ইতালি (১৯১৯-১৯৩৬): ফ্যাসিবাদের উত্থান, মুসোলিনির বিদেশনীতি, ইতালি-আবিসিনিয়া ও লিগ

ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান

প্রথম মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ইউরোপ জুড়ে দেখা দিয়েছিল সামাজিক অশান্তি, বিক্ষোভ, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন, বেকারত্ব হতাশা ও অবসাদ। এই পটভূমিকায় ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে। মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, ফ্যাসিবাদ হল মৃত্যুযন্ত্রণাকাতর পুঁজিবাদের প্রতিফলন (Fascism was the expression of capitalism in its death throes)। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছিল, সেই ব্যর্থ পুঁজিবাদকে রক্ষার জন্য ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে। অনেকে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের জন্য সাম্যবাদকে দায়ী করেছেন। সাম্যবাদীরা ক্ষমতা দখল করতে পারে এই আশঙ্কায় ভীত হয়ে ভূস্বামী, শিল্পপতি, আমলা ও সৈন্যবাহিনী দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল আদর্শবাদকে আঁকড়ে ধরেছিল। বেশিরভাগ ঐতিহাসিক এই সরল ব্যাখ্যা গ্রহণ করেননি। এদের মতে, অনেক কারণে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়। উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হল যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত সামাজিক বিশৃঙ্খলা, ইতালির জাতীয়তাবাদীদের হতাশা, এবং ইতালির রাজনৈতিক দলগুলির ব্যর্থতা। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কমিউনিস্ট ভীতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ইতালি লাভবান হয়নি, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালি মিত্রশক্তি গক্ষে যোগ দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু যুদ্ধে কোনো কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। প্যারিস শান্তি সম্মেলনে আড্রিয়াটিক সাগরের উপকূল ও উত্তর সীমান্তে ইতালি কিছু নতুন অঞ্চল লাভ করেছিল কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা এতে খুশি হয়নি। প্রথম মহাযুদ্ধ ইতালির অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল।

যুদ্ধের পর ইতালির বৈদেশিক ঋণের বোঝা বেড়েছিল। যুদ্ধের পর ঋণদান বন্ধ হলে ইতালি দুর্যোগের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়, বৈদেশিক বাণিজ্যে রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি থাকায় বৈদেশিক ঋণের বোঝা বেড়ে চলেছিল (Italy found itself with a staggering debt, a great imbalance in foreign trade)। যুদ্ধের সময় সরকার কৃষক ও শ্রমিকদের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধের পর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব না হওয়ায় শহরের শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘট ও গ্রামাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধের পর সৈন্যবাহিনী ভেঙে দেওয়া হলে কর্মহীন সৈনিকরা দস্যুবৃত্তিতে যোগ দিয়েছিল অথবা কর্মহীনদের সংখ্যা বাড়িয়েছিল। যুদ্ধোত্তর ইতালির রাজনৈতিক দলগুলি যথাযথভাবে তাদের দায়দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। ইতালির পার্লামেন্টে তিনটি বড়ো রাজনৈতিক দল ছিল-সমাজবাদী, ক্যাথলিক পপুলার পার্টি ও লিবারেল। সমাজবাদীদের একটি শাখা উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকেছিল, এরা কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে (১৯২০)। ক্যাথলিক পপুলার পার্টির মধ্যেও ঐক্য ছিল না, যাজক বিরোধিতা ছাড়া এদের মধ্যে ঐক্যের সাধারণ সূত্র ছিল না। এই দল সমাজবাদী ও লিবারেলদের বিশ্বাস করত না, রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা ছিল অনেকটা নেতিবাচক। লিবারেল দল সরকারের অর্থনীতির বিরোধিতা করত।

এই তিনটি দলই যুদ্ধ পরবর্তীকালের পরিস্থিতি নিয়ে শুধু বিতর্ক চালাত, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারেনি। যুদ্ধোত্তর মন্ত্রীসভাগুলি ছিল কোয়ালিশন সরকার, প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সেসকো নিত্তি বা জিওভানি জিওলিত্তি দেশের সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারেননি। কোয়ালিশন সরকারের নীতি দেশের তিনটি গোষ্ঠীর মানুষকে এর বিরোধী করে তুলেছিল, এই তিনটি গোষ্ঠী হল ভূস্বামী, শিল্পপতি ও জাতীয়তাবাদী। ভূস্বামীরা কৃষক বিদ্রোহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শিল্পপতিরা ধর্মঘট নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছিল, আর জাতীয়তাবাদীরা প্যারিস চুক্তিকে ইতালির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য করেছিল। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কবি গাব্রিয়েল দ্য আনানজিও তার অনুগামীদের নিয়ে ফিউম দখল করলে দেশে জাতীয়তাবাদীরা উৎসাহিত হয়েছিল। এরা ইতালিকে একটি শ্রেষ্ঠ ভূমধ্যসাগরীয় ও বন্ধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। জিওলিত্তি সরকার ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে শান্তি চুক্তি করলে জাতীয়তাবাদীরা প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়েছিল। ইতালি আলবানিয়া থেকে সরে এলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে কাপুরুষতার অভিযোগ এনেছিল। প্রাক্তন সৈনিকরা নতুন ইতালি গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল, যুদ্ধোত্তর ইতালির দুরবস্থা তাদের মনোকষ্টের কারণ হয়। ভূস্বামী, শিল্পপতি, সৈনিক ও জাতীয়তাবাদীরা নতুন নেতার খোঁজ করতে থাকে যিনি ইতালিকে এই দুর্দশা থেকে উদ্ধার করতে পারবেন। ইতালির রাজনৈতিক দুরবস্থা থেকে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়। বেনিটো মুসোলিনি হলেন তাদের উদ্ধারকর্তা (Critics of prevailing tendencies in Italian politics found a way of expressing their protests in fascism and in the leadership of Benito Mussolini)।

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বেনিটো মুসোলিনির জন্ম হয়। পিতা ছিলেন কর্মসূত্রে কর্মকার, আদর্শে সমাজতন্ত্রী, মাতা শিক্ষিকা। জীবনে তিনি বহু ধরনের জীবিকা অনুসরণ করেন, কিছুকাল শিক্ষকতা ও সৈনিকের কাজ করেন, পরে সাংবাদিকতাকে আশ্রয় করেছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, সমাজতন্ত্রী সংবাদপত্র মিলানের আভান্তির (Avanti) তিনি সম্পাদক ছিলেন। সরকারের উত্তর আফ্রিকা সংক্রান্ত নীতির কঠোর সমালোচনা করার জন্য তিনি কারারুদ্ধ হন, অস্ট্রিয়ার শহর টেন্ট থেকে বিতাড়িত হন। সমালোচকরা মনে করেন এসবের একটাই উদ্দেশ্য ছিল-নিজেকে ইতালির জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করা। আদর্শবাদের প্রতি তার নিষ্ঠা আন্তরিক ছিল না (He was concerned primarily with personal advancement rather than with the cause he advocated)। প্রথম জীবনে তিনি হস্তক্ষেপ নীতির বিরোধী ছিলেন, পরে তিনি এর উগ্র সমর্থকে পরিণত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সমাজবাদীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, তিনি শ্রমিকদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন। তিনি প্রচার করেন যে, মহাযুদ্ধে ইতালির ভূমিকাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, ইতালি তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে (Italy had been cheated of the gains won by the blood of its sons)। তার লেখা ও বক্তৃতা সৈন্যবাহিনীর অফিসার, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও হতাশ তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মিলানে এদের নিয়ে গঠিত হয় ফ্যাসিস্ট দল (fascio) (এই শব্দটির অর্থ হল সংগ্রামী গোষ্ঠী (fighting group))। বহু বিচিত্র গোষ্ঠীর মানুষজন নিয়ে ফ্যাসিস্ট দল গড়ে উঠেছিল। স্থানীয় বহু সংস্থা ও কবি আনানজিওর অনুগামীরা সকলে এই দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। ফ্যাসিস্ট দল সমাজতন্ত্র বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল, এর মধ্যে বহু দল, উপদল ও গোষ্ঠী ছিল। দলীয় নেতাদের চাপে মুসোলিনি রক্ষণশীল পুঁজিপতি ও বণিকদের পক্ষ নেন।

মুসোলিনির ছিল গণবিমোহিনী শক্তি, তিনি ইতালির মানুষকে অল্পদিনের মধ্যে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। তিনি ফ্যাসিস্ট আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন (Mussolini made fascism a party with national support)। ঐতিহাসিকদের অনুমান মুসোলিনি এত সহজে ক্ষমতা দখল করতে পারলেন তার কারণ হল ইতালির উদারনৈতিক দলের জিওলিত্তি সরকার ব্যর্থ হয়েছিল। এই সরকার দেশের ক্রমবর্ধমান (১৯২০-২১) কৃষক অসন্তোষ ও শ্রমিক বিক্ষোভ দমন করতে পারেনি। ফ্যাসিস্ট দল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মর্যাদা পেয়েছিল, আইনসভায় আসন লাভ করেছিল, মধ্যবিত্তের ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্যাসিস্ট দল যখন গঠিত হয় এর সদস্যসংখ্যা ছিল তিন লক্ষ। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ নির্বাচনের সময় ফ্যাসিস্ট দল দেখেছিল যে, সরকার বেশ দুর্বল, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে বাধা দিতে অক্ষম। সৈন্যবাহিনী ও রাজসভার অনেকে এই দলের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন ছিল। মুসোলিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, এখনই ক্ষমতা দখলের চেষ্টা হলে তা সফল হতে পারে (There was every reason to believe that an all-out drive for power would be successful)। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে মুসোলিনি ক্ষমতা দখলের আভাস দেন। তিনি পার্লামেন্টে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, সরকার ফ্যাসিস্টদের দমনের চেষ্টা করলে বিদ্রোহ হবে। এই বক্তৃতার পরেও উদারনৈতিক ও সমাজতন্ত্রীরা সতর্ক হয়নি। ১৯২২ আগস্ট মাসে সমাজতন্ত্রীরা সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দিলে ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতায় আরোহণ পর্ব শুরু হয়ে যায়। জাতি এই বিশৃঙ্খলা মানতে রাজি ছিল না, এর সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিস্ট দল সমাজতন্ত্রীদের ওপর ব্যাপক আঘাত হেনেছিল। বিভিন্ন শহরে ফ্যাসিস্ট দলের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ফ্যাসিস্ট দল রাজতন্ত্রী ও চার্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে এদের নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ২৭ অক্টোবর মুসোলিনি ও তার ব্ল‍্যাক সার্টসদের রোম অভিযান শুরু হলে রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল গৃহযুদ্ধের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য মুসোলিনিকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে মুসোলিনি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন। তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দেননি। ক্ষমতার প্রথম বছরে তিনি পুলিশ বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন, পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সেনেটে ফ্যাসিস্টদের নিযুক্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। তার দলীয় কর্মীদের নিয়ে (স্কোয়াদৃষ্টি) তিনি গঠন করেন রাষ্ট্রের বেতনভোগী মিলিশিয়া। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনী আইন সংশোধন করে তিনি এই ব্যবস্থা করলেন, যে দল নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পাবে, আইনসভায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন তাকে দেওয়া হবে। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের নির্বাচনে মুসোলিনির দল সন্ত্রাস চালিয়ে ৪.৫ মি. ভোট পেয়ে দুই- তৃতীয়াংশ আসন দখল করেছিল। মুসোলিনির একনায়কতন্ত্র স্থাপনের পক্ষে আর কোনো বাধা ছিল না (drift towards totalitarianism became evident)।

রাজনৈতিক বিরোধীদের বিনাশ করার পরিকল্পনা নিয়ে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে গুপ্ত হত্যা শুরু করা হয়েছিল। নরমপন্থী সমাজবাদী নেতা জিয়াকমো ম্যাটিওত্তি (Matteotti) আততায়ীর হাতে নিহত হন। প্রতিবাদে বিরোধী দলগুলি আইনসভা বর্জন করে চলে যায়, ফ্যাসিবাদের অগ্রগতি অব্যাহত থাকে। বিরোধীদের ওপর আক্রমণ বন্ধ হয়নি, মন্ত্রীসভার অফ্যাসিস্ট সদস্যরা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, ফ্যাসিস্ট বাদে অন্যসব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সংবাদপত্রের ওপর মুসোলিনি বিধিনিষেধ আরোপ করেন। আমলাতন্ত্র ও স্থানীয় শাসনের ওপর ফ্যাসিস্ট দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গুপ্ত পুলিশ বিভাগ (OVRA) গঠন করে মুসোলিনি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ করেন।

রাষ্ট্রক্ষমতা অধিগ্রহণ করে মুসোলিনি রাষ্ট্রযন্ত্রটি ভেঙে দেননি। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুসোলিনি আইন প্রণয়নের সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন, সরকারি আদেশ জারি করে শাসনের ব্যবস্থা করেন (to govern by decrees)। সব উচ্চপদে নিয়োগের অধিকার ছিল তার হাতে, উচ্চপদাধিকারীরা সকলে তার কাছে দায়বদ্ধ ছিল। সব মন্ত্রী ও আধিকারিকরা ব্যক্তিগতভাবে মুসোলিনির প্রতি দায়বদ্ধ ছিল। মুসোলিনির ব্যবস্থায় দেশের মধ্যে ফ্যাসিস্ট দলই ছিল সর্বেসর্বা (the party was the source of real power in the country)। নিম্নতম স্তরে ছিল ১০,০০০ ফ্যাসি, ক্রম-বিন্যস্ত এই ব্যবস্থায় একেবারে শীর্ষে ছিল ফ্যাসিস্ট গ্র্যান্ড কাউন্সিল (Fascist grand council)। এই কাউন্সিলের সদস্য ছিল মাত্র বিশজন, এদের হাতে ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা। এই কাউন্সিলের ক্ষমতা আবার কেন্দ্রীভূত হয়েছিল চেয়ারম্যান মুসোলিনি ও তার সেক্রেটারি জেনারেলের হাতে। রাজনীতিতে প্রবেশের জন্য দলীয় সদস্যপদ ছিল বাধ্যতামূলক, দলের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হত, দেশের তরুণরা ফ্যাসিস্ট দলের সদস্যপদ গ্রহণে আগ্রহ দেখিয়েছিল। ফ্যাসিস্ট তরুণ সংগঠন বালিলা, অ্যাভান গার্ডিয়া ইত্যাদির সদস্যদের দলীয় সদস্যপদ প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হত।

রাষ্ট্রের সব অঙ্গের ওপর ফ্যাসিস্ট দল নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছিল। দুভাবে এই উদ্দেশ্য সাধন করা হয়—কোনো বিভাগে ফ্যাসিস্টদের নিয়োগ করে অথবা সমান্তরাল সংগঠন গড়ে তুলে। সৈন্য ও পুলিশ বিভাগের ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্টরা এই ধরনের নীতি অনুসরণ করেছিল। সৈন্য ও পুলিশ বিভাগে ফ্যাসিস্ট দলের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন মানুষদের স্থান করে দেওয়া হয়। তাছাড়া ফ্যাসিস্ট দলের নিজস্ব পুলিশ বাহিনী ছিল, দলের নেতৃত্বে একটি আধা-সামরিক বাহিনী মিলিশিয়া গড়ে তোলা হয়। ইতালির একটি শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠান হল পোপতন্ত্র। মুসোলিনি পোপের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েননি, বরং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে পোপের সঙ্গে একটি চুক্তি করে রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে যে বিরোধ ছিল তার অবসান ঘটান। মুসোলিনি ভ্যাটিকান শহরের মধ্যে পোপের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন, বিনিময়ে পোপ ইতালি রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নেন, পোপের প্রদেশগুলির ইতালি রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিও তিনি মেনে নেন। পোপ ইতালি সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে বিশপদের নিযুক্ত করবেন, যাজকরা রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে, রাষ্ট্র তাদের বেতন দেবে। মুসোলিনির পোপের সঙ্গে আপস ব্যবস্থা তাকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল, তার পতনের পর ইতালির নতুন সরকার এই ব্যবস্থা মেনে নেয়।

ইতালিতে ফ্যাসিস্ট শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর নতুন সমন্বিত রাষ্ট্রব্যবস্থা (The corporative state)। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও শ্রেণি সংগ্রামের বিরোধী বিকল্প আদর্শ হিসেবে এই ব্যবস্থাকে প্রচার করা হয়। দেশে ট্রেড ইউনিয়ন, ধর্মঘট, ছাঁটাই সব তুলে দেওয়া হয়। সব অর্থনৈতিক বিরোধ মেটানোর জন্য তিনি সিন্ডিকেট বা করপোরেশন গঠন করেন। পেশাদার মানুষ, নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে এগুলি গঠন করা হয়। এদের কাজ ছিল উৎপাদন ব্যবস্থায় শান্তি রক্ষা করা এবং শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। এসব করপোরেশন থেকে মনোনীত সদস্যরা পার্লামেন্টে সদস্যপদের জন্য মনোনীত হত, আবার অন্যান্য জাতীয় সংস্থায় মনোনয়নে অগ্রাধিকার লাভ করত। ঐতিহাসিকরা মনে করেন তিনটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই করপোরেটিভ ব্যবস্থা গঠন করা হয়।

  • প্রথমত, এই আদর্শবাদের আবরণ দিয়ে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্রকে আড়াল করা হয়। বলা হয় এটি হল একটি নতুন সামাজিক ঐক্য ও সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা।
  • দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিস্ট দলের প্রধান সমর্থক গোষ্ঠী পুঁজিপতি ও ভূস্বামীদের এই ব্যবস্থা খুশি করেছিল কারণ শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সম্ভাবনা দূর হয়।
  • তৃতীয়ত, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পার্টির সমর্থকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়।

ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণে এই ব্যবস্থার অকার্যকারিতা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, এটি ছিল একটি প্রতারণা (In reality, corporatism was a fraud that never worked in practice)। মুসোলিনির এই ব্যবস্থা ক্ষমতা দখলের পূর্ব মুহূর্তে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, তবে সামগ্রিকভাবে ইতালির অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারেনি বা শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। মুসোলিনির মৌল অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা ছিল না, তিনি আড়ম্বর ভালোবাসতেন, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তিনি জনপরিষেবামূলক কাজকর্মের উন্নতির জন্য বিরাট পরিকল্পনা করেন, অনেক বৃহৎ রাস্তা ও রেলপথ নির্মাণ করেন। সামরিক বাহিনীর সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ইতালিকে বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। তিনি খাদ্য উৎপাদনের ওপর জোর দেন, অন্যান্য কৃষিকাজ যেমন অলিভ তেল উৎপাদন ব্যাহত হয়। তিনি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে উৎসাহ দিয়ে তিনি ৬০মি. পৌঁছোনোর লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেন। এর প্রভাব পড়েছিল ইতালির মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানের ওপর, ইতালির মজুরদের প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। মুসোলিনি ইতালির জন্য সমৃদ্ধি চাননি, চেয়েছিলেন জাতীয় গৌরব, তার মতে, নৈতিক উন্নতি। শিক্ষাক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট সরকার কিছুটা সফল হয় কারণ প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়। নিরক্ষরতা কমেছিল তবে ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়া হত, মৌল নিয়মানুবর্তিতা অবহেলিত হয়। ফ্যাসিস্ট দল ইতালির মৌল সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারেনি। দক্ষিণ ইতালি ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর, দেশে ছিল ম্যালেরিয়া, দস্যুবৃত্তি, জাতীয় আয়ের অসম বণ্টন। লুইগি করজিনি জানিয়েছেন যে, মুসোলিনি সত্যিকারের গঠনমূলক কাজ করেননি, কর্মযজ্ঞের মেকি আবরণ তৈরি করে জনগণকে প্রভাবিত করেন (Mussolini devoted his time not to constructive work but to putting on a good show for the Italian people)।

ফ্যাসিস্ট দর্শন খুব সুনির্দিষ্ট নয়। মুসোলিনি চিন্তার চেয়ে কাজের ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন (Action was more important than philosophy)। রাজনীতির যাযাবর বলে ফ্যাসিস্টদের বর্ণনা করা হয়েছে (the gypsies of politics)। ফ্যাসিস্ট দর্শনের বেশিরভাগ হল নেতিবাচক, ইতিবাচক দিকগুলি যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্র বিরোধী, উদারনীতি ও সমাজতন্ত্রের শত্রু। ফ্যাসিবাদের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন জিওভানি জেন্টিল (Gentile)। তিনি প্রচার করেছিলেন যে, পুরোনো সব দর্শনে সম্প্রদায় ও জাতির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, পার্থিব সমৃদ্ধি ও যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদ স্বাধীনতা আনবে কর্তৃত্ববাদের মাধ্যমে, শৃঙ্খলা ও আত্মত্যাগ দিয়ে মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে। জেন্টিল বলেছেন যে, ফ্যাসিবাদ হল এক ধরনের অতীন্দ্রিয় অনুভূতি (mystic sentiment)। বুদ্ধি দিয়ে নয়, ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তা অনুভব করতে হবে (The fascist spirit is will, not intellect)। ফ্যাসিস্ট নেতারা তাদের বক্তৃতায় রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা বলেছেন, জোর দিয়েছেন ইচ্ছাশক্তি, ক্ষমতা, সাহস, বীরত্ব, ত্যাগ, শৃঙ্খলা ও জয়ের ওপর। এ যুগের শ্রেষ্ঠ ইতালীয় দার্শনিক বেনিডেটো ক্রোচে ফ্যাসিস্ট দর্শনের মধ্যে যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত কোনো দর্শনের সাক্ষাৎ পাননি (an incoherent and bizarre mixture of appeals) ফ্যাসিস্ট দল ও রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন ডুসে মুসোলিনি। প্রচার মাধ্যম তাকে ইতালির মুক্তিদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, ইতালির কৃষক ও শ্রমিক তাকে বহুগুণের আধার হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বিদেশি নেতারাও তাকে ইতালির শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মুসোলিনি প্রথাগত কূটনৈতিক পথ পছন্দ করেননি, কারণ তিনি চেয়েছিলেন জাতীয় গৌরব, সম্প্রসারণ ও যুদ্ধ। ইতালির অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ দরকার, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মর্যাদা পেতে হলে উপনিবেশের প্রয়োজন হয়। উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার একাংশ উপনিবেশে কাজ পাবে, বসতি স্থাপন করবে। প্রাচীন রোমের গৌরবগাথা স্মরণ করে তিনি ইতালির জন্য আড়ম্বরপূর্ণ বৈদেশিক নীতির পরিকল্পনা করেন। স্থল, নৌ ও বিমান বহরের সম্প্রসারণের জন্য ব্যবস্থা নেন। পূর্ব ইউরোপের গ্রিসের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হন, অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়াতে হস্তক্ষেপ করেন। মহামন্দার সুযোগ নিয়ে তিনি আবিসিনিয়া অধিকার করে নেন (১৯৩৬)।

মুসোলিনির বিদেশনীতি (১৯২২-১৯৩৯)

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা দখলের পর থেকে মুসোলিনি হলেন ইতালির পররাষ্ট্রনীতির ভাগ্যনিয়ন্তা। তার ফ্যাসিস্ট দল ও সরকার প্রচার করেছিল যে মহাযুদ্ধে ইতালির ক্ষয়- ক্ষতির বিনিময়ে বিশেষ কিছুই লাভ হয়নি। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন চুক্তিতে ইতালিকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট উইলসনের বাধাদানের জন্য তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। মুসোলিনি ক্ষমতা দখলের পরই ঘোষণা করেন যে তিনি শান্তিচুক্তির সংশোধন চান (revision), স্থিতাবস্থা রক্ষা করার তিনি পক্ষপাতী নন। যুদ্ধ পরবর্তীকালের দুর্দশাগ্রস্ত দেশবাসীকে তার দল ও সরকার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল। ইতালির অতীত গৌরব স্মরণ করে তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন। হিটলারের মতো তিনি যুদ্ধের অনিবার্যতায় বিশ্বাস করতেন এবং ঘোষণা করেছিলেন যে দশ বছরের মধ্যে আবার যুদ্ধ বাধবে। ইতালি সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে চলবে। লিগের কর্তৃত্ব ইতালি মানবে না, প্রয়োজন হলে ইতালি লিগের সদস্যপদ ত্যাগ করবে (over and over again he asserted that Italy must be an expanding power. To the extent that the peace treaties stood in the way of Italian expansion, they must be revised, and Italy would not be balked by the procedures of the new League of Nations)। তিনি পশ্চিমি শক্তিবর্গকে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন যে স্থিতাবস্থা তিনি মেনে নেবেন না। ইউরোপে শান্তিরক্ষা করতে হলে তার দাবি মেনে নিতে হবে, তাকে উপেক্ষা করা যাবে না।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনি গ্রিস-আলবানিয়া সীমান্তে ইতালীয় সৈন্যদের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে গ্রিসের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হন, গ্রিসের করফু দ্বীপটি অধিকার করে নেন। গ্রিস ক্ষতিপূরণ দিয়ে দ্বীপটি ফেরত পেয়েছিল। মুসোলিনি পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে আপসমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে আস্থা স্থাপন করতে পারেননি। তিনি সহযোগিতামূলক কূটনীতি (collaborative diplomacy) পছন্দ করতেন না। তিনি মনে করতেন ফ্যাসিস্ট ইতালির পক্ষে এধরনের কূটনীতি যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ নয় (The satisfactions to be gained from collaborative diplomacy did not seem to him to be worthy of fascist Italy, wich must dazzle the world with spectacular triumphs of its own)। চমকপ্রদ সাফল্যের কথা মাথায় রেখে তিনি বিদেশ নীতি পরিচালনা করেন। ইতালির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তার পররাষ্ট্রনীতির ওপর অবশ্যই প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিশের দশকের শেষদিক থেকে মহামন্দা শুরু হলে মুসোলিনি সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন (The deterioration of economic conditions at the end of the 1920s and the consequent disruption of European power relations opened new vistas to his eyes and made him impatient of old restraints)। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বরখাস্ত করে নিজেই বিদেশ নীতি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতালির নৌবহর ও সামরিক বাহিনীর সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঘোষণা করেন যে ইতালি শুধু ভূমধ্যসাগরে তার কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ রাখবে না, সারা বিশ্বে তার কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়বে। ইতালি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলবে, পূর্ব ইউরোপে ইতালি তার প্রভাব বিস্তার করবে।

ই. এইচ. কার লিখেছেন যে পূর্ব ইউরোপে ইতালির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফ্রান্স। ফ্রান্স যুগোশ্লাভিয়ার পক্ষ নিলে উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধে ছিল (Franco-Italian rivalry had flared up soon after the war as the result of French support of Yugoslav claims)। মুসোলিনি এই অঞ্চলে ফরাসি প্রভাব দূর করে ইতালির প্রভাবাধীন রাষ্ট্রজোট গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ফ্রান্সের সঙ্গে ইতালির ঔপনিবেশিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল। ইতালির ধারণা হয় ফ্রান্স তার ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বাধা দিয়ে চলেছে। ফ্রান্স বল্কান অঞ্চলে যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া ও রুমানিয়ার সঙ্গে জোট বাধলে ইতালি অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিকে নিয়ে পাল্টা জোট গঠনের কথা ভেবেছিল। যুদ্ধোত্তরকালে যুগোশ্লাভিয়া ছিল ইতালির প্রধান শত্রু। ইতালিতে জাতীয় আবেগ প্রবল হয়ে উঠলে উগ্রপন্থীরা যুগোশ্লাভিয়ার ফিউম বন্দরটি দখল করে নিয়েছিল। পরে ইতালি যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে এই বিরোধ মিটিয়ে নিয়ে নেটুনো কনভেনশন (Nettuno Convention) স্বাক্ষর করেছিল, উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনি আলবানিয়ার সঙ্গে টিরানা চুক্তি করে ঐ অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার পেয়েছিলেন। আলবানিয়ার ওপর ইতালির প্রভাব বৃদ্ধি পেলে যুগোশ্লাভিয়া আতঙ্কিত বোধ করেছিল। ইতালি তুরস্ক ও হাঙ্গেরির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে পূর্ব ইউরোপে নিজের অবস্থানকে মজবুত করে নিয়েছিল। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের মার্সেই বন্দরে যুগোশ্লাভিয়ার রাজা আলেকজান্ডার ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে অবনতি ঘটে। এই হত্যাকাণ্ডে ইতালির হাত আছে বলে ফ্রান্স সন্দেহ করেছিল।

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতা দখল করলে ইউরোপীয় রাজনীতির দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটে যায়। এই ঘটনার ফলে ইতালি ও ফ্রান্স পরস্পরের কাছে এসেছিল (The recounciliation between France and Italy was the last important diplomatic volte-face directly inspired by Hitler’s advent to power)। মুসোলিনি মনে করেন হিটলারের আগ্রাসী নীতি ইতালির পক্ষে বিপজ্জনক। হিটলার অস্ট্রিয়ার ওপর চাপ দিলে তিনি গোপনে এই দেশকে সাহায্য দেন। অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর এঙ্গেলবার্ট ডলফাস আততায়ীর হাতে নিহত হলে মুসোলিনি অস্বস্তিবোধ করেন। তিনি কূটনৈতিক পথে ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিতে মন দেন। মুসোলিনি উত্তর সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করলে হিটলার ধীরে চলার নীতি নেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনি ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভালের সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তি করেন। ফ্রান্স ইতালিকে তিউনিসিয়া ও আফ্রিকার অন্যত্র সুযোগসুবিধা দিতে রাজি হয়। ইতালি ইউরোপে শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে ফ্রান্সের সঙ্গে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্ট্রেসা সম্মেলনে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালির রাষ্ট্রপ্রধানরা মিলিত হয়ে ইউরোপে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এটি হল মিত্রপক্ষের সংহতি বজায় রাখার শেষ প্রয়াস (a last display of Allied solidarity)।

হিটলার ইউরোপীয় পরিস্থিতি সম্যকভাবে অনুধাবন করে ইতালির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিতে মন দেন। তিনি অস্ত্রসজ্জা শুরু করে রাইনল্যান্ড অধিকার করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে হিটলার ও মুসোলিনির মধ্যে মৈত্রী স্থাপিত হল, উভয়ে সাম্যবাদ বিরোধী ছিলেন। পরের বছর জাপান এই জোটে যোগ দিলে গড়ে ওঠে রোম-বার্লিন-টোকিও অ্যাক্সিস। মুসোলিনি পূর্ব আফ্রিকায় সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেন। ধরে নিয়েছিলেন হিটলারের উত্থানে আতঙ্কিত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড তাকে বাধা দেবে না। স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে মুসোলিনি ও হিটলার সেখানে ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রাঙ্কোর পক্ষ নেন। উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব ক্রমশ জোরদার হয়ে ওঠে। মুসোলিনি জার্মানির সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সংযুক্তি মেনে নেন, মিউনিখ চুক্তি করে হিটলারকে চেকোশ্লোভাকিয়ার একাংশ অধিকারের ব্যবস্থা করে দেন। তিনি আবিসিনিয়া অধিকার করে ইতালির ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান। হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করলে মুসোলিনি গোড়ার দিকে নিরপেক্ষ ছিলেন, পরে হিটলারের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেন।

ইতালি-আবিসিনিয়া ও লিগ

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনি বলেছিলেন যে বিংশ শতাব্দী হবে ফ্যাসিবাদের শতক। এই শতাব্দী হবে ইতালীয় শতক যখন তৃতীয়বার ইতালি মানব সভ্যতাকে পথ দেখাবে। তিনি আরো বলেছিলেন যে দশ বছরের মধ্যে ইউরোপ ফ্যাসিবাদে দীক্ষিত হবে। ফ্যাসিবাদের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হল সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ। হতভাগ্য আফ্রিকা মহাদেশের পূর্বাঞ্চলে একমাত্র স্বাধীন দেশ ছিল আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া)। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালির উপনিবেশ এই দেশটিকে প্রায় পরিবেষ্টিত করে ফেলেছিল। উনিশ শতকের শেষপাদে আফ্রিকা নির্লজ্জ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়েছিল। এই সময় ইতালি আবিসিনিয়া অধিকারের প্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল, অনগ্রসর আবিসিনিয়া ইতালির আগ্রাসন প্রতিরোধ করেছিল। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে আডোয়ার যুদ্ধে ইতালি আবিসিনিয়ার সৈন্যবাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়। আবিসিনিয়া তার নিজের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষা করেছিল। কিন্তু বিশ শতকের তিরিশের দশকের মধ্যভাগে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত উদ্ধত, জাত্যভিমানী ফ্যাসিস্ট ইতালিকে প্রতিরোধ করার মতো ক্ষমতা তার ছিল না। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ইতালি আবিসিনিয়া দখল করে তার সাম্রাজ্যভুক্ত করে নিয়েছিল।

ইতালি-আবিসিনিয়া যুদ্ধের পটভূমিকায় ছিল লিগের যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা এবং বৃহৎ শক্তিবর্গের তোষণনীতি। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপান চিনের বৃহৎ প্রদেশ মাঞ্চুরিয়া অধিকার করেছিল। লিগ জাপানকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করলে সে লিগের সদস্যপদ ত্যাগ করেছিল। হিটলার ভার্সাই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে অস্ত্রসজ্জা শুরু করেছিলেন, লিগ নীরব দর্শকের ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়েছিল। পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি নাৎসিবাদের উত্থানে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে স্ট্রেসা সম্মেলনে এই তিনটি দেশ মিলিতভাবে হিটলারের বিরুদ্ধে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে ইতালিকে বন্ধু হিসেবে পেতে চেয়েছিল। হিটলারের উত্থানে সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিল ফ্রান্স। আবিসিনিয়ায় অভিযান চালালে ইংল্যান্ড আপত্তি করবে না এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। মুসোলিনি পশ্চিমি শক্তিবর্গের তোষণনীতি থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌছেছিলেন।

আবিসিনিয়া আক্রমণের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হল ফ্যাসিবাদী ইতালির সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী নীতি। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মতো ইতালি বিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল। একনায়কতন্ত্রী মুসোলিনি দেশের সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে প্রচার চালাতেন, প্রচার মাধ্যমগুলি সাম্রাজ্যের সুবিধার দিকগুলি তুলে ধরত। যুদ্ধকে জাতীয় গৌরবলাভের মাধ্যমে হিসেবে তুলে ধরা হয়। মুসোলিনি যুদ্ধের সম্ভাবনাকে মনে রেখে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে চলেন। উত্তরে ইরিত্রিয়া ও দক্ষিণে সোমালিল্যান্ডের মধ্যস্থলে অবস্থিত আবিসিনিয়া অধিকার করা সামরিক দিক থেকে দুঃসাধ্য ছিল না। এই বিশাল দেশটি জয় করা সম্ভব হলে পূর্ব আফ্রিকায় ইতালির সাম্রাজ্য সম্পূর্ণতা পাবে। ইতালি কর্তৃক আবিসিনিয়া আক্রমণের আরো একটি বড়ো কারণ ছিল। ডিক্টেটর মুসোলিনি জাতীয় অপমানের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য ইতালির সৈন্যবাহিনী উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছিল। ইতালির ফ্যাসিস্ট দল যুদ্ধোন্মাদনা সৃষ্টি করে সৈন্যবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিল।

ডেভিড টমসন লিখেছেন যে ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের কারণ হল ঐ দেশটির বিশাল আয়তন এবং প্রচুর প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ। ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণকে বুঝিয়েছিল যে ঐদেশে পাইন আপেল থেকে প্লাটিনাম সব পাওয়া যায়। সেইসময় ইতালি ছিল ইউরোপের একটি দরিদ্র, জনবহুল দেশ। তিরিশের দশকের বিশ্ব মহামন্দার ধাক্কায় ইতালির অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দেশের মধ্যে বেকারের সংখ্যা বেড়েছিল, সরকারকে সুদের হার কমাতে হয়। মুসোলিনি মনে করেন আবিসিনিয়ার মতো বৃহৎ দেশ দখল করা সম্ভব হলে ইতালির অর্থনৈতিক সমস্যার অনেকখানি সমাধান হয়ে যাবে। এখান থেকে ইতালির শিল্পের জন্য প্রচুর কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব হবে, আবার এখানকার বাজারে শিল্পপণ্য বিক্রি করা যাবে। ইতালির উদ্বৃত্ত জনগণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে, পুঁজিপতিরা এখানে নতুন শিল্পস্থাপন করতে পারবে।

ইতালি-আবিসিনিয়া দ্বন্দ্বের আসল কারণ হল ইতালির জাতীয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা এবং সাম্রাজ্যলাভের আবেগময় কামনা। ইতালির অধীনস্থ ইরিত্রিয়া ও সোমালিল্যান্ডের মধ্যবর্তী হওয়ায় আবিসিনিয়ার সঙ্গে প্রায়ই সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের উপনিবেশের সঙ্গেও এধরনের ঘটনা ঘটত। এসব সীমান্ত সংঘাত শান্তিপূর্ণভাবে মেটানোর জন্য আবিসিনিয়া ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ইতালির সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ইতালি ও আবিসিনিয়ার সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সোমালিল্যান্ড সীমান্তে একটি সংঘর্ষ হয়। ওয়াল ওয়াল মরূদ্যানের অধিকার নিয়ে বিরোধ বেধেছিল। ইতালি মরূদ্যানটি দখল করেছিল কিন্তু তিরিশ জন ইতালি সৈন্য সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছিল। ইতালি এই সংঘাতের জন্য আবিসিনিয়াকে দায়ী করে ক্ষমা প্রার্থনা ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। আবিসিনিয়া ইতালির আগ্রাসী মনোভাব বুঝতে পেরে লিগকে হস্তক্ষেপ করতে বলেছিল। ইতালি এই ঘটনার পর আবিসিনিয়া সীমান্তে সৈন্যসমাবেশ ও সমরসজ্জা অব্যাহত রেখেছিল। লিগ ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশকে আপসে সালিশির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মিটিয়ে নিতে বলেছিল, কিন্তু ইতালি শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মেটাতে আগ্রহ দেখায়নি। সালিশি কমিটির প্রস্তাব সে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ অক্টোবর মুসোলিনি আবিসিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আক্রমণ শুরু করেন। পরের বছর রাজধানী আদ্দিস আবাবার পতন ঘটলে সম্রাট হাইলে সেলাসি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আবিসিনিয়া ইতালিকে প্রতিহত করতে পারেনি, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বসন্তকালে প্রতিরোধ শেষ হয়ে যায়।

ইতালি লিগকে অগ্রাহ্য করলে লিগ তাকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করেছিল। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করা হয়, অবরোধের পণ্য তালিকা থেকে কয়লা ও তেলকে বাদ দেওয়া হয়। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইতালির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবার পক্ষপাতী ছিল না, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, আলবানিয়া ও সুইজারল্যান্ড এই অর্থনৈতিক অবরোধ মানেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ইতালিতে অস্ত্রশস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করে দেন। ব্রিটেন ও ফ্রান্স গোপন কূটনৈতিক পথে ইতালিকে সন্তুষ্ট করে বিরোধের নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিল। আবিসিনিয়ার দুই- তৃতীয়াংশ তারা ইতালিকে দিতে চেয়েছিল। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভাল ও ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোর এই নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসেন। লাভাল-হোর পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে পড়লে ইংল্যান্ডের জনমত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। হোরের উত্তরাধিকারী ইডেন যৌথ নিরাপত্তার ওপর জোর দেন। অর্থনৈতিক অবরোধ ছাড়া ইতালির বিরুদ্ধে অন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক অবরোধ সামরিক শক্তির সহায়তা ছাড়া সফল হয় না। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইতালির বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এসময় জার্মানি, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল লিগের সদস্য ছিল না। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সমর্থন ছাড়া লিগের পক্ষে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। পশ্চিমি গণতান্ত্রিক দেশগুলি আগ্রাসনের সামনে কঠোর হতে পারেনি বলে লিগের যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়ে যায়। বিনাবাধায় ইতালি আবিসিনিয়া গ্রাস করে নিয়েছিল, লিগ পরে অর্থনৈতিক অবরোধ ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দ্বিধাগ্রস্ত নীতি লিগের ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল।

ডেভিড টমসন জানাচ্ছেন ইতালি কর্তৃক আবিসিনিয়া অধিকারের ফলে লিগের নেতৃত্বাধীন যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার পতন ঘটেছিল। মাঞ্চুরিয়া, জার্মানি ও ইতালির ক্ষেত্রে দেখা যায় লিগ তার আদর্শ ও সংবিধান অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অর্থনৈতিক অবরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, সব সদস্যরাষ্ট্র লিগের সঙ্গে এব্যাপারে সহযোগিতা করেনি। সামরিক শক্তি ছাড়া অর্থনৈতিক অবরোধ ব্যর্থ হয়ে যায়। ডেভিড টমসন মনে করেন এই আর্থিক অবরোধের ব্যাপারটি ছিল অবিজ্ঞচিত ও অকার্যকর (Unwise or ineffective)। অর্থনৈতিক অবরোধ নিয়ে সদস্য দেশগুলির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। মুসোলিনি আবিসিনিয়াতে সফল হলে হিটলার উৎসাহিত হয়ে রাইনল্যান্ড অধিকার করেন। ভার্সাই সন্ধির শর্ত তিনি আগেই ভেঙেছিলেন, রাইনল্যান্ড অধিকার করে তিনি লোকার্নো চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেন। জার্মানি স্বেচ্ছায় ফ্রান্সের সঙ্গে এই চুক্তি করেছিল। ডেভিড টমসনের মতে, এই ঘটনার পর শুধু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান লিগ নয়, আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তিগুলি তাদের মর্যাদা ও স্থায়িত্ব হারিয়ে ফেলেছিল।

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালি আবিসিনিয়া অধিকার করেছিল। ঐ বছর স্পেনের সামরিক নেতারা প্রজাতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। ইউরোপের ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি উৎসাহিত হয়ে গৃহযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, গণতন্ত্র কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। জার্মানি, ইতালি ও জাপান অক্ষশক্তি গঠন করেছিল। আবিসিনিয়া যুদ্ধের পর পৃথিবী আর একধাপ মহাযুদ্ধের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। জাপান উৎসাহিত হয়ে চিনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরু করেছিল (১৯৩৭)। আগ্রাসী জার্মানি ও জাপান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মহড়া শুরু করেছিল।

তথ্যসূত্র 

  • আধুনিক ইউরোপ : ফরাসি বিপ্লব থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (১৭৮৯-১৯৪৫), সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, মিত্রম, কলকাতা, ২০১৩, পৃ ৪৬৫-৪৭৮

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.