রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী

প্রত্যেক সমাজেই কম-বেশি সংগঠিত এমন কিছু সামাজিক গোষ্ঠী বা দল থাকে যেগুলো সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলে। সমাজের এসব গোষ্ঠী সবসময় চিন্তাবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের বিশেষ প্রভাব ও ভূমিকার জন্য। এ গোষ্ঠীগুলো কখনো জনগণকে সচেতন করার ও তাদের দাবি আদায়ে বা জনগণের সর্বজনীন স্বার্থে কাজ করে। আবার কখনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে নিজেদের স্বার্থেই কাজ করে। সংগঠিত এসব গোষ্ঠীর অন্যতম হলো রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী। একনায়কতন্ত্র কিংবা উদারনৈতিক গণতন্ত্র সব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পাশাপাশি বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীও প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা ভিন্ন হলেও প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এদের উপস্থিতি অপরিহার্যভাবে স্বীকৃত।

রাজনৈতিক দল (Political Party)

সংজ্ঞা

সব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংগঠিত সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি দেখা গেলেও উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশে পরিণত হয়েছে। জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের বিচারে ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্র সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের অপরিহার্যতা প্রমাণিত- যা গণতন্ত্রকে সম্ভব করে তোলে। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে প্রথম রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি লক্ষণীয়। “রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রের বাইরে থাকা গোষ্ঠীগুলির সরকারী অফিস এবং সরকারী নীতির উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিযোগিতা করার প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ পশ্চিম ইউরোপে অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলি অস্তিত্ব লাভ করেছিল।” (Almond and Powell, Comparative Politics Today: a World View, p-88.)

সাধারণভাবে রাজনৈতিক দল বলতে এমন এক দল মানুষকে বুঝায় যারা নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যে ঐকমত্য পোষণ করে, সেসব লক্ষ্য অর্জনে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালায়, লক্ষ্য স্তবায়নে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনে চেষ্টা করে অথবা সরকারকে নিজ স্বার্থের অনুকূলে ভাবিত করার চেষ্টা করে।

  • R.M. Maclver তার ‘The Modern State’ (p-390) গ্রন্থে রাজনৈতিক দলকে কিছু নীতির পক্ষে সংগঠিত একটি সংঘ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন- যেটি সাংবিধানিক উপায়ে সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। (কিছু নীতি বা নীতির সমর্থনে সংগঠিত এমন একটি সংঘ যা সাংবিধানিক উপায়ে এটি সরকারের সিদ্ধান্ত নির্ধারণে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে।) (R. M. Maclver, The Modern State (p-390))
  • Edward Burke বলেন, “যখন কোন নির্দিষ্ট নীতিতে একটি সংগঠিত জনসমষ্টি যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সচেষ্ট হয় তখন তাকে রাজনৈতিক দল বলে।” (Thought on The Cause of Present Discontents’ in The Work of E. Bruke, Vol.-1, p-530.)
  • “রাজনৈতিক দল এমন একটি সংগঠন যা স্বার্থ, উদ্বেগ এবং লক্ষ্যগুলির একটি সাধারণ সমষ্টির পক্ষে ভোটারদের একত্রিত করে।” (Microsoft Encarta, Encyclopedia 2003.)
  • Earnest Barker “একটি রাজনৈতিক দলকে এমন একটি সামাজিক গঠন হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যা (১) স্বেচ্ছাসেবী সমাজের ক্ষেত্র থেকে সংযুক্ত ধারণাগুলির একটি সমষ্টি সংগ্রহের জন্য একটি জলাধার হিসাবে কাজ করে এবং (২) একটি রাজনৈতিক পরিবাহী হিসাবেও কাজ করে যার মাধ্যমে সেই অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ধারণাগুলি সামাজিক জলাধার থেকে রাষ্ট্রের ব্যবস্থায় প্রবাহিত হয় এবং সেই ব্যবস্থায় রাজনৈতিক যন্ত্রের চাকা ঘুরিয়ে দেয়।” (Barker, Principles of Social and Political Theories, p-210.)
  • “কোনো কিছুর ‘রাজনৈতিক দল’ হয়ে ওঠার অর্থ সবসময় একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কিত করা এবং অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের পার্থকায়িত করা। প্রতিটি রাজনৈতিক দল মূলত একটি নির্দিষ্ট সংগঠনে অংশীদারিত্ব এবং নির্দিষ্ট কর্মসূচি দ্বারা অন্যদের থেকে নিজেদের পৃথকীকরণকে নির্দেশ করে।” (Sigmund Neuman, Modern Political Parties, Chicago, 1956, p-395.)

রাজনৈতিক দল হলো সংগঠিত একদল মানুষ যারা জনস্বার্থ বিষয়ে একই দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ ও লালন করে এবং যারা নিজেদের কার্যক্রম ও নীতি বাস্তবায়ন বা সমুন্নত করার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক একক হিসেবে কাজ করে। সুতরাং রাজনৈতিক দল বলতে আমরা এমন একটি জনগোষ্ঠীকে বুঝি যারা সুনির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়ে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত করার লক্ষ্যে সাংবিধানিক উপায়ে – দলীয় নীতি ও আর্দশ প্রচার, লোক সংগ্রহ, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, প্রার্থী মনোনয়ন, প্রচারণা ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করতে সচেষ্ট থাকে অথবা সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।

  • রাজনৈতিক সমাজতাত্ত্বিকগণ রাজনৈতিক দলকে সরকার গঠন ও চালনার জন্য একটি সংগঠন ছাড়াও অবশ্যম্ভাবীভাবে একটি সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে। Max Weber বলেন, “রাজনৈতিক দল একটি সহযোগী ধরনের সামাজিক সম্পর্ক, যার সদস্যপদ আনুষ্ঠানিকভাবে বিনামূল্যে নিয়োগের (free recruitment) উপর নির্ভর করে।” (Weber, The Theory of Social and Economic Organizations, NY, 1964, p-407)। তাদের মতে, রাজনৈতিক দল একটি সামাজিক গোষ্ঠী; কারণ এটি পরস্পর নির্ভরশীল কর্মকাণ্ডের একটি ব্যবস্থা এবং সদস্যদের সর্বজন স্বীকৃত লক্ষ্য সাধনের জন্য উদ্দেশ্যমূলক সমন্বিত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। রাজনৈতিক দল সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক দাবি মেটানোর একটি সংগঠন ছাড়া আর কিছু নয়।
  • S.J Eldersveld বলেন যে, রাজনৈতিক দল হলো একটি বৃহৎ সামাজিক গোষ্ঠী, বৃহত্তর সমাজের মধ্যে একটি কার্যকর এবং নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় পরিচালিত কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা। (Political Parties : A Behavioral Analysis, p-1).
  • Karl Marx ও Friedrich Engels রাজনৈতিক দলকে বিবেচনা করেছেন পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বহারাদের শ্রেণী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার ও রাজনৈতিক মতাদর্শে সংঘবদ্ধ করার সংগঠন হিসেবে।

রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য

প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

  • ১। নির্দিষ্ট কিছু মৌল নীতির ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মধ্যে সমঝোতা থাকতে হবে। সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সম-মনোভাব পোষণকারী একদল লোক নিয়ে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে।
  • ২। রাজনৈতিক দল একটি স্বার্থভিত্তিক সংগঠন। বিভিন্ন স্বার্থের সমন্বয় সাধন এর কাজ।
  • ৩। রাজনৈতিক দল বিভিন্ন গোষ্ঠীর মিলন ক্ষেত্র। একটি জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দল সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে বলে একটি বিভিন্ন গোষ্ঠীর সম্মেলন ঘটাতে পারে।
  • ৪। রাজনৈতিক দলের একটি সুগঠিত কাঠামো অবশ্যই থাকতে হবে। কাঠামোগত সংহতি ছাড়া রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। একটি স্বতন্ত্র্য কাঠামোর মধ্যে দলের সদস্যগণ ঐক্যবদ্ধ থাকে।
  • ৫। রাজনৈতিক দলে কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি ও কার্যক্রম থাকবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্থিরিকৃত নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দল তার নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে।
  • ৬। রাজনৈতিক দল সাধারণ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট হবে, অর্থাৎ জনস্বার্থ রক্ষা ও সমুন্নত রাখার জন্য রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি থাকবে। জনগণের কল্যাণে কাজ করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে। কাজেই জনভিত্তি গড়ে তোলার এবং জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য জনস্বার্থ সমুন্নত করার কার্যক্রম রাজনৈতিক দলের থাকা বাঞ্ছনীয়।
  • ৭। জনগণের কল্যাণে ও তাদের ভাগ্যোন্নয়নে গৃহীত নীতিমালা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দল সাংগঠনিক উপায়ে ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করবে এবং সে লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
  • ৮। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কায়েমি স্বার্থের পরিবর্তে রাজনৈতিক দল জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে সংগঠিত হবে এবং জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ ও সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করবে।

রাজনৈতিক দলের প্রকারভেদ

রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক এলিটদের নিয়োগকারী ও প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান। আধুনিককালে রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার উদ্ভবের পর হতে ইউরোপ ও আমেরিকায় সদস্য নিয়োগ, নেতৃত্ব নির্বাচন, নেতৃত্বের ধরন, দলীয় কাঠামো, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ইত্যাদির ভিন্নতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

  • ইংল্যান্ডে দলীয় সদস্য হিসেবে ভূস্বামী ও নব্য শিল্পপতিদের নিয়োগের ভিত্তিতে রক্ষণশীল ও উদারপন্থী দল নামে দু’টি দলের অস্তিত্ব দেখা যায়।
  • শিল্পায়ন পরবর্তী সময়ে সমাজবাদী দলের (Socilist party) উদ্ভব ঘটে শহুরে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে।
  • জ্যার এর শাসনাধীন রাশিয়ায় পুঁজিপতিদের শোষণ হতে শ্রমিকদের রক্ষার জন্য মার্ক্সবাদে উদ্বুদ্ধ Lenin বিপ্লবী দল (Revolutionary party) হিসেবে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করেন Communist party-র পতাকাতলে।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলোর কলোনী আমলে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতীয়তাবাদী দলীয় ব্যবস্থার উদ্ভব হলো, যেগুলোকে চিন্তাবিদগণ National Movement হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। স্বাধীনতার পর এসব আন্দোলন রাজনৈতিক দলের রূপ পরিগ্রহ করে।

এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের চিন্তাবিদগণ দলীয় সংহতি, স্বার্থ, নীতিমালা, কাঠামো, ক্ষমতার কেন্দ্র, দলের উদ্ভব ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে রাজনৈতিক দলের শ্রেণীবিভাগ করা হয়। Lester G. Seligman রাজনৈতিক দলের নিম্নরূপ শ্রেণী বিভাগ করেছেন (Seligman, Elite Recruitment and Political Development, The Role of Elites, in Finkle and Gable, ed. Political Development and Social Change, 2nd Ed. p-244.) :

  • ১। গণমুখী বা লোকানুবর্তী রাজনৈতিক দল (Populist Party): যে দলের জনপ্রতিনিধিত্ব ব্যাপক তাকে Populist party বলা হয়। এগুলো আকারে বড় দল বা ছোট দল হতে পারে, কিন্তু জনগণের মধ্যে এর ব্যাপক ও সামগ্রিক প্রতিনিধিত্ব থাকে। দল কোন শ্রেণী, ধর্ম বা ভাষার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদের প্রতি অনেক বেশি সমর্থন দেয়।
  • ২। গোষ্ঠী বা উপদলভিত্তিক রাজনৈতিক দল (Sectariant Party): এসব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকে সীমিত। নির্দিষ্ট কোন উপদলের প্রতিনিধি নিয়ে এ দল গড়ে উঠে। বিশেষ কোন গোষ্ঠীর সাথে এ দলের সংশ্লিষ্টতা; যেমন: ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বা আঞ্চলিক গোষ্ঠী। এ দলগুলো সাধারণত ভোট জয়ের চেয়ে নিজেদের আদর্শগত শুদ্ধতার উপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করে। এ দল গণসদস্য পদকে উৎসাহিত করে না; যেমন: ভারতের বিজেপি ও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
  • ৩। বহুমুখী দল (Pluralistic Party): এ দলগুলোর ব্যাপক ও বিস্তৃত প্রতিনিধিত্ব থাকে এবং সমাজের সব ধরনের স্বার্থে সমন্বয় ঘটে এ রাজনৈতিক দলে। এ দল আকারে বড় হয়, সমাজের সকল শ্রেণী-গোষ্ঠীর লোক এ দলের সদস্য। অনেক স্বার্থের সম্মেলন ঘটে বলে এ দলের ব্যাপকভিত্তিক মতাদর্শ থাকে; যেমন: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ভারতীয় কংগ্রেস। নব্য গতিপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী এ দলে অন্তর্ভুক্ত হবার সুযোগ থাকে।

Maurice Duverger তার ‘Political Parties’ (1964) গ্রন্থে রাজনৈতিক দলের সদস্য, নির্বাচন ও সংসদীয় আসন সংখ্যাকে দলের শক্তির ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলকে চার ভাগে ভাগ করেছেনঃ

  • ১। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল (Party with majority bent): সেসব দলকে তিনি এ শ্রেণীভুক্ত করেছেন যেগুলো সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম। দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় এ ধরনের দল সহজে শনাক্ত করা যায়; যেমনঃ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বহু দলীয় ব্যবস্থায় এ ধরনের দল শনাক্ত করা কষ্টকর। এ দলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তববাদীতা, সংযম ও রক্ষণশীলতা। এ দল জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমর্থন আদায়ে চেষ্টা করে না।
  • ২। প্রধান দল (Major parties): যেসব দল কখনই সংসদে বা আইন সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না কিন্তু বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন হলেও অন্য দলের সাহায্য নিয়ে সরকার পরিচালনা করে সেগুলোকে Duverger প্রধান দল বা Major Parties বলে অভিহিত করেছেন। এসব দলের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
  • ৩। ক্ষুদ্র দল (Minor parties) : কম জনসমর্থনপুষ্ট দুর্বল ও গুরুত্বহীন রাজনৈতিক দলকে তিনি এ শ্রেণীভুক্ত করেছেন। আইন সভায় এসব দলের আসন সংখ্যা খুবই কম থাকে বলে সরকারের শরীক দল বা বিরোধী দল হিসেবে জোরালো ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়।
  • ৪। মধ্যম দল (Medium parties): শক্তির দিক থেকে এ দল প্রধানদল ও ক্ষুদ্রদলের মাঝামাঝি অবস্থান করে। আইন সভায় এ দলের সদস্য সংখ্যা Minor parties-এর চেয়ে বেশি থাকে বলে এ দল একেবারে গুরুত্বহীন নয়। সরকারের শরীক দল হিসেবে এক দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব পেয়ে থাকে; যেমন: বাংলাদেশে ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি।

এ ছাড়া, Maurice Duverger (p-17-40) মৌলিক সাংগঠনিক একক বিচারে রাজনৈতিক দলকে আবার চারভাগে ভাগ করেছেন:

  • Caucus Party : সাধারণভাবে বিশিষ্টজনদের নিয়ে এ দল গড়ে উঠে। বাছাইকৃত সদস্য নিয়ে এ দল গড়ে উঠে। সাংগঠনিকভাবে এসব দল দুর্বল হয়। তবে ক্ষমতা অর্জন এ দলের প্রধান লক্ষ্য। মূলত ছোট একটি গোষ্ঠীকে (সভাকে) কেন্দ্র করে এ রাজনৈতিক দল সৃষ্টি ও কার্যক্রম আবর্তিত হয়। ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে গড়ে ওঠা রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক দলগুলো এ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত; যেমন: ফ্রান্সের রেডিক্যাল পার্টি।
  • Branch Party: এসব দলের সদস্য সংখ্যা থাকে বৃহৎ পরিসরে। সদস্যদের রাজনৈতিক দীক্ষাদান এ দলের প্রধান লক্ষ্য। ব্যাপক আঞ্চলিকভিত্তিক নেটওয়ার্ক-এর আওতায় অনেকগুলো শাখার সমন্বয়ে দল গড়ে উঠে। পেশাভিত্তিক কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে এ দল কাজ করে। সাংগঠনিক দিক থেকে এ দল অনেক বেশি শক্তিশালী; যেমনঃ ১৯১৪ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দলসমূহ, নাজি পার্টি।
  • Cell Party : এ দল গড়ে উঠে কর্মক্ষেত্রভিত্তিক ছোট ছোট গোষ্ঠীর সমন্বয়ে, যেগুলোকে সেল বলে। সদস্য ও নেতৃত্বের মধ্যে উল্লম্ব (Vertical) যোগাযোগ অর্থাৎ পদসোপানভিত্তিক অন্তঃদলীয় যোগাযোগ এ দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কখনো কখনো গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমান্তরাল যোগাযোগ থাকে। এ দলের সদস্যগণ খুবই সক্রিয় থাকে। এটি অতিমাত্রায় কেন্দ্রিকৃত এবং প্রতিনিধিদের উপর কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এ দলের বৈশিষ্ট্য; যেমন: সমাজতান্ত্রিক দল।
  • Milita Party : সাংগঠনিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য এ ধরনের দলের সৃষ্টি। সাম্প্রদায়িক প্রকৃতির এ দল একান্ত গোপনীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। সাধারণত একটি দলের মধ্যেই এটি গড়ে উঠে; যেমন: উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্যারা মিলিশিয়া সংগঠনগুলো বা শ্রীলংকার তামিল টাইগার্স।

এ ছাড়া, দলের সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তিতে কোন কোন চিন্তাবিদ রাজনৈতিক দলকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন:

  • (ক) ক্যাডার পার্টি (Cadre party): পদসোপানভিত্তিক নেতৃত্বের কাঠামো সম্বলিত রাজনৈতিক দলকে ক্যাডার পার্টি বলা হয়ে থাকে, যে দলে সদস্য হবার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন হয়। দলের সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে যোগ্যতার প্রমাণ দেখিয়ে উচ্চতর পদে আসীন হতে হয়। এ ধরনের রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত দলের উচ্চ পর্যায়ের সদস্যগণ দ্বারা গৃহীত হয়। নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনীত হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের কমিটিও দ্বারা। যেমন: জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, কমিউনিস্ট পার্টি।
  • (খ) গণভিত্তিক দল (Mass party): এ ধরনের রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিশেষ কোন শর্ত পূরণ করতে হয় না। সর্বসাধারণের জন্য দলের সদস্যপদ লাভের সুযোগ উন্মুক্ত থাকে এবং যে কেউ এ দলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এসব দলে নেতৃত্ব আঞ্চলিক ও জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে থাকে, তবে শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের বিশেষ ভূমিকা থাকে। এ দলে নেতৃত্বের কাঠামোতে কোন পদসোপান নীতি অনুসরণ করা হয় না। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক কমিটির মতামত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়, যদিও উন্নয়নশীল দেশে তা দেখা যায় না; বরং শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। চালনাক

আধুনিককালে উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব দেখা যায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আঞ্চলিক ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সার্বিকভাবে দেশে দেশে আদর্শ, প্রকৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিবেচনায় তিন ধরনের রাজনৈতিক দল দেখা যায়:

  • ১। উদারনৈতিক (Liberal);
  • ২। মধ্যপন্থি (Moderate) এবং
  • ৩। চরমপন্থি (Extreme/radical)।
    • (ক) চরম ডান (Extreme Right): ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল।
    • (খ) চরম বাম (Extreme left): বামপন্থি দলগুলো।

রাজনৈতিক দলের যে শ্রেণীবিন্যাস করা হোক না কেন প্রকৃতিগত দিক হতে রাজনৈতিক দলগুলো উপরোক্ত তিন Category-তে অন্তর্ভুক্ত কর যায়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর হতে এ পর্যন্ত অনেক রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে। কখনো দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটেছে, আবার কখনো সরকারের উচ্চ পর্যায় হতে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। অধিকন্তু কখনো অন্তঃদলীয় কোন্দলের কারণে দল ভেঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়:

  • ১। দলের ভিত্তি: বাংলাদেশে কিছু দল অর্থনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে; যেমন : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, কমিউনিস্ট পার্টি। আবার কিছু দল ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে; যেমন: জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, মুসলিম লীগ। ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দলগুলোর অধিকাংশেরই সামাজিক ভিত্তি দুর্বল।
  • ২। নেতৃত্বের সংকট ও সাংগঠনিক দুর্বলতা: অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নেতৃত্বের সংকটে ভোগে। সুদক্ষ নেতৃত্বের অভাবে তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা দেখা যায়।
  • ৩। অন্তঃদলীয় কোন্দাল ও বিভিন্ন গোষ্ঠী বা উপদল: সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে অন্তঃদলীয় কোন্দল দেখা যায় এবং বিভিন্ন উপদল বা গোষ্ঠীতে দল বিভাজিত হয়ে পড়ে।
  • ৪। অঙ্গ সংগঠন: প্রায় সব রাজনৈতিক দলেরই অঙ্গ সংগঠন রয়েছে। এগুলো দলে যেমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনকেও অস্থিতিশীল করে তোলে।
  • ৫। আন্তঃদলীয় কোন্দল: কায়েমি স্বার্থ ও আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন দলের মধ্যে আন্তঃদলীয় কোন্দল লক্ষণীয়।
  • ৬। গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব: অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মধ্যে নেতৃত্ব নির্বাচনে এবং অন্য দলগুলোর প্রতি আচরণে গণতান্ত্রিক ভাবধারার অভাব দেখা যায়।
  • ৭। পেশি শক্তির ব্যবহার: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পেশি শক্তির ব্যবহারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
  • ৮। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব: সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠলেও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ব্যাহত হয়।
  • ৯। ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব: আদর্শিক দুর্বলতার কারণে ও দলগুলো সুনির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাবে দলীয় নেতৃত্বে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব প্রকট।
  • ১০। সহনশীলতার অভাব ও প্রতিক্রিয়াশীলতা: রাজনৈতিক নেতৃত্বের গণতান্ত্রিক মনোভাব ও চর্চার অভাবে পারস্পরিক সহনশীলতার অভাবের সাথে সাথে প্রতিক্রিয়াশীলতাও প্রকট।
  • ১১। কায়েমি স্বার্থ ও সুবিধাবাদ: প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোন না কোন ধরনের কায়েমি স্বার্থের উপস্থিতি রয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক দলে অনুপ্রবেশ এবং কায়েমি স্বার্থের কারণে দলের মধ্যে সুবিধাবাদ লক্ষণীয়।
  • ১২। মেরুকরণ: চরম ডান ও চরম বাম দলগুলোর মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে এবং কিছু কিছু মধ্যপন্থী দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও সহনশীলতার অভাব দেশে মেরুকরণের অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
  • ১৩। আদর্শিক দুর্বলতা: কায়েমি স্বার্থ ও সুবিধাবাদের কারণে বিভাজন যেসব নতুন দলের জন্ম দেয় সে দলগুলোর মধ্যে প্রকট আদর্শিক দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়।
  • ১৪। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা: প্রতিক্রিয়াশীলতা ও সহনশীলতার অভাবের ফলে দলগুলোর মধ্যে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার প্রবণতা তীব্র।
  • ১৫। সামাজিকীকরণের সমস্যা: রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ হলো অনুসারীদের দলীয় ও রাষ্ট্রীয় নীতি-আদর্শ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিতকরণ। কিন্তু অধিকাংশ দল এ ব্যাপারে সক্রিয় নয় বা নিষ্ক্রিয়। ফলে রাজনৈতিক দীক্ষার অভাবে দলীয় কোন্দল, বিভাজন, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, সহনশীলতার অভাব ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

রাজনৈতিক দলের ভূমিকা

একনায়কতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক সব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিরাজমান দলগুলো সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ করে। অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ বা উপাদান হিসেবে রাজনৈতিক দলকে কিছু ভূমিকা পালন করতে হয়। “রাজনৈতিক দলগুলোকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রকাশের প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং সংঘাতের প্রকাশ ও ব্যবস্থাপনা উভয়ের সাথে জড়িত প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার রীতি রয়েছে।” (D. Apter, The Politics of Modernization, Chicago, 1965, p-170.) রাজনৈতিক দল সুিনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে কাজ করে- বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর সমন্বয়, সংঘবদ্ধকরণ, লোক সংগ্রহ, জনমত গঠন, জাতীয় সংহতি, স্বার্থ জ্ঞাপন ও গ্রন্থীকরণ, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রার্থী নির্বাচন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈধতা আনয়ন, জাতীয় সংহতি বিধান, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ, দ্বন্দ্ব নিরসন, রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সরকারি দলের আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক যোগাযোগ ও অনুপ্রবেশ (Political Penetration)। নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো:

  • ১। বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর সমন্বয়: একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল সুনির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠে। এ দলে বিভিন্ন শ্রেণী গোষ্ঠীর সমাবেশ ঘটে, যাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। রাজনৈতিক দল সব স্বার্থের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নানামুখী বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ রাখে।
  • ২। সংঘবদ্ধকরণ: একটি জাতীয় রাজনৈতিক দলের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ বিপুল জনগোষ্ঠীকে সভা, সমাবেশ, মিছিল, প্রচার ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ রাখে এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা দেয়।
  • ৩। লোক সংগ্রহ (Political recruitment): সামাজিকীকরণ যেখানে শেষ হয় লোক সংগ্রহ সেখানে শুরু। রাজনৈতিক জ্ঞানার্জনের পর ব্যক্তি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তার ভূমিকা প্রাপ্ত হয়। সাধারণভাবে লোক সংগ্রহ বলতে জনগণকে নাগরিকতার শিক্ষা প্রদান করে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণকে বুঝায়। রাজনৈতিক লোক সংগ্রহ হলো সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সমাপ্তির পর ব্যক্তিকে রাজনৈতিক ভূমিকা প্রদান করা। “লোক সংগ্রহ হলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সরকারি পদের জন্য লোক নির্বাচন, যোগাযোগ মাধ্যমের সংস্পর্শে আসা, সংগঠনে যোগদান, অফিস শিক্ষা ও পরীক্ষার জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ।” (Almond and Powell, Comperative Politics Today A World Vierw, p-8.)। সামাজিকীকরণের পর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ধারণা প্রাপ্তির পর ব্যক্তি কোন একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী (কর্মী অথবা সমর্থক) হয়। রাজনৈতিক নিয়োগের প্রধান মাধ্যম হলো রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দল ব্যক্তিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সমাজতান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক সব রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক নিয়োগের প্রধান উদ্যোক্তা। বিভিন্ন রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে ব্যক্তির কি ভূমিকা হবে তা নির্দিষ্ট করে রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির প্রাধান্যবিস্তারকারী ভূমিকা নির্ধারণ করে রাজনৈতিক দল; যেমন: নির্বাচনে জয়ী দল সরকার গঠনের পর বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দায়িত্ব বণ্টন করে।
  • ৪। জনমত গঠন: জনমত গঠনে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দল মতাদর্শভিত্তিক সংগঠন। বিভিন্ন সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধানের উপায় নির্ধারণে মতাদর্শের ভিত্তিতে জনমত গঠন করে রাজনৈতিক দল। সরকারি দল সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পক্ষে জনগণের সমর্থন আদায়ে জনমত গঠন করে। মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে বিরোধী দল সরকারি কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অথবা সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে পারে। আবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে কোন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারি কাজের পক্ষে অথবা জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে জনমত গঠন করতে পারে।
  • ৫। জাতীয় সংহতি: সার্বিকভাবে সরকারি দল কিংবা বিরোধীদল সব রাজনৈতিক দল সমাজ রূপান্তরে ভূমিকা রাখে। একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে তার পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করে। এতে জনগণের সংকীর্ণ মানসিকতায় পরিবর্তন সূচিত হয়। তারা আদিম অনুভূতি (Primordial Sentiment) ত্যাগ করে গোষ্ঠী আচরণের (Group behavior) শিক্ষা লাভ করে- যা জাতীয় স্বার্থের পক্ষে সহায়ক। Allan R. Ball-এর মতে, রাজনৈতিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে একত্রীকরণ, সহজতরকরণ ও স্থিতিশীলকরণ। তার মতে, রাজনৈতিক দল গোষ্ঠীগত সংকীর্ণ স্বার্থকে একত্রিত করে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে সংহতি বিধান করে জনগণের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা দূর করে এবং জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে জনগোষ্ঠীর একাত্মতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাজনৈতিক দল বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সম্মিলন স্থল। এটি জাতীয় সংহতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক দল সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, জাতিগত বা আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোকে একটি রাজনৈতিক আদর্শে ঐক্যবদ্ধ করে এবং সংকীর্ণ আঞ্চলিক আনুগত্যের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা দেয় ও তাদের একটি রাজনৈতিক পরিচয়ের আওতায় নিয়ে আসে।
  • ৬। স্বার্থ জ্ঞাপন ও গ্রন্থিকরণ: আধুনিকীকরণের ফলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও গতিশীলতা সৃষ্টি হয়। ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠী নতুন নতুন দাবি সরকারের কাছে পেশ করে ও চাপ সৃষ্টি করে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল যেহেতু স্বার্থের সংগঠন তাই বিভিন্ন শ্রেণী এবং স্বার্থগোষ্ঠীর উত্থাপিত ভিন্ন ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন স্বার্থকে একত্রিত করে সরকারের কাছে উপস্থাপন করে। এতে সরকারের উপর বিভিন্নমুখী (Diversified) স্বার্থের চাপ কিছুটা হলেও কমে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দল উত্থাপিত দাবি পূরণে সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে বা চাপ প্রয়োগ করে সরকারকে নানা পরিবর্তন আনতে বাধ্য করে।
  • ৭। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রার্থী নির্বাচন: রাজনৈতিক দল নিজস্ব লক্ষ্য অর্জন ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার গঠন করতে আগ্রহী। এ লক্ষ্যে দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে বিজয় অর্জনের জন্য যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন ও নিজস্ব কর্মসূচি জনসমক্ষে তুলে ধরার মাধ্যমে প্রচার কাজ পরিচালনা করে। বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন করে।
  • ৮। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: রাজনৈতিক উন্নয়ন গণঅংশগ্রহণ দাবি করে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক আধুনিকীকরণ শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি করে, জনগণ সচেতন হয়, অধিক জনগোষ্ঠী রাজনীতিতে সচেতন হয়ে উঠে, নতুন এলিট শ্রেণীর জন্ম হয়, যারা রাজনৈতিক অংশগ্রহণের দাবি করে, ক্ষমতা অর্জন ও চর্চার প্রয়াস চালায়। কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যাপক অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে গণঅংশগ্রহণের দাবি অস্বীকার করে; কিন্তু বর্ধিত হারে নগরায়ন, গণমাধ্যমের বিকাশ এবং শিক্ষার প্রসার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে কোন প্রকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রাপ্তির বা অর্জনের প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে। রাজনৈতিক দল এদেরকে আত্মীকরণ (Absorb) করে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। রাজনৈতিক দল বিপুল জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট করে। বর্তমানে যে কোন দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দলভিত্তিক। ফলে রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা থেকে সব কিছু দলনির্ভর। দলীয় টিকিট ছাড়া কোন প্রার্থী নির্বাচনে জনগণেরও ভোট পাবার আশা করতে পারে না। রাজনৈতিক দলের প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া জনগণ পরোক্ষভাবে তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক দল ব্যক্তিকে সরকারে নিয়োগ করে। রাজনৈতিক দল কোন সিদ্ধান্ত, নীতি বা আদর্শের পক্ষে বা বিপক্ষে প্রচারণার দ্বারা জনমত গড়ে তোলার মাধ্যমে রাজনীতিতে জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। এক দলীয় শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক অংশগ্রহণের দাবি বহু দলীয় ব্যবস্থার চেয়ে ভিন্ন প্রক্রিয়ায় মোকাবেলা করা হয়। এসব ব্যবস্থায় রাজনীতিতে গণঅংশগ্রহণের দাবি নিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট পন্থায় মিটিয়ে থাকে; যেমন: এক দলীয় ব্যবস্থায় জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকে, যদিও একটি মাত্র দল থেকেই বিভিন্ন প্রার্থীর মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করতে হয়।
  • ৯। বৈধতা প্রদান: উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈধতার সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। রাজনৈতিক দল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সম্মেলন ক্ষেত্র এবং এতে বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে লোক সংগ্রহ ও নিয়োগ ঘটে এবং সুনির্দিষ্ট নীতি ও মতাদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। রাজনৈতিক দল এসব গোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তথা সরকারকে বৈধতা দান করে। এক দলীয় ব্যবস্থায়ও রাজনৈতিক দল জনগোষ্ঠীকে দলীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে উদ্বুদ্ধ করে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বৈধতা প্রাপ্তিতে সাহায্য করে।
  • ১০। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ: রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে রাজনৈতিক দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দল জনগণকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ে অবগত করা এবং এর মাধ্যমে জনগণকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় করে তোলে। সর্বাত্মকবাদ থেকে গণতন্ত্র সব রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই রাজনৈতিক দল অপরিহার্যভাবে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক দল ফলপ্রসূ বাহনগুলোর অন্যতম। সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল দু’টি কাজ করে: (ক) বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা প্রবাহমান রাখে; এবং (খ) পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের ধারা সংযোজনের প্রয়াস চালায়। রাজনৈতিক দলে বিজড়িত হওয়া অর্থ হলো রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া; অর্থাৎ সরকার, রাজনৈতিক কার্যক্রম, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত রাজনৈতিক দল জনগণকে উদ্দীপিত করে যা প্রচলিত রাজনৈতিক মনোভাব ও বিশ্বাসকে জোরদার করে এবং নতুন মনোভাব জাগরিত করে। রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক বিষয় ও সমস্যার ব্যাপারে জনগণকে অবহিত করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক দল জনগণের সামনে তাদের নীতি, আদর্শ প্রচার করার সাথে সাথে অন্য দলের দোষ-ত্রুটিগুলো তাদের সামনে তুলে ধরে। ফলে জনগণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোভাব ও বিশ্বাস সম্পর্কে অবগত হতে পারে; যেমন গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী দল জনগণের মধ্যে নতুন নতুন বিশ্বাস মূল্যবোধ বা মনোবৃত্তি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। Almond and Powell-এর মতে রাজনৈতিক দল মানুষের মধ্যে বোধগত (Cognitive), অনুভূতিমূলক (Affective) ও মূল্যায়নমূলক (Evaluative)-এ তিনটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিকশিত করতে পারে। রাজনৈতিক দল জনগণকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সরকার, রাজনৈতিক বিশ্বাস, মনোভাব, মূল্যবোধ, ধ্যানধারণা ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন করে (Cognitive); সরকারের কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের অবহিত করে ও অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে (Affective) এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যাবতীয় কর্মকাণ্ড মূল্যায়নে সক্ষম করে তোলে (Evaluative)। রাজনৈতিক দলের কাজে অংশগ্রহণ আনুগত্যের শিক্ষা দেয়।
  • ১১। সেতু বন্ধন : সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রাজনৈতিক দল কার্যকর ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক দল স্বার্থ গ্রন্থিকরণ ও তা একত্রীকরণ করে তা সরকারের কাছে পেশ করে। সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্ত জনগণকে অবহিত করে। এসব কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করে ও জনদাবি সরকারের নিকট এবং সরকারি সিদ্ধান্ত জনগণের মাঝে অনুপ্রবেশের (Penetration) কাজ করে। এভাবে রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রাখা এবং জনগণকে সক্রিয় ও সজাগ (Vigilant) রাখার কাজটি করে যা উন্নয়নের জন্য আবশ্যক।
  • ১২। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক দল জনঅংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে। সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ও সরকারকে বৈধতা প্রদান করে; জনগণের বিভিন্নমুখী সমর্থনকে একত্রীকরণ এবং এসব দাবি আদায়ে সরকারকে প্রভাবিত করে ও জনগণকে সাহায্য করে। বিরোধী দল সরকারি দল তথা সরকারের যাবতীয় কার্যকলাপের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখে ও সমালোচনার মাধ্যমে সরকারের আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সাংবিধানিক ব্যবস্থার অভিযোজন (Adaptability), ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনে বা আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শাসকদলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা সংশোধন করা সহজ হয়। যেখানে সংবিধান পরিবর্তনের বা সংশোধনের প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা শাসক দলের থাকে না, সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলসমূহ জাতীয় স্বার্থে সরকারকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা দানের মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও গতিশীল রাখতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কাজগুলো সম্পাদনের দ্বারা রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অনন্য ভূমিকা পালন করে।

এ ছাড়া, রাজনৈতিক দল বিভিন্নগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি বিধানের মাধ্যমে স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রশমিত করার প্রয়াস পায়। বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের গ্রন্থিকরণ ও তা আদায়ে সরকারের সাথে মধ্যস্থতার কাজ করে স্বার্থ-গোষ্ঠীর সাথে সরকারের দ্বন্দ্ব নিরসন করে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসক দল সংখ্যালঘু দলগুলোর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে যথার্থ প্রতিনিধিত্ব প্রদানের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্ব নিরসন করে। ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক দলগুলো আর্থ-সামাজিক অবস্থা বা অন্যান্য নানা সমস্যার কারণে তাদের সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে না; যেমন:

  • ১। সুনেতৃত্বের অভাব: উন্নয়নশীল দেশে যথার্থ ও সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার অভাব, পুঁজিপতি ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের কারণে রাজনৈতিক পেশাদারিত্বের ঘাটতি, রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব ইত্যাদি কারণে সুনেতৃত্ব গড়ে উঠে না।
  • ২। দলীয় সংহতির অভাব: অনেক রাজনৈতিক দলই সুসংগঠিত নয়। অর্থাৎ সাংগঠনিক দুর্বলতা রাজনৈতিক দলের সঠিক ভূমিকা পালনে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব কিংবা উদ্দেশ্য সাধনের প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির ব্যাপারে নেতাদের মতানৈক্যের কারণে প্রায় সব রাজনৈতিক দলেই বিভাজন (Cleaques) ও উপদলীয় কোন্দল দেখা যায়। এসব বিষয় রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাকে প্রকট করে তোলে। ফলে দলের অভ্যন্তরে সংহতি বিনষ্ট হয়।
  • ৩। প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সমস্যা: গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এবং ব্যক্তির একক কর্তৃত্ব রাজনৈতিক দলের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা আরও প্রকট আকারে দেখা দেয়।
  • ৪। সহনশীলতার অভাব: রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীলতার অভাব, পারস্পরিক অবিশ্বাস আন্তঃদলীয় কোন্দল তীব্রতর করে তোলে। এ ছাড়া পেশি শক্তির ব্যবহার অবস্থাকে আরও নাজুক করে তোলে।
  • ৫। অবিশ্বাস: পারস্পরিক অবিশ্বাস ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি করে ও সহযোগিতার মনোভাব নষ্ট করে দেয়।
  • ৬। স্বার্থ ও সুবিধাবাদ: কায়েমি স্বার্থ ও সুবিধাবাদের কারণে দল বদল রাজনৈতিক দলকে সাংগঠনিক দিক থেকে দুর্বল করে দেয় ও গণবিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে।

তার্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিবর্তন ও উন্নয়নে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নির্ভর করে নেতৃত্বের সবলতা ও সততার উপর, তাদের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, জনকল্যাণের মানসিকতা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক এলিট ও নেতৃবৃন্দের দায়বদ্ধতার (Commitment) উপর।

বাংলাদেশে অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতির কারণ

যে কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের অপরিহার্য কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে: (ক) ঐক্যবদ্ধতা, (খ) যৌথ প্রয়াস, (গ) সাংগঠনিক কাঠামো, (ঘ) শৃঙ্খলা, (৫) সমস্বার্থ, (চ) নীতি ও আদর্শ, এবং (ছ) ক্ষমতা লাভ ও তা বজায় রাখা। উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো যতক্ষণ বজায় রাখা যায় এবং বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয় সাধন করা যায় ততক্ষণ একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতের ভিন্নতার কারণে উপদল থাকলেও দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয় না। কিন্তু এরূপ অনানুষ্ঠানিক উপদল মাত্রাতিরিক্ত শক্তিশালী হলে কিংবা উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো যদি বজায় রাখা না যায় বা এগুলোর সংকট দেখা দেয় তখনই একটি রাজনৈতিক দলে উপদলীয় কোন্দল ও ভাঙ্গন দেখা দেয়। ফলে বহু দলের উদ্ভব ঘটে। যেসব কারণে রাজনৈতিক দলের মৌলিক বিষয়সমূহ বিঘ্নিত হয় সেগুলো নিম্নরূপঃ

  • ১। জাতীয় আদর্শের অনৈক্য: বাংলাদেশে অনুন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপস্থিতির কারণে জাতীয় আদর্শের ক্ষেত্রে গণমানুষের মধ্যে জাতীয় আদর্শের বিষয়ে অনৈক্য দেখা যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় সংহতির বিষয়টি অনেকটাই অপরিচিত। রাজনৈতিক এলিটগণও জাতীয় আদর্শের বিষয়ে মতানৈক্য ভোগে যেমন: রাষ্ট্রীয় মৌল নীতি, সরকারের প্রকৃতি, অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি বিষয়ে মতানৈক্যে অনেক রাজনৈতিক দলের উদ্ভবের অন্যতম একটি কারণ।
  • ২। জাতীয় নীতিমালার অনৈক্য: সুষ্ঠু দলীয় ব্যবস্থা, কোন্দলবিহীন কার্যকর রাজনীতি সুশৃঙ্খল দলীয় ব্যবস্থার জন্য জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সময় পরও এ বিষয়গুলো সম্পর্কে ঐকমত্যের অভাব বহু রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্ম দিয়েছে। ফলে এ দেশে বহু রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
  • ৩। আদর্শ ও কৌশলগত পার্থক্য: জাতীয় আদর্শ ও নীতিমালার ব্যাপারে অনৈক্য অনেক রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্ম দেয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক এলিট ও জনগণের মধ্যে জাতীয় আদর্শ ও নীতিমালার ব্যাপারে অনৈক্য অনেক বিভাজনের সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া, যেসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে সেসব উদ্দেশ্য সাধনের কৌশল নিয়ে দলের মধ্যে মতানৈক্য থাকে। এ বিরোধ এলিটদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও ফাটল সৃষ্টি করে। ফলে রাজনৈতিক দলের ভাঙ্গন দেখা যায় ও নতুন দলের উদ্ভব ঘটে। ধর্মভিত্তিক ও বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ধর্মীয় শাসন ও সমাজতন্ত্র কায়েমের পন্থা নিয়ে অনৈক্য অনেক বাম রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছে।
  • ৪। ক্ষমতার লোভ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতৃবৃন্দের মধ্যে পদ ও ক্ষমতার লোভ প্রকট যা পারস্পরিক প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। এভাবে পদ ও ক্ষমতার লোভ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। অনেক সময় ক্ষমতা প্রত্যাশী নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ উত্থাপন করেন ও দল ত্যাগ করেন এবং নতুন দল গঠন করেন, যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ (আওয়ামী লীগ মালেক, আওয়ামী লীগ মিজান ও বাকশাল) এবং রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপিতে (আবদুল মতিন ও শামছুল হক এবং দুদু-নিলু) ঘটেছে।
  • ৫। অসহিষ্ণুতা ও ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব: আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার অভাব লক্ষণীয়। অনেক সময় শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বা সিদ্ধান্তগ্রহণের সময় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা বিরোধের জন্ম দেয়। পরস্পরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। এর ফলে নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় ও দলে ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
  • ৬। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব: সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠলেও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিকীরণ ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নীতি ও আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে; যেমন: আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাপা। ফলে ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাবে নীতি ও আদর্শের প্রতি আনুগত্যের অভাব অনেক সময় দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে।
  • ৭। সামাজিকীকরণের সমস্যা: বাংলাদেশে সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলো দুর্বল, অসংগঠিত ও সুসমন্বিত নয়। জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার মত পর্যাপ্ত কর্মসূচি অনুসৃত হয় না। রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ হলো অনুসারীদের দলীয় ও রাষ্ট্রীয় নীতি-আদর্শ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিতকরণ। কিন্তু অধিকাংশ দল এ ব্যাপারে সক্রিয় নয় বা নিষ্ক্রীয়। ফলে রাজনৈতিক দীক্ষার অভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শে ব্যাপক বিভক্তি এবং দলীয় কোন্দল, বিভাজন, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, সহনশীলতার অভাব ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয় ও দলে ভাঙ্গন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
  • ৮। সুবিধাবাদ ও স্বার্থান্ধতা: যেহেতু একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, সুবিধাবাদী শ্রেণী নিজেদের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। অনেক নেতা, কর্মী, দল ও দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু নিজেদের স্বার্থ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে এসব গোষ্ঠী দল ত্যাগ করে ও নতুন দল গঠন করে।
  • ৯। দারিদ্র্য: বাংলাদেশ একটি অনুন্নত দেশ। এখানে বিরাজমান রাজনৈতিক দলগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হলে বা আশা পূরণে ব্যর্থ হলে তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। হতাশা থেকে অসন্তোষ জন্ম নেয়। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী হতাশাগ্রস্ত জনগণের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন দল গঠন করে।
  • ১০। অর্থনৈতিক কারণ : সব দেশের মত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু উন্নত দেশের মত এ দেশের বুর্জোয়া শ্রেণী অর্থনীতিতে খুব বেশি প্রতিষ্ঠিত নয়। ফলে রাজনীতি স্থিতিশীল নয়। এর কারণে সৃষ্টি হয় উপদলীয় কোন্দল ও দলীয় ভাঙ্গন।
  • ১১। সামরিক শাসন : এ দেশে একাধিকবার সামরিক শাসক ক্ষমতা দখলের পর নিজের ক্ষমতাকে অরাজনৈতিক চরিত্র দেয়ার জন্য উপর থেকে রাজনৈতিক দল চাপিয়ে দিয়েছে। বেসামরিকীকরণ করতে গিয়ে সামরিক শাসক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দ্বারা নিজ দলে লোক সংগ্রহ করেছে। আবার, অন্য দলের মোকাবেলায় এসব দলের সুবিধাবাদী লোকদের বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এসব দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি করেছে ও নতুন দল গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছে।
  • ১২। বিদেশী শক্তির প্রভাব: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগে উন্নত দেশগুলোতে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ আমাদের দেশে পাচারে সচেষ্ট থাকে সব সময়। এসব দেশ আমাদের দেশের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে দলে ভাঙ্গন ধরায় এবং নতুন দল গঠনে উদ্বুদ্ধ করে।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (Pressure Groups)

আধুনিককালে বিভিন্ন গোষ্ঠীর উপস্থিতি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম দিক। আধুনিক যুগ বা আধুনিকোত্তর যুগ গতিশীলতার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ গতিশীলতা সমাজবদ্ধ মানুষকে সচেতনতা দানের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় করে তোলে। নতুনভাবে গতিপ্রাপ্ত জনগণ বিভিন্ন স্বার্থকে কেন্দ্র করে সংঘবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়। উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের মতই স্বার্থ-গোষ্ঠীর উপস্থিতি এখন অপরিহার্য। এসব স্বার্থগোষ্ঠী নিজের স্বার্থ আদায় অথবা স্বার্থের পক্ষে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে যখন বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে তখন তাদের আমরা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করি। কালের আবর্তে বিংশ শতকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সামাজিকীকরণ, আধুনিকীকরণ, স্বার্থজ্ঞাপন ও গ্রন্থিকরণ এবং সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যে কারণে বিংশ শতকের শুরু হতে কিছু চিন্তাবিদ রাজনীতির ক্ষেত্রে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বিশ্লেষণের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন, যাদের মধ্যে আছেন- Arthur Bently, David Truman, Bartrum Latham প্রমুখ। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক আলোচনার প্রবক্তাদের মতে রাজনীতি শুধু মানুষের মিথস্ক্রিয়ার বা আন্তঃক্রিয়ার (Interaction) জটিল জাল নয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল এবং এর মাধ্যমে সচল থাকে। Latham বলেন, সমাজ হলো গোষ্ঠীর সমষ্টি বা গোষ্ঠীর জগৎ। বিরামহীনভাবে এসব গোষ্ঠীর জন্ম হয় এবং এদের কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজ গতিশীল থাকে।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংজ্ঞা

সাধারণভাবে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য সাধন বা স্বার্থ আদায়ে সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী যা সরকারের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে তাকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হলো কোন সংগঠিত সামাজিক গোষ্ঠী যেটি সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টারত।

  • A.R Ball বলেন, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হলো এমন একটি গোষ্ঠী যার সদস্যগণ কোন বিষয়ে সাধারণ সম-মনোভাব (Common Participatory Attitude) দ্বারা আবদ্ধ। অর্থাৎ একই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠী যারা সমানভাবে উদ্দেশ্য সাধনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে, তাকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলে। Ball স্বার্থগোষ্ঠী ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে একই বলে মনে করেন। তার মতে, সমজাতীয় উদ্দেশ্যগত বৈশিষ্ট্য হতে অংশীদারি মনোভাব সৃষ্টি হয়। সুতরাং স্বার্থ গোষ্ঠীই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী।
  • Bently বলেন, স্বার্থই গোষ্ঠীর ভিত্তি। Truman মনে করেন অংশীদারি মনোভাব স্বার্থ গোষ্ঠীর ভিত্তি। কাজেই একই মনোভাবসম্পন্ন এক দল লোক কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে অন্য গোষ্ঠীর উপর অথবা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করলে সে গোষ্ঠীকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলা হয়। এ গোষ্ঠী সরকারের ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করে না; বরং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করে সরকারের সিদ্ধান্তকে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
  • “একটি স্বার্থ-গোষ্ঠী হ’ল কোনও বিষয়ে সাধারণ মনোভাবের সাথে ব্যক্তিদের যে কোনও সমষ্টি যারা সেই বিষয়ে সমাজে অন্যদের উপর নির্দিষ্ট দাবি বা দাবি করে।” (A Watson and M. Fitgerold, Promise and Prospects of American Democrcy, p. 170)
  • “একটি স্বার্থ গোষ্ঠী জন্ম নেয় যখন একটি গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে এক বা একাধিক বিশেষ ক্ষেত্রে জনসাধারণের নীতিকে প্রভাবিত করতে চায়।”

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কাজ

উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সুনির্দিষ্ট কিছু কার্য সম্পাদন করে:

  • ১। স্বার্থজ্ঞাপন ও গ্রন্থিকরণ : উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী স্বার্থ জ্ঞাপন ও গ্রন্থিকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এসব গোষ্ঠী যেহেতু সদস্যদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গঠিত হয় তাই তারা নানামুখী সমস্যা ও দাবি সংগ্রহ ও সে দাবিগুলোর সমন্বয় সাধন করে রাজনৈতিক দল ও সরকারের কাছে বা কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থাপন করে। সমাজের বিভিন্ন অংশ ও পেশার মানুষের দাবিসমূহ প্রধানত চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়।
  • ২। তথ্য সংগ্রহ : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো তথ্যের উৎস। এসব গোষ্ঠী স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য এসব তথ্য ব্যবহার করে। সরকারকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে- (ক) আইন সভার সদস্যদের মাধ্যমে নিজ বক্তব্য পেশের সময়, ও (খ) শাসন বিভাগে নিজ বক্তব্য পেশের সময় সংরক্ষিত তথ্য সরবরাহ করে। তাছাড়া সময় সময় গণমাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে এসব তথ্য সরবরাহ করে।
  • ৩। জনসংযোগ ও যোগাযোগ রক্ষা : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী জনসংযোগের কাজ করে থাকে। এসব গোষ্ঠী সবসময় নিজেদের স্বার্থ রক্ষা ও প্রসারের লক্ষ্যে জনগণের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। জনগণের স্বার্থ সরকারের নিকট পৌঁছানো আবার সরকারের বিভিন্ন নীতি ও আইন জনগণকে অবহিত করার জন্য যোগাযোগ রক্ষা আবশ্যক। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নিজেদের দাবির যৌক্তিকতা জনগণকে বোঝানো এবং সরকারের বিতর্কিত ও জনস্বার্থবিরোধী কার্যক্রম সম্পর্কে তাদের অবহিত করার জন্য জনসংযোগ করে থাকে।
  • ৪। সরকারের সমালোচনা : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সবসময় সরকারের কাজের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখে। সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে প্রচার চালায় ও জনগণকে অবহিত করে এবং সরকারের বিতর্কিত কাজের সমালোচনা করে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সরকারের মনোভাব জনগণের সামনে তুলে ধরে। ফলে সরকার দায়িত্বশীল আচরণ করতে বাধ্য হয়।
  • ৫। সরকারকে পরামর্শ দান: চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারকে পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সহায়তা দিয়ে থাকে। উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিশেষ কোন বিষয়ে বা বিশেষ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীতি প্রণয়ন বা আইন তৈরিতে অথবা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার আগে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করা হয়। ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা সরকার কাজে লাগাতে পারে; অন্যদিকে সরকার সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারে ও সম্ভাব্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
  • ৬। রাজনৈতিক প্রচারণা: চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত। রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব গোষ্ঠী পরিচালিত। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করা। ক্ষমতা লাভ এদের লক্ষ্য নয়। যেহেতু রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত তাই চাপসৃষ্টিকারী নির্বাচন সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রচারণা করে।
  • ৭। রাজনৈতিক পরিবর্তন: চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ রাজনৈতিক বিষয়াবলি দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা মনোভাব ও অনুভূতি ব্যক্ত করে। রাজনৈতিক বিষয়ে তারা সংবেদনশীল। কাজেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ভূমিকা রাখে। আবার বিভিন্ন সময় সামাজিক পরিবর্তনের আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে।
  • ৮। সামাজিকীকরণ ও লোকসংগ্রহ: বর্তমানে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক দলের সাথে সংযুক্ত এবং দল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এরা রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে কাজ করে। কাজেই এসব গোষ্ঠী শুধু রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রচারণাই করে না, বরং নির্দিষ্ট দলের পক্ষে জনগণকে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শে দীক্ষিত করে। এভাবে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে অনেক ব্যক্তি রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে সচেতন ও আগ্রহী হয়। ধীরে ধীরে তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়। এভাবে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক নিয়োগ বা লোক সংগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিতকরণে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী (কৌশল)

প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বর্তমানে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব অনস্বীকার্য। মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নির্দিষ্ট কিছু পন্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারকে, অন্য কথায় সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এসব গোষ্ঠীর কর্মক্ষেত্র পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলেও স্বার্থ আদায় ও সংরক্ষণের নির্দিষ্ট ক্ষেত্র রয়েছে। নিজ নিজ লক্ষ্য অর্জনে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে নিজ স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করার প্রয়াস চালায়- প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে। Hod Hague and Martin Harrop চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাবের কৌশল দেখিয়েছেন এভাবে (Hod Hague and Martin Harrop, Comparative Government and Politics, 2nd ed, 1987, p-121-131.) :

তারা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব আলোচনার চারটি প্রধান মাধ্যম বর্ণনা করেছেন:

  • (ক) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও সরকারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ (Direct contact between interest groups and government)।
    • (i) রাজনৈতিক এলিট শ্রেণী প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে (Presentation in the political elite)।
    • (ii) এলিট সংশ্লিষ্টতা (Elite involvement)।
    • (iii) ব্যক্তিগত আবেদন (Personal petition)।
    • (iv) আমলাতন্ত্র (Bureaucracy)।
    • (v) আইনসভা (Assembly)
  • (খ) রাজনৈতিক দল (Indirect influence through political parties)।
  • (গ) গণমাধ্যম (Indirect influence through the mass media)।
  • (ঘ) প্রতিবাদ, প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড ও সহিংসতা (Protest, Direct action and Violence)।

Almond and Powell স্বার্থজ্ঞাপনের দু’প্রকৃতির উপায় তুলে ধরেন (Almond and Powell, Comparative Politics, (2nd), 1963, p-178.) –

  • (ক) সাংবিধানিক/বৈধ পন্থা (Constitutional channel)
    • (i) ব্যক্তিগত যোগাযোগ (Personal connection)
    • (ii) এলিট প্রতিনিধিত্ব (Elite representation)
    • (iii) লবিং (Lobying)
    • (iv) আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম (Formal and institutional channel of access)
    • (v) রাজনৈতিক দল (Political parties)
    • (vi) আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ ও আমলাতন্ত্র (Legislature, Executive and Bureaucracy)
    • (vii) প্রতিবাদ ও অন্যান্য কর্মসূচি (Protest and Movement)
  • খ) বলপ্রয়োগমূলক পন্থা (কৌশল) (Coercive Channel)
    • (i) হরতাল ও অবরোধ (Strike and Obstruction)
    • (ii) দাঙ্গা (Riot)
    • (iii) রাজনৈতিক সন্ত্রাস (Political Terror Tacties)

সার্বিকভাবে প্রভাব বিস্তারের কৌশলগুলো নিম্নরূপ :

  • ১। ব্যক্তিগত যোগাযোগ: ব্যক্তিগত যোগাযোগ বলতে পারিবারিক বন্ধন, বিদ্যালয়, স্থানীয় ও সামাজিক বন্ধনকে বোঝানো হয়; যেমন: এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহপাঠীদের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ। সামাজিক বন্ধন অনেক নেতাকে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতার পুরো মেয়াদকালে প্রভাবিত করে। এটি রাজনৈতিক এলিটদের প্রভাবিত করার একটি অনানুষ্ঠানিক পন্থা বা কৌশল।
  • ২। এলিট প্রতিনিধিত্ব ও যোগাযোগ: সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাঠামোতে প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে সরাসরি ও ধারাবাহিকভাবে স্বার্থজ্ঞাপন বা কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করার একটি অন্যতম কৌশল এটি। বিভিন্ন গোষ্ঠী নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে; যেমন: সরকার কোন গোষ্ঠীর দাবি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নীতি নির্ধারণের সময় ঐ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে। আবার অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এলিটদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা যোগাযোগের দ্বারাও প্রভাব বিস্তার করা যায়। সাধারণত আমলাতান্ত্রিক স্তরে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সক্রিয়তা বেশি দেখা যায়। সরকার কারিগরি বা অন্যান্য বিষয়ে কোন গোষ্ঠীর অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাথে আলোচনা ও তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে থাকে; যেমন: বণিক সমিতি, শিল্পপতি গোষ্ঠী ইত্যাদি। আইন সভায় বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করে ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়।
  • ৩। লবিং: আইনসভাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে লবিং অনেক বেশি কার্যকর। স্বার্থগোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো লবিস্টদের মাধ্যমে আইন সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
  • ৪। গণমাধ্যম: এটি প্রভাব বিস্তারের প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম। গণমাধ্যমগুলো তথ্য প্রবাহের প্রধানতম মাধ্যম। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো গণমাধ্যমের সাহায্যে তাদের দাবি পেশ ও প্রচারণার মাধ্যমে সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। যদিও গণমাধ্যম অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম, তবুও সঠিক দিক-নির্দেশনার অভাব ও রাজনৈতিক এলিটদের নিয়ন্ত্রণের কারণে তারা যথার্থ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় অনেক সময়।
  • ৫। প্রতিবাদ সমাবেশ, ধর্মঘট ও অন্যান্য: এটি সরকারের উপর চাপসৃষ্টির উল্লেখযোগ্য পন্থা। বিশেষ করে যেসব স্বার্থগোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্বল তারা এ কৌশল ব্যবহার করে। এটি সাংবিধানিক ও বলপ্রয়োগমূলক পন্থার মাঝামাঝি একটি কৌশল। সাধারণভাবে ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীগুলো প্রতিবাদ সমাবেশ, ধর্মঘট বা অন্যান্য কৌশলে (মানববন্দন) সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
  • ৬। রাজনৈতিক দল: একটি রাজনৈতিক দলে অনেকগুলো স্বার্থগোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত থাকে। এসব গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে তাদের দাবিগুলো সরকারের কাছে পেশ করে ও সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে রাজনৈতিক দলকে বাধ্য করতে সক্ষম। এসব গোষ্ঠী দলের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
  • ৭। হরতাল, বন্ধ/অবরোধ: সুসংগঠিত, সংঘমূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠগুলো এ পন্থা অবলম্বন করে। শ্রমিক সংঘগুলো তাদের দাবি আদায়ে সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য এ পন্থা/কৌশলে চাপসৃষ্টি করে থাকে। সহানুভূতিশীল বৃহৎ গোষ্ঠী বা দলের সমর্থন ছাড়া এ পন্থা সফল হয় না।
  • ৮। দাঙ্গা: এটি অন্যতম একটি সহিংস পদ্ধতি। সরকারের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে এটির সাফল্য মিশ্র। সমস্বার্থে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমন্বিত দাঙ্গা সফল হলেও একক কোন গোষ্ঠীর দাঙ্গা সাধারণত ব্যর্থ হয়। সাধারণত অস্থায়ী গোষ্ঠীগুলো দাবি আদায়ে চাপ সৃষ্টির জন্য এ কৌশল ব্যবহার করে।
  • ৯। সহিংসতা: বলপ্রয়োগমূলক কৌশলগুলোর মধ্যে এটি চরম একটি কৌশল। এ কৌশল সাধারণত সরকারের উপর অধিক প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। কোন নীতির পরিবর্তন, কাঠামোগত পরিবর্তন বা বৈধতার সংকট সৃষ্টির লক্ষ্যে এ কৌশল ব্যবহার করা হয়। আবার অনেক সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যও এ কৌশল ব্যবহার করা হয়; যেমন: গুপ্ত হত্যা, নেতা অপহরণ, কোন সরকারি কর্মচারীর উপর হামলা বা তার অপহরণ ইত্যাদি এ কৌশলের অন্তর্ভুক্ত।

প্রভাবশালী নির্ধারক (Influencing Factors)

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ সিদ্ধান্তগ্রহণকারী নেতাদের নিকট তাদের দাবি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে এবং সহানুভূতিশীল সাড়া পেতে আগ্রহী। ফলে এসব গোষ্ঠী তাদের দাবি উত্থাপনে উপযুক্ত কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করে। তবে দাবির প্রতি দৃষ্টি কতখানি আকৃষ্ট হবে তা বেশকিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে:

  • ১। রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি : উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে দাবি উত্থাপনকে উৎসাহিত করা হয়। এ ছাড়া দেশের প্রচলিত আইনে দাবির প্রকাশ স্বীকৃত। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক কাঠামোসমৃদ্ধ আদর্শিক রাজনৈতিক দল রয়েছে সেখানে (কমিউনিষ্ট পার্টি) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
  • ২। দাবির বৈধতা: চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী যে দাবি উত্থাপন করে তার বৈধতার ব্যাপারে বিশ্বাস প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। অবাস্তব বা পূরণ করা অসম্ভব এমন দাবি কর্তৃপক্ষের সহানুভূতিশীল দৃষ্টি/মনোভাব পাবার যোগ্যতা রাখে না।
  • ৩। তথ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ: সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য উত্থাপিত দাবি সম্পর্কিত তথ্য চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর নিকট থাকা এবং তথ্যের উৎসের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি।
  • ৪। সিদ্ধান্তগ্রহণকারীর পূর্ব ধারণা: স্বার্থগোষ্ঠী কর্তৃক পেশকৃত দাবি পূরণে কি রকম প্রতিক্রিয়া বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তগ্রহণকারীর পূর্ব ধারণার উপরও সিদ্ধান্তগ্রহণকারীর উপর প্রভাবের মাত্রা নির্ভর করে।
  • ৫। সিদ্ধান্তগ্রহণকারীর মনোভাব: দাবি আদায়ে চাপসৃষ্টিকারীর প্রভাব কর্তৃপক্ষের মনোভাবের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল।
  • ৬। কৌশল ও শক্তি : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারকে কতখানি প্রভাবিত করতে পারবে তা চাপ সৃষ্টির অনুসৃত কৌশলের উপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর শক্তিও বিশেষ বিবেচ্য বিষয়।
  • ৭। সমর্থন: সুসংগঠিত বৃহৎ গোষ্ঠী বা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থন প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর গুরুত্ব

  • রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি: আধুনিককালে উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের মত চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্রিয়াশীল স্বার্থজ্ঞাপনের বিশেষায়িত কাঠামো হিসেবে স্বার্থ-গোষ্ঠী/চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কারণ এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন গোষ্ঠীর দাবি সম্পর্কে অবহিত হন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন (নীতি প্রণয়নের দ্বারা) করে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে খাপখাওয়াতে ও পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম করে তুলতে সাহায্য করে।
  • নতুন দাবি পূরণে নতুন কাঠামো গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা : সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন গোষ্ঠী রাজনীতিতে গতিশীল বা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এসব গোষ্ঠীর দাবি মেটাতে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন কাঠামো গড়ে উঠবে। কাজেই স্বার্থ গোষ্ঠীগুলো নতুন দাবি পূরণে নতুন কাঠামো গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। ফলে নতুন কাঠামো সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নতুন দাবি মেটানোর সামর্থ্য অর্জন করে। এ নতুন স্বার্থজ্ঞাপনের লক্ষ্যে নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব সচেতনতা, আধুনিকীকরণ ও উন্নয়নের সূচক।
  • অধিকহারে গোষ্ঠী সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিতকরণ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি : অধিকহারে গোষ্ঠী সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করতে অনেক সময় সরকার নতুন স্বার্থজ্ঞাপক গোষ্ঠী সংগঠিত করে। আবার সমর্থন লাভের প্রত্যাশায় সরকার স্বার্থগোষ্ঠীর সংগঠন উৎসাহিত করে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্যদের সমর্থন পাবার জন্য ও তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য কোন কোন রাজনৈতিক সংগঠন গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করে; যেমনঃ রাজনৈতিক দল তার অঙ্গ সংগঠন হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইউনিয়ন গঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। এভাবে সংগঠিত গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়।
  • জনসচেতনতা সৃষ্টি : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো তাদের দাবি আদায়ে অনেক সময় জনমত গঠন করে। এসব গোষ্ঠী তাদের দাবি সম্পর্কে প্রচারণা চালায় ও জনমত গঠন করে। দাবি সম্পর্কে প্রাচারণা চালানোর দ্বারা এসব গোষ্ঠী জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত করে। জনগণ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য প্রাপ্ত হয় ও তথ্য সমৃদ্ধ হয়- যা তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে। এটি উন্নয়ন ও গতিশীলতার একটি সূচক।
  • সরকার দলের সাথে সম্পর্ক : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সবসময় সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ এবং সজাগ। সরকারের নানা কাজের বিষয়ে তারা সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখে। সরকারি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো সরকারি নীতিমালা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে এবং এসব নীতিমালা বাস্তবায়নে জনসমর্থন আদায়ে সরকারি নীতিমালার পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টা চালায়। আবার বিরোধী দলের সাথে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো আমলাতন্ত্র ও সরকারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে এবং সরকারবিরোধী জনমত গঠনের মাধ্যমে সরকারকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে বাধ্য করে।
  • নির্বাহী বিভাগে প্রভাব : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো আইনসভায়, নির্বাহী বিভাগ ও আমলাতন্ত্রে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বক্তব্য উপস্থাপনের ভূমিকা পালন করে। নির্বাহী বিভাগ বিভিন্ন সময় কোন গোষ্ঠীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের সময় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পরামর্শ গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকারের সাথে স্বার্থগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব নিরসনে এসব গোষ্ঠী ভূমিকা রাখে।

আধুনিককালে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো প্রভৃত গুরুত্বের দাবিদার। একদিকে তারা জন দাবি আদায়ে ও অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে সরকারকে দায়িত্বশীল রাখে। রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রাখে; রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পার্থক্য

উৎপত্তিগত দিক হতে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল প্রাথমিকভাবে একই প্রকৃতির। অনেক রাজনৈতিক দল প্রাথমিকভাবে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে উৎপত্তি লাভ করে এবং ক্রমান্বয়ে নীতি, লক্ষ্য, কর্মসূচি ও আকার সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের রূপ পরিগ্রহ করে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার (Interaction) দ্বারা আবদ্ধ। তাদের কর্মকাণ্ড ও মিথাস্ক্রিয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রাখে। উভয়ই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। উভয়ই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী স্বার্থজ্ঞাপন ও গ্রন্থিকরণের সাথে যুক্ত। আবার, রাজনৈতিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও উভয়ে ভূমিকা রাখে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড জনমত গঠন, সামাজিকীকরণ, যোগাযোগ, তথ্য সরবরাহ, সরকারের সমালোচনা ইত্যাদি পর্যন্ত সম্প্রসারিত। কিছু সাদৃশ্য থাকলেও উভয়ের মধ্যে উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিগত নিম্নরূপ পার্থক্য দেখা যায়:

  • ১। উৎপত্তি (Origin) : উৎপত্তির বিচারে রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পার্থক্য লক্ষণীয়। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উৎপত্তি ঘটে শুধুমাত্র স্বার্থকে কেন্দ্র করে। সমস্বার্থের একদল মানুষের সমআচরণের ফলে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর জন্ম হয়। রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি ঘটে সুনির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শকে কেন্দ্র করে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ সরকার গঠন ও পরিচালনা এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি অপরিহার্য হয়ে উঠে।
  • ২। সংগঠন (Organisation): চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর চেয়ে রাজনৈতিক দলের সংগঠন অনেক বেশি শক্তিশালী ও ব্যাপক। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে গঠিত হয় বলে রাজনৈতিক দলের সংগঠন দৃঢ়। অন্যদিকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মতাদর্শগত দুর্বলতা ও স্বার্থকেন্দ্রিকতার কারণে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংগঠন সুদৃঢ় নয়। রাজনৈতিক দলের সদস্যগণ কঠোর দলীয় শৃঙ্খলায় আবদ্ধ। দলীয় কর্মসূচির প্রতি আনুগত্য ও অঙ্গীকার তাদের ঐক্যবদ্ধ রাখে। ফলে দলের সদস্য সংখ্যা বেশি হলেও তারা সুসংগঠিত। অন্যদিকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা কম হলেও অঙ্গীকারাবদ্ধতার অভাব, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংগঠন অপেক্ষাকৃত দুর্বল।
  • ৩। উদ্দেশ্য (Objectives): রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য অনেক বিস্তৃত ও বহুবিধ। কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী স্বার্থ নিয়ে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে না। সর্বজনীন কল্যাণের উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী স্বার্থকে কেন্দ্র করে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য সীমিত। একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ সিদ্ধির জন্য চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়।
  • ৪। সামাজিক ভিত্তি (Social Base): ব্যাপক ও বিস্তৃত উদ্দেশ্যের কারণে রাজনৈতিক দলের ভিত্তি অনেক বিস্তৃত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির আওতাভুক্ত। অন্যদিকে সদস্যদের সমজাতীয় স্বার্থই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভিত্তি। কাজেই এর ভিত্তি সংকীর্ণ।
  • ৫। ব্যাপকতা (Comprehensiveness) : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর চেয়ে রাজনৈতিক দলের সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ও স্বার্থ-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল নানামুখী স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই এর উদ্দেশ্য ও কর্মসূটি অনেক ব্যাপক। সমগ্র দেশের জনগোষ্ঠীর সর্বজনীন কল্যাণে তাকে কাজ করতে হয়। অন্যদিকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা অনেক কম থাকে। কখনো কখনো আঞ্চলিক দলের তুলনায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা বেশি থাকতে পারে। তবে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির বিচারে একটি রাজনৈতিক দলের তুলনায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ব্যাপকতা সীমিত।
  • ৬। অন্তঃদলীয় বিরোধ (Inter-party Conflict/Cliques) : একটি রাজনৈতিক দলে অনেক স্বার্থ গোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটে। প্রত্যেক গোষ্ঠী দলের নীতি-কর্মসূচিকে প্রভাবিত করার চেষ্টারত থাকতে পারে। ফলে রাজনৈতিক দল ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত হতে পারে এবং এতে অন্তঃদলীয় কোন্দল সৃষ্টি হতে পারে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্যগণ সমজাতীয় স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে বলে এতে অভ্যন্তরীণ বিরোধের সম্ভাবনা অনেক কম থাকে।
  • ৭। দেশপ্রেম (Patriotism): রাজনৈতিক দল সর্বজনীন কল্যাণে কাজ করে। এর নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচিতে দেশপ্রেমের ভাবধারা ফুটে ওঠে কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর নিকট নিজ স্বার্থের তুলনায় জাতীয় স্বার্থ গৌণ। তাদের কর্মকাণ্ডে দেশপ্রেমের মাত্রাও কম।
  • ৮। স্বার্থজ্ঞাপন ও গ্রন্থিকরণ (Interest Articulation and Aggregation): চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কোন নির্দিষ্ট অঞ্চল বা শ্রেণীর দাবি বা স্বার্থ সরকারের নিকট পেশ করে ও তা আদায়ে চাপসৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলে যেহেতু অনেক স্বার্থগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত থাকে দল এসব গোষ্ঠীর স্বার্থ চিহ্নিত ও গ্রন্থিকরণের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের নিকট পেশ করে এবং এসব দাবি আদায়ের চেষ্টা করে। রাজনৈতিক দল মূলত স্বার্থ চিহ্নিতকরণের চেয়ে একত্রীকরণ বা গ্রন্থিকরণের কাজ বেশি করে ও তা জ্ঞাপন করে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ছোট পরিসরে স্বার্থ চিহ্নিতকরণের কাজ ও জ্ঞাপনের কাজ করে।
  • ৯। কার্য পরিচালনা (Functioning/Working/Operation) : রাজনৈতিক দলের বক্তব্য স্পষ্ট, কার্যক্রম প্রকাশ্য। সুনির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দল প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে। অন্যদিকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী গোপনে ও পরোক্ষভাবে কার্যাবলি পরিচালনা করে। এদের কর্মপদ্ধতি জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক দল নীতি, কর্মসূচির পক্ষে জনসমর্থন পাবার জন্য প্রত্যক্ষভাবে কার্য পরিচালনা করে।
  • ১০। সামাজিকীকরণ (Socialisation): রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী উভয়ই সামাজিকীকরণের ভূমিকা রাখে। তবে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সামাজিকীকরণের ভূমিকা সীমিত। রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে সামাজিকীকরণের কিছু কাজ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী করে থাকে। তবে, রাজনৈতিক দলের সামাজিকীকরণের পরিধি অনেক বিস্তৃত। রাজনৈতিক দল জনগণকে রাজনৈতিক আচার-আচরণ, বিশ্বাস, মনোভাব, মূলবোধ, সরকারের কাজ, ব্যক্তির অধিকার, দায়িত্ব, কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করে তোলে। সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল দু’টি কাজ করে থাকে: (ক) বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারা প্রবাহমান রাখে; (খ) পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের ধারা সংযোজনের চেষ্টা করে। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কোন উদ্দেশ্য থাকে না বলে জনগণকে সামাজিকীকরণে তাদের দায়বদ্ধতা থাকে না।
  • ১১। নির্বাচন ও রাষ্ট্র পরিচালনা (Election and Running Government) : রাজনৈতিক দল তার আদর্শ ও নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক্ষমতা অর্জনের জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন করে ও প্রচারণা চালায় এবং জয়লাভের পর সরকার গঠন করে। পক্ষান্তরে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ক্ষমতা অর্জনের কোন লক্ষ্য থাকে না। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না; বরং সম্পৃক্ত দলের পক্ষে প্রচারণা চালায়। ক্ষমতা অর্জনের পরিবর্তে তারা কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করার চেষ্টারত থাকে।
  • ১২। সংহতি (Integrity): বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর সমন্বিত রূপ বলে রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংহতি বিধান কঠিন, কারণ এখানে নানা স্বার্থকেন্দ্রিক উপদল থাকে। কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্যগণ সমআচরণ ও সমস্বার্থের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ বলে সংহতির সমস্যা দেখা যায় না।
  • ১৩। সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Decision-making): চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীতে সমঝোতা ও সংহতি দৃঢ়, কারণ এর সদস্যগণ সমস্বার্থের প্রতিভূ। ফলে সিদ্ধান্তগ্রহণ সহজ ও সর্বজনীন। কিন্তু রাজনৈতিক দলে নানা স্বার্থগোষ্ঠী থাকে বলে সিদ্ধান্তগ্রহণ অনেক কঠিন। সকল গোষ্ঠীর সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তগ্রহণ করা অনেক কঠিন।
  • ১৪। সমঝোতা (Understanding): নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও একাধিক রাজনৈতিক দল সমঝোতার ভিত্তিতে সরকার গঠন করতে পারে। আবার গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া হতে পারে। নানামুখী সাংঘর্ষিক স্বার্থের প্রতিভূ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা খুব একটা দেখা যায় না।

রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে প্রকৃতি, কাজ, লক্ষ্য, আদর্শ ইত্যাদি বিচারে অনেক পার্থক্য রয়েছে- যদিও অনেক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সমন্বয়ে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে পারে; কিংবা প্রাথমিকভাবে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে জন্ম নিয়েও একটি রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে পারে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলের মধ্যে থেকেই কাজ করে, তাই উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করা খুব সহজ নয়। মূলকথা হলো উভয়ের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা সচল থাকে।

তথ্যসূত্র 

  • রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব, মোকাদ্দেসুর রহমান, আজিজিয়া বুক ডিপো, ঢাকা, ২০১৩
  • অন্যান্য তথ্যসূত্র নিবন্ধের মধ্যেই রয়েছে

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.