতার জন্য অনেকখানি দায়ী ছিল। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেনসো ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের পরাজয় ও অবমাননা দেখেছিলেন, তার মধ্যে প্রবল জার্মান বিদ্বেষ ছিল। তিনি সমগ্র রাইনল্যান্ড অধিকার করে ফ্রান্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট উইলসনের বাধাদানের জন্য তা সম্ভব হয়নি।

জার্মানির নিরস্ত্রীকরণ ও ক্ষতিপূরণ আদায় হল এই জার্মান ভীতির পরিণতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ড ফ্রান্সের এই জার্মান ভীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। জার্মানির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। জার্মানিকে যুদ্ধের জন্য শাস্তি পেতে হবে। এই নির্বাচন প্রতিশ্রুতি তিনি বাস্তবায়িত করেন। আর ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ফ্রান্স জার্মানিকে দুর্বল করে রাখতে চেয়েছিল। মিত্রশক্তিবর্গের আরও সমস্যা ছিল, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় (১৯১৭)। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে ইউরোপকে বাঁচানোর জন্য বিজয়ী শক্তিবর্গকে ব্যবস্থা নিতে হয়। ভার্সাই সন্ধির খসড়া ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তৈরি হয়, বিজয়ী শক্তিগুলি রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির ব্রেস্ট-লিটোভস্কের সন্ধির ও রুমানিয়ার সঙ্গে স্বাক্ষরিত বুখারেস্ট চুক্তির শর্তাবলি জানত না। পরাজিত শত্রুর প্রতি জার্মানির মনোভাব সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল না। ডেভিড টমসন মনে করেন এটি ছিল মিত্রশক্তিবর্গের কঠোর, হৃদয়হীন আচরণের একটি কারণ। যুদ্ধ চলাকালীন মিত্রশক্তিবর্গ অনেক দেশের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল, ভার্সাই সন্ধির সময় এগুলি তাদের মেনে চলতে হয়। নিজেদের মধ্যে সম্পর্কে জটিলতা দেখা দিতে পারে এই আশঙ্কায় তারা সন্ধির শর্তাদির পরিবর্তন করেনি। ডেভিড টমসনের মতে, প্যারিস সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছিল (The Paris conference must stand in history as a conspicuous failure)। চুক্তি রচনাকালে আদর্শবাদ ও বাস্তবতার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলেছিল, বাস্তবতাবাদ বেশি ছিল, আদর্শবাদের অভাব ছিল তা নয়, দুটি ক্ষেত্রেই অপব্যবহার হল শান্তিচুক্তির ব্যর্থতার বড়ো কারণ (This was not due to either an excess of realism or a lack of idealism, but rather to a misapplication of both)।

দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে জার্মানির ক্ষতিপূরণ সমস্যা

মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি সাধারণ নিয়ম হল বিজয়ী রাষ্ট্র বিজিতের ওপর যুদ্ধের সব দায় চাপিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করে থাকে। ইউরোপের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে দেখা যায় বিজয়ী শক্তি বিজিত শক্তিকে যুদ্ধ বাধানোর শাস্তি হিসেবে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করেছে। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে সকলে আশঙ্কা করেছিল বিজয়ী মিত্রশক্তিবর্গ পরাজিত জার্মানিকে বিপুল পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করবে। যুদ্ধ শেষে মিত্রশক্তিবর্গ জার্মানির কাছ থেকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও লোকক্ষয়ের জন্য সীমিত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রথম থেকে একটি সমস্যা দেখা দেয়, সীমিত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দানের ক্ষমতাও জার্মানির ছিল না। ঠিক এই কারণে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির দেয় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। মিত্রশক্তিবর্গ ঠিক করেছিল ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ও পরিশোধ করার পদ্ধতি মিত্রশক্তি কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিশন নির্ধারণ করবে। মিত্রশক্তিবর্গ আরও বলেছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের মধ্যে কমিশন হিসেবনিকেশের কাজ শেষ করবে এবং তিরিশ বছরের মধ্যে জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ দানের কাজ শেষ করতে হবে। ক্ষতিপূরণ বাবদ জার্মানিকে অগ্রিম এককালীন ১০০ কোটি পাউন্ড দিতে হবে। ক্ষতিপূরণের সঙ্গে বিজয়ী শক্তিবর্গের যুদ্ধঋণ সমস্যাটি জড়িত ছিল। ঋণগ্রস্ত দেশগুলি ক্ষতিপূরণের অর্থ থেকে মার্কিন পুঁজিপতি ও সরকারের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধের কথা ভেবেছিল।

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মিত্রশক্তিবর্গ ও জার্মান প্রতিনিধিরা ক্ষতিপূরণ সমস্যা আলোচনার জন্য সুইজারল্যান্ডের স্পাতে মিলিত হয়। জার্মানি ক্ষতিপূরণ বাবদ কয়লা দিতে রাজি হয়েছিল। ক্ষতিপূরণের অর্থ মিত্রশক্তিবর্গের মধ্যে কীভাবে বণ্টিত হবে তাও এখানে ঠিক হয়ে যায়। জার্মানির দেয় অর্থের ৫২ শতাংশ পাবে ফ্রান্স, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ২২ শতাংশ, ইতালি দশ শতাংশ, বেলজিয়াম ৮ শতাংশ এবং বাকি অর্থ ছোটো ছোটো দেশগুলির মধ্যে বণ্টিত হবে। ক্ষতিপূরণ নিয়ে মিত্রশক্তিবর্গ ও জার্মানির মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। জার্মানি প্রথম কিস্তির টাকা দেয়নি, নিরস্ত্রীকরণের কয়েকটি শর্ত পালন করেনি। এই অপরাধে মিত্রশক্তিবর্গ রাইন নদীর পূর্বতীরের তিনটি শহর ডুসেলডর্ফ, ডুইসবার্গ ও রুঢ়োট অধিকার করেছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ক্ষতিপূরণ কমিশন হিসেবনিকেশ শেষ করে জার্মানির মোট দেয় ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছিল ৬৬০ কোটি পাউন্ড। মিত্রশক্তিবর্গের অনেকে মনে করেছিল, জার্মানি এই বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করতে পারবে না। এই পটভূমিকায় জার্মানির ক্ষতিপূরণ বাবদ দেয় অর্থকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। গ বিভাগে রাখা হয় ৪০০ কোটি পাউন্ড, বলা হয় জার্মানিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। ক ও খ বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট অর্থ জার্মানি একটি ক্ষতিপূরণ তালিকা অনুযায়ী পরিশোধ করবে, ক্ষতিপূরণ কমিশন এই তালিকা তৈরি করেছিল। ঠিক হয় জার্মানি প্রতিবছর তার রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত অর্থের ২৫ শতাংশ এবং আরও দশ কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেবে, জার্মানি এই বন্দোবস্ত মেনে নিয়েছিল।

ক্ষতিপূরণ কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী জার্মানি ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তি ৫ কোটি পাউন্ড পরিশোধ করেছিল, এরপর তিন বছর জার্মানি আর নগদ অর্থ দিতে পারেনি। জার্মানিতে প্রচণ্ড মুদ্রাসংকট দেখা দিয়েছিল, পাউন্ডের সঙ্গে মার্কের বিনিময় হার ক্রমশ নামতে থাকে, মুদ্রাস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। মিত্রশক্তিবর্গ ধরে নিয়েছিল জার্মানি ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করতে পারবে না, এজন্য বিদেশি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। মার্কের এত অবমূল্যায়ন হয় যে মিত্রশক্তি মার্ক নিতে অস্বীকার করেছিল। ইংল্যান্ড জার্মানির সমস্যা উপলব্ধি করেছিল কিন্তু ফ্রান্স ক্ষতিপূরণকে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায় হিসেবে দেখেছিল। দুর্বল জার্মানি ফ্রান্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ফ্রান্স জার্মানির শিল্প বলপূর্বক অধিকার করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা ভেবেছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে পারেনি, পণ্য সরবরাহেও ব্যর্থ হয়েছিল। ফ্রান্স জার্মানির শিল্পসমৃদ্ধ রূঢ় অঞ্চল দখলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম রূঢ় অঞ্চল দখল করেছিল। ফরাসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জার্মান সরকার নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছিল, জার্মানি পণ্য ও অর্থ সরবরাহ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিল। রূঢ় অধিকার নিয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। এই ঘটনা জার্মানির অর্থনৈতিক জীবনকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। জার্মানির মুদ্রা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, মিত্রশক্তি বর্গের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ক্রমশ বিলীন হতে থাকে।

রূঢ় দখলের পর তিনটি ঘটনা ঘটেছিল যা পরিস্থিতির খানিকটা পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। গুস্তাফ স্ট্রেসম্যান জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি পশ্চিমি শক্তিবর্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার নীতি গ্রহণ করেন। ফ্রান্সে হেরিয়টের নেতৃত্বে নতুন প্রগতিশীল বামপন্থী মন্ত্রীসভা গঠিত হয়, এই মন্ত্রীসভা জার্মানি সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল। তৃতীয় ঘটনাটি হল ক্ষতিপূরণ সমস্যাটিকে বিচার-বিবেচনা করার জন্য মার্কিন বিশেষজ্ঞ জেনারেল ডাওয়েজের নেতৃত্বে (Dawes) একটি কমিটি গঠন করা হয়।

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ডাওয়েস কমিটি ক্ষতিপূরণ কমিশনের কাছে তার রিপোর্ট পেশ করেছিল। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে জার্মানির স্ট্রেসম্যান, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী হেরিয়ট ও ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যান। জার্মানির মুদ্রা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। জার্মানির পুরোনো মুদ্রা মার্ক বাতিল করে নতুন মুদ্রা রেনটেনমার্ক চালু করা হয়, এই মুদ্রাও বেশিদিন টেকেনি। ডাওয়েস কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী স্বশাসিত নতুন ব্যাংক স্থাপন করে তার হাতে রাইখমার্ক পরিচালনার ভার দেওয়া হয়। ডাওয়েস কমিটি সুপারিশ করেছিল যে জার্মানি প্রতিবছর ক্ষতিপূরণ বাবদ মিত্রশক্তিবর্গকে ৫০ মি. পাউন্ড দেবে, প্রতি বছর তার পরিমাণ বাড়বে, পঞ্চম বছরে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১২৫ মি. পাউন্ড। এই অর্থ জার্মানির রেল, শিল্প, মাদকদ্রব্য, চিনি ও অন্যান্য পণ্যের ওপর স্থাপিত শুল্ক থেকে সংগ্রহ করা হবে। ডাওয়েস কমিটির সুপারিশে ছিল জার্মানির ক্ষতিপূরণের অর্থ তার রাইখমার্কে দেবে, প্রাপকরা তা নিজেদের মুদ্রায় রূপান্তরিত করবে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জার্মানির রেল, ব্যাংক ও শুল্ক বিভাগে মিত্রপক্ষের প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়, সমগ্র ব্যবস্থা তদারকির জন্য একজন ক্ষতিপূরণ এজেন্ট ছিল। রূঢ় অঞ্চল থেকে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করতে বলা হয়, মজুত অর্থভাণ্ডার গড়ার জন্য জার্মানিকে চার কোটি পাউন্ড ঋণ দিতে বলা হয়েছিল।

ডাওয়েস পরিকল্পনার অনেকগুলি ভালো দিক ছিল। বোঝাপড়ার পরিবেশে সমগ্র পরিকল্পনাটি রচিত হয়, ডাওয়েস কমিটি সাধ্যানুযায়ী জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছিল। ক্ষতিপূরণের অর্থকে হস্তান্তরের সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। জার্মানির সমগ্র সম্পদ আটক না করে কয়েকটি নির্দিষ্ট রাজস্বের উৎসের ওপর প্রাপক দেশগুলির নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের ব্যবস্থা হয়েছিল। রাজনীতি-নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কমিটি সমস্যাটিকে দেখেছিল। এই পরিকল্পনায় অবশ্য ত্রুটিও ছিল। জার্মানিকে বার্ষিক ক্ষতিপূরণের কিস্তি দিতে বলা হয়। জার্মানির দেয় মোট ক্ষতিপূরণ কত এবং জার্মানি কত বছরে তা পরিশোধ করবে নিদিষ্ট করে তা বলা হয়নি। এজন্য জার্মানিতে হতাশা ও অবসাদ কাটেনি। জার্মানদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে আর্থিক সমৃদ্ধির অর্থ হল অধিকহারে ক্ষতিপূরণ দান। জার্মানরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। জার্মানির জন্য বৈদেশিক ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, মার্কিন পুঁজিপতিদের ঋণে জার্মানিতে আপাত সমৃদ্ধি এসেছিল, ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

ডাওয়েজ পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ার পর মিত্রপক্ষীয় দেশগুলির সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছিল। জার্মানি লোকার্নো চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি লিগের সদস্য হয়। জার্মানি রাইনল্যান্ড থেকে সৈন্য অপসারণ, সার অঞ্চল প্রত্যর্পণ এবং জার্মানির ওপর থেকে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়েছিল। জার্মানি এককালীন বেশি টাকা দিয়ে ক্ষতিপূরণ সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল। ডাওয়েস পরিকল্পনা ছিল অস্থায়ী ব্যাপার, জার্মানির সামগ্রিক দায়দায়িত্ব এতে নির্ধারিত হয়নি। সৈন্য অপসারণ ও ক্ষতিপূরণ সমস্যার সমাধানের জন্য মিত্রশক্তিবর্গ আলোচনা করতে রাজি হয়েছিল। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন বিশেষজ্ঞ আর্থার ইয়াং-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়, ঐ বছর জুন মাসে এই কমিটি মিত্রপক্ষের কাছে তাদের সুপারিশ পেশ করেছিল।

ইয়াং কমিটি এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছিল। জার্মানি পরবর্তী ৩৭ বছর ধরে বার্ষিক ১০ কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দেবে, ২২ বছর ধরে যুদ্ধ ঋণগ্রস্ত দেশগুলি বছরে যে অর্থ পরিশোধ করে জার্মানি তা সরবরাহ করবে। ডাওয়েস পরিকল্পনায় জার্মানির ওপর যে নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়েছিল তা বাতিল করা হয়। ক্ষতিপূরণের অর্থ হস্তান্তরের দায়িত্ব জার্মান সরকারকে দেওয়া হয়। বিনিময় সংক্রান্ত কোনো অসুবিধা দেখা দিলে জার্মানি ক্ষতিপূরণ দুবছরের জন্য স্থগিত রাখতে পারবে। একটি আন্তর্জাতিক সেটেলমেন্ট ব্যাংক ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত সব লেনদেন পরিচালনা করবে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ইয়াং প্রস্তাব কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রাইনল্যান্ড থেকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ক্ষতিপূরণের তিন-চতুর্থাংশ অর্থ ফ্রান্সকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কমিটির জার্মান সদস্য হালমার স্যাক্ট বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন ক্ষতিপূরণের প্রয়োজনীয় অর্থ জার্মানির পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব নাও হতে পারে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ইয়াং পরিকল্পনা কার্যকর করা হলে ছ’মাসের মধ্যে মিত্রপক্ষীয় সৈন্য রাইনল্যান্ড ত্যাগ করে চলে যায়।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা শুরু হয়েছিল, অনিবার্যভাবে জার্মান অর্থনীতির ওপর এর ভয়ংকর প্রভাব পড়েছিল। পুঁজির বিনিয়োগ কমে যায়, উৎপাদন হ্রাস পায়, পণ্যের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে নেমে গিয়েছিল। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্ট্রেসম্যান মারা যান, মার্কিন পুঁজিপতিরা জার্মানিতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে সাহস করেনি। অর্থনৈতিক মহামন্দার কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হুভার যুদ্ধঋণ ও ক্ষতিপূরণের ওপর ১৯৩২ সনের জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দেন (Hoover’s moratorium)। এই সময়সীমা পার হওয়ার আগেই জার্মানির চ্যান্সেলর ব্রুনিং কার্যত ক্ষতিপূরণ সমস্যার সমাধান করে ফেলেন। তিনি ঘোষণা করেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে জার্মানির পক্ষে ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। এর পরেও মিত্রশক্তিবর্গ সুইজারল্যান্ডের লসানে মিলিত হয়ে জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ এককালীন ১৫ কোটি পাউন্ড আদায়ের চেষ্টা করেছিল, জার্মানি এই প্রস্তাব সরাসরি বাতিল করে দিয়েছিল। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর এক দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।

সন্দেহ নেই যুদ্ধ ক্ষতিপূরণ সমস্যা জার্মানির যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির ভয়ংকর ক্ষতি করেছিল, দেশে বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও হতাশা দেখা দিয়েছিল। সরকার ও জনগণ জার্মানির অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। ভয়ংকর মুদ্রাস্ফীতি মধ্যবিত্তের সর্বনাশ করেছিল, শ্রমিক শ্রেণিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের প্রকৃত আয় কমেছিল। এদের হতাশাকে মূলধন করে হিটলারের নাৎসি দল ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে, ফ্রান্স ক্ষতিপূরণকে তার নিরাপত্তা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে দেখেছিল। ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে শত্রুতা বেড়েছিল। শেষপর্যন্ত মিত্রশক্তিবর্গ ক্ষতিপূরণ বাবদ জার্মানির কাছ থেকে ১৫ কোটি পাউন্ডের বেশি আদায় করতে পারেনি। এজন্য পশ্চিমি গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে পরবর্তীকালে অনেক বেশি রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয়েছিল, জার্মান জাতি এই জাতীয় অবমাননা কখনও ভুলতে পারেনি। অস্বীকার করা যায় না এই সমস্যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পথ অনেকখানি প্রশস্ত করে দিয়েছিল।

ভাইমার প্রজাতন্ত্র (Weimar republic)

প্রথম মহাযুদ্ধের শেষপর্বে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতালিতে গণতন্ত্র বিরোধী, একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস শুরু হয়েছিল। জার্মানির আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পরে কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম পদত্যাগ করেন, জার্মানিতে প্রজাতন্ত্র স্থাপন করা হয় (The German revolution of 1918 was the offspring of confusion)। ভাইমার শহরে মিলিত হয়ে জাতীয় সভা প্রজাতন্ত্রী সংবিধান রচনা করেছিল (১৯১৯), এজন্য এই প্রজাতন্ত্রের নাম হয় ভাইমার প্রজাতন্ত্র (Weimar Republic)। ১৯১৮ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জার্মানিতে প্রজাতন্ত্র টিকে ছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এজন্য বিজয়ী শক্তিবর্গের দায়িত্ব কম ছিল না, তাদের উচিত ছিল ভাইমার প্রজাতন্ত্রকে সবরকম সাহায্য দিয়ে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা (It was in their interest that the pacific Weimar Democracy should firmly establish itself in Germany) ()। জার্মানি সম্পর্কে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য এই প্রজাতন্ত্রকে অনেকখানি দুর্বল করে ফেলেছিল। জার্মানির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হল দেশের শক্তিশালী সামাজিক গোষ্ঠীগুলি একে সমর্থন করেনি। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে যুদ্ধক্লান্ত, হতাশ, ক্ষুধার্ত, ভীত, সন্ত্রস্ত জার্মানিতে বিদ্রোহ ও অশান্ত পরিবেশের মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল (a situation in which war-weariness, fear, hunger, disillusionment and social resentment exploded into violence)। জার্মানির বিভিন্ন প্রান্তে সৈনিক ও শ্রমিকরা কাউন্সিল গঠন করে স্থানীয় শাসনের ভার নিয়েছিল। এরা দুটি দাবি রেখেছিল-যুদ্ধের অবসান এবং কাইজারের পদত্যাগ। ব্যাভেরিয়াতে স্বতন্ত্র প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা হয়। কাইজারের পদত্যাগের অব্যবহিত পরে ৯ নভেম্বর ১৯১৯ ফ্রেডারিক এবার্টের নেতৃত্বে জাতীয় প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠিত হয়। এবার্ট শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। নির্বাচিত আইন- সংসদ সংবিধান তৈরি করে দেশের শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির ব্যবস্থা করবে এমনটি ছিল তার পরিকল্পনা।

এবার্টের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিল দুটি উগ্রপন্থী সমাজতন্ত্রী গোষ্ঠী- এদের নেতৃত্ব দেন কার্ল লিবনেক্ট (Liebknecht) ও রোজা লুক্সেমবার্গ। এরা স্পার্টাকাস (Spartacist) পন্থী নামে পরিচিত ছিল। এরা ধর্মঘট, আন্দোলন এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছিল। এই পরিস্থিতিতে অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট এবার্ট সৈন্যবাহিনীর প্রধান উইলিয়াম গ্রিনারের সাহায্য নিতে বাধ্য হন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে স্পার্টাকাস দল অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বার্লিন শহর দখলের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়, লিবনেক্ট ও রোজা লুক্সেমবার্গ দুজনেই নিহত হন। সৈন্যবাহিনী সমস্ত প্রদেশের বিদ্রোহীদের ক্ষমতা দখলের প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়েছিল। জাতীয় সরকারের কর্তৃত্ব সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, মিউনিখে কুট আইজনার (Eisner) নিহত হন, জার্মান বিপ্লবের রক্তাক্ত পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে (The violent phase of the German revolution was over)।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবার্ট বিদ্রোহ দমন করে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের সাধারণ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেনি। এই আইনসভা ভাইমার শহরে মিলিত হয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিল। আইনসভা একটি আইনানুগ সরকার গঠন করে, বিজয়ী শক্তিবর্গের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে এবং দেশের জন্য একটি প্রজাতন্ত্রী সংবিধান রচনা করে (It had to establish a legal government to conclude peace with the Allies, and to write a new constitution for the new republic)। আইনসভা ফ্রেডারিক এবার্টকে প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিল। সোসালিস্ট, ক্যাথলিক সেন্টার পার্টি ও ডেমোক্রেটিক দলের সদস্যদের নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। বিজয়ী শক্তিবর্গের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করা ছিল আরও অনেকবেশি কঠিন কাজ। ভার্সাই চুক্তির শর্তাবলি জাতীয় দলগুলিকে ক্ষুব্ধ করেছিল, কিন্তু সেনাপতি গ্রিনার ও এবার্ট আইনসভাকে এই চুক্তি গ্রহণ করতে রাজি করান। সেই মুহূর্ত থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ভাইমার প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচার শুরু করেছিল। এরা প্রচার করেছিল যে জার্মানি যুদ্ধে পরাস্ত হয়নি, শান্তিবাদী, সমাজতন্ত্রী ও আপসপন্থীরা জার্মানির পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাত করেছে।

প্রজাতন্ত্রের সংবিধান দুইকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করেছিল, প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয় প্রেসিডেন্টকে। গোপন সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে তিনি নির্বাচিত হবেন। নিম্নকক্ষ রাইখস্ট্যাগের সদস্যরা সরাসরি নির্বাচিত হবেন, আনুপাতিক নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল। বিসমার্কের শাসনতন্ত্রের ত্রুটিগুলি দূর করে আইনসভাকে সারাদেশে কর স্থাপনের অধিকার দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র, নাগরিকত্ব, ভ্রমণ, জাতীয় প্রতিরক্ষা, মুদ্রা, শুল্ক, ডাক, তার ও রেলপথের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। ফৌজদারি, দেওয়ানি আইন, বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক কল্যাণ, সংবাদপত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। জাতীয় সরকার ধর্ম, শিক্ষা, গৃহনির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নির্দেশ দিতে পারবে। চ্যান্সেলর ও তার মন্ত্রীসভা নিম্নকক্ষের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, অঙ্গরাজ্যগুলির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার বজায় রাখা হয়। এই ব্যবস্থার দুটি ত্রুটি হল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, বহুদল ও উপদলের আবির্ভাব এবং জনগণের আইন-প্রণয়নের ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণের অধিকার (Initiative) এবং গণভোট (referendum)। এই সংবিধান প্রেসিডেন্টকে প্রভৃত ক্ষমতা দিয়েছিল। তিনি মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন, সামরিক বাহিনীর প্রধান হবেন, প্রয়োজন হলে গণভোট নেবেন, জরুরি অবস্থা দেখা দিলে সংবিধান বাতিল করতে পারবেন (৪৮ ধারা)। এই ধারার অপব্যবহার করে প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটানো হয়।

১৯১৯-১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল হল ভাইমার প্রজাতন্ত্রের দুর্যোগপর্ব, এই সময়ে প্রজাতন্ত্র কতকগুলি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। ভার্সাই সন্ধির শর্তানুযায়ী সৈন্যবাহিনী ভেঙে দিতে হয়, পদচ্যুত সৈনিক ও সেনানায়কদের মধ্যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ভার্সাই চুক্তির অন্যান্য শর্তও দেশের মধ্যে বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল, প্রজাতন্ত্রের শত্রুরা এর সুযোগ নিয়েছিল (Nothing did more to help the enemies of the Republic than its leaders’ efforts to carry out the terms of the Versailles Treaty)। প্রজাতন্ত্রী সরকার সৈন্যবাহিনী ভেঙে দেবার নির্দেশ দিলে তারা সেনাপতি লুটউৎজ ও লুডেনডর্ফ কাপের নেতৃত্বে (Kapp) নতুন সরকারের প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিদ্রোহীরা বার্লিন অভিমুখে যাত্রা করলে ট্রেড ইউনিয়ন ও সমাজবাদী পার্টির ধর্মঘট পরিস্থিতি সামলে দিয়েছিল। লুটউৎজ ও কাপ বার্লিন ত্যাগ করে পালিয়ে যান, সরকার রক্ষা পায়। এবার্ট বিদ্রোহী সৈন্যদের শাস্তি দিতে পারেননি কারণ রূঢ় অঞ্চলে বিদ্রোহী সৈন্যরা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছিল, সৈন্যবাহিনীর সাহায্য নিয়ে সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়।

ভাইমার প্রজাতন্ত্রের সামনে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা ছাড়াও আরো অনেক জটিল সমস্যা ছিল। একটি বড়ো সমস্যা হল যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ সমস্যা। জার্মানিকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করে মোট ৩৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। এবার্ট সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছিল যদিও জার্মান জনগণ তা পছন্দ করেনি, আর জার্মানির এত অর্থ দেবার ক্ষমতাও ছিল না। জার্মানি প্রথমে পঞ্চাশ কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিতে পেরেছিল, তারপরের ক্ষতিপূরণ দেওয়া বন্ধ করেছিল। সরকার নতুন কর বসিয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় করতে পারেনি কারণ এই শর্তটির বিরুদ্ধে জার্মানদের প্রবল আপত্তি ছিল (policy of fulfilment)। ঋণ সংগ্রহ করে এবং নোট ছাপিয়ে বিদেশিদের প্রাপ্য শোধ করার চেষ্টা করেছিল (borrowing and printing money)। এর পরিণতি হয়েছিল মারাত্মক, সমগ্র দেশে অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। জার্মান কারেন্সি মার্কের দাম ক্রমাগত কমতে থাকে, মধ্যবিত্তের সঞ্চয় সব নষ্ট হয়ে যায়। সরকারি কর্মচারীদের প্রকৃত বেতন কমেছিল, শ্রমিকরা দুর্দশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়, বণিক, শিল্পপতি ও ফাটকাবাজদের অনেকে লাভবান হন।

কিভাবে বণিক, শিল্পপতি ও ফটকাবাজদের অনেকে এই অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির ফলে লাভবান হন তা নিয়ে একটু বলা যাক –

  • ১. এরা প্রায়ই ট্যাঞ্জিবল এসেট বা স্থাবর সম্পত্তি মজুদ করে রাখতো যেগুলো ইনফ্লেশনের সময়ও তাদের মূল্য ধরে রাখতো বা এমনকি বৃদ্ধিও পেত। এগুলোর মধ্যে রিয়্যাল এস্টেট, ফ্যাক্টরি, মেশিনারি ও কোম্পানির স্টক ছিল। কারেন্সি হিসেবে মার্ক এর মূল্যের পতন ঘটলে এইসব সম্পত্তির নমিনাল ভেল্যু বৃদ্ধি পায়, আর এর ফলে যেসব ধনি ব্যক্তির কাছে এই সব সম্পত্তি ছিল তাদের সম্পদের মূল্যও বেড়ে যায়। (এই কারণেই জমির দাম ও সোনার দাম সবসময় বাড়ে, কারণ ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি যত বৃদ্ধি পায়, মানে টাকার মূল্য বা মানুষের পারচেসিং পাওয়ার যত কমে, এইসব স্থাবর সম্পত্তি প্রতি বিনিময় যোগ্য টাকার পরিমাণও তত বাড়ে, মানে দাম বাড়ে।)
  • ২. স্পেকিউলেটিভ ট্রেইডে জড়িত হবার মাধ্যমে ফটকাবাজ বা স্পেক্যুলেটররা ও কিছু শিল্পপতি এই অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। এক্ষেত্রে তারা ইনফ্লেশনের সময় প্রথমে দাম কম থাকলে সম্পত্তি বা বিদেশী কারেন্সি ক্রয় করে, আর এরপর ইনফ্লেশনের কারণে স্বাভাবিকভাবেই যখন দাম বৃদ্ধি পেয়ে যায় তখন এই সম্পত্তি ও বিদেশী কারেন্সিগুলো অধিক দামে বিক্রি করে, আর এর মাধ্যমে লাভবান হয়।
  • ৩. যেসকল ব্যবসায় আগে থেকেই ঋণ ছিল তারা এরকম অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির ফলে উপকৃত হয় কেননা সেই ঋণের রিয়্যাল ভেল্যু কমে যায়, কেননা মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় রিয়্যাল টার্মে তাদের যে অর্থ প্রদেয় তার মূল্য কমে যাচ্ছে, ফলে তাদের পক্ষে সহজেই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে। ঋণ গ্রহণ করার সময় নেয়া টাকার যে মূল্য ছিল, ঋণ পরিশোধ করার সময় সেই অর্থের মূল্য অনেকটাই কম থাকছে, তাই তাদের লাভ হচ্ছে, অন্যদিকে যাদের থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল, যেমন ব্যাংক, তাদের ক্ষতি হচ্ছে।
  • ৪. যেসব শিল্পপতি ও মার্চেন্টরা রপ্তানি করত তাদেরও এক্ষেত্রে লাভ হয়, কারণ বিদেশী ক্রেতাদের কাছে তাদের পণ্যের মূল্য কমে যায়, ফলে তাদের পণ্যের ডিমান্ড বেড়ে যায় ও বিক্রি বেশি হয়, আর এর বিনিময়ে তারা প্রচুর পরিমাণে লোকাল কারেন্সি হিসেবে মার্ক লাভ করে।
  • ৫. এই গোষ্ঠীগুলো ইনফ্লেশনের সময় খুব দ্রুত তাদের পণ্য ও সেবার দাম এডজাস্ট করে, যেটা শ্রমিকদের মজুরি ও সরকারি আমলাদের বেতনের ক্ষেত্রে হয়নি। এর ফলে এদের মধ্যে যে গ্যাপ হয় তার ফলে জীবনযাত্রার জন্য দরকারি খরচ বা কস্ট অফ লিভিং-ও বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষের ইনকাম তাই পণ্য ও সেবার সাথে তাল মেলাতে পারেনা, যেখানে বিজনেসগুলো ঠিকই পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে তাদের প্রফিট আগের মতোই রাখে। মানে তাদের ক্ষতি হয়নি, কিন্তু সাধারণ জনতার হয়।

সব মিলে এই অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি মধ্যবিত্তের জমানো টাকা শূন্য করে দেয় আর শ্রমি ও সরকারি চাকুরেদের রিয়্যাল ওয়েজ বা প্রকৃত মজুরি কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে উচ্চবিত্তরা, যারা বণিক, শিল্পপতি ও ফটকাবাজ ছিল তাদের উন্নতি হয়।

যাই হোক, দেশের মধ্যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল বলে সরকার বিদেশিদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেনি। জার্মানি ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ফ্রান্স ও বেলজিয়াম তার শিল্পসমৃদ্ধ রূঢ় অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল (১৯২৩)। এর প্রতিবাদে এই অঞ্চলের জার্মানরা কাজকর্ম বন্ধ করে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা জার্মানির দুর্ভাগ্যের জন্য ভার্সাই চুক্তি এবং সরকারের সন্ধির শর্ত মানার নীতিকে দায়ী করেছিল (Republic’s acceptance of the peace treaty and the inauguration of the policy of fulfilment)। জার্মানিতে এই পর্বে তিনটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ছিল- অতিবামপন্থী সমাজতন্ত্রী দল, উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী ও মধ্যপন্থী উদারনৈতিক দল। তৃতীয় দলটি ভাইমার প্রজাতন্ত্রের সমর্থক ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য হল এদের সদস্যসংখ্যা ছিল কম। উগ্র দক্ষিণপন্থীরা ভার্সাই চুক্তি, ক্ষতিপূরণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, জার্মানির অবমাননা, ফ্রান্সের আগ্রাসী মনোভাব সবকিছুর জন্য প্রজাতন্ত্রকে দায়ী করেছিল। উগ্রপন্থীরা মাথিয়াস এরজবার্জার (Erzberger)-কে হত্যা করেছিল কারণ তিনি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, আর ওয়াল্টার রথেনোকে হত্যা করা হয় কারণ তিনি র‍্যাপালো চুক্তি করে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি পশ্চিমের সঙ্গে সহযোগিতায় বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে শুধু কয়েকজন ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রকেও আক্রমণ করা হয়। ডুসেলডর্ফ ও আখেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রাইনল্যান্ড প্রজাতন্ত্র স্থাপন করেছিল, স্যাক্সনি ও থুরিঙ্গিয়াতেও অনুরূপ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিল। বার্লিন সরকার সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে এখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করেছিল। ব্যাভেরিয়াতে গুস্তাভ ভন কর (Kahr) হিটলারের সহায়তা নিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন, তিনিও ছিলেন একজন দক্ষিণপন্থী। হিটলার নিজেই এদের হটিয়ে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেন, কিন্তু তার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায় (১৯২৩)। এইসব ঘটনার পর ভাইমার প্রজাতন্ত্র অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন থেকে মুক্তি পেয়েছিল।

১৯২৩-১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের সময়কাল হল ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পুনর্গঠন পর্ব। ঐ বছর গুস্তাভ স্ট্রেসম্যান (stresemann) জার্মানির চ্যান্সেলর হন, অল্পদিন তিনি চ্যান্সেলর ছিলেন (মাত্র ১০০ দিন) তবে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রজাতন্ত্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রেসিডেন্ট এবার্টের মৃত্যু হলে হিন্ডেনবার্গ প্রেসিডেন্ট হন এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঐ পদে ছিলেন। জার্মান পিপলস পার্টির সদস্য স্ট্রেসম্যান কাভুরের মতো মধ্যপন্থীদের নিয়ে স্থিতিশীল কোয়ালিশন সরকার গঠনের কথা ভেবেছিলেন। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছিল, তিনি রূঢ় অঞ্চলে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের অবসান ঘটান। জার্মানির পুনরুজ্জীবনের জন্য পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। তিনি জার্মানিকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন (Stresemann’s ambition was to restore Germany to its place among the leading nations of the world)।

বিজয়ী শক্তিবর্গকে তিনি জার্মানির পরিস্থিতি বুঝিয়েছিলেন। পশ্চিমি দেশগুলি ডাওয়েজ পরিকল্পনা গ্রহণ করে (১৯২৪) জার্মানিকে সহজ শর্তে ঋণদানের ব্যবস্থা করেছিল। জার্মানি সহজ শর্তে যুদ্ধ ক্ষতিপূরণ পরিশোধের সুযোগ পেয়েছিল। জার্মানির মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়। হিটলার ডাওয়েজ পরিকল্পনার সমালোচনা করেছিলেন ঠিকই, তা সত্ত্বেও এই ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ার ফলে জার্মানির শিল্প উৎপাদন ও বাণিজ্য দুই-ই বেড়ে যায়। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে বেকারত্ব কমে এসেছিল, জীবনযাত্রার মান ও শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি দুই-ই বেড়েছিল (The Dawes plan made possible remarkable progress in German industry and commerce and a steady rise of living standards and real wage between 1924 and 1929)। স্ট্রেসম্যান পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে আপস করতে চেয়েছিলেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের সঙ্গে লোকার্নো চুক্তি করে জার্মানির পশ্চিম সীমান্ত মেনে নেন, যুদ্ধ পরিহার করার প্রতিশ্রুতি দেন। কারের মতে, লোকার্নো হল যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যে প্রকৃত বিভাজন রেখা (Locarno is the real dividing line between the years of war and the years of peace)। স্ট্রেসম্যান পশ্চিমি দেশগুলিকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হন। জার্মানি লিগের সদস্য হয় (১৯২৬), ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে রাইনল্যান্ড থেকে সামরিক পর্যবেক্ষকদের সরিয়ে নিতে রাজি হয়, ১৯৩০ মধ্যে রাইনল্যান্ড থেকে সব বিদেশি সৈন্য সরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে হেগ সম্মেলনে ইয়াং প্ল্যান গৃহীত হয়, তার সঙ্গে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। জার্মানির ক্ষতিপূরণ পরিশোধের ব্যবস্থা আরও সহজ করা হয়।

১৯২৯-১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল হল ভাইমার প্রজাতন্ত্রের চরম ব্যর্থতার পর্ব। স্ট্রেসম্যানের বৈদেশিক নীতিতে সাফল্য অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রকে শক্তিশালী করেনি। এই সরকারের সবচেয়ে বড়ো অপরাধ ছিল ভার্সাই সন্ধিকে মেনে নেওয়া। জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থীরা প্রজাতন্ত্রকে এজন্য ক্ষমা করতে পারেনি। জার্মানির ভূস্বামী, শিল্পপতি, বণিক, আমলা, সৈন্যবাহিনীর অফিসার কেউই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি, জার্মানিতে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য তৈরি হয়নি। ১৯১৯- ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জার্মানিতে এত বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলেছিল যে সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। ভাইমার প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হল এর দলব্যবস্থা (one of the greatest sources of weakness in the Republic was the operation of the party system)| অনেকগুলি দল ও উপদল ছিল, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা ছিল, বহু দলের সদস্যদের নিয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করা হত (keeping a coalition intact and working was often impossible)। ১৯১৯-১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মানিতে একুশটি মন্ত্রীসভা গঠিত হয় (Between February 1919 and January 1933 there were twenty-one different Reich cabinets)। ভাইমার প্রজাতন্ত্র জার্মানির যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনে ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯২৪-২৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জার্মানির অর্থনীতিতে যে আপাত সমৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল তার পেছনে ছিল মার্কিন পুঁজিপতিদের লগ্নি করা মূলধন। যে মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা শুরু হয়ে যায় জার্মানিতে মার্কিন বিনিয়োগও বন্ধ হয়। জার্মানির ব্রুনিং সরকার ব্যয় সংকোচের নীতি অনুসরণ করে জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম, বেকারভাতা, সরকারি কর্মচারীদের বেতন, পেনশন ইত্যাদি কমিয়েছিল। জার্মানিতে বেকারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ছয় মিলিয়ন, শিল্পপতি ও শ্রমিক সকলে সরকারের সমালোচনা করতে থাকে। এই পটভূমিকায় হিটলার ও তার নাৎসি দল জাতীয় সম্মানরক্ষা, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও সাম্যবাদীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। শিল্পপতি, বণিক, ভূস্বামী, আমলাতন্ত্র ও সৈন্যবাহিনী নাৎসিদের সমর্থন করতে থাকে কারণ তারা সাম্যবাদী বিপ্লবের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। গর্ডন ক্রেগ জানিয়েছেন ভাইমার প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতার একটি বড়ো কারণ হল এই সরকার জার্মানির নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে পারেনি (the republican parties did not make an effective appeal to the post war generation)। জার্মানিতে মধ্যপন্থী দলগুলি নিয়ে মধ্যপন্থী কোয়ালিশন গঠন করা সম্ভব হয়নি। ছোটো ছোটো দলগুলি সংসদীয় পদ্ধতিও ঠিকমত মেনে চলত না, পাটির নির্দেশে চলত। নিম্নকক্ষ রাইখস্ট্যাগ দায়িত্বশীল সংসদ হিসেবে কাজ করতে পারেনি। চরম দক্ষিণপন্থী ও চরম বামপন্থীদের পরাস্ত করে প্রজাতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বামপন্থীদের দমন করা সম্ভব হলেও, দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীদের দমন করা সম্ভব হয়নি কারণ দেশবাসী তা পছন্দ করেনি। মহামন্দা শুরু হলে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সংঘাত বেড়েছিল, অর্থনৈতিক দুর্দশার সুযোগ নিয়ে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলি ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল।

মহামন্দা (১৯২৯-১৯৩৪)

ই. এইচ. কার বলেছেন যে, মহামন্দার কারণগুলি সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি, অর্থনীতিবিদরা এসম্পর্কে একমত হতে পারেনি। ডেভিড টমসন এর তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সংকোচন, অস্বাভাবিক ফাটকাবাজি এবং ক্ষতিপূরণ সমস্যা আর এর সঙ্গে ছিল বিশ্বব্যাপী আস্থার সংকট। প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্বে এক ধরনের আপাত সমৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল। মার্কিন পুঁজিপতিরা ঋণের জোগান দিয়েছিল, জার্মানি ৯০০ মিলিয়ন ঋণ পেয়েছিল, যুদ্ধ ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০০ মিলিয়ন ব্যয় করেছিল, বাকিটা তার শিল্পে ও পুনর্গঠনের কাজে বিনিয়োগ করেছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতো দেশ ক্ষতিপূরণ অর্থ থেকে তাদের যুদ্ধ ঋণ শোধ করেছিল। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা শুরু হয়েছিল, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে আমেরিকা ও কানাডার কৃষি অর্থনীতিতে তার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যদেশ থেকে পণ্য কিনত না, যারা মার্কিন পণ্য কিনত তাদের সোনা দিয়ে পণ্য বিনিময় করতে হত। ইউরোপীয় দেশগুলি সোনা দিয়ে তাদের ঋণ পরিশোধ করত। ইউরোপের অনেক দেশের স্বর্ণভাণ্ডার নিঃশেষিত হয়ে যায়, সোনা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। একটি দুষ্ট চক্র তৈরি হয়েছিল (It was a vicious circle), বিভিন্ন দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক এই দুষ্ট চক্র নষ্ট করে দিয়েছিল। আমেরিকায় কৃষিজ পণ্যের দাম কমলে শিল্পপণ্যের চাহিদা কমেছিল (The American farmer, faring badly, cut down his own expenditure, and American industry began to feel the pinch)।

শিল্পপণ্যের চাহিদা কমলে উৎপাদন কমানো হয়, শেয়ার বাজারের ওপর তার প্রভাব পড়েছিল। শেয়ারের দাম ক্রমাগত পড়তে থাকে, সরকার ও ব্যাংকগুলি পণ্যমূল্য হ্রাস রোধ করতে পারেনি (It was the bubble of speculation which brought the real crash, and it burst on wall street in October 1929)। আমেরিকার শেয়ার বাজারের পতন ঘটলে সারা পৃথিবীতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। এই মন্দা সরকারি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও শিল্পকে শুধু প্রভাবিত করেনি, খাদ্য ও কাঁচামাল উৎপাদনকারীরা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের পর গম, তুলো, কফি, চিনি, মাংসের দাম অস্বাভাবিক হারে কমেছিল, উৎপাদকদের সর্বনাশ হয়ে হয়ে যায়। অর্থনৈতিক সংকট পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মার্কিন পুঁজিপতিরা ঋণ দিতে অস্বীকার করেছিল, স্বল্পমেয়াদি ঋণ আদায় করেছিল। সবচেয়ে অসুবিধার মধ্যে পড়েছিল ইউরোপের ঋণগ্রস্ত দেশগুলি যারা আমেরিকার কাছ থেকে ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করত। পণ্যের দাম এত নেমে গিয়েছিল যে তা দিয়ে মার্কিন ঋণ শোধ করা সম্ভব ছিল না। তারা সোনা দিয়ে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে থাকে। নিজেদের কৃষি ও শিল্প-বাণিজ্যকে রক্ষার জন্য এইসব দেশ শুল্ক বসিয়ে ভরতুকি দিয়ে অথবা কোটার ব্যবস্থা করে বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের পথ ধরেছিল (Economic nationalism and state regulation of trade had come to stay)। বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য কমেছিল (Trade between nations shrank rapidly and steadily from the end of 1929 until 1934, and in an ever-contracting spiral)। ইউরোপের অর্ধেক দেশ দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল, বাকি অর্ধেক দেউলিয়া অবস্থার দিকে এগোতে থাকে। এর অনিবার্য পরিণতি হল দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়, দারিদ্র্য বেড়েছিল (As bankruptcies occurred, and factories slowed down production or went out of business, millions of workers were thrown out of work)।

বিশ্বব্যাপী যে সংকট তৈরি হল তাকে বলা হয়েছে সমৃদ্ধির মধ্যে দারিদ্র্য (poverty amidst plenty)। ডেভিড টমসন জানিয়েছেন যে, একমাত্র মহাযুদ্ধের অভিঘাতের সঙ্গে এর তুলনা করা যায় (In its shattering effect upon European prosperity and stability, the great Depression was comparable with the Great War itself)। অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত ব্যাংক ক্রেডিট-আনস্টান্ট দেউলিয়া হয়ে যায়, জার্মানির ব্যাংকগুলিও বন্ধ হয়ে যায়, তিন বছরে পাঁচ হাজার মার্কিন ব্যাংক বন্ধ হয়েছিল, বিদেশি লগ্নিকারীরা জার্মানিকে ঋণ দিতে অস্বীকার করেছিল। তার আর্থিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে, প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ জরুরি আইন জারি করে সরকারি ব্যয় কমান, কৃষিতে ভরতুকির ব্যবস্থা করেন, নতুন কর বসান। মহামন্দার সময় জার্মানি ও অস্ট্রিয়া অর্থনৈতিক সংঘ স্থাপন করে তাদের সমস্যা সমাধানের কথা ভেবেছিল, ফ্রান্সের বাধাদানের জন্য তা সম্ভব হয়নি। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনেক দেশ মনে করেছিল এটি হল একটি সাময়িক, অস্থায়ী ঘটনা, অল্পদিনে তাদের ভুল ভেঙে যায়। ইংল্যান্ডে জাতীয় সরকার গঠিত হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হুভার ঋণ আদায়ের ওপর ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দেন (Hoover’s moratorium)। হুভার সরকারি ঋণ পরিশোধ বন্ধ রেখেছিলেন, বেসরকারি ঋণের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার স্বর্ণমান বজায় রেখে চলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল, বেশিরভাগ দেশ স্বর্ণমান ত্যাগ করেছিল। ফ্রান্স, ইতালি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, রুমানিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বর্ণমান বজায় রেখেছিল। অর্থনৈতিক সংকট মোচনের জন্য বিভিন্ন দেশ তিনটি পরিকল্পনার কথা ভেবেছিল।

মুদ্রা ব্যবস্থা ও বিনিময় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার অতিরিক্ত ক্ষমতা হাতে তুলে নিয়েছিল। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে তারা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে চেয়েছিল, অবাধ, মুক্ত অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ করার প্রস্তাব ছিল। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন দেশ আঞ্চলিক সংগঠন তৈরি করে তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কথা ভেবেছিল। তৃতীয়ত, বহু দেশ আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ করে মহামন্দার মোকাবেলা করার কথা ভেবেছিল। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে লসান (Lausanne) সম্মেলনে যুদ্ধ ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়, জার্মানি ক্ষতিপূরণ দানে অক্ষমতা জানালে তাও বাতিল হয়ে যায় (the year 1932 saw the last act in that confused drama of reparation and inter-allied debts which had tormented the world for more than ten years)।

মহামন্দাকে অনেকে বলেছেন সভ্যতার সংকট, পুঁজিবাদের সংকট (It was the breakdown of capitalism itself)। বিভিন্ন দেশের শিল্প উৎপাদন এক-দশমাংশে এসে দাঁড়িয়েছিল, কাঁচামালের দাম কমেছিল ৫০ শতাংশ, সারা পৃথিবীতে তিন কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছিল, লেনদেনে সংকট চলেছিল। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছিল। অতি-উৎপাদনকে অনেকে এই বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অনেকে একে অস্থায়ী বাণিজ্যিক মন্দা হিসেবে গণ্য করেছিল (a particularly severe example of cyclical trade depressions)। অবশ্যই মহামন্দা ছিল তার চেয়ে অনেক বড়ো ঘটনা। ১৯২৯-৩৪ খ্রিস্টাব্দের সংকট বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিভিন্ন আকার নিলেও আসলে এটি ছিল আস্থার সংকট। যুদ্ধোত্তরকালে মার্কিন পুঁজির ওপর প্রতিষ্ঠিত আপাত সমৃদ্ধি এই বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল, এই সমৃদ্ধির কোনো স্থিতিশীল ভিত্তি ছিল না। মহামন্দার মোকাবেলায় গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল, মহামন্দার জন্য জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি সমর্থন কমেছিল, জঙ্গি, একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থা অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান করতে পারবে এমন ধারণা গড়ে উঠেছিল (The almost universal and almost simultaneous appearance of fascist movements throughout Europe in the early 1930s was the most ominous political consequence of the Great Depression)। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নাগরিক অধিকার, উদারনীতিবাদ ইত্যাদির প্রতি আস্থা কমেছিল। ইউরোপীয় সভ্যতা এমন সংকটের মুখে আগে কখনও পড়েনি। অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্য থেকে সংকট তৈরি হয়েছিল, বাইরে থেকে কোনো বিপদ আসেনি।

মানুষ নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য এই মানসিক সংকটের জন্য দায়ী ছিল। এই অর্থনৈতিক সংকটকে অনেকে ইউরোপীয় সভ্যতার নৈতিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন। পশ্চিমি সভ্যতা উদারনৈতিক ব্যবস্থায় আস্থা স্থাপন করে লাভবান হয়েছিল, ১৯৩০ দশকে মহামন্দার সময় এই আদর্শ ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ইউরোপের মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছিল কারণ সেখানে মহামন্দার প্রভাব পড়েনি। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি নিজেদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করত, পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে তাদের লেনদেন ছিল খুবই কম। পশ্চিমি পুঁজিপতিরা ধরে নিয়েছিল উৎপাদন হল সভ্যতা ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি, অতি-উৎপাদন যে বিপর্যয় ঘটাতে পারে সে ধারণা তাদের ছিল না। শুধু অপর্যাপ্ত উৎপাদন নয়, সম্পদের সুষম বণ্টন হল জাতির অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাপকাঠি। মহামন্দা সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহ দিয়েছিল। অনগ্রসর কৃষিনির্ভর দেশগুলিতে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল, কৃষিজ পণ্যের দাম এত নেমে যায় যে, কৃষকের ঋণ ও করের বোঝা বেড়েছিল। ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। মহামন্দার পটভূমিকায় ভারতে গান্ধিজির নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

মহামন্দার প্রভাবে রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। ইউরোপীয় দেশের সরকারগুলি অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হতে থাকে। মহামন্দা অবাধ মুক্ত অর্থনীতি ও অবাধ বাণিজ্যের অবসান ঘটিয়েছিল। ইউরোপে আন্তর্জাতিক মানসিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রত্যেক রাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে থাকে। মহামন্দার ধাক্কায় যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলন বসেছিল, সম্মেলন স্থিতিশীল মুদ্রা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছিল। বিনিময়, শুল্ক, বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ে কোন আন্তর্জাতিক চুক্তি করা সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ও বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণকে সবদেশ মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইংল্যান্ডে পুনরুজ্জীবনের সংকেত পাওয়া যায়, যুদ্ধ ঋণ ৩.৫ শতাংশ হারে জাতীয় ঋণে রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, বাণিজ্য বেড়েছিল, এজন্য রুজভেল্টের নিউ ডিল ও ডলারের অবমূল্যায়ন অনেকখানি দায়ী ছিল। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে মহামন্দা কার্যত শেষ হয়েছিল (The year 1933 may be said to mark the end of that specific period of contemporary history known as the world economic crisis)

ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। যেসব দেশ স্বর্ণমান ত্যাগ করেছিল তারাই প্রথম মহামন্দা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। বিভিন্ন দেশ নিজেদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে মহামন্দা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস চালিয়েছিল। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংগঠনসমূহ তাদের গুরুত্ব হারিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছিল। যেসব দেশ স্বর্ণমান আঁকড়ে ছিল সেসব দেশে সমৃদ্ধি এসেছিল দেরিতে। ১৯৩৩ থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা শেষ হয়েছিল। তিন বছর ধরে পশ্চিমি নেতারা এই সংকটের সমাধান খুঁজে বেড়িয়েছিল, কিন্তু সমাধান মেলেনি। ১৯৩৩ থেকে অর্থনৈতিক সংকট প্রশমিত হলে রাজনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল, জাপান ও জার্মানি লিগের সদস্যপদ ত্যাগ করেছিল। নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ব্যর্থ হয়, এসব ঘটনার ওপর মহামন্দার প্রভাব পড়েছিল।

জার্মানিতে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের পতন ও নাৎসিবাদের উত্থান

প্রথম মহাযুদ্ধের পর জার্মানিতে অর্থনৈতিক সংকট ও হতাশা দেখা দিয়েছিল, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ সমস্যা এজন্য অনেকখানি দায়ী ছিল। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা শুরু হলে জার্মানির ওপর তার প্রভাব পড়েছিল। জার্মানি সহ ইউরোপের অনেক দেশ এসময় মার্কিন লগ্নির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। মহামন্দার সময় মার্কিন পুঁজিপতিরা ইউরোপে নতুন করে অর্থলগ্নি করতে অস্বীকার করলে সংকট তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। জার্মানির প্রজাতান্ত্রিক সরকার এই মহামন্দার ধাক্কা সামলাতে পারেনি। সরকার ব্যয় সংকোচ করে ও নতুন কর বসিয়ে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিল কিন্তু শিল্পে মন্দা দেখা দেয়, বেকারের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। গণতন্ত্র বিরোধী শক্তিগুলি এই ধারণা প্রচার করেছিল যে প্রজাতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের ফলে জার্মানির পরাজয় ও অবমাননা ঘটেছে, দারিদ্র্য ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। সমাজতন্ত্রীরা ক্ষমতার লোভে জার্মানির পক্ষে অবমাননাকর ভার্সাই চুক্তি গ্রহণ করেছে। এই চুক্তির জন্য জার্মানি তার সাম্রাজ্য হারিয়েছিল। ৩৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ জার্মানির কাঁধে চাপানো হয়। জার্মানির নিরস্ত্রীকরণের ব্যবস্থা হয়েছিল, জার্মানির শিল্প সমৃদ্ধ সার অঞ্চল বিজয়ী শক্তিবর্গের হাতে তুলে দিতে হয়। ভার্সাই চুক্তিকে জার্মান জাতি আরোপিত চুক্তি হিসেবে গণ্য করেছিল (dictated peace), আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি হয়নি। ফ্রান্সের শত্রুতার জন্য ভাইমার প্রজাতন্ত্র গোড়ার দিকে সাফল্য লাভ করতে পারেনি। ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকার দেশে ভয়ংকর মুদ্রাস্ফীতি ডেকে এনেছিল। জার্মানির মুদ্রা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত চরম বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়।

এই পটভূমিকায় ফ্রান্স ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য জার্মানির শিল্প- সমৃদ্ধ রূঢ় অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। জার্মানি নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের পথ ধরেছিল, বিদেশিদের সঙ্গে অসহযোগিতা করেছিল। এর পরের পাঁচ বছর জার্মানির অবস্থার খানিকটা উন্নতি হয়, শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। স্ট্রেসম্যান লোকার্নো চুক্তি (১৯২৫) করে জার্মানির পশ্চিম সীমান্ত মেনে নেন, ফ্রান্স ও পশ্চিমি শক্তিবর্গকে আশ্বস্ত করেন। পশ্চিমি শক্তিবর্গ ডাওয়েজ ও ইয়াং পরিকল্পনার মাধ্যমে জার্মানির ক্ষতিপূরণ সমস্যা সমাধানের প্রয়াস চালিয়েছিল, জার্মানি বিদেশ থেকে ঋণ পেয়েছিল। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে স্ট্রেসম্যানের মৃত্যুর পর থেকে জার্মানিতে আবার নতুন করে সংকট শুরু হয়ে যায়। সৈন্যবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিনার একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন কারণ রাইখস্ট্যাগে কোনো দলেরই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না, অপর দিকে মহামন্দার ধাক্কায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল।

ন্যাশনাল সোসালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হলেন এডলফ হিটলার। গর্ডন ক্রেগ মনে করেন হিটলারের ক্ষমতা দখলের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল দুটি ঘটনা-একটি হল মহামন্দা, জার্মান অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব এবং অপরটি হল জার্মানিতে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দুর্বলতা। জার্মানির গণতান্ত্রিক সংবিধানের ত্রুটির জন্য গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী হতে পারেনি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে হিটলারের নাৎসি দল ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার একটি ছোটো শহরে হিটলারের জন্ম হয়, পিতা ছিলেন একজন সামান্য সরকারি কর্মচারী। শিল্পকলার প্রতি তার উৎসাহ ছিল, কিন্তু তিনি শিক্ষার বিশেষ সুযোগ পাননি। তেইশ বছর বয়সে তিনি অস্ট্রিয়া ছেড়ে মিউনিখে চলে আসেন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিনি ব্যাভেরিয়ার সৈন্যদলের করপোরাল হিসেবে লড়াই করেন, বীরত্বের জন্য পুরস্কৃত হন। যুদ্ধের পর মিউনিখের একটি ছোট্ট রক্ষণশীল, জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দেন, এই গোষ্ঠীর নাম ছিল জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ন্যাশনাল সোসালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (NSDAP)। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ন্যাশনাল সোসালিস্ট দলের সর্বময় কর্তা বা ফুয়েরার (Fueherer) হন। এই সময় তিনি নিজস্ব একটি অনুগত বাহিনী গঠন করেন, এরা ব্রাউন শার্ট পরিধান করত, এদের বলা হয় ঝটিকা বাহিনী (storm troopers)। সমাজতন্ত্রীরা লিবনেক্ট ও রোজা লুক্সেমবার্গের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর অনেক অফিসার প্রজাতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন। ভাইমার প্রজাতন্ত্র যুদ্ধ পরবর্তীকালের বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দমনে ব্যর্থ হয়েছিল। হিটলার উৎসাহিত হয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন (১৯২৩), কিন্তু এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়, হিটলার বন্দি হন, ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন। কারাবাসে থাকাকালীন তার বিখ্যাত আত্মজীবনী মেইন ক্যাম্ফ (Mein Kampf) রচনা করেন, এই গ্রন্থখানিকে বলা হয়েছে নাৎসি বাইবেল। এই গ্রন্থে পাওয়া যায় জার্মানির তৎকালীন অবস্থা, নাৎসি রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়ে হিটলার নতুন উদ্যমে পার্টি ও জনমত গঠনের কাজে মন দেন। তিনি প্রজাতন্ত্র, সাম্যবাদ ও ইহুদি বিরোধী অবস্থান নেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে নাৎসি দলের সদস্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১,৭৮,০০০। তিনি সরকারি শাসনযন্ত্রের মতো একটি পার্টি শাসন যন্ত্র নির্মাণ করেন, তার পার্টিতে বৈদেশিক দপ্তর, সৈন্যবাহিনী সবই ছিল। পার্টির অধীনে তিনি শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবী সৈন্যবাহিনী গঠন করেন, এর নাম দেন এস. এস. (Schutz-staffel)। এই সুসংগঠিত দলের প্রধান নেতা হলেন হিটলার। তিনি ছিলেন দলের নেতা, স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর নেতা এবং ন্যাশনাল সোসালিস্ট লেবার অর্গানিজেশনের চেয়ারম্যান। কোনো নেতা হিটলারকে অমান্য করতে পারতেন না, হিটলার এরকম ক্ষেত্রে তার বিশ্বস্ত অনুচরদেরও সরিয়ে দিতেন। ক্ষমতা দখলের পর, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন রাত্রিবেলা (The Night of the Long Knives) তিনি তার বিরোধীদের সরিয়ে দেন, অনেকে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস থেকে জার্মানির ব্রুনিং সরকার সংকটের মধ্যে পড়েছিল। প্রথমত, হিটলারের অনুগামী ব্রাউন শার্টস দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছিল, দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের কার্যকাল শেষ হয়ে এসেছিল, তার নির্বাচনের জন্য সরকারকে ব্যবস্থা করতে হবে। মহামন্দার মধ্যে নির্বাচন জাতীয় অর্থনীতিতে বিপর্যয় আনবে এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। নির্বাচনে হিটলারকে পরাস্ত করে বৃদ্ধ হিন্ডেনবার্গ জয়ী হলেন ঠিকই কিন্তু দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। ব্রুনিং বৈদেশিক নীতিতে সাফল্য এনে তার সরকারের স্থিতিশীলতা আনতে চেয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমি শক্তিবর্গের কাজে দুটি প্রস্তাব রেখেছিলেন-ক্ষতিপূরণের অবসান এবং সামরিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। তিনি জার্মানি ও অস্ট্রিয়াকে নিয়ে অর্থনৈতিক সংঘ গঠন করতে চেয়েছিলেন, ফ্রান্সের বাধাদানের জন্য তা ব্যর্থ হয়। ফ্রান্সের জন্য জার্মানি হুভার মোরেটোরিয়ামের (Hoover Moratorium) সুযোগ নিতে পারেনি। হিটলারের ঝটিকা বাহিনী নিষিদ্ধ করার দাবি উঠলে তিনি তা মেনে নিতে বাধ্য হন। এসব সত্ত্বেও তার সরকার রাইখস্ট্যাগে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় (১৯৩২)।

পরবর্তী আট মাস জার্মানির রাজনীতি ছিল অত্যন্ত জটিল, অস্থির ও সংকটপূর্ণ। তিনজন ব্যক্তি এই সময়কার রাজনীতির ছিলেন আসল নায়ক-সৈন্যবাহিনীর অফিসার শ্লেচার, ব্যারন ফ্রানজ ভন পাপেন ও হিটলার। শ্লেচারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ পাপেনকে জার্মানির চ্যান্সেলর নিযুক্ত করেন। এই তিন জনেই গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। পাপেন হিটলারের ঝটিকা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, প্রাশিয়ার সমাজতন্ত্রী সরকারকে বরখাস্ত করেন। তিনি জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ সমস্যা থেকে মুক্ত করেন এবং জার্মানির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে এই অভিযোগে নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন থেকে প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ও নভেম্বর মাসে জার্মানিতে দুবার নির্বাচন হয়, পাপেন আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেননি। পাপেন-কে সরিয়ে প্রেসিডেন্ট শ্লেচারকে ডিসেম্বর মাসে (১৯৩২) চ্যান্সেলর নিযুক্ত করেন। তিনি কৃষি অর্থনীতি ও শিল্পে ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু রাইখস্ট্যাগে সমাজতন্ত্রীদের সমর্থন তিনি পাননি। ইতিমধ্যে পাপেন হিটলারের সঙ্গে আপস করে নেন, ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি হিন্ডেনবার্গ হিটলারকে কোয়ালিশন সরকারের চ্যান্সেলর নিযুক্ত করেন। যদিও হিটলারের মন্ত্রীসভায় মাত্র তিনজন নাৎসি দলের মন্ত্রী ছিল, নাৎসিরা ঐ দিন রাত্রিবেলায় বার্লিন শহরে উৎসবের আয়োজন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে তারাই হল জার্মানির নতুন শাসক দল।

নাৎসি দলের প্রভাব বিস্তার-নাৎসি রাষ্ট্রব্যবস্থা

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি নাৎসিরা ক্ষমতা লাভ করলেও আইনসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এজন্য চ্যান্সেলর হিটলার খুব সতর্কভাবে এগিয়েছিলেন। হিটলার তার অনুচরদের নিয়ে গোয়েরিং-এর নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ সহায়ক বাহিনী গঠন করেন। এদের দিয়ে তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পর্যুদস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগে, হিটলার এই ঘটনার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করেন এবং রাষ্ট্র ও জনগণকে রক্ষার নামে (For the protection of the people and the state) প্রেসিডেন্টের আদেশ জারি করে সংবিধানের নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত ধারাটি বাতিল করে দেন। এই সময় থেকে হিটলারের অনুগামীরা পরিকল্পিতভাবে সাম্যবাদী, সমাজতন্ত্রী ও উদারনীতিবাদীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। সারা দেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়। এসব সত্ত্বেও মার্চ মাসের নির্বাচনে (১৯৩৩) নাৎসি দল রাইখস্ট্যাগে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে হিটলার আইনসভায় একটি বিশেষ আইন পাস করিয়ে নেন (Enabling Act)। এই আইনবলে মন্ত্রীসভা আইন-প্রণয়ন ও বাজেট সংক্রান্ত বিশেষ ক্ষমতা লাভ করেছিল। এই আইনবলে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসেই হিটলার জার্মানির ডিক্টেটর হয়ে বসেছিলেন।

বিশেষ ক্ষমতা লাভ করে হিটলার জার্মানির প্রশাসনিক ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। তিনি প্রথমে জার্মানির অঙ্গরাজ্যগুলির গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেন। এই সব অঙ্গরাজ্যের সরকার বাতিল করে তিনি কেন্দ্রের কাছে দায়বদ্ধ গভর্নরদের নিয়োগ করেন। জার্মান ভাষায় এই প্রক্রিয়ার নাম হল গ্লিসচালটুঙ (Gleichschaltung), তিনি জার্মানিতে একনায়কতন্ত্রী কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। সব রাজনৈতিক দলকে একে একে নিষিদ্ধ করা হয়। রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগানোর অপরাধে কমিউনিস্ট দল বেআইনি ঘোষিত হয়, সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি তিনি ভেঙে দেন। স্ট্রেসম্যানের পিপলস পার্টি বা হিটলারের সহযোগী ন্যাশনালিস্ট পার্টি কেউই রেহাই পায়নি। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। হিটলার ঘোষণা করেন জার্মানিতে একমাত্র রাজনৈতিক দল হল ন্যাশনাল সোসালিস্ট পার্টি (নাৎসি দল), জার্মানিতে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রয়াসকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়।

শুধু রাজনৈতিক দলগুলিকে ধ্বংস করে হিটলার ক্ষান্ত হননি, জার্মানির সমস্ত শ্রমিক সংগঠনগুলি তিনি ভেঙে দেন। তার দলের নেতৃত্বে একটি লেবার ফ্রন্ট গঠিত হয়। এই লেবার ফ্রন্টের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করার অধিকার ছিল না। ফ্রন্টের কাজ ছিল শ্রমিকদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা, সাম্যবাদী প্রভাব মুক্ত করা এবং নাৎসি দলের সঙ্গে সহযোগিতা করা। হিটলার উপলব্ধি করেছিলেন ভাইমার প্রজাতন্ত্রের ব্যর্থতার একটি কারণ হল আমলাতন্ত্রের অসহযোগিতা। তিনি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাননি, বিশেষ ক্ষমতাবলে তিনি জার্মানির সিভিল সার্ভিসকে নতুন করে গঠন করেন। যেসব আমলা নাৎসিদলের প্রতি অনুগত ছিল না বা প্রকৃত জার্মান রক্তের নয় তাদের আমলাতন্ত্র থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই নীতি হিটলার বিচার বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছিলেন। রাজনৈতিক অপরাধের বিচারের জন্য পিপল’স ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। বিচারের ক্ষেত্রেও হিটলার হস্তক্ষেপ করতে থাকেন, তার নিজস্ব পুলিশ বাহিনী ‘গেস্টাপো’ যে-কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে আটক করে রাখতে পারত। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে হিটলার এসব সংস্থাকে আইনের আওতার বাইরে বলে ঘোষণা করেন।

ক্ষমতালাভের পর হিটলার ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান। পোপের সঙ্গে চুক্তি করে তিনি জার্মানির রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা দেন। অল্পকাল পরেই তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়, ক্যাথলিক চার্চ, চার্চ নেতা ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে হিটলারের ক্যাথলিক নীতির বিরুদ্ধে পোপ একাদশ পায়াস (Pius XI) প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। হিটলারের দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে জার্মানির ক্যাথলিকরা প্রতিবাদ জানাতে থাকে, জার্মানির প্রোটেস্ট্যান্টরাও তার দমনমূলক নীতি থেকে রেহাই পায়নি। তিনি তাদের নাৎসি জাতি নীতি এবং নাৎসি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে বলেন। যাজকরা আপত্তি জানালে তাদের বন্দি শিবিরে পাঠানো হয়। যেসব যাজক আনুগত্যের শপথ নিয়েছিল তারা টিকে থাকে। চার্চের পর হিটলার জনমত ও সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেন, সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে রাইখ প্রেস আইন পাস করে তিনি সংবাদপত্রের অজার্মান সম্পাদক নিয়োগ নিষিদ্ধ করে দেন। জার্মান বেতারকে নাৎসি পার্টির প্রচার যন্ত্রে পরিণত করা হয়। জোসেফ গোয়েবলস তার প্রচার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন, চলচ্চিত্রসহ সমস্ত প্রচার মাধ্যমগুলির ওপর তিনি নাৎসি দলের কর্তৃত্ব স্থাপন করেন।

নিউম্যান জানিয়েছেন যে, জার্মানিতে নিজের ক্ষমতা সুরক্ষিত করার জন্য হিটলার নাৎসি দল ও সৈন্যবাহিনীর ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। নাৎসি দল থেকে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেন। যারা মনে করেছিলেন হিটলার একজন সমাজতন্ত্রী তাদের ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। পুঁজিপতি, বণিক, ভূস্বামী, সামরিক অফিসার ও রাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তার ঝটিকা বাহিনীর প্রধান প্রতিবাদ করলে গুপ্তঘাতকের হাতে তিনি নিহত হন। প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে হিটলার দলের মধ্যে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের মৃত্যু হলে হিটলার একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলরের পদ গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাষ্ট্র প্রধান এবং সৈন্যবাহিনীর প্রধান, তার উপাধি হয় ফুয়েরার। সৈন্যবাহিনীর সমস্ত অফিসার ও সৈনিকদের ফুয়েরারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে হত। সেনাপতিদের নিয়ে তিনি সুপ্রিম কম্যান্ড অব দ্য আর্মড ফোর্সেস গঠন করেন, হিটলার হন তার প্রধান। ফুয়েরারের হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল।

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হিটলার জার্মানির সর্বাধিনায়ক হয়ে বসেছিলেন। রাষ্ট্র, দল, আমলাতন্ত্র, সৈন্যবাহিনী, শ্রমিক সংস্থা ও প্রচার মাধ্যমগুলির ওপর তার একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপিত হয়। হিটলার জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র এই দুই আদর্শের কথা বলেছিলেন। তার জাতীয়তাবাদের অর্থ হল সব জার্মানদের নিয়ে বৃহত্তর জার্মানি গঠন করা, সেই বৃহত্তর জার্মানিতে বিদেশিরা থাকবে না, ইহুদিদের কোনো স্থান হবে না (Nationalism meant the union of all Germans within a greater Germany and the expulsion from the integrated Reich of all alien elements, especially Jews)। হিটলারের সমাজতন্ত্রের প্রতি কোনো আনুগত্য ছিল না। তার তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কারও অনার্জিত আয় থাকবে না, সুদের ওপর নির্ভর করা চলবে না, সব অর্থনৈতিক সংগঠন ও সংস্থা করপোরেটিভ রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করে যাবে (Socialism meant abolition of income unearned by work, and abolition of the thraldom of interest, a corporative state, and organization by that state of all economic and social life in the cause of state power)। ক্ষমতালাভের চার বছরের মধ্যে হিটলার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করেছিলেন। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দুগুণ হয়েছিল, বেকারের সংখ্যা ৬০ লক্ষ থেকে কমে ১০ লক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল। জার্মানির অস্ত্রসজ্জা ও সমরাস্ত্র উৎপাদন থেকে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভর করার জন্য তিনি চার বছরের পরিকল্পনা (Four-year plan) গ্রহণ করেন। হিটলারের জনপ্রিয়তা বেড়েছিল, জার্মানি সাময়িকভাবে মুদ্রাস্ফীতি, মন্দা, বেকারত্ব ও হতাশা থেকে মুক্তি পেয়েছিল।

হিটলারের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। ঐ সময় থেকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত তিনি জার্মান পররাষ্ট্রনীতির নিয়ন্তা ছিলেন। তার আত্মজীবনী মেইন ক্যাম্ফ-এ তার পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা পাওয়া যায়। হিটলার ভার্সাই চুক্তির অবমাননাকর শর্তগুলিকে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি জার্মানির ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের সীমান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাননি। তিনি জার্মান রাইখের সম্প্রসারণে বিশ্বাসী ছিলেন (Lebensraum) (এই জার্মান শব্দটির অর্থ হল living space, ভালোভাবে বাঁচার জন্য যথেষ্ট অঞ্চল।)। জার্মান জাতির স্বাভাবিক সম্প্রসারণের ক্ষেত্র হল পূর্ব ইউরোপ। স্লাভ অধ্যুষিত এই অঞ্চল ছিল উর্বর এবং সামরিক দিক থেকে সুরক্ষিত। এই অঞ্চলে জার্মান আধিপত্য স্থাপিত হলে জার্মানি দুদিক থেকে লাভবান হবে। স্লাভ আধিপত্যের আশঙ্কা থেকে জার্মানরা মুক্তি পাবে, আবার এই অঞ্চলে জার্মান জাতি তার স্বাভাবিক প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবে। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে বহু জার্মান বাস করত, হিটলার এদের নিয়ে বৃহত্তর জার্মানি গঠন করতে চেয়েছিলেন। তার বৃহত্তর জার্মানিতে ইহুদি, পোল, ডেন ও অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর স্থান হবে না (Germany must expand eastward, effectively removing slav threat by doing so, and bringing under control the most fertile and strategically the most secure land in Europe)। হিটলার মনে করতেন যে জার্মানরা হল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি, জার্মানির নিয়তি হল বিশ্বে নেতৃত্ব দান করা, শাসন করা (Hitlerism evolved a complete doctrine of racialism which presented Germans as the master race (Herrenvolk) with a historic destiny to rule the world once it had purged itself of contamination by Jews, Christians, liberals, socialists and communists)।

হিটলারের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি ছিল যুদ্ধের অনিবার্যতা (The idea of war ran like a red thread throughout the book (Mein Kampf))। হিটলার মনে করেন ফ্রান্সের শত্রুতা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছে (Hitler believed that war was made inevitable by France), সুতরাং যুদ্ধের জন্য জার্মানিকে প্রস্তুতি নিতে হবে। কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম যুদ্ধের প্রস্তুতি না নিয়ে ভুল করেছিলেন। এজন্য সমস্ত অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা দূর করে জার্মানিকে সমস্ত শক্তি নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। বৈদেশিক নীতির লক্ষ্য পূরণে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগোতে হবে (Germany must be able to pursue its foreign aims with a united will and determination)। যুদ্ধকে অনিবার্য বলে ধরে নিয়ে হিটলার প্রকৃত বন্ধুর অনুসন্ধানে মন দেন। জার্মানির প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কার বন্ধুরা যথেষ্ট দক্ষ ও যোগ্য ছিল না। হিটলার মনে করেন জার্মানির সবচেয়ে কার্যকর বন্ধু হতে পারে ইতালি ও গ্রেট ব্রিটেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে হিটলার ইতালির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে সক্ষম হন। ইংল্যান্ডের বন্ধুত্বলাভের জন্য তিনি সবরকম ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি ছিলেন। উপনিবেশ, নৌশক্তি বা বিশ্ববাজার নিয়ে তিনি ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে চাননি। তিনি ইংল্যান্ডের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফ্রান্সকে নিঃসঙ্গ ও ধ্বংস করার কথা ভেবেছিলেন (to isolate France and make possible its destruction)।

পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্যগুলি পূরণের জন্য হিটলার আরও কতকগুলি আনুষঙ্গিক সিদ্ধান্ত নেন, এর একটি হল তার জাত্যাভিমান। অন্য দুটি দিক হল তার ইহুদি বিদ্বেষ ও সাম্যবাদ বিরোধিতা। হিটলার মনে করেন জার্মানরা হল বিশুদ্ধ আর্য, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য তিনি জার্মানির পার্শ্ববর্তী জার্মান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি জয় করে বৃহত্তর জার্মানি গঠনের পরিকল্পনা করেন। জার্মান সাম্রাজ্যে জার্মান ছাড়া স্লাভ, পোল, ডেন প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস করত। জার্মান জাতির বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য তিনি এদের বিতাড়নের পরিকল্পনা করেন। ইহুদিদের সম্পর্কে হিটলারের প্রবল জাতি বিদ্বেষ ছিল। জার্মানির বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনে ইহুদিরা আধিপত্য স্থাপন করেছে, ইহুদিরা জার্মান জাতিকে শোষণ করছে, তিনি জার্মানিকে এদের আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। হিটলার সাম্যবাদের ঘোর শত্রু ছিলেন, এই আদর্শবাদকে তিনি বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। সাম্যবাদী রাষ্ট্র রাশিয়াকে তিনি জার্মান সাম্রাজ্যভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিলেন, সাম্যবাদের সঙ্গে জার্মানির সংঘাত ছিল অনিবার্য। এসব লক্ষ্য সামনে রেখে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত হিটলার জার্মানির পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেছিলেন।

পররাষ্ট্রনীতির প্রথম পর্বে হিটলার তিনটি লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছিলেন। তার গতিশীল পররাষ্ট্রনীতির জন্য তিনি অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতির ওপর জোর দেন। তার আগেকার জার্মান সরকার যেসব চুক্তি করেছিলেন তিনি সেগুলি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। অন্যান্য শক্তি তার পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য পূরণে কতখানি বাধা দেবে তা যাচাই করে নিতে তিনি চেয়েছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পরে তিনি দুটি কাজ করেছিলেন। নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন থেকে তিনি জার্মানির প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নেন (১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত লোকার্নো চুক্তি তার পছন্দ ছিল না)। হিটলার ভয় পেয়েছিলেন বৈষম্যমূলক নিরস্ত্রীকরণ পরিকল্পনার পরিবর্তে ন্যায্য পরিকল্পনা গৃহীত হলে জার্মানি তাতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হবে। জার্মানির জন্য তিনি নতুন সামরিক প্রস্তুতির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ত্যাগ করা ছাড়া তার সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।

হিটলার গোড়ার দিকে পশ্চিমি শক্তিবর্গকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে জার্মানির কোনো আগ্রাসী পরিকল্পনা নেই। সদিচ্ছার প্রমাণস্বরূপ তিনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের সঙ্গে আপসে বিরোধ মিটিয়ে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। হিটলার এই চুক্তি করে পূর্ব সীমান্ত সম্পর্কে খানিকটা নিশ্চিন্ত হন, ফ্রান্স ও তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করেন। ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত পারস্পরিক সহযোগিতার চুক্তিটিকে তিনি সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন। হিটলার অস্ট্রিয়াকে জার্মান রাইখের অঙ্গ বলে মনে করতেন, অস্ট্রিয়াবাসী নাৎসিদের উৎসাহ দিয়ে তিনি অস্ট্রিয়াকে রাইখের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। তার পরিকল্পনার আভাস পেয়ে ইতালি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ভয় পেয়েছিল। ফ্রান্স আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গঠনের কথা ভেবেছিল, ইংল্যান্ডের উৎসাহ না থাকায় তা পরিত্যক্ত হয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স জার্মানিকে সন্তুষ্ট করে যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার কথা ভেবেছিল। ইতিমধ্যে হিটলার এক ঘোষণা মারফত জানিয়ে দেন যে, তিনি ভার্সাই চুক্তির সামরিক শর্ত মানবেন না, বিমানবহর গঠনের কথা প্রকাশ করে দেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে হিটলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি স্ট্রেসায় মিলিত হয়েছিল, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। হিটলার ইংল্যান্ডের সঙ্গে আপস করার জন্য একটি নৌচুক্তি স্বাক্ষর করেন (১৯৩৫), এই চুক্তিতে জার্মানি ইংল্যান্ডের নৌশক্তির ৩৫ শতাংশ নির্মাণ করার অধিকার লাভ করেছিল। সাবমেরিন নির্মাণের ওপর কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। ভার্সাই চুক্তি ভঙ্গ করে ইংল্যান্ড প্রথম হিটলারের সামরিক প্রস্তুতিকে আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছিল।

ডেভিড টমসন জানিয়েছেন যে, ১৯৩৫-১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গণতান্ত্রিক দেশগুলি রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, লাভবান হয় অক্ষশক্তিবর্গ। জার্মানি অস্ত্রসজ্জা শুরু করেছিল, বাধ্যতামূলক সামরিক কাজ চালু করেছিল, রাইনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া অধিকার করে শক্তিবৃদ্ধি করেছিল (The story of the shift in the balance of power in Europe between 1935 and March 1939 is, in material terms, one of accumulative gains of power by the Axis states. The rearmament and introduction of conscription in Germany, the occupation of the Rhineland, of Austria, of Czechoslovakia, were all net gains to the Axis and severe losses to the Western democratic powers)। জার্মানির উত্থানের পথে যেসব বাধার সৃষ্টি করা হয়েছিল সব অপসারিত হয়। ইউরোপের একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলি পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলেছিল, অপরদিকে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেকসময় মিল হত না। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ইতালি আবিসিনিয়া আক্রমণ করেছিল, এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ইতালি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে সহযোগিতার পর্ব শেষ হয়ে যায়। ইতালির সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, তুরস্ক, গ্রিস প্রভৃতি দেশ প্রতিবাদ জানিয়েছিল। লিগের নেতৃত্বে ইতালির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কিন্তু ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স গোপনে ইতালির সঙ্গে সমঝোতা করতে চেয়েছিল।

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে হিটলার পশ্চিমি গণতান্ত্রিক দেশগুলির অসহায়তা লক্ষ্য করে তার সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন। পশ্চিমি দেশগুলি আবিসিনিয়া সংকট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে হিটলার সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে রাইনল্যান্ড অধিকার করে নেন, এখানে জার্মান সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ভার্সাই ও লোকার্নো চুক্তির রাইনল্যান্ড সংক্রান্ত শর্তগুলি হিটলার ভঙ্গ করতে দ্বিধা করেননি। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স হিটলারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি, লিগ ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা আরও একবার প্রমাণিত হল। ফ্রান্সের মিত্রদেশগুলি তার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল, ফ্রান্স নিজেই তার নিরাপত্তা সম্পর্কে আতঙ্কিত বোধ করতে থাকে। রাইনল্যান্ড সংকটের ফলে লাভবান হয়েছিল ইতালি। মুসোলিনি ইতালিকে একটি ভূমধ্যসাগরীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে মুসোলিনি তার উচ্চাশা পূরণের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি স্পেনের বিদ্রোহী সেনাপতিদের পক্ষ নিয়ে জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রপতি সুচনিগকে জার্মানির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিতে মন দিতে বলেন। জার্মানি ইতালির মনোভাব দেখে খুশি হয়েছিল, হিটলার ইতালির স্পেন-নীতিকে সমর্থন করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর রোম-বার্লিন অক্ষশক্তি গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। হিটলার ও মুসোলিনি যৌথভাবে স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে সাহায্য দিয়ে যান। এই পর্বে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন ফ্রান্সকে সঙ্গে নিয়ে একনায়কতন্ত্রী দেশগুলিকে তোষণ করার নীতি অনুসরণ করেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ বন্ধ করার প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়। হিটলার পশ্চিমি দেশগুলির দূর্বলতা ধরে ফেলেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাপান চিনে দ্বিতীয় পর্বের আগ্রাসন শুরু করলে ব্রিটিশ স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাপান, জার্মানি ও ইতালি অ্যান্টি-কমিনটার্ন প্যাক্টে স্বাক্ষর করেছিল, রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি গঠনের পথে আর কোনো বাধা ছিল না (১৯৩৭)। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের ফ্যাসিস্ট একনায়ক গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে অক্ষশক্তির সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, তবে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিরপেক্ষ থাকেন।

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে হিটলার তার সম্প্রসারণবাদী নীতি অনুসরণ করে অস্ট্রিয়া অধিকারের পরিকল্পনা করেন। অস্ট্রিয়া অধিকারের আগে তিনি সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করে নেন। অস্ট্রিয়ার সুচনিগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান শুরু করে দেন, অস্ট্রিয়ার পক্ষ থেকে প্রতিরোধ ছিল না (There was no resistance in Austria and probably inclusion with the Reich was welcome to the majority of the population)। সুচনিগকে ভয় দেখিয়ে হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করে রাইখের অন্তর্ভুক্ত করে নেন (১৯৩৮, ১১ মার্চ), জার্মান সৈন্যবাহিনী অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করেছিল। অস্ট্রিয়া জার্মান রাইখের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয় (Anschluss)। মুসোলিনি হিটলারের এই আগ্রাসন সমর্থন করেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এই ঘটনায় হিটলার অবশ্যই উৎসাহিত হয়েছিলেন। হিটলারের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল চেকোশ্লোভাকিয়া। অস্ট্রিয়া অধিকারের অল্পকাল পরে চেকোশ্লোভাকিয়ার সুদেতেন জার্মানদের পক্ষ নিলে হিটলার সেখানে গোলযোগ সৃষ্টি করেন। চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের সামরিক চুক্তি ছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তাকে সাবধান করে দেওয়ায় হিটলার অল্পকালের জন্য তার আক্রমণাত্মক কর্মসূচি স্থগিত রেখেছিলেন। ইংল্যান্ডের উদ্যোগে ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি যৌথভাবে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মিউনিখ চুক্তি করে শান্তিপূর্ণভাবে সুদেতেন জার্মান সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী চেকোশ্লোভাকিয়ার এক-তৃতীয়াংশ জার্মানিকে দিয়ে দেওয়া হয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স (চেম্বারলেন ও দালাদিয়ের) ধরে নিয়েছিল জার্মানি সন্তুষ্ট হয়েছে, তাদের আপসনীতি (তোষণনীতি) সফল হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতি হিটলারের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট এমিল হাচাকে ভয় দেখিয়ে হিটলার সমগ্র চেকোশ্লোভাকিয়া জার্মানির হাতে তুলে দিতে বাধ্য করেন, স্বাধীন চেকোশ্লোভাকিয়ার অস্তিত্ব লুপ্ত হয়।

জার্মানি চেকোশ্লোভাকিয়া অধিকার করলে তোষণনীতির ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে যায়। পশ্চিমি শক্তিবর্গ ধরে নিয়েছিল এবার হল পোল্যান্ডের পালা কারণ ডানজিগ ও সন্নিহিত অঞ্চলের ওপর হিটলারের দাবি ছিল। ইংল্যান্ড সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে দেয়, নতুন বন্ধুর খোঁজ করতে থাকে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ঘোষণা করেছিল যে পোল্যান্ড আক্রান্ত হলে তারা সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করবে। যুদ্ধের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধ শুরু করার আগে হিটলার সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন, একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে লড়াই করার ঝুঁকি হিটলার নিতে চাননি। পশ্চিমি গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে ধ্বংস করে তিনি পূর্বে সাম্যবাদী রাশিয়াকে আক্রমণ করার কথা ভেবেছিলেন। পশ্চিমি গণতন্ত্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস ছিল, মিউনিখ চুক্তির সময় রাশিয়াকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। হিটলার একে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আপস করার সিদ্ধান্ত নেন। রাশিয়ার আস্থা অর্জনের জন্য হিটলার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সঙ্গে স্বাক্ষরিত নৌচুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে (২৩ আগস্ট) রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে সব বিরোধের নিষ্পত্তি হয়ে যায়, উভয় দেশ একটি অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। পূর্ব সীমান্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে হিটলার ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। এর ঠিক দুদিন পরে ইংল্যান্ড জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়

১৯৩৩-১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে হিটলার ছিলেন আক্রমণাত্মক ও আগ্রাসী। এই নীতি অনুসরণ করে তিনি অনেকগুলি লক্ষ্য পূরণ করেছিলেন। ভার্সাই চুক্তি ভঙ্গ করে তিনি জার্মানিকে অস্ত্রসজ্জিত করেন, বিমানবহর গঠন করেন, রাইনল্যান্ড পুনরায় জার্মানির অধিকারে স্থাপিত হয়। রাইনল্যান্ডের সামরিকীকরণ শুরু হয়েছিল। রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য হিটলার লিগ ও নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন ত্যাগ করেছিলেন। সম্প্রসারণবাদের প্রবক্তা হিটলার বলপ্রয়োগে অস্ট্রিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া অধিকার করে নেন। অস্ট্রিয়া ছিল জার্মান অধ্যুষিত অঞ্চল, তেমন বাধা আসেনি, কিন্তু চেকোশ্লোভাকিয়া সম্পর্কে তা বলা যায় না। এখানে তিনি ছিলেন আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী। ইউরোপে একাধিপত্য ও বিশ্ব সাম্রাজ্যের তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন (World or nothing)। শত্রু সাম্যবাদী সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে কৌশল হিসেবে তিনি অনাক্রমণ চুক্তি করেন। তার পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি ছিল যুদ্ধের অনিবার্যতা। তাই যুদ্ধের জন্য তিনি প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন এবং পশ্চিমি দেশগুলির চেয়ে অনেকখানি এগিয়েছিলেন। শুধু যুদ্ধের পরিণতি তিনি আগে থেকে অনুমান করতে পারেননি। হিটলারের আগ্রাসী, সম্প্রসারণবাদী পররাষ্ট্রনীতি জার্মানির পক্ষে মঙ্গলজনক হয়নি, অলক্ষ্যে ভয়ংকর পরিণতির দিকে জার্মানি এগিয়ে চলেছিল। হিটলারের পার্শ্বচর গোয়েরিং তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন জার্মানি পরাস্ত হলে শুধু ঈশ্বরই তাকে রক্ষা করবেন (If we lose this war, then god have mercy on us)।

তথ্যসূত্র 

  • আধুনিক ইউরোপ : ফরাসি বিপ্লব থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৭৮৯-১৯৪৫), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, মিত্রম, কলকাতা, ২০১৩, পৃ ৪৩৯-৫৩, ৪৮৭-৯৮, ৫০১-৫০৮

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.