Table of Contents
ভূমিকা
কিছু শব্দ আছে, যারা নিছকই শব্দ নয়। তারা যেন জীবন্ত সত্তা, একেকজন পর্যটক। দূর দেশ থেকে আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে তার জন্মস্থানের জলহাওয়া, পোশাক-আশাক, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। সে যখন নতুন কোনো দেশে পা রাখে, তখন শুধু নিজেকেই পরিচয় করায় না, বরং সেই নতুন দেশের সবকিছুকে নিজের চশমা দিয়ে দেখতে শুরু করে। আর এভাবেই, অজান্তেই, সে সেই নতুন দেশটাকে একটু একটু করে বদলে দিতে থাকে।
‘ট্রান্সজেন্ডার’ (Transgender) তেমনই একটি শব্দ। আটলান্টিকের ওপার থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সে আজ আমাদের উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে পাসপোর্টের মতো জ্বলজ্বল করছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের স্বীকৃতি, তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে রয়েছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিশ্রুতি, আর তার চোখে রয়েছে এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন—যেখানে লিঙ্গের পরিচয়ে কেউ পিছিয়ে থাকবে না। এই নবাগত অতিথিকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। সরকারি দপ্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম, সিনেমার পর্দা থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের এনজিও অফিস—সর্বত্রই তার জয়জয়কার। বহু মানুষের জীবনে এই শব্দটি আশার আলো নিয়ে এসেছে, দিয়েছে আত্মপরিচয়ের ভাষা, দিয়েছে সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করার নতুন অস্ত্র।
কিন্তু এই আলোর ঝলকানির নিচে কি কোনো গভীর ছায়া লুকিয়ে আছে? এই অতিথি কি কেবলই একজন নিরীহ বন্ধু, নাকি তার হাসির আড়ালে রয়েছে এক সূক্ষ্ম আধিপত্যের রাজনীতি? একটি শব্দ যখন তার জন্মস্থানের যাবতীয় ধারণা, বিভাজন আর ক্ষমতার সমীকরণকে স্যুটকেসে ভরে নিয়ে আসে, তখন সে কি পারে অন্য এক সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাসকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে? নাকি সে তার নিজের আদলেই সবকিছুকে নতুন করে সাজাতে চায়?
এই জটিল এবং কিছুটা অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো নিয়েই দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেছেন, ভেবেছেন, এবং একসঙ্গে লিখেছেন অনিরুদ্ধ দত্ত (Aniruddha Dutta) এবং রায়না রায় (Raina Roy)। তাদের এই যুগলবন্দী এক অসাধারণ মেলবন্ধন। অনিরুদ্ধ একজন প্রখর ধীসম্পন্ন গবেষক (Ethnographer), যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে জ্ঞানচর্চা করেন, তত্ত্বের জটিল পৃথিবীতে বিচরণ করেন। আর রায়না হলেন মাটির কাছাকাছি থাকা একজন কর্মী (Activist), যার জীবনের প্রতিটি দিন কাটে পূর্ব ভারতের লিঙ্গ ও যৌন প্রান্তিক (Gender/Sexually Marginalized) মানুষদের সাথে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে। তাদের দুজনের অবস্থান ভিন্ন, একজনের হাতে অ্যাকাডেমিক পুঁজি, আরেকজনের হাতে মাঠের অভিজ্ঞতা। এই দুই ভিন্ন জগৎ থেকে আসা মানুষ দুটি যখন তাদের নোটবুক মেলালেন, তখন যে কথোপকথন তৈরি হলো, তাতেই জন্ম নিলো “Decolonizing Transgender in India: Some Reflections” নামক একটি যুগান্তকারী প্রবন্ধ। এটি কেবল একটি অ্যাকাডেমিক লেখা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ইশতেহারও বটে।
এই প্রবন্ধটি কোনো চূড়ান্ত রায় দেয় না, বরং আমাদের কিছু ভাবতে শেখায়। এটি আমাদের হাত ধরে নিয়ে যায় পরিচয়ের সেই অলিগলিতে, যেখানে আলো-ছায়ার খেলা চলে। চলুন, আমরা সেই পথেই হাঁটি। বোঝার চেষ্টা করি, ‘ট্রান্সজেন্ডার’ নামক এই বৈশ্বিক ছাতাটি যখন ভারতের নিজস্ব লিঙ্গ বৈচিত্র্যের (Gender Variance) উপর মেলে ধরা হয়, তখন সেই ছাতার নিচে কারা আশ্রয় পায়, আর কাদের গা থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ে। এই যাত্রা হয়তো আমাদের নিজেদের পরিচয় নিয়ে, আমাদের ভাষা নিয়ে, এবং আমাদের মুক্তির ধারণা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করবে।
স্যুটকেস ভর্তি ধারণা: ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি একা আসে না
কোনো শব্দই শূন্যে ভেসে থাকে না। প্রতিটি শব্দের একটি ইতিহাস থাকে, একটি ভূগোল থাকে। ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি যে পশ্চিমা সমাজ থেকে এসেছে, সেখানে তার গড়ে ওঠার পেছনে নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক বাস্তবতা কাজ করেছে। দত্ত ও রায় এই বাস্তবতাগুলোকেই বলছেন ‘কনসেপচুয়াল ব্যাগেজ’ (Conceptual Baggage) বা ধারণাগত বোঝা। এই বোঝাগুলো অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী। আসুন, এই অদৃশ্য স্যুটকেসটা একটু খুলে দেখা যাক, ভেতরে কী কী আছে।
১. সিস-ট্রান্স বাইনারি (The Cis-Trans Binary): পৃথিবীর দ্বিবিভাজন
এই স্যুটকেসের সবচেয়ে বড় এবং ভারী জিনিসটি হলো একটি বাইনারি বা দ্বিবিভাজনের ধারণা। এই ধারণা অনুযায়ী, লিঙ্গ পরিচয়ের দিক থেকে পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে দুটি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ভাগে ভাগ করা যায়।
-
সিসজেন্ডার (Cisgender): এরা হলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। জন্মের সময় চিকিৎসাবিজ্ঞান বা পরিবার তাদের যে লিঙ্গ (Sex) নির্ধারণ করে দিয়েছিল (যেমন, পুরুষ বা নারী), তাদের লিঙ্গ পরিচয় (Gender Identity) বা আত্ম-উপলব্ধিও তার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ, যাকে ছেলে বলা হয়েছে, সে নিজেকে ছেলেই মনে করে। ‘সিস’ শব্দটি ল্যাটিন, যার অর্থ ‘একই পাশে’। এই শব্দটি তৈরিই করা হয়েছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’-এর বিপরীত হিসেবে, যাতে সিসজেন্ডার মানুষকে ‘স্বাভাবিক’ বা ‘সাধারণ’ এবং ট্রান্সজেন্ডার মানুষকে ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘ব্যতিক্রম’ বলে মনে না হয়। কিন্তু এই আপাত নিরীহ বিভাজনটি এক ধরনের অদৃশ্য ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করে, যেখানে ‘সিস’ পরিচয়টিই হয়ে ওঠে মাপকাঠি বা আদর্শ।
-
ট্রান্সজেন্ডার (Transgender): এরা হলেন সেই মানুষেরা, যাদের লিঙ্গ পরিচয় তাদের জন্মগত লিঙ্গের সাথে মেলে না। ‘ট্রান্স’ শব্দের অর্থ ‘বিপরীত পাশে’ বা ‘জুড়ে’।
এই বিভাজনটি পশ্চিমা অ্যাক্টিভিজমের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। এটি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের জন্য স্বতন্ত্র আইনি ও সামাজিক স্বীকৃতি দাবি করার ভিত্তি তৈরি করে। কিন্তু এর সমস্যা হলো, এটি পৃথিবীকে সাদা এবং কালো—এই দুটি রঙে দেখে। যারা এই দুই ভাগের কোনোটিতেই নিজেকে ফেলতে পারেন না বা চান না, যারা সময়ের সাথে সাথে নিজেদের অবস্থান বদলান, সেই ধূসর অঞ্চলের মানুষদের জন্য এখানে জায়গা খুব কম। এই বাইনারি কাঠামো ঔপনিবেশিক আমলের জনগণনা বা সেন্সাসের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতের জটিল সামাজিক বাস্তবতাকে (যেমন, বর্ণপ্রথা) নিজেদের বোঝার সুবিধার্থে সরল, অনড় ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছিল (Dirks, 2001)। পরিচয়ের এই দ্বিবিভাজনও তেমনি এক ধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক শাসন চাপিয়ে দেয়।
২. হোমো-ট্রান্স বাইনারি (The Homo-Trans Binary): পরিচয় বনাম আকর্ষণ
স্যুটকেসের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি হলো আরেকটি বিভাজন। এটি বলে যে, তোমার লিঙ্গ পরিচয় (তুমি কে?) এবং তোমার যৌন অভিমুখিতা (Sexual Orientation) (তুমি কার প্রতি আকৃষ্ট হও?)—এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং স্বাধীন বিষয়। পশ্চিমা এলজিবিটি (LGBT) আন্দোলনের ইতিহাসে এই বিভাজনটি তৈরি করা হয়েছিল একটি কৌশলগত কারণে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, মনোবিজ্ঞান সমকামিতাকে (Homosexuality) এক ধরনের ‘লিঙ্গীয় বিপর্যয়’ বা ‘Gender Inversion’ হিসেবে দেখত। অর্থাৎ, একজন গে (Gay) পুরুষকে অপরিহার্যভাবে ‘মেয়েলি’ এবং একজন লেসবিয়ান (Lesbian) নারীকে ‘পুরুষালি’ বলে মনে করা হতো। এই ডাক্তারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তি পেতে এবং মূলধারার সমাজে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য অ্যাক্টিভিস্টরা জোরালোভাবে বলেন, “আমরাও তোমাদের মতোই পুরুষ, শুধু আমরা পুরুষদের ভালোবাসি” অথবা “আমরাও তোমাদের মতোই নারী, শুধু আমরা নারীদের ভালোবাসি।”
এই পৃথকীকরণের মাধ্যমে তারা একদিকে যেমন সমকামিতাকে ‘স্বাভাবিক’ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, তেমনই ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের সংগ্রামকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এই পরিষ্কার বিভাজনটি কি সব সংস্কৃতির জন্য সত্য? দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে, যেখানে লিঙ্গ এবং যৌনতা প্রায়শই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেখানে এই মডেলটি কি খাপ খায়? যেমনটা অখিল কাটিয়াল (Akhil Katyal, 2010) দেখিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ‘গান্ডু’ (Feminized, anally-penetrated person) শব্দটি যতটা অপমানজনক, ‘লণ্ডেবাজ’ (The man who plays around with boys) শব্দটি ততটা নয়। এর কারণ, এখানে মূল সমস্যাটি সমকামী আকর্ষণ নয়, বরং পৌরুষ বা ম্যাসকুলিনিটি (Masculinity) থেকে বিচ্যুতি। এখানে লিঙ্গ আর যৌনতাকে আলাদা করার পশ্চিমা মডেলটি হোঁচট খায়। কোঠি বা হিজড়াদের পরিচয় এই মডেল দিয়ে বোঝা প্রায় অসম্ভব, কারণ তাদের সত্তার মধ্যেই লিঙ্গীয় ভিন্নতা এবং যৌন আকাঙ্ক্ষা একাকার হয়ে আছে।
৩. রৈখিক পরিবর্তনের আখ্যান (The Linear Transition Narrative): একমুখী যাত্রার গল্প
এই স্যুটকেসের তৃতীয় জিনিসটি হলো একটি সরলরৈখিক গল্প। এই গল্প অনুযায়ী, ট্রান্সজেন্ডার হওয়া মানে একটি যাত্রা—একটি নির্দিষ্ট বিন্দু (জন্মগত লিঙ্গ) থেকে শুরু করে আরেকটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে (কাঙ্ক্ষিত লিঙ্গ) পৌঁছানো। এই যাত্রার একটি নির্দিষ্ট ‘টেলস’ (Telos) বা চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে। সাধারণত, এই যাত্রাটি হয় পুরুষ থেকে নারী (Male-to-Female, MTF) অথবা নারী থেকে পুরুষ (Female-to-Male, FTM)। এই যাত্রাপথে কিছু নির্দিষ্ট ধাপ থাকে: প্রথমে আত্ম-উপলব্ধি, তারপর পরিবারের কাছে প্রকাশ (Coming Out), তারপর মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন, হরমোন থেরাপি (Hormone Therapy), এবং সবশেষে চূড়ান্ত গন্তব্য হিসেবে সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি (Sex Reassignment Surgery – SRS)। এই সার্জারির পর একজন ‘সম্পূর্ণ’ নারী বা পুরুষ হিসেবে নতুন জীবন শুরু হয়।
এই আখ্যানটি অনেকের জন্য সত্যি এবং জীবনদাতা। কিন্তু এটি যখন একমাত্র বা ‘আদর্শ’ পথ হিসেবে উপস্থাপিত হয়, তখন এটি একটি প্রেসক্রিপশনে পরিণত হয়। যারা এই সরলরৈখিক পথে হাঁটেন না, যারা সার্জারি চান না বা করাতে পারেন না, যারা নারী বা পুরুষ—এই দুইয়ের কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে চান না, তাদের কী হবে? এই আদর্শ আখ্যানটি কি তাদের যাত্রাকে ‘অসম্পূর্ণ’ বা ‘ব্যর্থ’ বলে দেগে দেয় না? এই মডেলটি একটি চিকিৎসা-শিল্প কমপ্লেক্সকেও (Medical-Industrial Complex) উৎসাহিত করে, যেখানে হরমোন এবং সার্জারিই হয়ে ওঠে ‘প্রকৃত’ ট্রান্স পরিচয়ের একমাত্র প্রমাণ।
এই তিনটি ধারণার স্যুটকেস নিয়েই ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশ করেছে। আর এখানেই দত্ত ও রায়ের মূল উদ্বেগের শুরু। এই পশ্চিমা চশমা দিয়ে ভারতের জটিল, বহুমাত্রিক এবং ঐতিহাসিক লিঙ্গ বৈচিত্র্যকে মাপতে গেলে, অনেক কিছুই হয় হারিয়ে যায়, নয়তো ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়।
পর্যটক আসার আগে: দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব উঠান
‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা এনজিও-র সাইনবোর্ড আসার অনেক আগে থেকেই ভারতবর্ষের মাটিতে লিঙ্গ ও যৌনতার এক নিজস্ব জগৎ ছিল। সেই জগৎ কোনো তত্ত্ব দিয়ে গড়া নয়, বরং মানুষের জীবনযাপন, তাদের ভাষা, তাদের সম্পর্ক এবং তাদের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তৈরি। রায়না রায়ের নিজের জীবনের গল্পই সেই জগতের একটি জীবন্ত দলিল।
রায়না যখন কৈশোরে কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় প্রথম যান, তখন তিনি এমন এক পৃথিবীর সন্ধান পান, যা বাইরের ভদ্র সমাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেই ক্রুজিং পার্কগুলো ছিল একাধারে মুক্তির এবং বিপদের জায়গা। সেখানে তিনি দেখা পান তার মতোই আরও অনেক ‘মেয়েলি ছেলে’র। তারা বেশিরভাগই ছিলেন নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। বাইরের দুনিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা নিজেদের জন্য একটি আশ্রয় তৈরি করে নিয়েছিলেন—একটি নিজস্ব সম্প্রদায়, যার ভিত্তি ছিল এক ধরনের ভগ্নিত্ব বা ‘সিস্টারহুড’। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতেন এক বিশেষ সাংকেতিক ভাষায় (যাকে অনেক সময় ‘হিজড়া ফার্সি’ বা স্থানীয় অপভ্রংশ বলা হয়)। এই ভাষা বাইরের কেউ বুঝত না। এটি ছিল তাদের আত্মরক্ষার বর্ম এবং ঐক্যের প্রতীক। এই ভাষায় তারা একে অপরের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করতেন, নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতেন এবং বাইরের জগতের বিপদ থেকে পরস্পরকে সতর্ক করতেন।
এই জগতেই রায়না পরিচিত হন ‘কোঠি’ (Kothi) এবং ‘দুরানি’ (Dhurani)র মতো শব্দের সাথে। এই শব্দগুলো প্রমিত বাংলা অভিধানে পাওয়া যাবে না, কিন্তু এই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এগুলোর অর্থ ছিল খুব স্পষ্ট। কোঠি বলতে বোঝানো হতো সেইসব জন্মসূত্রে পুরুষদের, যাদের মন, আচরণ এবং সত্তা ছিল মেয়েলি এবং যারা মূলত পুরুষদের প্রতিই আকৃষ্ট হতেন।
কিন্তু এই কোঠি জগৎটিও একরঙা ছিল না। এর ভেতরেও ছিল নানা বৈচিত্র্য এবং স্তরবিন্যাস:
-
কোডি কোঠি (Kodi Kothi): এরা বাইরে থেকে পুরুষের পোশাক পরতেন এবং সমাজে পুরুষ হিসেবেই চলতেন। কিন্তু তাদের ভেতরের সত্তা ছিল কোঠি। তাদের চালচলন, কথা বলার ভঙ্গি এবং আকাঙ্ক্ষা ছিল মেয়েলি। দিনের বেলায় তারা হয়তো কারখানার শ্রমিক বা দোকানের কর্মচারী, কিন্তু রাতের অন্ধকারে ক্রুজিং পার্কে তারা নিজেদের কোঠি সত্তায় ফিরে যেতেন।
-
ভেলকি কোঠি (Bhelki Kothi): এরা ছিলেন আরও সাহসী বা প্রকাশ্য। তারা মেয়েদের পোশাক (যেমন, শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ) পরতেন এবং নিজেদের নারীসত্তা নিয়েই জনসমক্ষে বিচরণ করতেন। এদেরকে ‘ভড়ক্তি’ বা ‘ভেলী’ও বলা হতো। তাদের এই প্রকাশ্য নারীত্ব প্রায়শই তাদের আরও বেশি সামাজিক লাঞ্ছনা এবং হিংসার শিকার করত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই পরিচয়গুলো পাথরে খোদাই করা ছিল না। এগুলো ছিল তরল এবং পরিবর্তনশীল। একজন ব্যক্তি তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে, এমনকি দিনের বিভিন্ন সময়ে, কোডি এবং ভেলকির মধ্যে আসা-যাওয়া করতে পারতেন। রায়না নিজেও তার যৌবনে অ্যান্ড্রোজিনাস (Androgynous) এবং মেয়েলি পোশাকের মধ্যে দিয়ে নিজের পরিচয় খুঁজেছেন। এই তরলতা কোনো বিভ্রান্তি ছিল না, বরং এটাই ছিল তাদের বেঁচে থাকার কৌশল এবং আত্মপ্রকাশের ভঙ্গি।
এই কোঠি সম্প্রদায়ের সাথে ভারতের সুপ্রাচীন হিজড়া (Hijra) সম্প্রদায়ের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কিন্তু জটিল। হিজড়ারা কেবল একটি পরিচয় নয়, একটি সুসংগঠিত সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যাদের নিজস্ব গুরু-শিষ্যের পরম্পরা বা ‘ঘরানা’ (Gharana) আছে। তাদের জীবিকাও নির্দিষ্ট—বিয়ে বা সন্তানের জন্ম উপলক্ষে নেচে-গেয়ে আশীর্বাদ করা, যাকে ‘বাধাই’ (Badhai) বলা হয়। সেরেনা নন্দার (Serena Nanda, 1990) গবেষণা দেখায়, হিজড়ারা সমাজে এক দ্বৈত ভূমিকা পালন করেন—একদিকে তারা অশুভ এবং ভয়ের পাত্র, অন্যদিকে তাদের আশীর্বাদ শুভ বলে মনে করা হয়। অনেক কোঠিই জীবনের কোনো এক পর্যায়ে হিজড়া ঘরানায় যোগ দিতেন। কেউ কেউ ‘নির্ভাণ’ (Nirvan) নামক এক কষ্টকর অপারেশনের (Penectomy and Castration) মধ্যে দিয়ে যেতেন, যা তাদের শরীরকে আমূল বদলে দিত।
আবার অনেকে, রায়নার মতো, হিজড়া ঘরানায় আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ না দিয়েও তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। কেউ হয়তো কিছুদিনের জন্য হিজড়া পেশায় যেতেন, আবার পরে কোডি কোঠি হিসেবে সাধারণ জীবনে ফিরে আসতেন। গায়ত্রী রেড্ডির (Gayatri Reddy, 2005) গবেষণা যেমন দেখিয়েছে, হিজড়ারা নিজেদের নারী বা পুরুষ—কোনোটির থেকেই আলাদা মনে করেন এবং তাদের সামাজিক ভূমিকা এই স্বতন্ত্রতার উপরেই নির্ভরশীল। তারা নারী হিসেবে ‘পাস’ (Passing) করতে চান না, যদিও কেউ তাদের নারী ভাবলে তারা খুশি হন।
এই নিজস্ব জগৎটির দিকে তাকালে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই:
-
পরিচয়ের অস্থিতিশীলতা ও বহুত্ব: এখানে পরিচয় ছিল পরিবর্তনশীল। নারী বা পুরুষ—এই বাইনারির বাইরেও তাদের নিজস্ব জগৎ ছিল।
-
লিঙ্গ ও যৌনতার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন: কোঠি পরিচয়টি পশ্চিমা ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা ‘গে’—কোনোটির সাথেই পুরোপুরি মেলে না। এটি একইসাথে একটি লিঙ্গীয় পরিচয় এবং একটি যৌন পরিচয়।
-
শ্রেণি, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের গুরুত্ব: এই গোষ্ঠীগুলো কেবল লিঙ্গ বা যৌনতার ভিত্তিতে তৈরি হয়নি। শ্রেণি (Class) এবং বর্ণের (Caste) অবস্থান ছিল এদের পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রায়না যেমনটা উল্লেখ করেছেন, এই মানুষেরা বেশিরভাগই ছিলেন সমাজের নিম্নবর্গ থেকে আসা, দলিত (Dalit) বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। তাদের সংগ্রাম কেবল পরিচয়ের ছিল না, ছিল টিকে থাকারও। তাদের কাছে লিঙ্গীয় আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতার চেয়ে অনেক সময় দৈনন্দিন রুটি-রুজির সংস্থান বেশি জরুরি ছিল।
এই সমৃদ্ধ, জটিল এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই ‘ট্রান্সজেন্ডার’ নামক বৈশ্বিক পর্যটকের আগমন ঘটে। আর তখনই শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।
এনজিও-রাজের আগমন: যেভাবে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ একচ্ছত্র অধিপতি হলো
বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে ভারতে এলজিবিটিকিউ (LGBTIQ) আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করলেও, ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষে। এই উত্থানের পেছনে সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি ছিল রাষ্ট্র (The State), আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংস্থা (Transnational Funders) এবং উন্নয়নমূলক খাত বা এনজিও-গুলো (Non-Governmental Organizations), বিশেষ করে এইচআইভি-এইডস (HIV-AIDS) প্রতিরোধের প্রেক্ষাপটে।
এইডস প্রতিরোধের জন্য বিশ্বজুড়ে যখন বিপুল পরিমাণ অর্থায়ন শুরু হলো, তখন সেই অর্থ ব্যয়ের জন্য প্রয়োজন পড়ল নির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য এবং ‘টার্গেট’ করা যায় এমন জনগোষ্ঠী। ভারতের ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম (NACP)-এর দ্বিতীয় পর্বে (২০০২-২০০৭) ‘এমএসএম’ (MSM – Men who have Sex with Men) বা ‘পুরুষের সাথে যৌন সংসর্গকারী পুরুষ’-কে একটি ‘উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ’ (High Risk) গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সময়েই পূর্ব ভারতে কোঠি-দুরানি সম্প্রদায়ের মানুষদের সংগঠিত করে অনেক কমিউনিটি-ভিত্তিক সংগঠন (CBO – Community-Based Organizations) গড়ে ওঠে, যারা এমএসএম ক্যাটাগরিতে তহবিল পেত। রায়না নিজেও এই ধরনের সংস্থায় কাজ করার সময় দেখেছেন, কীভাবে ফিল্ডওয়ার্কাররা ক্রুজিং সাইট থেকে মানুষদের ‘কোঠি’ হিসেবে চিহ্নিত করে এইডস সচেতনতার আওতায় আনছেন। লরেন্স কোহেনের (Lawrence Cohen, 2005) ভাষায়, এইডস প্রতিরোধের বিশ্বায়নের প্রয়োজনে—বা ‘এইডস কসমোপলিটানিজম’-এর যুগে—‘কোঠি’ একটি ‘উদীয়মান বাস্তবতা’ (Emergent Reality) হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু খেলাটা বদলে গেল NACP-র তৃতীয় পর্বে (২০০৭-২০১২)। এই সময়ে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি সরকারি পরিভাষায় শক্তিশালীভাবে প্রবেশ করে। প্রাথমিকভাবে, ঔপনিবেশিক আমলের শব্দ ‘ইউনাক’ (Eunuch)-এর বদলে হিজড়াদের বোঝাতে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এর পরপরই, ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (UNDP)-এর মতো প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ভারতে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জন্য আরও নির্দিষ্ট কর্মসূচি তৈরির জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
এর ফলস্বরূপ, ২০০৯ সালে ভারতের বিভিন্ন বড় শহরে আঞ্চলিক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, সারা দেশের জন্য ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা ‘টিজি’ (TG)-র একটি সাধারণ, কার্যকরী সংজ্ঞা তৈরি করা। কলকাতার এমনই একটি সভায় যে সংজ্ঞাটি উঠে আসে, তা দত্ত ও রায়ের প্রবন্ধের কেন্দ্রবিন্দু। সেই সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘ট্রান্সজেন্ডার’ একটি ছাতা-পরিভাষা (Umbrella Term), যার নিচে ট্রান্সসেক্সুয়াল, ক্রস-ড্রেসার থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন ‘স্থানীয়’ পরিচয়, যেমন—কোঠি, দুরানি, হিজড়া ইত্যাদি সবাই অন্তর্ভুক্ত।
আপাতদৃষ্টিতে এই সংজ্ঞাটিকে অত্যন্ত উদার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু দত্ত ও রায় এর গভীরে লুকিয়ে থাকা এক সূক্ষ্ম ক্ষমতার রাজনীতিকে উন্মোচিত করেছেন। এই প্রক্রিয়াটিকে তারা বলছেন স্কেলার হায়ারার্কি (Scalar Hierarchy) বা মাত্রার অনুক্রম তৈরি করা। এই অনুক্রমে:
-
শীর্ষে রয়েছে: ‘ট্রান্সজেন্ডার’—একটি বৈশ্বিক (Global), সর্বজনীন, আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক ক্যাটাগরি।
-
নীচে রয়েছে: ‘কোঠি’, ‘হিজড়া’, ‘দুরানি’—এগুলো হলো ‘স্থানীয়’ (Local), ‘আঞ্চলিক’ (Regional) বা ‘ঐতিহ্যবাহী’ (Traditional) পরিচয়।
ব্যাপারটা অনেকটা একটা বহুজাতিক কোম্পানির স্থানীয় ছোট দোকানগুলোকে কিনে নেওয়ার মতো। দোকানগুলো হয়তো থাকে, কিন্তু তাদের নিজস্ব পরিচয় মুছে গিয়ে তারা এখন বড় কোম্পানির একটি ‘ব্র্যান্ড’ বা ‘আউটলেট’ মাত্র। একইভাবে, ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি কোঠি বা হিজড়াদের স্বতন্ত্র ইতিহাস, জটিলতা এবং দর্শনকে মুছে দিয়ে তাদের কেবল ‘ট্রান্সজেন্ডারের ভারতীয় সংস্করণ’ হিসেবে পরিচিত করায়। গায়ত্রী চক্রবর্তীর স্পিভাকের (Gayatri Chakravorty Spivak, 1999) কথা মনে রেখে বলা যায়, জ্ঞানের জগতেও এক ধরনের আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজন (International Division of Labor) কাজ করে। যেখানে পশ্চিমা ধারণাগুলো ‘তত্ত্ব’ বা ‘থিওরি’ হিসেবে গণ্য হয়, আর অ-পশ্চিমা জ্ঞানকে কেবল ‘ডেটা’ বা ‘উদাহরণ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখানেই ‘ডিকোলোনাইজিং’ বা উপনিবেশমুক্ত করার প্রশ্নটি সবচেয়ে জরুরি হয়ে ওঠে। কারণ এই জ্ঞানীয় আধিপত্য এক নতুন ধরনের উপনিবেশবাদ (Neocolonialism), যা তরবারির বদলে ক্যাটাগরি এবং তহবিলের মাধ্যমে শাসন করে।
সীমান্তের লড়াই: কে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ হতে পারবে এবং কে পারবে না?
যখনই কোনো একটি ক্যাটাগরি ক্ষমতা, সম্মান এবং অর্থায়নের উৎস হয়ে ওঠে, তখনই সেই ক্যাটাগরির সীমানা নিয়ে তীব্র সংঘাত শুরু হয়। ‘ট্রান্সজেন্ডার’ ক্যাটাগরিটি প্রভাবশালী হওয়ার সাথে সাথে ভারতেও এই ‘সীমান্তের লড়াই’ (Border Wars) শুরু হয়ে যায়, যা দত্ত (Dutta, 2013) তার অন্য একটি লেখায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
সবচেয়ে বড় এবং তিক্ত বিতর্কটি তৈরি হয়েছিল এমএসএম (MSM) এবং টিজি (TG)-র সীমানা নিয়ে। যেহেতু রাষ্ট্র এবং ফান্ডাররা এই দুটি গোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা তহবিল বরাদ্দ করছিল, তাই কোন সম্প্রদায় কোন বাক্সে পড়বে, তা নিয়ে অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে রেষারেষি শুরু হয়। রায়না তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এমনই একটি রক্তক্ষয়ী (রূপক অর্থে) সভার বর্ণনা দিয়েছেন। ২০১০ সালে ‘প্রজেক্ট পেহচান’ (Project Pehchan) নামক একটি বড় এইচআইভি প্রকল্পের জন্য কলকাতায় একটি আলোচনা সভা চলছিল। সেই সভায়, একদল অ্যাক্টিভিস্ট, যারা মূলত নিজেদের ট্রান্স নারী হিসেবে পরিচয় দিতেন, তারা অন্য একদল অ্যাক্টিভিস্টকে সরাসরি আক্রমণ করে বসেন। তাদের অভিযোগ ছিল, এই দ্বিতীয় দলটি আসলে ‘পুরুষ’ (Men), যারা অতীতে নিজেদের ‘কোঠি’ বা ‘এমএসএম’ বলত, কিন্তু এখন শুধুমাত্র টিজি-দের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল পাওয়ার লোভে নিজেদের ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বলে দাবি করছে।
এই ঘটনাটি সম্প্রদায়ের ভেতরে আগে থেকেই বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলোকে—যেমন কোডি কোঠি এবং ভেলকি কোঠি বা হিজড়াদের মধ্যেকার উত্তেজনা—প্রাতিষ্ঠানিক সিলমোহর দিয়ে আরও তীব্র করে তোলে।
কিন্তু এই চাপের মুখেও প্রতিরোধের স্বর একেবারে হারিয়ে যায়নি। রায়না সেই সভার এক অসাধারণ মুহূর্তের কথা স্মরণ করেন। যখন এই বিতর্ক তুঙ্গে, তখন রায়নার এক হিজড়া বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বলেন, “আমি পেশায় হিজড়া, লিঙ্গ পরিচয়ে টিজি, আর যৌন আচরণে এমএসএম।” এই একটি বাক্য—কী নিপুণ এবং ধ্বংসাত্মক তার শক্তি! এটি এক ঝটকায় ফান্ডারদের তৈরি করা সমস্ত কৃত্রিম দেয়ালকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। এটি দেখিয়ে দেয় যে, মানুষের জীবন এবং তার বহুস্তরীয় পরিচয় এই সরলরৈখিক, পারস্পরিকভাবে স্বতন্ত্র বাক্সগুলোর চেয়ে অনেক বেশি জটিল এবং সমৃদ্ধ। এটি ছিল পরিচয়ের উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এক চতুর এবং শক্তিশালী প্রতিরোধ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর চাপই জয়ী হয়। এই বিতর্কের পর, ‘কোঠি’ শব্দটি উন্নয়ন খাতের পরিভাষা থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ সিবিও (CBO) তখন বাধ্য হয়ে নিজেদের হয় ‘টিজি’ নয়তো ‘এমএসএম’ হিসেবে নথিভুক্ত করে।
এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। সম্প্রদায়ের ভেতরের ভাষা (Intracommunity Usage) এবং বাইরের বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাষার (Official Usage) মধ্যে একটি গভীর বিভাজন তৈরি হয়ে গেল। রায়না যেমনটা বলছেন, কলকাতার রাস্তায় একজন কোঠি আরেকজন কোঠিকে দেখে আজও “হেই, ইউ ট্রান্সজেন্ডার!” বলে ডাকেন না। তারা নিজেদের মধ্যে ‘কোঠি’ বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু যখন কোনো ফান্ডার, গবেষক বা সরকারি কর্মকর্তার সামনে কথা বলতে হয়, তখন তাদের ‘ট্রান্সজেন্ডার’ নামক আনুষ্ঠানিক পোশাকটি পরতে হয়।
এই বিভাজনটি কেবল ভাষাগত নয়, এটি ক্ষমতারও। যারা ইংরেজি ভাষা এবং এই নতুন ‘রাজনৈতিকভাবে সঠিক’ (Politically Correct) পরিভাষায় পারদর্শী, তারাই অ্যাক্টিভিজম এবং উন্নয়ন খাতের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সুযোগ পান। এই ‘ভাষাগত পুঁজি’ (Linguistic Capital) একটি নতুন ধরনের অভ্যন্তরীণ হায়ারার্কি তৈরি করে। আর যারা শুধুমাত্র নিজেদের সম্প্রদায়ের ভাষায় কথা বলেন, সেই দলিত ও নিম্নবিত্ত কোঠিদের কণ্ঠস্বর ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে, যা তাদের আরও প্রান্তিক করে তোলে।
‘ভদ্রমহিলা’ হওয়ার চাপ এবং ‘সম্পূর্ণ’ নারীর অলীক ধারণা
‘ট্রান্সজেন্ডার’ ক্যাটাগরির প্রসার কেবল প্রাতিষ্ঠানিক জগৎকেই প্রভাবিত করেনি, এটি সম্প্রদায়ের ভেতরের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদার ধারণাকেও নতুন করে গড়ে তুলেছে। বহু ক্ষেত্রেই, ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি ‘ট্রান্সসেক্সুয়াল’ (Transsexual) শব্দের সাথে সমার্থক হয়ে উঠেছে। এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘রূপান্তরকামী’ (Rupantarkami) শব্দটি জনপ্রিয় হয়েছে, যা মূলত রূপ বা ফর্মে রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষাকে বোঝায়। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ থেকে অন্য লিঙ্গে ‘সম্পূর্ণ’ রূপান্তরিত হওয়ার ধারণা।
এই নতুন মডেলে, একজন ‘ট্রান্স নারী’ (Trans Woman) হিসেবে পরিচিতি পাওয়াটা অনেক ক্ষেত্রেই হিজড়া বা কোঠি পরিচয়ের চেয়ে বেশি ‘সম্মানজনক’ (Respectable) বলে বিবেচিত হতে শুরু করে। এর কারণ, হিজড়া বা কোঠিদের জীবনযাত্রার সাথে প্রায়শই যৌনকর্ম, ভিক্ষাবৃত্তি বা জনসমক্ষে ‘অমার্জিত’ বা ‘উচ্ছৃঙ্খল’ আচরণের মতো বিষয়গুলো জড়িয়ে থাকে, যা মধ্যবিত্তীয় ‘ভদ্রতা’র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয় না।
রায়না এমন অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, যেখানে সিবিও নেতারা সম্প্রদায়ের সদস্যদের হিজড়া/কোঠির মতো আচরণ না করে ‘ভদ্রমহিলা’র মতো আচরণ করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তাদের যুক্তি, “তোমরা যেভাবে পাবলিক প্লেসে চিৎকার-চেঁচামেচি করো, কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়ে কি অমন করে? তোমাদের সম্মান থাকবে কী করে?” এখানে (মূলত উচ্চবর্ণ, মধ্যবিত্ত) নারীত্বকে (Womanhood) একটি আদর্শ হিসেবে তুলে ধরে লিঙ্গীয় প্রান্তিকতার (Gender Liminality) অন্যান্য প্রকাশগুলোকে—যা কিনা এই সম্প্রদায়ের শক্তি ও প্রতিরোধের ভাষা—তাকে অপমান করা হচ্ছে, তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মর্যাদার এই নতুন অনুক্রমটি শারীরিক রূপান্তরের ক্ষেত্রেও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। হিজড়া সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী অপারেশন, যাকে তাদের সাংকেতিক ভাষায় ‘ছিবড়ানো’ (Chhibrano) বলা হয়, তাকে আধুনিক ‘সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি’ (SRS)-র তুলনায় ‘নিম্নমানের’, ‘অস্বাস্থ্যকর’ বা ‘অসম্পূর্ণ’ বলে হেয় করা হতে থাকে। তিস্তা দাসের (Tista Das) মতো ট্রান্স নারীরা, যারা আধুনিক সার্জারির মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছেন, তাদের ‘সম্পূর্ণ নারীত্ব’ (Sampurna Womanhood) অর্জনের আখ্যানটি অনেকের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠে (Das, 2013)। এর ফলে, যারা এই অত্যন্ত ব্যয়বহুল সার্জারি করাতে পারেন না বা চান না, সেই বিশাল সংখ্যক হিজড়া এবং নন-ট্রান্সসেক্সুয়াল কোঠিদের ‘অসম্পূর্ণ’ বা ‘কম মানুষ’ হিসেবে দেখার একটি বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি হয়।
এই প্রক্রিয়াটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে, কীভাবে একটি বৈশ্বিক ধারণা—যা মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে—স্থানীয় প্রেক্ষাপটে এসে নতুন ধরনের সামাজিক স্তরবিন্যাস (Social Hierarchy) এবং কলঙ্ক (Stigma) তৈরি করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত সম্প্রদায়ের ঐক্য এবং বৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
পরিচয়ের মানচিত্র: সরল রেখা বনাম আঁকাবাঁকা পথ
রাষ্ট্র, আইন এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলো সবসময়ই চায় পরিচয়ের একটি পরিষ্কার, স্থিতিশীল এবং সহজবোধ্য মানচিত্র। তারা চায় প্রতিটি নাগরিক একটি নির্দিষ্ট, সুসংগত এবং একমাত্রিক পরিচয়ের (Stable, Consistent, and Singular Identity) বাক্সে প্রায় ফিট (neatly fit) হয়ে যাক। কারণ, তবেই তাদের গণনা করা, নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদের জন্য ‘পরিষেবা’ ডিজাইন করা সহজ হয়। এই যুক্তিকেই বলে বায়োপলিটিক্যাল পাওয়ার (Biopolitical Power)।
পশ্চিমা বিশ্বে তৈরি হওয়া ‘ট্রান্স ১০১’ (Trans 101) ধরনের গাইডবুকগুলো এই সরল মানচিত্রেরই প্রতিচ্ছবি। সেখানে পরিচয়ের একটি পরিষ্কার তালিকা থাকে: ট্রান্স পুরুষ, ট্রান্স নারী, জেন্ডারকুয়্যার, ক্রস-ড্রেসার, অ্যাজেন্ডার ইত্যাদি। সেখানে প্রতিটি পরিচয়কে একে অপরের থেকে আলাদা এবং স্থিতিশীল বলে ধরে নেওয়া হয়। এই মানচিত্রে, একজন ট্রান্স নারীকে কেবল ‘নারী’ হিসেবেই দেখতে চাওয়া হয়। তিনি যে একই সাথে অন্য কোনো পরিচয়ও ধারণ করতে পারেন বা তার পরিচয় যে সময়ের সাথে বদলাতে পারে, সেই সম্ভাবনাকে প্রায়শই অস্বীকার করা হয়।
কিন্তু ভারতের কোঠি-হিজড়া জগতের বাস্তবতা এই সরল, জ্যামিতিক মানচিত্রকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে। তাদের জীবনযাপন হলো এক ‘অবাধ্য’ (Unruly) অনুশীলন। তারা রাষ্ট্রীয় ক্যাটাগরিকে ব্যবহার করে, কিন্তু তার কাছে আত্মসমর্পণ করে না।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court of India, 2014) তার ঐতিহাসিক NALSA রায়ে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার মন্ত্রক (Ministry of Social Justice and Empowerment, 2014) তাদের রিপোর্টে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা নারী-পুরুষের বাইনারির বাইরে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ (Third Gender)-কে আইনি বৈধতা দিয়েছে, যা একটি অত্যন্ত প্রগতিশীল পদক্ষেপ। কিন্তু একই সাথে, তারা পরিচয় যাচাই করার জন্য মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা বা রাষ্ট্র-নিযুক্ত কমিটির দ্বারা সার্টিফিকেশনের মতো পদ্ধতির সুপারিশ করেছে। এর অর্থ হলো, রাষ্ট্র যদিও নতুন ক্যাটাগরিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তবুও সে পরিচয়ের ‘সত্যতা’ যাচাই করার ক্ষমতা নিজের হাতেই রাখতে চায়। সে চায়, প্রতিটি নাগরিক একটি নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয় লিঙ্গ পরিচয় বেছে নিক।
কিন্তু হিজড়া বা কোঠিদের জীবন এই ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাদের অনেকের কাছেই একাধিক পরিচয়পত্র থাকে—একটিতে লিঙ্গ ‘পুরুষ’, অন্যটিতে ‘নারী’, এবং হয়তো নতুনটিতে ‘অন্যান্য’। এটি কোনো ভুল বা প্রতারণা নয়, এটি তাদের টিকে থাকার কৌশল। এটি এক ‘অবাধ্য নাগরিকত্ব’ (Unruly Citizenship)-এর অনুশীলন।
রায়নার সেই হিজড়া বন্ধুর কথা আবার ভাবুন। তিনি যখন নারী হিসেবে সরকারি পরিচয়পত্র পেয়ে গর্বিত হন, কিন্তু কেউ তাকে ‘মহিলা’ বললে তৎক্ষণাৎ তালি বাজিয়ে (যাকে ‘ঠিকরি’ বলা হয়) নিজের স্বতন্ত্র হিজড়া পরিচয় ঘোষণা করেন, তখন তিনি কী করেন? তিনি একই সাথে রাষ্ট্রীয় ক্যাটাগরিকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করেন এবং সেই ক্যাটাগরির সীমাবদ্ধতাকে জনসমক্ষে উন্মোচিত করে দেন। তিনি দেখিয়ে দেন যে, তিনি একই সাথে নারী এবং নারী নন (Both woman and not-woman)। তার পরিচয় কোনো স্থির বিন্দু নয়, বরং একটি চলমান পারফরম্যান্স।
এই অনুশীলনগুলোই হলো ‘ট্রান্সজেন্ডার’ ক্যাটাগরির উপনিবেশিক প্রবণতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী, জীবন্ত এবং মাটির কাছাকাছি থাকা প্রতিরোধ। তারা আমাদের শেখায় যে, পরিচয়ের মানচিত্র সরলরৈখিক হতে পারে না; তা আসলে আঁকাবাঁকা, বহুস্তরীয় এবং অফুরন্ত সম্ভাবনায় পূর্ণ এক পথ।
শেষ কথা: পরিচয়ের উপনিবেশমুক্তি কোন পথে?
তাহলে এই দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা কোথায় এসে দাঁড়ালাম? ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি কি তবে পুরোপুরি বর্জনীয়, একটি নব্য-ঔপনিবেশিক চক্রান্ত? দত্ত ও রায় এত সরল সিদ্ধান্তে পৌঁছান না। তারা বাস্তববাদী। তারা স্বীকার করেন যে, এই শব্দটি অনেকের জীবনে মুক্তির স্বাদ এনেছে। এটি আন্তর্জাতিক স্তরে সংহতি তৈরি করতে, আইনি লড়াই লড়তে এবং স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো পরিষেবা পেতে একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
তাদের প্রস্তাবনা তাই বর্জনের নয়, বরং রূপান্তরের। তারা বলছেন, ‘ট্রান্সজেন্ডার’-কে একটি ছাতা-পরিচয় (Umbrella Identity) হিসেবে না দেখে, একটি বিশ্লেষণাত্মক পরিভাষা (Analytic Rubric) হিসেবে ব্যবহার করা হোক। এর অর্থ হলো, এই ক্যাটাগরির অধীনে পরিষেবা পাওয়ার জন্য কাউকে আগে থেকে নির্ধারিত কোনো ‘ট্রান্সজেন্ডার’ পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করতে বাধ্য করা উচিত নয়। যে কোনো ধরনের লিঙ্গীয় প্রান্তিকতার শিকার মানুষই যেন এই সুবিধার আওতায় আসতে পারে। সবচেয়ে জরুরি হলো, শব্দটিকে তার সত্তাতাত্ত্বিক বোঝা থেকে মুক্ত করা বা ডি-অন্টোলজাইজ (De-ontologize) করা। অর্থাৎ, ‘ট্রান্সজেন্ডার’ কোনো নির্দিষ্ট ধরনের ‘হওয়া’ বা ‘being’ নয়, এটি একটি অবস্থান, একটি পরিস্থিতি।
এই উপনিবেশমুক্তির প্রক্রিয়াটি কেবল একটি অ্যাকাডেমিক বা ভাষাগত প্রকল্প নয়। এর জন্য প্রয়োজন কিছু বাস্তব এবং কাঠামোগত পরিবর্তন:
- ১. ক্ষমতার অনুক্রমকে ভাঙা: বৈশ্বিক (Global) এবং স্থানীয় (Local) ডিসকোর্সের মধ্যে যে ক্ষমতার অনুক্রম বা ‘স্কেলার হায়ারার্কি’ তৈরি হয়েছে, তাকে সক্রিয়ভাবে ভেঙে ফেলতে হবে। স্থানীয় জ্ঞান, ভাষা এবং অভিজ্ঞতাকে কেবল ‘উদাহরণ’ হিসেবে ব্যবহার না করে, তাকে তাত্ত্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে হবে। কোঠি বা হিজড়াদের জীবন থেকে উঠে আসা ধারণাগুলো দিয়ে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ ক্যাটাগরিটাকেই প্রশ্ন করতে হবে, তাকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।
- ২. অ্যাক্টিভিজমের পিরামিড ভাঙা: সামাজিক আন্দোলনের যে পিরামিড- কাঠামোয় পশ্চিমা মেট্রোপলিসের অর্থদাতা বা ইংরেজি-ভাষী বড় এনজিও-রা শীর্ষে এবং গ্রামের ছোট সিবিও-গুলো নীচে অবস্থান করে, সেই কাঠামোকে গণতান্ত্রিক করে তোলা প্রয়োজন। অর্থায়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে বিকেন্দ্রীভূত করতে হবে, যাতে মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষদের কণ্ঠস্বর নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শোনা যায়।
- ৩. নিরন্তর কথোপকথন: এই কাজটি কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়। এর জন্য প্রয়োজন গবেষক, অ্যাক্টিভিস্ট, সম্প্রদায় এবং অর্থায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি সৎ, আত্মসমালোচনামূলক এবং সম্মানজনক সংলাপ।
শেষ পর্যন্ত, ‘ট্রান্সজেন্ডার’-কে উপনিবেশমুক্ত করার এই সংগ্রাম কেবল ভারতের মতো দেশের ‘সাংস্কৃতিক ভিন্নতা’-কে অন্তর্ভুক্ত করার প্রকল্প নয়। এটি আসলে ‘পশ্চিম’ এবং ‘অ-পশ্চিম’ উভয় স্থানেই এলজিবিটিকিউ আন্দোলনকে আরও গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আত্মসচেতন করে তোলার একটি বৃহত্তর সংগ্রামের অংশ।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের পরিচয় কোনো আরোপিত সংজ্ঞার কারাগারে বন্দী থাকার জন্য নয়। তা আসলে অফুরন্ত সম্ভাবনার এক খোলা আকাশ। সেই আকাশে প্রতিটি তারারই নিজস্ব আলোয়, নিজস্ব কক্ষপথে জ্বলার অধিকার আছে। কারো আলো হয়তো স্থির, কারো আলো হয়তো দপদপ করে, কারো আলো হয়তো ক্ষণিকের জন্য জ্বলে উঠেই মিলিয়ে যায়। কিন্তু প্রতিটি আলোই সত্য, প্রতিটি আলোই সম্পূর্ণ। সেই বহুত্বের স্বীকৃতিতেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত মুক্তির পথ।
তথ্যসূত্র
- Boyce, P., & Khanna, A. (2011). Rights and representations: Querying the male-to-male sexual subject in India. Culture, Health & Sexuality, 13(S1), 89–100.
- Cohen, L. (2005). The Kothi wars: AIDS cosmopolitanism and the morality of classification. In V. Adams & S. L. Pigg (Eds.), Sex in development: Science, sexuality, and morality in global perspective (pp. 269–303). Duke University Press.
- Das, T. (2013, June 21). Ami kichhutei tomar chhele hote chai na ma [I do not want to be your son, Ma]. News Bangla.
- Dirks, N. B. (2001). Castes of mind: Colonialism and the making of modern India. Princeton University Press.
- Dutta, A. (2013). Legible identities and legitimate citizens: The globalization of transgender and subjects of HIV-AIDS prevention in Eastern India. International Feminist Journal of Politics, 15(4), 494–514.
- Dutta, A., & Roy, R. (2014). Decolonizing transgender in India: Some reflections. TSQ: Transgender Studies Quarterly, 1(3), 320–337.
- Hall, K. (2005). Intertextual sexuality: Parodies of class, identity, and desire in liminal Delhi. Journal of Linguistic Anthropology, 15(1), 125–144.
- Katyal, A. (2010). No ‘sexuality’ for all—Some notes from India. Polyvocia, 2, 21–29.
- MOSJE (Ministry of Social Justice and Empowerment). (2014). Report of the Expert Committee on the issues relating to Transgender Persons. Retrieved from socialjustice.nic.in/transgenderpersons.php
- Nanda, S. (1990). Neither man nor woman: The hijras of India. Wadsworth Publishing Company.
- Reddy, G. (2005). With respect to sex: Negotiating hijra identity in South India. University of Chicago Press.
- SAATHII (Solidarity and Action against the HIV Infection in India). (2009). Report of the regional TG/Hijra consultation in Eastern India. Retrieved from http://www.saathii.org/orissapages/tg_hijra_issues_consultation%20.html
- SC (The Supreme Court of India). (2014). National Legal Services Authority versus Union of India and Others. Retrieved from judis.nic.in/supremecourt/imgs1.aspx?filename=41411
- Spivak, G. C. (1999). A critique of postcolonial reason: Toward a history of the vanishing present. Harvard University Press.
Leave a Reply