Table of Contents
ভূমিকা: প্লেটো লোকটা কে ছিলেন, বলুন তো?
ধরুন, আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। গ্রিসের এথেন্স শহর। সেখানে সক্রেটিস নামে এক অদ্ভুত জ্ঞানী লোক ছিলেন, যিনি খালি প্রশ্ন করতেন আর মানুষকে ভাবাতেন। যেনতেন প্রশ্ন নয়, একেবারে অস্তিত্বের গোড়ায় গিয়ে ঘা মারতেন তিনি। সেই সক্রেটিসেরই সবচেয়ে বিখ্যাত, এবং বলা ভালো, সবচেয়ে অনুরক্ত ছাত্র ছিলেন প্লেটো (Plato)। গুরুর প্রতি তাঁর ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে, সক্রেটিস যখন শহরের কর্তাব্যক্তিদের রোষানলে পড়ে হেমলক বিষ পানে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন (আনুমানিক ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), প্লেটোর মনে হলো, এ কেমন বর্বরতা! এ কেমন রাষ্ট্র যেখানে এমন প্রজ্ঞাবান, নির্মোহ সত্যসন্ধানীকে মরতে হয়! এই তীব্র অভিঘাত, এই ব্যক্তিগত শোক এবং সামাজিক অবক্ষয়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্লেটোর চিন্তাজগতে এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। এই ভাবনা থেকেই হয়তো তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছিল এক আদর্শ রাষ্ট্রের (Ideal State) স্বপ্ন – এমন এক রাষ্ট্র যেখানে ন্যায়বিচার (Justice) কেবল মুখের কথা হবে না, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রোথিত থাকবে, আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন তারাই, যারা সত্যিকার অর্থেই যোগ্য, জ্ঞানী এবং নিঃস্বার্থ।
প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা বুঝতে হলে আমাদের একটু তাঁর সময়টাকেও বুঝতে হবে। তখন এথেন্সের গণতন্ত্রের স্বর্ণযুগ (Age of Pericles) অস্তমিত। দীর্ঘস্থায়ী পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ (Peloponnesian War, ৪৩১-৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এথেন্সকে কেবল সামরিকভাবেই পর্যুদস্ত করেনি, এর নৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকেও দুর্বল করে দিয়েছিল। যুদ্ধের পর প্রথমে ত্রিশ টাইর্যান্টের (Thirty Tyrants) স্বৈরাচারী শাসন, এবং পরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের নামে উচ্ছৃঙ্খলতা ও দলীয় কোন্দল প্লেটোকে গভীরভাবে হতাশ করে। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে বাগাড়ম্বরপ্রিয় সোফিস্টরা (Sophists) তরুণদের বিভ্রান্ত করছে, কীভাবে রাজনৈতিক নেতারা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে। এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিলেন প্লেটো। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক রাষ্ট্রের নকশা করতে, যেখানে জ্ঞান (Knowledge) ও সদ্গুণ (Virtue) হবে সর্বোচ্চ চালিকাশক্তি। তাঁর এই ভাবনাগুলো তিনি মূলত লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর কালজয়ী সংলাপগুলোতে, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো “রিপাবলিক” (The Republic), এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর চিন্তার বিবর্তন দেখা যায় “দ্য লজ” (The Laws) ও “স্টেটসম্যান” (Statesman) গ্রন্থগুলোতে। প্লেটোর লেখার বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সরাসরি কোনো তত্ত্ব প্রচার করেননি, বরং সক্রেটিসকে প্রধান চরিত্র করে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাঁর দার্শনিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। চলুন, ডুব দেওয়া যাক প্লেটোর সেই গভীর ভাবনার জগতে। তবে হ্যাঁ, বিষয়টা একটু জটিল, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, কিংবা জানালার বাইরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে পড়লে মন্দ লাগবে না! এই প্রবন্ধে আমরা চেষ্টা করবো প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার খুঁটিনাটি দিকগুলো তুলে ধরতে, তাঁর দর্শনের গভীরে প্রবেশ করতে এবং বুঝতে চাইবো, কেন আড়াই হাজার বছর পরেও তাঁর ভাবনাগুলো আমাদের নাড়া দেয়।
প্লেটোর জীবন ও দর্শন: রাষ্ট্রচিন্তার প্রেক্ষাপট
প্লেটোর আসল নাম ছিল অ্যারিস্টোক্লিস (Aristocles), “প্লেটো” ছিল তাঁর ডাকনাম, সম্ভবত তাঁর চওড়া কাঁধের (platus – broad) জন্য। তাঁর জন্ম হয়েছিল এথেন্সের এক অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী পরিবারে, আনুমানিক ৪২৮/৪২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তাঁর পরিবারের সদস্যরা এথেন্সের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, যা তাঁকে খুব কাছ থেকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। প্রথম জীবনে তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তরুণ বয়সে সক্রেটিসের সংস্পর্শে এসে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সক্রেটিসের প্রজ্ঞা, তাঁর প্রশ্ন করার অভিনব পদ্ধতি এবং সত্যের প্রতি তাঁর আপসহীন নিষ্ঠা প্লেটোকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। প্রায় আট বছর তিনি সক্রেটিসের নিবিড় সান্নিধ্যে ছিলেন। (Field, 1967)
সক্রেটিসের মৃত্যুর পর প্লেটো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং এথেন্স ত্যাগ করেন। কথিত আছে, তিনি প্রায় বারো বছর ধরে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন – মিশর, সাইরিন (উত্তর আফ্রিকা), ইটালি এবং সিসিলি। এই ভ্রমণকালে তিনি বিভিন্ন দার্শনিক গোষ্ঠী, বিশেষ করে দক্ষিণ ইতালির পিথাগোরীয়দের (Pythagoreans) সংস্পর্শে আসেন, যাদের গণিত ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা তাঁর দর্শনকে প্রভাবিত করেছিল। (Taylor, 2008)
ভ্রমণ শেষে এথেন্সে ফিরে আনুমানিক ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন, যার নাম দেন “একাডেমি” (Academy)। এটি ছিল ইউরোপের প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম এবং এটি প্রায় ৯০০ বছর ধরে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে টিকে ছিল। প্লেটোর অ্যাকাডেমির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যৎ দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়ক তৈরি করা, যারা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবে। গণিতশাস্ত্রকে তিনি দর্শনের প্রস্তুতির জন্য অপরিহার্য মনে করতেন; কথিত আছে, অ্যাকাডেমির প্রবেশদ্বারে লেখা ছিল: “জ্যামিতি না জেনে কেউ যেন এখানে প্রবেশ না করে।” (Cherniss, 1945)
প্লেটোর দর্শনের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো তাঁর “তত্ত্ববিদ্যা” বা “আইডিয়ার তত্ত্ব” (Theory of Forms/Ideas)। তিনি মনে করতেন, এই যে আমরা চারপাশে যা কিছু দেখি – চেয়ার, টেবিল, মানুষ, সুন্দর ফুল – এগুলো সবই পরিবর্তনশীল, অস্থায়ী এবং অসম্পূর্ণ। এগুলো হলো প্রকৃত সত্যের ছায়া বা অনুকরণ মাত্র। আসল বা পারমার্থিক সত্য (Forms) রয়েছে এক অন্য জগতে, যা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না, কেবল প্রজ্ঞা (Reason) ও বুদ্ধির (Intellect) মাধ্যমেই তা জানা সম্ভব। এই ফর্মগুলো হলো শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় এবং নিখুঁত। যেমন, অসংখ্য সুন্দর জিনিসের আড়ালে রয়েছে “সৌন্দর্যের ফর্ম” (Form of Beauty), বিভিন্ন ন্যায্য কাজের পেছনে রয়েছে “ন্যায়ের ফর্ম” (Form of Justice)। আর এই সমস্ত ফর্মের ঊর্ধ্বে রয়েছে ” কল্যাণের ফর্ম” (Form of the Good), যা অনেকটা সূর্যের মতো – অন্য সব ফর্মকে আলোকিত করে এবং তাদের অস্তিত্ব ও বোধগম্যতা (intelligibility) দান করে। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book VI-VII) এই তত্ত্ববিদ্যা প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার মূল ভিত্তি। কারণ, তাঁর মতে, আদর্শ রাষ্ট্রও একটি ফর্ম, এবং বাস্তব রাষ্ট্রকে সেই আদর্শের যত কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যাবে, ততই তা উন্নত হবে। আর এই কাজটি করতে পারবেন কেবল দার্শনিকরা, কারণ তাঁরাই ফর্মের জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন।
প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার নেপথ্যে: যে ঝোড়ো হাওয়া আর দার্শনিক কণ্ঠস্বর তাঁকে গড়েছিল
আচ্ছা, প্লেটো যে অমন আদর্শ রাষ্ট্রের (Ideal State) খসড়া আঁকলেন, যেখানে দার্শনিকরা রাজা হবেন আর সব চলবে ঘড়ির কাঁটার মতো, এই আইডিয়াটা কি তাঁর মাথায় আকাশ থেকে টুপ করে পড়েছিল? নাকি এর পেছনে ছিল লম্বা একটা গল্প, কিছু তেতো অভিজ্ঞতা আর আগের দিনের জ্ঞানীগুণীদের ফিসফাস? চলুন, আজ সেই গল্পটাই একটু নাড়াচাড়া করে দেখি। প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা বুঝতে হলে তাঁর সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর তাঁর আগের দার্শনিকদের ভাবনাগুলোও একটু ঝালিয়ে নেওয়া দরকার। অনেকটা সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো, আরকি!
টালমাটাল রাজনৈতিক মঞ্চ: প্লেটোর চোখের সামনের গ্রিস
প্লেটোর জন্ম হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন এথেন্সের আকাশ ছিল ঘন কালো মেঘে ঢাকা। তাঁর শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের বড় একটা অংশ কেটেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সামাজিক অবক্ষয়ের সাক্ষী হয়ে। এই পরিবেশটাই তাঁকে এক নিখুঁত, স্থিতিশীল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করেছিল।
পেলোপোনেশীয় যুদ্ধের (Peloponnesian War, ৪৩১-৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) দীর্ঘ ছায়া: আচ্ছা, সেই পেলোপোনেশীয় যুদ্ধ জিনিসটা কী ছিল, বলুন তো? এথেন্স আর স্পার্টা, দুই গ্রিক পাওয়ারহাউস, একে অপরের সঙ্গে এমন এক চুলোচুলি করল (প্রায় ২৭ বছর ধরে!) যে, পুরো গ্রিক বিশ্বটাই নড়বড়ে হয়ে গেল। এথেন্স, যেখানে প্লেটোর জন্ম (আনুমানিক ৪২৮/৪২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), সে তো একেবারে পর্যুদস্ত। শুধু টাকাপয়সা বা সৈন্যসামন্তের ক্ষতি নয়, এথেন্সের আত্মাটাই যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। যে গণতন্ত্র (Democracy) নিয়ে এত গর্ব ছিল, যুদ্ধের দীর্ঘ চাপ, নেতাদের ভুল সিদ্ধান্ত আর জনগণের খামখেয়ালিপনায় সেটাও কেমন যেন পানসে হয়ে গেল। প্লেটোর কচি চোখে এই ভাঙনের দৃশ্য নিশ্চয়ই গভীর দাগ কেটেছিল। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে একটা সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র যুদ্ধের নেশায় আর ভুল নীতিতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারে। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে স্থিতিশীলতা (Stability) ও ঐক্যের (Unity) প্রতি বিশেষভাবে আগ্রহী করে তোলে। (Kagan, 2003)
এথেনীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – এথেনীয় গণতন্ত্র: গণতন্ত্রের সেই আশ্চর্য প্রদীপ
পেলোপনেশীয় যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – পেলোপনেসীয় যুদ্ধ: যখন ভাইয়ের বুকে ছুরি চালায় ভাই
ত্রিশ স্বৈরাচারীর (The Thirty Tyrants, ৪০৪-৪০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) দুঃশাসন: পেলোপোনেশীয় যুদ্ধে এথেন্সের পরাজয়ের পর স্পার্টার মদতে সেখানে এক স্বল্পস্থায়ী কিন্তু নৃশংস স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা “ত্রিশ অত্যাচারীর শাসন” নামে কুখ্যাত। প্লেটোর নিজের পরিবারের কিছু সদস্য, যেমন তাঁর মাতুল চারমিডেস (Charmides) এবং সম্পর্কিত ভাই ক্রিটিয়াস (Critias), এই শাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ক্রিটিয়াস ছিলেন এর অন্যতম নেতা। প্রথমে প্লেটো হয়তো ভেবেছিলেন, এই অভিজাত শাসনে দেশের ভালো হবে। কিন্তু তাঁদের নিষ্ঠুরতা, নির্বিচার হত্যাকাণ্ড আর সম্পদ লুণ্ঠন দেখে প্লেটোর মোহভঙ্গ হয়। তিনি বুঝতে পারেন, শুধু গণতন্ত্রই নয়, অভিজাততন্ত্রও (Aristocracy) যদি নীতিভ্রষ্ট হয়, তাহলে তা জনগণের জন্য ভয়াবহ অভিশাপ বয়ে আনতে পারে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁকে যে কোনো ধরনের লাগামহীন ক্ষমতার (Unchecked Power) প্রতি সন্দিহান করে তোলে। (Xenophon, Hellenica, Book II)
পুনঃপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র ও সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড (Execution of Socrates, ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): ত্রিশ স্বৈরাচারীর পতনের পর এথেন্সে আবার গণতন্ত্র ফিরে আসে। কিন্তু এই গণতন্ত্রও প্লেটোকে স্বস্তি দিতে পারেনি। কারণ, এই গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনেই তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় গুরু সক্রেটিসকে (Socrates) বিচারের নামে প্রহসন করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সক্রেটিসের অপরাধ ছিল? তরুণদের “বিপথে” চালিত করা আর রাষ্ট্রের দেবতাদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো! প্লেটোর কাছে এটা ছিল চরম অন্যায়। যে রাষ্ট্র এমন জ্ঞানী ও নিঃস্বার্থ মানুষকে হত্যা করতে পারে, সেই রাষ্ট্রের কাঠামোয় নিশ্চয়ই বড় ধরনের গলদ আছে। সক্রেটিসের মৃত্যু প্লেটোর মনে গণতন্ত্রের প্রতি এক গভীর বিতৃষ্ণা এবং প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি চরম অনাস্থা তৈরি করে। তিনি উপলব্ধি করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত (Opinion of the Majority) সবসময় সঠিক বা ন্যায়সঙ্গত (Just) নাও হতে পারে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন প্রজ্ঞা (Wisdom) ও জ্ঞান (Knowledge), যা সাধারণ মানুষের থাকে না। (Stone, 1988)
দলীয় কোন্দল ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (Factionalism – Stasis): প্লেটোর সময়ে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোতে (City-states বা Polis) দলীয় কোন্দল, ক্ষমতার লড়াই আর ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন ছিল একটা সাধারণ ঘটনা। ধনী-দরিদ্রের বিভাজন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক রেষারেষি রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দিত। প্লেটো এই অন্তহীন সংঘাত (Stasis) থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে শ্রেণিবিভাজন থাকলেও, প্রতিটি শ্রেণির সুনির্দিষ্ট কাজ এবং তাদের মধ্যেকার সমন্বয় (Harmony) এই দলীয় কোন্দল দূর করবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।
এই উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্লেটোর মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় করেছিল যে, তৎকালীন কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাই (গণতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র) আদর্শ নয়। সবগুলোর মধ্যেই গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। তাই তিনি এমন এক নতুন ব্যবস্থার কথা ভাবতে শুরু করেন, যা হবে স্থিতিশীল, ন্যায়পরায়ণ এবং যোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত।
দার্শনিক পূর্বসূরিদের কণ্ঠস্বর: প্লেটোর ভাবনার কারিগর
প্লেটো শূন্য থেকে তাঁর দর্শন তৈরি করেননি। তাঁর আগে অনেক দার্শনিকই জগৎ, জীবন, জ্ঞান ও রাষ্ট্র নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাচিন্তা করে গেছেন। প্লেটো তাঁদের কারো কারো দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছিলেন, কারো কারো চিন্তাকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন, আবার কারো কারো চিন্তাকে তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন।
সক্রেটিস (Socrates, আনুমানিক ৪৭০-৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): অবিচল স্তম্ভ: প্লেটোর ওপর সবচেয়ে গভীর ও প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল তাঁর গুরু সক্রেটিসের। সক্রেটিস নিজে কিছু লিখে যাননি, প্লেটোর সংলাপগুলোর (Dialogues) মাধ্যমেই আমরা তাঁর দর্শন সম্পর্কে জানতে পারি।
- সদ্গুণই জ্ঞান (“Virtue is Knowledge”): সক্রেটিসের এই কেন্দ্রীয় ধারণাটি প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার মূল ভিত্তি। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, মানুষ জেনেবুঝে অন্যায় করে না। অজ্ঞতাই (Ignorance) হলো সব পাপের মূল। যদি মানুষ জানে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, তাহলে সে ভালোটাই বেছে নেবে। প্লেটো এই ধারণাকে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো জ্ঞান – বিশেষ করে “কল্যাণের ধারণা” (Form of the Good) সম্পর্কে জ্ঞান। আর এই জ্ঞান কেবল দার্শনিকদেরই (Philosophers) থাকে। তাই দার্শনিকরাই শাসনের জন্য সবচেয়ে যোগ্য (Philosopher King)।
- আত্মার যত্ন (Care of the Soul – Psychēs Therapeia): সক্রেটিস পার্থিব ধন-সম্পদের চেয়ে আত্মার উন্নতিকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। প্লেটোও তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে নাগরিকদের নৈতিক ও আত্মিক উন্নতির ওপর জোর দিয়েছেন। শিক্ষাব্যবস্থার (Education) মূল লক্ষ্যই হলো আত্মার বিকাশ।
- সংলাপ পদ্ধতি (Dialectic Method – Elenchus): সক্রেটিস প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে মানুষের ভুল ধারণাগুলো ধরিয়ে দিতেন এবং সত্য অনুসন্ধানে সাহায্য করতেন। প্লেটো এই পদ্ধতিকে আরও পরিশীলিত করে তাঁর দর্শনের প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে, ডায়ালেক্টিক বা তর্কশাস্ত্রই হলো সর্বোচ্চ জ্ঞান লাভের পথ।
- সংজ্ঞার অনুসন্ধান (Search for Definitions): সক্রেটিস বিভিন্ন নৈতিক ধারণা (যেমন: ন্যায়, সাহস, সংযম) এর সঠিক ও সর্বজনীন সংজ্ঞা খুঁজতেন। প্লেটোও এই ধারা অনুসরণ করে “রিপাবলিক” গ্রন্থে ন্যায়ের সংজ্ঞা নিরূপণের চেষ্টা করেছেন।
সক্রেটিসের জীবন ও মৃত্যু প্লেটোকে শিখিয়েছিল যে, সত্য ও ন্যায়ের জন্য আপসহীন সংগ্রাম করতে হয়, এমনকি যদি তার জন্য জীবনও দিতে হয়। (Taylor, 2008)
পিথাগোরীয় ধারা (Pythagoreans, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক): সংখ্যা, সমন্বয় ও আত্মা: দক্ষিণ ইতালির পিথাগোরীয় দার্শনিক গোষ্ঠীর চিন্তাধারা প্লেটোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, বিশেষ করে তাঁর সিসিলি ভ্রমণের সময়।
- গণিতের গুরুত্ব (Importance of Mathematics): পিথাগোরীয়রা বিশ্বাস করতেন, জগৎ পরিচালিত হয় গাণিতিক নিয়ম ও শৃঙ্খলার দ্বারা। সংখ্যাই হলো সবকিছুর মূল ভিত্তি। প্লেটোও গণিতকে দর্শনের প্রস্তুতির জন্য অপরিহার্য মনে করতেন। তাঁর অ্যাকাডেমির (Academy) প্রবেশদ্বারে লেখা ছিল, “জ্যামিতি না জেনে কেউ যেন এখানে প্রবেশ না করে।” আদর্শ রাষ্ট্রের শাসকদের শিক্ষাক্রমে গণিত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।
- সমন্বয় ও শৃঙ্খলা (Harmony and Order): পিথাগোরীয়রা মহাবিশ্বের শৃঙ্খলার (Cosmos) ওপর জোর দিতেন। প্লেটো এই ধারণা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে একটি সুশৃঙ্খল ও সমন্বিত রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন, যেখানে প্রতিটি অংশ নিজ নিজ কাজ সঠিকভাবে করবে।
- আত্মার অমরত্ব ও দেহান্তরবাদ (Immortality of the Soul and Transmigration): পিথাগোরীয়রা আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করতেন এবং মনে করতেন আত্মা বিভিন্ন দেহ ধারণ করে। প্লেটোও আত্মার অমরত্বের ধারণা গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর “রিপাবলিক” গ্রন্থের শেষে “মিথ অফ এর” (Myth of Er) এর মাধ্যমে তা ব্যাখ্যা করেছেন। এই ধারণা নৈতিক দায়িত্ববোধের জন্ম দেয়।
- গোষ্ঠীগত জীবন (Communal Living): কিছু পিথাগোরীয় সম্প্রদায় একসঙ্গে সমবায়ী জীবন যাপন করত, যেখানে সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা সীমিত ছিল। প্লেটোর অভিভাবক শ্রেণির (Guardians) জন্য সম্পত্তি ও পরিবারের সাম্যবাদের (Communism of Property and Family) ধারণার পেছনে এর কিছুটা প্রভাব থাকতে পারে। (Guthrie, 1962)
হেরাক্লিটাস (Heraclitus, আনুমানিক ৫৩৫-৪৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও পারমেনাইডিস (Parmenides, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতক): পরিবর্তন ও স্থায়িত্বের দ্বৈরথ: এই দুই বিপরীতধর্মী দার্শনিকের চিন্তাও প্লেটোর দর্শনকে প্রভাবিত করেছিল।
- হেরাক্লিটাস: তাঁর বিখ্যাত উক্তি “সবকিছুই পরিবর্তনশীল” (Panta rhei – everything flows) এবং “একই নদীতে দুবার পা দেওয়া যায় না।” তিনি মনে করতেন, এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ (Sensible World) সতত পরিবর্তনশীল ও অস্থির। প্লেটো এই জগতের পরিবর্তনশীলতার ধারণা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মতে, এই জগৎ প্রকৃত জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না, কারণ যা নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তার সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা অসম্ভব।
- পারমেনাইডিস: হেরাক্লিটাসের বিপরীতে পারমেনাইডিস মনে করতেন, প্রকৃত সত্তা (Being) হলো এক, শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় ও পূর্ণ। পরিবর্তন ও বহুত্ব হলো ভ্রম (Illusion)। প্লেটো পারমেনাইডিসের এই অপরিবর্তনীয় সত্তার ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর “ফর্মের তত্ত্ব” (Theory of Forms/Ideas) তৈরি করেন। ফর্মগুলো হলো শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়, নিখুঁত সত্তা, যা কেবল প্রজ্ঞার দ্বারা জানা যায়। এই ফর্মের জগৎই হলো প্রকৃত জ্ঞানের জগৎ। (Kirk, Raven & Schofield, 1983)
এভাবে প্লেটো হেরাক্লিটাসের পরিবর্তনশীল জগৎ এবং পারমেনাইডিসের অপরিবর্তনীয় সত্তার মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর দ্বৈত জগৎ তত্ত্বে (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ও বুদ্ধিগ্রাহ্য ফর্মের জগৎ)।
সোফিস্টগণ (Sophists, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক): বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিপক্ষ: সোফিস্টরা ছিলেন একদল ভ্রমণকারী শিক্ষক, যারা অর্থের বিনিময়ে অলঙ্কারশাস্ত্র (Rhetoric), তর্কবিদ্যা ও রাজনৈতিক সাফল্যের কৌশল শেখাতেন। প্লেটো তাঁর সংলাপগুলোতে সোফিস্টদের কঠোর সমালোচনা করেছেন, তবে তাঁদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়েই তাঁর নিজস্ব দার্শনিক অবস্থান আরও সুস্পষ্ট হয়েছে।
- আপেক্ষিকতাবাদ (Relativism): প্রোটাগোরাসের (Protagoras) মতো সোফিস্টরা বলতেন, “মানুষই সবকিছুর পরিমাপক” (Man is the measure of all things)। অর্থাৎ, কোনো শাশ্বত সত্য বা নৈতিকতা নেই, সবকিছুই ব্যক্তি বা সমাজের সাপেক্ষে আপেক্ষিক। প্লেটো এই আপেক্ষিকতাবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় ফর্মের মাধ্যমে জ্ঞান ও নৈতিকতার একটি নৈর্ব্যক্তিক (Objective) ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
- শক্তিই ন্যায় (Might is Right): থ্রাসিমেকাসের (Thrasymachus) মতো সোফিস্টরা “রিপাবলিক”-এ দাবি করেছিলেন যে, ন্যায় হলো শক্তিমানের স্বার্থ। প্লেটো এই ধারণাকে খণ্ডন করে ন্যায়ের এক গভীরতর, আত্মিক সংজ্ঞা দিয়েছেন।
সোফিস্টদের বিতর্কমূলক যুক্তির মোকাবিলা করতে গিয়েই প্লেটো তাঁর দার্শনিক পদ্ধতিকে আরও শাণিত করেছিলেন এবং নৈতিকতা ও জ্ঞানের একটি সুদৃঢ় ভিত্তি খুঁজেছিলেন, যা তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় প্রতিফলিত হয়েছে। (Kerferd, 1981)
অন্যান্য প্রভাব: এছাড়াও, অ্যানাক্সাগোরাসের (Anaxagoras) “Nous” (মন বা বুদ্ধি) যা জগৎকে শৃঙ্খলা দেয়, কিংবা এম্পেডোক্লিসের (Empedocles) চারটি মৌলিক উপাদান (মাটি, জল, বায়ু, আগুন) এবং আকর্ষণ-বিকর্ষণের ধারণা – এই সমস্ত পূর্ববর্তী চিন্তাভাবনা প্লেটোর দার্শনিক পরিমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করেছিল। এমনকি গ্রিক ট্র্যাজেডি (Greek Tragedy), হোমারের মহাকাব্য (Homeric Epics) এবং লোকশ্রুত পুরাণকাহিনীগুলোও (Mythology) প্লেটোর লেখায় বারবার ফিরে এসেছে, কখনও সমর্থিত হয়েছে, কখনও সমালোচিত হয়েছে।
সমন্বয়: এই প্রভাবগুলো কীভাবে প্লেটোর ভাবনাকে রূপ দিয়েছে
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা কোনো আকস্মিক উদ্ভাবন ছিল না। এটি ছিল তাঁর সময়কার রাজনৈতিক সংকট এবং পূর্ববর্তী দার্শনিক চিন্তাধারার সঙ্গে তাঁর নিজস্ব প্রতিভার এক জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফসল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, স্বৈরাচার এবং গণতন্ত্রের ব্যর্থতা তাঁকে এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিল যা হবে স্থিতিশীল ও সুশৃঙ্খল। সক্রেটিসের “সদ্গুণই জ্ঞান” এবং সোফিস্টদের আপেক্ষিকতাবাদের বিরোধিতা তাঁকে দার্শনিক রাজার ধারণার দিকে নিয়ে যায়, যেখানে প্রজ্ঞাবানরাই শাসন করবেন। পিথাগোরীয়দের সমন্বয় ও গণিতের ধারণা এবং পারমেনাইডিসের অপরিবর্তনীয় সত্তার তত্ত্ব তাঁকে ফর্মের জগতের ওপর ভিত্তি করে এক আদর্শ রাষ্ট্রকাঠামো গড়তে অনুপ্রাণিত করে। হেরাক্লিটাসের পরিবর্তনশীলতার ধারণা তাঁকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের অসম্পূর্ণতা এবং মতামতের (Doxa) অনিশ্চয়তা সম্পর্কে সচেতন করে। সক্রেটিসের আত্মার যত্ন এবং পিথাগোরীয়দের আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা প্লেটোর রাষ্ট্রে শিক্ষা ও নৈতিকতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে ভূমিকা রাখে।
প্লেটো যেন একজন দক্ষ মণিকারের মতো তাঁর পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং দার্শনিক ভাবনাগুলোকে সংগ্রহ করে, নিজের প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় এক নতুন ও অভূতপূর্ব রাষ্ট্রদর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র হয়তো কাল্পনিক, কিন্তু সেই কল্পনার পেছনে ছিল বাস্তব পৃথিবীর ক্ষত, সক্রেটিসের মতো গুরুর আত্মত্যাগ এবং হেরাক্লিটাস থেকে পিথাগোরাস পর্যন্ত বহু দার্শনিকের যুগান্তকারী চিন্তার অনুরণন। এই সমস্ত উপাদানের মিশ্রণেই প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা হয়ে উঠেছে এমন এক সৃষ্টি, যা আড়াই হাজার বছর পরেও আমাদের ভাবায়, অনুপ্রাণিত করে এবং কখনও কখনও বিতর্কিতও করে তোলে। অনেকটা পুরোনো দিনের সেইসব ভূতের গল্পের মতো, যা শুনলে গা ছমছম করে, কিন্তু বারবার শুনতে ইচ্ছে করে! প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তাও তেমনই, জটিল কিন্তু আকর্ষণীয়, আর তার শেকড় লুকিয়ে আছে এক অশান্ত সময় আর অনেক জ্ঞানী মানুষের ভাবনার গভীরে।
“রিপাবলিক”: প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার আধার
প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ এবং প্রভাবশালী বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ রচনা “রিপাবলিক”-এ। এই গ্রন্থটি কেবল রাষ্ট্রদর্শন নয়, বরং নীতিশাস্ত্র (Ethics), জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology), অধিবিদ্যা (Metaphysics), শিক্ষাদর্শন (Philosophy of Education) এবং শিল্পকলার দর্শন (Philosophy of Art) নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছে। বইটির গ্রিক শিরোনাম “পলিটেয়া” (Politeia), যার অর্থ হতে পারে সংবিধান বা রাষ্ট্রব্যব ব্যবস্থা। এটি সক্রেটিস এবং তাঁর কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে দীর্ঘ সংলাপের আকারে লেখা, যেখানে মূল প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে: “ন্যায় কী?” (What is Justice? – Ti esti dikaiosyne?) এবং “ন্যায্য জীবনযাপন কি অন্যায় জীবনযাপনের চেয়ে শ্রেয় ও সুখকর?”
“রিপাবলিক” লেখার পেছনে প্লেটোর একাধিক উদ্দেশ্য ছিল। একদিকে তিনি সক্রেটিসের স্মৃতিকে অমর করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল, তার দার্শনিক প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, তিনি এথেন্সের তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা দিতে চেয়েছিলেন, যা হবে ন্যায় ও প্রজ্ঞার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ন্যায়ের ধারণা (Concept of Justice – Dikaiosyne)
“রিপাবলিক”-এর প্রথম দিকে প্লেটো ন্যায়ের প্রচলিত কিছু ধারণাকে খণ্ডন করেন। যেমন:
- সেফালাসের (Cephalus) সংজ্ঞা: ন্যায় হলো সত্য কথা বলা এবং ঋণ পরিশোধ করা। সক্রেটিস দেখান যে, কিছু পরিস্থিতিতে (যেমন, উন্মাদ বন্ধুর কাছে অস্ত্র ফেরত দেওয়া) এটি অন্যায় হতে পারে।
- পলিমারকাসের (Polemarchus) সংজ্ঞা: ন্যায় হলো বন্ধুদের উপকার করা এবং শত্রুদের ক্ষতি করা। সক্রেটিস প্রশ্ন তোলেন, কে প্রকৃত বন্ধু আর কে প্রকৃত শত্রু, তা নির্ধারণ করা কঠিন। তাছাড়া, কারও ক্ষতি করা কি আদৌ ন্যায়ের কাজ হতে পারে?
- থ্রাসিমেকাসের (Thrasymachus) সংজ্ঞা: ন্যায় হলো শক্তিমানের স্বার্থ (Justice is the interest of the stronger)। থ্রাসিমেকাস নামে এক সোফিস্ট এই তার্কিক সংজ্ঞা দেন। সক্রেটিস দীর্ঘ যুক্তির মাধ্যমে দেখান যে, শাসকের প্রকৃত স্বার্থ হলো প্রজাদের কল্যাণ করা, যেমন রাখালের স্বার্থ হলো পালের যত্ন নেওয়া। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book I)
এই প্রচলিত সংজ্ঞাগুলো খণ্ডন করার পর প্লেটো ন্যায়ের একটি গভীরতর অনুসন্ধানে ব্রতী হন। তিনি বলেন, ন্যায়কে বুঝতে হলে প্রথমে বৃহত্তর পরিসরে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের মধ্যে তাকে খুঁজতে হবে, তারপর সেই জ্ঞান ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সহজ হবে। এই যুক্তির ভিত্তিতেই তিনি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের আলোচনায় প্রবেশ করেন।
প্লেটোর মতে, ন্যায় কোনো বাহ্যিক আচরণ বা আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, বরং এটি আত্মার একটি অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং সামাজিক ভারসাম্য।
ব্যক্তিগত ন্যায় (Individual Justice): প্লেটো মানুষের আত্মাকে (Soul – Psyche) তিনটি অংশে বিভক্ত করেছেন:
- প্রজ্ঞা বা যুক্তি (Reason/Logos – τὸ λογιστικόν): এটি আত্মার সর্বোচ্চ অংশ, যা জ্ঞান, সত্য ও শৃঙ্খলা ভালোবাসে। এর কাজ হলো বিচার-বিবেচনা করা এবং সঠিক পথ নির্দেশ করা।
- সাহস বা আকাঙ্ক্ষা (Spirit/Thymos – τὸ θυμοειδές): এটি সম্মান, জয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ক্রোধের উৎস। এটি যুক্তির সহজাত মিত্র এবং কামনাকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- ক্ষুধা বা কামনা (Appetite/Eros – τὸ ἐπιθυμητικόν): এটি শারীরিক চাহিদা (খাদ্য, পানীয়, যৌনতা) এবং জাগতিক বাসনার কেন্দ্র। এটি আত্মার বৃহত্তম অংশ এবং যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
ব্যক্তিজীবনে ন্যায় তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন আত্মার এই তিনটি অংশ নিজ নিজ স্বাভাবিক কাজ সঠিকভাবে করে এবং প্রজ্ঞার দ্বারা অন্য দুটি অংশ (সাহস ও কামনা) সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ, প্রজ্ঞা শাসন করবে, সাহস তাকে সমর্থন ও রক্ষা করবে, এবং কামনা সংযত থাকবে। এই অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যই হলো ব্যক্তিগত ন্যায়। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book IV)
রাষ্ট্রীয় ন্যায় (Social/Political Justice): রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্লেটো একই রকম ত্রিস্তরীয় কাঠামোর কথা বলেছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রে স্বাভাবিকভাবেই তিনটি প্রধান শ্রেণি বা কার্যগত গোষ্ঠী (Functional Classes) তৈরি হবে, যা নাগরিকদের স্বাভাবিক প্রবণতা ও যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে:
- শাসক শ্রেণি বা দার্শনিক রাজা (Rulers/Philosopher Kings – Άρχοντες): যাদের প্রধান গুণ হলো প্রজ্ঞা (Wisdom – Sophia)। তারা সংখ্যায় হবেন সবচেয়ে কম এবং তাদের কাজ হবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা, আইন প্রণয়ন করা এবং রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা।
- সহায়ক বা সৈনিক শ্রেণি (Auxiliaries/Warriors – Ἐπίκουροι): যাদের প্রধান গুণ হলো সাহস (Courage – Andreia)। তারা শাসক শ্রেণির নির্দেশ মেনে রাষ্ট্রকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করবেন।
- উৎপাদক শ্রেণি (Producers/Artisans – Δημιουργοί): এই শ্রেণিতে থাকবেন কৃষক, কারিগর, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ, যারা রাষ্ট্রের বৈষয়িক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি) পূরণ করবেন। তাদের মধ্যে কামনার (Appetite) দিকটি প্রধান হলেও, তা সংযমের (Temperance/Moderation – Sophrosyne) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে।
রাষ্ট্রীয় ন্যায় তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন এই তিনটি শ্রেণি নিজ নিজ নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এবং কেউ অপরের কাজে হস্তক্ষেপ না করে (Principle of Specialization – οἰκείοπραγία)। উৎপাদক শ্রেণি যদি শাসন করতে চায়, বা সৈনিক শ্রেণি যদি অর্থ উপার্জনে মত্ত হয়, তাহলেই রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও অন্যায় দেখা দেবে। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book IV) অনেকটা আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মতো – প্রতিটি অঙ্গ যদি তার নিজের কাজ ঠিকমতো করে, তাহলেই শরীর সুস্থ থাকে। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তাই। ন্যায় হলো এই সামাজিক সমন্বয় (Harmony) এবং প্রত্যেকের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের সদ্গুণ।
আদর্শ রাষ্ট্র (The Ideal State – Kallipolis)
প্লেটোর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের নাম ছিল ক্যালিপলিস (Kallipolis), যার গ্রিক অর্থ “সুন্দর শহর” বা “উত্তম নগরী”। এই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হলো উপরে আলোচিত ন্যায় এবং শ্রমবিভাগের নীতি।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি (Origin of the State): প্লেটোর মতে, কোনো মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রত্যেকে তার বিভিন্ন চাহিদা মেটানোর জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ একত্রিত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book II) রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ হলো নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান) পূরণ করা। এর জন্য বিভিন্ন পেশার মানুষের প্রয়োজন হয়, যা শ্রমবিভাগের জন্ম দেয়। প্রত্যেকে যদি তার স্বাভাবিক প্রবণতা ও দক্ষতা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট কাজ করে, তাহলে উৎপাদন বেশি হবে এবং কাজের মানও ভালো হবে।
দার্শনিক রাজা (Philosopher King – Basileus Philosophos): প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার সবচেয়ে মৌলিক, বৈপ্লবিক এবং একই সঙ্গে বিতর্কিত ধারণা হলো দার্শনিক রাজার শাসন। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন: “যতদিন পর্যন্ত দার্শনিকরা রাজা না হবেন, অথবা এই পৃথিবীর রাজা ও রাজপুত্ররা দর্শনের স্পৃহা ও ক্ষমতা লাভ না করবেন… ততদিন পর্যন্ত রাষ্ট্র বা মানবজাতি এই অশুভ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে না।” (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book V, 473d)
- দার্শনিকের যোগ্যতা: কেন দার্শনিকরাই শাসনের জন্য সবচেয়ে যোগ্য? কারণ, প্লেটোর মতে, একমাত্র দার্শনিকরাই প্রকৃত জ্ঞান (Episteme) অর্জন করতে সক্ষম। তারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের পরিবর্তনশীল মতামতের (Doxa) ঊর্ধ্বে উঠে শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় ফর্ম বা আইডিয়ার জগৎকে (Intelligible World) উপলব্ধি করতে পারেন। বিশেষ করে, তাঁরা “কল্যাণের ফর্ম” (Form of the Good) সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন, যা সকল জ্ঞান ও নৈতিকতার উৎস। এই জ্ঞান থাকার কারণেই তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে, আবেগের বশবর্তী না হয়ে, যুক্তির আলোকে রাষ্ট্রের কল্যাণ করতে পারবেন। তাঁরা সত্যকে ভালোবাসেন, অর্থের প্রতি তাঁদের লোভ নেই, তাঁরা সাহসী, সংযমী এবং তাঁদের স্মৃতিশক্তি প্রখর।
- দার্শনিক রাজার অনীহা: প্লেটো এটাও জানতেন যে, প্রকৃত দার্শনিকরা সাধারণত ক্ষমতার প্রতি আগ্রহী হন না। তাঁরা জ্ঞানচর্চা ও ধ্যানের জগতেই থাকতে ভালোবাসেন। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, অনেকটা গুহার রূপকের সেই মুক্ত মানুষটির মতো, তাঁদের বাধ্য হয়ে শাসনের দায়িত্ব নিতে হবে। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book VII)
- সমালোচনা ও প্লেটোর উত্তর: অনেকে বলতে পারেন, দার্শনিকরা তো বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, তাঁরা কীভাবে রাষ্ট্র চালাবেন? প্লেটোর উত্তর হলো, দীর্ঘ ও যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতাও অর্জন করতে হবে। তাছাড়া, যিনি সর্বোচ্চ সত্য জানেন, তিনিই তো সবচেয়ে ভালোভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন, যেমন একজন অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেনই জাহাজকে নিরাপদে তীরে নিয়ে যেতে পারেন।
অভিভাবক শ্রেণি (Guardians – Phylakes): দার্শনিক রাজা এবং সৈনিক শ্রেণি – এই দুই মিলিয়ে হলো অভিভাবক শ্রেণি। এদের জীবনযাত্রা হবে কঠোর শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং রাষ্ট্রের সেবায় সম্পূর্ণরূপে নিবেদিত।
-
সম্পত্তি ও পরিবারের সাম্যবাদ (Communism of Property and Family): প্লেটো অভিভাবক শ্রেণির জন্য এক ধরনের সাম্যবাদের প্রস্তাব করেন। তাঁদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি (জমি, বাড়ি, অর্থ) থাকবে না। তাঁরা রাষ্ট্রের ব্যারাকে একসঙ্গে বসবাস করবেন, সাধারণ সৈনিকদের মতো খাবার খাবেন। তাঁদের কোনো ব্যক্তিগত পরিবারও থাকবে না। নারী-পুরুষ অভিভাবকরা একসঙ্গে থাকবেন এবং তাঁদের সন্তানরাও রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সামষ্টিকভাবে প্রতিপালিত হবে। পিতামাতা জানবে না কোনটি তাদের সন্তান, সন্তানরাও জানবে না কারা তাদের পিতামাতা। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল:
-
- ঐক্য প্রতিষ্ঠা: ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার থেকেই সাধারণত স্বার্থপরতা, বিভেদ ও দুর্নীতির জন্ম হয়। এগুলো না থাকলে অভিভাবকরা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে রাষ্ট্রের সেবা করতে পারবেন এবং তাঁদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য বজায় থাকবে।
- পক্ষপাতহীনতা: সম্পত্তি ও পরিবারের মোহ না থাকলে তাঁরা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না।
- নারীদের মুক্তি: নারীরা সন্তান প্রতিপালন ও গৃহস্থালির কাজ থেকে মুক্তি পেয়ে পুরুষদের মতোই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে (শাসন ও প্রতিরক্ষা) অংশগ্রহণ করতে পারবেন। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book V) এই প্রস্তাবটি প্লেটোর সময়েও অত্যন্ত বৈপ্লবিক ছিল এবং আজও এটি বহু বিতর্কের জন্ম দেয়। অ্যারিস্টটল এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।
-
শিক্ষাব্যবস্থা (Education – Paideia): প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অভিভাবক শ্রেণির সদস্যদের শৈশব থেকে শুরু করে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত এক দীর্ঘ, কঠোর ও সুপরিকল্পিত শিক্ষাক্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এই শিক্ষার লক্ষ্য হলো তাঁদের শরীর ও আত্মার সুষম বিকাশ ঘটানো এবং তাঁদের মধ্যে প্রজ্ঞা, সাহস ও সংযমের মতো গুণাবলি তৈরি করা।
-
- প্রথম পর্যায় (শৈশব থেকে কৈশোর): সঙ্গীত (Music – Mousikē, যার মধ্যে সাহিত্য, কবিতা, গান, নৃত্য অন্তর্ভুক্ত) এবং ব্যায়াম (Gymnastics – Gymnastikē)। সঙ্গীতের মাধ্যমে আত্মার কোমলতা ও শৃঙ্খলা এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের শক্তি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। তবে, হোমার ও হেসিয়ডের মতো কবিদের লেখা, যেখানে দেবতাদের অনৈতিকভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, তা পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হবে।
- দ্বিতীয় পর্যায় (কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত): গণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যা। এই বিষয়গুলো বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতা বাড়ায় এবং ফর্মের জগৎ উপলব্ধি করার জন্য মনকে প্রস্তুত করে।
- তৃতীয় পর্যায় (ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়স): দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি (Dialectic)। এটি হলো যুক্তির মাধ্যমে সত্য অনুসন্ধানের সর্বোচ্চ পদ্ধতি। এর মাধ্যমে তাঁরা ফর্মের জগৎ, বিশেষ করে ” কল্যাণের ফর্ম” সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবেন।
- চতুর্থ পর্যায় (পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স): বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তাঁদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সামরিক দায়িত্বে পাঠানো হবে।
- পঞ্চাশ বছর বয়সের পর: যারা এই সমস্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন এবং দার্শনিক প্রজ্ঞা অর্জন করবেন, তাঁরাই পালাক্রমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাসনের (দার্শনিক রাজা) দায়িত্ব পাবেন। (Nettleship, 1901; Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book II, III, VII)
-
নারীদের ভূমিকা (Role of Women): প্লেটো তাঁর সময়ের তুলনায় অত্যন্ত প্রগতিশীল চিন্তা করে বলেছিলেন যে, নারীরাও পুরুষদের মতো একই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পেলে অভিভাবক শ্রেণির সদস্য হতে পারবেন। শারীরিক শক্তি ছাড়া অন্যান্য মানসিক ও বৌদ্ধিক গুণে নারীরা পুরুষদের চেয়ে কম নন। তাই তাঁদেরও শাসন ও প্রতিরক্ষার কাজে সমান অধিকার থাকা উচিত। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book V)
ধাতুর উপকথা (Myth of the Metals – Gennaion Pseudos): প্লেটো জানতেন যে, এই কঠোর শ্রেণিবিভাজন এবং দার্শনিক রাজার শাসন সাধারণ মানুষ সহজে মেনে নেবে না। তাই তিনি একটি “অভিজাত শ্রুতিকথা” বা “মহৎ মিথ্যার” (Noble Lie/Myth) প্রস্তাব করেন। এই উপকথা অনুযায়ী, ঈশ্বর যখন মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন, তখন তাদের আত্মায় বিভিন্ন ধাতু মিশিয়ে দিয়েছিলেন:
- যাদের আত্মায় সোনা (Gold) মেশানো, তারা জন্মগতভাবেই শাসন করার যোগ্য (দার্শনিক রাজা)।
- যাদের আত্মায় রুপা (Silver) মেশানো, তারা সহায়ক বা সৈনিক হওয়ার যোগ্য।
- যাদের আত্মায় তামা (Bronze) বা লোহা (Iron) মেশানো, তারা উৎপাদক শ্রেণির (কৃষক, কারিগর) কাজ করার জন্য উপযুক্ত।
প্রত্যেককে তার ধাতুর গুণ অনুযায়ী কাজ করতে হবে এবং এতেই রাষ্ট্রের মঙ্গল। যদিও পিতামাতার ধাতু অনুযায়ী সন্তানের ধাতু নির্ধারিত হওয়ার প্রবণতা থাকবে, তবে ব্যতিক্রমও ঘটতে পারে। যদি কোনো সোনার পিতামাতার সন্তান তামা বা লোহা নিয়ে জন্মায়, তাকে উৎপাদক শ্রেণিতে পাঠিয়ে দিতে হবে; আবার, যদি কোনো তামার পিতামাতার সন্তান সোনা নিয়ে জন্মায়, তাকে শাসক শ্রেণিতে উন্নীত করতে হবে। এই মিথ্যার উদ্দেশ্য ছিল সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, প্রত্যেককে তার অবস্থানে সন্তুষ্ট রাখা এবং রাষ্ট্রের ঐক্যের প্রতি আনুগত্য তৈরি করা। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book III, 414c-415d) এই “মহৎ মিথ্যা”র ধারণাটি নৈতিকভাবে বিতর্কিত, কারণ এটি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তবে প্লেটোর যুক্তি ছিল, রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য এই ধরনের পৌরাণিক কাহিনি প্রয়োজন।
শিল্প ও সাহিত্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ (Censorship of Arts): প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রে শিল্প ও সাহিত্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। তিনি মনে করতেন, অনেক প্রচলিত শিল্প-সাহিত্য, বিশেষ করে হোমার ও হেসিয়ডের মহাকাব্য এবং সমসাময়িক নাটকগুলো, মানুষের মনে, বিশেষত তরুণদের মনে, বিরূপ প্রভাব ফেলে।
- অনুকরণ তত্ত্ব (Theory of Imitation – Mimesis): প্লেটোর মতে, শিল্পকলা হলো অনুকরণের অনুকরণ, অর্থাৎ সত্য থেকে তিন ধাপ দূরে। প্রকৃত সত্য হলো ফর্ম (যেমন, খাটের ফর্ম), যা ঈশ্বর তৈরি করেন। কাঠমিস্ত্রি সেই ফর্মকে অনুকরণ করে একটি বাস্তব খাট তৈরি করে (দ্বিতীয় ধাপ)। আর শিল্পী সেই বাস্তব খাটকে অনুকরণ করে তার ছবি আঁকে (তৃতীয় ধাপ)। তাই শিল্পকলা আমাদের সত্য থেকে দূরে সরিয়ে মিথ্যার জগতে নিয়ে যায়। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book X)
- নৈতিক প্রভাব: কবিরা প্রায়শই দেবতাদের অনৈতিক, হিংসাপূর্ণ ও দুর্বল হিসেবে চিত্রিত করেন, যা তরুণদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি করে। নাটকগুলো মানুষের আবেগ (শোক, ভয়, হাস্যরস) উদ্দীপ্ত করে, যা আত্মার যৌক্তিক অংশকে দুর্বল করে দেয়।
- রাষ্ট্রের ভূমিকা: তাই আদর্শ রাষ্ট্রে শুধুমাত্র সেইসব শিল্প ও সঙ্গীতকেই উৎসাহিত করা হবে, যা সদ্গুণ, সাহস, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। যে কবিরা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর লেখা লিখবেন, তাদের নির্বাসিত করা হবে। (Annas, 1981) প্লেটোর এই দৃষ্টিভঙ্গি সৃজনশীল স্বাধীনতা ও শিল্পকলার স্বতন্ত্রতার (autonomy) পরিপন্থী বলে অনেকেই সমালোচনা করেছেন।
গুহার রূপক (Allegory of the Cave)
“রিপাবলিক”-এর সপ্তম বইয়ের শুরুতে প্লেটো তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) এবং দার্শনিক রাজার অপরিহার্যতা বোঝানোর জন্য একটি অসাধারণ রূপক কাহিনি বর্ণনা করেছেন, যা “গুহার রূপক” (Allegory of the Cave) নামে বিশ্ববিখ্যাত।
কাহিনিটা অনেকটা এরকম: কল্পনা করুন, কিছু মানুষ আজন্ম এক অন্ধকার গুহার ভেতরে শিকল দিয়ে এমনভাবে বাঁধা যে, তারা কেবল তাদের সামনের দেয়ালের দিকেই তাকাতে পারে, মাথা ঘোরাতে পারে না। তাদের পেছনে, গুহার মুখের কাছে, একটি উঁচু জায়গায় আগুন জ্বলছে। সেই আগুন ও বন্দিদের মাঝখান দিয়ে একটি পথ রয়েছে, যেখান দিয়ে কিছু লোক বিভিন্ন ধরনের মূর্তি ও জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর তারা এমনভাবে কথা বলছে বা শব্দ করছে যে, বন্দিরা মনে করছে শব্দগুলো ছায়া থেকেই আসছে। বন্দিরা দেয়ালের ওপর সেই মূর্তি ও জিনিসপত্রের ছায়াগুলোই কেবল দেখতে পায় এবং সেগুলোকেই তারা আসল বস্তু বলে মনে করে। তাদের কাছে এই ছায়ার জগৎই হলো একমাত্র বাস্তবতা।
এবার কল্পনা করুন, যদি কোনো একজন বন্দিকে হঠাৎ মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং তাকে জোর করে গুহার বাইরে, দিনের আলোয় নিয়ে আসা হয়। প্রথমে সে সূর্যের তীব্র আলোয় কিছুই দেখতে পাবে না, তার চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে তার চোখ সইয়ে গেলে সে প্রথমে ছায়া, তারপর পানিতে প্রতিবিম্ব, তারপর আসল মানুষ ও অন্যান্য বস্তু এবং সবশেষে রাতের আকাশের তারা ও চাঁদ এবং দিনের বেলায় সূর্যকে দেখতে পাবে। তখন সে বুঝতে পারবে যে, গুহার ভেতরে সে যা দেখত, তা ছিল নিছকই ছায়া, আসল সত্য নয়। এই সূর্যই হলো ” কল্যাণের ফর্ম” (Form of the Good), যা সকল জ্ঞান ও অস্তিত্বের উৎস।
এই মুক্ত মানুষটিই হলো দার্শনিক, যিনি অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত জ্ঞান (Forms) লাভ করেছেন। প্লেটোর মতে, এই দার্শনিকের দায়িত্ব হলো আবার সেই অন্ধকার গুহায় ফিরে যাওয়া, তার পুরোনো সঙ্গীদের কাছে সত্যের কথা বলা এবং তাদেরও অজ্ঞতার শিকল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা। কিন্তু গুহার অন্য বন্দিরা তার কথা বিশ্বাস করবে না, তাকে পাগল ভাববে, এমনকি তাকে উপহাস করবে বা মেরেও ফেলতে পারে (যেমনটা সক্রেটিসের ক্ষেত্রে হয়েছিল)। কারণ, তারা সেই ছায়ার জগতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
এই রূপকের মাধ্যমে প্লেটো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন:
- অজ্ঞতার স্বরূপ: সাধারণ মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের মতামত ও ভ্রম (illusion) নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, যা গুহার ছায়ার মতো।
- জ্ঞানার্জনের কঠিন পথ: প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা একটি কষ্টসাধ্য ও বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া, যা প্রচলিত বিশ্বাস ও অভ্যাসকে চ্যালেঞ্জ করে।
- দর্শনের ভূমিকা: দর্শনই মানুষকে অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের আলোয় নিয়ে যেতে পারে।
- দার্শনিকের সামাজিক দায়িত্ব: দার্শনিকের দায়িত্ব শুধু নিজের মুক্তি নয়, বরং সমাজকে আলোকিত করা এবং অন্যদেরও সত্যের পথে পরিচালিত করা, যদিও কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
- শিক্ষার প্রকৃত অর্থ: শিক্ষা হলো আত্মার মোড় ঘোরানো (turning of the soul) – অন্ধকারের দিক থেকে আলোর দিকে, অর্থাৎ ফর্মের জগতের দিকে। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book VII, 514a-521b)
আদর্শ রাষ্ট্রের অবক্ষয় (Decline of the Ideal State)
প্লেটো শুধু আদর্শ রাষ্ট্রের (অভিজাততন্ত্র – Aristocracy, যেখানে জ্ঞানীরা শাসন করেন) রূপরেখাই দেননি, সেই রাষ্ট্র কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবক্ষয়ের শিকার হয়ে বিভিন্ন নিকৃষ্ট ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় (Imperfect Constitutions) পরিণত হতে পারে, তারও একটি মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ দিয়েছেন “রিপাবলিক”-এর অষ্টম ও নবম বইতে। তিনি দেখিয়েছেন, প্রতিটি রাষ্ট্রব্যবস্থার অবক্ষয় তার পরবর্তী, আরও নিকৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দেয়। এই ক্রমবিবর্তন অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ধরনের মানুষের চরিত্রের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
অভিজাততন্ত্র বা আদর্শ রাষ্ট্র (Aristocracy/Ideal State): এটি সর্বোত্তম ব্যবস্থা, যেখানে প্রজ্ঞা ও ন্যায় প্রধান। শাসকরা হলেন দার্শনিক, যারা রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য নিবেদিত।
-
অবক্ষয়ের সূচনা: অভিভাবক শ্রেণির সদস্যরা যদি প্রজননের সঠিক নিয়ম (Nuptial Number – একটি জটিল গাণিতিক ফর্মুলা, যা প্লেটো রহস্যময়ভাবে উল্লেখ করেছেন) মেনে চলতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মে কম যোগ্যতাসম্পন্ন সন্তানের জন্ম হবে। তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রজ্ঞার চেয়ে সম্মান ও খ্যাতির প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
টিমোক্রেসি বা সম্মানতন্ত্র (Timocracy – Τιμοκρατία): (স্পার্টার মডেলের কাছাকাছি)
-
বৈশিষ্ট্য: এই ব্যবস্থায় শাসকরা প্রজ্ঞার চেয়ে সামরিক সম্মান, খ্যাতি ও জয়ের পেছনে ছোটেন। রাষ্ট্রে সাহস ও সামরিক শৃঙ্খলা প্রধান হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির আকাঙ্ক্ষা জন্মাতে শুরু করে, তবে তা গোপনে।
-
টিমোক্রেটিক মানুষ: উচ্চাকাঙ্ক্ষী, গর্বিত, কিছুটা রুক্ষ, সঙ্গীতের চেয়ে ব্যায়াম বেশি পছন্দ করে, তবে অর্থের প্রতিও কিছুটা লোভ থাকে।
-
অবক্ষয়: সম্মানের পাশাপাশি যখন অর্থের লোভ বাড়তে থাকে, তখন টিমোক্রেসি অলিগার্কিতে পরিণত হয়।
অলিগার্কি বা ধনিকতন্ত্র (Oligarchy – Ὀλιγαρχία):
-
বৈশিষ্ট্য: এই ব্যবস্থায় ধনীরাই রাষ্ট্র শাসন করে। অর্থই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও যোগ্যতার প্রধান মাপকাঠি। সমাজে ধনী ও দরিদ্র – এই দুই শ্রেণিতে তীব্র বিভাজন দেখা দেয়। রাষ্ট্র তার ঐক্য হারায়।
-
অলিগার্কিক মানুষ: কৃপণ, অর্থলোভী, পরিশ্রমী (অর্থ উপার্জনের জন্য), কিন্তু তার কামনাগুলো সংযত থাকে শুধু লোকলজ্জা বা সম্পদ হারানোর ভয়ে।
-
অবক্ষয়: ধনীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দরিদ্ররা বিদ্রোহ করে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।
ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্র (Democracy – Δημοκρατία):
-
বৈশিষ্ট্য: অলিগার্কির বিরুদ্ধে দরিদ্রদের বিদ্রোহের ফলে গণতন্ত্রের জন্ম হয়। এখানে সবাই সমান স্বাধীনতা ও অধিকার (বিশেষ করে, যা খুশি তাই করার অধিকার – ἐλευθερία) পায়। বিভিন্ন ধরনের জীবনযাত্রা ও মতামতের সহাবস্থান দেখা যায়। পদাধিকারীরা অনেক সময় লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত হন।
-
গণতান্ত্রিক মানুষ: বহুমুখী, পরিবর্তনশীল, কোনো একটি বিশেষ গুণের প্রতি অনুরক্ত নয়, বরং সব ধরনের কামনা ও ইচ্ছাকেই সমান গুরুত্ব দেয়। তার জীবনে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না।
-
প্লেটোর সমালোচনা: প্লেটো এথেন্সের তৎকালীন প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বাড়াবাড়ি দেখে এর কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি মনে করতেন, গণতন্ত্রে অজ্ঞ ও অযোগ্য লোকেরাও শাসনের সুযোগ পেয়ে যায়, কারণ সেখানে যোগ্যতার কোনো বিচার থাকে না। এই অবাধ স্বাধীনতা উচ্ছৃঙ্খলতা ও নৈরাজ্যের জন্ম দেয়। প্রত্যেকে নিজের খুশিমতো চলে, কোনো নিয়মকানুন মানে না। প্লেটোর কাছে গণতন্ত্র ছিল একটি আকর্ষণীয় কিন্তু অসংগঠিত ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা। (Sabine, 1973)
-
অবক্ষয়: গণতন্ত্রের চরম উচ্ছৃঙ্খলতা ও স্বাধীনতার অপব্যবহার থেকে জন্ম নেয় স্বৈরতন্ত্রের চাহিদা। জনগণ একজন শক্তিশালী নেতার সন্ধান করে যে এই বিশৃঙ্খলা দূর করতে পারবে।
টির্যানি বা স্বৈরতন্ত্র (Tyranny – Τυραννίς):
-
বৈশিষ্ট্য: এটি হলো প্লেটোর চোখে নিকৃষ্টতম ও সবচেয়ে অন্যায়পূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা। একজন শক্তিশালী ও ধূর্ত নেতা (Tyrant) জনগণের রক্ষাকর্তা (Champion of the people) হিসেবে আবির্ভূত হন, তাদের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেন, ধনীদের সম্পত্তি কেড়ে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেন এবং ধীরে ধীরে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য দেহরক্ষী রাখেন, বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করেন এবং প্রজাদের ওপর চরম অত্যাচার চালান। রাষ্ট্রে ভয়, সন্দেহ ও অবিচার বিরাজ করে।
-
স্বৈরাচারী (Tyrannical) মানুষ: তার আত্মার কামনা অংশটি সম্পূর্ণ লাগামহীন হয়ে যায়। সে তার সকল ইচ্ছা পূরণের জন্য যেকোনো অন্যায় করতে প্রস্তুত। সে সন্দেহবাতিক, বন্ধুহীন এবং প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে অসুখী মানুষ, কারণ সে তার নিজের কামনার দাস। (Plato, trans. Grube & Reeve, 1992, Republic, Book VIII-IX)
প্লেটোর এই ক্রমবিবর্তন তত্ত্ব অনেকটা চক্রাকার। স্বৈরাচারের চরম অত্যাচারের পর হয়তো আবার মানুষ ন্যায়ের সন্ধান করবে এবং আদর্শ রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। এই বিশ্লেষণ কেবল রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনই নয়, বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং নৈতিক অবক্ষয়েরও একটি গভীর চিত্র তুলে ধরে।
“রিপাবলিক”-এর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: আলোচনার পরিধি সীমিত হলেও, “রিপাবলিক”-এর আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ না করলেই নয়:
- আত্মার অমরত্ব (Immortality of the Soul): বইটির দশম অধ্যায়ে প্লেটো আত্মার অমরত্বের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়েছেন এবং মৃত্যুর পর আত্মার পরিণতি কী হয়, তা “মিথ অফ এর” (Myth of Er) নামক এক রূপক কাহিনির মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। এই কাহিনিতে এর নামে এক সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গিয়ে পরলোকে যায় এবং বারো দিন পর ফিরে এসে সেখানকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। সেখানে দেখানো হয়েছে, কীভাবে আত্মারা তাদের পূর্বজীবনের কাজের ফল ভোগ করে এবং নতুন জীবন বেছে নেয়। এর মাধ্যমে প্লেটো নৈতিক দায়িত্ব ও পরকালের ধারণাকে যুক্ত করেছেন।
- সুখ (Eudaimonia): “রিপাবলিক”-এর মূল প্রশ্ন ছিল, ন্যায্য জীবন কি অন্যায্য জীবনের চেয়ে শ্রেয় ও সুখকর? প্লেটো বিস্তারিত যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, হ্যাঁ, ন্যায্য জীবনই প্রকৃত সুখের উৎস। কারণ, ন্যায় হলো আত্মার স্বাস্থ্য ও শৃঙ্খলা। একজন ন্যায্য মানুষ (যার আত্মা প্রজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত) মানসিকভাবে সুস্থ, সুশৃঙ্খল ও সুখী, ঠিক যেমন একটি সুস্থ শরীর আরামদায়ক। অন্যদিকে, অন্যায্য মানুষ (যার আত্মা কামনা দ্বারা বিপর্যস্ত) মানসিকভাবে অসুস্থ ও অসুখী, যতই তার পার্থিব সম্পদ থাকুক না কেন। দার্শনিকই হলেন সবচেয়ে সুখী মানুষ, কারণ তিনি সর্বোচ্চ জ্ঞান ও ন্যায়ের অধিকারী।
“দ্য লজ” (The Laws – Nomoi): প্লেটোর পরিণত রাষ্ট্রচিন্তা
“রিপাবলিক” লেখার অনেক বছর পর, জীবনের প্রায় শেষ দিকে (সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০-এর দশকে), প্লেটো “দ্য লজ” (The Laws) নামে একটি বিশাল গ্রন্থ রচনা করেন। এটি তাঁর দীর্ঘতম সংলাপ এবং একমাত্র সংলাপ যেখানে সক্রেটিস অনুপস্থিত। প্রধান বক্তা এখানে একজন “এথেনীয় আগন্তুক” (Athenian Stranger), যাকে অনেকেই প্লেটোর নিজের প্রতিচ্ছবি বলে মনে করেন। এই বইতে প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও পরিমার্জন লক্ষ্য করা যায়। তিনি সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যে, “রিপাবলিক”-এ বর্ণিত আদর্শ রাষ্ট্র (ক্যালিপলিস), যেখানে দার্শনিক রাজা শাসন করবেন এবং অভিভাবকদের মধ্যে সম্পত্তি ও পরিবারের সাম্যবাদ থাকবে, তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব। সাইরাকিউজে (সিসিলির একটি গ্রিক উপনিবেশ) সেখানকার শাসক ডায়োনিসিয়াস দ্য ইয়ংগারকে (Dionysius the Younger) দার্শনিক শাসকে পরিণত করার তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, যা তাঁকে আরও বাস্তববাদী করে তুলেছিল।
তাই “দ্য লজ”-এ তিনি একটি “দ্বিতীয় সেরা রাষ্ট্র” (Second-best State) এর রূপরেখা দেন, যা সম্পূর্ণ আদর্শ না হলেও, মানুষের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়ে অধিকতর বাস্তবসম্মত ও প্রয়োগযোগ্য। এই রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে আইনের শাসন (Rule of Law), দার্শনিক রাজার ব্যক্তিগত প্রজ্ঞা নয়। (Klosko, 2006)
- আইনের সর্বোচ্চ প্রাধান্য (Supremacy of Law): “দ্য লজ”-এর মূল কথা হলো, রাষ্ট্র পরিচালিত হবে সুচিন্তিত ও বিস্তারিত আইনের দ্বারা। শাসকরাও এই আইনের অধীন থাকবেন, তাঁরা আইনের সেবক (Servants of the Law) মাত্র। প্লেটো এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন: “যেখানে আইন শাসকদের অধীন এবং তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই, সেই রাষ্ট্রের পতন আসন্ন; কিন্তু যেখানে আইন শাসকদের প্রভু এবং শাসকরা আইনের দাস, সেখানে পরিত্রাণ এবং দেবতারা রাষ্ট্রের ওপর যা কিছু ভালো বর্ষণ করেন, তার সবকিছুই পাওয়া যায়।” (Plato, trans. Taylor, 1960, Laws, 715d)
- মিশ্র সংবিধান (Mixed Constitution): প্লেটো এখানে রাজতন্ত্র (Monarchy – যা প্রজ্ঞার প্রতীক) এবং গণতন্ত্রের (Democracy – যা স্বাধীনতার প্রতীক) ভালো দিকগুলো সমন্বয় করে একটি মিশ্র বা ভারসাম্যপূর্ণ সংবিধানের প্রস্তাব করেন। এর ফলে চরম স্বৈরতন্ত্র বা চরম উচ্ছৃঙ্খলতা – কোনোটিই প্রশ্রয় পাবে না।
- সম্পত্তি ও পরিবার (Property and Family): “রিপাবলিক”-এর মতো কঠোর সাম্যবাদের ধারণা এখানে পরিত্যক্ত হয়েছে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি (জমি) এবং পরিবারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে, অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্পত্তির পরিমাণে ঊর্ধ্বসীমা (চারগুণ পর্যন্ত তারতম্য) এবং নিম্নসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিবাহকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং বিবাহবিচ্ছেদ ও সন্তানহীনতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
- ভূগোল, জনসংখ্যা ও অর্থনীতি: প্রস্তাবিত রাষ্ট্রটির নাম হবে ম্যাগনেসিয়া (Magnesia), যা ক্রীট দ্বীপে অবস্থিত হবে। এর নাগরিকের সংখ্যা হবে ৫০৪০ জন। এই সংখ্যাটি বেছে নেওয়ার কারণ হলো এটি ১ থেকে ১২ পর্যন্ত অনেক সংখ্যা দ্বার বিভাজ্য, যা প্রশাসনিক ও সামাজিক বিন্যাসের জন্য সুবিধাজনক। রাষ্ট্রের অর্থনীতি হবে মূলত কৃষিভিত্তিক এবং বৈদেশিক বাণিজ্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। মুদ্রা হবে অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য, বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য নয়।
- সরকারি কাঠামো ও পদাধিকারী (Government Structure and Magistrates): রাষ্ট্রের প্রশাসনে বিভিন্ন ধরনের পদাধিকারী থাকবেন, যাদের নির্বাচন ও দায়িত্ব বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, আইনরক্ষক (Law Guardians – Nomophylakes), কাউন্সিল (Council), সামরিক কর্মকর্তা এবং বিচারক। নির্বাচনের ক্ষেত্রে বয়স, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
- নকটার্নাল কাউন্সিল (Nocturnal Council – Νυκτερινὸς Σύλλογος): এটি “দ্য লজ”-এর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কিছুটা রহস্যময় প্রতিষ্ঠান। এই পরিষদটি গঠিত হবে রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রবীণ, জ্ঞানী ও সদ্গুণসম্পন্ন দশজন সদস্য, তরুণ কিছু প্রতিশ্রুতিশীল সদস্য এবং কিছু নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ নিয়ে। তারা মূলত রাতের বেলায় মিলিত হবেন (তাই এই নাম) এবং রাষ্ট্রের সংবিধান, আইনকানুন, শিক্ষা ও নৈতিকতার তত্ত্বাবধান করবেন। এই কাউন্সিল অনেকটা “রিপাবলিক”-এর দার্শনিক রাজার সম্মিলিত রূপ, যারা রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি রক্ষা করবেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আইনের সংস্কার করবেন। এটি রাষ্ট্রের “নোঙর” (anchor) বা “আত্মা” (soul) হিসেবে কাজ করবে। (Morrow, 1960)
- ধর্ম ও শিক্ষা (Religion and Education): “দ্য লজ”-এ ধর্ম ও শিক্ষার ওপর আরও বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। নাগরিকদের মধ্যে আস্তিকতা (ঈশ্বরের অস্তিত্ব, তাঁর মঙ্গলময়তা এবং মহাজাগতিক শৃঙ্খলা) প্রতিষ্ঠা করা হবে। নাস্তিকতা (Atheism) একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এর জন্য শাস্তির বিধান থাকবে। শিক্ষাব্যবস্থা হবে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক, যেখানে সঙ্গীত, ব্যায়াম, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং আইনশাস্ত্র পড়ানো হবে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে নাগরিকদের সদ্গুণী ও আইন মান্যকারী করে তোলা।
- আইনের প্রস্তাবনা (Preambles to Laws): “দ্য লজ”-এর একটি অভিনব বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ আইনের শুরুতে তার উদ্দেশ্য, যৌক্তিকতা ও নৈতিক ভিত্তি ব্যাখ্যা করে একটি প্রস্তাবনা (Preamble) যুক্ত করার সুপারিশ। প্লেটো মনে করতেন, আইন শুধু শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানানো উচিত নয়, বরং নাগরিকদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে, তাদের যৌক্তিক সম্মতি আদায় করে আইন মানতে উৎসাহিত করা উচিত। এই প্রস্তাবনাগুলো অনেকটা প্ররোচনামূলক (persuasive) বক্তৃতা, যা নাগরিকদের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাবে।
“দ্য লজ” প্লেটোর রাজনৈতিক চিন্তার পরিণত ও বাস্তববাদী দিকের প্রতিফলন। এখানে তিনি মানুষের প্রকৃতি এবং সমাজের জটিলতাকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। যদিও এটি “রিপাবলিক”-এর মতো কাব্যিক ও উদ্দীপনাময় নয়, তবুও এর বিস্তারিত আইনকানুন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পশ্চিমা রাজনৈতিক ও আইন দর্শনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।
“স্টেটসম্যান” (Statesman – Politikos): রাষ্ট্রনায়কের শিল্প
“রিপাবলিক” ও “দ্য লজ”-এর মাঝামাঝি সময়ে (আনুমানিক ৩৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্লেটো “স্টেটসম্যান” (Statesman বা Politikos) নামে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংলাপ রচনা করেন। এই সংলাপে তিনি আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের (True Statesman) প্রকৃতি, গুণাবলি এবং তাঁর রাষ্ট্রপরিচালনার শিল্প (Art of Statesmanship) নিয়ে আলোচনা করেছেন। এখানেও প্রধান বক্তা সক্রেটিস নন, বরং ইলিয়া থেকে আগত এক আগন্তুক (Eleatic Stranger)।
বিভাজন পদ্ধতি (Method of Division – Diairesis): এই সংলাপে প্লেটো তাঁর প্রিয় লজিক্যাল পদ্ধতি – বিভাজন বা দ্বিখণ্ডন – ব্যবহার করে রাষ্ট্রনায়কের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণের চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান ও শিল্পকে ধাপে ধাপে বিভাজিত করে তিনি দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রপরিচালনা একটি বিশেষ ধরনের জ্ঞান বা বিজ্ঞান (Science of Rulership)।
রাষ্ট্রনায়ক বনাম অন্যান্য বিশেষজ্ঞ: প্লেটো রাষ্ট্রনায়ককে অন্যান্য বিশেষজ্ঞ (যেমন, সেনাপতি, বিচারক, বক্তা, এমনকি পুরোহিত) থেকে পৃথক করেছেন। রাষ্ট্রনায়কের কাজ হলো এই সমস্ত বিশেষজ্ঞকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। তিনি হলেন প্রধান নির্দেশক বা “রাজকীয় তাঁতি” (Royal Weaver)।
আইনের ভূমিকা: “স্টেটসম্যান”-এ প্লেটো আইন এবং রাষ্ট্রনায়কের বিবেচনার (Discretion) মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে এক জটিল আলোচনা করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে, আইন সবসময় নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী নিখুঁত সমাধান দিতে পারে না, কারণ আইন হলো একটি সাধারণ নিয়ম যা সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক, যিনি প্রকৃত রাষ্ট্রপরিচালনার জ্ঞান রাখেন, তিনি প্রয়োজনে আইনের ঊর্ধ্বে উঠে নিজের বিবেক ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যেমন একজন দক্ষ চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসার নিয়ম পরিবর্তন করতে পারেন। তবে, যদি এমন প্রজ্ঞাবান রাষ্ট্রনায়ক পাওয়া না যায় (যা সাধারণত বিরল), সেক্ষেত্রে আইনের শাসনই শ্রেয়।
শাসনব্যবস্থার শ্রেণিবিভাগ: “স্টেটসম্যান”-এ প্লেটো শাসনব্যবস্থার একটি নতুন এবং আরও সূক্ষ্ম শ্রেণিবিভাগ করেছেন। এখানে তিনি দুটি মানদণ্ড ব্যবহার করেছেন: (১) শাসকের সংখ্যা (এক, কয়েকজন, বহুজন) এবং (২) তারা আইন মেনে চলেন কিনা (আইনসম্মত বা আইনবহির্ভূত)।
-
আইনসম্মত রূপ (Lawful Forms):
-
- রাজতন্ত্র (Monarchy): একজনের শাসন, আইনসম্মত (যদি প্রকৃত জ্ঞানী হন, তবে এটি সর্বোত্তম)।
- অভিজাততন্ত্র (Aristocracy): কয়েকজনের শাসন, আইনসম্মত।
- গণতন্ত্র (Democracy): বহুজনের শাসন, আইনসম্মত (এটি তিনটি ভালো রূপের মধ্যে দুর্বলতম, কিন্তু তিনটি খারাপ রূপের মধ্যে সেরা)।
-
আইনবহির্ভূত রূপ (Lawless Forms):
-
- স্বৈরতন্ত্র (Tyranny): একজনের শাসন, আইনবহির্ভূত (নিকৃষ্টতম)।
- ধনিকতন্ত্র (Oligarchy): কয়েকজনের শাসন, আইনবহির্ভূত।
- গণতন্ত্র (Democracy): বহুজনের শাসন, আইনবহির্ভূত (তিনটি খারাপ রূপের মধ্যে এটিই কম মন্দ, কারণ ক্ষমতা অনেকের মধ্যে বিভক্ত থাকে)।
এখানে লক্ষণীয় যে, প্লেটো গণতন্ত্রের দুটি রূপের কথা বলেছেন – একটি আইনসম্মত, অন্যটি আইনবহির্ভূত। (Rosen, 1995)
“তাঁতির রূপক” (Weaver Analogy): রাষ্ট্রনায়কের শিল্পকে প্লেটো দক্ষ তাঁতির কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেমন তাঁতি বিভিন্ন ধরনের সুতো (শক্ত ও নরম) একত্রিত করে একটি সুন্দর ও টেকসই বস্ত্র তৈরি করেন, তেমনি রাষ্ট্রনায়ক সমাজের বিভিন্ন প্রকৃতির নাগরিকদের (যেমন, সাহসী ও উদ্যমী এবং সংযমী ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ) একত্রিত করে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন এবং একটি সুসংহত, শক্তিশালী ও ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র গঠন করেন। রাষ্ট্রনায়কের কাজ হলো সঠিক শিক্ষা ও আইনের মাধ্যমে এই বিপরীতধর্মী উপাদানগুলোকে সংযুক্ত করা।
“স্টেটসম্যান” গ্রন্থটি রাষ্ট্রপরিচালনাকে একটি জটিল শিল্প ও বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে এবং আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের দুর্লভ গুণাবলির ওপর আলোকপাত করে। এটি “রিপাবলিক”-এর আদর্শবাদ এবং “দ্য লজ”-এর বাস্তবতাবাদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার সমালোচনা
প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী দর্শন হলেও, এটি শুরু থেকেই বহু প্রশংসা ও তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। তাঁর কিছু ধারণা আজও বিতর্কিত এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হয়।
- গণতন্ত্রবিরোধী ও স্বৈরাচারী প্রবণতা: প্লেটোর সবচেয়ে কঠোর সমালোচনা এসেছে তাঁর গণতন্ত্র বিরোধিতা এবং দার্শনিক রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতার ধারণার জন্য। বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী দার্শনিক কার্ল পপার (Karl Popper) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Open Society and Its Enemies” (১৯৪৫)-এর প্রথম খণ্ডে (“The Spell of Plato”) প্লেটোকে মুক্ত সমাজের (Open Society) শত্রু এবং টোটালিটারিয়ানিজম বা সর্বাত্মকবাদী স্বৈরতন্ত্রের (Totalitarianism) পথপ্রদর্শক হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। পপারের মতে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি বদ্ধ সমাজ (Closed Society), যেখানে কোনো পরিবর্তন, নতুন চিন্তা বা ব্যক্তি স্বাধীনতার সুযোগ নেই। দার্শনিক রাজার অসীম ক্ষমতা, কঠোর শ্রেণিবিভাজন, “মহৎ মিথ্যা”র ব্যবহার এবং ভিন্নমত দমনের প্রবণতা – এগুলো সবই স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের লক্ষণ। (Popper, 1945)
- শ্রেণিবিভাজন ও সামাজিক বৈষম্য: প্লেটোর রাষ্ট্রে নাগরিকদের তিনটি কঠোর শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে, যেখানে উৎপাদক শ্রেণির (সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও) কোনো রাজনৈতিক অধিকার নেই এবং তাদের ভূমিকা কেবল অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই শ্রেণিবিভাজন আধুনিক সাম্য (Equality) ও মানবাধিকারের (Human Rights) ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। “ধাতুর উপকথা” এই বৈষম্যকে ন্যায্যতা দেওয়ার একটি কৌশল মাত্র।
- অবাস্তব ও কাল্পনিক (Utopian and Impractical): “রিপাবলিক”-এ বর্ণিত অনেক ধারণাই, বিশেষ করে অভিভাবক শ্রেণির জন্য সম্পত্তি ও পরিবারের সাম্যবাদ, বাস্তবে প্রয়োগ করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করা হয়। প্লেটোর ছাত্র অ্যারিস্টটল (Aristotle) নিজেই এই সাম্যবাদের কঠোর সমালোচনা করে বলেছিলেন যে, যা কিছু সকলের সাধারণ সম্পত্তি, তার প্রতি কারোরই বিশেষ যত্ন থাকে না (“Politics”, Book II)। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা, এগুলোকে অস্বীকার করা কঠিন।
- “মহৎ মিথ্যা”র (Noble Lie) নৈতিকতা: রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের জন্য জেনে-শুনে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার প্রস্তাবটি নৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। এটি নাগরিকদের সঙ্গে প্রতারণা এবং সত্যের প্রতি প্লেটোর নিজের ঘোষিত অঙ্গীকারের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
- শিল্পকলার প্রতি চরম বিরূপতা ও নিয়ন্ত্রণ (Censorship of Arts): প্লেটোর শিল্পকলার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং কবিদের নির্বাসনের প্রস্তাব সৃজনশীল স্বাধীনতা ও শৈল্পিক অভিব্যক্তির পরিপন্থী। এটি শিল্পকলার নিজস্ব মূল্য এবং মানুষের আবেগ ও কল্পনার গুরুত্বকে অস্বীকার করে।
- ব্যক্তি স্বাধীনতার অভাব (Lack of Individual Freedom): প্লেটোর রাষ্ট্রে ব্যক্তির স্থান গৌণ, রাষ্ট্রের কল্যাণই মুখ্য। ব্যক্তির জীবন, শিক্ষা, পেশা, এমনকি চিন্তাভাবনাও রাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আধুনিক উদারনৈতিক (Liberal) চিন্তাধারায় ব্যক্তি স্বাধীনতাকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, প্লেটোর রাষ্ট্রে তার অভাব প্রকট।
- জ্ঞানতাত্ত্বিক স্বৈরতন্ত্র (Epistemological Authoritarianism): শুধুমাত্র দার্শনিকরাই পরম সত্য বা ” কল্যাণের ফর্ম” জানেন এবং তারাই শাসনের যোগ্য – এই ধারণাটি এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। কারা প্রকৃত দার্শনিক, তা কে নির্ধারণ করবে? এবং তাদের ক্ষমতা কি কখনো চ্যালেঞ্জ করা যাবে না?
- নারীর অবস্থান বিষয়ে অস্পষ্টতা: যদিও প্লেটো “রিপাবলিক”-এ নারীদের অভিভাবক হওয়ার এবং পুরুষদের মতো একই শিক্ষা ও দায়িত্ব পাওয়ার কথা বলেছেন, যা তাঁর সময়ের তুলনায় বৈপ্লবিক, “দ্য লজ”-এ তাঁর অবস্থান কিছুটা রক্ষণশীল বলে মনে হয়। সেখানে তিনি নারীদের জন্য ভিন্ন ধরনের শিক্ষা এবং গার্হস্থ্য দায়িত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। (Okin, 1979)
তবে এই সমালোচনাগুলোর উত্তরে এটাও মনে রাখা দরকার যে, প্লেটো তাঁর সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একটি আদর্শ সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সুশৃঙ্খল ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর অনেক প্রস্তাবই ছিল তৎকালীন গ্রিক পলিসগুলোর (City-states) সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা।
প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতা
বহু সমালোচনা সত্ত্বেও, প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা পশ্চিমা রাজনৈতিক দর্শন, নীতিশাস্ত্র এবং শিক্ষাদর্শনের ওপর এক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। তাঁকে ছাড়া পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাস কল্পনা করা কঠিন, যেমনটা আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড (Alfred North Whitehead) বিখ্যাতভাবে মন্তব্য করেছিলেন যে, “ইউরোপীয় দার্শনিক ঐতিহ্য প্লেটোর রচনার পাদটীকা ছাড়া আর কিছুই নয়।” (Whitehead, 1929, p. 39)
- রাজনৈতিক ভাববাদের (Political Idealism) জনক: প্লেটোই প্রথম দার্শনিক যিনি রাষ্ট্রের একটি আদর্শ রূপ (Ideal Form) কল্পনা করেছিলেন এবং বাস্তব রাষ্ট্রকে সেই আদর্শের নিরিখে বিচার করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তীকালের বহু আদর্শবাদী দার্শনিককে অনুপ্রাণিত করেছে।
- শিক্ষার অপরিহার্য ভূমিকা: রাষ্ট্র গঠনে এবং সুনাগরিক তৈরিতে শিক্ষার যে অপরিহার্য ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা রয়েছে, তা প্লেটো অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর বিস্তারিত শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষার লক্ষ্যের ধারণা আজও শিক্ষাবিদদের অনুপ্রাণিত করে।
- যোগ্য ও নৈতিক নেতৃত্বের ধারণা: শাসকের যোগ্যতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং নৈতিক চরিত্রের ওপর প্লেটো যে গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তা সকল যুগের জন্যই প্রাসঙ্গিক। দুর্নীতিমুক্ত ও জনকল্যাণকামী নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা আজও বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান।
- আইনের শাসনের (Rule of Law) গুরুত্ব: প্লেটো “দ্য লজ”-এ আইনের শাসনের যে ধারণা দিয়েছেন, তা আধুনিক সাংবিধানিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি। শাসকরাও যে আইনের ঊর্ধ্বে নন, এই নীতি গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।
- রাজনৈতিক দর্শনের মৌলিক প্রশ্নাবলি: প্লেটো রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কিত এমন সব মৌলিক ও চিরন্তন প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন (যেমন – ন্যায় কী? আদর্শ রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিত? কারা শাসন করবে এবং কেন? রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সম্পর্ক কী? স্বাধীনতার সীমা কতটুকু?), যা নিয়ে আজও দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নিরন্তর বিতর্ক ও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। (Annas, 1999)
- ইউটোপীয় সাহিত্যের (Utopian Literature) অনুপ্রেরণা: প্লেটোর “রিপাবলিক” পরবর্তীকালে বহু ইউটোপীয় বা স্বপ্নলোকের কাহিনি রচনার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, যেমন স্যার টমাস মোরের (Sir Thomas More) “ইউটোপিয়া” (Utopia, ১৫১৬) এবং টমাসো ক্যাম্পানেলার (Tommaso Campanella) “সূর্যনগরী” (The City of the Sun, ১৬২৩)।
- পরবর্তী দার্শনিকদের ওপর প্রভাব: প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা তাঁর ছাত্র অ্যারিস্টটলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, যদিও অ্যারিস্টটল অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর গুরুর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। রোমান দার্শনিক সিসেরো (Cicero), ইহুদি দার্শনিক ফিলো (Philo), খ্রিস্টান দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন (St. Augustine) থেকে শুরু করে রেনেসাঁসের দার্শনিক, এমনকি আধুনিক যুগের রুশো (Rousseau), কান্ট (Kant) এবং হেগেল (Hegel) পর্যন্ত বহু চিন্তাবিদের ওপর প্লেটোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
আজকের দিনে প্লেটোর প্রাসঙ্গিকতা: আড়াই হাজার বছর পরেও প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক, কারণ তিনি যে সমস্যাগুলো নিয়ে ভেবেছিলেন, তার অনেকগুলোই আজও আমাদের সমাজে বিদ্যমান।
- রাজনৈতিক দুর্নীতি ও অযোগ্য নেতৃত্ব: যখন আমরা দেখি অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তখন প্লেটোর “দার্শনিক রাজা” বা অন্ততপক্ষে জ্ঞানী ও নৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে পড়ে।
- সামাজিক ন্যায়বিচার ও বৈষম্য: প্লেটোর ন্যায়ের ধারণা (প্রত্যেকের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ এবং সামাজিক সমন্বয়) আজকের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনার দাবি রাখে।
- শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য: আজকের শিক্ষাব্যবস্থা যখন শুধুমাত্র পেশাগত দক্ষতা তৈরির কারখানায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে, তখন প্লেটোর সামগ্রিক শিক্ষাদর্শন (যা শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশের ওপর জোর দেয়) আমাদের পথ দেখাতে পারে।
- গণতন্ত্রের সংকট ও পপুলিজম (Populism): যখন গণতন্ত্র উচ্ছৃঙ্খলতা বা জনতোষণবাদী রাজনীতির শিকার হয়, তখন প্লেটোর গণতন্ত্রের সমালোচনা (যদিও তা একপেশে) আমাদের গণতন্ত্রের দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
- রাষ্ট্রের ভূমিকা ও নাগরিকের দায়িত্ব: ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের কতটা হস্তক্ষেপ করা উচিত এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের দায়িত্ব কী – এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে প্লেটোর ভাবনা আজও প্রাসঙ্গিক।
হয়তো প্লেটোর ক্যালিপলিস বা কাল্পনিক রাষ্ট্র কোনোদিন মাটির পৃথিবীতে গড়ে উঠবে না। দার্শনিক রাজাও হয়তো এক সুদূর, অবাস্তব কল্পনা। কিন্তু একটা ভালো, ন্যায়পরায়ণ ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিত, শাসকের কী কী গুণ থাকা দরকার, সমাজে ন্যায়বিচার কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় – এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবনার যে খোরাক প্লেটো যুগিয়ে গেছেন, তা অমূল্য। তাঁর চিন্তাগুলো আমাদের উৎসাহিত করে একটি উন্নততর সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতে, প্রশ্ন করতে এবং নিজেদের ও আমাদের নেতাদের আরও ভালো হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে।
উপসংহার: প্লেটো আজও কেন জরুরি?
প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে কথা বলতে গেলে মনে হয়, যেন এক প্রাচীন কিন্তু চিরনবীন প্রাজ্ঞ বন্ধুর সঙ্গে বসে আমরা মানব সমাজের শাশ্বত সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করছি। তাঁর কিছু প্রস্তাব হয়তো আজকের মানদণ্ডে অগ্রহণযোগ্য, কিছু সমাধান হয়তো বাড়াবাড়ি রকমের আদর্শবাদী। কিন্তু তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মঙ্গল, একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর ন্যায়ের জয় হবে, মূর্খতা, দুর্নীতি আর অবিচারের পরাজয় ঘটবে।
আজকের এই জটিল, সংঘাতপূর্ণ এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে যখন আমরা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার, নেতৃত্বের সংকট এবং নৈতিক অবক্ষয়ের মুখোমুখি হই, তখন প্লেটোর কথাগুলো, তাঁর প্রশ্নগুলো, তাঁর স্বপ্নগুলো নতুন করে আমাদের ভাবায়, আলোড়িত করে।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র হয়তো একটা ইউটোপিয়া (Utopia), একটা স্বপ্নলোক। কিন্তু সেই স্বপ্ন দেখার সাহসটাই বা কম কীসের? একটা ভালো রাষ্ট্র, একটা ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়ার স্বপ্ন যদি আমরা না-ই দেখি, সেই স্বপ্নের পেছনে যদি না-ই ছুটি, তাহলে আমরা এগোব কী করে? প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা আমাদের সেই স্বপ্ন দেখতে শেখায়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রশ্ন করতে শেখায়, তর্ক করতে শেখায়, আর সর্বোপরি, সেরাটার জন্য আপসহীনভাবে চেষ্টা করতে উৎসাহিত করে। আর তাই, সক্রেটিসের সেই অমর ছাত্র, আড়াই হাজার বছর পরেও, আমাদের কাছে এত জীবন্ত, এত প্রাসঙ্গিক, এত জরুরি।
তথ্যসূত্র
- Annas, J. (1981). An Introduction to Plato’s Republic. Oxford University Press.
- Annas, J. (1999). Platonic Ethics, Old and New. Cornell University Press.
- Aristotle. (n.d.). Politics (B. Jowett, Trans.). Retrieved from http://classics.mit.edu/Aristotle/politics.html
- Barker, E. (1960). Greek Political Theory: Plato and His Predecessors. Methuen.
- Cherniss, H. F. (1945). The Riddle of the Early Academy. University of California Press.
- Cross, R. C., & Woozley, A. D. (1964). Plato’s Republic: A Philosophical Commentary. Macmillan.
- Field, G. C. (1967). Plato and His Contemporaries: A Study in Fourth-Century Life and Thought (3rd ed.). Methuen.
- Guthrie, W. K. C. (1962). A History of Greek Philosophy, Vol. 1: The Earlier Presocratics and the Pythagoreans. Cambridge University Press.
- Kagan, D. (2003). The Peloponnesian War. Penguin Books.
- Kerferd, G. B. (1981). The Sophistic Movement. Cambridge University Press.
- Kirk, G. S., Raven, J. E., & Schofield, M. (1983). The Presocratic Philosophers: A Critical History with a Selection of Texts (2nd ed.). Cambridge University Press.
- Klosko, G. (2006). The Oxford Handbook of the History of Political Philosophy. Oxford University Press.
- Morrow, G. R. (1960). Plato’s Cretan City: A Historical Interpretation of the Laws. Princeton University Press.
- Nettleship, R. L. (1901). Lectures on the Republic of Plato. Macmillan.
- Okin, S. M. (1979). Women in Western Political Thought. Princeton University Press.
- Plato. (1960). The Laws (A. E. Taylor, Trans.). J.M. Dent & Sons.
- Plato. (1992). Republic (G. M. A. Grube, Trans., Rev. C. D. C. Reeve). Hackett Publishing Company. (Original work c. 375 BCE)
- Plato. (n.d.). Statesman (B. Jowett, Trans.). Retrieved from http://classics.mit.edu/Plato/stateman.html
- Popper, K. R. (1945). The Open Society and Its Enemies, Vol. 1: The Spell of Plato. Routledge.
- Rosen, S. (1995). Plato’s Statesman: The Web of Politics. Yale University Press.
- Sabine, G. H. (1973). A History of Political Theory (4th ed., Rev. T. L. Thorson). Dryden Press.
- Stone, I. F. (1988). The Trial of Socrates. Little, Brown and Company.
- Taylor, A. E. (2008). Plato: The Man and His Work. Dover Publications. (Original work published 1926)
- Whitehead, A. N. (1929). Process and Reality: An Essay in Cosmology. Macmillan.
- Xenophon. (n.d.). Hellenica. (H. G. Dakyns, Trans.). The Project Gutenberg EBook. Retrieved from https://www.gutenberg.org/files/1174/1174-h/1174-h.htm
Leave a Reply