চে গুয়েভারা: যে বিপ্লব আজও পথ হাঁটে

ভূমিকা

দেয়ালে, পুরনো বইয়ের দোকানে, কফি শপের আবছা আলোয় কিংবা কোনো প্রতিবাদী তরুণের টি-শার্টে একজোড়া চোখ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখে স্বপ্ন আছে, ক্লান্তি আছে, আছে এক ধরনের উদাসীন অথচ ইস্পাত-কঠিন সংকল্প। তারকাখচিত এক বেরেট টুপি (beret cap) পরা, এলোমেলো চুল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির সেই মুখটা পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত মুখগুলোর একটি। কিন্তু কে এই মানুষ? কী তার গল্প? কেন মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরেও তিনি কোটি তরুণের কাছে দ্রোহ আর মুক্তির এক জীবন্ত প্রতীক? আবার কেনই বা একদল মানুষের কাছে তিনি কেবলই এক রক্তপিপাসু, একনায়কতন্ত্রের সহযোগী?

এই মানুষটির পোশাকি নাম এর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সের্না। কিন্তু পৃথিবী তাকে চেনে এক শব্দে—‘চে’ (Che)। তার জীবনটা কোনো সাধারণ জীবন নয়, যেন এক মহাকাব্য। ভালোবাসা, অ্যাডভেঞ্চার, আদর্শ, ত্যাগ, বিপ্লব, ক্ষমতা, বিতর্ক আর সবশেষে এক করুণ, নিঃসঙ্গ মৃত্যু—মানবজীবনের প্রায় সব নাটকীয় উপাদানই সেখানে উপস্থিত। চলুন, আজ সেই মহাকাব্যের পাতাগুলো একটু উল্টে দেখার চেষ্টা করি। এই চেষ্টা কেবল একজন ব্যক্তিকে জানার জন্য নয়, বরং একটি সময়কে, একটি স্বপ্নকে এবং সেই স্বপ্নের ভাঙা-গড়ার জটিল ইতিহাসকে বোঝার জন্য।

এই গল্পের এক অদ্ভুত প্যারাডক্স আছে। যে মানুষটি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করলেন, মৃত্যুর পর সেই পুঁজিবাদই তাকে বানালো সবচেয়ে বিক্রয়যোগ্য পণ্যের একটি। তার ছবি আজ টি-শার্টে, মগে, পোস্টারে—এক বিরাট বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের অংশ। এই প্যারাডক্স কি তার পরাজয়? নাকি তার বিজয়ের এক ভিন্ন রূপ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যই আমাদের আরও গভীরে যেতে হবে। যেতে হবে আর্জেন্টিনার রোজারিও শহর থেকে বলিভিয়ার দুর্গম গিরিখাত পর্যন্ত বিস্তৃত এক আশ্চর্য যাত্রাপথে। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু হলো না। কারণ কিছু মানুষের গল্প তাদের মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় না, বরং সেখান থেকেই যেন নতুন করে শুরু হয়।

রোজারিওর সেই ছেলেটি ও তার বইয়ের জগত

গল্পের শুরুটা হয় আর্জেন্টিনার রোজারিও (Rosario) শহরে, ১৯২৮ সালের ১৪ই জুন। এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিলেন এর্নেস্তো গুয়েভারা, পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। বাবা, এর্নেস্তো গুয়েভারা লিঞ্চ, ছিলেন একজন স্থপতি ও ব্যবসায়ী, যার রক্তে বইত আইরিশ বিদ্রোহের উত্তরাধিকার। তিনি প্রায়ই তার সন্তানদের বলতেন, “জেনে রেখো, তোমাদের ধমনীতে আইরিশ বিদ্রোহীদের রক্ত বইছে।” মা, সেলিয়া দে লা সের্না, ছিলেন এক অভিজাত স্প্যানিশ পরিবারের কন্যা, কিন্তু চিন্তাভাবনায় অত্যন্ত প্রগতিশীল এবং বামপন্থী। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা নারী, যিনি সেই যুগেও নিজের চুল ছোট করে কাটতেন, প্যান্ট পরতেন এবং গাড়ি চালাতেন। তাদের পরিবার ঠিক গতানুগতিক ধনী পরিবার ছিল না। বাবার ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো প্রায়ই ব্যর্থ হতো, ফলে পরিবারকে বারবার বাসস্থান বদলাতে হয়েছে। কিন্তু যা বদলায়নি, তা হলো তাদের বাড়ির মুক্তচিন্তার পরিবেশ।

তাদের বিশাল লাইব্রেরিটা ছিল ছোট এর্নেস্তোর আসল পৃথিবী। সেখানে ৩০০০-এর বেশি বই ছিল। কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ভারী ভারী বইয়ের পাশে দিব্যি জায়গা করে নিত জ্যাক লন্ডন বা জুল ভার্নের রোমাঞ্চকর উপন্যাস। তিনি যেমন পড়তেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ, তেমনি মগ্ন হতেন পাবলো নেরুদা বা শার্ল বোদলেয়ারের কবিতায়। তার প্রিয় কবিদের একজন ছিলেন পাবলো নেরুদা, যার কবিতার বই তিনি সবসময় সাথে রাখতেন, এমনকি গেরিলা যুদ্ধের ময়দানেও। জওহরলাল নেহেরুর আত্মজীবনী থেকে শুরু করে জ্যাঁ-পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ—জ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যা সেই লাইব্রেরিতে অনুপস্থিত ছিল (Anderson, 1997)। এই বইয়ের জগতই তার চিন্তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবা খেলতেন, যা তাকে কৌশলগত চিন্তায় পারদর্শী করে তোলে। বাবার সাথে দাবা খেলতে খেলতে তিনি শিখেছিলেন, জীবনের প্রতিটি চালের পেছনে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।

জীবনের শুরুতেই তার এক কঠিন শত্রু জুটেছিল—হাঁপানি বা অ্যাজমা (asthma)। মাত্র দুই বছর বয়সে এই রোগ তার সঙ্গী হয় এবং আজীবন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এই রোগের তীব্রতার কারণে তার শৈশব ছিল আর দশটা ছেলের চেয়ে ভিন্ন। প্রায়ই মধ্যরাতে তার ঘুম ভেঙে যেত তীব্র শ্বাসকষ্টে, বুকের ভেতর সাঁই সাঁই শব্দ হতো, মনে হতো যেন কেউ গলা টিপে ধরেছে। যে বয়সে ছেলেরা মাঠে দৌড়ে বেড়ায়, সেই বয়সে তাকে প্রায়ই ইনহেলার হাতে শ্বাসকষ্ট নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে হতো। কিন্তু এই শারীরিক সীমাবদ্ধতা তাকে মানসিকভাবে করে তুলেছিল অবিশ্বাস্য রকমের জেদি। যেন শরীরকে এক প্রতিপক্ষ বানিয়ে তার বিরুদ্ধে এক আমৃত্যু যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যে ছেলেটি ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারে না, সে-ই রাগবি খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সাথে সমানে সমানে টক্কর দিত, যার জন্য তার ডাকনামই হয়ে গিয়েছিল ‘ফুসের’ (Fuser)—El Furibundo Serna বা ‘ক্রুদ্ধ সের্না’-র সংক্ষিপ্ত রূপ। তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়েও কনকনে ঠান্ডা পানিতে সাঁতার কাটত। যেন শরীরের দুর্বলতাকে জয় করার এক আমৃত্যু পণ করেছিল সে। এই অদম্য ইচ্ছাশক্তিই হয়তো তাকে পরবর্তী জীবনে এক অপরাজেয় গেরিলা যোদ্ধায় রূপান্তরিত করেছিল।

বাবা-মায়ের সমাজতান্ত্রিক মনোভাব এবং লাইব্রেরির হাজারো বই তাকে শৈশব থেকেই এক রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের পরাজয়ে ব্যথিত হতেন, ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার খবর রাখতেন। কিন্তু তখনও তিনি বিপ্লবী নন। তিনি কেবলই এক কৌতূহলী, সংবেদনশীল এবং অত্যন্ত পড়ুয়া যুবক, যার চোখে পৃথিবীকে জানার এক অসীম ক্ষুধা। তার ভেতরের আগুনটা তখনও ছাইচাপা, জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়।

মটরসাইকেল এবং আত্মার রূপান্তর

বুয়েনস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়ার সময় এর্নেস্তোর ভেতরকার ভবঘুরে মনটা জেগে উঠল। বইয়ের পাতার জ্ঞান আর চিকিৎসকের নিরাপদ জীবনের হাতছানি তাকে আটকে রাখতে পারল না। ১৯৫২ সাল। পড়াশোনায় এক বছরের বিরতি নিয়ে তিনি তার প্রাণের বন্ধু, প্রাণরসায়নবিদ আলবার্তো গ্রানাদোকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এক দীর্ঘ সফরে। বাহন—‘লা পোদেরোসা’ (La Poderosa) বা ‘The Mighty One’ নামে পরিচিত এক জীবনের বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আসা নর্টন ৫০০ সিসি মোটরসাইকেল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই—দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে নিজের চোখে দেখা, বইয়ের পাতায় পড়া জগতটাকে বাস্তবে অনুভব করা।

এই নয় মাসের প্রায় ৮০০০ কিলোমিটারের ভ্রমণটি কেবল একটি অ্যাডভেঞ্চার ছিল না, এটি ছিল এর্নেস্তোর জীবনের এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়। এই ভ্রমণকাহিনীই পরে বিখ্যাত হয় ‘দ্য মটরসাইকেল ডায়েরিজ’ নামে। যা কিছু তিনি বইয়ে পড়েছিলেন, তা এবার নিজের চোখে দেখতে শুরু করলেন। তিনি দেখলেন চিলির চুকিকামাতা (Chuquicamata) তামার খনিতে শ্রমিকদের অমানবিক জীবন, যেখানে মার্কিন কোম্পানিগুলো দেশের সম্পদ লুট করছে আর শ্রমিকরা খনির ধুলোয় নিঃশ্বাস নিতে নিতে ধুঁকে ধুঁকে মরছে সিলিকোসিসে। তিনি এক কমিউনিস্ট খনি-শ্রমিক দম্পতির সাথে রাত কাটিয়েছিলেন, যারা কাজ খোঁজার জন্য পথে পথে ঘুরছিল এবং তীব্র শীতে একটি কম্বলও তাদের ছিল না। এর্নেস্তো এবং আলবার্তো তাদের একমাত্র কম্বলটি সেই দম্পতিকে দিয়ে নিজেরা কনকনে ঠান্ডায় রাত কাটিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎ তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তিনি ডায়েরিতে লেখেন, সেই হিমশীতল রাতে তাদের দুঃখ অনুভব করে তিনি যেন ল্যাটিন আমেরিকার শোষিত মানুষের আত্মার সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি দেখলেন নামমাত্র পারিশ্রমিকে দিনরাত খেটে যাওয়া কৃষকদের ফ্যাকাশে মুখ, দেখলেন আদিবাসী মানুষদের ওপর চলতে থাকা শতাব্দীর পর শতাব্দীর শোষণ আর বঞ্চনা। পেরুর ইনকা সভ্যতার মহান কেন্দ্র মাচু পিচুর ধ্বংসাবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি অনুভব করলেন এক গৌরবময় অতীতের করুণ বর্তমান। তিনি ভাবছিলেন, যে সভ্যতা এত উন্নত নগরী নির্মাণ করতে পারে, তাদের উত্তরসূরিরা আজ কেন এত দরিদ্র আর ক্ষমতাহীন?

ভ্রমণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাটি হয়েছিল পেরুর সান পাবলোর এক কুষ্ঠ কলোনিতে (leper colony)। আমাজন নদীর তীরে অবস্থিত এই কলোনিতে তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে রোগীদের সেবা করেন। কিন্তু তিনি কেবল তাদের চিকিৎসক ছিলেন না, হয়ে উঠেছিলেন তাদের বন্ধু। যে কুষ্ঠরোগীদের সমাজ অচ্ছুত মনে করে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, এর্নেস্তো কোনো রকম হাতমোজা ছাড়াই তাদের স্পর্শ করতেন, তাদের সাথে একসাথে বসে খেতেন, তাদের সাথে ফুটবল খেলতেন, তাদের সাথে মিশে গিয়েছিলেন আত্মার আত্মীয়ের মতো। তার ২৯তম জন্মদিনে তিনি একটি প্রতীকী কাজ করেন। কলোনির ডাক্তার ও নার্সরা থাকতো নদীর এক পাড়ে, আর রোগীরা অন্য পাড়ে। এই বিভেদকে অগ্রাহ্য করে, তীব্র হাঁপানি নিয়েও তিনি সাঁতরে আমাজনের উত্তাল শাখা নদীটি পার হয়ে রোগীদের কাছে যান তার জন্মদিন পালন করতে। এটি ছিল মানুষে মানুষে বিভেদের বিরুদ্ধে তার প্রথম ব্যক্তিগত বিদ্রোহ। এই সাঁতার যেন ছিল এক রূপান্তর প্রক্রিয়া; এক পাড়ের বুর্জোয়া যুবক থেকে অন্য পাড়ের সর্বহারাদের কমরেড হয়ে ওঠা (Guevara, 2003)।

মটরসাইকেল যাত্রার শেষে তার ডায়েরিতে তিনি যে কথাগুলো লিখেছিলেন, তা তার রূপান্তরের এক জীবন্ত দলিল: “এই ভবঘুরে জীবন আমার ভেতরটাকে যতটা বদলে দিয়েছে, তা আমি আগে বুঝতে পারিনি… আমি আর আগের আমি নেই। আমার ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণ আমাকে যা দেখিয়েছে, তা হলো—এই মহাদেশের বিভক্তিগুলো কৃত্রিম… মেক্সিকো থেকে ম্যাগেলান প্রণালী পর্যন্ত বিস্তৃত এই একক জাতির মুক্তির জন্য আমি লড়ব।” (Guevara, 2003)। তিনি এক নতুন পরিচয়ের সন্ধান পেলেন—তিনি আর শুধু আর্জেন্টাইন নন, তিনি একজন লাতিন আমেরিকান। যে যুবকটি নিছক অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বেরিয়েছিল, সে ফিরে এলো এক গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে। তার মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করল যে, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মুক্তির জন্য ছোটখাটো সংস্কার যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন এক আমূল পরিবর্তন। প্রয়োজন এক বিপ্লবের।

গুয়াতেমালা ও সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন রূপ

ডাক্তারি পাস করার পর এর্নেস্তোর সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। এক, আর্জেন্টিনায় ফিরে গিয়ে অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি সফল ও আরামদায়ক জীবন কাটানো। দুই, তার নতুন পাওয়া চেতনাকে অনুসরণ করে বেরিয়ে পড়া। তিনি দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি আবার ঘর ছাড়লেন। এবার তার লক্ষ্য ছিল আরও স্পষ্ট—ল্যাটিন আমেরিকার সেইসব জায়গায় যাওয়া, যেখানে সামাজিক পরিবর্তনের হাওয়া বইছে।

তিনি পৌঁছালেন গুয়াতেমালায়। তখন সেখানে প্রেসিডেন্ট হাকোবো আরবেনসের (Jacobo Árbenz) নেতৃত্বে এক গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সরকার ক্ষমতায়। আরবেনস কিছু যুগান্তকারী ভূমি সংস্কারের (land reform) উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি ‘ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি’র (United Fruit Company) হাতে থাকা বিশাল পরিমাণ অব্যবহৃত জমি অধিগ্রহণ করে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা। এই কোম্পানিটি গুয়াতেমালার অর্থনীতি ও রাজনীতিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করত যে, লোকে একে ‘এল পুলপো’ (El Pulpo) বা ‘অক্টোপাস’ বলে ডাকত, কারণ এর শুঁড় দেশের সবকিছু—রেললাইন, টেলিফোন ব্যবস্থা, প্রধান বন্দর—সবই আঁকড়ে ধরেছিল।

আরবেনসের এই পদক্ষেপে সরাসরি ক্ষুব্ধ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ (CIA)। কারণ ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির সাথে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেস এবং সিআইএ প্রধান অ্যালেন ডালেসের সরাসরি আর্থিক ও আইনি স্বার্থ জড়িত ছিল। তাদের কাছে আরবেনসের সংস্কার ছিল কমিউনিজমের নামান্তর। ফলাফল? ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর প্রত্যক্ষ মদতে ‘অপারেশন পিবিসাকসেস’ (Operation PBSuccess) নামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে (coup d’état) আরবেনস সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলো। সিআইএ প্রশিক্ষিত ভাড়াটে সৈন্য, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এবং ভুয়া রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে দেশে এক গৃহযুদ্ধের আবহ তৈরি করে, যার মুখে আরবেনস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন (Castañeda, 1997)। গুয়াতেমালার আকাশ কালো করে মার্কিন বোমারু বিমান উড়তে লাগল, যা আসলে সিআইএ-এর ভাড়া করা।

এর্নেস্তো গুয়েভারা এই পুরো ঘটনাটি নিজের চোখে দেখলেন। তিনি দেখলেন, কীভাবে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে নিছক কিছু বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য নির্মমভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। তিনি বিপ্লবীদের পক্ষে অস্ত্র তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, একটি অস্ত্রাগার পাহারা দেওয়ার দায়িত্বও নিয়েছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরাজিত আরবেনস সমর্থকদের সাথে তাকেও গুয়াতেমালা থেকে পালাতে হলো। এই সময়েই তিনি তার প্রথম স্ত্রী, পেরুর নির্বাসিত অর্থনীতিবিদ হিলদা গাদেয়ার (Hilda Gadea) সংস্পর্শে আসেন, যিনি তাকে ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবী মহলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

গুয়াতেমালার এই রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা তার চিন্তার জগতে এক স্থায়ী ছাপ ফেলে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক পথে সামাজিক পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব। শোষক শ্রেণি এবং তাদের আন্তর্জাতিক প্রভুরা কখনোই বিনাযুদ্ধে তাদের ক্ষমতা ও স্বার্থ ছাড়বে না। মুক্তির একমাত্র পথ হলো সশস্ত্র সংগ্রাম (armed struggle)। তিনি তার এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “গুয়াতেমালার পর আমি বুঝেছি, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে চিকিৎসক নয়, সৈনিক হতে হবে।” গুয়াতেমালার এই অভিজ্ঞতা তাকে চিকিৎসক এর্নেস্তো থেকে বিপ্লবী ‘চে’-তে রূপান্তরিত হওয়ার পথে এক নির্ণায়ক ধাপ এগিয়ে দিল।

মেক্সিকোর সেই রাত ও এক কিংবদন্তীর জন্ম

গুয়াতেমালা থেকে পালিয়ে এর্নেস্তো পৌঁছালেন মেক্সিকো সিটিতে। তখন মেক্সিকো সিটি ছিল ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশের নির্বাসিত বিপ্লবীদের এক মিলনকেন্দ্র। তিনি একটি হাসপাতালে সামান্য বেতনে কাজ করতেন আর সুযোগ পেলেই রাজনৈতিক বিতর্কে যোগ দিতেন। এখানেই ১৯৫৫ সালের এক বৃষ্টিভেজা রাতে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির সাথে দেখা হলো—ফিদেল কাস্ত্রো। ফিদেল ছিলেন একজন ক্যারিশম্যাটিক কিউবান আইনজীবী এবং বিপ্লবী। তিনি কিউবার মার্কিন-সমর্থিত স্বৈরশাসক ফুলগেন্সিও বাতিস্তাকে (Fulgencio Batista) ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য একটি বিপ্লবী দল গোছানোর চেষ্টা করছিলেন।

সেই রাতে দুজনের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কথা হলো। ফিদেল তার কিউবা বিপ্লবের পরিকল্পনা শোনালেন। এর্নেস্তো শোনালেন গুয়াতেমালায় তার অভিজ্ঞতার কথা। ফিদেল খুঁজছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সামরিক জ্ঞানে আগ্রহী সঙ্গী। আর এর্নেস্তো খুঁজছিলেন একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ, একটি লক্ষ্য, যার জন্য জীবন বাজি রাখা যায়। ফিদেলের কথায় তিনি সেই পথের সন্ধান পেলেন। রাত ফুরোবার আগেই তিনি ফিদেলের ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অফ জুলাই মুভমেন্ট’ (26th of July Movement) নামের বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, দলের চিকিৎসক হিসেবে। ফিদেল পরে এই সাক্ষাৎ সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমার দশ মিনিটও লাগেনি তাকে আমার দলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে। আর তার লেগেছিল আরও কম সময়।”

এই দলেই তিনি তার বিখ্যাত ‘চে’ (Che) নামটি পান। আর্জেন্টিনীয় স্প্যানিশ ভাষায় ‘চে’ শব্দটি বন্ধু বা সহচরকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত একটি সাধারণ শব্দ ( অনেকটা আমাদের ‘দোস্ত’ বা ‘বন্ধু’র মতো)। এর্নেস্তো কথায় কথায় এই শব্দটি ব্যবহার করতেন বলে তার কিউবান সঙ্গীরা তাকে মজা করে ‘চে’ বলে ডাকতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এই ডাকনামটিই তার বৈপ্লবিক পরিচয়ে পরিণত হয়, যে নামে তাকে আজ সারা বিশ্ব চেনে (Anderson, 1997)।

মেক্সিকোতে তারা কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধের নায়ক আলবার্তো বায়ো (Alberto Bayo) তাদের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল শেখান। এই প্রশিক্ষণে চে সবাইকে ছাড়িয়ে যান। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, শৃঙ্খলাবোধ এবং নেতৃত্বের গুণাবলী সবার নজরে আসে। তিনি শুধু সেরা ছাত্রই ছিলেন না, প্রশিক্ষক বায়োর প্রিয় ছাত্রও হয়ে উঠেছিলেন। প্রশিক্ষণ চলাকালীন মেক্সিকান পুলিশ তাদের সবাইকে গ্রেফতার করে। ফিদেলের চেষ্টায় সবাই ছাড়া পেলেও চে এবং আরেকজন কমরেড বেশি কিছুদিন জেলে আটক থাকেন। কিন্তু কোনো কিছুই তাদের সংকল্পকে টলাতে পারেনি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তারা আরও দ্রুত তাদের বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

গ্রানমা, সিয়েরা মায়েস্ত্রা ও এক অসম যুদ্ধ

১৯৫৬ সালের ২৫শে নভেম্বর। ৮২ জন বিপ্লবীকে নিয়ে ‘গ্রানমা’ (Granma) নামের একটি পুরনো, ছোট ইয়টে (yacht) চেপে ফিদেল কাস্ত্রো মেক্সিকো থেকে কিউবার উদ্দেশে রওনা দিলেন। যে নৌকাটি মাত্র ১২ জনের জন্য তৈরি, তাতে চড়ে বসেছিল ৮২ জন মানুষ, সাথে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ। চে ছিলেন সেই দলের একমাত্র বিদেশি এবং আনুষ্ঠানিক চিকিৎসক। যাত্রাটি শুরু থেকেই ছিল বিপর্যয়কর। অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নৌকাটি প্রায় ডুবতে বসেছিল, সবাই ভুগছিল মারাত্মক সমুদ্রপীড়ায়। তীব্র হাঁপানির কষ্ট নিয়ে চে ইঞ্জিনের পাশে বসেছিলেন, কারণ সেখানেই বাতাস কিছুটা চলাচল করত।

খারাপ আবহাওয়া এবং অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নৌকাটি নির্ধারিত সময়ের দুই দিন পর, ২রা ডিসেম্বর, কিউবার উপকূলে পৌঁছায়। কিন্তু তারা নেমেছিল এক জলাভূমিতে, যা তাদের পরিকল্পনাকে আরও জটিল করে তোলে। সেখানে নামার সাথে সাথেই তারা বাতিস্তার সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণের শিকার হন। ‘আলেগ্রিয়া দে পিও’ (Alegría de Pío) নামক স্থানে এই আক্রমণে ৮২ জনের বিশাল দলটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অধিকাংশই নিহত হন বা ধরা পড়েন। চে নিজেও ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হন। সেই মুহূর্তে তার সামনে পড়েছিল একটি ওষুধের বাক্স এবং একটি গুলির বাক্স। তিনি মুহূর্তের জন্য দ্বিধা না করে গুলির বাক্সটি তুলে নেন। সেই মুহূর্তেই চিকিৎসক এর্নেস্তোর চূড়ান্ত মৃত্যু ঘটে এবং বিপ্লবী চে গুয়েভারার জন্ম হয় (Anderson, 1997)।

ফিদেল, তার ভাই রাউল এবং চে-সহ মাত্র ২২ জনের মতো বেঁচে যাওয়া বিপ্লবী কিউবার দক্ষিণ-পূর্বের দুর্গম সিয়েরা মায়েস্ত্রা (Sierra Maestra) পর্বতমালার গভীরে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন। এটি ছিল এক চরম হতাশার মুহূর্ত। বিপ্লব শুরু হওয়ার আগেই যেন শেষ হয়ে গিয়েছিল। না ছিল খাবার, না ছিল পর্যাপ্ত অস্ত্র। তাদের মনোবল প্রায় শূন্যের কোঠায়।

কিন্তু এই চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিই চে-র ভেতরের গেরিলা সত্তাকে বের করে আনে। তিনি কেবল দলের চিকিৎসক হিসেবেই কাজ করেননি, ধীরে ধীরে একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা এবং কৌশলী কমান্ডার (Comandante) হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। হাঁপানির তীব্র কষ্টকে উপেক্ষা করে তিনি সহযোদ্ধাদের সাথে মাইলের পর মাইল পাহাড় পাড়ি দিতেন। গেরিলা যুদ্ধের দিনগুলোতে তার চরিত্রের দুটি দিক খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

একদিকে তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের কঠোর শৃঙ্খলার প্রতীক। দলের মধ্যে কেউ নিয়ম ভাঙলে, কাপুরুষতা দেখালে বা বিশ্বাসঘাতকতা করলে তিনি ছিলেন নির্দয়। ইউতিমিও গেররা (Eutimio Guerra) নামের একজন কৃষক পথপ্রদর্শক যখন অর্থের লোভে বাতিস্তার চর হয়ে ওঠে এবং তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করে, তখন চে নিজের হাতে তাকে গুলি করে হত্যা করেন। তার ডায়েরিতে তিনি এই ঘটনাটি নির্মোহভাবে বর্ণনা করেছেন, যা তার চরিত্রের কঠোর দিকটি তুলে ধরে। তার এই কঠোরতা অনেককে ভীত করত, কিন্তু যুদ্ধের কঠিন বাস্তবতায় দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এটি জরুরি ছিল বলে তিনি মনে করতেন।

অন্যদিকে, সাধারণ গ্রামবাসী এবং সহযোদ্ধাদের প্রতি তার মমত্ববোধ ছিল অসীম। তিনি স্থানীয় নিরক্ষর কৃষকদের অক্ষরজ্ঞান দেওয়ার জন্য ক্যাম্পেই স্কুল খুলেছিলেন। তাদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জনগণের সমর্থন ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ জেতা অসম্ভব। তাই তারা কৃষকদের ওপর বাতিস্তার সৈন্যদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং তাদের বন্ধু হয়ে ওঠেন। রাতের বেলা হাঁপানির টান উঠলে গাছের ডালে হেলান দিয়ে বসে তিনি মার্ক্সবাদ এবং লেনিনবাদের ওপর ক্লাস নিতেন। তিনি একটি গোপন রেডিও স্টেশন, ‘রেডিও রেবেলদে’ (Radio Rebelde) প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিপ্লবের বার্তা সারা কিউবায় ছড়িয়ে দিত এবং বাতিস্তার প্রচারণার বিরুদ্ধে সত্য খবর পরিবেশন করত।

তার সামরিক প্রজ্ঞা এবং অকল্পনীয় সাহসিকতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেলে ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে, সান্তা ক্লারার যুদ্ধে (Battle of Santa Clara)। চে-র নেতৃত্বে মাত্র ৩০০ জনের একটি গেরিলা দল কিউবার একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত সান্তা ক্লারা শহর আক্রমণ করে। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল বাতিস্তার কয়েক হাজার সুসজ্জিত সৈন্য। যুদ্ধের সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তটি ছিল একটি সাঁজোয়া ট্রেন (armored train) দখল করা। বাতিস্তা সরকার সৈন্যদের জন্য অস্ত্র ও রসদ বোঝাই করে ট্রেনটি পাঠিয়েছিল। চে এবং তার সহযোদ্ধারা বুলডোজার দিয়ে রেললাইন উপড়ে ফেলে ট্রেনটিকে থামিয়ে দেন এবং প্রচণ্ড যুদ্ধের পর মলোটভ ককটেল ব্যবহার করে সেটি দখল করে নেন।

সান্তা ক্লারার এই বিজয় ছিল কিউবান বিপ্লবের কফিনে শেষ পেরেক। এই বিজয়ের খবর পাওয়ার পর বাতিস্তার মনোবল পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। এর কয়েকদিন পরেই, ১৯৫৯ সালের ১লা জানুয়ারি, স্বৈরশাসক বাতিস্তা তার পরিবার ও বিপুল সম্পদ নিয়ে কিউবা থেকে পালিয়ে যান। দীর্ঘ দুই বছরের সংগ্রাম শেষে বিপ্লব সফল হলো। হাভানার রাস্তায় লক্ষ লক্ষ মানুষ নেমে এসে ফিদেল এবং তার বিপ্লবীদের বীরের মতো বরণ করে নেয়।

ক্ষমতার অলিন্দে স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংঘাত

বিপ্লব জয় করা এক জিনিস, আর একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। বিপ্লবের পর চে গুয়েভারা কিউবার নতুন সরকারের অন্যতম প্রধান স্থপতি হয়ে উঠলেন। তাকে কিউবার জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব (native-born citizenship) দেওয়া হলো, যা ছিল সর্বোচ্চ সম্মান। প্রথমে তিনি ‘লা কাবানা’ (La Cabaña) দুর্গের কমান্ডার এবং বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালের (revolutionary tribunal) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়টি তার জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়।

বাতিস্তার শাসনামলে যারা সাধারণ মানুষের ওপর হত্যা, নির্যাতন এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল—যেমন পুলিশ, সেনা কর্মকর্তা, চর—তাদের বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। চে এই বিচার প্রক্রিয়ার দায়িত্বে ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, এই সময়ে শত শত মানুষকে (আনুমানিক ৫৫ থেকে কয়েকশ) কোনো যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই, সংক্ষিপ্ত এবং অন্যায় বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। চে নিজে এই মৃত্যুদণ্ডগুলো অনুমোদন করতেন। তার সমালোচকরা এই সময়কার ভূমিকার জন্য তাকে ‘লা কাবানার কসাই’ (The Butcher of La Cabaña) বলেও অভিহিত করেন (Castañeda, 1997)। অন্যদিকে, তার সমর্থকরা যুক্তি দেন যে, এই বিচারগুলো ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে এবং একটি বিপ্লবের পর পাল্টা-বিপ্লব (counter-revolution) ঠেকানোর জন্য এগুলো জরুরি ছিল। চে নিজেও জাতিসংঘে দেওয়া এক ভাষণে গর্বের সাথে বলেছিলেন, “আমরা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি, দিচ্ছি এবং দিতে থাকব, যতক্ষণ তা প্রয়োজন হবে”। সত্য যাই হোক, এই অধ্যায়টি চে-র মানবতাবাদী চিকিৎসক পরিচয়ের ওপর একটি স্থায়ী কালো দাগ ফেলে দেয়।

এরপর তাকে জাতীয় ভূমি সংস্কার ইনস্টিটিউটের প্রধান, জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট (President of the National Bank) এবং পরে শিল্পমন্ত্রী (Minister of Industries) করা হয়। কিউবার নোটে তিনি শুধু তার ডাকনাম ‘চে’ সই করতেন, যা তার প্রাতিষ্ঠানিক পদের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞার প্রকাশ ছিল। এই পদগুলোতে থাকাকালীন তিনি কিউবার অর্থনীতিকে নতুন করে সাজানোর এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। তার লক্ষ্য ছিল একটি স্বনির্ভর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি (socialist economy) প্রতিষ্ঠা করা, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধকে মোকাবেলা করতে পারবে।

কিন্তু অর্থনীতি নিয়ে তার পরিকল্পনাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক মডেলের অন্ধ অনুকরণ না করে কিউবার নিজস্ব পথ খুঁজতে চেয়েছিলেন। তিনি বস্তুগত প্রণোদনার (material incentives) চেয়ে নৈতিক প্রণোদনার (moral incentives) ওপর বেশি জোর দেন। তার মতে, শ্রমিকরা বেশি বেতনের লোভে কাজ করবে না, বরং সমাজতান্ত্রিক চেতনা ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে কাজ করবে। কিন্তু একজন চিকিৎসক এবং গেরিলা যোদ্ধার পক্ষে একটি দেশের জটিল অর্থনীতি সামলানো সহজ ছিল না। তার কিছু হঠকারী সিদ্ধান্ত, যেমন—কিউবার প্রধান ফসল চিনির উৎপাদনের চেয়ে রাতারাতি শিল্পায়নকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং অনভিজ্ঞতা কিউবার অর্থনীতিকে আরও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেয় (Anderson, 1997)।

তবে তার মূল লক্ষ্য কেবল অর্থনৈতিক পরিবর্তন ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন মানুষের চিন্তার জগতে বিপ্লব ঘটাতে। তিনি ‘নয়া মানব’ বা ‘New Man’ (El Hombre Nuevo) নামে একটি দার্শনিক ধারণার জন্ম দেন। এই ‘নয়া মানব’ হবেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি বস্তুগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের মঙ্গলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন। তার কাছে ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে সমষ্টির স্বার্থ বড় হবে। চে নিজে এই আদর্শের এক মূর্ত প্রতীক হওয়ার চেষ্টা করতেন। মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, কোনো অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা নিতেন না, এমনকি ছুটির দিনেও স্বেচ্ছাশ্রম (voluntary labor) হিসেবে আখ খেতে বা কারখানায় কাজ করতে যেতেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর এই কঠোর নৈতিক আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি। এই আদর্শের মধ্যে এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক ছায়া খুঁজে পান সমালোচকরা, যেখানে ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্র ও আদর্শ বড় হয়ে ওঠে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চে হয়ে ওঠেন কিউবার বিপ্লবের সবচেয়ে সোচ্চার এবং ক্যারিশম্যাটিক মুখপাত্র। ১৯৬৪ সালে জাতিসংঘে দেওয়া তার বিখ্যাত ভাষণে তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৬৫ সালে আলজিয়ার্সে দেওয়া এক ভাষণে তিনি কেবল পশ্চিমা বিশ্বকেই নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নকেও একহাত নেন। তিনি বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে অসম বাণিজ্য করে এক ধরনের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ করছে। এই আপসহীন মনোভাব তাকে মস্কোর বিরাগভাজনে পরিণত করে এবং ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারের জন্যও এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করে, কারণ তখন কিউবা সোভিয়েত সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

এই সময়েই তার ব্যক্তিগত জীবনেও পরিবর্তন আসে। তিনি প্রথম স্ত্রী হিলদা গাদেয়াকে ডিভোর্স করে তার বিপ্লবী সহযোদ্ধা আলেইদা মার্চকে (Aleida March) বিয়ে করেন এবং চার সন্তানের জনক হন। কিন্তু সংসার জীবন বা রাষ্ট্র পরিচালনার রুটিন কাজ তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তার ভেতরকার বিপ্লবী সত্তা তাকে নতুন কোনো সংগ্রামের জন্য তাগাদা দিচ্ছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, “আমার পায়ের তলার মাটি আবার চুলকোচ্ছে।”

বিশ্ব বিপ্লবের নিঃসঙ্গ অভিযাত্রা

১৯৬৫ সাল। চে গুয়েভারা হঠাৎ করেই জনসম্মুখ থেকে পুরোপুরি উধাও হয়ে গেলেন। কিউবার ক্ষমতা, সম্মান, পরিবার—সবকিছু ছেড়ে তিনি কোথায় গেলেন, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে তীব্র জল্পনা-কল্পনা শুরু হলো। কয়েক মাস পর ফিদেল কাস্ত্রো জনসমক্ষে চে-র লেখা একটি বিদায়ী চিঠি প্রকাশ করেন। সেই চিঠিতে চে লেখেন, “আমি অনুভব করছি যে, কিউবার প্রতি এবং বিপ্লবের প্রতি আমার যা করণীয় ছিল, তা আমি সম্পন্ন করেছি… বিশ্বের অন্যান্য দেশ এখন আমার নিরহংকার প্রচেষ্টার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। আমি কিউবার সরকার, দল এবং আমার পরিবার—সবকিছুর সাথে আমার আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করছি।” (Guevara, Farewell Letter, 1965)।

আসলে ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও চে সুখী ছিলেন না। তার ভেতরকার বিপ্লবী সত্তা তাকে একটি দেশের মন্ত্রী বা রাষ্ট্রনায়কের রুটিন জীবনে আটকে থাকতে দিচ্ছিল না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, বিপ্লব কোনো একটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এটি একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। তার ‘ফোকো তত্ত্ব’ (Foco Theory) অনুযায়ী, একটি দেশের বিপ্লবী পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। একটি ছোট, নিবেদিতপ্রাণ গেরিলা দলই (foco বা কেন্দ্রবিন্দু) সঠিক রণকৌশলের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় লড়াই শুরু করে জনগণের সমর্থন আদায় করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় ক্ষমতা দখল করতে পারে। এই তত্ত্বকে বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্যই তিনি আবার অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন।

তার প্রথম গন্তব্য ছিল আফ্রিকার কঙ্গো। সেখানে নিহত জাতীয়তাবাদী নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বার অনুসারীরা সিআইএ-সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। চে আশা করেছিলেন, তিনি সেখানে গিয়ে ‘আফ্রিকার ভিয়েতনাম’ তৈরি করবেন। তিনি ছদ্মবেশে, সম্পূর্ণ পরিচয় গোপন করে কঙ্গোয় প্রবেশ করেন। কিন্তু কঙ্গোর অভিজ্ঞতা ছিল এক কথায় বিপর্যয়কর। সেখানকার যোদ্ধাদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না, তাদের মধ্যে ছিল উপজাতীয় কোন্দল, এবং তারা লড়াইয়ের চেয়ে জাদু-টোনায় বেশি বিশ্বাসী ছিল। চে নিজে আফ্রিকান সংস্কৃতি ও রাজনীতির সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না এবং স্থানীয় জনগণের সমর্থনও তারা অর্জন করতে পারেনি। কয়েক মাসের ব্যর্থ ও হতাশাজনক চেষ্টার পর, চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় তাকে সঙ্গীদের নিয়ে কঙ্গো ছাড়তে হয়। তার নিজের ভাষায়, এটি ছিল একটি ‘ব্যর্থতার ইতিহাস’ (a history of failure) (Guevara, 2000)। এই ব্যর্থতা তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়, কিন্তু তার সংকল্পকে ভাঙতে পারেনি।

বলিভিয়া ও এক বিপ্লবীর অন্তিম যাত্রা

কঙ্গোর চরম ব্যর্থতা চে-কে দমাতে পারেনি। তার জেদ যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল। তিনি এবার ল্যাটিন আমেরিকায় বিপ্লবের আগুন জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তার নতুন রণক্ষেত্র হিসেবে তিনি বেছে নিলেন বলিভিয়াকে। তিনি ভেবেছিলেন, বলিভিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান (পাঁচটি দেশের সীমান্ত রয়েছে) এবং চরম দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামীণ পরিস্থিতি গেরিলা যুদ্ধের জন্য আদর্শ। এখান থেকে বিপ্লব শুরু করে তা ধীরে ধীরে আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি, ব্রাজিল—সারা মহাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। এটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিকল্পনা।

১৯৬৬ সালের শেষ দিকে তিনি উরুগুয়ের এক ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বলিভিয়ায় প্রবেশ করেন। তার সাথে ছিল হাতে গোনা কয়েকজন বিশ্বস্ত কিউবান সহযোদ্ধা। তারা বলিভিয়ার দক্ষিণ-পূর্বের দুর্গম নানকাউয়াসু (Ñancahuazú) অঞ্চলের পাহাড়ি জঙ্গলে একটি গেরিলা দল গঠন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শুরু থেকেই সবকিছু ভুল পথে এগোতে থাকে।

  • জনগণের সমর্থনের অভাব: সিয়েরা মায়েস্ত্রার অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বিপরীতে, বলিভিয়ার স্থানীয় কেচুয়াভাষী (Quechua) কৃষকরা তাদের সমর্থন করেনি। তারা চে-র বিদেশি দলকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখত। চে এবং তার সঙ্গীরা তাদের ভাষা জানতেন না, তাদের সংস্কৃতি বুঝতেন না। ফলে তারা জনগণের কাছ থেকে খাবার, আশ্রয় বা তথ্য—কোনো সাহায্যই পাননি। যে জনগণের মুক্তির জন্য তিনি লড়তে এসেছিলেন, সেই জনগণই তাকে প্রত্যাখ্যান করল।

  • রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা: বলিভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির (Bolivian Communist Party) নেতা মারিও মোঞ্জে (Mario Monje) প্রথমে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে পিছিয়ে যান। তিনি দাবি করেন যে, বলিভিয়ার বিপ্লবের নেতৃত্ব তাকেই দিতে হবে, যা চে মেনে নিতে পারেননি। এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে চে এবং তার দল শহুরে নেটওয়ার্ক এবং রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ও একা হয়ে পড়ে।

  • সিআইএ-র সফল অভিযান: অন্যদিকে, বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার মতো একজন বিশ্ববিখ্যাত বিপ্লবীর উপস্থিতির খবর পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সিআইএ-র বিশেষ উপদেষ্টারা (যেমন কিউবান-আমেরিকান এজেন্ট ফেলিক্স রড্রিগেজ) বলিভিয়ান সেনাবাহিনীকে গেরিলা-দমন যুদ্ধে প্রশিক্ষণ ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করে। চে-কে ধরার জন্য এক বিশাল এবং সমন্বিত অভিযান শুরু হয়।

দিনের পর দিন খাবার ছাড়া, হাঁপানির ওষুধ ফুরিয়ে যাওয়া অবস্থায়, বিচ্ছিন্ন ও বিপর্যস্ত চে-র ছোট্ট দলটি (৫০ জনেরও কম) পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পালাতে থাকে। তাদের দলের অনেকেই হয় বলিভিয়ান সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে নিহত হন, নয়তো ধরা পড়েন। চে-র নিজের স্বাস্থ্যও পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। তার বিখ্যাত ‘বলিভিয়ান ডায়েরি’তে তিনি এই চরম হতাশা, একাকীত্ব এবং আসন্ন পরাজয়ের কথা লিখে গেছেন। ডায়েরির পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছে এক নিঃসঙ্গ জেনারেলের করুণ আর্তি। একটি পাতায় তিনি লেখেন, “আজ আমার বয়স ৩৯ হলো, আর আমি এমন এক বয়সের দিকে এগোচ্ছি যখন আমাকে ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু আপাতত আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ।” (Guevara, 1968)।

১৯৬৭ সালের ৮ই অক্টোবর। বলিভিয়ার ইউরো গিরিখাতে (Yuro Ravine) এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর চে-র দলের প্রায় সবাই নিহত হন। তিনি নিজেও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন এবং তার রাইফেলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় নিঃস্ব এবং আহত অবস্থায় তিনি বলিভিয়ান সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন। তাকে নিকটবর্তী গ্রাম লা হিগেরার (La Higuera) একটি জীর্ণ মাটির স্কুলে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়।

পরদিন, ৯ই অক্টোবর, বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট রেনে বারিয়েন্তোসের সরাসরি নির্দেশে এবং সিআইএ-র তত্ত্বাবধানে তাকে বিনা বিচারে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মারিও তেরান (Mario Terán) নামের একজন বলিভিয়ান সার্জেন্টকে তাকে গুলি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কথিত আছে, মৃত্যুর আগে চে তার হত্যাকারীর চোখে চোখ রেখে অসম্ভব শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমি জানি তুমি আমাকে গুলি করতে এসেছ। গুলি করো, কাপুরুষ! তুমি তো শুধু একজন মানুষকে মারবে! বিপ্লবকে নয়।” (Taibo II, 1999)।

তার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর বলিভিয়ান সেনাবাহিনী তার প্রাণহীন দেহ হেলিকপ্টারে করে কাছের শহর ভ্যালেগ্রান্দে (Vallegrande) নিয়ে যায় এবং একটি হাসপাতালের লন্ড্রির টেবিলে শুইয়ে সাংবাদিকদের সামনে প্রদর্শন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সারা বিশ্বকে দেখানো যে, কিংবদন্তী বিপ্লবীর পতন ঘটেছে এবং বিপ্লবের স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। প্রমাণ হিসেবে রাখার জন্য তার হাত দুটি কেটে নেওয়া হয় এবং বাকি দেহটি রাতের অন্ধকারে একটি রানওয়ের পাশে গোপন গণকবরে পুঁতে ফেলা হয়। তারা চেয়েছিল, চে-র নাম, তার অস্তিত্ব, সবকিছু যেন ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে যায়।

মৃত্যুর পরের জীবন ও এক অন্তহীন বিতর্ক

কিন্তু শাসকরা যা চেয়েছিল, তা হয়নি। মৃত্যুর পরেই চে গুয়েভারা হয়ে ওঠেন এক অবিনশ্বর কিংবদন্তী। ভ্যালেগ্রান্দের সেই হাসপাতালের টেবিলে শোয়ানো তার শান্ত, চোখ-খোলা মৃতদেহের ছবি অনেকটা যিশু খ্রিস্টের ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। এই ছবিটিই যেন তার পুনর্জন্মের প্রতীক হয়ে ওঠে। আলবার্তো কোরদার (Alberto Korda) তোলা তার সেই বিখ্যাত ‘গেরিয়েরো ইরোইকো’ (Guerrillero Heroico) ছবিটি ১৯৬৮ সালে প্যারিসের ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী মিছিল পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রতিবাদের এক অপ্রতিরোধ্য প্রতীকে পরিণত হয়।

তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তি, দ্রোহ, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা এবং তারুণ্যের এক চিরকালীন আইকন। তার মুখ আঁকা টি-শার্ট পরা তরুণ হয়তো তার জটিল মার্ক্সবাদী তত্ত্বের কিছুই জানে না, কিন্তু সে জানে এই মুখটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্থিতাবস্থার (status quo) বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী চড়ের নাম। চে-র জীবন ও মৃত্যু এক শক্তিশালী মিথ (myth) তৈরি করেছে, যা তার বাস্তব অর্জন বা ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে গেছে।

অবশ্যই, চে গুয়েভারা এক সরলরৈখিক, সাদা-কালো চরিত্র নন। তিনি অত্যন্ত জটিল এবং বিতর্কিত। তার জীবনকে মূল্যায়ন করতে গেলে দুটি দিকই সামনে আসে।

তার কিংবদন্তী হওয়ার কারণ:

  • আদর্শবাদ ও আত্মত্যাগ: তিনি শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য নিজের আরামের জীবন, পরিবার, চিকিৎসকের পেশা, এমনকি একটি দেশের মন্ত্রীর ক্ষমতা—সবকিছু অনায়াসে ত্যাগ করেছিলেন। তার জীবনে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কোনো স্থান ছিল না।

  • সাহস ও দৃঢ়তা: শারীরিক অসুস্থতা এবং চরম প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি কখনো নিজের লক্ষ্য থেকে একচুলও সরে আসেননি। তার সাহস ছিল প্রায় কিংবদন্তীতুল্য।

  • আপসহীন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা: তিনি ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শোষণের এক নির্ভীক ও সোচ্চার কণ্ঠ। তার কণ্ঠস্বর কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে।

তার সমালোচনার দিকগুলোও গুরুতর:

  • কঠোরতা ও সহিংসতা: বিপ্লবের নামে তিনি বহু মানুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার কাছে লক্ষ্যের স্বচ্ছতা উপায় বা পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা অনেক ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। লা কাবানার বিচারগুলো তার এই নির্মমতার সাক্ষী।

  • ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক: শিল্পমন্ত্রী হিসেবে তার অর্থনৈতিক নীতিগুলো ব্যর্থ হয়েছিল এবং কিউবার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। তার ‘নয়া মানব’ তৈরির স্বপ্নও ছিল বাস্তবতাবিবর্জিত এবং একনায়কতান্ত্রিক সমাজের পরিচায়ক।

  • ব্যক্তির ঊর্ধ্বে আদর্শ: তিনি আদর্শকে এতটাই বড় করে দেখতেন যে, তার সামনে ব্যক্তির স্বাধীনতা, ভিন্নমত এবং জীবনের মূল্য অনেক সময় গৌণ হয়ে যেত। তার পৃথিবীতে ভিন্নমতের কোনো স্থান ছিল না।

ত্রিশ বছর ধরে গোপন থাকার পর, ১৯৯৭ সালে কিউবান এবং আর্জেন্টাইন বিজ্ঞানীদের একটি দল বলিভিয়ার ভ্যালেগ্রান্দের সেই রানওয়ের পাশ থেকে চে গুয়েভারার দেহাবশেষ খুঁজে বের করে। তার হাতবিহীন কঙ্কালটি কিউবায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং সান্তা ক্লারা শহরে, যেখানে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সামরিক বিজয় অর্জন করেছিলেন, সেখানে এক বিশাল স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

হয়তো এখানেই গল্পের একটি বৃত্ত পূর্ণ হয়। শাসকরা যাকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল, তিনিই ফিরে এলেন ইতিহাসের বীর হয়ে। তার প্রাসঙ্গিকতা তাই আজও ফুরিয়ে যায়নি। তিনি কি নায়ক না খলনায়ক? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো একেকজনের কাছে একেক রকম। কিন্তু তিনি যে এক অসামান্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি আমাদের অবিরাম মনে করিয়ে দেন যে, এই পৃথিবীতে এখনও শোষণ আছে, বঞ্চনা আছে, অবিচার আছে। আর যতক্ষণ এই অবিচারগুলো থাকবে, ততক্ষণ কোনো না কোনো তরুণের টি-শার্টে, কোনো প্রতিবাদীর পতাকায় বা কোনো স্বপ্নাতুর কিশোরের পড়ার ঘরের দেয়ালে চে গুয়েভারার ওই স্বপ্নময় অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখটি ফিরে ফিরে আসবে। এক অসমাপ্ত বিপ্লবের গল্প হয়ে, এক না-নেভা আগুনের শিখা হয়ে। এক মহাকাব্যিক জীবনের প্রতীক হয়ে, যা আমাদের ভাবতে শেখায়—স্বপ্নের জন্য মানুষ কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে।

তথ্যসূত্র

  • Anderson, J. L. (1997). Che Guevara: A revolutionary life. Grove Press.
  • Castañeda, J. G. (1997). Compañero: The life and death of Che Guevara. Alfred A. Knopf.
  • Guevara, E. (1961). Guerrilla warfare. Monthly Review Press.
  • Guevara, E. (1965). Che Guevara’s farewell letter. Marxists Internet Archive. Retrieved from https://www.marxists.org/archive/guevara/1965/10/03.htm
  • Guevara, E. (1968). The Bolivian diary of Ernesto Che Guevara. Pathfinder Press.
  • Guevara, E. (2000). The African dream: The diaries of the revolutionary war in the Congo. Grove Press.
  • Guevara, E. (2003). The motorcycle diaries: Notes on a Latin American journey. Ocean Press.
  • Taibo, P. I., II. (1999). Guevara, also known as Che. St. Martin’s Press.

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.