Table of Contents
ভূমিকা
ইতিহাস বড় অদ্ভুত এক জিনিস। মাঝে মাঝে এর গতিপথ এতটাই নাটকীয় হয়ে ওঠে যে বড় বড় সাহিত্যিকদের লেখা গল্পও এর কাছে হার মানে। আজ আমরা ইতিহাসের সেরকমই এক বাঁকের গল্প বলবো। একদিকে বিশাল, পরাক্রমশালী পারস্য সাম্রাজ্য (Persian Empire), যার প্রতাপে কাঁপে অর্ধেক পৃথিবী। অন্যদিকে ছোট ছোট, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ক্লান্ত, খণ্ড-বিখণ্ড কিছু নগর-রাষ্ট্র (City-states) – যাদের আমরা চিনি গ্রিক নামে। এই দুই শক্তির মধ্যে যে সংঘাত বেধেছিল, পৃথিবীর ইতিহাস তাকে চেনে গ্রেকো-পার্সিয়ান যুদ্ধ (Greco-Persian Wars) নামে।
এটা শুধু দুটো সাম্রাজ্যের যুদ্ধ ছিল না। ছিল দুটো ভিন্ন সংস্কৃতির লড়াই, দুটো ভিন্ন চিন্তাধারার সংঘাত। একদিকে ছিল সম্রাটের একক শাসন, অন্যদিকে গণতন্ত্রের কচি চারাগাছ। একদিকে প্রাচ্যের বিশালতা, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের নতুন আত্মবিশ্বাস। একদিকে নিয়মতান্ত্রিক আনুগত্য, অন্যদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান। চলুন, গল্পের গভীরে প্রবেশ করা যাক, যেখানে বীরত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, ধূর্ততা আর ভাগ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
গল্পের শুরুটা যেখানে: দুই পৃথিবীর পরিচয়
যেকোনো বড় ঝড়ের আগে আকাশ যেমন শান্ত থাকে, তেমনি এই মহাযুদ্ধের আগেও পৃথিবীটা বেশ শান্তই ছিল। তবে সেই শান্ত বাতাসের নিচে দুটো ভিন্ন ধরনের সভ্যতা নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠছিল, যাদের মধ্যেকার পার্থক্যই ছিল ভবিষ্যৎ সংঘাতের মূল কারণ।
পারস্যের জগত: রাজাধিরাজের সাম্রাজ্য
পারস্যের হাখামানেশি সাম্রাজ্য (Achaemenid Empire) তখন তার স্বর্ণযুগে। মহান সাইরাস (Cyrus the Great) যে সাম্রাজ্যের পত্তন করেছিলেন, তা ছিল সহনশীলতা আর বহু-সাংস্কৃতিক ঐক্যের এক অভূতপূর্ব উদাহরণ। সাইরাস বিজিত অঞ্চলের মানুষের ধর্ম বা সংস্কৃতির উপর হস্তক্ষেপ করতেন না। তার দেখানো পথেই পরবর্তীতে সম্রাট দারায়ুস দ্য গ্রেট বা প্রথম দারায়ুস (Darius the Great) এই সাম্রাজ্যকে এক অবিশ্বাস্য উচ্চতায় নিয়ে যান। পশ্চিমে ঈজিয়ান সাগর থেকে পূর্বে সিন্ধু নদ, উত্তরে ককেশাস পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে মিশর আর লিবিয়া—সবই ছিল তার পদানত।
এই বিশাল সাম্রাজ্যকে শাসন করার জন্য দারায়ুস এক অসাধারণ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি পুরো সাম্রাজ্যকে অনেকগুলো প্রদেশে বা ‘সত্রপি’-তে (Satrapies) ভাগ করেন। প্রতিটি সত্রপির দায়িত্বে থাকতেন একজন করে শাসক বা ‘সত্রপ’ (Satrap), যিনি সরাসরি সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন। রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দ্রুত সংবাদ ও সৈন্য পাঠানোর জন্য তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত ‘রাজকীয় সড়ক’ বা রয়্যাল রোড (Royal Road), যা সার্ডিস থেকে রাজধানী সুসা পর্যন্ত প্রায় ২৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল। এই সড়কের ধারে ধারে ছিল ঘোড়া বদলের ব্যবস্থা, যাতে রাজকীয় দূতরা অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে যাতায়াত করতে পারত।
পারস্যের রাজা ছিলেন ‘রাজাদের রাজা’ বা শাহানশাহ (Shahanshah)। তার ক্ষমতা ছিল প্রায় ঐশ্বরিক। তার কথাই ছিল আইন। তবে এই একক শাসনের মধ্যেও এক ধরনের শৃঙ্খলা আর স্থিতিশীলতা ছিল, যা বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতির মানুষকে এক ছাতার নিচে ধরে রেখেছিল। পারস্যের সেনাবাহিনী ছিল তার শক্তির প্রধান উৎস—বিভিন্ন জাতির সৈন্যে গড়া এক বিশাল বাহিনী, যার কেন্দ্রে ছিল কিংবদন্তিতুল্য ১০,০০০ সৈন্যের ‘অমর বাহিনী’ বা ইমমর্টালস (Immortals)। তাদের সংখ্যা কখনোই কমত না, কারণ একজন মারা গেলে বা আহত হলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন তার জায়গা নিত।
গ্রিকদের জগত: স্বাধীনতার কলরব
অন্যদিকে গ্রিকরা তখন অনেকগুলো ছোট ছোট নগর-রাষ্ট্রে বিভক্ত। যেমন এথেন্স, স্পার্টা, করিন্থ, থিবস। ভৌগোলিক কারণেই গ্রিস দেশটা পাহাড় আর সমুদ্রে ঘেরা, যা নগর-রাষ্ট্রগুলোকে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এই বিচ্ছিন্নতাই তাদের মধ্যে এক ধরনের স্বতন্ত্র পরিচয়ের জন্ম দেয়, যাকে তারা বলত ‘পলিস’ (Polis)। প্রতিটি পলিস ছিল স্বাধীন এবং সার্বভৌম। তাদের নিজেদের আইন, নিজেদের সরকার, এমনকি নিজেদের সেনাবাহিনীও ছিল।
এই নগর-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সারাক্ষাক্ষণ লেগে থাকত ঝগড়াঝাঁটি, রেষারেষি, এমনকি যুদ্ধও। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এত বিভেদ সত্ত্বেও তাদের মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐক্য ছিল। তারা সবাই একই ভাষায় কথা বলত, একই দেবতাদের পূজা করত, আর অলিম্পিক গেমসের মতো অনুষ্ঠানে একত্রিত হতো। নিজেদের তারা ‘হেলেন’ (Hellene) বলে পরিচয় দিত এবং বাকি বিশ্বকে বর্বর বা ‘বারবারিয়ান’ (Barbarian) বলে মনে করত, কারণ বিদেশিদের ভাষা তাদের কাছে ‘বার-বার’ শব্দের মতো অর্থহীন মনে হতো।
এই গ্রিক বিশ্বের দুটো প্রধান শক্তি ছিল এথেন্স আর স্পার্টা। স্পার্টা ছিল এক সামরিক রাষ্ট্র। স্পার্টান পুরুষদের জন্মই হতো যোদ্ধা হওয়ার জন্য। শৈশব থেকে কঠিন প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে তাদের এমনভাবে তৈরি করা হতো যে, মৃত্যুভয় তাদের স্পর্শ করতে পারত না। তাদের শাসন করত দুটো রাজা আর অভিজাতদের এক পরিষদ—এক ধরনের অলিগার্কি (Oligarchy)।
এর ঠিক বিপরীত ছিল এথেন্স। এথেন্স ছিল বাণিজ্য, শিল্পকলা আর নতুন চিন্তার কেন্দ্র। এখানেই প্রথমবারের মতো ‘গণতন্ত্র’ বা ডেমোক্রেসির (Democracy) ধারণা শিকড় গাড়ে। অবশ্য সেই গণতন্ত্র আজকের মতো ছিল না; নারী, দাস বা বিদেশিদের সেখানে কোনো ভোটাধিকার ছিল না। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নাগরিকরা সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতে পারত, যা ছিল তৎকালীন বিশ্বের জন্য এক বৈপ্লবিক ধারণা।
গণ্ডগোলের শুরুটা হলো আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনর (Asia Minor) উপকূলের আইওনিয়ান (Ionian) গ্রিক শহরগুলোকে নিয়ে। এই শহরগুলো সংস্কৃতিতে গ্রিক হলেও ভৌগোলিকভাবে পারস্য সাম্রাজ্যের দোরগোড়ায় অবস্থিত ছিল। একসময় স্বাধীন থাকলেও পারস্য সাম্রাজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে তারা পারস্যের অধীনে চলে যায়। পারস্য শাসকরা তাদের উপর একজন করে স্বৈরশাসক বা ‘টাইর্যান্ট’ (Tyrant) বসিয়ে দিয়েছিলেন। আইওনিয়ান গ্রিকদের রক্তে ছিল স্বাধীনতার নেশা। পারস্যের বিশাল সাম্রাজ্যের অধীনে সম্রাটের প্রজা হয়ে থাকতে তাদের মন চাইছিল না। তাদের মনে হচ্ছিল, তারা যেন খাঁচায় বন্দী। এই অসন্তোষের আগুনই একদিন দাবানল হয়ে জ্বলে উঠবে।
আইওনিয়ান বিদ্রোহ: ছোট্ট এক স্ফুলিঙ্গ (৪৯৯-৪৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯ অব্দ। মিলেটাস (Miletus) নামের এক সমৃদ্ধ আইওনিয়ান শহরের উচ্চাভিলাষী স্বৈরশাসক ছিলেন অ্যারিস্টাগোরাস (Aristagoras)। তিনি পারস্যের স্থানীয় সত্রপ আর্টাফার্নেসকে (Artaphernes) বোঝালেন যে কাছের ‘নাক্সোস’ (Naxos) দ্বীপ দখল করতে পারলে পারস্যের লাভ হবে এবং তার নিজের ক্ষমতাও বাড়বে। কিন্তু পারস্পরিক অবিশ্বাস আর দুর্বল পরিকল্পনার কারণে সেই অভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলো। অ্যারিস্টাগোরাস বুঝলেন, ব্যর্থতার দায়ভার তার উপরেই পড়বে এবং পারস্য সম্রাট দারায়ুস তাকে কঠোর শাস্তি দেবেন।
নিজের চামড়া বাঁচাতে তিনি এক ভয়ানক বুদ্ধি আঁটলেন। তিনি স্বৈরশাসকের পোশাক ছুড়ে ফেলে দিয়ে মিলেটাসের জনগণকে পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য উসকে দিলেন এবং গণতন্ত্রের ঘোষণা দিলেন (Holland, 2005)। স্বাধীনতার এই ডাক আইওনিয়ার অন্য গ্রিক শহরগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। তারাও তাদের পারস্য-সমর্থিত শাসকদের তাড়িয়ে দিয়ে বিদ্রোহে যোগ দিল।
কিন্তু অ্যারিস্টাগোরাস জানতেন, শুধু আইওনিয়ানদের শক্তিতে পারস্যের মতো অসীম শক্তিধর সাম্রাজ্যকে হারানো যাবে না। তার মূল ভূখণ্ডের গ্রিক ভাইদের সাহায্য দরকার। তিনি সাহায্যের আশায় জাহাজ ভাসালেন।
প্রথমে গেলেন স্পার্টায়। স্পার্টানরা ছিল গ্রিসের সেরা যোদ্ধা। তাদের সাহায্য ছাড়া এই বিদ্রোহ সফল হওয়া কঠিন। তিনি স্পার্টার রাজা ক্লিওমেনেসের (Cleomenes) সামনে ব্রোঞ্জের এক মানচিত্র মেলে ধরে পারস্য সাম্রাজ্যের বিশালতা আর দুর্বলতার এক আকর্ষণীয় বর্ণনা দিলেন। বললেন, “দেখুন, পারস্য জয় করা কত সোজা! তাদের সৈন্যরা পরে ট্রাউজার, মাথায় দেয় নরম টুপি। তাদের বর্ম নেই, তারা তির-ধনুক নিয়ে লড়ে। আপনাদের মতো হোপলাইটদের (Hoplite) সামনে তারা দাঁড়াতেই পারবে না! আর তাদের রাজধানী সুসায় (Susa) আছে অগণিত সম্পদ।”
ক্লিওমেনেস তার কথায় প্রভাবিত হচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি একটিমাত্র প্রশ্ন করলেন, “পারস্যের রাজধানী সুসা এখান থেকে কতদূর?”
অ্যারিস্টাগোরাস সরল মনে জবাব দিলেন, “হে রাজা, তিন মাসের হাঁটা পথ।”
এই কথা শোনার সাথে সাথে ক্লিওমেনেসের মুখের ভাব বদলে গেল। তিনি অ্যারিস্টাগোরাসকে সূর্যাস্তের আগেই স্পার্টা ছেড়ে চলে যেতে বললেন। স্পার্টানরা তাদের নিজের ভূমি ছেড়ে এতদূরে, অজানা এক দেশে, তিন মাসের পথের দূরত্বে যুদ্ধ করতে যেতে একেবারেই রাজি ছিল না।
হতাশ অ্যারিস্টাগোরাস এরপর গেলেন এথেন্সে। এথেন্সের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। কিছুদিন আগেই তারা ক্লেইসথেনিসের (Cleisthenes) নেতৃত্বে স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেয়ে গণতন্ত্রের নতুন স্বাদ পেয়েছে। তাদের ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক হিপ্পিয়াস (Hippias) পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পারস্যের সত্রপের কাছে এবং এথেন্সে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করছিলেন। তাই পারস্যকে এথেনিয়ানরা নিজেদের শত্রু হিসেবেই দেখত। তাছাড়া, আইওনিয়ানদের তারা নিজেদেরই এক শাখা বলে মনে করত।
এথেন্সের অ্যাসেম্বলিতে (Assembly) অ্যারিস্টাগোরাসের জ্বালাময়ী বক্তৃতা কাজ দিল। এথেন্স রাজি হলো। তারা ২০টি যুদ্ধজাহাজ পাঠালো, সাথে তাদের মিত্র এরিট্রিয়া (Eretria) শহর পাঠালো আরও ৫টি। এই ২৫টি জাহাজই ছিল বিদ্রোহের একমাত্র বৈদেশিক সাহায্য। হেরাডোটাস পরে লিখেছিলেন, “এই জাহাজগুলোই ছিল গ্রিক আর বর্বরদের মধ্যেকার সকল অঘটনের সূচনা” (Herodotus, trans. 2003)।
এই ছোট্ট সাহায্য পেয়ে আইওনিয়ানরা সাহসে ভর করে পারস্যের আঞ্চলিক রাজধানী সার্ডিস (Sardis) আক্রমণ করে বসল। তারা শহরের নিম্নভাগ দখল করে আগুন লাগিয়ে দিল। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল স্থানীয় দেবী সিবেলের (Cybele) প্রাচীন মন্দিরও। এই ঘটনা পারস্য সম্রাট দারায়ুসের কানে পৌঁছালে তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। মন্দির পোড়ানোর ঘটনাকে তিনি এক বিরাট ধর্মীয় অপমান হিসেবে দেখলেন। কথিত আছে, তিনি এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে, তিনি আকাশে তির ছুড়ে ঈশ্বরের কাছে এথেনিয়ানদের ধ্বংস করার শক্তি চেয়েছিলেন। এরপর তিনি তার এক ভৃত্যকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রতিদিন খাওয়ার আগে তাকে তিনবার মনে করিয়ে দিতে, “প্রভু, এথেনিয়ানদের কথা ভুলবেন না।”
আইওনিয়ান বিদ্রোহ অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। পারস্য তাদের বিশাল শক্তি নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ অব্দে লাডের যুদ্ধে (Battle of Lade) পারস্যের নৌবহর বিদ্রোহীদের সম্মিলিত নৌবহরকে শোচনীয়ভাবে হারিয়ে দেয়। এরপর তারা মিলেটাস শহর অবরোধ করে এবং দখলের পর পুরুষদের হত্যা করে, আর নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে পারস্যে পাঠিয়ে দেয়। মিলেটাসের পতন দেখে গ্রিসের অন্য শহরগুলোয় শোকের ছায়া নেমে আসে। কিন্তু গল্পের এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। দারায়ুসের মাথায় তখন প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। বিশেষ করে এথেন্স আর এরিট্রিয়ার উপর, যারা বিদ্রোহীদের সাহায্য করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিল।
প্রথম পারস্য আক্রমণ: ম্যারাথনের মহাকাব্য (৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
দারায়ুস প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর হলেন। তার লক্ষ্য ছিল দুটো—এক, এথেন্স আর এরিট্রিয়াকে শাস্তি দেওয়া এবং দুই, গ্রিসের বাকি নগর-রাষ্ট্রগুলোকে পারস্যের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৯২ অব্দে তিনি তার জামাতা মার্ডোনিয়াসের (Mardonius) নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী ও নৌবহর পাঠালেন। এই বাহিনী উত্তর দিক দিয়ে থ্রেস (Thrace) আর ম্যাসিডোনিয়া (Macedonia) দখল করতে করতে এগোচ্ছিল। কিন্তু এই অভিযান শুরুতেই এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়ল। মাউন্ট অ্যাথোসের (Mount Athos) কাছে এক ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক ঝড়ে পারস্যের নৌবহরের প্রায় তিনশ’ জাহাজ আর বিশ হাজার সৈন্য সলিলসমাধি লাভ করে। মার্ডোনিয়াস নিজেও আহত হন। ভগ্ন হৃদয়ে তিনি পারস্যে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
কিন্তু দারায়ুস হাল ছাড়ার পাত্র নন। তিনি জানতেন, সরাসরি আক্রমণে ঝুঁকি আছে। তাই তিনি প্রথমে কূটনৈতিক চাল চাললেন। তিনি গ্রিসের সব নগর-রাষ্ট্রে দূত পাঠালেন। দূতরা গিয়ে রাজার নামে ‘মাটি ও জল’ (Earth and Water) দাবি করল, যা ছিল পারস্যের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের প্রতীক। অনেক দ্বীপ আর উত্তরের শহর ভয়ে এই দাবি মেনে নিল। কিন্তু এথেন্স আর স্পার্টা দেখাল চরম ধৃষ্টতা। এথেনিয়ানরা পারস্যের দূতদের এক গর্তে ফেলে দিয়ে বলল, “এখান থেকেই তোমাদের মাটি আর জল নিয়ে নাও।” স্পার্টানরা আরও এক কাঠি সরেস। তারা দূতদের এক কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়ে বলল, “ওখানেই তোমরা রাজার জন্য মাটি আর জল খুঁজে পাবে।” এই অপমানজনক প্রত্যাখ্যানের পর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল।
দুই বছর পর, খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ অব্দে, দারায়ুস নতুন করে এক অভিযান পাঠালেন। এবার নেতৃত্বে ছিলেন অভিজ্ঞ সেনাপতি ডেটিস (Datis) এবং সম্রাটের ভাইপো আর্টাফার্নেস (Artaphernes)। এবার তারা উত্তরের ঝুঁকিপূর্ণ পথ এড়িয়ে ঈজিয়ান সাগরের (Aegean Sea) ভেতর দিয়ে দ্বীপগুলো দখল করতে করতে এগোতে লাগল। তাদের রণতরীগুলো ছিল মূলত পরিবহন জাহাজ, যা প্রায় ২৫,০০০ পদাতিক সৈন্য এবং কিছু অশ্বারোহী বাহিনী বহন করছিল।
তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল এরিট্রিয়া। ছয় দিন অবরোধের পর শহরের দুজন অভিজাত নাগরিক বিশ্বাসঘাতকতা করে দরজা খুলে দিলে পারস্যের সেনারা শহরে ঢুকে পড়ে। তারা শহরটি ধ্বংস করে, মন্দিরগুলো জ্বালিয়ে দেয় এবং অধিবাসীদের দাস বানিয়ে পারস্যে পাঠিয়ে দেয়। আইওনিয়ানদের সাহায্য করার প্রথম শাস্তি দেওয়া হলো। এবার পালা এথেন্সের।
পারস্য বাহিনী এথেন্স আক্রমণের জন্য ম্যারাথন (Marathon) নামক এক সমতল ভূমিতে এসে নামল। এই জায়গাটা বেছে নেওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল। এটি ছিল সমতল, যা পারস্যের অশ্বারোহী বাহিনীর জন্য সুবিধাজনক। তাছাড়া, ক্ষমতাচ্যুত এথেনিয়ান স্বৈরশাসক হিপ্পিয়াসও তাদের সাথে ছিলেন। ম্যারাথন ছিল তার পুরনো এলাকা এবং তিনি আশা করছিলেন যে, তার সমর্থকরা পারস্য বাহিনীকে দেখলে এথেন্সের ভেতরেই বিদ্রোহ করে বসবে।
এথেন্সে তখন চরম উত্তেজনা। পারস্যের বিশাল সেনাবাহিনী শহরের দোরগোড়ায়। এখন কী হবে? এথেনিয়ানরা কি শহরের দুর্গের ভেতরে থেকে অবরোধের মুখে পড়বে, নাকি খোলা ময়দানে গিয়ে লড়বে?
এথেন্সের দশজন সেনাপতির (Strategoi) মধ্যে তখন তুমুল বিতর্ক। তাদের মধ্যে মিল্টিয়াডিস (Miltiades) নামের একজন ছিলেন, যিনি একসময় পারস্যের অধীনে শাসন করেছিলেন এবং তাদের যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে ভালোই জানতেন। তিনি যুক্তি দিলেন, খোলা ময়দানেই লড়তে হবে। শহরের ভেতরে বসে থাকলে হিপ্পিয়াসের সমর্থকরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, আর তাতে মনোবল ভেঙে যাবে। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় পোলিমার্ক (Polemarch) বা যুদ্ধমন্ত্রী ক্যালিমাকাসসহ (Callimachus) বাকিরা রাজি হলেন।
এথেনিয়ানরা স্পার্টার কাছে সাহায্যের জন্য তাদের সেরা দৌড়বিদ ফেইডিপ্পিডিসকে (Pheidippides) পাঠিয়েছিল। তিনি প্রায় ২৪০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ মাত্র দুই দিনে পাড়ি দিয়ে স্পার্টায় পৌঁছান। কিন্তু স্পার্টানরা এক ধর্মীয় উৎসব, কার্নিয়ার (Carneia) দোহাই দিয়ে বলে যে, পূর্ণিমার আগে তারা যুদ্ধে যেতে পারবে না। তাদের আসতে আরও প্রায় দশ দিন দেরি হবে। এথেন্সকে লড়তে হবে একাই। সাথে ছিল শুধু তাদের বিশ্বস্ত মিত্র প্লাটিয়া (Plataea) শহরের এক হাজার সৈন্য।
ম্যারাথনের মাঠে প্রায় ১০ হাজার গ্রিক সৈন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের প্রধান শক্তি ছিল তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পদাতিক সৈন্য, হোপলাইট। তারা ফ্যালাংক্স (Phalanx) নামক এক বিশেষ ব্যূহে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করত। এটা ছিল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঢাল দিয়ে তৈরি এক মানব-দেয়াল, যার ভেতর থেকে লম্বা বর্শা বেরিয়ে থাকত—এক চলমান বর্ম।
অন্যদিকে, পারস্যের সৈন্য ছিল প্রায় ২৫ হাজার বা তারও বেশি। তাদের শক্তি ছিল তিরন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনী। কিন্তু তাদের পদাতিক সৈন্যরা ছিল হালকা বর্ম পরা, যা হোপলাইটদের লম্বা বর্শার সামনে তেমন কিছুই না।
কয়েকদিন দুই বাহিনী একে অপরকে পর্যবেক্ষণ করার পর মিল্টিয়াডিস সুযোগ নিলেন। তিনি জানতে পারেন যে পারস্যের অশ্বারোহী বাহিনী কোনো কারণে তাদের মূল শিবির থেকে দূরে আছে (সম্ভবত জাহাজে তোলা হচ্ছিল এথেন্সের অন্যদিকে আক্রমণের জন্য)। এটাই ছিল সুযোগ। তিনি এক দারুণ রণকৌশল আঁটলেন। তিনি তার সেনাবাহিনীর কেন্দ্রভাগকে পাতলা করে দুই পাশ বা ‘উইং’ (Wing) শক্তিশালী করলেন, যাতে পারস্যের বিশাল বাহিনীকে দৈর্ঘ্যে মেলানো যায় এবং তাদের ঘিরে ফেলার সুযোগ থাকে।
যুদ্ধ শুরু হলে গ্রিক হোপলাইটরা প্রায় দেড় কিলোমিটার দৌড়ে পারস্যের তিরন্দাজদের দিকে এগিয়ে গেল। এই দৌড় বা ‘চার্জ’ ছিল দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ—এক, এটি পারস্যের তির থেকে তাদের বাঁচিয়েছিল, এবং দুই, পারস্যের সেনারা ভাবতেও পারেনি যে এত কমসংখ্যক সৈন্য তাদের দিকে এভাবে ছুটে আসবে।
যুদ্ধের শুরুতে যা হওয়ার তাই হলো। পারস্যের শক্তিশালী কেন্দ্রভাগ এথেনিয়ানদের দুর্বল কেন্দ্রকে পেছনে হটিয়ে দিল। কিন্তু ঠিক তখনই ঘটল আসল ঘটনা। এথেনিয়ানদের শক্তিশালী দুই পাশের সৈন্যদল পারস্যের দুই পাশের দুর্বল বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে কেন্দ্রের দিকে ঘুরে গেল এবং দুই দিক থেকে পারস্যের মূল বাহিনীকে সাঁড়াশি আক্রমণ (double envelopment) করল। পারস্যের সেনারা এই কৌশলের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। তারা দিশেহারা হয়ে পড়ল। শৃঙ্খলা ভেঙে গেল এবং তারা যেদিক পারল, পালাতে শুরু করল। অনেকে নিজেদের জাহাজের দিকে ছুটল, অনেকে ডুবে মরল পাশের জলাভূমিতে।
যুদ্ধ শেষে দেখা গেল, মাঠে ৬,৪০০ জন পারস্য সৈন্যের লাশ পড়ে আছে। অন্যদিকে এথেনিয়ানদের মারা গেছে মাত্র ১৯২ জন, যার মধ্যে যুদ্ধমন্ত্রী ক্যালিমাকাসও ছিলেন (Herodotus, trans. 2003)। এটি ছিল এক অভাবনীয় বিজয়।
জনশ্রুতি আছে, ফেইডিপ্পিডিস নামের সেই দৌড়বিদই নাকি যুদ্ধ জয়ের সংবাদ নিয়ে ম্যারাথন থেকে এথেন্স পর্যন্ত প্রায় ৪২ কিলোমিটার পথ দৌড়ে গিয়েছিলেন। এথেন্সে পৌঁছে তিনি শুধু বলতে পেরেছিলেন, “নেনিকিকামেন!” (Nenikēkamen!) অর্থাৎ, “আমরা জয়ী হয়েছি!” এই কথা বলেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এই ঘটনাকে স্মরণ করেই আজকের ম্যারাথন দৌড়ের প্রচলন। যদিও ঐতিহাসিকেরা এই গল্প নিয়ে সন্দিহান এবং মনে করেন এটি দুটি ভিন্ন কাহিনির মিশ্রণ।
ম্যারাথনের যুদ্ধ ছিল এক মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। প্রথমবারের মতো গ্রিকরা প্রমাণ করল যে পারস্যের বিশাল সেনাবাহিনীকে খোলা ময়দানেও হারানো সম্ভব। এই জয় এথেন্সকে এক নতুন আত্মবিশ্বাস এনে দিল। গ্রিসের অন্যরাও বুঝতে পারল, ঐক্যবদ্ধ থাকলে পারস্য অপরাজেয় নয়। কিন্তু তারা জানত, পারস্যের রাজা এই অপমান ভুলবেন না। আরও বড় ঝড় আসছে।
দশ বছরের বিরতি: ঝড়ের আগের শান্তি (৪৯০-৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
ম্যারাথনের পরাজয়ের পর দারায়ুস ক্রোধে আরও বড় এক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দে মিশরে এক বড় ধরনের বিদ্রোহ শুরু হয়, এবং তার কিছুদিন পরেই দারায়ুস মারা যান। ফলে গ্রিস আক্রমণের পরিকল্পনা সাময়িকভাবে থেমে যায়। পারস্যের সিংহাসনে বসেন তার পুত্র খাশায়ারশা, যাকে আমরা জার্ক্সিস (Xerxes) নামে চিনি।
জার্ক্সিস প্রথমে গ্রিস নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না। তার মনোযোগ ছিল মিশর আর ব্যাবিলনের বিদ্রোহ দমনের দিকে। কিন্তু তার কাজিন এবং সেনাপতি মার্ডোনিয়াস তাকে ক্রমাগত উসকে যাচ্ছিলেন। মার্ডোনিয়াস ম্যারাথনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে এবং পুরো গ্রিস জয় করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। অবশেষে জার্ক্সিস রাজি হলেন। তিনি এমন এক আয়োজন শুরু করলেন, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি বা শোনেনি। ইতিহাসবিদ হেরাডোটাসের মতে, জার্ক্সিস প্রায় চার বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সমগ্র সাম্রাজ্য থেকে সৈন্য, রসদ, আর জাহাজ জড়ো করা হলো। হেরাডোটাসের বর্ণনায় সৈন্য সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ এবং জাহাজের সংখ্যা ১২০০-র বেশি (সংখ্যাটা অতি অবশ্যই অতিরঞ্জিত, আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে সৈন্য সংখ্যা ২ থেকে ৩ লাখ এবং জাহাজ ৬০০-৮০০টি ছিল)। কিন্তু এই সংখ্যাই বলে দেয় আয়োজনটা কী বিশাল ছিল (Holland, 2005)।
অন্যদিকে, এই দশ বছরে এথেন্সেও এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। এর নায়ক ছিলেন থেমিস্টোক্লেস (Themistocles) নামের এক বিচক্ষণ কিন্তু ধূর্ত রাজনীতিবিদ। তিনি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন, কিন্তু তার দূরদৃষ্টি ছিল অসাধারণ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পারস্যের সাথে আসল লড়াইটা হবে সমুদ্রে।
এই সময়ে এথেন্সের কাছে লরিয়াম (Laurium) নামক এক জায়গায় রুপার এক নতুন বিশাল খনি আবিষ্কৃত হয়। খনি থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ রুপা নিয়ে এথেন্সে বিতর্ক শুরু হলো। প্রথা অনুযায়ী, এই অর্থ সব নাগরিকের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার কথা। কিন্তু থেমিস্টোক্লেস এক যুগান্তকারী প্রস্তাব দিলেন। তিনি অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে বললেন, এই টাকা দিয়ে এথেন্সের পুরনো শত্রু, কাছের দ্বীপ এজিনার (Aegina) বিরুদ্ধে লড়ার জন্য একটি শক্তিশালী নৌবহর বা নেভি (Navy) তৈরি করা হোক। তিনি সরাসরি পারস্যের নাম নেননি, কারণ তাতে হয়তো মানুষ ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য ছিল পারস্যের আসন্ন আক্রমণের জন্যই প্রস্তুতি নেওয়া। তার এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন অ্যারিস্টাইডিস (Aristides) নামের আরেক জনপ্রিয় নেতা, যিনি ‘অ্যারিস্টাইডিস দ্য জাস্ট’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি টাকাটা জনগণের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত থেমিস্টোক্লেসেরই জয় হয়। এথেন্সের জনগণ তাকে সমর্থন করে এবং অ্যারিস্টাইডিসকে ১০ বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠায় (ostracism)। সেই টাকা দিয়ে এথেন্স প্রায় ২০০টি নতুন ধরনের যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে, যার নাম ছিল ট্রাইরিম (Trireme)। এই জাহাজে তিন স্তরে ১৮০ জন দাঁড়বাহক থাকত এবং এটি ছিল অত্যন্ত দ্রুত ও বিধ্বংসী। এই সিদ্ধান্তই যে পরে গ্রিসের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে, তা তখন কেউ ভাবেনি।
পারস্যের বিশাল অভিযানের খবর পেয়ে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের মধ্যকার শত্রুতা ভুলে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করল। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮১ অব্দে স্পার্টার নেতৃত্বে করিন্থে এক সম্মেলন হলো। সেখানে ৩২টি নগর-রাষ্ট্র মিলে পারস্যের বিরুদ্ধে এক জোট গঠন করল, যা হেলেনিক লিগ (Hellenic League) নামে পরিচিত। এটি ছিল গ্রিক ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত। চিরশত্রুরা কাঁধে কাঁধ মেলাতে রাজি হলো। ঠিক হলো, স্পার্টা তার কিংবদন্তিতুল্য সামরিক ঐতিহ্যের কারণে স্থল ও নৌ উভয় বাহিনীরই নেতৃত্ব দেবে, যদিও নৌবাহিনীর বেশিরভাগ জাহাজ আর অর্থ আসছিল এথেন্স থেকে।
দ্বিতীয় পারস্য আক্রমণ: জার্ক্সিসের মহাযাত্রা (৪৮০-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ অব্দের বসন্তে জার্ক্সিস তার বিশাল বাহিনী নিয়ে গ্রিসের দিকে রওনা হলেন। তার আয়োজন ছিল এলাহি। এশিয়াকে ইউরোপের সাথে যুক্ত করার জন্য তিনি হেলস্পন্ট (Hellespont) প্রণালীর উপর দুটো বিশাল ভাসমান সেতু তৈরি করালেন। কিন্তু এক সামুদ্রিক ঝড়ে সেতু দুটো ভেঙে যায়। ক্রোধে উন্মত্ত জার্ক্সিস অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড করে বসলেন। তিনি সমুদ্রকে ৩০০ বার চাবুক মারার এবং জলে এক জোড়া শেকল ফেলার নির্দেশ দেন। এমনকি সেতুর কারিগরদের শিরশ্ছেদ করা হয়। এই ঘটনাটি গ্রিকদের কাছে জার্ক্সিসের ঔদ্ধত্য বা হুব্রিস (Hubris) এর চূড়ান্ত নিদর্শন ছিল। তারা বিশ্বাস করত, কোনো মানুষ যখন নিজেকে প্রকৃতির বা ঈশ্বরের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করে, তখনই তার পতন অনিবার্য।
থার্মোপাইলি: অমরত্বের গিরিপথ (৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
জার্ক্সিসের বিশাল সেনাবাহিনী যখন উত্তর গ্রিস দিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগোচ্ছিল, তখন গ্রিক জোট সিদ্ধান্ত নিল তাদের থার্মোপাইলি (Thermopylae) নামক এক সরু গিরিপথে আটকানোর চেষ্টা করবে। এই গিরিপথটি ছিল একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা। এটি এতই সরু ছিল যে, পারস্যের বিশাল সেনাবাহিনী তাদের সংখ্যার সুবিধা এখানে কাজে লাগাতে পারবে না। একই সাথে গ্রিক নৌবহর আর্টেমিসিয়ার (Artemisium) প্রণালীতে অবস্থান নেবে, যাতে পারস্যের নৌবহর গিরিপথের পাশ দিয়ে গ্রিক বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে না পারে।
এই কঠিন আত্মঘাতী দায়িত্ব পড়ল স্পার্টার রাজা লিওনিডাসের (Leonidas) উপর। তিনি তার ৩০০ জন সেরা স্পার্টান যোদ্ধা, যারা প্রত্যেকেই পুত্রসন্তানের পিতা (যাতে তাদের বংশ রক্ষা হয়), এবং আরও প্রায় ৬-৭ হাজার সহযোগী গ্রিক সৈন্য নিয়ে থার্মোপাইলিতে অবস্থান নিলেন। স্পার্টানদের মূল বাহিনী আসতে পারেনি, কারণ তখন সেই কার্নিয়া উৎসব চলছিল।
জার্ক্সিস থার্মোপাইলিতে পৌঁছে এই মুষ্টিমেয় গ্রিক সেনাকে দেখে উপহাস করলেন। তিনি ভাবলেন, এরা তার বিশাল বাহিনী দেখে ভয়েই পালিয়ে যাবে। তিনি চারদিন অপেক্ষা করলেন। কিন্তু যখন দেখলেন তারা একচুলও নড়ছে না, তখন তিনি আক্রমণের নির্দেশ দিলেন।
পরপর দুই দিন ধরে পারস্যের সেরা সেনারা, এমনকি কিংবদন্তিতুল্য ‘ইমমর্টালস’ও, গ্রিকদের রক্ষণব্যূহ ভাঙতে পারল না। সরু গিরিপথে স্পার্টানদের লম্বা বর্শা, ভারী বর্ম আর দুর্ভেদ্য ফ্যালাংক্স ব্যূহের সামনে তারা বারবার কচুকাটা হচ্ছিল। হেরাডোটাসের বর্ণনায়, লিওনিডাস তার সৈন্যদের নিয়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছিলেন, যেমন হঠাৎ করে পিছু হটার ভান করে পারস্যের সৈন্যদের ব্যূহ ভাঙতে প্রলুব্ধ করা এবং তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের আক্রমণ করা।
কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো। এফিয়াল্টেস (Ephialtes) নামের এক স্থানীয় লোক বিশ্বাসঘাতকতা করল। সে পুরস্কারের লোভে পারস্য বাহিনীকে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এক গোপন পথের সন্ধান দিল, যে পথ দিয়ে গিরিপথের পেছন দিকে পৌঁছানো যায়।
লিওনিডাস যখন দেখলেন যে তারা চারদিক থেকে আক্রান্ত হতে চলেছেন, তখন তিনি তার সহযোগীদের বেশিরভাগকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন, যাতে তারা পরে আবার যুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু তিনি এবং তার ৩০০ স্পার্টান, সাথে ৭০০ থেস্পিয়ান (যারা স্বেচ্ছায় থেকে গিয়েছিল) এবং ৪০০ থিবান সৈন্য (যাদের জিম্মি হিসেবে রাখা হয়েছিল), সেখানেই থেকে গেলেন। তারা জানতেন, তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু তারা চেয়েছিলেন পালিয়ে না গিয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়তে, যাতে গ্রিসের বাকিরা প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আরও কিছুটা সময় পায়। ডেলফির দৈববাণীতে (Oracle of Delphi) বলা হয়েছিল, হয় স্পার্টা তার একজন রাজাকে হারাবে, নয়তো পুরো রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। লিওনিডাস নিজের জীবন দিয়ে স্পার্টাকে বাঁচানোর পথ বেছে নিলেন (Green, 1996)।
থার্মোপাইলির শেষ যুদ্ধ ছিল এক অসম লড়াই। লিওনিডাস এবং তার মুষ্টিমেয় যোদ্ধারা সিংহের মতো লড়ে সবাই মারা গেলেন। পারস্য বাহিনী গিরিপথ দখল করল, কিন্তু এই নৈতিক বিজয় গ্রিকদের মনোবলকে আকাশে তুলে দিল। লিওনিডাস এবং তার ৩০০ স্পার্টান চিরদিনের জন্য বীরত্ব, আত্মত্যাগ আর কর্তব্যের প্রতীক হয়ে রইলেন।
সালামিসের যুদ্ধ: এক ধূর্ত চাল (৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
থার্মোপাইলির পতনের পর পারস্য বাহিনীর সামনে এথেন্স পর্যন্ত আর কোনো বাধা রইল না। থেমিস্টোক্লেস আগেই এথেন্সের জনগণকে কাছের সালামিস (Salamis) দ্বীপে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি ডেলফির এক দ্ব্যর্থক দৈববাণীকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছিলেন। দৈববাণীতে বলা হয়েছিল, “কাঠের দেয়ালই তোমাদের রক্ষা করবে”। অনেকে ভেবেছিল এর মানে এক্রোপলিসের পুরনো কাঠের প্রাচীর। কিন্তু থেমিস্টোক্লেস সবাইকে বোঝান, এই ‘কাঠের দেয়াল’ হলো এথেন্সের নৌবহর, অর্থাৎ তাদের জাহাজ।
পারস্যের সেনারা খালি এথেন্স শহরে ঢুকে এক্রোপলিসসহ (Acropolis) পুরো শহর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। ম্যারাথনের প্রতিশোধ নেওয়া হলো। জার্ক্সিস তার জীবনের লক্ষ্য পূরণ করলেন। সালামিস দ্বীপে দাঁড়িয়ে এথেনিয়ানরা অসহায়ভাবে তাদের প্রিয় শহরের ধ্বংস দেখল।
এথেন্সের পতনের পর গ্রিক জোটের মধ্যে ভাঙন দেখা দিল। পেলোপনেসিয়ান নগর-রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে করিন্থ, চাইল তাদের নৌবহর নিয়ে পেলোপনিস (Peloponnese) উপদ্বীপে ফিরে গিয়ে করিন্থের যোজককে (Isthmus of Corinth) রক্ষা করতে। সেখানে তারা একটি প্রাচীর তৈরি করছিল। কিন্তু থেমিস্টোক্লেস জানতেন, যদি নৌবহর ভেঙে যায় এবং খোলা সমুদ্রে পারস্যের বিশাল নৌবহরের মুখোমুখি হয়, তবে গ্রিসের পতন নিশ্চিত। তাকে কিছু একটা করতেই হতো। তিনি এক ভয়ানক চাল চাললেন।
তিনি স্পার্টান কমান্ডার ইউরিবিয়াডেসকে (Eurybiades) বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে সালামিসের সরু প্রণালীই যুদ্ধের জন্য সেরা জায়গা। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছিল না। তখন তিনি তার বিশ্বস্ত ভৃত্য সিকিন্নাসকে (Sicinnus) গোপনে জার্ক্সিসের কাছে এক দূত হিসেবে পাঠালেন। দূত গিয়ে জার্ক্সিসকে বলল, “এথেন্সের সেনাপতি থেমিস্টোক্লেস আসলে আপনারই শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি আপনাকে জানাচ্ছেন যে গ্রিক নৌবহরের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে এবং তারা রাতের অন্ধকারে পালানোর পরিকল্পনা করছে। আপনি যদি এখনই প্রণালীর দুই মুখ বন্ধ করে আক্রমণ করেন, তবে তারা সবাই আপনার হাতে বন্দী হবে।”
জার্ক্সিস এই টোপ গিললেন। তার কাছে এটা খুবই যৌক্তিক মনে হলো। তিনি তার নৌবহরকে সালামিসের সরু প্রণালীতে ঢোকার নির্দেশ দিলেন, যাতে গ্রিকরা পালাতে না পারে। তিনি নিজে কাছের এক পাহাড়ের উপর সোনার সিংহাসনে বসে এই সহজ বিজয় দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন, তার লিপিকাররা প্রস্তুত ছিল বীরত্বের কাহিনি লেখার জন্য।
কিন্তু তিনি জানতেন না, এটাই ছিল থেমিস্টোক্লেসের পাতা ফাঁদ। সালামিসের প্রণালী ছিল খুবই সরু এবং অগভীর। সেখানে পারস্যের বিশাল এবং ভারী জাহাজগুলো ঠিকমতো ঘোরার বা কৌশল প্রয়োগের সুযোগই পাচ্ছিল না। অন্যদিকে, এথেন্সের ছোট, হালকা এবং দ্রুতগামী ট্রাইরিম জাহাজগুলো সহজেই তাদের পাশ কাটিয়ে, ধাক্কা মেরে (ramming), বা দাঁড় ভেঙে দিয়ে পারস্যের জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দিতে লাগল।
পারস্যের নৌবহরের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হলো। নিজেদের জাহাজেই একে অপরের সাথে ধাক্কা খাচ্ছিল। প্রথম সারির জাহাজগুলো পালাতে গিয়ে পেছনের সারির জাহাজগুলোর পথ আটকে দিচ্ছিল। গ্রিকরা এই সুযোগে তাদের কচুকাটা করতে শুরু করল। জার্ক্সিস তার সিংহাসনে বসে অসহায়ের মতো দেখলেন, কীভাবে তার গর্বের নৌবহর চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ২০০-র বেশি পারস্যের জাহাজ ডুবে গেল বা দখল হয়ে গেল, অন্যদিকে গ্রিকদের ক্ষতি হলো মাত্র ৪০টি জাহাজের (Strauss, 2004)।
সালামিসের যুদ্ধ ছিল এই পুরো সংঘাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত (turning point)। এই পরাজয়ের পর জার্ক্সিস ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, গ্রিকরা হয়তো উত্তরে গিয়ে হেলস্পন্টের সেতু ধ্বংস করে দেবে এবং তিনি এশিয়াতে ফেরার পথ হারাবেন। তিনি তার সেনাবাহিনীর বড় একটি অংশ নিয়ে দ্রুত পারস্যে ফিরে গেলেন। গ্রিসে রয়ে গেল শুধু তার সেরা সেনাপতি মার্ডোনিয়াসের অধীনে একটি এলিট বাহিনী, পরের বছর যুদ্ধ শেষ করার জন্য।
প্লাটিয়া আর মাইকেলি: শেষ আঘাত (৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
পরের বছর, খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯ অব্দে, গ্রিসের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য দুটো চূড়ান্ত যুদ্ধ হলো। মার্ডোনিয়াস প্রথমে কূটনীতির চেষ্টা করলেন। তিনি এথেন্সকে পারস্যের সাথে মৈত্রী করার প্রস্তাব দিলেন, বিনিময়ে তাদের শহর পুনর্নির্মাণ এবং বিশাল এলাকা জুড়ে শাসনের অধিকার দেওয়ার লোভ দেখালেন। কিন্তু এথেনিয়ানরা গর্বের সাথে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলল, “যতদিন সূর্য তার নির্দিষ্ট পথে চলবে, ততদিন আমরা জার্ক্সিসের সাথে কোনো চুক্তি করব না।”
ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। মার্ডোনিয়াস আবার এথেন্স দখল করে ধ্বংস করলেন। এবার গ্রিসের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী একত্রিত হলো। স্পার্টার রিজেন্ট পাউসানিয়াসের (Pausanias) নেতৃত্বে প্রায় ৪০ হাজার হোপলাইটসহ মোট লক্ষাধিক সৈন্যের এক বিশাল গ্রিক বাহিনী মার্ডোনিয়াসের পারস্য বাহিনীর মুখোমুখি হলো প্লাটিয়ার (Plataea) প্রান্তরে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে দুই বাহিনী একে অপরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল, কেউই প্রথম আক্রমণের ঝুঁকি নিতে চাইল না। অবশেষে এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে, যখন গ্রিক বাহিনীর একটি অংশ রসদের জন্য পিছু হটছিল, মার্ডোনিয়াস ভাবলেন গ্রিকরা পালাচ্ছে। তিনি আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু স্পার্টান এবং অন্য গ্রিক হোপলাইটরা ঘুরে দাঁড়িয়ে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু করল। সেই যুদ্ধে পারস্যের অশ্বারোহী বাহিনী এবং তিরন্দাজরা স্পার্টানদের দুর্ভেদ্য ফ্যালাংক্সের সামনে অসহায় হয়ে পড়ল। মার্ডোনিয়াস নিজেই যুদ্ধে নিহত হলেন। তার মৃত্যুতে পারস্যের সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল। গ্রিসের মাটি থেকে পারস্যের হুমকি চিরতরে দূর হলো।
কথিত আছে, যেদিন প্লাটিয়াতে এই যুদ্ধ হচ্ছিল, ঠিক সেদিনই ঈজিয়ান সাগরের ওপারে, মাইকেলির (Mycale) উপকূলে গ্রিক নৌবহর পারস্যের অবশিষ্ট নৌবহরকে আক্রমণ করে। পারস্যের সেনারা ভয়ে তাদের জাহাজগুলোকে তীরে তুলে এক প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করেছিল। কিন্তু গ্রিক হোপলাইটরা জাহাজ থেকে নেমে এসে সেই ব্যূহও আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। এই দুই বিজয়ের সাথে সাথেই দ্বিতীয় পারস্য আক্রমণ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল এবং যুদ্ধ গ্রিসের মাটি থেকে এশিয়ার মাটিতে স্থানান্তরিত হলো।
ফলাফল: যুদ্ধের পর কী হলো?
গ্রেকো-পার্সিয়ান যুদ্ধের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এর প্রভাব শুধু গ্রিস বা পারস্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং পুরো পশ্চিমা সভ্যতার গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
গ্রিসের জন্য: এক নতুন যুগের সূচনা
১. আত্মবিশ্বাস ও ঐক্যের জন্ম: এই অবিশ্বাস্য বিজয় গ্রিকদের মধ্যে এক নতুন আত্মবিশ্বাস ও প্যান-হেলেনিক (Pan-Hellenic) বা সর্ব-গ্রিক গর্বের জন্ম দেয়। তারা ভাবতে শুরু করে যে তাদের সংস্কৃতি, তাদের জীবনযাত্রা, এবং তাদের শাসনব্যবস্থা পারস্যের স্বৈরাচারী শাসনের চেয়ে উন্নত। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, স্বাধীন নাগরিকরা কেবল রাজার আদেশে যুদ্ধ করা সৈন্যদের চেয়ে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে লড়তে পারে।
২. এথেন্সের স্বর্ণযুগ (The Athenian Golden Age): যুদ্ধের প্রধান নায়ক, বিশেষ করে নৌ-শক্তির কারণে, এথেন্সের সম্মান ও ক্ষমতা বহুলাংশে বেড়ে যায়। মাইকেলির যুদ্ধের পর আইওনিয়ান দ্বীপগুলোকে পারস্যের ভবিষ্যৎ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এথেন্সের নেতৃত্বে ডেলিয়ান লিগ (Delian League) নামে এক জোট গঠিত হয়। জোটের সদস্যরা জাহাজ বা অর্থ দিয়ে সাহায্য করত এবং তার কোষাগার রাখা হয় ডেলোস (Delos) দ্বীপে। কিন্তু ধীরে ধীরে এথেন্স এই জোটকে নিজের সাম্রাজ্যে পরিণত করে। তারা কোষাগার এথেন্সে নিয়ে আসে এবং জোটের অর্থ দিয়ে নিজেদের শহরকে সাজাতে শুরু করে। পেরিক্লিসের (Pericles) নেতৃত্বে এথেন্সে যে স্বর্ণযুগের সূচনা হয়—পার্থেননের (Parthenon) মতো স্থাপত্য নির্মাণ, সোফোক্লিস ও ইউরিপিদিসের মতো নাট্যকারদের উত্থান, সক্রেটিসের মতো দার্শনিকদের আবির্ভাব—তার পেছনে ডেলিয়ান লিগের অর্থ এক বিশাল ভূমিকা রেখেছিল।
৩. ভবিষ্যৎ সংঘাতের বীজ: এথেন্সের এই ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব গ্রিসের আরেক শক্তিশালী নগর-রাষ্ট্র স্পার্টার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্পার্টা এবং তার মিত্ররা এথেন্সের ক্ষমতাকে ভয় পেতে শুরু করে। এই দুই শক্তির রেষারেষি, ভয় আর অবিশ্বাসের ফলস্বরূপই পরবর্তীতে বিধ্বংসী পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের (Peloponnesian War) (৪৩১-৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) জন্ম হয়, যা পুরো গ্রিক বিশ্বকে প্রায় ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
পারস্যের জন্য: কৌশল পরিবর্তন
১. সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা: গ্রিস জয় করতে না পারলেও পারস্য সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়নি। এটি আরও প্রায় ১৫০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শক্তি হিসেবে টিকে ছিল। তবে পশ্চিমে আর বিস্তারের চেষ্টা তারা করেনি।
২. কূটনীতির নতুন খেলা: পারস্য শাসকরা বুঝতে পারেন যে সরাসরি সামরিক অভিযানে গ্রিকদের তাদের নিজেদের মাটিতে হারানো কঠিন। তাই তারা নতুন এবং আরও কার্যকর কৌশল অবলম্বন করে। তারা গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিবাদে ‘পারস্যের সোনা’ (Persian Gold) ঢালতে শুরু করে। পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের সময় তারা স্পার্টাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে এথেন্সের নৌবহরকে ধ্বংস করতে, এবং পরে আবার এথেন্স ও তার মিত্রদের সাহায্য করে স্পার্টার ক্ষমতা খর্ব করতে। তাদের লক্ষ্য ছিল গ্রিকদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখা, যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পারস্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে না পারে। এই নীতি বেশ কার্যকর হয়েছিল।
বিশ্বের জন্য: এক নতুন ধারণার জন্ম
১. পূর্ব বনাম পশ্চিম (East vs. West): এই যুদ্ধ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘পূর্ব’ (East) এবং ‘পশ্চিম’ (West) এই দুই ধারণার জন্ম দেয়। গ্রিক ঐতিহাসিক এবং লেখকদের চোখে এই যুদ্ধ ছিল ‘স্বাধীনতা’ ও ‘গণতন্ত্রের’ সাথে ‘স্বৈরাচার’ ও ‘পরাধীনতার’ লড়াই। এই ধারণাটি, যদিও সরলীকৃত, পশ্চিমা সভ্যতার আত্মপরিচয়ের একটি মৌলিক অংশ হয়ে ওঠে এবং আজও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিতর্কে এর প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
২. ইতিহাস লিখন: এই যুদ্ধ না হলে হয়তো আমরা হেরাডোটাসের মতো একজন ঐতিহাসিক পেতাম না। তিনি এই মহাযুদ্ধের কারণ ও ঘটনাপ্রবাহ অনুসন্ধান করার জন্যই বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তার লেখা ‘The Histories’ বইটিই পশ্চিমা সভ্যতার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত। তিনি কেবল ঘটনার বর্ণনা দেননি, বরং তার পেছনের কারণ অনুসন্ধানেরও চেষ্টা করেছেন। এ কারণেই তাকে ‘ইতিহাসের জনক’ (Father of History) বলা হয়।
৩. আলেকজান্ডারের পথের সূচনা: গ্রেকো-পার্সিয়ান যুদ্ধ শেষ হলেও এর রেশ রয়ে গিয়েছিল। প্রায় দেড় শতাব্দী পর, ম্যাসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ এবং তার পুত্র মহান আলেকজান্ডার (Alexander the Great) এই পুরনো শত্রুতার দোহাই দিয়েই এক ঐক্যবদ্ধ গ্রিক বাহিনী নিয়ে পারস্য আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। আলেকজান্ডার তার অভিযানকে জার্ক্সিসের আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবেই দেখিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি পুরো পারস্য সাম্রাজ্য জয় করে গ্রিক সংস্কৃতিকে ভারত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। এভাবেই এক যুদ্ধের প্রতিশোধ আরেক মহাবিজয়ের জন্ম দিয়েছিল।
শেষ কথা
গ্রেকো-পার্সিয়ান যুদ্ধ নিছক কিছু রক্তক্ষয়ী ঘটনার সমষ্টি নয়। এটি একটি মহাকাব্য। যেখানে থেমিস্টোক্লেসের ধূর্ততা, লিওনিডাসের বীরত্ব, জার্ক্সিসের ঔদ্ধত্য আর ম্যারাথনের মাঠে দৌড়ে আসা সাধারণ এথেনিয়ান কৃষকদের দেশপ্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ছোট্ট, বিভক্ত, ঝগড়াটে গ্রিকরা যে বিশাল, সুসংগঠিত পারস্য সাম্রাজ্যকে হারিয়ে দিয়েছিল, তা মানব ইতিহাসের অন্যতম আশ্চর্য এবং অনুপ্রেরণাদায়ক ঘটনা।
এই যুদ্ধ আমাদের শেখায়, শুধু সংখ্যা বা আকার দিয়ে শক্তি মাপা যায় না। সাহস, ঐক্য, বিশ্বাস আর সঠিক কৌশল থাকলে অসম লড়াইও জেতা সম্ভব। ম্যারাথন, থার্মোপাইলি, আর সালামিসের সেই উত্তাল দিনগুলোর গল্প তাই আজও আমাদের প্রেরণা দেয়। ভাবতে অবাক লাগে, আড়াই হাজার বছর আগের সেই ঘটনাগুলো আজও কীভাবে আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি আর আত্মপরিচয়ের ধারণাকে প্রভাবিত করে চলেছে। ইতিহাস আসলেই বড় অদ্ভুত, বড় রহস্যময় এক জাদুকর।
তথ্যসূত্র
-
Green, P. (1996). The Greco-Persian Wars. University of California Press.
-
Herodotus. (2003). The Histories (A. de Sélincourt, Trans.; J. Marincola, Ed.). Penguin Classics. (Original work published c. 440 BCE).
-
Holland, T. (2005). Persian Fire: The First World Empire and the Battle for the West. Little, Brown.
-
Lazenby, J. F. (1993). The Defence of Greece, 490-479 B.C. Aris & Phillips.
-
Strauss, B. (2004). The Battle of Salamis: The Naval Encounter That Saved Greece—and Western Civilization. Simon & Schuster.
-
Waters, M. (2014). Ancient Persia: A Concise History of the Achaemenid Empire, 550–330 BCE. Cambridge University Press.
Leave a Reply