চৈনিক সভ্যতার উপাখ্যান: ড্রাগনের ছায়ায় হাজার বছরের পথচলা

Table of Contents

ভূমিকা

কিছু কিছু গল্প শুরু করতে হয় ঘোর বর্ষার এক রাতে, যখন চারদিক অন্ধকার এবং টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনো সঙ্গী নেই। সেই সব গল্প আমাদের পরিচিত জগতের সীমানা ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। চৈনিক সভ্যতার গল্পটা তার চেয়েও পুরনো, তার চেয়েও গভীর। এটা কোনো সাধারণ গল্প নয়; এ এক মহাকাব্য। হাজার হাজার বছরের পুরনো এক নদীর মতো, যা কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল, কিন্তু তার বয়ে চলা থামেনি। এর বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে আছে দর্শন, যুদ্ধ, আবিষ্কার আর মানুষের টিকে থাকার অবিশ্বাস্য কাহিনি।

চলুন, আমরা সেই নদীর স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই। সময়ের ভেলায় চড়ে একটু ঘুরে আসা যাক সেই বিস্ময়কর জগৎ থেকে, যার নাম চীন।

যে মাটিতে জন্ম (The Land and the People)

যেকোনো সভ্যতাকে বুঝতে হলে আগে তার ভূগোলকে বুঝতে হয়। চীনের ভূগোলটা একটা দুর্গের মতো। এর পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর, পশ্চিমে আর দক্ষিণে সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালা আর তিব্বত মালভূমি, এবং উত্তরে রুক্ষ গোবি মরুভূমি। এই প্রাকৃতিক দেয়াল চীনকে বাকি বিশ্ব থেকে হাজার হাজার বছর ধরে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এই বিচ্ছিন্নতাই তাদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র বিশ্ববীক্ষার জন্ম দেয়। তারা নিজেদের পৃথিবীকে বলত ‘ঝংগুও’ (Zhongguo) বা ‘মধ্যবর্তী রাজ্য’ (Middle Kingdom)। তাদের ধারণা ছিল, তারাই সভ্য জগতের কেন্দ্রে বাস করে, আর চারপাশের বাকিরা সব অসভ্য ‘বর্বর’ (Barbarians)।

এই বিশ্বদৃষ্টির একটি গভীরতর ধারণা হলো ‘তিয়ানশিয়া’ (Tianxia) বা ‘স্বর্গের অধীনে সমস্ত কিছু’ (All Under Heaven)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, চীনের সম্রাট কেবল চীনের শাসক নন, তিনি ‘স্বর্গের পুত্র’ (Son of Heaven) হিসেবে সমগ্র পৃথিবীর নৈতিক ও মহাজাগতিক শাসক। তাই অন্য রাষ্ট্রগুলো চীনের সমকক্ষ নয়, বরং ছোট ভাইয়ের মতো, যাদের বড় ভাই হিসেবে চীনের প্রতি আনুগত্য ও সম্মান দেখানো উচিত। এই ধারণা থেকেই চীনের বিখ্যাত ‘উপঢৌকন ব্যবস্থা’ (Tribute System) গড়ে উঠেছিল, যেখানে ভিয়েতনাম, কোরিয়া, জাপান এবং মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলো চীনা সম্রাটকে উপঢৌকন পাঠিয়ে তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করত এবং বিনিময়ে বাণিজ্যিক সুবিধা ও সুরক্ষা লাভ করত। এটি নিছক একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল না, ছিল এক বিশ্বব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি, যার কেন্দ্রে ছিল চীন।

চীনের প্রাণ হলো দুটি নদী—উত্তরের হোয়াং হো (Huang He) বা হলুদ নদী এবং দক্ষিণের ইয়াংজি (Yangtze) নদী। হলুদ নদী যেমন উর্বর পলিমাটি দিয়ে চীনের কৃষির জন্ম দিয়েছে, তেমনি তার বিধ্বংসী বন্যা জন্ম দিয়েছে প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্বের বোধ। এই অববাহিকার শুষ্ক, শীতল জলবায়ুতে জন্ম নিয়েছে জোয়ার, বাজরা আর গমের মতো শস্য। এখানকার মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে কঠোর, সুশৃঙ্খল এবং যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে, সবুজ, শান্ত ও দীর্ঘ ইয়াংজি নদী দিয়েছে সমৃদ্ধি আর জীবনের প্রাচুর্য। এর উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া ধান চাষের জন্য আদর্শ। দক্ষিণের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে সৃজনশীল, বণিক, শিল্পী এবং কবি হিসেবে পরিচিত। এই দুই নদীর ভিন্ন চরিত্রই যেন চীনের দ্বৈত সত্তার প্রতীক—কঠোর উত্তরের প্রশাসক আর সৃষ্টিশীল দক্ষিণের শিল্পী। চীনের ইতিহাস জুড়ে এই দুই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং মেলবন্ধন তার গতিপথকে নির্ধারণ করেছে (Marks, 2012)।

সূচনার শুরু: হলুদ নদীর তীরে (The Cradle of the Yellow River)

যেকোনো সভ্যতার গল্পের শুরুতেই একটা নদী থাকে। মিশরীয় সভ্যতার জন্য নীল নদ, সিন্ধু সভ্যতার জন্য সিন্ধু নদ। চীনের জন্য সেই নদীর নাম হোয়াং হো বা হলুদ নদী। এই নদীর পানি পলিমাটির কারণে হলুদ দেখায়, তাই এমন নাম। এই পলিমাটি ছিল উর্বর, চাষবাসের জন্য চমৎকার। এখানেই প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার বছর আগে চীনের আদি মানুষেরা ঘর বাঁধতে শুরু করে। নব্যপ্রস্তর যুগে (Neolithic Age) এখানে ইয়াংশাও (Yangshao) এবং লংচান (Longshan) সংস্কৃতির মতো উন্নত জনপদের বিকাশ ঘটেছিল, যারা সুন্দর মাটির পাত্র বানাতে পারত এবং সংঘবদ্ধ জীবনযাপন করত। ইয়াংশাও সংস্কৃতির (আনুমানিক ৫০০০-৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) মানুষ লাল রঙের মাটির পাত্রে কালো রঙ দিয়ে মাছ, পাখি এবং জ্যামিতিক নকশা আঁকত, যা তাদের শৈল্পিক চেতনার পরিচয় দেয়। অন্যদিকে, লংচান সংস্কৃতির (আনুমানিক ৩০০০-১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) কারিগররা কুমোরের চাকা ব্যবহার করে ডিমের খোলার মতো পাতলা, কালো ও মসৃণ মাটির পাত্র তৈরি করত, যা তাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের প্রমাণ।

হলুদ নদীকে বলা হয় চীনের আঁতুড়ঘর (Cradle of Chinese Civilization), কিন্তু এই নদী যেমন জীবন দিয়েছে, তেমনি কেড়েও নিয়েছে। বন্যার পর বন্যা। একে তাই ‘চীনের দুঃখ’ও (China’s Sorrow) বলা হতো। এই ধ্বংস আর সৃষ্টির অদ্ভুত চক্রের মধ্য দিয়েই চৈনিক মানসের জন্ম। তারা প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনাকে মেনে নিতে শিখল, এর সাথে লড়াই করে বাঁচতে শিখল। প্রকৃতির এই দ্বৈত রূপ—কখনো মা, কখনো দানবী—তাদের দর্শনে ও জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। এই শেখাটাই তাদের সভ্যতার মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল (Ebrey, 2010)।

চীনের প্রথম তিনটি কিংবদন্তিতুল্য রাজবংশ হলো শিয়া (Xia), শাং (Shang) এবং চৌ (Zhou)। শিয়া রাজবংশ (আনুমানিক ২০৭০-১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেকে একে পৌরাণিক বলে মনে করলেও, সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলো, যেমন এরলিতু (Erlitou) সংস্কৃতি, এর ঐতিহাসিক অস্তিত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, মহান ইউ (Yu the Great) হলুদ নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল প্রকৃতির ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণের এক প্রতীকী বিজয়।

শাং রাজবংশ (আনুমানিক ১৬০০-১০৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) থেকে আমরা সুস্পষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পেতে শুরু করি। শাংরা ছিল ব্রোঞ্জযুগের এক শক্তিশালী সভ্যতা। তারা যে শুধু দুর্দান্ত যোদ্ধা ছিল তাই নয়, তাদের শিল্পবোধও ছিল অসাধারণ। তাদের তৈরি বিশাল বিশাল ব্রোঞ্জ পাত্রগুলোতে যে জটিল ও শৈল্পিক কারুকার্য দেখা যায়, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। এই পাত্রগুলো কেবল রান্নার বা পান করার জন্য ছিল না; এগুলো ছিল ধর্মীয় আচারের কেন্দ্রবিন্দু। শাংরা বিশ্বাস করত যে, তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা পরলোকে শক্তিশালী এবং তারা জীবিতদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই এই পাত্রগুলোতে খাবার ও মদ উৎসর্গ করে তারা পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্ট করত। পাত্রের গায়ে খোদাই করা ‘তাওতি’ (Taotie) নামক পৌরাণিক পশুর মুখ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও শিল্পের এক অনন্য মেলবন্ধন।

শাংদের সবচেয়ে বড় অবদান হলো চীনা লিখন পদ্ধতির প্রাচীনতম রূপের বিকাশ। তারা ওরাকল বোন্স (Oracle Bones) বা ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য ব্যবহৃত পশুর কাঁধের হাড় বা কচ্ছপের পেটের খোলে প্রশ্ন খোদাই করত। যেমন, “আগামী দশ দিন কি বৃষ্টি হবে?”, “সম্রাজ্ঞী কি পুত্রসন্তানের জন্ম দেবেন?” বা “রাজার দাঁতের ব্যথা কি সেরে যাবে?”। তারপর সেই হাড় বা খোলটিকে উত্তপ্ত করা হতো। তাপে এর ওপর যে ফাটল ধরত, সেই ফাটলের নকশা দেখেই পুরোহিত বা স্বয়ং রাজা ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। এই খোদাই করা অক্ষরগুলোই আজকের চীনা অক্ষরের পূর্বপুরুষ। প্রায় তিন হাজারেরও বেশি সময় ধরে এই লিপি বিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু তার মূল কাঠামোটি আজও টিকে আছে। এই ওরাকল বোন্স আমাদের শাংদের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি এবং দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে এক অমূল্য ধারণা দেয় (Keightley, 1999)।

অধ্যায় ৩: রাজবংশের গোলকধাঁধা এবং স্বর্গের বিধান (The Dynastic Cycle and the Mandate of Heaven)

চীনের ইতিহাস বুঝতে গেলে একটা জিনিস আগে বুঝতে হবে—তার রাজবংশের চক্র (Dynastic Cycle)। এখানে একটার পর একটা রাজবংশ (Dynasty) এসেছে আর গেছে। ব্যাপারটা অনেকটা ঋতু পরিবর্তনের মতো। নতুন রাজবংশ আসে বসন্তের মতো নতুন আশা নিয়ে, ভূমি সংস্কার করে, কর কমায় এবং দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। তারপর গ্রীষ্মের মতো শক্তিশালী হয়, সাম্রাজ্য বিস্তার করে। শরতের মতো স্থিতিশীল থাকে, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। অবশেষে শীতের মতো দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। সম্রাটরা বিলাসী জীবনযাপন শুরু করে, রাজসভায় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা বা ক্ষমতালোভী নপুংসকদের (eunuchs) প্রভাব বাড়ে, করের বোঝা বাড়তে থাকে এবং প্রজারা শোষিত হয়।

কিন্তু কে ঠিক করে দেবে কোন রাজা শাসন করবে? এখানেই চীনারا এক অদ্ভুত সুন্দর তত্ত্ব নিয়ে এল। নাম তার ‘স্বর্গের বিধান’ বা ‘ম্যান্ডেট অফ হেভেন’ (Mandate of Heaven)। এই তত্ত্বের জন্মদাতা ছিল চৌ রাজবংশ (১০৪৬-২৫৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), যারা শাংদের পরাজিত করে ক্ষমতায় এসেছিল। নিজেদের শাসনকে বৈধতা দিতে তারা প্রচার করল যে, শেষ শাং শাসক অত্যাচারী, মদ্যপ এবং অযোগ্য হয়ে পড়েছিল, তাই স্বর্গ (Heaven) বা ‘তিয়ান’ (Tian) তাদের কাছ থেকে শাসনের অধিকার কেড়ে নিয়ে ধার্মিক ও যোগ্য চৌ শাসকদের দিয়েছে।

ব্যাপারটা একটু বিচিত্র, তাই না? স্বর্গের বিধান জিনিসটা কী? এটা কোনো লিখিত দলিল নয়, এটা একটা বিশ্বাস। চীনারা বিশ্বাস করত, ‘তিয়ান’ হলো মহাবিশ্বের এক নৈতিক শক্তি। যে রাজা বা সম্রাট ন্যায়পরায়ণ, প্রজাদের জন্য ভালো কাজ করেন, তাকেই স্বর্গ রাজ্য শাসনের অধিকার দেয়। কিন্তু যখনই কোনো শাসক অত্যাচারী বা অযোগ্য হয়ে ওঠেন, তখনই স্বর্গ তার সেই অধিকার কেড়ে নেয়। তখন দেশে বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি বা বিদ্রোহ দেখা দেয়। এগুলোই হলো চিহ্ন যে, শাসকের ওপর থেকে স্বর্গের আশীর্বাদ উঠে গেছে। তখন নতুন কোনো যোগ্য নেতা এসে পুরনো শাসককে সরিয়ে নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার নৈতিক অধিকার পান (Fairbank & Goldman, 2006)।

এই তত্ত্বটি ছিল একাধারে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়। এটি যেমন রাজাকে বিশাল ক্ষমতা দিত, তেমনি তার ওপর একটা নৈতিক দায়িত্বও চাপিয়ে দিত—প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করা। প্রজাদের কাছেও রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার একটা বৈধ কারণ তৈরি হতো, যদি তারা প্রমাণ করতে পারত যে রাজা স্বর্গের বিধান হারিয়েছেন। এই একটি তত্ত্ব চীনের রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং রাজবংশের উত্থান-পতনকে একটি নৈতিক কাঠামোর মধ্যে ব্যাখ্যা করেছে।

চৌ শাসনকাল ছিল চীনের ইতিহাসে দীর্ঘতম, প্রায় ৮০০ বছর। কিন্তু শেষের দিকে তাদের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা একেবারে কমে যায় এবং চীন অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সময়টাকে বলা হয় ‘ওয়ারিং স্টেটস পিরিয়ড’ (Warring States Period, ৪৭৫-২২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) বা যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের কাল। দেশজুড়ে চলছিল ভয়ানক হানাহানি, বিশ্বাসঘাতকতা আর রাজনৈতিক অস্থিরতা। কিন্তু এই অন্ধকার সময়েই জ্বলে উঠেছিল জ্ঞানের সবচেয়ে উজ্জ্বল শিখা।

জ্ঞানের স্বর্ণযুগ: শত দর্শনের জন্ম (The Hundred Schools of Thought)

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সবচেয়ে বড় সৃষ্টিগুলো প্রায়ই আসে সবচেয়ে বড় ধ্বংসের সময় থেকে। চৌ রাজবংশের শেষের দিকে চীন যখন যুদ্ধ আর সংঘাতে জর্জরিত, ঠিক তখনই দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ঘটে। এই সময়টাকে বলা হয় ‘শত দর্শনের যুগ’ বা ‘হান্ড্রেড স্কুলস অফ থট’ (Hundred Schools of Thought)। ভাবনার এক আশ্চর্য বিস্ফোরণ! সমাজের এই সংকট থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে বেরিয়ে এলেন অসংখ্য জ্ঞানীগুণী, দার্শনিক। তাদের মধ্যে প্রধান কয়েকটি দর্শন চীনের ভাগ্য চিরদিনের জন্য নির্ধারণ করে দেয়।

১. কনফুসীয়বাদ (Confucianism): কুং ফু-ৎসি (Kong Fuzi), যাকে আমরা কনফুসিয়াস (Confucius) নামে চিনি, তিনি ছিলেন এই দর্শনের প্রবক্তা। তিনি কোনো নতুন ধর্মের কথা বলেননি, বরং একটি সুশৃঙ্খল এবং নৈতিক সমাজ কীভাবে গড়া যায়, তার পথ দেখিয়েছিলেন। তার দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল পরিবার এবং সামাজিক সম্পর্ক। তিনি বলেন, পরিবার যদি ঠিক থাকে, তবে সমাজও ঠিক থাকবে। পাঁচটি প্রধান সম্পর্কের (Five Relationships) ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন: শাসক-প্রজা, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, বড় ভাই-ছোট ভাই, এবং বন্ধু-বন্ধু। এই প্রতিটি সম্পর্কের মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল পারস্পরিক। যেমন, শাসকের কর্তব্য প্রজাকে রক্ষা করা, আর প্রজার কর্তব্য শাসকের প্রতি অনুগত থাকা। তার কাছে মানবিকতা বা ‘রেন’ (Ren), ধার্মিকতা বা ‘ই’ (Yi), আচার-অনুষ্ঠানের সঠিক পালন বা ‘লি’ (Li), এবং পিতৃভক্তি বা ‘শিয়াও’ (Filial Piety) ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ। কনফুসিয়াসের পর তার অনুসারী মেঞ্চিয়াস (Mencius) বলেন যে মানুষ স্বভাবতই ভালো, আর শুনজি (Xunzi) বলেন যে মানুষ স্বভাবতই মন্দ এবং তাকে শিক্ষার মাধ্যমে ভালো করতে হয়। এই দর্শন দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনের শাসনব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, সমাজ এবং সংস্কৃতির প্রধান চালিকাশক্তি ছিল (Creel, 1949)।

২. তাওবাদ (Taoism): কনফুসিয়াস যদি বলেন সমাজের নিয়ম মেনে চলো, তবে তাওবাদের প্রবক্তা লাওৎসে (Laozi) বলবেন, ‘আরে ধুর! প্রকৃতির মতো বয়ে চলো।’ তাও (Tao) শব্দের অর্থ ‘পথ’ বা ‘The Way’। এই পথ হলো প্রকৃতির পথ। তাওবাদীরা মনে করতেন, সমাজের জটিল নিয়মকানুন আর মানুষের সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে অসুখী করে তোলে। সুখী হওয়ার আসল উপায় হলো প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া, সহজ-সরল জীবনযাপন করা এবং অপ্রয়োজনীয় সব কিছু ত্যাগ করা। তাদের কাছে নিষ্ক্রিয় কর্ম বা ‘উ ওয়েই’ (Wu Wei) একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যার মানে হলো, জোর করে কিছু না করে প্রকৃতির স্রোতের সাথে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া, ঠিক যেমন জল কোনো বাধা পেলে তার পাশ দিয়ে বয়ে যায়, তার সাথে যুদ্ধ করে না। তাওবাদ চীনের শিল্প (বিশেষ করে ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং), কবিতা, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং মানুষের সাধারণ জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে (Kohn, 2000)।

৩. আইনবাদ বা লিগালিজম (Legalism): এই দর্শনটি ছিল বেশ কঠোর এবং বাস্তববাদী। এর প্রবক্তারা, যেমন হান ফেই (Han Fei), কনফুসিয়াসের নৈতিকতা বা তাওবাদের প্রকৃতি-প্রেমের ওপর বিশ্বাস করতেন না। তারা মনে করতেন, মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর এবং অলস। তাই তাদের শাসন করার জন্য দরকার কঠোর আইন এবং সেই আইনের কঠিন প্রয়োগ। পুরস্কার এবং শাস্তির ভয় দেখিয়েই কেবল মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। শাসকের ক্ষমতা হতে হবে নিরঙ্কুশ এবং ব্যক্তিগত আবেগ বা নৈতিকতার কোনো স্থান সেখানে নেই। এই দর্শন অনুযায়ী, রাষ্ট্রের শক্তিই সর্বোচ্চ, ব্যক্তির কোনো অধিকার নেই। এই দর্শনটি শুনতে খুব নিষ্ঠুর মনে হলেও, চীনের ইতিহাসে এর প্রভাব ছিল অনেক বেশি। কারণ এই আইনবাদের ওপর ভিত্তি করেই চীন প্রথমবারের মতো একতাবদ্ধ হয়েছিল (Schwartz, 1985)।

এই তিনটি প্রধান দর্শন ছাড়াও মোঁজি (Mozi)-র মতো দার্শনিক ছিলেন, যিনি সর্বজনীন ভালোবাসা (Universal Love) এবং রক্ষণাত্মক যুদ্ধের কথা বলতেন, যা ছিল কনফুসীয় পরিবারকেন্দ্রিক নৈতিকতার সরাসরি বিরোধী। আবার ছিলেন সান জু (Sun Tzu), যার লেখা ‘দ্য আর্ট অফ ওয়ার’ (The Art of War) আজও বিশ্বের সেরা রণকৌশলের বই হিসেবে সমাদৃত, যেখানে বলা হয়েছে শ্রেষ্ঠ বিজয় হলো যুদ্ধ না করেই জয়লাভ করা। এই সব চিন্তার সংঘর্ষে চীনের মননভূমি উর্বর হয়েছিল।

চীনের প্রথম সম্রাট এবং ড্রাগনের হুঙ্কার (The First Emperor and the Rise of the Dragon)

যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের হানাহানির যুগ শেষ হলো এক ব্যক্তির হাত ধরে, যার নাম ছিল ইং ঝেং (Ying Zheng)। তিনি ছিলেন চিন (Qin) রাজ্যের রাজা। আইনবাদী (Legalist) পরামর্শকদের সাহায্যে তিনি একের পর এক রাজ্য জয় করে খ্রিষ্টপূর্ব ২২১ অব্দে পুরো চীনকে এক পতাকার নিচে নিয়ে আসেন। তারপর তিনি নিজেকে এক নতুন উপাধি দেন—চিন শি হুয়াং (Qin Shi Huang), যার অর্থ ‘চীনের প্রথম সম্রাট’।

চিন শি হুয়াং ছিলেন এক আশ্চর্য চরিত্র। একদিকে তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী শাসক, অন্যদিকে এক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক। চীনকে একতাবদ্ধ করার জন্য তিনি সবকিছু এক করে দিয়েছিলেন। তিনি মুদ্রা, ওজন ও পরিমাপের একক, এবং লেখার পদ্ধতিকেও একটি স্ট্যান্ডার্ড রূপে নিয়ে আসেন। এমনকি তিনি রাস্তার গাড়ির চাকার মধ্যবর্তী দূরত্বও (Axle Width) নির্দিষ্ট করে দেন, যাতে সারা সাম্রাজ্যে একই মাপের রাস্তা তৈরি করা যায় এবং সামরিক ও বাণিজ্যিক যানচলাচল দ্রুত হয়। তিনি বিশাল সড়ক ও খাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। তার সবচেয়ে বড় কীর্তি হলো চীনের মহাপ্রাচীরের (The Great Wall of China) বিভিন্ন অংশকে একত্রিত করে উত্তরের যাযাবর, বিশেষ করে শিয়ংনু (Xiongnu) উপজাতির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য একটি বিশাল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যদিও আজকের যে প্রাচীর আমরা দেখি, তার বেশিরভাগ মিং (Ming) রাজবংশের তৈরি, কিন্তু এর গোড়াপত্তন করেছিলেন চিন শি হুয়াং। এই নির্মাণযজ্ঞে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জোর করে কাজ করানো হয়েছিল এবং অনেকেই সেখানে মারা যায় (Waldron, 1990)।

কিন্তু তার নিষ্ঠুরতার কথাও ভোলার নয়। তিনি ভিন্নমত সহ্য করতে পারতেন না। আইনবাদী দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং অতীতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য তিনি অন্য সব দর্শনের বই পুড়িয়ে ফেলার আদেশ দেন, যা ‘বার্নিং অফ বুকস অ্যান্ড বারিং অফ স্কলার্স’ (Burning of Books and Burying of Scholars) নামে কুখ্যাত। কথিত আছে, তিনি ৪৬০ জন কনফুসীয় পণ্ডিতকে জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন, কারণ তারা তার নীতির সমালোচনা করেছিল।

তার মৃত্যুর পরের জগৎ নিয়েও ছিল বিশাল পরিকল্পনা। তিনি অমর হতে চেয়েছিলেন, আলকেমিস্টদের পাঠিয়েছিলেন অমরত্বের অমৃত সন্ধানে। কিন্তু যখন বুঝলেন তা সম্ভব নয়, তখন পরকালের জন্য এক এলাহি আয়োজন করলেন। তিনি তার সমাধিস্থলের পাশে বানালেন এক বিশাল সেনাবাহিনী—হাজার হাজার পোড়ামাটির সৈন্য (Terracotta Army), ঘোড়া, রথ। প্রত্যেকটা সৈন্যের চেহারা আলাদা, প্রত্যেকের অভিব্যক্তি জীবন্ত, যেন তারা সত্যিকারের সৈন্যের প্রতিকৃতি। তাদের হাতে থাকা ব্রোঞ্জের অস্ত্রগুলো ক্রোমিয়ামের প্রলেপ দেওয়ায় দুই হাজার বছর পরেও ঝকঝকে ছিল। যেন তারা মৃত্যুর পরেও সম্রাটের সাম্রাজ্যকে রক্ষা করবে। ১৯৭৪ সালে এক কৃষক কূপ খনন করতে গিয়ে হঠাৎ করে এই আশ্চর্য সেনাবাহিনী আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কার সারা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল (Portal, 2007)।

চিন রাজবংশ মাত্র ১৫ বছর টিকেছিল। চিন শি হুয়াং-এর মৃত্যুর পরই তার কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুনে সাম্রাজ্য পুড়ে যায়। কিন্তু তিনি যে ঐক্যবদ্ধ চীনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নটা রয়ে গিয়েছিল।

সোনালি যুগ: হান, তাং এবং সং (The Golden Ages: Han, Tang, and Song)

চীনের ইতিহাসে কয়েকটি যুগকে সোনালি যুগ বলা হয়, যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য এবং প্রযুক্তিতে দেশটি উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল।

হান রাজবংশ (Han Dynasty, ২০৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ – ২২০ খ্রিষ্টাব্দ)

চিনদের পতনের পর হানরা ক্ষমতায় আসে। তারা চিনের মতো কঠোর ছিল না, বরং কনফুসীয় দর্শনকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। হান যুগ ছিল চীনের প্রথম সত্যিকারের সোনালি যুগ, যা প্রায় চারশো বছর ধরে চলেছিল। এই সময়েই সিল্ক রোড (Silk Road) বা রেশম পথের বাণিজ্য বিস্তার লাভ করে, যা চীনকে মধ্য এশিয়া, ভারত, পারস্য এবং এমনকি রোমান সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করেছিল। এই পথ দিয়ে কেবল রেশম, মশলা আর মূল্যবান পাথরই যেত না, যেত জ্ঞান, ধর্ম আর সংস্কৃতিও। বৌদ্ধধর্ম (Buddhism) এই পথ ধরেই প্রথম চীনে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে তাওবাদ ও কনফুসীয়বাদের পাশাপাশি চীনের অন্যতম প্রধান ধর্মে পরিণত হয় (Hansen, 2012)।

কাগজ (Paper) আবিষ্কার ছিল হান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। এর আগে মানুষ লিখত বাঁশের চাটাই বা রেশমের কাপড়ে, যা ছিল বেশ ব্যয়বহুল এবং ভারী ও ব্যবহার করতে অস্বস্তিকর। কাগজ আবিষ্কারের ফলে জ্ঞানচর্চা এবং তথ্য সংরক্ষণ অনেক সহজ হয়ে গেল। এই যুগেই সিমা চিয়ান (Sima Qian)-এর মতো মহান ইতিহাসবিদ ‘রেকর্ডস অফ দ্য গ্র্যান্ড হিস্টোরিয়ান’ (Records of the Grand Historian) রচনা করেন, যা চীনের ইতিহাস রচনার মডেল হয়ে ওঠে। হান যুগ চীনের পরিচিতি এতটাই দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছিল যে, আজও চীনের প্রধান জনগোষ্ঠী নিজেদের ‘হান চাইনিজ’ বলে পরিচয় দেয়।

তাং রাজবংশ (Tang Dynasty, ৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ)

হানদের পতনের পর প্রায় ৪০০ বছরের অস্থিতিশীলতা শেষে তাং রাজবংশ চীনকে আবার এক করে। তাং যুগকে চীনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং বিশ্বজনীন (Cosmopolitan) যুগ বলা হয়। এর রাজধানী চ্যাং’আন (Chang’an) ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং উন্নত শহর, যেখানে দশ লক্ষেরও বেশি মানুষের বাস ছিল। সিল্ক রোডের কল্যাণে এখানে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ আসত—পারস্যের বণিক, ভারতের পুরোহিত, জাপানের ছাত্র, মধ্য এশিয়ার সঙ্গীতশিল্পী। এটি ছিল এক সত্যিকারের বহু-সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেখানে নেস্টোরিয়ান খ্রিষ্টধর্ম, জরাথুস্ট্রবাদ, এবং ইসলামের মতো বিদেশি ধর্মগুলোও চর্চা হতো। এই যুগেই চীনে একমাত্র নারী সম্রাট, উ জেতিয়ান (Wu Zetian) শাসন করেছিলেন, যিনি তার বুদ্ধিমত্তা ও কঠোরতার জন্য পরিচিত ছিলেন।

তাং যুগ ছিল কবিতার স্বর্ণযুগ। লি বাই (Li Bai) এবং ডু ফু (Du Fu)-র মতো কবিরা এমন সব কবিতা লিখেছেন, যা আজও চীনা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কাঠ খোদাই করে ছাপার কৌশল (Woodblock Printing) এই সময়েই উন্নত হয়, যা বই তৈরিকে আরও সহজ করে দেয় এবং জ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে। কিন্তু ৭৫৫ সালের আন লুশান বিদ্রোহ (An Lushan Rebellion) এই স্বর্ণযুগের ওপর এক বিরাট আঘাত হানে এবং তাং সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে যায়।

সং রাজবংশ (Song Dynasty, ৯৬০-১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দ)

তাংদের পতনের পর সং রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। সামরিক দিক দিয়ে তারা হয়তো তাংদের মতো শক্তিশালী ছিল না এবং যাযাবরদের আক্রমণে তাদের সাম্রাজ্য ছোট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির দিক থেকে তারা ছিল সবার সেরা। এই যুগকে চীনের ‘রেনেসাঁস’ বলা যায়।

তিনটি যুগান্তকারী আবিষ্কার এই সময়ে হয়:

  • গানপাউডার (Gunpowder): তাওবাদী আলকেমিস্টরা অমরত্বের ওষুধ বানাতে গিয়ে হঠাৎ করে বারুদ আবিষ্কার করে ফেলেন। চীনারা প্রথমে একে আতশবাজি আর উৎসবে ব্যবহার করত, পরে সামরিক কাজে এর ব্যবহার শুরু হয়, যা যুদ্ধের ইতিহাসে বিপ্লব নিয়ে আসে। তারা বোমা, গ্রেনেড এবং এক ধরনের রকেটও তৈরি করেছিল।

  • দিকনির্ণায়ক কম্পাস (Magnetic Compass): সমুদ্রে দিক চেনার জন্য চীনারা চুম্বকের ধর্মকে কাজে লাগিয়ে কম্পাস তৈরি করে, যা নৌ-চলাচলে বিপ্লব নিয়ে আসে এবং বিশ্ব আবিষ্কারের পথ খুলে দেয়।

  • মুভেবল টাইপ প্রিন্টিং (Movable Type Printing): বি শেং (Bi Sheng) নামের এক কারিগর আলাদা আলাদা মাটির অক্ষর বানিয়ে ছাপার এক নতুন কৌশল আবিষ্কার করেন। যদিও চীনে হাজার হাজার অক্ষরের কারণে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়নি, কিন্তু এই প্রযুক্তিই পরে ইউরোপে ছাপাখানার বিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করেছিল।

সং যুগে চীনে এক অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল। তারা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কাগজের মুদ্রা (Paper Money) চালু করে (Gernet, 1962)। তাদের বিশাল নৌবহর বা ‘জাঙ্ক’ (Junks) ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বাণিজ্য করত। শহরগুলো হয়ে উঠেছিল জমজমাট, যেখানে রেস্তোরাঁ, নাট্যশালা আর চায়ের দোকানের ছড়াছড়ি ছিল। এই সময়েই নব্য-কনফুসীয়বাদ (Neo-Confucianism)-এর উদ্ভব হয়, যা বৌদ্ধ ও তাওবাদী চিন্তাকে আত্মস্থ করে কনফুসীয় দর্শনকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।

পণ্ডিতের পথ: পরীক্ষা ব্যবস্থা (The Scholar’s Path: The Examination System)

চীনের শাসনব্যবস্থার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল তার আমলাতন্ত্র (Bureaucracy), যা মেধার ভিত্তিতে পরিচালিত হতো। এই ব্যবস্থার মূলে ছিল ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস এক্সামিনেশন (Imperial Civil Service Examination) বা ‘কেজু’ (Keju)। হান যুগে এর সূচনা হলেও, সং এবং পরবর্তী রাজবংশগুলোর সময়ে এটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।

এই পরীক্ষা ব্যবস্থা যে কারো জন্য, এমনকি একজন সাধারণ কৃষকের ছেলের জন্যও, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার পথ খুলে দিয়েছিল। তত্ত্বগতভাবে এটি ছিল খুবই গণতান্ত্রিক। একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণের জীবন এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো। তাকে শৈশব থেকে কনফুসীয় ক্লাসিকস, যেমন ‘ফোর বুকস অ্যান্ড ফাইভ ক্লাসিকস’, ইতিহাস এবং সাহিত্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হতো। পরীক্ষাগুলো ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং বিভিন্ন ধাপে অনুষ্ঠিত হতো—স্থানীয়, প্রাদেশিক এবং সবশেষে রাজধানীতে সম্রাটের সামনে। দিনের পর দিন পরীক্ষার্থীদের একটি ছোট, জানালাবিহীন কুঠুরির মধ্যে বসে থেকে প্রশ্নের উত্তর লিখতে হতো। হাজার হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র কয়েকজন উত্তীর্ণ হতো। যারা সর্বোচ্চ স্তরের পরীক্ষায় পাশ করত, তারা ‘জিনশি’ (Jinshi) উপাধি পেত এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা বা ‘ম্যান্ডারিন’ (Mandarin) হিসেবে নিযুক্ত হতো।

এই পরীক্ষা ব্যবস্থা চীনকে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি স্থিতিশীল এবং শিক্ষিত শাসকশ্রেণী উপহার দিয়েছিল। এটি সামাজিক গতিশীলতা (Social Mobility) তৈরি করেছিল এবং জন্মপরিচয়ের চেয়ে শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। তবে এর একটি নেতিবাচক দিকও ছিল। পরীক্ষার্থীরা কেবল নির্দিষ্ট কিছু ক্লাসিক বই মুখস্থ করায় ব্যস্ত থাকত, ফলে তাদের মধ্যে সৃজনশীলতা বা বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। এই ব্যবস্থা এমন এক শাসকগোষ্ঠী তৈরি করেছিল, যারা নৈতিক ও সাহিত্যিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হলেও প্রায়োগিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানে পিছিয়ে ছিল (Miyazaki, 1976)।

বহিরাগতদের শাসন: মোঙ্গল ও মাঞ্চু (Rule by Outsiders: Mongols and Manchus)

চীনের বিশাল সভ্যতা আর সম্পদ সবসময়ই উত্তরের যাযাবরদের আকর্ষণ করেছে। এদের মধ্যে দু’বার তারা পুরো চীন দখল করতে সক্ষম হয়েছিল।

ইউয়ান রাজবংশ (Yuan Dynasty, ১২৭১-১৩৬৮): উত্তর থেকে আসা মোঙ্গলরা ছিল ভয়ংকর যোদ্ধা। চেঙ্গিস খানের (Genghis Khan) নেতৃত্বে তারা বিশ্বজয়ে বেরিয়েছিল। তার নাতি কুবলাই খান (Kublai Khan) সং রাজবংশকে পরাজিত করে পুরো চীন দখল করে নেন এবং ইউয়ান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রথম কোনো অ-চীনা শক্তি পুরো চীন শাসন করল।

মোঙ্গলরা চীনাদের থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখত। তারা একটি চার-শ্রেণির সামাজিক কাঠামো তৈরি করে, যেখানে মোঙ্গলরা ছিল শীর্ষে, তারপর অন্যান্য বিদেশি মিত্ররা, তারপর উত্তর চীনের হানরা এবং সবশেষে দক্ষিণ চীনের হানরা। তারা চীনাদের উচ্চ সরকারি পদে নিয়োগ দিত না এবং তাদের সাথে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করত না। কুবলাই খান বেইজিংকে (তৎকালীন দাদু) রাজধানী বানান। তিনি একজন দক্ষ শাসক ছিলেন এবং তার সময়ে চীনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল, যাকে ‘প্যাক্স মঙ্গোলিকা’ (Pax Mongolica) বলা হয়। তার সময়েই ভেনিসের বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো (Marco Polo) চীনে আসেন এবং প্রায় ১৭ বছর সেখানে কাটান। তার ভ্রমণকাহিনি ইউরোপীয়দের কাছে চীনের এক রহস্যময় ও ঐশ্বর্যশালী ছবি তুলে ধরে (Polo, 1958)। মোঙ্গল শাসন এক শতাব্দীরও কম সময় স্থায়ী হয়েছিল। চীনারা তাদের বিদেশি শাসক হিসেবেই দেখত এবং ১৩৬৮ সালে এক কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের পতন ঘটে।

চিং রাজবংশ (Qing Dynasty, ১৬৪৪-১৯১২): মিং রাজবংশের পতনের পর উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসা মাঞ্চুরা (Manchu) চীন দখল করে এবং চিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। এটিই ছিল চীনের সর্বশেষ রাজবংশ। মাঞ্চুরা মোঙ্গলদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান ছিল। তারা চীনা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে এবং কনফুসীয় দর্শন অনুযায়ী দেশ শাসন করে। তবে নিজেদের পরিচয় বজায় রাখতে তারা পুরুষদের মাঞ্চু রীতি অনুযায়ী চুল বাঁধতে (Queue hairstyle) বাধ্য করেছিল, যা ছিল তাদের আনুগত্যের প্রতীক। যারা এই আদেশ মানত না, তাদের শিরশ্ছেদ করা হতো।

চিং শাসনামলের প্রথম দিকে কাংজি (Kangxi) এবং চিয়ানলং (Qianlong)-এর মতো মহান সম্রাটদের অধীনে চীন শান্তি ও সমৃদ্ধি দেখেছিল এবং এর সাম্রাজ্য আকারে সবচেয়ে বড় হয়েছিল। কাংজি এবং চিয়ানলং দুজনেই শিল্প-সাহিত্যের বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাদের সময়েই বিশাল সব গ্রন্থ সংকলিত হয়। কিন্তু ১৮ শতকের শেষ দিক থেকে তাদের পতন শুরু হয়। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, দুর্নীতি এবং অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সাম্রাজ্যকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই বাইরের বিশ্ব থেকে নতুন আঘাত আসে।

প্রাচীরের আড়ালে এবং বাইরের বিশ্বের আঘাত (Isolation and the Impact of the West)

মোঙ্গলদের তাড়িয়ে দিয়ে যে মিং রাজবংশ (Ming Dynasty, ১৩৬৮-১৬৪৪) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা ছিল হান চাইনিজ এবং তাদের লক্ষ্য ছিল চীনের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা। তারা বেইজিংয়ে সুবিশাল ফরবিডেন সিটি (Forbidden City) বা নিষিদ্ধ নগরী নির্মাণ করে। এই নিষিদ্ধ নগরী কেবল ইঁট-পাথরের দালান ছিল না; এটা ছিল স্বর্গ আর পৃথিবীর মধ্যে এক সংযোগস্থল, যেখানে সম্রাট ‘স্বর্গের পুত্র’ (Son of Heaven) হিসেবে বাস করতেন। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ছাদের কার্নিশ, প্রতিটি রঙ—সবকিছুর পেছনে ছিল গভীর মহাজাগতিক দর্শন। এই সময়েই চীনের মহাপ্রাচীরকে মেরামত করে আজকের রূপ দেওয়া হয়।

মিং যুগের এক বিস্ময়কর অধ্যায় হলো অ্যাডমিরাল ঝেং হে-র (Admiral Zheng He) সমুদ্রযাত্রা। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সালের মধ্যে তিনি বিশাল নৌবহর (‘ট্রেজার ফ্লিট’) নিয়ে সাতবার ভারত মহাসাগরে অভিযান চালান। তার জাহাজগুলো ছিল কলম্বাসের জাহাজের চেয়ে কয়েক গুণ বড়। তিনি পূর্ব আফ্রিকা, আরব উপদ্বীপ এবং ভারত পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। এই অভিযানগুলো যদি চলতে থাকত, তাহলে হয়তো বিশ্বের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হতো। কিন্তু কনফুসীয় পণ্ডিতদের পরামর্শে সম্রাট এই ব্যয়বহুল অভিযান বন্ধ করে দেন। তারা মনে করত, চীনের বাইরের বিশ্বের কাছ থেকে শেখার কিছু নেই। চীন ধীরে ধীরে নিজেকে বাকি বিশ্ব থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে (Levathes, 1994)।

এই বিচ্ছিন্নতাই পরে কাল হয়ে দাঁড়ায়। চিং রাজবংশের শেষ দিকে শিল্প বিপ্লবে বলীয়ান ইউরোপীয় শক্তিগুলো চীনের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। ব্রিটিশরা চীনের চা আর রেশমের বিনিময়ে দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে অবৈধভাবে ভারতে উৎপাদিত আফিম (Opium) চীনে বিক্রি করতে শুরু করে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ চীনা নাগরিক আফিমে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং দেশের রুপা বিদেশে পাচার হতে থাকে। যখন চিং সরকার আফিম বাণিজ্য বন্ধ করার চেষ্টা করে, তখন ব্রিটিশরা যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধই কুখ্যাত প্রথম আফিম যুদ্ধ (First Opium War, ১৮৩৯-১৮৪২) নামে পরিচিত।

যুদ্ধে হেরে গিয়ে চীনকে নানকিং চুক্তির (Treaty of Nanking) মতো অসম চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়, যা তাদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে। তাদের হংকং ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে হয় এবং বাণিজ্যের জন্য পাঁচটি বন্দর খুলে দিতে হয়। এই সময়টিকে চীনারা ‘শতবর্ষের অবমাননা’ (Century of Humiliation) বলে মনে করে (Spence, 1990)। এরপর দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ, চীন-জাপান যুদ্ধ এবং অন্যান্য বৈদেশিক শক্তির ক্রমাগত চাপে চীন প্রায় একটি আধা-উপনিবেশে পরিণত হয়। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, যেমন তাইপিং বিদ্রোহ (Taiping Rebellion), যা ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধগুলোর একটি, এবং বক্সার বিদ্রোহ (Boxer Rebellion), চিং রাজবংশকে আরও দুর্বল করে দেয়। অবশেষে ১৯১২ সালে এক বিপ্লবের মাধ্যমে রাজবংশটি ভেঙে পড়ে এবং চীনের হাজার হাজার বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।

সভ্যতার স্তম্ভসমূহ: যা চীনকে চীন বানিয়েছে (Pillars of Civilization: What Made China, China)

রাজবংশের উত্থান-পতন তো ইতিহাসের বাইরের খোলস। কিন্তু কী সেই জিনিস যা এই সভ্যতাকে হাজার হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছে?

চীনা লিপি ও সাহিত্য (Chinese Writing System and Literature): চীনের ভাষা অঞ্চলভেদে ভিন্ন। ক্যান্টোনিজের সাথে ম্যান্ডারিনের কোনো মিল নেই। কিন্তু তাদের লেখার পদ্ধতি এক। এই চিত্রলিপিভিত্তিক (Logographic) ব্যবস্থাটিই চীনকে ভাষাগত ভিন্নতা সত্ত্বেও সাংস্কৃতিকভাবে এক করে রেখেছে। একজন বেইজিংয়ের মানুষ আর একজন ক্যান্টনের মানুষ একে অপরের কথা না বুঝলেও, একই সংবাদপত্র পড়তে পারত। এই লিপি যেমন জটিল, তেমনি শৈল্পিক। এই লিপিতেই লেখা হয়েছে চীনের মহান সাহিত্যকর্মগুলো। এর মধ্যে চারটি উপন্যাসকে ‘ফোর গ্রেট ক্লাসিক্যাল নভেলস’ (Four Great Classical Novels) বলা হয়: রোমান্স অফ দ্য থ্রি কিংডমস (Romance of the Three Kingdoms), ওয়াটার মার্জিন (Water Margin), জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট (Journey to the West), এবং ড্রিম অফ দ্য রেড চেম্বার (Dream of the Red Chamber)। এই উপন্যাসগুলো চীনের ইতিহাস, সমাজ ও দর্শনের গভীরে প্রোথিত (Hsia, 1968)।

শিল্পকলা ও নন্দনতত্ত্ব (Art and Aesthetics): চীনা শিল্প প্রকৃতির উপাসনা করে। তাদের ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিংয়ে (shan shui, অর্থাৎ পাহাড়-জল) বিশাল পর্বতের নিচে মানুষ আঁকা হয় খুব ছোট করে। এটি তাওবাদী দর্শনের প্রতীক—প্রকৃতির বিশালতার কাছে মানুষ কত ক্ষুদ্র! ক্যালিগ্রাফি (Calligraphy) বা লিপিকলা তাদের কাছে কেবল লেখা নয়, এটি এক প্রকার ধ্যান এবং ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। আর চীনের পোর্সেলিন (Porcelain) বা চিনামাটির বাসন, জেড (Jade) পাথরের কারুকার্য আর রেশমের (Silk) ওপর সূচিশিল্প তো বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তাদের স্থাপত্যকলাও অনন্য, যেখানে ফেং শুই (Feng Shui)-এর নীতি মেনে প্রকৃতি ও মানুষের বাসস্থানের মধ্যে ভারসাম্য আনা হতো। বিখ্যাত ডুগং (dougong) ব্র্যাকেট সিস্টেম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে কাঠের দালানকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করত।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা (Science, Technology, and Medicine): আমরা আগেই চারটি মহান আবিষ্কারের (Four Great Inventions)—কাগজ, ছাপা, বারুদ, এবং কম্পাসের—কথা বলেছি। এগুলো ছাড়াও আকুপাংচার (Acupuncture), মক্সিবাসশন (Moxibustion) ও ভেষজ চিকিৎসায় চীনারা বহু যুগ ধরে পারদর্শী। তাদের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থা (Traditional Chinese Medicine) বা TCM-এর মূলে রয়েছে ‘চি’ (Qi) বা জীবনীশক্তি এবং ‘ইন ও ইয়াং’ (Yin and Yang) বা মহাজাগতিক দ্বৈততার ভারসাম্য রক্ষার ধারণা (Unschuld, 1985)। জ্যোতির্বিদ্যাতেও তাদের জ্ঞান ছিল অবাক করার মতো। তারা নির্ভুলভাবে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করত এবং সূর্যগ্রহণ ও ধূমকেতুর আবির্ভাবের রেকর্ড রাখত, যা শাসনকার্যে শুভ-অশুভ নির্ধারণে ব্যবহৃত হতো (Needham, 1954)।

পরিবার, সমাজ এবং নারীর অবস্থান (Family, Society, and the Role of Women): কনফুসীয় দর্শন অনুযায়ী, পরিবারই হলো সমাজের কেন্দ্র। পিতৃপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা (Ancestor Veneration) এবং গুরুজনদের মান্য করা ছিল বাধ্যতামূলক। এই পারিবারিক কাঠামোই চীনের সমাজকে স্থিতিশীল রেখেছে শত শত বছর ধরে। তবে এই ব্যবস্থা ছিল চরমভাবে পিতৃতান্ত্রিক (Patriarchal)। নারীদের অবস্থান ছিল পুরুষের অধীনে—প্রথমে পিতা, তারপর স্বামী, এবং শেষে পুত্রের। সং রাজবংশের সময় থেকে ফুট-বাইন্ডিং (Foot-binding) বা পা বাঁধার মতো এক নিষ্ঠুর প্রথা চালু হয়, যেখানে ছোটবেলা থেকে মেয়েদের পা শক্ত করে বেঁধে রাখা হতো যাতে তা আর বাড়তে না পারে। ছোট পা সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হলেও এটি নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল এবং তাদের পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছিল। তবে এর মধ্যেও নারীরা পরিবারের ভেতরে যথেষ্ট ক্ষমতা রাখত এবং ইতিহাসে উ জেতিয়ানের মতো শক্তিশালী নারীর উদাহরণও রয়েছে (Ebrey, 1993)।

শেষ কথা: ড্রাগনের নতুন যাত্রা

চৈনিক সভ্যতার গল্পটা শেষ করার মতো নয়। ১৯১২ সালে রাজতন্ত্রের অবসানের পর চীন এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। সান ইয়াত-সেনের (Sun Yat-sen) নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু তারপর আসে গৃহযুদ্ধ, জাপানি আগ্রাসন এবং অবশেষে ১৯৪৯ সালে মাও সেতুং-এর (Mao Zedong) নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লব। একুশ শতকে এসে চীন আবার এক নতুন রূপে বিশ্বের সামনে আবির্ভূত হয়েছে—এক অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে।

হলুদ নদীর স্রোতের মতো এই সভ্যতা এখনো বয়ে চলেছে। এই গল্পে যেমন আছে চিন শি হুয়াং-এর মতো নিষ্ঠুর সম্রাটের হুঙ্কার, তেমনি আছে লাওৎসের মতো দার্শনিকের শান্ত দীর্ঘশ্বাস। আছে মহাপ্রাচীর তৈরির লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ঘাম আর রক্ত, আবার আছে সং রাজবংশের কোনো এক কারিগরের নতুন কিছু আবিষ্কারের নির্মল আনন্দ।

এই সভ্যতা অনেকবার ভেঙেছে, আবার নিজেকে গড়েছে। বাইরের শক্তি এসে শাসন করেছে, কিন্তু দিন শেষে তারাই চীনা সংস্কৃতিতে মিশে গেছে। এই সহনশীলতা (Resilience) আর ধারাবাহিকতাই (Continuity) হলো চৈনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় জাদু। এটা এমন এক ড্রাগন, যা হাজার হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকলেও তার নিঃশ্বাসে বয়ে চলে ইতিহাস, দর্শন আর অসীম বিস্ময়। সেই বিস্ময়ের জগতে একবার প্রবেশ করলে আর বের হওয়া যায় না। কেবল মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয় তার অনন্ত পথচলা।

তথ্যসূত্র

  • Creel, H. G. (1949). Confucius: The Man and the Myth. John Day Company.
  • Ebrey, P. B. (1993). The Inner Quarters: Marriage and the Lives of Chinese Women in the Sung Period. University of California Press.
  • Ebrey, P. B. (2010). The Cambridge Illustrated History of China. Cambridge University Press.
  • Fairbank, J. K., & Goldman, M. (2006). China: A New History. Harvard University Press.
  • Gernet, J. (1962). Daily Life in China on the Eve of the Mongol Invasion, 1250-1276. Stanford University Press.
  • Hansen, V. (2012). The Silk Road: A New History. Oxford University Press.
  • Hsia, C. T. (1968). The Classic Chinese Novel: A Critical Introduction. Columbia University Press.
  • Keightley, D. N. (1999). The Ancestral Landscape: Time, Space, and Community in Late Shang China (ca. 1200-1045 B.C.). Institute of East Asian Studies, University of California, Berkeley.
  • Kohn, L. (2000). Daoism and Chinese Culture. Three Pines Press.
  • Levathes, L. (1994). When China Ruled the Seas: The Treasure Fleet of the Dragon Throne, 1405-1433. Simon & Schuster.
  • Marks, R. B. (2012). China: Its Environment and History. Rowman & Littlefield Publishers.
  • Miyazaki, I. (1976). China’s Examination Hell: The Civil Service Examinations of Imperial China. Yale University Press.
  • Needham, J. (1954). Science and Civilisation in China (Vol. 1). Cambridge University Press.
  • Polo, M. (1958). The Travels of Marco Polo. (R. Latham, Trans.). Penguin Classics.
  • Portal, J. (2007). The First Emperor: China’s Terracotta Army. British Museum Press.
  • Schwartz, B. I. (1985). The World of Thought in Ancient China. The Belknap Press of Harvard University Press.
  • Spence, J. D. (1990). The Search for Modern China. W. W. Norton & Company.
  • Unschuld, P. U. (1985). Medicine in China: A History of Ideas. University of California Press.
  • Waldron, A. (1990). The Great Wall of China: From History to Myth. Cambridge University Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.