Table of Contents
ভূমিকা
আমরা যখন প্লেটোর কথা ভাবি, আমাদের চোখের সামনে কী ভাসে? ধবধবে সাদা পোশাক পরা এক জ্ঞানী বৃদ্ধ, এথেন্সের কোনো এক ছায়াঘেরা বাগানে তরুণদের সঙ্গে হেঁটে বেড়াচ্ছেন আর জগতের গভীরতম প্রশ্নগুলো নিয়ে কথা বলছেন। তাঁর হাতে হয়তো ধরা আছে ‘রিপাবলিক’ বা ‘সিম্পোজিয়াম’-এর মতো কোনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি। এই প্লেটোকে আমরা চিনি। ইনি আমাদের পরিচিত, বইয়ের পাতায় অমর হয়ে থাকা প্লেটো। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন এক আদর্শ জগতের কথা, ফর্মের জগৎ (World of Forms), যেখানে ন্যায়, সৌন্দর্য, সত্য—এই সবকিছু তাদের নিখুঁত ও চিরস্থায়ী রূপে বাস করে। আমাদের এই চারপাশের চেনা জগৎটা তো সেই আসল জগতের একটা ঝাপসা, অসম্পূর্ণ ছায়া মাত্র। এ হলো এক স্বপ্নিল, কাব্যিক দর্শন যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কবি, শিল্পী, সাধক ও দার্শনিকদের অনুপ্রাণিত করে আসছে।
কিন্তু এই গল্পের যদি একটা অন্য পিঠ থাকে? যদি এমন হয়, আমরা যে প্লেটোকে বইয়ের পাতায় খুঁজে বেড়াই, তিনি তাঁর সবচেয়ে জরুরি, সবচেয়ে মৌলিক কথাগুলো কখনও বইয়ের পাতায় লিখেই যাননি? যদি এমন হয় যে, প্লেটোর দর্শনের যে বিশাল হিমশৈল আমরা দেখতে পাই, তার সবচেয়ে বড় আর ভারী অংশটা আমাদের চোখের আড়ালে, জলের নিচেই রয়ে গেছে? যেন আমরা শুধু চূড়াটা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি, কিন্তু আসল ভিত্তিটা রয়ে যাচ্ছে আমাদের ধারণার বাইরে।
বিষয়টা শুনতে একটা টানটান উত্তেজনার গোয়েন্দা গল্পের মতো, তাই না? যেন এক গুপ্তধনের মানচিত্র আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংকেতটাই মুছে ফেলা হয়েছে। প্লেটোর এই না-বলা কথা বা ‘অলিখিত মতবাদ’ (Unwritten Doctrines) দর্শন জগতে ঠিক এমনই এক আলোড়ন, এমনই এক রহস্য। এটি প্লেটোকে পড়ার, তাঁকে বোঝার পুরো দৃষ্টিকোণটাই ওলটপালট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এটি আমাদের বাধ্য করে প্লেটোকে নতুন চোখে দেখতে—কেবল একজন মহান সাহিত্যিক হিসেবে নয়, বরং একজন কঠোর, পদ্ধতিগত দার্শনিকের চোখে, যাঁর একটি সুনির্দিষ্ট ও সুসংহত দর্শন-ব্যবস্থা ছিল।
চলুন সেই অন্য প্লেটোর খোঁজে বের হই। যে প্লেটো তাঁর একাডেমির চার দেওয়ালের ভেতরে, তাঁর সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছাত্রদের কাছে এমন সব কথা বলতেন, যা তিনি সাধারণের জন্য লিখে যাওয়াটা কেবল অপ্রয়োজনীয়ই নয়, বিপজ্জনকও মনে করতেন। এই যাত্রায় আমরা ইতিহাসের ধুলোমাখা পথ পাড়ি দেব, প্রাচীন পাণ্ডুলিপির আবছা অক্ষরগুলো বোঝার চেষ্টা করব, আর একদল আধুনিক গবেষকের সঙ্গে এই দার্শনিক রহস্যের সমাধানে নামব।
রহস্যের প্রথম সূত্র: কোত্থেকে এলো এই ধারণা?
এত বড় একটা দাবি—যে প্লেটোর মূল দর্শনটাই অপ্রকাশিত—এর পেছনে নিশ্চয়ই শক্তপোক্ত প্রমাণ থাকতে হবে। হুট করে তো আর এমন কথা বলা যায় না। এই ধারণার শেকড় লুকিয়ে আছে ইতিহাসের গভীরে, আর সবচেয়ে বড় সূত্রটি রেখে গেছেন স্বয়ং প্লেটোর সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্র, মহাজ্ঞানী এরিস্টটল।
এরিস্টটল প্রায় কুড়িটা বছর প্লেটোর একাডেমিতে কাটিয়েছেন। তিনি প্লেটোকে যতটা কাছ থেকে দেখেছেন, তেমনটা আর কেউ দেখেননি। এরিস্টটল প্লেটোকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু তিনি অন্ধ ভক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সমালোচক ছাত্র, যিনি গুরুর দর্শনকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এরিস্টটল তাঁর বিভিন্ন বইয়ে, বিশেষ করে তাঁর দর্শনের আকরগ্রন্থ ‘মেটাফিজিক্স’ (Metaphysics) এবং ‘ফিজিক্স’ (Physics)-এ, বারবার প্লেটোর এমন কিছু তত্ত্বের কথা বলেছেন, যা প্লেটোর লেখা কোনো সংলাপে সরাসরি খুঁজে পাওয়া যায় না। এরিস্টটল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছেন, প্লেটোর অধিবিদ্যার (Metaphysics) একেবারে কেন্দ্রে ছিল দুটি মৌলিক বা আদি নীতি (archai / principles)। একটি হলো ‘এক’ (The One / το εν), যা ঐক্যের প্রতীক, মঙ্গলের উৎস এবং আকারের নির্ধারক। অন্যটি হলো ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’ (The Indefinite Dyad / αόριστος δυάς), যা বহুত্ব, অনৈক্য এবং আকারহীনতার প্রতীক। এরিস্টটলের মতে, প্লেটো বিশ্বাস করতেন, এই জগতের যা কিছু—বস্তু, চিন্তা, আত্মা—সবকিছুর উৎপত্তি হয়েছে এই দুটি বিপরীতধর্মী নীতির পারস্পরিক ক্রিয়া থেকে (Aristotle, Metaphysics, 987b-988a)।
ভাবুন তো একবার! যে ছাত্র গুরুর সবচেয়ে কাছের ছিলেন, তিনি এমন কিছুর কথা লিখছেন যা গুরুর লেখা বইগুলোতে নেই। এরিস্টটল কি তাহলে প্লেটোকে ভুল বুঝেছিলেন? নাকি তিনি এমন কোনো প্লেটোকে চিনতেন, যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেনি? এরিস্টটল প্লেটোর দর্শনকে সমালোচনা করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে অগ্রাহ্যও করেছেন, কিন্তু তিনি যে প্লেটোর মৌখিক শিক্ষার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তা নিয়ে সন্দেহ করার সুযোগ কম। তাঁর সাক্ষ্যকে তাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
শুধু এরিস্টটল নন, প্লেটোর পরেও অনেক দার্শনিক এই গোপন শিক্ষার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্লেটোর ছাত্র জেনোক্রেটিস (Xenocrates), যিনি প্লেটোর মৃত্যুর পর একাডেমির প্রধান হয়েছিলেন, তিনিও এই দুই নীতির তত্ত্বকেই প্লেটোর মূল দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং এর ওপর ভিত্তি করেই তাঁর নিজের দর্শন গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীকালে নব্য-প্লেটোনিক (Neoplatonist) ধারার প্রতিষ্ঠাতা প্লোটিনাস (Plotinus) থেকে শুরু করে প্রোক্লাস (Proclus) পর্যন্ত প্রায় সকলেই তাঁদের দর্শনের ভিত্তি গড়েছেন প্লেটোর এই মৌখিক শিক্ষার ওপর। তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, প্লেটোর সর্বোচ্চ সত্য তাঁর সংলাপের চেয়ে তাঁর মৌখিক শিক্ষার মধ্যেই বেশি স্পষ্ট ছিল।
তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং প্রত্যক্ষ প্রমাণটি হয়তো প্লেটো নিজেই আমাদের জন্য রেখে গেছেন। প্লেটোর লেখা একটি চিঠি, যা ‘সপ্তম পত্র’ (Seventh Letter) নামে পরিচিত, সেখানে তিনি দর্শন, জ্ঞান এবং লেখালেখির সম্পর্ক নিয়ে কিছু অদ্ভুত, প্রায় বিপ্লবী কথা বলেছেন। এই চিঠিটির সত্যতা নিয়ে সামান্য বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশ গবেষকই আজ একমত যে এটি প্লেটোরই লেখা। এই চিঠিতে প্লেটো তাঁর বন্ধু ডিওনের স্বজনদের লিখছেন:
“…এই বিষয়গুলো (দর্শনের সর্বোচ্চ সত্য) নিয়ে আমার কোনো লেখা নেই, এবং কখনও থাকবেও না। কারণ এটি অন্য জ্ঞানের মতো ভাষায় প্রকাশ করার বিষয় নয়। বরং দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে, একসঙ্গে জীবনযাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আত্মায় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এটি জন্ম নেয়, এবং তারপর নিজেই নিজেকে লালন করে।” (Plato, Seventh Letter, 341c-d)
কী সাংঘাতিক কথা! যে মানুষটি দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকদের একজন, তিনিই বলছেন তাঁর সর্বোচ্চ জ্ঞান লিখে প্রকাশ করার মতো নয়। তাঁর মতে, লেখা হলো একটা প্রাণহীন বস্তু। তাকে প্রশ্ন করা যায় না, সে পাল্টা উত্তর দেয় না। লেখা যদি ভুল মানুষের হাতে পড়ে, তাহলে তার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে, তাকে রক্ষা করার কেউ থাকে না। আসল জ্ঞান হলো এক জীবন্ত, আত্মিক প্রক্রিয়া, যা গুরু-শিষ্যের নিবিড় সম্পর্কের উত্তাপে জন্ম নেয়। এটি কোনো তথ্য নয় যে বাইরে থেকে গ্রহণ করা যায়, বরং এটি এক গভীর উপলব্ধি যা ভেতর থেকে জন্মায়।
প্লেটোর আরেকটি বিখ্যাত সংলাপ ‘ফিড্রাস’-এও (Phaedrus) তিনি লেখার সীমাবদ্ধতা নিয়ে একই ধরনের কথা বলেছেন। সেখানে সক্রেটিসের মুখ দিয়ে তিনি বলছেন, লেখা জিনিসটা অনেকটা চিত্রকর বা ভাস্করের আঁকা ছবির মতো। দেখতে জীবন্ত মনে হলেও সে আসলে মৃত। তাকে প্রশ্ন করলে সে বোবার মতো গম্ভীর মুখে নিশ্চুপ হয়ে থাকে। লেখা তার ‘পিতার’ (অর্থাৎ লেখকের) সাহায্য ছাড়া নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, যে কেউ তাকে ভুল বুঝতে পারে বা অপমান করতে পারে (Plato, Phaedrus, 275d-e)। এর বিপরীতে, জীবন্ত জ্ঞান হলো সেই কথা যা জ্ঞানীর আত্মায় লেখা থাকে, যা নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং জানে কার সঙ্গে কথা বলা উচিত আর কার সঙ্গে নয়।
এই সূত্রগুলো যখন একটির পর একটি মেলানো হয়, তখন একটা ছবি ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। প্লেটো হয়তো তাঁর সংলাপগুলোকে সাধারণ মানুষকে দর্শনের প্রতি আগ্রহী করে তোলার একটা উপায় (protreptic) হিসেবে ব্যবহার করতেন। এগুলো ছিল দর্শনের জগতে প্রবেশের জন্য সুন্দর করে সাজানো এক আমন্ত্রণপত্র। কিন্তু আসল ভোজসভা, আসল পাঠ, কেবল তাঁর একাডেমির বিশ্বস্ত এবং পরীক্ষিত ছাত্রদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল।
টিউবিঙেন স্কুল এবং নতুন যুগের বিতর্ক
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত প্লেটোর এই অলিখিত মতবাদের বিষয়টি কিছু বিশেষজ্ঞের অ্যাকাডেমিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে জার্মানির টিউবিঙেন বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Tübingen) একদল গবেষক এই ধারণাটিকে একেবারে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তাঁদের হাত ধরেই জন্ম নেয় প্লেটো-চর্চার এক নতুন ধারা, যা ‘টিউবিঙেন স্কুল’ (Tübingen School) নামে পরিচিত। এই ধারার দুই প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন হান্স জোয়াকিম ক্রেমার (Hans Joachim Krämer) এবং কনরাড গাইজার (Konrad Gaiser)। পরবর্তীকালে টমাস স্লেজাক (Thomas A. Szlezák) এবং ইতালিতে জিওভান্নি রিয়ালে (Giovanni Reale) এই মতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান।
তাঁদের মূল বক্তব্য ছিল খুবই সরল কিন্তু বিপ্লবী। তাঁরা বললেন, প্লেটোকে বুঝতে হলে শুধু তাঁর লেখা সংলাপগুলো পড়লে চলবে না, বরং তাঁর এই অলিখিত মতবাদকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। প্রচলিত ধারণা ছিল, প্লেটোর যা কিছু বলার, তার সবই তিনি তাঁর সংলাপের মধ্যেই বলে গেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ শ্লাইয়ারমাখারের (Friedrich Schleiermacher) সময় থেকে এই মতটিই ছিল প্রধান। শ্লাইয়ারমাখার মনে করতেন, প্লেটোর দর্শনের শৈল্পিক রূপ (সংলাপ) এবং তার বিষয়বস্তু অবিচ্ছেদ্য; প্লেটোর দর্শন বোঝার জন্য সংলাপের বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
কিন্তু টিউবিঙেন স্কুল বলল, না, ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। সংলাপগুলো হলো সেই বিশাল হিমশৈলের চূড়া যা জলের উপরে দেখা যায়। কিন্তু আসল ভিত্তি, অর্থাৎ তাঁর সম্পূর্ণ অধিবিদ্যা (Metaphysics), তাঁর দর্শনের পদ্ধতিগত কাঠামো, সেটা জলের নিচে, তাঁর মৌখিক শিক্ষার মধ্যেই লুকানো আছে (Krämer, 1990; Reale, 2000)।
তাঁদের মতে, সংলাপগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই অসম্পূর্ণ এবং রহস্যময়। এগুলো হলো এক ধরনের ‘দার্শনিক সাহিত্য’, যার উদ্দেশ্য পাঠককে চিন্তা করতে উসকে দেওয়া, কিন্তু চূড়ান্ত উত্তর না দেওয়া। চূড়ান্ত উত্তর মিলত একাডেমির ভেতরের আলোচনাচক্রে, যা ছিল পদ্ধতিগত (systematic) এবং তত্ত্বনির্ভর। সংলাপগুলো হলো এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি, যা শিক্ষার্থীকে আরও গভীর ও জটিল তত্ত্বগুলো গ্রহণ করার জন্য যোগ্য করে তোলে।
এই ধারণাটি প্রচলিত প্লেটো-চর্চাকে একেবারে নাড়িয়ে দিল। এতদিন ধরে সবাই মনে করত প্লেটো একজন অনুসন্ধানী, পরীক্ষামূলক দার্শনিক যিনি কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু টিউবিঙেন স্কুল এক নতুন প্লেটোকে আমাদের সামনে হাজির করল—একজন পদ্ধতিগত দার্শনিক, যাঁর একটি সুসংহত অধিবিদ্যার কাঠামো ছিল। এই বিতর্কের ফলে প্লেটো গবেষকরা দুটি প্রধান শিবিরে ভাগ হয়ে গেলেন। একদিকে টিউবিঙেন স্কুলের সমর্থকরা, যারা ‘এসোটেরিক’ (esoteric) বা গুহ্য প্লেটোর ওপর জোর দেন। অন্যদিকে, ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যাকারীরা, যারা ‘এক্সোটেরিক’ (exoteric) বা প্রকাশ্য, অর্থাৎ লিখিত প্লেটোকেই আসল প্লেটো বলে মনে করেন।
এখন প্রশ্ন হলো, কী ছিল সেই গুহ্য বা অলিখিত মতবাদে? এরিস্টটল এবং অন্যান্যদের সাক্ষ্য থেকে টিউবিঙেন স্কুল প্লেটোর সেই গোপন দর্শনকে যেভাবে পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করেছে, চলুন, সেই রহস্যময় জগতের গভীরে প্রবেশ করা যাক।
অলিখিত মতবাদের মূল ভিত্তি: দুটি আদি নীতি (The Two Principles)
টিউবিঙেন স্কুলের পুনর্গঠন অনুসারে, প্লেটোর সমগ্র দর্শনের ভিত্তি ছিল দুটি বিপরীতধর্মী কিন্তু পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল আদি নীতি (archai)। এই দুটি নীতি থেকেই জগতের বাকি সবকিছুর উদ্ভব।
১. এক (The One / το εν)
এটি হলো প্লেটোর দর্শনের সর্বোচ্চ এবং পরম নীতি। এটি কোনো বস্তু নয়, কোনো সত্তা নয়, বরং সকল সত্তার উৎস। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো যেমন ‘শুভের রূপ’ (Form of the Good)-কে অন্য সব ফর্মের ঊর্ধ্বে, এমনকি সত্তা ও জ্ঞানেরও ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন (beyond being and knowledge), অলিখিত মতবাদে সেই ‘শুভ’ বা ‘The Good’ হলো এই ‘এক’-এরই নামান্তর। এটি হলো পরম বাস্তবতা।
এই ‘এক’-এর কাজ কী?
- ঐক্য প্রদানকারী (Unifying): এটি জগতের সমস্ত বহুত্ব এবং বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে। একটি কবিতা যেমন অনেকগুলো শব্দকে একটি ঐক্যবদ্ধ রূপে নিয়ে আসে, ‘এক’ তেমনি জগতের বহুতাকে একটি সুসংহত রূপে নিয়ে আসে।
- নির্ধারক (Determining): এটি আকারহীন বস্তুকে একটি নির্দিষ্ট আকার বা সীমা (limit/peras) দেয়। যেমন, একজন ভাস্কর এক খণ্ড পাথরকে একটি নির্দিষ্ট মূর্তি হিসেবে গড়ে তোলেন। এখানে ভাস্করের মনের ধারণাটি হলো ‘এক’-এর মতো, যা আকারহীন পাথরকে একটি নির্দিষ্ট রূপ দিচ্ছে।
- সত্তার উৎস (Source of Being): কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে, কারণ তা ‘এক’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। ‘এক’ থেকেই সবকিছুর সত্তা উৎসারিত হয়।
- মঙ্গলের উৎস (Source of Goodness): যেহেতু এটিই পরম ‘শুভ’, তাই কোনো কিছু ততটাই ভালো, যতটা সে ‘এক’-এর কাছাকাছি বা তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এটি অনেকটা গণিতের সংখ্যা ‘১’-এর মতো। ‘১’ নিজে ঠিক সংখ্যা নয়, বরং সব সংখ্যার ভিত্তি বা উৎস। ঠিক তেমনি, ‘এক’ নিজে কোনো সত্তা নয়, বরং সকল সত্তার উৎস। এটি জগতের সমস্ত শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য, অনুপাত এবং স্থিতিশীলতার কারণ।
২. অনির্দিষ্ট দ্বৈত (The Indefinite Dyad / αόριστος δυάς)
এটি হলো দ্বিতীয় নীতি এবং এটি ‘এক’-এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এরিস্টটল একে ‘বড় এবং ছোট’ (the great and the small) বলেও উল্লেখ করেছেন। এটি হলো:
- বহুত্বের নীতি (Principle of Plurality): এটি সবকিছুকে বিভাজিত করে, সংখ্যায় বাড়ায়। এটি হলো সেই শক্তি যা এককে ভেঙে বহু করে।
- আকারহীনতার নীতি (Principle of Formlessness): এর নিজস্ব কোনো নির্দিষ্ট আকার বা সীমা নেই। এটি অসীম (apeiron) এবং বিশৃঙ্খল।
- অস্থিতিশীলতার নীতি (Principle of Instability): এটি কোনো কিছুকে স্থির থাকতে দেয় না, বরং তাকে ক্রমাগত বেশি বা কম, বড় বা ছোট, তীব্র বা মৃদু হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়। যেমন, গরম এবং ঠান্ডার মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিভাজন রেখা নেই; এটি একটি নিরন্তর স্কেল। এই নিরন্তর পরিবর্তনশীলতার নীতিই হলো ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’।
এটি যেন সেই কাঁচামাল বা উপাদান (matter/substrate), যার ওপর ‘এক’ ক্রিয়া করে জগৎ তৈরি করে। এটি বিশৃঙ্খলা, অসীম বিভাজন এবং আকারহীনতার উৎস। এটিকে একটি নেতিবাচক বা মন্দ নীতি হিসেবে দেখার সুযোগ থাকলেও, প্লেটোর কাছে এটি ছিল জগতের সৃষ্টির জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। ‘এক’ একা কিছু সৃষ্টি করতে পারে না; তার ক্রিয়া করার জন্য একটি ক্ষেত্র প্রয়োজন, আর সেই ক্ষেত্রটিই হলো ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’।
উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক
বিষয়টা বুঝতে একটা সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরুন, একজন সঙ্গীতশিল্পী একটি সুর তৈরি করবেন। তাঁর মনে সুরের একটি ধারণা আছে—একটি নির্দিষ্ট তাল, লয় এবং মেলোডি। এই ধারণাটি হলো ‘এক’-এর মতো—ঐক্যবদ্ধ, সুশৃঙ্খল এবং নির্দিষ্ট। আর তাঁর সামনে আছে নিস্তব্ধতা, যা থেকে যেকোনো সুর বা শব্দ তৈরি হতে পারে। এই অসীম সম্ভাবনাময় নিস্তব্ধতা বা শব্দের কাঁচামাল হলো ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’-এর মতো।
শিল্পী যখন তাঁর যন্ত্রে সেই নির্দিষ্ট সুরটি বাজান, তখন তিনি আসলে কী করেন? তিনি তাঁর মনের ভেতরের ওই ‘এক’-এর ধারণাকে (নির্দিষ্ট সুর) ওই অসীম সম্ভাবনার (শব্দ) ওপর আরোপ করেন। এই আরোপের ফলেই বিশৃঙ্খল শব্দ একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল এবং অর্থপূর্ণ সুরে পরিণত হয়।
প্লেটোর মতে, আমাদের এই জগৎ ঠিক এভাবেই তৈরি হয়েছে। পরম ‘এক’ বা ‘শুভ’ এই আকারহীন, বিশৃঙ্খল ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’-এর ওপর ক্রিয়া করে জগতের সমস্ত কিছুকে—গ্রহ-নক্ষত্র থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি, এমনকি আমাদের নৈতিক গুণাবলি পর্যন্ত—একটি নির্দিষ্ট রূপ, সীমা ও শৃঙ্খলা দান করেছে (Gaiser, 1980)। একটি নৈতিক গুণ, যেমন ‘সাহস’, সেটিও এই দুই নীতির মিশ্রণ। খুব বেশি সাহস হলো হঠকারিতা (rashness), আর খুব কম সাহস হলো ভীরুতা (cowardice)। সাহস হলো এই দুই প্রান্তিকের (অনির্দিষ্ট দ্বৈত) মাঝখানে ‘এক’ দ্বারা নির্ধারিত একটি সঠিক অনুপাত বা মধ্যপন্থা।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: পিথাগোরাস ও প্রাক-সক্রেটীয় দর্শন
প্লেটোর এই দুই নীতির ধারণা আকাশ থেকে পড়েনি। এর শেকড় ছিল প্রাচীন গ্রিক দর্শনের গভীরে। প্লেটো আসলে তাঁর পূর্বসূরিদের চিন্তার এক বিশাল সংশ্লেষণ ঘটিয়েছিলেন।
-
পিথাগোরাস (Pythagoras): পিথাগোরাসের অনুগামীরা বিশ্বাস করতেন যে, এই মহাবিশ্বের মূল ভিত্তি হলো সংখ্যা। জগতের সবকিছুই গাণিতিক অনুপাত দিয়ে তৈরি। তাঁদের দর্শনেও দুটি বিপরীতধর্মী নীতির কথা বলা হয়েছিল—সীমা (Peras) এবং অসীম (Apeiron)। প্লেটোর ‘এক’ অনেকটা পিথাগোরীয় ‘সীমা’-র মতো, যা বিশৃঙ্খলকে সুশৃঙ্খল করে। আর ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’ হলো ‘অসীম’-এর ধারণার একটি পরিশীলিত রূপ। প্লেটোর দর্শনে গণিতের এই কেন্দ্রীয় ভূমিকা সরাসরি পিথাগোরীয় প্রভাবের ফল।
-
পার্মেনাইডিস (Parmenides): পার্মেনাইডিস বলেছিলেন, সত্তা হলো এক, অখণ্ড, অপরিবর্তনীয় এবং শাশ্বত। তাঁর এই পরম ‘এক’-এর ধারণা প্লেটোর ‘The One’-কে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পার্মেনাইডিসের কাছে বহুত্ব ও পরিবর্তন ছিল কেবলই মায়া।
-
হেরাক্লিটাস (Heraclitus): অন্যদিকে, হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, জগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল, সবকিছুই নিরন্তর এক প্রবাহের মধ্যে রয়েছে (“panta rhei”)। এই চির-পরিবর্তনশীল, অস্থিতিশীলতার ধারণাটি প্লেটোর ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’-এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। হেরাক্লিটাসের কাছে স্থিতি বা ঐক্য ছিল মায়া।
সুতরাং, প্লেটোর অলিখিত মতবাদকে তাঁর পূর্বসূরিদের—বিশেষ করে পার্মেনাইডিসের স্থির ‘এক’ এবং হেরাক্লিটাসের চঞ্চল ‘বহুত্ব’—এই দুই চরম বিপরীত ধারণার মধ্যে একটি সেতুবন্ধনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে। প্লেটো দেখিয়েছেন, জগৎ কেবল এক নয়, আবার কেবল বহুও নয়, বরং এক ও বহুর এক জটিল মিথস্ক্রিয়া।
ফর্ম, সংখ্যা এবং জগতের স্তরবিন্যাস
প্লেটোর সংলাপগুলোতে আমরা যে ফর্মের তত্ত্ব (Theory of Forms) পাই, সেখানে ফর্মগুলোকে বলা হয়েছে চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় আদর্শ রূপ। যেমন, ‘সৌন্দর্য’-এর একটি ফর্ম আছে, ‘ন্যায়’-এর একটি ফর্ম আছে।
অলিখিত মতবাদে এই ফর্মের ধারণাটি আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় এবং আরও সুনির্দিষ্ট হয়। এরিস্টটলের সাক্ষ্য অনুযায়ী, প্লেটো তাঁর শেষ জীবনে ফর্মগুলোকে সংখ্যার সঙ্গে এক করে দেখতেন। তিনি এগুলোকে বলতেন ‘আদর্শ সংখ্যা’ (Ideal Numbers)। প্রতিটি ফর্মই যেন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বা গাণিতিক অনুপাত। এই আদর্শ সংখ্যাগুলো আমাদের পরিচিত গণিতের ১, ২, ৩, ৪-এর মতো নয়, যা দিয়ে আমরা গণনা করি। এগুলো হলো স্বয়ং ‘দ্বিত্ব’ (Twoness), ‘ত্রিত্ব’ (Threeness) ইত্যাদির ফর্ম।
তাহলে জগতের চূড়ান্ত স্তরবিন্যাস বা হায়ারার্কি (hierarchy) কেমন দাঁড়াল?
- ১. সর্বোচ্চ স্তর (Principles): দুটি আদি নীতি—‘এক’ (The One) এবং ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’ (The Indefinite Dyad)। এরা জগতের অন্য সবকিছুর উৎস, কিন্তু নিজেরা অন্য কিছু থেকে উৎপন্ন নয়।
- ২. দ্বিতীয় স্তর (Forms/Ideal Numbers): আদর্শ সংখ্যা বা ফর্ম। এগুলো হলো প্রথম দুই নীতির সরাসরি মিলনের ফল। ‘এক’ যখন ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’-এর ওপর সীমা আরোপ করে, তখনই এই আদর্শ সংখ্যা বা ফর্মগুলোর জন্ম হয়। যেমন, ‘এক’ দ্বৈতকে সীমিত করে ‘দ্বিত্ব’-এর ফর্ম তৈরি করে। এই স্তরেই ‘ন্যায়’, ‘সৌন্দর্য’, ‘সাহস’ ইত্যাদি ফর্মগুলো অবস্থান করে, যা আসলে এক ধরনের জটিল গাণিতিক অনুপাত।
- ৩. তৃতীয় স্তর (Mathematical Objects): জ্যামিতিক আকার (বিন্দু, রেখা, তল), এবং সাধারণ গণিতের সংখ্যা (mathematical numbers)। এগুলো ফর্মের জগতের চেয়ে নিম্নস্তরের, কারণ এগুলো বহুত্ব ধারণ করে (যেমন, অনেকগুলো ত্রিভুজ থাকতে পারে), কিন্তু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের চেয়ে উচ্চস্তরের কারণ এগুলো বিশুদ্ধ ও বিমূর্ত।
- ৪. চতুর্থ স্তর (Sensible World): আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, পরিবর্তনশীল জগৎ। যা হলো ফর্মের জগতের একটি চলন্ত, অসম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি।
এই কাঠামোটি বুঝতে পারলে প্লেটোর দর্শনকে আর বিচ্ছিন্ন কিছু তত্ত্বের সমষ্টি বলে মনে হয় না। বরং মনে হয়, এটি একটি সুসংহত, অখণ্ড দর্শন-ব্যবস্থা, যার শিখরে রয়েছে এক পরম অধিবিদ্যা, যা থেকে ধাপে ধাপে বাকি সবকিছু নেমে এসেছে।
সংলাপগুলোর নতুন পাঠ: অলিখিত মতবাদের আলোয়
অলিখিত মতবাদের তত্ত্বটি যদি সত্যি হয়, তবে প্লেটোর বিখ্যাত সংলাপ বা ডায়ালগগুলোকে আর আগের মতো করে পড়া যায় না। সেগুলোকে নতুন আলোয় দেখতে হয়। টিউবিঙেন স্কুলের গবেষকরা দেখিয়েছেন, কীভাবে এই তত্ত্ব সংলাপগুলোর অনেক দুর্বোধ্য অংশকে স্পষ্ট করে তোলে।
-
ফিলেবাস (Philebus): প্লেটোর এই শেষ দিকের সংলাপটিকে অলিখিত মতবাদের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ সাক্ষী হিসেবে দেখা হয়। এখানে সক্রেটিস জগতের সবকিছুকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন: (১) সীমা (Peras), (২) অসীম (Apeiron), (৩) উভয়ের মিশ্রণ (Mixture), এবং (৪) মিশ্রণের কারণ (Cause of the Mixture)। এই পরিভাষাগুলো এরিস্টটলের বর্ণনা করা প্লেটোর অলিখিত মতবাদের সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। ‘সীমা’ হলো ‘এক’, ‘অসীম’ হলো ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’, এবং ‘কারণ’ হলো সেই ঐশ্বরিক বুদ্ধি বা নূস (Nous) যা এই মিলন ঘটায়।
-
রিপাবলিক (Republic): ‘রিপাবলিক’-এর কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘শুভের রূপ’ বা Form of the Good। প্লেটো একে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সূর্য যেমন আমাদের দেখার ক্ষমতা দেয় এবং সবকিছুকে দৃশ্যমান করে, তেমনি ‘শুভের রূপ’ আমাদের জানার ক্ষমতা দেয় এবং অন্য সব ফর্মকে অস্তিত্ব ও সারবত্তা দান করে। অলিখিত মতবাদের নিরিখে, এই ‘শুভের রূপ’ আর কিছুই নয়, এটি হলো সর্বোচ্চ নীতি ‘এক’। রাষ্ট্রের গঠন, আত্মার গঠন—সবকিছুতেই সেই একই নীতির প্রতিফলন দেখা যায়: একটি শাসক নীতি (যুক্তি বা Reason) যা আবেগ ও বাসনার বহুত্বকে (অনির্দিষ্ট দ্বৈত) নিয়ন্ত্রণ করে শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।
-
পার্মেনাইডিস (Parmenides): এই সংলাপটি প্লেটোর সবচেয়ে কঠিন এবং রহস্যময় রচনাগুলোর একটি। এখানে বৃদ্ধ পার্মেনাইডিস তরুণ সক্রেটিসকে ‘এক’ সম্পর্কে কিছু জটিল ধাঁধার মতো প্রশ্ন (hypotheses) দিয়ে নাজেহাল করছেন। যেমন: যদি ‘এক’ থাকে, তাহলে কী হয়? আর যদি ‘এক’ না থাকে, তাহলেই বা কী হয়? প্রচলিত ব্যাখ্যায় এটি একটি নিছক যুক্তির অনুশীলন। কিন্তু অলিখিত মতবাদের আলোকে, এটি হলো একাডেমির ছাত্রদের জন্য একটি অত্যাধুনিক মানসিক ব্যায়াম (gymnastic exercise)। এর উদ্দেশ্য হলো ছাত্রদেরকে সর্বোচ্চ নীতি ‘এক’-এর জটিল এবং আপাতবিরোধী প্রকৃতি সম্পর্কে ভাববার জন্য প্রস্তুত করা।
-
টিমিয়াস (Timaeus): এই সংলাপে প্লেটো জগৎ সৃষ্টির একটি পৌরাণিক কাহিনী শুনিয়েছেন। এখানে এক কারিগর বা ডেমিউর্গ (Demiurge) ফর্মের জগতের দিকে তাকিয়ে বিশৃঙ্খল উপাদান বা খোরা (Chora/Receptacle)-র ওপর শৃঙ্খলা ও গাণিতিক অনুপাত আরোপ করে এই মহাবিশ্ব তৈরি করছেন। এই কাহিনীটিকে অলিখিত মতবাদের একটি চমৎকার রূপক বা পৌরাণিক উপস্থাপন হিসেবে দেখা যায়। ডেমিউর্গ এখানে ‘এক’-এর প্রতিনিধি, যিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’-এর প্রতীক খোরার ওপর কাজ করে জগৎ সৃষ্টি করছেন।
সেই কিংবদন্তিতুল্য বক্তৃতা: ‘মঙ্গল প্রসঙ্গে’ (On the Good)
প্লেটোর অলিখিত মতবাদের অস্তিত্বের পক্ষে একটি চমৎকার ঐতিহাসিক ঘটনা প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। ঘটনাটি হলো প্লেটোর একটি প্রকাশ্য বক্তৃতা, যার বিষয় ছিল ‘মঙ্গল প্রসঙ্গে’ বা ‘On the Good’ (Περὶ τἀγαθοῦ)।
এরিস্টটলের ছাত্র এরিস্টোক্সেনাস (Aristoxenus) এই ঘটনার একটি মজার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, এথেন্সের বহু সাধারণ মানুষ প্লেটোর এই বিখ্যাত বক্তৃতা শোনার জন্য ভিড় জমিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, প্লেটো বুঝি মানুষের জীবনের ভালো জিনিসগুলো—যেমন স্বাস্থ্য, সম্পদ, শক্তি—এইসব নিয়ে কথা বলবেন। অর্থাৎ, দৈনন্দিন জীবনের মঙ্গল বা সুখ নিয়ে আলোচনা হবে।
কিন্তু বক্তৃতা শুরু হওয়ার পর তাদের সকলের আক্কেল গুড়ুম! প্লেটো সম্পদ বা স্বাস্থ্য নিয়ে একটি শব্দও বললেন না। পরিবর্তে তিনি গণিত, সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যামিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে দুর্বোধ্য আলোচনা শুরু করলেন। তিনি বোঝাতে লাগলেন কীভাবে জগতের সমস্ত কিছু সংখ্যার মাধ্যমে গঠিত এবং কীভাবে সবকিছু একটি চূড়ান্ত ঐক্যের দিকে নির্দেশ করে। এবং সবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, পরম ‘মঙ্গল’ বা ‘The Good’ আসলে ‘এক’ (The One)।
বলাই বাহুল্য, অধিকাংশ শ্রোতা কিছুই বুঝতে না পেরে হতাশ হয়ে এবং কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে চলে গিয়েছিল। তারা যা শুনতে এসেছিল, তার সঙ্গে এই গাণিতিক অধিবিদ্যার কোনো মিল খুঁজে পায়নি (Gaiser, 1980)।
এই ঘটনাটি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরে। প্রথমত, প্লেটো সত্যিই তাঁর সর্বোচ্চ দার্শনিক তত্ত্ব জনসমক্ষে আলোচনা করেছিলেন, কিন্তু তা ছিল অদীক্ষিত বা অপ্রস্তুত শ্রোতাদের বোঝার ক্ষমতার বাইরে। দ্বিতীয়ত, এটি প্রমাণ করে যে তাঁর দর্শনের কেন্দ্রে ‘The Good’-এর ধারণাটি ‘The One’-এর ধারণার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল, যা এরিস্টটলের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
বিরোধীদের বক্তব্য: পাল্টা যুক্তি কী?
প্লেটোর অলিখিত মতবাদের ধারণাটি যে সবাই নিঃশর্তভাবে মেনে নিয়েছে, তা কিন্তু নয়। এর বিরুদ্ধেও বেশ কিছু জোরালো যুক্তি আছে, যা এই বিতর্ককে আজও জীবন্ত রেখেছে। আমেরিকার বিখ্যাত প্লেটো-গবেষক হ্যারল্ড চেরনিস (Harold Cherniss) এবং গ্রেগরি ভ্লাস্টোস (Gregory Vlastos) ছিলেন এই ধারণার ঘোর বিরোধী।
তাঁদের প্রধান যুক্তিগুলো হলো:
- ১. নীরবতার যুক্তি (Argument from Silence): বিরোধীদের সবচেয়ে বড় এবং সরল প্রশ্ন হলো, প্লেটোর অলিখিত মতবাদ যদি এতই গুরুত্বপূর্ণ হবে, তবে প্লেটো তাঁর বিশাল সাহিত্যকর্মে (যা প্রায় ৩০টি সংলাপ নিয়ে গঠিত) এর কোনো স্পষ্ট উল্লেখ করলেন না কেন? তাঁর সংলাপগুলোতে তো অনেকবার সুযোগ ছিল এই দুটি আদি নীতির কথা সরাসরি বলার। কিন্তু তিনি তা করেননি। এই দীর্ঘ নীরবতা কি প্রমাণ করে না যে এমন কোনো গোপন তত্ত্ব ছিলই না?
- ২. সাক্ষ্যের দুর্বলতা এবং এরিস্টটলের ব্যাখ্যা: চেরনিস তাঁর বিখ্যাত বই The Riddle of the Early Academy (1945)-এ যুক্তি দিয়েছেন যে, অলিখিত মতবাদের পক্ষে সবচেয়ে বড় সাক্ষী হলেন এরিস্টটল, কিন্তু এরিস্টটল নিজেই প্লেটোকে ভুল বুঝেছিলেন। চেরনিসের মতে, এরিস্টটল প্লেটোর দর্শনকে তাঁর নিজের দার্শনিক কাঠামোর (যেমন, চারটি কারণের তত্ত্ব) মধ্যে ফেলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি প্লেটোর রূপক এবং পৌরাণিক ভাষাগুলোকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে একটি পদ্ধতিগত দর্শন তৈরি করেছেন যা আসলে প্লেটোর ছিল না। চেরনিস দেখানোর চেষ্টা করেন যে, এরিস্টটল যে তত্ত্বগুলোর কথা বলেছেন, তার প্রতিটি উপাদানের বীজ প্লেটোর সংলাপের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
- ৩. দর্শনের বিকাশ বনাম স্থির ব্যবস্থা: প্লেটোর সংলাপগুলো পড়লে মনে হয়, তাঁর চিন্তা স্থির ছিল না, বরং সারাজীবন ধরে বিকশিত হয়েছে। তাঁর প্রথম দিকের সংলাপ (যেমন, অ্যাপোলজি), মধ্যবর্তী সংলাপ (যেমন, রিপাবলিক) এবং শেষ দিকের সংলাপের (যেমন, ফিলেবাস, আইন) মধ্যে চিন্তার পরিবর্তন ও বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই বিকাশমান, অনুসন্ধানী, এবং কখনও কখনও স্ব-বিরোধী চরিত্রটি একটি আগে থেকে ঠিক করে রাখা স্থির, সুশৃঙ্খল ও গোপন ব্যবস্থার ধারণার সঙ্গে মেলে না। বিরোধীদের মতে, টিউবিঙেন স্কুল প্লেটোর জীবন্ত ও পরীক্ষামূলক দর্শনকে একটি মৃত, অনমনীয় তন্ত্রে (dogmatic system) পরিণত করেছে।
- ৪. সংলাপের সাহিত্যিক ও দার্শনিক মূল্য: প্লেটোর দর্শনের আসল সৌন্দর্য ও শক্তি তাঁর সংলাপের মধ্যেই নিহিত। সংলাপের নাটকীয়তা, চরিত্রগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া, যুক্তির উত্থান-পতন এবং আলোচনার উন্মুক্ত প্রকৃতি—এগুলোই হলো প্লেটোনিক দর্শনের প্রাণ। অলিখিত মতবাদের তত্ত্বটি এই সংলাপগুলোকে নিছক একটি ভূমিকা বা প্রবেশিকা বানিয়ে দেয়, যা প্লেটোর সাহিত্যিক ও দার্শনিক প্রতিভার প্রতি একপ্রকার অবিচার।
একই নদীর ভিন্ন ভিন্ন স্রোত: প্লেটোর না-বলা কথা ও তার উত্তরাধিকার
একটি তুলনামূলক দার্শনিক অভিযাত্রা
এতক্ষণ আমরা জানলাম যে, প্লেটো শুধু সুন্দর সংলাপ লেখেননি, বরং তাঁর একাডেমির নিভৃত কক্ষে এক গভীর, পদ্ধতিগত দর্শনের কথা বলতেন। তাঁর সেই না-বলা কথা বা ‘অলিখিত মতবাদে’র কেন্দ্রে ছিল দুটি আদি নীতি—পরম ‘এক’ (The One) এবং বিশৃঙ্খল ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’ (The Indefinite Dyad)। এই দুই নীতি থেকেই ধাপে ধাপে ফর্ম, সংখ্যা এবং সবশেষে আমাদের এই চেনা জগতের জন্ম।
এখন এক নতুন, আরও জটিল প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এই গোপন দর্শন, এই না-বলা কথাগুলোর কী হলো? প্লেটোর মৃত্যুর পর তাঁর শিক্ষার্থীরা এবং পরবর্তী প্রজন্মের দার্শনিকরা এই রহস্যময় তত্ত্বকে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন? তাঁরা কি একে সযত্নে লালন করেছিলেন, নাকি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন? নাকি নিজেদের মতো করে বদলে নিয়েছিলেন?
বিষয়টা অনেকটা এমন, যেন এক মহান সঙ্গীতশিল্পী তাঁর জীবনের সেরা সুরটি কেবল তাঁর সবচেয়ে কাছের শিষ্যদের শুনিয়ে গেছেন, কোনো স্বরলিপি লিখে যাননি। এখন সেই শিষ্যরা যখন নিজেরা শিল্পী হলেন, তাঁরা সেই সুরকে কীভাবে ব্যবহার করলেন? কেউ কি হুবহু সেই সুরটিই বাজানোর চেষ্টা করলেন? কেউ কি তার ওপর ভিত্তি করে নতুন সুর তৈরি করলেন? নাকি কেউ সেই সুরের মূল কাঠামোটাকেই অস্বীকার করে বসলেন?
এখন আমরা সেই গল্পটাই শুনব। প্লেটোর অলিখিত মতবাদের এই নদী কীভাবে বিভিন্ন খাতে বয়ে গেছে, তার একটা তুলনামূলক চিত্র আঁকার চেষ্টা করব। আমাদের এই যাত্রায় আমরা দেখব প্লেটোর শ্রেষ্ঠ ছাত্র এরিস্টটল, তাঁর একাডেমির উত্তরাধিকারী, এবং পরবর্তী প্লেটোনিক দার্শনিকরা কীভাবে এই গুহ্য জ্ঞানের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছিলেন।
প্রথম সাক্ষী এবং প্রথম বিদ্রোহী – এরিস্টটল
এরিস্টটল ছিলেন প্লেটোর ছায়াসঙ্গী। প্রায় বিশ বছর তিনি প্লেটোর একাডেমিতে কাটিয়েছেন। প্লেটোর না-বলা কথাগুলোর সবচেয়ে বড় সাক্ষী যদি কেউ থেকে থাকেন, তবে তিনি এরিস্টটল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তিনি কেবল সাক্ষীই ছিলেন না, ছিলেন এই মতের প্রথম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচকও। তাঁর দর্শনকে প্লেটোর অলিখিত মতবাদের সঙ্গে একটি দীর্ঘ, জটিল বিতর্কের ফসল হিসেবে দেখা যায়।
সাদৃশ্য ও প্রভাব: প্লেটোর ছায়া যেখানে রয়ে গেল
এরিস্টটল প্লেটোর দর্শন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও, তাঁর চিন্তার কাঠামোয় প্লেটোর, বিশেষ করে তাঁর অলিখিত মতবাদের, গভীর ছাপ রয়ে গেছে।
১. প্রথম নীতি বা চালিকাশক্তির ধারণা: প্লেটোর দর্শনের শিখরে ছিল ‘এক’ বা ‘শুভ’ (The One/The Good), যা ছিল জগতের চূড়ান্ত উৎস। এরিস্টটলও তাঁর দর্শনে একটি প্রথম নীতির কথা বলেছেন, যার নাম ‘অচল চালক’ বা ‘প্রাইম মুভার’ (Unmoved Mover)। প্লেটোর ‘এক’-এর মতো এরিস্টটলের প্রাইম মুভারও শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় এবং জগতের চূড়ান্ত কারণ। কিন্তু তাদের কাজের ধরনে পার্থক্য আছে। প্লেটোর ‘এক’ জগৎ সৃষ্টি করে আকারহীন দ্বৈতের ওপর সীমা আরোপ করে। অন্যদিকে, এরিস্টটলের প্রাইম মুভার জগৎকে চালায় আকর্ষণের মাধ্যমে। সে নিজে নড়ে না, কিন্তু জগৎ তার প্রতি ভালোবাসায় বা আকর্ষণে চালিত হয়, ঠিক যেমন একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার চিন্তায় চালিত হয়। মূল কাঠামোটা একই—এক পরম উৎস থেকে জগতের শৃঙ্খলা আসছে।
২. আকার ও উপাদানের দ্বৈতবাদ (Form and Matter): প্লেটোর অলিখিত মতবাদের দুটি মূল ভিত্তি ছিল ‘এক’ (আকার ও শৃঙ্খলার উৎস) এবং ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’ (আকারহীন উপাদান)। এরিস্টটল এই দ্বৈতবাদকে সরাসরি গ্রহণ করেছেন, কিন্তু তাকে এক নতুন রূপ দিয়েছেন। প্লেটোর ‘এক’ এবং ‘দ্বৈত’ ছিল জগতের বাইরে থাকা দুটি অতীন্দ্রিয় (transcendent) নীতি। এরিস্টটল এদেরকে জগতের ভেতরে, প্রতিটি বস্তুর মধ্যে নিয়ে এলেন। তাঁর কাছে প্রতিটি বস্তুই দুটি জিনিস দিয়ে তৈরি—আকার (Form) এবং উপাদান (Matter)। যেমন, একটি ব্রোঞ্জের মূর্তির উপাদান হলো ব্রোঞ্জ, আর তার আকার হলো ভাস্করের দেওয়া মূর্তির রূপটি। এখানে প্লেটোর ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’ যেন এরিস্টটলের ‘উপাদান’ (Matter) হয়ে উঠেছে, যা সম্ভাবনাময় কিন্তু আকারহীন। আর প্লেটোর ‘এক’-এর নির্ধারক ভূমিকাটি যেন এরিস্টটলের ‘আকার’ (Form) হয়ে উঠেছে, যা সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়।
বৈসাদৃশ্য ও বিদ্রোহ: যেখানে এরিস্টটল আলাদা পথ ধরলেন
এরিস্টটল প্লেটোর কাঠামোর অনেক কিছু নিলেও, তার ভিত্তিটাকেই বদলে দিয়েছিলেন।
১. অতীন্দ্রিয় বনাম জাগতিক (Transcendent vs. Immanent): এটাই হলো প্লেটো আর এরিস্টটলের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য। প্লেটোর কাছে আসল জগৎ ছিল ফর্মের অতীন্দ্রিয় জগৎ। আমাদের এই চেয়ারগুলো নকল, কিন্তু ‘চেয়ার’-এর আসল ফর্মটি অন্য জগতে আছে। এরিস্টটল বললেন, না, এটা অর্থহীন। ফর্ম বা আকার বস্তুর বাইরে কোথাও থাকে না, বরং বস্তুর ভেতরেই থাকে। প্রতিটি নির্দিষ্ট ঘোড়ার মধ্যেই ‘ঘোড়াত্ব’-এর আকারটি নিহিত আছে, আলাদা কোনো স্বর্গে নেই। তিনি প্লেটোর দর্শনকে স্বর্গ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনলেন।
২. গণিত বনাম জীববিজ্ঞান: প্লেটোর অলিখিত মতবাদের জগতটা ছিল মূলত গাণিতিক। তাঁর কাছে বাস্তবতার মূল চাবিকাঠি ছিল সংখ্যা আর জ্যামিতি। এরিস্টটল ছিলেন মূলত একজন জীববিজ্ঞানী। তাঁর কাছে বাস্তবতাকে বোঝার মডেল ছিল জীবন্ত প্রাণী, সংখ্যা নয়। তিনি প্রাণীদের পর্যবেক্ষণ করে, তাদের শ্রেণিবিন্যাস করে জগৎকে বুঝতে চেয়েছেন। তাই তাঁর দর্শনে গণিতের ভূমিকা কমে গেল এবং পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার গুরুত্ব বাড়ল।
সুতরাং, এরিস্টটলের দর্শন হলো প্লেটোর অলিখিত মতবাদের সঙ্গে এক দীর্ঘ কথোপকথন। তিনি প্লেটোর পদ্ধতিগত কাঠামোটি (প্রথম নীতি, আকার-উপাদানের দ্বৈতবাদ) গ্রহণ করেছেন, কিন্তু তার অতীন্দ্রিয়বাদী ও গাণিতিক চরিত্রকে বর্জন করে তাকে এক অভিজ্ঞতাবাদী ও জাগতিক দর্শনে রূপান্তরিত করেছেন।
গোঁড়া বা অর্থোডক্স উত্তরাধিকারী – আর্লি প্লেটোনিজম (প্রাচীন আকাদেমি)
প্লেটোর মৃত্যুর পর তাঁর একাডেমির হাল ধরলেন যারা, যেমন তাঁর ভাগ্নে স্পিউসিপাস এবং পরে জেনোক্রেটিস, তাঁরা এরিস্টটলের মতো বিদ্রোহী ছিলেন না। বরং তাঁরা ছিলেন গুরুর না-বলা কথাগুলোর সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গোঁড়া অনুসারী। তাঁরা এই অলিখিত মতবাদকে প্লেটোর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করে তাকে আরও কঠোর ও পদ্ধতিগত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
-
স্পিউসিপাস (Speusippus): তিনি প্লেটোর অলিখিত মতবাদের গাণিতিক দিকটার ওপর এতটাই জোর দিয়েছিলেন যে তিনি ফর্মের ধারণাকে প্রায় বাতিল করে দেন। তিনি বলেন, বাস্তবতার মূল ভিত্তি হলো সংখ্যা, যা প্লেটোর দুই নীতি—‘এক’ এবং ‘বহুত্ব’ (তাঁর কাছে অনির্দিষ্ট দ্বৈতের নাম)—থেকে উৎপন্ন। তিনি প্লেটোর দর্শনকে একটি বিশুদ্ধ গাণিতিক ব্যবস্থায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি প্লেটোর ‘এক’=‘শুভ’ এই সমীকরণ মানেননি। তাঁর মতে, ‘শুভ’ শুরুতে থাকে না, বরং বিকাশের শেষে পাওয়া যায়।
-
জেনোক্রেটিস (Xenocrates): তিনি ছিলেন একজন সমন্বয়কারী। তিনি প্লেটোর সংলাপের ফর্ম এবং অলিখিত মতবাদের সংখ্যাকে এক করে ফেলার চেষ্টা করেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল, “ফর্ম হলো সংখ্যা।” তিনি প্লেটোর দুই নীতির তত্ত্বকে পুরোপুরি গ্রহণ করেন এবং এর ওপর ভিত্তি করে তাঁর ত্রিস্তরীয় জগতের (ইন্দ্রিয়াতীত, স্বর্গীয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য) ধারণা দেন। তাঁর বিখ্যাত সংজ্ঞা, “আত্মা হলো স্ব-চালিত সংখ্যা”, অলিখিত মতবাদের সরাসরি প্রয়োগের একটি চমৎকার উদাহরণ।
সুতরাং, প্রাচীন আকাদেমি প্লেটোর অলিখিত মতবাদকে কোনো রহস্য হিসেবে দেখেনি। তাদের কাছে এটাই ছিল আসল প্লেটোনিজম। তারা এরিস্টটলের মতো একে চ্যালেঞ্জ না করে, বরং একেই তাদের দর্শনের ভিত্তিপ্রস্তর বানিয়েছিল।
সমন্বয় ও রূপান্তর – মিডল প্লেটোনিজম
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে তৃতীয় শতক পর্যন্ত সময়কালকে মিডল প্লেটোনিজম বলা হয়। এই সময়ে প্লেটোনিজম অন্যান্য প্রভাবশালী দর্শন, বিশেষ করে এরিস্টটলবাদ এবং স্টোয়িসিজমের সঙ্গে একটি দীর্ঘ বিতর্কে লিপ্ত হয় এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিতও হয়। এই পর্বের দার্শনিকরা প্লেটোর অলিখিত মতবাদের কাঠামোকে এক নতুন, ধর্মতাত্ত্বিক রূপ দেন।
-
পরম ঈশ্বরের ধারণা: মিডল প্লেটোনিজমে প্লেটোর সর্বোচ্চ নীতি ‘এক’ বা ‘শুভ’ ধীরে ধীরে এক পরম, অতীন্দ্রিয় এবং প্রায় ব্যক্তিক ঈশ্বরের রূপ নিতে থাকে। এই ঈশ্বর জগতের ঊর্ধ্বে বাস করেন এবং তিনি পরিপূর্ণ মঙ্গলময়।
-
ফর্ম কিভাবে ঈশ্বরের চিন্তা: তাহলে ফর্মগুলো কোথায় থাকে? মিডল প্লেটোনিস্টরা এর এক চমৎকার সমাধান বের করেন। তাঁরা বলেন, ফর্মগুলো হলো এই পরম ঈশ্বরেরই চিন্তা বা ভাবনা (thoughts in the mind of God)। এই ধারণাটি প্লেটোনিজমের সঙ্গে ইহুদি ধর্মতত্ত্বের মেলবন্ধনে সাহায্য করে, যেমনটা আলেকজান্দ্রিয়ার ফিলো (Philo of Alexandria)-র লেখায় দেখা যায়।
-
স্পষ্ট স্তরবিন্যাস: এই সময়ে প্লেটোর দর্শনের স্তরবিন্যাস আরও স্পষ্ট ও জটিল হয়ে ওঠে। একেবারে শীর্ষে আছেন পরম ঈশ্বর (‘এক’)। তাঁর নিচে আছে ফর্ম বা তাঁর চিন্তা। তারপর আছে এক দ্বিতীয় ঈশ্বর বা ডেমিয়ার্জ, যিনি ফর্মগুলোর দিকে তাকিয়ে জগৎ সৃষ্টি করেন। এবং সবশেষে আছে আমাদের এই জাগতিক জগৎ। প্লেটোর ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’-কে প্রায়শই বিশৃঙ্খল ‘উপাদান’ (Matter) হিসেবে দেখা হতো, যা মন্দের উৎস।
সুতরাং, মিডল প্লেটোনিজম প্লেটোর অলিখিত মতবাদের দুই নীতি এবং স্তরবিন্যাসের ধারণাকে গ্রহণ করে, কিন্তু তাকে একটি ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে নতুন করে সাজিয়ে তোলে। এখানে প্লেটোর দর্শন এরিস্টটল ও স্টোয়িকদের কিছু ধারণার সঙ্গে মিশে এক নতুন রূপ লাভ করে।
রহস্যময় চূড়ান্ত পরিণতি – নিওপ্লেটোনিজম
খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে প্লোটিনাস (Plotinus) নামে এক মহাজ্ঞানী দার্শনিকের হাত ধরে প্লেটোনিজমের যে চূড়ান্ত ও সবচেয়ে প্রভাবশালী রূপটি জন্মায়, তাই হলো নিওপ্লেটোনিজম। নিওপ্লেটোনিজমকে প্লেটোর অলিখিত মতবাদের সবচেয়ে গভীর, জটিল এবং আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা হিসেবে দেখা হয়। প্লোটিনাস প্লেটোর দুই নীতি এবং স্তরবিন্যাসের ধারণাকে এক বিশাল, গতিশীল সৃষ্টিতত্ত্বে পরিণত করেন।
পরম ‘এক’ (The One): প্লোটিনাসের দর্শনের কেন্দ্রে রয়েছে ‘এক’। এটি প্লেটোর ‘এক’-এর ধারণারই চূড়ান্ত রূপ। এই ‘এক’ এতটাই অতীন্দ্রিয় যে একে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, এমনকি একে ‘সত্তা’ বা ‘ঈশ্বর’ বললেও কম বলা হয়। এটি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এটি কোনো কিছু ইচ্ছা করে সৃষ্টি করে না। পূর্ণতার কারণে এর থেকে আলোকরশ্মির মতো আপনাআপনি বাকি সবকিছু উৎসারিত (emanate) হয়, যেভাবে সূর্য থেকে আলো ছড়ায় কিন্তু সূর্যের কোনো কমতি হয় না।
উৎসারণের তিনটি স্তর (Three Hypostases): ‘এক’ থেকে তিনটি প্রধান স্তর উৎসারিত হয়:
-
বুদ্ধি বা Nous (Intellect): এটি ‘এক’ থেকে উৎসারিত প্রথম স্তর। এখানেই প্লেটোর ফর্মের জগৎ অবস্থিত। এটি হলো সেই ঐশ্বরিক মন যেখানে সমস্ত ফর্ম চিরস্থায়ীভাবে বাস করে।
-
আত্মা বা Soul (Psyche): এটি Nous থেকে উৎসারিত হয়। এর দুটি দিক আছে—একটি ঊর্ধ্বমুখী, যা Nous-এর দিকে তাকিয়ে থাকে, এবং একটি নিম্নমুখী, যা আমাদের এই জাগতিক জগৎকে সৃষ্টি ও পরিচালনা করে।
-
উপাদান বা Matter (Hyle): এটি হলো নিঃসরণের সর্বনিম্ন স্তর, যেখানে ‘এক’-এর আলো প্রায় নিভে যায়। এটি হলো অন্ধকারের প্রতীক, আকারহীনতা এবং মন্দের উৎস। প্লেটোর ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’-এর ধারণাটি এখানে মন্দের একটি পূর্ণাঙ্গ অধিবিদ্যক ব্যাখ্যায় পরিণত হয়েছে।
প্লোটিনাসের দর্শন কেবল সৃষ্টিতত্ত্বেই থেমে থাকে না, এটি একটি আধ্যাত্মিক যাত্রার পথও বাতলে দেয়। মানুষের আত্মার লক্ষ্য হলো এই স্তরগুলো পার হয়ে আবার তার উৎস, অর্থাৎ পরম ‘এক’-এর সঙ্গে মিলিত হওয়া। এই রহস্যময় মিলনই হলো জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
সুতরাং, নিওপ্লেটোনিজম প্লেটোর অলিখিত মতবাদের কাঠামোকে তার যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে গেছে। দুই নীতির ধারণাটি এখানে এক গতিশীল নিঃসরণ (emanation) এবং প্রত্যাবর্তন (return) প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে, যা পরবর্তী হাজার বছর ধরে পশ্চিমা ও ইসলামিক রহস্যবাদকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
তুলনামূলক সারণী: এক নজরে উত্তরাধিকার
দার্শনিক ধারা | ‘এক’ (The One) বা প্রথম নীতির ব্যাখ্যা | ‘অনির্দিষ্ট দ্বৈত’ (The Dyad) বা দ্বিতীয় নীতির ব্যাখ্যা | ফর্মের অবস্থান ও প্রকৃতি |
এরিস্টটল | অচল চালক (Unmoved Mover); জগতের আকর্ষণের কেন্দ্র। | আকারহীন উপাদান (Matter); সম্ভাবনাময় সত্তা। | জাগতিক; প্রতিটি বস্তুর ভেতরে নিহিত (Immanent)। |
আর্লি প্লেটোনিজম | পরম ‘এক’ ও ‘শুভ’; সংখ্যার উৎস। | বহুত্ব বা অসীম; সংখ্যার অপর উপাদান। | সংখ্যা; ‘এক’ ও ‘বহুত্ব’ থেকে উৎপন্ন আদর্শ সংখ্যা। |
মিডল প্লেটোনিজম | পরম, অতীন্দ্রিয় ঈশ্বর। | বিশৃঙ্খল উপাদান; মন্দের উৎস। | ঈশ্বরের মনে থাকা চিন্তা বা ভাবনা (Transcendent)। |
নিওপ্লেটোনিজম | পরম, неописуемый ‘এক’; সবকিছুর উৎস, যা থেকে জগৎ উৎসারিত হয়। | উপাদান (Matter); নিঃসরণের সর্বনিম্ন স্তর, মন্দের উৎস। | Nous বা বুদ্ধির জগতে অবস্থিত (Transcendent)। |
শেষ কথা: যে নদী আজও বহমান
প্লেটোর না-বলা কথাগুলোর এই দীর্ঘ যাত্রা আমাদের দেখায়, কীভাবে একটি গভীর দার্শনিক ধারণা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হতে পারে। এটি অনেকটা ডিএনএ-র মতো, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হয়, কিন্তু প্রতিটি নতুন প্রজন্মে একটু ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়।
-
এরিস্টটল এই ডিএনএ-কে গ্রহণ করে তার কিছু জিন বদলে দিয়ে এক নতুন প্রজাতির (জাগতিক দর্শন) জন্ম দিয়েছেন।
-
আর্লি প্লেটোনিস্টরা এই ডিএনএ-কে বিশুদ্ধ রাখতে চেয়েছেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে একটি কঠোর পারিবারিক কাঠামো তৈরি করেছেন।
-
মিডল প্লেটোনিস্টরা এই ডিএনএ-র সঙ্গে অন্য দর্শনের ডিএনএ মিশিয়ে এক শংকর (syncretic) রূপ তৈরি করেছেন।
-
আর প্লোটিনাস এই ডিএনএ-র মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমস্ত সম্ভাবনাকে বিকশিত করে তাকে এক মহাজাগতিক ও আধ্যাত্মিক রূপ দিয়েছেন।
প্লেটোর অলিখিত মতবাদকে বোঝা তাই কেবল একটি ঐতিহাসিক কৌতূহল মেটানো নয়। এটি হলো পশ্চিমা দর্শনের মূল স্রোতটিকে বোঝার একটি চাবিকাঠি। এটি আমাদের দেখায় যে, প্লেটো কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন সুন্দর সংলাপের রচয়িতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক গভীর পদ্ধতির নির্মাতা, যাঁর চিন্তা পরবর্তী হাজার বছরের দর্শন ও ধর্মতত্ত্বকে পথ দেখিয়েছে। তাঁর সেই না-বলা কথাগুলো হয়তো আজও আমাদের চারপাশে কোনো না কোনো রূপে রয়ে গেছে, কেবল কান পেতে শোনার অপেক্ষা। সেই নদীর স্রোত আজও হয়তো নিঃশব্দে বয়ে চলেছে।
উপসংহার: আমরা কোন প্লেটোকে গ্রহণ করব? এক অসমাপ্ত অনুসন্ধান
এই দীর্ঘ, জটিল এবং রহস্যময় আলোচনার শেষে আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম? প্লেটোর কি সত্যিই একটি গোপন দর্শন ছিল, যা তিনি কেবল তাঁর বিশ্বস্ত শিষ্যদেরই শিখিয়েছেন?
এই প্রশ্নের কোনো ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তর নেই। হয়তো কোনোদিনও পাওয়া যাবে না। আমরা টাইম মেশিনে চড়ে প্লেটোর একাডেমিতে ফিরে যেতে পারব না। কিন্তু এই বিতর্কের আসল গুরুত্ব হয়তো উত্তর খুঁজে পাওয়ার মধ্যে নয়, বরং প্রশ্নটির মধ্যেই নিহিত। প্লেটোর অলিখিত মতবাদের তত্ত্বটি, তা ঐতিহাসিক সত্যি হোক বা না হোক, আমাদের প্লেটোকে নতুন করে পড়তে শেখায়, নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্লেটোর সংলাপগুলো হয়তো শুধু দার্শনিক যুক্তির একটি শুষ্ক সংকলন নয়, বরং তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এগুলো পাঠককে একটি নির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক এবং বৌদ্ধিক পথে চালিত করার জন্য অত্যন্ত যত্নসহকারে তৈরি করা শৈল্পিক ও শিক্ষামূলক মাধ্যম। এই তত্ত্ব আমাদের বাধ্য করে প্লেটোর লেখার প্রতিটি লাইনের আড়ালে, প্রতিটি রূপকের গভীরে লুকিয়ে থাকা সম্ভাব্য অর্থের কথা ভাবতে।
আমরা হয়তো কোনোদিন প্লেটোর একাডেমির সেই ক্লাসরুমে ফিরে যেতে পারব না, যেখানে তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রদের কাছে জগতের গভীরতম রহস্যের কথা বলতেন। সেই জ্ঞান হয়তো সময়ের অতলে চিরতরে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার প্রতিধ্বনি রয়ে গেছে এরিস্টটলের লেখায়, নব্য-প্লেটোনিকদের দর্শনে, এবং হয়তো প্লেটোর নিজের লেখার ইশারায়, তাঁর রেখে যাওয়া সূত্রগুলোর মধ্যে।
আমাদের সামনে এখন দুটি প্লেটো। একজন হলেন লেখক প্লেটো—উজ্জ্বল, স্পষ্ট, যুক্তিবাদী, যিনি তাঁর অমর সংলাপগুলোর মাধ্যমে আজও আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। আরেকজন হলেন শিক্ষক প্লেটো—যাঁর কণ্ঠস্বর ক্ষীণ, রহস্যময়, প্রায় শোনা যায় না, কিন্তু যাঁর আকর্ষণ দুর্নিবার।
হয়তো প্লেটোকে পুরোপুরি বোঝার জন্য এই দুই প্লেটোকেই আমাদের প্রয়োজন। তাঁর লেখা সংলাপগুলো হলো সেই সুন্দর, সাজানো-গোছানো পথ, যা আমাদের দর্শনের মন্দিরের ফটক পর্যন্ত নিয়ে যায়। আর তাঁর অলিখিত মতবাদের ধারণাটি হলো সেই মন্দিরের আবছা অন্ধকারে থাকা গর্ভগৃহের একটি ঝলক, যা আমাদের চিরকাল বিস্মিত, কৌতূহলী এবং অনুসন্ধিৎসু করে রাখে।
শেষ পর্যন্ত, প্লেটোর দর্শন হয়তো কোনো সমাপ্ত সিদ্ধান্তের নাম নয়। এটি এক অসমাপ্ত যাত্রার নাম। তিনি উত্তর দেওয়ার চেয়ে বেশি প্রশ্ন তৈরি করে গেছেন। আর এখানেই হয়তো তাঁর মহত্ত্ব। তিনি আমাদের হাতে কোনো তৈরি করা সহজ উত্তর তুলে দেননি, বরং অনন্ত জিজ্ঞাসার পথে ঠেলে দিয়েছেন। সেই জিজ্ঞাসার পথেই হয়তো একদিন, কোনো এক মুহূর্তে, আমাদের নিজের আত্মাতেই সেই আলোর ঝলকানি দেখা দেবে, যার কথা তিনি তাঁর সপ্তম পত্রে বলে গিয়েছিলেন।
কে জানে! জগৎ এবং জ্ঞান, দুটোই বড় রহস্যময়।
তথ্যসূত্র
- Aristotle. (n.d.). Metaphysics (W. D. Ross, Trans.). The Internet Classics Archive. (Original work published c. 350 B.C.E.)
- Cherniss, H. F. (1945). The riddle of the early academy. University of California Press.
- Cooper, J. M. (Ed.). (1997). Plato: Complete works. Hackett Publishing Company.
- Gaiser, K. (1993). Plato’s enigmatic lecture ‘On the Good’. In D. J. O’Meara (Ed.), Plato’s enigmatic lecture ‘On the Good’ (pp. 24–52). Clarendon Press.
- Krämer, H. J. (1990). Plato and the foundations of metaphysics: A work on the theory of the principles and unwritten doctrines of Plato with a collection of the fundamental documents (J. R. Catan, Trans.). SUNY Press.
- Reale, G. (1997). Toward a new interpretation of Plato (J. R. Catan & G. R. T. Eccles, Trans.). The Catholic University of America Press.
- Szlezák, T. A. (1999). Reading Plato (G. Zanker, Trans.). Routledge.
- Vlastos, G. (1981). On Plato’s unwritten doctrines. In Platonic studies (pp. 379–403). Princeton University Press.
Leave a Reply