কনফুসিয়াস: এলোমেলো সময়ের এক সরল পথপ্রদর্শক

Table of Contents

ভূমিকা

নামটা শুনলেই কেমন যেন একটা গুরুগম্ভীর ভাব চলে আসে, তাই না? কনফুসিয়াস (Confucius)। লাইব্রেরির ধুলোমাখা তাকে রাখা প্রাচীন সব বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা এক রাশভারী পণ্ডিত, যিনি কেবল নীরস তত্ত্বকথা আওড়ান – এমন একটা ছবিই যেন ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কিন্তু যদি বলি, এই মানুষটা আসলে আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন, যাঁর জীবনের একটা বিশাল অংশ কেটেছে না পাওয়ার বেদনা, দুঃখ-কষ্ট আর গভীর হতাশায়? যদি বলি, তাঁর বলে যাওয়া কথাগুলো আড়াই হাজার বছর পেরিয়ে এসেও আমাদের আজকের এই জটিল,প্যাঁচালো জীবনের অনেক কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান বাতলে দিতে পারে? একটু কি অবাক হচ্ছেন? চলুন না, ডুব দিয়ে দেখি এই রহস্যময় দার্শনিকের গভীর চিন্তার জগতে। কে জানে, হয়তো এমন কোনো মুক্তো খুঁজে পাওয়া যাবে, যা আমাদের এলোমেলো জীবনটাকে একটু হলেও গুছিয়ে দেবে।

ব্যাপারটা হলো, কনফুসিয়াস যখন এই নশ্বর পৃথিবীতে আলো-বাতাস নিয়ে বেঁচে ছিলেন, সেই সময়টাও কিন্তু আজকের মতো কম এলোমেলো, কম ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ছিল না। সেটা ছিল চীনের বসন্ত ও শরৎকালের (Spring and Autumn period – 春秋時代, Chūnqiū Shídài) প্রায় শেষের দিককার কথা, আনুমানিক ৭৭১ থেকে ৪৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। চারদিকে তখন কেবলই ভাঙনের সুর। ঝোউ রাজবংশের (Zhou Dynasty) কেন্দ্রীয় ক্ষমতা তখন অস্তমিতপ্রায়, আর ছোট ছোট অসংখ্য রাজ্য একে অপরের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই জড়িয়ে পড়ছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। নৈতিকতার তখন বড়ই আকাল, মানুষের জীবনে শান্তি যেন এক সোনার হরিণ। ঠিক যেন আমাদের আজকের এই অশান্ত পৃথিবীর মতোই, যেখানে সবাই কেমন যেন দিশেহারা, একটা শক্ত খুঁটি আঁকড়ে ধরতে চাইছে। এমন একটা ঘোর অমানিশার সময়েই লু (Lu – 魯國) নামের ছোট্ট একটি প্রদেশে, আনুমানিক ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, জন্মেছিলেন এই যুগান্তকারী দার্শনিক। তাঁর আসল নাম ছিল কোং চিউ (Kong Qiu – 孔丘) আর সম্মানসূচক নাম ছিল ঝোংনি (Zhongni – 仲尼)। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত কোং ফুজি (Kong Fuzi – 孔夫子) নামে, যার মানে হলো ‘গুরু কোং’ (Master Kong)। এই ‘কোং ফুজি’ নামটিই পরবর্তীকালে জেসুইট ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে ল্যাটিন উচ্চারণে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের কাছে ‘কনফুসিয়াস’ নামে পরিচিতি লাভ করে (Creel, 1949)।

কনফুসিয়াসের শৈশবকাল খুব একটা সুখের ছিল না। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। তাঁর মা, ইয়ান ঝেংজাই (Yan Zhengzai – 顔徵在), অনেক কষ্টে তাঁকে লালন-পালন করেন। সংসারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই তাঁকে নানা রকম ছোটখাটো কাজ করতে হয়েছে – কখনো শস্যভাণ্ডারের রক্ষক, কখনো বা পশুপালের তত্ত্বাবধায়ক। কিন্তু এতসব প্রতিকূলতার মাঝেও পড়াশোনার প্রতি ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। তখন তো আর আজকের দিনের মতো স্কুল-কলেজ ছিল না, তাই তিনি নিজে নিজেই পড়াশোনা করে প্রাচীন কাব্য (Poetry), ইতিহাস (History), রীতিনীতি (Rites) আর সঙ্গীতে (Music) অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এই বিষয়গুলোই ছিল তৎকালীন অভিজাত শিক্ষার মূল ভিত্তি।

তাঁর মনে একটা গভীর স্বপ্ন ছিল – সমাজে আবার শান্তি আর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবেন, মানুষকে নৈতিকতার পথে চালিত করবেন, একটা আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। এই স্বপ্ন বুকে নিয়েই তিনি বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদের দরবারে হাজির হয়েছেন, সুশাসনের জন্য মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু হায়! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। শাসকেরা তখন ক্ষমতা আর রাজ্যবিস্তারের নেশায় উন্মত্ত, কে শোনে তখন এই সাদাসিধে মানুষটার নৈতিকতার বাণী! অনেকটা যেন সেই আদর্শবাদী, স্বপ্নবান তরুণের মতো, যে একা হাতে পৃথিবীকে বদলে দিতে চায়, কিন্তু বাস্তবতার কঠিন দেয়ালে পদে পদে হোঁচট খায়। তবে তিনি কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। জীবনের একটা বড় অংশ, প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স থেকে শুরু করে, তিনি শিষ্যদের শিক্ষাদানে অতিবাহিত করেন। তাঁর ছাত্রের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না, বলা হয়ে থাকে প্রায় তিন হাজার! যাদের মধ্যে বাহাত্তর জন ছিলেন বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ এবং মেধাবী। আর এই শিষ্যদের মাধ্যমেই তাঁর গভীর জীবনদর্শন আর অমূল্য চিন্তাধারা ছড়িয়ে পড়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে।

কেন পড়বো কনফুসিয়াসের দর্শন? এই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কী লাভ?

এই প্রশ্নটা আপনার মনে আসতেই পারে। আড়াই হাজার বছর আগের এক চীনা দার্শনিকের ভাবনাচিন্তা আজকের এই রকেটগতির, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে আমাদের কী এমন কাজে লাগবে? উত্তরটা কিন্তু খুব জটিল নয়, বরং বেশ সোজাসাপ্টা। মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলো – যেমন ব্যক্তিগত সুখ, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক ন্যায়বিচার, নৈতিক আচরণ, আদর্শ জীবনযাপন – এগুলো কিন্তু যুগে যুগে প্রায় একই রকম থাকে। মানুষ আগেও এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতো, এখনো ভাবে, ভবিষ্যতেও হয়তো ভাববে। কনফুসিয়াস ঠিক এই চিরন্তন মানবিক প্রশ্নগুলো নিয়েই কথা বলেছেন। তাঁর দর্শন কোনো ঈশ্বরপ্রেরিত ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ (divine revelation) নয়, বরং মানুষের বহু বছরের সম্মিলিত প্রজ্ঞা, গভীর পর্যবেক্ষণ আর বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এক জীবনবিধান। অনেকটা যেন আমাদের গ্রামের সেই বহুদর্শী, বিচক্ষণ বৃদ্ধ মানুষটির মতো, যিনি জীবনের নানা চড়াই-উতরাই দেখে, বহু ঘাটের জল খেয়ে অভিজ্ঞ হয়েছেন এবং সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই আমাদের জীবনের আঁকাবাঁকা পথে চলার দিশা দেখান।

কনফুসিয়াসের দর্শনের মূল কথাগুলো যদি খুব সংক্ষেপে, এক নিঃশ্বাসে বলতে হয়, তবে তা হলো – ব্যক্তির আত্ম-উন্নয়ন (self-cultivation), সামাজিক সম্প্রীতি (social harmony) এবং সুশাসন (good governance)। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, সমাজের প্রতিটি ইট, অর্থাৎ ব্যক্তি যদি নিজেকে শুধরে নেয়, নৈতিকভাবে উন্নত করে, তাহলে তার পরিবারেও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আর প্রতিটি পরিবার যদি সুশৃঙ্খল ও সম্প্রীতিপূর্ণ হয়, তাহলে পুরো সমাজটাই সুন্দর হয়ে উঠবে। সমাজ ঠিক হলে রাষ্ট্রও স্বাভাবিকভাবেই সুশাসিত ও সুশৃঙ্খলভাবে চলবে। পুরো ব্যাপারটাই যেন একটা ডমিনো এফেক্টের (domino effect) মতো – একটা টোকা দিলে পরপর সবগুলো গুটি পড়ে যায়! (Schwartz, 1985)। তাঁর কাছে, বাইরের জগতের পরিবর্তন আনার আগে নিজের ভেতরের জগতটাকে আলোকিত করা জরুরি।

চলুন, তাঁর দর্শনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, মানে কিছু ভারী ভারী শব্দ আর কী, একটু সহজ ভাষায়, গল্পের ছলে বোঝার চেষ্টা করি। কে জানে, এই পুরনো কথাগুলোর মধ্যেই হয়তো আমরা খুঁজে পাবো আজকের দিনের নতুন কোনো সমাধান।

রেন (仁 – Ren): মানবতা, ভালোবাসা আর সহানুভূতির সেই নরম পরশ

কনফুসিয়াসের দার্শনিক সৌধের একেবারে কেন্দ্রে, তার হৃদপিণ্ড হিসেবে অবস্থান করছে একটি ছোট্ট কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী ধারণা, যার নাম ‘রেন’ (仁 – Ren)। বাংলায় এর কাছাকাছি ভাবানুবাদ হতে পারে মানবতা (humanity), পরার্থপরতা (altruism), সহানুভূতি (compassion), হিতৈষণা (benevolence), বা নিখাদ ভালোবাসা (love)। তবে ঠিক ‘ভালোবাসা’ বললে এর গভীরতা আর ব্যাপকতা পুরোপুরি প্রকাশ পায় না। এটা আসলে সেই মৌলিক মানবিক গুণ, সেই অন্তর্নিহিত সদ্‌ভাবনা যা মানুষকে প্রকৃত ‘মানুষ’ করে তোলে। হার্বার্ট ফিঙ্গারেট (Fingarette, 1972) তাঁর বিখ্যাত বইতে দেখিয়েছেন, এই ‘রেন’ কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং এটি মানুষের দৈনন্দিন আচার-আচরণের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।

ধরুন, কনকনে শীতের এক সকালে আপনি রাস্তায় হাঁটছেন। দেখলেন, পথের ধারে একটা শীর্ণকায় বৃদ্ধ ভিখারি ছেঁড়া কাঁথায় নিজেকে জড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে, তার চোখে অসহায় আর্তি। অথবা দেখলেন, একটা ছোট্ট বিড়ালছানা গাড়ির তলায় চাপা পড়ার উপক্রম, ভয়ে তার ছোট্ট বুকটা ধকধক করছে। আপনার বুকের ভেতরটা তখন কেমন করে ওঠে, বলুন তো? ঐ যে একটা অব্যক্ত বেদনা, একটা মোচড় দেওয়া অনুভূতি, ওটাই হলো ‘রেন’-এর একটা ছোট্ট, কিন্তু উজ্জ্বল ঝলক। কনফুসিয়াস বলতেন, এই ‘রেন’ বা মানবিকতার বীজ প্রতিটি মানুষের অন্তরেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে, শুধু প্রয়োজন তাকে সযত্নে খুঁজে বের করা, চিনে নেওয়া এবং প্রতিদিনের চর্চার মাধ্যমে তাকে বিকশিত করা।

‘রেন’ মানে কিন্তু কেবল অন্যের প্রতি দয়া বা করুণা দেখানো নয়। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে আত্মসম্মানবোধ (self-respect) এবং আত্ম-উন্নয়নের (self-cultivation) ধারণা। যে মানুষ নিজেকে ভালোবাসতে জানে না, নিজেকে সম্মান করতে পারে না, সে অন্যকেও সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে বা সম্মান করতে পারে না। কনফুসিয়াসের সেই বিখ্যাত উক্তিটি এখানে প্রণিধানযোগ্য: “যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ করো না, তা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিও না” (己所不欲,勿施於人 – jǐ suǒ bù yù, wù shī yú rén) (Analects 15.24, Lau translation)। এই নীতিটিকে প্রায়শই ‘সিলভার রুল’ (Silver Rule) বলা হয়ে থাকে, যা কিনা বিভিন্ন ধর্মে ও সংস্কৃতিতে প্রচলিত ‘গোল্ডেন রুল’ (Golden Rule – তুমি যা চাও অন্যেরা তোমার প্রতি করুক, তুমিও তাদের প্রতি তাই করো)-এর একটি ভিন্নতর কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রূপ। এই পারস্পরিকতার (reciprocity) নীতিকে কনফুসিয়াস ‘শু’ (恕 – Shu) নামে অভিহিত করেছেন, যা ‘রেন’-এরই একটি অবিচ্ছেদ্য ব্যবহারিক দিক। ‘শু’ মানে হলো অন্যের অবস্থানে নিজেকে কল্পনা করে তার অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করা।

‘রেন’ অর্জন করার জন্য কোনো দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কঠোর তপস্যা করার প্রয়োজন নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অতি সাধারণ, ছোট ছোট ভালো কাজের মাধ্যমেই এর চর্চা করা সম্ভব। যেমন, বাবা-মায়ের প্রতি আন্তরিক কর্তব্য পালন করা, ভাই-বোনের সঙ্গে স্নেহপূর্ণ সম্পর্ক রাখা, বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বস্ততা ও সততা বজায় রাখা, প্রতিবেশীর বিপদে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যাওয়া, এমনকি কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক আচরণ করা – এ সবই ‘রেন’-এর বিভিন্ন প্রকাশ। এটি একটি সার্বজনীন গুণ, যা দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সকলের জন্যই প্রযোজ্য।

কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন, একজন শাসকের জন্য ‘রেন’ অপরিহার্য। যে শাসকের হৃদয়ে ‘রেন’ নেই, তিনি প্রজাদের ভালোবাসতে পারেন না, তাদের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করতে পারেন না। ফলে তার শাসন হয়ে ওঠে নিপীড়নমূলক। পক্ষান্তরে, ‘রেন’-এর অধিকারী শাসক তার প্রজাদের সন্তানের মতো ভালোবাসেন এবং তাদের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করেন।

লি (禮 – Li): সামাজিক শৃঙ্খলা, রীতিনীতি ও শিষ্টাচারের সুবিন্যস্ত কাঠামো

যদি ‘রেন’ (仁) হয় কনফুসীয় দর্শনের উষ্ণ, স্পন্দনশীল আত্মা, তবে ‘লি’ (禮 – Li) হলো তার সুগঠিত, সুশৃঙ্খল শরীর। ‘লি’-এর আক্ষরিক অর্থ হলো আচার-অনুষ্ঠান (ritual), প্রথা (custom), রীতিনীতি (propriety), শিষ্টাচার (etiquette) বা সামাজিক নিয়মকানুন (social norms)। কনফুসিয়াস গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, একটি সুস্থ ও সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য এই ‘লি’-এর অনুশীলন এবং তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা অপরিহার্য। ‘লি’ যেন সমাজের সেই অদৃশ্য আঠা, যা বিভিন্ন মানুষকে একসঙ্গে বেঁধে রাখে।

এখন আপনার মনে এই প্রশ্নটা উঁকি দিতে পারে যে, এই ‘লি’ মানে কি কেবল সেইসব পুরনো দিনের অর্থহীন, জবরজং আচার-অনুষ্ঠান, যেগুলো আমাদের আধুনিক, যুক্তিবাদী মন কিছুতেই মানতে চায় না? যেমন, বিশেষ তিথিতে বিশেষ দেবতার পূজা বা অর্থ না বুঝেই মন্ত্র পাঠ করা? উত্তর হলো, ঠিক তা নয়। কনফুসিয়াসের ‘লি’ একটি অনেক ব্যাপক এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ধারণা। এর মধ্যে যেমন আছে ধর্মীয় বা আনুষ্ঠানিক আচার-অনুষ্ঠান (যেমন পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন বা বিভিন্ন সামাজিক উৎসব), তেমনই আছে দৈনন্দিন জীবনের সামাজিক শিষ্টাচার, গুরুজনদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন, বিভিন্ন সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপযুক্ত আচরণবিধি, এমনকি কথাবার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং চালচলনের মার্জিত ভঙ্গিও। যেমন, খাওয়ার সময় অপ্রয়োজনীয় শব্দ না করা, কারো সঙ্গে কথা বলার সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে সম্মানসূচকভাবে কথা বলা, বয়োজ্যেষ্ঠদের আগে চলতে না দেওয়া, সভায় বা জনসমাগমে শালীনতা বজায় রাখা, প্রতিজ্ঞা করলে তা রক্ষা করা, সময়ানুবর্তিতা – এই সবই ‘লি’-এর বিস্তৃত পরিধির অন্তর্গত (Rosemont Jr. & Ames, 2009)।

‘লি’ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কনফুসিয়াসের মতে, ‘লি’ আমাদের আবেগগুলোকে (emotions) একটা সঠিক এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য পথে চালিত করতে সাহায্য করে। ধরুন, আপনার কোনো কারণে ভীষণ রাগ হয়েছে। ‘লি’ আপনাকে শেখাবে, কীভাবে সেই রাগকে সংযত করতে হয়, কীভাবে পরিস্থিতি অনুযায়ী আপনার আচরণের মাত্রা নির্ধারণ করতে হয়, যাতে তা অন্যের জন্য পীড়াদায়ক না হয়। যদি সমাজে ‘লি’-এর প্রচলন না থাকতো, তাহলে পুরো সমাজটাই হয়ে উঠতো একটা বিশৃঙ্খল, অরণ্যসদৃশ জায়গা, যেখানে প্রত্যেকে কেবল নিজের ইচ্ছেমতো, নিজের প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হয়ে আচরণ করতো, আর তার অনিবার্য পরিণতি হতো সংঘাত আর অরাজকতা। অনেকটা যেন ব্যস্ত রাস্তায় ট্রাফিক আইন না মেনে এলোপাথাড়ি গাড়ি চালানোর মতো ব্যাপার! সবাই যদি নিজেদের খেয়ালখুশি মতো গাড়ি চালায়, তাহলে কী ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে, একবার কল্পনা করে দেখুন তো!

তবে কনফুসিয়াস এটাও খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ‘লি’-এর অনুশীলন যেন কখনো যান্ত্রিক, প্রাণহীন বা লোকদেখানো না হয়ে যায়। যদি ‘লি’ বা বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের পেছনে ‘রেন’ বা আন্তরিকতা, মানবিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ না থাকে, তাহলে সেই আচার-অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং ভণ্ডামিপূর্ণ। যেমন, আপনি যদি কেবল সমাজের চোখে ভালো সাজার জন্য বা দায়সারাভাবে গুরুজনকে প্রণাম করেন, কিন্তু আপনার অন্তরে তাঁর প্রতি কোনো সত্যিকারের শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা না থাকে, তাহলে সেই প্রণাম একটি শূন্যগর্ভ প্রদর্শনী মাত্র (Analects 3.3, Watson translation)। ‘রেন’ হলো অন্তরের প্রেরণা, আর ‘লি’ হলো তার বাহ্যিক প্রকাশ। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ।

কনফুসিয়াস প্রাচীন ঝোউ রাজবংশের (Zhou Dynasty) রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, কারণ তিনি মনে করতেন এগুলোর মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধগুলো সংরক্ষিত হয়। তবে তিনি এটাও বুঝতেন যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু রীতিনীতির পরিবর্তন বা পরিমার্জন প্রয়োজন হতে পারে। মূল উদ্দেশ্য হলো সামাজিক সম্প্রীতি ও নৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা।

জুনজি (君子 – Junzi): আদর্শ মানুষ, ভদ্রলোক, নাকি উন্নত ব্যক্তিত্বের প্রতীক?

কনফুসিয়াসের দর্শনে ‘জুনজি’ (君子 – Junzi) বা ‘আদর্শ মানুষ’ (gentleman/superior person/exemplary person) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন্দ্রীয় ধারণা। প্রাচীনকালে ‘জুনজি’ শব্দটি সাধারণত অভিজাত বংশের পুরুষদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, অনেকটা আমাদের দেশের ‘রাজকুমার’ বা ‘জমিদারপুত্র’ গোছের। কিন্তু কনফুসিয়াস এই শব্দটিকে একটি নতুন, নৈতিক অর্থ প্রদান করেন। তাঁর মতে, ‘জুনজি’ তিনিই, যিনি জন্মসূত্রে অভিজাত নন, বরং যিনি নৈতিক গুণাবলি, প্রজ্ঞা এবং আচরণের মাধ্যমে নিজেকে উন্নত স্তরে উন্নীত করেছেন। ‘জুনজি’ তিনিই, যিনি আন্তরিকভাবে ‘রেন’ (মানবতা) ও ‘লি’ (রীতিনীতি)-এর চর্চা করেন, যিনি জ্ঞানী (wise), সাহসী (courageous) – বিশেষত নৈতিকভাবে সাহসী, এবং সর্বোপরি, যিনি নৈতিকভাবে উন্নত (morally cultivated) এক ব্যক্তিত্ব।

‘জুনজি’ হওয়া কোনো জন্মগত অধিকার নয়, এটি একটি অর্জন, একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর জন্য প্রয়োজন আজীবন নিরন্তর আত্ম-উন্নয়ন (self-cultivation), গভীর অধ্যয়ন এবং অর্জিত জ্ঞানের বাস্তব অনুশীলন। কনফুসিয়াস বলতেন, “জুনজি নিজের কাছে যা চান, তা কঠোরভাবে পালন করেন এবং নিজের উন্নয়নে সচেষ্ট থাকেন; আর সাধারণ বা হীনমনা মানুষ (小人 – Xiaoren বা petty person) অন্যের কাছে যা আশা করে, তা না পেলে কেবল অভিযোগ আর দোষারোপ করে বেড়ায়” (Analects 15.21, Slingerland translation)। ‘শিয়াওরেন’ হলো ‘জুনজি’-র ঠিক বিপরীত। ‘শিয়াওরেন’ স্বার্থপর, সংকীর্ণমনা এবং কেবল নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৎপর থাকে।

একজন ‘জুনজি’ কখনো উদ্ধত বা অহংকারী হন না, তিনি স্বভাবতই বিনয়ী এবং নিরহংকার হন। তিনি অন্যের ভালো গুণগুলো দেখেন এবং তা থেকে শেখার চেষ্টা করেন, অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ান না বা তা নিয়ে অহেতুক সমালোচনা করেন না। তিনি নিজের ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন। তিনি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। তিনি যা বলেন, তা করেন এবং যা করেন, তা জেনেশুনেই বলেন। অনেকটা সেই স্বল্পভাষী, কিন্তু অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং কাজের মানুষটির মতো, যাঁকে আমরা সবাই অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি এবং যাঁর ওপর ভরসা করা যায়।

‘জুনজি’ হওয়ার পথটা কিন্তু ফুলের বিছানো নয়, বরং বেশ কণ্টকাকীর্ণ এবং শ্রমসাধ্য। এর জন্য প্রয়োজন অসীম ধৈর্য, গভীর অধ্যবসায়, কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নৈতিক অবস্থান ধরে রাখার দৃঢ় মানসিকতা। কিন্তু কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন, আন্তরিক চেষ্টা করলে এবং সঠিক পথে চললে প্রত্যেকেই এই আদর্শের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে, বা অন্তত সেই পথে চলার প্রয়াস নিতে পারে। তাঁর শিক্ষাদানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল এই ধরনের ‘জুনজি’ তৈরি করা, যাঁরা সমাজের নেতৃত্ব দেবেন এবং সাধারণ মানুষকে সঠিক পথে চালিত করবেন।

একজন ‘জুনজি’ লাভের আশায় উৎফুল্ল হন না, আবার ক্ষতির আশঙ্কায় মুষড়েও পড়েন না। তিনি জানেন যে, জীবনের উত্থান-পতন স্বাভাবিক। তিনি সর্বদা শান্ত, ধীরস্থির এবং নিজের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকেন। তিনি ছোটখাটো বিষয়ে বিচলিত না হয়ে বৃহত্তর কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করেন।

শিয়াও (孝 – Xiao): পারিবারিক ভক্তি, শ্রদ্ধা আর কর্তব্যের সেই মজবুত বাঁধন

কনফুসিয়াসের সামাজিক দর্শনের একেবারে ভিত্তিপ্রস্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবারের ধারণা। আর এই পরিবারের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘শিয়াও’ (孝 – Xiao) বা সন্তানের কর্তব্য (filial piety)। এর সহজ অর্থ হলো জীবিত বাবা-মা এবং প্রয়াত পূর্বপুরুষদের প্রতি গভীর ভক্তি, আন্তরিক শ্রদ্ধা, নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং দায়িত্বশীল আচরণ।

‘শিয়াও’ মানে কিন্তু কেবল বাবা-মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া বা তাঁদের প্রতিটি আদেশ অন্ধভাবে মেনে চলাই নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি গভীর মানসিক এবং আধ্যাত্মিক বন্ধন। বাবা-মা যখন বৃদ্ধ এবং দুর্বল হয়ে পড়বেন, তখন তাঁদের সেবাযত্ন করা, তাঁদের একাকিত্ব দূর করা, তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা, এবং তাঁদের মৃত্যুর পরেও তাঁদের স্মৃতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা, তাঁদের ভালো কাজগুলোকে অনুসরণ করা – এ সবই ‘শিয়াও’-এর বিস্তৃত পরিধির অন্তর্গত। কনফুসিয়াস মনে করতেন, যে সন্তান তার বাবা-মায়ের প্রতি যথাযথভাবে ‘শিয়াও’ পালন করে, সে স্বাভাবিকভাবেই সমাজের অন্যান্য গুরুজন এবং রাষ্ট্রের প্রতিও দায়িত্বশীল ও শ্রদ্ধাশীল হবে (Nylan, 2001)। অর্থাৎ, পরিবারই হলো নৈতিকতা চর্চার প্রথম এবং প্রধান শিক্ষালয়। পরিবারে অর্জিত এই গুণাবলিই পরে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হয়।

তবে এখানে একটা খুব ইন্টারেস্টিং এবং প্রায়শই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা ব্যাপার আছে। ‘শিয়াও’ মানে কিন্তু বিচারবুদ্ধিহীন অন্ধ আনুগত্য (blind obedience) নয়। যদি বাবা-মা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন বা কোনো অন্যায় বা অযৌক্তিক আদেশ দেন, তাহলে সন্তান অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে, কোমল ভাষায় তাঁদের সেই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার বা তাঁদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাঁদের অসম্মান করবে না বা তাঁদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করবে না (Analects 4.18)। এটা অনেকটা সেই আধুনিক ডিবেটিং ক্লাবের মতো, যেখানে প্রতিপক্ষকে যুক্তির মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ বা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় না। মূল কথা হলো, শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসার জায়গাটা যেন অটুট থাকে।

এই ‘শিয়াও’-এর ধারণা থেকেই চীন, কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনামসহ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পারিবারিক বন্ধন ঐতিহ্যগতভাবেই অত্যন্ত দৃঢ় এবং শ্রদ্ধাপূর্ণ। যদিও বিশ্বায়নের এই যুগে এবং আধুনিকতার দ্রুত পরিবর্তনশীল স্রোতে এই ধারণাগুলো কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে বা পরিবর্তিত হচ্ছে, তবুও এর মূল আবেদন এবং গুরুত্ব এখনো বহুলাংশে রয়ে গেছে। ‘শিয়াও’ শুধু বাবা-মায়ের প্রতিই নয়, বড় ভাই-বোনের প্রতিও ছোটদের শ্রদ্ধাশীল আচরণ এবং ছোটদের প্রতি বড়দের স্নেহপূর্ণ দায়িত্বকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

ঝেংমিং (正名 – Zhengming): নামের যথার্থতা, নাকি সবকিছুর ঠিকঠাক থাকা?

কনফুসীয় দর্শনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও কিছুটা জটিল এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ধারণা হলো ‘ঝেংমিং’ (正名 – Zhengming)। এর আক্ষরিক বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘নামের যথার্থতা প্রতিপাদন’ বা ‘সঠিক নামকরণ’ (Rectification of Names)। এর মূল কথা হলো, এই সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রত্যেকটা নাম, পদবি বা ভূমিকার (যেমন – রাজা, মন্ত্রী, পিতা, পুত্র, শিক্ষক, ছাত্র) সঙ্গে কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব, কর্তব্য এবং প্রত্যাশিত আচরণবিধি জড়িয়ে থাকে। সেই নাম বা পদের অধিকারী ব্যক্তি যদি সেই অনুযায়ী তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন না করেন, যদি তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে অসংগতি দেখা দেয়, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি এবং আস্থার সংকট তৈরি হয়।

যেমন, ‘রাজা’ এই নামটির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই প্রজার কল্যাণ করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, দেশকে রক্ষা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো জড়িত। যদি কোনো রাজা এই দায়িত্বগুলো পালন না করে কেবল নিজের ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাস আর অন্যায়-অত্যাচারে মত্ত থাকেন, তাহলে তিনি ‘রাজা’ নামের প্রতি সুবিচার করছেন না, তিনি নামের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। একইভাবে, ‘পিতা’ নামের সঙ্গে সন্তানের স্নেহপূর্ণ প্রতিপালন, সুশিক্ষা দান এবং তাদের সুরক্ষা প্রদানের দায়িত্ব জড়িত। ‘শিক্ষক’ নামের সঙ্গে সঠিকভাবে, আন্তরিকতার সঙ্গে এবং নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষাদানের দায়িত্ব জড়িত। কনফুসিয়াস একবার ডিউকে জি কং (Duke Ji Kang)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, “শাসক যদি শাসকের মতো আচরণ করে, মন্ত্রী যদি মন্ত্রীর মতো আচরণ করে, পিতা যদি পিতার মতো আচরণ করে, এবং পুত্র যদি পুত্রের মতো আচরণ করে, তবেই সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করবে।” অন্যথায়, তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “যদি নামগুলো সঠিক না থাকে, তাহলে কথার কোনো ভিত্তি থাকে না; যদি কথার কোনো ভিত্তি না থাকে, তাহলে কাজ সম্পন্ন হয় না; …মানুষ হাত-পা নাড়ানোরও জায়গা পাবে না।” (Analects 13.3 এবং 12.11, বিভিন্ন অনুবাদকের ভাষ্য থেকে)। অর্থাৎ, প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ নাম বা পদের প্রতি সুবিচার করে, নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তবেই সমাজে সুস্থিতি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।

ব্যাপারটা অনেকটা একটা বড় অর্কেস্ট্রা দলের মতো। অর্কেস্ট্রার প্রত্যেক বাদকের (যেমন – বেহালাবাদক, বংশীবাদক, ড্রামবাদক) একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা এবং বাদনশৈলী থাকে। যদি কেউ তার নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন না করে অন্য কিছু বাজাতে শুরু করে, বা তাল কেটে ফেলে, তাহলে পুরো সঙ্গীতটাই হযবরল, শ্রুতিকটু এবং অর্থহীন হয়ে যাবে। তাই সামাজিক সম্প্রীতির জন্য ‘ঝেংমিং’ বা নামের যথার্থতা রক্ষা করা অপরিহার্য। এটি শুধু শব্দের মারপ্যাঁচ নয়, বরং সামাজিক দায়বদ্ধতার এক গভীর উপলব্ধি।

শিক্ষা (學 – Xue) এবং চিন্তা (思 – Si): আত্ম-উন্নয়নের দুই অপরিহার্য পাখা

কনফুসিয়াসের কাছে শিক্ষার (學 – Xue) গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, প্রায় শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই। তিনি মনে করতেন, মানুষ জন্মগতভাবে প্রায় একই রকম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়, কিন্তু শিক্ষার আলো এবং অনুশীলনের মাধ্যমেই তাদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য তৈরি হয়, তারা প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে (Analects 17.2)। তাঁর কাছে শিক্ষা মানে কেবল কতগুলো বই মুখস্থ করা বা কিছু তথ্য মস্তিষ্কে জমা করা নয়, বরং এর মূল উদ্দেশ্য হলো নৈতিক চরিত্র গঠন (moral character building), প্রজ্ঞার উন্মোচন (wisdom cultivation) এবং জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।

তিনি প্রায়শই বলতেন, “শেখা এবং নিয়মিতভাবে তা অনুশীলন করা ও জীবনে প্রয়োগ করা – এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কী আছে?” (Analects 1.1, Legge translation)। তাঁর শিক্ষাপদ্ধতিও ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং অংশগ্রহণমূলক। তিনি গতানুগতিক একমুখী বক্তৃতা দেওয়ার পরিবর্তে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে, আলোচনার মাধ্যমে, বাস্তব উদাহরণ দিয়ে এবং শিষ্যদের নিজস্ব চিন্তা ও উপলব্ধি প্রকাশে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তাদের ভেতরের সুপ্ত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। অনেকটা আজকের দিনের আধুনিক, শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক ইন্টারঅ্যাকটিভ (interactive) বা অংশগ্রহণমূলক শিক্ষণ পদ্ধতির মতো। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত জ্ঞান সেটাই যা মানুষকে আরও বিনয়ী, আরও জিজ্ঞাসু এবং আরও দায়িত্বশীল করে তোলে, অহংকারী বা আত্মম্ভরী নয়।

তবে কনফুসিয়াস শুধু শেখার (Xue) ওপর জোর দেননি, একইসঙ্গে তিনি চিন্তাভাবনা বা মনন (思 – Si) করার ওপরও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলতেন, “শুধু শিখলে কিন্তু চিন্তা না করলে, অর্জিত জ্ঞান বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে; আবার শুধু চিন্তা করলে কিন্তু না শিখলে, তা বিপজ্জনক হতে পারে” (Analects 2.15)। অর্থাৎ, শিক্ষা এবং চিন্তা একে অপরের পরিপূরক। যা কিছু শেখা হচ্ছে, তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে, তার যথার্থতা বিচার করতে হবে, তার অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং কীভাবে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। এই দুয়ের সমন্বয়েই প্রকৃত প্রজ্ঞা অর্জিত হয়।

কনফুসিয়াসের মতে, শিক্ষার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো ‘জুনজি’ (君子) বা আদর্শ, নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা, যাঁরা সমাজের কল্যাণে, মানুষের মঙ্গলে নিজেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগাবেন। তাঁর কাছে, যে শিক্ষা মানুষকে নৈতিকভাবে উন্নত করে না, যে শিক্ষা মানুষকে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল করে না, যে শিক্ষা মানুষকে সমাজের প্রতি দায়িত্ববান করে না – তা আদতে কোনো শিক্ষাই নয়, তা অর্থহীন। এই শিক্ষার আলোকেই একজন ব্যক্তি ‘রেন’, ‘লি’ এবং অন্যান্য সদ্গুণাবলি অর্জন করতে পারে।

কনফুসিয়াস যে শুধু মানবিক বিদ্যা বা নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন, তা নয়। তিনি ‘ছয়টি কলা’ (六藝 – Liu Yi) বা Six Arts-এর ওপরও গুরুত্বারোপ করতেন। এগুলো হলো: রীতিনীতি (Rites – 禮), সঙ্গীত (Music – 樂), ধনুর্বিদ্যা (Archery – 射), রথচালনা (Charioteering – 御), লিখন বা ক্যালিগ্রাফি (Calligraphy/Writing – 書), এবং গণিত (Mathematics – 數)। এই বিষয়গুলো একজন ‘জুনজি’-র সার্বিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হতো।

পাঁচ প্রকার সম্পর্ক (五倫 – Wulun): সামাজিক কাঠামোর সেই অলঙ্ঘনীয় ভিত্তি

কনফুসীয় দর্শন সমাজকে দেখে একটা জটিল, বহুমাত্রিক এবং আন্তঃসম্পর্কিত জাল (web of relationships) হিসেবে। এই জালের প্রতিটি সুতো যদি নিজ নিজ জায়গায় সঠিকভাবে বিন্যস্ত থাকে এবং একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তবেই পুরো জালটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল থাকে। এই সামাজিক জালের সুস্থতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য কনফুসিয়াস কিছু মৌলিক মানবিক সম্পর্ককে বিশেষভাবে চিহ্নিত ও গুরুত্ব দিয়েছেন। এগুলোকে একত্রে বলা হয় ‘পাঁচ প্রকার সম্পর্ক’ (五倫 – Wulun) বা The Five Constant Relationships। এই সম্পর্কগুলো হলো:

  1. শাসক ও অধীনস্থের (বা প্রজা) সম্পর্ক (Ruler and Subject – 君臣)

  2. পিতা ও পুত্রের (বা সন্তান) সম্পর্ক (Father and Son – 父子)

  3. স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক (Husband and Wife – 夫婦)

  4. বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের সম্পর্ক (Elder Brother and Younger Brother – 兄弟)

  5. বন্ধুদের পারস্পরিক সম্পর্ক (Friend and Friend – 朋友)

এই পাঁচটি সম্পর্কের মধ্যে প্রথম চারটি হলো স্তরভিত্তিক (hierarchical) বা অসম। অর্থাৎ, এই সম্পর্কগুলোতে একজনের কিছুটা কর্তৃত্ব (authority) থাকে এবং অন্যজনের থাকে আনুগত্য (obedience) বা শ্রদ্ধার দায়। যেমন, শাসকের প্রতি প্রজার আনুগত্য, পিতার প্রতি পুত্রের আনুগত্য, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য (যদিও এই বিষয়টি আধুনিক প্রেক্ষাপটে অনেক সমালোচিত ও বিতর্কিত), এবং বড় ভাইয়ের প্রতি ছোট ভাইয়ের শ্রদ্ধা। কিন্তু কনফুসিয়াসের দর্শন অনুযায়ী, এই আনুগত্য বা কর্তৃত্ব কখনোই একতরফা বা স্বৈরাচারী নয়। প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রেই উভয় পক্ষেরই কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। যেমন, শাসকের যেমন প্রজার আনুগত্য লাভের অধিকার আছে, তেমনই প্রজার প্রতি ন্যায়পরায়ণ হওয়া, তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং তাদের রক্ষা করা শাসকের পবিত্র দায়িত্ব। একইভাবে, পিতার যেমন সন্তানের কাছ থেকে ভক্তি ও সেবা পাওয়ার অধিকার আছে, তেমনই সন্তানের প্রতি স্নেহশীল হওয়া, তাদের সুশিক্ষা দেওয়া এবং তাদের প্রতিপালন করা পিতার অলঙ্ঘনীয় কর্তব্য। অর্থাৎ, প্রত্যেক সম্পর্কের দুটো দিকই আছে – অধিকার এবং সেই সাথে সমান্তরাল দায়িত্ব (Van Norden, 2011)। একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন।

বন্ধুদের সম্পর্কটা (朋友) এই তালিকার মধ্যে একটু স্বতন্ত্র। এটি স্তরভিত্তিক না হয়ে বরং সমতার (equality) ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো পারস্পরিক বিশ্বাস (trust – 信), বিশ্বস্ততা (faithfulness), আন্তরিকতা (sincerity) এবং একে অপরের প্রতি মঙ্গলকামনা ও সহযোগিতা।

কনফুসিয়াস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, এই পাঁচ প্রকার সম্পর্ক যদি প্রতিটি ব্যক্তি নিজ নিজ অবস্থান থেকে সঠিকভাবে, আন্তরিকতার সঙ্গে এবং দায়িত্বশীলভাবে পালন করে, তাহলে পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে স্বাভাবিকভাবেই সম্প্রীতি, শৃঙ্খলা এবং শান্তি বিরাজ করবে। এই সম্পর্কগুলোই হলো একটি সুস্থ ও নৈতিক সামাজিক কাঠামোর মূল ভিত্তি।

তিয়েন (天 – Tian) এবং তিয়েনমিং (天命 – Tianming): সেই অদৃশ্য স্বর্গীয় বিধান আর নৈতিকতার মহাজাগতিক পথনির্দেশনা

কনফুসিয়াসের দর্শনে ‘তিয়েন’ (天 – Tian) বা ‘স্বর্গ’ (Heaven) একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কিছুটা অস্পষ্ট ধারণা। এই ‘তিয়েন’ কোনো ব্যক্তিসত্তাসম্পন্ন, মানব-সদৃশ ঈশ্বর (anthropomorphic God) নয়, যেমনটা অনেক পশ্চিমা ধর্মে দেখা যায়। বরং, এটি একটি নৈর্ব্যক্তিক, সর্বব্যাপী নৈতিক শক্তি বা প্রকৃতির এক সুশৃঙ্খল নিয়ম (moral cosmic order)। কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন, এই ‘তিয়েন’ নীরবে, নিঃশব্দে পৃথিবীর সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে, ঋতুর পরিবর্তন ঘটায়, এবং মানুষের ভালো-মন্দ কাজের ওপর নজর রাখে ও তার একটা নৈতিক বিচার করে। তবে এই বিচার পরকালে নয়, বরং ইহজীবনেই প্রতিফলিত হয় – হয় ব্যক্তিগত জীবনে, নয়তো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে।

এর সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো ‘তিয়েনমিং’ (天命 – Tianming) বা ‘স্বর্গের বিধান’ (Mandate of Heaven)। এটি মূলত একটি রাজনৈতিক এবং নৈতিক ধারণা, যা চীনের ইতিহাসে ঝোউ রাজবংশ (Zhou Dynasty) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের পূর্ববর্তী শাং রাজবংশকে (Shang Dynasty) ক্ষমতাচ্যুত করার ন্যায্যতা প্রতিপাদনের জন্য। ‘তিয়েনমিং’-এর মূল কথা হলো, শাসকেরা ‘তিয়েন’-এর কাছ থেকে অর্থাৎ, এক ধরনের নৈতিক বৈধতার ভিত্তিতে শাসন করার অধিকার লাভ করে। কিন্তু এই অধিকার শর্তহীন বা চিরস্থায়ী নয়। যদি কোনো শাসক অত্যাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ, অযোগ্য বা প্রজার কল্যাণে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি ‘তিয়েন’-এর এই পবিত্র ম্যান্ডেট বা অনুমোদন হারিয়ে ফেলেন। তখন ‘তিয়েন’ সেই শাসকের কাছ থেকে শাসনের অধিকার কেড়ে নেয় এবং অন্য কোনো যোগ্য, গুণী এবং প্রজাবৎসল ব্যক্তির হাতে তা তুলে দেয়। এইভাবেই চীনের ইতিহাসে এক রাজবংশের পতন এবং অন্য রাজবংশের উত্থানকে নৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে (Pines, 2014)।

কনফুসিয়াস নিজে ‘তিয়েন’-এর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং এর বিধানকে সম্মান করতেন। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে তিনি প্রায়শই ‘তিয়েন’-এর ইচ্ছার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করতেন, মানুষের উচিত ‘তিয়েন’-এর এই নৈতিক বিধান বা প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী জীবনযাপন করা, অর্থাৎ সৎ ও ন্যায় পথে চলা। তবে তিনি ভাগ্য বা দৈবের (fate) ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ তার সদিচ্ছা, কঠোর পরিশ্রম এবং নৈতিক আচরণের মাধ্যমে নিজের ভাগ্যকে প্রভাবিত করতে পারে, যদিও চূড়ান্ত পরিণতি ‘তিয়েন’-এর হাতেই ন্যস্ত। কনফুসিয়াস একবার বলেছিলেন, “পঞ্চাশ বছর বয়সে আমি স্বর্গের বিধান (তিয়েনমিং) বুঝতে পেরেছি” (Analects 2.4)। এর মানে এই নয় যে তিনি কোনো দৈববাণী শুনেছেন, বরং জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, গভীর পর্যবেক্ষণ এবং নিরন্তর আত্ম-অনুসন্ধানের মাধ্যমে তিনি প্রকৃতির অন্তর্নিহিত নৈতিক নিয়ম এবং মহাজাগতিক শৃঙ্খলা সম্পর্কে এক গভীর উপলব্ধি অর্জন করেছিলেন।

অ্যানালেক্টস (論語 – Lunyu): যেখানে সংরক্ষিত কনফুসিয়াসের অমৃতসমান বাণী

একটা মজার ব্যাপার হলো, কনফুসিয়াস নিজে কিন্তু কোনো গ্রন্থ রচনা করে যাননি, যেমনটা করেছিলেন প্লেটো বা অ্যারিস্টটল। তাঁর অমূল্য চিন্তাভাবনা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি, বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তা, উপদেশ, শিষ্যদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন এবং তাঁর জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো তাঁর মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর তাঁর অনুগত শিষ্যরা এবং তাঁদের শিষ্যরা সযত্নে সংগ্রহ করে একটি গ্রন্থে সংকলিত করেন। এই গ্রন্থটিরই চীনা নাম ‘লুনইউ’ (論語 – Lunyu), যা পশ্চিমা বিশ্বে ‘দ্য অ্যানালেক্টস অফ কনফুসিয়াস’ (The Analects of Confucius) নামে সুপরিচিত। এটিই কনফুসীয় দর্শন এবং তাঁর জীবন সম্পর্কে জানার প্রধানতম এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস।

‘অ্যানালেক্টস’ কোনো সুবিন্যস্ত, বিষয়ভিত্তিক দার্শনিক সন্দর্ভ (philosophical treatise) নয়, যেমনটা আমরা আধুনিক যুগে দেখে থাকি। এটি অনেকটা একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি বা স্মারকগ্রন্থের মতো, যেখানে ছোট ছোট, আপাত-বিচ্ছিন্ন অনুচ্ছেদে কনফুসিয়াসের বিভিন্ন সময়ের তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি, নীতিবাক্য, প্রশ্নোত্তর এবং তাঁর জীবনের নানা টুকরো ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর ব্যঞ্জনায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই আপাত-ছিন্নভিন্ন উক্তিগুলোর সমষ্টিগত পাঠের মাধ্যমেই তাঁর সামগ্রিক জীবনদর্শন, তাঁর চরিত্র এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি আমাদের সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়। বইটি পড়লে প্রায়শই মনে হয়, যেন স্বয়ং কনফুসিয়াস তাঁর শান্ত, সৌম্যকান্তি মুখে মৃদু হাসি নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন – কখনো তিনি স্নেহশীল বন্ধুর মতো, কখনো বিচক্ষণ অভিভাবকের মতো, আবার কখনো বা প্রজ্ঞাবান, অভিজ্ঞ শিক্ষকের মতো আমাদের জীবনের সঠিক পথের দিশা দিচ্ছেন। এর ভাষা সরল, কিন্তু অর্থ অত্যন্ত গভীর ও বহুমাত্রিক। প্রতিটি উক্তি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ চিন্তা করার এবং তা নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে।

সঙ্গীত (樂 – Yue): সুরের মূর্ছনায় নৈতিকতার জাগরণ

কনফুসিয়াসের দর্শনে সঙ্গীতের (樂 – Yue) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল, যা প্রায়শই আমরা উপেক্ষা করে যাই। তিনি সঙ্গীতকে কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখতেন না, বরং এটিকে তিনি নৈতিক চরিত্র গঠন, সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপন এবং এমনকি সুশাসনের একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সঠিক ধরনের সঙ্গীত মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে পরিশুদ্ধ করতে পারে, তাদের মধ্যে সদ্ভাব জাগ্রত করতে পারে এবং সমাজে এক ধরনের অদৃশ্য শৃঙ্খলা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

কনফুসিয়াস বলতেন, “কবিতা (詩 – Shi) দ্বারা নিজেকে উদ্বুদ্ধ করো, রীতিনীতি (禮 – Li) দ্বারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো, এবং সঙ্গীত (樂 – Yue) দ্বারা নিজেকে পরিপূর্ণ করো।” (Analects 8.8)। তাঁর মতে, সঙ্গীতের সুর, ছন্দ এবং ভাব যদি মহৎ ও পরিশীলিত হয়, তবে তা মানুষের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাদের আত্মাকে উন্নত করে। অন্যদিকে, উচ্ছৃঙ্খল, কুরুচিপূর্ণ বা অধঃপতিত সঙ্গীত মানুষের মনে নেতিবাচক আবেগ সৃষ্টি করে এবং সামাজিক অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে।

তিনি প্রাচীনকালের কিছু সঙ্গীতকে অত্যন্ত উচ্চাসন দিয়েছিলেন, কারণ সেগুলোর মধ্যে নৈতিকতা ও সামাজিক শৃঙ্খলার ভাব ফুটে উঠত। তিনি মনে করতেন, একটি রাজ্যের সঙ্গীত শুনলেই সেই রাজ্যের শাসনব্যবস্থা এবং জনগণের নৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। যদি সঙ্গীত হয় সুরেলা, শান্ত ও ভাবগম্ভীর, তবে বুঝতে হবে রাজ্যে সুশাসন ও শান্তি বিরাজ করছে। আর যদি সঙ্গীত হয় কর্কশ, বিশৃঙ্খল ও উত্তেজনাপূর্ণ, তবে বুঝতে হবে রাজ্যে অরাজকতা ও নৈতিক অধঃপতন ঘটেছে। তাই, ‘লি’ (রীতিনীতি) এবং ‘ইউ’ (সঙ্গীত) কে তিনি সামাজিক শৃঙ্খলার দুটি স্তম্ভ হিসেবে দেখতেন।

আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা: ঝোং (忠 – Loyalty), শিন (信 – Trustworthiness), ইয়োং (勇 – Courage), ঝি (知 – Wisdom) এবং চেং (誠 – Sincerity)

কনফুসীয় দর্শনে আরও বেশ কিছু নৈতিক গুণাবলির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যা একজন ‘জুনজি’র চরিত্রের অপরিহার্য অংশ এবং একটি সুস্থ সমাজের জন্য অত্যাবশ্যক।

  • ঝোং (忠 – Zhong) বা আনুগত্য/কর্তব্যপরায়ণতা: এটি কেবল শাসকের প্রতি অন্ধ আনুগত্য নয়, বরং নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা এবং যার প্রতি অনুগত থাকার কথা (যেমন – রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, বন্ধু), তার মঙ্গলের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা। তবে এই আনুগত্যও বিচারবুদ্ধিহীন নয়। যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অন্যায় পথে চালিত হয়, তবে তাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করাও ‘ঝোং’-এর অংশ।

  • শিন (信 – Xin) বা বিশ্বস্ততা/সত্যবাদিতা: কথা ও কাজে মিল থাকা, প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা, অন্যের বিশ্বাস অর্জন করা এবং সেই বিশ্বাস ধরে রাখা। সমাজে পারস্পরিক আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতা না থাকলে কোনো সম্পর্কই টেকে না, কোনো সম্মিলিত কাজও সফল হয় না। ‘শিন’ হলো সামাজিক আস্থার ভিত্তি।

  • ইয়োং (勇 – Yong) বা সাহস: এটি কেবল শারীরিক বা সামরিক সাহস নয়, বরং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো নৈতিক সাহস (moral courage) – অর্থাৎ, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস, অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করার সাহস, এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজের নৈতিক আদর্শে অটল থাকার সাহস। কনফুসিয়াস বলতেন, “যা সঠিক তা জানা সত্ত্বেও তা না করা হলো সাহসের অভাব।” (Analects 2.24)।

  • ঝি (知 – Zhi) বা প্রজ্ঞা/জ্ঞান: এটি কেবল তথ্যগত জ্ঞান নয়, বরং ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচার করার ক্ষমতা, দূরদর্শিতা এবং জীবনের গভীরতর তাৎপর্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা। এই প্রজ্ঞা অর্জিত হয় শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং গভীর চিন্তাভাবনার মাধ্যমে।

  • চেং (誠 – Cheng) বা আন্তরিকতা/অকপটতা: চিন্তা, বাক্য এবং কর্মে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা। মনের ভেতরে এক, আর বাইরে আরেক – এমন দ্বৈত আচরণ ‘চেং’-এর পরিপন্থী। আন্তরিকতা হলো সকল সদ্গুণের ভিত্তি।

এই গুণাবলিগুলো পরস্পর সম্পর্কিত এবং একটি সামগ্রিক নৈতিক জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য।

কনফুসীয় দর্শনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও আজকের দিনে তার প্রাসঙ্গিকতা

কনফুসিয়াসের দর্শন তাঁর মৃত্যুর পর কেবল চীনের সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি। এটি ধীরে ধীরে কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনামসহ পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, পারিবারিক মূল্যবোধ, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এমনকি রাজনৈতিক চিন্তাধারার ওপরও এক গভীর এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। এই অঞ্চলটিকে প্রায়শই ‘কনফুসীয় সংস্কৃতি বলয়’ (Confucian cultural sphere) হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই দেশগুলোর সামাজিক আচার-আচরণ, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ, কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতা এবং সমষ্টিগত ঐক্যের ওপর কনফুসীয় দর্শনের সুস্পষ্ট ছাপ আজও পরিলক্ষিত হয় (Tu Weiming, 1985)। হান রাজবংশ (Han Dynasty, ২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ২২০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত কনফুসীয় দর্শন চীনের রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ হিসেবে স্বীকৃত ছিল।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, এই একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত পরিবর্তনশীল, প্রযুক্তি-নির্ভর, বিশ্বায়িত পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কনফুসিয়াসের সেই আড়াই হাজার বছর পুরনো দর্শন কি আদৌ প্রাসঙ্গিক? অনেকেই হয়তো বলবেন, না। তাঁরা যুক্তি দেখাতে পারেন যে, কনফুসীয় দর্শনের কিছু কিছু দিক, যেমন – নারীর প্রতি খানিকটা রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি (যদিও এর অনেকটুকুই পরবর্তীকালের ব্যাখ্যাকারদের সৃষ্টি), সামাজিক স্তরবিন্যাসের (hierarchy) ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া, বা শাসকের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্যের কথা বলা – এগুলো আজকের এই গণতান্ত্রিক, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এবং সমতাভিত্তিক যুগে অচল এবং গ্রহণযোগ্য নয়। এই সমালোচনাগুলোর কিছু বাস্তব ভিত্তিও অস্বীকার করা যায় না। তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, কনফুসিয়াস তাঁর সময়, সমাজ এবং পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষাপটে কথা বলেছিলেন। সব দর্শনই তার কালের সন্তান।

কিন্তু এতসব সমালোচনা সত্ত্বেও, তাঁর দর্শনের যে চিরন্তন মানবিক আবেদন, যে মৌলিক নৈতিকতার সুর – যেমন মানবতা ও সহানুভূতির চর্চা (‘রেন’), সামাজিক শিষ্টাচার ও শৃঙ্খলার গুরুত্ব (‘লি’), পারিবারিক বন্ধন ও শ্রদ্ধাবোধের অপরিহার্যতা (‘শিয়াও’), শিক্ষার মাধ্যমে আত্ম-উন্নয়নের সাধনা (‘শুয়ে’), নৈতিক ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা, সত্যবাদিতা (‘শিন’), আনুগত্য (‘ঝোং’) এবং আন্তরিকতা (‘চেং’) – এগুলো কিন্তু আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং মূল্যবান। আজকের এই ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিক, ভোগবাদী, প্রায়শই সংঘাতপূর্ণ এবং পরিবেশগতভাবে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে কনফুসিয়াসের ভারসাম্যপূর্ণ, মানবিক, দায়িত্বশীল এবং প্রকৃতি-সচেতন জীবনদর্শনের আবেদন এতটুকুও ফুরিয়ে যায়নি। বরং, তাঁর কথাগুলো আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায় – কীভাবে আমরা আরও ভালো, আরও দায়িত্বশীল মানুষ হতে পারি, কীভাবে আমরা আমাদের পরিবার, সমাজ এবং এই বিশ্বকে আরও একটু সুন্দর, আরও একটু শান্তিময় এবং আরও একটু সম্প্রীতিপূর্ণ করে তুলতে পারি।

কনফুসিয়াস হয়তো কোনো জাদুকর ছিলেন না, যিনি তাঁর জাদুর কাঠির এক স্পর্শে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন গভীর মানবতাবাদী এবং একজন আজীবন শিক্ষক। তিনি জানতেন, সমাজ পরিবর্তন কোনো রাতারাতি ঘটে যাওয়া বিপ্লব নয়, এটি একটি ধীরস্থির, দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যার শুরুটা করতে হয় প্রতিটি ব্যক্তির নিজের জীবন থেকে, নিজের ঘর থেকে। তাঁর দর্শন অনেকটা সেই শান্ত, ধীরগতির কিন্তু ফল্গুধারার নদীর মতো, যা হয়তো বাইরে থেকে তেমন গর্জন করে না, কিন্তু নীরবে, নিঃশব্দে বয়ে চলে মাটির তলা দিয়ে, আর উর্বর করে তোলে চারপাশের ভূমিকে, ফলবান করে তোলে জীবনকে।

যদি কখনো আপনার চলার পথে ক্লান্তি আসে, যদি কখনো মনে হয় চারপাশের পৃথিবীটা বড্ড বেশি জটিল, বড্ড বেশি এলোমেলো আর অর্থহীন লাগছে, যদি কখনো জীবনের মানে খুঁজে পেতে দিশেহারা বোধ করেন, তাহলে একবার অন্তত থামুন। একটু সময় নিয়ে কনফুসিয়াসের সেই সরল, কিন্তু গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কথাগুলো নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। কে বলতে পারে, হয়তো এই আড়াই হাজার বছর আগের প্রজ্ঞাবান দার্শনিকের সহজ-সরল, মানবিক কথাগুলোর মধ্যেই আপনি খুঁজে পাবেন আপনার অনেক না-বলা প্রশ্নের উত্তর, আপনার অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের নিরসন, আর আপনার চলার পথের নতুন দিশা। কে জানে, হয়তো তাঁর দেখানো সেই আলোকিত পথেই আপনিও একদিন হয়ে উঠবেন একজন সত্যিকারের ‘জুনজি’ – একজন আদর্শ, নৈতিক ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ, যিনি নিজের জীবনকে সুন্দর ও অর্থপূর্ণ করার পাশাপাশি চারপাশের এই অশান্ত পৃথিবীটাকেও একটুখানি সুন্দর, একটুখানি বাসযোগ্য করে তোলার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যান। মন্দ কী, বলুন? চেষ্টার তো কোনো শেষ নেই, আর ভালো হওয়ারও কোনো বিকল্প নেই!

তথ্যসূত্র

  • Creel, H. G. (1949). Confucius: The Man and the Myth. New York: John Day Company.
  • Fingarette, H. (1972). Confucius: The Secular as Sacred. New York: Harper & Row.
  • Lau, D. C. (Trans.). (1979). Confucius: The Analects (Lun yü). Harmondsworth: Penguin Books.
  • Legge, J. (Trans.). (1893). The Chinese Classics, Vol. I: Confucian Analects, The Great Learning, and The Doctrine of the Mean. Oxford: Clarendon Press. (Many modern reprints available)
  • Nylan, M. (2001). The Five “Confucian” Classics. New Haven: Yale University Press.
  • Pines, Y. (2014). “The Concept of ‘Tian’ and ‘Tianming’ in the ‘Shujing’ and its Implications for the Study of the ‘Zhouyi'”. In G. S. Nelson (Ed.), The Chinese Classic of Changes: The Yi Jing from Divination to Philosophy (pp. 143-167). London: Bloomsbury Academic.
  • Rosemont Jr., H., & Ames, R. T. (2009). The Chinese Classic of Family Reverence: A Philosophical Translation of the Xiaojing. Honolulu: University of Hawai’i Press.
  • Schwartz, B. I. (1985). The World of Thought in Ancient China. Cambridge, MA: Harvard University Press.
  • Slingerland, E. (Trans.). (2003). Confucius: Analects – With Selections from Traditional Commentaries. Indianapolis: Hackett Publishing Company.
  • Tu Weiming. (1985). Confucian Thought: Selfhood as Creative Transformation. Albany: State University of New York Press.
  • Van Norden, B. W. (2011). Introduction to Classical Chinese Philosophy. Indianapolis: Hackett Publishing Company.
  • Waley, A. (Trans.). (1938). The Analects of Confucius. London: George Allen & Unwin. (Many modern reprints available)
  • Watson, B. (Trans.). (1997). The Analects of Confucius. New York: Columbia University Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.