অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রদর্শন: পলিটিক্সের পাতায় আঁকা আদর্শ ও বাস্তবতার নকশা

Table of Contents

ভূমিকা: কে এই অ্যারিস্টটল এবং কেন তাঁর ভাবনা এত গুরুত্বপূর্ণ?

আচ্ছা, প্রথমেই আবার একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। অ্যারিস্টটল (Aristotle) – নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিশাল মাপের চিন্তাবিদের ছবি। জন্মেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪ অব্দে, গ্রিসের উত্তরে অবস্থিত ছোট্ট শহর স্ট্যাগাইরাতে (Stagira)। তাঁর বাবা, নিকোম্যাকাস (Nicomachus), ছিলেন ম্যাসিডোনিয়ার তৎকালীন রাজা তৃতীয় অ্যামিন্টাসের (Amyntas III) রাজসভার চিকিৎসক। এই পারিবারিক সূত্রেই হয়তো তিনি ছোটবেলা থেকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের একটা প্রাথমিক ধারণা পেয়েছিলেন। রাজার নাতি, অর্থাৎ ভবিষ্যৎ মহাবীর আলেকজান্ডারের (Alexander the Great) গৃহশিক্ষকও ছিলেন তিনি একটা সময়ে। ভাবা যায়, যে বালক একদিন অর্ধেক পৃথিবী জয় করবে, তার কচি মনে জ্ঞানের প্রথম বীজ বুনেছিলেন আমাদের এই দার্শনিক!

সতেরো বা আঠারো বছর বয়সে তিনি চলে এলেন সেই সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থান এথেন্সে। ভর্তি হলেন মহাজ্ঞানী প্লেটোর (Plato) বিখ্যাত বিদ্যায়তন ‘একাডেমি’-তে (Academy)। সেখানে তিনি কাটিয়ে দিলেন প্রায় কুড়িটা বছর – প্রথমে ছাত্র হিসেবে, পরে শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে। প্লেটো ছিলেন তাঁর গুরু, তাঁর চিন্তার ওপর প্লেটোর প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু অ্যারিস্টটল শুধু গুরুর প্রতিধ্বনি ছিলেন না। প্লেটো যেখানে ছিলেন মূলত ভাববাদী (Idealistic), বাস্তব জগতের চেয়ে ভাব বা ধারণার জগৎকে (World of Forms/Ideas) বেশি গুরুত্ব দিতেন, সেখানে অ্যারিস্টটল ছিলেন ঘোর বাস্তববাদী (Realistic) এবং অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricist)। তিনি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান আহরণের জন্য আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎটাকেই খুঁটিয়ে দেখতে হবে, তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, সেগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করতে হবে এবং তারপর সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। এই যে একটা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, একটা প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি (Pragmatic approach), এটাই অ্যারিস্টটলকে প্লেটো এবং অন্যান্য পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা করেছে। তিনি শুধু দর্শন নয়, যুক্তিবিদ্যা (Logic), জীববিজ্ঞান (Biology), নীতিশাস্ত্র (Ethics), অধিবিদ্যা (Metaphysics), সাহিত্যতত্ত্ব (Poetics), অলঙ্কারশাস্ত্র (Rhetoric) – জ্ঞানের হেন কোনো শাখা নেই যেখানে তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল না। এজন্যই তাঁকে অনেকে “সর্ববিদ্যার জনক” (The Father of All Sciences) বা সংক্ষেপে “দ্য ফিলোসফার” (The Philosopher) বলেও অভিহিত করেন।

তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “পলিটিক্স” (Politics) রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনার এক আকরগ্রন্থ। এটি কোনো এক বৈঠকে লিখে ফেলা বই নয়, বরং দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা এবং গভীর চিন্তাভাবনার ফসল। জনশ্রুতি আছে, তিনি তাঁর ছাত্রদের সাহায্যে প্রায় ১৫৮টি গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের (City-states বা Polis) সংবিধান বা শাসনতন্ত্র (Constitution) সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছিলেন (Sabine & Thorson, 1973)। চিন্তা করুন, সেই আড়াই হাজার বছর আগে, যখন আজকের মতো ইন্টারনেট বা লাইব্রেরির সুবিধা ছিল না, তখন এমন একটা বিশাল কাজ করাটা কী অসাধ্য সাধন ছিল! এই তুলনামূলক পদ্ধতি (Comparative method) ব্যবহারের কারণেই তাঁকে অনেকে “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক” (Father of Political Science) হিসেবেও স্বীকার করেন।

কিন্তু কেন এত বছর পরেও আমরা অ্যারিস্টটলকে পড়ছি? কারণ, মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলো কিন্তু খুব বেশি পাল্টায়নি। রাষ্ট্র কী? কেন এর প্রয়োজন? কেমন হওয়া উচিত একটা ভালো রাষ্ট্র? নাগরিক কারা? ন্যায়বিচার কী? কেন সমাজে অস্থিরতা বা বিপ্লব (Revolution) দেখা দেয়? এসব শাশ্বত প্রশ্ন নিয়ে তিনি যেভাবে আলোচনা করেছেন, তা আজও আমাদের অবাক করে। তাঁর উত্তরগুলো হয়তো আজকের প্রেক্ষাপটে পুরোপুরি গ্রহণীয় নয়, কিন্তু তাঁর প্রশ্ন তোলার ভঙ্গি, তাঁর বিশ্লেষণের গভীরতা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। তাঁর কথাগুলো শুনলে কখনও মনে হয়, এ তো আমাদের পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের আড্ডারই একটা পরিশীলিত রূপ, আবার কখনও মনে হয়, এ যেন কোনো অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কের বিচক্ষণ পরামর্শ।

যে আঁতুড়ঘরে জন্ম অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রভাবনার: সেকালের গ্রিস ও পূর্বসূরিদের গল্প

রাজনৈতিক প্রভাব

ভূগোল যখন ইতিহাসের মঞ্চ: গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের চালচিত্র: অ্যারিস্টটলের চিন্তাভাবনাকে বুঝতে হলে প্রথমেই ডুব দিতে হবে প্রাচীন গ্রিসের সেই সময়কার রাজনৈতিক মানচিত্রে। আজকের মতো বড় বড় দেশ বা জাতীয় রাষ্ট্র (Nation-state) তখন ছিল না। গ্রিস তখন অসংখ্য ছোট ছোট স্বাধীন নগর-রাষ্ট্রে (Polis / City-state) বিভক্ত ছিল – যেমন এথেন্স, স্পার্টা, করিন্থ, থিবস ইত্যাদি। এই পোলিসগুলো ছিল একেকটা সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ, যাদের নিজস্ব সরকার, নিজস্ব আইন, নিজস্ব সেনাবাহিনী, এমনকি নিজস্ব দেবদেবীও থাকত। আয়তনে ছোট হওয়ায় (সাধারণত একটি শহর ও তার আশেপাশের কৃষিক্ষেত্র নিয়ে গঠিত) এখানকার নাগরিকরা (অবশ্যই সীমিত অর্থে, কারণ নারী, দাস, বিদেশিরা নাগরিক ছিলেন না) প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতে পারতেন, অন্তত কিছু পোলিসে। (Pomeroy et al., 2018)। এই নগর-রাষ্ট্রগুলোর জীবনযাত্রা কিন্তু আজকের দিনের মতো অতটা শান্তশিষ্ট ছিল না। তাদের মধ্যে প্রায়শই লেগে থাকত রেষারেষি, যুদ্ধবিগ্রহ। কখনও এথেন্স স্পার্টার সঙ্গে লড়ছে, তো কখনও থিবস অন্য কারো সঙ্গে। এই যে একটা লাগাতার অস্থিতিশীলতা (Instability), ক্ষমতার রদবদল, আর বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থার উত্থান-পতন – যেমন কোথাও গণতন্ত্র (Democracy), কোথাও অভিজাততন্ত্র (Aristocracy), কোথাও আবার স্বৈরতন্ত্র (Tyranny) – এগুলো অ্যারিস্টটল খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি তো আর ঘরে বসে শুধু বই পড়েননি, রীতিমতো প্রায় ১৫৮টা পোলিসের সংবিধান ঘেঁটেছিলেন বলে শোনা যায়! (Sabine, 1973)। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁর রাষ্ট্রচিন্তাকে একটা পোক্ত ভিত্তি দিয়েছিল।

পেলোপনেশীয় যুদ্ধ ও তার দীর্ঘ ছায়া: অ্যারিস্টটলের জন্মের কিছুকাল আগেই শেষ হয়েছিল গ্রিক বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ – পেলোপনেশীয় যুদ্ধ (Peloponnesian War, 431-404 BCE), যা মূলত এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ছিল। এই যুদ্ধের ফলে এথেন্সের তথাকথিত স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে যায়, গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যেকার ঐক্য নষ্ট হয়ে যায়। একটা দীর্ঘমেয়াদী হতাশা আর রাজনৈতিক অবক্ষয় (Political decay) গ্রাস করে অনেক পোলিসকে। অ্যারিস্টটল যখন বড় হচ্ছেন, তখনও এই যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন সর্বত্র স্পষ্ট ছিল। এই অবক্ষয়, এই ভাঙন তাঁকে নিশ্চয়ই ভাবিয়েছিল – কেন এমন হয়? কীভাবে একটা স্থিতিশীল, ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র গঠন করা যায়? (Kagan, 2003)। তাঁর “পলিটিক্স” (Politics) গ্রন্থে বিপ্লব (Revolution) বা স্ট্যাসিস (Stasis – গৃহবিবাদ, সাংবিধানিক পরিবর্তন) নিয়ে যে বিস্তারিত আলোচনা, তার পেছনে এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একটা বড় ভূমিকা রেখেছে।

পেলোপনেশীয় যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – পেলোপনেসীয় যুদ্ধ: যখন ভাইয়ের বুকে ছুরি চালায় ভাই

ম্যাসিডোনিয়ার উত্থান ও নগর-রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সঙ্কট: অ্যারিস্টটলের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে ম্যাসিডোনিয়ার রাজদরবারে। তিনি ম্যাসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের (Philip II of Macedon) পুত্র, অর্থাৎ ভবিষ্যৎ দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের (Alexander the Great) গৃহশিক্ষক ছিলেন। এই সময়টা ছিল গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতার জন্য এক ক্রান্তিকাল। ম্যাসিডোনিয়া ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল এবং গ্রিক পোলিসগুলোর ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছিল। ফিলিপ ও পরে আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে গ্রিক বিশ্ব এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, যেখানে স্বাধীন নগর-রাষ্ট্রের ধারণাটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। (Cartledge, 2004)। এই যে নগর-রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ওপর একটা বাইরের শক্তির ছড়ি ঘোরানো, এটা অ্যারিস্টটলকে নিশ্চয়ই ভাবিয়েছিল। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা মূলত পোলিস বা নগর-রাষ্ট্র কেন্দ্রিক হলেও, এই বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদী (Imperialistic) শক্তির উত্থান হয়তো তাঁকে রাষ্ট্রের আকার, পরিধি এবং বিভিন্ন প্রকার রাষ্ট্রের সহাবস্থান নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করেছিল। যদিও তাঁর লেখায় এর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন খুব বেশি নেই, তবুও এই পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাঁর মনোজগতে কোনো না কোনোভাবে ছাপ ফেলেছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।

এথেন্সের গণতন্ত্র: কাছ থেকে দেখা এক পরীক্ষা: অ্যারিস্টটল জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন এথেন্সে, প্লেটোর একাডেমিতে। এথেন্স ছিল সেই সময়ের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের (Direct Democracy) এক জীবন্ত পরীক্ষাগার। যদিও অ্যারিস্টটল নিজে এথেন্সের নাগরিক ছিলেন না (তিনি ছিলেন স্ট্যাগাইরার অধিবাসী, যা পরে ম্যাসিডোনিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়), তিনি খুব কাছ থেকে এথেন্সের গণতান্ত্রিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে গণপরিষদে (Assembly) সাধারণ নাগরিকরা তর্কবিতর্ক করে, কীভাবে নেতারা জনমতকে প্রভাবিত করে (কখনও কখনও যাকে আমরা বলি ডেমাগগারি বা Demagoguery), কীভাবে বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হয়। এথেন্সের গণতন্ত্রের কিছু ভালো দিক যেমন ছিল, তেমনি কিছু দুর্বলতাও তাঁর চোখে ধরা পড়েছিল। যেমন, অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা, অযোগ্য লোকের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠের tyranny (Tyranny of the majority) ইত্যাদি। সক্রেটিসের মতো জ্ঞানী মানুষকে এই এথেন্সের গণতন্ত্রই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, এই ঘটনা প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়ের মনেই গভীর দাগ কেটেছিল। (Plato, Apology)। তাই অ্যারিস্টটল যখন তাঁর শাসনতন্ত্রের শ্রেণিবিভাগে গণতন্ত্রকে একটি “বিকৃত” রূপ হিসেবে দেখান (যদিও তাঁর ‘পলিটি’ বা মধ্যতন্ত্রে গণতান্ত্রিক উপাদান ছিল), তার পেছনে এথেন্সের বাস্তব অভিজ্ঞতা একটা বড় কারণ ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, লাগামহীন বা উচ্ছৃঙ্খল গণতন্ত্র রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

এথেনীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – এথেনীয় গণতন্ত্র: গণতন্ত্রের সেই আশ্চর্য প্রদীপ

চিন্তার পরম্পরা: যে দার্শনিকদের কাঁধে দাঁড়িয়ে অ্যারিস্টটল

শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতিই নয়, অ্যারিস্টটলের চিন্তার জগৎ তৈরিতে তাঁর পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক দার্শনিকদেরও একটা বিশাল অবদান ছিল। তিনি তো আর শূন্য থেকে শুরু করেননি, বরং তাঁর আগে যারা ভেবেছেন, লিখেছেন, তাঁদের কাজকে তিনি আত্মস্থ করেছেন, সমালোচনা করেছেন, এবং তার ভিত্তিতে নিজের দর্শনকে দাঁড় করিয়েছেন।

  • সক্রেটিস (Socrates, c. 470-399 BCE): জ্ঞান ও সদ্গুণের অন্বেষণ: সরাসরি কোনো গ্রন্থ রচনা না করলেও, সক্রেটিস ছিলেন গ্রিক দর্শনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর অবিরাম প্রশ্ন (“সক্রেটিয় পদ্ধতি” বা Socratic Method), সদ্গুণই (Virtue) জ্ঞান এই ধারণা, এবং “নিজেকে জানো” (Know thyself) – এই আহ্বানগুলো পরবর্তী প্রজন্মের দার্শনিকদের profundamente প্রভাবিত করেছিল। সক্রেটিসই প্রথম নৈতিক প্রশ্নগুলোকে দর্শনের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য এবং আইনের শাসনের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা (যা তাঁর মৃত্যুদণ্ড গ্রহণের সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রতিফলিত) অ্যারিস্টটলের চিন্তাতেও ছায়া ফেলেছে। অ্যারিস্টটলও বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের সদ্গুণসম্পন্ন করে তোলা এবং একটি ভালো জীবন (Good life) যাপনে সহায়তা করা। (Taylor, 1991)।

  • প্লেটো (Plato, c. 428-348 BCE): গুরু ও প্রতিপক্ষ: অ্যারিস্টটলের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব যদি কারো থেকে থাকে, তিনি হলেন তাঁর গুরু প্লেটো। প্রায় কুড়ি বছর অ্যারিস্টটল প্লেটোর একাডেমিতে কাটিয়েছেন। প্লেটোর “রিপাবলিক” (The Republic), “স্টেটসম্যান” (Statesman) এবং “লজ” (The Laws) – এই গ্রন্থগুলোতে যে রাষ্ট্রদর্শনের অবতারণা করা হয়েছে, তা অ্যারিস্টটলের জন্য ছিল এক বিরাট আলোচনার ক্ষেত্র। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের (Ideal State) ধারণা, দার্শনিক রাজার (Philosopher King) তত্ত্ব, ন্যায়বিচারের (Justice) স্বরূপ, শিক্ষার গুরুত্ব, এমনকি সম্পত্তির সাম্যবাদী (Communistic) ধারণা (অভিভাবক শ্রেণির জন্য) – এগুলো সবই অ্যারিস্টটলকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। (Plato, Republic)।

    কিন্তু অ্যারিস্টটল সবকিছু অন্ধভাবে মেনে নেননি। তিনি প্লেটোর অনেক ভাববাদী (Idealistic) ও কাল্পনিক ধারণার সমালোচনা করেছেন। যেমন, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রকে তিনি অবাস্তব মনে করতেন। সম্পত্তির সাম্যবাদ বা পরিবারের বিলোপসাধনকেও তিনি মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির পরিপন্থী বলে মনে করতেন। প্লেটো যেখানে ছিলেন মূলত অবরোহী (Deductive) পদ্ধতির অনুসারী, অ্যারিস্টটল সেখানে ছিলেন আরোহী (Inductive) ও পর্যবেক্ষণমূলক (Observational) পদ্ধতির ওপর বেশি আস্থাশীল। প্লেটো যেখানে “ভাবলোক” বা “ফর্মের জগৎ”-কে (World of Forms/Ideas) বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, অ্যারিস্টটল সেখানে এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব জগৎটাকেই জ্ঞানের উৎস হিসেবে দেখেছেন। (Barnes, 1995)।

    তবে, প্লেটোর ঋণ অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। রাষ্ট্রের নৈতিক উদ্দেশ্য, সুনাগরিক তৈরি, আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা (বিশেষত প্লেটোর “লজ” গ্রন্থে) – এসব বিষয়ে প্লেটোর চিন্তার ছাপ অ্যারিস্টটলের ওপর স্পষ্ট। প্লেটো যেন একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন, আর অ্যারিস্টটল সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন নিজের মতো করে, বাস্তবতার নিরিখে।

    প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা: একটি আদর্শ রাষ্ট্রের খোঁজে

  • সোফিস্টগণ (The Sophists, 5th century BCE): যুক্তির কারিগর ও প্রচলিত ধারণার সমালোচক: সক্রেটিস ও প্লেটোর আগে, গ্রিক বিশ্বে একদল পরিব্রাজক শিক্ষক ছিলেন, যাঁরা সোফিস্ট নামে পরিচিত। প্রোটাগোরাস (Protagoras), গর্জিয়াস (Gorgias), থ্র্যাসিমেকাস (Thrasymachus) প্রমুখ সোফিস্টরা কোনো সুসংহত দর্শন প্রচার না করলেও, তাঁরা মানুষের প্রচলিত ধারণা, নৈতিকতা ও আইনকানুন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শিখিয়েছিলেন। তাঁরা অলঙ্কারশাস্ত্র (Rhetoric) ও তর্কশাস্ত্রের (Dialectic) ওপর জোর দিতেন এবং অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দিতেন কীভাবে রাজনৈতিক জীবনে সফল হওয়া যায়। প্রোটাগোরাসের সেই বিখ্যাত উক্তি – “মানুষই সকল বস্তুর পরিমাপক” (Man is the measure of all things) – আপেক্ষিকতাবাদের (Relativism) ইঙ্গিত দেয়। (Guthrie, 1971)।

    প্লেটো ও অ্যারিস্টটল উভয়েই সোফিস্টদের এই আপেক্ষিকতাবাদ ও নৈতিক সুবিধাবাদের সমালোচনা করেছেন। তাঁরা একটি সার্বজনীন ও শাশ্বত সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোফিস্টদের উত্থাপিত প্রশ্নগুলো – যেমন, আইন কি প্রকৃতিগত (By nature / Physis) নাকি প্রথাগত (By convention / Nomos)? ন্যায়বিচার কি শক্তিমানের স্বার্থ (Interest of the stronger)? – এগুলো এরিস্টটলকেও ভাবিয়েছে। সোফিস্টরা যে বিতর্ক ও আলোচনার আবহ তৈরি করেছিলেন, তা দর্শনের বিকাশের জন্য খুবই জরুরি ছিল।

  • অন্যান্য পূর্বসূরি (Other Predecessors): এছাড়াও, থেলিস (Thales), অ্যানাক্সিমান্ডার (Anaximander), হেরাক্লিটাস (Heraclitus), পারমেনাইডিস (Parmenides) প্রমুখ প্রাক-সক্রেটিস দার্শনিকদের জগৎ ও প্রকৃতি সম্পর্কিত অনুসন্ধানগুলো দর্শনের একটি যুক্তিনিষ্ঠ ভিত্তি তৈরি করেছিল। যদিও তাঁদের কাজ সরাসরি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ছিল না, কিন্তু তাঁদের বিশ্ববীক্ষা ও জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) পরবর্তীকালের চিন্তাবিদদের প্রভাবিত করেছিল। যেমন, হেরাক্লিটাসের পরিবর্তনশীলতার (Flux) ধারণা এবং পারমেনাইডিসের অপরিবর্তনীয় সত্তার (Being) ধারণা – এই দুই বিপরীতমুখী চিন্তা দর্শনের অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

সব মিলিয়ে অ্যারিস্টটল: এক সংশ্লেষণের নাম

তাহলে দেখা যাচ্ছে, অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নয়, বরং এটি একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক ও দার্শনিক অভিযাত্রার ফসল। একদিকে ছিল গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের উত্থান-পতন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর বিভিন্ন শাসনব্যবস্থার বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অন্যদিকে ছিল সক্রেটিস, প্লেটো, সোফিস্ট এবং আরও অনেক চিন্তাবিদের রেখে যাওয়া অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডার।

অ্যারিস্টটল এই দুটোকেই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। তিনি প্লেটোর মতো শুধু কল্পনার জগতে বিচরণ করেননি, আবার নিছক তথ্য সংগ্রাহকও ছিলেন না। তিনি বাস্তব পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, পূর্বসূরিদের ভাবনাকে বিশ্লেষণ করেছেন, এবং তারপর নিজের যুক্তিবাদী মনন দিয়ে সেগুলোকে সংশ্লেষণ (Synthesize) করে এক নতুন ও প্রায়োগিক (Pragmatic) রাষ্ট্রদর্শনের জন্ম দিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন, রাষ্ট্র শুধু টিকে থাকার জন্য নয়, বরং নাগরিকদের “ভালো জীবন” নিশ্চিত করার জন্য। আর এই ভালো জীবনের জন্য প্রয়োজন একটি স্থিতিশীল, ন্যায়পরায়ণ এবং সুশাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা।

তাঁর এই অন্বেষণ আজও আমাদের পথ দেখায়। যখন আমরা আজকের পৃথিবীর জটিল রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর দিকে তাকাই, তখন অ্যারিস্টটলের সেই দূরদর্শী চিন্তাগুলো নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তিনি যেন সেই ধ্রুবতারা, যা ঝড়ের রাতে নাবিককে সঠিক পথের দিশা দেয়। তাঁর ভাবনাগুলো বুঝতে হলে, তাঁর বেড়ে ওঠার পরিবেশটাকেও একটু তলিয়ে দেখা দরকার, ঠিক যেমন একটা ফলের স্বাদ নিতে হলে তার গাছটাকেও চেনা ভালো।

অ্যারিস্টটলের পদ্ধতি: বাস্তবতার নিরিখে জ্ঞানার্জন

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তা বুঝতে হলে তাঁর জ্ঞানার্জনের পদ্ধতিটা একটু জেনে নেওয়া দরকার। প্লেটো যেখানে মূলত অবরোহী পদ্ধতি (Deductive method) অর্থাৎ সাধারণ সত্য থেকে বিশেষ সত্যে উপনীত হতেন, সেখানে অ্যারিস্টটল ব্যবহার করতেন আরোহী পদ্ধতি (Inductive method) এবং পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি (Observational method)। তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে সেটিকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তারপর একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে আসতে হবে। জীববিজ্ঞানে তিনি যেমন অসংখ্য প্রাণী পর্যবেক্ষণ করে তাদের শ্রেণিবিন্যাস করেছিলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও তেমনি বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রের সংবিধান বিশ্লেষণ করে তাদের ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরেছেন।

তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হলো টেলিয়োলজিক্যাল (Teleological) বা উদ্দেশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি মনে করতেন, প্রত্যেক বস্তুর বা সত্তার একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য (Telos বা End) রয়েছে, এবং সেই উদ্দেশ্য পূরণেই তার সার্থকতা। যেমন, একটা বীজের উদ্দেশ্য হলো পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষে পরিণত হওয়া। তেমনি, মানুষের উদ্দেশ্য হলো তার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলোর পূর্ণ বিকাশ ঘটানো এবং একটি “ভালো জীবন” (Good life) বা ইউডাইমোনিয়া (Eudaimonia) লাভ করা। আর রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো এই ভালো জীবন লাভে তার নাগরিকদের সহায়তা করা। (Aristotle, Politics, Book I, Chapter 2)। এই উদ্দেশ্যবাদী চিন্তা তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি: মানুষ কেন একা থাকতে পারে না? “রাজনৈতিক জীব” ধারণার বিস্তার

অ্যারিস্টটলের সেই বিখ্যাত উক্তি – “মানুষ স্বভাবতই একটি রাজনৈতিক জীব” (Man is by nature a political animal / Zoon Politikon) (Aristotle, Politics, Book I, Chapter 2) – এর চেয়ে সহজ অথচ গভীর কথা আর কী হতে পারে? এর মানে কী? এর মানে হলো, মানুষ একা একা বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করার জন্য জন্মায়নি। তার প্রকৃতিই এমন যে সে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চায়, একটা বৃহত্তর সমাজের অংশ হতে চায়। শুধু তাই নয়, তার মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ, তার ভেতরের গুণাবলির চরম উৎকর্ষ – এগুলো সমাজের বাইরে, রাষ্ট্রের বাইরে সম্ভব নয়। যে মানুষ সমাজ ছাড়া বাঁচতে পারে, বা যার সমাজ প্রয়োজন হয় না, সে হয় পশু, না হয় দেবতা (Either a beast or a god)।

তিনি রাষ্ট্রের উৎপত্তিকে কোনো আকস্মিক ঘটনা বা নিছক চুক্তির (Social contract) ফল হিসেবে দেখেননি, যেমনটা পরবর্তীকালে হব্‌স, লক বা রুশো বলেছেন। অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র হলো একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান (Natural institution), যা মানুষের প্রকৃতির ভেতর থেকেই ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তনের ধারাটা তিনি খুব সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন:

  • ১. পরিবার (Family / Oikos): এই বিবর্তনের প্রথম ধাপ হলো পরিবার। নারী ও পুরুষের স্বাভাবিক জৈবিক আকর্ষণ, সন্তান উৎপাদনের প্রবৃত্তি এবং বংশরক্ষার তাগিদ থেকে পরিবারের সৃষ্টি। পরিবার শুধু জৈবিক প্রয়োজনই মেটায় না, স্নেহ-ভালোবাসা, নিরাপত্তা এবং দৈনন্দিন কিছু অর্থনৈতিক প্রয়োজনও পূরণ করে। পরিবারের প্রধান সাধারণত বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ। এটি হলো সমাজের ক্ষুদ্রতম এবং মৌলিক একক।
  • ২. গ্রাম (Village / Kome): কয়েকটি পরিবার যখন কাছাকাছি বসবাস করতে শুরু করে এবং তাদের প্রয়োজনগুলো আরও ভালোভাবে মেটানোর জন্য একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে, তখন গড়ে ওঠে গ্রাম। গ্রামে শ্রমবিভাগ (Division of labor) কিছুটা স্পষ্ট হয়, নিরাপত্তা বাড়ে এবং পারস্পরিক আদান-প্রদান সহজ হয়। গ্রাম কয়েকটি পরিবারের সমষ্টি, যা পরিবারের চেয়ে বৃহত্তর কিন্তু রাষ্ট্রের চেয়ে ক্ষুদ্রতর।
  • ৩. রাষ্ট্র বা নগর-রাষ্ট্র (Polis / City-state): কয়েকটি গ্রাম একত্রিত হয়ে যখন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ (Self-sufficient / Autarkes) জনসমষ্টি তৈরি করে, যারা কেবল বেঁচে থাকার (Mere life) মৌলিক প্রয়োজনগুলোই নয়, বরং একটি “ভালো জীবন” (Good life / Eu Zen) যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে, তখনই তাকে বলে রাষ্ট্র বা পোলিস। (Aristotle, Politics, Book I, Chapter 2)। অ্যারিস্টটলের সময়ের গ্রিসে এই পোলিসগুলো ছিল ছোট ছোট নগর-রাষ্ট্র, যেমন এথেন্স, স্পার্টা ইত্যাদি।

লক্ষ্য করুন, অ্যারিস্টটলের কাছে রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন নয়। এগুলো অবশ্যই দরকার, কিন্তু এগুলো গৌণ। রাষ্ট্রের প্রধান এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো তার নাগরিকদের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ (Moral and intellectual development) ঘটানো, তাদের মধ্যে সদ্গুণ (Virtue) জাগিয়ে তোলা এবং তাদের “ইউডাইমোনিয়া” বা পরম সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করা। তাই তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “রাষ্ট্রের উদ্ভব জীবনের প্রয়োজনে, কিন্তু এর অস্তিত্ব ভালো জীবনের জন্য।” (The state comes into existence originating in the bare needs of life, and continuing in existence for the sake of a good life.) (Barker, 1959, p. 263)। এই “ভালো জীবন” মানে কিন্তু শুধু ভোগ-বিলাস নয়, বরং যুক্তির অনুশীলন, দর্শনের চর্চা এবং সর্বোপরি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা।

এই প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটল “স্বয়ংসম্পূর্ণতা” বা “Autarky”-র ওপর খুব জোর দিয়েছেন। একটি রাষ্ট্রকে তখনই স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা যাবে, যখন তার নাগরিকদের ভালো জীবনের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবই সে সরবরাহ করতে পারবে – খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, নিরাপত্তা, শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ ইত্যাদি। রাষ্ট্র যদি এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারে, তাহলে সে তার নাগরিকদের ভালো জীবন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হবে।

নাগরিকতা (Citizenship / Politeia): কারা রাষ্ট্রের অংশীদার? যোগ্যতার মাপকাঠি

রাষ্ট্র তো বুঝলাম, কিন্তু এই রাষ্ট্রের নাগরিক (Citizen / Polites) কারা হবেন? আজকের দিনে আমরা জন্মসূত্রে বা কিছু শর্ত পূরণ করে খুব সহজেই কোনো দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে যাই। কিন্তু অ্যারিস্টটলের নাগরিকত্বের ধারণা ছিল বেশ সীমিত এবং সম্ভ্রান্তবাদী (Elitist)। তিনি কিন্তু রাষ্ট্রের সকল বাসিন্দাকে নাগরিকের মর্যাদা দেননি। তাঁর মতে, নাগরিক হলেন তাঁরা, “যাঁরা রাষ্ট্রের বিচারিক ও আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজে (Deliberative and judicial functions) অংশগ্রহণ করার অধিকার ও ক্ষমতা রাখেন।” (Aristotle, Politics, Book III, Chapter 1)। অর্থাৎ, যাঁরা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেন, তাঁরাই প্রকৃত নাগরিক।

এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু শ্রেণির মানুষ নাগরিকের তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন:

  • নারী (Women): অ্যারিস্টটল মনে করতেন, নারীরা প্রকৃতিগতভাবেই আবেগপ্রবণ এবং তাঁদের স্থান মূলত গার্হস্থ্য জীবনে (Household), রাষ্ট্রের জনসাধারণের (Public) পরিসরে নয়। তাঁদের বিচারবুদ্ধি পুরুষদের তুলনায় কম বিকশিত, তাই তাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণের যোগ্য নন। (এটি আজকের দিনে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য একটি ধারণা)।

  • দাস (Slaves): দাসদের তিনি প্রভুর জীবন্ত সম্পত্তি (Living property) বা হাতিয়ার (Tool) হিসেবে গণ্য করতেন। তাঁদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা বিচারবুদ্ধি নেই বলে ধরে নেওয়া হতো, তাই তাঁদের নাগরিক অধিকারের প্রশ্নই ওঠে না। (এ নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা আছে)।

  • শ্রমিক ও কারিগর (Laborers and Artisans): যাঁরা কায়িক শ্রমের (Manual labor) মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন, যেমন কৃষক, শ্রমিক, কারিগর – এঁদেরও তিনি নাগরিক হিসেবে গণ্য করতে রাজি ছিলেন না। তাঁর যুক্তি ছিল, এঁদের সারাদিন গতর খেটে উপার্জন করতে হয়, ফলে তাঁদের রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করার মতো অবসর (Leisure / Schole) বা মানসিকতা থাকে না। ভালো নাগরিক হওয়ার জন্য যে মননশীলতা, শিক্ষা ও যুক্তির অনুশীলন প্রয়োজন, কায়িক শ্রমে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তা থেকে বঞ্চিত।

  • বিদেশি (Foreigners / Metics): যাঁরা অন্য রাষ্ট্র থেকে এসে বসবাস করছেন, তাঁরাও নাগরিক হিসেবে গণ্য হতেন না, কারণ রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের স্বাভাবিক আনুগত্য থাকবে না বলে মনে করা হতো।

  • শিশু ও বৃদ্ধ (Children and the very old): শিশুরা অপরিণত, আর অতি বৃদ্ধরা শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন না।

তাহলে নাগরিক কারা? মূলত, প্রাপ্তবয়স্ক, শিক্ষিত, সচ্ছল পুরুষ, যাঁদের যথেষ্ট অবসর আছে এবং যাঁরা রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেদের মেধা ও শ্রম দিতে প্রস্তুত, তাঁরাই অ্যারিস্টটলের চোখে আদর্শ নাগরিক। নাগরিকের প্রধান গুণ হলো রাষ্ট্রের সংবিধান মেনে চলা এবং শাসক ও শাসিত – উভয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা। অর্থাৎ, একজন ভালো নাগরিক যেমন ভালোভাবে শাসন করতে জানবেন, তেমনি প্রয়োজনে শাসিত হতেও দ্বিধা করবেন না (Rule and be ruled in turn)। (Aristotle, Politics, Book III, Chapter 4)।

অ্যারিস্টটলের নাগরিকত্বের এই ধারণা আজকের গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। তবে, তাঁর এই ধারণার পেছনে একটা যুক্তি ছিল – তিনি চেয়েছিলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো যেন যোগ্য, জ্ঞানী ও নিঃস্বার্থ ব্যক্তিদের হাতেই থাকে, যাঁরা আবেগের বশে বা ব্যক্তিগত স্বার্থে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন না।

দাসপ্রথা (Slavery / Douleia): একটি বিতর্কিত কিন্তু তৎকালীন বাস্তবতার প্রতিফলন?

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার যে বিষয়টি আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত ও নিন্দিত, তা হলো তাঁর দাসপ্রথার প্রতি সমর্থন। তিনি মনে করতেন, দাসপ্রথা একটি প্রাকৃতিক (Natural) এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। তাঁর মতে, কিছু মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই (By nature) দাস হওয়ার জন্য জন্মায়, আর কিছু মানুষ জন্মায় প্রভু (Master) হওয়ার জন্য। যাদের শারীরিক শক্তি বেশি কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা বা যুক্তিবোধ (Reason) কম, তারা স্বাভাবিকভাবেই অন্যের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার জন্য উপযুক্ত। এরা হলো “স্বাভাবিক দাস” (Natural slaves)। এরা প্রভুর জীবন্ত উপকরণ (Living instrument), অনেকটা পোষা প্রাণীর মতো, যারা প্রভুর দৈনন্দিন কাজকর্মে সহায়তা করে এবং প্রভুকে অবসর এনে দেয়, যাতে প্রভু দর্শন চর্চা, শিল্পকলা বা রাষ্ট্রীয় কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন। (Aristotle, Politics, Book I, Chapters 4-7)।

তিনি অবশ্য “প্রথাগত দাসত্বের” (Conventional slavery) কথাও বলেছেন, যেমন যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানো। তবে তাঁর মূল জোর ছিল “স্বাভাবিক দাসত্বের” ওপর। তিনি মনে করতেন, দাস ও প্রভুর সম্পর্ক উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক। দাস যেমন একজন বিচক্ষণ প্রভুর নির্দেশনায় নিজের জীবন ধারণ করতে পারে, তেমনি প্রভুও দাসের শ্রমের দ্বারা উপকৃত হয়ে উচ্চতর কাজে মন দিতে পারেন।

তবে, অ্যারিস্টটল এও স্বীকার করেছেন যে, সব দাসই স্বাভাবিক দাস নয়। অনেকে অন্যায়ভাবে দাসে পরিণত হতে পারে। তিনি এমনকি এও বলেছেন যে, যদি এমন কোনো যন্ত্র (Automated tools) আবিষ্কার করা যেত যা মানুষের কায়িক শ্রমের কাজগুলো করে দিতে পারত – যেমন তাঁত যদি নিজে নিজে কাপড় বুনতে পারত, বা বীণা যদি নিজে নিজে বাজতে পারত – তাহলে হয়তো দাসপ্রথার প্রয়োজন হতো না। (Aristotle, Politics, Book I, Chapter 4)। এই উক্তিতে তাঁর দূরদর্শিতার একটা ক্ষীণ আভাস পাওয়া যায়, কারণ আধুনিক প্রযুক্তি অনেকটা সেই স্বপ্নকেই বাস্তবায়িত করেছে এবং দাসপ্রথার অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।

তা সত্ত্বেও, একজন মহাজ্ঞানী দার্শনিকের কাছ থেকে দাসপ্রথার মতো একটি অমানবিক প্রথার সমর্থন পাওয়াটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এটি নিঃসন্দেহে তাঁর দর্শনের একটি কালো দিক। তবে, আমাদের মনে রাখতে হবে, অ্যারিস্টটল তাঁর সমসাময়িক সমাজের প্রচলিত ধারণা ও প্রথা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যেখানে দাসপ্রথা ছিল একটি স্বীকৃত ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি সেই সময়ের বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, যদিও তা আজকের নৈতিক মানদণ্ডে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

সংবিধান বা শাসনতন্ত্র (Constitution / Politeia): রাষ্ট্রের আত্মা ও তার শ্রেণিবিভাগ

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে সংবিধান বা শাসনতন্ত্রের (গ্রিক ভাষায় “পলিটেয়া”) ধারণা। তিনি সংবিধানকে তুলনা করেছেন রাষ্ট্রের আত্মার (Soul of the state) সাথে। আত্মা যেমন জীবদেহকে পরিচালিত করে এবং তার স্বরূপ নির্ধারণ করে, সংবিধানও তেমনি রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট রূপ দেয় এবং তার কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাঁর মতে, “সংবিধান হলো রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদের, বিশেষত সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী পদের বিন্যাস” (A constitution is the organization of offices in a state, and determines what is to be the governing body, and what is the end of each community) (Aristotle, Politics, Book III, Chapter 6; Book IV, Chapter 1)। সহজ ভাষায় বললে, একটা দেশ কীভাবে চলবে, তার আইনকানুন কী হবে, কে বা কারা দেশ চালাবে, নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য কী হবে – এসব মৌলিক বিষয়গুলোই সংবিধানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। সংবিধান বদলালে রাষ্ট্রের চরিত্রও বদলে যায়।

অ্যারিস্টটল তাঁর সময়ের প্রায় ১৫৮টি নগর-রাষ্ট্রের সংবিধান বিশ্লেষণ করে একটি কালজয়ী শ্রেণিবিভাগ তৈরি করেন। এই শ্রেণিবিভাগটি তিনি দুটো মূল নীতির ওপর ভিত্তি করে করেছিলেন:

  • ১. শাসকের সংখ্যা (Number of rulers): অর্থাৎ, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা কি একজনের হাতে, নাকি অল্প কয়েকজনের হাতে, নাকি বহু মানুষের হাতে ন্যস্ত।
  • ২. শাসনের উদ্দেশ্য (Purpose or End of rule): অর্থাৎ, শাসকরা কি সমগ্র জনগণের বা রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণের (Common good or common interest) জন্য শাসন করছেন, নাকি তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগত স্বার্থ (Selfish interest) চরিতার্থ করার জন্য শাসন করছেন।

এই দুটো নীতিকে একত্র করে তিনি প্রধানত ছয় ধরনের সংবিধান বা সরকারের কথা বলেন – তিনটি “স্বাভাবিক” বা “শুদ্ধ” (Normal/True/Correct) রূপ, যেখানে শাসকরা জনকল্যাণে ব্রতী; এবং এই তিনটি শুদ্ধ রূপেরই তিনটি “বিকৃত” বা “ভ্রষ্ট” (Perverted/Corrupt) রূপ, যেখানে শাসকরা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলে মগ্ন। (Aristotle, Politics, Book III, Chapter 7):

শাসকের সংখ্যা স্বাভাবিক/শুদ্ধ রূপ (সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত) বিকৃত/ভ্রষ্ট রূপ (ব্যক্তিগত/শ্রেণিগত স্বার্থে পরিচালিত)
একজনের শাসন রাজতন্ত্র (Monarchy / Basileia) – জ্ঞানী ও গুণী রাজার জনকল্যাণমূলক শাসন। স্বৈরতন্ত্র (Tyranny / Tyrannis) – উচ্ছৃঙ্খল ও অত্যাচারী শাসকের স্বার্থপর শাসন।
কয়েকজনের শাসন অভিজাততন্ত্র (Aristocracy / Aristokratia) – শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন কিছু ব্যক্তির শাসন। ধনিকতন্ত্র (Oligarchy / Oligarkhia) – মুষ্টিমেয় ধনীর স্বার্থরক্ষাকারী শাসন।
বহুজনের শাসন পলিটি বা মধ্যতন্ত্র (Polity / Politeia) – মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের আইনানুগ শাসন। গণতন্ত্র (Democracy / Demokratia) – দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠের উচ্ছৃঙ্খল ও স্বার্থপর শাসন।

আসুন, এই প্রকারভেদগুলো নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক:

  • রাজতন্ত্র (Monarchy): এটি হলো একজনের শাসন। যখন একজন অসাধারণ গুণসম্পন্ন, জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ ও জনদরদি ব্যক্তি (রাজা বা রানী) সমগ্র জনগণের মঙ্গলার্থে শাসন করেন, তখন তাকে রাজতন্ত্র বলে। এখানে শাসকের লক্ষ্য থাকে প্রজাদের কল্যাণ সাধন করা। অ্যারিস্টটল মনে করতেন, যদি সত্যিই এমন একজন সর্বগুণান্বিত ব্যক্তিকে পাওয়া যায়, তাহলে রাজতন্ত্রই হতে পারে শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে এমন আদর্শ রাজা পাওয়া খুবই দুর্লভ।

  • স্বৈরতন্ত্র (Tyranny): এটি রাজতন্ত্রেরই বিকৃত রূপ। যখন সেই একজন শাসক জনকল্যাণ ভুলে গিয়ে কেবল নিজের ক্ষমতা, ভোগবিলাস ও ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বলপ্রয়োগ ও অত্যাচারের মাধ্যমে শাসন করেন, তখন তাকে স্বৈরতন্ত্র বলে। স্বৈরাচারী শাসক আইনকানুন মানেন না, জনগণের অধিকার হরণ করেন এবং রাষ্ট্রের সম্পদ নিজের খেয়ালখুশিমতো ব্যবহার করেন। এ যেন “এক যে ছিল রাজা” গল্পের সেই অত্যাচারী রাজা, যার ভয়ে রাজ্যের লোক তটস্থ থাকতো। অ্যারিস্টটলের মতে, স্বৈরতন্ত্র হলো নিকৃষ্টতম শাসনব্যবস্থা।

  • অভিজাততন্ত্র (Aristocracy): এটি হলো সমাজের সবচেয়ে যোগ্য, জ্ঞানী, গুণী ও সচ্চরিত্রবান “কয়েকজন” ব্যক্তির সম্মিলিত শাসন। “Aristocracy” শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ “Aristos” (শ্রেষ্ঠ) এবং “Kratos” (শাসন) থেকে, অর্থাৎ “শ্রেষ্ঠদের শাসন”। এঁরা নিঃস্বার্থভাবে রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করেন। অ্যারিস্টটল এটিকে একটি উত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করতেন, তবে এর সমস্যা হলো, বাস্তবে কারা “শ্রেষ্ঠ” তা নির্ধারণ করা কঠিন এবং এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা পরবর্তীতে স্বার্থপর হয়ে উঠতে পারেন।

  • ধনিকতন্ত্র (Oligarchy): এটি অভিজাততন্ত্রের বিকৃত রূপ। যখন রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা কিছু ধনী ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে এবং তারা কেবল নিজেদের ধনসম্পদ বৃদ্ধি ও নিজেদের শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য শাসন পরিচালনা করে, তখন তাকে ধনিকতন্ত্র বলে। এখানে যোগ্যতা বা গুণের চেয়ে অর্থবিত্তই মুখ্য হয়ে ওঠে। ধনিকতন্ত্রে দরিদ্র ও সাধারণ মানুষ শোষিত ও বঞ্চিত হয়, ফলে সমাজে বৈষম্য ও অসন্তোষ বাড়ে।

  • পলিটি (Polity) বা মধ্যতন্ত্র (Constitutional Government): এটি হলো “বহুজন” বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শাসন, তবে তা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং জনকল্যাণমুখী। অ্যারিস্টটলের মতে, এটি গণতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের একটি মিশ্রণ (Mixture of democracy and aristocracy/oligarchy) এবং বাস্তবতার নিরিখে এটিই “শ্রেষ্ঠ বাস্তবসম্মত” (Best practicable) শাসনব্যবস্থা। “পলিটি”তে চরম ধনী ও চরম দরিদ্রের পরিবর্তে মধ্যবিত্ত শ্রেণির (Middle class) প্রাধান্য থাকে। অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি সাধারণত যুক্তিবাদী, মধ্যপন্থী (Moderate) ও স্থিতিশীল হয়। তারা ধনীদের মতো উদ্ধতও নয়, আবার দরিদ্রদের মতো বিদ্রোহীও নয়। তাই তাদের শাসনে রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং বিপ্লবের সম্ভাবনা কমে। পলিটিতে আইনের শাসন (Rule of law) সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে। (Aristotle, Politics, Book IV, Chapters 11-12)। অনেকে এটিকে অ্যারিস্টটলের আদর্শের কাছাকাছি একটি ব্যবস্থা বলে মনে করেন।

  • গণতন্ত্র (Democracy): আজকের দিনে আমরা “গণতন্ত্র” বলতে যা বুঝি (যেমন, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র), অ্যারিস্টটলের গণতন্ত্রের ধারণা কিন্তু তেমন ইতিবাচক ছিল না। তাঁর সময়ের এথেন্সের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে (Direct democracy) প্রায়শই অশিক্ষিত, আবেগপ্রবণ ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা (Mob rule) সংখ্যাধিক্যের জোরে এমন সব সিদ্ধান্ত নিত, যা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতো। নেতারা অনেক সময় জনমোহক নেতা (Demagogue) হয়ে জনগণকে ভুল পথে চালিত করতেন। তাই অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রকে পলিটির একটি বিকৃত রূপ হিসেবে দেখেছেন, যেখানে দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেবল নিজেদের স্বার্থে শাসন করে এবং ধনীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে বা তাদের ওপর অত্যাচার চালায়। তাঁর গণতন্ত্র অনেকটা আজকের “সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ (Majoritarianism)” বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনের কাছাকাছি।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন, কোনো একক শাসনব্যবস্থাই সব পরিস্থিতিতে বা সব সমাজের জন্য চিরকালের জন্য শ্রেষ্ঠ নয়। একটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান, জনগণের চরিত্র, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা সেখানে উপযুক্ত হবে। তবে, সাধারণভাবে তিনি “পলিটি” বা মধ্যতন্ত্রকেই সবচেয়ে স্থিতিশীল ও কাঙ্ক্ষিত শাসনব্যবস্থা হিসেবে সুপারিশ করেছেন, কারণ এটি চরমপন্থা পরিহার করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে সক্ষম।

বিপ্লব (Revolution / Stasis): কেন রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে বা বদলে যায়? তার প্রতিকারই বা কী?

রাষ্ট্র যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে, তেমনি আবার ভেঙেও যেতে পারে বা তার মৌলিক চরিত্র বদলে যেতে পারে। অ্যারিস্টটল এই পরিবর্তন বা বিপ্লব (গ্রিক ভাষায় “Stasis”, যার অর্থ আরও ব্যাপক – গৃহযুদ্ধ, অস্থিরতা, সাংবিধানিক পরিবর্তন ইত্যাদি) নিয়ে অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর “পলিটিক্স” গ্রন্থের পঞ্চম পুস্তক বা অধ্যায়ে। তাঁর কাছে বিপ্লব মানে শুধু সরকার উৎখাত নয়, বরং সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন – যেমন রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ, বা ধনিকতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তর।

বিপ্লবের সাধারণ কারণ

অ্যারিস্টটলের মতে, বিপ্লবের মূল এবং সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো বৈষম্য (Inequality) এবং অন্যায়-অবিচারের অনুভূতি (Feeling of injustice)। (Aristotle, Politics, Book V, Chapter 1)। যখন সমাজের একদল মানুষ মনে করে যে, তারা তাদের যোগ্যতা, অবদান বা অধিকার অনুযায়ী যা প্রাপ্য, তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আর অন্য একদল অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, তখনই তাদের মনে ক্ষোভ, ঈর্ষা ও অসন্তোষ জমা হয়। এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভই একসময় বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দেয়। তিনি বলেছেন, “সমতার আকাঙ্ক্ষা থেকেই বিপ্লবের জন্ম” (The universal and chief cause of this revolutionary feeling has already been mentioned; viz. the desire of equality, when men think that they are equal to others who have more than themselves; or, again, the desire of inequality and superiority, when conceiving themselves to be superior they think that they have not more but the same or less than their inferiors; pretensions which may and may not be just.)।

বিপ্লবের বিশেষ কারণসমূহ

সাধারণ কারণ ছাড়াও, অ্যারিস্টটল আরও কিছু সুনির্দিষ্ট বা বিশেষ কারণের কথা উল্লেখ করেছেন, যা বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রে বিপ্লবের জন্ম দিতে পারে:

  • শাসকদের ঔদ্ধত্য, লোভ ও দুর্নীতি (Insolence, greed, and corruption of rulers): শাসকরা যখন অহংকারী হয়ে ওঠে, জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তখন জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

  • অতিরিক্ত সম্মান বা অসম্মান (Excessive honor or dishonor): যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তার যোগ্যতার চেয়ে বেশি সম্মান বা ক্ষমতা দেওয়া হয়, অথবা কাউকে অন্যায়ভাবে অসম্মানিত বা অধিকারচ্যুত করা হয়, তখন ভারসাম্য নষ্ট হয়।

  • ভয় (Fear): যখন একদল লোক অন্যায় বা শাস্তির ভয়ে ভীত থাকে, অথবা অন্য কোনো শক্তিশালী দলের উত্থানে শঙ্কিত হয়ে পড়ে, তখন তারা আত্মরক্ষার্থে বিপ্লবের পথে যেতে পারে।

  • ঘৃণা ও অবজ্ঞা (Contempt and hatred): যখন শাসক শ্রেণি শাসিতদের ঘৃণা বা অবজ্ঞা করে, অথবা সমাজের এক অংশ অন্য অংশের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে, তখন সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।

  • রাষ্ট্রের কোনো অংশের অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা অতিবৃদ্ধি (Disproportionate growth of a part of the state): যদি রাষ্ট্রের কোনো একটি অঙ্গ বা শ্রেণি অন্যদের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী বা সম্পদশালী হয়ে ওঠে, তাহলে তা সামগ্রিকভাবে (Overall) ভারসাম্য নষ্ট করে এবং বিপ্লবের কারণ হতে পারে।

  • নির্বাচনী চক্রান্ত ও দুর্নীতি (Election intrigues and corruption): নির্বাচনে কারচুপি, স্বজনপ্রীতি বা অসদুপায় অবলম্বন করে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার চেষ্টা করলে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

  • সামান্য বিষয়কে অবহেলা (Negligence of small matters): অনেক সময় ছোটখাটো অন্যায় বা অসঙ্গতিকে উপেক্ষা করা হয়, যা ধীরে ধীরে জমা হতে হতে একসময় বিরাট আকার ধারণ করে এবং বিপ্লবের জন্ম দেয়। “ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল”-এর মতো আরকি!

  • জাতিগত ও শ্রেণিগত বিভেদ (Ethnic and class differences): বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বা সামাজিক শ্রেণির মধ্যে যদি তীব্র বিভেদ ও বিদ্বেষ থাকে, তা থেকেও বিপ্লব আসতে পারে।

  • বিদেশি শক্তির প্রভাব (Influence of foreigners): কখনও কখনও বিদেশি শক্তির মদত বা হস্তক্ষেপেও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়।

  • পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্র (Family feuds and conspiracies): রাজপরিবার বা শাসক পরিবারের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও অনেক সময় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে।

অ্যারিস্টটল বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থায় (যেমন, গণতন্ত্র, ধনিকতন্ত্র, রাজতন্ত্র) বিপ্লবের নির্দিষ্ট কারণগুলোও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন, ধনিকতন্ত্রে বিপ্লব হয় সাধারণত দরিদ্র জনগণের বিদ্রোহের কারণে, যারা ধনীদের শোষণ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর গণতন্ত্রে বিপ্লব হতে পারে ধনী ও অভিজাতদের ষড়যন্ত্রে (যারা সংখ্যাগুরু দরিদ্রদের শাসনে নিজেদের বঞ্চিত মনে করে) অথবা কোনো জনপ্রিয় নেতার (ডেমাগগ) উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে, যিনি জনগণকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করতে চান।

বিপ্লব প্রতিরোধের উপায় (Prevention of Revolution)

শুধু রোগের কারণ নির্ণয় করেই অ্যারিস্টটল ক্ষান্ত হননি, সেই রোগ নিরাময়ের বা প্রতিরোধের উপায়ও বাতলেছেন। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো যেন এক অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র:

  • আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও আনুগত্য সৃষ্টি (Cultivating obedience to law): জনগণকে আইন মেনে চলতে উৎসাহিত করতে হবে, এমনকি ছোটখাটো বিষয়েও। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।

  • নাগরিকদের মধ্যে সমতা ও ন্যায্যতার বোধ জাগানো (Promoting equality and justice): রাষ্ট্রকে চেষ্টা করতে হবে সম্পদ, সম্মান ও ক্ষমতার বণ্টনে যথাসম্ভব ন্যায্যতা ও সমতা (বিশেষত আনুপাতিক সমতা) বজায় রাখতে। বৈষম্য কমাতে হবে।

  • শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন (Reforming and improving education): নাগরিকদের এমনভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হবে যাতে তারা সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, সুনাগরিকের গুণাবলি অর্জন করে এবং রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করে। শিক্ষার মাধ্যমে সংকীর্ণ দলীয় বা শ্রেণিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

  • মধ্যপন্থা অবলম্বন (Adherence to the “golden mean”): কোনো ক্ষেত্রেই চরমপন্থা ভালো নয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় এবং সামাজিক জীবনে একটি ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থা অনুসরণ করতে হবে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিভেদ কমাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে শক্তিশালী করতে হবে।

  • শাসকদের দুর্নীতিমুক্ত, নিঃস্বার্থ ও জনকল্যাণকামী হওয়া (Rulers being non-corrupt, selfless, and dedicated to public good): শাসকরা যদি সৎ, যোগ্য ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হন, তাহলে বিপ্লবের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। তাঁদের দেখাতে হবে যে তাঁরা ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের ভালোর জন্যই কাজ করছেন।

  • রাষ্ট্রের সকল অংশের সুষম উন্নয়ন (Balanced development of all parts of the state): কোনো একটি অংশ যেন অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী বা অবহেলিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

  • ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ এবং ক্ষমতার পৃথকীকরণ (Preventing abuse of power and separation of powers): ক্ষমতা যেন কারো হাতে কুক্ষিগত না হয়ে যায় এবং কেউ যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে, তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্ন সরকারি পদের মেয়াদ সীমিত রাখা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

  • সতর্কতা ও দূরদর্শিতা (Vigilance and foresight): বিপ্লবের ছোটখাটো লক্ষণ দেখা দিলেই শাসককে সতর্ক হতে হবে এবং দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। “সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়” – এই প্রবাদটি এখানে খুব প্রাসঙ্গিক।

  • বহিরাগতদের প্রতি সতর্কতা (Caution regarding outsiders): রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহিরাগতদের নিয়োগ বা তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।

  • বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি (Promoting harmony between different classes): ধনী-দরিদ্র, শাসক-শাসিত – সকল শ্রেণির মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বোঝাপড়া তৈরির চেষ্টা করতে হবে। (Aristotle, Politics, Book V, Chapters 8-9)।

অ্যারিস্টটলের বিপ্লব সম্পর্কিত এই আলোচনা আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়। কারণ, তিনি কেবল বিপ্লবের কারণই দেখাননি, তা থেকে উত্তরণের পথও বাতলেছেন, যা আধুনিক রাষ্ট্রনায়কদের জন্যও শিক্ষণীয়।

আইনের শাসন (Rule of Law / Nomos Basileus): আবেগের ঊর্ধ্বে নৈর্ব্যক্তিক যুক্তি

অ্যারিস্টটল ব্যক্তির শাসনের (Rule of man) চেয়ে আইনের শাসনকে (Rule of law) অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি হলো, “আইন হলো আবেগবর্জিত যুক্তি” (Law is reason unaffected by desire/passion) (Aristotle, Politics, Book III, Chapter 16)। এর মানে কী? এর মানে হলো, একজন ব্যক্তি শাসক যতই জ্ঞানী, গুণী বা সৎ হোন না কেন, তাঁর সিদ্ধান্ত ও কাজে ব্যক্তিগত আবেগ, পছন্দ-অপছন্দ, রাগ-অনুরাগ বা পক্ষপাতিত্ব (Bias) ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। মানুষ হিসেবে তিনি ভুলের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু আইন হলো নৈর্ব্যক্তিক (Impersonal), স্থির এবং সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আইন কোনো ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, বরং তা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

তাই অ্যারিস্টটল মনে করতেন, সুশাসনের জন্য আইনের প্রাধান্য অপরিহার্য। এমনকি শ্রেষ্ঠ শাসকেরও (যদি তিনি মানুষ হন) আইনের অধীনে থাকা উচিত। আইন যেমন নাগরিকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে, তেমনি শাসকের ক্ষমতাকেও সীমিত রাখবে। এতে করে শাসকের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কমবে এবং রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। তিনি প্লেটোর “দার্শনিক রাজা” (Philosopher King)-র ধারণার সঙ্গে পুরোপুরি একমত ছিলেন না, কারণ তিনি মনে করতেন, কোনো একক ব্যক্তি, যতই জ্ঞানী হোন না কেন, আইনের চেয়ে নির্ভরযোগ্য হতে পারেন না। তবে, তিনি এও স্বীকার করেছেন যে, আইন সব পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য নাও হতে পারে বা আইনের ব্যাখ্যা প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে, বিচারক বা শাসকের বিবেচনাবোধ (Discretion) প্রয়োগের সুযোগ থাকবে, কিন্তু সেটাও হবে আইনের কাঠামোর মধ্যে।

আইনের শাসনের এই ধারণা আধুনিক সাংবিধানিকতাবাদের (Constitutionalism) অন্যতম ভিত্তিপ্রস্তর।

সম্পত্তি (Property / Ktema): ব্যক্তিগত মালিকানা, সামাজিক ব্যবহার

সম্পত্তির মালিকানা কেমন হওয়া উচিত – ব্যক্তিগত (Private), রাষ্ট্রীয় (Communal), নাকি অন্য কোনো ধরনের? এ নিয়ে অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটো তাঁর “রিপাবলিক” (Republic) গ্রন্থে একটি বৈপ্লবিক ধারণা দিয়েছিলেন। প্লেটো চেয়েছিলেন, তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের অভিভাবক শ্রেণির (Guardians – অর্থাৎ, শাসক ও সৈনিক) কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা পরিবার থাকবে না, সবই হবে যৌথ বা রাষ্ট্রীয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, যাতে তাঁরা ব্যক্তিগত স্বার্থ বা মোহের ঊর্ধ্বে উঠে নিঃস্বার্থভাবে রাষ্ট্রের সেবা করতে পারেন।

কিন্তু অ্যারিস্টটল এই চরম সাম্যবাদী (Communist) ধারণার সঙ্গে একমত ছিলেন না। তিনি তাঁর “পলিটিক্স” গ্রন্থের দ্বিতীয় পুস্তকে প্লেটোর এই তত্ত্বের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং ব্যক্তিগত মালিকানার পক্ষে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন (Aristotle, Politics, Book II, Chapter 5)। তাঁর মতে:

  • উৎসাহ ও যত্ন (Incentive and care): ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষকে কাজের প্রতি আরও বেশি উৎসাহিত করে। নিজের জিনিস হলে মানুষ তার বেশি যত্ন নেয়, তার উন্নতি সাধনের চেষ্টা করে। “সবার জিনিস কারো জিনিস নয়” – এই মনোভাব তৈরি হলে সম্পত্তির অপচয় ও অবহেলা বাড়ে।

  • উদারতা ও পরোপকার (Generosity and benevolence): ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলেই মানুষ দানধ্যান বা পরোপকারের সুযোগ পায়। যদি সবই রাষ্ট্রের হয়, তাহলে এই সদ্গুণগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকে না।

  • স্বাভাবিক প্রবৃত্তি (Natural instinct): নিজের জন্য কিছু করা বা নিজের অধিকারে কিছু রাখা মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তিকে অস্বীকার করা ঠিক নয়।

  • শৃঙ্খলা ও নির্দিষ্টতা (Order and specificity): ব্যক্তিগত মালিকানা সমাজে একটা শৃঙ্খলা আনে এবং কার কী দায়িত্ব, তা নির্দিষ্ট করে দেয়। যৌথ মালিকানায় প্রায়শই দায়িত্ব নিয়ে ঠেলাঠেলি বা বিরোধ দেখা দেয়।

  • অভিজ্ঞতা (Experience): ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেখানেই সম্পত্তির যৌথ মালিকানার চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেই নানা রকম সমস্যা দেখা দিয়েছে।

তবে, অ্যারিস্টটল লাগামহীন ব্যক্তিগত সম্পত্তির পক্ষেও ছিলেন না। তিনি ব্যক্তিগত মালিকানাকে সমর্থন করলেও, তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার (Social responsibility) কথা বলেছেন। তাঁর আদর্শ ছিল – “সম্পত্তি হবে ব্যক্তিগত, কিন্তু তার ব্যবহার হবে যথাসম্ভব যৌথ” (Property should be private in ownership, but common in use)। অর্থাৎ, মানুষ তার উদ্বৃত্ত সম্পদ বন্ধু-বান্ধব ও সমাজের অন্যান্যদের প্রয়োজনে ব্যবহার করবে, যা সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য বাড়াতে সাহায্য করবে। তিনি মনে করতেন, অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ বা লোভ (Greed) রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। সম্পদের সুষম বণ্টন এবং তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।

এই প্রসঙ্গে তিনি অর্থনীতি (Oikonomia) এবং অর্থবিদ্যা বা ধনবিজ্ঞান (Chrematistics) এর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। ‘Oikonomia’ বা গৃহস্থালি পরিচালনা হলো জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার কলা, যা একটি স্বাভাবিক ও অপরিহার্য কার্যকলাপ। অন্যদিকে, ‘Chrematistics’ হলো নিছক অর্থ উপার্জনের বা সম্পদ জমানোর কলা, বিশেষত সুদ বা অন্যায্য ব্যবসার মাধ্যমে, যার কোনো সীমা নেই। অ্যারিস্টটল এই সীমাহীন অর্থলিপ্সাকে অনৈতিক ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করতেন (Aristotle, Politics, Book I, Chapters 8-11)।

শিক্ষা (Education / Paideia): সুনাগরিক ও সদ্গুণ তৈরির কারখানা

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তায় শিক্ষা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় উপাদান। তিনি মনে করতেন, একটি রাষ্ট্রের উৎকর্ষ নির্ভর করে তার নাগরিকদের উৎকর্ষের ওপর। আর নাগরিকদের উৎকর্ষ অর্জনের প্রধান উপায় হলো সঠিক শিক্ষা। তাই তিনি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে একটি সুপরিকল্পিত ও সার্বজনীন (নাগরিকদের জন্য) শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সবিশেষ জোর দিয়েছেন। “পলিটিক্স” গ্রন্থের অষ্টম (এবং সপ্তম) পুস্তক তিনি মূলত শিক্ষা নিয়েই আলোচনা করেছেন।

তাঁর মতে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো:

  • সুনাগরিক তৈরি করা (To produce good citizens): নাগরিকদের এমনভাবে শিক্ষিত করে তোলা যাতে তারা রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয় এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সঠিকভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।

  • সদ্গুণ (Virtue / Arete) জাগিয়ে তোলা: শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সদ্গুণগুলো (যেমন – সাহস, সংযম, ন্যায়পরায়ণতা, প্রজ্ঞা) বিকশিত করা, যাতে তারা একটি “ভালো জীবন” যাপন করতে পারে।

  • অবসরের সদ্ব্যবহার (Proper use of leisure): নাগরিকদের এমনভাবে প্রশিক্ষিত করা যাতে তারা তাদের অবসর সময়কে গঠনমূলক ও উন্নততর কাজে (যেমন – দর্শন চর্চা, শিল্পকলা, সঙ্গীত) ব্যয় করতে পারে। কায়িক শ্রম থেকে মুক্তি পেলেই যে অবসর সার্থক হবে, তা নয়; সেই অবসরকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেটাও শিক্ষার মাধ্যমেই শিখতে হয়।

  • রাষ্ট্রের প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা (Education consistent with the nature of the state): রাষ্ট্রের সংবিধান বা চরিত্র যেমন হবে (যেমন, গণতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক), শিক্ষাব্যবস্থাকেও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। কারণ, যে ধরনের নাগরিক একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন, শিক্ষা সে ধরনের নাগরিকই তৈরি করবে। (Aristotle, Politics, Book VIII, Chapter 1)।

অ্যারিস্টটল শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে মূলত চারটি জিনিসের কথা বলেছেন:

  • ১. পঠন ও লিখন (Reading and Writing): দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনে এবং জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক সোপান হিসেবে।
  • ২. শরীরচর্চা (Gymnastics): দেহকে সুস্থ, সবল ও সুগঠিত করার জন্য এবং সাহস ও সহিষ্ণুতা অর্জনের জন্য। তবে তিনি অতিরিক্ত বা পেশাদারী মল্লযুদ্ধ বা শরীরচর্চার বিরোধী ছিলেন, যা দেহের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়।
  • ৩. সঙ্গীত (Music): সঙ্গীত কেবল চিত্তবিনোদনের জন্য নয়, বরং এটি মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং নৈতিক চরিত্র গঠনে (Moral education) ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় (Emotional balance) সাহায্য করে। সঙ্গীত আত্মার উন্নতি সাধন করে এবং অবসরের সদ্ব্যবহারের একটি উৎকৃষ্ট উপায়।
  • ৪. অঙ্কন (Drawing – কখনও কখনও এটিকে বাদও দেওয়া হয়): সৌন্দর্যবোধ ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য।

অ্যারিস্টটল শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত শিক্ষার বিভিন্ন স্তর এবং প্রতিটি স্তরের উপযোগী পাঠ্যক্রমেরও একটি রূপরেখা দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষা একটি আজীবন প্রক্রিয়া, তবে বাল্য ও কৈশোরকালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তাঁর শিক্ষাদর্শনে শারীরিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক – এই তিন দিকের সুষম বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

আদর্শ রাষ্ট্র (Ideal State / Eudaimon Polis) বনাম শ্রেষ্ঠ বাস্তবসম্মত রাষ্ট্র (Best Practicable State / Ariste Politeia)

প্লেটোর মতো অ্যারিস্টটলও একটি “আদর্শ রাষ্ট্রের” (Ideal State) কল্পনা করেছেন, যেখানে নাগরিকরা পরিপূর্ণ সুখী ও সার্থক জীবন (Eudaimonia) যাপন করতে পারবে। “পলিটিক্স” গ্রন্থের সপ্তম ও অষ্টম পুস্তকে তিনি এই আদর্শ রাষ্ট্রের একটি চিত্র এঁকেছেন। এই আদর্শ রাষ্ট্রের কিছু বৈশিষ্ট্য হলো:

  • জনসংখ্যা (Population): জনসংখ্যা খুব বেশিও হবে না (যাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়), আবার খুব কমও হবে না (যাতে রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে না পারে)। একটা মাঝারি আকার, যাতে নাগরিকরা একে অপরকে ভালোভাবে চিনতে পারে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা সহজ হয়। তিনি “যত বেশি, তত ভালো” এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।

  • ভূখণ্ড (Territory): ভূখণ্ডও জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এটি এমন হবে যা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য সুবিধাজনক, স্বাস্থ্যকর এবং নাগরিকদের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট উর্বর। সমুদ্রের কাছাকাছি হলে ভালো, যাতে বাণিজ্য ও নৌ-শক্তির সুবিধা পাওয়া যায়, তবে খুব বেশি বাণিজ্যিক হলে আবার নাগরিকদের নৈতিক চরিত্র নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে।

  • নাগরিকদের চরিত্র (Character of citizens): আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকরা হবে গুণী, সাহসী, বুদ্ধিমান ও যুক্তিবাদী। তারা রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকবে এবং সার্বজনীন (Public) কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে।

  • অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Economic system): রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি হবে কৃষি। নাগরিকদের ভরণপোষণের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ রাষ্ট্র নিজেই উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। অতিরিক্ত বাণিজ্য বা শিল্পকে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দেননি।

  • শাসনব্যবস্থা (System of government): আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনভার থাকবে সেইসব নাগরিকদের হাতে, যাঁরা বয়সে প্রবীণ, অভিজ্ঞ এবং সদ্গুণে গুণান্বিত। এটি অনেকটা অভিজাততন্ত্র বা পলিটির কাছাকাছি একটি ব্যবস্থা হবে, যেখানে আইনের শাসন সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে।

তবে অ্যারিস্টটল প্লেটোর মতো শুধু কল্পনার জগতে বিচরণ করেননি। তিনি জানতেন যে, এই ধরনের নিখুঁত আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত কঠিন, প্রায় অসম্ভব। তাই তিনি একটি “শ্রেষ্ঠ বাস্তবসম্মত রাষ্ট্রের” (Best practicable state) ধারণাও দিয়েছেন – অর্থাৎ, এমন একটি শাসনব্যবস্থা যা হয়তো পুরোপুরি আদর্শ নয়, কিন্তু বেশিরভাগ রাষ্ট্রের পক্ষেই তা অর্জন করা সম্ভব এবং যা মোটামুটি স্থিতিশীল ও ন্যায়সঙ্গত একটি সমাজ উপহার দিতে পারে। আর এই শ্রেষ্ঠ বাস্তবসম্মত রাষ্ট্রটিই হলো তাঁর সেই বিখ্যাত “পলিটি” বা মধ্যতন্ত্র, যেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রাধান্য থাকে, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে এবং আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। (Ross, 1995)। পলিটি হলো বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখা এক সুন্দর স্বপ্ন।

ন্যায়বিচার (Justice / Dikaiosyne): বণ্টনের সমতা ও সংশোধনের বিধান – রাষ্ট্রের ভিত্তি

অ্যারিস্টটল ন্যায়বিচারের (Justice) ধারণাকে রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর এবং সামাজিক জীবনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে, ন্যায়বিচার হলো একটি সামাজিক সদ্গুণ (Social virtue), যা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে। ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো রাষ্ট্র দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে না। তিনি তাঁর “নিকোম্যাকিয়ান এথিক্স” (Nicomachean Ethics) গ্রন্থের পঞ্চম পুস্তকে এবং “পলিটিক্স”-এ বিভিন্ন প্রসঙ্গে ন্যায়বিচারের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

অ্যারিস্টটল প্রধানত দুই ধরনের বা অর্থে ন্যায়বিচারের কথা বলেছেন:

১. সার্বিক বা আইনানুগ ন্যায়বিচার (General or Legal Justice): এই অর্থে ন্যায়বিচার মানে হলো আইনের প্রতি আনুগত্য এবং সমাজের সকল প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুন মেনে চলা। যে ব্যক্তি আইন মেনে চলে এবং অপরের প্রতি তার সকল কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে, সে-ই ন্যায়পরায়ণ। এই অর্থে ন্যায়বিচার সকল সদ্গুণের সমষ্টি।

২. বিশেষ ন্যায়বিচার (Particular Justice): এটি আরও নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং এর দুটি প্রধান রূপ রয়েছে:

  • বণ্টনমূলক ন্যায়বিচার (Distributive Justice): এর সম্পর্ক হলো রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, সম্মান, পদমর্যাদা বা সম্পদ নাগরিকদের মধ্যে তাদের যোগ্যতা (Merit), অবদান (Contribution) বা প্রয়োজন অনুযায়ী আনুপাতিক হারে (Proportionately) বণ্টন করা। অর্থাৎ, যে যেমন যোগ্য বা যার যেমন অবদান, সে তেমন পাবে – “সকলকে সমানভাবে নয়, বরং প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অনুযায়ী” (Not equal shares to all, but to each his due)। এখানে জ্যামিতিক সমানুপাত (Geometrical proportion) অনুসরণ করা হয়। যেমন, একজন বীর সেনাপতি আর একজন সাধারণ সৈনিক রাষ্ট্র থেকে একই পরিমাণ সম্মান বা পুরস্কার পাবেন না, যদি তাদের অবদান ভিন্ন হয়। এই ধরনের ন্যায়বিচারের লক্ষ্য হলো সমাজে আনুপাতিক সমতা (Proportional equality) প্রতিষ্ঠা করা। (Aristotle, Nicomachean Ethics, Book V, Chapter 3)।
  • সংশোধনমূলক বা প্রতিদানমূলক ন্যায়বিচার (Corrective or Retributive Justice / Commutative Justice): এর সম্পর্ক হলো ব্যক্তিগত লেনদেন, চুক্তি বা সামাজিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে যদি কোনো অন্যায় বা ক্ষতি সংঘটিত হয়, তাহলে তার প্রতিকার করা এবং ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এখানে গাণিতিক সমতা (Arithmetical equality) অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ, কে কার কতটুকু ক্ষতি করেছে, ঠিক ততটুকুই তাকে পূরণ করতে হবে বা শাস্তি পেতে হবে – এক্ষেত্রে ব্যক্তির যোগ্যতা বা সামাজিক মর্যাদা বিবেচ্য নয়। যেমন, কেউ যদি কারো জিনিস চুরি করে, তাহলে তার শাস্তি হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পাবে। এটি আবার দুই প্রকার হতে পারে:
    • ঐচ্ছিক লেনদেন সংক্রান্ত (Voluntary transactions): যেমন – ক্রয়-বিক্রয়, ঋণ, ভাড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে ন্যায্যতা।
    • অনৈচ্ছিক লেনদেন সংক্রান্ত (Involuntary transactions): যেমন – চুরি, ডাকাতি, অপমান, আঘাত, হত্যা ইত্যাদি অপরাধের বিচার ও শাস্তি। এর লক্ষ্য হলো অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। (Aristotle, Nicomachean Ethics, Book V, Chapter 4)।

অ্যারিস্টটলের ন্যায়বিচারের এই ধারণাগুলো আজও আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল সমাজের জন্য এই উভয় প্রকার ন্যায়বিচারই অপরিহার্য।

বন্ধুত্ব (Friendship / Philia): সামাজিক ঐক্যের আঠা

যদিও সরাসরি রাষ্ট্রচিন্তার অংশ হিসেবে সবসময় বিস্তারিত আলোচিত হয় না, অ্যারিস্টটল “বন্ধুত্ব” বা “ফিলিয়া”-কে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। “নিকোম্যাকিয়ান এথিক্স”-এর অষ্টম ও নবম পুস্তক তিনি বন্ধুত্বের আলোচনাতেই ব্যয় করেছেন। তাঁর মতে, বন্ধুত্ব কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, এটি রাষ্ট্রের ঐক্যের (Social cohesion) জন্যও অপরিহার্য। যেখানে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকে, সেখানে ন্যায়বিচারের প্রয়োজনও কমে যায়।

তিনি তিন ধরনের বন্ধুত্বের কথা বলেছেন:

  • ১. উপযোগিতার বন্ধুত্ব (Friendship of utility): যেখানে একে অপরের কাছ থেকে কোনো সুবিধা বা উপযোগ পাওয়ার জন্য বন্ধুত্ব হয়।
  • ২. আনন্দের বন্ধুত্ব (Friendship of pleasure): যেখানে একে অপরের সঙ্গ আনন্দদায়ক বলে বন্ধুত্ব হয়।
  • ৩. সদ্গুণের বন্ধুত্ব (Friendship of virtue / Perfect friendship): এটিই শ্রেষ্ঠ বন্ধুত্ব, যেখানে দুজন সদ্গুণসম্পন্ন মানুষ একে অপরের ভালো চায় এবং পরস্পরের গুণাবলির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বন্ধুত্ব করে।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন, একটি রাষ্ট্রে যদি নাগরিকদের মধ্যে (বিশেষত সদ্গুণের) বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, তাহলে তারা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, রাষ্ট্রের কল্যাণে একসঙ্গে কাজ করবে এবং সামাজিক ঐক্য আরও সুদৃঢ় হবে। শাসকের উচিত নাগরিকদের মধ্যে এই ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উৎসাহিত করা।

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা: সেকাল ও একাল

অ্যারিস্টটল নিঃসন্দেহে একজন যুগান্তকারী ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ছিলেন, যাঁর ভাবনা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু তাঁর চিন্তাভাবনার কিছু দিক রয়েছে যা আজকের আধুনিক গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের নিরিখে সমালোচিত ও অগ্রহণযোগ্য। এই সীমাবদ্ধতাগুলো স্বীকার করে নিলেও তাঁর সার্বিক অবদান ম্লান হয় না, তবে এগুলো জানা দরকার:

  • নগর-রাষ্ট্রের সংকীর্ণ পরিধি (Limited scope of the Polis): অ্যারিস্টটলের সমগ্র রাষ্ট্রচিন্তা আবর্তিত হয়েছে গ্রিক নগর-রাষ্ট্র বা “পোলিস”-কে কেন্দ্র করে, যা ছিল আয়তনে ছোট এবং জনসংখ্যায় সীমিত। তিনি আধুনিক কালের বিশাল জাতীয় রাষ্ট্র (Nation-state), সাম্রাজ্য (Empire) বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের (International relations) জটিলতা নিয়ে কোনো ধারণা দিতে পারেননি। তাঁর রাষ্ট্রদর্শন তাই অনেকাংশে স্থান-কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ।

  • নাগরিকত্বের সংকীর্ণ সম্ভ্রান্তবাদী ধারণা (Narrow and elitist concept of citizenship): নারী, দাস, শ্রমিক, কারিগর ও বিদেশিদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং কেবল অবসরভোগী, সচ্ছল পুরুষদেরই নাগরিক হিসেবে গণ্য করাটা আজকের দিনে চরম বৈষম্যমূলক ও অগণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত হয়। এটি মানুষের মৌলিক সমতার ধারণার পরিপন্থী।

  • দাসপ্রথার পক্ষে সাফাই (Justification of slavery): “স্বাভাবিক দাসত্বের” মতো একটি অমানবিক প্রথাকে সমর্থন করা এবং তাকে স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় বলে যুক্তি দেওয়া অ্যারিস্টটলের দর্শনের সবচেয়ে কলঙ্কজনক দিক। এটি মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের সম্পূর্ণ বিরোধী।

  • নারীদের প্রতি অত্যন্ত রক্ষণশীল ও অবমাননাকর মনোভাব (Conservative and derogatory attitude towards women): নারীদের তিনি পুরুষের তুলনায় হীন, আবেগপ্রবণ এবং গার্হস্থ্য কাজের জন্যই কেবল উপযুক্ত মনে করতেন। তাদের রাজনৈতিক বা সামাজিক জীবনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে, এটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। এই লিঙ্গবৈষম্যমূলক (Sexist) দৃষ্টিভঙ্গি আজকের সমাজে অচল।

  • “গণতন্ত্র” সম্পর্কে নেতিবাচক ও সীমিত ধারণা (Negative and limited understanding of “Democracy”): তিনি যে গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, তা ছিল মূলত তাঁর সমসাময়িক এথেন্সের প্রত্যক্ষ, লাগামহীন ও উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসন। তাই তিনি গণতন্ত্রকে একটি বিকৃত বা ভ্রষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আজকের আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, যেখানে আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, ক্ষমতার পৃথকীকরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়, তার সঙ্গে অ্যারিস্টটলের গণতন্ত্রের ধারণার মিল খুব কম।

  • অর্থনৈতিক বিষয়ে কিছুটা উদাসীনতা (Relative indifference to economic issues): যদিও তিনি সম্পত্তি ও অর্থ উপার্জনের নীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি, উৎপাদন ব্যবস্থা, বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়কে তিনি যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল, ততটা দেননি। তাঁর ঝোঁক ছিল মূলত রাজনৈতিক ও নৈতিক বিষয়ের প্রতি।

  • পরিবর্তনের প্রতি ভীতি (Fear of change): অ্যারিস্টটল স্থিতিশীলতার ওপর খুব বেশি জোর দিয়েছেন এবং বিপ্লব বা পরিবর্তনকে একটি নেতিবাচক ঘটনা হিসেবে দেখেছেন। যদিও তিনি পরিবর্তনের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। প্রগতি বা সামাজিক উন্নয়নের ধারণা তাঁর চিন্তায় ততটা প্রবল ছিল না।

এই সীমাবদ্ধতাগুলো সত্ত্বেও, অ্যারিস্টটলকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাস আলোচনা করা অসম্ভব। তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, বিশ্লেষণের গভীরতা এবং যৌক্তিক বিন্যাস আজও আমাদের বিস্মিত করে।

উপসংহার: আজও কেন পড়ব অ্যারিস্টটলকে? প্রাসঙ্গিকতা ও উত্তরাধিকার

এতক্ষণ ধরে আমরা অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার নানা অলিগলিতে ঘুরে বেড়ালাম। কখনও তাঁর প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়েছি, কখনও তাঁর সীমাবদ্ধতায় হতাশ হয়েছি। কিন্তু দিনের শেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় – এই আড়াই হাজার বছর পরেও কেন আমরা এই প্রাচীন গ্রিক দার্শনিককে নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করছি? তাঁর চিন্তা কি আজকের এই অত্যাধুনিক যুগেও প্রাসঙ্গিক?

উত্তরটা হলো – হ্যাঁ, বহুলাংশেই প্রাসঙ্গিক। কারণ, অ্যারিস্টটলই প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র ও পদ্ধতিগত শাস্ত্র (Systematic discipline) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রকে নিছক কল্পনা বা ধর্মতত্ত্বের জগৎ থেকে নামিয়ে এনে বাস্তবতার মাটিতে দাঁড় করিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর আরোহী ও পর্যবেক্ষণমূলক পদ্ধতি আধুনিক সমাজবিজ্ঞান গবেষণার অন্যতম ভিত্তি।

তাঁর সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ, বিপ্লবের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কিত বিশ্লেষণ, আইনের শাসনের গুরুত্ব, শিক্ষার ভূমিকা, ন্যায়বিচারের ধারণা, নাগরিকতার তাৎপর্য, মধ্যপন্থা অবলম্বনের পরামর্শ – এগুলো আজও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র ও সমাজতত্ত্বের মৌলিক আলোচনার বিষয়। তিনি শিখিয়েছেন যে, একটি রাষ্ট্র শুধু টিকে থাকার জন্য নয়, বরং তার নাগরিকদের নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামগ্রিক কল্যাণের (Well-being) জন্য অপরিহার্য। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং কীভাবে তারা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বা অস্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখে।

যখন আমরা আজকের পৃথিবীর দিকে তাকাই – বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, বৈষম্য, ক্ষমতার অপব্যবহার, আদর্শ নাগরিকের অভাব, শিক্ষার সংকট, ন্যায়বিচারের অভাব – তখন অ্যারিস্টটলের কথাগুলো যেন নতুন করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনে হয়, তিনি যেন টাইম মেশিনে করে এই যুগে এসে আমাদের সমস্যাগুলোই তুলে ধরছেন আর তার সমাধানের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তাঁর অনেক ধারণা হয়তো আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না, কিন্তু তাঁর প্রশ্নগুলো, তাঁর ভাবনাগুলো আমাদের নতুন করে পথ দেখায়, আমাদের চিন্তার জট খুলতে সাহায্য করে।

অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তা যেন এক বিশাল সমুদ্র, যার গভীরে রয়েছে অসংখ্য মণিমুক্তা। যতবার ডুব দেওয়া যায়, তত নতুন নতুন রত্ন খুঁজে পাওয়া যায়। তাই তাঁকে পড়া মানে শুধু একটি ঐতিহাসিক মতবাদ জানা নয়, বরং নিজের সমাজ, রাষ্ট্র ও পারিপার্শ্বিক জগৎটাকে আরও ভালোভাবে বোঝা এবং একটি শ্রেয়তর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য অনুপ্রাণিত হওয়া। তিনি যেন সেই অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শক, যিনি অতীতের আলোয় বর্তমানের পথ চেনান এবং ভবিষ্যতের দিকে অঙ্গুলিসংকেত করেন। তাঁর ভাবনাগুলো নিয়ে তর্ক হতে পারে, দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু তাঁকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। রাষ্ট্র যতদিন থাকবে, মানুষ যতদিন সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করবে, ততদিন অ্যারিস্টটলের প্রাসঙ্গিকতাও অমলিন থাকবে। অনেকটা সেই পুরোনো দিনের রেডিওর মতো, অ্যান্টেনাটা একটু এদিক-ওদিক করলেই আজও পরিষ্কার শোনা যায় তাঁর কণ্ঠস্বর – যুক্তির, প্রজ্ঞার আর গভীর জীবনবোধের সেই সুর।

তথ্যসূত্র

  • Aristotle. (n.d.). Nicomachean Ethics. (Various translations exist, e.g., translated by W. D. Ross, Terence Irwin, or Roger Crisp).
  • Aristotle. (n.d.). Politics. (Various translations exist, e.g., translated by Benjamin Jowett, C. D. C. Reeve, or Ernest Barker).
  • Barker, E. (1959). The Political Thought of Plato and Aristotle. Dover Publications. (Original work published 1906).
  • Barnes, J. (1995). The Cambridge Companion to Aristotle. Cambridge University Press.
  • Cartledge, P. (2004). Alexander the Great: The Hunt for a New Past. Overlook Press.
  • Guthrie, W. K. C. (1971). The Sophists. Cambridge University Press.
  • Kagan, D. (2003). The Peloponnesian War. Penguin Books.
  • Kraut, R. (2002). Aristotle: Political Philosophy. Oxford University Press.
  • Miller, F. D. (1995). Nature, Justice, and Rights in Aristotle’s Politics. Clarendon Press.
  • Plato. (n.d.). Apology. (Various translations exist).
  • Plato. (n.d.). Republic. (Various translations exist).
  • Pomeroy, S. B., Burstein, S. M., Donlan, W., Roberts, J. T., Tandy, D. W., & Tsouvala, G. (2018). A Brief History of Ancient Greece: Politics, Society, and Culture (4th ed.). Oxford University Press.
  • Ross, W. D. (1995). Aristotle (6th ed.). Routledge. (Original work published 1923).
  • Sabine, G. H., & Thorson, T. L. (1973). A History of Political Theory (4th ed.). Dryden Press. (Original work by Sabine published 1937).
  • Taylor, C. C. W. (1991). Socrates: A Very Short Introduction. Oxford University Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.