Table of Contents
ভূমিকা
পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আসেন, যারা আমাদের চেনা পৃথিবীর দেওয়ালে সজোরে একটা ধাক্কা দেন। তাঁদের কাজ অনেকটা দক্ষ সার্জনের মতো, যিনি মমতাহীন নির্লিপ্ততায় আমাদের শরীর কেটে ভেতরের রোগটি দেখিয়ে দেন। সেই দৃশ্য হয়তো সুখকর নয়, কিন্তু তা এক অনস্বীকার্য সত্য। এই দার্শনিক শল্যচিকিৎসকেরা আমাদের স্বস্তি দেন না, বরং অস্বস্তিতে ফেলেন। আমরা যেভাবে জীবনকে দেখি, যেভাবে সুখ খুঁজি, যেভাবে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখি—সেই সবকিছুকে তাঁরা প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তাঁদের কথা শুনলে প্রথমে প্রচণ্ড রাগ হয়, মন খারাপ হয়, মনে হয়—আরে, কী সব আবোলতাবোল কথা! কিন্তু তারপর, অনেক রাতে একা একা যখন নিজের মুখোমুখি হতে হয়, যখন জীবনের না-পাওয়াগুলো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, তখন মনে হয়, লোকটা কি খুব ভুল কিছু বলেছিল?
আর্থার শোপেনহাওয়ার ছিলেন ঠিক সেই রকম একজন দার্শনিক। দর্শনের জগতে তাঁকে বলা হয় চরমতম নৈরাশ্যবাদী (Pessimist) দার্শনিক—এককথায় দুঃখবাদের রাজা। তাঁর মতে, আমাদের এই জীবনটা আসলে একটা বিরাট ভুল। একটা কষ্ট থেকে আরেকটা কষ্টের দিকে ছুটে চলাই জীবনের সারমর্ম। সুখ বলে যা ভাবি, তা আসলে কষ্টের সাময়িক অনুপস্থিতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের অস্তিত্ব এক মহাজাগতিক প্রহসন, যার শেষ অংকে কেবলই শূন্যতা।
কথাগুলো শুনলেই মনটা তেতো হয়ে যায়, তাই না? কিন্তু এই মানুষটির দর্শন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বড় বড় চিন্তাবিদ, লেখক, শিল্পী, এমনকি বিজ্ঞানীদেরও প্রভাবিত করে গেছে। ফ্রিডরিখ নিৎশে, লুদভিগ ভিটগেনস্টাইন, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, লিয়েভ তলস্তয়, মার্সেল প্রুস্ত, টমাস মান, রিচার্ড ভাগনার, আলবার্ট আইনস্টাইন, এমনকি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক এরউইন শ্রোডিঙ্গার পর্যন্ত তাঁর কাছে ঋণী। তালিকাটা বেশ লম্বা এবং বিস্ময়কর। কেন এই আপাত বিষণ্ণ দর্শন এত গুরুত্বপূর্ণ? কেন জীবনের প্রতি এত নির্মোহ, এত কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের চিন্তার জগতে এমন গভীর ছাপ ফেলতে পারল? চলুন, আজ সেই গল্পটাই শোনা যাক। তবে গল্পটা শুরু করতে হবে মানুষটাকে দিয়ে। কারণ, তাঁর দর্শন আর তাঁর জীবনকে আলাদা করে দেখার কোনো উপায় নেই। তিনি যা লিখেছেন, তা তিনি জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন।
যে মানুষটি জগতের উপর বিরক্ত ছিলেন
১৭৮৮ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি, ডানজিগ (তৎকালীন প্রুশিয়া, বর্তমানে পোল্যান্ডের গদানস্ক) শহরের এক ধনী এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারে শোপেনহাওয়ারের জন্ম। তাঁর বাবা, হাইনরিশ ফ্লোরিস শোপেনহাওয়ার, ছিলেন একজন সফল আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী, প্রজাতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং প্রচণ্ড স্বাধীনচেতা মানুষ। তিনি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং চাইতেন তাঁর ছেলেও পৃথিবীর নাগরিক (Cosmopolitan) হয়ে উঠুক। এই কারণে ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘আর্থার’, কারণ এই নামটি জার্মান, ফরাসি এবং ইংরেজি—তিনটি প্রধান ইউরোপীয় ভাষাতেই প্রচলিত। বাবা ছিলেন বিচক্ষণ, কিছুটা কঠোর, কিন্তু ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ছিল বিশাল। তিনি আর্থারকে ব্যবসা শেখানোর জন্য এবং পৃথিবীর নানা সংস্কৃতি সম্পর্কে পরিচিত করানোর জন্য ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরিয়ে বেড়াতেন। এই ভ্রমণগুলোই ছোট্ট আর্থারের মনে পৃথিবীর বিশালতা এবং মানুষের দুঃখ-কষ্টের সার্বজনীন রূপ সম্পর্কে প্রথম ধারণা তৈরি করে দেয়।
মা, ইয়োহানা শোপেনহাওয়ার, ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তিনি ছিলেন প্রাণচঞ্চল, সামাজিক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং সাহিত্যমনা। পরবর্তীকালে তিনি ভাইমারের (Weimar) একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর বৈঠকখানায় তখন জার্মানির শ্রেষ্ঠ মননশীল মানুষদের আড্ডা বসতো—স্বয়ং কবিগুরু গ্যেটের (Goethe) মতো ব্যক্তিত্বও সেখানে নিয়মিত আসতেন। ইয়োহানার স্যালন ছিল ভাইমারের সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
শুনতে খুব আদর্শ পরিবেশ মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বাবা ও মায়ের ভিন্নধর্মী চরিত্র এবং আকাঙ্ক্ষার মাঝখানে ছোট্ট আর্থারের জীবন ছিল এক টানাপোড়েনের গল্প। বাবার বিচক্ষণতা আর গভীরতার সাথে মায়ের চপলতা আর সামাজিক খ্যাতির মোহ—এই দুই বিপরীত মেরুর সংঘর্ষ ছোট্ট আর্থারের মনোজগতে এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে। বাবা চাইতেন ছেলে হোক বাস্তববাদী ব্যবসায়ী, আর মা চাইতেন নিজের মতো করে এক ঝলমলে জীবন।
১৮০৫ সালে, যখন শোপেনহাওয়ারের বয়স মাত্র ১৭, তখন তাঁর বাবা হামবুর্গের একটি খালের জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনা শোপেনহাওয়ারের জীবনকে চিরতরে বদলে দেয়। তিনি আজীবন বিশ্বাস করতেন, তাঁর বাবার এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য মায়ের চপলতা, সংসারের প্রতি উদাসীনতা এবং অন্য পুরুষের প্রতি আসক্তি অনেকাংশে দায়ী। বাবার মৃত্যুর পর মা ইয়োহানা তাঁর তরুণী কন্যা অ্যাডেলকে নিয়ে ভাইমারে চলে যান এবং নিজের সাহিত্যচর্চা ও সামাজিক জীবন নিয়ে পুরোপুরি মেতে ওঠেন।
শোপেনহাওয়ারের সাথে তাঁর মায়ের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। শোপেনহাওয়ার মনে করতেন তাঁর মা ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক, অগভীর এবং হৃদয়হীনা। মায়ের জনপ্রিয়তা, তাঁর লেখা অগভীর উপন্যাস, এবং তাঁর প্রাণোচ্ছল জীবনযাপন—এই সবকিছুকেই শোপেনহাওয়ার ঘৃণা করতেন। অন্যদিকে, মা তাঁর বিষণ্ণ, খিটখিটে, উদ্ধত ছেলেকে সহ্য করতে পারতেন না। তাঁদের পত্রালাপ পড়লে বোঝা যায় সম্পর্কের তিক্ততা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল। একবার মা তাঁকে লিখেছিলেন, “তুমি অসহ্য এবং বোঝাস্বরূপ… তোমার সমস্ত ভালো গুণ তোমার অতি-বুদ্ধির কারণে ঢাকা পড়ে যায় এবং তোমার খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য জগতের কাছে অকেজো হয়ে পড়ে।” (Safranski, 1990)। এই পারিবারিক টানাপোড়েন শোপেনহাওয়ারের চিন্তার জগতে, বিশেষ করে নারী সম্পর্কে তাঁর কুখ্যাত বিদ্বেষী মনোভাবের পেছনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।
বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি প্রচুর অর্থসম্পদ পান, যা তাঁকে সারাজীবন কোনো পেশার তোয়াক্কা না করে স্বাধীনভাবে পড়াশোনা ও লেখালেখি করার সুযোগ করে দেয়। বাবার ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে কিছুদিন অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্যবসার কাজ শেখার চেষ্টা করেন, কিন্তু মন বসাতে পারেননি। অবশেষে তিনি গটিঙেন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং পরে দর্শন পড়া শুরু করেন। সেখানে অধ্যাপক গটলব শুলৎসের (Gottlob Ernst Schulze) উপদেশে তিনি প্লেটো আর ইমানুয়েল কান্টের (Immanuel Kant) দর্শনে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। প্লেটোর ‘আইডিয়া’ (Platonic Ideas) এবং কান্টের ‘বস্তু স্বরূপ’ (Thing-in-itself) তাঁর চিন্তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
কিন্তু তাঁর চিন্তার জগতে সবচেয়ে বড় বিপ্লবটি ঘটেছিল অন্য একটি উৎসের মাধ্যমে—প্রাচীন ভারতের উপনিষদ। এক বন্ধু, প্রাচ্যবিদ ফ্রেডরিখ মায়ার (Friedrich Majer), তাঁকে উপনিষদের একটি ল্যাটিন অনুবাদ উপহার দেন। বইটি ছিল ফরাসি পণ্ডিত আঁকেতিল-দ্যু-পেরোঁর (Anquetil-Duperron) করা ফার্সি অনুবাদের ল্যাটিন রূপ, যার নাম ছিল ‘Oupnekhat’। শোপেনহাওয়ার এই বইটিকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে মনে করতেন। তিনি বলতেন, “উপনিষদের প্রতিটি বাক্য থেকে গভীর, মৌলিক এবং মহৎ চিন্তা বেরিয়ে আসে… সারা পৃথিবীতে এর মতো এত উপকারী এবং উন্নত করার মতো পড়া আর কিছু নেই। এটি আমার জীবনের সান্ত্বনা ছিল এবং মৃত্যুরও সান্ত্বনা হবে।” (Magee, 2005)। উপনিষদের ‘মায়া’ (Illusion) এবং ‘ব্রহ্ম’ (The ultimate reality) এর ধারণা তাঁর কান্টীয় দর্শনকে এক নতুন মাত্রা দেয়। পশ্চিমের যুক্তির সাথে প্রাচ্যের প্রজ্ঞার এই মেলবন্ধনই শোপেনহাওয়ারের দর্শনকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
মাত্র ৩০ বছর বয়সে, ১৮১৮ সালে, তিনি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ, ‘জগৎ ইচ্ছা ও প্রতিভাসরূপে’ (The World as Will and Representation / Die Welt als Wille und Vorstellung), লেখা শেষ করেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এই বই দর্শনের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। তিনি ভাবতেন, এই বই প্রকাশের সাথে সাথে জার্মানির বিদ্বৎসমাজ তাঁকে নিয়ে আলোড়িত হবে, বিশেষ করে তৎকালীন জার্মান দর্শনের মধ্যমণি জি.ডব্লিউ.এফ. হেগেলকে (G.W.F. Hegel) তিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবেন। তিনি হেগেলের দর্শনকে ‘ফাঁপা বুলি’, ‘হাতুড়েপনা’ এবং ‘বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা’ বলে মনে করতেন।
কিন্তু হায়! বইটি প্রকাশের পর প্রায় কেউই এর দিকে ফিরেও তাকায়নি। বলা হয়, বইটির বেশিরভাগ কপি বিক্রি না হওয়ায় প্রকাশক সেগুলো বাতিল কাগজ হিসেবে বেচে দিয়েছিলেন। এই চরম ব্যর্থতা এবং উপেক্ষা শোপেনহাওয়ারকে আরও একা, ক্ষুব্ধ এবং মানববিদ্বেষী করে তোলে। তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে হেগেলের ক্লাসের একই সময়ে নিজের ক্লাস রেখেছিলেন, এই ভেবে যে ছাত্ররা হেগেলের ‘অর্থহীন বাগাড়ম্বর’ ছেড়ে তাঁর ‘সত্য দর্শনে’র ক্লাসে ছুটে আসবে। ফলাফল হলো উল্টো। হেগেলের ক্লাস থাকতো ছাত্রে পরিপূর্ণ, আর শোপেনহাওয়ারের ক্লাসে হাতে গোনা কয়েকজন, বা কখনো কখনো কেউই থাকতো না। এই অপমানে তিনি শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দেন এবং অ্যাকাডেমিক জগতের প্রতি তাঁর ঘৃণা স্থায়ী হয়।
জীবনের বাকিটা সময় তিনি ফ্রাঙ্কফুর্টের একাকী জীবনে কাটিয়ে দেন। তাঁর একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল তাঁর পোষা পুডল কুকুর। তিনি তাঁর কুকুরের কয়েকটি প্রজন্মের নাম রেখেছিলেন ‘আত্মা’ (Atma) বা ‘বুৎজ’ (Butz)। লোকে বলত, বুড়ো শোপেনহাওয়ার যখন মারা যাবেন, তখন তাঁর আত্মা ওই কুকুরের মধ্যে প্রবেশ করবে! তিনি এক অদ্ভুত, কঠোর রুটিন মেনে চলতেন। প্রতিদিন সকালে তিন ঘণ্টা লেখালেখি, তারপর ঠিক দুপুরে এক ঘণ্টা বাঁশি বাজানো, বিকেলে পোষা কুকুরকে নিয়ে দুই ঘণ্টার জন্য লম্বা পথ হাঁটা এবং সন্ধ্যায় শহরের সেরা রেস্তোরাঁর একটি নির্দিষ্ট টেবিলে বসে খাওয়া। এই একাকী, খিটখিটে, কিন্তু প্রচণ্ড মেধাবী মানুষটি জীবনের শেষ দিকে এসে তাঁর প্রাপ্য খ্যাতি পেতে শুরু করেন। ১৮৫১ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘Parerga and Paralipomena’ (যার অর্থ ‘পরিপূরক কাজ ও বাদ পড়া বিষয়’) তাঁকে জার্মানিসহ পুরো ইউরোপে বিখ্যাত করে তোলে। এই বইয়ের ভাষা ছিল তাঁর মূল গ্রন্থের চেয়ে অনেক সহজবোধ্য এবং বিষয়বস্তু ছিল দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কিত, যা সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁকে পৌঁছে দেয়।
১৮৬০ সালে যখন তিনি তাঁর আরামকেদারায় বসে শান্তিতে মারা যান, তখন তিনি একজন সম্মানিত ও বিখ্যাত দার্শনিক। কিন্তু যে সত্য তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বলে বিশ্বাস করতেন, তা সুখের কোনো গল্প শোনায় না।
যে আঁধার চিরে জন্ম নিলো এক বিষণ্ণ দর্শন
কোনো মানুষ শূন্য থেকে জন্মায় না। তার চিন্তা, তার বিশ্বাস, তার দর্শন—এসবের শিকড় ছড়িয়ে থাকে তার সময় আর পারিপার্শ্বিকতার গভীরে। একজন মানুষ যে সময়ে বড় হন, যে রাজনৈতিক ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে যান, যে দার্শনিকদের বই পড়েন বা যাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, সেই সবকিছু মিলেই তাঁর মানসপট তৈরি হয়। দর্শনের জগতে সবচেয়ে বিষণ্ণ বলে পরিচিত আর্থার শোপেনহাওয়ারের ক্ষেত্রেও এই কথাটি আশ্চর্য রকম সত্যি।
আমরা অনেকেই ভাবি, শোপেনহাওয়ারের এই চরম দুঃখবাদ (Pessimism) হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা, মায়ের সাথে তিক্ত সম্পর্ক বা অ্যাকাডেমিক জগতে তাঁর ব্যর্থতা থেকেই জন্মেছে। এই কারণগুলো সত্যি, কিন্তু তা ছবির একটি অংশ মাত্র। পুরো ছবিটা বুঝতে হলে আমাদের সেই সময়ের উত্তাল ইউরোপের দিকে তাকাতে হবে এবং দেখতে হবে কোন দার্শনিকদের ছায়ায় বা আগুনের আঁচে তাঁর চিন্তার তরবারি শাণিত হয়েছিল। চলুন, সেই গল্পটাই আজ শোনা যাক। যে গল্প বলবে, কেন একজন মানুষ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, আমাদের অস্তিত্বটাই এক মহাজাগতিক ভুল।
এক উত্তাল পৃথিবী: বিপ্লব, যুদ্ধ এবং আশার মৃত্যু
শোপেনহাওয়ার যে সময়ে জন্মেছিলেন এবং বেড়ে উঠছিলেন, সেই সময়টা ইউরোপের জন্য কোনো শান্ত, স্থির পুকুর ছিল না। সেটা ছিল এক ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের কাল। তাঁর জন্মের ঠিক এক বছর পরেই, ১৭৮৯ সালে, ঘটে যায় ফরাসি বিপ্লব (French Revolution)। এই বিপ্লব শুধু ফ্রান্সের রাজতন্ত্রকে নাড়িয়ে দেয়নি, পুরো ইউরোপের চিন্তার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী’ (Liberty, Equality, Fraternity)—এই তিনটি শব্দ ছিল নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন, যেখানে যুক্তি (Reason) আর মানবতাবাদই হবে শেষ কথা। মনে করা হচ্ছিল, মানুষ তার পুরনো কুসংস্কার আর ধর্মের শৃঙ্খল ভেঙে এক যুক্তিনির্ভর স্বর্গরাজ্য (Utopia) প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে।
কিন্তু সেই স্বপ্ন খুব দ্রুতই এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। বিপ্লবের পরপরই শুরু হলো সন্ত্রাসের রাজত্ব (Reign of Terror)। হাজার হাজার মানুষকে গিলোটিনে চড়িয়ে হত্যা করা হলো। যে বিপ্লব এসেছিল মানুষের মুক্তির জন্য, সেই বিপ্লবই হয়ে উঠল এক রক্তপিপাসু দানব। এই ঘটনা ইউরোপের বুদ্ধিজীবীদের মনে এক গভীর দাগ কেটে যায়। তাঁরা দেখলেন, মানুষের ভেতরের যুক্তি বা মানবতা নয়, বরং এক আদিম, পাশবিক শক্তিই যেন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। এই আশাভঙ্গের বেদনা শোপেনহাওয়ারের দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি দেখেছিলেন, ইতিহাসের তথাকথিত ‘প্রগতি’ (Progress) আসলে একটি ভ্রম, যার আড়ালে লুকিয়ে আছে মানুষের আদিম পাশবিকতা (Safranski, 1990)।
এরপর এলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ফরাসি বিপ্লবের বিশৃঙ্খলা থেকে উঠে আসা এই সেনাপতি প্রায় পুরো ইউরোপকে যুদ্ধের আগুনে ঠেলে দিয়েছিলেন। নেপোলিয়নের যুদ্ধ (Napoleonic Wars, 1803-1815) ছিল এক অন্তহীন রক্তপাত আর ধ্বংসের মহাযজ্ঞ। শোপেনহাওয়ার নিজে এই যুদ্ধের সাক্ষী ছিলেন। তাঁর পরিবারকে যুদ্ধের কারণে বারবার বাসস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে লক্ষ লক্ষ তরুণকে জোর করে সেনাবাহিনীতে ঢোকানো হচ্ছে এবং অর্থহীন এক ক্ষমতার লড়াইয়ে তারা প্রাণ দিচ্ছে। এই ভয়াবহতা দেখে তাঁর পক্ষে এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব ছিল যে, ইতিহাস কোনো মহৎ বা যৌক্তিক লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। বরং তিনি দেখেছিলেন, ব্যক্তির অহংকার (Egoism) যখন জাতি বা রাষ্ট্রের রূপ নেয়, তখন তা কীরকম ধ্বংসলীলা চালাতে পারে। এই ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে তিনি কোনো মহৎ উদ্দেশ্য দেখেননি, দেখেছিলেন কেবল এক অন্ধ, অতৃপ্ত ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’ বা ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’র নগ্ন আস্ফালন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর দর্শনকে এক বাস্তব, রক্ত-মাংসময় ভিত্তি দিয়েছিল।
তিনি ছিলেন একজন কসমোপলিটান বা বিশ্বনাগরিক, যিনি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে (Nationalism) প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। নেপোলিয়নের যুদ্ধ ইউরোপজুড়ে যে উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিল, তা দেখে তিনি আরও বিরক্ত হয়েছিলেন। তাঁর কাছে এই দেশপ্রেম ছিল মানুষের মূর্খতা আর দম্ভের একটি রূপ মাত্র। এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাঁকে শিখিয়েছিল যে, মানবজাতি কোনো স্বর্গীয় পরিকল্পনার অংশ নয়, বরং এক অন্ধ শক্তির হাতের পুতুল।
দর্শনের যুদ্ধক্ষেত্র: কার কাঁধে চড়ে, কার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে
শোপেনহাওয়ারের দর্শন যেমন তাঁর সময় দ্বারা প্রভাবিত, তেমনি তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক দার্শনিকদের সাথে তাঁর এক জটিল সম্পর্কও এর পেছনে কাজ করেছে। তিনি কারও কারও কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন, আবার কারও কারও দর্শনকে ধূলিসাৎ করে দিতে চেয়েছেন।
ইমানুয়েল কান্ট: যে গুরুর কাঁধে চড়েছিলেন
শোপেনহাওয়ার নিজেই বলতেন, তাঁর দর্শন বোঝা অসম্ভব যদি কেউ আগে প্লেটো আর কান্ট না পড়ে থাকেন। বিশেষ করে ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) ছিলেন তাঁর দর্শনের ভিত্তিপ্রস্তর। কান্ট বলেছিলেন, আমরা এই জগৎকে সরাসরি জানতে পারি না। আমাদের মন জগৎকে কিছু ছাঁচের (Categories) মাধ্যমে দেখে, যেমন—দেশ (Space), কাল (Time) এবং কার্যকারণ (Causality)। তাই আমরা যা দেখি, তা হলো আমাদের মনের দ্বারা নির্মিত এক জগৎ, যাকে কান্ট বলেছেন ‘প্রতিভাস’ (Phenomenon)। আসল জগৎটা কেমন, যা এই ছাঁচের বাইরে, তাকে কান্ট বলেছেন ‘বস্তু-স্বরূপ’ (Noumenon বা Thing-in-itself), এবং তাঁর মতে, এই ‘বস্তু-স্বরূপ’ সম্পর্কে আমরা কখনোই কিছু জানতে পারব না।
শোপেনহাওয়ার কান্টের এই বিভাজনকে প্রায় পুরোটাই গ্রহণ করলেন। তাঁর দর্শনের প্রথম অংশ, ‘জগৎ প্রতিভাসরূপে’ (The World as Representation), পুরোটাই কান্টের এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এখানেই তিনি এক বিপ্লবী মোচড় দিলেন। কান্ট যেখানে বলেছিলেন ‘বস্তু-স্বরূপ’ অজ্ঞেয় (unknowable), শোপেনহাওয়ার সেখানে বললেন, “না, আমি এর নাগাল পাওয়ার একটা গোপন পথ খুঁজে পেয়েছি!”
তিনি বললেন, আমাদের নিজেদের শরীরই হলো সেই গোপন দরজা। আমরা আমাদের শরীরকে বাইরে থেকে একটি বস্তু হিসেবে দেখি (প্রতিভাস), কিন্তু ভেতর থেকে আমরা একে সরাসরি অনুভব করি আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আকাঙ্ক্ষা বা তাড়না হিসেবে। এই ভেতরের যে শক্তি, যা আমরা সরাসরি জানতে পারি, সেটাই হলো সেই অজ্ঞেয় ‘বস্তু-স্বরূপ’। আর এর নামই তিনি দিলেন ‘ইচ্ছা’ (Will) (Magee, 2005)। এভাবেই তিনি কান্টের কাঠামো ব্যবহার করে তার ভেতরে নিজের মৌলিক এবং ভয়ংকর দর্শনকে স্থাপন করলেন। তিনি কান্টের দেখানো পথে হেঁটে এমন এক জায়গায় পৌঁছালেন, যেখানে কান্ট নিজে যাওয়ার কথা ভাবেননি।
প্লেটো: আদর্শ জগতের ছায়া
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর (Plato) প্রভাবও শোপেনহাওয়ারের ওপর গভীর ছিল। প্লেটো বিশ্বাস করতেন, আমাদের এই চেনা জগৎ আসল জগৎ নয়। এটি হলো এক আদর্শ, চিরন্তন জগতের (World of Forms/Ideas) ছায়া মাত্র। যেমন, আমরা পৃথিবীতে অনেক সুন্দর চেয়ার দেখি, কিন্তু এক জায়গায় আছে ‘আদর্শ চেয়ার’-এর ধারণা (The Form of Chair), যার অনুকরণেই পৃথিবীর সব চেয়ার তৈরি।
শোপেনহাওয়ার প্লেটোর এই ‘আইডিয়া’র (Platonic Ideas) ধারণাটিকে নিজের দর্শনে খুব চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে, অন্ধ, একক ‘ইচ্ছা’ (Will) নিজেকে সরাসরি এই পৃথিবীর কোটি কোটি বস্তুতে প্রকাশ করে না। এর মাঝখানে একটি স্তর আছে, আর সেটাই হলো প্লেটোর ‘আইডিয়া’। যেমন, মহাজাগতিক ‘ইচ্ছা’ প্রথমে নিজেকে ‘সিংহের আইডিয়া’ বা ‘মানুষের আইডিয়া’ হিসেবে প্রকাশ করে, এবং তারপর সেই আইডিয়াগুলো পৃথিবীতে অগণিত সিংহ বা মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়।
এই ধারণাটি তাঁর শিল্পদর্শনে (Aesthetics) কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। তাঁর মতে, আমরা যখন কোনো মহান শিল্পকর্ম দেখি, তখন আমরা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুকে দেখি না, বরং তার পেছনের সেই চিরন্তন ‘আইডিয়া’কে অবলোকন করি। আর এই মুহূর্তে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত হয়ে যাই, যা আমাদের সাময়িক প্রশান্তি দেয়।
জার্মান ভাববাদ: যে শত্রুদের তিনি ঘৃণা করতেন
শোপেনহাওয়ারের দর্শনকে বুঝতে হলে তাঁর সমসাময়িক জার্মান ভাববাদী (German Idealists) দার্শনিকদের—বিশেষ করে হেগেল (G.W.F. Hegel), ফিখটে (J.G. Fichte) এবং শেলিং (F.W.J. Schelling)-এর বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র বিদ্বেষকে বুঝতে হবে। এই দার্শনিকেরা ছিলেন চরম আশাবাদী (Optimists)। তাঁদের মূল কথা ছিল, এই জগৎ যৌক্তিক (Rational) এবং ইতিহাস এক মহৎ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে, যাকে হেগেল বলেছেন ‘পরমাত্মা’র (Absolute Spirit) আত্ম-উপলব্ধি।
হেগেল মনে করতেন, “যা কিছু বাস্তব, তাই যৌক্তিক” (The real is rational)। তিনি নেপোলিয়নকে দেখে বলেছিলেন, “আমি বিশ্ব-আত্মাকে ঘোড়ার পিঠে চড়ে যেতে দেখলাম।” অর্থাৎ, নেপোলিয়নের ধ্বংসলীলার মধ্যেও তিনি ইতিহাসের এক যৌক্তিক অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছিলেন।
শোপেনহাওয়ারের কাছে এই ধরনের কথাবার্তা ছিল চরম ভণ্ডামি এবং অর্থহীন বাগাড়ম্বর। তিনি হেগেলের দর্শনকে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা’ বলে উড়িয়ে দিতেন এবং তাঁকে ‘হাতুড়ে দার্শনিক’ (charlatan) বলতেন। যেখানে হেগেল দেখেছেন যুক্তি আর প্রগতি, সেখানে শোপেনহাওয়ার দেখেছেন কেবলই অন্ধ, অযৌক্তিক ‘ইচ্ছা’র নিষ্ঠুর খেলা। তাঁর মতে, এই জগৎ যৌক্তিক হওয়া তো দূরের কথা, এটি সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ জগৎগুলোর একটি। তিনি বিশ্বাস করতেন, হেগেলের মতো অধ্যাপকেরা সরকারের টাকা খেয়ে মানুষকে স্বস্তিদায়ক মিথ্যা কথা শোনান, যাতে বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি কারও কোনো প্রশ্ন না জাগে (Safranski, 1990)। শোপেনহাওয়ারের দুঃখবাদ ছিল এই রাষ্ট্র-সমর্থিত আশাবাদের বিরুদ্ধে এক তীব্র এবং সপাট জবাব।
প্রাচ্যের আলো: উপনিষদ ও বৌদ্ধধর্ম
ইউরোপীয় দর্শনের এই বিতর্কের বাইরে শোপেনহাওয়ার এমন এক জায়গা থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন, যা তৎকালীন ইউরোপে ছিল প্রায় অচেনা—প্রাচীন ভারতীয় দর্শন। উপনিষদ এবং বৌদ্ধধর্মের চিন্তাধারা তাঁর দর্শনকে এক নতুন এবং গভীর মাত্রা দিয়েছিল।
তিনি যখন উপনিষদের ল্যাটিন অনুবাদ ‘Oupnekhat’ পড়েন, তখন তিনি যেন নিজের চিন্তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পান। উপনিষদের ‘মায়া’ (Maya) বা Illusion-এর ধারণা—অর্থাৎ এই জগৎ যে এক মায়াজাল এবং আসল সত্য নয়—তা তাঁর ‘জগৎ প্রতিভাসরূপে’ (The World as Representation) ধারণার সাথে হুবহু মিলে যায়।
উপনিষদের মহাবাক্য “তৎ ত্বম্ অসি” (Tat Tvam Asi), অর্থাৎ “তুমিই সেই”—এই ধারণাটি তাঁর নৈতিকতার (Ethics) ভিত্তি হয়ে ওঠে। এর অর্থ হলো, জগতের সবকিছুর মূলে রয়েছে একই সত্তা (ব্রহ্ম)। তাই আমি আর অন্য মানুষ বা প্রাণী আলাদা নই। আমরা সবাই একই মহাজাগতিক ইচ্ছার প্রকাশ। এই উপলব্ধি থেকেই জন্মায় করুণা (Compassion)। যখন আমি বুঝতে পারি যে অন্যের কষ্ট আসলে আমারই কষ্ট, তখন আমি আর কারও ক্ষতি করতে পারি না। এই কারণেই তিনি পশু অধিকারের মতো আধুনিক একটি ধারণার প্রবক্তা ছিলেন (Atwell, 1995)।
একইভাবে, বৌদ্ধধর্মের চারটি আর্যসত্য (Four Noble Truths)—জীবনে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ হলো আসক্তি বা তৃষ্ণা, এই তৃষ্ণাকে ত্যাগ করলে দুঃখের অবসান সম্ভব, এবং তা করার পথ আছে (অষ্টাঙ্গিক মার্গ)—তাঁর দর্শনের সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। বৌদ্ধধর্মের ‘নির্বাণ’ (Nirvana), অর্থাৎ সব আকাঙ্ক্ষা নিভিয়ে ফেলার মাধ্যমে পরম শান্তিতে পৌঁছানোর ধারণা, শোপেনহাওয়ারের দর্শনের চূড়ান্ত লক্ষ্য—‘ইচ্ছাকে অস্বীকার করা’র (Denial of the Will) সমার্থক।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আর্থার শোপেনহাওয়ার কেবল এক বিষণ্ণ, একাকী মানুষ ছিলেন না, যিনি নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ থেকে একটি দর্শন তৈরি করেছেন। তাঁর দর্শন ছিল তাঁর সময়ের এক জটিল এবং সৎ প্রতিক্রিয়া। ফরাসি বিপ্লবের আশাভঙ্গ, নেপোলিয়নের যুদ্ধের নির্মমতা, কান্টের দর্শনের কাঠামো, প্লেটোর আইডিয়া, হেগেলের আশাবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং ভারতীয় দর্শনের গভীর প্রজ্ঞা—এই সবকিছু মিলেমিশে তৈরি হয়েছিল তাঁর চিন্তার জগৎ।
দর্শনের গভীরে: জগৎ আসলে কী?
শোপেনহাওয়ারের দর্শন বুঝতে হলে আমাদের দুটি ভাগে ভাগ করে এগোতে হবে। ঠিক যেভাবে তিনি তাঁর মূল বইটির নামকরণ করেছিলেন: জগৎ প্রতিভাসরূপে (The World as Representation) এবং জগৎ ইচ্ছারূপে (The World as Will)। এই বিভাজনটি তাঁর দর্শনের একেবারে কেন্দ্রবিন্দু।
প্রথম ভাগ: এই যে দুনিয়া, এ কেবলই এক ‘প্রতিভাস’ (Representation)
ধরুন, আপনি আর আমি একটা সুন্দর লাল গোলাপের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি বলছি, “বাহ্, কী সুন্দর ফুল!” আপনিও হয়তো একই কথা বলছেন। কিন্তু আমরা দুজন কি একই জিনিস দেখছি? শোপেনহাওয়ার বলবেন, “না”।
তিনি তাঁর দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেন ইমানুয়েল কান্টের উপর। কান্ট দেখিয়েছিলেন যে, আমরা জগৎকে সরাসরি জানতে পারি না। আমাদের জ্ঞান ইন্দ্রিয় এবং মস্তিষ্কের মাধ্যমে ফিল্টার হয়ে আসে। জগৎ আমাদের কাছে যেভাবে প্রতিভাত হয় (appears), আমরা কেবল সেটুকুই জানি। এই প্রতিভাত জগতকেই শোপেনহাওয়ার বলেছেন ‘প্রতিভাস’ (Vorstellung / Representation)। তাঁর বইয়ের প্রথম বাক্যটিই হলো: “Die Welt ist meine Vorstellung” – “The world is my representation” (জগৎ আমারই প্রতিভাস)।
ব্যাপারটা আরেকটু সহজ করা যাক। কল্পনা করুন, আমরা সবাই এমন এক জোড়া রঙিন চশমা পরে আছি যা কখনও খোলা যায় না। আমি পরে আছি নীল চশমা, আপনি পরে আছেন হলুদ চশমা। আমি সবকিছু নীলচে দেখছি, আপনি সবকিছু হলদেটে। আমরা কেউই আসল রংটা দেখছি না। শোপেনহাওয়ারের মতে, আমাদের মনটাই হলো সেই চশমা। এই মনের দুটো ফ্রেম আছে: দেশ (Space) এবং কাল (Time)। আর চশমার কাঁচটা হলো কারণতা বা কার্যকারণ নীতি (Principle of Sufficient Reason/Causality)। আমরা যা কিছুই অভিজ্ঞতা করি—এই টেবিল, ওই গাছ, আকাশের তারা—তা এই দেশ, কাল এবং কারণতার ছাঁচে ফেলেই করি। এর বাইরের জগৎ—আসল জগৎ, বা কান্টের ভাষায় ‘বস্তু স্বরূপ’ (Ding an sich / Thing-in-itself)—কেমন, তা আমরা আমাদের বুদ্ধি বা ইন্দ্রিয় দিয়ে কখনোই জানতে পারব না (Schopenhauer, 1818/1969)।
তাঁর ডক্টরাল থিসিস, ‘On the Fourfold Root of the Principle of Sufficient Reason’-এ তিনি এই কার্যকারণ নীতিকে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি দেখান যে, আমরা যখন কোনো কিছুর ব্যাখ্যা খুঁজি, তখন আমরা চার ধরনের ‘কেন’-এর উত্তর দিই:
- ১. ভৌত কারণ (Physical Causality): বস্তু জগতের কার্যকারণ। কেন বিলিয়ার্ডের একটি বলকে অন্য একটি বল ধাক্কা দিলে সেটি গড়িয়ে যায়? কারণ প্রথম বলটির শক্তি দ্বিতীয়টিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। এটি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম।
- ২. যৌক্তিক কারণ (Logical Causality): যুক্তির জগতের কার্যকারণ। একটি সিদ্ধান্ত কেন সত্য? কারণ তা নির্দিষ্ট যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি বা প্রতিজ্ঞা (premises) থেকে এসেছে। যেমন, সকল মানুষ মরণশীল; সক্রেটিস একজন মানুষ; সুতরাং, সক্রেটিস মরণশীল। এখানে সিদ্ধান্তটি তার প্রতিজ্ঞা দ্বারা নির্ধারিত।
- ৩. গাণিতিক কারণ (Mathematical Causality): দেশ ও কালের জগতের কার্যকারণ। একটি ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি কেন দুই সমকোণ? কারণ এটি ইউক্লিডীয় জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম দ্বারা নির্ধারিত।
- ৪. মনস্তাত্ত্বিক কারণ (Psychological Causality): আমাদের কাজের পেছনের কারণ বা প্রেরণা (Motive)। একজন মানুষ কেন একটি নির্দিষ্ট কাজ করে? কারণ তার একটি উদ্দেশ্য বা প্রেরণা আছে। যেমন, একজন চোর কেন চুরি করে? কারণ তার অর্থলাভের প্রেরণা আছে।
এই সবকিছুই হলো ‘প্রতিভাসে’র জগতের নিয়ম। এই জগতের বাইরে কী আছে, তা এই নিয়ম দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। এই ধারণাটিকেই তিনি উপনিষদের ‘মায়া’র সাথে তুলনা করেছেন। আমরা যে জগৎ দেখছি—আমাদের সাফল্য, ব্যর্থতা, ভালোবাসা, ঘৃণা—তা এক বিরাট মায়াজাল, যা আসল সত্যকে ঢেকে রেখেছে। তাহলে কি আমরা এক দুর্ভেদ্য কারাগারে বন্দী? এই মায়ার পর্দা ভেদ করার কি কোনো উপায় নেই?
এই পর্যন্ত শুনে মনে হতে পারে, এতো কান্টেরই কথা। শোপেনহাওয়ার নতুন কী বললেন? এখানেই গল্পের আসল মোচড়। কান্ট যেখানে বলেছিলেন যে ‘বস্তু স্বরূপ’ কী, তা আমরা কখনোই জানতে পারব না, শোপেনহাওয়ার সেখানে বললেন, “না, আমি একটা পথ খুঁজে পেয়েছি। একটা ছোট্ট ফোকর আছে, যা দিয়ে ওই মায়ার পর্দার ওপারে উঁকি দেওয়া যায়।”
দ্বিতীয় ভাগ: পর্দার আড়ালে সেই আদিম ‘ইচ্ছা’ (Will)
শোপেনহাওয়ার প্রশ্ন করলেন, এই জগতে একটি মাত্র জিনিস আছে যাকে আমরা দুটো ভিন্ন উপায়ে জানতে পারি। সেই জিনিসটি কী?
উত্তর হলো: আমাদের নিজেদের শরীর।
যখন আমরা আয়নার সামনে নিজের শরীর দেখি বা স্পর্শ করি, তখন তা দেশ-কালে অবস্থিত একটা বস্তু, একটা ‘প্রতিভাস’ মাত্র। ঠিক যেমন অন্য যেকোনো বস্তু—টেবিল, চেয়ার বা গাছ। এটা হলো শরীর সম্পর্কে আমাদের বাইরের জ্ঞান, যা ইন্দ্রিয়নির্ভর। কিন্তু আমরা আমাদের শরীরকে ভেতর থেকেও অনুভব করতে পারি। আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয়, আনন্দ, রাগ, যৌন আকাঙ্ক্ষা—এই সবকিছুই আমরা সরাসরি অনুভব করি। এর জন্য কোনো যুক্তি বা ইন্দ্রিয়ের ফিল্টারের দরকার হয় না। এটা এক তাৎক্ষণিক, সরাসরি উপলব্ধি। আমি যখন হাত নাড়াতে চাই, তখন আমার এই চাওয়া এবং হাতের নড়াচড়া—এই দুটি ঘটনাকে আমি ভেতর থেকে এক এবং অভিন্ন বলে অনুভব করি।
শোপেনহাওয়ার বললেন, এই যে ভেতরের সরাসরি অনুভূতি, এটাই হলো সেই আসল জগতের, সেই ‘বস্তু স্বরূপে’র এক ঝলক। আর এই ভেতরের চালিকাশক্তিটির তিনি নাম দিলেন ‘ইচ্ছা’ (Wille / Will)।
এখানে ‘ইচ্ছা’ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি (যেমন, আমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছে), শোপেনহাওয়ারের ‘ইচ্ছা’ তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক, আদিম এবং ভয়ংকর এক ধারণা। এটি কোনো ব্যক্তিগত বা সচেতন আকাঙ্ক্ষা নয়। এটি হলো এক অন্ধ, অতৃপ্ত, অযৌক্তিক এবং চিরন্তন এক মহাজাগতিক শক্তি যা সবকিছুর মূলে ক্রিয়াশীল। এটি কোনো ঈশ্বর নয়, কারণ এর কোনো জ্ঞান বা উদ্দেশ্য নেই। এটি কেবল এক নিরন্তর, অর্থহীন তাড়না।
- গ্রহগুলো যে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, তার পেছনে আছে মহাকর্ষের যে শক্তি, তা এই ‘ইচ্ছা’রই একটি প্রকাশ।
- চুম্বক যে লোহাকে আকর্ষণ করছে, তার পেছনেও এই ‘ইচ্ছা’।
- গাছ যে মাটি ভেদ করে আলোর দিকে বেড়ে উঠছে, তার পেছনেও এই ‘ইচ্ছা’।
- কোষ যে বিভাজিত হচ্ছে, ডিএনএ যে নিজের প্রতিরূপ তৈরি করছে, তার পেছনেও এই ‘ইচ্ছা’।
- একটা সিংহ যে হরিণকে শিকার করছে, বা একটা মাকড়সা যে জাল বুনছে, তার পেছনেও এই ‘ইচ্ছা’।
- আর আমরা, মানুষ, যে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছি, খাচ্ছি, ভালোবাসছি, ঘৃণা করছি, বংশবৃদ্ধি করছি, সামাজিক প্রতিষ্ঠা চাইছি, জ্ঞান অর্জন করছি—এই সবকিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে ওই একই অন্ধ, আদিম ‘ইচ্ছা’। আমাদের যুক্তি, বুদ্ধি, শিল্প—সবই এই ইচ্ছার দাসত্ব করে, একে চরিতার্থ করার উপায় খুঁজে বের করে।
এই ‘ইচ্ছা’র কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই। এর একমাত্র কাজ হলো নিজেকে ক্রমাগত প্রকাশ করা, টিকে থাকা এবং বিস্তার লাভ করা (objectification)। এটি এক অতৃপ্ত ক্ষুধা, যা কখনো মেটে না। শোপেনহাওয়ারের মতে, এই পুরো জগৎ, যা আমরা ‘প্রতিভাস’ হিসেবে দেখি, তা আসলে এই অন্ধ ‘ইচ্ছা’রই দৃশ্যমান রূপ বা আয়না। আমরা সবাই, মানুষ থেকে শুরু করে নুড়িপাথর পর্যন্ত, যেন এক বিশাল পুতুল নাচের পুতুল, আর পর্দার আড়ালের সেই পুতুলচালক হলো এই মহাজাগতিক ‘ইচ্ছা’ (Will)।
দুঃখবাদের জন্ম: কেন জীবনটা আসলে কষ্টের?
যদি জগতের মূল চালিকাশক্তিই হয় এক অতৃপ্ত, অন্ধ ‘ইচ্ছা’, তাহলে এর পরিণতি কী?
শোপেনহাওয়ারের উত্তর ভয়াবহ রকমের সহজ: দুঃখ (Leiden / Suffering)।
যেহেতু ‘ইচ্ছা’র প্রকৃতিই হলো চাওয়া, এবং এই চাওয়া কখনো পূরণ হয় না, তাই জীবনটাও মূলত অতৃপ্তি আর কষ্টের একটা চক্র। আমাদের জীবনটা একটা পেন্ডুলামের মতো, যা কেবল কষ্ট আর একঘেয়েমির (Boredom)-এর মধ্যে দুলতে থাকে। সুখ হলো এই দুইয়ের মাঝখানের ক্ষণস্থায়ী, প্রায় অদৃশ্য একটি মুহূর্ত।
যখন আমাদের কোনো কিছু চাওয়ার থাকে (যেমন, একটা ভালো চাকরি, পছন্দের মানুষ, বা সামান্য এক গ্লাস জল), তখন আমরা থাকি ‘কষ্টে’র মধ্যে। এই অভাববোধটাই কষ্ট। আর যখন সেই চাওয়াটা পূরণ হয়ে যায়, তখন কী হয়? আমরা কি সুখী হই? শোপেনহাওয়ার বলবেন, না। আমরা সাময়িকভাবে একটা স্বস্তি পাই, কিন্তু পরক্ষণেই এক নতুন শূন্যতা আমাদের গ্রাস করে। এই শূন্যতার নাম একঘেয়েমি। এই একঘেয়েমি থেকে বাঁচতে আমরা আবার নতুন কিছু চাইতে শুরু করি, আর পেন্ডুলামটা আবার কষ্টের দিকে দুলতে শুরু করে।
ধরুন, আপনার বহুত দিনের শখ একটা দামি গাড়ি কেনার। আপনি দিনরাত পরিশ্রম করলেন, টাকা জমালেন, গাড়িটা কিনলেন। প্রথম কয়েক দিন, হয়তো কয়েক মাস, আপনার দারুণ আনন্দ হলো। তারপর? গাড়িটা পুরোনো হতে শুরু করল, নতুন মডেল বাজারে এলো, আপনার বন্ধু হয়তো আরও দামী একটা গাড়ি কিনে ফেলল। আপনার সেই আগের আনন্দটা আর নেই। গাড়িটা এখন আপনার জীবনের একটা সাধারণ অংশ। আপনি নতুন কোনো আকাঙ্ক্ষার পেছনে ছুটতে শুরু করেছেন।
এটাই হলো জীবনের ট্র্যাজেডি। সুখ আসলে একটা ভ্রম (illusion)। এটা কোনো ইতিবাচক অনুভূতি নয়, বরং দুঃখের সাময়িক অনুপস্থিতি মাত্র। শোপেনহাওয়ারের মতে, সুখের স্মৃতি মধুর হলেও, তা সঞ্চয় করে রাখা যায় না, কিন্তু কষ্টের স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী এবং তা বারবার ফিরে আসে। জীবন হলো এমন এক সমুদ্র, যার তীরে তীরে কেবল অতীতের আকাঙ্ক্ষা আর ভবিষ্যতের উদ্বেগের ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে। তিনি আরও বলেন, “আনন্দ এবং ভোগান্তি জীবনের দাঁড়িপাল্লায় যেভাবে ওজন করা হয়, তাতে ভোগান্তির পাল্লাই সবসময় ভারী থাকে।”
এমনকি তিনি এও যুক্তি দেন যে, এই জগৎ না থাকার চেয়ে থাকাটা বেশি খারাপ। যদি কোনো জগৎ না থাকতো, তাহলে কোনো কষ্টও থাকতো না। যেহেতু জগৎ আছে এবং এর মূলে আছে অতৃপ্ত ইচ্ছা, তাই কষ্ট অনিবার্য। জীবন হলো এমন এক ঋণ যা আমরা মৃত্যুর মাধ্যমে পরিশোধ করি। এই কারণেই তাঁর দর্শনকে বলা হয় চরম নৈরাশ্যবাদী।
স্বাধীনতা ও নিয়তিবাদ (Freedom and Determinism)
তাহলে এর মানে কি এই যে আমরা স্বাধীন নই? আমাদের কি কোনো ইচ্ছার স্বাধীনতা (Free Will) নেই?
শোপেনহাওয়ারের উত্তর একই সাথে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। তিনি বলেন, প্রতিভাসে’র জগতে, অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের জগতে, আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। আমাদের প্রতিটি কাজ আমাদের চরিত্র (Character) এবং প্রেরণা (Motive)-এর দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। আমাদের চরিত্র জন্মগত এবং অপরিবর্তনীয়—এটি হলো আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে ‘ইচ্ছা’র একটি নির্দিষ্ট প্রকাশ। যখন কোনো প্রেরণা (যেমন, একটি লোভনীয় প্রস্তাব বা একটি অপমান) আমাদের সামনে আসে, তখন আমাদের চরিত্র অনুযায়ী আমরা একটি নির্দিষ্টভাবেই কাজ করতে বাধ্য। ঠিক যেমন একটি গাছ আলোর দিকেই বাড়বে, বা ক্ষার আর অ্যাসিড মিশলে লবণ তৈরি হবে। “একজন মানুষ যা চায় তা করতে পারে, কিন্তু সে কী চাইবে তা সে চাইতে পারে না” (“A man can do what he wills, but he cannot will what he wills”)—এই হলো তাঁর বিখ্যাত উক্তি (Schopenhauer, 1840/2010)। আমরা আমাদের কাজের জন্য দায়ী, কারণ আমাদের চরিত্রই আমাদের আসল সত্তা, কিন্তু সেই কাজটি করা ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না।
কিন্তু এক অধিবিদ্যাগত (metaphysical) অর্থে আমরা স্বাধীন। আমাদের আসল সত্তা, সেই ‘ইচ্ছা’, যা দেশ-কাল-কারণতার ঊর্ধ্বে, তা সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু সেই স্বাধীনতা আমাদের কোনো কাজে আসে না, কারণ তা অন্ধ এবং উদ্দেশ্যহীন। একমাত্র মুক্তি আসতে পারে যদি আমরা এই ‘ইচ্ছা’কেই অস্বীকার করতে শিখি, যা আমরা পরে আলোচনা করব।
প্রেম, ভালোবাসা এবং প্রজাতির চালাকি
শোপেনহাওয়ারের দর্শনের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং একই সাথে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশগুলোর একটি হলো প্রেম এবং যৌনতা নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ। আমরা যাকে রোমান্টিক প্রেম, স্বর্গীয় ভালোবাসা বা ‘soulmate’ খুঁজে পাওয়া বলি, শোপেনহাওয়ারের কাছে তা ছিল প্রকৃতির সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং চতুর এক চাল।
তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘প্রেমের অধিবিদ্যা’ (The Metaphysics of Sexual Love)-তে তিনি এই বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, দুজন মানুষের মধ্যে যে তীব্র আকর্ষণ, যে মোহ, যে একে অপরের জন্য সবকিছু ত্যাগ করার মানসিকতা তৈরি হয়, তার পেছনে তাদের ব্যক্তিগত সুখ বা অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। এর পেছনে কাজ করে ‘প্রজাতির প্রতিভা’ (Genius of the Species)। এই ‘প্রজাতির প্রতিভা’ হলো আসলে ওই অন্ধ ‘ইচ্ছা’রই আরেক রূপ, যার একমাত্র লক্ষ্য হলো পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করা এবং মানব প্রজাতিকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম রূপে টিকিয়ে রাখা।
যখন একজন পুরুষ একজন নারীর প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে, সে আসলে অবচেতনভাবে তার ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে বেড়ায়। নারীও ঠিক তাই করে। স্বাস্থ্য, শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, শারীরিক গঠন—এইসবের এক জটিল এবং নিখুঁত হিসাব-নিকাশ আমাদের অবচেতনে চলতে থাকে। আমরা ভাবি, আমরা প্রেমে পড়েছি। কিন্তু আসলে ‘প্রজাতির প্রতিভা’ আমাদের দিয়ে তার কাজ করিয়ে নিচ্ছে।
তিনি কিছু অদ্ভুত, প্রায় কমিক্যাল উদাহরণ দেন। যেমন, একজন খর্বাকৃতির পুরুষ হয়তো দীর্ঘাঙ্গী নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়, কারণ তাদের সন্তানেরা মাঝারি উচ্চতার হবে। একজন অতি পুরুষালী স্বভাবের পুরুষ হয়তো খুব নারীসুলভ গুণের নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়, কারণ এতে ভারসাম্য রক্ষা পায়। নাক লম্বা মানুষ ছোট নাকের মানুষের প্রতি এবং ফর্সা মানুষ শ্যামবর্ণের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়—যাতে প্রজন্ম একটি চরম অবস্থা থেকে মধ্যম অবস্থায় ফিরে আসে। আমরা যেটাকে ‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ বলি, তা আসলে অবচেতন মনের এই জটিল ক্যালকুলেশনেরই ফল, যা প্রজাতির স্বার্থে কাজ করে।
এই কারণেই প্রেম এত তীব্র, এত মোহময় এবং এত কাব্যিক। ‘ইচ্ছা’ আমাদের চোখে এক মায়ার পর্দা ফেলে দেয়, যাতে আমরা আমাদের আসল উদ্দেশ্যটা ভুলে যাই এবং এই প্রজননের কঠিন দায়িত্বটি হাসিমুখে পালন করি। যেইমাত্র প্রজাতির উদ্দেশ্য (অর্থাৎ, সন্তান জন্মদান) সফল হয়, বা সফল হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়, সেই মায়ার পর্দা সরে যায়। মোহ কেটে যায়, আর দুজন মানুষ আবিষ্কার করে যে তারা হয়তো একে অপরের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। দাম্পত্য জীবনের ঝগড়া, অশান্তি, তিক্ততা—এইসবের কারণ এটাই। শোপেনহাওয়ারের ভাষায়, “বিয়ের মাধ্যমে এক প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মের সুখের জন্য নিজেদের সুখকে বিসর্জন দেয়।” (Schopenhauer, 1851)। ভালোবাসার মোহ কেটে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, তা হয় বন্ধুত্ব আর অভ্যাস, অথবা ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা।
কথাগুলো শুনতে খুব নিষ্ঠুর লাগছে, তাই না? কিন্তু আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান (Evolutionary Psychology) কিন্তু অনেকটাই শোপেনহাওয়ারের এই তত্ত্বের প্রতিধ্বনি করে।
সজারুর উভয়সংকট (The Porcupine Dilemma)
মানুষের সামাজিক সম্পর্ক এবং একাকিত্বের যন্ত্রণা নিয়ে শোপেনহাওয়ার একটি চমৎকার রূপক ব্যবহার করেছেন, যা ‘সজারুর উভয়সংকট’ নামে পরিচিত এবং তাঁর ‘Parerga and Paralipomena’-তে পাওয়া যায়।
গল্পটা এরকম: শীতের এক কনকনে রাতে একদল সজারু (Porcupine) ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিল। নিজেদের উষ্ণ রাখার জন্য তারা একে অপরের খুব কাছাকাছি এলো। কিন্তু যেই তারা গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে গেল, অমনি একে অপরের গায়ের কাঁটা ফুটে কষ্ট পেতে লাগল। তাই তারা আবার দূরে সরে গেল। কিন্তু দূরে সরে গেলেই আবার সেই কনকনে ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে তারা আবার কাছে আসে, আবার কাঁটার খোঁচা খায়। এভাবেই তারা সারা রাত একবার কাছে আসে, একবার দূরে সরে—একটা আরামদায়ক দূরত্ব খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে, যেখানে ঠাণ্ডাও লাগবে না, আবার কাঁটাও ফুটবে না।
শোপেনহাওয়ারের মতে, মানব সমাজও ঠিক এই সজারুদের মতো। একাকিত্বের ঠাণ্ডা আমাদের অসহ্য লাগে, তাই আমরা অন্যের সঙ্গ খুঁজি, বন্ধুত্ব করি, ভালোবাসতে চাই। কিন্তু মানুষের কাছাকাছি গেলেই তাদের চরিত্রের নানা কাঁটা—অহংকার, রুক্ষতা, স্বার্থপরতা, ভিন্নমত—আমাদের বিদ্ধ করে। তাই আমরা আবার দূরে সরে যাই, নিজের খোলসে ঢুকে পড়ি। জীবনে সুখী হওয়ার অর্থ হলো, অন্যের সাথে এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ দূরত্ব বজায় রেখে চলা, যাকে তিনি ‘ভদ্রতা ও সৌজন্য’ (politeness and good manners) বলেছেন। এই দূরত্ব আমাদের একাকিত্বের শূন্যতা থেকেও বাঁচায়, আবার অন্যের খুব কাছাকাছি যাওয়ার কষ্ট থেকেও রক্ষা করে (Schopenhauer, 1851)।
তাহলে মুক্তির পথ কী?
এই পর্যন্ত পড়ে যদি আপনার মনে হয় শোপেনহাওয়ার কেবলই এক হতাশাবাদী, যিনি দুঃখের জয়গান গেয়ে গেছেন, তাহলে ভুল হবে। তিনি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু সেই সাথে মুক্তির পথও বাতলে দিয়েছেন। কীভাবে এই অন্ধ, সর্বগ্রাসী ‘ইচ্ছা’র চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব? এইখানেই তাঁর দর্শনের সবচেয়ে আশাবাদী এবং গভীর অংশটি নিহিত আছে। তিনি মূলত তিনটি পথের কথা বলেছেন, যা পর্যায়ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হয়।
১. শিল্পের মাধ্যমে সাময়িক মুক্তি (Aesthetic Contemplation)
শোপেনহাওয়ারের মতে, মুক্তি বা পরিত্রাণের (Salvation) প্রথম ঝলক আমরা পেতে পারি শিল্পের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। যখন আমরা কোনো অসাধারণ শিল্পকর্ম দেখি—হোক তা কোনো চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত বা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য (যেমন, সূর্যাস্তের দৃশ্য)—তখন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আমরা কিছুক্ষণের জন্য আমাদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-কষ্ট, আর আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত হয়ে যাই।
সেই মুহূর্তে আমরা আর একজন ব্যক্তি থাকি না, যে কিছু একটা চায়। আমরা তখন হয়ে উঠি এক ‘বিশুদ্ধ, ইচ্ছামুক্ত জ্ঞানের কর্তা’ (Pure, Will-less Subject of Knowing)। আমরা শুধু দেখি, শুধু অবলোকন করি। সেই মুহূর্তে ‘আমি’ এবং ‘আমার’ বলে কিছু থাকে না। সাবজেক্ট আর অবজেক্ট এক হয়ে যায়। পেন্ডুলামটা তখন কষ্ট আর একঘেয়েমির মধ্যে দোলা বন্ধ করে দেয়। আমরা ‘ইচ্ছা’র দাসত্ব থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি পাই। এটা এক পরম প্রশান্তির মুহূর্ত।
শোপেনহাওয়ার শিল্পের একটি স্তরবিন্যাস (Hierarchy) করেছেন:
-
স্থাপত্য (Architecture): এটি শিল্পের সর্বনিম্ন রূপ, যা মহাকর্ষ এবং কাঠিন্যের মতো ‘ইচ্ছা’র সবচেয়ে প্রাথমিক প্রকাশকে দেখায়।
-
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য (Painting and Sculpture): এগুলো প্লেটোনিক ‘আইডিয়া’ বা ভাবকে প্রকাশ করে—যেমন, মানুষের আদর্শ রূপ, পশুর আদর্শ রূপ ইত্যাদি।
-
কাব্য ও ট্র্যাজেডি (Poetry and Tragedy): এগুলো আরও উঁচুতে, কারণ এগুলো মানুষের জীবনের জটিলতা, আকাঙ্ক্ষা এবং দুঃখকে সরাসরি তুলে ধরে। একটি ভালো ট্র্যাজেডি দেখে আমরা জীবনের অন্তর্নিহিত দুঃখকে উপলব্ধি করি এবং এক ধরনের মহৎ প্রশান্তি লাভ করি।
-
সঙ্গীত (Music): সব শিল্পের মধ্যে শোপেনহাওয়ার সঙ্গীতকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, অন্য সব শিল্প জগতের কোনো না কোনো ‘আইডিয়া’ বা ‘ভাব’-কে অনুকরণ করে। তারা হলো ভাবের ছায়া। কিন্তু সঙ্গীত কোনো কিছুর অনুকরণ নয়। সঙ্গীত হলো স্বয়ং সেই অন্ধ ‘ইচ্ছা’রই সরাসরি প্রতিচ্ছবি বা অনুলিপি। সুরের ওঠা-নামা, ছন্দ, লয়, হারমোনি আর ডিসহারমোনি—এই সবকিছুই আমাদের ‘ইচ্ছা’র অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম, সাময়িক শান্তি এবং চিরন্তন যন্ত্রণার এক বিমূর্ত প্রকাশ। তাই ভালো সঙ্গীত শুনলে আমরা এত গভীরভাবে আলোড়িত হই। কারণ, সেই মুহূর্তে আমরা জগতের মূল চালিকাশক্তির সাথে একাত্ম হয়ে যাই, কিন্তু তার দাসত্ব থেকে মুক্ত থেকে (Magee, 2005)। একটি সিম্ফনি শোনা মানে হলো মহাবিশ্বের গোপন ভাষাটিকে সরাসরি অনুভব করা।
তবে এই মুক্তি সাময়িক। সঙ্গীত শেষ হলে, বা চিত্রশালা থেকে বেরিয়ে এলেই আমরা আবার আমাদের পুরনো জীবনে, ‘ইচ্ছা’র কারাগারে ফিরে আসি।
২. নৈতিকতা ও করুণার পথ (Ethics of Compassion)
মুক্তি লাভের দ্বিতীয় এবং আরও গভীর পথটি হলো নৈতিকতা, যার একমাত্র ভিত্তি হলো করুণা (Mitleid / Compassion)।
শোপেনহাওয়ার প্রশ্ন করেন, আমরা কেন অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হই? কেন অন্যের দুঃখে আমাদের কষ্ট হয়? তাঁর উত্তর হলো, যখন আমরা করুণা অনুভব করি, তখন আমরা অবচেতনভাবে সেই মহৎ সত্যটি উপলব্ধি করি যে, আমার মধ্যে যে ‘ইচ্ছা’ কষ্ট পাচ্ছে, ঠিক একই ‘ইচ্ছা’ অন্য প্রাণীটির মধ্যেও কষ্ট পাচ্ছে।
এই জগতে যা কিছু আছে—মানুষ, পশু, পাখি, এমনকি গাছপালা—সবাই আসলে একই ‘ইচ্ছা’র ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। আমরা নিজেদেরকে আলাদা ভাবি, কারণ আমরা ‘প্রতিভাসে’র মায়াজালে, ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নীতি’তে (Principle of Individuation) আটকা পড়ে আছি। দেশ ও কাল আমাদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়েছে। কিন্তু ‘করুণা’র মুহূর্তে এই দেয়াল ভেঙে যায়। আমি বুঝতে পারি, আমার আর অন্যের দুঃখের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। এই উপলব্ধিকেই ভারতীয় দর্শনে বলা হয়েছে “তৎ ত্বম্ অসি” (Tat Tvam Asi)—”তুমিই সেই”। অন্যের মধ্যে আমি আসলে নিজেকেই দেখছি। যে অত্যাচারী সে যেমন ইচ্ছার প্রকাশ, যে অত্যাচারিত সেও একই ইচ্ছার প্রকাশ। একই ইচ্ছা নিজেকেই আঘাত করছে।
এই করুণা থেকেই জন্ম নেয় সত্যিকারের নৈতিকতা। ভালো মানুষ সে-ই, যে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট বলে অনুভব করে এবং কারো ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকে (Justice) এবং সাধ্যমতো অন্যকে সাহায্য করে (Loving-kindness)। কারণ, সে জানে, অন্যের ক্ষতি করা মানে আসলে নিজেরই ক্ষতি করা, যেহেতু আমরা সবাই একই যন্ত্রণার অংশীদার (Schopenhauer, 1840/2010)। এই কারণেই শোপেনহাওয়ার তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে পশু অধিকারের (Animal Rights) এক বলিষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন। তিনি মনে করতেন, যেহেতু পশুরাও কষ্ট অনুভব করতে পারে এবং তারাও ইচ্ছার প্রকাশ, তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা এক ঘোর অন্যায়।
৩. বৈরাগ্য: ইচ্ছাকে অস্বীকার করা (Asceticism: The Denial of the Will)
শিল্প আমাদের দেয় সাময়িক মুক্তি। করুণা আমাদের শেখায় নৈতিকভাবে বাঁচতে। কিন্তু ‘ইচ্ছা’র দাসত্ব থেকে চিরস্থায়ী মুক্তির পথ কী? শোপেনহাওয়ারের মতে, সেই চূড়ান্ত পথ হলো বৈরাগ্য (Askese / Asceticism), যা করুণার চূড়ান্ত পরিণতি।
এটা হলো সচেতনভাবে ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’ (Will-to-Live)-কে অস্বীকার করা। এর অর্থ হলো স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ করা, সব ধরনের জাগতিক ভোগ-বিলাস ত্যাগ করা, যৌন আকাঙ্ক্ষাকে পুরোপুরি দমন করা (কারণ এটি ‘ইচ্ছা’র সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ) এবং ধীরে ধীরে নিজের সব চাওয়া-পাওয়াকে নিঃশেষ করে দেওয়া। সাধু-সন্ন্যাসী, বৌদ্ধ ভিক্ষু বা খ্রিষ্টান মিস্টিকরা ঠিক এই পথেই হাঁটেন। যখন কোনো মানুষ অন্যের অপরিসীম দুঃখ-কষ্ট দেখে এতটাই করুণা অনুভব করেন যে, তিনি শুধু অন্যের কষ্ট লাঘব করেই ক্ষান্ত হন না, বরং এই কষ্ট উৎপাদনকারী ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’র প্রতিই বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন, তখনই বৈরাগ্যের সূচনা হয়।
এখানে একটা জরুরি বিষয় মনে রাখতে হবে। শোপেনহাওয়ার আত্মহত্যাকে (Suicide) এই মুক্তির পথ হিসেবে দেখেননি, বরং একে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর মতে, আত্মহত্যা আসলে ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’কে অস্বীকার করা নয়, বরং এর চরম প্রকাশ। একজন মানুষ আত্মহত্যা করে, কারণ সে জীবনের কষ্টগুলো আর সহ্য করতে পারছে না, কিন্তু সে আসলে আরও ভালোভাবে, আরও সুখে বাঁচতে চেয়েছিল। তার চাওয়া পূরণ হয়নি বলেই সে জীবনটাকেই ধ্বংস করে দেয়, কিন্তু সে ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’কে ধ্বংস করে না। এটা ইচ্ছার আত্মসমর্পণ নয়, বরং ইচ্ছার এক হতাশ আস্ফালন।
প্রকৃত মুক্তি আসে বৈরাগ্যের মাধ্যমে, যখন সাধক ধীরে ধীরে সব আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে এক পরম প্রশান্তির অবস্থায় পৌঁছান। শোপেনহাওয়ার এই অবস্থাকে বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাণ (Nirvana)-এর সাথে তুলনা করেছেন। এটা এমন এক অবস্থা, যা আমাদের চেনা জগতের ভাষায় বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। এটা এক পরম শূন্যতা, কিন্তু তা অভাবের শূন্যতা নয়, বরং এক পরিপূর্ণ প্রশান্তির মহাশূন্যতা, যেখানে ‘ইচ্ছা’র কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই কোনো কষ্ট, কোনো জগৎ, কোনো প্রতিভাসও নেই। এটা হলো চূড়ান্ত পরিত্রাণ (Welter, 2011)। ইচ্ছার ঝড়ের পর নেমে আসা অনন্ত নীরবতা।
প্রাচ্যের আয়নায় এক পশ্চিমা ঋষি: শোপেনহাওয়ার ও অদ্বৈত বেদান্ত
শোপেনহাওয়ারের দর্শনের সবচেয়ে রহস্যময় এবং আকর্ষণীয় দিকগুলোর একটি হলো প্রাচ্যের চিন্তার সাথে তার গভীর সংযোগ। উনিশ শতকের জার্মানিতে বসে একজন দার্শনিক কীভাবে হাজার হাজার বছর আগের ভারতীয় ঋষিদের চিন্তার সাথে এতটা একাত্ম হতে পারলেন, তা এক বিস্ময়। তাঁর দর্শনের গভীরে প্রবেশ করলে মনে হয়, তিনি যেন ইমানুয়েল কান্টের হাত ধরে যাত্রা শুরু করেছিলেন, কিন্তু পথিমধ্যে গঙ্গা-যমুনার পবিত্র জলে স্নান করে এক নতুন দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন। এই দিশাটিই হলো উপনিষদ বা বেদান্ত, এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আচার্য শংকর প্রচারিত অদ্বৈত বেদান্ত (Advaita Vedanta)।
শোপেনহাওয়ার উপনিষদকে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার এবং সান্ত্বনা বলে মনে করতেন। কিন্তু তিনি কেবল একজন মুগ্ধ পাঠকই ছিলেন না। তিনি অদ্বৈত বেদান্তের কাঠামোটিকে তাঁর নিজের দর্শনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। যেন তিনি একটি পুরোনো ভারতীয় মন্দিরের নকশা নিয়ে তার ওপর গথিক স্থাপত্যের কারুকাজ করেছেন। চলুন, এই দুই চিন্তার জগতের মিল এবং অমিলের জায়গাগুলো একটু তলিয়ে দেখা যাক।
কী আশ্চর্য মিল!
প্রথমবার শোপেনহাওয়ারের দর্শন এবং অদ্বৈত বেদান্ত পাশাপাশি রাখলে যে কেউ চমকে উঠতে বাধ্য। মনে হবে, যেন একই সত্য দুই ভিন্ন ভাষায়, দুই ভিন্ন যুগে উচ্চারিত হচ্ছে।
১. জগৎ এক মায়াজাল (Maya / Representation)
অদ্বৈত বেদান্তের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে ‘মায়া’ (Maya) বা ‘অবিদ্যা’ (Avidya)-র ধারণা। আচার্য শংকর বলেন, আমরা যে জগৎকে আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করি—এই নাম-রূপের (Nama-Rupa) জগৎ—তা পারমার্থিক সত্য বা চূড়ান্ত বাস্তবতা নয়। এটি এক ধরনের ইল্যুশন, এক মহাজাগতিক ভ্রম। যেমন অন্ধকারে একটি দড়িকে সাপ বলে ভুল করা হয়, তেমনি আমরা অবিদ্যা বা অজ্ঞতার কারণে এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মকে (Brahman) এই বহুধা বিভক্ত জগৎ হিসেবে ভুল করি। এই জগৎ পুরোপুরি অসত্য নয়, কিন্তু পারমার্থিক সত্যও নয়। এর এক ব্যবহারিক বাস্তবতা (ব্যবহারিক সত্তা) আছে, কিন্তু জ্ঞান লাভ হলে এই বাস্তবতা মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয় (Deutsch, 1969)।
এবার শোপেনহাওয়ারের দিকে তাকান। তাঁর দর্শনের প্রথম কথাই হলো, “জগৎ আমারই প্রতিভাস” (The World as Representation / Die Welt als Vorstellung)। তিনিও বলছেন, আমরা যে জগৎকে দেখি, তা আসল জগৎ বা ‘বস্তু-স্বরূপ’ (Thing-in-itself) নয়। এটি আমাদের মনের দ্বারা নির্মিত এক জগৎ, যা দেশ (Space), কাল (Time) এবং কার্যকারণ (Causality)-এর চশমা দিয়ে দেখা। এই প্রতিভাসের জগৎই আমাদের বাস্তবতার একমাত্র রূপ, কিন্তু এর আড়ালে লুকিয়ে আছে আসল সত্য। শোপেনহাওয়ারের ‘প্রতিভাস’ আর শংকরের ‘মায়া’ যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দুজনেই বলছেন, আমরা এক স্বপ্নের জগতে বাস করছি এবং আসল সত্যকে দেখতে পাচ্ছি না।
২. পর্দার আড়ালে সেই এক এবং অদ্বিতীয় (Brahman / Will)
যদি এই চেনা জগৎ মায়া বা প্রতিভাস হয়, তাহলে আসল সত্যটা কী?
অদ্বৈত বেদান্তের উত্তর হলো: ব্রহ্ম। ব্রহ্মই একমাত্র পারমার্থিক সত্য—তিনি এক, অদ্বিতীয়, নির্বিকার, শাশ্বত এবং দেশ-কালের অতীত। উপনিষদ বলছে, “একমেবাদ্বিতীয়ম্” (তিনি এক, দ্বিতীয় কেউ নেই)। এই বহুধা বিভক্ত জগৎ সেই এক ব্রহ্মেরই প্রকাশ মাত্র।
শোপেনহাওয়ারও ঠিক একই কথা বলছেন। তাঁর মতে, এই প্রতিভাসের জগতের আড়ালে যে একক, অখণ্ড সত্তা রয়েছে, তার নাম ‘ইচ্ছা’ (Will / Wille)। এই ‘ইচ্ছা’ও এক, অবিভাজ্য এবং দেশ-কাল-কারণতার ঊর্ধ্বে। পৃথিবীর কোটি কোটি জীব, গাছপালা, গ্রহ-নক্ষত্র—সবই ওই এক এবং অদ্বিতীয় ‘ইচ্ছা’র ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ বা বস্তুভবন (Objectification) মাত্র (Magee, 2005)।
সুতরাং, শংকর এবং শোপেনহাওয়ার—দুজনই চরম অদ্বৈতবাদী বা অদ্বয়বাদী বা একত্ববাদী (Monist)। তাঁরা দুজনেই বিশ্বাস করেন, এই আপাত বহুত্বের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক পরম ঐক্য।
৩. মুক্তির পথ (Moksha / Denial of the Will)
যেহেতু আমাদের দুঃখের কারণ হলো এই মায়ার জগতে নিজেকে আবদ্ধ ভাবা, তাই মুক্তির একমাত্র উপায় হলো এই মায়াজাল ছিন্ন করা।
অদ্বৈত বেদান্তের মতে, মুক্তির পথ হলো জ্ঞান (Jnana)। যখন সাধক গুরুর উপদেশে এবং নিজের মননের মাধ্যমে এই সত্য উপলব্ধি করেন যে, “অহং ব্রহ্মাস্মি” (Aham Brahmasmi) অর্থাৎ “আমিই ব্রহ্ম”, তখন তাঁর অবিদ্যা দূর হয়। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর আত্মা (Atman) আর ব্রহ্ম ভিন্ন নয়। এই জ্ঞান লাভের মাধ্যমেই তিনি মোক্ষ (Moksha) বা জীবন্মুক্ত অবস্থা লাভ করেন (Shankara, Trans. 1978)।
শোপেনহাওয়ারও মুক্তির কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ‘ইচ্ছা’র দাসত্বই হলো সব দুঃখের কারণ। এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’কে অস্বীকার করার (Denial of the Will-to-Live) মাধ্যমে। এই অস্বীকারের পথটি শুরু হয় শিল্পের মাধ্যমে সাময়িক মুক্তি দিয়ে, তারপর করুণার (Compassion) মাধ্যমে অন্যের সাথে একাত্মতা অনুভব করে এবং সবশেষে বৈরাগ্য (Asceticism)-এর মাধ্যমে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। এই চূড়ান্ত অবস্থাকে তিনি বৌদ্ধধর্মের নির্বাণ (Nirvana)-এর সাথে তুলনা করেছেন, যা এক পরম প্রশান্তির অবস্থা।
উভয় ক্ষেত্রেই, মুক্তির অর্থ হলো ব্যক্তি-সত্তার (Individuality) মায়া থেকে বেরিয়ে এসে এক বৃহত্তর সত্যের সাথে একাত্ম হওয়া বা বিলীন হয়ে যাওয়া।
কিন্তু পথ গিয়েছে বেঁকে
এতগুলো গভীর মিল থাকা সত্ত্বেও, এই দুই দর্শনের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যা কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। এই পার্থক্যগুলোই শোপেনহাওয়ারকে একজন স্বতন্ত্র চিন্তাবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
১. পরম সত্তার প্রকৃতি: আনন্দ বনাম অন্ধ তাড়না
এটাই হলো সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। অদ্বৈত বেদান্তের মতে, ব্রহ্মের স্বরূপ হলো ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ’ (Sat-Chit-Ananda) অর্থাৎ শাশ্বত অস্তিত্ব (Being), বিশুদ্ধ চেতনা (Consciousness) এবং পরম আনন্দ (Bliss)। ব্রহ্ম কোনো নেতিবাচক বা ভয়ংকর সত্তা নন। তিনি হলেন সব আনন্দের উৎস, পরম শান্তির আধার। মোক্ষ লাভ করা মানে সেই আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মের সাথে একাত্ম হওয়া।
কিন্তু শোপেনহাওয়ারের ‘ইচ্ছা’ ঠিক এর বিপরীত। তাঁর ‘ইচ্ছা’ কোনো চেতন সত্তা নয়, এর কোনো জ্ঞান বা উদ্দেশ্য নেই। এটি এক অন্ধ, অতৃপ্ত, অযৌক্তিক এবং নিরন্তর তাড়না, যা কেবলই কষ্ট আর সংঘাত তৈরি করে। এটি কোনো আনন্দের উৎস নয়, বরং সব দুঃখের মূল কারণ। শোপেনহাওয়ারের কাছে পরম সত্তা কোনো পূজনীয় ঈশ্বর বা আনন্দের সাগর নয়, বরং এক ভয়ংকর, মহাজাগতিক বিভীষিকা, যার থেকে পালিয়ে যাওয়াই একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ (Atwell, 1995)।
এককথায়, একজন বলছেন পর্দার ওপারে আছে পরম আলো ও আনন্দ, আরেকজন বলছেন সেখানে আছে এক অতল, অর্থহীন অন্ধকার।
২. মুক্তির পথের ভিন্নতা: জ্ঞান বনাম বৈরাগ্য
যেহেতু পরম সত্তার প্রকৃতি নিয়ে দুজনের ধারণা ভিন্ন, তাই মুক্তির পথের ওপর তাঁদের জোর দেওয়ার জায়গাও আলাদা। শংকরের মতে, মুক্তির মূল চাবিকাঠি হলো জ্ঞান (Jnana)। অজ্ঞতা বা অবিদ্যাই হলো বন্ধনের কারণ, তাই সঠিক জ্ঞানই সেই বন্ধন কেটে দিতে পারে। কর্ম বা উপাসনা চিত্তশুদ্ধির জন্য সহায়ক হতে পারে, কিন্তু জ্ঞান ছাড়া মোক্ষ সম্ভব নয়। এটি মূলত এক জ্ঞানভিত্তিক বা জ্ঞানীয় (Cognitive) পথ (Deutsch, 1969)।
অন্যদিকে, শোপেনহাওয়ার মনে করেন, কেবল জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। কারণ আমাদের বুদ্ধি বা জ্ঞান (Intellect) নিজেই তো ‘ইচ্ছা’র দাস। তাই ‘ইচ্ছা’কে জয় করতে হলে কেবল বুদ্ধির ব্যায়াম করলে চলবে না, ইচ্ছাকে সরাসরি দমন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর বৈরাগ্য, আত্ম-ত্যাগ এবং সব ধরনের জাগতিক ভোগ-বিলাস বর্জন। তাঁর পথটি তাই কেবল জ্ঞানভিত্তিক নয়, বরং এটি এক ঐকান্তিক বা ইচ্ছাশক্তি-ভিত্তিক (Volitional) সংগ্রাম।
৩. চূড়ান্ত লক্ষ্যের ভিন্নতা: পূর্ণতা বনাম শূন্যতা
শেষ পর্যন্ত মুক্তি বা মোক্ষের স্বরূপ কী? অদ্বৈত মতে, মোক্ষ হলো নিজের আসল সত্তা, অর্থাৎ আনন্দময় ব্রহ্মকে ফিরে পাওয়া। এটি কোনো শূন্য অবস্থা নয়, বরং এক পরিপূর্ণ, অনন্ত অবস্থা। এটি ব্যক্তির ক্ষুদ্র সত্তার বিলুপ্তি ঘটিয়ে এক মহৎ, আনন্দময় সত্তায় রূপান্তরিত হওয়া।
শোপেনহাওয়ারের চূড়ান্ত লক্ষ্য, যা তিনি নির্বাণের সাথে তুলনা করেছেন, তা অনেক বেশি নেতিবাচকভাবে বর্ণিত। এটি হলো ‘ইচ্ছা’র সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। যেহেতু জগৎ ‘ইচ্ছা’রই প্রকাশ, তাই ইচ্ছার বিলুপ্তি মানে জগতেরও বিলুপ্তি। আমাদের চেনা জগতের দৃষ্টিকোণ থেকে এই অবস্থাটি এক পরম শূন্যতা (Nothingness) ছাড়া আর কিছুই নয় (Schopenhauer, 1969, Vol. 1, §71)। যদিও তিনি একে ‘পরম প্রশান্তি’ বলেছেন, কিন্তু সেই প্রশান্তি হলো ঝড়ের থেমে যাওয়ার প্রশান্তি, অস্তিত্বের পূর্ণতার আনন্দ নয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, শোপেনহাওয়ার অদ্বৈত বেদান্তের কাছ থেকে একটি মানচিত্র পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই মানচিত্র ব্যবহার করে তিনি যে দেশ আবিষ্কার করলেন, তা শংকরের ভারতভূমি থেকে অনেকটাই আলাদা। তিনি মায়ার ধারণা নিলেন, অদ্বৈত সত্তার ধারণা নিলেন, মুক্তির ধারণাও নিলেন। কিন্তু সেই অদ্বৈত সত্তার হৃদয়ে তিনি ‘আনন্দ’ খুঁজে পেলেন না, পেলেন এক অন্তহীন ‘যন্ত্রণা’। এই পার্থক্য হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর সময়কার ইউরোপীয় নৈরাশ্যবাদ এবং তাঁর খ্রিষ্টীয় সাংস্কৃতিক পটভূমির কারণে তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত, শোপেহাওয়ারকে একজন পশ্চিমা বেদান্তিস্ট বলা যেতে পারে, কিন্তু এক বিদ্রোহী বেদান্তিস্ট।
গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ন ধরে এক জার্মান পথিক
আর্থার শোপেনহাওয়ারের চিন্তার জগতে যদি উপনিষদ হয় মস্তিষ্ক, তবে বৌদ্ধধর্ম ছিল তার হৃদয়। তিনি নিজেকে বৌদ্ধ না বললেও, তাঁর দর্শনের সাথে বৌদ্ধধর্মের সাদৃশ্য এতটাই গভীর যে, অনেক পণ্ডিত তাঁকে ‘প্রথম ইউরোপীয় বৌদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন (App, 2011)। তিনি গৌতম বুদ্ধকে মানবজাতির ইতিহাসে আবির্ভূত হওয়া শ্রেষ্ঠতম মানুষদের একজন বলে মনে করতেন এবং তাঁর দর্শনকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত ও সত্যনিষ্ঠ দর্শনগুলোর অন্যতম বলে সম্মান করতেন। শোপেনহাওয়ারের কাছে বৌদ্ধধর্ম ছিল তাঁর নিজের আবিষ্কৃত সত্যের এক শক্তিশালী ঐতিহাসিক সমর্থন। তিনি দেখেছিলেন, আড়াই হাজার বছর আগেই ভারতের এক রাজপুত্র সেই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, যেখানে তিনি নিজে কান্ট এবং প্লেটোর পথ ধরে এসে দাঁড়িয়েছেন।
চলুন, এই দুই দুঃখবাদী দর্শনের গভীরে ডুব দেওয়া যাক এবং তাদের মিল ও অমিলের জায়গাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা যাক।
একই নদীর দুই তীর: কী আশ্চর্য সাদৃশ্য!
শোপেনহাওয়ার এবং বুদ্ধ—দুজনই তাঁদের দর্শনের যাত্রা শুরু করেছেন জীবনের এক মৌলিক এবং অপ্রিয় সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমে: জীবন দুঃখময়।
১. জীবনের মূল সমস্যা: দুঃখ (Dukkha / Suffering): বৌদ্ধধর্মের একেবারে ভিত্তি হলো চারটি আর্যসত্য (Four Noble Truths)। এর প্রথম সত্যটি হলো: “জীবনে দুঃখ আছে” (Dukkha)। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু—সবই দুঃখ। প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছেদ দুঃখ, অপ্রিয় বিষয়ের সাথে সংযোগ দুঃখ, এবং যা চাই তা না পাওয়াও দুঃখ। এককথায়, আমাদের অস্তিত্বের সাথে দুঃখ ওতপ্রোতভাবে জড়িত (Rahula, 1974)।
শোপেনহাওয়ারও ঠিক একই কথা দিয়ে তাঁর দর্শন শুরু করেন। তাঁর মতে, আমাদের জীবনটা একটা পেন্ডুলামের মতো, যা কেবল কষ্ট (Pain) আর একঘেয়েমি (Boredom)-এর মধ্যে দুলতে থাকে। সুখ হলো এই দুইয়ের মাঝখানের ক্ষণস্থায়ী একটি মুহূর্ত মাত্র। যেহেতু জীবনের মূলে রয়েছে এক অতৃপ্ত ‘ইচ্ছা’ (Will), তাই অতৃপ্তি আর কষ্টই জীবনের স্বাভাবিক অবস্থা।
২. দুঃখের কারণ: তৃষ্ণা (Tanha / Will): দুঃখের কারণ কী? দ্বিতীয় আর্যসত্যে বুদ্ধ বলছেন, দুঃখের কারণ হলো ‘তৃষ্ণা’ (Pali: Tanha; Sanskrit: Trishna)। এই তৃষ্ণা তিন প্রকার: কামতৃষ্ণা (Sensual pleasure), ভবতৃষ্ণা (Desire for existence) এবং বিভবতৃষ্ণা (Desire for non-existence)। এই অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষাই আমাদের জন্ম-মৃত্যুর চক্র বা সংসার (Samsara)-এর মধ্যে বেঁধে রাখে।
শোপেনহাওয়ারের দর্শনে এই ‘তৃষ্ণা’র প্রতিরূপ হলো ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’ (Will-to-Live / Wille zum Leben)। এটিও এক অন্ধ, আদিম এবং অতৃপ্ত তাড়না, যা আমাদের ক্রমাগত এক আকাঙ্ক্ষা থেকে আরেক আকাঙ্ক্ষার দিকে ঠেলে নিয়ে যায় এবং সব দুঃখের মূল কারণ হিসেবে কাজ করে। শোপেনহাওয়ারের ‘ইচ্ছা’ এবং বুদ্ধের ‘তৃষ্ণা’—দুটোই হলো সেই আগুন যা আমাদের পুড়িয়ে মারে (Magee, 2005)।
৩. দুঃখ নিরোধ: নির্বাণ (Nirvana / Denial of the Will): দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় কী? তৃতীয় আর্যসত্যে বুদ্ধ বলছেন, এই তৃষ্ণাকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ বা নিরোধ করার মাধ্যমেই দুঃখের অবসান সম্ভব। এই অবস্থাই হলো ‘নির্বাণ’ (Nirvana), যার আক্ষরিক অর্থ ‘নিভে যাওয়া’। এটি হলো সব আকাঙ্ক্ষার আগুন নিভে যাওয়ার পর এক পরম শান্তি ও মুক্তির অবস্থা।
শোপেনহাওয়ারও ঠিক একই সমাধানের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’কে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার (Denial of the Will) করার মাধ্যমেই চূড়ান্ত মুক্তি বা পরিত্রাণ (Salvation) সম্ভব। এই অস্বীকারের চূড়ান্ত পর্যায় হলো বৈরাগ্য (Asceticism), যা সাধককে এক পরম প্রশান্তির অবস্থায় নিয়ে যায়। শোপেনহাওয়ার নিজেই তাঁর এই অবস্থাকে বৌদ্ধধর্মের নির্বাণের সাথে তুলনা করেছেন (Schopenhauer, 1969, Vol. 1, §71)।
৪. মুক্তির পথ: নৈতিকতা ও প্রজ্ঞা (The Path): চতুর্থ আর্যসত্যে বুদ্ধ নির্বাণ লাভের পথ হিসেবে অষ্টাঙ্গিক মার্গের (The Noble Eightfold Path) কথা বলেছেন। এই পথের তিনটি প্রধান অংশ হলো: শীল (Sila) বা নৈতিক আচরণ, সমাধি (Samadhi) বা মানসিক একাগ্রতা, এবং প্রজ্ঞা (Panna) বা জ্ঞান।
শোপেনহাওয়ারের মুক্তির পথও প্রায় একই রকম। তিনিও নৈতিকতার ওপর জোর দিয়েছেন, যার ভিত্তি হলো করুণা (Compassion)। করুণার মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি যে, সব জীব একই দুঃখের অংশীদার। এই উপলব্ধি আমাদের অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে (শীল)। এরপর আসে বৈরাগ্য, যা এক ধরনের মানসিক শৃঙ্খলা বা সমাধি। এবং সবশেষে, এই পুরো প্রক্রিয়াটি এক গভীর জ্ঞান বা প্রজ্ঞার জন্ম দেয়।
কিন্তু কিছু পথের ভিন্নতাও আছে
এতগুলো গভীর মিল থাকা সত্ত্বেও, এই দুই চিন্তাধারার মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে।
১. অধিবিদ্যাগত ভিত্তি: পরম সত্তা বনাম শূন্যতা: শোপেনহাওয়ার ছিলেন একজন অধিবিদ্যাগত (Metaphysical) দার্শনিক। তিনি জগৎকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি পরম সত্তার ধারণা এনেছেন—’ইচ্ছা’ (Will)। তাঁর মতে, এই ‘ইচ্ছা’ই হলো জগতের মূল উপাদান, সেই বস্তু-স্বরূপ (Thing-in-itself)।
অন্যদিকে, আদি বৌদ্ধধর্ম ছিল মূলত অধিবিদ্যা-বিরোধী (Anti-metaphysical)। বুদ্ধ জগৎ কী দিয়ে তৈরি বা এর কোনো পরম সত্তা আছে কিনা—এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করতেন। বৌদ্ধধর্মের অন্যতম মূল ভিত্তি হলো ‘অনাত্মা’ বা ‘অনাত্তা’ (Anatta / No-self)-র ধারণা, অর্থাৎ কোনো স্থায়ী, অপরিবর্তনীয় আত্মা বা সত্তার অস্তিত্ব নেই (Collins, 1982)। সুতরাং, যেখানে শোপেনহাওয়ার এক পরম, অখণ্ড ‘ইচ্ছা’র কথা বলছেন, সেখানে বুদ্ধ সব ধরনের স্থায়ী সত্তার ধারণাকেই অস্বীকার করছেন।
২. মুক্তির পথের জোর: জ্ঞান বনাম বৈরাগ্য: বৌদ্ধধর্মে, বিশেষ করে অষ্টাঙ্গিক মার্গে, মুক্তির জন্য জ্ঞান বা প্রজ্ঞা (Panna)-কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সঠিক দৃষ্টি (Right View) হলো পথের প্রথম ধাপ। অজ্ঞতা বা অবিদ্যাই হলো দুঃখের মূল শিকড় (Rahula, 1974)।
শোপেনহাওয়ারের দর্শনে যদিও জ্ঞানের ভূমিকা আছে, কিন্তু মূল জোরটা দেওয়া হয়েছে ‘ইচ্ছা’র ওপর। যেহেতু ‘ইচ্ছা’ অন্ধ এবং অযৌক্তিক, তাই তাকে কেবল জ্ঞান দিয়ে পরাস্ত করা কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে ইচ্ছাকে দমন করা, অর্থাৎ বৈরাগ্য (Asceticism)। তাঁর পথটি অনেক বেশি ইচ্ছাশক্তি-নির্ভর এবং সংগ্রামের।
৩. করুণার উৎস: প্রজ্ঞা বনাম একাত্মতা: বৌদ্ধধর্মে করুণা (Karuna) আসে প্রজ্ঞা থেকে। যখন একজন সাধক ‘অনাত্মা’ তত্ত্ব উপলব্ধি করেন এবং বুঝতে পারেন যে ‘আমি’ বলে কোনো স্থায়ী সত্তা নেই, তখন তাঁর অহংবোধ দূর হয়ে যায় এবং তিনি সকল প্রাণীর প্রতি সমব্যথী হন।
শোপেনহাওয়ারের করুণা আসে এক অধিবিদ্যাগত একাত্মতার উপলব্ধি থেকে। তিনি মনে করেন, জগতের সব জীব আসলে একই ‘ইচ্ছা’র প্রকাশ। তাই অন্যের দুঃখ আসলে আমারই দুঃখ। এই “তৎ ত্বম্ অসি” (তুমিই সেই) উপলব্ধি থেকেই তাঁর করুণার জন্ম। একটির ভিত্তি হলো সত্তার অনুপস্থিতি (অনাত্মা), অন্যটির ভিত্তি হলো এক অখণ্ড সত্তার উপস্থিতি (ইচ্ছা) (Atwell, 1995)।
শোপেনহাওয়ার এবং বুদ্ধ—দুজনই মানবজাতির দুঃখের এক গভীর এবং নির্মম চিত্র এঁকেছেন এবং আকাঙ্ক্ষা ত্যাগের মাধ্যমে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। পার্থক্যটা হলো তাঁদের যাত্রাপথে এবং মানচিত্রে। বুদ্ধ ছিলেন একজন প্রয়োগবাদী চিকিৎসক, অন্যদিকে শোপেনহাওয়ার ছিলেন একজন সিস্টেম-নির্মাতা দার্শনিক। তাঁদের পথ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু তাঁদের উভয়ের আঙুলই একই দিকে নির্দেশ করছে—সেই পরম শান্তির দিকে, যেখানে সব আকাঙ্ক্ষা নিভে যায়।
এক আশ্চর্য কথোপকথন যা কখনও হয়নি: শোপেনহাওয়ার ও শূন্যবাদী বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন
দর্শনের ইতিহাসে কিছু আশ্চর্য সমাপতন ঘটে। মনে হয় যেন, দুই ভিন্ন যুগে, দুই ভিন্ন মহাদেশে বসে দুজন মানুষ একই নদীর দিকে তাকিয়ে আছেন, একই সত্যের গন্ধ পাচ্ছেন, অথচ তাঁরা একে অপরকে চেনেন না, জানেন না। আর্থার শোপেনহাওয়ার এবং ভারতীয় মহাযান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক নাগার্জুনের (Nagarjuna) সম্পর্কটা ঠিক তেমনই—এক আশ্চর্য কথোপকথন, যা আসলে কখনও হয়নি। শোপেনহাওয়ার যখন তাঁর দর্শনের শেষে এক পরম ‘শূন্যতা’র (Nothingness) কথা বলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই মহাযান বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদ (Śūnyatāda) এবং এর প্রধান প্রবক্তা নাগার্জুনের কথা মনে পড়ে। কিন্তু শোপেনহাওয়ার কি সত্যিই নাগার্জুনের দর্শন পড়েছিলেন? তাঁদের এই দুই ‘শূন্য’-এর ধারণা কি একই? চলুন, এই রহস্যের গভীরে যাওয়া যাক।
শোপেনহাওয়ারের বৌদ্ধ-পাঠশালা: কী ছিল, কী ছিল না
প্রথমেই একটি ঐতিহাসিক সত্য পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। শোপেনহাওয়ারের সময়ে ইউরোপে বৌদ্ধধর্ম নিয়ে যেটুকু জ্ঞান ছিল, তা ছিল খুবই সীমিত এবং অসম্পূর্ণ। তিনি বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন মূলত কিছু ইউরোপীয় পণ্ডিত ও অনুবাদকের কাজের মাধ্যমে। এদের মধ্যে ছিলেন:
- আইজ্যাক জ্যাকব শ্মিট (Isaac Jacob Schmidt): যিনি তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম নিয়ে লিখেছিলেন।
- রবার্ট স্পেন্স হার্ডি (Robert Spence Hardy): যিনি সিংহল (শ্রীলঙ্কা)-এর পালি গ্রন্থাবলীর ওপর ভিত্তি করে লিখেছিলেন।
- এশিয়াটিক রিসার্চেস (Asiatic Researches) এর মতো জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ।
এইসব উৎস থেকে শোপেনহাওয়ার মূলত থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের (যাকে তখন ‘দক্ষিণী বৌদ্ধধর্ম’ বলা হতো) এবং তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের একটি সাধারণ চিত্র পেয়েছিলেন। তিনি চারটি আর্যসত্য, অনাত্মা, কর্মফল এবং নির্বাণ সম্পর্কে জেনেছিলেন। কিন্তু নাগার্জুনের মতো মহাযান দর্শনের গভীরে প্রবেশ করা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। নাগার্জুনের মাধ্যমিক বা মধ্যমক দর্শনের (Madhyamaka philosophy) জটিল গ্রন্থ, যেমন ‘মূলমধ্যমককারিকা’ (Mūlamadhyamakakārikā), তখন ইউরোপে অনূদিত বা পরিচিত ছিল না (App, 2011)।
সুতরাং, ঐতিহাসিক দিক থেকে, শোপেনহাওয়ারের নাগার্জুন পড়ার কোনো প্রমাণ নেই। তিনি যে ‘শূন্যতা’র কথা বলেছেন, তা তিনি বৌদ্ধধর্মের সাধারণ ধারণা এবং তাঁর নিজের দার্শনিক সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে বলেছেন, নাগার্জুনের শূন্যবাদের ওপর ভিত্তি করে নয়।
শূন্যের দুই রূপ: এক নয়, তবু কাছাকাছি
তাহলে কি এই মিলটি পুরোপুরি কাকতালীয়? না, ঠিক তা-ও নয়। বরং বলা যায়, এটি দুই ভিন্ন পথ ধরে একই ধরনের সমস্যার গভীরে পৌঁছানোর ফল। কিন্তু তাঁদের সমাধান ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মৌলিকভাবে আলাদা।
১. শোপেনহাওয়ারের ‘শূন্যতা’ (Das Nichts / Nothingness): শোপেনহাওয়ারের কাছে ‘শূন্যতা’ হলো তাঁর দর্শনের শেষ কথা, এক চূড়ান্ত গন্তব্য। আসুন ব্যাপারটা ধাপে ধাপে বুঝি:
-
এটি এক আপেক্ষিক শূন্যতা (Relative Nothingness): শোপেনহাওয়ার খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, এই ‘শূন্যতা’ হলো আমাদের এই ‘ইচ্ছা’-শাসিত জগতের সাপেক্ষে শূন্য। যে জগতে আমরা বাস করি, তা হলো ‘ইচ্ছা’র প্রকাশ। এই জগতে আছে চাওয়া, পাওয়া, কষ্ট, সংঘাত। যখন সাধনার মাধ্যমে ‘ইচ্ছা’কে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়, তখন এই জগৎ বিলীন হয়ে যায়। সেই অবস্থাটিকে এই জগতের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘শূন্য’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
-
এটি এক অধিবিদ্যাগত সমাপ্তি: শোপেনহাওয়ারের দর্শনে ‘ইচ্ছা’ হলো এক পরম, অধিবিদ্যাগত সত্তা (Metaphysical entity)। তাঁর ‘শূন্যতা’ হলো সেই সত্তার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি বা নেগেশন (negation)। এটি ঝড়ের থেমে যাওয়ার পরের নিস্তব্ধতা। এটি এক ইতিবাচক অবস্থা নয়, বরং সবকিছুর (বিশেষ করে কষ্টের) অবসানের অবস্থা। তিনি নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন, এই শূন্যতা কি পরম শূন্যতা, নাকি এমন কিছু যা আমরা বুঝতে পারি না? কিন্তু তিনি একে একটি চূড়ান্ত অবস্থা বা গন্তব্য হিসেবেই দেখেছেন (Schopenhauer, 1969, Vol. 1, §71)।
২. নাগার্জুনের ‘শূন্যতা’ (Śūnyatā / Emptiness): নাগার্জুনের ‘শূন্যতা’ কোনো গন্তব্য নয়, এটি কোনো পরম শূন্য বা ভয়েড নয়। এটি হলো বস্তুর আসল প্রকৃতি বোঝার একটি উপায়, একটি দার্শনিক পদ্ধতি।
-
এটি অন্তর্নিহিত সত্তার অভাব: নাগার্জুনের মতে, জগতের কোনো বস্তুরই নিজস্ব, স্বাধীন বা স্থায়ী সত্তা (স্বভাব) নেই। সবকিছুই অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে উৎপন্ন হয়। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার (Dependent Origination / Pratītyasamutpāda) কারণেই সবকিছু ‘শূন্য’। একটি টেবিল ‘শূন্য’, কারণ এটি কাঠ, পেরেক, শ্রমিকের শ্রম ইত্যাদি ছাড়া নিজে নিজে অস্তিত্বশীল হতে পারে না। এই নির্ভরশীলতাই হলো শূন্যতা।
-
এটি মধ্যম পথ (Middle Path): নাগার্জুনের শূন্যবাদ কোনো শূন্যবাদী দর্শন বা নিহিলিজম (Nihilism) নয়। নিহিলিজম বলে, কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আবার এর বিপরীত দর্শন, শাশ্বতবাদ (Eternalism), বলে যে সবকিছুর স্থায়ী অস্তিত্ব আছে। নাগার্জুন এই দুই চরম ধারণার মাঝখানের পথটি দেখিয়েছেন। তিনি বলছেন, বস্তু একেবারে নেই তা-ও নয়, আবার তার কোনো স্থায়ী অস্তিত্ব আছে তা-ও নয়। বস্তুর অস্তিত্ব আপেক্ষিক এবং নির্ভরশীল। তাই ‘শূন্যতা’ মানে ‘অনস্তিত্ব’ নয়, বরং ‘অন্তর্নিহিত সত্তার অভাব’ (lack of inherent existence) (Garfield, 1995)।
-
এটি কোনো অধিবিদ্যাগত সত্তা নয়: নাগার্জুনের ‘শূন্যতা’ কোনো পরম সত্তা বা তার অভাব নয়। এটি বস্তুর ধর্ম বা প্রকৃতি। এটি জগতের বাইরে কোনো নির্বাণ বা স্থান নয়, বরং জগৎকে সঠিকভাবে দেখার একটি উপায়। জগৎ এবং নির্বাণ আসলে ভিন্ন কিছু নয়। যখন আমরা জগৎকে অজ্ঞতার দৃষ্টিতে দেখি, তখন তা সংসার। যখন প্রজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখি, তখন তার শূন্য রূপটিই নির্বাণ।
এক কাল্পনিক কথোপকথন
যদি কোনোদিন এই দুই দার্শনিকের দেখা হতো, তাঁদের কথোপকথনটা কেমন হতো?
শোপেনহাওয়ার: “এই জগৎ এক অন্ধ, অতৃপ্ত ‘ইচ্ছা’র প্রকাশ এবং এর সারমর্মই হলো দুঃখ। এই দুঃখ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো এই ‘ইচ্ছা’কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এক পরম শূন্যতায় বিলীন হওয়া।”
নাগার্জুন (মৃদু হেসে): “আপনি ‘ইচ্ছা’কে এক পরম সত্তা হিসেবে ধরে নিয়েছেন, যা জগতের কারণ। তারপর আপনি তার বিপরীত হিসেবে ‘শূন্যতা’ নামে আরেকটি চরম অবস্থাকে কল্পনা করছেন। দুটিই অধিবিদ্যাগত চরমপন্থা। আমি বলি, আপনার ঐ ‘ইচ্ছা’ও শূন্য। তার কোনো অন্তর্নিহিত, স্বাধীন সত্তা নেই। আপনার দুঃখও শূন্য। এমনকি আপনার মুক্তির ধারণাও শূন্য। আপনাকে কোনো কিছুকে ‘অস্বীকার’ করতে হবে না, আপনাকে শুধু বস্তু ও ধারণার এই শূন্য প্রকৃতিটি উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই আপনি মুক্ত। মুক্তি মানে কোথাও পৌঁছানো নয়, মুক্তি মানে সঠিকভাবে দেখা।”
এই কাল্পনিক সংলাপ থেকেই বোঝা যায়, শোপেনহাওয়ার ছিলেন একজন আপাদমস্তক অধিবিদ্যাগত দার্শনিক, যিনি একটি চূড়ান্ত সত্তা (Will) এবং তার চূড়ান্ত বিলুপ্তি (Nothingness)-তে বিশ্বাস করতেন। অন্যদিকে, নাগার্জুন ছিলেন একজন অধিবিদ্যা-বিরোধী দার্শনিক, যিনি সব ধরনের চূড়ান্ত সত্তার ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
শোপেনহাওয়ার নাগার্জুন পড়েননি, কিন্তু তিনি এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছিলেন যেখানে নাগার্জুনের দর্শনের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। দুজনেই বুঝেছিলেন, আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা এবং ভাষার জগৎটি চূড়ান্ত সত্য নয়। দুজনেই প্রচলিত বাস্তবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কিন্তু তাঁদের পথ ছিল ভিন্ন। শোপেনহাওয়ার একটি নতুন অধিবিদ্যা তৈরি করেছেন, আর নাগার্জুন সব অধিবিদ্যাকে ভেঙে দিয়েছেন। শোপেনহাওয়ারের শূন্যতা হলো একটি পূর্ণচ্ছেদের মতো—গল্পের শেষ। আর নাগার্জুনের শূন্যতা হলো ভাষার ব্যাকরণের মতো—যা সব শব্দের পেছনে লুকিয়ে থেকে তাদের অর্থ দেয়, কিন্তু নিজে কোনো শব্দ নয়। এই আশ্চর্য মিল এবং অমিলই শোপেনহাওয়ারকে দর্শনের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র এবং চিরকালীন আকর্ষণীয় চরিত্র করে তুলেছে।
এক বিষণ্ণ দার্শনিকের দীর্ঘ ছায়া: যারা শুনেছিল সেই শীতল স্বর
ইতিহাসে কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের চিন্তা অনেকটা টাইম বোমার মতো। যখন তাঁরা কথা বলেন, তখন চারপাশ থাকে নিস্তব্ধ, কেউ কান দেয় না। তাঁদের বইয়ের পাতা ধুলোয় ধূসর হয়, তাঁদের নাম বিদ্বজ্জনের আসরে উচ্চারিত হয় না। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর বহু বছর পর, সেই নীরব কথাগুলো হঠাৎ করে কান্নার মতো বেজে ওঠে, সেই ধুলোমাখা বইয়ের অক্ষরগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। আর্থার শোপেনহাওয়ার ছিলেন ঠিক সেই রকম একজন মানুষ। তাঁর জীবদ্দশায় অ্যাকাডেমিক জগৎ তাঁকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর দর্শন ছিল এক গভীর বীজ, যা উনিশ শতকের অনুর্বর মাটিতে নীরবে অঙ্কুরিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। যখন সেই বীজ থেকে গাছ গজালো, তখন তার ছায়া পড়ল দর্শন, মনোবিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, এমনকি বিজ্ঞানের জগতেও।
শোপেনহাওয়ারের দর্শন কেন এত প্রভাবশালী হলো? কারণ তিনি এমন কিছু সত্যের কথা বলেছিলেন, যা শুনতে অপ্রিয় হলেও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। তিনি মানুষের ভেতরের সেই অন্ধকার দিকটার দিকে আঙুল তুলেছিলেন, যেদিকে তাকাতে আমাদের ভয় করে। তিনি আশাবাদের রঙিন চশমাটা খুলে নিয়ে আমাদের দেখিয়েছিলেন জীবনের নগ্ন, ধূসর রূপ। চলুন, আজ সেই দীর্ঘ ছায়ার গল্প শোনা যাক। দেখা যাক, কীভাবে এই একাকী, বিষণ্ণ দার্শনিকের শীতল স্বর পরবর্তী প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের কানে পৌঁছেছিল এবং তাঁদের জগৎকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিল।
ছাত্র ও বিদ্রোহী—ফ্রিডরিখ নিৎশে
দর্শনের ইতিহাসে কিছু সম্পর্ক থাকে পিতা-পুত্রের মতো, আবার কিছু থাকে কেইন ও অ্যাবেলের মতো—যেখানে ভালোবাসা ও হত্যার আকাঙ্ক্ষা একসাথে বাস করে। শোপেনহাওয়ার ও নিৎশের সম্পর্ক ছিল এই দুইয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। তরুণ বয়সে নিৎশে ছিলেন শোপেনহাওয়ারের একনিষ্ঠ ভক্ত, আর পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচক। কিন্তু শত্রুতা সত্ত্বেও, নিৎশে আজীবন শোপেনহাওয়ারের ছায়া থেকে বের হতে পারেননি।
শিক্ষকের সন্ধান
১৮৬৫ সাল। ২১ বছর বয়সী এক উজ্জ্বল, কিন্তু দিশাহীন তরুণ, ফ্রিডরিখ নিৎশে, লাইপজিগের এক পুরোনো বইয়ের দোকানে ঘুরছিলেন। সেখানে তিনি একটি বই খুঁজে পান—শোপেনহাওয়ারের ‘জগৎ ইচ্ছা ও প্রতিভাসরূপে’ (The World as Will and Representation)। নিৎশে পরে লিখেছেন, তিনি বইটি বাড়ি নিয়ে যান এবং প্রায় ঘোরের মধ্যে একটানা পড়তে থাকেন। তিনি অনুভব করেন, যেন এক দৈববাণী তাঁর কানে প্রবেশ করছে। তিনি লিখেছেন, “প্রতিটি লাইন থেকে আমি অস্বীকার, ত্যাগ এবং আত্মসমর্পণের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম… আমি বইটির মধ্যে একটি আয়না দেখতে পেলাম, যেখানে আমি জগৎ, জীবন এবং আমার নিজের প্রকৃতিকে এক ভয়ংকর মহিমায় প্রতিফলিত হতে দেখলাম।” (Nietzsche, 1874/1997)।
কেন তরুণ নিৎশে এতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন? কারণ শোপেনহাওয়ার তাঁকে সেই সততা দিয়েছিলেন, যা তিনি তাঁর সময়ের সংস্কৃতিতে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। উনিশ শতকের জার্মান সংস্কৃতি ছিল আশাবাদ, প্রগতি এবং রাষ্ট্রীয় অহংকারে পরিপূর্ণ। হেগেলের দর্শন বলছিল, ইতিহাস এক মহৎ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিৎশে এই স্বস্তিদায়ক কথাগুলোর মধ্যে এক ধরনের মিথ্যাচার অনুভব করছিলেন। শোপেনহাওয়ারই প্রথম তাঁকে বললেন, “না, এসব মিথ্যা। জীবন মানেই কষ্ট, জগৎ অযৌক্তিক এবং এর কোনো অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নেই।” এই নির্মম সততা নিৎশের কাছে মুক্তির মতো মনে হয়েছিল।
তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘শিক্ষকরূপে শোপেনহাওয়ার’ (Schopenhauer as Educator)-এ নিৎশে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করেছেন, শোপেনহাওয়ার তাঁকে শিখিয়েছেন কীভাবে একজন খাঁটি দার্শনিক হতে হয়—যিনি জনপ্রিয়তার তোয়াক্কা করেন না, যিনি আরামদায়ক মিথ্যার বদলে কঠিন সত্যকে বেছে নেন এবং যিনি নিজের জীবন দিয়েই তাঁর দর্শনকে যাপন করেন। শোপেনহাওয়ার ছিলেন তাঁর প্রথম এবং একমাত্র ‘শিক্ষক’।
বিদ্রোহ এবং অতিক্রম (Overcoming)
কিন্তু শিষ্যের কাজ কেবল গুরুকে অনুসরণ করা নয়, গুরুকে অতিক্রম করাও। নিৎশের দর্শন যত পরিণত হতে থাকল, তিনি শোপেনহাওয়ারের দর্শনের সীমাবদ্ধতাগুলো ততই স্পষ্টভাবে দেখতে শুরু করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, শোপেনহাওয়ার সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু তাঁর সমাধানটি ছিল ভুল—এক ধরনের জীবনবিমুখ সমাধান। এখানেই নিৎশে তাঁর গুরুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন।
১. ইচ্ছা: অস্বীকার বনাম রূপান্তর: শোপেনহাওয়ারের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’ (Will-to-Live)—এক অন্ধ, অর্থহীন তাড়না, যা কেবলই দুঃখ উৎপাদন করে। এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো এই ইচ্ছাকে অস্বীকার করা, বৈরাগ্যের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা।
নিৎশে এই ধারণাটিকে পুরোপুরি উল্টে দিলেন। তিনি বললেন, জীবনের মূল চালিকাশক্তি ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’ নয়, বরং ‘ক্ষমতার ইচ্ছা’ (Will to Power)। এটি নিছক টিকে থাকার অন্ধ তাড়না নয়, বরং নিজেকে প্রসারিত করার, বাধা অতিক্রম করার, সৃষ্টি করার এবং আধিপত্য বিস্তার করার এক চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা। শোপেনহাওয়ারের কাছে ‘ইচ্ছা’ ছিল এক রোগ, যার নিরাময় প্রয়োজন। নিৎশের কাছে ‘ইচ্ছা’ ছিল জীবনের মূল শক্তি, যাকে অস্বীকার করলে চলবে না, বরং তাকে আলিঙ্গন করতে হবে, তাকে মহৎ কোনো উদ্দেশ্যে চালিত করতে হবে। যেখানে শোপেনহাওয়ার দেখেছিলেন এক ক্লান্তিকর চক্র, নিৎশে সেখানে দেখেছিলেন ক্রমাগত আত্ম-অতিক্রমের (Self-overcoming) সম্ভাবনা।
২. দুঃখ: পলায়ন বনাম আলিঙ্গন: শোপেনহাওয়ারের মতে, জীবন দুঃখময়, তাই জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। শিল্পের মাধ্যমে সাময়িক মুক্তি, করুণার মাধ্যমে অন্যের দুঃখে সমব্যথী হওয়া এবং বৈরাগ্যের মাধ্যমে চূড়ান্ত মুক্তি—এই সবই হলো জীবন এবং তার কষ্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার উপায়।
নিৎশে এই জীবনবিমুখতাকে বলতেন ‘দুর্বলের নৈতিকতা’। তিনি বললেন, মহান ব্যক্তিরা দুঃখ থেকে পালিয়ে যান না, তাঁরা দুঃখকে স্বাগত জানান। কারণ তাঁরা জানেন, কষ্টই মানুষকে শক্তিশালী করে, মহৎ করে। তিনি প্রস্তাব করলেন ‘আমোর ফাতি’ (Amor Fati) বা ‘নিয়তির প্রতি প্রেম’-এর ধারণা। এর অর্থ হলো, জীবনের সবকিছুকে—তার আনন্দ, তার কষ্ট, তার কদর্যতা, তার সৌন্দর্য—কোনোকিছু বাদ না দিয়ে সানন্দে গ্রহণ করা। নিৎশের আদর্শ মানব, ‘অতিমানব’ (Übermensch), দুঃখ দেখে কাঁদেন না, বরং বলেন, “এটাই জীবন? বেশ, আরেকবার হোক!” (Nietzsche, 1883-1885/1961)।
৩. করুণা: মহৎ গুণ বনাম অবক্ষয়ের লক্ষণ: শোপেনহাওয়ারের নৈতিকতার ভিত্তি ছিল করুণা (Compassion)। তাঁর মতে, করুণাই আমাদের শেখায় যে আমরা সবাই একই দুঃখের অংশীদার, এবং এটিই আমাদের নৈতিক কাজের উৎস।
নিৎশের কাছে এই করুণা ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় রোগগুলোর একটি, যা খ্রিষ্টধর্ম থেকে এসেছে। তিনি মনে করতেন, করুণা দুর্বলকে আরও দুর্বল করে তোলে এবং সবলকে তার শক্তি প্রয়োগ করতে বাধা দেয়। এটি জীবনকে অস্বীকার করারই আরেকটি রূপ। তিনি করুণার বদলে মহৎ ব্যক্তিদের মধ্যে এক ধরনের ‘দূরত্ববোধ’ (Pathos of Distance) এবং নিজের মূল্যবোধ নিজে তৈরি করার ক্ষমতার কথা বলেছেন।
এইভাবে, নিৎশে শোপেনহাওয়ারের প্রতিটি মূল ধারণাকে গ্রহণ করে তাকে রূপান্তরিত করেছেন। শোপেনহাওয়ার যদি হন প্রশ্ন, তবে নিৎশে হলেন তার এক ভয়ংকর এবং জীবনবাদী উত্তর। কিন্তু সেই উত্তরটি জন্মাতোই না, যদি শোপেনহাওয়ার প্রথমে সেই প্রশ্নটি না করতেন।
অন্তরের অতলস্পর্শী মানচিত্র—সিগমুন্ড ফ্রয়েড
যদি শোপেনহাওয়ার হন সেই অভিযাত্রী যিনি প্রথমবার এক অন্ধকার, অজানা মহাদেশের তীরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তবে সিগমুন্ড ফ্রয়েড হলেন সেই মানচিত্রকর, যিনি সেই মহাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে তার নদী, পাহাড় এবং অরণ্যের বিস্তারিত নকশা তৈরি করেছিলেন। সেই অন্ধকার মহাদেশটি হলো মানুষের ‘অবচেতন মন’ (The Unconscious)।
ফ্রয়েড নিজে দাবি করতেন যে তিনি শোপেনহাওয়ারের লেখা অনেক পরে, তাঁর নিজের তত্ত্বগুলো দাঁড় করানোর পরেই পড়েছিলেন। কিন্তু এই দুই চিন্তাবিদের দর্শনের মধ্যে যে সাদৃশ্য, তা এতটাই গভীর যে তাকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। ফ্রয়েড একবার বলেছিলেন, “সম্ভবত আমি তাঁর (শোপেনহাওয়ারের) লেখা পড়া থেকে বিরত থেকেছি, কারণ আমি জানতাম, তাঁর চিন্তার সাথে আমার চিন্তার মিল খুঁজে পেলে আমি হয়তো আমার নিজের আবিষ্কারের মৌলিকত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ব।” (Procktor, 1988)।
আসুন, এই অদ্ভুত সাদৃশ্যের জগৎটিতে ডুব দেওয়া যাক।
১. মহাজাগতিক ‘ইচ্ছা’ এবং মনস্তাত্ত্বিক ‘ইড’: শোপেনহাওয়ারের ‘ইচ্ছা’ (Will) কী? এটি এক অন্ধ, অযৌক্তিক, আদিম এবং সর্বগ্রাসী শক্তি, যা আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডকে পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর কোনো নৈতিকতা নেই, কোনো যুক্তি নেই, আছে কেবল অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা।
এবার ফ্রয়েডের ‘ইড’ (Id)-এর কথা ভাবুন। এটি আমাদের মনের সবচেয়ে আদিম অংশ, যা জন্ম থেকেই আমাদের সাথে থাকে। এটি সম্পূর্ণরূপে অবচেতন এবং ‘সুখের নীতি’ (Pleasure Principle) দ্বারা চালিত। এর একমাত্র লক্ষ্য হলো তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌনতা, আগ্রাসন—এইসব আদিম তাড়নাগুলো ইড থেকেই জন্মায়। শোপেনহাওয়ারের মহাজাগতিক ‘ইচ্ছা’ যেন ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক মডেলে এসে ‘ইড’ রূপে ব্যক্তির মনের গভীরে বাসা বেঁধেছে। আমাদের সচেতন ‘অহং’ (Ego) বা বুদ্ধি, যা বাস্তবতার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করে, তা যেন সেই অন্ধ শক্তির লাগাম টেনে ধরার এক অসহায় সারথি।
২. প্রেমের অধিবিদ্যা এবং লিবিডো তত্ত্ব: শোপেনহাওয়ার তাঁর ‘প্রেমের অধিবিদ্যা’ (The Metaphysics of Sexual Love) প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, আমরা যাকে রোমান্টিক প্রেম বলি, তা আসলে ‘প্রজাতির ইচ্ছা’র এক চতুর খেলা। এর মূল উদ্দেশ্য ব্যক্তির সুখ নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্ম তৈরির মাধ্যমে প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখা। যৌন আকাঙ্ক্ষাই হলো ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’র সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ।
ফ্রয়েডের ‘লিবিডো’ (Libido) তত্ত্বের সাথে এর সাদৃশ্য চমকে দেওয়ার মতো। ফ্রয়েডের মতে, লিবিডো হলো এক ধরনের মানসিক শক্তি, যা মূলত যৌন তাড়না থেকে উদ্ভূত হয় এবং আমাদের ব্যক্তিত্ব ও আচরণের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। ফ্রয়েডও দেখিয়েছেন, কীভাবে এই যৌন শক্তি আমাদের জীবনের সবকিছুকে—আমাদের কাজ, আমাদের শিল্প, আমাদের স্বপ্ন—গোপনে প্রভাবিত করে। শোপেনহাওয়ার যাকে ‘প্রজাতির প্রতিভা’ বলেছেন, ফ্রয়েড তাকেই মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন।
৩. দমন (Repression) এবং প্রতিভাসের জগৎ: শোপেনহাওয়ারের মতে, আমাদের বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা (Intellect) হলো ‘ইচ্ছা’র দাস। এর একটি প্রধান কাজ হলো, ইচ্ছার সেইসব ভয়ঙ্কর তাড়নাগুলোকে আড়াল করা, যা আমাদের সামাজিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। আমরা এক ‘প্রতিভাসে’র জগতে বাস করি, যা আসল সত্যকে ঢেকে রাখে।
ফ্রয়েডের অন্যতম প্রধান আবিষ্কার হলো ‘দমন’ (Repression)-এর ধারণা। আমাদের মন তার বেদনাদায়ক, লজ্জাজনক বা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষাগুলোকে অবচেতন মনে ঠেলে দেয়। এই দমিত বিষয়গুলোই পরে নানা রকম মানসিক রোগ, স্বপ্ন বা ‘মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথা’র (Freudian slip) মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করে। শোপেনহাওয়ার যা দার্শনিকভাবে বর্ণনা করেছেন, ফ্রয়েড তাকেই একটি ক্লিনিক্যাল তত্ত্বে পরিণত করেছেন।
শোপেনহাওয়ার ছিলেন দর্শনের মনোবিশ্লেষক, আর ফ্রয়েড ছিলেন মনোবিজ্ঞানের দার্শনিক। দুজনেই আমাদের দেখিয়েছেন, আমরা আমাদের নিজেদের ঘরের মালিক নই। আমাদের চেতনার আলোকিত ঘরের নিচে এক অন্ধকার ভুগর্ভস্থ কক্ষ আছে, আর সেখান থেকেই আসল কলকাঠি নাড়া হয়।
শিল্পীদের দার্শনিক—সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি
কোনো দার্শনিকের প্রভাব যদি মাপতে হয়, তবে দেখতে হবে বিজ্ঞানীরা তাঁকে কতটা উদ্ধৃত করছেন। কিন্তু কোনো দার্শনিকের গভীরতা যদি মাপতে হয়, তবে দেখতে হবে শিল্পীরা তাঁকে কতটা ভালোবাসেন। এই নিরিখে, শোপেনহাওয়ার নিঃসন্দেহে আধুনিক যুগের অন্যতম গভীরতম দার্শনিক। লিয়েভ তলস্তয় থেকে শুরু করে স্যামুয়েল বেকেট, রিচার্ড ভাগনার থেকে হোর্হে লুইস বোর্হেস—শোপেনহাওয়ারের বিষণ্ণ সুর তাঁদের সৃষ্টিতে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
কেন শিল্পীরা তাঁকে এত ভালোবাসেন? কারণ শোপেনহাওয়ার শিল্পকে এক মহাজাগতিক মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, শিল্প কোনো বিনোদন বা অলংকার নয়। এটি হলো সেই পবিত্র জানালা, যা দিয়ে আমরা কিছুক্ষণের জন্য ‘ইচ্ছা’র কারাগার থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং জগতের চিরন্তন রূপ বা ‘আইডিয়া’কে অবলোকন করতে পারি। এটি এক ধরনের পরিত্রাণ (Salvation)। এই ধারণা শিল্পীদের কাছে ছিল এক বিরাট পুরস্কার।
সাহিত্য:
-
লিয়েভ তলস্তয় (Leo Tolstoy): তলস্তয় তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়সে শোপেনহাওয়ার পড়েন এবং এতটাই প্রভাবিত হন যে, তিনি লেখেন, “শোপেনহাওয়ার হলেন মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান।” তলস্তয়ের শেষ জীবনের রচনাগুলোতে এই প্রভাব স্পষ্ট। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসিকা ‘দ্য ডেথ অফ ইভান ইলিচ’ (The Death of Ivan Ilyich) যেন শোপেনহাওয়ারের দর্শনের এক সাহিত্যিক রূপায়ণ। ইভান ইলিচের জীবন ছিল পুরোপুরি ‘প্রতিভাসে’র জীবন—সামাজিক মর্যাদা, ভালো চাকরি, সুন্দর বাড়ি—সবই ছিল বাইরের খোলস। যখন সে এক ভয়ংকর রোগে আক্রান্ত হয়, তখন সে প্রথমবার জীবনের অর্থহীনতা এবং তার মেকি জীবনের মুখোমুখি হয়। মৃত্যুর মুহূর্তে সে উপলব্ধি করে, তার পুরো জীবনটাই ছিল এক বিরাট ভুল। তলস্তয়ের শেষ জীবনের বৈরাগ্য এবং খ্রিষ্টীয় আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝোঁককেও শোপেনহাওয়ারের ‘ইচ্ছাকে অস্বীকার করা’র ধারণার প্রতিধ্বনি হিসেবে দেখা যায়।
-
টমাস মান (Thomas Mann): জার্মান এই ঔপন্যাসিক নিৎশে এবং ফ্রয়েডের পাশাপাশি শোপেনহাওয়ার দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর প্রথম মহৎ উপন্যাস, ‘বুডেনব্রুকস’ (Buddenbrooks), একটি পরিবারের চার প্রজন্মের গল্প বলে, যেখানে ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা’ ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। প্রথম প্রজন্ম শক্তিশালী, কর্মঠ ব্যবসায়ী। কিন্তু প্রজন্ম যত এগোতে থাকে, ততই তারা শৈল্পিক, সংবেদনশীল এবং জীবনের প্রতি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শেষ প্রজন্মের প্রতিনিধি, ছোট্ট হানো বুডেনব্রুক, জীবনের নিষ্ঠুরতার সাথে মানিয়ে নিতে পারে না এবং তার একমাত্র সান্ত্বনা খুঁজে পায় সঙ্গীতে—বিশেষ করে ভাগনারের সঙ্গীতে (যিনি নিজেও একজন শোপেনহাওয়ারিয়ান)। এই উপন্যাসটি হলো ‘ইচ্ছা’র অবক্ষয়ের এক মহাকাব্য।
-
মার্সেল প্রুস্ত (Marcel Proust): প্রুস্তের বিশাল উপন্যাস ‘ইন সার্চ অফ লস্ট টাইম’ (In Search of Lost Time) হলো শোপেনহাওয়ারের ‘জগৎ প্রতিভাসরূপে’ ধারণার এক চূড়ান্ত সাহিত্যিক প্রকাশ। এই উপন্যাসের জগৎটি পুরোপুরি বক্তার চেতনার দ্বারা নির্মিত। সময়, স্মৃতি, প্রেম, ঈর্ষা—এই সবকিছুই এখানে আপেক্ষিক এবং ব্যক্তির উপলব্ধির ওপর নির্ভরশীল। প্রুস্ত দেখিয়েছেন, প্রেম কতটা যন্ত্রণাদায়ক এবং কীভাবে তা আমাদের সত্তাকে গ্রাস করে—যা শোপেনহাওয়ারের ‘প্রেমের অধিবিদ্যা’র কথাই মনে করিয়ে দেয়। শিল্পই এখানে একমাত্র মুক্তির পথ, যা সময়ের ধ্বংসলীলার ঊর্ধ্বে উঠে জীবনের সারসত্যকে ধরতে পারে।
-
স্যামুয়েল বেকেট (Samuel Beckett): যদি কোনো লেখককে শোপেনহাওয়ারের দর্শনের প্রতিমূর্তি বলা যায়, তবে তিনি হলেন স্যামুয়েল বেকেট। তাঁর নাটক ‘ওয়েটিং ফর গডো’ (Waiting for Godot) হলো শোপেনহাওয়ারের সেই বিখ্যাত পেন্ডুলামের এক নিখুঁত মঞ্চায়ন, যা কষ্ট (waiting) এবং একঘেয়েমির (boredom) মধ্যে দুলতে থাকে। ভ্লাদিমির এবং এস্ট্রাগন অর্থহীনভাবে অপেক্ষা করে, অর্থহীন খেলা খেলে, অর্থহীন কথা বলে—শুধু সময় কাটানোর জন্য, জীবনের শূন্যতাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের জগৎ অন্তহীন, উদ্দেশ্যহীন এবং পরিত্রাণহীন। বেকেটের চরিত্ররা সেই পৃথিবীতে বাস করে, যা শোপেনহাওয়ার বর্ণনা করেছিলেন।
সঙ্গীত:
-
রিচার্ড ভাগনার (Richard Wagner): শোপেনহাওয়ার সঙ্গীতকে সব শিল্পের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন, কারণ এটি সরাসরি ‘ইচ্ছা’র প্রতিচ্ছবি। এই ধারণা সুরকার রিচার্ড ভাগনারকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। ১৮৫৪ সালে শোপেনহাওয়ারের দর্শন পড়ার পর ভাগনারের শিল্পচিন্তা পুরোপুরি বদলে যায়। তাঁর অপেরা ‘ট্রিস্টান উন্ড ইসোল্ডে’ (Tristan und Isolde) হলো শোপেনহাওয়ারের দর্শনের এক সুরময় মহাকাব্য। ট্রিস্টান ও ইসোল্ডের অতৃপ্ত, সর্বগ্রাসী প্রেম হলো সেই অন্ধ ‘ইচ্ছা’র প্রতীক, যা এই ‘প্রতিভাসে’র জগতে (দিনের আলোয়) কখনও শান্ত হতে পারে না। তাদের একমাত্র মুক্তি নিহিত আছে রাতে, অর্থাৎ মৃত্যুতে, যেখানে তাদের ব্যক্তি-সত্তা বিলীন হয়ে যাবে এবং ‘ইচ্ছা’র যন্ত্রণা থেকে তারা চিরমুক্তি পাবে। অপেরার শেষাংশ, ‘লিবেস্টোড’ (Liebestod বা Love-Death), হলো সেই নির্বাণের সুর, যেখানে প্রেম ও মৃত্যু এক হয়ে যায়।
যুক্তি ও পরীক্ষাগারে প্রতিধ্বনি—দর্শন ও বিজ্ঞান
এটা ভাবা স্বাভাবিক যে, একজন চরম হতাশাবাদী দার্শনিকের প্রভাব কেবল শিল্পী আর সাহিত্যিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, শোপেনহাওয়ারের চিন্তার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে কঠোর যুক্তিবাদী দার্শনিক এবং এমনকি শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের জগতেও।
দর্শন:
-
লুদভিগ ভিটগেনস্টাইন (Ludwig Wittgenstein): বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী এই দার্শনিকের প্রথম পর্বের মহৎ গ্রন্থ ‘ট্র্যাকটেটাস লজিকো-ফিলোসফিকাস’ (Tractatus Logico-Philosophicus)-এর ওপর শোপেনহাওয়ারের প্রভাব অনস্বীকার্য। ভিটগেনস্টাইন দেখিয়েছেন, ভাষার কাজ হলো জগতের (অর্থাৎ, যা কিছু ঘটে) ছবি আঁকা। যা কিছু ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়, তা হলো ‘প্রতিভাসে’র জগৎ। কিন্তু এর বাইরেও কিছু আছে—যেমন, নৈতিকতা (ethics), সৌন্দর্য (aesthetics), এবং জীবনের অর্থ—যা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না, যা কেবল ‘দেখানো’ (shown) যায়। এই বর্ণনাতীত (ineffable) জগতের ধারণা শোপেনহাওয়ারের কাছ থেকে সরাসরি নেওয়া। শোপেনহাওয়ার যেমন বলেছিলেন, ‘ইচ্ছা’ এবং তার অস্বীকারের জগৎটি যুক্তির ঊর্ধ্বে, ভিটগেনস্টাইনও তেমনি মনে করতেন, জীবনের গভীরতম বিষয়গুলো সম্পর্কে কেবল নীরব থাকাই সম্ভব। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “যা নিয়ে কথা বলা যায় না, তা নিয়ে নীরব থাকাই শ্রেয়” (Whereof one cannot speak, thereof one must be silent), হলো এই শোপেনহাওয়ারিয়ান ভাবনারই চূড়ান্ত প্রকাশ (Janik & Toulmin, 1973)।
-
অস্তিত্ববাদ (Existentialism): শোপেনহাওয়ারকে প্রায়শই ‘অস্তিত্ববাদের জনক’ বলা হয়। যদিও তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেননি, কিন্তু তাঁর দর্শনে অস্তিত্ববাদের মূল থিমগুলো স্পষ্ট: এক ঈশ্বরহীন, অর্থহীন জগতে ব্যক্তির নিঃসঙ্গ নিক্ষেপণ (thrownness); জীবনের অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা (Angst); এবং স্বাধীনতার বোঝা। জ্যাঁ-পল সার্ত্র (Jean-Paul Sartre) বা আলবেয়ার কামু (Albert Camus)-র মতো দার্শনিকেরা যখন বলেন, অস্তিত্ব সারধর্মের আগে আসে (existence precedes essence), তখন তাঁরা সেই কথাই বলেন যা শোপেনহাওয়ার আগেই বলেছিলেন—আমাদের জীবনের কোনো পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য নেই। তবে পার্থক্য হলো, যেখানে শোপেনহাওয়ার এই অর্থহীনতা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে বৈরাগ্যকে বেছে নিয়েছিলেন, সেখানে কামু বেছে নিয়েছেন বিদ্রোহকে (Revolt), আর সার্ত্র বেছে নিয়েছেন অঙ্গীকারকে (Commitment)। কিন্তু সমস্যাটি প্রথম চিহ্নিত করেছিলেন শোপেনহাওয়ারই।
বিজ্ঞান:
-
আলবার্ট আইনস্টাইন (Albert Einstein): আইনস্টাইন শোপেনহাওয়ারের একজন গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলেন। তাঁর কাছে শোপেনহাওয়ারের দর্শন ছিল এক ধরনের ব্যক্তিগত সান্ত্বনা। তিনি বলেছিলেন, “শোপেনহাওয়ারের লেখা পড়া এক অমূল্য অভিজ্ঞতা, কারণ তা আমাদের শেখায় কীভাবে অন্যের এবং নিজের জীবনের কষ্ট ও আকাঙ্ক্ষার অর্থহীনতাকে মেনে নিয়ে নিজের ক্ষুদ্র অহংকারের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়।” আইনস্টাইনের জন্য, বিজ্ঞান ছিল সেই ‘শৈল্পিক অবলোকন’ (aesthetic contemplation), যা তাঁকে মানুষের জীবনের কোলাহল এবং ‘ইচ্ছা’র তাড়না থেকে মুক্তি দিয়ে প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মের মধ্যে শান্তি খুঁজে পেতে সাহায্য করত। তিনি মানুষের জগৎ থেকে পালিয়ে বিজ্ঞানের জগতে আশ্রয় নিতেন, ঠিক যেমন শোপেনহাওয়ার শিল্প বা দর্শনের জগতে আশ্রয় নিতে বলেছেন (Einstein, 1954)।
-
এরউইন শ্রোডিঙ্গার (Erwin Schrödinger): কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক শ্রোডিঙ্গার শোপেনহাওয়ার এবং উপনিষদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত বই ‘হোয়াট ইজ লাইফ?’ (What is Life?) এবং ‘মাই ভিউ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (My View of the World)-এ তিনি চেতনার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, আপাতদৃষ্টিতে আমরা কোটি কোটি ভিন্ন ভিন্ন চেতনার অধিকারী হলেও, আসলে মূলে রয়েছে এক এবং অদ্বিতীয় চেতনা। তিনি লেখেন, “চেতনার বহুত্ব আসলে একটি মায়া (Maya) মাত্র।” এই ধারণাটি উপনিষদের ‘ব্রহ্ম’ এবং শোপেনহাওয়ারের একক, অবিভাজ্য ‘ইচ্ছা’র ধারণার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। শ্রোডিঙ্গার মনে করতেন, আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রাচীন প্রাচ্য দর্শনের মধ্যে এক গভীর যোগসূত্র রয়েছে, আর সেই যোগসূত্রটি খুঁজে পেতে শোপেনহাওয়ার তাঁকে পথ দেখিয়েছিলেন (Schrödinger, 1944)।
শেষ কথা
তাহলে, আর্থার শোপেনহাওয়ারকে আমরা কীভাবে মনে রাখব? কেবলই একজন হতাশাবাদী, খিটখিটে বুড়ো হিসেবে, যিনি জীবনকে অভিশাপ মনে করতেন?
নাকি একজন সাহসী সত্যদ্রষ্টা হিসেবে, সেই দার্শনিক শল্যচিকিৎসক হিসেবে, যিনি জীবনের কঠিনতম সত্যগুলোর মুখোমুখি হতে ভয় পাননি?
শোপেনহাওয়ার আমাদের কোনো সহজ উত্তর বা সস্তা সান্ত্বনা দেন না। তিনি আশাবাদীদের (optimists)-দের ‘নিষ্ঠুর’ বলে মনে করতেন, কারণ তারা মানুষকে এমন এক জগতে সুখের মিথ্যা আশা দেয়, যেখানে কষ্টই হলো নিয়ম। তাঁর দর্শন এক শীতল জলের ঝাপটার মতো, যা আমাদের মোহ এবং ভ্রমের ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়। তিনি আমাদের বলেন, সুখের পেছনে ছোটা একটা মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই অর্থহীন।
কিন্তু তাঁর দর্শন এখানেই শেষ হয়ে যায় না। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, এই অবধারিত কষ্টের পৃথিবীতেও এক ধরনের গভীর প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। শিল্পের নির্মল আনন্দে, অন্যের দুঃখে সমব্যথী হওয়ার মাধ্যমে, এবং সবশেষে, নিজের ভেতরের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষাগুলোকে জয় করার মাধ্যমে সেই প্রশান্তি লাভ করা যায়। তিনি জীবনের রোগ নির্ণয় করেছেন, কিন্তু সেই সাথে নিরাময়ের পথও বাতলে দিয়েছেন।
হতে পারে, শোপেনহাওয়ারের পৃথিবীটা আনন্দময় নয়। কিন্তু এটা এমন এক পৃথিবী, যেখানে করুণা, শিল্প আর প্রজ্ঞার জন্য একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। আর এই দুঃখময় পৃথিবীতে ওই তিনটি জিনিসই হয়তো আমাদের সবচেয়ে বড় সম্বল। ফ্রাঙ্কফুর্টের রাস্তায় তাঁর পোষা কুকুরটিকে নিয়ে হাঁটতে থাকা সেই একাকী দার্শনিকের কথা ভাবলে তাই আর শুধু বিষণ্ণতা জাগে না, এক ধরনের অদ্ভুত শ্রদ্ধাও জন্মায়। তিনি জীবনের ক্ষতগুলো দেখিয়েছেন, কিন্তু সেই সাথে মলমটাও বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেই মলম খুঁজে নেওয়া বা না নেওয়ার দায়ভার তিনি আমাদের হাতেই তুলে দিয়ে গেছেন।
তথ্যসূত্র
- App, U. (2011). The Birth of Orientalism. University of Pennsylvania Press.
- Atwell, J. E. (1995). Schopenhauer on the Character of the World: The Metaphysics of Will. University of California Press.
- Collins, S. (1982). Selfless Persons: Imagery and Thought in Theravada Buddhism. Cambridge University Press.
- Deutsch, E. (1969). Advaita Vedanta: A Philosophical Reconstruction. East-West Center Press.
- Einstein, A. (1954). Ideas and Opinions. Crown Publishers.
- Garfield, J. L. (1995). The Fundamental Wisdom of the Middle Way: Nāgārjuna’s Mūlamadhyamakakārikā. Oxford University Press.
- Janik, A., & Toulmin, S. (1973). Wittgenstein’s Vienna. Simon & Schuster.
- Magee, B. (2005). The Philosophy of Schopenhauer. Oxford University Press.
- Nietzsche, F. (1961). Thus Spoke Zarathustra (R. J. Hollingdale, Trans.). Penguin Books. (Original work published 1883-1885)
- Nietzsche, F. (1997). Untimely Meditations (R. J. Hollingdale, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1874)
- Procktor, C. E. (1988). The Roots of Psychoanalysis and Psychotherapy. Open University Press.
- Rahula, W. (1974). What the Buddha Taught. Grove Press.
- Safranski, R. (1990). Schopenhauer and the Wild Years of Philosophy. Harvard University Press.
- Schopenhauer, A. (1969). The World as Will and Representation (Vol. 1 & 2, E. F. J. Payne, Trans.). Dover Publications. (Original work published 1818, expanded 1844)
- Schopenhauer, A. (2015). Parerga and Paralipomena: Short Philosophical Essays (Vol. 1 & 2, E. F. J. Payne, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1851)
- Schopenhauer, A. (2010). On the Basis of Morality (A. B. Bullock, Trans.). Dover Publications. (Original work published 1840)
- Schrödinger, E. (1944). What Is Life? The Physical Aspect of the Living Cell. Cambridge University Press.
- Shankara. (1978). Crest-Jewel of Discrimination (Viveka-Chudamani) (S. Prabhavananda & C. Isherwood, Trans.). Vedanta Press.
- Welter, R. (2011). Arthur Schopenhauer: The Next World-Saviour. In P. S. Luchte (Ed.), Early Post-Kantian German Philosophy (pp. 155-174). Acumen Publishing.
- Young, C. (2005). Schopenhauer. Routledge.
Leave a Reply