আলোকায়ন কী? — ইমানুয়েল কান্ট

(“আলোকায়ন কী এই প্রশ্নের উত্তর?” (Answering the Question: What Is Enlightenment?) একটা বিখ্যাত প্রবন্ধ। জার্মান ভাষায় এর নামটা হলো ‘Beantwortung der Frage: Was ist Aufklärung?’। অবশ্য সচরাচর একে ডাকা হয় শুধুই “What Is Enlightenment?” নামে। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের লেখা এই প্রবন্ধটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৮৪ সালে। ঠিক এক বছর আগে “আলোকায়ন কী” প্রশ্নটা তুলেছিলেন রেভারেন্ড ইয়োহান ফ্রিডরিশ সোলনার (Johann Friedrich Zöllner)। ভদ্রলোক শুধু ধর্মযাজকই ছিলেন না, ছিলেন প্রুশীয় সরকারের একজন কর্মকর্তাও। ফ্রেডরিখ গেডিকে (Friedrich Gedike) ও ইয়োহান এরিখ বিস্টার (Johann Erich Biester)-দের সম্পাদিত বার্লিনশে মোনাটশ্রিফট (Berlinische Monatsschrift) (Berlin Monthly) নামের পত্রিকার ১৭৮৪ সালের ডিসেম্বর সংখ্যাতে কান্ট এই পুরোনো প্রশ্নটার উত্তর দিয়েছিলেন। তবে, ব্যাপারটার শুরু হয়েছিল অন্য এক ঘটনা থেকে। পত্রিকা সম্পাদক বিস্টারেরই একটা লেখা ছাপা হয়েছিল ১৭৮৩ সালের এপ্রিলে। সেই লেখার শিরোনাম ছিল, “প্রস্তাবনা, বিয়ের অনুষ্ঠানে পাদ্রিদের অংশগ্রহণ বন্ধ করা হোক” (“Proposal, not to engage the clergy any longer when marriages are conducted”)। ওই লেখার প্রতিক্রিয়া জানাতেই সোলনার তার প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী মহলের দিকে। সে সময়কার প্রথম সারির অনেক চিন্তাবিদই প্রবন্ধ লিখে সোলনারের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। তবে সব ছাপিয়ে গিয়েছিল কান্টের লেখাটা। যতগুলো উত্তর এসেছিল, তার মধ্যে কান্টের প্রবন্ধটাই সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।)

আলোকায়ন (Enlightenment) ব্যাপারটা হলো, মানুষের নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নেওয়া নাবালকত্ব (Minority) থেকে তার মুক্তি। এই নাবালকত্ব জিনিসটা কী? নাবালকত্ব হলো, অন্যের কোনো নির্দেশ ছাড়া নিজের বুদ্ধি কাজে লাগাতে না পারা। এই নাবালকত্ব মানুষ নিজেই নিজের ঘাড়ে চাপায়। এমনটা তখনই ঘটে যখন তার বুদ্ধিসুদ্ধির অভাব থাকে না, অভাব থাকে সংকল্প ও সাহসের। অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের বুদ্ধি কাজে লাগানোর সাহস। সাপের আউডে (Sapere aude)! সোজা বাংলায়, জানার সাহস করো! নিজের বুদ্ধি কাজে লাগানোর হিম্মতটুকু রাখো! এই হলো গিয়ে আলোকায়নের মূলমন্ত্র।

আলসেমি ও কাপুরুষতার জন্য মানবজাতির এত বিশাল একটা অংশ দিব্যি আজীবন নাবালক হয়ে থাকতেই পছন্দ করে। অথচ প্রকৃতি তাদের কবেই অন্যের খবরদারি থেকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে (naturaliter maiorennes)। ঠিক এই কারণেই অন্যদের পক্ষে তাদের অভিভাবক (Guardians) সেজে বসাটা হয়ে যায় জলের মতো সোজা। নাবালক হয়ে থাকার মধ্যে যে কী ভীষণ আরাম! আমার হয়ে ভাবার জন্য যদি একটা বই থাকে, আমার বিবেকের দেখভালের জন্য যদি একজন ধর্মগুরু (Spiritual advisor) থাকেন, আমার শরীর স্বাস্থ্যের নিয়মকানুন ঠিক করে দেওয়ার জন্য যদি একজন ডাক্তার থাকেন, তাহলে আমার নিজের আর কোনো ঝুটঝামেলা পোহানোর দরকার পড়ে না। আমার নিজের ভাবার কী দরকার, যদি পকেটে পয়সা থাকে? পয়সা খরচ করলেই তো হলো। অন্যরা তখন আমার হয়ে এই বিরক্তিকর কাজটা কী আনন্দের সাথেই না করে দেবে। মানবজাতির বেশিরভাগ মানুষ, মেয়েরা পর্যন্ত, সাবালকত্বের দিকে পা বাড়ানোটাকে কেবল ঝামেলার নয়, রীতিমতো সাংঘাতিক বিপজ্জনক বলেও মনে করে। তাদের সেইসব দয়ালু অভিভাবকেরা এই বিষয়টা খুব ভালো করেই জানে। ওরাই তো পরম মমতায় তাদের ওপর নজরদারির মহান দায়িত্বটা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। প্রথমে তারা তাদের এই পোষা জীবগুলোকে বোকা বানিয়ে ফেলে। এরপর খুব সাবধানে খেয়াল রাখে, এই শান্তশিষ্ট প্রাণীগুলো যেন তাদের বানানো খেলার খাঁচার বাইরে এক পা-ও ফেলতে সাহস না পায়। সবশেষে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, একা চলতে গেলে কী ভয়ানক বিপদ সামনে অপেক্ষা করছে। আসলে বিপদটা কিন্তু অত বড় কিছু না। কয়েকবার আছাড় খেলেই তো তারা ঠিকঠাক হাঁটা শিখে যেত। কিন্তু ঐ এক-আধটা উদাহরণই তাদের কেমন ভীরু বানিয়ে দেয়। সাধারণত এরপর কোনো চেষ্টা করার আগেই তারা পিছিয়ে যায়।

কাজেই কোনো একজন মানুষের পক্ষে সেই নাবালকত্ব থেকে বেরিয়ে আসাটা বড়ই কঠিন, যা তার প্রায় স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে এমনকি এই অবস্থাকে ভালোবেসেও ফেলেছে। নিজের বুদ্ধি বিবেচনা কাজে লাগাতে সে এখন সত্যিই অক্ষম, কারণ তাকে কোনোদিন সেই চেষ্টাটা করতেই দেওয়া হয়নি। নিয়মকানুন আর গৎবাঁধা বুলি (Precepts and formulas) হচ্ছে তার ভেতরের স্বাভাবিক প্রতিভাকে কাজে লাগানোর কিংবা নষ্ট করে ফেলার একটা যান্ত্রিক হাতিয়ার। এসবই তার চিরস্থায়ী নাবালকত্বের শেকল, তার পায়ের বেড়ি। কেউ যদি সেই শেকল ঝেড়ে ফেলেও দেয়, তবুও সে হয়তো সরু একটা খাদ পার হতে গিয়ে থমকে দাঁড়াবে, অনিশ্চিতভাবে লাফ দেবে। কারণ এমন মুক্ত স্বাধীন চলাফেরায় সে একেবারেই অভ্যস্ত নয়। তাই এমন মানুষের সংখ্যা আঙুলে গোনা যায়, যারা নিজেদের আত্মার বিকাশ (cultivation of their spirit) ঘটিয়ে নাবালকত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে; সাহসের সাথে নিজের পথে হাঁটতে পেরেছে।

কিন্তু একটা গোটা জনসমাজের নিজেকে আলোকিত করার সম্ভাবনাটা বরং অনেক বেশি। সত্যি বলতে কী, তাকে কেবল তার স্বাধীনতাটুকু দিয়ে দিলে ব্যাপারটা প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। কারণটা হলো, জনসাধারণের প্রতিষ্ঠিত অভিভাবকদের মধ্যেও সবসময় কিছু স্বাধীন চিন্তার মানুষ পাওয়া যায়। ওনারা প্রথমে নিজেদের নাবালকত্বের জোয়াল ছুড়ে ফেলেন। তারপর ছড়িয়ে দেন নিজেদের মূল্যবোধের চেতনা। ছড়িয়ে দেন প্রত্যেক মানুষের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করার আহ্বানের যুক্তিসঙ্গত বোধটা। এখানে একটা বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার আছে। যে জনসমাজকে অভিভাবকেরা একসময় এই জোয়ালের নিচে চেপে রেখেছিল, কখনো কখনো তারাই আবার সেই অভিভাবকদের জোয়ালের নিচে থাকতে বাধ্য করে। এমনটা হয় তখনই, যখন সেই জনসমাজেরই কিছু অভিভাবক — যারা নিজেরা আলোকায়নের কোনো আলো পায়নি — তারা জনতাকে ঠিকঠাক উসকানি দেয়। কুসংস্কার (Prejudices) চাপিয়ে দেওয়া যে কী ভীষণ ক্ষতিকর একটা ব্যাপার! কারণ দিনের শেষে ওই কুসংস্কারগুলো ঠিক তাদের ওপরই প্রতিশোধ নেয়, যারা নিজেরা বা তাদের পূর্বপুরুষেরা একদিন সেগুলোর জন্ম দিয়েছিল। একারণেই একটা জনসমাজ খুব ধীরে, খুব শ্লথ গতিতে আলোকায়ন অর্জন করে। একটা বিপ্লব দিয়ে হয়তো গায়ের জোরে চলা স্বৈরতন্ত্র (Personal despotism) আর লোভী বা অত্যাচারীর নিপীড়ন (Avaricious or tyrannical oppression) থামিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মানুষের ভাবনার জগতে তাতে সত্যিকারের কোনো সংস্কার (True reform) আসে না। তার বদলে পুরোনো কুসংস্কারের জায়গা নিতে জন্ম নেয় কেবল নতুন নতুন কুসংস্কার। পুরোনো গুলোর মতোই সেই নতুন সংস্কারগুলো নির্বোধ জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে চমৎকার হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

তবে এই আলোকায়নের জন্যে স্বাধীনতার থেকে বেশি কিছুর দরকার পড়ে না। সত্যি বলতে কী, স্বাধীনতা নামে যা কিছু আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ জিনিসটারই দরকার পড়ে। সেই দরকারি জিনিসটা হলো, সব বিষয়ে নিজের যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহারের স্বাধীনতা (Freedom to make public use of one’s reason in all matters)। কিন্তু আমি চারপাশ থেকে কেবল একটা চিৎকারই শুনতে পাই: তর্ক করবে না! অফিসার বলেন, তর্ক করবে না, যাও ড্রিল করো! ট্যাক্স অফিসার বলেন, তর্ক না করে পয়সা দাও! পাদ্রি বলেন, তর্ক নয়, বিশ্বাস করো! (পৃথিবীতে শুধু একজন শাসকই আছেন যিনি বলেন: তর্ক করো, যত খুশি তর্ক করো, যা নিয়ে খুশি তর্ক করো, কিন্তু আমার আদেশ মেনে চলো!) চারিদিকে কেবল স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ। কিন্তু কোন ধরনের বাধা আলোকায়নের পথ আটকে দেয়? আবার কোন বাধাটা পথ না আটকে তাকে বরং এগিয়েই নিয়ে যায়? আমার উত্তরটা খুব সোজা। নিজের যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহার (Public use of one’s reason) সবসময় স্বাধীন হতে হবে। একমাত্র সেটাই মানুষের মধ্যে আলোকায়ন আনতে পারে। তবে নিজের যুক্তির ব্যক্তিগত ব্যবহার (Private use of one’s reason) প্রায়ই খুব কঠিন নিয়মে বেঁধে রাখা যায়। তাতে আলোকায়নের এগিয়ে চলার পথে তেমন কোনো বাধা তৈরি হয় না। নিজের যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহার বলতে আমি সেই পরিস্থিতিকে বোঝাচ্ছি, যখন একজন বিদ্বান বা পণ্ডিত ব্যক্তি তার বিচারবুদ্ধি ও চিন্তাভাবনা বৃহত্তর পাঠক সমাজের (অর্থাৎ, বিশ্বের সকল পাঠকের) কাছে উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে যুক্তির ব্যক্তিগত ব্যবহার আমি তাকেই বলি, যখন কেউ একটা নির্দিষ্ট বেসামরিক পদের (Civil post) বা দপ্তরের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তার যুক্তি কাজে লাগায়। এখন, একটা রাষ্ট্রকে (Commonwealth) ঠিকঠাক চালাতে গেলে একটা বিশেষ ব্যবস্থার দরকার হয়। এই ব্যবস্থার কিছু সদস্যকে অনেকটা যন্ত্রের মতো নিষ্ক্রিয় থাকতে হয়, যাতে সরকারের বানানো একটা ছকে ফেলে সবাইকে এক দিকে চালানো যায়। কিংবা অন্তত সেইসব লক্ষ্য নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানো যায়। এখানে তর্ক করার কোনো সুযোগ নেই। সোজা কথা, আদেশ মানতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই ব্যবস্থার অংশ যে মানুষটা, সে যখন নিজেকে কেবল রাষ্ট্রের নয়, গোটা বিশ্বের একজন নাগরিক (Society of citizens of the world) হিসেবে দেখে, তখন তার পরিচয়টা পাল্টে যায়। তখন সে একজন পণ্ডিত হিসেবে তার লেখার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। তখন সে অবশ্যই তর্ক করতে পারে। আর তাতে, যন্ত্রের নিষ্ক্রিয় অংশ হিসেবে তার যে দায়িত্ব, সেটার কোনো ক্ষতি হয় না। তাহলে তো সাংঘাতিক একটা ব্যাপার হবে, যদি কোনো অফিসার ডিউটিতে থাকাকালীন তার বড়কর্তার দেওয়া আদেশের কার্যকারিতা নিয়ে তর্ক জুড়ে দেন। তাকে অবশ্যই হুকুম মানতে হবে। কিন্তু সেই একই মানুষটা যখন একজন পণ্ডিত হিসেবে সামরিক ব্যবস্থার ভুলত্রুটি নিয়ে দুটো কথা লেখে এবং সেগুলো সবার সামনে তুলে ধরে, তখন তাকে অন্যায়ভাবে থামানো যায় না। একজন নাগরিক তার ওপর চাপানো কর (Taxes) দেওয়ার ক্ষেত্রে বেঁকে বসতে পারে না। যখন তাকে কর দিতেই হচ্ছে, তখন সেই কর (Levies) নিয়ে যাচ্ছেতাই সমালোচনা করলে শাস্তিও হতে পারে, কারণ তাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। কিন্তু সেই একই মানুষ যখন একজন পণ্ডিত হিসেবে সবার সামনে এই করের অবিচার (Injustice) বা বোকামি নিয়ে নিজের ভাবনাগুলো লেখে, তখন তার নাগরিক কর্তব্যের কোনো অবহেলা হয় না। ঠিক একই ঘটনা ঘটে একজন পাদ্রির (Clergyman) ক্ষেত্রেও। তিনি তার ধর্মশিক্ষা ক্লাসের (Catechism class) ছাত্র আর মণ্ডলীর (Congregation) কাছে সেই গির্জার ধর্মমত (Creed) অনুযায়ীই শেখাতে বাধ্য। কারণ এই শর্তেই তো তাকে চাকরিতে রাখা হয়েছে। কিন্তু একজন পণ্ডিত হিসেবে তার আছে পুরোপুরি স্বাধীনতা। তাকে বরং উৎসাহিত করা হয়, যেন তিনি তার সাবধানে পরীক্ষা করা সৎ ভাবনাগুলো সবার কাছে পৌঁছে দেন। সেই ধর্মমতে যা কিছু ভুল আছে, কিংবা ধর্মীয় ও গির্জার কাঠামোর (Religious and ecclesiastical body) উন্নতির জন্যে তার যা কিছু বলার আছে, সবই তিনি জানাতে পারেন। এখানে তার বিবেকের (Conscience) ওপর কোনো বোঝা চাপার ব্যাপার নেই। অন্যদিকে, গির্জার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যা কিছু শেখান, সেখানে নিজের ভাবনা অনুযায়ী কিছু বলার স্বাধীনতা তার কোথায়? তাকে তো কথা বলতে হয় অন্যের হয়ে, বেঁধে দেওয়া নিয়মকানুন মেনে। তিনি বলবেন: আমাদের গির্জা এই বা ঐ বিষয় শেখায়; এই হলো তার পেছনের যুক্তি। এরপর তিনি তার মণ্ডলীর জন্যে সেইসব অনুশাসন (Precepts) থেকে সেগুলোর কাজে লাগার দিকগুলো দেখিয়ে দেন। এমন সব অনুশাসন, যেগুলোতে হয়তো তিনি নিজে মনেপ্রাণে সই করতে পারবেন না, কিন্তু প্রচার করতে পারেন। কারণ এমনও তো হতে পারে যে, সেগুলোর ভেতরেই কোথাও সত্য লুকিয়ে আছে। অন্ততপক্ষে সেগুলোতে তার ভেতরের ধর্মের (Inner religion) সাথে কোনো বিরোধ তো নেই। তিনি যদি বিশ্বাস করতেন যে সেখানে এমন কোনো গোলমাল আছে, তাহলে বিবেকের দংশনে তিনি তার পদে এক মুহূর্তও থাকতে পারতেন না; তাকে পদত্যাগ করতে হতো। তাই, একজন নিযুক্ত শিক্ষক তার মণ্ডলীর সামনে তার যুক্তির যে ব্যবহার করেন, তা নিতান্তই একটা ব্যক্তিগত ব্যবহার। কারণ একটা মণ্ডলী — সে যত বড় জমায়েতই হোক — আসলে একটা ঘরোয়া জমায়েত (Domestic gathering) মাত্র। এই জায়গায় তিনি একজন যাজক হিসেবে স্বাধীন নন, হতেও পারেন না। কারণ তিনি অন্যের নির্দেশ (Commission) পালন করছেন। অন্যদিকে একজন পণ্ডিত যখন তার লেখার মাধ্যমে কথা বলেন, তিনি আসলে কথা বলেন সাধারণ মানুষের সাথে, অর্থাৎ গোটা বিশ্বের সাথেই। আর তাই, তার যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহারে (Public use of his reason) তিনি ভোগ করেন অবাধ স্বাধীনতা। তিনি নিজের যুক্তি খাটান, নিজের হয়ে কথা বলেন। কারণ, আধ্যাত্মিক বিষয়ে জনগণের অভিভাবকদের নিজেদেরই নাবালক হয়ে থাকাটা একটা চরম অযৌক্তিকতা (Absurdity), যা কেবল আরও অযৌক্তিকতাকেই চিরস্থায়ী করে তোলে।

আচ্ছা, তাহলে ধর্মযাজকদের একটা সমাজের কথা ভাবা যাক। ধরা যাক কোনো গির্জার সিনড (Ecclesiastical synod) বা একটা ক্লাসিস (Venerable classis) — যেমন ডাচরা নিজেদের বলে থাকে। তারা কি একটা নির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় ধর্মমতে শপথ করে নিজেদের বেঁধে ফেলতে পারে? সেই বাঁধনে তারা কি শুধু নিজেদেরই বাঁধবে, নাকি তাদের দেখাদেখি পুরো জাতিটাকেই একটা অবিরাম অভিভাবকত্বের (Unceasing guardianship) নিচে নিয়ে আসবে? একেবারে চিরকালের জন্যে? আমি বলব, এই কাজটা একেবারেই অসম্ভব। এমন একটা চুক্তি, যা কিনা মানবজাতিকে চিরকালের জন্যে আরও আলোকায়ন থেকে বঞ্চিত করে, সেটা একেবারেই অচল, একেবারেই বাতিল (Absolutely null and void)। এমন চুক্তি যদি সর্বোচ্চ ক্ষমতা (Supreme power), রাজকীয় সংসদ (Imperial diets) কিংবা দুনিয়ার সবচেয়ে পবিত্র শান্তিচুক্তি (Solemn peace treaties) দিয়েও পাশ করানো হয়, তবুও তার কানাকড়ি মূল্য নেই। একটা যুগ কোনোভাবেই নিজেকে এমন কোনো নিয়মে বাঁধতে পারে না, বা পরবর্তী যুগের জন্যে এমন কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারে না, যাতে ওই যুগটার পক্ষে তার জ্ঞান বাড়ানো, ভুল থেকে নিজেকে শুধরে নেওয়া, কিংবা আলোকায়নের পথে আরও একটু এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। তা তো হবে মানব প্রকৃতির বিরুদ্ধেই একটা অপরাধ। কারণ এগিয়ে চলাই তো মানব প্রকৃতির আসল ধর্ম। তাই পরের প্রজন্মগুলোর সম্পূর্ণ অধিকার আছে এই ধরনের সিদ্ধান্তকে বেআইনি (Unauthorized), মহাপাপ (Sacrilegiously) বলে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার। একটা জাতির জন্যে কোনো একটা আইন ভালো না মন্দ, তা বোঝার একটা সহজ উপায় আছে। নিজেকে শুধু একটা প্রশ্ন করতে হবে: সেই জাতিটা কি স্বেচ্ছায় নিজের ওপর এমন কোনো আইন চাপিয়ে নিত? এখন, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে, দেশে একটা শৃঙ্খলা আনার দোহাই দিয়ে এমন কোনো ব্যবস্থা হয়তো চালু করা যেতে পারে। সেই সময়েও কিন্তু প্রত্যেক নাগরিকের, বিশেষ করে একজন পাদ্রির বা পণ্ডিতের পুরোপুরি স্বাধীনতা থাকবে। তিনি তার লেখার মাধ্যমে প্রকাশ্যে বর্তমান ব্যবস্থার (Present institution) ভুলত্রুটি নিয়ে কথা বলতে পারবেন। এই চালু হওয়া শৃঙ্খলাটা ঠিক ততদিনই টিকবে, যতদিন না এই বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের বোধ এতটা পরিষ্কার হচ্ছে যে তাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর রাজার (Crown) কানে পৌঁছায়। তাদের প্রস্তাবটা হবে এমন: যে মণ্ডলীগুলো নতুন, উন্নততর ভাবনার ওপর ভর করে নিজেদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে বদলে নিতে চায়, তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। আবার যারা পুরোনো ব্যবস্থাতেই থাকতে চায়, তাদেরও জোর করা চলবে না। তবে এমন একটা স্থায়ী ধর্মীয় সংবিধান (Permanent religious constitution) মেনে নেওয়া, যা নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কোনো প্রশ্নই তুলতে পারবে না — এই ব্যাপারটা কিছুতেই চলে না। এমনকি এক জীবনের জন্যেও নয়। কারণ এর মাধ্যমে মানবজাতির উন্নতির একটা রাস্তাকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাকে একরকম বন্ধ্যা করে ফেলা হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে যা হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক ক্ষতিকর। একজন মানুষ বড়জোর নিজের জন্যে — তাও খুব অল্প সময়ের জন্যে — আলোকায়ন স্থগিত রাখতে পারে। কিন্তু আলোকায়নকে একেবারে ছেড়ে দেওয়া, তা নিজের জন্যেই হোক বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যেই হোক, সেটা তো মানবজাতির পবিত্র অধিকারকে পায়ে পিষে ফেলার মতো একটা ব্যাপার। একটা জাতি যা নিজের ভালো ভেবেও কখনো করে না, একজন রাজার তো সেই কাজটা করার অধিকার আরও কম। কারণ তার আইন বানানোর ক্ষমতাটাই আসে জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা থেকে। তিনি তো সেই সম্মিলিত ইচ্ছেটাকেই নিজের ইচ্ছে বলে চালান। তার কাজ শুধু এইটুকু দেখা যে, যে কোনো উন্নতি — সেটা আসলই হোক বা দেখতেই কেবল ভালো লাগুক — যেন দেশের নাগরিক শৃঙ্খলার (Civil order) কোনো ক্ষতি না করে। যতক্ষণ এই ব্যাপারটা ঠিক থাকছে, ততক্ষণ বাকি বিষয়গুলো তিনি প্রজাদের ওপরেই ছেড়ে দিতে পারেন। তারা তাদের আত্মার পরিত্রাণের জন্যে যা দরকার মনে করে, তা-ই করুক। সেটা তার ভাবনার বিষয় নয়। তবে তার ভাবনার বিষয় হলো, কেউ যেন অন্যকে তার পরিত্রাণ খুঁজে পাওয়ার ও সেই পথে এগিয়ে চলার চেষ্টায় জোর করে বাধা না দেয়। তিনি যদি প্রজাদের লেখালেখিকে সরকারি নজরদারির আওতায় এনে সেগুলোর মধ্যে নাক গলাতে শুরু করেন, তাহলে তার মহিমায়ও (Majesty) দাগ লাগে। বিশেষ করে তিনি যদি তার নিজের সর্বোচ্চ জ্ঞান (Own supreme insight) দিয়ে এই কাজ করতে যান, তাহলে তাকে লোকে ‘সিজার ব্যাকরণবিদদের চেয়ে বড় নন’ (Caesar non est super grammaticos) বলে টিটকারি দেবে। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে তখন, যখন তিনি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে এতটা ছোট করে ফেলেন যে, নিজের রাজ্যেরই কিছু ধর্মব্যবসায়ী স্বৈরাচারীকে (Spiritual despotism) অন্য প্রজাদের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রশ্রয় দেন।

এখন যদি প্রশ্ন ওঠে, আমরা কি এখন একটা আলোকিত যুগে (Enlightened age) বাস করছি? উত্তরটা হলো, না। তবে আমরা আলোকায়নের একটা যুগে (Age of enlightenment) বাস করছি। এখন যা অবস্থা, তাতে সাধারণ মানুষেরা এখনো সেই জায়গায় পৌঁছায়নি, যেখানে তারা অন্যের সাহায্য ছাড়া ধর্মীয় বিষয়ে নিজের বুদ্ধি দিয়ে ঠিকঠাক ভাবতে পারে। সেই পথ এখনো অনেক বাকি। কিন্তু স্পষ্ট ইঙ্গিতও আছে যে, এখন তাদের জন্যে এই দিকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রটা খুলে যাচ্ছে। সার্বজনীন আলোকায়ন (Universal enlightenment) বা মানুষের নিজের ঘাড়ে চাপানো নাবালকত্ব থেকে বেরিয়ে আসার পথের বাধাগুলোও একটু একটু করে কমছে। এই দিক থেকে দেখলে, এই যুগটা হলো আলোকায়নের যুগ। কিংবা বলা যায়, ফ্রেডরিকের (Frederick) শতাব্দী।

একজন রাজপুত্র (Prince), যিনি মনে করেন ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের ওপর কিছু চাপিয়ে না দিয়ে তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়াই তার কর্তব্য, যিনি এই কথাটা বলতে নিজের মর্যাদাহানি মনে করেন না, যিনি সহনশীলতার মতো দাম্ভিক নামটাকেও ছুঁড়ে ফেলেন — তিনিই তো সত্যিকারের আলোকিত। এক কৃতজ্ঞ বিশ্ব ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তো তার প্রশংসাই করবে। কারণ তিনিই প্রথম, অন্তত সরকারের দিক থেকে তো বটেই, যিনি মানবজাতিকে নাবালকত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তিনিই প্রত্যেককে বিবেকের সব ব্যাপারে নিজের যুক্তি (Own reason) ব্যবহার করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তার শাসনামলে একটা চমৎকার ব্যাপার ঘটে। শ্রদ্ধেয় ধর্মযাজকেরা তাদের দাপ্তরিক দায়িত্বের বাইরে গিয়েও স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন। পণ্ডিত হিসেবে তারা নিজেদের বিচারজ্ঞান (Judgments) ও ভাবনা (Insights) সবার সামনে তুলে ধরেন, এমনকি সেইসব ভাবনা যদি প্রচলিত ধর্মমত (Creed adopted) থেকে একটু আলাদাও হয়, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। যাদের ওপর কোনো দাপ্তরিক দায়িত্বের বাঁধন নেই, তারা তো এই স্বাধীনতা আরও বেশি করে পায়। স্বাধীনতার এই হাওয়া দেশের সীমানা পেরিয়েও বইতে শুরু করে। এমনকি সেইসব দেশেও, যেখানে তাকে লড়তে হয় এমন এক সরকারের সাথে, যে সরকার নিজেই নিজের কাজটা ঠিকমতো বোঝে না। কারণ এই ঘটনাটা সেইসব সরকারের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় — স্বাধীনতায় ভয়ের কিছু নেই। তাতে জনগণের শান্তি (Public concord) বা রাষ্ট্রের ঐক্যের (Unity of the commonwealth) কোনো ক্ষতি হয় না। মানুষ তো নিজের চেষ্টাতেই একটু একটু করে বর্বরতা থেকে বেরিয়ে আসে। যদি না কেউ ইচ্ছে করে তাদের টেনেহিঁচড়ে পেছনে আটকে রাখার ফন্দি না করে।

আমি এতক্ষণ আলোকায়নের মূল কথাটা — অর্থাৎ, মানুষের নিজের ঘাড়ে চাপানো নাবালকত্ব থেকে তার মুক্তির আলোচনা — মূলত ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। এর কারণ হলো, শিল্পকলা বা বিজ্ঞানের বেলায় আমাদের শাসকেরা প্রজাদের ওপর অভিভাবক সেজে থাকার খুব একটা আগ্রহ দেখান না। তাছাড়াও, এই ধর্মীয় নাবালকত্বটাই হলো সবচেয়ে ক্ষতিকর, সবচেয়ে লজ্জার। কিন্তু যে রাষ্ট্রপ্রধান ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সমর্থন করেন, তার মনটা (Frame of mind) আরও বড় হয়। তিনি বুঝতে পারেন যে, আইনকানুন তৈরির বেলাতেও প্রজাদের নিজেদের যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহার করতে দিলে কোনো বিপদ নেই। দেশের আইনকে আরও ভালো করার জন্যে প্রজারা তাদের ভাবনা জানাতে পারে, এমনকি অকপটে প্রচলিত আইনের সমালোচনাও করতে পারে। আমাদের সামনেই এর একটা উজ্জ্বল উদাহরণ আছেন। এমন একজন সম্রাট (Monarch), যাকে আজ পর্যন্ত কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি, যাকে আমরা মন থেকে সম্মান করি।

কিন্তু কেবল সেই মানুষটাই, যিনি নিজে আলোকিত, যিনি ভূতের ভয়ে আঁতকে ওঠেন না, আবার দেশের শান্তি রক্ষার জন্যে যার হাতে আছে বিশাল এক সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী — তিনিই কেবল সেই কথাটা বলার সাহস রাখেন, যা একটা স্বাধীন রাষ্ট্রও বলতে ভয় পায়। তিনি বলেন: যত খুশি তর্ক করো, যা নিয়ে খুশি তর্ক করো; শুধু আমার আদেশটা মেনে চলো! মানুষের জীবনে একটা অদ্ভুত, অপ্রত্যাশিত ব্যাপার দেখা যায়। বড় করে দেখলে প্রায় সবকিছুই কেমন যেন ধাঁধার মতো লাগে। নাগরিক স্বাধীনতা একটু বেশি থাকলেই যে মানুষের আত্মার স্বাধীনতাও বাড়বে, এমনটা ভাবা হয়। কিন্তু অনেক সময় ঠিক উল্টোটা ঘটে। সেই বাড়তি স্বাধীনতাই তার পথের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আবার অন্যদিকে, নাগরিক স্বাধীনতা একটু কম থাকলে আত্মার বেড়ে ওঠার জন্যে যেন আরও বেশি জায়গা পাওয়া যায়। এভাবেই প্রকৃতি তার শক্ত খোলসের ভেতর থেকে একটা বীজকে খুব যত্ন করে বের করে আনে — যে বীজটাকে সে সবচেয়ে মমতায় লালন করে। এই বীজটা আর কিছু নয়, মুক্তভাবে ভাবার ইচ্ছে, তার ভেতরের ডাক। এই চিন্তাটাই তখন ধীরে ধীরে মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলে। এর ফলে মানুষ আস্তে আস্তে কাজেও স্বাধীনতা পেতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত এই প্রভাবটা গিয়ে পড়ে সরকারের নীতির ওপর। তখন সরকারও বুঝতে পারে, মানুষ নামের এই জীবটা আর নিছক একটা যন্ত্র নয়। তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে চালানোতেই লাভ।

 

প্রয়োজনীয় টীকা

১. ইমানুয়েল কান্ট: ইনি ছিলেন একজন জার্মান দার্শনিক (১৭২৪-১৮০৪) এবং আধুনিক দর্শনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র এবং নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর কাজ পশ্চিমা দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এই প্রবন্ধটা তাঁর নীতি ও সমাজ-রাজনৈতিক দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

২. আলোকায়ন (Enlightenment): আলোকায়ন ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল যুক্তি, বিজ্ঞান, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং ধর্ম ও ঐতিহ্যের অন্ধ অনুশাসনের বিরোধিতা। কান্টের এই প্রবন্ধটা ছিল সেই আন্দোলনের মূল চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করার একটা প্রচেষ্টা।

৩. নাবালকত্ব (Minority): এখানে ‘নাবালকত্ব’ বলতে বয়স নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক পরাধীনতাকে বোঝানো হয়েছে। কান্ট জার্মান শব্দ Unmündigkeit ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ অন্যের অভিভাবকত্ব বা নির্দেশনা ছাড়া চলতে না পারা। এটা একটা স্ব-আরোপিত অবস্থা, যা ভয় ও আলস্য থেকে জন্মায়।

৪. সাপের আউডে (Sapere aude)!: এটা একটা ল্যাটিন প্রবাদ, যার আক্ষরিক অর্থ “জানার সাহস করো” (Dare to know)। কান্ট রোমান কবি হোরেস-এর কাছ থেকে এই উক্তিটা ধার করে একে আলোকায়নের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজের বুদ্ধি ব্যবহার করার জন্য মানসিক শক্তি বা সাহস অর্জনের কথা বলেছেন।

৫. অভিভাবক (Guardians): ‘অভিভাবক’ বলতে কান্ট সেই সময়ের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের বুঝিয়েছেন, যারা সাধারণ মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করত। যেমন- গির্জা, রাষ্ট্র বা নির্দিষ্ট মতাদর্শের প্রবক্তারা। এরা মানুষকে ভাবতে শেখানোর বদলে, কী ভাবতে হবে তা বলে দিত।

৬. বিপ্লব (Revolution): কান্ট বিপ্লবের মাধ্যমে আসা আকস্মিক পরিবর্তনের চেয়ে ধীর, বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, বিপ্লব হয়তো স্বৈরাচারী শাসককে সরাতে পারে, কিন্তু মানুষের চিন্তার পদ্ধতি বা পুরোনো কুসংস্কারকে দূর করতে পারে না। তার বদলে নতুন কুসংস্কার সেই জায়গা দখল করে। সত্যিকারের মুক্তির জন্য চিন্তার জগতে সংস্কার প্রয়োজন।

৭. নিজের যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহার (Public use of one’s reason): এটা কান্টের যুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ‘যুক্তির প্রকাশ্য ব্যবহার’ বলতে বোঝায় একজন নাগরিকের ‘পণ্ডিত’ হিসেবে সমগ্র বিশ্বের সামনে নিজের চিন্তা ও মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার অধিকার। যেমন- একজন সেনা কর্মকর্তা চাকরির বাইরে একজন লেখক হিসেবে সামরিক নীতির সমালোচনা করতে পারেন। এই স্বাধীনতা আলোকায়নের জন্য অপরিহার্য।

৮. নিজের যুক্তির ব্যক্তিগত ব্যবহার (Private use of one’s reason): ‘যুক্তির ব্যক্তিগত ব্যবহার’ বলতে বোঝায় একজন ব্যক্তি যখন কোনো নির্দিষ্ট দাপ্তরিক বা পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। সেই পদে থাকাকালীন তাকে প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। যেমন- একজন সরকারি কর কর্মকর্তা কর ব্যবস্থার সমালোচনা করতে পারেন না, তাকে নিয়ম মেনে কর আদায় করতে হয়। সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য এই শৃঙ্খলা প্রয়োজন।

৯. ফ্রেডরিকের (Frederick) শতাব্দী: এখানে প্রুশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিক (শাসনকাল: ১৭৪০-১৭৮৬) -এর কথা বলা হয়েছে। ফ্রেডরিক ছিলেন একজন “আলোকিত স্বৈরশাসক” (Enlightened Despot)। তিনি শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বাকস্বাধীনতা, বিশেষ করে ধর্মীয় বিতর্কের স্বাধীনতা, অনুমোদন করতেন। কান্ট ফ্রেডরিকের এই নীতির প্রশংসা করেছেন, কারণ তা আলোকায়নের পথ প্রশস্ত করেছিল।

১০. সিজার ব্যাকরণবিদদের চেয়ে বড় নন (Caesar non est super grammaticos): এটা একটা পুরনো ল্যাটিন প্রবাদ, যার অর্থ “সম্রাটও ব্যাকরণের নিয়মের ঊর্ধ্বে নন”। কান্ট এর মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন যে, একজন শাসকের ক্ষমতা রাজনৈতিক শৃঙ্খলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। জ্ঞান, যুক্তি বা সত্যের মতো বিষয়ে শাসকের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই।

১১. মানুষ নামের এই জীবটা আর নিছক একটা যন্ত্র নয়: এটা কান্টের নীতিদর্শনের মূল ভিত্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব মর্যাদা আছে, কারণ সে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারে। তাই মানুষকে কখনো নিছক যন্ত্র বা অন্যের লক্ষ্যের ‘উপায়’ হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রত্যেক মানুষ নিজেই নিজের ‘লক্ষ্য’। এই প্রবন্ধের শেষে তিনি সেই ধারণারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.