Table of Contents
ভূমিকা
ম্যাকিয়াভেলি – নামটা শুনলেই কেমন একটা খটকা লাগে, তাই না? মনে হয় যেন কোনো ধূর্ত, কুটিল লোকের কথা বলা হচ্ছে। যার কাছে নীতির কোনো দাম নেই, ক্ষমতার জন্য যে সবকিছু করতে পারে। আমরা কথায় কথায় বলি, “লোকটা একটা ম্যাকিয়াভেলি!” আমাদের মনে ম্যাকিয়াভেলির যে ছবিটা আঁকা, তা হলো এক শয়তানের পরামর্শদাতার। তার নামটাই যেন একটা গালি।
কিন্তু আসলেই কি তাই? নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি কি সত্যিই মন্দ কাজের উস্কানিদাতা ছিলেন? নাকি তিনি এমন কিছু বলেছিলেন, যা সেই সময়ের মানুষ হজম করতে পারেনি? এমন কোনো রূঢ় সত্য, যা আজও আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়?
চলুন, আজ আমরা সেই ধোঁয়াশা কাটানোর চেষ্টা করি। ৫০০ বছর আগের এক ইতালীয় কূটনীতিক এবং লেখকের জগতে ডুব দিই। দেখব, কেন তিনি আজও এত প্রাসঙ্গিক, এত বিতর্কিত। এই যাত্রায় আমরা দেখব এক অন্য ম্যাকিয়াভেলিকে—যিনি কেবল একজন দার্শনিক নন, বরং একজন রক্ত-মাংসের মানুষ, যার জীবনে ছিল সফলতা, ব্যর্থতা, তীব্র যন্ত্রণা এবং নির্বাসনের অসহনীয় একাকিত্ব। এই দীর্ঘ আলাপে আমরা কেবল তার বিখ্যাত বই ‘দ্য প্রিন্স’ নিয়েই থাকব না, বরং তার অন্যান্য লেখা এবং তার দর্শনের গভীরতাকেও ছোঁয়ার চেষ্টা করব।
যে সময়ে ম্যাকিয়াভেলির জন্ম (The Man and His Time)
যেকোনো মানুষকে বুঝতে হলে তার সময়টাকে বুঝতে হয়। ম্যাকিয়াভেলির জন্ম ১৪৬৯ সালে, ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। সময়টা অদ্ভুত। একদিকে রেনেসাঁর স্বর্ণযুগ। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান—সবকিছুতে নতুন হাওয়া লেগেছে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল—সবাই তখন শিল্পের জগতকে চিরদিনের জন্য বদলে দিচ্ছেন। চারদিকে নতুন আবিষ্কার, নতুন চিন্তা। মনে হবে, চারদিকে যেন এক সৃজনশীলতার উৎসব চলছে।
কিন্তু এই উৎসবের আড়ালে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা ছিল ভয়ানক অস্থিতিশীল, নোংরা এবং রক্তমাখা।
ইতালি তখন কোনো একক, ঐক্যবদ্ধ দেশ ছিল না। এটি ছিল ছোট ছোট নগর-রাষ্ট্রে (city-states) বিভক্ত—যেমন ফ্লোরেন্স, ভেনিস, মিলান, নেপলস, আর পোপের শাসনাধীন রোম। এই রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সঙ্গে সব সময় যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত থাকত। অনেকটা আমাদের পাড়ার ক্লাবে ক্লাবে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ের মতো, তবে এর ব্যপ্তি ছিল বিশাল এবং বাজিটা ছিল মানুষের জীবন ও রাজ্যের অস্তিত্ব।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাইরের শক্তির নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। ফ্রান্স, স্পেন, পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য (Holy Roman Empire)—সবাই ছিল ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো। তারা ইতালির এই বিভক্ত অবস্থার সুযোগ নিতে চাইত, এখানকার ধনসম্পদ লুট করতে চাইত। পোপ তখন কেবল একজন নিরীহ ধর্মীয় নেতা নন, তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত শক্তিশালী রাজনৈতিক খেলোয়াড়। তার নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল, তিনি জোট তৈরি করতেন, জোট ভাঙতেন, যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। ধর্মের নামে চলত ক্ষমতার নির্দয় খেলা।
এই টালমাটাল পরিবেশেই ম্যাকিয়াভেলি বড় হচ্ছিলেন। তার যৌবনে তিনি ফ্লোরেন্সের এক নাটকীয় পরিবর্তনের সাক্ষী ছিলেন। ক্ষমতাশালী মেডিচি পরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন জিরোলামো সাভোনারোলা (Girolamo Savonarola) নামের এক ধর্মপ্রাণ কিন্তু কট্টরপন্থী সন্ন্যাসী। সাভোনারোলা ফ্লোরেন্সে এক ঐশ্বরিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি শহরের সমস্ত বিলাসিতা, শিল্পকলা এবং অনৈতিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার বিখ্যাত ‘ vainglories এর আগুন’ (Bonfire of the Vanities) এ বহু শিল্পকর্ম, বই এবং প্রসাধনী পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু তার এই কঠোর শাসন বেশিদিন টেকেনি। পোপের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে এবং রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তিনিও ক্ষমতার চক্রান্তে পরাজিত ও নিহত হন। এই ঘটনা ম্যাকিয়াভেলির মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি হয়তো এখান থেকেই প্রথম শিক্ষা পেয়েছিলেন যে, কেবল নৈতিকতা বা ধর্মীয় বিশ্বাস দিয়ে রাষ্ট্র চালানো যায় না; নিরস্ত্র নবীরা (unarmed prophets) সবসময় পরাজিত হয়।
সাভোনারোলার পতনের পরই, ১৪৯৮ সালে, মাত্র ২৯ বছর বয়সে, ম্যাকিয়াভেলি ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্রের দ্বিতীয় চ্যান্সেলরির সচিব (Secretary to the Second Chancery) এবং ‘যুদ্ধ ও শান্তির দশজনের কমিটি’র (Ten of War) সচিব নিযুক্ত হন। পদটা শুনতে যত বড় মনে হচ্ছে, ততটা নয়, কিন্তু এর গুরুত্ব ছিল অনেক। তিনি ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ কূটনীতিক (diplomat) এবং আমলা। এই পদে থেকে তিনি ফ্রান্সের রাজা দ্বাদশ লুই থেকে শুরু করে পবিত্র রোমান সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান, এমনকি পোপ ষষ্ঠ আলেক্সান্ডারের কুখ্যাত পুত্র সিজার বোর্জিয়া (Cesare Borgia) পর্যন্ত অনেকের দরবারে দৌড়ঝাঁপ করেছেন।
তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন শাসকেরা কীভাবে ক্ষমতা ধরে রাখে, কীভাবে ষড়যন্ত্র করে, কীভাবে মিত্র পরিবর্তন করে চোখের পলকে। তিনি বই পড়ে রাজনীতি শেখেননি, রাজনীতির ময়দানে থেকে এর প্রতিটি নোংরা চাল হাতে-কলমে শিখেছেন। তার এই বাস্তব, তিক্ত অভিজ্ঞতাই তার দর্শনের মূল ভিত্তি।
কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিল না। ১৪৯৪ থেকে ১৫১২ সাল পর্যন্ত ফ্লোরেন্সে ছিল একটি প্রজাতন্ত্র (republic)। কিন্তু ১৫১২ সালে ক্ষমতাশালী মেডিচি (Medici) পরিবার স্প্যানিশ সৈন্যদের সহায়তায় ফ্লোরেন্স দখল করে নেয় এবং প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটায়। ম্যাকিয়াভেলির মতো প্রজাতন্ত্রের অনুগত কর্মকর্তাদের কপাল পোড়ে। তার দীর্ঘ ১৪ বছরের চাকরি চলে যায়।
শুধু তাই নয়, ১৫১৩ সালে মেডিচিদের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে ফ্লোরেন্সের কুখ্যাত বার্জেলো কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং ‘স্ট্র্যাপাডো’ (strappado) নামক এক ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়। এই পদ্ধতিতে হাত পেছনে বেঁধে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো এবং হঠাৎ করে নিচে ফেলে দেওয়া হতো, যা কাঁধের হাড়কে স্থানচ্যুত করে দিত। এই অমানুষিক নির্যাতনের পরেও ম্যাকিয়াভেলি তার নিরপরাধ হওয়ার দাবিতে অটল ছিলেন।
অবশেষে, মেডিচি পরিবারের একজন কার্ডিনাল পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর (পোপ দশম লিও) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু তাকে ফ্লোরেন্স থেকে নির্বাসিত করা হয়। শহরের বাইরে সান কাশানাও নামক গ্রামে তার ছোট্ট একটি খামারবাড়িতে তিনি একাকী, অপমানিত জীবন কাটাতে শুরু করেন। এই নির্বাসনের নিঃসঙ্গতা আর দারিদ্র্যই তার জন্য শাপে বর হয়ে আসে।
তার বন্ধু ফ্রান্সেসকো ভেত্তোরিকে লেখা এক বিখ্যাত চিঠিতে তিনি তার দৈনন্দিন জীবনের এক করুণ কিন্তু অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, দিনের বেলা তিনি গ্রামের সাধারণ কাঠুরে আর কৃষকদের সঙ্গে মিশতেন, সরাইখানায় গিয়ে তাস খেলতেন, ঝগড়া করতেন। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই তিনি চলে যেতেন তার পড়ার ঘরে। সেখানে তিনি দিনের ধুলোমাখা পোশাক বদলে প্রাচীন রোমানদের মতো অভিজাত পোশাক (curial robes) পরতেন। তারপর তিনি ডুব দিতেন তার বইয়ের জগতে। তিনি প্রাচীন ইতিহাসবিদ ও দার্শনিকদের বই পড়তেন—লিভি, ট্যাসিটাস, সিসেরো। তিনি লিখেছেন, এই বইগুলোর মাধ্যমে তিনি মহান মানুষদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের প্রশ্ন করতেন, আর তারা চার ঘণ্টা ধরে তার উত্তর দিত। এই সময়ে তিনি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, এমনকি মৃত্যুর ভয়ও ভুলে যেতেন।
এই একাকিত্ব আর গভীর পড়াশোনার ফসলই হলো তার বিখ্যাত দুটি বই—‘দ্য প্রিন্স’ (The Prince বা Il Principe) এবং ‘ডিসকোর্সেস অন লিভি’ (Discourses on Livy বা Discorsi sopra la prima deca di Tito Livio)। (Skinner, 1978)
ম্যাকিয়াভেলি: যে ঝড় তাকে তৈরি করেছিল
কিন্তু মানুষ কি শূন্য থেকে তৈরি হয়? তার চিন্তা, তার দর্শন, তার ভয়—এসবের পেছনে কি কোনো কারণ থাকে না? ম্যাকিয়াভেলিও শূন্য থেকে আসেননি। তাকে বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হবে তার সময়ের দিকে—সেই রক্তাক্ত, ষড়যন্ত্রপূর্ণ ইতালির দিকে। আর ডুব দিতে হবে সেই পুরনো দার্শনিক বিতর্কের গভীরে, যার সঙ্গে তিনি লড়েছিলেন, যাকে তিনি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন। চলুন দেখা যাক, কোন রাজনৈতিক ঝড় আর কোন চিন্তার স্রোত নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি নামের এই কূটনীতিককে এক বিপ্লবী রাষ্ট্রচিন্তাবিদে পরিণত করেছিল। এই যাত্রায় আমরা দেখব, তিনি শয়তানের দূত ছিলেন না; তিনি ছিলেন তার সময়ের এক অনিবার্য ফসল।
ইতালির রক্তাক্ত ক্যানভাস: যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ম্যাকিয়াভেলিকে গড়েছে
যেকোনো মানুষকে বুঝতে হলে তার সময়কে বুঝতে হয়। ম্যাকিয়াভেলির জন্ম ১৪৬৯ সালে, ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। তার সময়টা ছিল রেনেসাঁর স্বর্ণযুগ। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান—সবকিছুতে নতুন প্রাণের জোয়ার। কিন্তু এই সৃজনশীলতার আলোর নিচেই ছিল রাজনীতির এক ঘোর অন্ধকার।
সেই সময়ে ইতালি কোনো একক, ঐক্যবদ্ধ দেশ ছিল না। এটি ছিল ছোট ছোট নগর-রাষ্ট্রে (city-states) বিভক্ত—ফ্লোরেন্স, ভেনিস, মিলান, নেপলস, আর পোপের শাসনাধীন রোম। এই নগর-রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত থাকত। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, এক জঙ্গলে কোনো বাঘ নেই, আর ছোট-বড় সব শেয়াল আর নেকড়েরা নিজেদের রাজা ভেবে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
মিত্রতা এখানে ছিল কাঁচের দেয়ালের মতো। আজ যে বন্ধু, কাল সে-ই শত্রু। চুক্তি হতো সকালে, আর বিকেলে তা ভেঙে ফেলা হতো সামান্য স্বার্থের জন্য। ম্যাকিয়াভেলি নিজে ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ কূটনীতিক (diplomat)। তিনি খুব কাছ থেকে এই নোংরা খেলাটা দেখেছেন। তিনি বুঝেছিলেন, এই জগতে নৈতিকতা বা সরল বিশ্বাস নিয়ে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। এখানে টিকে থাকতে হলে শক্তি আর ধূর্ততা—দুটোই লাগে।
ইতালির এই বিভক্ত অবস্থার সুযোগ নিচ্ছিল বাইরের বড় বড় শক্তিগুলো—ফ্রান্স, স্পেন, পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য (Holy Roman Empire)। তারা সবাই ছিল ক্ষুধার্ত শকুনের মতো, ইতালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। তারা ইতালির এক পক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে উস্কে দিত, নিজেদের সৈন্য নিয়ে ঢুকে পড়ত, আর ইচ্ছেমতো লুটপাট চালাত।
ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন একজন তীব্র দেশপ্রেমিক। তার মনে এই নিয়ে গভীর যন্ত্রণা ছিল। তিনি দেখছিলেন, কীভাবে তার মাতৃভূমি বিদেশি শক্তির খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছে। এই অপমান আর অসহায়ত্ববোধ থেকেই তার মনে একটি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীন ইতালির স্বপ্ন জন্মায়। তিনি এমন একজন নেতার স্বপ্ন দেখতেন, যিনি এই সব বিভেদ দূর করে ইতালিকে এক করতে পারবেন—প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হয়েও। তার বিখ্যাত বই ‘দ্য প্রিন্স’-এর পুরো দর্শনটাই যেন এই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের একটি নকশা। (Skinner, 2000)
সেই সময়ে পোপ কেবল একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইতালির অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক খেলোয়াড়। তার নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল, বিশাল ভূখণ্ড ছিল (the Papal States)। তিনি জোট তৈরি করতেন, যুদ্ধ ঘোষণা করতেন, ষড়যন্ত্র করতেন। ধর্মের পবিত্র পোশাকের আড়ালে তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ এবং প্রায়শই নিষ্ঠুর শাসক।
ম্যাকিয়াভেলি পোপ ষষ্ঠ আলেক্সান্ডার এবং তার পুত্র সিজার বোর্জিয়ার (Cesare Borgia) মতো চরিত্রদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সিজার বোর্জিয়া ছিলেন একই সঙ্গে সাহসী, বুদ্ধিমান এবং চরম নিষ্ঠুর। তিনি বাবার ক্ষমতার ওপর ভর করে খুব অল্প সময়ে একটি বিশাল রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ম্যাকিয়াভেলি সিজারের কাজের পদ্ধতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, ক্ষমতা অর্জন ও ধরে রাখার জন্য মাঝে মাঝে কতটা নির্মম হতে হয়। সিজারের চরিত্রটিই তার ‘আদর্শ প্রিন্স’-এর অন্যতম একটি মডেল হয়ে ওঠে।
ইতালির নগর-রাষ্ট্রগুলো নিজেদের সেনাবাহিনীর বদলে মূলত ভাড়াটে সৈন্যদের (mercenaries বা condottieri) ওপর নির্ভর করত। এই ভাড়াটে সৈন্যরা টাকার জন্য যুদ্ধ করত, তাদের কোনো দেশপ্রেম ছিল না। ম্যাকিয়াভেলি তার নিজের শহর ফ্লোরেন্সকে এই ভাড়াটে সৈন্যদের হাতে বারবার অপমানিত হতে দেখেছেন। তারা হয় যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যেত, নয়তো শত্রুর সঙ্গে হাত মেলাত।
এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এক গভীর সিদ্ধান্তে পৌঁছান: একটি রাষ্ট্র কখনোই ভাড়াটে সৈন্যের ওপর নির্ভর করে শক্তিশালী হতে পারে না। রাষ্ট্রের নিজস্ব নাগরিক সেনাবাহিনী (citizen army) থাকতে হবে, যারা দেশের জন্য প্রাণ দেবে। এই চিন্তাটি তার রাষ্ট্রদর্শনের একটি মূল ভিত্তি ছিল।
ম্যাকিয়াভেলি নিজে ছিলেন ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্রের একজন একনিষ্ঠ সেবক। কিন্তু ১৫১২ সালে ক্ষমতাশালী মেডিচি (Medici) পরিবার স্প্যানিশদের সাহায্যে প্রজাতন্ত্রকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। ম্যাকিয়াভেলির চাকরি চলে যায়। শুধু তাই নয়, তাকে মেডিচিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়, এমনকি নির্যাতনও (torture) করা হয়।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি নির্বাসিত (exiled) হন। এই নির্বাসনের একাকীত্ব আর হতাশার মধ্যেই তিনি তার সবচেয়ে বিখ্যাত লেখাগুলো লেখেন। তিনি ক্ষমতা হারিয়েছিলেন, সম্মান হারিয়েছিলেন। এই ব্যক্তিগত বিপর্যয় তাকে ক্ষমতার প্রকৃতি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে। ‘দ্য প্রিন্স’ ছিল একদিকে যেমন তার রাজনৈতিক জ্ঞানের সারসংক্ষেপ, অন্যদিকে মেডিচিদের কাছে চাকরি ফিরে পাওয়ার একটি মরিয়া আবেদন।
এই রক্তাক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিই ছিল সেই মাটি, যেখানে ম্যাকিয়াভেলির বাস্তববাদী (realistic) এবং প্রায়শই নির্মম দর্শনের বীজ রোপিত হয়েছিল।
চিন্তার জগতে লড়াই: যে দার্শনিকদের তিনি পড়তেন এবং ভাঙতেন
ম্যাকিয়াভেলি শূন্য থেকে তার দর্শন তৈরি করেননি। তিনি ছিলেন রেনেসাঁসের একজন শিক্ষিত মানুষ, যিনি প্রাচীন গ্রিক ও রোমান ক্লাসিক পড়েছেন। কিন্তু তিনি তার পূর্বসূরিদের অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি। বরং তিনি তাদের সঙ্গে এক ধরনের বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন।
ম্যাকিয়াভেলির সময়ে রেনেসাঁস মানবতাবাদ (Renaissance Humanism) ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। মানবতাবাদীরা প্রাচীন গ্রিস ও রোমের সাহিত্য ও দর্শনের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন। তারা এক ধরনের বই লিখতেন, যার নাম ছিল ‘মিরর ফর প্রিন্সেস’ (Mirrors for Princes / specula principum)। এই বইগুলোতে শাসকের কেমন হওয়া উচিত, তার এক আদর্শ ছবি তুলে ধরা হতো।
এই বইগুলোর মূল কথা ছিল—একজন শাসককে অবশ্যই দয়ালু, সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং সবার ওপরে, একজন ভালো খ্রিস্টান হতে হবে। বিখ্যাত মানবতাবাদী দার্শনিক ইরাসমাস তার ‘The Education of a Christian Prince’ বইতে ঠিক এই কথাই বলেছিলেন।
ম্যাকিয়াভেলিও একটি ‘মিরর ফর প্রিন্সেস’ লিখেছেন—তার বইটির নাম ‘দ্য প্রিন্স’। কিন্তু তিনি এই ধারার লেখকদের সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর রসিকতা করেছেন। তিনি তাদের সব আদর্শকে উল্টে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একজন শাসকের দয়ালু বা সৎ থাকার চেয়ে, দয়ালু বা সৎ ভান করাটা বেশি জরুরি। তিনি দেখিয়েছেন যে, রাজনীতির বাস্তব জগতে টিকে থাকতে হলে একজন শাসককে প্রায়ই সেই সব কাজ করতে হয়, যা প্রচলিত নৈতিকতার সম্পূর্ণ বিরোধী। এইভাবে তিনি মানবতাবাদী আদর্শবাদের ওপর এক প্রচণ্ড আঘাত হানেন। (Skinner, 1978)
ম্যাকিয়াভেলি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রাচীন রোমান ইতিহাসবিদদের দ্বারা, বিশেষ করে টাইটাস লিভি (Livy) এবং ট্যাসিটাস (Tacitus) দ্বারা। দার্শনিকদের আদর্শবাদী কথার চেয়ে ইতিহাসবিদদের লেখা বাস্তব ঘটনা তাকে বেশি আকর্ষণ করত।
লিভির লেখা রোম প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস পড়তে পড়তেই তিনি তার আরেকটি অসাধারণ বই ‘ডিসকোর্সেস অন লিভি’ (Discourses on Livy) লেখেন। এখান থেকে তিনি শিখেছিলেন—
- কীভাবে একটি প্রজাতন্ত্র শক্তিশালী হয়।
- নাগরিক গুণাবলি (civic virtue) এবং দেশপ্রেম একটি রাষ্ট্রের জন্য কতটা জরুরি।
- দ্বন্দ্ব (conflict) সবসময় খারাপ নয়; অভিজাত শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের মধ্যেকার সংঘাতই রোমকে শক্তিশালী ও মুক্ত করেছিল। (Pocock, 1975)
তিনি ইতিহাসকে দেখতেন উদাহরণ (examples) এর এক ভাণ্ডার হিসেবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানব চরিত্র যেহেতু বদলায় না, তাই ইতিহাসের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
প্রাচীন রোমান দার্শনিক ও বাগ্মী সিসেরো (Cicero) ছিলেন মানবতাবাদীদের কাছে এক আদর্শ চরিত্র। সিসেরো তার বই ‘অন ডিউটিজ’ (De Officiis)-এ বলেছিলেন যে, যা নৈতিকভাবে সঠিক, তা-ই রাজনৈতিকভাবে উপকারী। সততাই শ্রেষ্ঠ নীতি এবং একজন শাসকের উচিত সবসময় তার কথা রাখা।
ম্যাকিয়াভেলি তার ‘দ্য প্রিন্স’-এর বিখ্যাত অধ্যায়গুলোতে (১৫-১৮) সরাসরি সিসেরোর এই ধারণাকে আক্রমণ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই ধারণাটি সুন্দর, কিন্তু বাস্তবসম্মত নয়। যে শাসক সবসময় সৎ থাকতে চাইবে, সে অসৎদের এই পৃথিবীতে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই একজন সফল শাসককে হতে হবে সিংহের মতো শক্তিশালী এবং শিয়ালের মতো ধূর্ত। প্রয়োজনে তাকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতেও জানতে হবে।
এইভাবে, ম্যাকিয়াভেলি ক্লাসিক্যাল ঐতিহ্যের দুটি ধারার মধ্যে একটিকে (বাস্তববাদী বা রিয়ালিস্ট ইতিহাস) অন্যটির (আদর্শবাদী বা ভাববাদী বা আইডিয়ালিস্ট দর্শন) বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেন।
মধ্যযুগের পুরোটা সময় ধরে রাজনৈতিক চিন্তা ছিল খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের অধীন। সেন্ট অগাস্টিন বা টমাস অ্যাকুইনাসের মতো দার্শনিকেরা শিখিয়েছেন যে, রাষ্ট্র ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ এবং একজন শাসকের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো প্রজাদের আত্মার মুক্তির পথে সাহায্য করা। পার্থিব গৌরব বা ক্ষমতা ছিল গৌণ।
ম্যাকিয়াভেলি এই হাজার বছরের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করলেন। তিনি রাজনীতিকে ধর্ম ও নৈতিকতা থেকে পুরোপুরি আলাদা করে দিলেন। তিনি বললেন, রাষ্ট্রের নিজস্ব নৈতিকতা আছে, যা ব্যক্তিগত নৈতিকতা থেকে ভিন্ন। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতাই হলো সর্বোচ্চ লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য শাসক যদি কোনো পাপও করেন, তবে তা গ্রহণযোগ্য। এই ধারণাটিকে পরে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্রের কারণ’ (reason of state / raison d’état)। (Berlin, 1979)
তিনি খ্রিস্টধর্মের সমালোচনাও করেছেন। তার মতে, খ্রিস্টধর্ম মানুষকে নম্র ও পরকালমুখী করে তোলে, যা রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেয়। এর বিপরীতে, প্রাচীন রোমানদের ধর্ম তাদের সাহসী, দেশপ্রেমিক এবং জাগতিক গৌরবের প্রতি আগ্রহী করে তুলত।
ভাঙনের গর্ভ থেকে জন্ম
তাহলে ছবিটা কী দাঁড়াল?
ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন এমন এক ঝড়ের মুখে পড়া নাবিক, যিনি দেখছিলেন তার জাহাজ (ইতালি) টুকরো টুকরো হয়ে ডুবে যাচ্ছে। চারদিকে ছিল বিশৃঙ্খলা, বিশ্বাসঘাতকতা আর দুর্বলতা। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিই তাকে বাধ্য করেছিল একটি শক্ত নোঙরের সন্ধান করতে—আর সেই নোঙর হলো ক্ষমতা।
অন্যদিকে, চিন্তার জগতে তিনি দেখছিলেন যে পুরনো আদর্শবাদী দর্শনগুলো (সিসেরো বা খ্রিস্টীয় দর্শন) এই ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে। এগুলো সুন্দর কথা, কিন্তু বাস্তবতার কঠিন মাটিতে এগুলোর কোনো দাম নেই। তাই তিনি সেই দর্শনগুলোকে নির্মমভাবে বর্জন করলেন এবং প্রাচীন রোমের বাস্তববাদী ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলেন।
ম্যাকিয়াভেলি তাই কোনো শয়তান ছিলেন না, যিনি মানুষকে খারাপ হতে শিখিয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক চিকিৎসক, যিনি তার সময়ের অসুস্থ রাষ্ট্রকে নিরাময় করার জন্য এক তিক্ত ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলেন। তিনি আয়নার মতো তার সময়ের কদর্য চেহারাটাকেই তুলে ধরেছিলেন। সেই চেহারাটা এতটাই কুৎসিত ছিল যে, আমরা আজও সেই আয়নাটার দিকে তাকাতে ভয় পাই।
তার চিন্তা জন্ম নিয়েছিল এক গভীর সংকট এবং হতাশা থেকে। অদ্ভুত না ব্যাপারটা?
মানব চরিত্র—ম্যাকিয়াভেলির চশমায় (Human Nature: Through Machiavelli’s Lens)
ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক দর্শন বুঝতে হলে প্রথমে তার মানব চরিত্র সম্পর্কিত ধারণাকে বুঝতে হবে। কারণ তার সব পরামর্শের ভিত্তি হলো মানুষ আসলে কেমন, সেই সম্পর্কিত তার নিজস্ব বিশ্লেষণ।
প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের মতো তিনি মানুষকে আদর্শবাদী প্রাণী হিসেবে দেখেননি, যারা যুক্তি ও নৈতিকতা দিয়ে পরিচালিত হয়। মধ্যযুগের খ্রিস্টান দার্শনিকদের মতো তিনি মানুষকে ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি হিসেবেও দেখেননি, যারা পাপী হলেও অনুতাপের মাধ্যমে মুক্তি পেতে পারে। এমনকি রেনেসাঁর মানবতাবাদীরা (humanists), যারা মানুষের মর্যাদা ও সম্ভাবনার জয়গান গাইছিলেন, তাদের সঙ্গেও তিনি একমত ছিলেন না।
ম্যাকিয়াভেলির চোখে মানুষ হলো এক স্বার্থপর, লোভী, অকৃতজ্ঞ এবং ভীরু প্রাণী। তার লেখায় বারবার এই নৈরাশ্যবাদী (pessimistic) দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে।
তিনি ‘দ্য প্রিন্স’-এ লিখেছেন, “মানুষ সম্পর্কে সাধারণভাবে এই কথা বলা যায় যে তারা অকৃতজ্ঞ, চঞ্চল, ভণ্ড ও প্রতারক, বিপদ থেকে পালায় এবং লাভের জন্য পাগল।” (Machiavelli, The Prince, Chapter XVII)।
তার মতে, মানুষের এই মৌলিক চরিত্র কখনো বদলায় না। ইতিহাসজুড়ে মানুষ একই রকম আবেগ—যেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা, হিংসা, ভয়—দ্বারা চালিত হয়েছে। তারা ভালোবাসার চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে (interest বা interesse) অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। মানুষের স্মৃতিশক্তিও খুব দুর্বল, বিশেষ করে উপকারের কথা তারা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। কিন্তু ভয় বা শাস্তির কথা তারা সহজে ভোলে না। এই কারণেই তিনি পরে বলবেন যে, শাসকের জন্য ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে ভয়ের পাত্র হওয়া বেশি নিরাপদ।
মানুষের এই স্বার্থপর প্রকৃতিই রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। একজন শাসককে যদি সফল হতে হয়, তবে তাকে মানুষের এই দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগাতে জানতে হবে। তাকে ধরে নিতে হবে যে, সুযোগ পেলেই মানুষ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তাই শাসকের কাজ হলো এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করা, যেখানে মানুষ নিজের স্বার্থেই শাসকের প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য হয়।
এই দৃষ্টিভঙ্গিটা শুনতে খুব খারাপ লাগছে, তাই না? কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি বলবেন, আমি বানিয়ে কিছু বলছি না। আমার ১৪ বছরের কূটনৈতিক জীবনে আমি যা দেখেছি, ইতিহাস খুলে আমি যা পড়েছি, এটাই তার সারমর্ম। এটাই বাস্তবতা। রাজনীতি কোনো সাধু-সন্ন্যাসীদের আশ্রম নয়। এখানে টিকে থাকতে হলে মানুষের ভালোমানুষির ওপর ভরসা করে চললে চলবে না। শাসকের কাজ হলো রাষ্ট্রকে রক্ষা করা, প্রজাদের নিরাপত্তা দেওয়া। এই কাজ করতে গিয়ে যদি তাকে মানুষের মন্দ দিকগুলোকে ব্যবহার করতে হয়, তবে তাই সই।
এই যে মানুষের ওপর এক গভীর অবিশ্বাস, এটাই ম্যাকিয়াভেলির বাস্তববাদী রাজনীতির (political realism) প্রথম ধাপ। তিনি আদর্শের রঙিন চশমা খুলে ফেলে রাজনীতির কদর্য, নগ্ন রূপটাকে দেখতে চেয়েছিলেন।
‘দ্য প্রিন্স’—ক্ষমতার সেই বিতর্কিত ম্যানুয়াল
ম্যাকিয়াভেলির নাম শুনলেই যে বইটির কথা আমাদের মাথায় আসে, সেটি হলো ‘দ্য প্রিন্স’। এটি ছোট্ট একটি বই, মাত্র ২৬টি অধ্যায়। কিন্তু এর প্রভাব বিশাল। বইটি তিনি লিখেছিলেন ১৫১৩ সালে, তার নির্বাসনের প্রথম বছরে। তিনি এটি উৎসর্গ করেছিলেন ফ্লোরেন্সের নতুন শাসক লরেঞ্জো ডি মেডিচিকে (Lorenzo de’ Medici)।
এর পেছনে তার একটা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ছিল। তিনি মেডিচিদের বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তিনি একজন যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোক এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তার জ্ঞানকে কাজে লাগানো যেতে পারে। সহজ কথায়, এটি ছিল তার হারানো চাকরি ফিরে পাওয়ার একটি মরিয়া আবেদনপত্র। (Mansfield, 1996)
কিন্তু এই বইতে তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা আগের সব রাজনৈতিক দর্শনকে চুরমার করে দেয়। তার আগে প্লেটো, অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে মধ্যযুগের খ্রিস্টান দার্শনিকেরা (যেমন, সেন্ট অগাস্টিন বা টমাস অ্যাকুইনাস) এবং এমনকি সিসেরোর মতো রোমানরাও বলেছেন, একজন শাসককে অবশ্যই সৎ, দয়ালু, ন্যায়পরায়ণ এবং ধার্মিক হতে হবে। অর্থাৎ, রাজনীতি আর ব্যক্তিগত নৈতিকতা (morality) অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
ম্যাকিয়াভেলি এই হাজার বছরের ঐতিহ্যকে প্রথম এবং সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিলেন। তিনি বললেন, রাজনীতির জগৎটা নৈতিকতার জগৎ নয়। এটি ক্ষমতার জগৎ। এখানে টিকে থাকতে হলে শাসকের ভালো বা মন্দ হওয়ার চেয়েও বেশি জরুরি হলো কার্যকর (effective) হওয়া। তিনি প্রশ্ন তোলেননি যে একজন শাসকের কেমন হওয়া উচিত (what ought to be)। তিনি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, ক্ষমতা পেতে এবং ধরে রাখতে গেলে একজন শাসককে বাস্তবে কী করতে হয় (what is done)। এই আদর্শবাদকে বর্জন করে কঠোর বাস্তবতার দিকে ঝোঁকাই ছিল তার দর্শনের সবচেয়ে বড় বিপ্লব।
চলুন, ‘দ্য প্রিন্স’-এর কিছু বিখ্যাত এবং বিতর্কিত ধারণা একটু তলিয়ে দেখা যাক।
বইয়ের শুরুতেই ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেন: প্রজাতন্ত্র (republics) এবং রাজত্ব (principalities)। যেহেতু তিনি বইটি একজন রাজাকে (প্রিন্স) উদ্দেশ্য করে লিখছেন, তাই তিনি প্রজাতন্ত্রের আলোচনা বাদ দিয়ে কেবল রাজত্ব নিয়েই কথা বলেন। তিনি রাজত্বগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন, যা ক্ষমতা অর্জন ও ধরে রাখার কৌশল বোঝার জন্য জরুরি।
-
বংশানুক্রমিক রাজত্ব (Hereditary Principalities): এগুলো শাসন করা সবচেয়ে সহজ। কারণ প্রজারা শাসকের পরিবারকে দীর্ঘদিন ধরে শাসন করতে দেখে অভ্যস্ত। শাসকের শুধু পূর্বপুরুষদের নিয়মকানুন মেনে চললেই হয়। বড় কোনো বিপর্যয় না ঘটলে এই ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন নয়।
-
মিশ্র রাজত্ব (Mixed Principalities): যখন একটি পুরোনো রাজ্যের সঙ্গে নতুন কোনো অঞ্চল দখল করে যুক্ত করা হয়, তখন তাকে মিশ্র রাজত্ব বলে। এগুলো শাসন করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ নতুন অঞ্চলের মানুষ পুরনো শাসকের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে নতুন শাসককে স্বাগত জানায়, কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই তারা বোঝে যে নতুন শাসকও তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। ফলে বিদ্রোহের আশঙ্কা থাকে। এখানে সফল হতে হলে শাসককে হয় নতুন অঞ্চলে গিয়ে বাস করতে হবে, অথবা সেখানে কলোনি স্থাপন করতে হবে।
-
নতুন রাজত্ব (New Principalities): এগুলোই ম্যাকিয়াভেলির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। যে শাসক নিজের যোগ্যতায় বা অন্যের সাহায্যে নতুন একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তার চ্যালেঞ্জই সবচেয়ে বেশি। এই নতুন রাজ্য দুইভাবে পাওয়া যেতে পারে:
-
নিজের শক্তিতে ও ভার্চু দ্বারা: যারা নিজের সেনাবাহিনী এবং যোগ্যতা (ভার্চু) দিয়ে রাজ্য জয় করেন, তাদের রাজ্য জয় করা কঠিন, কিন্তু শাসন করা সহজ। কারণ তারা যে ভিত্তি তৈরি করেন, তা খুব মজবুত হয়।
-
অন্যের শক্তিতে ও ফরচুনা দ্বারা: যারা অন্যের সাহায্যে বা ভাগ্যের জোরে (ফরচুনা) শাসক হন, তাদের রাজ্য জয় করা খুব সহজ, কিন্তু তা ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব। কারণ তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল এবং তাদের ক্ষমতার কোনো শক্ত ভিত্তি থাকে না। সিজার বোর্জিয়া ছিলেন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
-
-
পাপের মাধ্যমে অর্জিত রাজত্ব (Principalities acquired by crime): কিছু শাসক আছেন যারা ষড়যন্ত্র বা চরম নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। ম্যাকিয়াভেলি এদের প্রশংসা করেননি, কিন্তু স্বীকার করেছেন যে এই পদ্ধতিতেও ক্ষমতা পাওয়া যায়।
-
ধর্মীয় রাজত্ব (Ecclesiastical Principalities): যেমন পোপের শাসনাধীন রোম। ম্যাকিয়াভেলির মতে, এগুলো শাসন করা সবচেয়ে সহজ। কারণ এগুলোর ভিত্তি হলো প্রাচীন ধর্মীয় প্রথা, যা এতটাই শক্তিশালী যে শাসকের যোগ্যতা বা আচরণ যেমনই হোক না কেন, তার ক্ষমতা অটুট থাকে। তিনি কিছুটা বিদ্রূপের সুরেই বলেন, এই রাজ্যগুলো ঈশ্বর দ্বারা সমর্থিত, তাই এগুলো নিয়ে আলোচনা করা ধৃষ্টতা।
এই শ্রেণিবিভাগ দেখায় যে, ম্যাকিয়াভেলি কতটা পদ্ধতিগতভাবে (systematically) ক্ষমতাকে বিশ্লেষণ করেছেন।
ম্যাকিয়াভেলির দর্শনের কেন্দ্রে আছে এই দুটি ধারণা। এই দুটি শব্দকে ঠিকঠাক না বুঝলে ম্যাকিয়াভেলিকে বোঝা প্রায় অসম্ভব।
-
ফরচুনা (Fortuna): একে আমরা ভাগ্য, নিয়তি বা অদৃষ্ট বলতে পারি। ম্যাকিয়াভেলি ফরচুনাকে এক প্রাচীন দেবীরূপে কল্পনা করেছেন, যিনি খামখেয়ালি এবং নিষ্ঠুর। তিনি ফরচুনাকে তুলনা করেছেন এক ভয়ংকর, উত্তাল নদীর সঙ্গে। যখন বন্যা আসে, তখন এই নদী কোনো বাধা মানে না; ঘরবাড়ি, গাছপালা, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মানুষ অসহায় হয়ে তাকিয়ে দেখে। রাজনীতিতেও এরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা, সংকট (crisis), বা দুর্ঘটনা আসে, যা শাসকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মিত্রের আকস্মিক বিশ্বাসঘাতকতা, বা নতুন কোনো শক্তির উত্থান। ফরচুনা হলো সেইসব জিনিস, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।
-
ভার্চু (Virtù): এই শব্দটির সরাসরি বাংলা করা খুব কঠিন। এটি খ্রিস্টীয় ‘Virtue’ বা পুণ্য (সততা, দয়া, ক্ষমা) নয়। ম্যাকিয়াভেলির ‘ভার্চু’ হলো এক ধরনের জাগতিক দক্ষতা। এটি হলো শাসকের ব্যক্তিগত সাহস, বুদ্ধি, শক্তি, ধূর্ততা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। এটি এক পৌরুষদীপ্ত, আক্রমণাত্মক গুণ। ভার্চু হলো সেই গুণ, যা দিয়ে একজন শাসক ভাগ্য বা ফরচুনাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। ম্যাকিয়াভেলি বলেন, যে শাসকের ভার্চু আছে, সে বন্যার জন্য আগে থেকেই নদীর তীরে বাঁধ (dykes) এবং খাল (channels) তৈরি করে রাখে। অর্থাৎ, সে সংকটের জন্য প্রস্তুত থাকে। তার মতে, “ফরচুনা হয়তো আমাদের কাজের অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু বাকি অর্ধেক বা তার কাছাকাছি সে আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণের জন্যই ছেড়ে দেয়।” (Machiavelli, The Prince, Chapter XXV)।
একজন সফল শাসক তিনিই, যার মধ্যে প্রচণ্ড ভার্চু আছে এবং যিনি ফরচুনার আকস্মিক ঝাপটা সামলে নিতে পারেন। তিনি সিজার বোর্জিয়ার মতো চরিত্রকে ভার্চুর এক দারুণ উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন। সিজার ছিলেন পোপের পুত্র, যিনি বাবার ক্ষমতার (ফরচুনা) ওপর ভর করে নিজের রাজ্য তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, বুদ্ধিমান এবং নিষ্ঠুর (ভার্চু)। তিনি যা যা করা দরকার, সবই করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার পতন হয়েছিল, কারণ এক চরম দুর্ভাগ্যের শিকার তিনি হয়েছিলেন—তার বাবা মারা গেলেন এবং একই সময়ে তিনি নিজেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এটা ছিল ফরচুনার এক চরম আঘাত, যা তার ভার্চুও সামলাতে পারেনি।
ম্যাকিয়াভেলির মতে, ফরচুনা একজন নারীর মতো, যে সাহসী তরুণদেরই বেশি পছন্দ করে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মারতে হয়, ধমকাতে হয়। যে শাসক বেশি সাবধানী, তার চেয়ে যে বেশি আগ্রাসী, তার ভাগ্য বেশি প্রসন্ন থাকে।
এটি ‘দ্য প্রিন্স’-এর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সবচেয়ে ভুল বোঝা প্রশ্নগুলোর একটি। ম্যাকিয়াভেলি বলছেন, একজন শাসকের জন্য সবচেয়ে ভালো হলো ভালোবাসা এবং ভয়—দুটোই পাওয়া। কিন্তু যেহেতু দুটো একসঙ্গে পাওয়া প্রায় অসম্ভব, তাই যদি একটিকে বেছে নিতেই হয়, তবে “ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে ভয়ের পাত্র হওয়া অনেক বেশি নিরাপদ (far safer)।”
তার যুক্তিটা কী? যুক্তিটা দাঁড়িয়ে আছে মানব চরিত্র নিয়ে তার নৈরাশ্যবাদী ধারণার ওপর। তিনি বলেন, মানুষ স্বভাবতই অকৃতজ্ঞ, চঞ্চল এবং স্বার্থপর। ভালোবাসা টিকে থাকে কৃতজ্ঞতার এক ভঙ্গুর সুতোর ওপর, যা মানুষ নিজের সামান্য স্বার্থের জন্যও ছিঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করে না। কিন্তু ভয় টিকে থাকে শাস্তির আশঙ্কার ওপর, যা মানুষ সহজে ভোলে না। ভয় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য এক অনুভূতি।
তবে এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত আছে, যা অনেকেই এড়িয়ে যান। ম্যাকিয়াভেলি বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন যে, শাসককে এমনভাবে ভয় তৈরি করতে হবে যেন তা ঘৃণায় (hatred) পরিণত না হয়। কারণ ভালোবাসা হারালে বড়জোর শাসকের প্রতি উদাসীনতা তৈরি হয়, কিন্তু ঘৃণা তৈরি হলে তা বিদ্রোহের জন্ম দেয়।
আর ঘৃণা এড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায় কী? তার মতে, দুটি জিনিস থেকে শাসককে দূরে থাকতে হবে: জনগণের সম্পত্তি এবং তাদের নারীদের ওপর হাত দেওয়া যাবে না। তিনি তার সেই বিখ্যাত রূঢ় মন্তব্যটি করেন: “মানুষ তার বাবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিলেও তার পৈতৃক সম্পত্তি হরণকারীকে সহজে ক্ষমা করে না।” (Machiavelli, The Prince, Chapter XVII)।
এই কথাগুলো শুনতে হয়তো খুব রূঢ় এবং আধুনিক সংবেদনশীলতার পরিপন্থী লাগছে। কিন্তু একটু ভাবুন তো, আজকের পৃথিবীর অনেক নেতাই কি এই নীতি মেনে চলেন না? তারা জনগণের ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টার চেয়ে ভয়ের মাধ্যমে শাসন ধরে রাখতে বেশি আগ্রহী।
শাসকের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত? ভালো মানুষ, নাকি খারাপ মানুষ? ম্যাকিয়াভেলি এই বাইনারি থেকে বেরিয়ে এসে এক দারুণ উপমা ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, শাসককে হতে হবে একই সঙ্গে সিংহ এবং শিয়ালের মতো। তাকে জানতে হবে কখন কোনটি হতে হবে।
-
সিংহ (Lion): সিংহের মতো শক্তিশালী এবং সাহসী হতে হবে, যাতে সে শত্রুদের (নেকড়েদের) ভয় দেখিয়ে তাড়াতে পারে। অর্থাৎ, শাসকের সামরিক শক্তি এবং ভয় দেখানোর ক্ষমতা প্রয়োজন। কিন্তু সিংহ বোকা হয়, সে ফাঁদ বোঝে না।
-
শিয়াল (Fox): আবার শিয়ালের মতো ধূর্ত এবং চালাক হতে হবে, যাতে সে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ (traps) চিনতে পারে এবং তা এড়িয়ে যেতে পারে। শিয়াল শক্তিশালী নয়, কিন্তু সে নিজেকে রক্ষা করতে জানে।
যে শাসক কেবল সিংহের মতো বল প্রয়োগ করে, সে ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। আবার যে শাসক কেবল শিয়ালের মতো ধূর্ত, সে শক্তিমান শত্রুর সামনে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। সফল শাসক এই দুয়ের এক নিখুঁত মিশ্রণ।
এর মানে কী? এর মানে হলো, শাসককে প্রয়োজনে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে হবে, ছলনার আশ্রয় নিতে হবে, মিথ্যা কথা বলতে হবে। ম্যাকিয়াভেলি বলেন, “একজন বিচক্ষণ শাসক তার দেওয়া কথা রাখতে পারেন না, বা রাখা উচিতও নয়, যখন তা তার স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়।” কারণ তার মতে, সব মানুষ যদি সৎ হতো, তাহলে শাসকেরও সৎ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু যেহেতু মানুষ খারাপ এবং তারা আপনার সঙ্গে দেওয়া কথা রাখবে না, তাই আপনারও তাদের সঙ্গে কথা রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। (Machiavelli, The Prince, Chapter XVIII)
তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রচলিত নৈতিকতা একটি বিলাসিতা, যা সবসময় বহন করা সম্ভব নয়।
এই সিংহ আর শিয়ালের ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাস্তবতা আর বাহ্যিক রূপের পার্থক্য। ম্যাকিয়াভেলির মতে, একজন শাসকের জন্য ভালো গুণাবলি (দয়া, সততা, ধর্মভীরুতা) থাকার চেয়ে, তার ঐসব গুণ আছে বলে দেখানোটা অনেক বেশি জরুরি।
তিনি বলেন, শাসকের উচিত নিজেকে দয়ালু, বিশ্বাসযোগ্য, মানবিক, সৎ এবং ধার্মিক হিসেবে উপস্থাপন করা। বিশেষ করে ধার্মিকতার ভান করাটা খুব জরুরি। কারণ সাধারণ মানুষ বিচার করে তারা যা দেখে এবং যা শোনে, তার ওপর ভিত্তি করে। তারা শাসকের ভেতরের আসল রূপ দেখতে পায় না। অল্প কিছু মানুষ হয়তো শাসকের আসল চেহারাটা বোঝে, কিন্তু তারা বিশাল জনমতের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না।
“প্রত্যেকেই দেখে আপনি বাইরে কেমন, কিন্তু খুব কম লোকই বোঝে আপনি আসলে কী।” (Machiavelli, The Prince, Chapter XVIII)।
শাসককে হতে হবে একজন দক্ষ অভিনেতা, একজন ভণ্ড (a great pretender and dissembler)। তাকে প্রয়োজনে ভালো এবং মন্দ—দুটোই হওয়ার ক্ষমতা রাখতে হবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী তাকে তার রূপ বদলাতে হবে। যদি ভালো থেকে কাজ হয়, তবে ভালো। যদি মন্দ না হলে নয়, তবে মন্দ হতেও দ্বিধা করা যাবে না।
ম্যাকিয়াভেলিকে প্রায়ই নিষ্ঠুরতার পূজারী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু এটা একটা সরলীকরণ। তিনি নিষ্ঠুরতাকে সমর্থন করেননি, বরং তিনি নিষ্ঠুরতার সঠিক ব্যবহার নিয়ে কথা বলেছেন। তার মতে, নিষ্ঠুরতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
-
সঠিকভাবে ব্যবহৃত নিষ্ঠুরতা (Cruelty well-used): এই ধরনের নিষ্ঠুরতা একবারেই প্রয়োগ করা হয়, এবং তা করা হয় কেবল নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। যখন কোনো নতুন শাসক ক্ষমতা দখল করেন, তখন রাজ্যের স্থিতিশীলতার জন্য সব প্রয়োজনীয় নিষ্ঠুর কাজ একবারে, খুব দ্রুত সেরে ফেলা উচিত। উদ্দেশ্য হলো নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা এবং এরপর আর নিষ্ঠুরতার পুনরাবৃত্তি না করা। এরপর শাসকের উচিত ধীরে ধীরে জনগণের জন্য ভালো কাজ বা সুযোগ-সুবিধা (benefits) দেওয়া, যাতে তারা পুরোনো ভয়াবহতা ভুলে যায় এবং শাসকের প্রতি অনুগত হয়। সিজার বোর্জিয়া যখন রোমানিয়া প্রদেশ দখল করেন, তখন সেখানে শৃঙ্খলা ফেরাতে তিনি রেমিরো দে অরকো নামের এক নিষ্ঠুর লোককে দায়িত্ব দেন। রেমিরো চরম নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে প্রদেশটিকে শান্ত করে। কিন্তু তার নিষ্ঠুরতার কারণে জনগণ তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তখন সিজার বোর্জিয়া একদিন সকালে রেমিরোকে পাবলিক স্কয়ারে দুই টুকরো করে কেটে ফেলে রাখেন। এতে জনগণ ভয়ও পেল, আবার সন্তুষ্টও হলো। ম্যাকিয়াভেলির চোখে, এটা ছিল নিষ্ঠুরতার এক মাস্টারক্লাস ব্যবহার।
-
ভুলভাবে ব্যবহৃত নিষ্ঠুরতা (Cruelty badly-used): যে নিষ্ঠুরতা অল্প অল্প করে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে, তা মানুষের মনে ক্রমাগত ভয় আর ঘৃণা তৈরি করে। এর ফলে শাসকের শাসন কখনোই স্থিতিশীল হয় না, তাকে সবসময় ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
অর্থাৎ, ম্যাকিয়াভেলির কাছে নিষ্ঠুরতা কোনো ব্যক্তিগত ক্রোধ বা আনন্দের বিষয় নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অস্ত্র, যা খুব সাবধানে এবং হিসাব করে ব্যবহার করতে হয়। অনেকটা সার্জনের ছুরির মতো—যা যন্ত্রণা দেয়, কিন্তু বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য প্রয়োজনীয়। (Viroli, 2014)
এই বিখ্যাত উক্তিটি প্রায়ই ম্যাকিয়াভেলির ঘাড়ে চাপানো হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তিনি হুবহু এই কথাটি তার কোনো লেখায় বলেননি। তবে তার দর্শনের সারমর্ম অনেকটা এরকমই দাঁড়ায়। তিনি যা বলেছেন তা হলো, শাসকের কাজের বিচার হবে তার ফলাফলের (result) ওপর ভিত্তি করে।
“মানুষের সব কাজের বিচারে, বিশেষ করে রাজাদের কাজের ক্ষেত্রে, শেষ ফলটাই দেখা হয়।” (Machiavelli, The Prince, Chapter XVIII)।
যদি একজন শাসক রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং রাজ্যের গৌরব বাড়াতে সফল হন, তাহলে তিনি কোন উপায়ে (means) তা করেছেন, মানুষ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সাধারণ মানুষ সবসময় বিজয়ীর পক্ষেই থাকে। সবাই তার সফলতাকেই মনে রাখবে এবং তার প্রশংসা করবে।
এর মানে, রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে (reason of state বা raison d’état) একজন শাসক যদি কোনো অনৈতিক কাজ—যেমন মিথ্যা বলা, চুক্তি ভঙ্গ করা বা নিষ্ঠুরতা—করতে বাধ্য হন, তবে সেটি গ্রহণযোগ্য। কারণ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতাই হলো সর্বোচ্চ নৈতিক লক্ষ্য (highest good)। এই ধারণাটি ছিল তৎকালীন ধর্মীয় নৈতিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত।
রাষ্ট্রনায়কের তরবারি—ভাড়াটে সৈন্য বনাম নাগরিক সেনা (The Prince’s Sword: Mercenaries vs. Citizen Army)
ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক চিন্তার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রায়ই উপেক্ষিত দিক হলো তার সামরিক তত্ত্ব। তিনি কেবল একজন তাত্ত্বিক ছিলেন না; ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্রের সচিব থাকাকালীন তিনি একটি নাগরিক সেনাবাহিনী (citizen militia) গঠনের চেষ্টা করেছিলেন এবং তাতে আংশিক সফলও হয়েছিলেন।
তার সময়ে ইতালির নগর-রাষ্ট্রগুলো মূলত ভাড়াটে সৈন্যদের (mercenaries বা condottieri) ওপর নির্ভরশীল ছিল। ম্যাকিয়াভেলি এই ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর তীব্র ঘৃণা এবং অবিশ্বাস পোষণ করতেন। ‘দ্য প্রিন্স’-এ তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, “ভাড়াটে এবং সাহায্যকারী সৈন্যরা অকেজো এবং বিপজ্জনক।”
কেন? তার যুক্তি ছিল:
- ১. অবিশ্বস্ত: ভাড়াটে সৈন্যরা কেবল টাকার জন্য যুদ্ধ করে। তাদের কোনো দেশপ্রেম বা আনুগত্য নেই। যে বেশি টাকা দেবে, তারা তার পক্ষেই চলে যাবে। শান্তির সময়ে তারা শাসকের কোষাগার খালি করে, আর যুদ্ধের সময়ে তারা হয় পালিয়ে যায়, নয়তো শত্রুর সঙ্গে হাত মেলায়।
- ২. কাপুরুষ: যেহেতু তারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিতে চায় না, তাই তারা সত্যিকারের ভয়ংকর যুদ্ধে জড়াতে চায় না।
- ৩. বিপজ্জনক: একজন সফল ভাড়াটে সেনাপতি নিজেই শাসকের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। সে হয়তো ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতে পারে।
এর সমাধান কী? ম্যাকিয়াভেলির মতে, একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি অবশ্যই তার নিজস্ব ভালো আইন এবং ভালো সেনাবাহিনী হতে হবে। আর ভালো সেনাবাহিনী মানে হলো নাগরিক সেনাবাহিনী (citizen army বা milizia cittadina)। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের নাগরিকদের দিয়েই সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে। কারণ নাগরিকেরা তাদের নিজেদের পরিবার, সম্পত্তি এবং স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে। তাদের আনুগত্য এবং সাহস ভাড়াটে সৈন্যদের চেয়ে অনেক বেশি হবে।
এই ধারণাটি কেবল সামরিক ছিল না, এটি ছিল গভীরভাবে রাজনৈতিক। একটি নাগরিক সেনাবাহিনী তৈরি করার অর্থ হলো নাগরিকদের সশস্ত্র করা। এর মানে হলো, নাগরিকদের ওপর আস্থা রাখা। এটি একটি প্রজাতন্ত্রিক ধারণা, যেখানে নাগরিকেরা কেবল প্রজা নয়, বরং রাষ্ট্রের সক্রিয় রক্ষক। এই ধারণাটি তার রিপাবলিকান চিন্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তার আরেকটি বই, দ্য আর্ট অফ ওয়ার (Dell’arte della guerra), এই বিষয়ের ওপরই লেখা। (Gilbert, 1986)
‘ডিসকোর্সেস অন লিভি’—এক অন্য ম্যাকিয়াভেলি
যারা শুধু ‘দ্য প্রিন্স’ পড়েন, তারা ম্যাকিয়াভেলির একটি খণ্ডিত এবং প্রায়শই বিকৃত রূপ দেখতে পান। তারা মনে করেন, তিনি কেবল স্বৈরাচারী, নিষ্ঠুর শাসনের সমর্থক। কিন্তু তার আসল এবং পছন্দের রাজনৈতিক আদর্শ লুকিয়ে আছে তার আরেকটি বিশাল বই, ‘ডিসকোর্সেস অন লিভি’-তে। এই বইটি তিনি লিখেছেন প্রাচীন রোমান ইতিহাসবিদ টাইটাস লিভির (Titus Livy) লেখা প্রথম দশটি বইয়ের ওপর আলোচনা বা ভাষ্য হিসেবে।
এই বইতে আমরা এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ম্যাকিয়াভেলিকে খুঁজে পাই। এখানে তিনি কোনো রাজতন্ত্রের (monarchy) বা প্রিন্সিপালিটির (principality) গুণগান করেননি, বরং একটি প্রজাতন্ত্রের (republic) শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। তার মতে, একটি সুস্থ, দীর্ঘস্থায়ী এবং গৌরবময় রাষ্ট্রের জন্য প্রজাতন্ত্রই হলো সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা।
ব্যাপারটা কি অদ্ভুত না? যে লোক ‘দ্য প্রিন্স’-এ একজন একনায়ককে ক্ষমতা দখলের সব অনৈতিক কৌশল বাতলে দিচ্ছেন, তিনিই আবার প্রজাতন্ত্রকে শ্রেষ্ঠ বলছেন! এই আপাত প্যারাডক্সকে কীভাবে মেলানো যায়?
এই প্যারাডক্স বোঝার জন্য আমাদের আবার তার সময়ের দিকে তাকাতে হবে এবং তার দুটি বইয়ের উদ্দেশ্যকে আলাদাভাবে দেখতে হবে।
-
‘দ্য প্রিন্স’ হলো একটি জরুরি অবস্থার ব্যবস্থাপত্র। ম্যাকিয়াভেলি মনে করতেন, যখন একটি রাষ্ট্র দুর্নীতিগ্রস্ত (corrupt), বিভক্ত এবং বিশৃঙ্খল, যখন আইনকানুন ভেঙে পড়েছে, তখন সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য একজন শক্তিশালী, একক শাসকের (প্রিন্স) প্রয়োজন। অনেকটা গুরুতর অসুস্থ রোগীকে সারিয়ে তোলার জন্য কড়া ডোজের ওষুধের মতো। প্রিন্স হলেন সেই ‘ডাক্তার’, যিনি কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে রাষ্ট্রকে সুস্থ করে তুলবেন।
-
‘ডিসকোর্সেস’ হলো সুস্থ রাষ্ট্রের জন্য একটি গাইডবুক। একবার রাষ্ট্র স্থিতিশীল হয়ে গেলে এবং নাগরিকেরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হলে, তখন জনগণের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির জন্য প্রজাতন্ত্রই হলো আদর্শ।
‘ডিসকোর্সেস’-এ তিনি দেখিয়েছেন কেন প্রজাতন্ত্র একটি রাজতন্ত্রের চেয়ে শ্রেয়:
রাজতন্ত্র নির্ভর করে একজন শাসকের ব্যক্তিগত গুণাবলির (ভার্চু) ওপর। শাসক ভালো হলে রাজ্য ভালো চলে, শাসক খারাপ হলে রাজ্যের পতন হয়। কিন্তু প্রজাতন্ত্র নির্ভর করে আইনের শাসনের (rule of law) এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ওপর। এটি কোনো একক ব্যক্তির খামখেয়ালির ওপর চলে না। তাছাড়া, প্রজাতন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের নাগরিক থাকে, তাই এটি সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আরও ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
অ্যারিস্টটলের মতো ম্যাকিয়াভেলিও বিশ্বাস করতেন, সাধারণ মানুষ হয়তো এককভাবে খুব বিচক্ষণ নয়, কিন্তু সম্মিলিতভাবে তারা একজন একক শাসকের চেয়ে বেশি বিচক্ষণ এবং স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারে। “জনগণের কণ্ঠস্বর ঈশ্বরের কণ্ঠস্বরের মতো” (Vox populi, vox Dei)—এই প্রবাদটি তিনি ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে, সার্বিকভাবে জনগণ ভালো-মন্দ বিচার করতে রাজাদের চেয়ে বেশি সক্ষম।
এটি ম্যাকিয়াভেলির সবচেয়ে মৌলিক এবং বিপ্লবী ধারণাগুলোর একটি। তার আগের প্রায় সব দার্শনিক (যেমন প্লেটো) মনে করতেন, একটি আদর্শ রাষ্ট্র হলো শান্ত, সংঘাতহীন এবং ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি বললেন, এই ধারণা ভুল। তিনি প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ পলিবিয়াসের (Polybius) শাসনতন্ত্রের চক্র (anacyclosis) তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই তত্ত্বানুযায়ী, শাসনব্যবস্থাগুলো একটি চক্রে আবর্তিত হয়: রাজতন্ত্র (monarchy) ক্ষয়ে গিয়ে স্বৈরতন্ত্র (tyranny) হয়, অভিজাততন্ত্র (aristocracy) ক্ষয়ে গিয়ে গোষ্ঠীতন্ত্র (oligarchy) হয়, এবং গণতন্ত্র (democracy) ক্ষয়ে গিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জনতা বা নৈরাজ্য (anarchy) হয়।
ম্যাকিয়াভেলি এর সমাধান খুঁজে পেয়েছিলেন প্রাচীন রোম প্রজাতন্ত্রের মডেলে। রোম কোনো একক শাসনতন্ত্র ছিল না, এটি ছিল একটি মিশ্র সরকার (mixed government বা governo misto)। এতে রাজতন্ত্রের উপাদান (দুইজন কনসাল), অভিজাততন্ত্রের উপাদান (সিনেট) এবং গণতন্ত্রের উপাদান (জনগণের প্রতিনিধি বা ট্রাইবিউন) একসঙ্গে কাজ করত। এই তিনটি শক্তির মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতার ভারসাম্য (checks and balances) ছিল।
তার মতে, রোমের শক্তি ও স্বাধীনতার মূল উৎস ছিল দুটি শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব—অভিজাত শ্রেণি (patricians/nobles) এবং সাধারণ মানুষ (plebeians/common people)। এই দুই শ্রেণির স্বার্থ আলাদা, এবং তাদের মধ্যে সবসময় এক ধরনের টানাপোড়েন চলে। ম্যাকিয়াভেলির মতে, এই দ্বন্দ্ব যদি আইনের মাধ্যমে সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে তা রাষ্ট্রকে দুর্বল না করে বরং আরও শক্তিশালী ও মুক্ত করে তোলে। সাধারণ মানুষের (plebs) ক্রমাগত চাপের কারণেই রোমে ভালো আইন তৈরি হয়েছিল, যা সবার স্বাধীনতা রক্ষা করত। (Pocock, 1975)
প্রজাতন্ত্রে নাগরিকেরা দেশের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের ওপরে স্থান দিতে শেখে। এই দেশপ্রেম, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং নাগরিক দায়িত্ববোধই হলো নাগরিক গুণাবলি। এই গুণাবলিই একটি রাষ্ট্রকে মহান করে তোলে। যখন নাগরিকদের মধ্যে এই গুণাবলির ক্ষয় হয়, যখন তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্র দুর্নীতিগ্রস্ত (corruzione) হয়ে পড়ে এবং পতনের দিকে এগিয়ে যায়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ম্যাকিয়াভেলি স্বৈরাচারের পূজারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন কট্টর বাস্তববাদী এবং একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল একটি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীন ইতালি—যেখানে নাগরিকেরা মুক্তভাবে বাঁচতে পারবে। ‘দ্য প্রিন্স’-এর নায়ক হলেন সেই প্রতিষ্ঠাতা বা সংস্কারক, যিনি বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটাবেন। আর ‘ডিসকোর্সেস’-এর আদর্শ হলো সেই প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র, যা নাগরিকদের স্বাধীনতায় মহিমান্বিত হবে। (Skinner, 2000)
ধর্ম, নৈতিকতা ও রাষ্ট্র—এক বিপজ্জনক বিচ্ছেদ
ম্যাকিয়াভেলির দর্শনের আরেকটি বিপ্লবী দিক হলো ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাষ্ট্র থেকে কার্যকরীভাবে আলাদা করে দেখা। তিনি ধার্মিক ছিলেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু তিনি এটা পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা কার্যকরী (instrumental) হওয়া উচিত, আধ্যাত্মিক নয়।
শাসককে ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিক হওয়ার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তার উচিত জনগণের সামনে নিজেকে অত্যন্ত ধার্মিক হিসেবে উপস্থাপন করা। কারণ ধর্ম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, অনুগত রাখে এবং সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক ভিত্তি দেয়। প্রাচীন রোমানরা তাদের ধর্মকে (প্যাগান ধর্ম) রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার কাজে সফলভাবে ব্যবহার করেছিল। তাদের ধর্ম ছিল জাগতিক এবং এটি সাহস, গৌরব ও দেশপ্রেমকে উৎসাহিত করত।
এর বিপরীতে, তিনি খ্রিস্টধর্মের তীব্র সমালোচনা করেছেন, বিশেষ করে তার সময়ের ক্যাথলিক চার্চের। তার মতে, খ্রিস্টধর্ম মানুষকে পরকালের দিকে বেশি মনোযোগী করে তুলেছে এবং জাগতিক গৌরব ও পৌরুষের (manliness) চেয়ে নম্রতা, বিনয় এবং দুঃখভোগকে বড় করে দেখেছে। এর ফলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং শাসকেরা যা খুশি তাই করার সুযোগ পেয়েছে। “আমাদের ধর্ম… জাগতিক সম্মানের চেয়ে বরং নম্রতাকে মহিমান্বিত করেছে… তারা মহিমান্বিত করেছে বিনয়ী ও ধ্যানমগ্ন মানুষদের, আগ্রাসী মানুষদের নয়।” (Machiavelli, Discourses, Book II, Chapter 2)। এটি রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দিয়েছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, পোপের নেতৃত্বে চার্চ নিজেই ইতালির রাজনৈতিক বিভক্তির জন্য দায়ী।
তিনিই প্রথম আধুনিক চিন্তাবিদ যিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, রাষ্ট্রের নিজস্ব নৈতিকতা আছে (ragion di stato), যা ব্যক্তিগত খ্রিস্টীয় নৈতিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন সাধারণ মানুষের জন্য যা পাপ (যেমন, মিথ্যা বলা, চুক্তি ভঙ্গ করা, মানুষ হত্যা করা), রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে শাসকের জন্য তা প্রয়োজনীয় এবং এমনকি প্রশংসনীয় কর্তব্য হতে পারে। দার্শনিক ইসাইয়াহ বার্লিন (Isaiah Berlin) এই অবস্থাকে দুটি ভিন্ন ও বেমানান নৈতিকতার জগৎ হিসেবে বর্ণনা করেছেন—প্যাগান জগৎ এবং খ্রিস্টান জগৎ। ম্যাকিয়াভেলি প্রথমটিকে বেছে নিয়েছিলেন। তার কাছে, রাজনৈতিক নেতার জন্য সবচেয়ে বড় পাপ হলো রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়া, ব্যক্তিগত আত্মার মুক্তি নয়। (Berlin, 1979) এই চিন্তাই আধুনিক ‘সেকুলার’ (secular) রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি স্থাপন করে, যেখানে রাষ্ট্রকে কোনো ধর্মীয় অনুশাসনের অধীন রাখা হয় না।
ম্যাকিয়াভেলির উত্তরাধিকার—কেন তিনি আজও প্রাসঙ্গিক?
৫০০ বছর পরেও কেন আমরা ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে এত আলোচনা করি? কারণ তিনি রাজনীতির সেই কঠিন সত্যগুলো তুলে ধরেছিলেন, যা আমরা স্বীকার করতে চাই না, কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে ঘটতে দেখি।
-
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক: ম্যাকিয়াভেলিকে প্রায়ই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের (modern political science) জনক বলা হয়। কারণ তিনিই প্রথম রাজনীতিকে ধর্ম ও আদর্শবাদের জগৎ থেকে বের করে এনে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে বৈজ্ঞানিক ও নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি অভিজ্ঞতাবাদী (empirical) পদ্ধতির ওপর জোর দিয়েছেন—অর্থাৎ, যা ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করা, ইতিহাসের উদাহরণ থেকে শেখা এবং তারপর সিদ্ধান্তে আসা।
-
‘ম্যাকিয়াভেলিয়ান’ শব্দের জন্ম: তার মৃত্যুর পর, বিশেষ করে ‘দ্য প্রিন্স’ প্রকাশিত হওয়ার পর, তার নাম হয়ে ওঠে ধূর্ততা, নিষ্ঠুরতা আর নীতিহীনতার সমার্থক। বিশেষ করে প্রোটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। নাট্যকারেরা, এমনকি শেক্সপিয়ারও, তাকে এক শয়তানি চরিত্র (the ‘Machiavel’) হিসেবে মঞ্চে তুলে ধরেন। ইংরেজিতে শয়তানের একটি ডাকনাম হয়ে যায় ‘ওল্ড নিক’ (Old Nick), যা তার নাম নিকোলো থেকে এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। তার বই ‘দ্য প্রিন্স’ ১৫৫৯ সালে ক্যাথলিক চার্চের নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায় (Index of Prohibited Books) অন্তর্ভুক্ত হয় এবং প্রায় ৩০০ বছর ধরে নিষিদ্ধ ছিল।
-
ব্যাখ্যার বিতর্ক: ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কেউ তাকে দেখেন ‘শয়তানের শিক্ষক’ হিসেবে। আবার জ্যাঁ-জ্যাক রুশোর মতো দার্শনিকেরা মনে করতেন, ‘দ্য প্রিন্স’ আসলে একটি বিদ্রূপাত্মক (satirical) লেখা। ম্যাকিয়াভেলি রাজা বা প্রিন্সদের পরামর্শ দেওয়ার ভান করে আসলে সাধারণ মানুষকে রাজাদের আসল চরিত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন। যদিও এই মতটি বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ গ্রহণ করেন না, এটি দেখায় যে তার লেখা কতটা বহুমাত্রিক।
-
বাস্তববাদী রাজনীতির (Realpolitik) পথপ্রদর্শক: ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘রিয়ালপলিটিক’ ধারণা, যেখানে জাতীয় স্বার্থকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং নৈতিকতাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়, তার মূলে রয়েছে ম্যাকিয়াভেলির দর্শন। আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আমরা প্রতিনিয়ত এর প্রয়োগ দেখি। যখন কোনো দেশ মানবাধিকারের কথা বলেও অন্য কোনো স্বৈরাচারী দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক বা সামরিক চুক্তি করে জাতীয় স্বার্থে, তখন কি আমরা ম্যাকিয়াভেলির ছায়া দেখতে পাই না?
-
নেতৃত্বের চিরন্তন প্রশ্ন: একজন নেতাকে কতটা আদর্শবাদী আর কতটা বাস্তববাদী হওয়া উচিত? জনগণের ভালোবাসা নাকি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা—কোনটি বেশি জরুরি? নিরাপত্তা বনাম স্বাধীনতা—এই দ্বন্দ্বের সমাধান কী? ম্যাকিয়াভেলি যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন, সেগুলো আজও প্রত্যেক নেতাকে এবং প্রত্যেক নাগরিককে মোকাবেলা করতে হয়। এমনকি আধুনিক কর্পোরেট জগতেও ম্যানেজমেন্ট গুরুরা ‘ক্ষমতা’ ও ‘কৌশল’ শেখাতে গিয়ে ম্যাকিয়াভেলির দ্বারস্থ হন।
শেষ কথা
তাহলে ম্যাকিয়াভেলি কে? শয়তানের দোসর, নাকি একজন ভুল বোঝা দেশপ্রেমিক?
হয়তো তিনি এর কোনোটিই নন, অথবা দুটোই।
তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক শবব্যবচ্ছেদকারী (political anatomist)। একজন ডাক্তার যেমন নির্মোহভাবে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে শরীরের গঠন এবং রোগের কারণ বোঝেন, ম্যাকিয়াভেলিও তেমনি নির্মোহভাবে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাকে ব্যবচ্ছেদ করে এর ভেতরের কার্যকারিতা বোঝার চেষ্টা করেছেন। তার লেখায় তিনি কোনো সহানুভূতি বা নৈতিকতার প্রলেপ দেননি। যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন, তাই লিখেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল নিরাময় করা, তার মাতৃভূমি ইতালিকে বিদেশি শক্তির হাত থেকে মুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ করা। ‘দ্য প্রিন্স’-এর শেষ অধ্যায়টি কোনো শীতল বিশ্লেষণ নয়; এটি ইতালির মুক্তির জন্য এক আবেগঘন, কাব্যিক আহ্বান।
তার লেখা আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে, কারণ তা আমাদের ক্ষমতার কদর্য রূপটা আয়নার মতো দেখিয়ে দেয়। আমরা হয়তো আদর্শের সুন্দর জগতে বাস করতে চাই, কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, রাজনীতির জগৎটা প্রায়শই আদর্শের জগৎ নয়। এটি শক্তি, স্বার্থ এবং টিকে থাকার এক কঠিন, নির্মম লড়াই।
ফ্লোরেন্সের বাইরে সেই নির্বাসিত, নিঃসঙ্গ মানুষটি হয়তো ভাবতেও পারেননি যে তার লেখা একদিন বিশ্বজুড়ে এত ঝড় তুলবে। তিনি হয়তো শুধু চেয়েছিলেন তার অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান দিয়ে তার দেশকে সাহায্য করতে, তার হারানো সম্মান ফিরে পেতে। তার ভাগ্য (ফরচুনা) হয়তো তার প্রতি সদয় ছিল না, কিন্তু তার লেখনীর শক্তি (ভার্চু) তাকে অমর করে রেখেছে।
ম্যাকিয়াভেলিকে পড়া হয়তো আপনাকে একজন ভালো মানুষ হতে শেখাবে না। কিন্তু এটি আপনাকে শেখাবে, এই জটিল পৃথিবীটা কীভাবে চলে। আর সেই জ্ঞান হয়তো ভালো মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্যেও কম জরুরি নয়।
তথ্যসূত্র
- Berlin, I. (1979). The Originality of Machiavelli. In H. Hardy & R. Hausheer (Eds.), Against the Current: Essays in the History of Ideas (pp. 25–79). The Hogarth Press.
- Gilbert, F. (1986). Machiavelli: The Renaissance of the Art of War. In P. Paret (Ed.), Makers of Modern Strategy from Machiavelli to the Nuclear Age (pp. 11-31). Princeton University Press.
- Machiavelli, N. (1996). Discourses on Livy (H. C. Mansfield & N. Tarcov, Trans.). University of Chicago Press. (Original work published 1531).
- Machiavelli, N. (1998). The Prince (H. C. Mansfield, Trans.). University of Chicago Press. (Original work published 1532).
- Mansfield, H. C. (1996). Machiavelli’s Virtue. University of Chicago Press.
- Pocock, J. G. A. (1975). The Machiavellian Moment: Florentine Political Thought and the Atlantic Republican Tradition. Princeton University Press.
- Skinner, Q. (1978). The Foundations of Modern Political Thought, Vol. 1: The Renaissance. Cambridge University Press.
- Skinner, Q. (2000). Machiavelli: A Very Short Introduction. Oxford University Press.
- Viroli, M. (2014). Redeeming ‘The Prince’: The Meaning of Machiavelli’s Masterpiece. Princeton University Press.
Leave a Reply