কনফুসিয়াসের সামগ্রিক দর্শন সম্পর্কে জানতে যান এখানে – কনফুসিয়াস: এলোমেলো সময়ের এক সরল পথপ্রদর্শক
Table of Contents
ভূমিকা
একবার ভাবুন তো, একটা গোটা দেশ জুড়ে অরাজকতা। যেন এক বিশাল অর্কেস্ট্রা, কিন্তু কেউ কারো সুরের তোয়াক্কা করছে না, যে যার মতো বেসুরো বাজিয়ে চলেছে। রাজা আছেন, কিন্তু তাঁর কথা শোনার মতো লোক খুঁজে পাওয়া ভার। চারিদিকে শুধু হানাহানি, ক্ষমতার লোভ, আর ছোট ছোট রাজ্যগুলো একে অপরের সাথে এমনভাবে মারামারি করছে, যেন দেশটা একটা কসাইখানা নয়, তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু। সাধারণ মানুষ? তাদের কথা আর কী বলব! তারা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, এই দুঃস্বপ্নের রাত কবে পোহাবে? সূর্যটা কি আর উঠবে না?
এমনই এক সময়ে, আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, চীনের ধূসর মাটিতে এক দার্শনিকের আবির্ভাব হলো। যেন ঘন অন্ধকারের বুক চিরে এক চিলতে ভোরের আলো। নাম তাঁর কুং ফু-জু (孔夫子, Kǒng Fūzǐ), তবে ইতিহাসের পাতায় আর আমাদের হৃদয়ে তিনি কনফুসিয়াস (Confucius) নামেই স্থায়ী আসন গেড়েছেন। তিনি তলোয়ার ধরেননি, সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাজ্য জয় করতে ছোটেননি। তাঁর হাতে ছিল না কোনো বিধ্বংসী অস্ত্র, ছিল না কোনো জাদুকরী ক্ষমতা। তাঁর হাতিয়ার ছিল চিন্তা, প্রজ্ঞা আর মানুষের ভেতরের ঘুমন্ত দেবতাকে জাগিয়ে তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। তিনি এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে নীতি হবে রাজার মুকুটের চেয়েও উজ্জ্বল, যেখানে ভালোবাসা আর কর্তব্যের অদৃশ্য সুতোয় সমাজ বাঁধা থাকবে, কাঁটাতারের বেড়া আর শাস্তির ভয়ে নয়। চলুন, ডুব দেওয়া যাক সেই মহান দার্শনিকের রাষ্ট্রচিন্তার অতল, শান্ত, কিন্তু গভীর সাগরে।
যে সময়ে কনফুসিয়াসের জন্ম: এক অস্থির সময়ের করুণ প্রতিচ্ছবি
কনফুসিয়াস এই ধরাধামে এসেছিলেন আনুমানিক ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, চীনের লু (魯, Lu) রাজ্যে। এই সময়টাকে ইতিহাসবিদরা বলেন বসন্ত ও শরৎ যুগ (春秋時代, Spring and Autumn period, ৭৭১-৪৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। নামটা শুনে বসন্তের ফুলের গন্ধ কিংবা শরতের স্নিগ্ধ বাতাসের কথা মনে হতে পারে, কিন্তু আদতে সময়টা ছিল ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিরতা আর নৈতিক অবক্ষয়ের এক জীবন্ত দলিল। চৌ সাম্রাজ্যের (周朝, Zhou Dynasty) সোনালী দিন তখন অস্তমিত। কেন্দ্রীয় শাসকের কর্তৃত্ব ছিল একটা ছেঁড়া পালের মতো, যা আর ঝোড়ো বাতাস সামলাতে পারছিল না। দেশটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্যে, আর সেই রাজ্যগুলোর উচ্চাভিলাষী শাসকেরা একে অপরের সাথে অবিরাম যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন (Creel, 1949)। পুরনো রীতিনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ – সবকিছু যেন ভাঙা কাঁচের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ঠিক যেন একটা বনেদি পরিবারের কর্তা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পত্তি নিয়ে যে কদর্য মারামারি শুরু হয়, দেশের অবস্থাও ছিল অনেকটা তেমনই। নীতি তখন নির্বাসনে, আর ক্ষমতা দখলের নগ্ন উল্লাস চলছিল সর্বত্র।
কনফুসিয়াস নিজে জন্মেছিলেন এক অভিজাত (scholar-official class, 士, shì) কিন্তু ততদিনে শ্রীহীন, দরিদ্র পরিবারে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা সং (宋, Song) রাজ্যের অভিজাত ছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে লু রাজ্যে এসে সাধারণ জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। জনশ্রুতি আছে, তাঁর মা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণা ও বিদুষী মহিলা, যিনি কনফুসিয়াসের চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হলেও, তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল অসীম, যেন মরুভূমির বুকে এক ফোঁটা জলের জন্য তৃষ্ণার্ত পথিকের আকুতি। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঠিক শিক্ষা আর অন্তরের গভীরে প্রোথিত নৈতিকতাবোধই পারে এই ঘোর দুর্দিন থেকে সমাজকে টেনে তুলতে, মানুষকে আলোর পথ দেখাতে।
যৌবনে তিনি বিভিন্ন সরকারি পদে কাজ করেছেন, যেমন শস্যভাণ্ডারের তত্ত্বাবধায়ক, পশুপালনের পরিদর্শক ইত্যাদি। এই সব ছোটখাটো কাজ থেকেও তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকত বৃহত্তর পরিসরে। তিনি চীনের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন, শাসকদের কাছে তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর কথা কেউ কানে তোলেনি, অথবা শুনলেও গুরুত্ব দেয়নি। শাসকেরা তখন দ্রুত ফল পেতে উদগ্রীব, অনেকটা আজকের দিনের ফাস্টফুড কালচারের মতো। নৈতিকতার দীর্ঘমেয়াদী পথে তাঁদের আস্থা ছিল কম; ক্ষমতার খেলায় কে আর নীতি-আদর্শের ধার ধারে (Schwartz, 1985)? তাঁরা খুঁজছিলেন এমন কোনো জাদুমন্ত্র, যা রাতারাতি তাঁদের সিংহাসন পাকা করে দেবে। কনফুসিয়াসের ধীরগতির, চরিত্রগঠনমূলক সংস্কারের প্রতি তাঁদের তেমন আগ্রহ ছিল না। অনেকটা আজকের দিনের কিছু নেতার মতো, যারা চটকদার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চান, দেশের বা দশের মঙ্গলের চেয়ে নিজেদের আখের গোছানোতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন।
তবে কনফুসিয়াস হতাশায় ভেঙে পড়া মানুষদের দলে ছিলেন না। শাসকেরা তাঁর কথায় কর্ণপাত না করলেও, তিনি তাঁর জ্ঞান বিতরণ বন্ধ করেননি। তিনি তাঁর শিষ্যদের (disciples) মাধ্যমে তাঁর চিন্তা ও দর্শন ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল এমন একদল মানুষ তৈরি করা, যারা জ্ঞানে, গুণে এবং নৈতিকতায় শ্রেষ্ঠ হবে – যাদের তিনি বলতেন ‘জুনজি’ (君子, Jūnzǐ) বা আদর্শ মানুষ – এবং তারাই একদিন রাষ্ট্র পরিচালনায় সঠিক নেতৃত্ব দেবে, সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসবে। তাঁর বাসস্থানই হয়ে উঠেছিল তাঁর শিক্ষাকেন্দ্র, যেখানে দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞানপিপাসু তরুণেরা এসে ভিড় করত।
কনফুসিয়াসের মনের কারিগর: যে সময় ও চিন্তা তাঁকে পথ দেখিয়েছিল
আচ্ছা, ভাবুন তো একবার, কোনো বিশাল বটগাছ কি এক দিনে আকাশ ছুঁতে পারে? পারে না। তার জন্য দরকার হয় উর্বর মাটি, জল, আলো-বাতাস আর দীর্ঘ সময়ের পরিচর্যা। ঠিক তেমনি, কোনো মহান দার্শনিকের চিন্তাও তো আর আকাশ থেকে পড়ে না! তার পেছনেও থাকে সময়ের জল-হাওয়া, পারিপার্শ্বিকতার চাপ, আর পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া জ্ঞানের অমূল্য ভাণ্ডার। আমাদের আজকের গল্পের নায়ক, মহামতি কনফুসিয়াসও (Confucius) এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর সেই বিখ্যাত রাষ্ট্রচিন্তা, যেখানে রাজার চেয়ে নীতি বড়, যেখানে ভালোবাসা আর কর্তব্যে সমাজ বাঁধা—সেই চিন্তার বীজ বুনে দিয়েছিল তাঁর সময়ের ভয়াবহ রাজনৈতিক বাস্তবতা আর তারও আগেকার কিছু গভীর দার্শনিক স্রোত।
যখন চীন কাঁদছিল: এক চরম অরাজকতার যুগ
কনফুসিয়াস জন্মেছিলেন এমন এক সময়ে, যেটাকে ইতিহাসবিদরা বলেন “বসন্ত ও শরৎ যুগ” (春秋時代, Chūnqiū Shídài, আনুমানিক ৭৭১-৪৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। নামটা শুনতে বেশ কাব্যিক, তাই না? মনে হয় যেন ফুলে ফুলে ভরা বসন্ত আর মেঘমুক্ত শরতের আকাশ। কিন্তু নামের সাথে বাস্তবতার ছিল যোজন যোজন ফারাক। এই সময়টা ছিল চীনের ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার, অস্থিতিশীল আর রক্তক্ষয়ী অধ্যায়গুলোর একটি (Hinsch, 2002)।
আগেকার চৌ সাম্রাজ্য (周朝, Zhōu Dàcháo) একসময় বিশাল চীনের বুকে শান্তি আর শৃঙ্খলা এনেছিল। কিন্তু কনফুসিয়াসের সময় তার মরণদশা। রাজার ক্ষমতা কমে গিয়ে ঠেকেছিল নামে মাত্র। অনেকটা আজকের দিনের কোনো পুরনো বনেদি বাড়ির কর্তার মতো, যাঁর হুকুম তামিল করার মতো লোক আর বিশেষ নেই, শুধু পুরনো সম্মানটুকুই যা সম্বল। বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্যে। আর এই রাজ্যগুলোর শাসকেরা? তাঁরা যেন উন্মত্ত নেকড়ের পাল! একে অপরের জমি দখল, সম্পদ লুট আর প্রভাব বিস্তারের জন্য অবিরাম যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত। নৈতিকতা, মানবিকতা – এসব শব্দ তখন অভিধানেই বোধহয় ধুলো জমছিল। “জোর যার মুলুক তার” – এটাই ছিল সে সময়ের অলিখিত আইন (Creel, 1970)।
ভাবুন তো সেই সাধারণ মানুষগুলোর কথা! তাদের জীবন ছিল প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চিত। আজ হয়তো ফসল ফলিয়েছে, কালই হয়তো যুদ্ধের আগুনে সব পুড়ে ছাই। আজ যে রাজা, কাল হয়তো সে বন্দি বা নিহত। সামাজিক মূল্যবোধ ভেঙে চুরমার। কে কাকে বিশ্বাস করবে, কিসের উপর ভরসা রাখবে – তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এই সার্বিক অবক্ষয়, এই অন্তহীন হানাহানি কনফুসিয়াসের সংবেদনশীল মনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি প্রতিনিয়ত দেখছিলেন, কীভাবে নীতির অভাবে একটা গোটা সভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিই তাঁর মনে একটা প্রশ্ন জাগিয়েছিল – আচ্ছা, এই ভাঙন রোধ করার কি কোনো উপায় নেই? সমাজকে আবার কীভাবে শৃঙ্খলার পথে, শান্তির পথে ফিরিয়ে আনা যায়? এই গভীর আর্তিই তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল এক নতুন রাষ্ট্রনৈতিক দর্শনের সন্ধানে (Schwartz, 1985)।
পুরোনো দিনের সোনার কাঠি: চৌ সাম্রাজ্যের আদর্শের হাতছানি
কনফুসিয়াস কিন্তু শূন্য থেকে তাঁর চিন্তার প্রাসাদ গড়েননি। তিনি ছিলেন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাঁর অস্থির বর্তমানের বিপরীতে তিনি প্রায়শই তাকাতেন অতীতের দিকে, বিশেষ করে পশ্চিম চৌ সাম্রাজ্যের (Western Zhou Dynasty, আনুমানিক ১০৪৬-৭৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রথম দিককার সময়ের প্রতি। তাঁর চোখে, সেটা ছিল এক স্বর্ণযুগ – যখন শাসকেরা ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, প্রজারা ছিল অনুগত, আর সমাজে ছিল শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি।
এই অতীতের প্রতি আকর্ষণের পেছনে বিশেষ কিছু কারণ ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব ছিল:
১. চৌ-এর ডিউক (周公, Zhōugōng): এক কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক: কনফুসিয়াসের চোখে, চৌ-এর ডিউক ছিলেন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক ও শাসকের প্রতিমূর্তি। ডিউক ছিলেন চৌ সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাজা উ-এর (King Wu) ভাই। রাজা উ-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাজা চেং (King Cheng) যখন নাবালক, তখন ডিউক অভিভাবক হিসেবে দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করেন। তিনি চাইলে নিজেই সিংহাসন দখল করতে পারতেন, কিন্তু তা না করে তিনি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং রাজা চেং সাবালক হওয়ার পর তাঁর হাতে ক্ষমতা তুলে দেন। এই নিঃস্বার্থপরায়ণতা, প্রজ্ঞা এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর দক্ষতা কনফুসিয়াসকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ডিউক চৌ-এর সময়ের আচার-অনুষ্ঠান (禮, Lǐ) এবং সঙ্গীত (樂, Yuè) চর্চার মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার যে প্রয়াস, তা কনফুসিয়াস তাঁর নিজের দর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিলেন (Eno, 2009)। কনফুসিয়াস প্রায়ই স্বপ্নে ডিউক চৌ-কে দেখতেন বলে উল্লেখ আছে, যা তাঁর প্রতি কনফুসিয়াসের গভীর শ্রদ্ধা ও মানসিক নৈকট্যের পরিচায়ক (Analects, 7.5)।
২. স্বর্গের বিধান (天命, Tiānmìng – Mandate of Heaven): ক্ষমতার নৈতিক ভিত্তি: চৌ শাসকেরা তাঁদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য “স্বর্গের বিধান” নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ধারণার প্রবর্তন করেছিলেন। এর মূল কথা হলো, শাসক তাঁর শাসনক্ষমতা লাভ করেন এক সর্বোচ্চ নৈতিক শক্তি বা “স্বর্গ” থেকে। কিন্তু এই ক্ষমতা শর্তহীন নয়। শাসক যতদিন ন্যায়পরায়ণ থাকবেন, প্রজার কল্যাণ করবেন এবং নৈতিকভাবে দেশ শাসন করবেন, ততদিনই তিনি এই “স্বর্গীয় অনুমোদন” লাভ করবেন। যদি শাসক অত্যাচারী বা অযোগ্য প্রমাণিত হন, তাহলে স্বর্গ তাঁর থেকে সেই অনুমোদন প্রত্যাহার করে নেবে এবং অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তির হাতে শাসনের ভার তুলে দেবে (Graham, 1989)। এই ধারণাটি শাসকের উপর একটি নৈতিক দায়বদ্ধতা চাপিয়েছিল। কনফুসিয়াস এই “স্বর্গের বিধান” তত্ত্বটিকে গ্রহণ করেছিলেন এবং একে আরও পরিশীলিত করে শাসকের নৈতিক আচরণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁর মতে, শাসকের ব্যক্তিগত সদ্গুণই (德, Dé) হলো স্বর্গের বিধান ধরে রাখার চাবিকাঠি।
৩. ‘লি’ (禮, Lǐ) বা আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক নিয়ম: পশ্চিম চৌ যুগে ‘লি’ বা আচার-অনুষ্ঠান শুধুমাত্র ধর্মীয় উপাসনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষের আচরণবিধি, পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও কর্তব্য – সবকিছুই ‘লি’-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতো। এই ‘লি’ সমাজে এক ধরনের শৃঙ্খলা ও স্তরবিন্যাস (hierarchy) বজায় রাখতে সাহায্য করত, যা কনফুসিয়াসের মতে একটি সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য। তবে কনফুসিয়াস ‘লি’-এর বাহ্যিক আড়ম্বরের চেয়ে তার অন্তর্নিহিত নৈতিক চেতনা ও আন্তরিকতার উপর বেশি জোর দিয়েছিলেন (Fingarette, 1972)। তিনি মনে করতেন, ‘লি’ পালনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিনয়, শ্রদ্ধা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জন্মায়।
৪. ‘দ্য’ (德, Dé) বা সদ্গুণ/নৈতিক শক্তি: ‘দ্য’ বা শাসকের ব্যক্তিগত সদ্গুণ ও নৈতিক প্রভাবের ধারণাটিও চৌ যুগে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশ্বাস করা হতো, পুণ্যবান শাসকের ‘দ্য’ বা নৈতিক শক্তি প্রজাদের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তাদেরও সদ্গুণের পথে চালিত করে। কনফুসিয়াস এই ‘দ্য’-এর ধারণাকে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন। তাঁর মতে, আইন ও শাস্তির ভয়ের চেয়ে শাসকের নৈতিক আদর্শ ও ব্যক্তিগত উদাহরণ অনেক বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর (Analects, 2.3)।
প্রাচীন গ্রন্থাদির জ্ঞান: ঐতিহ্যের পাতায় প্রজ্ঞা
কনফুসিয়াস ছিলেন একজন অক্লান্ত পাঠক ও জ্ঞানসাধক। তিনি প্রাচীন গ্রন্থাদি, বিশেষ করে যেগুলো চৌ যুগের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে, সেগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন। এই গ্রন্থগুলো তাঁর চিন্তাজগৎকে সমৃদ্ধ করেছিল এবং তাঁর নৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি জুগিয়েছিল।
১. শুচিং (書經, Shūjīng) বা বুক অফ ডকুমেন্টস (Book of Documents): এই গ্রন্থে প্রাচীনকালের (বিশেষ করে সিয়া, শাং ও চৌ সাম্রাজ্যের) শাসকদের ঘোষণা, বক্তৃতা ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ ছিল। এতে পুণ্যবান ও অত্যাচারী – উভয় প্রকার শাসকের কাহিনীই পাওয়া যায়, যা থেকে কনফুসিয়াস রাষ্ট্র পরিচালনার নৈতিক নীতিমালা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করেছিলেন। কীভাবে শাসকের আচরণ রাজ্যের উত্থান-পতনের কারণ হতে পারে, তার বহু দৃষ্টান্ত এই গ্রন্থে ছিল (Legge, 1865)।
২. শিচিং (詩經, Shījīng) বা বুক অফ সংস (Book of Songs): এটি ছিল প্রাচীন চীনের ৩০৫টি কবিতা বা গানের একটি সংকলন। এই কবিতাগুলোতে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, সামাজিক রীতিনীতি এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিফলিত হয়েছে। কনফুসিয়াস এই গ্রন্থটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন, এই কবিতাগুলো পাঠের মাধ্যমে মানুষের অনুভূতি পরিশীলিত হয়, নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হয় এবং সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা জন্মায় (Analects, 17.9)। তিনি তাঁর শিষ্যদের প্রায়ই শিচিং অধ্যয়নের উপদেশ দিতেন, কারণ এটি মানুষকে সঠিকভাবে কথা বলতে এবং আবেগ প্রকাশ করতে শেখায়।
৩. ই চিং (易經, Yìjīng) বা বুক অফ চেঞ্জেস (Book of Changes): এটি মূলত একটি ভাগ্যগণনার গ্রন্থ হলেও, এর মধ্যে মহাবিশ্বের পরিবর্তনশীল প্রকৃতি এবং বিপরীত শক্তির (যেমন ইন ও ইয়াং) ভারসাম্যের উপর গভীর দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়। কনফুসিয়াস পরিণত বয়সে এই গ্রন্থটি অধ্যয়ন করে এর অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন বলে কথিত আছে (Nylan, 2001)। যদিও এটি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তাকে কতটা সরাসরি প্রভাবিত করেছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে মহাজাগতিক সম্প্রীতি ও ভারসাম্যের ধারণা তাঁর দর্শনে অনুপস্থিত ছিল না।
‘শি’ (士, Shì) বা পণ্ডিত-কর্মকর্তা শ্রেণীর উত্থান: কনফুসিয়াসের সময়ে ‘শি’ বা পণ্ডিত-কর্মকর্তা শ্রেণীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা তৈরি হচ্ছিল। অতীতে ‘শি’-রা ছিলেন মূলত নিম্নস্তরের যোদ্ধা বা অভিজাত শ্রেণীর সদস্য। কিন্তু বসন্ত ও শরৎ যুগে যুদ্ধবিগ্রহের কৌশলের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনা ও কূটনীতির গুরুত্ব বাড়তে থাকায় শিক্ষিত ও জ্ঞানবান ব্যক্তিদের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই ‘শি’-রাই ক্রমশ বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসনে পরামর্শদাতা, অমাত্য বা কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হতে শুরু করেন।
কনফুসিয়াস নিজেও এই ‘শি’ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জন্মসূত্রে আভিজাত্যের চেয়ে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নৈতিক যোগ্যতাই হলো সরকারি পদে নিয়োগের প্রধান মাপকাঠি হওয়া উচিত। তিনি এমন একদল ‘শি’ বা ‘জুনজি’ (君子, Jūnzǐ – আদর্শ মানুষ বা ভদ্রলোক) তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নিঃস্বার্থভাবে রাষ্ট্রের ও জনগণের সেবা করবে (Pines, 2009)। এই ‘শি’ শ্রেণীর উত্থান এবং তাদের জন্য একটি নৈতিক ও কার্যকরী ভূমিকা নির্ধারণ করা কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল।
অন্যান্য চিন্তাধারার ক্ষীণ প্রতিধ্বনি (যদিও প্রধানত প্রতিক্রিয়ামূলক)
কনফুসিয়াসের সময়ে বা তার কিছু আগে-পরে আরও কিছু দার্শনিক চিন্তার উন্মেষ ঘটছিল, যেগুলোকে একত্রে “শত মতবাদ” (百家爭鳴, Bǎijiā zhēngmíng) এর প্রাথমিক পর্যায় বলা যেতে পারে। যদিও কনফুসিয়াস মূলত চৌ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ছিলেন, তবুও সমসাময়িক কিছু ভিন্ন চিন্তার অস্তিত্ব হয়তো তাঁকে তাঁর নিজের অবস্থানকে আরও সুস্পষ্ট করতে সাহায্য করেছিল।
যেমন, পরবর্তীকালে যে আইনবাদ (Legalism) একটি শক্তিশালী দার্শনিক ধারা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তার কিছু প্রাথমিক ধারণা হয়তো তখন থেকেই বাতাসে ভাসছিল। আইনবাদীরা যেখানে মানুষের প্রকৃতিকে সহজাতভাবে স্বার্থপর মনে করে কঠোর আইন ও শাস্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলতেন, কনফুসিয়াস সেখানে নৈতিকতা ও শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন। এই বিপরীতমুখী চিন্তার অস্তিত্ব হয়তো কনফুসিয়াসকে তাঁর নৈতিক দর্শনের অপরিহার্যতা আরও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
একইভাবে, তাওবাদের (Taoism) কিছু আদিম রূপ, যা প্রকৃতির অনাড়ম্বর জীবন এবং জাগতিক জাঁকজমক থেকে দূরে থাকার কথা বলে, তারও কিছু আভাস হয়তো ছিল। তবে কনফুসিয়াস সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন, যা তাওবাদী নিষ্ক্রিয়তার (無為, Wúwéi) ধারণার থেকে ভিন্ন।
অতীতের আলোয় ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তা কোনো আকস্মিক উদ্ভাবন ছিল না। এর শিকড় প্রোথিত ছিল তাঁর সময়ের ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট এবং তারও আগেকার চৌ সাম্রাজ্যের স্বর্ণোজ্জ্বল ঐতিহ্য ও নৈতিক আদর্শের গভীরে। প্রাচীন গ্রন্থাদির জ্ঞান, কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বদের উদাহরণ এবং সমসাময়িক সামাজিক পরিবর্তন – এই সবকিছুই তাঁর সংবেদনশীল ও প্রজ্ঞাবান মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।
তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ সমন্বয়ক। তিনি অতীতের মূল্যবান উপাদানগুলোকে সযত্নে চয়ন করে, সেগুলোকে তাঁর নিজস্ব প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ছাঁচে ফেলে এক নতুন ও সুসংহত রূপ দিয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই – কীভাবে এই চরম অবক্ষয় ও অরাজকতার হাত থেকে সমাজকে বাঁচানো যায়, কীভাবে মানুষকে আবার নীতির পথে, শৃঙ্খলার পথে, এবং সর্বোপরি, মানবতার পথে ফিরিয়ে আনা যায়। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা ছিল সেই মহৎ লক্ষ্যেরই এক বাস্তবসম্মত রূপরেখা।
ঠিক যেমন একজন দক্ষ কারিগর পুরনো দিনের ভাঙা আয়নার কাঁচগুলোকে যত্ন করে কুড়িয়ে নিয়ে, সেগুলোকে আবার নতুন করে সাজিয়ে অপূর্ব নকশা তৈরি করেন, কনফুসিয়াসও তেমনি অতীতের জ্ঞান আর বর্তমানের প্রয়োজনকে মিলিয়ে এক কালোত্তীর্ণ দর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন। সেই দর্শন আজও আমাদের পথ দেখায়, আজও আমাদের ভাবায়। আর এখানেই তো তাঁর সার্থকতা, তাই না?
কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তার মূল ভিত্তি: নীতিই সবকিছুর ঊর্ধ্বে, যেন ধ্রুবতারা
কনফুসিয়াসের সুবিশাল রাষ্ট্রচিন্তার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে, যেন পদ্মফুলের মাঝখানে, রয়েছে নৈতিকতা (Ethics, 道德, Dàodé)। তিনি বারংবার বলেছেন, একটি রাষ্ট্র তখনই সুন্দরভাবে চলতে পারে, যখন তার ভিত্তি হবে সুদৃঢ় নৈতিক আদর্শের উপর স্থাপিত। আইন আর শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানুষকে হয়তো সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাদের মুখ বন্ধ করা যায়, কিন্তু তাদের হৃদয় জয় করা যায় না। আর হৃদয় জয় করতে না পারলে সেই শাসন কখনও টেকসই হয় না, তা সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন (Analects, 2.3)। কনফুসিয়াসের মতে, শাসকের ব্যক্তিগত চরিত্রই হলো রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শক্তি, সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। যদি শাসক নিজে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হন, তাহলে তাঁর গুণাবলি সূর্যের আলোর মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, প্রজাদের অনুপ্রাণিত করবে।
আসুন, তাঁর কিছু মৌলিক ধারণা, যা তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার স্তম্ভস্বরূপ, সেগুলো একটু বিস্তারিতভাবে, গল্পের ছলে জেনে নিই:
রেন (仁, Rén) – মানবতা বা পরার্থপরতা: এক ফোঁটা শিশিরের স্নিগ্ধতা
যদি কনফুসিয়াসের সমগ্র দর্শনকে একটিমাত্র শব্দে ধারণ করতে বলা হয়, তবে সেই শব্দটি নিঃসন্দেহে হবে ‘রেন’। এর সঠিক বাংলা বা ইংরেজি প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়াটা বেশ দুরূহ। একে বলা যেতে পারে মানবতা, সহানুভূতি, দয়া, পরার্থপরতা, অন্তর্নিহিত সদ্গুণ। ‘রেন’ হলো মানুষের প্রতি মানুষের সেই গভীর ভালোবাসা, যা স্বার্থের cálculos ছাপিয়ে ওঠে। এটি অন্যের দুঃখে নিজে ব্যথিত হওয়া, অন্যের আনন্দে আন্তরিকভাবে খুশি হওয়া, এবং সর্বোপরি, মানুষ হিসেবে নিজের সম্পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো (Chan, 1963)। ‘রেন’-এর চীনা অক্ষরটি (仁) দুটি অংশ নিয়ে গঠিত: ‘মানুষ’ (人) এবং ‘দুই’ (二), যা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্বকেই নির্দেশ করে।
রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এর মানে কী? খুব সহজ। এর মানে হলো, শাসককে হতে হবে ‘রেন’ গুণসম্পন্ন, তাঁর হৃদয়ে থাকতে হবে অকৃত্রিম মানবপ্রেম। তিনি প্রজাদের ভালোবাসবেন নিজের সন্তানের মতো, তাদের সুখ-দুঃখ অনুভব করবেন নিজের হৃদয়ের গভীরে। তিনি এমন কোনো কাজ করবেন না, যা তিনি নিজের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেন। কনফুসিয়াস বলতেন, “己所不欲,勿施於人” (jǐ suǒ bù yù, wù shī yú rén) – “যা তুমি নিজের জন্য চাও না, তা অন্যের প্রতি করো না” (Analects, 12.2, 15.24)। এই যে সোনালী নীতি (Golden Rule), এটা যদি শাসকেরা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন, তাহলে রাষ্ট্রে কত অশান্তি, কত সংঘাত যে আপনাআপনি কমে যায়, তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
তবে ‘রেন’ শুধু শাসকের একার জন্য নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্যই এটি একটি অপরিহার্য গুণ। প্রত্যেকে যদি অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, অপরের কল্যাণ কামনা করে, তাহলে সমাজটা এমনিতেই একটা ফুলের বাগানের মতো সুন্দর হয়ে ওঠে, যেখানে হিংসা-বিদ্বেষের কাঁটাগুলো শুকিয়ে যায়। ‘রেন’ হলো সেই আঠা, যা সমাজকে একত্রে ধরে রাখে।
লি (禮, Lǐ) – আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক নিয়ম: জীবনের সুর-তাল-লয়
‘লি’ শব্দটির অর্থও বেশ ব্যাপক এবং গভীর। এটি শুধু বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান (rituals) বা রীতিনীতি (customs) নয়, বরং এর মধ্যে রয়েছে শিষ্টাচার (propriety), সামাজিক নিয়মকানুন (social norms), এবং সর্বোপরি, সঠিক আচরণবিধি (proper conduct) যা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কনফুসিয়াস গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, সমাজে শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখার জন্য ‘লি’-এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ‘লি’ মানুষকে শেখায় কাকে সম্মান করতে হবে, কার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে, কোন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত আর কী করা অনুচিত (Fingarette, 1972)।
অনেকে ভাবতে পারেন, এসব আচার-অনুষ্ঠান তো নিছকই লোকদেখানো ব্যাপার, এর মধ্যে আবার এত গভীরতা কিসের! কিন্তু কনফুসিয়াস তেমনটা মনে করতেন না। তাঁর মতে, ‘লি’ আন্তরিকতার সাথে পালনের মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে বিনয়, সংযম, শ্রদ্ধা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ জন্মায়। এগুলো নিছকই শুকনো নিয়মকানুন নয়, বরং এগুলো মানুষের ভেতরের সদ্গুণাবলিকে ফুটিয়ে তোলার এক একটি মাধ্যম। যেমন, সন্তানের পিতা-মাতার প্রতি ‘লি’ পালন করা মানে শুধু তাঁদের ভরণপোষণ বা সেবা করা নয়, বরং তাঁদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ‘লি’ পালনের মাধ্যমে শাসকের প্রতি আনুগত্য এবং রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়।
রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে, ‘লি’ অনুযায়ী শাসকের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে, মন্ত্রীর নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে, সেনাপতির যেমন আছে, তেমনি সাধারণ নাগরিকেরও রাষ্ট্রের প্রতি নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ ‘লি’ বা আচরণবিধি সঠিকভাবে ও আন্তরিকতার সাথে মেনে চলে, তাহলে সমাজে একটা ভারসাম্য (harmony) তৈরি হয়, একটা ছন্দময় গতি আসে। ‘লি’ ছাড়া সমাজ হয়ে পড়ে বিশৃঙ্খল, সুর-তাল-লয়হীন এক বেসুরো ঐকতান, অনেকটা ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়া ব্যস্ত রাস্তার মোড়ের মতো, যেখানে যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কনফুসিয়াস এমনকি সঙ্গীত (樂, Yuè) এবং ‘লি’-কে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে দেখেছেন। সঙ্গীত যেমন মানুষের মনকে পরিশীলিত করে, তেমনি ‘লি’ সামাজিক আচরণকে সুন্দর করে (Book of Rites, capítulo XVII).
জুনজি (君子, Jūnzǐ) – আদর্শ মানুষ বা ভদ্রলোক: আঁধারের মাঝে বাতিঘর
কনফুসিয়াসের কল্পনায় ‘জুনজি’ হলেন সেই আদর্শ মানুষ – The superior man বা the gentleman। তিনি জন্মসূত্রে অভিজাত বা কুলীন নন, বরং তিনি অভিজাত হয়ে ওঠেন তাঁর চরিত্র, জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং নৈতিকতার গুণে। ‘জুনজি’ হবেন জ্ঞানী (wise), কিন্তু নিরহংকার; বিনয়ী (modest), কিন্তু দুর্বল নন; ন্যায়পরায়ণ (righteous), কিন্তু কঠোর নন; আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম (self-disciplined), এবং অবশ্যই ‘রেন’ ও ‘লি’ গুণাবলিতে পরিপূর্ণ (Analects, 4.5, 4.16)। ‘জুনজি’ সবসময় আত্ম-উন্নয়নে সচেষ্ট থাকবেন, নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নেবেন এবং ক্রমাগত নিজেকে আরও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন। তিনি ছোটখাটো বিষয়ে বিচলিত হন না, তুচ্ছ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভাবেন।
কনফুসিয়াস মনে করতেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় এমন ‘জুনজি’-দেরই থাকা উচিত, কারণ তাঁরা ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে নিঃস্বার্থভাবে জনগণের মঙ্গলের কথা ভাববেন। তাঁরা হবেন সমাজের জন্য রোল মডেল, জীবন্ত উদাহরণ, যাঁদের দেখে অন্যরা শিখবে, অনুপ্রাণিত হবে। কনফুসিয়াস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “শাসক যদি নিজে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হন, তাহলে আদেশ না দিলেও প্রজারা সৎ পথে চলবে। আর শাসক যদি অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ হন, তাহলে কঠোর আদেশ জারি করলেও প্রজারা তা মানবে না, বরং ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবে” (Analects, 13.6)। আজকের দিনে এমন ‘জুনজি’ শাসক খুঁজে পাওয়াটা যেন খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতোই কঠিন, তাই না? কিন্তু কনফুসিয়াস এই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ‘জুনজি’ তৈরি করা সম্ভব।
ঝেংমিং (正名, Zhèngmíng) – নামের যথার্থতা বা Rectification of Names: যেমন নাম, তেমন কাজ
এটি কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তার একটি অত্যন্ত মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ দিক। ‘ঝেংমিং’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো ‘নামকে সঠিক করা’ বা ‘নামের সংশোধন’। এর গভীর তাৎপর্য হলো, প্রতিটি নাম বা পদের (title) সাথে যে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব, কর্তব্য এবং প্রত্যাশা জড়িত, তা সঠিকভাবে পালন করা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ, নাম এবং বাস্তবতা যেন এক হয়; শব্দের সাথে অর্থের যেন কোনো ফারাক না থাকে (Make names correspond to realities)।
উদাহরণস্বরূপ, ‘রাজা’ (king) নামের সাথে প্রজার মঙ্গলচিন্তা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি গুরুদায়িত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যদি কোনো ব্যক্তি ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করেও সেই দায়িত্বগুলো পালন না করে শুধু ব্যক্তিগত ভোগবিলাসে মত্ত থাকেন, প্রজাদের উপর অত্যাচার করেন, তাহলে তিনি তাঁর নামের প্রতি সুবিচার করছেন না, তিনি ‘রাজা’ নামের অবমাননা করছেন। কনফুসিয়াস একদা চি-এর ডিউক জিং-কে (Duke Jing of Qi) শাসনের মূলনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেছিলেন, “রাজাকে রাজার মতো আচরণ করতে হবে, মন্ত্রীকে মন্ত্রীর মতো, পিতাকে পিতার মতো এবং পুত্রকে পুত্রের মতো” (君君、臣臣、父父、子子 – jūn jūn, chén chén, fù fù, zǐ zǐ) (Analects, 12.11)।
যদি সমাজে নামের সাথে কাজের এই সঙ্গতি না থাকে, যদি শব্দগুলো তাদের প্রকৃত অর্থ হারিয়ে ফেলে, তাহলে সমাজে বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা এবং আস্থাহীনতা দেখা দেয়। মানুষ বুঝতে পারে না কার কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করা উচিত, কার কী ভূমিকা। এর ফলে, রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে, সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়তে শুরু করে। এই ধারণাটি আজও কী আশ্চর্যরকমভাবে প্রাসঙ্গিক! যখন নেতারা তাঁদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করেন, যখন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ঘোষিত লক্ষ্যের বিপরীত কাজ করে, তখন ‘ঝেংমিং’-এর অভাব প্রকট হয়ে ওঠে এবং জনমনে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম হয়। কনফুসিয়াস মনে করতেন, ভাষার শুদ্ধতা ও যথার্থতা রক্ষা করা সুশাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত।
শিয়াও (孝, Xiào) – পারিবারিক আনুগত্য ও তার রাষ্ট্রীয় প্রয়োগ: শিকড়ের প্রতি টান
‘শিয়াও’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কনফুসীয় ধারণা, যার অর্থ হলো পারিবারিক আনুগত্য, বিশেষ করে পিতা-মাতা ও পূর্বপুরুষদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধ (filial piety)। কনফুসিয়াস মনে করতেন, পরিবার হলো রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক, এবং এটিই হলো নৈতিকতার প্রথম শিক্ষালয়। একটি সুস্থ, সুশৃঙ্খল এবং স্নেহময় পারিবারিক পরিবেশই শিশুর মধ্যে প্রাথমিক সদ্গুণাবলির বীজ বপন করে। যে ব্যক্তি পরিবারে তার পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্বশীল ও শ্রদ্ধাশীল, সে স্বাভাবিকভাবেই সমাজের অন্যান্য গুরুজন এবং রাষ্ট্রের প্রতিও অনুগত ও দায়িত্বশীল হবে (Hsu, 1975)।
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের যে নিঃশর্ত ভালোবাসা, সেবা ও কর্তব্য, সেই একই ধরনের মনোভাব (তবে ভিন্ন মাত্রায় ও আঙ্গিকে) রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের এবং শাসকের প্রতি কর্মকর্তাদের থাকা উচিত। তবে এই আনুগত্য কখনওই একতরফা বা অন্ধ আনুগত্য নয়। পিতা যেমন সন্তানের মঙ্গল কামনা করবেন, তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করবেন, তেমনি শাসকও প্রজাদের কল্যাণ নিশ্চিত করবেন, তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করবেন। এটি একটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও কর্তব্যের সম্পর্ক। ‘শিয়াও’-এর মধ্যে শুধু জীবিত পিতা-মাতার সেবাই নয়, মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং তাঁদের সম্মান বজায় রাখার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত।
‘শিয়াও’-এর মাধ্যমে সমাজে যে শৃঙ্খলা, শ্রদ্ধাবোধ এবং পারস্পরিক দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তা একটি স্থিতিশীল ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পরিবারে শেখা এই মূল্যবোধগুলোই বৃহত্তর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিফলিত হয়। এর পাশাপাশি ‘টি’ (悌, Tì) অর্থাৎ বড় ভাইয়ের প্রতি ছোট ভাইয়ের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য এবং ছোট ভাইয়ের প্রতি বড় ভাইয়ের স্নেহ ও কর্তব্যের ধারণাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা পারিবারিক সম্প্রীতি বাড়াত।
শিক্ষা (教育, Jiàoyù) – নৈতিকতা বিকাশের আলোকবর্তিকা, শুধু পাশ করার জন্য নয়
কনফুসিয়াস শিক্ষার উপর এমন невероят গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে, তাঁকে চীনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বললেও অত্যুক্তি হয় না। তবে তাঁর কাছে শিক্ষা মানে শুধু কতগুলো বই মুখস্থ করা বা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে একটা ডিগ্রি অর্জন করা নয়। তাঁর কাছে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল নৈতিক চরিত্রের বিকাশ, ‘রেন’, ‘লি’, ‘ই’ (義, Yì – righteousness বা ন্যায়পরায়ণতা) এবং অন্যান্য সদ্গুণাবলির অনুশীলন ও আত্মস্থকরণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, “স্বভাবগতভাবে (by nature) মানুষ প্রায় একই রকম, কিন্তু অভ্যাসের (by practice) মাধ্যমে তারা একে অপরের থেকে অনেক দূরে সরে যায়” (性相近也,習相遠也 – xìng xiāng jìn yě, xí xiāng yuǎn yě) (Analects, 17.2)। আর এই ‘অভ্যাস’ গড়ে তোলার প্রধান উপায় হলো সঠিক শিক্ষা।
সঠিক শিক্ষার মাধ্যমেই সাধারণ মানুষকে ‘জুনজি’ বা আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে জন্মপরিচয় বা বংশমর্যাদার পরিবর্তে মেধা (merit) ও নৈতিক যোগ্যতার (moral character) উপর সর্বাধিক জোর দিয়েছিলেন। এই অর্থে তাঁকে মেধাভিত্তিক শাসনের (Meritocracy) একজন প্রাচীন ও শক্তিশালী প্রবক্তা বলা যেতে পারে (Creel, 1970)। তিনি বলতেন, শিক্ষার দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত, ধনী-দরিদ্র বা সামাজিক অবস্থানের ভেদাভেদ সেখানে থাকা উচিত নয় (有教無類, yǒu jiào wú lèi – In teaching, there should be no distinction of classes) (Analects, 15.39).
তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেগুলোকে একত্রে ‘ষষ্ঠ শিল্প’ (六藝, Liù Yì – Six Arts) বলা হয়: (১) ‘লি’ (禮, Rites) বা আচার-অনুষ্ঠান ও শিষ্টাচার, (২) ‘ইউয়ে’ (樂, Music) বা সঙ্গীত, (৩) ‘শে’ (射, Archery) বা ধনুর্বিদ্যা, (৪) ‘ইউ’ (御, Charioteering) বা রথচালনা, (৫) ‘শু’ (書, Calligraphy/Writing) বা লিপিবিদ্যা এবং (৬) ‘শু’ (數, Mathematics) বা গণিত। এই বিষয়গুলো শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের জন্য ছিল না, বরং এগুলো ছিল চরিত্র গঠন, মানসিক শৃঙ্খলা এবং সামাজিক দক্ষতার বিকাশের মাধ্যম। উদাহরণস্বরূপ, সঙ্গীত মানুষের মনকে পরিশীলিত ও সংবেদনশীল করে, ধনুর্বিদ্যা ও রথচালনা মনোযোগ ও শারীরিক সক্ষমতা বাড়ায়, আর আচার-অনুষ্ঠান সামাজিক আচরণের শিক্ষা দেয়। ইতিহাস ও কবিতার (বিশেষ করে ‘বুক অফ সংস’ – 詩經, Shījīng) চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অতীত থেকে শিক্ষা নিত এবং মানবিক অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হতো।
শাসকের ভূমিকা: প্রজাপালক, স্বৈরাচারী নন, যেন এক স্নেহময় মালী
কনফুসিয়াসের চোখে শাসক কোনো স্বৈরাচারী প্রভু নন, বরং তিনি হলেন জনগণের পালক, তাদের পিতা বা অভিভাবকের মতো। তাঁর প্রধান এবং পবিত্র দায়িত্ব হলো জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। তাঁর ব্যক্তিগত আচরণ হবে নিষ্কলুষ, অনুকরণীয়, কারণ প্রজারা তাঁকেই অনুসরণ করবে।
নৈতিক শাসন (德治, Dézhì – Rule by Virtue) বনাম আইন ও শাস্তির শাসন (法治, Fǎzhì – Rule by Law): হৃদয়ের পরিবর্তন, জোর করে নয়
কনফুসিয়াস কঠোর আইন আর নির্মম শাস্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এই ধরনের শাসন মানুষকে হয়তো বাহ্যিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, কিন্তু তাদের অন্তরের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “যদি কঠোর আইন (政, zhèng – government regulations/laws) দিয়ে জনগণকে পরিচালনা করা হয় এবং শাস্তির (刑, xíng – punishments) ভয় দেখিয়ে তাদের শৃঙ্খলায় আনার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তারা হয়তো শাস্তি এড়িয়ে চলার জন্য নিয়ম মেনে চলবে, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো প্রকৃত লজ্জাবোধ (恥, chǐ – sense of shame) বা নৈতিকতাবোধ তৈরি হবে না। পক্ষান্তরে, যদি নৈতিক আদর্শ (德, Dé – virtue/moral force) দিয়ে তাদের পরিচালনা করা হয় এবং আচার-অনুষ্ঠান (禮, Lǐ – rites/propriety) দিয়ে তাদের শৃঙ্খলায় আনা হয়, তাহলে তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই লজ্জাবোধ তৈরি হবে এবং তারা নিজেরাই সঠিক ও সৎ পথে চলবে” (Analects, 2.3)।
এর মানে এই নয় যে কনফুসিয়াস রাষ্ট্রে আইনের প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। অবশ্যই একটি সুশৃঙ্খল সমাজের জন্য আইনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাঁর কাছে নৈতিক আদর্শ, সামাজিক রীতিনীতি এবং শাসকের ব্যক্তিগত উদাহরণ ছিল প্রাথমিক ও প্রধান চালিকাশক্তি, আর আইন ছিল সহায়ক বা নিতান্ত প্রয়োজনে ব্যবহার্য একটি গৌণ ব্যবস্থা (Schwartz, 1985)। অনেকটা ভালো ডাক্তারের চিকিৎসার মতো – মূল চিকিৎসা হলো সঠিক পথ্য, নিয়মকানুন মেনে চলা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন, আর ঔষধ হলো নিতান্তই যখন অন্য কিছুতে কাজ হচ্ছে না, তখনকার জন্য। নৈতিক শাসন হৃদয়ের গভীরে পরিবর্তন আনে, যা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
স্বর্গের বিধান (天命, Tiānmìng – Mandate of Heaven): ক্ষমতার উৎস ও জবাবদিহিতা
এটি প্রাচীন চীনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ধারণা, যা কনফুসিয়াসও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রহণ করেছিলেন এবং গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছিলেন। চৌ সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এই ধারণাটি প্রচলিত ছিল। এই ধারণা অনুযায়ী, শাসক তাঁর শাসনক্ষমতা লাভ করেন ‘স্বর্গ’ (天, Tiān – Heaven, যা এক ধরনের সর্বোচ্চ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি বা প্রাকৃতিক বিধান) থেকে। কিন্তু এই ক্ষমতা কোনো বংশানুক্রমিক অধিকার বা শর্তহীন ব্যাপার নয় (Graham, 1989)।
শাসক ততদিনই এই ‘স্বর্গের বিধান’ অনুযায়ী শাসনের অধিকারী থাকবেন, যতদিন তিনি ন্যায়পরায়ণ থাকবেন, প্রজার কল্যাণ করবেন, নৈতিকভাবে শাসন পরিচালনা করবেন এবং স্বর্গের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। যদি কোনো শাসক অত্যাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ এবং প্রজাপীড়ক হয়ে ওঠেন, যদি তিনি তাঁর নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি ‘স্বর্গের বিধান’ হারাবেন। এর অনিবার্য পরিণতি হলো, জনগণ বা অন্য কোনো যোগ্য শক্তি তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার নৈতিক অধিকার লাভ করে। এই ধারণাটি একদিকে যেমন শাসকের শাসনকে এক ধরনের ঐশ্বরিক বৈধতা (divine legitimacy) দিত, অন্যদিকে তেমনি শাসকের উপর একটি নৈতিক জবাবদিহিতার (accountability) দায় চাপিয়ে দিত। যদিও কনফুসিয়াস সরাসরি বিপ্লব বা বিদ্রোহের কথা খুব একটা বলেননি, তবে ‘স্বর্গের বিধান’ হারানোর এই ধারণাটি প্রকারান্তরে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান বা ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি নৈতিক ভিত্তি যুগিয়েছিল। মেনসিয়াস (孟子, Mencius), যিনি ছিলেন কনফুসিয়াসের প্রধান শিষ্যদের একজন, এই ধারণাকে আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, অত্যাচারী শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা ন্যায়সঙ্গত।
জনগণের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা: খালি পেটে ধর্ম হয় না
কনফুসিয়াস খুব ভালোভাবেই বুঝতেন যে, জনগণের মৌলিক অর্থনৈতিক চাহিদাগুলো যদি পূরণ না হয়, তাহলে তাদের কাছ থেকে উচ্চ নৈতিক আচরণ বা রাষ্ট্রীয় আনুগত্য আশা করাটা বাতুলতা মাত্র। ক্ষুধার্ত মানুষ নীতিবাক্য শোনে না, তার প্রথম চিন্তা থাকে অন্ন। তাই শাসকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো জনগণের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করা, তাদের জীবিকার পথ সুগম করা। এর জন্য প্রয়োজন কৃষিকাজের উন্নতি সাধন করা (কারণ প্রাচীন চীনের অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক), করের বোঝা সহনীয় এবং ন্যায্য পর্যায়ে রাখা, এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ যাতে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে কুক্ষিগত না হয়ে জনগণের কল্যাণে ব্যয়িত হয়, তা নিশ্চিত করা (Mencius, 1A7, 3A3 – যদিও এই বিষয়ে মেনসিয়াস আরও অনেক বিস্তারিতভাবে বলেছেন, তবে এর মূল বীজ কনফুসিয়াসের চিন্তাতেই নিহিত ছিল। যেমন, Analects 12.7-এ শিষ্য জিগং (Zigong) যখন শাসনের উপাদান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, কনফুসিয়াস পর্যাপ্ত খাদ্য, পর্যাপ্ত সামরিক সরঞ্জাম এবং জনগণের আস্থার কথা বলেন, যার মধ্যে আস্থাকেই তিনি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন, তবে খাদ্যের প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য)।
তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণ যদি অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকে, তাহলে তারা নৈতিক শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হবে, সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলবে এবং ফলস্বরূপ সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় থাকবে। শাসকের উচিত এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে মানুষ সৎপথে উপার্জন করতে পারে এবং একটি সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারে।
আদর্শ রাষ্ট্র: যেখানে সম্প্রীতি (和, Hé – Harmony) বিরাজ করে, ঐকতানের মতো
কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তার চূড়ান্ত লক্ষ্য, তাঁর সকল দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হলো একটি সম্প্রীতিপূর্ণ (harmonious) সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে তাদের ভূমিকা পালন করবে এবং সকলে মিলে একটি ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করবে। এই সম্প্রীতি (和, Hé) মানে কিন্তু নিছক নীরবতা, নির্জীব স্থবিরতা বা সকলের একই রকম চিন্তা ও মতামতের অধিকারী হওয়া নয় (যাকে বলা হয় 同, Tóng – sameness or conformity)। বরং, কনফুসীয় সম্প্রীতি হলো বিভিন্ন উপাদান, বিভিন্ন মত ও পথের মধ্যে একটি সৃজনশীল ও গতিশীল ভারসাম্য (dynamic balance) রক্ষা করা (Analects, 13.23)। অনেকটা একটি সার্থক ঐকতান (orchestra) সৃষ্টির মতো, যেখানে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তাদের নিজ নিজ স্বতন্ত্র সুর বজায় রেখেও সম্মিলিতভাবে একটি শ্রুতিমধুর ও পরিপূর্ণ সঙ্গীত সৃষ্টি করে (Goldin, 2011)। প্রতিটি সুর আলাদা, কিন্তু তারা একে অপরের সাথে এমনভাবে মিশে যায় যে একটি বৃহত্তর ঐকতান তৈরি হয়।
এই কাঙ্ক্ষিত সম্প্রীতি অর্জনের জন্য প্রয়োজন:
- শাসক ও শাসিতের মধ্যে গভীর পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ। যেন পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক।
- সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘লি’ বা আচার-অনুষ্ঠান ও শিষ্টাচারের যথাযথ ও আন্তরিক পালন।
- প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য (যা ‘ঝেংমিং’ বা নামের যথার্থতার সাথে সম্পর্কিত) সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনতা এবং তা নিষ্ঠার সাথে পালনে আন্তরিক সদিচ্ছা।
- সর্বোপরি, সমাজের সকল স্তরে ‘রেন’ বা মানবতা, সহানুভূতি ও পরার্থপরতার ব্যাপক চর্চা।
কনফুসিয়াস গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, এই সম্প্রীতির যাত্রা শুরু হয় ব্যক্তি থেকে, তারপর তা পরিবারে, সমাজে এবং পরিশেষে রাষ্ট্রে ও সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি, যা ‘মহান শিক্ষা’ (大學, Dàxué – The Great Learning) নামক কনফুসীয় ক্লাসিক গ্রন্থে পাওয়া যায়, এই ক্রমিক প্রক্রিয়াটিকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরে:
“প্রাচীনকালে যে মহান ব্যক্তিরা সমগ্র বিশ্বে তাঁদের উজ্জ্বল সদ্গুণাবলি (明德, míngdé – illustrious virtue) ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁরা প্রথমে নিজেদের রাষ্ট্রকে সুশৃঙ্খল ও সঠিকভাবে পরিচালনা (治國, zhìguó – ordering the state) করেছিলেন। যাঁরা নিজেদের রাষ্ট্রকে সুশৃঙ্খল করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা প্রথমে নিজেদের পরিবারকে নিয়ন্ত্রণে (齊家, qíjiā – regulating the family) এনেছিলেন। যাঁরা নিজেদের পরিবারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চেয়েছিলেন, তাঁরা প্রথমে নিজেদের ব্যক্তিগত চরিত্র গঠন ও পরিশুদ্ধ (修身, xiūshēn – cultivating the person) করেছিলেন। যাঁরা নিজেদের চরিত্র গঠন করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা প্রথমে নিজেদের হৃদয়কে পবিত্র ও সঠিক (正心, zhèngxīn – rectifying the heart/mind) করেছিলেন। যাঁরা নিজেদের হৃদয়কে পবিত্র করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা প্রথমে নিজেদের চিন্তাকে সৎ ও আন্তরিক (誠意, chéngyì – making thoughts sincere) করেছিলেন। যাঁরা নিজেদের চিন্তাকে সৎ করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা প্রথমে নিজেদের জ্ঞানকে প্রসারিত ও পূর্ণাঙ্গ (致知, zhìzhī – extending knowledge) করেছিলেন। আর জ্ঞানের প্রসার ঘটে বস্তুজগতের নিয়ম ও নীতি অনুসন্ধানের (格物, géwù – investigating things) মাধ্যমে।” (The Great Learning, Text, 4-5, Legge-এর অনুবাদ অবলম্বনে)।
এই যে ক্রমবিন্যাস, ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিশ্বশান্তি (平天下, píng tiānxià – pacifying the world) পর্যন্ত পৌঁছানোর এই যে সোপান – এটা অনেকটা পুকুরের শান্ত জলে একটি ছোট্ট ঢিল ছুড়লে যেমন প্রথমে একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি হয় এবং সেই তরঙ্গ ক্রমশ বড় থেকে বড়তর হয়ে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে অবশেষে পুকুরের কিনারায় গিয়ে পৌঁছায়, ঠিক সেভাবেই। আত্ম-উন্নয়নই হলো সকল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণের মূল ভিত্তি।
কনফুসিয়াস বনাম অন্যান্য চিন্তাধারা: দর্শনের বহু স্বর
কনফুসিয়াসের সময়ে চীনে আরও অনেক দার্শনিক চিন্তাধারার উদ্ভব হয়েছিল, যাদের একত্রে “শত মতাদর্শ” (百家爭鳴, Bǎijiā zhēngmíng – Hundred Schools of Thought) বলা হয়। এদের মধ্যে আইনবাদ (Legalism) ও তাওবাদ (Taoism) ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং প্রায়শই কনফুসীয়বাদের সাথে এদের তুলনা করা হয় বা সংঘাত দেখা যায়।
১. আইনবাদ (法家, Fǎjiā – Legalism): কঠোর শৃঙ্খলার পক্ষপাতী: আইনবাদীরা, যেমন শাং ইয়াং (商鞅, Shang Yang) বা হান ফেইজি (韓非子, Han Feizi), মানুষের সহজাত প্রকৃতিকে স্বার্থপর ও দুষ্ট বলে মনে করতেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, কঠোর আইন, নির্মম শাস্তি এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের মাধ্যমেই কেবল সমাজে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব। নৈতিকতা, আচার-অনুষ্ঠান বা শাসকের ব্যক্তিগত গুণাবলির উপর তাঁরা তেমন আস্থা রাখতেন না। তাঁদের কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সুসংহত করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য, প্রয়োজনে যে কোনো উপায়ে। এর বিপরীতে, কনফুসিয়াস মানুষের সহজাত সম্ভাবনার উপর (বিশেষত শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত হওয়ার) আস্থাশীল ছিলেন এবং নৈতিক আদর্শ ও আত্ম-অনুশাসনের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলার কথা বলেছেন। আইনবাদীরা যেখানে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিয়েছেন, কনফুসিয়াস সেখানে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের কথা বলেছেন। ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস হলো, স্বল্পমেয়াদে আইনবাদীরা কিন সাম্রাজ্য (Qin Dynasty) প্রতিষ্ঠায় সফল হলেও, তাঁদের কঠোরতা ও নির্মমতার কারণে সেই সাম্রাজ্য দ্রুতই পতনের মুখে পতিত হয়। অন্যদিকে, কনফুসীয়বাদ ধীরে ধীরে চীনা রাষ্ট্র ও সমাজের গভীরে প্রোথিত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় (Bodde & Morris, 1967)।
২. তাওবাদ (道家, Dàojiā – Taoism): প্রকৃতির কোলে ফেরা: লাওৎসে (老子, Laozi) এবং ঝুয়াংজি (莊子, Zhuangzi) প্রমুখ তাওবাদী দার্শনিকেরা প্রকৃতির অনাড়ম্বর জীবন এবং ‘তাও’ (道, Dao – The Way or The Path, যা মহাবিশ্বের অন্তর্নিহিত প্রাকৃতিক নিয়ম) অনুসরণ করার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁরা মনে করতেন, সমাজের অধিকাংশ সমস্যাই সৃষ্টি হয় মানুষের কৃত্রিম নিয়মকানুন, উচ্চাভিলাষ এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম থেকে বিচ্যুতির কারণে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তাঁরা ‘অকর্ম’ (無為, Wúwéi – non-action or effortless action) নীতির কথা বলেছেন, যার অর্থ হলো শাসকের উচিত যথাসম্ভব কম হস্তক্ষেপ করা এবং প্রকৃতিকে তার আপন গতিতে চলতে দেওয়া। কনফুসিয়াস যেখানে সক্রিয়ভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার, শিক্ষা এবং নৈতিক চরিত্র গঠনের মাধ্যমে একটি আদর্শ সমাজ গড়ার কথা বলেছেন, তাওবাদীরা সেখানে ব্যক্তিগত মুক্তি এবং প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়ার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কনফুসিয়াস যেখানে সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলেছেন, তাওবাদীরা সেখানে অনেক সময় জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সরল জীবনযাপনের পক্ষপাতী ছিলেন। তবে এই দুই ধারার মধ্যে কিছু মিলও ছিল, যেমন উভয়ই এক ধরনের সম্প্রীতি বা ভারসাম্যের কথা বলেছে, যদিও তাদের পথ ছিল ভিন্ন (Welch, 1966)।
কনফুসীয় চিন্তার ঐতিহাসিক অভিযাত্রা ও বিবর্তন: স্রোতস্বিনী নদীর মতো
কনফুসিয়াসের মৃত্যুর (৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) পর তাঁর চিন্তাধারা তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তবে কিন সাম্রাজ্যের (২২১-২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সময় আইনবাদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং কনফুসীয় গ্রন্থাদি পোড়ানো হয়, পণ্ডিতদের নির্যাতন করা হয় (焚書坑儒, Fénshū Kēngrú – Burning of books and burying of scholars)। এটি ছিল কনফুসীয়বাদের জন্য এক অন্ধকার যুগ।
কিন্তু কিন সাম্রাজ্যের পতনের পর হান সাম্রাজ্যের (২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ২২০ খ্রিস্টাব্দ) সময় কনফুসীয়বাদ ক্রমশ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে, বিশেষ করে সম্রাট উ (Emperor Wu of Han, ১৪১-৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর শাসনামলে। দং ঝংশু (董仲舒, Dong Zhongshu) প্রমুখ পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় কনফুসীয়বাদকে রাষ্ট্রীয় পরীক্ষার (civil service examination) ভিত্তি করা হয়। এর ফলে, সরকারি পদে নিয়োগের জন্য কনফুসীয় ক্লাসিকগুলো অধ্যয়ন করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এই ব্যবস্থা চীনে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে কমবেশি প্রচলিত ছিল এবং তা একদল শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান আমলাশ্রেণী (scholar-officials) তৈরিতে সাহায্য করেছিল, যারা কনফুসীয় নৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করত (de Bary et al., 1960)।
পরবর্তীকালে, সং (宋, Song Dynasty, ৯৬০-১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ) ও মিং (明, Ming Dynasty, ১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সাম্রাজ্যের সময় নব্য-কনফুসীয়বাদের (理學, Lǐxué – School of Principle বা 道學, Dàoxué – School of the Way) উদ্ভব ঘটে। ঝু শি (朱熹, Zhu Xi), ওয়াং ইয়াংমিং (王陽明, Wang Yangming) প্রমুখ দার্শনিকেরা কনফুসীয় চিন্তার সাথে বৌদ্ধ ও তাওবাদী দর্শনের কিছু উপাদান সমন্বিত করে একে আরও পরিশীলিত ও আধ্যাত্মিক রূপ দেন। তাঁরা মহাবিশ্বের মূলনীতি (理, Lǐ – principle) এবং মানুষের প্রকৃতি (性, Xìng – nature) নিয়ে গভীর দার্শনিক আলোচনা করেন, যা রাষ্ট্রচিন্তাকেও প্রভাবিত করে।
তবে উনিশ ও বিশ শতকে পশ্চিমা শক্তির অভিঘাত এবং অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখে কনফুসীয়বাদকে চীনের অনগ্রসরতার জন্য দায়ী করা হয়। মে ফোর্থ মুভমেন্ট (五四運動, Wǔsì Yùndòng, ১৯১৯) এবং পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের (文化大革命, Wénhuà Dàgémìng, ১৯৬৬-১৯৭৬) সময় কনফুসীয় ঐতিহ্য কঠোরভাবে সমালোচিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, একবিংশ শতাব্দীতে এসে কনফুসীয়বাদ চীনে এবং বিশ্বব্যাপী নতুন করে আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। চীনা সরকার বর্তমানে কনফুসীয় মূল্যবোধকে (যেমন, সম্প্রীতি, সামাজিক শৃঙ্খলা, পারিবারিক আনুগত্য) জাতীয় সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে তুলে ধরছে এবং বিশ্বব্যাপী কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট (孔子學院, Kǒngzǐ Xuéyuàn) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রচার করছে। এই পুনঃজাগরণ নিয়ে অবশ্য বিতর্কও রয়েছে (Angle, 2012)।
কনফুসিয়াসের চিন্তাধারার সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা: চাঁদের কলঙ্ক
কোনো মহান চিন্তাবিদের চিন্তাই প্রশ্নাতীত বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়, কনফুসিয়াসও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার কিছু দিক নিয়ে অতীতে যেমন সমালোচনা হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে:
- ১. রক্ষণশীলতা ও প্রগতিবিরোধিতা: কনফুসিয়াস অতীতের স্বর্ণযুগ, বিশেষ করে চৌ সাম্রাজ্যের প্রাথমিক পর্যায়কে আদর্শ হিসেবে দেখতেন এবং সেই সময়ের রীতিনীতি ও ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সমালোচকদের (যেমন, প্রখ্যাত লেখক লু শুন – 魯迅, Lu Xun তাঁর “A Madman’s Diary” গল্পে) মতে, এই অতিরিক্ত অতীতমুখিনতা এবং ঐতিহ্যের প্রতি অন্ধ আনুগত্য অনেক সময় সামাজিক পরিবর্তন ও প্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। নতুন চিন্তা বা উদ্ভাবনের চেয়ে পুরনোকে আঁকড়ে ধরে থাকাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়।
- ২. কর্তৃত্ববাদী (Authoritarian) শাসনের ঝুঁকি: শাসকের প্রতি আনুগত্য (忠, Zhōng – loyalty), সামাজিক শৃঙ্খলার উপর অতিরিক্ত জোর এবং স্তরবিন্যাসযুক্ত (hierarchical) সমাজকাঠামোর কারণে কনফুসীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা অনেক সময় কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরাচারী শাসনের জন্ম দিতে পারে বা তাকে ন্যায্যতা দিতে পারে। যদি শাসক ‘জুনজি’ না হয়ে দুর্নীতিপরায়ণ বা অত্যাচারী হন, তাহলে জনগণের প্রতিবাদ করার বা ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। কারণ, কাঠামোটি উপর থেকে নীচের দিকে নির্দেশিত।
- ৩. সামাজিক স্তরবিন্যাসকে (Social Hierarchy) সমর্থন: কনফুসিয়াসের দর্শনে উল্লিখিত পাঁচ প্রকার মৌলিক মানবিক সম্পর্ক (五倫, Wǔlún – The Five Cardinal Relationships: শাসক-প্রজা, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, বড় ভাই-ছোট ভাই, বন্ধু-বন্ধু) একটি সুস্পষ্ট স্তরবিন্যাসযুক্ত সমাজকে তুলে ধরে। যদিও এই সম্পর্কগুলো পারস্পরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের উপর নির্ভরশীল (যেমন, শাসক যেমন প্রজার আনুগত্য পাবেন, তেমনি প্রজার কল্যাণ নিশ্চিত করবেন), তবুও এতে সমতার (equality) অভাব পরিলক্ষিত হয়, যা আধুনিক গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয় (Rozman, 1991)।
- ৪. নারীর অধস্তন অবস্থান: কনফুসীয় সমাজে নারীর ভূমিকাকে মূলত পারিবারিক পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল এবং তাকে পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বের (patriarchal authority) অধীনস্থ হিসেবে দেখা হতো (যেমন, “তিন আনুগত্য”: পিতার প্রতি, স্বামীর প্রতি, এবং স্বামীর মৃত্যুর পর পুত্রের প্রতি আনুগত্য – 三從四德, Sāncóng Sìdé)। যদিও কনফুসীয় ক্লাসিকগুলোতে সরাসরি নারীবিদ্বেষী উক্তি কম, তবে এর ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার বহুলাংশে উপেক্ষিত হয়েছে। এটি আধুনিক নারীবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বড় সমালোচনার বিষয় (Yao, 2000)।
- ৫. বাস্তবায়নের জটিলতা ও আদর্শবাদিতা: কনফুসিয়াসের আদর্শ রাষ্ট্র বহুলাংশে শাসকের ব্যক্তিগত নৈতিকতা ও সদ্গুণের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ইতিহাসে এমন নৈতিকভাবে প্রায়-নিখুঁত ‘জুনজি’ শাসক খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত বিরল। ফলে, কনফুসিয়াসের আদর্শ রাষ্ট্র অনেক সময় একটি ইউটোপীয় (utopian) কল্পনা বা অর্জন করা কঠিন এমন একটি আদর্শ বলে মনে হতে পারে। বাস্তব পৃথিবীতে মানুষের দুর্বলতা, লোভ ও ক্ষমতার অপব্যবহার একটি সাধারণ ঘটনা।
- ৬. আইনের ভূমিকার সম্ভাব্য অবমূল্যায়ন: নৈতিকতা ও আচার-অনুষ্ঠানের উপর অতিরিক্ত জোর দিতে গিয়ে কনফুসিয়াস হয়তো একটি জটিল ও বৃহৎ সমাজে সুশৃঙ্খলতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সুস্পষ্ট, নিরপেক্ষ এবং প্রয়োগযোগ্য আইনের (rule of law) গুরুত্বকে কিছুটা অবমূল্যায়ন করেছেন। শুধুমাত্র নৈতিক উপদেশের মাধ্যমে সকল প্রকার সামাজিক অপরাধ বা সংঘাত মোকাবেলা করা কঠিন হতে পারে (Bodde & Morris, 1967)।
কনফুসিয়াসের প্রাসঙ্গিকতা: আড়াই হাজার বছর পরেও কেন তিনি গুরুত্বপূর্ণ?
এতসব সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তা ও নৈতিক দর্শন আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে শুধু চীন নয়, কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনামসহ সমগ্র পূর্ব এশিয়ার সভ্যতা, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর চিন্তাধারা চীনা আমলাতন্ত্রের (bureaucracy) নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি স্থাপন করেছিল, যেখানে মেধা, শিক্ষা ও নৈতিক যোগ্যতার মাধ্যমে সরকারি পদে নিয়োগের একটি উন্নত ব্যবস্থা (যদিও বাস্তবে সবসময় তা নিখুঁত ছিল না) গড়ে উঠেছিল।
আজকের এই দ্রুত পরিবর্তনশীল, প্রযুক্তিচালিত, এবং অনেক ক্ষেত্রে মূল্যবোধহীন পৃথিবীতেও কনফুসিয়াসের অনেক ধারণা ও আদর্শ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে:
-
নেতাদের ব্যক্তিগত সততা ও নৈতিক আচরণের উপর গুরুত্বারোপ: বর্তমান যুগে যখন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার একটি বৈশ্বিক সমস্যা, তখন শাসকের ব্যক্তিগত চরিত্র ও নৈতিকতার উপর কনফুসিয়াসের অবিচল আস্থা এক নতুন দিশা দেখাতে পারে।
-
শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিক ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরি: শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা কারিগরি শিক্ষার পরিবর্তে নৈতিক শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের উপর জোর দেওয়া একটি সুস্থ ও দায়িত্বশীল সমাজ বিনির্মাণে অপরিহার্য।
-
পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষা: আধুনিক সমাজে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার প্রেক্ষাপটে পারিবারিক ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সামাজিক সম্প্রীতির উপর কনফুসীয় গুরুত্ব অত্যন্ত সময়োপযোগী।
-
শাসকের জবাবদিহিতা এবং জনগণের প্রতি তাঁর কর্তব্য: ‘স্বর্গের বিধান’ ধারণার মাধ্যমে শাসকের যে জবাবদিহিতার কথা বলা হয়েছে, তা আধুনিক গণতান্ত্রিক চেতনার সাথেও সংগতিপূর্ণ।
-
পরিবেশ সচেতনতা ও প্রকৃতির সাথে ভারসাম্য: কনফুসীয় দর্শনে প্রকৃতির সাথে সম্প্রীতি (যদিও তাওবাদের মতো মুখ্য নয়) এবং পরিমিতিবোধের (moderation) যে ধারণা রয়েছে, তা আজকের পরিবেশ সংকট মোকাবেলায় অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে।
তবে হ্যাঁ, সময় বদলেছে, পৃথিবী অনেক দূর এগিয়েছে। কনফুসিয়াসের চিন্তাকে আজকের প্রেক্ষাপটে গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই কিছু ক্রিটিকাল মূল্যায়ন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন প্রয়োজন। যেমন, তাঁর সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারণা বা নারীর ভূমিকা সংক্রান্ত তৎকালীন দৃষ্টিভঙ্গি আজকের সমতাভিত্তিক সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তাঁর মূল নৈতিক আবেদন – যেমন ‘রেন’ বা মানবতা, ‘ই’ বা ন্যায়পরায়ণতা, ‘লি’ বা শিষ্টাচার, ‘ঝাং’ বা বিশ্বস্ততা, ‘শিয়াও’ বা পারিবারিক আনুগত্য (এর ইতিবাচক দিকগুলো) – এগুলো শাশ্বত ও চিরন্তন মানবিক মূল্যবোধ, যা যে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর।
শেষের কথা: যখন নীতিই হয় রাজার রাজা
কনফুসিয়াস ছিলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা ঋষি। তিনি এমন এক সময়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে সময়ে তলোয়ারের ঝনঝনানির চেয়ে জ্ঞানের আলো বেশি সমাদৃত হবে, যেখানে মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে নিঃস্বার্থভাবে, শাসকেরা হবেন প্রজার প্রকৃত সেবক, তাঁদের হৃদয়ে থাকবে অসীম মমতা, আর গোটা সমাজ চলবে নীতির অমোঘ শক্তিতে, ভয়ে বা লোভে নয়। তাঁর সেই স্বপ্ন হয়তো আজও পৃথিবীর বুকে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, আমরা হয়তো সেই আদর্শ থেকে এখনও অনেক দূরে। কিন্তু তিনি যে জ্ঞানের বীজ পরম যত্নে বপন করে গিয়েছিলেন তাঁর চিন্তায়, তাঁর কথায়, তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে, তা আজও অঙ্কুরিত হচ্ছে, আজও মানবজাতিকে সঠিক পথের দিশা দেখাতে নীরবে কাজ করে চলেছে।
রাতের ঘন অন্ধকারে দিকভ্রান্ত নাবিক যেমন ধ্রুবতারা দেখে পথের সন্ধান পায়, কনফুসিয়াসের চিন্তাধারাও তেমনি রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির জন্য এক নৈতিক কম্পাস। সেই কম্পাস হয়তো আমাদের জীবনের বা রাষ্ট্রের সকল জটিল সমস্যার চটজলদি সমাধান করে দেবে না, কারণ জীবন অত সরলরৈখিক নয়। কিন্তু কোন পথে গেলে মানুষের মঙ্গল, কোন পথে গেলে কল্যাণ, কোন পথে গেলে সম্প্রীতি ও শান্তি – সেই পরম কাঙ্ক্ষিত পথের আবছা ইঙ্গিতটুকু অন্তত সে দিতে পারে। আর এই অশান্ত, সংঘাতময় পৃথিবীতে সেই আবছা ইঙ্গিতটুকুই বা কম কীসে?
দিনশেষে, রাষ্ট্র তো আসলে ইট-পাথরের দালানকোঠা নয়, রাষ্ট্র তো আসলে মানুষ দিয়েই তৈরি। মানুষ যদি ভালো হয়, মানুষ যদি নৈতিক হয়, মানুষ যদি মানবিক হয়, তাহলে দেশ ভালো হতে, রাষ্ট্র সুন্দর হতে বাধ্য। আর মানুষকে সেই ভালো, নৈতিক ও মানবিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই তো মহামতি কনফুসিয়াস তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর সেই ঐকান্তিক, নিঃস্বার্থ চেষ্টাটুকু যদি আমরা হৃদয়ে ধারণ করতে পারি, তাঁর দেখানো পথে যদি এক পা-ও এগোতে পারি, তাহলেও অনেক। কী বলেন? হয়তো তাহলেই আমরা সেই স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারব, যেখানে নীতিই হবে রাজার রাজা, যেখানে ভালোবাসাই হবে সবচেয়ে বড় আইন।
তথ্যসূত্র
- Angle, S. C. (2012). Contemporary Confucian Political Philosophy: A Critical Introduction. Polity Press.
- Bodde, D., & Morris, C. (1967). Law in Imperial China: Exemplified by 190 Ch’ing Dynasty Cases. Harvard University Press.
- Chan, W. T. (Trans. & Comp.). (1963). A Source Book in Chinese Philosophy. Princeton University Press.
- Confucius. (Various translations). The Analects (論語, Lúnyǔ). (e.g., translated by James Legge, Arthur Waley, D.C. Lau, Edward Slingerland, Annping Chin).
- Creel, H. G. (1949). Confucius: The Man and the Myth. John Day Company.
- Creel, H. G. (1970). The Origins of Statecraft in China, Volume One: The Western Chou Empire. University of Chicago Press.
- de Bary, W. T., Chan, W. T., & Watson, B. (Eds.). (1960). Sources of Chinese Tradition, Vol. 1. Columbia University Press.
- Eno, R. (2009). Early China: A Social and Cultural History. Cambridge University Press.
- Fingarette, H. (1972). Confucius: The Secular as Sacred. Harper & Row.
- Goldin, P. R. (2011). Confucianism. University of California Press.
- Graham, A. C. (1989). Disputers of the Tao: Philosophical Argument in Ancient China. Open Court.
- Hinsch, B. (2002). Women in Early Imperial China. Rowman & Littlefield Publishers.
- Hsu, F. L. K. (1975). Iemoto: The Heart of Japan. Schenkman Publishing Company.
- Legge, J. (Trans.). (1865). The Chinese Classics, Vol. III: The Shoo King or The Book of Historical Documents. Trübner & Co.
- Legge, J. (Trans.). (1893). The Chinese Classics, Vol. I: Confucian Analects, The Great Learning, and The Doctrine of the Mean. Clarendon Press. (Includes The Great Learning – 大學, Dàxué).
- Liji (禮記, Book of Rites). (Various translations, e.g., by James Legge).
- Lu Xun. (1918). A Madman’s Diary (狂人日記, Kuángrén Rìjì). (Various translations available, e.g., by Yang Xianyi and Gladys Yang).
- Mencius. (Various translations). Mencius (孟子, Mèngzǐ). (e.g., translated by James Legge, D.C. Lau, Irene Bloom).
- Nylan, M. (2001). The Five “Confucian” Classics. Yale University Press.
- Pines, Y. (2009). Envisioning Eternal Empire: Chinese Political Thought of the Warring States Era. University of Hawaii Press.
- Rozman, G. (Ed.). (1991). The East Asian Region: Confucian Heritage and Its Modern Adaptation. Princeton University Press.
- Schwartz, B. I. (1985). The World of Thought in Ancient China. Harvard University Press.
- Welch, H. (1966). Taoism: The Parting of the Way. Beacon Press.
- Yao, X. (2000). An Introduction to Confucianism. Cambridge University Press.
Leave a Reply