Table of Contents
ভূমিকা
প্লেটোনিজম! নামটা শুনলেই কেমন একটা ভারী ভারী ভাব চলে আসে, তাই না? মনে হয়, এ নিশ্চয়ই গুরুগম্ভীর পণ্ডিতদের বিষয়, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য নয়। ধুলোমাখা মোটা মোটা বইয়ের আড়ালে কপাল কুঁচকে বসে থাকা কিছু মানুষের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যারা এমন সব দুর্বোধ্য বিষয় নিয়ে কথা বলেন যা আমাদের মাথার অনেক উপর দিয়ে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা যদি এমন না হয়? যদি বলি, প্লেটোনিজম কোনো জটিল তত্ত্বের নাম নয়, বরং এটি একটি যাত্রার গল্প? ছায়া থেকে আলোর দিকে, বিভ্রম থেকে সত্যের দিকে এক আশ্চর্য অভিযাত্রার নামই হলো প্লেটোনিজম। এটি এমন এক ধারণা যা শুধু দর্শনের ক্লাসরুমে আটকে থাকেনি, বরং ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি এবং এমনকি আমাদের ‘ভালোবাসা’ বা ‘সত্য’ নিয়ে ভাবনার গভীরেও।
ভাবুন তো, আপনি এক অন্ধকার গুহায় জন্ম থেকে শেকলে বাঁধা। আপনার পেছনে জ্বলছে এক আগুন, আর সেই আগুনের সামনে দিয়ে লোকজন নানা জিনিসপত্র নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আপনি কোনোদিন পেছনের দিকে তাকাতে পারেননি। আপনার জগৎ হলো সামনের দেয়াল। সেই দেয়ালে আপনি কেবল হেঁটে যাওয়া মানুষ আর জিনিসপত্রের ছায়া দেখতে পান, আর শোনেন তাদের কথার প্রতিধ্বনি। আপনার জন্য, ওই ছায়া আর প্রতিধ্বনিই হলো বাস্তব জগৎ। আপনি কি কখনো কল্পনা করতে পারবেন যে এই ছায়ার বাইরেও একটা সত্যিকারের জগৎ আছে? যেখানে সত্যিকারের গাছ, সত্যিকারের পাখি, সত্যিকারের সূর্য আছে? যেখানে শব্দগুলো প্রতিধ্বনি নয়, বরং সরাসরি উৎসারিত হয়?
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, গ্রিসের এথেন্সের এক দার্শনিক ঠিক এই প্রশ্নটিই করেছিলেন। তাঁর নাম প্লেটো (Plato)। আর তাঁর এই বিখ্যাত গুহার রূপক (Allegory of the Cave) দিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। এই যাত্রা প্লেটোনিজমের অলিগলিতে ঘুরবে, দেখবে কীভাবে একটি ধারণা হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকে, নিজেকে পাল্টায়, নতুন রূপে জন্ম নেয় এবং আজও আমাদের চিন্তার জগতে আলো ফেলে যাচ্ছে। এটি কেবল একটি দর্শনের ইতিহাস নয়, এটি মানব আত্মার এক অনন্ত অনুসন্ধানের কাহিনি।
চলুন, সেই মহাযাত্রা শুরু করা যাক।
এই আর্টিকেলে প্লেটোর দর্শন নিয়ে মেইনস্ট্রিম ধারণাকেই ব্যবহার করা হয়েছে। টিউবিঙ্গেন স্কুল কর্তৃক সামনে নিয়ে আসা প্লেটোর অলিখিত দর্শনের ভিত্তিতে প্লেটোর উত্তরাধিকার সম্পর্কে জানতে এখানে যান – অন্য এক প্লেটো এবং তাঁর না-বলা কথা: এক দার্শনিক রহস্যের সন্ধান
প্লেটোর জগৎ ও ধারণার জন্ম (The World of Plato and the Birth of an Idea)
যেকোনো বড় গল্পের শুরুতেই তার নায়ক এবং প্রেক্ষাপটকে চিনে নিতে হয়। আমাদের এই গল্পের নায়ক প্লেটো, কিন্তু তাঁর বেড়ে ওঠার সময়টা ছিল অস্থিরতায় ভরা। প্লেটোর জন্ম হয়েছিল এমন এক এথেন্সে, যা তার স্বর্ণযুগ পেরিয়ে এসেছে এবং এক দীর্ঘ, বিধ্বংসী যুদ্ধ—পেলোপনেশীয় যুদ্ধ (Peloponnesian War)—শেষ করে স্পার্টার কাছে পরাজিত হয়েছে। তিনি দেখেছিলেন গণতন্ত্রের নামে উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসন, দেখেছেন অভিজাতদের স্বৈরাচারী ‘ত্রিশ স্বৈরাচার’ (Thirty Tyrants)-এর নিষ্ঠুরতা, যার মধ্যে তাঁর কিছু আত্মীয়ও ছিলেন। এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর নৈতিক অবক্ষয় প্লেটোর মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তিনি এমন এক সত্যের সন্ধান করছিলেন, যা রাজনৈতিক পালাবদলের মতো ঠুনকো নয়, যা চিরস্থায়ী।
এই অস্থির সময়ে এথেন্সের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন এক অদ্ভুত মানুষ—সক্রেটিস (Socrates)। তিনি কোনো বই লেখেননি, কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠা করেননি। তাঁর একমাত্র কাজ ছিল মানুষকে প্রশ্ন করা। ‘সততা কী?’, ‘ন্যায়বিচার কী?’, ‘সৌন্দর্য কী?’—এইসব মৌলিক প্রশ্ন। তিনি কোনো উত্তর দিতেন না, বরং তাঁর শাণিত প্রশ্নের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতেন যে, যারা নিজেদের জ্ঞানী বলে মনে করে, তারা আসলে কতটা অজ্ঞ। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘সক্রেটিয় পদ্ধতি’ বা ‘এলেঙ্কাস’ (Socratic method or Elenchus)। সক্রেটিস নিজেকে বলতেন একজন ‘ধাইমা’ বা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক ধাত্রী’ (intellectual midwife), যিনি নিজে জ্ঞান জন্ম দেন না, কিন্তু অন্যের ভেতর থেকে জ্ঞানকে বের করে আনতে সাহায্য করেন।
প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের সবচেয়ে মেধাবী এবং অনুরক্ত ছাত্র। তিনি গুরুর এই প্রশ্নগুলোকে খুব গুরুত্বের সাথে নিলেন। কিন্তু যখন খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ সালে এথেন্সের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার সক্রেটিসকে ‘তরুণদের বিপথগামী করা’ এবং ‘নগর-দেবতাদের অস্বীকার করার’ মতো ভিত্তিহীন অভিযোগে হেমলক বিষ পানে মৃত্যুদণ্ড দিল, প্লেটোর জগৎটা ওলটপালট হয়ে গেল। তাঁর কাছে এটি ছিল চূড়ান্ত প্রমাণ যে, এই পরিবর্তনশীল, আবেগতাড়িত, অজ্ঞতায় ভরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ চূড়ান্ত সত্য বা আদর্শের জায়গা হতে পারে না। যে সমাজ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা করে, সেই সমাজের ভিত্তি নিশ্চয়ই কোনো ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সত্য নিশ্চয়ই অন্য কোথাও আছে। এমন এক জায়গায়, যা ক্ষয় হয় না, যা চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়।
এই গভীর হতাশা ও দার্শনিক জিজ্ঞাসা থেকেই জন্ম নিল প্লেটোনিজমের হৃৎপিণ্ড—ধারণাতত্ত্ব বা আকারতত্ত্ব (Theory of Forms/Ideas)।
আসল জগৎটা কোথায়? (The Theory of Forms)
প্লেটোর মতে, আমরা যে জগৎটাকে পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করি—এই যে চেয়ার, টেবিল, গাছ, বিড়াল—এগুলো আসলে সত্যিকারের জগৎ নয়। এগুলো হলো ‘আসল’ জগতের একটি অসম্পূর্ণ অনুকরণ বা ছায়া মাত্র। আমাদের এই ভৌত জগৎ (physical world) হলো এক অন্তহীন পরিবর্তনের স্রোত। এখানে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। আজ যা সুন্দর, কাল তা ম্লান হয়ে যায়; আজ যে ন্যায়পরায়ণ, কাল সে অন্যায় করতে পারে। তাই এই জগতে সত্যিকারের জ্ঞান (knowledge) পাওয়া সম্ভব নয়, কেবল মতামত (opinion) পাওয়া সম্ভব।
তাহলে আসল জগৎটা কোথায়? প্লেটো বললেন, সেই জগৎটি আমাদের ইন্দ্রিয়ের অতীত, একটি বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ। তিনি এর নাম দিলেন ‘ধারণার জগৎ’ (World of Forms/Ideas)। গ্রিক শব্দ ‘eidos’ বা ‘idea’ বলতে প্লেটো মানসিক ধারণা বোঝাননি, বরং বুঝিয়েছেন কোনো কিছুর নিখুঁত ‘আকার’, ‘রূপ’ বা ‘আদর্শ নমুনা’।
ব্যাপারটা সহজ করে বোঝা যাক। ধরুন, আপনি জীবনে অনেকগুলো চেয়ার দেখেছেন—কাঠের চেয়ার, প্লাস্টিকের চেয়ার, ভাঙা চেয়ার, নতুন চেয়ার। এদের কোনোটিই নিখুঁত নয়, কোনোটিই চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু এই সমস্ত চেয়ারের পেছনে একটি ‘চেয়ার’ হওয়ার নিখুঁত ধারণা বা আদর্শ রূপ আছে, তাই না? সেই আদর্শ ‘চেয়ারত্ব’ (chair-ness) কী, তা আমরা বুদ্ধির মাধ্যমে বুঝি। প্লেটোর মতে, সেই নিখুঁত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় ‘চেয়ারের ধারণা’ বা Form of Chair সত্যিই এক জায়গায় বিদ্যমান। আমাদের জগতের সমস্ত চেয়ার হলো সেই আসল চেয়ারের এক-একটি অসম্পূর্ণ কপি বা ছায়া।
একইভাবে, ‘সৌন্দর্য’ (Beauty), ‘ন্যায়বিচার’ (Justice), ‘সাহস’ (Courage)—এই সবকিছুরই একটি নিখুঁত, শাশ্বত ধারণা বা Form আছে। আমরা পৃথিবীতে যে সুন্দর বস্তু বা ন্যায় কাজ দেখি, সেগুলো ওই আসল ‘সৌন্দর্য’ বা ‘ন্যায়বিচার’-এর ধারণা বা ফর্ম-এ অংশগ্রহণ (participation) করার ফলেই সুন্দর বা ন্যায় হতে পারে।
এই ধারণার জগতের একটি নির্দিষ্ট কাঠামো আছে। একেবারে চূড়ায় আছে ‘পরম শুভের ধারণা’ বা Form of the Good। এটি অন্য সব ধারণার উৎস এবং এদের বোধগম্য করে তোলে। প্লেটো একে সূর্যের সাথে তুলনা করেছেন। যেমন সূর্য আলো দিয়ে আমাদের চোখকে দৃশ্যমান বস্তু দেখতে সাহায্য করে, তেমনি ‘পরম শুভের ধারণা’ আমাদের বুদ্ধিকে অন্য সব ধারণা (Forms) বুঝতে সাহায্য করে। এটিই সকল অস্তিত্ব ও জ্ঞানের চূড়ান্ত উৎস (Plato, Republic, 508e-509b)।
এই ধারণাতত্ত্বকে প্লেটো আরও দুটি বিখ্যাত রূপকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন:
১. গুহার রূপক (Allegory of the Cave): আগেই বলা হয়েছে, গুহার ভেতরের শেকলবন্দী মানুষেরা আমরা, যারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ছায়াগুলোকে সত্যি বলে মনে করি। কোনো একজন বন্দী যদি শেকল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে—যা হলো দার্শনিক শিক্ষার প্রতীক—প্রথমে সূর্যের আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। সে কষ্ট পাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে সত্যিকারের জগৎ—অর্থাৎ ধারণার জগৎ—দেখতে পাবে। সেই হলো দার্শনিক। তার দায়িত্ব হলো আবার গুহায় ফিরে গিয়ে অন্যদের এই সত্যের কথা জানানো। যদিও অন্যরা তাকে পাগল ভাবতে পারে বা মেরেও ফেলতে পারে, যেমনটা সক্রেটিসের ক্ষেত্রে হয়েছিল (Plato, Republic, 514a–520a)।
২. বিভক্ত রেখা (The Divided Line): প্লেটো একটি রেখা কল্পনা করতে বলেছেন, যাকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিচের অংশটি হলো আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ (Visible World), আর উপরের অংশটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ (Intelligible World)। এই দুটি ভাগকে আবার দুটি করে উপবিভাগে ভাগ করা হয়েছে। একেবারে নিচে আছে ছায়া ও প্রতিবিম্ব (shadows and images), যার সম্পর্কে আমাদের কেবল কল্পনা বা বিভ্রম (eikasia/illusion) হয়। তার উপরে আছে বাস্তব বস্তু (physical objects), যার সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস (pistis/belief) জন্মায়। এই দুটি মিলে হলো মতামতের জগৎ (doxa/opinion)। এরপর শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ। এর নিচের স্তরে আছে গাণিতিক ও জ্যামিতিক ধারণা (mathematical objects), যা আমরা অনুমানের (hypotheses) ভিত্তিতে বুঝি (dianoia/thought)। একেবারে চূড়ায় আছে সেই নিখুঁত ধারণা বা ফর্ম, যা আমরা কোনো অনুমান ছাড়াই সরাসরি প্রজ্ঞার (dialectic) মাধ্যমে উপলব্ধি করি (noesis/understanding)। জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর এটিই (Plato, Republic, 509d–511e)।
আত্মা: এক অমর যাত্রী ও তার রথ
কিন্তু আমরা কীভাবে এই ধারণার জগৎ সম্পর্কে জানব, যদি তা আমাদের ইন্দ্রিয়ের বাইরে থাকে?
এখানেই প্লেটো আত্মার (Soul/Psyche) ধারণা নিয়ে আসেন। তাঁর মতে, আমাদের আত্মা অমর এবং অজর। এটি আমাদের শরীরের আগে থেকেই অস্তিত্বশীল এবং মৃত্যুর পরেও থাকবে। জন্মের আগে আমাদের আত্মা সেই ধারণার জগতে বাস করত এবং সমস্ত নিখুঁত ফর্মকে চাক্ষুষ করেছিল। কিন্তু যখন আত্মা এই মর্ত্যের দেহে প্রবেশ করে, তখন সেই জ্ঞান বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। দেহ হলো আত্মার কারাগার।
তাই প্লেটোর কাছে, জ্ঞানার্জন আসলে নতুন কিছু শেখা নয়, বরং ভুলে যাওয়া জ্ঞানকে পুনঃস্মরণ করা (Anamnesis or Recollection)। যখন আমরা কোনো জ্যামিতিক প্রমাণ শিখি, বা ‘ন্যায়বিচার’ কী তা বোঝার চেষ্টা করি, আমরা আসলে আমাদের আত্মার গভীরে থাকা সেই পুরনো স্মৃতিকেই জাগিয়ে তুলি। মেনো (Meno) সংলাপে সক্রেটিস একজন অশিক্ষিত দাস বালককে শুধু প্রশ্ন করার মাধ্যমেই জ্যামিতির একটি জটিল তত্ত্ব সমাধান করিয়ে দেখান যে, জ্ঞান তার ভেতরেই ছিল, তিনি শুধু তাকে সাহায্য করেছেন স্মরণ করতে (Plato, Meno, 81a–86b)।
ফেড্রাস (Phaedrus) সংলাপে প্লেটো আত্মার গঠন বোঝাতে এক অসাধারণ রূপক ব্যবহার করেন: রথের রূপক (Chariot Allegory)। আত্মা হলো একটি রথ, যার একজন সারথি এবং দুটি ডানাওয়ালা ঘোড়া আছে।
-
সারথি (The Charioteer): এটি হলো আত্মার যুক্তিবাদী অংশ (Reason/Logos), যা জ্ঞান ও সত্যের সন্ধান করে এবং রথকে সঠিক পথে, অর্থাৎ ঊর্ধ্বে ধারণার জগতের দিকে চালনা করার চেষ্টা করে।
-
সাদা ঘোড়া (The White Horse): এটি হলো আত্মার আত্মিক বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী অংশ (Spirit/Thymos), যা সম্মান, গৌরব, লজ্জা ও ন্যায়সঙ্গত ক্রোধের মতো আবেগ ধারণ করে। এই ঘোড়াটি স্বভাবতই মহৎ এবং সারথির আদেশ মানতে চায়।
-
কালো ঘোড়া (The Black Horse): এটি হলো আত্মার ক্ষুধার্ত বা কামনা-বাসনার অংশ (Appetite/Eros), যা শারীরিক চাহিদা, যেমন—খাবার, পানীয় ও যৌনতার মতো লাগামহীন আকাঙ্ক্ষা করে। এই ঘোড়াটি অবাধ্য এবং রথকে নিচের দিকে, অর্থাৎ মাটির জগতের দিকে টেনে নামাতে চায়।
একটি সুস্থ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ সে-ই, যার আত্মার যুক্তিবাদী সারথি এই দুই ঘোড়াকে—বিশেষ করে কালো ঘোড়াটিকে—নিয়ন্ত্রণ করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন করে এবং আত্মাকে ঊর্ধ্বলোকে চালিত করে।
দার্শনিক রাজা ও আদর্শ রাষ্ট্র: পৃথিবীতে স্বর্গের ছায়া
প্লেটো শুধু তত্ত্ব দিয়েই থেমে থাকেননি। তিনি একটি নিখুঁত সমাজ বা রাষ্ট্র (State/Polis) কেমন হবে, তারও একটি বিস্তারিত রূপরেখা দিয়েছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ রিপাবলিক (The Republic)-এ। যেহেতু কেবল দার্শনিকরাই কষ্টকর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ধারণার জগৎ সম্পর্কে জানতে পারেন এবং ‘পরম শুভের ধারণা’ উপলব্ধি করতে পারেন, তাই তারাই হলেন রাষ্ট্র পরিচালনার সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। এরাই হলেন দার্শনিক রাজা (Philosopher King)। তারা ক্ষমতার লোভে শাসন করেন না, বরং দায়িত্ববোধ থেকে করেন।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রটিও হবে মানুষের আত্মার তিনটি অংশের প্রতিচ্ছবি:
-
শাসক শ্রেণি (Rulers/Guardians): দার্শনিকরা, যারা হবেন রাষ্ট্রের যুক্তিবাদী অংশ। তাদের প্রধান গুণ হলো প্রজ্ঞা (wisdom)।
-
সৈনিক শ্রেণি (Auxiliaries/Soldiers): যারা হবেন রাষ্ট্রের আত্মিক অংশ, দেশকে রক্ষা করবেন। তাদের প্রধান গুণ হলো সাহস (courage)।
-
উৎপাদক শ্রেণি (Producers): কৃষক, কারিগর, ব্যবসায়ীরা, যারা হবেন রাষ্ট্রের ক্ষুধার্ত অংশ, রাষ্ট্রের বৈষয়িক প্রয়োজন মেটাবেন। তাদের গুণ হলো সংযম (temperance)।
যখন প্রতিটি শ্রেণি নিজের নির্দিষ্ট কাজ ঠিকভাবে করবে এবং অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না, তখনই রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার (Justice) প্রতিষ্ঠিত হবে। প্লেটোর কাছে ন্যায়বিচার মানে ছিল সম্প্রীতি বা ভারসাম্য (harmony)। এই রাষ্ট্রে শাসক শ্রেণির কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা পরিবার থাকবে না, যাতে তারা নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবা করতে পারে। এমনকি শিল্প-সাহিত্যকেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, যাতে তা নাগরিকদের মনে ভুল ধারণা তৈরি করতে না পারে। প্লেটোর এই আদর্শ রাষ্ট্র অনেকের চোখে একনায়কতান্ত্রিক বা টোটালিটারিয়ান (totalitarian) মনে হতে পারে, কিন্তু প্লেটোর লক্ষ্য ছিল একটি নিখুঁত ও স্থিতিশীল সমাজ তৈরি করা, যা মর্ত্যের জগতে আদর্শ জগতের প্রতিচ্ছবি হবে।
এটাই ছিল প্লেটোর মূল দর্শন। এক কথায়, আমাদের এই জগৎটা একটা মায়া, একটা ছায়া। আসল জগৎটা অন্য কোথাও। আর সেই জগতের সন্ধান পেতে হলে আমাদের যুক্তির আলোয় নিজের আত্মার গভীরে তাকাতে হবে এবং এক কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে যান – প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা: একটি আদর্শ রাষ্ট্রের খোঁজে
প্লেটোর পরে – একাডেমি, অ্যারিস্টটল ও সংশয়ের উদয় (After Plato: The Academy, Aristotle, and the Rise of Skepticism)
প্লেটো শুধু কিছু ধারণা দিয়েই চলে যাননি। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৭ সালের দিকে এথেন্সে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘একাডেমি’ (Academy)। বলা হয়ে থাকে, এটিই পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। এই একাডেমিতে প্লেটোর দর্শন নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও গবেষণা চলতে থাকে প্রায় ৯০০ বছর ধরে! তবে এই দীর্ঘ সময়ে প্লেটোনিজম কিন্তু এক জায়গায় থেমে থাকেনি। এটি নদীর মতো বাঁক নিয়েছে, কখনো শুকিয়ে গেছে, আবার কখনো নতুন স্রোতে প্লাবিত হয়েছে।
প্রাচীন একাডেমি: গুরুদেবের পথ ধরে (The Old Academy)
প্লেটোর মৃত্যুর পর একাডেমির হাল ধরেন তাঁর ভাগ্নে স্পিউসিপাস (Speusippus) এবং তারপর জেনোক্রেটিস (Xenocrates)। তাঁরা প্লেটোর দর্শনকে একটি সুশৃঙ্খল ও অধিবিদ্যাগত (metaphysical) রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। প্লেটো যেখানে ধারণার জগৎকে কাব্যিক ও রূপকের ভাষায় বর্ণনা করেছেন, তাঁরা সেগুলোকে আরও কঠোর দার্শনিক সংজ্ঞায় বাঁধতে চাইলেন। তাঁরা প্লেটোর গণিত-প্রীতিকে, যা তাঁর একাডেমির প্রবেশদ্বারে “জ্যামিতি না জেনে কেউ প্রবেশ করবে না” (Let no one ignorant of geometry enter) লেখা থেকে স্পষ্ট, আরও এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁদের হাতে প্লেটোনিজম কিছুটা কাঠখোট্টা ও সংখ্যাতাত্ত্বিক হয়ে ওঠে, যেখানে ফর্ম এবং সংখ্যাকে প্রায় এক করে দেখা হতো (Dillon, 2003)।
অ্যারিস্টটল: শ্রেষ্ঠ ছাত্রের বিদ্রোহ (Aristotle: The Best Student’s Rebellion)
একাডেমির সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন নিঃসন্দেহে অ্যারিস্টটল (Aristotle)। তিনি প্রায় ২০ বছর প্লেটোর অধীনে পড়াশোনা করেন। কিন্তু গুরুর মৃত্যুর পর তিনি প্লেটোর সবচেয়ে মৌলিক তত্ত্ব—ধারণাতত্ত্বের—বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন। এই সমালোচনা পশ্চিমা দর্শনের গতিপথ চিরদিনের জন্য পাল্টে দেয়।
অ্যারিস্টটল প্রশ্ন তোলেন, এই ‘ধারণার জগৎ’ থাকার দরকারটা কী? তিনি বলেন, যদি চেয়ারের একটি আদর্শ ফর্ম থাকে, তবে তো সেই ফর্ম এবং আমাদের জগতের চেয়ারের মধ্যেকার সম্পর্ক বোঝানোর জন্য আরেকটি তৃতীয় ধারণার (Third Man) দরকার হবে, এবং এই প্রক্রিয়া অসীম পর্যন্ত চলতে থাকবে। এটি বিখ্যাত ‘তৃতীয় মানব যুক্তি’ (Third Man Argument) নামে পরিচিত, যা প্লেটো নিজেও তাঁর পার্মেনিদিস (Parmenides) সংলাপে উল্লেখ করেছিলেন।
অ্যারিস্টটলের মতে, কোনো বস্তুর ‘আকার’ বা ‘ফর্ম’ (form) বস্তুর বাইরে কোনো ঊর্ধ্বেলোকে থাকে না, বরং তা বস্তুর মধ্যেই নিহিত থাকে (immanent)। একটি নির্দিষ্ট ঘোড়ার ‘ঘোড়াত্ব’ (horseness) ওই ঘোড়াটির মধ্যেই বিদ্যমান, অন্য কোনো বিমূর্ত জগতে নয়। তিনি প্লেটোর দ্বৈত জগৎকে (two-world view) প্রত্যাখ্যান করে এক জগতের (one-world view) বাস্তববাদী দর্শনের জন্ম দেন। এই গুরু-শিষ্যের বিতর্ক—আদর্শবাদ (idealism) বনাম বাস্তববাদ (realism)—আজও দর্শনের এক কেন্দ্রীয় বিষয়।
মধ্য একাডেমি: সব কিছুই কি সংশয়ের চোখে? (The Middle Academy and Skepticism)
অ্যারিস্টটলের সমালোচনার পর একাডেমির ভেতরেও প্লেটোর দর্শনের নিশ্চিত অবস্থান টলে যায়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আর্কেসিলাউস (Arcesilaus) এবং পরে কারনিয়াডেস (Carneades)-এর মতো দার্শনিকরা এক অদ্ভুত সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তাঁরা বলেন, প্লেটো যে নিশ্চিত জ্ঞানের (certain knowledge) কথা বলেছেন, তা অর্জন করা সম্ভবত সম্ভবই নয়।
তাঁরা সক্রেটিসের সেই বিখ্যাত উক্তি “আমি শুধু এটাই জানি যে আমি কিছুই জানি না” (I know that I know nothing)-কে নতুন করে আঁকড়ে ধরেন। তাঁরা বলেন, আমাদের ইন্দ্রিয় আমাদের ধোঁকা দেয়, এমনকি আমাদের যুক্তিও ভুল করতে পারে। তাই কোনো কিছুকেই নিশ্চিতভাবে ‘সত্য’ বা ‘মিথ্যা’ বলা উচিত নয়, বরং সম্ভাব্যতার (probability) ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একে বলা হয় একাডেমিক সংশয়বাদ (Academic Skepticism)। ভাবা যায়? প্লেটোর অনুসারীরাই তাঁর নিশ্চিত জ্ঞানের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছেন! তাঁরা প্লেটোর সংলাপের ডায়ালেক্টিক পদ্ধতির ওপর জোর দেন, যেখানে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় না। তাঁরা মনে করতেন, এটাই সক্রেটিস ও প্লেটোর আসল শিক্ষা (Long & Sedley, 1987)।
নতুন প্লেটোনিজম-এর পূর্বাভাস: সমন্বয়ের যুগ (The Harbinger of Neoplatonism)
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে অ্যান্টিওকাস অফ অ্যাসকালন (Antiochus of Ascalon) নামে একজন দার্শনিক এই সংশয়বাদের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, প্লেটো মোটেও সংশয়বাদী ছিলেন না। তিনি প্লেটোনিজমের সাথে তৎকালীন জনপ্রিয় দুটি দর্শন—অ্যারিস্টটলের দর্শন (Aristotelianism) ও স্টোয়িকবাদ (Stoicism)-এর সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেন। তিনি প্লেটোর ধারণার জগৎ এবং অ্যারিস্টটলের বাস্তব জগতের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এই সময়টাকে অনেক ঐতিহাসিক মধ্য প্লেটোনিজম (Middle Platonism) বলে থাকেন। এই সমন্বয়ের প্রবণতাই ছিল পরবর্তীকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধারা, অর্থাৎ নতুন প্লেটোনিজম বা নিওপ্লেটোনিজমের (Neoplatonism) ভ্রূণ।
নিওপ্লেটোনিজম – এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব (Neoplatonism: A Mystical Revolution)
রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে, প্লেটোর সরল ও যুক্তিনিষ্ঠ দর্শন এক নতুন, আধ্যাত্মিক ও অতিন্দ্রীয় রূপ নেয়। এই ধারাটি এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে পরবর্তী প্রায় এক হাজার বছর ধরে পশ্চিমা দর্শন, খ্রিষ্টধর্ম, ইসলাম ও ইহুদি ধর্মকে এটি গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এর নাম নিওপ্লেটোনিজম (Neoplatonism)। প্লেটোর দর্শন এখানে আর শুধু জ্ঞানতত্ত্ব বা অধিবিদ্যা নয়, বরং হয়ে উঠল এক মোক্ষলাভের পথ।
এর প্রধান স্থপতি ছিলেন মিশরে জন্ম নেওয়া রোমান দার্শনিক প্লোটিনাস (Plotinus) (আনুমানিক ২০৪-২৭০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি প্লেটোর দর্শনকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যান, যা প্রায় ধর্মের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। প্লোটিনাস যেন প্লেটোর ধারণার জগৎকে হাতে ধরে স্বর্গের দরজায় পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর লেখাগুলো তাঁর ছাত্র পোরফিরি (Porphyry) ছয়টি খণ্ডে নয়টি করে মোট ৫৪টি প্রবন্ধে সংকলন করেন, যার নাম এনিয়াডস (Enneads)।
প্লোটিনাসের মতে, এই সমগ্র মহাবিশ্ব একটি মূল উৎস থেকে নির্গত (emanated) হয়েছে। অনেকটা যেমন সূর্য থেকে আলো বা তাপ ছড়িয়ে পড়ে, বা একটি ফোয়ারা থেকে জল উপচে পড়ে, ঠিক সেভাবে। এই প্রক্রিয়াটি কোনো সচেতন সিদ্ধান্ত নয়, বরং উৎসের প্রকৃতিরই একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। এই মহাজাগতিক কাঠামোর তিনটি প্রধান স্তর বা ‘হাইপোস্টেসিস’ (Hypostases) রয়েছে:
- ১. ‘এক’ বা ‘দ্য ওয়ান’ (The One/τὸ Ἕν): এটি হলো সবকিছুর চূড়ান্ত উৎস। এটি এতটাই পরম ও অসীম যে একে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, কোনো সংজ্ঞায় বাঁধা যায় না। এটি প্লেটোর ‘পরম শুভের ধারণা’ (Form of the Good)-এর এক নতুন ও আরও চরম রূপ। এটি ‘ভালো’ (The Good), কিন্তু আমরা যেটাকে ভালো বলি, তার চেয়েও অনেক ঊর্ধ্বে। এটি কোনো সত্তা নয়, বরং সকল সত্তার উৎস। একে নিয়ে কিছুই বলা যায় না (It is beyond being), কারণ যেকোনো কথাই একে সীমাবদ্ধ করে ফেলবে। তাই প্লোটিনাস একে বর্ণনা করতে নেতিবাচক ভাষা (negative theology) ব্যবহার করেন—এটি কী নয়, তা বলা যায়, কিন্তু এটি কী, তা বলা যায় না। এটি বর্ণনাতীত, অচিন্তনীয়, এক পরম শূন্যতা যা আসলে পরম পূর্ণতা (Plotinus, Enneads, VI.9)।
- ২. ‘নূস’ বা ‘বুদ্ধিবৃত্তি’ (Nous/Intellect): ‘এক’-এর পূর্ণতা থেকে প্রথম যে জিনিসটি উপচে পড়ে বা নির্গত হয়, তা হলো ‘নূস’। এটি হলো মহাজাগতিক মন বা বুদ্ধিবৃত্তি। প্লেটোর সেই বিখ্যাত ধারণার জগৎ (World of Forms) এখানেই অবস্থিত। তবে এটি কোনো স্থির সংগ্রহশালা নয়। ‘নূস’ হলো এক জীবন্ত, গতিশীল বুদ্ধিবৃত্তি যা একই সাথে নিজেকে এবং সমস্ত ধারণাকে চিন্তা করে। এখানে প্রতিটি ধারণা অন্য সব ধারণার সাথে এক নিখুঁত ঐক্যে বিদ্যমান। ‘নূস’ হলো ‘এক’-এর প্রথম প্রতিচ্ছবি এবং এটিই প্রথম সত্তা (being)।
- ৩. ‘বিশ্বাত্মা’ (World Soul/Psyche): ‘নূস’ থেকে নির্গত হয় ‘বিশ্বাত্মা’। এই আত্মা দুটি অংশে বিভক্ত। উপরের অংশটি ‘নূস’-এর দিকে তাকিয়ে থাকে এবং এর থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি লাভ করে। আর নিচের অংশটি আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, জড় জগৎকে (material world) তৈরি করে, তাকে আকার দেয় এবং সজীব রাখে। সময় ও স্থানের জন্ম এখানেই। আমাদের প্রত্যেকের আত্মা (individual soul) এই বিশ্বাত্মারই একটি অংশ।
এই কাঠামোর একেবারে নিচে রয়েছে জড় (Matter)। জড় হলো আলোর অনুপস্থিতি, অন্ধকারের মতো। এটি হলো অ-সত্তা (non-being) এবং এটিই মন্দের উৎস, কারণ এটি ‘এক’ থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত। আমাদের আত্মা এই জড় দেহে বন্দী হয়ে তার স্বর্গীয় উৎসকে ভুলে গেছে।
প্লোটিনাসের দর্শনের মূল লক্ষ্য কী? লক্ষ্য হলো আমাদের আত্মা, যা এই জড় জগতে নির্বাসিত এবং ‘এক’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তাকে পুনরায় তার উৎসের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই প্রত্যাবর্তন ঘটবে কোনো ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে নয়, বরং গভীর দার্শনিক ধ্যান বা প্রজ্ঞা (Contemplation/Theoria)-এর মাধ্যমে। আত্মা প্রথমে নিজেকে জাগতিক কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত করবে, তারপর বিশ্বাত্মার সাথে এক হবে, এরপর ‘নূস’-এর সাথে একীভূত হয়ে সমস্ত ধারণার জ্ঞান লাভ করবে, এবং সবশেষে এক দুর্লভ মুহূর্তে ‘এক’-এর সাথে এক অবর্ণনীয়, আনন্দময় মিলনের অভিজ্ঞতা লাভ করবে। এই চূড়ান্ত অবস্থাকে বলা হয় ‘হেনোসিস’ (Henosis) বা পরম একত্ব। এই অবস্থায় ‘আমি’ এবং ‘তুমি’-র কোনো ভেদ থাকে না। প্লোটিনাসের জীবনীকার পোরফিরি লিখেছেন যে প্লোটিনাস তাঁর জীবনে চারবার এই পরম অভিজ্ঞতার স্তরে পৌঁছেছিলেন (Gerson, 2017)।
প্লোটিনাসের পরে ইয়ামব্লিকাস (Iamblichus) ও প্রোক্লাস (Proclus)-এর মতো নিওপ্লেটোনিস্টরা এই ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তোলেন। তাঁরা এর সাথে বিভিন্ন পৌত্তলিক (pagan) দেব-দেবী এবং জাদুবিদ্যা জাতীয় ধর্মীয় আচার বা থিয়ার্জি (Theurgy) যুক্ত করেন। তাঁরা মনে করতেন, শুধু ধ্যানের মাধ্যমেই নয়, বরং বিশেষ আচারের মাধ্যমেও দেবতারা মানুষের আত্মাকে ঊর্ধ্বলোকে আরোহণে সাহায্য করতে পারেন। এটি ছিল ক্রমবর্ধমান খ্রিষ্টধর্মের বিরুদ্ধে পৌত্তলিক ধর্মকে একটি দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি দেওয়ার প্রচেষ্টা। প্রোক্লাসের হাতে নিওপ্লেটোনিজম এক বিশাল, সুসংহত ও প্রায় গাণিতিক কাঠামোর রূপ নেয়, যা ছিল প্রাচীন গ্রিক দর্শনের শেষ মহান কীর্তি।
প্লেটোনিজম ও ধর্ম – এক নতুন মেলবন্ধন (Platonism and Religion: A New Synthesis)
প্লেটোর দর্শন যদি শুধু দার্শনিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, তবে হয়তো তা এত দীর্ঘজীবী হতো না। এর আসল শক্তি প্রকাশ পেল যখন এটি তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর সাথে মিশে যেতে শুরু করল।
ইহুদি ধর্মে প্লেটোনিজম
প্রথম মেলবন্ধনটি ঘটান আলেকজান্দ্রিয়ার এক ইহুদি দার্শনিক, ফিলো (Philo of Alexandria) (আনুমানিক ২০ খ্রিস্টপূর্ব – ৫০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি হিব্রু বাইবেলকে (Old Testament) রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করে তার সাথে প্লেটোর দর্শনের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, প্লেটো যাকে ‘ধারণার জগৎ’ (World of Forms) বলেছেন, তা আসলে পরম ও অপ্রাপ্য ঈশ্বরেরই চিন্তার জগৎ। অর্থাৎ, জগৎ সৃষ্টির আগে ঈশ্বর তাঁর মনে সমস্ত কিছুর নিখুঁত ধারণা তৈরি করে রেখেছিলেন। এই ধারণাগুলোই হলো প্লেটোর ফর্ম। তিনি ঈশ্বরের এই সৃজনশীল শক্তিকে ‘লোগোস’ (Logos) বা ‘ঐশ্বরিক বাক্য’ নামে অভিহিত করেন, যা ঈশ্বর এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। ফিলোর এই ব্যাখ্যা পরবর্তী খ্রিষ্টান ও মুসলিম দার্শনিকদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল (Runia, 1986)।
খ্রিষ্টধর্মে প্লেটোনিজম: সবচেয়ে সফল জুটি
নিওপ্লেটোনিজমের সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছিল খ্রিষ্টধর্মের ওপর। শুরুর দিকে টারটুলিয়ানের (Tertullian) মতো খ্রিষ্টান চিন্তাবিদরা (Church Fathers) গ্রিক দর্শনকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। কিন্তু ক্লিমেন্ট (Clement of Alexandria) ও অরিজেন (Origen)-এর মতো আলেক্সান্দ্রীয় চিন্তাবিদরা প্লেটোনিজমকে খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের (theology) একটি দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
তবে এই ধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন সেইন্ট অগাস্টিন অফ হিপ্পো (St. Augustine of Hippo) (৩৫৪-৪৩০ খ্রিস্টাব্দ)। অগাস্টিন তাঁর যৌবনে দ্বৈতবাদী ম্যানিকিয়ানিজম (Manichaeism) ধর্ম এবং সংশয়বাদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন, কিন্তু পরে প্লোটিনাসের লেখা পড়ে নিওপ্লেটোনিজমের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এই দর্শনই তাঁকে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের পথে চালিত করে। অগাস্টিন প্লেটোর দর্শনকে খ্রিষ্টীয় কাঠামোর মধ্যে এমনভাবে একীভূত করে নেন যে, পরবর্তী হাজার বছর ধরে পশ্চিমা খ্রিষ্টধর্ম মূলত এক ‘খ্রিষ্টীয় প্লেটোনিজম’-এ পরিণত হয়।
-
ঈশ্বরের মনে থাকা ধারণা: অগাস্টিন ফিলোর মতো করেই বলেন যে প্লেটোর ফর্ম হলো ঈশ্বরের মনে থাকা চিরন্তন ধারণা (Ideas in the mind of God)।
-
আত্মা ও শরীর: প্লেটোর মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে আত্মা শরীর থেকে পৃথক এবং শ্রেষ্ঠ। শরীর হলো আত্মার কারাগার। তবে খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি দেহের পুনরুত্থান (resurrection of the body)-কেও স্বীকার করেন।
-
মন্দের সমস্যা (Problem of Evil): অগাস্টিন নিওপ্লেটোনিক ধারণা ব্যবহার করে ম্যানিকিয়ানিজমের দ্বৈতবাদকে খণ্ডন করেন। তিনি বলেন, মন্দ কোনো বস্তু বা শক্তি নয়, বরং ভালোর অনুপস্থিতি বা বিকৃতি (privation of good), যেমন অন্ধকার হলো আলোর অনুপস্থিতি বা অসুস্থতা হলো স্বাস্থ্যের অভাব।
-
জ্ঞান ও ঐশ্বরিক আলো: প্লেটো যেমন বলেছেন জ্ঞান হলো পুনঃস্মরণ, অগাস্টিন তেমন বলেন যে আমরা সত্যকে জানতে পারি ঐশ্বরিক আলোকসজ্জা (Divine Illumination)-র মাধ্যমে। আমাদের মন নিজে থেকে সত্য তৈরি করতে পারে না; ঈশ্বর আমাদের মনে সত্যকে বোঝার জন্য আলো ফেলেন, ঠিক যেমন সূর্য আমাদের চোখকে পৃথিবীকে দেখতে সাহায্য করে।
-
অন্তর্মুখীনতা (Interiority): অগাস্টিনের বিখ্যাত উক্তি, “বাইরে যেও না, নিজের ভেতরে ফিরে এসো। সত্য মানুষের অন্তরেই বাস করে।” এই অন্তর্মুখী যাত্রা, আত্মার গভীরে ঈশ্বরের সন্ধান করা, প্লেটোনিক ও নিওপ্লেটোনিক দর্শনেরই প্রতিধ্বনি।
অগাস্টিনের মাধ্যমে প্লেটোনিজম খ্রিষ্টীয় দর্শনের ডিএনএ-তে পরিণত হয়। মধ্যযুগ জুড়ে ইউরোপে প্লেটোর খুব কম লেখাই পাওয়া যেত, কিন্তু অগাস্টিনের লেখার মাধ্যমে প্লেটোর চিন্তা সজীব ছিল। আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন বোয়েথিয়াস (Boethius), যিনি প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের দর্শনকে ল্যাটিন জগতে পরিচিত করান। তাঁর লেখা কনসোলেশন অফ ফিলোসফি (Consolation of Philosophy) মধ্যযুগের অন্যতম জনপ্রিয় বই ছিল, যা প্লেটোনিক থিম, যেমন—চিরন্তনতা ও ভাগ্যের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
ইসলামী দর্শনে প্লেটোনিজম (Platonism in Islamic Philosophy)
নবম ও দশম শতকে যখন বাগদাদের ‘বায়তুল হিকমাহ’ (House of Wisdom)-এ গ্রিক দর্শন আরবিতে অনূদিত হতে শুরু করে, তখন মুসলিম দার্শনিকদের হাতে প্লেটো ও নিওপ্লেটোনিজমের এক নতুন যাত্রা শুরু হয়। আল-কিন্দি (Al-Kindi), আল-ফারাবি (Al-Farabi) এবং ইবনে সিনা (Avicenna)-র মতো দার্শনিকরা প্লোটিনাসের নির্গমন তত্ত্ব (theory of emanation)-কে ইসলামী একেশ্বরবাদের সাথে খাপ খাইয়ে নেন।
তাঁদের মতে, আল্লাহ (পরম ‘এক’) থেকে প্রথমে ‘প্রথম বুদ্ধিবৃত্তি’ (First Intellect) নির্গত হয়, এবং তারপর ধাপে ধাপে অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তি, আত্মা ও মহাজাগতিক গোলক তৈরি হয়, যা এই পৃথিবীকে পরিচালনা করে। আল-ফারাবির ‘আদর্শ নগরী’ বা আল-মদিনা আল-ফাদিলা (The Virtuous City) বইটি প্লেটোর রিপাবলিক-এর দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। এখানেও তিনি একজন ‘নবী-দার্শনিক’-কে শাসক হিসেবে কল্পনা করেছেন, যিনি ঐশ্বরিক জ্ঞান লাভ করে সমাজকে পরিচালনা করেন। ইবনে সিনার আত্মা সম্পর্কিত দর্শনও প্লেটোনিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এভাবেই প্লেটোর দর্শন ইসলামী স্বর্ণযুগে (Islamic Golden Age) এক নতুন জীবন লাভ করে এবং পরে স্পেনের মাধ্যমে পুনরায় ইউরোপে প্রবেশ করে মধ্যযুগের স্কলাস্টিসিজমকে (Scholasticism) প্রভাবিত করে (Fakhry, 2002)।
রেনেসাঁস থেকে আধুনিক যুগ – প্লেটোর প্রত্যাবর্তন (From the Renaissance to the Modern Era: The Return of Plato)
মধ্যযুগে ইউরোপে অ্যারিস্টটলের দর্শন প্লেটোর চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী ছিল, মূলত কারণ তাঁর লেখাগুলো সহজলভ্য ছিল এবং থমাস অ্যাকুইনাসের (Thomas Aquinas) মাধ্যমে খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের সাথে মিশে গিয়েছিল। কিন্তু পঞ্চদশ শতকে ইতালিতে রেনেসাঁসের সময় কনস্টান্টিনোপল থেকে গ্রিক পাণ্ডুলিপি পশ্চিমে আসতে শুরু করলে এক অত্যন্ত বিশাল ঘটনা ঘটে—ইউরোপ যেন প্লেটোকে নতুন করে আবিষ্কার করল।
ফ্লোরেন্সের রেনেসাঁস ও প্লেটোর পুনর্জন্ম
ফ্লোরেন্সে কসিমো দে’ মেদিচি (Cosimo de’ Medici)-র পৃষ্ঠপোষকতায় মারসিলিও ফিচিনো (Marsilio Ficino) নামে এক পণ্ডিত প্লেটোর সমস্ত লেখা এবং প্লোটিনাসের এনিয়াডস ল্যাটিনে অনুবাদ করেন। তিনি ফ্লোরেন্সে একটি নতুন ‘প্লেটোনিক একাডেমি’ (Platonic Academy) প্রতিষ্ঠা করেন, যা ক্লাসিক্যাল প্লেটোনিজমের পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দেয়। ফিচিনো প্লেটোর প্রেমতত্ত্ব (Symposium সংলাপ থেকে), অমর আত্মা এবং ধারণার জগৎকে খ্রিষ্টীয় মরমীবাদের সাথে মিশিয়ে এক নতুন মানবতাবাদী দর্শন তৈরি করেন। তিনি ‘প্লেটোনিক প্রেম’ (Platonic Love) ধারণাটিকে জনপ্রিয় করেন, যা শারীরিক আকর্ষণের ঊর্ধ্বে উঠে আত্মার মাধ্যমে সৌন্দর্যের আদর্শ রূপ এবং ঈশ্বরের দিকে আরোহণের পথ দেখায়। এই দর্শন রেনেসাঁসের শিল্প (যেমন বত্তিচেল্লির চিত্রকলা), সাহিত্য ও চিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল (Kraye, 2007)।
যুক্তির যুগে প্লেটোনিজম
সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডে বস্তুবাদী দর্শনের (materialism) উত্থান ঘটে, যার নেতৃত্বে ছিলেন টমাস হবসের (Thomas Hobbes) মতো দার্শনিকরা। এর প্রতিক্রিয়ায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল দার্শনিক—যেমন রালফ কাডওয়ার্থ (Ralph Cudworth) ও হেনরি মোর (Henry More)—প্লেটোর দর্শনকে আঁকড়ে ধরেন। তাঁরা কেমব্রিজ প্লেটোনিস্ট (Cambridge Platonists) নামে পরিচিত। তাঁরা মনে করতেন, জগৎটা শুধু জড় পদার্থের সমষ্টি নয়। এর পেছনে এক আধ্যাত্মিক ও যুক্তিনিষ্ঠ বাস্তবতা আছে। তাঁরা প্লেটোর চিরন্তন নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সত্যের (eternal moral and intellectual truths) ধারণা দিয়ে বস্তুবাদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামি—দুয়েরই বিরোধিতা করেন। তাঁদের মতে, মানুষের যুক্তি হলো ‘প্রভুর মোমবাতি’ (the candle of the Lord), যা দিয়ে সে ঐশ্বরিক সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে।
রোমান্টিকতাবাদ ও জার্মান ভাববাদ
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে প্লেটোনিজমের প্রভাব এক নতুন রূপ নেয়। রোমান্টিক কবিরা—যেমন কোলরিজ (Coleridge), শেলি (Shelley) ও ব্লেক (Blake)—প্লেটোর ধারণার জগতের মধ্যে তাঁদের অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্য, কল্পনা (imagination) ও অসীমের প্রতি আকর্ষণের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান। তাঁদের কাছে প্রকৃতি ছিল সেই আদর্শ জগতের এক জীবন্ত ছায়া বা প্রতীক।
অন্যদিকে জার্মানিতে ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant)-এর দর্শন প্লেটোর চিন্তার এক আধুনিক সংস্করণ উপস্থাপন করে। কান্টের ফেনোমেনা (Phenomena) বা আমাদের অভিজ্ঞতার জগৎ এবং নোউমেনা (Noumena) বা আমাদের অভিজ্ঞতার অতীত আসল জগৎ (thing-in-itself)-এর বিভাজন প্লেটোর দুই জগতের তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। যদিও একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল: প্লেটোর মতে, আমরা প্রজ্ঞার মাধ্যমে আদর্শ জগৎকে জানতে পারি, কিন্তু কান্টের মতে নোউমেনা সম্পর্কে আমাদের কোনো জ্ঞান সম্ভব নয়। কান্টের পরে হেগেল (Hegel)-এর মতো জার্মান ভাববাদীরা (German Idealists) প্লেটোর দ্বান্দ্বিক (dialectic) পদ্ধতিকে তাঁদের দর্শনের কেন্দ্রে স্থাপন করেন, যেখানে একটি ধারণা (thesis) তার বিপরীতের (antithesis) সাথে সংঘর্ষের মাধ্যমে এক উচ্চতর সংশ্লেষণে (synthesis) পৌঁছায়।
আজকের দিনে প্লেটোনিজম – বেঁচে থাকা এক প্রাচীন দৈত্য (Platonism Today: A Living Ancient Giant)
আড়াই হাজার বছর পর প্লেটো কি এখনো প্রাসঙ্গিক? উত্তরটা হলো, আগের চেয়ে অনেক বেশি। প্লেটোনিজমের ভূত আজও দর্শনের করিডোরে, গণিতের ক্লাসরুমে, এমনকি পদার্থবিজ্ঞানের ল্যাবেও ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা হয়তো নামটা ব্যবহার করি না, কিন্তু ভাবনাটা রয়ে গেছে।
গণিতে প্লেটোনিজম (Mathematical Platonism)
আজকের দিনে প্লেটোনিজমের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি হলো গণিতের দর্শন। প্রশ্নটা খুব সহজ: সংখ্যা বা জ্যামিতিক আকারগুলো (যেমন, একটি নিখুঁত বৃত্ত বা পাই π-এর অসীম মান) কি মানুষের আবিষ্কার (invention), নাকি আবিষ্কার (discovery)?
আপনি যখন বলেন “২ + ২ = ৪”, এই সত্যটি কি আপনি তৈরি করেছেন, নাকি এটি মহাবিশ্বের একটি অন্তর্নিহিত সত্য যা আপনি শুধু খুঁজে বের করেছেন? গাণিতিক প্লেটোনিস্টরা (Mathematical Platonists) বিশ্বাস করেন যে সংখ্যা, সেট (set), এবং অন্যান্য গাণিতিক বস্তুগুলো মানুষের মনের বাইরে স্বাধীনভাবে, এক বিমূর্ত জগতে (abstract realm) বিদ্যমান। ঠিক যেমন প্লেটোর ফর্ম। আমরা গণিত করি না, আমরা গণিত আবিষ্কার করি। বিখ্যাত গণিতবিদ কুর্ট গোডেল (Kurt Gödel) এবং দার্শনিক গটলব ফ্রেগে (Gottlob Frege) এই মতের পক্ষে ছিলেন। অনেক গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী অবচেতনভাবেই প্লেটোনিস্ট। তাঁরা বিশ্বাস করেন, মহাবিশ্বের নিয়মগুলো এক সুন্দর গাণিতিক ভাষায় লেখা, যা মানুষের অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল নয় (Balaguer, 2016)। পদার্থবিদ ইউজিন উইগনার (Eugene Wigner) তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে এই নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, কেন গণিতের মতো একটি বিমূর্ত বিষয় ভৌত জগৎকে এত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করতে পারে (The Unreasonable Effectiveness of Mathematics in the Natural Sciences)। এই আশ্চর্য মিল অনেককে ভাবতে বাধ্য করে যে হয়তো মহাবিশ্বের কাঠামোর গভীরে এক ধরনের গাণিতিক বা প্লেটোনিক বাস্তবতা লুকিয়ে আছে।
বিশ্লেষণী দর্শনে প্লেটোনিজম (Platonism in Analytic Philosophy)
বিশ্লেষণী দর্শনে ‘সার্বিক’ বা ‘ইউনিভার্সাল’-এর সমস্যা (Problem of Universals) নামে একটি পুরনো বিতর্ক চালু আছে। যেমন, পৃথিবীতে অনেক লাল জিনিস আছে—লাল গোলাপ, লাল গাড়ি, লাল রক্ত। এই সমস্ত জিনিসের মধ্যে ‘লালত্ব’ (redness) নামক যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, সেটির অস্তিত্ব কী? এটি কি শুধুই একটি নাম (nominalism), নাকি একটি মানসিক ধারণা (conceptualism), নাকি ‘লালত্ব’ নামক কোনো বিমূর্ত সত্তা সত্যিই আছে (realism)? যারা মনে করেন এর একটি বাস্তব অস্তিত্ব আছে, তারা এক ধরনের প্লেটোনিস্ট।
একইভাবে, নৈতিকতার ক্ষেত্রেও প্লেটোনিজমের প্রভাব দেখা যায়। নৈতিক বাস্তববাদীরা (Moral Realists) মনে করেন যে ‘ভালো’, ‘মন্দ’, ‘ন্যায়’—এই ধারণাগুলো আমাদের ব্যক্তিগত বা সাংস্কৃতিক মতামত নয়। এগুলো হলো বস্তুনিষ্ঠ সত্য (objective truths), যা আবিষ্কার করা সম্ভব। এই চিন্তাধারাটাও প্লেটোর ‘The Good’-এর ফর্ম থেকে অনুপ্রাণিত।
প্লেটোনিজমের সমালোচনা (Critiques of Platonism)
অবশ্যই, প্লেটোনিজমের সমালোচকের অভাবও কোনো যুগে ছিল না। অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগেও এর তীব্র সমালোচনা হয়েছে।
-
ফ্রিডরিখ নিৎশে (Friedrich Nietzsche): নিৎশে প্লেটোনিজমকে পশ্চিমা সভ্যতার সবচেয়ে বড় ‘ভুল’ বলে মনে করতেন। তিনি বলেন, প্লেটো এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, জীবন্ত, গতিশীল জগৎকে অস্বীকার করে এক কাল্পনিক, রক্তমাংসহীন, স্থির ‘আসল জগৎ’ তৈরি করেছেন। নিৎশের মতে, এই জীবন-বিমুখতাই পরে খ্রিষ্টধর্মের ভিত্তি তৈরি করে। তাঁর বিখ্যাত উক্তি: “খ্রিষ্টধর্ম হলো সাধারণ মানুষের জন্য প্লেটোনিজম (Christianity is Platonism for the people)।”
-
কার্ল পপার (Karl Popper): বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী দার্শনিক কার্ল পপার তাঁর বই The Open Society and Its Enemies-এ প্লেটোকে আধুনিক স্বৈরাচারের (totalitarianism) অন্যতম জনক হিসেবে অভিযুক্ত করেন। পপারের মতে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে সমষ্টির ভালোর জন্য বিসর্জন দেওয়া হয়, যেখানে ভিন্নমতকে দমন করা হয় এবং যেখানে একদল সম্ভ্রান্ত ‘দার্শনিক রাজা’ শাসন করেন, তা একটি মুক্ত সমাজের (open society) পরিপন্থী।
উপসংহার: সেই গুহা, সেই ছায়া ও অনন্ত জিজ্ঞাসা
প্লেটোর সেই গুহা থেকে আমরা অনেক দূর এসেছি, তাই না? এথেন্সের ধুলোমাখা পথ থেকে যাত্রা শুরু করে আমরা রোমান সাম্রাজ্যের মরমীবাদ, মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্ব, রেনেসাঁসের শিল্প, আধুনিক গণিত হয়ে আজকের কোয়ান্টাম ফিজিক্স পর্যন্ত ঘুরে এলাম। প্লেটোনিজমের পোশাক পাল্টেছে, ভাষা পাল্টেছে, কিন্তু তার মূল আত্মাটা একই রয়ে গেছে।
সেই আত্মাটা কী?
সেটা হলো এক গভীর অতৃপ্তি। আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, পরিবর্তনশীল, ক্ষয়িষ্ণু জগতের প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস। আর এর পেছনে লুকিয়ে থাকা এক শাশ্বত, নিখুঁত, অপরিবর্তনীয় সত্যের জন্য তীব্র এক আকাঙ্ক্ষা। প্লেটোনিজম আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, যা কিছু আমরা দেখি বা অনুভব করি, তা হয়তো গল্পের শেষ কথা নয়।
প্লেটোনিজম আমাদের শেখায়, যা দেখি, তার সবটুকু বিশ্বাস করতে নেই। ছায়ার পেছনে কায়া থাকে। ঘটনার পেছনে থাকে কারণ। বিশৃঙ্খলার আড়ালে থাকে নিয়ম। আমরা সবাই হয়তো কোনো না কোনো গুহায় শেকলে বাঁধা। আমাদের চারপাশের জগৎটা হয়তো সত্যিই এক মায়াবী ছায়া। কিন্তু প্লেটো আমাদের কানে কানে বলে যান, শেকল ছেঁড়ার সাহস করো। আলোর দিকে তাকাও। কষ্ট হবে, চোখ ধাঁধিয়ে যাবে, পুরোনো বিশ্বাসগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, কিন্তু সেখানেই হয়তো অপেক্ষা করছে পরম সত্য।
এই দর্শন কোনো চূড়ান্ত উত্তর দেয় না, বরং এক অনন্ত জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। ‘সত্য’ কী? ‘সৌন্দর্য’ কী? ‘ন্যায়’ কী? একটি ‘আদর্শ জীবন’ কেমন হওয়া উচিত? এই প্রশ্নগুলোই প্লেটোর আসল উত্তরাধিকার। আর সেই জিজ্ঞাসাই হয়তো মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। প্লেটো আড়াই হাজার বছর আগে যে প্রশ্ন তুলেছিলেন, আমরা আজও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছি আমাদের বিজ্ঞান, শিল্প, ধর্ম আর দর্শনের মধ্যে।
তথ্যসূত্র
- Balaguer, M. (2016). Platonism in Metaphysics. In E. N. Zalta (Ed.), The Stanford Encyclopedia of Philosophy (Winter 2016 Edition). Stanford University. https://plato.stanford.edu/archives/win2016/entries/platonism/
- Beiser, F. C. (2002). German Idealism: The Struggle against Subjectivism, 1781–1801. Harvard University Press.
- Dillon, J. (2003). The Heirs of Plato: A Study of the Old Academy (347–274 BC). Clarendon Press.
- Fakhry, M. (2002). Al-Farabi, Founder of Islamic Neoplatonism: His Life, Works and Influence. Oneworld Publications.
- Gerson, L. P. (2017). From Plato to Platonism. Cornell University Press.
- Kraye, J. (Ed.). (2007). The Cambridge Companion to Renaissance Humanism. Cambridge University Press.
- Kraut, R. (Ed.). (2017). The Cambridge Companion to Plato (2nd ed.). Cambridge University Press.
- Long, A. A., & Sedley, D. N. (1987). The Hellenistic Philosophers: Volume 1, Translations of the Principal Sources with Philosophical Commentary. Cambridge University Press.
- Nietzsche, F. (2005). Beyond Good and Evil (R.-P. Horstmann & J. Norman, Eds.; J. Norman, Trans.). Cambridge University Press. (Original work published 1886).
- Plato. (1997). Complete Works (J. M. Cooper, Ed.; G. M. A. Grube, Trans.). Hackett Publishing Company. (This single volume contains all the dialogues referenced, such as Republic, Meno, and Phaedrus).
- Plotinus. (1991). The Enneads (S. MacKenna, Trans.; J. Dillon, Ed.). Penguin Classics.
- Popper, K. R. (2011). The Open Society and Its Enemies (New One-Volume Edition). Princeton University Press. (Original work published 1945).
- Runia, D. T. (1986). Philo of Alexandria and the Timaeus of Plato. Brill.
Leave a Reply