ফ্রয়েডের সমাজচিন্তা

“I think, the meaning of the evolution of civilization is no longer obscure to us. It must present the struggle between Eros and Death, between the instinct of life and the instinct of destruction, as it works itself out in the human species. This struggle is what all life essentially consists of, and the evolution of civilization may therefore be simply described as the struggle for life of the human species. And it is this battle of the giants that our nurse-maids try to appease with their lullaby about Haven…..”

“আমি মনে করি, সভ্যতার বিবর্তনের অর্থ এখন আর আমাদের কাছে অস্পষ্ট নয়। এটি অবশ্যই ইরোস এবং মৃত্যুর মধ্যে, জীবনের প্রবৃত্তি এবং ধ্বংসের প্রবৃত্তির মধ্যে সংগ্রামকে উপস্থাপন করে, যেমনটা মানব প্রজাতির মধ্যে দেখা যায়। এই সংগ্রামই মূলত সমস্ত জীবনকে নিয়ে গঠিত, এবং সভ্যতার বিবর্তনকে তাই কেবল মানব প্রজাতির জীবনের সংগ্রাম হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। আর এই দৈত্যদের লড়াই, যা আমাদের নার্স-মেইডরা আমাদেরকে হ্যাভেন সম্পর্কে তাদের ঘুমপাড়ানি গান দিয়ে তুষ্ট করার চেষ্টা করে…..”

ভূমিকা

মনঃসমীক্ষণের জনক হিসেবে পরিচিত অস্টিয়ান চিন্তাবিদ সিগমন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) (১৮৫৬-১৯৩৯) ছিলেন মূলত একজন মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের ক্ষেত্রে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস যেরূপ খ্যাতি অর্জন করে পাঠক সমাজে বিশেষ অবস্থান করে নেন, ঠিক সেরূপ অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী সিগমন্ড ফ্রয়েড মনস্তত্ত্ব, নৃতত্ত্ব ও ধর্মের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক প্রতিভারূপে আবির্ভূত হন এবং প্রায় একই আসনে পাঠক মনে স্থান করে নেন। মনোবিশ্লেষণের রাজত্বে এই প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সিগমন্ড ফ্রয়েড কালক্রমে তার অসাধারণ প্রতিভা দ্বারা মনোবিশ্লেষক, মনস্তত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার গবেষণার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব (Psycho-analysis Theory)। এখানে তিনি মানব মনের তিনটি স্তরের কথা উল্লেখ করেন। যথা: সজ্ঞান স্তর (Conscious stage); অর্ধ-সজান স্তর (Unconscious stage) এবং নির্মান স্তর (Subconscious stage)। ফ্রয়েড বলেন, মানুষের যৌন চিন্তাই সকল কর্ম ও ব্যবহারের ভিত্তিভূমি। ফ্রয়েড তার আলোচনায় আদিম মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে টোটেমবাদ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন। এছাড়াও তিনি আধুনিক সভ্যতার সংকট দেখে হতাশ হয়েছেন। তিনি মনে করেন, আধুনিক সভ্যতা মানুষের সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছে এবং বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দিয়েছে। এ প্রেক্ষিতে তিনি মানবসমাজের সংকটের মনঃসমীক্ষণ রচনা করেন। ফ্রয়েড আরো উল্লেখ করেন, মানুষের মধ্যে রয়েছে জীবন প্রবৃত্তি (Life instinct) এবং মরণ প্রবৃত্তি (Death instinct)। জীবন প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে সৃষ্টির প্রেরণা যোগায় এবং মরণ প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে ধ্বংসের প্রবণতা সৃষ্টি করে। বস্তুত আধুনিক সমাজচিন্তায় ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

ফ্রয়েডের জীবনী

আধুনিক সমাজচিন্তার জগতে যে বিভিন্ন মতবাদগুলো বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করেছে তার মধ্যে বিশ্ববরেণ্য মনঃসমীক্ষক সিগমন্ড ফ্রয়েডের Theory বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি ১৮৫৬ সালের ৫ মে চেকোশ্লাভাকিয়ার মোরাভিয়ার ফ্রিবার্গে এক মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রায় আশি (৮০) বছর এই শহরেই ছিলেন। কিন্তু নাৎসি (Nazi) কর্তৃক অস্ট্রিয়া আক্রমণের কারণে শেষে অন্যত্র চলে যান। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা স্কুলে (Medical School of the University of Vienna) ভর্তি হন এবং আট বছর পর গ্রাজুয়েট হন। চল্লিশ বছর ধরে তিনি অধিকতর অশান্তি ও আত্মবিশ্লেষণের ফলে প্রচুর অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি যেহেতু ভিক্টোরিয়ান যুগে (Victorian era) বাস করতেন, তাই সেই সময় যৌন অবদমন (Sexual repression) বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছেন। উপরন্তু প্রথম মহাযুদ্ধকালে ইউরোপ ধ্বংসের সময় তার স্ত্রীও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফ্রয়েড এসব যৌন অবদমন ও শত্রুতামূলক আগ্রাসনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, যার প্রভাব পরবর্তীতে তার মানব আচরণ বিশ্লেষণে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

উনিশ শতকের শেষের দিকে তিনি স্নায়বিক রোগের চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি তার চিকিৎসাকালে কিছু রোগের (আংশিক পক্ষাঘাত, কাঁপুনি, কানে কম শোনা ইত্যাদি) দৃশ্যত দৈনিক সমস্যাগুলোর মধ্যে জৈবিক কোন ভিত্তি খুঁজে পান নি। এটা এমন স্বীকৃতি পায় যে, এই ধরনের দৈহিক সমস্যাগুলো অনেক সময় মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে থাকে। ঐ সময়ে এই উপসর্গকে হিস্টিরিয়া (Hysteria) বলা হতো।

তার সহকর্মী Josef Breuer এর উৎসাহে ফ্রয়েড হিস্টিরিয়া রোগের এবং নতুন চিকিৎসায় হাত দেন এবং ব্যর্থ হন। Breuer হিস্টিরিয়াগ্রস্ত যুবতী মেয়েদের সাথে আবেগময় বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা করতেন। কিন্তু Breuer এই “Talking cure’ পদ্ধতি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না এবং পরবর্তীতে তা পরিত্যাগ করেন। যাহোক, ফ্রয়েড এই পদ্ধতির কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং প্রতিনিয়ত তার ব্যবহার করতে থাকেন। এভাবে চিকিৎসার দিকে তার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে তিনি অনেক সময় ব্যয় করেন, নানা সংশোধনের মাধ্যমে তিনি একটি নতুন পদ্ধতি গড়ে তোলেন, যা ফ্রয়েড এর ‘মনঃসমীক্ষণ’ (Psycho-analysis) নামে পরিচিত।

ফ্রয়েড তার রোগীদের সাথে নানান মিথস্ক্রিয়া ও আত্মবিশ্লেষণের সাহায্যে ১৯০১, ১৯২৪, ১৯৪০ এর দশকে ‘মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বটির’ ব্যাপক প্রসার ঘটান। তত্ত্বটি শৈশব স্মৃতি, নিজ্ঞান প্রেষণা, দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তি, যৌনতা ও ক্রোধের মতো বিষয়গুলো কিভাবে কাটিয়ে উঠে ইত্যাদির সাহায্যে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, প্রেষণা এবং মানসিক বিকৃতির ব্যাখ্যা করতে প্রয়াস করেছেন। অবশেষে এই বিখ্যাত মনীষী ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ফ্রয়েডের রচনাবলি

ফ্রয়েড এর তত্ত্বটি মোটামুটিভাবে প্রথম সর্বসাধারণের মনোযোগের বিষয় হয় যখন তার প্রথম বই ‘The Interpretation of Dreams’ (1899-1900) প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ফ্রয়েড আরো কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেন যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

  • 1. The Interpretation of Dreams (1900),
  • 2. The Pschopathology of everyday (1901),
  • 3. Jokes and their Relation to the Unconscious: A Case of Hysteria (1905).
  • 4. Three Essay on Sexuality (1905),
  • 5. Totem and Taboo (1913),
  • 6. On the History of the Psycho-analytical Movement (1914).
  • 7. Group Psychology and the Analysis of the Ego (1921).
  • 8. An Autobiographical Study (1925),
  • 9. The Future of an Illusion (1927),
  • 10. Civilization and Its Discontents (1930),
  • 11. Moses and Monotheism (1934-1938)।

ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সংগঠন তত্ত্ব  (Structure and Development of Personality)

সিগমন্ড ফ্রয়েড তার ‘The Interpretation of Dreams’ (1980 Vols IV-V) গ্রন্থে শত শত রোগীর জীবন ইতিহাস পরীক্ষা করে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সংগঠন সম্বন্ধে একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন, যা ফ্রয়েডের ‘মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব’ নামে পরিচিত।

ব্যক্তিত্বের কাঠামো (Structure of Personality)

ফ্রয়েড তার ব্যক্তিত্ব কাঠামোর তিনটি মৌল সত্তা বা উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা: ১. ইদ্ (Id) -আদিম সত্তা, ২. ইগো (Ego) – অহং সত্তা এবং ৩. সুপার ইগো (Super Ego) -অতি অহং বা বিবেক বা অধিসত্তা। এই তিনটি সত্তার মাধ্যমেই মানুষের ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে –

  • ১. আদিম সত্তা (Id) : মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে আদিম সত্তা (Id) বলে। Id স্তর মানুষের জন্মগত জৈবিক সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চায়। সমস্ত যৌন কামনা বাসনা এই স্তরে প্রকাশ পেতে থাকে। আদিমসত্তা (Id) যেন অবচেতন মনের এক স্বার্থপর শিশু। সে শুধু তৃপ্তি চায়, আনন্দ চায়। শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সে শুধুমাত্র একটি আদিম সত্তা (Id) নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তার জৈবিক প্রেষণাগুলো চরিতার্থ হলেই সে খুশি হয়।
  • ২. অহং সত্তা (Ego) : অহং (Ego) হলো বাস্তব জ্ঞানের সমষ্টি এবং বাস্তব নিয়মের সেবায় নিয়োজিত। অহং মানুষকে সামাজিক উপায়ে, বাস্তবসম্মত উপায়ে তার প্রেষণাগুলোকে পূরণ করার জন্য প্রেরণা দেয়। অথবা অহং ব্যক্তির আদিম সত্তা (Id) কে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাখতে চেষ্টা করে। অহং এর কাজ হলো আদিম কামনা ও বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।
  • ৩. অধিসত্তা (Super Ego) : Super Ego ব্যক্তিতে আদর্শবোধ তথা ভালো, মন্দ, উচিত, অনুচিত প্রভৃতি শিক্ষা দেয়। এটা সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধের স্বীকৃতিস্বরূপ। এটি নিজস্ব বিবেকের মূল্য দেয়। Hall and Lindzeg (1957) বলেন, “বিবেক হলো ব্যক্তির নৈতিক হাতিয়ার। সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ বিবেক দ্বারা সামাজিক মূল্যবোধ মেনে চলে। সমাজের মূল্যবোধের পরিপন্থি কোন কাজে মানুষ লিপ্ত হয় না। অধিসত্তা অহংকে প্রভাবিত করে।”

ফ্রয়েডের মতে, মানুষের যৌন চিন্তাই সকল কর্মের ও ব্যবহারের ভিত্তিভূমি। যৌনবোধ ও কাম প্রবৃত্তি মানুষের সকল প্রকার ব্যবহার ও কর্মের নিয়ন্তা। মানুষ কাজ করে যৌন প্রবৃত্তি থেকে এবং যৌন প্রবৃত্তি সমাজের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। ফ্রয়েডের এই ধরনের ব্যাখ্যাকে ‘কর্মের মনস্তাত্ত্বিক’ ব্যাখ্যা বলা হয়।

ব্যক্তিত্বের বিকাশ (Development of Personality)

ফ্রয়েড ব্যক্তিত্ব বিকাশে কতকগুলো পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন:

  • ১. লিবিডো (Libido): “লিবিডো’ আরও সহজভাবে এবং সংকীর্ণভাবে যৌন প্রবৃত্তিকে বোঝায় যা ফ্রয়েড এখানে বিস্তৃতভাবে “ইরোস” হিসাবে ব্যাখ্যা করছে। শৈশবকাল থেকে বৃদ্ধ বয়স অবধি মানুষের মধ্যে যে যৌনচেতনা বর্তমান থাকে ফ্রয়েড তাকে লিবিডো বলেছেন। তবে শিশুকালের কাম প্রবৃত্তি এবং পরিণত বয়সের কাম প্রবৃত্তির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। ফ্রয়েড লিবিডোর বিভিন্ন রকম আত্মপ্রকাশের কথা উল্লেখ করেছেন :
    • প্রথমত, শিশু নিজেকে ভালোবাসার মধ্যে লিবিডোর আত্মপ্রকাশ ঘটে থাকে। অন্যকথায় যাকে বলা যায় আত্মপ্রেম (Nareissism)।
    • দ্বিতীয়ত, এর আত্মপ্রকাশ ঘটে বালক তার বন্ধু এবং খেলার সাথীর প্রতি আকর্ষণবোধের মধ্য দিয়ে। যাকে বলা হয় Fieno sexuality.
    • তৃতীয়ত, লিবিডোর আত্মপ্রকাশ ঘটে পরিণত বয়সে যুবতীর প্রতি যুবকের যৌন আকর্ষণ এবং ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। একে বলা হয় Hetero sexuality.
  • ২. প্রাক-যৌনকাম স্তর (Pre-genital stage): এ স্তরকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়।
    • ক. মুখকাম স্তর (Oral stage): শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের সর্বপ্রথম স্তর হলো Oral stage, এই পর্যায়টি এক বছর বয়সের মধ্যে দেখা যায়। এই পর্যায়ে শিশুরা দুগ্ধ পান করে এবং পরে দাঁত দিয়ে কামড় দিয়ে আহার্য গ্রহণ করতে শিখে। এই বয়সে মুখই হলো যৌন তৃপ্তির উৎস। অর্থাৎ ফ্রয়েড মনে করেন, দুগ্ধ এবং চর্বন ক্রিয়ায় শিশুরা যে আনন্দ পায়, সেটা যৌন পরিতৃপ্তিরই নামান্তর। প্রথম বছরে যদি শিশুর দুগ্ধপান স্পৃহা চরম পরিতৃপ্তি লাভ করে তাহলে শিশু ভবিষ্যৎ জীবনে আশাবাদী হয়। কিন্তু শিশুর মুখকামিতা ব্যাহত হলে পরবর্তী জীবনে সে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সে তর্ক করা, বক্তৃতা দেওয়া এবং মদ্যপান, সিগারেট খাওয়া ভালোবাসে।
    • খ. পায়ুকাম স্তর (Anal stage) : এই পর্যায় দুই থেকে তিন বছর বয়সে শিশু যৌন তৃপ্তির পথ হিসেবে পায়ুদ্বার উদ্দীপনাকে বেছে নেয়। এই বয়সে শিশু পায়ু দ্বারের রেচন বা বর্জন প্রক্রিয়া থেকে তৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু পিতামাতার কঠোর শাস্তির জন্য সে এসব প্রক্রিয়া অবদমিত করে ফেলে এবং কোষ্ঠবদ্ধ করে রেখে যৌন তৃপ্তির বিকল্প পথ আবিষ্কার করে। এই বয়সে কঠোর শাস্তি শিশুকে ভবিষ্যৎ জীবনে মল ত্যাগের প্রতি বিতৃষ্ণা করে তুলতে পারে, যা পরিণত বয়সে কৃপণতা, অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা ও কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে।
    • গ. আত্মরতি স্তর (Phallic stage) : এই পর্যায়ে ৪-৬ বছর বয়সে শিশু বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সম লিঙ্গের প্রতি হিংসাবোধ করে। এই বয়সে শিশু নিজের যৌন অঙ্গকে উদ্দীপিত করে আনন্দ পায়।
    • ঘ. সুপ্তিকাল (Latency stage): এই পর্যায়ে ৬-১৪ বছর বয়সের শিশু শৈশব অবস্থা থেকে প্রাপ্তবয়স্কতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
    • ঙ. যৌন স্তর (Genital stage): এ পর্যায়ে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির অন্যের প্রতি ভালোবাসা বিকাশ লাভ করে এবং যৌন যন্ত্রের পূর্ণতা হেতু স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারে।

ফ্রয়েড কাম প্রবৃত্তির দুটো দিকের কথা উল্লেখ করেছেন। যথাঃ ১. ইডিপাস এষণা (Oedipus complex) এবং ২. ইলেকট্রা এষণা (Electra complex) |

  • ১. ইডিপাস এষণা: পুরুষ শিশুরা মাতার প্রতি যৌন আকর্ষণবোধ ও যৌন আসক্তি এবং সাথে সাথে পিতার প্রতি ঈর্ষাবোধকে ইডিপাস এষণা বলা হয়।
  • ২. ইলেকট্রা এষণা: অন্যদিকে পিতার প্রতি মেয়ের যৌন আকর্ষণবোধকে ইলেকট্রা এষণা বলা হয়।

সারণি: ফ্রয়েডের ব্যক্তিত্ব বিকাশ স্তর

স্তর (Stage) কাছাকাছি বয়স (Approxim ate ages) যৌন তৃপ্তির কেন্দ্র (Erotic Focus) মূল কার্যাবলি এবং অভিজ্ঞতাসমূহ (Kye tasks and experiences)
মুখকাম (Oral) ০-১ মুখ (Mouth, sucking. bitting) স্তন্যপান অভ্যাস ছাড়ানো (Weaning from breast or bottle)
পায়ুকাম (Anal) ১-৩ পায়ুদ্ধার (Anus: expelling or retaining feces) টয়লেট অভ্যাস করানো (Toilet training)
আত্মরতি (Phallic) ৩-৬ যৌনাঙ্গ (Genitals: mastur- bating) প্রাপ্তবয়স্ক ভূমিকার সঙ্গে একাত্মতা, এবং ইডিপাস সংকট কাটিয়ে ওঠা (Identifying with adult role models: coping with Oedipus crisis)
সুপ্তিকাল (Latency) ৬-১২ কিচ্ছু না (None: Sexually repressed) সামাজিক সংশ্রব বৃদ্ধি (Expanding Social contacts)
যৌনকাম (Genital) বয়ঃসন্ধির সম্মুখে (Puberty onward) যৌনাঙ্গ (Genitals: being sexually intimate) অন্তরঙ্গ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা (Establishing relationships: intimate contributing to society through working)

Source: Weiten W. Psychology: Themes and Variation 1989, P-438.

ফ্রয়েড এর মতে, উপরিউক্ত পর্যায়গুলো পার না হলে মানুষের ব্যক্তিত্ব সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হতে পারে না। এর ফলে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ দেখা দেয়।

ব্যক্তিত্বের গতিশীলতা (Dynamics of Personality)

ব্যক্তিত্বের চলমান আচরণ ও গতিময়তার জন্য তার আদি কামনাগুলো দায়ী। এগুলো একটি বৃহৎ ও মৌলিক শক্তি থেকে সৃষ্টি হয়। একথা ভাবলে ঠিক হবে না যে, যে শক্তি আমাদের শ্বাসক্রিয়া বা হজমের ক্ষমতা যোগায় এবং যে শক্তির মাধ্যমে আমরা চিন্তা এবং স্মরণ করার ক্ষমতা পাই তা পৃথক। ফ্রয়েড এখানে শক্তিরূপে যে আত্মিক শক্তির কথা বলেছেন শক্তির নিত্যতা সূত্রানুযায়ী, সমগ্র মহাজাতিক ব্যবস্থায় শক্তির কোন ধ্বংস নেই; শক্তি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হতে পারে মাত্র। এ মতে আত্মিক শক্তি পরিবর্তিত হয়ে শারীরবৃত্তীয় শক্তিতে পরিণত হয় এবং উল্টোও হতে পারে। ফ্রয়েড ব্যক্তিত্বের গতিময়তা আলোচনায় প্রবৃত্তির (Instinct) উপর খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ উত্তেজনার সহজাত মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা হলো প্রবৃত্তি। মনস্তত্ত্বগত দিক থেকে যাকে ইচ্ছা (খাদ্য) বলে দৈহিক উত্তেজনার ক্ষেত্রে তাকে অভাববোধ (Need) বলে। এরূপ ক্ষুধাকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। শারীরতত্ত্বীয়ভাবে এর অবস্থা হলো দেহ কলায় পুষ্টিগত ঘাটতি। পক্ষান্তরে, মনস্তত্বগতভাবে ইচ্ছা হলো খাদ্য পাওয়া।

তিনি মনে করেন, ব্যক্তিত্বের গতিময়তার ক্ষেত্রে সহজাত প্রবৃত্তি পারিপার্শ্বিক উদ্দীপনার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি প্রবৃত্তি হলো আত্মিক শক্তির পরিমাপ। ফ্রয়েড যাকে বলেছেন, “A measure of the demand made upon the mind for work.” (“কাজের জন্য মনের উপর তৈরি চাহিদার একটি পরিমাপ।”) (1905: 168) সাধারণভাবে প্রবৃত্তিগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা: ১. জীবন প্রবৃত্তি (Life instinct) এবং ২. মরণ প্রবৃত্তি (Death instinct)।

  • ১. জীবনবৃত্তি (Life instinct): ব্যক্তিকে বেঁচে থাকতে ও জীবনের গতির প্রসারণের জন্য কাজ করতে হয়। জীবন প্রবৃত্তি একটি গঠনমূলক সম্পাদনা। ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং যৌনতা এ ভাগে পড়ে। যে শক্তির মাধ্যমে জীবন প্রবৃত্তি তার কাজ সমাধা করে তা হলো লিবিডো। ফ্রয়েড এখানে যৌনতার উপর অধিক মনোযোগ দিয়েছেন: “Actually the sex instinct is not one instinct but many that is there are a number of separate bodily needs which give rise to erotize wishes.” [Hall & Lindzey, 1957: 39] বা “প্রকৃতপক্ষে যৌন প্রবৃত্তি একটি প্রবৃত্তি নয়, বরং অনেকগুলি পৃথক শারীরিক চাহিদা রয়েছে যা যৌন ইচ্ছার জন্ম দেয়।”ফ্রয়েড ত্বক, ঠোঁট, মুখগহ্বর, পায়ুদ্ধার এবং যৌনাঙ্গ ইত্যাদিকে একত্রে ‘যৌনময় বলয়’ (Erogenous zones) বলেছেন। যার মাধ্যমে ব্যক্তি সুখানুভূতি লাভ করে।
  • ২. মরণ প্রবৃত্তি (Death instinct): ব্যক্তিকে ধ্বংসের পথে বা আত্মনিগ্রহের পথে পরিচালিত করে। এটি একটি বিধ্বংসী (Destructive) সম্পাদনা। “The goal of all life is death.” (সকল জীবনের লক্ষ্য মৃত্যু।) [ফ্রয়েড, 1920: 38]। ব্যক্তির মধ্যে দুটো বিপরীত শক্তি সদা সক্রিয় থেকে জীবনের স্বরূপ উদঘাটিত করে।

সমালোচনা

ফ্রয়েডের মতবাদের মধ্যে যে অভিনবত্ব আছে তা অস্বীকার করা যায় না এবং সে কারণেই ফ্রয়েডের মতবাদ চিন্তাজগতে বেশ একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ফ্রয়েডের মতবাদেরও নানা রকম সমালোচনা করা হয়েছে। তার মতবাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুরো উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো নিম্নে দেওয়া হলো-

  • ১. ফ্রয়েড যৌনাকাঙ্ক্ষা বিষয়টাকে অতিরঞ্জিত করেছেন। যার মধ্যে তার মতবাদের বিরুদ্ধে সর্বযৌনতাবাদ (Par-sexuality) এর অভিযোগ আনা হয়েছে। মানুষের জীবনে যৌন প্রেষণার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মানুষের আচরণের মূলে এই একটি প্রেষণার অস্তিত্বই আছে এমন কথা বলা চলে না। বস্তুত মানুষের আচরণ এত জটিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ যে, কেবলমাত্র যৌন প্রেষণার সাহায্যে তার ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন।
  • ২. ফ্রয়েড মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত রোগীদের উপর ভিত্তি করেই তার মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু অসুস্থ মানুষের মানসিক ব্যাধির উপর ভিত্তি করে যে মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তার যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা যায়।
  • ৩. ফ্রয়েডের ‘ইডিপাস এষণা’ সম্পর্কিত অভিমত কষ্টকল্পিত আনুমানিক ধারণা মাত্র। অনেক সুস্থ ব্যক্তি এ জাতীয় এষণা নিজেদের মধ্যে অনুভব করে না।
  • ৪. ফ্রয়েডের বিচারবুদ্ধি অপেক্ষা সহজাত প্রবৃত্তির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত যুক্তিগ্রাহ্য নয়। বিচারবুদ্ধির সাহায্যে আমরা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির প্রকাশকে নানাভাবে পরিবর্তিত, প্রয়োজন হলে পরিশোধিত করতে পারি।
  • ৫. শৈশব ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্বের ভিত্তি রচনা করে – এ সিদ্ধান্ত বিতর্কমূলক।

উপরিউক্ত সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ফ্রয়েডের ‘মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব’ এর প্রভাব অপরিসীম। ফ্রয়েডের তত্ত্বের কোন কোন ধারণা আমাদের সমকালীন সামাজিক মনোবিজ্ঞানীরা সাদরে গ্রহণ করেছে। ফলে মানবজীবন সম্বন্ধে গবেষণায় ফ্রয়েডের তত্ত্বের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মানব ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় সূচনা করেছে।

সভ্যতার এবং এর অসন্তোষ (Civilization and Its Discontents)

আধুনিক সমাজচিন্তার জগতে যে বিভিন্ন মতবাদগুলো বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করেছে তার মধ্যে বিশ্ববরেণ্য মনঃসমীক্ষক সিগমন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্ব বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার তত্ত্ব বর্ণনায় ‘Civilization and Its Discontents’ (১৯৩০) গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য (From Sigmund Freud, Civilization and Its Discontents, trans. James Strachey (New York: Norton. 1961). Chapters 6 and 7. PP-64-80.)। এই গ্রন্থে তিনি মানবসভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তার মতবাদের প্রধান বিষয় হলো Sex is the determinant factor of society, অর্থাৎ, মানবসমাজ যৌনপ্রবৃত্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন সভ্যতা মানুষের জন্য অভিশাপ হিসেবে অভিভূত হয়েছে। মানুষের সকল অশান্তির মূলে রয়েছে এ সভ্যতা। আর এ সভ্যতাই মানুষের সকল সুখ- শান্তি ও আনন্দ-অনুভূতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

সভ্যতার উদ্ভব ও পরিবার গঠন 

ফ্রয়েড এর মতে, মানুষ যখন সমষ্টিগতভাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়াসে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য সচেষ্ট হয় তখনই সভ্যতার উদ্ভব ঘটে। সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ফ্রয়েড বলেন, সমাজ বিকাশের অতি আদিম পর্যায়ে পুরুষজাতি নারী জাতির প্রতি তার কাম প্রবৃত্তি অনুভব করেছে। নারীকে সারাক্ষণ কাছে রেখে পুরুষরা যৌন আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করেছে। যৌন প্রবৃত্তির তাড়না যেমন পুরুষরা অনুভব করেছে, তেমনি অসহায়বোধ ও সন্তানের নিরাপত্তার ধারণা পুরুষের সাথে নারীকে ঘনিষ্ঠ করতে সহায়তা করেছে। এমনিভাবে নারী ও পুরুষের ভালোবাসা এবং সন্তানদের প্রতি ভালোবাসাও স্নেহের মাধ্যমে পরিবার সৃষ্টি হয়েছে।

ফ্রয়েড বলেন, ভালোবাসা হলো কৃষ্টি বা Culture এর প্রধান উৎস। এ ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে সমাজের যথেষ্ট পরিবর্তন সূচিত হয়। সমাজের সাথে সাথে মানুষ পরিবারবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে এবং অস্তিত্ব রক্ষায় সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করে জাতিকে প্রগতির পথে পরিচালিত করে। তার মতে, সভ্যতা দু’টি উদ্দেশ্য সাধন করে – ১. প্রতিকূল অবস্থা থেকে মানুষকে রক্ষা করে, ২. পারস্পরিক সৌহার্দ্যের সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে।

সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে মানুষের মধ্যে গড়ে উঠে হৃদ্যতা, যা তাদের দলবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করতে প্রেরণা যোগায়। বাঁচার তাগিদে ধারণার পিছনে রয়েছে আত্মরক্ষার আকাঙ্ক্ষা। পক্ষান্তরে, ভালোবাসার চেতনা নিয়েছে সর্বজনীন রূপ। এ প্রত্যয়টিকে তিনি প্রকাশ করেছেন কবি গিলাবের অনুকরণে দু’টি প্রতীকের মাধ্যমে। যথাঃ 1. Hunger and 2. Love. -What makes the world? এখানে Hunger বা ক্ষুধা ব্যক্তিসত্তা এবং Love বা ভালোবাসা সর্বজনীন সত্তা সংরক্ষণের চেতনাতে তিনি জীবন প্রবৃত্তি হিসেবে সূচিত করেছেন। আর এর পাশাপাশিই বিরাজ করেছে ধ্বংস বা মরণ প্রবৃত্তি।

জীবন ও মরণ প্রবৃত্তি

ফ্রয়েড মানবসভ্যতার জীবনী শক্তি হিসেবে কাম প্রবৃত্তি বা লিবিডোকে উল্লেখ করেন। মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা ভালোবাসা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা ইত্যাদি জীবন প্রবৃত্তির অন্তর্গত। আর হিংসা ধ্বংসাত্মক প্রবণতাই হলো মরণ প্রবৃত্তি। জীবন প্রবৃত্তি আর মরণ প্রবৃত্তির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য। মানুষের অবদমিত জীবন প্রবৃত্তি ও মরণ প্রবৃত্তি হতাশা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে যার মধ্য দিয়ে জাগ্রত হয় ধ্বংস চেতনা। ধ্বংসের মধ্যেই নিহিত থাকে সৃষ্টির বীজ। জীবন প্রবৃত্তির সাথে মরণ প্রবৃত্তির বিরোধের ফলশ্রুতিতে সমাজ ও সভ্যতা নতুন নতুন স্তরে উপনীত হয়। এ সম্পর্কে ফ্রয়েড তার ‘Totem and Taboo’ (1913) ও ‘Moses and Monotheism’ (1934-1938) গ্রন্থ দু’টিতে বলেন, “আদি যুগে আদি পিতা বা গোত্রপতি পুত্রদের বঞ্চিত করে তারা নারীদের উপর একচ্ছত্র অধিকার ‘ভোগ’ করতো।” অবদমিত পুত্ররা যৌন তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পিতার প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠে এবং এক সময় পিতাকে হত্যা করে পিতার প্রতীক হিসেবে একটি Totem প্রাণীকে নিয়ে যায়। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় নতুন সমাজচেতনা। Totem প্রাণীকে কেন্দ্র করে আদিম বিচ্ছিন্ন সমাজব্যবস্থার বদলে তারা প্রতিষ্ঠিত করে সুখবন্ধ সমাজজীবন। এ প্রসঙ্গে ফ্রয়েড বলেন, এমন করে মানুষ ধ্বংসের ভেতর দিয়ে সৃষ্টি এবং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রাণের তথা সভ্যতা বিকাশের প্রয়াস পেয়েছে।

অবাধ যৌনাচার ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃত্তিগুলোতে বাধা প্রদানের মাধ্যমে সভ্যতা কর্তৃক মানুষকে বাধাদান

আদিম সমাজে মানুষের মূল যৌনাচার প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত ও প্রশমিত ছিল না। ফলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ কম ছিল। কিন্তু ক্রমাগত মানুষের সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের ফলে আরোপিত হয় কতকগুলো অনুশাসন ও অনুমোদন। ফলশ্রুতিতে মানুষের যৌনাচার প্রবৃত্তির উপর বাধা আসে। সভ্যতার বিকাশ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও গোপনীয়তা আরোপিত হওয়ায় মানুষ হতাশাগ্রস্ত, কলহপ্রিয়, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। ফ্রয়েডের মতে, সমাজ অনুমোদিত কার্যাবলি এবং ব্যক্তির নিজস্ব মনের তাগিদের নিয়ত সংঘাত চলেছে।

ফ্রয়েড দেখিয়েছেন, আদিম ব্যবস্থা থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সমাজ সভ্যতায় উপনীত হয়েছে। কিন্তু এসব পরিবর্তনের পিছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো সুখ কামনা করা এবং দুঃখ এড়ানো। মানুষের সকল কাজের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এ সুখ লাভের কামনার মাধ্যমে। কিন্তু সুখ-দুঃখ জীবনের চালিকাশক্তি হলেও সুখ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সভ্যতা তাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃত্তিগুলোকে অবদমিত করে। ফ্রয়েডের মতে, মানুষ যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার মধ্য দিয়েই সুখ আসে। কিন্তু সভ্যতাই নানা বিধিনিষেধের মাধ্যমে মানুষকে যৌন স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে এবং অবাধ সুখ কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সভ্যতা মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধেরও জন্ম দিয়েছে এবং তা ব্যক্তি জীবনকে দারুণ অসন্তোষের মধ্যে নিক্ষিপ্ত করে। ফ্রয়েড এর মতে, এ অসন্তোষ সৃষ্টির কারণ তিনটি- ১. দৈহিক নশ্বরতা, ২. প্রাকৃতিক নিষ্ঠুরতা, ৩. সামাজিক সম্পর্ক। উল্লিখিত কারণ তিনটির মধ্যে প্রথম দু’টি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষ এর কবলে পড়তে বাধ্য। কিন্তু শেষের কারণটি মানুষের সকল দুঃখ ও অসন্তোষের মূল কারণ। সামাজিক সম্পর্কের রীতিনীতি, আচার-আচরণ এবং আইন মানুষের ব্যক্তিচেতনাকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে। ব্যক্তির বুদ্ধির চিন্তাকে তিনি সভ্যতা বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন।

সভ্যতা মানুষের শত্রুতা ও বৈরিতার জন্ম দিয়েছে যার জন্য যুদ্ধ ও সংঘর্ষ অনিবার্য। ফ্রয়েড মার্কস ও অন্যান্যদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তিই সমাজের পারস্পরিক শত্রুতার জন্য দায়ী নয়। কারণ আদিম সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না, কিন্তু তখনও মানুষের মধ্যে অশান্তি, শত্রুতা এবং সংঘর্ষ ছিল। তার মতে, সভ্যতা বাহ্যিক দৃষ্টিতে মানুষকে মুক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছে বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সত্য নয়। শিশু যা ইচ্ছে করে কিন্তু তা তার মায়ের জন্য করতে পারে না। মানুষ তার সুখের জগৎ বিশ্বাসকে নির্মাণ করতে চাইলেও আইনের জন্য তা পারে না।

মন্তব্য

  • ১. সভ্যতার সামাজিক প্রথা বা ঐতিহ্যকে বজায় রাখার ফলে স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছাকে সবলে দমন করতে হয়। ফ্রয়েডের মতে, সভ্যতা মানুষের ইচ্ছাগুলোকে স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হতে সাহায্য না করে, বরং বাধা দেয়। ফলে ব্যক্তির সুখানুভূতি নষ্ট হয়ে যায়।
  • ২. ফ্রয়েড বলেন, মানুষ যতদিন পর্যন্ত আদিম স্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ততদিন পর্যন্ত মানুষ শান্তিতে ছিল। কিন্তু সভ্যতা সমাজের সহজাত প্রবৃত্তি প্রকাশের গোপনীয়তা আরোপিত হওয়ায় মানুষ অনিবার্যভাবে হতাশাগ্রস্ত, কলহপ্রিয়, আবেগপ্রবণ ও স্নায়ুবিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
  • ৩. উপরের আলোচনায় দেখা যায়, জীবন ও মরণ প্রবৃত্তি কাম বস্তু হতে বঞ্চিত হওয়ায় সভ্যতাই মানুষের মধ্যে সংঘাত ও অসন্তোষের মূল কারণ। ফ্রয়েডের মতে, সুখ আসে যৌন তৃপ্তি থেকে। তিনি বলেন, জীবন বৃত্তির অর্থাৎ যৌন তৃপ্তির অপরিপূর্ণতার ফলে সৃষ্টি হতাশা, মরণ প্রবৃত্তির ফলে সৃষ্টি বিদ্বেষ মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
  • ৪. সভ্যতা মানুষকে যৌন স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে। অথচ এ যৌন প্রবৃত্তিই সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল। ফ্রয়েড বরেছেন, সমাজ কর্তৃক মানুষের মূল প্রবৃত্তিগুলো যখন বাধাগ্রস্ত হয় তখন সে হিংস্র হয়ে উঠে এবং সৃজনশীলতা সৃষ্টির ব্যাপারে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যার প্রমাণস্বরূপ যুদ্ধের ধ্বংসের মধ্যে নতুনের জন্ম হয়। একের সৃষ্টি অন্যের ধ্বংস।

ফ্রয়েডের পর্যালোচনা থেকে বুঝা যায়, সভ্যতা মানুষের জন্য কতবড় অভিশাপ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। মানুষকে সুখী করার এবং স্বাধীনতা দানের পরিবর্তে নিক্ষেপ করেছে বিভিন্ন যন্ত্রণা ও দুর্দশার মধ্যে, তা কেবল শোধরানো সম্ভব যদি মানুষ আদিম অবস্থায় ফিরে যায়।

সমালোচনা

  • ১. ফ্রয়েড মূলত একজন মনোবিজ্ঞানী। সামাজিক বিষয়গুলোকে তিনি একপেশে মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন।
  • ২. সভ্যতা বিকাশে যৌনাভূতির যে একক ভূমিকা তিনি দেখিয়েছেন তা নিরপেক্ষভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক সমালোচক বলেছেন, তিনি মানুষের যৌনকামনাকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজ বিকাশের অন্যান্য মূল্যবান উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করেছেন।
  • ৩. অনেকে বলেছেন, তার বক্তব্যের সমর্থনে তিনি যে সমস্ত কাল্পনিক বা পৌরাণিক তথ্য প্রদান করেছেন তা যদি বিজ্ঞানের বিচারে বাতিল হয়ে যায় তাহলে সমস্ত তত্ত্বই ভ্রান্ত বলে ধরে নিতে হবে।

ফ্রয়েডের তত্ত্বের যথেষ্ট ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সমাজবিজ্ঞানে তার কর্তৃত্বের অস্বীকার করা যায় না। কেননা সমাজ ও মনের গভীরতম যোগসূত্র বিষয়টি মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতিতে বিচার করে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশকে একজন মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন। যৌন চরিত্র কিভাবে সমাজ ও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তা থেকে সামাজিক পরিবর্তন ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটে তা ফ্রয়েডই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। যৌন জীবনের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট সামজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্র নির্ণয়ে তার ব্যাখ্যা সমাজবিজ্ঞানকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। “The Civilization and Its Discontents’ গ্রন্থের অনুবাদক James Strachey লিখেছেন, “The civilization and its discontents is a work whose interest regards beyond sociology.” (সভ্যতা এবং এর অসন্তোষ এমন একটি কাজ যার পরিসর সমাজবিজ্ঞানের ঊর্ধ্বে।) এ উক্তি থেকে তার এ তত্ত্বের গুরুত্ব সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উপলব্ধি করা যায়। আধুনিক চিন্তাজগতে ফ্রয়েড যে মূল্যবান তত্ত্ব দিয়েছেন একথা অনেক চিন্তাবিদই স্বীকার করেছেন। সমাজবিজ্ঞানে তার যৌন সম্পর্কিত তত্ত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। পরিশেষে বলা যায়, তিনি বর্তমানের দুঃখকষ্টের জন্য আধুনিক সভ্যতাকে দায়ী করেছেন, কিন্তু এ দুঃখকষ্ট মোচনের জন্য সার্বিক প্রতিকার ও সুপারিশমালা প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছেন।

তথ্যসূত্র

  • আধুনিক ও ধ্রুপদী সামজতাত্ত্বিক চিন্তাধারা, ড. মোঃ আহসান হাবিব, গ্রন্থ কুটির, জানুয়ারি, ২০১৪
  • অন্যান্য তথ্যসূত্র নিবন্ধের মধ্যেই

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.