Table of Contents
ভূমিকা
মধ্যদুপুর। বাইরে ঝিমঝিম করে বৃষ্টি নামছে। এই মেঘলা, বিষণ্ণ দিনে পৃথিবীর যাবতীয় কোলাহল যেন থেমে গেছে। আপনার হাতে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা, আর অন্য হাতে আপনার ব্যক্তিগত জাদুর প্রদীপ—মোবাইল ফোন। আপনি আনমনে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের নিউজফিড (Newsfeed) স্ক্রল করছেন। একটা নিপাট ভালোমানুষ গোছের বিড়ালের মজার ভিডিও দেখে আপনার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। বন্ধুর বিয়ের ছবিতে ‘লাইক’ দিলেন, শুভকামনা জানালেন। একটা তীব্র রাজনৈতিক পোস্ট দেখে সামান্য ভ্রূ কুঁচকে দ্রুত এড়িয়ে গেলেন। বিতর্কে জড়ানোর মতো মনের অবস্থা এখন নেই।
এরপর ইউটিউবে ঢুকলেন পুরনো দিনের গান শুনতে। একটা গান শেষ হতেই পরের গানটা আপনাআপনি বেজে উঠল। কী আশ্চর্য! এই গানটাই তো আপনার শুনতে ইচ্ছে করছিল! এই সুরটাই তো আপনি খুঁজছিলেন মনের গভীরে। কেমন করে জানল সে? গুগল করতে গেলেন বৃষ্টির দিনে গরম গরম খিচুড়ি রান্নার সবচেয়ে সহজ রেসিপি। হাজার হাজার লিঙ্কের ভিড়ে প্রথম দুটি লিঙ্কের মধ্যেই পেয়ে গেলেন আপনার মায়ের হাতের রান্নার মতো সেই চিরচেনা স্বাদ আর পদ্ধতির রেসিপিটা।
সবকিছুই কী ভীষণ স্বাভাবিক, কী ভীষণ মসৃণ, তাই না? যেন আপনার মনের কথাগুলো কেউ একজন আগে থেকেই জেনে বসে আছে। আপনার পছন্দ, আপনার ভালো লাগা, আপনার গোপন বিষণ্ণতা, আপনার রাজনৈতিক অনীহা—সবকিছুই তার নখদর্পণে। সে আপনার জন্য এমন এক পৃথিবী সাজিয়ে দিয়েছে, যেখানে কোনো অস্বস্তি নেই, কোনো বড়সড় ধাক্কা নেই, সবই আপনার মনের মতো।
এই ‘কেউ একজন’ কোনো মানুষ নয়। কোনো সর্বজ্ঞানী জাদুকরও নয়। এর নাম অ্যালগরিদম (Algorithm)। এক অদৃশ্য, সর্বব্যাপী কারিগর, যে আপনার ডিজিটাল জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নীরবে, নিভৃতে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। আমরা ভাবি, আমরা স্বাধীন। আমরা যা খুশি তাই দেখছি, পড়ছি, শুনছি। কিন্তু আসলেই কি তাই? নাকি আমরা এক চমৎকারভাবে সাজানো মঞ্চের অভিনেতা, যার প্রতিটি পদক্ষেপের নির্দেশনা আসছে পর্দার পেছন থেকে? আমরা কি আদৌ কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, নাকি আমাদের দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ানো হচ্ছে?
এই দীর্ঘ লেখায় আমরা সেই অদৃশ্য কারিগরের মায়াজাল ভেদ করার এক দুঃসাহসী চেষ্টা করব। দেখব, কীভাবে এই ডিজিটাল ভূত আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে এবং আমাদের চিন্তার জগৎ, আমাদের আবেগ, এমনকি আমাদের বাস্তবতাকেও নতুন করে নির্মাণ করছে। চলুন, এই রহস্যময়, আলো-আঁধারির জগতের গভীরে ডুব দেওয়া যাক।
অ্যালগরিদম নামের সেই ‘ভূত’টি আসলে কে?
অ্যালগরিদম শব্দটা শুনলেই আমাদের চোখে কম্পিউটার কোডের হিজিবিজি সংকেত, গণিতের জটিল সব সূত্র আর ডেটা সায়েন্টিস্টদের গুরুগম্ভীর মুখের ছবি ভেসে ওঠে। ব্যাপারটা আদতে যতটা জটিল, ততটাই সরল। খুব সহজ করে বললে, অ্যালগরিদম হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধান বা কাজ সম্পন্ন করার জন্য ধাপে ধাপে সাজানো কিছু নিয়ম বা নির্দেশাবলী।
ধরুন, আপনি চা বানাবেন। তার জন্য আপনার একটি অ্যালগরিদম বা রেসিপি আছে:
- ১. পাত্রে জল নাও।
- ২. জল ফোটাও।
- ৩. পরিমাণমতো চা পাতা দাও।
- ৪. প্রয়োজনমতো চিনি আর দুধ মেশাও।
- ৫. ছেঁকে কাপে ঢালো।
এই পাঁচটি ধাপ হলো চা বানানোর অ্যালগরিদম। এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে আপনি একটি ভালো মানের চা পাবেন। অ্যালগরিদম নামটি এসেছে নবম শতাব্দীর পারস্যের গণিতবিদ মুহম্মদ ইবনে মুসা আল-খারেজমির (Muḥammad ibn Mūsā al-Khwārizmī) নাম থেকে, যিনি গণিতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের পদ্ধতিগত নিয়মাবলী তৈরি করেছিলেন।
কম্পিউটার বা যেকোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ঠিক এভাবেই কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কাজ করে। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, টিকটক—সবারই নিজস্ব এবং অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যালগরিদম আছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য একটাই: আপনাকে প্ল্যাটফর্মে যত বেশি সময় সম্ভব আটকে রাখা। কারণ, আপনার মনোযোগই (Attention) তাদের ব্যবসার মূল পণ্য। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শোশানা জুবফ (Shoshana Zuboff) এই মডেলটিকে বলেছেন ‘নজরদারিমূলক পুঁজিবাদ’ বা ‘সারভেইল্যান্স ক্যাপিটালিজম’ (Surveillance Capitalism)। এই মডেলে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বিনামূল্যে পরিষেবা দেওয়ার বিনিময়ে ব্যবহারকারীর আচরণগত তথ্য (Behavioral Data) সংগ্রহ করে এবং সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে মানুষের ভবিষ্যৎ আচরণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে। এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোই তারা বিজ্ঞাপনদাতা বা অন্যান্য গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে (Zuboff, 2019)। আপনি যত বেশি সময় দেবেন, তারা তত বেশি ডেটা পাবে, তাদের ভবিষ্যদ্বাণী তত নিখুঁত হবে এবং তারা তত বেশি আয় করতে পারবে।
কীভাবে শেখে এই অ্যালগরিদম?
এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্যই অ্যালগরিদমকে আপনার সম্পর্কে জানতে হয়। প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে সে আপনার ডেটা (Data) বা তথ্য সংগ্রহ করে। আপনি কোন পোস্টে লাইক দিচ্ছেন, কী শেয়ার করছেন, কোন বন্ধুর পোস্টে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, কোন ভিডিও কতক্ষণ দেখছেন, কোথায় ক্লিক করছেন, কোন বিজ্ঞাপনটি এড়িয়ে যাচ্ছেন, এমনকি কোনো ছবির ওপর কত সেকেন্ড আপনার মাউস বা চোখ আটকে ছিল (Hover Time)—সবই তার নজরে থাকে। আপনার ফোনের লোকেশন ডেটা (Location Data), আপনার কন্টাক্ট লিস্ট, আপনার কেনাকাটার অভ্যাস, এমনকি আপনি কখন ঘুমান বা কখন জেগে ওঠেন—এই সবকিছুই তার জানার পরিধির মধ্যে।
এই বিপুল পরিমাণ তথ্যকে বলা হয় ‘বিগ ডেটা’ (Big Data)। এই ডেটা বিশ্লেষণ করার জন্য অ্যালগরিদম ব্যবহার করে মেশিন লার্নিং (Machine Learning) এবং ডিপ লার্নিং (Deep Learning)-এর মতো প্রযুক্তি। সহজ ভাষায়, মেশিন লার্নিং হলো কম্পিউটারকে ডেটা থেকে নিজে নিজে শিখতে শেখানো। অনেকটা একটি শিশুর মতো। আপনি একটি শিশুকে হাজারবার বিড়ালের ছবি দেখিয়ে বললে, ‘এটা বিড়াল’, সে একসময় নিজে থেকেই বিড়াল চিনতে শিখে যায়। একইভাবে, অ্যালগরিদম আপনার হাজার হাজার কার্যকলাপ দেখে আপনার পছন্দ-অপছন্দের ধরণ বা প্যাটার্ন (Pattern) শিখে নেয়।
এর ওপর ভিত্তি করে অ্যালগরিদম আপনার একটি ‘ডিজিটাল টুইন’ (Digital Twin) বা ডিজিটাল প্রোফাইল তৈরি করে। এই প্রোফাইলটি আপনার বাস্তব ‘আমি’-র চেয়েও হয়তো বেশি নিখুঁত। কারণ এতে আপনার সেই সব গোপন ইচ্ছার কথাও লেখা থাকে, যা আপনি হয়তো সচেতনভাবে নিজেও জানেন না বা স্বীকার করতে চান না। এই প্রোফাইলের ওপর ভিত্তি করেই অ্যালগরিদম সিদ্ধান্ত নেয়, আপনাকে এরপর কী দেখানো হবে। একে বলা হয় ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিশ্লেষণ (Predictive Analysis)। অ্যালগরিদম ভবিষ্যদ্বাণী করে, কোন জিনিসটা আপনার ভালো লাগার বা আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, এবং সেটাই আপনার সামনে তুলে ধরে। ব্যাপারটা অনেকটা একজন ব্যক্তিগত সহকারীর মতো, যে আপনার মেজাজ-মর্জি বুঝে সব ব্যবস্থা করে রাখে। কিন্তু এই সহকারী মোটেও নিঃস্বার্থ নয়। তার প্রতিটি কাজের পেছনে রয়েছে এক সুনির্দিষ্ট এবং প্রায়শই অদৃশ্য বাণিজ্যিক স্বার্থ।
সামাজিক মাধ্যমের গোলকধাঁধা: ফিল্টার বাবল ও ইকো চেম্বারের বাসিন্দা
সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া (Social Media) আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা থেকে শুরু করে খবর পড়া বা বিনোদন—সবকিছুর জন্যই আমরা এর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এর নিউজফিড কীভাবে কাজ করে, তা কি আমরা ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেছি?
একসময় ফেসবুক বা টুইটারের নিউজফিড ছিল কালানুক্রমিক (Chronological)। অর্থাৎ, আপনার বন্ধুরা বা আপনি যাদের ফলো করেন, তারা যা পোস্ট করত, তা সময়ের ক্রমানুসারে আপনি দেখতে পেতেন। ব্যাপারটা ছিল সহজ এবং স্বচ্ছ। কিন্তু এখন আর তা হয় না। এখন নিউজফিড সম্পূর্ণভাবে এনগেজমেন্ট-ভিত্তিক অ্যালগরিদম (Engagement-based Algorithm) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অ্যালগরিদমই বিচারক। সে-ই ঠিক করে দেয়, কার পোস্ট আপনি আগে দেখবেন, কারটা পরে, আর কারটা হয়তো আপনার চোখেই পড়বে না।
এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি কী? ভিত্তি হলো আপনার পূর্ববর্তী আচরণ এবং ‘এনগেজমেন্ট’ (Engagement) বা সম্পৃক্ততা। অ্যালগরিদম দেখেছে, আপনি নির্দিষ্ট কিছু বন্ধুর পোস্টে বা নির্দিষ্ট ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শের পেজে বেশি লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করেন। তখন সে সিদ্ধান্ত নেয়, ওই বন্ধু বা ওই ধরনের পেজের পোস্টই আপনাকে বেশি করে দেখানো উচিত। কারণ, এতে আপনার প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।
ফিল্টার বাবল: আপনার ব্যক্তিগত মায়াজগৎ
এর ফলে যা ঘটে, তা এককথায় ভয়াবহ। ধীরে ধীরে আপনার নিউজফিড একটা আরামদায়ক আয়নার মতো হয়ে যায়, যেখানে আপনি কেবল আপনার নিজের প্রতিচ্ছবিই দেখতে পান। আপনার নিজের বিশ্বাস, নিজের মতাদর্শ, নিজের পছন্দেরই প্রতিধ্বনি আপনি অবিরত শুনতে থাকেন। ভিন্নমত, ভিন্ন চিন্তাধারা বা ভিন্ন সংস্কৃতির পোস্টগুলো অ্যালগরিদম আপনার কাছ থেকে সযত্নে ফিল্টার করে বা ছেঁকে সরিয়ে রাখে।
এই অবস্থাকেই প্রযুক্তি বিশ্লেষক এলি প্যারাইজার (Eli Pariser) তাঁর বিখ্যাত বইতে নাম দিয়েছেন ‘ফিল্টার বাবল’ (Filter Bubble)। আমরা প্রত্যেকে নিজের অজান্তেই এক একটি অদৃশ্য, ব্যক্তিগতকৃত তথ্য-বুদবুদের মধ্যে বাস করতে শুরু করি। এই বুদবুদের ভেতরে যা তথ্য আসে, আমরা তাকেই সমগ্র বিশ্ব বলে ধরে নিই। আমাদের মনে হতে থাকে, ‘আরে, সবাই তো আমার মতোই ভাবে!’ বা ‘এটাই তো সত্যি!’ (Pariser, 2011)। এই বাবল আমাদের এক আরামদায়ক ভ্রান্তির মধ্যে রাখে, কিন্তু আমাদের চারপাশের জটিল এবং বৈচিত্র্যময় বাস্তবতা থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
ইকো চেম্বার: যেখানে প্রতিধ্বনিরাই একমাত্র সত্য
ফিল্টার বাবলের হাত ধরেই তৈরি হয় আরেক বিপদ—‘ইকো চেম্বার’ (Echo Chamber)। এটি এমন এক বদ্ধ ডিজিটাল পরিবেশ, যেখানে একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা চিন্তাধারা বারবার বিভিন্ন মানুষ ও সূত্রের মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হতে হতে আরও শক্তিশালী হয় এবং বিকল্প কোনো ধারণাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। আইন বিশেষজ্ঞ ক্যাস সানস্টাইন (Cass Sunstein) এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করেন। তিনি দেখান, সমমনা মানুষদের বদ্ধ পরিবেশে আলোচনা ক্রমশ তাদের আরও চরমপন্থী করে তোলে (Sunstein, 2001)।
ধরুন, আপনি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন। অ্যালগরিদম আপনাকে সেই দলের সমর্থক গোষ্ঠী, সেই দলের নেতাদের পোস্ট এবং সেই দলের পক্ষে লেখা সংবাদই বেশি করে দেখাবে। আপনি যখন দেখবেন আপনার ডিজিটাল জগতের সবাই—আপনার বন্ধু, আপনার পছন্দের নিউজ পেজ, আপনার প্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার—একই কথা বলছে, তখন আপনার বিশ্বাস আরও পোক্ত হবে। আপনার মনে হবে, আপনার চিন্তাই একমাত্র সঠিক এবং নৈতিক। এর ফলে অন্য দলের সমর্থকদের প্রতি আপনার মনোভাব অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। আপনি তাদের আর ভিন্নমতের মানুষ হিসেবে দেখবেন না, বরং শত্রু, দেশদ্রোহী বা মূর্খ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করবেন।
সামাজিক মাধ্যমগুলো এভাবেই সমাজে বিভেদ এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ (Political Polarization) বাড়িয়ে তুলছে। আমরা নিজেদের তৈরি করা ছোট ছোট উপজাতিতে (Digital Tribes) বিভক্ত হয়ে পড়ছি এবং অন্যের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। ফলস্বরূপ, একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অপরিহার্য যে পারস্পরিক আলোচনা, সহনশীলতা এবং বিতর্কের পরিসর, তা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।
আবেগের ডিজিটাল সংক্রমণ (Digital Emotional Contagion)
অ্যালগরিদমের খেলা শুধু তথ্য বা মতাদর্শের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি আমাদের আবেগকেও নিয়ন্ত্রণ ও সংক্রমিত করতে পারে। ২০১৪ সালে ফেসবুক একটি অত্যন্ত বিতর্কিত গবেষণা চালায়, যা ‘ইমোশনাল কন্টাজিয়ন’ নামে পরিচিত। প্রায় সাত লক্ষ ব্যবহারকারীর অগোচরে তাদের নিউজফিডকে ম্যানিপুলেট করা হয়েছিল। কিছু ব্যবহারকারীকে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি করে ইতিবাচক (Positive) শব্দযুক্ত পোস্ট দেখানো হয়, আর কিছু ব্যবহারকারীকে দেখানো হয় নেতিবাচক (Negative) শব্দযুক্ত পোস্ট।
ফলাফল ছিল চমকে দেওয়ার মতো এবং কিছুটা ভয়েরও। যারা বেশি ইতিবাচক পোস্ট দেখেছিলেন, তারা নিজেরাও পরবর্তী সময়ে বেশি ইতিবাচক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অন্যদিকে, যাদের নেতিবাচক পোস্ট দেখানো হয়েছিল, তাদের স্ট্যাটাসও উল্লেখযোগ্যভাবে নেতিবাচক হয়ে উঠেছিল (Kramer et al., 2014)। এই গবেষণা প্রমাণ করে যে, ডিজিটাল মাধ্যমে আবেগও ভাইরাসের মতো সংক্রামক। অ্যালগরিদম চাইলে আমাদের মন ভালো করে দিতে পারে, আবার বিষণ্ণতার অন্ধকারেও ঠেলে দিতে পারে। এই ক্ষমতা বিজ্ঞাপনদাতা বা রাজনৈতিক প্রচারকদের হাতে গেলে তার পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। তারা চাইলে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃত্রিমভাবে রাগ, ভয় বা আশার সঞ্চার করতে পারে।
সার্চ ইঞ্জিনের দৈববাণী এবং তথ্যের মায়াজাল
গুগল ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলে না। যেকোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, যেকোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে আমরা গুগলের শরণাপন্ন হই। আমরা গুগলকে একটি নিরপেক্ষ, সর্বজ্ঞ তথ্যভান্ডার হিসেবে বিশ্বাস করি। কিন্তু গুগল কি সত্যিই নিরপেক্ষ? তার দেখানো ফলাফল কি ধ্রুব সত্য?
উত্তর হলো—না। গুগলের সার্চ রেজাল্টও (Search Result) অ্যালগরিদম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এটি অত্যন্ত ব্যক্তিগতকৃত (Personalized)। আপনি এবং আপনার বন্ধু যদি একই বিষয় লিখে গুগলে সার্চ করেন, তবে আপনাদের দুজনের সার্চ রেজাল্ট ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এর কারণ, গুগলের অ্যালগরিদম আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। আপনার ভৌগোলিক অবস্থান, আপনার পূর্ববর্তী সার্চের ইতিহাস, আপনি কোন ধরনের লিঙ্কে বেশি ক্লিক করেন, আপনার ব্রাউজিং ডেটা, আপনার বয়স, লিঙ্গ—এই সমস্ত ডেটার ওপর ভিত্তি করে গুগল সিদ্ধান্ত নেয়, কোন ফলাফলটি আপনার জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক (Relevant) এবং উপকারী হবে।
ধরুন, আপনি ঢাকায় বসে ‘সেরা রেস্তোরাঁ’ লিখে সার্চ করলেন। গুগল আপনাকে ঢাকার রেস্তোরাঁর তালিকা দেখাবে। আবার, আপনি যদি আগে প্রায়ই ইতালিয়ান খাবারের রেসিপি খুঁজে থাকেন, তাহলে গুগল আপনাকে সেরা ইতালিয়ান রেস্তোরাঁর তালিকা আগে দেখাতে পারে। এই ব্যক্তিগতকরণ অনেক ক্ষেত্রে উপকারী এবং সময় বাঁচায়।
কিন্তু এর একটি অন্ধকার দিকও আছে। আমরা যখন কোনো বিতর্কিত বা জটিল বিষয়ে তথ্য খুঁজি, তখন অ্যালগরিদম আমাদের সেই ধরনের ফলাফলই দেখায়, যা আমাদের পূর্ববর্তী বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়। ফলে আমাদের ফিল্টার বাবল আরও শক্তিশালী হয়। আমরা যা বিশ্বাস করতে চাই, গুগল যেন সেই বিশ্বাসকেই সমর্থন জানিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, তুমিই ঠিক!’ একে বলা হয় নিশ্চিতকরণ পক্ষপাত (Confirmation Bias), এবং অ্যালগরিদম এই মানবীয় দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই চলে।
তথ্যের সত্যতা এবং প্রথম পাতার অদৃশ্য ক্ষমতা
গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৫ শতাংশেরও বেশি ব্যবহারকারী গুগলের সার্চ রেজাল্টের প্রথম পাতাটিই শুধু দেখেন (Jansen & Spink, 2006)। দ্বিতীয় বা তৃতীয় পাতায় কী আছে, তা দেখার ধৈর্য বা আগ্রহ খুব কম মানুষেরই থাকে। অর্থাৎ, অ্যালগরিদম যা প্রথম পাতায় দেখাচ্ছে, সেটিই অধিকাংশ মানুষের কাছে ‘সত্য’ বা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে গৃহীত হয়। প্রথম পাতায় স্থান না পাওয়া মানে কার্যত অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
এই বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (Search Engine Optimization – SEO) এর মাধ্যমে অ্যালগরিদমকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। ভুল তথ্য, অপপ্রচার (Propaganda) বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বকেও (Conspiracy Theory) কার্যকর SEO-এর মাধ্যমে গুগলের প্রথম পাতায় নিয়ে আসা সম্ভব। ফলে, একজন সাধারণ ব্যবহারকারী যখন কোনো বিষয়ে জানতে চান, তিনি হয়তো সত্যের বদলে একটি চমৎকারভাবে সাজানো মিথ্যার মুখোমুখি হতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন বা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মতো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত বিষয় নিয়েও যদি কেউ সংশয় প্রকাশ করে সার্চ করেন, যেমন “ভ্যাকসিন কি নিরাপদ?”—অ্যালগরিদম তাকে সেই সংশয়কে সমর্থন করে এমন ভুয়া বিজ্ঞান বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের লিঙ্কও দেখাতে পারে, যা তাকে আরও বিভ্রান্ত করবে। গবেষকরা এই ঘটনাকে “ডেটা ভয়েড” (Data Voids) হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, যেখানে কোনো বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব থাকলে ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদরা সহজেই সেই শূন্যস্থান পূরণ করে (Golebiewski & boyd, 2019)। এভাবেই সার্চ ইঞ্জিন, যা আমাদের জ্ঞানার্জনের প্রধান হাতিয়ার হওয়ার কথা ছিল, তা কখনও কখনও অজ্ঞতা ও মিথ্যার প্রচারের যন্ত্রে পরিণত হয়।
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের অতলান্ত: সংস্কৃতি ও চরমপন্থার নির্মাণ
ইউটিউব বা নেটফ্লিক্সের মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো (Streaming Platform) আমাদের বিনোদনের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে। টিভি চ্যানেলের নির্দিষ্ট সময়সূচির বদলে এখন আমরা যখন খুশি, যা খুশি তাই দেখতে পারি। কিন্তু এখানেও পর্দার আড়ালে মূল চালিকাশক্তি হলো সুপারিশকারী অ্যালগরিদম (Recommendation Algorithm)।
আপনি একটি ভিডিও বা সিনেমা দেখার পর, প্ল্যাটফর্মটি আপনাকে ‘আপনার জন্য প্রস্তাবিত’ (Recommended for You) বা ‘এরপর দেখুন’ (Up Next) শিরোনামে আরও কিছু কনটেন্টের তালিকা দেখায়। এই তালিকাটিও তৈরি হয় আপনার রুচি, দেখার ইতিহাস, এবং আপনার মতো অন্যান্য ব্যবহারকারীদের আচরণের ওপর ভিত্তি করে। অ্যালগরিদমের একমাত্র লক্ষ্য হলো, আপনাকে একটির পর একটি ভিডিও দেখিয়ে প্ল্যাটফর্মে আটকে রাখা, যাকে বলা হয় ‘সেশন টাইম’ (Session Time) বাড়ানো।
র্যাবিট হোল এফেক্ট: চরমপন্থার চোরাবালি
ইউটিউবের অ্যালগরিদমের একটি বহুল আলোচিত এবং বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্য হলো ‘র্যাবিট হোল এফেক্ট’ (The Rabbit Hole Effect)। এর অর্থ হলো, অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীকে ক্রমশ আরও চরম, উগ্র বা চাঞ্চল্যকর (Extreme/Sensational) কনটেন্টের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সমাজবিজ্ঞানী জেইনেপ তুফেকি (Zeynep Tufekci) তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, কীভাবে সাধারণ ভিডিও দেখতে দেখতে একজন ব্যবহারকারীকে অ্যালগরিদম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা রাজনৈতিক চরমপন্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেমন, আপনি হয়তো নিরামিষ রান্নার ভিডিও দেখতে শুরু করলেন। অ্যালগরিদম আপনাকে এরপর ভেগান জীবনযাত্রা নিয়ে ভিডিও দেখাবে, তারপর পশু অধিকার নিয়ে আবেগঘন ভিডিও, এবং শেষ পর্যন্ত হয়তো উগ্রপন্থী পশু অধিকার কর্মীদের কর্মকাণ্ড বা পশু খামারে হামলা করার ভিডিও দেখাতে শুরু করবে (Tufekci, 2018)।
একইভাবে, সাধারণ রাজনৈতিক ভাষ্য বা সংবাদ শুনতে শুনতে ব্যবহারকারীকে ক্রমশ কট্টরপন্থী মতাদর্শের দিকে চালিত করা হয়। কারণ অ্যালগরিদম শিখেছে যে, চরম, আবেগপূর্ণ এবং বিতর্কিত কনটেন্ট ব্যবহারকারীর মনোযোগ বেশি সময় ধরে রাখতে পারে। এর ফলে, বহু সাধারণ মানুষ নিজের অজান্তেই উগ্রবাদে দীক্ষিত হয়ে পড়ে, যার সামাজিক পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।
সাংস্কৃতিক হোমোজেনাইজেশন: একই সুরে বাঁধা বিশ্ব
অ্যালগরিদম শুধু আমাদের ব্যক্তিগত রুচিকেই নয়, বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতিকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। নেটফ্লিক্স বা স্পটিফাইয়ের মতো প্ল্যাটফর্ম যখন কোনো একটি সিনেমা বা গানকে তাদের অ্যালগরিদমের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচার করে, তখন সেটি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি গ্লোবাল হিটে (Global Hit) পরিণত হয়। এর ফলে সারা বিশ্বের মানুষ একই ধরনের বিনোদনমূলক কনটেন্ট গ্রহণ করতে শুরু করে।
একদিকে এটি যেমন বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে, তেমনই অন্যদিকে এটি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে নষ্ট করে একটি একমুখী বা সমরূপী (Homogenized) বিশ্ব সংস্কৃতি তৈরি করার ঝুঁকিও বাড়ায়। স্থানীয় বা প্রান্তিক শিল্পীদের কাজ অ্যালগরিদমের আনুকূল্য না পাওয়ায় চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। অ্যালগরিদম যা জনপ্রিয় বলে মনে করে, সেটিই আরও জনপ্রিয় হতে থাকে, আর যা জনপ্রিয় নয়, তা চিরকাল অগোচরেই থেকে যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘ম্যাথিউ এফেক্ট’ (Matthew Effect)—যার আছে, তাকে আরও দেওয়া হবে। এভাবেই অ্যালগরিদম হয়ে উঠছে এক নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক দারোয়ান (Cultural Gatekeeper), যে ঠিক করে দিচ্ছে কোন সংস্কৃতি বাঁচবে আর কোনটা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে।
মনস্তত্ত্বের খেলা এবং মনোযোগের অর্থনীতি
কেন আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করে যাই, এটা জেনেও যে এটা আমাদের সময়ের অপচয় করছে এবং আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে? এর পেছনেও রয়েছে শক্তিশালী মনস্তাত্ত্বিক কারণ, যা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো খুব সচেতনভাবে তাদের পণ্যের ডিজাইনে ব্যবহার করে।
ডোপামিন চক্র: ডিজিটাল আসক্তির ফাঁদ
আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন (Dopamine) নামে এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার আছে, যা আনন্দ বা পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি তৈরি করে। আমরা যখন কোনো সুস্বাদু খাবার খাই বা কোনো পছন্দের কাজ করি, তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসৃত হয়, যা আমাদের সেই কাজটি আবার করতে উৎসাহিত করে।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এই ডোপামিন চক্রকে কাজে লাগিয়ে আসক্তি তৈরি করে। আপনি যখন একটি ছবি পোস্ট করেন, তখন প্রতিটি লাইক বা কমেন্টের নোটিফিকেশন আপনার মস্তিষ্কে সামান্য পরিমাণে ডোপামিন নিঃসরণ করে। এই অনুভূতিটা এতটাই ভালো লাগে যে, আপনি বারবার অ্যাপটি খুলে দেখতে চান নতুন কোনো নোটিফিকেশন এসেছে কি না।
এই পুরস্কারটি অনিয়মিত এবং অপ্রত্যাশিত (Intermittent Variable Rewards)। আপনি জানেন না কখন, কতগুলো লাইক বা কমেন্ট আসবে। মনোবিজ্ঞানী বি.এফ. স্কিনারের গবেষণা অনুযায়ী, এই অনিশ্চয়তাই আসক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। এটা অনেকটা ক্যাসিনোর স্লট মেশিনের (Slot Machine) মতো, যেখানে আপনি জ্যাকপট পাওয়ার আশায় বারবার লিভার টানতে থাকেন (Eyal, 2014)। ‘পুল-টু-রিফ্রেশ’ (Pull-to-refresh) ফিচারটি ডিজাইনগতভাবে স্লট মেশিনের লিভারেরই অনুকরণ। অ্যালগরিদম জানে কখন আপনাকে একটি নোটিফিকেশন পাঠালে আপনার ফিরে আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এভাবেই আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর এক ধরনের আচরণগত দাসে (Behavioral Slave) পরিণত হই।
তুলনার সংস্কৃতি, ফোমো এবং মানসিক স্বাস্থ্য
ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকে আমরা অন্যের জীবনের সবচেয়ে সেরা, সম্পাদিত এবং ফিল্টার করা মুহূর্তগুলোই দেখতে পাই—সুন্দর জায়গায় ছুটি কাটানো, নতুন গাড়ি কেনা, দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়া, নিখুঁত শারীরিক গঠন। এই চমৎকারভাবে সাজানো, কৃত্রিম বাস্তবতার সঙ্গে আমরা আমাদের নিজেদের সাধারণ, আটপৌরে, অগোছালো জীবনের তুলনা করতে শুরু করি।
এই অবিরত সামাজিক তুলনা (Social Comparison) আমাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা, ঈর্ষা, উদ্বেগ (Anxiety) এবং বিষণ্ণতার (Depression) জন্ম দেয়। এর সাথে যুক্ত হয় ‘ফোমো’ (FOMO – Fear of Missing Out) বা পিছিয়ে পড়ার ভয়। অ্যালগরিদম আমাদের সেই সব মানুষের প্রোফাইলই বেশি করে দেখায়, যাদের জীবনযাপন আমাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, যা আমাদের FOMO-কে আরও উসকে দেয়। ফলে, আমরা এক অন্তহীন অতৃপ্তি এবং অপ্রাপ্তির চক্রে আটকে পড়ি। গবেষণায় দেখা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে (Twenge, 2017)।
মনোযোগের অর্থনীতি: যেখানে আপনিই পণ্য
হার্বার্ট সাইমন, যিনি একজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ছিলেন, তিনি অনেক আগেই, ১৯৭১ সালে, এক অমোঘ সত্য উচ্চারণ করেছিলেন: “তথ্যের প্রাচুর্য মনোযোগের দারিদ্র্য তৈরি করে” (Simon, 1971)। আজকের ডিজিটাল যুগে এই কথাটি ভীষণভাবে সত্যি।
আমরা এখন ‘মনোযোগের অর্থনীতি’ (The Attention Economy) নামক এক নতুন যুগে বাস করছি। এই অর্থনীতির মূল মুদ্রা হলো মানুষের মনোযোগ। ফেসবুক, গুগল, টিকটকের মতো কোম্পানিগুলো একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে আপনার মনোযোগের এক একটি কণা দখল করার জন্য। কারণ, আপনার মনোযোগই তারা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি করে।
এই অর্থনীতিতে, আমরা ব্যবহারকারীরা হলাম পণ্য, এবং বিজ্ঞাপনদাতারা হলো গ্রাহক। অ্যালগরিদম হলো সেই নিখুঁত যন্ত্র, যা পণ্যকে (আমাদের মনোযোগ) গ্রাহকের (বিজ্ঞাপনদাতার) কাছে পৌঁছে দেয়। টিম উ (Tim Wu) তাঁর ‘The Attention Merchants’ বইতে এই ভয়ংকর অথচ লাভজনক ব্যবসায়িক মডেলটির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন (Wu, 2016)। আমরা বিনামূল্যে পরিষেবা পাচ্ছি ভেবে খুশি হই, কিন্তু আসলে আমরা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান এবং অফেরতযোগ্য সম্পদ—আমাদের সময়, মনোযোগ এবং ব্যক্তিগত তথ্য—দিয়ে তার মূল্য পরিশোধ করছি।
অদৃশ্য বিচারক: অ্যালগরিদম যখন জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে
অ্যালগরিদমের প্রভাব শুধু আমাদের নিউজফিড বা বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এর জাল ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে, যেখানে এটি নীরবে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করছে।
প্রেম, বিয়ে ও রোমান্স: টিন্ডার (Tinder) বা বাম্বল (Bumble)-এর মতো ডেটিং অ্যাপে অ্যালগরিদমই আপনার সম্ভাব্য জীবনসঙ্গীকে বেছে দিচ্ছে। আপনার ছবি, আপনার সোয়াইপের ইতিহাস, আপনার দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অ্যালগরিদম সিদ্ধান্ত নেয়, কার প্রোফাইল আপনাকে দেখানো হবে এবং আপনার প্রোফাইল কাকে দেখানো হবে। এর ফলে মানুষের মতো জটিল একটি বিষয়কেও কিছু ডেটা পয়েন্টে নামিয়ে আনা হয়, যা অনেক সময় বর্ণ, শ্রেণি বা শারীরিক গঠনের মতো অগভীর বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বৈষম্য তৈরি করতে পারে।
চাকরি ও জীবিকা: বহু কোম্পানি এখন আবেদনকারীদের জীবনবৃত্তান্ত (CV) বা রিজ্যুমে বাছাই করার জন্য অটোমেটেড সিস্টেম (Automated System) ব্যবহার করে। অ্যালগরিদম নির্দিষ্ট কিছু কিওয়ার্ড (Keyword) বা অভিজ্ঞতার ধরণ খোঁজে। যদি আপনার সিভিতে সেই শব্দগুলো না থাকে, তাহলে হয়তো কোনো মানব সম্পদ কর্মকর্তার (Human Resource Manager) চোখ পড়ার আগেই আপনার আবেদনটি বাতিল হয়ে যাবে। এই সিস্টেমগুলো পুরনো ডেটার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়ায় তারা প্রাতিষ্ঠানিক লিঙ্গ বা বর্ণবৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ঋণ, বীমা এবং বিচার ব্যবস্থা: অ্যালগরিদমের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রয়োগ ঘটছে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে (High-stakes fields)। ব্যাংকগুলো এখন ঋণগ্রহীতার যোগ্যতা যাচাই করার জন্য অ্যালগরিদমিক ক্রেডিট স্কোরিং (Algorithmic Credit Scoring) ব্যবহার করছে। বীমা কোম্পানিগুলো আপনার স্বাস্থ্য বা ড্রাইভিং ডেটার ওপর ভিত্তি করে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করছে। এমনকি কিছু দেশের বিচার ব্যবস্থায় অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুর করা বা প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করতেও অ্যালগরিদমিক টুল ব্যবহার করা হচ্ছে। এই অ্যালগরিদমগুলো যদি পক্ষপাতদুষ্ট (Biased) ডেটার ওপর প্রশিক্ষিত হয়, তবে তারা বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যকে আরও শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। গণিতজ্ঞ ক্যাথি ও’নিল (Cathy O’Neil) এই ধরনের ক্ষতিকর অ্যালগরিদমগুলোকে ‘গণিত ধ্বংসের অস্ত্র’ (Weapons of Math Destruction) বলে অভিহিত করেছেন (O’Neil, 2016)।
আমরা কি অসহায় পুতুল? উত্তরণের পথ কী?
এতসব আলোচনার পর মনে হতে পারে, আমরা অ্যালগরিদমের হাতের অসহায় পুতুল ছাড়া আর কিছুই নই। আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা বা পছন্দের কোনো মূল্য নেই। এই ধারণাটি হতাশাজনক এবং আংশিকভাবে সত্য হলেও, পুরোপুরি নয়। আমরা চাইলেই এই অদৃশ্য কারিগরের লাগাম কিছুটা হলেও নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারি। এর জন্য প্রয়োজন গভীর সচেতনতা এবং কিছু সুচিন্তিত পদক্ষেপ।
১. অ্যালগরিদমিক স্বাক্ষরতা (Algorithmic Literacy): প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো এটা বোঝা এবং স্বীকার করা যে, আমরা যা কিছু অনলাইনে দেখছি, তার প্রায় সবকিছুই অ্যালগরিদম দ্বারা ফিল্টার করা, ব্যক্তিগতকৃত এবং ম্যানিপুলেট করা। আপনার নিউজফিড বা সুপারিশের তালিকা কোনো নিরপেক্ষ বাস্তবতা নয়, বরং আপনার জন্যই বিশেষভাবে তৈরি করা একটি মায়াজগৎ। এই মৌলিক সচেতনতাই আপনাকে ডিজিটাল কনটেন্টকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখতে এবং প্রশ্ন করতে সাহায্য করবে।
২. নিজের বাবল ভাঙুন (Break Your Bubble): ইচ্ছাকৃতভাবে এবং সক্রিয়ভাবে আপনার ফিল্টার বাবল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন। এমন মানুষ বা পেজকে ফলো করুন, যাদের মতাদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গি আপনার সঙ্গে মেলে না। তাদের বক্তব্যকে খারিজ না করে বোঝার চেষ্টা করুন। শুধু একটি সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভর না করে একাধিক উৎস থেকে খবর পড়ুন, বিশেষ করে যেগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান ভিন্ন। মাঝে মাঝে DuckDuckGo-এর মতো প্রাইভেসি-কেন্দ্রিক সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করুন, যা আপনার ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে না এবং নিরপেক্ষ ফলাফল দেখানোর চেষ্টা করে। আপনার দেখার বা শোনার তালিকায় ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু যোগ করুন যা আপনার স্বাভাবিক রুচির বাইরে।
৩. ডিজিটাল ডায়েট ও সচেতন ব্যবহার (Digital Diet & Mindful Usage): আপনার ডিজিটাল ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনুন। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপের অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশনগুলো বন্ধ করে দিন। প্রতিটি নোটিফিকেশনই আপনাকে অ্যাপে ফিরিয়ে নেওয়ার একটি টোপ। প্রতিদিন কতক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন, তার জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করুন। অনেক ফোনেই এখন এই সুবিধা (Digital Wellbeing) রয়েছে। ‘ইনফিনিট স্ক্রল’ (Infinite Scroll) থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। কোনো কিছু খোঁজার জন্য বা নির্দিষ্ট কারো সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অ্যাপ ব্যবহার করুন, উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করার জন্য নয়।
৪. অ্যালগরিদমকে প্রশিক্ষণ দিন (Train Your Algorithm): আপনি অ্যালগরিদমের কাছে সম্পূর্ণ অসহায় নন। আপনি তাকে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। ইউটিউবে বা ফেসবুকে ‘Not Interested’ বা ‘Don’t Recommend Channel’ বাটনগুলো ব্যবহার করুন। আপনি যা দেখতে চান না, সে সম্পর্কে অ্যালগরিদমকে স্পষ্ট সংকেত দিন। একইভাবে, আপনি যে ধরনের কনটেন্ট বেশি দেখতে চান, সেগুলোর সাথে ইতিবাচকভাবে যুক্ত হন।
৫. তথ্যের উৎস যাচাই করুন: কোনো চাঞ্চল্যকর খবর বা আবেগঘন তথ্য শেয়ার করার আগে কয়েক মুহূর্ত থামুন। এর উৎস যাচাই করুন। এটি কি কোনো নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যমের খবর? নাকি কোনো অচেনা ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজ থেকে ছড়ানো গুজব? মিথ্যা খবর সাধারণত তীব্র আবেগ (রাগ, ভয়) উস্কে দেয়, তাই অ্যালগরিদম এগুলোকে দ্রুত ছড়িয়ে দেয় (Vosoughi et al., 2018)। এই বিষাক্ত চক্র ভাঙার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
৬. প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি: ব্যক্তি পর্যায়ের চেষ্টার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক এবং নীতিগত পরিবর্তনও জরুরি। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে তাদের অ্যালগরিদমের স্বচ্ছতা (Transparency) এবং দায়বদ্ধতা (Accountability) নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। ব্যবহারকারীর ডেটা কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, অ্যালগরিদম কীভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে—এই বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের আরও খোলামেলা হতে হবে। ইউরোপের জিডিপিআর (GDPR)-এর মতো আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগের জন্য বিশ্বজুড়ে যে আলোচনা চলছে, তাকে সমর্থন করা উচিত।
শেষ কথা: কারিগর ও তার সৃষ্টি
অ্যালগরিদম নিজে ভালোও নয়, মন্দও নয়। এটি একটি হাতিয়ার মাত্র। একটি ছুরি দিয়ে যেমন ফল কাটা যায়, তেমনই মানুষও খুন করা যায়। দোষটা ছুরির নয়, ব্যবহারকারীর উদ্দেশ্য এবং সমাজের নজরদারির। অ্যালগরিদমের স্রষ্টা মানুষ, এবং এর লক্ষ্য কী হবে, তা মানুষই নির্ধারণ করে দিয়েছে। এখনকার প্রভাবশালী অ্যালগরিদমগুলোর মূল লক্ষ্য হলো মুনাফা সর্বোচ্চকরণ, মানবকল্যাণ নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত এই ব্যবসায়িক মডেলটি অপরিবর্তিত থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অ্যালগরিদম আমাদের দুর্বলতাগুলোকে পুঁজি করেই চলবে।
আমরা এক অদ্ভুত, সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের হাতে থাকা ছোট্ট একটি যন্ত্রের মাধ্যমে আমরা সারা বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশ করতে পারি, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর খোঁজ পেতে পারি, নতুন শিল্প সৃষ্টি করতে পারি। আবার সেই একই যন্ত্র আমাদের সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর জগতের বাসিন্দা বানিয়ে ফেলতে পারে, আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে পারে, আমাদের আসক্ত করে তুলতে পারে। এই অদৃশ্য কারিগর আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, আবার একই সাথে জটিল এক মায়াজালে আবদ্ধও করেছে।
এই জাল থেকে মুক্তির চাবিকাঠি আমাদের হাতেই রয়েছে। সেই চাবিকাঠিটি হলো কৌতূহল এবং প্রশ্ন করার সাহস। কেন আমি এটা দেখছি? এর পেছনে কার স্বার্থ জড়িত? আমাকে যা দেখানো হচ্ছে, তার বাইরের পৃথিবীটা আসলে কেমন? যে আরামদায়ক পৃথিবীটা আমার জন্য তৈরি করা হয়েছে, সেটা কি আসলেই আমার জন্য ভালো?
ফোনটা একপাশে সরিয়ে রেখে একটু জানালার বাইরে তাকান। সেখানে যে বিশাল, জটিল, সুন্দর ও কুৎসিত পৃথিবীটা রয়েছে, তার অনেকটাই হয়তো আপনার নিউজফিডে নেই। সেই পৃথিবীকে নিজের চোখে দেখার, নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে ডিজিটাল যুগের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা। আপনার ডিজিটাল পৃথিবীটা কি আপনার নিয়ন্ত্রণে, নাকি অদৃশ্য কোনো কারিগরের ইশারায় চলছে? এই প্রশ্নটি নিজেকে করার মাধ্যমেই হয়তো সত্যিকারের পরিবর্তনের শুরুটা হবে।
তথ্যসূত্র
- Eyal, N. (2014). Hooked: How to Build Habit-Forming Products. Portfolio/Penguin.
- Golebiewski, M., & boyd, d. (2019). Data Voids: Where Missing Data Can Easily Be Exploited. Data & Society. Retrieved from https://datasociety.net/pubs/Data-Voids-Where-Missing-Data-Can-Easily-Be-Exploited.pdf
- Jansen, B. J., & Spink, A. (2006). How are we searching the World Wide Web? A comparison of nine search engine transaction logs. Information Processing & Management, 42(1), 248–263.
- Kramer, A. D. I., Guillory, J. E., & Hancock, J. T. (2014). Experimental evidence of massive-scale emotional contagion through social networks. Proceedings of the National Academy of Sciences, 111(24), 8788–8790.
- O’Neil, C. (2016). Weapons of Math Destruction: How Big Data Increases Inequality and Threatens Democracy. Crown.
- Pariser, E. (2011). The Filter Bubble: What the Internet Is Hiding from You. Penguin UK.
- Simon, H. A. (1971). Designing organizations for an information-rich world. In M. Greenberger (Ed.), Computers, communications, and the public interest (pp. 37-72). The Johns Hopkins Press.
- Sunstein, C. R. (2001). Republic.com. Princeton University Press.
- Tufekci, Z. (2018, March 10). YouTube, the great radicalizer. The New York Times. Retrieved from https://www.nytimes.com/2018/03/10/opinion/sunday/youtube-politics-radical.html
- Twenge, J. M. (2017). iGen: Why Today’s Super-Connected Kids Are Growing Up Less Rebellious, More Tolerant, Less Happy–and Completely Unprepared for Adulthood–and What That Means for the Rest of Us. Atria Books.
- Vosoughi, S., Roy, D., & Aral, S. (2018). The spread of true and false news online. Science, 359(6380), 1146–1151.
- Wu, T. (2016). The Attention Merchants: The Epic Scramble to Get Inside Our Heads. Alfred A. Knopf.
- Zuboff, S. (2019). The Age of Surveillance Capitalism: The Fight for a Human Future at the New Frontier of Power. PublicAffairs.
Leave a Reply