Table of Contents
ভূমিকা
ইতিহাস জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। কখনও মনে হয় শুকনো কিছু ঘটনা আর সাল-তারিখের তালিকা, আবার কখনও মনে হয় জীবন্ত এক আয়না, যেখানে আমরা নিজেদের মুখ দেখি। এই আয়না যিনি আমাদের সামনে প্রথম বৈজ্ঞানিক স্বচ্ছতায় তুলে ধরেছিলেন, তাঁর নাম থুসিডাইডিস (Thucydides)। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের মানুষ। কিন্তু তাঁর লেখা ‘পেলোপনেশীয় যুদ্ধের ইতিহাস’ (History of the Peloponnesian War) পড়লে মনে হয়, এই তো, গতকালকের খবরের কাগজের ভেতরের পাতার বিশ্লেষণ পড়ছি। মানুষ বদলায় না, পরিস্থিতি বদলায়। কিংবা হয়তো পরিস্থিতিও বদলায় না, শুধু পাত্র-পাত্রী আর জায়গার নামগুলো বদলে যায়। ইতিহাসের মঞ্চে একই নাটক ঘুরেফিরে অভিনীত হয়, কেবল অভিনেতারা নতুন মুখোশ পরে আসে।
থুসিডাইডিস কেবল একজন ইতিহাসবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক। তাঁর লেখা শুধু এথেন্স আর স্পার্টার সাতাশ বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের কাহিনী নয়, এটি মানব প্রকৃতির এক গভীর ব্যবচ্ছেদ। কেন মানুষ যুদ্ধ করে? ক্ষমতা আসলে কী? ন্যায়-অন্যায়বোধ কি পরিস্থিতির সাথে বদলে যায়? রাষ্ট্রনায়কদের অহংকার কীভাবে একটি জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়? গণতন্ত্রের মহত্তম আদর্শ আর তার নিষ্ঠুরতম রূপের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? এই প্রশ্নগুলো তিনি এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যা আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন এবং সামরিক চিন্তার জগতে কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে আছে।
আসুন, আমরা ডুব দিই থুসিডাইডিসের জগতে। তবে ভয় পাবেন না, এখানে জটিল তত্ত্বের কচকচানি থাকবে না। বরং থাকবে গল্প, থাকবে মানুষের ভেতরের রূপ দেখার এক আশ্চর্য আয়না। আমরা দেখব, কীভাবে একজন পরাজিত সেনাপতির নির্বাসনের যন্ত্রণা হয়ে উঠল মানব সভ্যতার জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
পর্যবেক্ষক এবং তাঁর জগৎ (The Man Behind the Curtain)
যেকোনো লেখকের দর্শন বুঝতে হলে আগে তাঁর জীবন ও সময়কে একটু ছুঁয়ে দেখতে হয়। থুসিডাইডিসের জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এমন এক সময়ে যখন এথেন্স তার স্বর্ণযুগের চূড়ায় অবস্থান করছিল। পেরিক্লিসের (Pericles) নেতৃত্বে গণতন্ত্র, দর্শন, শিল্পকলা, স্থাপত্য—সবকিছুতেই এথেন্স ছিল অদ্বিতীয়। সেটি ছিল এক আশ্চর্য সময়। একদিকে পার্থেননের মতো স্থাপত্যশৈলীর বিস্ময়কর নিদর্শন তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে সক্রেটিস রাস্তায় রাস্তায় তরুণদের সাথে তর্কে মাতাচ্ছেন, তাদের এতদিনের বিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ফেলছেন। সফোক্লিস আর ইউরিপিডিসের নাটকগুলো মানুষের নিয়তি, অহংকার আর নৈতিকতার জটিল প্রশ্নগুলো মঞ্চে জীবন্ত করে তুলছে। এমন এক টগবগে, আত্মবিশ্বাসী এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্পন্দনশীল এথেন্সের সন্তান ছিলেন থুসিডাইডিস।
তিনি জন্মেছিলেন এক সম্ভ্রান্ত এবং ধনী পরিবারে। থ্রেস অঞ্চলে তাঁর পারিবারিক খনির মালিকানা ছিল, যা তাঁকে দিয়েছিল অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং উঁচু মহলে মেলামেশার সুযোগ। শুধু তাই নয়, তিনি এথেন্সের একজন নির্বাচিত সেনাপতি বা ‘স্ট্র্যাটেগোস’ (Strategos) পদেও আসীন হয়েছিলেন। এটি কোনো সামান্য পদ ছিল না। এথেনীয় গণতন্ত্রে দশজন ‘স্ট্র্যাটেগোস’ ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক ও রাজনৈতিক নির্বাহীদের মধ্যে অন্যতম। অর্থাৎ, তিনি কেবল দূর থেকে ঘটনা দেখতেন না, ঘটনার একজন সক্রিয় অংশীদারও ছিলেন। তিনি জানতেন ক্ষমতা কীভাবে কাজ করে, সংসদে বিতর্ক কীভাবে হয়, জনগণের আবেগ কীভাবে সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, আর যুদ্ধের ময়দানে একটি ভুল গণনার পরিণাম কী হতে পারে।
যে হাওয়া গড়েছিল পাহাড়: থুসিডাইডিসের দর্শনের শেকড় সন্ধান
মানুষ একা একা তৈরি হয় না। প্রতিটি মানুষ তার সময়ের সন্তান। তার চিন্তার সুতো বোনা হয় পারিপার্শ্বিক ঘটনা, চারপাশের মানুষের বিশ্বাস আর বাতাসের মধ্যে ভেসে বেড়ানো নানা রকম ধারণা দিয়ে। যে মানুষটিকে আমরা ইতিহাসের প্রথম বৈজ্ঞানিক চিন্তাবিদ বলি, সেই থুসিডাইডিসও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর যে হিমশীতল, নির্মোহ দর্শন আমাদের আজও ভাবায়, তা শূন্য থেকে জন্ম নেয়নি। বরং তাঁর চারপাশের রাজনৈতিক ঝড় এবং পূর্ববর্তী দার্শনিকদের চিন্তার ঢেউয়ের সংঘাত থেকেই জন্ম নিয়েছিল সেই অনন্য দৃষ্টিকোণ।
কিন্তু কীভাবে? কোন হাওয়া লেগেছিল তাঁর পালে? কোন স্রোত তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল ক্ষমতার এমন গভীর এবং কখনও কখনও অন্ধকার এক উপলব্ধির দিকে? চলুন, আজ আমরা সেই শেকড়ের সন্ধান করি। আমরা দেখব, কীভাবে এথেন্সের স্বর্ণযুগ, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং কিছু অসাধারণ চিন্তাবিদের দর্শন মিলেমিশে তৈরি করেছিল থুসিডাইডিসের জগৎ।
যে ঝড়ের নাম পেলোপনেশীয় যুদ্ধ (The Political Cauldron)
থুসিডাইডিসের চিন্তার আঁতুড়ঘর ছিল তাঁর সময়। তিনি এমন এক পৃথিবীতে চোখ মেলেছিলেন, যা একদিকে ছিল সম্ভাবনায় ভরপুর, অন্যদিকে ছিল সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে। তাঁর দর্শনকে বুঝতে হলে এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বোঝাটা জরুরি।
পারস্য যুদ্ধের ছায়া এবং এথেন্সের উত্থান
থুসিডাইডিসের জন্মের ঠিক আগেই গ্রিক বিশ্ব এক বিশাল ঝড় সামলে উঠেছিল—পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (The Persian Wars, 499-449 BCE)। এথেন্স এবং স্পার্টার নেতৃত্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্রগুলো অবিশ্বাস্যভাবে বিশাল পারস্য বাহিনীকে পরাজিত করে। এই জয় গ্রিকদের মধ্যে, বিশেষ করে এথেনীয়দের মধ্যে, এক অভাবনীয় আত্মবিশ্বাস ও গর্বের জন্ম দেয়। তারা ভাবতে শুরু করে, তারা অসাধারণ, তাদের ভাগ্য বিধাতা নিজেই গড়ে দিচ্ছেন।
এই যুদ্ধের পর থেকেই জন্ম নেয় এথেনীয় সাম্রাজ্য। পারস্যের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আক্রমণ থেকে ঈজিয়ান সাগরের দ্বীপ ও নগর-রাষ্ট্রগুলোকে রক্ষা করার জন্য এথেন্সের নেতৃত্বে ‘ডেলিয়ান লিগ’ (Delian League) নামে একটি সামরিক জোট গঠিত হয়। সদস্যরা হয় জাহাজ দিত, নয়তো তার বদলে অর্থ দিত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পারস্যের হুমকি কমে গেলেও এথেন্স এই জোটকে ছাড়েনি। বরং তারা মিত্রদের ওপর জোর খাটাতে শুরু করে। যা ছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী জোট, তা ধীরে ধীরে পরিণত হয় একটি কর-আদায়কারী সাম্রাজ্যে। কোনো রাষ্ট্র জোট ছাড়তে চাইলে এথেন্স তার নৌ-শক্তি দিয়ে তাদের দমন করত। (Kagan, 2003)।
থুসিডাইডিস এই সাম্রাজ্যের উত্থান ও তার কার্যকলাপ খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে আত্মরক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে ক্ষমতা, গৌরব আর অর্থনৈতিক স্বার্থের চাপে এক আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। তাঁর বিখ্যাত তিনটি চালিকাশক্তি—ভয়, সম্মান ও স্বার্থ—এর বাস্তব প্রয়োগ তিনি এখানেই প্রথম দেখেছিলেন।
পেরিক্লিসের স্বর্ণযুগ এবং গণতন্ত্রের আস্ফালন
থুসিডাইডিসের যৌবন কেটেছে পেরিক্লিসের (Pericles) শাসনামলে, যা ‘এথেন্সের স্বর্ণযুগ’ নামে পরিচিত। এই সময়ে এথেন্স গণতন্ত্র, দর্শন, শিল্পকলা এবং স্থাপত্যের শিখরে পৌঁছেছিল। পার্থেননের মতো স্থাপত্য তৈরি হচ্ছে, নাগরিকদের সরাসরি গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ে এথেন্স ছিল আত্মবিশ্বাসের প্রতিমূর্তি। পেরিক্লিস তাঁর বিখ্যাত ভাষণে এথেন্সকে ‘গ্রিসের বিদ্যালয়’ (School of Hellas) বলে অভিহিত করেছিলেন।
কিন্তু এই গণতন্ত্রের পেছনেও একটি অন্ধকার দিক ছিল। এর খরচ আসত সাম্রাজ্যের শোষিত মিত্রদের কাছ থেকে পাঠানো করের টাকায়। এথেনীয় গণতন্ত্র তার নাগরিকদের জন্য যতটা উদার ছিল, বহিরাগতদের জন্য ছিল ততটাই কঠোর। থুসিডাইডিস দেখেছিলেন, কীভাবে একই রাষ্ট্রব্যবস্থা একই সাথে মহৎ আদর্শ এবং নিষ্ঠুর শোষণের ধারক হতে পারে। এই দ্বৈত রূপ তাঁর চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি বুঝেছিলেন, আদর্শের কথা বলা সহজ, কিন্তু ক্ষমতার বাস্তবতা ভিন্ন।
যুদ্ধের উন্মাদনা এবং নেতৃত্বের অবক্ষয়
পেরিক্লিসের মৃত্যুর পর এথেন্সের রাজনৈতিক নেতৃত্বে এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়। সেই জায়গা দখল করে ক্লিয়নের (Cleon) মতো উগ্র জনতোষী নেতারা (demagogues)। তারা যুক্তির চেয়ে জনগণের আবেগকে বেশি গুরুত্ব দিত। তারা সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য চরম নিষ্ঠুরতার পক্ষে সওয়াল করত। মাইটিলিনির বিতর্কে (Mytilenean Debate) ক্লিয়ন যেভাবে সমস্ত পুরুষকে হত্যার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন, তা থুসিডাইডিসকে দেখিয়েছিল যে, গণতন্ত্র কতটা সহজেই উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনে পরিণত হতে পারে। তিনি দেখেছিলেন, বিচক্ষণ নেতৃত্ব ছাড়া গণতন্ত্রের জাহাজ বিপথে চালিত হতে বাধ্য। (Finley, 1963)।
এই রাজনৈতিক অবক্ষয়, যুদ্ধের নৃশংসতা এবং নিজের নির্বাসনের অভিজ্ঞতা—এই সবকিছু মিলে থুসিডাইডিসের মনে রাষ্ট্র ও ক্ষমতা সম্পর্কে একটি মোহমুক্ত, বাস্তববাদী এবং প্রায়শই হতাশাব্যঞ্জক ধারণার জন্ম দিয়েছিল।
পেলোপনেশীয় যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান – পেলোপনেসীয় যুদ্ধ: যখন ভাইয়ের বুকে ছুরি চালায় ভাই
পুরোনো প্রজ্ঞা, নতুন প্রশ্ন (The Intellectual Ferment)
থুসিডাইডিস কেবল রাজনৈতিক ঘটনার পর্যবেক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের একজন সক্রিয় অংশীদার। তাঁর দর্শনকে বুঝতে হলে সেই সময়ের দার্শনিক ও চিন্তকদের প্রভাবও বিবেচনা করতে হবে।
হেরোডোটাসের ছায়া (The Shadow of Herodotus)
যেকোনো বড় চিন্তাবিদ তাঁর পূর্বসূরির কাঁধে দাঁড়িয়েই জগৎকে দেখেন, কখনও সেই কাঁধ থেকে লাফ দিয়ে নতুন পথে হাঁটেন। থুসিডাইডিসের জন্য সেই পূর্বসূরি ছিলেন হেরোডোটাস, ‘ইতিহাসের জনক’। হেরোডোটাস ছিলেন একজন অসাধারণ গল্পকার। তাঁর ইতিহাস ছিল নানা রকম লোককথা, কিংবদন্তী আর আশ্চর্য ঘটনায় ভরপুর। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেবতারা মানুষের ভাগ্যে হস্তক্ষেপ করেন এবং অহংকারীকে (hubris) শাস্তি দেন।
থুসিডাইডিস ঠিক এর উল্টো পথে হেঁটেছিলেন। তিনি হেরোডোটাসের পদ্ধতিকে একরকম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ইতিহাস হবে যুক্তিনির্ভর এবং তথ্যভিত্তিক। তাঁর লেখায় দেবতাদের কোনো ভূমিকা নেই। যা আছে তা হলো মানুষের সিদ্ধান্ত এবং তার পরিণাম। এই অর্থে, তিনি ছিলেন প্রথম সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসবিদ। তিনি হেরোডোটাসের মতো গল্প বলতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন ঘটনার পেছনের কার্যকারণ সম্পর্ক (cause and effect) খুঁজে বের করতে। এটি ছিল এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। (Hornblower, 2008)।
সফিস্টদের আগমন: যখন সত্য আপেক্ষিক (The Sophists: When Truth Became Relative)
থুসিডাইডিসের ওপর সবচেয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছিল যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, তার নাম সফিজম (Sophism)। সফিস্টরা ছিলেন একদল পরিব্রাজক শিক্ষক, যারা অর্থের বিনিময়ে তরুণদের অলঙ্কারশাস্ত্র (rhetoric), রাজনীতি এবং সফল হওয়ার কৌশল শেখাতেন। তাঁরা প্রচলিত বিশ্বাসগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিলেন।
সফিস্টদের মূল অবদান ছিল দুটি ধারণার মধ্যে বিতর্ক তৈরি করা: নোমোস (Nomos) এবং ফিসিস (Physis)।
-
নোমোস মানে হলো মানুষের তৈরি আইন, প্রথা বা নৈতিকতা। যেমন, ‘চুরি করা অন্যায়’—এটি একটি নোমোস।
-
ফিসিস মানে হলো প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক নিয়ম। যেমন, ‘সবল প্রাণী দুর্বল প্রাণীকে শিকার করে’—এটি হলো ফিসিস।
সফিস্টরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, আমাদের ন্যায়-অন্যায় বোধ কি প্রকৃতির অংশ (ফিসিস), নাকি এটি কেবল সমাজের সুবিধার্থে তৈরি করা একটি নিয়ম (নোমোস)? প্রোটাগোরাসের (Protagoras) মতো সফিস্টরা বলতেন, “মানুষই সবকিছুর পরিমাপক” (Man is the measure of all things)। এর অর্থ হলো, কোনো পরম সত্য বা নৈতিকতা নেই। যা একজনের কাছে সত্য, তা আরেকজনের কাছে মিথ্যা হতে পারে।
এই চিন্তা থুসিডাইডিসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর বিখ্যাত মেলিয়ান ডায়ালগে (Melian Dialogue) আমরা এই বিতর্কের সরাসরি প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। মেলোসের অধিবাসীরা নোমোস বা ন্যায়ের কথা বলে, আর এথেনীয়রা ফিসিস বা প্রকৃতির নিয়মকে তুলে ধরে। তারা বলে, “শক্তিশালীরা যা পারে তাই করে, আর দুর্বলদের তা-ই মেনে নিতে হয়।” এটা ছিল সফিস্টদের বিতর্কের এক বাস্তব প্রয়োগ। থুসিডাইডিস দেখিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলো প্রায়শই ফিসিস-এর নিয়মেই চলে, যেখানে শক্তিই হলো চূড়ান্ত সত্য। (Guthrie, 1971)।
এছাড়া, সফিস্টরা অলঙ্কারশাস্ত্র বা কথা বলার শিল্পের ওপর জোর দিতেন। থুসিডাইডিসের বইয়ের বিখ্যাত বক্তৃতাগুলো, যেখানে তিনি বিভিন্ন পক্ষের যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা সফিস্টদের অলঙ্কারশাস্ত্রের প্রভাবকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
চিকিৎসকের চোখে ইতিহাস (The Physician’s Gaze)
থুসিডাইডিসের সময়ে গ্রিসে আরেকটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ঘটছিল—বিজ্ঞানের জগতে, বিশেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্রে। হিপোক্রেটিস (Hippocrates) এবং তাঁর অনুসারীরা রোগকে আর ঈশ্বরের অভিশাপ বা অলৌকিক ঘটনা বলে মানতে রাজি ছিলেন না। তারা রোগের প্রাকৃতিক কারণ অনুসন্ধান করতেন। তারা রোগীর লক্ষণগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন, রোগ নির্ণয় করতেন এবং তার সম্ভাব্য গতিপথ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা করতেন।
থুসিডাইডিসের ইতিহাস লেখার পদ্ধতির সাথে এর আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
- ১. পর্যবেক্ষণ: তিনি ঘটনার খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করতেন।
- ২. রোগ নির্ণয় (Diagnosis): তিনি ঘটনার পেছনের মূল কারণ (truest cause) খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন। যেমন, পেলোপনেশীয় যুদ্ধের মূল কারণ ছিল স্পার্টার ভয়।
- ৩. প্রোগনোসিস (Prognosis): তিনি বিশ্বাস করতেন, যেহেতু মানব প্রকৃতি অপরিবর্তনীয়, তাই একই ধরনের পরিস্থিতি ভবিষ্যতেও তৈরি হবে।
তাঁর বইয়ে এথেন্সের প্লেগের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা প্রায় একটি মেডিকেল রিপোর্টের মতো। তিনি নিজে সেই রোগে ভুগেছিলেন এবং এর লক্ষণগুলো একজন চিকিৎসকের নির্মোহ দৃষ্টিতে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে ইতিহাসকে একটি মানবিক নাটক হিসেবে না দেখে, একটি বিশ্লেষণাত্মক কেস স্টাডি হিসেবে দেখতে সাহায্য করেছিল। (Cochrane, 1929)।
মঞ্চের ট্র্যাজেডি, ইতিহাসের ট্র্যাজেডি (Tragedy on Stage, Tragedy in History)
থুসিডাইডিসের সময়ে এথেন্স ছিল গ্রিক ট্র্যাজেডির কেন্দ্র। এস্কাইলাস, সফোক্লিস আর ইউরিপিডিসের মতো নাট্যকারদের নাটকগুলো মানুষের অহংকার (hubris), নিয়তি এবং পতনের গল্প বলত। এই নাটকগুলোর একটি সাধারণ কাঠামো ছিল: একজন মহৎ নায়ক তার কোনো ভুলের কারণে বা অহংকারের বশবর্তী হয়ে সীমা লঙ্ঘন করে এবং তার ফলে তার জীবনে বিপর্যয় (nemesis) নেমে আসে।
থুসিডাইডিসের ইতিহাসকে প্রায়শই একটি বিশাল গ্রিক ট্র্যাজেডি হিসেবে পাঠ করা হয়, যেখানে নায়ক হলো স্বয়ং এথেন্স।
-
মহত্ত্ব: পেরিক্লিসের ভাষণে এথেন্সের যে আদর্শ রূপ আমরা দেখি, তা হলো নায়কের মহত্ত্ব।
-
অহংকার (Hubris): মেলোসের প্রতি নিষ্ঠুরতা এবং সিসিলি অভিযানের মতো উচ্চাভিলাষী ও বেপরোয়া সিদ্ধান্ত ছিল এথেন্সের অহংকারের প্রকাশ।
-
পতন (Nemesis): সিসিলি অভিযানে বিপর্যয়কর পরাজয় এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে হেরে যাওয়া ছিল সেই অহংকারের অনিবার্য পরিণতি।
থুসিডাইডিস হয়তো সচেতনভাবেই তাঁর ইতিহাসকে একটি ট্র্যাজেডির কাঠামোতে সাজিয়েছিলেন, যাতে পাঠকরা কেবল ঘটনাগুলোই না জানে, বরং এর পেছনের গভীর নৈতিক এবং দার্শনিক তাৎপর্যও অনুধাবন করতে পারে। (Cornford, 1907)।
স্রোতের সংমিশ্রণ
শেষ পর্যন্ত আমরা কী দেখতে পাই? থুসিডাইডিস কোনো একক ঝর্ণা থেকে জল পান করেননি। তাঁর চিন্তার নদীটি তৈরি হয়েছিল একাধিক স্রোতের সংমিশ্রণে।
তিনি তাঁর সময়ের রাজনৈতিক সংঘাত থেকে পেয়েছিলেন কাঁচামাল—ক্ষমতার লড়াই, সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, গণতন্ত্রের সংকট। সফিস্টদের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন প্রশ্ন করার সাহস এবং বিশ্লেষণের ধারালো অস্ত্র। হিপোক্রেটিসের বিজ্ঞানমনস্কতা তাঁকে শিখিয়েছিল নির্মোহ পর্যবেক্ষণ। আর ট্র্যাজেডির নাট্যকাররা তাঁকে দিয়েছিলেন একটি কাঠামো, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রিয় শহরের উত্থান ও পতনের মহাকাব্যকে একটি চিরন্তন মানব কাহিনীতে রূপ দিতে পেরেছিলেন।
এই সবগুলো উপাদান মিলেমিশে এমন এক দর্শনের জন্ম দিয়েছিল যা ছিল তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। থুসিডাইডিস আমাদের দেখিয়েছেন, পৃথিবীকে বুঝতে হলে কেবল ঘটনার দিকে তাকালেই চলবে না, তাকাতে হবে তার পেছনের অদৃশ্য শক্তিগুলোর দিকে—মানুষের প্রকৃতি, ক্ষমতার লোভ এবং চিন্তাগুলোর সংঘাতের দিকে। আর তাই আড়াই হাজার বছর পরেও তাঁর লেখা পুরনো হয় না, বরং নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
নির্বাসনের সেই অভিশাপ থেকে হওয়া আশীর্বাদ
তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ৪২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পেলোপনেশীয় যুদ্ধের সময় তাঁকে উত্তর গ্রিসের অ্যাম্ফিপোলিস (Amphipolis) শহর রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটি ছিল এথেন্সের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর, কারণ এর আশেপাশে ছিল মূল্যবান খনি এবং নৌ-কাঠ তৈরির জঙ্গল। কিন্তু স্পার্টার সেই সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান এবং ক্ষিপ্র সেনাপতি ব্রাসিদাসের (Brasidas) ঝটিকা আক্রমণের সামনে থুসিডাইডিস সময়মতো পৌঁছাতে পারেননি। শহরটি স্পার্টার দখলে চলে যায়।
এথেনীয় গণতন্ত্র যেমন তার নায়কদের মাথায় তুলে নাচত, তেমনি ব্যর্থদের ছুড়ে ফেলতেও এক মুহূর্ত দ্বিধা করত না। এই ব্যর্থতার শাস্তি হিসেবে থুসিডাইডিসকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। দীর্ঘ বিশ বছরের নির্বাসন!
একজন সফল সেনাপতি এবং এথেন্সের অভিজাত নাগরিকের জন্য এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে? নিজের প্রিয় শহর থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি শত্রুদের এলাকায়, মিত্রদের এলাকায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু এই অভিশাপই মানব সভ্যতার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই দীর্ঘ নির্বাসনের সময়েই তিনি পেলোপনেশীয় যুদ্ধের ইতিহাস লেখার মনস্থির করেন। নির্বাসিত হওয়ায় তিনি এক অভাবনীয় সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি স্পার্টানদের সাথে কথা বলতে পারতেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারতেন। তিনি পেলোপনেশীয় লিগের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মিশে এথেন্সের সাম্রাজ্য সম্পর্কে তাদের ক্ষোভ ও ভয়ের কারণগুলো সরাসরি জানতে পারতেন। এই বিচরণশীল জীবন তাঁকে একটি একক দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠতে সাহায্য করেছিল।
একজন পরাজিত এবং নির্বাসিত সেনাপতি হিসেবে তিনি ক্ষমতার চূড়া এবং পতনের অন্ধকার—দুটোই খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর লেখাকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। তিনি নিছক জয়-পরাজয়ের গল্প বলেননি, তিনি বলতে চেয়েছেন এর পেছনের কারণগুলো, মানুষের মনস্তত্ত্বকে (psychology)।
এক নতুন ধারার ইতিহাস: দৈবকে বিদায়
তিনি তাঁর লেখার শুরুতেই এক বৈপ্লবিক ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, তাঁর লেখায় কোনো পৌরাণিক কাহিনী বা লোকমুখে প্রচলিত চটকদার গল্প থাকবে না, যা শুনতে ভালো লাগলেও সত্য থেকে অনেক দূরে। তাঁর পূর্বসূরি হেরোডোটাসকে (Herodotus) বলা হয় ‘ইতিহাসের জনক’, কিন্তু তাঁর লেখায় গল্প, জনশ্রুতি আর ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের ছড়াছড়ি ছিল। হেরোডোটাস বিশ্বাস করতেন, দেবতারা মানুষের ভাগ্যে হস্তক্ষেপ করেন, অহংকারীকে শাস্তি দেন।
থুসিডাইডিস সেই পথ সম্পূর্ণ বর্জন করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো কঠোর তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ তৈরি করা। তিনি ইতিহাসের জগৎ থেকে দেবতাদের নির্বাসিত করলেন। তাঁর মতে, ঘটনার পেছনে কাজ করে মানুষের সিদ্ধান্ত, আবেগ এবং স্বার্থ—কোনো দৈব শক্তি নয়। এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের পেছনে সম্ভবত তাঁর সময়ের চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটিসের (Hippocrates) প্রভাব ছিল। হিপোক্রেটিস যেমন রোগকে ঈশ্বরের অভিশাপ না বলে প্রাকৃতিক কারণের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, থুসিডাইডিসও তেমনি যুদ্ধ ও রাজনৈতিক ঘটনাকে মানবিক কারণের ফল হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।
তিনি লেখেন, তাঁর কাজ হয়তো চটকদার গল্পের অভাবে পাঠককে সেভাবে আকর্ষণ করবে না, কিন্তু এটি হবে ‘চিরকালের সম্পদ’ (a possession for all time)। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, “মানব প্রকৃতি (human nature) যেহেতু একই রকম থাকে, তাই অতীতে যা ঘটেছে, তার অনুরূপ বা কাছাকাছি ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটবে।” তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর লেখা যেন ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক ও নাগরিকদের জন্য একটি শিক্ষণীয় উপাদান হয়ে থাকে, যেন তারা অতীতের ভুল থেকে শিখতে পারে (Kagan, 2009)। এই লক্ষ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন প্রথম ‘বৈজ্ঞানিক ইতিহাসবিদ’ (scientific historian), যিনি কার্যকারণ সম্পর্ক (cause and effect) দিয়ে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, দৈব বা ভাগ্য (Tyche) দিয়ে নয়।
মানব প্রকৃতির চালিকাশক্তি (The Human Equation)
থুসিডাইডিসের দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে মানব প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা। তিনি মনে করতেন, মানুষের কর্মকাণ্ডের পেছনে কিছু সার্বজনীন এবং অপরিবর্তনীয় চালিকাশক্তি কাজ করে। রাষ্ট্র হলো মানুষেরই সমষ্টি, তাই রাষ্ট্রও সেই একই চালিকাশক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। তাঁর বিখ্যাত বইয়ের প্রথম খণ্ডে স্পার্টায় পাঠানো এথেনীয় দূতদের ভাষণে তিনি এই তিনটি মূল চালিকাশক্তির কথা বলেন। এগুলো হলো ভয়, সম্মান এবং স্বার্থ। আসুন, এই তিনটিকে একটু গভীরভাবে দেখি।
১. ভয় (Fear – Phobos): ক্ষমতার ছায়া
এটি সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী এবং আদিম চালক। নিজের নিরাপত্তা হারানোর ভয়, শত্রুর হাতে পরাজিত হওয়ার ভয়, কিংবা প্রতিবেশীর শক্তি বেড়ে যাওয়ার ভয়। থুসিডাইডিস তাঁর পুরো বই জুড়ে দেখিয়েছেন, ভয় কীভাবে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অযৌক্তিক এবং ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। ভয় যুক্তির আলোকে নিভিয়ে দেয় এবং সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিণতির কল্পনা করতে বাধ্য করে।
তাঁর মতে, পেলোপনেশীয় যুদ্ধের মূল কারণ (truest cause) ছিল স্পার্টার ভয়। তিনি লেখেন: “যে কারণে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তা হলো এথেন্সের শক্তির উত্থান এবং এর ফলে স্পার্টার মনে যে ভয়ের জন্ম হয়েছিল।” (Thucydides, 1.23)। স্পার্টা ছিল গ্রিসের তৎকালীন প্রধান স্থলশক্তি, একটি রক্ষণশীল এবং স্থিতাবস্থায় বিশ্বাসী রাষ্ট্র। অন্যদিকে এথেন্স ছিল এক উদীয়মান, গণতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদী নৌ-শক্তি। এথেন্সের ডেলিয়ান লিগ (Delian League) যখন ধীরে ধীরে একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হচ্ছিল এবং তার প্রভাব বাড়ছিল, তখন স্পার্টা ও তার মিত্ররা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই ভয়ই তাদের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। করিন্থের মতো মিত্ররা স্পার্টার এই ভয়কে কাজে লাগিয়েছিল, তাদের নিষ্ক্রিয়তাকে কাপুরুষতা বলে অভিযুক্ত করেছিল, যা স্পার্টাকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে।
এই ভয় আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও একইভাবে কাজ করে। একটি দেশ যখন আরেকটি দেশের পারমাণবিক শক্তি বা অর্থনৈতিক উত্থান দেখে, তখন তার মধ্যে ভয় জন্মায় এবং সেই ভয় থেকেই সে আত্মরক্ষার নামে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা ছিল এই ভয়েরই বহিঃপ্রকাশ, যা ‘পারস্পরিক নিশ্চিত ধ্বংস’ (Mutually Assured Destruction) নামে এক ভয়ঙ্কর ভারসাম্যের জন্ম দিয়েছিল।
২. সম্মান (Honor – Timē): গৌরবের সন্ধান
মানুষ ও রাষ্ট্র কেবল ভয় বা স্বার্থ দিয়ে চলে না। সম্মান, মর্যাদা বা গৌরব (glory) লাভের আকাঙ্ক্ষাও একটি বড় চালিকাশক্তি। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার ইচ্ছা, অন্যের চোখে সম্মানিত হওয়ার বাসনা, কিংবা অপমানিত হলে প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা—এই সবই ‘সম্মান’-এর অন্তর্গত। গ্রিক সংস্কৃতিতে ক্লিওস (kleos) বা অমর খ্যাতির ধারণাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হোমারের মহাকাব্য থেকে শুরু করে বীরদের জীবনে এর প্রভাব ছিল অপরিসীম।
এথেন্স তার সাম্রাজ্যকে কেবল অর্থনৈতিক লাভের জন্য ধরে রাখেনি, এর সাথে জড়িয়ে ছিল তাদের গৌরব আর সম্মানের প্রশ্ন। পেরিক্লিস তাঁর বিখ্যাত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ভাষণে (Funeral Oration) এথেন্সকে ‘গ্রিসের বিদ্যালয়’ (School of Hellas) বলে অভিহিত করেছিলেন, যা তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। যুদ্ধে পরাজিত হওয়া বা সাম্রাজ্য হারানো ছিল তাদের জন্য চরম অপমানের। সিসিলি অভিযানে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল এই গৌরব অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। অ্যালসিবিয়াডিস এথেনীয়দের বুঝিয়েছিলেন যে, এই অভিযান তাদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে দেবে।
আবার, যুদ্ধের শুরুতে করিন্থ যখন স্পার্টাকে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করছিল, তখন তারা স্পার্টার সম্মানবোধে আঘাত করেছিল। তারা বলেছিল, স্পার্টা যদি তার মিত্রদের রক্ষা করতে এগিয়ে না আসে, তবে সে তার নেতৃত্বের সম্মান হারাবে। সম্মান হারানোর ভয় এবং সম্মান অর্জনের আকাঙ্ক্ষা—এই দুটিই রাষ্ট্রকে ঝুঁকিপূর্ণ পথে চালিত করতে পারে, যা অনেক সময় যুক্তিসঙ্গত স্বার্থের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে।
৩. স্বার্থ (Interest – Ōphelia): সাম্রাজ্যের চালিকা
এটি সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত এবং সোজাসাপ্টা চালক। অর্থনৈতিক লাভ, সম্পদ বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক রুটের নিয়ন্ত্রণ—এগুলোই হলো স্বার্থ। থুসিডাইডিস দেখিয়েছেন, এথেনীয় সাম্রাজ্য মূলত অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর দাঁড়িয়েছিল। ডেলিয়ান লিগের সদস্যরা প্রথমে পারস্যের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য এথেন্সকে অর্থ বা জাহাজ দিত। কিন্তু পারস্যের হুমকি কমে যাওয়ার পরেও এথেন্স জোর করে তাদের কাছ থেকে কর (tribute) আদায় করতে থাকে। এই অর্থ দিয়ে এথেন্স তার বিশাল নৌবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ করত, পার্থেননের মতো বিশাল স্থাপত্য তৈরি করত এবং বিচারক থেকে শুরু করে নৌকার দাঁড় টানা সাধারণ নাগরিকদেরও বেতন দিত। গণতন্ত্রের খরচ চালাত সাম্রাজ্য।
এথেন্সের দূতরা স্পার্টায় দাঁড়িয়ে খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করেছিল যে, তারা তাদের সাম্রাজ্য ছেড়ে দিতে পারে না, কারণ তা তাদের নিরাপত্তার জন্য এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য অপরিহার্য। এই অর্থনৈতিক স্বার্থ তাদের সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে এবং প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করেছিল। স্বার্থের এই হিসাব অনেক সময় ভয় বা সম্মানের চেয়েও বেশি ঠাণ্ডা মাথার হয়, কিন্তু তার পরিণাম কম বিধ্বংসী হয় না।
থুসিডাইডিস মনে করতেন, এই তিনটি শক্তি—ভয়, সম্মান এবং স্বার্থ—মানুষের সব কর্মকাণ্ডের পেছনে একটির পর একটি করে বা একসাথে কাজ করে। তিনি কোনো নৈতিক রায় দেননি। তিনি বলেননি এটা ভালো বা ওটা খারাপ। তিনি শুধু একজন চিকিৎসকের মতো রোগ নির্ণয় করেছেন। বলেছেন, ‘এই হলো মানব প্রকৃতি। একে অস্বীকার করার উপায় নেই। একে বুঝতে পারলেই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব।’ (Strassler, 1996)।
ক্ষমতার নির্মম বাস্তবতা (The World as It Is)
থুসিডাইডিসকে প্রায়ই ‘রাজনৈতিক বাস্তবতা’ বা পলিটিক্যাল রিয়ালিজম (Political Realism) নামক মতবাদের জনক বলা হয়। এই তত্ত্বের মূল কথা হলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালিত হয় শক্তি বা ক্ষমতা (Power – Dunamis) দ্বারা, নৈতিকতা বা ন্যায়বিচার (Justice – Dikaiosunē) দ্বারা নয়। রাষ্ট্রগুলো একটি নৈরাজ্যিক (anarchic) পরিবেশে বাস করে, যেখানে তাদের মাথার ওপর কোনো বিশ্ব সরকার বা পুলিশ নেই যে তাদের রক্ষা করবে। তাই প্রতিটি রাষ্ট্রকে নিজের নিরাপত্তার জন্য নিজেকেই শক্তি অর্জন করতে হয়। ‘শক্তিশালীরাই টিকে থাকে’ (survival of the fittest) – এটাই এই জগতের নিয়ম।
এই তত্ত্বের মূলে রয়েছে গ্রিক দর্শনের একটি পুরনো বিতর্ক: নোমোস বনাম ফিসিস (Nomos vs. Physis)। নোমোস হলো মানুষের তৈরি আইন, প্রথা বা নৈতিকতা। আর ফিসিস হলো প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক নিয়ম। সফিস্টদের মতো দার্শনিকরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ন্যায়বিচারের ধারণাটি কি সার্বজনীন, নাকি এটি কেবলই শক্তিশালী কর্তৃক দুর্বলদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটি প্রথা? থুসিডাইডিস এই বিতর্ককে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন।
এই তত্ত্বের সবচেয়ে নির্মম এবং স্পষ্ট উদাহরণ হলো থুসিডাইডিসের বইয়ের পঞ্চম খণ্ডে বর্ণিত বিখ্যাত ‘মেলিয়ান ডায়ালগ’ (Melian Dialogue)।
মেলিয়ান ডায়ালগ: যখন ন্যায়বিচার পরাজিত হয়
মেলোস (Melos) ছিল ঈজিয়ান সাগরের একটি ছোট্ট দ্বীপ। এর অধিবাসীরা ছিল ডোরিয়ান (Dorian) বংশোদ্ভূত, স্পার্টার মতো। কিন্তু পেলোপনেশীয় যুদ্ধে তারা নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিল। ৪১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের বিশাল নৌবাহিনী দ্বীপটি ঘিরে ফেলে এবং তাদের কাছে দুটি বিকল্প দেয়: হয় এথেন্সের সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে যাও, নয়তো ধ্বংস হয়ে যাও।
মেলোসের নেতারা আলোচনার জন্য এথেনীয় দূতদের সাথে বসেন। এই আলোচনাটিই ‘মেলিয়ান ডায়ালগ’ নামে পরিচিত, যা বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম সেরা রাজনৈতিক বিতর্কের একটি।
মেলোসের নেতারা তাদের যুক্তির শুরুটা করেন ন্যায়বিচারের (নোমোস) আবেদন দিয়ে। তারা বলেন:
- ন্যায়ের যুক্তি: “আমরা স্বাধীন, আমরা নিরপেক্ষ। আমাদের আক্রমণ করা আপনাদের জন্য অন্যায়। আপনারা কীভাবে এমন একটি কাজ করতে পারেন যা ন্যায্য নয়?”
- ঈশ্বরের যুক্তি: “আমরা ন্যায়ের পক্ষে আছি, তাই দেবতারা আমাদের সাহায্য করবেন। আপনারা অন্যায়ের পক্ষে, তাই দেবতারা আপনাদের বিরুদ্ধে থাকবেন।”
- মিত্রের যুক্তি: “আমাদের স্বজাতি স্পার্টা আমাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। তারা আমাদের ফেলে যেতে পারে না।”
- আশার যুক্তি: “আমরা আত্মসমর্পণ করব না। আশা আছে যে আমরা টিকে থাকতে পারব।”
এর উত্তরে এথেনীয়রা যে জবাব দেয়, তা রাজনৈতিক বাস্তবতার এক নিষ্ঠুর সারসংক্ষেপ। তারা কোনো রাখঢাক না রেখেই ফিসিস বা প্রকৃতির নিয়মকে সামনে নিয়ে আসে:
“তোমরাও জানো, আমরাও জানি যে, ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি কেবল তখনই ওঠে যখন দুই পক্ষের শক্তি সমান হয়। এছাড়া, শক্তিশালীরা যা পারে তাই করে, আর দুর্বলদের তা-ই মেনে নিতে হয় যা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।” (The strong do what they can and the weak suffer what they must.)
তারা মেলিয়ানদের প্রতিটি যুক্তিকে ক্ষমতার নিরিখে খণ্ডন করে:
- ন্যায়বিচার নিয়ে: “আমরা এখানে ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলতে আসিনি, এসেছি স্বার্থ নিয়ে কথা বলতে। আমাদের সাম্রাজ্যের স্বার্থেই তোমাদের অধীনস্ত করা প্রয়োজন। তোমাদের নিরপেক্ষতা আমাদের জন্য দুর্বলতার লক্ষণ।”
- ঈশ্বর নিয়ে: “আমরা ঈশ্বরের ব্যাপারে বিশ্বাস করি, এবং মানুষের ব্যাপারে জানি যে, প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়মে তারা সবসময় অন্যের ওপর প্রভুত্ব করতে চায়। এই নিয়ম আমরা তৈরি করিনি, এটা আগে থেকেই ছিল। আমরা শুধু একে অনুসরণ করছি। তোমরাও যদি আমাদের মতো শক্তিশালী হতে, তোমরাও একই কাজ করতে।”
- স্পার্টা নিয়ে: “স্পার্টা হয়তো তোমাদের জন্য সহানুভূতি বোধ করবে, কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থ বিপন্ন করে তোমাদের বাঁচাতে আসবে না। রাষ্ট্রগুলো দূরবর্তী মিত্রদের জন্য বড় ঝুঁকি নেয় না।”
- আশা নিয়ে: “আশা বিপদের সময় মানুষকে সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু আশা কোনো কাজের পরিকল্পনা নয়। তোমরা আশার ওপর ভরসা করে বাস্তবতাকে অস্বীকার করছ।”
শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল? মেলোসের মানুষ ন্যায়ের ওপর ভরসা করে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে। ফলস্বরূপ, এথেন্স শহরটি অবরোধ করে, দখল করে নেয়, সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। (Thucydides, 5.89-111)।
এই সংলাপটি পড়ার সময় গায়ে কাঁটা দেয়। থুসিডাইডিস এখানে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি শুধু দুই পক্ষের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। অনেকেই মনে করেন, তিনি এখানে এথেন্সের উদ্ধত এবং নিষ্ঠুর রূপটি তুলে ধরেছেন। তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন, ক্ষমতার এমন নির্লজ্জ ব্যবহার এবং অহংকার (hubris) শেষ পর্যন্ত পতন ডেকে আনে। মেলোসের ঘটনার পরের বছরই এথেন্স সিসিলি অভিযানে গিয়ে বিপর্যয় ডেকে আনে। যেন প্রকৃতি বা ইতিহাস নিজেই এর প্রতিশোধ নেয়। তিনি হয়তো এথেন্সের এই কাজের সমর্থক ছিলেন না, কিন্তু তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো এভাবেই চিন্তা করে। এখানে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই, আছে শুধু শক্তির হিসাব। (Connor, 1984)।
যখন যুদ্ধ অনিবার্য (The Thucydides Trap)
থুসিডাইডিসের দর্শন আজকের দিনেও কতটা প্রাসঙ্গিক, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ‘থুসিডাইডিস ট্র্যাপ’ (Thucydides Trap) তত্ত্বটি। হার্ভার্ডের অধ্যাপক গ্রাহাম অ্যালিসন (Graham Allison) এই তত্ত্বের নামকরণ করেন।
তত্ত্বটি থুসিডাইডিসের সেই বিখ্যাত উক্তিটির ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে: “যে কারণে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তা হলো এথেন্সের শক্তির উত্থান এবং এর ফলে স্পার্টার মনে যে ভয়ের জন্ম হয়েছিল।”
অ্যালিসনের মতে, এটি একটি ঐতিহাসিক প্যাটার্ন বা ফাঁদ। যখন একটি উদীয়মান শক্তি (rising power) একটি প্রতিষ্ঠিত বা শাসক শক্তিকে (ruling power) চ্যালেঞ্জ করে, তখন তাদের মধ্যে কাঠামোগত চাপ (structural stress) তৈরি হয়। শাসক শক্তি তার আধিপত্য, সম্মান এবং স্বার্থ হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত হয়। আর উদীয়মান শক্তি চায় বিশ্বব্যবস্থায় নিজের যোগ্য স্থান, সম্মান এবং প্রভাব আদায় করে নিতে। এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বই ভয়, সম্মান এবং স্বার্থের ত্রিমুখী চাপে যুদ্ধকে প্রায় অনিবার্য করে তোলে।
অ্যালিসন তাঁর বই Destined for War-এ দেখিয়েছেন, গত ৫০০ বছরে এরকম ১৬টি ঘটনার মধ্যে ১২টিতেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ হয়েছে (Allison, 2017)। যেমন, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জার্মানির উত্থান ব্রিটেনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার পরিণতি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
আজকের বিশ্বের দিকে তাকান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো প্রতিষ্ঠিত শক্তি, আর চীন হলো উদীয়মান শক্তি। চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে উত্তেজনা, তাইওয়ান নিয়ে সংঘাত, বাণিজ্য যুদ্ধ, এবং সেমিকন্ডাক্টর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা—এই সবই কি ‘থুসিডাইডিস ট্র্যাপ’-এর লক্ষণ নয়?
থুসিডাইডিস আমাদের সতর্ক করে দিয়ে গেছেন যে, এই পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপদসংকুল। তিনি বলেননি যে যুদ্ধ হবেই (inevitable) শব্দটি দিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন যে, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, এড়ানো প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি তাঁর পুরো বই জুড়েই দেখিয়েছেন, মানুষের সিদ্ধান্ত, ভুল গণনা এবং নেতৃত্বের ব্যর্থতাই শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় ডেকে আনে। এর অর্থ হলো, নিয়তি চূড়ান্ত নয়। প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা এবং সৃজনশীল কূটনীতির মাধ্যমে এই ফাঁদ এড়ানো সম্ভব, যদিও তা অত্যন্ত কঠিন। থুসিডাইডিস আসলে আমাদের একটি সতর্কবার্তা দিচ্ছেন, ভবিষ্যদ্বাণী নয়।
ক্ষমতার ট্র্যাজেডি (The Tragedy of Power)
থুসিডাইডিসকে কেবলই একজন কট্টর বাস্তববাদী ভাবলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। তাঁর লেখায় ছড়িয়ে আছে এক গভীর বিষাদের সুর, এক ট্র্যাজিক অনুভূতি। তিনি দেখিয়েছেন যে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যখন তাদের শক্তি এবং অহংকারের (hubris) বশবর্তী হয়ে সীমা লঙ্ঘন করে, তখন তাদের পতনও হয় ভয়াবহ। তিনি যেন গ্রিক ট্র্যাজেডির নাট্যকারদের মতোই দেখিয়েছেন, কীভাবে মহৎ গুণাবলীও অতিরিক্ত হয়ে গেলে ধ্বংসের কারণ হয়।
পেরিক্লিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ভাষণ: এথেন্সের আদর্শ
যুদ্ধের প্রথম বছরের শেষে, পেরিক্লিস নিহত সৈনিকদের স্মরণে একটি ভাষণ দেন, যা ‘ফিউনানারেল ওরেশন’ নামে বিখ্যাত। এই ভাষণে তিনি এথেন্সের জয়গান গেয়েছেন। তিনি এথেন্সকে এঁকেছেন এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে, যেখানে গণতন্ত্র নাগরিকদের সমান অধিকার দেয়, যেখানে মানুষ আইন মেনে চলে, যেখানে খোলামেলা আলোচনা হয়, এবং যেখানে শিল্প-সাহিত্য-দর্শনের চর্চা হয়। এটি ছিল এথেন্সের আত্মপরিচয়ের সর্বোচ্চ প্রকাশ। এই আদর্শ এথেন্সের জন্যই সৈন্যরা প্রাণ দিতে দ্বিধা করেনি। এই ভাষণটি হলো ট্র্যাজেডির প্রথম অঙ্ক, যেখানে নায়ক তার মহত্ত্বের চূড়ায় অবস্থান করছে।
এথেন্সের প্লেগ: আদর্শের ভাঙন
এর পরের অধ্যায়েই থুসিডাইডিস বর্ণনা করেন ট্র্যাজেডির দ্বিতীয় অঙ্ক। যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে এথেন্সে এক ভয়াবহ প্লেগ বা মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। শহরের প্রাচীরের ভেতরে গাদাগাদি করে থাকা মানুষ মাছির মতো মরতে থাকে। থুসিডাইডিস নিজেও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তিনি এই মহামারীর যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা কেবল রোগের লক্ষণগুলোর তালিকা নয়, এটি সামাজিক এবং নৈতিক অবক্ষয়ের এক মর্মস্পর্শী দলিল। তিনি একজন চিকিৎসকের নির্মোহ দৃষ্টিতে রোগের শারীরিক লক্ষণগুলো বর্ণনা করেন, আবার পরক্ষণেই একজন সমাজবিজ্ঞানীর মতো এর নৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করেন।
তিনি দেখিয়েছেন, মৃত্যু যখন নিশ্চিত এবং আসন্ন, তখন পেরিক্লিসের ভাষণে বর্ণিত সেই আদর্শ এথেন্স কীভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
- আইনের অবসান: মানুষ আইনকে ভয় পেল না, কারণ বিচার হওয়ার আগেই হয়তো সে মারা যাবে।
- ধর্মের অবসান: যারা ধার্মিক ছিল, তারা দেখল ধার্মিক-অধার্মিক সবাই একইভাবে মরছে। তাই তারা প্রার্থনা ছেড়ে দিল। ঈশ্বরের ভয় উবে গেল।
- নৈতিকতার অবসান: মানুষ তাৎক্ষণিক ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে উঠল, কারণ ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। অন্যের সম্পত্তি লুঠ করতেও তারা দ্বিধা করল না।
“কোনো কিছুতেই তাদের বাধা দেওয়ার মতো না ছিল ঈশ্বরের ভয়, না ছিল মানুষের আইন। কারণ তারা ধরে নিয়েছিল, ধার্মিক হওয়া বা না হওয়া সমান, যেহেতু সবাইকেই সমানভাবে ধ্বংস হতে দেখছিল।” (Thucydides, 2.53)।
এই বর্ণনার মাধ্যমে থুসিডাইডিস দেখিয়েছেন যে, সভ্যতা ও নৈতিকতার আবরণটি কতটা পাতলা। চরম সংকটের মুখে তা কীভাবে ভেঙে যায়। একজন নির্লিপ্ত বাস্তববাদী নন, বরং একজন ব্যথিত পর্যবেক্ষক হিসেবেই তিনি এই অধ্যায়টি লিখেছেন, যিনি তাঁর প্রিয় শহরের নৈতিক পতন দেখে কষ্ট পাচ্ছেন (Orwin, 1994)।
কোরকিরার গৃহযুদ্ধ: যখন শব্দ তার অর্থ হারায়
যুদ্ধের বিষবাষ্প কেবল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা নগর-রাষ্ট্রগুলোর ভেতরেও ছড়িয়ে পড়েছিল, জন্ম দিয়েছিল ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের (স্ট্যাসিস – stasis)। এর সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ হলো কোরকিরার (Corcyra) গৃহযুদ্ধ। সেখানে গণতান্ত্রিক এবং অভিজাত—এই দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল যে, তা সমস্ত মানবিক সীমা ছাড়িয়ে যায়।
থুসিডাইডিস এই গৃহযুদ্ধের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা মানব অবক্ষয়ের এক চরম দলিল। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে রাজনৈতিক শত্রুতা ব্যক্তিগত ঘৃণায় পরিণত হয় এবং সমাজের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে দেয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল ভাষার অবক্ষয়। শব্দগুলো তাদের প্রচলিত অর্থ হারিয়ে ফেলে:
“তারা নিজেদের কর্মকাণ্ডের অজুহাত দাঁড় করাতে গিয়ে শব্দগুলোর অর্থই পাল্টে দিল। বেপরোয়া দুঃসাহসকে বলা হলো—বন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততা; বিচক্ষণ দ্বিধাকে বলা হলো—শোভন কাপুরুষতা; আর সংযমকে আখ্যা দেওয়া হলো—পুরুষত্বের অভাব…”(Thucydides, 3.82)।
এই গৃহযুদ্ধের বর্ণনার মাধ্যমে থুসিডাইডিস দেখান যে, পেলোপনেশীয় যুদ্ধ কেবল সাম্রাজ্যের লড়াই ছিল না, এটি ছিল আদর্শের লড়াই যা গ্রিক বিশ্বকে ভেতর থেকে পচিয়ে দিচ্ছিল।
সিসিলি অভিযান: অহংকারের পতন
থুসিডাইডিসের দর্শনে ট্র্যাজেডির চূড়ান্ত রূপ হলো সিসিলি অভিযান (Sicilian Expedition)। যুদ্ধের মাঝখানে এথেন্স সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা দূরবর্তী সিসিলি দ্বীপ দখল করবে। এটি ছিল এক বিশাল এবং উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। তাদের যুক্তি ছিল, সিসিলি দখল করতে পারলে তাদের সম্পদ ও শক্তি বহুগুণ বেড়ে যাবে এবং তারা স্পার্টাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে পারবে।
অভিযানের আগে এথেন্সের সংসদে এক বিখ্যাত বিতর্ক হয়। বিচক্ষণ এবং বয়স্ক সেনাপতি নিসিয়াস (Nicias) এই অভিযানের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি এর অত্যন্ত বিপজ্জনক ঝুঁকি, বিপুল খরচ এবং অনিশ্চয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এথেন্সের উচিত তার বর্তমান সাম্রাজ্যকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা।
কিন্তু তরুণ, সুদর্শন এবং উচ্চাভিলাষী নেতা অ্যালসিবিয়াডিস (Alcibiades) জনগণের আবেগ উস্কে দেন। তিনি গৌরব, সম্পদ আর সাম্রাজ্য বিস্তারের রঙিন স্বপ্ন দেখান। তিনি বলেন, এথেন্স একটি গতিশীল শক্তি, থেমে গেলেই তার পতন হবে। এথেন্সের জনগণ লোভে, গৌরবের নেশায় এবং অহংকারে অন্ধ হয়ে নিসিয়াসের সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে এবং এক বিশাল, জাঁকজমকপূর্ণ বাহিনী সিসিলিতে পাঠায়। থুসিডাইডিস সেই বাহিনী যাত্রার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা একাধারে মহৎ এবং করুণ।
ফলাফল হয় বিপর্যয়কর। ভুল নেতৃত্ব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সিরাকিউসের প্রতিরোধের মুখে এথেন্সের অভিযান ব্যর্থ হয়। ৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, সিরাকিউসের বন্দরে এক চূড়ান্ত নৌ-যুদ্ধে এথেন্সের নৌবহর ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ডাঙা পথে পলায়নরত এথেনীয় সেনাবাহিনীকেও ধাওয়া করে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়। হাজার হাজার সৈন্যকে হত্যা করা হয় বা ক্রীতদাস হিসেবে পাথরের খনিতে অনাহারে-অত্যাচারে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করা হয়।
এটি ছিল এথেন্সের পতনের সূচনা। থুসিডাইডিস এখানে দেখিয়েছেন, কীভাবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও জনগণের সম্মিলিত আবেগ, লোভ এবং অহংকারের (hubris) বশবর্তী হয়ে ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যুক্তি (logos) যখন আবেগের (pathos) কাছে পরাজিত হয়, তখনই ট্র্যাজেডির জন্ম হয়। সিসিলি অভিযান ছিল এথেন্সের সেই সীমা লঙ্ঘনের চূড়ান্ত উদাহরণ, যার পর তার পতন ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা। (Strauss, 1964)।
ইতিহাসবিদের শিল্প (The Historian’s Craft)
থুসিডাইডিস কীভাবে তাঁর এই মহাকাব্য রচনা করলেন? তাঁর পদ্ধতিও তাঁর দর্শনের মতোই বৈপ্লবিক ছিল।
বক্তৃতা: ঘটনার পেছনের ভাবনা
থুসিডাইডিসের বইয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন নেতার দেওয়া বক্তৃতা—পেরিক্লিসের ভাষণ, ক্লিয়নের বিতর্ক, মেলিয়ান ডায়ালগ। এখন প্রশ্ন হলো, তিনি কি এই বক্তৃতাগুলো হুবহু রেকর্ড করেছিলেন? কোনো টেপ রেকর্ডার তো ছিল না।
থুসিডাইডিস নিজেই এর জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, বক্তারা ঠিক কী বলেছিলেন তা শব্দে শব্দে মনে রাখা বা জানা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাই তিনি যা করেছেন, তা হলো:
“আমি বক্তাদের এমনভাবে কথা বলিয়েছি, যা আমার মতে প্রতিটি পরিস্থিতিতে তাঁদের বলার প্রয়োজন ছিল। তবে আমি সবসময় বক্তৃতার মূল ভাব, যা সত্যিই বলা হয়েছিল, তার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি।” (Thucydides, 1.22)।
অর্থাৎ, এই বক্তৃতাগুলো আক্ষরিক অর্থে সত্যি না হলেও, ভাবগতভাবে সত্যি। এগুলো আসলে থুসিডাইডিসের একটি সাহিত্যিক এবং দার্শনিক কৌশল। এই বক্তৃতাগুলোর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন পক্ষের চিন্তাভাবনা, তাদের যুক্তি এবং দর্শনের গভীরতা তুলে ধরেছেন। এগুলো নিছক ভাষণ নয়, এগুলো হলো একেকটি রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রবন্ধ, যা যুদ্ধের পেছনের আদর্শগত লড়াইকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তোলে। এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, যুদ্ধ কেবল অস্ত্রের লড়াই নয়, আদর্শেরও লড়াই।
বস্তুনিষ্ঠতার সন্ধান
তাঁর আরেকটি দাবি ছিল বস্তুনিষ্ঠতা (objectivity) বা নিরপেক্ষতা। তিনি তাঁর লেখায় দেবতাদের হস্তক্ষেপ বা অলৌকিক ঘটনার কোনো স্থান দেননি। তিনি কারণ এবং ফলাফলের ওপর জোর দিয়েছেন। নির্বাসিত হওয়ায় তিনি দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিই দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং তাদের বিবরণের সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বইয়ের প্রথম খণ্ডে তিনি গ্রিসের প্রাচীন ইতিহাস (যাকে তিনি ‘Archaeology’ বলেছেন) বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, কীভাবে কিংবদন্তী থেকে আসল তথ্য বের করতে হয়।
কিন্তু তিনি কি পুরোপুরি নিরপেক্ষ ছিলেন? সমালোচকরা বলেন, কোনো মানুষই তাঁর সময় ও পরিবেশের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। থুসিডাইডিস একজন এথেনীয় ছিলেন এবং তাঁর লেখায় পেরিক্লিসের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধা দেখা যায়। তিনি পেরিক্লিসের মৃত্যুর পর এথেন্সের নেতাদের (যেমন ক্লিয়ন) অবক্ষয়ের চিত্র এঁকেছেন। তিনি এথেন্সের পতনকে একটি মহৎ ট্র্যাজেডি হিসেবে এঁকেছেন, যেখানে নায়ক তার নিজের ভুলেই ধ্বংস হয়ে যায়। তবে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অসাধারণ। তিনি যে মানদণ্ড স্থাপন করে গেছেন, তা আজও ইতিহাসবিদদের জন্য একটি আদর্শ।
সহস্রাব্দের প্রতিধ্বনি (The Echo Through Millennia)
আড়াই হাজার বছর পর কেন আমরা এখনও থুসিডাইডিসকে নিয়ে এত আলোচনা করছি? কারণ তিনি কোনো নির্দিষ্ট সময়ের বা নির্দিষ্ট যুদ্ধের গল্প বলেননি। তিনি বলেছেন মানুষের গল্প, ক্ষমতার গল্প। তাঁর অন্তর্দৃষ্টিগুলো সকল স্থানের এবং কালের।
-
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে: তাঁকে ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ‘রিয়ালিজম’ তত্ত্বটি কল্পনা করা যায় না। তাঁর দর্শনকে পরবর্তীকালে আরও বিকশিত করেছেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, যিনি তাঁর দ্য প্রিন্স-গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে রাষ্ট্রনায়ককে টিকে থাকার জন্য অনেক সময় নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। টমাস হবস, যিনি নিজে থুসিডাইডিসের একজন অনুবাদক ছিলেন, তাঁর লেভায়াথান (Leviathan) গ্রন্থে বর্ণিত ‘প্রাকৃতিক অবস্থা’ (state of nature)-র ধারণাটি থুসিডাইডিসের নৈরাজ্যিক বিশ্বব্যবস্থার ধারণার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। আধুনিক কালে, হান্স মর্গেনথাউ, কেনেথ ওয়াল্টজ, এবং আজকের দিনের হেনরি কিসিঞ্জার বা জন মেয়ারশাইমারের মতো চিন্তাবিদরা তাঁর কাছে ঋণী।
-
সামরিক চিন্তায়: বিশ্বের বড় বড় সামরিক একাডেমিগুলোতে (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজ) আজও থুসিডাইডিস পড়ানো হয়। যুদ্ধের কারণ, রণকৌশল, বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক এবং রাজনীতির সাথে যুদ্ধের সম্পর্ক বোঝার জন্য তাঁর বই একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। ক্লজেউইটজের বিখ্যাত উক্তি “যুদ্ধ হলো অন্য উপায়ে রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা” (War is the continuation of politics by other means) – এর মূল ভাবনা থুসিডাইডিসের লেখায় স্পষ্ট।
-
দর্শনে: তিনি আমাদের মানব প্রকৃতি, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা এবং ভাগ্যের মতো চিরন্তন প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেন। তিনি সহজ কোনো উত্তর দেন না, বরং আমাদের সামনে একটি জটিল চিত্র তুলে ধরেন, যেখানে ভালো-মন্দের সরল বিভাজন নেই।
-
সাধারণ পাঠকের জন্য: তাঁর লেখা আমাদের শেখায় কীভাবে আবেগ নয়, যুক্তি দিয়ে পৃথিবীকে বিশ্লেষণ করতে হয়। এটি আমাদের শেখায়, ক্ষমতার আস্ফালন এবং অহংকার কীভাবে পতনের কারণ হতে পারে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইতিহাস বারবার ফিরে আসে, কারণ মানব প্রকৃতি বদলায় না।
শেষ কথা
রাতের আকাশে যেমন অগণিত তারা, ইতিহাসের আকাশে তেমনই অসংখ্য ঘটনা। থুসিডাইডিস আমাদের একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে গেছেন, যা দিয়ে আমরা সেই ঘটনাগুলোর পেছনের বিন্যাসটি দেখতে পাই। তিনি দেখিয়েছেন, ভয়, সম্মান আর স্বার্থের মহাকর্ষীয় টানে কীভাবে রাষ্ট্রগুলো একে অপরের দিকে ছুটে যায়, কখনও মিত্র হিসেবে, কখনও শত্রু হিসেবে।
তাঁর জগৎ সাদাকালো নয়, ধূসর। সেখানে কোনো নিখুঁত নায়ক বা নিখুঁত খলনায়ক নেই। আছে শুধু পরিস্থিতির চাপে (অ্যানাঙ্কে – ananke বা necessity) এবং নিজেদের বিচার-বুদ্ধি (গ্নোমে – gnome বা judgment) অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হওয়া কিছু মানুষ আর রাষ্ট্র। এথেন্সের গণতন্ত্র ছিল মহৎ, কিন্তু সেই গণতন্ত্রই আবার মেলোসের ওপর চালিয়েছিল অকথ্য অত্যাচার। স্পার্টা ছিল স্বৈরাচারী, কিন্তু তারাই আবার গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোর ‘স্বাধীনতা’ রক্ষার জন্য লড়েছিল।
থুসিডাইডিস আমাদের কোনো সহজ সমাধান দেন না। তিনি শুধু আয়নাটা তুলে ধরেন। সেই আয়নায় আমরা এথেন্স আর স্পার্টাকে দেখি, আবার একই সাথে দেখি আজকের বিশ্বকে, এমনকি আমাদের নিজেদের ভেতরের দ্বন্দ্বগুলোকেও। তাঁর লেখা তাই কোনো প্রাচীন বই নয়, এটি এক জীবন্ত প্রজ্ঞা, যা আমাদের শেখায় কীভাবে এই জটিল পৃথিবীতে চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হয়।
ইতিহাস হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে না, কিন্তু থুসিডাইডিস আমাদের শিখিয়েছেন, ইতিহাস আমাদের অন্ততপক্ষে সম্ভাব্য বিপদগুলোর ব্যাপারে সতর্ক করতে পারে। বাকিটা নির্ভর করে আমাদের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার ওপর। মানুষ কি পারবে তার প্রকৃতির এই বিধ্বংসী চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে? থুসিডাইডিস প্রশ্নটি তুলে দিয়ে গেছেন, উত্তর খোঁজার দায়িত্ব আমাদের।
তথ্যসূত্র
- Allison, G. (2017). Destined for War: Can America and China Escape Thucydides’s Trap? Houghton Mifflin Harcourt.
- Cochrane, C. N. (1929). Thucydides and the Science of History. Oxford University Press.
- Connor, W. R. (1984). Thucydides. Princeton University Press.
- Cornford, F. M. (1907). Thucydides Mythistoricus. Edward Arnold.
- Finley, M. I. (1963). The Ancient Greeks. Chatto & Windus.
- Guthrie, W. K. C. (1971). The Sophists. Cambridge University Press.
- Hornblower, S. (2008). A Commentary on Thucydides (Vols. 1-3). Oxford University Press.
- Kagan, D. (2003). The Peloponnesian War. Penguin Books.
- Kagan, D. (2009). Thucydides: The Reinvention of History. Viking Penguin.
- Orwin, C. (1994). The Humanity of Thucydides. Princeton University Press.
- Strassler, R. B. (Ed.). (1996). The Landmark Thucydides: A Comprehensive Guide to the Peloponnesian War. Free Press.
- Strauss, L. (1964). The City and Man. University of Chicago Press.
- Thucydides. (c. 400 B.C.E.). History of the Peloponnesian War. (R. Warner, Trans.). Penguin Classics.
Leave a Reply