প্লেটো: এক জাদুকরের দর্শন ও ছায়ার জগৎ

Table of Contents

ভূমিকা

আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, এই যে আমরা চেয়ার, টেবিল, বিড়াল বা কুকুর দেখছি, এগুলো আসলে কী? কিংবা যখন আমরা কোনো কিছুকে ‘সুন্দর’ বলি, এই সৌন্দর্যের ধারণাটা আমাদের মাথায় কোত্থেকে আসে? পৃথিবীতে তো কোটি কোটি সুন্দর জিনিস আছে, কিন্তু তাদের সবার মধ্যে কমন কোনো একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে, যা তাদের ‘সুন্দর’ বানিয়েছে। সেই মূল সৌন্দর্যটা কী? আচ্ছা, ‘ন্যায়বিচার’ শব্দটা আমরা হরহামেশাই ব্যবহার করি। কিন্তু এই ন্যায়বিচার জিনিসটা আসলে কী? একে কি ছুঁয়ে দেখা যায়? এর কি কোনো নির্দিষ্ট আকার আছে? যদি থাকে, তবে তা কোথায় থাকে?

এইসব আপাতদৃষ্টিতে সহজ, কিন্তু ভয়ংকর জটিল প্রশ্ন নিয়ে যিনি প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভেবেছিলেন, তোলপাড় করেছিলেন তৎকালীন গ্রিক সভ্যতায়, তাঁর নাম প্লেটো। প্লেটো কেবল একজন দার্শনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন গল্পকার, একজন কবি, একজন গণিতবিদ এবং এক স্বপ্নদর্শী জাদুকর। তাঁর দর্শনের জগৎটা এতটাই অদ্ভুত আর মায়াবী যে সেখানে একবার ঢুকলে বের হওয়া মুশকিল। তিনি আপনাকে এমন এক জগতে নিয়ে যাবেন, যেখানে আমাদের এই পরিচিত পৃথিবীটা হয়ে যাবে একটা ছায়া, একটা অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব, একটা মায়া। আর আসল জগৎটা থাকবে আমাদের চোখের আড়ালে, কেবল মন আর বুদ্ধি দিয়ে যাকে ছোঁয়া যায়।

চলুন, আজ আমরা সেই জাদুকরী জগতে একটু ঢুঁ মেরে আসি। খুব সহজ করে, গল্পের মতো করে প্লেটোর জগৎটাকে বোঝার চেষ্টা করব। 

শুরুর গল্প: সক্রেটিসের মৃত্যু এবং এক নতুন দার্শনিকের জন্ম

প্লেটোকে বুঝতে হলে তাঁর গুরু সক্রেটিসকে ছাড়া এক পা-ও এগোনো যাবে না। সক্রেটিস ছিলেন এথেন্সের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এক অদ্ভুত মানুষ। খালি পা, ময়লা পোশাক, কিন্তু চোখে ছিল জ্ঞানের দ্যুতি। তাঁর কোনো স্কুল ছিল না, তিনি মোটা মোটা বই লিখতেন না। তাঁর কাজই ছিল লোকজনকে প্রশ্ন করা। আপনি জ্ঞানী? আচ্ছা, বলুন তো জ্ঞান (Knowledge) কী? আপনি সাহসী? বাহ্, সাহস (Courage) কাকে বলে বুঝিয়ে বলুন তো! আপনি কি ধার্মিক? চমৎকার! ধর্মভীরুতা (Piety) জিনিসটা আসলে কী?

তিনি এমন সব মৌলিক প্রশ্ন এমনভাবে করতেন যে এথেন্সের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ, কবি আর জ্ঞানীগুণীরাও তাঁর সামনে বোকা বনে যেতেন। তিনি দেখাতেন যে, তারা যা জানে বলে দাবি করে, আসলে সে সম্পর্কে তাদের কোনো স্পষ্ট ধারণাই নেই। এই পদ্ধতির নাম ছিল ‘সক্রেটীয় পদ্ধতি’ (Socratic Method) বা ‘এলেনখাস’ (Elenchus)। এর উদ্দেশ্য কাউকে অপমান করা ছিল না, বরং তাদের নিজেদের অজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা ছিল মূল লক্ষ্য। কারণ সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, জ্ঞানের প্রথম ধাপ হলো এটা স্বীকার করা যে, “আমি কিছুই জানি না” (I know that I know nothing)।

কিন্তু সব সময় সত্য কথা বলা বিপদ ডেকে আনে। তৎকালীন এথেন্স ছিল এক টালমাটাল সময় পার করছিল। পেলোপনেসীয় যুদ্ধে স্পার্টার কাছে শোচনীয় পরাজয়, প্লেগের মহামারী এবং কুখ্যাত ‘ত্রিশ স্বৈরাচারীর’ (Thirty Tyrants) শাসনের পর গণতন্ত্র ফিরে এলেও তা ছিল ভঙ্গুর ও সন্দিহান। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এথেন্সের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা সক্রেটিসের এই প্রশ্নবাণে অতিষ্ঠ হয়ে গেল। তাদের মনে হলো, এই লোকটা তরুণদের মাথা বিগড়ে দিচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত দেবতাদের অস্বীকার করছে আর নতুন দেবতা আমদানি করছে। এই প্রশ্ন করার ‘অপরাধে’ এথেন্সের গণতান্ত্রিক সরকার তাঁকে তরুণদের পথভ্রষ্ট করার দায়ে অভিযুক্ত করল এবং হেমলক বিষ পানে মৃত্যুদণ্ড দিল (Plato, Apology)।

প্লেটো তখন তরুণ, বয়স ত্রিশের নিচে। নিজের চোখের সামনে তাঁর গুরুকে, এথেন্সের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী মানুষটিকে, তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে হত্যা হতে দেখলেন। এই ঘটনা প্লেটোর মনে এক গভীর দাগ কেটেছিল। তিনি বুঝেছিলেন, সাধারণ মানুষের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার দেওয়াটা কত বড় ভুল হতে পারে। অজ্ঞতা যে কত ভয়ংকর, তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর মনে এক গভীর বিতৃষ্ণার জন্ম হলো। গুরুর এই মৃত্যু প্লেটোর দর্শনকে অনেকটাই গড়ে দিয়েছিল। তিনি এমন এক আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, যেখানে জ্ঞানীরাই দেশ চালাবেন, অজ্ঞ জনতা নয়। আর তাই, নিজের সব দর্শন, সব ভাবনা তিনি নিজের মুখে না বলে তাঁর প্রিয় গুরু সক্রেটিসের মুখ দিয়ে বলানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। প্লেটোর প্রায় সব লেখাই সংলাপ বা নাটকীয় ভঙ্গিতে লেখা, যার মূল চরিত্র সক্রেটিস। এভাবেই গুরুর প্রতি তিনি তাঁর আজীবনের ঋণ শোধ করেছিলেন।

প্লেটোর জন্ম: যে ঝড়ের রাতে তারার জন্ম হয়েছিল

কোনো মানুষই শূন্য থেকে জন্মায় না। ঠিক যেন একটা বিশাল বৃক্ষ, যার শিকড় থাকে মাটির অনেক গভীরে। সেই মাটি হলো তার সময়, তার ইতিহাস, তার চারপাশের মানুষ আর তাদের ভাবনাগুলো। প্লেটোর মতো বিশাল এক মহীরুহের শিকড়ও লুকিয়ে ছিল তাঁর সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর পূর্ববর্তী দার্শনিকদের চিন্তার উর্বর মাটিতে। প্লেটোকে বুঝতে হলে শুধু তাঁর দর্শন পড়লেই চলবে না, আমাদের একটু গোয়েন্দার মতো করে সেই সময়ের এথেন্সে ঢুঁ মারতে হবে। দেখতে হবে, কী এমন ঘটেছিল যে একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের তরুণ কবি হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে দর্শনের মতো এক জটিল পথে পা বাড়ালেন?

অংশ এক: রাজনৈতিক দাবানল ও এক শহরের মৃত্যু

প্লেটো জন্মেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন এথেন্স তার সোনালি দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছে আর বর্তমানের আগুনে পুড়ছে। পেরিক্লিসের (Pericles) নেতৃত্বে এথেন্স একসময় ছিল গ্রিক বিশ্বের জ্ঞান, শিল্প আর গণতন্ত্রের কেন্দ্র। পার্থেননের মতো স্থাপত্য, সফোক্লিসের মতো নাট্যকার—সব মিলিয়ে এক স্বর্ণযুগ। কিন্তু প্লেটোর যৌবনের এথেন্স ছিল সেই স্বর্ণযুগের এক করুণ ছায়া মাত্র।

পেলোপনেসীয় যুদ্ধ (Peloponnesian War, 431-404 BCE): এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন

প্লেটোর জন্মের কয়েক বছর আগেই এথেন্স জড়িয়ে পড়েছিল তার সবচেয়ে বড় শত্রু স্পার্টার সাথে এক দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। এই যুদ্ধ প্রায় তিন দশক ধরে চলেছিল। যুদ্ধ মানে শুধু হার-জিত নয়; যুদ্ধ মানে হলো সমাজের নৈতিকতার শেকড় ধরে টান দেওয়া। এই যুদ্ধে এথেন্স কেবল স্পার্টার কাছে হারেনি, সে নিজের কাছেও হেরে গিয়েছিল। যুদ্ধের ভয়াবহতা, প্লেগের মহামারী আর লাগাতার পরাজয় এথেন্সের নাগরিকদের আত্মবিশ্বাসকে চুরমার করে দিয়েছিল। যে গণতন্ত্র নিয়ে এথেন্সের এত গর্ব ছিল, সেই গণতন্ত্রের নেতারা প্রায়ই হঠকারী, আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত নিয়ে শহরকে আরও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন (Thucydides, History of the Peloponnesian War)।

প্লেটো এই ভাঙনের সাক্ষী ছিলেন। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে যুক্তি আর বিচার-বিবেচনার বদলে গণ-হিস্টিরিয়া (mass hysteria) আর স্বার্থপরতা বড় হয়ে ওঠে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর মনে গণতন্ত্র সম্পর্কে এক গভীর সংশয়ের জন্ম দেয়। তিনি ভাবতে শুরু করেন, সাধারণ মানুষের হাতে কি রাষ্ট্র পরিচালনার মতো এত বড় দায়িত্ব দেওয়া ঠিক?

ত্রিশ স্বৈরাচারীর শাসন (The Rule of the Thirty Tyrants, 404-403 BCE)

যুদ্ধের শেষে স্পার্টার মদতে এথেন্সে গণতন্ত্রকে হটিয়ে এক স্বৈরাচারী গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসানো হয়। ইতিহাসে এরা ‘ত্রিশ স্বৈরাচারী’ নামে পরিচিত। এই শাসনের সময়টা ছিল এথেন্সের জন্য এক বিভীষিকা। নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করা হতো, সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হতো। ভয়ের এক শীতল স্রোত বইছিল পুরো শহরজুড়ে।

মজার এবং দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই স্বৈরাচারী গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা ছিলেন ক্রিটিয়াস (Critias), যিনি ছিলেন প্লেটোর নিজের মায়ের আত্মীয়। আরেকজন সদস্য, কারমিডেস (Charmides), ছিলেন তাঁর মামা। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে হিসেবে প্লেটোর সামনেও সুযোগ ছিল এই নতুন সরকারে যোগ দেওয়ার। কিন্তু তিনি তাদের নৃশংসতা দেখে এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন যে রাজনীতির প্রতি তাঁর সব আগ্রহ হারিয়ে যায়। তিনি বুঝেছিলেন, শুধু গণতন্ত্রই খারাপ নয়, অভিজাতদের স্বৈরাচার (oligarchy) আরও ভয়ংকর হতে পারে। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছিল যে রাষ্ট্রক্ষমতা, তা সে জনতার হাতেই থাকুক বা অভিজাতদের হাতে, যদি জ্ঞান ও নৈতিকতা ছাড়া পরিচালিত হয়, তবে তা কেবলই ধ্বংস ডেকে আনে।

গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন এবং সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড (The Execution of Socrates, 399 BCE)

ত্রিশ স্বৈরাচারীর পতন ঘটিয়ে এথেন্সে আবার গণতন্ত্র ফিরে আসে। প্লেটো হয়তো একটু আশার আলো দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই আশাও নিভে গেল এক ভয়ংকর ঘটনায়। এই নতুন গণতান্ত্রিক সরকারই তাঁর গুরু, তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা, সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিল। অভিযোগ ছিল, সক্রেটিস তরুণদের বিপথে চালিত করছেন এবং রাষ্ট্রের দেবতাদের অস্বীকার করছেন।

প্লেটোর কাছে এটা ছিল এক বিশাল ধাক্কা। যে মানুষটা সারা জীবন শুধু সত্য আর জ্ঞানের সন্ধান করে গেলেন, যিনি এথেন্সের সেরা মস্তিষ্ক, তাঁকে কি না হত্যা করল অজ্ঞ জনতার ভোটে চালিত এক সরকার! এই ঘটনা প্লেটোর দর্শনকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। তিনি নিশ্চিত হন যে, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনীতি দিয়ে হবে না। এর সমাধান লুকিয়ে আছে দর্শনের গভীরে। রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে শাসনভার তুলে দিতে হবে সেইসব মানুষের হাতে, যারা জ্ঞানী, নির্মোহ এবং যারা ‘পরম কল্যাণ’ (The Form of the Good) সম্পর্কে জানেন। অজ্ঞতার শাসন নয়, জ্ঞানের শাসন—এটাই হয়ে উঠল তাঁর দর্শনের মূলমন্ত্র। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য রিপাবলিক’ (The Republic) হলো এই রাজনৈতিক ক্ষতেরই একটি দার্শনিক প্রতিষেধক (Popper, 1945)।

দার্শনিকদের ভাবনার উত্তরাধিকার

প্লেটো কেবল তাঁর রাজনৈতিক পরিবেশ দ্বারাই প্রভাবিত হননি, তিনি তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক দার্শনিকদের ভাবনার এক বিশাল ভাণ্ডারের উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি কারও দর্শনকে হুবহু গ্রহণ করেননি, আবার পুরোপুরি বাতিলও করেননি। বরং তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ সমন্বয়ক। তিনি বিভিন্ন দার্শনিকের আপাত-বিরোধী ভাবনাগুলোকে একসাথে মিলিয়ে এক নতুন, সুবিশাল দর্শন তৈরি করেছিলেন।

সক্রেটিস (Socrates): দর্শনের কেন্দ্রে যে মানুষটি

সক্রেটিস ছিলেন প্লেটোর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রভাব। প্লেটোর দর্শনের প্রায় পুরোটাই সক্রেটিসের তোলা প্রশ্নগুলোর একটি বিস্তৃত উত্তর।

  • সংজ্ঞার সন্ধান (Search for Definitions): সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, কোনো কিছু সম্পর্কে জানতে হলে আগে তার সংজ্ঞা জানতে হবে। ‘ন্যায়বিচার’ কী, তা না জেনে কি ন্যায়পরায়ণ হওয়া যায়? প্লেটোর আকারের তত্ত্ব (Theory of Forms) হলো এই সংজ্ঞার সন্ধানেরই একটি চূড়ান্ত রূপ। প্লেটো বললেন, এই সংজ্ঞাগুলো কোনো মানুষের মনে থাকে না, এরা থাকে এক শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় জগতে—আকারের জগৎ।

  • সদ্গুণই জ্ঞান (Virtue is Knowledge): সক্রেটিস বলতেন, কেউ জেনেবুঝে খারাপ কাজ করে না। মানুষ অন্যায় করে কারণ সে জানে না কোনটা আসল ভালো। এই ধারণাটি প্লেটো পুরোপুরি গ্রহণ করেন। তাঁর মতে, একজন মানুষ তখনই অন্যায় করে যখন তার আত্মার ‘যুক্তি’ (Reason) অংশটি ‘কামনা’ (Appetite) দ্বারা পরাজিত হয়। আর দার্শনিক-রাজার শাসনের ভিত্তিও এখানেই – যেহেতু তাঁরাই ‘কল্যাণ’ কী তা জানেন, তাই তাঁরাই সবচেয়ে ভালোভাবে দেশ শাসন করতে পারবেন।

হেরাক্লিটাস (Heraclitus): পরিবর্তনের স্রোত

হেরাক্লিটাস ছিলেন এক রহস্যময় দার্শনিক। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল, “সবকিছুই প্রবহমান” (Panta rhei)। তিনি বলতেন, “একই নদীতে দুবার পা রাখা যায় না,” কারণ দ্বিতীয়বার নামার আগেই নদী এবং আপনি উভয়ই বদলে গেছেন। তাঁর মতে, এই জগৎ হলো এক চিরন্তন পরিবর্তনের স্রোত।

প্লেটো এই ধারণাটির সাথে আংশিকভাবে একমত ছিলেন। তিনি আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ (Sensible World)—এই যে আমাদের চেনা পৃথিবী—তাকে ঠিক হেরাক্লিটাসের মতোই পরিবর্তনশীল ও অস্থায়ী বলে মনে করতেন। এই জগতে কোনো কিছুই স্থির নয়, তাই এ জগৎ থেকে কোনো সত্যিকারের জ্ঞান (Knowledge) পাওয়া সম্ভব নয়, কেবল মতামত (Opinion) পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্লেটো এটা মানতে রাজি ছিলেন না যে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। যদি তাই হয়, তাহলে তো কোনো কিছুই নিশ্চিতভাবে জানা যাবে না।

পারমেনাইডিস (Parmenides): স্থিরতার পূজারী

হেরাক্লিটাসের ঠিক উল্টো কথা বলতেন পারমেনাইডিস। তিনি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, পরিবর্তন বা গতি বলে আসলে কিছু নেই, সবই আমাদের ইন্দ্রিয়ের ভ্রম। আসল সত্তা (Being) হলো এক, শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় এবং পূর্ণ। যা আছে, তা আছেই। যা নেই, তা নিয়ে ভাবাও যায় না।

প্লেটোর সামনে এখন দুটি চরম বিপরীতধর্মী চিন্তা: সবকিছুই পরিবর্তনশীল (হেরাক্লিটাস) বনাম কিছুই পরিবর্তন হয় না (পারমেনাইডিস)। প্লেটো এক অসাধারণ কৌশলে এই দুই চিন্তার মধ্যে একটি সমন্বয় ঘটালেন। তিনি বললেন, দুজনই আংশিকভাবে সঠিক।

  • হেরাক্লিটাসের জগৎ: আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎটি হেরাক্লিটাসের জগতের মতোই পরিবর্তনশীল।

  • পারমেনাইডিসের জগৎ: কিন্তু এর বাইরে আরেকটি জগৎ আছে, যা হলো আকারের জগৎ (World of Forms)। এই জগৎটি পারমেনাইডিসের সত্তার মতোই শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় ও নিখুঁত।

এভাবেই প্লেটো দুটি ভিন্ন জগৎ তৈরি করে পশ্চিমা দর্শনের অন্যতম বড় একটি দ্বন্দ্বের সমাধান করলেন (Russell, 1945)।

পিথাগোরীয় সম্প্রদায় (The Pythagoreans): গণিত ও আত্মার রহস্য

প্লেটো দক্ষিণ ইতালিতে ভ্রমণের সময় পিথাগোরাসের অনুসারীদের সংস্পর্শে আসেন। এই সম্প্রদায়ের ভাবনা প্লেটোর দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

  • গণিতই জগতের ভিত্তি: পিথাগোরীয়রা বিশ্বাস করতেন, এই মহাবিশ্বের মূল ভিত্তি হলো সংখ্যা এবং গাণিতিক সম্পর্ক। প্লেটো এই ধারণাটি গ্রহণ করেন। তাঁর কাছে জ্যামিতি ছিল বিশুদ্ধ, বিমূর্ত চিন্তার সেরা উদাহরণ, যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের জগৎ থেকে আকারের জগতের দিকে নিয়ে যায়। তাঁর একাডেমির প্রবেশদ্বারে লেখা “জ্যামিতি না জেনে কেউ এখানে প্রবেশ করবে না” এই প্রভাবেরই সাক্ষ্য বহন করে।

  • আত্মার অমরত্ব ও জন্মান্তরবাদ (Immortality and Transmigration of the Soul): পিথাগোরীয়রা বিশ্বাস করতেন, আত্মা অমর এবং মৃত্যুর পর তা নতুন দেহে জন্ম নেয়। প্লেটো এই ধারণাটি গ্রহণ করে একে আরও উন্নত রূপ দেন। তাঁর স্মৃতির তত্ত্ব (Theory of Recollection) অনুযায়ী, আত্মা জন্ম নেওয়ার আগে আকারের জগতে ছিল এবং জ্ঞানার্জন মানে হলো সেই ভুলে যাওয়া স্মৃতিকে মনে করা।

এক নতুন দর্শনের জন্ম

তাহলে কী দাঁড়ালো? প্লেটোর দর্শন কোনো আকস্মিক বিস্ফোরণ ছিল না। এটি ছিল তাঁর সময়ের রাজনৈতিক সংকট এবং পূর্ববর্তী দার্শনিকদের চিন্তার এক অসাধারণ সংশ্লেষণ (synthesis)।

এথেন্সের রাজনৈতিক বিপর্যয় তাঁকে শিখিয়েছিল একটি আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে, যেখানে জ্ঞানের শাসন চলবে। সক্রেটিস তাঁকে শিখিয়েছিলেন প্রশ্ন করতে এবং সংজ্ঞার পেছনে ছুটতে। হেরাক্লিটাস তাঁকে দেখিয়েছিলেন এই পরিবর্তনশীল জগতের স্বরূপ, আর পারমেনাইডিস তাঁকে দিয়েছিলেন এক অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত জগতের ধারণা। পিথাগোরীয়রা তাঁকে দিয়েছিলেন গণিতের ভাষা আর আত্মার অমরত্বের বিশ্বাস।

প্লেটো এই সবগুলোকে একসাথে মিলিয়ে তৈরি করলেন তাঁর জাদুকরী দর্শন—একদিকে ছায়ার জগৎ, আরেকদিকে আসল জগৎ; একদিকে নশ্বর দেহ, আরেকদিকে অমর আত্মা; একদিকে অজ্ঞতার অন্ধকার, আরেকদিকে জ্ঞানের সূর্য। যে ঝোড়ো সময়ে প্লেটোর জন্ম হয়েছিল, সেই ঝড়ই যেন তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল এক নতুন, স্থির ধ্রুবতারার সন্ধানে। আর সেই সন্ধান থেকেই জন্ম নিয়েছিল পশ্চিমা দর্শনের সবচেয়ে প্রভাবশালী এক অধ্যায়।

একাডেমি প্রতিষ্ঠা এবং প্লেটোর সংলাপ

সক্রেটিসের মৃত্যুর পর প্লেটো বেশ কয়েক বছর এথেন্সের বাইরে, মিশর ও ইতালির সিসিলিতে ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণ তাঁর জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করে। প্রায় ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, চল্লিশ বছর বয়সে, তিনি এথেন্সে ফিরে আসেন এবং শহরের বাইরে বীর একাডেমাসের নামে উৎসর্গীকৃত একটি বাগানে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর বিখ্যাত স্কুল—একাডেমি (The Academy)। এটিকে পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বলা যেতে পারে। একাডেমির প্রবেশদ্বারে লেখা ছিল, “জ্যামিতি না জেনে কেউ এখানে প্রবেশ করবে না” (Let no one ignorant of geometry enter here)। এর কারণ প্লেটো বিশ্বাস করতেন, গণিত এবং জ্যামিতি হলো বিমূর্ত চিন্তার প্রথম পাঠ, যা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ থেকে বুদ্ধিগ্রাহ্য জগতের দিকে নিয়ে যায়।

প্লেটো তাঁর দর্শন লিপিবদ্ধ করেছেন প্রায় ৩৬টি সংলাপ (Dialogues) এবং কিছু চিঠির মাধ্যমে। এই সংলাপগুলোকে সাধারণত তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়:

  • প্রাথমিক পর্ব (Early Dialogues): এই লেখাগুলোতে সক্রেটিসের ঐতিহাসিক চরিত্র এবং তাঁর দর্শনকে বিশ্বস্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন—Apology, Crito, Euthyphro। এখানে সক্রেটিস মূলত প্রশ্ন করেন কিন্তু কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান না।

  • মধ্যম পর্ব (Middle Dialogues): এই পর্বে প্লেটো সক্রেটিসের চরিত্রকে ব্যবহার করে তাঁর নিজের বিখ্যাত তত্ত্বগুলো, যেমন—আকারের তত্ত্ব, আত্মার অমরত্ব, আদর্শ রাষ্ট্র—উপস্থাপন করেন। The Republic, Phaedo, Symposium এই পর্বের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

  • শেষ পর্ব (Late Dialogues): জীবনের শেষ দিকে এসে প্লেটো তাঁর নিজের তত্ত্বগুলোকেই আবার প্রশ্নবিদ্ধ ও পরিমার্জন করেন। এই সংলাপগুলো বেশ জটিল ও বিমূর্ত। যেমন—The Laws, Timaeus, Parmenides

অধিবিদ্যা (Metaphysics): দুই জগৎ এবং আকারের তত্ত্ব

প্লেটোর দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে আছে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত, সবচেয়ে বিপ্লবী এবং সবচেয়ে অদ্ভুত তত্ত্বটি—তত্ত্বের জগৎ বা আকারের তত্ত্ব (Theory of Forms বা Theory of Ideas)। এটিই তাঁর অধিবিদ্যার মূল ভিত্তি। অধিবিদ্যা মানে হলো বাস্তবতার স্বরূপ নিয়ে আলোচনা। কী আসল, কী নকল, জগতের চূড়ান্ত সত্তা কী—এইসব প্রশ্ন। প্লেটো এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এক অসাধারণ গল্পের মাধ্যমে।

গুহার রূপক (The Allegory of the Cave): মায়া এবং বাস্তবতার গল্প

প্লেটোর এই তত্ত্ব বুঝতে হলে আমাদের তাঁর সাথে একটি অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করতে হবে। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য রিপাবলিক’-এর সপ্তম খণ্ডে তিনি এই রূপকটির বর্ণনা দেন।

কল্পনা করুন, কিছু মানুষ জন্ম থেকে একটা অন্ধকার গুহার ভেতর শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় আছে। তাদের হাত, পা, গলা এমনভাবে বাঁধা যে তারা শুধু সামনের দেয়ালের দিকেই তাকাতে পারে, পেছনে বা আশেপাশে তাকানোর কোনো উপায় নেই। তাদের পেছনে, বেশ কিছুটা দূরে, একটা আগুন জ্বলছে। সেই আগুন আর বন্দিদের মাঝখান দিয়ে একটা নিচু দেয়ালের ওপর দিয়ে কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে। তাদের হাতে নানা রকম জিনিস—পুতুল, জীবজন্তুর মূর্তি, গাছের মডেল ইত্যাদি। গুহার দেয়ালে ওই জিনিসগুলোর ছায়া পড়ছে, আর আগুনের কাঁপা কাঁপা আলোয় সেই ছায়াগুলো নড়াচড়া করছে। মাঝে মাঝে ওই লোকেরা কথাও বলছে, আর গুহার প্রতিধ্বনির কারণে বন্দিদের মনে হচ্ছে যেন ছায়াগুলোই কথা বলছে।

এখন ভাবুন তো, ওই যে বন্দি মানুষগুলো, তারা তো জন্ম থেকে কেবল ওই ছায়াগুলোই দেখে আসছে। তাদের কাছে ওই ছায়াগুলোই হলো আসল জগৎ, ওটাই বাস্তবতা (Reality)। তারা ছায়াগুলোকে নাম দেবে, ওগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। তাদের কাছে ‘গাছ’ মানে হলো দেয়ালে পড়া গাছের ছায়াটা, ‘মানুষ’ মানে মানুষের ছায়াটা। এর বাইরে যে সত্যিকারের গাছ বা মানুষ থাকতে পারে, এটা তাদের কল্পনারও অতীত (Plato, Republic, Book VII)।

এবার ধরুন, কোনোভাবে একজন বন্দি ছাড়া পেয়ে গেল। তাকে জোর করে ঘুরিয়ে, আগুনের দিকে তাকাতে বাধ্য করা হলো। আগুনের তীব্র আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে যাবে, সে কিছুই দেখতে পাবে না। তারপর তাকে যদি আরও কষ্ট দিয়ে, গুহার খাড়া পথ বেয়ে বাইরে, দিনের আলোয় নিয়ে আসা হয়? সূর্যের প্রখর আলোয় তার চোখ ঝলসে যাবে। সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করবে। কিন্তু ধীরে ধীরে, যখন তার চোখ সয়ে আসবে, সে প্রথমে বস্তুগুলোর ছায়া দেখবে, তারপর পানিতে তাদের প্রতিবিম্ব দেখবে, এবং অবশেষে সে সত্যিকারের গাছ, পাখি, নদী, আকাশ এবং সবশেষে সূর্যকে দেখবে।

তখন সে কী বুঝবে? সে বুঝবে, গুহার ভেতরে সে যা দেখে এসেছে, তা ছিল আসল জিনিসের একটা দুর্বল, অস্পষ্ট ছায়া মাত্র! আসল জগৎ তো এটা! এই সূর্যের আলোয় ঝলমল করা জগৎ! তখন তার কাছে গুহার ওই ছায়া জগৎটা তুচ্ছ আর হাস্যকর মনে হবে। সে তার পুরনো সঙ্গীদের জন্য দুঃখ বোধ করবে, যারা এখনো সেই ছায়ার জগতেই বন্দি হয়ে আছে।

দুইটি জগৎ: ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক

এই গল্পটা হলো প্লেটোর দর্শনের চাবিকাঠি। প্লেটো বলছেন, আমরা সবাই ওই গুহার বন্দিদের মতো। এই যে জগৎ আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়—চোখ, কান, নাক, ত্বক—দিয়ে অনুভব করছি, এটা আসলে আসল জগৎ নয়। এটা হলো আসল জগতের একটা ছায়া বা অনুলিপি (copy) মাত্র। এই জগৎ পরিবর্তনশীল, অস্থায়ী। এখানে সবকিছু ভাঙে, গড়ে, জন্মায়, মরে। আজ যে ফুলটা সুন্দর, কাল তা শুকিয়ে যায়। আজ যে মানুষটা তরুণ, কাল সে বৃদ্ধ হয়। প্লেটো এই জগতের নাম দিয়েছেন ‘ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ’ (Sensible World) বা ‘বদলে যাওয়ার জগৎ’ (World of Becoming)। এটা হলো মায়ার জগৎ, ছায়ার জগৎ।

তাহলে আসল জগৎ কোনটা? প্লেটোর মতে, আসল জগৎ হলো ওই গুহার বাইরের জগৎ, যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের অতীত, কিন্তু মন বা বুদ্ধি (Intellect) দিয়ে বোঝা যায়। এই জগতের নাম তিনি দিয়েছেন ‘আকারের জগৎ’ (World of Forms) বা ‘বুদ্ধিগ্রাহ্য জগৎ’ (Intelligible World)। এই জগৎ হলো শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় এবং নিখুঁত।

বিষয়টা আরেকটু সহজ করা যাক। ধরুন ‘চেয়ার’ এর কথা। পৃথিবীতে নানা রকম চেয়ার আছে—কাঠের চেয়ার, প্লাস্টিকের চেয়ার, রকিং চেয়ার, ভাঙা চেয়ার, নতুন চেয়ার। এদের কোনোটারই সাথে কোনোটার হুবহু মিল নেই। কিন্তু আমরা সবগুলোকেই ‘চেয়ার’ বলে ঠিকই চিনে ফেলি। কীভাবে? প্লেটো বলবেন, কারণ আমাদের মনের গভীরে ‘চেয়ার’ এর একটা নিখুঁত, চিরন্তন ধারণা বা ‘আকার’ (Form) আছে। ওই ‘আকার’ হলো আসল চেয়ার (The Form of Chairness), যা কখনো ভাঙে না, পুরোনো হয় না। ওটা একটা আইডিয়া, একটা পারফেক্ট ব্লুপ্রিন্ট। পৃথিবীর সমস্ত ভৌত চেয়ার হলো ওই আসল চেয়ারের এক-একটা অসম্পূর্ণ নকল বা ছায়া।

একইভাবে ‘সৌন্দর্য’ (Beauty), ‘ন্যায়বিচার’ (Justice), ‘সাহস’ (Courage), ‘সমতা’ (Equality)—এই সবকিছুরই একটা করে নিখুঁত, শাশ্বত ‘আকার’ বা ফর্ম আছে আসল জগতে। আমরা পৃথিবীতে যে সুন্দর ফুল বা সুন্দর মুখ দেখি, সেগুলো ওই আসল সৌন্দর্যের (The Form of Beauty) এক-একটা অসম্পূর্ণ প্রকাশ মাত্র। সেগুলো সুন্দর কারণ তারা ওই আসল সৌন্দর্যে ‘অংশগ্রহণ’ (participate) করে।

আকারগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং তাদের জগৎ

প্লেটোর এই আকারগুলো কেমন?

  1. শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় (Eternal and Unchanging): এদের কোনো শুরু বা শেষ নেই। এরা কখনো বদলায় না। জ্যামিতির ত্রিভুজের ধারণা যেমন বদলায় না।

  2. অ-ভৌত (Non-physical): এরা কোনো স্থান বা কালে অবস্থান করে না। এরা হলো বিশুদ্ধ ধারণা বা আইডিয়া।

  3. নিখুঁত (Perfect): প্রতিটি আকার তার নিজের একটি নিখুঁত উদাহরণ। যেমন, সৌন্দর্যের আকার হলো নিখুঁত সৌন্দর্য।

  4. বাস্তবতার উৎস (Source of Reality): ভৌত জগতের সবকিছু এদের অনুকরণের মাধ্যমেই নিজেদের অস্তিত্ব ও পরিচয় লাভ করে। একটি বৃত্তাকার প্লেট বাস্তব, কারণ এটি ‘বৃত্তের আকার’-কে অনুকরণ করে।

  5. একক (One): প্রতিটি ধারণার জন্য কেবল একটিই আকার আছে। যেমন, পৃথিবীতে কোটি কোটি সুন্দর জিনিস থাকলেও, ‘সৌন্দর্যের আকার’ মাত্র একটিই।

এই আকারগুলোরও একটি ক্রমবিন্যাস (hierarchy) আছে। একেবারে শীর্ষে, অর্থাৎ সমস্ত আকারের ঊর্ধ্বে যিনি আছেন, তিনি হলেন ‘পরম কল্যাণের আকার’ (The Form of the Good)। গুহার রূপকে এটা হলো সূর্য। সূর্য যেমন সবকিছুকে দেখার শক্তি দেয় এবং প্রাণ দেয়, তেমনি এই ‘পরম কল্যাণ’ বাকি সব আকারকে (যেমন—ন্যায়বিচার, সৌন্দর্য) অস্তিত্ব ও অর্থ দেয় এবং আমাদের মনকে সেগুলো জানার শক্তি দেয়। একজন দার্শনিকের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এই পরম কল্যাণকে জানা (Plato, Republic, Book VI)। এটিই চূড়ান্ত বাস্তবতা এবং জ্ঞানের উৎস।

অংশগ্রহণের সমস্যা এবং তৃতীয় মানব যুক্তি (The Problem of Participation and The Third Man Argument)

প্লেটোর এই তত্ত্বে কিছু গভীর দার্শনিক সমস্যাও ছিল, যা নিয়ে প্লেটো নিজেও সচেতন ছিলেন। একটি বড় প্রশ্ন হলো, একটি ভৌত বস্তু কীভাবে একটি অ-ভৌত আকারে ‘অংশগ্রহণ’ (Participation বা Methexis) করে? একটি চেয়ার কি ‘চেয়ারত্বের আকার’-এর একটি অংশ ধারণ করে? তাহলে তো আকারটি বিভাজিত হয়ে যায়, যা তার একত্বের ধারণার পরিপন্থী।

এর থেকেও বড় সমালোচনা হলো ‘তৃতীয় মানব যুক্তি’ (Third Man Argument), যা প্লেটো নিজেই তাঁর ‘পারমেনাইডিস’ (Parmenides) নামক সংলাপে তুলে ধরেছেন। যুক্তিটি অনেকটা এরকম:

  • ১. ধরা যাক, আমাদের কাছে কিছু নির্দিষ্ট মানুষ আছে (সক্রেটিস, প্লেটো, ইত্যাদি)।
  • ২. এদের সবার মধ্যে মিল হলো যে এরা সবাই ‘মানুষ’। এই মিলকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্লেটো ‘মানবতার আকার’ (Form of Man) এর ধারণা আনলেন।
  • ৩. এখন, নির্দিষ্ট মানুষগুলো এবং ‘মানবতার আকার’—এই দুইয়ের মধ্যেই তো একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, তা হলো এরা উভয়ই ‘মানুষ’ এর মতো।
  • ৪. তাহলে এই নতুন মিলটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য আরেকটি নতুন, উচ্চতর আকার দরকার, একটি ‘তৃতীয় মানব’ (Third Man) আকার, যেখানে সক্রেটিস এবং মূল ‘মানবতার আকার’ উভয়ই অংশগ্রহণ করে।
  • ৫. এরপর এই তৃতীয় মানব আকার এবং আগের দুটিকে ব্যাখ্যা করতে চতুর্থ আরেকটি আকারের প্রয়োজন হবে। এভাবে অসীম পর্যন্ত চলতেই থাকবে (Infinite Regress)। এটি প্লেটোর আকারের তত্ত্বের একটি বড় দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হয়।

জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology): জ্ঞান মানে মনে করা

এখন একটা বড় প্রশ্ন আসতেই পারে। আসল জগৎ (World of Forms) যদি আমাদের ইন্দ্রিয়ের বাইরেই থাকবে, তাহলে আমরা সেটা সম্পর্কে জানব কীভাবে? চেয়ারের নিখুঁত আকারটা আমার মাথায় এলো কোত্থেকে?

স্মৃতির তত্ত্ব (Theory of Recollection / Anamnesis)

এখানে প্লেটো আরও একটি চমকপ্রদ তত্ত্ব হাজির করলেন। তিনি বললেন, আমাদের আত্মা (Soul) অমর। আমাদের এই ভৌত শরীরে জন্ম নেওয়ার আগে আমাদের আত্মা ওই আকারের জগতে ছিল। সেখানে সে সব নিখুঁত আকারগুলোকে (Forms) সরাসরি দেখেছে—আসল চেয়ার, আসল সৌন্দর্য, আসল ন্যায়বিচার। কিন্তু পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার সময়, এই ভৌত শরীরের কারাগারে বন্দি হওয়ার যন্ত্রণায় এবং ইন্দ্রিয়ের জগতের গোলকধাঁধায় পড়ে সেই স্মৃতি আমরা ভুলে যাই।

তাহলে ‘শেখা’ বা ‘জ্ঞানার্জন’ মানে কী? প্লেটোর মতে, শেখা মানে নতুন কিছু জানা নয়, বরং ভুলে যাওয়া জ্ঞানকে মনে করা। এই তত্ত্বের নাম হলো ‘স্মৃতির তত্ত্ব’ (Theory of Recollection বা Anamnesis)। যখন আমরা পৃথিবীতে কোনো একটি অসম্পূর্ণ সুন্দর জিনিস দেখি, সেটা আমাদের আত্মার গভীরে ঘুমিয়ে থাকা আসল সৌন্দর্যের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে। শিক্ষক বা দর্শন হলো সেই মাধ্যম, যা আমাদের এই ভুলে যাওয়া জ্ঞানকে মনে করতে সাহায্য করে।

প্লেটো তাঁর ‘মেনো’ (Meno) সংলাপে এর একটি চমৎকার উদাহরণ দেন। সেখানে সক্রেটিস একজন অশিক্ষিত দাস বালককে জ্যামিতির কিছু জটিল প্রশ্ন করেন। কোনো কিছু না শিখিয়ে, শুধু প্রশ্ন করার মাধ্যমেই তিনি বালকটির ভেতর থেকে একটি জ্যামিতিক উপপাদ্যের সঠিক সমাধান বের করে আনেন। প্লেটোর মতে, এটা প্রমাণ করে যে জ্ঞান বালকটির আত্মার ভেতরে আগে থেকেই ছিল, সক্রেটিস শুধু সেটাকে জাগিয়ে তুলেছেন, ধাত্রীর মতো করে বের করে এনেছেন।

বিভক্ত রেখার রূপক (The Analogy of the Divided Line)

জ্ঞান এবং মতামতের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে প্লেটো ‘দ্য রিপাবলিক’-এ আরেকটি শক্তিশালী রূপক ব্যবহার করেন, যা ‘বিভক্ত রেখা’ (The Divided Line) নামে পরিচিত। তিনি একটি রেখাকে দুটি প্রধান অংশে ভাগ করতে বলেন: একটি অংশ হলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ (যা থেকে আমরা কেবল মতামত (Opinion / Doxa) পাই) এবং অন্য অংশটি হলো বুদ্ধিগ্রাহ্য জগৎ (যা থেকে আমরা আসল জ্ঞান (Knowledge / Episteme) পাই)।

এরপর তিনি এই দুটি অংশকে আবার দুটি করে মোট চারটি ভাগে ভাগ করেন:

  1. কল্পনা (Imagination / Eikasia): এটি জ্ঞানের সর্বনিম্ন স্তর। এখানে আমরা শুধু ছায়া, প্রতিবিম্ব বা শিল্পের অনুকরণ দেখি। গুহার বন্দিদের জগৎ এটাই।

  2. বিশ্বাস (Belief / Pistis): এটি হলো ভৌত বস্তু সম্পর্কে আমাদের ধারণা। আমরা চেয়ার, টেবিল, গাছপালা দেখি এবং বিশ্বাস করি যে এগুলোই বাস্তব। গুহার বন্দি যখন আসল বস্তুগুলো (যেমন পুতুল) দেখে, সে এই স্তরে পৌঁছায়।

  3. চিন্তা (Thought / Dianoia): এটি হলো প্রকৃত জ্ঞানের প্রথম ধাপ। গণিত ও জ্যামিতির জগৎ এটা। এখানে আমরা ভৌত বস্তুর সাহায্য নিই (যেমন, ত্রিভুজ আঁকি) কিন্তু চিন্তা করি বিমূর্ত ধারণা নিয়ে। তবে এখানে কিছু অনুমানের (hypotheses) ওপর নির্ভর করতে হয়।

  4. বুদ্ধি বা প্রজ্ঞা (Intelligence or Understanding / Noesis): এটি জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর। এখানে কোনো অনুমান বা ভৌত বস্তুর সাহায্য ছাড়াই, কেবল বিশুদ্ধ যুক্তি ও ডায়ালেকটিক (dialectic) ব্যবহার করে আকারগুলোকে এবং সবশেষে ‘পরম কল্যাণের আকার’কে সরাসরি উপলব্ধি করা যায়। এটিই হলো দার্শনিকের চূড়ান্ত গন্তব্য।

এই চারটি স্তর গুহার রূপকের সাথে হুবহু মিলে যায়। ছায়া দেখা (কল্পনা), পুতুল দেখা (বিশ্বাস), গুহার বাইরে এসে বস্তু দেখা (চিন্তা) এবং সবশেষে সূর্যকে দেখা (প্রজ্ঞা)।

পদার্থবিদ্যা ও বিশ্বতত্ত্ব (Physics and Cosmology): এক শিল্পীর হাতে গড়া জগৎ

প্লেটো কি শুধু বিমূর্ত জগৎ নিয়েই ভেবেছেন? আমাদের এই চেনা জগৎ, আকাশ, বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে তাঁর কি কিছুই বলার ছিল না? অবশ্যই ছিল। তাঁর শেষ দিকের সংলাপ ‘টিমিয়াস’ (Timaeus)-এ তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও গঠন নিয়ে এক কাব্যিক এবং গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি একে একটি ‘সম্ভাব্য গল্প’ (a likely story) বলেছেন, কারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ যেহেতু নিখুঁত নয়, তাই এ সম্পর্কে নিখুঁত জ্ঞানও সম্ভব নয়, কেবল সম্ভাব্য ব্যাখ্যাই দেওয়া যায়।

ডিমিআর্জ: ঐশ্বরিক কারিগর (The Demiurge)

প্লেটোর মতে, এই মহাবিশ্ব শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। এর শুরুতে ছিল দুটি জিনিস: (১) শাশ্বত, নিখুঁত আকারগুলো (The Forms), যা হলো ব্লুপ্রিন্ট; এবং (২) বিশৃঙ্খল, আকারহীন পদার্থ বা স্থান (Disordered matter/space), যাকে তিনি বলেছেন ‘গ্রাহক’ (The Receptacle / Chora)

এরপর এলেন একজন বুদ্ধিমান এবং কল্যাণকামী ঐশ্বরিক কারিগর, যার নাম ডিমিআর্জ (Demiurge)। তিনি ঈশ্বর নন, কারণ তিনি শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি করেন না। তিনি একজন শিল্পী বা স্থপতির মতো। তিনি ওই বিশৃঙ্খল পদার্থের ওপর আকারগুলোর নকশা আরোপ করে একটি সুশৃঙ্খল ও সুন্দর মহাবিশ্ব (Cosmos) তৈরি করলেন। যেহেতু তিনি কল্যাণকামী, তাই তিনি চাইলেন তাঁর সৃষ্টি যতটা সম্ভব নিখুঁত হোক। তাই তিনি আকারগুলোর আদলে এই জগৎকে নির্মাণ করেছেন।

বিশ্বাত্মা এবং পাঁচটি মৌল (The World Soul and the Five Elements)

ডিমিআর্জ প্রথমে একটি বিশ্বাত্মা (World Soul) তৈরি করেন এবং তাকে ভৌত জগতের সাথে মিশিয়ে দেন। এর ফলে আমাদের এই মহাবিশ্ব একটি জীবন্ত, বুদ্ধিমান সত্তায় পরিণত হয়। গ্রহ-নক্ষত্রের সুশৃঙ্খল গতি এই বিশ্বাত্মারই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।

এরপর তিনি চারটি মৌলিক উপাদান (elements) দিয়ে ভৌত জগৎ তৈরি করেন: আগুন, বাতাস, জল ও মাটি। মজার ব্যাপার হলো, প্লেটো এই চারটি উপাদানকে জ্যামিতিক আকারের সাথে যুক্ত করেছিলেন। তাঁর মতে, এদের ক্ষুদ্রতম কণাগুলো হলো প্লেটোনিক সলিড (Platonic Solids):

  • আগুন (Fire): চতুস্তলক (Tetrahedron) – সবচেয়ে হালকা ও ধারালো।
  • বাতাস (Air): অষ্টতলক (Octahedron)।
  • জল (Water): বিংশতলক (Icosahedron)।
  • মাটি (Earth): ঘনক (Cube) – সবচেয়ে স্থিতিশীল।
  • পঞ্চম আরেকটি আকার, দ্বাদশতলক (Dodecahedron), দিয়ে ডিমিআর্জ সমগ্র মহাবিশ্বের আকার দিয়েছেন।

এই জ্যামিতিক তত্ত্বের মাধ্যমে প্লেটো দেখিয়েছেন যে ভৌত জগৎ বিশৃঙ্খল নয়, বরং এর পেছনেও একটি গাণিতিক ও যৌক্তিক শৃঙ্খলা রয়েছে, যা বুদ্ধিমান সত্তারই পরিচায়ক।

আত্মার রথ: মানুষের মন কীভাবে কাজ করে? (The Tripartite Soul)

মানুষ কেন ভুল করে? কেন জেনে শুনেও খারাপ কাজ করে? এর উত্তরে প্লেটো আত্মার এক অসাধারণ ছবি এঁকেছেন, যা ‘আত্মার ত্রিধা বিভাজন’ (Tripartite Theory of the Soul) নামে পরিচিত। তিনি তাঁর ‘ফেড্রাস’ (Phaedrus) সংলাপে আত্মাকে একটি রথের সাথে তুলনা করেছেন, যা দুটি ডানাওয়ালা ঘোড়া টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর রথের চালকের আসনে বসে আছে একজন সারথি (Charioteer)।

  • ১. সারথি (The Charioteer): এ হলো আমাদের ‘যুক্তি’ (Reason বা Logos)। এর কাজ হলো সত্যকে খোঁজা, বুদ্ধিকে ব্যবহার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং বাকি দুটো অংশকে নিয়ন্ত্রণ করা। এর আকাঙ্ক্ষা হলো জ্ঞান।
  • ২. সাদা ঘোড়া (The White Horse): এ হলো আমাদের ‘সাহস’ বা ‘আবেগ’ (Spirit বা Thumos)। এটা সম্মান, গৌরব, জয়ের আকাঙ্ক্ষা করে। এটা লজ্জাবোধ করে, অন্যায় দেখলে রেগে যায়। যদি যুক্তির অধীনে থাকে, তবে এই ঘোড়া খুব শক্তিশালী ও মহৎ। সে সারথির ভালো বন্ধু।
  • ৩. কালো ঘোড়া (The Black Horse): এ হলো আমাদের ‘কামনা’ বা ‘প্রবৃত্তি’ (Appetite বা Eros)। এর কাজ হলো জাগতিক সুখ খোঁজা—খাবার, পানীয়, যৌনতা, অর্থ। এই ঘোড়াটা বন্য, অবাধ্য এবং একে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। সে কেবল নিজের প্রবৃত্তির কথাই শোনে।

প্লেটোর মতে, একজন সুখী এবং ন্যায়পরায়ণ মানুষ (Just Man) হলেন তিনি, যার আত্মার ভেতর সারথি (যুক্তি) সাদা ঘোড়ার (আবেগ) সাহায্য নিয়ে অবাধ্য কালো ঘোড়াটাকে (কামনা) ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যখন কামনা বা প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখনই মানুষ ভুল পথে চালিত হয় এবং তার জীবনে বিশৃঙ্খলা নেমে আসে। এই অভ্যন্তরীণ সম্প্রীতিই হলো সত্যিকারের সুখ বা ইউডাইমোনিয়া (Eudaimonia)—অর্থাৎ মানব জীবনের চূড়ান্ত বিকাশ।

দার্শনিক রাজার দেশ: আদর্শ রাষ্ট্র কেমন হবে? (The Ideal State in The Republic)

সক্রেটিসের মৃত্যু প্লেটোকে শিখিয়েছিল যে গণতন্ত্র, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের শাসন, কতটা ভয়ংকর হতে পারে। কারণ সাধারণ মানুষ আবেগ (spirit) আর কামনা (appetite) দ্বারা চালিত হয়, যুক্তি (reason) দিয়ে নয়। তারা গুহার ছায়া দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই প্লেটো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য রিপাবলিক’ (The Republic)-এ এক আদর্শ রাষ্ট্রের (Ideal State) রূপরেখা দিয়েছেন, যেখানে শাসন করবে কোনো রাজনীতিবিদ বা সেনাপতি নয়, শাসন করবে দার্শনিক!

প্লেটো আত্মার তিনটি ভাগের আদলে রাষ্ট্রকেও তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। কারণ রাষ্ট্র তো ব্যক্তিরই একটি বৃহৎ সংস্করণ (The state is the soul writ large)।

  • ১. শাসক শ্রেণি বা দার্শনিক-রাজা (Rulers বা Philosopher-Kings): এরা হবেন রাষ্ট্রের মাথা। এঁরা আত্মার ‘যুক্তি’র প্রতীক। এঁরা লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকবেন এবং শুধু দেশের কল্যাণের কথাই ভাববেন। দীর্ঘ এবং কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এঁরা ‘পরম কল্যাণের আকার’ (The Form of the Good) সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবেন। যেহেতু তাঁরাই সত্যকে জানেন, তাই কেবল তাঁদেরই অধিকার আছে দেশ শাসন করার।
  • ২. অভিভাবক বা সৈন্য শ্রেণি (Guardians বা Auxiliaries): এরা হবেন রাষ্ট্রের বুক বা হাত। এঁরা আত্মার ‘সাহস’ বা ‘আবেগ’-এর প্রতীক। এঁদের কাজ হলো দেশকে রক্ষা করা, আইনকানুন প্রয়োগ করা এবং শাসক শ্রেণির আদেশ মেনে চলা। এঁরা হবেন সাহসী, অনুগত এবং আত্মত্যাগী।
  • ৩. উৎপাদক শ্রেণি (Producers): এরা হবেন রাষ্ট্রের পেট বা নিম্নভাগ। এঁরা আত্মার ‘কামনা’র প্রতীক। কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী—এরা সবাই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এঁদের কাজ হলো উৎপাদন করা এবং রাষ্ট্রের বৈষয়িক চাহিদা মেটানো।

ন্যায়বিচার (Justice) কী?

প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন এই তিনটি শ্রেণির প্রত্যেকে নিজের নির্দিষ্ট কাজটা ঠিকভাবে করবে এবং অন্য শ্রেণির কাজে নাক গলাবে না। অর্থাৎ, উৎপাদক উৎপাদন করবে, সৈন্যরা দেশরক্ষা করবে আর দার্শনিকরা শাসন করবেন। ঠিক যেমন একজন ব্যক্তির ভেতরে ন্যায়বিচার মানে হলো যুক্তি, আবেগ ও কামনার মধ্যে সঠিক সমন্বয়।

দার্শনিক-রাজার জীবন ও শিক্ষা

প্লেটোর এই আদর্শ রাষ্ট্রের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং চমকপ্রদ অংশ হলো শাসক ও সৈন্য শ্রেণির জীবনযাপন। দেশের প্রতি তাঁদের যেন কোনো ব্যক্তিগত টান বা লোভ না জন্মায়, সেজন্য প্লেটো কিছু কঠোর নিয়ম প্রস্তাব করেছিলেন:

  • ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না: শাসক ও সৈন্য শ্রেণির কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা টাকা-পয়সা থাকবে না। রাষ্ট্র তাঁদের সব চাহিদা মেটাবে।
  • পারিবারিক জীবন থাকবে না: তাঁদের কোনো ব্যক্তিগত পরিবারও থাকবে না। নারী-পুরুষ সবাই একসাথে থাকবেন, সন্তানেরা জন্ম নেওয়ার পর রাষ্ট্রের কাছে চলে যাবে এবং রাষ্ট্রই তাদের মানুষ করবে। কে কার সন্তান, তা কেউ জানবে না।
  • নারী-পুরুষের সমানাধিকার: প্লেটো মনে করতেন, শাসনের যোগ্যতা নারী বা পুরুষ হিসেবে নির্ধারিত হয় না, বরং আত্মার গুণ দিয়ে নির্ধারিত হয়। তাই যোগ্য নারীরাও পুরুষদের মতোই শাসক বা সৈন্য হতে পারবেন।
  • মহৎ মিথ্যা (The Noble Lie): প্লেটো একটি ‘মহৎ মিথ্যা’ বা gennaion pseudos-এর প্রস্তাব করেন। নাগরিকদের বলা হবে যে, ঈশ্বর তাদের বিভিন্ন ধাতুর সংমিশ্রণে তৈরি করেছেন। যাদের আত্মায় সোনা আছে, তারা শাসক; যাদের রুপা আছে, তারা সৈন্য; আর যাদের ব্রোঞ্জ বা লোহা আছে, তারা উৎপাদক। এই গল্পটি সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান মেনে নিতে এবং সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

আদর্শ রাষ্ট্রের পতন এবং প্লেটোর পরবর্তী চিন্তা

প্লেটো এও দেখিয়েছেন কীভাবে এই আদর্শ রাষ্ট্র (Aristocracy) ধীরে ধীরে অধঃপতিত হয়। প্রথমে তা পরিবর্তিত হয় টিমোক্রেসি (Timocracy)-তে (যেখানে সম্মানের লোভই প্রধান), তারপর অলিগার্কি (Oligarchy)-তে (ধনীকদের শাসন), এরপর ডেমোক্রেসি (Democracy)-তে (স্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসন) এবং সবশেষে এর পতন হয় টাইরানি (Tyranny) বা স্বৈরতন্ত্রে।

জীবনের শেষ দিকে এসে প্লেটো হয়তো বুঝেছিলেন যে তাঁর রিপাবলিক-এ বর্ণিত রাষ্ট্রকাঠামোটি অতিরিক্ত রকমের আদর্শবাদী ছিল। তাই তাঁর শেষ এবং সর্ববৃহৎ গ্রন্থ ‘দ্য লজ’ (The Laws)-এ তিনি একটি অপেক্ষাকৃত বাস্তবসম্মত, ‘দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ’ (second-best) রাষ্ট্রের কথা বলেন। এখানে দার্শনিক-রাজার বদলে আইনের শাসনকেই (Rule of Law) সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রেম, শিল্প এবং হারানো আটলান্টিস

প্লেটোনিক লাভ (Platonic Love): এক ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা

‘প্লেটোনিক লাভ’ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি নিষ্কাম, শরীরবিহীন ভালোবাসা। কিন্তু প্লেটোর ধারণাটি ছিল আরও গভীর। তাঁর ‘সিম্পোজিয়াম’ (Symposium) সংলাপে তিনি দেখিয়েছেন, প্রেম বা ইরোস (Eros) হলো এক শক্তিশালী চালিকাশক্তি যা আমাদের মর্ত্যের জগৎ থেকে ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে যেতে পারে। এটি একটি সিঁড়ির মতো:

  • ১. যাত্রা শুরু হয় একটি সুন্দর দেহের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে।
  • ২. এরপর মানুষ বোঝে, সৌন্দর্য শুধু একটি দেহে সীমাবদ্ধ নয়, তাই সে সকল সুন্দর দেহের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে।
  • ৩. তারপর সে দৈহিক সৌন্দর্যের চেয়ে আত্মার সৌন্দর্যকে বড় করে দেখে এবং সুন্দর আত্মার প্রেমে পড়ে।
  • ৪. এই ভালোবাসা আরও বিমূর্ত হয়ে সুন্দর কার্যকলাপ, আইন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ধাবিত হয়।
  • ৫. এরপর সে জ্ঞানের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে।
  • ৬. অবশেষে, এই সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে উঠে সে সৌন্দর্যের মূল উৎস, সেই শাশ্বত ও নিখুঁত ‘সৌন্দর্যের আকার’ (The Form of Beauty)-কে সরাসরি উপলব্ধি করে।

সুতরাং, প্লেটোর প্রেম হলো এক দার্শনিক যাত্রা, যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের জগৎ থেকে আকারের জগতে পৌঁছে দেয়।

শিল্প ও কবিতা নিয়ে প্লেটোর অ্যালার্জি

প্লেটোর দর্শন বুঝতে গিয়ে অনেকেই একটা জায়গায় হোঁচট খান। প্লেটো নিজে এত বড় একজন শিল্পী, তাঁর লেখাগুলো সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। অথচ তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবি ও শিল্পীদের নির্বাসনে পাঠানোর কথা বলেছেন! কেন? কারণটা তাঁর সেই ‘আকারের তত্ত্ব’-এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে। মনে করে দেখুন:

  • আসল জগৎ হলো আকারের জগৎ (সত্যের প্রথম স্তর)।
  • আমাদের এই ভৌত জগৎ হলো সেই আকারের জগতের একটা নকল (সত্য থেকে এক ধাপ দূরে)।
  • শিল্পী বা কবি যখন একটি ছবি আঁকেন বা কবিতা লেখেন, তখন তিনি এই নকল জগতের কোনো একটা জিনিসকে (যেমন, একটি বিছানা) নকল করেন।

সুতরাং, প্লেটোর মতে, শিল্পকলা হলো ‘নকলের নকল’ (a copy of a copy)। এটা সত্য থেকে দুই ধাপ দূরে। শিল্প আমাদের সত্যের দিকে না নিয়ে, বরং আরও বেশি করে ছায়ার জগতের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এটি আমাদের আত্মার যুক্তিবাদী অংশকে নয়, বরং আবেগপ্রবণ ও কামনা-বাসনার অংশকে নাড়া দেয়, যা রাষ্ট্রের শৃঙ্খলার জন্য বিপজ্জনক (Plato, Republic, Book X)।

আটলান্টিসের উপকথা (The Myth of Atlantis)

প্লেটো কেবল দার্শনিক তত্ত্বই দেননি, তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত উপকথাগুলোর একটিরও জন্মদাতা। তাঁর ‘টিমিয়াস’ ও ‘ক্রিটিয়াস’ (Timaeus and Critias) সংলাপে তিনি এক উন্নত ও শক্তিশালী দ্বীপ-রাষ্ট্র আটলান্টিসের গল্প বলেন। এই রাষ্ট্রটি ছিল প্রযুক্তিতে উন্নত, সম্পদে পরিপূর্ণ। কিন্তু একসময় তাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটে, তারা অহংকারী ও সাম্রাজ্যলোভী হয়ে ওঠে। অবশেষে দেবতারা তাদের ঔদ্ধত্যের শাস্তি দেন এবং ভয়াবহ ভূমিকম্প ও বন্যায় একদিন ও এক রাতের মধ্যে পুরো দ্বীপটি সমুদ্রে তলিয়ে যায়। এই গল্পটি সম্ভবত একটি রাজনৈতিক রূপক, যা এথেন্সকে তার অহংকার ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির ব্যাপারে সতর্ক করার জন্য বলা হয়েছিল।

প্লেটোর প্রভাব: আড়াই হাজার বছরের উত্তরাধিকার

প্লেটোর দর্শন কি কেবলই কিছু অদ্ভুত তত্ত্বের সমষ্টি? একদমই না। পশ্চিমা সভ্যতার চিন্তার ইতিহাসে প্লেটোর মতো প্রভাবশালী আর কেউ নেই। দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড (Alfred North Whitehead) তো বলেই দিয়েছেন, “ইউরোপীয় দর্শনের সবচেয়ে নিরাপদ সাধারণীকরণ হলো, এটি প্লেটোর রচনার একটি পাদটীকা মাত্র” (Whitehead, 1978)।

  • অ্যারিস্টটল: প্লেটোর শ্রেষ্ঠ ছাত্র অ্যারিস্টটল তাঁর গুরুর আকারের তত্ত্বের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, আকারগুলো কোনো ভিন্ন জগতে থাকে না, বরং ভৌত বস্তুর মধ্যেই নিহিত থাকে। কিন্তু তাঁর সমগ্র দর্শনই ছিল প্লেটোর তোলা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা।

  • খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব: প্লেটোর ‘আকারের জগৎ’-এর ধারণা পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় দার্শনিকদের, বিশেষ করে নব্য-প্লেটোনিকদের (Neo-Platonists) মাধ্যমে, ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সেন্ট অগাস্টিনের মতো চিন্তাবিদরা প্লেটোর ‘আকার’গুলোকে ঈশ্বরের মনের ভেতরের ধারণা (Ideas in the mind of God) হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

  • ইসলামী দর্শন: আল-ফারাবি, ইবনে সিনার মতো ইসলামী দার্শনিকরাও প্লেটোর দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, বিশেষ করে তাঁর রাষ্ট্রদর্শন ও অধিবিদ্যা দ্বারা। আল-ফারাবিকে তো ‘দ্বিতীয় শিক্ষক’ (অ্যারিস্টটলের পরে) বলা হতো এবং তাঁর ‘আল-মদিনা আল-ফাদিলা’ (The Virtuous City) গ্রন্থটি প্লেটোর ‘রিপাবলিক’-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত।

  • রেনেসাঁ ও আধুনিক যুগ: রেনেসাঁর সময় প্লেটোর লেখাগুলো নতুন করে আবিষ্কৃত হয় এবং মানবতাবাদী চিন্তাধারাকে উসকে দেয়। আধুনিক যুগের অনেক দার্শনিক, যেমন—দেকার্তের যুক্তিবাদ, কান্টের অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ জ্ঞান (a priori knowledge)—এসবের পেছনেও প্লেটোর ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়।

সমালোচনা ও শেষ কথা

প্লেটোর সমালোচনাও কম হয়নি। তাঁর অভিজাততন্ত্র, গণতন্ত্রের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং একটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থার ধারণা আধুনিক উদারপন্থী চিন্তাধারার সাথে মেলে না। বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী দার্শনিক কার্ল পপার (Karl Popper) তাঁর বিখ্যাত বই The Open Society and Its Enemies-এ প্লেটোকে আধুনিক স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার (totalitarianism) অন্যতম জনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অন্যদিকে, ফ্রিডরিখ নিৎশে (Friedrich Nietzsche) প্লেটোকে অভিযুক্ত করেছেন এই বলে যে, তিনিই প্রথম পশ্চিমা দর্শনকে ‘জীবন-বিমুখ’ করেছেন, এই মর্ত্যের জীবনকে অস্বীকার করে এক কাল্পনিক ‘আসল’ জগতের পেছনে ছুটতে শিখিয়েছেন।

তাহলে প্লেটোকে আমরা কীভাবে মনে রাখব? একজন স্বৈরাচারী চিন্তাবিদ হিসেবে, নাকি একজন স্বপ্নদর্শী জাদুকর হিসেবে?

আসলে প্লেটোর মহত্ত্ব এখানেই যে তিনি আমাদের এমন সব প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন, যা এর আগে কেউ সেভাবে করেনি। বাস্তবতা কী? জ্ঞান কী? ন্যায়বিচার কী? আত্মা কী? একটি আদর্শ সমাজ কেমন হওয়া উচিত? এই প্রশ্নগুলোর কোনো সহজ উত্তর নেই। প্লেটো হয়তো যে উত্তরগুলো দিয়েছেন, সেগুলোর সাথে আমরা একমত না-ও হতে পারি। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র আমাদের কাছে ভয়ংকর লাগতে পারে, তাঁর আকারের জগৎকে বাড়াবাড়ি কল্পনা বলে মনে হতে পারে।

কিন্তু তিনি আমাদের চিন্তার দরজায় যে টোকা দিয়ে গেছেন, সেই টোকার শব্দ আড়াই হাজার বছর পরেও আমাদের ভাবায়। তিনি আমাদের সেই গুহার বন্দি, যে শিকল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়েছিল এবং আমাদেরও ডাকছে ছায়ার জগৎ ছেড়ে আসল সত্যের আলোর দিকে যাওয়ার জন্য। সেই আলোয় পৌঁছানো হয়তো খুব কঠিন, হয়তো অসম্ভব। কিন্তু সেই আলোর দিকে যাত্রার স্বপ্ন দেখাটাও তো কম কথা নয়, তাই না?

প্লেটোর দর্শন হলো সেই অনন্ত যাত্রার এক অসাধারণ মানচিত্র। এটি আমাদের শেখায় যে, যা দেখি, তার বাইরেও দেখার কিছু থাকতে পারে; যা জানি, তার চেয়েও বেশি কিছু জানার থাকতে পারে। আর এই অনন্ত জিজ্ঞাসা আর অজানার প্রতি আকর্ষণই তো দর্শন, যা প্লেটোকে করে তুলেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এক জাদুকর।

তথ্যসূত্র

  • Annas, J. (1995). An Introduction to Plato’s Republic. Oxford University Press.
  • Kraut, R. (Ed.). (2017). The Cambridge Companion to Plato (2nd ed.). Cambridge University Press.
  • Nietzsche, F. (2005). Twilight of the Idols and The Anti-Christ. (R. J. Hollingdale, Trans.). Penguin Classics. (Original work published 1889).
  • Plato. (n.d.). Apology. (B. Jowett, Trans.). The Internet Classics Archive. http://classics.mit.edu/Plato/apology.html
  • Plato. (2016). The Laws. (T. L. Pangle, Trans.). University of Chicago Press. (Original work published c. 350 B.C.E.).
  • Plato. (n.d.). Meno. (B. Jowett, Trans.). The Internet Classics Archive. http://classics.mit.edu/Plato/meno.html
  • Plato. (n.d.). Phaedrus. (B. Jowett, Trans.). The Internet Classics Archive. http://classics.mit.edu/Plato/phaedrus.html
  • Plato. (2000). The Republic. (G. R. F. Ferrari, Ed., T. Griffith, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published c. 380 B.C.E.).
  • Plato. (n.d.). Symposium. (B. Jowett, Trans.). The Internet Classics Archive. http://classics.mit.edu/Plato/symposium.html
  • Plato. (2013). Timaeus and Critias. (A. E. Taylor, Trans.). Dover Publications. (Original work published c. 360 B.C.E.).
  • Popper, K. (2002). The Open Society and Its Enemies, Vol 1: The Spell of Plato. Routledge. (Original work published 1945).
  • Russell, B. (1945). A History of Western Philosophy. Simon & Schuster.
  • Taylor, A. E. (1956). Plato: The Man and His Work. Meridian Books.
  • Thucydides. (n.d.). The History of the Peloponnesian War. (R. Crawley, Trans.). The Internet Classics Archive. http://classics.mit.edu/Thucydides/pelopwar.html
  • Vlastos, G. (1991). Socrates, Ironist and Moral Philosopher. Cornell University Press.
  • Whitehead, A. N. (1978). Process and Reality: An Essay in Cosmology. The Free Press. (Original work published 1929).

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.