Table of Contents
ভূমিকা
আপনি কি কখনো কফির কাপ হাতে নিয়ে জানালার বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভেবেছেন, এই যে জগৎটাকে আমি দেখছি, এটা আসলে কী? এই যে চায়ের কাপ, এর উষ্ণতা, জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা—এগুলো কি শুধুই আমার মনের খেলা, নাকি সত্যিই এদের কোনো অস্তিত্ব আছে? প্রশ্নটা ছেলেমানুষি মনে হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় দার্শনিকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই এক প্রশ্ন। আমরা যা জানি, তা আসলেই জানি তো? নাকি সবই এক বিরাট ভ্রম? রেনে দেকার্ত নামে এক ফরাসি ভদ্রলোক তো ভাবনার এই চোরাবালিতে এমনভাবে ডুবেছিলেন যে, নিজের অস্তিত্ব ছাড়া আর সবকিছুকেই সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। তিনি তার বিখ্যাত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি” (Cogito, ergo sum)। কিন্তু ঐ ‘আমি’টুকু ছাড়া বাকি জগতের কী হবে? দেকার্ত এক ধরনের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন ঈশ্বরের ধারণার মধ্যে, কিন্তু সেই আশ্রয়টি অনেকের কাছেই মনে হয়েছিল বড়ই নিঃসঙ্গ এবং দুর্বল। দর্শনের ইতিহাসে দেকার্ত একটি দরজা খুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই দরজার ওপারে কী আছে, তা পুরোপুরি দেখে যেতে পারেননি।
এইরকম এক ঘোর লাগা দুপুরে আমাদের গল্পের শুরু। গল্পের নায়কের নাম এডমুন্ড হুসার্ল। তিনি ঠিক গল্পের নায়ক নন, বরং এক জেদি গোয়েন্দা, এক জ্ঞানপিপাসু সাধক। তার অনুসন্ধানের বিষয় কোনো খুনের রহস্য নয়, বরং তার চেয়েও জটিল, তার চেয়েও গভীর—আমাদের চেতনার (consciousness) রহস্য। তিনি চেয়েছিলেন দর্শনের জন্য এমন এক ভিত্তি খুঁজে বের করতে, যা গণিতের সূত্রের মতো অভ্রান্ত, যাকে কোনোভাবেই আর সন্দেহ করা যাবে না। দেকার্ত যেখানে শুরু করে একরকম থেমে গিয়েছিলেন, হুসার্ল যেন সেখান থেকেই তার যাত্রা শুরু করতে চাইলেন। এই বিপজ্জনক ও রোমাঞ্চকর অভিযানেরই নাম দিয়েছিলেন তিনি—প্রতিভাসতত্ত্ব (Phenomenology)।
আসুন, আমরা সেই গোয়েন্দার হাত ধরে চেতনার গহীন অরণ্যে প্রবেশ করি। ভয় পাবেন না, পথ হারাবার সম্ভাবনা কম। কারণ আমাদের হাতে আছে তার দেওয়া একটি আশ্চর্য টর্চলাইট, যা দিয়ে আমরা অভিজ্ঞতার আনাচে-কানাচে আলো ফেলে দেখব। এই যাত্রাপথে আমরা দেখব, কীভাবে আমাদের পরিচিত জগৎটা একটু একটু করে বদলে যায়, আর আমরা এক নতুন জগতের সন্ধান পাই, যা আমাদের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল। এ এক অদ্ভুত যাত্রা, যেখানে বাইরের জগৎকে ভুলে গিয়ে ভেতরের জগতের মানচিত্র আঁকতে হয়। যেখানে প্রশ্ন বাইরের আপেলটি নিয়ে নয়, প্রশ্ন হলো আমার চেতনায় ভেসে ওঠা আপেলের প্রতিভাসটি নিয়ে।
দর্শনের শেকড় সন্ধান: হুসার্ল কেন এমন করে ভাবলেন?
মানুষ কেন এমন হয়? কোনো মানুষ কেন শিল্পী হয়, কেউ বা বিপ্লবী, আবার কেউ বা নিভৃতচারী সাধক? এই প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর নেই। আমরা সবাই আমাদের সময়ের সন্তান। আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, চারপাশের মানুষের বিশ্বাস আর যুগের হাওয়া—এই সবকিছু মিলেই আমাদের চিন্তার জগৎ তৈরি হয়। আমরা যা কিছু ভাবি, যা কিছু তৈরি করি, তার পেছনে অদৃশ্য সুতোর মতো জড়িয়ে থাকে এই প্রভাবগুলো।
দার্শনিকদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ভিন্ন নয়। একজন দার্শনিক হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে শূন্য থেকে এক বিরাট দর্শন বানিয়ে ফেলেন না। তার চিন্তার পেছনেও থাকে পূর্বসূরিদের ছায়া, থাকে সমকালের চাপ, থাকে কিছু ধারণার প্রতি গভীর অনুরাগ আর কিছু ধারণার প্রতি তীব্র বিরোধিতা। আমাদের আজকের গল্পের নায়ক এডমুন্ড হুসার্লও এর ব্যতিক্রম নন। তার প্রতিভাসতত্ত্ব (Phenomenology) নামের যে গূঢ় ও রহস্যময় দর্শন, তার জন্মও হয়েছিল এক বিশেষ ঐতিহাসিক ও দার্শনিক প্রেক্ষাপটে।
আসুন, আমরা একটু গোয়েন্দার মতো করে হুসার্লের চিন্তার শেকড় সন্ধান করি। দেখি, কোন কোন কারিগর তার চিন্তার এই আশ্চর্য ইমারত গড়তে সাহায্য করেছিলেন, আর কোন কোন প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তিনি তার নিজস্ব পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। এই যাত্রায় আমরা দেখব, হুসার্লের দর্শন কেবল এক বিমূর্ত তত্ত্বের খেলা ছিল না, বরং তা ছিল তার সময়কার সংকট থেকে মুক্তির এক আকুল প্রচেষ্টা।
যে কারিগরদের কাছে তিনি ঋণী
যেকোনো বড় চিন্তাবিদই তার পূর্বসূরিদের কাঁধে চড়েই দূরের আকাশ দেখেন। হুসার্লও কয়েকজন বড় মাপের দার্শনিকের কাছে গভীরভাবে ঋণী ছিলেন। তিনি তাদের কাজকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি। বরং তাদের দেওয়া চাবি দিয়েই নতুন সব দরজা খুলেছেন।
রেনে দেকার্ত: সন্দেহের শুরু এবং ‘আমি’র আবিষ্কার
হুসার্লের দর্শনের সঙ্গে যার সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তিনি হলেন ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (René Descartes)। দেকার্তকে বলা হয় আধুনিক দর্শনের জনক। তিনি এমন এক জ্ঞান খুঁজছিলেন যা পুরোপুরি নিশ্চিত, যাকে কোনোভাবেই সন্দেহ করা যায় না। এই নিশ্চিত ভিত্তি খোঁজার জন্য তিনি এক ভয়ংকর খেলা শুরু করলেন—সবকিছুকে সন্দেহ করার খেলা। আমার ইন্দ্রিয় আমাকে ধোঁকা দিতে পারে, আমি হয়তো স্বপ্ন দেখছি, এমনকি কোনো দুষ্ট দৈত্যও হয়তো আমাকে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করছে। এই সার্বিক সন্দেহের শেষে দেকার্ত একটিমাত্র জিনিস খুঁজে পেলেন যাকে আর সন্দেহ করা যায় না—আর তা হলো তার নিজের চিন্তার অস্তিত্ব। তিনি বললেন, “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি” (I think, therefore I am)। এই ‘আমি’ বা ‘অহং’ (Ego) হলো তার দর্শনের অকাট্য ভিত্তি (Descartes, 1641/1984)।
হুসার্ল দেকার্তের এই পদক্ষেপ দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনিও দর্শনের জন্য একটি নিশ্চিত ভিত্তি খুঁজছিলেন। দেকার্তের মতোই তিনি জগৎকে সন্দেহ করার পদ্ধতি গ্রহণ করলেন, যার নাম তিনি দিলেন এপোহে (Epoché) বা ব্র্যাকেটবন্দী করা। কিন্তু হুসার্লের মতে, দেকার্ত এই অসাধারণ আবিষ্কারের পর একটি বড় ভুল করে ফেলেন। তিনি খুব দ্রুত এই আত্মসচেতন ‘আমি’ থেকে লাফ দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং তারপর বাহ্যিক জগতের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চলে যান। হুসার্লের মতে, দেকার্ত তার নিজের আবিষ্কৃত জগতের ভেতরে যথেষ্ট সময় কাটাননি। তিনি চেতনার দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়েই আবার বাইরের জগতে ফিরে গিয়েছিলেন।
হুসার্ল বললেন, “না, আমাদের চেতনার ভেতরেই থাকতে হবে।” দেকার্ত যেখানে থেমে গিয়েছিলেন, হুসার্ল সেখান থেকে শুরু করলেন। তার পুরো দর্শনই হলো দেকার্তের আবিষ্কৃত সেই ‘আমি’ বা চেতনার রাজ্যের এক বিস্তারিত মানচিত্র আঁকার প্রচেষ্টা। একারণে হুসার্ল তার একটি বিখ্যাত বইয়ের নামই দিয়েছিলেন কার্তেসীয় ধ্যান (Cartesian Meditations), যা দেকার্তের প্রতি তার ঋণ ও সমালোচনার এক চমৎকার দলিল (Husserl, 1960)।
ফ্রানৎস ব্রেনতানো: চেতনার সেই আশ্চর্য জাদু
হুসার্লের চিন্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠিটি যদি কারও কাছ থেকে এসে থাকে, তিনি হলেন তার শিক্ষক ফ্রানৎস ব্রেনতানো (Franz Brentano)। ব্রেনতানো একজন মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন, যিনি মানসিক ঘটনা (mental phenomena) এবং ভৌত ঘটনার (physical phenomena) মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বললেন, মানসিক ঘটনার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে যা ভৌত ঘটনার নেই। সেই বৈশিষ্ট্যটি হলো, চেতনা সবসময় কোনো না কোনো কিছুর দিকে নির্দেশ করে, কোনো কিছুর দিকে মুখ করে থাকে। তিনি এর নাম দিলেন ‘ইনটেনশনালিটি’ (Intentionality)। যেমন, ভালোবাসা সবসময় ‘কাউকে’ বা ‘কিছুকে’ ভালোবাসা হয়। চিন্তা সবসময় ‘কোনো বিষয়’ নিয়ে চিন্তা হয়। ঘৃণা সবসময় ‘কোনো কিছুর’ প্রতি ঘৃণা হয়। চেতনা কখনো ফাঁকা থাকে না (Moran, 2000)।
হুসার্ল এই ধারণাটিকে লুফে নিলেন। কিন্তু ব্রেনতানো যেখানে ইনটেনশনালিটিকে শুধু মন এবং বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করার একটি উপায় হিসেবে দেখেছিলেন, হুসার্ল তাকে এক মহাকাব্যিক রূপ দিলেন। হুসার্লের কাছে ইনটেনশনালিটি শুধু চেতনার একটি বৈশিষ্ট্য নয়, এটিই হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমাদের কাছে একটি অর্থপূর্ণ জগৎ তৈরি হয়। চেতনা কেবল নিষ্ক্রিয়ভাবে কোনো কিছুর দিকে নির্দেশ করে না, বরং সে সক্রিয়ভাবে তার বিষয়বস্তুকে ‘গঠন’ (constitute) করে। এই একটি ধারণা হুসার্লের পুরো দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো। ব্রেনতানো তাকে যে বীজটি দিয়েছিলেন, হুসার্ল তাকে এক বিশাল মহীরুহে পরিণত করলেন।
ইমানুয়েল কান্ট: মনের চশমা
জার্মান দর্শনের মহীরুহ ইমানুয়েল কান্টও (Immanuel Kant) হুসার্লকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। কান্ট দর্শনে এক ‘কোপার্নিকান বিপ্লব’ ঘটিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমাদের মন নিষ্ক্রিয়ভাবে বাইরের জগৎ থেকে জ্ঞান গ্রহণ করে না। বরং আমাদের মনই কিছু নির্দিষ্ট কাঠামো বা ছাঁচ (যেমন দেশ ও কাল) দিয়ে জগৎকে সাজিয়ে তোলে, তারপর তাকে অভিজ্ঞতা করে। জগৎ নিজে কেমন (thing-in-itself বা noumenon), তা আমরা কখনোই জানতে পারি না। আমরা কেবল জগৎ আমাদের কাছে যেভাবে প্রতিভাত হয় (phenomenon), তাকেই জানতে পারি।
হুসার্ল কান্টের এই ধারণাটি পছন্দ করলেন যে, মন সক্রিয়ভাবে জগৎকে গঠন করে। কিন্তু কান্টের ‘অজ্ঞেয় জগৎ’ (thing-in-itself) ধারণাটি তার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়েছিল। যে জিনিসকে জানাই যাবে না, তা নিয়ে কথা বলে লাভ কী? হুসার্লের এপোহে (Epoché) পদ্ধতিটি ছিল কান্টের এই সমস্যার এক চরম সমাধান। তিনি বললেন, “ঠিক আছে, চলো আমরা ঐ অজ্ঞেয় জগতের অস্তিত্ব আছে কি নেই, সেই প্রশ্নটাকেই ব্র্যাকেটবন্দী করে রাখি। আমরা কেবল আমাদের চেতনার কাছে জগৎ যেভাবে ধরা দেয়, সেই প্রতিভাস বা ফেনোমেনন নিয়েই কাজ করব।” এভাবে হুসার্ল কান্টের ফেনোমেনন-এর জগৎকে একমাত্র গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন এবং অজ্ঞেয় জগতের ধারণাটিকে দার্শনিক আলোচনার বাইরে পাঠিয়ে দিলেন (Zahavi, 2003)।
যে প্রতিপক্ষের সঙ্গে তিনি লড়েছিলেন
একজন চিন্তাবিদ কেবল পূর্বসূরিদের দ্বারা প্রভাবিত হন না, তিনি তার সমসাময়িক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে লড়াই করেও নিজের চিন্তাকে শাণিত করেন। হুসার্লের দর্শন বুঝতে হলে তাকেও বুঝতে হবে, তিনি কাদের বিরুদ্ধে তার তলোয়ার শান দিচ্ছিলেন।
মনস্তত্ত্ববাদ (Psychologism): সত্যের আপেক্ষিকতা: হুসার্লের প্রথম জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল মনস্তত্ত্ববাদ। এই মতবাদ অনুযায়ী, যুক্তিবিদ্যা বা গণিতের নিয়মগুলো মানুষের মনের কিছু মনস্তাত্ত্বিক অভ্যাসের ফল। অর্থাৎ, ২+২=৪ এই সত্যটি সার্বজনীন নয়, বরং এটি মানুষের মস্তিষ্কের গঠনের ফল। এই ধারণা হুসার্লকে আতঙ্কিত করেছিল। কারণ এর মানে দাঁড়ায়, সত্য আপেক্ষিক। যদি তাই হয়, তবে জ্ঞান বা বিজ্ঞান বলে কিছুই থাকতে পারে না। তার বিখ্যাত গ্রন্থ লজিক্যাল ইনভেস্টিগেশনস (Logical Investigations) ছিল এই মনস্তত্ত্ববাদের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ এবং সফল যুদ্ধ। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, সত্য এবং যৌক্তিক নিয়মগুলো মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা নয়, বরং এগুলো হলো আদর্শ বা শ্বাশত সত্তা (ideal entities), যা আমাদের মনের ওপর নির্ভরশীল নয় (Husserl, 1970a)।
ঐতিহাসিকতাবাদ (Historicism): ইতিহাসের কারাগারে বন্দী সত্য: আরেকটি মতবাদ যা হুসার্লকে ভাবিয়েছিল তা হলো ঐতিহাসিকতাবাদ, যার প্রবক্তা ছিলেন উইলহেম ডিলথের মতো চিন্তাবিদরা। এই মত অনুযায়ী, যেকোনো দর্শন, শিল্প বা মূল্যবোধ তার নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগের ফসল। প্রতিটি যুগের নিজস্ব ‘সত্য’ আছে, কোনো সার্বজনীন বা চিরন্তন সত্য নেই। হুসার্লের কাছে এটাও ছিল আপেক্ষিকতাবাদেরই আরেকটি রূপ। যদি প্লেটোর দর্শন কেবল প্রাচীন গ্রিসের জন্য সত্য হয়, আর কান্টের দর্শন কেবল অষ্টাদশ শতকের জার্মানির জন্য, তাহলে দর্শনের উদ্দেশ্য কী? হুসার্ল এই ‘ইতিহাসের কারাগার’ থেকে দর্শনকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তার সারবস্তু-বিষয়ক হ্রাসকরণ (Eidetic Reduction) পদ্ধতিটি ছিল এই সমস্যার সমাধান। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি অভিজ্ঞতার পরিবর্তনশীল, ঐতিহাসিক উপাদানগুলো বাদ দিয়ে তার অপরিহার্য, সার্বজনীন কাঠামো বা ‘সারসত্তা’ (essence) খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, যা দেশ-কালের ঊর্ধ্বে (Føllesdal, 1999)।
যুগের হাওয়া এবং সংকটের অনুভূতি
হুসার্লের শেষ জীবনের চিন্তা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল তার সময়কার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি দ্বারা। তিনি এমন এক সময়ে বাস করছিলেন যখন ইউরোপ এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
বিজ্ঞানের সংকট এবং জীবন-জগতের নির্বাসন
ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকের শুরুতে বিজ্ঞান অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছিল। এর ফলে এক ধরনের বিজ্ঞানমনস্কতা বা প্রত্যক্ষবাদ (Positivism) তৈরি হয়, যা মনে করত একমাত্র প্রকৃতি বিজ্ঞানই পারে জগৎ সম্পর্কে সত্য জ্ঞান দিতে। জগৎকে কেবল গাণিতিক সূত্র আর কার্যকারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করার এক প্রবল প্রবণতা দেখা যায়।
হুসার্ল এর মধ্যে এক গভীর সংকট দেখতে পান। তিনি তার শেষ জীবনের প্রধান গ্রন্থ দ্য ক্রাইসিস অফ ইউরোপিয়ান সায়েন্সেস (The Crisis of European Sciences)-এ বলেন, বিজ্ঞান তার সাফল্যের মোহে নিজের ভিত্তিকেই ভুলে গেছে। সব বিজ্ঞানের ভিত্তি হলো আমাদের প্রত্যক্ষ, জীবন্ত অভিজ্ঞতার জগৎ, যাকে তিনি বলেছেন জীবন-জগৎ (Lebenswelt বা Lifeworld)। এটা হলো আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের জগৎ, যেখানে সূর্য ওঠে আর ডোবে, ফুল ফোটে, আমরা ভালোবাসি আর ঘৃণা করি। বিজ্ঞানীরা তাদের ল্যাবরেটরিতে বসে যে জগৎকে পরিমাপ করেন, সেই জগৎ এই জীবন-জগতের ওপর নির্মিত একটি বিমূর্ত কাঠামো মাত্র। সংকটটি হলো, বিজ্ঞান এই জীবন-জগতকে ভুলে গিয়ে তার বিমূর্ত মডেলকেই একমাত্র সত্য বলে দাবি করছে। এর ফলে মানব অভিজ্ঞতা, জীবনের অর্থ, মূল্যবোধ—এই সবকিছুই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে (Husserl, 1970b)।
রাজনৈতিক সংকট এবং অযৌক্তিকতার উত্থান
হুসার্ল যখন এই কথাগুলো লিখছেন, তখন জার্মানি তথা ইউরোপে ফ্যাসিবাদের মতো ভয়ঙ্কর অযৌক্তিক মতাদর্শ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তিনি নিজে ইহুদি হওয়ার কারণে নাৎসিদের উত্থান তাকে ব্যক্তিগতভাবেও স্পর্শ করেছিল। তিনি দেখেছিলেন, বিজ্ঞানের শীতল, যান্ত্রিক জগৎ যখন মানুষের জীবনের অর্থ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ সেই অর্থ খোঁজার জন্য রক্ত, মাটি, জাতি বা নেতার মতো অযৌক্তিক ধারণার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
হুসার্লের মতে, ইউরোপের এই সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো দর্শনের কাছে ফিরে আসা। কিন্তু কোন দর্শন? সেই দর্শন, যা আবার আমাদের জীবন-জগতের গভীরে প্রবেশ করবে এবং আমাদের অভিজ্ঞতার অর্থ পুনরুদ্ধার করবে। প্রতিভাসতত্ত্বের কাজই হবে এই জীবন-জগতের প্রত্নতাত্ত্বিকের ভূমিকা পালন করা, বিজ্ঞানের বিমূর্ততার নিচে চাপা পড়া আমাদের আদি অভিজ্ঞতাকে উন্মোচন করা। তিনি দর্শনকে দেখেছিলেন ইউরোপীয় মানবতার আধ্যাত্মিক আরোগ্য লাভের একটি উপায় হিসেবে।
কী বোঝা গেল?
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এডমুন্ড হুসার্লের দর্শন কোনো আকাশ থেকে পড়া তত্ত্ব নয়। এর শেকড় একদিকে দেকার্ত, ব্রেনতানো আর কান্টের চিন্তার গভীরে প্রোথিত, অন্যদিকে তা মনস্তত্ত্ববাদ ও ঐতিহাসিকতাবাদের মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে উঠেছে। আর এই পুরো গাছটি দাঁড়িয়ে আছে বিংশ শতকের ইউরোপের সংকটময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জমিনের ওপর।
হুসার্ল ছিলেন একজন দার্শনিক, যিনি তার সময়ের গোলমাল, হট্টগোল আর বিভ্রান্তির মধ্যে এক টুকরো স্থির, নিশ্চিত জমি খুঁজছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, বিজ্ঞান মানুষকে ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু অর্থ কেড়ে নিয়েছে। তাই তিনি আমাদের ভেতরের জগতে, আমাদের নিজেদের চেতনার গভীরে ডুব দিতে বলেছিলেন। তিনি আমাদের সেই দর্পণের সামনে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, যার ওপারে রয়েছে আমাদের অভিজ্ঞতার এক আশ্চর্য জগৎ। তার এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু তার এই সন্ধান যে এক সৎ, গভীর এবং তার সময়ের প্রতি দায়বদ্ধ এক মানুষের সন্ধান ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
হুসার্ল কেন বিরক্ত হলেন? দর্শনের বাজারের হট্টগোল
হুসার্লের জন্ম হয়েছিল ১৮৫৯ সালে, মরাভিয়ার প্রোস্তেইয়োভ শহরে, যা তখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এবং এখন চেক প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত। তিনি গণিত দিয়ে তার পড়াশোনা শুরু করেছিলেন এবং গণিতের সুনিশ্চিত, শান্ত ও স্থিতিশীল জগতে তিনি স্বস্তি খুঁজে পেতেন। দুই আর দুই যোগ করলে সবসময় চার হয়। এর মধ্যে কোনো কিন্তু নেই, কোনো যদি নেই। পিথাগোরাসের উপপাদ্য প্রাচীন গ্রিসে যা ছিল, আজও তাই আছে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। এই জগৎটা বেশ আরামের। কারণ এখানে সত্য আপেক্ষিক নয়, সত্য সার্বজনীন এবং শ্বাশত। গণিতের জগৎ এক নির্মল প্রশান্তির জগৎ, যেখানে সবকিছুর একটি সুনির্দিষ্ট জায়গা আছে, একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে।
কিন্তু গণিতের এই নির্মল জগৎ থেকে দর্শনের জগতে পা রাখতেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তিনি দেখলেন, দর্শন যেন এক বিশাল গোলমেলে বাজার বা এক বিশৃঙ্খল কুস্তির আখড়া। প্রত্যেকে নিজের মতের ঝাণ্ডা উড়িয়ে চেঁচামেচি করছে, একে অপরের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত। কেউ বলছেন, জগৎটা আসলে ঈশ্বরের চিন্তা বা এক পরম চেতনার প্রকাশ (ভাববাদ – Idealism)। তাদের মতে, আমাদের চারপাশের বস্তুগত জগৎ আসলে মনেরই এক বাহ্যিক রূপ। আবার কেউ ঠিক তার উল্টোটা বলছেন, জগৎ হলো নিছকই অণু-পরমাণুর সমষ্টি, এখানে চেতনা বা মন বলে আলাদা কিছু নেই, সবই মস্তিষ্কের জটিল বিক্রিয়ার ফল (বস্তুবাদ – Materialism)। আবার কেউ বলছেন, আমরা যা দেখি তা আমাদের স্নায়বিক প্রক্রিয়ার বাইরে আর কিছুই নয়, সুতরাং জগৎকে জানা অসম্ভব (সংশয়বাদ – Skepticism)।
দর্শনের দুই হাজার বছরের ইতিহাসে কোনো সর্বজনীন ঐকমত্য নেই। প্লেটো যা বলে গেছেন, তার শিষ্য অ্যারিস্টটলই তা অনেকাংশে খণ্ডন করেছেন। কান্ট যা নির্মাণ করেছেন, হেগেল এসে তাকে উল্টে দিয়েছেন। এই দেখে হুসার্লের মনে হলো, এভাবে চলতে পারে না। দর্শন যদি জ্ঞানের সর্বোচ্চ শাখা হয়, তবে তার একটি শক্ত ভিত্তি থাকতে হবে। বিজ্ঞানের মতো দর্শনেরও একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকা উচিত, যা ব্যক্তিগত মতামতের ঊর্ধ্বে গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান দিতে পারে।
বিশেষ করে দুটি মতবাদ হুসার্লকে প্রচণ্ড বিরক্ত করেছিল, যা তৎকালীন জার্মান দর্শন জগতে প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল। একটি হলো প্রকৃতিবাদ (Naturalism)। প্রকৃতিবাদীরা মনে করেন, জগৎকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রকৃতি-বিজ্ঞানই যথেষ্ট। চেতনা, মন, আবেগ, নৈতিকতা—এগুলো সবই স্নায়ুতন্ত্রের জটিল কার্যকলাপের ফল এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে টিকে থাকা বৈশিষ্ট্য। একজন প্রকৃতিবাদী বলবেন, আপনার গোলাপ দেখে যে আনন্দ হচ্ছে, তা আসলে আপনার চোখে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর প্রবেশ এবং তার ফলে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। ভালোবাসা মানে অক্সিটোসিনের খেলা, আর নৈতিকতা মানে টিকে থাকার লড়াইয়ে সুবিধাজনক সামাজিক আচরণ।
হুসার্লের কাছে এটা ছিল জগৎকে বড্ড বেশি সরলীকরণ করে ফেলা, এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক ঔদ্ধত্য। একটি গোলাপ দেখে আমাদের মনে যে সৌন্দর্যের অনুভূতি হয়, তাকে কি শুধুই ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর মস্তিষ্কের স্নায়বিক স্পন্দন দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায়? গোলাপের ‘সৌন্দর্য’ নামক গুণটি কোথায় থাকে? মস্তিষ্কের কোষে? নাকি আলোর তরঙ্গে? হুসার্ল মনে করতেন, না। প্রকৃতিবাদ অভিজ্ঞতার ‘কীভাবে’ (how it works) নিয়ে কথা বলে, কিন্তু অভিজ্ঞতার ‘কী’ (what it is) নিয়ে নীরব থাকে। এটি আমাদের প্রথম-পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে পাওয়া জীবন্ত অভিজ্ঞতাকে (lived experience) পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেয়। হুসার্ল মনে করতেন, অভিজ্ঞতার একটি নিজস্ব জগৎ আছে, যা প্রকৃতি বিজ্ঞান দিয়ে ধরা যায় না। প্রকৃতিবাদ জগৎকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জগতের অর্থকেই হারিয়ে ফেলে।
আরেকটি মতবাদ তাকে আরও বেশি ভাবিয়ে তুলেছিল, যার নাম মনস্তত্ত্ববাদ (Psychologism)। এই মতবাদ হুসার্লের প্রথম দিকের লেখায়, বিশেষ করে তার Logical Investigations গ্রন্থে, প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল। এই মতবাদ অনুযায়ী, যুক্তিবিদ্যা বা গণিতের নিয়মগুলোও নাকি মানুষের মনের গঠন বা বিবর্তনীয় অভ্যাসের ফল। অর্থাৎ, দুই যোগ দুই চার হয়, কারণ আমাদের মস্তিষ্ক লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যদি ভিন্ন কোনো গ্রহে ভিন্ন কোনো পরিবেশে বুদ্ধিমান প্রাণী ভিন্নভাবে বিবর্তিত হতো, তবে তাদের জন্য হয়তো দুই আর দুই পাঁচও হতে পারত। তাদের যুক্তির নিয়ম হয়তো আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো (Zahavi, 2003)।
হুসার্লের কাছে এটা ছিল ভয়াবহ এক কথা। এর মানে কি এই যে, সত্য আপেক্ষিক? সত্য কি তাহলে প্রজাতি বা ব্যক্তির মনের গঠনের উপর নির্ভরশীল? তিনি বললেন, অসম্ভব। এটা সত্যের ধারণাকেই ধ্বংস করে দেয়। একটি ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণ—এই সত্যটি মানুষ আবিষ্কার করার আগেও সত্য ছিল, মানুষ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও সত্য থাকবে। সত্য হবে সার্বজনীন, শ্বাশত এবং অপরিহার্য (necessary)। মনস্তত্ত্ববাদ সত্যকে (Truth) মানসিক ঘটনার (mental event) সাথে গুলিয়ে ফেলে, যা এক বিরাট ভুল। একটি সত্য ধারণা করা একটি মানসিক ঘটনা, কিন্তু সত্যটি নিজে কোনো মানসিক ঘটনা নয়।
দর্শনের এই দিগ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি দর্শনকে একটি ‘কঠোর বিজ্ঞানে’ (rigorous science) পরিণত করবেন। এমন এক জ্ঞান, যার ভিত্তি হবে পাথরের মতো শক্ত, যাকে কোনো সন্দেহ দিয়ে টলানো যাবে না।
এই প্রতিজ্ঞা থেকেই জন্ম নিল তার বিখ্যাত স্লোগান— “Zurück zu den Sachen selbst!” অর্থাৎ, “সরাসরি বিষয়ের কাছে ফিরে যাও!” (Husserl, 1900/1970a)। কিন্তু এই ‘বিষয়’ (the things themselves) মানে কী? ইট, কাঠ, পাথর? টেবিল, চেয়ার? না। হুসার্লের ‘বিষয়’ ছিল আরো গভীর, আরো সূক্ষ্ম। তা হলো, আমাদের চেতনায় কোনো বস্তু বা ধারণা যেভাবে ধরা দেয়, ঠিক সেই রূপটি। সেই প্রতিভাস (phenomenon)। বাইরের জগতের বস্তুটি নয়, বরং বস্তুটি আমার অভিজ্ঞতায় যেভাবে হাজির হয়, সেই হাজির হওয়াটাই হলো তাঁর গবেষণার বিষয়। আর এই গবেষণার পদ্ধতিই হলো প্রতিভাসতত্ত্ব।
আশ্চর্য সেই চশমা এবং জগৎকে বন্ধনীতে বন্দী করার জাদু
হুসার্লের পদ্ধতির প্রথম ধাপটিই সবচেয়ে বৈপ্লবিক এবং অদ্ভুত, এবং সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝার শিকার। তিনি বললেন, দর্শনের অভ্রান্ত ভিত্তি খুঁজে পেতে হলে আমাদের প্রথমে যা কিছু আমরা জানি বলে মনে করি, সেগুলোকে সরিয়ে রাখতে হবে।
ধরুন, আপনার সামনে একটি লাল আপেল রাখা আছে। আপনি সেটাকে দেখছেন। এখন যদি প্রশ্ন করি, “আপনি কি নিশ্চিত যে আপেলটা আসলেই ওখানে আছে?” আপনি হয়তো একটু বিরক্ত হয়েই বলবেন, “অবশ্যই! আমি তো দেখতেই পাচ্ছি।” কিন্তু হুসার্ল বলবেন, একটু থামুন। আপনার দেখার ওপর এত ভরসা করছেন? হতে পারে এটা আপনার হ্যালুসিনেশন। হতে পারে আপনি স্বপ্ন দেখছেন। দেকার্ত যেমন বলেছিলেন, হতে পারে কোনো দুষ্টু দৈত্য (evil demon) আপনাকে প্রতারণা করছে। আধুনিক যুগে আমরা বলতে পারি, হতে পারে আপনি ‘ম্যাট্রিক্স’-এর মতো কোনো কম্পিউটার সিমুলেশনের মধ্যে আছেন, যেখানে কোনো দুষ্টু বিজ্ঞানী আপনার মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠিয়ে আপেলের অনুভূতি তৈরি করছে। তাহলে আপেলটার বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার উপায় কী?
হুসার্ল বললেন, কোনো উপায় নেই। এবং মজার ব্যাপার হলো, আমাদের সেই চেষ্টা করার দরকারও নেই। আমরা বরং একটি দার্শনিক চাল চালতে পারি। আমরা আপেলটা বাস্তবে আছে কি নেই, সেই বিশ্বাসকে একটু সময়ের জন্য বন্ধনীতে আটকে রাখি (bracketing)। এই দার্শনিক স্থগিতাদেশের জন্য তিনি একটি গ্রিক শব্দ ব্যবহার করলেন— এপোহে (Epoché), যার অর্থ হলো বিচার বা রায়দান থেকে বিরত থাকা। এটা অনেকটা সিনেমার পর্দায় ‘পজ’ বাটন টেপার মতো, অথবা গণিতে যেমন আমরা কোনো জটিল সমীকরণের একটি অংশকে ব্র্যাকেটের মধ্যে রেখে দিই, ঠিক তেমন (Moran, 2000)।
এপোহে করার মানে এই নয় যে আমরা বলছি জগৎটা মিথ্যা বা এর অস্তিত্ব নেই। আমরা জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছি না, আবার স্বীকারও করছি না। আমরা শুধু বলছি, জগতের অস্তিত্ব আছে কি নেই—এই প্রশ্নটা আপাতত করছি না। আমরা জগতের অস্তিত্বের দাবিকে বিচার করা থেকে নিজেদের বিরত রাখছি। কেন? কারণ আমাদের উদ্দেশ্য তো বাইরের আপেলটাকে জানা নয়, আমাদের উদ্দেশ্য হলো ‘আপেলটা আমার চেতনায় কীভাবে ধরা দিচ্ছে’—সেটাকে জানা। বাইরের জগতের অস্তিত্বের প্রশ্নটি একটি অধিবিদ্যক (metaphysical) প্রশ্ন, যা নিয়ে হাজার বছর ধরে কোনো মীমাংসা হয়নি। হুসার্ল এই বিতর্ক পাশ কাটাতে চাইলেন।
এই প্রক্রিয়াকে হুসার্ল নাম দিয়েছেন প্রতিভাসতাত্ত্বিক হ্রাসকরণ (Phenomenological Reduction)। এটি একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের চারপাশ সম্পর্কে জমে থাকা সব ধারণা, বিশ্বাস, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানকে একপাশে সরিয়ে রাখি। আমাদের এই সাধারণ, আটপৌরে জগৎ সম্পর্কিত বিশ্বাসকে হুসার্ল বলেছেন প্রাকৃতিক মনোভাব (Natural Attitude)। এই মনোভাব নিয়ে আমরা চলি, ফিরি, কাজ করি। আমরা ধরেই নিই যে এই জগৎটা আমাদের থেকে স্বাধীন এবং বাস্তব। আমরা যখন রাস্তায় হাঁটি, তখন আমরা ভাবি না যে রাস্তাটা আমার মনের কল্পনা কিনা। আমরা ধরেই নিই এটা বাস্তব এবং এর উপর দিয়েই হাঁটি। প্রতিভাসতাত্ত্বিক হ্রাসকরণের মাধ্যমে আমরা এই প্রাকৃতিক মনোভাব থেকে সরে এসে এক বিশুদ্ধ পর্যবেক্ষকের অবস্থানে চলে যাই, যিনি কেবল অভিজ্ঞতার দিকেই নজর দেন।
ভাবুন তো একবার! আপনি আপনার চারপাশের জগতের অস্তিত্বের বিশ্বাসকে বন্ধনীতে বন্দী করে ফেলেছেন। আপনার বাড়ি, আপনার বন্ধু, আপনার বইয়ের তাক, এমনকি আপনার নিজের শরীর—সবকিছুর অস্তিত্বের দাবিকে আপনি স্থগিত করেছেন। তাহলে অবশিষ্ট কী রইল?
অবশিষ্ট রইল আপনার চেতনার অবিচ্ছিন্ন স্রোত। আপনার অভিজ্ঞতা। আপেলটা বাইরে থাক বা না থাক, আপনার চেতনায় যে ‘লাল, গোল, মসৃণ একটি আপেলের অভিজ্ঞতা’ হচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতাকে তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। সেই অভিজ্ঞতাটি অকাট্য, অসন্দিগ্ধ। দেকার্ত যেমন তার চিন্তার অস্তিত্বকে নিশ্চিত বলে জেনেছিলেন, হুসার্লও তেমনি এই অভিজ্ঞতার প্রবাহকে তার দর্শনের অভ্রান্ত ভিত্তি হিসেবে খুঁজে পেলেন। এটাই সেই ‘সরাসরি বিষয়’, যার কাছে তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। এই বিশুদ্ধ চেতনার ক্ষেত্রটিই হলো প্রতিভাসতত্ত্বের গবেষণার বিষয়। জগৎকে বন্ধনীতে বন্দী করার পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা হলো বিশুদ্ধ চেতনা (Pure Consciousness) এবং তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রতিভাসসমূহ। যেন এক নতুন জগৎ চোখের সামনে উন্মোচিত হলো, যে জগৎটি সবসময়ই ছিল, কিন্তু আমরা তাকে খেয়াল করিনি।
শুধু ব্র্যাকেটবন্দী করাই নয়, সারবস্তু খুঁজে বের করা
এপোহে করে জগৎকে ব্র্যাকেটবন্দী করাটা ছিল প্রথম ধাপ। কিন্তু হুসার্ল এখানেই থেমে থাকেননি। তার উদ্দেশ্য শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা ছিল না। “আমি একটি লাল আপেল দেখছি, যা মসৃণ এবং মিষ্টি গন্ধযুক্ত”—এটা তো শুধু একটি ব্যক্তিগত ডায়েরির মতো হয়ে গেল। দর্শন তো এর চেয়েও বেশি কিছু চায়। তিনি চেয়েছিলেন সার্বজনীন সত্য খুঁজে বের করতে। কিন্তু কীভাবে ব্যক্তিগত, পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতা থেকে সার্বজনীন, অপরিহার্য সত্যে পৌঁছানো যায়? আমার আপেলের অভিজ্ঞতা তো আপনার আপেলের অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন হতে পারে।
এর জন্য হুসার্ল আরও এক ধরনের হ্রাসকরণের কথা বললেন, যার নাম সারবস্তু-বিষয়ক হ্রাসকরণ (Eidetic Reduction)। ‘Eidos’ একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ হলো সারবস্তু বা সারসত্তা (essence)। প্লেটোর দর্শনেও এই ধারণাটি ছিল (Form বা Idea), কিন্তু হুসার্ল একে এক নতুন রূপ দিলেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে হুসার্ল কোনো একটি অভিজ্ঞতার পরিবর্তনীয় অংশগুলোকে বাদ দিয়ে তার অপরিহার্য, অপরিবর্তনীয় কাঠামোটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
ব্যাপারটা একটা উদাহরণের মাধ্যমে বোঝা যাক। ধরুন, আপনি ‘চেয়ার’ নামক বস্তুটির সারবস্তু জানতে চান। প্রথমে আপনি এপোহে করে চেয়ারটির বাস্তব অস্তিত্বের প্রশ্নটিকে ব্র্যাকেটবন্দী করলেন। এখন আপনার চেতনায় শুধু চেয়ারের প্রতিভাসটি আছে। এরপর আপনি আপনার কল্পনায় চেয়ারটিকে নিয়ে খেলা শুরু করুন। একে বলে মুক্ত কল্পনাশ্রয়ী পরিবর্তন (Free Imaginative Variation)।
ভাবুন, চেয়ারটি কাঠের বদলে প্লাস্টিকের হলে কি এটি আর চেয়ার থাকবে? হ্যাঁ, থাকবে। যদি এর চারটি পায়ের বদলে তিনটি পা থাকে? তাও হয়তো চেয়ার বলা যাবে। যদি এর রঙ লাল না হয়ে নীল হয়? অবশ্যই চেয়ার থাকবে। যদি এর কোনো হাতল না থাকে? তাহলেও এটা চেয়ার। এই সবই হলো চেয়ারের আনুষঙ্গিক (contingent) বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যদি বসার জায়গাটিই না থাকে, তাহলে কি একে আর চেয়ার বলা যাবে? না। যদি এমনভাবে তৈরি হয় যে এতে কোনোভাবেই বসা সম্ভব নয়, তাহলে কি এটি চেয়ার? না।
এই কাল্পনিক পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা চেয়ারের আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য (যেমন রঙ, উপাদান, পায়ের সংখ্যা) থেকে তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যকে (যেমন—একজন মানুষের বসার জন্য একটি উপযুক্ত পৃষ্ঠতল প্রদান করা) আলাদা করতে পারি। এই অপরিহার্য কাঠামোটিই হলো চেয়ারের ‘সারসত্তা’ বা eidos। এই সারসত্তা কোনো নির্দিষ্ট চেয়ারের নয়, বরং ‘যেকোনো’ চেয়ারের জন্য প্রযোজ্য। এভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সার্বজনীন, অপরিহার্য সত্যে পৌঁছাতে পারি (Smith, 2013)।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে হুসার্ল শুধু ভৌত বস্তুই নয়, বরং আরও বিমূর্ত ধারণারও সারসত্তা খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন। যেমন, ‘প্রত্যক্ষণ’ (perception) ক্রিয়াটির সারসত্তা কী? প্রত্যক্ষণ মানেই হলো কোনো বস্তুকে তার শারীরিক উপস্থিতিতে সরাসরি অভিজ্ঞতা করা। এটা স্মৃতি (memory) বা কল্পনা (imagination) থেকে আলাদা। স্মৃতিতে বস্তুটা অনুপস্থিত থাকে, কল্পনায় বস্তুটা তৈরি করা হয়, কিন্তু প্রত্যক্ষণে বস্তুটা ‘সেখানেই’ থাকে। এই অপরিহার্য পার্থক্যটি আমরা এই পদ্ধতির মাধ্যমেই খুঁজে বের করতে পারি। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে, এই সারসত্তাগুলো আমাদের মনের সৃষ্টি নয়, বরং আমরা এগুলোকে আমাদের চেতনার গভীরে আবিষ্কার করি। এগুলো হলো চেতনার নিজস্ব কাঠামোগত নিয়ম।
চেতনার জাদু—ইনটেনশনালিটি, নোয়েসিস এবং নোয়েমা
এপোহে এবং হ্রাসকরণের মাধ্যমে আমরা যখন চেতনার বিশুদ্ধ রাজ্যে প্রবেশ করলাম, হুসার্ল সেখানে এক আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করলেন। এই আবিষ্কারটি তার দর্শনের একেবারে কেন্দ্রবিন্দু। তিনি তার শিক্ষক ফ্রানৎস ব্রেনতানোর (Franz Brentano) কাছ থেকে একটি ধারণা ধার করেছিলেন এবং তাকে এক নতুন, বৈপ্লবিক রূপ দিয়েছিলেন। তিনি দেখলেন, চেতনা কখনো শূন্য বা ফাঁকা থাকে না। চেতনা সবসময় কোনো না কোনো কিছুর দিকে মুখ করে থাকে। চেতনা সবসময় ‘কোনোকিছুর চেতনা’ (consciousness of something) হয়। এই বৈশিষ্ট্যটির তিনি এক গালভরা নাম দিলেন— ইনটেনশনালিটি (Intentionality) বা উদ্দেশ্যমূলকতা।
ব্যাপারটা খুব সহজ, কিন্তু এর তাৎপর্য গভীর। আপনি যখন ‘ভাবছেন’, আপনি আসলে ‘কিছু একটা’ নিয়ে ভাবছেন। যখন ‘ভালোবাসছেন’, তখন ‘কাউকে’ ভালোবাসছেন। যখন ‘ঘৃণা করছেন’, তখন ‘কিছু একটাকে’ ঘৃণা করছেন। এমনকি যখন আপনি কিছুই ভাবছেন না বলে মনে করছেন, তখনও আপনি ‘কিছু না ভাবার’ অভিজ্ঞতাটি লাভ করছেন। চেতনা অনেকটা টর্চলাইটের আলোর মতো; সে নিজে একা থাকতে পারে না, সবসময় কোনো না কোনো বস্তুর ওপর গিয়ে পড়ে। এই ‘কোনো কিছুর দিকে মুখ করে থাকা’ ধর্মটাই হলো ইনটেনশনালিটি।
হুসার্ল এই ইনটেনশনালিটি বা উদ্দেশ্যমূলক অভিজ্ঞতাকে একটি কাঠামোর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করলেন। তিনি এর দুটি দিক স্পষ্ট করলেন:
- ১. নোয়েসিস (Noesis): এটি হলো চেতনার কাজটি (the act of consciousness)। যেমন—দেখা, শোনা, কল্পনা করা, স্মরণ করা, বিচার করা, ভালোবাসা, ঘৃণা করা ইত্যাদি। এটা হলো ‘কীভাবে’ কোনো কিছুকে চেতনা ধারণ করছে, সেই প্রক্রিয়া। এটা চেতনার সক্রিয় দিক, এর ক্রিয়াশীল রূপ।
- ২. নোয়েমা (Noema): এটি হলো চেতনার বিষয়বস্তু (the object of consciousness)। অর্থাৎ, নোয়েসিস বা চেতনার কাজটি যা ধারণ করে। যেমন—আমি যখন একটি গাছ দেখি, আমার ‘দেখা’ কাজটি হলো নোয়েসিস। আর আমার চেতনায় যে ‘গাছ-যেমন-আমার-কাছে-প্রতিভাত-হচ্ছে’ (the tree-as-perceived), সেটিই হলো নোয়েমা (Husserl, 1913/1983)।
এখানে একটা সূক্ষ্ম কিন্তু জরুরি পার্থক্য আছে। নোয়েমা কিন্তু বাইরের জগতের বাস্তব গাছটি নয়। কারণ বাইরের গাছটির অস্তিত্বকে তো আমরা এপোহে করে ব্র্যাকেটে বন্দী করে রেখেছি। নোয়েমা হলো সেই গাছটির অর্থপূর্ণ প্রতিরূপ, যা আমাদের চেতনায় গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু গাছের দৃশ্যমান রূপই নেই, এর সাথে জড়িয়ে থাকা আমাদের সব ধারণা, স্মৃতি এবং প্রত্যাশাও রয়েছে। যেমন, ‘এটা একটা আমগাছ, এর থেকে মিষ্টি আম পাওয়া যাবে’, ‘ছোটবেলায় এইরকম গাছে চড়তাম’, ‘এই গাছের পাতাগুলো কী সবুজ’—এই পুরো অর্থ-কাঠামোটিই হলো নোয়েমা। নোয়েমা হলো ‘অভিজ্ঞত বস্তু’ (experienced object), বাস্তব বস্তু (real object) নয়। নোয়েমা হলো চেতনার দ্বারা অর্থপ্রাপ্ত বস্তু।
নোয়েসিস আর নোয়েমার এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে বলা হয় নোয়েটিক-নোয়েম্যাটিক কোরিলেশন (Noetic-Noematic Correlation)। একটি ছাড়া অন্যটি থাকতে পারে না। যেকোনো অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণে এই দুটি দিককেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এই ধারণা দিয়ে হুসার্ল দেখালেন যে, আমাদের চেতনা নিষ্ক্রিয়ভাবে শুধু বাইরের জগতের ছবি তোলে না, যেমনটা একটা ক্যামেরা করে। বরং চেতনা সক্রিয়ভাবে জগতকে অর্থ প্রদান করে, জগতকে ‘গঠন’ (constitute) করে। আমাদের চারপাশের এই যে অর্থপূর্ণ জগৎ, তা আমাদের চেতনারই সৃষ্টি। জগৎ আমাদের কাছে অর্থহীন ডেটা হিসেবে আসে না, বরং শুরু থেকেই অর্থপূর্ণ হিসেবে প্রতিভাত হয়। এই অর্থপ্রদানের কাজটিই করে আমাদের উদ্দেশ্যমূলক চেতনা।
একই বস্তু, হাজারো প্রতিভাস: প্রত্যক্ষণের স্তরবিন্যাস
হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্ব আমাদের প্রত্যক্ষণের প্রক্রিয়াকে আরও গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করে। তিনি দেখালেন যে, আমরা কোনো বস্তুকে কখনোই একবারে বা সামগ্রিকভাবে দেখি না। আমাদের অভিজ্ঞতা সবসময় একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে হয়। এই দৃষ্টিকোণভিত্তিক অভিজ্ঞতাকে হুসার্ল বলেছেন abschattung, যার অর্থ হলো আদল, ছায়া বা প্রতিচ্ছায়া (adumbration or profile)।
ভাবুন তো, আপনার সামনের কফি মগটির কথা। আপনি এর একটি দিক দেখছেন—হয়তো এর হাতলটি আপনার ডানদিকে, আর মগের গায়ে একটি ফুলের ছবি। আপনি মগের পেছনের দিকটা, ভেতরের তলানি, বা নিচের অংশটা দেখতে পাচ্ছেন না। আপনি যা দেখছেন, তা হলো মগটির একটিমাত্র প্রতিচ্ছায়া বা আদল। কিন্তু আপনি কি মগটিকে একটি অসম্পূর্ণ খণ্ড হিসেবে দেখছেন? না। আপনি একে একটি পূর্ণাঙ্গ, ত্রিমাত্রিক মগ হিসেবেই অভিজ্ঞতা করছেন।
এটা কীভাবে সম্ভব? হুসার্ল বলেন, কারণ প্রতিটি নির্দিষ্ট প্রতিচ্ছায়া (abschattung) দেখার সাথে সাথেই আমাদের চেতনা সেই বস্তুটির একটি পূর্ণাঙ্গ রূপকে ‘উদ্দেশ্য’ (intend) করে। আপনি শুধু একটি প্রোফাইল দেখছেন, কিন্তু আপনার চেতনা সেই একটি প্রোফাইলের মাধ্যমে পুরো মগটিকে ধারণ করছে। আপনি যখন মগটির চারপাশে ঘোরেন, বা এটিকে হাতে তুলে ঘোরান, তখন আপনার চোখে একের পর এক নতুন প্রতিচ্ছায়া ভেসে ওঠে। মগের পেছনের দিকটি সামনে আসে, নিচের অংশটি দৃশ্যমান হয়। এই প্রতিচ্ছায়াগুলো অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু আপনার চেতনায় ‘মগ’ নামক বস্তুটি একই থাকছে। এই স্থিতিশীল, অভিন্ন বস্তুটিই হলো নোয়েমা, যা অসংখ্য পরিবর্তনশীল প্রতিচ্ছায়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে।
এই ধারণাটি আমাদের দেখায় যে, প্রত্যক্ষণ কোনো স্থির বা এক মুহূর্তের ঘটনা নয়। এটি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া, যেখানে আমাদের চেতনা সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড দৃষ্টিকোণকে একটি অর্থপূর্ণ সমগ্রে রূপান্তরিত করে। আমাদের চেতনা যেন একজন দক্ষ সম্পাদক, যিনি অসংখ্য বিচ্ছিন্ন শটকে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সিনেমাতে পরিণত করেন। এই প্রক্রিয়ার ফলেই আমরা একটি পরিবর্তনশীল অভিজ্ঞতার স্রোতের মধ্যেও একটি স্থিতিশীল জগৎকে অনুভব করতে পারি। এই ধারণাটিই আমাদের পরবর্তী আলোচনার জন্য পথ তৈরি করে দেয়—দিগন্তের ধারণা।
দিগন্তের হাতছানি এবং অভিজ্ঞতার অসম্পূর্ণতা
প্রতিচ্ছায়ার ধারণার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হুসার্লের আরেকটি চমৎকার ধারণা—দিগন্ত (Horizon)। তিনি লক্ষ করলেন, আমাদের প্রতিটি অভিজ্ঞতার একটি সীমানা বা দিগন্ত থাকে, যা সেই অভিজ্ঞতাকে তার প্রেক্ষিত এবং পূর্ণতা দেয়। প্রতিটি প্রত্যক্ষণের একটি অভ্যন্তরীণ দিগন্ত (inner horizon) এবং একটি বাহ্যিক দিগন্ত (outer horizon) থাকে।
অভ্যন্তরীণ দিগন্ত হলো বস্তুর সেই অংশগুলো, যা বর্তমানে অদৃশ্য কিন্তু প্রত্যাশিত। আপনি যখন টেবিল দেখেন, আপনি তার একটি দিকই দেখেন—উপরের অংশ, সামনের দুটি পা। আপনি পেছনের দিকটা বা নিচের দিকটা দেখতে পান না। কিন্তু এই অদৃশ্য অংশগুলো আপনার অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবেই বিদ্যমান থাকে। আপনি জানেন যে টেবিলের একটি পেছনের দিক আছে, আপনি ঘুরে গেলেই তা দেখতে পাবেন। এই যে ‘দেখতে পাব’—এই প্রত্যাশাটিই আপনার বর্তমান প্রত্যক্ষণের একটি অংশ। এই অদৃশ্য কিন্তু সম্ভাব্য প্রতিচ্ছায়াগুলোর সমষ্টিই হলো বস্তুর অভ্যন্তরীণ দিগন্ত। এই দিগন্তের জন্যই বস্তুটি আপনার কাছে একটি ত্রিমাত্রিক, পূর্ণাঙ্গ বস্তু হিসেবে প্রতিভাত হয়, একটি সমতল ছবি হিসেবে নয়। অভ্যন্তরীণ দিগন্তই আমাদের অভিজ্ঞতায় গভীরতা (depth) যোগ করে।
বাহ্যিক দিগন্ত হলো বস্তুটি যে পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে অবস্থিত। টেবিলটি একটি ঘরের মধ্যে আছে, ঘরটি একটি বাড়ির অংশ, বাড়িটি একটি রাস্তায় অবস্থিত, রাস্তাটি একটি শহরের অংশ, ইত্যাদি। প্রতিটি বস্তুই একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের অংশ হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেয়। শুধু তাই নয়, এই বাহ্যিক দিগন্তের মধ্যে বস্তুটির সাথে সম্পর্কিত সমস্ত অর্থ এবং সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গও অন্তর্ভুক্ত। যেমন, একটি বই শুধু একটি কাগজ ও কালির সমষ্টি নয়; তার বাহ্যিক দিগন্তে রয়েছে লেখক, ভাষা, সাহিত্য, জ্ঞান, লাইব্রেরি, ছাপাখানা—পুরো একটি সাংস্কৃতিক জগৎ।
এই দিগন্তের ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেখায় যে, আমাদের অভিজ্ঞতা কখনোই বিচ্ছিন্ন বা সম্পূর্ণ নয়। প্রতিটি অভিজ্ঞতাই আরও অভিজ্ঞতার সম্ভাবনার দিকে ইশারা করে। জগৎ আমাদের কাছে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে উন্মোচিত হয়, একটি স্থির চিত্র হিসেবে নয়। এই দিগন্তমূলক কাঠামোই আমাদের জগতকে স্থিতিশীল এবং বোধগম্য করে তোলে। জগৎ যেন একটি অসীম নেটওয়ার্ক, যেখানে প্রতিটি বিন্দু অন্য সব বিন্দুর সাথে সংযুক্ত (Gallagher & Zahavi, 2012)।
সময়ের স্রোত এবং চেতনার গোপন সঙ্গীত
হুসার্লের দর্শনের একটি অন্যতম গভীর এবং সুন্দর অংশ হলো তার সময়-চেতনার (time-consciousness) বিশ্লেষণ। তিনি প্রশ্ন তুললেন, আমরা সময়কে কীভাবে অনুভব করি? এই যে ‘বর্তমান’ মুহূর্ত, এটা আসলে কী? ঘড়ির কাঁটার টিক টিক করে এগিয়ে যাওয়া আর আমাদের চেতনার ভেতরে সময়ের প্রবাহ—এই দুটি কি এক?
ধরুন, আপনি একটি গান শুনছেন। আপনি গানের একটি সুরকে (melody) কীভাবে শোনেন? আপনি তো শুধু একটিমাত্র স্বর (note) শোনেন না। যদি শুধু বর্তমান মুহূর্তের স্বরটিই শুনতেন, তাহলে কোনো সুরই তৈরি হতো না, আপনি শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু শব্দ শুনতেন—‘সা… রে… গা…’। একটি সুর শোনার জন্য আপনাকে অবশ্যই এইমাত্র বেজে যাওয়া স্বরটিকেও মনে রাখতে হবে এবং পরবর্তী স্বরটির জন্য একটি প্রত্যাশা রাখতে হবে।
এই পর্যবেক্ষণ থেকে হুসার্ল আমাদের সময়-চেতনার একটি অসাধারণ কাঠামো তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, চেতনার প্রতিটি ‘এখন’ বা বর্তমান মুহূর্তের তিনটি অংশ থাকে:
- ১. আদিম ছাপ (Primal Impression / Urimpression): এটি হলো বর্তমান মুহূর্তে যা ঘটছে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। গানের যে স্বরটি ঠিক এই মুহূর্তে আপনার কানে আসছে। এটি হলো অভিজ্ঞতার কাঁচামাল।
- ২. ধারণা (Retention): এটি হলো এইমাত্র অতীত হয়ে যাওয়া মুহূর্তটির একটি রেশ, যা এখনো চেতনায় লেগে আছে। এটি স্মৃতি (memory) থেকে আলাদা। স্মৃতি হলো অতীতের কোনো ঘটনাকে সচেতনভাবে মনে করা, যেমন গতকাল কী খেয়েছিলেন তা মনে করা। কিন্তু ধারণা হলো বর্তমানের একটি জীবন্ত অংশ, যা বর্তমানকে তার প্রেক্ষিত দেয়। আগের স্বরটির রেশ এখনো আপনার চেতনায় আছে বলেই আপনি বর্তমান স্বরটিকে একটি সুরের অংশ হিসেবে বুঝতে পারছেন। এটি অনেকটা ধূমকেতুর লেজের মতো, যা বর্তমান মুহূর্তকে অনুসরণ করে এবং তাকে অর্থপূর্ণ করে তোলে।
- ৩. প্রাক-ধারণা (Protention): এটি হলো আসন্ন মুহূর্তটির জন্য একটি অনির্দিষ্ট প্রত্যাশা। আপনি জানেন না ঠিক কোন স্বরটি আসবে, কিন্তু আপনি প্রত্যাশা করেন যে ‘কিছু একটা’ আসবে, সুরটি এগিয়ে যাবে। এই প্রত্যাশা ছাড়া অভিজ্ঞতার কোনো ধারাবাহিকতা থাকত না।
এই তিনটি অংশ—আদিম ছাপ, ধারণা এবং প্রাক-ধারণা—মিলেমিশে একটি জীবন্ত, প্রসারিত বর্তমান তৈরি করে। চেতনা কোনো স্থির বিন্দু নয়, বরং এটি একটি স্রোত, যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একসঙ্গে বয়ে চলেছে। এই অভ্যন্তরীণ সময়-চেতনার (internal time-consciousness) স্রোতই আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তি। এই স্রোতের জন্যই আমাদের জীবন একটি ধারাবাহিক গল্প বলে মনে হয়, বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের সমষ্টি নয় (Gallagher & Zahavi, 2012)। এই বিশ্লেষণটি দেখায়, হুসার্ল কত গভীরে গিয়ে চেতনার গঠন বোঝার চেষ্টা করেছিলেন।
আমি কে? অতীন্দ্রিয় অহং এবং একাকীত্বের ভয়
এপোহে করে আমরা জগৎকে ব্র্যাকেটবন্দী করলাম। তারপর চেতনার গভীরে ইনটেনশনালিটি ও সময়ের স্রোত আবিষ্কার করলাম। কিন্তু এই সবকিছুর সাক্ষী কে? এই যে অবিরাম চেতনার স্রোত বয়ে চলেছে, এর ধারক কে? এই অভিজ্ঞতার কেন্দ্রবিন্দুতে কে আছে?
হুসার্ল বললেন, এই ধারক হলো অতীন্দ্রিয় অহং (Transcendental Ego)। এটা আমাদের সাধারণ, জাগতিক ‘আমি’ (empirical ego) নয়, যে কিনা খেতে ভালোবাসে বা বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করে, যার একটি নির্দিষ্ট নাম ও ইতিহাস আছে। সেই জাগতিক ‘আমি’ তো তার শরীর, তার মন, তার ব্যক্তিত্ব সহ এপোহের বন্ধনীতে আটকা পড়েছে। অতীন্দ্রিয় অহং হলো এক বিশুদ্ধ চেতনার কেন্দ্র, যা সমস্ত অভিজ্ঞতার পেছনে এক ঐক্যসূত্র হিসেবে কাজ করে। এটা অনেকটা সিনেমার পর্দার মতো, যার উপর সব দৃশ্য ভেসে ওঠে, কিন্তু নিজে অদৃশ্য ও অপরিবর্তিত থাকে। এই অহং কোনো বস্তু নয়, বরং এটি হলো সেই শূন্য বিন্দু (zero-point) যা থেকে সমস্ত অভিজ্ঞতা উৎসারিত হয় এবং যার চারপাশে সমস্ত অভিজ্ঞতা সংগঠিত হয় (Husserl, 1913/1983)।
কিন্তু এখানে একটা বড় সমস্যা দেখা দিল। যদি আমার জগৎ আমার চেতনাই তৈরি করে থাকে, আর সেই চেতনার কেন্দ্রে যদি থাকি শুধু আমি (আমার অতীন্দ্রিয় অহং), তাহলে তো আমি এক ভয়ংকর একাকীত্বের মধ্যে বন্দী হয়ে গেলাম! এই দার্শনিক মতকে বলা হয় এককবাদ (Solipsism)। এর মানে হলো, এই জগতে কেবল আমারই অস্তিত্ব আছে, বাকি সবকিছু—আপনারা যারা এই লেখাটি পড়ছেন, আমার বন্ধু, আমার পরিবার—সবাই আমার চেতনার সৃষ্টি, আমার কল্পনা মাত্র।
এটি দর্শনের একটি পুরনো এবং ভীতিপ্রদ সমস্যা। হুসার্ল এই ভয়ংকর ফাঁদ থেকে বের হওয়ার জন্য এক অসাধারণ পথের সন্ধান দিলেন। তিনি তার Cartesian Meditations গ্রন্থে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, আমার চেতনায় শুধু যে গাছ, পাখি বা টেবিলের অভিজ্ঞতা হয় তা নয়, আমার চেতনায় ‘অন্য মানুষেরও’ (the Other) অভিজ্ঞতা হয়। আমি যখন আপনার দিকে তাকাই, আমি শুধু একটি চলমান শরীর দেখি না। আমি আপনাকে একজন ‘অন্য চেতনা’ (another consciousness) হিসেবেই অনুভব করি।
কীভাবে? হুসার্ল একটি জটিল প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিলেন, যাকে বলা যায় সহানুভূতিমূলক সংযোগ (Empathic Pairing)। তিনি Körper (বস্তু-শরীর) এবং Leib (জীবন্ত-শরীর) এর মধ্যে পার্থক্য করেন। আমি আমার নিজের শরীরকে ভেতর থেকে অনুভব করি, এটি আমার জীবন্ত শরীর (Leib)। আমি যখন আপনার শরীরকে দেখি, যা আমার শরীরের মতোই আচরণ করছে—হাসছে, কাঁদছে, কথা বলছে—তখন আমার চেতনায় একটি ‘জোড়’ (pairing) তৈরি হয়। আমি আমার নিজের জীবন্ত শরীরের (Leib) অভিজ্ঞতার সাথে আপনার শরীরকে (Körper) মেলাই। আমি যেহেতু জানি যে আমার শরীরের আচরণের পেছনে একটি চেতনা কাজ করছে, তাই আমি অনুমান করি (বা আরও প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করি) যে আপনার শরীরের পেছনেও একটি চেতনা আছে, যা আপনার কাছে Leib হিসেবে অনুভূত হয়। এই প্রক্রিয়াকে তিনি বলেছেন আন্তঃবিষয়কতা (Intersubjectivity)।
এইভাবে, আমি বুঝি যে আপনিও আমার মতোই এই জগৎকে আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। আপনারও একটি জগৎ আছে। আমার জগৎ আর আপনার জগৎ মিলেমিশে একটি সাধারণ, বস্তুনিষ্ঠ (objective) জগৎ তৈরি হয়। এই জগৎ আর শুধু ‘আমার জন্য’ জগৎ থাকে না, এটা হয়ে ওঠে ‘আমাদের জন্য’ জগৎ। পৃথিবী যে গোল, সেটা আমার একার বিশ্বাস নয়, এটা আমাদের সবার দ্বারা গঠিত একটি আন্তঃবিষয়ক সত্য। সুতরাং, হুসার্ল এককবাদের বিপদ থেকে দর্শনকে রক্ষা করলেন এবং দেখালেন যে আমাদের জগৎ এক সম্মিলিত সৃষ্টির ফল (Husserl, 1960; Zahavi, 2003)।
জীবন-জগৎ (Lebenswelt): দর্শনের শেষ আশ্রয় এবং বিজ্ঞানের হারানো ভূমি
জীবনের সায়াহ্নে এসে বড় বড় শিল্পীরা অনেক সময় তাদের জটিল কারুকার্য ছেড়ে এক আশ্চর্য সারল্যের দিকে ফিরে যান। তারা বুঝতে পারেন, সবচেয়ে গভীর সত্যটি হয়তো সবচেয়ে সহজ কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। দার্শনিক এডমুন্ড হুসার্লের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছিল। জীবনের শেষ দিকে এসে, যখন ইউরোপ এক ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংকটের মুখোমুখি, তখন তিনিও যেন তার নিজের দর্শনের জটিল ইমারত থেকে নেমে এসে মাটির কাছাকাছি দাঁড়াতে চাইলেন। তার এই শেষ জীবনের উপলব্ধি, তার এই ফিরে আসার আকুতিই মূর্ত হয়ে উঠেছে এক অসাধারণ ধারণার মধ্যে, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন জীবন-জগৎ (Lebenswelt বা Lifeworld)।
হুসার্ল তখন বৃদ্ধ। তিনি দেখছেন, তার দেশ জার্মানিতে এক ভয়ঙ্কর, অযৌক্তিক মতাদর্শ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তিনি দেখছেন, বিজ্ঞান অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করা সত্ত্বেও মানুষের জীবনের অর্থ, তার সুখ-দুঃখ, তার মূল্যবোধের প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর দিতে পারছে না। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তার নিজের দর্শনও হয়তো একটু বেশি বিমূর্ত, একটু বেশি শৈল্পিক এবং সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বড্ড বেশি দূরে সরে গেছে। এপোহে, অতীন্দ্রিয় অহং—এইসব জটিল ধারণার ভিড়ে সেই সাধারণ, জীবন্ত, রক্ত-মাংসে গড়া অভিজ্ঞতাটিই হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে। এই সংকটময় উপলব্ধি থেকেই জন্ম নিল তার শেষ মহান গ্রন্থ, The Crisis of European Sciences and Transcendental Phenomenology, আর তার কেন্দ্রীয় ধারণা—জীবন-জগৎ।
জীবন-জগৎ আসলে কী?
জীবন-জগৎ হলো আমাদের সেই আদি, প্রত্যক্ষ এবং স্বতঃস্ফূর্ত অভিজ্ঞতার জগৎ, যেখানে আমরা বিজ্ঞান বা দর্শনের কোনো তত্ত্বের চশমা পরার আগে বাস করি। এটা হলো আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের জগৎ, আমাদের প্রতিদিনের যাপনের জগৎ।
-
এটা সেই জগৎ, যেখানে সূর্য ওঠে আর ডোবে, যদিও বিজ্ঞান আমাদের বলে যে পৃথিবী ঘোরে।
-
এটা সেই জগৎ, যেখানে মাটি শক্ত আর জল তরল, যদিও বিজ্ঞান বলে সবকিছুই আসলে প্রায়-শূন্য অণু-পরমাণুর সমষ্টি।
-
এটা সেই জগৎ, যেখানে গোলাপ সুগন্ধি ছড়ায়, কাঁটা ব্যথা দেয়, আর বন্ধুর হাসি আমাদের মন ভালো করে দেয়।
এই জগৎটি আগে থেকেই আমাদের কাছে পরিচিত, আগে থেকেই অর্থপূর্ণ। এখানে প্রতিটি বস্তুর একটি ব্যবহারিক অর্থ আছে। একটি চেয়ার কেবল চারটি পায়াওয়ালা বস্তু নয়, এটি ‘বসার জন্য’। একটি নদী কেবল H₂O-র প্রবাহ নয়, এটি ‘সাঁতার কাটার জায়গা’, ‘নৌকা চালানোর পথ’ বা ‘পবিত্র তীর্থ’। এই জগৎটি আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ভাষা এবং আমাদের ইতিহাস দিয়ে বোনা। আমরা এই জগতের ভেতরেই জন্মাই, বেড়ে উঠি এবং এই জগৎকে আমরা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিই। হুসার্ল বলেন, এই জীবন-জগৎ হলো “সেই ভূমি যা আমাদের সমস্ত অনুশীলনকে, তা সে প্রাক-বৈজ্ঞানিক হোক বা বৈজ্ঞানিক, বহন করে।”
বিজ্ঞানের সংকট: গ্যালিলিওর সেই বিপর্যয়কারী পদক্ষেপ
হুসার্ল বললেন, আধুনিক ইউরোপের সংকট শুরু হয়েছিল রেনেসাঁসের সময়, বিশেষ করে গ্যালিলিওর একটি যুগান্তকারী কিন্তু বিপর্যয়কর পদক্ষেপের মাধ্যমে। গ্যালিলিও থেকে শুরু করে নিউটন এবং আইনস্টাইন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জগৎকে এক নতুন উপায়ে দেখতে শুরু করলেন। তারা জগৎকে গাণিতিকীকরণ (mathematization) করলেন।
তারা বললেন, জগতের আসল রূপ তার রঙ, গন্ধ, বা সৌন্দর্যের মধ্যে নেই। জগতের আসল রূপ লুকিয়ে আছে তার গাণিতিক গঠনে। জগৎ আসলে এক বিশাল জ্যামিতিক নকশা। গ্যালিলিও যখন বললেন পৃথিবী ঘুরছে, তিনি আমাদের জীবন-জগতের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে (যেখানে আমরা দেখি সূর্য ঘুরছে) একটি ‘ভ্রম’ বলে চিহ্নিত করলেন এবং একটি বিমূর্ত গাণিতিক মডেলকে ‘প্রকৃত সত্য’ বলে প্রতিষ্ঠা করলেন।
এই পদক্ষেপটি বিজ্ঞানের জন্য অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে এলো। এর ফলে আমরা প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পারলাম, প্রযুক্তিগত বিস্ময় তৈরি করতে পারলাম। কিন্তু এর জন্য আমাদের এক বিরাট মূল্য দিতে হলো। আমরা আমাদের জীবন-জগতকে হারিয়ে ফেললাম। বিজ্ঞান জগৎ থেকে তার সমস্ত গুণাবলী (রঙ, গন্ধ, অর্থ, মূল্যবোধ) শুষে নিয়ে তাকে একটি বর্ণহীন, গন্ধহীন, অর্থহীন গাণিতিক কাঠামোতে পরিণত করল।
হুসার্লের মতে, এটাই ছিল ইউরোপীয় বিজ্ঞানের সংকট (crisis)। সংকটটি বিজ্ঞানের নিজের সফলতার মধ্যে নয়। সংকটটি হলো মানবজীবনের জন্য তার প্রাসঙ্গিকতার সংকট। বিজ্ঞান তার নিজের ভিত্তিকেই ভুলে গেছে। কারণ, সব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, সব গাণিতিক মডেল শেষ পর্যন্ত আমাদের এই জীবন-জগতের অভিজ্ঞতার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে।
-
একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী যখন টেলিস্কোপে চোখ রাখেন, তখন তিনি তার জীবন-জগতের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকেন।
-
একজন পদার্থবিজ্ঞানী যখন কণার সংঘর্ষ পর্যবেক্ষণ করেন, তখন তিনি যে সংখ্যাগুলো নোট করেন, তা তার জীবন-জগতেরই কলম আর কাগজ দিয়ে করেন।
-
বিজ্ঞানের বিমূর্ত জগৎটি আমাদের এই প্রত্যক্ষ জীবন-জগতের ওপর নির্মিত একটি দ্বিতীয় স্তরের, আদর্শায়িত (idealized) জগৎ।
সংকটটি হলো, বিজ্ঞান এই ভিত্তিকে ভুলে গিয়ে নিজেকেই একমাত্র সত্য বলে দাবি করছে। এর ফলে, যে প্রশ্নগুলো মানবজীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—যেমন, আমাদের জীবনের অর্থ কী? আমরা কীভাবে ভালো জীবনযাপন করব? সৌন্দর্য বা ন্যায় কী?—এই প্রশ্নগুলো বিজ্ঞানের জগতে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞান আমাদের বলছে জগৎ ‘কীভাবে’ কাজ করে, কিন্তু জগৎ ‘কী’—সেই প্রশ্নটিকেই সে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। আর এই অর্থহীনতার শূন্যস্থান পূরণ করতেই ফ্যাসিবাদের মতো ভয়ঙ্কর অযৌক্তিক মতাদর্শ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
দর্শনের নতুন কাজ: জীবন-জগতের প্রত্নতত্ত্ববিদ
তাহলে এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় কী? হুসার্ল বললেন, আমাদের আবার সেই হারানো ভূমিতে ফিরে যেতে হবে। দর্শন বা বিজ্ঞানের কাজ হলো এই জীবন-জগতের গভীরে ফিরে যাওয়া এবং বৈজ্ঞানিক বিমূর্ততার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আমাদের মূল অভিজ্ঞতাকে পুনরুদ্ধার করা।
দর্শনকে হতে হবে এই জীবন-জগতের প্রত্নতত্ত্ববিদ (archaeologist of the lifeworld)। যেমন একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ মাটির স্তর খুঁড়ে একটি প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন, তেমনি দার্শনিকের কাজ হবে আমাদের আধুনিক চিন্তার স্তরগুলো (যেমন বিজ্ঞান, দর্শন) খুঁড়ে তার নিচে থাকা আদি, সর্বজনীন জীবন-জগতকে উন্মোচন করা।
এই কাজটি করার জন্যই প্রতিভাসতত্ত্বের প্রয়োজন। এপোহে এবং হ্রাসকরণের মাধ্যমে আমরা বিজ্ঞানের তৈরি করা বিমূর্ত জগৎকে ব্র্যাকেটবন্দী করে আমাদের আদি, প্রত্যক্ষ জীবন-জগতের অভিজ্ঞতায় ফিরে যেতে পারি। এই জীবন-জগৎই হলো সেই চূড়ান্ত ভিত্তি, যার ওপর সমস্ত জ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে। এটিই হলো দর্শনের শেষ আশ্রয়।
এই জীবন-জগতের ধারণাটি হুসার্লের দর্শনকে এক নতুন, মানবিক এবং প্রায় আধ্যাত্মিক মাত্রা দিয়েছে। এটি কেবল জ্ঞানের বিশ্লেষণ নয়, এটি আধুনিক মানুষের হারানো অর্থ পুনরুদ্ধারের এক আকুল প্রচেষ্টা। এই ধারণাটিই পরবর্তীতে হাইডেগার, গ্যাডামার, মের্লো-পন্টি এবং আলফ্রেড শুটজের মতো চিন্তাবিদদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সমস্ত জটিল তত্ত্বের শেষে আমাদের সেই সাধারণ, প্রতিদিনের যাপনের জগতের কাছেই ফিরে আসতে হয়, কারণ সেখানেই আমাদের আসল শিকড়।
এক হারানো বাড়ির জন্য হাহাকার: জীবন-জগৎ এবং আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা
উনিশ শতকের আকাশ যেন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় ঢাকা ছিল। শিল্প বিপ্লবের চিমনি থেকে ওঠা ধোঁয়ার মতোই মানুষের মন থেকেও উঠছিল এক চাপা হাহাকার। কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিখ নিৎশে, ম্যাক্স ওয়েবারের মতো চিন্তাবিদরা তাদের নিজেদের মতো করে এই হাহাকারের কারণ খুঁজছিলেন। তারা সবাই দেখছিলেন, আধুনিক মানুষ যেন তার নিজের বাড়ি থেকে নির্বাসিত, নিজের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন (alienated) হয়ে পড়েছে। তারা যেন এক শেকড়হীন বৃক্ষ, যার পাতা আছে, ফুল আছে, কিন্তু মাটির সঙ্গে কোনো যোগ নেই।
প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে, এডমুন্ড হুসার্ল যখন তার ‘জীবন-জগৎ’ (Lebenswelt) ধারণাটি নিয়ে এলেন, তখন তিনি হয়তো সরাসরি এই ‘বিচ্ছিন্নতা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু তার বিশ্লেষণের গভীরে কান পাতলে সেই একই হাহাকারের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। হুসার্ল, মার্ক্স, নিৎশে, ওয়েবার—তারা যেন একই অসুস্থ রোগীর ভিন্ন ভিন্ন নাড়ি টিপে একই রোগের লক্ষণ বর্ণনা করছিলেন। সেই রোগটি হলো আধুনিক মানুষের তার আদি, অর্থপূর্ণ জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া।
মার্ক্সের কারখানা: শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ
কার্ল মার্ক্সের (Karl Marx) জন্য আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতার প্রধান মঞ্চ ছিল পুঁজিবাদী কারখানা। তিনি দেখালেন, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিক চারটি দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে:
- ১. তার শ্রমের ফল থেকে: সে যা তৈরি করে, তা তার নিজের থাকে না, মালিকের হয়ে যায়।
- ২. তার শ্রম প্রক্রিয়া থেকে: সে একটি বিশাল প্রক্রিয়ার ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তার কাজে কোনো সৃজনশীলতা বা আনন্দ নেই।
- ৩. তার প্রজাতি-সত্তা (Species-Being) থেকে: মানুষ হিসেবে তার সৃজনশীল, সামাজিক সত্তা থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
- ৪. অন্যান্য মানুষ থেকে: পুঁজিবাদী সমাজে মানুষে মানুষে সম্পর্ক হয় প্রতিযোগিতার, সহযোগিতার নয়।
মার্ক্সের মতে, এই বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ হলো ব্যক্তিগত মালিকানা এবং শ্রম বিভাজন, যা মানুষের স্বাভাবিক, সৃজনশীল জীবনকে এক যান্ত্রিক, অর্থহীন রুটিনে পরিণত করেছে (Marx, 1844/1959)।
হুসার্লের জীবন-জগতের ধারণাটি এখানে কীভাবে প্রাসঙ্গিক? হুসার্লের জীবন-জগৎ হলো সেই জগৎ, যেখানে কাজ হলো জীবনের এক অর্থপূর্ণ, অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন কৃষক যখন তার জমিতে ফসল ফলান, তখন তার কাজ, তার ফসল, তার পরিবার এবং তার পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি—সবকিছু এক সূত্রে গাঁথা। এই জগৎটি মার্ক্সের সেই অবিচ্ছিন্ন, সৃজনশীল প্রজাতি-সত্তার জগতের খুব কাছাকাছি। আধুনিক পুঁজিবাদী জগৎ, মার্ক্সের চোখে, এই জীবন-জগতকে ধ্বংস করে দিয়ে মানুষকে এক বিমূর্ত, বিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক সত্তায় পরিণত করেছে, যার একমাত্র পরিচয় তার শ্রমশক্তি।
নিৎশের মরুভূমি: ঈশ্বরের মৃত্যু এবং মূল্যবোধের নির্বাসন
ফ্রেডরিখ নিৎশে (Friedrich Nietzsche) আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে দেখেছিলেন এক আধ্যাত্মিক সংকট হিসেবে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “ঈশ্বর মৃত” (God is dead)। এর মানে শুধু এই নয় যে, মানুষ আর ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। এর গভীরতর অর্থ হলো, যে খ্রিস্টান নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ গত দুই হাজার বছর ধরে পশ্চিমা সভ্যতাকে অর্থ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে এসেছে, তার ভিত্তিটাই ধসে পড়েছে।
ঈশ্বরের মৃত্যুর পর মানুষ এক বিশাল শূন্যতা বা নিহিলিজমের মুখোমুখি হয়েছে। সে এখন এক মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে কোনো পথ নেই, কোনো ধ্রুবতারা নেই, কোনো ভালো-মন্দ নেই। এই অবস্থাই হলো আধুনিক মানুষের আধ্যাত্মিক বিচ্ছিন্নতা। সে তার মূল্যবোধের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে (Nietzsche, 1882/1974)।
হুসার্লের জীবন-জগৎও ছিল মূল্যবোধ আর অর্থে পরিপূর্ণ এক জগৎ। সেখানে সূর্য ওঠাটা কেবল একটি প্রাকৃতিক ঘটনাই নয়, তা নতুন দিনের, নতুন সম্ভাবনার প্রতীক। হুসার্ল দেখালেন, আধুনিক বিজ্ঞান এই অর্থপূর্ণ, মূল্যবোধে ভরা জীবন-জগতকে নির্বাসনে পাঠিয়ে এক মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ, অর্থহীন, ফ্যাক্ট-সর্বস্ব জগৎকে প্রতিষ্ঠা করেছে। নিৎশে যাকে বলছেন ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’, হুসার্ল তাকেই বলছেন ‘জীবন-জগতের ওপর বিজ্ঞানের বিজয়’। দুজনেই দেখছেন, আধুনিক মানুষ এক অর্থহীন জগতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, যেখানে কেবল শীতল তথ্য আছে, কিন্তু কোনো উষ্ণ মূল্যবোধ নেই।
ওয়েবারের লোহার খাঁচা: যৌক্তিকতার কারাগারে বন্দী
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) আধুনিক সমাজের বিচ্ছিন্নতাকে ব্যাখ্যা করেছেন যৌক্তিকীকরণ (Rationalization) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তিনি দেখালেন, আধুনিক জগৎ, বিশেষ করে তার আমলাতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ, এক ধরনের উদ্দেশ্যমূলক-যৌক্তিকতা (instrumental rationality) দ্বারা চালিত। এখানে সবকিছুই দক্ষতা, গণনা এবং নিয়ন্ত্রণের অধীন। আবেগ, ঐতিহ্য, মায়া-মমতা—এইসব ‘অযৌক্তিক’ বিষয়গুলোকে সমাজ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে।
ওয়েবার এই অবস্থাকে বর্ণনা করার জন্য এক ভয়ঙ্কর উপমা ব্যবহার করেছেন: ‘লৌহার খাঁচা’ (iron cage)। আধুনিক মানুষ এই যৌক্তিকতার এক লোহার খাঁচায় বন্দী হয়ে পড়েছে। সে তার মানবিক গুণাবলী হারিয়ে ফেলে এক যন্ত্রের ক্ষুদ্র অংশে পরিণত হয়েছে। তার জীবন হয়ে উঠেছে নিয়মকানুন আর গণনার এক অন্তহীন প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো জাদু বা রহস্যের স্থান নেই। ওয়েবার এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন ‘জগতের মোহমুক্তি’ (disenchantment of the world) (Weber, 1905/2002)।
হুসার্লের জীবন-জগতের ধারণাটি ওয়েবারের এই ‘মোহমুক্ত’ জগতের ঠিক বিপরীত। জীবন-জগৎ হলো সেই ‘মোহময়’ (enchanted) জগৎ, যেখানে সবকিছুই অর্থপূর্ণ, জীবন্ত এবং রহস্যময়। বিজ্ঞান এবং যৌক্তিকীকরণ এই মোহময় জীবন-জগতকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ওয়েবার যাকে বলছেন ‘লৌহার খাঁচা’, হুসার্ল তাকেই বলছেন গাণিতিক মডেলের দ্বারা জীবন-জগতের প্রতিস্থাপন। দুজনেই দেখছেন, আধুনিক মানুষ তার নিজের তৈরি করা যৌক্তিকতার জালেই আটকা পড়েছে, যা তাকে তার আদি, স্বতঃস্ফূর্ত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল এবং সংস্কৃতির শিল্পায়ন
পরবর্তীকালে, থিওডোর অ্যাডোর্নো এবং ম্যাক্স হোর্কহাইমারের মতো ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের (Frankfurt School) চিন্তাবিদরা মার্ক্স, নিৎশে এবং ওয়েবারের চিন্তাকে মিলিয়ে এক নতুন সমালোচনা তৈরি করেন। তারা দেখান, আধুনিক পুঁজিবাদ কেবল আমাদের শ্রমকেই নয়, আমাদের অবসর এবং সংস্কৃতিকেও পণ্যে পরিণত করেছে। তারা একে বলেছেন ‘সংস্কৃতি শিল্প’ (Culture Industry)। সিনেমা, সঙ্গীত, টেলিভিশন—এই সবকিছুই এখন বাজারের পণ্য, যা আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতাকে ভোঁতা করে দেয় এবং আমাদের এক ধরনের মিথ্যা, আরোপিত চেতনার মধ্যে বন্দী রাখে।
এখানেও হুসার্লের জীবন-জগতের ধারণাটি প্রাসঙ্গিক। জীবন-জগৎ হলো সেই জগৎ, যেখানে সংস্কৃতি (যেমন লোকগান, লোককথা) জীবনের এক স্বতঃস্ফূর্ত, অর্গানিক প্রকাশ। আর সংস্কৃতি শিল্প এই স্বতঃস্ফূর্ত জীবন-জগতকে ধ্বংস করে দিয়ে এক কৃত্রিম, বাণিজ্যিক জগৎ তৈরি করে, যা মানুষকে তার নিজের সৃজনশীলতা এবং সত্যিকারের অভিজ্ঞতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
একই নদীর ভিন্ন ভিন্ন ঘাট
মার্ক্সের কারখানার বিচ্ছিন্ন শ্রমিক, নিৎশের মরুভূমির পথ হারানো পথিক, ওয়েবারের লোহার খাঁচার বন্দী আমলা, আর হুসার্লের গাণিতিক জগতে নির্বাসিত জীবন-জগতের মানুষ—এরা সবাই যেন একই নাটকের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র। তাদের সবার মধ্যেই রয়েছে এক গভীর হাহাকার—এক হারানো বাড়ির জন্য, এক হারানো অর্থের জন্য, এক হারানো জীবনের জন্য।
হুসার্ল হয়তো নিজেকে একজন বিপ্লবী সমাজতাত্ত্বিক ভাবতেন না। কিন্তু তার জীবন-জগতের ধারণাটি আধুনিক সমাজের সমালোচনার জন্য এক শক্তিশালী দার্শনিক ভিত্তি প্রদান করে। তিনি দেখিয়েছেন, আমাদের বিচ্ছিন্নতার মূল কেবল অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কাঠামোতেই নয়, তার শেকড় প্রোথিত আছে আমাদের চিন্তা করার পদ্ধতির মধ্যেই—আমাদের সেই প্রবণতার মধ্যে, যা প্রত্যক্ষ, জীবন্ত অভিজ্ঞতাকে বিসর্জন দিয়ে বিমূর্ত, গাণিতিক মডেলকে আঁকড়ে ধরতে চায়। এই দিক থেকে, হুসার্ল কেবল একজন জ্ঞানতাত্ত্বিকই নন, তিনি আধুনিক সভ্যতার এক গভীর চিকিৎসকও বটে, যিনি আমাদের রোগের কারণটি একেবারে গোড়ায় গিয়ে নির্ণয় করতে চেয়েছিলেন।
হিন্দু, বৌদ্ধ ও সুফি-দর্শনের বিভিন্ন উপাদানের সাথে সাদৃশ্য
দুই নদীর মোহনা: হুসার্লের আয়নায় ভারতীয় আস্তিক্যবাদী (হিন্দু) দর্শন
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, হাজার হাজার মাইল দূরে, ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা দুজন মানুষ কি একই রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে? একজন হয়তো জার্মানির এক নিভৃত বিশ্ববিদ্যালয় কক্ষে বসে সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন, অন্যজন হয়তো হিমালয়ের কোনো গুহায় বা গঙ্গার তীরে বসে ধ্যান করেছেন। তাদের ভাষা আলাদা, তাদের পোশাক আলাদা, তাদের জীবনের লক্ষ্যও হয়তো আলাদা। কিন্তু যখন তারা দুজনেই চেতনার গহীন অরণ্যে ডুব দেন, তখন কি তারা একই রকম মানচিত্র খুঁজে পেতে পারেন?
প্রশ্নটা শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। কিন্তু দর্শনের ইতিহাসে এমন আশ্চর্য ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে। এডমুন্ড হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্বের (Phenomenology) সঙ্গে যখন আমরা প্রাচীন ভারতীয় আস্তিক দর্শনের (এখন যাকে হিন্দু দর্শন বলা হয়), বিশেষ করে অদ্বৈত বেদান্ত (Advaita Vedanta), যোগদর্শনের (Yoga) এর পরিচয় করাই, তখন এক অবিশ্বাস্য প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। মনে হয়, যেন দুটি ভিন্ন পর্বত থেকে উৎপন্ন হওয়া দুটি নদী বহু পথ ঘুরে এসে একই মোহনায় মিলিত হচ্ছে। তাদের যাত্রাপথ ভিন্ন, কিন্তু তাদের জলের স্বাদ যেন একই রকম।
বাইরের কোলাহল থেকে ভেতরের দিকে যাত্রা
হুসার্লের দর্শনের প্রথম এবং সবচেয়ে বৈপ্লবিক পদক্ষেপটি ছিল এপোহে (Epoché) বা ব্র্যাকেটবন্দী করা। তিনি বলেছিলেন, জগৎ সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান পেতে হলে আমাদের প্রথমে বাইরের জগতের অস্তিত্ব আছে কি নেই, সেই প্রশ্নটিকে স্থগিত রাখতে হবে। আমাদের সাধারণ, আটপৌরে বিশ্বাস (যাকে তিনি বলেছেন প্রাকৃতিক মনোভাব বা Natural Attitude) থেকে সরে এসে কেবল চেতনার ভেতরে যা ঘটছে, তার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এটা হলো এক ধরনের ইচ্ছাকৃত অন্তর্মুখী যাত্রা, বাইরের কোলাহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনে ভেতরের জগতের নীরব সাক্ষী হওয়া।
এই ধারণাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে পরিচিত যে কারও মনে যোগদর্শনের কথা আসবে। পতঞ্জলির যোগসূত্রে অষ্টাঙ্গযোগের পঞ্চম অঙ্গটিই হলো প্রত্যাহার (Pratyahara)। প্রত্যাহার মানে হলো, ইন্দ্রিয়গুলোকে তাদের নিজ নিজ বিষয় (রূপ, রস, গন্ধ ইত্যাদি) থেকে গুটিয়ে এনে ভেতরের দিকে চালিত করা। বাইরের জগৎ থেকে মনকে সরিয়ে এনে তাকে আত্মমুখী করা। হুসার্ল যেমন ‘প্রাকৃতিক মনোভাবকে’ ব্র্যাকেটবন্দী করতে বলছেন, যোগীও তেমনি তার ইন্দ্রিয়গুলোকে জগৎ থেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। দুজনেরই উদ্দেশ্য এক: বাইরের জগতের বিক্ষেপ থেকে মুক্ত হয়ে চেতনার বিশুদ্ধ রূপটিকে পর্যবেক্ষণ করা (Bryant, 2009)।
একইভাবে, অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম প্রধান সাধনা হলো বিচার (Vichara) বা আত্ম-অনুসন্ধান। ঋষি রমণ মহর্ষি যেমন প্রশ্ন করতে বলতেন, “আমি কে?”—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সাধক তার শরীর, মন, বুদ্ধি, অহংকার—এইসব বাহ্যিক উপাধিকে ‘আমি নই, আমি নই’ (নেতি নেতি) বলে বর্জন করতে থাকেন। এই প্রক্রিয়াটিও এক ধরনের দার্শনিক হ্রাসকরণ (reduction), যেখানে পরিবর্তনশীল, অনিত্য সবকিছুকে সরিয়ে দিয়ে চেতনার মূল সত্তায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। হুসার্ল যেমন তার এপোহের মাধ্যমে বিশুদ্ধ চেতনার (Pure Consciousness) স্তরে পৌঁছাতে চান, বেদান্তের সাধকও তেমনি মায়ার আবরণ সরিয়ে শুদ্ধ চৈতন্যের (Pure Consciousness) অনুভূতি লাভ করতে চান।
সেই নিঃসঙ্গ সাক্ষী: অতীন্দ্রিয় অহং এবং সাক্ষী-চৈতন্য
হুসার্ল যখন জগৎকে ব্র্যাকেটবন্দী করেন, তখন অবশিষ্ট থাকে এক বিশুদ্ধ চেতনা, যা সবকিছুর সাক্ষী। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন অতীন্দ্রিয় অহং (Transcendental Ego)। এই অহং আমাদের সাধারণ, জাগতিক ‘আমি’ নয়। এটা হলো এক অপরিবর্তনীয়, নীরব দর্শক, যার সামনে আমাদের সব চিন্তা, আবেগ, আর অভিজ্ঞতার নাটক মঞ্চস্থ হয়। এই অহং নিজে নাটকের কোনো চরিত্র নয়, সে হলো প্রেক্ষাগৃহের সেই আলো, যা পুরো মঞ্চকে আলোকিত করে রাখে কিন্তু নিজে নাটকের অংশ হয় না।
এই ধারণাটি অদ্বৈত বেদান্তের কেন্দ্রীয় ধারণাগুলোর একটির সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। সেটি হলো সাক্ষী-চৈতন্য (Sākṣī-Caitanya) বা সাক্ষী-চেতনা। শঙ্কর এবং তার অনুসারীরা বলেন, আমাদের জাগতিক আমির (যাকে বলা হয় জীব বা Jīva) পেছনে এক কূটস্থ, অপরিবর্তনীয় চেতনা রয়েছে, যা সবকিছুকে নিরাসক্তভাবে দেখে যায়। এই সাক্ষী-চৈতন্যই হলো আমাদের আসল স্বরূপ বা আত্মা (Ātman)। সে সুখ-দুঃখ, পাপ-পুণ্য, জন্ম-মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। সে কেবল একজন সাক্ষী বা দ্রষ্টা (Drashtā)। যেমন একটি সিনেমার পর্দায় আগুন লাগার দৃশ্য দেখানো হলে পর্দাটি নিজে পুড়ে যায় না, তেমনি জীবনের সব ঘটনার সাক্ষী হলেও সাক্ষী-চৈতন্য নিজে সেই ঘটনায় লিপ্ত হয় না বা তার দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
বিখ্যাত দার্শনিক জে. এন. মোহান্তি (J.N. Mohanty), যিনি হুসার্ল এবং ভারতীয় দর্শন উভয় ক্ষেত্রেই একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তিনি এই মিলটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, হুসার্লের অতীন্দ্রিয় অহং এবং বেদান্তের সাক্ষী-চৈতন্য উভয়ই হলো:
- ১. নিষ্ক্রিয় (Passive): এরা কোনো কাজ করে না, কেবল পর্যবেক্ষণ করে।
- ২. অপরিবর্তনীয় (Unchanging): চেতনার বিষয়বস্তু অনবরত বদলায়, কিন্তু সাক্ষী নিজে বদলায় না।
- ৩. স্ব-প্রকাশ (Self-Luminous): তাকে অন্য কিছু দিয়ে আলোকিত করতে হয় না, সে নিজেই নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ।
- ৪. সর্বজনীন (Universal): এটি কোনো ব্যক্তিগত সত্তা নয়, বরং চেতনার এক সার্বজনীন কাঠামো (Mohanty, 1992)।
এই মিল এতটাই গভীর যে, মনে হয় যেন হুসার্ল এবং শঙ্কর একই সত্তার কথা বলছেন, শুধু ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক পরিভাষা ব্যবহার করে।
জগতের প্রতিভাস এবং মায়ার খেলা
হুসার্ল জগৎকে ব্র্যাকেটবন্দী করার পর যে জগৎ অবশিষ্ট থাকে, তা হলো প্রতিভাস (Phenomenon)—অর্থাৎ, জগৎ আমার চেতনায় যেভাবে ধরা দেয়। তিনি বলেন, আমাদের চেতনা সক্রিয়ভাবে এই জগৎকে ‘গঠন’ (constitute) করে। জগৎ আমাদের কাছে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের চেতনার উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়ার (intentional acts) মাধ্যমেই। এর মানে হলো, আমরা যে জগৎকে অভিজ্ঞতা করি, তা আমাদের চেতনা-নিরপেক্ষ কোনো বস্তুনিষ্ঠ জগৎ নয়, বরং তা হলো ‘চেতনার-জন্য-জগৎ’ (world-for-consciousness)।
এই ধারণাটিও অদ্বৈত বেদান্তের মায়া (Māyā) তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। শঙ্কর বলেন, আমরা যে নাম-রূপে ভরা জগৎ দেখি, তা পরম সত্য বা ব্রহ্মের (Brahman) একটি প্রতিভাস মাত্র। এই জগৎকে শঙ্কর পুরোপুরি মিথ্যা বা অলীক বলেননি, যেমনটা অনেকে ভুল করে ভাবেন। তিনি একে বলেছেন ব্যাবহারিক সত্য (empirical reality)। এই জগৎ ততক্ষণই সত্য, যতক্ষণ আমরা অজ্ঞানতার (Avidyā) মধ্যে থাকি। জ্ঞান লাভ হলে বোঝা যায় যে, এই নানা রূপে ভরা জগৎ আসলে এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মেরই প্রকাশ। মায়া হলো সেই শক্তি, যা এককে বহু হিসেবে দেখায়।
হুসার্লের ‘গঠন’ এবং শঙ্করের ‘মায়া’ ঠিক এক জিনিস নয়। হুসার্লের উদ্দেশ্য জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological), আর শঙ্করের উদ্দেশ্য অধিবিদ্যক (metaphysical) এবং মুক্তি-সংক্রান্ত (soteriological)। কিন্তু দুজনেই একটি বিষয়ে একমত: আমরা যে জগৎকে আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখি এবং বুদ্ধি দিয়ে বুঝি, তা চূড়ান্ত সত্য নয়। এর সত্যতা আমাদের চেতনার ওপর নির্ভরশীল। জগৎ যেভাবে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়, তার পেছনে রয়েছে চেতনার এক গভীর এবং সক্রিয় ভূমিকা (Sinha, 1958)।
পথের ভিন্নতা, গন্তব্যের প্রতিধ্বনি
এতগুলো গভীর মিল থাকা সত্ত্বেও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, হুসার্ল এবং ভারতীয় ঋষিদের যাত্রার উদ্দেশ্য এক ছিল না। এই পার্থক্যটি বোঝা অত্যন্ত জরুরি, নইলে এই তুলনাটি সরলীকরণের দোষে দুষ্ট হবে।
হুসার্লের লক্ষ্য ছিল জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological)। তিনি দর্শনকে একটি ‘কঠোর বিজ্ঞানে’ (rigorous science) পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানের জন্য একটি অভ্রান্ত ভিত্তি খুঁজে বের করা। তার প্রতিভাসতত্ত্ব একটি পদ্ধতি, জগৎকে জানার একটি নতুন উপায়।
অন্যদিকে, ভারতীয় দর্শনের, বিশেষ করে বেদান্ত ও যোগের লক্ষ্য হলো মুক্তি-সংক্রান্ত (soteriological)। এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো মোক্ষ (Mokṣa) বা নির্বাণ (Nirvāṇa) লাভ করা—অর্থাৎ, জন্ম-মৃত্যুর চক্র এবং সব ধরনের দুঃখ (Duḥkha) থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়া। তাদের কাছে চেতনাকে জানাটা কেবল জ্ঞানার্জনের জন্য নয়, বরং তা হলো অস্তিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। হুসার্ল যেখানে একজন জ্ঞানপিপাসু দার্শনিক, ভারতীয় ঋষিরা সেখানে একাধারে দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক চিকিৎসক।
এই পার্থক্যের কারণেই হুসার্ল অতীন্দ্রিয় অহংকে আবিষ্কার করেই থেমে যান, সেটিকে বিশ্লেষণ করেন না। কিন্তু বেদান্তের সাধক সেই সাক্ষী-চৈতন্যকে কেবল আবিষ্কার করেই থামেন না, তিনি সেই সাক্ষীর সঙ্গে একাত্ম হতে চান, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ (আমিই ব্রহ্ম) এই অনুভূতিতে স্থিত হতে চান।
বৌদ্ধ দর্শন: শূন্যতার দর্পণে প্রতিভাস
এক হাতে তালি বাজলে তার শব্দ কেমন হয়? এই প্রশ্নটি জাপানের জেন বৌদ্ধধর্মের একটি বিখ্যাত ধাঁধা বা কোআন (Kōan)। এর কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর নেই। এর উদ্দেশ্য হলো যুক্তিকে ছাড়িয়ে গিয়ে এক গভীরতর উপলব্ধিতে পৌঁছানো। এবার ভাবুন তো, এডমুন্ড হুসার্ল যদি এই প্রশ্ন শুনতেন, তিনি কী করতেন? তিনি হয়তো বলতেন, “একটু দাঁড়ান। তালিটা বাস্তবে বাজছে কি বাজছে না, সেই প্রশ্নটা আপাতত ব্র্যাকেটে রাখি। বরং আমার চেতনায় এই যে ‘এক হাতে তালি বাজার শব্দহীনতার অভিজ্ঞতা’ হচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতার গঠনটা কী? সেটাই আসল প্রশ্ন।”
কী আশ্চর্য! একজন জার্মান দার্শনিক আর একজন জেন গুরু যেন একই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন, যদিও তাদের পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্বের সঙ্গে যখন আমরা বৌদ্ধ দর্শনের, বিশেষ করে বুদ্ধের মূল শিক্ষা এবং পরবর্তীকালের নাগার্জুন বা বসুবন্ধুর মতো দার্শনিকদের চিন্তার পরিচয় করাই, তখন এক অভাবনীয় জগৎ উন্মোচিত হয়। মনে হয়, যেন দুটি ভিন্ন আয়নায় একই মুখের প্রতিবিম্ব দেখছি। আয়না দুটি আলাদা, তাই প্রতিবিম্বের গড়নেও কিছু পার্থক্য আছে। কিন্তু মূল মুখটা যে একই, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
চলুন, এই আশ্চর্য মিল ও অমিলের জগতে ডুব দেওয়া যাক।
প্রথম মনোযোগের শিল্প এবং জগৎকে বন্ধনীতে বন্দী করা
হুসার্লের দর্শনের প্রবেশদ্বার হলো এপোহে (Epoché)। এর মানে হলো, বাইরের জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের স্বাভাবিক বিশ্বাসকে বিচার করা থেকে বিরত থাকা। এটা জগৎকে অস্বীকার করা নয়, বরং জগতের প্রতি আমাদের আটপৌরে, অভ্যস্ত বোঝাপড়াকে থামিয়ে দিয়ে কেবল চেতনার প্রবাহের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এটা এক ধরনের পদ্ধতিগত মেডিটেশন, যেখানে লক্ষ্য হলো অভিজ্ঞতার বিশুদ্ধ রূপটিকে পর্যবেক্ষণ করা।
বৌদ্ধধর্মের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতেও রয়েছে ঠিক এমনই এক মনোযোগের শিল্প। বুদ্ধের অষ্টাঙ্গিক মার্গের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো সম্যক স্মৃতি (Samyak-smṛti) বা সঠিক মননশীলতা (Right Mindfulness) এবং সম্যক সমাধি (Samyak-samādhi) বা সঠিক একাগ্রতা (Right Concentration)। বিপাসনা (Vipassanā) বা অন্তর্দৃষ্টিমূলক ধ্যানের মূল কথাই হলো, যা কিছু ঘটছে—শারীরিক সংবেদন, আবেগ, চিন্তা—সেগুলোকে কোনো রকম বিচার না করে, ভালো-মন্দ তকমা না লাগিয়ে, কেবল একজন নিরাসক্ত পর্যবেক্ষকের মতো দেখে যাওয়া।
ফ্রান্সিসকো ভারেলা, ইভান থম্পসন এবং এলেনর রশ তাদের যুগান্তকারী গ্রন্থ দ্য এমবডিড মাইন্ড (The Embodied Mind)-এ দেখিয়েছেন, হুসার্লের এপোহে এবং বৌদ্ধদের বিপাসনা ধ্যানের মধ্যে এক গভীর পদ্ধতিগত মিল রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই লক্ষ্য হলো:
- ১. আমাদের অভ্যস্ত, স্বয়ংক্রিয় চিন্তার প্যাটার্নকে ভাঙা।
- ২. অভিজ্ঞতার প্রতি একটি নতুন, সতেজ এবং বিচারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা।
- ৩. চেতনার সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর স্তরগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা (Varela, Thompson, & Rosch, 1991)।
একজন প্রতিভাসতাত্ত্বিক যেমন তার চেয়ারের অভিজ্ঞতার দিকে তাকিয়ে চেয়ারটি বাস্তবে আছে কিনা সেই প্রশ্ন স্থগিত রাখেন, একজন বিপাসনা সাধকও তেমনি তার মনের মধ্যে রাগ উঠলে সেই রাগের কারণ বা ন্যায্যতা নিয়ে না ভেবে, কেবল ‘রাগ, রাগ’ বলে তার উদয় ও বিলয়কে পর্যবেক্ষণ করেন। দুজনেরই উদ্দেশ্য হলো, অভিজ্ঞতার সঙ্গে একাত্ম না হয়ে তার থেকে একটি দূরত্ব তৈরি করা, যাতে তার আসল স্বরূপটি উন্মোচিত হয়।
‘আমি’ নামক পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো
হুসার্ল যখন জগৎকে ব্র্যাকেটবন্দী করেন, তখন তিনি এক বিশুদ্ধ সাক্ষী-চেতনার সন্ধান পান, যার নাম তিনি দেন অতীন্দ্রিয় অহং (Transcendental Ego)। যদিও তিনি আমাদের জাগতিক ‘আমি’কে (empirical ego) ব্র্যাকেটবন্দী করেন, কিন্তু শেষে এসে তিনি অভিজ্ঞতার কেন্দ্র হিসেবে এক বিশুদ্ধ ‘অহং’-এর অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেন।
আর এখানেই বৌদ্ধ দর্শনের সঙ্গে তার সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে নাটকীয় পার্থক্যটি দেখা যায়। বৌদ্ধধর্মের অন্যতম মৌলিক এবং বৈপ্লবিক শিক্ষা হলো অনাত্মা বা অনাত্তা (Anātman/Anattā), যার অর্থ হলো ‘আত্মা-বিহীনতা’ বা ‘অ-আত্মা’ (No-Self)। বুদ্ধ বলেন, আমরা যাকে ‘আমি’ বা ‘আমার আত্মা’ বলে মনে করি, তা আসলে পাঁচটি উপাদানের (স্কন্ধ বা Skandhas) একটি অস্থায়ী সমষ্টি মাত্র। এই পাঁচটি উপাদান হলো: রূপ (শরীর), বেদনা (সংবেদন), সংজ্ঞা (প্রত্যক্ষণ), সংস্কার (মানসিক গঠন) এবং বিজ্ঞান (চেতনা)।
বৌদ্ধ দার্শনিকরা বলেন, এই পাঁচটি উপাদানের সমষ্টির বাইরে স্থায়ী, অপরিবর্তনীয়, একক কোনো ‘আমি’ বা ‘আত্মা’ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটা অনেকটা পেঁয়াজের মতো। আপনি যদি পেঁয়াজের সারবস্তু খোঁজার জন্য একটার পর একটা খোসা ছাড়াতে থাকেন, তাহলে শেষে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ‘আমি’ও ঠিক তেমনই।
মজার ব্যাপার হলো, হুসার্ল এবং বৌদ্ধ দার্শনিকরা দুজনেই ‘আমি’ নামক পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর কাজটি করেন। দুজনেই আমাদের সাধারণ, জাগতিক আমিকে বিশ্লেষণ করে তার উপাদানগুলোকে আলাদা করেন। কিন্তু শেষে এসে তাদের সিদ্ধান্ত ভিন্ন হয়ে যায়। হুসার্ল বলেন, সব খোসা ছাড়ানোর পর কেন্দ্রে একটি বিশুদ্ধ, অতীন্দ্রিয় অহং অবশিষ্ট থাকে। আর বৌদ্ধ দার্শনিকরা, বিশেষ করে নাগার্জুন (Nāgārjuna), বলেন যে শেষে যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো শূন্যতা (Śūnyatā)। অর্থাৎ, কোনো স্থায়ী, স্বাধীন সত্তার অনুপস্থিতি (Garfield, 1995)।
সুতরাং, পদ্ধতিগতভাবে মিল থাকলেও, তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য দুই মেরুর। একজন খুঁজে পান এক বিশুদ্ধ ‘অহং’, অন্যজন খুঁজে পান ‘অহং’-এর শূন্যতা।
জগতের স্বরূপ: প্রতিভাস না কি শূন্যতা?
হুসার্ল বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ আমাদের চেতনার দ্বারা ‘গঠিত’ (constituted)। বস্তুগুলো আমাদের চেতনায় প্রতিভাস (phenomenon) হিসেবে হাজির হয়। এর মানে, জগৎ আমাদের চেতনার ওপর নির্ভরশীল।
এই ধারণাটি বৌদ্ধধর্মের দুটি প্রভাবশালী দার্শনিক ধারার খুব কাছাকাছি চলে আসে।
১. মাধ্যমিক দর্শন (Mādhyamika) ও শূন্যতা: নাগার্জুন ছিলেন বৌদ্ধ দর্শনের এক মহীরুহ। তিনি তার মাধ্যমিক বা ‘মধ্যম পন্থা’ দর্শনে বলেন, জগতের কোনো বস্তুরই নিজস্ব, স্বাধীন বা স্থায়ী সত্তা (স্বভাব বা Svabhāva) নেই। সবকিছুই অন্যান্য কারণ ও শর্তের ওপর নির্ভরশীল। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকেই তিনি বলেছেন প্রতীত্যসমুৎপাদ (Pratītyasamutpāda) বা ‘নির্ভরশীল উৎপত্তি’। আর যেহেতু কোনো কিছুরই স্বাধীন সত্তা নেই, তাই সবকিছুই স্বভাবগতভাবে ‘শূন্য’ (śūnya)।
এখানে শূন্যতা মানে বিনাশ বা নাস্তিত্ব নয়। শূন্যতা মানে হলো, কোনো কিছুরই অন্তর্নিহিত, স্বাধীন অস্তিত্বের অভাব। একটি টেবিল ততক্ষণই টেবিল, যতক্ষণ তার কাঠ, পেরেক, নকশা এবং একজন ব্যবহারকারী আছে। এই উপাদানগুলো সরিয়ে নিলে ‘টেবিল’ বলে আলাদা কিছু পাওয়া যাবে না।
হুসার্লের ‘গঠিত জগৎ’ এবং নাগার্জুনের ‘নির্ভরশীল উৎপত্তি’—এই দুটি ধারণার মধ্যে এক গভীর সাদৃশ্য রয়েছে। দুজনেই বলছেন যে, আমরা যে জগৎকে অভিজ্ঞতা করি, তা কোনো পরম, স্বাধীন সত্তা নয়। এর অস্তিত্ব এবং অর্থ নির্ভর করে অন্যান্য শর্তের ওপর, যার মধ্যে চেতনা একটি প্রধান শর্ত (Murti, 1955)।
২. যোগাচার দর্শন (Yogācāra) ও চিত্তমাত্র (Cittamātra): বৌদ্ধ দর্শনের আরেকটি প্রভাবশালী শাখা হলো যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ (Vijñānavāda), যার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন বসুবন্ধু (Vasubandhu) এবং অসঙ্গ (Asaṅga)। তারা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন যে, আমরা যাকে বাহ্যিক জগৎ বলে মনে করি, তা আসলে আমাদের চিত্ত (Citta) বা বিজ্ঞানেরই (Vijñāna) প্রক্ষেপণ বা বিবর্তন মাত্র। একে বলা হয় চিত্তমাত্র (Cittamātra) বা ‘কেবল-মন’ (Mind-Only) তত্ত্ব। তাদের মতে, কোনো বাহ্যিক বস্তুর অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা কেবল চেতনার প্রবাহ এবং তার দ্বারা সৃষ্ট প্রতিভাস। এটা অনেকটা স্বপ্নের মতো। স্বপ্নে আমরা যে জগৎ দেখি, তা আমাদের মনই তৈরি করে, তার কোনো বাহ্যিক অস্তিত্ব থাকে না।
যোগাচার দর্শনের এই ‘কেবল-মন’ তত্ত্বটি হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্বের সবচেয়ে কাছাকাছি। হুসার্ল যখন এপোহের মাধ্যমে বাহ্যিক জগতের অস্তিত্বকে ব্র্যাকেটবন্দী করেন, তখন যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো বিশুদ্ধ চেতনা এবং তার বিষয়বস্তু (নোয়েমা)। যোগাচার দার্শনিকরাও ঠিক একই কথা বলছেন, যদিও তাদের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। পরবর্তীকালে দিগ্নাগ (Dignāga) এবং ধর্মকীর্তির (Dharmakīrti) মতো বৌদ্ধ জ্ঞানতাত্ত্বিকরা প্রত্যক্ষণ এবং অনুমানের যে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেছেন, তার সঙ্গেও হুসার্লের নোয়েসিস-নোয়েমা বিশ্লেষণের মিল খুঁজে পাওয়া যায় (Stcherbatsky, 1962)।
পথের উদ্দেশ্য: জ্ঞান না কি মুক্তি?
এত মিল থাকা সত্ত্বেও, হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্ব এবং বৌদ্ধ দর্শনের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, আর তা হলো তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
হুসার্লের লক্ষ্য ছিল জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological)। তিনি দর্শনকে একটি অভ্রান্ত ভিত্তি দিতে চেয়েছিলেন, জ্ঞানের স্বরূপ উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন। তার কাছে চেতনাকে জানাটা ছিল একটি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মতো। তিনি জগৎকে বুঝতে চেয়েছিলেন।
অন্যদিকে, বৌদ্ধ দর্শনের লক্ষ্য হলো পুরোপুরি মুক্তি-সংক্রান্ত (soteriological)। বুদ্ধ তার দর্শন প্রচার করেছিলেন একটিমাত্র কারণে: দুঃখ (Duḥkha) নিরসনের জন্য। তার কাছে চেতনা, অনাত্মা বা শূন্যতার বিশ্লেষণ কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যায়াম ছিল না। এগুলো ছিল সেই অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাকে দূর করার উপায়, যা আমাদের দুঃখ এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্রে বেঁধে রাখে। বৌদ্ধধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নির্বাণ (Nirvāṇa) লাভ করা—যা হলো সব বাসনা, ঘৃণা এবং অজ্ঞতার অগ্নি নির্বাপিত হওয়া। বৌদ্ধধর্ম জগৎকে কেবল বুঝতে চায় না, জগৎ থেকে উত্তীর্ণ হতে চায়।
সুতরাং, হুসার্ল হলেন একজন নির্ভীক জ্ঞানান্বেষণকারী, যিনি চেতনার মানচিত্র আঁকতে চান। আর বুদ্ধ হলেন একজন করুণাময় চিকিৎসক, যিনি সেই মানচিত্র ব্যবহার করে আমাদের অস্তিত্বের রোগ নিরাময় করতে চান।
প্রত্যক্ষণের ব্যবচ্ছেদ: হুসার্ল এবং নালন্দার জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্মশালা
দর্শনের ইতিহাসে কিছু কর্মশালা বসেছিল, যেখানে জ্ঞানের কারিগররা বসেছিলেন অভিজ্ঞতার সবচেয়ে সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই: আমরা যেটাকে ‘জানা’ বলি, সেই প্রক্রিয়াটিকে একেবারে ব্যবচ্ছেদ করে তার কলকব্জাগুলো খুলে দেখা। এডমুন্ড হুসার্ল জার্মানির ফ্রাইবুর্গে বসে এমনই একটি কর্মশালা খুলেছিলেন। আর তার প্রায় দেড় হাজার বছর আগে, ভারতের নালন্দা মহাবিহারের মতো জ্ঞানপীঠে দিগ্নাগ, ধর্মকীর্তি, শান্তরক্ষিতের মতো দার্শনিকরাও ঠিক একই রকম একটি কর্মশালা পরিচালনা করছিলেন। তাদের মধ্যে কোনোদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি। কিন্তু আশ্চর্য, তাদের ব্যবচ্ছেদের পর যে নকশাগুলো বেরিয়ে এসেছিল, তার মধ্যে এক গভীর, অলৌকিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
হুসার্লের কর্মশালা: নোয়েসিস ও নোয়েমা: আমরা আগেই দেখেছি, হুসার্লের মতে আমাদের যেকোনো অভিজ্ঞতার দুটি দিক আছে: নোয়েসিস (Noesis) এবং নোয়েমা (Noema)। নোয়েসিস হলো চেতনার কাজটি (the act)—যেমন দেখা, শোনা, বিচার করা, কল্পনা করা। আর নোয়েমা হলো সেই কাজের বিষয়বস্তু (the object-as-intended)—যেমন আমার চেতনায় ভেসে ওঠা ‘গাছ-যেমন-আমি-দেখছি’। হুসার্লের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, নোয়েমা বাইরের জগতের বাস্তব গাছটি নয়। বরং, এটি হলো চেতনার দ্বারা অর্থপ্রাপ্ত, গঠিত (constituted) একটি সত্তা। চেতনা যেন একজন শিল্পী, যে সংবেদনের কাঁচামাল (যাকে হুসার্ল বলেছেন hyletic data) নিয়ে তাতে অর্থ ও রূপের প্রলেপ দিয়ে নোয়েমাকে তৈরি করে।
নালন্দার কর্মশালা: নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষ: এবার চলুন আমরা টাইম মেশিনে চড়ে প্রায় ১৫০০ বছর পিছিয়ে যাই। নালন্দার সেই কর্মশালায় প্রবেশ করি, যার প্রধান কারিগর ছিলেন দিগ্নাগ (Dignāga) এবং তার সুযোগ্য উত্তরসূরি ধর্মকীর্তি (Dharmakīrti)। তারা বৌদ্ধ জ্ঞানতত্ত্ব বা প্রমাণশাস্ত্রের (Pramāṇaśāstra) দুই দিকপাল। তারা প্রশ্ন তুললেন, আমরা যখন কোনো কিছু প্রত্যক্ষণ করি (perceive), তখন ঠিক কী ঘটে?
তাদের উত্তর ছিল বৈপ্লবিক। তারা বললেন, আমাদের প্রত্যক্ষ দুই প্রকারের:
- ১. নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ (Nirvikalpaka Pratyakṣa): এটি হলো বিশুদ্ধ, কাঁচা, ধারণা-পূর্ববর্তী সংবেদন (pure, raw, pre-conceptual sensation)। যখন আমাদের ইন্দ্রিয় কোনো বস্তুর সংস্পর্শে আসে, তখন এক মুহূর্তের জন্য যে বিশুদ্ধ সংবেদনের ঝলকানি হয়, যাতে কোনো নাম, রূপ বা ধারণা মিশ্রিত থাকে না—সেটিই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ। এটা হলো ‘কিছু একটা’-র অভিজ্ঞতা, কিন্তু সেটা যে ‘কী’, তা মন তখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি। ধর্মকীর্তির মতে, এটাই হলো একমাত্র বিশুদ্ধ প্রত্যক্ষ, যা বাস্তবের অনন্য, ক্ষণিক সত্তা বা স্বলক্ষণ (svalakṣaṇa)-কে স্পর্শ করতে পারে (Dreyfus, 1997)। এটা অনেকটা কাঁচা মাটির দলার মতো।
- ২. সবিকল্পক প্রত্যক্ষ (Savikalpaka Pratyakṣa): নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের সেই কাঁচা সংবেদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মন বা বিকল্প (Vikalpa) সক্রিয় হয়ে ওঠে। মন তার স্মৃতিভাণ্ডার থেকে ধারণা (concept), নাম (name) ও রূপ (form) এনে সেই কাঁচা সংবেদনের ওপর চাপিয়ে দেয়। তখন সেই ‘কিছু একটা’ হয়ে ওঠে ‘একটি নীল ফুলদানি’ বা ‘একটি গরম চায়ের কাপ’। এই যে মনের দ্বারা নির্মিত, নাম-রূপে চিহ্নিত অভিজ্ঞতা—এটাই হলো সবিকল্পক প্রত্যক্ষ। এটা হলো সেই কাঁচা মাটির দলাকে একজন কুমোরের হাতে একটি নির্দিষ্ট পাত্রের রূপ দেওয়ার মতো। ধর্মকীর্তির মতে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সব অভিজ্ঞতাই হলো এই সবিকল্পক প্রত্যক্ষ, যা আসলে মনেরই এক নির্মাণ (conceptual construction)।
দুই কর্মশালার নকশার মিল: এবার দুটি নকশাকে পাশাপাশি রাখুন। মিলগুলো কি চোখে পড়ছে?
-
হুসার্লের সংবেদনের কাঁচামাল বা hyletic data-র সঙ্গে বৌদ্ধদের নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের এক অসাধারণ মিল রয়েছে। দুটোই হলো অভিজ্ঞতার সেই আদি, অগঠিত স্তর।
-
বৌদ্ধদের মনের গঠনমূলক কাজ বা বিকল্প (Vikalpa)-এর সঙ্গে হুসার্লের চেতনার সক্রিয় কাজ বা নোয়েসিস (Noesis)-এর মিল প্রায় হুবহু। দুটোই হলো সেই শিল্পী বা কারিগরের হাত, যা কাঁচামালে রূপ দেয়।
-
আর বৌদ্ধদের মনের দ্বারা নির্মিত, অর্থপূর্ণ সবিকল্পক প্রত্যক্ষ হলো হুসার্লের নোয়েমা (Noema)-র প্রতিচ্ছবি। দুটোই হলো সেই চূড়ান্ত শিল্পকর্ম—‘ফুলদানি-যেমন-আমার-চেতনায়-প্রতিভাত-হচ্ছে’। দুটোই বাস্তব বস্তু নয়, বরং চেতনার দ্বারা গঠিত অর্থপূর্ণ সত্তা।
সুতরাং, হুসার্ল এবং ধর্মকীর্তি—দুজনই বলছেন যে, আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ মনেরই এক সৃষ্টি। আমরা জগৎকে নিষ্ক্রিয়ভাবে গ্রহণ করি না, আমরা সক্রিয়ভাবে তাকে নির্মাণ করি। এই বিশ্লেষণাত্মক গভীরতা এতটাই যে, থিওডোর শ্চেরবাটস্কির (Theodor Stcherbatsky) মতো ভারততত্ত্ববিদরা ধর্মকীর্তিকে ‘ভারতের কান্ট’ বলে অভিহিত করেছেন, যদিও তাকে ‘ভারতের হুসার্ল’ বলাটা হয়তো আরও বেশি সঠিক হতো (Stcherbatsky, 1962)।
ঐতিহ্যের বিস্তার: শান্তরক্ষিত ও অতীশ দীপঙ্কর: এই জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্মশালার কাজ দিগ্নাগ বা ধর্মকীর্তিতেই থেমে থাকেনি। পরবর্তীকালে নালন্দার আরেকজন মহান দার্শনিক শান্তরক্ষিত (Śāntarakṣita) তার বিখ্যাত গ্রন্থ তত্ত্বসংগ্রহ (Tattvasaṅgraha)-তে এই জ্ঞানতাত্ত্বিক মডেলটিকে এক বিশাল রূপ দেন। তিনি অন্যান্য ভারতীয় দর্শনের (যেমন ন্যায়, মীমাংসা) প্রত্যক্ষ সম্পর্কিত ধারণাকে খণ্ডন করে ধর্মকীর্তির এই দ্বি-স্তরীয় মডেলটিকে প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তরক্ষিত অত্যন্ত সূক্ষ্ম যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, আমরা যাকে ‘বাহ্যিক বস্তু’ বলি, তার কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। যা আছে, তা হলো চেতনার প্রবাহ এবং তার দ্বারা নির্মিত রূপ। তিনি হুসার্লের মতোই এক দার্শনিক বিজারণের মাধ্যমে জগৎকে চেতনার ভেতরে নিয়ে আসেন (Kellner, 1976)।
আর এই মহান ঐতিহ্যেরই একজন বাহক ছিলেন আমাদের বাংলার গর্ব, বিক্রমপুরের সন্তান অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (Atīśa Dīpaṅkara Śrījñāna)। তিনি ছিলেন নালন্দা ও বিক্রমশীলা মহাবিহারের সেই শেষ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। তিনি যখন তিব্বতে যান, তখন তিনি কেবল মহাযান বৌদ্ধধর্মের আধ্যাত্মিকতাই নিয়ে যাননি, তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন দিগ্নাগ-ধর্মকীর্তি-শান্তরক্ষিতের এই কঠোর জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্লেষণকেও। তার বিখ্যাত গ্রন্থ বোধিপথপ্রদীপ (Bodhipathapradīpa)-এ তিনি জ্ঞান ও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। সেই পথের একটি অপরিহার্য অংশই হলো এটা বোঝা যে, আমাদের মন কীভাবে জগৎকে নির্মাণ করে। অতীশের কাছে, এই জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কোনো শুকনো পাণ্ডিত্য ছিল না। এটা ছিল অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাকে কাটার জন্য এক ধারালো অস্ত্র। কারণ, যতক্ষণ না আমরা বুঝতে পারছি যে আমাদের দুঃখময় জগৎ আমাদেরই মনের নির্মাণ, ততক্ষণ আমরা সেই দুঃখের চক্র থেকে মুক্তি পাবো কীভাবে?
এভাবেই, এক গভীর জ্ঞানতাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি, যা নালন্দায় বিকশিত হয়েছিল, তা অতীশের মাধ্যমে তিব্বতের মালভূমিতে পৌঁছে গিয়েছিল এবং আজও সেখানে সজীব হয়ে আছে। আর সেই একই অন্তর্দৃষ্টি, সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে, প্রায় হাজার বছর পরে জার্মানির এক দার্শনিকের লেখায় নতুন করে প্রাণ পেয়েছিল। জ্ঞানের এই গোপন স্রোত দেশ ও কালের সীমানা মানে না, এ যেন তারই এক আশ্চর্য প্রমাণ।
হৃদয়ের আয়নায় জগৎ: হুসার্ল এবং সুফিদের গহীন পথ
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্টের ধারে এক নিভৃত কক্ষে বসে যে দার্শনিক জগৎকে বন্ধনীতে বন্দী করার কথা ভাবছেন, তার ভাবনার সঙ্গে পারস্যের কোনো এক মরূদ্যানে বসে তারার দিকে তাকিয়ে থাকা কোনো মরমী সাধকের চিন্তার মিল থাকতে পারে? একজন খুঁজছেন জ্ঞানের অভ্রান্ত ভিত্তি, অন্যজন খুঁজছেন পরম সত্তার সঙ্গে মিলন। একজন কথা বলছেন যুক্তি আর কঠোর পদ্ধতির ভাষায়, অন্যজন কথা বলছেন কবিতা আর ভালোবাসার ভাষায়। তাদের মধ্যে দূরত্ব হাজার মাইলের, হাজার বছরের। কিন্তু তারা দুজনেই যখন মানব চেতনার সবচেয়ে গভীর স্তরে ডুব দেন, তখন তাদের তুলে আনা মুক্তাগুলোর মধ্যে এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
এডমুন্ড হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্ব (Phenomenology) এবং ইসলামের মরমী শাখা সুফিবাদের (Sufism) মধ্যে তুলনাটা অনেকটা এমনই। এই তুলনা কোনো সরাসরি প্রভাবের গল্প নয়। বরং এটা হলো দুটি ভিন্ন পথ ধরে একই সত্যের দিকে যাত্রার এক আশ্চর্য উপাখ্যান। চলুন, আমরা এই দুই ভিন্ন জগতের মধ্যেকার গোপন সেতুগুলো আবিষ্কার করার চেষ্টা করি।
জগতের কোলাহলকে ‘বন্ধনীতে’ বন্দী করা
হুসার্লের দর্শনের প্রথম ধাপই হলো এপোহে (Epoché)। এর মানে হলো, বাইরের জগতের অস্তিত্ব আছে কি নেই, তা সত্য না মিথ্যা—এইসব প্রশ্নকে আপাতত থামিয়ে দেওয়া। আমাদের প্রতিদিনের যে আটপৌরে বিশ্বাস (Natural Attitude), তাকে একপাশে সরিয়ে রেখে কেবল নিজের চেতনার ভেতরে যা ঘটছে, তার দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া। এটা জগৎকে অস্বীকার করা নয়, বরং জগতের প্রতি আমাদের অভ্যস্ত প্রতিক্রিয়াগুলোকে থামিয়ে দিয়ে অভিজ্ঞতার বিশুদ্ধ রূপটি দেখার এক সচেতন প্রচেষ্টা।
এবার চলুন সুফিদের জগতে। একজন সুফি সাধকের যাত্রাও শুরু হয় ঠিক এমনই এক ‘থামিয়ে দেওয়া’ বা ‘সরিয়ে রাখা’ দিয়ে। সুফিরা এই জগৎকে বলেন দুনিয়া। তাদের মতে, পরম সত্য বা হক (al-Haqq)-কে জানতে হলে প্রথমে এই দুনিয়ার আকর্ষণ, এর কোলাহল, এর প্রতি আমাদের মোহকে জয় করতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে এক ধরনের আধ্যাত্মিক এপোহে। সাধক মোরাকাবা (Murāqabah) বা ধ্যানে বসেন। তিনি তার মনকে হাজারো চিন্তা থেকে, ইন্দ্রিয়কে হাজারো আকর্ষণ থেকে গুটিয়ে আনেন। তার লক্ষ্য হলো, নিজের ভেতরের ‘আমি’ বা নফস (Nafs)-এর কোলাহলকে থামিয়ে দিয়ে হৃদয়ের (ক্বলব – Qalb) গভীরে থাকা পরম সত্তার ডাক শোনা।
বিখ্যাত সুফি দার্শনিক ইমাম আল-গাজ্জালি (Imam Al-Ghazali)-র নিজের জীবনই এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি তার সময়ের সবচেয়ে বড় জ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন। কিন্তু একসময় তিনি বুঝতে পারলেন, কেবল বই পড়ে, যুক্তি-তর্ক দিয়ে যে জ্ঞান পাওয়া যায়, তা তাকে শান্তি বা পরম নিশ্চয়তা (ইয়াকিন – Yaqīn) দিতে পারছে না। তখন তিনি তার অধ্যাপনা, সম্মান, প্রতিপত্তি—সবকিছু ত্যাগ করে সাধারণ এক দরবেশের জীবন বেছে নেন। তিনি তার অর্জিত সমস্ত জ্ঞানকে ‘ব্র্যাকেটবন্দী’ করে সরাসরি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্যকে জানার পথে বেরিয়ে পড়েন (Al-Ghazali, trans. 1953)। হুসার্ল যেমন দর্শনের সংকট থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন, আল-গাজ্জালিও তেমনি তার নিজের ভেতরের সংকট থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। আর দুজনেরই পথ ছিল এক—তত্ত্বের জগৎ থেকে সরে এসে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জগতে প্রবেশ করা।
সাক্ষী চেতনা এবং তার চূড়ান্ত বিলুপ্তি
হুসার্ল যখন জগৎকে ব্র্যাকেটবন্দী করেন, তখন অবশিষ্ট থাকে এক বিশুদ্ধ সাক্ষী চেতনা, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন অতীন্দ্রিয় অহং (Transcendental Ego)। এই অহং হলো এক নীরব দর্শক, যার সামনে আমাদের সব অভিজ্ঞতার নাটক মঞ্চস্থ হয়। এই অহং নিজে নিষ্ক্রিয়, অপরিবর্তনীয় এবং সব অভিজ্ঞতার কেন্দ্র।
সুফিদের দর্শনেও চেতনার এক গভীর সাক্ষী রূপের কথা বলা হয়েছে। তাদের মতে, মানুষের ক্বলব (Qalb) বা হৃদয়ই হলো সেই আয়না, যেখানে পরম সত্যের প্রতিবিম্ব পড়ে। এই হৃদয় যখন দুনিয়ার ময়লা থেকে পরিষ্কার হয়, তখন তা এক বিশুদ্ধ সাক্ষীতে পরিণত হয়, যা বস্তুর বাহ্যিক রূপের বদলে তার অন্তর্নিহিত সত্যকে দেখতে পায়।
কিন্তু এখানেই হুসার্ল এবং সুফিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে নাটকীয় পার্থক্যটি দেখা যায়। হুসার্ল এই অতীন্দ্রিয় অহংকে খুঁজে পেয়ে তাকেই তার দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু বা ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার দর্শন এই অহং-কে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
আর সুফিদের যাত্রার চূড়ান্ত লক্ষ্যই হলো এই ‘অহং’ বা ‘আমি’-কে পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়া। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ফানা (Fanā), যার অর্থ হলো বিলুপ্তি বা বিনাশ। সুফির মতে, এই ‘আমি’-টাই হলো পরম সত্তা বা আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় পর্দা। সুতরাং, সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে এই সাক্ষী ‘আমি’-কেও পরম সত্তার আলোয় বিলীন হয়ে যেতে হবে। ফানার স্তরে পৌঁছে সুফি বলেন, “আমি নেই, কেবল তিনিই আছেন।” এখানে সাক্ষী এবং যা কিছুর সে সাক্ষী, দুই-ই এক হয়ে যায়। এই ফানার পরেই আসে বাকা (Baqā) বা পরম সত্তার সঙ্গে স্থায়িত্ব লাভ করা।
সুতরাং, হুসার্ল যে অহং-কে আবিষ্কার করে পরম মমতায় প্রতিষ্ঠা করেন, সুফিরা সেই অহং-কেই ভালোবাসার আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেন। একজন খুঁজে পান চেতনার এক অবিচল কেন্দ্র, অন্যজন সেই কেন্দ্রকে ভেঙে দিয়ে অসীমের সঙ্গে একাকার হয়ে যান।
জগৎ কার সৃষ্টি? চেতনা নাকি প্রেম?
হুসার্লের মতে, আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ আমাদের চেতনার দ্বারা ‘গঠিত’ (constituted)। আমাদের চেতনা সক্রিয়ভাবে জগৎকে অর্থ প্রদান করে। জগৎ কোনো তৈরি হয়ে থাকা বস্তু নয়, যা আমরা কেবল আবিষ্কার করি। বরং, জগৎ আমাদের চেতনার উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়ার (intentionality) ফলেই আমাদের কাছে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এই ধারণাটির সঙ্গে সুফি দর্শনের, বিশেষ করে ইবন আরাবির (Ibn ‘Arabī) ওয়াহদাত আল-উজুদ (Waḥdat al-Wujūd) বা ‘সত্তার ঐক্য’ তত্ত্বের এক গভীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইবন আরাবির মতে, এই সমগ্র সৃষ্টিজগৎ আসলে এক পরম সত্তা বা আল্লাহ-রই তাজাল্লি (Tajallī) বা আত্মপ্রকাশ। আল্লাহ ছিলেন এক ‘গুপ্ত ধন’, তিনি চাইলেন যে তিনি প্রকাশিত হবেন, তাই তিনি প্রেম থেকে এই জগৎ সৃষ্টি করলেন। সুতরাং, এই জগতের প্রতিটি অণু-পরমাণু, প্রতিটি রূপ, প্রতিটি ঘটনা আসলে সেই এক পরম সত্তারই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। জগৎ তার থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং তারই আয়নায় তারই প্রতিবিম্ব (Chittick, 1989)।
এবার দুটি ধারণাকে পাশাপাশি রাখুন। হুসার্ল বলছেন, জগৎ আমাদের ‘চেতনার’ দ্বারা গঠিত। ইবন আরাবি বলছেন, জগৎ পরম সত্তার ‘প্রেম’ বা ‘ইচ্ছা’র দ্বারা প্রকাশিত। দুজনের ভাষাই ভিন্ন, প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কিন্তু দুজনেই বলছেন, আমরা যে জগৎকে দেখছি, তার পেছনে রয়েছে এক গভীর, সক্রিয়, সৃজনশীল শক্তি। জগৎ নিজে নিজে অর্থবহ নয়, সে অর্থ লাভ করে এক গভীরতর উৎস থেকে।
বিখ্যাত সুফি কবি জালালুদ্দিন রুমি (Rumi) যেন এই কথাই বলছেন তার কবিতায়:
“তোমার চোখ যদি বন্ধ করো, এই জগৎটাও মরে যায়।
যা কিছু তুমি দেখো, তা তোমার দেখার মাধ্যমেই বেঁচে থাকে।”
এই লাইনটি কি হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্বের এক মরমী কাব্যরূপ নয়? রুমি বলছেন, জগৎ আমাদের দেখার ওপর নির্ভরশীল। হুসার্লও ঠিক তাই বলছেন, তবে দর্শনের পরিভাষায়।
ভিন্ন পথ, একই প্রতিধ্বনি
তাহলে কি হুসার্ল একজন সুফি ছিলেন? বা সুফিরা কি না জেনেই প্রতিভাসতাত্ত্বিক ছিলেন? না, এমন সরল সিদ্ধান্তে আসাটা ভুল হবে। তাদের দুজনের যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
হুসার্লের উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological)। তিনি জ্ঞানের জন্য এক অভ্রান্ত ভিত্তি খুঁজছিলেন, দর্শনকে এক কঠোর বিজ্ঞানে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তার কাছে চেতনাকে জানাটা ছিল এক পরম বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনা।
অন্যদিকে, সুফিদের উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক ও মুক্তি-সংক্রান্ত (soteriological)। তাদের লক্ষ্য কোনো দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা নয়, বরং তাদের লক্ষ্য হলো পরম প্রেমময় সত্তার সঙ্গে মিলন এবং সেই মিলনের মাধ্যমে চিরন্তন শান্তি ও আনন্দ লাভ করা। তাদের পথ যুক্তির নয়, তাদের পথ প্রেমের বা ইশক (Ishq)-এর।
কিন্তু তাদের পথ ভিন্ন হলেও, সেই পথের বাঁকে বাঁকে যে দৃশ্য তারা দেখেছেন, তার মধ্যে এক আশ্চর্য মিল রয়েছে। দুজনেই আমাদের শিখিয়েছেন বাইরের কোলাহল ছেড়ে ভেতরের দিকে তাকাতে। দুজনেই দেখিয়েছেন, আমরা যে জগৎকে দেখি, তা আমাদের চেতনারই এক গভীর লীলা। হুসার্ল আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন এক দার্শনিকের টর্চলাইট, আর সুফিরা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন এক প্রেমিকের জ্বলন্ত মোমবাতি। আলো দুটো ভিন্ন, কিন্তু সেই আলোতে যা কিছু দেখা যায়, তার মধ্যে এক গভীর সত্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। আর সেই প্রতিধ্বনিই আমাদের বলে দেয়, জ্ঞানের পথ আর প্রেমের পথ হয়তো শেষ পর্যন্ত একই অসীমের দিকেই ধাবিত হয়।
এক নিভৃত বিপ্লবীর পদচিহ্ন: হুসার্ল কীভাবে বদলে দিলেন আমাদের ভাবনার জগৎ
ইতিহাসে কিছু বিপ্লব হয় রাজপথে, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে। আবার কিছু বিপ্লব ঘটে নীরবে-নিভৃতে, একলা কোনো দার্শনিকের পড়ার ঘরে। সেই বিপ্লবের আঁচ সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় না। তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে, কখনো কখনো কয়েক দশক। এডমুন্ড হুসার্ল ছিলেন এমনই এক নিভৃত বিপ্লবী। তার নাম হয়তো কার্ল মার্ক্স বা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতো ঘরে ঘরে পরিচিত নয়, কিন্তু তার চিন্তার প্রভাব আমাদের আজকের পৃথিবীকে যে কত গভীরভাবে বদলে দিয়েছে, তা জানলে অবাক হতে হয়।
তিনি যেন এক আশ্চর্য স্থপতি, যিনি এক নতুন ধরনের ইমারত তৈরির নকশা করে গেছেন। তার নিজের হাতে গড়া ইমারত হয়তো সম্পূর্ণ হয়নি, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের সেরা সেরা স্থপতিরা তার সেই নকশা আর পদ্ধতি ব্যবহার করেই নিজেদের জগৎ কাঁপানো সব স্থাপত্য তৈরি করেছেন। হুসার্লের ছাত্র আর অনুসারীদের তালিকাটি দেখলে মাথা ঘুরে যায়। বিংশ শতাব্দীর দর্শনের প্রায় সব বড় নামই কোনো না কোনোভাবে তার কাছে ঋণী।
আসুন, আমরা সেই প্রভাবের মানচিত্রটি একটু মেলে ধরি। দেখি, কীভাবে হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্ব (Phenomenology) নামের আপাত নিরীহ দর্শনটি অস্তিত্ববাদ থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞান, এমনকি আজকের দিনের কগনিটিভ সায়েন্স পর্যন্ত তার পদচিহ্ন রেখে গেছে।
তারকারাজি ছাত্র এবং ভালোবাসার বিদ্রোহ: বলা হয়, একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় সার্থকতা তার ছাত্রদের মধ্যে। আবার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিও সেখানেই লুকিয়ে থাকে। হুসার্লের ভাগ্য ছিল এমনই। তিনি তার সময়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের আকর্ষণ করেছিলেন, কিন্তু তার সেরা ছাত্ররাই তার চিন্তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তবে এ ছিল এক অদ্ভুত বিদ্রোহ, এক ‘ভালোবাসার বিদ্রোহ’। তারা হুসার্লের পদ্ধতিকে অস্বীকার করেননি, বরং সেই পদ্ধতি ব্যবহার করেই তার সিদ্ধান্তগুলোকে উল্টে দিয়েছিলেন।
মার্টিন হাইডেগার: জগতের কারাগারে নিক্ষিপ্ত মানুষ
দর্শনের ইতিহাসে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক সবসময়ই এক নাটকীয় উপাখ্যান। সক্রেটিসের জন্য যেমন প্লেটো, প্লেটোর জন্য অ্যারিস্টটল—এই পরম্পরা যেন এক অলিখিত নিয়ম। গুরু একটি পথের দিশা দেখান, আর সবচেয়ে প্রতিভাবান শিষ্যটিই সেই পথকে হয় আরও প্রশস্ত করেন, নয়তো সেই পথ থেকে বিদ্রোহ করে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। এডমুন্ড হুসার্ল এবং তার সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্র মার্টিন হাইডেগারের সম্পর্ক ছিল এই দ্বিতীয় ঘরানার এক মহাকাব্য। এ যেন এক ভালোবাসার বিদ্রোহ, এক গভীর ঋণ স্বীকার করে নিয়েই গুরুর সিংহাসন উল্টে দেওয়ার গল্প।
হুসার্ল যখন ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের মহীরুহ, তখন তার ছায়াতলে এসেছিলেন তরুণ, প্রখর মেধাবী হাইডেগার। হুসার্ল তার এই ছাত্রের মধ্যে নিজের দর্শনের ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, হাইডেগারই তার প্রতিভাসতত্ত্বের (Phenomenology) মশালটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, তার অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণ করবেন। কিন্তু হাইডেগার সেই মশালটি নিলেন বটে, তবে তিনি সেই মশাল হাতে নিয়ে গুরুর দেখানো আলোকিত পথে না হেঁটে, ঢুকে পড়লেন এক অন্ধকার, গহীন অরণ্যে, যে অরণ্যের অস্তিত্ব হয়তো তার গুরু জানতেনই না।
চিন্তার দুই মেরু: কাঁচের ঘর বনাম কাদা-মাটির পৃথিবী
এই বিদ্রোহের উৎস বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে হুসার্লের দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে ফিরে যেতে হবে। হুসার্লের দর্শন শুরু হয় এক বিশুদ্ধ, জগৎ-বিচ্ছিন্ন চেতনা বা অতীন্দ্রিয় অহং (Transcendental Ego) থেকে। এই অহং অনেকটা এক কাঁচের ঘরের ভেতর বসে থাকা বিজ্ঞানীর মতো। সে বাইরের জগৎকে দেখে, বিশ্লেষণ করে, কিন্তু জগৎ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এপোহে (Epoché) বা ব্র্যাকেটবন্দী করার মাধ্যমে এই অহং জগৎ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে এবং নিরাসক্তভাবে অভিজ্ঞতার গঠন পর্যবেক্ষণ করে। হুসার্লের জন্য, জগৎ হলো চেতনার সামনে হাজির হওয়া এক ‘বস্তু’ (object), যা বিশ্লেষণের বিষয়।
হাইডেগারের কাছে এই ধারণাটি ছিল এক বিরাট, মৌলিক ভুল। তিনি বললেন, এটা মানুষের অস্তিত্বের বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। মানুষ কখনোই জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো পর্যবেক্ষক নয়। আমরা কোনো কাঁচের ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে জগৎ দেখি না। আমরা জন্ম থেকেই জগতের ভেতরে আছি, জগতের কাদা-মাটি গায়ে মেখে আছি। আমাদের অস্তিত্বই হলো জগতের-ভেতরে-থাকা (In-der-Welt-sein / Being-in-the-world)। এই জগতের ভেতরে থাকাকেই হাইডেগার নাম দিলেন ডাজাইন (Dasein)।
Dasein একটি জার্মান শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ ‘সেখানে-থাকা’ (Being-there)। কিন্তু হাইডেগারের কাছে এর অর্থ আরও গভীর। ডাজাইন মানে শুধু কোনো চেয়ার বা টেবিলের মতো জগতের ‘ভেতরে’ থাকা নয়। ডাজাইন হলো সেই সত্তা, যার কাছে তার নিজের অস্তিত্বই একটি প্রশ্ন, একটি উদ্বেগের বিষয়। আমরা জগতে কেবল থাকিই না, আমরা আমাদের এই থাকাকে নিয়ে ভাবি, চিন্তা করি, ভয় পাই।
হাইডেগার বললেন, আমরা জগতে আমাদের নিজেদের ইচ্ছায় আসি না। আমরা জগতে নিক্ষিপ্ত (Geworfenheit / Thrownness) হই। আমরা নিজেদের জন্ম, সময়, সংস্কৃতি, ভাষা—কোনো কিছুই পছন্দ করে নিতে পারি না। আমরা চোখ খুলে দেখি, আমরা ইতিমধ্যেই এক বিশেষ পরিস্থিতিতে, এক বিশেষ জগতে পড়ে আছি। হুসার্লের অহং যেন এক স্বাধীন রাজা, যে তার ইচ্ছেমতো জগৎকে পর্যবেক্ষণ করে। আর হাইডেগারের ডাজাইন যেন এক কয়েদি, যে এক কারাগারের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে, যে কারাগার থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই, কারণ সেই কারাগারই তার অস্তিত্ব।
হাতুড়ির দর্শন: হুসার্লের ভুলটা কোথায়?
হাইডেগার এই পার্থক্য বোঝানোর জন্য এক অসাধারণ উদাহরণ ব্যবহার করলেন। ধরুন, একজন কাঠমিস্ত্রি একটি হাতুড়ি দিয়ে কাজ করছেন। যখন তিনি কাজে মগ্ন, তখন তিনি হাতুড়িটিকে একটি আলাদা ‘বস্তু’ হিসেবে ভাবেন না। হাতুড়িটি তার হাতেরই এক অংশ হয়ে যায়। এটি তার কাজের জন্য ‘হাজির-আছে’ বা ব্যবহারোপযোগী (Zuhanden / Ready-to-hand)। এটাই হলো জগতের সঙ্গে আমাদের স্বাভাবিক, মগ্ন সম্পর্ক।
কিন্তু যখন হাতুড়িটির মাথাটি ভেঙে যায় বা হাতলটি নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন কী হয়? তখন কাঠমিস্ত্রির মনোযোগ হাতুড়িটির দিকে যায়। তিনি সেটিকে একটি আলাদা ‘বস্তু’ হিসেবে দেখেন, যার নির্দিষ্ট কিছু গুণ আছে (যেমন ওজন, দৈর্ঘ্য, ভাঙা অংশ)। তখন হাতুড়িটি হয়ে যায় বিদ্যমান-বস্তু (Vorhanden / Present-at-hand)।
হাইডেগারের মতে, হুসার্লের পুরো দর্শনটাই হলো এই দ্বিতীয় প্রকারের, অর্থাৎ ‘বিদ্যমান-বস্তু’র দর্শন। হুসার্ল জগৎকে এমনভাবে দেখেন, যেন জগতের সবকিছুই ভেঙে গেছে, সবকিছুই আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক একটি গবেষণার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সেই মগ্ন, ক্রিয়াশীল, জগতের-সঙ্গে-একাত্ম-থাকা রূপটিকে ধরতে পারেননি। তিনি কাঠমিস্ত্রির কাজকে না দেখে, কেবল ভাঙা হাতুড়িটি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।
বিদ্রোহের পদ্ধতি: গুরুর অস্ত্রেই গুরুকে ঘায়েল
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, হাইডেগার তার গুরুর বিরুদ্ধে এই যে বিশাল বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, তার জন্য যে অস্ত্র তিনি ব্যবহার করলেন, তা ছিল হুসার্লেরই দেওয়া। হুসার্লের দর্শনের মূলমন্ত্র ছিল—”Zurück zu den Sachen selbst!” অর্থাৎ, “সরাসরি বিষয়ের কাছে ফিরে যাও!”
হাইডেগারও এই মন্ত্র অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। তিনি বললেন, “অবশ্যই, আমাদের সরাসরি বিষয়ের কাছে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু দর্শনের সবচেয়ে মৌলিক, সবচেয়ে আদি ‘বিষয়’ কোনটি?” হুসার্লের কাছে ‘বিষয়’ ছিল চেতনার কাছে প্রতিভাত হওয়া বস্তু। হাইডেগারের কাছে সেই আদি ‘বিষয়’ ছিল সত্তা (Being) নিজেই। এই যে সবকিছু ‘আছে’, এই ‘থাকা’ বা ‘হওয়া’ ব্যাপারটার মানে কী? দর্শনের ইতিহাসে প্লেটো থেকে শুরু করে সবাই ‘সত্তার’ (Beings) কথা বলেছে—অর্থাৎ চেয়ার, টেবিল, মানুষ, ঈশ্বর। কিন্তু এই সত্তাগুলো যে ‘আছে’, সেই ‘থাকা’ বা Being-কে সবাই ভুলে গেছে।
হাইডেগার হুসার্লের প্রতিভাসতাত্ত্বিক পদ্ধতিটিকেই ব্যবহার করলেন সত্তার রহস্য উন্মোচনের জন্য। তিনি সত্তার প্রতিভাস নিয়ে কাজ করলেন। তিনি ডাজাইনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা (যেমন উদ্বেগ, ভয়, মৃত্যুচিন্তা) বিশ্লেষণ করে সত্তার অর্থের গভীরে পৌঁছাতে চাইলেন। এককথায়, হাইডেগার হুসার্লের দেওয়া টর্চলাইটটি নিয়েই তার গুরুর দেখানো চেতনার আলোকিত রাজপথ ছেড়ে, সত্তার অন্ধকার, গহীন অরণ্যে যাত্রা করেছিলেন। তিনি হুসার্লের পদ্ধতিকে আরও মৌলিক এক প্রশ্নের দিকে চালিত করলেন।
সুতরাং, হাইডেগারের যুগান্তকারী গ্রন্থ বিইং অ্যান্ড টাইম (Being and Time) হুসার্লের প্রতি এক বিশাল ঋণ এবং একই সাথে এক গভীর সমালোচনার দলিল। এটি হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্ব ছাড়া যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি এটিকে হুসার্লের দর্শনের একটি চরম বিরোধিতা হিসেবেও দেখা যায়। হাইডেগার তার গুরুর কাঁধে চড়েই এক নতুন আকাশ দেখেছিলেন, যে আকাশ তার গুরুর কল্পনারও অতীত ছিল। এই জটিল, নাটকীয় এবং ফলপ্রসূ সম্পর্কই বিংশ শতাব্দীর দর্শনের গতিপথকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিল।
প্যারিসের পথ ধরে অস্তিত্ববাদের জন্ম: কাফে, সিগারেট আর স্বাধীনতার দর্শন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছাই থেকে যখন ইউরোপ আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন জার্মানির নিভৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনের এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল প্যারিসের রাস্তায়, তার কাফেগুলোতে, আর তরুণ প্রজন্মের সিগারেটের ধোঁয়ায়। সেই ঢেউয়ের নাম ছিল প্রতিভাসতত্ত্ব (Phenomenology)। কিন্তু ফরাসি মনের ছোঁয়ায় এসে এই জার্মান দর্শন তার কঠোর, অ্যাকাডেমিক খোলস ছেড়ে এক নতুন, নাটকীয় এবং উত্তাল রূপ নিল। জন্ম হলো এক নতুন দর্শনের, যার নাম অস্তিত্ববাদ (Existentialism)। ফরাসি অস্তিত্ববাদীরা হুসার্ল এবং হাইডেগারের কাছ থেকে ধার নিলেন তাদের যন্ত্রপাতি, কিন্তু সেই যন্ত্রপাতি দিয়ে তারা এমন এক ইমারত গড়লেন, যা দেখে হয়তো তাদের জার্মান গুরুরাও চমকে যেতেন।
১. জ্যাঁ-পল সার্ত্র: শূন্যতার স্বাধীনতা এবং অন্যের নরক
জ্যাঁ-পল সার্ত্র ছিলেন এই নতুন ধারার অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং রাজনৈতিক কর্মী। যুদ্ধবন্দী হিসেবে জার্মানিতে থাকার সময় তিনি হুসার্ল এবং হাইডেগারের লেখার সঙ্গে পরিচিত হন এবং এক নতুন জগতের সন্ধান পান।
সার্ত্র হুসার্লের ইনটেনশনালিটি (Intentionality) বা ‘চেতনা সবসময় কোনো কিছুর চেতনা’—এই ধারণাটিকে তার দর্শনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করলেন। তার কাছে এই ধারণাটি ছিল এক মুক্তির বার্তা। এর মানে হলো, চেতনা কখনোই নিজের মধ্যে আবদ্ধ নয়, সে সবসময় জগতের দিকে ছুটে যায়, জগতের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। কিন্তু এখানেই তিনি হুসার্লের সঙ্গে তার সবচেয়ে বড় বিচ্ছেদটি ঘটালেন। হুসার্ল যেখানে চেতনার পেছনে এক সাক্ষী বা চালক হিসেবে অতীন্দ্রিয় অহং (Transcendental Ego)-কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সার্ত্র তাকে নির্মমভাবে বাতিল করে দিলেন।
সার্ত্র তার যুগান্তকারী গ্রন্থ বিইং অ্যান্ড নাথিংনেস (Being and Nothingness)-এ ঘোষণা করলেন, চেতনা আসলে কিছুই নয়, এক বিরাট শূন্যতা (le Néant / Nothingness)। চেয়ার বা টেবিলের মতো চেতনার কোনো জমাট, স্থির সত্তা নেই। সে হলো এক বিশুদ্ধ স্বচ্ছতা, এক অনন্ত ছুটে চলা। আর আমাদের অহং (ego)? সেটা চেতনার পেছনে লুকিয়ে থাকা কোনো গোপন চালক নয়। আমাদের অহং তৈরি হয় জগতের মধ্যে, আমাদের কাজের মাধ্যমে, আমাদের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, অন্যের চোখে আমরা যা, তার মাধ্যমে।
এই ‘শূন্যতা’র ধারণাটিই সার্ত্রের স্বাধীনতার দর্শনের চাবিকাঠি। যেহেতু চেতনা নিজে কিছুই নয়, তাই সে যেকোনো কিছু হতে পারে। আমাদের কোনো পূর্বনির্ধারিত সারসত্তা (essence) নেই। আমরা প্রথমে জগতে আসি, তারপর আমাদের কাজের মাধ্যমে, আমাদের পছন্দের মাধ্যমে আমরা নিজেদের তৈরি করি। এটাই তার বিখ্যাত উক্তিটির মূল কথা: “অস্তিত্ব সারসত্তার আগে” (Existence precedes essence)। একটি ছুরি বানানোর আগে তার কারিগর জানেন ছুরিটির কাজ কী হবে, তার সারসত্তা কী। কিন্তু মানুষের কোনো কারিগর নেই। তাই মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন, সে নিজেই নিজের স্রষ্টা। এই স্বাধীনতা এক বিরাট বোঝা। কারণ আমাদের প্রতিটি কাজের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। এই কারণেই সার্ত্র বলেন, “মানুষ স্বাধীন হতে বাধ্য” (Man is condemned to be free)।
সার্ত্র হুসার্লের আরেকটি ধারণাকে এক নাটকীয় রূপ দেন—আন্তঃবিষয়কতা (Intersubjectivity)। হুসার্ল যেখানে অন্যকে বোঝার প্রক্রিয়াকে এক সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন, সার্ত্র তাকে এক অনন্ত দ্বন্দ্ব হিসেবে চিত্রিত করলেন। তার মতে, ‘অন্যের দৃষ্টি’ (The Look of the Other) আমাকে একটি বস্তুতে পরিণত করে। যখন অন্য কেউ আমার দিকে তাকায়, তখন আমি আর স্বাধীন কর্তা থাকি না, আমি তার চোখে একটি বিচার্য ‘বস্তু’ হয়ে যাই। আমার স্বাধীনতা তার দৃষ্টির সামনে জমে বরফ হয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই তিনি তার বিখ্যাত নাটক নো এক্সিট (No Exit)-এ সেই ভয়ঙ্কর লাইনটি লিখেছিলেন: “নরক হলো অন্য মানুষ” (Hell is other people)।
এভাবেই সার্ত্র হুসার্লের দেওয়া দার্শনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এমন এক জগৎ আঁকলেন যা অন্ধকার, উদ্বেগপূর্ণ, কিন্তু একই সাথে স্বাধীনতার আলোয় উজ্জ্বল।
২. সিমোন দ্য বোভোয়ার: নারী হয়ে ওঠার প্রতিভাস
সার্ত্রের জীবনসঙ্গী এবং নিজে একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার (Simone de Beauvoir) দেখালেন যে, প্রতিভাসতাত্ত্বিক পদ্ধতি কেবল বিমূর্ত দর্শনের বিষয় নয়, একে রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। তিনি এই পদ্ধতিকে প্রয়োগ করলেন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে গভীর একটি সমস্যায়—নারীর অবস্থানে।
তার কালজয়ী গ্রন্থ দ্য সেকেন্ড সেক্স (The Second Sex)-এর সেই অমর লাইনটি— “কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠে” (One is not born, but rather becomes, a woman)—আসলে এক গভীর প্রতিভাসতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ। বোভোয়ার এখানে সার্ত্রের ‘অস্তিত্ব সারসত্তার আগে’—এই সূত্রটিকেই প্রয়োগ করছেন। তিনি বলছেন, ‘নারী’ কোনো জৈবিক বা প্রাকৃতিক সারসত্তা নয়। এমন কোনো শাশ্বত ‘নারীত্ব’ নেই যা সব নারীর মধ্যে পাওয়া যাবে।
তাহলে ‘নারী’ কীভাবে তৈরি হয়? বোভোয়ার প্রতিভাসতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে নারীর ‘জীবন্ত অভিজ্ঞতা’ (lived experience) বিশ্লেষণ করে দেখালেন। তিনি দেখালেন, জন্ম থেকেই একটি মেয়েকে কীভাবে সমাজ, পরিবার, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং পুরুষের দৃষ্টি ধীরে ধীরে ‘নারী’ নামক সত্তায় পরিণত করে। তাকে শেখানো হয় সে নিষ্ক্রিয়, সে অন্যের জন্য, সে প্রকৃতি। তাকে ‘অন্য’ (the Other) হিসেবে গঠন (constitute) করা হয়, আর পুরুষ হয় কর্তা, পরম (the Absolute)।
বোভোয়ারের এই বিশ্লেষণ হলো হুসার্লের ‘গঠন’ (constitution) এবং ‘জীবন-জগৎ’ (Lebenswelt) ধারণার এক অসাধারণ নারীবাদী প্রয়োগ। তিনি কোনো বিমূর্ত তত্ত্ব থেকে শুরু করেননি। তিনি শুরু করেছেন নারীর দৈনন্দিন জীবন, তার শরীর, তার বয়ঃসন্ধি, তার যৌনতা, তার মাতৃত্ব, তার বার্ধক্য—এইসব মূর্ত, জীবন্ত অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি দেখালেন, কীভাবে এই অভিজ্ঞতাগুলো একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ‘জীবন-জগতে’র মধ্যে অর্থ লাভ করে এবং একজন মানুষকে ‘নারী’ হিসেবে তৈরি করে। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি কেবল নারীর অবস্থাকেই ব্যাখ্যা করেননি, তিনি মুক্তির পথও দেখিয়েছেন। যদি ‘নারী’ একটি নির্মাণ হয়, তবে তাকে পুনর্নির্মাণও করা সম্ভব।
৩. মরিস মের্লো-পন্টি: শরীরের প্রজ্ঞা এবং জগতের মাংস
ফরাসি অস্তিত্ববাদীদের মধ্যে যিনি হুসার্লের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং একই সাথে সবচেয়ে সৃজনশীল অনুসারী ছিলেন, তিনি হলেন মরিস মের্লো-পন্টি (Maurice Merleau-Ponty)। তিনি হাইডেগার বা সার্ত্রের মতো হুসার্লের চিন্তাকে সরাসরি বাতিল করেননি। বরং তিনি হুসার্লের শেষ জীবনের চিন্তা, বিশেষ করে তার ‘জীবন-জগৎ’ এবং ‘জীবন্ত শরীর’ (Leib)-এর ধারণাকে তার দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে নিয়ে এলেন এবং তাকে এক নতুন, কাব্যিক রূপ দিলেন।
মের্লো-পন্টি বললেন, পশ্চিমা দর্শন দেকার্তের সময় থেকে এক বিরাট ভুল করে আসছে। তারা মন এবং শরীরকে দুটি আলাদা সত্তা হিসেবে দেখেছে। হুসার্লও এই ভুলের ঊর্ধ্বে নন, কারণ তার অতীন্দ্রিয় অহং শেষ পর্যন্ত এক অশরীরী চেতনাই থেকে যায়। মের্লো-পন্টি এই দ্বৈতবাদকে ভাঙতে চাইলেন। তিনি বললেন, আমাদের চেতনার মূল কেন্দ্র কোনো বিমূর্ত মন বা অহং নয়। আমাদের চেতনার কেন্দ্র হলো আমাদের জীবন্ত, ক্রিয়াশীল শরীর (le corps propre / the lived body)।
আমরা জগৎকে মন দিয়ে জানি না, আমরা জগৎকে আমাদের শরীর দিয়ে জানি। আমাদের হাত দিয়ে কোনো কিছু স্পর্শ করার অভিজ্ঞতা, আমাদের চোখ দিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা—এগুলোই হলো জ্ঞানের আদি রূপ। আমার শরীর কোনো বস্তু নয়, যা আমি বাইরে থেকে দেখি। আমার শরীর হলো সেই ‘শূন্য বিন্দু’ (zero-point) যা থেকে আমি জগৎকে অভিজ্ঞতা করি। শরীর জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং শরীরই হলো জগতের সাথে আমাদের সংযোগের সেতু। তিনি দেখালেন, হুসার্ল যেটাকে ‘মন’ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন, তার অনেক কিছুরই উৎস আসলে আমাদের শরীরের প্রজ্ঞার (bodily wisdom) মধ্যে নিহিত।
তার শেষ জীবনের অসমাপ্ত কাজে মের্লো-পন্টি আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি বলেন, শরীর এবং জগৎ একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িত যে, তাদের আলাদা করা যায় না। তারা যেন একই ‘মাংস’ বা ‘flesh’ (la chair) দিয়ে তৈরি। জগৎ আমাকে দেখে, যেমন আমি জগৎকে দেখি। আমার শরীর জগতেরই এক ভাঁজ, আর জগৎ আমার শরীরেরই এক প্রসারণ। এই কাব্যিক এবং গভীর ধারণার মাধ্যমে মের্লো-পন্টি হুসার্লের অসমাপ্ত কাজকে এক নতুন দিকে নিয়ে গেলেন, যা জ্ঞানতত্ত্ব, শিল্পকলা এবং মনোবিজ্ঞানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
এভাবেই প্যারিসের পথ ধরে হুসার্লের দর্শন এক নতুন জীবন লাভ করেছিল। সার্ত্র, বোভোয়ার এবং মের্লো-পন্টি—এই ত্রয়ী হুসার্লের দেওয়া বীজকে ফরাসি মাটির উর্বরতায় এক নতুন, বর্ণময় এবং কাঁটাযুক্ত গাছে পরিণত করেছিলেন, যার ফল আজও আমাদের ভাবনার জগৎকে পুষ্ট করে চলেছে।
দর্শনের বাইরে যখন ছড়ালো আলো: হুসার্লের পদচিহ্ন সমাজ ও মননে
এডমুন্ড হুসার্ল যখন তার দর্শনকে একটি ‘কঠোর বিজ্ঞান’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তখন তিনি হয়তো ভাবেননি যে তার চিন্তার ঢেউ একদিন দর্শনের সুরক্ষিত সীমানা পেরিয়ে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সাহিত্য, এমনকি আইনশাস্ত্রের মতো ক্ষেত্রকেও প্লাবিত করবে। তিনি যে সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরি করেছিলেন অভিজ্ঞতার জগৎকে ব্যবচ্ছেদ করার জন্য, তা অন্যান্য ক্ষেত্রের গবেষকদের হাতে পড়ে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। তারা বুঝতে পারেন, হুসার্লের পদ্ধতি কেবল বিমূর্ত সত্তার বিশ্লেষণে নয়, বরং মানব জীবনের মূর্ত, জটিল সমস্যাগুলো বোঝার ক্ষেত্রেও এক শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
১. সমাজবিজ্ঞান: সামাজিক বাস্তবতার অদৃশ্য বুনন
সমাজবিজ্ঞানের মূল প্রশ্নগুলোর একটি হলো: সমাজ কীভাবে টিকে থাকে? কীভাবে লক্ষ লক্ষ ভিন্ন ভিন্ন মানুষ মিলেমিশে একটি সুসংহত জগৎ তৈরি করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ভিয়েনার সমাজবিজ্ঞানী আলফ্রেড শুটজ (Alfred Schutz) হুসার্লের দর্শনের মধ্যে এক নতুন পথের সন্ধান পান।
শুটজ হুসার্লের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন এবং তার সঙ্গে চিঠি চালাচালিও করতেন। তিনি বুঝতে পারেন, হুসার্লের শেষ জীবনের চিন্তা, বিশেষ করে জীবন-জগৎ (Lebenswelt) এবং আন্তঃবিষয়কতা (Intersubjectivity) ধারণা দুটি সামাজিক জগৎকে বোঝার চাবিকাঠি। শুটজ প্রশ্ন তোলেন, আমরা কীভাবে একে অপরকে বুঝতে পারি? আমি যখন রাস্তায় একজন পোস্টম্যানকে দেখি, তখন তাকে কেবল একটি চলমান শরীর হিসেবে দেখি না, আমি তাকে একজন ‘পোস্টম্যান’ হিসেবে দেখি এবং আশা করি যে তিনি চিঠি বিলি করবেন। এই সাধারণ বোঝাপড়াটা কীভাবে সম্ভব হয়?
এর উত্তরে শুটজ হুসার্লের জীবন-জগতের ধারণাটিকে ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, আমরা সবাই একটি সাধারণ, আগে থেকে বিদ্যমান ‘জীবন-জগতে’ বাস করি। এই জগৎটি আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ভাষার দ্বারা গঠিত। এই জগৎটি আমাদের একটি সাধারণ ‘জ্ঞানের ভাণ্ডার’ (stock of knowledge at hand) দেয়, যা আমরা সবাই কমবেশি ভাগ করে নিই। এই জ্ঞানের ভাণ্ডারেই লেখা থাকে যে, পোস্টম্যানরা চিঠি বিলি করেন, দোকানে গেলে টাকা দিয়ে জিনিস কিনতে হয়, বা লাল বাতি দেখলে রাস্তা পার হতে নেই। আমরা এই নিয়মগুলো নিয়ে প্রশ্ন করি না, এগুলোকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে মেনে নিই।
শুটজের মতে, সামাজিক বাস্তবতা কোনো বস্তুনিষ্ঠ, বাইরের কাঠামো নয়, যেমনটা এমিল ডুর্খাইমের মতো সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করতেন। বরং সামাজিক বাস্তবতা প্রতিনিয়ত আমাদের সম্মিলিত চেতনার মাধ্যমে, আমাদের দৈনন্দিন আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি ও টিকিয়ে রাখা হয়। আমরা আমাদের কাজের মাধ্যমে এই জগৎকে যেমন তৈরি করি, তেমনি এই জগৎও আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
শুটজের এই প্রতিভাসতাত্ত্বিক সমাজবিজ্ঞান (Phenomenological Sociology) পরবর্তীতে আমেরিকার সমাজবিজ্ঞানে দুটি প্রভাবশালী ধারার জন্ম দেয়:
-
এথনোমেথোডোলজি (Ethnomethodology): হ্যারল্ড গার্ফিঙ্কেল (Harold Garfinkel) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই ধারাটি অনুসন্ধান করে যে, সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে কোন কোন অলিখিত পদ্ধতি বা নিয়ম ব্যবহার করে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখে। তারা প্রায়ই অদ্ভুত সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা (breaching experiments) করতেন, যেমন দোকানে গিয়ে জিনিসের দাম নিয়ে দরাদরি করা, বা বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাড়াটিয়ার মতো আচরণ করা—শুধু এটা দেখার জন্য যে, আমাদের এই অলিখিত নিয়মগুলো ভাঙলে সামাজিক বাস্তবতা কীভাবে ভেঙে পড়ে।
-
সিম্বলিক ইন্টারেকশনিজম (Symbolic Interactionism): হার্বার্ট ব্লুমার এবং এরভিং গফম্যানের মতো সমাজবিজ্ঞানীরা দেখান যে, সমাজ তৈরি হয় প্রতীকী মিথস্ক্রিয়ার (symbolic interaction) মাধ্যমে। আমাদের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি কথা, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি এক একটি প্রতীক, যার মাধ্যমে আমরা একে অপরের কাছে অর্থ পৌঁছে দিই। গফম্যান দেখান, আমাদের সামাজিক জীবনটা অনেকটা মঞ্চে অভিনয়ের মতো, যেখানে আমরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ‘ভূমিকা’ পালন করি।
এভাবেই হুসার্লের দর্শন সমাজবিজ্ঞানীদের শিখিয়েছে, সমাজের বড় বড় কাঠামো (যেমন রাষ্ট্র, অর্থনীতি) বোঝার আগে আমাদের দেখতে হবে কীভাবে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিদিনের জীবনে সেই সমাজকে নির্মাণ করে চলেছে।
২. মনোবিজ্ঞান: তত্ত্বের খোলস ছেড়ে অভিজ্ঞতার কাছে ফেরা
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মনোবিজ্ঞানের জগৎ দুটি বড় তত্ত্ব দ্বারা শাসিত ছিল: ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ (Psychoanalysis), যা মানুষের আচরণকে তার অবচেতন মনের গভীর, অন্ধকার তাড়না দ্বারা ব্যাখ্যা করত; এবং আচরণবাদ (Behaviorism), যা মনকে একটি ‘ব্ল্যাক বক্স’ হিসেবে দেখে কেবল পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণ নিয়েই কাজ করত।
এই দুই ধারার বিরুদ্ধেই প্রতিভাসতাত্ত্বিক মনোবিজ্ঞান (Phenomenological Psychology) এক নতুন তৃতীয় পথ খুলে দেয়। আমেদেও জিওরজি (Amedeo Giorgi) এবং কার্ল রজার্সের (Carl Rogers) মতো মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের মনকে বোঝার জন্য কোনো পূর্বনির্ধারিত তত্ত্ব চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। একজন মানুষ যখন হতাশায় ভোগে, তখন তাকে ফ্রয়েডের কোনো তত্ত্বের ছাঁচে ফেলা বা তার আচরণকে কেবল উদ্দীপনা-প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে দেখাটা তার প্রতি অবিচার।
প্রতিভাসতাত্ত্বিক মনোবিজ্ঞানীদের মূলমন্ত্রটি ছিল বিশুদ্ধ হুসার্লীয়—‘অভিজ্ঞতার কাছে ফিরে যাও’। তাদের মতে, মনোবিজ্ঞানীর প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো রোগীর বা ব্যক্তির নিজস্ব, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জগতে প্রবেশ করা এবং সেই অভিজ্ঞতাকে তার নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা। একে বলা হয় সহানুভূতিমূলক বোঝা (Empathic Understanding)। মনোবিজ্ঞানী তার নিজের তত্ত্ব, নিজের পূর্বধারণাকে ‘ব্র্যাকেটবন্দী’ করে রোগীর কথা শোনেন। রোগীর জগৎ তার কাছে যেভাবে প্রতিভাত হচ্ছে, তার হতাশা, তার ভয়, তার আনন্দ—সেই ‘জীবন্ত অভিজ্ঞতা’টিকেই তারা বোঝার চেষ্টা করেন।
এই ধারাটি মানবতাবাদী মনোবিজ্ঞানের (Humanistic Psychology) বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখে। এটি মনোবিজ্ঞানের ফোকাসকে অসুস্থতা থেকে সরিয়ে এনে মানুষের বৃদ্ধি, সৃজনশীলতা এবং আত্ম-উপলব্ধির দিকে নিয়ে আসে। এটি আমাদের শিখিয়েছে, প্রতিটি মানুষই তার নিজের অভিজ্ঞতার জগতের কেন্দ্রবিন্দু এবং সেই জগৎকে সম্মান করাটাই হলো তাকে বোঝার প্রথম শর্ত।
৩. সাহিত্য সমালোচনা: পাঠকের জন্ম এবং লেখকের মৃত্যু
সাহিত্য সমালোচনার জগতেও হুসার্লের প্রভাব এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছিল। চিরাচরিত সাহিত্য সমালোচনায় একটি লেখার অর্থ খোঁজা হতো হয় লেখকের জীবনী ও উদ্দেশ্যের মধ্যে, নয়তো টেক্সটের ভেতরের ভাষাগত ও শৈলীগত গঠনের মধ্যে। পাঠক ছিলেন একজন নিষ্ক্রিয় গ্রাহক, যার কাজ হলো লেখকের রেখে যাওয়া অর্থটিকে আবিষ্কার করা।
কিন্তু ষাটের দশকে জার্মানিতে ‘রিডার-রেসপন্স ক্রিটিসিজম’ (Reader-Response Criticism) নামক এক নতুন ধারার জন্ম হয়, যার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন ভলফগ্যাং আইজার (Wolfgang Iser) এবং হান্স-রবার্ট ইয়াউস (Hans-Robert Jauss)। তাদের চিন্তার পেছনে হুসার্ল এবং তার শিষ্য রোমান ইনগারডেনের (Roman Ingarden) প্রভাব ছিল অপরিসীম।
এই সমালোচকরা বলেন, একটি সাহিত্যকর্মের অর্থ কেবল লেখকের উদ্দেশ্য বা টেক্সটের ভেতরে স্থির হয়ে থাকে না। একটি বইয়ের কালো অক্ষরগুলো কেবল কিছু সংকেত। সেই সংকেতগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে, অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে পাঠকের চেতনায়। পাঠক যখন পড়েন, তখন তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এবং কল্পনা দিয়ে টেক্সটের ফাঁক-ফোকরগুলো (gaps) পূরণ করেন। লেখকের তৈরি করা জগতের সঙ্গে পাঠকের জগৎ মিলেমিশে এক নতুন, অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি হয়।
সুতরাং, পাঠক নিষ্ক্রিয় গ্রাহক নন, পাঠক সক্রিয়ভাবে অর্থ নির্মাণে অংশ নেন। এখানেও আমরা হুসার্লের ‘গঠন’ (constitution) এবং ‘ইনটেনশনালিটি’ ধারণার স্পষ্ট প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। একটি সাহিত্যকর্ম হলো একটি ‘নোয়েমা’, যা লেখকের তৈরি করা টেক্সট (নোয়েসিস) এবং পাঠকের সক্রিয় চেতনা (নোয়েসিস)-এর মিলনে গঠিত হয়। একই ‘ডন কিহোতে’ উপন্যাস ষোড়শ শতকের একজন স্প্যানিশ পাঠকের চেতনায় যেভাবে গঠিত হবে, একবিংশ শতকের একজন বাঙালি পাঠকের চেতনায় তা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে গঠিত হতে পারে।
এই তত্ত্বটি সাহিত্য সমালোচনার জগতে ‘লেখকের মৃত্যু’ এবং ‘পাঠকের জন্ম’ ঘোষণা করে। এটি দেখায় যে, একটি টেক্সট তার পাঠকদের মাধ্যমেই বারবার নতুন করে জীবন লাভ করে, যা হুসার্লের প্রতিভাসতত্ত্বের এক সুদূরপ্রসারী এবং সৃজনশীল প্রয়োগ।
আজকের দিনের প্রতিধ্বনি
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, একশ বছরেরও বেশি সময় পরেও হুসার্লের চিন্তা আজকের দিনের অত্যাধুনিক গবেষণাক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
কগনিটিভ সায়েন্স: শরীরী মন (Embodied Mind)
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কগনিটিভ সায়েন্সের জগতে ‘মস্তিষ্ক হলো একটি কম্পিউটার’—এই ধারণাটি প্রভাবশালী ছিল। এই মডেল অনুযায়ী, মন হলো একটি সফটওয়্যার যা মস্তিষ্কের হার্ডওয়্যারে চলে। কিন্তু গত কয়েক দশকে এই মডেলটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এক নতুন ধারার জন্ম হয়েছে, যার নাম এনঅ্যাক্টিভিজম (Enactivism) বা শরীরী জ্ঞান (Embodied Cognition)।
এই নতুন ধারার বিজ্ঞানীরা বলছেন, মন কেবল মস্তিষ্কের ভেতরে থাকা কোনো বস্তু নয়। মন হলো মস্তিষ্ক, শরীর এবং পরিবেশের অবিরাম আদান-প্রদানের ফল। আমাদের জ্ঞান তৈরি হয় জগতের সাথে আমাদের শারীরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। এই ধারণাটি আশ্চর্যজনকভাবে মের্লো-পন্টির ‘জীবন্ত শরীর’ এবং হুসার্লের ‘জীবন-জগৎ’ ধারণার কাছাকাছি। কগনিটিভ সায়েন্সের এই গবেষকরা এখন একশ বছর আগের দার্শনিকদের লেখায় তাদের তত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছেন (Varela, Thompson, & Rosch, 1991)।
সেই নিভৃত বিপ্লবীর জয়
এডমুন্ড হুসার্ল হয়তো চেয়েছিলে দর্শনকে এক কঠোর বিজ্ঞানে পরিণত করতে, যার থাকবে এক অভ্রান্ত ভিত্তি। সেই স্বপ্ন হয়তো পুরোপুরি সফল হয়নি। তার নিজের ছাত্ররাই সেই ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি যা তৈরি করে গেছেন, তা হয়তো তার স্বপ্নের চেয়েও বড় কিছু। তিনি কোনো বদ্ধ ইমারত তৈরি করেননি, তিনি তৈরি করেছেন এক খোলা ময়দান আর কিছু অসাধারণ যন্ত্রপাতি।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার দিকে তাকাতে হয়, কীভাবে আমাদের পূর্বধারণাগুলোকে প্রশ্ন করতে হয়, কীভাবে জগতের অর্থ আমাদের চেতনার মাধ্যমেই তৈরি হয়। এই পদ্ধতিটিই হয়ে উঠেছে তার সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার। হাইডেগার সেই যন্ত্রপাতি দিয়ে সত্তার রহস্য ভেদ করতে চেয়েছেন, সার্ত্র খুঁজেছেন স্বাধীনতার উৎস, বোভোয়ার আবিষ্কার করেছেন নারীত্বের নির্মাণ, আর আজকের বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন মনের প্রকৃতি।
সবাই সেই একই নিভৃত বিপ্লবীর কাছে ঋণী। তিনি হয়তো আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার চিন্তার পদচিহ্ন রয়ে গেছে দর্শনের প্রতিটি বাঁকে, ভাবনার প্রতিটি নতুন পথে। একাকী পড়ার ঘরে শুরু হওয়া সেই নীরব বিপ্লব আজও আমাদের চিন্তা করার, দেখার এবং বোঝার পদ্ধতিকে বদলে দিয়ে চলেছে। এখানেই হুসার্লের আসল জয়।
হুসার্লের উত্তরাধিকার এবং আমাদের আজকের দিনের প্রাসঙ্গিকতা
এডমুন্ড হুসার্ল নামের সেই জেদি গোয়েন্দা কি তার অনুসন্ধানে সফল হয়েছিলেন? তিনি কি পেরেছিলেন দর্শনের জন্য সেই অভ্রান্ত ভিত্তি খুঁজে বের করতে?
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। অনেকেই তার সমালোচনা করেছেন। তার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র মার্টিন হাইডেগারই যেমন বলেছেন যে, হুসার্ল চেতনাকে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। হুসার্লের অতীন্দ্রিয় অহং যেন এক খাঁচায় বন্দী পাখির মতো জগৎকে বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করে। হাইডেগারের মতে, মানুষ কখনোই জগতের বাইরে নয়; মানুষ জন্ম থেকেই জগতের ভেতরে নিক্ষিপ্ত (Being-in-the-world বা Dasein)। আমাদের অস্তিত্ব জগৎ থেকে অবিচ্ছেদ্য। চেতনা আগে নয়, অস্তিত্বই আগে।
জ্যাঁ-পল সার্ত্রের মতো অস্তিত্ববাদীরাও তার অতীন্দ্রিয় অহং-এর ধারণাকে গ্রহণ করতে পারেননি। সার্ত্র মনে করতেন, অহং চেতনার পেছনে লুকিয়ে থাকা কোনো সত্তা নয়, বরং এটি জগতের মধ্যেই গঠিত হয়। মরিস মের্লো-পন্টি হুসার্লের জীবন-জগতের ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলেছেন যে, আমাদের চেতনার মূল কেন্দ্র কোনো বিমূর্ত অহং নয়, বরং আমাদের জীবন্ত, ক্রিয়াশীল শরীর (lived body)। আমাদের শরীরই জগৎকে জানার প্রাথমিক মাধ্যম।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এপোহে কি আদৌ পুরোপুরি সম্ভব? আমরা কি সত্যিই আমাদের সব বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও ভাষাগত সংস্কারকে ব্র্যাকেটবন্দী করতে পারি? হয়তো পারি না। আমরা সবসময়ই একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির মধ্যে থাকি, যা থেকে পুরোপুরি বের হওয়া অসম্ভব।
সমালোচনা সত্ত্বেও, হুসার্লের প্রভাব বিশাল এবং দীর্ঘস্থায়ী। তিনি বিংশ শতাব্দীর দর্শনের গতিপথ চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছেন। তাকে ছাড়া হাইডেগার, সার্ত্র, সিমোন দ্য বোভোয়ার, মের্লো-পন্টি, জাক দেরিদা, এমানুয়েল লেভিনাস—কারও চিন্তাই কল্পনা করা যায় না। অস্তিত্ববাদ (Existentialism), জ্ঞানতত্ত্ব (Hermeneutics), সমালোচনামূলক তত্ত্ব (Critical Theory), সমাজবিজ্ঞান (Sociology), মনোবিজ্ঞান (Psychology) এমনকি আধুনিক কগনিটিভ সায়েন্সের (Cognitive Science) উপরেও তার প্রতিভাসতত্ত্বের গভীর ছাপ রয়ে গেছে। আলফ্রেড শুটজ হুসার্লের জীবন-জগতের ধারণাকে ব্যবহার করে সামাজিক জগতের প্রতিভাসতত্ত্ব গড়ে তুলেছেন। আধুনিক কগনিটিভ সায়েন্সে ‘এনঅ্যাক্টিভিজম’ (Enactivism) নামক ধারাটি হুসার্লের শরীর ও পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ধারণার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।
কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য হুসার্লের দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? তার এই জটিল তত্ত্ব আমাদের কী কাজে লাগবে?
হয়তো হুসার্ল আমাদের কোনো সরাসরি উত্তর দিয়ে যাননি। কিন্তু তিনি আমাদের একটি নতুন উপায়ে দেখতে শিখিয়েছেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার দিকে মনোযোগ দিতে। এই যে প্রতিদিনের অতি সাধারণ ঘটনা—এক কাপ চা খাওয়া, বন্ধুর সাথে গল্প করা, বাসে করে বাড়ি ফেরা—এগুলোর প্রতিটিকে নতুন চোখে দেখার এক আশ্চর্য পদ্ধতি তিনি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন আমাদের পূর্বধারণাগুলোকে প্রশ্ন করতে এবং জগৎকে সতেজ, বিস্ময়কর দৃষ্টিতে দেখতে, যেন আমরা প্রথমবার দেখছি। একে বলা যায় এক ধরনের দার্শনিক সারল্য ফিরে পাওয়া।
হুসার্লের দর্শন আমাদের শেখায়, জগৎটাকে শুধু গ্রহণ না করে, তাকে প্রশ্ন করতে। নিজের চেতনাকে একটি রহস্যময় গবেষণাগার হিসেবে দেখতে। তিনি আমাদের সেই দর্পণের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন, যার ওপারে রয়েছে আমাদের নিজেদেরই চেতনার এক অজানা, গহীন অরণ্য। সেই অরণ্যে যাত্রা করা হয়তো কঠিন, কিন্তু নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর।
তথ্যসূত্র
- Adorno, T. W., & Horkheimer, M. (2002). Dialectic of enlightenment: Philosophical fragments (E. Jephcott, Trans.). Stanford University Press. (Original work published 1947).
- Al-Ghazali, A. H. (1953). Al-Ghazali’s “The Confessions”: Al-Munqidh min al-dalal (C. Field, Trans.). George Allen & Unwin.
- Bryant, E. F. (2009). The Yoga Sūtras of Patañjali: A new edition, translation, and commentary. North Point Press.
- Chittick, W. C. (1989). The Sufi path of knowledge: Ibn al-‘Arabi’s metaphysics of imagination. State University of New York Press.
- Descartes, R. (1984). The philosophical writings of Descartes (Vol. 2; J. Cottingham, R. Stoothoff, & D. Murdoch, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1641).
- Deutsch, E. (1973). Advaita Vedānta: A philosophical reconstruction. University of Hawaii Press.
- Dreyfus, G. B. J. (1997). Recognizing reality: Dharmakīrti’s philosophy and its Tibetan interpretations. State University of New York Press.
- Føllesdal, D. (1999). Husserl’s phenomenology. In R. H. Popkin (Ed.), The Columbia history of Western philosophy (pp. 675-683). Columbia University Press.
- Gallagher, S., & Zahavi, D. (2012). The phenomenological mind (2nd ed.). Routledge.
- Garfield, J. L. (Trans.). (1995). The fundamental wisdom of the middle way: Nāgārjuna’s Mūlamadhyamakakārikā. Oxford University Press.
- Heidegger, M. (1962). Being and time (J. Macquarrie & E. Robinson, Trans.). Harper & Row.
- Husserl, E. (1960). Cartesian meditations: An introduction to phenomenology (D. Cairns, Trans.). Martinus Nijhoff.
- Husserl, E. (1970a). Logical investigations (Vols. 1-2; J. N. Findlay, Trans.). Routledge & Kegan Paul.
- Husserl, E. (1970b). The crisis of European sciences and transcendental phenomenology: An introduction to phenomenological philosophy (D. Carr, Trans.). Northwestern University Press.
- Husserl, E. (1983). Ideas pertaining to a pure phenomenology and to a phenomenological philosophy, first book: General introduction to a pure phenomenology (F. Kersten, Trans.). Kluwer Academic Publishers. (Original work published 1913).
- Husserl, E. (1960). Cartesian meditations: An introduction to phenomenology (D. Cairns, Trans.). Martinus Nijhoff. (Original work published 1931).
- Husserl, E. (1970). The crisis of European sciences and transcendental phenomenology: An introduction to phenomenological philosophy (D. Carr, Trans.). Northwestern University Press. (Original work published 1936).
- Kellner, B. (Ed.). (1976). Shantarakshita’s Tattvasangraha. (G. Jha, Trans.). Motilal Banarsidass.
- Marx, K. (1959). Economic and philosophic manuscripts of 1844 (M. Milligan, Trans.). Progress Publishers. (Original work published 1844).
- Merleau-Ponty, M. (1962). Phenomenology of perception (C. Smith, Trans.). Routledge & Kegan Paul.
- Mohanty, J. N. (1992). Reason and tradition in Indian thought: An essay on the nature of Indian philosophical thinking. Clarendon Press.
- Moran, D. (2000). Introduction to phenomenology. Routledge.
- Murti, T. R. V. (1955). The central philosophy of Buddhism: A study of the Mādhyamika system. George Allen & Unwin.
- Nicholson, R. A. (Trans.). (1995). The Mathnawí of Jalálu’ddín Rúmí. Gibb Memorial Trust.
- Nietzsche, F. (1974). The gay science: With a prelude in rhymes and an appendix of songs (W. Kaufmann, Trans.). Vintage Books. (Original work published 1882).
- Sartre, J.-P. (1956). Being and nothingness: An essay on phenomenological ontology (H. E. Barnes, Trans.). Philosophical Library.
- Schimmel, A. (1975). Mystical dimensions of Islam. University of North Carolina Press.
- Schutz, A. (1967). The phenomenology of the social world (G. Walsh & F. Lehnert, Trans.). Northwestern University Press.
- Sinha, D. (1958). The idealist standpoint: A study in the Vedantic metaphysic of experience. Visva-Bharati.
- Smith, D. W. (2013). Husserl (2nd ed.). Routledge.
- Stcherbatsky, F. T. (1962). Buddhist logic (Vol. 1). Dover Publications. (Original work published 1932).
- Varela, F. J., Thompson, E., & Rosch, E. (1991). The embodied mind: Cognitive science and human experience. MIT Press.
- Weber, M. (2002). The Protestant ethic and the spirit of capitalism (S. Kalberg, Trans.). Roxbury Publishing Company. (Original work published 1905).
- Zahavi, D. (2003). Husserl’s phenomenology. Stanford University Press.
Leave a Reply