কৌটিল্যের কুটিল দর্শন: এক রহস্যময় রাজগুরুর জবানবন্দি

Table of Contents

ভূমিকা

ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, তাই না? আজ থেকে প্রায় তেইশ শ’ বছর আগের এক মানুষ, যার আসল নাম নিয়েও আছে সংশয়। কেউ বলে চাণক্য, কেউ বলে কৌটিল্য, আবার কারো মতে তিনি বিষ্ণুগুপ্ত। মানুষটা ঠিক কেমন ছিলেন, তা নিয়েও ধোঁয়াশা। ইতিহাসের পাতায় তিনি যেন এক কুয়াশামাখা চরিত্র। একটা ভৌতিক জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতো, যার অস্তিত্ব নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে, কিন্তু তার রেখে যাওয়া লগবুক—’অর্থশাস্ত্র’—আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উত্তাল সমুদ্রে এক ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছে। আধুনিক কূটনীতিক, গোয়েন্দা, কর্পোরেট স্ট্র্যাটেজিস্ট আর রাষ্ট্রনায়কদের কাছে এই বই যেন এক পবিত্র গ্রন্থ, যা ক্ষমতা আর নিয়ন্ত্রণের গোপনতম পাঠ দেয়।

এই মানুষটিকে নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই একটা হিমশীতল অনুভূতি হয়। মনে হয়, যেন এক নির্জন, পরিত্যক্ত প্রাসাদের সবচেয়ে অন্ধকার ঘরটিতে বসে কেউ নিচু, হিসহিসে গলায় রাজ্যের সবচেয়ে গোপন কথাগুলো বলে যাচ্ছে। তার কথায় কোনো আবেগ নেই, ফুলের মতো সুন্দর কোনো উপমা নেই, আছে শুধু কাটাকাটা যুক্তির ধারালো ছুরির ফলা। তিনি শেখাচ্ছেন, কীভাবে রাষ্ট্র চালাতে হয়। কীভাবে বন্ধু বানাতে হয়, আর সেই বন্ধুকে প্রয়োজনে দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলতে হয়। কীভাবে শত্রুর রাজ্যে গুপ্তচর পাঠিয়ে, তাদের সমাজে বিভেদের বিষ ছড়িয়ে দিয়ে, তাসের ঘরের মতো সব উল্টেপাল্টে দিতে হয়। তার দর্শন পড়লে এক মুহূর্তের জন্য মনে হবে, পৃথিবীতে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই; আছে শুধু প্রয়োজন। রাষ্ট্রের প্রয়োজন। রাজার প্রয়োজন। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন।

চলুন, আজ আমরা সেই রহস্যময় মানুষটির মনের গহীনে ডুব দিই। তার দর্শনের প্রতিটি স্তরকে পেঁয়াজের খোসার মতো করে ছাড়িয়ে দেখি। বোঝার চেষ্টা করি, কেন তিনি আজও এত প্রাসঙ্গিক, এত ভয়ংকর, এবং একই সাথে এতখানি শ্রদ্ধার পাত্র।

কে ছিলেন এই কৌটিল্য? মানুষ, কিংবদন্তি, নাকি একটি সম্মিলিত প্রজ্ঞা?

গল্পটা অনেকটা সিনেমার মতো শুরু হয়, যা আমরা বহুবার শুনেছি। মগধের সিংহাসনে তখন মহাপদ্মনন্দের পুত্র, ধননন্দ। প্রবল প্রতাপশালী, কিন্তু উদ্ধত, বিলাসী এবং প্রজাপীড়ক এক রাজা। কথিত আছে, আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময়েও এই নন্দবংশের ভয়ের কারণেই তার সৈন্যরা বিপাশা নদী পার হতে চায়নি। এমন এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজার রাজসভায় একদিন হাজির হলেন এক কৃশকায়, সামান্য দেখতে, কিন্তু জ্ঞান ও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক ব্রাহ্মণ। নাম তার বিষ্ণুগুপ্ত। কোনো এক কারণে রাজা তাকে অপমান করলেন। শুধু অপমানই নয়, লোকশ্রুতি অনুযায়ী, তার কৃষ্ণবর্ণ এবং সামান্য রূপের জন্য উপহাস করে চুলের ঝুঁটি ধরে সভাকক্ষ থেকে বের করে দিলেন।

রাগে, অপমানে সেই ব্রাহ্মণের মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি সেই সভাকক্ষে দাঁড়িয়েই এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা করলেন। তার শিখা বা চুলের ঝুঁটি খুলে ফেললেন এবং বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “যতদিন না আমি এই অহংকারী নন্দবংশকে সমূলে উৎখাত করে তার ভস্মের ওপর এক নতুন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করছি, ততদিন আমি এই শিখা বাঁধব না।” (Rangarajan, 1992)।

এই একটি ঘটনাই ভারতবর্ষের ইতিহাসকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিল। সেই সাধারণ চেহারার ব্রাহ্মণই ছিলেন চাণক্য বা কৌটিল্য। তিনি তার প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন। তিনি কোনো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না; তার অস্ত্র ছিল তার বুদ্ধি, তার জ্ঞান, আর মানুষকে পড়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। তিনি বিন্ধ্য পর্বতের জঙ্গল থেকে সাধারণ এক বালক, চন্দ্রগুপ্তকে খুঁজে বের করেন। সেই বালককে তিনি যুদ্ধবিদ্যা, অর্থনীতি, কূটনীতি আর রাজনীতি শিখিয়ে এমনভাবে তৈরি করলেন যে, সেই চন্দ্রগুপ্তই নন্দবংশকে ধ্বংস করে ভারতবর্ষের প্রথম এবং সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য—মৌর্য সাম্রাজ্যের—গোড়াপত্তন করেন। কৌটিল্য হন সেই বিশাল সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বা মহামাত্য।

এই গল্প সত্যি কি মিথ্যা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তর্ক চলতে পারে। অনেকেই মনে করেন, এটি পরবর্তীকালে নাট্যকারদের দ্বারা তৈরি একটি কাহিনী, যা কৌটিল্যের অসামান্য বুদ্ধিমত্তাকে একটি নাটকীয় রূপ দেওয়ার জন্য তৈরি। কিছু পণ্ডিত আবার প্রশ্ন তোলেন, চাণক্য, কৌটিল্য এবং বিষ্ণুগুপ্ত—এই তিনজন কি একই ব্যক্তি? অর্থশাস্ত্রের শেষে লেখক নিজের নাম বিষ্ণুগুপ্ত বলে উল্লেখ করেছেন, যিনি কৌটিল্য নামেও পরিচিত এবং যিনি নন্দ রাজাদের হাত থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন। এই সূত্র ধরেই তাদের এক বলে মনে করা হয়। তবে বিতর্ক যাই থাক, এটা প্রায় সকলেই স্বীকার করেন যে, কৌটিল্য নামে একজন অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন যিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গুরু এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আর তিনিই রচনা করেছিলেন ‘অর্থশাস্ত্র’—রাষ্ট্র পরিচালনার সেই ভয়ংকর সুন্দর, নির্মম এবং বাস্তববাদী ম্যানুয়াল।

যে আঁধার কৌটিল্যকে জন্ম দিয়েছিল: এক কুটিল দার্শনিকের পেছনের গল্প

ব্যাপারটা একটু ভাবুন তো। কোনো মানুষই কি শূন্য থেকে হঠাৎ করে তৈরি হয়? আইনস্টাইন তার পূর্ববর্তী নিউটন বা ম্যাক্সওয়েলের কাজ ছাড়া কি আপেক্ষিকতার তত্ত্ব দিতে পারতেন? পারতেন না। প্রতিটি বড় চিন্তার পেছনেই থাকে সময়ের ছাপ, থাকে পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া এক বিশাল ভাণ্ডার। কেউ সেই ভাণ্ডার থেকে গ্রহণ করে, কেউবা তাকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন পথের সন্ধান করে।

কৌটিল্য বা চাণক্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক তাই। আমরা যখন তার হিমশীতল, নির্মম বাস্তববাদী দর্শনের কথা পড়ি, তখন মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে—কী এমন ঘটেছিল সেই সময়ে? কেমন ছিল সেই পৃথিবী, যা একজন মানুষকে এতটা কঠোর (ruthless) এবং বাস্তববাদী (pragmatic) হতে বাধ্য করেছিল? কেন তিনি রাষ্ট্রের টিকে থাকাকেই পরম ধর্ম বলে মনে করলেন, যেখানে নৈতিকতাকে প্রায়শই একপাশে সরিয়ে রাখতে হয়?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের এক টাইম মেশিনে চড়ে বসতে হবে। ফিরে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় তেইশ-চব্বিশ শ’ বছর আগের ভারতবর্ষে। সেই সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর দার্শনিক বিতর্কের উত্তাল সমুদ্রে ডুব দিলেই আমরা খুঁজে পাব সেইসব উপাদান, যা দিয়ে তৈরি হয়েছিল কৌটিল্যের মতো এক জটিল চরিত্র। চলুন, সেই সফরেই বেরিয়ে পড়া যাক।

রাজনৈতিক উনুন: যে আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়েছিলেন কৌটিল্য

কৌটিল্যের সময়কার ভারতবর্ষ আজকের মতো এক অখণ্ড রাষ্ট্র ছিল না। এটি ছিল এক বিশাল রাজনৈতিক উনুন, যেখানে বিভিন্ন রাজ্য একে অপরের সাথে অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই পরিস্থিতিকে না বুঝলে কৌটিল্যের রাষ্ট্রচিন্তার মূল সুরটাই হারিয়ে যাবে।

মহাজনপদের যুগ এবং ক্ষমতার খেলা (The Era of Mahajanapadas)

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে ভারতে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয়, যা ‘মহাজনপদ’-এর যুগ নামে পরিচিত। অনেকটা প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলোর মতো, ভারতেও তখন ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ষোলটি রাজ্য (Sixteen Mahajanapadas) ছিল। কাশী, কোশল, অঙ্গ, মগধ, বৃজি, মল্ল, অবন্তী, গান্ধার—এই নামগুলো তখন কোনো শান্ত জনপদের ছিল না, ছিল একেকটি শক্তিধর এবং উচ্চাভিলাষী রাজ্যের।

এই রাজ্যগুলোর মধ্যে কোনো বন্ধুত্ব ছিল না, ছিল শুধু ক্ষমতার রেষারেষি। কে কাকে দখল করে নিজের সীমানা বাড়াবে, এই ছিল তাদের একমাত্র চিন্তা। আজকের দিনের আন্তর্জাতিক রাজনীতির মতোই তখন জোট তৈরি হতো, আবার স্বার্থ ফুরালে সেই জোট ভেঙেও যেত। এই সময়েই কৌটিল্য তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি পেয়েছিলেন—পৃথিবীতে শক্তিশালীরাই টিকে থাকে। দুর্বলদের জায়গা হয় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। এই যে অবিরাম সংঘাত আর বিশ্বাসঘাতকতার পরিবেশ, এটাই তার মনে ‘মাৎস্যন্যায়’ (Matsya Nyaya) বা ‘মাছের আইন’-এর ধারণাটিকে বদ্ধমূল করে দিয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন, একটি অসংগঠিত পৃথিবীতে বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, তেমনি শক্তিশালী রাজ্য দুর্বল রাজ্যকে গ্রাস করে। এই বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো এমন এক কেন্দ্রীভূত, শক্তিশালী রাষ্ট্র তৈরি করা, যাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করার সাহস পাবে না (Thapar, 2002)।

মগধের উত্থান: এক সাম্রাজ্যের ভ্রূণ (The Rise of Magadha)

এই ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে ধীরে ধীরে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে মগধ। বিম্বিসার, অজাতশত্রুর মতো বিচক্ষণ এবং নিষ্ঠুর রাজাদের হাত ধরে মগধ একের পর এক রাজ্যকে নিজের দখলে আনতে শুরু করে। এরপর আসে নন্দবংশ। মহাপদ্মনন্দকে ভারতের প্রথম ‘সাম্রাজ্য নির্মাতা’ (empire builder) বলা হয়। তিনি বাকি ক্ষত্রিয় রাজবংশগুলোকে ধ্বংস করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

নন্দদের শাসনব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দক্ষ কিন্তু প্রজাপীড়ক। তাদের ছিল এক বিশাল সেনাবাহিনী, এক সুসংগঠিত কর ব্যবস্থা এবং অঢেল সম্পদ। কৌটিল্য যখন বেড়ে উঠছিলেন, তখন তিনি চোখের সামনে এই নন্দ সাম্রাজ্যের ক্ষমতা এবং নিষ্ঠুরতা দুটোই দেখেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, একটি বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করার জন্য শুধু সামরিক শক্তিই যথেষ্ট নয়, এর জন্য প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত প্রশাসন, একটি পরিপূর্ণ কোষাগার এবং একটি কার্যকর গোয়েন্দা ব্যবস্থা। নন্দরা এর একটি কাঠামো তৈরি করেছিল, কিন্তু তাদের অহংকার এবং প্রজাদের প্রতি উদাসীনতা তাদের পতনের কারণ হয়। কৌটিল্য নন্দদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি তাদের প্রশাসনিক কাঠামোর ভালো দিকগুলো গ্রহণ করেন এবং তার সাথে যোগ করেন প্রজাহিতৈষী বা ‘যোগক্ষেম’ (Yogakshema)-এর ধারণা, যা নন্দদের ছিল না (Kosambi, 1975)।

আলেকজান্ডারের ঝড়: পশ্চিমের আঘাত (Alexander’s Invasion)

কৌটিল্যের চিন্তাধারাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল যে ঘটনাটি, তা হলো গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেকজান্ডার যখন হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন, তখন উত্তর-পশ্চিম ভারতের ছোট ছোট রাজ্যগুলো তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। তারা একে অপরের সাথে লড়াই করতে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, এক সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার কথা ভাবতেও পারেনি। পুরু (Porus) বীরের মতো লড়াই করলেও বাকিরা প্রায় বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করে।

এই ঘটনাটি কৌটিল্যের মনে দুটি বিষয় স্পষ্ট করে দেয়। প্রথমত, ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য দেশের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। দ্বিতীয়ত, একটি শক্তিশালী, একীভূত এবং কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য ছাড়া বিদেশি শক্তির মোকাবেলা করা অসম্ভব। আলেকজান্ডারের আক্রমণ তাকে শিখিয়েছিল যে, সীমান্ত সুরক্ষা (border security) এবং একটি ঐক্যবদ্ধ সামরিক কমান্ড (unified military command) কতটা জরুরি। অর্থশাস্ত্রে তিনি যে দুর্গ নির্মাণ, সীমান্ত চৌকি স্থাপন এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ওপর এত জোর দিয়েছেন, তার পেছনে আলেকজান্ডারের আক্রমণের স্মৃতি এক বড় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল (Rangarajan, 1992)।

এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই কৌটিল্যকে শিখিয়েছিল যে, আদর্শবাদ দিয়ে রাষ্ট্র চলে না। রাষ্ট্র চলে শক্তি, কৌশল আর বাস্তবতার কঠিন মাটিতে পা রেখে।

চিন্তার উত্তরাধিকার: যে দার্শনিকদের কাঁধে দাঁড়িয়েছিলেন কৌটিল্য

কৌটিল্য শুধু তার সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্বারাই প্রভাবিত হননি, তার চিন্তার পেছনে ছিল ভারতের এক সমৃদ্ধ দার্শনিক বিতর্কের ইতিহাস। তিনি কোনো শূন্য থেকে তার দর্শন তৈরি করেননি, বরং পূর্ববর্তী বিভিন্ন চিন্তাধারাকে গ্রহণ, বর্জন এবং সংশ্লেষণ (synthesis) করেই তার ‘অর্থশাস্ত্র’ রচনা করেছেন।

ধর্মশাস্ত্রের ধারা: যা তিনি ভাঙতে চেয়েছিলেন (The Tradition of Dharmashastra)

কৌটিল্যের আগে রাষ্ট্র এবং রাজার কর্তব্য নিয়ে আলোচনার প্রধান উৎস ছিল ধর্মশাস্ত্র এবং ধর্মসূত্রগুলো (যেমন, মনুসংহিতা, গৌতম ধর্মসূত্র)। এই গ্রন্থগুলোতে ‘ধর্ম’ (Dharma) বা নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্যকেই সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছিল। এই শাস্ত্রগুলো অনুযায়ী, রাজা হলেন ধর্মের রক্ষক। তার প্রধান কাজ হলো বর্ণাশ্রম ধর্মকে রক্ষা করা এবং প্রজাদের পারলৌকিক কল্যাণের পথ দেখানো। এখানে রাষ্ট্র ছিল মূলত ধর্মের একটি অনুষঙ্গ।

কৌটিল্য এই আদর্শবাদী ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে, বাস্তব রাজনীতির জটিল খেলায় শুধু ধর্ম বা নৈতিকতা দিয়ে টিকে থাকা যায় না। তাই তিনি ‘ধর্ম’-এর ওপর ‘অর্থ’ (Artha) বা রাষ্ট্রের বৈষয়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থকে স্থান দিয়েছিলেন। তার মানে এই নয় যে তিনি ধর্মকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তিনি ধর্ম এবং কাম-কে (desire) স্বীকার করেছেন, কিন্তু বলেছেন যে, এই দুটিই ‘অর্থ’-এর ওপর নির্ভরশীল। কারণ একটি সমৃদ্ধ এবং সুরক্ষিত রাষ্ট্র ছাড়া ধর্মচর্চা বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা পূরণ—কোনোটিই সম্ভব নয় (Olivelle, 2013)। তিনি ধর্মশাস্ত্রের ‘ধর্ম’-কে ‘রাজধর্ম’-এ রূপান্তরিত করেন, যেখানে রাজার প্রধান কর্তব্য হলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে অনৈতিক পথের আশ্রয় নিয়েও।

লোকায়ত বা চার্বাক দর্শন: বস্তুবাদী চিন্তার ছায়া (The Influence of Lokayata/Carvaka Philosophy)

প্রাচীন ভারতে একদল বস্তুবাদী দার্শনিক ছিলেন, যারা লোকায়ত বা চার্বাক নামে পরিচিত। তারা ছিলেন চূড়ান্ত নিরীশ্বরবাদী এবং সংশয়বাদী। তারা বেদ, পুরোহিত, যজ্ঞ, আত্মা বা পরকালের কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করতেন না। তাদের মতে, এই জগৎ এবং জীবনই একমাত্র সত্য। তাই তাদের মূলমন্ত্র ছিল: “যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ” (যতদিন বাঁচো, সুখে বাঁচো, প্রয়োজনে ঋণ করে ঘি খাও)। অর্থাৎ, পারলৌকিক মুক্তির মিথ্যার পেছনে না ছুটে এই জীবনের বৈষয়িক সুখকেই (material pleasure) গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

এই বস্তুবাদী চিন্তাধারার গভীর প্রভাব কৌটিল্যের ওপর পড়েছিল। কৌটিল্য হয়তো চার্বাকদের মতো ভোগবাদী ছিলেন না, কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন পুরোদস্তুর বস্তুবাদী। তিনি রাষ্ট্রকে কোনো ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন মানুষের তৈরি একটি সংগঠন হিসেবে যার মূল লক্ষ্য হলো বৈষয়িক সমৃদ্ধি (Artha) এবং ক্ষমতা (Danda) অর্জন। তিনি পারলৌকিক পুরস্কারের বদলে ইহলৌকিক সাফল্যকেই রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন। এই দিক থেকে দেখলে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হলো লোকায়ত দর্শনের রাজনৈতিক প্রয়োগ। তিনি যেন চার্বাকদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক (individual-centric) বস্তুবাদকে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক (state-centric) বাস্তববাদে পরিণত করেছিলেন (Bhattacharyya, 1991)।

শ্রমণ ধারা (বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম): এক পরোক্ষ প্রভাব (The Indirect Influence of Shramana Traditions)

কৌটিল্যের সময়েই বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের মতো শ্রমণ (Shramana) আন্দোলনগুলো ব্রাহ্মণ‍্যবাদের বিরুদ্ধে এক বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। এই ধর্মগুলো অহিংসা (Ahimsa), সাম্য এবং নৈতিক আচরণের ওপর জোর দিত। কৌটিল্যের হিংস্র এবং কুটিল রাজনীতির সাথে এই অহিংসাবাদী দর্শনের আপাতদৃষ্টিতে কোনো মিল নেই। বরং, তিনি মনে করতেন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে হিংসা বা দণ্ড অপরিহার্য।

কিন্তু প্রভাবটা ছিল আরও সূক্ষ্ম। বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্ম রাজাদের নৈতিক আচরণের ওপর জোর দিত। সম্রাট অশোক, যিনি কৌটিল্যের শিষ্য চন্দ্রগুপ্তের নাতি ছিলেন, তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘ধর্মবিজয়’-এর নীতি গ্রহণ করেন। কৌটিল্য হয়তো এই অহিংসার নীতিকে রাজনৈতিকভাবে অবাস্তব মনে করতেন, কিন্তু তিনি এই ধর্মগুলোর জনপ্রিয়তার কারণটা বুঝেছিলেন। তিনি হয়তো এও বুঝেছিলেন যে, শুধু দণ্ড বা ভয় দিয়ে প্রজাদের শাসন করা যায় না, তাদের কল্যাণও করতে হয়। বৌদ্ধ ধর্মের ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’ (for the welfare of many, for the happiness of many) নীতির একটি প্রতিচ্ছবি আমরা কৌটিল্যের ‘যোগক্ষেম’ ধারণার মধ্যে দেখতে পাই। তিনি হয়তো এই জনকল্যাণের ধারণাকে তার রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল রাখার একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন (Thapar, 2002)। অর্থাৎ, তিনি ধর্মের নৈতিক উদ্দেশ্যকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে রূপান্তরিত করেন।

পূর্ববর্তী অর্থশাস্ত্রকারগণ: তিনি যার উত্তরসূরি (Predecessors in the Arthashastra Tradition)

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কৌটিল্য নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি অর্থশাস্ত্রের প্রথম লেখক নন। তিনি তার গ্রন্থে বৃহস্পতি, উশনস, ভরদ্বাজ, বিশালাক্ষ, পরাশরসহ বহু পূর্ববর্তী আচার্যের নাম উল্লেখ করেছেন এবং তাদের মত খণ্ডন বা গ্রহণ করেছেন। এর থেকে বোঝা যায় যে, কৌটিল্যের আগেও ভারতে রাষ্ট্রচিন্তার একটি শক্তিশালী ‘অর্থশাস্ত্র’ ধারা প্রচলিত ছিল, যা ছিল মূলত বাস্তববাদী এবং রাষ্ট্রকেন্দ্রিক।

দুর্ভাগ্যবশত, এই পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলো আজ আর পাওয়া যায় না। কিন্তু কৌটিল্যের লেখার মাধ্যমে আমরা তাদের চিন্তার কিছু আভাস পাই। যেমন, তিনি আচার্য ভরদ্বাজের একটি মত উল্লেখ করেছেন, যেখানে ভরদ্বাজ পরামর্শ দিচ্ছেন যে, একজন মন্ত্রী যদি রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, তবে শুধু তাকে নয়, তার পুরো পরিবারকে নিঃশেষ করে দেওয়া উচিত। কৌটিল্য এই চরম নিষ্ঠুর মতের সাথে পুরোপুরি একমত না হলেও, এটি প্রমাণ করে যে তার আগেও কতটা নির্মম রাজনৈতিক চিন্তার অস্তিত্ব ছিল। কৌটিল্য এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং প্রায়শই পরস্পরবিরোধী চিন্তাগুলোকে একত্রিত করে একটি সুসংহত, সমন্বিত এবং অসামান্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই ধারার উদ্ভাবক নন, তিনি ছিলেন এই ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ সংকলক এবং সংশ্লেষক (Kangle, 1965)।

সময়ের সন্তান

তাহলে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল? কৌটিল্য কোনো আকাশ থেকে পড়া বজ্রপাত ছিলেন না। তিনি ছিলেন তার সময়ের সন্তান। তিনি এমন এক যুগে জন্মেছিলেন যেখানে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা, যেখানে শক্তিশালীরা দুর্বলদের পিষে ফেলত, যেখানে বিদেশি আক্রমণের ভয় সবসময় তাড়া করে বেড়াত। এই রূঢ় বাস্তবতাই তাকে শিখিয়েছিল যে, রাষ্ট্রের টিকে থাকাই সবচেয়ে বড় কথা।

আর তার চিন্তার রসদ তিনি পেয়েছিলেন পূর্ববর্তী দার্শনিকদের কাছ থেকে। তিনি ধর্মশাস্ত্রের আদর্শবাদকে বাস্তবতার জমিতে নামিয়ে এনেছেন, লোকায়ত দর্শনের বস্তুবাদকে রাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তি বানিয়েছেন, এবং অর্থশাস্ত্রের পুরোনো ধারাকে এক নতুন, পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন।

তিনি যেন একজন দক্ষ রসায়নবিদ, যিনি বিভিন্ন উপাদানকে সঠিক অনুপাতে মিশিয়ে এক ভয়ংকর কিন্তু কার্যকর বিষ তৈরি করেছেন—যে বিষ শত্রুকে মারে, কিন্তু রাষ্ট্রকে বাঁচায়। তাই কৌটিল্যকে বুঝতে হলে তার সময়কে বুঝতে হবে, তার পেছনের পৃথিবীকে জানতে হবে। কারণ সেই আঁধারই তাকে জন্ম দিয়েছিল, সেই রাজনৈতিক আর দার্শনিক সংঘাতই তাকে তৈরি করেছিল—একই সাথে ভয়ংকর এবং কালজয়ী এক রাষ্ট্রগুরু হিসেবে।

অর্থশাস্ত্র: শুধু অর্থের কথা নয়, এ এক সাম্রাজ্যের নীলনকশা

বইটির নাম ‘অর্থশাস্ত্র’ (Arthashastra) শুনে আজকের দিনে অনেকেই ভাবতে পারেন, এটা হয়তো অর্থনীতি বা টাকা-পয়সা সংক্রান্ত কোনো বই। এই ধারণাটি একেবারেই ভুল। সংস্কৃত ‘অর্থ’ শব্দের একটি মানে হলো সম্পদ বা material well-being, কিন্তু এর আরেকটি, আরও ব্যাপক অর্থ হলো ‘উদ্দেশ্য’ বা ‘লক্ষ্য’ (purpose)। কৌটিল্যের কাছে ‘অর্থ’ মানে হলো পৃথিবী, অর্থাৎ মানুষের বসতিসহ ভূমি। তাই অর্থশাস্ত্রের আক্ষরিক মানে দাঁড়ায়, “ভূমি অর্জন এবং তা রক্ষা করার বিজ্ঞান” (The science of acquiring and protecting the earth) (Kangle, 1965)। এটি শুধু সম্পদ ব্যবস্থাপনার বই নয়, এটি ক্ষমতা অর্জন, সংহতকরণ এবং সম্প্রসারণের এক পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা।

এটি কেবল একটি বই নয়, এটি একটি বিশ্বকোষ। পনেরোটি খণ্ডে (Adhikaranas) বিভক্ত এই গ্রন্থে আছে ১৫০টি অধ্যায় (Adhyayas), ১৮০টি বিষয় (Prakaranas) এবং প্রায় ৬০০০ সূত্র বা শ্লোক। কী নেই এতে?

  • প্রথম খণ্ডে রাজার প্রশিক্ষণ, মন্ত্রী নিয়োগ এবং গুপ্তচরদের নিয়ন্ত্রণের কথা।

  • দ্বিতীয় খণ্ডে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যক্ষদের (Superintendents) কাজ, যেমন—কোষাধ্যক্ষ, খনি অধিকর্তা, শুল্ক আদায়কারী, কৃষির নিয়ন্ত্রক। এখানে নগর পরিকল্পনা থেকে শুরু করে আদমশুমারির কথাও বলা আছে।

  • তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন (Civil and Criminal Law), বিচারব্যবস্থা এবং ‘কন্টকশোধন’ (Kantakashodhana) বা রাষ্ট্রের শত্রুদের নির্মূল করার ভয়ংকর পদ্ধতির বর্ণনা।

  • পঞ্চম খণ্ডে রাজকর্মচারীদের আচরণবিধি এবং বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দেওয়ার উপায়।

  • ষষ্ঠ থেকে পঞ্চদশ খণ্ড পর্যন্ত মূলত বৈদেশিক নীতি, যুদ্ধ, কূটনীতি, মিত্রদের সাথে আচরণ, দুর্গ নির্মাণ এবং শত্রুকে দুর্বল করার নানা গোপন কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এমনকি একজন আদর্শ পতিতার কী কী গুণ থাকা উচিত এবং কীভাবে তাদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সেই আলোচনাও কৌটিল্য বাদ দেননি। তিনি যেন একটি রাষ্ট্রকে একটি জটিল যন্ত্রের মতো দেখেছেন এবং সেই যন্ত্রকে সচল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি নাটবল্টুর নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে গেছেন।

মজার ব্যাপার হলো, এই মহামূল্যবান গ্রন্থটি বহু শতাব্দী ধরে হারিয়ে গিয়েছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পর এর উল্লেখ আর পাওয়া যায় না। মনে করা হতো, এটি চিরতরে বিলুপ্ত। কিন্তু ১৯০৫ সালে মহীশূরের ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন লাইব্রেরিয়ান, ডক্টর রুদ্রপট্টনম শামাশাস্ত্রী (Dr. Rudrapatnam Shamasastry), তালপাতায় লেখা এই বইয়ের একটি সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান। এরপর তিনি ১৯০৯ সালে এর একটি সংস্করণ এবং ১৯১৫ সালে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করলে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে পশ্চিমা অ্যাকাডেমিক মহলে, তোলপাড় শুরু হয়।

পশ্চিমের পণ্ডিতরা এতদিন ভাবতেন, রাষ্ট্রচিন্তার আধুনিক বাস্তববাদী (realist) ধারণা কেবল ইউরোপেই জন্মেছে, যার অন্যতম প্রবক্তা ম্যাকিয়াভেলি। কিন্তু অর্থশাস্ত্র আবিষ্কারের পর তারা দেখলেন, ম্যাকিয়াভেলির জন্মের প্রায় ১৮০০ বছর আগেই ভারতে এক ব্যক্তি আরও অনেক বিস্তারিত, আরও অনেক সুশৃঙ্খল এবং আরও অনেক ব্যাপক পরিসরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো আলোচনা করে গেছেন (Boesche, 2002)। বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) প্রথমে এর সত্যতা নিয়ে সন্দিহান থাকলেও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’-এর তুলনায় অর্থশাস্ত্র অনেক বেশি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এবং এর বাস্তববাদিতায় সত্যিকারের রেডিক্যাল।

রাষ্ট্রের শরীর: সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব (Saptanga Theory) – এক জীবন্ত সত্তার ব্যবচ্ছেদ

আচ্ছা, বলুন তো, একটি রাষ্ট্র কী দিয়ে তৈরি? মাটি, মানুষ, নাকি সরকার? কৌটিল্য এই প্রশ্নের এক অসাধারণ উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলছেন, রাষ্ট্র হলো একটি জীবন্ত শরীরের মতো। এর সাতটি অঙ্গ বা অংশ (limbs/Prakritis) আছে। এই সাতটি অঙ্গ সুস্থ ও সবল থাকলেই রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে। কোনো একটি অঙ্গ দুর্বল বা রোগাক্রান্ত হলে পুরো রাষ্ট্রই অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই তত্ত্বটির নাম ‘সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব’ (Saptanga Theory of the State)। এই অঙ্গগুলোর মধ্যে একটি আপেক্ষিক গুরুত্বের ক্রমও তিনি নির্ধারণ করেছেন।

১. স্বামী (The Sovereign King): স্বামী মানে এখানে ‘প্রভু’ বা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী রাজা। তিনি হলেন রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক, তার স্নায়ুতন্ত্র। তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কৌটিল্যের রাজা কোনো স্বেচ্ছাচারী স্বৈরশাসক নন। তাকে হতে হবে ‘রাজর্ষি’ (Rajarshi), অর্থাৎ রাজার মতো ক্ষমতাধর কিন্তু ঋষির মতো জ্ঞানী, সংযমী এবং ন্যায়পরায়ণ। তাকে চারটি বিদ্যা—আন্বীক্ষিকী (দর্শন ও যুক্তি), ত্রয়ী (তিন বেদ), বার্তা (কৃষি ও বাণিজ্য), এবং দণ্ডনীতি (শাসন ও আইন)—এ পারদর্শী হতে হবে। তার প্রধান কাজ হলো ‘যোগক্ষেম’ (Yogakshema) নিশ্চিত করা। ‘যোগ’ মানে যা নেই তা অর্জন করা (acquisition of what is not possessed), আর ‘ক্ষেম’ মানে যা আছে তা রক্ষা করা (preservation of what is possessed)। এককথায়, প্রজাদের নিরাপত্তা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা। রাজা হবেন শিক্ষিত, বিনয়ী, দূরদর্শী এবং ন্যায়পরায়ণ। কৌটিল্য রাজার জন্য একটি কঠোর দৈনন্দিন রুটিন বেঁধে দিয়েছেন, যেখানে তিনি দিনের ২৪ ঘণ্টাকে নির্দিষ্ট কাজে ভাগ করে নেবেন, যেন রাজ্যের কোনো দিকই—প্রশাসন, গুপ্তচরবৃত্তি, প্রজাদের আবেদন শোনা—অবহেলিত না হয়।

২. অমাত্য (The Ministers and Bureaucracy): অমাত্য বা মন্ত্রীরা হলেন রাষ্ট্রের চোখ। একা রাজার পক্ষে সব দেখা, সব জানা সম্ভব নয়। তাই তাকে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজন একদল যোগ্য, সৎ এবং অনুগত মন্ত্রী ও আমলা। কৌটিল্য একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের ওপর ব্যাপক জোর দিয়েছেন। তিনি বলছেন, এই মন্ত্রীদের নিয়োগের আগে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে। তাদের সততা, প্রজ্ঞা, বিশ্বস্ততা এবং আনুগত্য—সবই যাচাইয়ের বিষয়। এর জন্য তিনি ‘উপধা’ (Upadha) বা চারটি পরীক্ষার কথা বলেছেন—ধর্মোপধা (ধর্মের ভয় দেখিয়ে সততা পরীক্ষা), অর্থোপধা (টাকার লোভ দেখিয়ে পরীক্ষা), কামোপধা (নারীর প্রলোভন দেখিয়ে চরিত্র পরীক্ষা) এবং ভয়োপধা (প্রাণনাশের ভয় দেখিয়ে আনুগত্য পরীক্ষা)। যারা এই চারটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তারাই হবে সর্বোচ্চ মন্ত্রী হওয়ার যোগ্য। কারণ একজন অযোগ্য বা বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রী পুরো রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

৩. জনপদ (The Territory and People): জনপদ হলো রাষ্ট্রের পা এবং উরু, যার ওপর ভর করে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে। এর দুটি অংশ—ভূমি (territory) ও জনগণ (people)। ভূমি হতে হবে উর্বর, প্রাকৃতিক সম্পদে (খনি, বন, জল) ভরপুর, পশুচারণের জন্য উপযুক্ত এবং সুরক্ষিত। আর জনগণ হতে হবে পরিশ্রমী, সৎ, রাজার প্রতি অনুগত এবং কর প্রদানে ইচ্ছুক। কৌটিল্য মনে করতেন, খালি বা অনুর্বর জমি নিয়ে কোনো লাভ নেই, রাষ্ট্র শক্তিশালী হয় তার কর্মঠ ও সুখী নাগরিকদের দিয়ে। তিনি এমনকি এও বলেছেন যে, প্রয়োজনের সময় প্রজাদের বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতেও প্রস্তুত থাকতে হবে। একটি দুর্বল বা বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের জন্য বিশাল এক বোঝা।

৪. দুর্গ (The Forts): দুর্গ হলো রাষ্ট্রের বাহু, যা রাষ্ট্রকে বাইরের আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ থেকে রক্ষা করে। কৌটিল্য মনে করতেন, “কোষ এবং সেনাবাহিনী দুর্গের মধ্যেই নিরাপদ থাকে।” অর্থাৎ, দুর্গ ছাড়া রাষ্ট্রের সম্পদ ও শক্তি দুটোই অরক্ষিত। তিনি চার ধরনের দুর্গের কথা বলেছেন—ঔদক দুর্গ বা জলদুর্গ (নদী বা সমুদ্রবেষ্টিত), পার্বত দুর্গ বা পর্বতদুর্গ (পাহাড়ের ওপরে বা গুহায়), ধান্বন দুর্গ বা মরু দুর্গ (জল-ঘাসহীন মরুভূমির মাঝে) এবং বনদুর্গ (গভীর জঙ্গল ও জলাভূমিতে পূর্ণ)। একটি সুরক্ষিত রাজধানী এবং সীমান্ত রক্ষার জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শক্তিশালী দুর্গ থাকা অপরিহার্য।

৫. কোষ (The Treasury): কোষ বা রাজকোষ হলো রাষ্ট্রের মুখ, যেখান থেকে রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি, খাদ্য এবং রসদ আসে। কৌটিল্যের একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, “সকল কাজই অর্থের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং, সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো রাজকোষের যত্ন নেওয়া” (All undertakings depend upon finance. Hence, foremost attention shall be paid to the treasury) (Kangle, 1972)। একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী রাখা, দুর্গ নির্মাণ করা, আমলাদের বেতন দেওয়া, জনকল্যাণমূলক কাজ করা—সবকিছুর জন্যই চাই অর্থ। কিন্তু তিনি এও বলেছেন, কর সংগ্রহ করতে হবে ন্যায্যভাবে এবং প্রজাদের ওপর বোঝা না চাপিয়ে। তার বিখ্যাত উপমাটি হলো, কর আদায়কারী হবে মৌমাছির মতো, যে ফুল থেকে প্রয়োজনমতো মধু সংগ্রহ করে, কিন্তু ফুলের কোনো ক্ষতি করে না। অতিরিক্ত কর প্রজাদের বিদ্রোহী করে তোলে এবং রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।

৬. দণ্ড (The Army/Authority): দণ্ড মানে এখানে ‘লাঠি’ বা শাস্তিদানের ক্ষমতা, যা মূলত সেনাবাহিনীকে বোঝায়। সেনাবাহিনী হলো রাষ্ট্রের মন, যা তার শক্তি এবং সাহসকে প্রকাশ করে। কৌটিল্যের মতে, একটি রাষ্ট্রের অবশ্যই শক্তিশালী, সাহসী, সুপ্রশিক্ষিত এবং রাজার প্রতি অনুগত এক সেনাবাহিনী থাকতে হবে। তিনি ছয় ধরনের সেনার কথা বলেছেন: মৌল (hereditary troops, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য), ভৃতক (hired soldiers), শ্রেণী (guild soldiers), মিত্রবল (allied forces), অমিত্রবল (enemy deserters) এবং আটবিক (forest tribes)। শুধু বাইরের শত্রু নয়, ভেতরের বিদ্রোহ দমনের জন্যও সেনাবাহিনী অপরিহার্য। তবে এই ‘দণ্ড’ শুধু সামরিক শক্তি নয়, এটি রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগের সামগ্রিক ক্ষমতাও বটে।

৭. মিত্র (The Allies): মিত্র বা বন্ধুরাষ্ট্র হলো রাষ্ট্রের কান, যা দূরবর্তী বিপদ বা সুযোগের কথা আগে থেকে শুনতে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রই একা চলতে পারে না। তাই নির্ভরযোগ্য বন্ধুরাষ্ট্র থাকা খুব জরুরি। কৌটিল্য বলেছেন, এমন রাষ্ট্রকে বন্ধু বানানো উচিত যে প্রয়োজনে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে এবং বিপদে ফেলবে না। তিনি দুই ধরনের মিত্রের কথা বলেছেন—সহজ (sahaja) বা প্রাকৃতিক মিত্র (যেমন, প্রতিবেশীর প্রতিবেশী) এবং কৃত্রিম (kritrima) বা অর্জিত মিত্র, যাদের সাথে চুক্তি বা স্বার্থের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। তার মতে, একজন আদর্শ মিত্র তিনিই হবেন যিনি শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্য এবং যার সাথে স্বার্থের সংঘাত কম।

এই সাতটি অঙ্গ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। একটি ছাড়া অন্যটি অচল। রাজার গুরুত্ব সর্বাধিক, কিন্তু কোষ বা মিত্র ছাড়া রাজাও শক্তিহীন। কৌটিল্যের রাষ্ট্র তাই কোনো জড় বস্তু নয়, এটি একটি জীবন্ত, শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া এক সত্তা, যার প্রতিটি অঙ্গের যত্ন নেওয়া আবশ্যক।

রাজার ধর্ম: মাৎস্যন্যায় থেকে মুক্তি এবং ধর্মের এক নতুন ব্যাখ্যা

কৌটিল্য কেন একটি শক্তিশালী, প্রায় সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের ওপর এত জোর দিয়েছেন? তার দর্শনের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, এর মূল কারণ হলো এক ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে মানুষকে রক্ষা করা, যাকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘মাৎস্যন্যায়’ (Matsya Nyaya) বা ‘মাছের আইন’।

ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি। পুকুরে বা নদীতে যেমন কোনো আইন নেই, সেখানে বড় মাছ অবলীলায় ছোট মাছকে খেতে পারে, তেমনি একটি অসংগঠিত, অরাজক সমাজে শক্তিশালী মানুষ দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে। তাদের সম্পদ কেড়ে নেয়, তাদের অধিকার হরণ করে, তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এটাই হলো প্রকৃতির আদিম নিয়ম—’জোর যার মুলুক তার’। এই ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই রাষ্ট্রের জন্ম। রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো আইন (Dharma) এবং দণ্ড (Punishment) প্রয়োগ করে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, যাতে দুর্বলতম মানুষটিও নিরাপদে বাঁচতে পারে (Olivelle, 2013)।

এখানেই কৌটিল্যের ‘ধর্ম’ (Dharma) বিষয়ক ধারণাটি প্রচলিত আধ্যাত্মিক ধারণা থেকে আলাদা হয়ে যায়। তার কাছে ধর্ম মানে পারলৌকিক মুক্তি বা মোক্ষ নয়। তার কাছে ধর্ম হলো সামাজিক শৃঙ্খলা (social order), রাজার কর্তব্য, এবং সেইসব আইন যা সমাজকে একত্রে ধারণ করে রাখে। রাজা হলেন ‘ধর্মপ্রবর্তক’ (Dharmapravartaka) বা ধর্মের রক্ষক ও প্রবর্তক।

তাই রাজার প্রধান ধর্ম বা ‘রাজধর্ম’ (Rajdharma) হলো প্রজাপালন। তিনি প্রায়ই বলেছেন, “প্রজার সুখেই রাজার সুখ, প্রজার কল্যাণেই তাঁর কল্যাণ। নিজের যা ভালো লাগে তা রাজার জন্য হিতকর নয়, প্রজার কাছে যা প্রিয়, রাজার কাছেও তাই প্রিয় হওয়া উচিত” (Praja sukhe sukham rajnah, prajanam ca hite hitam)। এই একটি বাক্যেই বোঝা যায়, তার দর্শন চূড়ান্ত বিচারে কতটা প্রজাকেন্দ্রিক ছিল। ক্ষমতা তার কাছে লক্ষ্য ছিল না, ছিল লক্ষ্য অর্জনের একটি উপায় মাত্র। আর সেই লক্ষ্য হলো—একটি সুশৃঙ্খল, সমৃদ্ধ এবং নিরাপদ সমাজ, যেখানে মাৎস্যন্যায়ের কোনো স্থান নেই।

আইন ও বিচার: কণ্টকশোধন (Kantakashodhana) বা কাঁটা উপড়ে ফেলার নির্মমতা

সমাজকে মাৎস্যন্যায় থেকে রক্ষা করার জন্য কৌটিল্য বিচার ব্যবস্থার কথা বিষদভাবে বলেছেন। তিনি দুই ধরনের আদালতের প্রস্তাব করেন:

১. ধর্মস্থীয় (Dharmasthiya): এই আদালতগুলো মূলত দেওয়ানি মামলা (civil disputes) দেখত। জমি, ঋণ, চুক্তি, বিয়ে, উত্তরাধিকার ইত্যাদি সংক্রান্ত বিবাদের নিষ্পত্তি হতো এখানে। তিনজন ব্যবহারশাস্ত্র-জানা অমাত্য এবং তিনজন ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি মিলে এই বিচার করতেন।

২. কণ্টকশোধন (Kantakashodhana): আক্ষরিক অর্থে, “কাঁটা উপড়ে ফেলা”। এই আদালতগুলো ছিল আধুনিক ক্রিমিনাল কোর্ট এবং জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সির এক মিশ্রণ। সমাজের ‘কাঁটা’—অর্থাৎ চোর, ডাকাত, খুনি, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারী, বিদ্রোহী, গুপ্তচর এবং রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক যেকোনো ব্যক্তিকে নির্মূল করাই ছিল এদের কাজ। এই আদালতগুলো প্রচলিত সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর কম এবং গোয়েন্দা তথ্য ও তদন্তের ওপর বেশি নির্ভর করত। প্রয়োজন হলে, রাষ্ট্রের স্বার্থে সন্দেহভাজনদের ওপর নির্যাতন (torture) প্রয়োগ করে স্বীকারোক্তি আদায়ের অনুমতিও কৌটিল্য দিয়েছেন।

এখানেই আমরা কৌটিল্যের সেই নির্মম, বাস্তববাদী রূপটি দেখতে পাই। তার কাছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সবার ঊর্ধ্বে। ব্যক্তির অধিকার এখানে গৌণ। সমাজের শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে এমন যেকোনো ‘কাঁটা’কে তিনি নির্দয়ভাবে উপড়ে ফেলার পক্ষে ছিলেন। এই ধারণা আজকের মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে ভয়ংকর মনে হতে পারে, কিন্তু কৌটিল্যের চোখে এটি ছিল রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল রাখার জন্য একটি অপরিহার্য অস্ত্রোপচার।

কূটনীতির বিষাক্ত খেলা: মণ্ডল তত্ত্ব ও ষাড়গুণ্য

এতক্ষণ তো রাজ্যের ভেতরের কথা বললাম। এবার আসা যাক সেই অংশে, যা কৌটিল্যকে একই সাথে ভয়ংকর এবং আধুনিক করে তুলেছে। তার বৈদেশিক নীতি বা কূটনীতির জগৎ।

কৌটিল্য মনে করতেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হলো এক চিরস্থায়ী সংগ্রামের ক্ষেত্র। এখানে কেউ চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নয়। রাষ্ট্রের স্বার্থই (interest) শেষ কথা। তিনি আদর্শবাদ বা ভাববাদের কোনো জায়গা রাখেননি। তার মতে, সব রাষ্ট্রই ক্ষমতা বাড়াতে চায়, সম্প্রসারণ করতে চায়। এই সম্পর্কগুলোকে বোঝার জন্য তিনি একটি অসাধারণ জ্যামিতিক মডেল দিয়েছেন, যার নাম ‘মণ্ডল তত্ত্ব’ (Mandala Theory)।

‘মণ্ডল’ মানে হলো ‘বৃত্ত’ (circle)। ধরুন, আপনি একজন রাজা। আপনার নাম ‘বিজিগীষু’ (Vijigishu), অর্থাৎ যিনি জয় করতে ইচ্ছুক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আপনার রাজ্যটি হলো এই মণ্ডলের কেন্দ্র।

  • আপনার ঠিক পাশের রাজ্যটি হলো আপনার স্বাভাবিক শত্রু বা ‘অরি’ (Ari)। কারণ সীমানা নিয়ে সংঘাত, সম্পদের লোভ, ক্ষমতার রেষারেষি—এগুলো লেগেই থাকবে।
  • আপনার শত্রুর প্রতিবেশী রাজ্যটি আপনার স্বাভাবিক বন্ধু বা ‘মিত্র’ (Mitra)। কারণ প্রবাদেই আছে, “শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু।”
  • আপনার বন্ধুর পাশের রাজ্যটি হবে ‘অরিমিত্র’ (Arimitra) বা শত্রুর বন্ধু, তাই সে আপনার জন্য বিপজ্জনক।
  • আবার তার পাশের জন হবে ‘মিত্রমিত্র’ (Mitramitra) বা বন্ধুর বন্ধু, সে আপনারও বন্ধু হতে পারে।
  • সবশেষে, শত্রুর বন্ধুর বন্ধু হবে ‘অরিমিত্রামিত্র’ (Arimitramitra)।

এভাবে তিনি মোট ১২ জন রাজার একটি বৃত্ত তৈরি করেছেন, যেখানে প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থ অনুযায়ী অন্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে। এই বৃত্তের বাইরেও আরও দুজন গুরুত্বপূর্ণ রাজা আছেন: মধ্যম (Madhyama), যিনি বিজিগীষু এবং অরি উভয়ের পাশেই অবস্থিত এবং উভয়ের চেয়ে শক্তিশালী; এবং উদাসীন (Udasina), যিনি এই সবার থেকে ভৌগোলিকভাবে দূরে অবস্থিত কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী এবং যেকোনো পক্ষে যোগ দিয়ে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন।

এই মণ্ডলের ধারণাটি আজ ২১ শতকেও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়। যেমন, ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান বা চীন-ভারত-ভিয়েতনাম সম্পর্ককে এই তত্ত্ব দিয়ে সহজেই বোঝা যায় (Boesche, 2002)।

এই জটিল সম্পর্কের জালে টিকে থাকার জন্য এবং নিজের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য একজন রাজাকে ছয়টি কৌশল বা ‘ষাড়গুণ্য’ (Shadgunya) অবলম্বন করতে হবে:

  • ১. সন্ধি (Peace): যখন শত্রু আপনার চেয়ে শক্তিশালী, তখন তার সাথে শান্তিচুক্তি করে সময় নিন, নিজেকে শক্তিশালী করুন এবং সঠিক সুযোগের অপেক্ষা করুন।
  • ২. বিগ্রহ (War): যখন আপনি শত্রুর চেয়ে নিশ্চিতভাবে শক্তিশালী, তখন যুদ্ধ ঘোষণা করুন। তবে যুদ্ধের আগে লাভ-ক্ষতির হিসাব করে নিতে হবে।
  • ৩. আসন (Neutrality): যখন দুজনের শক্তিই সমান, তখন নিরপেক্ষ থাকুন। অপেক্ষা করুন, দেখুন পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। হয়তো দুই শত্রু নিজেরা যুদ্ধ করে দুর্বল হয়ে পড়বে, তখন আপনি লাভবান হবেন।
  • ৪. যান (Marching): যখন মনে হবে আপনি প্রতিপক্ষকে সহজেই আক্রমণ করতে পারবেন এবং আপনার নিজের অবস্থান সুরক্ষিত, তখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিন বা সৈন্যচালনা করুন।
  • ৫. সংশ্রয় (Seeking Shelter): যখন আপনি খুব দুর্বল এবং কোনো শক্তিশালী শত্রু আপনাকে আক্রমণ করতে উদ্যত, তখন অন্য কোনো আরও শক্তিশালী রাজার আশ্রয় নিন, ঠিক যেমন ছোট মাছ বড় মাছের আক্রমণ থেকে বাঁচতে অন্য কিছুর আড়ালে আশ্রয় নেয়।
  • ৬. দ্বৈধীভাব (Dual Policy): এটি সবচেয়ে কুটিল নীতি। এর মানে হলো, একই সাথে দুটি নীতি চালানো। যেমন, একজনের সাথে শান্তিচুক্তি করে অন্যজনের সাথে যুদ্ধ করা। অথবা কোনো রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব দেখিয়ে গোপনে তার শত্রুকে সাহায্য করা।

কৌটিল্যের কাছে এর কোনোটিই নৈতিক বা অনৈতিক নয়। সবই হলো প্রয়োজনভিত্তিক (expedient)। রাষ্ট্রের টিকে থাকা এবং সমৃদ্ধিই হলো পরম ধর্ম।

গুপ্তচর: রাজার তৃতীয় নয়ন এবং সাম্রাজ্যের অদৃশ্য জাল

কৌটিল্যের রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এবং ভয়ংকর অংশ হলো তার গুপ্তচর ব্যবস্থা (Espionage system)। তিনি মনে করতেন, গুপ্তচরেরা হলো রাজার চোখ ও কান। তাদের ছাড়া রাজা অন্ধ এবং বধির। অর্থশাস্ত্রে গুপ্তচরবৃত্তির ওপর এত বিস্তারিত এবং সুশৃঙ্খল আলোচনা আছে যে, আধুনিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তিনি গুপ্তচরবৃত্তিকে একটি শিল্প এবং বিজ্ঞানের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।

কৌটিল্য বিভিন্ন ধরনের গুপ্তচরের কথা বলেছেন। তারা সমাজের সব স্তরে এমনভাবে মিশে থাকবে যে, কেউ তাদের চিনতে পারবে না। প্রধানত দুই ধরনের গুপ্তচর ছিল—সংস্থ (Sanstha) বা এক জায়গায় স্থিতিশীল গুপ্তচর, এবং সঞ্চার (Sanchara) বা ভ্রাম্যমাণ গুপ্তচর।

স্থায়ী গুপ্তচরদের মধ্যে ছিল:

  • কাপটিক (Kapatika): ছাত্রের ছদ্মবেশে থাকা চালাক ও সাহসী গুপ্তচর।
  • উদাস্থিত (Udasthita): সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে থাকা গুপ্তচর, যার প্রচুর শিষ্য থাকবে (যারাও গুপ্তচর) এবং তারা নানা জায়গা থেকে খবর এনে গুরুকে দেবে।
  • গৃহপতিক (Grihapatika): গরিব কৃষকের ছদ্মবেশে থাকা গুপ্তচর।
  • বৈদেহক (Vaidehaka): বণিকের ছদ্মবেশে থাকা গুপ্তচর, যে ব্যবসার আড়ালে দেশ-বিদেশের তথ্য সংগ্রহ করবে।
  • তাপস (Tapasa): তপস্বীর ছদ্মবেশে থাকা গুপ্তচর, যে গ্রামের বাইরে আশ্রম বানিয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যদ্বাণী বা অলৌকিক ক্ষমতার ভান করে মানুষের মন থেকে গোপন কথা বের করে আনবে।

ভ্রাম্যমাণ গুপ্তচরদের মধ্যে ছিল আরও ভয়ংকর কিছু চরিত্র:

  • সত্রী (Satri): অনাথ, বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত গুপ্তচর যারা সংকেত ভাষা, ছদ্মবেশ এবং গুপ্তবিদ্যায় পারদর্শী।
  • তীক্ষ্ণ (Tikshna): বেপরোয়া প্রকৃতির গুপ্তচর, যারা অর্থ বা জীবনের মায়া করে না। এরা গুপ্তহত্যা, অগ্নিসংযোগ বা যেকোনো ভয়ংকর কাজ করতেও পিছপা হবে না।
  • রষদ (Rashada): বিষপ্রয়োগকারী গুপ্তচর (poisoners), যারা রাজার শত্রুদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের খাবারে বা পানীয়ে বিষ মিশিয়ে হত্যা করত।
  • ভিক্ষুকী (Bhikshuki): সন্ন্যাসিনী বা বিধবার ছদ্মবেশে থাকা নারী গুপ্তচর, যারা অন্দরমহলে সহজে প্রবেশ করে রানি বা মন্ত্রীদের স্ত্রীদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করত।

এই গুপ্তচরেরা শুধু শত্রুর রাজ্যে নয়, নিজের রাজ্যেও ছড়িয়ে থাকত। মন্ত্রীরা ঠিকমতো কাজ করছে কি না, সেনাপতিরা বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করছে কি না, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দুর্নীতি করছে কি না, এমনকি সাধারণ প্রজারা রাজার ওপর সন্তুষ্ট কি না—এই সব খবর রাজার কাছে পৌঁছে যেত। কৌটিল্যের রাষ্ট্র ছিল এক প্যানোপটিকন (panopticon)—জেরেমি বেন্থামের কল্পিত সেই কারাগার, যেখানে কেন্দ্রীয় টাওয়ার থেকে রক্ষী সব বন্দিকে দেখতে পায়, কিন্তু বন্দিরা রক্ষীকে দেখতে পায় না। কৌটিল্যের রাজা ছিলেন সেই অদৃশ্য রক্ষী।

সাম, দাম, দণ্ড, ভেদ: সমস্যা সমাধানের চতুরঙ্গ চাবিকাঠি

যেকোনো সমস্যা—সেটা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ হোক বা বৈদেশিক সংকট—সমাধানের জন্য কৌটিল্য চারটি উপায়ের (Upayas) কথা বলেছেন। তিনি এগুলোকে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন, অর্থাৎ সহজ থেকে কঠিনে যাওয়ার কথা বলেন।

  • ১. সাম (Sama): অর্থাৎ বুঝিয়ে-শুনিয়ে, আলোচনা করে বা যুক্তি দিয়ে সমস্যা সমাধান করা (Conciliation)। এটিই প্রথম এবং সেরা উপায়, কারণ এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। প্রতিপক্ষকে সম্মান দেখিয়ে, তার প্রশংসা করে নিজের পক্ষে আনার চেষ্টা করা।
  • ২. দাম (Dama): যদি বোঝানোতে কাজ না হয়, তবে উপহার, উৎকোচ বা আর্থিক সুবিধা দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিজের পক্ষে আনা (Gifts/Bribery)। এটা হতে পারে অর্থ, জমি বা কোনো পদ। মানুষের লোভকে ব্যবহার করে কার্যসিদ্ধি করা।
  • ৩. ভেদ (Bheda): এতেও কাজ না হলে শত্রুপক্ষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা (Sowing Dissent)। তাদের মিত্রদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে তাদের জোট ভেঙে দেওয়া। শত্রুর সেনাপতি বা মন্ত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ তৈরি করে তাদের দুর্বল করে দেওয়া। গুপ্তচর ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো এই নীতির একটি প্রধান অংশ।
  • ৪. দণ্ড (Danda): যখন উপরের কোনোটিতেই কাজ হবে না, তখন শেষ উপায় হলো শক্তি প্রয়োগ বা শাস্তি দেওয়া (Force/Punishment)। এটা হতে পারে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, নির্বাসন দেওয়া, অথবা চূড়ান্ত পর্যায়ে যুদ্ধ ঘোষণা করা।

লক্ষণীয় যে, কৌটিল্য যুদ্ধ বা শক্তি প্রয়োগকে শেষ উপায় হিসেবে রেখেছেন। তিনি রক্তপাত এবং ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব এড়াতে চেয়েছেন, কারণ যুদ্ধ রাষ্ট্রের জন্য ব্যয়বহুল এবং এর ফলাফল অনিশ্চিত। এই ধারণাটিই তাকে নিছক একজন যুদ্ধবাজ পরামর্শদাতা থেকে আলাদা করে। তিনি ছিলেন চূড়ান্ত বাস্তববাদী (pragmatist), যিনি সবচেয়ে কম খরচে সর্বোচ্চ ফল লাভ করতে চাইতেন।

কৌটিল্য বনাম ম্যাকিয়াভেলি: এক অনিবার্য তুলনা

কৌটিল্যের কথা উঠলেই যার নাম অবধারিতভাবে চলে আসে, তিনি হলেন ইতালির রেনেসাঁস যুগের দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (Niccolò Machiavelli)। দুজনকেই প্রায়শই “শয়তানের শিক্ষক” বলে আখ্যা দেওয়া হয়, কারণ দুজনেই মনে করতেন, রাষ্ট্রের স্বার্থে রাজাকে প্রয়োজনে অনৈতিক, নিষ্ঠুর বা প্রতারণামূলক কাজও করতে হতে পারে। দুজনেই রাজনীতিকে ধর্ম বা প্রচলিত নৈতিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।

তবে তাদের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে (Kosambi, 1957; Boesche, 2002)।

  • উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য: ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’ বইটির মূল লক্ষ্য ছিল একজন শাসক (Prince) কীভাবে ক্ষমতা দখল করবে এবং যে কোনো উপায়ে তা টিকিয়ে রাখবে। এটি মূলত শাসকের ব্যক্তিগত ক্ষমতার ম্যানুয়াল। অন্যদিকে, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এর লক্ষ্য আরও ব্যাপক ও প্রাতিষ্ঠানিক—শুধু ক্ষমতা নয়, একটি স্থিতিশীল, সুসংহত ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র (welfare state) গঠন ও পরিচালনা করা। কৌটিল্যের ফোকাস শাসকের ওপর নয়, রাষ্ট্রের (State) ওপর।

  • পরিধি ও গভীরতা: ম্যাকিয়াভেলির কাজ মূলত রাজনীতি এবং ক্ষমতা কেন্দ্রিক। কিন্তু কৌটিল্য অর্থনীতি, সমাজনীতি, আইন, বিচার, কৃষি, খনি, বন ব্যবস্থাপনা, গুপ্তচরবৃত্তি, সামরিক কৌশল—সবকিছুকেই তার আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অর্থশাস্ত্র একটি সম্পূর্ণ রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য পরিচালনার বিশ্বকোষ, আর ‘দ্য প্রিন্স’ হলো তার একটি খণ্ডাংশ মাত্র।

  • নৈতিকতার অবস্থান: ম্যাকিয়াভেলি প্রায় খোলামেলাভাবেই বলেছেন যে, শাসকের দুটি রূপ থাকা উচিত—মানুষের এবং পশুর। প্রয়োজনে তাকে শিয়ালের মতো ধূর্ত এবং সিংহের মতো হিংস্র হতে হবে। তিনি নৈতিকতাকে রাজনীতির বাইরে রাখতে চেয়েছেন, কারণ রাজনীতিতে নৈতিকতা দেখালে শাসকের পতন অনিবার্য। অন্যদিকে, কৌটিল্যও বাস্তববাদী, কিন্তু তিনি ‘ধর্ম’ বা ‘রাজধর্ম’-এর ধারণাকে পুরোপুরি ত্যাগ করেননি। তার কাছে রাজার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ‘যোগক্ষেম’ বা প্রজাদের কল্যাণ। তিনি অনৈতিক উপায় অবলম্বনের কথা বলেছেন, কিন্তু তা কেবল তখনই যখন রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থ বা নিরাপত্তা জড়িত। তার দর্শনে একটি নৈতিক ভিত্তি সব সময়ই উপস্থিত, যদিও তা প্রচলিত অর্থে নয়।

সহজ কথায়, ম্যাকিয়াভেলি শেখান কীভাবে একজন ভালো ‘প্রিন্স’ বা শাসক হওয়া যায়। আর কৌটিল্য শেখান কীভাবে একটি ভালো ‘স্টেট’ বা রাষ্ট্র তৈরি করা যায়, যার একটি অংশ মাত্র হলেন শাসক। ম্যাকিয়াভেলির পৃথিবীটা ছিল ছোট ছোট নগর-রাষ্ট্রের, আর কৌটিল্যের ক্যানভাস ছিল এক বিশাল সাম্রাজ্যের।

আজকের পৃথিবীতে কৌটিল্যের প্রাসঙ্গিকতা: কেন তিনি আজও প্রাসাদের ফিসফিসানি?

তেইশ শ’ বছর আগের কথা আজকের দিনে কতটা কাজে লাগতে পারে? অবাক করা বিষয় হলো, কৌটিল্যের দর্শন আজও বিস্ময়করভাবে প্রাসঙ্গিক। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, কিন্তু মানুষের আচরণ আর ক্ষমতার রাজনীতি বদলায়নি।

  • ভূ-রাজনীতি (Geopolitics): তার মণ্ডল তত্ত্ব আজকের দিনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বুঝতে একটি নিখুঁত চশমা। দেশগুলো যেভাবে জোট (alliances) তৈরি করে এবং ভাঙে, তার পেছনে সেই পুরোনো ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ নীতিই কাজ করে। চীনকে প্রতিহত করতে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার ‘কোয়াড’ জোট গঠন মণ্ডল তত্ত্বের এক আধুনিক উদাহরণ।

  • সুশাসন (Good Governance): তিনি যেভাবে একটি দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত এবং জনকল্যাণকামী আমলাতন্ত্রের ওপর জোর দিয়েছেন, তা আজকের যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই একটি আদর্শ। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি দমনে তার ‘কণ্টকশোধন’-এর ধারণা আজও প্রাসঙ্গিক।

  • অর্থনৈতিক নীতি: কর ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রাস্ফীতি রোধ, এবং সংকটকালে (যেমন দুর্ভিক্ষ বা মহামারী) রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে তার চিন্তাভাবনা আজও যেকোনো অর্থমন্ত্রীকে পথ দেখাতে পারে।

  • জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা: অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক নিরাপত্তা নিয়ে তার ভাবনা, বিশেষ করে গোয়েন্দা ব্যবস্থার ওপর তার গুরুত্ব, আজকের দিনের জাতীয় নিরাপত্তা মতবাদের ভিত্তিপ্রস্তর। সাইবার ওয়ারফেয়ার, ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ—এসবই হলো কৌটিল্যের ‘ভেদ’ নীতি এবং গুপ্তচরবৃত্তির আধুনিক সংস্করণ।

  • কর্পোরেট জগত: আজকের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যেভাবে প্রতিযোগী কোম্পানিকে টেক্কা দিতে মার্কেট অ্যানালিসিস করে, প্রতিদ্বন্দ্বীর দুর্বলতা খুঁজে বের করে, এবং প্রয়োজনে একীভূতকরণ (merger) বা অধিগ্রহণ (acquisition) করে—তার সবই কৌটিল্যের সন্ধি, বিগ্রহ বা ভেদ নীতির ছায়া।

উপসংহার: আলো-আঁধারির এক দার্শনিক, এক অনন্তকালের শিক্ষক

তাহলে কে ছিলেন এই কৌটিল্য? একজন মহান ঋষি, যিনি মাৎস্যন্যায়ের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন? নাকি এক ক্ষমতালোভী, কুটিল পরামর্শদাতা, যিনি রাজাকে শিখিয়েছেন কীভাবে প্রতারণা আর নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে হয়?

তিনি সম্ভবত এর কোনোটিই নন, অথবা দুটোই। তিনি ছিলেন একজন হিমশীতল বাস্তববাদী, যার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল একটি অখণ্ড, শক্তিশালী ও স্থিতিশীল ভারতরাষ্ট্র। তার কাছে রাষ্ট্র কোনো আবেগের জায়গা নয়, এটি একটি জটিল যন্ত্র। আর এই যন্ত্রকে সচল রাখতে যা যা করা প্রয়োজন, তিনি তার সবই করতে প্রস্তুত ছিলেন। প্রয়োজনে ছলে, বলে, কৌশলে—যেকোনো উপায়ে। তার দর্শনে ফুলের কোমলতা নেই, আছে ইস্পাতের কাঠিন্য।

তার দর্শন পড়লে শরীর হিম হয়ে আসে, কারণ তিনি মানুষের ভেতরের সেই আদিম ক্ষমতা আর স্বার্থের খেলাটাকে কোনো রকম রাখঢাক না করে, কোনো নৈতিকতার প্রলেপ না দিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। তিনি কোনো মিষ্টি কথা বলেন না, কোনো আদর্শের বুলি আওড়ান না। তিনি শুধু বলেন, পৃথিবীটা এমনই। টিকে থাকতে হলে তোমাকে এর নিয়মগুলো জানতে হবে। হয় তুমি শিকার করবে, নয়তো শিকারে পরিণত হবে। এর মাঝামাঝি কিছু নেই।

হয়তো এক জ্যোৎস্নাভরা রাতে, পাটলিপুত্রের কোনো নির্জন কক্ষে বসে এই রহস্যময় মানুষটি যখন তালপাতায় তার অমর গ্রন্থটি লিখছিলেন, তখন তার মনে কোনো পাপবোধ কাজ করেনি। কারণ তিনি হয়তো বিশ্বাস করতেন, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের ছায়াতলে কোটি কোটি মানুষ যে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে, তার জন্য কয়েকজনকে বা কয়েকটা নীতিকে বিসর্জন দেওয়াটা কোনো অন্যায় নয়। এটি একটি বৃহত্তর কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় এক ক্ষুদ্র বলিদান।

তিনি ঠিক ছিলেন না ভুল, সেই বিচার করার ভার হয়তো আমাদের নয়। ইতিহাস তার বিচারক। আমরা শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, তেইশ শ’ বছর পরেও তার দেখানো পথ ধরে পৃথিবী চলছে। তার কুটিল দর্শন আজও বিশ্বের বড় বড় রাজধানীগুলোর ক্ষমতার অলিন্দে, বন্ধ দরজার ওপাশে হওয়া গোপন বৈঠকের ফিসফিসানিতে কান পাতলে শোনা যায়। তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তি, এক আলো-আঁধারির দার্শনিক, যার ছায়া থেকে আমাদের মুক্তি নেই, হয়তো কখনো হবেও না।

তথ্যসূত্র

  • Bhattacharyya, S. (1991). Some Aspects of Indian Society: From C. 2nd Century B.C. to C. 4th Century A.D. Centre of Advanced Study in Ancient Indian History and Culture, Calcutta University.
  • Boesche, R. (2002). The First Great Political Realist: Kautilya and His Arthashastra. Lexington Books.
  • Kangle, R. P. (1965). The Kautiliya Arthasastra: A Study (Part 3). Motilal Banarsidass.
  • Kangle, R. P. (Trans.). (1972). The Kautiliya Arthasastra (Part 2): An English Translation with Critical and Explanatory Notes. Motilal Banarsidass.
  • Kosambi, D. D. (1957). An Introduction to the Study of Indian History. Popular Book Depot.
  • Kosambi, D. D. (1975). An Introduction to the Study of Indian History (Revised 2nd ed.). Popular Prakashan.
  • Olivelle, P. (Trans.). (2013). King, Governance, and Law in Ancient India: Kautilya’s Arthasastra. Oxford University Press.
  • Rangarajan, L. N. (Ed. & Trans.). (1992). Kautilya: The Arthashastra. Penguin Classics.
  • Thapar, R. (2002). The Penguin History of Early India: From the Origins to AD 1300. Penguin Books.
  • Weber, M. (1958). The Religion of India: The Sociology of Hinduism and Buddhism. (H. H. Gerth & D. Martindale, Trans. & Eds.). The Free Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.