ইমানুয়েল কান্ট: যে মানুষটি ঘড়ির কাঁটা ধরে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিলেন

Table of Contents

ভূমিকা

ছোট্ট একটা শহর। নাম কনিংসবার্গ (Königsberg)। এখন অবশ্য এই শহর রাশিয়ার অধীনে, নাম ক্যালিনিনগ্রাড। কিন্তু আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন শহরটা ছিল পূর্ব প্রুশিয়ার (East Prussia) রাজধানী। এই শহরে এক ভদ্রলোক থাকতেন, যার জীবন ছিল আশ্চর্য রকমের রুটিনমাফিক। এতটাই যে, শহরের মানুষ তার হাঁটার সময় মিলিয়ে নিজেদের ঘড়ির কাঁটা ঠিক করত। প্রতিদিন বিকেল সাড়ে তিনটায়, ধূসর ওভারকোট আর স্প্যানিশ বেতের ছড়ি হাতে তিনি তার বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেন। তার হাঁটার পথটিও ছিল নির্দিষ্ট—শহরের একটি শান্ত রাস্তা, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘দার্শনিকের পথ’ (The Philosopher’s Walk)। এই হাঁটার সময় বা পথের একচুলও নড়চড় হতো না। একবারই কেবল ব্যতিক্রম হয়েছিল। জ্যাঁ-জ্যাক রুশোর (Jean-Jacques Rousseau) লেখা এমিল (Émile) বইটি পড়তে গিয়ে তিনি এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, তার হাঁটার সময় পার হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনাটি কনিংসবার্গের মানুষের কাছে এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে, তা নিয়ে শহরে রীতিমতো গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।

এই ঘড়ির কাঁটা ধরা মানুষটির নাম ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant)।

বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, এমন নিস্তরঙ্গ, এমন একঘেয়ে জীবন আর হয় না। এই মানুষটির জীবনে কোনো নাটকীয়তা নেই, প্রেম-ভালোবাসার তুমুল ঝড় নেই, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা নেই। তিনি জন্মেছিলেন কনিংসবার্গে, এবং সেখানেই মারা গেছেন। সারাজীবন শহর ছেড়ে বলতে গেলে কোথাও যাননি। তার সবচেয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ ছিল কনিংসবার্গ থেকে মাত্র ৬০ মাইল দূরের এক শহরে। তিনি বিয়ে করেননি, তার কোনো সন্তানও ছিল না। তার জীবন ছিল কেবল পড়া, লেখা আর ভাবনার এক অবিচ্ছিন্ন স্রোত।

কিন্তু এই সাদামাটা, ছকে বাঁধা মানুষটি তার মাথার ভেতরে যে জগৎ তৈরি করেছিলেন, তা ছিল বৈপ্লবিক। সেই বিপ্লবের ঢেউ আজও দর্শন, বিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র আর রাজনীতির তীরে অবিরাম আছড়ে পড়ছে। কান্টের দর্শন বুঝতে বসাটা অনেকটা যেন এক গভীর, কুয়াশাচ্ছন্ন জঙ্গলে প্রবেশ করার মতো। প্রথমে পথ হারিয়ে ফেলার ভয় হয়, চারদিকে অচেনা শব্দ আর পরিভাষার ভিড়—ফেনোমেনা, নুমেনা, ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পারেটিভ, ট্রান্সেনডেন্টাল আইডিয়ালিজম। কিন্তু একটু ধৈর্য ধরে, তার দেখানো পথ ধরে এগোলে দেখা যায়, সেই জঙ্গল আসলে এক সুবিন্যস্ত বাগান। প্রতিটি গাছের পেছনে আছে অসামান্য যুক্তি আর ভাবনা, প্রতিটি পথের বাঁকে আছে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত। চলুন, আজ সেই বাগানেই একটা লম্বা চক্কর দিয়ে আসা যাক। দেখা যাক, কনিংসবার্গের সেই শান্ত, নিঃসঙ্গ পথচারী কীভাবে গোটা মানবজাতির চিন্তার পথটাকেই চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিলেন।

কান্টের কারিগর: যে ভাবনারা এক দার্শনিককে গড়েছিল

যেকোনো বড় নদীর উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যায়, তা কোনো একক ঝর্ণা থেকে আসেনি। অসংখ্য ছোট-বড় স্রোতধারা, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জল, আর বৃষ্টির জল—সব মিলেমিশে এক বিশাল সত্তা তৈরি হয়। বড় চিন্তকদের বেলায়ও ব্যাপারটা ঠিক তাই। ইমানুয়েল কান্টের মতো একজন যুগান্তকারী দার্শনিক শূন্য থেকে আবির্ভূত হননি। তার চিন্তার জগৎ এক বিশাল নদী, যা তার পূর্ববর্তী দার্শনিকদের ভাবনা এবং তার সময়ের রাজনৈতিক-সামাজিক স্রোতধারা দিয়ে পুষ্ট হয়েছিল।

আমরা প্রায়ই কান্টকে কনিংসবার্গের সেই ঘড়ির কাঁটা-ধরা, নিভৃতচারী মানুষ হিসেবে ভাবি। মনে হয়, তিনি যেন চারপাশের কোলাহল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে এক বিশুদ্ধ চিন্তার জগতে বাস করতেন। কিন্তু এই ধারণাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। কান্ট ছিলেন তার সময়ের একজন অত্যন্ত সচেতন এবং সক্রিয় পর্যবেক্ষক। তার দর্শনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি তত্ত্বে লুকিয়ে আছে তার পূর্বসূরিদের সাথে এক নীরব সংলাপ এবং তার পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর উত্তাল তরঙ্গের ছাপ।

চলুন, আজ আমরা কান্টের সেই কারিগরদের খুঁজে বের করি। যে দার্শনিক বিতর্ক আর রাজনৈতিক ঝড় তার চিন্তার নদীতে মিশে গিয়ে এক নতুন দর্শন তৈরি করেছিল, সেই নেপথ্যের গল্পটা একটু জেনে আসা যাক।

দর্শনের উত্তরাধিকার: কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এবং কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে

কান্টের দর্শন বুঝতে হলে প্রথমে সেই সময়ের দার্শনিক যুদ্ধক্ষেত্রটা বোঝা দরকার। তিনি যখন তার যাত্রা শুরু করেন, তখন মূলত দুটি প্রবল প্রতিপক্ষ শিবিরে ইউরোপের চিন্তার জগৎ বিভক্ত ছিল। তবে এদের ছাড়াও আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কারিগর ছিলেন, যারা কান্টের চিন্তার কাঁচামাল জুগিয়েছিলেন।

লাইবনিজ ও ভোলফ: যুক্তির সুশৃঙ্খল জগৎ

কান্টের যৌবনের পড়াশোনা হয়েছিল জার্মান বুদ্ধিবাদী (Rationalist) ধারার ছত্রছায়ায়। এই ধারার প্রধান দুই পুরোধা ছিলেন গটফ্রিড লাইবনিজ (Gottfried Wilhelm Leibniz) এবং তার সুযোগ্য শিষ্য ক্রিশ্চিয়ান ভোলফ (Christian Wolff)। কান্ট তার কর্মজীবনের শুরুতে ছিলেন একজন ভোলফিয়ান (Wolffian)।

লাইবনিজ-ভোলফের দর্শন ছিল আশ্চর্য রকমের আশাবাদী এবং সুশৃঙ্খল। তারা মনে করতেন, এই জগৎ ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্ট সম্ভাব্য সেরা জগৎ (The best of all possible worlds)। এখানে যা কিছু ঘটে, তার পেছনেই একটি যথেষ্ট কারণ (Principle of Sufficient Reason) আছে। বিশুদ্ধ যুক্তি (Pure Reason) দিয়ে এই জগতের সমস্ত রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব। তাদের কাছে, গণিতের মতোই দর্শনও কিছু স্বতঃসিদ্ধ থেকে যৌক্তিকভাবে জগতের একটি সম্পূর্ণ চিত্র আঁকতে পারে।

কান্ট এই কাঠামো থেকেই তার যাত্রা শুরু করেছিলেন। লাইবনিজ-ভোলফের যুক্তির প্রতি এই গভীর আস্থা কান্টের দর্শনেও রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে তিনি এই মতকে ‘মতান্ধতা’ (Dogmatism) বলে আখ্যা দেন। তার মনে প্রশ্ন জাগে, কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই শুধু যুক্তি দিয়ে কি আমরা জগৎ সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পারি? এই প্রশ্নই তাকে ঠেলে দেয় তার বিখ্যাত ‘ক্রিটিক অফ পিওর রিজন’ লেখার দিকে। তিনি যুক্তির ক্ষমতাকে স্বীকার করেছেন, কিন্তু একই সাথে তার সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন—যা লাইবনিজ করেননি (Beiser, 2005)।

আইজ্যাক নিউটন: বিজ্ঞানের স্বর্ণালী মানদণ্ড

অষ্টাদশ শতক ছিল নিউটনের যুগ। তার প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেম্যাটিকা (Principia Mathematica) মহাবিশ্বের এক আশ্চর্য সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছিল। তিনি দেখিয়েছিলেন, কয়েকটি সরল গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে গ্রহ-নক্ষত্রের গতি থেকে শুরু করে মাটিতে আপেল পড়া পর্যন্ত সবকিছু ব্যাখ্যা করা সম্ভব। নিউটনের এই সাফল্য বিজ্ঞানকে এক অসামান্য মর্যাদা দিয়েছিল।

কান্ট নিউটনের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি ভাবতেন, নিউটন যেভাবে প্রাকৃতিক জগতের জন্য একটি নিশ্চিত এবং সার্বজনীন ভিত্তি দিয়েছেন, দর্শন কি অধিবিদ্যার (Metaphysics) জন্য তেমন একটি ভিত্তি দিতে পারে? নিউটনের বিজ্ঞান ছিল কান্টের কাছে জ্ঞানের আদর্শ মডেল। তার একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল, দর্শনের জগতেও বিজ্ঞানের মতো নিশ্চিত জ্ঞান কীভাবে সম্ভব, তা খুঁজে বের করা (Friedman, 2013)।

মজার ব্যাপার হলো, কান্ট নিউটনের কিছু ধারণাকে (যেমন—নিরপেক্ষ দেশ ও কাল বা Absolute Space and Time) প্রথমে গ্রহণ করলেও পরে সেগুলোকে নিজের দর্শনের কাঠামোয় পুরোপুরি বদলে দেন। তিনি বলেন, দেশ ও কাল জগতের বাস্তব ধর্ম নয়, বরং আমাদের মনেরই সংবেদনের ছাঁচ (Forms of Intuition)। এভাবেই তিনি নিউটনের জগৎকে নিজের ‘কোপার্নিকান বিপ্লব’-এর অংশ করে নেন।

ডেভিড হিউম: যে মানুষটি কান্টকে ঘুম থেকে জাগিয়েছিলেন

যদি একজন দার্শনিকের নাম করতে হয় যিনি কান্টের চিন্তায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছিলেন, তিনি হলেন স্কটিশ অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricist) ডেভিড হিউম (David Hume)। কান্ট নিজেই স্বীকার করেছেন, হিউমের লেখা পড়েই তার ‘মতান্ধতার ঘুম’ (Dogmatic Slumber) ভেঙেছিল।

হিউম তার যুক্তির চাবুক মেরে অভিজ্ঞতাবাদের দেয়াল ভেঙে ফেলেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, আমরা যাকে কার্যকারণ (Causality) বলি, তা আসলে আমাদের মনের একটি অভ্যাস মাত্র। এই যুক্তি বিজ্ঞানের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিল, কারণ বিজ্ঞান কার্যকারণ সম্পর্কের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে।

হিউমের এই সংশয়বাদ (Skepticism) কান্টের সামনে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। যদি হিউম সঠিক হন, তাহলে নিউটনের বিজ্ঞানসহ সব জ্ঞানই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কান্ট এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তার Critique of Pure Reason বইটি ছিল মূলত হিউমের এই ধ্বংসাত্মক সমালোচনার একটি গঠনমূলক জবাব। তিনি হিউমকে ভুল প্রমাণ করতে চাননি, বরং দেখাতে চেয়েছেন যে হিউম সমস্যাটি সঠিকভাবে ধরলেও তার সমাধানটি ভুল ছিল। কান্ট বললেন, কার্যকারণ জগতের কোনো বস্তু নয়, আবার মনের অভ্যাসও নয়; এটি আমাদের প্রজ্ঞার একটি অন্তর্নির্মিত বর্গ (Category of Understanding)। এই বর্গ ছাড়া আমাদের পক্ষে কোনো সুসংবদ্ধ অভিজ্ঞতা লাভ করাই সম্ভব নয়। এভাবেই তিনি হিউমের সংশয়বাদকে অতিক্রম করে বিজ্ঞানের জন্য একটি নতুন ও শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেন (Kant, 1783/2004)।

জ্যাঁ-জ্যাক রুশো: নৈতিকতার বিপ্লবী কণ্ঠস্বর

কান্টের পড়ার ঘরের দেয়ালে মাত্র একজন ব্যক্তির ছবি টাঙানো থাকত—তিনি হলেন জ্যাঁ-জ্যাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau)। কান্টের জীবনে রুশোর প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর এবং ব্যক্তিগত। কথিত আছে, রুশোর লেখা এমিল (Émile) পড়তে গিয়েই কান্ট তার জীবনের একমাত্র দিনটিতে নিয়মিত বিকেলে হাঁটতে বের হতে ভুলে গিয়েছিলেন।

রুশো কান্টের নৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনে বিপ্লব এনেছিলেন। রুশোর কাছ থেকে কান্ট কয়েকটি মূল ধারণা গ্রহণ করেন:

  • মানুষের অন্তর্নিহিত মূল্য: রুশো সেই সময়ের অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে সাধারণ মানুষের অন্তর্নিহিত মর্যাদা ও নৈতিক মূল্যের কথা বলেন। তিনি বলেন, সভ্যতা মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে, কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ ছিল স্বাধীন ও সৎ। এই ধারণাটিই কান্টের দর্শনে রূপান্তরিত হয়ে ‘মানবতার সূত্র’ (Formula of Humanity)-তে পরিণত হয়। কান্ট বলেন, প্রত্যেক যুক্তিশীল প্রাণীর একটি পরম মূল্য বা মর্যাদা (Dignity) আছে, তাকে কখনোই নিছক উপায় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

  • স্বাধীনতা হিসেবে স্বায়ত্তশাসন: রুশোর The Social Contract বইয়ের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (General Will)। রুশো বলেন, মানুষ তখনই সত্যিকারের স্বাধীন, যখন সে এমন আইন মেনে চলে যা সে নিজেই নিজের জন্য তৈরি করেছে। এই ধারণাটি কান্টের নৈতিক দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে চলে আসে স্বায়ত্তশাসন (Autonomy) নামে। কান্টের মতে, নৈতিকতা মানে হলো নিজের যুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট নৈতিক আইনকে অনুসরণ করা, বাইরের কোনো চাপ বা প্রবৃত্তির বশে নয় (Cassirer, 1981)।

এককথায়, হিউম যদি কান্টের জ্ঞানতাত্ত্বিক সত্তাকে জাগিয়ে দিয়ে থাকেন, তবে রুশো জাগিয়েছিলেন তার নৈতিক সত্তাকে। রুশো কান্টকে শিখিয়েছিলেন যে, আসল প্রশ্ন শুধু ‘আমি কী জানতে পারি?’ নয়, বরং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো ‘আমার কী করা উচিত?’।

সময়ের প্রতিধ্বনি: রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

কান্ট শুধু দার্শনিকদের বইয়ের মধ্যেই ডুবে থাকতেন না। তার চারপাশের পৃথিবীও তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। অষ্টাদশ শতকের ইউরোপ ছিল এক উত্তাল সময়—জ্ঞানদীপ্তি, আলোকিত স্বৈরতন্ত্র এবং বিপ্লবের যুগ।

জ্ঞানদীপ্তির যুগ (The Enlightenment / Aufklärung)

কান্ট ছিলেন জ্ঞানদীপ্তি বা এনলাইটেনমেন্ট যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং এর প্রধান মুখপাত্র। এনলাইটেনমেন্ট ছিল এক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, যার মূলমন্ত্র ছিল যুক্তি, স্বাধীনতা এবং কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরোধিতা। এর আদর্শ ছিল ব্যক্তির নিজস্ব বুদ্ধিকে ব্যবহার করার সাহস।

কান্ট তার বিখ্যাত প্রবন্ধ “An Answer to the Question: What is Enlightenment?” (জ্ঞানদীপ্তি কী?)-এ এই যুগের সারমর্ম তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, “Enlightenment is man’s emergence from his self-incurred immaturity.” আর এই যুগের মূলনীতি বা মোটো হলো: “Sapere aude! (Dare to know!)” অর্থাৎ, ‘জানার সাহস করো! নিজের বুদ্ধি ব্যবহার করার সাহস করো!’

এই চেতনা কান্টের পুরো দর্শন জুড়ে প্রবাহিত। তিনি চেয়েছিলেন মানুষকে সব ধরনের অন্ধ কর্তৃত্ব—সেটা গির্জারই হোক বা রাষ্ট্রের—থেকে মুক্ত করে যুক্তির ওপর দাঁড় করাতে। তার দর্শন হলো ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তির এক দীর্ঘ ঘোষণা।

ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের ‘আলোকিত স্বৈরতন্ত্র’

কান্ট তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন প্রুশিয়ার শাসক ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের (Frederick the Great) অধীনে। ফ্রেডেরিক ছিলেন একজন ‘আলোকিত স্বৈরশাসক’ (Enlightened Despot)। তিনি নিজেকে বলতেন ‘রাষ্ট্রের প্রথম ভৃত্য’। তিনি শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং ভলতেয়ারের মতো দার্শনিকদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। তার সময়ে প্রুশিয়ায় তুলনামূলকভাবে চিন্তার স্বাধীনতা ছিল। ফ্রেডেরিক বলতেন, “Argue as much as you will, and about what you will, but obey!” (যত খুশি তর্ক করো, যা নিয়ে খুশি তর্ক করো, কিন্তু মান্য করো!)।

এই পরিবেশ কান্টের মতো একজন দার্শনিকের বিকাশের জন্য সহায়ক ছিল। তিনি নির্ভয়ে তার বৈপ্লবিক ধারণাগুলো প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। ফ্রেডেরিকের শাসনকাল তাকে এই বিশ্বাস জুগিয়েছিল যে, একজন শক্তিশালী কিন্তু যুক্তিশীল শাসক জনপরিসরে মুক্ত বিতর্ককে উৎসাহিত করতে পারেন (Kuehn, 2001)।

সেন্সরশিপের সাথে সংঘাত

কিন্তু এই স্বাধীনতা চিরস্থায়ী ছিল না। ফ্রেডেরিকের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী ফ্রেডেরিক উইলিয়াম দ্বিতীয় (Frederick William II) ক্ষমতায় আসেন, যিনি ছিলেন অনেক বেশি রক্ষণশীল। তিনি ধর্মীয় বিষয়ে মুক্ত আলোচনার ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করেন।

এই সময়ে কান্ট তার ধর্মবিষয়ক বই Religion within the Bounds of Bare Reason প্রকাশ করতে গিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রের সেন্সরশিপের কবলে পড়েন। তাকে সরকারিভাবে সতর্ক করা হয় এবং ধর্ম বিষয়ে আর কোনো লেখা প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়। কান্ট রাজার আদেশ মেনে নেন, কিন্তু রাজার মৃত্যুর পর তিনি তার এই অভিজ্ঞতার কথা বিস্তারিতভাবে লেখেন The Conflict of the Faculties বইতে।

এই সংঘাত কান্টের রাজনৈতিক চিন্তাকে আরও শাণিত করে। তিনি জনপরিসরে যুক্তির ব্যবহার (Public use of reason) এবং অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতার (Academic freedom) গুরুত্ব আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তিনি বুঝতে পারেন, সত্যিকারের প্রগতির জন্য চিন্তার স্বাধীনতা অপরিহার্য।

ফরাসি বিপ্লবের ঢেউ

কান্ট যখন তার জীবনের শেষ পর্যায়ে, তখন ফ্রান্সে ঘটে যায় ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা—ফরাসি বিপ্লব (French Revolution)। কনিংসবার্গের এই নিভৃতচারী অধ্যাপক অত্যন্ত আগ্রহ ও সহানুভূতির সাথে এই বিপ্লবের খবর রাখতেন। যদিও বিপ্লবের সহিংসতা (বিশেষ করে Terror পর্ব) তাকে ব্যথিত করেছিল, কিন্তু এর পেছনের আদর্শ—স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী (Liberty, Equality, Fraternity)—তাকে মুগ্ধ করেছিল।

তার কাছে, ফরাসি বিপ্লব ছিল মানবজাতির নৈতিক অগ্রগতির একটি নিদর্শন। এটি প্রমাণ করেছিল যে, মানুষ পুরনো স্বৈরাচারী শাসন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের জন্য একটি যুক্তিসম্মত, প্রজাতান্ত্রিক (Republican) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। এই বিপ্লবের আদর্শই তার বিখ্যাত রাজনৈতিক প্রবন্ধ Perpetual Peace (চিরস্থায়ী শান্তি)-এর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক বিশ্বের, যেখানে সব রাষ্ট্রই হবে প্রজাতান্ত্রিক এবং তারা একটি ফেডারেশনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে শান্তি বজায় রাখবে (Losurdo, 2004)।

স্রোতের সংমিশ্রণে নতুন নদী

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? ইমানুয়েল কান্ট এক নির্জন দ্বীপে বসে তার দর্শন রচনা করেননি। তিনি ছিলেন এক বিশাল চৌরাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে, যেখান দিয়ে তার পূর্বসূরিদের চিন্তার স্রোত এবং তার সময়ের রাজনৈতিক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।

লাইবনিজ ও ভোলফের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন যুক্তির প্রতি আস্থা। নিউটনের কাছ থেকে পেয়েছিলেন জ্ঞানের সুনিশ্চিত কাঠামোর স্বপ্ন। হিউমের কাছ থেকে পেয়েছিলেন সেই ঘুম-ভাঙানো ধাক্কা, যা তাকে নতুন পথে ভাবতে বাধ্য করেছিল। আর রুশোর কাছ থেকে পেয়েছিলেন মানুষের মর্যাদা ও নৈতিক স্বাধীনতার জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা।

এই দার্শনিক উত্তরাধিকারের সাথে মিশেছিল তার সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা—এনলাইটেনমেন্টের মুক্তি-স্পৃহা, ফ্রেডেরিকের আলোকিত শাসন, সেন্সরশিপের খাঁচা এবং ফরাসি বিপ্লবের সাম্যের আহ্বান।

কান্ট ছিলেন একজন অসাধারণ কারিগর। তিনি এই সমস্ত কাঁচামালকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু অন্ধভাবে অনুকরণ করেননি। তিনি সেগুলোকে তার নিজস্ব যুক্তির ছাঁচে ফেলে, তার কোপার্নিকান বিপ্লবের আগুনে গলিয়ে এক সম্পূর্ণ নতুন ও মৌলিক দর্শন তৈরি করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে আপাতদৃষ্টিতে বিরোধী ধারণাগুলোকে (যেমন, যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ, বা প্রকৃতি ও স্বাধীনতা) একটি বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে সমন্বিত করা যায়।

কনিংসবার্গের সেই দার্শনিকের জগৎ তাই মোটেও ছোট ছিল না। তার মাথার ভেতরে ছিল গোটা ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে আত্মস্থ করেই তিনি এমন এক দর্শন তৈরি করেছিলেন, যা কেবল তার সময়ের জন্যই নয়, আজো আমাদের পথ দেখায়।

দর্শনের যুদ্ধক্ষেত্র এবং কান্টের আগমন

কান্টের সময়ে, অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি, ইউরোপের দর্শনের জগতে বিশাল এক যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধটা কোনো তরবারির ছিল না, ছিল চিন্তার। যুদ্ধটা মূলত দুটি প্রধান দলের মধ্যে। একদলের নাম বুদ্ধিবাদী (Rationalists) আর অন্যদলের নাম অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricists)

বুদ্ধিবাদীরা, যেমন ফ্রান্সের রেনে দেকার্ত (René Descartes), জার্মানির গটফ্রিড লাইবনিজ (Gottfried Wilhelm Leibniz) বা নেদারল্যান্ডসের বারুখ স্পিনোজা (Baruch Spinoza), ছিলেন গণিত দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত। তারা মনে করতেন, খাঁটি, নিশ্চিত এবং সার্বজনীন জ্ঞান আসে কেবল বিশুদ্ধ যুক্তি (Pure Reason) থেকে। আমাদের মনই হলো জ্ঞানের উৎস। জন্মের সময়ই আমাদের মনে কিছু সহজাত ধারণা (Innate Ideas) থাকে, যা বাইরের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই আমরা জানতে পারি। দেকার্ত যেমন তার বিখ্যাত ‘আমি চিন্তা করি, অতএব আমি আছি’ (Cogito, ergo sum) যুক্তির মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিলেন, যা কোনো ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল নয়। বুদ্ধিবাদীদের কাছে, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো (চোখ, কান, নাক) প্রায়শই আমাদের ধোঁকা দেয়। মরুভূমিতে মরীচিকা দেখা বা দড়িতে সাপ দেখার মতো ভুল তো আমরা হরহামেশাই করি। তাই ইন্দ্রিয়ের ওপর পুরোপুরি ভরসা করা যায় না। আসল জ্ঞান হলো গণিতের মতো—স্বতঃসিদ্ধ, আবশ্যিক এবং যুক্তি দিয়ে প্রমাণিত।

অন্যদিকে, অভিজ্ঞতাবাদীরা, যেমন ইংল্যান্ডের জন লক (John Locke), জর্জ বার্কলি (George Berkeley) এবং স্কটল্যান্ডের ডেভিড হিউম (David Hume), বলতেন ঠিক এর উল্টো কথা। তাদের মতে, জন্মের সময় আমাদের মন থাকে একটা ধবধবে সাদা কাগজের (Tabula Rasa) মতো। সেখানে আগে থেকে কিছুই লেখা থাকে না। যা কিছু জ্ঞান আমরা অর্জন করি, তার সবই আসে অভিজ্ঞতা (Experience) থেকে, আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। বাইরে থেকে যা দেখি, শুনি, অনুভব করি, সেটাই আমাদের মনের সাদা কাগজে আঁকিবুকি কাটে। এই ছাপগুলো থেকেই ধারণা তৈরি হয়। লক বলতেন, “মনে এমন কিছুই নেই যা আগে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ছিল না।”

এই দুই দলের ঝগড়া যখন তুঙ্গে, তখন মঞ্চে এলেন ডেভিড হিউম। তিনি ছিলেন একজন চরম অভিজ্ঞতাবাদী এবং একই সাথে একজন ভয়ংকর সংশয়বাদী (Skeptic)। তিনি অভিজ্ঞতাবাদের যুক্তিকে তার শেষ সীমা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন এবং এমন এক সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন, যা গোটা দর্শনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

হিউম বললেন, আমরা যেটাকে বলি ‘কার্যকারণ’ (Causality), অর্থাৎ একটার কারণে আরেকটা ঘটে—এটা আসলে আমাদের মনের একটা ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা দেখি, একটা বিলিয়ার্ড বল (A) আরেকটা বিলিয়ার্ড বলকে (B) ধাক্কা দিলে দ্বিতীয়টা (B) নড়তে শুরু করে। বারবার এটা দেখতে দেখতে আমাদের মনে একটা অভ্যাস (Habit) বা মানসিক প্রত্যাশা (Mental Expectation) তৈরি হয়। আমরা ধরে নিই, A বলটি B বলের নড়াচড়ার ‘কারণ’। কিন্তু হিউম প্রশ্ন করলেন, আমরা আসলে কী দেখি? আমরা দেখি, A বলটি B বলকে স্পর্শ করে, এবং তার ঠিক পরেই B বলটি নড়তে শুরু করে। আমরা কেবল দুটি ঘটনাকে পরপর ঘটতে দেখি (Constant Conjunction), তাদের মধ্যে কোনো আবশ্যিক সম্পর্ক (Necessary Connection) আমরা কখনোই দেখি না। অর্থাৎ, এমন কোনো শক্তি বা আঠা আমরা দেখতে পাই না যা একটি ঘটনাকে আরেকটির সাথে জুড়ে রাখে।

তার মানে, সূর্য প্রতিদিন সকালে ওঠে, কিন্তু কাল সকালেও যে উঠবে, তার কোনো যৌক্তিক বা আবশ্যিক নিশ্চয়তা নেই। আমরা কেবল অতীতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এটা আশা করি। হিউমের এই যুক্তি ছিল দর্শনের ওপর এক পারমাণবিক বোমার মতো। কারণ, বিজ্ঞানের মূল ভিত্তিই হলো কার্যকারণ। যদি কার্যকারণ সম্পর্কটাই সত্যি না হয়, তাহলে তো নিউটনের সব সূত্র, বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার, এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ জ্ঞান পর্যন্ত প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়!

কান্ট নিজেই তার Prolegomena to Any Future Metaphysics বইতে স্বীকার করেছেন, “I openly confess that my recollection of David Hume was the very thing which many years ago first interrupted my dogmatic slumber” (Kant, 1783/2004)। অর্থাৎ, হিউমের এই কথাগুলোই তাকে তার ‘মতান্ধতার ঘুম’ (Dogmatic Slumber) থেকে সজোরে জাগিয়ে তুলেছিল। তিনি বুঝতে পারলেন, বুদ্ধিবাদ আর অভিজ্ঞতাবাদ—দুটোই একা একা অসম্পূর্ণ। শুধু বিশুদ্ধ যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে জগৎ সম্পর্কে নতুন কিছু জানা যায় না (কারণ তা কেবল ধারণার বিশ্লেষণ করে), আবার শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে জ্ঞানের সার্বজনীনতা ও নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না (কারণ অভিজ্ঞতা কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখায়)।

কান্ট ভাবলেন, এই দুই দলের মধ্যে একটা আপস করাতে হবে। আর সেই আপস করাতে গিয়েই তিনি দর্শনের ইতিহাসে তার বিখ্যাত ‘কোপার্নিকান বিপ্লব’ (Copernican Revolution) ঘটিয়ে ফেললেন।

কান্টের কোপার্নিকান বিপ্লব: জ্ঞানের নতুন সূত্র

জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস কী করেছিলেন? তার আগে সবাই ভাবত, পৃথিবী স্থির আর সূর্যসহ সব গ্রহ-নক্ষত্র পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। কোপার্নিকাস এই ধারণাকে উল্টে দিলেন। তিনি বললেন, সূর্য স্থির, আর পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। অর্থাৎ, তিনি দর্শক (পৃথিবী) এবং বস্তু (সূর্য)-র সম্পর্কটাকে বদলে দিয়েছিলেন।

কান্টও ঠিক তাই করলেন দর্শনের জগতে।

কান্টের আগের সব দার্শনিক, তারা বুদ্ধিবাদীই হোন বা অভিজ্ঞতাবাদী, একটা বিষয়ে একমত ছিলেন: জ্ঞান হলো আমাদের মনের সাথে বাইরের জগতের মিল। তারা মনে করতেন, আমাদের মন অনেকটা নিষ্ক্রিয় আয়নার মতো। বাইরের জগৎ (Object) যেমন, আমাদের মনে তার একটা ছাপ পড়ে। জ্ঞান হলো সেই ছাপের সঠিক অনুলিপি। অর্থাৎ, মনকে জগতের সাথে খাপ খাওয়াতে হয়।

কান্ট বললেন, “না, এতদিন আমরা ভুল পথে হেঁটেছি। ব্যাপারটা ঠিক উল্টো।”

তিনি প্রস্তাব করলেন, “Hitherto it has been assumed that all our knowledge must conform to objects. But all attempts to extend our knowledge of objects by establishing something in regard to them a priori, by means of concepts, have, on this assumption, ended in failure. We must therefore make trial whether we may not have more success in the tasks of metaphysics, if we suppose that objects must conform to our knowledge” (Kant, 1781/1998, Bxvi)।

অর্থাৎ, জ্ঞান বস্তুকে অনুসরণ করে না, বরং বস্তুকেই আমাদের জ্ঞানের কাঠামোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হয়।

তার মানে, আমাদের মন নিষ্ক্রিয় আয়না নয়, বরং অত্যন্ত সক্রিয় এক কারখানা। আমাদের মনই বাইরের জগৎ থেকে পাওয়া কাঁচা তথ্যগুলোকে (Raw Data) একটা কাঠামো দেয়, একটা অর্থ দেয়। অনেকটা চশমার মতো। ধরুন, আপনি একটা নীল রঙের চশমা পরে আছেন। আপনি যা-ই দেখবেন, সবকিছুই নীলচে মনে হবে। তার মানে এই নয় যে, গোটা জগৎটাই নীল। এর মানে হলো, আপনার চশমাটাই আপনার দেখার অভিজ্ঞতাকে নীল রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে। আপনি চশমাটা খুলতে পারবেন না, কারণ এটা আপনার চোখেরই অংশ।

কান্টের মতে, আমাদের মনেরও এমন কিছু অন্তর্নির্মিত ‘চশমা’ বা ‘ছাঁচ’ আছে। বাইরের জগৎ থেকে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে সংবেদন (Sensation) আসে, তা এই ছাঁচে পড়েই আমাদের কাছে ‘অভিজ্ঞতা’ (Experience) হিসেবে হাজির হয়। এই ছাঁচগুলো ছাড়া আমাদের পক্ষে কোনো কিছু জানা বা বোঝা সম্ভবই নয়।

এইখান থেকেই কান্টের দর্শনের দুটি বিশ্ব-বিখ্যাত এবং প্রায়শই ভুল বোঝা ধারণা আসে: ফেনোমেনা (Phenomena) আর নুমেনা (Noumena)

  • ফেনোমেনা (Phenomena): এটা হলো সেই জগৎ, যা আমাদের কাছে প্রতিভাত হয় (The world as it appears to us)। অর্থাৎ, আমাদের মনের ছাঁচে ফেলার পর, আমাদের চশমার ভেতর দিয়ে জগৎটাকে আমরা যেভাবে দেখি বা অনুভব করি। আমাদের বিজ্ঞান, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সব জ্ঞান এই ফেনোমেনাল জগৎ নিয়েই। এই জগৎ সুশৃঙ্খল, নিয়মমাফিক এবং বোধগম্য, কারণ আমাদের মনই একে শৃঙ্খলা দিয়েছে।

  • নুমেনা (Noumena): এটা হলো বস্তুর আসল স্বরূপ বা ‘বস্তুসত্তা’ বা ‘থিং-ইন-ইটসেলফ’ (Thing-in-itself / Ding an sich)। অর্থাৎ, আমাদের মনের ছাঁচ বা চশমা ছাড়া জগৎটা আসলে কেমন, সেটা। কান্টের মতে, এই নুমেনাল জগৎ সম্পর্কে আমরা কখনোই কিছু জানতে পারব না। কারণ, তাকে জানতে গেলেই আমাদের মনের চশমাটা পরে নিতে হবে, আর তখন সেটা আর নুমেনা থাকবে না, ফেনোমেনা হয়ে যাবে। এটা অনেকটা নিজের চোখ দিয়ে নিজের চোখ দেখার চেষ্টার মতো—অসম্ভব।

ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত, তাই না? আমরা যা কিছু জানি, তা আসলে আমাদেরই মনের তৈরি করা এক সংস্করণ। আসল জগৎটা কেমন, তা আমাদের জানার বাইরে। এর মানে কি কান্ট বলছেন যে, জগৎটা মায়া বা ভ্রম? না, ঠিক তা নয়। তিনি বলছেন, জগৎটা সত্যি, একটি স্বাধীন বাস্তবতা আছে (তিনি ভাববাদী বা Idealist নন, যারা মনে করেন জগৎ কেবল মনের ধারণা), কিন্তু তার আসল রূপটা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের জ্ঞান ফেনোমেনাল জগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে যাওয়া আমাদের সাধ্যাতীত (Allison, 2004)।

জ্ঞানের কারখানা: আমাদের মন কীভাবে কাজ করে?

কান্ট তার magnum opus, প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার বিশাল বই Critique of Pure Reason (বিশুদ্ধ প্রজ্ঞার সমালোচনা)-এ মনের এই কারখানাটার এক বিস্তারিত এবং জটিল বর্ণনা দিয়েছেন। তার মতে, জ্ঞান তৈরির প্রক্রিয়াটি একটি অ্যাসেম্বলি লাইনের মতো, যেখানে কয়েকটি ধাপে কাজ হয়।

প্রথম ধাপ: সংবেদনশীলতা (Transcendental Aesthetic / Sensibility)

এটা হলো জ্ঞান তৈরির প্রথম স্টেশন। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো (Senses) বাইরের জগৎ (নুমেনাল জগৎ) থেকে ক্রমাগত কাঁচা তথ্য বা সংবেদন (Sensation) গ্রহণ করে। কিন্তু এই তথ্যগুলো এলোমেলোভাবে আসে না। আমাদের মনে আগে থেকেই দুটি ছাঁচ বা ফিল্টার বসানো আছে: দেশ (Space) এবং কাল (Time)

কান্টের মতে, দেশ ও কাল বাইরের জগতের কোনো বাস্তব ধর্ম নয়। এগুলো আমাদের মনেরই গঠনগত বৈশিষ্ট্য, আমাদের সংবেদনের পূর্বশর্ত (A Priori forms of intuition)। আমরা কোনো কিছুকে দেশ ও কালের বাইরে কল্পনাও করতে পারি না। যেকোনো বস্তু হয় কোনো ‘স্থানে’ থাকবে, নয়তো কোনো ‘কালে’ ঘটবে। এগুলো হলো সেই ফ্রেম, যার মধ্যে আমরা সব অভিজ্ঞতাকে সাজাই। অনেকটা কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভের মতো, যা তথ্য সঞ্চয় করার আগে থেকেই একটি নির্দিষ্ট ফাইল সিস্টেমে ফরম্যাট করা থাকে। তথ্যগুলো সেই সিস্টেমের নিয়মেই সজ্জিত হয়। একইভাবে, আমাদের মন সব সংবেদনকে দেশ ও কালের কাঠামোয় ফেলে সাজিয়ে নেয়।

দ্বিতীয় ধাপ: প্রজ্ঞা (Transcendental Analytic / Understanding)

দেশ ও কালের ফ্রেমে সাজানো তথ্যগুলো এরপর মনের দ্বিতীয় স্টেশনে আসে, যার নাম প্রজ্ঞা। এখানেও আগে থেকে কিছু ছাঁচ বা ফোল্ডার বসানো আছে। কান্ট এগুলোর নাম দিয়েছেন ‘প্রজ্ঞার বর্গ’ (Categories of Understanding)। এগুলো হলো বিশুদ্ধ ধারণা (Pure Concepts), যা অভিজ্ঞতা থেকে আসে না, বরং অভিজ্ঞতাকে সম্ভব করে তোলে। কান্ট মোট বারোটি বর্গের কথা বলেছেন, যেগুলোকে তিনি চারটি গ্রুপে ভাগ করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো:

  • একতা/বহুত্ব (Unity/Plurality): অনেকগুলো জিনিসকে একসাথে ‘একটি’ হিসেবে দেখা (যেমন, একটি বই) বা একাধিক হিসেবে দেখা (যেমন, অনেকগুলো বই)।

  • দ্রব্য ও গুণ (Substance and Accident): পরিবর্তনশীলতার মধ্যেও কোনো কিছুর স্থায়ী অস্তিত্বকে (দ্রব্য) কল্পনা করা এবং তার পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যগুলোকে (গুণ) আলাদা করা। যেমন, একটি মোমবাতি গলে গেলেও আমরা মনে করি ‘মোম’ নামক দ্রব্যটিই রয়ে গেছে, শুধু তার আকৃতি বদলেছে।

  • কার্যকারণ (Causality and Dependence): একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার আবশ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা।

হিউম যেখানে বলেছিলেন কার্যকারণ সম্পর্কটা বাস্তব নয়, আমাদের মনের অভ্যাস মাত্র, কান্ট সেখানে বললেন, কার্যকারণ বাইরের নুমেনাল জগতে আছে কি না, তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের মনের গঠনই এমন যে, আমরা জগৎটাকে কার্যকারণের নিয়মেই বুঝতে বাধ্য। এটা আমাদের অভিজ্ঞতার এক পূর্বশর্ত (A Priori Condition)। কার্যকারণের ‘চশমা’ ছাড়া আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো হবে বিচ্ছিন্ন, অর্থহীন কিছু ঘটনার সমষ্টি, কোনো সুসংবদ্ধ জগৎ নয় (Guyer, 1987)। অনেকটা এলোমেলো অক্ষরের মতো, যা থেকে কোনো শব্দ বা বাক্য তৈরি হয় না। ক্যাটেগরিগুলোই হলো সেই ব্যাকরণ যা অক্ষরগুলোকে অর্থপূর্ণ শব্দ ও বাক্যে পরিণত করে।

জ্ঞানের প্রকারভেদ: কান্টের মাস্টারস্ট্রোক

এই জটিল কাঠামো ব্যাখ্যা করার জন্য কান্ট আরও দুটি বিখ্যাত বিভাজন তৈরি করলেন, যা দর্শনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

  • বিশ্লেষণী বনাম সংশ্লেষণী বিচার (Analytic vs. Synthetic Judgments):

    • বিশ্লেষণী (Analytic): যে বাক্যে বিধেয় (Predicate) পদটি উদ্দেশ্য (Subject) পদের সংজ্ঞার মধ্যেই লুকানো থাকে। যেমন, “সব অবিবাহিত পুরুষ ব্যাচেলর।” এখানে ‘ব্যাচেলর’ কথাটি ‘অবিবাহিত পুরুষ’ ধারণারই সমার্থক। এই বাক্য আমাদের নতুন কোনো তথ্য দেয় না, কেবল ধারণাকে স্পষ্ট করে। এগুলোকে বলা হয় ব্যাখ্যামূলক বিচার।

    • সংশ্লেষণী (Synthetic): যে বাক্যে বিধেয় পদটি উদ্দেশ্য পদের বাইরে থেকে নতুন তথ্য যোগ করে। যেমন, “এই টেবিলটি কাঠের তৈরি।” এখানে ‘কাঠের তৈরি’ হওয়াটা ‘টেবিল’ ধারণার আবশ্যিক অংশ নয়, টেবিল প্লাস্টিকেরও হতে পারত। এই বাক্য আমাদের জ্ঞানকে প্রসারিত করে। এগুলোকে বলা হয় জ্ঞানবর্ধক বধারণ।

  • অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ বনাম অভিজ্ঞতা-সাপেক্ষ (A Priori vs. A Posteriori):

    • অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ (A Priori): যে জ্ঞান অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে না, যা সার্বজনীন (Universal) ও আবশ্যিক (Necessary)। যেমন, ৭+৫ = ১২। এটা প্রমাণ করার জন্য আমাদের ৭টি আর ৫টি আপেল গোনার দরকার নেই।

    • অভিজ্ঞতা-সাপেক্ষ (A Posteriori): যে জ্ঞান অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয় এবং যা সম্ভাব্য (Contingent)। যেমন, “বৃষ্টি পড়ছে।” এটা জানার জন্য জানালার বাইরে তাকাতে হয়।

আগের দার্শনিকরা খুব সহজ একটা সমীকরণ করে রেখেছিলেন। তারা মনে করতেন, সব বিশ্লেষণী বিচারই A Priori (কারণ সেগুলো সংজ্ঞার ওপর নির্ভরশীল), আর সব সংশ্লেষণী বিচারই A Posteriori (কারণ নতুন তথ্য মানেই অভিজ্ঞতা)।

কিন্তু কান্ট এখানে তার তুরুপের তাসটি চাললেন। তিনি প্রশ্ন করলেন: এমন কি কোনো জ্ঞান থাকা সম্ভব, যা একই সাথে সংশ্লেষণী এবং অভিজ্ঞতা-নিরপেক্ষ (Synthetic A Priori)?

এটাই ছিল তার আসল আবিষ্কার! এমন জ্ঞান, যা আমাদের নতুন তথ্যও দেয় (Synthetic), আবার তা সার্বজনীন ও আবশ্যিকও (A Priori)। কান্ট বললেন, হ্যাঁ, সম্ভব। শুধু সম্ভবই নয়, গণিত, জ্যামিতি এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মূল ভিত্তিই হলো এই Synthetic A Priori জ্ঞান।

  • গণিত: “৭+৫ = ১২”। এই বাক্যটি বিশ্লেষণী নয়, কারণ ‘১২’ সংখ্যাটি ‘৭+৫’ ধারণার মধ্যে লুকিয়ে নেই। এটি একটি নতুন সংশ্লেষণ। কিন্তু এটি সার্বজনীন ও আবশ্যিক, তাই A Priori।

  • জ্যামিতি: “দুটি বিন্দুর মধ্যে সরলরেখাই হলো ক্ষুদ্রতম দূরত্ব।” এটিও নতুন তথ্য দেয় এবং সার্বজনীন।

  • বিজ্ঞান: “Every event has a cause” (প্রতিটি ঘটনার একটি কারণ আছে)। এই বাক্যটি বিশ্লেষণী নয়, কারণ ‘কারণ থাকা’ কথাটি ‘ঘটনা’ ধারণার সংজ্ঞার মধ্যে নেই। তাই এটি সংশ্লেষণী, নতুন তথ্য দিচ্ছে। আবার, এটি সার্বজনীন সত্য হিসেবে আমরা ধরে নিই, এর বিপরীত প্রমাণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেওয়া যায় না। তাই এটি A Priori।

এটা কীভাবে সম্ভব? কান্টের উত্তর হলো: কারণ দেশ, কাল এবং কার্যকারণ—এই ধারণাগুলো বাইরের জগৎ থেকে আসেনি। এগুলো আমাদের মনেরই কাঠামো, আমাদের অভিজ্ঞতা তৈরির সফটওয়্যার। তাই আমাদের দ্বারা গঠিত যেকোনো অভিজ্ঞতা এই নিয়মগুলো মেনে চলতে বাধ্য।

এই যুক্তির মাধ্যমে কান্ট হিউমের সংশয়বাদকে পরাস্ত করলেন এবং নিউটনের বিজ্ঞানের জন্য একটি শক্ত দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করলেন। তিনি দেখালেন যে, আমাদের জ্ঞান একদিকে যেমন অভিজ্ঞতার কাঁচামাল ছাড়া অচল (বুদ্ধিবাদীদের বিরুদ্ধে), তেমনই মনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও অসম্ভব (অভিজ্ঞতাবাদীদের বিরুদ্ধে)। তার সেই অমর উক্তিটি হলো: “Thoughts without content are empty, intuitions without concepts are blind” (Kant, 1781/1998, p. A51/B75)। অর্থাৎ, ধারণা (Concepts) ছাড়া সংবেদন (Intuitions) অন্ধ, আর সংবেদন ছাড়া ধারণা অন্তঃসারশূন্য। জ্ঞান হলো এই দুয়ের মেলবন্ধন।

নীতিশাস্ত্রের জগৎ: ‘কী আমার করা উচিত?’

জ্ঞানের জগৎ নিয়ে এই বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার পর কান্ট মনোযোগ দিলেন নীতিশাস্ত্রের দিকে। তার দ্বিতীয় বিখ্যাত বই Critique of Practical Reason (ব্যবহারিক প্রজ্ঞার সমালোচনা) এবং তার চেয়েও পঠনযোগ্য Groundwork of the Metaphysics of Morals (নীতিবিদ্যার অধিবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন)-এ তিনি দর্শনের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নগুলোর একটি তুললেন: “What should I do?” (আমার কী করা উচিত?)।

কান্টের নৈতিক দর্শনও তার জ্ঞানতত্ত্বের মতোই বৈপ্লবিক এবং কঠোর। তিনি বললেন, কোনো কাজের নৈতিক মূল্য তার ফলাফলের (Consequences) ওপর নির্ভর করে না। যেমন, উপযোগবাদীরা (Utilitarians), যেমন জেরেমি বেন্থাম বা জন স্টুয়ার্ট মিল, বলেন, যে কাজ সবচেয়ে বেশি মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি সুখ বয়ে আনে, সেটাই নৈতিক। কান্ট এই ধারণাকে পুরোপুরি রদ করে দিলেন। কারণ, ফলাফল আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারে। ভালো উদ্দেশ্যে করা কাজের ফল খারাপ হতে পারে, আবার খারাপ উদ্দেশ্যে করা কাজের ফলও ভালো হতে পারে।

তিনি বললেন, একটি কাজের নৈতিক মূল্য নির্ভর করে তার পেছনের উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায়ের (Motive/Intention) ওপর। আর একমাত্র যে জিনিসটি কোনো শর্ত ছাড়াই ভালো (Good without qualification), তা হলো সদিচ্ছা (Good Will)

বুদ্ধি, সাহস, সম্পদ, স্বাস্থ্য—এগুলো ভালো হতে পারে, কিন্তু খারাপ উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হতে পারে। একজন বুদ্ধিমান চোর তার বুদ্ধিকে চুরির কাজে লাগায়। একজন সাহসী সন্ত্রাসী তার সাহসকে মানুষ মারার কাজে লাগায়। কিন্তু সদিচ্ছা—অর্থাৎ, সঠিক কাজটি নিছক তা সঠিক বলেই করার ইচ্ছা—সবসময়ই ভালো, তার ফলাফল যা-ই হোক না কেন। এমনকি যদি এই সদিচ্ছা কোনো ফল উৎপাদনে পুরোপুরি ব্যর্থও হয়, তবুও তা একটি রত্নের মতোই নিজে থেকে ঝলমল করবে।

কর্তব্য বনাম প্রবৃত্তি (Duty vs. Inclination)

কান্টের মতে, একটি কাজ তখনই নৈতিকভাবে মূল্যবান হয়, যখন তা কর্তব্যের খাতিরে (From Duty) করা হয়, কোনো ব্যক্তিগত প্রবৃত্তি, আবেগ বা লাভের আশা থেকে নয়।

সেই বিখ্যাত দোকানদারের উদাহরণটি আবার দেখা যাক। একজন দোকানদার তার সব ক্রেতাকে সবসময় সঠিক পরিমাণের জিনিস দেন। তিনি কেন এটা করেন?

  • ১. স্বার্থপরতার কারণে (In accordance with duty, but from self-interest): তিনি ভাবছেন, যদি ঠকাই, তাহলে ব্যবসার সুনাম নষ্ট হবে এবং ক্রেতা হারাবো। কান্টের মতে, এটি অনৈতিক নয়, কিন্তু এর কোনো নৈতিক মূল্যও নেই।
  • ২. সহানুভূতির কারণে (In accordance with duty, but from immediate inclination): তিনি মানুষকে ভালোবাসেন এবং তাদের ঠকাতে তার সহজাতভাবেই খারাপ লাগে। কান্টের মতে, এটিও প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু এর কোনো সত্যিকারের নৈতিক মূল্য নেই। কারণ, এই অনুভূতি যদি না থাকত, বা তিনি যদি খিটখিটে মেজাজের হতেন, তাহলে হয়তো তিনি কাজটি করতেন না।
  • ৩. কর্তব্যের খাতিরে (From duty): তিনি সৎ থাকাটা তার নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করেন, সেটা তার ব্যবসা লোকসানেই চলুক বা তার ক্রেতাদের প্রতি কোনো সহানুভূতি নাই থাকুক। তিনি কাজটি করেন কারণ এটিই সঠিক কাজ।

কান্টের মতে, শুধুমাত্র তৃতীয় কারণটিই কাজটিকে সত্যিকারের নৈতিক মর্যাদা দেয়। নৈতিক কাজ হলো সেটাই, যা আপনি আপনার কর্তব্যের প্রতি সম্মান (Respect for the Moral Law) দেখিয়ে করেন, আপনার ভালো লাগা বা মন্দ লাগার তোয়াক্কা না করে (Kant, 1785/2012)।

শর্তহীন অনুজ্ঞা: নৈতিকতার সর্বোচ্চ আইন (The Categorical Imperative)

তাহলে প্রশ্ন আসে, আমাদের কর্তব্য কী, তা আমরা বুঝব কীভাবে? আমাদের নৈতিক কম্পাস কোনটি? এর উত্তরে কান্ট দিলেন তার নৈতিক দর্শনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং শক্তিশালী ধারণা: শর্তহীন অনুজ্ঞা (Categorical Imperative)

এটা হলো নৈতিকতার সর্বোচ্চ আইন, যা সব পরিস্থিতিতে, সব যুক্তিশীল প্রাণীর জন্য প্রযোজ্য। এর কোনো ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ নেই। এটা শর্তসাপেক্ষ অনুজ্ঞা (Hypothetical Imperative)-র মতো নয়। শর্তসাপেক্ষ অনুজ্ঞা হলো: ‘যদি তুমি X চাও, তাহলে Y করো’। যেমন, ‘যদি তুমি সুস্থ থাকতে চাও, তাহলে ব্যায়াম করো’। এখানে ব্যায়াম করাটা সুস্থ থাকার শর্তের ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু শর্তহীন অনুজ্ঞা হলো: ‘Y করো।’ ব্যস, এটুকুই। যেমন: ‘মিথ্যা কথা বলো না।’ এটা কোনো শর্তের ওপর নির্ভর করে না।

কান্ট এই অনুজ্ঞার কয়েকটি রূপ দিয়েছেন, যেগুলো আসলে একই আইনের ভিন্ন ভিন্ন দিক তুলে ধরে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি হলো:

১. সার্বজনীনতার সূত্র (The Formula of Universalizability)

“Act only according to that maxim whereby you can at the same time will that it should become a universal law of nature.”
(এমন নীতির (Maxim) ওপর ভিত্তি করে কাজ করো, যা তুমি একই সাথে চাইতে পারো যে তা একটি সার্বজনীন আইনে পরিণত হোক।)

সহজ ভাষায়, কোনো কাজ করার আগে নিজেকে দুটি প্রশ্ন করুন:

  • ক) আমি যে কাজটি করতে যাচ্ছি, তার পেছনের নীতিটি কী?
  • খ) সেই নীতিটি যদি পৃথিবীর সবাই সবসময় অনুসরণ করা শুরু করে (অর্থাৎ একটি সার্বজনীন আইন হয়ে যায়), তাহলে কি সেই পৃথিবীটা যৌক্তিকভাবে টিকে থাকতে পারবে? বা আমি কি এমন একটি পৃথিবীতে বাস করতে পারব?

উদাহরণ: মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা ধার করা। আমার কাজের নীতিটি (Maxim) হলো: “যখন আমার টাকার দরকার হবে, আমি ফেরত দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা ধার করব।” এখন ভাবুন তো, এই নীতিটি যদি একটি সার্বজনীন আইন হয়ে যায়? অর্থাৎ, সবাই যদি প্রয়োজনে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করে? তাহলে ‘প্রতিশ্রুতি’ শব্দটিরই কোনো অর্থ থাকবে না। কেউ আর কাউকে বিশ্বাস করবে না। ফলে, আমার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা ধার করার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে, কারণ কেউ তো আমাকে বিশ্বাসই করবে না! এখানে একটি যৌক্তিক স্ববিরোধ (Logical Contradiction) তৈরি হচ্ছে। সুতরাং, মিথ্যা বলা অনৈতিক।

২. মানবতার সূত্র (The Formula of Humanity as an End in Itself)

“Act in such a way that you treat humanity, whether in your own person or in the person of any other, always at the same time as an end and never merely as a means.”
(এমনভাবে কাজ করো, যাতে তুমি মানবতাকে, নিজের মধ্যে হোক বা অন্যের মধ্যে, সবসময় একটি উদ্দেশ্য (End) হিসেবে গণ্য করো, কখনোই কেবল উপায় বা মাধ্যম (Means) হিসেবে নয়।)

এর মানে হলো, প্রত্যেক মানুষের অন্তর্নিহিত মূল্য ও মর্যাদা (Dignity) আছে। কারণ, মানুষ যুক্তিশীল (Rational) এবং স্বায়ত্তশাসিত (Autonomous) প্রাণী। তাই কোনো মানুষকে নিছক নিজের স্বার্থসিদ্ধির ‘যন্ত্র’ বা ‘উপায়’ হিসেবে ব্যবহার করা চরম অনৈতিক। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা ধার করার উদাহরণে, আমি আমার বন্ধুকে মানুষ হিসেবে সম্মান করছি না; তাকে নিছক টাকার উৎসের ‘উপায়’ হিসেবে ব্যবহার করছি। এটি তার মর্যাদার লঙ্ঘন।

৩. উদ্দেশ্যের রাজ্যের সূত্র (The Formula of the Kingdom of Ends)

“Act in accordance with the maxims of a member giving universal laws for a merely possible kingdom of ends.”
(এমনভাবে কাজ করো যেন তুমি তোমার নীতির মাধ্যমে একটি সম্ভাব্য উদ্দেশ্যের রাজ্যের (Kingdom of Ends) একজন আইনপ্রণেতা সদস্য।)

এই সূত্রটি কান্টের নৈতিক দর্শনের সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকটি তুলে ধরে। তিনি আমাদের কল্পনা করতে বলেন এমন একটি আদর্শ জগতের কথা, যেখানে প্রত্যেকেই একে অপরের সাথে মানবতার সূত্র মেনে চলে। প্রত্যেকেই সেখানে একাধারে নিজের নৈতিক আইনের প্রণেতা (Sovereign) এবং সেই আইনের অধীন (Subject)। এই আদর্শ সমাজই হলো ‘উদ্দেশ্যের রাজ্য’। আমাদের প্রতিটি কাজ এমন হওয়া উচিত, যেন তা এই আদর্শ সমাজ গঠনে সাহায্য করে।

কান্টের এই নৈতিক দর্শন আধুনিক মানবাধিকার ধারণার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। প্রত্যেক মানুষের যে একটি অন্তর্নিহিত মর্যাদা আছে, যা কোনো অবস্থাতেই—এমনকি বৃহত্তর ভালোর জন্যও—লঙ্ঘন করা যায় না, এই ধারণাটি কান্টের কাছ থেকেই আমরা সবচেয়ে জোরালোভাবে পেয়েছি (Wood, 2008)।

স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন: নৈতিকতার ভিত্তি

কান্টের কাছে, নৈতিকতার পুরো ধারণাটিই একটি জিনিসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে: স্বাধীনতা (Freedom)। যদি আমাদের ভালো-মন্দ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে নৈতিকতার কোনো অর্থই হয় না। একটি পাথর পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়লে আমরা পাথরটিকে নৈতিকভাবে দায়ী করি না, কারণ তার কোনো স্বাধীনতা নেই।

কিন্তু কান্টের স্বাধীনতার ধারণাটিও খুব গভীর। তিনি দুই ধরনের জগতের কথা বলেন: প্রাকৃতিক জগৎ (World of sense), যা কার্যকারণের কঠোর নিয়মে বাঁধা, এবং বুদ্ধিগম্য জগৎ (World of understanding), যেখানে আমরা যুক্তিশীল প্রাণী হিসেবে স্বাধীন। মানুষ হিসেবে আমরা এই দুই জগতেরই বাসিন্দা। আমাদের শরীর প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন, কিন্তু আমাদের ‘ইচ্ছা’ (Will) স্বাধীন হতে পারে।

এই স্বাধীনতা মানে যা খুশি তাই করা নয়। কান্টের কাছে, স্বাধীনতা মানে হলো স্বায়ত্তশাসন (Autonomy)। Autonomy শব্দটি এসেছে গ্রিক ‘auto’ (নিজস্ব) এবং ‘nomos’ (আইন) থেকে। এর মানে হলো, নিজের জন্য নিজের আইন তৈরি করা। যখন আমরা আমাদের যুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট নৈতিক আইন (শর্তহীন অনুজ্ঞা) মেনে চলি, তখনই আমরা সত্যিকারের স্বাধীন।

এর বিপরীতে আছে পরাধীনতা (Heteronomy)। Heteronomy মানে হলো, যখন আমাদের ইচ্ছার আইন বাইরে থেকে আসে—হতে পারে তা আমাদের আবেগ, প্রবৃত্তি (Inclination), সমাজের চাপ, বা এমনকি ঈশ্বরের আদেশ থেকে। যখন আমরা কেবল শাস্তির ভয়ে বা পুরস্কারের লোভে কোনো কাজ করি, তখন আমরা পরাধীন। কান্টের কাছে, সত্যিকারের নৈতিক কাজ কেবল স্বায়ত্তশাসিত কর্তার পক্ষেই সম্ভব।

সৌন্দর্য, উদ্দেশ্য এবং ঈশ্বরের ধারণা: সেতু নির্মাণ

কান্টের প্রথম ক্রিটিক (বিশুদ্ধ প্রজ্ঞা) আমাদের দেখায় জ্ঞানের জগৎ, যা প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে। দ্বিতীয় ক্রিটিক (ব্যবহারিক প্রজ্ঞা) আমাদের দেখায় নৈতিকতার জগৎ, যা স্বাধীনতার জগৎ। এই দুটি জগৎকে দেখে মনে হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটিতে কার্যকারণ, অন্যটিতে স্বাধীনতা। কান্ট তার তৃতীয় এবং শেষ ক্রিটিক, Critique of Judgment (বিচার-শক্তির সমালোচনা)-এ এই দুই জগতের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণের চেষ্টা করেন।

এই বইতে তিনি দুটি ভিন্ন ধরনের বিচার-বুদ্ধি নিয়ে আলোচনা করেছেন: নান্দনিক বিচার (Aesthetic Judgment) এবং উদ্দেশ্যবাদী বিচার (Teleological Judgment)

নান্দনিকতা এবং মহত্ত্বের বোধ (The Beautiful and The Sublime)

কান্ট প্রশ্ন করলেন, আমরা যখন কোনো কিছুকে ‘সুন্দর’ বলি, তখন আমরা আসলে কী বোঝাই? তিনি বললেন, সৌন্দর্যের অনুভূতি (Feeling of the Beautiful) সার্বজনীন অথচ ব্যক্তিগত। এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে:

  • স্বার্থহীন আনন্দ (Disinterested Satisfaction): একটি সুন্দর গোলাপ ফুল দেখলে আমাদের যে আনন্দ হয়, তা স্বার্থহীন। আমরা ফুলটা খেতে চাই না বা তার কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা খুঁজি না।

  • উদ্দেশ্যহীন উদ্দেশ্যমূলকতা (Purposiveness without a purpose): সুন্দর বস্তুটিকে দেখলে মনে হয়, যেন কেউ একে খুব যত্ন করে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে তৈরি করেছে, কিন্তু সেই উদ্দেশ্যটা কী, তা আমরা বলতে পারি না। বস্তুটির বিভিন্ন অংশের মধ্যে এমন এক সামঞ্জস্য থাকে, যা আমাদের কল্পনা (Imagination) এবং প্রজ্ঞা (Understanding)-কে এক মুক্ত খেলায় (Free Play) মাতিয়ে তোলে, যা আমাদের আনন্দ দেয়।

  • সার্বজনীনতা (Universality): যখন আমি কিছুকে সুন্দর বলি, আমি আশা করি যে অন্যরাও আমার সাথে একমত হবে। আমি বলি না, ‘এটা আমার কাছে সুন্দর’; আমি বলি, ‘এটা সুন্দর’।

সৌন্দর্যের পাশেই কান্ট আলোচনা করেছেন মহৎ (The Sublime)-এর অনুভূতি নিয়ে। যখন আমরা বিশাল কোনো পর্বত, উত্তাল সমুদ্র বা নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশের সামনে দাঁড়াই, তখন আমাদের মনে যে ভয়-মিশ্রিত শ্রদ্ধার অনুভূতি হয়, সেটাই হলো মহত্ত্বের অনুভূতি। এই বিশাল প্রকৃতি আমাদের ইন্দ্রিয়কে পরাভূত করে, আমাদের ক্ষুদ্রতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় (Mathematical Sublime)। অথবা যখন আমরা প্রকৃতির ভয়ংকর শক্তি, যেমন ঝড় বা ভূমিকম্প দেখি, তখন আমাদের শারীরিক অসহায়ত্ব প্রকাশ পায় (Dynamical Sublime)। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের ভেতরের যুক্তিশীল সত্তা জেগে ওঠে এবং আমরা অনুভব করি যে, প্রকৃতির এই বিশালতা বা শক্তির চেয়েও আমাদের নৈতিক সত্তা ও যুক্তি অনেক বেশি মহৎ। আমরা প্রকৃতির কাছে দৈহিকভাবে হেরে গেলেও আত্মিকভাবে জিতে যাই (Zuckert, 2007)। এই অনুভূতিই আমাদের নৈতিক জগতের স্বাধীনতার কথা মনে করিয়ে দেয়।

প্রকৃতিতে উদ্দেশ্য এবং ঈশ্বরের ভূমিকা

কান্ট লক্ষ করলেন, জীবজগৎকে দেখলে মনে হয়, সবকিছুই যেন কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে তৈরি। একটি পাখির ডানা উড়বার জন্য, চোখ দেখবার জন্য। প্রতিটি অঙ্গ যেন পুরো প্রাণীটির টিকে থাকার উদ্দেশ্যের (Purpose) সঙ্গে নিখুঁতভাবে খাপ খেয়ে গেছে।

কান্ট বললেন, আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে পারব না যে, প্রকৃতির কোনো উদ্দেশ্য আছে বা কোনো ঐশ্বরিক কারিগর (Divine Designer) একে তৈরি করেছেন। এটা আমাদের জ্ঞানের (বিশুদ্ধ প্রজ্ঞা) বাইরের বিষয় (নুমেনাল)। কিন্তু আমরা প্রকৃতিকে বোঝার জন্য তাকে ‘যেন’ (as if) কোনো উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে, এভাবেই ভাবতে বাধ্য হই। এটা আমাদের বিচার-শক্তির একটি নিয়ম (Regulative Principle)।

এই সূত্র ধরেই কান্ট ঈশ্বর, অমরত্ব ও স্বাধীনতার প্রশ্নে ফিরে আসেন। প্রথম ক্রিটিকে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, বিশুদ্ধ যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ বা অপ্রমাণ—কোনোটাই করা যায় না। কিন্তু দ্বিতীয় ক্রিটিকে তিনি বললেন, নৈতিকতার স্বার্থে আমাদের তিনটি জিনিসকে স্বতঃসিদ্ধ (Postulate) হিসেবে মেনে নিতে হয়:

  • স্বাধীনতা (Freedom): আগেই বলা হয়েছে, নৈতিকতার জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য।

  • আত্মার অমরত্ব (Immortality of the Soul): নৈতিক আইন আমাদের নৈতিক পূর্ণতা অর্জনের নির্দেশ দেয়। কিন্তু এই জীবনে তা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। তাই আমাদের একটি অনন্ত জীবনকে ধরে নিতে হবে, যেখানে এই পূর্ণতা অর্জন সম্ভব।

  • ঈশ্বরের অস্তিত্ব (Existence of God): নৈতিক আইন আমাদের বলে এমন এক পৃথিবীর জন্য কাজ করতে যেখানে নৈতিক পূর্ণতা (Virtue) এবং সুখ (Happiness) একসাথে থাকে (Summum Bonum বা সর্বোচ্চ ভালো)। কিন্তু আমরা প্রায়ই দেখি, ধার্মিকরা কষ্ট পায় আর অধার্মিকরা সুখী হয়। তাই এমন একজন সর্বশক্তিমান ও নৈতিক সত্তার (ঈশ্বর) অস্তিত্ব মেনে নিতে হবে, যিনি এই মহাবিশ্বে নৈতিকতার নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিশ্চিত করেন যে, শেষ পর্যন্ত ধার্মিকতা ও সুখের সমন্বয় ঘটবে।

অর্থাৎ, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমরা জানতে পারি না, কিন্তু নৈতিক জীবনযাপনের জন্য আমাদের তার ওপর যৌক্তিক বিশ্বাস (Rational Faith) রাখতে হয়। কান্ট এখানে জ্ঞান (Knowledge) এবং বিশ্বাসের (Faith) জন্য আলাদা আলাদা জায়গা করে দিলেন। তার সেই বিখ্যাত উক্তি: “I have… found it necessary to deny knowledge, in order to make room for faith” (Kant, 1781/1998, p. Bxxx)।

কান্টের চোখে শিল্পের স্বাধীনতা: কেন একটি গোলাপ শুধু সুন্দর?

একটু আগেই আলোচনা করলাম, পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস আছে, যা আমাদের কোনো কাজেই লাগে না। একটা সুন্দর গোলাপ ফুল। আমরা ওটা খাই না, ওটা দিয়ে ঘর বানাই না, ওটা গায়ে দিয়ে শীতও তাড়ানো যায় না। তবু গোলাপের দিকে তাকিয়ে আমাদের মন ভালো হয়ে যায়। আমরা বলি, “বাহ্, কী সুন্দর!” মেঘের গায়ে বিকেলের আবির রঙের খেলা, পাখির একটি আকস্মিক সুর, বা নদীর ওপর চাঁদের আলোর ঝিকিমিকি—এগুলো আমাদের কোনো জাগতিক প্রয়োজন মেটায় না। তবু এগুলো আমাদের টানে, মুগ্ধ করে।

কেন এমন হয়? এই ‘সুন্দর’ জিনিসটা আসলে কী?

কনিংসবার্গের সেই নিভৃতচারী দার্শনিক, ইমানুয়েল কান্ট, তার জীবনের পড়ন্ত বেলায় এই প্রশ্নটি নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছিলেন। জ্ঞানের জগৎ আর নৈতিকতার জগতের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণের চেষ্টায় তিনি যখন তার তৃতীয় বিখ্যাত বই Critique of Judgment (বিচার-শক্তির সমালোচনা) লিখছিলেন, তখন তিনি সৌন্দর্যের এই রহস্যময় জগতে প্রবেশ করেন। আর সেখানে তিনি এমন এক বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন, যা শিল্পকলাকে চিরদিনের জন্য গির্জা, রাষ্ট্র আর নৈতিকতার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছিল। তিনি শিল্পের স্বাধীনতার এক নতুন সনদ রচনা করেছিলেন। যে দর্শনের পথ ধরেই পরে জন্ম নিয়েছিল বিখ্যাত স্লোগান: ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ (Art for Art’s Sake)।

চলুন, আজ আমরা কান্টের চোখে দেখি, শিল্প কেন স্বাধীন, কেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সুন্দর হওয়া, আর এই ধারণাটি কীভাবে গোটা পৃথিবীর শিল্প-ভাবনাকে বদলে দিয়েছিল।

কান্টের আগে শিল্পের জগৎ: দায়বদ্ধতার শৃঙ্খল

কান্টের আগে শিল্প ছিল অনেকটাই পরাধীন। শিল্পকে সবসময় কোনো না কোনো বৃহত্তর উদ্দেশ্যের ‘দাস’ হয়ে থাকতে হতো। একজন শিল্পী যখন ছবি আঁকতেন বা ভাস্কর্য গড়তেন, তখন তার কাজের মূল্য বিচার করা হতো কয়েকটি বাহ্যিক মানদণ্ডে:

  • ১. ধর্মীয় উদ্দেশ্য: শিল্পের একটি বড় কাজ ছিল ধর্মীয় বার্তা প্রচার করা। গির্জার ভেতরের বিশাল চিত্রকর্মগুলো বাইবেলের গল্প বলত, মানুষকে ঈশ্বরের মহিমা স্মরণ করিয়ে দিত, বা পাপের ভয় দেখাত। শিল্পের সৌন্দর্য এখানে মুখ্য ছিল না; মুখ্য ছিল তার ধর্মীয় উপযোগিতা।
  • ২. নৈতিক উদ্দেশ্য: প্লেটোর সময় থেকেই শিল্পকে নৈতিকতার মানদণ্ডে বিচার করা হতো। প্লেটো মনে করতেন, শিল্প যদি সমাজে ভালো নৈতিকতার প্রচার না করে, তাহলে তা বর্জনীয়। শিল্পকে হতে হবে নৈতিকগুণসম্পন্ন (Virtuous), মানুষকে ভালো নাগরিক হতে শেখাতে হবে।
  • ৩. সত্যের অনুকরণ (Mimesis): অ্যারিস্টটলের পর থেকে একটি প্রভাবশালী ধারণা ছিল যে, শিল্পের কাজ হলো বাস্তব জগৎকে অনুকরণ করা। একটি ছবি ততটাই ভালো, যতটা নিখুঁতভাবে তা বাস্তবকে ফুটিয়ে তুলতে পারে। একজন চিত্রকরের মূল দক্ষতা ছিল প্রকৃতিকে হুবহু ক্যানভাসে নকল করা।
  • ৪. জ্ঞান প্রদান: শিল্পকে অনেক সময় জ্ঞান বা তথ্য দেওয়ার মাধ্যম হিসেবেও দেখা হতো। ঐতিহাসিক ঘটনা বা পৌরাণিক কাহিনীকে ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হতো, যাতে মানুষ তা দেখে শিখতে পারে।

এই সমস্ত ক্ষেত্রেই শিল্প ছিল একটি উপায় (Means), কোনো উচ্চতর উদ্দেশ্যের (End) জন্য। সৌন্দর্য ছিল একটি বাড়তি পাওনা, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ছিল অন্য কিছু—ধর্ম, নৈতিকতা, জ্ঞান বা অনুকরণ। শিল্প যেন এক দায়বদ্ধতার শৃঙ্খলে বাঁধা ছিল।

কান্ট এসে এই শৃঙ্খলটিকেই ভেঙে দিলেন।

সৌন্দর্যের অনুভূতি: এক স্বার্থহীন আনন্দ

কান্ট তার বিশ্লেষণ শুরু করলেন একটি খুব সাধারণ প্রশ্ন দিয়ে: আমরা যখন কোনো কিছুকে ‘সুন্দর’ বলি, তখন আমাদের মনের ভেতরে ঠিক কী ঘটে? তিনি বললেন, সৌন্দর্যের অনুভূতি (Feeling of the Beautiful) অন্য সব অনুভূতি থেকে আলাদা। এর কয়েকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে।

এর প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি স্বার্থহীন (Disinterested)

ব্যাপারটা বুঝতে একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আপনার সামনে একটি পাকা, রসালো আম রাখা আছে। আপনি বললেন, “আমটা খুব সুন্দর।” এখানে আপনার ‘সুন্দর’ বলার পেছনে একটি তীব্র স্বার্থ (Interest) কাজ করছে। আপনি আমটা খেতে চান। আপনার ইন্দ্রিয় (জিহ্বা, নাক) সেই ফলটি ভোগ করার জন্য উদগ্রীব। এই ধরনের অনুভূতিকে কান্ট বলেন মনোগ্রাহী (The Agreeable)। যা আমাদের ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয় সুখ দেয়, তাই মনোগ্রাহী। এটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। আপনার হয়তো আম ভালো লাগে, আমার লাগে না।

এবার ভাবুন একটি সুন্দর গোলাপ ফুলের কথা। আপনি যখন ফুলটিকে ‘সুন্দর’ বলেন, তখন আপনার মনে কোনো স্বার্থ কাজ করে না। আপনি ফুলটা খেতে চান না, ওটা বিক্রি করে টাকা কামাতে চান না, বা ওটা দিয়ে অন্য কোনো কাজ সারতে চান না। আপনি কেবল ফুলটির রূপ (Form), তার পাপড়ির বিন্যাস, তার রঙের বিন্যাস দেখে এক ধরনের বিশুদ্ধ আনন্দ পান। এই আনন্দটাই হলো সৌন্দর্যের আনন্দ। এটা স্বার্থহীন, কারণ এটা আমাদের কোনো প্রয়োজন বা কামনা মেটায় না (Kant, 1790/2000)।

এই ‘স্বার্থহীনতা’র ধারণাটিই ছিল বৈপ্লবিক। এর মানে হলো, সৌন্দর্যের বিচার করার সময় আমরা বস্তুটির অস্তিত্ব আছে কি না, বা তা আমাদের কোনো কাজে লাগবে কি না—এইসব প্রশ্ন থেকে নিজেদের মুক্ত রাখি। আমরা কেবল তার রূপের দিকেই মনোযোগ দিই।

উদ্দেশ্যহীন উদ্দেশ্যমূলকতা: শিল্পের অদ্ভুত যুক্তি

কান্টের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি প্রথমটির চেয়েও কিছুটা জটিল, কিন্তু দারুণ মজার। তিনি বললেন, সুন্দর বস্তুর মধ্যে আমরা এক ধরনের ‘উদ্দেশ্যমূলকতা’ (Purposiveness) দেখতে পাই, কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট ‘উদ্দেশ্য’ (Purpose) খুঁজে পাই না। এই ধারণাটির নাম উদ্দেশ্যহীন উদ্দেশ্যমূলকতা (Purposiveness without a Purpose)

আবার উদাহরণে ফেরা যাক। একটি হাতঘড়ির দিকে তাকান। তার প্রতিটি যন্ত্রাংশ—কাঁটা, স্প্রিং, ডায়াল—একে অপরের সাথে নিখুঁতভাবে খাপ খেয়ে গেছে। তাদের সবার একটি সম্মিলিত উদ্দেশ্য আছে: সঠিক সময় দেখানো। এখানে উদ্দেশ্যমূলকতাও আছে, আবার একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্যও আছে।

এবার সেই গোলাপ ফুলটির দিকে আবার তাকান। তার পাপড়িগুলোর বিন্যাস, রঙের আভা, পাতার আকৃতি—সবকিছু মিলে এমন এক সামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে, যা দেখলে মনে হয় যেন কোনো এক মহান শিল্পী খুব যত্ন করে, কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে এটি ডিজাইন করেছেন। সবকিছু এত নিখুঁতভাবে মিলে গেছে! অর্থাৎ, এখানে আমরা একটি ‘উদ্দেশ্যমূলকতা’ বা ডিজাইনের ছাপ দেখতে পাই।

কিন্তু সেই উদ্দেশ্যটা কী? গোলাপের এমন সুন্দর হওয়ার উদ্দেশ্য কী? সময় দেখানো? কোনো কাজ করা? না। আমরা কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য খুঁজে পাই না। তার একমাত্র ‘উদ্দেশ্য’ যেন সুন্দর হওয়াটাই। সুন্দর বস্তু আমাদের কাছে এমনভাবে প্রতিভাত হয়, যেন তা একটি উদ্দেশ্যের জন্য তৈরি, কিন্তু সেই উদ্দেশ্যটি আমরা ধারণার (Concept) মাধ্যমে নির্দিষ্ট করতে পারি না।

কান্ট বললেন, ঠিক এই কারণেই সৌন্দর্য আমাদের আনন্দ দেয়। যখন আমরা একটি সুন্দর বস্তু দেখি, তখন আমাদের মনের দুটি প্রধান শক্তি—কল্পনা (Imagination) এবং প্রজ্ঞা (Understanding)—এক মুক্ত খেলায় (Free Play) মেতে ওঠে। কল্পনা বস্তুটির বিভিন্ন রূপকে একত্রিত করে, আর প্রজ্ঞা সেই রূপের মধ্যে একটি নিয়ম বা ধারণা খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট ধারণা (যেমন ‘চেয়ার’ বা ‘টেবিল’) পাওয়া যায় না, তাই এই দুটি শক্তি কোনো সিদ্ধান্তে না পৌঁছে একে অপরের সাথে খেলতে থাকে। এই মুক্ত, সামঞ্জস্যপূর্ণ খেলাই আমাদের মনে এক ধরনের বিশুদ্ধ আনন্দ তৈরি করে, যাকে আমরা বলি সৌন্দর্যের অনুভূতি (Guyer, 2005)।

শিল্পের জন্ম: প্রতিভার রহস্য

তাহলে এই সুন্দর শিল্পকর্ম তৈরি হয় কীভাবে? যদি সৌন্দর্য কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে না চলে, তাহলে শিল্পী কীভাবে তা তৈরি করেন?

এর উত্তরে কান্ট নিয়ে এলেন প্রতিভা (Genius)-র ধারণা। তিনি বললেন, শিল্পকর্ম নিছক নিয়মকানুন শিখে বা কঠোর পরিশ্রম করে তৈরি করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন এক বিশেষ ধরনের সহজাত ক্ষমতা, যার নাম প্রতিভা।

কান্টের মতে, প্রতিভা হলো:

“The innate mental predisposition (ingenium) through which nature gives the rule to art.”
(প্রতিভা হলো সেই সহজাত মানসিক ক্ষমতা, যার মাধ্যমে প্রকৃতিই শিল্পকে তার নিয়মকানুন প্রদান করে।)

অর্থাৎ, প্রতিভাবান শিল্পী নিজেও হয়তো জানেন না তিনি কীভাবে একটি অসাধারণ শিল্পকর্ম তৈরি করেন। তিনি কোনো নির্দিষ্ট সূত্র অনুসরণ করেন না। প্রকৃতি যেন তার মাধ্যমেই শিল্পের জন্য নতুন নিয়ম তৈরি করে।

প্রতিভার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে:

  • মৌলিকতা (Originality): প্রতিভা কখনোই অনুকরণ করে না। সে নতুন কিছু তৈরি করে, যা আগে ছিল না।

  • অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত (Exemplary): প্রতিভাবান শিল্পীর কাজ অন্যদের জন্য একটি মডেল বা দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। অন্য শিল্পীরা তার কাজ থেকে শেখে, কিন্তু তারা তাকে হুবহু নকল করতে পারে না।

  • অ-ব্যাখ্যাযোগ্য (Inexplicable): প্রতিভা তার নিজের প্রক্রিয়াকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। শিল্পী বলতে পারেন না তিনি ঠিক কোন কোন নিয়ম মেনে কাজটি করেছেন। এটা যেন তার ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে।

এই প্রতিভার ধারণাও রোমান্টিক আন্দোলনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল, যেখানে শিল্পীকে একজন সাধারণ কারিগরের ঊর্ধ্বে এক রহস্যময়, ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন স্রষ্টা হিসেবে দেখা হতো।

‘শিল্পের জন্য শিল্প’: স্বাধীনতার ঘোষণা

কান্টের এই সমস্ত ধারণাগুলোকে যদি আমরা একসাথে করি, তাহলে কী দাঁড়ায়?

  • ১. সৌন্দর্যের অনুভূতি স্বার্থহীন।
  • ২. সুন্দর বস্তুর কোনো বাহ্যিক, জাগতিক উদ্দেশ্য নেই।
  • ৩. শিল্পকর্ম কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তৈরি হয় না, তা প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি।

এই তিনটি ধারণার সম্মিলিত ফলই হলো ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ বা নান্দনিক স্বশাসন (Aesthetic Autonomy)-এর দর্শন। কান্ট সরাসরি “l’art pour l’art” এই ফরাসি বাক্যটি ব্যবহার করেননি (এটি পরে থিওফিল গতিয়ের মতো ফরাসি লেখকদের হাতে জনপ্রিয় হয়), কিন্তু তিনি এর জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী দার্শনিক ভিত্তিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন।

তার দর্শনের মানে হলো:

  • একটি শিল্পকর্মকে তার নিজের শর্তেই বিচার করতে হবে। তাকে নৈতিক কি না, ধার্মিক কি না, বা বাস্তবসম্মত কি না—এই প্রশ্নগুলো অবান্তর। শিল্পের একমাত্র বিচার্য বিষয় হলো, তা নান্দনিকভাবে সফল কি না। অর্থাৎ, তা কি আমাদের মধ্যে সেই স্বার্থহীন আনন্দ এবং কল্পনা ও প্রজ্ঞার মুক্ত খেলা জাগিয়ে তুলতে পারছে?

  • শিল্পীর একমাত্র দায়বদ্ধতা শিল্পের প্রতি, সৌন্দর্যের প্রতি। তাকে সমাজ বা রাষ্ট্রের ফরমায়েশ শোনার দরকার নেই। তার কাজ মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া নয়, বা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করা নয়। তার কাজ হলো সুন্দর সৃষ্টি করা।

  • শিল্পের মূল্য তার নিজের মধ্যেই নিহিত। তাকে অন্য কোনো কিছুর মাধ্যমে নিজের উপযোগিতা প্রমাণ করতে হবে না। একটি সুন্দর কবিতা বা একটি সুন্দর সুরের অস্তিত্বই তার চূড়ান্ত সার্থকতা।

এইভাবে কান্ট শিল্পকে সব ধরনের উপযোগিতাবাদী (Utilitarian) বিচার থেকে মুক্ত করলেন। তিনি শিল্পকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাজ্যের মর্যাদা দিলেন, যার নিজস্ব আইন এবং নিজস্ব মূল্য রয়েছে (Zuckert, 2007)।

কান্টের দীর্ঘ ছায়া: আধুনিক শিল্পের জন্ম

কান্টের এই নান্দনিক বিপ্লবের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি কেবল দর্শনের বইয়ের পাতায় আটকে থাকেনি, বরং ছবি আঁকার স্টুডিও থেকে শুরু করে কনসার্ট হল পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।

  • রোমান্টিসিজম থেকে আধুনিকতাবাদ: কান্টের দর্শন রোমান্টিক শিল্পীদের জন্য ছিল এক মুক্তির সনদ। তারা নিজেদের আর নিছক কারিগর ভাবতেন না, ভাবতেন ‘প্রতিভাবান’ স্রষ্টা হিসেবে। শিল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে তারা ব্যক্তিগত অনুভূতি ও কল্পনার প্রকাশকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। এই পথ ধরেই পরে জন্ম নেয় আধুনিকতাবাদ (Modernism)

  • বিমূর্ত শিল্পের ভিত্তি: ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন বিমূর্ত শিল্পের (Abstract Art) জন্ম হয়, তখন তার পেছনেও কান্টের দর্শনের পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। কান্টই প্রথম জোরালোভাবে বলেন যে, শিল্পের সৌন্দর্য তার অনুকরণের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না, বরং তার রূপ বা ফর্ম (Form)-এর ওপর নির্ভর করে। এই ধারণাটিই ভ্যাসিলি ক্যান্ডিনস্কি (Wassily Kandinsky) বা পিট মন্ড্রিয়ান (Piet Mondrian)-এর মতো শিল্পীদের জন্য পথ খুলে দেয়। তারা দেখান যে, বাস্তব জগতের কোনো বস্তুকে অনুকরণ না করেও, শুধু রঙ, রেখা এবং আকারের বিন্যাসের মাধ্যমেই একটি শক্তিশালী নান্দনিক অনুভূতি তৈরি করা সম্ভব। একটি বিমূর্ত ছবিকে যখন আমরা সুন্দর বলি, তখন আমরা কান্টের দেখানো পথেই হাঁটি—কারণ আমরা তার কোনো জাগতিক অর্থ খুঁজি না, কেবল তার ফর্মের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিই।

  • নান্দনিক সমালোচনা (Aesthetic Criticism): কান্টের পর থেকে শিল্প সমালোচনার একটি নতুন ধারার জন্ম হয়, যা ‘ফর্মালিস্ট ক্রিটিসিজম’ নামে পরিচিত। এই ধারার সমালোচকরা একটি শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু (Content) বা তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের চেয়ে তার ফর্ম বা গঠনশৈলীর ওপর বেশি জোর দেন। তারা বিচার করেন, শিল্পী তার উপাদানগুলোকে (রঙ, রেখা, শব্দ, ভাষা) কতটা সফলভাবে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সুন্দর রূপে বিন্যস্ত করতে পেরেছেন।

শিল্পের স্বাধীনতায় আমাদের আনন্দ

কান্ট আমাদের শিখিয়েছেন, জগৎকে দেখার দুটি ভিন্ন চশমা আছে। একটি হলো জ্ঞানের চশমা, যা দিয়ে আমরা কার্যকারণ খুঁজি, বস্তুর উপযোগিতা বিচার করি। আরেকটি হলো সৌন্দর্যের চশমা, যা দিয়ে আমরা জগৎকে কোনো স্বার্থ ছাড়াই, কেবল তার রূপের জন্য উপভোগ করি।

তিনি দেখিয়েছেন যে, শিল্প আমাদের কোনো কিছু শেখানোর জন্য বা কোনো কাজ করার জন্য নয়। শিল্প আমাদের জন্য এক মুক্ত খেলার মাঠ তৈরি করে দেয়। সেখানে আমাদের মন সব নিয়মকানুন আর দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনভাবে খেলতে পারে। আর সেই খেলার আনন্দই হলো সৌন্দর্যের আনন্দ।

পরেরবার যখন কোনো শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়াবেন—হোক তা কোনো জাদুঘরের দেয়ালে টাঙানো ছবি, কোনো কনসার্ট হলে বাজানো সুর, বা বইয়ের পাতায় লেখা একটি কবিতা—তখন তাকে কোনো অর্থ বা উপযোগিতার নিক্তিতে মাপার চেষ্টা না করে, এক মুহূর্তের জন্য কান্টের কথা ভাববেন। শিল্পটি আপনাকে কোনো বার্তা দিচ্ছে কি না, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে শুধু অনুভব করার চেষ্টা করুন, আপনার মনের ভেতরে কল্পনা আর প্রজ্ঞার সেই মুক্ত খেলাটা শুরু হয়েছে কি না।

যদি হয়, তবে আপনি শিল্পের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছেন। আর সেই উদ্দেশ্য হলো—কোনো উদ্দেশ্য না থাকা। শিল্পের এই স্বাধীনতায়, এই উদ্দেশ্যহীনতায়ই তার আসল মহিমা এবং আমাদের পরম আনন্দ। কনিংসবার্গের সেই দার্শনিক আমাদের এই সহজ কিন্তু গভীর সত্যটিই শিখিয়ে গেছেন।

চিরস্থায়ী শান্তির স্বপ্ন

জীবনের শেষ দিকে কান্ট রাজনীতি নিয়েও গভীরভাবে ভেবেছিলেন। তার একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ হলো Perpetual Peace: A Philosophical Sketch (চিরস্থায়ী শান্তির রূপরেখা)। এতে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে দেশগুলোর মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তার প্রস্তাবগুলো আজকের দিনেও আশ্চর্যজনকভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, শান্তির জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে:

  • রাষ্ট্রগুলোকে হতে হবে প্রজাতান্ত্রিক (Republican): যেখানে শাসনক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে থাকবে, ক্ষমতার পৃথকীকরণ থাকবে এবং নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। কান্টের ধারণা ছিল, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা কম। কারণ, যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হলে নাগরিকদের সম্মতি লাগবে, আর সাধারণ নাগরিকরাই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।

  • রাষ্ট্রগুলোর ফেডারেশন (Federation of Free States): এই প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি স্বাধীন ফেডারেশন (League of Nations-এর মতো) তৈরি করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করবে এবং দেশগুলোর মধ্যে বিবাদ মীমাংসা করবে।

  • সার্বজনীন আতিথেয়তার অধিকার (Cosmopolitan Right to Universal Hospitality): প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার থাকবে অন্য কোনো দেশে শান্তিপূর্ণভাবে প্রবেশ করার এবং তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা হবে না।

তার এই ধারণাটিই পরে ‘গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব’ (Democratic Peace Theory) নামে পরিচিতি লাভ করে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বে পরিণত হয়।

কনিংসবার্গের ভূত: কান্টের দীর্ঘ ছায়া

বড় বিপ্লবগুলো সবসময় খুব হইচই করে আসে না। কখনও কখনও তা আসে এক নিভৃতচারী, ঘড়ির কাঁটা-ধরা মানুষের হাত ধরে। ইমানুয়েল কান্ট ছিলেন তেমনই একজন। তিনি তরবারি হাতে নেননি, কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেননি। তিনি শুধু তার ছোট্ট শহর কনিংসবার্গের একটি পড়ার ঘরে বসে ভেবেছেন আর লিখেছেন। কিন্তু তার সেই ভাবনার শক্তি ছিল পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি। তার দর্শনের ঢেউ কেবল দর্শনের জগতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তা ছড়িয়ে পড়েছে বিজ্ঞান, রাজনীতি, শিল্পকলা, আইন এবং এমনকি আমাদের দৈনন্দিন নৈতিক চিন্তার গভীরে।

কান্টের মৃত্যুর পর দুই শতাব্দীরও বেশি সময় কেটে গেছে। কিন্তু তার চিন্তার ভূত আজও আমাদের তাড়া করে ফেরে। আমরা সচেতনভাবে তার কথা ভাবি বা না ভাবি, আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, যে ভাষায় চিন্তা করি, যে নৈতিক কাঠামোয় আমাদের ভালো-মন্দ বিচার করি—তার অনেকটাই কান্টের হাতে গড়া। তার প্রভাব এতটাই গভীর এবং সর্বব্যাপী যে, তাকে এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আধুনিক চিন্তার জগৎটা যেন এক বিশাল অট্টালিকা, আর কান্ট হলেন সেই অট্টালিকার প্রধান স্থপতি, যার নকশা ছাড়া বাকিদের কাজ করাই মুশকিল।

চলুন, আজ আমরা কান্টের সেই দীর্ঘ ছায়া অনুসরণ করে দেখি, কীভাবে কনিংসবার্গের সেই একাকী দার্শনিকের ভূত আজও আমাদের জগৎকে শাসন করে চলেছে।

দর্শনের নতুন ঈশ্বরেরা: জার্মান আদর্শবাদের জন্ম

কান্টের দর্শনের প্রভাব সবচেয়ে প্রথমে এবং সবচেয়ে তীব্রভাবে পড়েছিল তার নিজের দেশের দার্শনিকদের ওপর। কান্টের পর জার্মানির দর্শনের আকাশে যেন এক নতুন নক্ষত্রপুঞ্জের জন্ম হয়, যা জার্মান ভাববাদ (German Idealism) নামে পরিচিত। এই ধারার প্রধান তিন পুরোধা—ইয়োহান গটলিব ফিকটে (Johann Gottlieb Fichte), ফ্রেডরিখ শেলিং (Friedrich Schelling) এবং গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রেডরিখ হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel)—ছিলেন এক অর্থে কান্টেরই ভাবনার সন্তান, যদিও তারা ছিলেন কিছুটা বিদ্রোহী সন্তান।

কান্ট একটি দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ ফেনোমেনা (Phenomena) বা প্রতিভাত জগতের মধ্যে। এর পেছনের আসল জগৎ, অর্থাৎ নুমেনা (Noumena) বা বস্তুসত্তা, আমাদের জানার বাইরে। জার্মান ভাববাদীরা কান্টের এই দেয়ালটিকে মেনে নিতে পারেননি। তাদের কাছে এটা ছিল এক অসহনীয় সীমাবদ্ধতা। তারা ভাবলেন, কান্ট যে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছেন, আমরা সেই দরজাটাই ভাঙব।

  • ফিকটে কান্টের ‘আমি’ (I বা Ego)-কে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করলেন। তিনি বললেন, জগৎ মূলত আমাদের চেতনারই সৃষ্টি। কান্ট যেখানে বলেছিলেন মন জগৎকে আকার দেয়, ফিকটে সেখানে প্রায় বলে বসলেন, মনই জগৎকে তৈরি করে।

  • হেগেল, যিনি সম্ভবত কান্টের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক, কান্টের দর্শনকে একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখলেন। কান্ট যেখানে জ্ঞান, নৈতিকতা ইত্যাদির চিরস্থায়ী কাঠামো খুঁজেছিলেন, হেগেল সেখানে দেখালেন যে, চেতনা (Spirit বা Geist) ইতিহাসের মধ্য দিয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে উন্মোচিত করে। হেগেলের মতে, কান্টের ‘নুমেনা’ কোনো অজ্ঞেয় জগৎ নয়, বরং তা হলো চেতনার সেই রূপ, যা তখনও পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। হেগেলের বিখ্যাত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি (Dialectic) ছিল কান্টের চিন্তার প্যারাডক্সগুলোকে (Antinomies) সমাধান করে একটি উচ্চতর সংশ্লেষণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা (Beiser, 2005)।

এককথায়, কান্ট দর্শনের জন্য যে প্রশ্নগুলো তৈরি করেছিলেন, জার্মান ভাববাদীরা সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যদিও তাদের উত্তরগুলো কান্টের নিজের পছন্দের হতো না। কিন্তু তারা যে প্রশ্নগুলো নিয়ে কাজ করেছেন, সেই খেলার মাঠটা তৈরি করে দিয়েছিলেন কান্ট নিজেই।

জ্ঞানের মানচিত্র বদল: আমরা যেভাবে জগৎকে দেখি

কান্টের আগে দর্শনের মূল যুদ্ধ ছিল বুদ্ধিবাদ (Rationalism) আর অভিজ্ঞতাবাদের (Empiricism) মধ্যে। কান্ট এসে এই দুই শিবিরের মধ্যে একটি যুগান্তকারী সন্ধি স্থাপন করলেন। তিনি দেখালেন যে, জ্ঞান তৈরিতে যুক্তি এবং অভিজ্ঞতা—দুটোই অপরিহার্য। তার বিখ্যাত উক্তি, “ধারণা ছাড়া সংবেদন অন্ধ, আর সংবেদন ছাড়া ধারণা অন্তঃসারশূন্য,” দর্শনের একটি নতুন পথের দিশা দিয়েছিল।

কান্টের এই ‘কোপার্নিকান বিপ্লব’-এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী:

  • গঠনবাদ (Constructivism): কান্টের এই ধারণা যে, আমাদের মন নিষ্ক্রিয়ভাবে তথ্য গ্রহণ করে না, বরং সক্রিয়ভাবে জ্ঞান গঠন করে—এটিই পরবর্তীকালের গঠনবাদী চিন্তার মূল ভিত্তি। মনোবিজ্ঞানে জ্যাঁ পিয়াজে (Jean Piaget) বা শিক্ষাদর্শনে জন ডিউই (John Dewey)-এর মতো চিন্তাবিদদের কাজে কান্টের এই ধারণার স্পষ্ট প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তারা দেখিয়েছেন, শিশুরা বা শিক্ষার্থীরাও নিষ্ক্রীয়ভাবে জ্ঞান অর্জন করে না, তারা তাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে নিজেদের জগৎ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে।

  • ফেনোমেনোলজি (Phenomenology): বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক ধারা হলো ফেনোমেনোলজি, যার প্রতিষ্ঠাতা এডমন্ড হুসার্ল (Edmund Husserl)। হুসার্লের লক্ষ্য ছিল চেতনার গঠন বা কাঠামোকে সরাসরি বিশ্লেষণ করা। তিনি ‘ব্র্যাকেটিং’ (Bracketing) বা বাইরের জগতের অস্তিত্বের প্রশ্নকে সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে কেবল চেতনার অভিজ্ঞতার ওপর মনোযোগ দেওয়ার কথা বলেন। এই প্রকল্পটি গভীরভাবে কান্টীয়। কান্ট যেমন মনের কাঠামো (Categories) বিশ্লেষণ করেছিলেন, হুসার্লও তেমনি চেতনার কাঠামোর দিকে নজর দিয়েছিলেন (Moran, 2000)।

কান্টের পর থেকে দর্শন আর আগের মতো নেই। জগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কীভাবে সম্ভব—এই প্রশ্নটিই দর্শনের কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হয়ে ওঠে এবং প্রায় সব দার্শনিককেই কোনো না কোনোভাবে কান্টের এই প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।

মানুষ যখন নিজেই নিজের আইন: নৈতিকতা ও মানবাধিকারের ভিত্তি

কান্টের প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় নৈতিকতা এবং রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে। তার শর্তহীন অনুজ্ঞা (Categorical Imperative) এবং মানুষের অন্তর্নিহিত মর্যাদা (Dignity)-র ধারণা আধুনিক বিশ্বের নৈতিক ও আইনি কাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে।

  • মানবাধিকারের ভিত্তি: কান্ট বলেছিলেন, প্রত্যেক যুক্তিশীল জীবকে সবসময় একটি উদ্দেশ্য (End) হিসেবে গণ্য করতে হবে, কখনোই কেবল উপায় (Means) হিসেবে নয়। এর মানে হলো, প্রত্যেক মানুষের একটি পরম মূল্য আছে, যা তার যোগ্যতা, সম্পদ বা সামাজিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে না। এই ধারণাটিই হলো আধুনিক মানবাধিকার (Human Rights) ঘোষণার দার্শনিক ভিত্তি। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে যে বলা হয়েছে, “All human beings are born free and equal in dignity and rights”—এর পেছনে কান্টের ভূতের ছায়া অত্যন্ত স্পষ্ট।

  • স্বায়ত্তশাসনের ধারণা: কান্টের নৈতিকতার মূলে রয়েছে স্বায়ত্তশাসন (Autonomy) বা নিজের জন্য নিজের আইন তৈরি করার ধারণা। এই ধারণাটি আধুনিক গণতন্ত্রউদারতাবাদের (Liberalism) প্রাণভোমরা। একজন নাগরিক তখনই স্বাধীন, যখন সে এমন আইনের অধীনে থাকে, যা তৈরিতে তার নিজের সম্মতি আছে। এই ধারণাটি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির স্বাধীনতার সবচেয়ে শক্তিশালী দার্শনিক যুক্তিগুলোর একটি।

  • জন রলসের ন্যায়বিচার তত্ত্ব: বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দার্শনিক জন রলস (John Rawls) তার বিখ্যাত বই A Theory of Justice-এ একটি ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ কেমন হবে, তা নির্ধারণের জন্য একটি চিন্তা-পরীক্ষার (Thought Experiment) প্রস্তাব দেন, যার নাম ‘অজ্ঞতার আবরণ’ (Veil of Ignorance)। তিনি বলেন, কল্পনা করুন কিছু যুক্তিশীল মানুষ একটি সমাজের নিয়মকানুন তৈরি করতে বসেছে, কিন্তু তারা কেউ জানে না যে সেই সমাজে তাদের নিজের অবস্থান কী হবে—তারা ধনী হবে না গরিব, নারী হবে না পুরুষ, কোন জাতি বা ধর্মের হবে। এই অজ্ঞতার আবরণ ভেদ করে তারা যে নিয়মগুলো তৈরি করবে, সেটাই হবে সবচেয়ে ন্যায্য। এই পুরো প্রকল্পটি অত্যন্ত কান্টীয়। রলসের যুক্তিশীল প্রতিনিধিরা হলেন কান্টের স্বায়ত্তশাসিত নৈতিক কর্তারই রাজনৈতিক সংস্করণ (Rawls, 1971)।

চিরস্থায়ী শান্তির নকশা: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত

কান্ট তার প্রবন্ধ Perpetual Peace (চিরস্থায়ী শান্তি)-এ দেশগুলোর মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। তার প্রস্তাবগুলো ছিল: রাষ্ট্রগুলোকে হতে হবে প্রজাতান্ত্রিক (Republican), তাদের একটি ফেডারেশন তৈরি করতে হবে, এবং স্থায়ী সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে তুলে দিতে হবে।

আজকের দিনে এই কথাগুলোকে হয়তো খুব আদর্শবাদী মনে হতে পারে, কিন্তু এর প্রভাব প্রচণ্ড রকমের:

  • আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান: কান্টের এই ফেডারেশনের ধারণাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিগ অফ নেশনস (League of Nations) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ (United Nations) গঠনের অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল। আন্তর্জাতিক আইন এবং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশগুলোর মধ্যেকার বিবাদ মীমাংসার যে চেষ্টা আজ আমরা দেখি, তার দার্শনিক ভিত্তি কান্টই স্থাপন করেছিলেন।

  • গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব (Democratic Peace Theory): কান্টের এই ধারণা যে, প্রজাতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সাথে যুদ্ধে জড়ায় না—এটিই আজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। এম্পরিকাল গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সম্ভাবনা সত্যিই খুব কম। এই তত্ত্বটি আজ বিশ্বের বহু দেশের বিদেশ নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সৌন্দর্যের নতুন ঠিকানা: শিল্পকলা ও রোমান্টিসিজম

কান্টের প্রভাব কেবল দর্শন বা রাজনীতির মতো গুরুগম্ভীর জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি শিল্পকলা ও সৌন্দর্য নিয়েও ভেবেছিলেন এবং তার চিন্তাধারা শিল্প-সাহিত্যের গতিপথকেও প্রভাবিত করেছিল।

কান্ট তার Critique of Judgment বইতে বলেন, সৌন্দর্য কোনো বস্তুর অন্তর্নিহিত ধর্ম নয়, বরং এটি আমাদের মনের এক বিশেষ ধরনের বিচার-প্রক্রিয়ার ফল। তিনি সুন্দর (The Beautiful) এবং মহৎ (The Sublime)-এর মধ্যে পার্থক্য করেন। সুন্দর আমাদের মনে আনে শান্ত সামঞ্জস্যের অনুভূতি, আর মহৎ (যেমন—বিশাল পর্বত বা উত্তাল সমুদ্র) আমাদের ইন্দ্রিয়কে পরাভূত করে এক ভয়-মিশ্রিত শ্রদ্ধার জন্ম দেয়।

এই ধারণাগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিক আন্দোলন (Romantic Movement)-এর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। রোমান্টিক কবি, শিল্পী এবং সুরকাররা কান্টের ‘মহৎ’-এর ধারণায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারা প্রকৃতির বিশাল, ভয়ংকর ও অনিয়ন্ত্রিত রূপের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা খুঁজে পেতেন। শিল্পী কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখের (Caspar David Friedrich) আঁকা কুয়াশার সমুদ্রে দাঁড়িয়ে থাকা একাকী পথিকের ছবি বা বিঠোভেনের (Beethoven) সিম্ফনির নাটকীয়তা—এগুলোর মধ্যে কান্টের ‘সাবলাইম’-এর অনুভূতি মূর্ত হয়ে উঠেছে (Zamir, 2007)।

যে ছায়া আমাদের ছাড়েনি

তাহলে, কান্টের প্রভাবের সারমর্ম কী? তিনি আমাদের চিন্তার জন্য একটি নতুন ব্যাকরণ তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন: আমাদের জ্ঞানের সীমা কতটুকু? নৈতিকতার ভিত্তি কী? স্বাধীনতার মানে কী? একটি ন্যায্য সমাজ কেমন হওয়া উচিত?

আমরা হয়তো তার সব উত্তরে একমত না-ও হতে পারি। বহু দার্শনিক কান্টের সমালোচনা করেছেন, তার চিন্তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কান্টের সমালোচনা করতে গেলেও তার তৈরি করা ভাষাতেই কথা বলতে হয়। তিনি যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন, সেই প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

কনিংসবার্গের সেই একাকী পথচারী আজ আর নেই। তার নিয়মিত হাঁটার সেই ‘দার্শনিকের পথ’ হয়তো এখন অন্য কোনো নামে পরিচিত। কিন্তু তার ভূত রয়ে গেছে। আমাদের চিন্তার প্রতিটি কোণায়, আমাদের যুক্তির প্রতিটি ধাপে, আমাদের মানবাধিকারের প্রতিটি ঘোষণায় এবং আমাদের শান্তির প্রতিটি স্বপ্নে—সেই ভূতের দীর্ঘ ছায়া আজও আমাদের অনুসরণ করে। তিনি এমন কিছু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছেন, যার ওপর দাঁড়িয়েই আমরা আজকের পৃথিবীটাকে দেখি, বুঝি এবং বদলানোর চেষ্টা করি।

উপসংহার: কনিংসবার্গের সেই একাকী পথচারী

তাহলে, কে ছিলেন এই ইমানুয়েল কান্ট?

তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, যিনি দর্শনের দুটি প্রধান ধারা—যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ—এর মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন। তিনি জ্ঞানের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন, সেই সীমানার ভেতরে বিজ্ঞান কীভাবে সম্ভব। আবার, সেই সীমানার বাইরে নৈতিকতা, বিশ্বাস আর স্বাধীনতার জগৎকে তিনি উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, প্রত্যেক মানুষের মর্যাদা আছে, কারণ আমরা যুক্তিশীল এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রাণী। আমাদের শিখিয়েছেন, নৈতিকতা মানে শুধু ভালো কাজ করা নয়, বরং সঠিক কাজটি সঠিক কারণে করা—কর্তব্যের খাতিরে। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, সৌন্দর্য কেবল বস্তুর মধ্যে থাকে না, আমাদের মনের বিশেষ ধরনের বিচার-শক্তির মধ্যেও থাকে।

কনিংসবার্গের সেই ঘড়ির কাঁটা মেলানো মানুষটি তার নিস্তরঙ্গ জীবনে বসে মানুষের চিন্তা জগতের এমন সব তোলপাড় করা তত্ত্ব দিয়ে গেছেন, যা আধুনিক সভ্যতাকে তার ভিত্তি দিয়েছে। তিনি হয়তো কখনো কনিংসবার্গ ছেড়ে যাননি, কিন্তু তার চিন্তা পুরো পৃথিবীকে ভ্রমণ করেছে এবং আজও আমাদের পথ দেখাচ্ছে।

পরেরবার যখন কোনো নৈতিক দ্বিধায় পড়বেন, বা কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন, কিংবা বিজ্ঞানের কোনো নিয়ম নিয়ে ভাববেন, তখন কান্টের কথা মনে করতে পারেন। নিজেকে তার মতো প্রশ্ন করে দেখতে পারেন: “আমি যা করছি, তা যদি পৃথিবীর সবাই করা শুরু করে, তাহলে কেমন হবে? আমি কি অন্য মানুষটিকে নিছক আমার স্বার্থের উপায় হিসেবে ব্যবহার করছি? এই সৌন্দর্যের অনুভূতি কোথা থেকে আসছে? আমার জ্ঞান কতটুকু বাস্তব আর কতটুকু আমার মনের তৈরি?”

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে কনিংসবার্গের সেই একাকী পথচারীর আসল জাদু—যে জাদু আমাদের শেখায় কীভাবে যুক্তির আলোয় পৃথিবীকে দেখতে হয়, এবং একই সাথে তার সীমানাকে সম্মান করে বিশ্বাসের জন্য জায়গা রাখতে হয়।

তথ্যসূত্র

  • Allison, H. E. (2004). Kant’s transcendental idealism: An interpretation and defense (Revised and enlarged ed.). Yale University Press.
  • Beiser, F. C. (2005). German Idealism: The struggle against subjectivism, 1781-1801. Harvard University Press.
  • Beiser, F. C. (2005). Kant and the crisis of metaphysics: The Caird-Heidegger debate. In The Cambridge Companion to Kant and Modern Philosophy (pp. 204-233). Cambridge University Press.
  • Cassirer, E. (1981). Kant’s life and thought (J. Haden, Trans.). Yale University Press. (Original work published 1918)
  • Friedman, M. (2013). Kant’s construction of nature: A reading of the Metaphysical Foundations of Natural Science. Cambridge University Press.
  • Guyer, P. (1987). Kant and the claims of knowledge. Cambridge University Press.
  • Guyer, P. (2005). Values of taste: Essays on Kant, an eighteenth-century aesthetics. Cambridge University Press.
  • Kant, I. (1998). Critique of pure reason (P. Guyer & A. W. Wood, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1781/1787)
  • Kant, I. (2000). Critique of the power of judgment (P. Guyer & E. Matthews, Trans. & Ed.). Cambridge University Press. (Original work published 1790)
  • Kant, I. (2004). Prolegomena to any future metaphysics (G. Hatfield, Trans. & Ed.). Cambridge University Press. (Original work published 1783)
  • Kant, I. (2012). Groundwork of the metaphysics of morals (M. Gregor & J. Timmermann, Trans. & Ed.). Cambridge University Press. (Original work published 1785)
  • Kuehn, M. (2001). Kant: A biography. Cambridge University Press.
  • Losurdo, D. (2004). Hegel and the freedom of moderns (J. Elliott & M. Vatter, Trans.). Duke University Press.
  • Moran, D. (2000). Introduction to phenomenology. Routledge.
  • Rawls, J. (1971). A theory of justice. The Belknap Press of Harvard University Press.
  • Wood, A. W. (2008). Kantian ethics. Cambridge University Press.
  • Zamir, T. (2007). Double vision: Moral philosophy and Shakespearean drama. Princeton University Press.
  • Zuckert, R. (2007). Kant on beauty and biology: An interpretation of the ‘Critique of Judgment’. Cambridge University Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.