গ্রিক সভ্যতা: যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমাদের আজকের পৃথিবী

Table of Contents

ভূমিকা

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল অনেক, অনেক দিন আগে। ভাবুন তো, আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি, আমাদের চিন্তাভাবনা, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা, আমাদের বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য—এই সবকিছুর শেকড় কোথায়? খুঁজতে গেলে দেখবেন, বারবার একটি নামের কাছে আমাদের ফিরে যেতে হয়। সেই নামটি হলো—গ্রিস। প্রাচীন গ্রিস।

ভূমধ্যসাগরের তীরে, ছোট ছোট রুক্ষ পাহাড় আর রুপালি অলিভ গাছের ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক সভ্যতা, যা আজও আমাদের পথ দেখায়। যেন এক দূর সম্পর্কের দাদু, যার গল্প ফুরায় না, যার জ্ঞান আমাদের অবাক করে দেয়। চলুন, আজ সেই দাদুর গল্প শোনা যাক। তবে গল্পটা একটু অন্যভাবে বলা হবে। এখানে শুধু রাজা-রানীর যুদ্ধের শুকনো বর্ণনার চেয়েও বেশি থাকবে সাধারণ মানুষের কথা, তাদের ভাবনার কথা, তাদের স্বপ্নের কথা। কারণ সভ্যতা তো শুধু ইট-পাথরের দালান নয়, সভ্যতা হলো মানুষের মনোজগতের ইতিহাস (History of the Human Mind)। ইট-পাথর একসময় ক্ষয়ে যায়, কিন্তু মানুষের চিন্তা টিকে থাকে হাজার হাজার বছর।

গ্রিসের গল্প শুরু করার আগে একটু পেছনে যেতে হবে। ঠিক যেন মূল নাটকের আগে একটা দীর্ঘ প্রস্তাবনা। গ্রিকরা আকাশ থেকে পড়েনি। তাদের আগেও ঈজিয়ান সাগরের (Aegean Sea) বুকে মানুষের পদচিহ্ন ছিল, সভ্যতার আলো জ্বলেছিল। দুটো বড় সভ্যতার কথা না বললে গ্রিসের গল্পটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

মিনোয়ান সভ্যতা: এক শৈল্পিক রহস্য

একটি হলো মিনোয়ান সভ্যতা (Minoan Civilization), যার কেন্দ্র ছিল ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে বড় দ্বীপগুলোর একটি—ক্রীট (Crete)। খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ থেকে ১৪৫০ অব্দের কথা। এরা ছিল মূলত বণিক। তাদের জাহাজ ভেসে বেড়াত মিশর থেকে আনাতোলিয়া পর্যন্ত। তারা ছিল শান্তশিষ্ট আর অসম্ভব শৈল্পিক এক জাতি। তাদের রাজা ছিলেন কিংবদন্তির মিনোস (Minos), যার মা ছিলেন একজন ফিনিশীয় রাজকন্যা ইউরোপা, যাকে ষাঁড়ের ছদ্মবেশে অপহরণ করেছিলেন স্বয়ং জিউস। এই মিনোসের নামেই ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক আর্থার ইভান্স (Arthur Evans) এই সভ্যতার নামকরণ করেন।

তাদের ছিল বিশাল সব প্রাসাদ (Palace Complexes), যার মধ্যে নোসাসের (Knossos) প্রাসাদটি সবচেয়ে বিখ্যাত। এটা শুধু রাজার বাড়ি ছিল না, ছিল একাধারে প্রশাসনিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র। এই প্রাসাদের গঠন এতই জটিল আর গোলকধাঁধার মতো ছিল যে, সেখান থেকেই হয়তো গ্রিক পুরাণের সেই বিখ্যাত ল্যাবিরিন্থের (Labyrinth) ধারণাটি এসেছে, যেখানে বাস করত অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ষাঁড়—মিনোটর (Minotaur)। প্রাসাদের দেয়ালে আঁকা ফ্রেস্কোগুলো (Frescoes) দেখলে অবাক হতে হয়। সেখানে দেখা যায় ডলফিনের ছবি, লতাপাতার নকশা আর বিখ্যাত ‘বুল-লিপিং’ (Bull-Leaping) বা ষাঁড়ের ওপর দিয়ে লাফ দেওয়ার দৃশ্য। এই ছবিগুলোতে পুরুষদের ত্বক লালচে আর নারীদের ত্বক সাদা রঙে আঁকা। তাদের নারীরা পরত আধুনিক পোশাকের মতো ফিতাযুক্ত ব্লাউজ আর ঘাগরা। তাদের সমাজে নারীদের বেশ উঁচু স্থান ছিল বলেই মনে হয়। তাদের প্রধান দেবী ছিলেন একজন সর্পদেবী (Snake Goddess)। (Castleden, 2002)।

মিনোয়ানরা ‘লিনিয়ার এ’ (Linear A) নামে এক ধরনের লিপিতে লিখত, যার পাঠোদ্ধার আজও পুরোপুরি করা সম্ভব হয়নি। প্রায় শ’খানেক চিহ্ন ব্যবহার করা হতো এই লিপিতে। কী লিখেছিল তারা? কোনো প্রেমপত্র? কোনো ধর্মীয় স্তোত্র? নাকি স্রেফ বাণিজ্যিক হিসাবের খাতা? আমরা জানি না। ব্যাপারটা এখনো কুয়াশায় ঢাকা, তাই না? প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫০ অব্দে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। কেন? কেউ বলেন ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতের কথা, যা পার্শ্ববর্তী থেরা (Thera) বা আজকের সান্তোরিনি দ্বীপে হয়েছিল। সেই অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট সুনামি হয়তো ক্রীটের উপকূলীয় শহরগুলোকে ধুয়েমুছে নিয়ে গিয়েছিল। আবার কেউ বলেন, মূল ভূখণ্ড থেকে আসা মাইসিনিয়ানদের আক্রমণের কথা। কারণ যা-ই হোক, মিনোয়ানদের উজ্জ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে এভাবেই।

মাইসিনিয়ান সভ্যতা: যোদ্ধাদের উত্থান

এরপর মঞ্চে আসে মাইসিনিয়ানরা (Mycenaean Civilization)। খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১১০০ অব্দ পর্যন্ত গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে এদের দাপট ছিল। এরা ছিল যোদ্ধা। মিনোয়ানদের মতো শান্ত বা শৈল্পিক নয়, বরং বেশ যুদ্ধংদেহী এবং সংগঠিত। তাদের দুর্গগুলো ছিল পাহাড়ের চূড়ায়, বিশাল সব পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা, যাকে বলা হতো ‘সাইক্লোপিয়ান ওয়াল’ (Cyclopean Walls)। কারণ পরবর্তীকালের গ্রিকরা বিশ্বাস করত, এত বড় পাথর একমাত্র সাইক্লোপ্স (Cyclops) নামক একচোখা দৈত্যরাই তুলতে পারে।

মাইসিনির (Mycenae) সেই ‘লায়ন গেট’ (Lion Gate) আজও তাদের শক্তির জানান দেয়। উনিশ শতকের প্রত্নতাত্ত্বিক হাইনরিখ শ্লিমান (Heinrich Schliemann) যখন মাইসিনিতে খননকাজ চালান, তখন তিনি কিছু সমাধি আবিষ্কার করেন, যা ‘গ্রেভ সার্কেল’ (Grave Circle) নামে পরিচিত। এই সমাধিগুলো থেকে পাওয়া গিয়েছিল বিপুল পরিমাণ সোনার জিনিসপত্র—মুখোশ, তলোয়ার, পানপাত্র। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো সোনার একটি মুখোশ, যাকে শ্লিমান ভুল করে ‘আগামেমননের মুখোশ’ (Mask of Agamemnon) বলে দাবি করেছিলেন। যদিও আধুনিক গবেষণা বলছে, মুখোশটি আগামেমননের সময়ের চেয়েও কয়েকশ’ বছর পুরনো।

মাইসিনিয়ানরা ‘লিনিয়ার বি’ (Linear B) লিপিতে লিখত, যা ১৯৫০-এর দশকে মাইকেল ভেনট্রিস (Michael Ventris) নামে একজন স্থপতি ও ভাষাবিদ পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হন। আর তখনই এক যুগান্তকারী তথ্য বেরিয়ে আসে—এটি ছিল গ্রিক ভাষারই একটি আদিরূপ! এর মাধ্যমে জানা গেল, হোমারের মহাকাব্যের গ্রিকরা আর এই মাইসিনিয়ানরা ভাষাগতভাবে একই সূত্রে গাঁথা। কিংবদন্তির ট্রোজান যুদ্ধ (Trojan War), যা নিয়ে হোমার তার মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ লিখেছেন, ধারণা করা হয় এই মাইসিনিয়ান যুগেই সংঘটিত হয়েছিল। স্পার্টার রানী হেলেনকে (Helen) ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস (Paris) অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার ফলেই নাকি এই যুদ্ধের সূচনা। মাইসিনির রাজা আগামেমনন (Agamemnon), বীর অ্যাকিলিস (Achilles), ট্রোজান বীর হেক্টর (Hector)—এই নামগুলো যেন আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। (Chadwick, 1976)।

অন্ধকার যুগ: এক দীর্ঘ নীরবতা

কিন্তু এরপর? এরপর সব চুপচাপ। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে মাইসিনিয়ান সভ্যতা রহস্যজনকভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। বড় বড় শহর পরিত্যক্ত হলো, জনসংখ্যা কমে গেল, বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেল, এমনকি লেখার চলও প্রায় উঠে গেল। প্রায় ৪০০ বছরের জন্য গ্রিসের ইতিহাস যেন এক গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। এই সময়টাকে তাই বলা হয় গ্রিক অন্ধকার যুগ (Greek Dark Ages)

কেন এমন হলো? ঐতিহাসিকরা নানা কারণ খুঁজেছেন। একদল বলেন ‘ডোরিয়ান আক্রমণ’-এর (Dorian Invasion) কথা, যারা ছিল উত্তর থেকে আসা এক নতুন গ্রিকভাষী গোষ্ঠী। আরেকদল বলেন ‘সি পিপল’ (Sea Peoples) বা সামুদ্রিক যাযাবরদের আক্রমণের কথা, যারা একই সময়ে মিশর ও নিকট প্রাচ্যের অনেক সভ্যতা ধ্বংস করেছিল। আবার জলবায়ু পরিবর্তন, খরা বা অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কথাও বলেন অনেকে।

কারণ যা-ই হোক, এই অন্ধকার যুগ কিন্তু একেবারে নিষ্ফলা ছিল না। এই সময়েই ব্রোঞ্জের বদলে লোহার ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করে, যা ছিল আরও টেকসই এবং সহজলভ্য। মাইসিনিয়ান যুগের রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে গিয়ে ছোট ছোট গ্রামভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠতে থাকে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই দীর্ঘ নীরবতার মধ্যেই হোমারের মহাকাব্যগুলো মুখে মুখে গীত হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে ছিল। এই অন্ধকারই যেন এক নতুন ভোরের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, যে ভোরবেলা জন্ম নেবে গ্রিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক আবিষ্কার—পলিস।

পলিসের জন্ম: একটি শহরের গল্প

অন্ধকার যুগ পেরিয়ে গ্রিস যখন আবার জেগে উঠল, তখন তার রূপ বদলে গেছে। এখন আর কোনো একক রাজার অধীনে বিশাল সাম্রাজ্য নয়, বরং বলকান উপদ্বীপের এবড়োখেবড়ো ভূখণ্ডে, ঈজিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জে আর আনাতোলিয়ার উপকূলে গড়ে উঠেছে শত শত স্বাধীন নগর-রাষ্ট্র বা পলিস (Polis)। এথেন্স, স্পার্টা, করিন্থ, থিবস, আর্গোস, মিলেটাস—এরকম শত শত পলিস।

একটি পলিস মানে শুধু একটি শহর নয়। এর মধ্যে থাকত একটি সুরক্ষিত উঁচু স্থান বা অ্যাক্রোপলিস (Acropolis), যেখানে থাকত শহরের প্রধান মন্দিরগুলো। আর নিচে থাকত আগোরা (Agora) বা খোলা চত্বর, যা ছিল একাধারে বাজার, জনসভা এবং আড্ডার কেন্দ্র। প্রতিটি পলিস যেন একটি আলাদা দেশ। তাদের নিজস্ব সরকার, নিজস্ব আইন, নিজস্ব সেনাবাহিনী এবং নিজস্ব সংরক্ষক দেবতা বা প্যাট্রন গড (Patron God)।

পাহাড় আর সমুদ্র দিয়ে বিভক্ত গ্রিসের ভূগোলই হয়তো এই পলিসগুলোর জন্ম দিয়েছিল। এক পলিস থেকে অন্য পলিসে যাওয়া ছিল কঠিন। তাই তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকত। তাদের মধ্যে ভাষাগত ও ধর্মীয় মিল ছিল, তারা সবাই নিজেদের ‘হেলেনেস’ (Hellenes) বলে মনে করত। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তারা ছিল বিচ্ছিন্ন। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল, আবার রেষারেষিও ছিল মারাত্মক। অনেকটা একান্নবর্তী পরিবারের ভাইদের মতো। বিপদে আপদে এক, আবার অন্য সময়ে একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করেই দিন পার করে দেয়।

এই পলিসগুলোর কাঠামোতেই লুকিয়ে ছিল গ্রিক সভ্যতার আসল শক্তি। কারণ এখানেই প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হলো সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। প্রথমে ছিল রাজতন্ত্র (Monarchy), যেখানে শাসন করত একজন রাজা। তারপর এলো অভিজাততন্ত্র (Aristocracy), যেখানে শাসন করত কিছু অভিজাত ধনী পরিবার। এরপর কখনও কখনও একজন শক্তিশালী নেতা জোর করে ক্ষমতা দখল করতেন, যাকে বলা হতো টাইর‍্যান্ট (Tyrant)। টাইর‍্যান্ট বা স্বৈরশাসক শব্দটি এখন নেতিবাচক হলেও, তখনকার অনেক টাইর‍্যান্ট জনগণের উপকারও করতেন। আর এই সবকিছুর পথ ধরেই অবশেষে এথেন্সে জন্ম নিয়েছিল এক যুগান্তকারী ধারণা—গণতন্ত্র (Democracy)। (Hansen, 2006)।

দুই ভাই, দুই পলিস: এথেন্স ও স্পার্টা

শত শত পলিসের মধ্যে দুটি নাম আমাদের বিশেষভাবে জানতে হবে। কারণ তাদের আদর্শ ও জীবনযাত্রা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, আর তাদের দ্বন্দ্বই ক্লাসিক্যাল গ্রিসের ইতিহাসকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। এই দুই পলিস হলো এথেন্স ও স্পার্টা।

স্পার্টা: লৌহকঠিন শৃঙ্খলার নগরী

স্পার্টা ছিল এক নিখুঁত সামরিক রাষ্ট্র (Military State)। তাদের জীবনের একটাই উদ্দেশ্য ছিল—একজন অজেয় সৈনিক বা হপলাইট (Hoplite) হয়ে ওঠা। পেলোপনেসাস উপদ্বীপের ল্যাকোনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত এই পলিসটি পার্শ্ববর্তী মেসেনিয়া দখল করে সেখানকার অধিবাসীদের ভূমিদাস বা হেলট (Helot) বানিয়েছিল। এই বিশাল সংখ্যক হেলটদের বিদ্রোহের ভয়েই স্পার্টানরা নিজেদের এমন এক কঠোর সামরিক সমাজে পরিণত করেছিল।

স্পার্টান জীবন শুরু হতো জন্মের মুহূর্ত থেকেই। একটি শিশু জন্মানোর পর তাকে রাষ্ট্রের প্রবীণদের সামনে আনা হতো। যদি শিশুটি দুর্বল বা অসুস্থ হতো, তাকে টাইগেটাস পর্বতের চূড়া থেকে ফেলে দেওয়া হতো। কারণ স্পার্টার দুর্বল নাগরিকের কোনো প্রয়োজন নেই। যে শিশুটি টিকে যেত, সাত বছর বয়স হলেই তাকে পরিবার থেকে নিয়ে যাওয়া হতো আগোগে (Agoge) নামক এক কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সেখানে চলত অমানুষিক প্রশিক্ষণ। কম খাবার, পাতলা পোশাক, খালি পায়ে হাঁটা আর অবিরাম শারীরিক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাদের গড়ে তোলা হতো। তাদের শেখানো হতো চুরি করতে, কিন্তু ধরা পড়লে জুটত কঠিন শাস্তি—চুরি করার জন্য নয়, ধরা পড়ার জন্য। এর মাধ্যমে তাদের ধূর্ততা ও সহনশীলতা বাড়ানো হতো।

স্পার্টার নারীরাও কিন্তু পিছিয়ে ছিলেন না। তাদের কাজ ছিল শক্তিশালী, স্বাস্থ্যবান সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং রাষ্ট্রকে সেবা করা। যেহেতু পুরুষরা সারাক্ষবণ যুদ্ধ আর প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যারাক বা ‘সিসিশিয়া’-তে (Syssitia) থাকত, স্পার্টার নারীরা অন্য অনেক গ্রিক পলিসের নারীদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার ভোগ করত। তারা শরীরচর্চা করত, প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারত এবং নিজেদের মতামত দিতে পারত। এক স্পার্টান মায়ের গল্প প্রচলিত আছে, যিনি তার ছেলেকে যুদ্ধে যাওয়ার সময় ঢালটি এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “হয় এটি নিয়ে ফিরবে, নয়তো এর ওপরে শুয়ে (মৃত অবস্থায়)।”

স্পার্টার শাসনব্যবস্থা ছিল বেশ জটিল, এক ধরনের অলিগার্কি (Oligarchy) বা গোষ্ঠীতন্ত্র। সেখানে দুজন রাজা থাকতেন ভিন্ন দুটি পরিবার থেকে, যারা মূলত সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। ছিল ২৮ জন প্রবীণ সদস্য নিয়ে গঠিত এক পরিষদ বা গেরুসিয়া (Gerousia) এবং পাঁচজন নির্বাচিত কর্মকর্তা বা এফোর (Ephor), যাদের হাতেই ছিল মূল ক্ষমতা। (Pomeroy, 2002)।

এথেন্স: গণতন্ত্র ও দর্শনের পীঠস্থান

অন্যদিকে অ্যাটিকা অঞ্চলের পলিস এথেন্স ছিল শিল্প, সাহিত্য, দর্শন আর জ্ঞানের কেন্দ্র। স্পার্টা যদি হয় পেশিশক্তি, এথেন্স তবে মস্তিষ্ক। এথেন্সের পথচলা স্পার্টার মতো মসৃণ ছিল না। শুরুর দিকে এখানেও অভিজাতদের শাসন ছিল। সাধারণ কৃষকরা ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে প্রায় দাসে পরিণত হচ্ছিল। এই সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে এগিয়ে আসেন কয়েকজন আইন প্রণেতা। প্রথমে আসেন ড্রাকো (Draco), যার আইন ছিল এতটাই কঠোর যে বলা হতো সেগুলো রক্ত দিয়ে লেখা। এরপর আসেন সোলন (Solon), যিনি অনেক মানবিক আইন প্রণয়ন করেন, ঋণের দায়ে দাসত্ব নিষিদ্ধ করেন এবং নাগরিকদের ধনসম্পদের ভিত্তিতে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করে রাজনৈতিক অধিকার দেন।

কিন্তু এথেনীয় গণতন্ত্রের আসল স্থপতি ছিলেন ক্লেইস্থেনিস (Cleisthenes)। খ্রিস্টপূর্ব ৫০৮ অব্দে তিনি এক বৈপ্লবিক সংস্কার আনেন। তিনি পুরনো বংশ বা পরিবারের ভিত্তিতে গড়া রাজনৈতিক বিভাজন ভেঙে দিয়ে সকল নাগরিককে দশটি নতুন ‘ট্রাইব’ বা গোত্রে ভাগ করেন। এই গোত্রগুলো ছিল এলাকার ভিত্তিতে তৈরি, ফলে পুরনো অভিজাতদের প্রভাব কমে যায় এবং সাধারণ নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ে। তিনিই চালু করেন অস্ট্রাসিজম (Ostracism) বা নির্বাসন প্রথা, যেখানে নাগরিকরা ভোটের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তিকে দশ বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠাতে পারত, যদি মনে করা হতো যে সে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।

এথেন্সেই জন্ম নিয়েছিল পৃথিবীর প্রথম প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র (Direct Democracy)। যদিও সেই গণতন্ত্র আজকের মতো ছিল না। সেখানে শুধু স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নাগরিকরাই এক্লেসিয়া (Ekklesia) বা গণপরিষদে যোগ দিয়ে ভোট দিতে পারত। নারী, দাস, বা বিদেশি (যাদের মেটিক বলা হতো) তাদের কোনো ভোটাধিকার ছিল না। তবুও, এটি ছিল এক যুগান্তকারী ধারণা—যে দেশের সাধারণ নাগরিকরাই সরাসরি আইন প্রণয়ন করবে এবং দেশ চালাবে, কোনো রাজা বা অভিজাত গোষ্ঠী নয়। এথেন্সের এই মুক্ত পরিবেশেই জন্ম নিয়েছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের মতো দার্শনিক, সফোক্লিস, ইউরিপিডিসের মতো নাট্যকার এবং ফিডিয়াসের মতো ভাস্কর।

সোনার যুগ: যখন দেবতারা পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন (The Classical Period)

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতককে বলা হয় গ্রিসের ক্লাসিক্যাল যুগ (Classical Period) বা স্বর্ণযুগ। এই সময়েই গ্রিক সভ্যতা তার সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। কিন্তু এই স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে।

পারস্য যুদ্ধ: স্বাধীনতার লড়াই

পারস্য সাম্রাজ্য (Achaemenid Persian Empire) তখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি। তাদের বিশাল সাম্রাজ্য আনাতোলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যেখানে বেশ কিছু গ্রিক পলিস (আয়োনীয় পলিস) তাদের অধীনে ছিল। এই পলিসগুলো বিদ্রোহ করলে এথেন্স তাদের সাহায্য পাঠায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পারস্যের সম্রাট প্রথম দারিয়াস গ্রিস আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ অব্দে পারস্যের বিশাল সেনাবাহিনী ম্যারাথনের (Marathon) প্রান্তরে অবতরণ করে। সংখ্যার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থেকেও এথেনীয় হপলাইটরা অবিশ্বাস্য বীরত্বে পারস্য বাহিনীকে পরাজিত করে। কথিত আছে, এই বিজয়ের সংবাদ এথেন্সে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ফিডিপ্পিডিস (Pheidippides) নামক এক দৌড়বিদ প্রায় ২৬ মাইল দৌড়ে গিয়ে “আমরা জয়ী হয়েছি” বলেই মারা যান। তার সম্মানার্থেই আজকের ম্যারাথন দৌড়ের প্রচলন।

দশ বছর পর দারিয়ুসের পুত্র জার্ক্সিস (Xerxes) আরও বিশাল সেনাবাহিনী ও নৌবহর নিয়ে প্রতিশোধ নিতে আসেন। এইবার গ্রিক পলিসগুলো বুঝতে পারে, একা একা এই দানবকে হারানো যাবে না। স্পার্টার নেতৃত্বে তারা একজোট হয়। থার্মোপলির (Thermopylae) গিরিপথে স্পার্টার রাজা লিওনিডাস (Leonidas) তার মাত্র ৩০০ স্পার্টান এবং কয়েক হাজার সহযোগী সৈন্য নিয়ে কয়েকদিন ধরে জার্ক্সিসের লক্ষাধিক সৈন্যের পথ আটকে রাখেন। বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তারা সবাই নিহত হন, কিন্তু তাদের এই আত্মত্যাগ গ্রিসকে সংগঠিত হওয়ার জন্য অমূল্য সময় দিয়েছিল। এরপর সালামিসের (Salamis) নৌ-যুদ্ধে এথেনীয় সেনাপতি থেমিস্টোক্লিসের (Themistocles) চতুর কৌশলের কাছে পারস্যের বিশাল নৌবহর পরাজিত হয় এবং পরের বছর প্লাটিয়ার (Plataea) চূড়ান্ত যুদ্ধে পারস্য শক্তি সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়। (Herodotus, The Histories)।

পেরিক্লিসের যুগ: এথেন্সের জয়জয়কার

পারস্যকে হারানোর পর এথেন্সের আত্মবিশ্বাস ও সম্মান আকাশে গিয়ে ঠেকল। তারা ‘ডেলিয়ান লীগ’ (Delian League) নামে একটি সামরিক জোট গঠন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে পারস্যের আক্রমণ থেকে গ্রিক পলিসগুলোকে রক্ষা করা। কিন্তু খুব শীঘ্রই এথেন্স এই জোটকে নিজের সাম্রাজ্যে পরিণত করে। লীগের কোষাগার ডেলোস দ্বীপ থেকে এথেন্সে নিয়ে আসা হয় এবং জোটের সদস্যদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ দিয়ে এথেন্স নিজেকে সাজাতে শুরু করে।

এই সময়টাকেই বলা হয় পেরিক্লিসের যুগ (Age of Pericles)। পেরিক্লিস (Pericles) ছিলেন একজন অভিজাত বংশের নেতা ও সেনাপতি, যিনি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এথেন্সের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছেন। তিনি গণতন্ত্রকে আরও প্রসারিত করেন এবং দরিদ্র নাগরিকদেরও রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের জন্য বেতন দেওয়ার প্রথা চালু করেন। তার বিখ্যাত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ভাষণে (Funeral Oration) তিনি এথেন্সের আদর্শের এক অনবদ্য চিত্র তুলে ধরেছিলেন, যা আজও গণতন্ত্রের সমর্থকদের অনুপ্রাণিত করে।

পেরিক্লিসের নেতৃত্বেই অ্যাক্রোপলিসের ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরগুলো নতুন করে গড়া হয়। এই সময়েই নির্মিত হলো পার্থেনন (Parthenon)—শহরের রক্ষাকর্ত্রী দেবী এথেনা পার্থেনোসের (Athena Parthenos) সেই অপূর্ব মন্দির, যা আজও পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকর্ম হিসেবে টিকে আছে। এর স্থপতি ছিলেন ইকটিনাস (Ictinus) ও ক্যালিক্রেটিস (Callicrates) এবং ভাস্কর্যের দায়িত্বে ছিলেন পেরিক্লিসের বন্ধু ফিডিয়াস (Phidias)। এই মন্দিরটি শুধু উপাসনার স্থান ছিল না, এটি ছিল এথেন্সের শক্তি, সম্পদ এবং গণতন্ত্রের প্রতীক। এর স্থাপত্যশৈলীতে ডোরিক (Doric) এবং আয়োনিক (Ionic) রীতির এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, এর স্থপতিরা সামান্য দৃষ্টিভ্রম বা অপটিক্যাল ইলিউশন (Optical Illusion) দূর করার জন্য কলামগুলোকে একেবারে সোজা না করে মাঝখানে একটু স্ফীত করেছেন এবং কোণার কলামগুলোকে সামান্য কাত করে দিয়েছেন, যাতে দূর থেকে দেখলে সবকিছু নিখুঁত ও সোজা মনে হয়। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, তাই না? (Boardman, 1985)।

এথেনীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – এথেনীয় গণতন্ত্র: গণতন্ত্রের সেই আশ্চর্য প্রদীপ

থিয়েটারের জন্ম এবং ইতিহাসের উন্মোচন

এই যুগেই জন্ম নিল থিয়েটার (Theatre)। দেবী ডায়োনিসাসের (Dionysus) ধর্মীয় উৎসব থেকে জন্ম নেওয়া এই শিল্প খুব দ্রুতই গ্রিক সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। হাজার হাজার দর্শক খোলা আকাশের নিচে পাথরের গ্যালারিতে বসে নাটক দেখত। এই সময়ে আমরা পাই তিনজন মহান ট্র্যাজেডিয়ানকে—অ্যাস্কাইলাস (Aeschylus), সফোক্লিস (Sophocles), এবং ইউরিপিডিস (Euripides)। অ্যাস্কাইলাস মানুষের সাথে দেবতাদের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন, সফোক্লিসের ‘ইডিপাস রেক্স’ (Oedipus Rex) নাটকে আমরা দেখি ভাগ্যের কাছে মানুষের অমোঘ অসহায়ত্ব, আর ইউরিপিডিস তার ‘মিডিয়া’ (Medea) নাটকে মনস্তাত্ত্বিক গভীরতায় ডুব দিয়েছেন। নাটকের শেষে যখন কোনো জটিল পরিস্থিতি সমাধান করা যেত না, তখন অনেক সময় ক্রেনের সাহায্যে কোনো দেবতাকে মঞ্চে নামিয়ে আনা হতো, যিনি এসে সব সমস্যার সমাধান করে দিতেন। এই পদ্ধতিকে বলা হতো ‘দেউস এক্স ম্যাকিনা’ (Deus ex Machina) বা ‘যন্ত্র থেকে নির্গত দেবতা’।

ট্র্যাজেডির পাশাপাশি ছিল কমেডি (Comedy)। এর শ্রেষ্ঠ রূপকার ছিলেন অ্যারিস্টোফেনিস (Aristophanes)। তার কমেডিতে সমসাময়িক রাজনীতিক, দার্শনিক, এমনকি দেবতাদের নিয়েও তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হতো। ভাবুন তো, সেই সময়েই নাটকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধানদের সমালোচনা করার স্বাধীনতা তাদের ছিল!

ইতিহাস লেখারও বিজ্ঞানসম্মত শুরু এই সময়ে। হেরোডোটাসকে (Herodotus) বলা হয় ‘ইতিহাসের জনক’ (Father of History)। তিনি পারস্য যুদ্ধের ইতিহাস লিখেছেন গল্প বলার ঢঙে, যেখানে তিনি বিভিন্ন দেশের লোককথা, ভূগোল এবং সংস্কৃতির বর্ণনাও দিয়েছেন। অন্যদিকে, থুসিডাইডিস (Thucydides) লিখেছেন পেলোপনেশীয় যুদ্ধের ইতিহাস। তার লেখা ছিল অনেক বেশি যুক্তিনির্ভর এবং নির্মোহ। তিনি ঘটনার পেছনের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন এবং ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের ধারণা বাদ দিয়ে মানবীয় কারণগুলোর ওপর জোর দিয়েছেন, যা তাকে প্রথম প্রকৃত ঐতিহাসিক করে তুলেছে।

পেলোপনেশীয় যুদ্ধ: এক আত্মঘাতী সংঘাত

কিন্তু কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এথেন্সের বাড়াবাড়ি ক্ষমতা, সাম্রাজ্যবাদী আচরণ এবং ডেলিয়ান লীগের ওপর কর্তৃত্ব স্পার্টা এবং অন্যান্য পলিসের সহ্য হলো না। শুরু হলো আত্মঘাতী এক যুদ্ধ—পেলোপনেশীয় যুদ্ধ (Peloponnesian War)। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে (খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১-৪০৪) চলা এই যুদ্ধে গ্রিকরা গ্রিকদের বিরুদ্ধেই লড়ল। যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরেই এথেন্সে এক ভয়াবহ প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে, যাতে পেরিক্লিসসহ শহরের এক-চতুর্থাংশ মানুষ মারা যায়। এরপর সিসিলি অভিযানে (Sicilian Expedition) এথেন্সের নৌবহর প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে, স্পার্টা পারস্যের সাহায্য নিয়ে এথেন্সকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে। এথেন্সের সাম্রাজ্যের পতন হলো, তার দেয়াল ভেঙে ফেলা হলো এবং গণতন্ত্রের অবসান ঘটল। এই যুদ্ধ গোটা গ্রিসকে এতটাই দুর্বল আর বিভক্ত করে দিল যে, ক্লাসিক্যাল যুগের সূর্য যেন অস্তাচলে ঢলে পড়ল। (Thucydides, History of the Peloponnesian War)।

পেলোপনেশীয় যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – পেলোপনেসীয় যুদ্ধ: যখন ভাইয়ের বুকে ছুরি চালায় ভাই

দর্শনের জন্ম: “নিজেকে জানো”

গ্রিকদের সবচেয়ে বড় অবদান কী? যদি একটি জিনিস বেছে নিতে বলা হয়, তবে সেটি হবে—দর্শন (Philosophy)। ফিলোসফি শব্দটির মানেই হলো ‘জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা’ (Love of Wisdom)। গ্রিকরাই প্রথমবার জগতের সৃষ্টি ও ঘটনাপ্রবাহকে পৌরাণিক কাহিনীর বদলে যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও কার্যকারণ সম্পর্ক (Cause and Effect) দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা শুরু করে।

এই যাত্রার শুরু করেছিলেন আয়োনীয় অঞ্চলের প্রাক-সক্রেটিস দার্শনিকরা (Pre-Socratic Philosophers)। মিলেটাসের থেলিস (Thales) ভাবলেন, জগতের মূল উপাদান হলো জল। তার ছাত্র অ্যানাক্সিমান্ডার (Anaximander) বললেন, না, সবকিছু তৈরি এক অসীম, অনির্দিষ্ট বস্তু বা ‘অ্যাপেইরন’ (Apeiron) থেকে। হেরাক্লিটাস (Heraclitus) বললেন, জগতে কোনো কিছুই স্থির নয়, সবকিছু অবিরত পরিবর্তনশীল—“একই নদীতে দুবার পা রাখা যায় না।” অন্যদিকে, পিথাগোরাস (Pythagoras) বিশ্বাস করতেন, জগতের রহস্য লুকিয়ে আছে সংখ্যার মধ্যে এবং মহাবিশ্ব এক গাণিতিক ঐকতানে বাঁধা। আবার ডেমোক্রিটাস (Democritus) প্রস্তাব করলেন যে, সবকিছু ‘অ্যাটম’ (Atom) বা অবিভাজ্য কণা দ্বারা গঠিত।

কিন্তু দর্শনের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল তিন নক্ষত্র হলেন—সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল।

সক্রেটিস (Socrates): তিনি ছিলেন এক অদ্ভুত মানুষ। পেশায় ভাস্কর হলেও তার আসল কাজ ছিল এথেন্সের আগোরায় খালি পায়ে ঘুরে বেড়ানো আর যাকে পেতেন, তাকেই প্রশ্ন করা। “সততা কী?”, “সাহস কাকে বলে?”, “ন্যায়বিচার কী?”—এইসব প্রশ্ন করে তিনি লোকেদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন যে, তারা যা জানে বলে মনে করে, আসলে তারা সে সম্পর্কে কিছুই পরিষ্কারভাবে জানে না। তার বিখ্যাত উক্তি ছিল, “আমি শুধু একটি জিনিসই জানি, আর তা হলো আমি কিছুই জানি না।” (I know that I know nothing)। এই নিরন্তর প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সত্য অনুসন্ধানের পদ্ধতিকে বলা হয় সক্রেটিক মেথড (Socratic Method)। তিনি নিজে কিছুই লিখে যাননি। তার সম্পর্কে আমরা যা জানি, তার প্রায় সবই তার ছাত্র প্লেটোর লেখা থেকে। এথেন্সের ক্ষমতাবান লোকেরা তার এই কাজ পছন্দ করল না। তাদের মনে হলো, সক্রেটিস যুব সমাজকে প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করতে শিখিয়ে নষ্ট করে দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতা এবং যুবকদের বিপথগামী করার অভিযোগ আনা হলো। বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হলো। তিনি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও পালাননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রের আইনকে সম্মান করা নাগরিকের কর্তব্য, তা যতই অন্যায় হোক না কেন। হেমলক বিষ পান করে তিনি হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করেন। (Plato, Apology)।

প্লেটো (Plato): সক্রেটিসের মেধাবী ছাত্র ছিলেন প্লেটো। গুরুর এই অন্যায় মৃত্যু তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, গণতন্ত্রও কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। প্লেটো তার দর্শন প্রচারের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম ছিল ‘একাডেমি’ (Academy)। এটিকেই পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বলা যেতে পারে, যা প্রায় ৯০০ বছর টিকে ছিল। প্লেটোর সবচেয়ে বিখ্যাত তত্ত্ব হলো ‘ফর্মের তত্ত্ব’ (Theory of Forms)। তিনি মনে করতেন, আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে চারপাশে যা দেখি—চেয়ার, টেবিল, সৌন্দর্য, ন্যায়বিচার—এগুলো সবই আসল জিনিসের একটি অসম্পূর্ণ নকল বা ছায়া মাত্র। আসল, নিখুঁত ও চিরন্তন জিনিসটি রয়েছে এক আদর্শ জগতে (World of Forms)। যেমন, পৃথিবীর সব চেয়ার হলো ‘চেয়ার’ নামক একটি আদর্শ রূপ বা ফর্মের অনুকরণ। তার বিখ্যাত ‘গুহার রূপক’ (Allegory of the Cave)-এর মাধ্যমে তিনি এই ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন। তার বিখ্যাত বই ‘দ্য রিপাবলিক’ (The Republic)-এ তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছেন, যার শাসক হবেন কোনো রাজনীতিবিদ নন, বরং একজন দার্শনিক-রাজা (Philosopher-King), যিনি প্রকৃত জ্ঞান ও সত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম। (Russell, 1945)।

অ্যারিস্টটল (Aristotle): প্লেটোর একাডেমিতে প্রায় বিশ বছর কাটানোর পর তার ছাত্র অ্যারিস্টটল নিজেই এক স্বতন্ত্র দার্শনিক হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু তিনি গুরুর সব কথা মেনে নেননি। প্লেটো যেখানে আদর্শ জগত বা ফর্ম নিয়ে ভাবতেন, অ্যারিস্টটল সেখানে মনোযোগ দিলেন আমাদের এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব জগতের প্রতি। তিনি ছিলেন একজন পর্যবেক্ষক এবং সংগ্রাহক। জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, অধিবিদ্যা, রাজনীতি, কাব্যতত্ত্ব—জ্ঞানের প্রায় সব শাখাতেই তার অবদান রয়েছে। তাকেই বলা হয় ‘যুক্তিবিদ্যার জনক’ (Father of Logic), কারণ তিনিই প্রথম যুক্তির নিয়মকানুনগুলো সুসংবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ করেন। তিনি শত শত প্রাণীর দেহব্যবচ্ছেদ করে তাদের শ্রেণীবিন্যাস করেছিলেন। রাজনীতি বিষয়ে তিনি ১৫০টিরও বেশি পলিসের সংবিধান বিশ্লেষণ করে সরকারব্যবস্থার শ্রেণীবিন্যাস করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, যেকোনো বিষয়ের চরমপন্থা ভালো নয়, বরং ‘স্বর্ণালী মধ্যপন্থা’ (Golden Mean) অনুসরণ করাই শ্রেয়। যেমন, সাহস হলো কাপুরুষতা এবং হঠকারিতার মাঝামাঝি একটি সদ্গুণ। তার স্কুলটির নাম ছিল ‘লাইসিয়াম’ (Lyceum)। এই তিনজনের হাত ধরেই পশ্চিমা দর্শনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেডের মতে, ইউরোপের সমস্ত দর্শন হলো প্লেটোর লেখার পাদটীকা মাত্র। (Barnes, 1995)।

শিল্প, বিজ্ঞান আর দৈনন্দিন জীবন

সৌন্দর্যের উপাসনা: স্থাপত্য ও ভাস্কর্য

গ্রিকরা সৌন্দর্যকে পূজা করত। তাদের কাছে যা সুন্দর, তাই ভালো, তাই পবিত্র। এই সৌন্দর্যের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাদের ভাস্কর্যে, চিত্রকলায় আর স্থাপত্যে। গ্রিক স্থাপত্যে তিনটি প্রধান রীতি বা ‘অর্ডার’ (Order) দেখা যায়: সরল ও বলিষ্ঠ ডোরিক (Doric), কারুকার্যময় ও স্ক্রলের মতো চূড়াবিশিষ্ট আয়োনিক (Ionic), এবং পাতার নকশায় অলংকৃত জমকালো করিন্থিয়ান (Corinthian)

ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে, শুরুর দিকে আর্কাইক যুগে (Archaic Period) গ্রিক মূর্তিগুলো ছিল বেশ শক্ত, অনেকটা মিশরীয় মূর্তির মতো। মুখের কোণে থাকত এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি, যাকে বলা হয় ‘আর্কাইক স্মাইল’ (Archaic Smile)। কিন্তু ক্লাসিক্যাল যুগে এসে ভাস্কর্যে এক বিপ্লব ঘটে গেল। ভাস্কররা মানুষের শরীরকে নিখুঁত ও স্বাভাবিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে শিখলেন। তারা ‘কন্ট্রাপোস্টো’ (Contrapposto) নামে এক বিশেষ ভঙ্গি আবিষ্কার করেন, যেখানে মূর্তির শরীরের ভার এক পায়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, ফলে শরীরটা সামান্য বেঁকে যায় এবং দেখতে অনেক বেশি জীবন্ত ও গতিময় মনে হয়। মাইরনের (Myron) ‘ডিসকোবোলাস’ (Discobolus) বা চাকতি নিক্ষেপকারী মূর্তিটি এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

চিকিৎসা বিজ্ঞান ও গণিত

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও গ্রিকরা পিছিয়ে ছিল না। হিপোক্রেটিসকে (Hippocrates) বলা হয় ‘চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক’ (Father of Medicine)। তিনিই প্রথম রোগকে কোনো দৈব অভিশাপ বা কালো জাদু হিসেবে না দেখে, পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির মাধ্যমে এর প্রাকৃতিক কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন। তার নামে প্রচলিত ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ (Hippocratic Oath) আজও চিকিৎসকদের নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। গণিতের ক্ষেত্রে পিথাগোরাসের উপপাদ্য আমাদের সবার জানা।

ধর্ম, খেলাধুলা আর সাধারণ জীবন

গ্রিকদের দেবতারা থাকতেন অলিম্পাস (Olympus) পর্বতের চূড়ায়। জিউস (Zeus) ছিলেন দেবতাদের রাজা। তার ভাই পসাইডন (Poseidon) সমুদ্রের দেবতা আর হেডিস (Hades) পাতালপুরীর। এছাড়াও ছিলেন জ্ঞানের দেবী এথেনা (Athena), শিল্প ও সঙ্গীতের দেবতা অ্যাপোলো (Apollo), ভালোবাসার দেবী অ্যাফ্রোদিতি (Aphrodite)-সহ আরও অনেকে। মজার ব্যাপার হলো, গ্রিক দেবতারা কিন্তু সর্বগুণে গুণান্বিত ছিলেন না। তারা মানুষের মতোই হিংসা করতেন, প্রেমে পড়তেন, ঝগড়া করতেন এবং মানুষকে সাহায্য বা ক্ষতি করার জন্য পৃথিবীতে নেমে আসতেন। এই দেবতাকেন্দ্রিক গল্পগুলোই হলো গ্রিক পুরাণ (Greek Mythology)

ধর্মীয় উৎসবের অংশ হিসেবেই জন্ম হয়েছিল অলিম্পিক গেমসের (Olympic Games)। প্রতি চার বছর পর পর অলিম্পিয়া নামক স্থানে দেবতা জিউসের সম্মানে এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। এই সময়ে গোটা গ্রিসে ‘একিখেরিয়া’ (Ekecheiria) বা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হতো। বিজয়ীদের পুরস্কার ছিল শুধু একটি অলিভ পাতার মুকুট, কিন্তু এই মুকুট জয় করা ছিল একজন গ্রিকের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানের। (Miller, 2004)।

এথেন্সের একজন সাধারণ নাগরিকের দিন কাটত বেশ আড্ডায় আর আলোচনায়। তারা সকালে কাজ সেরে আগোরায় যেত। বিকেলে তারা ব্যায়ামাগার বা ‘জিমন্যাসিয়াম’-এ (Gymnasium) যেত শরীরচর্চা ও যোগাযোগের জন্য। সন্ধ্যা কাটত ‘সিম্পোজিয়াম’ (Symposium) বা পানাহারের আসরে, যেখানে মদ পানের পাশাপাশি চলত গভীর দার্শনিক আলোচনা। তবে এই জীবন ছিল শুধু পুরুষদের জন্য। নারীদের জীবন ছিল মূলত ‘ওইকোস’ (Oikos) বা ঘরকেন্দ্রিক। আর এই সমাজের একেবারে নিচে ছিল দাসরা (Slaves), যাদের কোনো অধিকারই ছিল না। এথেন্সের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল দাস। এই দাসদের শ্রমের ওপরই কিন্তু এথেন্সের গণতন্ত্র, দর্শন আর শিল্পের সৌধ দাঁড়িয়েছিল। এটা গ্রিক সভ্যতার এক অনস্বীকার্য অন্ধকার দিক। (Pomeroy, et al., 2018)।

আলেকজান্ডার এবং হেলেনিস্টিক যুগ: গ্রিসের বিশ্বজয়

পেলোপনেশীয় যুদ্ধের পর গ্রিক পলিসগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, তারা উত্তরের রাজ্য ম্যাসিডোনিয়ার (Macedonia) উত্থানকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। ম্যাসিডোনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ চতুর কূটনীতি ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মাধ্যমে গোটা গ্রিসকে তার অধীনে নিয়ে আসেন। তার ছেলে ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজেতা—আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (Alexander the Great)

অ্যারিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডার মাত্র বিশ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন এবং পরের তেরো বছরে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন, যা গ্রিস থেকে শুরু করে মিশর, পারস্য হয়ে একেবারে ভারতের বিপাশা নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

আলেকজান্ডার শুধু রাজ্য জয় করেননি, তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রিক সংস্কৃতি, ভাষা (যাকে বলা হতো কইনে গ্রিক) আর চিন্তাভাবনা। তার সাম্রাজ্যের বিস্তারের ফলে গ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় (মিশরীয়, পারসিক, ভারতীয়) সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ ঘটে। এই নতুন মিশ্র সংস্কৃতিকেই বলা হয় হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি (Hellenistic Culture), এবং আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর (৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে রোমানদের দ্বারা মিশর দখলের (৩০ খ্রিস্টপূর্ব) পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় হেলেনিস্টিক যুগ (Hellenistic Period)

এই সময়ে জ্ঞানের কেন্দ্র এথেন্স থেকে সরে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া (Alexandria) শহরে চলে আসে। আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি (Library of Alexandria) এবং মিউজিয়াম (Mouseion) ছিল প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র। এই যুগেই ইউক্লিড (Euclid) তার ‘এলিমেন্টস’ বইয়ে জ্যামিতির সূত্রগুলো সাজিয়েছিলেন, যা আজও আমরা পড়ি। আর্কিমিডিস (Archimedes) প্লবতা এবং লিভারের সূত্র আবিষ্কার করেন। এরাটোস্থেনিস (Eratosthenes) প্রায় নিখুঁতভাবে পৃথিবীর পরিধি মেপে ফেলেছিলেন। দর্শনের ক্ষেত্রেও নতুন ধারার জন্ম হয়। এপিকিউরিয়ানবাদ (Epicureanism) শেখায়, জীবনের উদ্দেশ্য হলো ভয় ও যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে মানসিক প্রশান্তি (Ataraxia) লাভ করা। আর স্টোয়িকবাদ (Stoicism) শেখায়, আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে যুক্তি ও প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলাই সুখী হওয়ার পথ। (Green, 1991)।

শেষ কথা: কেন আমরা আজও গ্রিকদের কাছে ঋণী?

হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলো ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অবশেষে শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যের (Roman Empire) অধীনে চলে যায়। রাজনৈতিকভাবে গ্রিসের পতন ঘটল, কিন্তু তার চিন্তার মৃত্যু হলো না। রোমানরা গ্রিকদের শত্রু হিসেবে দেখেনি, দেখেছে শিক্ষক হিসেবে। তারা গ্রিক সংস্কৃতি, শিল্প, দর্শন এবং বিজ্ঞানকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। তাদের মাধ্যমেই গ্রিক জ্ঞান গোটা ইউরোপে এবং পরবর্তীকালে রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

আজ আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি, তার ভ্রূণ জন্মেছিল এথেন্সের পাথুরে মাটিতে। আমরা যে যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করতে শিখি, তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো আর অ্যারিস্টটল। থিয়েটারে গিয়ে যে নাটক দেখি, অলিম্পিকের মশাল যা আজও জ্বলে ওঠে চার বছর পর পর, বিজ্ঞানের জগতে যে প্রশ্ন করার মানসিকতা—সবকিছুর পেছনেই রয়েছে গ্রিকদের ছোঁয়া।

গ্রিক সভ্যতা নিখুঁত ছিল না। তাদের সমাজে দাসপ্রথা ছিল, নারীদের সমান অধিকার ছিল না, তাদের অবিরাম যুদ্ধ একে অপরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল প্রশ্ন করার সাহস। তারা সবকিছুকে প্রশ্ন করেছে—ঈশ্বরকে, রাষ্ট্রকে, প্রকৃতিকে, নিজেকে। এই অন্তহীন জিজ্ঞাসা আর জানার আগ্রহই তাদের অমর করে রেখেছে।

অনেক দিন আগের সেই মানুষগুলো যেন আজও আমাদের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে যায়— “ভাবো, প্রশ্ন করো, নিজেকে জানো।” তাদের সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়াটাই হয়তো সভ্যতার সবচেয়ে বড় সার্থকতা।

তথ্যসূত্র

  • Barnes, J. (Ed.). (1995). The Cambridge Companion to Aristotle. Cambridge University Press.
  • Boardman, J. (1985). Greek Art. Thames & Hudson.
  • Castleden, R. (2002). Minoans: Life in Bronze Age Crete. Routledge.
  • Chadwick, J. (1976). The Mycenaean World. Cambridge University Press.
  • Green, P. (1991). Alexander to Actium: The Historical Evolution of the Hellenistic Age. University of California Press.
  • Hansen, M. H. (2006). Polis: An Introduction to the Ancient Greek City-State. Oxford University Press.
  • Herodotus. (c. 440 BCE). The Histories (Translated by A. D. Godley, 1920). Harvard University Press.
  • Kitto, H. D. F. (1951). The Greeks. Penguin Books.
  • Martin, T. R. (2013). Ancient Greece: From Prehistoric to Hellenistic Times (2nd ed.). Yale University Press.
  • Miller, S. G. (2004). Ancient Greek Athletics. Yale University Press.
  • Plato. (c. 399 BCE). Apology. In Plato: Complete Works (J. M. Cooper, Ed.). Hackett Publishing.
  • Pomeroy, S. B. (2002). Spartan Women. Oxford University Press.
  • Pomeroy, S. B., Burstein, S. M., Donlan, W., & Tandy, D. W. (2018). A Brief History of Ancient Greece: Politics, Society, and Culture (4th ed.). Oxford University Press.
  • Russell, B. (1945). A History of Western Philosophy. Simon & Schuster.
  • Thucydides. (c. 411 BCE). History of the Peloponnesian War (R. Crawley, Trans.; R. Strassler, Ed.). Free Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.