পেলোপনেসীয় যুদ্ধ: যখন ভাইয়ের বুকে ছুরি চালায় ভাই

Table of Contents

ভূমিকা

ইতিহাসের পাতা থেকে মাঝে মাঝে এমন সব গল্প উঠে আসে, যা শুনলে মনে হয় কোনো মহাকাব্য পড়ছি। সেখানে ভালোবাসা আছে, আছে ঘৃণা। আছে বন্ধুত্ব, আছে বিশ্বাসঘাতকতা। বীরত্ব আছে, আবার কাপুরুষতাও কম নেই। এমনই এক মহাকাব্যের নাম পেলোপনেসীয় যুদ্ধ (Peloponnesian War)। এটি নিছক দুটি রাষ্ট্রের সংঘাত ছিল না; ছিল একটি সভ্যতার আত্মহননের করুণ উপাখ্যান। যে গ্রিক সভ্যতা একদিন দর্শন, শিল্প আর গণতন্ত্রের আলোয় পৃথিবীকে পথ দেখিয়েছিল, সেই সভ্যতাই প্রায় তিন দশক ধরে নিজেদের মধ্যে এমন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল, যা তার সোনালি অধ্যায়ের উপর টেনে দিয়েছিল কালো এক পর্দা।

ভাবুন তো একবার, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর এথেন্স। শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন সক্রেটিসের (Socrates) মতো দার্শনিক, যিনি তরুণদের শেখাচ্ছেন কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়। নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হচ্ছে সোফোক্লিস (Sophocles) বা ইউরিপিদেসের (Euripides) নাটক, যা মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর নিয়তির অমোঘ বিধান নিয়ে ভাবাচ্ছে হাজারো দর্শককে। অ্যাক্রোপলিসের (Acropolis) চূড়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে পার্থেননের (Parthenon) মতো স্থাপত্য, যা মানুষের সৃষ্টিশীলতার চূড়ান্ত নিদর্শন। সেই স্বর্ণযুগের (Golden Age) এথেন্সই কিনা জড়িয়ে পড়ল এমন এক যুদ্ধে, যা তার সবকিছু কেড়ে নিতে উদ্যত হলো।

অন্যদিকে ছিল স্পার্টা—এক ভিন্ন জগৎ। সেখানে শিল্পের কদর ছিল না, ছিল না গণতন্ত্রের হট্টগোল। ছিল শুধু লোহার মতো কঠিন শৃঙ্খলা আর যুদ্ধের জন্য এক আজন্ম প্রস্তুতি। কিছুদিন আগেই এই দুই ভিন্ন মেরুর রাষ্ট্র কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রুখে দিয়েছিল পারস্যের মতো এক বিশাল সাম্রাজ্যের আক্রমণ। ম্যারাথনের ধুলোয়, সালামিসের জলে তাদের সম্মিলিত বীরত্বগাথা লেখা হয়েছিল। সেই তারাই কিনা পরিণত হলো পরস্পরের রক্তপিপাসু শত্রুতে। এই যুদ্ধ শুধু তলোয়ার আর বল্লমের যুদ্ধ ছিল না, ছিল দুটি ভিন্ন আদর্শ, দুটি ভিন্ন জীবনধারার লড়াই।

কেন এই যুদ্ধ হয়েছিল? কীভাবে ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি চালিয়েছিল? সেই গল্পই আজ বলব। তবে তার আগে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিন। কারণ গল্পটা বেশ দীর্ঘ, আর বেশ জটিলও বটে। এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে অহংকার, ভয়, লোভ আর ক্ষমতার নির্মম খেলা।

যুদ্ধের আগের পৃথিবী: বন্ধু যখন শত্রু হয়ে ওঠে

যেকোনো বড় ঝড়ের আগে আকাশ যেমন থমথমে শান্ত থাকে, পেলোপনেসীয় যুদ্ধের আগেও পরিস্থিতিটা অনেকটা তেমনই ছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে গ্রিক বিশ্ব মুখোমুখি হয়েছিল তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হুমকির—বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের (Persian Empire) আক্রমণ। সেই বিপদের দিনে গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের মধ্যকার রেষারেষি ভুলে একজোট হয়েছিল। এই গ্রিক-পারস্য যুদ্ধের (Greco-Persian Wars) বীরত্বগাথা কিংবদন্তিতুল্য।

এথেন্সের নৌবহর সালামিসের যুদ্ধে (Battle of Salamis, 480 BCE) পারস্যের নৌ-শক্তিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। আর স্পার্টার দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা প্লাটিয়ার প্রান্তরে (Battle of Plataea, 479 BCE) পারস্যের সেনাবাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। এই অবিশ্বাস্য জয়ের পর সবাই ভাবল, যাক, শান্তি ফিরে এল। গ্রিকরা এখন ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়বে।

কিন্তু বাস্তবে ঘটল ঠিক তার উল্টো। পারস্যকে হারানোর পর গ্রিক বিশ্বে এক ধরনের ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হলো এবং সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এল দুই প্রধান শক্তি—এথেন্স ও স্পার্টা। পারস্যের বিরুদ্ধে অর্জিত গৌরব আর সম্মান তাদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেল, আর সেই ভাগাভাগিই জন্ম দিল ভবিষ্যতের সংঘাতের বীজ। ধীরে ধীরে দুটি পরস্পরবিরোধী সামরিক জোট গড়ে উঠল, যা গোটা গ্রিক বিশ্বকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলল।

ডেলিয়ান লিগ: এথেন্সের সাম্রাজ্যবাদী খোলস

পারস্যের ভয় পুরোপুরি চলে যায়নি। তাই পারস্যের ভবিষ্যৎ আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য ঈজিয়ান সাগরের (Aegean Sea) দ্বীপপুঞ্জ আর ছোট ছোট নগররাষ্ট্রগুলো মিলে ৪৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটি জোট তৈরি করে। এর নাম দেওয়া হয় ডেলিয়ান লিগ (Delian League), কারণ এর সম্মিলিত কোষাগার রাখা হয়েছিল ডেলোস (Delos) দ্বীপের অ্যাপোলোর পবিত্র মন্দিরে। এই জোটের স্বাভাবিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয় এথেন্স, কারণ তাদের ছিল অপ্রতিরোধ্য নৌবহর।

শুরুতে এর উদ্দেশ্য ছিল মহৎ—সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং পারস্যের প্রভাব থেকে ঈজিয়ান সাগরকে মুক্ত রাখা। সদস্যরা হয় জাহাজ দিয়ে অথবা অর্থ (যাকে বলা হতো ‘ফোরোস’ বা phoros) দিয়ে এই জোটে অবদান রাখত। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে এথেন্সের মনোভাব বদলাতে শুরু করে। তারা লিগকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করে। যা ছিল একটি মুক্ত জোট (alliance), তা ধীরে ধীরে একটি সাম্রাজ্যে (empire) রূপান্তরিত হতে থাকে।

  • কোষাগার স্থানান্তর: ৪৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়। তারা লিগের কোষাগার ডেলোস থেকে এথেন্সে, দেবী এথেনার মন্দিরে (Parthenon) সরিয়ে আনে। তাদের যুক্তি ছিল, এথেন্স পারস্যের আক্রমণের মূল লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, তাই কোষাগার এখানেই সবচেয়ে নিরাপদ। কিন্তু এই ঘটনাটি ছিল প্রতীকী—লিগের সম্পদ এখন আর জোটের নয়, এককভাবে এথেন্সের। (Kagan, 2003)

  • সাম্রাজ্যবাদী আচরণ: এথেন্স জোর করে সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করত, যা দিয়ে তারা নিজেদের শহরকে সাজিয়ে তুলছিল। পেরিক্লিসের (Pericles) তত্ত্বাবধানে পার্থেনন, প্রোপিলাইয়া (Propylaea), ইরেকথিয়াম (Erechtheion) এর মতো পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কিছু স্থাপত্য তৈরি হচ্ছিল এই টাকায়। কোনো রাষ্ট্র যদি লিগ ছেড়ে যেতে চাইত বা চাঁদা দিতে অস্বীকার করত, এথেন্স তাদের উপর নির্দয়ভাবে চড়াও হতো। যেমন, ৪৭০-এর দশকে নাক্সোস (Naxos) এবং পরে থাসোস (Thasos) বিদ্রোহ করলে এথেন্স তাদের নৌবহর পাঠিয়ে দমন করে, তাদের প্রাচীর ভেঙে দেয় এবং তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। সামোসের (Samos) মতো শক্তিশালী মিত্র বিদ্রোহ করলে তাদেরও কঠোরভাবে দমন করা হয়। এথেন্সের কাছে ‘মিত্র’ শব্দটি তখন ‘প্রজা’ (subject) শব্দের সমার্থক হয়ে উঠেছিল।

  • আইনি ও অর্থনৈতিক আধিপত্য: এথেন্স জোটের সদস্যদের বাধ্য করত তাদের বড় বড় মামলা-মোকদ্দমা এথেন্সের আদালতে নিষ্পত্তি করতে। এতে এথেন্সের আইনি ও রাজনৈতিক প্রভাব আরও বেড়ে যায়। এছাড়া, তারা নিজেদের মুদ্রা (Athenian owl coin) পুরো সাম্রাজ্যে চালু করার চেষ্টা করে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে কিন্তু এথেন্সের বাণিজ্যিক সুবিধাকে বাড়িয়ে তোলে।

এককথায়, যা শুরু হয়েছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিরক্ষা জোট হিসেবে, তা পরিণত হয়েছিল এথেন্সের নিজস্ব সাম্রাজ্যে (Athenian Empire)। এথেন্সের নেতারা হয়তো ভাবতেন, তারা এই শক্তি ব্যবহার করে গ্রিক বিশ্বে স্থিতিশীলতা আনছেন, কিন্তু তাদের মিত্রদের কাছে এটা ছিল পরাধীনতারই নামান্তর।

পেলোপনেসীয় লিগ: স্পার্টার রক্ষণশীল দুর্গ

এথেন্স যখন সমুদ্রে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করছিল, তখন মূল ভূখণ্ডে স্পার্টা ছিল এক ভিন্ন শক্তির কেন্দ্র। স্পার্টা ও তার মিত্রদের নিয়ে গঠিত জোটের নাম ছিল পেলোপনেসীয় লিগ (Peloponnesian League)। এটি ছিল ডেলিয়ান লিগের চেয়ে অনেক পুরনো এবং এর গঠনও ছিল ভিন্ন। স্পার্টা তার মিত্রদের কাছ থেকে চাঁদা নিত না, কিন্তু যুদ্ধের সময় তাদের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে বাধ্য করত।

স্পার্টার সমাজ ছিল এথেন্সের ঠিক উল্টো। সেখানে গণতন্ত্র বা বাকস্বাধীনতার কোনো স্থান ছিল না। তাদের সমাজ ছিল পুরোপুরি সামরিক ধাঁচের।

  • আগোগে (Agoge): স্পার্টান ছেলেরা সাত বছর বয়স থেকে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে এক কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে বড় হতো। এই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার নাম ছিল আগোগে। তাদের শেখানো হতো কষ্টসহিষ্ণুতা, আনুগত্য এবং যুদ্ধের কৌশল। তাদের পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না, যাতে তারা চুরি করতে শেখে, কিন্তু ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল এমন এক যোদ্ধা তৈরি করা, যে কোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে।

  • হেলটদের ভয় (Fear of the Helots): স্পার্টার শক্তির পেছনে ছিল এক অন্ধকার দিক। তাদের অর্থনীতি চলত এক বিশাল ক্রীতদাস জনগোষ্ঠীর শ্রমে, যাদের বলা হতো হেলট (Helots)। এরা ছিল মূলত স্পার্টার বিজিত অঞ্চল মেসেনিয়ার (Messenia) মানুষ। সংখ্যায় হেলটরা স্পার্টান নাগরিকদের চেয়ে প্রায় সাত বা দশ গুণ বেশি ছিল। তাই স্পার্টার মনে সবসময় একটা ভয় কাজ করত—কখন এই হেলটরা বিদ্রোহ করে বসে। এই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতা তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। তারা নিজেদের সীমানার বাইরে খুব বেশি জড়াতে চাইত না, পাছে তাদের অনুপস্থিতিতে হেলটরা বিদ্রোহ করার সুযোগ পায়। এমনকি, স্পার্টার এক ধরনের গোপন পুলিশ বাহিনী ছিল, যার নাম ক্রিপটিয়া (Krypteia)। এই বাহিনীর তরুণ সদস্যরা রাতে লুকিয়ে হেলটদের হত্যা করত, শুধুমাত্র তাদের মনে ভয় জাগিয়ে রাখার জন্য। (Cartledge, 2003)

  • রক্ষণশীল সরকার: স্পার্টার সরকার ব্যবস্থা ছিল বেশ জটিল। সেখানে দুজন রাজা (dual kingship), পাঁচজন নির্বাচিত কর্মকর্তা বা এফর (Ephors), এবং ২৮ জন বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের একটি কাউন্সিল বা গেরুসিয়া (Gerousia) ছিল। যদিও একটি গণপরিষদ বা অ্যাপেলা (Apella) ছিল, কিন্তু মূল ক্ষমতা ছিল এফর এবং গেরুসিয়ার হাতে। এই ব্যবস্থা স্পার্টাকে অত্যন্ত স্থিতিশীল কিন্তু ভীষণ রক্ষণশীল করে তুলেছিল। তারা পরিবর্তনকে ভয় পেত।

এথেন্সের এই লাগামছাড়া ক্ষমতা বৃদ্ধি, তাদের গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং বাণিজ্যিক প্রভাব স্পার্টার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। স্পার্টা দেখছিল যে, এথেন্সের প্রভাব ধীরে ধীরে তাদের রক্ষণশীল মিত্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে, যা তাদের ক্ষমতার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে।

যুদ্ধের অব্যবহিত কারণ: স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল

এই দুই শক্তির মধ্যে অবিশ্বাস আর ভয়ের যে বারুদ জমা হয়েছিল, তাতে আগুন লাগানোর জন্য কয়েকটি স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট ছিল। প্রাচীন গ্রিসের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ থুসিডাইডিস (Thucydides), যিনি নিজে এই যুদ্ধে একজন এথেনিয়ান জেনারেল হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন, তার বইতে এই যুদ্ধের কারণ হিসেবে খুব সহজ কিন্তু গভীর একটি কথা বলেছেন। তার মতে, “এই যুদ্ধের আসল কারণ ছিল এথেন্সের ক্ষমতার বিস্ময়কর বৃদ্ধি এবং এর ফলে স্পার্টার মনে জন্ম নেওয়া ভয়।” (Thucydides, 1.23)

এই ভয় থেকেই জন্ম নিল অবিশ্বাস, আর অবিশ্বাস থেকে সংঘাত। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে হার্ভার্ডের অধ্যাপক গ্রাহাম অ্যালিসন একে ‘থুসিডাইডিসের ফাঁদ’ (Thucydides’s Trap) বলে অভিহিত করেছেন। যখন একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি (Established Power) আরেকটি উদীয়মান শক্তির (Rising Power) উত্থানকে নিজের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে, তখন তাদের মধ্যে যুদ্ধ প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। এথেন্স ছিল সেই উদীয়মান শক্তি, আর স্পার্টা ছিল প্রতিষ্ঠিত শক্তি। (Allison, 2017)

ছোটখাটো তিনটি ঘটনা এই সংঘাতকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে:

১. করসাইরার ঘটনা (The Affair of Corcyra): করসাইরা (আধুনিক করফু) ছিল এক শক্তিশালী নৌ-শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্র। তার সঙ্গে তার পুরনো উপনিবেশ এপিডামনাসের (Epidamnus) বিবাদ বাধে। এই বিবাদে করসাইরার মূল ভূখণ্ডের অভিভাবক করিন্থ (Corinth) এপিডামনাসের পক্ষ নেয়। করিন্থ ছিল স্পার্টার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী নৌ-মিত্র। যুদ্ধে করিন্থের কাছে হেরে গিয়ে করসাইরা সাহায্যের জন্য এথেন্সের দ্বারস্থ হয়। এথেন্সে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত তারা একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি (epimachia) করে করসাইরার পক্ষ নেয়, যার অর্থ হলো, করসাইরা আক্রান্ত হলেই কেবল এথেন্স সাহায্য করবে। সিপোটার যুদ্ধে (Battle of Sybota) এথেন্সের কয়েকটি জাহাজ করিন্থের নৌবহরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। স্পার্টার প্রধান মিত্রের বিরুদ্ধে এথেন্সের এই প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল একটি বড় উস্কানি।

২. পটিডিয়ার ঘটনা (The Affair of Potidaea): পটিডিয়া ছিল এক বিচিত্র অবস্থানে। সে ছিল একাধারে করিন্থের উপনিবেশ আবার এথেন্সের ডেলিয়ান লিগের সদস্য। এথেন্স পটিডিয়াকে আদেশ দেয় করিন্থ থেকে পাঠানো কর্মকর্তাদের বহিষ্কার করতে এবং তাদের সমুদ্রমুখী প্রতিরক্ষা প্রাচীর ভেঙে ফেলতে। এথেন্স ভয় পাচ্ছিল যে, পটিডিয়া করিন্থের উস্কানিতে বিদ্রোহ করতে পারে। পটিডিয়া এই অপমানজনক শর্ত মানতে অস্বীকার করে এবং বিদ্রোহ করে। এথেন্স পটিডিয়া অবরোধ করে, যা করিন্থকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে।

৩. মেগারার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা (The Megarian Decree): মেগারা (Megara) ছিল স্পার্টার আরেক মিত্র এবং এথেন্সের প্রতিবেশী। এথেন্স অভিযোগ তোলে যে মেগারার লোকজন এক পবিত্র জমিতে চাষাবাদ করেছে এবং এথেন্স থেকে পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসদের আশ্রয় দিয়েছে। এই অজুহাতে এথেন্স মেগারার বিরুদ্ধে এক কঠোর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এথেন্সের সাম্রাজ্যের কোনো বন্দরেই মেগারার বণিকদের প্রবেশাধিকার রইল না। এতে মেগারার অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এটি ছিল অর্থনৈতিক যুদ্ধের এক প্রাথমিক উদাহরণ।

এই ঘটনাগুলোর পর স্পার্টার মিত্ররা, বিশেষ করে করিন্থ, স্পার্টার উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে এথেন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য। তারা স্পার্টাকে তাদের ধীর এবং নিষ্ক্রিয় নীতির জন্য তিরস্কার করে বলে, “তোমরা বসে বসে দেখছ কীভাবে এথেন্স পুরো গ্রিসকে গ্রাস করছে! এথেনিয়ানরা নতুন জিনিস আবিষ্কার করতে জন্মেছে, আর তোমরা যা আছে তা ধরে রাখতেই ব্যস্ত।” অবশেষে, ৪৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পেলোপনেসীয় লিগের সভায় যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শান্তির সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যায়।

দুই শিবিরের শক্তি: হাতি বনাম তিমি

যুদ্ধটা যখন শুরু হলো, তখন পরিস্থিতিটা ছিল অনেকটা হাতি আর তিমির লড়াইয়ের মতো। দুজনের শক্তির জায়গা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

  • স্পার্টা (হাতি): তাদের শক্তি ছিল জমিনে। তাদের ছিল গ্রিসের সেরা সেনাবাহিনী। স্পার্টার প্রত্যেক নাগরিক ছিল জন্ম থেকে যোদ্ধা। তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের বলা হতো হপলাইট (Hoplite)। তারা যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফ্যালাঙ্কস (Phalanx) নামক দুর্ভেদ্য ব্যূহ রচনা করে যুদ্ধ করত, তখন তাদের সামনে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। একজন হপলাইটের বর্ম (panoply) প্রায় ৩০ কেজি ওজনের হতো, যার মধ্যে ছিল ব্রেস্টপ্লেট, হেলমেট, গ্রিভস (greaves), বড় গোলাকার ঢাল (aspis) আর তিন মিটার লম্বা বর্শা (doru)। এই ফ্যালাঙ্কস ছিল শৃঙ্খলার এক চলমান প্রাচীর। স্পার্টার রাজা আর্কিডামাস (Archidamus II) ভেবেছিলেন, এই অপ্রতিরোধ্য সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি সোজা এথেন্সের মূল ভূখণ্ড অ্যাটিকায় (Attica) আক্রমণ করবেন, তাদের শস্যক্ষেত্র জ্বালিয়ে দেবেন, আর খাবারের অভাবে এথেন্স আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। (Hanson, 2005)

  • এথেন্স (তিমি): তাদের শক্তি ছিল সমুদ্রে। তাদের ছিল এক বিশাল নৌবহর, যার প্রধান যুদ্ধজাহাজের নাম ছিল ট্রাইরিম (Trireme)। এই জাহাজগুলো ছিল অত্যন্ত দ্রুত এবং বিধ্বংসী। এর নাম ট্রাইরিম কারণ এতে তিন স্তরে দাঁড়া বা বৈঠা চালিত হতো। প্রতিটি জাহাজে থাকত ১৭০ জন দাঁড়টানা নাবিক, যারা ছিলেন এথেন্সের নিম্নবিত্ত নাগরিক (thetes)। এই নৌ-শক্তিই ছিল এথেন্সের গণতন্ত্রের ভিত্তি, কারণ এই নাবিকরাই ছিল এথেন্সের ক্ষমতার উৎস এবং তারাই অ্যাসেম্বলিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিত। তাদের প্রধান কৌশল ছিল জাহাজের সামনের দিকে থাকা ব্রোঞ্জের র‍্যাম (ram) দিয়ে শত্রু-জাহাজের গায়ে সজোরে ধাক্কা মেরে তাকে অকেজো করে দেওয়া।

এথেন্সের নেতা পেরিক্লিস ছিলেন একজন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, স্পার্টার সঙ্গে জমিনে লড়তে যাওয়াটা হবে আত্মহত্যার শামিল। তার পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বৈপ্লবিক। তিনি এথেন্সের চারপাশের সমস্ত গ্রামবাসীকে তাদের ঘরবাড়ি, শস্যক্ষেত্র ছেড়ে দিয়ে শহরের ‘দীর্ঘ প্রাচীরের’ (Long Walls) ভেতরে আশ্রয় নিতে বললেন। এই বিশাল প্রাচীর এথেন্স শহরকে তার সমুদ্রবন্দর পাইরিয়াস (Piraeus) পর্যন্ত সংযুক্ত করেছিল। এর ফলে, স্পার্টা বাইরে থেকে যতই অবরোধ করুক না কেন, সমুদ্রপথে এথেন্সের খাবার আর রসদ আসা বন্ধ হবে না। এই নীতির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ছিল ব্যাপক। অ্যাটিকার কৃষকদের জন্য তাদের পূর্বপুরুষের জমি ছেড়ে দেওয়া ছিল এক হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা। তারা প্রাচীরের উপর থেকে দেখত, কীভাবে স্পার্টানরা তাদের জলপাই গাছ কেটে ফেলছে, যা বড় হতে বহু বছর সময় লাগে। কিন্তু পেরিক্লিস তার বিখ্যাত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ভাষণে (Funeral Oration) এথেন্সের গণতান্ত্রিক আদর্শের জয়গান গেয়ে নাগরিকদের এই ত্যাগের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। (Thucydides, 2.34-46)

ব্যাপারটা মজার না? একজন চাইছে ভূমির লড়াই, অন্যজন চাইছে সামুদ্রিক লড়াই। কেউই অন্যের শক্তির জায়গায় গিয়ে যুদ্ধ করতে রাজি নয়। এভাবেই শুরু হলো এক দীর্ঘ, ক্লান্তিকর এবং অমীমাংসিত যুদ্ধ।

যুদ্ধের বিভিন্ন পর্ব: এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের ইতিবৃত্ত

পেলোপনেসীয় যুদ্ধকে মূলত তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রায় সাতাশ বছরের এই দীর্ঘ যুদ্ধ ছিল নানা নাটকীয় উত্থান-পতন আর অপ্রত্যাশিত ঘটনায় পূর্ণ।

প্রথম পর্ব: আর্কিডামিয়ান যুদ্ধ (The Archidamian War, ৪৩১-৪২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

যুদ্ধের শুরুটা হলো ঠিক যেমনটা ভাবা হয়েছিল। স্পার্টার রাজা আর্কিডামাসের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে অ্যাটিকা আক্রমণ করতে লাগল। তারা শস্যক্ষেত্র ধ্বংস করল, গ্রাম জ্বালিয়ে দিল। কিন্তু এথেন্সের মূল শহরের কিছুই করতে পারল না। কারণ শহরের মানুষজন দীর্ঘ প্রাচীরের ভেতর নিরাপদ আশ্রয়ে ছিল। ওদিকে পেরিক্লিস তার পরিকল্পনা অনুযায়ী নৌবহর পাঠিয়ে পেলোপনেসাস উপদ্বীপের উপকূলে হানা দিতে লাগলেন।

এথেন্সের প্লেগ (Plague of Athens, ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

কিন্তু এর মধ্যেই ঘটল এক ভয়ংকর বিপর্যয়, যা কোনো সেনাপতিই কল্পনা করেননি। যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে এথেন্সে ছড়িয়ে পড়ল এক ভয়াবহ মহামারী (সম্ভবত টাইফয়েড বা ইবোলা জাতীয় কিছু, তবে পরবর্তীকালের কুখ্যাত বুবোনিক প্লেগ নয়। প্রাচীনকালে “প্লেগ” শব্দটি ভীষণ মহামারি বোঝাতে ব্যবহার করত।)। দীর্ঘ প্রাচীরের ভেতরে অতিরিক্ত মানুষ গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকায় রোগটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদ থুসিডাইডিস নিজেও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তিনি এই মহামারীর এক জীবন্ত এবং হাড়হিম করা বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি লিখেছেন, মানুষের শরীর জ্বরে পুড়ে যেত, চোখ লাল হয়ে যেত, গলা-জিভ দিয়ে রক্ত পড়ত, আর এক অসহ্য দুর্গন্ধ বেরোত। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় মানুষ ছটফট করত, কিন্তু পানি খেয়েও তৃষ্ণা মিটত না। রাস্তায়, মন্দিরে লাশের স্তূপ জমে যেত। মানুষ আইনকানুন, সামাজিক বা ধর্মীয় রীতিনীতি কিছুই আর মানছিল না। কারণ কে কখন মারা যাবে, তার কোনো ঠিক ছিল না। ভবিষ্যতের কোনো আশা না থাকায় মানুষ তাৎক্ষণিক ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে উঠেছিল। এই প্লেগ এথেন্সের মনস্তত্ত্বকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিল। (Thucydides, 2.47-54)

এই মহামারীতে এথেন্সের প্রায় এক-চতুর্থাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়, যার মধ্যে ছিল বহু সৈন্য এবং নাবিক। সবচেয়ে বড় ক্ষতি ছিল, ৪২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই রোগে মারা গেলেন এথেন্সের মহান নেতা পেরিক্লিস। পেরিক্লিসের মৃত্যুর পর এথেন্সের রাজনীতিতে এক শূন্যতা তৈরি হয়। তার মতো দূরদর্শী নেতা আর কেউ ছিল না। ক্ষমতায় এল নতুন প্রজন্মের নেতারা, যারা ছিলেন অনেক বেশি আগ্রাসী এবং হঠকারী। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন ক্লিওন (Cleon), যিনি ছিলেন একজন চামড়ার ব্যবসায়ী এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় বক্তা (demagogue)। তিনি শান্তির বদলে সর্বাত্মক যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন।

মাইটিলিনির বিতর্ক (Mytilenean Debate)

ক্লিওনের আগ্রাসী মনোভাবের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো মাইটিলিনির ঘটনা। ৪২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেসবস (Lesbos) দ্বীপের মাইটিলিান শহর এথেন্সের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এথেন্স দ্রুত বিদ্রোহ দমন করে এবং অ্যাসেম্বলিতে ক্লিওনের প্ররোচনায় উত্তেজিত জনতা সিদ্ধান্ত নেয় যে, মাইটিলিনির সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যা করা হবে এবং নারী ও শিশুদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হবে। একটি জাহাজ এই ভয়ংকর আদেশ নিয়ে রওনাও হয়ে যায়। কিন্তু পরদিন এথেন্সবাসীর সম্বিৎ ফেরে। তারা বুঝতে পারে যে, তারা এক ভয়ংকর অন্যায় করতে চলেছে। ডিওডোটাস (Diodotus) নামের একজন নেতার যুক্তিতে তারা পূর্বের সিদ্ধান্ত বাতিল করে এবং দ্বিতীয় একটি জাহাজ পাঠায় আগের আদেশটি রদ করার জন্য। দ্বিতীয় জাহাজটি অবিশ্বাস্য গতিতে গিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছায় এবং একটি গণহত্যা রুখে দেয়। এই ঘটনাটি দেখায়, পেরিক্লিস-পরবর্তী এথেন্সের গণতন্ত্র কতটা আবেগনির্ভর এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।

তা সত্ত্বেও যুদ্ধ চলতেই থাকল। ৪২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স স্পার্টার বিরুদ্ধে এক অভাবনীয় জয় পায়। পাইলোসের যুদ্ধে (Battle of Pylos) এথেন্সের নৌবহর স্ফ্যাক্টেরিয়া (Sphacteria) দ্বীপে প্রায় ৪২০ জন স্পার্টান হপলাইট সৈন্যকে আটকে ফেলে। বেশ কিছুদিন অবরোধের পর, ১২০ জন স্পার্টান সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। এটা ছিল গ্রিক বিশ্বের জন্য এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। কারণ স্পার্টান সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে না, যুদ্ধ করতে করতে মারা যায়—এই ধারণাকে এথেন্স ভেঙে দিয়েছিল।

অন্যদিকে, স্পার্টারও একজন অসাধারণ সেনাপতি ছিলেন, যার নাম ব্রাসিডাস (Brasidas)। তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় এবং প্রথাবিরুদ্ধ। তিনি এক ছোট সেনাবাহিনী নিয়ে উত্তর গ্রিসে এথেন্সের সাম্রাজ্যে হানা দেন এবং অ্যাম্ফিপোলিস (Amphipolis) সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নেন। ৪২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যাম্ফিপোলিসের যুদ্ধে এথেন্সের আগ্রাসী নেতা ক্লিওন এবং স্পার্টার বীর সেনাপতি ব্রাসিডাস দুজনেই নিহত হন।

দুই পক্ষের প্রধান যুদ্ধবাজ নেতার মৃত্যুর পর এবং দশ বছর ধরে যুদ্ধ চলার পর দুই পক্ষই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই ৪২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের রক্ষণশীল নেতা নিকিয়াসের (Nicias) উদ্যোগে তারা ‘নিকিয়াসের শান্তি’ (Peace of Nicias) নামে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। কথা ছিল, এই শান্তি পঞ্চাশ বছর স্থায়ী হবে। কিন্তু হলো না। কারণ এই শান্তি ছিল কাগজের শান্তি। দুই পক্ষের মনেই ছিল তীব্র অবিশ্বাস।

দ্বিতীয় পর্ব: সিসিলিয়ান অভিযান (The Sicilian Expedition, ৪১৫-৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

শান্তিচুক্তি কয়েক বছরও টিকল না। এর মধ্যেই এথেন্স এমন এক ভয়ংকর ভুল করে বসল, যা ছিল তাদের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো।

এথেন্সের রাজনীতিতে তখন এক নতুন তারকার উদয় হয়েছে। তার নাম আলসিবিয়াদিস (Alcibiades)। তিনি ছিলেন অসম্ভব সুদর্শন, বুদ্ধিমান, অসামান্য বক্তা, কিন্তু ততটাই উচ্চাভিলাষী, খামখেয়ালি আর নীতিহীন। তিনি পেরিক্লিসের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও তার বিচক্ষণতার ছিটেফোঁটাও পাননি। আলসিবিয়াদিস এথেন্সের জনগণকে এক নতুন স্বপ্ন দেখালেন—ইতালির সিসিলি (Sicily) দ্বীপ দখল করার স্বপ্ন। সিসিলির সিরাকিউজ (Syracuse) শহরটি ছিল ডোরিয়ান (Dorian) বংশোদ্ভূত, স্পার্টার মতো, এবং ছিল অত্যন্ত সম্পদশালী। আলসিবিয়াদিস বোঝালেন, সিরাকিউজ দখল করতে পারলে এথেন্সের শক্তি এবং সম্পদ বহুগুণ বেড়ে যাবে, আর তারা সহজেই স্পার্টাকে পরাজিত করতে পারবে।

জনগণ তার বাগ্মিতায় উত্তেজিত হয়ে উঠল। এথেন্সের অ্যাসেম্বলিতে এ নিয়ে যে বিতর্ক হয়, তা ছিল গণতন্ত্রের দুর্বলতার এক করুণ প্রদর্শনী। বয়স্ক এবং বিচক্ষণ নেতা নিকিয়াস এই অভিযানের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি এর বিপদগুলো তুলে ধরেন এবং জনগণকে নিরস্ত করার জন্য অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্য ও জাহাজের সংখ্যা বাড়িয়ে বলেন। তিনি ভেবেছিলেন, এত বিশাল আয়োজন করতে এথেন্সবাসী রাজি হবে না। কিন্তু তার কৌশল বুমেরাং হলো। উত্তেজিত জনতা ভাবল, নিকিয়াস যখন এত বিশাল আয়োজনের কথা বলছেন, তার মানে জয় নিশ্চিত। তারা আরও বেশি উৎসাহে অভিযানের পক্ষে ভোট দিল।

তারা এক বিশাল নৌবহর তৈরি করল—১৩৪টি ট্রাইরিম এবং প্রায় পঞ্চাশ হাজার সৈন্য ও নাবিক। এই অভিযানের নেতৃত্বে দেওয়া হলো তিনজন সেনাপতিকে—আলসিবিয়াদিস, নিকিয়াস, এবং ল্যামাকাস (Lamachus)। অভিযানের জন্য যখন বিশাল নৌবহর এথেন্সের বন্দর পাইরিয়াস ছেড়ে যাচ্ছিল, তখন পুরো শহরবাসী তাদের বিদায় জানাতে এসেছিল। থুসিডাইডিস এই দৃশ্যকে বর্ণনা করেছেন এথেন্সের শক্তির এক চরম প্রদর্শনী হিসেবে, যার পেছনে লুকিয়ে ছিল এক অশুভ নিয়তি। (Thucydides, 6.30-32)

কিন্তু ভাগ্যদেবী হয়তো অন্য কিছু চেয়েছিল। নৌবহর সিসিলিতে পৌঁছানোর কিছুদিন পরই এথেন্স থেকে খবর এল, আলসিবিয়াদিসের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার (sacrilege) গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযানের ঠিক আগে এথেন্সের রাস্তায় থাকা হার্মিস দেবতার মূর্তি (Hermae) কারা যেন ভেঙে দিয়েছিল। সন্দেহ গিয়ে পড়ল আলসিবিয়াদিস আর তার বন্ধুদের উপর। তাকে বিচারের জন্য এথেন্সে ফিরে যেতে বলা হলো। আলসিবিয়াদিস বুঝলেন, এথেন্সে ফিরলে তার রাজনৈতিক শত্রুরা তাকে নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড দেবে। তাই তিনি করলেন কী, সোজা পালিয়ে চলে গেলেন শত্রু শিবির স্পার্টার কাছে!

এটা ছিল এথেন্সের জন্য এক বিশাল কৌশলগত এবং মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা। আলসিবিয়াদিস স্পার্টাকে এথেন্সের সব গোপন পরিকল্পনা জানিয়ে দিলেন। তিনি তাদের পরামর্শ দিলেন সিরাকিউজকে সাহায্য করার জন্য একজন দক্ষ সেনাপতি পাঠাতে এবং এথেন্সের কাছেই ডেসেলিয়া (Decelea) নামক জায়গায় একটি স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করতে। স্পার্টা ঠিক তাই করল।

এদিকে সিসিলিতে এথেন্সের বাহিনী একের পর এক ভুল করতে লাগল। ল্যামাকাস যুদ্ধে মারা গেলেন, আর নিকিয়াস একা নেতৃত্বে রইলেন। নিকিয়াস ছিলেন একজন দ্বিধাগ্রস্ত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেনাপতি। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। স্পার্টার পাঠানো সেনাপতি গিলিপ্পাসের (Gylippus) নেতৃত্বে সিরাকিউজের প্রতিরোধ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। এথেন্সের বাহিনী সিরাকিউজের বিশাল বন্দর এলাকায় কোণঠাসা হয়ে পড়ল।

যখন পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেল, তখন নিকিয়াস পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু ঠিক সেই রাতে একটি চন্দ্রগ্রহণ (lunar eclipse) হলো। নিকিয়াস একে অশুভ লক্ষণ মনে করে তার পুরোহিতদের পরামর্শে পিছু হটা সাতাশ দিনের জন্য স্থগিত রাখলেন। এই বিলম্বই এথেন্সের জন্য কাল হলো। সিরাকিউজের নৌবহর এথেন্সের নৌবহরকে বন্দরের মধ্যেই আটকে ফেলে এবং এক ভয়ংকর নৌযুদ্ধে তাদের প্রায় পুরো নৌবহর ধ্বংস করে দেয়। বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা ডাঙা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সিরাকিউজের সৈন্যরা তাদের তাড়া করে ধরে ফেলে। প্রায় সাত হাজার সৈন্যকে বন্দী করা হলো এবং তাদের সিরাকিউজের পাথর খাদানে (stone quarries) ক্রীতদাসের মতো কাজ করতে বাধ্য করা হলো, যেখানে বেশিরভাগ সৈন্যই অনাহারে, রোগ আর কষ্টে মারা যায়। (Hanson, 2005)

সিসিলি অভিযানের এই বিপর্যয় ছিল এথেন্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক পরাজয়। তাদের প্রায় ২০০টি জাহাজ এবং চল্লিশ হাজারেরও বেশি সৈন্যের সলিলসমাধি হলো। এথেন্সের কোমর ভেঙে গেল।

তৃতীয় পর্ব: আয়োনিয়ান বা ডেসেলিয়ান যুদ্ধ (The Ionian or Decelean War, ৪১৩-৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

সিসিলিতে এমন ভয়ংকর পরাজয়ের পর যে কোনো রাষ্ট্রেরই ভেঙে পড়ার কথা। কিন্তু এথেন্স ভাঙল না। তারা অবিশ্বাস্য মনোবল আর সহনশীলতা দেখিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। তারা রিজার্ভ ফান্ড ব্যবহার করে নতুন করে নৌবহর তৈরি করল।

কিন্তু পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গিয়েছিল। স্পার্টা এখন অনেক বেশি শক্তিশালী এবং আত্মবিশ্বাসী। আলসিবিয়াদিসের পরামর্শে তারা এথেন্সের কাছেই অ্যাটিকার ডেসেলিয়াতে একটি স্থায়ী দুর্গ তৈরি করেছিল। ফলে তারা এখন সারা বছর ধরে এথেন্সের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারত, তাদের কৃষিকাজ বন্ধ করে দিতে পারত। প্রায় ২০,০০০ এথেনিয়ান ক্রীতদাস এই সুযোগে পালিয়ে স্পার্টানদের কাছে আশ্রয় নেয়, যা এথেন্সের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে লরিয়ামের রুপার খনিতে, বড় আঘাত হানে।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা এল অন্য জায়গা থেকে। স্পার্টা তাদের পুরনো এবং প্রধান শত্রু পারস্যের সঙ্গে হাত মেলাল! পারস্য দেখল, গ্রিকরা নিজেরা মারামারি করে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, এটাই তাদের হারানো প্রভাব ফিরে পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। পারস্যের আঞ্চলিক শাসক বা সত্রপ (satrap) তিস্‌সাফারনেস (Tissaphernes) এবং ফার্নাবাজুসের (Pharnabazus) মাধ্যমে পারস্য স্পার্টাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য দিতে রাজি হলো একটি নৌবহর তৈরি করার জন্য। শর্ত একটাই—যুদ্ধ শেষে ঈজিয়ান সাগরের আয়োনিয়ান (Ionian) গ্রিক শহরগুলো পারস্যকে ফিরিয়ে দিতে হবে। যে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য গ্রিকরা একদিন একসাথে লড়েছিল, সেই স্বাধীনতাই স্পার্টা এখন ক্ষমতার লোভে পারস্যের কাছে বিক্রি করে দিল। (Kagan, 2003)

পারস্যের টাকায় স্পার্টা এক বিশাল নৌবহর তৈরি করল। তাদের সেনাপতি লাইসান্ডার (Lysander) ছিলেন একজন ধুরন্ধর এবং কুশলী নেতা। তিনি পারস্যের রাজপুত্র সাইরাস দ্য ইয়াংগারের (Cyrus the Younger) সাথে ব্যক্তিগত সখ্যতা গড়ে তোলেন, যা তাদের অর্থের জোগান নিশ্চিত করে।

এর মধ্যে এথেন্সের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও চলছিল চরম অস্থিরতা। ৪১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গণতন্ত্রকে হটিয়ে কিছু সময়ের জন্য ‘চারশ জনের পরিষদ’ (The Council of 400) নামে এক গোষ্ঠীতন্ত্র (Oligarchy) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যদিও তা দ্রুতই ক্ষমতাচ্যুত হয়। আলসিবিয়াদিসও তার গিরগিটির মতো চরিত্র বদল করে যাচ্ছিলেন। তিনি স্পার্টার রাজার স্ত্রীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় স্পার্টা থেকেও পালাতে বাধ্য হন এবং পারস্যের শিবিরে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে আবার তিনি এথেন্সের পক্ষে যোগ দেন এবং কয়েকটি নৌযুদ্ধে জয়লাভও করেন। কিন্তু এথেন্সবাসী তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না।

যুদ্ধের শেষটা হলো অত্যন্ত নাটকীয় এবং করুণভাবে। ৪০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এগোসপোটামি (Aegospotami) নামক জায়গায় হেলস্পন্ট প্রণালীতে এথেন্সের নৌবহর বিশ্রামের জন্য তীরে নোঙর করেছিল। সৈন্যরা খাবারের সন্ধানে জাহাজ ছেড়ে তীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। স্পার্টার সেনাপতি লাইসান্ডার দূর থেকে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সুযোগ বুঝে তিনি অতর্কিত আক্রমণ করে এথেন্সের প্রায় পুরো নৌবহরটিই (১৭০টিরও বেশি জাহাজ) ধ্বংস করে দিলেন। মাত্র কয়েকটি জাহাজ কোনোক্রমে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল। (Xenophon, Hellenica, 2.1)

এই পরাজয়ের পর এথেন্সের আর কিছুই বাকি রইল না। তাদের নৌ শক্তি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। লাইসান্ডার এবার তার নৌবহর নিয়ে এথেন্স অবরোধ করলেন। সমুদ্রপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শহরে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। কয়েক মাস অবরোধের পর, অনাহারে আর হতাশায় ধুঁকতে থাকা এথেন্স অবশেষে ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করল।

প্রায় তিন দশকের রক্তক্ষয়ী এক মহাকাব্যের এখানেই সমাপ্তি ঘটল।

যুদ্ধের পর: এক পরাজিত শহরের কান্না

স্পার্টার জয়ের পর তাদের কিছু মিত্র, যেমন করিন্থ আর থিবস (Thebes), দাবি তুলেছিল যে এথেন্স শহরকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হোক এবং এর অধিবাসীদের ক্রীতদাস বানানো হোক, যেমনটা এথেন্স নিজে মেলোসের (Melos) সাথে করেছিল।

কিন্তু স্পার্টা তাতে রাজি হলো না। তারা বলল, যে শহর একদিন পারস্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গ্রিসকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাকে এভাবে ধ্বংস করা যায় না। এই মহানুভবতার পেছনে অবশ্য বাস্তব কারণও ছিল। স্পার্টা চাইত না যে থিবস বা করিন্থের মতো কোনো রাষ্ট্র অতিরিক্ত শক্তিশালী হয়ে উঠুক। তবে তারা এথেন্সের উপর বেশ কিছু কঠোর এবং অপমানজনক শর্ত আরোপ করল।

  • এথেন্সকে তার সাম্রাজ্যের বাকি সব শহর ছেড়ে দিতে হলো। ডেলিয়ান লিগের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটল।

  • তাদের নৌবহরের মাত্র বারোটি জাহাজ বাদে বাকি সব স্পার্টার হাতে তুলে দিতে হলো।

  • সবচেয়ে অপমানজনক শর্ত ছিল—এথেন্সের সেই গর্বের ‘দীর্ঘ প্রাচীর’ এবং পাইরিয়াসের দুর্গ ভেঙে ফেলতে হবে।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জেনোফন (Xenophon) লিখেছেন, যখন প্রাচীর ভাঙা হচ্ছিল, তখন বাঁশি বাজানো হচ্ছিল এবং বিজয়ী সৈন্যরা উল্লাস করছিল। তাদের মনে হচ্ছিল, এই দিন থেকেই গ্রিসের আসল স্বাধীনতা শুরু হলো। কিন্তু এথেন্সের নাগরিকদের জন্য সেই দৃশ্য ছিল হৃদয়বিদারক। তাদের মনে হচ্ছিল, তাদের শহরের অস্তিত্ব, তাদের নিরাপত্তা, তাদের গর্বের প্রতীক—সবই বুঝি মাটির সাথে মিশে গেল। (Xenophon, Hellenica, 2.2)

স্পার্টা এথেন্সে গণতন্ত্র বাতিল করে তাদের সমর্থক ত্রিশজন স্বৈরাচারী শাসকের (The Thirty Tyrants) একটি গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিল। এদের নেতৃত্বে ছিল ক্রিটিয়াস (Critias), যিনি ছিলেন প্লেটোর আত্মীয় এবং একজন চরমপন্থী গোষ্ঠীতন্ত্রবাদী। এই শাসকেরা এথেন্সে এক ভয়ংকর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা মাত্র আট মাসে হাজার হাজার গণতন্ত্রপন্থী নাগরিককে বিনা বিচারে হত্যা বা নির্বাসিত করে এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।

এই যুদ্ধ-পরবর্তী তিক্ত এবং অবিশ্বাসের আবহেরই একটি করুণ পরিণতি ছিল ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের (Socrates) বিচার ও মৃত্যুদণ্ড। যদিও তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছিল ধর্ম অবমাননা এবং যুবসমাজকে কলুষিত করা, আসল কারণ ছিল রাজনৈতিক। সক্রেটিস ছিলেন ক্রিটিয়াস এবং আলসিবিয়াদিসের মতো অনেকেরই শিক্ষক। শহরের পতনের পর দিশেহারা এথেন্সবাসী তাদের দুর্দশার জন্য স্কেইপগোট বা বলির পাঁঠা খুঁজছিল। সক্রেটিসের নিরন্তর প্রশ্ন করার ধরণ এবং প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করার প্রবণতা তাকে অনেকের চোখে শত্রু বানিয়ে দিয়েছিল। (Cartledge, 2009)

কেন এই যুদ্ধ এত গুরুত্বপূর্ণ? এর থেকে আমরা কী শিখলাম?

পেলোপনেসীয় যুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। কিন্তু আজও পৃথিবীর সেরা সামরিক একাডেমি আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই যুদ্ধ নিয়ে গবেষণা হয়। কেন? কারণ এই যুদ্ধ আমাদের মানব প্রকৃতি, রাষ্ট্র পরিচালনা, এবং যুদ্ধের কৌশল নিয়ে কিছু চিরন্তন শিক্ষা দেয়।

  • ১. ইতিহাস রচনার জন্ম: এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সম্ভবত থুসিডাইডিসের লেখা “History of the Peloponnesian War” বইটি। তিনি ছিলেন প্রথম ইতিহাসবিদ, যিনি কোনো ঘটনাকে দেব-দেবী বা অলৌকিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে, মানবীয় কার্যকারণ (cause and effect) দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রগুলো মূলত তিনটি জিনিস দ্বারা চালিত হয়: ভয়, সম্মান এবং স্বার্থ (fear, honor, and interest)। তার এই বিশ্লেষণধর্মী, নিরপেক্ষ পদ্ধতিই আধুনিক ‘বৈজ্ঞানিক ইতিহাস’ (Scientific History) রচনার ভিত্তি তৈরি করে।
  • ২. গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের লড়াই: এই যুদ্ধকে অনেকেই গণতন্ত্র (Democracy) আর গোষ্ঠীতন্ত্রের (Oligarchy) মধ্যে আদর্শিক লড়াই হিসেবে দেখেন। এথেন্সের গণতন্ত্র অনেক সময় হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে (যেমন সিসিলি অভিযান), যা তাদের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। আবার স্পার্টার কঠোর, শৃঙ্খলাবদ্ধ শাসনব্যবস্থা তাদের দিয়েছে অবিশ্বাস্য সহনশীলতা এবং চূড়ান্ত বিজয়। এই বিতর্ক আজও চলছে—জনগণের আবেগ দ্বারা চালিত গণতন্ত্র শ্রেয়, নাকি মুষ্টিমেয়র কঠোর শাসন?
  • ৩. সাম্রাজ্যবাদের বিপদ: এথেন্সের পতন আমাদের দেখায় যে, শক্তি প্রয়োগ করে তৈরি করা সাম্রাজ্য কতটা ভঙ্গুর হতে পারে। ডেলিয়ান লিগের সদস্যদের উপর অত্যাচারই শেষ পর্যন্ত এথেন্সের জন্য কাল হয়েছিল। সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য যে বিপুল সম্পদ ও শক্তির প্রয়োজন, তা একসময় সাম্রাজ্যকেই ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেয়।
  • ৪. যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৈতিকতার অবক্ষয়: থুসিডাইডিস কোনো রাখঢাক না করেই যুদ্ধের নৃশংসতা তুলে ধরেছেন। তার বইয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত অংশগুলোর একটি হলো ‘মেলিয়ান ডায়ালগ’ (Melian Dialogue)। ৪১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স নিরপেক্ষ মেলোস (Melos) দ্বীপকে তাদের জোটে যোগ দিতে বাধ্য করতে যায়। মেলোসের বাসিন্দারা ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার কথা বললে, এথেন্সের প্রতিনিধিরা নির্মোহভাবে উত্তর দেয়, “শক্তিশালীরা যা পারে তাই করে, আর দুর্বলরা যা পারে তাই সহ্য করে।” (The strong do what they can and the weak suffer what they must.) (Thucydides, 5.89)। এটি ছিল শক্তির রাজনীতির (Power Politics) এক নগ্ন প্রকাশ। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ কীভাবে একটি সভ্য সমাজের নৈতিকতাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়, এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
  • ৫. থুসিডাইডিসের ফাঁদ: আগেই যেমনটা বলেছি, এই তত্ত্ব আজও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আজকের পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পর্ককে অনেকেই এই তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করেন। একটি উদীয়মান শক্তি যখন প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানায়, তখন সংঘাতের আশঙ্কা কতটা বাস্তব, পেলোপনেসীয় যুদ্ধ তার সবচেয়ে বড় এবং করুণ উদাহরণ।
  • ৬. যুদ্ধের পদ্ধতির পরিবর্তন: এই যুদ্ধ সনাতন যুদ্ধের ধারণাকে বদলে দেয়। এটি শুধু গ্রীষ্মকালীন কিছু হপলাইট লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এতে ছিল দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ, অর্থনৈতিক যুদ্ধ (বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা, পারস্যের অর্থ), নৌ-শক্তির ব্যাপক ব্যবহার, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এবং ভাড়াটে সৈন্যদের (mercenaries) ক্রমবর্ধমান ব্যবহার। এটি ছিল এক ধরনের ‘টোটাল ওয়ার’ (Total War) এর প্রাথমিক রূপ।

শেষ কথা

পেলোপনেসীয় যুদ্ধ কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল গ্রিক সভ্যতার এক আত্মঘাতী ও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ (fratricidal war)। এই যুদ্ধের শেষে স্পার্টা জিতেছিল ঠিকই, কিন্তু আসলে হেরে গিয়েছিল পুরো গ্রিস। দশকের পর দশক ধরে চলা এই যুদ্ধ গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু এবং সামরিকভাবে এতটাই দুর্বল করে দিয়েছিল যে, তারা আর কখনও তাদের পুরনো গৌরবে ফিরতে পারেনি। স্পার্টার আধিপত্যও বেশিদিন টেকেনি; তাদের স্বৈরাচারী আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে অন্য গ্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ শুরু করে (করিন্থিয়ান যুদ্ধ)। এই অন্তহীন গৃহযুদ্ধের সুযোগেই উত্তরের ম্যাসিডোনিয়ার (Macedonia) রাজা ফিলিপ (Philip II) এবং তার পুত্র মহাবীর আলেকজান্ডার (Alexander the Great) খুব সহজেই পুরো গ্রিস দখল করে নিতে পেরেছিলেন। গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ চিরতরে শেষ হয়ে যায়।

গল্পের শুরুটা হয়েছিল পারস্যের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার গৌরব দিয়ে, আর শেষটা হলো নিজেদের ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এক পরাজিত সভ্যতা দিয়ে। হয়তো এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সবচেয়ে বড় শত্রু বাইরে থাকে না, লুকিয়ে থাকে আমাদের নিজেদের ভেতরে—আমাদের ভয়, আমাদের লোভ, আর আমাদের অহংকারের মধ্যে। যখন এই ভেতরের শত্রুরা জয়ী হয়, তখন বাইরের শত্রুর আর প্রয়োজন পড়ে না। ধ্বংসটা আমরা নিজেরাই ডেকে আনি।

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলে মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়, তাই না?

তথ্যসূত্র

  • Allison, G. (2017). Destined for War: Can America and China Escape Thucydides’s Trap? Houghton Mifflin Harcourt.
  • Cartledge, P. (2003). The Spartans: The World of the Warrior-Heroes of Ancient Greece. Vintage Books.
  • Cartledge, P. (2009). Ancient Greece: A History in Eleven Cities. Oxford University Press.
  • Hanson, V. D. (2005). A War Like No Other: How the Athenians and Spartans Fought the Peloponnesian War. Random House.
  • Kagan, D. (2003). The Peloponnesian War. Viking Penguin.
  • Thucydides. (1998). The Landmark Thucydides: A Comprehensive Guide to the Peloponnesian War (R. B. Strassler, Ed.; R. Crawley, Trans.). Free Press.
  • Xenophon. (1998). The Landmark Xenophon’s Hellenika (R. B. Strassler, Ed.; J. Marincola, Trans.). Pantheon Books.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.