Table of Contents
ভূমিকা
আজ যে বিষয়টা নিয়ে লিখতে যাচ্ছি তা হচ্ছে পোশাক। খুব সাধারণ, খুব আটপৌরে একটা ব্যাপার, তাই না? আমরা শরীর ঢাকার জন্য, লজ্জা নিবারণের জন্য, শীত বা গ্রীষ্মের প্রকোপ থেকে বাঁচতে, কিংবা নিজেকে একটু সুন্দর করে সাজানোর জন্য পোশাক পরি। কিন্তু আসলেই কি ব্যাপারটা এত সহজ? নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস, ক্ষমতা আর রাজনীতির জটিল সব সমীকরণ?
একটি মেয়ে, ধরা যাক তার নাম নীলা। ভার্সিটিতে পড়ে। আজ তার মন খুব ফুরফুরে। সে ঠিক করলো আজ একটা নীল জিন্স আর উজ্জ্বল হলুদ রঙের একটা ফতুয়া পরে বের হবে। তার প্রিয় পোশাক। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে তার বেশ ভালো লাগলো। কিন্তু যেই না সে বসার ঘরের দরজা পর্যন্ত গেলো, তার মা পেছন থেকে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, “এটা কী পরেছিস? লোকে কী বলবে? একটু শালীন পোশাক পরতে পারিস না?”
এই যে ‘শালীন পোশাক’ (Decent Attire)—এই ধারণাটা আসলে কী? কে ঠিক করে দেয় কোনটা শালীন আর কোনটা অশালীন? নীলার কাছে যা আধুনিক, স্বচ্ছন্দ এবং সুন্দর, তার মায়ের কাছে তা কেন আপত্তিকর মনে হলো? এই ‘কেন’-এর উত্তর খুঁজতে গেলেই আমরা ঢুকে পড়ি এক বিশাল, কুয়াশাচ্ছন্ন গোলকধাঁধায়। এই গোলকধাঁধার নাম সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, ক্ষমতা এবং অবশ্যই, নারীবাদ (Feminism)।
পোশাক এবং শালীনতা (Modesty) নিয়ে নারীবাদী চিন্তাগুলো কোনো সরলরেখায় চলে না। এখানে অনেক বাঁক, অনেক ভিন্ন ভিন্ন পথ, অনেক তর্ক-বিতর্ক। কেউ বলেন পোশাক আমার শরীর, আমার ইচ্ছা, আমার রুচির প্রকাশ। আবার কেউ বলেন, এই ‘ইচ্ছা’টাই আসলে সমাজের তৈরি করা এক ধরনের অদৃশ্য শেকল। চলুন, এই জটিল কিন্তু আকর্ষণীয় বিতর্কের গহীন অরণ্যে আজ আমরা একটু হারিয়ে যাই।
স্বাধীনতার প্রথম পাঠ – উদারপন্থী নারীবাদ ও ব্যক্তিগত পছন্দের জয়গান
সবচেয়ে পরিচিত এবং জনপ্রিয় নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি হলো উদারপন্থী নারীবাদ (Liberal Feminism)। এই ঘরানার মূলমন্ত্র খুব সহজ এবং শক্তিশালী—‘আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত’ (My Body, My Choice)। তাদের মতে, একজন নারী কী পরবেন বা পরবেন না, স্কার্ট পরবেন নাকি শাড়ি, জিন্স পরবেন নাকি বোরকা—সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সম্পূর্ণ তার নিজের। অন্য কারো, তা সে পরিবারই হোক বা সমাজ, রাষ্ট্রই হোক বা ধর্ম, এখানে কথা বলার কোনো অধিকার নেই।
উদারপন্থী নারীবাদীরা মনে করেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ (Patriarchal Society) শুরু থেকেই নারীর উপর নানা ধরনের নিয়মকানুন চাপিয়ে দিয়েছে। নারীর শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করা এর মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি প্রকল্প। স্কার্টের ঝুল কতটা লম্বা হবে, ব্লাউজের গলা কতটা গভীর হবে, ওড়নাটা মাথায় থাকবে নাকি গলায় পেঁচানো থাকবে—এই সবকিছু সমাজ ঠিক করে দিতে চায়। উদারপন্থী নারীবাদ এই নিয়ন্ত্রণের ঘোর বিরোধী। তাদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার: একজন পুরুষ যদি খালি গায়ে বা শর্টস পরে রাস্তায় হাঁটতে পারে, তাহলে একজন নারীর পোশাকের ধরন নিয়ে এত প্রশ্ন উঠবে কেন? এই দ্বৈত নীতি (Double Standard) আসলে লিঙ্গীয় বৈষম্যেরই একটি রূপ।
তারা মনে করেন, নীলার জিন্স-ফতুয়া পরার ইচ্ছাটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রকাশ। তার মা যখন ‘শালীনতা’র কথা বলেন, তখন তিনি আসলে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের কথাই বলছেন। এই নিয়মগুলো নারীকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে আটকে রাখতে চায়—‘ভালো মেয়ে’, ‘লক্ষ্মী মেয়ে’র ছাঁচ। উদারপন্থী নারীবাদীদের কাছে, এই ছাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসাই হলো মুক্তির প্রথম ধাপ। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের (Mary Wollstonecraft) মতো প্রথম যুগের নারীবাদীরা যেমন নারীর শিক্ষার অধিকার চেয়েছিলেন, তেমনি আধুনিক উদারপন্থী নারীবাদীরা নারীর পোশাকের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেন। তাদের মতে, দুটোই বৃহত্তর স্বাধীনতার অংশ (Wollstonecraft, 1792)।
এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল ভিত্তি হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য (Individualism) এবং যৌক্তিক পছন্দ (Rational Choice) এর ধারণা, যা মূলত আলোকায়নের (Enlightenment) দর্শন থেকে এসেছে। একজন নারী একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে নিজের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা রাখেন। তাই পোশাকের মাধ্যমে তিনি কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করবেন, সেই স্বাধীনতা তাকে দিতেই হবে। এই ধারার নারীবাদীরা মনে করেন, নারীর ক্ষমতায়ন (Empowerment) তখনই সম্ভব, যখন সে আইনি, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে পুরুষের সমান সুযোগ পাবে এবং নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিজে নিতে পারবে। পোশাকের স্বাধীনতা সেই বৃহত্তর স্বাধীনতারই একটি অংশ মাত্র। যেমন, বিশ শতকের শুরুতে নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনের (Suffrage Movement) পাশাপাশি কর্সেটের (Corset) মতো কষ্টদায়ক, শ্বাসরোধী পোশাকের বিরুদ্ধেও একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। নারীরা বুঝতে পারছিলেন, শারীরিক মুক্তি ছাড়া মানসিক বা রাজনৈতিক মুক্তি অসম্ভব।
কিন্তু এই ‘পছন্দ’ বা ‘চয়েস’ কি আসলেই এত সরল? উদারপন্থী নারীবাদ প্রায়শই ধরে নেয় যে, মানুষ একটি শূন্যস্থানে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের পছন্দগুলো সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। একজন নারী যখন একটি নির্দিষ্ট পোশাক ‘পছন্দ’ করেন, তখন সেই পছন্দের পেছনে বিজ্ঞাপনের প্রভাব, সামাজিক চাপের প্রভাব, বা ‘ট্রেন্ডি’ থাকার আকাঙ্ক্ষার প্রভাব কতটুকু? উদারপন্থী নারীবাদ এই কাঠামোগত প্রভাবগুলোকে অনেক সময় যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না, যা তাদের তত্ত্বের একটি বড় সমালোচনা। এখান থেকেই আমাদের পরবর্তী অধ্যায়ের দরজা খুলে যায়।
পছন্দের মরীচিকা – র্যাডিকাল নারীবাদ ও অদৃশ্য শেকলের সন্ধান
ধরা যাক, নীলা তার মায়ের কথা না শুনে, কিছুটা মন খারাপ করেই, জিন্স-ফতুয়া পরেই ভার্সিটিতে গেলো। ক্লাসে বান্ধবীরা তার পোশাকের প্রশংসা করলো। তার খুব হালকা লাগছে, মুক্ত লাগছে। কিন্তু র্যাডিকাল নারীবাদীরা (Radical Feminists) এখানে একটা বড় ‘কিন্তু’ যোগ করবেন। তারা প্রশ্ন তুলবেন, নীলার এই ‘মুক্ত’ লাগার অনুভূতিটা কি আসল? নাকি এটাও এক ধরনের ভ্রম বা মায়া?
র্যাডিকাল নারীবাদীদের মূল বক্তব্য হলো, পিতৃতন্ত্র কেবল একটি সামাজিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, এটি আমাদের মনোজগতের গভীরে প্রোথিত এক কাঠামো। এটি কেবল বাইরে থেকে নিয়ম চাপায় না, বরং আমাদের চিন্তার ভেতরেই গেড়ে বসে। তারা মনে করেন, আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য—সবকিছু এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেখানে পৃথিবীকে পুরুষের চোখ দিয়ে দেখা হয়। একে তারা বলেন ‘পুরুষের দৃষ্টি’ (Male Gaze)। এই ধারণাটি মূলত ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সমালোচক লরা মালভি (Laura Mulvey) তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘Visual Pleasure and Narrative Cinema’-তে জনপ্রিয় করেন। মালভির মতে, সিনেমা থেকে বিজ্ঞাপন, সব জায়গায় নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যা বিষমকামী পুরুষের (Heterosexual Male) চোখকে আনন্দ দেয়। নারী এখানে কর্তা (Subject) নয়, বরং নিছক একটি দেখার বস্তু (Object)। তাকে দেখা হয়, সে দেখে না। তার শরীরকে খণ্ডিত করা হয়—কখনো শুধু ঠোঁট, কখনো পা, কখনো বুক—এবং আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয় পুরুষের ভোগের জন্য (Mulvey, 1975)।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, নীলার আঁটসাঁট জিন্স পরার ইচ্ছাটা হয়তো পুরুষের দৃষ্টিকে তৃপ্ত করার এক অচেতন চেষ্টা। সমাজে ‘আধুনিক’, ‘স্মার্ট’ বা ‘সেক্সি’ নারীর যে ছবিটা তৈরি করা হয়েছে, সেই ছবিতে প্রায়শই এমন পোশাক পরা এক নারীকেই দেখানো হয়। র্যাডিকাল নারীবাদীরা বলবেন, নীলা যখন নিজেকে ‘মুক্ত’ ভাবছে, তখন সে আসলে পিতৃতন্ত্রের তৈরি করা একটি খাঁচা থেকে বেরিয়ে অন্য একটি নতুন, আরও আধুনিক দেখতে খাঁচায় প্রবেশ করছে। যে খাঁচা তাকে বলে, ‘সুন্দর’ হতে হলে, ‘আকর্ষণীয়’ হতে হলে, তোমাকে নির্দিষ্ট ধরনের শরীর এবং পোশাক ধারণ করতে হবে।
এই ঘরানার অন্যতম বিখ্যাত লেখিকা নাওমি উলফ (Naomi Wolf) তার বেস্টসেলার বই ‘The Beauty Myth’-এ এই বিষয়টিকেই আরও বিস্তৃত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ‘সৌন্দর্য’ নামক ধারণাটি নারীর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যখন নারীরা শিক্ষা, চাকরি এবং আইনি ক্ষেত্রে অধিকার আদায় করতে শুরু করলো, তখন পিতৃতন্ত্র তাদের নতুন এক জালে আটকাতে চাইলো। সেই জালের নাম ‘সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ড’ (Beauty Standard)। এই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, নারীকে হতে হবে স্লিম, ফর্সা, মসৃণ ত্বকের অধিকারী এবং চিরযৌবনা। এর জন্য তাকে ডায়েট করতে হবে, জিমে যেতে হবে, দামী কসমেটিক্স মাখতে হবে এবং অবশ্যই, ‘ফ্যাশনেবল’ পোশাক পরতে হবে (Wolf, 1991)। এই সৌন্দর্যের ধারণাটি কোনো প্রাকৃতিক বিষয় নয়, এটি সামাজিকভাবে নির্মিত (Socially Constructed) এবং এর মূল উদ্দেশ্য হলো নারীকে ব্যস্ত রাখা, তার আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেওয়া এবং তাকে পুরুষের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা।
সুতরাং, র্যাডিকাল ফেমিনিস্টদের মতে, একজন নারী যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাজগোজ করেন, হাই হিল পরে পায়ের যন্ত্রণা সহ্য করেন বা শরীরের সঙ্গে লেগে থাকা পোশাক পরেন, তখন তিনি আসলে পিতৃতন্ত্রের বানানো ‘আদর্শ নারী’ হওয়ার খেলাতেই অংশ নিচ্ছেন। তার এই পছন্দকে ‘মুক্ত পছন্দ’ বলা যায় না। এটা আসলে এক ধরনের বাধ্যতামূলক আনুগত্য। দার্শনিক সান্ড্রা লি বার্টকি (Sandra Lee Bartky) একে বলেছেন ‘নারীর বাধ্যতা’ বা ‘নারীর শৃঙ্খলা’ (Feminine Discipline)। বার্টকির মতে, নারীরা প্রতিনিয়ত নিজেদের শরীরকে পর্যবেক্ষণ করে, শাসন করে, এবং সংশোধন করে—যেন তা পুরুষতান্ত্রিক সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি এত সূক্ষ্ম যে নারী নিজেই এর কারিগর হয়ে ওঠে, সে নিজেই নিজের জেলর (Bartky, 1988)।
তাহলে উপায় কী? এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কেমন হবে? র্যাডিকাল নারীবাদীদের একাংশ, যেমন অ্যান্ড্রিয়া ডোর্কিন (Andrea Dworkin), মনে করতেন পর্নোগ্রাফি থেকে শুরু করে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি পর্যন্ত সবকিছুই নারীকে বস্তু বানানোর (Objectification) একটি প্রক্রিয়া। তাদের মতে, নারীর উচিত এমন সব সাংস্কৃতিক উপাদানকে বর্জন করা যা তাকে যৌন বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করে। এর অংশ হিসেবে কেউ কেউ পুরুষালি পোশাক (Androgynous clothing) পরা বা এমন পোশাক পরার কথা বলেন যা লিঙ্গ পরিচয়কে ছাপিয়ে যায়, যা শরীরকে ঢেকে রাখে এবং যৌন আবেদনময়ী হিসেবে উপস্থাপিত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে। তবে এই সমাধানও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কারণ, পুরুষের পোশাককে ‘নিউট্রাল’ বা স্বাভাবিক ধরে নেওয়াটাও তো আরেক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাই বটে! কেন নারীর শরীরকে লুকিয়ে ফেলাই মুক্তির একমাত্র পথ হবে?
অবচেতনের আলমারি ও মনস্তাত্ত্বিক নারীবাদ
আমরা যা পরি, তা কি শুধুই সচেতন মনের সিদ্ধান্ত? নাকি এর পেছনে আমাদের অবচেতন (Unconscious) মনেরও কোনো ভূমিকা আছে? মনস্তাত্ত্বিক নারীবাদ (Psychoanalytic Feminism) এই প্রশ্নটিই তোলে। এই ধারার নারীবাদীরা সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) এবং জ্যাক লাকাঁর (Jacques Lacan) মতো মনোসমীক্ষকদের তত্ত্বকে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবচ্ছেদ করেন।
ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের ব্যক্তিত্বের অনেকটাই শৈশবের অভিজ্ঞতা দ্বারা গঠিত হয়। যদিও ফ্রয়েডের অনেক তত্ত্বই, যেমন ‘শিশ্ন-ঈর্ষা’ (Penis Envy), তীব্রভাবে নারীবিরোধী এবং সমালোচিত, নারীবাদী তাত্ত্বিকরা তার অবচেতন মনের ধারণাকে নতুনভাবে ব্যবহার করেছেন। তারা বলেন, ছোটবেলা থেকে একটি মেয়েকে যেভাবে বড় করা হয়, তাকে যে ধরনের পোশাক পরানো হয় (যেমন, নরম, গোলাপি রঙের ফ্রক), তা তার মনে ‘নারীত্ব’ সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি করে দেয়। বড় হয়ে তার পোশাকের পছন্দ সেই শৈশবের শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। সে হয়তো এমন পোশাক বেছে নেয় যা তাকে ‘সুরক্ষিত’ বা ‘নারীসুলভ’ অনুভব করায়, অথবা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী পোশাক বেছে নেয়। দুটোই তার অবচেতন মনের গভীরে থাকা কোনো দ্বন্দ্বের প্রকাশ হতে পারে।
ফরাসি তাত্ত্বিক লুস ইরিগারে (Luce Irigaray) বা জুলিয়া ক্রিস্টেভার (Julia Kristeva) মতো নারীবাদীরা ভাষা এবং প্রতীকের জগতে নারীর অবস্থান নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের মতে, আমাদের পুরো সাংস্কৃতিক জগৎটাই একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রতীকী ব্যবস্থা (Symbolic Order) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই ব্যবস্থায় ‘নারী’কে প্রায়শই ‘অন্য’ (the Other) বা পুরুষের বিপরীত হিসেবে দেখা হয়। পোশাক এই প্রতীকী ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শাড়ি বা স্কার্টের মতো পোশাকগুলো ঐতিহ্যগতভাবে ‘নারীসুলভ’ হিসেবে পরিচিত, কারণ এগুলো পুরুষের পোশাক প্যান্ট থেকে ভিন্ন। যখন একজন নারী পুরুষের পোশাক পরেন, তখন তিনি কেবল পোশাকই বদলান না, তিনি প্রতীকী জগতেও একটি আলোড়ন তৈরি করেন।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, নীলার জিন্স পরার ইচ্ছা কেবল আরাম বা ফ্যাশনের ব্যাপার নয়। এটি হতে পারে পিতৃতান্ত্রিক প্রতীকী ব্যবস্থা থেকে নিজেকে কিছুটা আলাদা করার একটি অবচেতন প্রচেষ্টা। আবার তার মায়ের উদ্বেগও কেবল ‘লোকে কী বলবে’ ভয় নয়, এটি হতে পারে প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার এক গভীর, মনস্তাত্ত্বিক আতঙ্ক। মনস্তাত্ত্বিক নারীবাদ আমাদের দেখায় যে, আমাদের আলমারির প্রতিটি পোশাকের পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে আমাদের না-বলা ইচ্ছা, ভয় এবং পরিচয়ের জটিল সব গল্প।
বোরকা, হিজাব এবং প্রতিরোধের রাজনীতি – উত্তর-ঔপনিবেশিক ও ইসলামিক নারীবাদ
এতক্ষণ আমরা যে আলোচনা করলাম, তার পুরোটাই ছিল মূলত পশ্চিমা প্রেক্ষাপটে। কিন্তু পৃথিবী তো শুধু পশ্চিমে সীমাবদ্ধ নয়। যখনই পোশাকের বিতর্ক ওঠে, বিশেষ করে মুসলিম নারীদের হিজাব বা বোরকা নিয়ে পশ্চিমা নারীবাদীদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি এবং প্রায়শই একপেশে মতামত দেখা যায়। তাদের অনেকেই মনে করেন, হিজাব বা বোরকা হলো নারীর ওপর পুরুষের নির্যাতনের চূড়ান্ত প্রতীক। এটা নারীকে অদৃশ্য করে রাখে, তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে দমন করে এবং তাকে জনপরিসর (Public Sphere) থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
কিন্তু উত্তর-ঔপনিবেশিক (Postcolonial) এবং ইসলামিক নারীবাদীরা (Islamic Feminists) এই সরলীকরণের তীব্র বিরোধিতা করেন। তারা বলেন, পশ্চিমা নারীবাদীরা প্রায়শই তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ দিয়ে অন্য সংস্কৃতির নারীদের বিচার করতে চান। এটা এক ধরনের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ (Cultural Imperialism), যেখানে পশ্চিমা মডেলকেই মুক্তির একমাত্র মডেল হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ভারতীয় নারীবাদী তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক (Gayatri Chakravorty Spivak) তার বিখ্যাত প্রবন্ধে এই মানসিকতাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে: “শ্বেতাঙ্গ পুরুষরা বাদামী নারীদের বাদামী পুরুষদের হাত থেকে রক্ষা করছে” (“White men are saving brown women from brown men”)। এখানে বাদামী নারীর নিজের কথা বলার কোনো সুযোগই থাকছে না (Spivak, 1988)।
এই ঘরানার চিন্তাবিদরা মনে করেন, হিজাব বা বোরকার অর্থ সব সময় এক নয়। এর অর্থ স্থির নয়, বরং তা নির্ভর করে পরিস্থিতি, স্থান এবং ব্যক্তির উপর। অনেক মুসলিম নারীর কাছে হিজাব কোনো জবরদস্তির প্রতীক নয়, বরং এটি তাদের ধর্মীয় পরিচয়, আধ্যাত্মিকতা, আত্মসম্মান এবং প্রতিরোধের একটি হাতিয়ার। যেমন, নৃবিজ্ঞানী সাবা মাহমুদ (Saba Mahmood) তার বিখ্যাত বই ‘Politics of Piety’-তে মিশরের কায়রোর সাধারণ নারীদের ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, তাদের জন্য হিজাব পরাটা কোনো নিপীড়ন নয়। বরং, এটি তাদের জন্য ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং নৈতিকভাবে একজন উন্নত মানুষ হয়ে ওঠার একটি দৈনন্দিন চর্চা। এটা তাদের নিজস্ব ‘এজেন্সি’ (Agency) বা আত্মকর্তৃত্বের প্রকাশ, যা পশ্চিমা নারীবাদী ‘প্রতিরোধ’-এর ধারণার সাথে মেলে না (Mahmood, 2005)।
ফিলিস্তিনি-আমেরিকান তাত্ত্বিক লিলা আবু-লুগোদ (Lila Abu-Lughod) তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রবন্ধে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, “মুসলিম নারীদের কি উদ্ধারের প্রয়োজন আছে?” (Do Muslim Women Need Saving?)। তিনি দেখিয়েছেন, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের সময় কীভাবে হিজাব বা বোরকাকে তালিবানি নিপীড়নের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল এবং বোরকা থেকে নারীকে ‘মুক্ত’ করাকে যুদ্ধের একটি নৈতিক যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল। আবু-লুগোদের মতে, এটা একটা ভয়ঙ্কর ঔপনিবেশিক মানসিকতা। তিনি বলেন, পশ্চিমা নারীরা যখন বিকিনি পরে নিজেদের স্বাধীন মনে করেন, তখন তারা কেন এটা বুঝতে পারেন না যে একজন মুসলিম নারীও হিজাব পরে নিজেকে সমানভাবে স্বাধীন, নিরাপদ এবং ক্ষমতাবান মনে করতে পারেন? (Abu-Lughod, 2002)।
মরোক্কান নারীবাদী ফাতেমা মেরনিসি (Fatema Mernissi) ইসলামি ইতিহাসের ভেতর থেকেই নারীর অধিকারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, হিজাবের ধারণাটি যেভাবে বর্তমানে ব্যাখ্যা করা হয়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে তা সেভাবে ছিল না। তার মতে, হিজাব বা পর্দার ধারণাটি পরবর্তীতে পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দ্বারা কঠোর রূপ পেয়েছে (Mernissi, 1991)। তার মতো ইসলামিক নারীবাদীরা ধর্মগ্রন্থের নারীবাদী পুনঃব্যাখ্যার (Feminist Reinterpretation) মাধ্যমে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
সুতরাং, পোশাকের অর্থ সরল নয়। একই বোরকা কারো জন্য হতে পারে পরিবারের বা রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া নিপীড়নের চিহ্ন (যেমন, ইরানের বাধ্যতামূলক হিজাব আইন), আবার কারো জন্য হতে পারে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সচেতন রাজনৈতিক প্রতিরোধের বর্ম (যেমন, ফ্রান্সে হিজাব নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন)। প্রেক্ষাপট না বুঝে কোনো পোশাক নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করাটা কেবল ভুলই নয়, বিপজ্জনকও বটে।
ফ্যাশনের ফাঁদ – মার্ক্সবাদী নারীবাদ ও পুঁজিবাদের অদৃশ্য হাত
এতক্ষণ আমরা পিতৃতন্ত্র এবং সংস্কৃতি নিয়ে কথা বললাম। কিন্তু এই সবকিছুর পেছনে যে আরও একটি বিশালকায় শক্তি কাজ করছে, সে কথা কি আমরা ভেবেছি? সেই শক্তির নাম পুঁজিবাদ (Capitalism)। মার্ক্সবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা (Marxist and Socialist Feminists) এই দিকটির ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেন।
তাদের মতে, নারীর পোশাক নিয়ে এত আলোচনা, এত দ্রুত পরিবর্তনশীল ট্রেন্ড, এত চাপ—এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। এই ইন্ডাস্ট্রি হাজার হাজার কোটি টাকার এক বিশাল বাজার। এই বাজার টিকে থাকে কীভাবে? প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ট্রেন্ড তৈরি করে। আজ যেটা ‘ইন’, কাল সেটাই ‘আউট’। এই বছর হয়তো স্কিনি জিন্স ফ্যাশনে আছে, পরের বছরই আপনাকে বলা হবে ব্যাগি জিন্স পরতে। এই শীতে প্যাস্টেল শেড, তো পরের শীতে নিওন গ্রিন। আপনাকে ক্রমাগত বোঝানো হবে, আপনার যা আছে তা যথেষ্ট নয়। নতুন ডিজাইনের পোশাক না পরলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন, আপনি আর ‘আধুনিক’ বা ‘ফ্যাশনেবল’ থাকবেন না।
এই যে দ্রুত পরিবর্তনশীল ফ্যাশন বা ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ (Fast Fashion), এটা আমাদের মধ্যে এক ধরনের অতৃপ্তি এবং নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। আমাদের যা আছে, তা নিয়ে আমরা খুশি থাকতে পারি না। আমাদের আরও চাই, নতুন কিছু চাই। এই ভোগবাদী চক্রের প্রধান শিকার হন নারীরা, কারণ ফ্যাশন এবং বিউটি ইন্ডাস্ট্রি মূলত নারীকেই তার প্রধান ভোক্তা (Consumer) হিসেবে দেখে এবং তৈরি করে। কার্ল মার্ক্সের ‘পণ্য-ফেটিশিজম’ (Commodity Fetishism) ধারণাটি এখানে প্রাসঙ্গিক। আমরা একটি পোশাকের ব্র্যান্ড ভ্যালু বা সামাজিক মর্যাদার দিকে এতই আকৃষ্ট হই যে, সেই পোশাকটি যারা তৈরি করেছে, সেই শ্রমিকদের শ্রম ও শোষণের বাস্তবতাকে আমরা ভুলে যাই। পোশাকটি আমাদের কাছে একটি জাদুকরী বস্তু হয়ে ওঠে, তার পেছনের মানবিক গল্পটি মুছে যায়।
এই বিশাল ও ঝলমলে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির পেছনে রয়েছে এক অন্ধকার জগৎ। সেখানে আছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের শোষণ, যাদের একটি বিশাল অংশই হলো নারী ও শিশু। বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলোতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে নারীরা অত্যন্ত কম মজুরিতে, অস্বাস্থ্যকর ও বিপজ্জনক পরিবেশে দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে তৈরি করছেন পশ্চিমা বিশ্বের নামীদামী ব্র্যান্ডের পোশাক। ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে আমাদের সামনে এনে দিয়েছিল। যে পোশাকটি পরে একজন পশ্চিমা নারী নিজেকে ‘ক্ষমতায়িত’ বা ‘স্বাধীন’ ভাবছেন, সেই পোশাকের প্রতিটি সুতোয় হয়তো জড়িয়ে আছে অন্য কোনো নারীর ঘাম, কান্না এবং রক্ত।
মার্ক্সবাদী নারীবাদীরা তাই প্রশ্ন তোলেন, এই ব্যবস্থায় কি আদৌ কোনো সত্যিকারের ‘পছন্দ’ সম্ভব? যখন আমাদের পছন্দগুলো বিজ্ঞাপন, মিডিয়া এবং বিলিয়ন ডলারের কর্পোরেশনগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তখন তাকে কি স্বাধীনতা বলা যায়? তারা মনে করেন, নারীর আসল মুক্তি কেবল পিতৃতন্ত্রের অবসানেই আসবে না, এর জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন দরকার। অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের (Angela Davis) মতো তাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন কীভাবে বর্ণ, শ্রেণি এবং লিঙ্গ—এই তিনটি শোষণমূলক ব্যবস্থা একে অপরের সাথে জড়িত এবং পুঁজিবাদ কীভাবে এই সবগুলোকেই টিকিয়ে রাখে (Davis, 1981)। যে ব্যবস্থা নারীকে একই সাথে সস্তা শ্রমিকে (producer) এবং ভোক্তাতে (consumer) পরিণত করে, সেই ব্যবস্থার মধ্যে থেকে পোশাক নিয়ে সত্যিকারের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় অসম্ভব।
পৃথিবীর কান্না ও পরিবেশ-নারীবাদ
মার্ক্সবাদী নারীবাদ যেখানে পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক শোষণের কথা বলে, সেখানে পরিবেশ-নারীবাদ (Ecofeminism) একটি নতুন এবং গভীর সংযোগ স্থাপন করে। পরিবেশ-নারীবাদীরা বলেন, যে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা নারীকে নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করে, ঠিক একই মানসিকতা প্রকৃতিকেও নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ করে। দুটোই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ কেবল নারী শ্রমিকের শোষণ নয়, এটি প্রকৃতির ওপরও এক নির্মম অত্যাচার। একটি জিন্স প্যান্ট তৈরি করতে হাজার হাজার লিটার জল লাগে। কাপড়ে রঙ করার জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থগুলো নদী-নালাকে দূষিত করে। পলিয়েস্টারের মতো সিনথেটিক কাপড়, যা এখন খুব জনপ্রিয়, তা মূলত প্লাস্টিক এবং এটি প্রকৃতিতে মেশে না। প্রতিটি ওয়াশে এই কাপড় থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক নির্গত হয়ে তা আমাদের জল ও খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। এই পরিবেশ ধ্বংসের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হয় দরিদ্র দেশগুলোর নারীরা, যাদের জীবন সরাসরি প্রকৃতি—জল, জঙ্গল, জমি—এর ওপর নির্ভরশীল।
ভারতীয় পরিবেশ-নারীবাদী বন্দনা শিবা (Vandana Shiva) দেখিয়েছেন, কীভাবে আধুনিক পুঁজিবাদী কৃষি ও শিল্প প্রকৃতি এবং নারীর জ্ঞান ও ভূমিকাকে ধ্বংস করেছে (Shiva, 1989)। একইভাবে, ফাস্ট ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি টেকসই, প্রাকৃতিক এবং ঐতিহ্যবাহী বস্ত্রশিল্পকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যে তাঁতি নারীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পরিবেশবান্ধব কাপড় বুনে আসছেন, তারা আজ সস্তা শিল্পজাত পোশাকের দাপটে কোণঠাসা।
পরিবেশ-নারীবাদ আমাদের একটি ভিন্ন ধরনের প্রতিরোধের কথা বলে। সেটি হলো, ভোগ কমিয়ে আনা, টেকসই ফ্যাশন (Sustainable Fashion) গ্রহণ করা, সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাক ব্যবহার করা, এবং স্থানীয় কারিগরদের সমর্থন করা। একটি পোশাক কেনার আগে শুধু তার ডিজাইন বা দাম না দেখে, এটা ভাবা যে—এই পোশাকটি কে তৈরি করেছে? কী দিয়ে তৈরি হয়েছে? এটি পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলবে? এই প্রশ্নগুলো করা এবং সচেতনভাবে পোশাক বেছে নেওয়াই হলো এক ধরনের পরিবেশ-নারীবাদী এক্টিভিজম। এটি কেবল ব্যক্তিগত পছন্দ নয়, এটি গ্রহ এবং এর ওপর নির্ভরশীল মানুষ, বিশেষ করে নারীদের প্রতি একটি রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা।
লিঙ্গ যখন অভিনয় – কুইয়ার তত্ত্ব ও পোশাকের পারফর্মেন্স
এতক্ষণের আলোচনায় আমরা মূলত নারী-পুরুষের বাইনারি বা দ্বৈত ধারণার মধ্যেই বিচরণ করেছি। কিন্তু লিঙ্গ (Gender) কি আসলেই এত সহজ? কুইয়ার তত্ত্ব (Queer Theory) এই প্রশ্নটিকেই সামনে নিয়ে আসে এবং পোশাকের বিতর্ককে একটি সম্পূর্ণ নতুন দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
কুইয়ার তত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হলেন দার্শনিক জুডিথ বাটলার (Judith Butler)। বাটলার তার যুগান্তকারী বই ‘Gender Trouble’-এ বলেন যে, লিঙ্গ আমাদের কোনো জন্মগত বা প্রাকৃতিক সত্তা নয়। বরং, লিঙ্গ হলো এক ধরনের ‘পারফর্মেন্স’ (Performance) বা অভিনয়। আমরা জন্মের পর থেকে সমাজের কাছ থেকে শিখি কীভাবে ‘ছেলে’ বা ‘মেয়ে’র মতো আচরণ করতে হয়, কথা বলতে হয় এবং অবশ্যই, পোশাক পরতে হয়। এই আচরণগুলোর ক্রমাগত পুনরাবৃত্তির মাধ্যমেই আমাদের লিঙ্গ পরিচয় নির্মিত হয়। বাটলার একে বলেছেন ‘পারফর্মেটিভিটি’ (Performativity) (Butler, 1990)।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, পোশাক হলো লিঙ্গ অভিনয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চসজ্জা বা কস্টিউম। একটি মেয়ে যখন ফ্রক পরে, তখন সে ‘নারীত্ব’ (Femininity) অভিনয় করছে। একটি ছেলে যখন প্যান্ট-শার্ট পরে, তখন সে ‘পুরুষত্ব’ (Masculinity) অভিনয় করছে। এই অভিনয়গুলো এত স্বাভাবিকভাবে আমাদের জীবনে মিশে গেছে যে আমরা এগুলোকে ‘প্রাকৃতিক’ বলে ধরে নিই।
কুইয়ার তত্ত্ব এই স্বাভাবিকতাকে ভেঙে দিতে চায়। এটি দেখায় যে, লিঙ্গের এই বাইনারি নিয়মকানুন কতটা ঠুনকো। ড্র্যাগ কুইনরা (Drag Queens) যখন অতিরঞ্জিত নারীসুলভ পোশাক ও মেকআপ করেন, তখন তারা কেবল মজা করার জন্য তা করেন না। তারা আসলে দেখিয়ে দেন যে ‘নারীত্ব’ নিজেই একটি অভিনয়, একটি অনুকরণ যার কোনো আসল রূপ নেই। একইভাবে, যখন একজন নারী পুরুষের মতো স্যুট পরেন বা একজন পুরুষ স্কার্ট পরেন, তখন তারা প্রচলিত লিঙ্গীয় নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করেন। এই ধরনের কাজকে অনেক সময় ‘জেন্ডারফাকিং’ (Genderfucking) বলা হয়, যা সচেতনভাবে লিঙ্গীয় প্রত্যাশাকে এলোমেলো করে দিয়ে এর কৃত্রিমতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, পোশাকের স্বাধীনতা কেবল নারী-পুরুষের সমতার প্রশ্ন নয়, বরং এটি লিঙ্গীয় বাইনারিকে অতিক্রম করে যাওয়ার প্রশ্ন। পোশাক হতে পারে প্রচলিত পরিচয়কে ভাঙার এবং নতুন পরিচয় নির্মাণের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। আজকাল যে আমরা ‘অ্যান্ড্রোজিনাস ফ্যাশন’ (Androgynous Fashion) বা ‘জেন্ডার-ফ্লুইড’ (Gender-fluid) পোশাকের চল দেখছি, তার পেছনে কুইয়ার তত্ত্বের গভীর প্রভাব রয়েছে। এটি আমাদের শেখায় যে, পোশাকের কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গ থাকা উচিত নয়। যে কেউ তার ইচ্ছামতো যেকোনো পোশাক পরতে পারে, কারণ লিঙ্গ নিজেই একটি পরিবর্তনশীল এবং বহুমাত্রিক ধারণা।
সবাই কি এক? – ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম ও পরিচয়ের ভিন্নতা
আমরা আবার নীলার গল্পে ফিরে যাই। নীলা একজন মধ্যবিত্ত, বাঙালি, শহুরে, মুসলিম পরিবারের মেয়ে। কিন্তু সব মেয়ের অভিজ্ঞতা কি নীলার মতো? একজন দলিত নারীর পোশাক পরার অভিজ্ঞতা, একজন আদিবাসী নারীর অভিজ্ঞতা, একজন গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের মেয়ের অভিজ্ঞতা, বা একজন ট্রান্সজেন্ডার নারীর অভিজ্ঞতা কি একই রকম হবে?
নিশ্চয়ই না। এখানেই আসে ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম (Intersectionality) বা ছেদভিত্তিক নারীবাদের ধারণা। এই তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী আইন বিশেষজ্ঞ কিম্বার্লি ক্রেনশ (Kimberlé Crenshaw)। তিনি বলেন, নারীর অভিজ্ঞতাকে শুধু ‘নারী’ হিসেবে দেখলে চলবে না। একজন মানুষের ওপর শোষণ ও বৈষম্য কেবল একটি পরিচয়ের ভিত্তিতে আসে না। বরং, একজন মানুষের পরিচয় অনেকগুলো বিষয়ের ছেদবিন্দুতে (Intersection) তৈরি হয়—তার লিঙ্গ, বর্ণ (Race), শ্রেণি (Class), জাতি (Caste), ধর্ম, যৌনতা (Sexuality), শারীরিক সক্ষমতা (Ability), জাতীয়তা ইত্যাদি। এই সবগুলো পরিচয় একে অপরের সাথে মিলেমিশে তার অভিজ্ঞতাকে তৈরি করে (Crenshaw, 1989)।
উদাহরণস্বরূপ, একজন উচ্চবিত্ত শ্বেতাঙ্গ নারী যখন ছেঁড়া জিন্স পরেন, তখন তাকে ‘ফ্যাশনেবল’, ‘বোহেমিয়ান’ বা ‘এজি’ বলা হতে পারে। কিন্তু একজন কৃষ্ণাঙ্গ বা নিম্নবিত্ত নারী একই পোশাক পরলে তাকে ‘অমার্জিত’, ‘দরিদ্র’ বা ‘অযত্নশীল’ হিসেবে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
আমাদের দেশেও ব্যাপারটা একই রকম। ঢাকার গুলশানের একজন ধনী পরিবারের মেয়ে যে পোশাক পরে সহজে পার্টিতে বা ক্লাবে যেতে পারেন, পঞ্চগড়ের একটি গ্রামের একজন কৃষক পরিবারের মেয়ের জন্য সেই পোশাক পরাটা কেবল অকল্পনীয়ই নয়, বিপজ্জনকও হতে পারে। কারণ তাদের সামাজিক অবস্থান, শ্রেণি এবং পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পোশাকের মাধ্যমে শালীনতা-অশালীনতার বিচারও সবার জন্য সমানভাবে কাজ করে না। প্রায়শই দেখা যায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের পোশাক নিয়ে অনেক বেশি নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়। তাদের পোশাককে ‘অসভ্য’ বা ‘পিছিয়ে পড়া’ হিসেবে দেখানো হয়।
শারীরিকভাবে ভিন্ন সক্ষম (Differently-abled) নারীদের কথা ভাবুন। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বা সমাজের সৌন্দর্যের ধারণা প্রায় সবসময়ই একটি সক্ষম শরীরকে (Able-bodied) কেন্দ্র করে তৈরি হয়। তাদের জন্য আরামদায়ক এবং ফ্যাশনেবল পোশাক খুঁজে পাওয়া এক বিরাট সংগ্রামের ব্যাপার। একইভাবে, প্লাস-সাইজ (Plus-size) নারীদের জন্য পছন্দসই পোশাক পাওয়াটাও একটা যুদ্ধ। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি তাদের শরীরকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে দেখে এবং তাদের পছন্দকে সীমিত করে দেয়।
আবার, একজন ট্রান্স নারী যখন শাড়ি পরেন, তখন তাকে যে ধরনের সামাজিক হেনস্থা, টিটকিরি এবং সহিংসতার শিকার হতে হয়, তা একজন সিসজেন্ডার (Cisgender) নারীর অভিজ্ঞতার থেকে একদম আলাদা। তার পোশাক পরাটা তার অস্তিত্বের লড়াইয়ের অংশ হয়ে ওঠে।
নারীবাদী তাত্ত্বিক বেল হুকস (bell hooks) দেখিয়েছেন, মূলধারার নারীবাদী আন্দোলন প্রায়শই শ্বেতাঙ্গ, মধ্যবিত্ত নারীদের সমস্যাকেই সবার সমস্যা হিসেবে তুলে ধরেছে এবং কৃষ্ণাঙ্গ বা অন্যান্য প্রান্তিক নারীদের অভিজ্ঞতাকে উপেক্ষা করেছে (hooks, 1984)। ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম আমাদের শেখায় যে, ‘নারী’ একটি মনোলিথিক সত্তা নয়। তাদের সমস্যাগুলোও এক রকম নয়। তাই পোশাক নিয়ে কোনো সরল সমাধান বা সার্বজনীন নীতি তৈরি করা সম্ভব নয়।
আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্র – স্লাট-শেমিং, ভিক্টিম-ব্লেমিং ও ডিজিটাল দুনিয়া
বর্তমানে পোশাক নিয়ে যুদ্ধটা শুধু বাড়ির অন্দরমহলে, রাস্তায় বা কর্মক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই। এর নতুন এবং সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধক্ষেত্র হলো ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া। এখানে একজন নারীর পোশাকের ছবি পোস্ট করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শত শত, এমনকি হাজার হাজার মন্তব্য এসে জমা হয়। প্রশংসার পাশাপাশি ধেয়ে আসে ভয়ঙ্কর ব্যক্তিগত আক্রমণ, হুমকি এবং গালিগালাজ। এই আক্রমণের একটি খুব পরিচিত রূপ হলো ‘স্লাট-শেমিং’ (Slut-shaming)।
স্লাট-শেমিং মানে হলো, কোনো নারীকে তার পোশাক, আচরণ বা যৌনতার কারণে—তা সে বাস্তব হোক বা কাল্পনিক—‘চরিত্রহীন’, ‘সহজলভ্যা’ বা ‘বেশ্যা’ বলে গালি দেওয়া এবং সামাজিকভাবে তাকে হেয় করা। কোনো অভিনেত্রী একটু খোলামেলা পোশাক পরলে, বা কোনো সাধারণ মেয়ে নিজের পছন্দমতো পোশাকের ছবি দিলে, তাকে সহজেই এই আক্রমণের শিকার হতে হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো নারীকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে সে সমাজের বেঁধে দেওয়া ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ বা ‘শালীন নারী’র ছাঁচ থেকে এক চুলও বেরিয়ে না আসে।
এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ‘ভিক্টিম-ব্লেমিং’ (Victim-blaming) বা ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার সংস্কৃতি। যখন কোনো নারী যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের শিকার হন, তখন প্রায়শই সমাজের প্রথম প্রশ্ন থাকে ধর্ষককে নিয়ে নয়, বরং ভুক্তভোগীকে নিয়ে—“সে কী পরেছিল?”; “এত রাতে বাইরে কী করছিল?”। যেন তার পোশাক বা তার আচরণই ধর্ষণের জন্য উস্কানি দিয়েছে!
নারীবাদীরা এই ধারণার তীব্র বিরোধিতা করেন। সুজান ব্রাউনমিলার (Susan Brownmiller) তার ক্লাসিক বই ‘Against Our Will’-এ যেমনটা দেখিয়েছেন, ধর্ষণ যৌনতার প্রকাশ নয়, বরং এটি ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণের প্রকাশ। এটি একটি সহিংস অপরাধ যার জন্য একমাত্র ধর্ষকই দায়ী (Brownmiller, 1975)। কোনো পোশাকই ধর্ষণের আমন্ত্রণ হতে পারে না। এই ভয়ঙ্কর সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই ২০১১ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে ‘স্লাটওয়াক’ (SlutWalk) এর মতো প্রতিবাদী মিছিলের আয়োজন করা হয়েছিল।
ডিজিটাল যুগে এই লড়াই আরও কঠিন হয়েছে। কারণ এখানে পরিচয় গোপন করে (Anonymity) খুব সহজেই কাউকে আক্রমণ করা যায়। ‘রিভেঞ্জ পর্ন’ (Revenge Porn) বা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে নারীকে ব্ল্যাকমেইল করাও পোশাক এবং শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণের একটি আধুনিক রূপ। আবার সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদমও অনেক সময় নারী দেহকে সেন্সর করে। যেমন, ইনস্টাগ্রামে প্রায়শই নারী স্তনবৃন্তের ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু পুরুষের খালি গায়ের ছবিতে কোনো বাধা নেই। এটিও এক ধরনের ডিজিটাল দ্বৈত নীতি।
কিন্তু একই সাথে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো নারীদের প্রতিবাদের নতুন সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে। #MeToo আন্দোলনের মতো আন্দোলনগুলো দেখিয়েছে যে, নারীরা এখন আর চুপ করে থাকতে রাজি নন। পোশাকের স্বাধীনতার লড়াই এখন ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজমেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
শরীর যখন রাজনীতি – বডি পজিটিভিটি ও তার সীমাবদ্ধতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘বডি পজিটিভিটি’ (Body Positivity) আন্দোলন বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এই আন্দোলনের মূল কথা হলো, সব ধরনের শরীরই সুন্দর—তা সে মোটা হোক বা চিকন, লম্বা হোক বা খাটো, ফর্সা হোক বা কালো। এটি নওমি উলফের ‘বিউটি মিথ’-এর সরাসরি বিরোধী একটি অবস্থান। এই আন্দোলন নারীদের শেখায় তাদের শরীরকে যেমন আছে, সেভাবেই ভালোবাসতে এবং সমাজের চাপিয়ে দেওয়া সৌন্দর্যের মাপকাঠিকে প্রত্যাখ্যান করতে। পোশাকের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব দেখা যায়। প্লাস-সাইজ মডেলরা র্যাম্পে হাঁটছেন, বিভিন্ন ব্র্যান্ড সব সাইজের পোশাক তৈরি করছে।
নিঃসন্দেহে এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এটি অনেক নারীর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এর কিছু সমালোচনাও রয়েছে। প্রথমত, অনেক সমালোচক মনে করেন, বডি পজিটিভিটি আন্দোলনকেও পুঁজিবাদ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে। এখন ‘বডি পজিটিভ’ ট্যাগলাইন ব্যবহার করে নতুন নতুন পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। যে ব্র্যান্ডগুলো আগে কেবল স্লিম মডেল ব্যবহার করত, তারাই এখন প্লাস-সাইজ মডেল ব্যবহার করে নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ হিসেবে দেখাচ্ছে, কিন্তু তাদের ব্যবসার মূল কাঠামো হয়তো একই রয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলন অনেক সময় ‘সৌন্দর্য’-এর ধারণা থেকে বের হতে পারে না। ‘সব শরীরই সুন্দর’—এই কথাটিও দিনশেষে শরীরের সৌন্দর্যের ওপরই জোর দেয়। র্যাডিকাল নারীবাদীরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেন আমাদের সবসময় সুন্দর হওয়ার কথাই ভাবতে হবে? একজন নারীর মূল্য কি তার সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরশীল? এর বদলে ‘বডি নিউট্রালিটি’ (Body Neutrality) বা ‘শরীর নিরপেক্ষতা’র একটি ধারণা সামনে আসছে। এর মূল কথা হলো, আমার শরীরকে সবসময় ভালোবাসতে বা সুন্দর ভাবতে হবে না। আমার শরীর কেবলই একটি শরীর, যা আমার জন্য নানা কাজ করে। এর প্রধান কাজ সুন্দর দেখানো নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি শরীরকে সৌন্দর্যের বেদী থেকে নামিয়ে এনে তাকে তার কাজের জন্য সম্মান করতে শেখায়। পোশাক তখন কেবল নিজেকে সুন্দর দেখানোর উপায় থাকে না, বরং তা হয় আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য এবং আত্মপ্রকাশের একটি মাধ্যম।
শেষ কথা: কোনো উপসংহার নেই
এত দীর্ঘ এবং জটিল আলোচনার পর আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম? পোশাক নিয়ে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কি কোনো নির্দিষ্ট, পরিষ্কার সমাধান আছে?
উত্তর হলো—না, নেই। আর এটাই হয়তো এই আলোচনার সবচেয়ে সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ দিক। নারীবাদ কোনো একক, অটল মতবাদ নয়, এটি একটি চলমান, জীবন্ত বিতর্ক। এখানে উদারপন্থীরা যেমন ব্যক্তির পছন্দকে চূড়ান্ত বলে মনে করেন, তেমনি র্যাডিকালরা সেই পছন্দের পেছনের অদৃশ্য রাজনৈতিক শেকলকে উন্মোচন করেন। মনস্তাত্ত্বিক নারীবাদ অবচেতনের খেলার কথা বলে, আর উত্তর-ঔপনিবেশিক নারীবাদীরা আমাদের শেখান অন্যের সংস্কৃতিকে বিচার না করে বুঝতে চেষ্টা করতে। মার্ক্সবাদীরা দেখান কীভাবে পুঁজিবাদের মুনাফার লোভ আমাদের পছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর পরিবেশ-নারীবাদীরা পৃথিবীর কান্না শুনতে শেখান। কুইয়ার তত্ত্ব লিঙ্গের বাইনারি ভেঙে দেয় আর ইন্টারসেকশনালিটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সব নারীর অভিজ্ঞতা এক নয়।
ব্যাপারটা অনেকটা মেঘলা বিকেলের আকাশের মতো। কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই, কোনো স্থির রঙ নেই, প্রতিনিয়ত রূপ পাল্টাচ্ছে, মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে।
আমরা আবার নীলার গল্পে ফেরা যাক। হয়তো সে তার মায়ের সাথে ঝগড়া করে, মন খারাপ করে জিন্স পরেই বেরিয়ে যাবে। হয়তো মায়ের মন রাখতে সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও পোশাকটা পাল্টে একটা সালোয়ার-কামিজ পরবে। অথবা হয়তো সে তার মায়ের পাশে বসবে, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে কেন এই পোশাকটা তার ভালো লাগে। হয়তো তার মা-ও মেয়ের কথা শুনবেন, নিজের ভয় আর উদ্বেগের কথা বলবেন। হয়তো তাদের মধ্যে কোনো সমাধান হবে না, কিন্তু একটা আলোচনার শুরু হবে।
সব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই কোন না কোন নারীবাদী দিক থেকেই দ্বিমত আসতে পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নীলা এবং তার মা, এবং আমরা সবাই, যেন বুঝতে পারি যে পোশাকের এই আপাতসরল বিতর্কটি কত গভীর। এর পেছনে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ক্ষমতা, অর্থনীতি, ধর্ম এবং হাজারো নারীর আনন্দ, বেদনা ও সংগ্রামের গল্প।
চূড়ান্ত উত্তর যাই হোক না কেন, প্রশ্নগুলো করতে শেখাটাই আসল। কেন একটি পোশাক ‘শালীন’ আর অন্যটি ‘অশালীন’? কে তৈরি করে এই নিয়ম? এই নিয়ম কার স্বার্থ রক্ষা করে? আমার পছন্দ কি আসলেই আমার, নাকি সমাজ, মিডিয়া আর বাজার আমার হয়ে পছন্দ করে দিচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো যখন আমরা নিজেদের এবং সমাজকে করতে শুরু করব, তখনই হয়তো সত্যিকারের আত্ম-সচেতনতা এবং মুক্তির দিকে এক পা এগোনো যাবে।
তথ্যসূত্র
- Abu-Lughod, L. (2002). Do Muslim Women Really Need Saving? Anthropological Reflections on Cultural Relativism and Its Others. American Anthropologist, 104(3), 783–790.
- Bartky, S. L. (1988). Foucault, Femininity, and the Modernization of Patriarchal Power. In I. Diamond & L. Quinby (Eds.), Feminism & Foucault: Reflections on Resistance (pp. 61-86). Northeastern University Press.
- Brownmiller, S. (1975). Against Our Will: Men, Women and Rape. Simon & Schuster.
- Butler, J. (1990). Gender Trouble: Feminism and the Subversion of Identity. Routledge.
- Crenshaw, K. (1989). Demarginalizing the Intersection of Race and Sex: A Black Feminist Critique of Antidiscrimination Doctrine, Feminist Theory and Antiracist Politics. University of Chicago Legal Forum, 1989(1), Article 8.
- Davis, A. Y. (1981). Women, Race, & Class. Random House.
- Friedan, B. (1963). The Feminine Mystique. W. W. Norton & Company.
- hooks, b. (1984). Feminist Theory: From Margin to Center. South End Press.
- Mahmood, S. (2005). Politics of Piety: The Islamic Revival and the Feminist Subject. Princeton University Press.
- Mernissi, F. (1991). The Veil and the Male Elite: A Feminist Interpretation of Women’s Rights in Islam. Perseus Books.
- Mulvey, L. (1975). Visual Pleasure and Narrative Cinema. Screen, 16(3), 6–18.
- Shiva, V. (1989). Staying Alive: Women, Ecology and Development. Zed Books.
- Spivak, G. C. (1988). Can the Subaltern Speak? In C. Nelson & L. Grossberg (Eds.), Marxism and the Interpretation of Culture (pp. 271-313). University of Illinois Press.
- Wolf, N. (1991). The Beauty Myth: How Images of Beauty Are Used Against Women. William Morrow and Company.
- Wollstonecraft, M. (1792). A Vindication of the Rights of Woman. J. Johnson.
Leave a Reply